আর দেবদাসঃ সে রাত্রিটা সে কলিকাতা ইডেন গার্ডেনের একটা বেঞ্চের উপর বসিয়া কাটাইয়া দিল। তাহার খুব যে ক্লেশ হইতেছিল, যাতনায় মর্মভেদ
হইতেছিল, তাহা নয়। কেমন একটা শিথিল ওঁদাস্য ধীরে ধীরে বুকের মধ্যে জমা হইয়া উঠিতেছিল। নিদ্রার মধ্যে শরীরের কোন একটা অঙ্গে হঠাৎ পক্ষাঘাত
হইলে, ঘুম ভাঙ্গিয়া সেটার উপর যেমন কোন অধিকার খুঁজিয়া পাওয়া যায় না, এবং বিস্মিত স্ত্তিত মন মুহুর্ত ঠাওরাইতে পারে না, কেন তাহার আজন্ম-সঙ্গী
চিরদিনের বিশ্বস্ত অঙ্গটা তাহার আহ্বানে সাড়া দিতেছে না; তাহার পর ধীরে ধীরে বুঝিতে পারা যায়, ধীরে ধীরে জ্ঞান জন্মে যে, এটা আর তাহার নিজের
নাই; দেবদাস এমনি ধীরে ধীরে সমস্ত রাত্রি ধরিয়া বুঝিতেছিল যে, সময়ে সংসারটার অকস্মাৎ পক্ষাঘাত হইয়া, তাহার সহিত চিরদিনের জন্য বিচ্ছেদ হইয়া
গিয়াছে। এখন তাহার উপর মিথ্যা রাগ-অভিমান আর কিছুই খাটিবে না। সাবেক অধিকারের কথাটা ভাবিতে যাওয়াই ভুল হইবে । তখন সূর্যোদয় হইতেছিল।
দেবদাস উঠিয়া দাঁড়াইয়া ভাবিল, কোথায় যাই। হঠাৎ স্মরণ হইল তাহার কলিকাতার বাসাটা । সেখানে চুনিলাল আছে। দেবদাস চলিতে লাগিল। পথে বার-দুই
ধাক্কা খাইল, হৌচট খাইয়া অঙ্গুলি রক্তাক্ত করিল-_টাল খাইয়া একজনের গায়ের উপর পড়িতেছিল,--সে মাতাল বলিয়া ঠেলিয়া দিল। এমনি করিয়া ঘুরিয়া
ঘুরিয়া দিনশেষে মেসের দরজায় আসিয়া দীড়াইল। চুনিবাবু তখন বেশবিন্যাস করিয়া বাহির হইতেছিলেন। _-এ কি, দেবদাস যে!
দেবদাস নীরবে চাহিয়া রহিল।
কখন এলে হে? মুখ শুকনো, স্ানাহার হয়নি_-ও কি-__কি! দেবদাস পথের উপরেই বসিয়া পড়িতেছিল, চুনিলাল হাত ধরিয়া ভিতরে লইয়া গেল। নিজের
শয্যার উপর বসাইয়া, শান্ত করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপার কি দেবদাস?
কাল বাড়ি থেকে এসেচি।
কাল? সমস্তদিন তবে ছিলে কোথায়? রাত্রেই বা কোথায় ছিলে?
ইডেন গার্ডেনে ।
পাগল নাকি! কি হয়েছে, বল দেখি?
শুনে কি হবে?
না বল, এখন খাওয়া-দাওয়া করো । তোমার জিনিসপত্র কোথায় ?
কিছুই আনিনি।
তা হোক, এখন খেতে বোস।
তখন জোর করিয়া চুনিলাল কিছু আহার করাইয়া,শয্যায় শুইতে আদেশ করিয়া দ্বার রুদ্ধ করিতে করিতে কহিল, একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর, আমি রাত্রে এসে
তোমাকে তুলব । বলিয়া সে তখনকার মত চলিয়া গেল। রাত্রি দশটার মধ্যে সে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, দেবদাস তাহার বিছানায় গভীর নিদ্রায় সুপ্ত। না
ডাকিয়া, সে নিজে একখানা কম্বল টানিয়া লইয়া, নীচে মাদুর পাতিয়া শুইয়া পড়িল। সারা রাত্রির মধ্যে দেবদাসের ঘুম ভাঙ্গিল না, প্রভাতেও না। বেলা দশটার
সময় সে উঠিয়া বসিয়া কহিল, চুনিবাবু, কখন এলে হে?
এইমাত্র আসচি।
তবে তোমার কোনরকম অসুবিধা হয়নি!
কিছু না।
দেবদাস কিছুক্ষণ তাহার মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া কহিল, চুনিবাবু, আমার যে কিছু নেই, তুমি আমাকে প্রতিপালন করবে?
