ডাদ্রমাসে রান্নাপূজার দিন এসেছে, এ সময়ে গৃহস্থমাত্রেই মনসাগাছ খোঁজে। রূপসী বাগদিনীর ছেলে চিনিবাস মনসাগাছ খুঁজতে গেল। মনসাগাছ নিয়ে পূর্বস্থলীর গৃহস্থরা উঠোনে পৌঁতে। মনসা বাস্তু। মনসা ক্ষেতে ধান, গাইয়ের পালানে দুধ, পুকুরে মাছ, গৃহস্থ বউয়ের কোলে ছেলে দেন। কিন্তু ঘরে ঘরে মনসাগাছ থাকে না। রান্নাপূজার পরদিন অরন্ধন।
'মা, রান্নাপুঞ্জা করবি না?' চিনিবাস জিগ্যেস করেছিল।
'না বাপ, এবার আমাদের রান্নাপুজা নেই।'
'কেন মা?'
'ই সনে তোর কাটোয়ার জ্যেঠা মরেছে না?'
'তোকে বললে কে?
'আমি জানি।'
চিনিবাস অবাক হয়ে ডাবল, এ কেমন কথা হল? গতবছর তো রান্নাপূজার দিন মা পিদিম খেলে বসে কত কি রেঁধেছিল। শোল মাছের টক, নারকেল দিয়ে কচুশাকের ঘণ্ট, তিতোপুঁটি ভাজা, সরলপুঁটির ঝাল, ময়ামাহ আর বেগুনের ঝোল, চালবাটা দিয়ে ঢেঁকিশাক, পিটুলি দিয়ে পাট পাতার বড়া আর তাসবড়া । পরদিন দু'বেলা ধরে চিনিবাস তাই খেয়েছিল।
এ-বছর বড় কষ্ট, এদিকে গঙ্গায় বান ওদিকে ঘোড়ে নদী টুবুটুকু। চিনিবাস শুনেছে অঞ্জনা নদীতে তিন খানা বাঁশ ওপর ওপর রাখলে ডুবে যায় এমনই ভাসাভাসি। সবাই বলাবলি করছে বান আসবে। বান কেমন জিনিস তা চিনিবাস দেখেনি। চিনিবাসের মা যখন ছোট ছিল তখন নাকি কাটোয়ার গঙ্গাতে বান এসেছিল।
চিনিবাসের মা নারকেলপাতা চেঁছে কাঠি বের করছিল। অন্তত দশটি নতুন ঝাঁটা বেঁধে দিতে হবে, নইলে আচার্যবাড়ির কাজ চলবে না।
'মা বান কেমন করে আসে গো?' চিনিবাসের কথা শুনে রূপসী বড় বিরক্ত হল। বলল, 'দেখিস এখন।'
রূপসীর মা গাবগাছের আঠা দিয়ে বাঁশের মাছধরা পলো পালিশ করছিল, সে বলল, 'দেখবি রে দেখবি, বান হবে, মড়ি হবে, মানুষ নিয়ে শেয়াল-শকুন ছিঁড়ে খাবে। 'উ কি কথা মা?' রূপসী মৃদু ধমক দিল।
'নেয্য কথা লো নেয্য কথা! পিঁপড়ে পতঙ্গ ভেসে যাবে, হাতী-ঘোড়া জীয়ে থাকবে, এ হল শাস্তরের কথা।'
'তবে যে সবাই বলতেছে ই বানে কেউ মরবে না?' চিনিবাস আবার জিগ্যেস করল। 'ও গোরাপ্রেমের বানের কথা? উ আমি জানি না বাবু। আমি তো শুনলাম শান্তিপুর-কাটোয়ার জনমনিষ্যের আর আনকথা মুখে নাই। শুনে আমি হেসে বাঁচি না। হাটে যেতে দেখি সবাই এক কথা বলে। আমি যাকে শুধাই কথাটি কি গো? সেই বলে, আ লো বাগদীবউ, কি যে কথা সে তো আমরা বুঝি না। শুধু শুনি গৌরাপ্ত সন্ন্যাসী নাকি উঁচুকে নিচু আর নিচুকে উঁচু করবে বলে লেচে বেড়াচ্চে। শুনে তো আমি শুধাই, হাঁ গো, তবে কি আমরা ঠাকুরদের পুকুরে জল সরব, উনাদের মত পালঙে শোব, খইমুড়ি যা মন হয় তাই খাব? তা যদি না হয় তবে আমি পোরাপ্রেমের বানে ভাসব কেন? আমায় সবে খুব মূখ নাড়লে, আমি বকনা বাছুরটা খুঁজে নিয়ে চলে এলাম। ই আবার কোন বান বাবা?'
