জায়গাটি নওয়াগড়ের সীমানায় ও বাস-পথের ওপরে। নওয়াগড় ছিল এক ছোটখাট স্টেট বা বড় জমিদারি। জমিদারের "রাক্সা" খেতাব মিলেছিল। স্বাধীনতার বছরে রাজা সাহেবের বয়েস ছিল এক। তা সত্ত্বেও এখন সে রাজা সাহেব নামেই পরিচিত। তালুক চলে গেলেও রাজা সাহেব নিঃসম্বল হন নি। রাজাসমূহ হস্তান্তরের সময়েই বহু জমি প্রচলিত নিয়মে জনা পঁচিশ ঠাকুরদেবতার নামে খাসে রাখা গিয়েছিল। তবু বাজা সাহেবের ওপর চূড়ান্ত অবিচার ঘটে যায়। রাজ্য সরকার পাপ করে বসে। বাসরাস্তা ও বেলপথ হবার কারণে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার খাস জমি আত্মসাৎ করে।
রাজা সাহেব কৈশোরেই ঘটে যায় এসব। দক্ষ রাজমাতা ও তার অনুগত তকিল এই চূড়ান্ত অবিচারে মরমে মরে যান। তারপর ওদিকে রাঁচি ও পাটনায় উকিলী পরামর্শ। এদিকে রাজা সাহেবের দিনগুজরানের ব্যবস্থা, একই সঙ্গে চলতে থাকে। আবাদী-জমি জঙ্গল-কাটাই ঠিকাদারি ও কাঠচেরাই কারখানা, লরি ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা, এগুলি পোক্ত করে নেবার পর শুরু হয় প্রতিকারকরে ছুটোছুটি।
কোনো প্রতিকার হয়েছে ছয় বছরের চেষ্টায়। আজ নওয়াগড়ে বড় ধুম। প্রাথমিক বিদ্যালয় ছুটি রাজমাতা ট্রান্সপোর্টের একশো লরির ছুটি। রাজা সাহেবের আবাস "দূরনিবাস" থেকে রঙিন কাগজে ঢাকা মিষ্টান্নের ডালা খালা, তোহরির কাছারি, টাহাড়ের শিবমন্দির, ইত্যাকার জায়গায় সওগাত যাচ্ছে।
অনেকদিন বাদে নওয়াগড়ে সবাই যেন বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করছে। রাজা সাহেব জানিয়ে দিয়েছেন, বুলি মনাও ধুম মচাও, ঘর ঘর দীপ জ্বালাও-যে যার খরচে। তা তেমন না হলেও সকলে যেন হালকা।
মাস দশেক আগে রাজা সাহেবের জমির বাটাইদার চাষীদের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভ দেখা দেয়। এরকম গত বছর আষ্টেক হচ্ছে। কোনো বারই পুলিস বসে যায় নি এখানে। প্রথমে বাজার লোক বাটাইদারদের মেরেছে, তারপর এসেছে পুলিস। বাটাইলরদের মধ্যে যাদের মনে করেছে পালের গোনা, ধরে নিয়ে গেছে।
এ রকম হয়েই আসছে, হয়েই থাকে। নওয়াগড়ের মাটি যত পুরনো, এসব ঘটনাও
তৎই পুরনো।
এর মধ্যে বছরে-বছরে বাটাইদারদের সংখ্যা বেড়েছে, খেতের শস্যের বাটা বা অধিকার বিষয়ে তাদের চেতনাও বেড়েছে। কোনো তৃতীয় শক্তি কাজ করছে বলেই পুলিসের সন্দেহ।
তৃতীয় শক্তিও না-কি এক দলে আবদ্ধ নেই। কৌন্ হো কমনিস্, কৌন হো আদিবাসী স্বার্থ সংরক্ষক, কৌন হো উগ্রপন্থ, লেকিন্ সব হি শালা গরিব কিষাণো কো মদত দেতে
হ্যায়।
এতেই গড়বড় সাগছে এবার। তিন মাস আগে বাটাইদাররা যে লড়াই করে, তাতে ওরা একটা কাপড়ে লিখেছিলো, মেহনত কা ফসল কা আধা বাট্টা পর্ হম্ লোগোঁকো মৌল্ অধিকার হ্যায়।
কাপড়টি দু'ধারে বাঁশে বাঁধিয়ে ওরা নিয়ে ঘুরেছিল। কথাগুলি যথেষ্ট অস্বস্তিজনক বক্তব্যটি। ভাগচাষী, রাজা সাহেবের ভাগচাষী বলবে প্রমোৎপাদিত ফসলে তার ন্যায্য অধিকার? এ তো ঠিক হয় না। আব ওদের মধ্যে লিখতে জানে কে? লিখে দিল কে?
রাজা সাহেবের মনে হয় গভীর বঞ্চনার বোধ। অবিচার, অবিচার। শোষিত তিনি, অত্যাচারিত। সরকার তাঁর জমি দিয়ে বাস ও রেলপথ করেছে। করেছে বলে তাঁর রাজমাতা ট্রান্সপোর্টের লরি ওই পথে কাঠ-কয়লা-শস্য কুলি বইছে, বেলগাড়ির ওয়াগন বইছে তাঁর চেরাই তক্তা, এতো গৌণ কথা। সেই অবিচারের প্রতিকার না হতে বাটাইদাবদের একি নতুন অবিচার? ফসলের ভাগ চাই, সরকারের শ্রমদপ্তরের নিয়ম মতো তাগ চাই?
