shabd-logo

বেহুলা

7 December 2023

3 Viewed 3

নদীটির নাম বেহুলা, গ্রামটির নাম বেহুলা, ব্লক ইরফানপুর, ব্লক আপিস-হেল্থ সেন্টার কৃষি সমবায় আপিস, সবই ইরফানপুরে; বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে আড়াই ঘণ্টা ট্রেনে গেলে ইরফানপুর স্টেশন। সেখানে নেমে স্রেফ হেঁটে যেতে হয়। শীত গ্রীষ্মে ধানক্ষেতের আল বা খেতের মাঝের হাঁটা পথ ধরে যাওয়া চলে। বর্ষায় পথ অগম্য। তখন কাদা। পিছল এঁটেল কাদা। গ্রামের লোকেরা বলে, কাঁদতে কাঁদতে বেউলো কাও, কাঁদতে কাঁদতে এসো। এখানেই আসে বসন্ত কুমার। হাফকিন ইনস্টিটিউটএ ছিল ও। বাঙালী ছেলে। অপুষ্টিজনিত ক্ষয়প্রাপ্ত, প্রতিরোধহীন মানব শরীরে কালাজ বা সাধারণ কবাইত সাপের বিষক্রিয়া ওর রিসার্চের বিষয়। সেই জনোই ও এখানে আসে, 24 পরগনার এই গণ্ডগ্রামে। এখানে অপুষ্ট, ক্ষয়প্রাপ্ত, প্রতিরোধহীন মানব শরীর ও কালাজ অ্যাবাউন্ডিং। গ্রামাঞ্চলটি খুবই উর্বরা কালাজ সাপ আবাদে। সমগ্র অঞ্চলটিতে দীর্ণ ও বুভুক্ষু মানুষের ফলনও প্রচুর। এই দুই উর্বরতা বৃষ্টি-বন্যা-খরা সত্ত্বেও অক্ষুন্ন থাকে। কালাজ এ অঞ্চলে শিয়ড়চাঁদা বা শিকড়চাঁদা নামে খ্যাত। কালাজের দংশন জনিত মৃত্যুও এখানে প্রচুর। "কালাজ বা বাংগেরাস কোরুলিয়ুস ভারতে সর্বত্র প্রাপ্ত। সমভূমিতে। ইস্পাত নীল উজ্জ্বল চামড়ায় জোড়ায় জোড়ায় সাদা সরু ডোরা। দৈর্ঘ্য 1500 মিলিমিটার। পুরুষরা দীর্ঘতর। সাপটি নিশাচর। গোখরোর পরেই কালাজের কামড়ে সর্বাধিক লোক মরে। পুরুলিয়ায় 'ডোমনাচিতি' নামে এ পরিচিত। সেখানে প্রবাদ, যদি কাটে ডোমনা ডেকে আন্ বান্না। অর্থাৎ মৃত্যু অনিবার্য। শবাচারের জন্যে ব্রাহ্মণ ডাক। গোখরো বা চন্দ্রবোড়ার বিষ 12 বা 15 মিলিগ্রাম দেহে প্রবেশ করলে স্নেক ভেনম অ্যান্টিসিরামে কাজ হয়। কালাজের বিষ 6 মিলিগ্রামের বেশি দেহে প্রবেশ করলে অ্যান্টিসিবামে কাজ হয় না। সাপটি শুকনো জায়গা ভালবাসে। যেমন, ইটের পাঁজা।"

বসন্ত কুমার বেহুলা গ্রামে এসে যে জোতদারের বাড়ির ঘর ভাড়া নিতে বাধ্য হয় (আর কারো পাকাবাড়ি বা বাড়তি ঘর নেই), সেই হৃদয় বা হেদো নস্করই কালান্স চাষ করে থাকেন। একদা তিনি ইটের পাঁজা করবার শুভসংকল্প করেন। কাজ শুরু করেন। লক্ষাধিক ইট পোড়ান। অতঃপর, চালানের খরচা সামলে লাভ থাকবে না বলে সংকল্প ত্যাগ করেন। উক্ত ইটপাজাগুলি, ইট পোড়াবার চুল্লিগুলি, কালাজ চাষের উপযুক্ত জায়গা। কিছু ইট এনে তিনি দোতলা সম্পূর্ণ করেন। তারপর ছেলের সঙ্গে কলকাতার মেয়ের বিয়ে হয়, এবং কুয়োতলায় বাঁধান্যে স্নানের ঘর করার দরকার পড়ে। এ বাড়ির বাঁধা মিস্ত্রী এসে মাষ্পজোখ করে ও জোগান সহ ইট আনতে যায়। যায় হেঁটে ও তড়িঘড়ি ছুটতে ছুটতে প্রজ্ঞ্যাবর্তন করে। বলে, 'বাবু? সাপের চাষ করে ছেড়েচেন? বাপো রে, ত্যাত কালাজ কল্মে দেকি নি। নমার বাবু! শিয়ড়চাঁদা কাটলে রক্তে নি বাবু।'

হেদো নস্কর গর্জে ওঠেন, 'কৎ টাকার ইট রয়েচে, ঝানিস?' 'সে তুমি ঝানো বাবু। আমি পারবুনি।'

'ছিরি মালরে ডেকে দ্যাকাচ্চি।'

'ছিরি মাল কেন, ধন্বন্তরি গেলি উহোথাক্ যাবু নি। শিয়রচাঁদার চাষ!' শ্রীপদ মাল এ অঞ্চলে সাপের ওকা, উইচ ডকটর এবং ছেলেদের ভোলাবার কাঠের

ঝুমঝুমি বানানো ওর শখ। বর্তমানে সে গ্রামে নেই। স্বশুরের দেওয়া আধ বিঘা জমির তদন্ত করতে বাদায় গেছে। ফিরে এসে ও সরজমিনে তদন্ত করতে যায় ও এসে বলে, * করেচেন কি? ওই অত ইট, গেরামের মদ্দি, এ ঝে মানুষমারা কল! একে শালার সাপের উৎপাতে মানুষের নিস্তার নি?'

'তুইও বলছিস?'

'হেঁটে ইটে দেকে আসুন।'

হেদো নম্বর তড়িঘড়ি কলকাতা থেকে কার্বলিক অ্যাসিড আনান, ও স্বণ্যহ সুরক্ষিত করেন! কিন্তু গ্রামটিতে কালাজ দংশন জনিত মৃত্যু হতে থাকে। মাসে একজন-দুজনকে সাপে কাটে। শ্রীপদ সব কেস্ নেয় না। না নিলে বাঁধন দিয়ে ইরফানপুর হেল্থ সেন্টারে পাঠায়। হেলথ সেন্টারটি দেখলে মনেও হয় না, কলকাতা এত কাছে। ডাক্তারের সম্বল কিছু সাল্‌ল্ফাডায়াজিন, এন্টারোকুইনল ও কাশির মিক্চার। তিনি পটাশ পারম্যাংগনেটে ক্ষতস্থান বেঁধে শ্রীপদ প্রদত্ত বাঁধন পরীক্ষা করে দেখে বলেন, 'কলকাতা নিয়ে যাও।' শ্রীপদ সাধারণত সঙ্গে আসে। ও আড়বুঝো নয়। বিষধর সাপ জুৎ করে না কামড়ালে ও চিকিৎসা করে ও রোগী বাঁচায়। নইলে হেল্থ সেন্টারে আনে। যা নিয়ম। যেহেতু জায়গাটিতে সর্পদংশন নিয়মিত ব্যাপার, সেহেতু এ সব হেল্থ সেন্টারে সর্পদংশনের অব্যর্থ ওষুধ স্নেক ডেনম অ্যান্টিসিরাম কখনোই সরবরাহ করা হয় না। ডাক্তার রোগীকে কলকাতা নিতে বলেন। শ্রীপদ বলে, 'বাবু! ঘুমে এলি পড়চে, চোকে ঝাপসা দেকচে, কতা সরচে নি, ঘাড় ভাঙচে, কলকেতাতক ঝেতে হলে টিকবে না। টেন নি একন।'

রোগীর লোকদের বলে, 'কিছু হবার নয় হে। অধরের আশা নি। ওরে কমে ডেকেচে।'

'ইল্লিশান দেবে নে?'

'সাপের ইল্লিশান নি'

'আসে নে?'

'না।'

রোগী খাটুলিতে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে লোকজন তাকে নিয়ে ফেরে। শ্রীপদ মাটিতে আঁকিবুকি কেটে বলে, 'ডোটের বচরে ভোট নেয় শালারা, কত ঝনা যায়, সবারে বলি, হেথা ইঞ্জিশান পাট্টে দাও। সে ইঞ্জিশান পড়লি মানুষ কপ করে মরে নে। সব শালা মথুরা কেয়ে কেষ্ট হয়।'

ডাক্তার আবার স্নেক ভেনম অ্যান্টিসিরাম চেয়ে পাঠান। ফলে গর্ভনিরোধক বড়ি ও আরো সাল্ফাডায়াজিন পান। এগুলি তিনি, মরিয়া হতাশায় টাইফয়েড-নিউমোনিয়া-বক্তামাশা- ক্রিমি সকল ব্যাধিতে দিয়ে চলেন ও কলকাতায় বদলি হবার চেষ্টা করেন। এখানে আসার পর তাঁর বিশ্বাস বেড়েছে, ভগবানই সর্বাবস্থায় মানুষকে বাঁচান। নইলে নিউমোনিয়ার রুগী গর্ভনিরোধক বড়ি খেয়ে সারে কি করে? বড়িগুলি নিশ্চয় দৈব আশীর্বাদ ধন্য। সাপে কাটা রোগী একসময়ে মরে। শবকৃত্য করে আজও এরা মৃতকে বেহুলার জলে ভাসায়। নদীটি নামের কারণে অভিশপ্ত। সর্পদষ্ট লাশ তাকে বইতেই হয়। বেহুলা যেহেতু মজে যাচ্ছে, সেহেতু বর্ষা বিনে তার স্রোতে গতি নেই। এমন ককিয়ে ককিয়ে সে লাশ বয়, যে মনে হয় জরতী বেহুলা নিরন্ন লখিন্দরের লাশ বইছে। প্রখর স্রোতময়ী সুবিশাল তামলীতে পড়ার আগে একটি বাঁওড়। সেখানে গিয়ে কলার ভেলাটি ঘুরপাক খায়, রুমে তলিয়ে যায়, তারপর গিয়ে ভেসে ওঠে তামসীতে।

স্বভাবতই শ্রীপদ এখানে, গ্রামজীবনে যথেষ্ট সমীহ পায়। কিন্তু যেহেতু কালাজে কাটলে, জুত করে কাটলে কিছু করার থাকে না। কালাজ কাটলে ঘন্টাখানেকের মধ্যে, বাঁধন ছাঁদন পড়লেও, অ্যান্টিভেনম না দিলে আশা থাকে না। না দিলে আরো আশা কম। দেখে দেখে শ্রীপদ ভেতর ভেতর আস্থা হারাচ্ছে নিজের ওপর। ইঞ্জেকশান হেল্থ সেন্টারে এলে সেই সবচেয়ে খুশি হবে। ও গ্রাম ছেড়ে কোথাও গেলে ঘবে ঘরে শঙ্কার ছায়া নামে। শ্রীপদর নিজেরও মনে হয়, নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে রেখে যাচ্ছে এদের। ঘুমোতে ঘুমোতে বিছানার নিচে হাত পড়লে সাপে কাটে, উনোনের ছাই কাটতে সাপে কাটে, রাতে বাইরে বসতে সাপে কাটে। সর্বত্র কালাজ। হেদো নস্করের ইটের পাঁজা সর্পদংশনে মৃত্যু বাড়িয়ে দিয়েছে।

সাপ কামড়াবে, মানুষ মরবে, এতে মানুষের মধ্যেও এক পরাজিত মানসিকতা। নদীটির নামও যেন সেই পরাজয়ের সহায়ক। নদীর নাম যদি বেহুলা হয়, তবে স্ত্রী-পুরুষে লখিন্দর হবেই। মনসা পুজোর সঙ্গে এর কোন যোগ নেই। এখানে মনসা বাস্ত রূপে ঘট ও মনসাসিজের ডালে পূজিতা। পূজোর দিনে নানা বিধি রান্না। পরদিন অরন্ধন। অনেকের কাছে এটি "রান্না পুজো" নামেও পরিচিত। পতিত ইটের জমিনে কাসাজ চাষে সোনা ফলাবার পর থেকে হেদো নস্কর মনসাপুজোর ধূম বাড়িয়েছে। এখন ও এ কথাও বলে, 'তো বেটাদের ছেন্দা নি। তাতেই সাপে কাটে। আমার ইটের পাঁজা হতে সাপে বিরিদ্দি, তবে আমায় কেন কাটে নে?"

