পদার্থ
আমরা ইতস্ততঃ যে সকল বস্তু দেখিতে পাই, সে সমৃদয়কে পদার্থ বলে। পদার্থ দ্বিবিধ; সজীব ও নির্জীব। যে সকল বস্তুর জীবন আছে, অর্থাৎ যাহাদের জন্ম, বৃদ্ধি ও মৃত্যু আছে, উহারা সঞ্জীব পদার্থ; যেমন মনু্য, পণ্ড, পক্ষী, কীট, পতঙ্গ, বৃক্ষ, লতা ইত্যাদি। যে সকল বস্তুর জীবন নাই, যেখানে রাখ, সেইখানে থাকে, এক স্থান হইতে অন্য স্থানে যাইতে পারে না, উহাদিগকে নির্জীব বা জড় পদার্থ কহে; যেমন ধাতু, প্রস্তর, মৃত্তিকা ইত্যাদি। সজীব পদার্থের মধ্যে যাহারা ইচ্ছামত গমনাগমন করিতে পারে, তাহাদিগকে প্রাণী বলে; যেমন মনুষ্য, পশু, পক্ষী, কীট, পতঙ্গ ইত্যাদি। আর যে সকল বস্তু ভূমিতে জন্মে, ইচ্ছামত গমনাগমন করিতে পারে না, উহারা উদ্ভিদ পদার্থ; যেমন তরু, লতা, তৃণ ইত্যাদি।
ঈশ্বর
ঈশ্বর, কি প্রাণী, কি উদ্ভিদ, কি জড়, সমস্ত পদার্থের সৃষ্টি করিয়াছেন। এ নিমিত্ত ঈশ্বরকে সৃষ্টিকর্তা বলে। ঈশ্বরকে কেহ দেখিতে পায় না; কিন্তু তিনি সর্বদা সর্বত্র বিদ্যমান আছেন। আমরা যাহা করি, তিনি তাহা দেখিতে পান; আমরা যাহা মনে ভাবি, তিনি তাহা জানিতে পারেন। ঈশ্বর পরম দয়ালু, তিনি সমস্ত জীবের আহার- দাতা ও রক্ষাকর্তা।
চেতন পদার্থ
সমুদয় চেতন পদার্থের সাধারণ নাম জন্তু। জত্তগণ মুখ দ্বারা আহারের গ্রহণ, এবং মুখ ও নাসিকা দ্বারা বায়ুর আকর্ষণ করিয়া প্রাণধারণ করে। আহার দ্বারা শরীরের পুষ্টি হয়, তাহাতেই উহারা বাঁচিয়া থাকে। আহার না পাইলে, শরীর শুষ্ক হইতে থাকে, এবং অল্প দিনের মধ্যেই প্রাণত্যাগ ঘটে। প্রায় সকল জন্তুর পাঁচ ইন্দ্রিয় আছে। সেই পাঁচ ইন্দ্রিয় দ্বারা, তাহারা দর্শন, শ্রবণ, আঘ্রাণ, আস্বাদন ও স্পর্শ করিতে পারে।
পুত্তলিকার চক্ষু আছে, দেখিতে পায় না; মুখ আছে, খাইতে পারে না; নাসিকা আছে, গন্ধ পায় না; হস্ত আছে, কোনও কর্ম করিতে পারে না; কর্ণ আছে, কিছুই শুনিতে পায় না; চরণ আছে, চলিতে পারে না। ইহার কারণ এই, পুত্তলিকা জড় পদার্থ, উহার চেতনা নাই। ঈশ্বর কেবল প্রাণীদিগকে চেতনা দিয়াছেন। তিনি ভিন্ন আর কাহারও চেতনা দিবার ক্ষমতা নাই। দেখ, মহ্যেরা পুত্তলিকার মুখ, চোখ, নাক, কান, হাত, পা সমূদয় গড়িতে পারে, এবং উহাকে ইচ্ছামত বেশ-ভূষাও পরা- ইতে পারে, কিন্তু চেতনা দিতে পারে না; উহা অচেতন পদার্থই থাকে, দেখিতেও পায় না, শুনিতেও পায় না, চলিতেও পারে না, বলিতেও পারে না।
পৃথিবীর সকল স্থানেই নানাবিধ ক্ষুদ্র ও বৃহৎ জন্ম আছে; তাহাদের মধ্যে কতকগুলি স্বলচর, অর্থাৎ কেবল স্থলে থাকে; আর কতকগুলি জলচর, অর্থাৎ কেবল জলেথাকে, আর কতকগুলি, স্থল ও জল উভয় স্থানেই থাকে, উহাদিগকে উভচর বলা যাইতে পারে।
যাবতীয় প্রাণীর মধ্যে মনুষ্য সর্বপ্রধান। আর সমূদয় জীব মনু্য অপেক্ষা নিকৃষ্ট। তাহারা কোনও ক্রমে, বুদ্ধি ও ক্ষমতাতে মনুষ্যের তুল্য নহে।
যে সকল জপ্তর শরীরের চর্ম রোমশ, অর্থাৎ রোমে আবৃত, এবং যাহারা চারি পায়ে চলে, তাহাদিগকে পণ্ড বলে; যেমন গো, মহিষ, অশ্ব, গর্দভ, ছাগল, মেষ, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি। পশুর চারি পা; এজন্য পশুদিগকে চতুষ্পদ জন্তু এলে। কতকগুলি জন্তুর পায়ে খুর আছে, যেমন গো, মহিষ, অশ্ব, গর্দভ, ছাগল, মেষ প্রভৃতির। কোনও কোনও পশুর খুব অখণ্ডিত অর্থাৎ জোড়া; যেমন ঘোড়ার। কতকগুলির খুর দুই খণ্ডে বিভক্ত, যেমন গো, মেধ, ছাগল প্রভৃতির। কোনও কোনও পশুর পায়ে খুর নাই, নখর আছে; যেমন সিংহ, ব্যাঘ্র, কুকুর, বিড়াল প্রভৃতির। বানরগণের দেহ লোমে আচ্ছাদিত বটে, কিন্তু উহারা চতুস্পদ নহে। উহারা হস্ত ও পদ উভয়েরই অঙ্গুলি দ্বারা বৃক্ষের শাখা ধরিতে পারে; এজন্য পণ্ডিতেরা উহাদিগকে চতুষ্পদ না বলিয়া চতুর্হন্ত বলিয়া থাকেন। বানর, বুদ্ধিতে মহু্য অপেক্ষা অনেকাংশে নিকৃষ্ট হইলেও, অন্য জন্তু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
জন্তুর মধ্যে পক্ষিজাতি, দেখিতে অতি সুন্দর। তাহাদের সর্বাঙ্গ পালকে ঢাকা। পক্ষীর দুই পাশে দুই পক্ষ অর্থাৎ ডানা আছে; উহা দ্বারা উড়িতে পারে, অনেক দূর গেলেও ক্লেপবোধ করে না। পক্ষীর ছটি পা আছে; তাহা দ্বারা চলিতে পারে, এবং বৃক্ষের শাখায় বসিতে পারে; প্রায় সকল পক্ষী, খড়, কুটা, তৃণ প্রভৃতি আহরণ করিয়া অতি পরিষ্কৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাসা প্রস্তুত করে। কোন কোন পক্ষী অতিশয় ক্ষুদ্র; যেমন চড়ুই, বাবুই ইত্যাদি। আমেরিকায় একপ্রকার পক্ষী আছে, উহা ভ্রমর অপেক্ষা বৃহৎ নহে।
কাক, কোকিল, পারাবত প্রভৃতি অনেকগুলি পক্ষীর আকার কিছু বৃহৎ। আফ্রিকা- দেশে উটপক্ষী নামে একপ্রকার পক্ষী দেখিতে পাওয়া যায়; উহা উচ্চে ছয় সাত হাত পর্যন্ত হইয়া থাকে। হুংস, সারস প্রভৃতি কতকগুলি পক্ষী জলে খেলা করে ও সাঁতার দিতে ভালবাসে, উহারা জলচর পক্ষী। সন্তরণের সুবিধার জন্য, পরমেশ্বর জলচর পক্ষীর পায়ের অঙ্গুলি, একখানি পাতলা চর্ম দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত করিয়া দিয়াছেন। পক্ষী সকল আপন আপন বাসায় ডিম পাড়ে। কিছুদিন ভানায় ঢাকিয়া গরমে রাখিলে, ডিমের ভিতর হইতে ছানা বাহির হয়। ইহাকেই ডিমে তা দেওয়া ও ডিম ফুটান বলে।
মৎস্য একপ্রকার জন্তু। ইহারা জলে থাকে। মৎ্যের শরীর ছালে আচ্ছাদিত। ঐ ছালের উপর মসৃণ চিকণ শহু অর্থাৎ আইস আছে। বোয়াল, মাগুর প্রভৃতি কতকগুলি মৎস্যের ছালে আঁইন্স নাই। মৎস্তের দুই পাশে যে পাখনা আছে, তাহার বলে জলে ভাসিয়া বেড়ায়। মৎস্তেরা অতি বেগে সাঁতার দিতে পারে, এবং জলের ভিতর দিয়া গিয়া, কীট ও অন্য অন্য ভক্ষ্য বস্তু ধরে।
আর একপ্রকার জন্তু আছে, তাহাদিগকে সরীসৃপ বলে; যেমন সাপ, গোসাপ, টিক্- টিকি, গিরগিটি, বেঙ ইত্যাদি।
সর্প প্রভৃতি কতকগুলি সরীস্বপের পা নাই, বুকে ভর দিয়া চলে; সর্পের শরীরের চর্ম অতি মসৃণ ও চিক্কণ। ভেক, কচ্ছপ, গোসাপ, টিটিকি প্রভৃতি কতকগুলি সরীস্বপের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পা আছে; উহারা তাহা দ্বারা চলে। ভেকজাতি নিরীহ, কৌতুক ও আমো- দের নিমিত্ত, উহাদিগকে ক্লেশ দেওয়া উচিত নহে। কেহ কেহ এমন নিষ্ঠুর যে, ভেক দেখিলেই ডেলা মারে ও যষ্টি প্রহার করে।
পতঙ্গও একপ্রকার জন্তু। পতঙ্গ নানাবিধ। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে ফড়িং, মশা, মাছি প্রজা- পতি প্রভৃতি বহুবিধ পতঙ্গ উড়িয়া বেড়ায়। পতঙ্গগণ পক্ষী, মৎস্য প্রভৃতি জন্তুর আহার। কীট অতি ক্ষুদ্র জন্তু। কীট নানাবিধ। উকুন, ছারপোকা, পিপীলিকা, উই প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জন্তু কীট জাতি। পতঙ্গের ন্যায় কীটেরা উড়িয়া বেড়াইতে পারে না। এ সমস্ত ভিন্ন আরও অনেকবিধ জন্তু আছে। তাহারা এত ক্ষুদ্র যে, অণুবীক্ষণনামক যন্ত্র ব্যতিরেকে, কেবল চক্ষুতে দেখিতে পাওয়া যায় না। তাহারা স্ব স্ব প্রকৃতি অনু- সারে জলে ও স্থলে অবস্থিতি করে।
সমস্ত জগৎ ক্ষুদ্র ও বৃহৎ জীবসমূহে পরিবৃত। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কি অপার মহিমা! তিনি সমস্ত জীবের প্রতিদিনের পর্যাপ্ত আহারের যোজনা করিয়া রাখিয়াছেন। অধিকাংশ জন্তু লতা, পাতা, ফল, মূল, ঘাস খাইয়া প্রাণধারণ করে। কতকগুলি দপ্ত আপন অপেক্ষা দুর্বল জন্তর প্রাণবধ করিয়া, তাহাদের মাংস খায়। উহাদিগকে খাপদ অথবা শিকারী জন্তু বলে।
গো, অশ্ব, গর্দভ, কুকুর, বিড়াল প্রভৃতি কতকগুলি জন্তু লোকালয়ে থাকে, এবং মানুষে যাহা দেয়, তাহাই খাইয়া প্রাণধারণ করে। এই সকল জন্তুকে গ্রাম্যপন্ড বলে। গ্রাম্য- পশুরা অতি শান্তস্বভাব, মহস্তের অনেক উপকারে আইসে।
কোনও কোনও প্রাণী, মনু্যের ন্যায় সন্তান প্রসব করে এবং স্তন্যপান করাইয়া থাকে; ইহাদিগকে স্তন্যপায়ী কহে। কোনও কোনও প্রাণী, পক্ষীর ন্যায় অণ্ড প্রসব করে; উহাদিগকে অণ্ডজ বলে। মৎশ্য, সরীসৃপ, কীট, পতঙ্গ মাত্রেই অগুঙ্গ।
কোন্ জন্তু কোন্ শ্রেণীতে নিবিষ্ট, কাহার কি নাম, বিশেষরূপে জানা অতি আবশ্যক। কোনও জন্তুকেই অযথা নামে ডাকা উচিত নহে; যাহার যে নাম, তাহাকে সেই নামে ডাকা কর্তব্য। কোনও কোনও ব্যক্তি বাছড়কে পক্ষী বলে; কিন্তু বাছড় পক্ষী নহে, স্তন্যপায়ী। পশুদিগের ন্যায় উহাদিগেরও চারি পা আছে। সম্মুখের দুই পায়ের অঙ্গুলি শরীরের অপেক্ষা অনেক বৃহৎ, এবং একখানি পাতলা চর্ম দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত উহাকেই আমরা বাদুড়ের ডানা বলি। সমুদ্রে একপ্রকার স্ববৃহৎ মৎস্যকৃতি জন্তু বাস করে তাহার নাম তিমি। তিমি স্তন্যপায়ী, অতএব উহাকে মৎশ্য বলা উচিত নহে। চিংড়িও একপ্রকার জলজ কীট, মৎস্ত নহে।
লোকে সচরাচর গুটিপোকাকে কীট বলিয়া থাকে; কিন্তু বাস্তবিক গুটিপোকা কাঁট নহে, পতঙ্গ। অণ্ড হইতে নির্গত হইয়া, উহারা কিছুকাল কীটের অবস্থায় থাকে, পরে সহসা উহাদের আকৃতির পরিবর্তন হইতে আরম্ভ হয়। ক্রমে উহাদের পাখা উঠে এবং উহারা উড়িয়া বেড়াইতে শিখে। গুটিপোকার ন্যায় প্রজাপতিকেও ঐরূপ তিন অবস্থায় দেখিতে পাওয়া যায়।
ঈশ্বর, কি অভিপ্রায়ে কোন্ বস্তুর সৃষ্টি করিয়াছেন, আমরা তাহা অবগত নহি, এজন্য কতকগুলিকে পূজা ও পবিত্র জ্ঞান করি আর কতকগুলিকে ঘৃণা করি। কিন্তু ইহা অন্যায় ও ভ্রান্তিমূলক। বিশ্বকর্তা ঈশ্বরের সন্নিধানে, সকল জন্তই সমান। অতএব আমাদেরও ঐরূপ জ্ঞান করা উচিত।
পশুদের মধ্যে পদমর্যাদা নাই। লোকে সিংহকে মৃগেন্দ্র (অর্থাৎ পশুর রাজা বলে। সকল পশু অপেক্ষা সিংহের সাহস ও বিক্রম অধিক; এই নিমিত্ত মনুহ্যেরা উহাকে, ঐ উপাধি দিয়াছে; নচেৎ, সিংহ অন্য অন্য পশু অপেক্ষা কোন মতেই উৎকৃষ্ট নহে।
মানবজাতি, বুদ্ধি ও ক্ষমতাতে সকল জন্তু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। তাহাদের বুদ্ধি ও বিবেচনা- শক্তি আছে; এজন্য সর্ববিধ জন্তুর উপর আধিপত্য করে। মানুষ, পশুর জ্ঞায় চারি পায়ে চলে না, দুই পায়ের উপর ভর দিয়া সোজা হইয়া দাঁড়ায়। মানুষের দুই হাত, দুই পা। দুই পা দিয়া ইচ্ছামত সর্বত্র যাতায়াত করিতে পারে। মানুষ দুই হস্ত দ্বারা আহার-সামগ্রীর আহরণ করে, গৃহসামগ্রী ও পরিধান-বস্ত্র প্রস্তুত করিয়া লয়, এবং গৃহনির্মাণ করিয়া, তাহাতে বাস করে। গৃহের মধ্যে বাস করে, এজন্য মানুষকে রৌদ্র, বৃষ্টি, ঝড় প্রভৃতিতে ক্লেশ পাইতে হয় না।
মনুষ্যজাতি একাকী থাকিতে ভালবাসে না। তাহারা পিতা, মাতা, ভ্রাতা, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা প্রভৃতি পরিবারবর্গের মধ্যগত ও প্রতিবেশিমণ্ডলে বেষ্টিত হইয়া বাস করে। এরূপও দেখিতে পাওয়া যায়, কোনও কোনও ব্যক্তি লোকালয় ছাড়িয়া অরণ্যে বাস করে; কিন্তু তাদৃশ লোক অতি বিরল। অধিকাংশ লোকই, গ্রামে ও নগরে পরস্পরের নিকটে বাটা নির্মাণ করিয়া অবস্থিতি করে। যেখানে অল্প লোক বাস করে, তাহার নাম গ্রাম। যেখানে বহুসংখ্যক লোকের বাস, তাহাকে নগর বলে। যে নগরে রাজার বাস, অথবা রাজকীয় প্রধান স্থান থাকে, তাহাকে রাজধানী বলে, যেমন কলিকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী।
মনুষ্যেরা গ্রামে ও নগরে, একত্র হইয়া বাস করে। ইহার তাৎপর্য এই, তাহাদের পর- স্পর সাহায্য হইতে পারিবে ও পবল্পব দেখাশুনা ও কথাবার্তায় মুখে কালযাপন হইবে। যাহারা এইরূপে একত্র বাস করে, তাহাদিগকে অন্যান্যের প্রতিবেশী বলা যায়; প্রতিবেশীদিগের মধ্যে সর্বদা সম্ভাব থাকা উচিত, পরস্পর কলহ ও বিবাদ করিলে অসুখের বৃদ্ধি হয়। যে লোক যে দেশে বাস কবে, তাহাকে সে দেশের নিবাদী বলে। দেশের সমস্ত নিবাসী লোক লইয়া এক জাতি হয়। পৃথিবীতে নানা দেশ ও জাতি আছে।