এবার বাটাইদাররা রাজা সাহেবের লোকদের ফসল ওঠাতে দেয় নি। বলেছিল, মার বেটাদের। মারতে মারতে মথুরা সিংকে ওরা জখমই করে, চন্দন মলের বন্দুক নেয় কেডে। স্বয়ং রাজা সাহেবকেই গুলি চালাতে হয়। ওদের একদল মরে।
এতো হয়, হয়েই থাকে। নওয়াগড়ের মাটি যত পুরনো, এসব ঘটনাও ততই পুরনো। ঘুম পাড়াতে গিয়ে কোনো ঠাকুমা কোনো নাতিকে রূপকথা বলার সুরে বলে থাকে, উস্ কে বাদ আয়ে রাজা সাহেব! বোলে, কা দুখিয়া, ইয়ে কা খঢ়ড়াই হ্যায়? তোহাব নানা বোলে, কা খচড়াই? ফসল দিয়া করো, ঔর তুমহারা হত্যারা সেপাই লোগোঁকো যনে বোলো। উস্ কে বাদ চালায়া রাঙা সাহেব গোলি। মার দে তোহার নানাকো, ফাট গয়ে কলিজা ঔর খুন নিকলে যৈসে ভার্দো র্মে গঙ্গা জীমে পানি।
এই হয়, হয়েই থাকে। জমির ধনী মালিক আব গরিব কিষাণ-ক্ষেতমজুর-বাটাইদাবেব কাহিনী এই রকমই হয়ে থাকে। কেউ পারে না এ কাহিনী বদলে দিতে।
এবার তফাত ছিল। ওরা মারতে মারতে, মার খেতে খেতে শ্লোগান দিচ্ছিল,
মেহনত কা ফসল কা
আধা বাট্টা পর্
হম্ লোগো কো
মৌল অধিকার হ্যায়
এমনটি নওয়াগড়ের মাটির জীবনকালে ঘটে নি। ফলে পূন্সিস বসে গেল নওয়াগড়ে। দুখিয়ার লাশ চালান গেল। জখম লোক সব হাসপাতালে। শান্তিভক্ষ ও আইনভঙ্গের কেস বাটাইদারদের নামে। হঠাৎ নতুন এক কাণ্ড। বাটাইদার ইউনিয়নও আদালতে আর্ভি করে
বসে আছে। তারাও লড়বে। এই সব কারণে, নওয়াগড়ে পুলিস বসে যাওয়ায় সবাই খুব দমে। গুম্ মেরেছিল তিনমাস।
তার মধ্যে রাজাসাহেবের কি প্রতিকার মিলেছে। বদ্ধ বাতাসন পাতলা হয়েছে। কি
যে হয়েছে, সে কথাই মুখে মুখে।
ভিখারী দুসাদকে কেউ পাত্তা দিচ্ছিল না। দেবার কথাও নয়। অত্যন্ত ভীরু আর নির্বাহ লোকটা। ঘুরে ঘুরে ছাগল চরানই ওর জীবিকা। ছাগলরাই কাজের একমাত্র সহায়, ছাগল জাতি। ওদের যত্ন-আত্তি লাগে না। বহু রকম পাতা খায় ওরা, ঘাস তো খায়ই। বছরে একাধিকবার একাধিক বাচ্চা পড়ে।
অন্য কেউ হলে ছাগল থেকে কপাল ফিরত বোধহয়। ভিখারীর যে কি কপাল। ওর ছাগপালে পরিবার পরিকল্পনা। দুই বকরি, এক বকরা- নইলে এক বকরি, দুই বকরা-ইসিসে বঢ়তাহি নেহি। কা কিয়া যায় মহারাজ। ভিখারী পোড়া-কপালে।
অন্য লোক হলে ছাগল চরিয়ে কপাল ফেরাত। তোর কপাল ফেরে না কেন? কি করে ফিরবে? জঙ্গলে চরাই। লাকড়া নিয়ে যায়। শেয়াল নিয়ে যায়। এক পোয়া ছাতু দিয়ে দাও লালার্জী, আর ওই লেবুর আচার এতটুকু, পাঁচ পয়সার। পাঁচ পয়সার নিমকও দাও।
বাস! ওই হয়ে গেল?
হাঁ লালাজী।
ভিখারী তুই ছাগল হাটে বেচিস না কেন? হাটে বেচলে বেশি দাম পাস্। কা কিয়া যায়? আমাকে তো কেউ বেশি দাম দিতেই চায় না। ভিখারী ভীরু হাসে ও নিজের অবাঞ্ছিত অস্তিত্বের জন্যে যেন লজ্জিত হয়ে চলে যায়।
মাঝে মাঝে দেখা যায় ও কোলে বাচ্চা নিয়ে, ধাড়ি ছাগল তাড়িয়ে জঙ্গলের দিকে ছুটছে। মুখে-চোখে ভীষণ ভয় আর উদ্বেগ। মুখের কোণে ফেনা। ভিখারী যখনই ভয় পায়, জিভটা শুকিয়ে ওঠে ওর। ঠোঁটের কোণে জমে ফেনা।
প্রথম প্রথম নওয়াগড়ের লোক অবাক হ'ত।
কি হ'ল, ও ভিখারী?
পুলিস আয়ি, পুলিস।
তাতে তোর কি?
বকরা উঠা লি যায় মো লোক।
পালায়, পালায় ভিখারী। জঙ্গলে আছে নেকড়ে, শেয়াল ছাগলের দুশমন ওরা। তিখারীর একই দুশমন পুলিস। জঙ্গলে ঢুকে পড়ে ও, ঢুকেই দা দিয়ে গাছের ডাল কেটে ছাগলের খোঁয়াড় বানায়। তার মধ্যে ঢোকায় পশুগুলিকে। নিজে খোঁয়াড়ের মুখে বসে কাঁপে। আর তো কিছু নেই ওর সম্পদ বলতে। ওর সম্পত্তি ওই ছাগলগুলি। না জমিজমা,
না বউ-বাচ্চা, না কোনো কাজ। পরনে নেংটি, ছাগল চরাও। এ কোনো মন্দ কাজ নয়।
যদি কথনো হাগল হয় দশ-পনেরোটা, ভিখারী তখন আগে নিয়ে যাবে ওগুলি সুমাদির হাটে। অনেক টাকায় বেচবে। গাভীন বকরী রেখে স-ব বেচে দেবে।
তারপর একটা বড় ধৃতি কিনবে। সব সময়ে কেনে ছোট ধুতি, লেংটি মতো পরে। একটা নতুন গামছা। তারপর সুমাদি বা অন্য কোথাও দুসাদটোলিতে খোঁজ
করবে। হাটে তো নাপিতরা আসে, তারাই বলতে পারবে। কোনো বিধবা, বয়স্কা দুসাদিনকে বিয়ে করবে। তখন একটা ঘরও হবে হয়তো। দু'জনে থাকলে ছাগল সংখ্যায় বাড়বে।
