shabd-logo

শঙ্কুর শনির দশা

5 November 2023

6 Viewed 6

৭ই জুন

আমাকে দেশ বিদেশে অনেকে অনেক সময় জিজ্ঞাসা করেছে আমি জ্যোতিষে বিশ্বাস করি। কি না। প্রতিবারই আমি প্রশ্নটার একই উত্তর দিয়েছি—আমি এখনও এমন কোনও জ্যোতিষীর সাক্ষাৎ পাইনি যাঁর কথায় বা কাজে আমার জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর বিশ্বাস জন্মাবে। কিন্তু আজ থেকে তিন মাস আগে অবিনাশবাবু যে জ্যোতিষীকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসেন, আজ আমি বলতে পারি যে তাঁর গণনা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে।

অবিশ্যি এটাও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে গণনা না ফললেই বেশি খুশি হতাম। তিনি বলেছিলেন, 'আজ থেকে তিন মাস পরে তোমার চরম সংকটের দিন আসছে। শনির দৃষ্টি পড়বে তোমার উপর। এমনই অবস্থায় পড়বে যে, মনে হবে এর চেয়ে মৃত্যুও ভাল।' এ অবস্থা থেকে মুক্তি হবে কি না জিজ্ঞেস করাতে বললেন, 'যে তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু, তাকে সংহার করতে পারলে তবেই মুক্তি। আমি স্বভাবতই জিজ্ঞেস করলাম এ শত্রুটি কে। তাতে তিনি ভারী রহস্যজনকভাবে একটু হেসে বললেন, 'তুমি নিজে।'

এই রহস্যের কিনারা এখনও হয়নি, কিন্তু সংকট যেটা এসেছে তার চেয়ে মৃত্যু যে ভাল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই সংকটের সূত্রপাত আজই পাওয়া একটি চিঠিতে। দু' মাস আগে আমি ম্যাড্রিড থেকে একটা বিজ্ঞানী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ পাই। এই চিঠিতে সম্মেলনের উদ্যোক্তা বিশ্ববিখ্যাত প্রাণিতত্ত্ববিদ্‌ ডি-সান্টস লিখেছিলেন, 'আমরা সকলেই বিশেষ করে তোমাকে চাই। তুমি না এলে আমাদের সম্মেলন যথেষ্ট মর্যাদা লাভ করবে না। আশা করি তুমি আমাদের হতাশ করবে না।' এ চিঠি পাবার তিন দিন পরে আমার বন্ধু জন সামারভিল ইংল্যান্ড থেকে আমাকে লেখে ম্যাডিড যাবার জন্য বিশেষ অনুরোধ জানিয়ে। ডি-সান্টসকে হতাশ করার কোনও অভিপ্রায় আমার ছিল না। বছরে অন্তত একবার করে বিদেশে গিয়ে নানান দেশের নানান বয়সের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আমার নিজের চিন্তাকে সঞ্জীবিত করা—এটা আমার একটা অভ্যাসের মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছে। এর ফলেই বয়স সত্ত্বেও আমার দেহ মন এখনও সঞ্জীব ।

ম্যাড্রিডের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যে চিঠি লিখি, তারও জবাব আমি দু সপ্তাহের মধ্যে পেয়ে যাই। ১৫ই জুন, অর্থাৎ আজ থেকে আট দিন পরে, আমার রওনা হবার কথা । এই অবস্থায় বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো আজকের চিঠি। মাত্র তিন লাইনের চিঠি। তার মর্ম হচ্ছে—ম্যান্ড্রিড বিজ্ঞানী সম্মেলনের কর্তৃপক্ষ তাঁদের আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করছেন। পরিষ্কার ভাষা। তাঁরা চান না যে আমি এ সম্মেলনে যোগদান করি। কারণ ? কারণ কিছু বলা নেই চিঠিতে।

এ থেকে কী বুঝতে হবে আমায়? কী এমন ঘটতে পারে, যার ফলে এঁরা আমাকে অপাঙক্তেয় বলে মনে করছেন ?

উত্তর আমার জানা নেই। কোনও দিন জানতে পারব কি না তাও জানি না । আজ আর লিখতে পারছি না। দেহ মন অবসন্ন। আজ এখানেই শেষ করি

১০ই জুন

আজ সামারভিলের চিঠি পেলাম। সেটা অনুবাদ করলে এই দাঁড়ায়—

প্রিয় শম্ভু,

তুমি দেশে ফিরেছ কি না জানি না। ইন্‌সব্রুকে গত মাসে তোমার বক্তৃতা সম্পর্কে কাগজে যা বেরিয়েছে সেটা পড়ে আমি দু' রাত ঘুমোতে পারিনি। নিঃসন্দেহে তুমি কোনও কঠিন মানসিক পীড়ায় ভুগছ, না হলে তোমার মুখ দিয়ে এ ধরনের কথা উচ্চারণ হতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। আমি খবরটা পড়ে ইন্‌সব্রুকে প্রোফেসর স্টাইনারকে ফোন করেছিলাম। তিনি বললেন বক্তৃতার পরে তোমার আর কোনও খবর জানেন না। আশঙ্কা হয় তুমি ইউরোপেই কোথাও আছ, এবং অসুস্থ হয়ে পড়েছ। তা যদি না হয়, যদি এ চিঠি তোমার হাতে পড়ে, তা হলে পত্রপাঠ আমাকে টেলিগ্রামে তোমার কুশল সংবাদ জানাবে, এবং সেই সঙ্গে চিঠিতে তোমার এই অভাবনীয় আচরণের কারণ জানাবে। ইতি তোমার

জন সামারভিল

পুনঃ—খবরটা কীভাবে টাইমস্-এ প্রকাশিত হয়েছে, সেটা জানাবার জন্য এই কাটিং । প্রথমেই বলি রাখি যে আমি ইন্‌সব্রুকে গত মাসে কেন, কোনও কালেই যাইনি ।

এইবার টাইমস-এর খবরের কথা বলি। তাতে লিখছে—বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় বৈজ্ঞানিক প্রোঃ টি. শঙ্কু গত ১১ই মে অস্ট্রিয়ার ইন্‌সব্রুক শহরে বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্বন্ধে একটা বক্তৃতা দেন। সভায় স্থানীয় এবং ইউরোপের অন্যান্য শহরের অনেক বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক উপস্থিত ছিলেন। প্রোঃ শঙ্কু এইসব বৈজ্ঞানিকদের সরাসরি কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেন। ফলে শ্রোতাদের মধ্যে তুমুল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়, এবং অনেকেই বক্তাকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে মঞ্চের দিকে অগ্রসর হন। জনৈক শ্রোতা একটি চেয়ার তুলে প্রোঃ শঙ্কুর দিকে নিক্ষেপ করেন। অতঃপর ইন্‌সব্রুক-নিবাসী পদার্থবিজ্ঞানী ডক্টর কার্ল গ্রোপিয়াস বক্তাকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেন।

এই হল খবর । সামারভিল যেমন চেয়েছিল, আমি তার চিঠি পাওয়ামাত্র জবাব লিখে সে চিঠি নিজে ডাকে ফেলে এসেছি। কিন্তু তাতে আমি কী ফল আশা করতে পারি ? সামারভিল কি আমার কথা বিশ্বাস করবে ? কোনও সুস্থমস্তিষ্ক মানুষ কি বিশ্বাস করবে যে আমারই পরিবর্তে অবিকল আমারই মতো দেখতে একজন লোক ইন্‌সব্রুকে গিয়ে এই বক্তৃতা দিয়ে আমার সর্বনাশ করেছে ? সামারভিলের সঙ্গে আমার তেত্রিশ বছরের বন্ধুত্ব সে-ই যদি বিশ্বাস না করে তো কে করবে ? খবরে বলেছে যে, ডক্টর গ্রোপিয়াস আমাকে—অর্থাৎ এই রহস্যজনক দ্বিতীয় শঙ্কুকে বাঁচান। প্রোপিয়াসকে আমি চিনি। সাত বছর আগে বাগদাদে আন্তর্জাতিক আবিষ্কারক সম্মেলনে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। স্বল্পভাষী অমায়িক ব্যক্তি বলে মনে হয়েছিল। সামারভিলের সঙ্গে তাঁকেও একটা চিঠি লিখে দিয়েছি।

নিজেকে এত অসহায় আর কখনও মনে হয়নি। আশঙ্কা হচ্ছে, বাকি জীবনটা এই বিশ্রী কলঙ্কের বোঝা কাঁধে নিয়ে গিরিডি শহরে দাগি আসামির মতো কাটাতে হবে ।

২১শে জুন

গ্রোপিয়াসের চিঠি—এবং অত্যন্ত জরুরি চিঠি। আজই ইন্‌সব্রুক যাবার বন্দোবস্ত করতে হবে।

টাইমস-এর বিবরণ যে অতিরঞ্জিত নয় সেটা গ্রোপিয়াসের চিঠিতে বুঝলাম। রুমানিয়ার মাইক্রো-বায়োলজিস্ট জর্জ পোপেঙ্গু নাকি আমার দিকে চেয়ার ছুড়ে মারেন। এনজাইম সম্পর্কে তাঁর মহামূল্য গবেষণাকে আমি নাকি অবাচীন বলে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। ফলে অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই তিনি প্রচণ্ডভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। প্রোপিয়াস মঞ্চে আমার পাশেই বসে ছিল; সে আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে এক পাশে সরিয়ে আমার প্রাণ বাঁচায়। চেয়ারটা একটা মাইক্রোফোনকে বিকল করে দিয়ে টেবিলের উপর রাখা জল ভর্তি দুটো কাচের গেলাসকে চুরমার করে দেয়। গ্রোপিয়াস লিখছে—

“তোমাকে আমি হাত ধরে টেনে সটান লাইবনিৎস হলের বাইরে নিয়ে আসি । তুমি তখন এত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলে যে, তোমাকে ধরে রাখা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল । বাইরে আমার গাড়ি অপেক্ষা করছিল; কোনওরকমে তাতে তোমাকে তুলে আমি রওনা দিই। হাত ধরেই বুঝেছিলাম যে, তোমার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা ছিল হাসপাতালে নিয়ে যাব, কিন্তু এক কিলোমিটার গিয়ে একটা চৌমাথায় ট্র্যাফিক লাইটের দরুন গাড়িটা থামার সঙ্গে সঙ্গে তুমি দরজা খুলে নেমে পালাও। তারপর অনেক খুঁজেও আর তোমার দেখা পাইনি। তোমার চিঠি পেয়ে বুঝলাম তুমি দেশে ফিরে গেছ। বিদেশি বৈজ্ঞানিক মহলে তোমার নামে যে কলঙ্ক রটেছে সেটা কীভাবে দূর হবে জানি না, তবে তুমি যদি একবার ইন্‌সব্রুকে আসতে পার, তা হলে ভাল ডাক্তারের সন্ধান দিতে পারি। তোমাকে পরীক্ষা করে যদি কোনও মস্তিষ্ক বা স্নায়ুর গণ্ডগোল ধরা পড়ে, তা হলে সে দিনকার ঘটনার একটা স্পষ্ট কারণ পাওয়া যাবে, এবং সেটা তোমার পক্ষে সুবিধাজনক হবে। অসুখ যদি হয়েই থাকে তা হলে চিকিৎসার কোনও ত্রুটি হবে না ইন্‌সব্রুকে।

