shabd-logo

বাঙ্গালার ইতিহাস [দ্বিতীয় ভাগ]

29 December 2023

1 Viewed 1

প্রথম অধ্যায়

১৭৫৬ খৃষ্টীয় অব্দের ১০ই এপ্রিল, সিরাজউদ্দৌলা বাঙ্গালা ও বিহারের সিংহাসনে অধিরূঢ় হইলেন। তৎকালে, দিল্লীর অধীশ্বর এমন দুরবস্থায় পড়িয়াছিলেন যে, নূতন নবাব তাঁহার নিকট সনন্দ প্রার্থনা করা আবঞ্চক বোধ করিলেন না।

তিনি, রাজ্যাধিকার প্রাপ্ত হইয়া প্রথমতঃ, আপন পিতৃব্যপত্নীর সমুদয় সম্পত্তি হরণ করিবার নিমিত্ত, সৈন্য প্রেরণ করিলেন। তাঁহার পিতৃব্য নিবাইশ মহম্মদ, ষোল বৎসর ঢাকার অধিপতি থাকিয়া, প্রভুত অর্থসঞ্চয় করিয়াছিলেন। তিনি লোকান্তরপ্রাপ্ত হইলে, তাঁহার পত্নী তদীয় সমস্ত সম্পত্তির অধিকারিণী হয়েন। ঐ বিধবা নারী আপন সম্পত্তি রক্ষার নিমিত্ত, যে সৈন্য রাখিয়াছিলেন, তাহারা কার্যকালে পলায়ন করিল; সুতরাং তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি, নির্বিবাদে, নবাবের প্রাসাদে প্রেরিত হইল, এবং তিনিও সহজে আপন বাসস্থান হইতে বহিষ্কৃতা হইলেন।

রাজবল্লভ ঢাকায় নিবাইশ মহম্মদের সহকারী ছিলেন, এবং মুসলমানদিগের অধিকার- সময়ের প্রথা অনুসারে; প্রজার সর্বনাশ করিয়া, যথেষ্ট ধনসঞ্চয় করেন। ১৭৫৬ খৃঃ অব্দের আরম্ভে, নিবাইশ পরলোক যাত্রা করেন। তৎকালে আলিবর্দি সিংহাসনারূঢ় ছিলেন, কিন্তু বার্ধক্যবশতঃ, হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিলেন। রাজবল্লভ ঐ সময়ে মুরশিদাবাদে উপস্থিত থাকাতে, সিরাজউদ্দৌলা, তাঁহাকে কারাগারে বন্ধ করিয়া, তদীয় সম্পত্তি রুদ্ধ করিবার নিমিত্ত, ঢাকায় লোক প্রেরণ করেন। রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস, অগ্রে সংবাদ জানিতে পারিয়া, সমস্ত সম্পত্তি লইয়া, নৌকারোহণপূর্বক, গঙ্গাসাগর • অথবা জগন্নাথ যাত্রার ছলে কলিকাতায় পলায়ন করেন। এবং, ১৭ই মার্চ, তথায় উপস্থিত হইয়া, তথাকার অধ্যক্ষ ড্রেক সাহেবের অনুমতি লইয়া নগর মধ্যে বাস • করেন। তিনি মনে মনে স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন, যাবৎ পিতার মুক্তিসংবাদ না

'পান, ততদিন ঐ স্থানে অবস্থিতি করিবেন।

? রাজবল্লভের সম্পত্তি এইরূপে হস্তবহির্ভূত হওয়াতে, সিরাজউদ্দৌলা সাতিশয় অসন্তষ্ট 'হইয়াছিলেন; এক্ষণে, সিংহাসনারূঢ় হইয়া, কৃষ্ণদাসকে আমার হস্তে সমর্পণ করিতে হইবেক, এই দাওয়া করিয়া, কলিকাতায় দূত প্রেরণ করিলেন। কিন্তু ঐ দূত বিশ্বাসযোগ্য পত্রাদির প্রদর্শন করিতে না পারিবাতে, ড্রেক সাহেব তাহাকে নগর হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন।

কিছু দিন পরে, যুরোপ হইতে এই সংবাদ আসিল, অল্পদিনের মধ্যেই, ফরাসি দিগের সহিত ইংরেজদের যুদ্ধ ঘটিবার সম্ভাবনা হইয়াছে। তৎকালে ফরাসিরা, করমণ্ডল উপকূলে, অতিশয় প্রবল ও পরাক্রান্ত ছিলেন; আর কলিকাতায় ইংরেজদিগের যত ঘুরোপীয় সৈন্য ছিল, চন্দননগরে ফরাসিদের তদপেক্ষা দশগুণ অধিক থাকে। এই সমস্ত কারণে, কলিকাতাবাসী ইংরেজরা আপনাদের দুর্গের সংস্কার করিতে আরম্ভ করিলেন। এই ব্যাপার, অনতিবিলম্বে, অল্পবয়স্ক উদ্ধতস্বভাব নবাবের কর্ণগোচর হইল। ইংরেজ- দিগের উপর তাঁর সবিশেষ দ্বেষ ছিল; এজন্য, তিনি, ভয় প্রদর্শনপূর্বক, ড্রেক সাহেবকে এই পত্র লিখিলেন, আপনি নূতন দুর্গ নির্মাণ করিতে পাইবেন না; পুরাতন যাহা আছে, ভাঙিয়া ফেলিবেন; এবং, অবিলম্বে, কৃষ্ণদাসকে আমার লোকের হস্তে সমর্পণ করিবেন।

আলিবর্দির মৃত্যুর দুই এক মাস পূর্বে, সিরাজউদ্দৌলার দ্বিতীয় পিতৃব্য সায়দ মহম্মদের পরলোকপ্রাপ্তি হয়। তাঁহার পুত্র সকতজঙ্গ তদীয় সমস্ত স্যৈ, সম্পত্তি, ও পূর্ণিয়ার রাজত্বের অধিকারী হয়েন। সুতরাং, সকতজঙ্গ, সিরাজউদ্দৌলার সুবাদার হইবার কিঞ্চিং পূর্বে, রাজ্যশাসনে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। তাঁহারা উভয়েই তুল্যরূপ নির্বোধ, নৃশংস, ও অবিমৃষ্ণকারী ছিলেন; সুতরাং, অধিককাল, তাঁহাদের পরস্পর সম্প্রীত ও ঐক্যবাক্য থাকিবেক, তাহার কোনও সম্ভাবনা ছিল না।

সিরাজউদ্দৌলা, সিংহাসনে অধিরূঢ় হইয়া, মাতামহের পুরান কর্মচারী ও সেনাপতি- দিগকে পদচ্যুত করিলেন। কুপ্রবৃত্তির উত্তেজক কতিপয় অল্পবয়স্ক দুষ্ক্রিয়াসক্ত ব্যক্তি তাঁহার প্রিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন হইয়া উঠিল। তাহারা, প্রতিদিন, তাঁহাকে কেবল অন্তায্য ও নিষ্ঠুর ব্যাপারের অনুষ্ঠানে পরামর্শ দিতে লাগিল। ঐ সকল পরামর্শের এই ফল দর্শিয়াছিল যে, তৎকালে, প্রায় কোন ব্যক্তির সম্পত্তি বা কোনও স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পায় নাই।

রাজ্যের প্রধান প্রধান লোকেরা, এই সমস্ত অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া, তাঁহার

পরিবর্তে, অন্য কোনও ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

তাঁহারা, আপাততঃ, সকতজঙ্গকেই লক্ষ্য করিলেন। তাঁহারা নিশ্চিত জানিতেন, তিনি সিরাজউদ্দৌলা অপেক্ষা ভদ্র নহেন। কিন্তু, মনে মনে এই আশা করিয়াছিলেন, আপাততঃ, এই উপায় দ্বারা, উপস্থিত বিপদ হইতে মুক্ত হইয়া, পরে, কোনও যথার্থ ভদ্র ব্যক্তিকে সিংহাসনে নিবিষ্ট করিতে পারিবেন। এ বিষসেমুদয় পরামর্শ স্থির হইলে, সকতজঙ্গের সুবাদারীর সনন্দ প্রার্থনায়, দিল্লীতে দূত প্রেরিত হইল। আবেদন পত্রে বার্ষিক কোটি মুদ্রা কর প্রদানের প্রস্তাব থাকাতে অনায়াসেই তাহাতে সম্রাটের সম্মতি হইল।

সিরাজউদ্দৌলা, এই চক্রান্তেব সন্ধান পাইয়া, অবিলম্বে সৈন্ত সংগ্রহ কবিয়া, সকতজজের প্রাণদণ্ডার্থে, পূর্ণিয়া যাত্রা কবিলেন। সৈন্য সকল, রাজমহলে উপস্থিত হইয়া, গঙ্গা পার হইবার উ্যোগ করিতেছে, এমন সময়ে, নবাব, কলিকাতাব ড্রেক সাহেবের নিকট হইতে, আপন পূর্বপ্রেরিত পত্রেব এই উত্তব পাইলেন, আমি আপনকার আজ্ঞায় কদাচ সম্মত হইতে পাবি না।

এই উত্তব পাইয়া, তাঁহাব কোপানল প্রজ্বলিত হইযা উঠিল। তখন তিনি, ইংবেজেরা রাজ্যের বিরুদ্ধাচাবীদিগকে আশ্রয় দিতেছে; এবং, আমার অধিকারের মধ্যে, দুর্গ নির্মাণ করিবা, আপনাদিগকে দৃঢ়ীভূত করিতেছে, অতএব, আমি তাহাদিগকে নির্মূল কবিব, এই প্রতিজ্ঞা কবিয়া, সৈন্যদিগকে, অবিলম্বে শিবিব ভঙ্গ কবিযা, কলিকাতা যাত্রা কবিতে আদেশ দিলেন, কাশিমবাজারে, ইংবেজদিগের যে কুঠী ছিল, আগমন- কালে তাহা লুঠ কবিলেন; এবং তথায় যে যে যুরোপীয়দিগকে দেখিতে পাইলেন, সকলকেই কাবারুদ্ধ কবিলেন।

কলিকাতাবাসী ইংবেজেরা, যাটি বৎসবেব অধিককাল, নিরুপদ্রবে ছিলেন, সুতরাং, বিশেষ আস্থা না থাকাতে, তাঁহাদেব দুর্গ একপ্রকার নষ্ট হইয়া গিয়াছিল, তাঁহারা আপনাদিগকে এত নিঃসঙ্গ ভাবিয়াছিলেন যে, দুর্গপ্রাচীবেব বহির্ভাগে বিংশতি ব্যামের মধ্যেও, অনেক গৃহ নির্মাণ কবিয়াছিলেন। তৎকালে, দুর্গ মধ্যে একশত সম্ভব জন মাত্র সৈন্য ছিল; তন্মধ্যে কেবল যাটি জন যুবোপীয়। বারুদ পুবান ও নিস্তেজ; কামান সকল মবিচাধবা। এ দিকে, সিবাজউদ্দৌলা, চল্লিশ পঞ্চাশ সহস্র সৈন্ন্যা ও উত্তম উত্তম কামান লইয়া, কলিকাতা আক্রমণ করিতে আসিতেছেন। ইংরেজেরা দেখিলেন আক্রমণ নিবারণের কোনও সম্ভাবনা নাই; অতএব, সন্ধি প্রার্থনায়, বারংবার পঞ্জ প্রেরণ করিতে লাগিলেন, এবং বহুসংখ্যক মুদ্রা প্রদানের প্রস্তাব করিলেন। কিন্তু, নবাবের অন্ত কোনও বিষয়ে কর্ণ দিতে ইচ্ছা ছিল না; তিনি ইংরেজদিগকে একবারে উচ্ছিন্ন করিবার মানস করিয়াছিলেন; অতএব, পত্রের কোনও উত্তর না দিয়া, অবিশ্রামে কলিকাতা অভিমুখে আসিতে লাগিলেন।

১৬ই জুন, তাঁহাব সৈন্তোর অগ্রসর ভাগ চিৎপুরে উপস্থিত হইল। ইংরেজেরা, ইতঃপূর্বে তথায় এক উপদুর্গ প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছিলেন। তথা হইতে তাঁহারা, নবাবের সৈন্তের উপর, এমন ভয়ানক গোলাবৃষ্টি করিতে লাগিলেন যে, তাহারা হটিয়া গিয়া, দমদমায় অবস্থিতি করিল। নবাবের সৈন্তরা, ১৭ই জুন, নগর বেষ্টন করিয়া, তৎপর দিন, এককালে চারিদিকে আক্রমণ করিল। তাহারা, ভিত্তির সন্নিহিত গৃহ সকল অধিকার করিয়া, এমন ভয়ানক গোলাবৃষ্টি করিতে লাগিল যে, এক ব্যক্তিও, সাহস করিয়া, গড়ের উপর দাঁড়াইতে পারিল না। ঐ দিবস অনেক ব্যক্তি হত ও অনেক ব্যক্তি আহত হইল, এবং দুর্গের বহির্ভাগ বিপক্ষের হস্তগত হওয়াতে, ইংরেজদিগকে দুর্গের অভ্যন্তর ভাগে প্রবেশ করিতে হইল। রাত্রিতে, বিপক্ষেরা দুর্গের চতুঃপার্শ্ববর্তী অতি বৃহৎ কতিপয় গৃহে অগ্নিপ্রদান করিল। ঐ সকল গৃহ অতি ভয়ানক রূপে জ্বলিত হইতে লাগিল।

অতঃপর কি করা উচিত, ইহার বিবেচনা করিবার নিমিত্ত, দুর্গস্থিত ইংরেজেরা একত্র সমবেত হইলেন। তৎকালীন সেনাপতিদিগের মধ্যে এক ব্যক্তিও কার্যঞ্জ ছিলেন না। তাঁহারা সকলে কহিলেন, পলায়ন ব্যতিরেকে পরিত্রাণ নাই। বিশেষতঃ এত অধিক এতদ্দেশীয় লোক দুর্গ মধ্যে আশ্রয় লইয়াছিল যে, তন্মধ্যে যে আহারসামগ্রী ছিল, তাহাতে এক সপ্তাহ চলিতে পারিত না। অতএব নির্ধারিত হইল, গড়ের নিকট যে সকল নৌকা প্রস্তুত আছে, পরদিন প্রত্যুষে, নগর পরিত্যাগ করিয়া, তন্দ্বারা পলায়ন করাই শ্রেয়ঃ। কিন্তু, দুর্গ মধ্যে, এক ব্যক্তিও এমন ক্ষমতাপন্ন ছিলেন না যে, এই ব্যাপার সুশৃঙ্খল রূপে সম্পন্ন করিয়া উঠেন। সকলেই আজ্ঞাপ্রদানে উদ্ব্যত; কেহই আজ্ঞা- প্রতিপালনে সম্মত নহে।

নিরূপিত সময় উপস্থিত হইলে, প্রথমতঃ স্ত্রীলোক সকল প্রেরিত হইলেন। অনন্তর, দুর্গস্থিত সমুদয় লোক ও নাবিকগণ ভয়ে অতিশয় অভিভূত হইল। সকল ব্যক্তিই তীরাভিমুখে ধাবমান। নাবিকেরা নৌকা লইয়া পলাইতে উত্থত। ফলতঃ সকলেই আপন লইয়া ব্যস্ত। যে, যে নৌকা সম্মুখে পাইল, তাহাতেই আরোহণ করিল। সর্বাধ্যক্ষ ড্রেক সাহেব, ও সৈন্নাধ্যক্ষ সাহেব, সর্বাগ্রে পলায়ন করিলেন। যে কয়েকখান নৌকা উপস্থিত ছিল, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে, কতক জাহাজের নিকটে, কতক হাবড়া পারে, চলিয়া গেল; কিন্তু, সৈন্য ও ভদ্রলোক অর্ধেকেরও অধিক দুর্গের মধ্যে রহিয়া গেল।

সর্বাধ্যক্ষ সাহেবের পলায়ন সংবাদ প্রচারিত হইবামাত্র, অবশিষ্ট ব্যক্তিরা, একত্র সমবেত হইয়া, হলওয়েল সাহেবকে আপনাদের অধ্যক্ষ স্থির করিলেন। পলায়িতেরা, জাহাজে। আরোহণ করিয়া, প্রায় একক্রোশ ভাটিয়া গিয়া নদীতে নঙ্গর করিয়া রহিল। ১৯শে জুন, নবাবের সৈন্তেরা পুনর্বার আক্রমণ করিল; কিন্তু পরিশেষে অপসারিত হইল। দুর্গবাসীরা, দুই দিবস পর্যন্ত, আপনাদের রক্ষা করিল; এবং জাহাজস্থিত লোকদিগকে অনবরত এই সঙ্কেত করিতে লাগিল, তোমরা আসিয়া আমাদের উদ্ধার কর। এই উদ্ধারক্রিয়া অনায়াসে সম্পন্ন হইতে পারিত। কিন্তু, পলায়িত ব্যক্তিরা, পরিত্যক্ত, ব্যক্তিদিগের উদ্ধারার্থে, একবারও উদ্যোগ করিল না। যাহা হউক, তখনও তাহাদের অন্য এক আশা ছিল। রয়েল জর্জ নামে একখানা জাহাজ, চিৎপুরের নীচে, নঙ্গর করিয়া- ছিল। হলওয়েল সাহেব, ঐ জাহাজ গড়ের নিকটে আনিবার নিমিত্ত, দুইজন ভদ্র- লোককে পাঠাইয়া দিলেন; দুর্ভাগ্যক্রমে, উহা আসিবার সময় চড়ায় লাগিয়া গেল। এইরূপে, দুর্গস্থিত হত্যভাগ্য দিগের শেষ আশাও উচ্ছিন্ন হইল।

১৯শে জুন রাত্রিতে, নবাবের সৈন্তরা, দুর্গের চতুর্দিকস্থ অবশিষ্ট গৃহ সকলে অগ্নি প্রদান

করিয়া, ২০শে, পুনর্বার; পূর্বাপেক্ষা অধিকতর পরাক্রম সহকারে, আক্রমণ করিল। হল-

ওয়েল সাহেব, আর নিবারণ চেষ্টা করা ব্যর্থ বুঝিয়া, নবাবের সেনাপতি মানিকচাঁদের নিকট পত্র দ্বারা সন্ধির প্রার্থনা করিলেন। দুই প্রহর চারিটার সময়, নবাবের পক্ষের এক সৈনিক পুরুষ, কামান বন্ধ করিতে সঙ্কেত করিল। তদনুসারে, ইংরেজরা, সেনা- পতির উত্তর আসিল ভাবিয়া, আপনাদের কামান ছোঁড়া রহিত করিবামাত্র, বিপক্ষেরা প্রাচীরের নিকট দৌড়িয়া আসিল; প্রাচীর লঙ্ঘন করিয়া দুর্গ মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল; এবং, তৎপরে এক ঘণ্টার মধ্যে, দুর্গ অধিকার করিয়া, লুঠ আরম্ভ করিল। বেলা পাঁচটার সময়, সিবাজউদ্দৌলা, চৌপালায় চডিয়া, দুর্গ মধ্যে উপস্থিত হইলে, যুরোপীয়েরা তাঁহার সম্মুখে নীত হইল। হলওয়েল সাহেবের দুই হস্ত বদ্ধ ছিল, নবাব খুলিয়া দিতে আজ্ঞা দিয়া, তাঁহাকে এই বলিয়া আশ্বাস প্রদান করিলেন, তোমার একটি কেশও স্পৃষ্ট হইবেক না; অনন্তর, বিশ্বয় প্রকাশপূর্বক কহিলেন, এত অল্প সংখ্যক ব্যক্তি, কিরূপে, চারিশত গুণ অধিক সৈন্যের সহিত এতক্ষণ যুদ্ধ করিল। পরে, এক অনাবৃত প্রদেশে সভা কবিষা, তিনি কৃষ্ণদাসকে সম্মুখে আনিতে আদেশ করিলেন। নবাৰ যে ইংরেজদিগকে আক্রমণ করেন, কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দেওয়া তাহার প্রধান কারণ। তাহাতে সকলে অনুমান করিয়াছিল, তিনি কৃষ্ণদাসের গুরুতর দণ্ড করিবেন; কিন্তু তিনি, তাহা না করিয়া, তাঁহাকে এক মহামূল্য পরিচ্ছদ পুরস্কার দিলেন।

বেলা ছয় সাত ঘণ্টার সময়, নবাব, সেনাপতি মানিকচাঁদের হস্তে দুর্গ সমর্পণ করিয়া, শিবিরে গমন করিলেন। সমুদয়ে এক শত ছচল্লিশ জন ঘুরোপীয় বন্দী ছিল। সেনাপতি সে রাত্রি তাহাদিগকে যেখানে রাখিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন, এমন স্থানের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। তৎকালে দুর্গের মধ্যে, দীর্ঘে বার হাত, প্রন্থে নয় হাত, এরূপ এক গৃহ ছিল। বাহুসঞ্চারের নিমিত্ত, ঐ গৃহের এক এক দিকে এক এক মাত্র গবাক্ষ থাকে। ইংরেজেরা কলহকারী দুর্বৃত্ত সৈনিকদিগকে ঐ গৃহে রুদ্ধ করিয়া রাখিতেন। নবাবের সেনাপতি, দারুণ গ্রীষ্মকালে, সমস্ত য়ুরোপীয় বন্দীদিগকে ঐ ক্ষুদ্র গৃহে নিক্ষিপ্ত করিলেন। সে রাত্রিতে যন্ত্রণার পরিসীমা ছিল না। বন্দীরা, অতি ত্বরায়, ঘোরতর পিপাসায় কাতর হইল। তাহারা, রক্ষকদিগের নিকট বারংবার প্রার্থনা করিয়া, যে জল পাইল, তাহাতে কেবল তাহাদিগকে ক্ষিপ্তপ্রায় করিল। প্রত্যেক ব্যক্তি, সমাকরূপে নিশ্বাস আকর্ষণ করিবার আশায়, গবাক্ষের নিকটে যাইবার নিমিত্ত, বিবাদ করিতে লাগিল। এবং, যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া, রক্ষীদিগের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিল, তোমরা, গুলি করিয়া, আমাদের এই দুঃসহ যন্ত্রণার অবসান কর। এক এক জন করিয়া, ক্রমে ক্রমে, অনেকে পঞ্চত্ব পাইয়া ভূতলশায়ী হইল। অবশিষ্ট ব্যক্তিরা শবরাশির উপর দাঁড়াইয়া, নিশ্বাস আকর্ষণের অনেক স্থান পাইল, এবং তাহাতেই কয়েকজন জীবিত থাকিল।

পরদিন প্রাতঃকালে ঐ গৃহের দ্বার উদঘাটিত হইলে, দৃষ্ট হইল, এক শত ছচল্লিশের মধ্যে, তেইশ জন মাত্র জীবিত আছে। অন্ধকূপহত্যা নামে যে অতি ভয়ঙ্কর ব্যাপার প্রসিদ্ধ আছে, সে এই। এই হত্যার নিমিত্তই, সিরাজউদ্দৌলার কলিকাতা আক্রমণ শুনিতে এত ভয়ানক হইয়া রহিয়াছে; উক্ত ঘোরতর অত্যাচার প্রযুক্তই, এই বৃত্তান্ত লোকের অন্তঃকরণে অধ্যাপি দেদীপ্যমান আছে, এবং সিরাজউদ্দৌলাও নৃশংস রাক্ষস বলিয়া প্রসিদ্ধ হইয়াছেন। কিন্তু তিনি, পরদিন প্রাতঃকাল পর্যন্ত, এই ব্যাপারের বিন্দু বিসর্গ জানিতেন না। সে রাত্রিতে, সেনাপতি মানিকচাঁদের হস্তে দুর্গের ভার অর্পিত ছিল; অতএব, তিনিই সমস্ত দোষের ভাগী।

২১শে জুন, প্রাতঃকালে, এই নিদারুণ ব্যাপার নবাবের কর্ণগোচর হইলে তিনি অতিশয় অনবধান প্রদর্শন করিলেন। অন্ধকূপে রুদ্ধ হইয়া, যে কয় ব্যক্তি জীবিত থাকে, হল- ওয়েল সাহেব তাহাদের মধ্যে এক জন। নবাব, তাঁহাকে আহ্বান করিয়া ধনাগার দেখাইয়া দিতে কহিলেন। তিনি দেখাইয়া দিলেন; কিন্তু ধনাগারের মধ্যে পঞ্চাশ সহস্রের অধিক টাকা পাওয়া গেল না।

সিরাজউদ্দৌলা, নয় দিবস, কলিকাতার সান্নিধ্যে থাকিলেন; অনন্তর, কলিকাতার নাম আলীনগর রাখিয়া, মুরশিদাবাদ প্রস্থান করিলেন। ২রা জুলাই, গঙ্গা পার হইয়া তিনি হুগলীতে উত্তীর্ণ হইলেন, এবং লোক দ্বারা ওলন্দাজ ও ফরাসিদিগের নিকট কিছু কিছু টাকা চাহিয়া পাঠাইলেন। তিনি তাঁহাদিগকে এই বলিয়া ভয় প্রদর্শন করিলেন, যদি অস্বীকার কর, তোমাদেরও ইংরেজদের মত দুন্নবস্থা করিব। তাহাতে ওলন্দাজেরা সাড়ে চারি লক্ষ, আর ফরাসিরা সাড়ে তিন লক্ষ টাকা দিয়া পরিত্রাণ পাইলেন।

যে বৎসর কলিকাতা পরাজিত হইল, ও ইংরেজেরা বাংলা হইতে দূরীকৃত হইলেন, সেই বৎসর, অর্থাৎ ১৭৫৬ খৃঃ অব্দে, দিনামারেরা, এই দেশে বাসের অনুমতি পাইয়া শ্রীরাম- পুর নগর সংস্থাপিত করিলেন।

সিরাজউদ্দৌলা, জয়লাভে প্রফুল্ল হইয়া, পূর্ণিয়ার অধিপতি পিতৃব্যপুত্র সকতজঙ্গকে আক্রমণ করা স্থির করিলেন। বিবাদ উত্থাপন করিবার নিমিত্ত, আপন এক ভৃত্যকে ঐ প্রদেশের ফৌজদার নিযুক্ত করিয়া, পিতৃব্যপুত্রকে এই আজ্ঞাপত্র লিখিলেন, তুমি অবিলম্বে ইহার হস্তে সমস্ত বিষয়ের ভার দিবে। ঐ উদ্ধত যুবা, পত্রপাঠে ক্রোধান্ধ ও ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া, উত্তব লিখিলেন, আমি সমস্ত প্রদেশের যথার্থ অধিপতি, দিল্লী হইতে সনন্দ পাইয়াছি, অতএব, আজ্ঞা কবিতেছি, তুমি অবিলম্বে মুবশিদাবাদ হইতে চলিয়া যাও। এই উত্তব পাইয়া, সিবাজউদ্দৌলা, ক্রোধে অধৈর্য হইলেন, এবং অতি ত্ববায়, সৈন্য সংগ্রহ কবিয়া পূর্ণিয়া যাত্রা কবিলেন। সকতজঙ্গও, এই সংবাদ পাইযা সৈন্ত লইযা, তদভিমুখে আগমন করিতে লাগিলেন। কিন্তু সকতজঙ্গ নিজে যুদ্ধেব কিছুই জানিতেন না, এবং কাহাবও পরামর্শ শুনিতেন না। তাঁহাব সেনাপতিবা সৈন্য সহিত এক দৃঢ় স্থানে উপস্থিত হইল। ঐ স্থানেব সম্মুখে জলা, পাব হইবাব নিমিত্ত মধ্যে এক মাত্র সেতু ছিল। স্যৈ সকল সেই স্থানে শিবিব সন্নিবেশিত কবিল। কিন্তু, তদীয় স্যৈ মধ্যে, এক ব্যক্তিও উপযুক্ত সেনাপতি ছিলেন না, এবং অনুষ্ঠানেবও কোনও পবিপাটি ছিল না। প্রত্যেক সেনাপতি আপন আপন সুবিধা অনুসাবে, পৃথক পৃথক স্থানে সেনাপতি নিবেশিত কবিলেন।

সিবাজউদ্দৌলাব সৈন্য, ঐ জলাব সম্মুখে উপস্থিত হইয়া সকতজঙ্গেব সৈন্যের উপর গোলা চালাইতে লাগিল। বড় বড় কামানের গোলাতে ৩দীষ সৈন্য ছিন্নভিন্ন হইলে, তিনি নিতান্ত উন্মত্তেব ল্যাষ, স্বীষ অশ্বাবোহীদিগকে, জলা পাব হইয়া, বিপক্ষ সৈন্ত আক্রমণ কবিতে আজ্ঞা দিলেন। তাহাবা অতি কষ্টে কর্দম পাব হইযা, শুষ্ক স্থানে উপস্থিত হইবামাত্র, সিবাজউদ্দৌলাব সৈন্য অতি ভয়ানক রূপে তাহাদিগকে আক্রমণ করিল।

ঘোবতব যুদ্ধ হইতেছে, এমন সময়ে, সকতজঙ্গ স্বীয় শিবিবে প্রবেশ করিলেন, এবং, অত্যধিক স্ববাপান কবিষ।, এমন মত্ত হইলেন যে, আব সোজা হইয়া বসিতে পাবেন না। তাঁহাব সেনাপতিবা আসিযা তাঁহাকে, বণস্থলে উপস্থিত থাকিবার নিমিত্ত, অতিশয় অনুবোধ কবিতে লাগিলেন, পবিশেষে, ধবিয়া থাকিবাব নিমিত্ত এক ভৃত্যসমেত, তাঁহাকে হস্তীতে আবোহণ কবাইয়া, জলাব প্রান্তভাগে উপস্থিত কবিলেন। তথায় উপস্থিত হইবামাত্র, শত্রুপক্ষ হইতে এক গোলা আসিয়া তাঁহাব কপালে লাগিল। তিনি তৎক্ষণাৎ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইলেন। সৈন্তরা, তাহাকে প্রাণত্যাগ করিতে দেখিয়া, শ্রেণীভঙ্গ- পূর্বক পলায়ন কবিল। দুই দিবস পরে, নবাবের সেনাপতি মোহনলাল পূর্ণিয়া অধিকার কবিলেন, এব' তথাকাব ধনাগাবে প্রাপ্ত ন্যূনাধিক নবতি লক্ষ টাকা ও সকতজঙ্গের যাবতীয় অন্তঃপুরিকাগণ মুবশিদাবাদে পাঠাইয়া দিলেন।

সিবাজউদ্দৌলা, সাহস করিয়া, যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হইতে পাবেন নাই, বস্তুতঃ, তিনি বাজমহলেব অধিক বান নাই, কিন্তু, এই জয়ের সমুদয় বাহাদুরী আপনাব বোধ করিয়া, মহাসমাবোহে মুবশিদাবাদ প্রত্যাগমন কবিলেন।

এ দিকে, ড্রেক সাহেব, কাপুরুষত্ব প্রদর্শনপূর্বক, পলায়ন করিয়া স্বীয় অনুচরবর্গের সহিত নদীমুখে জাহাজে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। তথায়, অনেক ব্যক্তি, রোগাডিভূত হইয়া প্রাশত্যাগ করিল।

কলিকাতার দুর্ঘটনার সংবাদ মাদ্রাজে পঁহুছিলে, তথাকার গবর্ণর ও কৌন্সিলের সাহেবেরা যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হইলেন, এবং চারিদিকে বিপদ সাগর দেখিতে লাগিলেন। সেই সময়ে, ফবাসিদিগের সহিত ত্বরায় যুদ্ধ ঘটিবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা হইয়া- ছিল। ফরাসিরা তৎকালে পণ্ডিচেরীতে অতিশয় প্রবল ছিলেন; ইংরেজ দিগের সৈন্ত অতি অল্প মাত্র ছিল। তথাপি তাঁহারা বাঙ্গালার সাহায্য করাই সর্বাগ্রে কর্তব্য স্থির করিলেন। তদনুসারে, তাঁহারা অতি ত্ববায় কতিপয় যুদ্ধজাহাজ ও কিছু সৈন্য সংগ্রহ করিলেন, এবং এডমিরল ওয়াট্সন সাহেবকে জাহাজের কর্তৃত্ব দিয়া, আর কর্ণেল ক্লাইব সাহেবকে সৈন্যাধ্যক্ষ করিয়া, বাঙ্গালায় পাঠাইলেন।

ক্লাইব, অষ্টাদশ বর্ষ বয়ঃক্রম কালে, কোম্পানির কেরানি নিযুক্ত হইয়া ত্রয়োদশ বৎসর পূর্বে, ভারতবর্ষে আগমন করেন, সাংগ্রামিক ব্যাপারে গাঢতব অনুরাগ থাকাতে, প্রার্থনা করিয়া সেনাসংক্রান্ত কর্মে নিবিষ্ট হয়েন, এবং, অল্প কাল মধ্যে, একজন প্রসিদ্ধ যোদ্ধা হইয়া উঠেন। এই সময়ে, তিনি বয়সে যুবা, কিন্তু অভিজ্ঞতাতে বৃদ্ধ হইয়াছিলেন। মান্দ্রাজে উদ্যোগ করিতে অনেক সময় নষ্ট হয়; এজ্য, জাহাজ সকল অক্টোবরের পূর্বে বহির্গত হইতে পারিল না। তৎকালে উত্তরপূর্বীয় বায়ুর সঞ্চার আবদ্ধ হইয়াছিল; এ প্রযুক্ত, জাহাজ সকল, ছয় সপ্তাহের ন্যূনে, কলিকাতায় উপস্থিত হইতে পারিল না, তন্মধ্যে দুইখানার আরও অধিক বিলম্ব হইয়াছিল।

কলিকাতার উদ্ধারার্থে, মাদ্রাজ হইতে সমুদয়ে ৯০০ গোবা ও ১৫০০ সিপাই প্রেরিত হয়। তাহারা, ২০শে ডিসেম্বর, ফলতায়, ও ২৮শে, মায়াপুরে পঁহুছিল। তৎকালে মায়া- পুরে মুসলমানদিগের এক দুর্গ ছিল। কর্ণেল ক্লাইব, শেষোক্ত দিবসে, রজনীযোগে, স্বীয়, সমস্ত সৈন্য তীবে অবতীর্ণ করিলেন; কিন্তু, পথদর্শকদিগের দোষে, অরুণোদয়ের পূর্বে, ঐ দুর্গের নিকট পহুছিতে পারিলেন না।

নবাবের সেনাপতি মানিকচাঁদ, কলিকাতা হইতে অকস্মাৎ তথায় উপস্থিত হইয়া, ক্লাইবকে আক্রমণ করিলেন। ঐ সময়ে, নবাবের সৈন্তরা যদি প্রকৃতরূপে কার্য সম্পাদন করিত, তাহা হইলে, ইংরেজেরা নিঃসন্দেহ পরাজিত হইতেন। যাহা হউক, ক্লাইব, অতি ত্বরায় কামান আনাইয়া, শত্রুপক্ষের উপর গোলা চালাইতে আরম্ভ করিলেন। তন্মধ্যে এক গোলা মানিকচাঁদের হাওদার ভিতর দিয়া চলিয়া যাওয়াতে, তিনি, যুৎপরোনাস্তি ভীত হইয়া, তৎক্ষণাৎ কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিলেন। পরিশেষে, কলিকাতায় থাকিতেও সাহস না হওয়াতে, তথায় কেবল পাঁচশত স্যৈ রাখিয়া, আপন প্রভুর নিকটস্থ হইবার মানসে। তিনি অতি সত্বব মুরশিদাবাদ প্রস্থান করিলেন। অনন্তর, ক্লাইব স্থলপথে কলিকাতা যাত্রা করিলেন। জাহাজ সকল তাঁহার উপস্থিতির পূর্বেই তথার পহুছিয়াছিল। ওয়াটসন সাহেব, কলিকাতার উপর, ক্রমাগত দুইঘন্টা কাল, গোলাবৃষ্টি করিয়া ১৭৫৭ খৃঃ অব্দের ২রা জানুয়ারি, ঐ স্থান অধিকার করিলেন। এইরূপে, ইংরেজেরা পুনর্বার কলিকাতার অধিকার প্রাপ্ত হইলেন, অথচ স্বপক্ষীয় এক ব্যক্তিরও প্রাণহানি হইল না।

দ্বিতীয় অধ্যায়

ক্লাইব বিলক্ষণ বুঝিতে পারিয়াছিলেন, ভয় প্রদর্শন না করিলে, নবাব কদাচ সন্ধি করিতে চাহিবেন না। অতএব তিনি, কলিকাতা উদ্ধারের দুই দিবস পরে, যুদ্ধজাহাজ ও সৈন্য পাঠাইয়া, হুগলী অধিকাব করিলেন। তৎকালে এই নগর প্রধান বাণিজ্যস্থান ছিল।

বোধ হইতেছে, কলিকাতা অধিকার হইবার অব্যবহিত পরে, ক্লাইব মুবশিদাবাদের শেঠদিগেব নিকট এই প্রার্থনা করিয়া পাঠাইয়াছিলেন যে, তাঁহারা, মধ্যস্থ হইয়া, নবাবের সহিত ইংরেজদিগের সন্ধি করিয়া দেন। তদনুসারে তাঁহারা সন্ধির প্রস্তাব করেন। সিরাজউদ্দৌলাও, প্রথমতঃ, প্রসন্নচিত্তে, তাঁহাদের পরামর্শ শুনিয়াছিলেন; কিন্তু ক্লাইব, হুগলী অধিকার করিয়া, তথাকার বন্দর লুঠ করিয়াছেন, ইহা শুনিবামাত্র, ক্রোধে অন্ধ হইয়া, সসৈন্ত অবিলম্বে কলিকাতা যাত্রা করিলেন। তিনি, ৩০শে জানুয়ারি, হুগলীর ঘাটে গঙ্গা পার হইলেন; এবং, ২রা ফেব্রুয়ারি, কলিকাতার সন্নিকটে উপস্থিত হইয়া, ক্লাইবের ছাউনির এক পোয়া অন্তরে শিবির নিবেশিত করিলেন।

ক্লাইব, ৭০০ গোরা ও ১২০০ সিপাই, এইমাত্র স্যৈ সংগ্রহ করিয়াছিলেন। কিন্তু নবাবের সৈন্য প্রায় চত্বারিংশৎ সহস্র।

সিরাজউদ্দৌলা পহুছিবামাত্র, ক্লাইব, সন্ধি প্রার্থনায়, তাঁহার নিকট দূত প্রেরণ করিলেন। নবাবের সহিত দূতদিগের অনেকবার সাক্ষাৎ ও কথোপকথন হইল। তাহাতে তাঁহারা স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন, নবাব যদিও মুখে সন্ধির কথা কহিতেছেন, তাঁহার অন্তঃকরণ সেরূপ নহে। বিশেষতঃ, তাহাকে উপস্থিত দেখিয়া, কলিকাতার চারিদিকের লোক ভয়ে পলায়ন করাতে, ইংরেজদিগের আহারসামগ্রী দুষ্প্রাপ্য হইতে লাগিল। অতএব ক্লাইব, এক উ্যমেই, নবাবকে আক্রমণ করা আবশ্বক বিবেচনা করিলেন। তিনি ৪ঠা ফেব্রুয়ারি রাত্রিতে, ওয়াইসন সাহেবের জাহাজে গিয়া, তাঁহার নিকট ছয়শত জাহাজী গোরা চাহিয়া লইলেন, এবং তাহাদিগকে সঙ্গে করিয়া, রাত্রি একটার সময় তীরে উত্তীর্ণ হইলেন। দুইটার সময়, সমুদয় সৈন্ত স্ব স্ব অস্ত্র লইয়া প্রস্তুত হইল, এবং চরিটার সময়, একবারে নবাবের ছাউনির দিকে যাত্রা করিল। সৈন্ত সমুদয়ে ১৩৫০ গোরা ও ৮০০ সিপাই। অকুতোভয় ক্লাইব, সাহসে নির্ভর করিয়া, এইমাত্র সৈন্য লইয়া, বিংশতি গুণ অধিক সৈন্য আক্রমণ করিতে চলিলেন।

শীতকালের শেষে, প্রায় প্রতিদিন কৃষ্ণটিকা হইয়া থাকে। সে দিবসও প্রভাত হইবামাত্র, এমন নির্বিড কুষ্মটিকা হইল যে, কোনও ব্যক্তি, আপনার সম্মুখের বস্তুও দেখিতে পায় না। যাহা হউক, ইংরেজেরা, যুদ্ধ করিতে করিতে, বিপক্ষের শিবির ভেদ করিয়া চলিয়া গেলেন। হত ও আহত সমূদয়ে তাঁহাদের দুই শত বিংশতি জন মাত্র সৈন্য নষ্ট হয়। কিন্তু নবাবের তদপেক্ষায় অনেক অধিক লোক নিধন প্রাপ্ত হইয়াছিল।

নবাব, ক্লাইবের ঈদৃশ অসম্ভব সাহস দর্শনে, অতিশয় ভয়প্রাপ্ত হইলেন, এবং বুঝিতে পারিলেন, কেমন ভয়ানক শত্রুর সহিত বিবাদে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। অতএব, তিনি তৎক্ষণাৎ তথা হইতে চারি ক্রোশ দূরে গিযা ছাউনি করিলেন। ক্লাইব দ্বিতীয়বার আক্রমণের সমুদয় উদ্যোগ করিলেন। কিন্তু নবাব, তদীয় অসম্ভব সাহস ও অকুতোভয়তা দর্শনে, যুদ্ধের বিষয়ে এত ভগ্নোৎসাহ হইয়াছিলেন যে, সন্ধির বিষয়েই সম্মত হইয়া ১ই ফেব্রুয়ারি, সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করিলেন।

এই সন্ধি দ্বারা ইংরেজেরা, পূর্বের ন্যায়, সমুদয় অধিকার প্রাপ্ত হইলেন। অধিকন্তু, কলি- কাতায় দুর্গনির্মাণ ও টাকশালস্থাপন করিবার অনুমতি পাইলেন; আর তাঁহাদের পণ্য- দ্রব্যের শুষ্কদান রহিত হইল। নবাব ইহাও স্বীকার করিলেন, কলিকাতায় আক্রমণ কালে যে সকল দ্রব্য গৃহীত হইযাছে, সমুদয় ফিরিয়া দিবেন; আর যাহা যাহা নষ্ট হইয়াছে, সে সমুদয়ের যথোপযুক্ত মূল্য ধরিয়া দিবেন।

ইংরেজেরা যুদ্ধে জয়ী হইয়াছেন, এই ভাবিয়া, নবাব এই সকল নিয়ম তৎকালে অতিশয় অনুকূল বোধ করিলেন। আর ক্লাইবও এই বিবেচনা করিয়া সন্ধিপক্ষে নির্ভর করিলেন যে, ঘুরোপে ফরাসিদিগের সহিত ইংরেজ দিগের যুদ্ধ আরব্ধ হইয়াছে; আর কলি- কাতায় ইংরেজ দিগের যত ঘুরোপীয় সৈন্ত আছে, চন্দননগরে ফরাসিদিগেরও তত আছে। অতএব, চন্দননগর আক্রমণ করিতে যাইবার পূর্বে, নবাবের সহিত নিষ্পত্তি করিয়া, সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিন্ত হওয়া আবশ্বক।

ইংরেজ ও ফরাসি, এই উভয় জাতির যুরোপে পরস্পর যুদ্ধ আরব্ধ হইবার সংবাদ কলি-

কাতায় পঁহুছিলে, ক্লাইব, চন্দননগরবাসী ফরাসিদিগের নিকট প্রস্তাব করিলে, ঘুরোপে

যেরূপ হউক, ভারতবর্ষে আমরা কেহ কোনও পক্ষকে আক্রমণ করিব না। তাহাতে

চন্দননগরের গবর্ণর উত্তর দিলেন যে, আপনকার প্রস্তাবে সম্মত হইতে আমার আপত্তি নাই; কিন্তু, যদি প্রধান পদারূঢ় কোনও ফরাসি সেনাপতি আইসেন, তিনি এরূপ সন্ধি- পত্র অগ্রাজ করিতে পারেন। ক্লাইব বিবেচনা করিলেন, যাহাতে নিশ্চিন্ত হইতে পারা যায়, এরূপ নিষ্পত্তি হওয়া অসম্ভব। আর, যতদিন চন্দননগরে ফরাসিদের অধিক সৈন্ত্য থাকিবেক, তাবৎকাল পর্যন্ত কলিকাতা নিরাপদ হইবেক না। তিনি ইহাও নিশ্চিত বুঝিয়াছিলেন যে, সিরাজউদ্দৌলা কেবল ভয় প্রযুক্ত সন্ধি করিয়াছেন। সুযোগ পাইলে, নিঃসন্দেহ, যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবেন। বস্তুতঃ, সিবাজউদ্দৌলা, এ পর্যন্ত, ক্রমাগত, ফরাসিদিগের সহিত ইংরেজ দিগের উচ্ছেদের মন্ত্রণা করিতেছিলেন এবং যুদ্ধকালে ফরাসিদিগের সাহায্যার্থে কিছু সৈন্যও পাঠাইয়া ছলেন।