কিন্তু কিছুতে আর স্বপ্ন সত্যি হয় না ভিখারীর জীবনে। বাড়া গ্রামের দুসাদরা জঙ্গল-জমিতে মুসাদটোলি করেছে। সেখানে ভালই ছিল ভিখারী। কিন্তু কা কিয়া যায় মহারাজ। বাড়ার গণেশী সিং মালিক খে য়ো। কি হ'ল তাব সঙ্গে দুসাদের, গণেশীকে মেরে ফেলল ওরা। পুলিস এসে গ্রামে বসল, আর দুসাদদের বকরি-বকরা তুলে নিতে থাকল। ভিখারীরও।
কত কেঁদেছিল ভিখারী। আর কিছু নেই আমার এই বকরা-বকরী সম্বল। কিন্তু পুলিস বোঝে না কিছু। শেষে রাঁকা দুসাদ বলল, গাড়ীন বকরি নিয়ে পালিয়ে যা। নাড়া গ্রামে কোনো গোলমাল নেই। মাঠ আছে চরাই করতে। বটগাছের নিচে থাকবি।
বটগাছের নিচে কাশের ঝোপড়ি। বকরীর বাচ্চা হ'ল। সে বাচ্চা বড় হ'ল। নাড়ার মালিক-পরোয়ার রাজপুত লোক সব। মাংস খায়। দেহে তাগন খুব। তারা ভিখারীকে চেয়েও দেখেনি। মাংস খেলে বকরা কিনে নিত। দাম খুব কম দিত। আট টাকা, দশ টাকা। দশ-বারো-পনেরো সের মাংসের দাম কি তাতে হয়? কা কিয়া যায় মহারাজ সব কি আর সকলের কপালে হয়? কিন্তু নাড়ার এক মালিক-পরোয়ার গোলি সে মার দি এক ঔরত কো। হোলির গানের দলে মেয়েটি ছিল। বাস্! নাড়াতে এসে গেল পুলিস। পুলিস আসতেই মালিক-পরোয়ার বলল, ভিখারী দুসাদের কাছ থেকে একটা বকরা নিয়ে আয়। তিন দিনে তিনটি বকরা পুলিসকে দিয়ে ভিখারী ভাগ গিয়ে।
সকলের জন্যে এ দুনিয়া বহোত বড়া না হোতা, ভিখারীকে লিয়ে দুনিয়া বহোতহি ছোটা। নাড়ার পর ভাঙা বুকে ভিখারী গিয়েছিল টাহাড়। টাহাড়ের শিব মন্দিরের পূজারী হনুমান মিশ্রকে প্রণামও করে এসেছিল।
কি চেহারা! টকটকে রং, শরীরে আলো বেরুচ্ছে। কৈসে না হোই? দেওতা রোজ দুধ খান, দুধে স্নান করেন, মহাদেব ভগবানের সঙ্গে কথা বলেন।
ভিখারী গিয়েছিল বনের আঁচলে দুসাদ-গঞ্জের টোলিতে। টাহাড়ের দুসাদরা ওকে খুব যত্ন করে ডেকে নেয়। ছাগল চরাই করার সময়ে এক বুড়ি দুসাদিন ওর গাভীন্ বকরি দেখাই-ভালাই করত। সে ওকে বেঁধেও দিত। ওরা বলেছিল, থেকে যাও। আমাদের সমাজে এক ঘর লোক বাড়ে। বিয়ের ব্যবস্থাও করে দেব।
বেশ ছিল ওখানে ভিখারী। কিন্তু দেওতার কাছে এল একদিন দারোগা। সাত দিন থেকে গেল টাহাড়ে, ঔর দেওতা বললেন, ভিখারী দূসাদ! বকরা দে দারোগাকে খেতে।
এটা যে বেচতে যাচ্ছিলাম দেওতা।
কি? পুলিস দারোগা হ'ল দেও-দেওতা ঔর বরাস্তোনের পরে। সে খাবে, তাতে পয়সার কথা?
বকরা ভেট দিয়ে টাহাড় হাড়ে ভিখারী। টাহাড়ের দুসাদরা দুঃখ করেছিল। কা কিয়া যায়? ভিখারীর তো তোমাদের মত মজদুরি কাম, খেতমজদুরি কাম, পোরমিট নিয়ে জঙ্গলের শুখা লাকড়িগুড়ানো কাম নেই। তার তো এই ছাগলগুলি সম্বল। ছাগল পালবে, বেচবে, পালবে, বেচবে। পুলিস যে তার জীবিকার একমাত্র উপায় নষ্ট করে দেয় বারবার।
খুব পছন্দ হয়েছিল টাহাড়ের দুসাদটোলি। তোমাদের চেয়েও গরীব বলে ভিখারীকে কেউ ছোট মনে করনি। বুড়ি মা রেঁধে দিয়েছে খাটো আর ধূধুলের তরকারি। ছরোয়ার বউ, ছেলেকে দিয়ে পাঠিয়েছে করমচার আচার ছট পরবের প্রসাদ। হরোয়া একটা শজারু মারলে তার মাংস ভিখারীও খেয়েছে। সব ছেড়ে শেষ অবধি নওয়াগড়। প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার সুখচাদজী মানুষ ভাল। স্কুলের চালাঘরের পাশের বটগাছের নিচে বসে ভিখারীর সঙ্গে কথা বলে। অল্প বয়স, এ সব জায়গায় রীতকরণ বোঝে না। তাতেই বলে, বাতে তো সাবালকের পঢ়াই শিখাই, তুমিও চলে এস ভিখারী।
কা কিয়া যায় মহারাজ! ভিখারীকে তুমি পড়তে শিখাবে, বাস্? ভাগো ভিখারী নওয়াগড়সে। রাজাসাহেব ভাগাবে, পুলিস চলে আসবে, লালা সওদা বেচবে না, কুয়াব জন্স মিলবে না।
সুখচাঁদ বলে, কৈসে হোই?
কৈসে না হোই? এক টরচ বাতি দেখ্ কর হাম পুছল্ করল, উসি কা কত্রে দাম হো, এ লালাজী? তো লালা, কিনা গুস্সা হোই? কা ভিখারী, দুসাদ হো তু, ছোটো কাম করত্ রহস্, আতি কা টরচ জ্বালায়ে গা?
নওয়াগড়ে ভিখারী থাকে একটি ভাঙ্গা বাসের মধ্যে। ভাঙ্গা বাস, ভাঙ্গা লরি, সব কেনে রাজাসাহেবের ডকিল। জমতে জমতে অনেক হলে ভেঙ্গে ভেঙ্গে লোহালক্কড় বেচে সেখানেই থাকে। সেখানে থাকে কয়েক ঘর ভিখমাঙা। বাস ও লরিব মধ্যে মধ্যে ঘাস ঝোপ। ছাগল চরে। ছাগলচরাই করার জন্যে মাঠঘাট নওয়াগড়ে এখনো মাছে। তিখাবীর তো এত ছাগল নেই যে মাঠ নষ্ট করবে?
