shabd-logo

ভূমিকা

27 December 2023

0 Viewed 0

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশ এমন কয়েকটি বিদ্যুৎ-গর্ভ ব্যক্তিকে সৃষ্টি করেছিল যাদের আশীর্বাদের পুণ্যফল এখনও আমরা ভোগ করছি। প্রাগাধুনিক যুগের গৌড়বঙ্গে বিচিত্র প্রতিভাধর ব্যক্তির যে আবির্ভাব হয় নি, তা নয়। কিন্তু একই শতাব্দীতে সমগ্র দেশের মানস-আকাশ এভাবে আর কোন দিন ফলবান সম্ভাবনায় পূর্ণ হয়ে ওঠে নি। মধ্যযুগের বহ্নিকুণ্ড জালিয়ে পুরাতন বাঙালী-সংস্কৃতির ফিনিক্স, পাখী আত্মবিসর্জন দেবার সঙ্গে সঙ্গে জাতবেদার দীপ্তি ও দাহ নিয়ে বিশ্বাকাশসঞ্চারী যে সমস্ত মহাগরুড়ের জন্ম হল, তাঁদের মধ্যে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র ও বিবেকানন্দের নাম আজ বাঙালীজীবনের পাতিত্যমোচনের বীজমন্ত্ররূপে পরিগণিত হয়েছে। এঁদের মধ্যে আবার বিদ্যাসাগর নিঃসঙ্গ দেবক্রমের মতো বিশাল প্রান্তরে একাকী দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হয়, নিরাভরণ গিরিশৃঙ্গের মতো নিঃসঙ্গতাই তাঁর শোভা। বস্তুতঃ অন্যকালে হলে তাঁকে আমরা বিধাতার দুর্জেয় পরিহাস বলেই মনে করতাম। যে বাংলাদেশের সমতলভূমিবাসী এরগুসভা থেকে পাহাড় বহু দূরে পলাতক, সমুদ্রও অদৃশ্যপ্রায়, সেখানে কি করে নগাধিরাজের উচ্চতা এবং সমুদ্রের বিশালতা একটি ব্যক্তি- চরিত্রকে আশ্রয় করতে পারে, এ এক সমস্তার বিষয়।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) এমন একটি বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব, যা আজকের দিনে প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ সেই বিস্ময়কে ব্যক্ত করে বলেছেন, "মাঝে মাঝে বিধাতার নিয়মের এরূপ আশ্চর্য ব্যতিক্রম হয় কেন, বিশ্বকর্মা যেখানে চার কোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন সেখানে হঠাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বলা কঠিন।" বিধাতার সেই আশ্চর্য ব্যতিক্রম এই খর্বদেহ ও ক্ষীণতন্ত ব্যক্তিটি একই সঙ্গে এত প্রেম, এত করুণা, এত জ্ঞান, এত বীর্য-এত মহৎ মনুষ্যত্বের অরুপণ আশীর্বাদ কোথা থেকে পেলেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। তাই আজ তিনি পুণ্যশ্লোক, অদীনপুণ্য; তাই আজ তাঁর জীবনকথা বাংলার ঘরে ঘরে প্রবাদে পরিণত হয়েছে। “দগ্ধাস্থিপঞ্জরময় ভারতের এই মহাশ্মশানে এই মৃত জাতির শস্রদেতে নৃতন জীবন সঞ্চার করিবে কে?" আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর প্রশ্ন করেছিলেন। জীবন সঞ্চার করবে বিদ্যাসাগরের চরিত্রাদর্শ, সংস্কারমুক্ত নিমোহ দৃষ্টি, আত্মপ্রত্যয়সিদ্ধ যুক্তি ও মানবপ্রেম। তাঁর বিশাল, বিচিত্র, কর্মব্যাকুল জীবনকথা আমাদের বর্তমান আলোচনার উদ্দেশ্য নয়। তাঁর গ্রন্থ ও অন্যান্য রচনা এবং বাংলাভাষা ও বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর রচনার যে সম্পর্ক, সেই প্রসঙ্গেই এখানে দু-চার কথার অবতারণা করা যাচ্ছে।

২. একদা বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হত। কেউ কেউ সে গৌরব রামমোহনকে দিতে চাইতেন; যিনি এ বিষয়ের অনুসন্ধানে আর একটু অগ্রসর হয়েছেন, তিনি আরও কিছু পিছিয়ে গিয়ে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিত-মুন্সী এবং তাঁদের সঞ্চালক উইলিয়ম কেরীকেই সে গৌরবের অংশভাগী করতে চাইতেন। কিন্তু একটু সতর্ক হয়ে ভেবে দেখলেই এ বিষয়ে অনেক ভুল ধারণার নিরসন হবে। একথা অবশ্যই সত্য যে, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিত-মুন্সী, রামমোহন বা বিদ্যাসাগর- কেউ-ই বাংলা গদ্য সৃষ্টি করেন নি। উনিশ শতকের গোডা থেকেই ফোর্ট উইলিযম কলেজে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের বাংলা ভাষা শেখাবার জন্য কয়েকখানি গদ্যনিবন্ধ ও কাহিনী-সংক্রান্ত পুস্তিকা রচিত ও প্রকাশিত হয়েছিল- একথা সত্য বটে, এবং এর আগে বাংলা গদ্যে লেখা কোন কাহিনী-বিষয়ক পুস্তিকা রচিত হয় নি, প্রবন্ধ গ্রন্থও রচিত হয় নি। কিন্তু পর্বত-গহবরবন্দী জলকুণ্ডেরও উৎস আছে; ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পূর্বেও বাংলা গদ্যের নিদর্শন পাওয়া গেছে। খ্রীষ্টীয় ষোডশ শতাব্দী থেকে বাংলা গদ্যে লেখা চিঠিপত্র পাওয়া যাচ্ছে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতেও চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, মনুয়া-ক্রযবিক্রয়পত্র, চুক্তিপত্র, বিবাদ-মীমাংসা এবং সহজিযা বৈষ্ণবদের পুঁথিপত্রে বাংলা গদ্যের যে ব্যবহার দেখা যাচ্ছে তা যেমন পরিচ্ছন্ন, তেমনি সরল। তার অন্বয়ও পুরো সাধুভাষার রীতি অনুসরণ করেছে। অবশ্য একথা ঠিক যে প্রাগাধুনিক যুগে চিঠিপত্রের মতো নিতান্ত 'কেজে।' ব্যাপারে বাংলা গদ্যের ব্যবহার থাকলেও সাহিত্যকর্মে গদ্যের প্রয়োগ হত না। শুধু কাব্য সমাপ্তিতে পুষ্পিকায় পুঁথি রচনা বা নকলের সংবাদাদি গ্যেই দেখা হত। যথা- "লিখিতং শ্রী পিতমলাল শুকুল। সাকিম সামপুর পরগণে জাহানাবাদ। পঠানার্থে এরঘুনাথ ভকত সাং বদনগঞ্জ পরগণে জাহানাবাদ। সন ১২৪০ বার শত চল্লিশ সাল তারিখ ২৮ আঠাশ্যা কার্তিক রোজ মঙ্গলবার বেলা তিন প্রহরের সমএ সমাপ্ত হইল।"১

মধ্যযুগে গ্যাত্মক ব্যাপারেও পয়ার-ত্রিপদী ছন্দ ব্যবহৃত হত। আজকাল হলে মঙ্গল- কাব্য গছ্যেই লেখা হত। 'শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত,-এর রষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী তার বিখ্যাত গ্রন্থের অনেকটা গদ্যে লিখলে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। কিন্তু সে যুগের লেখকেরা ব্যবহারিক কর্মে গদ্যের ব্যবহার জানলেও সাহিত্যকর্মে কেন গদ্যের ব্যবহার করেন নি, তার কারণ অনুমান করা যেতে পারে।

সে যুগের বাংলা সাহিত্য প্রধানতঃ ছিল গীতাত্মক ও আবৃত্তিমূলক। সব কাব্যই হয় গান করা হত, আর না হয় শুর করে পাঁচালীর ঢঙে আবৃত্তি করা হত। উপরন্তু দেবলীলা বা দেবপ্রভাবিত মর্ত্যলীলাই ছিল কাব্যরচনার প্রধান motif; সে ক্ষেত্রে ছন্দোবদ্ধ বাক্‌নির্মিতিই ছিল প্রশস্ত। উপবস্তু চৌদ্দ মাত্রার পয়ার ছন্দটি অতিশয় স্থিতি- স্থাপক-এতে গন্ধ্যাত্মক কাজও দিব্যি চলে যায়। বোধ হয় এই জন্য সাহিত্যকর্মে বাংলা গদ্যের ব্যবহার হতে বিলম্ব হয়েছিল। তবে এই গদ্যরীতির মূলে এই প্রভাবগুলি কার্যকরী হয়েছিল বলে মনে হয় সংস্কৃত গদ্যরীতির, কথক ঠাকুরদের বচনবিদ্যাস এবং সরল পয়ারের বিলম্বিত তাল। কালক্রমে পয়ারছন্দের লয় বর্ধিত হয় এবং অন্ত্যাম্বুপ্রাস উঠে গিয়ে মুখের কথার প্রভাবে গদ্যরীতির উদ্ভব হয়। অবশ্য প্রাচীন গংলা গদ্যের চাদটি বিশুদ্ধ সাধুভাষার ছাদ হলেও মুখের কথার বিন্যাসপদ্ধতি যে গ্যরীতিকে প্রভাবিত করবে তাতে আর আশ্চর্য কি! গদ ধাতুর তো মানেই হল কথা বলা। কিন্তু প্রাচীন বাংলায় পয়ার-ত্রিপদীর মূল ছাদটি যেমন প্রায়শই সাধুরীতিকে অনুসরণ করেছে, তেমনি খুব পুরনো কাল থেকেই রাংলা গদ্যে সাধুরীতি অনুসৃত হয়ে আসছে। অনেকের ধারণা, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতের দলই বাংলা গদ্যের কৃত্রিম সাধু- রীতি তৈরী করেছিলেন। একথা যে ঠিক নয়, তার প্রমাণ প্রাগাধুনিক পর্বের এই গদ্য পত্রগুলি:

১. "এথা আমার কুশল। তোমার কুশল নিবস্তরে বাঞ্ছা করি। অখন তোমার-আমার সন্তোষ-সম্পাদক পত্রাপত্রি গতায়াত হইলে উভয়া- হুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে।" (১৪৭৭ শকাব্দে অর্থাৎ ১৫৫৫ খৃঃ অব্দে কুচবিহার রাজের অহোমরাজকে লেখা পত্রাংশ)। ২. "অতঃপর তারা প্রভৃতি দেবদারা সকল শিবের তরে প্রহেলিক। প্রবন্ধে গৌরীকে সমর্পণ করিয়া কথোপকাল পালন করি বা হবেক ইঙ্গিত করিতেছেন অবধান করহ।" (সপ্তদশ শতাব্দীর কবি রামকৃষ্ণ রায়ের শিবায়ন, এতে মাঝে মাঝে দু'চার ছত্র গদ্য আছে)।

২. 'সাহিত্যদর্পণে' গম্ভের সংজ্ঞা-"বৃত্তগন্ধোঞ্চিতং গদ্মস্"- অর্থাৎ ছন্দোলেশবর্জিত পঙক্তিকে গম্ভ বলে। দণ্ডী 'কাব্যাদশে' বলেছেন, "অপাদঃ পদসম্ভানো গাম্"-যাতে চতুষ্পদীবং পদাবিভাগ নেই তাকে গদ্ম বলে।

৩. দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত-বঙ্গসাহিত্য-পরিচয়, ২য়, পৃ. ১৬৭২।

৪. দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ও আশুতোষ ভট্টাচার্য সম্পাদিত রামকৃষ্ণ কবিচন্দ্র রচিত 'শিবায়ন', পৃ. ১৪৬।

৩. "আপনে আমার জ্ঞানদাতা শ্রীগুরু আপনি আমার জ্ঞান জন্মাইয়াছেন কিনা তাহার বুঝিবার কারণ আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন তাহাতে আপনি আমাকে যে প্রকার জ্ঞান জন্মাইয়াছেন তাহাতে আমি যে প্রকার বুঝিয়াছি তেমত কহিলাম।"৫ (১১৫৮ বঙ্গাব্দ বা ১৭৫০ খৃঃ অব্দে নবা করা 'জ্ঞানাদি সাধনা' শীর্ষক সহজিয়া গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত)।

৪. "আমরা স্বকীয়ার দস্তখত বিনা বিচারে পারিব না আমরা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূব মতাবলম্বী অতএব বিচারে যে ধর্ম স্থায়ী হয় তাহাই লইবে এই মত করার হইল বিচার মানিলাম তাহাতে পাতসাই শুভা শ্রীযুত নবাব জাফর খাঁ সাহেব নিকট দরখাস্ত হইল তি"হো কহিলেন ধর্মাধর্ম বিনা তজবিজ্ঞ হয় না অতএব বিচার কবুল করিলেন।" (১২০৫ বঙ্গাব্দে বা ১৭১৭ খৃঃ অব্দে প্রস্তুত বৈষ্ণব পরকীয়া মত স্থাপনের দলিল)

৫. "সবিশেষ পত্রার্থে জ্ঞাত হইবে ১১ মাঘ রটন্তি চতুর্দশীতে শ্রীশ্রী দুই প্রতিমার স্থাপনা করাইবে তাহার পরে শ্রীযুত দীননাথ রায়কে এখা পাঠাইবে। ফিতরত আলি খাঁ এথা পহু চে নাঞি দাখিল হইলে। 'তাহার চলন মাফিক ব্যবহার হবেক শ্রীযুত মেস্তর মেদলটীন সাহেবকে জে খত এ পত্রের মধ্যে পাঠাইতেছি তাহাতে গোন্ধ না দিয়া মহুর করিধা পাঠাইলাম পাঠ করিয়া গোন্ধ দিয়া বন্ধ করিয়া তাঁহাকে দিয়া তথাকার রোয়দাদ লিখিবা আপনার মঙ্গলবার্তা লিখিয়া স্থির রাখিবা।" (১১৭৮ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৭৭২ খৃঃ অব্দে পুত্র গুরুদাসকে লেখা মহারাজ নন্দকুমারের চিঠি)।

এই উদ্ধৃ তি থেকে দেখা যাবে, ষোডশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত যে সমস্ত গদ্যের দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে তার সাহিত্যগুণ ধর্তব্যের মধ্যে না হলেও এর অন্বয়বিন্যাস ও বাচনবীতি মোটামুটি সাধুভাষাকেই অনুসরণ করেছে। অবশ্য সপ্তদশ শতাব্দী থেকে চিঠিপত্র, ক্রয়বিক্রয়, দলিলদস্তাবেজ-সংক্রান্ত গদ্য রচনাগুলিতে সে যুগের রেওয়াজ মতো অজস্র ফারসী-আরবী শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। হলহেড, তাঁর The Grammar of the Bengal Language-এ জগতধির রায়ের যে চিঠিখানিকে বাংলা গদ্যের দৃষ্টান্তস্বরূপ উপস্থাপিত করেছেন তাতে ইসলামি শব্দের প্রাচুর্য লক্ষণীয়। সুতরাং সাধারণ কাজকর্মে ও আদালতের বাংলায় কতটা আরবী-ফারসীর প্রভাব ছিল তা সহজেই অনুমান করতে পারা যায়। এখনও কি ধর্মাধিকরণের প্রাঙ্গণ থেকে সেমেটিক ভাষায় অকারণ প্রাচুর্য উঠে গেছে? সে যাই হোক, শাসনকার্য ও আইন- আদালতের প্রয়োজনেই সে যুগের গদ্যে এত আরবী-ফারসীর ছড়াছড়ি ঘটেছিল এমন কি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের রামরাম বসুর 'রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্রে' (১৮০১'- ও ইসলামি শব্দের বাড়াবাড়ি হান্তকর হয়ে পড়েছিল। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের আর এক বিখ্যাত অধ্যাপক ও পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার অসাধারণ ভাষাকুশলী হলেও তাঁর 'রাজাবলি--ত' (১৮০৮) মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস বর্ণনায় প্রচুর ইসলামি শব্দ (যথা-জিম্বা, কিল্লা, দখল, জবান, দমা, ওগররহ, তক্ত, তমসুক, জলুস, মোক্তিয়ার, সলাই, সিক্কা, খোতবা, জিন্নতুল, বিলায়েই, বিরাদরি, দরমাদি, চুগল, খেদমত, গুজারি ইত্যাদি) ব্যবহারে রূপণতা করেন নি। ১৭৮৮ সালে টমাস বাইবেলের যে সামান্য অনুবাদ করেছিলেন তাতেও ইসলামি শব্দ স্থান পেয়েছিল। যথা-"খোদার মাহিনা মিতু কিন্তু খোদার চিরকালই জিছছ, ক্রাইষ্ট হইতে।" কিন্তু কেরী ও হলহেড বাংলা ভাষায় আরবী-ফারসী শব্দের বাড়াবাড়ি আদৌ পছন্দ করতেন না। বোধ হয় কেরীর নির্দেশেই রামরাম বসু তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ 'লিপিমালা'র (১৮০২) ভাষা থেকে ইসলামি শব্দের বহর একেবারে কমিয়ে দেন। কেরীর বাইবেল অনুবাদের ভাষাভঙ্গিমা অনভ্যস্ত ও কুত্রিম হলেও তিনি সাধুভাষার ওপর ভিত্তি করেই বাইবেল অনুবাদে অগ্রসর হয়েছিলেন। এখানে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রচিত বলে গৃহীত একটু পরিচ্ছন্ন গণ্যের নমুনা উদ্ধৃতা হচ্ছে:

বিক্রমাদিত্য কহিতে লাগিল। কন্তার খাটের সঙ্গে কথা কহিতে- ছিলাম। কল্লা তাহা গোষা করিয়া ফিরিয়া দিলেন। এ ঘরে আর কেহ আছহ। তালবিতাল উত্তর দিলেক। কেনে। মহারাজ। পরে রাজা কহিলেন। কে তুমি। তালবিতাল কহিলেক। আমি রাজকন্যার পরিধেয় বস্তু・・・বল শুনি কন্যার কাপড। সে কন্যা কে পাইবে। তালবিতাল কহিলেক। যে ফিরা ঘরে গিয়াছে সেই পাইবেক। কল্লা একথা শুনিয়া কাপড় ফেলিতে পারেন না।

হাসিয়া উঠিলেন। কথা কহিলেন।" এখানে দেখা যাচ্ছে তালবেতালের গল্পে যেমন পরিহাসরস জমেছে, তেমনি সাধু ভাষার ছাদটিও প্রায় আধুনিক কালের মতোই মনে হচ্ছে।

৩.

উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা গন্ধের বিবর্তনে দেখা যাচ্ছে, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিত-মুন্সীরা স্বয়ং রামমোহন এবং 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' (১৮৪৩) প্রকাশের পূর্ববর্তী সাময়িক পত্রে বাংলা গদ্যের অনভ্যস্ত জড়তা অনেকটা হ্রাস পেতে থাকে। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিত-মুন্সীদের অনেকেরই ভাষার জড়তা ঘোচে নি, কারও অন্বয় ঠিক হয় নি। এঁদের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়ের গদ্যভাষায় বেশ দক্ষতা ছিল; তিনি নানা ধরনের গদ্যরীতি নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন; গুরুগম্ভীর সংস্কৃতগন্ধী সাধুভাষা, পরিচ্ছন্ন সরল সাধুভাষা এবং ভদ্রেতর সমাজের সংলাপ থেকে পাওয়া 'স্ল্যাং' ধরনের কথ্যভাষা-প্রতিটি বিভাগেই তিনি অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর 'প্রবোধ- চন্দ্রিকায়' (আনুমানিক ১৮১৩ সালে রচিত, ১৮৩৩ সালে প্রকাশিত) কিছু কিছু উৎকট পঙক্তি আছে বলে কেউ কেউ মনে করেন, কটমট ধরনের দুর্বোধ্য গদ্য লিখতেই তিনি অভ্যন্ত ছিলেন। ১০ কিন্তু একথা সত্য নয়। 'প্রবোধচন্দ্রিকায়' নানা ধরনের গদ্যবীতির উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি সংস্কৃত শ্লোকের মূলানুগ অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর নিজের ভাষা অনেক সহজ অথচ ক্লাসিক গাম্ভীর্যপূর্ণ। পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর এই রীতিটিকে মাজিত করে যাবতীয় মননকর্মের বাহন করে তুলেছিলেন। ভাষাশিল্পী হিসেবে মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের কিছু সাদৃশ্য আছে। লৌকিক বাগ বিন্যাসের রীতি মৃত্যুঞ্জয় কতটা সাফল্য ও ঔদার্যের সঙ্গে অনুসরণ করেছিলেন, এখানে তাব একটু দৃষ্টান্ত দেওয়া যাচ্ছে।

"ইহা দেখিয়া গতিক্রিয়া কহিল খাও এখন পিঠা খাও যেমন মতি তেমনি গতি। অনন্তর তৎপতি গালে হাত দিয়া অধোমুখ হইয়া

৯. সাহিত্য-পবিষৎ পত্রিকা, ২৯শ ভাগ ('ব্রিটিশ মিউজিয়মের কাগজপত্র'-ডঃ গুনীতিকুমার চট্টোপধ্যায়)। ১০. রামগতি স্কাররত্ব এবং দীনেশচন্দ্র মৃত্যুঞ্জয়ের একছত্র তুলে তাঁকে নিন্দা করেছেন। সেটি হল এই -"কোকিল কূল-কলালাপ-বাচাল যে মলয়াচল। নিল যে উচ্ছলন্দ্বী করাতাচ্ছ নিস্ত'রাস্তঃ কণ। চ্ছন্ন হইয়া আসিতেছে।" (এ. রঞ্জন পাবলিশিং হাউস প্রকাশিত 'মৃত্যুঞ্জয়-গ্রন্থাবলী', পৃ. ১৪৪) এটি কিন্তু তাঁর মৌলিক রচনা নয়। একটি সংস্কৃত শ্লোকের অনুবাদ। 'বৈষম্য দোষরহিত' এবং সাম্যগুণবৎ বাক্যে'র উদাহরণ হিসেবে তিনি এই পঙক্তিটি উদ্ধৃত করেছেন।

কিঞ্চিৎ কাল থাকিয়া কহিল যা যা তুই আর পোড়ানে যার যেমন কপাল তার তেমনি সকলি মিলে। কিন্তু যা হউক বেটা ভাল বটে, আমি বিশ্ববঞ্চক আমাকেও বঞ্চনা করিল বাপের বেটা বটে। এ ব্যক্তি যেখানে থাকুক সেখানে গিয়া তাহাকে খুঁজিয়া তাহার সঙ্গে বন্ধুয়ালি করিতে হইল।১১

উইলিয়ম কেরীও এই ধরনের চতি বুলিব সহায়তায় 'কথোপকথন' (ইংরাজী আখ্যা-Dialogues, intended to facilitate the acquiring of the Bengalee Language-1801) লিখেছিলেন ।১২ এ ভাষার কাঠামো সাধুভাষার হলেও এতে সংলাপের বাক্বীতিটি অনুস্বত হয়েছে:

১ মা-গুলো তোর ভাতার কারে কেমন ভালবাসে তাহা বল শুনি।

২ য়া-আহা তাহাব কথা কহ কেন এখন আর আমাদের কি আদর তাছে। নূতনের দিকে মন ব্যতিরেকে পুরাণের দিগে কে চাহে। ১মা-তাহা হউক। তুই সকলেব বড় তোর ছাল্যপিলা হইয়াছে। ১য়া-কালিকে ভাই দুপরলো কচি লাগালে মাঝ্যবিটি তাহা

কি বলিব।

১মা-কি জন্য কচকচি হইল।

২য়া-দূব কব ভাই। তাহা কহিলে আর কি হবে লোকে শুনিলে

মন্দ বলিবে। আমার বাড়ী ভরা শত্রু এই জন্য ভয় করি ।১০

বাজা রামমোহন রায়কে (১৭৭৪-১৮৩৩) বাংল। গদ্যের একজন প্রধান লেখক বলা হয়ে থাকে। বলতে গেলে তিনি বাঙালীকে হাতে ধরে বাংলা গদ্য লিপতে পড়তে শিখিয়েছেন ।১৪ তাঁর আগে কেরী এবং তাঁর অনুচরবর্গ বাংলা গদ্যকে সাহিত্যকর্মে ব্যবহার করলেও মননশীল ও বিতর্কের বিষয়কে গদ্যের যুক্তিবন্ধের মধ্যে আনবার প্রথম গৌবব বামমোহনের প্রাপ্য অবশ্য তাঁব গদ্যকে ঠিক সাহিত্য-গুণোপেত ভাষা বলা যায় না। প্রমথ চৌধুরী তাঁর গদ্যরীতি সম্বন্ধে বলেছেন, "এ গদ্য, আমরা যাহাকে modern prose বলি, তাহা নয়। পদে পদে পূর্বপক্ষকে প্রদক্ষিণ করিয়া অগ্রসর হওয়া আধুনিক গদ্যের প্রকৃতি নয়। "১৫ নৈয়ায়িক বাংলার উত্তর সাধক রামমোহনের ভাষা হয় অধিকাংশ স্থলে বিতর্কের ভাষা হয়েছে, নয়তো "সংস্কৃত শাস্ত্রের ভাষ্যকারদিগের রচনা পদ্ধতি অনুসরণে" (প্রমথ চৌধুরী) পর্যবসিত হয়েছে। তাঁর মতো অমিতবলশালী জ্ঞানযোদ্ধা ও অতন্দ্র কর্মযোগী বাংলা গদ্যের শিল্পরূপ দিতে পারেন নি, বড়ই আক্ষেপের বিষয়। অবশ্য কয়েক স্থলে তিনি অতি চমৎকার সরল গদ্য লিখেছিলেন। তাঁর 'পাদরি ও শিষ্য সম্বাদ'-এর (১৮২৩) তীক্ষ্ণ পরিহাস ছেড়ে দিলেও এর বাগ ভঙ্গিমার লঘু ধরন বাস্তবিক প্রশংসার যোগ্য। অতি সহজ, পরিচ্ছন্ন সরস গদ্য লেখার সামর্থ্যও যে তাঁর প্রচুর ছিল তা এই দৃষ্টান্ত থেকেই প্রতিভাত হবে:

"বিবাহের সময় স্ত্রীকে অর্ধ অঙ্গ করিয়া স্বীকার করেন, কিন্তু ব্যবহারের সময় পশু হইতে নাঁচ জানিয়া ব্যবহার করেন। যেহেতু স্বামীর গৃহে প্রায় সকল পত্নী দাশুবৃত্তি করে・・・・・・স্ত্রীলোক সকল গোসেবাদি কর্ম করেন, এবং পাকাদির নিমিত্ত গোময়ের ঘসি স্বহস্তে দেন, বৈকালে পুষ্করিণী অথবা নদী হইতে জলাহরণ করেন, রাত্রিতে শয্যাদি করা যাহা ভৃত্যের কর্ম, তাহাও করেন, মধ্যে মধ্যে কোনো কর্মে কিঞ্চিৎ ত্রুটি হইলে তিরস্কার প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। দুঃখ এই, যে এই পর্যন্ত অধীন ও নানা দুঃখে দুঃখিনী, তাহারদিগকে প্রত্যক্ষ দেখিয়াও কিঞ্চিৎ দয়া আপনকারদের উপস্থিত হয় না, যাহাতে বন্ধন পূর্বক দাহ করা হইতে রক্ষা পায়।”১৬ ('প্রবর্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ')

১৮৪৭ সালে বিদ্যাসাগরের 'বেতাল পঞ্চবিংশতি' প্রকাশিত হলে সাহিত্য-রসসিক্ত গদ্যের প্রথম প্রতিষ্ঠা হল। রামমোহন বাংলা গদ্যকে সর্ববিধ মননকর্মের বাহন করে তুললেও তাতে রসঙ্গষ্টির অবকাশ ছিল না, যদিও তাতে বিচার-বিতর্ক খুব ভালো- ভাবেই সমাধা হতে পারে।১৭ দেখা গেছে রামমোহনের সমকালেই অনেকের লেখাতেই সাধু ছাদের পরিচ্ছন্ন রূপটি ক্রমেই একটা বিশিষ্ট রীতিরূপে ফুটে উঠেছিল। এখানে আমরা রামমোহনের সমকালীন কয়েকজন লেখকের রচনার যৎসামান্য দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করে সে কথার প্রমাণ দেবার চেষ্টা করব।

১. "এই সকল কথা শুনিয়া হাসিও পায় দুঃখও হয়। ভাল, জিজ্ঞাসা করি যদি এই সকল গহিত কৰ্ম্ম করিলেই লোক ব্রহ্মজ্ঞানী হয়, তবে হাড়ি ডোম চাড়াল ও মুচি ইহারা কি অপরাধ করিয়াছে, ইহারদিগকেও কেন ব্রহ্মজ্ঞানী না কহা যায়, তাহারা ভাক্ত তত্বজ্ঞানী মহাশয়সকল হইতেও এই সকল কল্মে এবং অধিকই হইবেক, ন্যূন কোন মতেই হইবেক না..."।১৮ (রামমোহনের প্রতিযোগী কাশীনাথ তর্কপঞ্চাননের 'পাষণ্ড পীড়ন'- ১৮২৩ খৃঃ অব্দে প্রকাশিত)

২. "তালধ্বজ পুরীতে বিক্রম নামে রাজার পুত্র মাধব এক দিবস স্যৈ- ' সামস্ত সহিত যুগ মারিতে কোন মহাবনে গিয়া সৈন্যসামন্ত বাখিয়া ঘোডায় চডিয়া অতিীিঘ্র মৃগেব পাছে পাছে গিয়া আপন সেনাগণের অদৃষ্ট হইলেন। অতি নির্জন বনে যুগের অন্বেষণে প্রবেশ করিয়া ইতস্তত ভ্রমণ করিতে করিতে দেখিলেন, সে বনে চন্দ্রকলার ম৩ চন্দ্রকলা নামে পরমাসুন্দরী ষোড়শ বর্ষীয়া এক কল্লা জল লইতে সরোবরে যাইতেছে। "১৯ (গৌরমোহন বিদ্যালম্বাবের 'স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক'-১৮২৪) ৩. "বহু অন্বেসণ করিয়া যশোহরনিপাসী এক মুনসী সমভিব্যাহারে লইয়া আগমন করিলেন। কর্তা কহেন শুন মুনসী আমার সন্তান- দিগকে পারসী পড়াইবা এবং বহিষ্কারে থাকিবা। সে দিবস বাবুরা কোন স্থানে নিমন্ত্রণে সাদাকঢ় হইয়া গমন করিবেন সঙ্গে সাইবা। মায় খোরাকি তিনটঙ্কা পাইবা।" (১৮২৩ সালে রচিত ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে প্রমথনাথ শর্মার 'নববাবুবিলাস' থেকে উদ্ধৃত।) ৪. "কথক মাস হইল শ্রীরামপুরের ছাপাখানা হইতে এক ক্ষুদ্র পুস্তক

অনায়াসেই হৃদয়ঙ্গম করিতেন, কিন্তু সে লেখায শব্দের বিশেষ পরিপাট্য ও তাদৃশ মিষ্টতা ছিল না।" সংবাদ প্রভাকব, ১৮৪৪, ১৩ই মার্চ, (ব্রচেষ্ণনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়েব বাংলা সাময়িক পত্র' (পৃ. ৫১) থেকে উদ্ধৃত।)

প্রকাশ হইয়াছিল ও সেই পুস্তক মাস মাস ছাপাইবার কল্পও ছিল তাহার অভিপ্রায় এই যে এতদ্দেশীয় লোকেরদের নিকটে সকল প্রকার বিদ্যা প্রকাশ হয় কিন্তু সে পুস্তকে সকলের সম্মতি হইল ন এই প্রযুক্ত যদি সে পুস্তক মাস মাস ছাপা যাইত তবে কাহারো উপকার হইত না অতএব তাহার পরিবর্তে এই সমাচারের পত্র ছাপাইতে আরম্ভ করা গিয়াছে। ইহার নাম সমাচার দর্পণ। ২ -(১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত 'সমাচার দর্পণে'র প্রথম সংখ্যা)

৫. এতদ্দেশীয় বিশিষ্ট বংশোদ্ভব অনেক মহাশয়েরা লোকের প্রপঞ্চ বাক্যেতে প্রতাবিত হইতেছেন তাহাতে তাঁহারদিগের কোনরূপেই ভাল হইবার সম্ভাবনা না দেখিযা খেদিত হইয়া বিবেচনা করিলাম যে নানা দেশ প্রচলিত বেদবেদান্ত মনুমিতাক্ষরা প্রভৃতি গ্রন্থের আলোচনা দ্বারা তাঁহাদিগের ভ্রান্তি দূর কবিতে চেষ্টা করিব।”২১

(১৮৩১ সালে প্রকাশিত 'জ্ঞানান্বেষণ' পত্রের প্রথম সংখ্যা) ৬. "মহাত্মা শ্রীণুক্ত বাজা রামমোহন রায় কর্তৃক ব্রহ্মজ্ঞান বিষয়ে যে সকল গ্রন্থ প্রস্তুত হইয়াছিল তাহা এইক্ষণে সাধারণের অপ্রাপ্ত হইয়াছে এবং অনেকে তাহার মর্ম্ম জানিতে বাসনা কবেন। অতএব সেই সকল গ্রন্থ এবং অন্য যে কোন গ্রন্থ, যাহাতে ব্রহ্মজ্ঞানের প্রসঙ্গ আছে তাহা এই পত্রিকাতে উদ্ধ, ত হইবে।”২২ (১১৬৫ শকে ১লা ভাদ্র প্রকাশিত 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'র প্রথম সংখ্যা)

৭. "পাবি যুববাজ হইয়াও গোরক্ষক ছিলেন, এবং সেই পৰ্ব্বতে আপন পিতার পশুগণ চরাইতেছিলেন। তিনি সেই স্তানে ঐ তিন দেবী কর্তৃক সৌন্দর্যের বিষষ জিজ্ঞাসিত হইয়া কিঞ্চিৎ কাল চিন্তা করিযা বলিলেন যে, বিনস দেবী অতি সুন্দরী; তাহাতে ঘুনো ও মিনবা এই উভয় দেবী বড় বিমর্ষা হইয়া ও ক্রোধ করিযা তাঁহাকে ও তাঁহার প্রাচীন পিতাকে শান্তি করিতে উদ্যত হইলেন।"

(কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগে ১৮৩০ সালে প্রকাশিত 'সত্যইতিহাসসার' পৃ. 2) 

এই উল্ক, তিগুলি থেকে দেখা যাবে, রামমোহনের সমকালে এবং বিদ্যাসাগরের আবির্ভাবের আগেই সাধু ছাঁদের বাংলা গদ্য শিক্ষিতসমাজে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল-এ বিষয়ে সাময়িক পত্রের দানও কম নয়। কিন্তু তখনও সুরতালের সামঞ্জস্ত ও বাক্যগঠনের স্থিতিস্থাপকতা অনেকের কানে ধরা পড়ে নি। বিদ্যাসাগর তাঁর প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ ('বেতালপঞ্চবিংশতি') থেকেই বাংলা গদ্যের মেদমাংসে লাবণ্য সঞ্চার করতে থাকেন। গদ্যভাষারও যে একটা বিশিষ্ট রচনাপদ্ধতি আছে, তাবও কবিতার মতো স্তব-তাল-যতি আছে-সর্বোপরি গন্ধ্যে ও বিশেষ ব্যক্তিমনের প্রতিফলন হতে পারে, সাহিত্যে যাকে 'স্টাইল' বলে, একথা তার গ্রন্থগুলি থেকে সর্বপ্রথম অবলীলাক্রমে ফুটে উঠল। অতঃপর অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয দেবার চেষ্টা করব।

8

বিলাসাগরকে কেউ কেউ শুধু স্কুলপাঠ্য পুস্তিকা ও অনুদিত গ্রন্থের রচনাকার বলে গদ্যশিল্পী হিসাবে তাঁর কৃতিত্বকে লঘু করতে চাইতেন। কিন্তু ভাষা ও সাহিত্যের গঠনেব কালে অনুবাদকর্মের দ্বারাই সাহিত্যের শ্রীরাদ্ধ হয়। তা ছাড়াও বিদ্যাসাগরের যে সমস্ত স্বাধীন রচনা আছে, তাতেও তাঁর মৌলিক রচনাশক্তির যথেষ্ট পর্বিচর পাওয়া যায়। অনেক সমর লেখকের কৃতিত্বের গুণে অনূদিত গ্রন্থও মৌলিক গ্রন্থের মতোই চিত্তাকর্ষী হয়। অনুবাদক বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব বিষয়ে আমরা দ্বিতীখণ্ডে সবিস্তারে আলোচনা করব।

'বেতালপঞ্চবিংশতি' (১৮৪৭) বিদ্যাসাগবের প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ হলেও, তাঁর জীবনচরিও- কারদের মতে তিনি তাবও আগে 'ব্যহুদের চর্বিত' নামে একখানি গ্রন্থ লিগেছিলেন, যেটি ভাগবতের রুষ্ণলীলার অন্তর্ভুক্ত কিয়দংশের স্বচ্ছন্দ অনুবাদ। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ গ্রন্থ মুদ্রিত হয় নি, এবং তার পাণ্ডুলিপিও নষ্ট হবে গেছে। এ বিষরে কয়েকটি তথ্য উপস্থাপিত করা যাচ্ছে।

বিদ্যাসাগরেব দু'জন জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিহারীলাল সরকার বলেছেন যে 'বাসুদেব চরিতে'র জীর্ণ পাণ্ডুলিপি তাঁরা স্বচক্ষে দেখেছিলেন। এব' সেই পাণ্ডুলিপি থেকে তাঁবা স্ব স্ব গ্রন্থে কিছু কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। পাণ্ডুলিপির কোন পত্রাঙ্ক থেকে উদাহরণগুশি নেওয়া হয়েছে তাঁরা তাও জানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিদ্যাসাগবের 'বে তালপঞ্চবিংশতি'র পূর্বেই 'বাহুদেব চরিত' রচিত হয়েছিল। বোধ হয় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ-কর্তৃপক্ষের অনুরোধে। ২৩