লোক মাত্রেরই জন্মভূমিঘটিত এক এক উপাধি থাকে; ঐ উপাধি দ্বারা তাহাদিগকে অন্য দেশীয় লোক হইতে পৃথক বলিয়া জানা যায়। বাঙ্গালা দেশে আমাদের নিবাস, এই নিমিত্ত আমাদিগকে বাঙ্গালী বলে। এইরূপ উড়িয়া দেশের নিবাসী লোকদিগকে উড়িয়া বলে; মিথিলার নিবাসীদিগকে মৈথিল, ইংলণ্ডের নিবাসীদিগকে ইংরেজ। প্রাণী সকল, দিনের বেলায় আপন আপন কর্ম করে, রাত্রিকালে নিদ্রা যায়। নিদ্রা যাইবার সময়, তাহারা শয়ন করে ও নয়ন মুদ্রিত করিয়া থাকে। অশ্ব প্রভৃতি কতক- গুলি জন্তু দাঁড়াইয়া নিদ্রা যায়। শশক প্রভৃতি কতকগুলি জন্তু, চক্ষু না মুদিয়া নিদ্রা যাইতে পারে। সিংহ, ব্যাঘ্র প্রভৃতি শিকারী জন্ত দিবাভাগে নিদ্রা যায়, এবং রাত্রি কালে আহার অন্বেষণ করিয়া বেড়ায়।
আমরা নিদ্রা যাইবার সময়, কখনও কখনও স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন সকল অমূলক চিন্তা মাত্র, কার্যকারক নহে। প্রাণী সকল যখন নিদ্রা যায়, তখন উহাদিগকে নিদ্রিত বলে, যখন নিদ্রা না যাইয়া জাগিয়া থাকে, তথন উহাদিগকে জাগরিত বলে।
মনুষ্য ভিন্ন সকল প্রাণীই কাঁচা বস্তু খাইয়া থাকে। গো, মহিষ, ছাগ প্রভৃতি জন্তু সকল মাঠে কাঁচা ঘাস খায়। সিংহ, ব্যাঘ্র প্রভৃতি শ্বাপদেরা কোনও জন্ত মারিয়া তৎক্ষণাৎ তাহার কাঁচা মাংস খাইয়া ফেলে। পক্ষিগণ জীয়ন্ত কীট পতঙ্গ ধরিয়া তৎক্ষণাৎ ভক্ষণ করে। মনু্যেরা প্রায় সকল বস্তুই, অগ্নিতে পাক করিয়া খায়। ভাল পাক করা হইলে, এই সমুদয় বস্তু সুস্বাদু ও পুষ্টিকর হয়; কাঁচা খাইলে পরিপাক হয় না, পীড়াদায়ক হয়।
প্রাণিগণ যখন হচ্ছন্দ-শরীরে আহার বিহার করিয়া বেড়ায়, তখন তাহাদিগকে সুস্ব বলা যায়; আর যখন তাহাদের পীড়া হয়, হুচ্ছন্দে আহার বিহার করিতে পারে না, সর্বদা শুইয়া থাকে, ঐ সময়ে তাহাদিগকে অসুস্থ বলে। সময়ে সময়ে অসাবধানতা প্রযুক্ত মনুষ্যের পীড়া হইয়া থাকে। পীড়া হইলে, চিকিৎসকেরা ঔষধ পথ্য প্রভৃতির ব্যবস্থা করেন; সবলেরই ঐ ব্যবস্থা অনুসারে চলা উচিত ও আবশ্বক। যাহারা ঐ ব্যবস্থা অনুসারে চলে, তাহারা অধিক ক্লেশ পায় না, ত্বরায় রোগমুক্ত ও সুস্থ হইয়া উঠে। যাহারা চিকিৎসকের ব্যবস্থায় অবহেলা করে, তাহারা বিস্তর ক্লেশ পায়, এবং তাহাদের মধ্যে অনেকে মরিয়া যায়।
কোনও কোনও জন্তু অধিক কাল বাঁচে, কোনও কোনও জন্তু অল্প কাল বাঁচে। হস্তী প্রায় একশত বৎসর বাঁচে। কুকুর প্রায় চৌদ্দ পনর বৎসর বাঁচে। অধিকাংশ কীট পতঙ্গ প্রায় এক বৎসরের অধিক বাঁচে না। কোনও কোনও কীট এক ঘণ্টা মাত্র বাঁচে। অতি ক্ষুদ্র জাতীয় মশা, সূর্যের আলোকে অল্পকাল মাত্র খেলা করিয়া, ভূতলে পড়ে ও প্রাণত্যাগ করে। মহাজাতি, প্রায় সমুদয় জন্তু অপেক্ষা অধিক কাল বাঁচে। মরণের অবধারিত কাল নাই। অনেকে প্রায় যাটি বৎসরের মধ্যে মরিয়া যায়। যাহারা সত্তর, আশী, নব্বই, অথবা একশত বৎসর বাঁচে, তাহাদিগকে লোকে দীর্ঘজীবী বলে। কিন্তু অনেকেই শৈশবকালে মরিয়া যায়। এক্ষণে যাহারা নিতান্ত শিশু আছে, তাহা- রাও তাহাদের পিতা, মাতা, পিতামহ, পিতামহীর ন্যায়, বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বাঁচিতে প্লারে, কিন্তু চিরজীবী হইবে না। কেহই অমর নহে, সকলকেই মরিতে হইবে। জন্তু সকল মরিলে তাহাদের শরীরে প্রাণ ও চেতনা থাকে না। তখন উহারা আর পূর্বের মত দেখিতে, শুনিতে, চলিতে, বলিতে কিছুই পারে না; কেবল অচেতন স্পন্দহীন জড় পদার্থ মাত্র পড়িয়া থাকে। মৃত শরীর বিশ্রী ও বিবর্ণ হইয়া যায়, এবং অল্পকালের মধ্যেই গলিত ও দুর্গন্ধ হইয়া পড়ে, এজন্য কেহ মরিলে, লোকে অবিলম্বে তাহার দেহ দগ্ধ করে। কোনও কোনও জাতি দাহ করে না, মাটিতে পুতিয়া ফেলে। মনুস্থা শৈশবকালে অতি অজ্ঞ থাকে। ক্রমে ক্রমে যত বড় হয়, উপদেশ পাইয়া, নানা বিষয় শিখিতে আরম্ভ করে। আমরা এই যে পৃথিবীতে বাস করিতেছি, ইহা কত বড়, ইহার আকার কেমন, শিশুরা তাহার কিছুই জানে না। অধিক কি, তাহাদের কি নাম, কোন্ হাত ডান, কোন্ হাত বাঁ, শিখাইয়া না দিলে, ইহাও জানিতে পারে না। বালকেরা সকল বিষয়ে অজ্ঞ বলিয়া, তাহাদিগকে শিক্ষার্থে পাঠশালায় পাঠান হয়। যাহারা বাল্যকালে যত্নপূর্বক বিদ্যাভ্যাস করে, তাহারা মনের সুখে কালযাপন করে। আর যাহারা বিজ্ঞাভ্যাসে আলস্য ও অবহেলা করিয়া, কেবল খেলিয়া বেড়ায়, তাহারা মূর্খ হয় ও যাবজ্জীবন দুঃখ পায়।
ইন্দ্রিয়
ইন্দ্রিয় জ্ঞানের দ্বারস্বরূপ, অর্থাৎ ইন্দ্রিয় দ্বারা সর্ববিধ জ্ঞান জন্মে। ইন্দ্রিয় না থাকিলে আমরা কোনও বিষয়ে কিছু মাত্র জানিতে পারিতাম না। মনুক্সের পাঁচ ইন্দ্রিয়। সেই পাঁচ ইন্দ্রিয় এই; চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক্। চক্ষু দ্বারা যে জ্ঞান জন্মে, তাহাকে দর্শন বলে; কর্ণ দ্বারা যে জ্ঞান জন্মে, তাহাকে শ্রবণ; নাসিকা দ্বারা যে জ্ঞান জন্মে, তাহাকে আঘ্রাণ; জিহ্বা দ্বারা যে জ্ঞান জন্মে, তাহাকে আস্বাদন; ত্বক্ দ্বারা যে জ্ঞান জন্মে, তাহাকে স্পর্শ বলে।
চক্ষু দর্শনেন্দ্রিয়। চক্ষু দ্বারা সকল বস্তুর দর্শন নিষ্পন্ন হয়। চক্ষু না থাকিলে, কোন্ বস্তুর কেমন আকার, কোন্ বস্তু শাদা, কোন্ বস্তু কালো, কিছুই জানিতে পারিতাম না। যেখানে আলোক থাকে, সেখানে চক্ষুতে দেখা যায়; যেখানে গাঢ় অন্ধকার, কিছুই আলোক নাই, সেখানে কিছুই দেখা যায় না। দিনের বেলায় সূর্যের আলোক থাকে, এজন্য অতি সুন্দর দেখিতে পাওয়া যায়। রাত্রিকালে চন্দ্র ও নক্ষত্র দ্বারাও অতি অল্প আলোক হয়; এ নিমিত্ত, বড় স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায় না, প্রদীপ জালিলে বিলক্ষণ আলোক হয়; তখন উত্তম দেখিতে পাওয়া যায়। চক্ষু অতি কোমল পদার্থ, অল্পেই নষ্ট হইতে পারে; এজন্য চক্ষুর উপর দুইখানি আবরণ আছে। ঐ আবরণকে চক্ষুর পাতা বলে। চক্ষুতে আঘাত লাগিবায় অথবা কিছু পড়ি- বার আশঙ্কা হইলে, পাতা দিয়া চক্ষু ঢাকিয়া ফেলি। চক্ষুর পাতার ধারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রোম আছে, তাহাতে চক্ষুর অনেক রক্ষা হয়। ঐ রোমের নাম পদ্ম। পদ্ম আছে বলিয়া, চক্ষুতে ধূলা, কূটা, কীট প্রভৃতি পড়িতে পায় না, এবং সূর্যের উত্তাপ অধিক লাগে না।
যাহার দুই চক্ষু নাই, সে অন্ধ। অন্ধ কিছুই দেখিতে পায় না। সে কোথাও যাইতে পারে না। যাইতে হইলে, একজন তাহার হাত ধরিয়া লইয়া যায়, নতুবা সে পড়িয়া মরে। অন্ধ হওয়া বড় ক্লেশ। যাহার এক চক্ষু নাই, তাহাকে কাণা বলে। কাণা এক চক্ষু দ্বারা দেখিতে পায়। কাণাকে, অন্ধের মত ক্লেশ পাইতে হয় না। অক্ষিগোলকের সম্মুখভাগে যে গোলাকৃতি অংশ কৃষ্ণবর্ণ দেখায়, ঐ অংশকে চক্ষুর তারা বলে। উহা কাচের ন্যায় স্বচ্ছ। তাহার পশ্চাদ্ভাগে একটি কোমল পাতলা পর্দা থাকে। আমরা যে বস্তু দেখি, সে বস্তু হইতে আলোক আসিয়া, ঐ তারা ভেদ করিয়া অভ্যস্বরে প্রবেশ করে। তখন ঐ কোমল পাতলা পর্দার উপর সেই বস্তুর ক্ষুদ্র প্রতিকৃতি আবির্ভূত হয়, তাহাতেই আমাদের দর্শনজ্ঞান জন্মে।
কর্ণ দ্বারা সকল শব্দের শ্রবণ হয়; এ নিমিত্ত কর্ণকে শ্রবণেন্দ্রিয় বলে। কর্ণ না থাকিলে, আমরা কিছুই শুনিতে পাইতাম না। শব্দ সকল প্রথমতঃ কর্ণকুহরে প্রবেশ করে। কর্ণকুহরে, পটহের মত যে অতি পাতলা একখণ্ড চর্ম আছে, তাহাতে ঐ সকল শব্দের প্রতিঘাত হয়, এবং তাহাতেই শ্রবণজ্ঞান নিষ্পন্ন হইয়া থাকে। কোনও কোনও লোক এমন দুর্ভাগ্য যে, তাহাদের শ্রবণশক্তি নাই; তাহাদিগকে বধির অর্থাৎ কালা বলে। কেহ কিছু বলিলে অথবা কোনও শব্দ করিলে, কালারা শুনিতে পায় না।
নাসিকা
, নাসিকাকে ঘ্রাণেন্দ্রিয় বলে। নাসিকার দ্বারা গন্ধের আঘ্রাণ পাওয়া যায়। নাসিকা না থাকিলে, কি ভাল, কি মন্দ, কোনও গন্ধের আঘ্রাণ পাওয়া যাইত না। নাসিকারন্ধ্রের অভ্যন্তরে কতকগুলি সূক্ষ্ম স্বন্দ্ব স্নায়ু সঞ্চারিত আছে। ঐ সকল স্নায়ু দ্বারা গন্ধের আঘ্রাণ পাওয়া যায়। যে গন্ধের আঘ্রাণে মনে প্রীতি জন্মে, তাহাকে সুগন্ধ বা সৌরভ বলে। যে গন্ধের আঘ্রাণে অসুখ ও ঘৃণাবোধ হয়, তাহাকে দুর্গন্ধ বলে। চন্দন ও গোলাপের গন্ধ সুগন্ধ। কোনও বস্তু পচিলে যে গন্ধ হয়, তাহাকে দুর্গন্ধ বলে।
জিহ্বা
জিহ্বা দ্বারা সকল বস্তুর আস্বাদ পাওয়া যায়; এজন্ম জিহ্বাকে রসনেন্দ্রিয় বলে। বসন শব্দের অর্থ আস্বাদন। জিহ্বার অন্ত এক নাম রসনা। জিহ্বা না থাকিলে, আমরা কোনও বস্তুর আস্বাদন বুঝিতে পারিতাম না। জিহ্বাতে কতকগুলি বৃক্ষ্ম সুক্ষ্ম স্নায়ু আছে। মুখের ভিতর কোনও বস্তু দিলে, ঐ সকল স্নায়ুর দ্বারা তাহার স্বাদ হয়। বস্তুর আস্বাদন নানাবিধ। গুড়ের আস্বাদ মিষ্ট। তেঁতুল অম্ল বোধ হয়। নিম ও চিরতা তিক্ত, এবং মরিচ কটু লাগে। যাহা খাইতে ভাল লাগে, তাহাকে সুস্বাদ বলে; যাহা মন্দ লাগে, তাহাকে বিশ্বাদ বলে। কোনও কোনও বস্তুর কিছুই আস্বাদ নাই। মুখে দিলে, না অম্ল, না মিষ্ট, না তিক্ত, না কটু, কিছুই বোধ হয় না; যেমন, গঁদ, চুয়ান জল ইত্যাদি।
ত্বক্
ত্বক্ স্পর্শেন্দ্রিয়। ত্বক দ্বারা স্পর্শজ্ঞান জন্মে। ত্বক্ সকল শরীর ব্যাপিয়া আছে, এবং সমস্ত ত্বকেই স্নায়ু সঞ্চারিত আছে; এজন্য শরীরের সকল অংশেই স্পর্শজ্ঞান হইয়া থাকে। কিন্তু সকল অঙ্গ অপেক্ষা, হস্তই স্পর্শজ্ঞানের প্রধান সাধন। অন্ধকারে যখন দেখিতে পাওয়া যায় না, তখন হস্ত ও অন্যান্য অবয়ব দ্বারা স্পর্শ করিয়া, প্রায় সকল বস্তু জানিতে পারা যায়। বায়ু দেখিতে পাওয়া যায় না, কিন্তু স্পর্শেন্দ্রিয় দ্বারা উহার অনুভব হয়।
এই পাঁচ ইন্দ্রিয় জ্ঞানের পথস্বরূপ ইন্দ্রিয়পথ দ্বারা আমাদের মনে জ্ঞানের সঞ্চার হয়। ইন্দ্রিয়বিহীন হইলে, আমরা সকল বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞান থাকিতাম। এই সমস্ত ইন্দ্রিয়ের বিনিয়োগ দ্বারা অভিজ্ঞতা জন্মে। অভিজ্ঞতা জন্মিলে, ভাল, মন্দ, হিত, অহিত এই সমস্ত বিবেচনা করিবার ক্ষমতা হয়। অতএব ইন্দ্রিয় মনুক্সের পক্ষে অশেষ প্রকারে উপকারক।
মনুষ্যের ন্তায়, পশু, পক্ষী ও অন্যান্য জন্তুরও এই সকল ইন্দ্রিয় আছে। কিন্তু তাহাদের কোনও কোনও ইন্দ্রিয়, মনুক্সের অপেক্ষা অধিক প্রবল। বিড়ালের শ্রবণশক্তি অনেক অধিক। এরূপ হইবার তাৎপর্য এই যে, বিড়ালের শ্রবণশক্তি অধিক না হইলে, অন্ধকারময় স্থানে মূষিক প্রভৃতির সঞ্চার বুঝিতে পারিত না। কোনও কোনও কুকুর- জাতির ঘ্রাণশক্তি অতিশয় প্রবল; পলায়িত পশুর কেবল গাত্রগন্ধের আঘ্রাণ অনুসারে, তাহার অন্বেষণ করিয়া লয়। ঘ্রাণশক্তি এত অধিক না হলে, তাহারা সহজে শিকার করিতে পারিত না। যে সকল জন্তু আঘ্রাণ দ্বারা শিকার না করিয়া দৃষ্টি দ্বারা শিকার করে, তাহাদের দর্শনশক্তি অতিশয় প্রবল। যে পশুর অনুসরণে প্রবৃত্ত হয়, উহা অধিক দূরবর্তী হইলেও ইহারা দেখিতে পায়। যেখানে অল্প অন্ধকার সেখানে বিড়াল, মনুয়্য অপেক্ষা ভাল দেখিতে পায়। কিন্তু যেখানে ঘোর অন্ধকার, কিছুমাত্র আলোক নাই, সেখানে বিড়াল, মহুয়্য অপেক্ষা অধিক দেখিতে পায় না। এইরূপ যে জন্তুর যে ইন্দ্রিয়ের যেরূপ আবশ্যক, ঈশ্বর তাহাকে তাহাই দিয়াছেন। তিনি কাহারও কোনও বিষয়ে ন্যূনতা রাখেন নাই।
বাক্যকথন-ভাষা