জঙ্গলে বসে এ সব কথাই ভাবে ভিখারী। তবে আর ভাবে। পুলিস লালাজীর দোকান লুটে নেয় না, গয়লাদের গরু কেড়ে নেয় না। যার যা আছে রাখতে দেয়। তার ছাগলগুলো কেন কেড়ে নেয়? ছাগলগুলি ছাড়া আর যে কিছু নেই তার।
তারপর ছাগলগুলি খোঁয়াড়ে রেখে, মনে মনে রামজী অওতারকে ডেকে তার পশুগুলিকে রক্ষা করতে বলে ও দুরুদুরু বুকে আসে নওয়াগড়ে। তার আস্তানায়। এ সময়ে তাকে বড় মদত দেয় ল্যাংড়া, কানী ও কুষ্ঠরণী ছোকরা দোরা। ওরাই বলে দেয়, পুলিস এখনো আছে। ভাগ্যা।
স্কুলের কলসি ও ছাতু-গুড় নিয়ে তিখারী আবার চলে যায় জঙ্গলে। রামন্ত্রী অওতার কখনো কৃপা করেন। ছাগলগুলি অক্ষত থাকে। কথনো ভুলে যান ভিখারীর আবেদন। তখন লাকড়া নিয়ে নেয় কোনোটা। সাপ কেটে দেয় বকরা। শেয়াল নিয়ে যায় বাচ্চা।
জঙ্গলে গিয়ে ভিখারী পশুগুলিকে জল খাওয়ায়। নিজে খায় ছাতু ও গুড়, কাপড়ের খুঁটে জলে মেখে। এভাবে কখনো দু-তিন দিনও কাটে। রোজই ওকে যেতে হয় নওয়াগড়। তারপর পুলিস চলে যায় ও ফেরে।
এবার তো তিন-তিন মাস নওয়াগড়ে পুলিস। ভিখারী একেবারে বুনোই হয়ে গিয়েছিল। জঙ্গলের কিনার ধরে ধরে ও চলে যায় বাড়ার দিকে। সেখানে জঙ্গলে দেখা হয় রাকা দুসাদের সঙ্গে। রাকা সাহায্য না করলে এবার ভিখারী এতদিন জঙ্গলে থাকতে পারত না। রাঁকা ওর সমস্যার কথা খুব মন দিয়ে শোনে। তারপর বলে, দাঁড়াও, দেখছি।
তিন-চারজন দুসাদ ছেলেকে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যিখানে ঢুকে যায় রাঁকা। খুব পোক্ত কবে খোঁয়াড় বানিয়ে দেয়। উপরে থাকে সপত্র গাছের ডালের ছাউনি। বলে, থেকে যাও এখানে। এই নালা থেকে জল পাবে। কি খাব?
পয়সা দাও, কিনে দিয়ে যাব।
এই যে।
কয়েকদিন বাদে রাঁকা বলে, কতদিন থাকবে কে জানে। ওই বকরাটা বেচে দাও।
কোথায়?
হাটে।
তোহরিতে?
আর কোথায়?
কখনো যাই না।
বিশ্বাস পেলে আমাকে দাও।
একি কথা রাঁকা? বিশ্বাস করব না?
দেখি। বকরাটি বেচে দেয় রাঁকা এবং ভিখারী হাতে ষাট টাকা নিয়ে নিজেকে মনে করে রাজা।
এই তিন মাস সময়ের মধ্যে তার বকরির বাচ্চা হয়। আরেকটি বকরা বেচে খোরাকির
টাকা দেয় রাকাকে।
রাঁকাই বলে, এখন পুলিস নেই। মাঝে মাঝে টোলিতে এসে ঘুরে যেও।
বাঢ়ার টোলিতেই একদিন কনু দুসাদ বলে নওয়াগড় থেকে পুলিস চৌকি উঠে যাচ্ছে।
সত্যি?
তাই তো শুনলাম।
ডিধারীর মনে হয়, এখন চলে গেলেই হয়। ছাগল এখন আটটা। দুটো বকরি, দুটো বকরা, বাচ্চা চারটে।
রাঁকা বলে, চলে যাক, তারপর যেও।
চলে যায় পুলিস, চৌকি তুলে নেয়। তারপর ভিখারী রওনা হয় নওয়াগড়ে। আস্তানায়
ফিরবে বলে মন খুব খুশি। আর নওাগড়ে ঢোকে যখন, যখন ফেরে আস্তানায়, তখন তাকে দেখে ভিখিরীরা কি খুশি, কি বুণি।
কানী ঝাউডাঙ্গ দিয়ে ওর বাসাটা ঝাঁট দিয়ে দেয়। এক চোখে সব দেখে নেয় আর বলে, দেখে নে, সব তো আছে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব আছে, ঘাসে বোনা চাট্টিটা, গলাভাঙা বোতলটা, টিনের কুপি। খবর আছে ভিখারী।
কি?
দোরা তো ভেগে গেল।
কোথায়?
সুমাদি। হাটে বসলে বেশি পয়সা। আর ল্যাংড়া কি করছে জানিস? দালিকে তাড়িয়ে দিয়ে আরেকটা মেয়েকে এনেছে।
তুই?
আমাকে কে নেবে বল্? এক চোখে দেখি না, দুচোখ কানা হলে পয়সা বেশি। আর তত বুড়োও হইনি। তাই মানুষ বলে, খেটে খেতে পারিস না? কম খাঁটি? যাই না তোহরিতে? হাঁটি না অতটা পথ?
সেই তো।
বাপ্ রে, কত ছাগল হ'ল?
কালই বেচতে বেরোব।
নওয়াগড়ে আরো খবর।
কি?
রাজাসাহেবের কি মিলেছে সরকারের কাছ থেকে। তাই খুব হইচই, আর খাওয়া-দাওয়া। সন্ধ্যেবেলা কব্জি পুড়বে।
তোদের মজা।
না না এরা কি সে রকম, যে না খেয়ে ফেলবে এঁটো পাতে কিছু? আমরা খেতে পাব? সে খেয়েছিলাম তোহরির বৈজনাথ লালার মা মরে গেলে। এত এত পুরি-কটৌরি।
হ্যাঁ হ্যাঁ।
কোথায় যাস?
একবার সুখচাঁদজীর কাছে যাই।
সুখচাঁদজী ওকে দুসাদ আর ছাগল চরৈয়া বলে ঘেন্না করে না। নওয়াগড়ে ঢোকার পর কেউ ভিখারীকে জিগ্যেস করেনি কি ভিখারী! এতদিন কোথায় ছিলি?
সে যে থাকে, তাও কারো চোখে পড়ে না। সে যে এসেছে, তাও কারো চোখে পড়ে কা কিয়া যায় মহারাজ? এ তো হয়েই থাকে, হয়েই চলে। ছাগলের মাংস, দুধ, এসব না।
জোগাবার জন্যে ভিখারীকে দরকার। অত্যন্ত সস্তায় মাংস ও দুধ জোগাবার জন্যে। কিন্তু তা বলে তাকে হিসেবের মধ্যে আনা? ন না তা হয় না। এ কাহিনী ব্লুড় পুরনো। নওয়াগড়ের মাটির চেয়েও পুরনো।
সুখচাঁদের ইস্কুল আজ ছুটি, ছুটি, ছুটি। সুখচাঁদ বসেছিল বটগাছটির নিচে। নওয়াগড়ের গয়লারা খুবই সম্পন্ন লোক। মোতিহার ও ভকত বসে কি যেন শুনছিল। বয়েস কম, বোঝাবার উৎসাহ আছে, সুখচাঁদ ওদের খুব বিশদ করে কি বোঝাচ্ছে। এস এস ভিখারী, কবে এলে?
