shabd-logo

একাদশ পরিচ্ছেদ

8 October 2023

4 Viewed 4

তাহার পর দুই-তিনদিন দেবদাস মিছিমিছি পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইল-_-অনেকটা পাগলের মত । ধর্মদাস কি কহিতে গিয়াছিল, তাহাকে চক্ষু রাঙ্গাইয়া
ধমকাইয়া উঠিল। গতিক দেখিয়া চুনিলালও কথা কহিতে সাহস করিল না। ধর্মদাস কীদিয়া বলিল, চুনিবাবু, কেন এমন হল?

চুনিলাল বলিল, কি হয়েচে ধর্মদাসঃ

একজন অন্ধ আর-একজন অন্ধকে পথের কথা জিজ্ঞাসা করিল। ভিতরের খবর দু'জনের কেহই জানে না। চোখ মুছিতে মুছিতে ধর্মদাস বলিল, চুনিবাবু,
যেমন করে হোক দেব্তাকে তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিন। আর লেখাপড়া যদি করবে না, ত এখানে থেকে কি হবেঃ

কথাটা খুব সত্য । চুনিলাল চিন্তা করিতে লাগিল । চারি-পাঁচদিন পরে একদিন ঠিক তেমনি সন্ধ্যার সময় চুনিবাবু বাহির হইতেছিল--দেবদাস কোথা হইতে
আসিয়া হাত ধরিল, চুনিবাবু, সেখানে যাচ্চ?

চুনিলাল কুষ্ঠিত হইয়া বলিতে গেল, হা-_না, বল ত আর যাইনে।

দেবদাস কহিল, না, যেতে বারণ করচি নে; কিন্তু একটি কথা বল, কি আশায় সেখানে তুমি যাও?

আশা আর কি? এমনি সময় কাটে।

কাটে? কৈ, আমার সময় ত কাটে না! আমি সময় কাটাতে চাই।

চুনিলাল কিছুক্ষণ তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিল, বোধ করি তাহার মনের ভাব মুখে পড়িতে চেষ্টা করিল। তাহার পর কহিল, দেবদাস, তোমার কি হয়েচে
খুলে বলতে পারো?

কিছুই ত হয়নি।

বলবে না?

না চুনি, বলবার কিছুই নেই।

চুনিলাল বহুক্ষণ অধোমুখে থাকিয়া কহিল, দেবদাস, একটা কথা রাখবে?

কি?

সেখানে আর একবার তোমাকে যেতে হবে । আমি কথা দিয়েচি।

যেখানে সেদিন গিয়েছিলাম-_-সেইখানে ত?

হা

ছিঃ__আমার ভাল লাগে না।

যাতে ভাল লাগে, আমি করে দেব।

দেবদাস অন্যমনক্কের মত কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আচ্ছা, চল যাই।

অবনতির এক সোপান নীচে নামাইয়া দিয়া চুনিলাল কোথায় সরিয়া গিয়াছে। একা দেবদাস চন্দ্রমুখীর ঘরে নীচে বসিয়া মদ খাইতেছে__অদূরে বসিয়া
চন্দ্রমুখী বিষগ্রমুখে চাহিয়া চাহিয়া সভয়ে বলিয়া উঠিল-_দেবদাস, আর খেয়ো না।

দেবদাস মদের গ্রাস নীচে রাখিয়া ভ্রকুটি করিল, কেন?

অল্পদিন মদ ধরেচ, অত সইতে পারবে না।

সহ্য করব বলে মদ খাইনে । এখানে থাকব বলে শুধু মদ খাই।

এ কথা চন্দ্রমুখী অনেকবার শুনিয়াছে। এক-একবার তাহার মনে হয় দেয়ালে মাথা ঠুকিয়া সে রক্তগঙ্গা হইয়া মরে। দেবদাসকে সে ভালবাসিয়াছে। দেবদাস
মদের গ্রাস ছুঁড়িয়া ফেলিল। কৌচের পায়ায় লাগিয়া সেটা চূর্ণ হইয়া গেল। তখন আড় হইয়া বালিশে হেলান দিয়া জড়াইয়া জড়াইয়া কহিল, আমার উঠে যাবার
ক্ষমতা নেই, তাই এখানে বসে থাকি_ জ্ঞান থাকে না, তাই তোমার মুখের পানে চেয়ে কথা কই-__ কন্দ__র--তবু অজ্ঞান হইনে_-তবু একটু জ্ঞান
থাকে__তোমাকে ছুঁতে পারিনে__আমার বড় ঘৃণা হয়।

চন্দ্রমুখী চক্ষু মুছিয়া ধীরে ধীরে কহিতে লাগিল, দেবদাস, কত লোক এখানে আসে, তারা কখনো মদ স্পর্শও করে না।

দেবদাস চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া উঠিয়া বসিল। টলিয়া টলিয়া ইতস্ততঃ হস্ত নিক্ষেপ করিয়া বলিল,_স্পর্শ করে না? আমার বন্দুক থাকলে তাদের গুলি
করতাম । তারা যে আমার চেয়েও পাপিষ্ঠ- চন্দরমুখী!