যাহা হউক, ক্লাইব বিবেচনা করিলেন, নবাবের অনুমতি ব্যতিরেকে, ফরাসিদিগকে আক্রমণ কবা পরামর্শসিদ্ধ নহে। কিন্তু, এ বিষয়ে অনুমতির নিমিত্ত, তিনি যতবার প্রার্থনা করিলেন, প্রত্যেকবারেই, নবাব কোনও স্পষ্ট উত্তর দিলেন না। পরিশেষে, ওয়াটসন সাহেব নবাবকে এইভাবে পত্র লিখিলেন, আমার যত সৈন্য আসিবার কল্পনা ছিল, সমুদয় আসিযাছে; এক্ষণে আপনকার রাজ্যে এমন প্রবল যুদ্ধানল প্রজ্জলিত করিব যে, সমুদয় গঙ্গার জলেও ঐ যুদ্ধানলেব নির্বাণ হইবেক না। সিরাজউদ্দৌলা, এই পত্র পাঠে যৎপবোনাস্তি ভীত হইয়া, ১৭৫৭ খৃঃ অব্দেব ১০ই মার্চ, বিনয় করিয়া, এক পত্র লিখিলেন। ঐ পত্রেব শেষে এই কথা লিখিত ছিল, যাহা আপনকার উচিত বোধ তয়, করুন।

ক্লাইব ইহাকেই ফবাসিদিগকে আক্রমণ করিবার অনুমতি গণ্য করিয়া লইলেন, এবং অবিলম্বে, সৈন্য সহিত, স্থলপথে, চন্দননগর যাত্রা করিলেন। ওয়াটসন সাহেবও সমস্ত যুদ্ধজাহাজ সহিত, জলপথে প্রস্থান করিয়া, ঐ নগরের নিকটে নঙ্গর করিলেন। ইংরেজ- দিগের সৈন্ত চন্দননগব অবরোধ করিল। ক্লাইব, স্বীয় স্বভাবসিদ্ধ সাহসিকর্তা সহকারে, অশেষবিধ চেষ্টা কবিলেন; কিন্তু জাহাজী সৈন্যের প্রযতেই ঐ স্থান হস্তগত হইল। ইংরেজেরা, এ পর্যন্ত, ভারতবর্ষে অনেক যুদ্ধ করিযাছিলেন; কিন্তু এই যুদ্ধ সর্বাপেক্ষা ভয়ানক। নয় দিন অবরোধের পর, চন্দননগর পরাজিত হয়।

এরূপ প্রবাদ আছে, ইংরেজেরা ফরাসি সৈন্য ও সেনাপতিদিগকে উৎকোচ দিয়া বশীভূত করেন, তাহাদের বিশ্বাসঘাতকতাতেই চন্দননগব পরাজিত হয়। এই প্রবাদের মূল এই, ফরাসি গবর্ণর, ইংরেজদিগের জাহাজের গতির প্রতিবোধের নিমিত্ত, নৌকা ডুবাইয়া গঙ্গার প্রায় সমুদায় অংশ রুদ্ধ করিয়া, কেবল এক অল্প পরিসর পথ রাখিয়াছিলেন। এই বিষয় অতি অল্প লোক জানিত। ফরাসিদিগের এক কর্মচারী ছিল, তাহার নাম টেরেনো। টেরেনো, কোনও কারণবশতঃ, ফরাসি গবর্ণর রেনড সাহেবের উপর বিরক্ত হইয়া, ইংরেজদিগের পক্ষে আইসে, এবং ক্লাইবকে ঐ পথ দেখাইয়া দেয়। উত্তরকালে, ঐ ব্যক্তি, ইংরেজদিগের নিকট কর্ম করিয়া, কিছু উপার্জন করে, এবং ঐ উপার্জিত অর্থের কিয়ৎ অংশ ফ্রান্সে আপন বৃদ্ধ পিতার নিকট পাঠাইয়া দেয়। কিন্তু তাহার পিতা এই টাকা গ্রহণ করেন নাই, বিশ্বাসঘাতকের দত্ত বলিয়া, স্বণা প্রদর্শনপূর্বক ফিরিয়া পাঠান। ইহাতে টেরেনোর অন্তঃকরণে এমন নির্বেদ উপস্থিত হয় যে, সে উদ্বন্ধন দ্বারা প্রাণত্যাগ করে।

সিরাজউদ্দৌলার সহিত যে সন্ধি হয়, তদ্বারা ইংরেজরা টাকশাল ও দুর্গ নির্মাণ করিবার অনুমতি পান। যাটি বৎসরের অধিক হইবেক, তাঁহারা, এই দুই বিষয়ের নিমিত্ত বারং- বার প্রার্থনা কবিয়াও, কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। কলিকাতার যে পুরাতন দুর্গ নবাব অনায়াসে অধিকাব করেন, তাহা অতি গোপনে নির্মিত হইয়াছিল। এক্ষণে, ক্লাইব, এই সন্ধির পরেই, এতদ্দেশীয় সৈন্তে পরাজয় করিতে না পারে, এরূপ এক দুর্গ নির্মাণ করিতে আরম্ভ করিলেন, এবং তাহার সমাধান বিষয়ে সবিশেষ সত্ত্বর ও সযত্ন হইলেন। যখন নক্সা প্রস্তুত করিয়া আনে, তখন তিনি, তাহাতে কত ব্যয় হইবেক, বুঝিতে পারেন নাই। কার্য আরন্ধ হইলে, ক্রমে দৃষ্ট হইল, দুই কোটি টাকাব ন্যূনে নির্বাহ হইবেক না। কিন্তু তখন আর তাহার কোনও পরিবর্তন করিবার উপায় ছিল না। কলিকাতার বর্তমান দুর্গ, এইরূপে, দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হইয়াছিল। সেই বৎসরেই, এক টাকশাল নির্মিত, এবং আগষ্ট মাসের ঊনবিংশ দিবসে, ইংরেজদিগের টাকা প্রথম মুদ্রিত হয়।

ক্লাইব, এইরূপে, পরাক্রম দ্বারা, ইংরেজদিগের অধিকার পুনঃস্থাপিত করিয়া, মনে মনে স্থির করিলেন, পরাক্রম ব্যতীত অন্য কোনও উপায়ে এ অধিকারের রক্ষা হইবেক না। তিনি, প্রথম অবধিই, নিশ্চিত বুঝিরা ছিলেন, ইংরেজরা নিশ্চিন্ত থাকিলে চলিবেক না, অবশ্য তাহাদিগকে অন্য অন্য উপায় দেখিতে হইবেক। আর ইহাও বুঝিতে পরিয়া- ছিলেন, ফবাসিদিগের সাহায্য পাইলে নবাব দুর্জন হইয়া উঠিবেন। অতএব, যাহাতে ফরাসিরা পুনরায় বাঙ্গালাতে প্রবেশ করিতে না পায়, এ বিষয়ে তিনি সবিশেষ সতর্ক ও সচেষ্ট ছিলেন।

তৎকালে, দক্ষিণ বাজ্যে ফরাসিদিগের বুসি নামে এক সেনাপতি ছিলেন। তি

নি, অনেক দেশ জয় করিয়া সাতিশয় পরাক্রান্ত হইয়া উঠেন। সিরাজউদ্দৌলা, ইংরেজবিগের প্রতি মুখে বন্ধুত্ব দর্শাইতেন; কিন্তু, ঐ ফরাসি সেনাপতিকে, সৈন্য সহিত বাঙ্গালার আসিয়া, ইংরেজদিগকে আক্রমণ করিবার নিমিত্ত, পত্রদ্বারা বারংবার আহ্বান করিতেছিলেন। নবাব এবিষয়ে যে সমস্ত পত্র লিখিলেন, তাহার কয়েক খান ক্লাইবের হস্তে আইসে। ইংরেজেরা সিরাজউদ্দৌলাকে খর্ব করিয়াছিলেন, এজন্ম, তিনি তাঁহাদের প্রতি অক্রোধ হইতে পারেন নাই। সময়ে সময়ে, তাঁহার ক্রোধ উদ্বেল হইয়া উঠিত। অর্বাচীন নির্বোধ নবাব, ক্রোধোদয় কালে, উন্মত্তপ্রায় হইতেন; কিন্তু, ক্রোধ নিবৃত্ত হইলে, ইংরেজদিগের ভয় উঁহার অন্তঃকরণে আবির্ভুত হইত। ওয়াইপ নামে এক সাহেব, তাঁহার দরবারে ইংরেজদিগের রেসিডেন্ট ছিলেন। নবাব, একদিন, খুলে দিব বলিয়া, তাঁহাকে ভয় দেখাইতেন; দ্বিতীয় দিন, তাঁহার নিকট মর্যাদাশুচক পরিচ্ছদ পুরস্কার পাঠাইতেন। একদিন, ক্রোধে অন্ধ হইয়া, ক্লাইবের পত্র ছি"ডিয়া ফেলিতেন; দ্বিতীয় দিন, বিনয় ও দীনতা প্রকাশ করিয়া, তাঁহাকে পত্র লিখিতেন।

ইংরেজরা বুঝিতে পারিলেন, যাবৎ এই দুর্দান্ত বালক বাঙ্গালার সিংহাসনে অধিকঢ় থাকিবেক, তাবৎ কোনও প্রকারে ভদ্রস্থতা নাই। অতএব, তাঁহারা, কি উপায়ে নিরাপদ হইতে পাবেন, মনে মনে এ বিষয়ের আন্দোলন করিতেছেন, এমন সময়ে দিল্লীর সম্রাটের কোষাধ্যক্ষ পরাক্রান্ত শেঠবংশীয়েরা নবাবের সর্বাধিকারী রাজা বায়দুর্লভ, সৈন্যদিগের ধনাধ্যক্ষ ও সেনাপতি মীরজাফর, এবং উমিচাঁদ ও খোজা বাজীদ নামক দুই জন ঐশ্বর্যশালী বণিক, ইত্যাদি কতিপয় প্রধান ব্যক্তি তাঁহাদেব নিকট এক পত্র প্রেরণ করিলেন।

সিরাজউদ্দৌলা, নিষ্ঠব তা ও স্বেচ্ছাচারিতা দ্বাবা, তাঁহাদের অন্তঃকরণে নিবতিশয় বিরাগোৎপাদন করিযাছিলেন। বিশেষতঃ, তাহারা আপনাদের ধন, মান, জীবন সর্বদা সঙ্কটাপন্ন বোধ করিতেন। পূর্ব বৎসর, সক৩জঙ্গকে সিংহাসনে নিবেশিত করিবার নিমিত্ত, সকলে এক বাক্য হইয়াছিলেন; কিন্তু তাঁহাদের সে উদ্যোগ বিফল হইয়া যায়। এক্ষণে তাঁহারা, সিবাজউদ্দৌলাকে রাজ্যভ্রষ্ট করিবার নিমিত্ত, প্রাণ পর্যন্ত পণ করিযা; ইংরেজদিগের নিকট সাহায্য প্রার্থনায় গোপনে পত্রপ্রেরণ করেন।

ইংবেজবা বিবেচনা কবিলেন, আমরা সাহায্য না করিলেও, এই রাজবিপ্লব ঘটিবেক; সাহায্য করিলে, আমাদের অনেক উপকারের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু, তৎকালের কৌন্সিলের মেম্বরেরা প্রায় সকলেই ভীরুস্বভাব ছিলেন; এমন গুরুতর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতে তাঁহাদেব সাহস হইল না। এডমিরেল ওয়াটসন সাহেবও বিবেচনা করিযা- ছিলেন, যাহাবা এ পর্যন্ত কেবল সামান্যকারণে বাণিজ্য কবিযা আসিতেছে, তাহাদের পক্ষে দেশাধিপতিকে পদচ্যুত করিতে উদ্যত হ্যা অত্যন্ত অসংসাহসের কর্ম। কিন্তু ক্লাইব অকুতোভয় ও অত্যন্ত সাহসী ছিলেন; সঙ্কট পড়িলে, তাঁহাব ভয় না জন্মিয়া, বরং সাহস ও উৎসাহের বৃদ্ধি হইত। তিনি উপস্থিত প্রস্তাবে সম্মত হইতে, কোনও- ক্রমে, পবান্মুখ হইলেন না।

ক্লাইব, এপ্রিল মে দুই মাস, মুরশিদাবাদের রেসিডেন্ট ওয়াট্স সাহেব দ্বারা, নবাবের প্রধান প্রধান কর্মচারীদিগের সহিত মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন; এত গোপনে যে, সিরাজ- উদ্দৌলা কিছুমাত্র বুঝিতে পারেন নাই। একবার মাত্র তাঁহার মনে সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছিল। তখন তিনি মীরজাফরকে ডাকাইয়া কোরান স্পর্শ করাইয়া, শপথ করান। জাফরও যথোক্ত প্রকারে শপথ করিয়া প্রতিজ্ঞা করেন, আমি কখনও কৃতঘ্ন হইব না।

সমুদায় প্রায় স্থির হইয়াছে, এমন সময়ে উমিচাঁদ সমস্ত উচ্ছিন্ন করিবার উদ্যোগ করিয়াছিলেন। নবাবের কলিকাতা আক্রমণ কালে, তাঁহার অনেক সম্পত্তি নষ্ট হইয়াছিল, এ নিমিত্ত, মূল্যস্বরূপ তাঁহাকে যথেষ্ট টাকা দিবার কথা নির্ধারিত হয়। কিন্তু তিনি, তাহাতে সন্তুষ্ট না হইয়া এক দিন বিকালে, ওয়াইস সাহেবের নিকটে গিয়া কহিলেন, মীরজাফরের সহিত ইংরেজদিগের যে প্রতিজ্ঞাপত্র হইবেক, তাহাতে আমাকে আর ত্রিশ লক্ষ টাকা দিবার কথা লিখিয়া দেখাইতে হইবেক; নতুবা, আমি এখনই, নবাবের নিকটে গিয়া সমুদয় পরামর্শ ব্যক্ত করিব। উমিচাঁদ এরূপ করিলে, ওয়াট্ট্স প্রভৃতি যে সকল ব্যক্তি এই ব্যাপারে লিপ্ত ছিলেন, তৎক্ষণাৎ তাঁহাদের প্রাণদণ্ড হইত। ওয়াট্ট্স সাহেব, কালবিলম্বের নিমিত্ত, উমিচাঁদকে অশেষ প্রকারে সান্ত্বনা করিয়া, অবিলম্বে কলিকাতায় পত্র লিখিলেন।

এই সংবাদ পাইয়া, ক্লাইব প্রথমতঃ একবারে হতবুদ্ধি হইয়াছিলেন। কিন্তু তিনি, ধূর্ততা ও প্রতারকতা, বিষয়ে, উমিচাঁদ অপেক্ষা অধিক পণ্ডিত ছিলেন; অতএব, বিবেচনা করিয়া স্থির করিলেন, উমিচাঁদ গর্হিত উপায় দ্বারা অর্থলাভের চেষ্টা করিতেছে; এ ব্যক্তি সাধারণের শত্রু, ইহার দুষ্টতাদমনের নিমিত্ত, যে কোনও প্রকার চাতুবী করা অন্যায় নহে। অতএব আপাততঃ, ইহাব দাওয়া অঙ্গীকার করা যাউক। পরে এ ব্যক্তি আমাদের হস্তে আসিবেক। তখন ইহাকে ফাঁকি দেওয়া কঠিন হইবেক না। এই স্থির করিয়া তিনি, ওয়াটুস সাহেবকে উমিচাদের দাওয়া স্বীকার করিতে আজ্ঞা দিয়া, দুই খান প্রতিজ্ঞাপত্র প্রস্তুত করিলেন, এক খান শ্বেত বর্ণের; দ্বিতীয় লোহিত বর্ণেব। লোহিত বর্ণের পত্রে উমিচাঁদকে ত্রিশ লক্ষ টাকা দিবার কথা লেখা বহিল, শ্বেত বর্ণের পত্রে সে কথার উল্লেখ রহিল না। ওয়াটসন সাহেব, ক্লাইবের ন্যায়, নিতান্ত ধর্মজ্ঞানশূন্ন ছিলেন না। তিনি প্রতারণাঘটিত লোহিত বর্ণের প্রতিজ্ঞাপত্রে; স্বীয় নাম স্বাক্ষরিত করিতে সম্মত হইলেন না। কিন্তু উমিচাদ অতিশয় চতুর ও অতিশয় সতর্ক; তিনি, প্রতিজ্ঞাপত্রে ওয়াট্ট্সনের নাম স্বাক্ষরিত না দেখিলে, নিঃসন্দেহ সন্দেহ করিবেন। ক্লাইব কোনও কর্ম অঙ্গহীন করিতেন না, এবং, অভিপ্রেত সাধনের নিমিত্ত সকল কর্মই করিতে পারিতেন। তিনি ওয়াট্সন সাহেবের নাম জাল করিলেন। লোহিত বর্ণের পত্র উমিচাঁদকে দেখান গেল, এবং তাহাতেই তাঁহার মন সুস্থ হইল। অনস্তব, মীরজাফরের সহিত এই নিয়ম হইল, ইংরেজেরা যেমন অগ্রসব হইবেন, তিনি, স্বীয় প্রভুর সৈন্ত হইতে আপন সৈন্য পৃথক করিয়া, ইংরেজদিগের সহিত মিলিত হইবেন। এইরূপে সমুদয় স্থিরীকৃত হইলে, ক্লাইব সিরাজউদ্দৌলাকে এই মর্মে পত্র লিখলেন যে, আপনি ইংরেজদিগের অনেক অনিষ্ট করিয়াছেন, সন্ধিপত্রের নিয়মলঙ্ঘন করিয়াছেন যে যে ক্ষতিপুরণ স্বীকার করিয়াছিলেন তাহা করেন 'নাই, এবং ইংরেজদিগকে বাঙ্গালা হইতে তাড়াইয়া দিবার নিমিত্ত, ফরাসিদিগকে আহ্বান করিয়াছেন। অতএব, আমি স্বয়ং মুরশিদাবাদে যাইতেছি, আপনকার সভার প্রধান প্রধান লোকদিগের উপর ভার দিব, তাঁহারা সকল বিষয়ের মীমাংসা করিয়া দিবেন।

নবাব, এই পত্রের লিখনভঙ্গী দেখিয়া, এবং ক্লাইব স্বয়ং আসিতেছেন ইহা পাঠ করিয়া অতিশয় ব্যাকুল হইলেন, এবং ইংরেজদিগের সহিত যুদ্ধ অপরিহরণীয় স্থির করিয়া, অবিলম্বে সৈন্য সংগ্রহপূর্বক, কলিকাতা অভিমুখে যাত্রা করিলেন। ক্লাইবও, ১০৫৭ খৃঃ অব্দের জুন মাসের আরন্তেই, আপন সৈন্য লইয়া প্রস্থান করিলেন। তিনি, ১৭ই জুন কাটোয়াতে উপস্থিত হইলেন, এবং পর দিন তথাকার দুর্গ আক্রমণ ও অধিকার করিলেন।

১৯শে জুন, ঘোরতর বর্ষার আরম্ভ হইল। ক্লাইব, নদী পার হইয়া নবাবের সহিত যুদ্ধ করি, কি ফিরিয়া যাই, মনে মনে এই আন্দোলন করিতে লাগিলেন। কারণ, তিনি তৎকাল পর্যন্ত মীরজাফরের কোনও উদ্দেশ পাইলেন না, এবং তাঁহার একখানি পত্রিকাও প্রাপ্ত হইলেন না। তখন তিনি, স্বীষ সেনাপতিদিগকে সমবেত করিয়া, পরামর্শ করিতে বসিলেন। তাঁহারা সকলেই যুদ্ধের বিসয়ে অসম্মতিপ্রদর্শন করিলেন। ক্লাইবও, প্রথমত তাঁহাদের সিদ্ধান্তই গ্রাহ্য করিয়াছিলেন; কিন্তু, পরিশেষে, অভিনিবেশ- পূর্বক বিবেচনা করিয়া, ভাগ্যে যাহা থাকে ভাবিয়া, যুদ্ধপক্ষই অবলম্বন করিলেন। তিনি স্থির বুঝিয়াছিলেন, যদি এত দূর আসিয়া, এখন ফিরিয়া যাই, তাহা হইলে, বাঙ্গালাতে

ইংরেজ দিগের অভ্যুদয়ের আশা একবারে উচ্ছিন্ন হইবেক। ২২শে জুন, সূর্যোদয় কালে, সৈন্য সকল গঙ্গা পার হইতে আবস্তু করিল। দুই প্রহব চারিটার সময়, সমুদয় সৈন্য অপর পারে উত্তীর্ণ হইল। তাহারা, অবিশ্রান্ত গমন করিযা রাত্রি দুই প্রহর একটার সময়, পলাশির বাগানে উপস্থিত হইল।

প্রভাত হইবামাত্র, যুদ্ধ আরম্ভ হইল। ক্লাইব, উৎকন্ঠিত চিত্তে মীবজাফবের ও তদীয় সৈন্যের আগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। কিন্তু, তখন পর্যন্ত, তাঁহার ও তদীয় সৈন্তের কোনও চিহ্ন দেখা গেল না। যুদ্ধক্ষেত্রে নবাবের পঞ্চদশ সহস্র অশ্বারোহ ও পঞ্চত্রিংশৎ সহস্র পদাতি স্যৈ উপস্থিত হইয়াছিল। কিন্তু তিনি স্বয়ং চাটুকারবর্গে বেষ্টিত হইয়া, সকলেব পশ্চাদ্ভাগে তাঁবুর মধ্যে ছিলেন। মীরমদন নামক একজন সেনাপতি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। মীরজাফর, আত্মসৈন্য সহিত, তথায় উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েন নাই।

বেলা প্রায় দুই প্রহরের সময়, কামানের গোলা লাগিয়া, সেনাপতি মীরমদনের দুই পা উডিয়া গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ নবাবের তাঁবুতে নীত হইলেন এবং তাঁহার সম্মুখেই প্রাণত্যাগ করিলেন। তদৃষ্টে নবাব যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হইলেন, এবং ভৃত্যদিগকে বিশ্বাসঘাতক বলিয়া সন্দেহ করিতে লাগিলেন। তখন, তিনি মীরজাফরকে ডাকাইয়া আনিলেন, এবং তাঁর চরণে স্বীয় উষ্ণীষ স্থাপিত করিয়া, অতিশয় দীনতা প্রদর্শনপূর্বক এই প্রার্থনা করিতে লাগিলেন যে, অন্ততঃ আমার মাতামহের অনুরোধে, আমার অপরাধ ক্ষমা কবিয়া, এই বিষম বিপদের সময় সহায়তা কর।

জাফর অঙ্গীকার করিলেন, আমি আত্মধর্ম প্রতিপালন করিব; এবং, তাহার প্রমাণ- স্বরূপ, নবাবকে পরামর্শ দিলেন, অদ্য বেলা অত্যন্ত অধিক হইয়াছে, সৈন্য সকল ফিরাইয়া আনুন। যদি জগদীশ্বর রূপা করেন, কল্য আমরা, সমূদয় সৈন্য একত্র করিয়া, যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হইব। তদনুসারে, নবাব সেনাপতিদিগকে যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হইবার আজ্ঞা পাঠাইলেন। নবাবের অপর সেনাপতি মোহনলাল ইংরেজদিগের সহিত ঘোর তর যুদ্ধ করিতেছিলেন; কিন্তু নবাবের এই আজ্ঞা পাইয়া নিতান্ত অনিচ্ছাপূর্বক নিবৃত্ত হইলেন। তিনি অকস্মাৎ ক্ষান্ত হওয়াতে, সৈন্যদিগের উৎসাহভঙ্গ হইল। তাহারা, ভঙ্গ দিয়া, চারি দিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। সুতরাং কাইবের অনায়াসে সম্পূর্ণ জয়লাভ হইল। যদি মীরজাফর বিশ্বাসঘাতক না হইতেন এবং ঈদৃশ সময়ে একপ প্রতাবণা না করিতেন, তাহা হইলে, ক্লাইবের, কোনও ক্রমে, জয়লাভের সম্ভাবনা ছিল না।

তদনন্তর, সিরাজউদ্দৌলা, এক উষ্ট্রে আরোহণ করিয়া, দুই সহস্র অশ্বারোহ সম- ভিব্যাহারে, সমস্ত রাত্রি গমন করতঃ, পব দিন বেলা ৮টার সময়, মুরশিদাবাদে উপস্থিত হইলেন, এবং উপস্থিত হইয়াই আপনার প্রধান প্রধান ভৃত্য ও অমাত্যবর্গকে সন্নিধানে আসিতে আজ্ঞা করিলেন। কিন্তু তাহারা সকলেই স্ব স্ব আলয়ে প্রস্তান কবিল। অন্যের কথা দূরে থাকুক, সে সময়ে, তাঁহার ঋণ্ডব পর্যন্ত তাঁহাকে পরিত্যাগ কবিয়াছিলেন।

নবাব, সমস্ত দিন, একাকী আপন প্রাসাদে কালযাপন করিলেন; পরিশেষে, নিতান্ত হতাশ হইয়া, রাত্রি তিনটার সময়ে, মহিষীগণ ও কতিপয় প্রিয়পাত্র সমভিব্যাহারে করিয়া, শকটারোহণপূর্বক, ভগবানগোলায় পলায়ন করিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া, ফরাসি সেনাপতি লা সাহেবের সহিত মিলিত হইবার নিমিত্ত, তিনি নৌকারোহণপূর্বক জলপথে প্রস্থান করিলেন। ইতঃপূর্বে, তিনি, ঐ সেনাপতিকে পাটনা হইতে আসিতে পত্র লিখিয়াছিলেন।

পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদিগের, হত আহত সমূদয়ে, কেবল কুড়ি জন গোরা ও পঞ্চাশ জন সিপাই নষ্ট হয়। যুদ্ধ সমাপ্তির পর, মীরজাফর, ক্লাইবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, তাঁহার রণজয় নিমিত্ত সভাজন ও হর্ষপ্রদর্শন করিলেন। অনন্তর, উভয়ে একত্র হইয়া মুরশিদাবাদ • চলিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া, মীরজাফর রাজকীয় প্রাসাদ অধিকার করিলেন। রাজধানীর প্রধান প্রধান লোক ও প্রধান প্রধান রাজকীয় কর্মচারী সমবেত হইলেন।

অবিলম্বে এক দরবাব হইল। ক্লাইব, আসন হইতে গাত্রোত্থান কবিয়া, মীবভাফরেৰ

কব গ্রহণপূর্বক সিংহাসনে বসাইযা তাঁহাকে বাঙ্গালা, বিহাব, উড্যিাব নবাব বলিযা

সম্ভাষণ ও বন্দনা কবিলেন। তৎপবে তাঁহাবা উভযে কযেকজন ইংবেজ এবং ক্লাইবের

দেওয়ান বামচাদ ও তাঁহাব মুন্সী নবকৃষ্ণকে সঙ্গে লইযা, ধনাগাবে প্রবেশ কবিলেন;

কিন্তু তন্মধ্যে স্বর্ণ ও বৌপ্য উভয়ে দুই কোটী টাকার অধিক দেখিতে পাইলেন না।

তৎকালেব মুসলমান ইতিহাস লেখক কহেন যে, উহা কেবল বাহ্য ধনাগাব মাত্র। এতদ্ভিন্ন, অন্তঃপুবে আব এক ধনাগাব ছিল, ক্লাইব, তাহাব কিছুমাত্র সন্ধান পান নাই। ঐ কোষে স্বর্ণ, বজত ও বত্বে আট কোটি টাকার ন্যূন ছিলনা। মীবজায়ব, আমির বেগ খাঁ, বামচাঁদ, নবরফ, এই কষনে ঐ ধন যথাযোগ্য ভাগ কবিয়া লযেন। এই নির্দেশ নিতান্ত অমূলক বা অসম্ভব বোধ হয় না, কাবণ, বাংচাদ তৎকালে ফাটি টাকা মাত্র মাক্কি বেতন পাইতেন, কিন্তু, দশ বৎসব পবে, তিনি এক, কোটি পচিশ লক্ষ টাকার বিষষ বাখিয়া মবেন। মুন্সী নবরষেবও মাস্কি বেতন যাটি টাকার অধিব ছিল না। কিন্তু তিনি, অল্প দিন পবে, মাতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষে, নষ লক্ষ টাকা ব্যয় কবেন। এই ব্যক্তিই পবিশেষে, বাঙা উপাধি প্রাপ্ত হইবা, বাঙা নবরফ নামে বিদ্যাত এইষা- ছিলেন।

এক্ষণে ইংবেজেবা সকল সঙ্কট হইতে মুক্ত হইলেন। ১৭৫৬ খৃঃ অব্দেব 'জুন মাসে, তাঁহাদেব সবস্বলুণ্ঠন, বাণিজ্যের উচ্ছেদ এবং বর্মচাবিদিগেব প্রাণদণ্ড হয়। বস্তুতঃ, তাঁহাবা বাঙ্গালাতে এক বাবে সর্ব প্রকাবে সম্বদ্বশুন্য হইযাছিলেন। কিন্তু, ১৭৫৭ খৃঃ অব্দেব জুন মাসে, তাঁতাবা কেবল আপনাদেব বুঠীস্বল পুনর্বার তধিকার করিলেন, এমন নহে, আপনাদেব বিপক্ষ সিদ্বান্ডউদ্দৌলাকে বাজ,চু।৩ কবিলেন, এবং ৬৯গত এক ব্যক্তিকে নবাবী পদ দিলেন, আব তাঁহাদেব প্রতিদ্বন্দ্বী ফবাসিবা বাঙ্গাল। হইতে দূর্বীকৃত হইলেন।

নবাব কলিকাতা তাক্রমণ কবাতে, কোম্পানি বাহ। দুবেব, এবং ইংবেজ বাঙ্গালি ও আবমানি বণিকদিগেব যথেষ্ট ক্ষতি হইযাছিল, সেই ক্ষতিব পূণস্বরূপ, বে। স্পানি বাহাদুব, এক কোটি টাকা পাইলেন, ইংরেজ বণিকেবা পঞ্চাশ লক্ষ, বাঙ্গালি বণিকেরা বিশ লক্ষ, আবমানি বণিকেবা সাত লক্ষ, এ সমস্ত ভিন্ন, সৈন্য সংক্রান্ত লোকেবা অনেক পাবিতোষিক পাইলেন। আব, কোম্পানিব যে সকল কর্মচাবীবা মীরভাফবকে সিংহাসনে নিবেশিত কবিয়াছিলেন, তাঁহাবাও বঞ্চিত হইলেন না। ক্লাইব ষোল লক্ষ টাকা পাইলেন, কৌন্সিলেব অন্যান্য মেম্ববেবা, কিছু কিছু ন্যূন পবিমাণে, পুবন্ধাব প্রাপ্ত হইলেন। ইহাও নির্ধাবিত হইল, মহাবাষ্ট্রখাতের অন্তর্গত সমূদয় স্থান ও তাহাব বাজে ছয শত ব্যাম পর্যন্ত, ইংরেজদিগেব হইবেক, কলিকাতার দক্ষিণ বুল্লী পর্যন্ত সমুদয দেশ কোম্পানির জমিদারী হইবেক; আর, ফরাসিরা, কোনও কালে, এ দেশে বাস করিবার অনুমতি পাইবেন না।

এ দিকে, সিরাজউদ্দৌলা, ভগবানগোলা হইতে রাজমহলে পঁহুছিয়া, আপন স্ত্রী ও কন্যাব জন্য অন্ন পাক করিবার নিমিত্ত, এক ফকিরের বুটীরে উপস্থিত হইলেন। পূর্বে ঐ ফকিরের উপর তিনি অনেক অত্যাচার করিয়াছিলেন। এক্ষণে ঐ ব্যক্তি তাঁহার অনুসন্ধানকারীদিগকে তৎক্ষণাৎ তাঁহার পহুছসংবাদ দিলে, তাহারা আসিয়া তাঁহাকে রুদ্ধ করিল। সপ্তাহ পূর্বে, তিনি ঐ সকল ব্যক্তির সহিত আলাপও করিতেন না; এক্ষণে, অতি দীন বাক্যে, তাহাদের নিকট বিনয় করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাহারা, তদীব বিনয়বাক্য শ্রবণে বধির হইয়া, তাঁহার সমস্ত স্বর্ণ ও রত্ন লুটিয়া লইল, এবং তাঁহাকে মুরশিদাবাদে প্রত্যানয়ন করিল।

যৎকালে, তিনি রাজধানীতে আনীত হইলেন, তখন মীরজাফর, অধিক মাত্রায় অহিফেন সেবন করিয়া, তন্দ্রাবেশে ছিলেন; তাঁহার পুত্র পাপাত্মা মীরন, সিরাজ- উদ্দৌলার উপস্থিতিসংবাদ শুনিয়া, তাঁহাকে আপন আলয়ের সন্নিধানে রুদ্ধ করিতে আজ্ঞা দিল, এবং দুই ঘণ্টার মধ্যেই, স্বীয় বয়স্তগণেব নিকট তাঁহার প্রাণবধের ভার লইবাব প্রস্তাব করিল। কিন্তু, তাহারা একে একে সকলেই অস্বীকার করিল। মহম্মদিবেগ নামক এক ব্যক্তি আলিবর্দি খাঁর নিকট প্রতিপালিত হইযাছিল; পরিশেষে সেই দুবাত্মাই এই নিষ্ঠুর ব্যাপারের সমাধানের ভাব গ্রহণ করিল। সে ব্যক্তি গৃহে প্রবেশ করিবামাত্র, হতভাগ্য নবাব, তাহার আগমনের অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া, করুণ স্বরে কহিলেন, আমি যে, বিনা অপরাধে, হুসেন কুলি খাঁর প্রাণদণ্ড করিয়াছিলাম, তাহাব প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ আমায় অবশ্বই প্রাণত্যাগ করিতে হইবেক। তিনি এই বাক্য উচ্চারণ করিবামাত্র, দুরাচার মহম্মদিবেগ তরবারি প্রহার দ্বারা তাঁহার মস্তকচ্ছেদন করিল। উপর্যুপরি কতিপয় আঘাতের পর, তিনি, হুসেনকুলি খাঁর প্রাণদণ্ডের প্রতিফল পাইলাম, এই বলিয়া পঞ্চত্ব প্রাপ্ত ও ভূতলে পতিত হইলেন।

অনন্তর, মীরনেব আজ্ঞাবহেরা নবাবের মৃতদেহ খণ্ড খণ্ড করিল, এবং অযত্ন ও অবজ্ঞা- পূর্বক, হস্তিপৃষ্ঠে নিক্ষিপ্ত করিয়া, জনাকীর্ণ রাজপথ দিয়া, গোর দিবার নিমিত্ত লইয়া চলিল। ঐ সমযে, সকলে লক্ষ্য করিয়াছিল, কোনও কারণবশতঃ, পথের মধ্যে মাহুতেৰ খামিবার আবশ্যক হওয়াতে, আঠারো মাস পূর্বে সিরাজউদ্দৌলা যে স্থানে হুসেনকুলি খাঁর প্রাণবধ করিযাছিলেন, ঐ হস্তী ঠিক সেই স্থানে দণ্ডায়মান হয়; এবং, যে ভূভাগে বিনা অপরাধে, তিনি হুসেনের শোণিতপাত করিয়াছিলেন, ঠিক সেই স্থানে, তাঁহার খণ্ডিত কলেবর হইতে কতিপয় রুধিরবিন্দু নিপতিত হয়।

তৃতীয় অধ্যায়

মীরজাফরের প্রভুত্ব এক কালে বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যা, তিন প্রদেশে অব্যাহত রূপে অঙ্গীকৃত হইল। কিন্তু, অতি অল্পকালেই, প্রকাশ পাইল, তাঁহার কিছুমাত্র বিষয়বুদ্ধি নাই। তিনি স্বভাবতঃ নির্বোধ, নিষ্ঠুর ও অর্থলোভী ছিলেন। রাজ্যের প্রধান প্রধান হিন্দু কর্মচারীরা, পূর্ব পূর্ব নবাবদিগের অধিকার কালে, যথেষ্ট ধনসঞ্চয় করিয়াছিলেন। তিনি প্রথমতঃ, তাঁহাদের সর্বস্বহরণ মনস্থ করিলেন। প্রধানমন্ত্রী রাজা রায় দুর্লভ কেবল বিলক্ষণ ধনবান ছিলেন, এমন নহে; তাঁহার নিজের ছয় সহস্র সৈন্যও ছিল। মীরজাফর সর্বাগ্রে তাঁহাকেই লক্ষ্য করিলেন।

মীরজাফরকে সিংহাসনে নিবেশিত করিবার বিষয়ে, রাজা রায় দুর্লভ প্রধান উদ্যোগী ছিলেন। যখন সিরাজউদ্দৌলাকে রাজ্যভ্রষ্ট কবিবার নিমিত্ত চক্রান্ত হয়, রায় দুর্লভই চক্রান্তকারীদিগের নিকট প্রস্তাব করেন যে, মীরজাফরকে নবাব করা উচিত। তথাপি মীরজাফর, সর্বাগ্রে, রায় দুর্লভের সর্বনাশের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইলেন। ফলতঃ, তাঁহাব উপর মীরজাফরের এমন বিদ্বেষ জন্মিয়াছিল যে, তাঁহার সহিত সিবাজউদ্দৌলার কনিষ্ঠ ভ্রাতার বন্ধুতা আছে, এই সন্দেহ করিয়া, সেই অল্প বযস্ক নিরপরাধ রাজকুমারের প্রাণবধ করিলেন। বায় দুর্লভও, কেবল ইংবেজদিগের শরণাগত হইয়া, সে যাত্রা পরিত্রাণ পাইলেন।

বাজা বামনারাযণ, বহুকাল অবধি বিহারেব ডেপুটি গবর্ণব ছিলেন। নবাব মনস্থ করিলেন, তাঁহাকে পদচ্যুত কবিয়া, তদীয় সমুদয সম্পত্তি অপহরণ করিবেন, ও আপন ভ্রাতাকে গবর্ণরী পদ দিবেন। ক্লাইবের মতে মীবজাফরের ভ্রাতা মীরজাফর অপেক্ষাও নির্বোধ ছিলেন। নবাব মেদিনীপুরে গবর্ণর রাজা রাম সিংহের ভ্রাতাকে কারাগারে রুদ্ধ করিলেন; তাহাতে রাম সিংহও তাঁহাব প্রতি ভগ্নস্নেহ হইলেন। পূর্ণিয়ার ডেপুটি গবর্ণর অদল সিংহ, মন্ত্রীদিগের কুমন্ত্রণা অনুসারে, রাজবিদ্রোহে অভ্যুত্থান করিলেন।

এইরূপে, মীরজাফরের সিংহাসনারোহণের পর, পাঁচ মাসের মধ্যে, তিন প্রদেশে তিন বিদ্রোহ ঘটিল। তখন তিনি ব্যাকুল হইয়া, বিদ্রোহশাস্তির নিমিত্ত, ক্লাইবের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। তৎকালে ক্লাইব বাঙ্গালাতে সকলেরই বিশ্বাসভাজন ছিলেন। এই বিশ্বাস অপাত্রে বিন্তস্ত হয় নাই। তিনি, উপস্থিত তিন বিদ্রোহের শাস্তি করিলেন অথচ এক বিন্দু রক্তপাত হইল না।

নবাব বিনয়বাক্যে প্রার্থনা করাতে, ক্লাইব পাটনা যাইবার সময়, মুরশিদাবাদ হইয়া যান। নবাব, ইংরেজদিগের যত টাকা দিবার অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, এ পর্যন্ত, তাহার অধিকাংশই পরিশোধিত হয় নাই। ক্লাইব, রাজধানীতে উত্তীর্ণ হইয়া, নবাবকে জানাইলেন যে, সে সকলের পরিশোধ করিবার কোনও বন্দোবস্ত করিতে হইবেক। নবাব, তদনুসারে, দেয়-পরিশোধ স্বরূপ, বর্ধমান, নদীয়া, হুগলী, এই তিন প্রদেশের রাজস্ব তাঁহাকে নির্ধারিত করিয়া দিলেন।

এই বিষয়ের নিষ্পত্তি হইলে পর, ক্লাইব ও নবাব, স্ব স্ব সৈন্য লইয়া, পাটনা যাত্রা করিলেন। তাঁহারা তথায় উপস্থিত হইলে, রামনারায়ণ ক্লাইবের শরণাগত হইয়া কহিলেন, যদি ইংরেজরা আমায় অভয়দান করেন, তাহা হইলে, আমি নবাবের আজ্ঞানুবর্তী থাকিতে পারি। ক্লাইব বিস্তর বুঝাইলে পর, নবাব রামনারায়ণের উপর অক্রোধ হইলেন। অনন্তর, রামনারায়ণ, মীরজাফরের শিবিরে গিয়া, তাঁহার সমুচিত সম্মান করিলেন। মীরজাফর, এ যাত্রায়, তাঁহাকে পদচ্যুত করিলেন না। পরে, ক্লাইব ও নবাব, একত্র হইয়া মুরশিদাবাদে প্রত্যাগমন করিলেন। রাজা রায়দুর্লভ, পূর্বাপর, তাঁহাদের সমভিব্যাহারে ছিলেন। তিনি, মনে মনে নিশ্চয় করিয়াছিলেন, ইংরেজেরা যাবং উপস্থিত আছেন, ততদিনই রক্ষার সম্ভাবনা।

পাটনার ব্যাপারে এইরূপে নিষ্পন্ন হওয়াতে, জাফরের পুত্র মীরন অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইলেন। তাহাদের পিতা পুত্রের এই অভিপ্রায় ছিল, পরাক্রান্ত হিন্দুদিগের দমন ও সর্বস্বহরণ করিবেন। কিন্তু, এ যাত্রায়, তাহা না হইয়া, বরং তাঁহাদের পরাক্রমের দৃঢীকরণ হইল। তাঁহারা উভয়েই, ক্লাইবের এইরূপ ক্ষমতা দর্শনে, অসন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন। মীরজাফর, শুনিতে তিন প্রদেশের নবাব ছিলেন বটে, কিন্তু বাস্তবিক কিছুই ছিলেন না; ক্লাইবই সকল ছিলেন।

দুই বৎসর পূর্বে, ইংরেজ দিগকে, নবাবের নিকট স্বপক্ষে একটি অনুকূল কথা বলাইবার নিমিত্ত, টাকা দিয়া যে সকল প্রধান লোকের উপাসনা করিতে হইত, এক্ষণে সেই সকল ব্যক্তিকে ইংরেজদিগের উপাসনা করিতে হইল। মুসলমানেরা দেখিতে লাগিলেন, চতুর হিন্দুরা, অকর্মণ্য নবাবের আনুগত্য পরিত্যাগ করিয়া, ক্লাইবের নিকটেই, সকল বিষয়েই, প্রার্থনা করিতে আরম্ভ কবিয়াছে। কিন্তু ক্লাইব, ঐ সকল বিষয়ে, এমন বিজ্ঞতা ও বিবেচনাপূর্বক কার্য করিতেন যে, যাবৎ তাঁহার হস্তে সকল বিষয়ের কর্তৃত্ব ভার ছিল, তাবৎ, কোনও অংশে, বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয় নাই।

হতভাগ্য দিল্লীশ্বরের পুত্র শাহআলম, প্রয়াগের ও অযোধ্যার শুবাদারদিগের সহিত সন্ধি করিয়া, বহুসংখ্যক সৈন্য লইয়া, বিহারদেশ 'আক্রমণ করিতে উত্থত হইলেন। ঐ দুই সুবাদারে, এই সুযোগে, বাঙ্গালা রাজ্যের কোনও অংশ আত্মসাৎ করিতে পারা যায় কি না, এই চেষ্টা দেখা যেরূপ অভিপ্রেত ছিল, উক্ত রাজকুমারের সাহায্য করা সেরূপ ছিল না। শাহআলম ক্লাইবকে পত্র লিখিলেন, যদি আপনি আমার উদ্দ্যেসিদ্ধি বিষয়ে সহায়তা করেন, তাহা হইলে, আমি আপনাকে, ক্রমে ক্রমে এক এক প্রদেশের আধিপত্য প্রদান করিব। কিন্তু ক্লাইব উত্তর দিলেন, আমি মীরজাফরের বিপক্ষাচরণ।