আজ ভোরে সুখচাঁদজী।
ভাল আছো?
রামজী যৈসে রাখেন। আপনি ভাল?
হ্যাঁ ভিখারী। বোস বোস।
ভিখারী তীরু হেসে দূরে বসল হাত জোড় করে। গয়লাদের পায়ে মোটা নাগরা, কানে পেতলের রিং, হাতে লাঠি, মাথায় পাগড়ি, ওদের ভয় করে ভিখারী। মোতিহার ভিখারী দুসাদকে আমলই দিল না। বলল না না সুখচদির্জী আবার বলুন। প্রথম থেকে?
হ্যাঁ হ্যাঁ।
বললাম তো।
তবু বুঝছি না। রাজাসাহেবের খাস জমি দিয়ে রেল লাইন বসল, বাস রাস্তা হ'ল, এতো হয়েই থাকে। কি ভকত। সরকার কি আকাশ দিয়ে লাইন টানবে, বাস রাস্তা বানাবে, তা কি হয়?
হ্যাঁ হ্যাঁ মোতিহার, ঠিক ঠিক। তার জন্যে রাজাসাহেব মামলা করল কেন? ওই কথাটাই আমি বুঝছি না। সুখচাঁদ বলল, কেন করবে না? দেখুন, ও জমি কার ছিল? রাজাসাহেবের ছিল? নিশ্চয়। আরে কত কত জমিন। সে জমিতে রাজাসাহেবের হক ছিল?
একি কথা জী! নিশ্চয় ছিল? এই নিজের সম্পত্তির ওপর যে হক, এর নাম ভারতীয় সংবিধানে এক মৌল অধিকার। মৌল অধিকার সাত রকম। আর সংবিধানের কর্তব্য হ'ল প্রতি ভারতীয় নাগরিকের মৌল অধিকার রক্ষা করা।
কা তাজ্জব! "মৌল অধিকার" কোই বুরা বাত না হ্যায় জী?
ঠিক বাত হ্যায়? কেসে হো বুরাই বাত? য়ে খেয়াল আপকো কৈসে আয়া, হাঁ মোতিহারজী? মোতিহার বলল, তখন বাটাইদারবা চেঁচাচ্ছিল "মৌল অধিকার" বলে, উসিসে না পুলিস আয়ি?
নেই নেই, যো তো আইন-শৃঙ্খলা কা বাত আ গিয়া থা না? ইস লিয়ে আয়ি পুলিস। মৌল অধিকার কি রকম হয়?
সুখচাঁদ খুব খুশি হয়। কেননা বিদ্যা জাহির করার সুযোগ মেলে তার। আঙ্গুলের কড় গুণে গুণে সে বলে চলে, প্রথমে হ'ল সাম্যতার মৌল অধিকার। জাত কি পাত, ধর্ম, কোনো কারণ দেখানো চলবে না। সবাই সমান। এ সব কারণে কারো ওপর অবিচার হতে পাবে না। এর নাম প্রথম মৌন অধিকার।
এ কথা লেখা আছে? নিশ্চয়।
মোতিহার সতো বিশ্বাসের তেজে সদর্পে বলল, সে জরুর আংরেজের লেখা। জাত-পাত-ধর্ম তফাত থাকবে না? আমি আর ভিখারী দূসাদ সমান?
নিশ্চয়। সংবিধান বলছে।
তবুও তা ঝুট। এ তো চোখেই দেখা যাচ্ছে সব সময়ে। জাতের কারণে ভিখারী দুসাদকে কোনো উঁচা জাতের লোক ঘরে উঠতে দেবে না, ওর ছোঁয়া জল খাবে না। এ নিশ্চয়ই কোনো দুশমনের বানানো কথা। কেন সুখচাঁদজি? জবাহরজী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, ইন্দিরাজী ছিলেন। আমরা তো কখনো এ সব কথা শুনিনি আর চোখেও দেখিনি দুসাদ আর বরাস্তোনকে কেউ সমান মান দেখাচ্ছে। সুখচাঁদ মৌচাকে ঢিল মারে না। ওর সাধ্যমত সরল ভাষায় স্বাধীনতায় মৌল অধিকার কি কি, তা বোঝাতে চেষ্টা করে।
এখন ভকত বলে, ঝুট বাত।
কেন?
যে যা কাজকাম করবে, তার স্বাধীনতা আছে?
নিশ্চয়।
মুসলমান যা খায়, তার বেওসা করতে পারবে নওয়াগড়ের কেউ, করতে দেবে?
সুখচাঁদ হাসে। তারপর বলে, অন্যগুলোও শুনে নিন। তারপরে বলি, আমি তো সন্ধ্যাবেলা সাবালকদের পড়াই, ক্লাস নিই। আপনারা আসুন, অন্যদেরও আনুন। পড়তে শিখলে আপনারা
তো নিজেরা পড়তে পারবেন।
কি করে হয়? এই বয়সে?
লেখাপড়ার কি বয়স আছে?
জরুর।
কি আর বলব! নিন শনুন
। 'খুব মন দিয়ে শোনে মোতিহার ও ভকত।' ভিখারী একবারও মুখ খোলে না। শুনে যায় মৌল অধিকারগুলির কথা এবং সুখচাঁদকে সসম্ভ্রমে দেখে।
এখন মোতিহার বলে, ওই শেষ কথাটা, হাঁ, কারো সম্পত্তি সে যাই হোক না কেন, তা থেকে তাকে বঞ্চিত করা চলবে না, হাঁ ওটা ভাল লিখেছে।
এই কারণেই রাজাসাহেব ছ' লাখ টাকা পেলেন।
ছয় লাখ!
ছয় লক্ষ টাকার কথা ভিখারীর মনে কোন ভাবান্তর ঘটায় না। কেন না ছয় লক্ষ টাকা যে কত টাকা, সে বিষয়ে তার কোন ধারণা নেই। মোতিহার ও ডকত কিন্তু থ মেরে যায়। ছয় লক্ষ টাকা!
সুখচাঁদ নিম্ন প্রাইমারী শিক্ষকের অনুমোদিত বেতনহারে মাইনে পায়। টাকার অঙ্ক তার মনেও কোন ভাবান্তর ঘটায় না। সে এখন মৌল অধিকার বোঝাতে চেষ্টা করে।
সেই কথাই তো বলছি। রাজাসাহেবের তো তাঁর জমির ওপর ছিল মৌল অধিকার। সরকার যখন লাইন পাতল, রাস্তা কাটল সে জমি দখল করে, তখন তো সে অধিকারে চোট দিল।
কৈসে?
আরে, অনুমতি তো নেয় নি। ভেবেছিল ওটা সরকারী জমিই চলছে। গোল হয়েছিল কোথাও।
হাঁ হাঁ, তারপর?
রাজাসাহেব সাবালক হয়ে কেস করল।
কার নামে?