কিছুক্ষণ থামিয়া কি যেন ভাবিতে লাগিল; তাহার পর আবার কহিল, যদি কখনও মদ ছাড়ি--যদিও ছাড়ব না_-তা হলে আর কখন ত এখানে আসব না।
আমার উপায় আছে, কিন্তু তাদের কি হবে?

একটুখানি থামিয়া বলিতে লাগিল, বড় দুঃখে মদ ধরেচি__-আমাদের বিপদের, দুঃখের বন্ধু! আর তোমাকে ছাড়তে পারিনে,_

দেবদাস বালিশের উপর মুখ রগড়াইতে লাগিল। চন্দ্রমুখী তাড়াতাড়ি কাছে আসিয়া মুখ তুলিয়া ধরিল। দেবদাস ভ্রকুটি করিল__ছিঃ, ছুঁয়ো না__-এখনো
আমার জ্ঞান আছে। চন্্রমুখী, তুমি ত জান না__আমি শুধু জানি আমি কত যে তোমাদের ঘৃণা করি। চিরকাল ঘৃণা করব-_তবু আসব, তবু বসব, তবু কথা
কব- নাহলে যে উপায় নেই। তা কি তোমরা কেউ বুঝবে? হাঃ-_হাঃ_-লোকে পাপ কাজ আধারে করে, আর আমি এখানে মাতাল হই--এমন উপযুক্ত স্থান
জগতে কি আর আছে! আর তোমরা-_

দেবদাস দৃষ্টি সংযত করিয়া কিছুক্ষণ তাহার বিষণ্ন মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আহা! সহিষ্কুতার প্রতিমূর্তি! লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অপমান, অত্যাচার,
উপদ্রব-ন্ত্রীলোকে যে কত সইতে পারে--তোমরাই তার দৃষ্টান্ত ।

তাহার পর চিত হইয়া শুইয়া পড়িয়া, চুপি চুপি কহিতে লাগিল- চন্দ্রমুখী বলে, সে আমাকে ভালবাসে_আমি তা চাইনে__চাইনে__চাইনে_লোকে
থিয়েটার করে, মুখে টুনকালী মাখে-_চোর হয়-__ভিক্ষা করে__রাজা হয়__রানী হয়__ভালবাসে-_-কত ভালবাসার কথা বলে--কত কীদে-_ঠিক যেন সব সত্য!
চন্্রমুখী আমার থিয়েটার করে, আমি দেখি! কিন্তু তাকে যে মনে পড়ে-_-একদণ্ডে কি যেন সব হয়ে গেল। কোথায় সে চলে গেল-_আর কোন্‌ পথে আমি চলে
গেলাম। এখন একটা সমস্ত জীবনব্যাপী মস্ত অভিনয় আর্ত হয়েছে। একটা ঘোর মাতাল--আর এই একটা--হোক, তাই হোক-_মন্দ কি! আশা নেই, ভরসা
নেই__সুখও নেই, সাধও নেই-_বাঃ বহুৎ আচ্ছা__

তাহার পর দেবদাস পাশ ফিরিয়া বিড়বিড় করিয়া কি বলিতে লাগিল।

চন্দ্রমুখী তাহা বুঝিতে পারিল না। অল্পক্ষণেই দেবদাস ঘুমাইয়া পড়িল। চন্দ্রমুখী তখন কাছে আসিয়া বসিল। অঞ্চল ভিজাইয়া মুখ মুছাইয়া দিয়া, সিক্ত
বালিশ বদলাইয়া দিল। একটা পাখা লইয়া কিছুক্ষণ বাতাস করিয়া, বহুক্ষণ অধোবদনে বসিয়া রহিল। রাত্রি তখন প্রায় একটা । দীপ নিভাইয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া
অন্য কক্ষে চলিয়া গেল।