করিতে পারিব না। শাহআলম, সম্রাটের সহিত বিবাদ করিয়া, তদীয় সম্মতি

ব্যতিরেকে, বিহারদেশ আক্রমণ করিতে আসিয়াছিলেন। এই নিমিত্ত, সম্রাটও

ক্লাইবকে এই আজ্ঞাপত্র লিখিলেন, তুমি আমার বিদ্রোহী পুত্রকে দেখিতে পাইলে রুদ্ধ

করিয়া, আমার নিকট পাঠাইবে।

মীরজাফরের স্যৈসকল, বেতন না পাওয়াতে, অতিশয় অবাধ্য হইয়াছিল; সুতরাং, সে সৈন্য দ্বারা উল্লিখিত আক্রমণের নিবারণ কোনও মতে সম্ভাবিত ছিল না। এজন্য, তাঁহাকে, উপস্থিত বিপদ হইতে উত্তীর্ণ হইবার নিমিত্ত, পুনর্বার ক্লাইবের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিতে হইল। তদনুসারে ক্লাইন, সত্বর হইয়া ১৭৫৯ খৃঃ অব্দে, পাটনা যাত্রা করিলেন। কিন্তু, ক্লাইবের উপস্থিতিব পূর্বেই, এই ব্যাপার একপ্রকার নিস্পন্ন হইয়াছিল। রাজকুমার ও প্রয়াগের সুবাদার, নয় দিবস পাটনা অবরোধ করিয়াছিলেন। ঐ স্থান তাঁহাদের হস্তগত হইতে পারিত; কিন্তু তাঁহারা শুনিলেন, ইংরেজেরা আসিতেছেন, এবং অযোধ্যার সুবাদার, প্রয়াগের সুবাদারের অনুপস্থিতিরূপ সুযোগ পাইয়া, বিশ্বাস- ঘাতকতাপূর্বক, তাঁহার রাজধানী অধিকার কবিধাছেন। এই সংবাদ পাইয়া, প্রয়াগের সুবাদার, আপনার উপায় আপনি চিন্তা করুন এই বলিয়া, রাজকুমারের নিকট বিদায় লইয়া, স্বীয় রাজ্যের রক্ষার নিমিত্ত, প্রস্থান করিলেন। এই উপলক্ষে যে যুদ্ধ উপস্থিত হইল, তাহাতেই তাঁহার মৃত্যু হইল। রাজকুমারের সৈন্তরা অনতিবিলম্বে তাঁহাকে পরিত্যগ করিল। কেবল তিনশত ব্যক্তি তাঁহার অদৃষ্টেব উপর নির্ভর করিয়া রহিল। পরিশেষে, তাঁহার এমন ছববস্থা ঘটিয়াছিল যে, তিনি ক্লাইবের নিকট ভিক্ষার্থে লোক প্রেরণ করেন। ক্লাইব, বদান্যতা প্রদর্শনপূর্বক, রাজকুমারকে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পাঠাইয়া দেন।

মীরজাফর, এইরূপে উপস্থিত বিপদ হইতে পরিত্রাণ পাইয়া, কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ, ক্লাইবকে ওমরা উপাধি দিলেন, এবং, কোম্পানিকে নবাব সরকারে কলিকাতার জমিদারীর যে রাজস্ব দিতে হইত, তাহা তাঁহাকে জায়গীরস্বরূপ দান করিলেন। নির্দিষ্ট আছে, ঐ রাজস্ব বার্ষিক তিন লক্ষ টাকার ন্যূন ছিল না।

এই সকল ঘটনার কিছুদিন পরে, মীরজাফর, কলিকাতায় আসিয়া, ক্লাইবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন; এবং তিনিও, যৎপরোনাস্তি সমাদরপূর্বক, তাঁহার সংবর্ধনা করিলেন। তিনি তথায় থাকিতে থাকিতে, ওলন্দাজদিগের সাতখানা যুদ্ধ জাহাজ নদীমুখে আসিয়া নঙ্গর করিল। ঐ সাত জাহাজে পঞ্চদশ শত সৈন্ত ছিল। অতি ত্বরায় ব্যক্ত হইল, ঐ সকল জাহাজ নবাবের সম্মতি ব্যতিরেকে আইসে নাই। ইংরেজদিগকে দমনে রাখিতে পারে, এরূপ একদল স্বরোপীয় সৈন্য আনাইবার নিমিত্ত, তিনি, কিছুদিন অবধি, চু' চুড়াবাসী ওলন্দাজদিগের সহিত যন্ত্রণা করিতেছিলেন। খোজাবাজীদ নামক কাশ্মীর দেশীয় বণিক এই সকল কুমন্ত্রণার সাধক হইয়াছিলেন।

খোজাবাজীদ আলিবর্দি খাঁর সবিশেষ অনুগ্রহ পাত্র ছিলেন। লবণ ব্যবসায় তাঁহার একচেটিয়া ছিল। তিনি এমন ঐশ্বর্যশালী ছিলেন যে, সহস্র মুদ্রার ন্যূনে তদীয় দৈনন্দিন ব্যয়ের নির্বাহ হইত না। একদা তিনি নবাবকে পঞ্চদশ লক্ষ টাকা উপহার দিয়া- ছিলেন। পূর্বে তিনি মুরশিদাবাদে ফবাসিদিগের এজেন্ট ছিলেন; পরে, চন্দননগরের পরাজয় দ্বারা তাঁহাদের অধিকার উচ্ছিন্ন হইলে, ইংরেজদিগের পক্ষে আইসেন।

সিরাজউদ্দৌলা তাঁহাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতেন। কিন্তু, উক্ত নবাবকে রাজ্যভ্রষ্ট করিবার নিমিত্ত ইংরেজদিগকে আহ্বান করিবার বিষয়ে, তিনিই প্রধান উদ্যোগী হইয়া- ছিলেন। রাজবিপ্লবের পর্ব, তিনি দেখিলেন যে ইংবেজদিগের নিকট যে সকল আশা করিয়াছিলেন, তাহা পূর্ণ হইল না; এজন্ম, তাঁহাদের দমন করিবার নিমিত্ত, বহুসংখ্যক ওলন্দাজী সৈন্যের আনয়ন বিষয়ে যত্নবান হইয়াছিলেন।

তৎকালে চু চূড়ার কৌন্সিলে দুই পক্ষ ছিল। গবর্ণর বিসদম সাহেব এক পক্ষের প্রধান। ইনি ক্লাইবের বন্ধু ছিলেন। তাঁহার নিতান্ত বাসনা, কোনরূপে সন্ধিভঙ্গ না হয়। বর্ণেট নামক এক ব্যক্তি অপর পক্ষের প্রধান। এই পক্ষের লোকেরা অতিশয় উদ্ধত ছিলেন। তাঁহাদের মত অনুসারে, চুঁচুড়ার সমুদয় কার্য সম্পন্ন হইত। ইতঃপূর্বে, ইংরেজেরা, আপনাদের মঙ্গলের নিমিত্ত, ওলন্দাজদিগকে নিষেধ করিয়াছিলেন যে, আপনারা এই নদীতে স্বজাতীয় নাবিক রাখিতে পারিবেন না। ওলন্দাজেবা, বহুসংখ্যক স্যৈ পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত, বটেবিয়াতে পত্র লিখিয়াছিলেন। তাঁহারা মনে মনে আশা করিয়াছিলেন, এদেশে এক্ষণে নানা বিশৃঙ্খলা ঘটিয়াছে, এই সুযোগে আপনাদের অনেক ইষ্টসাধন করিতে পারা যাইবেক।

এই সৈক্সের উপস্থিতি সংবাদ অবগত হইয়া, ক্লাইব, অতিশয ব্যাকুল হইলেন। তৎকালে ওলন্দাজদিগের সহিত ইংরেজদের সন্ধি ছিল। আব, যত তাঁহাদের ঘুরোপীয় সৈন্য থাকে, ইংরেজ দিগের তাহার তৃতীয়াংশের অধিক ছিল না। যাহা হউক, ক্লাইব, স্বীয় স্বভাবসিদ্ধ পরাক্রম ও অকুতোভয়তা সহকারে, কার্য করিতে লাগিলেন।

ক্লাইব, বাঙ্গালাতে ফরাসিদিগের প্রাধান্তলাভ করিয়া, মনে মনে নিশ্চয় করিয়াছিলেন ওলন্দাজদিগকেও প্রবল হইতে দিবেন না। এক্ষণে, তিনি মীরজাফরকে কহিলেন, আপনি ওলন্দাজী সৈন্তদিগকে প্রস্থান করিতে আজ্ঞাপ্রদান করুন। নবাব কহিলেন, আমি স্বয়ং হুগলীতে গিয়া এ বিষয়ের শেষ করিব। কিন্তু তথায় উপস্থিত হইয়া, তিনি, ক্লাইবকে পত্র লিখিলেন, আমি ওলন্দাজদিগের সহিত বন্দোবস্ত করিয়াছি, প্রস্থানের উপযুক্ত কাল উপস্থিত হইলেই, তাহাদের সমুদয় জাহাজ চলিয়া যাইবেক।

ক্লাইব, এই চাতুরীর মর্ম বুঝিতে পারিয়া, স্থির করিলেন, ওলন্দাজী জাহাজ সকল আর অগ্রসর হইতে দেওয়া উচিত নহে; অতএব, কলিকাতার দক্ষিণবর্তী টানা নামক স্থানে যে চর ছিল, তাহা দৃঢ়ীভূত করিতে লাগিলেন। কিন্তু, তিনি নিশ্চয় করিয়াছিলেন, অগ্রে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবেন না। ওলন্দাজেরা, দুর্গের নিকটবর্তী হইয়া, অবিলম্বে আক্রমণ করিলেন, কিন্তু পরাস্ত হইলেন। অনন্তর, তাঁহাবা কিঞ্চিৎ অপস্বত হইয়া, সাত শত যুরোপীয় ও আট শত মালাই সৈন্ত, ভূমিতে অবতীর্ণ করিলেন। ঐ সকল সৈন্ত, স্থলপথে গঙ্গার পশ্চিম পার দিয়া, চুঁচুডা অভিমুখে চলিল। ক্লাইব, ওলন্দাজদিগের অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া, চুঁচুড়া ও চন্দননগরের মধ্যস্থলে অবস্থিতি করিবার নিমিত্ত, পূর্বেই কর্ণেল ফোর্ড সাহেবকে স্বল্প স্যৈ সহিত পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।

ওলন্দাজী সৈন্য, ক্রমে অগ্রসর হইয়া চু চুড়ার এক ক্রোশ দক্ষিণে ছাউনি করিল। কর্ণেল ফোর্ড জানিতেন, উভয় জাতির পরস্পর সন্ধি আছে, এজন্ত, সহসা তাঁহাদিগকে আক্রমণ না করিয়া, স্পষ্ট অনুমতির নিমিত্ত, কলিকাতার কৌন্সিলে পত্র লিখিলেন। ক্লাইব তাস খেলিতেছেন, এমন সময়ে ফোর্ড সাহেবের পত্র উপস্থিত হইল। তিনি, খেলা হইতে না উঠিয়াই, পেন্সিল দিয়া এই উত্তর লিখিলেন, ভ্রাতঃ! অবিলম্বে তাহাদের সহিত যুদ্ধ কর; কল্য আমি কৌন্সিলের অনুমতি পাঠাইব। ফোর্ড, এই আদেশ প্রাপ্তি মাত্র, আক্রমণ করিয়া, আধ ঘণ্টার মধ্যেই, ওলন্দাজদিগকে পরাস্ত করিলেন। তাঁহাদের যে সকল জাহাজ নদী মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল, ঐ সময়ে তৎসমুনায়ও ইংরেজদিগের হস্তে পতিত হইল। এইরূপে ওলন্দাজদিগের ঐ মহো্যোগ পরিশেষে ধূমশেষ হইয়া গেল।

এই যুদ্ধের অব্যবহিত পরক্ষণেই, রাজকুমার মীরন, ছয় সাত সহস্র অশ্বারোহ সৈন্য সহিত চু চুডায় উপস্থিত হইলেন। ওলন্দাজেরা জয়ী হইলে, তিনি তাহাদের সহিত যোগ দিতেন, সন্দেহ নাই; কিন্তু, এক্ষণে, অগত্যা ইংবেজদের সহিত মিলিত হইয়া, ওলন্দাজদিগকে আক্রমণ করিলেন। কর্ণেল ফোর্ড, যুদ্ধ সমাপ্তির অব্যবহিত পরেই, চু" চুড। অবরোধ কবিলেন। ঐ নগর ত্বরায় ইংরেজদিগেব হস্তগত হইত। কিন্তু ওলন্দাজের। ক্লাইবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করাতে, তিনি উক্ত নগর অধিকার করিলেন না। অনন্তর, তাঁহারা যুদ্ধের সমুদয় ব্যয় ধরিয়া দিতে স্বীকার করাতে, তিনি তাঁহাদের জাহাজ সকলও ছাড়িয়া দিলেন।

ক্লাইব, ক্রমাগত তিন বৎসর গুরুতর পরিশ্রম করিয়া, শারীরিক সাতিশয় অপটু হইয়াছিলেন। এজন্য, এই সকল ঘটনার অবসানেই, ১৭৬০ খৃঃ অব্দের ফেব্রুয়ারিতে, ধনে মানে পূর্ণ হইয়া ইংলণ্ড যাত্রা করলেন। গবর্ণমেন্টের ভার বান্সিাটার্ট সাহেবের হস্তে ন্যস্ত হইল। বাঙ্গালা দেশ যে একেবারে নিরুপদ্রব হইবেক, তাহার কোন সম্ভাবনা ছিল না। বৃদ্ধ নবাব মীরজাফর নিজপুত্র মীরনের হস্তে রাজ্যশাসনের ভার সমর্পণ করিলেন। যুবরাজ

রাজপুরুষদিগের সহিত সাতিশয় সাহষ্কার ব্যবহার ও প্রজাগণের উপর অসহ্য অত্যাচার

আরম্ভ করাতে, সকলেই তাঁহার শাসনে অসন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন। তিনি ক্রমে এরূপ

নিষ্ঠুর ব্যাপারের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলেন যে, সকলে সিরাজউদ্দৌলার কুক্রিয়া সকল

বিশ্বত হইয়া গেল।

সম্রাটের পুত্র শাহআলম, সর্বসাধারণের ঈদৃশ অসন্তোষ দর্শনে সাহসী হইয়া, দ্বিতীয় বার বিহার আক্রমণের উদ্যোগ করিলেন। পূর্ণিয়ার গবর্ণর, কাদিম হোসেন খাঁ, সৈন্য লইয়া, তাঁহার সহিত যোগ দিবার নিমিত্ত, প্রস্তুত হইলেন। শাহআলম, কর্মনাশা পার হইয়া বিহারের সীমান্তে পদার্পণ মাত্র, সংবাদ পাইলেন, সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ক্রুর ইমাদ উন্মুলুক সম্রাটের প্রাণবধ করিয়াছে। এই দুর্ঘটনা হওয়াতে, শাহআলম ভারতবর্ষের সম্রাট হইলেন, এবং অযোধ্যার সুবাদারকে সাম্রাজ্যের সর্বাধিকারিপদে নিযুক্ত কবিলেন। কিন্তু তিনি নামেমাত্র সম্রাট হইলেন; তাঁহার পরাক্রমও ছিল না, প্রজাও ছিল না; তৎকালে, তাঁহার রাজধানী পর্যন্ত বিপক্ষের হস্তগত ছিল; এবং তিনিও নিজে নিজ রাজ্যে একপ্রকার পলায়িত স্বরূপ ছিলেন।

তিনি পাটনা অভিমুখে যাত্রা করিলে, পরাক্রান্ত রামনারায়ণ, নগররক্ষার একপ্রকার উদ্যোগ করিষা, সাহায্যপ্রাপ্তির নিমিত্ত, মুরশিদাবাদে পত্র লিখিলেন। কর্ণেল কালিরড তৎকালে সৈন্যের অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি, ইংলণ্ডীয় সৈন্ত লইয়া তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিলেন; এবং মীরনও, স্বীয় সৈন্য সমভিব্যাহারে, তাঁহার অনুগামী হইলেন।

মীরণ, ইতঃপূর্বে, দুই নিজ কর্মকারকের প্রাণদণ্ড করিয়াছিলেন, এবং স্বহস্তে দুই ভোগ্যা কামিনীর মস্তকচ্ছেদন করেন। আলিবর্দি খাঁর দুই কন্যা, ঘেসিতি বেগম, আমান বেগম, আপন আপন স্বামী নিবাইশ মহম্মদ ও সায়দ আহম্মদের মৃত্যুর পর; গুপ্তভাবে ঢাকায় বাস করিতেছিলেন। মীরন, এই যুদ্ধ যাত্রাকালে, তাঁহাদের প্রাণবধ করিতে আজ্ঞাপ্রেরণ করিলেন। ঢাকার গবর্ণর, এই নিষ্ঠুর ব্যাপারের সমাধানে অসম্মত হওয়াতে, তিনি আপন এক ভৃত্যকে এই আজ্ঞা দিয়া পাঠাইলেন যে, তাহাদিগকে, মুরশিদাবাদে আনয়নচ্ছলে, নৌকায় আরোহণ করাইয়া, পথের মধ্যে নৌকা সমেত জলমগ্ন করিবে। এই নির্দেশ প্রকৃত প্রস্তাবেই প্রতিপালিত হইল। হত্যাকারীরা, ডুবাইয়া দিবার নিমিত্ত,

নৌকায় ছিপি খুলিবার উপক্রম করিলে, কনিষ্ঠা ভগিনী করুণস্বরে কহিলেন হে সর্ব- শক্তিমান জগদীশ্বর! আমরা উভয়েই পাপীয়সী ও অপরাধিনী বটে, কিন্তু মীরনের কখনও কোনও অপরাধ করি নাই; প্রত্যুত, আমরাই তাঁহার এই সমস্ত আধিপত্যের মূল।

মীরন, প্রস্থানকালে, স্বীয় স্বরণ পুস্তকে এই অভিপ্রায়ে তিনশত ব্যক্তির নাম লিখিয়া- ছিলেন যে, 'প্রত্যাগমন করিয়া তাহাদের প্রাণদণ্ড করিবেন। কিন্তু আর তাঁহাকে প্রত্যাগমন করিতে হইল না।

কর্ণেল কালিয়ড রামনারায়ণকে এই অনুরোধ কবিয়াছিলেন, যাবৎ আমি উপস্থিত না হই, আপনি, কোনওক্রমে, সম্রাটের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইবেন না। কিন্তু তিনি, এই উপদেশ অগ্রাহ্য করিয়া, নগব হইতে বহির্গমনপূর্বক, সম্রাটের সহিত সংগ্রামে প্রেরত্ত হইয়া, সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইলেন। সুতরাং, পাটনা নিতান্ত অশরণ হইল। সম্রাট, এক উদ্যমেই, ঐ নগর অধিকার করিতে পারিতেন, কিন্তু, অগ্রে তাহার চেষ্টা না কবিযা, দেশ লুণ্ঠনেই সকল সময় নষ্ট কবিলেন। ঐ সময় মধ্যে, কালিয়ড, স্বীয় সমুদয় সৈন্য সহিত, উপস্থিত হইলেন এবং অবিলম্বে সম্রাটের সৈন্য আক্রমণের প্রস্তাব কবিলেন। কিন্তু মীরন, ফেব্রুযাবীব দ্বাবিংশ দিবসেব পূর্বে গ্রহ সকল অনুকূল নহেন, এই বলিয়া আপত্তি উত্থাপন কবাতে, প্রস্তাবিত আক্রমণ স্থগিত বহিল।

২০শে, সম্রাট, তাঁহাদের উভয়েব সৈন্ত এককালে আক্রমণ কবিলেন। মীরনেব পঞ্চদশ সহস্র অশ্বাবোহ সহসা ভঙ্গ দিয়া পলাযন কবিল। কিন্তু কর্ণেল কালিয়ড, দৃঢ়তা ও অকুতোভয়তা সহকারে, সম্রাটের সৈন্য আক্রমণ করিয়া, অবিলম্বে পরাজিত কবিলেন। শাহআলম, সেই বাত্রিতেই, শিবিব ভঙ্গ কবিয়া, বণক্ষেত্রের পাঁচ ক্রোশ অন্তরে গিযা অবস্থিতি কবিলেন। অনম্ভব, তিনি, স্বীষ সেনাপতির পরামর্শ অনুসাবে, গিরিমার্গ বাবা অতর্কিত রূপে গমন কবিয়া, সহসা মুবশিদাবাদ অধিকাব করিবার আশায়, প্রস্থান কবিলেন।

এই প্রবাণ অতি ত্ববাপূর্বক সম্পাদিত হইল। কিন্তু মীরন, জানিতে পাবিয়া দ্রুতগতি পোত দ্বারা, আপন পিতাব নিকট এই সম্ভাবিত বিপদের সংবাদ প্রেবণ করিলেন। অল্পকাল মধ্যেই, সম্রাট, মুবশিদাবাদের পঞ্চদশ ক্রোশ দূরে; পর্বত হইতে অবতীর্ণ হইলেন, কিন্তু, সত্বব আক্রমণ না করিয়া, জনপথ মধ্যে, অনর্থক কালহরণ কবিতে লাগিলেন। এই অবকাশে কর্ণেল কালিয়ডও আসিয়া পহুছিলেন। উভয় সৈন্য পরম্পর দৃষ্টিগোচর স্থানে শিবির সন্নিবেশিত করিল। ইংরেজেরা যুদ্ধদানে উদ্ব্যত হইলেন, কিন্তু সম্রাট, সহসা অসম্ভব ত্রাসযুক্ত হইয়া পাটনা প্রতিগমনপূর্বক, ঐ নগর দৃঢ়কপে অববোধ করিবার নিমিত্ত, স্বীয় সৈন্য সহিত যাত্রা করিলেন।

সম্রাট, ক্রমাগত নয় দিবস, পাটনা আক্রমণ কবিলেন। প্রথমতঃ নিশ্চিত বোধ হইয়া- ছিল, উক্ত নগর অবিলম্বে তাঁহার হস্তগত হইবেক। কিন্তু, কাপ্তেন নক্স অত্যল্প সৈন্য সহিত সহসা পাটনায় উপস্থিত হওয়াতে, সে আশঙ্কা দূব হইল। তিনি, কর্ণেল কালিয়ড কর্তৃক প্রেরিত হইয়া, বর্ধমান হইতে ত্রয়োদশ দিবসে তথায় উপস্থিত হইলেন, এবং রাত্রিতে, বিপক্ষের শিবির পরীক্ষা করিয়া, পরদিন, তাহাদের মধ্যাহ্নকালীন নিদ্রার সময়, আক্রমণ করিলেন। সম্রাটের সেনা, সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইল। তখন তিনি,

আপন শিবিরে অগ্নিদান করিয়া, পলায়ন করিলেন।

দুই এক দিন পরে, কাদিম হোসেন খাঁ, ষোড়শ সহস্র সৈন্য সমভিব্যাহারে হাজীপুরে পঁহুছিয়া, পাটনা আক্রমণের উপক্রম করিলেন। কিন্তু কাপ্তেন নক্স, সহস্রের অনধিক সৈন্য মাত্র সহিত গঙ্গা পার হইয়া, তাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করিলেন। এই জয়লাভকে অসাধারণ সাহসের কার্য বলিতে হইবেক। এই জয়লাভ দর্শনে, এতদ্দেশীয় লোকেরা ইংরেজদিগকে মহাপরাক্রান্ত নিশ্চয় করিলেন। এই যুদ্ধে, রাজা সিতাব রায় এমন অসাধারণ সাহসিকতা প্রদর্শন করেন যে, তদ্দর্শনে ইংরেজেরা, তাঁহার ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছিলেন। পরাজয়ের পর, পূর্ণিয়ার গবর্ণর, সম্রাটেব সহিত মিলিত হইবার নিমিত্ত, প্রস্থান করিলেন। কর্ণেল কালিয়ড ও মীবন, উভয়ে একত্র হইয়া, তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। বর্ষার আরম্ভ হইল; তথাপি তাঁহারা তাঁহার অনুসরণে বিরত হইলেন না। ১৭৬০ খৃঃ অব্দেব ২রা জুলাই রজনীতে অতিশয় দুর্যোগ হইল। মীরন আপন পটমণ্ডপে উপবিষ্ট হইয়া, গল্প শুনিতেছিলেন; দৈবাৎ, ঐ সময়ে, অশনিপাত দ্বারা, তাঁহার ও তাঁহার দুইজন পরিচারকের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হইল। কর্ণেল কালিয়ড, এই দুর্ঘটনা প্রযুক্ত, কাদিম হোসেনের অনুসবণে বিরত হইলেন, এবং পাটনা প্রত্যাগমন- পূর্বক, বর্ষার অনুরোধে তথায় শিবিব সন্নিবেশিত করিলেন।

মীরন নিতান্ত দুরাচার, কিন্তু নিজ পিতার রাজত্বের প্রধান অবলম্বনস্বরূপ ছিলেন। তৎকালের মুসলমান ইতিহাসলেখক কহেন, নির্বোধ ইন্দ্রিয়পরায়ণ বৃদ্ধ নবাবের যে কিছু বুদ্ধি ও বিবেচনা ছিল, এতক্ষণে তাহা একবাবে লোপ পাইল। অতঃপর রাজকার্যে অত্যন্ত গোলযোগ ঘটিতে লাগিল। সেনাগণ, পূর্বতন বেতন নিমিত্ত, রাজভবন অবরোধ করিয়া, বিসংবাদে উদ্ব্যত হইল। তখন, নবাবের জামাতা, মীবকাসিম, তাহাদের পুরোবর্তী হইবা কহিলেন, আমি অঙ্গীকার করিতেছি, স্বধন দ্বারা তোমাদিগকে সন্তুষ্ট করিব। এই বলিয়া, তিনি তাহাদিগকে আপাততঃ ক্ষান্ত করিলেন।

নবাব মীরকাসিমকে, দৌত্যকার্যে নিযুক্ত করিয়া, কলিকাতায় পাঠাইলেন। তথায়, বান্সিটার্ট ও হেস্টিংস সাহেবের নিকটে, তাঁহার বুদ্ধি ও ক্ষমতা বিশেষরূপে প্রকাশ পায়। তৎকালে, এই দুই সাহেবের মত অনুসারেই, কোম্পানির এতদ্দেশীয় সমুদয় বিষয়কর্ম নিস্পন্ন হইত। দ্বিতীয়বার দূত প্রেবণ আবঞ্চক হওয়াতে, মীরকাসিম পুনর্বার প্রেরিত হয়েন। এইরূপে, দুইবাব, মীরকাসিমের বুদ্ধি ও ক্ষমতা দেখিয়া, গবর্ণর সাহেবের অন্তঃকরণে এই দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে যে, কেবল এই ব্যক্তি অধুনা বাঙ্গালার রাজকার্য নির্বাহে সমর্থ। তদনুসারে, তিনি মীরকাসিমকে তিন প্রদেশের ডেপুটি নাজিমী পদ প্রদানের প্রস্তাব করিলেন। মীরকাসিম সম্মত হইলেন। অনন্তর, বান্সিটার্ট ও হেস্টিংস, উভয়ে, এক দল স্যৈ সহিত মুরশিদাবাদ গমন করিয়া, মীরজাফরের নিকট ঐ প্রস্তাব করিলে, তিনি তদ্বিষয়ে অত্যন্ত অনিচ্ছাপ্রদর্শন করিলেন। তিনি বুঝিতে পারিলেন, এরূপ হইলে, সমুদয় ক্ষমতা অবিলম্বে জামাতার হস্তে যাইবেক, আমি আপন সভামণ্ডপে পুত্তলিকা প্রায় হইব।

বান্ধিটার্ট সাহেব, নবাবের অনিচ্ছা দেখিয়া, দোলায়মানচিত্ত হইলেন। মীরকাসিম এই বলিয়া ভয় দেখাইলেন, আমি সম্রাটের পক্ষে যাইব। তিনি স্পষ্ট বুঝিয়াছিলেন, এত কাণ্ড করিযা, কখনই মুরশিদাবাদে নিরাপদে থাকিতে পারিবেন না। তখন, বান্সিটার্ট সাহেব, দৃঢ়তা সহকারে কার্য করা আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, ইংলণ্ডীয় সৈন্যদিগকে বাজভবন অধিকাব করিতে আদেশ দিলেন। তদ্দর্শনে শঙ্কিত হইয়া, মীরজাফর অগত্যা সম্মত হইলেন।

অনন্তর, মুরশিদাবাদ ও কলিকাতা, এ উভয়ের অন্যতব স্থানে, বৃদ্ধ নবাবকে এক বাসস্থান দিবার প্রস্তাব হইল। নবাব বিবেচনা করিলেন, যদি আমি মুরশিদাবাদে থাকি, তাহা হইলে, যেখানে এতকাল আধিপত্য করিলাম, তথায সাক্ষিগোপাল হইয়া থাকিতে হইবেক, এবং জামাতৃরুত পবিভব সহ্য করিতে হইবেক। অতএব, আমার কলিকাতায় যাওযাই শ্রেয়ঃকল্প। তিনি, এক সামান্য নর্তকীকে আপন প্রণয়িনী করিয়াছিলেন, এবং তাহারই আজ্ঞাকাবী ছিলেন। ঐ কামিনী উত্তব কালে মণিবেগম নামে সবিশেষ প্রসিদ্ধ হন। মুসলমান পুর্বাবৃত্তলেখক কহেন, ঐ রমণী ও মীরজাফর, প্রস্থানের পূর্বে, অন্তঃপুরে প্রবেশপূর্বক, পূর্ব পূর্ব নবাবদিগের সঞ্চিত মহামূল্য রত্নসকল হস্তগত কবিয়া, কলিকাতা প্রস্থান করিলেন।

চতুর্থ অধ্যায়

১৭৬০ খৃঃ অব্দের ৪ঠা অক্টোবর, ইংরেজেরা মীর কাসিমকে বাঙ্গালা ও বিহারের সুবাদার করিলেন। তিনি, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ, কোম্পানি বাহাদুরকে বর্ধমান প্রদেশের অধিকাব প্রধান করিলেন, এবং কলিকাতার কৌন্সিলের মেম্বরদিগকে বিংশতি লক্ষ টাকা উপঢৌকন দিলেন। সেই টাকা তাঁহারা সকলে যথাযোগ্য অংশ করিয়া লইলেন। মীবকাসিম অতিশয় বুদ্ধিশালী ও ক্ষমতাপন্ন ছিলেন। তিনি সিংহাসনে অধিরূঢ় হইয়া, ইংরেজদিগকে এবং মীরজাফরের ও নিজের সৈন্য ও কর্মচারীদিগকে যত টাকা দিতে হইবেক, প্রথমতঃ তাহার হিসাব প্রস্তুত করিলেন, তৎপরে সেই সকল পরিশোধ, করিবার উপায় দেখিতে লাগিলেন। তিনি, সকল বিষয়ে ব্যয়ের সঙ্কোচ করিয়া আনিলেন; অভিনিবেশপূর্বক সমুদয় হিসাব দেখিতে লাগিলেন। এবং, মীরজাফরের শিথিল শাসনকালে, রাজপুরুষেরা সুযোগ পাইয়া যত টাকা অপহরণ করিয়াছিলেন, অনুসন্ধান করিয়া, তাঁহাদের নিকট হইতে, সেই সকল টাকা আদায় করিয়া লইতে লাগিলেন। তিনি, জমীদারদিগের নিকট হইতে, কেবল বাকী আদায় করিয়া ক্ষান্ত হইলেন না, সমুদয় জমীদারীর নূতন বন্দোবস্তও করিলেন। তাঁহার অধিকারের পূর্বে, দুই প্রদেশের রাজস্ব বার্ষিক ১৪২৪৫০০০ টাকা নির্ধারিত ছিল, তিনি বৃদ্ধি করিয়া ২৫৬২৪০০০ টাকা করিলেন। এই সকল উপায় দ্বারা তাঁহার ধনাগার অনতিবিলম্বে পরিপূর্ণ হইল। তখন, তিনি সমস্ত পূর্বতন দেয়ের পরিশোধ করিলেন। নিয়মিত রূপে বেতন দেওয়াতে, তদীয় সৈন্যসকল বিলক্ষণ বশীভূত রহিল।

ইংরেজেরা তাঁহাকে রাজ্যাধিকার প্রদান করেন। কিন্তু ইংরেজ দিগের অধীনতা হইতে আপনাকে মুক্ত করা তাঁহার মুখ্য উদ্দেশ্য হইয়া উঠিল। তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন, যদিও আমি সর্বসম্মত নবাব বটে, বাস্তবিক সমূদয় ক্ষমতা ও প্রভুত্ব ইংবেজদিগের হস্তেই রহিয়াছে। আর, তিনি ইহাও বুঝিতে পারিয়াছিলেন, বলপ্রকাশ ব্যতিরেকে কখনই ইংরেজদিগের হস্ত হইতে আপনাকে মুক্ত করিতে পারিবেন না, অতএব, স্বীয় সৈন্যের শুদ্ধি ও বৃদ্ধি বিষয়ে তৎপর হইলেন। যে সকল সৈন্য অকর্মণ্য হইযাছিল, তাহাদিগকে ছাড়াইয়া দিলেন; সৈন্যদিগকে, ইংবেদী রীতি অনুসারে, শিক্ষা দিতে লাগিলেন, এবং এক আরমানিকে সৈন্যের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করিলেন।

এই ব্যক্তি পারল্ডের অন্তর্গত ইস্পাহান নগবে জন্মগ্রহণ করেন। ইহাব নাম গর্গন খাঁ। ইনি অসাধারণ ক্ষমতাপন্ন ও বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। গগিন, প্রথমতঃ, একজন সামান্য বস্ত্রব্যবসায়ী ছিলেন; কিন্তু যুদ্ধবিদ্যা বিষয়ে অসাধাবণ বৃদ্ধি নৈপুণ্য থাকাতে, মীবকাসিম তাঁহাকে সৈনাপত্যে নিযুক্ত করিলেন। তিনিও, সাতিশয় অধ্যবসায় সহকারে, স্বীয় স্বামীকে ইংরেজদিগের অধীনতা হইতে মুক্ত করিবার উপায় দেখিতে লাগিলেন। তিনি কামান ও বন্দুক প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিলেন, এবং গোলন্দাজদিগকে শিক্ষা দিতে লাগিলেন। তাহার শিক্ষিত সৈন্য সকল এমন উৎত্ত্বষ্ট হইয়া উঠিল যে, বাঙ্গালাতে কখনও কোনও রাজার সেরূপ ছিল না।

মীরকাসিম, ইংরেজদিগের অগোচরে আপন অভিপ্রায় সিন্ধ করিবার নিমিত্ত, মুরশিদাবাদ পরিত্যাগ করিয়া, মুঙ্গেরে রাজধানী করিলেন। ঐ স্থানে তাঁহার আরমানি সেনাপতি বন্দুক ও কামানের কারখানা স্থাপিত করিলেন। বন্দুকের নির্মাণ কৌশলের নিমিত্ত, ঐ নগরের অ্যাপি রে প্রতিষ্ঠা আছে, গর্সিন থাঁ তাহার আবিকরণ। তৎকালে, গর্সনের বয়ঃ ক্রম

ত্রিশ বৎসরের অধিক ছিল না।

সম্রাট শাহ আসন তৎকাল পর্যন্ত, বিহারের পর্যন্তদেশে ভ্রমণ করিতেছিলেন। অতএব, ১৯৬০ খৃঃ অন্ধের বর্ষা শেষ হইবা মাত্র, মেজং কার্নাক, নৈন্ত সহিত যাত্রা করিয়া, তাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করিলেন। যুদ্ধের পর কার্ণাক সাহেব, সন্ধি প্রস্তাব কবিষা, বাজা সিতাব বাযকে তাঁহাব নিকট পাঠাইলেন। সম্রাট তাহাতে সম্মত হইলে, ইংলণ্ডীর সেনাপতি, তদীয় শিবিবে গমনপূর্বক, তাঁহাব সমুচিত সম্মান কবিলেন।

মীরকাসিম, সম্রাটের সহিত ইংবেজদিগেব সন্ধিবার্তা শ্রবণে, অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইলেন, এবং আপনার পক্ষে কোনও অপকাব না ঘটে, এই নিমিত্ত সত্বব পাটনা গমন কবিলেন। মেজর কার্ণাক মীবকাসিমকে, সম্রাটের সহিত সাক্ষাৎ কবিবাব নিমিত্ত, সবিশেষ অনুবোধ কবিতে লাগিলেন। কিন্তু তিনি, কোনও ক্রমে, সম্রাটের শিবিবে গিযা সাক্ষাৎ কবিতে সম্মত হইলেন না। পবিশেষে, এই নির্বাবিত হইল, উভয়েই ই-বেজদিগেব কুঠিতে আসিযা, পরস্পর সাক্ষাৎ কবিবেন।

উপস্থিত কায়েব নির্বাহের নিনিত্ত, এক সিংহাসন প্রস্তুত হইল। সমস্ত ভাবতবর্ষেব সম্রাট তদুপবি উপবেশন কবিলেন। মীরকাসিম, সমুচিত সম্মান প্রদর্শণ পূর্বক, তাঁহাব সম্মুখবর্তী হইলেন, সম্রাট তাঁহাকে বাঙ্গালা, বিহাব ও উডিয়্যাব স্ববাধাবী প্রদান কবিলেন, তিনি প্রতি বৎসব চতুর্বিংশতি লক্ষ টাকা কবদান স্বীকার কবিলেন। তৎপবে, সম্রাট দিল্লী বাত্রা কবিলেন। কার্ণাক সাহেব, কর্মনাশাব তাঁব পর্যন্ত, তাঁহাব অনুগমন কবিলেন। সম্রাট, কার্ণাকের নিকট বিদাব লইবাব নমখ, প্রস্তাব কবিলেন, ই-বেজেবা যখন প্রার্থনা কবিবেন, তানই আমি তাহাদিগকে বাঙ্গালা, বিহার, উডিষ্যা, এই তিন প্রদেশের দেওয়ানী প্রদান কবির। ১৭৫৫ খৃঃ অব্দে, উডিয়্যাব অধিকাংশ মহাবাষ্ট্রীরদিগকে প্রদত্ত হয, নূবর্ণবেধাব উত্তরবর্তী অংশ মাত্র অবশিষ্ট থাকে। তদবধি ঐ অংশই উডিয়্যা নানে উল্লিখিত হইত।

মীবকাসিম, পাটনাব গবর্ণব বামনাবাযণ ব্যতিবিক্ত, সমৃদখ জমিদাবদিগকে সম্পূর্ণরূপে আপন বশে আনিযাছিলেন। বাননাবাষণের ধনবান বলিবা প্যাতি ছিল, কিন্তু তিনি ই-বেজদিগের আশ্রযচ্ছাধাতে সন্নিবিষ্ট ছিলেন। এজন্য, সহসা তাঁহাকে আক্রমণ করা অবিধেয বিবেচনা কবিধা, নবাব কৌশলক্রমে তাহাব সর্বনাশের উপাত্ত দেখিতে লাগিলেন। বামনাবাবণ তিন বৎসব হিসাব পবিষ্কার কবেন নাই। নবাব ই বেজদিগকে লিখিলেন, বামনাবাষণের নিকট বাকীব আদায় না হইলে, আমি আপনাদের প্রাপের পবিশোব কবিতে পাবিব না, আব, যাবৎ আপনাদের সৈন্য পাটনাতে থাকিবেক, তাবং ঐ বাকীব আদায়েব কোনও সম্ভাবনা নাই।

তৎকালে, কলিকাতাব কৌন্সিলে দুই পক্ষ ছিল, এক পক্ষ মীরকাসিমেব অনুকূল, তন্য পক্ষ তাঁহাব প্রতিকূল; গবর্ণব বাঙ্গিটার্ট সাহেব অনুকূল পক্ষে ছিলেন মীবকাসিনেব প্রস্তাব লইযা, উভয় পক্ষের বিস্তব বাদানুবাদ হইল। পবিশেষে বান্ধিটাটের পথই প্রবল হইল। এই পক্ষের মত অনুসারে, ইংবেজেবা পাটনা হইতে আপনাদের সৈন্ত উঠাইয়া আনিলেন; সুতরাং, রামনারায়ণ নিতান্ত অসহায় হইলেন; এবং, নবাবও

তাঁহাকে রুদ্ধ ও কারাবদ্ধ করিতে কালবিলম্ব করিলেন না। গুপ্ত ধনাগার দেখাইয়া

দিবার নিমিত্ত তাঁহার কর্মচারীদিগকে অনেক যন্ত্রণা দেওয়া হইল; কিন্তু, গবর্ণমেন্টের আবঞ্চক ব্যয়ের নিমিত্ত যাহা আবঞ্চক, তদপেক্ষা অধিক টাকা পাওয়া গেল না। মীরকাসিম, এ পর্যন্ত, নির্বিবাদে রাজ্যশাসন করিলেন। পরে তিনি, কোম্পানির কর্মকারকদিগের আত্মম্ভরিতা দোষে, যেরূপে রাজ্যভ্রষ্ট হইলেন, এক্ষণে তাহার উল্লেখ করা যাইতেছে।

ভারতবর্ষের যে সকল পণ্যদ্রব্য এক প্রদেশ হইতে প্রদেশান্তরে নীত হই৩, তাহাব শুল্ক হইতেই রাজস্বের অধিকাংশ উৎপন্ন হইত। এইরূপে রাজস্ব গ্রহণ করা এক প্রকার অসভ্যতার প্রথা বলিতে হইবেক; কারণ, ইহাতে বাণিজ্যের বিলক্ষণ ব্যাঘাত জন্মে। কিন্তু, এই কালে, ইহা বিলক্ষণ প্রচলিত ছিল, এবং ইংরেজেরাও, ১৮৩৫ খৃঃ অব্দের পূর্বে, ইহা রহিত করেন নাই। যখন কোম্পানি বাহাদুর, সালিযানা তিন হাজার টাকার পেস্কস দিয়া, বাণিজ্য করিবার অনুমতি পাইযাছিলেন, তদবধি ওদীয পণ।দ্রব্যেব মাশুল লাগিত না। কলিকাতার গবর্ণর এক দন্তকে স্বাক্ষর করিতেন, মাশুলঘাটায় তাহা দেখাইলেই, কোম্পানির বস্তু সকল বিনা মাশুলে চলিয়া যাইত।

এই অধিকার কেবল কোম্পানিব নিজের বাণিজ্য বিষধে ছিল; কিন্তু যখন ইংবেজেরা অত্যন্ত পরাক্রান্ত হইয়া উঠিলেন, তখন কোম্পানির যাবতীয় কর্মকাবকেরা বাণিজ্য করিতে আরম্ভ করিলেন। যত দিন ক্লাইব এ দেশে ছিলেন, তাঁহাবা সকলেই, দেশীয় বণিকদের ন্যায়, রীতিমত শুল্কপ্রদান করিতেন। পবে যখন তিনি স্বদেশে যাত্রা করিলেন, এবং কৌন্সিলের সাহেবেরা অন্য এক নবাবকে সিংহাসনে বসাইলেন, তখন তাঁহারা, আরও প্রবল হইয়া, বিনা শুল্কেই বাণিজ্য করিতে লাগিলেন। ফলতঃ, তৎকালে তাঁহারা এমন প্রবল হইয়াছিলেন যে, তাঁহাদিগকে কোনও প্রকার বাধা দিতে নবাবের কর্মকারকদিগের সাহস হইত না।