রেল বিভাগ, পূর্ত বিভাগ। সে কেসে জিতে গেল?
নিশ্চয়।
ওই কথাটাই ভাল, সম্পত্তিতে মৌল অধিকার। তবে তো তা শুমিন হতে হবে, তাই নয়?
না না ভকতজী। কি বলি! দেখুন না, আপনার সম্পত্তি, ঘর- গরু-মোষ-আসবাব-বাসন, সব্। মোতিহারজীরও তাই। আমার সম্পত্তি এই কাপড়জামা-খাটিয়া-বইগুলো। ভিখরীর সম্পত্তি ওই ছাগলগুলো। স্থাবর-অস্থাবর সবই সম্পত্তি। সে কেউ কেড়ে নিলে ক্ষতি-পূরণ দিতে বাধ্য।
বুঝলাম। খুব শান্তি হল সব কথা জেনে। আসবেন আবার।
বিদায় নেবার সময়ে মোতিহার বলে, এবার একটা বিয়ে করে নিন। আপনার জাতির মেয়ে নওয়াগড়ে আছে, আর ক্ষেতী-ভৈসা-হাল-সাইকেল সব দেবে।
না না।
চলি সুখচাঁদঞ্জী?
হ্যাঁ জী।
ওরা চলে যায়। এখন ভিখারী যেন কোন নতুন কথা জেনে তার আঘাতে বির্পযন্ত।
সুখচাঁদনী।
বল ভিখারী।
ও কথা যে আপনি বললেন, ও সত্যি?
সত্যি।
ও মৌলা অধিকার?
মৌলা নয়, মৌল।
আর আমি ভাবতাম, ও বাটাইদারদের নারা উঠাবার কথা এক। ওরাও তো ও কথা
বলেছিল।
হ্যাঁ ভিখারী।
রাজাসাহেবের জমিন তাঁর সম্পত্তি?
হ্যাঁ।
আবার আমার বকরা-বকরি আমার সম্পত্তি?
নিশ্চয়।
তো রাজাসাহেবে কা জমিন ছিন্ লি সরকার, ঔর না জানে কিনা রুপয়া দি? হ্যাঁ।
তো আমার বকরা বকরি তুলে নিয়ে যায় পুলিস, সুখচাঁদস্লী! ওহি ডরে আমি ভেগে যাই জঙ্গলেতো আমার বকরা-বকরি নিয়ে যায় পুলিস, আমি তো কখনো এক টাকাও
পাই না? তা সরকার ভুলে গেছে পুলিসকে ওই মৌল অধিকারের কথা বলতে? সেটা তো জুলুম কবে ভিগান্ধী।
তবে রাজাসাহেব যে টাকা পেল সুখচাঁদজী, শুধু রাজাসাহেব আর বড়মানুষরা পায়? বেদনার্ত হেসে সুখচাঁদ বলে, কাজে হয়তো তাই দাঁড়ায় ভিখারী। কিন্তু সংবিধানে তাল কথাই লেখা আছে। আমি তো বললাম তখন।
হম্ কা জানে সুখচাঁদজী কা লিখা হ্যায়।
রাজাসাহেব যে পেলেন, সেও মামলা করে। সংবিধানে এও লেখ্য আছে যে, মৌল অধিকার নষ্ট হলে তুমি মামলা করতে পার।
আমি? আমি কি করে মামলা করব সুখচাঁদজী? আমি মামলার কি জানি? পুলিস ছাগল নিলে কোনো দুসাদ তার নামে মামলা করতেও পারে না।
সুখচাঁদ বলে, করতে পারে, করার হক আছে।
কৈসে?
মানে হক আছে।
টাকা কোথায়? সাহস কোথা দুসাদের? ও হকের কথা আমি বুঝি না সুখচাঁদজী। উসিসে কুছ কাম তো হোতা নেই!
তাও সত্যি। কি যে বলি তোমায়.......
কি আর বলবেন?-সুখচাঁদের বিভ্রান্তি ও বিব্রত ভাব দেখে হঠাৎ ভিখারী ওকে ভরসা দিয়ে হাসে। বলে, আপ কা করিয়েগা? ধরতি মে যো হি চলতা হ্যায় ওহি চলতে রহবে, হায় কিন?
তা নয় ভিখারী। যা লেখা আছে তাই ঠিক। সেগুলো কাজে দাঁড়ায় না, কেন-না গলত্
আমাদের মধ্যেই। এতো আমাদেরও কাজ, তাই না?
আমি বুঝি না। মোতিহারজী ঔর ভকতজী, বাপ রে! কত কত গরু আর মোষ ওদের। ওরা তো অনেক জানে। ওরা যা বলল, তাই ঠিক। জাত পাত কি সমান হয়?
সুখচদি নিজে ভিখারীর ছোঁয়া খাবার কথা ভাবতেও পারে না, কিন্তু তার ধারণা, সে জাত-পাত, ছুঁয়াছুঁতে অবিশ্বাসী। কেন-না ছাপা বইয়ে লেখা আছে জাত-পাঁত, ছুঁয়াছুঁত মিথ্যা, আর ছাপার অক্ষরে তার বিশ্বাস খুব। সেই বিশ্বাসের ভোরে সে বলে, এ সব গেঁয়ো লোকের বিশ্বাস। না জবাহরজী তা বিশ্বাস করতেন, না ইন্দিরঞ্জী।
তবুও তো হুয়াহুত আছে, হ্যায় কি ন। আর থাকবেই। দেখুন না, এতো ভগবানের সৃষ্টি। রামজী অওতার' কাকে বানালেন বরান্তোন, কাকে বানালেন দুসাদ, ইসিসে ছুঁয়াছুতও চলতা হ্যায়। আমি তো কিছুই জানি না। কিন্তু টাহাড়ের দেওতা হনুমান মিশ্র তো এক আচ্ছা বরাস্তোন, হায় ন? উনি দুসাদের ছায়াতে কখনো পা ফেলেন না। ওর সঙ্গে তো মহাদেব বিশ্বনাথের বাতচিত হয়। দেওদেওতার ইচ্ছা উনি জানেন।
সুখচাঁদ নাচার হয়ে হাল ছেড়ে দেয় ও বলে, বল ভিখারী, কেমন ছিলে? এখন ভিখারীর মুখ আলোকিত হয়। হেসে ও বলে, ভালই ছিলাম। এত ভাল থাকব ভাবিনি। আর সব চেয়ে ভাল কি, বকরা বকরি দশটা হয়েছে। দশটা! বল কি?
বকরা দুটো জোয়ান। তা পনেরো-ষোল সের মাংস হবে। হাটে মাংস বেচে আট টাকা সের। যদি ছয় টাকা সেরেও কেনে গোটা মাল, তবে? দুটোতে প্রায় দুশো টাকা পাবে।
দুশো টাকা!