'মা!' রূপসী গলা তুলল।
'আ লো দেখিস! অঙ্গ যে রসে গেল।"
'তুই তো মা গৌরাঙ্গ দেখিসনি?'
'দেখতে যাব কেন লো? গৌরাপ্ত কি আমায় রাঙ্গা করবে?'
'তবে যা মাছ ধরগা যা!'
'আ লো, রূপের গোমর করিস না। মাছ ধরা আজ মন্দ কাজ হল। এই মাছ ধরে ধরে তোকে এত বড়টা করেছিলাম।'
চিনিবাস দেখল বাতাস বেগতিক। সে মনসাগাছ নেবে কি না জানবার জন্যে বাতাসের আগে আচার্যবাড়ি গেল।
পূর্বস্থলীর আচার্য পরিবার বড় ধার্মিক সচ্ছল গৃহস্থ। এই 1435 শকাব্দে কম গৃহস্থেরই ক্ষমতা আছে যে, নিত্য কাঙালী ডোজন করায়। কিন্তু বড় আচার্যের উঠোনে বেলা দুপুর পর্যন্ত এখনো একশতটি পাতা পড়ে। নবদ্বীপের গৌরাঙ্গ সন্ন্যাসীর সংবাদ এখন বাতাসের আগে ধায়। এখন তিনি গৌড় থেকে শান্তিপুর গিয়ে মাতৃদর্শন করে আবার নীলাচলে চলেছেন।
বড় আচার্যের ইচ্ছা যে এ পথ দিয়ে নিমাই গেলে তাঁব বাড়িতে দুটি দিন রাখবেন। 'আ গো কেন?' তাঁর আচার্যানী জানতে চেয়েছিলেন। বড় আচার্য তো সিরস্তদার, পোতদার, ধনীমানী মানুষ দেখলে তবে সম্মান করেন। যুবক সন্ন্যাসীকে এ সম্মান কেন? 'কেন! কেন কি গো? আমি দশজনকে ডাত দিই কেন?'
'পুণ্য কর।'
'পুণ্য কর! একে বলে স্ত্রী-বুদ্ধি। দশজনকে ভাত দেও, কাপড় দেও মানুষ তোমায় মাথায় করে রাখবে।'
'গৌরাঙকে সম্মান করো কেন?'
'ও গো, গৌরাঙ এখন নতুন নতুন গো! মানুষ এখন গৌরাঙের নামে সত্বর মজ। যে জন গৌরাঙ ভজে তার এখন সমাজে সম্মান। শান্তিপুরের তাঁতি বেটারা অব্দি গৌবাও যখন নগরে গেল, তখন কাঙালীরে কাপড় বিলিয়ে নাম করল। শামি যদি করি আমার ভাল হবে।'
'আ গো আপনি তো অধিক ব্যয় করতে ওরাও। তা গৌরাঙ সন্ন্যাসী আসবে, তাব
চেলাচামুণ্ডা এতগুলি! ব্যয় হবে কত আমি সে কথাটি ভেবে মরি।' 'আরে স্ত্রী-বুদ্ধি! গৌরাও এখন কৃষ্ণনামে মেতে রয়েছে। সে মানুষ একবার আাসবে, একবার নয় বায় করব। তুমি বোঝ না। এতে আমার নামতাক দশদিকে যাবে।' 'তিনি নাকি মানুষ ডেকে ডেকে আচণ্ডালে কোল দেয়? এ কথাটি জেনে আমি অবাক যাই গো!'
'কোন্স দিলে কি? কোল তো উনির সঙ্গে যাবে। উনি গেলে তবে চাঁড়াল বাগদী আবার যেমন ছিল তেমন রইবে। তোমার এত কথায় কাজ কি? যাও না, রান্নাপূজার কাজে যাও না!'
