shabd-logo

শিকার

1 December 2023

7 Viewed 7

জায়গাটি গোমো-ডালটনগঞ্জ লাইনে পড়ে। স্টেশনটিতে একদা ট্রেন দাঁড়াত। সম্ভবত ট্রেন দাঁড়াবার খরচ পোষায় না। তাই স্টেশন ঘর, থাকার কোয়ার্টার ও কুলী বস্তির ঘরে দেখা যায় গরু ও ছাগল মাঝে মাঝে। 'কুরুডা আউটস্টেশন, অ্যাবান্ডনড্' লেখা বোর্ড। এখানে এসে ট্রেনের গতি মন্থর হয়। হাঁপাতে হাঁপাতে ট্রেনটি ওপরে ওঠে। অল্প অল্প করে এখান থেকেই ট্রেনটি ওঠে কুরুডা পাহাড়ে। ঢালু পাহাড়। কিছুদুর উঠে ট্রেনটি ঢোকে একটি গিরিখাতে। আধ মাইল লম্বা গিরিখাতের দুপাশে ব্লাস্ট করা পাথর। পাহাড়ের ওপরে বাঁশবন, এবং মাঝে মাঝে বাতাসে বাঁশগাছ নুয়ে পড়ে ট্রেনের ছাদে ঝাপট মারে। তারপর ট্রেনটি নামে ও তার গতিবেগ বাড়ে। এবার স্টেশন তোহরি। এ অঞ্চলের ব্যস্ততম স্টেশন। বহু বাস রাস্তার জংশন। তোহরি কোল্হল্টও বটে। ট্রেনে কয়লা ওঠে। চর্তুদিকে সারফেস্ কোলিয়ারি। এ অঞ্চলে মাটির প্রায় ওপরেই নিম্নমানের কয়লা মেলে। তবে তোহরির আসল লক্ষ্মী কাঠের ঠিকাদাররা। শাল অঞ্চল। ট্রাকে রাতদিন শাল-গুঁড়ি আসে। কাঠ-কারখানায় চেরাই হয় ও দিকে দিকে চলে যায়। কুরুডার নৈঃশব্দ্যের পর তোহরির সরগরম একটা অভিজ্ঞতা।

দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে পাহাড়ের মাথা দিয়ে ট্রেন চলার দৃশ্যটি একটা অভিজ্ঞতা। রোজ দেখে গ্রামবাসীরা, তবু বিস্ময় ফুরোয় না। ট্রেনটা যাচ্ছে, যাচ্ছে, ইঞ্জিনটা হাঁপাচ্ছে; এবার খাতটা ট্রেনটাকে গিলে ফেলল। দৌড়ে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে কোথায় ট্রেনটাকে উগরে দিল। পাহাড়ের মাথায় একদিন কয়েকটা হাতিও দেখা গিয়েছিল। বাঁশগাছ খেতে খেতে হাতিগুলো দাঁড়িয়ে পড়ে। দূর থেকে তাদের পুতুল হাতির মতো দেখাচ্ছিল। ট্রেনটি চলে যেতে তারা শুঁড় তুলে চেঁচিয়ে দৌড় মারে। 

কুরুডা গ্রামটি স্টেশনের অনেক পিছনে। দুটি পাহাড়, একটি প্রান্তর পেরিয়ে। আরেকটু কাছে হলে হয়তো গ্রামের মানুষেরাই এসে ওই পরিত্যক্ত পাকা বাড়িতে থেকে যেত।

কুরুডা গ্রামের মতো গ্রামে যারা থাকে, তাদের জীবনে বাৎসরিক পূজাপার্বণ ছাড়া বৈচিত্রা খুবই কম। সেইজন্যই কুরুড়া পাহাড়ের ওপরের দৃশ্যগুলি এমন করে তাদের চোখ ভোলায়।

মেরী ওঁরাও যখন এসে দাঁড়ায়, তখন সে যেমন ট্রেনটিকে দেখে, যাত্রীরাও চোখ পড়লে তাকে দেখে। বয়স আঠারো, দীর্ঘাঙ্গী, চ্যাপ্টা মুখ-নাক, রং তামাটে ফর্সা। সাধারণত ও ছাপা শাড়ি পরে। দূর থেকে ওকে খুব মোহনীয় দেখায় কিন্তু কাছে গেলে বোঝা যায়, ওর চোখের ভাষায় খুব কঠিন প্রত্যাখ্যান আছে।

ওকে দেখলে কেউ আদিবাসী বলবে না। কিন্তু ও আদিবাসী। এক সময়ে কুরুডায় সায়েবদের টিম্বার-প্লান্টেশন ছিল। স্বাধীনতার পর ক্রমে ক্রমে সায়েবরা চলে যায়। ডিক্সনদের বাংলো ও বাড়ি দেখাশোনা করত মেরীর মা। ডিক্সনের ছেলে 1959-এ এসে বাড়ি, জঙ্গল সব বেচে দিয়ে চলে যায়। যাবার আগে ভিনির গর্ভে মেরীকে দিয়ে যায়। সে যায় অস্ট্রেসিয়া। মেরীর নাম রাখেন গিজার পাদরী। তখনও তিনি ক্রীশ্চান ছিল। তারপর রাঁচির প্রসাদজী যখন ডিক্সন-বাংলোয় থাকতে এলেন তিনিকে কাজে বহাল করতে অরাজী হলেন, ডিনি আবার ক্রীশ্চান ধর্ম ছেড়ে দিল। মেরী প্রসাদদের গাই-মোষ চরায়। ও অত্যন্ত দক্ষ গাই-চরাই। তাছাড়া ফলের পাইকারী খদ্দের কুঞ্জরাদের কাছে ও অসম্ভব দর কষে প্রসাদদের ফলবাগিচার সরিফা ও আমরুদ বেচে। ক্ষেতের সবজি নিয়ে চলে যায় ট্রেনে চেপে তোহরি।

সবাই বলে, প্রসাদজী খুব ভাগ্যমন্ত। ডিনির সঙ্গে ওঁর মাইনের বন্দোবস্ত, মেরীর সঙ্গে খাওয়া-থাকা কাপড়ালত্তার কড়ার। ডিক্সনবাংলো সায়েবদের থাকার জন্যে তৈরি। সায়েবরা, ভিনির কথা, বারোজন আয়া নোকর-জমাদার রাখত। এখন প্রসাদজীর আমলে বিশাল বাংলোটি মেরীই পরিষ্কার রাখে।

তোহরি বাজারে মেরীর ভক্তবৃন্দ অগণ্য। স্টেশনে নামে ও রানীর মতো। বাজারে গিয়ে নিজের জায়গায় বসে স্বাধিকারে। অন্যান্য বাজারিয়াদের কাছে বিড়ি নেয়, ওদের পয়সায় চা-পান খায়, কিন্তু কারুকে আমল দেয় না। বাজারিয়াদের নেতা, মস্তান ছেলে জালিম ওর প্রণয়ী। জালিম অথবা ও, একজনের পয়সা জমে একশো টাকা হলেই ওরা বিয়ে করবে।

বিয়ে করবে, এই কথার ভিত্তিতেই ও জালিমকে কাছে আসতে দিয়েছে। ওঁরাও মায়ের মেয়ে, দেখতে অন্যরকম, লম্বাও বেশি। তাই স্বজাতে ওর জন্যে ছেলে মেলেনি। আদিবাসী যুবকদের কাছে মেরীর গায়ের রং একটা প্রতিরোধের দেওয়াল। ছেলে দেখেছিলেন প্রসাদ গিন্নী। ওদের মালীর ছেলে। বলেছিলেন, এখানেই থাকবি।

তিনি বর্তে যায়। মেরী বলে, 'না। মা জী বলেছে, তার কাজের লোক বাঁধা থাকবে বলে।'

ঘর দেবে।

ঝোপড়ি।

ছেলেটা ডালো।

না। ঝোপড়িতে থাকব, ঘাটো খাব, মরদ মদ খাবে, তেল-সাবান পাব না, ফর্সা কাপড়

পরব না, অমন জীবন আমি চাই না।

মেরী রাজী হয়নি। গ্রাম-সমাজে ও স্বীকৃত। মেয়েরা ওর বন্ধু, পালা-পার্বণে নাচতে ও অদ্বিতীয়। তাই বলে ওদের জীবন কাটাতে ও চায় না।

প্রণয়ী হতে চেয়েছে বহুবার বহুজন। মেরী দা তুলে দেখিয়েছে। তারা বাইরের মানুষ। ডিনির মতো, তাকেও পেটে বাচ্চা দিয়ে ওরা পালাবে না, কে কথা দিতে পারে?