ইংরেজদের গোমস্তারা, শুভবঞ্চন করিবার নিমিত্ত, ইচ্ছা অনুসাবে, ইংবেজী নিশান তুলিত, এবং দেশীয় বণিক ও রাজকীয় কর্মকারকদিগকে যৎপরোনাস্তি ক্লেশ দিত। ব্যক্তি মাত্রেই, যে কোনও ইংরেজের স্বাক্ষরিত দস্তক হস্তে করিয়া, আপনাকে কোম্পানি বাহাদুরের তুল্য বোধ করিত। নবাবের লোকেরা কোনও বিষয়ে আপত্তি করিলে, ঘুরোপীয় মহাশয়েরা, সিপাই পাঠাইয়া, তাহাদিগকে ধরিয়া আনিতেন ও কারারুদ্ধ করিয়া রাখিতেন। শুষ্ক না দিয়া কোনও স্থানে কিছু দ্রব্য লইয়া যাইবার ইচ্ছা হইলে, নাবিকেরা নৌকার উপর কোম্পানির নিশান তুলিয়া দিত। সাতঃ, এইরূপে, নবাবের পরাক্রম এককালে লোপ পাইল। দেশীয় বণিকদিগের সর্বনাশ উপস্থিত হইল ইংরেজ মহাত্মাবা বিলক্ষণ ধনশালী হইয়া উঠিলেন। নবাবের বাজস্ব অত্যন্ত ন্যূন হইল, কাবণ, ইংবেজেবাই কেবল মাশুল দিতেন না, এমন নহে; যাহাবা তাঁহাদেব চাকব বলিয়া পরিচয় দিত, তাহাবাও, তাঁহাদেব নাম কবিধা, মাশুল ফাঁকি দিতে আবন্ত কবিল। মীরকাসিম, এই সকল অত্যাচাবেব উল্লেখ করিয়া, কলিকাতাব কৌন্সিলে অনেকবাব অভিযোগ কবিলেন। পবিশেষে, তিনি এই বলিয়া ভয় দেখাইলেন, আপনাবা ইহাব নিবাবণ না কবিলে, আমি বাজ্যাধিকার পবিত্যাগ কবিব।

বান্সিঢাট ও হেস্টিংস সাহেব এই সকল অন্যায়েব নিবাবণ বিষবে অনেক চেষ্টা কবিলেন, কিন্তু, কৌন্সিলের অন্যান্য মেম্ববেবা, ঐ সকল অবৈধ উপাষ দ্বাবা, উপার্জন কবিতেন, স্বতবাং তাঁহাদেব স সকল চেষ্টা বিফল হইল। পরিশেষে, ঐ সকল অবৈধ ব্যবহাবের এত বাড়াবাডি হম্বা উঠিল যে, কাম্পানিব গোমস্তাদিগেব নির্বাবিত মূল্যেই, দেশীয় বণিকদিগকে এব বিক্রয় কবিতে হইত। অতঃপব, মীরকাসিম ই বেজদিগকে শত্রু মধ্যে পবিগণিত কবিলেন, এব" ওবায উভয় পক্ষের পরম্পর যুদ্ধ ঘটিবাব সম্পূর্ণ সম্ভাবনা হইযা উঠিল।

ইহাব নিবারণার্থে, বান্সিঢার্ট সাহেব, স্ববং মুঙ্গেবে গিয়া, নবাবের সহিত সাক্ষাৎ কবিলেন, নবাবও (সীহৃন্ত ভাবে তাহাব সংবর্ধনা কবিলেন। পবে, বিষয়কর্মের কথা উত্থাপিত হইলে, মীরকাসিম, কোম্পানির কর্মকাবকদিগের অত্যাচার বিষয়ে যৎপরো- নাস্তি অসন্তোষ প্রদর্শনপূর্বক, অনেক অনুযোগ কবিলেন। বান্সিটার্ট সাহেব, তাঁহাকে অশেব প্রকাবে সান্ত্বনা কবিয়া, প্রস্তাব কবিলেন কি দেশীয় লোক, কি ইংবেজ সকলকেই বস্তুমাত্রেব একবিব মাশুল দিতে হইবেক, কিন্তু আমাব স্বয়ং এরূপ নিয়ম নির্ধাবিত কবিবাব ক্ষমতা নাই, অতএব, কলিকাতায় গিযা কৌন্সিলেব সাহেবদিগঞ্জে এই নিষম নির্বাবিত কবিতে পরামর্শ দিব। নবাব, অত্যন্ত অনিচ্ছাপূর্বক, এই প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, কিন্তু কহিলেন, যদি ইহাতেও এই অনিযমেব নিবাবণ না হয়, আমি মাশুলেব প্রথা একেবাবে বহিত কবিযা কি দেশীষ, কি যুবোপীর, উভয়বিধ বণিক দিগকে সমান কবিব।

বান্সিটার্ট সাহেব, কৌন্সিলে এই বিষযেব প্রস্তাব কবিবাব নিমিত্ত, সত্বর কলিকাতায় প্রত্যাগমন কবিলেন। কিন্তু মীবকাসিম, কৌন্সিলেব মতামত পবিজ্ঞান পর্যন্ত অপেক্ষা না কবিযা, শুল্ক সম্পর্কীয় কর্মকাবকদিগেব নিকট এই আজ্ঞা পাঠাইলেন, তোমরা ইংবেজদেব নিকট হইতেও শতকবা নয় টাকাব হিসাবে মাশুল আদায় কবিবে। ইংবেজেবা মাশুল দিতে অসম্মত হইলেন এবং নবাবের কর্মকারকদিগকে কয়েদ করিয়া রাখিলেন। মফঃস্বলের কুঠির অধ্যক্ষ সাহেবেরা, কর্মস্থান পরিত্যাগ করিয়া, সত্বর কলিকাতায় উপস্থিত হইলেন। শতকরা নয় টাকা শুল্কের বিষয়ে বাঙ্গিটার্ট সাহেব যে প্রস্তাব করিলেন, হেস্টিংস ভিন্ন অন্য সকলেই, অবজ্ঞা প্রদর্শন পূর্বক, তাহা অগ্রাহ করিলেন। তাঁহারা সকলেই কহিলেন, কেবল লবণের উপর আমরা শতকরা আডাই টাকা মাত্র শুম দিব।

মীরকাসিম তৎকালে বাঙ্গালায় ছিলেন না, যুদ্ধযাত্রায় নেপাল গমন করিয়াছিলেন। তিনি তথা হইতে প্রত্যাগত হইয়া শ্রবণ করিলেন, কৌন্সিলের সাহেবর' মাশুল দিতে অসম্মত হইয়াছেন, এবং তাঁহার কর্মকারকদিগকে কয়েদ করিয়া রাখিয়াছেন। তখন তিনি, কিঞ্চিংমাত্র বিলম্ব না করিয়া, পূর্ব প্রতিজ্ঞার অনুযায়ী কার্য করিলেন, অর্থাৎ বাঙ্গালা ও বিহারের মধ্যে, পণ্যদ্রব্যের শুঃ একেবারে উঠাইয়া দিলেন।

কৌন্সিলের মেম্বরেরা শুনিয়া ক্রোধে অন্ধ হইলেন, এবং কহিলেন, নবাবকে, আপন প্রজাদিগের নিকট পূর্বমত শুল্ক লইতে হইবেক এবং ইংরেজদিগকে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিতে দিতে হইবেক। এ বিষয়ে ঘোরতর বিতণ্ডা উপস্থিত হইল। হেস্টিংস সাহেব কহিলেন, মীরকাসিম অধীশ্বব রাজা, নিজ প্রজাগণের হিতানুষ্ঠন কেন না করিবেন। ঢাকার কুঠীর অধ্যক্ষ বাট্সন সাহেব কহিলেন, এ কথা নবাবের গোমস্তাবা বলিলে সাজে, কৌন্সিলের মেম্বরের উপযুক্ত নয়ে। হেষ্টিংস কহিলেন, পাজী না হইলে, এরূপ কথা মুখে আনে না।

এইরূপ রোষবশ হইয়া, কৌন্সিলের মেম্বরেবা এবংবিধ গুরুতর বিষয়ে বাদানুবাদ করিতে লাগিলেন। পরিশেষে এই নির্ধারিত হইল, দেশীয় লোকের বাণিজ্যেই পূর্ব নিরূপিত শুল্ক থাকে, এ বিষয়ে উপরোধ করিবার নিমিত্ত, আমিয়ট ও হে সাহেব মীরকাসিমের নিকট গমন করুন। তাঁহারা, তথায় পঁহুছিয়া, নবাবের সহিত কয়েকবার সাক্ষাৎ করিলেন। প্রথমতঃ বোধ হইয়াছিল, সকল বিষয়েরই নির্বিবাদে নিষ্পত্তি হইতে পারিবেক। কিন্তু, পাটনার কুঠীর অধ্যক্ষ এলিস সাহেবের উদ্ধত আচরণ দ্বারা, মীমাংসার আশা একেবারে উচ্ছিন্ন হইল। কোম্পানির সমুদয় কর্মকারকের মধ্যে এলিস অত্যন্ত দুর্বৃত্ত ছিলেন। নবাব আমিয়ট সাহেবকে বিদায় দিলেন, কিন্তু তাঁহার যে সকল কর্মকারক কলিক, তায় কয়েদ ছিল, হে সাহেবকে তাহাদের প্রতিভূ স্বরূপ আটক করিয়া রাখিলেন। আমিয়ট সাহেব নবাবের হস্তবহির্ভূত হইয়াছেন বোধ করিয়া, এলিস সাহেব অকস্মাৎ পাটনা আক্রমণ ও অধিকার করিলেন। কিন্তু তাঁহার সৈন্ত সকল সুরাপানে মত্ত ও অত্যন্ত উচ্ছঙ্খল হওয়াতে, নবাবের একদল বহুসংখ্যক সৈন্য আসিয়া পুনর্বার নগর অধিকার করিল; এলিস ও অন্যান্য ঘুরোপীয়েরা রুদ্ধ ও কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইলেন।

মীরকাসিম, পাটনার এই বৃত্তান্ত শুনিয়া, বোধ করিলেন, এক্ষণে নিঃসন্দেহ ইংরেজদিগের সহিত যুদ্ধ ঘটিবেক। অতএব, তিনি সমস্ত মফঃস্বল কুঠীর কর্মকারক সাহেবদিগকে রুদ্ধ কবিতে ও আমিয়ট সাহেবের কলিকাতা যাওয়া স্থগিত কবিতে আজ্ঞা দিলেন। আমিয়ট সাহেব মুবশিদাবাদে পহুছিযাছেন, এমন সময়ে নগবাধ্যক্ষের নিকট ঐ আদেশ উপস্থিত হওয়াতে, তিনি ঐ সাহেবকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। সাহেব উক্ত আদেশ অমান্ত কব্যতে, দাঙ্গা উপস্থিত হইল, ঐ দাঙ্গাতে তিনি পঞ্চত্ব পাইলেন। মীবকাসিম, শেঠকশীয় প্রধান বণিকদিগকে ইংবেজেব অম্লগত বলিযা সন্দেহ করিতেন; এজন্য তাহাদিগকে মুরশিদাবাদ হইতে আনাইযা মুঙ্গেবে কাবারুদ্ধ কবিয়া রাখিলেন।

আমিরট সাহেবের মৃত্যু এবং এলিস সাহেব ও তদীয সহচববর্গেব কাবাবরোধের সংবাদ কলিকাতায় পহুছিলে, কৌন্সিলের সাহেবেবা অবিলম্বে যুদ্ধাবস্ত করা নির্ধাবিত কবিলেন। বান্সিটার্ট ও হেস্টিংস সাহেব, ইহা বুঝাইবাব নিমিত্ত, বিস্তব চেষ্টা পাইলেন যে, মীরকাসিম পাটনায যে কযেকজন সাহেবকে কযেদ কবিয়া বাধিযাছেন, তাঁহাদেব যাবৎ উদ্ধাব না হব, অন্ত", তাবৎ কাল পর্যন্ত, ক্ষান্ত থাকা উচিত, কিন্তু তাহা ব্যর্থ হইল। অধিকাংশ মেম্বরের সম্মতিক্রমে, ই'বেজদিগেব সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইল। সেই সমবে, মীরজাফব স্বীকার কবিলেন, যদি ইংবেদেশ পুনর্বার আমাকে নবাব কবেন, আমি কেবল দেশীয লাকদিগেব বাণিজ্য বিসযে পূর্ব শুল্ক প্রচলিত বাখিব, ইংরেজ দিগকে বিনা শুল্কে বাণিজ্য কবিতে দিব। অতএব, কীন্সিলেব সাহেববা তাঁহাকেই পুনর্বাব সিংহাসনে নিবিষ্ট করা মনস্থ কবিলেন। বাযাত্তবিষা বৃদ্ধ মীরজাফর ৩ৎকালে কুষ্ঠবোগে প্রায চলৎশক্তিবছি ৩ হইযাছিলেন, তথাপি, মুরশিদাবাদগামী ইংলণ্ডীয সৈন্য সমভি- ব্যাহাবে, পুনবাব নবাব হইতে চলিলেন।

মীবকাসিম, স্বীয সৈন্যদিগকে সুশিক্ষিত কবিবাব নিমিত্ত, অশেষ প্রয়াস পাইয়াছিলেন। বাস্তবিক, বাঙ্গালা দেশে, কখনও কোনও বাজাব তদ্রূপ উৎকুষ্ট সৈন্য ছিল না, তাঁহাব সেনাপতি গর্গিন খাঁও যুদ্ধ বিষয়ে অসাধাবণ ক্ষমতাপন্ন ছিলেন। তথাপি উপস্থিত যুদ্ধ অল্প দিনেই শেষ হইল। ১৭৬৩ খৃঃ অব্দেব ১৯শে জুলাই, কাটোয়াতে নবাবের সৈন্য- সকল পবাজিত হইল। মতিঝিলে নবাবের যে সৈন্য ছিল, ইংবেজেরা ২৪শে, তাহা পবাজিত কবিয়া, মুরশিদাবাদ অধিকার কবিলেন। স্মৃতিব সন্নিহিত ঘেবিয়া নামক স্থানে, ২বা আগষ্ট, আর এক যুদ্ধ হয়, তাহাতেও মীবকাসিমের সৈন্য পবাজিত হইল। রাজ- মহলেব নিকট, উদয়নালাতে তাঁহাব এক দৃঢ় গডখাই কবা ছিল, নবাবের সৈন্যসকল পলাইযা তথায় আশ্রয় লইল।

এই সকল যুকালে নীবকাসিম মুঙ্গেবে ছিলেন, এক্ষণে উদয়নালাব সৈন্য মধ্যে উপস্থিত থাকিতে মনস্থ কবিলেন। তিনি এতদ্দেশীয় যে সমস্ত প্রধান প্রধান লোকদিগকে কারা- বন্ধ কবিয়া বাখিয়াছিলেন, প্রস্থানের পূর্বে, তাঁহাদেব প্রাণদণ্ড কবিলেন। তিনি পাটনার পূর্ব গবর্ণব বাজা বামনাবাযণকে, গলদেশে বালুকাপূর্ণ গোণী বন্ধ করিয়া, নদীতে নিক্ষিপ্ত করাইলেন; রুষ্ণদাস প্রভৃতি সমুদয় পুত্র সহিত রাজা রাজবল্লভ, রায়রাইয়া রাজা উমেদ সিংহ, রাজা বনিয়াদ সিংহ, রাজা ফতে সিংহ, ইত্যাদি অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির প্রাণদণ্ড করিলেন, এবং শেঠবংশীয় দুইজন ধনবান বণিককে, মুঙ্গেরের গডের বুরুজ হইতে, গঙ্গায় নিক্ষিপ্ত করাইলেন। বহুকাল পর্যন্ত, নাবিকেরা, ঐ স্থান দিয়া যাতায়াত কালে, উক্ত হতভাগ্যদ্বয়ের বধস্থান দেখাইয়া দিত।

মীরকাসিম, এই হত্যাকাণ্ডের সমাপন করিয়া, উদয়নালাস্থিত সৈন্য সহিত মিলিত হইলেন। অক্টোবরের আরম্ভে, ইংরেজেরা, নবাবের শিবিব আক্রমণ করিয়া, তাঁহাকে পরাজিত করিলেন। পবাজয়ের দুই-এক দিবস পরে, তিনি মুঙ্গেরে প্রতিগমন করিলেন। কিন্তু ইংরেজদিগের যে সৈন্য তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতেছিল, তাহার নিবারণ করা অসাধ্য বোধ করিয়া, সৈন্য সহিত পাটনা প্রস্থান করিলেন। যে কয়েকজন ইংরেজ তাঁহার হস্তে পড়িয়াছিল, তিনি তাঁহাদিগকেও সমভিব্যাহরে লইয়া গেলেন।

মুঙ্গের পরিত্যাগের পরদিন, তাহাব সৈন্য রেবা তীরে উপস্থিত হইল। সেই স্তানে তাঁহার শিবির মধ্যে, হঠাৎ অত্যন্ত গোলযোগ উপস্থিত হইল। সকল লোকই নদী পাব হইয়া পলাইতে উদ্যত। দৃষ্ট হইল, কয়েক ব্যক্তি, এক শব লইয়া, গোব দিতে যাইতেছে। জিজ্ঞাসা করাতে কহিল, ইহা সৈন্মাধ্যক্ষ গর্গিন খাঁর কলেবব। বিকালে, তিন চারি জন মোগল, তদীয় পটমণ্ডপে প্রবেশ করিয়া, তাঁহাব প্রাণবন্ধ করে। তৎকালে উল্লিখিত ঘটনার এই কারণ প্রদর্শিত হইয়াছিল, তাহারা সেনাপতির নিকট বেতন প্রার্থনা করিতে যায়; তিনি তাহাদিগকে হাঁকাইয়া দেওয়াতে তাহাবা ৩ববাধিব প্রভাবে তাঁহার প্রাণবধ করে। কিন্তু সে সময়ে তাহাদের কিছুই পাওনা ছিল না। নয় দিবস পূর্বে তাহারা বেতন পাইয়াছিল।

বস্তুতঃ, ইহা এক অলীক কল্পনা মাত্র। এই অশুভ ঘটনার প্রকৃত কাবণ এই যে, মীর- কাসিম, স্বীয় সেনাপতি গগিন খাব প্রাণবধ করিবার নিমিত্ত, ছল পূবক তাহাদিগকে পাঠাইয়া দেন। গগিনের খাজা পিক্রস নামে এক ভ্রাতা কলিকাতায় থাকিতেন। বাঙ্গিটার্ট ও হেস্টিংস সাহেবের সহিত তাঁহার অতিশয় প্রণয় ছিল। পিক্রস, এই ও নুরোধ করিয়া, গোপনে গর্গিনকে পত্র লিখিয়াছিলেন, তুমি নবাবের কর্ম ছাড়িয়া দাও, আর যদি সুযোগ পাও, তাঁহাকে অবরুদ্ধ কর। নবাবের প্রধান চর, এই বিষয়ের সন্ধান পাইয়া, রাত্রি দুই প্রহর একটার সময়ে, আপন প্রভুকে এই বলিয়া সাবধান করিয়া দেয় যে, আপনকাব সেনাপতি বিশ্বাসঘাতক। ৩ৎপরে, এক দিবস অতীত না হইতেই, আরমানি সেনাপতি গর্গিন খাঁ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েন। নবাবের সৈন্ন্য সকল, প্রকৃত প্রস্তাবে শিল্পিত হইয়াও, প্রতিযুদ্ধেই যে, ইংরেজদিগের নিকট পরাজিত হয়, গর্গিন খাঁর বিশ্বাস- মাওকতাই তাহার একমাত্র কারণ।

তদনন্তর, মীরকাসিম সত্বর পাটনা প্রস্থান করিলেন। মুঙ্গের ইংরেজদিগের হস্তগত হইল। তখন নবাব বিবেচনা করিলেন, পাটনাও পরিত্যাগ করিতে হইবেক; এবং, পরিশেষে, দেশত্যাগীও হইতে হইবেক। ইংরেজদের উপর তাঁহার ক্রোধের ইয়ত্তা ছিল না। তিনি, পাটনা পরিত্যাগের পূর্বে, সমস্ত ইংরেজ বন্দীদিগের প্রাণদণ্ড নির্ধারিত করিয়া, আপন সেনাপতিদিগকে, বন্দীগৃহে গিয়া তাহাদের প্রাণবধ করিতে আজ্ঞা দিলেন। তাঁহারা উত্তর করিলেন, আমরা ঘাতক নহি যে, বিনা যুদ্ধে প্রাণবধ করিব। তাহাদের হস্তে অস্ত্র প্রদান করুন, যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত আছি। তাঁহারা এইরূপে অস্বীকার করাতে, নবাব শমরু এক য়ুরোপীয় কর্মচারীকে। তাঁহাদের প্রাণবধের আদেশ দিলেন।

শমক, পূর্বে ফরাসিদিগের একজন সার্জন ছিল, পরে, মীরকাসিমের নিকট নিযুক্ত হয়। সে এই জুগুপ্সিত ব্যাপারের সমাধানের ভারগ্রহণ করিল, এবং, কিয়ৎসংখ্যক সৈনিক সহিত, কারাগৃহে প্রবিষ্ট হইযা, গুলি করিয়া, ডাক্তার ফুলর্টন ব্যতিরিক্ত সকলেরই প্রাণবধ করিল। আটচল্লিশজন ভদ্র ইংরেজ, ও একশত পঞ্চাশজন গোরা, এইরূপে, পাটনায় পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল। শমরু, ৩ৎপরে, অনেক রাজার নিকট কর্ম করে; পরিশেষে, সিরধানার আধিপত্য প্রাপ্ত হয়। এই হত্যায় যে সকল লোক হ৩ হয়, তন্মধ্যে কৌন্সিলের মেম্বর এলিস, হে, লসিংটন, এই তিনজনও ছিলেন। ১০৬৩ খৃঃ অব্দের ৬ই নবেম্বর, পাটনানগর ইংরেজদিগের হস্তগত হইল; মীরকাসিম, পলাইয়া, অযোধ্যার সুবাদাবের আশ্রয় লইলেন।

এইকপে, প্রায় চারি মাসে, যুদ্ধের শেষ হইল। পর বৎসর, ২২শে অক্টোবর, ইংরেজ- দিগের সেনাপতি, বক্সারে, অযোধ্যার সুবাদারের সৈন্ধুসকল পরাজিত করিলেন। জয়ের পর উজ্জীরের সহিত যে বন্দোবস্ত হয়, বাঙ্গালার ইতিহাসের সহিত তাহাব কোনও সংস্রব নাই; এজন্য, এ স্থলে সে সকলের উল্লেখ না করিয়া, ইহা কহিলেই পর্যাপ্ত হইবেক যে, তিনি প্রথমতঃ মীরকাসিমকে আশ্রয় দিয়াছিলেন, পরে, তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি হরণ করিয়া, তাডাইয়া দেন।

মীরজাফর, দ্বিতীয়বার বাঙ্গালার সিংহাসনে আরূঢ় হইয়া, দেখিলেন, ইংরেজদিগকে য৩ টাকা দিবার অঙ্গীকার করিয়াছেন, তাহার পরিশোধ করা অসাধ্য। তৎকালে তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ হইয়াছিলেন। তাঁহার রোগ ক্রমে বদ্ধমূল হইয়া আসিয়াছিল। তিনি, ১৭৬৫ খৃঃ অব্দের জানুয়ারি মাসে, চতুঃসপ্ততি বৎসর বয়সে, মুরশিদাবাদে প্রাণত্যাগ 'করিলেন।

তাঁহার উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করা দিল্লীর সম্রাটের অধিকার। কিন্তু, তৎকালে, সম্রাটের কোনও ক্ষমতা ছিল না। ইংরেজদিগের যাহা ইচ্ছা হইল, তাহাই তাঁহারা করিলেন।

মণিবেগমের গর্ভজাত নজমউদ্দৌলা নামে মীরজাফরের এক পুত্র ছিল; কলিকাতার কৌন্সিলের সাহেবেরা, অনেক টাকা পাইয়া, তাঁহাকেই নবাব করিলেন। তাঁহার সহিত নূতন বন্দোবস্ত হইল। ইংবেজেরা দেশরক্ষার ভার আপনাদের হস্তে লইলেন, এবং নবাবকে, রাজ্যের দেওয়ানী ও ফৌজদারী সংক্রান্ত কার্য নির্বাহের নিমিত্ত, একজন নায়েব নাজিম নিযুক্ত করিতে কহিলেন।

নবাব অনুরোধ করিলেন, নন্দকুমারকে ঐ পদে নিযুক্ত করা যায়। কিন্তু কৌন্সিলের সাহেবেরা তাহ। স্পষ্টরূপে অস্বীকার করিলেন। অধিকন্তু, বান্সিটার্ট সাহেব, ভাবী গবর্ণরদিগকে সতর্ক কবিবার নিমিত্ত, নন্দকুমারের কুক্রিয়া সকল কৌন্সিলের বহিতে বিশেষ করিয়া লিখিয়া রাখিলেন। আলিবর্দি খাঁর কুটুম্ব মহম্মদ বেজা ঐ পদে নিযুক্ত হইলেন।

পঞ্চম অধ্যায়

ভারতবর্ষীয় কর্মচারীদের কুব্যবহাবে যে সকল বিশৃঙ্খলা ঘটে, এবং মীরকাসিম ও

উজ্জীরের সহিত যে যুদ্ধ ও পাটনায় যে হত্যা হয়, এই সকল ব্যাপাব অবগত হইয়া,

ডিরেক্টরেবা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইলেন। তাঁহারা এই ভয় করিতে লাগিলেন, পাছে এই

নবোপার্জিত রাজ্য হস্তবহির্ভূত হয়, এবং ইহাও বিবেচনা কবিলেন, যে ব্যক্তির বুদ্ধি-

কৌশলে ও পরাক্রমপ্রভাবে রাজ্যাধিকার লব্ধ হইয়াছে, তিনি ভিন্ন অন্য কোনও ব্যক্তি

এক্ষণে তাহা রক্ষা করিতে সমর্থ হইবেন না। অতএব, তাঁহারা ক্লাইবকে পুনরায়

ভারতবর্ষে আসিতে অনুরোধ করিলেন।

তিনি ইংলণ্ডে পঁহুছিলে, ভিবেক্টরেরা তাঁহার সমুচিত পুরস্কার কবেন নাই, ববং তাঁহার জায়গীর কাডিয়া লইয়াছিলেন। তথাপি তিনি, তাঁহাদের অনুরোধে, পুনরায় ভারতবর্ষে আসিতে সম্মত হইলেন। ডিরেক্টরেরা তাঁহাকে, কার্যনির্বাহ বিষয়ে সম্পূর্ণ ক্ষমতা দিয়া, বাঙ্গালার গবর্ণর ও প্রধান সেনাপতির পদে নিযুক্ত করিলেন; কহিয়া দিলেন, ভারত- বর্ষীয় কর্মচারীদিগের নিজ নিজ বাণিজ্য দ্বারাই এত অনর্থ ঘটিতেছে; অতএব তাহা অব্য রহিত করিতে হইবেক। আট বৎসরের মধ্যে, তাঁহাদের কর্মচাবীরা, উপর্যুপরি কয়েক নবাবকে সিংহাসনে বসাইয়া, দুই কোটির অধিক টাকা উপঢৌকন লইয়াছিলেন। অতএব, তাঁহারা স্থির করিয়া দিলেন, সেরূপ উপঢৌকন রহিত করিতে হইবেক। তাঁহারা আরও আজ্ঞা করিলেন, কি রাজ্যশাসন সংক্রান্ত, কি সেনা সংক্রান্ত, সমস্ত কর্মচারী দিগকে এক এক নিয়মপত্রে নাম স্বাক্ষর ও এই প্রতিজ্ঞা করিতে হইবেক, চারি হাজার টাকার অধিক উপঢৌকন পাইলে, সরকারী ভাণ্ডারে জমা করিয়া দিবেন, এবং গবর্ণবের অনুমতি ব্যতিবেকে, হাজাব টাকাব অধিক উপহাব লইতে পাবিবেন না।

এই সকল উপদেশ দিযা, ডিবেক্টবেবা ক্লাইবকে ভাবতবর্ষে প্রেবণ কবিলেন। তিনি ১৭০৫ খৃঃ অব্দেব ৩বা মে, কলিকাতায় উত্তীর্ণ হইয। দখিলেন, ডিবেক্টবেবা, যে সকল আপদেব আশা কবিবা উদ্বিগ্ন হইযাছিলেন, সে সমস্ত অতিক্রান্ত হইয়াছে, কিন্তু গবর্ণমেন্ট যৎপবোনাস্তি বিশৃঙ্খল হইয়া উঠিযাছে। অন্ত্যেব কথা দূবে থাকুক, কৌন্সিলেব মেম্ববেবা৭ (কাম্পানির মঙ্গলচেষ্টা কবেন না। সমুদয কর্মচাবীব অভিপ্রায এই, যে কোনও উপায়ে অর্থোপাজন কবিবা, ত্ববাব ই লণ্ডে প্রতিগমন করিবেন। সকল বিষয়েই সম্পূর্ণরূপ অবিচাব। আব, এতদ্দেশীধ লোকদিগেব উপব এত অত্যাচাব হইতে আবস্তু হইবা ছল বে, ইবেজ এই শব্দ শুনিলে, তাঁহাদের মনে ঘৃণাব উদয় হইত। ফলতঃ, ৩ৎকালে, গবর্ণনেন্ট স' কান্ত ব্যক্তির্ণণগেব ধর্মাধর্মজ্ঞান ও ভদ্রতাব লেশমাত্র ছিল না।

পূর্ব বৎসব ডিবেক্টবেবা দৃঢ়রূপে আজ্ঞা কবিবাছিলেন, তাঁহাদের কর্মচাবীবা আব কোনও কপে উপঢৌকন লইতে পাবিবেন না, এই আঞ্জ। উপস্থিত হইবাব সময়, বুদ্ধ নবাব মীরজাফর মৃতু।শয্যায় ছিলেন। কৌন্সিলেব মেম্ববেবা উক্ত আজ্ঞা কৌন্সিলের পুস্তকে নিবিষ্ট করেন নাই, ববং মীবজাধবেব মৃত্যুব পর্ব, এক ব্যক্তিকে নবাব কবিয়া, তাঁহাব নিকট হইতে অনেক উপহাব গ্রহণ কবেন, সেই পত্রে ডিবেক্টবেবা ইহাও আদেশ কবিয়াছিলেন তাঁহাদেব কর্মচাবাদিগকে নিজ নিজ বাণিজ্য, পবিত্যাগ কবিতে হইবেক। কিন্তু, এই স্পষ্ট আজ্ঞা লঙ্ঘন কবিয়া, কৌন্সিলেব সাহেবেবা নূতন নবাবের সহিত বন্দোবস্ত কবেন, ইংবেজেবা, পূর্ববৎ, বিনা শুল্কে, বাণিজ্য কবিতে পাইবেন।

ক্লাইব, উপস্থতির অব্যবহিত পবেই, ডিবেক্টববিগেব আজ্ঞা সকল প্রচলিত কবিতে ইচ্ছা কবিলেন। কৌন্সিলেব মেম্ববেবা বান্সিঢাট সাহেবের সহিত যেরূপ বিবাদ কবিতেন, তাহাবও সহিত সেইরূপ কবিতে আবস্ত কবিলেন। কিন্তু ক্লাইব অন্যবিধ পদার্থে নির্মিত। তিনি জিদ কবিতে লাগিলেন, সকল ব্যক্তিকেই, আব উপঢৌকন লইব না বলিয়া, নিবমপত্রে নাম স্বাক্ষব কবিতে হইবেক। যাহাবা অস্বীকাব কবিলেন, তিনি তাঁহাদিগকে ৩ৎক্ষণাৎ পদচ্যুত কবিলেন। তদ্দর্শনে কেহ কেহ নাম স্বাক্ষর কবিলেন। আব, যাহাবা, অপর্যাপ্ত অর্থ উপার্জন কবিযাছিলেন, তাঁহাবা গৃহপ্রস্থান কবিলেন। কিন্তু সকলেই, নির্বিশেষে, তাঁহাব বিষম শত্রু হইয়া উঠিলেন।

সমুদয় বাজস্ব যুদ্ধবাধেই পর্যবসিত হইতেছে, অতএব সন্ধি কণা অতি আবশ্যক. এই বিবেচনা কবিষা, ক্লাইব, জুন মাসের চতুর্বিংশ দিবসে, পশ্চিম অঞ্চল যাত্রা কবিলেন। নজমউদ্দৌলাব সহিত এইরূপ সন্ধি হইল যে, ইংবেজেবা বাজ্যের সমস্ত বন্দোবস্ত কবিবেন, তিনি, আপন ব্যয়নির্বাহের নিমিত্ত, প্রতিবৎসব পঞ্চাশ লক্ষ টাকা পাইবেন, মহম্মদ রেজা খাঁ, রাজা দুর্লভরাম, ও জগৎ শেঠ, এই তিনজনের মত অনুসারে, ঐ পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ব্যয়িত হইবেক। কিছু দিন পরে, অযোধ্যার নবাবের সহিত সন্ধি হইল। এই যাত্রায় যে সকল কার্য নিষ্পন্ন হয়, দিল্লীর সম্রাটের নিকট হইতে, কোম্পানির নামে তিন প্রদেশের দেওয়ানী প্রাপ্তি সে সকল অপেক্ষ। গুরুতর। পূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে, সম্রাট অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, ইংরেজেরা যখন প্রার্থনা করিবেন, তখনই তিনি তাঁহাদিগকে তিন প্রদেশের দেওয়ানী দিবেন। ক্লাইব, এলাহাবাদে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, ঐ প্রতিজ্ঞার পরিপূবণের প্রার্থনা করিলেন। তিনিও তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন। ১২ই আগষ্ট, সম্রাট কোম্পানি বাহাদুরকে বাঙ্গালা বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী প্রদান করিলেন; আর, ক্লাইব, স্বীকার করিলেন, উৎপন্ন রাজস্ব হইতে সম্রাটকে প্রতি- মাসে দুই লক্ষ টাকা দিবেন।

তৎকালে, সম্রাট আপন রাজ্যে পলায়িত স্বরূপ ছিলেন। তাঁহার রাজকীয় পরিচ্ছদ আদি ছিল না। ইংরেজদিগের খানা খাইবার দুই মেজ একত্রিত ও কার্মিক বস্ত্রে মণ্ডিত করিয়া, সিংহাসন প্রস্তুত করা হইল। সমস্ত ভাব তবর্ষের সম্রাট, তদুপরি উপবিষ্ট হইয়া, বার্ষিক দুই কোটি টাকার রাজস্ব সহিত, তিন কোটি প্রজা ইংবেজ দিগের হস্তে সমর্পিত করিলেন। তৎকালীন মুসলমান ইতিহাসলেখক এ বিষয়ে এই ইঙ্গিত করিয়াছেন, পূর্বে, এরূপ গুরুতর ব্যাপারের নির্বাহকালে, কত অভিজ্ঞ মন্ত্রীব ও কার্যদক্ষ দূতের প্রেরণ, এবং কত বাদানুবাদের আবক্ষকতা হইত, কিন্তু, এক্ষণে, ইহা এত অল্প সময়ে সম্পন্ন হইল যে, একটা গর্দভের বিক্রয়ও ঐ সময় মধ্যে সম্পন্ন হইযা উঠে না।

পলাশির যুদ্ধের পর, ইংরেজদিগের পক্ষে যে সকল হিতকর ব্যাপার ঘটে, এই বিষয়ে সে সকল অপেক্ষা গুরুতর। ইংরেজেরা, ঐ যুদ্ধ দ্বাবা, বাস্তবিক এ দেশের প্রভু হইয়া- ছিলেন বটে; কিন্তু এতদ্দেশীয় লোকেরা, এ পর্যন্ত, তাঁহাদিগকে সেরূপ মনে করিতেন না; এক্ষণে, সম্রাটের এই দান দ্বারা, তিন প্রদেশের যথার্থ অধিকারী বোধ করিলেন। তদবধি, মুরশিদাবাদের নবাব সাক্ষিগোপাল হইলেন। ক্লাইব, এই সকল ব্যাপারের সমাধান করিয়া, ৭ই সেপ্টেম্বর, কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিলেন।

কোম্পানির কর্মচারীরা যে নিজ নিজ বাণিজ্য করিতেন, তদুপলক্ষেই অশেষবিধ অত্যাচার ঘটিত। এজন্য, ডিরেক্টরেরা বারংবার এই আদেশ করেন যে, উহা এক বারে রহিত হয়। কিন্তু তাঁহাদের কর্মচারীরা, ঐ সকল আদেশ এ পর্যন্ত অমান্য করিয়া রাখিয়াছিলেন। তাঁহাদের অন্তিম আদেশ কিঞ্চিং অস্পষ্ট ছিল, এবং ক্লাইবও বিবেচনা করিলেন যে, সিবিল কর্মচারীদিগের বেতন অত্যন্ত অল্প; সুতরাং, তাহারা, অব্য, গর্হিত উপায় দ্বারা, পোষাইয়া লইবেক। এজন্য, তিনি তাহাদের বাণিজ্য, এক বারে রহিত না করিয়া, ভদ্র রীতি ক্রমে চালাইবার মনন করিলেন।

এই স্থির করিয়া, ক্লাইব, লবণ, গুবাক, তবাক, এই তিন বস্তুর বাণিজ্য ভদ্র রীতি ক্রমে চালাইবার নিমিত্ত, এক সভা স্থাপিত করিলেন। নিয়ম হইল, কোম্পানির ধনাগারে, শতকরা ৩৫ টাকার হিসাবে, মাশুল জমা করা যাইবেক, এবং ইহা হইতে যে উপস্বত্ব হইবেক, রাজ্যশাসন সংক্রান্ত ও সেনাসম্পর্কীয় সমুদয় কর্মচারীরা ঐ উপস্বত্বের যথাযোগ্য অংশ পাইবেন। কৌন্সিলের মেম্বরেরা অধিক অংশ পাইবেন, তাঁহাদের নীচের কর্মচারীরা অপেক্ষাকৃত ন্যূন পরিমাণে প্রাপ্ত হইবেন।

ডিরেক্টরদিগের নিকট এই বাণিজ্যপ্রণালীর সংবাদ পাঠাইবার সময়, ক্লাইব তাঁহাদিগকে, গবর্ণরের বেতন বাড়াইয়া দিবাব নিমিত্ত, অনুবোধ কবিয়াছিলেন, কারণ, তাহা হইলে, তাঁহার এই বাণিজ্য বিষযে কোনও সংস্রব বাখিবার আবশ্যকতা থাকিবেক না। কিন্তু, তাঁহারা, তৎপরে পঞ্চদশ বৎসব পর্যন্ত, এই সৎপরামর্শ গ্রাহ্য করেন নাই। তাঁহারা, উক্ত নূতন সভার স্থাপনেব সংবাদ শ্রবণ মাত্র, অতি কঢ় বাক্যে তাহা অস্বীকার করিলেন; ক্লাইব এই সভাব স্থাপন করিয়াছিলেন বলিযা, তাঁহার যথোচিত তিরস্কার লিখিলেন, এবং এই আদেশ পাঠাইলেন উক্ত সভা রহিত করিতে হইবেক, এবং কোনও সরকারী কর্মচারী বাঙ্গালার বাণিজ্যে লিপ্ত থাকিতে পারিবেন না।

এ কাল পর্যন্ত, সমুদয রাজস্ব কেবল কাজকার্যনিবাহেব ব্যয়ে পর্যবসিত হইতেছিল। কোম্পানির শুনিতে অনেক আয় ছিল বটে, কিন্তু তাঁহারা সর্বদাই ঋণগ্রস্ত ছিলেন। কি সুরোপীব, কি এতদ্দেশীষ, সমুদয় কর্মচাবীরা কেবল লুঠ করিত, কিছুই দয়া ভাবিত না। ইংলণ্ডে ক্লাইবকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল, কোম্পানির এরূপ আয় থার্কিতেও, চিরকাল এত অপ্রতুল কেন। তাহাতে তিনি এই উত্তর দেন, কোনও ব্যক্তিকে কোম্পানি বাহাদুরের নামে, এক বার বিল করিতে দিলেই, সে বিষয় করিয়া লয়।

কিন্তু ব্যয়ের প্রধান কারণ সৈন্য। সৈন্য সকল যাবৎ নবাবের হইয়া যুদ্ধ করিত, তিনি ততদিন তাহাদিগকে ভাতা দিতেন। এই ভাতাকে ডবলধাটা কহা যাইত। এই পারিতোষিক তাহাবা এত অধিক দিন পাইয়া আসিয়াছিল যে, পরিশেষে তাহা আপনাদের ন্যায্য প্রাপ্য বোধ কবিত। ক্লাইব দেখিলেন, সৈন্যসংক্রান্ত ব্যয়ের লাঘব করিতে না পারিলে, কখনই রাজস্ব বাঁচিতে পারে না। তিনি ইহাও জানিতেন যে, ব্যয় লাঘবের যে কোনও প্রণালী অবলম্বন করিবেন, তাহাতেই আপত্তি উত্থাপিত হইবেক। কিন্তু তিনি অতিশয় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন; অতএব, একবারেই এই আজ্ঞা প্রচারিত করিলেন, অ্যাবধি ডবলবাটা রহিত হইল।,

এই ব্যাপার শ্রবণগোচর করিয়া, সেনাসম্পর্কীয় কর্মচারীবা যার পর নাই অসন্তুষ্ট হইলেন। তাঁহারা কহিলেন, আমাদের অস্ত্রবলে দেশজয় হইয়াছে; অতএব, ঐ জয় দ্বারা আমাদের উপকার হওয়া সর্বাগ্রে উচিত। কিন্তু ক্লাইবের মন বিচলিত হইবার নহে। তিনি তাঁহাদিগকে কিছু কিছু দিতে ইচ্ছুক ছিলেন; কিন্তু ইহাও স্থির করিয়া-

ছিলেন, সৈন্তেণ ব্যয়লাঘব করা নিতান্ত আবশ্যক। সেনাপতিরা ক্লাইবকে আপনাদের

অভিপ্রায় অনুসারে কর্ম করাইবার নিমিত্ত, চক্রান্ত করিলেন। তাঁহারা, পরস্পর গোপনে

পরামর্শ করিয়া স্থির করিলেন, সকলেই একদিনে কর্ম পরিত্যাগ করিবেন। তদনুসারে, প্রথম ত্রিগেডের সেনাপতিরা সর্বাগ্রে কর্ম পবি ত্যাগ করিলেন। ক্লাইব, এই সংবাদ পাইয়া, অতিশয় ব্যাকুল হইলেন এবং সন্দেহ করিতে লাগিলেন, হয়ত, সমুদয় সৈন্য মধ্যে এইরূপ চক্রান্ত হইয়াছে। তিনি অনেকবার অনেক বিপদে পডিয়াছিলেন, কিন্তু এমন দায়ে কখনও ঠেকেন নাই। মহাবাঈয়েবা পুনর্বার বাঙ্গালা দেশ আক্রমণের উদ্যোগ করিতেছেন; এদিকে, ইংবেজ দিগের সেনা অধ্যক্ষহীনা হইল। কিন্তু ক্লাইব, এরূপ সঙ্কটেও চলচিত্ত না হইয়া, আপন স্বভাবসিদ্ধ সাহস সহকারে, কাষ কবিতে লাগিলেন। তিনি মাদ্রাজ হইতে সেনাপতি আনিবার আজ্ঞাপ্রদান কবিলেন। বাঙ্গালার যে যে সেনাপতি স্পষ্ট বিদ্রোহী হযেন নাই, তাঁহাব। ক্ষান্ত হইলেন। ক্লাইব প্রধান প্রধান বিদ্রোহীদিগকে পদচু্যুত করিয়া, ইংলণ্ডে পাঠাইয়া দিলেন। এবংবিধ কাঠিন্ত- প্রয়োগ দ্বারা, তিনি সৈন্তাদগকে পুনবার বশীভূত করিয়া আনিলেন, এবং গবর্ণমেন্টকেও এই অভূতপূর্ব ঘোরতর আপদ হইতে মুক্ত কারলেন।

ক্লাইব ভারতবর্ষে আসিয়া, বিংশতি মাসে, কোম্পানির কার্যের গুশৃঙ্খলাব স্থাপন ও ব্যয়ের লাঘব করিলেন, তিন প্রদেশের দেওয়ানী প্রাপ্তি দ্বারা রাজস্বব্রদ্ধি কবিণা, প্রায় দুই কোটি টাকা বার্ষিক আয় স্থিব কবিলেন, এবং সৈন্য মধে। যে ঘোরতর বিদ্রোহ উপস্থিত হয়, তাহার শান্তি করিষা, বিলক্ষণ সুবীতি স্থাপিত করিলেন। তিনি, এই সমস্ত গুরুতর পরিশ্রম দ্বারা, শারীরিক এরূপ ক্লিষ্ট হইলেন যে, স্বদেশে প্রস্থান না করিলে আর চলে না। অতএব, ১৭৬৭ খৃঃ অব্দের ফেব্রু নাবি মাসে, তিনি জাহাজে আবোহণ করিলেন।