সম্প্রতি একটি সংবাদে দেখা যাচ্ছে যে, এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারে ঊনবিংশ শতা- ব্দীতে লেখ। একখানি রুফল। লা বিষয়ক গদ্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি আছে। লেখকের নাম হেনরি সাজান্ট। এটি ফাট ডই.লরম কলেজের কাগজপত্রের অন্তর্ভুক্ত।১৬ সাদা কাগজের পানিপথ্য ভাগবত-সবলম্বী এই পাণ্ডুলিপির আখ্যাপত্র এই ধরনের: শ্রীমদ্ভাগবত / সনাবারণের অষ্টমাবতাব/ শ্রীকৃষ্ণ তাহাব ওন্ম ও বাল্যলীলা। এবং কংসবধের উপা- খ্যান / ভাষা সংগ্রহঃ । -হনোর পাবজ্যান্ট শহেবেন ক্রিয়তে। হেনেরি সাজ্যান্ট বোধহয় ফোট উইলিয়ম কলেজের ছাত্র ছিলেন এব' বাংলা শিখে ভাগবতের কিয়দংশের চমৎকার অম্ল দে করেন। পাণ্ডুলিপিতে পেন্সিল দিয়ে ভ্রমসংশোধনের অস্পষ্ট চিহ্ন আছে, হাতের লেখা অতি চমৎকার, কোন বাঙালী লিপিকাবের তওয়াই অধিকতর সম্ভাবনা। এই সম্পর্কে কেউকেউ অনুমান করেছেন, বিদ্যাসাগব যখন ফোর্ট উইলিযম কলেজের শিক্ষক ছিলেন, ১৫ এখন তিনি বোধ হয় কোন সিভিলিবান ছাত্রের পেখাব ভাগবতের কিছু কিছু বংশোধন করে দেন। পরে যথন কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে সবল বাংলায় বিদেশী ছাত্রেব উপ-োগী কোন আধ্যান লিখতে বললেন, ২৬ তখন তিনি 'বাস্তবের চবি ত' বচনা করেন। এই প্রসঙ্গে F5.কট্ট মলে কবেন ব, বিঙ্গাসাগর 'বান্ডদের চাবত' নানে বাস্তবক কান আধ্যানগ্রন্থ রচনা করেছিলেন বলে মনে হয় না। উক্ত হেরি সার্জ্যান্টের ভাগবত অনুবাদের কথা কিংবদন্তীর আকারে বিদ্যাসাগরের রচনা বলে প্রচারিত হয়েছে, প্রচার করেছেন তাঁর জীবনচরিতকারদ্বয়। কিন্তু এ অনুমানের পক্ষে কোন যুক্তি নেই। বিদ্যা- সাগরের চরিতকারেরা যদি নির্জলা মিথ্যা বলে থাকেন তো আলাদা কথা। অন্ত কোন বিরোধী প্রমাণ না পেলে 'বাহুদেব চরিত'কে বিদ্যাসাগরের প্রথম গদ্যগ্রন্থ বলে স্বীকার করে নিতে হবে।

অবশ্য উক্ত সার্জ্যান্ট সায়েবের বাংলা গদ্যের রীতি সে যুগের যে-কোন বাঙালীর পক্ষে।

শ্লাঘনীয় হতে পারত, “অনেক দিন পরে ভাদ্রমাসে কৃষ্ণপক্ষে অষ্টমী তিথীতে বুধবারে

অর্ণরাত্রিতে যখন পৃথিবী অনেক দুবাচার ও অধর্ম দ্বারা অনাথার ন্যায় হইলেন তখন স্বর্গ হইতে ঈশ্বরীযঠিহত (?) প্রকাশিত আশ্চর্য সন্তান উৎপন্ন হইলেন যে সময়ে বহুদেব সেই বালককে সন্দর্শন করিয়া দিব্যচক্ষু পাইলেন তখন বুঝিলেন যে উনি নিশ্চয় ঈশ্বর বটেন দেবকীরও তদ্রূপ 'ক্লান হইল.....। ২৭ এ ভাষা বিদেশীর রচনা বলে মনেই হয় না। মনে হয় এ আখ্যানে হিন্দুর ধর্মগ্রন্থের কাহিনী গৃহীত হয়েছিল বলে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের কর্তৃপক্ষ এটি কলেজের পাঠ্য গ্রন্থরূপে গণ প্রকাশ করতে সম্মত হন নি।২৮ পাণ্ডুলিপির আকারে এ গ্রন্থ বহুদিন বিদ্যাসাগরের কাছে ছিল, পরে যখন তিনি মুদ্রণের জন্য সচেষ্ট হন, তখন পাণ্ডুলিপিটি খাঁজে পাওয়া যায় নি। সুতরাং তাঁর জীবিত- কালে এর মুদ্রণ সম্ভব হয় নি। তাঁর লোকান্তব প্রাপ্তির পরে তাঁর পুত্র নারায়ণ চন্দ্র অনেক কষ্টে এই পাণ্ডুলিপি কাঁটদষ্ট অবস্থায় খুঁজে পান এবং বিদ্যাসাগরের জীবনীকার দু'জনকে তিনি এ পাণ্ডুলিপি দেখতে দেন। তাঁরা এ পাণ্ডুলিপি (বিশেষতঃ বিহারীলাল) অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে পড়েছিলেন ।২০ মনে হয় এই গ্রন্থ বিদ্যাসাগরের প্রথম বার ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের সেরেস্তাদার পদে অধিষ্ঠিত থাকার সময় এবং 'বেতালপঞ্চবিংশতি'-র রচনার পূর্বেই রচিত হয়। বিহারীলাল সরকার মনে করেন, ১৮৪২ থেকে ১৮৪৭ খ্রীঃ অব্দের কোন এক সময়ে এ গ্রন্থ রচিত হয়ে থাকবে। ১০

বিদ্যাসাগরের এ অনুবাদ যে অতি সুললিত তাঁতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি এই গ্রন্থে অনুবাদ-কর্মের প্রথম পরীক্ষা করেছেন, রচনার গুণে অনুবাদ বলে মনেই হয় না। জীবন- চরিতকারের একথা সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত: "ইহা অবলম্বন বা অনুবাদ হউক; লিপিচাতুর্য ও ভাষাসৌন্দর্যে মূল সৃষ্টিসৌন্দর্যের সমীপবর্তী" (বিহারীলাল)। এর বিষয়বস্তু হল শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্বন্ধের কয়েকটি আখ্যান। ঠিক আক্ষরিক অনুবাদ নয় কোথাও ভাবাহবাদ, কোথাও-বা কিঞ্চিৎ আক্ষরিক অনুবাদ। একটু দৃষ্টান্ত দেওয়া যাচ্ছে:

"একদিবস কৃষ্ণবলরাম ও অন্য অন্য গোপবালকেরা একত্রে মিলিয়া খেলা করিতেছিলেন। ইতিমধ্যে বলরাম প্রভৃতি গোপনন্দনেরা নন্দমহিষীর নিকট গিয়া কহিল, ওগো, কৃষ্ণ মাটি খাইয়েছে। আমরা বারণ করিলাম, শুনিল না। তখন পুত্রবৎসলা যশোদা মাস্তেব্যস্তে আসিযা কৃষ্ণের গণ্ড ধবিলেন এবং এর্জন করিয়া কহিলেন, রে দুষ্ট তুই মাটি খাইযাছিস! রহ, আজ আমি তোঁকে মাটি খাওযা ভাল করিয়া শিখাইতেছি। "০১

এই অনুবাদ যে কত সবল, তা পঞ্চানন তর্করত্ন অনূদিত এবং শ্রীজীব ন্যায় তীর্থ সম্পাদিত অধুনা প্রচলিত ভাগবতের অনুবাদ (পৃ ৬২৮) মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে। বিহারী- লাল সরকার বলেছেন, "তবে 'বাস্তুদেব চরিতে'র অনুবাদের ভাষা ও লিপিভঙ্গী অপেক্ষা তাঁহার পরবর্তী অনুবাদ ও প্রবন্ধাদির লিপিভঙ্গী যে অধিকতর পরিমার্জিত ও বিশুদ্ধীকৃত হইয়াছে তৎপক্ষে সন্দেহ নাই।"৩২ কিন্তু এ বিষয়ে আমরা ভিন্ন মত পোষণ কবি। 'বেতালপঞ্চবিংশতি'র প্রথম সংস্করণের ভাষা 'বাসুদেব চরিতে'র ভাষার চেয়ে অনেক অনভ্যস্ত। কিন্তু 'বাহুদেব চরিতে'র ভাষা প্রথম রচন। বলে মনেই হয় না। পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যাওয়াতে বাংলা গদ্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।

৫.

বিদ্যাসাগরের দ্বিতীয় গ্রন্থ 'বেতালপঞ্চবিংশতি' ১৮৪৭ সালে (সংবং ১৯০৩) প্রকাশিত হয়। এই আখ্যানগ্রন্থ থেকে সে যুগের বাঙালী-সমাজ সর্বপ্রথম গল্পরসের আস্বাদ লাভ করে। বেতালের অদ্ভূতরস এবং বুদ্ধির চমক সে যুগের সাধারণ পাঠকের বিশেষ কৌতূহল জাগিয়েছিল। শিরীষ বৃক্ষে প্রলম্বমান বেতালেব প্রশ্নে রাজা বিক্রমাদিত্যের বিচক্ষণ জবাব সহজ বুদ্ধিকেই আশ্রয় করেছে, কোন কুটিল, জটিল বা দুরূহ-দুবধিগম্য বিষয় বেতাল অবতারণা করেনি। যে প্রশ্নের সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি ও যুক্তিব দ্বাবা জবাব দেওয়া যায় বিক্রমাদিত্যের অবলম্বন সেই সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি। রাজা বেতালের আখ্যানঘটিত চব্বিশটি প্রশ্নেরই যুক্তিসঙ্গত জবাব দিয়েছেন, কেবল শেষ আখ্যানের (পঞ্চবিংশতি আখ্যান) জবাব দিতে না পেরে মৃদু হেসে তৃষ্ণীস্তাব অবলম্বন করেছেন। সে আখ্যান ও তৎসংলগ্ন প্রশ্নটি এখানে সংক্ষেপে বলা যাচ্ছে:

দাক্ষিণাত্যের ধর্মপুর নগরের রাজা মহাবল রাজ্যভ্রষ্ট হয়ে মহিষী ও ক্যাকে নিয়ে অরণ্যে পালিয়ে যান। একদা আহার সংগ্রহের ইচ্ছায় অন্তত্র যাবার সময়ে তিনি অরণ্যে একস্থানে মহিষী ও কন্যাকে বসিয়ে রেখে যান। বহুক্ষণ হয়ে গেলেও রাজা ফিরলেন না। ক্রমে সন্ধা উপস্থিত হল। তখন মাতা-কন্যা অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে রোদন করতে লাগলেন। ইতিমধ্যে কুণ্ডিনের অধিপতি চন্দ্রসেন এবং তাঁর পুত্র ঐ অরণ্যে মৃগয়াব্যাপদেশে হাজির হন। তাঁরা মাতা ও কন্যাকে সান্ত্বনা দিয়ে রাজধানীতে নিয়ে এলেন এবং "কিছুদিন পরে, রাজা রাজকন্তার, রাজকুমার রাজমহিষীর পাণিগ্রহণ করিলেন।" এই আখ্যানটি বিবৃত করে বেতাল জিজ্ঞাসা করল, "মহারাজ! এই দুই নারীর সন্তান জন্মিলে তাহাদের পর- স্পর কি সম্বন্ধ হইবে, বল।" এ উদ্ভট প্রশ্নের জবাব দেওয়া দুরূহ। এখনকার বেতাল একটু ঘুরিয়ে প্রশ্ন করতে পারত, এদের সন্তান পরস্পরকে কি বলে ডাকবে। এ হেঁয়ালির যথার্থ জবাব হয় না। তাই "বিক্রমাদিত্য, ঈষৎ হাসিয়া মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন।" অবশ্য আমাদের পিতৃ-অনুগামী সমাজ বলে এ প্রশ্নেরও জবাব দেওয়া যায়। তাদের মধ্যে খুডো-ভাইপোর সম্বন্ধ হবে। অর্থাৎ রাজা চন্দ্রসেন এবং মহাবলের কন্যার সন্তান হবে খুল্লতাত, এবং বাজপুত্র হবে ভ্রাতুপুত্র। এই আখ্যান থেকে মনে হচ্ছে, শিরীষবৃক্ষে দোদুল্যমান বেতালের বাসর-ঘরেস জামাই-ঠকানে। প্রশ্ন বিলক্ষণ জানা ছিল। এ আখ্যান অবক্ষয়ী হিন্দুযুগে সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছিল। ফলে এতে নরনারীর শঠতা বঞ্চনা, চরিত্রভ্রষ্টতা, কামুকতা এবং উপপতি-উপপত্নীর বাহুল্য অধিকতর প্রাধান্ত পেযেছে। এর সঙ্গে সে যুগের সমাজজীবনের কিছু সংযোগ থাকা কিছু বিচিত্র নস। কারণ অধঃ পতিত ভ্রষ্ট সমাজ না হলে ভ্রষ্ট-ভ্রষ্টার গল্প সেযুগে এত মুখরোচক ও না। 'বেঙাল-

পঞ্চবিংশতি'-র মূল হচ্ছে সোমদেবের 'কথাসরিৎসাগর', তাতে এটি "বেতালপঞ্চ-

বিংশতিকা" নামে উল্লিখিত হয়েছে। 'কথাসরিৎসাগরে' এবং ক্ষেমেন্দ্রের 'বৃহৎকথামঞ্জণী'-তে

বেতালের আখ্যান পুরাতন আকারেই ছিল-যদিও মূল গল্পগুলির উৎস জন্য কোন বৃত্তের

অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে মনে হয। পরে অনেকেই এই আখ্যানগুলিকে পদ্মে এবং গদ্যে-পদ্যে

('চ쫫') পুনলিখনে উৎসাহিত হয়েছিলেন। শিবদাস ভট্ট জণ্ডলদত্ত এবং বল্পভদাসের

নামে 'বেতালপঞ্চবিংশতি'ব নান। সংস্কৃত পুঁথি পাওয়া গেছে। কেউ কেউ বলেন, গল্পগুলি

নাকি পূর্বে ছন্দেই লেখা হয়েছিল। এর মধ্যে বল্লভদাসের গল্পগুলি আকারে সংক্ষিপ্ত। 

এ পর্যন্ত সংস্কৃত 'বেতাল পঞ্চবিংশতির' তিনটির নির্ভরযোগ্য সংস্করণ মুদ্রিত হয়েছে। ১৮৭৩ খৃঃ অব্দে কলকাতা থেকে জীবানন্দ বিদ্যাসাগরের সম্পাদনায় জঞ্চলদত্তের বেতাল নাগরী অক্ষরে ছাপা হয়। বেতালের এই হচ্ছে এই অঞ্চলের প্রথম মুদ্রিত সংস্করণ। এরপর লাইপজিগ থেকে ১৯১৫ সালে শিবদাস ভট্টের মূল সংস্কৃত বেতাল জার্মান টীকা সহ প্রকাশিত হয়-Die Vetala Pancavimsatike, এবং ১৯৩৪ সালে American Oriental Series-এর চতুর্থ খণ্ডে জন্তলদত্তের বেতাল প্রকাশিত হয়েছে। ৩৪ প্রাদেশিক ভাষাতেও এর অনুবাদ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। মহম্মদ শাহের রাজত্বকালে রাজা জয়- সিংহের আদেশে সুবত কবীশ্বর 'বেতালপঞ্চবিংশতি'র ব্রঙ্গ, ভাষায় অনুবাদ করেন। গিলক্রাইস্টের প্রবর্তনায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের জন্য উক্ত কলেজের মুন্সী মুজাতার আলি খাঁ (ইনি 'বিলা' নামে হিন্দুস্থানী সাহিত্যে পবিচিও) এবং 'প্রেমসাগর'-এর কবি লাহু লাল কব, ব্রজ, ভাখা থেকে হিন্দী-হিন্দুস্থানীতে অন্তবাদ করেন (১৮০৫)। এর নাম দেওয়া হয়েছিল 'বৈতাল পচ্চীসী'। ১৮৫২ সালে বিদ্যাসাগরের সম্পাদনায় এর একটি নতুন সংস্করণ এবং ১৮৫৮ সালে হরিশচন্দ্র তর্কালঙ্কারের দ্বারা বিদ্যাসাগরেব সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ প্রকাশিত হয়।৩০ বিদ্যাসাগরের 'বেতালপঞ্চবিংশতি' সংস্কৃত থেকে নয়, 'বৈতাল পচ্চীসী' শীর্ষক হিন্দুস্থানী গ্রন্থ থেকেই অনূদিত হয়েছিল।

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অধ্যক্ষ (সেক্রেটারী) জি, টি, মার্শেলের নির্দেশে বিদ্যাসাগব "বৈতাল পচীসী নামক প্রসিদ্ধ হিন্দী পুস্তক অবলম্বন" (দ্বিতীয় সংস্করণ বেতালেব বিজ্ঞাপন) করে অনুবাদ করেন এবং নাম দেন 'বেতালপঞ্চবিংশতি'। এর প্রথম থেকে নবম সংস্করণ পর্যন্ত তিনি বিরামচিহ্ন হিসেবে শুধু দাঁড়ি চিহ্ন ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু দশম সংস্করণে (১৯৩৩ সংবং-১৮৭৭ খ্রীঃ অঃ) থেকে ইংরেজী গ্রন্থের কথা-সেমি- কোলন প্রভৃতি বিরামচিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছিল।৩৬ সংস্কৃত থেকে অনুবাদ না করে তিনি হিন্দুস্থানী 'বৈতাল পচ্চীসী' থেকে কেন অনুবাদ কবলেন তার কাবণ দুজ্ঞের নয়। প্রথম বার ফার্ট উইলিষম কলেজে সেবেস্তাদাবেব (অর্থাৎ প্রথম পণ্ডিত) পদে অধিষ্ঠিত থাকাব সমযে তাঁকে বিদেশী ছাত্রদেব বাংলা পড়াতে হত, বাংলা ও হিন্দীতে লেখা উত্তব পত্র পরীক্ষা করতে হ৩। কার্যান্ডুবোধে তাঁকে বেশ ভালো কবে ইংবেদী শিখতে হবেছিল। একজন হিন্দুস্থানী পণ্ডিত প্রতিদিন তাঁকে হিন্দী শেবাতেন। এইভাবে তিনি অল্পকালের মধ্যে হিন্দী-হিন্দুস্থানী ভাবাব বিশেষ অধিকার গুর্জন কবেন। হিন্দী ভাষাজ্ঞান তাঁব কিবকম আবত্তে এসেছে তাব পরীক্ষা করবার জন্মই বাবতয তিনি হিন্দী 'বৈতাল পচ্চীসা' অবলম্বনে 'বতালপঞ্চবিংশতি' বচন। কবেন। অবশ্য এব কিছু কিছু উগ্র আদি- বসেব বর্ণনা (ন। মূল নংস্কৃতেও ছিল), তিনি দ্বিতীয় সংস্করণ থকে ত্যাগ কবে- ছিলেন।