মনুক্সেরা, মুখ দ্বারা নানাবিধ শব্দের উচ্চারণ করিয়া, মনের ভাব ব্যক্ত করে। শব্দের উচ্চারণ বিষয়ে জিহ্বাই প্রধান সাধন। এইরূপ শব্দের উচ্চারণকে কথা কহা বলে, এবং ঐ উচ্চারিত শব্দের নাম ভাষা। যে শক্তির দ্বারা শব্দের উচ্চারণ নিষ্পন্ন হয়, তাহাকে বাকশক্তি বলে।
পশু, পক্ষী ও অন্ত্যান্ত জন্তদিগের বাশক্তি নাই। তাহাদের মনে, কখনও কখনও কোনও ভাবের উদয় হয় বটে, কিন্তু উহারা মনুয্যের মত কথা কহিয়া, তাহা ব্যক্ত করিতে পারে না; কেবল এক প্রকার অব্যক্ত শব্দ ও চীৎকার করে। গো, মহিষ, মেষ, ছাগল, গর্দভ, কুকুর, বিড়াল, পক্ষী, ভেক প্রভৃতি জন্তু সকল এক এক প্রকার শব্দ করে। ঐ সকল শব্দ দ্বারা তাহারা হর্ষ, বিষাদ, রোষ, অভিলাষ প্রভৃতি মনের ভাব ব্যক্ত করে। কিন্তু সে সকল অব্যক্ত শব্দ বুঝিতে পারা যায় না, এজন্য ঐ সকল শব্দকে ভাষা বলে না। শুক প্রভৃতি কতকগুলি পক্ষীকে শিখাইলে, উহারা মনুষ্যের মত স্পষ্ট শব্দ উচ্চারণ করিতে পারে, কিন্তু অর্থ বুঝাইতে পারে না। যাহা শিখে, বারংবার তাহাই উচ্চারণ করিতে থাকে।
চিন্তা ও বাশক্তির অভাবে, পশু পক্ষী ও আর আর জন্তুদিগকে মনুষ্য অপেক্ষা, অনেক হীন অবস্থায় থাকিতে হইয়াছে। তাহাদের কোথায় জন্ম, কত বয়স, কি নাম, কাহার কি অবস্থা, ইত্যাদি কোনও বিষয় পরস্পর জানাইতে পারে না; হুতরাং তাহারা পরষ্পর শিক্ষা দিতে অক্ষম, এবং আপনাদিগকে সুখী ও স্বচ্ছন্দ করিবার নিমিত্ত, কোনও উপায় করিতেও সমর্থ নয়। ফলতঃ, মনুয়্য ভিন্ন আর সকল জন্তুকেই, চিরকাল এই হীন অবস্থায় থাকিতে হইবে; এবং মহস্তেরা অনায়াসে তাহাদিগকে পরাভূত ও বশীভূত করিতে পারিবে।
আমাদের বাশক্তি ও চিন্তাশক্তি উভয়ই আছে। মনে যে বিষয়ের চিন্তা করি, জিহ্বা 1 রা তাহা উচ্চারণ করিতে পারি। জিহ্বা ও কণ্ঠনালী এ উভয়কে বাগিন্দ্রিয় বঙ্গে।
জিহ্বা দ্বারা উচ্চারণ সম্পন্ন হয়, কণ্ঠনালী দ্বারা শব্দ নির্গত হয়। কোনও কোনও লোক এমন হতভাগ্য যে, কথা কহিতে পারে না। উহাদিগকে মূক অর্থাৎ বোবা বলে। সকল ব্যক্তিই অতি শৈশবকালে কথা কহিতে শিখে। প্রথম কথা কহিতে শিখা, স্বজাতীয় লোকের নিকটে হয়; এ নিমিত্ত প্রথম শিক্ষিত ভাষাকে জাতিভাষা বলে।
সকলেরই স্পষ্ট কথা কহিতে চেষ্টা করা উচিত; তাহা হইলে সকলে অনায়াসে বুঝিতে পারে। আর যখন বলিবে, সত্য বই মিথ্যা বলিবে না। মিথ্যা বলা বড় দোষ; মিথ্যা বলিলে কেহ বিশ্বাস করে না; সকলেই ঘৃণা করে। কি বালক, কি বৃদ্ধ, কি ধনবান্, কি দরিদ্র, কাহারও অশ্লীল ও অসাধু ভাষা মুখে আনা উচিত নহে। কি ছোট, কি বড়, সকলকেই প্রিয় ও মিষ্ট বাক্যে বলা উচিত। রূঢ় ও কর্কশ বাক্য বলিয়া, কাহারও মনে বেদনা দেওয়া উচিত নহে।
সকল দেশেরই ভাষা পৃথক্ পৃথক্। না শিখিলে, এক দেশের লোক অন্যদেশীয় লোকের ভাষা বুঝিতে পারে না। আমরা যে ভাষা বলি, তাহাকে বাঙ্গালা বলে। কাশী অঞ্চলের লোক যে ভাষা বলে, তাহাকে হিন্দী বলে। পারস্ত্য দেশের লোকের ভাষা, পারসী। আরব দেশের ভাষা, আরবী। হিন্দী ভাষাতে আরবী ও পারসী কথ। মিশ্রিত হইয়া, এক ভাষ। প্রস্তুত হইয়াছে, উহাকে উর্দু বলে। উর্দুকে স্বতন্ত্র ভাষা বলা যাইতে পারে না। কতকগুলি আরবী ও পারসী কথা ভিন্ন উহা সর্ব প্রকারেই হিন্দী। ইংলণ্ডীয় লোকের অর্থাৎ ইংরেজদিগের ভাষা, ইংরেজী।
ইংরেজেরা আমাদের দেশের রাজা ছিল, সুতরাং ইংরেজী আমাদের রাজভাষা ছিল; এ নিমিত্ত সকলে আগ্রহপূর্বক ইংরেজী শিক্ষিত; কিন্তু অগ্রে মাতৃভাষা না শিখিয়া, পরের ভাষা শিক্ষা কোনও মতে উচিত নহে।
পূর্বকালে ভারতবর্ষে যে ভাষা প্রচলিত ছিল, তাহার নাম সংস্কৃত। সংস্কৃত অতি প্রাচীন ও অতি উৎকৃষ্ট ভাষা। এ ভাষা এখন আর চলিত ভাষা নহে। কিন্তু ইহাতে অনেক ভাল ভাল গ্রন্থ আছে। সংস্কৃত ভাল না জানিলে, হিন্দী বাঙ্গালা প্রভৃতি ভাষাতে উত্তম ব্যুৎপত্তি জন্মে না।
কাল
প্রভাত ও সন্ধ্যা কাহাকে বলে, তাহা সকলেই জানে। যখন সূর্যের উদয় হয়, আমরা শয্যা হইতে উঠি, ঐ সময়কে প্রভাত বলে। যখন সূর্য অস্ত যায়, অন্ধকার হইতে আরম্ভ হয়, ঐ সকলকে সন্ধ্যা বলে। প্রভাত অবধি সন্ধ্যা পর্যন্ত যে সময়, তাহাকে দিবাভাগ বলে। আর সন্ধ্যা অবধি প্রভাত পর্যন্ত যে সময়, তাহাকে রাত্রি বলে। দিবা- ভাগে প্রায় সকল জীব জাগরিত থাকে ও আপন আপনকর্ম করে। রাত্রিকালে আরাম করে ও নিদ্রা যায়। দিবাভাগের প্রথম ভাগকে পূর্বাহ্ণ, মধ্য ভাগকে মধ্যাহ্ন, শেষ ভাগকে অপরাহ্ণ ও সায়াহ্ন বলে।
দিবা ও রাত্রি এ ছয়ে এক দিবস হয়, অর্থাৎ এক প্রভাত হইতে আর এক প্রভাত পর্যন্ত যে সময়, তাহাকে দিবস বলে। দিবসকে যাটি ভাগ করিলে, ঐ এক এক ভাগকে এক এক দণ্ড বলে। আড়াই দণ্ডে এক হোরা বা ঘণ্টা; তিন ঘণ্টাতে অর্থাৎ সাড়ে সাত দণ্ডে এক প্রহর; আট প্রহরে এক দিবস; পনর দিবসে এক পক্ষ হয়। দুই পক্ষ; শুরু ও কৃষ্ণ। যে পক্ষে চন্দ্রের বৃদ্ধি হইয়া থাকে, তাহাকে শুক্লপক্ষ বলে। আর যে পক্ষে চন্দ্রের হ্রাস হইতে থাকে, তাহাকে কৃষ্ণপক্ষ বলে। দুই পক্ষে অর্থাৎ ত্রিশ দিনে এক মাস হয়। দুই মাসে এক ঋতু; সমূদয়ে ছয় ঋতু, সেই ছয় ঋতু এই গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাস গ্রীষ্ম ঋতু; আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষা ঋতু; ভাদ্র ও আশ্বিন এই দুই মাসশরৎ ঋতু, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এই দুই মাস হেমন্ত ঋতু; পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস শীত ঋতু, ফাল্গুন ও চৈত্র এই দুই মাস বসন্ত ঋতু। ছয় ঋতুতে অর্থাৎ বাব মাসে এক বৎসর হয়।
সচরাচর সকলে বলে ত্রিশ দিনে এক মাস হয়। কিন্তু সকল মাস সমান হয় না। কোনও মাস উনত্রিশ দিনে, কোনও মাস ত্রিশ দিনে, কোনওমাস একত্রিশ দিনে, কোনও মাদ বত্রিশ দিনে হয়। এই ন্যূনাধিক্য বশতঃ বৎসরে তিনশত পঁয়ষট্টি দিন হইয়া থাকে। সকল মাস ত্রিশ দিনে হইলে, তিন শত যাটি দিনে বৎসর হইত। পূর্ব কালের লোকেরা তিন শত যাটি দিনে বৎসরের গণনা কবিতেন। সে অনুসারে, অদ্যাপি সামান্ত লোকে তিন শত যাটি দিনে বৎসর বলে। মাসের শেষ দিবসকে সংক্রান্তি বলে। চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে বৎসর সমাপ্ত হয়। বৈশাখ মাসের প্রথম দিবসেনূতন বৎসরের আরম্ভ হয়, চিরকালই বৎসরের পর বৎসর আসিতেছে ও যাইতেছে। এইরূপ এক শত বৎসরে এক শতাব্দী হয়।
কোনও সুপ্রসিদ্ধ রাজার অধিকার, অথবা কোনও সুপ্রসিদ্ধ ঘটনা অবলম্বন করিয়া বৎসরের গণনা আরব্ধ হইয়া থাকে। এইরূপে যে বৎসরের গণনা করা যায়, তাহাকে শাক বলে। আমাদের দেশে তিন শাক প্রচলিত; সংবৎ, শকাব্দাঃ ও সাল। বিক্রমা- দিত্য নামে এক অতি প্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন; তিনি যে শাক প্রচলিত করিয়া গিয়াছেন, তাহার নাম সংবৎ। আর শালিবহন রাজা যে শাক প্রচলিত করেন, তাহার নাম শকাব্দাঃ। বিক্রমাদিত্যের উনবিংশ শতাব্দী অতীত হইয়াছে, এক্ষণে বিংশ শতাব্দী চলিতেছে। শালিবাহনের অষ্টাদশ শতাব্দী অতীত হইয়াছে, এক্ষণে উনবিংশ শতাব্দী চলিতেছে। মুসলমানেরা মহম্মদের মক্কা হইতে পলায়নের দিবস অবধি এক শাকের গণনা করেন, উহার নাম হিজিরা। ভারতবর্ষের প্রসিদ্ধ মোগল সম্রাট আব্বর, হিজিরা নামের পরিবর্তে ঐ শাককে ইলাহী নামে প্রতিষ্ঠিত করেন। উহাই বাঙ্গালাদেশে সাল নামে প্রচলিত হইয়াছে। এক্ষণে আমাদের দেশে বিষয়কর্মে, সকল শাক অপেক্ষা সাল অধিক প্রচলিত। এই শাকের ত্রয়োদশ শতাব্দী অতীত হইয়াছে, এক্ষণে চতুর্দশ শতাব্দী চলিতেছে। এইরূপ ইংরেজ, ফরাসি, জর্মন প্রভৃতি ঘুরোপীয় জাতিরা, যিশুখ্রীষ্টের জন্ম অবধি এক শাকের গণনা করেন; উহাকে খ্রীষ্টীয় শাক বলে। খ্রীষ্টীয় শাকের উনবিংশ শতাব্দী অতীত হইয়াছে, এক্ষণে বিংশ শতাব্দী চলিতেছে।
গণনা-অঙ্ক
বস্তুর সংখ্যা করিবার ও মূল্য বলিবার নিমিত্ত, গণনা জানা অতিশয় আবশ্যক। সচরা- চর সকলে কয়েকটি কথা দ্বারা গণনা করিয়া থাকে। যথা-এক, দুই, তিন, চারি, পাঁচ ইত্যাদি। কিন্তু যখন পুস্তকে অথবা অন্য কোনও স্থানে, কেহ কোনও বস্তুর সংখ্যা- পাত করে, তখন সে ব্যক্তি এক, দুই ইত্যাদি শব্দ না লিখিয়া উহাদের স্কুলে ১, ২ প্রভৃতি অঙ্কপাত করে। ঐ ঐ অঙ্ক দ্বারা সেই সেই শব্দের কার্য নিষ্পন্ন হয়।
অঙ্ক সমৃদয়ে দশটি মাত্র। উহাদের আকার ও নাম এই-
১
২
৫৬
৮
৯
তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট
নয়
শূক্ত
এক দুই যেমন, বর্ণমালার কয়েকটি অক্ষরের পরস্পর যোজনা দ্বারা, সকল বিষয় লিখিতে পারা যায়; সেইরূপ, কেবল এই কয়টি অক্ষরের পরস্পর যোগে, কি ছোট কি বড়, সকল সংখ্যাই লিখা যায়।
অন্তিম অঙ্ককে শূন্য বলে, অর্থাৎ উহা কিছুই নয়। অন্য নয়টি অঙ্কের আশ্রয় ব্যতি- রেকে, কেবল উহা দ্বারা কোনও সংখ্যার বোধ হয় না। কিন্তু, ১ এই অঙ্কের পর বসা- ইলে, অর্থাৎ এইরূপ ১০ লিখিলে দশ হয়; ২ এই অঙ্কের পর বসাইলে, ২০ কুড়ি হয়; ৩ এই অঙ্কের পর, ৩০ ত্রিশ; ৪ এই অঙ্কের পর, ৪০ চল্লিশ; এই অঙ্কের পর, ৫০ পঞ্চাশ ইত্যাদি। যদি ১ এই অঙ্কের পর দুই শূন্য বসান যায়, অর্থাৎ এইরূপ ১০০ লিখা যায়, তবে তাহাতে এক শত বুঝায়। ১ লিখিয়া তিন শুল্ক বসাইলে, অর্থাৎ এইরূপ ১০০০ লিখিলে, সহস্র বুঝায়।
১, ৩, ৫, ৭, ১ ইত্যাদি অঙ্ককে বিষম অঙ্ক বলে। আর, ২, ৪, ৬, ৮, ১০ ইত্যাদি অঙ্ককে সম অঙ্ক বলে।
অঙ্ক দ্বারা যখন কেবল সংখ্যার বোধ হয়, তখন উহাদিগকে সংখ্যাবাচক বলে। সংখ্যা- বাচক শব্দের নাম ও আকার নিয়ে দর্শিত হইতেছে।
১ এক
৩২ বত্রিশ
৬৩ তেষট্টি
২ দুই
৩৩ তেত্রিশ
৬৪ চৌষট্টি
৩
তিন
৩৪ চৌত্রিশ
৬৫ পঁয়ষট্টি
৪ চার
৩৫ পঁয়ত্রিশ
৬৬ ছষট্টি
পাচ
৩৬ ছত্রিশ
৬৭ সাতষট্টি
৬
৩৭ সাঁইত্রিশ
৬৮ আটষট্টি
৭ সাত
৩৭ আটত্রিশ
৬৯ ঊনসত্তর
৮ আট
৩৯ ঊনচল্লিশ
৭. সত্তর
৯ নয়
৪. চল্লিশ
৭১ একাত্তর
১০ দশ
৪১ একচল্লিশ
৭২ বাযাত্তব
১১ এগাব
৪২ বিযাল্লিশ
৭০ তিষাত্তর
১২ বার
৪৩ তিতাল্লিশ
৭৪ চুযাত্তর ৭৫ পঁচাত্তব
১৩ তেব
৪৪ চুযাল্লিশ
১৪ চৌদ্দ
৪৫ পর্যতাল্লিশ
৭৬ ছিযাত্তব
১৫ পনর
৪৬ ছচল্লিশ
৭৭ সাতাত্তর
১৬ ষোল
৪৭ সাতচল্লিশ
৭৮ আটাত্তর
১৭ সতর
৪৮ আটচল্লিশ
৭৯ ঊনআশি
১৮ আঠাব
৪৯ ঊনপঞ্চাশ
৮০ আশি
১৯ উনিশ
৫০ পঞ্চাশ
৮১ একাশি
২০ কুডি, বিশ
৫১ একান্ন
৮২ বিবাশি
২১ একুশ
৫২ বায়ান্ন
৮৩ তিবাশি
২২ বাইশ
৫৩ তিপ্পান্ন
৮৪ চুরাশি
২৩ তেইশ
৫৪ চুযান্ন
৮৫ পঁচাশি
২৪ চব্বিশ
৫৫ পঞ্চান্ন
৮৬ ছিযাশি
২৫ পঁচিশ
৫৬ ছাপ্পান্ন
৮৭ সাতাশি
২৬ ছাব্বিশ
৫৭ সাতান্ন
৮৮ অষ্টাশি
২৭ সাতাশ
৫৮ আটান্ন
৮৯ ঊননব্বই
২৮ আটাশ
৫৯ ঊনষাটি
৯. নব্বই
২৯ উনত্রিশ
৬০ যাটি
৯১ একনব্বই
৩৫ ত্রিশ
৬১ একষট্টি
১২ বিবনব্বই
৩১ একত্রিশ
৬২ বাষট্টি
৯৩ তিরনব্বই
১৪ চুরনব্বই
১৮ আটনব্বই
৯৯ নিরনব্বই
১০০০০ অযুত
৯৫ পঁচনব্বই
১৬ ছিয়ানব্বই
১০০ শত
১০০০০০ লক্ষ
১০০০০০০ নিযুত
৯৭ সাতনব্বই
১০০০ সহস্র
১০০০০০০০ কোটি
দশ শতে এক সহস্র, দশ সহস্রে এক অযুত, দশ অযুতে এক লক্ষ, দশ লক্ষে এক নিযুত, দশ নিযুতে এক কোটী হয়। ইহা ভিন্ন অর্বুদ, বৃন্দ, খর্ব প্রভৃতি আরও কতক- গুলি সংখ্যা আছে সে সকলের সচরাচর ব্যবহার নাই।