ইংরেজেরা তিন প্রদেশের দেওয়ানী প্রাপ্ত হইবাছিলেন বটে, কিন্তু রাজস্ব সংক্রান্ত কার্য বিষয়ে নিতান্ত অনভিজ্ঞ ছিলেন। যুবোপী। কর্মচারীরা এ পর্যন্ত বাণিজ্য কার্যেই ব্যাপৃত ছিলেন; ভূমির করসংগ্রহ বিষয়ে কিছুই অবগত ছিলেন না। পূর্ব পূব সুব্যবারেরা, হিদুদিগকে সাতিণর সইষ্ণুস্বভাব ও হিসাবে বিলক্ষণ নিপুণ দেখিয়া, এই সকল বিষয়ের ভার তাঁহাদের হস্তে ন্যস্ত রাখিতেন। ইংরেজেরা এ দেশের তাবৎ বিষয়েই অজ্ঞ ছিলেন; সুতরাং, তাঁহাদিগকেও সমস্ত ব্যাপারই, পূর্ব রীতি অনুসারে প্রচলিত রাখিতে হইল। রাজা সীতাব রায়, বিহারের দেওয়ানের কর্মে নিযুক্ত হইয়া পাটনায় অবস্থিতি করিলেন। মহম্মদ রেজা খাঁ, বাঙ্গালার দেওয়ান হইয়া, মুরশিদাবাদে রহিলেন। প্রায় সাত বৎসর, এইরূপে রাজশাসন সম্পন্ন হয়। পরে, ১৭৭২ খৃঃ অব্দে, ইংরেজেরা স্বয়ং সমস্ত কার্যের নির্বাহ করিতে আরম্ভ করেন।

এই কয় বৎসর, রাজশাসনের কোনও প্রণালী বা শৃঙ্খলা ছিল না। জমীদার ও প্রজাবর্গ, কাহাকে প্রভু বলিয়া মাধ্য করিবেন, তাহার কিছুই জানিতেন না। সমস্ত রাজকার্যের নির্বাহের ভার নবাব ও তদীয় অমাত্যবর্গের হস্তে ছিল। কিন্তু ইংরেজেরা, এ দেশের সর্বত্র, এমন প্রবল হইয়াছিলেন যে, তাঁহারা, যৎপরোনাস্তি অত্যাচার কবিলেও, রাজ- পুরুষেরা তাঁহাদের শাসন করিতে পারিতেন না। আর, পার্লিমেন্টের বিধান অনুসারে, কলিকাতার গবর্ণর সাহেবেরও এমন ক্ষমতা ছিল না যে, মহারাষ্ট্রখাতের বহির্ভাগে কোনও ব্যক্তি কোনও অপরাধ করিলে, তাহার দণ্ডবিধান করিতে পারেন। ফলতঃ, ইংরেজদিগের দেওয়ানী প্রাপ্তির পর, সাত বৎসর, সমস্ত দেশে যার পর নাই বিশৃঙ্খলা ও অতি ভয়ানক অত্যাচার ঘটিয়াছিল।

এইরূপে, রাজশাসন বিষয়ে নিরতিশয় বিশৃঙ্খলা ঘটাতে, সমস্ত দেশে ডাকাইতীর ভয়ানক প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল। সকল ভিলাই ডাকাইতের দলে পরিপূর্ণ হইয়া উঠে; ৩জন্ত, কোনও ধনবান ব্যক্তি নিরাপদে ছিলেন না। ফলতঃ, ডাকাইতীর এত বাড়াবাড়ি হইয়াছিল যে, ১৭৭, খৃঃ অব্দে, যখন কোম্পানি বাহাদুর আপন হস্তে রাজশাসনের ভার লইলেন, তখন তাহাদিগকে, ডাকাইতীব দমনের নিমিত্ত, অতি কঠিন আইন জারী করিতে হইযাছিল। তাঁহারা এরূপ আদেশ করিয়াছিলেন যে, ডাকাইতকে, তাহার নিজ গ্রামে লইয়া গিয়া, ফাঁসি দেওয়া যাইবেক, তাহার পরিবার, চিরকালের নিমিত্ত, রাজকীয় দাস হইবেক এবং সেই গ্রামের সমুদয় লোককে দণ্ডভাজন হইতে হইবেক।

এই অরাজক সময়েই, অধিকাংশ ভূমি নিষ্কর হয়। সম্রাট বাঙ্গালার সমুদয় রাজস্ব ইংরেজদিগকে নির্ধারিত করিয়া দিয়াছিলেন বটে; কিন্তু তাহা, কলিকাতায় আদায় না হইয়া, মুরশিদাবাদে আদায় হইত। মালের কাছারীও সেই স্থানেই ছিল। মহম্মদ রেজা খাঁ, রাজা দুর্লভরাম, রাজ কান্ত সিংহ, এই তিন ব্যক্তি বাঙ্গালার রাজস্ব সংক্রান্ত সমস্ত কার্যের নির্বাহ করিতেন। তাঁহারাই সমস্ত বন্দোবস্ত করিতেন, এবং বাজস্ব আদায় করিয়া কলিকাতায় পাঠাইয়া দিতেন। তৎকালে, জমীদারেরা কেবল প্রধান কর- সংগ্রাহক ছিলেন। তাঁহারা, পূর্বোক্ত তিন মহাপুরুষের ইচ্ছাকৃত অনবধানের গুণে, ইংরেজদিগের চক্ষু ফুটিবার পূর্বে, প্রায় চল্লিশ লক্ষ বিঘা সরকারী ভূমি ব্রাহ্মণদিগকে নিষ্কর দান করিয়া, গবর্ণমেন্টের বার্ষিক ত্রিশ চল্লিশ লক্ষ টাকা ক্ষতি করেন।

লার্ড ক্লাইবের প্রস্থানের পর, বেরিলস্ট সাহেব, ১৭৬৭ খৃঃ অব্দে, বাঙ্গালার গবর্ণর হইলেন। পর বৎসর, ডিরেক্টরেরা, কর্মচারীদিগের লবণ ও অন্যান্য বস্তু বিষয়ক বাণিজ্য রহিত করিবার নিমিত্ত, চূড়ান্ত হুকুম পাঠাইলেন। তাঁহারা এইরূপ আদেশ করিয়াছিলেন যে, দেশীয় বাণিজ্য কেবল দেশীয় লোকেরা করিবেক। কোনও ঘুরোপীয় তাহাতে লিপ্ত থাকিতে পারিবেক না। কিন্তু, ঘুরোপীয় কর্মচারীদেগের বেতন অতি অল্প ছিল; এজন্ম, তাঁহারা এরূপও আদেশ করিয়াছিলেন, বেতন ব্যতিরিক্ত, সরকারী খাজনা হইতে, তাহাদিগকে শতকরা আড়াই টাকার হিসাবে দেওয়া যাইবেক; সেই টাকা সমুদায় সিবিল ও মিলিটারি কর্মচারীরা যথাযোগ্য অংশ করিয়া লইবেন।

ক্লাইবের প্রস্থানের পর, কোম্পানির কার্য সকল পুনর্বার বিশৃঙ্খল হইতে লাগিল। আর অনেক ছিল বটে; কিন্তু ব্যয় তদপেক্ষা অধিক হইতে লাগিল। ধনাগারে দিন দিন বিষম অনাটন হইতে আরম্ভ হইল। কলিকাতার গবর্ণর, ১৭৬৯ খৃঃ অব্দের অক্টোবর মাসে, হিসাব পরিষ্কার করিযা দেখিলেন, অনেক দেনা হইয়াছে, এবং আবও দেনা না করিলে চলে না। তৎকালে, টাকা সংগ্রহ করিবার এই রীতি ছিল, কোম্পানির ঘুরোপীয় কর্মচারীরা যে অর্থসঞ্চয় করিতেন, গবর্ণর সাহেব, কলিকাতার ধনাগারে তাহা জমা লইয়া, লণ্ডন নগরে ডিরেক্টরদিগের উপর সেই টাকার ববাত পাঠাইতেন। ভারতবর্ষ হইতে যে সকল পণ্য প্রেরিত হইত, তৎসমুদয়ের বিক্রয় দ্বারা অর্থ সংগ্রহ ব্যতিরেকে, ডিরেক্টরদিগের ঐ হুণ্ডীর টাকা দিবার কোনও উপায় ছিল না। কলিকাতার গবর্ণর যথেষ্ট ধার করিতে লাগিলেন; কিন্তু, পূর্ব অপেক্ষা ন্যূন পরিমাণে, পণ্যদ্রব্য পাঠাইতে আরম্ভ করিলেন; সুতরাং, ঐ সকল হুণ্ডীর টাকা দেওয়া ডিরেক্টরদিগের পক্ষে অসাধ্য হইয়া উঠিতে লাগিল। এজন্ত, তাঁহারা কলিকাতাব গবর্ণরকে এই আজ্ঞা করিয়া পাঠাইলেন, আর এরূপ হুণ্ডী না পাঠাইয়া, এক বৎসর, কলিকাতাতেই টাকা ধার করিয়া, কার্য সম্পন্ন করিবে।

ইহাতে এই ফল হইল যে, সরকারী কর্মচারীরা, ফরাসি, ওলন্দাজ ও দিনামারদিগের দ্বারা, আপন আপন উপার্জিত অর্থ ঘুরোপে পাঠাইতে লাগিলেন; অর্থাৎ চন্দননগর, চুঁচুড়া ও শ্রীরামপুরের ধনাগারে টাকা জমা করিয়া দিয়া, বিলাতের অন্যান্য কোম্পানির নামে হুণ্ডী লইতে আরম্ভ করিলেন। উক্ত সওদাগরেরা, ঐ সকল টাকায় পণ্যদ্রব্য কিনিয়া, যুবোপে পাঠাইতেন; হুণ্ডীর মিয়াদ মধ্যেই, ঐ সমস্ত বস্তু তথায় পহুছিত ও বিক্রীত হইত। এই উপায় দ্বারা, ভারতবর্ষস্থ অন্যান্য যুবোপীয় বণিকদিগের টাকার অসঙ্গতি নিবন্ধন কোনও ক্লেশ ছিল না; কিন্তু, ইংবেজ কোম্পানি যৎপরোনাস্তি ক্লেশে পড়িলেন। ডিরেক্টরেরা নিষেধ করিলেও, কলিকাতার গবর্ণর, অগত্যা পুনর্বার পূর্ববং ঋণ করিয়া, ১৭৬৯ খৃঃ অব্দে, ইংলণ্ডে হণ্ডী পাঠাইলেন, তাহাতে লণ্ডন নগরে কোম্পানির কার্য একবারে উচ্ছিন্ন হইবার সম্ভাবনা ঘটিয়া উঠিল।

নজমউদ্দৌলা, ১৭৬৫ খৃঃ অব্দের জানুয়ারি মাসে, নবাব হইয়াছিলেন। পর বৎসর তাঁহার মৃত্যু হইলে, সৈফউদ্দৌলা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েন। ১৭৭০ খৃঃ অব্দে, বসন্ত- রোগে তাঁহার প্রাণান্ত হইলে, তদীয় ভ্রাতা মোবারিকউদ্দৌলা তৎপদে অধিরোহণ করেন। তাঁহার পূর্বাধিকারীরা, আপন আপন ব্যয়ের নিষিত, যত টাকা পাইতেন, কলি- কাতার কৌন্সিলের সাহেবেরা তাঁহাকেও তাহাই দিতেন। কিন্তু ডিরেক্টরেরা, প্রতি- বৎসর তাঁহাকে তত না দিয়া, ১৬ লক্ষ টাকা দিবার আদেশ করেন।

১৭৭০ খৃঃ অব্দে, ঘোরতর দুর্ভিক্ষ হওয়াতে, দেশ শৃষ্ণ হইয়া গিয়াছিল। উক্ত দুর্ঘটনার সময়, দরিদ্র লোকেরা, যে কি পর্যন্ত ক্লেশ ভোগ করিয়াছিল, তাহা বর্ণনা করা যায় না। এইমাত্র কহিলে এক প্রকার বোধগম্য হইতে পারিবেক যে, ঐ দুর্ভিক্ষে দেশের প্রায় স্মৃতীয় অংশ লোক কালগ্রাসে পতিত হয়। ঐ বৎসরেই, ডিবেক্টরদিগের আদেশ অনুসারে, মুরশিদাবাদে ও পাটনায়, কৌন্সিল অব রেবিনিউ অর্থাৎ রাজস্ব সমাজ স্থাপিত হয়। তাঁহাদের এই কর্ম নির্ধারিত হইয়াছিল যে, তাঁহারা রাজস্ব বিষয়ক তত্ত্বানুসন্ধান ও দাখিলার পরীক্ষা করিবেন। কিন্তু, রাজস্বের কার্যনির্বাহ, তৎকাল পর্যন্ত, দেশীয় লোকদিগেব হস্তে ছিল। মহম্মদ রেজা খাঁ মুরশিদাবাদে, ও রাজা সিতাব রায় পাটনায়, থাকিয়া পূর্ববং কার্যনির্বাহ করিতেন। ভূমি সংক্রান্ত সমুদয় কাগজ পত্রে তাঁহাদের সহী ও মোহর চলিত।

বেরিলস্ট সাহেব, ১৭৬৯ খৃঃ অব্দে, গবর্ণরীপদ পরিত্যাগ করাতে, কার্টিয়র সাহেব তৎ- পদে অধিরূঢ় হয়েন। কিন্তু, কলিকাতার গভর্ণমেন্টের অকর্মণাতা প্রযুক্ত, কোম্পানির কার্য অত্যন্ত বিশৃঙ্খল ও উচ্ছিন্নপ্রায় হইয়া উঠে। ডিরেক্টরেরা, কুরীতিসংশোধন ও ব্যয়- লাঘব করিবাব নিমিত্ত, কলিকাতার পূর্ব গবর্ণর বান্সিটার্ট, স্ক্রাফটন, কর্নেল ফোর্ড, এই তিন জনকে ভাবতবর্ষে পাঠাইয়া দেয়। কিন্তু, তাঁহারা যে জাহাজে আরোহণ করিয়া- ছিলেন, অন্তরীপ উত্তীর্ণ হইবার পব, আর উহাব কোনও উদ্দেশ পাওয়া যায় নাই। সকলে অনুমান করেন, ঐ জাহাজ সমুদয় লোক সহিত সমূদ্রে মগ্ন হয়।

ষষ্ট অধ্যায়

কার্টিয়র সাহেব, ১৭৭২ খৃঃ অব্দে, গবর্ণরী পরিত্যাগ করিলে, ওয়ারন হেস্টিংস সাহেব তৎপরে অধিরূঢ় হইলেন। হেস্টিংস, ১৭৪৯ খৃঃ অব্দে, রাজশাসন সংক্রান্ত কর্মে নিযুক্ত হইয়া, আঠার বৎসর বয়ঃক্রমকালে, এদেশে আইসেন; এবং গুরুতর পরিশ্রম সহকারে, এতদ্দেশীয় ভাষা ও রাজনীতি শিক্ষা করিতে আরম্ভ করেন। ১৭৫৬ খৃঃ অব্দে, ক্লাইব তাঁহাকে মুরশিদাবাদের রেসিডেন্টের কর্মে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তৎকালে, গবর্ণরের পদ ভিন্ন, ইহা অপেক্ষা সম্মানের কর্ম আর ছিল না। যখন বাম্পিটার্ট সাহেব কলিকাতার প্রধান পদ প্রাপ্ত হয়েন, তখন কেবল হেস্টিংস তাঁহার বিশ্বাসপাত্র ছিলেন। ১৭৬১ খৃঃ অব্দের ডিসেম্বর মাসে, হেস্টিংস কলিকাতার কৌন্সিলের মেম্বর হন। তৎকালে, অন্য সকল মেম্বরই বান্সিটাট সাহেবের প্রতিপক্ষ ছিলেন, তিনিই একাকী তাঁহার মতের পোষকতা করিতেন। ১৭৭০ খৃঃ অব্দে, ডিরেক্টরেরা তাঁহাকে মান্দ্রাজ কৌন্সিলের দ্বিতীয় পদে অভিষিক্ত করেন। তিনি তথায় নানা স্থনিয়ম প্রচলিত করিয়াছিলেন; তজ্জন্ত, ডিরেক্টরেরা তাঁহার উপর অতিশয় সন্তুষ্ট ছিলেন। এক্ষণে, কলিকাতার গবর্ণরের পদ শূন্য হওয়াতে, তাহারা তাঁহাকে, সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত বিবেচনা করিয়া, ঐ পদে অভিষিক্ত করিলেন। তৎকালে, তাঁহার চল্লিশ বৎসব বয়ঃক্রম হইয়াছিল।

দেশীয় লোকেরা যে রাজস্ব সংক্রান্ত সমুদায় বন্দোবস্ত করেন, ইহাতে ডিরেক্টরেরা অতিশয় বিরক্ত ছিলেন। তাঁহারা দেখিলেন, আয় ক্রমে অল্প হইতেছে। অতএব, দেওয়ানী প্রাপ্তির সাত বৎসব পরে, তাঁহারা যথার্থ দেওয়ান হওয়া, অর্থাৎ রাজস্বের বন্দোবস্তের ভার আপনাদের হস্তে লইয়া ঘুরোপীয় কর্মচারী দ্বারা কার্যনির্বাহ করা, মনস্থ করিলেন। এই নূতন নিয়ম হেস্টিংস সাহেবকে আসিয়াই প্রচলিত করিতে হইল। তিনি ১৩ই এপ্রিল, গবর্ণরের পদ গ্রহণ করিলেন। ১৪ই মে কৌন্সিলেব সম্মতি ক্রমে, এই ঘোষণা প্রচারিত হইল যে, 'ইংরেজেরা স্বয়ং রাজস্বের কার্যনির্বাহ করিবেন; যে সকল খুরোপীয় কর্মচারীরা রাজস্বের কর্ম করিবেন, তাঁহাদের নাম কালেক্টর হইবেক; কিছু কালের নিমিত্ত, সমুদয় জমী ইজারা দেওয়া যাইবেক। আর, কৌন্সিলের চারিজন মেম্বর, প্রত্যেক প্রদেশে গিয়া, সমস্ত বন্দোবস্ত করিবেন। ইহারা, প্রথমে কৃষ্ণনগরে গিয়া, কার্যারম্ভ করিলেন। পূর্বাধিকারীরা, অত্যন্ত কম নিরিখে, মালগুজারী দিতে চাহিবাতে, তাঁহারা সমুদায় জমী নীলাম করাইতে লাগিলেন। যে জমীদার অথবা তালুকদার ন্যায্য মালগুজারী দিতে সম্মত হইলেন, তিনি আপন বিষয় পূর্ববৎ অধিকার করিতে লাগিলেন; আর, যিনি অত্যন্ত কম দিতে চাহিলেন, তাঁহাকে পেশন দিয়া, অধিকার- চ্যুত করিয়া, তৎপরিবর্তে অন্য ব্যক্তিকে অধিকার দেওয়াইলেন। গবর্ণব স্বচক্ষে সমূদয় দেখিতে পারিবেন, এই অভিপ্রায়ে, মালের কাছারী মুবশিদাবাদ হইতে কলিকাতায় আনীত হইল।

এইরূপে রাজস্বকর্মের নিয়ম পরিবর্তিত হওয়াতে, দেশের দেওয়ানী ও ফৌজদারী কর্মেরও নিয়মপরিবর্ত আবশ্যক হইল। প্রত্যেক প্রদেশে, এক ফৌজদারী ও এক দেওয়ানী, দুই বিচারালয় সংস্থাপিত হইল। ফৌজদারী আদালতে কালেক্টর সাহেব, কাজী, মুফতি, এই কয়জন একত্র হইয়া বিচার করিতেন। আর, দেওয়ানী আদালতেও, কালেক্টর সাহেব মোকদ্দমা করিতেন, দেওয়ান ও অন্যান্য আমলারা তাঁহার সহকারিতা করিত। মোকদ্দমার আপীল শুনিবার নিমিত্ত, কলিকাতায় দুই বিচারালয় স্থাপিত হইল। তন্মধ্যে, যে স্কুলে দেওয়ানী বিষয়ের বিচার হইত, তাহার নাম সদর দেওয়ানী আদালত, আর যে স্থানে ফৌজদারী বিষয়ের, তাহার নাম নিজামৎ আদালত, রহিল।

এ পর্যন্ত, আদালতে, যত টাকার মোকদ্দমা উপস্থিত হইল, প্রাড়, বিবাক তাহার চতুর্থ অংশ পাইতেন, এক্ষণে তাহা রহিত হইল; অধিক জরিমানা রহিত হইয়া গেল; মহাজনদিগের, স্বেচ্ছাক্রমে খাতককে রুদ্ধ করিয়া, টাকা আদায় করিবার যে ক্ষমতা ছিল, তাহাও নিবারিত হইল; আর দশ টাকার অনধিক দেওয়ানী মোক মার নিষ্পত্তির ভার পরগণার প্রধান ভূম্যধিকারীর হস্তে অপিত হইল। ইংরেজেরা, আপনা- দিগের প্রণালী অনুসারে, বাঙ্গালার শাসন করিবার নিমিত্ত, প্রথমে এই সকল নিয়ম নির্ধারিত করিলেন।

ডিরেক্টরেরা স্থির করিয়াছিলেন যে, মহম্মদ রেজা খাঁর অসৎ আচরণ দ্বারাই, বাঙ্গালার রাজস্বের ক্ষতি হইতেছে। তাঁহার পদপ্রাপ্তির দিবস অবধি, তাঁহারা তাঁহার চরিত্র বিষয়ে সন্দেহ করিতেন। তাঁহারা ইহাও বিশ্বত হয়েন নাই যে, যখন তিনি, মীরজাফরের রাজত্ব সময়ে, ঢাকার চাকলায় নিযুক্ত ছিলেন; তখন, তথায় তাঁহার অনেক লক্ষ টাকা তহবীল ঘাটি হইয়াছিল। কেহ কেহ তাঁহার নামে এ অভিযোগও করিয়াছিল যে, তিনি, ১৭৭০ খৃঃ অব্দের দারুণ অকালের সময়, অধিকতর লাভেব প্রত্যাশায়, সমুদায় শস্য একচাটিয়া করিয়াছিলেন। আর সকলে সন্দেহ করিত, তিনি অনেক রাজস্ব ছাপাইয়া রাখিয়াছিলেন, এবং প্রজাদিগেরও অধিক নিপীড়ন করিয়াছিলেন।

যৎকালে তিনি মুরশিদাবাদে কর্ম করিতেন, তখন বাঙ্গালায় তিনি অদ্বিতীয ব্যক্তি ছিলেন। নায়েব সুবাদার ছিলেন। সুতরাং রাজস্বেব সমূদয় বন্দোবস্তের ভার তাঁহার হস্তে ছিল; আর নায়েব নাজিম ছিলেন, সুতরাং পুলিশেরও সমুদয় ভার তাঁহারই হস্তে ছিল। ডিরেক্টরেরা বুঝিতে পারিলেন, যত দিন তাঁহার হস্তে এরূপ ক্ষমতা থাকিবেক, কোনও ব্যক্তি তাঁহার দোষপ্রকাশে অগ্রসর হইতে পারিবেক না। অতএব তাঁহারা এই আজ্ঞা করিয়া পাঠাইলেন যে, মহম্মদ রেজা খাঁকে কয়েদ করিয়া সপরিবারে কলিকাতায় আনিতে, এবং তাঁহার সমুদয় কাগজপত্র আটক করিতে, হইবেক।

হেষ্টিংস সাহেব গবর্ণবের পদে অধিকঢ় হইবার দশ দিবস পরেই, ডিরেক্টরদিগের এই আজ্ঞা তাঁহার নিকট পহুছে। যৎকালে ঐ আজ্ঞা পহছিল, তখন অধিক রাত্রি হইয়া ছিল; এজন্য, সে দিবস তদনুযায়ী কার্য হইল না। পরদিন প্রাতঃকালে, তিনি, মহম্মদ রেজা খাঁকে কলিকাতায় পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত, মুরশিদাবাদের রেসিডেন্ট মিডিণ্টন সাহেবকে পত্র লিখিলেন। তদনুসারে, রেজা খাঁ, সপরিবারে, জলপথে, কলিকাতায় প্রেরিত হইলেন। মিডিল্টন সাহেব তাঁহার কার্যের ভার গ্রহণ করিলেন। রেজা খাঁ চিতপুরে উপস্থিত হইলে, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, অকস্মাৎ এরূপ ঘটিবার কারণ জানাইবার নিমিত্ত, একজন কৌন্সিলের মেম্বার তাঁহার নিকটে প্রেরিত হইলেন। আর, হেষ্টিংস সাহেব এইরূপ পত্র লিখিলেন, আমি কোম্পানির ভৃত্য, আমাকে তাঁহাদের আজ্ঞা প্রতিপালন করিতে হইয়াছে; নতুবা, আপনকার সহিত আমার যেরূপ সৌহৃদ্য আছে, তাহার কোনও ব্যতিক্রম হইবেক না, জানিবেন।

বিহারের নায়েব দেওয়ান রাজা সিতাব রায়েরও চরিত্র বিষয়ে সন্দেহ জন্মিয়াছিল; এজন্য, তিনিও কলিকাতায় আনীত হইলেন। তাঁহার পরীক্ষা অল্প দিনেই সমাপ্ত হইল। পরীক্ষায় তাঁহার কোনও দোষ পাওয়া গেল না; অতএব তিনি মান পূর্বক বিদায় পাইলেগ। তৎকালীন মুসলমান ইতিহাস লেখক, সরকারী কার্যের নির্বাহ বিষয়ে, তাঁহার প্রশংসা করিয়াছেন; কিন্তু ইহাও লিখিয়াছেন, প্রধানপদারূঢ অন্ত্যান্ত লোকের ন্যায়, তিনিও, অন্ত্যায় আচরণপূর্বক, প্রজাদিগের নিকট অধিক ধন গ্রহণ করিতেন।

অপরাধী বোধ করিয়া কলিকাতায় আনয়ন করাতে, তাঁহার যে অমর্যাদা হইয়াছিল, তাহার প্রতিবিধানার্থে, কিছু পারিতোষিক দেওয়া উচিত বোধ হওয়াতে, কৌন্সিলের সাহেবেরা তাঁহাকে এক মর্যাদাসূচক পরিচ্ছদ পুরস্কার দিলেন এবং বিহারের রায় রাইয়া করিলেন। কিন্তু, অপরাধিবোধে কলিকাতায় আনয়ন করাতে, তাঁহাব যে অপমানবোধ হইয়াছিল, তাহাতে তিনি একবারে ভগ্নচিত্ত হইলেন। ইংরেজেরা, এ পর্যন্ত এতদ্দেশীয় যত লোক নিযুক্ত করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে তাঁহারা রাজা সিতাব রায়েব সর্বদা সবিশেষ গৌরব করিতেন। তিনি এরূপ তেজস্বী ছিলেন যে, অপবাধিবোধে অধিকারচ্যুত করা, কয়েদ করিয়া কলিকাতায় আনা, এবং দোষের আশঙ্কা কবিয়া পরীক্ষা করা, এই সকল অপমান তাঁহার অত্যন্ত অসঙ্গ হইয়াছিল। ফলতঃ, পাটনা প্রতিগমন করিয়া, ঐ মনঃপীড়াতেই তিনি প্রাণত্যাগ কবিলেন। তাঁহার পুত্র রাজা কল্যাণ সিংহ তদীয় পদে অভিষিক্ত হইলেন। পাটনা প্রদেশে, উৎকৃষ্ট দ্রাক্ষাফলের নিমিত্ত, যে প্রসিদ্ধ হইয়াছে, রাজা সিতাব রায়ই তাহাব আদিকারণ। তাঁহার উদ্যোগেই, ঐ প্রদেশে, দ্রাক্ষা ও খরমুজের চাষ আরক হয়।

মহম্মদ রেজা খাঁর পরীক্ষায় অনেক সময় লাগিয়াছিল। নন্দকুমার তাঁহার দোষোদঘাটক নিযুক্ত হইলেন। প্রথমতঃ স্পষ্টবোধ হইয়াছিল, অভিযুক্ত ব্যক্তির দোষ সম্প্রমাণ হইলেন বটে, কিন্তু আর পূর্ব কর্ম প্রাপ্ত হইলেন না।

হইবেক। কিন্তু, দ্বৈবার্ষিক বিবেচনার পর, নির্ধারিত হইল, মহম্মদ রেজা খাঁ নির্দোষ

নিজামতে মহম্মদ রেজা খাঁর যে কর্ম ছিল, তিনি পদচ্যুত হইলে পর, তাহা দুই ভাগে বিভক্ত হইল। নবাবকে শিক্ষা দেওয়ার ভার মণিবেগমের হস্তে অর্পিত হইল; আর, সমুদয় ব্যয়ের তত্ত্বাবধানার্থে, হেস্টিংস সাহেব, নন্দকুমারের পুত্র গুরুদাসকে নিযুক্ত করিলেন। কৌন্সিলের অধিকাংশ মেম্বর এই নিয়োগ বিষয়ে বিস্তর আপত্তি করিলেন, কহিলেন, গুরুদাস নিতান্ত বালক, তাহাকে নিযুক্ত করায়, তাহার পিতাকে নিযুক্ত করা হইতেছে; কিন্তু, তাহার পিতাকে কখনও বিশ্বাস করা যাইতে পারে না। হেষ্টিংস

তাঁহাদের পরামর্শ না গুনিয়া, গুরুদাসকেই নিযুক্ত করিলেন।

এই সময়ে, ইংলণ্ডে কোম্পানির বিষয়কর্ম অত্যন্ত বিশৃঙ্খল ও উচ্ছিন্ন প্রায় হইয়াছিল। ১৭৬৭ সালে লার্ড ক্লাইবের প্রস্থান অবধি, ১৭৭২ সালে হেস্টিংসের নিয়োগ পর্যন্ত, পাঁচ বৎসর ভারতবর্ষে যেমন ঘোরতর বিশৃঙ্খলা ঘটিয়াছিল, ইংলণ্ডের ডিরেক্টরদিগের কার্যও তেমনই বিশৃঙ্খল হইয়াছিল। যৎকালে কোম্পানির দেউলিয়া হইবার সম্ভাবনা হইয়াছে, তাদৃশ সময়ে ডিরেক্টরেরা মূলধনের অধিকারীদিগকে, শতকরা সাড়ে বার টাকার হিসাবে, মুনাফার অংশ দিলেন। যদি তাঁহাদের কার্যের বিলক্ষণ উন্নতি থাকিত, তথাপি তন্ত্রপ মুনাফা দেওয়া, কোনও মতে, উচিত হইত না। যাহা হউক, এইরূপ পাগলামি করিয়া, ডিরেক্টরেরা দেখিলেন, ধনাগারে এক কপর্দকও সম্বল নাই। তখন তাঁহাদিগকে, ইংলণ্ডের বেঙ্কে, প্রথমতঃ চল্লিশ লক্ষ, তৎপরে আর বিশ লক্ষ, টাকা ধার করিতে হইল। পরিশেষে, রাজমন্ত্রীর নিকটে গিয়া, তাঁহাদিগকে এক কোটি টাকা ধার চাইতে হইয়াছিল।

এ পর্যন্ত, পার্লিমেন্টের অধ্যক্ষেরা, ভারতবর্ষ সংক্রান্ত কোনও বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেন নাই। কিন্তু, এক্ষণে কোম্পানির বিষয়কর্মের এবপ্রকার দুরবস্থা প্রকাশিত হওয়াতে, তাঁহারা সমুদায় ব্যাপার আপনাদের হস্তে আনিতে মনন করিলেন। কোম্পানির শাসনে যে সকল অল্লায় আচরণ হইয়াছিল, তাহার পরীক্ষার্থে এক কমিটী নিয়োজিত হইল। ঐ কমিটী বিজ্ঞাপনী প্রদান করিলে, রাজমন্ত্রীরা বুঝিতে পারিলেন, সম্পূর্ণরূপে নিয়ম- পবিবর্ত না হইলে, কোম্পানির পরিত্রাণের উপায় নাই। তাঁহারা, সমস্ত দোষের সংশোধনার্থে, পার্লিমেন্টে নানা প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন। ডিরেক্টরেরা তদ্বিষয়ে, যত দূব পারেন, আপত্তি করিলেন; কিন্তু, তাঁহাদের অসদাচরণ এত স্পষ্ট প্রকাশ পাইয়া- ছিল, ও তাহাতে মনুষ্য মাত্রেরই এমন ঘৃণা জন্মিয়াছিল যে, পার্লিমেন্টের অধ্যক্ষেরা, তাঁহাদের সমস্ত আপত্তির উল্লঙ্ঘন করিয়া, রাজমন্ত্রীর প্রস্তাবিত প্রণালীরই পোষকতা

করিলেন।

অতঃপর, ভারতবর্ষীয় রাজকর্মের সমুদয় প্রণালী, ইংলণ্ড ও ভারতবর্ষ উভয় স্থানেই, পরিবর্তিত হইল। ডিরেক্টর মনোনীত করণের প্রণালীও কিয়ৎ অংশে পরিবর্তিত হইল। ইংলণ্ডে কোম্পানির কার্যে যে সমস্ত দোষ ঘটিয়াছিল, ইহা দ্বারা তাহার অনেক সংশোধন হইল। ইহাও আদিষ্ট হইল যে, প্রতি বৎসর, ছয় জন ডিরেক্টরকে পদ ত্যাগ করিতে হইবেক, এবং তাঁহাদের পরিবর্তে, আর ছয়জনকে মনোনীত করা যাইবেক। আর, ইহাও আদিষ্ট হইল যে, বাঙ্গালার গবর্ণর ভারতবর্ষের গবর্ণর জেনেরল হইবেন, অন্তান্ত রাজধানীর রাজনীতিঘটিত যাবতীয় ব্যাপার তাঁহার অধীনে থাকিবেক। গবর্ণর ও কৌন্সিলের মেম্বরদিগের ক্ষমতা বিষয়ে, সর্বদা বিবাদ উপস্থিত হইত। অতএব নিয়ম হইল, গবর্ণর জেনেবল ফোট উইলিয়মের একমাত্র গবর্ণর ও সেনানী হইবেন। গবর্ণর জেনেরল, কৌন্সিলের মেম্বর, ও জজদিগের বাণিজ্য নিষিদ্ধ হইল। এজন্য, গবর্ণর জেনেরলের আড়াই লক্ষ, ও কৌন্সিলের মেম্বরদিগের আশী হাজার টাকা, বার্ষিক বেতন নির্ধারিত হইল। ইহাও আজ্ঞপ্ত হইল যে, কোম্পানির অথবা রাজার কার্যে নিযুক্ত কোনও ব্যক্তি উপঢৌকন লইতে পারিবেন না। আর, ডিরেক্টরদিগের প্রতি আদেশ হইল যে, ভারতবর্ষ হইতে রাজশাসন সংক্রান্ত যে সকল কাগজপত্র আসিবেক, সে সমুদয় তাঁহারা রাজ-মন্ত্রিগণের সম্মুখে উপস্থিত করিবেন। বিচারনির্বাহ বিষয়ে, এই নিয়ম নির্ধারিত হইল যে, কলিকাতায় সুপ্রীম কোর্ট নামে এক বিচারালয় স্থাপিত হইবেক। তথায়, বার্ষিক অশীতি সহস্র মুদ্রা বেতনে, একজন চীফ জষ্টিস, অর্থাৎ প্রধান বিচারকর্তা, ও যষ্টি সহস্র মুদ্রা বেতনে, তিন জন পিউনি জজ, অর্থাৎ কনিষ্ঠ বিচারকর্তা থাকিবেন। এই জজেরা কোম্পানির অধীন হইবেন না, রাজা স্বয়ং তাঁহাদিগকে নিযুক্ত করিবেন। আর, ঐ ধর্মাধিকরণে, ইংলণ্ডীয় ব্যবহারসংহিতা অনুসারে, ব্রিটিশ সজেক্ট- দিগের বিবাদ নিষ্পত্তি করা যাইবেক। পরিশেষে, এই অনুমতি হইল যে, ভারতবর্ষ সংক্রান্ত কার্যের নির্বাহ বিষয়ে, পার্লিমেন্টের অধ্যক্ষেরা প্রথম এই যে নিয়ম নির্ধারিত করিলেন, ১৭৭৪ সালে, ১লা আগষ্ট, তদনুযায়ী কার্যারম্ভ হইবেক।

হেস্টিংস সাহেব, বাঙ্গালার রাজকার্যনির্বাহ বিষয়ে, সবিশেষ ক্ষমতাপ্রকাশ করিয়াছিলেন; এজন্য, তিনি গবর্ণর জেনেরলের পদ প্রাপ্ত হইলেন। সুপ্রীম কৌন্সিলে তাঁহার সহিত রাজকার্যের পর্যালোচনার্থে, চারিজন মেম্বর নিযুক্ত হইলেন। ইহাদের মধ্যে, বারওয়েল সাহেব, বহুকাল অবধি, এতদ্দেশে রাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন; আর, কর্ণেল মন্সন, সর জন ক্লবরিং ও ফ্রান্সিস সাহেব, এই তিন জন, ইহার পূর্বে, কখনও এদেশে আইসেন নাই।

হেস্টিংস, এই তিন নূতন মেম্বরের মান্দ্রাজে পহুছিবার সংবাদ শ্রবণ মাত্র, তাঁহাদিগকে এক অনুরাগসূচক পত্র লিখিলেন, তাঁহারা খাজরীতে পহুছিলে, কৌন্সিলের প্রধান মেম্বরকে তাঁহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে পাঠাইলেন, এবং তাঁহার একজন নিজ পারিষদও, স্বাগতজিজ্ঞাসার্থে, প্রেরিত হইলেন। কলিকাতায় উত্তীর্ণ হইলে, তাঁহাদের যেরূপ সমাদর হইয়াছিল, লার্ড ক্লাইব ও বান্ধিটার্ট সাহেবেরও সেরূপ হয় নাই। আসিবা মাত্র, সতরটা সেলামী তোপ হয় ও তাঁহাদের সংবর্ধনা করিবার নিমিত্ত, কৌন্সিলের সমুদয় মেম্বর একত্র হন। তথাপি তাঁহাদের মন উঠিল না।

তাঁহারা ডিরেক্টরদিগের নিকট এই অভিযোগ করিয়া পাঠাইলেন, আমরা সমুচিত সমাদর প্রাপ্ত হই নাই; আমাদের সংবর্ধনা করিবার নিমিত্ত, সৈন্য বহিষ্কৃত করা যায় নাই; সেলামী তোপও উপযুক্ত সংখ্যায় হয় নাই, আমাদের সংবর্ধনা কৌন্সিলগৃহে না

করিয়া, হেস্টিংসের বাটীতে করা হইয়াছিল; আর আমরা যে নূতন গবর্ণমেন্টের অবয়ব

স্বরূপ আসিয়াছি, উপযুক্ত সমারোহপূর্বক, তাহার ঘোষণা করা হয় নাই। ২০শে অক্টোবর, কৌন্সিলের প্রথম সভা হইল; কিন্তু বারওয়েল সাহেব তখন পর্যন্ত না পঁহুছিবাতে, সে দিবস কেবল নূতন গবর্ণমেন্টের ঘোষণা মাত্র হইল; অন্যান্য সমুদয় কর্ম, আগামী সোমবার ২৪শে তারিখে বিবেচনার নিমিত্ত, রহিল। নূতন মেম্বরেরা ভারতবর্ষের কার্য কিছুই অবগত ছিলেন না; অতএব, সভার আরম্ভ হইলে, হেষ্টিংস সাহেব কোম্পানির সমুদয় কার্য যে অবস্থায় চলিতেছিল, তাহার এক সবিশেষ বিবরণ তাঁহাদের সম্মুখে ধরিলেন। কিন্তু, প্রথম সভাতেই, এমন বিবাদ উপস্থিত হইল যে, ভারতবর্ষের রাজশাসন, তদবধি প্রায় সাত বৎসর পর্যন্ত, অত্যন্ত বিশৃঙ্খল হইয়াছিল। বারওয়েল সাহেব একাকী গবর্ণর জেনেরলের পক্ষে ছিলেন; অন্য তিন মেম্বর, সকল বিষয়ে, সর্বদা, তাঁহার বিরুদ্ধ পক্ষেই মত দিতেন। তাঁহাদের সংখ্যা অধিক; সুতরাং, গবর্ণব জেনেরল কেবল সাক্ষিগোপাল হইলেন; কাবণ, যে স্থলে বহুসংখ্যক ব্যক্তিব উপর কোনও বিষয়ের ভার থাকে, তথায় মতভেদ হইলে, অধিকাংশ ব্যক্তির মত- অনুসারেই, সমস্ত কার্য সম্পন্ন হইয়া থাকে। বস্তুতঃ, সমস্ত ক্ষমতা তাঁহাদের হস্তেই পতিত হইল। তাঁহাদের ভারতবর্ষে আসিবার পূর্বে, হেস্টিংস এতদ্দেশে যে সকল ঘোরতর অত্যাচার ও অন্যায়াচবণ করিয়াছিলেন, তাঁহারা তৎসমুদায় সবিশেষ অবগত ছিলেন, এবং হেস্টিংসকে অতি অপরুষ্ট লোক স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন; এজন্য, হেস্ট্রিংস যাহা কহিতেন, ন্যায় অল্লায় বিবেচনা না করিয়া, এক বারে তাহা অগ্রাহ্য করিতেন; সুতরাং, তাঁহারা যে রাগদ্বেষশূষ্ণ হইয়া কার্য করিবেন, তাহাব সম্ভাবনা ছিল না।

হেস্টিংস সাহেব, কিয়ৎ দিবস পূর্বে, মিডিণ্টন সাহেবকে লক্ষ্ণৌ রাজধানীতে বেসিডেন্ট নিযুক্ত করিয়াছিলেন; এক্ষণে, নূতন মেম্বররা তাঁহাকে, সে কর্ম পরিত্যাগ করিয়া, কলি- কাতায় আসিতে আজ্ঞা দিলেন, আব, হেস্টিংস সাহেব নবাবের সহিত যে সকল বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন, সে সমস্ত অগ্রাহ্য করিয়া, তাঁহার নিকট নূতন বন্দোবন্তের প্রস্তাব কবিয়া পাঠাইলেন। হেস্টিংস তাঁহাদিগকে ক্ষান্ত হইতে অনুরোধ করিলেন, এবং কহিলেন, এরূপ হইলে সর্বত্র প্রকাশ হইবেক যে, গবর্ণমেন্ট মধ্যে অনৈক্য উপস্থিত হইয়াছে। এতদ্দেশীয় লোকেরা গবর্ণরকে গবর্ণমেন্টের প্রধান বিবেচনা করিয়া থাকে; এক্ষণে, তাঁহাকে একপ ক্ষমতাশূন্য দেখিলে, সহজে বোধ করিতে পারে যে, বাজবিপ্লব উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু, ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয়েরা, রোষ ও দ্বেষের বশবর্তী হইয়া, তাহাতে কর্ণপাত

করিলেন না। দেশীয় লোকেরা, অল্প কাল মধ্যে, কৌন্সিলের এবংবিধ বিবাদের বিষয় অবগত হইলেন, এবং ইহাও জানিতে পারিলেন, হেষ্টিংস সাহেব এত কাল সকলের প্রধান ছিলেন, এক্ষণে আর তাঁহার কোনও ক্ষমতা নাই। অতএব, যে সকল লোক তৎকৃত কোনও কোনও ব্যাপারে অসন্তুষ্ট ছিল, তাহারা, ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয় মেম্বরদিগের নিকট, তাঁহার নামে অভিযোগ করিতে আরম্ভ করিল। তাঁহারাও আন্তরিক যত্ন ও উৎসাহ সহকাবে, তাহাদের অভিযোগ গ্রাহ্য করিতে লাগিলেন। ঐ সময়েই, বর্ধমানের অধিপতি মৃত তিলকচন্দ্রের বনিতা, স্বীয় তনয়কে সমভিব্যাহারে করিয়া, কলিকাতায় উপস্থিত হইলেন। তিনি এই আবেদনপত্র প্রদান করিলেন, আমি রাজার মৃত্যুর পর, কোম্পানির ইংরেজ ও দেশীয় কর্মচারীদিগকে নয় লক্ষ টাকা উৎকোচ দিয়াছি, তন্মধ্যে হেস্টিংস সাহেব ১৫০০০ টাকা লইয়াছিলেন। হেস্টিংস বাঙ্গালা পারসীতে হিসাব দেখিতে চাহিলেন; কিন্তু রাণী কিছুই দেখাইলেন না। কোনও ব্যক্তিকে সম্মান দান করা এ পর্যন্ত গবর্ণমেন্টের প্রধান ব্যক্তির অধিকার ছিল; কিন্তু হেস্টিংসের বিপক্ষেরা, তাঁহাকে তুচ্ছ কবিয়া, আপনারা শিশুরাজাকে খেলাত দিলেন।