হ্যাঁ ভিখারী।
ভিখারীর চোখ জলে ভরে আসে। বলে, সেই আশীর্বাদ করুন সুখচাঁদজী। দুশো টাকা পেলে আমার সব দুঃখের আসানী মিলে।
কৈসে?
কৈসে নহী? দেখুন না, তাহলে বিয়েও করতে পারি। সংসার হয় নিজের। দুসাদ মেয়ে খাটেপিটে জী। বকরা-বকরি নিয়ে জীবন চলে যাবে। একটা কোপড়ি তুলে নেব কোথাও। বাসনকোসন হবে, সংসার যেমন হয়।
তোমার ঘর কোথায় ভিখারী?
সেই বিষ্ণুপাড়া ছাড়িয়ে।
কেউ নেই তোমার?
হোক, তোমার ভাল হোক।-আন্তরিক শুভেচ্ছায় বলে সুখচাঁদ। ভিখারীকে খুব আপনজন মনে হয় ওর।
চলি সুখচাঁদঞ্জী।
এস।
আজ না কি বাজি পুড়বে?
শুনছি তো তাই।
ভিখারী রওনা হয় ঘব-পানে। মনটা কেন যেন ভাল লাগে ওর। বকরা বকরিগুলিকে আদর করতে সাধ যায়। পুলিস ওর একটা উপকার করে গেছে। নওয়াগড়ে পুলিস-চৌকি না বসলে ও পালাত না বাড়া।
বাড়া গিয়েছিল বলে রাঁকার মদত পেল। সে মদত পেল বলেই ছাগল বেড়ে বেড়ে দশটা
হল।
পথে ও কিনে নিল আটা, লবণ, মরিচ, শুকনো কচু। লালাকে বলল, ভাল আছেন সালাজী?
লালা ওর কথার জবাবও দিল না। রামধারী ঠিকাদারদের কথা শুনতেই বাস্ত থাকল। সওদা নিতে নিতে ভিখারী শুনল, বাজি পোড়ানো হবে "পূবমহল"-এর সামনের মাঠে। সন্ধ্যাবেলা। পাঁচ হাজার টাকার বাজি পুড়বে। শুনে ও ঠিক করল, সন্ধ্যাবেলাই বাজি পোড়ানো দেখতে যাবে। এখন ও একটা ছোট কাপড়কাচা সাবানও কিনল। সাবান দিয়ে কাপড়টা কেচে নেবে।
কচুর রাখবে শুকনো ঝাল, রুটি বানাবে কড়া সেঁকা। আজ আর কাল দুদিন চলে যাবে। দুশো টাকা। ল্যাংড়া যদি আরেকটা মেয়ে আনতে পারে, ভিখারীও পাবে একটা বউ। প্রথমটা বকরি চরাতে হবে। তারপর বলা যায় না, হয়তো জমি পেতে পারে কিছু। বিয়ে করলে আত্মীয়-বন্ধুর সমাজ পাবে একটা ভিখারী। তারাও সাহায্য করবে। একা একা পারা যায় না-কি? বাড়া-টাহাড়-নাড়া আরো আরো রঙ্ক মানুষের মদতে ও সাহচর্যে মনে ভোর থাকে কত।
কাপড় কেচে নিল ভিখারী। রাঁধতে বেলা গেল। খেতে সূর্য ডুবল। ছাগলগুলি গুণে গুণে বাসে ওঠাল ও। ঝাঁপ টেনে দেবে, এমন সময়ে ওরা এস।
রাজাসাহেবের সেপাই, দুজন পুলিস।
পুলিস।
ভিখারী ভীষণ ভয়ে ঝাঁপে পিঠ রেখে দাঁড়াল। এ কি ব্যাপার? পুলিসচৌকি নেই, পুলিস নেই, সেই জনাই তো নওয়াগড়ে ফিরেছে ভিখারী। পুলিস?
কা ভিখারী? ডর গৈল্ কা?
সেপাই গজানন হাসল। মুখে মদের গন্ধ
। দো বকরা নিকাল। রাজাসাহেব পুরা থানাকে নেমন্তন্ন করে বসেছে, কাঁহা মিলে গোস্? নায় নায়। বকরা না হ্যায়।
তত্ত্বকরি নিকাল।
এ্যায়সা ন করিও সিপাই সাহেব, গোড় লাগি, গোড় লাগি তুমহারা। ওহি হামারা জীউ-জীবন হায় দেওতা। ন লিয়া করো।
ভাগ্ শালে দুসাদ!
গজানন হাতের চেটো দিয়ে প্রচণ্ড চড় মারে ভিখারীর মুখে। নাকের চামড়া ও সেটি ফেটে রক্ত করে। ভিখারী তবুও চেঁচায় ওহি পুলিসকে ডরসে মরে হাম, ডাগ যাই বাড়া, ন লিয়া করো সিপাহীজী, ও পুলিস উঠা লেতা বকরি, লেতেছি চত্তা।
কাহে ন লি? রাজাসাহেব পাত্তা চলাই তব পুলিস আই না? গোস্ কা খরিদ খায়েগি? তু রাজাসাহেব কা মলুক র্মে রহত্ হো, ন? চল, ভাগ।
ভিখারী বিপদে পাগল ও উন্মত্ত হয়। বলে, বকরা-বকরি পর হামানি কে ঐসেহি হক্ হ্যায়, যৈসে হক্ থে রাজাসাহেব কা য়ো জমিন পর ঔর জমিন ছিল্ লি যব, উসি হক সে উল্কা রূপয়া মিলি। হাম কাহে ছোড়ে হামানি কা হক?
কা? কা বোলা দুসাদ?
সিপাহী ও পুলিস দুটি ভিখারীকে মারে। দক্ষ নিপুণ পেশাদারী, প্রশাসন অনুমোদিত মার। মারতে তাদের দম ছোটে না ও মারতে মারতে তারা বলে চলে, কথাগুলো শুনেছ ডাই গজানন? বাটাইদার লোক ওই লড়াই করতে গিয়ে এদের হক-টক শিখিয়েছে। পুলিস বকরা খাবে না শালা? কোন খাবে শুনি? পুলিস খাবে না? ই ভাই গজানন, এ তো আরেক রাজাসাহেব নওয়াগড়ে। রাজাসাহেবের জমিনে হক আর এর বকরায় হক না-কি একই?