১, ২, ৩, ৪, ৫, ইত্যাদি অঙ্ক যেমন এক, দুই, তিন, চারি, পাঁচ ইত্যাদি যেমন সংখ্যার বাচক হয়, সেইরূপ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ইত্যাদি পূরণের বাচক হইয়া থাকে। যাহা দ্বারা কোনও সংখ্যা পূর্ণ হয়, তাহাকে ঐ সংখ্যার পূরণ বলে। যে অঙ্ক দ্বারা সেই পূরণের বোধ হয়, তাহাকে পূরণবাচক বলে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ইত্যাদি পূরণবাচক শব্দ। যদি দুই রেখা।। লিখা যায়, তবে শেষেরটিকে দ্বিতীয়, অর্থাৎ দুই সংখ্যার পুরণ বলিতে হইবে, আর আগেরটিকে প্রথম; কারণ, শেষের রেখাটি না লিখিলে দুই সংখ্যা পূর্ণ হয় না। আর আগের রেখাটি না থাকিলে, এক সংখ্যা সম্পন্ন হয় না। এইরূপ তিন রেখা।।। লিখিলে শেষেরটিকে তৃতীয়, অর্থাৎ তিন সংখ্যার পূরণ বলিতে হইবে; কারণ, শেষের রেখাটি না থাকিলে, তিন সংখ্যা পূর্ণ হয় না। চারি রেখা।।।। লিখিলে, শেষেরটিকে চতুর্থ রেখা, পাঁচ রেখা।।।।। লিখিলে, শেষেরটিকে পঞ্চম রেখা বলা যায়; কারণ, শেষের দুই রেখা না থাকিলে, চারি ও পাঁচ সংখ্যা পূর্ণ হয় না।
১, ২, ৩, ৪ ইত্যাদি অঙ্ক যখন পূরণ অর্থে লিখিত হয়, তখন ঐ ঐ অঙ্কের শেষে প্রথম দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ইত্যাদি পূরণবাচক শব্দের শেষ অক্ষর যোগ করিয়া দেওয়া উচিত; তাহা হইলে অর্থবোধের কোনও ব্যতিক্রম ঘটে না; যেমন, ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ ইত্যাদি। এইরূপ অঙ্কের শেষে মপ্রভৃতি অক্ষর যোজিত থাকিলে, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ বুঝাইবে। ঐ ঐ অক্ষরের যোগ না থাকিলে, এক, দুই, তিন, চারি; কি প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ; ইহার স্পষ্ট বোধ হওয়া দুর্ঘট। যদি কেহ এরূপ লিখে, "আমি চৈত্র মাসের ৩ দিবসে এই কর্ম করিয়াছিলাম," তাহা হইলে তিন দিবসে ইহা নিশ্চিত বুঝ। যাইবে না; কেহ এরূপ বুঝিবে, ঐ কর্ম করিতে তিন দিবস লাগিয়াছিল; কেহ বোধ করিবে, মাসের তৃতীয় দিবসে ঐ কর্ম করা হইয়াছিল। ফলতঃ, যে লিখিয়াছিল, তাহার অভিপ্রায় কি, ইহার নির্ণয় হওয়া কঠিন। কিন্তু ৩ এই অঙ্কের পর যদি য় এই অক্ষরের যোগ থাকে, তবে আর কোনও সংশয় থাকে না, কেবল তৃতীয় বুঝাইবে।
পূরণবাচক অঙ্ক লিখিবার ধারা
প্রথম
দ্বিতীয়
তৃতীয়
চতুর্থ
১ম
৩য়
৪র্থ
পঞ্চম
সপ্তম
অষ্টম
৫ম
৭ম
৮ম
নবম
দশম
একাদশ
দ্বাদশ
৯ম
১০ম
১১শ
১২শ
ত্রয়োদশ
চতুর্দশ
পঞ্চদশ
ষোডশ
১৩শ
১৪
১৫শ
১৬শ
সপ্তদশ
অষ্টাদশ
উনবিংশ
বিংশ
১৭শ
১৮শ
১৯শ
२०१
একবিংশ
দ্বাবিংশ
ত্রয়োবিংশ
চতুর্বিংশ
২১শ
২২শ
২৩শ
২৪শ
পঞ্চবিংশ
ষড় বিংশ
সপ্তবিংশ
অষ্টাবিংশ
২৫শ
১৬শ
২৭শ
২৮শ
উনজিংশ
ত্রিংশ
একত্রিংশ
দ্বাত্রিংশ
২৯শ
৩০শ
৩১শ
৩২শ
মাসের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ইত্যাদি দিবস বুঝাইতে হইলে ১, ২, ইত্যাদি অঙ্কের
পর, পহিলা, দোসরা, তেসরা ইত্যাদি শব্দের শেষ অক্ষর যোগ করা আবশ্যক। যথা,
পহিলা
দোসরা
তেসরা
চৌঠা
১লা
রা
881
পাঁচই
ছয়ই
সাতই
আটই
এই
ই
৭ই
চই
নয়ই
দশই
এগাবই
বারই
১ই
১০ই
১১ই
১২ই
তেরই
চৌদ্দই
পনরই
ষোলই
১৩ই
১৪ই
১৫ই
১৬ই
সতরই
আঠারই
উনিশে
বিশে
১৭ই
১৮ই
১৯শে
২০শে
একুশে
বাইশে
তেইশে
চব্বিশে
২১শে
২২শে
২৩শে
২৪শে
পঁচিশে
২৫শে
ঊনত্রিশে
ছাব্বিশে
২৬শে
ত্রিশে
আটাশে
২৭শে
একত্রিশে
২৮শে
বত্রিশে
২৯শে
৩০শে
সাতাশে
৩১শে
৩২শে
বর্ণ
নানা বর্ণের বস্তু দেখিলে নয়নের যেরূপ প্রীতি জন্মে, সর্বদা এক বর্ণের বস্তু দেখিলে সেরূপ হয় না, বরং বিরক্তি জন্মে। এজন্য জগতের যাবতীয় পদার্থ এক বর্ণের না হইয়া, নানা বর্ণের হইযাছে। সকল বর্ণ অপেক্ষা, হরিত বর্ণ অধিক মনোরম ও অধিকক্ষণ দেখিতে পারা যায়; এজন্য জগতে অনন্ত বর্ণের বস্তু অপেক্ষা, হরিত বর্ণের বন্ধই অধিক।
কি স্বাভাবিক, কি কৃত্রিম, সকল পদার্থের নানাবিধ বর্ণ দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু যেখানে যত বর্ণ আছে, সকলই তিনটি মাত্র মূল বর্ণ হইতে উৎপন্ন। সেই তিন মূল বর্ণ এই; নীপ, পীত, লোহিত। এই তিন মূল বর্ণকে যত ভিন্ন ভিন্ন প্রকারে মিশ্রিত করা যায়, তত ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ উৎপন্ন হয়। ঐ সকল উৎপন্ন বর্ণকে মিশ্র বর্ণ বলে। মিশ্র বর্ণের মধ্যে হরিত, পাটল, ধূমল এই তিনটি প্রধান। তদ্ভিন্ন কপিশ, ধূসর, পিঙ্গল ইত্যাদি নানা মিশ্র বর্ণ আছে, সে সকল ঐ তিন মূল বর্ণের মিশ্রণে উৎপন্ন হয়।
কৃষ্ণ, সচরাচর বর্ণ বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। কিন্তু কৃষ্ণ, বর্ণ নহে। অমুক বস্তু কৃষ্ণ, ইহা বলিলে সেই বস্তুতে সর্ব বর্ণের অসম্ভাব, অর্থাৎ কোনও বর্ণ নাই, ইহাই প্রতীয়মান হইবে। শুরু বর্ণে সকল প্রকার মূল বর্ণই বিদ্যমান থাকে। মধ্যাহ্নকালীন সূর্যের রশ্মি শ্বেতবর্ণ। এই রশ্মি, ঝাড়ের কলম অথবা তদনুরূপ অন্য কোন কাচখণ্ডের ভিতর দিয়া যাইলে, বাহির হওয়ার পর আর শুক্লবর্ণ থাকে না। তখন এই রশ্মিকে শুভ্র বস্ত্রের উপর ধরিলে, লোহিত, পাটল, পীত, হরিত, নীল, ধূমল ও ভায়লেট এই সাতটি বর্ণ পরে পরে দেখিতে পাওয়া যায়।
কখনও কখনও গগনমণ্ডলে, ধশ্নকের মত নানাবর্ণের অতি সুন্দর যে বস্তু দেখিতে পাওয়া যায়, লোকে তাহাকে রামধণ্ড বলে। ঝাড়ের কলমের মত বৃষ্টি কালীন জলবিন্দু- সমূহে সূর্যের কিরণ পড়িয়া, এরূপ লোহিত, পাটল, পীত প্রভৃতি সাত বর্ণের পরম সুন্দর ধনুকের আকার উৎপন্ন হয়। সূর্যের বিপরীত দিকে রামধনুর উদয় হইয়া থাকে।
বস্তুর আকার পরিমাণ
সকল বস্তুরই আকার ভিন্ন ভিন্ন। কোনও কোনও বস্তু বড়, কোনও কোনও বন্ধ ছোট। ঘটী অপেক্ষা কলসী বড়, বিড়াল অপেক্ষা গরু বড়; শিশু অপেক্ষা যুবা বড়। সকল বস্তুরই আকারে দৈর্ঘ্য, বিস্তার, বেধ, এই তিন গুণ আছে। বস্তুর লম্বা দিকের পরিমাণকে দৈর্ঘ্য, দুই পার্শ্বের পরিমাণকে বিস্তার, দুই পৃষ্ঠের পরিমাণকে বেধ বলে। পুস্তকের উপরিভাগ হইতে নিম্নভাগ পর্যন্ত যে পরিমাণ, তাহার নাম দৈর্ঘ্য; এক পার্শ্ব হইতে অপর পার্শ্ব পর্যন্ত যে পরিমাণ, তাহার নাম বিস্তার; এক পৃষ্ঠ হইতে অপর পৃষ্ঠ পর্যন্ত যে পরিমাণ, তাহার নাম বেধ।
বস্তুর দৈর্ঘ্য মাপা যাইতে পারে। আমরা কাপড়ের দৈর্ঘ্য মাপিতে পারি। এক স্থান হইতে আর এক স্থান কত দূর, তাহাও মাপা যায়। আমরা হস্ত দ্বারা সকল বস্তু মাপিয়া থাকি। কনুই অবধি মধ্যম অঙ্গুলির অগ্রভাগ পর্যন্ত এক হাত। সকলের হাত সমান নহে। এ নিমিত্ত হাতের নিরূপিত পরিমাণ আছে। ৮ যবোদরে এক এক অঙ্গুল ২৪ অঙ্গুলে ১ হাত। যবোদর শব্দে যবের মধ্য ভাগ। আটটি যব সারি সারি রাখিলে, উহাদের মধ্যভাগের যে পরিমাণ, তাহাকে অঙ্গুল বলে। এরূপ ২৪ অঙ্গুলে, অর্থাৎ ১৯২ যবোদরে এক হাত হয়। ৪ হাতে ১ ধন্ত; ২০০০ ধনুতে অর্থাৎ ৮০০০ হাতে ১ ক্রোশ হয়; ৪ ক্রোশে ১ যোজন।
লোকে বস্তুর দৈর্ঘ্য যেরূপে মাপে, বস্তুর উচ্চতাও সেইরূপে মাপা যায়। আমরা দেও- য়াল, খুঁটি, কপাট, গাছ ইত্যাদির উচ্চতা মাপিতে পারি। বস্তুর উপরের দিকের যে দৈর্ঘ্য, তাহাকে উচ্চতা বলে। বস্তুর নীচের দিকের যে দৈর্ঘ্য, তাহার নাম গভীরতা। দৈর্ঘ্য যেরূপে মাপা যায়, গভীরতাও সেইরূপে মাপা যাইতে পারে। কোনও কোনও কূপের গভীরতা ১০, ১২ হাত; কোনও পুষ্করিণীর গভীরতা ২০, ২৫ হাত। কোনও কোনও বস্তু, কোনও কোনও বস্তু অপেক্ষা অধিক ভারী। ক্ষুদ্র পুস্তক অপেক্ষা বৃহৎ পুস্তক অধিক ভারী। সমান আকারের এক খণ্ড কাঠ অপেক্ষা এক খণ্ড লৌহ অধিক ভারী। অনেক বস্তু ওজনে বিক্রীত হয়। বস্তুর ভারের পরিমাণকে ওজন কহে। সেই পরিমাণ এই-
১ টাকার যত ভার, তাহা ১ তোলা;
• তোলায়
৪ ছটাকে
১ ছটাক,
১ পোয়া;
৪ পোয়ায়
১ সের;
৪. সেরে
১ মণ।
ধাতু
আমরা সর্বদা যে সকল বস্তু ব্যবহার করি, উহাদের অধিকাংশই ধাতু। থালা, ঘটী, বাটী, গাড়ু, পিলসুজ, ছুরি, কাঁচি, ছু'চ ইত্যাদি বস্তু ও নানাবিধ অলঙ্কার, এ সমুদয় ধাতুনির্মিত।
অন্ত অন্য বস্তু অপেক্ষা, ধাতুর ভার অধিক। অধিকাংশ ধাতু কঠিন, ঘা মারিলে সহসা ভাঙ্গে না। ধাতু আগুনে গলান যায়। প্রায় সকল ধাতুকে পিটিয়া, অতি পাতলা সরু তার প্রস্তুত করা যাইতে পারে। কোনও কোনও ধাতু এমন ভারসহ যে, সরু তারে ভারী বস্তু ঝুলাইলেও ছিঁড়িয়া পড়ে না।
ধাতু আকরে পাওয়া যায়। আকরে বিশুদ্ধ ও বিমিশ্র দুই প্রকার ধাতু থাকে। ধাতু যখন স্বভাবতঃ নির্দোষ হয়, তখন উহাকে বিশুদ্ধ বলা যায়, আর যখন অন্য অন্য বস্তুর সহিত মিশ্রিত থাকে, তখন উহাকে বিমিশ্র বলে। স্বর্ণ, রৌপ্য, পারদ, সীস, তাম্র, লৌহ, রঙ্গ, দস্তা, এই আটটি প্রধান ধাতু।
স্বর্ণ
গলাইলে স্বর্ণের ভার কমিয়া যায় না ও ব্যত্যয় হয় না; এজন্য স্বর্ণকে উৎকষ্ট ধাতু বলে। স্বর্ণ জল অপেক্ষা উনিশগুণ ভারী। সর্ষপ প্রমাণ স্বর্ণকে পিটিয়া দৈর্ঘ্যে ও প্রন্থে নয় অঙ্গুল পাত প্রস্তুত করা যাইতে পারে; এবং ঐ পরিমাণের স্বর্ণে ২৩৫ হাত তার প্রস্তুত হইতে পারে। স্বর্ণ এমন ভারসহ যে, এক যবোদরের মত স্কুল তারে ৫ মণ ৩৪ সের ভার ঝুলাইলেও ছিঁড়িয়া পড়ে না।
স্বর্ণ স্বভাবতঃ অতিশয় উজ্জ্বল, দেখিতে অতি সুন্দর, মলিন হয় না, এজন্য লোকে উহাতে অলঙ্কার গড়ায়। স্বর্ণের মূল্য প্রায় সকল ধাতু অপেক্ষা অধিক। এ দেশে স্বর্ণে যে মুদ্রা প্রস্তুত হয়, তাহাকে মোহর বলে। ইংলণ্ডে সচরাচর যে স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহৃত হইয়া থাকে, তাহার নাম সভরিন্; ইহাকেই এদেশের লোকে গিনি বলিয়া থাকে। বিশুদ্ধ স্বর্ণের বর্ণ কাঁচা হরিদ্রার মত। বিশুদ্ধ স্বর্ণ অপেক্ষাকৃত নরম; এজন্য সচরাচর উহাতে ব্যবহারোপযোগী কোনও দ্রব্য প্রস্তুত হয় না। ব্যবহারোপযোগী করিতে হইলে, উহার সহিত অল্প তামা ও রূপা মিশ্রিত করিয়া দৃঢ় করিয়া লইতে হয়। এইরূপ তামা
ও রূপা মিশ্রিত করাকে খাদ দেওয়া বলে। পৃথিবীর প্রায় সকল প্রদেশেই স্বর্ণের আকর আছে; কিন্তু কালিফর্ণিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও ঘুরাল পর্বতেই অধিক।
রৌপ্য
রৌপ্য, জল অপেক্ষা প্রায় এগার গুণ ভারী। রৌপ্য শুরু ও উজ্জল। স্বর্ণে যেরূপ পাতলা পাতলা পাত ও সরু তার হয়, ইহাতেও প্রায় সেইরূপ হইতে পারে। রৌপ্য এমন ভারসহ যে, এক যবোদরের মত স্থল তারে ৪ মণ ১১ সের ভার ঝুলাইলেও ছি"ড়িয়া পড়ে না।
পৃথিবীর প্রায় সকল প্রদেশেই রৌপ্যের আকর আছে; কিন্তু আমেরিকা দেশে সর্বা- পেক্ষা অধিক। রূপাতে টাকা, আধুলি, সিকি, দুয়ানি নির্মিত হয়। কপাতে নানাবিধ অলঙ্কার গড়ায়,
এবং ঘটী, বাটী প্রভৃতিও নির্মিত হইয়া থাকে।
পারদ
পারদ, রৌপ্যের ন্যায় শুভ্র ও উজ্জ্বল। এই ধাতু জল অপেক্ষা প্রায় চৌদ্দগুণ ভারী। ইহা আর আব ধাতুর মতন কঠিন নহে, জলের ন্যায় তরল; যাবতীয় তবল দ্রব্য অপেক্ষা অধিক ভারী; সর্বদা দ্রব অবস্থায় থাকে; কিন্তু মেরুসন্নিহিত দেশে লইয়া গেলে জমিয়া যায়। তখন অন্য অন্য ধাতুব ন্যায় ইহাতেও সরু তার ও পাতলা পাত প্রস্তুত হইতে পারে; এবং ঘা মারিলে ইহা সহসা ভাঙ্গিয়া যায় না।
স্পর্শ করিলে, পারদ স্বভাবতঃ সমস্ত তরল দ্রব্য অপেক্ষা শীতল বোধ হয়; কিন্তু অগ্নির
উত্তাপ দিলে, সহজেই উষ্ণ হইয়া উঠে। পারদকে অনায়াসেই অসংখ্য খণ্ডে বিভক্ত করা যাইতে পারে। ঐ সকল খণ্ড গোলাকার হয়। ভারতবর্ষ, চীন, তিব্বত, সিংহল, জাপান, স্পেন, অস্ট্রিয়া, বাভেবিয়া, পেরু, মেক্সিকো এই সকল দেশে পারদের আকর আছে।
সীস
সাঁস, স্বর্ণ, রৌপ্য প্রভৃতি ধাতু অপেক্ষা নবম; জল অপেক্ষা এগারগুণ ভারী। সীসের ভার, রৌপ্য অপেক্ষা কিঞ্চিং অধিক। ইহা অল্প উত্তাপে গলে; কিন্তু অধিক উত্তাপ দিলে উড়িয়া যায়। জল বা অনাবৃত স্থলে ফেলিয়া রাখিলে, সীসের অধিক ভাব পরি- বর্তন হয় না, উপরের উজ্জ্বলতা মাত্র নষ্ট হইয়া যায়।