অতি শীঘ্র শীঘ্র, হেস্টিংসের নামে ভূরি ভূরি অভিযোগ উপস্থিত হইতে লাগিল। এক- জন এই বলিয়া দরখাস্ত দিল যে, হুগলীর ফৌজদার বৎসরে ৭২০০০ টাকা বেতন, পাইয়া থাকেন, তন্মধ্যে তিনি হেষ্টিংস সাহেবকে ৩৬০০০ ও তাঁহার দেওয়ানকে ৪০০০ টাকা দেন। আমি বার্ষিক, ৩২০০০ টাকা পাইলেই, ঐ কর্ম সম্পন্ন কবিতে পারি। উপস্থিত অভিযোগ গ্রাহ্য করিয়া, সাক্ষ্য লওয়া গেল। হেস্টিংসের বিপক্ষ মেম্বনেরা কহিলেন, যথেষ্ট প্রমাণ হইয়াছে। তদনুসারে, ফৌজদাব পদচ্যুত হইলেন। অন্য এক ব্যক্তি, ন্যূন বেতনে, ঐ পদে নিযুক্ত হইলেন; কিন্তু অভিযোক্তার কিছুই হইল না।

এক মাস অতীত না হইতেই, আর এই এক অভিযোগ উপস্থিত হইল, মণিবেগম নয় লক্ষ টাকার হিসাব দেন নাই। পীড়াপীড়ি করাতে, বেগম কহিলেন, হেষ্টিংস সাহেব যখন আমাকে নিযুক্ত করিতে আইসেন, আমোদ উপলক্ষে বায় কবিবার নিমিত্ত, তাঁহাকে এক লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা উৎকোচ দিয়াছি। হেস্টিংস কহিলেন, আমি ঐ টাকা লইয়াছি বটে, কিন্তু সরকারী হিসাবে খরচ কবিয়া কোম্পানির দেড় লক্ষ টাকা বাঁচাইয়াছি। হেস্টিংস সাহেবের এই হেতুবিন্যাস কাহারও মনোনীত হইল না।

এক্ষণে স্পষ্ট দৃষ্ট হইল, অভিযোগ করিলেই গ্রাহ্য হইতে পারে। এই সুযোগ দেখিয়া, নন্দকুমার হেস্টিংসের নামে এই অভিযোগ উপস্থিত করিলেন যে, গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর, সাড়ে তিন লক্ষ টাকা লইয়া, মণিবেগমকে ও আমার পুত্র গুরুদাসকে, মুরশিদাবাদে নবাবের রক্ষণাবেক্ষণ কার্যে, নিযুক্ত করিয়াছিলেন। ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয়েরা প্রস্তাব করিলেন, সাক্ষ্য দিবার নিমিত্ত, নন্দকুমারকে কৌন্সিলের সম্মুখে আনীত করা যাউক ৯হেস্টিংস উত্তর করিলেন, আমি যে সভায় অধিপতি, তথায় আমার অভি- যোক্তাকে আসিতে দিব না, বিশেষতঃ এমন বিষয়ে অপদার্থ ব্যক্তির ক্লায় সম্মত হইয়া গবর্ণর জেনেরলের পদের অমর্যাদা করিব না। এই সমস্ত ব্যাপার স্বপ্রীম কোর্টে প্রেরণ করা যাউক। ইহা কহিয়া, হেস্টিংস, গাত্রোত্থান করিয়া, কৌন্সিলগৃহ হইতে চলিয়া গেলেন; বারওয়েল সাহেবও তাঁহার অনুগামী হইলেন।

তাঁহাদের প্রস্থানের পর, ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয়েরা নন্দকুমারকে কৌন্সিলগৃহে আহ্বান করিলে, তিনি এক পত্র পাঠ করিয়া কহিলেন, মণিবেগম যখন যাহা ঘুস দিয়াছেন, তদ্বিষয়ে এই পত্র লিখিয়াছেন। কিছু দিন পূর্বে, বেগম গবর্ণমেন্টে এক পত্র লিখিয়া- ছিলেন, সর জন ডাইলি সাহেব, নন্দকুমারের পঠিত পত্রের সহিত মিলাইবার নিমিত্ত, ঐ পত্র বাহির করিয়া দিলেন। মোহর মিলিল, হস্তাক্ষরের ঐক্য হইল না। যাহা হউক, কৌন্সিলের মেম্বরেরা নন্দকুমারের অভিযোগ যথার্থ বলিয়া স্থির করিলেন এবং হেস্টিংসকে ঐ টাকা ফিরিয়া দিতে কহিলেন। কিন্তু তিনি তাহাতে কোনও মতে সম্মত হইলেন না।

এই বিষয়ের নিষ্পত্তি না হইতেই, হেস্টিংস নন্দকুমারের নামে, চক্রান্তকারী বলিয়া, স্বপ্রীম কোর্টে অভিযোগ উপস্থিত করিলেন। এই 'অভিযোগের কিছু দিন পরেই, কামালউদ্দীন নামে একজন মুসলমান এই অভিযোগ উপস্থিত করিল, নন্দকুমার এক কাগজে আমার নাম জাল করিয়াছেন। স্বপ্রীম কোর্টেব জজেরা, উক্ত অভিযোগ গ্রাহ কবিয়া, নন্দকুমাকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত কবিলেন। ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয়েরা জজদিগের নিকট বাবংবার প্রস্তাব করিযা পাঠাইলেন, জামীন লইয়া নন্দকুমারকে কাবাগার হইতে মুক্ত করিতে হইবেক। কিন্তু জজেরা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন পূর্বক তাহা অস্বীকাব করিলেন। বিচারের সময় উপস্থিত হইলে, জজেরা ধর্মাসনে অধিষ্ঠান করিলেন; জুবীরা নন্দকুমারকে দোষী নির্ধারিত করিয়া দিলেন; জজেরা নন্দকুমারের প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রদান কবিলেন। তদনুসারে, ১৭৭৫ খৃঃ অব্দের জুলাই মাসে, তাঁহার ফাঁসি হইল।

যে দোষে, সুপ্রীম কোর্টের বিচারে, নন্দকুমারের প্রাণদণ্ড হইল, তাহা যদি তিনি যথার্থই করিয়া থাকেন, সুপ্রীম কোর্ট স্থাপিত হইবার ছয় বৎসর পূর্বে করিয়াছিলেন; সুতরাং, তৎসংক্রান্ত অভিযোগ, কোনও ক্রমে, সুপ্রীম কোর্টেব গ্রাহ ও বিচার্য হইতে পারে না। বিশেষতঃ যে আইন অনুসারে এই সুবিচার হইল, ন্যায়পরায়ণ হইলে, প্রধান জজ সর ইলাইজা ইম্পি, কদাচ উপস্থিত ব্যাপারে, ঐ আইনের মর্ম অনুসারে, কর্ম করিতেন না। কারণ, ঐ আইন ভারতবর্ষীয় লোকদিগের বিষয়ে প্রচলিত হইবেক বলিয়া নির্দিষ্ট হয় নাই। ফলতঃ নন্দকুমারের প্রাণদণ্ড ন্যায়মার্গ অনুসারে বিহিত হইয়াছে, ইহা কোনও ক্রমে প্রতিপন্ন হইতে পারে না।

এতদ্দেশীয় লোকেরা, এই অভূতপূর্ব ব্যাপার দর্শনে, এক বারে হতবুদ্ধি হইলেন, কলিকাতাবাসী ইংরেজেরা প্রায় সকলেই গবর্ণর জেনেরলের পক্ষ ও তাঁহার প্রতি অতিশয় অনুরক্ত ছিলেন; তাঁহারও, অবিচারে নন্দকুমারের প্রাণদণ্ড দেখিয়া, যৎপরো- নাস্তি আক্ষেপ ও বিরাগপ্রদর্শন করিয়াছিলেন।

নন্দকুমার এতদ্দেশের একজন অতি প্রধান লোক ছিলেন। ইংরেজদিগের সৌভাগ্যদশা উদিত হইবার পূর্বে, তাঁহার এরূপ আধিপত্য ছিল যে, ইংরেজেরাও বিপদ পড়িলে, সময়ে সময়ে, তাঁহার আত্মগত্য করিতেন ও শরণাগত হইতেন। নন্দকুমার দুরাচার ছিলেন, যথার্থ বটে; কিন্তু, ইম্পি ও হেস্টিংস তাঁহা অপেক্ষা অধিক দুরাচার, তাহার সন্দেহ নাই।

নন্দকুমার, হেস্টিংসের নামে, নানা অভিযোগ উপস্থিত করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। হেস্টিংস দেখিলেন, নন্দকুমার জীবিত থাকিতে তাঁহার ভদ্রস্থতা নাই; অতএব, যে কোনও উপায়ে, উহার প্রাণবন্ধ করা নিতান্ত আবশুক। তদনুসারে, কামালউদ্দীনকে উপলক্ষ করিয়া, সুপ্রীম কোর্টে পূর্বোক্ত অভিযোগ উপস্থিত করেন। ধর্মাসনারূঢ় ইম্পি, গবর্ণর জেনেরলের পদারূঢ় হেস্টিংসের পরিতোষার্থে, এক বারেই ধর্মাধর্মজ্ঞান ও ন্যায় অন্যায় বিবেচনায় শূন্য হইয়া, নন্দকুমারের প্রাণবধ করিলেন। হেস্টিংস, তিন চারি বৎসর পরে, এক পত্র লিখিয়াছিলেন; তাহাতে ইম্পিকৃত এই মহোপকারের বিষয় উল্লিখিত হইয়াছিল। ঐ পত্রে এইরূপ লিখিত ছিল, এক সময়ে, ইম্পির আনুকূল্যে, আমার সৌভাগ্য ও সম্ভ্রম রক্ষা পাইয়াছে। এই লিখন দ্বারা ইহাও প্রতিপন্ন হইতে পারে, নন্দকুমার হেস্টিংসেব নামে যে সকল অভিযোগ উপস্থিত করিয়াছিলেন, সে সমস্ত অমূলক নহে; আর, সুপ্রীম কোর্টের অবিচারে তাঁহার প্রাণদণ্ড না হইলে, তিনি সে সমুদায় সম্প্রমাণও করিয়া দিতেন, সেই ভয়েই হেস্টিংস ইম্পির সহিত পরামর্শ করিয়া, নন্দকুমারের প্রাণবধসাধন করেন।

মহম্মদ রেজা খাঁর পরীক্ষার ফলিতার্থের সংবাদ ইংলণ্ডে পঁহুছিলে, ডিক্টেরেরা কহিলেন, আমাদের বিলক্ষণ প্রতীতি জন্মিয়াছে যে, মহম্মদ রেজা খাঁ সম্পূর্ণ নিরপরাধ। অতএব, তাঁহারা, নবাবের সাংসারিক কর্ম হইতে গুরুদাসকে বহিষ্কৃত করিয়া, তৎপদে মহম্মদ রেজা থাকে নিযুক্ত করিতে আদেশপ্রদান করিলেন।

সুপ্রীম কৌন্সিলের সাহেবেরা দেখিলেন, তাঁহাদের এমন অবসর নাই যে, কলিকাতা সদর নিজামত আদালতে স্বয়ং অধ্যক্ষতা করিতে পারেন। এজন্য, পূর্বপ্রণালী অনুসারে, পুনর্বার ফৌজদারী আদালত ও পুলিসের ভার একজন দেশীয় লোকের হস্তে সমর্পিত করিতে মানস করিলেন। তদনুসারে ঐ আদালত কলিকাতা হইতে মুরশিদাবাদে নীত হইল, এবং মহম্মদ রেজা খাঁ তথাকার প্রধান পদে প্রতিষ্ঠিত হইলেন।

সপ্তম অধ্যায়

ক্রমে ক্রমে রাজস্বের বৃদ্ধি হইতে পারিবেক, এই অভিপ্রায়ে, ১৭৭২ সালে, পাঁচ বৎসরের নিমিত্ত, জমি সকল ইজারা দেওয়া হইয়াছিল। কিন্তু প্রথম বৎসরেই দৃষ্ট হইল, জমিদারেরা যত কর দিতে সমর্থ, তাহার অধিক ইজারা লইয়াছেন। খাজানা, ক্রমে ক্রমে, বিস্তর বাকী পড়িল। ফলতঃ, এই পাঁচ বৎসরে, এক কোটি আঠার লক্ষ টাকা রেহাই দিয়াও, ইজারাদারদিগের নিকট এক কোটি বিশ লক্ষ টাকা রাজস্ব বাকী রহিল; তন্মধ্যে অধিকাংশেরই আদায় হইবার সম্ভাবনা ছিল না। অতএব, কৌন্সিলের উভয় পক্ষীয়েরাই, নূতন বন্দোবস্তের নিমিত্ত, এক এক প্রণালী প্রস্তুত করিয়া পাঠাইলেন; কিন্তু ডিরেক্টরেরা উভয়ই অগ্রাহ্য করিলেন। ১৭৭৭ সালে পাট্টার মিয়াদ গত হইলে, ডিরেক্টরেরা, এক বৎসরের নিমিত্ত, ইজারা দিতে আজ্ঞা করিলেন। এইরূপ বৎসরে বৎসরে ইজারা দিবার নিয়ম, ১৭৮২ সাল পর্যন্ত, প্রবল ছিল।

১৭৭৬ সালে, সেপ্টেম্বর মাসে, কর্ণেল মন্সন সাহেবের মৃত্যু হইল; সুতরাং, তাঁহার

পক্ষের দুইজন মেম্বর অবশিষ্ট থাকাতে, হেষ্টিংস সাহেব কৌন্সিলে পুনর্বার ক্ষমতা প্রাপ্ত

হইলেন; কারণ, সমসংখ্যক স্থলে, গবর্ণর জেনেরলের মতই বলবৎ হইত।

১৭৭৮ সালের শেষ ভাগে, নবাব মুবারিকউদ্দৌলা, বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া, এই প্রার্থনায় কলিকাতার কৌন্সিলে পত্র লিখিলেন যে, মহম্মদ রেজা খাঁ আমার সহিত সর্বদা কর্কশ ব্যবহার করেন; অতএব, ইহাকে স্থানান্তরিত করা যায়। তদনুসারে, হেস্টিংস সাহেবের মতক্রমে, তাঁহাকে পদচ্যুত করিয়া, নায়েব সুবাদারের পদ রহিত করা গেল, এবং নবাবের রক্ষণাবেক্ষণ এবং আয় ও ব্যয়ের পর্যবেক্ষণ কার্যের ভার মণিবেগমের হস্তে অর্পিত হইল। ডিরেক্টরেরা এই বন্দোবস্তে সাতিশয় অসন্তুষ্ট হইলেন, এবং অতি ত্বরায় এই আদেশ পাঠাইলেন, নায়ের সুবাদারের পদ পুনর্বার স্থাপিত করিয়া, তাহাতে মহম্মদ রেজা থাঁকে নিযুক্ত ও মণিবেগমকে পদচ্যুত, করা যায়।

১৭৭৮ খৃঃ অব্দে, বাঙ্গালা অক্ষরে সর্বপ্রথম এক পুস্তক মুদ্রিত হয়। অসাধারণ বুদ্ধিশক্তি সম্পন্ন হালহেড সাহেব, সিবিল কর্মে নিযুক্ত হইয়া, ১৭৭০ খৃঃ অব্দে, এতদ্দেশে আসিয়া ভাষা শিক্ষা করিতে আরম্ভ করেন। তিনি যেরূপ শিক্ষা করিয়াছিলেন, পূর্বে কোনও যুরোপীয় সেরূপ শিখিতে পারেন নাই। ১৭৭২ খৃঃ অব্দে, রাজকার্যনির্বাহের ভার ঘুরোপীয় কর্মচারীদিগের হস্তে অর্পিত হইলে হেস্টিংস সাহেব বিবেচনা করিলেন, এতদ্দেশীয় ব্যবহারশাস্ত্রে তাঁহাদের জ্ঞান থাকা আবশ্যক। পরে, তদীয় আদেশে ও আনুকূল্যে, হালহেড নাহেব, হিন্দু ও মুসলমানদিগের সমুদয় ব্যবহারশাস্ত্র দৃষ্টে, ইংরেজী ভাষাতে এক গ্রন্থ সঙ্কলিত করেন। ঐ গ্রন্থ, ১৭৭৫ খৃঃ অব্দে, মুদ্রিত হয়। তিনি সাতিশয় পরিশ্রম সহকারে, বাঙ্গালা ভাষা শিখিয়াছিলেন; এবং বোধ হয়, ইংরেজদের মধ্যে, তিনিই প্রথমে এই ভাষায় বিশিষ্টরূপ ব্যুৎপন্ন হইয়াছিলেন। ১৭৭৮ খৃঃ অব্দে, তিনি বাঙ্গালাভাষায় এক ব্যাকরণ প্রস্তুত করেন। উহাই সর্বপ্রথম বাঙ্গালা ব্যাকরণ। তৎকালে রাজধানীতে ছাপার যন্ত্র ছিল না। উক্ত গ্রন্থ হুগলীতে মুদ্রিত হইল। বিখ্যাত চার্লস উইভিন্স সাহেব এদেশের নানা ভাষা শিখিতে আরম্ভ করেন। তিনি অতিশয় শিল্পদক্ষ ও বিলক্ষণ উৎসাহশালী ছিলেন। তিনিই সর্বাগ্রে, স্বহস্তে খুদিয়া ও ঢালিয়া, বাঙ্গালা অক্ষব প্রস্তুত করেন। ঐ অক্ষরে তাঁহার বন্ধু হালহেড সাহেবের ব্যাকরণ মুদ্রিত হয়।

সুপ্রীম কোর্ট নামক বিচাবালয়ের সহিত গবর্ণমেন্টের বিরোধ উপস্থিত হওয়াতে, অনেক বৎসর পর্যন্ত, দেশের পক্ষে অনেক অমঙ্গল ঘটিয়াছিল। ঐ বিচারালয়, ১৭৭৪ খৃঃ অব্দে, স্থাপিত হয়, কোম্পানির রাজশাসনের সহিত ইহার কোনও সম্পর্ক ছিল না। ভারতবর্ষে আসিবার সময়, জজদের এইরূপ দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, প্রজাদিগের উপব ঘোরতর অত্যাচার হইতেছে; সুপ্রীম কোর্ট তাহাদের ক্লেশনিবারণেব একমাত্র উপায়। তাঁহারা, চাঁদপাল ঘাটে, জাহাজ হইতে অবতীর্ণ হইয়া দেখিলেন, দেশীয় লোকেরা রিক্ত পদে গমনাগমন করিতেছে। তখন তাঁহাদের মধ্যে একজন কহিতে লাগিলেন, দেখ ভাই। প্রজাদের ক্লেশের পরিসীমা নাই; আবশ্যক না হইলে আর সুপ্রীম কোর্ট স্থাপিত হয় নাই। আমি সাহস করিয়া বলিতেছি, আমাদের কোর্ট ছয়মাস চলিলেই, এই হতভাগ্যদিগকে জুতা ও মোজা পরাইতে পারিব।

ব্রিটিশ সজেক্ট, অর্থাৎ ভারতবর্ষবাসী সমুদায ইংবেজ, ও মহারাষ্ট্র খাতের অন্তবর্তী সমস্ত লোক, ঐ কোর্টের এলাকার মধ্যে ছিলেন। আব ইহাও নির্দিষ্ট হইয়াছিল, যে সকল লোক, সাক্ষাৎ অথবা পরম্পরায, কোম্পানি অথবা ব্রিটিশ সব্জেক্টের কার্যে নিযুক্ত থাকিবেক। তাহারাও ঐ বিচারালয়ের অধীন হইবেক। সুপ্রীম কোর্টের জজেরা, এই বিধি অবলম্বন করিয়া, এতদ্দেশীয় দূরবর্তী লোকদিগের বিষয়েও হস্তক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহারা কহিতেন, যে সকল লোক কোম্পানিকে কর দেয়, তাহারাও কোম্পানির চাকর। পার্লিমেন্টের অত্যন্ত ত্রুটি হইয়াছিল যে, কোর্টের ক্ষমতার বিষয় স্পষ্টরূপে নির্ধারিত করিয়া দেন নাই। তাঁহারা, এক দেশের মধ্যে, পরস্পর নিরপেক্ষ অথচ পরস্পর প্রতীদ্বন্দ্বী, দুই পরাক্রম স্থাপিত করিয়া, সাতিশয় অবিবেচনার কার্য করিয়া- ছিলেন। এক্ষণে, উভয় পক্ষের পরস্পর বিবাদানল বিলক্ষণ প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল।

সুপ্রীম কোর্টের কার্যারম্ভ হইবামাত্র, তথাকার বিচারকেরা আপনাদের অধিকার বিস্তার করিতে আরম্ভ করিলেন। যদি কোনও ব্যক্তি, ঐ আদালতে গিয়া, শপথ করিয়া বলিত, অমুক জমিদার আমার টাকা ধারেন, তিনি শতক্রোশ দূরবর্তী হইলেও, তাঁহার নামে তৎক্ষণাৎ পরোয়ানা বাহির হইত, এবং কোন, ওজর না শুনিয়া, তাঁহাকে ধরিয়া আনিয়া জেলখানায় রাখা যাইত। পরিশেষে, আমি সুপ্রীম কোর্টের অধীন নহি, এই বাক্য বারংবার কহিলেই, সে ব্যক্তি অব্যাহতি পাইতেন; কিন্তু তাহাতে তাঁহার যে ক্ষতি ও অপমান হইত, তাহার কোনও প্রতিবিধান হইত না। এই কুরীতির দোষ, অল্পকাল মধ্যেই, প্রকাশ পাইতে লাগিল। যে সকল প্রজা ইচ্ছাপূর্বক কর দিত না; তাহারা, জমীদার ও তালুকদারদিগকে পূর্বোক্ত প্রকারে কলিকাতায় লইয়া যাইতে দেখিয়া, রাজস্ব দেওয়া একবারেই রহিত করিল। প্রথম বৎসর, সুপ্রীম কোর্টের জজেরা সকল জিলাতেই, এইরূপ পরোয়ানা পাঠায়াছিলেন। তদুষ্টে, দেশ মধ্যে, সমুদয় লোকেবই চিত্তে যৎপরোনান্তি হ্রাস ও উদ্বেগের সঞ্চার হইল। জমীদারেরা, এই ঘোরতর নূতন বিপদ উপস্থিত দেখিয়া, সাতিশয় শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন হইতে লাগিলেন। যে আইন অনুসারে, তাঁহারা বিচারার্থে কলিকাতায় আনীত হইতেন, তাঁহারা তাহার কিছুই জানিতেন না।

সুপ্রীম কোর্ট, ক্রমে ক্রমে, এরূপ ক্ষমতাবিস্তার করিতে লাগিলেন যে, তাহাতে রাজস্ব আদায়ের বিলক্ষণ ব্যাঘাত জন্মিতে লাগিল। তৎকালে রাজস্ব কার্যের ভার প্রবিন্সল কোর্ট অর্থাৎ প্রদেশীয় বিচারালয়ের প্রতি অর্পিত ছিল। পূর্বাবধি এই রীতি ছিল, জমিদারেরা করদান বিষয়ে অন্যথাচরণ করিলে, তাঁহাদিগকে কয়েদ করিয়া আদায় করা যাইত। এই পুরাতন নিয়ম, তৎকাল পর্যন্ত, প্রবল ও প্রচলিত ছিল। সুপ্রীম কোর্ট এবিষয়েও হস্তক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। করদানে অমনোযোগী ব্যক্তিরা এইরূপে কয়েদ হইলে, সকলে তাহাদিগকে সুপ্রীম কোর্টে আপীল করিতে পরামর্শ দিত। তাহারাও, আপীল করিবামাত্র, জামিন দিয়া খালাস পাইত। জমিদারেরা দেখিলেন, হুপ্রীম কোর্টে দরখাস্ত করিলেই, আর কয়েদ থাকিতে হয় না। অতএব, সকলেই কর দেওয়া রহিত করিলেন। এইরূপে রাজস্ব সংগ্রহ প্রায় এক প্রকার রহিত হইয়া আসিল।

সুপ্রীম কোর্ট ক্রমে সর্বপ্রকার বিষয়েই হস্তার্পণ করিতে লাগিলেন। মফঃসলের ভূমি সংক্রান্ত মোকদ্দমাও তথায় উপস্থিত হইতে লাগিল; এবং জজেরাও, জিলা আদালতে কোনও কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, ইচ্ছাক্রমে ডিক্রী দিতে ও হুকুম জারী করিতে লাগিলেন। পূর্বে, ইজারদার অঙ্গীকৃত কর দিতে অসম্মত হইলে, তাহার ইজারা বিক্রীত হইত। কিন্তু সে, নূতন ইজারাদারকে স্বপ্রীম কোর্টে আনিয়া, তাহার সর্বনাশ করিত। জমিদার কোনও বিষয় কিনিলে, যোত্রহীনেরা হুপ্রীম কোর্টে তাঁহার নামে নালিশ করিত, এবং তিনি আইন মতে বাজানা আদায় করিয়াছেন, এই অপরাধে, দণ্ডনীয় ও অবমানিত হইতেন।

স্বপ্রীম কোর্ট প্রদেশীয় ফৌজদারী আদালতের উপরেও ক্ষমতা প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিলেন। গবর্ণমেন্ট ঐ সকল আদালতের কার্য মুরশিদাবাদের নবাবের হস্তে রাখিয়া- ছিলেন। সুপ্রীম কোর্টের জজেরা কহিলেন, নবাব মুবারিকউদ্দৌলা সাক্ষিগোপাল মাত্র, সে কিসের রাজা, তাহার সমুদয় রাজ্য মধ্যে আমাদের অধিকার। নবাব ইংলণ্ডের অধিপতির অথবা ইংলণ্ডের আইনের অধীন ছিলেন না; তথাপি হুপ্রীম কোর্ট তাঁহার নামে পরোয়ানা জারী করা ন্যায্য বিবেচনা করিলেন। জজেরা স্পষ্টই বলিতেন, রাজশাসন অথবা রাজস্ব কার্যের সহিত যে যে বিষয়ের সম্পর্ক আছে, আমরা সে সমূদয়েরই কর্তা; যে ব্যক্তি আমাদের আজ্ঞালঙ্ঘন করিবেক, ইংলণ্ডের আইন অনুসারে, তাহার দণ্ডবিধান করিব। কোম্পানির কর্মচারীদিগের অবিচার ও অত্যাচার হইতে দেশীয় লোকদিগের পরিত্রাণ করিবার জন্য, এই বিচারালয় স্থাপিত হইয়াছে; এত অধিক ক্ষমতাবিশিষ্ট না হইলে, সে অভিপ্রায় সিদ্ধ হইতে পারে না। ফলতঃ সুপ্রীম কোর্টকে সর্বপ্রধান ও স্বপ্রীম গবর্ণমেন্টকে অকিঞ্চিৎকর করাই তাঁহাদের মুখ্য উদ্দ্যে হইয়া উঠিয়াছিল।

উপরি লিখিত বিষয়ের উদাহরণস্বরূপ একটি দেওয়ানী ও একটি ফৌজদারী মোকদ্দমা উল্লিখিত হইতেছে।

পাটনানিবাসী এক ধনবান মুসলমান, আপন পত্নী ও ভ্রাতৃপুত্র রাখিয়া, পরলোক যাত্রা করেন। এইরূপ জনরব হইয়াছিল যে, ধনী ভ্রাতৃপুত্রকে দত্তকপুত্র করিয়া যান। ধনীর পত্নী ও ভ্রাতৃপুত্র উভয়ে, ধনাধিকার বিষয়ে বিবদমান হইয়া, পাটনার প্রবিন্সল কোর্টে মোকদ্দমার উপস্থিত করেন। জজেরা, কার্যনির্বাহের প্রচলিত রীতি অনুসারে, কাজী ও মুফতীকে ভার দেন যে, তাঁহারা, সাক্ষীর জবানবন্দী লইয়া, মুসলমানদিগের সরা অনুসারে, মোকদ্দমার নিষ্পত্তি করেন। তদনুসারে, তাঁহারা অনুসন্ধান দ্বারা, অবগত হইলেন, বাদী ও প্রতিবাদী যে সকল দলীল দেখায়, সে সমুদায় জাল; তাহাদের এক ব্যক্তিও প্রকৃত উত্তরাধিকারী নহে। সুতরাং ঐ সম্পত্তি বিভাগ সরা অনুসারে করা আবশ্যক। তাঁহারা, তদীয় সমস্ত ধনের চতুর্থ অংশ তাঁহার পত্নীকে দিয়া, অবশিষ্ট বার আনা তাঁহার ভ্রাতাকে দিলেন। এই ভ্রাতার পুত্রকে ধনী দত্তক করিয়া যান।

ঐ অবীরা সুপ্রীম কোর্টে আপীল করিল। এই মোকদ্দমা যে স্পষ্টই সুপ্রীম কোর্টের এলাকার বহির্ভুত, ইহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু জজেরা, আপনাদের অধিকারভুক্ত করিবার নিমিত্ত, কহিলেন, মৃত ব্যক্তি সরকারী জমা রাখিত, সুতরাং সে কোম্পানির কর্মকারক; সমুদয় সরকারী কর্মকারকের উপর আমাদের অধিকার আছে। তাঁহারা ইহাও কহিলেন, ইংলণ্ডের আইন অনুসারে, পাটনার প্রবিন্সল জজদিগের এরূপ ক্ষমতা নাই যে, তাঁহারা কোনও মোকদ্দমা, নিষ্পত্তি করিবার নিমিত্ত, কাহাকেও সোপর্দ করিতে পারেন। অতএব তাঁহারা স্থির করিলেন, এই মোকদ্দমার সানি তজবীজ আবঞ্চক। পরে,

তাঁহাদের বিচারে ঐ অর্থীরার পক্ষে জয় হইল, এবং সে তিন লক্ষ টাকা পাইল। তাঁহারা এই পর্যন্ত করিয়াই ক্ষান্ত হইলেন, এমন নহে; কাজী, মুফতী, ও ধনীব ভ্রাতৃ- পুত্রকে গ্রেপ্তার করিবার নিমিত্ত, একজন সারজন পাঠাইলেন; কহিয়া দিলেন যদি চারি লক্ষ টাকার জামীন দিতে পারে, তবেই ছাড়িবে, নতুবা গ্রেপ্তার করিয়া আনিবে। কাজী আপন কাছাবী হইতে বাটী যাইতেছেন, এমন সময়ে, সুপ্রীম কোর্টের লোক, তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিল।

এইরূপ ব্যাপার দর্শনে প্রজাদের অন্তঃকরণে অবশ্যই বিরুদ্ধ ভাব জন্মিতে পারে; এই নিমিত্ত, প্রবিন্সল কোর্টের জজেরা অতিশয় ব্যাকুল ও উদ্বিগ্ন হইলেন। তাঁহারা দেখিলেন, গবর্ণমেন্টের ক্ষমতা লোপ পাইল, এবং রাজকার্যনির্বাহ একবারেই রহিত হইল। অনন্তর, আব অধিক অনিষ্ট না ঘটে, এজন্য তাঁহারা তৎকালে কাজীব জামীন হইলেন।

যে যে ব্যক্তি, প্রবিন্সণ কোর্টেব হুকুম অনুসাবে, ঐ মোকদ্দমার বিচাব কবিয়াছিলেন, সুপ্রীম কোর্ট তাঁহাদের সকলকেই অপরাধী কবিলেন, এবং, সকলকেই রুদ্ধ কবিয়া আনিবাব নিমিত্ত, সিপাই পাঠাইয়া দিলেন কাজী বৃদ্ধ হইয়াছিলেন, কলিকাতায় আসিবার কালে, পথি মধ্যে তাঁহার মৃত্যু হইল। মুফতীও অন্যূন চারি বৎসর জেলে থাকিলেন; পবিশেষে পার্লিমেন্টের আদেশ অনুসাবে, মুক্তি পাইলেন। তাঁহাদের অপবাধ এই, তাঁহারা আপন কর্তব্য কর্মের সম্পাদন কবিয়াছিলেন।

জজেবা, ইহাতে অসন্তুষ্ট হইয়া, প্রবিন্সল কোর্টের জজেব নামেও সুপ্রীম কোর্টে নালিশ উপস্থিত কবিযা, তাঁহাব ১৫০০০ টাকা দণ্ড করিলেন। ঐ টাকা কোম্পানিব ধনাগাব

হইতে দত্ত হইল।

সুপ্রীম কোর্টের জজেবা, ফৌজদারী মোকদ্দমার নিষ্পত্তি বিষযে, যেকপে হস্তার্পণ করিয়া-

ছিলেন; নিম্নলিখিত বৃত্তান্ত তাহার এক উত্তম দৃষ্টান্ত। শুপ্রীম কোর্টের এক ঘুরোপীয় উকীল ঢাকায় থাকিতেন। একজন সামাহ্য পেয়াদা কোনও কুকর্ম করাতে, ঐ নগরেব ফৌজদাবী আদালতে তাহার নামে নালিশ হয়। তাহার দোষ সপ্রমাণ হইলে, এই আদেশ হইল, সে ব্যক্তি যাবৎ না আত্মদোষের ক্ষালন করে, তাবৎ তাহাবে কারাগারে

রুদ্ধ থাকিতে হইবেক।

সকলে, তাহাকে পরামর্শ দিয়া, সুপ্রীম কোর্টে দরখাস্ত করাইল। অনন্তর, পেয়াদাকে অকারণে রুদ্ধ করিয়াছে, এই সূত্র ধরিয়া, শুপ্রীম কোর্টের একজন জজ, ফৌজদারী আদালতের দেওয়ানকে কয়েদ করিয়া আনিবার নিমিত্ত, পরোয়ানা বাহির করিলেন। ফৌজদার, আপন বন্ধুবর্গ ও আদালতের আমলাগণ লইয়া, বসিয়া আছেন, এমন সময়ে পূর্বোক্ত ঘুরোপীয় উকীল একজন বাঙ্গালিকে তাঁহার বাটীতে পাঠাইয়া দিলেন। সে ব্যক্তি, বাটীতে প্রবেশপূর্বক, তাঁহার দেওয়ানকে কয়েদ করিবার উপক্রম করিল; কিন্তু, সকলে প্রতিবাদী হওয়ায়, তাহাকে আপন মনিবের নিকট ফিরিয়া যাইতে হইল। উকীল, এই বৃত্তান্ত শুনিবামাত্র, কতকগুলি অস্ত্রধারী পুরুষ সঙ্গে লইয়া, বলপূর্বক ফৌজদারের বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিবার উত্তম করিলেন। সেই বাটীতে ফৌজদারের পরিবার থাকিত, এজন্য তিনি তাহাদিগকে প্রবেশ করিতে দিলেন না। তাহাতে ভয়ানক দাঙ্গা উপস্থিত হইল। উকীলের একজন অনুচর ফৌজদারের পিতার মস্তকে আঘাত করিল; এবং উকীলও নিজে, এক পিস্তল বাহির করিয়া, ফৌজদারেব সম্বন্ধীকে গুলি করিলেন। কিন্তু, দৈবযোগে, তাহা মারাত্মক হইল না। সুপ্রীম কোর্টের জজ হাউড সাহেব, এই ব্যাপার গুনিয়া, তৎক্ষণাৎ ঢাকার সৈন্যাধ্যক্ষকে লিখিয়া পাঠাইলেন, আপনি উকীলের সাহায্য করিবেন; আব ইহাও লিখিলেন, আপনি উকীলকে জানাইবেন, তিনি যে কর্ম করিয়াছেন, তাহাতে আমাদের যথেষ্ট তুমি জন্মিয়াছে সুপ্রীম কোর্টে, তাঁহার যথোচিত সহায়তা কবিবেন। ঢাকার প্রবিন্সল কৌন্সিলের সাহেবেরা গবর্ণর জেনেরল বাহাদুরকে পত্র লিখিলেন, ফৌজদারী আদালতের সমুন্বয় কার্য এককালে স্থগিত হইল; এরূপ অত্যাচারের পর, সবকারী কর্মের নির্বাহ কবিতে আর লোক পাওয়া দুষ্কর হইবেক। গবর্ণব জেনেবল ও কৌন্সিলের মেম্বরেরা দেখিলেন, স্বপ্রীম কোর্ট হইতেই গবর্ণমেন্টের সমুদয় ক্ষমতা লোপ পাইল। কিন্তু, কোনও প্রকারে, তাঁহাদের সাহস হইল না যে, কোনও প্রতিবিধান করেন। জজেরা বলিতেন, আমরা ইংলণ্ডেশ্বরের নিযুক্ত; কোম্পানিব সমূদয় কর্মকারক অপেক্ষা আমাদের ক্ষমতা অনেক অধিক; যে সকল ব্যক্তি আমাদের আজ্ঞালঙ্ঘন করিবেক, তাহাদিগকে রাজবিদ্রোহীর দণ্ড দিব। যাহা হউক, পরিশেষে এমন এক বিষয় ঘটিয়া উঠিল যে, উভয় পক্ষকেই পরম্পর স্পষ্ট বিবাদে প্রবৃত্ত হইতে হইল।

কাশিজোড়ার রাজার কলিকাতাস্থ কর্মাধ্যক্ষ কাশীনাথবাবু, ১৭৭১ সালের ১৩ই আগষ্ট, রাজার নামে স্বপ্রীম কোর্টে এক মোকদ্দমা উপস্থিত করিলেন। তাহাতে রাজার উপর এক পরোয়ানা বাহির হইল এবং তিন লক্ষ টাকার জামিন চাহা গেল। সেই পরোয়ানা এড়াইবার নিমিত্ত, বাজা অন্তর্হিত হওয়াতে, উহা জারী না হইয়া ফিরিয়া আসিল। তদনন্তর, তাঁহার স্থাবর অস্থাবর সমুদয় সম্পত্তি ক্রোক করিবার জন্ত, আর এক পূরোহানা বাহির হইল। সরিফ সাহেব, ঐ ব্যাপারের সমাধা করিবার নিমিত্ত, একজন সারজন ও যাটিজন অস্ত্রধারী পুরুষ পাঠাইয়া দিলেন।

রাজা গবর্ণমেন্টে আবেদন করিলেন, সুপ্রীম কোর্টের লোকেরা আসিয়া আমার লোক জনকে প্রহার ও আঘাত করিয়াছে, বাড়ী ভাঙ্গিয়াছে, অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়াছে, "জিনিসপত্র লুঠ করিয়াছে, দেবালয় অপবিত্র করিয়াছে, দেবতার অঙ্গ হইতে আভরণ খুলিয়া লইয়াছে, খাজানা আদায় বন্ধ করিয়াছে, এবং রাইতদিগকে খাজনা দিতে মানা করিয়াছে।

গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর কৌন্সিলের বৈঠকে এই নিধার্য করিলেন, অতঃপর সতর্ক হওয়া উচিত; এমন সকল বিষয়েও ক্ষান্ত থাকিলে, রাজশাসনের এককালে লোপাপত্তি হয়; অনন্তর, রাজাকে স্বপ্রীম কোর্টের আজ্ঞাপ্রতিপালন করিতে নিষেধ করিয়া, তিনি মেদিনীপুরের সেনাপতিকে এই আজ্ঞাপত্র লিখিলেন, তুমি সরিফের লোক সকল আটক কবিবে। এই আজ্ঞা পহুছিতে অধিক বিলম্ব হওয়ায়, তাহাদের দৌরাত্ম্য ও বাজার বাটীলুঠের নিবারণ হইতে পারিল না; কিন্তু ফিরিয়া আসিবার কালে সকলে কযেদ হইল।

সেই সময়ে গবর্ণব জেনেরল এরূপ আদেশও কবিলেন যে, যে সমুদয জমিদার, তালুকদার ও চৌধুবী ব্রিটিশ সবজেক্ট অথবা বিশেষ নিয়মে আবদ্ধ নহেন, তাঁহারা যেন হুপ্রীম কোর্টের আজ্ঞাপ্রতিপালন না করেন; আর, প্রদেশীষ সেনাধ্যক্ষদিগকে নিষেধ করিলেন, আপনাবা সৈন্ন্য দ্বারা হুপ্রীম কোর্টের সাহায্য কবিবেন না।

সারজন ও তাঁহাদেব সঙ্গী লোকদিগেব কয়েদ হইবার সংবাদ সুপ্রীম কোর্টে পহুছিবামাত্র, জজেরা, অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া, প্রথমতঃ কোম্পানির উকীলকে, তুমি সংবাদ দিয়াছ, তাহাতেই আমাদের লোক সকল কয়েদ হইল, এই বলিয়া জেলখানায় পুরিয়া চাবি দিয়া বাখিলেন। পরিশেষে, গবর্ণর জেনেরল ও কৌন্সিলের মেম্বরদিগেব নামেও এই বলিযা সমন কবিলেন যে, আপনারা কাশীনাথবাবুর মোকদ্দমা উপলক্ষে, সুপ্রীম, কোর্টের লোকদিগকে রুদ্ধ করিয়া, কোর্টের হুকুম অমান্য করিয়াছেন। কিন্তু হেস্ট্রিংস সাহেব স্পষ্ট উত্তর দিলেন, আমরা, আপন পদের ক্ষমতা অনুসারে, যে কর্ম করিয়াছি, সে বিষয়ে সুপ্রীম কোর্টের হুকুম মান্ত করিব না। এই ব্যাপার ১৭৮০ সালের মার্চ মাসে ঘটে।

এই সময়ে কলিকাতাবাসী সমুদয় ইংরেজ ও স্বয়ং গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর সুপ্রীম কোর্টের অত্যাচার হইতে পরিত্রাণ পাইবার প্রার্থনায়, পার্লিমেন্টে এক আবেদন পত্র পাঠাইলেন। এ বিষয়ে বিশেষ বিবেচনা হইয়া, নূতন আইন জারী হইল। তাহাতে, হুপ্রীম কোর্টের জজেরা, সমস্ত দেশের উপর কর্তৃত্ব চালাইবার নিমিত্ত, যে ঔদ্ধত্য করিবেন, তাহা রহিত হইয়া গেল।

এই আইন জারী হইবার পূর্বেই, হেস্টিংস সাহেব জজদিগের বদনে মধু দান করিয়া, সুপ্রীম কোর্টকে ঠাণ্ডা করিয়াছিলেন। তিনি চীফ জষ্টিস সর ইলাইজা ইম্পি সাহেবকে, মাসিক ৫০০০ টাকা বেতন দিয়া, সদর দেওয়ানী আদালতের প্রধান জজ করেন, এবং আফিসের ভাড়া বলিয়া, মাসে ৬০০ টাকা দিতে আরম্ভ করেন; আর, একজন ছোট জজকে, চুঁচুড়ায় এক নূতন কর্ম দিয়া, বড় মানুষ করিয়া দেন। ইহার পর কিছুকাল, সুপ্রীম কোর্টের কোনও অত্যাচার শুনিতে পাওয়া যায় নাই।

এই সময়ে, হেষ্টিংস সাহেব, দেশীয় বিচারালয়ের অনেক সুধারা করিলেন, দেওয়ানী মোকদ্দমা শুনিবার নিমিত্ত, নানা জিলাতে দেওয়ানী আদালত স্থাপিত করিলেন; প্রবিন্সল কোর্টে কেবল রাজস্ব সংক্রান্ত কার্যের ভার রাখিলেন। চীফ জমিস, সদর দেওয়ানী আদালতের কর্মে বসিযা, জিলা আদালতের কর্মনির্বাহার্থে কতকগুলি আইন প্রস্তুত করিলেন। এইরূপে, ক্রমে ক্রমে, নব্বইটি আইন প্রস্তুত হয়। ঐ মূল অবলম্বন করিয়াই, কিয়ৎকাল পবে, লার্ড কর্ণওয়ালিস দেওয়ানী আইন প্রস্তুত করেন।