16
Articles
দেবদাস
0.0
"দেবদাস" প্রখ্যাত বাঙালি লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা একটি কালজয়ী ক্লাসিক। এই মর্মস্পর্শী আখ্যানটি দেবদাসের করুণ কাহিনি, অপ্রত্যাশিত প্রেমের দ্বারা গ্রাস করা এক যুবককে নিয়ে আসে। 20 শতকের গোড়ার দিকে স্থাপিত, গল্পটি ঔপনিবেশিক ভারতে সামাজিক নিয়ম এবং শ্রেণীগত পার্থক্যগুলির জটিলতাগুলি অন্বেষণ করে। বইটি স্পষ্টভাবে মদ্যপান এবং হতাশার মধ্যে দেবদাসের আত্ম-ধ্বংসাত্মক বংশদ্ভুত চিত্রিত করে, পারোর প্রতি তার প্রেম এবং পারিবারিক চাপের কারণে তাকে বিয়ে করতে না পারা থেকে উদ্ভূত। শরৎচন্দ্রের উদ্দীপনামূলক গল্প বলার এবং গভীর চরিত্রের অন্বেষণ "দেবদাস" কে একটি স্থায়ী সাহিত্যিক মাস্টারপিস করে তোলে, প্রেম, ক্ষতি এবং সামাজিক সীমাবদ্ধতার থিমগুলিকে উস্কে দেয় যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাঠকদের সাথে অনুরণিত হতে থাকে।
1

প্রথম পরিচ্ছেদ

7 October 2023
1
0
0

একদিন বৈশাখের দ্বিপ্রহরে রৌদ্রেরও অন্ত ছিল না, উত্তাপেরও সীমা ছিল না। ঠিক সেই সময়টিতে মুখৃষ্যেদের দেবদাস পাঠশালা-ঘরের এক কোণে ছেঁড়া মাদুরের উপর বসিয়া, শ্রেট হাতে লইয়া, চক্ষু চাহিয়া, বুজিয়া, পা

2

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

7 October 2023
0
0
0

দেবদাসকে পরদিন খুব মারধর করা হইল-_সমস্তদিন ঘরে রুদ্ধ করিয়া রাখা হইল। তাহার পর, তাহার জননী যখন ভারী কান্নাকাটি করিতে লাগিলেন, তখন দেবদাসকে ছাড়িয়া দেওয়া হইল। পরদিন ভোরবেলায় সে পলাইয়া আসিয়া পার্ব

3

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

7 October 2023
0
0
0

দিনের পর দিন যায়__এ দুটি বালক-বালিকার আমোদের সীমা নাই-_সমস্ত দিন ধরিয়া রোদে রোদে ঘুরিয়া বেড়ায়, সন্ধ্যার সময় ফিরিয়া আসিয়া মারধর খায়, আবার সকালবেলায় ছুটিয়া পলাইয়া যায়__আবার তিরক্কার-প্রহার

4

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

7 October 2023
1
0
0

এমনি করিয়া এক বৎসর কাটিল বটে, কিন্তু আর কাটিতে চাহে না। দেবদাসের জননী বড় গোলযোগ করিতে লাগিলেন । স্বামীকে ডাকিয়া বলিলেন, দেবা যে মুখ্য চাষা হয়ে গেল,__-একটা যা হয় উপায় কর। তিনি ভাবিয়া বলিলেন,

5

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

7 October 2023
0
0
0

পার্বতী এই তের বছরে পা দিয়াছে_-ঠাকুরমাতা এই কথা বলেন। এই বয়সে শারীরিক সৌন্দর্য অকম্মাৎ যেন কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া কিশোরীর সর্বাঙ্গ ছাইয়া ফেলে। আত্মীয়স্বজন হঠাৎ একদিন চমকিত হইয়া দেখিতে পান যে,

6

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

8 October 2023
0
0
0

রাত্রি বোধ হয় একটা বাজিয়া গিয়াছে । তখনও স্লান জ্যোৎস্না আকাশের গায়ে লাগিয়া আছে। পার্বতী বিছানার চাদরে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়া ধীরপদবিক্ষেপে সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া আসিল। চারিদিকে চাহিয়া দেখিল

7

সপ্তম পরিচ্ছেদ

8 October 2023
0
0
0

পরদিন পিতার সহিত দেবদাসের অল্পক্ষণের জন্য কথাবার্তা হইল। পিতা কহিলেন, তুমি চিরদিন আমাকে জ্বালাতন করিয়াছ, যতদিন বাঁচিব, ততদিনই জ্বালাতন হইতে হইবে । তোমার মুখে এ কথায় আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। দে