বড় আচার্যানী নিশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলেন। আচার্য তো বলেই খালাস। বসে বসে শত শত লোকের রান্না করেন, এখন কি তাঁর সেদিন আছে? সকলের রান্না সেরে ভাত খেতে খেতে সন্ধ্যে হয়। উনোনে রাতের ভাত-ডাল বসিয়ে দিয়ে তবে তিনি খেতে বসেন।
'কে রে?'
উঠোনের এক কোপে চিনিবাস এসে দাঁড়িয়েছে।
'আমি চিনিবাস গো!"
'কে?'
'উপসী বাগদিনীর বেটা। আপনাদের কি মনসাগাছ এনে দেব মা, শুযোলে!'
বড় আচার্যানীর সর্ব-অঙ্গ জ্বলে গেল। কি অলক্ষণ কি অপয়া তাই দেখ! এখন ঠাকুরের ভোগ দিতে যাবেন, এখনি বাগদীদের ছেলেটা মুখ দেখাল?
'এই এত বড় গাছ গো!'
চিনিবাস হাত দুটি তুলে দেখাল। রান্নাঘরের দোর দিয়ে গরম ভাতের গন্ধ আসছে। বামুন-মা ডালের হাঁড়িতে কতখানি কবেই না ঘি ঢালে। দুধ দিয়ে সাদা ধপধপে লাউয়ের শুক্তো কাঁধে আর মূলো-বড়ি-নারকেলের ঘন্ট। সব ঘি-চপচপে, সম্বরার সুবাসে ম-ম। কতদিন চিনিবাস গরম ভাত খায়নি। কতদিন বামুনবাড়িতেও খায়নি।
'সে পরে বলব' খন, এখন বাড়ি যা।'
'বামুন-মা, রান্নাপুজো কবে গো??
'সোমবার।'
'কচুশাক এনে দেব?"
'না বাপু তুই যা!'
এই ছেলে বামুন-মা বলসে আচার্যানীর অঙ্গ জ্বলে। রূপসী বাগদিনীর মত গরীব এ পূর্বস্থলীতে কেউ নেই। খেতে পায় না, মাথার চুল জট বাঁধা, তবু রূপ মরে না ওর। ছেলেটাও চাঁদপানা। আচার্যানী ছেলে ছেলে করে এত বার ব্রত পুজো করে কালোজিরের মত কয়েকটি মেয়ে পেলেন বলেই না ছোট আচার্যানীকে আনলেন কর্তা!
'যেন চোখ দিয়ে গিলে খায়।'
আচার্যানী চোখ সরু করে দেখলেন চিনিবাস কোথায় দাঁড়িয়ে। উঠোনের কোপে ঐ 'আতাগাছটি হল সক্ষ্মণের গণ্ডী। বাগদী বল, জেলে বল, গেবস্ত সংসারে সকলেরই দরকার, তা, সবাই ঐ আতাগাছের ওপারে এসে কথা কয়ে কয়ে চলে যায়। চিনিবাস বুড়ো আঙুলে ভর করে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন দেখতে চেষ্টা করছে। ছোট আচার্যানী ছেলে কোলে করে দাওয়ায় এসে দাঁড়িয়ে আবার টুপ করে ঘরে ঢুকে গেলেন। ছেলেটি বড় ভোগে। চিনিবাসের নজর লাগলে হয়তো আবার ভুগবে।
'ওরে এক পাই মুড়ি দেন গো!' ছোট আচার্যানী ঘর থেকে ডেকে বললেন। মুড়ি নিয়ে খুশি হয়ে চলে যা বাবা, আমার ছেলেটার দিকে তাকাস না। চিনিবাসের চোখ দুটো যেন সর্বদা খাই খাই। এত খিদে ওর কোথেকে আসে কে জানে!
'নে মুড়ি নিয়ে চলে যা'।
চিনিবাসের যে কি ভূত চাপল মাথায় কে জানেও হঠাৎ বড় আচার্যানীকে জিগ্যেস করে বসল, 'হ্যাঁ গো বামুন-মা, সোনার গৌরাঙ্গ এলে আমরা নাকি সকলের সঙ্গে এক দাওয়ায় বসে পেসাদ পার?'