কথাটি ও বসন্তকেও বলে। বসন্ত অন্য মানসিকতা এবং অন্য পৃথিবীর মানুষ। গবেষণা করতে এসেছে, হেদো নম্বরের সর্বশক্তিমানতা ওর কাছে অনস্তিত্ব। এস. ডি. ও. ওর ভগ্নীপতি। তাঁর মাধ্যমে এই থাকার ব্যবস্থা। হাকিমকে অবলাইজ করতে পেরে হেদো নস্করও খুব খুশি। রেজিম যে রকমই হোক, হাকিম-হুকুম থাকলে কিঞ্চিৎ ফায়দা ও ওঠাবেই।

হেদোর কথা শুনে ও গ্রামীণ মানুষের সংস্কারবদ্ধতা দেখে শুধু, এবং ঈষৎ হেসে বলে, 'কার্বলিক ঢালছেন, আলো আছে বাড়িতে, খাসজঙ্গল রাখেন নি, জুতো ছাড়া বেরোন না, সাপ কাটে না।'

'না মশায়। ইটের পাঁজা-ইটের পাঁজা, সবাই বলতেছে। পাঁজা করুন ছিল না, তকন সাপে কাটে নে? আমি ত' জ্ঞান হতে দেকতেছি বেউলোয় ভেলা ভাসে। ছিরিপদরও হাতযশ নি। নইলে, ওঝা তুমি, গুপীন মানুষ, ইঞ্জিশান দেবার কতা বল কেন?'

'বলে বুঝি?'

'আরে বাপুরে! আমারে ছিঁড়ে খায়। ইঞ্জিশান আনার বেবস্তা কর। ঝেই বলচ ইঞ্জিশন, সেই তুমি হার মানচ তো?'

'হেল্থ-সেন্টার স্নেক ভেনম অ্যান্টিসিরাম রাখে না? বলেন কি?'

'রাখে কখনো? এ দক্ষিণে কোতা সাপের কোপ নেই? সর্বত্তর সাপ মশায়! লতে-শতে মানুষ মারে। নরে-নাগে বাস, কতায় বলেচে। হেল্থ সেন্টারও হয়েচে। সেতা ইল্লিশান কোতা আচে? যে সনে অনেক মরে, সে সনে এট্টু পাটায়। পাটাবে বা কেন? সাপে কাটা হল নিয়তি। কে কবে সাপের লেখা হতে বাঁচে?"

বসন্তর মনে এক্যাডেমিক আকর্ষণ জাগে। সাপ সম্পর্কে এই পরাজিত মনোভাব কেন? তারপর ওর মনে হয়, সর্পদংশনে মৃত্যু যেখানে ক্রনিক, সে অঞ্চলে, স্নেক ভেনম অ্যান্টিসিরাম থাকে না কেন? সরকারের স্বাস্থ্যদপ্তরও কি মনে করে, "সাপের কাটা কপালের লেখা?"

'সাপে কাটলে?'

'ছিরিপদ।'

'সারাতে পারে?'

'পারলে ও, না পারলে ও। তবে ও মলে পরে খুব চিন্তা। ছেলে ও পতে যায় নি।'

'ওর বাবাও এই কাজ করত?'

'সে ছিল গুণী মানুষ। রামপদ মালের নাম এ দিগরে ঝানতু সবে। কাল মরেচে, আজ ভাসাতে নেচে, রামপদ বলে, দারোগা বাবু? ছেলে যে বেঁচে আছে গো! জীয়ন্তে ভাসাবে? - দারোগা বলে, জেবন দে, তোরে পাঁচশো টাকা দেব। সে ছেলেরে রামপদ বাঁচাল, টাকা নিল, আমার স্বচক্ষে দেখা। তখন আমি ছোট।'

'শ্রীপদকে দেখতে হচ্ছে।'

'ও গুনো কি? শিশিতে?'

'ইঞ্জেকশান'

'ইঞ্জিশান?'

'সাপ নিয়ে কাজ করি তো!'

'কাজ হয়।'

'আমাকে তো দু'বার কামড়েছে। বেঁচে তো আছি। তাহলে কাজ হয় নিশ্চয়।'

'সাদা গুঁড়ো ঝ্যামন?'

'পাউডার-সিরাম।'

'কাজ হয়? অ্যাঁ? ওই সাদা গুঁড়ো ইঞ্জিশান করলি মানুষ বাঁচবে?'

'আমি বেঁচে আছি, না?'

এখন হেদো নম্বর অন্য কথা পাড়ে। বলে, 'হাকিমের সম্মন্দি, এ ছোটলোকের কাজে এলেন বা কেন? এ কি ভদ্দরলোকের কাজ?'

বসন্ত সে কথার জবাব দেয় না ও বলে, 'কলটা কোথায় আপনার?'

'ওই ঝে? চাপা কল, সেপটিক সেজখানা, মান্যিগন্যি মানুষ এলে এই হেদো নস্করের

ঘর ! তা, স্টোড, বাসন দেখচি?'

'রাধব না? খাব কি?'

'আমার বাড়ি থেকে রেঁধে খাবেন?' 'হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনুন, এই যে ঘরের ভাড়া দিচ্ছি, আবার খাওয়ার জন্যে খরচ করব, সবই তো আমি পাচ্ছি। তাহলে আপনার নিতে কি?'

'ঝাক, দুদটা ঝ্যানো কিনবেন না' 'টিনের গুঁড়ো দুধই তো আছে।'

হেদো হেসে ফেলে ও বলে, 'বুঝিচি। ভগ্নীপোতের নিষেদ। ঝাক, দরকার-অদরকারে বলবেন।'

দু-এক দিনের মধ্যেই শ্রীপদ ও বসন্তের সাক্ষাৎ ও বন্ধুত্ব হয়। যুদ্ধের মাধ্যমে। চরণ

বেরার যুবতী ও সধবা, গর্ভবতী মেয়েকে যেদিন সাপে কাটে। বসন্ত চা খেয়ে কাপ-ডিশ ধুচ্ছিল। হঠাৎ লম্বা মত একটি লোক ছুটতে ছুটতে আসে। বলে, 'আপনি ইঞ্জিশান নে চল বাবু, ছিরিপদ ডাকতেচে।'

'কেন?'

'মালতীকে সাপে কেটেছে গো, গন্তবর্তী মেয়ে!'

বসন্ত ইঞ্জেকশান নিতে নিতে বলে, 'বাঁধা হয়েছে?'

'হ্যাঁ হ্যাঁ। ছিরিপদ.......

চরণ বেরার বাড়িতে উঠোনে মেয়েটি শায়িত। বসন্ত দেখে, একেবারে নিয়ম মতে উরুর ওপর তিনটি বাঁধন। বাঁধনের নিচে নিয়ম মতে চেরা ও কাটা। রোগা, হাড়পাকানো, ঝাঁকড়াচুলো শ্রীপদ ক্ষিপ্রহাতে বাঁধন খোলে, একটু ওপরে বাঁধে। বাঁধতে বধিতে বলে, 'বাবু এয়েচেন? ইজিশান দ্যান, ইঞ্জিশান দ্যান, তেমন জুতে কামড়াতে পারে নি, তবু শিয়ড়চাঁদা বলে কতা!'

বসন্ত ইঞ্জেকশন দেয়। হাঁড়ি দেখে বলে, 'গরম জলের তাপ দিচ্ছিলেন?'

'হ্যাঁ।'

ক্ষত স্থানের পাশে, গোড়ালিতে শ্রীপদ নরুন চেরে ও মেয়েটি অস্ফুটে "আঃ" বলে। শ্রীপদ বলে, 'রা কেড়েচে ঝকন, তকন আশা আচে।'

'তাই বল ছিরিপদ! জামাই ধুয়ে আবাদে গেল। এ কি হল মা?'

শ্রীপদ খুব খারাপ কথা বলে ও খ্যাঁচায়। বলে, 'মাটিতে হাঁড়ি-কলসি ভাঁদ করেচ, মনে থাকে নে? কোতা বাস কত্তেচ? কলসির পোঁদ জইড়ে, বুঝলেন বাবু? ঝ্যামন কাচে গেচে!'

'সাপটা?'

'তিনি বামুন তো! এখন কালনিন্দা যাচ্ছেন। পরে দাহ হবেন।'

ঘন্টাখানেক বাদে মেয়েটির বিপদ কাটে। চরণ ও তার স্ত্রী শ্রীপদর পায়ে পড়ে। শ্রীপদ ওদের প্রণাম নেয় ও ফিচেল হেসে বলে, 'বাঁচাল উনি।'

বসন্তও প্রণাম পায় কয়েকটি। শ্রীপদ বলে, 'আবাদ হতে জামাই এলে একদিন মনসামঙ্গল লাগিয়ে দাও হে চরণ। অনেক কাল খ্যটি জোটে নে। গরানের নৌকো বেয়ে-বেয়ে চাট্টি টাকাও তো করেচ।'

'সে আর বলতে?'

শ্রীপদ বলে, 'চলুন বাবু, ঝেয়ে দুটো কতা বলি। হেতা বিপদ সেরে গেচে।' চরশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে শ্রীপদ বলে, 'আসুন, সাপের চাষ কোতা হচ্চে দেকুন।' দূর থেকে ওরা পতিত ইটের পাঁজাটি দেখে। শ্রীপদ বিড়ি ধরায়, মাটিতে দুধু ফেলে বলে, 'ওই গুখেগোর ব্যাটা হেদো নস্কর!'

'ওঁরই পাঁজা?'

'নয়তো এমন কীত্তি কার? সাপের মহল্লা এটা। সাপে-কাটা লাশ টানতে টানতে বেউলোর জল মজে যাচ্চে। বর্ষা ছাড়া সোঁত নি, তাতে নস্কর সাপের চাষ দিল।'

'আচ্ছা, সাপে-কাটা লাশ পোড়ায় না কেন?'

শ্রীপদ বিষন্ন হাসে। বলে, 'বলে দেন গে, মাপ্তে আসবে। নদীর বওতা থাকে, লাশ টেনে তামলীতে ফেলল, লাশ ঝেয়ে সাগরে শামিল হলেন! বেউলো তো মত্তে বসেচে। ই কি আবাস? ঝে ঝত খাল-নদী সব ঝেয়ে সাগরে পড়তেচে ঝপাঝল। পুইড়ে দে লাশের কাপড়টা ভাইসে দে, বলার জো আছে?'

কথাগুলির পেছনে একটি পরিচ্ছন্ন ও যুক্তিনিষ্ঠ মন উঁকি মারে ও বসন্তকে চমকে দেয়।

'ইটের পাঁজা ভেঙে ফেললে হয় না?'

শ্রীপদ ওকে বলে, 'চলেন, আমার ঘরে চলেন। বসে কতা কই।'

বসন্ত সাপ-বিষয়ক গবেষণা করছে বটে, কিন্তু সাপুড়ে বা সাপের ওঝা বিষয়ে ওর ধারণা শরৎচন্দ্রের "শ্রীকান্ত: প্রথম পর্ব" বইয়ের ভিত্তিতে গঠিত। শ্রীপদ কোনো অংশেই "শাহজী" সদৃশ নয় দেখে ও মনে-মনে ধাক্কা খায় যেন। শ্রীপদর বউ ওদের চা করে দেয়, এবং তার চেহারা মোটেও অন্নদা দিদির কাছ দিয়ে যায় না দেখে ও আবার ধাক্কা খায়। তারপর বোঝে, উক্ত কাহিনীর চিত্ররূপ ওর বারণাকে গঠন করেছিল। নইলে পশ্চিমবঙ্গের সাপুড়ে ও মিসেস সাপুড়ের পক্ষে, মঞ্চ-পর্দার কুশলী নট-নটী সদৃশ হওয়া খুবই কঠিন। বহু দুধ-মাখন-মাছ-মাংস-আল্লাদী জীবন হলে তবে মঞ্চ বা পর্দায় দূর্গত নিরন্নের চরিত্রায়ণ সম্ভব। শ্রীপদ বলে, 'কোতা হতে হেতা এলেন? ইরফানপুরের ডাক্তার বলিছিল বটে আপনি

আসবেন। তা এমন ভাগাড়ে কেন?"