গ্রোপিয়াস ইন্‌সব্রুকের একটা কাগজ থেকে সেদিনকার ঘটনার একটা ছবিও পাঠিয়ে দিয়েছে। হন্তদন্ত গ্রোপিয়াস 'আমার পিঠে হাত দিয়ে 'আমাকে' এক পাশে সরিয়ে দিচ্ছেন। এই 'আমি'-র সঙ্গে আমার চেহারার কোনও পার্থক্য ছবিতে ধরতে পারলাম না। কেবল আমার চশমাটা—যেটা ছবিতে দেখছি প্রায় খুলে এসেছে— সেটার কাচ স্বচ্ছ না হয়ে ঘোলাটে বলে মনে হচ্ছে। 'আমার' ডাইনে বাঁয়ে টেবিলের পিছনে বসা ব্যক্তিদের মধ্যে আরও দুজনকে চেনা যাচ্ছে; একজন হলেন রুশ বৈজ্ঞানিক ডক্টর বোরোডিন, আর অন্যজন ইনকেরই তরুণ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রোফেসর ফিংকেলস্টাইন। ফিংকেলস্টাইন তার হাত দুটো আমার দিকে বাড়িয়ে রয়েছে। হয়তো সেও আমাকে আক্রমণ করতে যাচ্ছিল ।

আজ সারা দিন ধরে গভীরভাবে চিন্তা করে বুঝেছি যে, আমাকে ইন্‌সব্রুক যেতেই হবে। সেই জ্যোতিষীর কথা মনে পড়ছে। সে বলেছিল, আমার এই পরম শত্রুটিকে সংহার না করলে আমার মুক্তি নেই। আমার মন বলছে, এই ব্যক্তি এখনও ইন্‌সব্রুকেই রয়েছে আত্মগোপন করে। তার সন্ধানই হবে এখন আমার একমাত্র লক্ষ্য । সামারভিলকে লিখে দিয়েছি আমার সংকল্পের কথা। দেখা যাক কী হয় ।

২৩শে জুন

আজ নতুন করে আমার মনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

আমার ডায়রি খুলে গত তিন মাসের দিনলিপি পড়ে দেখছিলাম। মে মাসের তেসরা থেকে বাইশে পর্যন্ত দেখলাম কোনও এনট্রি নেই। সেটা অস্বাভাবিক নয়, কারণ উল্লেখযোগ্য কিছু না ঘটলে আমি ডায়রি লিখি না। কিন্তু খটকা লাগছে এই কারণে যে, ওই সময়টাতেই ইন্‌সব্রুকের ঘটনাটা ঘটেছিল। এমন যদি হয় যে আমি ইন্‌সব্রুকের নেমন্তন্ন পেয়েছিলাম, ইন্‌সব্রুকে গিয়েছিলাম, ওই রকম বক্তৃতাই দিয়েছিলাম, এবং তারপর ইন্‌সব্রুক থেকে ফিরে এসেছিলাম—কিন্তু এই পুরো ঘটনাটাই আমার মন থেকে লোপ পেয়ে গেছে ? কোনও সাময়িক মস্তিষ্কের ব্যারাম থেকে কি এ ধরনের বিস্মৃতি সম্ভব ? এটা অবিশ্যি খুব সহজেই যাচাই করা যেত দুঃখের বিষয় যে দুটি ব্যক্তির সঙ্গে গিরিডিতে আমার প্রতি দিনই দেখা হয়, তাদের একজনও ওই সময়টা এখানে ছিলেন না। আমার চাকর প্রহ্লাদ গত দু মাস হল ছুটি নিয়ে দেশে গেছে। যাকে বদলি দিয়ে গেছে, সেই ছেদিলালকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বললাম, 'গতমাসে আমি গিরিডি ছেড়ে কোথাও গিয়েছিলাম কি না তোমার মনে আছে ? সে চোখ কপালে তুলে বলল, 'আপনার স্মরোন থাকবে না তো হামার থাকবে কেইসন বাবু ? আমারই ভুল হয়েছে। এ জিনিস কাউকে জিজ্ঞেস করা যায় না। একজনকে জিজ্ঞেস করা যেত; আমার বন্ধু অবিনাশবাবু। কিন্তু তিনি গত শুক্রবার চাইবাসা চলে গেছেন তাঁর ভাগনির বিয়েতে।

ইন্‌সব্রুকের কোনও চিঠি আমার ফাইলের মধ্যে পাইনি। আশা করি আমার আশঙ্কা

অমূলক ।

আমি ৬ই জুলাই ইন্‌সব্রুক রওনা হচ্ছি। কপালে কী আছে কে জানে ।

৭ই জুলাই

ইন্‌সব্রুক। বিকেল চারটে। ভিয়েনা থেকে ট্রেন ধরে সকাল দশটায় পৌঁছেছি এখানে। ছবি সমেত নকল-শঙ্কুর বক্তৃতা এখানকার কাগজে বেরোনোর যে কী ফল হয়েছে, সেটা শহরে পদার্পণ করেই বুঝেছি। পরপর তিনটে হোটেলে আমাকে জায়গা দেয়নি। তৃতীয় হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়েছিলাম, ড্রাইভার মাথা নেড়ে না করে দিল। শেষটায় হাতে ব্যাগ নিয়ে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট হেঁটে একটা গলির ভিতর ছোট্ট একটা সরাইখানা গোছের হোটেলে ঘর পেলাম। মালিকের পুরু চশমা দেখে মনে হল সে ভাল চোখে দেখে না, আমার বিশ্বাস সেই কারণেই আতিথেয়তার কোনও ত্রুটি হল না । কিন্তু এভাবে গা ঢাকা দিয়ে থেকে কাজের বেশ অসুবিধে হবে বলে মনে হচ্ছে।

আজ রাত্রে সামারভিল আসছে। তাকে গিরিডি থেকেই ইন্‌সব্রুকে যাচ্ছি বলে লিখেছিলাম, এবং এখানে এসেই টেলিফোন করেছি। তার জরুরি কাজ ছিল, তাও সে আসবে বলে কথা দিয়েছে।

গ্রোপিয়াসকে ফোন করেছিলাম। তার সঙ্গে আজ সাড়ে পাঁচটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। সে থাকে এখান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে। বলেছে গাড়ি পাঠিয়ে দেবে ।

আরও একজনকে ফোন করা হয়ে গেছে এরমধ্যে প্রোফেসর ফিংকেলস্টাইন। শুধু একজনের কাছ থেকে ঘটনার বিবরণ শুনলে চলবে না, তাই ফিংকেলস্টাইনের সঙ্গে কথা বলা দরকার। ভদ্রলোক বাড়ি ছিলেন না। চাকর ফোন ধরেছিল। আমার নম্বর দিয়ে দিয়েছি, বলেছি এলেই যেন ফোন করেন।

পাহাড়ে ঘেরা অতি সুন্দর শহর ইন্‌সব্রুক। যুদ্ধের সময় অনেক কিছুই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, এখন আবার সব নতুন করে গড়েছে। অবিশ্যি শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো মনের অবস্থা আমার নেই। আমার এখন একমাত্র লক্ষ্য হল সেই জ্যোতিষীর গণনায় নির্ভর করে আমার মুক্তির পথ খোঁজা ।

৭ই জুলাই, রাত সাড়ে দশটা

গ্রোপিয়াসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ঘটনাটা গুছিয়ে লিখতে চেষ্টা করছি ।

পাঁচটার কিছু আগেই আমার এই অ্যাপোলো হোটেলের একটি ছোকরা এসে খবর দিল হে প্রোফেসর শাকোর জন্য গাড়ি পাঠিয়েছেন হের ডকটর গ্রোপিয়ুস। গাড়ির চেহারা দেখে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলাম। এক কালে —অর্থাৎ অন্তত ত্রিশ বছর আগে—এটা হয়তো বেশ বাহারের গাড়ি ছিল, কিন্তু এখন রীতিমতো জীর্ণদশা। প্রোপিয়াস কি দরিদ্র, না কৃপণ ?

পাঁচটার মধ্যেই গ্রুনেওয়াল্ডট্রাসে পৌঁছে গেলাম। এই রাস্তাতেই প্রোপিয়াসের বাড়ি। একটা প্রাচীন গির্জা ও গোরস্থান পেরিয়ে গাড়িটা বাঁয়ে একটা গেটের ভিতর দিয়ে ঢুকে গেল। বাড়িটাও দেখলাম গাড়িরই মতো। গেট থেকে সদর দরজা পর্যন্ত রাস্তার দু' পাশে বাগান আগাছায় ভরে আছে, অথচ আসবার পথে অন্যান্য বাড়ির সামনের বাগানে ফুলের প্রাচুর্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেছে ।

বাগদাদে গ্রোপিয়াসের চেহারা যা মনে ছিল, তার তুলনায় এবারে তাকে অনেক বেশি বিধ্বস্ত বলে মনে হল। সাত বছরে এত বেশি বুড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। হয়তো কোনও পারিবারিক দুর্ঘটনা ঘটে থাকবে। আমি এ ব্যাপারে কোনও অনুসন্ধিৎসা প্রকাশ করলাম না, কারণ তার নিজের স্বাস্থ্যের চেয়ে আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কে সে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন বলে মনে হল ।

বৈঠকখানায় দুজনে মুখোমুখি বসার পর প্রোপিয়াস বেশ মিনিট দুয়েক ধরে আমাকে পর্যবেক্ষণ করল। শেষটায় আমাকে বাধ্য হয়েই হালকাভাবে জিজ্ঞেস করতে হল, 'আমিই

সেই শঙ্কু কি না সেটা ঠাহর করতে চেষ্টা করছ?' গ্রোপিয়াস আমার প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে যে কথাটা বলল, তাতে আমার ভাবনা দ্বিগুণ বেড়ে গেল ।