ওকে নিয়ে একবার তো তোহরি বাজারে দাঙ্গা বেধে যায়। টিম্বার লরীর ড্রাইভার রতন সিং, মদ খেয়ে ওকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। তখনই জালিম এসে বাধা দেয় এবং রতন সিংয়ের সঙ্গে তার মারামারি হয়। তারপরেই দেখা গেল মেরী জালিমের পাশে বসে সবজি

বা চীনেবাদাম বা ভুট্টা বেচছে। কোনদিন ও জালিমের ঘরে যায়নি। না, বিয়ে হোক আগে। জালিম তাতে খুবই সশ্রদ্ধ। হ্যাঁ, মেরীর মধ্যে সাচাই আছে, অস্ট্রেলিয়ান রক্তের তেজ।

মেরীর মধ্যে কোথাও আছে অবিশ্বাস। জালিমকেও ও পুরো বিশ্বাস করে না। একশো টাকা জমলেই ওরা বিয়ে করবে, এ তোহরির বাজারিয়ারাও জানে। সে একশো টাকা, জালিমের বক্তব্য, সে-ই জমাবে। মেরী কিছু আনতে পারলে ভালো। তাই জালিমের ওপরেই ও ছেড়ে রেখেছে টাকা জমাবার দায়িত্ব। জালিমের পক্ষে কাজটি সহজ নয়। গ্রামে ওর মা-বাবা, ভাই-বোন আছে। এখানে ঘর ভাড়া করতে হবে, বাসনকোসন কিনতে হবে। সব খরচ কুলিয়ে উঠতে পারবে না। তারপর মেরীকে কাপড়টা, জামাটা, সাবানটা দিতে ইচ্ছে যায়।

মেরী ওকে অবশ্য প্রথম উপহারটি দেয়। রঙিন সুতোর গেঞ্জী।

তুমি দেহ্ন? জালিম খুব খুশি।

নায়। তোরা ভৌজী ভেন্স।

এরপর জালিম ওকে এটা সেটা দিয়েছে। যে সব শাড়ি-জামা মেরী পরে না। বিয়ের পর পরবে।

মেরী বোঝে, জালিম যথেষ্ট কষ্ট করছে টাকা জমাবার জন্যে। বুঝেও কিছু বলে না, একশো না হোক, বিরানব্বই টাকা ওর জমানো আছে।

টাকাটি ওর উপার্জন। প্রসাদ বাড়িতে। সরকারী কানুন হল, জঙ্গল-অঞ্চলে, কারো বাড়িতেই যদি মহুয়া গাছ থাকে, তাতে যে তুলবে তার অধিকার মহুয়া ফলে। মহুয়া ক্যাশ ফল। মহুয়া থেকে মদ হয়, মহুয়া ফলের কালো বিচির তেল হল কাচে কাপড়কাচ সাবান তৈরির উপাদান। প্রসাদ বাড়ির চারিটি মহুয়া গাছের ফলই মেরী কুড়োয়। গ্রামের অন্য কেউ, মস্করা করেও সে ফলে হাত দিতে পারেনি। তখনই মেরী দা তুলেছে। এ তার হকের জিনিস। এর জন্যেই ও প্রসাদ বাড়িতে বিনে মাইনেয় এত খাটে।

প্রসাদ-গিন্নীর ব্যাপারটি খুব পছন্দ নয়, কিন্তু লছমন প্রসাদ বলেন, 'ওদিকে চেও না। কে এমন করে বাড়ি সাফ করবে, গাই চরাবে? তোরি গিয়ে ফল, সবজি, বাদাম বেচে আসবে লাভ রেখে?'

মেরী ভূতের মতো খাটে, কিন্তু প্রসাদজীর কাছ থেকে ও কোন অন্তরঙ্গতা বরদাস্ত করে না।

কি রে মেরী, মৌয়া বেচে কত টাকা হল?

অপনার দরকার?

মহাজনী কারবার খুলে দে।

হ্যাঁ, তাই খুলব।

দেখ আমি বলেই তোকে মৌয়া তুলতে দিই। নইলে সরকারী হক্। নোকর লাগিয়ে তুলে দিতে তো পারতাম? নিই না তো?

নোকররা এসেই দেখুক। দা আছে না। খুব রুক্ষ ও গম্ভীর গলা মেরীর। প্রসাদজী বলেন, হবে না? সাহেবী রক্ত।

প্রসাদ-গিন্নি মেরীকে দিয়ে তেল ডলিয়ে, গা দাবিয়ে নেন। চর্বিসর্বস্ব শরীরে মেরীর নিটোল ও কঠিন শরীরটি দেখেন। বলেন, 'কি রে, সাদীর কদ্দূর? জালিম কি বলে?'

গরীব মানুষের কথা শুনে আপনি কি করবেন? আপনি সাদী দিয়ে দেবেন?

রাম রাম! মুসলমানের সঙ্গে? আমি সাদী দেব? কেন? মুসলমান তো সাদী করবে বলছে। আপনার ভাই তো রাখতে চেয়েছিল। মুখের মতন জুতোটি খেয়ে গিন্নি চুপ করেন। যে মেয়ে ভূতগত খাটে, আধমণী বস্তা পিঠে নিয়ে চলে যায় ট্রেনে চেপে, আধঘণ্টায় পুরো বাড়ি সাফ করে, তার মুখের কথা সইতে হবে বই কি।

মেরীকে সবাই ভয় করে। মেরী তার অটুট স্বাস্থ্য, অসীম কর্মক্ষমতা, ক্ষুরধার বুদ্ধি নিয়ে ঘর সাফ করে, গাই চরায়। চরাতে-চরাতে ভাজা মকাই দিয়ে লাঞ্চ সেরে নেয়। দাড়িয়ে থেকে ফল পাড়ে ও পাড়ায়। নিজে ওজন করে দেয় কুঞ্জরাদের। পাখি ও বাদুড়ে খাওয়া ফল বোরায় তুলে নিয়ে যায়, ওর মায়ের পোষা মুরগীদের খাওয়ায়। বর্ষা সমাগমে বীজ থেকে গজিয়ে ওঠা চারা নেড়ে নেড়ে বসায়। সমস্ত দিকে কড়া নজর ওর। প্রসাদদের প্রয়োজনীয় চাল-তেল-ঘি-মসলা তোহরি বাজার থেকে কিনে আনে। নিজেই বলে, 'যত পয়সা বাঁচাই আপনাদের, আর নাফা করে দিই, তাতে আপনার কত টাকা জমে বছরে মা জী? কেন সস্তার শাড়ি নেব? ডালো কাপড় পরব, তেল-সাবান মাখব, সব দেবেন।'

প্রসাদ-গিন্নি অগত্যা ওকে ভালো কাপড় পরান।

মাঝে মাঝে ও গ্রামে যায় আড্ডা মারতে। অবরে-সবরে। সেখানে গিয়ে পেটে কাপড় বেঁধে প্রসাদ-গিন্নি হয়, এক পা খুঁড়িয়ে প্রসাদজী হয়, সকলকে হাসায়। সেখানে ও খুবই সহজ। যুবক ছেলেরা যখন বলে, 'মুসলমানী বিবি এখানে যে?'

তোরা কেউ বিয়ে করলি?

তুই করলি?

আমার মতো লম্বা হয়ে, এত গোরা হয়ে এলি না কেন?