'সাপে-কাটায় মরে বেশি, সাপে-কাটা নিয়ে আমার কাজ, তাই এসেছি।'

'ডাক্তার? ইল্লিশান দেবেন?'

'ডাক্তার নই। তবে ইঞ্জেকশান, যদ্দিন থাকব, তদ্দিন দিতে পারব।'

'কদ্দিন থাকবেন?'

'তিন মাস।'

'া। তা ইট পাঁজার কতা কি বলছিলেন?

'ওটা ডেঙে লোপাট করে দিলেই তো হয়।'

'সে বলতে গেলে বিত্তান্ত! হেদো নম্বর ঝকন ইট পাঁজা খরচা পোষাবে নে বলে ঠিক

করল, তখন এক কন্টাকটর এইছিল। ইট নে আবাদে ঝাবে। বেউলো হয়ে তামলী হয়ে

নৌকোয় নে ঝাবে।'

'তারপর?'

'পিচেশ তো? আমি বন্ধু, বেচে দাও বাবু, হোতা সাপের শওর হবে। বলল, দরে না পোষালেও বেচতে হবে? রইল পাঁজা। কেরুমে সাপের শওর হল। ওনার দরে ঝকন পুষল, তকন ওর কাচে ঝাবে কে? সাপের সঙ্গে খেলা চলে? গত সনে বন্ধু, বৈশেকে মাটি শুগনো, পাঁজা বেড়ে খাল কেটে আগুন দাও। ক টিন কেরাচিনি পাঞ্জায় ঢালতি হবে, খানাতেও কাঠ-ঝোপ পোয়াল ফেলে কেরাচিনি দিতি হবে। এতে সাপ মরে, আমি সেই মেনীপুরে দেকে এইচি। এক পতিত গড় সাপের পাঁজা হইছিল। এমনি ভাবে আগুন দে সাপ পুইড়ে গরমেন্ নিকেশ করল। সে গড়ের ঠেঙে একন ইশকুল।'

'রাজী হল না?'

'না। বলে ইটের পাঁজা কি আমার ঘরের দোরে? বিশ টিন কেরাচিনির ফন্দ হাঁকচ, পয়সা তুমি দেবে? উনি কেরাচিনির' কন্টেলের মালিক। কেরাচিনি ওকে পয়সা দে কিনতে হুতুনি। তবুও ছাড়ল না কেরাচিনি।'

'আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। অমন বাঁধন দিতে, বাঁধন সরাতে, চিরতে আপনি শিখলেন কি বাবার কাছে?'

'নিশ্চয়। বাবু! আমি ইল্লিশানের কতা বলি বলে সবাই ঝেনে গেচে ছিরিপদ আসলে ডুষো মাল, কিছু ঝানে নে। কিন্তুক...'

'কি?'

'আপনি তো সকল কানো।'

'বলুন না।'

শ্রীপদ উশখুশ করে ও বলে, 'সে কতা পরে হবে। একন কান। চ্যান-খাওয়া সারুন।

আপনিও রইলেন, আমিও রইলাম।'

বসন্ত চলে আসে। ও ঘরে ঢুকতে না ঢুকতে হেদো নস্করের কি থালায় সার-সার বাটি বসিয়ে ঢাকা দিয়ে নিয়ে আসে। বলে, 'গিন্নি মা বলল, ভদ্দরনোকের ছেলে ঝ্যামন চাল ফুট্টে নেয়। তরকারির হাংনামা কতে হবে নে।'

বসন্ত ঢাকা খুলে বড় বড় মাছের দাগা দেখে ভির্মি খায় ও বলে, 'তোমার গিন্নিমাকে বলবে, আজ পাঠিয়েছেন, নিলাম। আর যেন না পাঠান। আমি এত খাই না' হেদো নস্করের ইটের পাঁজার কাহিনী শোনার পর থেকে ওর মনে একটা "কিন্তু" এসে

গেছে। এমনিতে ও খুব শান্ত স্বভাবের ছেলে। কোন ঘটনা নিয়ে ক্ষুব্ধ হলেও ও কিছু বলে

উঠতে পারে না। তার ওপর, মধ্যবিত্ত স্বভাবের দরুন, পরের হ্যাপায় জড়াতে ও একেবারে

নারাজ। তবু, সাপ নিয়েই ওর কাজ, এবং সর্পদংশনে মৃত্যুর ভয়াবহতা ও কানে। একটা

লোকের ইটের পাঁজার জন্যে গ্রামে এত লোক মরবে? বছবে বিশ-পঁচিশ জন? কথাটি ও ওর ভগ্নীপতিকেও বলে, নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে। এস, ডি, ও. কথাটিতে গুরুত্ব দেন না ও বলেন, 'হ্যাঁ। এর আগে মানুষ সাপের কামড়ে মরত না? ইটের পাঁজার কারণেই মরছে?'

'ডেথ রেট বেড়ে গেছে।'

'সে যা হোক, ও নিয়ে তুমি ঘাটাতে যেও না। লোকটা সুবিধের নয়।' 'আসল কথা হল, এখানে হেল্থ সেন্টারে অ্যান্টিসিরাম দরকার।' 'দরকার তো জানি। 'ডাক্তার আছে, রিকুইজিশান দেবে, দেখা যাক।'

ডগ্নীপতি বসন্তকে তাঁর নিজস্ব সমস্যার কথা বলেন। এখন বেহুলা ব্লকের অবস্থা বেশ শান্ত। বর্গাদার সমস্যার একরকম সমাধান হয়েছে। সবাই খুশি নয়। কিন্তু কবে কী হয়েছে, যাতে সবাই খুশি হয়েছে? পঞ্চায়েতি নির্বাচনও একরকম উৎরে গেছে। হেদো নস্কর পঞ্চায়েত-প্রধান। কোনো কারণেই তার ও গ্রামবাসীর সম্পর্ক তিক্ত করা ঠিক নয়। জোতদার পঞ্চায়েত-প্রধান হলে গ্রামবাসীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল থাকে না, থাকার কথাও নয়। কিন্তু "আমার বক্তব্য হচ্ছে, সম্পর্ক মন্দ হলে আপনা থেকে হোক। তোমাকে নিয়ে যেন কোন সিচুয়েশন না বিস্ফোরক হয়। গ্রামে শিক্ষিত, বাইরের ছেলে থাকলেই পোলিটিকাল চেহারা নেয় সকল ঘটনা।'

বসন্ত জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়ে গ্রামে ফেরে এবং শ্রীপদ মাল তাকে ডেকে যায়। চরণ বেরার বাড়িতে মনসামঙ্গল হবে। 'খুব গান-নাচ হবে। মনসার ভোগ দেবে চরণ। আপনি তো ফিরতি টিকিট কেটে হেথা এয়েচ, চল দেকে আসবে।' বসন্ত সম্মতি জানায়।

হেদো নম্বর খুঁতখুঁত করে। বলে, 'হাকিমের শালা হয়ে হোতা ঝাবেন? শালারা মাকে

খিচুড়ি ভোগ দেয়, তাই খাবেন?' 'সাপ নিয়ে কাজ! না বলতে পারি?'

হেদো নম্বর ব্যাপারটি সুচক্ষে দেখে না ও বউকে বলে, 'নানা নিদি পাটাতে হবে নে কেঁদে কেঁদে। ভদ্দরলোক! এক কাজ বলে এয়েচে, কে ঝানে কি মতলব? নয় তো বন্ধু হল ছিরে মাল!'

'তোমার সাতে পারবে?'

'তা কখনো পারে? তবে ঝেয়ে হাকিমের শালা! তেমন ঘাঁটাতেও চাই না। ভাল-ডালস্তে দু-তিন মাস কাটো চলে গেলেই শান্তি। হাকিম বলল, নস্কর, হোতাকে রাখ। নইলে আমি ছেঁড়া ঝামেলা জোটাই?'

'জেলে ঘরে আসতেচে মাচ বেচতে, বাগদী ঢুকে শাক বেচছে, সব ছোঁয়ান্যাপা হচ্চে।' 'ও কতা বোল নি। একন ও সব কথা মনে হলে কিল খাবে, কিল হজম করবে।'

বসন্ত কিছুই জানতে পারে না এবং মহানন্দে মনসার গান শুনতে যায়। চরণের উঠোন লেপা-পৌঁছা। হ্যাজাকের আলোয় মনসার ধ্বজা হাতে শ্রীপদ এসে দাঁড়ায়। এক পায়ে ঘুঙুর, এক হাতে ঘুঙুর-দেওয়া বালা পরে সে তাল দিয়ে দিয়ে গান গায়। দোহার ধরে ওর সঙ্গী ও ছেলে। মনসার গান বলতে বেহুলার উপাখ্যান। বসন্ত গান শুনে বোঝে, এরা কাহিনীটিকে আঞ্চলিক রূপ দিয়েছে।

শ্রীপদর গানে, বেহুলা ও সখিন্দর সংসার করতে থাকে। শেষে লখিন্দর স্বর্গে যায়। বেহুলার ওপর অভিশাপ নামে। দেবতারা বলেন, দেবসভায় লাস্য দেখিয়ে নেচেছিল বেহুলা। তার ফলে যে পাপ হয়, সে পাপ খণ্ডাতে বেহুলাকে, কলিকালে বেহুলা নদী হয়ে বয়ে যেতে হবে। সর্পদষ্ট শব ওর জলে ভাসলে সদ্গতি পাবে। বেহুলা বলে, কবে সম্পত্তি হবে আমার? দেবতারা তার উত্তর দেন না। সেই থেকে বেহুলা নদী হয়ে বইছে। গানের শেষে মনসা বন্দনা হয় ও উঠোনে ধ্বজা পোঁতা হয়। খুবই মূল্যবান অভিজ্ঞতা। খাঁড়ি মুসুরের খিচুড়ি পাঁচ রকম ভাঙ্গা মায়ের ভোগ। খেতে খেতে শ্রীপদ গভীর বিশ্বাসে বলে, 'এখানেই হইছিল সব। চম্পাই নগর এখন বেউলোর গর্ভে। বেউলো কেখানে দাঁইড়ে দাঁইড়ে নদী হয়, সেখানে এক আশ্চাজ্জ কদম গাচ আচে। বৈশেষে কদম ফুল ফোটে।'

চরণ বলে, 'বোশেখ অব্দি রইলে দেকবেন, বেউলোর মেলা বসে। সেতা নানা ঠাঁই হতে মাল আসবে, সাপের খেলা দেকাবে, দেকার জিনিস।'

শ্রীপদ বলে, 'সাপ ধত্তে আসে।'

'সাপ ধরে?"

'ধরে না? সাপ এখন ভাল ব্যবসা। বঙ্গাবঙ্গ দাঁড়াস ধরে। চামড়ার দাম কলকাতায় বিস্তর। জীয়ন্ত গোকরো গুল্লে কবরেজী দোকানে ওষুধ কত্তে বিষ নেয়।'

'আপনি সে কাজ করেন না?'

'না।! বাবার নিষেদ। কত্তে নি।'

'চলে কি করে?'

'চলে নে। চ্যায়রা দেকে বুজচেন না? নম্বরের জমি ডস্সা। যারে বলে নির্ভস্স্সা।'

'কত জমি?'

'সরকারী সিলিংকে কলা দেকিয়ে বিস্তর জমি। কোনটা দেবত্তর, কোনটা কারখানা করবে বলে রেকেচে, কোনটা দেকাচ্চে ফলবাগান হবে, কোনটা না কি মেছো ভেড়ি হবে-সর্বত্তর

চাষ হচ্ছে। ধান-কলাই পার্ট-সে বিস্তর চাম।'

'উনি চেষ্টা করলেই ত ইঞ্জেকশন আসে।'

'করবে কেন? কোনদিন কিছু করল নে, আবার ওই হল পঞ্চায়েতের মাতা, আমরা

চিরকাল ওর কাচে বাঁদা রইলাম।'

খাওয়া শেষ হয়। শ্রীপদ বলে, 'চলুন, আপনাকে পঁউচে দিই।

রাত হচ্চে, তেনারাও বেরুচ্চেন। দাঁড়ান, লাঠি নিই। ওই লাঠি ঠক-ঠক ভত্সা। চবাতি

কিনব, তা আর হয়ে উঠচে না।'

'না, আমি চলে যাব। কিন্তু আপনার সঙ্গে বসতে হবে। আমার কাজে আপনি সাহায্য না করলে পারব না।'

'সে বসব। এট্টা কতা! এই ইঞ্জিশানে মানুষ বাঁচে তো?'