সর ইলাইজা ইম্পি সাহেবের সদর দেওয়ানীতে কর্মস্বীকাবের সংবাদ ইংলণ্ডে পহুছিলে, ডিবেক্টবেরা, অত্যন্ত অসন্তোষ প্রদর্শণপূর্বক, ঐ বিষয় অস্বীকার করিলেন। কিন্তু তাঁহারা বুঝিতে পারিলেন, হেস্টিংস, কেবল শান্তিরক্ষার্থেই, তদ্বিষয়ে সম্মত হইয়াছে। রাজমন্ত্রীরাও, সদর দেওয়ানীতে কর্ম স্বীকাব কবিয়াছেন বলিয়া, সর ইলাইজা ইম্পি সাহেবকে, কর্ম পবিত্যাগ করিয়া, ইংলণ্ডে প্রতিগমন করিতে আদেশ দিলেন, এবং তিনি পূর্বোক্ত কর্ম স্বীকার করিয়াছিলেন বলিয়া, তাহাব নামে অভিযোগ উপস্থিত করিলেন। সর গিলবর্ট এলিয়ট সাহেব তাঁহাব অভিযোক্তা নিযুক্ত হইলেন। ইনিই, কিছুকাল পরে, লার্ড মিন্টো নামে, ভারতবর্ষের গবর্ণর জেনেবল হইয়াছিলেন। ১৭৮০ সালের ১৯শে জানুযারি, কলিকাতায় এক সংবাদপত্র প্রচারিত হইল; তৎপূর্বে

ভারতবর্ষে উহা কখনও দৃষ্ট হয় নাই।

হেস্টিংস সাহেব, ইহার পর চারি বৎসব, বাঙ্গালার কার্য হইতে অবস্থত হইয়া, বারাণসী ও অযোধ্যার রাজকার্যের বন্দোবস্ত, মহীশুরের রাজা হায়দার আলির সহিত যুদ্ধ, ভারতবর্ষের সমুদয় প্রদেশে সন্ধি স্থাপন, ইত্যাদি কার্যেই অধিকাংশ ব্যাপৃত রহিলেন। তিনি অযোধ্যা ও বারাণসীতে সে সমস্ত ঘোরতর অত্যাচার করিয়াছিলেন, সে সমুদয় প্রচারিত হওয়াতে, ইংলণ্ডে তাঁহাকে পদচ্যুত করিবার প্রস্তাব হইয়াছিল। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধ্যক্ষগণের সম্মতি না হওয়াতে, তিনি স্বপদেই থাকিলেন। হেস্টিংস, ১০৮৪ সালের শেষ ভাগে, আর একবার অযোধ্যাযাত্রা করিলেন। ১৭৮৫ সালের আরস্তে, তথা হইতে প্রত্যাগমন করিয়া, তিনি আপন পদের উত্তরাধিকারী মেকফর্সন সব, হস্তে ত্রেজরি ও ফোর্ট উইলিয়মের চাবি সমর্পণ করিলেন, এবং, জাহাজে আরোহণ করিয়া, জুন মাসে, ইংলণ্ডে উপস্থিত হইলেন।

১৭৮৪ সালে, এই দেশের পরম হিতকারী ক্লীবলও সাহেবের মৃত্যু হয়। তিনি, অতি অল্প বয়সে, সিবিল কর্মে নিযুক্ত হইয়া, ভারতবর্ষে আইসেন। পঁহুছিবার পরেই, ভাগলপুর অঞ্চলের সমস্ত রাজকার্যের ভার তাঁহার হস্তে সমর্পিত হয়। এই প্রদেশের দক্ষিণ অংশে এক পর্বতশ্রেণী আছে, তাহার অধিত্যকাতে অসভ্য পুলিন্দজাতিরা বাস করিত। সন্নিকৃষ্ট জাতিরা সর্বদাই তাহাদের উপর অত্যাচার করিত; তাহারাও, সময়ে সময়ে পর্বত হইতে অবতীর্ণ হইয়া, অত্যাচারীদিগের সর্বস্ব লুণ্ঠন করিত। ক্লীবলণ্ড, তাহাদের অবস্থার সংশোধন বিষয়ে, নিরতিশয় যত্নবান হইয়াছিলেন; এবং যাহাতে তাহারা সুখী হইতে পারে, সাধ্যানুসারে তাহার চেষ্টা করিতে ত্রুটি করেন নাই। তাঁহার এই প্রয়াস সম্পূর্ণরূপে সফল হইয়াছিল। ক্রমে তাঁহার অধীনস্থ সমস্ত" প্রদেশের অবস্থার পবিবর্তন হইল; পার্বতীয় অসভ্য পুলিন্দজাতিরাও, সভ্য জাতির ন্যায়, শান্ত স্বভাব হইয়া উঠিল।

আবাদ না থাকাতে, ঐ প্রদেশেব জলবায়ু অতিশয় পীডাকর ছিল। তাহাতে ক্লীবলগু সাহেব, শারীরিক অত্যন্ত অসুস্থ হইযা, স্বাস্থালাভেব প্রত্যাশায়, সমুদ্রযাত্রা করিলেন। তথায় তাঁহার মৃত্যু হইল। মৃত্যুকালে তাঁহাব উনত্রিংশ বৎসর মাত্র বয়ঃক্রম ছিল। ডিরেক্টবেবা তদীয় সদগুণে এমন প্রীত ছিলেন যে, তাঁহার স্মরণার্থে সমাধিস্তন্ত নির্মাণের আদেশ প্রদান করিলেন। তিনি যে অসভ্য অকিঞ্চন পার্বতীয়দিগকে সভ্য করিয়াছিলেন, তাহারাও অনুমতি লইযা, তদীয় গুণগ্রামের চিরস্মরণীয় তাসম্পাদনার্থে, এক কীর্তিস্তম্ভ নির্মিত করিল। এতদ্দেশীয় লোকেরা, ইহার পূর্বে, আব কখনও, কোন মুরোপীয়েব স্মবণার্থে, কীতিস্তম্ভ নির্মিত করেন নাই।

১৭৮৩ সালে, সর উইলিয়ম জোন্স, সুপ্রীম কোর্টের জজ হইয়া, এতদ্দেশে আগমন করেন। তিনি, বিদ্যাহীলন দ্বারা, স্বদেশে বিলক্ষণ খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার ভারতবর্ষে আসিবার মুখ্য অভিপ্রায় এই যে, তিনি এতদ্দেশের আচার, ব্যবহার, পুরাবৃত্ত, ও ধর্ম বিষয়ে বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিতে পারিবেন। তিনি, এদেশে আসিয়াই, সংস্কৃত ভাষার অনুশীলন করিতে আরম্ভ কবিলেন। কিন্তু পডাইবার নিমিত্ত পণ্ডিত পাওয়া দুর্ঘট হইয়া উঠিল। তৎকালীন ব্রাহ্মণপণ্ডিতেরা স্নেচ্ছজাতিকে পবিত্র সংস্কৃত ভাষা অথবা শাস্ত্রীয় বিষয়ে উপদেশ দিতে সম্মত হইতেন না। অনেক অনুসন্ধানের পর, একজন উত্তম সংস্কৃত বৈদ্য, মাসিক পাঁচ শত টাকা বেতনে, তাঁহাকে সংস্কৃত ভাষা শিখাইতে সম্মত হইলেন। সর উইলিয়ম জোন্স, স্বল্প দিনেই, উক্ত ভাষায় এমন ব্যুৎপন্ন হইয়া উঠিলেন যে, অনায়াসে, ইংরেজীতে শকুন্তলা নাটকের ও মনুসংহিতার অনুবাদ করিতে পারিলেন।

তিনি, ১৭৮৪ সালে, ভারতবর্ষের পূর্বকালীন আচার, ব্যবহার, রীতি, নীতি, ভাষা, শাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ের অনুসন্ধানের অভিপ্রায়ে, কলিকাতায় এসিয়াটিক সোসাইটি নামক এক সভা স্থাপিত করিলেন। যে সকল লোক, এ বিষয়ে, তাঁহার ন্যায়, একান্ত অনুরক্ত ছিলেন, তাঁহারা এই সোসাইটির মেম্বর হইলেন। হেস্টিংস সাহেব এই সভার প্রথম অধিপতি হয়েন, এবং, প্রগাঢ় অনুরাগ সহকারে, সভার সভ্যগণের উৎসাহর্ধন করেন। সর উইলিয়ম জোন্সের তুল্য সর্বগুণাকর ইংরেজ এ পর্যন্ত ভারতবর্ষে আইসেন নাই। তিনি, এতদ্দেশে, দশ বৎসর বাস করিয়া, ঊনপঞ্চাশ বর্ষ বয়ঃক্রমে, পরলোক- যাত্রা করেন।

১৭৮৩ সালে, কোম্পানির কার্যনির্বাহক প্রণালী পার্লিমেন্টের গোচর হইলে, প্রধান অমাত্য ফক্স সাহেব, ভারতবর্ষীয় রাজশাসন বিষয়ে, এক নূতন প্রণালী প্রস্তুত করিলেন। ঐ প্রণালী স্বীকৃতি হইলে, ভারতবর্ষে কোম্পানির কোনও সংস্রব থাকিত না। কিন্তু ইংলণ্ডেশ্বর তাহাতে সম্মত হইলেন না। প্রধান অমাত্য ফক্স সাহেব পদচ্যুত হইলেন। উইলিয়ম পিট সাহেব, তাঁহার পরিবর্তে, প্রধান মন্ত্রীর পদে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। তৎকালে তাঁহার বয়ঃক্রম চব্বিশ বৎসর মাত্র। কিন্তু তিনি, রাজকার্য নির্বাহ বিষয়ে, অসাধারণ ক্ষমতাপন্ন ছিলেন। তিনি এতদ্দেশীয় রাজশাসনের এক নূতন প্রণালী প্রস্তুত করিলেন। ঐ প্রণালী, পার্লিমেন্টে ও রাজসমীপে, উভয়ত্রই স্বীকৃত হইল।

এ পর্যন্ত, ডিরেক্টরেরাই এতদ্দেশীয় সমস্ত কার্যের নির্বাহ কবিতেন। রাজমন্ত্রীরা কোনও বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতেন না। কিন্তু, ১৭৮৪ সালে, পিট সাহেবের প্রণালী প্রচলিত হইলে, ভারতবর্ষীয় সমস্ত বিষয়ের পর্যবেক্ষণ নিমিত্ত, বোর্ড অব কন্ট্রোল নামে এক সমাজ স্থাপিত হইল। রাজা স্বয়ং এই বোর্ডের সমুদয় মেম্বর নিযুক্ত কবিতেন। কোম্পানির বাণিজ্য ভিন্ন, ভারতবর্ষীয় সমস্ত বিষয়েই তাঁহাদের হস্তার্পণের অধিকার হইল।

অষ্টম অধ্যায়

হেস্টিংস সাহেব মেকফর্সন সাহেবের হস্তে গবর্ণমেন্টের ভারার্পণ করিয়া যান। ডিরেক্টরেরা, তাঁহার প্রস্থান সংবাদ অবগত হইবামাত্র, লার্ড কর্ণওয়ালিস সাহেবকে, গবর্ণর জেনেরল ও কমাণ্ডর ইন চীফ, উভয় পদে নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন। কর্ণওয়ালিস পুরুষামুক্রমে বড় মানুষের সন্তান, ঐশ্বর্যশালী, ও অসাধারণ বুদ্ধিশক্তিসম্পন্ন ছিলেন; এবং পৃথিবীর নানাস্থানে নানা প্রধান প্রধান কর্ম করিয়া, সকল বিষয়েই বিশেষরূপ পারদর্শী হইয়াছিলেন।

তিনি, ১৭৮৬ খৃঃ অব্দে, ভারতবর্ষে পঁহুছিলেন। যে সকল বিবাদ উপস্থিত থাকাতে, হেষ্টিংস সাহেবের শাসন অতিশয় বিশৃঙ্খল হইয়া গিয়াছিল, লার্ড কর্ণওয়ালিসের নামে ও প্রবল প্রতাপে, সে সমৃদয়ের সত্বর নিষ্পত্তি হইল। তিনি, সাত বৎসর নির্বিবাদে, রাজশাসন কার্য সম্পন্ন করিলেন; অনন্তর, মহীশূরের অধিপতি হায়দর আলির পুত্র টিপু স্থলতানের সহিত যুদ্ধ করিয়া, তাঁহার গর্ব খর্ব করিলেন; পরিশেষে সুলতানের প্রার্থনায়, তাঁহার রাজ্যের অনেক অংশ ও যুদ্ধের সমুদয় ব্যয় লইয়া, সন্ধি স্থাপন করিলেন।

লার্ড কর্ণওয়ালিস, বাঙ্গালা ও বিহারের রাজস্ব বিষয়ে, যে বন্দোবস্ত করেন, তাহা দ্বারাই ভারতবর্ষে তাঁহার নাম বিশেষ বিখ্যাত হইয়াছে। ডিরেক্টরেরা দেখিলেন, রাজস্ব -সংগ্রহ বিষয়ে নিত্য নূতন বন্দোবস্ত করাতে, দেশের পক্ষে অনেক অপকার হইতেছে; তাঁহারা বোধ করিলেন, প্রায় ত্রিশ বৎসর হইল, আমরা দেওয়ানী পাইয়াছি, এতদিনে আমাদের ঘুরোপীয় কর্মচারীরা, অবশ্যই, ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ের সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়াছেন। তাঁহারা বিবেচনা করিয়া স্থির করিলেন, রাজা ও প্রজা উভয়েরই হানিকর না হয়, এমন কোনও দীর্ঘকাল স্থায়ী ন্যায্য বন্দোবস্ত করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে। তাঁহাদের নিতান্ত বাসনা হইয়াছিল, চিরকালের নিমিত্ত একবিধ রাজস্ব নির্ধারিত হয়। কিন্তু লার্ড কর্ণওয়ালিস দেখিলেন, তৎকাল পর্যন্ত, এ বিষয়ের কিছুই নিশ্চিন্ত জানিতে পারা যায় নাই; অতএব, অগত্যা, পূর্ব প্রচলিত বার্ষিক বন্দোবস্তুই আপাততঃ বজায় রাখিলেন।

ঐ সময়ে তিনি, কতকগুলি প্রশ্ন প্রস্তুত করিয়া, এই আভপ্রায়ে কালেক্টর সাহেবদিগের নিকট পাঠাইয়া দিলেন যে, তাঁহারা ঐ সকল প্রশ্নের যে উত্তর লিখিবেন, তন্দ্বারা ভূমির রাজস্ব বিষয়ের নিগূঢ় তত্ত্ব অবগত হইতে পারিবেন। তাঁহারা যে বিজ্ঞাপনী দিলেন, তাহা অতি অকিঞ্চিৎকর; অতি অকিঞ্চিৎকর বটে; কিন্তু, তৎকালে, তদপেক্ষায় উত্তম পাইবার কোনও আশা ছিল না। অতএব, কর্ণওয়ালিস, আপাততঃ দশ বৎসরের নিমিত্ত বন্দোবস্ত করিয়া, এই ঘোষণা করিলেন, যদি ডিরেক্টরেরা স্বীকার করেন, তবে ইহাই চিরস্থায়ী করা যাইবেক। অনন্তর, বিখ্যাত সিবিল সরবেন্ট জন শোর সাহেবের প্রতি, রাজস্ব বিষয়ে, এক নূতন প্রণালী প্রস্তুত করিবার ভার অর্পিত হইল। তিনি উক্ত বিষয়ে সবিশেষ অভিজ্ঞ ও নিপুণ ছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিষয়ে তাঁহার নিজের মত ছিল না; তথাপি তিনি ঐ বিষয়ে গবর্ণমেন্টের যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছিলেন। এই দশসালা বন্দোবস্তে ইহাই নির্ধারিত হইল, এ পর্যন্ত যে সকল জমিদার কেবল রাজস্ব সংগ্রহ করিতেছেন; অতঃপর তাঁহারাই ভূমির স্বামী হইবেন; প্রজারা তাঁহাদের সহিত রাজস্বের বন্দোবস্ত করিবেক।

দেশীয় কর্মচারীরা রাজস্ব সংক্রান্ত প্রায় সমুদায় পুরাতন কাগজপত্র নষ্ট করিয়াছিল; অবশিষ্ট যাহা পাওয়া গেল, সমূদয়ের পরীক্ষা করিয়া এবং ইতিপূর্বে কয়েক বৎসরে যাহা আদায় হইয়াছিল, তাহার গড় ধরিয়া, কর নির্ধারিত করা গেল। গবর্ণমেন্ট এরূপও ঘোষণা করিয়া দিলেন, নিষ্কর ভূমির সহিত এ বন্দোবস্তের কোনও সম্পর্ক নাই; কিন্তু আদালতে ঐ সকল ভূমির দলীলের পরীক্ষা করা যাইবেক; যে সকল ভূমির দলীল অকৃত্রিম হইবেক; সে সমুদয় বাহাল থাকিবেক; আর কৃত্রিম বোধ হইলে, তাহা বাতিল করিয়া, ভূমি সকল বাজেয়াপ্ত করা যাইবেক।

এই সমুদয় প্রণালী ডিরেক্টরদিগের সমাজে সমর্পিত হইলে, তাঁহারা তাহাতে সম্মত হইলেন এবং ঐ বন্দোবস্তুই নির্ধারিত ও চিরস্থায়ী করিবার নিমিত্ত, কর্ণওয়ালিস সাহেবকে অনুমতি দিলেন। তদনুসারে, ১৭৯৩ সালের ২২শে মার্চ, এই বিজ্ঞাপন দেওয়া গেল যে, বাঙ্গালা ও বিহারের রাজস্ব ৩১০৮৯১৫০ টাকা ও বারণসীর রাজস্ব ৪০০০৬১৫ টাকা, চিরকালের নিমিত্ত নির্ধারিত হইল।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়াতে, বাঙ্গালা দেশের যে সবিশেষ উপকার দর্শিয়াছে, ইহাতে কোনও সন্দেহ নাই। এরূপ না হইয়া, যদি, পূর্বের ন্যায় রাজস্ব বিষয়ে নিত্য নূতন পরিবর্তের প্রথা প্রচলিত থাকিত, তাহা হইলে, এদেশের কখনই মঙ্গল হইত না। কিন্তু ইহাতে দুই অমঙ্গল ঘটিয়াছে; প্রথম এই যে ভূমি ও ভূমির মূল্য নিশ্চিত না জানিয়া বন্দোবস্ত করা হইয়াছে; তাহাতে কোনও কোনও ভূমিতে অত্যন্ত অধিক, কোনও কোনও ভূমিতে অতি সামান্ত, কর নির্ধারিত হইয়াছে; দ্বিতীয় এই যে, সমুদয় ভূমি যখন বন্দোবস্ত কবিয়া দেওয়া গেল, তখন যে সকল প্রজারা, আবাদ করিয়া, চিরকাল, ভূমির উপস্বত্ব ভোগ করিয়া আসিতেছিল, নূতন ভূমধ্যকারীদিগকে স্বেচ্ছাচার হইতে তাহাদের পরিত্রাণের কোনও বিশিষ্ট উপায় নির্দিষ্ট করা হয় নাই।

১৭৯৩ সালে, বাঙ্গালার শাসন নিমিত্ত আইন প্রস্তুত হয়। পূর্বে যে যে আইন প্রচলিত করা গিয়াছিল, লার্ড কর্ণওয়ালিস সে সমৃদয়ের একত্র সঙ্কলন করিলেন, এবং সংশোধন ও অনেক নূতন আইনের যোগ করিয়া, তাহ। এক গ্রন্থের আকারে প্রচারিত করিলেন। ইহাই উত্তরকালীন যাবতীয় আইনের মূলস্বরূপ। ১৭৯৩ সালের আইন সকল এরূপ সহজ ও তাহাতে এরূপ গুণবত্তা প্রকাশিত হইয়াছে যে তৎপ্রণেতার যথেষ্ট প্রশংসা করিতে হয়। ঐ সমুদয় আইন দেশীয় কতিপয় ভাষাতে অনুবাদিত হইয়া সর্বত্র প্রচারিত হইল।

তৎকালে ফরস্টর সাহেব সর্বাপেক্ষায় উত্তম বাঙ্গালা জানিতেন তিনি, বাঙ্গালা ভাষায় ঐ সমূদয় আইনের অনুবাদ করেন। এই সাহেব, কিঞ্চিৎকাল পরে, বাঙ্গালা ভাষায় সর্বপ্রথম, এক অভিধান প্রস্তুত করেন। পারসী ভাষায় সবিশেষ নিপুণ এডমনস্টন সাহেব, ঐ ভাষাতে আইনের তরজমা করেন। এই অনুবাদ এমন উত্তম হইয়াছিল যে, গবর্ণমেন্ট, সন্তুষ্ট হইয়া, তাঁহাকে দশহাজার টাকা পারিতোষিক দেন। এই সমস্ত আইন অনুসারে, বিচারালয়ে যে সকল প্রথা প্রচলিত হয়, তাহা প্রায় চব্বিশ বৎসর পর্যন্ত প্রবল থাকে। পরে, দেশীয় লোকদিগকে বিচার সংক্রান্ত উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত করা নির্ধারিত হওয়াতে, তাহার কোনও কোনও অংশ পরিবর্তিত হয়।

লার্ড কর্ণওয়ালিস বিচারালয়ে পাঁচ সোপান স্থাপিত করেন। প্রথম, মুন্সেফ ও সদর আমীন, দ্বিতীয়, রেজিস্টর; তৃতীয়, জিলা জজ; চতুর্থ, প্রবিন্সল কোর্ট; পঞ্চম, সদর দেওয়ানী আদালত। তিনি এই অভিপ্রায়ে সমুদয় সিবিল সরকেন্টদিগের বেতন বৃদ্ধি করিয়া দিলেন যে, আর তাঁহারা উৎকোচগ্রহণের লোভ করিবেন না। কিন্তু বিচারালয়ের দেশীয় কর্মচারীদিগের বেতন পূর্ববৎ অতি সামান্যই রহিল। উচ্চপদাভিষিক্ত ঘুরোপীয় কর্মচারীরা পূর্বে কতিপয় শত টাকা মাত্র মাসিক বেতন পাইতেন। কিন্তু, এক্ষণে তাঁহারা অনেক সহস্র টাকা বেতন পাইতে লাগিলেন। পূর্বে, দেশীয় লোকেরা উচ্চ উচ্চ বেতন পাইয়া আসিয়াছিলেন। ফৌজদার বৎসরে যাটি সত্তব হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পাইতেন; এক এক সুবার নায়েব দেওয়ান বার্ষিক নয় লক্ষ টাকার ন্যূন বেতন পাইতেন না। কিন্তু, ১৭৯৩ সালে, দেশীয লোকদিগের অত্যুচ্চ বেতন একশত টাকার অধিক ছিল না।

লার্ড কর্ণওয়ালিস রাজশাসন দৃঢ়ীভূত করিযাছেন, এবং, চিবস্থায়ী বন্দোবস্ত দ্বারা, দেশীয় লোকদিগের মঙ্গল কবিয়াছেন। দেশীয় লোকেরা, তাঁহার দয়ালুতা ও বিজ্ঞতাব নিমিত্ত, যে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করিয়াছিলেন, তাহা অপাত্রে বিন্যস্ত হয় নাই। ডিরেক্টরেবা, তাঁহাব অসাধারণ গুণদর্শনে অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া, ইণ্ডিয়া হৌসে তাঁহার প্রতিমূর্তি সংস্থাপিত করেন, এবং ভাবতবর্ষ পরিত্যাগ দিবস অবধি বিংশতি বৎসর পর্যন্ত, তাঁহার বার্ষিক পঞ্চাশ সহস্র টাকা বৃত্তি নির্ধারিত করিয়া দেন।

২৮শে অক্টোবর, সর জন শোব সাহেব গবর্ণর জেনেরলেব পদে অধিকঢ় হইলেন। তিনি, সিবিল কর্মে নিযুক্ত হইয়া, অতি অল্প বয়সে, ভারতবর্ষে আগমন করেন; কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই, অসাধারণ বুদ্ধি ও প্রগাঢ় বিবেচনা শক্তি দ্বারা, বিখ্যাত হইয়া উঠেন। দশসালা বন্দোবস্তের সময়, তিনি রাজস্ব বিষষে এক উৎত্কৃষ্ট পাণ্ডুলেখ্য প্রস্তুত করেন। ঐ পাণ্ডুলেখ্যে এমন প্রগাঢ় বিদ্যা ও দূরদর্শিতা প্রদর্শিত হয় যে, উহা ইংলণ্ডের প্রধান মন্ত্রী পিট সাহেবের সম্মুখে উপনীত হইলে, তিনি তদ্দর্শনে সাতিশয় চমৎকৃত হন, এবং, ডিরেক্টরদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, পরামর্শপূর্বক স্থির করেন যে, লার্ড কর্ণওয়ালিসের পরে, ইহাকেই গবর্ণর জেনেরলের পদে নিযুক্ত করিতে হইবেক।

তাঁহার নিয়োগের পর বৎসর, অতি প্রসিদ্ধ বিদ্যাবান, সুপ্রীম কোর্টের অপক্ষপাতী জজ,

সর উইলিয়ম জোন্স, আটচল্লিশ বৎসর বয়ঃক্রম কালে, কালগ্রাসে পতিত হন। সর জন শোর সাহেবের সহিত তাঁহাব বিলক্ষণ সৌহৃদ্য ছিল; শোর সাহেব তদীয় জীবনবৃত্তান্তের সঙ্কলন করিয়া, এক উৎকষ্ট পুস্তক প্রস্তুত ও প্রচাবিত কবেন। ১৭৯৫ সালে, নবাব মুবারিকউদ্দৌলার মৃত্যু হইলে, তদীয় পুত্র নাজির উলমুলুক মুরশিদাবাদের সিংহাসনে অধিরূঢ় হইলেন। কিন্তু তৎকালে, মুরশিদাবাদের নবাব নিযুক্ত করা অতি সামান্ত বিষয় হইয়া উঠিয়াছিল। অতএব, এই মাত্র বলিলেই পর্যাপ্ত

হইবেক, পিতা যেরূপ মাসহারা পাইতেন, পুত্রও সেইরূপ পাইতে লাগিলেন। সর জন শোর সাহেব, নির্বিরোধে, পাঁচ বৎসর ভারতবর্ষের শাসনকার্য সম্পন্ন করিয়া, কর্ম পরিত্যাগের প্রার্থনা করিলেন। তাঁহার অধিকার কালে, বাঙ্গালা দেশে লিখনোপযুক্ত কোনও ব্যাপার ঘটে নাই। কিন্তু, তদীয় শাসনকাল শেষ হইবার সময়ে, এক ভয়ানক ব্যাপার উপস্থিত হইয়াছিল। সৈন্যেরা অসন্তোষের চিহ্ন দর্শাইতে লাগিল। ঐ সময়ে, মহীশূরের অধিপতি টিপু সুলতান, সৈন্য দ্বারা আনুকূল্য পাইবার প্রার্থনায়, ফরাসি- দিগের নিকট বারংবার আবেদন করিতে লাগিলেন। গত যুদ্ধে ইংরেজেরা তাঁহাকে যেরূপ খর্ব করিয়াছিলেন, তাহা তিনি, এক নিমিষের নিমিত্তেও, ভুলিতে পারেন নাই; অহোরাত্র, কেবল বৈরনির্যাতনের উপায় চিন্তা করিতেন। তিনি এমন আশা করিয়াছিলেন, ফরাসিদিগের সাহায্য লইয়া, ইংরেজদিগকে একবারে ভারতবর্ষ হইতে দূর করিয়া দিবেন। ডিরেক্টরেরা, এই সমস্ত বিষয়ের সবিশেষ পর্যালোচনা করিয়া, স্থির করিলেন যে, এমন সময়ে কোনও বিচক্ষণ ক্ষমতাপন্ন লোককে গবর্ণর জেনেরলের পদে নিযুক্ত করিয়া পাঠান উচিত। অনন্তর, তাঁহারা লার্ড কর্ণওয়ালিস সাহেবকে পুনর্বার ভারতবর্ষীয় রাজশাসনের ভারগ্রহণার্থ অনুরোধ করিলেন। এবং তিনিও তাঁহাদের প্রস্তাবে সম্মত হইলেন।

কিন্তু, আসিবার সমুদয় আয়োজন হইয়াছে, এমন সময়ে তিনি আয়লণ্ডে রাজপ্রতিনিধির পদে নিযুক্ত হইলেন। ডিরেক্টরেরা, বিলম্ব না করিয়া, লার্ড ওয়েলেসলিকে গবর্ণর জেনেরলের পদে নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন। ইহারই নামান্তর লার্ড মনিঙ্গটন। এই লার্ড বাহাদুর লার্ড কর্ণওয়ালিস মহোদয়ের ভ্রাতার নিকট শিক্ষা পাইয়াছিলেন; এবং, সবিশেষ অনুরাগ ও পরিশ্রম সহকারে, ভারতবর্ষীয় রাজনীতি বিষয়ে সুশিক্ষিত হইয়াছিলেন। তিনি ১৭৯৮ সালের ১৮ই মে, কলিকাতায় পঁহুছিলেন। গোলযোগের সময়ে, যেরূপ দূরদৃষ্টি, পরাক্রম ও বিজ্ঞতা সহকারে কার্য করা আবশ্বক, সে সমুদায়ই তাঁহার ছিল। তিনি ভারতবর্ষীয় শাসনকার্যের ভারগ্রহণ করিবামাত্র, ইংরেজদিগের সাম্রাজ্য বিষয়ক সমস্ত আশঙ্কা একবারে অন্তর্হিত হইল।

তিনি ভারতবর্ষে উপস্থিত হইয়া, দেখিলেন, টাকা অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য; সৈন্ত সকল একে অকর্মণ্য, তাহাতে আবার অসন্তুষ্ট হইয়া আছে; উত্তরে সিন্ধিয়া, দক্ষিণে টিপু সুলতান, পূর্ণ শত্রু হইয়া, বিভীষিকা দর্শাইতেছেন; ফরাসিদিগের, দিন দিন, ভারতবর্ষে বিলক্ষণ প্রাদুর্ভাব বাড়িতেছে। তিনি, অতি ত্বরায়, সৈন্য সকল সম্যক্ কর্মণ্য করিয়া তুলিলেন; যে সকল ফরাসিসেনাপতি, বহু সৈন্য সহিত, হায়দরাবাদে বাস করিতে- ছিলেন, অঁহাদিগকে দূরীভূত করিলেন; আর, তাঁহারা যে সকল সৈম্বের সংগ্রহ করিয়া- ছিলেন, সে সমৃদয়ের শ্রেণীভঙ্গ করিয়া দিলেন। তাহাদের পরিবর্তে, সেই স্থানে ইংরেজী সেনা স্থাপিত করিলেন; এবং, একবারেই টিপুর সহিত যুদ্ধের ঘোষণা করিয়া দিলেন। সমুদয় শত্রু মধ্যে, তিনিই অত্যন্ত উদ্ধত হইয়া উঠিয়াছিলেন।

মান্দ্রাজের কৌন্সিলের সাহেবেরা, লার্ড ওয়েলেসলির মতের পোষকতা না করিয়া, বরং তাঁহার প্রতিকূলবর্তী হইয়াছিলেন। তিনি, অবিলম্বে, মান্দ্রাজে উপস্থিত হইলেন, তাঁহাদের তাদৃশ ব্যবহারের নিমিত্ত যথোচিত তিরস্কার করিয়া, স্বয়ং, সমস্ত বিষয়ের নির্বাহ করিতে লাগিলেন। এবং, সত্বর সৈন্ত সংগ্রহ করিয়া, ১৭৯৯ খৃঃ অব্দের ২৭শে মার্চ, টিপু স্থলতানকে আক্রমণ করিবার নিমিত্ত, স্যৈপ্রেরণ করিলেন। টিপুর রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তন, মে মাসের চতুর্থ দিবসে, ইংরেজদিগের হস্তগত হইল। এই যুদ্ধে টিপু প্রাণ- ত্যাগ করিলেন। হায়দর পরিবারের রাজ্যাধিকার শেষ হইল। ডিরেক্টরেরা, এই সংগ্রামের সবিশেষ বৃত্তান্ত শুনিয়া, গবর্ণর জেনেরল বাহাদুরকে বার্ষিক পঞ্চাশ সহস্র টাকার পেনশন প্রদান করিলেন।

লার্ড ওয়েলেসলি, সিবিল সরবেন্টদিগকে দেশীয় ভাষায় নিতান্ত অজ্ঞ দেখিয়া, ১৮০০ খৃঃ অব্দে, কলিকাতায় কালেজ অব ফোর্ট উইলিয়ম নামক বিদ্যালয় স্থাপিত করিলেন। সিবিলেরা ইংলণ্ড হইতে কলিকাতায় পঁহুছিলে, তাঁহাদিগকে প্রথমতঃ এই বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইতে হইত। তাহারা যাবৎ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হইতেন, তাবৎ কর্মে নিযুক্ত হইতে পারিতেন না। এই বিজ্ঞালয়ের ব্যবহারার্থে, বাঙ্গালা প্রভৃতি ভাষাতে, কতিপয় পুস্তক সংগৃহীত ও মুদ্রিত হইল। এই বিদ্যালয়ের সংস্থাপন সংবাদ ডিরেক্টরদিগের নিকটে পহুছিলে, তাঁহারা সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন; কিন্তু, বহুব্যয়সাধ্য হইয়াছে বলিয়া, সকল বিষয়ের সংক্ষেপ করিতে আজ্ঞাপ্রদান কবিলেন।

১৮০৩ খৃঃ অব্দে, লার্ড ওয়েলেসলি বাহাদুরকে সিন্ধিয়া ও হোলকারের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে হইল। এই দুই পরাক্রান্ত রাজ, অল্প দিনেই, পরাজিত ও খবীকৃত হইলেন। তাঁহাদের রাজ্যের অনেক অংশ ইংরেজদিগের সাম্রাজ্যে যোজিত হইল। সেপ্টেম্বর মাসে, ইংরেজেরা মুসলমানদিগের প্রাচীন রাজধ নী দিল্লীনগর প্রথম অধিকার করিলেন। পূর্বে, মহারাষ্ট্রীয়েরা দিল্লীশ্বরের উপর অনেক অত্যাচার করিয়াছিলেন। এক্ষণে, ইংরেজেরা তাঁহাকে সম্রাটের পদে পুনঃস্থাপিত করিলেন। কিন্তু তাঁহার প্রভুশক্তি রহিল না। তিনি কেবল বার্ষিক পনর লক্ষ টাকা বৃত্তি পাইতে লাগিলেন।

এই সময়ে নাগপুরের রাজার সহিত বিবাদ উপস্থিত হওয়াতে, লার্ড ওয়েলেসলি বাহাদুর, অবিলম্বে, উড়িষ্মায় সৈন্তপ্রেরণ করিলেন। মহারাষ্ট্রীয়েরা যুদ্ধে ভঙ্গ দেওয়াতে, ১৮০৩ খৃঃ অব্দে, সেপ্টেম্বরের অষ্টাদশ দিবসে, ইংরেজদিগের সেনা জগন্নাথের মন্দির অধিকার করিল। তদবধি সমুদয় উড়িষ্ঠা দেশ পুনরায় বাঙ্গালারাজ্যের অন্তর্ভুত হইল। ৪৮ বৎসর পূর্বে, আলিবর্দি খাঁ, আপন অধিকারের শেষ বৎসরে, মহারাষ্ট্রীয়দিগের হস্তে এই দেশ সমর্পণ করেন। ইংরেজেরা, পুরীর পুরোহিতদিগের প্রতি, অতিশয় দয়া ও সমাদর প্রদর্শন করিলেন এবং পুরী সংক্রান্ত আয় ব্যয় প্রভৃতি তাবৎ ব্যাপারই, পূর্ববৎ, তাঁহাদিগকে আপন বিবেচনা অনুসারে সম্পন্ন করিতে কহিলেন। কিন্তু, তিন বৎসর পরে, ইংরেজেরা, করবৃদ্ধি করিবার অভিপ্রাযে, মন্দিরের অধ্যক্ষতাগ্রহণ ও নিজের লোক দ্বারা কর সংগ্রহ করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সংগৃহীত ধনের কিয়দংশ মাত্র দেবসেবায় নিযোজিত হইত, অবশিষ্ট সমূদয় কোম্পানির ধনাগারে প্রবেশ করিত।

বহুকাল অবধি ব্যবহাব ছিল, পিতা মাতা, গঙ্গাসাগরে গিয়া, শিশু সন্তান সাগর জলে নিক্ষিপ্ত কবিতেন। তাঁহাবা এই কর্ম ধর্মবোধে কবিতেন বটে; কিন্তু ধর্মশাস্ত্রে ইহার কোনও বিধি নাই। গবর্ণব জেনেবল বাহাদুর, এই নৃশংস ব্যবভাব একেবাবে উঠাইয়া দিবার নিমিত্ত, ১৮০২ সালের ২০শে আগষ্ট, এক আইনজারী কবিলেন ও তাহার পোষকতাব নিমিত্ত, গঙ্গাসাগবে এক দল সিপাই পাঠাইয়া দিলেন। তদবধি এই নৃশংস ব্যবহার একেবারে বহিত হইয়া গিয়াছে।

লার্ড ওয়েলেসলি এই মহারাজ্যের প্রায় তৃতীযাংশ বৃদ্ধি কবেন এবং, রাজস্ববৃদ্ধি করিয়া, পনর কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা স্থিত করেন। কিন্তু, তিনি নিয়ত সংগ্রামে লিপ্ত থাকাতে, রাজস্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, ঋণেরও বিলক্ষণ বৃদ্ধি হইয়াছিল। ডিরেক্টরেরা, তাঁহাব এরূপ যুদ্ধবিষয়ক অনুরাগ দর্শনে, যৎপরোনাস্তি অসন্তোষ প্রকাশ করিলেন, এবং যাহাতে শান্তি- সংস্থাপনপূর্বক রাজশাসন সম্পন্ন হয়, এমন কোনও উপায় অবলম্বন করিবার নিমিত্ত, সবিশেষ ব্যগ্র হইলেন।

লার্ড ওয়েলেসলি দেখিলেন, আর তাঁহার উপর ডিরেক্টরদিগের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা নাই। এজন্ত, তিনি, তাঁহাদেব লিখিত পত্রের উত্তর লিখিয়া, কর্ম পরিত্যাগ করিলেন; এবং, ১৮০৫ খৃঃ অব্দের শেষে, ইংলণ্ড গমনার্থ জাহাজে আরোহণ করিলেন।

ডিরেক্টরেরা, ক্ষতিস্বীকার করিয়াও, শান্তিস্থাপন ও ব্যয়লাঘব করা কর্তব্য স্থির করিয়া, লার্ড কর্ণওয়ালিস সাহেবকে পুনর্বার গবর্ণর জেনেরলের পদে নিযুক্ত করিলেন। তৎকালে তিনি অতিশয় বৃদ্ধ হইয়াছিলেন, তথাপি তাঁহাদের প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, এবং, জাহাজে আরোহণ করিয়া, ১৮০৫ খৃঃ অব্দের ৩০শে জুলাই, কলিকাতাষ উত্তীর্ণ হইলেন। তিনি, কালবিলম্ব না করিয়া, ভারতবর্ষীয় ভূপতিদিগের সহিত সন্ধিস্থাপন করিবাব নিমিত্ত, পশ্চিম অঞ্চলে গমন করিলেন। কিন্তু তিনি পশ্চিম অভিমুখে যত গমন করিতে লাগিলেন, ততই শারীরিক দুর্বল হইতে লাগিলেন; পরিশেষে, গাজীপুরে উপস্থিত হইয়া ঐ বৎসরের এই অক্টোবর, কলেবর পরিত্যাগ করিলেন। ইংলণ্ডে তাঁহার মৃত্যু সংবাদ পহুছিলে, ডিরেক্টরেরা, তাঁহার উপর আপনাদের অনুরাগ দর্শাইবার নিমিত্ত, তাঁহার পুত্রকে চারি লক্ষ টাকা উপহার দিলেন।

কৌন্সিলের প্রধান মেম্বর সর জর্জ বার্লো সাহেব গবর্ণর জেনেরলের পদে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। ডিরেক্টরেরা তাঁহাকে এই উচ্চ পদে নিযুক্ত করিলেন; কিন্তু রাজমন্ত্রীরা কহিলেন, এই পদে লোক নিযুক্ত করা আমাদের অধিকার। এই বিষয়ে বিস্তর বাদানুবাদ উপস্থিত হইল। পরিশেষে, লার্ড মিন্টোকে গবর্ণর জেনেরলের পদে নিযুক্ত করাতে, সে সমুদয়ের মীমাংসা হইয়া গেল। সব জর্জ বার্লো সাহেবের অধিকারকালে, গবর্ণমেন্ট শ্রীক্ষেত্রযাত্রীদিগের নিকট মাশুল আদায়ের ও মন্দিরের অধ্যক্ষতার ভার স্বহস্তে লইয়াছিলেন। যাত্রীর সংখ্যাবৃদ্ধির নিমিত্ত, নানা উপায় করা হইয়াছিল। ইহাতে রাজস্বের যথেষ্ট বৃদ্ধি হয়। তৎকালে এই যে প্রথা প্রচলিত হইয়াছিল, উহা প্রায় ত্রিশ বৎসরের অধিক প্রবল থাকে।

লার্ড মিন্টো বাহাদুর, ১৮০৭ খৃঃ অব্দের ৩১শে জুলাই, কলিকাতায় উত্তীর্ণ হইলেন। তিনি, ১৮১৩ খৃঃ অব্দের শেষ পর্যন্ত, রাজশাসন সম্পন্ন করিয়াছিলেন। এই সময় মধ্যে, বাঙ্গালাদেশে রাজকার্যেব কোনও বিশেষ পরিবর্ত হয় নাই। কেবল পঞ্চোত্তরা মাশুল বিষয়ে, পূর্ব অপেক্ষা কঠিন নিয়মে, নূতন বন্দোবস্ত হইয়াছিল। লার্ড কর্ণওয়ালিস সাহেব, ১৭৮৮ খৃঃ অব্দে, এই নিয়ম রহিত করিয়া যান। পরে ১৮০১ খৃঃ অব্দে, পুনর্বার প্রবর্তিত হয়। এইরূপে রাজস্বের বৃদ্ধি হইল বটে; কিন্তু বাণিজ্যের বিস্তর ব্যাঘাত জন্মিতে ও প্রজাদের উপর ঘোরতর অত্যাচার হইতে লাগিল।

১৮১০ খৃঃ অব্দে, ইংরেজেরা, ফরাসিদিগকে পরাজিত করিয়া, বুধো ও মরিশস নামক দুই উপদ্বীপ অধিকার করিলেন, এবং তৎপর বৎসর, ওলন্দাজদিগকে পরাজিত করিয়া জাবা নামক সমৃদ্ধ উপদ্বীপের অধিকার প্রাপ্ত হইলেন।

বিংশতি বৎসর পূর্বে কোম্পানি বাহাদুর যে চার্টর অর্থাৎ সনন্দ লইয়াছিলেন, তাহার যিয়াদ পূর্ণ হওয়াতে, ১৮১৩ খৃঃ অব্দে, নূতন চার্টর গৃহীত হইল। এই উপলক্ষে এতদ্দেশীয় রাজকার্য সংক্রান্ত কয়েকটি নিয়মের পরিবর্ত হইয়াছিল। দুইশত বৎসরের অধিক কাল অবধি, ইংলণ্ডের মধ্যে কেবল কোম্পানি বাহাদুরের ভারতবর্ষে বাণিজ্য করিবার অধিকার ছিল। কিন্তু এক্ষণে কোম্পানি বাহাদুর ভারতবর্ষের রাজসিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। রাজ্যেশ্বরের বাণিজ্য করা উচিত নহে, এই বিবেচনায়, নূতন বন্দোবস্তের সময়, কোম্পানি বাহাদুরের কেবল রাজ্যশাসনের ভার রইল। আর অন্তান্ত বণিকদিগের বাণিজ্যে অধিকার হইল। পূর্বে কোম্পানির কর্মচারী ভিন্ন অন্যান্য ঘুরোপীয়- দিগকে, ভারতবর্ষে আসিবার অনুমতি প্রাপ্তি বিষয়ে, যে ক্লেশ পাইতে হইত, তাহা একবারে নিবারিত হইল। এক্ষণে, ডিরেক্টরেরা যাহাদিগকে অনুমতি দিতে চাহিতেন না, তাহারা বোর্ড অব কন্ট্রোল নামক সভাতে আবেদন করিয়া, কৃতকার্য হইতে লাগিল।