তুই তো সাহেবের মেয়ে।

'বড় সাহেব! ঔরতের পেটে বাচ্চা দিয়ে চুহার মতো ভেগে যায়। আমার মা হল বদমাশ। যখন দেখলি গোরা মেয়ে, তখনই তো মেরে ফেলবি? তাহলে কি এত ল্যাঠা হত?'

মেরে ফেললে তোর কি হত?

আমি থাকতামই না।

ছেঁড়া কথা রাখ। মুসলমানী হবি তো হবি। হবার আগে আমাদের একদিন.....

কি?

ভাত-মুরগী-খাসী আর মদ?

খাওয়াব। শুব খাওয়াব। কবে খাওয়াইনি? বল্ তোরা?

তা খাওয়াস বটে।

যে মেরী, প্রসাদজীর মুনাফা রাখতে মণ-মণ বোঝা টানে, ফল বেচে কুঞ্জরাদের সঙ্গে লড়াই করে, চীনেবাদাম একটা কারুকে দেয় না, সেই মেরীই ও বাড়ি থেকে চুরি করে আনে বাদাম তেল, আটা, গুড়। লবণ আর মসলা।

টোলীতে যে কোন ওঁরাও বাড়িতে বসে ও মাটির চাটুতে আটার পিঠে ভাজে, সকলের সঙ্গে খায়। জালিমকে বিয়ে করবে তা যেমন জানে, এও জানে, ও-যে কোন ওঁরাও মেয়ের মতো দেখতে হলে-ওর পিতা সোম্বা বা বুধনা বা মংলা এঁরাও হলে-এ বিয়ে ওঁরাওরা হতে দিত না। শ্বেতাঙ্গ পিতার জারজ মেয়ে বলে ওকে ওঁরাওরা রক্তের রক্ত মনে করে না এবং স্বয়ং স্ব-সমাজের কঠোর রীতিনীতি ওর ওপর আরোপ করে না।

করলে ও বিদ্রোহ করত। কবে না বলে ওর দুঃখ হয়। ওর অন্তরের অন্তরে কোথায় যেন ওঁরাও সমাজের একজন হবার আকাক্তক্ষা আছে। খুব খুশি হত ও। ওর তের-চোদ্দ বছর বয়সে যদি কোন সাহসী ওঁরাও ছেলে ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করত। মেরী তোহরিতে দু-তিনটি হিন্দী ছবি দেখেছে। আমন উঠলে তোহরিতে ভ্রাম্যমাণ ফিল্ম দল আসে। খোলা মাঠে সিনেমা দেখায়। কুরুন্ডা গ্রামের মেয়েরা কেন, ছেলেরাই বলতে গেলে কেউ সিনেমা দেখেনি। সিনেমা দেখেনি, ভালো কাপড় পরে নি, পেট ভরে খায়নি। এদের পরে মেরীর এক রকম মমতাও আছে।

এই রকম করেই চলতে থাকে মেরীর জীবন। একদিন হঠাৎ, ট্রেন থামিয়ে প্রসাদজীর ছেলের সঙ্গে নেমে পড়ে ঠিকাদার তশীলদার সিং, এবং মেরীর জীবন বিপর্যস্ত হয়, কুরুডার শান্ত ও দরিদ্র অস্তিত্বে ঝড় ওঠে।

দুই

প্রসাদজীর বাংলোর সংলগ্ন জমি পঁচাত্তর একর বা দুশো পঁচিশ বিঘা। এ অঞ্চলে সিলিং কেউ মানে না, দূরে দূরে একদা টিম্বার-প্লান্টারদের যে সব বাংলো আছে, সবগুলির সঙ্গেই অসাগর জমি। ডিক্সন সাহেব পঞ্চাশ একরে শাল গাছ লাগান। ও অঞ্চলের বামন শাল নয়, জায়েন্ট শাল। কালে গাছগুলি মহীরুহ হয়েছে। ফেলিংএর জন্যে প্রস্তুত। শালগাছ না থাকলে প্রসাদজী এ জমিতে কি কি ফলাতে পারতেন, তা নিয়ে আক্ষেপ করতেন। এখন শাল গাছের দাম জেনে থেকে তাঁর একমাত্র লক্ষ্য, উচ্চতম দামে গাছ বেচা। হেন প্রস্তাবে লালচাঁদ এবং মূনিজী, অঞ্চলের আরো দুই জঙ্গল মালিকও খুশি হন। প্রসাদের ছেলে বনোয়ারী সচেষ্ট হয় ও ডাল্টনগঞ্জ ছিপাডোর চষতে থাকে। ফলশ্রুতি তশীলদার সিং।

তশীলদার সিং এসেই প্রথমে বধ্য গাছগুলি দেখে। তারপর দাঁও কষাকষি চলে। প্রসাদ বললেন, 'এ রকম শাল কাঠ! এই দামে বেচা যায়?'

বেচবেন কেন? যেখানে নাফা মিলবে, সেখানে বেচবেন?

একটা দামের মত দাম বলুন।

প্রসাদজী! বনোয়ারী আমার চিকে দোস্ত। ছিপাডোরে ও সার্ভিস করে, আমি ঠিকাদারী। মিছে বলব না, ম্যাচিওর গাছ, কাঠ ডি পাক্কা।

সাহেবরা লাগিয়ে গেছে।

হ্যাঁ। তবে এখানে গাছ কাটাব, টুকরা হবে! ট্রাক এখানে আসবে না। সাহেবদের দিন নেই যে হাঁথি আনব ফরেস্ ডিপাট্ থেকে আর তোরি অব্দি টানাব কাঠ। আমাকে মুরহাই অবধি নিতে হবে। কাঁচা রাস্তায় ট্রাকের টায়ার ফাঁসবে। তার আগে গাছ কাটাব, কত খরচা আমার হবে বলুন?

নাফা তো হবে? জরুর। বিনা নাফা কোই কাম করে? তবুও নাফা আপনার বেশি। জলের দরে বাংলা কিনলেন, তৈরি শাল ফরেস্ পেলেন! যা পাবেন, সবই নাফা। কেঁও কি, এর জন্যে তো আপনার কিছু ইনভেস্ না হ্যায়। মকাই নয় যে ভৈঁষা লাঙল টেনেছে, নৌকর কেটেছে। সরিফা বা আমরুন্দ নয়, যে পাখি বাদুড় তাড়িয়েছেন। ফরেস্ এরিয়া, শাল এরিয়া, গাছ আছে বেচে দিবেন ফটাফট্!

লালচাঁদ আর মুনিও বললেন, 'ইনা তকরার না করো তৈয়া। ও চলে গেলে কি করব? শাল গাছে যখন বাতাস চলে, দরিয়া গজায়, ওহি শুনেগা? ফুল হয়, ফল হয় না। ওহি দেখেগা? কিনতে চায়, বেচে দেব।'

ঠিকাদারও তাই চায়। সাহেবরা কি সব গাছ লাগিয়ে গেছে। আকাশ ফুঁড়ে মাথা উঠেছে, গুঁড়ি রেল ইঞ্জিনের মতো মোটা। শুধু প্রসাদজীর গাছ কিনবে কেন? এ অঞ্চলের সব গাছ ও কিনবে।

প্রতি পাঁচ-সাত বছরে কিছু কিছু গাছ তৈরি হবে, ও আমিই কিনব। ফটাফট! য়ে আতিতক্ ভার্জিন এরিয়া হ্যায়, হাহি মনোপলি গাছ ফেলিং করেগা।

তাই ঠিক হল। প্রসাদজী পরে বুঝলেন, গাছ বওয়ার খরচের কথাটি সর্বাংশে সত্য নয়। কেন না মুরহাই ছাড়িয়ে, কুরুডার কাছাকাছি চলে এলো ট্রাক। ওদিকটা সমতল ও পাথুরে। ট্রাক আসতে বাধা নেই। সেখানে তাঁবু পড়ল ঠিকাদারের। গাছ কাটার জন্য দক্ষ লোক এলো দুজন।

ঠিকাদার ম্যান পাওয়ার রংরুট করতে বসল। কুরুডা, মুরহাই, সিহো, ধাপারি, ধুমা,

চিনাডোহা-ছয়টা গ্রামের ওঁরাও মুণ্ডা পুরুষরা মেয়েরা এলো। অবিশ্বাস্য কথা। ঘরে বসে

পয়সা। গাছ কাটবে অন্য লোক, তার ডাল-পালা ছাঁটাই, কাটা গাছ পিস্ করার পর সেগুলি

বয়ে ট্রাকে নেওয়া, পুরুষরা দিন বারো আনা, মেয়েরা আট আনা। তারপর দুপুরে মকাইয়ের ছাতু টিফিন। অবিশ্বাস্য সব! ছাতুর সঙ্গে লবণ এবং লঙ্কা। গ্রাম-পহান্ ও গাঁওবুড়ারা মেয়ে-পুরুষ আনবে। গ্রাম পিছু প্রতি হপ্তায় এক বোরা লবণ। গাঁওবুড়ারা বলল, মেয়েরা কাজ করবে, তাদের ইজ্জত?