'সময়ে পড়া চাই। তবে ভাল মত বিষ ঢুকলে কাজ হয় না।'

'এ ইঞ্জিশান ওষুদ কোম্পনি তৈরি করে না কেন? নানা নিদি কত্তেছে?'

'যাতে বছরে মাত্র বিশ হাজার লোক মরে, তার ওষুধ তৈরি করলে পড়তায় পোষায় না। কামড়ায় লাখ চারেক লোককে, মারা পড়ে হাজার বিশেক। তার মধ্যেও নির্বিষ সাপ কামড়ালে ভয়ে মরে কিছু, বাজে ওঝার হাতে মারা পড়ে কিছু। আপনি এ কথায় রাগ করবেন না।'

'না রাগ করব না। আমি নিজের ক্ষ্যাম্ভার দৌড় ঝানিনি? কাল কতা হবে। একন চলে ঝান।' পরদিন শ্রীপদর বাড়ি যায় বসন্ত। নিজের কাজের কথা বলে। শ্রীপদ অতান্ত স্বাভাবিক ও যুক্তিবাদী কথা বলে ওকে অবাক করে দেয়। শ্রীপদ বলে, 'যতাস্তানে এয়েচেন। উপোসী ক্যাংলার শরীলে কালাজের, আমরা শিয়ড়চাঁনা বলি, তার বিষে কি হয়! সে ত আমি মুখেই বলে দিতে পারি। একেনে সকলঝনা উপোসী ক্যাংলা।'

'মনে হচ্ছে স্বচক্ষে দেখতে পাব।'

'তা পাবেন। হেদো নস্করের পাঁজা! আপনার ভগ্নীপোত কি বললেন? চমকাচ্চেন কেন? হেতা কোন কতা চাপা রয় নে। হাকিমের সম্মন্দী বলে হেদো চুপ আচে। নইলে আপনি ছোটলোকদের সঙ্গে মিশতেচ, তাতে কি ও চুপ রইত? টাকা আচে ত! ওর জ্যাটাতো ডাই পরাদ নম্বর হেলে চাষা, তাতে সেও হেদোর কাচে ছোটলোক। জব্দ হইছিল সত্তর সনে। হেতা পটকাটিও ফোটে নে, ও বেটা ভয়ে পালাল, বলে গেল, ধান কেটে তোরা নি গে যা ভাগ করে।'

'কালাজ কাটলে কি কি লক্ষণে বোঝেন?'

'বাবু! উনি হল যম! শোখরো কাটলে, উনি কাটলে শিরায় ঝিমুনি লাগে, ঝিঁ ঝিঁ ধরে ঝ্যামন, তবে গোখরো কাটলি জ্বালা, চন্দত্ববোড়া কাটলি পুড়ে ঝায়, ইনি কাটলি তকনি যস্তরনা নি। বিষদাঁত এটুনি। তা বাদে হাড়ের মদো শিরশিরনি, কাটার ঠেকে যন্তরনা, আর সকল শরীলে এলে ঝিমঝিমে ঘুম, ঢোকে ঝাপসা দেকে।'

'আপনি তো সব জানেন।"

'বইয়ে নেকা আচে?'

'ঠিক এই কথা লেখা আছে।'

'রাগ করনি। আপনার শিক্ষা বইয়ে পড়ে, ওই ঝারে বল লাইবেরি—'

'লেবরেটরি।'

'ওই হল। সেতা সাপ দেকে শিক্কা। আমরা নরে-নাগে বাস করি। তায় সাপের ওকা! মাল!"

'এই যে চিকিৎসা করেন, এ আপনার বংশগত কাজ। আবার ইঞ্জেকশনেও বিশ্বাস। সাধারণত সাপুড়ে বা মালরা ডাক্তারী ইঞ্জেকশনের ওপর চটা।'

'দেখুন, একন ভেঙে বলি। অন্যদের কতা বলব না। আমি ওদের গোত্তরের মাল নই। দাঁড়ান, দেকাই। অ রাধি। সাট্টিফিকেটটা আন্ তো মা?'

শ্রীপদর ভাইঝি একটি বিবর্ণ ও কালি ফিকে হয়ে যাওয়া বাঁধানো কাগজ আনে। তাতে লেখা আছে, তামলি স্কুল থেকে শ্রীপতি মাল বৃত্তি পরীক্ষায় জেলার মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হয়েছে।

ওটি নিস্পৃহ কণ্ঠে নিয়ে যেতে বলে শ্রীপদ। বিড়ি টানে। চোখে কোন অতীত। বেদনা। তারপর বলে, 'তকন, কোতা ইস্কুল নি। মাসে দুটো টাকা হলে ইরফানপুর ইস্কুন্সি পড়া হতু। হেদোর বাপের ঠেঙে আমার বাল কত ব্যাগ্যতা করিছিল।'

'দিল না?'

'না। বলল, আজ মালের পো পড়বে, কাল জেলের পো পড়বে, পরশু তোরা মাতায় পা রেকে চলবি। তাতেই হয় নে। 'সেই থেকে এই কাজ করছেন?'

'এ কাজে তো পয়সা নি। ঝকন চাষ হয়, হেদোর খেত চখি, পেট না চললি আবাদ ঝাই। সে ঝাক। ওই এট্টু বিদ্যে আচে। বাপের সঙ্গে কলকাতা যেতু, হাসপাতাল দেকিচি। হাসপাতাল ভাল বাবু, ডাক্তারী ভাল, আগে হলি টাইফায়েটে, কলেরায় মরতু সবাই। একন ঝদি সময় থাকতে ডায়মন্‌হারবারে হাসপাতালে নিয়ে পারি, বেঁচে ওটে। সেতা নিলে বা ইরফানপুরে নিলে বিয়োতে ঝেয়ে মাগীগুনো মরে নে।'

'তাতেই বিশ্বাস এল?'

'না। আরো কতা আচে। জাত মাল ঝদি সাচাই হয়, তাইলে আমার পতে চলবে।'

'যেমন?'

'মানুষ ভয়ে মরে অনেক। আগে কাটা দেকব। দেকে যদি ঝানি নিবিষ সাপ, তকন রুণীরে ভত্সা দেব, লাফ-ঝাঁপ মারব, মস্তর বলব, কাটা জায়গা ঝাড়ব, ওষুধ দেব, রুগী বাঁচালি আমার হাতযশ হবে। মানুষ ভয়ে মরে বাবু! ঢোঁড়া-দাঁড়াস-ঘরমূনো-চিতি-লাউডগা নিবিষ। সবাই কানে। কিন্তু কামড়ালি ভাবে গোখরো বা শিয়রচাঁদা কাটল।'

'বিষাক্ত সাপ কামড়ালে?'

'সকল সময়ে জুত করে কাটতে পারে না। আগে কাটা দেকব। ঝানব কে দংশালেন। ঝকন বুঝব তেজুতে কাটে নি, তরুন বাঁধন দেব, চেষ্টা করব। ওষুধ দেব। মন্তর কইব, ঝাড়ব।'

'ওষুধে কাজ হয়?

'হয় বাবু। শরীলে তেজুতে বিষ না গেলি কাজ হয়। চালতে-কক্কল-টাবা, লেবু-সাদা আর নীল অপ্রাজিতা-চিনি-কাঁটানটে পাক করে ওষুধ দেব। আগে বাঁদব, চিরব, মুকে কাপড় নে, বা ধুলো নে কাটা জায়গা চুষব। আরো নানা নিদি ওষুদ অচে।'

'বাঁচে?'

'বাঁচে কি বলচ বাবু? এতেই তো বেঁচে আচে। তোমরা বলবে হাতুড়ে টোটকা। তা দেক, কলকেতা থে এটুনি দূর! না আচে ইঞ্জিশান, না আচে ডাক্তার, এই তো ভত্সা।' 'যদি বেজায়গায় কাটে?'

'বাবু! অন্ধকারে চলে, পায়ে কামড়টা বেশি। ঘরে এসে কাটে, ঘুমের ঘোরে হাতটা পড়ল, হাতে কাটল। তকন বাঁদন চলে। গলায় বুকে-কোমরে কাটে কম। কাটলি মরে!

কোতা বাদন দেবে? সর্বত্তর কি বাঁদন চলে?' 'ভাল মতে কাটলে?"

'বাঁদন দেব, চিরব, চুষব, ইরফানপুর নিতে বলব। সেতা ঝেয়ে, গত সাত বছরে মাত্তর দু বার ইল্লিশান পেইচি, বেঁচেচে। ভাল জুতে কাটলে মালের সাদ্য নি বাবু। ঝারা ভূষো মাল, তারা তেমন রুগী নে বাদন খুলবে, মন্তর দেকাবে, কিন্তুক তুমি ত ঝানো, তেমন বিষ দেহে গেলি ইল্লিশানেও কাজ হয় নে। কলকেতায় ডাক্তার বলেছিল। তাতেই বাবা বাঁচেনি।'

'সাপ কামড়েছিল?' 'শিয়রচাঁদা।' এ কথা বসন্তও জানে। বায়ো মিলিগ্রামের বেশি গোখরোর বিশ্ব, পনেরো মিলিগ্রামের বেশি চন্দ্রবোড়ার বিষ, ছয় মিলিগ্রামের বেশি কালাজের বিষ শরীরে ছড়িয়ে পড়লে জেক ভেনম অ্যান্টিসিয়াম বিফল হবে। চন্দ্রবোড়ার ক্ষেত্রে শরীরের রক্তে লালকণিকা ভেঙে যায়, নাক-মুক-মূত্র ও গুহ্যাদ্বারে রক্তস্রাব হয়। তাৎক্ষণিক মৃত্যু করুণাময়। নয় মাংস গলে-খসে অসহ মৃত্যু। গোখরো ও কালাজের বিষ নিউরোটক্সিন। স্নায়ু অবশ-অবশ, পেশী সংকোচন, লালা নিষ্ক্রমণ, ঘুম-ঘুম ভাব, স্বাস কমে আসা, মৃত্যু।

শ্রীপদ বলল, 'আমি ঝানি আমার ক্ষ্যামতার দৌড়। আর ইঞ্জিশান হয়েচে যকন, তকন মরতি ঝাবে কেন মানুষ?'

'দূর্বল শরীরেও একই প্রতিক্রিয়া হয়?'

'একই। উপোসী ক্যান্তালীয় মনে জোর থাকে নে, সামান্য বিষ দেহে গেলিও মরে।" বসন্ত অত্যন্ত চিন্তাকুল চিত্তে ঘরে ফেরে। সামান্য বিষ দেহে গেলেও মানুষ মরে? দুর্বল ও প্রতিরোধহীন শরীর বলে?

সহসা তার মনে হয়, সব কিছু একাডেমিক আগ্রহে দেখা ঠিক নয়। দুর্বল শরীরে কালাৰ বিষের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়, তা ও দেখতে ও লিপিবদ্ধ করতে পারে। কিন্তু মহানগরীর এত কাছে একটি গ্রামে এত অন্ধকার কেন?

লাভে পোষাবে না বলে নম্বর ইট বেচবে না। পরিণামে কালাজের বংশবৃদ্ধি ও মানুষের মৃত্যু। মানুষগুলি অনাহারে শীর্ণ কেন? নস্কর এই ক্রনিক অনাহারে কোন ভূমিকায় আছে? কেন হেল্থ সেন্টারে এ্যান্টিসিরাম থাকে না?

হেল্থ-সেন্টারের ছোকরা ডাক্তার মাথা নাড়েন। না, তিনি জানেন না কোন "কেন"র উত্তর। কলকাতায় স্বাস্থ্যদপ্তর মানে মন্ত্রী-আমলা-ফাইল। মানুষ ও মানবিক সমস্যা সেখানে ফাইলে লিখিত অক্ষর মাত্র।

বলেন, 'আমার হাসপাতাল দেখলে বুঝবেন। একটা বেডে ছয়জন পোয়াতি বাচ্চা নিয়ে থাকে, এমনও হয়। এ্যান্টিসিয়াম? চাইলাম এ্যান্টিসিরাম, পাঠাবে এন্টারোকুইনল। অফিসিয়ালি নো ম্যালেরিয়া। তাই ম্যালেরিয়া হচ্ছে জানালেও ওষুধ পাঠাবে না। পাঠায় গাদা গাদা কন্ট্রাসেপ্টিড ট্যাবলেট আর একটা মিকচার।'

'বলেন কি?'