'কি বলসি""
বড় আচার্যানী এখন গলা তুলে চেঁচাতে শুরু করলেন। চেঁচামেচির মধ্যে অনেকখানি হল স্বামীর বিরুদ্ধে আক্ষেপ।
'আ গো, তিনি চাঁড়াল-বাগদী নিয়ে নাচতেছে, নাচুক গা! মনিষা না দেবতা না তিনি কি বস্তু তা কি আমরা জানি? তিনি বান আনতেছে, বানের সঙ্গে ভেসে চলে যাবে গো! আমাদের এই গাঁয়ে জন্ম কাটাতে হবে। আমরা কেন নাচতে যাই?'
রূপসী বাগদীর বিরুদ্ধেও অনেক বিষোদগার ছিল। মেয়েটা মন্দ। ওর ছেলেটা মন্দ, গ্রামের কলঙ্ক একটা।
ছোট আচার্যানী তাড়াতাড়ি এক ঘটি জল আর একখণ্ড মিশ্রী এনে দাঁড়িয়ে রইলেন। কারণে অকারণে বড় আচার্যানী এইভাবেই চেঁচান। চেঁচাতে চেঁচাতে ওঁর মুখে থুথু উঠে যায়। তখন একখণ্ড মিশ্রী আর এক ঘটি জল খেলে উনি শান্ত হন।
চিনিবাস তো কোঁচড়ে মুড়ি কটা নিয়ে দৌড় দিল। ছুটতে ছুটতে শেষ অব্দি খালের ধারে পৌঁছে গেল। খালে জল টুবুটুবু। এত জলে মাছ ধরা যায় না। কিন্তু গেঁড়ি-গুগলি বিস্তর। চিনিবাসের দিদিমার বুঝি নারকেল পাতা চাঁহা হয়ে গিয়েছে তাই গুগলি তুলতে এসেছে। বুড়ি বসে থাকতে জানে না।
'গুগলি তুলে কি হবে আয়ী?'
চিনিবাস আশায়-আশায় জিগ্যেস করল। কবিরাজ মশায়ের শ্বশুরের চোখে ছানি পড়ছে। গুগলির ঝোল খেলে চোখ ভাল থাকে বলে কবিরাজ গিন্নী মাঝে মাঝে বাবার জন্যে গুগলি রাখেন। কখনো চারটি চাল দেন, অথবা একটা কুমড়ো। দিদিমা নাতির কথা শুনে বললে, 'এমনি রে এমনি! কেউ নিলে তো নিলে। নইলে গুগলির শাঁস আর কচুশাক দিয়ে ঘণ্ট রধিব। তোকে মুড়ি কে দিলে? আচাজ্জি বউ?'
'হ্যাঁ।' চিনিবাস তাড়াতাড়ি মুড়ি গালে ফেলতে বাস্ত।
রূপসীর মা, চিনিবাসের দিদিমা এখন কার উদ্দেশ্যে যেন মুখ বাঁকা করে গাল দিল। বলল, 'তখন তো কত কথা, হ্যানো দেব, ত্যানো দেব, কাপড় দেব, সব্বস্ব ভার নেব এখন কি সব ভুলে গেল?' 'কে আয়ী?
'তোর শত্রুর, তোর মায়ের শত্রুর!'
চিনিবাস দিদিমার সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে গুগলি তুলল, যতক্ষণ না হাত-পা জলে ভিজে ভিজে অসাড় হয়। তারপর বাড়ি ফিরতে ফিরতে চিনিবাস বলল, 'এ বন্যে নয়, সেই বানের কথা বল আয়ী।'
'পেলয় বান!' বুড়ি তখনি মাথা নাড়লে।
'কি রকম?'
'তোর মা তখন সোমত্ত মেয়ে। রূপে রঙ্গ ভেসে যায়। সকালবেলা থেকেই গুঁডো-গুঁড়ো বিষ্টি, যেন বাতাসে তুষ উড়তেছে। আর বাতাসের কি ডাক মা!'
'তা বাদে?'