“ডক্টর ওয়েবার আসছেন। তিনি তোমাকে পরীক্ষা করে দেখবেন। সে দিন তোমাকে ওয়েবারের ক্লিনিকেই নিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তুমি সে সুযোগ দাওনি। আশা করি এবারে তুমি আপত্তি করবে না। একমাত্র আমিই বিশ্বাস করি যে সে দিন তুমি অসুস্থ ছিলে বলেই এ সব কথা বলতে পেরেছিলে। অন্য যারা ছিল তারা আমার সঙ্গে একমত নয়। তারা এখনও পেলে তোমাকে ছিঁড়ে খাবে। কিন্তু ওয়েবারের পরীক্ষার ফলে যদি প্রমাণ হয় যে তোমার মাথায় গোলমাল হয়েছে, তা হলে হয়তো এরা তোমাকে ক্ষমা করবে। শুধু তাই নয় : চিকিৎসার সাহায্যে সুস্থ হয়ে তুমি হয়তো আবার তোমার সুনাম ফিরে পাবে।

আমি অগত্যা বলতে বাধ্য হলাম যে গত চল্লিশ বছরে এক দিনের জন্যেও আমি অসুস্থ হইনি। দৈহিক, মানসিক, কোনও ব্যাধির সঙ্গেই আমার পরিচয় নেই ।

গ্রোপিয়াস বলল, তা হলে কি তুমি বলতে চাও যে এত সব নামকরা বৈজ্ঞানিক—শিমানোস্কি, রিটার, পোপেস্কু, আমান, স্ট্রাইখার, এমন কী আমি নিজে—এদের সম্বন্ধে তুমি এত নীচ ধারণা পোষণ কর ?' আমি যথাসম্ভব শান্তভাবে বললাম, 'গ্রোপিয়াস, আমি বিশ্বাস করি যে আমারই মতো দেখতে আর একজন লোক রয়েছে, যে নিজে বা অন্য কোনও লোকের প্ররোচনায় আমাকে অপদস্থ করার জন্য এই সব করছে।'

“তা হলে সে লোক এখন কোথায় ? সে দিন আমার গাড়ি থেকে নেমে সে শহর থেকে কি ভ্যানিস করে গেল ? তোমার না হয় পাসপোর্ট ছিল, টিকিট ছিল, তুমি সোজা প্লেন ধরে দেশে ফিরে গেছ, কিন্তু একজন প্রতারকের পক্ষে তো হঠাৎ শহর থেকে পালানো এত সহজ নয়।'

আমি বললাম, 'আমার বিশ্বাস সে লোক এই শহরেই আছে। এমনও হতে পারে যে সে একজন অখ্যাত বৈজ্ঞানিক, অনেক জায়গায় আমাকে দেখেছে, আমার বক্তৃতা শুনেছে। বোঝাই যাচ্ছে আমার সঙ্গে তার কিছুটা সাদৃশ্য আছে, বাকিটা সে মেকআপের সাহায্যে পুষিয়ে নিয়েছে।

প্রোপিয়াসের চাকর হট চকোলেট দিয়ে গেল। চাকরের সঙ্গে সঙ্গে একটা কুকুরও এসে ঘরে ঢুকেছে, বুঝলাম সেটা জাতে ডোবারমান পিশার। কুকুরটা আমাকে দেখে লেজ নাড়তে নাড়তে কাছে এসে আমার প্যান্ট শুঁকতে লাগল। কিন্তু তার পরেই দেখলাম সে আমার মুখের দিকে চেয়ে বার তিনেক গর্র গর্র শব্দ করল। গ্লোপিয়াস 'ফ্রিকা, ফ্রিকা' বলে দু' বার ধমক দিতেই সে যেন বিরক্ত হয়ে আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে কিছু দূরে কার্পেটের উপর বসে পড়ল ।

"তুমি এখানে এসেছ বলে আর কেউ জানে কি ?' গ্রোপিয়াস প্রশ্ন করল।

আমি বললাম, 'ইন্‌সব্রুকে আমার জানা বলতে আর একজনই আছেন। তাঁকে এসে ফোন করেছিলাম, কিন্তু তিনি বাড়ি ছিলেন না। তাঁর চাকরকে আমার ফোন নম্বর দিয়ে দিয়েছি।' "কে তিনি ?'

আমি একটু হেসে বললাম, "তিনিও প্রোফেসর শঙ্কুর বক্তৃতায় উপস্থিত ছিলেন। তোমার পাঠানো খবরের কাগজের ছবিতে তাঁকে দেখলাম।"

গ্রোপিয়াস ভূ কুঞ্চিত করল ।

'কার কথা বলছ তুমি ?

"প্রোফেসর ফিংকেলস্টাইন। '

"আই সি।

খবরটা শুনে গ্রোপিয়াসকে তেমন প্রসন্ন বলে মনে হল না। প্রায় আধমিনিট চুপ থাকার পর আমার দিকে সোজা তাকিয়ে বলল, 'ফিংকেলস্টাইনের গবেষণা সম্বন্ধে সে দিন তুমি কী

বলেছিলে সেটা মনে আছে ?' আমি বাধ্য হয়েই মাথা নেড়ে 'না' বললাম ।

যদি মনে থাকত, তা হলে আর তাকে ফোন করতে না। তুমি বলেছিলে, একটি তিন বছরের শিশুও তার চেয়ে বেশি বুদ্ধি রাখে। '

আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। খুব ভাল করেই জানি, এই উম্মাদ বক্তৃতার জন্য আমি দায়ী নই, কিন্তু এখানকার লোকের যদি সত্যিই ধারণা হয়ে থাকে যে এই প্রতারকই হচ্ছে আসল শঙ্কু, তা হলে আমার বিপদের শেষ নেই। প্রোপিয়াস ছাড়া কি তা হলে আমি কারুর উপরেই ভরসা রাখতে পারব না ?

একটা গাড়ির শব্দ ।

“এই বোধ হয় ওয়েবার এল, বলল গ্রোপিয়াস ।

ডাক্তারকে আমার ভাল লাগল না। জার্মানির তুলনায় অস্ট্রিয়ার লোকেদের মধ্যে যে মোলায়েম ভাব থাকে, সেটা এর মধ্যেও আছে, তবে সেটার মাত্রাটা যেন একটু অস্বস্তিকর রকম বেশি। মুখে লেগে থাকা সরল হাসিটাও কেন জানি কৃত্রিম বলে মনে হয় ।

ওয়েবার আধ ঘণ্টা ধরে আমাকে নানারকম প্রশ্ন করে পরীক্ষা করল, আমিও সব সহ্য করলাম। যাবার সময় বলল, 'গ্রোপিয়াস তোমাকে গাড়ি পাঠিয়ে দেবে, কাল সকালে গটফিস্ট্রাসেতে আমার ক্লিনিকে এসো, সেখানে আমার যন্ত্রপাতি আছে। তোমাকে সুস্থ করাটা আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে রইল । '

আমি মনে মনে বললাম— তোমার চেয়ে অন্তত দশগুণ বেশি সুস্থ আমি। তুমি একমাস নখ কাটোনি, তোমার ঠোঁটে সিগারেটের কাগজ লেগে আছে, তোমার জিভের দোষে কথা জড়িয়ে যায়—তুমি করবে আমার মাথার ব্যামোর চিকিৎসা ?

ওয়েবারকে গাড়িতে তুলে দিতে গ্রোপিয়াস ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, ওর দেরি দেখে আমি ঘরটা ঘুরে দেখছিলাম, তাকের উপর ফোটো অ্যালবাম দেখে পাতা উলটে দেখি একটা ছবিতে আমি রয়েছি। এ ছবি আমার কাছে নেই, তবে এটা তোলার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। বাগদাদের হোটেল প্লেনডিডের সামনে তোলা। আমি, গ্রোপিয়াস আর রুশ বৈজ্ঞানিক কামেস্কি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি ।

“তোমার সঙ্গে জিনিসপত্র কী আছে ?' গ্রোপিয়াস ঘরে ফিরে এসে প্রশ্ন করল। 'কেন বলো তো ?'

"আমার মনে হয়, তুমি আমার এখানে চলে এসো। তোমার নিরাপত্তার জন্যই আমি এই প্রস্তাব করছি। আমার বড় গেস্টরুম আছে, তুমি এর আগেও সেখানে থেকে গেছ—যদিও তোমার সেটা মনে থাকার কথা নয়। মে মাসে যখন এসেছিলে, তখন তুমি আমারই

আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলে। ব্যাপারটা অসম্ভব জানলেও মাথাটা কেমন যেন গুলিয়ে উঠছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'আমাকে কি তুমিই নেমন্তন্ন করেছিলে ?"

প্রোপিয়াস এর উত্তরে উঠে গিয়ে পাশের ঘর থেকে একটা ফাইল নিয়ে এল। তাতে অন্য চিঠির মধ্যে আমার দুখানা চিঠি রয়েছে। অবিকল আমার চিঠির কাগজ, আমার সই, আমার অলিভেটি টাইপরাইটারের হরফ। প্রথম চিঠিটায় লিখেছি যে, মে মাসে এমনিতেই আমি ইউরোপ যাচ্ছি, কাজেই ইন্‌সব্রুকে যাওয়ায় কোনও অসুবিধা নেই। দ্বিতীয় চিঠিটায় জানিয়েছি কবে পৌঁছোচ্ছি ।

রহস্য ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে এবং সেই সঙ্গে আমার সংকটাপন্ন অবস্থাটাও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এখানের হোটেলেই যখন আমাকে ঢুকতে দেয়নি, তখন যে লোককে আমি প্রকাশ্য বক্তৃতায় নাম ধরে অপমান করেছি, আমার প্রতি তার মনোভাব কী হবে সেটা বোঝাই যাচ্ছে।

কিন্তু প্রোপিয়াসকে বলতে হল যে এখুনি তার বাড়িতে এসে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

'আজ রাত্রে আমার বন্ধু সামারভিল লন্ডন থেকে আসছে। কাল যদি আমরা দুজনে

একসঙ্গে তোমার বাড়িতে এসে উঠি ?' 'সামারভিল কে ?' একটু সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করল প্রোপিয়াস। আমি সামারভিলের পরিচয় দিয়ে বললাম, 'সে আমার বিশিষ্ট বন্ধু ; ঘটনাটা শুনে সে বিশেষ চিন্তিত। '

তোমার কি ধারণা এখানে এসে তোমাকে দেখলে তার চিন্তা দূর হবে ? আমি কোনও উত্তর না দিয়ে গ্রোপিয়াসের দিকে চেয়ে রইলাম। আমি জানি ও কী বলবে, এবং ঠিক তাই বলল ।

"তোমার বন্ধুও তোমার চিকিৎসার জন্য আমারই মতো ব্যস্ত হয়ে উঠবে এতে কোনও সন্দেহ নেই। '

আমি হোটেলে ফিরেছি সন্ধ্যা সাতটায়। ফিংকেলস্টাইনের কাছ থেকে কোনও ফোন আসেনি। ঘরে গিয়ে চেয়ারে বসে আজকের আশ্চর্য ঘটনাগুলো নিয়ে চিন্তা করছি, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। সামারভিল। রেলস্টেশন থেকে ফোন করছে। বললাম, 'কী হল, তুমি আসছ না ?