মেরে-ধরে রক্তাক্ত ভিখারীকে ফেলে রেখে গুবা ঝাঁপ খোলে বকরা ও বকরি চারটিই নিয়ে চলে যায় মহোল্লাসে।
ভিখারী পশুর মত কাঁদতে থাকে, কাঁদতেই থাকে। নড়তে পারে না যন্ত্রণায়, ও কাঁদে বঞ্চনার বেদনায়। মিথ্যে কথা, সব মিথ্যে কথা সুখচাঁদজীব। বকরা বকবিতে তার যে অধিকার, সেও এক মৌল অধিকার? সম্পত্তিতে অধিকার সপ্তম মৌল অধিকার? মৌল অধিকার যাতে ক্ষুন্ন না হয় তা দেখে ভারতের সংবিধান? মিথ্যে কথা, সব মিথ্যে কথা। ভিখারীর মৌল অধিকার যে বারবার ক্ষুঝ হয়? রাজাসাহেবের ক্ষতিপূরণ মেলে, ভিখারীর মেলে না কেন? রাজাসাহেবকে ছয় লক্ষ টাকা দিলেই ক্ষতিপূরণ হয়। ভিখারী মুসাদের বকরা-বকরি নিয়ে বাঁচবার মৌল অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে তাকে নিরাপত্তা দেবার ক্ষমতা ভারত সরকারের নেই, সে জন্যই ভিখারী ক্ষতিপূরণ পায় না!
গায়ে কাদের শীতল ছোঁয়া। কানী ও ল্যাংড়া, ল্যাংড়ার মেয়েমানুষ ভিখারীকে ধরাধরি করে সরিয়ে আনে। ল্যাংড়ার মেয়েমানুষ ন্যাকড়া ভিজিয়ে ওর গা থেকে রক্ত মোছে। কানী মোছে মুখের রক্ত। ল্যাংড়া বলে, পানি পিলে ভিখারী
ল্যাংড়ার মেয়েমানুষ বলে, চুন নিয়ে আসি আমি। চুন দিলে রক্ত বন্ধ হবে, বাথাও হবে না।
তিন ভিখিরি ডিখাবীর পরিচর্যা করে। ক্ষত শুকোতে, উঠে দাঁড়াতে ভিখারীর দিন দশেক যায়। তারপর তিখারী বলে, চল্, ল্যাংড়া, বাচ্চাগুলো বেচে দিয়ে আসি। যা মিলে!
কুড়ি টাকায় চারটি বাচ্চা বেচে দেয় ভিখারী। ওর কোমর। আর সোজা হবে না, ক্ষতবিক্ষত মুখে চিহ্ন থেকে যাবে মৌল অধিকার রক্ষায় প্রথম ও শেষ প্রতিবাদের পরিণামের। মাথাটা কামিয়ে ফেলতে হবে ঘা শুকোলে।
অর কা করব, হাঁ ভিখারী?
ভিখ মাতত্ত্ব।
ডিস্।
হাঁ, ডি মাঙ্য
ইহা।
নায়।
মাথা নাড়ে ভিখারী। ওদের টাকা দেয় তিনটে করে। লালার দোকানে শোধ দেয় হয় টাকা। ছাগল বাঁধা দড়ির দরুন মোতিহাবের চাকরকে শোষ দেয় দু'টাকা। তিনটি টাকা টাংকে
গোঁজে। গাছের ডাল চেঁছে লাঠি বানিয়ে নেয় একটা। তোহরির হাট থেকে বাটি কিনবে
একটা। ভিক্ষাপাত্র। ছ' আনা নিলামে, এক টাকা নিলামে, যা মেলে।
সুখচাঁদ ওকে দেখে দাওয়া থেকে নেমে আসে। ঘটনাটির কথা ও শুনেছে। ভিখারী!
চলে যাচ্ছি সুখচাঁদকী
কোথায়, ভিখারী কোথায়?
যেখানে ভিখ মিলবে।
ভিখ! ভিষ মিলবে।
হাঁ সুখচাঁদজী।
কিন্তু তোমার গায়ে তো এখনো......
এই কথা! কা কিয়া যায় মহারাজ? আপ তো ঝুট বোস দিয়া হমানি কো। মেরে লিয়ে তো য়ো মৌলা অধিকার হ্যায়ই নহী। সিরিফ রাজাসাহেব কা লিয়ে হ্যায়। চলে সুখচাঁদজী। লাঠির ভরে চলে তিখারী দুসাদ। ধীরে ধীরে। পরম নির্ভয়ে। এখন পুলিস দেখলেও ভয় পাবে না ও। বকরা বকরি, জমি, বাসনবর্তন, দুসাদের সম্পত্তি থাকলে পুলিসকে ভয় করতে হয়। পালাতে হয় জঙ্গলে। তেমন দুসাদ দেখলে, হাঁ, পুলিস জরুর মারেগি, ছিন্ লেগি সব। নিঃস্ব রঙ্ক ভিখিরী দুসাদ দেখলে পুলিস মারবে না। কখনো মারবে না। ভিখারীর এখন মনে হয়, এই কথাটা জানত না কেন ও? মাতৃভূমিতে দুসাদ যদি রাজাসাহেব, লালাজী, পুলিস, হনুমান মিশ্র সকলের ক্ষমা পেয়ে বেঁচে থাকতে চায়; তার একমাত্র পথ হল তিখমাস্তা হয়ে যাওয়া? যেসব দুসাদ বকরি-চরৈয়া ভিখারী দুসাদের মত মাতৃভূমি থেকে মানুষের মত বাঁচার রসদ খুঁজতে যায়, তাদের ওপরেই তো বেগে যায় ওরা।
নিজেকে একলাও লাগে না ওব। কোথায় নেই ডিখমাঙা? কানী-ল্যাংড়া-দোরারা সব জায়গায় আছে। এখন ভিখারী এল্টা বড়, মস্ত বড় সমাজের সদস্য।
সুখচাঁদ ওর দিকে চেয়ে থাকে। দেখে ভিখারী দুসাদ সাত নম্বর মৌল অধিকারে বঞ্চিত হলেও, তিন নম্বর মৌল অধিকারের প্ররক্ষা পেয়েছে। স্বাধীনতার অধিকার। যে-কোনো বৃত্তি বা জীবিকার অধিকার। ভিখারী ভিখমাঙার বৃত্তি নিয়েছে। ও যাতে জন্ম জন্মকাল তিখমাকাই থেকে যায়, ভারতের সংবিধান তা নিশ্চয় দেখবে। ওকে উন্নততর জীবনে ও জীবিকায় যদি কেউ উত্তরিত করতে চায়? মৌল অধিকারে সে হস্তক্ষেপ ভারতের সংবিধান সহ্য করবে না। ভারতের যেখানেই সে অন্যায় ঘটুক, ভারতের সংবিধান সেখানে নামিয়ে দেবে পুলিস, রিজার্ভ পুলিস, সামরিক পুলিস, সেনাবিভাগ, ট্যাঙ্ক, জঙ্গীবিমান সব।
ভিখারী দুসাদ পা ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে পথের মোড়ে অদৃশ্য হয়। এখন আর তার কিছু হারাবার
নেই।