8

অষ্টম পরিচ্ছেদ

8 October 2023
0
0
0

সতর্ক এবং অভিজ্ঞ লোকদিগের স্বভাব এই যে, তাহারা চক্ষুর নিমিষে কোন দ্রব্যের দোষগুণ সম্বন্ধে দৃঢ় মতামত প্রকাশ করে না-_সবটুকুর বিচার না করিয়া, সবটুকুর ধারণা করিয়া লয় না; দুটো দিক দেখিয়া চারিদিকের কথ

9

নবম পরিচ্ছেদ

8 October 2023
0
0
0

আর দেবদাসঃ সে রাত্রিটা সে কলিকাতা ইডেন গার্ডেনের একটা বেঞ্চের উপর বসিয়া কাটাইয়া দিল। তাহার খুব যে ক্লেশ হইতেছিল, যাতনায় মর্মভেদ হইতেছিল, তাহা নয়। কেমন একটা শিথিল ওঁদাস্য ধীরে ধীরে বুকের মধ্যে জমা

10

দশম পরিচ্ছেদ

8 October 2023
0
0
0

পার্বতী আসিয়া দেখিল, তাহার স্বামীর মস্ত বাড়ি। নৃতন সাহেবী ফ্যাশনের নহে, পুরাতন সেকেলে ধরনের । সদর মহল, অন্দর মহল, পূজার দালান, নাটমন্দির, অতিথিশালা, কাছারি-বাড়ি, তোশাখানা, কত দাসদাসী-_পার্বতী অবাক

11

একাদশ পরিচ্ছেদ

8 October 2023
0
0
0

তাহার পর দুই-তিনদিন দেবদাস মিছিমিছি পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইল-_-অনেকটা পাগলের মত । ধর্মদাস কি কহিতে গিয়াছিল, তাহাকে চক্ষু রাঙ্গাইয়া ধমকাইয়া উঠিল। গতিক দেখিয়া চুনিলালও কথা কহিতে সাহস করিল না। ধর্মদা

12

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

10 October 2023
0
0
0

দুই ভাই দ্বিজদাস ও দেবদাস ও গ্রামের অনেকেই জমিদার নারায়ণ মুখৃয্যের সৎকার করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল। দ্বিজদাস চীৎকার করিয়া কীদিয়া পাগলের মত হইয়াছে__পাড়ার পাচজন তাহাকে ধরিয়া রাখিতে পারিতেছে না।

13

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

10 October 2023
0
0
0

পিতার মৃত্যুর পর ছয় মাস ধরিয়া ক্রমাগত বাটীতে থাকিয়া, দেবদাস একেবারে জ্বালাতন হইয়া উঠিল। সুখ নাই, শান্তি নাই, একান্ত একঘেয়ে জীবন। তার উপর ক্রমাগত পার্বতীর চিন্তা; আজকাল সব কাজেই তাহাকে মনে পড়ে ।

14

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

10 October 2023
0
0
0

বৎসর-দুই হইল পার্বতী মহেন্দ্রের বিবাহ দিয়া অনেকটা নিশ্চিন্ত হইয়াছে । জলদবালা বুদ্ধিমতী ও কর্মপটু । পার্বতীর পরিবর্তে সংসারের অনেক কাজ সে-ই করে। পার্বতী এখন অন্যদিকে মন দিয়াছে । আজ পাঁচ বৎসর হইল তা

15

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

10 October 2023
0
0
0

আজ দুই বৎসর হইতে অশথঝুরি গ্রামে চন্দরমুখী ঘর বীধিয়াছে। ছোট নদীর তীরে একটা উঁচু জায়গায় তাহার ঝরঝরে দু'খানি মাটির ঘর; পাশে একটা চালা,তাহাতে কাল রংয়ের একটা পরিপুষ্ট গাভী বাধা থাকে । ঘর-দুইটির একটিতে

16

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

10 October 2023
0
0
0

কলিকাতা ত্যাগ করিয়া কিছুদিন যখন দেবদাস এলাহাবাদে বাস করিতেছিল, তখন হঠাৎ একদিন সে চন্দ্রমুখীকে চিঠি লিখিয়াছিল, বৌ, মনে করেছিলাম, আর কখনো ভালবাসব না। একে ত ভালবেসে শুধুহাতে ফিরে আসাটাই বড় যাতনা, তার

---