'বান আসতে আমরা সব যেয়ে বড় আচাজ্জির দালানে উঠলাম। কতজন গাছে চেপে রইল, কতজনা ভেসে গেল। মানুষ পোকামাকড়ের মত মরে দেখে বামুনরা সকলকে দালানে-উঠোনে ঠাঁই দিলে।'
'তা বাদে?'
গল্পের এই জায়গাটি চিনিবাসের বড় প্রিয়। বারবার ও এই গল্পটা শুনতে পারে শুধু এই কথাগুলো শুনবে বলে। রূপকথার চেয়েও আশ্চর্য সব কথা। বানের সময়ে মানুষরা সব দেবতা হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়, নইলে এমন কাণ্ড করবে কেন?
'অন্ন বিনা প্রাণী মরে যায় দেখে, বামুনরা ধামা ধামা চিড়ে-মুড়ি-বাতাসা দিয়ে সব প্রাণ বাঁচালে মা! যারা বাঁধতে জায়গা পেলে তাদের চাল-ডাল দিলে।'
'আমর মা-কে?'
'আঙাকাপড় দিলে বামুনরা। পরনের কাপড় ত্যানা হয়ে যেয়েছিল।'
'তা বাদে?"
'নতুন গোলঘরে (গোয়ালঘরে) মোদের ঠাঁই দিলে।'
'তা বাদে?"
মাচা থেকে শুকনো কাঠ, চাল-ডাল-তেল-নুনের সিষে, আনাজপাতি, মাছ। জল নেমে গেলে, যে-যার ঘরে গেল কিন্তু রূপসী আর তার মা-র জন্যে বড় আচার্যের কি ভাবনা, কি ভাবনা! ওদের মত দুঃখী কে আছে? কে এমন গাঁয়ের একটেরেয় থাকে? কতদিন ধরে ওদের আগলে রাখলেন, তারপর নিজের মাহিন্দারের সঙ্গে রূপসীর বিয়ে দিলেন, বিয়ের পর বছর না পুরতে চিনিবাস হল। কিন্তু রূপসীর বরটা করে ভুগে মরে গেল।
'ও জয়ী, তা বাদে?'
'তুই হতেও দয়া ছিল, মন ছিল। এখন য্যামন মুড়ি দিয়ে বিদেক্ষ করে দেয় ত্যামন নিমায়া ছিল না।'
চিনিবাসের দিদিমা মাথা নেড়ে আরো কি বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। আর তখনি ওবা ঢাকের বোল শুনতে পেল। ঢোলমোহর দিয়ে বড় আচার্য সকলকে যেতে বলছেন ওঁর বাড়িতে। কীর্তন, ঠাকুর সেবা, প্রসাদ বিতরণ, আর গৌরাঙ্গ দর্শন হবে। সবাই যাবে। দিবাকর চক্রবর্তীর মত বামুন, চিনিবাসের মত বাগদী, সবাই। বাবা গো! সত্যিই বামুনরা সবাইকে ডাকছে, সবাইকে খেতে দেবে? চিনিবাসের দিদিমা কিছু বুঝে কিছু না-বুঝে ঘন ঘন মাথা নাড়তে লাগল। এ বান-ও যে সেই গঙ্গার বানের মত মনে হচ্ছে? সবাই এক জায়গায় দাঁড়াবে বসবে, একসঙ্গে চিড়েমুড়ি ভাগ করে খাবে?
'চিড়েমুড়ি না রে আয়ী! ভাত হবে, পরমান্ন, ঘি সম্বরা ডাল, আর নারকেল ছাঁচিকুমড়োর বেল্গুন! গয়লাবউ খাসা দই পেতেছে, জানলি?'
'যা মা-কে যেয়ে বল্ গা, কাপড়-চোপড় যেন ক্ষারে সেদ্ধ করে। এটু তেল আনতে পারিস? মাথাটা যেন সন্ন্যাসীর জট মা! এমন মাথা নিয়ে যাব কেমন করে?'