ঠিকাদার বলল, সবাই সবায়ের মা-বোন! যে তুলবে, তাকে ভাগিয়ে দেব।

ট্রাকের গতিময়তা, ঠিকাদারের কথাবার্তার স্পীড, তড়িঘড়ি কাজের ব্যবস্থার স্পীড, তাতে গাঁওবুড়াদের মাথা ঘুরে গেল। ফলে তাদের মনেই হল না, ঠিকাদারের কথাটি ঠিক নয়। সবাই সবায়ের মা-বোন হতে পারে না। কথা পাকা হতে ঠিকাদার গাঁওবুড়াদের ছ'জনার হাতে ছ'বোতল এক নম্বরী চোলাই ধরিয়ে দিল। কুরুডার গাঁওবুড়ারা অন্যদের বলল, 'গাঁয়ে যেয়ে পহানকে বলে থানে পূজা দে। সময়টা ভালোই পড়ল আমাদের।'

ঠিকাদার ট্রেনের ড্রাইভারের সঙ্গেও কথা বলে নিল। দূরহাইতে ট্রেন ধরে। সেখানে কথা বলে নিলে, দরকারে কুরুড়াতে ট্রেন ধরবে। ওয়াগন মিলবে। ড্রাইভারকেও বোতল দিল ঠিকাদার। পাকা শাল গাছ একেকটির দাম দিচ্ছে সে পনের টাকা। কোন খরচেই তার বিশাল মুনাফা আটকায় না। সে বেচবে কিউবিক ফুট হিসেবে। বনোয়ারীকে সে একটি ট্রানজিস্টার দিল। বনোয়ারী না বললে সে জানতেও পারত না, বামন শালের দেশে এই কোয়ালিটির শাল গাছ আছে। সমস্ত ব্যাপারটি অত্যন্ত লাভজনক। ঠিকাদারটি তার স্বজাতীয় প্রসাদ বা মূনি বা লালচাঁদের বর্বর অশিক্ষা ও' অজ্ঞতাকে তারিফ করল। বেটারা জানেও না, কি মাল ছেড়ে দিচ্ছে। বনোয়ারীকে সে গাছ পিছু এক টাকা গোপনে দিয়ে দিয়েছে। তাতেও তার প্রচুর মুনাফা থাকছে। বহু গাছ পাঁচ সাত বছরে কাটার মতো তৈরি হবে। প্রসাদকে হতে রাখা দরকার। শীগগিরই এ সব অঞ্চল যুক্ত হবে ওদিকের তোহরি ও এদিকে নিরলা-ঘাটের সঙ্গে। রাস্তা তৈরি হচ্ছে। রাস্তা হয়ে গেলে তখন, ভবিষ্যতে ট্রান্সপোর্ট খরচা বেঁচে যাবে।

কিছুদিন বসে ঠিকাদারটি তোহরি থেকে এক বাক্স মিষ্টি, এক হাঁড়ি ঘি নিয়ে প্রসাদের বাড়ি এলো। প্রসাদ বললেন, 'মেরী! মেহমান এলো। কুছু চায়ে-উয়ে আন্।'

মেরী আজই স্নান করেছে। ফলে খুব ঘষামাজা চেহারা, চুলে তেল দিয়ে বেণী বাঁধা। ছাপা কাপড় সামনে আঁচল দিয়ে পরা, হাতে ও কানে পেতলের গহনা। ট্রে-তে চা খাবার নিয়ে মেরী ঢুকল, তশীলদার সিং সোজা হয়ে বসল। আরে বাব্বা! এ কি মেয়েছেলে? এই জঙ্গলে?

প্রসাদজী বুঝলেন। মেরী বেরিয়ে যেতেই উনি বললেন, আমার নোকরানীর মেয়ে। ওর মা যখন ওর মতো জোয়ানী, তখন...

মেরীর রূপের গোপন রহস্য বিবৃত করে তিনি উপসংহার স্বরূপ বললেন, আমার পরিবার ওকে বেটি সমঝতে, আমাদের ও মা-বাবার মতো ভক্তি করে। তা তো হবেই। তশীলদার সিং বলল, নইলে আপনাকে সবাই বড়মানুষ বলে কেন? সেই বড়, যার দিল-কলিজা বড়। সে মনে মনে ভাবল, এই জঙ্গলে গাছ কাটানোর ব্যাপারটি

খুবই নাফাজনক। মেরী তার অবস্থিতি কালকে অন্য অর্থেও নাফাজনক করতে পারে। মেরী হল বহির্জগৎ তোহরি ও কুরুডার নিয়মিত যোগাযোগ-সেতু। রাতে প্রসাদজীকে ওষুধ খাবার গরম জল দিতে এসে ও বলল, য়ো হারামী তো আপনাদের ঠকিয়েছে। নাফা পিটে নিল। তোহরিসে ছিপাডোর সবাই হাসছে।

প্রসাদজী বাঁধানো দাঁতের পাটি খুলে জলের বাটিতে রাখলেন। তারপর ওষুধ খেলেন। একটু পরে বললেন কা করে মেরী? রোড না হ্যায়, আমার ক্ষমতা কি যে নাফায় কারুকে বেচব? জঙ্গলে থাকলে এই হয়। বনোয়ারীটা ওকে আনল। বনোয়ারীটা গোঁয়ার, তাতে ওর মায়ের দলে। আমি আগে 'না' বললাম, তাতে লালচাঁদ ঔর মূলনি রেগে গেল। বাড়িতেও অনেক আপত্তি হল।

বনোয়ারীও টাকা খিঁচে নিয়েছে। তুই জানিস?

হমানি কো মালুম হ্যায়।

দেখ কি দুঃখের কথা।

নিশ্বাস ফেলে প্রসাদজী একটা টাকা ওকে দিলেন। এরকম মাঝে মধ্যে দেন। বললেন, আমার একটি ফল, একদানা ভুট্টায় যাতে না ঠকি, সে জন্যে তুই কত কষ্ট করিস। নিজের ছেলে, কিছু বোঝে না। কি করব বল? আমি কি জানি না, আমি মরলে এই সব কিছু বেচে দিয়ে বেটা ভেগে যাবে? পরে যখন গাছ বেচবেন, ততদ্দিনে রোড হয়ে যাবে, উস্কো মৎ দে না। নিজে যাবেন ছিপাডোর। বড় কোম্পানীর সঙ্গে কথা বলে কাজ করবেন। তখন নরম হবেন না।

ঠিক বলেছিস।

মেরী কুরুডার গাঁওবুড়াদেরও বলল, বারো আনা আর আট আনা! এ পয়সায় তোহরি বা ছিপডোরে কোন কুলী বাবুদের ব্যাগ বয় না।

গাঁওবুড়ারা বলল, কা করে মেরী! আমি 'না' বললে গাঁয়ের লোক খেপে যেত। বলত, কে আমাদের এই পয়সা বা দিচ্ছে?