“আসছি তো বটেই, একটা উৎকণ্ঠা হচ্ছিল—তাই ফোনটা করলাম। '

'কী ব্যাপার ?'

'তুমি অক্ষত আছ কি না সেটা জানা দরকার ।

"অক্ষত এবং সম্পূর্ণ সুস্থ।

'ভেরি গুড। আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে আসছি। অনেক খবর আছে।

আমার সম্বন্ধে সামারভিল যে কতটা উদ্বিগ্ন সেটা এই টেলিফোনেই বুঝতে পারলাম। কিন্তু কী খবর আনছে সে ? আমার ঘরে যদিও দুটো খাট রয়েছে, কিন্তু ঘরটা এত ছোট যে আমি সামারভিলের জন্য

পাশের ঘরটা বন্দোবস্ত করব বলে ঠিক করেছিলাম। যখন বাড়ি ফিরেছি তখনও ঘরটা খালি

ছিল। হোটেলের মালিককে সেটা সম্বন্ধে বলব বলে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, সে ঘরে বাতি জ্বলছে এবং আধ-খোলা দরজা দিয়ে কড়া চুরুটের গন্ধ আসছে। আর কোনও খালি ঘর আছে কি ? খোঁজ নিয়ে জানলাম, নেই। অগত্যা আমার এই ছোট ঘরেই সামারভিলকে থাকতে হবে।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই সামারভিল এসে পড়ল । ইতিমধ্যে কখন যে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে, সেটা খেয়াল করিনি; সেটা বুঝলাম সামারভিলকে ভিজে বর্ষাতি খুলতে দেখে। বলল, 'আগে কফি আনাও, তারপর কথা হবে। *

কথাটা বলে সেও গ্রোপিয়াসের মতো মিনিটখানেক ধরে আমার দিকে চেয়ে রইল। এ ব্যাপারটা প্রায় আমার গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে, যদিও সামারাভিলের প্রতিক্রিয়া হল অন্যরকম।

'তোমার চাহনিতে কোনও পরিবর্তন দেখছি না শঙ্কু । আমার বিশ্বাস তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ।'

আমি এত দিনে নিশ্চিন্তির হাঁপ ছাড়লাম ।

কফি আসার পর সামারভিলকে আজকের সারা দিনের ঘটনা বললাম। সব শুনে সে বলল, 'আমি গত ক' দিনে পুরনো জার্মান বৈজ্ঞানিক পত্রিকা ঘেঁটে গ্রোপিয়াসের কয়েকটা প্রবন্ধ আবিষ্কার করেছি। গত দশ বছরের মধ্যে সে কোনও লেখা লেখেনি, কিন্তু তার আগে লিখেছে।

'কী সম্বন্ধে লিখেছে ?’

"তার ব্যর্থতা সম্বন্ধে।

'কী রকম ? কীসের ব্যর্থতা ?'

এর উত্তরে সামারভিল যা বলল তাতে যে আমি শুধু অবাকই হলাম তা নয়; এর ফলে সমস্ত ঘটনাটা একটা নতুন চেহারা নিয়ে উপস্থিত হল আমার সামনে। সে বলল-

'তোমার তৈরি অমনিস্কোপ, তোমার ধন্বন্তরি ওষুধ মিরাকিউরল, তোমার লিঙ্গুয়াগ্রাফ, তোমার এয়ারকন্ডিশনিং পিল—প্রত্যেকটি জিনিসই গ্রোপিয়াসের মাথা থেকে বেরিয়েছিল। দুঃখের বিষয় প্রতি বারই সে জেনেছে যে তার ঠিক আগেই তুমি এগুলোর পেটেন্ট নিয়ে বসে আছ। অর্থাৎ প্রতিভার দৌড়ে প্রতি বারই সে তোমার কাছে অল্পের জন্য হার মেনেছে। দশ বছর আগে তার শেষ প্রবন্ধে যে অত্যন্ত আক্ষেপ করে বলেছে যে কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্য খ্যাতিলাভের ব্যাপারটা নেহাতই আকস্মিক। প্রাচীন পুথিপত্র ঘেঁটে ও এর নজিরও দেখিয়েছে—যেমন মাধ্যাকর্ষণের ব্যাপারে খ্যাতি হল নিউটনের, কিন্তু তারও ত্রিশ বছর আগে ইতালির বৈজ্ঞানিক ফ্রাতেল্লি নাকি এই মাধ্যাকর্ষণের কথা লিখে গেছেন। '

আমি বললাম, 'ঠিক সেইভাবে বেতার আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমাদের জগদীশ বোসের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন মার্কনি।

'এগজ্যাক্টলি', বলল সামারভিল। কাজেই গ্রোপিয়াস যদি তোমার প্রতি বিরূপভাব পোষণ করে তা হলে আশ্চর্য হয়ো না। " 'তা তো বুঝলাম, কিন্তু এতে দ্বিতীয় শঙ্কুর রহস্যের সমাধান হচ্ছে কীভাবে ?

প্রশ্নটা করাতে সামারভিল গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, 'তোমার সঙ্গে প্রোপিয়াসের শেষ দেখা হয়েছিল বাগদাদে সাত বছর আগে। তারপর থেকে সে আর কোনও বিজ্ঞান সম্মেলনে যায়নি। এই প্রথম গত মে মাসে ইন্‌সব্রুকে তারই উদ্যোগে আয়োজিত বিজ্ঞানী সম্মেলনে সে যোগদান করে। আর-

আমি সামারভিলকে বাধা দিয়ে বললাম, 'কিন্তু এই সম্মেলন থেকে আমি কোনও চিঠি পাইনি। "

“সে তো পাবেই না। কিন্তু গ্রোণিয়াস নিশ্চয়ই বলেছে যে সে তোমাকে ডেকেছে। এমনকী সে তোমার সই সমেত চিঠিও নিশ্চয়ই তার ফাইলে রেখেছে। '

আমাকে বলতেই হল যে, সে চিঠি আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি।

"তার সঙ্গে এর আগে তোমার চিঠি লেখালেখি হয়েছে ?' সামারভিল প্রশ্ন করল।

আমি বললাম, 'বাগদাদে ওর সঙ্গে আলাপ হবার পর আমি ওকে দু' বার চিঠি লিখেছি, আর পর পর পাঁচ বছর নববর্ষের সম্ভাষণ জানিয়ে কার্ড পাঠিয়েছি ।'

সামারভিল গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। তারপর বলল, 'তোমার সঙ্গে চেহারার মিল আছে এমন কোনও লোক নিশ্চয়ই জোগাড় করেছে গ্রোপিয়াস। যেটুকু তফাত — সেটুকু মেকআপের সাহায্যে ম্যানেজ করেছে, আর বক্তৃতার বিষয়টা তাকে আগে থেকেই শিখিয়ে নিয়েছে। টাকার লোভে এ কাজটা অনেকেই করতে রাজি হবে। এই দ্বিতীয় শঙ্কুর তো কোনও দায়-দায়িত্ব নেই; সে ফরমাশ খেটে টাকা পেয়ে খালাস, এদিকে আসল শঙ্কুর যা সর্বনাশ হবার তা হয়েই গেল, আর গ্রোপিয়াসেরও প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেল। ভাল কথা, তোমার বক্তৃতার কোনও রেকর্ডিং গ্রোপিয়াসের কাছে থাকতে পারে '

প্রশ্নটা শুনেই আমার মনে পড়ে গেল, বাগদাদে প্রোপিয়াসকে একটা ছোট্ট টেপরেকর্ডার সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে দেখেছি। আমি বললাম, 'সেটা খুবই সম্ভব। শুধু তাই না, আমার একটা ভাল রঙিন ছবিও তার কাছে আছে। আমি আজই দেখেছি। '

সামারভিল একটা আক্ষেপসূচক শব্দ করে বলল, 'মুশকিলটা কী জান? যাকে শঙ্কু সাজিয়েছে তাকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অথচ গোপিয়াসের শয়তানি প্রমাণ করতে গেলে এই দ্বিতীয় শঙ্কুর প্রয়োজন । *

এই হোটেলে ঘরে টেলিফোন নেই। দোতলার তিনজন বাসিন্দার জন্য একটিমাত্র টেলিফোন রয়েছে প্যাসেজে। যদি এক নম্বরের জন্য ফোন আসে তা হলে একবার একবার করে রিং হতে থাকে, দুই নম্বর হলে ডাবল রিং, আর তিন হলে তিনবার। টেলিফোন দুই দুই করে বাজছে দেখে বুঝলাম আমারই ফোন ।

দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে ফোন ধরলাম।

'হ্যালো !"

'প্রোফেসর শঙ্কু কথা বলছেন ?

"হ্যাঁ।"

"আমার নাম ফিংকেলস্টাইন। '

আমি বৃথা বাক্যব্যয় না করে আসল প্রসঙ্গে চলে গেলাম।

গত মে মাসে এখানে একটা বিজ্ঞানীসভায় তুমি বোধ হয় উপস্থিত ছিলে। কাগজে

তোমার ছবি দেখলাম। ' “তুমি কি তোমার চশমা হারিয়েছ ?

এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের কী জবাব দিতে হবে ভাবছি, সেই ফাঁকে ফিংকেলস্টাইন আর

একটা প্রশ্ন করে বসল ।

"তোমার চশমার কাঁচ কি ঘোলাটে, না স্বচ্ছ ?'

আমি বললাম, স্বচ্ছ। এবং সে চশমা আমার কাছেই আছে, কোনও দিন হারায়নি। ' “আমার তাই বিশ্বাস। যাই হোক, বিজ্ঞান সভায় যে শঙ্কু বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তিনি ঘর

থেকে বেরোবার সময় তাঁর চশমাটা খুলে মেঝেতে পড়ে যায়। সেটা আমি তুলে নিই। শুধু চশমা নয়, তার সঙ্গে একটি জিনিস আটকে ছিল, সেটাও আমার কাছে আছে।'

'কী জিনিস ?"

'সেটা তুমি এলে দেখাব। ওটা না পেলে কিছু আমারও ধারণা হত যে, যিনি বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি আসল শঙ্কু, নকল নন।'

কথাটা শুনে আমার হৃৎকম্প শুরু হয়ে গেছে। বললাম, 'কখন তোমার সঙ্গে দেখা করা যায় ?'

ফিংকেলস্টাইন বলল, 'এখন রাত হয়ে গেছে, আর দিনটাও ভাল না। কাল সকাল সাড়ে আটটায় আমার বাড়িতে এসো। বেশি সকাল হয়ে যাচ্ছে না তো ?'

'না না। ঠিক সাড়ে আটটায় যাব। আমার সঙ্গে আমার ইংরেজ বন্ধু জন সামারভিলও থাকবে।'

'বেশ, তাকে নিয়ে এসো। তখনই কথা হবে। অনেক কিছু বলার আছে। '

ফোন রেখে দিলাম। সামারভিল পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। দুজনে আবার ঘরে ফিরে এলাম। সামারভিল দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, 'তিন নম্বরে যিনি আছেন তাঁকে চেনো ?