'ডেটল নেই, তুলো নেই, সিরিঞ্জ নেই, ক্লিনিকাল টেস্টের কোন ব্যবস্থা নেই, মার্কুরি ক্রোম অব্দি দেবে না মশাই। কোয়ার্টার নেই, মেয়ে নার্স পাই না। জমাদারের স্যাংশান নেই। তবু মানুষ বেঁচে ফেরে। কেন জানেন? এরা বোধহয় যমের অরুচি। ফলে সব কেস্ পাঠাই কলকাতা নয় ডায়মন্ডহারবার? কি করব?'

'অ্যান্টিসিরাম চেয়ে পাঠান।'

'পাঠাই মশায়, পাঠাই।"

'পান না?'

'না। আপনার কাছে আছে শুনলাম?'

'সে ত সামান্য।' 'দেবেন?'

'দেখি। আপনার দরকার ত বেশি।'

'অতান্ত মন ভেঙে যায়, জানলেন? জানি ইঞ্জেকশন দিলে সারবে, বেঁচে যাবে, অথচ.... শ্রীপদ যখন আনে কেস..... আমার কি মনে হয় জানেন?'

'কি?'

'ইনট্রাভেনাস দিতে পারবে না, কিন্তু ট্রেনিং দিতে পারলে শ্রীপদর মত বুদ্ধিমান লোক স্বচ্ছন্দে ইন্‌ট্রামাস্কুলর বা সাবকাটেনস ইঞ্জেকশান দিতে পারত। অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক। লিগেচার, সাঙ্গন সব করে তবে আনে। বাঁচায় ও, অথচ ও হল কোয়াক, আমি ডাক্তার।'

'সাকশন করা কি ঠিক?'

'ওর দাঁত আর মাড়ি ডাল। দেবেন সিরাম?'

'দেখছি।'

'আপনার ভগ্নীপতিকে বলুন না?'

বসন্ত হেসে ফেলে। বলে, 'খবরটা সবাই জানে, তাই না? অথচ হিমাদ্রিদা এখানে আসেননি, আমিও কাউকে বলিনি। তবু সবাই জানে।'

'ছোট জায়গা ত!'

'বলব।'

ডগ্নীপতি বসন্তর ওপর খুশি হন না! বলেন, লিখে দিচ্ছি, কলকাতায় এখানে গেলে পাবে। খানিকটা পাবে। তবে আমার নাম যেন জানাজানি না হয়। হেল্থ-ডিরেকটারেট কিছুই করে না। কলকাতার হাসপাতালগুলোই সভ্য দেশের পক্ষে লজ্জার বিষয়। মফঃস্বলে হেস্থের ব্যাপার একেবারে আদিম অবস্থায়। হেল্থ সেন্টারে ওষুধ দেবে! হেল্থ সেন্টার! কটা জেলা-সদর হাসপাতালে ও. টি এআর-কন্ডিশন্ড, এক্স-রে মেসিন ফাংশান করে, রুণীর বিছানা পরিষ্কার? ওয়ার্ডে কুকুর ঘুরছে! এবার লিখে দিচ্ছি, কিন্তু ও নিয়ে বেশি মাথা খামিও না। আমি চাকরি করতে এসেছি, চাকরি করে শান্তিতে থাকতে চাই। বাঘের ঘরে ঘোগ ঢুকে গেছে। তোমার দু দিনের উৎসাহে কিস্সু হবে না।'

বসন্ত কলকাতা চলে যায় ও অ্যানিটসিরাম নিয়ে ফেরে। যাঁর কাছে যায়, তিনি, "অ! অ্যান্টিসিরাম!" বলে ঝিমিয়ে পড়েন ও দিয়ে দেন। তারপর, বলা উচিত বিবেচনায় বলেন, 'এর আবার সব রিঅ্যাকশন আছে।'

'জানি।'

'কি জানেন?'

'ও তো আমাদের ইনস্টিটিউটেই তৈরি হয়। আচ্ছা, এগুলো কি এখানেই থাকে?' 'আমি ত তাই দেখছি। দেওয়ালের শোভা আর কি!'

বসন্তর আবারও মনে হয়, যদি বাজারী ওষুধ হত! তারপরই তার বিপক্ষীয় যুক্তিগুলি ওর মনে জাগে এবং হতাশ লাগে ওর। সর্পদংশন কোন ওষুধ কোম্পানিকে আগ্রহী করতে পারে না। কেন না সাপ কামড়ায় চার লাখ মানুষকে, মরে হাজার বিশেক। খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার হল, বহু বছর ধরে ওই বিশ হাজার মৃত্যুর পরিসংখ্যান থেকে যাচ্ছে প্রায় এক চেহারায়। ভারতে কি সাপ ও মানুষে কোন সমঝোতা আছে? বেশ, ওষুধ কোম্পানি না করুক, সরকার তো তৈরি করছে ওষুধ। গোখরো-কালাজ- চন্দ্রবোড়া ও অহিয়াজের বিষে খোড়াকে হাইপার-ইম্যুনাইজ করে ঘোড়ার প্লাজমা থেকে। প্লাজমাকে রাসায়নিক উপায়ে শুকিয়ে। এই শুকনো অবস্থায় অ্যান্টিতেনম বহুকাল থাকে।

তৈরি করে যদি, বণ্টন করে না কেন? কলকাতায় ওষুধ গুদামজাত করে লাভ কি? কেন সাপে-কাটার বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থা কলকাতায়? কলকাতার চৌকাঠে থেকেও ইরফানপুর হেলথ্ সেন্টার ও বেহুলা ব্লক কেন কালাজের দয়ায় বাঁচবে?

হেদো নম্বর ইট বেচে দিল না কেন? হেদো নস্করদের শাস্তি দেবার উপায় প্রশাসনের হাতে নেই কেন?

এখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারের একটি কথা ওর মনে পড়ে এবং স্টেরাইল-পাইরোজেন যুক্ত-ফিজিওলজিক্যাল সল্ট সল্যুশন কেনার সময়ে ও সিরিঞ্জও কেনে দুটো, একটি টর্চ এবং আন্দাজে সাইজ আঁচ করে ফুটপাত থেকে কৃত্রিম স্যান্ডাকের পাম্পও।

ইচ্ছে করেই সন্ধ্যার ট্রেনে ফেরে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারকে বাড়িতে গিয়ে ও অ্যাস্টিভেনম ও সল্যুশন দেয়। বলে, আমার নাম যেন কোন মতে জানাজানি না হয়। তাহলে আমি-আপনি ফেঁসে যাব।

ডাক্তার অভিভূত হয়ে পড়ে ও বলে, 'কোনদিন ভুলব না ভাই! সাপে-কাটা রুগী ইঞ্জেকশন নেই বলে গ্যাঁজলা তুলে মরে, সে চোখে দেখা যে কি কষ্টের!'

বসন্তর মনে পড়ে, হেল্ম-সেপ্টারের মলিন, চটা ওঠা, ফাটল ধরা দেওয়ালে ক্যালেণ্ডার-কাটা সাইবাবা বামাক্ষ্যাপা ও মা সারদামণি-রামকৃষ্ণের ছবি। বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা, প্রশাসনের নির্মম ঔদাসীন্যে বিফল হলে হতভাগ্য ডাক্তার বোধহয় উক্ত মহান পুরুষ ও রমণীদের মূলগাঁওকর অঙ্কিত প্রতিকৃতি থেকে ডরসা খোঁজে। কিন্তু কালাজ কামড়ালে সাঁইবাবার ছাই ও মধুও বিফল।

ও বলে, 'ট্রেনিং নিয়েছিলেন নিশ্চয়?'

'কিসের?'

'অ্যান্টিভেনম দেবার?'

'হ্যাঁ হ্যাঁ।'

'অ্যান্টি-রিঅ্যাকশনের ওষুধপত্তর আপনি যে করে হ'ক, জোগাড় করবেন।'

'করব।'

'চলি তা হলে।'

'ওগুলো আপনি নিচ্ছেন?'

'রাখলাম কিছু।'

'প্রচুর মরে, জানলেন?'

'জানি।'

'অন্ধকার বড্ড যে?

'উর্চ আছে।'

অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে বেহুলার দিকে চলতে চলতে বসন্তর মনে আজ আনন্দ হয়।

যে কারণে আনন্দ হয়, তার সঙ্গে ও যে কাজ করতে এসেছে তার কোন যোগ নেই। পরদিন ও শ্রীপদকে টচটি এবং জুতো জোড়া দেয়। বলে, 'এমনি দিচ্ছি না কাজ করিয়ে নেব।'

'আমাকে দিয়ে?' শ্রীপদ জুতো জোড়াটিতে হাত বোলায়, গন্ধ শোঁকে এবং ভাষাতীত কৃতজ্ঞতা চোখে নিয়ে বারবার বসন্তর দিকে তাকায়।

'হ্যাঁ। এখন মনে করে বলুন, এমন কোন রুগী পেয়েছেন, যাকে কালাজ কেটেছে, তেমন বিষ ঢোকে নি, আপনি সব চেষ্টা করেছেন, রুণী কয়েক দিন বাদে মারা গেছে?'

'ভুনি দাসী।'

'সে কে?'

'শশ্মশানের ডোম, সাগরের বউ।'

'কেসটা বলে যান।'

'লিখবেন?'

'হ্যাঁ।'

'চা বলি?'

'বলুন।'

'রাধি, চা কর্ মা এট্টু।"

'বলুন।'

'ভুনি দাসী ঘুমোচ্ছিল। মাটিতে শোয়া ছেতা, চ্যাটাই পেতে, কানেন ত সব। তা হাতের কেড়ে আঙুলে কাটল। আমারে ডাকল, তা গেলাম। ঝেরে বাঁদন দিলাম, চিরলাম, রক্ত চুষলাম। রাতভোর সেতা রইলাম। তা বেলা হতে বিপদ সারল। তাতেও বাঁদন খুলি নি। ঠাঁই সইরে দিয়ে ঘুয়েছিলাম। সাঁজ নাগাদ বেশ কতা কইলো, চোকে পষ্ট দেকল, দেকলাম রক্ত পড়লে হাওয়া লেগে জমচে। হাতে দিব্যি সাড়, ছুঁচ ফোটাতে গাল দিলে। আমি চলে এলাম।'

রাধি চা আনল। চা খেল ওরা। দুধহীন গুড়ের চা পরম তৃপ্তিতে চেটেপুটে খেয়ে গেলাসটা নামিয়ে শ্রীপদ বলল, 'পরদিন সাগর ডাকলে। ঝেয়ে দেকি, হাঁ বাঁদন খুলে দিচলাম, তা ঝেয়ে দেকি, ঝেদিনে সাপে কাটে, সেদিনে পায়ে বাঁশের চোঁচ ফুটে বাতা হইছিল, সেই পা ফুলে উঠেচে, বুকে ফিক ব্যতা, আর ক্ষ্যানে ক্ষ্যানে বেহোঁশ হয়ে পড়তেচে। হোঁশ আসতে বলে, শ্বাস নিতে পারচি না, বুকে ব্যতা গো! তকনি ইরফানপুর নে ঝাওয়া হল। বাঁচল নि।'

ডাক্তার কি বললেন?

'বলল, তুমি ত সাপে কাটার চিকিচ্ছে ঠিকই করিছিলে ছিরিপদ, কিন্তুক ওর শরীলে কিছু ছিল নে, তাতে ওই ঝে বাঁশের চোঁচ, তাতেও বিষক্রিয়া হল।' শ্রীপদ নিষ্ফল ক্রোধে থুথু ফেলল। বলল, 'ডাক্তারের সেতাও ইঞ্জিশান ছিল নে ঝা ঝা দরকার। যুবতী মেয়ে-ছেলে, তিন সন্তানের মা, ধনুষ্টঙ্গারে বেঁকে গেল। আর কি গ্যাঁজলা মুকে। ছেলেদের মানুষ কত্তে সাগর এই সেদিনে বিয়ে বসল। সাতটি মাস বেচারী কেঁদে কেঁদে মরেচে।' 'এই একটা?' 'আরো আচে। স্বচক্ষে দেকিয়ে দেব। আচেন ত একন? দেখতে পাবেন। আচ্ছা, সাপের বিষ নামল, তাতেও বিষক্রিয়া হল?'

'হয়।'

'নিবারণ কিসি?'

'তখন ডাক্তার বিনা গতি নেই।'

'ওষুধ নি, ইঞ্জিশান নি, ডাক্তার কি করে?'

'রুণী মরে।'

'আমাদের মরণ সর্বত্তর।'

'এবার শুনুন। ইঞ্জেকশনের চুঁচ, ওষুধ সব এনেছি। আপনাকে শেখাব।'

'আমাকে।'

'আপনাকে।'

'আপনি বলচ, আমি পারব?'