মেরী বলল, 'ওর লোড লেগে গেছে। পাঁচ-সাত বছরে আবার ও আসবে। তখন তিন টাকা দু' টাকা নেবে দর কষে। ওকে দিতেই হবে। নইলে এখানে বাইরের লোক পাবে। কোথায়?

রোড নেই, কাজ মেলে না, জানিস তো সব।

মেরীর মনে হল, ঠিকাদারের চাহনির উত্তর অনুযায়ী সেও তার বুদ্ধি মতে সকলকে লোকটার স্বরূপ জানিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু তশীলদার সিং ওর কথা ভুলল না। কয়েকদিন বাদে, মেরী যখন মোষের পিঠে চড়ে অন্য গরু-মোষ তাড়িয়ে ঘরে ফিরছে, তশীলদার এসে দাঁড়াল। বলল, কি খুবসুরহ রে! তোকে হেমা মালিনীর মতো দেখাচ্ছে।

কা বোলা?

তোকে হেমা মালিনীর মত দেখাচ্ছে।

তোমাকে উল্লুর মতো দেখাচ্ছে।

তশীলদার সিং এ হেন মন্তব্যে খুবই প্রশ্রয় পেল ও কাছে এলো। মেরী মোষটা থামাল না। চলতে চলতে একটি ধারাল দা ও ফস্ করে বের করস ও অলস কন্ঠে বলল, তোমার মতো সরু প্যান্ট, কালো চশমা পরা ঠিকাদার তোহরির রাস্তায় টাকায় দশটা মেলে, তাদের আমি এই দা দেখাই। বিশ্বাস না কর, গিয়ে জেনে এসো।

তশীলদারের কাছে ওর কথা বলার তঙ্গীটি খুব আকর্ষণীয় মনে হল। রাতে খেতে বসে বনোয়ারী বলল, মেরী আমার বন্ধুকে অপমান করেছে।

কথাটা বলল বাপকে, জবাব দিল মেরী, কি অপমান করেছি তোমার বন্ধুকে?

রুঠা বাত বলেছিস।

এবার বাত বলে ছেড়ে দিয়েছি। পরে ওরকম বদমাশি নাখারা করতে এলে নাক কেটে দেব।

বনোয়ারীও ঘাবড়ে গেল। বলল, কা, কোই বুরা কিয়া য়ো?

আমার কাছে সেটা বুরাই বাত। তোমার কাছে সেটা ভালো কথা হতে পারে।

প্রসাদজী বললেন, তুই ওকে বারণ করে দিস। গাছ কিনতে এসে এ সব ঝামেলা ভালো

নয়।

মেরীও যেন তোহরি বাজারে শাল গাছ বেচার কথা না বলে। বাড়ির জমিতে হলেও শাল গাছ বেচা বে-আইনী। শাল সরকারের গাছ। রাখ তোর আইন। আইন মতে জমি কে রাখে, এ তল্লাটে শাল গাছ কে বেচে না?

মেরী বনোয়ারীকে সরাসরি বলল, আমি তোমাদের গাছ বেচার কথা তোহরি বাজারে বলেছি?

বলেছিস্ বলেছি? বলতে মানা করেছি।

আমাকে হুঁশ দিতে হবে না।

মেরী চলে গেল। প্রসাদজী বললেন, এ ঠিক বাত নয়। তোর বন্ধুকে বলে দিবি। বাড়িতে থাকে, মেয়ের মতন, ওকে কিছু বললে আমার অপমান।

বনোয়ারী তশীলদারকে বলল, য়ো বহোৎ খচড়াই আর রুঠা মেয়ে। কারুকে পাত্তা দেয় না।

কে পাত্তা চায়?

তা ছাড়া ওর সাদীও ঠিক হয়ে আছে।

কোথায়?

মুসলমানের ঘরে।

রাম রাম! সমাজে কি ছেলে নেই?

ওর পছন্দ।

তশীলদারের বিশ্বাসই হল না, কুরুডার মতো জংলী গ্রামের মেরী ওঁরাও ওকে উড়িয়ে দিতে পারে। গাছ দাগানো ও কাটা, টুকরো করা ও চালান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ও মেরীর সঙ্গ ধরে থাকল। মেরী ওকে পাত্তা দেবে না, মুসলমানকে বিয়ে করবে, তাতে ওর জেদ বেড়ে গেল।

এরপরেই ও মেরীর জন্যে ডালটনগঞ্জ থেকে একটা নাইলন শাড়ি কিনে আনে, প্রসাদজীর জন্যে মিষ্টি। প্রসাদজীকে বলে, কত আসি যাই, চা-য়ো খাওয়ায়, একটা কাপড় দিলাম। প্রসাদজী নিতে রাজী হল না, কিন্তু তশীলদার শোনেনি। মেরী গিয়েছিল তোহরি। ফিরে এসে কাপড়টার কথা ও শোনে। প্রথমে প্রসাদজীকে পয়সার হিসেব বুঝিয়ে দেয়। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে চা-রুটি খায়। তারপর বেরোয় কাপড় নিয়ে।

তশীলদার তাঁবুতে বসে মেয়ে-মরদকে পয়সা দিচ্ছিল। প্রচুর মানুষের ভিড়। তারই মধ্যে মেরী ঢুকে পড়ে ও জঘন্য গাল দিয়ে কাপড়টা ছুঁড়ে দেয়। বলে, শহরের রাস্তী পেয়েছিস আমাকে। কাপড় দিয়ে ভোলাতে এসেছিল? ফের বদমাশি করবি তো নাক কেটে নেব। হাত দুলিয়ে বেরিয়ে যায় ও সগর্বে।

তশীলদারের মুখ খুব ছোট হয়ে যায় ওদের কাছে। সে বলতে যায় ভালো মনে একটা জিনিস দিলাম....

গাঁওবুড়ারা বলে, আর দিস না।

কি বললে?

আর দিস না।

উ কা আচ্ছা ঔরত হ্যায়? মুসলমানকো সাথ সাদী করেগা কোট আচ্ছা ঔরত?

আর বলিস না। হঠাৎ তশীলদার বোঝে, সে এবং তার লোকজন সংখ্যায় কম, এরাই বেশী। সকলের কাছেই বলোয়া বা দা! সে চুপ করে যায়।

রাতে ড্রাইভারও তাকে বলে, এ সব নাখারা উঠাবেন না। য়ে আদিবাসী লোক খচড়াই হোতা। কোই থানামে পাত্তা চলায়ে তো মুশকিল হয়েগা।

ড্রাইভার জানে, তশীলদারের ঘরে বউ ছেলে আছে। জানে, তা সত্ত্বেও তশীলদার মেয়েদের লালচে মরে। মেরী খুবই মোহনীয়া বটে, কিন্তু সেই কারণে আদিবাসীদের খেপিয়ে দিয়ে থানা-পুলিস করা বোকামি। মেরী যদি রাজী থাকত, তাহলে কোন কথাই উঠত না। মেরী নারাজ। তশীলদারকে সেটা মেনে নিতেই হবে।

এরপর প্রসাদজীও গম্ভীর হয়ে যায়। চা আনতে থাকে ভিনি। তশীলদার ও বাড়ী যাওয়া ছেড়ে দেয়। কিন্তু মেরীর ধান্ধা ও ছড়ে না।

মেরী যখন গাই চরিয়ে ফেরে, তোরি থেকে ফেরে, তোহরি যাবে বলে তিন মাইল দূরে মুরহাই স্টেশনে যায়, হাট করতে যায় ধূমা, তশীলদার ওর সঙ্গে দূরত্ব রেখে ওকে অনুসরণ করে।

মেয়েরা বলে, মেরী, ও ঠিকাদার তোকে ভালবাসে।

হাতের মধ্যে পাচ্ছে না বলে। পেলেই ভালবাসা উপে যাবে। আমার মাকেও তো সাহেব ভালোবেসেছিল।

সাদী করবে তোকে।

বউ আছে।

তাতে কি?