'কেন বলো তো? লোকটি আজ সন্ধ্যায় এসেছে।'

'ভদ্রলোকের একটু বেশি রকম কৌতূহল বলে মনে হল। চুরুটের গন্ধ পেয়ে পিছনে।

ফিরে দেখি দরজাটা এক ইঞ্চি ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে। তোমার ফোনের কথা শোনার জন্য তার এত আগ্রহ কেন ? এর উত্তর আমি জানি না। লোকটা কে তাও জানি না। আশা করি কাল

ফিংকেলস্টাইনের সঙ্গে কথা বলে রহস্য অনেকটা পরিষ্কার হবে

এখন রাত এগারোটা। বৃষ্টি হয়ে চলেছে। সামারভিল শুয়ে পড়েছে।

৯ই জুলাই

কাল ডায়রি লিখতে পারিনি। লেখার মতো অবস্থা ছিল না। সেই জ্যোতিষীর গণনা শেষ পর্যন্ত ফলেছে। একটা কথা মানতেই হবে; শয়তানিতে একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে বৈজ্ঞানিককে টেক্কা দেওয়া অসম্ভব। যাক গে, আপাতত কালকের অসামান্য ঘটনাগুলোর বর্ণনায় মনোনিবেশ করি।

সকাল সাড়ে আটটায় ফিংকেলস্টাইনের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। টেলিফোন ডিরেক্টরিতে ফিংকেলস্টাইনের ঠিকানা দেখে সামারভিল বলল, 'হেঁটে যাওয়া যেতে পারে। বেশি দূর না—আধ ঘণ্টায় পৌঁছে যাব। সামারভিলের চেনা শহর ইন্‌সব্রুক। তা ছাড়া আমাকে ট্যাক্সিতে তোলার বিপদের কথাও ও জানে। আটটায় বেরিয়ে পড়লাম। প্রাচীন শহরের ভিতর দিয়ে রাস্তা। সামারভিল দেখলাম

অলিগলির মধ্য দিয়ে শর্টকাটগুলোও জানে। একটা গলি পেরিয়ে খোলা জায়গায় পড়তেই

দেখি, ডাইনে ছবির মতো সুন্দর সিল নদী বয়ে যাচ্ছে। আমরা নদীর ধার ধরে কিছু দূর গিয়ে

বাঁয়ে একটা পার্ক ছাড়িয়ে আবার বাঁ দিকেই ঘুরে একটা নির্জন রাস্তায় পড়লাম। এটাই

‘রোজেনবাম আলে' অর্থাৎ ফিংকেলস্টাইনের বাড়ির রাস্তা। এগারো নম্বর খুঁজে পেতে

কোনওই অসুবিধা হল না । ছোট অথচ ছবির মতো সুন্দর বাড়ি। সামনেই বাগান, তাতে নানা রঙের ফুল ফুটে রয়েছে, আর তারই মধ্যে সামনের দরজার ডান পাশে একটা আপেল গাছ দাঁড়িয়ে আছে। প্রহরীর মতো ।

আমরা এগিয়ে গিয়ে দরজার বেল টিপলাম। একজন প্রৌঢ় চাকর এসে দরজা খুলে দিল। আমাকে দেখেই তার মুখে হাসি ফুটে ওঠাটা কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগল ।

‘আসুন ভেতরে....আপনি কিছু ফেলে গেছেন বুঝি ?”

আমার বুকের ভিতরে যেন একটা হাতুড়ি পড়ল ।

"প্রোফেসর ফিংকেলস্টাইন আছেন ?' সামারভিলের গলার স্বরে সংশয়। 'মনিব তো এখনও ঘরেই আছেন। '

'কোথায় ঘর ?'

'দোতলায় উঠেই ডান দিকে । ইনি তো একটু আগেই '

তিন ধাপ করে সিঁড়ি উঠে দোতলায় পৌঁছে গেলাম। ডান দিকের ঘরের দরজা খোলা । সামারভিল তার লম্বা পা ফেলে আগে ঢুকে 'মাই গড !' বলে দাঁড়িয়ে গেল ।

এটা ফিংকেলস্টাইনের স্টাডি। মেহগেনির টেবিলের সামনে অদ্ভুতভাবে মাথাটাকে পিছনে চিতিয়ে চেয়ারে বসে আছে ফিংকেলস্টাইন, তার হাত দুটো চেয়ারের দু' পাশে ঝুলে রয়েছে।

এগিয়ে গিয়ে দেখি, যা অনুমান করেছি তাই। ফিংলেস্টাইনের মুখের দিকে চাওয়া যায় না। তাকে গলা টিপে মারা হয়েছে। কণ্ঠনালীর দু' পাশে আঙুলের দাগ এখনও টাটকা ।

এই দৃশ্য দেখে ফিংকেলস্টাইনের চাকর যেটা করল সেটাও মনে রাখার মতো । একটা অস্ফুট চিৎকার করে আমার দিকে একটা বিস্ফারিত দৃষ্টি দিয়ে সে টেবিলের উপর রাখা টেলিফোনটার

উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তার উদ্দেশ্য স্পষ্ট সে পুলিশে খবর দেবে। সামারভিল যেটা করল সেটা অবিশ্যি তার উপস্থিত বুদ্ধির পরিচায়ক। সে এক ঘুষিতে ভৃত্যটিকে ধরাশায়ী করল। দেখে বুঝলাম, ভৃত্য অজ্ঞান ।

'তুমি ফাঁদে পড়েছ, শঙ্কু । রুদ্ধশ্বাসে বলল সামারভিল। মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করতে হবে।'

'কিন্তু ওটা কী ?'

আমার চোখ চলে গেছে টেবিলের উপর রাখা একটা প্যাডের দিকে। তাতে একটি মাত্র কথা লেখা রয়েছে লাল পেনসিলে — এসটে'। অর্থাৎ ফার্স্ট, প্রথম। আরও যে কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল ফিংকেলস্টাইনের সেটা কথাটার পরেই পেনসিলের দাগ থেকে বোঝা যাচ্ছে। পেনসিলটা পড়ে রয়েছে টেবিলের পাশে মেঝেতে ।

যা করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। 'এসর্টে' লিখে কী বোঝাতে চেয়েছিল ফিংকেলস্টাইন ? প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয়—এইভাবে বোঝানো যেতে পারে, এমন কী আছে ঘরের মধ্যে ? বইয়ের তাক বোঝাতে পারে কি ? মনে হয় না। আমি বুঝতে পারছি, কী জিনিসের অবস্থান বোঝাতে চেয়েছিল ফিংকেলস্টাইন। আমার চশমা । জিনিসটা পাওয়া গেল টেবিলের প্রথম —অর্থাৎ ওপরের দেরাজটা খুলে। কাগজপত্র

কলম পেনসিল ইত্যাদির মধ্যে একটা কাডবোর্ডের বাক্স রাখা রয়েছে, তার ঢাকনাতে জার্মান

ভাষায় লেখা 'শঙ্কুর চশমা এবং চুল । বাক্সটা নিয়ে আমরা দুজনে চম্পট দিলাম। ভৃত্য এখনও বেহুঁশ ।

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় লক্ষ করলাম জুতোর ছাপ; ওঠার সময় তাড়াতাড়িতে চোখে পড়েনি।

বাইরেও রয়েছে সেই ছাপ; দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেট ছাড়িয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। আসার ছাপ, যাওয়ার ছাপ, দু' রকমই আছে। কাল রাত্রের বৃষ্টিই অবিশ্যি এর জন্য দায়ী । আমরা চাপটা অনুসরণ করে কিছু দূর অগ্রসর হয়ে দেখি, সেটা রাস্তা ছেড়ে ঘাসের উপর উঠে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও আমরা পা চালিয়ে এগিয়ে গেলাম। দশ মিনিট এদিকে ওদিকে খুঁজেও যখন দ্বিতীয় শঙ্কুর কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না, তখন বাধ্য হয়ে হোটেলে ফিরে আসতে হল। মালিক আমাকে দেখেই বলল, 'তোমার ফোন এসেছিল। ডক্টর গ্রোপিয়াস। তোমাকে অবিলম্বে টেলিফোন করতে বলেছেন।'

দোতলায় উঠে দেখি, আমাদের পাশের ঘর আবার খালি হয়ে গেছে।

খাটে বসে পকেট থেকে বাক্সটা বার করলাম। খুলে দেখি শুধু চশমা নয়, তার সঙ্গে একটা ছোট্ট খামও রয়েছে। চশমাটা ঠিক আমার চশমারই মতো, কেবল কাচটা গ্রে রঙের। খামটা খুলতে তার থেকে একটা চিরকুট বেরোল, তাতে লেখা— 'লাইবনিৎস হলে বিজ্ঞানসভায় ভারতীয় বৈজ্ঞানিক প্রোফেসর শঙ্কুর চোখ থেকে খুলে পড়া চশমা সংলগ্ন নাইলনের চুল ।

নাইলনের চুল ?

খামের ভিতরেই ছিল চুলটা। দেখতে ঠিক পাকা চুলেরই মতো বটে, কিন্তু সেটা যে কৃত্রিম, তাতে কোনও সন্দেহ নেই ।

এই চুল থেকেই ফিংকেলস্টাইন বুঝে ফেলেছিল যে, বক্তৃতা সভার শঙ্কু আসল শঙ্কু নয় । কিন্তু আমার এই সংকটে ফিংকেলস্টাইনের সাহায্যলাভের আর কোনও উপায় নেই । ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। তাতে হঠাৎ টোকা পড়তে দুজনেই চমকে উঠলাম। এ সময়

আবার কে এল

খুলে দেখি গোপিয়াস ।

সামারভিলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে গ্রোগিয়াসকে বসতে বললাম, কিন্তু সে বসল না। দরজার মুখে দাঁড়ানো অবস্থাতেই বলল, 'আজ তোমাকে নিয়ে যাব বলেছিলাম, কিন্তু আজ ওয়েবারের একটু অসুবিধে আছে। তা ছাড়া আমার বাড়িতে আজ একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমার এক চাকর ফ্রান্ৎস কাল রাত্তিরে থ্রম্বোসিসে মারা গেছে। আজ তার শেষকৃত্য : আমায় উপস্থিত থাকতে হবে।'

এর উত্তরে আমাদের কিছু বলার নেই; কয়েক মুহূর্ত বিরতির পর গ্রোপিয়াসই কথা বলল। এবার সে একটা প্রশ্ন করল ।

“ফিংকেলস্টাইন মারা গেছে, জান কি ?”