ইংলণ্ড, স্কটলগু, আয়লণ্ড, জর্মনি, ফ্রান্স ও আমেরিকা এই সকল দেশে অপর্যাপ্ত সাঁদ পাওয়া যায়। হিমালয় পর্বত ও তিব্বত দেশেও সীসের আকর আছে। সীসেষ্টগালা-গুলি নির্মিত হয়। কিছু শক্ত ও উত্তমরূপে গোলাকার করিবার নিমিত্ত, ইহাতে হরিতাল মিশ্রিত করে। রসারন ও রঙ্গ মিশ্রিত করিলে, সীসে ছাপিবার অক্ষর নির্মিত হয়।
সীস কাগজের উপর টানিলে, ধূসরবর্ণ রেখা পড়ে। লোকের সংস্কার আছে, সীসে পেন্সিল প্রস্তুত হয়, বাস্তবিক তাহা নহে, উহা গ্রাফাইট বা কৃষ্ণসীস নামে একরূপ অঙ্গারে প্রস্তুত হইয়া থাকে। এই কৃষ্ণসীস আমেরিকা, জর্মনি প্রভৃতি দেশে আকরে পাওয়া যায়।
তাম
এই ধাতু জল অপেক্ষা আটগুণ ভারী। ইহা লালবর্ণ, উজ্জ্বল, দেখিতে অতি সুন্দর। ইহাকে পিটিয়া যেমন পাত করা যায়, তার তেমন হয় না। তাম্র, সকল ধাতু অপেক্ষা অধিক গভীর শব্দজনক লৌহ অপেক্ষা অনেক সহজে গলান যায়। এক যবোদরের মত স্থূল তারে ৩ মণ ১৫ সের ভার ঝুলাইলেও ছি"ড়িয়া যায় না।
তাত্রে পয়সা প্রস্তুত হয়। অনেকে তামাতে পাকস্থালী, জলপাত্র প্রভৃতি প্রস্তুত করে। সুইডেন, সাক্সনি, গ্রেটব্রিটেন, ফ্রান্স, পেরু, মেক্সিকো, চীন, জাপান, নেপাল, আগ্রা,
আজমীর প্রভৃতি দেশে তাষের আকর আছে।
লৌহ
লৌহ, সকল ধাতু অপেক্ষা অধিক কার্যোপযোগী; এই ধাতুতে লাঙ্গলের ফাল, কোদাল, কাস্তিয়া প্রভৃতি কৃষিকার্যের যন্ত্র সকল নির্মিত হয়। কুড়াল, খন্তা, কাটারি, চাবি, কুলুপ, শিকল, পেরেক, হাতা, বেড়ি, কড়া, হাতুড়ি ইত্যাদি সকল বস্তু সর্বদা প্রয়োজনে লাগে, সে সমুদয় লৌহে নির্মিত হইয়া থাকে।
লৌহ, জল অপেক্ষা সাত আট গুণ ভারী; লোহাতে মানুষের চুলের সমান সরু তার হইতে পারে। ইহা সকল প্রধান ধাতু অপেক্ষা অধিক ভারসহ, এক যবোদরের মত স্কুল তারে ৬ মণ ১৭ সের ভারী বস্তু ঝুলাইলেও ছিড়িয়া যায় না।
এক সের লৌহের সহিত ন্যূনাধিক এক তোলা অঙ্গার মিশ্রিত করিলে, ইস্পাত প্রস্তুত হয়। ইস্পাতকে উত্তাপ দ্বারা লোহিতবর্ণ করিয়া শীতল জলে ডুবাইলে উহা অত্যন্ত কঠিন হইয়া পড়ে। ছুরি, কাঁচি, তরবারি প্রভৃতি সুতীক্ষ্ণ অস্ত্র ইস্পাতে নির্মিত হইয়া থাকে।
লৌহ, সকল ধাতু অপেক্ষা অধিক পাওয়া যায়, এবং সকল দেশেই ইহার আকর আছে। কিন্তু ইংলণ্ড, ফ্রান্স, সুইডেন, রুষিয়া এই কয় দেশে কিছু অধিক।
রজ
রঙ্গ, অর্থাৎ রাঙ শুরুবর্ণ ও উজ্জল; জল অপেক্ষা সাতগুণ ভারী; রূপা অপেক্ষা নরম; সীস অপেক্ষা কঠিন।
ইংলণ্ড, জর্মনি, চিলি, মেক্সিকো, বঙ্গদ্বীপ এই কয় স্থানে সর্বাপেক্ষা অধিক রঙ্গ জন্মে। রঙ্গের ইংরেজী নাম টিন। লৌহের পাতে রঙ্গের কলাই করিলে, উহা দেখিতে সুন্দর হয়; এবং শীঘ্র মরিচা ধরিয়া নষ্ট হয় না। এই পাতে বাক্স, পেটারা, কৌটা প্রভৃতি অনেক দ্রব্য নির্মিত হয়। উহাদিগকেই আমরা সচরাচর টিনের বাক্স, টিনের পেটারা ইত্যাদি বলিয়া থাকি।
দুই ভাগ রাঙ ও সাত ভাগ তামা মিশ্রিত করিলে, উত্তম কাঁসা প্রস্তুত হয়। কাঁসায় ঘটী, বাটী, গেলাস ইত্যাদি নানা বস্তু প্রস্তুত করে।
পারা ও রাঙ মিশ্রিত হইয়া কাচের পশ্চাদ্ভাগে লাগিয়া থাকিলে, ঐ কাচে উত্তম প্রতিবিম্ব পড়ে। ঐরূপ কাচকে দর্পণ বলে। লোকে দর্পণে মুখ দেখে। কখনও কখনও, পারদ ও রঙ্গের পরিবর্তে রৌপ্যও ব্যবহৃত হইয়া থাকে।
দস্তা
দস্তা, রাঙ অপেক্ষা কোমল এবং সীস অপেক্ষা কঠিন। এই ধাতু জল অপেক্ষা সাত গুণ ভারী; পূর্বোক্ত সকল ধাতু অপেক্ষা লঘু, দেখিতে উজ্জ্বল ও নীলের আভাযুক্ত শ্বেতবর্ণ। দস্তা, সীসের ন্যায় জলে নষ্ট নয় না, অথচ সীস অপেক্ষা লঘু। এজন্য ছাদের নল প্রভৃতি দস্তাতে গঠিত হয়। লৌহের পাতে দস্তার কলাই করিয়া, লোকে বালতি, গৃহের ছাদ ইত্যাদি নির্মিত করিয়া থাকে।
তিন ভাগ দস্তা ও চারি ভাগ তামা মিশ্রিত করিলে পিতল হয়। তামায় যত শীঘ্র মরিচা ধরে, পিতলে তত শীঘ্র ধরে না। কলসী, গাড়, পিলগুজ প্রভৃতি বস্তু পিতলে প্রস্তুত হয়।
ক্রয়-বিক্রয়-মুদ্রা
যাহাদের যে বস্তু অধিক থাকে, তাহারা সে বস্তু আপনাদের আবশ্যক মত রাখিয়া, অতিরিক্ত অংশ বেচিয়া ফেলে। আর যাহাদের যে বস্তুর অপ্রতুল থাকে, তাহারা সেই বস্তু অন্য লোকের নিকট হইতে কিনিয়া লয়। লোকে মুদ্রা দিয়া আবশ্যক বস্তু কিনিয়া থাকে। যদি মুদ্রা চলিত না থাকিত, তাহা হইলে নিজের কোনও বস্তুর সহিত বিনিময় করিয়া, অন্ত্যের নিকট হইতে আবশুক বস্তু লইতে হইত। কিন্তু তাহাতে অনেক অস্থ- বিধা ঘটিত।
কোনও বস্তু কিনিতে হইলে যত মুদ্রা দিতে হয়, উহাকে ঐ বস্তুর মূল্য বলে। বস্তুর মূল্য সকল সময়ে সমান থাকে না; কখনও অধিক হয়, কখনও অল্প হয়। যখন যে বস্তু অধিক মূল্যে কিনিতে হয়, তখন তাহাকে মহার্ঘ বা অক্রেয় বলে। আর যখন যে বস্তু অল্প মূল্যে কিনিতে পাওয়া যায়, তখন তাহাকে হুলভ বা সস্তা বলে।
মুদ্রা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধাতুখণ্ড। স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, এই ত্রিবিধ ধাতুতে মুদ্রা নির্মিত হয়। এই সকল ধাতু দুষ্প্রাপ্য; এ নিমিত্ত ইহাতে মুদ্রা প্রস্তুত করে। দেশের রাজা ভিন্ন, আর কোনও ব্যক্তির মুদ্রা প্রস্তুত করিবার অধিকার নাই। রাজাও স্বহস্তে মুদ্রা প্রস্তুত করেন না। মুদ্রা প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত লোক নিযুক্ত করা থাকে। রাজা, স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্রের যোগাড় করিয়া দেন; নিযুক্ত ভৃত্যেরা তাহাতে মুদ্রা প্রস্তুত করে। যে স্থানে মুদ্রা প্রস্তুত হয়, ঐ স্থানকে টাকশাল বলে। কলিকাতা ও বোম্বাই নগরে টাকশাল আছে।
টাকশালের লোকেরা হস্ত দ্বারা মুদ্রা প্রস্তুত করে না। মুদ্র। প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত, তথায় নানাবিধ কল আছে। টাকার উপর যে মুখ ও যে সকল অক্ষর মুদ্রিত থাকে, তাহা ঐ কলে প্রস্তুত হয়, ঐ মুখ, ঐ অক্ষর, হস্ত দ্বারা নির্মিত হইলে তত পরিষ্কৃত হইত না। কোন্ রাজার অধিকারে, কোন্ বৎসরে, ঐ মূদ্রা প্রস্তুত ও প্রচলিত হইল, এবং ঐ মুদ্রার মূল্য কত, ঐ সকল অক্ষরে এই সমুদয় লিখিত থাকে। আর ঐ মুখও রাজার মুখের প্রতিকৃতি।
সকল দেশেই নানাবিধ মুদ্র। প্রচলিত আছে। আমাদের দেশে যে সকল মুদ্রা প্রচলিত, তন্মধ্যে পয়সা তাম্রনির্মিত, টাকা, আধুলি, সিকি, দুয়ানি রৌপ্যনির্মিত। আর ঐরূণ টাকা, আধুলি, সিকি স্বর্ণনির্মিতও আছে। স্বর্ণনির্মিত টাকাকে সুবর্ণ ও মোহর বলে।
৪ পয়সায়
১ আনা,
৮ পয়সায়
১ দু আনি;
৪ আনায়
৮ আনায়
১ সিকি;
১ আধুলি;
১৬ আনায়
১ টাকা।
সিকি পয়সা অপেক্ষা অনেক ছোট, কিন্তু এক সিকির মূল্য ১৬ পয়সা; ইহার কারণ এই যে, রৌপ্য তাম্র অপেক্ষা দুষ্প্রাপ্য; এজন্ত রৌপ্যের মূল্য তাম্র অপেক্ষা এত অধিক। স্বর্ণ সর্বাপেক্ষা দুষ্প্রাপ্য; এজন্ম স্বর্ণের মূল্য সর্বাপেক্ষা অধিক। পূর্বে এক মোহরের মূল্য ১৬ টাকা অথবা ১০২৪ পয়সা ছিল; কিন্তু এক্ষণে উহার মূল্য তদপেক্ষা অনেক অধিক হইয়াছে। যদি রৌপ্য ও স্বর্ণের মুদ্রা এত দুষ্প্রাপ্য না হইত, সকলে অনায়াসে পাইতে পারিত, তাহা হইলে মুদ্রার এত গৌরব হইত না। দুষ্প্রাপ্য হওয়াতেই উহার এত মূল্য ও এত গৌরব হইয়াছে।
হীরক
যত প্রকার উৎকৃষ্ট প্রস্তর আছে, হীরকের জ্যোতি সর্বাপেক্ষা অধিক। হারক আকবে জন্মে। পৃথিবীর সকল প্রদেশে হীরকের আকব নাই। ভারতবর্ষে দাক্ষিণাত্য প্রদেশে গোলকুণ্ডা প্রভৃতি কতিপয স্থানে, দক্ষিণ আমেরিকার অন্তঃপাতী ব্রেজীল বাজ্যে, রুষিষার অন্তর্বর্তী যুরাল পর্বতে, এবং আফ্রিকাব দক্ষিণ বিভাগে হীরকেব আকর আছে। আকব হইতে তুলিবাব সময হীবা অতিশয মলিন থাকে, পরে পবিষ্কৃত করিযা লয়।
এ পর্যন্ত যত বস্তু জানা গিযাছে, হীরা সকল অপেক্ষা কঠিন। হীবার গুঁড়া ব্যতিরেকে, আব কিছুতেই উহা পরিষ্কৃত করিতে পারা যায় না। বিশুদ্ধ হীরক অতি পরিষ্কৃত জলেব ন্যায় নির্মল। ঐকপ হীরাই অতি সুন্দর ও প্রশংসনীয। তদ্ভিন্ন, রক্ত, পীত, নীল, হবিত প্রভৃতি নানা বর্ণের হীরা আছে। বর্ণ যত গাঢ় হয়, হাঁবাব মূল্য তত অধিক হয, কিন্তু বিশুদ্ধ নির্মল হীবাই সর্বাপেক্ষা উৎক্রষ্ট ও মহামূল্য। আকার বর্ণ ও নির্মলতা অনুসারে মূল্যের তারতম্য হয।
হীরার মূল্য এত অধিক যে, শুনিলে বিশ্বযাপন্ন হইতে হয। পোটু গালের বাজাব নিকট এক হীরা আছে, তাহার মূল্য ৫,৬৪, ৪৮০০০ পাঁচ কোটি চৌষট্টি লক্ষ, আটচল্লিশ সহস্র টাকা। আমাদের দেশে কোহিমুর নামে এক উৎকৃষ্ট হীরা ছিল। সচরাচব সকলে বলে, উহার মূল্য ৩,৫০,০০০০০ তিন কোটি পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। এক্ষণে এই মহামূল্য হীবা ইংলণ্ডে আছে।
হীরকের ন্যায, নীলকান্ত, পদ্মবাগ, মরকত প্রভৃতি আরও বহুবিধ মহামূল্য প্রস্তব আছে। শোভা ও মূল্য বিষযে, উহাবা হীবক অপেক্ষা অনেক নান। পদ্মরাগ সম্পূর্ণ- কপে নির্দোষ ও সৌষ্ঠবযুক্ত হইলে, হীরকের অপেক্ষাও মূল্যবান হয়, তবে এইরূপ পদ্ম- বাগ অতি বিরল। হীরক, নীলকান্ত, পদ্মরাগ, মবকত প্রভৃতি মহামূল্য প্রস্তব সকলকে মণি ও রত্ব বলে।
বিবেচনা করিযা দেখিলে হীরা অতি অকিঞ্চিৎকর পদার্থ। ঔজ্জল্য ব্যতিরিক্ত উহার আর কোনও গুণ নাই, কাচ কাটা বই, আর কোনও বিশেষ প্রয়োজনে আইসে না।
এরূপ প্রস্তরের একখণ্ড গৃহে রাখিবার নিমিত্ত অত অর্থ ব্যয় করা কেবল অহঙ্কার প্রদর্শন ও মৃঢ়তা মাত্র।
ইহা অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, এই মহামূল্য প্রস্তর ও কয়লা, দুই-ই এক পদার্থ। কিছু দিন হইল, দেপ্রেয় নামক এক ফরাসীদেশীয় পণ্ডিত, অনেক যত্ন, পরিশ্রম ও অনু- সন্ধানের পর, কয়লাতে হীরা প্রস্তুত করিয়াছেন। পূর্বে কেহ কখনও হীরা গলাইতে পারে নাই; কিন্তু তিনি বিষ্ঠার বলে ও বুদ্ধির কৌশলে, তাহাতেও কৃতকার্য হইয়াছেন।
কাচ
কাচ অতি কঠিন, নির্মল, মসৃণ পদার্থ, এবং অতিশয় ভঙ্গপ্রবণ, অর্থাৎ অনায়াসে ভাঙ্গিয়া যায়। কাচ স্বচ্ছ, অর্থাৎ উহার ভিতর দিয়া দেখিতে পাওয়া যায়। ঘরের মধ্যে থাকিয়া, জানালা ও কপাট বন্ধ করিলে অন্ধকার হয়, বাহিরের কোনও বস্তু দেখিতে পাওয়া যায় না। কিন্তু সার্সি বন্ধ করিলে, পূর্বের মত আলোক থাকে ও বাহিরের বস্তু দেখা যায়। তাহার কারণ এই, সার্সি কাচে নির্মিত। সূর্যের আভা, কাচের ভিতর দিয়া আসিতে পারে, কিন্তু কাষ্ঠের ভিতর দিয়া আসিতে পারে না।
বালুকা ও এক প্রকার ক্ষার, এই দুই বস্তু একত্রিত করিয়া অগ্নির উৎকট উত্তাপ লাগা- ইলে, গলিয়া উভয়ে মিলিয়া কাচ হয়। বালুকা যেরূপ পরিষ্কৃত থাকে; কাচ সেই অনু- সারে পরিষ্কৃত হয়। কাচে লাল, সবুজ, হরিদ্রা প্রভৃতি রঙ করে; রঙ করিলে অতি সুন্দর দেখায়।
কাচ অনেক প্রয়োজনে লাগে। সার্সি, আরসি, সিসি, বোতল, গেলাস, ঝাড়, লণ্ঠন ইত্যাদি নানা বস্তু কাচে প্রস্তুত হয়।
কাচ কোনও অস্ত্রে কাটা যায় না, কেবল হীরাতে কাটে। হীরার সূক্ষ্ম অগ্রভাগ কাচের উপর দিয়া টানিয়া গেলে একটি দাগ পড়ে, তার পর জোর দিলেই দাগে দাগে ভাঙ্গিয়া যায়। যদি হীরার অগ্রভাগ স্বভাবতঃ সূক্ষ্ম থাকে, তবেই তাহাতে কাচ কাটা যায়। যদি হীরা ভাঙ্গিয়া, অথবা, আর কোনও প্রকারে উহার অগ্রভাগ সূক্ষ্ম করিয়া লওয়া যায়, তাহাতে কাচের গায়ে আঁচড় মাত্র লাগে, কাটিবার মত দাগ বসে না।