ছাড় ওর কথা।

গাছ কাটা চলতে থাকে। ক্রমে শীত কমে। পলাশ গাছ এখানে মাইলের পর মাইল। গাছে নতুন কুঁড়ি আসে। তারপর একদিন পহানের ঘরে নাগারা বাজে। জানা যায়, হোলির দিন আদিবাসীদের যে শিকার খেলার নিয়ম আছে, এবার সে শিকার মেয়েদের। বারো বছর পুরুষরা এ দিনে শিকারে যায়। তারপর আসে মেয়েদের পালা। পুরুষদের মতো তারাও বেরোয় বলোয়া-তীর-ধনুক নিয়ে। জঙ্গলে পাহাড়ে ছোটে। শজারু-খরগোশ-পাখি যা পায় তাই মারে। তারপর সবাই মিলে বনভোজন করে, মদ খায়, গান গায়, সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে। পুরুষরা যা যা করে, ওরাও ঠিক তাই করে। বারো বছরে একদিন। তখন হোলির আগুন জ্বেলে ওরা গল্প করতে বসে। বুধনি গল্প বলে, সেবার আমরা গুলবাঘা মারলাম। আমি তখন জোয়ানী ছিলাম।

গল্প শোনে বুড়িরা, প্রৌঢ়ারা রাঁধে, জোয়ান মেয়েরা গান গায়।

কেন ওরা শিকার করে, তা ওরা জানে না। পুরুষরা জানে। হাজার-লক্ষ চাঁদ ধরে ওরা এ দিনে শিকার খেলছে। একদিন বনে জানোয়ার ছিল, জীবন বন্য ছিল, শিকার খেলার অর্থ ছিল। এখন বন শূন্য, জীবন অপচিত ও নিঃশেষ, শিকার খেলা অর্থহীন। সত্যি শুধু একদিনের আনন্দটুকু। তশীলদারের ক্লান্তিহীন একাগ্র অনুসরণে মেরীর ধৈর্য চলে যাচ্ছিল। জালিমও জেনে যেতে পারে। জানালে সে খেপে যাবে। হয়তো বাগে পেলে তোহরি বাজারে মারতে যাবে তশীলদারকে। তশীলদারের অনেক টাকা, অনেক লোকজন। শহুরে খচড়া। কোন চুরির মামলা সাজিয়ে শেষ পর্যন্ত জালিমকে ফাঁসাতে পারে।

এরই সঙ্গে সঙ্গে ধৈর্য হারাচ্ছিল তশীলদারও। গাছকাটা হয়ে যাবে শীঘ্রই, কারবার গুটিয়ে চলে যেতে হবে, তখন কি হবে? তশীলদার একদিন মেরির হাত চেপে ধরল।

সময়টা অনুকূল ছিল। এবার পুরুষদের শিকার খেলা নেই। পুরুষরা মদ খাবে, হোলির গান বাঁধবে নতুন নতুন, সং সেজে গাইতে বেরুবে, পয়সা নেবে। তশীলদার ওদের হোলির মদ দেবে বলেছে।

গাছ-কাটাইয়ের জায়গা থেকে ঘরে ফিরেই গান, রোজ গান। টানা বৈচিত্রাহীন সুরে। তাই শুনছিল মেরী। হাট ফেরত। শুনতে শুনতে সন্ধ্যা হল। ও ঘরের দিকে রওনা হল। তশীলদার জানত ও আসবে। ওর হাত চেপে ধরল তশীলদার। বলল, আজ ছাড়ব

ना।

মেরী প্রথমে ঘাবড়ে যায়। ধস্তাধস্তিতে দা-টা ছিটকে পড়ে। অনেক চেষ্টায়, অনেকক্ষণ নীরব ধস্তাধস্তির পর মেরী ছিটকে সরে আসতে পারল। দুজনেই উঠে দাঁড়াল। তশীলদারের চোখে এখন কালো চশমা নেই। বড় জুলপি, লম্বা চুল, টেরিক্লথের প্যান্ট, সুঁচলো জুতো, গায়ে ঘন লাল জামা। হোলির গানের পটভূমিতে ওকে একটা জানোয়ার মনে হল মেরীর। জা-নো-য়া-র! শব্দগুলো মনে ধাক্কা মারল। হঠাৎ মেরী হাসল।

মেরী!

ব্বাস, ওখানেই থাকো। এগিও না।

কি দেখছিস?

তোমাকে।

আমি তোকে-

আমাকে খুব চাও তুমি, তাই না?

খুব।

ডালো।

কি ভালো?

বুঝলাম সত্যিই চাও।

সত্যি চাই। তোর মতো মেয়ে মানুষ আমি দেখিনি। লাখ টাকার মাল তুই। তোর কদর করবে ও বাজারিয়া? ও মুসলমান?

তুমি করবে তো?

নিশ্চয়। কাপড় দেব, গহনা দেব-

আচ্ছা?

সব দেব। মেরী খুব জোরে জোরে নিশ্বাস টানল। তারপর বলল, আজ নয়। আজ আমি অশুচ আছি।

কবে, মেরী কবে?

মেরীর চোখ ও মুখ কোমল হল। বলল, হোলির দিনে। তুমি থাকবে ওই বুরুর কাছে। সব মেয়েরা শিকার খেলতে দূরে দূরে যাবে। আমি তোমার কাছে আসব। তুমি তো জানো কোন্ বুরু! তুমি তো সেই পাথরটার আড়াল থেকে আমায় দেখ।

বুঝেছি।

তবে সেই বাত রইল?

হাঁ মেরী।

কারুকে বোল না কিন্তু! মরদের তো দোষ লাগে না, ঔরতের দোষ লাগে। আমি তো বেজন্মা, তায় মুসলমানকে সাদী করতে যাচ্ছিলাম।

করবি না তো?

আর করি? তুমিও একটু ধৈর্য ধরে থেক। ও রকম করে আমার পিছনে ঘুরো না।

তোর জন্যে কত কষ্ট করলাম..... সব পুষিয়ে দেব। হোলির দিনে।

মেরী ওর গালে হাত বুলিয়ে দিল। বলল, তুমি বড় ভালো গো! আগে বুঝিনি। হেলে দুলে মেরী রওনা হল। ও জানত, আক্ত তশীলদার ওকে পিছন থেকে দ্বিতীয় বার জাপটে ধরবে না।

তিন

আগের রাতে আগুন জ্বলেছে, আজ রাতেও জ্বলবে। কাল রাতে হোলির আগুন অনেক ওপরে উঠে আকাশ রাঙা করে রেখেছিল বেশ কিছুক্ষণ। আজ সকাল হতেই পুরুষরা মেতেছে মদে-গানে আবিরে। অত্যন্ত বুড়ি যারা, তারা কয়েকজন বাচ্চাদের আগলাচ্ছে।

মেয়েরা সবাই বনে। যে যার ঘরের সামনে বলোয়া-পুরুষদের তীরধনুক নিয়ে উত্তেজনায় টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। পহান্ নাগারায় ঘা দিতেই ওরা কুলকুলির তীক্ষ্ণ আওয়াজে আকাশ চিরে দিয়ে ছুটে গেছে। তিনি ছুটেছে প্রসাদজীর একটা শার্ট আর প্রসাদ-গিন্নীর সায়া পরে।

বুনি,, মুংরি, সোমারি, শনিচরী-এদের ছোটাছুটির দিন বিগত। ওরা মদের বোতল, রান্নার চাল-ডাল, বাসন, মদের চাট, মকাই ভাজা, পেঁয়াজ লঙ্কা নিয়ে গেছে পরিত্যক্ত বম্ ফিল্ড বাংলায়। সেখানে কুয়োয় জল আছে। পুরুষরাও শিকারের পর ওখানেই রাঁধে ও খায়। বুনি মেয়েদের বলেছে, আমাদের সময়ে আমরা খরা-শজারু তিতির, কিছু না নিয়ে ফিরতাম না। দেখব তোরা কি করিস। শিকার কেমন করিস?