আমি যে ফিংকেলস্টাইনের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিলাম, সেটা পাশের ঘর থেকে একজন লোক শুনেছিল সেটা মনে আছে। সে যদি গ্রোপিয়াসের অনুচর হয়ে থাকে, তা হলে আমার সাড়ে আটটায় অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা গ্রোপিয়াসের কানে পৌঁছেছিল নিশ্চয়ই। তবুও আমি অজ্ঞতা ও বিস্ময়ের ভান করে বললাম, 'সে কী! কখন ?

"আজ সকালে। অ্যাকাডেমি অফ সায়ান্স থেকে ফোন করেছিল এই কিছুক্ষণ আগে । ওর চাকর আনটন প্রথমে পুলিশে খবর দেয়, তারপর অ্যাকাডেমির প্রেসিডেন্ট গ্রোসমানকে ফোন করে। '

আমরা দুজনে চুপ। গ্রোপিয়াস এক পা এগিয়ে এল।

'আনটন একজন লোকের কথা বলেছে— গায়ের রং ময়লা, মাথায় টাক, দাড়ি আছে, চশমা আছে ; আজ সকালে ফিংকেলস্টাইনের বাড়িতে গিয়েছিল। তার নামটাও বলেছিল আনটন। '

'বর্ণনা যখন আমার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, তা হলে নামটাও মিলতে পারে, আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম। আর সেটাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, কারণ সকালে সত্যিই গিয়েছিলাম। ফিংকেলসাইনের সঙ্গে দেখা । সামারভিল ছিল। গিয়ে দেখি ফিংকেলস্টাইন মৃত। তাকে টুটি টিপে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।

'প্রোফেসর শঙ্কু, রক্ত জল করা গলায় বলল গ্রোপিয়াস, বক্তৃতায় ভাষার সাহায্যে বৈজ্ঞানিকদের আক্রমণ করা এক জিনিস, আর সরাসরি তাদের একজনকে আক্রমণ করে তাকে হত্যা করা আর এক জিনিস। তুমি নিজেই যখন বলছ তোমার মস্তিষ্কে কোনও গোলমাল নেই, তখন এই অপরাধের জন্য তোমার কী শাস্তি হবে সেটা তুমি জান নিশ্চয়ই ?'

এবার সামারভিল মুখ খুলল। তারও কণ্ঠস্বর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।

'ডক্টর গ্রোপিয়াস, আপনি যখন বক্তৃতার দিন মঞ্চ থেকে শঙ্কুকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তার চোখ থেকে চশমাটি খুলে পড়ে যায়। ঘোলাটে কাচ, কতকটা সানগ্লাসের মতো। সেই চশমাটি ফিংকেলস্টাইন তুলে নেয়। চশমার ডান্ডায় একটি চুল আটকে ছিল। চুলটা নাইলনের। আজ ফিংকেলস্টাইনের চাকরের কথায় মনে হল, শঙ্কুরই মতো দেখতে আর একজন লোক আমাদের আধ ঘণ্টা আগে ফিংকেলস্টাইনের সঙ্গে দেখা করতে যায়। আমরা সিঁড়িতে তার জুতোর ছাপ দেখেছি। বাড়ির বাইরে এবং রাস্তাতেও দেখেছি। এই লোকটি যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই খুনটা হয়। আততায়ী দস্তানা পরেনি। তার আঙুলের স্পষ্ট ছাপ ফিংকেলস্টাইনের গলায় ছিল। এই জাল শঙ্কু যে খুনটা করেছে, সেটা আপনি আসল শঙ্কর ঘাড়ে চাপাবেন কী করে ?

গ্রোপিয়াস হঠাৎ হো হো করে এক অস্বাভাবিক হিংস্র তেজে হেসে উঠল।

‘কী করে চাপাব সেটা দেখতেই পাবে। কাল শঙ্কু আমার বাড়িতে বসে আমার পেয়ালা থেকে হট চকোলেট খেয়েছে, আমার ফোটো অ্যালবামের পাতা উলটে দেখেছে—এ সবে কি আর তার আঙুলের ছাপ পড়েনি ? আজকাল কৃত্রিম আঙুলের ছাপ তৈরি করা যায়। প্রোফেসর সামারভিল। হান্‌স গ্রোপিয়াসের আবিষ্কার এটা। ইতিমধ্যে ইউরোপের তিনজন সেরা ক্রিমিন্যালকে আমি এর উপায় বাতলে দিয়েছি ।

এতক্ষণ লক্ষ করিনি যে, দরজার বাইরে গ্রোপিয়াসের আড়ালে আর একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে পকেটে হাত দিয়ে। একে আমি চিনি। এই লোকই সে দিন পাশের ঘর থেকে আড়ি পেতেছিল।

'অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে তোমার এই পরিণাম হতে চলেছে, প্রোপিয়াস আমার দিকে চেয়ে বলল। 'এই অবস্থায় পড়ে মাথা যদি সত্যিই খারাপ হয়, তা হলে অবিশ্যি ওয়েবারের ক্লিনিক রয়েছে; সেখানে আমারই আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে ব্রেনসাপ্লান্টের কাজ শুরু হয়েছে। এবারে বোধ হয় আর আমাকে টেক্কা দিতে পারবে না। গুড ডে, শঙ্কু । গুড ডে, প্রোফেসর সামারভিল।

প্রোপিয়াস আর তার অনুচর সিঁড়িতে ভারী শব্দ তুলে নীচে নেমে গেল। আমি খাটে বসে পড়লাম। সামারভিল পায়চারি শুরু করেছে। দু'বার তাকে বলতে শুনলাম—কী শয়তান। কী শয়তান

আমি বুঝতে পারছি চারদিক থেকে জাল ঘিরে আসছে আমাকে। আঙুলের ছাপও যদি মিলে যায়, তা হলে আর বেরোবার কোনও পথ নেই। যদি না— যদি না জাল শঙ্কুকে খুঁজে বের করে পুলিশের সামনে উপস্থিত করা যায়।

"ফাঁদে যখন পড়েছি', পায়চারি থামিয়ে বলল সামারভিল 'তখন ফাঁদের শেষ দেখে যেতে হবে। মরতে হলে লড়ে মরা ভাল, এভাবে নয়। '

বুঝলাম, আমার বিপদকে নিজের ঘাড়ে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছে না সামারভিল । চাবি দিয়ে সুটকেস খুলে রিভলভার বার করে সে পকেটে পুরল। বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে শিকারেও যে তার আশ্চর্য দখল, সেটা সে ভিনিজুয়েলার জঙ্গলে অনেক বার প্রমাণ করেছে।

আমিও আমার 'অ্যানাইহিলিন গান' বা নিশ্চিহ্নাস্ত্রটা সঙ্গে নিলাম। মাত্র চার ইঞ্চি লম্বা আমার এই আশ্চর্য অস্ত্রটি আমি পারতপক্ষে ব্যবহার করি না।

ঘরের দরজা বন্ধ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমরা হোটেলের বাইরে বেরিয়ে এলাম। একটা ট্যাক্সি দেখে সেটাকে হাত তুলে থামিয়ে এগিয়ে যেতে, ড্রাইভার আমাকে দেখেই 'নাইন, নাইন' অর্থাৎ না না বলে মাথা নাড়ল। সেটাই আবার 'ইয়া ইয়া' হয়ে গেল যখন সামারভিল তার হাতে একটা একশো গ্রোশেনের নোট গুঁজে দিল ।

একটুক্ষণ আগেই একটা সাইরেনের শব্দ পেয়েছি; আমাদের ট্যাক্সিটা যখন রওনা হয়েছে তখন দেখলাম, একটা পুলিশের গাড়ি আমাদের হোটেলের দিকে যেতে যেতে আমাদের গাড়িটা দেখেই ব্রেক কষল।

সামারভিল এবার একটা দুশো গ্রোশেনের নোট ড্রাইভারের হাতে দিয়ে বলল, 'খুব জোরে চালাও—গুনেওয়ার্ল্ডস্ট্রাসে যাব। '

সকালে রোদ বেরিয়েছিল, কিন্তু এখন দেখছি পশ্চিম দিক থেকে কালো মেঘ এসে আকাশটাকে ছেয়ে ফেলেছে। তার ফলে তাপমাত্রাও নেমে গেছে অন্তত বিশ ডিগ্রি ফারেনহাইট । আমাদের মার্সেডিস ট্যাক্সি ঝড়ের মতো এগিয়ে চলল ট্র্যাফিক বাঁচিয়ে ।

মিনিট দশেক চলার পর পিছনে দূর থেকে আবার সাইরেনের শব্দ পেলাম। সামারভিল ড্রাইভারের পিঠে হাত দিয়ে একটা মৃদু চাপ দিল। ফলে আমাদের গাড়ির গতি আরও বেড়ে গেল। স্পিডোমিটারের কাঁটা প্রায় একশো কিলোমিটারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। চালকের অশেষ বাহাদুরি যে আমাদের অ্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচিয়ে সে বিশ মিনিটের মধ্যে এনে ফেলল গ্রুনেওয়াচ্ছস্ট্রাসে তে।

সামনে একটা মিছিল, তাই বাধ্য হয়ে গাড়ির গতি কমাতে হল। দশ-বারোজন লোক

একটা কফিন নিয়ে বাঁয়ে গোরস্থানের গেটের ভিতর দিয়ে ঢুকে গেল। তার মধ্যে দুজনকে

চিনলাম—কাল যে চাকরটি হট চকোলেট এনে দিয়েছিল, এবং প্রোপিয়াস নিজে । আমাদের গাড়ি গোরস্থানের গেট ছাড়িয়ে প্রোপিয়াসের গেটে পৌঁছানোর ঠিক আগে সামারভিল চেঁচিয়ে উঠল-

‘স্টপ দ্য কার !-গাড়ি ব্যাক্ করো।

বকশিস পাওয়া ড্রাইভার তৎক্ষণাৎ গাড়ি থামিয়ে ব্যাক করে গোরস্থানের গেটের সামনে এসে থামল। আমরাও নামলাম, আর সেই সঙ্গে সাইরেনের শব্দে গোরস্থানের স্তব্ধতা চিরে পুলিশের গাড়ি এসে আমাদের ট্যাক্সির পিছনে সশব্দে ব্রেক কষল ।

গোরস্থানে একটা সদ্য খোঁড়া গর্তের পাশে রাখা হয়েছে কফিনটাকে। শবযাত্রীদের সকলেই আমাদের দিকে দেখছে—এমনকী প্রোপিয়াসও।

পুলিশের গাড়ি থেকে একজন ইনস্পেকটর ও আরও দুটি লোকের সঙ্গে নামল ফিংকেলস্টাইনের ভৃত্য আনটন, এবং নেমেই আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ওই সেই লোক।