কাচ প্রস্তুত করিবার প্রণালী প্রথম কি প্রকারে প্রকাশিত হয়, তাহার নির্ণয় করা অসাধ্য। এরূপ জনশ্রুতি আছে, ফিনিশিয়াদেশীয় কতকগুলি বণিক, জলপথে বাণিজ্য করিতে যাইতেছিলেন। সিরিয়া দেশে উপস্থিত হইলে, ঝড় তুফানে তাঁহাদিগকে সমু- দ্রের তীরে লইয়া ফেলে। বণিকেরা তীরে উঠিয়া, বালির উপর পাক করিতে আরম্ভ করেন। সমুদ্রের তীরে কেলি নামে একপ্রকার চারা গাছ ছিল; উহার কাঠে তাঁহারা আগুন জালিয়াছিলেন। বালি ও কেলির ক্ষার মিশ্রিত হইয়া, অগ্নির উত্তাপে গলিয়া কাচ হইয়াছিল, উহা দেখিয়া, ঐ বণিকেরা কাচ প্রস্তুত করিতে শিখিয়াছিলেন। যেরূপে যে দেশে কাচের প্রথম উৎপত্তি হউক, উহা বহুকাল অবধি প্রচলিত আছে, তাহার সন্দেহ নাই। প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থে কাচের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। মিশর দেশেও, তিন সহস্র বৎসর পূর্বে কাচের ব্যবহার ছিল, তাহার স্পষ্ট প্রমাণ পাওযা গিয়াছে।
জল-নদী-সমুদ্র
জল অতি তরল বস্তু, স্রোত বহিয়া যায় এবং এক পাত্র হইতে আর এক পাত্রে ঢালিতে পারা যায়। পৃথিবীর অধিকাংশ জলে মগ্ন। যে জলরাশি পৃথিবীকে বেষ্টিত করিয়া আছে, তাহার নাম সমুদ্র।
সমুদ্রের জল এত লোণা ও বিশ্বাদ যে, কেহ পান করিতে পারে না। সমুদ্রের জল, সকল স্থানে সমান লোণা নহে, কোনও স্থানে অল্প লোণা, কোনও স্থানে অধিক। উত্তব সমুদ্র অপেক্ষা, দক্ষিণ সমুদ্রের জল অধিক লোণা।
সমুদ্রের জলে লবণ মিশ্রিত আছে বলিয়া, উহা লোণা হয। আমরা সচরাচব যে লবণ খাই, তাহা সমুদ্র হইতে উৎপন্ন। উডিয়া প্রভৃতি দেশে সমুদ্রের জল জাল দিয়া, এখনও লবণ প্রস্তুত করে। লোণা জল সূর্যের উত্তাপে শুকাইয়া গেলে লবণের ভাগ পডিযা থাকে। রাজপুতানা, ইংলণ্ড প্রভৃতি দেশে যে সকল লবণের খনি আছে, তাহা এই- রূপেই উৎপন্ন হইয়া থাকিবে।
অল্প পরিমাণে সমুদ্রের জল লইয়া পরীক্ষা করিলে দেখিতে পাওযা যায়, উহাতে কোনও বর্ণ নাই। কিন্তু সমুদ্রের রাশীকৃত জল নীলবর্ণ দেখায়। নীলবর্ণ দেখায় কেন, তাহার কারণ এ পর্যন্ত স্থিরীকৃত হয় নাই।
সমুদ্র কত গভীর, এ পর্যন্ত তাহার নির্ণয় হয় নাই। কেহ কেহ অনুমান করেন, যেখানে সর্বাপেক্ষা অধিক গভীর, সেখানেও আডাই ক্রোশের বড় অধিক হইবেক না। অনেকে সমুদ্রের জল মাপিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। কেহ ৩,১২০ হাত, কেহ ৪,৮০০ হাত, কেহ ১৯,৪০০ হাত দীর্ঘ মানরঙ্কু সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত করিয়াছিলেন, কিন্তু কোন রজ্জই তল স্পর্শ করিতে পারে নাই, সুতরাং সমুদ্রের জলের ইয়ত্তা করা দুঃসাধ্য। লাপ্লাস্ নামক ফরাসিদেশীয় অতি প্রসিদ্ধ পণ্ডিত বলিয়াছিলেন, সমুদ্রে যত জল আছে, যদি আর তাহার চতুর্থ ভাগ অধিক হয়, তবে সমস্ত পৃথিবী জলপ্লাবিত হইয়া যায়, আর যদি তাহার চতুর্থ ভাগ ন্যূন হয়, তাহা হইলে সমূদয় নদী, খাল প্রভৃতি শুকাইয়া যায়।
যথানিয়মে প্রতিদিন সমূদ্রের জলের যে হ্রাস ও বৃদ্ধি হয়, উহাকে জোয়ার ও ভাটা বলে। অর্থাৎ সমুদ্রের জল যে সহসা স্ফীত হইয়া উঠে, তাহাকে জোয়ার বলে; আর ঐ জল পুনরায় যে ক্রমে ক্রমে অল্প হইতে থাকে, তাহাকে ভাটা বলে। সূর্য ও চন্দ্রের আকর্ষণে এই অদ্ভুত ঘটনা হয়।
লোকে জাহাজে চড়িয়া সমুদ্রের উপর দিয়া এক দেশ হইতে অন্য দেশে যায়। যদি জাহাজ ঝড় ও তুফানে পড়ে, অথবা পাহাড়ে কিংবা চড়ায় লাগে, তাহা হইলে বড় বিপদ; জাহাজের সমস্ত লোকের প্রাণ নষ্ট হইতে পারে।
সমুদ্র এত বিস্তৃত যে, কতক দূর গেলে আর তীর দেখা যায় না, অথচ জাহাজের লোক পথহারা হয় না। তাহার কারণ এই, জাহাজে কম্পাস্ নামে একটি যন্ত্র থাকে; ঐ যন্ত্রে একটি সূচী আছে; জাহাজ যে মুখে যাউক না কেন, সেই সূচী সর্বদা উত্তরমুখে থাকে; তাহা দেখিয়া নাবিকেরা দিঙ নির্ণয় করে।
প্রাতঃকালে যেদিকে সূর্যের উদয় হয়, তাহাকে পূর্ব দিক বলে; যেদিকে সূর্য অস্ত যায়, তাহাকে পশ্চিম দিক বলে। পূর্বদিকে ডান হাত করিয়া দাঁড়াইলে, সম্মুখে উত্তর ও পশ্চাতে দক্ষিণ দিক্ হয়। এই পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ লক্ষ্য করিয়া লোকে, কি স্থলপথে, কি জলপথে, পৃথিবীর সকল স্থানে যাতায়াত করে।
নদীর ও অন্যান্য স্রোতের জল সুস্বাদ, সমুদ্রের জলের ন্যায় বিস্বাদ ও লবণময় নহে। যাবতীয় নদীর উৎপত্তিস্থান প্রস্রবণ। গঙ্গা, যমুনা, সিন্ধু প্রভৃতি যত বড় বড় নদী আছে, সকলেরই এক এক প্রস্রবণ হইতে উৎপত্তি হইয়াছে। বর্ষাকালে সর্বদা বৃষ্টি হয়; এজন্য ঐ সময়ে সকল নদীর প্রবাহের বৃদ্ধি হইয়া থাকে।
সমস্ত প্রধান প্রধান নদীর জল সমুদ্রে পড়ে। কিন্তু তাহাতে সমুদ্রের জলের বৃদ্ধি হয় না। কারণ, নদীপাত দ্বারা সমুদ্রের যত জল বাড়ে, ঐ পরিমাণে সমুদ্রের জল, সর্বদা কুঞ্ঝটিকা ও বাষ্প হইয়া আকাশে উঠে। ঐ সমস্ত বাষ্পে মেঘ হয়। মেঘ সকল, যথা- কালে জল হইয়া ভূতলে পতিত হয়। সেই জল দ্বারা পুনরায় নদীর প্রবাহের বৃদ্ধি হয়। সমুদ্র ও নদীতে নানাপ্রকার মংন্ড ও জলজন্তু আছে।
উদ্ভিদ
যে সকল বস্তুর জীবন আছে, অথচ জন্তুর ন্যায় গমনাগমনের শক্তি নাই, তাহাদের নাম উদ্ভিদ; যেমন লতা, তৃণ, বৃক্ষ ইত্যাদি। উহারা সচরাচর ভূমি ভেদ করিয়া উঠে, এজন্য উহাদিগকে উদ্ভিদ বলে। উদ্ভিদ সকল যখন বাড়িতে থাকে, তখন উহাদিগকে জীবিত বলা যায়; আর যখন শুকাইয়া যায়, আর বাড়ে না তখন উহাদিগকে মৃত বলে। উহারা যেখানে জন্মে, সেইখানেই থাকে; এই নিমিত্ত উহাদিগকে স্থাবর বলে।
উদ্ভিদ সকল, মূল দ্বারা ভূমি হইতে রস আকর্ষণ কবে। ঐ আকৃষ্ট রসই উদ্ভিদের থা্য। রস, মূল হইতে ঋদ্ধদেশে উঠে। তৎপর ক্রমে ক্রমে সমস্ত শাখা, প্রশাখা ও পত্রে প্রবেশ করে। এইরূপে ভূমির রস উদ্ভিদের সর্ব অবয়বে সঞ্চারিত হয়। তাহাতে উহারা জীবিত থাকে ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। কোনও কোনও উদ্ভিদ ভূমিতে না জন্মিয়া, বৃক্ষের উপরে জন্মে; এবং বৃক্ষ হইতে রস গ্রহণ করিয়া পুষ্টি লাভ করে। এরূপ উদ্ভিদের নাম তরুরুহ বা পরগাছা। শীতকালে রদের সঞ্চাব রুদ্ধ হয়, এজন্য পত্র সকল শুষ্ক ও পতিত হয়। বসন্তকাল উপস্থিত হইলে, পুনর্বার বসেব সঞ্চার হইতে আরম্ভ হয়; তখন নূতন পত্র নির্গত হইতে থাকে।
বৃক্ষ, লতা প্রভৃতি উদ্ভিদগণের অবয়ব সকল ছালে আচ্ছাদিত। অবয়ব সকল ছালে আচ্ছাদিত বলিয়া, উদ্ভিদে সহঙ্গে আঘাত লাগে না, এবং পুষ্টি বিষয়েও আনুকূল্য হয়। যদি ছাল অত্যন্ত আঘাত পায়, তাহা হইলে উদ্ভিদ নিস্তেজ হইয়া পড়ে, এবং ক্রমে শুকাইয়া যায়।
প্রায় সমস্ত উদ্ভিদের ফলের মধ্যে বীজ জন্মে। সেই বীজ ভূমিতে রোপিলে, তাহা হইতে নূতন উদ্ভিদের উদ্ভব হয়। কতকগুলি উদ্ভিদ এরূপ আছে যে, উহাদের শাখা, অথবা মূলের কিয়দংশ ভূমিতে রোপিয়া দিলে, নূতন উদ্ভিদ জন্মে।
উদ্ভিদ, মহস্থ্যের জীবনধারণের প্রধান উপায়। আমরা কি অন্ন, কি বস্ত্র, কি বাসগৃহ, সমূদয়ই উদ্ভিদ হইতে লাভ করি। ফল, মূল, পত্র, পুষ্প প্রভৃতি আমাদের আহার; কাঠাদি দ্বারা অগ্নি আলিয়া অন্ন ব্যঞ্জন প্রভৃতি রন্ধন করি; তুলা হইতে সূত্র প্রস্তুত করিয়া লই; এবং তৃণ, কাষ্ঠ প্রভৃতি দ্বারা বাসগৃহ নির্মাণ করিয়া থাকি।
জপ্তর ন্যায় উদ্ভিদের আয়তন এবং আকাবের বিলক্ষণ তারতম্য আছে। আফ্রিকাদেশস্থ বাওবাব বৃক্ষের কাণ্ড এরূপ স্তুপ যে, 'তাহার বঙ্কল খুলিয়া লইয়া তাঁবু প্রস্তুত করিলে তন্মধ্যে চল্লিশ পঞ্চাশ ব্যক্তি অবলীলাক্রমে শয়ন করিতে পারে। অষ্ট্রেলিয়া দ্বীপে দেবদারু জাতীয় একপ্রকার বৃক্ষ, তিন শত হস্তেরও অধিক উচ্চ হইয়া থাকে। ভূমি হইতে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হাত পর্যন্ত তাহার কোনও শাখা প্রশাখা থাকে না; অতএব তাহার গুঁড়িই ত্রিতল গৃহের অপেক্ষা উচ্চ। আমাদের দেশেও শাল, বট প্রভৃতি নানা- বিধ প্রকাণ্ড বৃক্ষ আছে। বটবৃক্ষ তাদৃশ উচ্চ না হইলেও, আয়তনে অতি বৃহৎ হইয়া থাকে। গুজরাট প্রদেশে একটি বটবৃক্ষ ছিল; তিন চারি সহস্র লোক তাহার ছায়ায় বিশ্রাম করিতে পারিত।
এক দিকে যেরূপ বৃহদাকার বৃক্ষ আছে, অপর দিকে সেইরূপ ক্ষুদ্রাকৃতি উদ্ভিদ ও দেখিতে পাওয়া যায়। ছত্রক বা কোঁড়ক জাতীয় কোনও কোনও উদ্ভিদ এত ক্ষুদ্র যে, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহাযা ব্যতিরেকে দৃষ্টিগোচর হয় না। বর্ষাকালে পুস্তকে যে ছাতা পড়ে, তাহা এই জাতীয় উদ্ভিদ। কোনও কোনও কোডক অপেক্ষাকৃত বৃহৎ হয়; উহাদিগকে বেঙের ছাতা বলে।
আম, কাঁঠাল, জাম, আতা, পিয়ারা, বাদাম, দাডিম ইত্যাদি নানাবিধ মিষ্ট ও সুস্বাদ ফল বৃক্ষে জন্মে। যেখানে এই সকল ফলের বৃক্ষ অনেক থাকে, তাহাকে উত্থান বলে। যেখানে বহু পুষ্পবৃক্ষ রোপণ করা যায়, তাহাকে পুষ্পোদ্যান কহে।
কতকগুলি বৃক্ষের ছালে আমাদের অনেক উপকাব হয়। স্পেন দেশে কর্ক নামে এক প্রকার বৃক্ষ জন্মে। উহার বহুল এরূপ স্থুল, কোমল ও রক্তশূন্য যে তদ্বারা শিশি, বোতল প্রভৃতির ছিপি নির্মিত হয়। আমেরিকাব পেরু প্রদেশস্থ সিঙ্কোনা নামক বৃক্ষের ত্বক সিদ্ধ করিলে যে কাথ হয়, তাহা হইতে কুইনাইন উৎপন্ন হয়। ইদানীং দার্জিলিঙ অঞ্চলে সিঙ্কোনার চাষ হইতেছে। পাট ও শণ গাছের ছালের তত্ত্ব হইতে চট, রজ্জু প্রভৃতি প্রস্তুত হয়; তিসির ছাল হইতে যে সুক্ষ্ম তন্ত্র বাহির হয়, তাহাতে লিনেন কেন্দ্রিক ইত্যাদি উৎকৃষ্ট বস্তের বযন হইয়া থাকে।
অসুখের সময়, রোগীকে যে এরোরুট পথ্য দেওয়া হয়, তাহা হরিদ্রাজাতীয় একপ্রকার বৃক্ষের মূল হইতে উৎপন্ন। কোনও কোনও বৃক্ষের মূলদেশে কচুর ন্যায় একপ্রকার পদার্থ জন্মে, ঐ পদার্থকে কন্দ বলে যেমন আলু, পলাও, ওল, মানকচু, শালগম ইত্যাদি।
অনেকে প্রাতঃকালে ও সায়াহ্নে, চা খাইয়া থাকেন। ঐ চা, একপ্রকার গুন্মের শুল্ক পত্র কিয়ৎক্ষণ উষ্ণ জলে রাখিয়া দিলে, প্রস্তুত হয়। চীন, জাপান, আসাম, দার্জিলিঙ প্রভৃতি দেশে প্রচুর পরিমাণে, ঐ গুন্মের চাষ হইয়া থাকে। পূর্বে বঙ্গদেশের অনেক স্তানে নীলের চাষ হইত। উহার গাছ জলে পচাইলে, একপ্রকার নীলবর্ণ পদার্থ বাহির হয়; ঐ পদার্থ পৃথক্ করিয়া লইয়া শুষ্ক করিলেই, নীলবড়ি উৎপন্ন হইয়া থাকে।
কোনও কোনও বৃক্ষের নির্যাস বা আঠা অনেক প্রয়োজনে লাগে। কাগজ হইতে পেন্সিল বা কালির দাগ উঠাইবার জন্য যে রবর ব্যবহৃত হয়, তাহা বটগাছের ন্যায় একপ্রকার বৃহৎ গাছের আঠা মাত্র। ধূনা, টার্পিন তৈল, খদির, হিঙ্গ, কপূর, গঁদ ইত্যাদি সমূদয়ই বৃক্ষনির্যাস হইতে উৎপন্ন। পোস্ত গাছের ফল চিরিয়া দিলে যে রস নির্গত হয়, তাহা হইতে অহিফেন বা আফিম প্রস্তুত হয়।
সুমাত্রা, বোর্ণিও প্রভৃতি দ্বীপে তালজাতীয় একপ্রকার বৃক্ষ জন্মে, উহার মজ্জা হইতে সাগুদানা প্রস্তুত হইয়া থাকে।
পরিশ্রম-অধিকার
আমরা চারিদিকে যে সমস্ত বস্তু দেখিতে পাই, ঐ সকল বস্তু কোনও না কোনও লোকের হইবে। যে বস্তু যাহার, সে ব্যক্তি পরিশ্রম করিয়া উহা প্রাপ্ত হইয়াছে। বিনা পরিশ্রমে কেহ কোন বস্তু পাইতে পারে না, ভিক্ষা করিলে, পরিশ্রম ব্যতিরেকে, কোনও কোনও বস্তু পাওযা যাইতে পারে, কিন্তু ভিক্ষা করা ভদ্র লোকের কর্ম নয়। যে ভিক্ষা করে, সে নিতান্ত নিস্তেজ ও নীচাশয়, এবং সকল লোকের ঘৃণা ও অশ্রদ্ধার ভাজন হয়।
যদি কোনও ব্যক্তি কখনও পরিশ্রম না করিত, তাহা হইলে গৃহনির্মাণ ও কৃষিকর্ম সম্পন্ন হইত না, খাদ্যসামগ্রী, পবিধেয় বস্ত্র ও পাঠ্য-পুস্তক, কিছুই পাওয়া যাইত না, সকল লোক দুঃখে কালযাপন করিত, পৃথিবী এক্ষণে, অপেক্ষাকৃত যেরূপ শুখের স্থান হইয়াছে, সেরূপ কদাচ হইত না।