মেরী আজ জালিমের দেওয়া নতুন শাড়ী পরেছে, পুঁতির মালা। নাচতে নাচতে বুনিকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, শিকার খেলে এসে তোকে সাদী করে নেব। তখন আমি বর, তুই বউ। তাই হবে।

তোকে নাচার।

নাচব।

মেরী আজ আনন্দে উপছে পড়েছে। মায়ের পোষা মুরগি চারটে ও কিনে নিয়েছে মার হাতে নগদ দশ টাকা দিয়ে। মুরগিগুলো এখন শনিচরীর হাতে। মেরী মদও দিয়েছে দু' বোতল। এটা উপরি। মেয়েরা আগেই তশীলদারের কাছে মদ চেয়ে নিয়েছে। তশীলদার পুরুষদের মদের ওপর খাসীও দিয়েছে একটা। বলেছে, সন্ধ্যায় ও এসে সকলকে শহরের টুইস্ নাচ দেখাবে। মদ খাবে বোতল বোতল। গাছ কাটা হয়ে গেছে ওর, পড়ে আছে কাটা গাছের টুকরো। সে অনেক। তশীলদার অসীম উদারতায় সেগুলো কুরুডার লোকদের জ্বালানি করতে দিয়ে দিয়েছে। বলেছে, আবার আসব, তোদের দিয়েই গাছ কাটাব। তখন মদে চুবিয়ে রাখব তোদের।

বুধনিদের সঙ্গে রঙ্গ রসিকতা করে মেরীও ছুটে গেল। শনিচরী বলল, ওঃ, মেরীকে কেমন দেখাচ্ছে আজ? যেন মুনিজীর বেটার বউ। বুধনি বলল, ও বিয়ে করে চলে

গেলে কুরুডা কানা হয়ে যাবে। মুংরি বলল, কখনো খালি হাতে টোলিতে আসেনি। তোরা ওকে দেখছিস, ভুলে গেছিস,

ডিনি কত সুন্দর ছিল জোয়ানীতে?

সোরি ঢুকছিল আর হটিছিল। সহসা ও প্রায় চোখ বুজে গেয়ে উঠল,

হোলিতে আগুন রে

হোলিতে আগুন

তুমি দেখে দেখে ঘরে এসো ভুলে থেক' না'

অন্যরা তার সঙ্গে ধুয়ো ধরল। বিগতযৌবন, প্রৌঢ়া, চারটি জরতী প্রেমের গান গাইছে, রোদ তাতছে, নেশা জমছে, দূর-দূরান্তে নাগারা ও ভেঁপুর শব্দ।

মেরী ছুটে চলল। মেয়েরা সবাই কুরুড়া পাহাড়ে উঠেছে। জঙ্গলে ঢুকছে, নালার ধারে যাচ্ছে। মেরী হাসল। শিকার ওরা পাবে না। সব খেলার মতো শিকার খেলারও নিয়ম আছে। শজারু-খরগোশ তিতির মেয়ে কি হবে? বড় শিকার মারতে হয় টোপ ফেলে।

রঙিন শাড়ি ও লাল জামায় মেরী এখন চলন্ত পলাশ গাছ যেন। যেন বাতাসে এক ঝাঁক পলাশ ফুল ছুটে যাচ্ছে। চারদিকে পলাশ আর পলাশ। লালে লাল সব। একটি খরগোশ ছুটে গেল। মেরী হাসল। ও জানে ওর বাসা কোন্ গর্তে। চলে যা! ভয় নাই! মেরী হেসে বলল। ওঃ, মদের নেশায় কি মাতন। রক্তে নাচছে উদগ্র পিপাসা। তশীলদার, তশীলদার, আমি এলাম বলে। তশীলদার ওকে খুব চায়। এখন ওর কাছে জালিম কিছু নয়। তশীলদার ওকে কত উগ্রতায় চাইতে পারে? কত ডিগ্রী ফারেনহাইটে? মেরীর মতো বন্য রক্ত আছে ওর? এত সাহস?

একটি শজারু। যা, চলে যা! আজকের দিন না হলে ওটা মারত মেরী, মাংস খেত। আজ আর ছোট কিছুতে মন উঠবে না ওর। শিকার চাই, বড় শিকার! মানুষ চাই, তশীলদার। দূর থেকে বুরুটি দেখা গেল। সিধা খাড়াই পাথর। ওপর থেকে কার্নিশের মতো বেরিয়ে থাকা পাথর। সেখান থেকে গিটগিন্দা লতা নেমে লতাজাল সৃষ্টি করেছে। জালের গায়ে হলুদ গিটগিন্দা ফুল। জালের পিছনে আড়াল। ভাবতেও রক্ত চমকাল মেরীর। তারপর এগিয়ে গিয়ে লতাজালের পিছনেই খাদ, খাদের পাড়ে আলগা পাথর। খাদের ভেতরটা কত গভীর কেউ জানে না। কেউ নেমে দেখেনি। সেই অতল ও শীতল অন্ধকারে যদি নামা যেত? সে ও তশীলদার! তশীলদারের গাঢ় লাল শার্ট চোখে পড়ল বিলিতি মদ, সিগারেট, তশীলদার।

চলো জী অন্দর চলো।

অন্দর কাঁহা? তোরি অন্দর র্মে ঘুসে? হাঁ জী, হাঁ।

খাদের ধারে। লতাজালের আড়ালে।

পহলে দারু পিও!

শুধু দারু কেন? সিগারেট দাও।

কেমন খেলি?

বহোৎ বড়িয়া।

অত তাড়াতাড়ি খাস না।

নেশা চাই যে?

কত?

অনেক অনেক নেশা চাই। আরো মদ। নেশা হচ্ছে। মাথায় তারা জ্বলছে-নিভছে আঃ, নেশায় চোখে ঝালর নামছে। ঝালরটা ঝিলমিলে। ঝালরের ওপারে তশীলদারের মুখ। আরো মদ। বোতলটা গড়িয়ে গেল। খাদের গভীরে। শব্দও হল না। খাদ কত গভীর? মুখটা এবার, হ্যাঁ এবার শিকারের মতো হচ্ছে বটে।

মেরী সাদরে তশীলদারের মুখে হাত বোলাল, ঠোঁটে চুমকুড়ি খেল। তশীলদারের চোখে আগুন, মুখ হাঁ, ঠোঁট লালামাখা, দাঁতে ঝিলিক, মেরী দেখছে, দেখছে, মুখটা বদলাতে বদলাতে এবার? এবার? হাঁ, জানোয়ার হয়ে গেল।

অব লে মুঝকো?

মেরী হেসে ওকে জড়াল, মাটিতে শোয়াল, তশীলদার হাসছে, মেরী দা-টা ওঠাল, নামাল, ওঠাল, ওঠাল নামাল।

কয়েক লক্ষ চাঁদ কাটল। মেরী উঠে দাঁড়াল। রক্ত? জামায়? কাপড়ে? নালায় ধুয়ে নেবে। ক্ষিপ্র নৈপুণ্যে ও তশীলদারের পকেট থেকে পার্স নিল। আনেক টাকা। অনে টাকা। কোমরের গেঁজে খুলে নিজের সঞ্চয়ের টাকার সঙ্গে টাকাগুলো রাখল।

তারপর আগে তশীলদারকে খাদে ফেলল, ওর পার্স, সিগারেট, রুমাল। পাথরের পর পাথর। রক্তের গন্ধে রাতেই হায়না চলে আসবে, নেকড়ে। কিংবা আসবে না।

মেরী বেরিয়ে এলো। নালার দিকে চলল। নালায় নেমে নগ্ন হয়ে স্নান করতে করতে ওর মুখ গভীর তৃপ্তিতে ভরে গেল। যেন পুরুষসঙ্গ করে অশেষ তৃপ্তি পেয়েছে ও।