চুনিলাল হাসিল । সে জানিত, দেবদাসের পিতা মহা ধনবান ব্যক্তি । তাই হাসিয়া কহিল, আমি প্রতিপালন করব! বেশ কথা। তোমার যতদিন ইচ্ছা থাক,
কোন ভাবনা নেই।
চুনিবাবু, তোমার আয় কত?
ভাই, আমার আয় সামান্য । বাটীতে কিছু বিষয়-সম্পত্তি আছে, তা দাদার কাছে গচ্ছিত রেখে এখানে বাস করি । তিনি প্রতিমাসে সত্তর টাকা হিসাবে পাঠিয়ে
দেন। এতে তোমার আমার স্বচ্ছন্দ চলে যাবে ।
তুমি বাড়ি যাও না কেন?
চুনিলাল ঈষৎ মুখ ফিরাইয়া কহিল, সে অনেক কথা ।
দেবদাস আর কিছু জিজ্ঞাসা করিল না। ক্রমে আহারাদির জন্য ডাক পড়িল। তাহার পর দুইজনে স্নানাহার শেষ করিয়া পুনরায় ঘরে আসিয়া বসিলে চুনিলাল
বলিল, দেবদাস, বাপের সঙ্গে ঝগড়া করেচ?
না।
আর কারো সঙ্গে?
দেবদাস তেমনি জবাব দিল, না।
তাহার পর ছুনিলালের হঠাৎ অন্য কথা স্মরণ হইল। কহিল, ওহো, তোমার এখনো বিয়েই হয়নি যে!
এই সময় দেবদাস অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া শুইয়া পড়িল । অল্পক্ষণেই চুনিলাল দেখিল, দেবদাস ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। এমনি করিয়া ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া আরও
দুইদিন অতীত হইল । তৃতীয় দিবসের প্রাতঃকালে দেবদাস সুস্থ হইয়া উঠিয়া বসিল। মুখ হইতে সেই ঘন ছায়া যেন অনেকটা সরিয়া গিয়াছে বোধ হইল।
চুনিলাল জিজ্ঞাসা করিল, আজ শরীর কেমন?
বোধ হয় অনেকটা ভাল। আচ্ছা চুনিবাবু, রাত্রে তুমি কোথায় যাও?
আজ চুনিলাল লঙ্জিত হইল; বলিল, হা, তা যাই বটে, কিন্তু সে কথা কেন?
আচ্ছা,_আর তুমি কেন কলেজে যাও না?
না__লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েচি।
ছিঃ, তা কি হয়? মাস-দুই পরে তোমার পরীক্ষা । পড়াও তোমার মন্দ হয়নি, এবার কেন পরীক্ষা দাও না!
না_পড়া ছেড়ে দিয়েচি।
চুনিলাল চুপ করিয়া রহিল। দেবদাস পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় যাও-_বলবে না? তোমার সঙ্গে আমিও যাবো ।
চুনিলাল দেবদাসের মুখপানে চাহিয়া বলিল, কি জান দেবদাস,আমি খুব ভাল জায়গায় যাইনে।
দেবদাস যেন আপনার মনে কহিল, ভাল আর মন্দ! ছাই কথা!-_চুনিবাবু, আমাকে সঙ্গে নেবে নাঃ
তা নিতে পারি। কিন্ত তুমি যেয়ো না।
না, আমি যাবই। যদি ভাল না লাগে, আর না হয় যাব না। কিন্তু তুমি যে সুখের আশায় প্রত্যহ উন্মুখ হয়ে থাকো-_যাই হোক চুনিবাবু, আমি নিশ্চয়ই
যাবো।
চুনিলাল মুখ ফিরাইয়া একটু হাসিল; মনে মনে বলিল, আমার দশা! মুখে বলিল, আচ্ছা তাই যেয়ো।
অপরাহ্ুবেলায় ধর্মদাস জিনিসপত্র লইয়া উপস্থিত হইল । দেবদাসকে দেখিয়া কীদিয়া ফেলিল। দেব্তাঃ আজ তিন-চারদিন ধরে মা কত যে কীদচেন__
কেন রে?
কিছু না বলে হঠাৎ চলে এলে কেন? একখানা পত্র বাহির করিয়া হাতে দিয়া কহিল, মার চিঠি।
ছুনি চন্দ্রমুখীকে কতকটা চিনিতে পারিয়াছিল। ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না-_না, নোট-ফোটের লোক আলাদা__সে তুমি নও। কিন্তু সত্যি কথাটা বল ত?
চন্দ্রমুখী কহিল, সত্যিই একটু মায়া পড়েচে।
ছুনি বিশ্বাস করিল না; হাসিয়া কহিল, এই পাঁচ-মিনিটের মধ্যে?
এবার চন্দ্রমুখীও হাসিতে লাগিল । বলিল, তা হোক । মন ভালো হলে আর একদিন এনো-আর একবার দেখব । আনবে ত?
কি জানি!
আমার মাথার দিব্যি রইল।
আচ্ছা দেখব।