পবিশ্রম না করিলে কেহ কখনও ধনবান্ হইতে পারে না। কেহ কেহ পৈতৃক বিষয পাইয়া ধনবান হয়, যথার্থ বটে, কিন্তু তাহারা পবিশ্রম না করুক, তাহাদের পূর্ব- পুরুষেরা অর্থাৎ পিতা, পিতামহ প্রভৃতি পবিশ্রম দ্বারা ঐ ধন উপার্জন করিযা গিযাছেন। বিনা পরিশ্রমে একপ ধনলাভ অল্প লোকেব ঘটে, স্বতবা সেই কষজন ভিন্ন, সকল লোককেই পরিশ্রম করিতে হয।
লোকে পরিশ্রম করিযা অর্থ উপার্জন করে। অর্থ না হইলে সংসাবযাত্রা সম্পন্ন হয় না। অন্ন, বস্ত্র, গৃহ প্রভৃতি সমস্ত বস্তু অর্থসাধ্য। যদি অতঃপর আর কেহ পরিশ্রম না কবে, তবে যে সকল আহারসামগ্রী প্রস্তুত আছে, অল্প কালের মধ্যে তাহা ফুরাইয়া যাইবে, সমস্ত বস্ত্র, ক্রমে ক্রমে ছিন্ন হইবে এবং আর আর যে সকল বস্তু আছে, সমস্তই কালক্রমে শেষ হইবে। তাহা হইলে সকল লোককে, নানা কষ্ট পাইযা প্রাণত্যাগ করিতে হইবে। বালকেরা পরিশ্রম করিয়া জীবিকানির্বাহ করিতে সমর্থ নহে। তাহারা যতদিন কর্মক্ষম না হয, পিতা মাতা তাহাদের প্রতিপালন করেন। অতএব, যখন পিতা মাতা বৃদ্ধ হইযা কর্ম করিতে অক্ষম হন, তখন তাঁহাদের প্রতিপালন করা পুত্রদিগের অবশ্বকর্তব্য কর্ম, না করিলে ঘোবতর অধর্ম হয়।
বালকগণেব উচিত, বাল্যকাল অবধি পবিশ্রম করিতে অভ্যাস করা, তাহা হইলে বড হইযা অনাযাসে সকল কর্ম করিতে পারিবে, স্বযং অন্ন বস্ত্রের ক্লেশ পাইবে না, এবং বৃদ্ধ পিতা মাতার প্রতিপালন করিতেও পারগ হইবে। কোনও কোনও বালক এমন হতভাগ যে, সর্বদা অলস হইযা সময় নষ্ট কবিতে ভালবাসে, পবিশ্রম করিতে হইলে সর্বনাশ উপস্থিত হয়। তাহারা বাল্যকালে বিদ্যাভ্যাস, এবং বড হইয়া ধনোপার্জন, কিছুই করিতে পারে না, হুতরাং যাবজ্জীবন ক্লেশ পায়, এবং চিরকাল পরের গলগ্রহ হইয়া থাকে।
যে ব্যক্তি পরিশ্রম করিয়া যে বস্তু উপার্জন করে, অথবা অম্লের দত্ত যে বস্তু প্রাপ্ত হয়, সে বস্তু তাহার। সে ভিন্ন অস্তের তাহা লইবার অধিকার নাই। যে বস্তু যাহার, তাহা তাহারই থাকা উচিত। লোকে জানে, আমি পরিশ্রম করিয়া যে বস্তু উপার্জন করিব, তাহা আমারই থাকিবে, অন্যে লইতে পারিবে না, এজন্যই তাহার পরিশ্রম করিতে প্রবৃত্তি হয়। কিন্তু সে যদি জানিত, আমার পরিশ্রমের ধন অ্যে লইবে, তাহা হইলে তাহার কখনও পরিশ্রম করিতে প্রবৃত্তি হইত না।
যদি কেহ অন্যের বস্তু লইতে বাঞ্ছা করে, ঐ বস্তু তাহার নিকট চাহিয়া অথবা কিনিয়া লওয়া উচিত; অজ্ঞাতসারে অথবা বলপূর্বক, কিংবা প্রতারণা করিয়া লওয়া উচিত নহে। এরূপ করিয়া লইলে, অপহরণ করা হয়।
যদি কাহারও কোন দ্রব্য হারায়, তাহা পাইলে তৎক্ষণাৎ তাহাকে দেওয়া উচিত, আপনার হইল মনে করিয়া লুকাইয়া রাখিলে চুরি করা হয়। চুরি করা বড় দোষ। দেখ, ধরা পড়িলে চোরকে কত নিগ্রহভোগ করিতে হয়; তাহার কত অপমান; সে সকলের ঘৃণাস্পদ হয়; চোর বলিয়া কেহ বিশ্বাস করে না; কেহ তাহার সহিত আলাপ করিতে চাহে না। অতএব, প্রাণাস্তেও পরের দ্রব্যে হস্তার্পণ করা উচিত নহে। কতকগুলি সাধারণ বস্তু আছে, তাহাতে সকল লোকের সমান অধিকার; সকলেই বিনা পরিশ্রমে পাইতে পারে। বায়ু, সূর্যের আলোক, বৃষ্টি ও নদীর জল, এ সমস্ত, ও এরূপ আর আর বস্তুতে সকল লোকেরই সমান অধিকার। এতদ্ভিন্ন আর কোনও বস্তু পাইবার বাঞ্ছা করিলে, অবশ্য পরিশ্রম করিতে হইবে, বিনা পরিশ্রমে তাহা পাইবার কোনও সম্ভাবনা নাই।
ইতর জন্তু
মহুয়্য ভিন্ন আর সকল প্রাণীকে ইতর জন্তু কহে। ইতর জন্তুর মধ্যে কোনও কোনও জাতি তৃণাদি ভক্ষণ করিয়া জীবন ধারণ করে; উহাদিগকে তৃণজীবী বলে; যেমন গো, মহিষ, অশ্ব, হরিণ, ছাগল ইত্যাদি। আবার কোনও কোনও জাতি, অপর জীবের প্রাণবধ করিয়া তাহাদের মাংস খায়; উহারা শ্বাপদ বা হিংস্র জন্তু; যেমন সিংহ, ব্যাঘ্র, শৃগাল, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি। কোনও কোনও জন্তু মনুয়ের ন্যায় উদ্ভিদ ও মাংস দুই-ই আহার করে। ভল্লুকেরা সচরাচর ফল, মূল ইত্যাদি ভক্ষণ করে; কিন্তু এ সকল থাঞ্চের অভাব হইলে, মাংসাহার দ্বারাও উদরপূর্তি করিয়া থাকে।
তৃণজীবী জন্তুরা মনুষ্যের অনেক উপকারে আইসে। গরুর মত মনুষ্যের উপকারী জীব পৃথিবীতে আর নাই। দুগ্ধে শরীরের পুষ্টিসাধন হয় এবং ক্ষীর, দধি, ছানা, নবনীত প্রভৃতি নানা উপাদেয় খাদ্য প্রস্তুত হয়; চর্মে পাছকা নির্মিত হয়, শৃঙ্গ ও খুর গলাইয়া চিরুনি প্রস্তুত করে; অস্থিতে ছুরির বাঁট গড়ে; এবং গোময় হইতে উৎকৃষ্ট সার প্রস্তুত হইয়া থাকে। ভূমিকর্ষণ, শকটচালন প্রভৃতি কর্মেও গরুকে নিযুক্ত করা যায়। অতএব সকল মনুষ্যেবই গরুকে যত্ন ও আদর করা কর্তব্য। গরুর ন্যায় মহিষও আমাদের অনেক কাজে লাগে। মহিষের দুগ্ধ হইতে যে ঘৃত উৎপন্ন হয়, তাহাকে ভয়সা ঘি বলে।
মেষ ও ছাগ হইতে আমরা কতিপয় নিতান্ত আবশ্যক সামগ্রী প্রাপ্ত হই। তিব্বত দেশের ছাগলের লোমে শাল হয়। আমেরিকায় আপপাকা নামে একপ্রকার জন্তু আছে, তিব্বত দেশের ছাগলের ন্যায়, উহাবও লোম সূক্ষ্ম ও দীর্ঘ। এই লোমে যে বস্ত্র প্রস্তুত হয়, তাহাকেও আলপাকা বলে।
অশ্ব যেমন বলিষ্ঠ ও বেগবান্, তেমনই সাহসী ও শান্তস্বভাব। অশ্বে আরোহণ করিয়া অনায়াসেই, সুদূর পথ অতি সত্বব যাওয়া যায়। লোকে ঘোড়ার গাড়ীতে চড়িয়া বিনা ক্লেশে এক স্থান হইতে অন্য স্থানে গমন করে। কোনও কোনও দেশে, অশ্ব দ্বারা কৃষি- কর্ম সম্পন্ন হয়।
হরিণজাতি দেখিতে অতি সুশ্রী। উহারা যখন শিং উঠাইয়া, একেবারে চারি পা তুলিয়া, লম্ফ দিতে দিতে বেগে গমন কবে, তখন উহাদিগকে অতিশয় সুন্দর দেখায়। তিব্বত ও নেপালে কস্তুরিকা মৃগ নামে এক জাতীয় হরিণ বাস করে, উহাদের নাভি- দেশে এক প্রকাব সুগন্ধি পদার্থ জন্মে, তাহাকেই আমরা সচরাচর কস্তুরী বা মৃগনাভি বলিয়া থাকি। মৃগীদের নাভিদেশে কস্তুরী থাকে না।
হিমালয় প্রদেশে চমবী-নামক একপ্রকার জন্তু আছে, উহার লাঙ্গুলের লোমে চামর প্রস্তুত হয়।
সমুদ্রের তলদেশে, স্থানে স্থানে একজাতীয় বড় শুক্তি বা ঝিনুক আছে। তাহাদের মধ্যে বালুকণার ন্যায় কোনও ক্ষুদ্র কঠিন বস্তু প্রবিষ্ট হইলে, তৎপ্রদেশ হইতে রস নির্গত হইতে থাকে; ঐ রস জমিয়া শুভ্র, মসৃণ, উজ্জ্বগ ও গোলাকৃতি একপ্রকার কঠিন পদার্থে পরিণত হয়। এই পদার্থের নাম মুক্তা। সিংহলদ্বীপের উপকূল ও পারস্য উপসাগরে মুক্তা পাওয়া যায়।
কীট ও পতঙ্গ হইতেও নানাবিধ ব্যবহারোপযোগী সামগ্রীর উৎপত্তি হইয়া থাকে। লাক্ষা বা গালা কীটঙ্গ পদার্থ। অশ্বত্থ, ডুমুর, পলাশ প্রভৃতি বৃক্ষের বহুলে একপ্রকার কীট দেখিতে পাওয়া যায়। ঐ কীটের অঙ্গ হইতে যে লোহিতবর্ণ পদার্থ ক্ষরিত হয় তাহারই নাম লাক্ষা।
তুত, আসন প্রভৃতি গাছের পাতায় গুটিপোকা অণ্ড প্রসব করিয়া থাকে। পোকা হইতে পতঙ্গের অবস্থায় আসিবার কিঞ্চিৎ পূর্বে, উহাদের মুখ হইতে সূক্ষ্ম সূত্রের মত লালা নিঃসৃত হইতে থাকে, এবং বায়ুর সংযোগে অবিলম্বেই দৃঢ় হইয়া যায়। এই সূক্ষ্ম সূত্রের নাম রেশম। লালা নিঃসরণ করিবার সময় পোকা অনবরত ফিরিতে ঘুরিতে থাকে, এবং ক্রমে রেশম নির্মিত একটা ডিম্বাকার আবরণে রুদ্ধ হইয়া যায়। এই আবরণকে গুটি বা কোয়া কহে। কোয়া উষ্ণ জলে ফেলিয়া, বা অন্য কোনও উপায়ে, পোকাকে বিনষ্ট না করিলে, উহা কিছু দিনের মধ্যেই আবরণ কাটিয়া পলায়ন করে। ভারতবর্ষ, জাপান, চীন, ইটালি প্রভৃতি দেশে, নিয়মমত গুটিপোকার চাষ হইয়া থাকে। চাষীরা এই পোকাকে যত্নের সহিত রক্ষা করে, এবং অণ্ড হইতে কীট জন্মিলে তাহাদিগকে নরম তুতের পাতা, ছোট ছোট করিয়া কাটিয়া খাইতে দেয়। তসর, গরদ, চেলী প্রভৃতি নানাবিধ বহুমূল্য বস্তু রেশমে প্রস্তুত হয়।
মধুমক্ষিকা দ্বারা মন্ত্যের বহু উপকার সাধিত হয়। উহারা যে বাসগৃহ নির্মাণ করে, তাহার নাম মধুচক্র। মধুচক্রের চলিত নাম মৌচাক। মৌমাছিরা মৌচাকে বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খোপ প্রস্তুত করে, এবং প্রত্যেক খোপে এক একটি ডিম্ব প্রসব করে। বর্ষা- কালে প্রায়ই কোনও পুষ্প প্রস্ফুটিত হয় না, হইলেও বৃষ্টির জলে তাহার মধু ধুইয়া যায়। এজন্য বসন্তকালে যখন নানাবিধ ফুল ফুটে, তখন মৌমাছিরা ঐসকল ফুল হইতে যত্নে মধু আহরণ করিয়া, মধুচক্রে আনিয়া রাখে। চাক ভাঙ্গিলেই সেই মধু সংগ্রহ করা যায়। সমূদয় চাক ভাঙ্গিলে মধুমক্ষিকারা একেবারে উপায়হীন হয়, এজন্য তাহাব কিয়- দংশ রাখিয়া দেওয়া কর্তব্য। মৌচাক গলাইলে, মোম প্রস্তুত হয়। মোমের বাতি ঈষৎ হরিদ্রাবর্ণ। আমরা সচরাচর যে বাতি জালিয়া থাকি, তাহা চর্বির, মোমের নহে।
পাথরিয়া কয়লা-কেরোসিন তৈল
উৎকৃষ্ট পাথরিয়া কয়লা দেখিতে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ ও উজ্জ্বল। পাথরিয়া কয়লা ধাতুর ন্যায় আকরে জন্মে। কোনও কোনও পাথরিয়া কয়লার আকব ভূমির অনেক নিয়ে থাকে। লোকে গভীর কূপ খনন করিয়া ঐ সকল খনিতে উপস্থিত হয়, এবং সাবল প্রভৃতি। দ্বারা কয়লা কাটিয়া, ভূমির উপরিভাগে লইয়া আইসে। রাণীগঞ্জ, আসানসোল, সীতা- রামপুর, ঝরিয়া, গিরিধি প্রভৃতি অঞ্চলে বিস্তর পাথরিয়া কয়লার খনি আছে। আমরা যে পাথরিয়া কয়লা ব্যবহার করি, তাহা ঐ সকল প্রদেশে পাওয়া যায়। আসাম প্রদেশেও কয়লার খনি আছে।
পাথরিয়া কয়লাকে রন্ধনকার্যের উপযোগী করিতে হইলে, একবার কি দুইবার পোড়া- ইয়া লইতে হয়; তখন উহাকে কোক কয়লা বলে।
এক প্রকার পাথরিয়া কয়লা আছে, তাহা চুয়াইলে কেরোসিন তৈল নির্গত হয়। পূর্বে এই রূপেই কেরোসিন তৈল প্রস্তুত হইত। কিন্তু এক্ষণে আমরা যে কেরোসিন তৈল ব্যবহার করি, তাহা আমেরিকা, রুবিয়া, বর্মা প্রভৃতি দেশে আকরে জন্মে। আকর- স্থলে কূপ খনন করিলে, এই তৈল জলের সহিত নির্গত হইয়া উপরে ভাসিতে থাকে। তখন লোকে উহা তুলিয়া লয়; এবং শোধন করিয়া, বিক্রয়ের জন্য নানা দেশে পাঠাইয়া দেয়। কেরোসিন তৈল সহজেই জলিয়া উঠে; অতএব উহা সাবধান হইয়া ব্যবহার করা উচিত।
কৃষিকর্ম
আমরা প্রতিদিন যাহা খাই, তাহার অধিকাংশ কৃষিকর্ম দ্বারা উৎপন্ন। লোকে নিয়মিত কালে, লাঙ্গলাদি দ্বারা ভূমি খনন করিয়া বীজ বপন করে। গাছ জন্মিলে তাহাকে যত্ন পূর্বক রক্ষা করে, এবং যাহাতে উহা উত্তমরূপে বাড়িতে পারে, তাহার উপায় করিয়া দেয়। ফল পাকিলে গাছ কাটিয়া আনে ও ফল পৃথক করিয়া লয়। এইরূপ ভূমি খনন, বীজ বপন প্রভৃতি ক্রিয়াকে কৃষিকর্ম বা চাষ বলে। যাহারা কৃষিকর্ম করে তাহাদের নাম কৃষক বা চাষী।
কৃষি দ্বারা ধান্ত, গম, কয়লা প্রভৃতি নানাবিধ শ্য জন্মে। তন্মধ্যে ধার্য হইতে তণ্ডুল, যব হইতে ছাতু, গম হইতে ময়দা, আর ছোলা, মটর, অরহর, মুগ, মসুর, মাষ প্রভৃতি কলায় হইতে ডাইল হয়। তিল, সর্বপ প্রভৃতি কতকগুলি শস্য আছে, তাহা হইতে তৈল পাওয়া যায়। ইক্ষু হইতে গুড়, চিনি, মিছরি হয়। শাক, পটোল আলু, মূলা, লাউ, কুমড়া, ফুটি, তরমুজ ইত্যাদি খাদ্যসামগ্রীও কৃষিকর্ম দ্বারা উৎপন্ন হয়।
কৃষিকর্ম দ্বারা কার্পাস জন্মে। কার্পাসের বীজ পূর্বক করিলে তুলা হয়; তুলা হইতে স্বত্র হয়; সূত্রে বস্ত্র প্রস্তুত করে, আমরা সেই বস্ত্র পরি। অতএব আমাদের পরিধান- বস্ত্রও কৃষিকর্ম দ্বারা লব্ধ হয়।
ফল পাকিলে যে সকল উদ্ভিদ শুষ্ক ও জীবনহীন হয়, তাহাদিগকে ওষধি কহে, যেমন ধান্ত, কলাই, লাউ, কুমড়া, কদলী ইত্যাদি। বাঁশও ফুল ফল হইলে মারিয়া যায়। এজন্ত লোকে বাঁশের ফুল হওয়া, দোষ মনে করে।