একদা 'বেতালপঞ্চবিংশতি'-ব গ্রন্থকর্তৃত্ব সম্বন্ধে কিছু অপ্রীতিকর ব্যাপার ঘটেছিল। বিদ্যাসাগরের সতীর্থ, সহকর্মী ও বন্ধ মদনমোহন তর্কালঙ্কার বিদ্যাসাগবে, সর্ববিধ মঙ্গলকর্মে যথাসাধ্য সাহাব্য করতেন-এ বিধবে তাঁব মন আশ্চর্য ধবনের আধুনিক ছিল। তার জামা। বোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (পবে 'বিজ্ঞাভূষণ') ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত 'কবিবর মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জীবনচর্বিত ও তদগ্রন্থ আলোচনা' পুস্তিকাব দু' এক স্থলে এখন মন্তব্য করেছিলেন য বিদ্যাসাগবেব ক্ষুব্ধ হবাব কাবণ ঘটেছিল। লেগেন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের 'বঙালশঞ্চবিংশতি' সম্বন্ধে বলেছিলেন যে, বদিও ও গ্রন্থ বিদ্যাসাগবেব বচনা বলে চলে, তবু ও ত তাঁব শ্বশুর মাননোহনেরও এথেষ্ট দান আছে

"বিদ্যাসাগর প্রণীত বঙালপঞ্চবি শতি-তে নূতনভাব, ও অনেক ওমধুর বাক্য তর্কালঙ্কার দ্বানল অন্তর্নিবেশিত হইবাছে। ইহা তর্কালঙ্গাব দ্বানা এতদূব সংশোধিত ৭ পবিনা জত হইয়াছিল যে, বোমাণ্ট ও ফ্লচবেব লিখিত গ্রন্থগুলির ল্যাব ইহা উভব বন্ধব বচিত বলিলেও বলা যাইতে পাবে।" (ঐ পুস্তিকা, পৃ ৪২)

একথা সত্য হলে এ গ্রন্থের যশোভাগ দুজনকেই ভাগ করে দিতে হবে এবং প্রকা- বাস্তবে বিদ্যাসাগবেব ওপর নৃতাচাবের অভিযোগ এসে পড়ে। বিনি সাবাজীবন 'পিপানিডেব'৩' মতো মাথা উঁচু কবে চলেছিলেন, অন্যায় অসতাকে বিবাহ পবিহার করে চলতেন, তিনি প্রিয়বন্ধু মদনমোহনের পরিশ্রমের গৌরব আত্মম্মাৎ করবেন এ কখনও সম্ভব নয়। ৩৮ আসল ব্যাপার বিদ্যাসাগর 'বেতালপঞ্চবিংশতি'র দশম সংস্করণের বিজ্ঞাপনে পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করেন। মদনমোহন তর্কালঙ্কার এবং গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্বকে বেতালের রচিতাংশ শুনিয়ে তাঁদের অভিমত চাইতেন। 'জীবনচরিত'-এর বিজ্ঞাপনেও তিনি মদনমোহনের নিকট অনুবাদকর্মের জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে- ছিলেন। বেতাল-সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বলছেন:

"আমি বেতালপঞ্চবিংশতি লিখিয়া, মুদ্রিত করিবার পূর্বে, প্রযুক্ত গিরিশ্চন্দ্র বিদ্যারত্ব ও মদনমোহন তর্কালঙ্কারকেও গুনাইয়াছিলাম। তাঁহাদিগকে শুনাইবার অভিপ্রায় এই যে কোনও স্থল অসঙ্গত ও অসংলগ্ন বোধ হইলে, তাঁহারা স্ব স্ব অভিপ্রায় ব্যক্ত করিবেন; তদনুসারে আমি সেই সেই স্থল পরিবর্তিত করিব। আমার বিলক্ষণ স্মরণ আছে, কোন কোন উপাখ্যানে একটি স্থলও তাঁহাদের অসঙ্গত বা অসংলগ্ন বোধ হয় নাই; সুতরাং সেই সেই উপাখ্যানের কোনও স্থলেই কোনও প্রকার পরিবর্তন করিবার আবশ্যকতা ঘটে নাই। আর, যে সকল উপাখ্যানে, স্থানে স্থানে, দুই একটি শব্দ মাত্র পরিবর্ত্তিত হইয়াছিল। বিদ্যারত্ব ও তর্কালঙ্কার ইহার অতিরিক্ত আর কিছুই করেন নাই " (বেতালের দশম সংস্করণের বিজ্ঞাপন)

তখন মদনমোহন পরলোক গমন করেছেন, সুতরাং এ বিষয়ে তাঁর সাক্ষা পাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু গিরিশ্চন্দ্র বিদ্যারত্ব তখনও সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হয়ে তিনি বিদ্যাসাগরকে লিখে পাঠালেন: "এতদ্বিষয়ে প্রকৃত বৃত্তান্ত এই-আপনি, বেতালপঞ্চবিংশতি রচনা করিযা, আমাকে ও মদনযোহন তর্কালঙ্কারকে শুনাইযাছিলেন। শ্রবণকালে আমরা মধ্যে মধ্যে স্ব স্ব অভিপ্রায় ব্যক্ত করিতাম। তদনুসারে স্থানে স্থানে দুই একটি শব্দ পবিবর্তিত হইত। বেতাল পঞ্চ- বিংশতি বিষযে আমার অথবা তর্কালঙ্কারেব, এতদতিরিক্ত কোন সংস্রব বা সাহায্য ছিল না।" এই সমস্ত উল্লেখ থেকে পরিষ্কাব বোঝা যাচ্ছে, 'বেতালপঞ্চবিংশতি'-ব গ্রন্থ- কর্তৃত্ব সম্পূর্ণরূপে বিদ্যাসাগরেব, তাঁব ঘনিষ্ঠ বন্ধু মদনমোহন এবং অনুচব গিবিশচন্দ্রকে তিনি কিছু কিছু অংশ শুনিয়েছিলেন, তাঁদের অভিমতও চেয়েছিলেন। কিন্তু তাই বলে বোমন্ট ও ফ্লেচাবেব নাটকের মতো 'বেতালপঞ্চবিংশতি' দু বন্ধুব মিলিত বচনা-একথা যুক্তিসঙ্গত নয়।

'বঙালপঞ্চবিংশতি'-ব প্রথম সংস্করণের ভাষা। কিছু ডেঙা ছিল, এবং দু-চাবটি আরিবসের উগ্র বৃত্তান্ত ছিল, কিন্তু দ্বিতীয় সংঙ্গবণে তিনি ভাষাব জড়তা অনেকটা কাটিয়ে ওঠেন এবং অপ্রচলিত দুরূহ শব্দের স্বলে পচলিত শব্দ ব্যবহার করেন। অবশ্য ভুক৬, ১১ প্রাড বিবাক, মলিঙ্গ চ, বৈষণা, মহানস প্রভৃতি দুচাবটি অপ্রচলিত শব্দ খাবলেও বিদ্যাসাগর বর্তালেব ভাষাবিদ্যাস শব্দবোজনায় অতি সবল অথচ গম্ভীব বীতি ব্যবহার করেছেন। যাকে সাহিত্যেব সাধুভাষা বলে, তাব প্রথম পরিচয় 'বেতাল পঞ্চবিংশতি'-ব ভাষার পাওবা গেল। এখানে এই ধবণেব দুটি একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাচ্ছে:

১ "এই মাধাময স'সাব অতি অকিঞ্চিৎকব। ইহাতে লিপ্ত থাকিলে, কেবল জন্মমৃত্যু পরম্পরারূপ দুর্ভেদ্য শৃঙ্খলে বদ্ধ থাকিতে তথ প্রতাক্ষ পারদৃশশুণান পদার্থ মাত্রই যাাপ্রপঞ্চ, বাস্তবিক কিছুই নশে। ক কাতার পিতা, ক কাহাব পুত্র। সকলই ভ্রান্তিমূ্যক"। (বিজ্ঞানাগ বচনাবলী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮৬)

১ "তথাব এক অতি মনোহব সবোক্স ছিল। তান তাহাব শবে গিযা দেখিলেন, কমল সকল প্রফুল্ল হইযা আছে, মধুকবেবা মধুপানে মত্ত হইদা, ফাগুণ ববে গান কবিতেছে, হংস, সাবস, চক্রবাক প্রভৃতি জলবিহঙ্গগণ তীবে ও নীবে বিহাব কবিতেছে, চাবিদিকে, কিশলয় ৭ কওমে স্বশোভিত নানাবিধ পাদপসমূহ বসন্তলক্ষ্মীব সৌভাগ্য বিস্তাব কবিতেছে, সর্বতঃ শীতল সুগন্ধ গন্ধবহেব মন্দ মন্দ সঞ্চার হইতেছে।" (বি বচনাবলী, পৃ ৮৮)

৩. "সখি। আমি এই বিষম বিপদে পড়িযাছি, কি উপাব কবি, ব শুতে গি। কেমন কবিষা, পিতামাতাব নিকট মুখ দেখাইব। তাঁহাবা ক্লাবণ জিজ্ঞাসিলে, কি উত্তব দিল। বিশেষ ৩ঃ আজ আবাব সই সর্বনাশিয়া আসিবাছে, সই বা, দেখিয়া শুনিয়া কি মনে কবিবেক। সবি তুমি আমাৰ বিষ আনিবা দাও, খাইয। প্রাণত্যাগ কবি, ভাঙা হইলেই সকল আপদ ঘুচিয়া যায।" (ঐ, পৃ ৪৪)

এই তিনটি দৃষ্টান্ত থেকে দেখা যাবে, প্রথমটিতে ক্লাসিক গাম্ভীর্য, দ্বিতীয়টিতে বাম।টিক বর্ণনাব জন্ম ভাষা ভঙ্গিমায কিছু লঘুতা এবং তৃতীযটিতে সাধুভাষাব মাবফতে নাটকীয ধবণের মেয়েলি বাবাতি অনুস্বত হবেছে।

শোন। যায গোডাব দিকে নাকি বেতালেব ৩৩টা জনপ্রিযতা হয় নি। প্রথম দিকে ভাষার অনভ্যস্ততাই বোধ হয় তার কাবণ। কিন্তু পববর্তী সংস্কবণে ভাষ। সল ও মার্জিত হলে এটি একটি আদর্শ আখ্যানগ্রস্বরূপে সর্বত্র সমাদৃত হয়। এমন কি, সযুগে যুগে "অনেকে বেতালের অনেক অংশ মুখস্থ করিয়া রাখিতেন। ৪৩ পল্লীগ্রামের অন্তঃপুরিকারাও এ গ্রন্থ শুনতে খুব ভালোবাসতেন।৪৪

অনুবাদে বিদ্যাসাগর লাল্লুজীর হিন্দু-হিন্দুস্থানী গ্রন্থকে রেখায় রেখায় অনুসরণ কবেন নি, অনেক স্থান বাদ দিয়েছিলেন (দ্বিতীয় সংস্কবণে আদিরসের গল্পগুলিব উত্তাপ হ্রাস করা হয়), অনেক দীর্ঘ বর্ণন। সংক্ষিপ্ত করে নিয়েছিলেন। এখানে শিবদাস ভট্টের 'বেতালপঞ্চবিংশতি', লালুজীর 'বৈতাল পচ্চীসী' এবং বিদ্যাসাগবরুত বাংলা 'বেতাল- পঞ্চবিংশতি' থেকে একই অনুচ্ছেদ উল্ক, ৩ হচ্ছে:

১. "অন্যদা শ্মশানে নিশীথসমযে রুদন্তঃ সকরুণং শব্দং রাঙা শূণোতি। রাজ্ঞেণোক্তম্ দ্বারে কস্তিষ্ঠাত। বীববরেণোক্তম্ দেবাইমন্মি। কদন্ত্যা নার্যাঃ শব্দং শূণোসি। তেনোক্রম্। ৩খ্যাঃ সমীপে গত্বা শীঘ্রমের স্বরূপং সমানয়। এতো বীববরো কদন্ত্যাঃ শব্দলগ্নোগ তঃ।" (শিবদাস ভট্ট) ২. "অলকিস্স্সঃ একরোজ ক। জিক্রতৈ কি ইত্তিফাক রাওকে বক্ত মরঘটমে বংডীকে বোনেকী আবাজ আই। বাজ। সুনকে পুকারা কোই হাজীর হৈ। বীববব গুনতে হী বালা হাজীব জী হুকম, রাজনে যো হুকম কিয়া, জহা সে ঔবতকী বোনেকী আনাজ আতী হে, যা জাও; ঔব উসসেরোনেকা খবর পুছকর জলদ আও।” (১৮৫৮ সালে মুদ্রিত 'বৈতাল পঞ্জীসী'ব নব সংস্করণ)

৩. "একদিন নিশীথ সময়ে, অকস্মাৎ ক্রন্দনধ্বনি শ্রবণগোচর কবিরা রাজা বীরবরকে আহ্বান করিলে, সে তৎক্ষণাৎ সম্মুখবতী হইয। কতিল, মহাবাজ! কি আজ্ঞা হয়। বাজ। কহিলেন, দক্ষিণদিকে স্ত্রীলোকের ক্রন্দনধ্বনি শুনা যাইতেছে; ত্ববাব ইহাব তথ্যানুসন্ধান করিযা আমায় সংবাদ দাও। বীরবব, যে আজ্ঞা মহারাজ, বলিযা 'তৎক্ষণাৎ প্রস্তান করিল।" (বিদ্যাসাগর রচনাবলী, ১ম, পৃ. ৩১)

লাল্লুজী ব্রজ ভাষা থেকে অন্তবাদ করলেও শিবদাস ভটের সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে এর বিশেষ পার্থক্য নেই। অবশ্য জণ্ডল দত্ত ও শিবদাস ভট্টের মধ্যে ভাষাগত কিছু পার্থক্য মাছে। বিদ্যাসাগর মূলকে যথাসম্ভব অনুসরণ করেছেন। গ্রন্থ রচনার পর এটি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ছাত্রদের উপযুক্ত হয়েছে কিনা তার বিচারের ভাব পডে বেভাঃ কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর। তিনি প্রতিকূল মত প্রকাশ করেন। তখন বিদ্যাসাগর শ্রীরামপুবের মার্শম্যান সায়েবেব অনুকূল মত সংগ্রহ করে এ গ্রন্থকে পাঠ্যতালিকাভুক্ত কবেন এবং কলেজ-কর্তৃপক্ষ 'বেতালপঞ্চবিংশতি'-কে কলেজ-গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হন। ৪৫ কিন্তু বেতাল সম্বন্ধে কৃষ্ণমোহনেব আপত্তির কারণ বোঝা যাচ্ছে না। বেতালেব প্রথম সংস্কবণেব ভাষাব কিছু জড়তা ছিল বটে, কিন্তু কৃষ্ণমোহনের 'বিদ্যাকল্পদ্রুমে'ব তুলনায় এ ভাষা কোনও দিক দিয়েই কঠিন নয়। আব তা ছাড়া খ্রীষ্টানধর্মাবলম্বীদের অকচিকব হতে পাবে এমন বিশেষ কোন ধর্মীয় ব্যাপারেও (কালিকাব কাছে বলি দেওয়াব প্রসঙ্গ বাদ দিলে) উল্লেখ নেই। তবে কচিব স্থূলতাব জন্য (সংস্কৃত 'বেতালপঞ্চবিংশতি' ও হিন্দী 'বৈতাল পচ্চীসী'-তে প্রচুব অগ্নীল উপাখ্যান আছে) হয়তো কৃষ্ণমোহন এ আখ্যানের প্রতি বিরূপ হযেছিলেন। তবে সংস্কৃত সাহিত্যেব আখ্যানে এবকম আদিবসেব গল্প হামেসাই পাওয়া বাবে, আধুনিক কালের কচি যাকে প্রসন্ন মনে মেনে নিতে পারবে না। বিদ্যাসাগব ১৮৫২ সালে লাল্লুঙ্গীব 'বৈতাল পচ্চীসী'ব যে নতুন সংঙ্গবণ প্রকাশ কবেছিলেন তাব ভূমিকায তিনি সংস্কৃতে লেখা মূল গ্রন্থ সম্বন্ধে বলেছিলেন, "The work contains no traces of art or genious in its composition, but on the contrary exhibits the clumsy attempts at the wonderful, some a times bordering on childishness, which are so general in the Legends of a dark age". সবাই হাক সবস অন্তবাদের গুণে 'বেতালপঞ্চবিংশতি' একদা অতিশর জনপ্রিবতা লাভ করেছিল- গাট। ঊনবিংশ শতাব্দী ধাবই সে জনপ্রিয়তা অস্বপ্ন ছিল। বাংলা গদ্যের বিবর্তন ইতিহাসের দিক থেকেই বেতালপঞ্চবিংশতি' অধিক তব মূল্যবান, কারণ এই গ্রন্থেই সাহিত্যের গদ্যের প্রথম সার্থক ব্যহাব লক্ষ্য করা গছে।

জন ক্লার্ক মার্শমগন সাবেবের Outlines of the History of Bengal for the use of Youths in India গ্রন্থেব শষ নয় অধ্যায় (একাদশ-ঊনবিংশ অধ্যাব) অবলম্বনে বিদ্যাসাগর 'বাঙ্গালাব ইতিহাস'-দ্বিতীয ভাগ (১৮৪৮) বচন। কবেন। এতে ১৭৫৬ সাল অর্থাৎ সিবাজেব সিংহাসন লাভের পর থকে শুরু করে ১৮৩৫ খ্রীঃ অব্দে-লর্ড বেন্টিঙ্কের শাসনকাল পর্যন্ত মোট ঊনআশি বৎসরের বাংলার ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে মার্শম্যানের ইংরাজী গ্রন্থ দীর্ঘকাল ছাত্রসমাজের পাঠ্যপুস্তক বলে পরিগণিত হয়েছিল, এ ছাড়া স্টুয়ার্টের ইতিহাসও কিছু জনপ্রিয় ছিল। তবে মার্শম্যানের গ্রন্থ অধিকতর বিস্তারিত ও তথ্যবহ-যদিও শ্বেতাঙ্গ অহমিকা বর্জিত নয়। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে শ্রীরামপুরেব মিসনারীদের, বিশেষতঃ মার্শম্যান সায়েবের বেশ প্রীতির সম্পর্ক ছিল। মিসনারীদের প্রতি তাঁব কোন বিরাগ ছিল না।৪৬ 'বেঙাল- পঞ্চবিংশতি'-র ব্যাপারে মার্শম্যানের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়।