১৮১৩ খৃঃ অব্দের ৪ঠা অক্টোবর, লার্ড মিন্টো বাহাদুর, লার্ড ময়রা বাহাদুরের হস্তে ভারতবর্ষীয় রাজ্যশাসনের ভারসমর্পণ করিয়া ইংলণ্ড যাত্রা করিলেন; কিন্তু আপন আলয়ে উপস্থিত হইবার পূর্বেই, তাঁহার প্রাণত্যাগ হইল। পরিশেষে, লার্ড ময়রা বাহাদুরের নাম মারকুইস অব হেস্টিংস হইয়াছিল।

নবম অধ্যায়

লার্ড হেস্টিংস গবর্ণমেন্টের ভার গ্রহণ করিয়া দেখিলেন, নেপালীয়েরা, ক্রমে ক্রমে, ইংরেজদিগের অধিকৃত দেশ আক্রমণ করিয়া আসিতেছেন। সিংহাসনারঢ় রাজপরিবার, একশত বৎসরের মধ্যে নেপালে আধিপত্য স্থাপন করিয়া, ক্রমে ক্রমে রাজ্যের বৃদ্ধি করিয়াছিলেন। লার্ড মিন্টো বাহাদুরের অধিকারকালে, নানা বিবাদ উপস্থিত হইয়া- ছিল। লার্ড হেস্টিংস দেখিলেন, নেপালাধিপতির সহিত যুদ্ধ অপরিহার্য হইয়া উঠিয়াছে। তিনি প্রথমতঃ, সন্ধিরক্ষার্থে যথোচিত চেষ্টা করিলেন; কিন্তু নেপালেশ্বরের অসহনীয় প্রগল্ভতা দর্শনে পরিশেষে, ১৮১৪ খৃঃ অব্দে তাঁহাকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে হইল। প্রথম যুদ্ধে কোনও ফলোদয় হইল না; কিন্তু ১৮১৫ খৃঃ অব্দের যুদ্ধে, ইংরেজদিগের সেনাপতি অক্টরলোনি বাহাদুর সম্পূর্ণ জয়লাভ করিলেন। তখন, আপন রাজ্যের এক বৃহৎ অংশ পণ দিয়া, নেপালাধিপতিকে সন্ধিক্রয় করিতে হইল।

ভারতবর্ষের মধ্যভাগে, পিণ্ডারী নামে প্রসিদ্ধ বহুসংখ্যক অশ্বারোহ দম্য বাস করিত। অনেক বৎসর অবধি, ঐ অঞ্চলের দেশলুণ্ঠন তাহাদের ব্যবসায় হইয়া উঠিয়াছিল। অবশেষে, তাহারা ইংরেজদিগের অধিকার মধ্যে প্রবেশ করে। ঐ অঞ্চলের অনেক রাজা তাহাদের সম্পূর্ণ সহায়তা করিতেন। তাহারা পাঁচশত ক্রোশের অধিক দেশ ব্যাপিয়া, লুঠ করিত। তাহাদের নিবারণের নিমিত্ত, ইংরেজদিগকে একদল সৈন্য রাখিতে হইয়াছিল। তাহাতে প্রতিবৎসর যে খরচ পড়িতে লাগিল, তাহা অত্যন্ত অধিক বোধ হওয়াতে, পরিশেষে ইহাই যুক্তিযুক্ত ও পরামর্শসিদ্ধ স্থির হইল যে, সর্বদা এরূপ করা অপেক্ষা, একবার এক মহা্যোগ করিয়া, তাহাদিগকে নির্মূল করা আবশ্যক।

অনন্তর, লার্ড হেস্টিংস বাহাদুর, ডিরেক্টর সমাজের অনুমতি লইয়া, তিন রাজধানী হইতে বহুসংখ্যক সৈন্তের সংগ্রহ করিতে আদেশ প্রদান করিলেন। সংগৃহীত স্যৈ, এই দুর্বৃত্ত দস্থ্যদিগের বাসস্থান রুদ্ধ করিয়া, একে একে, তাহাদের সকল দলকেই উচ্ছিন্ন করিল।

ইংরেজদের সেনা, পিত্তণ্ডারীদিগের সহিত সংযুক্ত হইয়া, যুদ্ধক্ষেত্রে নিযুক্ত আছে, এমন সময়ে, পেশোয়া, হোলকার ও নাগপুরের রাজা, ইহারা সকলে, এককালে এক পরামর্শ হইয়া, এই আশায় ইংরেজদিগের প্রতিকূলবর্তী হইয়া উঠিলেন যে সকলেই একবিধ যত্ন করিলে, ইংরেজদিগকে ভারতবর্ষ হইতে দূর করিয়া দিতে পারিবেন। কিন্তু ইহারা সকলেই পরাজিত হইলেন। নাগপুরের রাজা ও পেশোয়া সিংহাসনচ্যুত হইলেন। তাঁহাদের রাজ্যের অধিকাংশ ইংরেজদিগের অধিকারভুক্ত হইল। উল্লিখিত ব্যাপারের নির্বাহকালে, লার্ড হেস্টিংসের পঁয়ষট্টি বৎসর বয়ঃক্রম; তথাপি, তাদৃশ গুরুতর কার্যের নির্বাহ বিষয়ে যেরূপ বিবেচনা ও উৎসাহের আবশ্বকতা, তাহা তিনি সম্পূর্ণরূপে প্রদর্শিত করিয়াছিলেন। পিণ্ডারী ও মহারাষ্ট্রীয়দিগের পরাক্রম একবারে লুপ্ত হইল, এবং ইংরেজেরা ভারতবর্ষে সর্বপ্রধান হইয়া উঠিলেন।

লার্ড হেস্টিংস বাহাদুরের অধিকারের পূর্বে, প্রজাদিগকে বিদ্যাদান করিবার কোনও অনুষ্ঠান হয় নাই। প্রজাবা অজ্ঞান কূপে পতিত থাকিলে, কোনও কালে, রাজ্যভঙ্গের আশঙ্কা থাকে না; এই নিমিত্ত, তাহাদিগকে বিস্তাদান করা রাজনীতির বিরুদ্ধ বলিয়াই পূর্বে বিবেচিত হইত। কিন্তু লার্ড হেস্টিংস বাহাদুব, এই সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করিয়া, কহিলেন, ইংবেজরা, প্রজাদের মঙ্গলেব নিমিত্তই, ভারতবর্ষে রাজ্যাধিকার স্থাপিত কবিষাছেন; অতএব, সর্বপ্রযত্নে, প্রজার সভ্যতাসম্পাদন ইংরেজ জাতিব অবশ্বকর্তব্য। অনন্তর, তদীয় আদেশ অনুসারে, স্থানে স্থানে বিদ্যালয় স্থাপিত হইতে লাগিল।

১৮২৩ খৃঃ অব্দের জানুয়ারি মাসে, হেস্টিংস ভারতবর্ষ হইতে প্রস্থান করিলেন। তিনি, নয় বৎসর কাল গুরুতর পরিশ্রম করিয়া, কোম্পানির রাজ্য ও রাজস্বের বিলক্ষণ বৃদ্ধি ও ঋণের পরিশোধ করেন। ইহার পূর্বে, ইংরেজদের ভারতবর্ষীয় সাম্রাজ্যের এরূপ সমৃদ্ধি কদাপি দৃষ্ট হয় নাই। ধনাগাব ধনে পরিপূর্ণ, এবং সমস্ত ব্যয়ের সমাধা করিয়া, বৎসরে প্রায় দুই কোটি টাকা উদ্বৃত্ত হইতে লাগিল।

অসাধারণ ক্ষমতাপন্ন রাজমন্ত্রী জর্জ ক্যানিং ভারতবর্ষীয় রাজকার্য বিষয়ে সম্পূর্ণ অভিজ্ঞ ছিলেন। লার্ড হেস্টিংস বাহাদুর কর্মপরিত্যাগ করিলে, তিনি গবর্ণর জেনেরলের পদে প্রতিষ্ঠিত হইলেন।

তাঁহার আসিবার সমুদয় উদ্যোগ হইয়াছে, এমন সময়ে অন্ত এক রাজমন্ত্রীর মৃত্যু হওয়াতে, ইংলণ্ডে এক অতি প্রধান পদ শূন্ত হইল, এবং ঐ পদে তিনিই নিযুক্ত হইলেন। তখন ডিরেক্টরেরা লার্ড আমহার্স্ট' বাহাদুরকে, গবর্ণর জেনেরলের পদে নিযুক্ত করিয়া, ভারতবর্ষে পাঠাইলেন। এই মহোদয়, দশ বৎসর পূর্বে, ইংলণ্ডেশ্বরের প্রতিনিধি হইয়া, চীনদেশের রাজধানী পেকিন নগরে গমন করিয়াছিলেন। তিনি, ১৮২৩ খৃঃ অব্দের ১লা আগস্ট, কলিকাতায় উত্তীর্ণ হইলেন। লার্ড হেস্টিংস বাহাদুরের প্রস্থান অবধি, লার্ড আমহস্ট বাহাদুরের উপস্থিতি পর্যন্ত, কয়েকমাস, কৌন্সিলের প্রধান মেম্বর জন আদম সাহেব গবর্ণর জেনেরলের কার্যনির্বাহ করেন। তাঁহার অধিকার কালে, বিশেষ কার্যের মধ্যে, কেবল মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতার উচ্ছেদ হইয়াছিল।

লার্ড আমহস্ট বাহাদুর, কলিকাতায় পহুছিয়া, দেখিলেন, ব্রহ্মদেশীয়ের' অত্যন্ত অত্যাচার করিতে আরম্ভ করিয়াছে। ইংরেজেরা যে সময়ে বাঙ্গালাদেশে অধিকার স্থাপন করেন, ব্রহ্মদেশের তৎকালীন রাজা, প্রায় সেই সময়েই, তত্রত্য সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন। তিনি মণিপুর ও আসাম অনায়াসে হস্তগত করেন, এবং, সেই গর্বে উদ্ধত হইয়া, মনে মনে সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন, ক্রমে ক্রমে, বাঙ্গালাদেশও হস্তগত করিবেন। তিনি, ইংরেজদের সহিত সন্ধি সত্ত্বেও, সন্ধির নিয়মলঙ্ঘন করিয়া কোম্পানির অধিকারভুক্ত কাচার ও আরাকান দেশে স্বীয় সৈন্য পাঠাইয়া দেন। আরাকান উপকূলে, টিকনাফ নদীর শিরোভাগে, শাপুরী নামে যে উপদ্বীপ আছে, ব্রহ্মেশ্বর তাহা আক্রমণ করিয়া, তথায় ইংরেজদিগের যে অল্পসংখ্যক রক্ষক ছিল, তাহাদের প্রাণবধ করেন। আরায় দূতপ্রেরণ করিয়া, এরূপ অনুষ্ঠানের হেতুজিজ্ঞাসা করাতে, তিনি সাতিশয় গর্বিত বাক্যে এই উত্তর দেন, ঐ উপদ্বীপ আমার অধিকারে থাকিবেক, ইহার অন্যথা হইলে, আমি বাঙ্গাল। আক্রমণ করিব।

এই সমস্ত অত্যাচার দেখিয়া, গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর, ১৮২৪ খৃঃ অব্দের ৬ই মে, ব্রহ্মাধিপতির সহিত যুদ্ধের ঘোষণা করিলেন। ইংরেজেরা, ১১ই মে, ব্রহ্মরাজ্যে সৈন্য উত্তীর্ণ করিয়া, রেঙ্গুনের বন্দর অধিকার করিলেন। তৎপরে, আসাম, আরাকান, ও মরগুই নামক উপকূল তাঁহাদের হস্তগত হইল। ইংবেজদিগের সেনা, ক্রমে ক্রমে, আরা রাজধানী অভিমুখে প্রস্থান করিল, এবং প্রয়াণকালে, বহুতর গ্রাম, নগর অধিকারপূর্বক, ব্রহ্মরাজের সেনাদিগকে পদে পদে পরাজিত করিতে লাগিল। ১৮২৬ খৃঃ অব্দের আরস্তে, ইংরেজদিগের সেনা অমরপুরের প্রত্যাসন্ন হইলে, রাজা, নিজ রাজধানীর রক্ষার্থে, ইংরেজদিগের প্রস্তাবিত পণেই, সন্ধি করিতে সম্মত হইলেন। অনন্তর, এক সন্ধিপত্র প্রস্তুত হইল; ঐ সন্ধিপত্র যান্দাবুসন্ধিপত্র নামে প্রসিদ্ধ। তন্দ্বারা ব্রহ্মাধিপতি ইংরেজদিগকে মণিপুর, আসাম, আরাকান, ও সমুদয় মার্তাবান উপকূল ছাড়িয়া দিলেন; এবং যুদ্ধের ব্যয় ধরিয়া দিবার নিমিত্ত, এক কোটি টাকা দিতে সম্মত হইলেন।

যৎকালে ব্রহ্মদেশীয়দিগের সহিত যুদ্ধ হইতেছিল, ঐ সময়ে ভরতপুরের অধিপতি

দুর্জনশালের সহিতও বিরোধ উপস্থিত হয়। তিনি, আপন ভ্রাতা মাধু সিংহের সহিত

পরামর্শ করিয়া, নিজ পিতৃব্যপুত্র অপ্রাপ্ত ব্যবহার বলবন্ত সিংহের হস্ত হইতে

রাজ্যাধিকার গ্রহণ করিবার উচ্চম করিয়াছিলেন। সর চার্লস মেটকাফ সাহেব, দুর্জন-

শালকে বুঝাইবার জন্য, বিস্তর চেষ্টা পাইলেন; কিন্তু কোনও ফলোদয় হইল না। তখন স্পষ্ট বোধ হইল, শস্ত্রগ্রহণ ব্যতিরেকে এ বিষয়ের মীমাংসা হইবেক না। বিশেষতঃ, এই স্থান অধিকার করা ইংরেজেরা অত্যন্ত আবশ্যক বিবেচনা করিয়াছিলেন। ১৮০৫ খৃঃ অব্দে, ইংরেজদিগের সেনাপতি, লার্ড লেক, ঐ স্থান অবরুদ্ধ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহাতে অধিক সেনা ও অনেক সেনাপতির প্রাণবিনাশ হয়। ইংরেজেরা, এ পর্যন্ত, যত দুর্গের অবরোধ করেন, তন্মধ্যে কেবল ভরতপুরের দুর্গই অধিকার করিতে পারেন নাই। ইহাতে, সমস্ত ভারতবর্ষ মধ্যে, এই জনরব হইয়াছিল, ইংরেজেরা এই দুর্গ কখনই অধিকার করিতে পারিবেন না। উহার চতুর্দিকে, অতি প্রশস্ত মৃন্ময় পাদদেশে, এক বৃহৎ পরিখা ছিল।

তৎকালে অনেক সৈন্য ব্রহ্মদেশীয় যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকিলেও, বিংশতি সহস্র সৈন্য ও একশত কামান ভবতপুবের সম্মুখে অবিলম্বে নীত হইল। ভাবতবর্ষীয় সমুদায লোক, প্রগাঢ় ঔৎসুক্য সহকাবে, এই ব্যাপার নিবীক্ষণ করিতে লাগিলেন। ২৩শে ডিসেম্বব, যুদ্ধ আরম্ভ হইল। ১৮২৬ খৃঃ অন্ধেব ১৮ই জানুয়ারী, প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ, লার্ড কম্ববমীর বাহ।দুব, ঐ স্থান অধিকার করিলেন। দুর্জনশাল ই'বেজদিগেব হস্তে পতিত হওয়াতে, তাঁহারা তাঁহাকে এলাহাবাদের দুর্গে রুদ্ধ করিলেন।

১৮২৭ খৃঃ অব্দে, লার্ড আমহস্ট বাহাদুর, পশ্চিম অঞ্চলে গমন কবিবা, দিল্লীতে উপস্থিত হইলেন। বাদশাহের সহিত, কোম্পানির ভারতবর্ষীয় সাম্রাজ্য বিষযে, কথোপকথন উপস্থিত হওয়াতে, গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর স্পষ্ট বাক্যে তাঁহাকে কহিলেন, ইংরেজেরা আর এখন তৈমুববংশীয়দিগের অধীন নহেন। রাজসিংহাসন এক্ষণে তাঁহাদের হইয়াছে। দিল্লীর রাজপবিবার এই কথা শুনিয়া বিষাদসমুদ্রে মগ্ন হইলেন। তাঁহারা ভাবিলেন, মহারাষ্ট্রীয়দিগেব নিকট, অশেষ প্রকারে, অবমানিত হইয়াছিলাম বটে; কিন্তু হিন্দু- স্থানের বাদশাহনামের অন্যথা হয় নাই। এক্ষণে, রাজ্যাধিকার চিরকালের নিমিত্ত হস্তবহির্ভূত হইল। ইংরেজদের এই ব্যবহারে ভারতবর্ষবাসী সমুদয় লোক অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ হইয়াছিলেন।

লার্ড আমহার্স্ট বাহাদুর উইলিয়ম বটরওয়ার্থ বেলিসাহেবের হস্তে গবর্ণমেন্টের ভারার্পণ করিয়া, ১৮২৮ খৃঃ অব্দের মার্চ মাসে, ইংলণ্ডে গমন করিলেন; তাঁহার কর্মপরিত্যাগের অভিপ্রায় ব্যক্ত হইলে, লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক উক্ত পদের নিমিত্ত, ডিরেক্টরদিগের নিকট প্রার্থনা জানাইলেন। বিংশতি বৎসর পূর্বে, তিনি মান্দ্রাজের গবর্ণর নিযুক্ত হইয়াছিলেন। কিন্তু ডিরেক্টরেরা, কোনও কারণবশতঃ উদ্ধত হইয়া, অন্তায় করিয়া, তাঁহাকে পদচ্যুত করেন। এক্ষণে তাঁহারা, উপস্থিত বিষয়ে তাঁহার প্রার্থনা গ্রাহ করিয়া, ১৮২৭ সালে, গবর্ণর জেনেরলের পদে নিযুক্ত করিলেন। ইহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবেক, তৎকালে ইংলণ্ডে, এই প্রধান পদের নিমিত্ত, তত্ত্বলা উপযুক্ত ব্যক্তি অতি অল্প পাওয়া যাইত।

লার্ড বেন্টিক বাহাদুর, ১৮২৮ সালের ৪ঠা জুলাই, কলিকাতায় পঁহুছিলেন। ছয় বৎসর পূর্বে, লার্ড হেস্টিংসের অধিকার কালে, ভারতবর্ষের ধনাগার ধনে পরিপূর্ণ হয়; এই সময়ে, তাহা একেবারে শূন্ত হইয়াছিল। আয় অপেক্ষা ব্যয় অনেক অধিক। লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক ডিরেক্টরদিগের নিকট প্রতিজ্ঞা করেন, আমি নিঃসন্দেহ ব্যয়ের লাঘব করিব। তিনি, কলিকাতায় পঁহুছিবার অব্যবহিত পরেই, রাজস্ব বিষয়ে দুই কমিটিস্থাপিত করিলেন।' তাঁহাদের উপর এই ভার হইল যে, সিবিল ও মিলিটারি বিষয়ে যে ব্যয় হইয়া থাকে, তাহার পরীক্ষা করিবেন, এবং তন্মধ্যে কি কমান যাইতে পারে, তাহা দেখাইয়া দিবেন। তাঁহারা যেরূপ পরামর্শ দিলেন, তদনুসারে সমুদয় কর্মস্থানে, ব্যয়ের লাঘব করা গেল। এরূপ কর্ম করিলে, কাজে কাজেই, অপ্রিয় হইতে হয়। লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক, ব্যয়- লাঘব করিয়া, কোর্টের যে আদেশ প্রতিপালন করিলেন, তাহাতে যাহাদের ক্ষতি হইল, তাহারা তাঁহাকে বিস্তর গালি দিয়াছিল। ফলতঃ যে রাজকর্মচারীকে রাজ্যের ব্যয় লাঘব করিবার ভরগ্রহণ করিতে হয়, তিনি কখনই, তদানীন্তন লোকের নিকট, সুখ্যাতি লাভের প্রত্যাশা করিতে পারেন না। সকলেই, তাঁহার বিপক্ষ হইয়া, চারিদিক কোলাহল করিতে লাগিল। তিনি, তাহাতে ক্ষুব্ধ বা চলচিত্ত না হইয়া, কেবল ব্যয়- লাঘব ও ঋণপরিশোধের উপায় দেখিতে লাগিলেন।

অনেক বৎসর অবধি, গবর্ণমেন্ট সহগমননিবারণার্থে সবিশেষ উৎসুক হইয়াছিলেন, এবং কত স্ত্রী সহমৃতা হয়, এবং দেশীয় লোকদিগেরই বা তদ্বিষয়ে কিরূপ অভিপ্রায়, ইহার নির্ণয় করিবার নিমিত্ত, অনেক অনুসন্ধানও হইয়াছিল। রাজপুরুষেরা অনেকেই কহিয়াছিলেন, দেশীয় লোকদিগের এ বিষয়ে অত্যন্ত অনুরাগ আছে; ইহা রহিত করিলে অনর্থ ঘটিতে পারে। লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক, কলিকাতায় পঁহুছিয়া, এই বিষয়ে বিশিষ্টরূপে বিবেচনা করিয়া দেখিলেন, ইহা অনায়াসে রহিত করা যাইতে পারে। কৌন্সিলের সমুদয় সাহেবরা তাঁহার মতে সম্মত হইলেন। তদন্তর, ১৮২৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর, এক আইন জারী হইল; তদনুসারে, ইংরেজদিগের অধিকার মধ্যে, এই নৃশংস ব্যাপার একবারে রহিত হইয়া গেল।

কতকগুলি ধনাঢ্য সম্নান্ত বাঙ্গালি, এই হিতানুষ্ঠানকে অহিত জ্ঞান করিলেন, এবং তাঁহাদের ধর্ম বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হইল বলিয়া, গবর্ণর জেনেরল বাহাদুরের নিকট এই প্রার্থনায় আবেদন করিলেন যে, ঐ আইন রদ করা যায়। লার্ড উইলিয়ম, এই ধর্ম রহিত করিবার বহুবিধ প্রবল মুক্তির প্রদর্শন পূর্বক, তাঁহাদের প্রার্থনা অগ্রাহ করিলেন। সেই সময়ে, দ্বারকানাথ ঠাকুর, কালীনাথ রায়চৌধুরী প্রভৃতি, কতকগুলি সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালি লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক বাহাদুরকে এক অভিনন্দন পত্র প্রদান করেন; তাহার মর্ম এই, আমরা, শ্রীযুতের এই দয়ার কার্যে অনুগৃহীত হইয়া, ধন্যবাদ করিতেছি।

যাঁহারা সহগমনের পক্ষ ছিলেন, তাঁহারা, অবিলম্বে, কলিকাতায় এক ধর্মসভার স্থাপন ও চাঁল করিয়া অর্থসংগ্রহ করিলেন, এবং, এই বিধি পুনঃস্থাপিত হয়, এই প্রার্থনায়, ইংলণ্ডেশ্বরের নিকট দরখাস্ত দিবার নিমিত্ত, একজন ইংরেজ উকীলকে ইংলণ্ডে পাঠাইয়া দিলেন। কিন্তু তথাকার রাজমন্ত্রীরা, সহগমনের অনুকূল যুক্তি সকল শ্রবণ- গোচর করিয়া, পরিশেষে নিবারণ পক্ষই দৃঢ করিলেন। বহুকাল অতীত হইল, সহমরণ রহিত হইয়াছে, এই দীর্ঘকাল মধ্যে, প্রজাদিগেব অসন্তোষের কোনও লক্ষণ লক্ষিত হয় নাই। ফলতঃ, এক্ষণে এই নিষ্ঠুব ব্যবহাব প্রায সকলে বিশ্বত হইয়াছেন। যদি ইহা ইতিহাস গ্রন্থে উল্লিখিত না থাকে, তাহা হইলে, উত্তরকালীন লোকেরা, এরূপ নৃশংস ব্যবহাব কোনও কালে প্রচলিত ছিল, এ বিষয়ে, বোধ হয়, প্রত্যয় করিবেক না।

১৮৩১ সালে, বিচারালযেব বীতিব অনেক পবিবর্ত আবন্ধ হইল। বাঙ্গালিবা, এ পর্যন্ত, অতি সামান্য বেতনে নিযুক্ত হইযা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মোকদ্দমাব বিচার কবিতেন। লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক, দেশীয় লোকদিগেব মান সম্ভ্রম বাড়াইবাব নিমিত্ত, তাঁহাদিগকে উচ্চ বেতনে উচ্চপদে নিযুক্ত করিতে মনন কবিলেন। এই বৎসবে, মুন্সেফ ও সদর আমীনদিগেব বেতন ও ক্ষমতাব বৃদ্ধি হইল, এবং উচ্চতর বেতনে, অতি সম্ভ্রান্ত প্রধান সদব আমীনী পদ নতন সংস্থাপিত হইল। দেওয়ানী বিষয়ে প্রধান সদর আমীনদিগের যথেষ্ট ক্ষমতা হইল। বেজিস্টাবেব পদ ও প্রবিন্সল কোর্ট উঠিয়া গেল; কেবল দেশীয় বিচাবকের ও জিলাজজেব পদ এবং সদব দেওযানী আদালত, বজায় থাকিল। ফলিতার্থ এই যে, মোকদ্দমার প্রথম শ্রবণ ও তাহার নিষ্পত্তি করণের ভাব দেশীয় বিচাবকদিগেব হস্তে অর্পিত হইল; আব, জিলাব ইংরেজ জজদিগের উপর কেবল আপীল শুনিবার ভাব রহিল।

লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক ফৌজদারী আদালতেও অনেক স্বরীতির স্থাপন করেন। পূর্বে, দায়রার সাহেবরা ছয় মাসে একবার আদালত করিতেন; কিয়ৎকাল পরে, কমিশনর সাহেবেরা তিনমাসে একবার। এক্ষণে এই হুকুম হইল, সিবিল ও সেশন জজেরা প্রতি- মাসে, এক একবার বৈঠক করিবেন। কয়েদী আসামী ও সাক্ষীদিগকে যে অধিক দিন ক্লেশ পাইতে হইত, তাহার অনেক নিবারণ হইল। ফলতঃ কার্যদক্ষ লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক বাহাদুরের অধিকারকালে, যে নানা স্থনিয়ম সংস্থাপিত হয়, সে সমূদয়েরই প্রধান উদ্দেশু এই, দেশীয় লোকদিগের মান সম্ভ্রম বাড়ে ও দুশৃঙ্খলরূপে কার্যনির্বাহ হয়।

১৮৩১ খৃঃ অব্দে, রাজা রামমোহন রায় ইংলণ্ডে গমন করেন। তিনি কোম্পানি সংক্রান্ত অনেক সম্ভ্রান্ত কর্ম করিয়াছিলেন; সংস্কৃত, আরবী, পারসী, উর্দু, হিব্রু, গ্রীক, লাটিন, ইংরেজী, ফরাসি এই নয় ভাষায় ব্যুৎপন্ন ও বিলক্ষণ বুদ্ধিশক্তিসম্পন্ন ছিলেন, এবং স্বদেশীয় লোকদিগকে, দেব, দেবীর আরাধনা হইতে বিরত করিয়া, বেদান্তপ্রতিপালিত পরব্রহ্মের উপাসনায় প্রবৃত্ত করিবার নিমিত্ত, সবিশেষ যত্নবান হইয়াছিলেন। যে সকল

ব্যক্তির সহিত তাঁহার মতের ঐক্য ছিল না, তাঁহারাও তদীয় বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করিতেন। রামমোহন রায় এ দেশের একজন অসাধারণ মনুষ্য ছিলেন, সন্দেহ নাই। পূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে, লার্ড আমহর্স্ট বাহাদুরের অধিকারকালে, তৈমুরবংশীয়দিগের সাম্রাজ্যনিবন্ধন প্রাধান্ত রহিত হয়। সম্রাট, অপহারিত মর্যাদার উদ্ধারবাসনায়, ইংলণ্ডে 'আপীল করিবার নিশ্চয় করিয়া, রাজা রামমোহন রায়কে উকীল স্থির করেন। পূর্বকালে, সমুদ্রযাত্রাস্বীকারে, ভারতবর্ষীয়দিগের নিন্দা ও অধর্ম হইত না। ইদানীন্তন সমযে, কোনও ব্যক্তি জাহাজে গমন করিলে, তাহাকে জাতিভ্রষ্ট হইতে হয়। কিন্তু, রাজা রামমোহন রায়, অসঙ্কুচিত চিত্তে, জাহাজে আরোহণপূর্বক, ইংলণ্ডে গমন করেন। তিনি, তথায় উপস্থিত হইয়া, যার পর নাই সমাদব প্রাপ্ত হয়েন। তাঁহার এই যাত্রার প্রয়োজন সিদ্ধ হয় নাই। ইংলণ্ডেশ্বর, ত্রিশ বৎসরের বৃত্তিভোগী তৈমুরবংশীয়দিগের আধিপত্যের পুনঃস্থাপন বিষয়ে, সম্মত হইলেন না। কিন্তু, তাঁহাদের যে বৃত্তি নিরূপিত ছিল, রামমোহন রায় তাহার আর তিন লক্ষ টাকা বৃদ্ধির অনুমতি প্রাপ্ত হইলেন। তিনি স্বদেশ প্রত্যাগমনের পূর্বেই, দেহযাত্রাসংবরণপূর্বক, ব্রিস্টল নগরের সন্নিকৃষ্ট সমাধি- ক্ষেত্রে সন্নিবেশিত হইয়াছেন।

১৮৩২ সাল অতিশয় দুর্ঘটনার বৎসর। যে সকল সওদাগরের হৌস, ন্যূনধিক পঞ্চাশ বৎসর, চলিয়া গ্রাসিতেছিল, এই বৎসরে সে সকল দেউলিয়া হইতে লাগিল। সর্বপ্রথমে পামর কোম্পানির হৌস, ১৮৩ সালে, দেউলিয়া হয়। আর পাঁচটার তৎপরে তিন চারি বৎসর পর্যন্ত কর্ম চলিয়াছিল; পরিশেষে, তাহারাও দেউলিয়া হইল। এই ব্যাপার ঘটাতে, সর্বসাধারণ লোকের ষোল কোটি টাকা ক্ষতি হয়। তন্মধ্যে, দেউলিয়াদিগের অবশিষ্ট সম্পত্তি হইতে, দুই কোটি টাকাও আদায় হয় নাই।

পূর্ব মেয়াদ অতীত হইলে, ১৮৩৩ সালে, কোম্পানি বাহাদুর পুনর্বার, বিংশতি বৎসরের নিমিত্ত, সনন্দ পাইলেন। এই উপলক্ষে, এতদ্দেশীয় রাজশাসনের অনেক নিয়ম পরিবর্তিত হইল। কোম্পানীকে ভারতবর্ষীয় বাণিজ্যে একবারে নিঃসম্পর্ক হইতে, ও সমুদায় কুঠী বেচিয়া ফেলিতে হইল। তৎপূর্ব বিশ বৎসর, চীনদেশীয় বাণিজ্যই তাঁহাদের একমাত্র অবলম্বন ছিল; এক্ষণে, তাহাও ছাড়িয়া দিতে হইল। ফলতঃ দুইশত তেত্রিশ বৎসর পর্যন্ত, তাঁহারা যে বণিগ্নগ্ধ ত্তি করিয়া আসিতেছিলেন, তাহাতে একেবারে নিঃসম্বন্ধ হইয়া, রাজশাসন কার্যেই ব্যাপৃত হইতে হইল। কলিকাতায় এক বিধিদায়িনী সভার সংস্থাপনের অনুমতি হইল। এই নিয়ম হইল, তাহাতে কৌন্সিলের নিয়মত মেম্বরেরা, ও কোম্পানির কর্মচারী ভিন্ন আর একজন মেম্বব, বৈঠক করিবেন। এই নূতন সভার কর্তব্য এই নির্ধারিত হইল, যখন যেরূপ আবক্ষক হইবেক, ভারতবর্ষে তখন তদমুরূপ আইন প্রচলিত করিবেন, এবং সুপ্রীম কোর্টের উপর কর্তৃত্ব ও তথাকার বন্দোবস্ত

করিবেন। আর, সমুদয় দেশের জন্য এক আইন প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত, লা কমিশন

নামে এক সভা স্থাপিত হইল। গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর, সমুদয় ভারতবর্ষের সর্বপ্রধান

অধিপতি হইলেন; অন্যান্য রাজধানী তাঁহার অধীন হইল। বাঙ্গালার রাজধানী বিভক্ত

হইয়া, কলিকাতা ও আগরা, দুই স্বতন্ত্র রাজধানী হইল। লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক, প্রজাগণের বিদ্যাবৃদ্ধি বিষয়ে যত্নবান হইয়া, ইংরেজী শিক্ষায় সবিশেষ উৎসাহ দিয়াছিলেন। ১৮১৩ সালে, পার্লিমেন্টের অনুমতি হয়, প্রজাদিগের বিদ্যাশিক্ষা বিষয়ে, রাজস্ব হইতে, প্রতিবৎসর, লক্ষ টাকা দেওয়া যাইবেক। এই টাকা, প্রায় সমুদায়ই, সংস্কৃত ও আরবী বিদ্যার অনুশীলনে ব্যয়িত হইত। লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক, ইংরেজী ভাষার অনুশীলনে তদপেক্ষা অধিক উপকার বিবেচনা করিয়া, উক্ত উভয় বিষয়ের ব্যয়সংক্ষেপ, ও স্থানে স্থানে ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপন, করিবার অনুমতি দিলেন। তদবধি, এতদ্দেশে, ইংরেজী ভাষার বিশিষ্টরূপ অনুশীলন হইতে আরম্ভ হইয়াছে।

লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক, দেশীয় লোকদিগকে মুরোপীয় চিকিৎসা বিদ্যা শিখাইবার নিমিত্ত, কলিকাতায়, মেডিকেল কলেজ নামক বিদ্যালয় স্থাপিত করিয়া, দেশের সাতিশয় মঙ্গল- বিধান করিয়াছেন। চিকিৎসা বিষয়ে নিপুণ হইবার নিমিত্ত, ছাত্রদিগের যে যে বিদ্যার শিক্ষা আবশ্যক, সে সমূদয়ের পৃথক পৃথক অধ্যাপক নিযুক্ত হইলেন।

সকল ব্যক্তিই কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ সঞ্চয় করিতে পারিবেক, এই অভিপ্রায়ে, লার্ড উইলিয়ম বেন্টিকের অধিকার সময়ে, সেবিংস বেঙ্ক স্থাপিত হয়। যদর্থে উহা স্থাপিত হয়, সম্পূর্ণরূপে তাহা সফল হইয়াছে।

লার্ড বেন্টিক বাহাদুর পঞ্চোত্তরা মাশুল বিষয়েও মনোযোগ দিয়াছিলেন। বহুকাল অবধি এই রীতি ছিল, দেশের এক স্থান হইতে স্থানান্তরে কোন দ্রব্য লইয়া যাইতে হইলে, মাসুল দিতে হইত; তদনুসারে, কি জলপথ কি স্থলপথ, সর্বত্র এক এক পরমিট স্থাপিত হয়। তথায়, দ্রব্য সকল আটকাইয়া তদারক করিবার নিমিত্ত, অনেক কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। পরমিটের কর্মচারীরা যে স্থলে গবর্ণমেন্টের মাশুল এক টাকা আদায় করিত, সেখানে আপনারা নিজে অন্ততঃ দুই টাকা লইত। ফলতঃ, তাহারা প্রজার উপর এমন দারুণ অত্যাচার করিত যে, এ বিষয়ে অধিকৃত একজন বিচক্ষণ য়ুরোপীয়, যথার্থ বিবেচনাপূর্বক, এই ব্যাপারকে অভিসম্পাত নামে নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন।

ইংরেজেরা যখন মুসলমানদের হস্ত হইতে রাজশাসনের ভারগ্রহণ করেন, তখন এই ব্যাপার প্রচলিত ছিল; এবং তাঁহারাও নিজে এ পর্যন্ত প্রচলিত রাখিয়া ছিলেন। কিন্তু, বিচক্ষণ লার্ড কর্নওয়ালিস বাহাদুর, ওই ব্যাপারকে দেশের বিশেষ ক্ষতিকর বোধ করিয়া, ১৭৮৮ সালে, একবারে রহিত করেন, এবং দেশের মধ্যে যেখানে যত পরমিটঘর ছিল, সমূদয় উঠাইয়া দেন। ইহার তের বৎসর পরে গবর্ণমেন্ট, কর সংগ্রহের নূতন নূতন পন্থা বহিষ্কৃত করিতে উদ্যত হইয়া, পুনর্বার এই মাস্থলের নিয়ম প্রবর্তিত করেন। এক্ষণে, লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক, সি, ই, ট্রিবিলিয়ন সাহেবকে, এই বিষয়ে, সবিশেষ অনুসন্ধান করিয়া, রিপোর্ট করিতে আজ্ঞা দিলেন; পরে, এই মাসুল উঠাইবার সদুপায় স্থির করিবার সিমিত্ত, একটি কমিটি স্থাপিত করিলেন। এই ব্যাপার, উক্ত লাট বাহাদুরের অধিকার কালে, রহিত হয় নাই বটে; কিন্তু তিনি, ইহার প্রথম উদ্যোগী বলিয়া, অশেষ প্রকারে প্রশংসাভাজন হইতে পারেন।

লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক, আপন অধিকারের প্রারম্ভ অবধি, এতদ্দেশে সমুদ্রে ও নদীতে বাষ্প নাবিককর্ম প্রচলিত করিবার নিমিত্ত, সবিশেষ যত্নবান ছিলেন। যাহাতে ইংলণ্ডের ও ভারতবর্ষের সংবাদ, মাসে মাসে, উভয়ত্র পহুছিতে পারে, তিনি তাহার যথোচিত চেষ্টা করিতে ত্রুটি করেন নাই। কিন্তু ডিরেক্টরেরা এবিষয়ে বিস্তর বাধা দিয়াছিলেন। তিনি, বোম্বাই হইতে সুয়েজ পর্যন্ত পুলিন্দা লইয়া যাইবার নিমিত্ত, বাষ্পনৌকা নিযুক্ত করিয়াছিলেন; তন্নিমিত্ত তাঁহারা যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করেন। যাহা হউক, লার্ড বেন্টিক, বাঙ্গালা ও পশ্চিমাঞ্চলের নদ নদীতে, লৌহ নির্মিত বাষ্পজাহাজ চালাইবার বিষয়ে, তাঁহাদিগকে সম্মত করিলেন। এই বিষয়ে, যুবোপীয় ও এতদ্দেশীয় লোকদিগের পক্ষে, বিলক্ষণ উপকারক হইয়াছে।

১৮৩৫ সালের মার্চ মাসে, লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক বাহাদুরের অধিকার সমাপ্ত হয়। তাঁহার অধিকারকালে, ভিন্নদেশীয় নরপতিগণের সহিত যুদ্ধনিবন্ধন কোনও উদ্বেগ ছিল না। এক দিবসেব জন্যেও, সন্ধি ও শাস্তিব ব্যাঘাত ঘটে নাই। তাঁহার অধিকার কাল কেবল প্রজাদিগেব শ্রীবৃদ্ধিকল্পে সঙ্কল্পিত হইয়াছিল।

10
Articles
বিদ্যাসাগর রচনাবলী
0.0
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) এমন একটি বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব, যা আজকের দিনে প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। ওনার লেখা একাধিক কিছু রচনা সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এই রচনাবলি বইটি।
1

ভূমিকা

27 December 2023
0
0
0

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশ এমন কয়েকটি বিদ্যুৎ-গর্ভ ব্যক্তিকে সৃষ্টি করেছিল যাদের আশীর্বাদের পুণ্যফল এখনও আমরা ভোগ করছি। প্রাগাধুনিক যুগের গৌড়বঙ্গে বিচিত্র প্রতিভাধর ব্যক্তির যে আবির্ভাব হয় নি, তা নয়। কি

2

বেতাল পঞ্চবিংশতি

27 December 2023
0
0
0

উপক্রমণিকা উজ্জয়িনী নগরে গন্ধর্বসেন নামে রাজা ছিলেন। তাঁহার চারি মহিষী। তাঁহাদের গর্ভে রাজার ছয় পুত্র জন্মে। রাজকুমারের সকলেই সুপণ্ডিত ও সর্ব বিষয়ে বিচক্ষণ ছিলেন। কালক্রমে, নৃপতির লোকান্তরপ্রাপ্তি হই

3

বাঙ্গালার ইতিহাস [দ্বিতীয় ভাগ]

29 December 2023
0
0
0

প্রথম অধ্যায় ১৭৫৬ খৃষ্টীয় অব্দের ১০ই এপ্রিল, সিরাজউদ্দৌলা বাঙ্গালা ও বিহারের সিংহাসনে অধিরূঢ় হইলেন। তৎকালে, দিল্লীর অধীশ্বর এমন দুরবস্থায় পড়িয়াছিলেন যে, নূতন নবাব তাঁহার নিকট সনন্দ প্রার্থনা করা আবঞ্

4

জীবন চরিত

31 December 2023
0
0
0

জীবনচরিতপাঠে দ্বিবিধ মহোপকার লাভ হয়। প্রথমতঃ, কোন কোন মহাত্মারা অভিপ্রেতার্থসম্পাদনে কৃতকার্য্য হইবার নিমিত্ত যেরূপ অক্লিষ্ট পরিশ্রম, অবিচলিত উৎসাহ, মহীয়সী সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তর অধ্যবসায় প্রদর্শন করিয়াছেন

5

বাল্যবিবাহের দোষ

2 January 2024
0
0
0

অষ্টমবর্ষীয় কন্যা দান করিলে পিতা মাতার গৌরীদানজ্য পুণ্যোদয় হয়, নবম- বর্ষীয়াকে দান করিলে পৃথ্বী দানের ফল লাভ হয়; দশমবর্ষীয়াকে পাত্রসাৎ করিলে পরত্র পবিত্রলোকপ্রাপ্তি হয়, ইত্যাদি স্মৃতিশাস্ত্রপ্রতিপাদিত

6

বোধোদয়

2 January 2024
0
0
0

পদার্থ আমরা ইতস্ততঃ যে সকল বস্তু দেখিতে পাই, সে সমৃদয়কে পদার্থ বলে। পদার্থ দ্বিবিধ; সজীব ও নির্জীব। যে সকল বস্তুর জীবন আছে, অর্থাৎ যাহাদের জন্ম, বৃদ্ধি ও মৃত্যু আছে, উহারা সঞ্জীব পদার্থ; যেমন মনু্য,

7

সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা

4 January 2024
0
0
0

বর্ণমালা ১। অইউ, কখগ ইত্যাদি এক একটিকে বর্ণ ও অক্ষর বলে। বর্ণ' সমুদায়ে পঞ্চাশটি। তন্মধ্যে ষোলটি স্বর, চৌত্রিশটি হল্। এই পঞ্চাশটি অক্ষরকে বর্ণমালা বলে। স্বরবর্ণ ২। অআইঈউউত্তপ্ত ৯৪ এ ঐ ও ঔ অং অঃ। এই

8

বিভিন্ন গ্রন্থের বিজ্ঞাপন

5 January 2024
0
0
0

ঋজুপাঠ প্রথম ভাগ বিজ্ঞাপন ঋজুপাঠের প্রথম ভাগ প্রচারিত হইল। ইহাতে পঞ্চতন্ত্রের কয়েকটা উপাখ্যান ও মহাভারতের কিয়দংশ উদ্ধৃত করা গিয়াছে। পঞ্চতন্ত্রের রচনাপ্রণালী দৃষ্টে স্পষ্ট বোধ হইতেছে, ইহা অতি প্রাচী

9

ঘটনাপঞ্জী

5 January 2024
0
0
0

ঘটনাপঞ্জী ১৮২০ খৃঃ অব্দ, ২৬শে সেপ্টেম্বর, সন ১২২৭, শকাব্দ ১৭৪২, ১২ই আশ্বিন মঙ্গলবার দিবা দ্বিপ্রহরে, মেদিনীপুর অন্তর্গত বীরসিংহ গ্রামে পিতামাতার প্রথম সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-ঠাকুরদাস

10

গ্রন্থপঞ্জী

6 January 2024
0
0
0

অমূল্যত্বক ঘোষ-বিদ্যাসাগর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ ও বাংলা সাহিত্য ইন্দ্র মিত্র-সাজঘর কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য-পুরাতন প্রসঙ্গ গোপিকামোহন ভট্টাচার্য-History of Sanskrit College

---