পুলিশ অফিসার আমার দিকে এগিয়ে এলেন ।

গোরস্থানে পাদরি তার শেষকৃত্য শুরু করে দিয়েছে।

‘প্রোফেসর শঙ্কু ! আমার নাম ইনস্পেক্টর ডিট্রিখ। আপনাকে আমাদের সঙ্গে একটু-

দুম—দুম—দুম- ।

সামারভিলের রিভলভার তিন বার গর্জিয়ে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে তিন বার কাঠ ফাটার শব্দ।

"ওকে পালাতে দিয়ো না।' সামারভিল চিৎকার করে উঠল—কারণ গ্রোপিয়াস গোরস্থানের পিছন দিক লক্ষ্য করে ছুট দিয়েছে। একজন পুলিশের লোক হাতে রিভলভার নিয়ে তার দিকে তিরবেগে ধাওয়া করে গেল। ইনস্পেক্টর ডিট্রিখ চেঁচিয়ে উঠলেন, 'যে পালাবে, তাকেই গুলি করা হবে।

এদিকে আমার বিস্ফারিত দৃষ্টি চলে গেছে কফিনের দিকে। তিনটের একটা গুলি তার পাশের দেয়াল ভেদ করে ভিতরে ঢুকে গেছে। অন্য দুটো ঢাকনার কানায় লেগে সেটাকে দ্বিখণ্ডিত করে স্থানচ্যুত করেছে।

কফিনের ভিতর বিশাল দুটি নিষ্পলক পাথরের চোখ নিয়ে যিনি শুয়ে আছেন, তিনি হলেন আমারই ডুপ্লিকেট—শঙ্কু নাম্বার টু ।

এবারে সমবেত সকলের রক্ত হিম করে, ডিট্রিখের হাত থেকে রিভলভার খসিয়ে দিয়ে, পুলিশের বগলদাবা গ্রোপিয়াসকে অজ্ঞান করে দিয়ে, কফিনবদ্ধ দ্বিতীয় শঙ্কু ধীরে ধীরে উঠে বসলেন। বুঝলাম, তাঁর পাঁজরা দিয়ে গুলি প্রবেশ করে তাঁর দেহের ভিতরের যন্ত্র বিকল করে দিয়েছে ; কারণ ওই বসা অবস্থাতেই গ্রোপিয়াস-সৃষ্ট জাল শঙ্কু তাঁর শরীরের ভিতরে রেকর্ড করা একটি পুরনো বক্তৃতা দিতে শুরু করেছেন—

‘ভদ্রমহোদয়গণ ! — আজ আমি যে কথাগুলো বলতে এই সভায় উপস্থিত হয়েছি, সেগুলো আপনাদের মনঃপুত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু

আমি আমার অ্যানাইহিলিন বন্দুকটি পকেট থেকে বার করলাম। আমার এই পৈশাচিক জোড়াটিকে পৃথিবীর বুক থেকে একেবারে মুছে ফেলতে পারলে তবেই আমার মুক্তি ।


38
Articles
শঙ্কু সমগ্র
0.0
একটি প্রফেসর এর জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু মহাজাগতিক ঘটনার সম্মিলিত রূপ
1

ব্যোমযাত্রীর ডায়রি

30 October 2023
1
0
0

প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর ডায়রিটা আমি পাই তারক চাটুজ্যের কাছ থেকে । একদিন দুপুরের দিকে আপিসে বসে পুজো সংখ্যার জন্য একটা লেখার প্রুফ দেখছি, এমন সময় তারকবাবু এসে একটা লাল খাতা আমার সামনে ফেলে দিয়ে

2

প্রোফেসর শঙ্কু ও ঈজিপ্সীয় আতঙ্ক

30 October 2023
1
0
0

পোর্ট সেইডের ইম্পিরিয়াল হোটেলের ৫ নং ঘরে বসে আমার ডায়রি লিখছি ! এখন রাত সাড়ে এগারোটা। এখানে বোধ হয় অনেক রাত অবধি লোকজন জেগে থাকে, রাস্তায় চলাফেরা করে, হইহল্লা করে। আমার পূর্বদিকের খোলা জানালাটা দ

3

প্রোফেসর শঙ্কু ও হাড়

30 October 2023
1
0
0

(বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু বেশ কয়েক বছর যাবৎ নিখোঁজ । তাঁর একটি ডায়রি কিছুদিন আগে আকস্মিকভাবে আমাদের হাতে আসে। 'ব্যোমযাত্রীর ডায়রি' নাম দিয়ে আমরা সন্দেশে ছাপিয়েছি। ইতিমধ্যে আম

4

প্রোফেসর শঙ্কু ও ম্যাকাও

30 October 2023
1
0
0

৭ই জুন বেশ কিছুদিন থেকেই আমার মন মেজাজ ভাল যাচ্ছিল না। আজ সকালে একটা আশ্চর্য ঘটনার ফলে আবার বেশ উৎফুল্ল বোধ করছি। আগে মেজাজ খারাপ হবার কারণটা বলি। প্রোফেসর গজানন তরফদার বলে এক বৈজ্ঞানিক কিছুদিন আগে

5

প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল

30 October 2023
2
0
0

আজ আমার জীবনে একটা স্মরণীয় দিন! সুইডিস অ্যাকাডেমি অফ সায়ান্স আজ আমাকে ডক্টর উপাধি দান করে আমার গত পাঁচ বছরের পরিশ্রম সার্থক করল। এক ফলের বীজের সঙ্গে আর এক ফলের বীজ মিশিয়ে এমন আশ্চর্য সুন্দর, সুগন্ধ

6

প্রোফেসর শঙ্কু ও গোলক-রহস্য

31 October 2023
1
0
0

৭ই এপ্রিলঅবিনাশবাবু আজ সকালে এসেছিলেন। আমাকে বৈঠকখানায় খবরের কাগজ হাতে বসে থাকতে দেখে বললেন, 'ব্যাপার কী ? শরীর খারাপ নাকি ? সকালবেলা এইভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না।'আমি বল

7

প্রোফেসর শঙ্কু ও চী-চিং:

31 October 2023
1
0
0

১৮ই অক্টোবরআজ সকালে সবে ঘুম থেকে উঠে মুখটুখ ধুয়ে ল্যাবরেটরিতে যাব, এমন সময় আমার চাকর প্রহ্লাদ এসে বলল, 'বৈঠকখানায় একটি বাবু দেখা করতে এয়েছেন। আমি বললাম, 'নাম জিজ্ঞেস করেছিস ?"প্রহ্লাদ বলল, 'আজ্ঞে

8

প্রোফেসর শঙ্কু ও খোকা

31 October 2023
1
0
0

৭ই সেপ্টেম্বরআজ এক মজার ব্যাপার হল। আমি কাল সকালে আমার ল্যাবরেটরিতে কাজ করছি, এমন সময় চাকর প্রহ্লাদ এসে খবর দিল যে একটি লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। কে লোক জিজ্ঞেস করতে প্রহ্লাদ মাথা চুলকে বলল 'আজ

9

প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত

31 October 2023
1
0
0

১০ই এপ্রিলভূতপ্রেত প্ল্যানচেট টেলিপ্যাথি ক্লেয়ারভয়েন্স—এ সবই যে একদিন না একদিন বিজ্ঞানের আওতায় এসে পড়বে, এ বিশ্বাস আমার অনেকদিন থেকেই আছে। বহুকাল ধরে বহু বিশ্বস্ত লোকের ব্যক্তিগত ভৌতিক অভিজ্ঞতার ক

10

প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু

2 November 2023
1
0
0

১৬ই এপ্রিল আজ জার্মানি থেকে আমার চিঠির উত্তরে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক প্রোফেসর পমারের চিঠি পেয়েছি। পমার লিখছেন— প্রিয় প্রোফেসর শঙ্কু, তোমার তৈরি রোবো (Robot) বা যান্ত্রিক মানুষ সম্বন্ধে তুমি যা লিখেছ,

11

প্রোফেসর শঙ্কু ও রক্তমৎস্য রহস্য

2 November 2023
1
0
0

১৩ই জানুয়ারি গত ক'দিনে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি, তাই আর ডায়রি লিখিনি। আজ একটা স্মরণীয় দিন, কারণ আজ আমার লিঙ্গুয়াগ্রাফ যন্ত্রটা তৈরি করা শেষ হয়েছে। এ যন্ত্রে যে কোনও ভাষার কথা রেকর্ড হয়ে গিয়ে তিন

12

প্রোফেসর শঙ্কু ও কোচাবাম্বার গুহা

2 November 2023
1
0
0

৭ই আগস্ট আজ আমার পুরনো বন্ধু হনলুলুর প্রোফেসর ডাম্বার্টনের একটা চিঠি পেয়েছি। তিনি লিখছেন— প্রিয় শ্যাঙ্কস, খামের উপর ডাকটিকিট দেখেই বুঝতে পারবে যে বোলিভিয়া থেকে লিখছি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও যে

13

প্রোফেসর শঙ্কু ও গোরিলা

2 November 2023
1
0
0

১২ই অক্টোবর আজ সকালে উশ্রীর ধার থেকে বেড়িয়ে ফিরছি, এমন সময় পথে আমার প্রতিবেশী অবিনাশবাবুর সঙ্গে দেখা। ভদ্রলোকের হাতে বাজারের থলি। বললেন, 'আপনাকে সবাই একঘরে করবে, জানেন তো। আপনি যে একটি আস্ত শকুনির

14

প্রোফেসর শঙ্কু ও বাগ্দাদের বাক্স

2 November 2023
1
0
0

১৯শে নভেম্বর গোল্ডস্টাইন এইমাত্র পোস্টআপিসে গেল কী একটা জরুরি চিঠি ডাকে দিতে। এই ফাঁকে ডায়রিটা লিখে রাখি। ও থাকলেই এত বকবক করে যে তখন ওর কথা শোনা ছাড়া আর কোনও কাজ করা যায় না। অবিশ্যি প্রোফেসর পেত্

15

স্বপ্নদ্বীপ

2 November 2023
1
0
0

২২শে মার্চ অনেকে বলেন যে, স্বপ্নে নাকি আমরা সাদা আর কালো ছাড়া অন্য কোনও রং দেখি না। আমার বিশ্বাস আসল ব্যাপারটা এই যে, বেশিরভাগ সময় স্বপ্নের ঘটনাটাই কেবল আমাদের মনে থাকে; রং দেখেছি কি না দেখেছি, সেট

16

আশ্চর্য প্রাণী

3 November 2023
1
0
0

১০ই মার্চ গবেষণা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আমার জীবনে এর আগে এ রকম কখনও হয়নি। একমাত্র সান্ত্বনা যে এটা আমার একার গবেষণা নয়, এটার সঙ্গে আরও একজন জড়িত আছেন । হামবোল্টও বেশ মুষড়ে পড়েছে। তবে এত সহজে নিরুদ্যম