মার্শম্যানের ইংরেজী গ্রন্থটি মোটামুটি পূর্ণাঙ্গ বলে বিদ্যাসাগর এই গ্রন্থের কয়েকটা অধ্যায় প্রায় অনুবাদ করলেন। এর রচনার গুণে গ্রন্থটি ছাত্রসমাজে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে আর একটা কৌতূহলজনক সংবাদ দেওয়া যেতে পারে। ১৮৫ সালে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের সেক্রেটারী মেজর জি. টি. মার্শেল বিদ্যাসাগরের 'বাঙ্গলাব ইতিহাসে'ব টীকাটিপ্পনীসহ ইংরেজী অনুবাদ পকাশ করেন। গ্রন্থটিব আখ্যাপত্র এইরূপ: A Guide to Bengal being a close translation of Ishwar Chandra Shuama's, Rengalee Version of that portion of Marshman's History of Bengal, which comprizes the rise and progress of the British Dominion with notes and observations, By Major G. T. Marshall, Secretary and Examiner to the Fort William-এর ভূমিকা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বঙ্গসরকার ১৮৪৬ সালে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজেব ছাত্রদের জন্য দুখানি বাংলা পাঠ্যপুস্তকের পৃষ্ঠপোষকতা করবার জন্য দুটি বিষয় নির্দিষ্ট কবে দেন-কোন পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক যুগের হিন্দুরাজার বর্ণনা এবং ভারত বা বাংলাদেশের ইংরেজ রাজত্বকালীন ইতিহাস। "Accordingly two works were prepared by Iswar Chandra Sharma, namely, 'Betala Panchabingshati' Leing a translation of Hindee work 'Bytal Pachisi', containing legends of Raja Vikramaditya and 'Banglar Itihas' being a free translation of that portion of Marshman's History of Pengal which comprehends the rise and progress of the British Dominion in Pengal", মার্শেল সায়েব মার্শম্যানের সম্মতিক্রমে বিদ্যাসাগবেব 'বাঙ্গালাব ইতিহাসে'র ইংরেজী অনুবাদ কবে নাম দেন A Guide to Bengal, তিনি বাংলাভাষা বেশ ভালই জানতেন, "তবা" তাঁব অনুবাদ মূলকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে অন্তসবণ কবেছিল। ৪৭ উপবস্তু তিনি বিদেশী ছাত্রদের জন্না এতে বাংলাদেশের পথঘাট, লোকজন, আচাবব্যবহাব প্রভৃতি সম্বন্ধেও কিছু কিছু টাকা বোগ কবে দিয়েছেন। বিদ্যাসাগবেব 'বঙ্গোলাব ইতিহাস' শিক্ষা- বিভাগের কর্ণবাদের মধ্যেও কতটা খ্যাতিলাভ কবেছিল-এটাই ভাব বড় প্রমাণ। এব সুললিত ভাষা পরিচ্ছন্ন ভঙ্গিমাব জন্য সে যুগেব কেউ কেউ এব অনেকম্বল আবৃত্তি করতে পারতেন।৪৮

এ গ্রন্থ "চনার পর বিদ্যাসাগবের নির্দেশ ও উপদেশে তাঁব স্নেহভাজন পণ্ডিত বামগতি ভাবষঃ মার্শণ্যানের ই'বেঙ্গী গ্রত্বে প্রথমাংশ অনুবাদ কবে 'বাঙ্গালার ইতিশস- প্রথম ভাগ' (১৮৫৯) বচন। কবেন। এতে তিনি'।হন্দু বাজাদিগেব চবমাবস্থা অবধি নবাব আলিবর্দীখার অধিকার কাল পর্যন্ত" সংক্ষেপে বর্ণনা কবেন। উক্ত পুস্তিকাব দ্বিতীয় সংস্করণের বিজ্ঞাপনে তিনি মার্শম্যান ও স্টুয়ার্টের নাম উল্লেখ কবেছিলেন।

বা লাব ইতিতাস পুনরুদ্ধারের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র যেমন কৌলী ছিলেন, বিদ্যাসাগব তেমনি ভাবতবর্ষের ইতিহাস সম্বন্ধে কৌতূহলী ছিলেন এ বিষয়ে একপানি বিস্তাবিত গ্রন্থ সিথিকার জন্য বহু উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁব ব্যক্তিগত গ্রন্থাগাবে ভাব ও বাংলার ইতিহান-সংক্রান্ত দশী ৭ ই বেজী ভাষায় লেখা বহু গ্রন্থ ও তথ্য সণুচী ও হবেছিল।১৯ কিন্তু শাবীবিক অসুস্থতাব জন্য তাব মনস্কাণনা সিদ্ধ হল না। এ জন্য তিনি অশ্বস্ত অবস্থাতেও পরিচিত জনের কাছে নিতাই ক্ষোভ প্রকাশ করতেন।' শেষঞ্জাবনে শণ্যাগত হয়েও বাংলাব তথা ভাবতেব ইতিহাস বচনাব অভিলাষের কথা ভুলতে পাবেন নি। সেই সময় নীলাম্বব মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, "ভাবতবর্ষেব একখানি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লিখিবার সমস্ত সংগ্রহ কবিয়া বাথিয়াছি, কেবল শরীব ভাল নয় বলিয়া আজ কাল কবিয়া বিলম্ব হইয়া পড়িতেছে।"*১

সে যুগে বাংলাভাষায় লেখা ছাত্রপাঠ্য বাংলাব ইতিহাস বলতে প্রায় কোন গ্রন্থই ছিল না। বেভাঃ কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বিদ্যাবল্পভ্রমে' বোম ও মিশব দেশ সম্বন্ধে অনেকগুলি মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও তাঁব ভাষা অত্যন্ত জড়তাগ্রস্ত, স্বল্পাঠ্য হওযাব অনুপযোগী। ক্ষেত্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের 'গ্রীবদেশীষ ইতিহাস' (১৮৩৩), ফেলিক্স কেবীব 'ব্রিটনদেশীয় বিববণসঙ্কষ' (১৮-৯-২০) মার্শম্যানের 'পুবাবৃত্তের সংক্ষেপ বিব ণ' (১৮৩৩), পীদার্স নেব 'প্রাচীন ইতিহাসসমৃচ্চব' (৮৩০। প্রভৃতি গ্রন্থগুলিব সাব্দ বা লাদেশের ইতিহাসের বড় একটা যোগাযোগ ছিস না কারণ এগুলি ও ন্যদেশেব ইতিবৃত্ত। 'কমাত্র ক্ষত্রমোহনকে বাদ দিলে, ৩ ন্যলোকদের বচনা ভঙ্গিমার ৬৬তাব জন্য তাদের গ্রন্থ আদৌ জনপ্রিণ হব নি। অবশ্য বাজা বাজেন্দ্রলাল মিত্র 'বিবিদার্থ সংগ্রহে' ভাবতের বাজপকাহিনী। ১৭৭৩ কেব ২২ সংখ্যা), চন্দ্রগুপ্তের বিববণ। ঐ সংখ্যা), ইস্ট ইন্ডিবা কোম্পানী, সম্রাট অশোক প্রভৃতি সম্বন্নে পানকর্পণ প্রামাণিক ঐতিহাসিক প্রবন্ধ বচনা কবে।ছলেন। নীপমণি বসাকের 'ভারতবর্ষের ইতিহাস' (১৮৫৭) স্কুলপাঠ্য গ্রন্থ হলেও এতেই সবপ্রথম ভাবতীণ দৃষ্টকোণ থকে ভারতের হিন্দ, পাঠান ও মুঘল যুগের হা হুকাস ভালোচনার চেষ্টা দেখ। বাব। উক্ত ইতিহাসের প্রথম ভাগের বিজ্ঞাপনে নীলমণি বসাক বা বলেছিলেন বিদ্যাবাগণের অভিমতের সঙ্গে তাব বান বিবোদ নই: এই দেশের পুবারও ১।ছে, তাহা ইংবাজী ভাষাতে লিখিত, বাঙ্গাল। ভাষাতে এই পুণাবৃও প্রাণ নাই। এই ভাবাতে ব দুই একবানা পুস্তব দেখা বাব, তাহা ই'বাঙ্গী হইতে ভাষান্তবিত, তাহাতে হিন্দুদিগেব প্রাচীন বৃত্তান্ত কিছুই নাই, এব তাহ। এমত নাবস যে, কান শক্তি তাহা পাঠ কবিতে ইচ্ছা কবেন না, এবং পাস কবিলেও তৃপ্তিবোধ হব না। অধিকন্তু এই সকল পুস্তক বালকদিগেব পাঠের উপবোগী নহে, এই সন্ত্য তাহা কোন পাঠশালাতে পঠিত হয় না, স্বতবাং বালবেরা ভাব এবধে। ভালমন্দ বিছুই জােিত পাবে না, এবং ইংবাজী পুস্তক পাঠ কবিরা অনেক বালকের এমত সংস্বাব জন্মে যে, এদেশের ধর্ম্মকৰ্ম্ম সকলি মিথ্যা এবং হিন্দুবা পূর্বকালে অতি মুচ ছিলেন, অপর বালকেবা অন্যদেশের ইতিহাস কণ্ঠস্থ কবিয়। বাথে, কিন্তু জন্মভূমিব কোন বিববণ বলিতে পারে না।"

বিদ্যাসাগর স্কুলপাঠ্য পুস্তকের জন্তই মার্শম্যানের গ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন বটে, কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের জন্যই এই গ্রন্থের প্রথম পরিকল্পনা হয়। ৩২. সে যাই হোক এর ভাষাও বর্ণনাভঙ্গিমা এত চমৎকার যে, একে প্রায় মৌলিক গ্রন্থ বলেই মনে হয়। কিন্তু কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন (যথা বিহারীলাল সরকার), বিস্তাসাগর মার্শম্যানের শ্বেতাঙ্গসুলভ অ-ভারতীয় মনোভাবকেও অবিকল অনুবাদ করেছেন কেন? উপরন্ত অন্ধকূপহত্যা সম্বন্ধে তিনি নিঃস্পৃহভাবে মার্শম্যানের বিবৃত ঘটনাই মেনে নিয়েছেন, তার সত্য-মিথ্যা সম্বন্ধে কোন মন্তব্য কবেন নি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে, এমন কি এই শতাব্দীতেও অনেকে সিরাজের প্রতি অতিশয় ভক্তিমান। ইংরেজেব শত্রু আমাদে মিত্র, এই সূত্রানুসাবে সিরাজকে ভাবাবেগের দৃষ্টিতে প্রায় শহীদের পর্যায়ে তুলে ধবা হয়। সে যুগে কেউ কেউ মনে করতেন, গবেষণার সাহায্যে সিরাজকে মার্শম্যানের আঁকা চিত্রের বিপরীতভাবেও দাড় করানো যেতে পাবে।৫০ কিন্তু বিস্তাসাগর নিরাজকে যে অতি অপদার্থ জঘন্যচরিত্রের ব্যক্তি মনে করতেন তা তাঁব 'বাঙ্গালাব ইতিহাস'-এব 'বিজ্ঞাপন' থেকেই জানা যায়-"এই পুস্তকে, অতি দুর্বাচার নবাব সরাজ উদ্দৌলার সিংহাসনাবোহণ অবধি, চিরস্মরণীয লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক মহোদবেব অধিকার সমাপ্ত বৃত্তান্ত বর্ণিত আছে।" অবস্তু অন্ধকূপহত্যার অপবাধ থেকে তিনি সিরাজকে মুক্তি দিয়েছেন, "কিন্তু তিনি পরদিন-প্রাতঃকাল পর্যন্ত, এই ব্যাপাবেব বিন্দুবিসর্গ জানিতেন না। সে রাত্রিতে সেনাপতি মাণিকচাঁদের হস্তে দুর্গের ভার অর্পিত ছিল; অতএব, তিনিই এই সমস্ত দোষের ভাগী।" সিরাজেব নারীর প্রতি অত্যাচার ও ধনসম্পত্তির ওপর লোভ (পৃ. ১০৭), ৫৬ মূচের মতো ক্রোধোন্মত্ততা (পৃ ১১৪), অব্যবস্থিতচিত্তত। (পৃ. ১১৫), দুর্দান্ত প্রকৃতি (পৃ. ১১৫), নিষ্কৃরতা ও স্বেচ্ছাচারিতা (পৃ. ১১৫) প্রভৃতি দোষগুলি বর্ণনায় তিনি মার্শম্যানকেই অনুকরণ করেছেন। মার্শম্যান সিবাজকে "A Monster of Cruelty"; বিদ্যাসাগব বলেছেন "নৃশংশ রাক্ষস।" এ অবশ্য দু-এক স্থলে তিনি মার্শম্যানের মন্তব্যের সঙ্গে কিছু নিজ মন্তব্যও জুড়ে বিবেছেন। মার্শম্যান লিখেছেন, "There can be no doubt that Nanda Koo nar was one of the most infamous characters among the natives" কিন্তু বিদ্যাসাগব এব সঙ্গে আব একটি পঙক্তি যোগ কবে দিয়েছিলেন, "নন্দমার দুরাচার ছিলেন এথার্থ বটে, কিন্তু, ইম্পি ও হেস্টিংস তাব অপেক্ষা অধিক দুরাচার, তাহাতে সন্দেহ নাই।"

হাতপূর্বে হিন্দী থকে বাংলা অনুবাদে বিয়াসাগবের কৃতিত্ব সম্বন্ধে দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। ই'বেজা থেকে বাংলা অনুবাদেও যে তিনি অসাধারণ শিলী ছিলেন, এখানে মার্শম্যান ও তাব বচনা পাশাপাশি বেগে তার প্রমাণ দেওবা বাচ্ছে:

মার্শম্যান- "There was in the fort at this time a room, eighteen feet long by fourteen, with only one window at each end to admit air, in which turbulent soldiers used to be confined Into this small chamber, the Mahomedans thurst all the European prisoners in the hottest month of the year Gradually one after another sank dow dead on the floor, and remainder, standing on this heap of bodies, had more room to bicathe in, and thus a few survived" (১৮৫ নাালব 1519 1.4 Dh)

বাগব "তৎকালে ছশের মধ্যে, দীলে বার হাত, প্রস্থে ন। তা এরূপ এক গৃহ ছিল। বাবুসকাণের নিনিষ, ঐ গ্রহেণ একক। দকে এক কনাত্র গবাক্ষ থাকে। ৩ বেজেলা কলহকাবা ঘর'ত্ত সৈনিক- থেকে ঐ গৃহে কদ্ধ কবিবা ব্যাপতেন। নবাবের সন পতি, দা গ্রীষ্মকালে, সনস্ত যুগোপীব বন্দীদিগেব ঐ ক্ষুদ্র গৃহে নিক্ষিপ্ত করিলেন এক এক জন কবিবা ক্রমে এমে, নেকে পরত্ব পাই।। ভূতৎশাণী হইপ। অবশিষ্ট ব্যাক্তবা শববাশিব উপব দাঁড়াইবা, নিশ্বাস আকষণের

অনেক স্থান পাইল, এবং তাহাতেই কয়েকজন জীবিত থাকিল।"

(এই সংগ্রহেব ১০৭-১০৮ পৃষ্ঠা) এ অনুবাদ মূলান্তগ, অথচ মৌলিক বচনাব লক্ষণযুক্ত। ইংবেদী থেকে অন্তবাদে তিনি কতটা পাবঙ্গম ছিলেন, তা তার 'ভ্রান্তিবিলাস' পডলেই বোঝা যাবে। অথচ তিনি ভালো কবে ইংরেজী শেখাব প্রথম প্রযোজন বোধ কবেন ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে সেবেস্তাদাবেব পদ গ্রহণেব পব। সেকালে গোডাব দিকে সংস্কৃত কলেজে ই'বেজী শেখাবার কোন ব্যবস্থা ছি না। এদিকে সংস্কৃত কলেজের দেবভাষামুবাগী ছাত্রগণও

বাস্তব জগতে চলবার চ্য ই-বেঙ্গী শিক্ষার প্রযোজনীতা বোধ করতে লাগল। ১৮২৭ সালে এই ছাত্রেরা সম্প্রবম ইংরেজী শিক্ষার সুযোগ লাভ কবল। অব্য ইংরেজী ভাষার শিক্ষা প্রব:৩৩ হলেও এ তখনও অব্য শিক্ষণীব বিষব হয় নি। ব্যাকবণশ্রেণী থেকে ছাএগণ ইচ্ছা করলে ই-বেজী শ্রেণীতে ইংবেদী শিক্ষাব জন্ত যোগ দিতে পারত। বিগাসাগর ১৮৩০ সালে ব্যাকরণের মুগ্ধবোধ শ্রেণীতে পড়তে পড়তে ই বেজী ক্লাসে যোগ দিবেছিলেন। ১৮৩৩-৩৪ খ্রীস্টাব্দের বার্ষিক পরীক্ষায় ইংবেজীব পঞ্চনশ্রেণীব ছাত্ররূপে তিনি পাবিতোস্কি পেযেছিলেন। সংস্কৃত কলেজে অধ্যযনেব কালে তিনি মাটামুটি ইংবেদী জ্ঞান সংগ্রহ করেছিলেন, এবং সেই বয়সেই তিনি "বহুল পবিমাণে ইংবাজী ভাব ই'বাগী চিন্তাব সংদ্যর্শে" (চণ্ডীচবণ-পৃ. ৬৯) আসেন। ১৮৩৫ খ্রীস্টাব্দে কিন্তু সংস্কৃত কলেজ থেকে ইংরেজী শিক্ষার ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু ১৮:৯ খ্রীস্টাব্দে উক্ত কলেজের ছাত্রেবা পুনবাব ইংবেজী চালু কবাব দ্য সেক্রেটাবী জি টি মার্শালের নিকট আবেদন কবেন, স্বাক্ষবকাবীদের মধ্যে ঈশ্ববচন্দ্র শর্মাব নামও ছিল। সংস্কৃত কলেজ থেকে ই'বেজী তুলে দেওবা হলেও মাদ্রাসা থেকে কিন্তু ই'বেজী লুপ্ত হয় নি, এবং তাব উন্নতিই হচ্ছিল। এই জন্য সংস্কৃত কলেজের ছাত্রেণা সেক্রেটাবীব নিকট এই মর্মে আবেদন করেন: “অতএব এইক্ষণে প্রার্থন। যে, অনুগ্রহপূর্ব্বক রী তাহসাবে আমাদিগেব ইংবাজিভাষাভ্যাসের অনুমতি প্রকাশ হব তাহা হইসে ক্রমে বাজকীয় কার্য্য ও শিল্পাদি বিথ্যা জানিবা লৌকিক কার্য্য নির্ব্বাতে সমর্থ হইতে পাবি।" এব ফলে ৮৪২ সালে সংস্কৃত কলেজে আবার ইংরেজী শিক্ষা প্রবর্তিত হয়, কিন্তু এবাবেও এ বিভাগের বিশেষ উন্নতি ৩য নি। অতঃপর উত্তরকালে স্বৎ' বিয়াসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হযে (১৮৫১) ই বেজী শিক্ষাব একি তব সুষ্ঠু ব্যবস্থা কবেন- ১৮৫৩ সাল থকে বীতমতো এবং নিম্নমানুণভাবে ইংবেদী শিক্ষা পুনঃ প্রতিত হব। এব পূর্বে তিনি নিজেব চেষ্টার ইংবেদী ভাষার মাটামুটি জ্ঞান অর্জন করেছিসেন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে সেরেস্তাদাবের পদে বোগ দিবে প্রশ্নেজনের অনুবোধে। তনি ইংবেদী ভাষা উত্তমরূপে আবত্ত করবার জন্য সচেষ্ট হলেন। এসমষ দত্ত নস্কৃত কলেে অধ্যক্ষের পর থেকে সবে গেলে (১৮৫০) শিক্ষাপবিষদ বঙ্গীয় সরকারকে সেই পদে বিদ্যাসাগরকে নিযুক্ত করতে সুপারিশ করলেন এবং তিনি যে ইংরেজী ভাষান বিজ্ঞ একথাও তাঁবা জানালেন, "একদিকে তিনি ই'বাজী ভাষার অভিজ্ঞ, অন্যদিকে সংস্কৃত- শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীর পণ্ডিত। 