'পারবেন। এবার কোন কেস হলে আমি কি ভাবে কি করি দেখে নেবেন।'

'ছেলেরে পড়াচ্চি, সে দেকলে হতু না?'

'সেও দেখুক। আপনি ত চিরকাল থাকবেন না।'

'আমি পারব?'

'পারবেন। আমি জানি, তাই শিরায় ইঞ্জেকশন দিই। আপনি দেবেন হাতের বা পায়ের এমন জায়গার ওপরে। চামড়ার নিচে। কতটা দেবেন, কিভাবে মেলাবেন, আমি বুঝিয়ে দেব। যে সিরাম আছে তাতে অনেক দিন যাবে।?

'খারাপ হয়ে যাবে নে?'

'না।'

'আমি ইঞ্জিশান দে বাঁচাতে পারব?'

'নিশ্চয়।'

'শ্রীপদ দু হাত মাথা চেপে বসে থাকল। তারপর চোখ মুছে বলল, 'পিত্তিপুরুণ গোঁসা হবে। হ'ক। আমারে ভগবান সবে কেনে আসে। কিছু কতে পারি নে গো। তেনারা ঝে বিদ্যে চাইপে দে গেচে, সে একন এক জগদ্দল বোকা। নয় মন্দ হলাম, বেপতে গেলাম, মানুষ ত বাঁচবে!

'হ্যাঁ, বাঁচবে।'

'তবে লেকাও?'

'শেখাব, শেখাব।'

শ্রীপদর লেখার ক্ষমতায় বিস্মিত হয় বসন্ত। বসন্ত প্রথমে ওকে, নিজের ঘরে বসিয়ে

হাতের ও পায়ের পেশীতে, চামড়ার নিচে ডিস্টিল্ ওয়াটার ফোঁড়ে ও দেখায়। তারপর বসন্তর ওপর ও শেখা প্র্যাকটিস করে। ফলে দুজনেরই হাতে পায়ে ব্যথা হয়। কিন্তু শ্রীপদ খুব তাড়াতাড়ি শেখে।

অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড ও গরম জল ব্যবহার করতে শেখায় বসন্ত। ফুটন্ত গরমজলে  অপ দিতে শেখায়। দুজনেই বেজায় উত্তেজিত ও আনন্দিত। শ্রীপদ বলে, 'আপান মোরে ঝা শেকাচ্ছ তাতে মানুষ বাঁচে। মানুষ বাঁচলি বিষহরির কোপ নি।'

'কিসের কোপ?'

'তাই ত বলি! ঝে যুগে ঝা মন্তর! শালারা ছেলে কিয়োতে বউরে হাসপাতালে দেচ্চনা? টাইফায়েট হলে সেতা যাচ্চ না? সাপে কাটলে ডাক্তারে ইঞ্জিশান থাকলে দেচ্চে তা নেচ্চ না?

বসন্ত হেসে ফেলে। কলকাতার অদূরে এই নির্বান্ধব বেহুলায় অবস্থিতি শ্রীপদর কারণে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। শ্রীপদ বলে, 'শিয়র চাঁদার স্ত্রি-পুরুষে বিয়ে পৌষ-মাঘে। এবার শালা অন্ধানে ধান কেটে সবাই চাঁদা করে কেরাচিনি কিনব, পাঁজায় আগুন দে বংশ লোপাট করব। ওঃ, সাপের আড়ত কি, ঝেমন মনসাপুরী!'

এর পরেই হেদো নস্করের বালক মাহিন্দার শশী, সাপের ভয় ভুলে পাঁজা থেকে চারটি ইট সরাতে যায় এবং উরুতে কষ্ট কালাজের ছোবল খায়। বসন্তকে ডেকে পাঠায় শ্রীপদ। বলে, 'বসাতে পারে নে গো, দাঁত ঘেঁষে দেচে মাত্তর!'

শশী ধরেই নেয় সে মারা যাচ্ছে এবং মনস্তাত্ত্বিক বিকলতায় কালাজে তেজুতে কামড়ের লক্ষণাদি ডেভেলপ করতে থাকে। শ্রীপদ ওকে প্রবল চিৎকারে গাল পাড়ে ও বলে, 'ঢং দেকাস না শশী!'

বসন্ত এসে দেখে বাঁধন ছাঁদন শেষ। জল গরম হচ্ছে, নিসাদল রেডি। ও বলে, 'দিন ইঞ্জেকশন। যেমন দেখিয়েছি।'

'ছিরিপদ? ইজিশান দেবে?' সবাই খুব ঘাবড়ে যায়। শ্রীপদ এখন প্রখ্যাত বালককে অ্যানটিরেবিড ইঞ্জেকশন দান কালে লুই পাস্তরের আত্মবিশ্বাসে গর্জে ওঠে, 'বিষহরির আজ্ঞায় ঝা কচ্চি তাতে যদি বিশ্বেস না পাস তো ভাগ শালারা!'

ও ইঞ্জেকশান দেয় এবং চেঁচাতে থাকে, "মা মনসা দয়া করে বিষয়ে পেরি ধরি।

ভুজঙ্গজননী ভূজঙ্গের বিষ নিলেন হরি।।

বিষ গেলেন সপ্ত স্বর্গের উপর দিকে।

মা মনসা দোহাই দিলেন শঙ্কর পিতার।।

বিষ গিয়ে শঙ্করের হল কণ্ঠহার।

জয় জয় শুভঙ্কর শঙ্করের দোহাই।।

বিজ্ঞান ও বিষহরি, উভয়ের সাধনা শ্রীপদ সুকৌশলে চালাতে থাকে। গরম জলে নিসাদল ফেলে ক্ষতস্থানে ঢালে। গরম জলের তাগ দেয়। ইঞ্জেকশান দেবার একঘন্টা বাদে বাঁধন বদলে অন্যত্র বাঁষে এবং চেঁচাতে থাকে।

"ধ্বনি ধ্বনি ধ্বনি যার।

ধ্বনি বলিতে বিষ নাই আর।।

হাড়ে মাসে ধ্বনি ফুটে।

ধ্বনি উড়িতে বিষ না উঠে।।" বসন্ত যখন বলে, শশীর আর প্রাশের আশঙ্কা নেই, তখন শ্রীপদ তার ঝোলা গোছায়। শশীর মাকে বলে, 'নস্করের ঠেওে চাল-ডাল মেঙে এনে মায়ের ভোগ দে। খুব চিল্লিয়ে কাঁদবি। বলবি, তোমার ইটের পাঁজা হতে সাপ কাটল, তোমারে দিতি হবে।'

'সে আর বলতি? দুর্গা ক্যাওরানী হেদো নস্কররে ছেড়ে দেবে? ওই পাঁজা হতে সব্বনাশ হচ্ছিল! তা ছিরিপদ! মা আজ্ঞা দেচে ইঞ্জিশান দিলে?'

'বাপ রে, তেনার আজ্ঞা না হলি পারি? এত অবিশ্বেস কেন গো? জান দে তোমাদের জান রাকি, তা কোনদিন কলাটা কচুটা নিচ্চি? তোমরা বাচা গুখেগো, ডাগলে পরে না এলে ঠিক হতু।'

শশীর মা শ্রীপদর পায়ে পড়ে ও সমবেত সবাই শশীর মাকে গাল পাড়ে। শ্রীপদ দক্ষ অভিনেতা। ও বোকে মঞ্চ এখন তার। তাই বলে, 'আরো কতা আচে, সবাই শোন!' '

বল হে। মরা ছেলে জীয়ালে তুমি!'

'মায়ের সেবক, মায়ের সেবক, তিনি না বললে পারি? তিনিই স্বপ্ন দেলে বসন্তরে পাটো দিচ্চি। সে তোরে শেকাবে সকল। বললে বেউলোর আবুস্তা দেকে মনে বড় কষ্ট!'

'বল গো!'

'হেদো নম্বর সরকারের কেরাচিনি নে ধরে ডিম ফোটাচ্ছে। ওর পাঁজা হতে সব্বনাশ, তা ও দেবে নে! এবার অষঘানে ধান তুলে দে আমরা সবাই চাঁদা তুলে কেরাচিনি কিনব।' 'কিনে?'

"পাঁজায় আগুন দে শিয়রচাঁদার বংশ নিবংশ করব। নইলে বাঁচবুনি।'

'তাই হবে! তাই হবে!'

বেরিয়ে এসে শ্রীপদ বলে, 'এখন নাচতেছে সব! তকন দেকবেন সবাই পাল কাটাবে।

নিঝের ভাল নিঝে বোঝে নে এরা। সবাই গুখেগো।'

তারপর বলে, 'আজ এটা কি দিন! 'আমি ইল্লিশান দিলাম, শশে বাঁচল? অ্যাঁ?'

'কিন্তু স্বপ্ন-টপ্প, ও কি বললেন?'

'সত্যি!' শ্রীপদ বসন্তর হাত চেপে ধরে। বলে, 'মায়ের আমার অনেক দয়া গো! আপনারে "হ্যাঁ" বলে থেকে মনস্তাপ হইছিল খুব। তা রাতে মা ওই শিয়রচাঁদার গওনা পরে স্বপন দেকাল। বলল, কা তুই। ওরে আমি পাটোচি।'

বসন্ত বোঝে, শ্রীপদর স্বপ্ন দেখাটি অটোসাজেশন। ওইভাবে ও আদিম বিশ্বাসের কাছে এখন অবিশ্বাসী হয়ে বিজ্ঞানে উত্তরণের জন্যে ক্ষমা চাইছে। এও বোঝে, শ্রীপদর মনের এসকল জট ওপড়ানো ওর সাধ্যি নয়। শ্রীপদর পক্ষে অন্ধকার ত্যাগ করে জ্যোতির্গময় হওয়া সম্ভব নয়। অন্ধকার ও আলো সহাবস্থান করবেই। কেননা, নামেই বিংশ শতকে আছে শ্রীপদ। আসলে নাগরিকের সকল সুবিধায় বঞ্চিত অন্ধকার জীবনে ওর বাস। বিষহরিকে বর্জন করা ওর সাধ্য নয়।

শ্রীপদ বলে, 'কাল হাটে ঝাব। কাল রাতে আমার ঘরে খেতে হবে কিন্তু। এ আমার গুরুদক্ষিণা।'

'খরচ করবেন?' 'করব না? শালার মাচ আনব, আলু আনব, আমার পরিবার সরা পিঠে ভাঙ্গবে। খুব খাব।'

বসন্ত সকালে ইরফানপুর চলে যায় ও দোকান থেকে মিষ্টি নিয়ে আসে। সন্ধেয় বেরোবার সময় হেদো নস্কর বলে, ছিরের বাড়ি খেতে যাচ্ছেন! এতে ছোটলোককে আশকারা দেয়া হয়।

বসন্ত হাসে ও বলে, 'ও আমার বন্ধু।'

'বন্ধু!'

'হ্যাঁ। আর, আমি ত এখানে থাকব না। আমার জন্যে ও আশকারা পাবে না।'

হেদো সত্যিই বিভ্রান্ত। সে বলে, 'নকশালরা এসব বলত বটে। আপনি ত তা নন?'

'না, না, মোটেই নয়।'

'গ্রাম দেশ! সমাজ আচে হেতা।'

'আমি চলি।'

ছিয়ে না কি ইল্লিশান দিয়েছে?

'হ্যাঁ।'

'বিষহরির আজ্ঞায়?'

'তাই তো বলছে।'

'মা আজ্ঞা দিল?'

'কি করে জানব বলুন? ও-ই পুজো করে, ও-ই জানে মিছে কথা বলার মানুষ কি?'

'না না! জিব ঘসে ঝাবে সে কথা কইলে। তা দিক। গাঁয়ের ভাল হ'ক।'

'ভালই হবে।'

'আমি ত শুনেই শশের মারে চাল-ডাল-মসলা দিইচি। মায়ের ভোগ দিক। বেটা বাঁচল।' 'ও বাঁচল, কিন্তু আপনার পাঁজার ব্যবস্থা না করলে সবাই বাঁচবে না।' 'দেকি। দর পেলেই কেঁপে দোব।'

শ্রীপদর বাড়িতে টেমির আলোয় হাঁসের মাংস, কচুঘন্ট ও ভাত খাওয়া হয়, রসগোল্লা খাবার পর শ্রীপদ বলে,

'মায়ের গান শুনবেন?'