মেয়েদের জমায়েতে মেরী সবচেয়ে বেশি মদ খেল, গান গাইল, নাচল, সবচেয়ে তারিয়ে তারিয়ে মাংস-ভাত খেল। শিকার পায়নি বলে সবাই ওকে প্রথমে খোঁটা দিল। তারপর বুধনি বলল, কি রকম, কি রকম করে খাচ্ছে দেখ? যেন সবচেয়ে বড় শিকার ও করেছে। মেরী এঁটো মুখেই বুধনিকে চুমু খেল একটা। তারপর দুটো খালি বোতল হাতে নিয়ে ঠুকে ঠুকে নাচতে শুরু করল। বিকেলের বাতাস ঠাণ্ডা। শনিচরী আগুন জ্বালল। মদ আর গান, মদ আর নাচ। সবাই যখন আগুন ঘিরে গোল হয়ে নাচছে, যখন গাইছে

হে হরম্দেও,

এমন হোলি বছর বছর হোক- এমনি শিকার বছর বছর করি-

মদ দিব তোমাকে

মদ দিব-

তখন নাচতে নাচতে মেরী পিছোতে থাকল। পিছোতে পিছোতে অন্ধকারে ওরা নাচছে, খুব নাচছে। মেরী অন্ধকারে ছুটে চলল। পথ ওর নখদর্পণে। কুরুডা পাহাড় দিয়ে ও আজ রাতে সাত মাইল হেঁটে তোহরি যাবে। জালিমকে ডেকে তুলবে। তোহরি থেকে বাস যায়, কাঠের ট্রাক। ওরা চলে যাবে কোথাও। রাঁচি-হাজারীবাগ-গোমো-পাটনা। আজ, বড় শিকারের পর, ওর জালিমকে চাই।

দূরে দূরে হোলির আগুন। অন্ধকারে, তারার আলোয় রেললাইন দেখে পথ চলতে চলতে মেরীর মনে কোন ভয় এলো না, কোন জানোয়ারের ভয়। আজকে ও সবচেয়ে বড় জানোয়ার

মেরেছে বলে বন্য চতুষ্পদদের বিষয়ে সব প্রাত্যহিক, রক্তে অভ্যাসের ভয় ওর চলে গেছে।

10
Articles
মহাশ্বেতা দেবীর ছোট গল্প সংকলন
0.0
"মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্পের সংগ্রহ" হল গল্পের একটি সংকলন যা ভারতে সামাজিক সংগ্রাম এবং মানবিক স্থিতিস্থাপকতাকে স্পষ্টভাবে চিত্রিত করে। গল্পগুলি বর্ণ বৈষম্য, লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার বিষয়বস্তু অন্বেষণ করে । মহাশ্বেতা দেবীর আখ্যানগুলি পদ্ধতিগত অন্যায়ের একটি শক্তিশালী সমালোচনা প্রদান করে এবং যারা সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছে তাদের আওয়াজ দেয়। সমসাময়িক ভারতের রূঢ় বাস্তবতাকে সহানুভূতি ও অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে তুলে ধরার লেখকের ক্ষমতার প্রমাণ হিসেবে সংগ্রহটি দাঁড়িয়েছে।
1

ভূমিকা

28 November 2023
0
0
0

1984 সালে প্রকাশিত তাঁর 'শ্রেষ্ঠ গল্প'-এর ভূমিকায় মহাশ্বেতা দেবী লিখেছিলেন, 'সাহিত্যকে শুধু ভাষা, শৈলী, আঙ্গিক নিরিখে বিচার করার মানদণ্ডটি ভুল। সাহিত্য বিচার ইতিহাস প্রেক্ষিতে হওয়া দরকার। লেখকের লেখার

2

বান

28 November 2023
0
0
0

ডাদ্রমাসে রান্নাপূজার দিন এসেছে, এ সময়ে গৃহস্থমাত্রেই মনসাগাছ খোঁজে। রূপসী বাগদিনীর ছেলে চিনিবাস মনসাগাছ খুঁজতে গেল। মনসাগাছ নিয়ে পূর্বস্থলীর গৃহস্থরা উঠোনে পৌঁতে। মনসা বাস্তু। মনসা ক্ষেতে ধান, গাইয়ের

3

বিছন

28 November 2023
0
0
0

কুরুডা ও হেসাডি গ্রামের উত্তরে জমি ঢেউখেলানো, একেবারে শুকনো রোদে জ্বলা। বৃষ্টির পরও এখানে ঘাস জন্মায় না। মাঝে মাঝে ফণীমনসার জমল ফণা তুলে থাকে, কয়েকটি নিমগাছ। এই দগ্ধ ও আন্দোলিত প্রান্তর, যেখানে মোষ চর

4

দ্রৌপদী

29 November 2023
1
0
0

নাম দোদি মেঝেন, বয়স সাতাশ, স্বামী দুলন মাছি (নিহত), নিবাস চেরাখান, খানা বাঁকড়াঝাড়, কাঁধে ক্ষতচিহ্ন (দোদি গুলি খেয়েছিল), জীবিত বা মৃত সন্ধান দিতে পারলে এবং জীবিত হলে গ্রেপ্তারে সহায়তায় একশত টাকা.....

5

রং নাম্বার

30 November 2023
0
0
0

রাত একটা। তীর্থবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। টেলিফোন বাজছে। মাঝরাতে টেলিফোন বাজলে কেন এত ভয় করে? 'হ্যালো। শুনুন.. হাসপাতাল থেকে বলছি.. আপনাদের পেশেন্ট এইমাত্র মারা গেলেন। হ্যালো।' 'আমাদের পেশেন্ট? হাসপাতালে আ

6

শিকার

1 December 2023
1
0
0

জায়গাটি গোমো-ডালটনগঞ্জ লাইনে পড়ে। স্টেশনটিতে একদা ট্রেন দাঁড়াত। সম্ভবত ট্রেন দাঁড়াবার খরচ পোষায় না। তাই স্টেশন ঘর, থাকার কোয়ার্টার ও কুলী বস্তির ঘরে দেখা যায় গরু ও ছাগল মাঝে মাঝে। 'কুরুডা আউটস্টেশন, অ

7

সাঁঝ-সকালের মা

6 December 2023
0
0
0

বৈশাখের তাতে মাঠের ছাতি ফাটে, সাধন কান্দোরীর মা জটি ঠাকুরনী মরে গেল। মরে যাবার আগে ত্রুটি ঠাকুরনীর পেট গলা ফুলে ঢাক হয়েছিল। বাঁশের দোলা বেঁধে সাধন কান্দোরীর মা-কে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল। 'মোকে আঁসপা

8

বাঁয়েন

7 December 2023
0
0
0

ডগীরথ যখন খুব ছোট তখনি ওর মা চণ্ডীকে বাঁয়েনে ধরেছিল। বাঁয়েনে ধরবার পরে চণ্ডীকে সবাই গাঁ-ছাড়া করে দিল। বাঁয়েনকে মারতে নেই, বাঁয়েন মরলে গাঁয়ের ছেলে-পিলে বাঁচে না। ডাইনে ধরলে পুড়িয়ে মারে, বাঁয়েনে ধরলে তা

9

বেহুলা

7 December 2023
0
0
0

নদীটির নাম বেহুলা, গ্রামটির নাম বেহুলা, ব্লক ইরফানপুর, ব্লক আপিস-হেল্থ সেন্টার কৃষি সমবায় আপিস, সবই ইরফানপুরে; বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে আড়াই ঘণ্টা ট্রেনে গেলে ইরফানপুর স্টেশন। সেখানে নেমে স্রেফ হেঁটে যেতে

10

মৌল অধিকার ও ভিখারী দুসাদ

8 December 2023
0
0
0

জায়গাটি নওয়াগড়ের সীমানায় ও বাস-পথের ওপরে। নওয়াগড় ছিল এক ছোটখাট স্টেট বা বড় জমিদারি। জমিদারের "রাক্সা" খেতাব মিলেছিল। স্বাধীনতার বছরে রাজা সাহেবের বয়েস ছিল এক। তা সত্ত্বেও এখন সে রাজা সাহেব নামেই পরিচি

---