যাই হোক বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে শিক্ষকতা কার্যে যোগ দিয়ে ইংরেজী শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করলেন। পরবর্তীকালে ভারতীয় রাজনীতির জনকস্থানীয় সুরেন্দ্রনাথের পিতা ডঃ দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলমাধব মুখোপাধ্যায়, শামাচরণ সরকার, রামরতন মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ গুপ্ত, আনন্দকৃষ্ণ বস্তু, অমৃতলাল মিত্র উৎকৃষ্ট জ্ঞান অর্জন এবং শ্রীনাথ ঘোষের কাছে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে উৎকুষ্ট জ্ঞান অর্জন করেন। তাঁর শিক্ষকেরা কউ তাঁর ছাত্রস্থানীয় কেউ-বা বন্ধু। ইংরেজী ভাষায় তিনি কতটা অভিজ্ঞ হয়েছিলেন, তার নানা প্রমাণ ইতস্ততঃ ছড়িয়ে আছে। ইংরেজী থেকে বাংলা অনুবাদেও তিনি বাংলা ভাষার মূল বৈশিষ্ট্য বাজায় রাখবার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। একবার অক্ষয়কুমার দত্তের ইংরেজী থেকে বাংলা অনুবাদ পড়ে তিনি বলেছিলেন, "লেখা বেশ বটে; কিন্তু অনুবাদের স্থানে স্থানে ইংরেজী ভাব আছে।"৫৭ এরপর তিনি অক্ষয়কুমারের বাংলা অনুবাদের ইংরেজী ভাব সংশোধন করে দিতেন। তিনি শেকস্পীয়রের নাটক অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পড়েছিলেন। শোভাবাজারের আনন্দকৃষ্ণ বস্তুর কাছে তিনি প্রত্যহ রাত্রিতে শেকস্পীয়র পড়তে যেতেন। ৫৮ সুতরাং 'বাঙ্গালার ইতিহাস' যে একখানি সুললিত অনুবাদগ্রন্থ হবে তাতে আর সন্দেহ কি? তবু এ গ্রন্থ স্কুলপাঠ্য গ্রন্থ, কোন মৌলিক রচনা নয়। এবং মৌলিক রচনা নয় বলে, তিনি মার্শম্যানের মূল গ্রন্থকে ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেছিলেন-অবশ্য কোন কোন উপাদান তিনি অন্য স্থান থেকেও নিয়েছিলেন। উপরন্তু এটি পাঠ্যপুস্তক বলে ইতিহাস সম্পর্কে কোন বিতর্ক ব্যাপারের অবতারণা তাঁর অভিপ্রেত ছিল না। বিস্তারিত আকারে ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনা করবেন বলে বিদ্যাসাগর অনেক উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। দুঃখের বিষয় নানা কারণে, শারীরিক অসুস্থতার জন্মই, এ কার্যে তিনি হস্তক্ষেপ করতে পারেন নি। যদি তিনি এই বিপুল পরিশ্রমসাধ্য কর্মে সফল হতেন তা হলে বাঙালীর লেখা একপানি মৌলিক ইতিহাস-গ্রন্থ বাঙালীর গৌরব বৃদ্ধি করত, বাংলায় ইতিহাস-সাহিত্যেরও শ্রীরদ্ধি হত। 

১৮৪৯ খ্রীস্টাব্দে (১৭৭১ শকাব্দ) চেম্বার্স' প্রণীত "Exemplary Biography-ব কয়েক জন পাশ্চাত্য মনীষীর জীবনকথা অবলম্বনে বিস্সাসাগবেব 'জীবনচবিত' প্রকাশিত হর। এব সবটাই মূলেব অনুবাদ। "এতদ্দেশীয বিদ্যার্থিগণের পক্ষে বিশিষ্টরূপ উপকাব দর্শিতে পাবে" এই মনোভাবের বসে তিনি চেম্বার্সেব স্কুলপাঠ্য গ্রন্থ থেকে বেছে নিবে কোপানিকান, গ্যালিলিও, নিউটন, হর্শেল, গ্রোশ্বাস, লিনিয়স, ডুবাল, উইলিযম জোন্স ও টমাস জেদ্বিন্স-এব জীবনচবিত সঙ্কলন কবেন। তখন এদেশে ছাত্রদেব জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাবাব উপবোগী এবং চবিত্রগঠনেরব অনুকূল বিশেষ কোন বাংলা পাঠ্য- পুস্তক প্রচলিত ছিল না। স্কুলবুক সোসাইটি, ভার্নাক্লাব লিটাবেচব সোসাইটি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কযেকখানি বালপাঠ্য পুস্তক বচিত হযেছিল বটে, কিন্তু তাব ভাষা শিক্ষারী বালকদের উপযোগী ছিল না, বিষণগুলি ও চবিত্রগঠনেও ৩৩৮। এমুকুল বলে বিবেচিত হবান। বিজ্ঞাসাগব এই জন্ম জনপ্রিব ইংরেজী পাঠ্যপুস্তক চেম্বাসে ব উক্ত 'বাবোগ্রাফি'-ব অন্তর্ভুক্ত কয়েকজন পাশ্চাত্য মনাধার জীবনচবিতের সবল অনুবাদ কাবেন। এই জীবনচর্বিতগুলির অধিকাংশই কোন বৈজ্ঞানিকের জীবনকথা। জ্যোতির্বিদ, উদ্ভিদতত্ত্বজ্ঞ, ভিসকশাস্বজ্ঞ, শিক্ষাব্রতা, ভারততত্তাবদ-বিবিধ পাশ্চাত্য মনীষীর কাহিনী অণুবার কবে তিনি বালক-বালিকাদের চ বজ্রগঠনের উপযোগা পাঠ্য গ্রন্থ সংকলন কবোছলেন। এব সমস্ত চর্বিত্রই যুবোপী।, শুধু টমাস জোন্স আফ্রিকার নিগ্রো বাজবাব ছিলেন। তিান এককার হবেও।শক্ষাদীক্ষা লাভ কবে অধ্যাপকরণে স্বতাঙ্গের মতোই সম্মান লাভ কবেছিলেন। অবশ এই নিগো বাজকুনাব সুবোপ থেকে বিদ্যা অজন করোহান বটে, কিন্তু দেশে ফিরে গিয়ে অনুন্নত কাফ্রি দম জে শিক্ষা বিস্তার না করে সর্বোণে বন্ধে বান বলে বিদ্যানাসব তাঁর জীবনকথা লেখার পর এই মন্তব্য কবেন, " বাধঃব কান পাকা তৈবা সমাজের বাজানো।জদিদের স্বদেশে প্রতিপ্রেবিত হওবাই উচিত ছিল। প্রাচা হইলে তিনি তখার পৈতৃক প্রজাগণের সভাতাসম্পাদন ও ভাতাদিগকে শিক্ষা প্রদান কবিতে পাবিতেন।" (বিঙ্গাসাগর- চেনাবলী পৃ. ১২৯)

এই জীবনচরিতগুলিতে দেখা যাবে, বিদ্যাসাগব মূলতঃ বৈজ্ঞানিক ধবনের চবিত্রই বেছে নিবেছিলেন এবং ধাবা অদৃষ্টের ওপর নিভব না কবে নিজেব চেষ্টা। ওপব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, বিদ্যাসাগব তাঁরেও জীবনকথা অতি যত্নের সঙ্গে সংগ্রহ কবেছিলেন। এই গ্রন্থে পদার্থবিদ্যা, বলবিজ্ঞান, উদ্ভিদ্‌৩৫ ও জ্যোতিবিদ্যা সংক্রান্ত অনেক শব্দের পবিভাষাব প্রয়োজন হযেছিল। গ্রন্থেব শেষে তিনি কয়েকটি ইংবাজী শব্দের বাংলা পরিভাষা তৈবি কবে নিয়েছিলেন। যথা-Heraldry-কুলাদর্শ, Museum-চিত্রশালিকা, Numismatics-টঙ্কবিজ্ঞান, Optics-দৃষ্টি বিজ্ঞান, Mineralogy-ধাতুবিদ্যা, Astrology-নক্ষত্রবিদ্যা, Perspective- পরিপ্রেক্ষিত. Ticket-প্রবেশিকা, Reflecting Telescope- প্রাতিফলিক দূরবীক্ষণ, Meta- physics -মনোবিজ্ঞান, State-মণ্ডল, Revolution-রাজবিপ্লব, Index-শঙ্গু, Elasticity-স্থিতিস্থাপক। এই পরিভাষার অনেকগুলি এখনও ব্যবহৃত হয়। পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞা, উদ্ভিদবিদ্যা-সংক্রান্ত পরিভাষাগুলি তৈরি করতে গিয়ে তিনি বহু চিন্তা করেছিলেন। তবে "সঙ্কলিত শব্দ সকল বিশুদ্ধ ও অবিসম্বাদিত হইয়াছে কিনা" সে বিষয়ে তিনি কিছু সংশয়যুক্ত ছিলেন।

এ ধরনের জীবনচরিত রচনার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল-পরিশ্রম, অধ্যবসায়, উৎসাহ, সহিঞ্চুতা প্রভৃতি মানসিক, গুণের সহায়তায় সাধারণ লোকও কতটা অসাধারণত্ব লাভ করতে পাণে ছাত্রসমাজের কাছে তার আদর্শ তুলে ধরা। দ্বিতীয়তঃ বিদেশী মহাপুরুষদের জীবনী বর্ণনা প্রসঙ্গে "আনুষঙ্গিক তত্তং দেশের রীতি, নীতি, ইতিহাস ও আচার পরিজ্ঞান হয়।" ছাত্রসমাজ বিদেশ সম্বদ্ধেও জ্ঞান সংগ্রহ করুক-এও তাঁর অভিপ্রায় ছিল।

অনুবাদ করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর দেখলেন, "বাঙ্গালা ভাষার ইঙ্গরেজী পুস্তকের অনুবাদ কবিলে প্রায় সুস্পষ্ট ও অনায়াসে বোধগম্য হয় না" ('জীবনচরিতে'র ২য় সংস্করণে বিজ্ঞাপন)। তাই তাঁব মনে হয়েছিল, বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক চিন্তাযুক্ত ইংরেজী গ্রন্থের সরল বাংলায় অনুবাদকর্মের তখনও সময় হয় নি। এই জন্য এই 'জীবনচরিত' অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত করেন, তিনি আর কোন ইংরেজী গ্রন্থের অনুবাদ করবেন না। অবশ্য এর পরেও তিনি একাধিক ইংবেডী গ্রন্থেব বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন।

'জীবনচরিতে'র চরিত্রগুলি সাধারণ ছাত্রের কাছে কিছু নীরস মনে হবে, বর্ণিত বিষয়ের সঙ্গেও সেযুগের অধিকাংশ পাঠার্থীর কিছুমাত্র যোগ ছিল না; উপরন্তু এতে যে সমস্ত স্থান, জনপদ ও ব্যক্তির প্রসঙ্গ ছিল তাও স্কুল-পাঠশালার ছাত্রের নিকট কিছু দুজ্ঞেয় মনে হয়েছিল। এই জন্য 'জীবনচরিতে'র ভাষা ঈসং গুরুভাব বলে মনে হয় এবং সে সম্বন্ধে স্বয়ং অনুবাদক অতিশয় অবহিত ছিলেন।

আরও একটা কথা -প্রথম সংস্করণের গ্রন্থগুলি ছ' মাসের মধ্যে নিঃশেষিত হলেও তিনি এ গ্রন্থের ভাষাগত অনভ্যস্ততার জন্য এর পুনর্মুদ্রণ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত করেছিলেন। তখন তিনি "বাঙ্গালায় এক নূতন জীবনচরিত পুস্তক সঙ্কলন" করবার বাসনা ও উদ্যোগ করেছিলেন। এই "নূতন জীবনচরিত” যথার্থতঃ কোন্ কোন্ ব্যক্তির চরিত্র অবলম্বন করে লেখবার সংকল্প করেছিলেন তা বোঝা যাচ্ছে নাঁ। 

'জীবনচরিত' প্রকাশিত হলে কেউ কেউ মনে করেছিলেন, এ গ্রন্থ পাঠ করে আমাদের দেশের বালকেরা বিদেশী মনীষীদের শ্রদ্ধা করতে শিখবে বটে, কিন্তু যাতে তারা স্বদেশের মহাপুরুষদেরও শ্রদ্ধা করতে পারে সে সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর কিছু লেখেন নি। অবস্তা তিনি দেশীয় ব্যক্তিরও গুণগ্রাহী ছিলেন, কর্মবীর মতিলাল শীল এবং দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনচরিত লিখবেন সিদ্ধান্ত করেছিলেন; কিন্তু সময়াভাবে তা কার্যে পরিণত করতে পারেন নি। শোনা যায়, তাঁর বন্ধু, শোভাবাজারের রাধাকান্ত দেবের দৌহিত্র আনন্দকৃষ্ণ বহু বিদ্যাসাগরকে স্বদেশীয় ব্যক্তির জীবনচরিত লিখতে অনুরোধ করেছিলেন (বিহারীলাল সরকার, পৃ. ২৪৩)। বিদ্যাসাগর এ প্রস্তাবে সম্মত হয়ে কিছু কিছু উপাদান, তথ্য ও গ্রন্থ সংগ্রহও করেছিলেন। এটাই কি তাঁর 'নূতন জীবনচরিত'-এর উপাদান? তাঁর বন্ধু ও পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ অমূল্যচরণ বস্তুও এইজন্ত তাঁকে অনেক গ্রন্থ সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু নানা ব্যাপারে ব্যস্ত থাকার জন্য তাঁর এই ইচ্ছা কার্যে পরিণত হয় নি। তিনি যদি তাঁর সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ বাঙালীদের সম্বন্ধে কিছু লিখে যেতেন, তাহলে বাংলার চরিতসাহিত্য যে অধিক তর বলশালী হত তাতে সন্দেহ নেই।

১৮৫১ সালে 'বোধোদয়' প্রকাশিত হয়। প্রথমে এর নাম ছিল 'শিশুশিক্ষা- ৪র্থ ভাগ' তাঁর অভিন্নহৃদয়-বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার তিনভাগ 'শিশুশিক্ষা' রচনা করেছিলেন। (১ম-২য়-১৮৪৯, ৩য়-১৮৫০) বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ের (তখন নাম ছিল হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়) বালিকাদের জন্ম। ৩২ তারই আদর্শে ও ধারাবাহিকতা বজায় রেখে তিনি প্রথমে 'বোধোদয়'-কে 'শিশুশিক্ষা ৪র্থ ভাগ' রূপেই চিহ্নিত করেছিলেন। মদনমোহনের 'শিশুশিক্ষা' বেশ স্থললিত ও সরস। একদা এই পুস্তিকা- গুলি বালক-বালিকাদের একমাত্র স্কুলপাঠ্য গ্রন্থ ছিল। কিন্তু 'বোধোদয়ের'র ভাব, ভাষা ও বর্ণনার নীতি ঠিক শিশুর উপযোগী নয়। বিদ্যাবুদ্ধি একটু পরিপক্ক না হলে 'বোধোদয়ে'র বিষয়বস্তু বালকবালিকার ঠিক বোধগম্য হয় না। বলা বাহুল্য এ গ্রন্থও তিনি বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ের জন্যই রচন। কবেছিলেন। কারণ দীর্ঘকাল ধরে তিনি বেখুন বালিকা বিদ্যালয়ের সম্পাদকরূপে ঐশিক্ষা প্রচারে আত্মনিয়োগ করে ছিলেন। বালিকাদের মনঃপ্রণালী গঠনের প্রয়োজনীয়তা তাঁর চেয়ে কে বেশী বুঝতে পারতেন?

বাল্যশিক্ষা-সংক্রান্ত গ্রন্থ নির্বাচন ব্যাপারে তিনি উইলিয়ম ও রবার্ট চেম্বার্স ভ্রাতৃদ্বয়ের রচিত ও সঙ্কলিত ইংরেজী গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতেন। ফ্রেডারিক জে. হালিডে ছোটলাটপদে যোগ দেবার (১৮৫৪) পূর্বে কিছুকাল শিক্ষা-পরিষদের সদশ্য ছিলেন। বাংলা ভাষায় কীভাবে অতি দ্রুত শিক্ষা বিস্তার করতে পারা যায় এ বিষয়ে তিনি (১৮৫৪, মার্চ) একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করেন। সে রিপোর্টের মূল হচ্ছে বিদ্যাসাগর প্রদত্ত তথ্য (১৮৫৪, ফেব্রুয়ারি)। বিদ্যাসাগর বালা শিক্ষা প্রচার ও বাংলা স্কুল-পাঠশালার ছাত্রদের জন্য পাঁচভাগে শিশুশিক্ষাবিষয়ক প্রাথমিক পুস্তক প্রচলনের কথা বলেন। 'শিশুশিক্ষা' তিনভাগে আছে- বর্ণপরিচয়, বানান এবং পঠনশিক্ষা; চতুর্থভাগে জ্ঞানোদয় সম্পর্কিত একখানি ছোট বই এ খানাই 'বোধোদয়'। পঞ্চমভাগে ছিল Chembers Educational Course-এর অস্বর্গত কয়েকটি নীতি- পাঠের অনুবাদ।

'বোধোদয়' চেম্বার্সের Rudiments of Knowledge অবলম্বনে রচিত হলেও বিদ্যাসাগর জন্ম গ্রন্থ থেকেও এব উপাদান স গ্রহ করেছিলেন।৬৩ এতে পদার্থ মানব- জাতি, ভাষা, কাল, গণনা-৭স্ব, বর্ণ, বস্তুব আকাব-পরিমাণ ক্ররবিক্রয় মুদ্রা নানা ধাতু, নদী-সমুদ্র, উদ্ভিদ, জন্ম, খনিজপদার্থ, শিল্পবাণিজ্য প্রভৃতি শলকদেব ও বশ্য জ্ঞাংবা বস্তুব সমাবেশ করা হয়েছিল। অপ্রাপ্তবংস্ত বালকবালিকাবা যাতে একখানি প্রাথমিক পাঠ্যপুশুক থেকেই জগৎ সম্বন্ধে মোটামুটি জ্ঞান সংগ্রহ করতে পাবে, এই ছিল বিদ্যাসাগবেব উদ্দেশ্য। এটি যে কত জনপ্রিয হযেছিল-তাব প্রমাণ এব অসংখ্য সম্ভবণ। তাঁব জীবি একাসেব মধ্যেই এব প্রায় এক শ' সংস্কবণ হয়েছিল।

এই নিতান্ত বালপাঠ। স্কুলেব পুস্তক সম্বন্ধেও একদা মতভেদেব ৩ বকাশ ঘটেছিল। এতে বিজ্ঞানবিষয়ক যে সমস্ত তথ্য আছে, তাতে নাকি কিছু তথ্যগত ভুলভ্রান্তি ছিল। পাঠকেবা সেই ভুলগুলি বিদ্যাসাগরকে দখিয়ে দিলে তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে তা সংশোধন কবে দিয়েছিলেন। ত্রিপুবা জেলাব কঙ্গা গ্রামেব বীড়ি ক্লাবের সম্পাদক মহম্মদ বেষাজ উদ্দিন আহম্মদ, ডাঃ চন্দ্রমোহন ঘোষ, 'শ্রীমন্ত সন্দাগব' পত্রিকার সম্পাদক-এ বা যেখানে যে ভুল দেখিয়ে দিয়েছেন, বিদ্যাসাগব তাব পববর্তী সঙ্গবণে সগুলি শুদ্ধ কবে এ দেব নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ গ্রন্থেব একটি বিষয় নিয়ে সে যুগে পাঠকমহলে কিঞ্চিৎ বিতর্কের সৃষ্ট হয়েছিল।

'বোধোদয়ে'র প্রথম সংস্করণে বহির্জগৎ ও মানবজীবনসম্বন্ধে নেক এথা সম্বলি হলেও ঈশ্বব সম্বন্ধে কোন উল্লেখ ছিল না। এতে নাকি বিজযরুষ্ণ গোস্বামী তাঁকে বলেন, "মহাশয়, ছেলেদের জন্য 'মন সুন্দর একখানি পাঠ্যপুস্তক বচনা কবিশেন, বাকিদেব জানিবার সকল কথাই তাহাতে আছে কেবল ঈশ্বর বিষয়ে কান কথা নাই কেন ?"