'নিশ্চয়।'

মনসামঙ্গলের গান। রাত বাড়ে। শেয়াল ডাকে। চারদিক নিঃশব্দ। বসন্তর মন ভরে যায়, ভরে যায়।

কয়েকদিন বাদে তামলীতে ডাক পড়ে শ্রীপদর। স্কুলের মাস্টারকে সাপে কেটেছে। শ্রীপদ

যায়, চেষ্টা করে খুব। কিন্তু সাপে কাটার পর আট ঘণ্টা কেটে গেছে বলে মৃতদেহেই চেষ্টা করতে হয়। এতে বসন্ত বোঝে, শ্রীপদর একটা নতুন পরিচয় গ্রামাঞ্চলে ছড়াচ্ছে। তামলীতেও সাপের ওঝা আছে ভূষণ মাল। ভূষণই শ্রীপদকে ডাকতে বলেছে। এটি খুবই দ্যোতক! ভূষণ স্বগ্রামে শ্রীপদকে ঢাকা মানে শ্রীপদর ইঞ্জেকশন দেবার কথা সে জেনেছে। এই ভাবেই দিন যায়। শ্রীপদ ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারের সহায়তায় বসন্ত, তার পেপারের কাজ করে চলতে পারে! ঘোড়ার প্লাজমা-সিরামে যারা অ্যালার্জিক নয়, তারাও প্রতিরোধহীন শরীরে সেকেন্ডারি সিম্পটম্ ডেভেলপ করে মারা যেতে পারে। খাদ্যহীন, পুষ্টিহীন শরীর। শোথ, স্ফীত প্লীহা, উদারময়, দাঁতের ক্ষত, ঘা এদের নিতা সাথী। অতএব অন্যান্য লক্ষণ দেখা দেয়!

মরে, মানুষ মরে। কিন্তু যে সব রুগী বেঁচে যায়, তারা ডাক্তারকে মনের জোর জোগায়, শ্রীপদকে। শ্রীপদর কাছে বসন্ত নতুন করে সব শেখে। সর্পদষ্ট রোগী ভয়েও মরে, তা বসন্ত পড়েছে।

সে ডয়ের চেহারা, রক্তমাংসের চেহারা শ্রীপদ ওকে দেখিয়ে দেয়। বলে, 'রাজীব ধোপার মরণটা দেখলেন? আমি গেলাম হাটে। ওরে কাটল ঢ্যামনা, ডাকল বামনা। ভয়ের চোটে বুকের ধুকধুকি থেমে গেল। বউ কাঁদল, কোতা গেচলে বাবা গো, তুমি রইলি ওর কিছু হুতুনি। ঢ্যামনা কাটলি মনে জানে তিনি কাটল। বাস্। এতেই আমাদের শাস্তবে বলেচে রুগীরে একা রাকবে নি, থকে হ'ক, মেরে হ'ক, মনে বল জোগাবে।'

'ভয়ে হার্টফেল করল।"

'এ ভয়ের নিরসন কী, বল?'

'ছেলে শিখছে?'

'নিশ্চয়? বেটা মস্তবতম্ভর শিখতে আসেনে। একন ইল্লিশানে খুব উৎসাহ। তবে লক্কন তো বেজে নে সকল? ওর হাতে ছাড়ি নি।'

'বাঁধন না বদলালে গ্যাংরিন আর কম্প করে খুললে মরণ, সেটা শেখাবেন।'

'সব, সব শিকুচ্চি। পয়সা ত নিই নি, তাতে নিশিকান্ত জেলে এট্রা কাঁটালকাটের বাক্স করে দে গেচে। ওর মারে বাঁচালাম? বলে, এতে ওষুদ ইল্লিশান রাকো। মায়ের নামে দিব্বি। তুমি আর তোমার ইঞ্জিশান একন ডস্স্সা। তা আপনার কান্স হচ্ছে?”

'নিশ্চয়। এখানে না এলে জানতেই পারতাম না উপোসী শরীরে ইঞ্জেকশান পড়লেও কত লক্ষণ দেখা দেয়, কী ভাবে মানুষ কষ্ট পায়।'

'হেদোরে তো কাটবে নে। তা'লে ঝানতেন হাতির আহার করা শরীলে কী কী লক্ষণ দেকা যায়। ওরে সাপেও কাটবে নে। কাটলে বুঝি বা সাপই মরে ঝাবে! বাপ রে! নম্বর

বলে কতা!'

'আমার যাবার সময় হল।'

'সে ভাবলি ত কষ্ট হয়!'

'আবার আসব হয় ত।'

'দেকুন! কাজে পড়লি কি আসা চলে? না একবার বেরুলি এই গয়েলে আবার গরু সাঁদায়?'

'আপনার মনসার গায়ে ও কি কালাজের চামড়ার গয়না? বেশ দেখতে হয়েছে ত?'

'ওই, মাতে হয়, চামড়া খসিয়ে গওনা কত্তে হয়। আমাদের ঝা নিয়ম। মালেরা নিয়ম রাকে নে সবে। একন ত দাঁড়াস মাত্তেছে, চামড়া বেচতেছে কলকেতায়। গোখরো পেলি ত দুনো লাভ।' বসন্তর চলে যাবার সম্ভাবনায় হেদো নস্কর খুবই খুশি হয় ও ইরফানপুরে থানায় বসে মনের কথা বলে আসে। বলে, 'হাকিমের শালা, তাতেই কিছু বলি নে। নইলে নকশালের কাঁদে হাগতেচে। ছিরিপদর সঙ্গে ওটা-বসা। ছোটজাতবে ইঞ্জিশান দিতেচে, সেতা ভাত খাচ্চে। ধান ওটার কালে বেটাদের ব্যাগে রাকা মুশকিল হবে। ওর দুদিনের খেলা, আমাকে মেরে ছুঁয়ে যাচ্চে।'

'কোন গণ্ডগোল পাকাচ্ছে না কি?'

'পাকায় নি বটে, কিন্তু গেরামের হাওয়াটা তো পালটে দিল? ছিরে মাল জুতো পায়ে, টচবাতি জেলে ঘুড়েছে? ছোট জাত ঝকন জুতো পরবে, তকন ঝানবেন ঘোর কলি। কী? না সাপে কাটবে। কাটবে ঝকন, তরুন কি জুতো পরে আটকাবি? তোর সাদ্যি আচে?'

বিষহরি সম্ভবত হেদো নম্বরের কথাগুলি শোনেন।

রাতে ঘুমের মধ্যে বসন্ত শোনে দরজায় ধাক্কা এবং কার বিপন্ন কণ্ঠে ডাক। ধড়মড় করে ওঠে ও, দরজা খোলে। স্বয়ং হেদো নস্কর, আরো কয়েকজন, শ্রীপদর ছেলে পতিত। পতিত কেঁদে ওঠে, 'ইজিশান নে চল বাবু! বাবারে... বাবারে...!'

'শ্রীপদকে?'

'হ্যাঁ বাবু, ঘুমের মদ্যে বগলে.....

হঠাৎ জায়গাটি তীব্র আলোয় ঝক্কায়! শলীর হাতে পেট্রোম্যাক্স। জ্বলছে। হেদো নস্করের কন্ঠেও ভয়। শ্রীপদকে সাপে কাটার গুরুত্ব তিনিও বোঝেন যেন। বলেন, 'আলো নিয়ে

যাই।'

'আপনি যাবেন?'

'ছিরিপদ....!'

বসন্ত টর্চ নিয়ে দৌড়য়।! কাঁষে কোলা। শ্রীপদকে সাপে কাটল। শ্রীপদকে?

উঠোনে ও ঘরে ভিড়। সকলকে ঠেলে সরায় বসন্ত, ভেতরে ঢোকে। কারা কেঁদে ওঠে, 'মালরে বাঁচিয়ে দাও বাবু। ও নইলে বাঁচবুনি।'

শ্রীপদ দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে। সামনে একটি নিহত কালাজ। শ্রীপদর হাত তুলে স্ত্রীর কাঁধে রাখা। স্ত্রী অঝোরে কাঁদছে। বগলে চেরার ক্ষত। শ্রীপদর দু চোখে ঘুম। চোখের পাতা নামছে বারবার, টেনে টেনে খুলছে।

'শ্রীপদ?'

'বাবু? বসন্ত বাবু?'

'গরম জল ফোটাও কেউ, অনেক জল। হ্যাজাক এখানে রাখ। শ্রীপদ! আমি ইঞ্জেকশান

দিচ্ছি।' ইঞ্জেকশান দিতে বসন্তর হাত কাঁপে। শ্রীপদ ক্ষীণ হাসে ও অনেক দূরে চলে যেতে

যেতে বাতাসে গলা ভাসিয়ে দিয়ে সুদূরের কন্ঠে কলে, 'বাঁদন দিতে চাইল পতিত, বাঁদন কোতা দেবে?'

'শ্রীপদ! সবচেয়ে বেশি ডোজ দিলাম।' 'দাও!' বসন্ত নির্মমভাবে শ্রীপদর বগলে কাটতে থাকে। শ্রীপদ আবার হাসে ও বলে, 'কোন সাড় পচ্চি না। কাজ হবে নে বাবু। তুমি বোস!'

গরম জল। অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড। প্রত্যেকটি চেষ্টা বৃথা জেনেও বসন্ত যুকতে থাকে। শ্রীপদ অনেক দূর থেকে বলে, 'হোতা কাটলে কি কাজ হয় বাবু? বগলে আর হাটো তফাত নি, তুমি ঝে বল?'

'শ্রীপদ, তাকাও।'

'চোকে দিষ্টি নি বাবু! আর ঘুম! আর ঘুম!'

'গরম জলের হাঁড়ি? কম্বলের আসনটা দাও।'

কম্বলের পুজো করার আসনে বগল জড়িয়ে গরম জলের ভাপ। সাড়া নেই শরীরে,

সাড়া থাকে না। বসন্ত শ্রীপদর নাড়ি দেখে, বুকে কান পাতে। শ্রীপদ অমানুষী চেষ্টায় চায় ও জড়িয়ে জড়িয়ে বলে, 'ইট বেচল না নস্কর!'

বসন্ত কান চেপে থাকে বুকে। তারপর আস্তে আস্তে ওঠে। শ্রীপদকে আস্তে শুইয়ে দেয়। তারপর হা হা করে কেঁদে ওঠে ও মুখ ঢাকে। বেহুলার শতাধিক লোক এক সঙ্গে কাঁদে। রাতটা চমকিত হয়। কালাজের পুরোন চামড়ার শিরোভূষণ পরে পেতলের মনসা একই দৃষ্টিতে সস্নেহ বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকেন।

সকাল হয়। সর্বনাশের সকাল যেন। কী করে খবর যায় কে জানে। তামসী, বকুলপুর, গাঙটি ও ফুলে গ্রাম থেকে মালেরা আসে। এখন বসন্ত দর্শক মাত্র। এতে ওর কোন ভূমিকা নেই। কলার ভেলা তৈরি হয়। তাতে বিছানা। শ্রীপদর ধূসর শরীর শয়িত। মালেরা একে একে ভেলায় ছোট ছোট সরা রাখে। চালতুলসীপাতা। প্রণাম করে শ্রীপদকে।

বিশাল, গ্রামের পক্ষে বিশাল ও দীর্ঘ শবযাত্রা। সবাই হরিধ্বনি দেয় ও চোখ মোছে। পুরুষরা নির্লজ্জায় কাঁদে। বেহুলায় ভেলাটি নামানো হয়! সবাই এখন পাশে পাশে হাঁটে। ডেলাটি টানতে বৃদ্ধা বেহুলার মাজা ফাটে। অভিশপ্ত সে, অভিশপ্ত। ধীরে, অতি ধীরে ডেলা চলে। বসন্ত হটিতে থাকে। ভূতেপাওয়া মানুষ যেন। হাঁটতে হাঁটতে সবাই এবার থমকে দাঁড়ায়। বাঁওড়া। এখানেই ভেলা পাক খায়। নিয়ম। তেলাটির দিকে চেয়ে যারা দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের চোখে অন্ধকার, এ রোদ ও দিনের দৃশ্য অন্ধকার।

কে যেন বলে, 'সাত বার ভেলা ঘোরাবে, তা বাদে ডুইবে নে তামসীতে তুলবে।' তারপর সবাই বিস্ময়ে অস্ফুট আর্তনাদ করে। কেন না ভেসাটি সকলকে চমকিত ও সন্ত্রাসিত করে মন্থরে পাক খায়, কেবলি পাক খায়। বাতাসে শ্রীপদর মুখের চাদর উড়ে যায় ও বসন্ত সভয়ে বোঝে, শ্রীপদর আধবোজা চোখে এক' তার প্রতি অভিযোগ। তার তিরস্কার। মানুষ, সর্পদংশনতীত মানুষ রিসার্চ পেপার নয়, বিবাদী বাগের দপ্তরে দস্মিক পরিসংখ্যান নয়। মানুষ বিনশ্বর। তাই মানুষের সহায়তা প্রয়োজন, ভয় দূর করা প্রয়োজন, প্রয়োজন তাকে বাঁচানোর।

শশীর মা ফুকরে ওঠে, 'অনাথ করে রেখে যাচ্চ বাবা, তাতেই ঝেতে পাচ্চ না? তাতেই ঘুরে ঘুরে দেকতেচ?"