ইদানীং অনেকেই কৃষিকর্মকে অশ্রদ্ধা করিয়া থাকেন; কিন্তু বাস্তবিক উহা অতি সম্মঈনের কার্য। পূর্বকালে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরাও চাষ করিতে লজ্জিত হইতেন না। বহুকাল পূর্বে, রোমদেশে সিন্সিনেটাস্ নামে এক অসাধারণ বীরপুরুষ বাস করিতেন।
তাঁহার সময়ে রোমরাজ্য একবার প্রবল শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হয়। সকলেই একমত হইয়া স্থির করিল যে, সিন্সিনেটাসকেই সৈল্লাধ্যক্ষপদে নিযুক্ত করিতে হইবে। দূতেরা যখন তাঁহার নিকট সংবাদ লইয়া যায়, তখন তিনি স্বহস্তে ভূমি কর্ষণ করিতেছিলেন। আমাদের দেশে ভূমিকে লক্ষ্মী বলে। স্থনিয়মে চাষ করিতে পারিলে, অল্প দিনের মধ্যেই লোকে ধনবান হইতে পারে। চব্বিশ পরগণার দক্ষিণ বিভাগে এক ব্যক্তি কয়েক বিঘা ভূমিতে কেবল নারিকেল বৃক্ষ রোপণ করিয়া দ্বাদশ বৎসরের মধ্যেই বিলক্ষণ সৃঙ্গতিপন্ন হইয়াছিল। যশোর জিলার একস্থান বহুকাল পতিত অবস্থায় ছিল। সেখানে কেবল দুই একটি প্রজু'র বৃক্ষ ভিন্ন, অপর কোনও বৃক্ষ সতেজে জন্মিত না। ইহা দেখিয়া এক সাহেব, ঐ ভূমি খজুর বৃক্ষের উপযোগী বুঝিতে পারিয়া, উহাতে বহুসংখ্যক খত্রু'র বৃক্ষ রোপণ করেন; এবং অল্পদিনের মধ্যেই যথেষ্ট ধন উপার্জন করিয়া, স্বদেশে গমন করেন।
কৃষিকর্মে প্রবৃত্ত হইলে, উদ্ভিদদিগের পুষ্টিসাধনের অন্য কি কি উপায়ের প্রয়োজন হয়, তাহা অবগত হওয়া আবঞ্চক। প্রাণিগণের ন্যায় উদ্ভিদেরাও বায়ু, আলোক, উত্তাপ, জল ও উপযুক্ত খায় ভিন্ন জীবনধারণ করিতে পারে না; অতএব যাহাতে এ সমুদায়ের মধ্যে কোনওটির কিছুমাত্র অভাব না হয়, সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখিতে হইবে।
জন্তু সকল যেরূপ প্রশ্বাস গ্রহণ ও নিশ্বাস ত্যাগ করে, উদ্ভিদগণও সেইরূপ করিয়া থাকে। বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করিতে না পারিলে যেমন আমাদের রোগ হয়, তেমনই উদ্ভিদগণেরও অপকার হয়। এজন্ম বৃক্ষাদি ঘন করিয়া রোপিলে, উহারা রীতিমত বাড়িতে পারে না। ঘন করিয়া রোপণ করিবার আরও দোষ আছে। যে ভূমিখণ্ডে দুইটি মাত্র বৃক্ষের উপযুক্ত খাদ্য থাকে, তাহাতে চারিটি বৃক্ষ রোপণ করিলে, কাহারও প্রচুর আহার হয় না; অতএব তাহায়া সকলেই হয় মরিয়া যায়, নয় অত্যন্ত নিস্তেজ হইয়া পড়ে।
সূর্যের আলোক ও উত্তাপ মনুষ্যের যে পরিমাণে আবশ্যক, উদ্ভিদের তদপেক্ষাও অধিক প্রয়োজনীয়। লাপলও প্রভৃতি শীতপ্রধান দেশে পাঁচ ছয় মাস ধরিয়া সূর্যের আলোক ও উত্তাপের অভাব হয়। এজন্য সে দেশে প্রায় কোন বৃক্ষই জন্মে না; যে দুই এক প্রকার গুম্মাদি দেখা যায়, তাহারা বসন্তের প্রারন্তে জন্মিয়া গ্রীষ্মের শেষেই মরিয়া যায়। বৃক্ষের মূলদেশের ভূমি খনন করিয়া, তাহাতে জলসেচন করিলে মৃত্তিকা সরস হয়। মৃত্তিকা সরস হইলে, বৃক্ষগণ অনায়াসেই রস আকর্ষণ করিয়া পুষ্টিলাভ করিতে পারে। রবিশস্য অর্থাৎ মটর, যব, গম প্রভৃতি বর্ষাকালের পরেই বপন করে। তখন ভূমি সরস থাকে; সুতরাং জলসেচনেয় আর প্রয়োজন হয় না।
যে ভূমিতে শস্তাদির প্রচুর পরিমাণে খাদ্য থাকে, তাহাকে উর্বরা ভূমি বলে। সকল শণ্যের খাদ্য ঠিক একরূপ নহে; কোন্ ক্ষেত্রে কোন্ উদ্ভিদের খাদ্য যথেষ্ট আছে, ইহা বুঝিয়া চাষ করিতে পারিলে, অধিক ফললাভ হয়। এক ভূমিতে বারংবার একই শস্যের চাষ করিলে ক্রমে শক্ষের যে খাদ্য, তাহা ফুরাইয়া যায়। তখন আর সে জমিতে ঐ শল্পের চাষ না করিয়া, অপর কোনও শস্তেব চাষ করা বিধেয়। এজন্ম বিচক্ষণ কৃষকেরা, এক ভূমিতে প্রতিবৎসর নূতন নূতন শস্তের চাষ করিয়া থাকে। ভূমির উর্বরতার হ্রাস হইয়া আসিলে অথবা কোনও ভূমিকে শক্তবিশেষের উপযোগী করিতে হইলে, তাহাতে সার দিতে হয়। পচা গোবর, পচা পাতা, খইল, চুণ ইত্যাদি ভূমির উত্তম সার। বিলাতের ভূমি বঙ্গদেশের ভূমি অপেক্ষা কোনও ক্রমে উর্বরা নহে; অথচ সার দিবার পারিপাট্যে অনেক অধিক শস্য উৎপাদন করিয়া থাকে। নিম্নভূমিতে সার দিবার তত প্রয়োজন হয় না। বর্ষাকালে মৃত্তিকাদি বহন কবিয়া, নানা দিক হইতে ঐ সকল ক্ষেত্রে জল আসিয়া পড়ে। এই জল কিছুকাল স্থিত হইলেই, মৃত্তিকাদি নীচে পড়িয়া যায়, উহাকেই পলি বলে। নদীতে বক্তা হইলে, নিকটবর্তী নিম্নভূমিতে এইরূপ পলি পডে এবং ভূমির উর্বরতা বাড়াইয়া দেয়।
শিল্প-বাণিজ্য-সমাজ
লোকে কৃষিকার্য প্রভৃতি দ্বারা যে সকল বস্তু লাভ কবে, তাহাদিগেব অধিকাংশ নানা উপায়ে ব্যবহারের উপযোগী করিয়া লইতে হয়। কার্পাস কৃষিকর্ম দ্বারা উৎপন্ন হয়, কিন্তু তুলা হইতে সূত্র এবং সূত্র হইতে বস্ত্র প্রস্তুত করিতে, বিশেষ পরিশ্রম ও কৌশল আবশ্যক হইয়া থাকে। লৌহ আকরে জন্মে; কিন্তু লৌহ হইতে ইস্পাত এবং সেই ইস্পাত হইতে ছুরি, কাঁচি প্রভৃতি প্রস্তুত করিতে, পুনর্বার পরিশ্রম ও কৌশল আবশ্যক হয়। এই সকল কার্যকে সচরাচর শিল্পকার্য বলে।
কর্মকার, কুম্ভকার, তন্তুবায় প্রভৃতিকে শিল্পী বল। যায়। উহারা না থাকিলে, আমাদিগের একদিনের জন্যও সুখে বাস করা সুকঠিন হইত। ওস্তবায় না থাকিলে, বস্ত্রাদি মিলিত না; কুস্তকার না থাকিলে, রন্ধনকার্য চলিত না, কর্মকার না থাকিলে, কি কুন্তকার, কি তত্ত্ববায়, কেহই অস্ত্রাদির অভাবে স্ব স্ব শিল্পকার্য চালাইতে পারিত না। এজন্য পৃথিবীর সবস্থানেই, শিল্পীদিগেব যথেষ্ট আদর। যে দেশে শিল্পকর্মের যত উন্নতি, সে দেশ তত সমৃদ্ধিশালী হয়। ইংলণ্ড, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে যে এত ধন ও ঐশ্বর্য, শিল্পকর্মের উন্নতি তাহার একটি প্রধান কারণ।
পূর্বকালে আমাদের দেশে শিল্পকর্মের বিশেষ উন্নতি ছিল। ঢাকাই মলিন বা মলমল নামক একপ্রকার সূক্ষ্ম বস্ত্র যুরোপে দরে বিক্রীত হইত। কটক প্রভৃতি স্থানের স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলঙ্কার, সকল স্থানেই আদৃত হইত। জ্ঞান ও উত্তমের অভাবে, এই সকল শিল্পের লোপ হইয়া আসিতেছে। যাহাতে পুনর্বার উহাদের উন্নতি হয়, তজ্জন্য সর্বপ্রকারে যত্নবান হওয়া উচিত।
কৃষকেরা যে শস্তাদি উৎপাদন করে, এবং শিল্পীরা যে সকল দ্রব্য প্রস্তুত করে, তাহা সকলের হস্তগত হওয়া আবশ্যক। এজন্ত কোনও কোনও লোক, কৃষক ও শিল্পী দিগের নিকট হইতে এই সকল দ্রব্যাদি ক্রয় করিয়া, এক একটি নির্দিষ্ট স্থানে বিক্রয় করিয়া থাকে। ঐ স্থানকে বিপণি বা বাজার কহে; এবং ঐ সকল পোককে বণিক বা ব্যবসায়ী বলিয়া থাকে। কৃষক ও শিল্পী না থাকিলে, যেরূপ দ্রব্যাদি প্রস্তুত হইত না, ব্যবসায়ী না থাকিলে সেইরূপ সকলে সুবিধামত দ্রব্যাদি ক্রয় করিতে পাইত না।
সকল দেশে সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় দ্রব্য জন্মে না, বা প্রস্তুত করিবার সুবিধা হয় না। কোনও কোনও দেশ ধান্তের বিশেষ উপযোগী, তথায় অল্প পরিশ্রমেই অপর্যাপ্ত ধান্ত উৎপন্ন হয়। কোনও কোনও দেশের ভূমিতে তত ধান্ত জন্মে না; কিন্তু কার্পাস চাষ করিলে, যথেষ্ট লাভ হইতে পারে। কোনও কোনও দেশে লবণের খনি আছে; কিন্তু অপর কোনও দ্রব্য ভাল জন্মে না। এই সকল দেশের লোক আপন আপন দ্রব্যাদি বিনিময় করিলে, সকলেই নিজ নিজ আব্যক সামগ্রী লাভ করিয়া, মুখে ও স্বচ্ছন্দে থাকিতে পারে। এইরূপ বিনিময়ের নাম বাণিজ্য।
বাণিজ্যের গুণে লোকের সুথ ও স্বচ্ছন্দতার যে কত বৃদ্ধি হইয়াছে, তাহার ইয়ত্তা করা যায় না। বাঙ্গালা দেশের ভূমি অতিশয় উর্বরা; এখানে থা্যসামগ্রী, অধিবাসী- দ্বিগের যে পরিমাণে আবশ্যক, তদপেক্ষা অধিক জন্মিয়া থাকে। আমরা এই খাণ্ডসামগ্রীর কিয়দংশের বিনিময়ে, কোনও কোনও আব্যক বস্তু অপরাপর দেশ হইতে প্রাপ্ত হই। আঙুর, বেদানা প্রভৃতি ফল কাবুল হইতে আইসে। লবণ, বস্ত্র, নানা- বিধ লৌহনির্মিত যন্ত্র ইত্যাদি বিলাত হইতে, এবং কুইনাইন, কেরোসিন তৈল প্রভৃতি দ্রব্য আমেরিকা হইতে আনীত হয়।
কৃষক, শিল্পী ও বণিক্ এই তিন শ্রেণীর লোকের সাহায্য আমাদিগের নিতান্ত আবশ্যক, সন্দেহ নাই। কিন্তু উহাদিগের দ্বারা কখনই আমাদের অভাবের মোচন হয় না। জ্ঞান ও ধর্মের উপার্জন, রোগের চিকিৎসা প্রভৃতি বিষয়ে অন্তবিধ লোকের সাহায্য লইতে হয়। এইরূপে নানা শ্রেণীর লোক, পরস্পরের সাহায্যে নিযুক্ত রহিয়াছে। এই সমস্ত বিভিন্ন শ্রেণীর লোকের সমাবেশ দ্বারা সমাজ সংগঠিত হয়।
সমাজ না থাকিলে, মনুষ্য কোন বিষয়ে, বিশেষতঃ জ্ঞান ও ধর্মের এতাদৃশ উন্নতি করিতে পারিত না। পশুপক্ষীদিগের সমাজ নাই; সুতরাং তাহাদের কোনও উন্নতি নাই। কেবল আহার অন্বেষণ করিতেই তাহাদের সমস্ত সময় কাটিয়া যায়। কিন্তু সমাজ থাকাতে, মনুয়েরা আহারাদি সংগ্রহ ব্যতীত, জ্ঞান ও ধর্মের উপার্জন করিবারও যথেষ্ট সময় পায়।
সমাজে ভাল মন্দ নানাবিধ লোক বাস করে। একদিকে, জ্ঞানী ও ধার্মিক লোকেরা সুশিক্ষা ও সৎপরামর্শ দ্বারা, সকলকেই সৎপথে লইয়া যাইবার চেষ্টা করেন এবং দরিদ্র ও বিপন্ন ব্যক্তির সাহায্য করিয়া সমাজের সুখবর্ধন করেন। অপরদিকে, চোর, ডাকাইত, প্রবঞ্চক প্রভৃতি দুশ্চরিত্র ব্যক্তিগণ, পরের দ্রব্য অপহরণ করিয়া তাহাদের সর্বনাশ করি- বার চেষ্টা করে। এই সকল লোকের দমন করিতে না পারিলে অল্পকাল মধ্যেই সমাজ বিশৃঙ্খল হইয়া পড়ে। যিনি সকলের উপর কর্তা হইয়া দেশে শান্তিরক্ষা করেন, তাহার নাম রাজা। রাজা, রাজপুরুষগণের সাহায্যে, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করিয়া থাকেন; এবং পিতার ন্যায় সর্বদাই আমাদের দুঃখমোচন করিবার চেষ্টা করেন। অতএব, সকলেরই রাজাকে ভক্তি ও পূজা করা কর্তব্য।
দুরূহ শব্দের অর্থ অণুবীক্ষণ-চক্ষুর অগোচর অতি ক্ষুদ্র বস্তু সকল যে যন্ত্র দ্বারা দেখিতে পাওয়া যায়। দেওয়া। সাধারণতঃ বঙ্গ ও দস্তা গলাইয়া কলাই করা হইয়া থাকে। পদ্মরাগ- লোহিতবর্ণের মণি। প্রস্রবণ-নির্ঝ'র, ঝরণা, পর্বতের উপরিভাগ হইতে যে জল নিম্নে পতিত হয়।
অভিজ্ঞতা-অনেক দেখিয়া শুনিয়া যে জ্ঞান জন্মে।
অম্লীল-কুৎসিৎ, ঘৃণাকর, লজ্জাজনক।
কপিশ - মেটিয়া।
কলাই-কোনও ধাতু গলাইয়া অন্য কোনও ধাতুনির্মিত পাত্র প্রভৃতিতে মাখাইয়া
ধূমল-বেগুনিয়া।
ধূসর-পাঁশুটিয়া।
নীলকান্ত- নীলবর্ণের মণি।
পটহু-ঢাক।
পাটল-পাটকিলে।
পিঙ্গল-পীতের আভাযুক্ত গাঢ় নীল।
মরকত- হরিদ্বর্ণের মণি।
মসৃণ-যাহার উপরিভাগ এমন সমান যে স্পর্শ করিলে কোনও মতে উচ্চনীচ বোধ
হয় না।
মস্তিষ্ক-মস্তকের ভিতর ঘুতের মত যে কোমল বস্তু থাকে। ইদানীন্তন য়ুরোপীয়
পণ্ডিতেরা মস্তিষ্ককে মন ও বুদ্ধির স্থান বলেন।
মেরু-পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তষয়। এই দুই স্থান অত্যন্ত হিমপ্রধান; এজন্ম
তথায় দ্রব দ্রব্য জমিয়া যায়।
লোহিত-লাল।
ভায়লেট-ঈষৎ লালের আভাযুক্ত গাঢ় নীল।
বিনিময়-বঙ্গল।
বিনিয়োগ-প্রয়োগ, কোনও বিষয়ে নিয়োজিতকরণ।
সাল ও হিজিরা-হিজিরার ৯৬৩ অব্দে সম্রাট, আকবর ঐ শাককে ইলাহী নামে প্রবর্তিত করেন। হিজিরার বৎসর চান্দ্রমাস অনুসারে পরিগণিত, ইলাহীর বৎসর সৌরমাস অনুসারে পরিগণিত। চান্দ্রমাস অনুসারে পরিগণিত বৎসর ৩৫৪ দিন, ২১ দণ্ড, ৩৫ পলে, হয়। ইলাহীর প্রবর্তনের সময় হইতে চান্দ্রমাসের অনুযায়ী গণনা অনুসারে ৩৫৫ বৎসর, আর সৌরমাসের অনুসারে ৩৪৫ বৎসর হইয়াছে। সুতরাং, এক্ষণে হিজিরার অব্দ ১৩৩১; ইলাহীর অব্দ ১৩১৯। সাল ইলাহীর নামান্তর মাত্র। স্নায়ু-সর্বশরীরে সঞ্চারিত সূত্রবৎ পদার্থসমূহ। মস্তিষ্কের সহিত এই সকল পদার্থের যোগ আছে। এইজন্য কোনও বস্তু ইন্দ্রিয়গোচর হইলে তদ্বিষয়ক জ্ঞান জন্মে।- হরিত-সবুজ।
হোরা-ইংরেজী এক ঘণ্টা, আড়াই দণ্ড কাল।