বিদ্যাসাগর তখন একটু হেসে বললেন, "ধাহাবা তোমার কাছে এরূপ পাপন, তাঁহাদিগকে বলিও এইবাব যে বোধোদ্য ছাপা হইবে তাহাতে ঈশ্বরের কথা থাকিবেক। "১৬ পরবর্তী সংঙ্গবণে তিনি প্রথমে পদার্থেব সংজ্ঞাদি বর্ণনা কবে দ্বিতীয প্রস্তাবে 'ঈশ্বর' বিংয়ে লিখলেন, "ঈশ্বর নিবাকাব চৈতন্যস্বরূপ। তাঁহাকে কেই দেগিতে পায় না, কিন্তু তিনি সর্বদা সর্বত্র বিদ্যমান আছেন।" পবে এব পাঠ আরও সংশোধিত হয়ে এই আকার ধাবণ করে: "ঈশ্বর, কি প্রাণী, কি উদ্ভিদ, কি জড, সমস্ত পদার্থের সৃষ্টি কবিয়াছেন। এ নিমিত্ত ঈশ্বরকে সৃষ্টিকর্তা বলে। ঈশ্ববকে কেহ দেখিতে পায় না; কিন্তু তিনি সর্বদা সর্বত্র বিদ্যমান আছেন। আমরা যাহা করি তাহা তিনি দেখিতে পান, আমরা যাহা মনে ভাবি, তিনি তাহা জানিতে পারেন। ঈশ্বর পবম দয়ালু। তিনি সমস্ত জীবেব আহার-দাতা ও রক্ষাকর্তা।" (বিদ্যাসাগর রচনাবলী, পৃ. ২৫৩৬৫। 'ঈশ্বব নিবাকাব চৈতন্যস্বরূপ'-১৮৪১ সালে প্রদত্ত বক্তৃতায় দেবেন্দ্রনাথ নাকি এই উক্তি করেছিলেন। যাঁরা ব্রহ্মমতানুকূল ছিলেন না (যথা-চরিতকার বিহারীলাল সবকার) তাবা এ পঙক্তিটি সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ বিরূপতা প্রকাশ করেছেন।৬৭ বিদ্যাসাগব এই বাল্যপাঠ্য পুস্তকটিকে কোন দার্শনিক ও জটিল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকথা পবিবেশন করতে চান নি, তর্কের কচকচি এলসের আরাম কর্মযোগী ও শিক্ষা প্রচারক বিদ্যাসাণব এ সমস্ত দার্শনিক তর্কাতর্কির ঘোব শত্রু ছিলেন। অনেকটা 'প্রাগম্যাটিকে'র মতো বস্তুব উপযোগেব দ্বাবা তিনি বস্তুর মূল্য নির্ণয় করতেন। তা না হলে সংস্কৃত ঐতিহ্যেব কর্ণধার হয়েও তিনি "বেদান্ত ও সাংখ্য যে ভ্রান্তদর্শন, এ সম্বন্ধে এখন আব মতদ্বৈধ নাই''৬৮-এ রকম সাংঘাতিক কথা অবলীলাক্রমে বলতে পারতেন না। শিক্ষাবিভাগের সম্পাদক (কাউন্সিল অব এডুকেশনের সেক্রেটারী) এফ. জে. ময়েট সায়েব সংস্কৃত কলেজের শিক্ষাপ্রকরণকে আধুনিক করবার অভিপ্রায়ে বিদ্যাসাগরকে একটি রিপোর্ট দিতে অনুরোধ করলে তিনি সেই প্রসঙ্গে (১৮৫০, ১৬ ডিসেম্বর) হিন্দুদর্শন সম্বন্ধে বলেন, "ইহা অতি সত্যকথা যে, হিন্দুদর্শনশাস্ত্রের অধিকাংশের সহিত আধুনিক সময়ের উন্নত চিন্তার সেই সাদৃষ্ণ অল্পই লক্ষিত হয়।... যুবকেরা এই পদ্ধতি অনুসারে (অর্থাৎ ইংরেজী শিখে পাশ্চাত্যদর্শন অধিগত করলে) শিক্ষিত হইলে সহজেই প্রাচীন হিন্দুদর্শন-শাস্ত্রের ভ্রমপ্রমাদাদি প্রদর্শন করিতে সমর্থ হইবে।"৬৯ এই উল্লেখ থেকে বোঝা যাচ্ছে, আধুনিক বিশ্ববোধের পটভূমিকায় তিনি হিন্দুদর্শনকে কোন্ দৃষ্টিতে দেখতেন। তাঁর ব্যক্তিগত আচার-আচরণে রক্ষণশীল মতের কেউ কেউ তাঁর ওপর প্রচ্ছন্নভাবে বিরূপ হয়েছিলেন। ঈশ্বর সম্বন্ধে বন্ধুমহলে তিনি যে সমস্ত অভিমত প্রকাশ করতেন তার জন্যও কেউ কেউ তাঁকে হিন্দু আচারের কোটর থেকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতেন। সুতরাং 'বোধোদয়ে'র প্রথম পৃষ্ঠায় পদার্থ সম্বন্ধে কয়েক পঙক্তি লেখার পর স্বল্প কয়েক ছত্রে ঈশ্বরের কথা-তাও আবার পৌরাণিক দেবসঙ্ঘ নয়, একেবারে ব্রাহ্মসমাজঘেঁষা 'ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্ত্যস্বরূপ'-ব্রাহ্মবিদ্বেষী রক্ষণশীল হিন্দুর পক্ষে এ উক্তি পরিপাক করাও কিছু আয়াসসাধ্য। কিন্তু 'বোধোদয়ে'র কয়েক স্থলেই ঈশ্বরের উল্লেখ আছে। যেমন- "ঈশ্বর কেবল প্রাণীদিগকে চেতনা দিয়াছেন। তিনি ভিন্ন আর কাহারও চেতনা দিবার ক্ষমতা নাই"। (বিদ্যাসাগর রচনাবলী, পৃ. ২৫৪) "ঈশ্বর কি অভিপ্রায়ে কোন বস্তুর সৃষ্টি করিয়াছেন আমরা তাহা অবগত নহিবিশ্বকর্তা ঈশ্বরের সন্নিধানে, সকল বস্তুই সমান।" (ঐ, পৃ. ২৫৬) আসলকথা, "সুকুমারমতি বালক-বালিকারা অনায়াসে বুঝিতে পারিবেক, এই আশায় অতি সরলভাষায় লিখিবার নিমিত্ত" বিদ্যাসাগর চেষ্টা করেছিলেন তাই এতে অনাবশ্যক, জটিল ব্যাপার পরিত্যাগ করেছেন। এতে তিনি "ইতস্ততঃ পরিদৃশুমান বস্তু সমূদয়কে” পদার্থ বলেছেন বলে বিহারীলাল সরকার দার্শনিক তত্ত্ব উত্থাপন কবে এ কথার বিরুদ্ধে বলেছেন, "পদার্থ শব্দের এরূপ অর্থগ্রক বড় অর্থহীন। সংস্কৃত দর্শনে যাহা কিছু শব্দবাচা, তাহাই পদার্থ। জাতি, গুণ, অধিক কি-অভাবও পদার্থ"। 

ভারতীয় দর্শনে অতিশয় অভিজ্ঞ বিদ্যাসাগর পদার্থের দার্শনিক অর্থ যথেষ্ট অবগত ছিলেন। কিন্তু দার্শনিক জ্ঞানের চেয়ে আর একটি জ্ঞান তাঁর আরও বেশী অধিগত হয়েছিল-তার নাম কাণ্ডজ্ঞান। তাঁর প্রখর কাণ্ডজ্ঞান ছিল বলে তিনি অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক-বালিকার মাথায় 'ঘটত্ব-পটত্বে'র পাষাণভার চাপাতে চান নি। বাস্তব জীবনে চলবার জন্য তাদের যেটুকু সাধারণ জ্ঞান দরকার, তিনি তাদের তাই দিতে চেয়েছিলেন। সেদিক থেকে 'বোধোদয়' আদর্শ গ্রন্থ।

১০.

বাঙালী ছাত্রকে সহজে সংস্কৃত ব্যাকরণ শেখাবার জন্য বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষপদে আসীন থাকাকালে 'সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা' (সংক্ষেপে 'উপক্রমণিকা') রচনা ও সঙ্কলন করেন (১৮৫১)। উক্ত পুস্তিকার বিজ্ঞাপনে তিনি বিস্তারিতভাবে এই ব্যাকরণ রচনার কারণ ও প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে লিখে গেছেন। সংস্কৃত কলেজের বালকদের মুগ্ধবোধ, ধাতুপাঠ ও অমরকোষ পড়তে হত। তারা অর্থ না বুঝে গ্রন্থগুলির পাঠ্যাংশ কণ্ঠস্থ করার চেষ্টা করত। মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ আয়ত্ত করা বড় দুঃসাধ্য, আয়ত্ত করলেও এর দ্বারা খুব বেশী উপকৃত হওয়া যায় না। তাই ছাত্র সমাজের সুবিধার জন্য তিনি জটিল সংস্কৃত ব্যাকরণকে এমনভাবে সরল করলেন যাতে অতি সাধারণ স্তরের বালকও দেবভাষা শিখতে কিছুমাত্র আয়াস বোধ না করে। এই 'উপক্রমণিকা' প্রকাশিত হবার পর শুধু সংস্কৃত কলেজে নয়, সারা বাংলাদেশের ছাত্র- সমাজ প্রাথমিক সংস্কৃত শিখবার জন্য একমাত্র এই বইখানাকে অবলম্বন করেছিল। 'উপক্রমণিকা'র রচনাসম্পর্কে একটি কাহিনী তাঁর কোন কোন জীবনচরিতে পাওয়া যায়। তাঁর বন্ধুস্থানীয় রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় একটু বেশী বয়সে তাঁর কাছে সংস্কৃত শিক্ষার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। "রাজকুষ্ণবাবুর বয়োধিক্য নিবন্ধন প্রচলিত প্রথার ধৈর্যচ্যুতির সম্ভাবনা ভয়ে তিনি এই দুর্বোধ্য ও বহুকালব্যাপী মুগ্ধবোধ শিক্ষা দেওয়ার পরিবর্তে অল্প আয়াসসাধ্য কোন নূতন উপায় উদ্ভাবন" করার জন্য চিন্তিত হলেন এবং "বাঙ্গালা অক্ষরের বর্ণমালা হইতে আরম্ভ করিয়া⋯⋯⋯⋯⋯” সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মাবলী সরলভাবে উপস্থাপিত করলেন। "পরিশেষে ইহাকেই মূল ভিত্তি করিয়া 'উপক্রমণিকা'র সৃষ্টি হইয়াছিল।"৭০ বোধ হয় গোড়ার দিকে তিনি এইভাবে স্বহস্তে সংক্ষিপ্ত ব্যাকরণের নিয়মাবলী লিখে তার সাহায্যে রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সংস্কৃত শিক্ষাদানে অগ্রসর হয়েছিলেন। কারণ মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের দ্বারা সেকাজ সম্ভব নয়, তা তিনি আগেই বুঝেছিলেন। 

ছাত্রজীবনে তিনি ন' বৎসর বয়সে (১৮২৯, জুন মাস) সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে প্রবেশ করেন, তাব দেড বৎসর পরে (১৮৩১, মার্চ) বিদ্যাসাগর পাঁচ টাকা করে বৃত্তি পান এবং ১৮৩৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত-মোট তিন বৎসর ছ' মাস তিনি ব্যাকরণেব শ্রেণীতে অধ্যয়ন করেন (দ্রষ্টব্য: 'শ্লোকমঞ্জরী'র বিজ্ঞাপন)। নয় থেকে বাবো বছর পর্যন্ত মোট তিন বৎসরে তাঁকে গোটা 'মুগ্ধবোধ' পড়তে হয়েছিল, শেষ ছ' মাসে 'অমরকোষ' (মমুক্তবর্গ) এবং 'ভট্টিকাব্যে'র পঞ্চম সর্গ পর্যন্ত অধ্যয়ন করতে হয়েছিল। এই তিন বৎসর ব্যাকরণ পড়তে গিয়ে বালক বিদ্যাসাগরকে 'মুগ্ধবোধ' ব্যাকরণ নিয়ে যে হিমসিম খেতে হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। অবঞ্চ কুমারহট্ট নিবাসী গঙ্গাধর তর্কবাগীশের শিক্ষাগুণে তিনি 'মুগ্ধবোধ' ভালই আয়ত্ত করেছিলেন। কিন্তু এ ব্যাকরণ বালকের পক্ষে কত দুরূহ তা তিনি নিজেই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই ১৮৫১ সালে যখন তাঁর নেতৃত্বে সংস্কৃত কলেজের পাঠসংস্কার শুরু হল, তখন অল্পবযস্ক শিক্ষার্থীর জন্য উপক্রমণিকা এবং বয়স্ক ছাত্রের জন্ম ব্যাকরণ কৌমুদী নির্দিষ্ট হল। তিনি নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছিলেন যে, মুগ্ধবোধ- অমরকোযাদি কিছু অধিগত করতে গেলেও ন্যূনপক্ষে পাঁচ বৎসর সময় লাগে। কিন্তু যতটা পরিশ্রম ব্যয় করতে হয় সেই পরিমাণে লাভ হয় নামমাত্র। তাই সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যতালিকা থেকে মুগ্ধবোধ, ধাতুপাঠ ও অমরকোষ তুলে দিয়ে সেখানে সিদ্ধান্ত কৌমুদী নির্দিষ্ট হল। কিন্তু সংস্কৃত কলেজের প্রথম পাঠার্থীরা "নিতান্ত শিশু; শিশুগণের পক্ষে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত সংস্কৃত ব্যাকবণপাঠ কোনক্রমেই সহজ ও স্বসাধ্য নয়" ('উপক্রমণিকা'র বিজ্ঞাপন)। উপরন্তু "ধাহাবা ইঙ্গরেজী অধ্যয়ন করেন, তাঁহাদের মধ্যেও অনেকে সংস্কৃতভাষা শিক্ষা করিতে অত্যন্ত উৎসুক ও অত্যন্ত অভিলাষী হইয়া থাকেন। কিন্তু সংস্কৃত ব্যাকরণ অত্যন্ত দুরূহ ও অত্যন্ত নীরস বলিয়া সাহস করিয়া অধ্যয়নে প্রবৃত্ত হইতে পাবেন না" (ঐ)। ৭১ তাই তিনি বাংলাভাষায় সংস্কৃতভাষাব মোটামুটি শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ সম্বলন করেন। "ছাত্রেবা প্রথমতঃ অতি সরল বাঙ্গালাভাষায় সঙ্কলিত সংস্কৃত ব্যাকরণ ও অতি সহজ সংস্কৃত গ্রন্থ পাঠ করিবেক; তৎপবে সংস্কৃতভাষায় কিঞ্চিৎ বোধাধিকাব জন্মিলে সিদ্ধান্ত কৌমুদী ও রঘুবংশাদি পাঠ কবিতে আরম্ভ কবিবেক" (ঐ)।

এরপর অধিক অগ্রসর ছাত্রদের জন্য তিনি 'মুগ্ধবোধ' ও 'লঘুকৌমুদী' অবলম্বনে 'ব্যাকবণ কৌমুদী' বচনা করেছিলেন। সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণ শ্রেণীকে তিনি এমনভাবে ঢেলে সাজিয়েছিলেন যে, ছাত্রদের "চারি পাঁচ বৎসরে ব্যাকরণে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ও সংস্কৃত ভাষাতেও বিলক্ষণ বোধাধিকার জন্মিতে পারিবে” (ঐ)। 

দ্বাদশ বৎসরেব চেষ্টা ব্যতিবেকে ব্যাকরণ অধিগত হয় না-রক্ষণশীল পণ্ডিতসমাজ এই মতে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু "সংস্কৃত ব্যাকবণ বড় খল শাস্ত্র, চিবকাল উপাসনা কবিলেও, প্রসন্ন হন না। "৭২ তাই কাব্যেব শর্কবামগুন দিয়ে ব্যাকবণ শেখাবাব প্রচেষ্টা (ভট্টিকাব্য), আদাবস্তে চ হবিধ্বনি কবে 'হবিনামামত ব্যাকবণ' (জীবগোস্বামী) লিখে একই সঙ্গে ব্যাকবণ শিক্ষা ও পুণ্যার্জনেব সুলভ উপায় আবিষ্কৃত হয়েছে। তবু এব মন পাওয়া ভাব। বিদ্যাসাগব সে দুঃসাধ্য কর্ম সহজ কবলেন। বাংলাদেশে আধুনিককালে ব্যাকবণ শিক্ষাকে সহজ করবার জন্য এবং ই'বেজী শিক্ষিত সমাজের ব্যাকবণ-ভীতি দূব কবাব ভন্ত বিদ্যাসাগবেব 'উপক্রমণিকা' বিশেষভাবে সহাযক হযেছিল, 'তাতে সন্দেহ নেই।

১১.