তারপর যেন মৃত শ্রীপদ বোকে, পিতৃদত্ত দায়িত্ব সে নিয়েছিল। তার সে দায়িত্ব নেবার কেউ নেই। পতিত কিছুই শেখে নি। বসন্ত চলে যাবে। পিণ্ডদানের অধিকার সে পতিতকে দিয়ে গেল, কিন্তু তার উত্তরাধিকার নিতে কেউ রইল না। শ্রীপদর উত্তরাধিকারী ত পিণ্ডদান করলেই হওয়া যায় না! যেন গভীর হতাশায় শ্রীপদ নদীকে কিছু বলে। বেহুলা বাঁওড়ে এবার টেনে নেয় ভেলাটি।

বসন্ত ফিরে আসে। সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকে ও, অন্বাত, অনাহারী। সারা রাত। সকালে ও হেদো নম্বরকে ডাকে। বলে, 'কেরোসিন বের করে দিন। সরকারী কেরোসিন।'

'কী হবে?'

'দেখতে পাবেন।'

'কিন্তু, কী হবে তা না বললি...' হেদো নম্বর আরো কথা বলতে চায়। শ্রীপদর মৃত্যুতে সেও মর্মাহত। কিন্তু কেরোসিন মানে অথরিটি হাতে রাখা। বসন্ত ওকে কোন কথাই শেষ করতে দেয় না।

'আগে গ্রামের সকলকে ডাকব নস্কর বাবু, কেরোসিন বের করাব। তারপর এস. ডি. ৩. কে জানাব। তারপর কলকাতায় গিয়ে যা করবার করব। আপনার ইটের পাঁজা... এস. ডি. ও. শুধু আমার ভগ্নীপতি নন, জবরদস্ত লোক। কেরোসিন আপনি এদের পারমিট থাকলেও দেন না, মজুত করেন। মজুত করেন আপনি, আমি জানি না? পঞ্চায়েতে প্রধান হয়েছেন! কীর্তিকলাপ জানলে প্রধান রাখবে আপনাকে?'

হেদো নস্কর, শাস্ত্র ও নির্বিরোধী বসন্তর চোখে নিজের আপাত-পরাজয় সংবাদ পড়ে এবং তারও মনে হয়, বড় বেশি বিচ্ছিন্ন গ্রাম, খানা ইরফানপুরে। মনে ভিত্তিহীন ভয়। সত্তর-একাত্তরে এ-হেন ভয়ের তাড়নেই ও পালিয়েছিল।

'নিন, ক টিন নেবেন।' শুকনো গলায় বলে ও।

'এক টিন রেখে সব নেব। শশী! চরণ, সাগর, রাবণ, নিশিকান্ত সকলকে ডাক্। বিশ জন লোক চাই।' বসন্তর গলায় ও মনে হিংস্র আনন্দ। নস্করের পাঁশুটে মুখ দেখে এত আনন্দ পাবে তা ও বোঝে নি।

'হোস পাইপগুলোও দেবেন। গ্রামে আগুন নেভাতে সরকার দিয়েছে। আপনি বেগুন গাছে জল দেন।'

চরণরা সবাই আসে। বসন্ত বলে, 'টিন নাও, পাইপ নাও, তারপর যত পার খড় আন।' চরণরা ওর দিকে তাকায়। শ্রীপদর মৃত্যুর প্রচণ্ড আঘাত, শোক, বিমূঢ়তা, সব সত্ত্বেও

বসন্ত ওদের জীবনের উজানমুখী প্রবহমানতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। 'বড় বড় বাঁশ নিয়ে চল। মেয়েছেলে, ছোট ছেলে কাছে আসে না যেন।'

খড়ের আঁটি ছিঁড়ে পাঁজা করা হয়, পাঁজায় ছুঁড়ে ফেলা হয়, হতে থাকে। খড়ের নিচে ক্রমে চাপা পড়ে পাঁজাটি। পাঁজা ঘিরে খড়ের পাঁচিল। আগুন বিষয়ে অভিজ্ঞ প্রশান-ডোম সাগর বলে, 'ছেলেরা কেয়ে কুলগাছ কাট গা। শসানে বিস্তর। একবার আগুন ধরলি নিভবে ना।

চরণ বলে, 'ঘর ঘর হতে তুষ চেয়ে আন্ গা। শীতে আগুন পোহাবে বলে সকলা ছুঁয়েছে।' খড়ের পাঁচিল ও পাঁজা-ঢাকা খড়ে কেরোসিন স্প্রে করা হয়। বসন্ত বলে, 'এক সঙ্গে চারদিকে আগুন দেবে। ন্যাকড়া জ্বালিয়ে খুঁড়বে! খড়ের পাঁচিল যেন না নেভে। সমানে খড় ফেলবে। সাপ বেরোতে দেখলেই লাঠি পেটাবে।'

'সে আর বলতে হবে নি বাবু, ছিরিপদরে খেয়েচে ঝকন, তকন আর বাঁচতে হচ্চে नि।'

আগুন জ্বলে। ধূ ধূ করে। সবাই সাগ্রহে দেখে। এবার বাইরে থেকে, অভ্যন্ত দক্ষতায় বাঁশের খোঁচা মেরে সাগর ডোম পাঁজা খুঁচিয়ে ইট ফেলতে থাকে ও বলে, 'সকলা খোঁচা মার্। সুমুন্দিরা নামুতে সাঁদাচ্ছে। হুই, হুই দেখ!"

আগুনের তাপে ছিটকে পড়ে কালাজ। সবাই চেঁচিয়ে ওঠে, নতুন উদ্দীপনা পায়। খড়ের পাঁচিলে কাঠ পড়ে, কেরোসিনের পিচকিরি। সাপ বেরোতে থাকে। মরতে থাকে। গ্রামের লোকগুলির শোক, কালাজ বিষয়ে ভয়, হেদো নস্করের ওপর রাগ, সব উত্তরিত হয় এক্ষণিক প্রথলন্ত ক্রোধে। আগুন তাই ভীষণ জ্বলে।

10
Articles
মহাশ্বেতা দেবীর ছোট গল্প সংকলন
0.0
"মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্পের সংগ্রহ" হল গল্পের একটি সংকলন যা ভারতে সামাজিক সংগ্রাম এবং মানবিক স্থিতিস্থাপকতাকে স্পষ্টভাবে চিত্রিত করে। গল্পগুলি বর্ণ বৈষম্য, লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার বিষয়বস্তু অন্বেষণ করে । মহাশ্বেতা দেবীর আখ্যানগুলি পদ্ধতিগত অন্যায়ের একটি শক্তিশালী সমালোচনা প্রদান করে এবং যারা সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছে তাদের আওয়াজ দেয়। সমসাময়িক ভারতের রূঢ় বাস্তবতাকে সহানুভূতি ও অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে তুলে ধরার লেখকের ক্ষমতার প্রমাণ হিসেবে সংগ্রহটি দাঁড়িয়েছে।
1

ভূমিকা

28 November 2023
0
0
0

1984 সালে প্রকাশিত তাঁর 'শ্রেষ্ঠ গল্প'-এর ভূমিকায় মহাশ্বেতা দেবী লিখেছিলেন, 'সাহিত্যকে শুধু ভাষা, শৈলী, আঙ্গিক নিরিখে বিচার করার মানদণ্ডটি ভুল। সাহিত্য বিচার ইতিহাস প্রেক্ষিতে হওয়া দরকার। লেখকের লেখার

2

বান

28 November 2023
0
0
0

ডাদ্রমাসে রান্নাপূজার দিন এসেছে, এ সময়ে গৃহস্থমাত্রেই মনসাগাছ খোঁজে। রূপসী বাগদিনীর ছেলে চিনিবাস মনসাগাছ খুঁজতে গেল। মনসাগাছ নিয়ে পূর্বস্থলীর গৃহস্থরা উঠোনে পৌঁতে। মনসা বাস্তু। মনসা ক্ষেতে ধান, গাইয়ের

3

বিছন

28 November 2023
0
0
0

কুরুডা ও হেসাডি গ্রামের উত্তরে জমি ঢেউখেলানো, একেবারে শুকনো রোদে জ্বলা। বৃষ্টির পরও এখানে ঘাস জন্মায় না। মাঝে মাঝে ফণীমনসার জমল ফণা তুলে থাকে, কয়েকটি নিমগাছ। এই দগ্ধ ও আন্দোলিত প্রান্তর, যেখানে মোষ চর

4

দ্রৌপদী

29 November 2023
1
0
0

নাম দোদি মেঝেন, বয়স সাতাশ, স্বামী দুলন মাছি (নিহত), নিবাস চেরাখান, খানা বাঁকড়াঝাড়, কাঁধে ক্ষতচিহ্ন (দোদি গুলি খেয়েছিল), জীবিত বা মৃত সন্ধান দিতে পারলে এবং জীবিত হলে গ্রেপ্তারে সহায়তায় একশত টাকা.....

5

রং নাম্বার

30 November 2023
0
0
0

রাত একটা। তীর্থবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। টেলিফোন বাজছে। মাঝরাতে টেলিফোন বাজলে কেন এত ভয় করে? 'হ্যালো। শুনুন.. হাসপাতাল থেকে বলছি.. আপনাদের পেশেন্ট এইমাত্র মারা গেলেন। হ্যালো।' 'আমাদের পেশেন্ট? হাসপাতালে আ

6

শিকার

1 December 2023
1
0
0

জায়গাটি গোমো-ডালটনগঞ্জ লাইনে পড়ে। স্টেশনটিতে একদা ট্রেন দাঁড়াত। সম্ভবত ট্রেন দাঁড়াবার খরচ পোষায় না। তাই স্টেশন ঘর, থাকার কোয়ার্টার ও কুলী বস্তির ঘরে দেখা যায় গরু ও ছাগল মাঝে মাঝে। 'কুরুডা আউটস্টেশন, অ

7

সাঁঝ-সকালের মা

6 December 2023
0
0
0

বৈশাখের তাতে মাঠের ছাতি ফাটে, সাধন কান্দোরীর মা জটি ঠাকুরনী মরে গেল। মরে যাবার আগে ত্রুটি ঠাকুরনীর পেট গলা ফুলে ঢাক হয়েছিল। বাঁশের দোলা বেঁধে সাধন কান্দোরীর মা-কে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল। 'মোকে আঁসপা

8

বাঁয়েন

7 December 2023
0
0
0

ডগীরথ যখন খুব ছোট তখনি ওর মা চণ্ডীকে বাঁয়েনে ধরেছিল। বাঁয়েনে ধরবার পরে চণ্ডীকে সবাই গাঁ-ছাড়া করে দিল। বাঁয়েনকে মারতে নেই, বাঁয়েন মরলে গাঁয়ের ছেলে-পিলে বাঁচে না। ডাইনে ধরলে পুড়িয়ে মারে, বাঁয়েনে ধরলে তা

9

বেহুলা

7 December 2023
0
0
0

নদীটির নাম বেহুলা, গ্রামটির নাম বেহুলা, ব্লক ইরফানপুর, ব্লক আপিস-হেল্থ সেন্টার কৃষি সমবায় আপিস, সবই ইরফানপুরে; বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে আড়াই ঘণ্টা ট্রেনে গেলে ইরফানপুর স্টেশন। সেখানে নেমে স্রেফ হেঁটে যেতে

10

মৌল অধিকার ও ভিখারী দুসাদ

8 December 2023
0
0
0

জায়গাটি নওয়াগড়ের সীমানায় ও বাস-পথের ওপরে। নওয়াগড় ছিল এক ছোটখাট স্টেট বা বড় জমিদারি। জমিদারের "রাক্সা" খেতাব মিলেছিল। স্বাধীনতার বছরে রাজা সাহেবের বয়েস ছিল এক। তা সত্ত্বেও এখন সে রাজা সাহেব নামেই পরিচি

---