17

মরুরহস্য

3 November 2023
2
0
0

১০ই জানুয়ারি নতুন বছরের প্রথম মাসেই একটা দুঃসংবাদ। ডিমেট্রিয়াস উধাও! প্রোফেসর হেক্টর ডিমেট্রিয়াস, বিখ্যাত জীবতত্ত্ববিদ। ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত ক্রীট দ্বীপের রাজধানী ইরাক্লিয়ন শহরের অধিবাসী ছিলেন ডিম

18

কভার্স

3 November 2023
1
0
0

১৫ই আগস্ট পাখি সম্পর্কে কৌতূহলটা আমার অনেক দিনের। ছেলেবেলায় আমাদের বাড়িতে একটা পোষা ময়না ছিল, সেটাকে আমি একশোর উপর বাংলা শব্দ পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করতে শিখিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল, পাখি কথা বললেও

19

একশৃঙ্গ অভিযান

4 November 2023
3
0
0

১লা জুলাই আশ্চর্য খবর। তিব্বত পর্যটক চার্লস উইলার্ডের একটা ডায়রি পাওয়া গেছে। মাত্র এক বছর আগে এই ইংরাজ পর্যটক তিব্বত থেকে ফেরার পথে সেখানকার কোনও অঞ্চলে যাম্‌পা শ্রেণীর এক দস্যুদলের হাতে পড়ে। দস্য

20

ডক্টর শেরিং-এর স্মরণশক্তি

4 November 2023
1
0
0

২রা জানুয়ারি আজ সকালটা বড় সুন্দর। চারিদিকে ঝলমলে রোদ, নীল আকাশে সাদা সাদা হৃষ্টপুষ্ট মেঘ, দেখে মনে হয় যেন ভুল করে শরৎ এসে পড়েছে। সদ্য পাড়া মুরগির ডিম হাতে নিলে যেমন মনটা একটা নির্মল অবাক আনন্দে

21

হিপনোজেন

5 November 2023
1
0
0

৭ই মে আমার এই ছেষট্টি বছরের জীবনে পৃথিবীর অনেক জায়গা থেকে অনেকবার অনেক রকম নেমন্তন্ন পেয়েছি; কিন্তু এবারেরটা একেবারে অভিনব। নরওয়ের এক নাম-না-জানা গণ্ডগ্রাম থেকে এক এক্সপ্রেস টেলিগ্রাম; টেলিগ্র

22

শঙ্কুর শনির দশা

5 November 2023
2
0
0

৭ই জুন আমাকে দেশ বিদেশে অনেকে অনেক সময় জিজ্ঞাসা করেছে আমি জ্যোতিষে বিশ্বাস করি। কি না। প্রতিবারই আমি প্রশ্নটার একই উত্তর দিয়েছি—আমি এখনও এমন কোনও জ্যোতিষীর সাক্ষাৎ পাইনি যাঁর কথায় বা কাজে আমার জ্য

23

শঙ্কুর সুবর্ণ সুযোগ

6 November 2023
2
0
0

২৪শে জুনইংলন্ডের সল্সবেরি প্লেনে আজ থেকে চার হাজার বছর আগে তৈরি বিখ্যাত স্টোনহেঞ্জের ধারে বসে আমার ডায়রি লিখছি। আজ মিড-সামার ডে, অর্থাৎ কর্কটক্রান্তি । যে সময় স্টোনহেঞ্জ তৈরি হয়, তখন এ দেশে প্রস্তর

24

মানরো দ্বীপের রহস্য

6 November 2023
1
0
0

মানরো দ্বীপ, ১২ই মার্চএই দ্বীপে পৌঁছানোর আগে গত তিন সপ্তাহের ঘটনা সবই আমার ডায়রিতে বিক্ষিপ্তভাবে লেখা আছে। হাতে যখন সময় পেয়েছি তখন সেগুলোকেই একটু গুছিয়ে লিখে রাখছি। আমি যে আবার এক অভিযানের দলে ভিড

25

কম্পু

8 November 2023
0
0
0

১২ই মার্চ, ওসাকা আজ সারা পৃথিবী থেকে আসা তিনশোর উপর বৈজ্ঞানিক ও শ'খানেক সাংবাদিকের সামনে কম্পুর ডিমনস্ট্রেশন হয়ে গেল। ওসাকার নামুরা টেকনলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের হলঘরের একপ্রান্তে মঞ্চের উপর একটা তিন ফু

26

মহাকাশের দূত

8 November 2023
0
0
0

২২শে অক্টোবরপ্রিয় শঙ্কু,ব্রেন্টউড, ১৫ই অক্টোবরমনে হচ্ছে আমার বারো বছরের পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফল পেতে চলেছি। খবরটা এখনও প্রচার করার সময় আসেনি, শুধু তোমাকেই জানাচ্ছি।কাল রাত একটা সাঁইত্রিশে এপসাইলন ই

27

নকুড়বাবু ও এল ডোরাডো

9 November 2023
0
0
0

১৩ই জুনআজ সকালের ঘটনাটা আমার কাজের রুটিন একেবারে তছনছ করে দিল। কাজটা অবিশ্যি আর কিছুই না : আমার যাবতীয় আবিষ্কার বা ইনভেশনগুলো সম্বন্ধে একটা প্রবন্ধ লিখছিলাম সুইডেনের বিখ্যাত 'কসমস' পত্রিকার জন্য। এ ক

28

শঙ্কুর কঙ্গো অভিযান

9 November 2023
0
0
0

প্রিয় শঙ্কু,আমার দলের একটি লোকের কালাজ্বর হয়েছে তাই তাকে নাইরোবি পাঠিয়ে দিচ্ছি। তার হাতেই চিঠি যাচ্ছে, সে ডাকে ফেলে দেবার ব্যবস্থা করবে। এই চিঠি কেন লিখছি সেটা পড়েই বুঝতে পারবে। খবরটা তোমাকে না দি

29

প্রোফেসর শঙ্কু ও ইউ.এফ.ও.

11 November 2023
0
0
0

১২ই সেপ্টেম্বরইউ. এফ.ও. অর্থাৎ আনআইডেনটিফাইড ফ্লাইং অবজেক্ট অর্থাৎ অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু। এই ইউ.এফ.ও. নিয়ে যে কী মাতামাতি চলছে গত বিশ-পঁচিশ বছর ধরে। সারা বিশ্বে বহু সমিতি গড়ে উঠেছে, যাদের কাজই হল এই ই

30

আশ্চর্জন্তু

11 November 2023
0
0
0

আগস্ট ৭আজ এক আশ্চর্য দিন।সকালে প্রহ্লাদ যখন বাজার থেকে ফিরল, তখন দেখি ওর হাতে একটার জায়গায় দুটো থলি। জিজ্ঞেস করাতে বলল, 'দাঁড়ান বাবু, আগে বাজারের থলিটা রেখে আসি। আপনার জন্য একটা জিনিস আছে, দেখে চমক

31

প্রোফেসর রন্ডির টাইম মেশিন

11 November 2023
0
0
0

নভেম্বর ৭পৃথিবীর তিনটি বিভিন্ন অংশে তিনজন বৈজ্ঞানিক একই সময় একই যন্ত্র নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে, এরকম সচরাচর ঘটে না। কিন্তু সম্প্রতি এটাই ঘটেছে। এই তিনজনের মধ্যে একজন অবিশ্যি আমি, আর যন্ত্রটা হল টাইম মে

32

শঙ্কু ও আদিম মানুষ

12 November 2023
0
0
0

এপ্রিল ৭ নৃতত্ত্ববিদ ডা. ক্লাইনের আশ্চর্য কীর্তি সম্বন্ধে কাগজে আগেই বেরিয়েছে। ইনি দক্ষিণ আমেরিকায় আমাজনের জঙ্গলে ভ্রমণকালে এক উপজাতির সন্ধান পান, যারা নাকি ত্রিশ লক্ষ বছর আগে মানুষ যে অবস্থায় ছিল

33

নেফ্রুদেৎ-এর সমাধি

12 November 2023
0
0
0

ডিসেম্বর ৭ এইমাত্র আমার জার্মান বন্ধু ক্রোলের কাছ থেকে একটা টেলিগ্রাম পেলাম। কোল লিখছে— সব কাজ ফেলে কায়রোতে চলে এসো। তুতানখামেনের সমাধির মতো আরেকটি সমাধি আবিষ্কৃত হতে চলেছে। সাকারার দু মাইল দক্ষিণে

34

শঙ্কুর পরলোকচর্চা

12 November 2023
0
0
0

সেপ্টেম্বর ১২ আজ বড় আনন্দের দিন। দেড় বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আজ আমাদের যন্ত্র তৈরির কাজ শেষ হল। 'আমাদের' বলছি এই কারণে যে, যদিও যন্ত্রের পরিকল্পনাটা আমার, এটা তৈরি করা আমার একার পক্ষে সম্ভব ছিল ন

35

শঙ্কু ও ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন

12 November 2023
0
0
0

৭ মে কাল জার্মানি থেকে আমার ইংরেজ বন্ধু জেরেমি সন্ডার্সের একটা চিঠি পেয়েছি। তাতে একটা আশ্চর্য খবর রয়েছে। চিঠিটা এখানে তুলে দিচ্ছি। প্রিয় শঙ্কু, জার্মানিতে আউগ্‌গ্সবুর্গে এসেছি ক্রোলের সঙ্গে ছুটি

36

ডাঃ দানিয়েলির আবিষ্কার

12 November 2023
0
0
0

১৫ এপ্রিল, রোম কাল এক আশ্চর্য ঘটনা। এখানে আমি এসেছি একটা বিজ্ঞানী সম্মেলনে। কাল স্থানীয় বায়োকেমিস্ট ডাঃ দানিয়েলির বক্তৃতা ছিল। তিনি তাঁর ভাষণে সকলকে চমৎকৃত করে দিয়েছেন। অবিশ্যি আমি যে অন্যদের মতো

37

ডন ক্রিস্টোবাল্ডির ভবিষ্যদ্বাণী

13 November 2023
0
0
0

সেপ্টেম্বর ৬ আজ আমার বন্ধু জেরেমি সন্ডার্সের কাছ থেকে একটা আশ্চর্য চিঠি পেয়েছি। সেটা হল এই— প্রিয় শঙ্কু, তোমাকে একটা অদ্ভুত খবর দেবার জন্য এই চিঠির অবতারণা। আমাদের দেশের কাগজে খবরটা বেরিয়ে

38

স্বর্ণপর্ণী

13 November 2023
0
0
0

১৬ জুনআজ আমার জন্মদিন । হাতে বিশেষ কাজ নেই, সকাল থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, আমি বৈঠকখানায় আমার প্রিয় আরামকেদারাটায় বসে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে আকাশপাতাল ভাবছি। বৃদ্ধ নিউটন আমার পায়ের পাশে কুণ্ডলী

---