এই প্রসঙ্গে এক খণ্ডেব অন্তর্ভুক্ত আবও দু একটি বচনা সম্বন্ধে আমবা সংক্ষিপ্ত মন্তব্য কবে এ প্রস্তাব সমাপ্ত কবব। নান। পত্রপত্রিকার সঙ্গে বিদ্যাসাগব জড়িত ছিলেন, বীতিমতো প্রবন্ধাদি দিবে সাহাব্য করতে বিশেবতঃ প্রগতিশীল ব্যাপাবে তিনি ছিলেন সহযোগিতাব উদাবহস্ত। 'সর্বশুস্কর।' (১৮৫০, ভাদ্র) নামে একটি মাসিকপত্রের সঙ্গে তাঁব কিছু যাগাযোগ ছিল। ঠনঠনের বকেওন যুকে নিলে 'সবশুভকবী' নানে একটি সভা এবং তাব মুখপত্রস্বরূপ 'সবশুভকণী পত্রিকা' প্রাতমানে প্রকাশ করবাব সংকল্প করে বিদ্যাসাগরের দ্বাবস্থ হন। এব বঙ্গে বিদ্যাসাগবের বান্ধব মদনমোহন তর্কালঙ্কাবেবও খুব বোগাযোগ ছিল। এব সম্পাদক হিসেবে নাম ছিল মতিলাল চট্টোপাধ্যাবেব। প্রতি সংখ্যাব একটি কবে দাঁর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশই এব বেশিষ্ট্য। এব প্রথম সংখ্যাব বিদ্যাসাগবের 'বাল্যবিবাহের দোষ' নামে একটি অনতিদীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় অবশ্য এতে লেখকের কোন নাম থাকত না। কিন্তু এই প্রবন্ধটি য বিদ্যাসাগবেবই বচনা তাব নানা প্রমাণ আাছে। প্রথমতঃ এব বিষ-বস্তু, ভাবাদর্শ ও যুক্তিব উপস্থাপন। বিদ্যাসাগবেব বৈশিষ্ট্যকেই স্মবণ কবিয়ে দেয়। দ্বিতীয়তঃ বিদ্যাসাগবেব তৃতীয সহোদব শম্ভুচন্দ্র বিদ্যাবত্ন ('বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিবাস' -সনৎকুমার গুপ্ত সম্পাদিত নতুন সংস্কবণ, পৃ. ৮০-৮১) এই তথ্যটি বিবৃত কবেছেন। ৭৩ এই প্রবন্ধে বিদ্যাসাগব অতি সবল ভাষায় এবং অকাট্য যুক্তি প্রযোগ করে যেভাবে বাল্যবিবাহের দোযোদ্‌ঘাটন করে বয়স্ক বিবাহের সমর্থন করেছেন, তাতেই তাঁর বিপ্লবী মনেরই পরিচয় পাওয়া যায়। নৈতিক, সামাজিক, স্বাস্থ্য, বংশানুগতি-সব দিক থেকে বিচার করেই তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন, "অতএব যে বাল্যবিবাহ দ্বারা আমাদিগের এতাদৃশী দুর্দশা ঘটিয়ে থাকে, সমূলে তাহার উচ্ছেদ করা কি সর্বতোভাবে শ্রেয়স্কর নহে?" এই প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি দেখিয়েছেন, বাল্যবিবাহের আর একটি কুফল বিধবার সংখ্যা বৃদ্ধি। তখনও তিনি বিধবাবিবাহ সম্বন্ধে আন্দোলনে অবতীর্ণ হন নি বটে, কিন্তু বিধবাদের দুঃখদুর্দশা সম্বন্ধে তিনি সহৃদয়তার সঙ্গে বলেছিলেন, "বিধবার জীবন কেবল দুঃখের ভার। এবং এই বিচিত্র সংসার তাহার পক্ষে জনশূন্য অরণ্যাকার। পতির সঙ্গে সঙ্গেই তাহার সমস্ত সুখ সাঙ্গ হইয়া যায়।... যে কঠোর ব্রহ্মচর্য ব্রতাচরণ পরিণত শরীর দ্বারাও নির্বাহকরণ দুষ্কর হয়, সেই দুশ্চর ব্রতে কোমলাঙ্গী বালিকাকে বাল্যাবধি ব্রতী হইতে হইলে তাহার সেই দুঃখদগ্ধ জীবন যে কত "দুঃখেতে যাপিত হয়, বর্ণনার দ্বারা তাহার কি জানাইব।" এখানে দেখা যাচ্ছে এই বেদনাবোধ থেকেই পরবর্তীকালে তিনি বিধবাবিবাহকে বৈধীকরণ এবং এর সামাজিক স্বীকৃতির জন্য সর্বস্ব পণ করেছিলেন। আর একটা কথা-এই প্রবন্ধে নর-নারীর বিবাহের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি যে কথা বলেছেন, প্রাচীন স্মার্ত আচার-আচরণে তার সমর্থন পাওয়া যাবে না, তার সমর্থন পাওয়া যাবে আধুনিক মানুষের জীবনপ্রতীতি মধ্যে। শাস্ত্র বলছেন, "পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভাষা।" পুন্নামক নবক থেকে পুত্র ত্রাণ করবে-এই হলো শাস্ত্রের নির্দেশ। আর শাস্ত্রই বলছেন 'অষ্টম বর্ষীয়া কন্যা দান করিলে পিতামাতার গৌরীদান জন্য পুণ্যোদয় হয়; নবম বর্ষীয়াকে দান করিলে পৃথিবী দানের ফললাভ হয়; দশম বর্ষীয়াকে পাত্রসাং করিলে পরত্র পবিত্র লোকপ্রাপ্তি হয়।" বিদ্যাসাগর স্মৃতিশাস্ত্র- প্রতিপাদিত এই সমস্ত নির্দেশকে অবহেলাভরে উপেক্ষা করেছেন। স্মৃতির বিধান ও লোকাচার প্রবল হয়ে বাস্যবিবাহের কুফল সম্বন্ধে সাধারণকে "কল্পিত ফলমৃগতৃষ্ণায় মুগ্ধ" করে রেখেছে। কিন্তু বিবাহের মূল উদ্দেশ্য, "সুমধুর পরস্পর প্রণয়"- তা বাল্যবিবাহের ফলে পদে পদে ব্যাহত হয়। বাল্যবিবাহের ফলে এবং অপরিণামদর্শী পিতামাতা কর্তৃক ঝটিতি পুত্রকন্তার বিবাহ দেওয়ার ফলে দাম্পত্য প্রেমের সুমধুর আস্বাদন থেকে অনেকেই বঞ্চিত হয়। বিদ্যাসাগর বলছেন, "মনের ঐক্যই প্রণয়ের মূল।・・・・・・ অম্মদ্দেশীয় বালদম্পতিরা পরস্পরের আশয় জানিতে পারিল না, অভিপ্রায়ে অবগাহন করিতে অবকাশ পাইল না, অবস্থার তত্ত্বানুসন্ধান পাইল না, আলাপ- পরিচয় দ্বারা ইতরেতরের চরিত্র-পরিচয়ের কথা দূরে থাকুক, একবার অন্ত্যোন্ত্য নয়ন- সঙ্ঘটনও হইল না, কেবল একজন উদাসীন বাচাল ঘটকের প্রবৃত্তিজনক বৃথা বচনে প্রত্যয় করিয়া পিতামাতার যেমন অভিরুচি হয়, ক্যাপুত্রের সেই বিধিই বিধিনিয়োগবৎ সুখ দুঃখের অনুল্লঙ্ঘনীয় সীমা হইয়া রহিল। এই জন্যই অম্মদ্দেশে দাম্পত্যনিবন্ধন অকপট প্রণয় প্রায় দৃষ্ট হয় না, কেবল প্রণয়ী ভর্তাস্বরূপ এবং প্রণয়িনী গৃহপরিচারিকা- স্বরূপ হইয়া সংসারযাত্রা নির্বাহ করে।" (বিদ্যাসাগর রচনাবলী, ১ম, পৃ. ২৪৩)

বিবাহবন্ধনকে শাস্ত্রসংহিতার অষ্টপাশ থেকে এবং প্রজাস্বষ্টির যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি দিয়ে তিনি পরস্পরের মনের মিল ও প্রণয়কেই প্রাধান্য দিয়েছেন। বিদ্যাসাগর সে যুগের পক্ষে কতটা অগ্রসর হয়েছিলেন তা বোঝা যাবে এই ইঙ্গিতে-প্রাগ, বিবাহের কালেও নর-নারী যদি পরস্পরে আশয় জানতে চায়, অভিপ্রায়ে অবগাহন করতে চায়, "আলাপপরিচয় দ্বারা" "নয়নসঙ্ঘটনেও" উদ্যত হয়, তাহলে বিদ্যাসাগরের আপত্তি নেই, বরং তাই-ই তাঁর মনোগত অভিলাষ। এর থেকে তাঁকে সেযুগের পক্ষে যেন গ্রহান্তরের জীব বলে মনে হচ্ছে। যে সমস্ত ব্যাপারে এখনও কারও কারও চক্ষু ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে কুঞ্চিত হয়ে ওঠে, এক শতাব্দী পূর্বে মহাপুরুষ বিদ্যাসাগর তাকেই বরমাল্য দিয়েছিলেন। এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে ('বাল্যবিবাহের দোষ') তাঁর যে যুক্তিবাদ, কাণ্ডজ্ঞান ও ভাবাবেগ দেশাচারকে উপেক্ষা করেছে, পরবর্তীকালে বিধবাবিবাহ প্রচার ও বহুবিবাহ-নিরোধ বিষয়ক পুস্তিকাগুলিতে তার আরও পরিপক্ক প্রকাশ দেখা গেছে।

আমাদের এই সংগ্রহে বিদ্যাসাগরের সম্পাদিত কয়েকখানি সংস্কৃত ও একখানি হিন্দী গ্রন্থের ভূমিকা উদ্ধৃত করা হয়েছে। এর মধ্যে 'ঋজুপাঠে'ব (সংস্কৃত-অনুশীলনের পাঠ্যগ্রন্থ) তিনখণ্ডের ভূমিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, সংস্কৃত সাহিত্য বিচারে তিনি যুক্তি- বুদ্ধিব আবেদনই বেশী মেনে নিয়েছেন। প্রয়োজন স্থলে দেবভাষাব পূজনীয় গ্রন্থকেও সমালোচনা করতে ছাড়েন নি। 'পঞ্চতন্ত্রে'র মধ্যে অশ্লীল উপাখ্যান আছে, উপরন্ত "অধুনাতন গ্রন্থের ন্যায়, রচনার মাধুর্য নাই, কথাযোজনাব চাতুর্য নাই। তাই তিনি কয়েকটা মারাত্মক দোষ (পৌনরুক্ত, প্রাসঙ্গিক বিষযেব অতিবিস্তৃত বর্ণনা প্রভৃতি) দেখেছেন, এবং বাল্মীকির পরবর্তী নব্য কাব্যগ্রন্থে তিনি অধিকতর কাব্যলক্ষণ দেখেছেন, 'হিতোপদেশ'কেও তিনি কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন। এতেও অশ্লীল উপাখ্যানের অসদ্ভাব নেই, অসংলগ্নতার বহু দৃষ্টান্ত আছে। এ গ্রন্থ বালকদের জন্য রচিত, অথচ এতে একাধিক অম্লীল উপাখ্য।ন আছে। এই জন্য বিদ্যাসাগর বলেছেন, "অতএব, আশ্চর্য বোধ হইতেছে যে, বালকদিগের নিমিত্ত নীতি পুস্তক লিখিতে আরম্ভ করিয়া, কি-প্রকারে গ্রন্থকর্তার এরূপ অগ্নীল উপাখ্যান সঙ্কলন করিতে প্রবৃত্তি হইল।" (ঋজুপাঠের তৃতীয় ভাগের বিজ্ঞাপন)। ভট্টিকাব্য সম্বন্ধে তাঁর সুচিন্তিত অভিমত-কাব্যকার ব্যাকরণের উদাহরণের দিকে লক্ষ্যদৃষ্টি ছিলেন বলে, ভট্টিকাব্যের অধিকাংশই অত্যন্ত নীরস ও অত্যন্ত কর্কশ। ফলতঃ ভট্টিকাব্য কোন মতেই উৎকুষ্ট কাব্যমধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না।" "বেণীসংহার' রচয়িতা ভট্টনারায়ণ সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্য, "ভট্টনারায়ণ নাটকের নিয়ম যত প্রতিপালন করিয়াছেন, কবিত্বশক্তি তত প্রদর্শন করিতে পারেন নাই।" হিন্দী 'বৈতাল পচ্চীসী'র মূল সংস্কৃত 'বেতালপঞ্চবিংশতি' সম্বন্ধে তিনি যথার্থ বলেছেন যে, এতে কোনও প্রকার শিল্পকলার চিহ্ন নেই, এবং ছেলেমানুষীভরা গালগল্পের দিকেই গল্পগুলির প্রবণতা বেশী, সংস্কৃতির অবক্ষয়ের যুগে য। হল সাধারণ লক্ষণ। ৭০ (বিদ্যাসাগর রচনাবলীর ৩৬৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য) 'সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাবে' (১৮৫৩) তিনি সংস্কৃত সাহিত্য সম্বন্ধে 'সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম আধুনিক ভাবতীয় ঐতিহাসিক হিসেবে যা বলেছেন, আমরা পরবর্তী খণ্ডে সে বিষযে আলোচনা করে তাঁর নির্ভীক সমালোচকের ভূমিকা সম্বন্ধে বিচার-বিশ্লষেণ করব।

প্রথম খণ্ডেব ভূমিকা এখানেই সমাপ্ত হল। বিদ্যাসাগরের যথার্থ সাহিত্য-প্রতিভা, গদ্যবীতি এবং বাংলা গদ্যের গঠনে তাঁর দান সম্পর্কে আমরা অন্ত্যান্ত খণ্ডে আলোচনা করব। প্রথম খণ্ডে পাঠ্যশ্রেণীভুক্ত যে পুস্তক-পুস্তিকাগুলি প্রকাশিত গুল, তাতে বিজ্ঞা- সাগরের স্বাধীন বচনার স্বরূপ এবং শিল্পপ্রতিভার বৈশিষ্ট্য ততটা ফুটে ওঠে নি। পরবর্তী খণ্ডসমূহে তাঁর প্রতিভাব যথার্থ স্মারকচিহ্নস্বরূপ বিখ্যাত গ্রন্থগুলিব আলোচন। থাকবে। সর্বশেষ খণ্ডে আমবা তাঁব মনোলোকের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা-বিভাগ



10
Articles
বিদ্যাসাগর রচনাবলী
0.0
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) এমন একটি বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব, যা আজকের দিনে প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। ওনার লেখা একাধিক কিছু রচনা সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এই রচনাবলি বইটি।
1

ভূমিকা

27 December 2023
0
0
0

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশ এমন কয়েকটি বিদ্যুৎ-গর্ভ ব্যক্তিকে সৃষ্টি করেছিল যাদের আশীর্বাদের পুণ্যফল এখনও আমরা ভোগ করছি। প্রাগাধুনিক যুগের গৌড়বঙ্গে বিচিত্র প্রতিভাধর ব্যক্তির যে আবির্ভাব হয় নি, তা নয়। কি

2

বেতাল পঞ্চবিংশতি

27 December 2023
0
0
0

উপক্রমণিকা উজ্জয়িনী নগরে গন্ধর্বসেন নামে রাজা ছিলেন। তাঁহার চারি মহিষী। তাঁহাদের গর্ভে রাজার ছয় পুত্র জন্মে। রাজকুমারের সকলেই সুপণ্ডিত ও সর্ব বিষয়ে বিচক্ষণ ছিলেন। কালক্রমে, নৃপতির লোকান্তরপ্রাপ্তি হই

3

বাঙ্গালার ইতিহাস [দ্বিতীয় ভাগ]

29 December 2023
0
0
0

প্রথম অধ্যায় ১৭৫৬ খৃষ্টীয় অব্দের ১০ই এপ্রিল, সিরাজউদ্দৌলা বাঙ্গালা ও বিহারের সিংহাসনে অধিরূঢ় হইলেন। তৎকালে, দিল্লীর অধীশ্বর এমন দুরবস্থায় পড়িয়াছিলেন যে, নূতন নবাব তাঁহার নিকট সনন্দ প্রার্থনা করা আবঞ্

4

জীবন চরিত

31 December 2023
0
0
0

জীবনচরিতপাঠে দ্বিবিধ মহোপকার লাভ হয়। প্রথমতঃ, কোন কোন মহাত্মারা অভিপ্রেতার্থসম্পাদনে কৃতকার্য্য হইবার নিমিত্ত যেরূপ অক্লিষ্ট পরিশ্রম, অবিচলিত উৎসাহ, মহীয়সী সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তর অধ্যবসায় প্রদর্শন করিয়াছেন

5

বাল্যবিবাহের দোষ

2 January 2024
0
0
0

অষ্টমবর্ষীয় কন্যা দান করিলে পিতা মাতার গৌরীদানজ্য পুণ্যোদয় হয়, নবম- বর্ষীয়াকে দান করিলে পৃথ্বী দানের ফল লাভ হয়; দশমবর্ষীয়াকে পাত্রসাৎ করিলে পরত্র পবিত্রলোকপ্রাপ্তি হয়, ইত্যাদি স্মৃতিশাস্ত্রপ্রতিপাদিত

6

বোধোদয়

2 January 2024
0
0
0

পদার্থ আমরা ইতস্ততঃ যে সকল বস্তু দেখিতে পাই, সে সমৃদয়কে পদার্থ বলে। পদার্থ দ্বিবিধ; সজীব ও নির্জীব। যে সকল বস্তুর জীবন আছে, অর্থাৎ যাহাদের জন্ম, বৃদ্ধি ও মৃত্যু আছে, উহারা সঞ্জীব পদার্থ; যেমন মনু্য,

7

সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা

4 January 2024
0
0
0

বর্ণমালা ১। অইউ, কখগ ইত্যাদি এক একটিকে বর্ণ ও অক্ষর বলে। বর্ণ' সমুদায়ে পঞ্চাশটি। তন্মধ্যে ষোলটি স্বর, চৌত্রিশটি হল্। এই পঞ্চাশটি অক্ষরকে বর্ণমালা বলে। স্বরবর্ণ ২। অআইঈউউত্তপ্ত ৯৪ এ ঐ ও ঔ অং অঃ। এই

8

বিভিন্ন গ্রন্থের বিজ্ঞাপন

5 January 2024
0
0
0

ঋজুপাঠ প্রথম ভাগ বিজ্ঞাপন ঋজুপাঠের প্রথম ভাগ প্রচারিত হইল। ইহাতে পঞ্চতন্ত্রের কয়েকটা উপাখ্যান ও মহাভারতের কিয়দংশ উদ্ধৃত করা গিয়াছে। পঞ্চতন্ত্রের রচনাপ্রণালী দৃষ্টে স্পষ্ট বোধ হইতেছে, ইহা অতি প্রাচী

9

ঘটনাপঞ্জী

5 January 2024
0
0
0

ঘটনাপঞ্জী ১৮২০ খৃঃ অব্দ, ২৬শে সেপ্টেম্বর, সন ১২২৭, শকাব্দ ১৭৪২, ১২ই আশ্বিন মঙ্গলবার দিবা দ্বিপ্রহরে, মেদিনীপুর অন্তর্গত বীরসিংহ গ্রামে পিতামাতার প্রথম সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-ঠাকুরদাস

10

গ্রন্থপঞ্জী

6 January 2024
0
0
0

অমূল্যত্বক ঘোষ-বিদ্যাসাগর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ ও বাংলা সাহিত্য ইন্দ্র মিত্র-সাজঘর কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য-পুরাতন প্রসঙ্গ গোপিকামোহন ভট্টাচার্য-History of Sanskrit College

---