চিনিবাস যেন হাওয়ার আগে উড়ে মা-কে খবর দিতে চলে গেল। রূপসী বারবার হাত যোড় করে কপালে ঠেকালে। একি একটা সোজা কথা? ওঃ, তিনি যদি তার চিনিবাসকে মাথায় হাত দেন, আর্শীবাদ করেন! তা হলে তো সবাই জানবে চিনিবাসও মানুষ; রূপসীও মানুষ। আরেকজন আছেন এ গাঁয়ে, অহঙ্কারে মাথা উঁচু করে বেড়ান। রূপসীর খুব ইচ্ছে করে গৌরাঙ্গকে জিগ্যেস করে, কাউকে দিয়ে জিগ্যেস করায়, একটি অহঙ্কারী পুরুষের এক সন্তান বাগদী বলে চিরদিন গরীব হয়ে থাকবে, ঘরের ছেলেটির শত ভাগের এক ভাগও পাবে না, এ কেমন বিচার?
রূপসীর মনে হতে লাগল যেন গৌরাঙ্গ এসে গেছেন, যেন চিনিবাসকে বুকে টেনে নিয়েছেন। যেন যত দুঃখ, যত কষ্ট, সব ঘুচে গেছে রূপসীর।
কিন্তু গৌরাঙ্গ এলেন না।
শান্তিপুর-কাটোয়া হয়েই কুমারহট্টের পথ ধরতে হল। সন্ন্যাস নেবার ক'বছরের মধ্যে মানুষ যেন তাঁকে ঘিরে মৌমাছির মত জমতে থাকে। মানুষের মাথায়-মাথায় থই থই। সবাই দেখতে চায়, সবাই একবার পা ছুঁতে চায়। কানা বলে আমায় ছুঁয়ে দাও, দিষ্টি হোক। খোঁড়া বলে পা-খানা ফিরে দাও ঠাকুর। কোলমরুনী ছেলে নিয়ে এসে পায়ে রাখতে চায়, ছেলে হয়ে বাঁচে না কেন তাই বলে দাও।
এমনি হাজার মানুষের হাজার বায়না। মানুষ শুধু আসতেই থাকল, আসতেই থাকল। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এ যাত্রায় উনি চিনিবাসের গ্রামের কাছাকাছিও আসতে পারলেন না।
মানুষরা আচার্যবাড়ির সামনে কতক্ষণ বসে রইল। শুধু তো গৌরাঙ্গদর্শন নয়। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। পেট ভরে খাবে বলে মা-ছেলে, বুড়োবুড়ি, কানা-খোঁড়া, অনাথ-আতুর সবাই এসে বসে রইল। আর তেমনি কি গুঁড়ি-গুঁড়ি বিষ্টি! আকাশকে কে যেন মাথার দিব্যি দিয়ে বলেছে 'জল ঢালো বাপু, তুমি মোটেই থেম না।'
ওই বিষ্টিতেই বান হয়, একটানা প্রহরের পর প্রহর ভিজতে ভিজতে কে যেন কাকে বললে। সবাই আশায় আশায় বসে রইল কোন-না-কোন সময়ে পেসাদ নিতে ডাক আসবে।
ঠিক সন্ধ্যার মুখে মুড়ি-বাতাসার ধামা নিয়ে মাহিন্দাররা মানুষের ভিড়ে নেমে এল। চিনিবাসরা কেউ উঠোনে ওঠেনি বটে, কিন্তু মাহিন্দাররা মিষ্টি গলায় বললে, 'তিনি যদি আসত, তবে তোমরা উঠোনে উঠতে বাপ সকল, আমরা ডেকে এনে বসাতাম। তা, তিনি তো আসেনি, এখন আর উঠোনে উঠে জলকাদা করে কি হবে বল?' 'তা... মুড়ি বাতাসা দিচ্ছ কেন গো? পেসাদ পাব বলেছিলে না?'
'তিনি যদি আসত, তবে শেসাদ নিশ্চয় রান্না হত। ইদিকে কীত্তন হত, হতে হতে পেসাদ রান্না হত। তোমরা সবাই পেসাদ পেতে। যোগাড় ছিল, সরঞ্জাম ছিল, সবই ছিল গো! তা তিনি যখন এল না, তখন আর পেসাদ কেমন কবে হয় বল?'
কিন্তুক, আমরা খাব বলে আশা করে এসিছি গো!" '
'এই দেখ! এয়েছিলে তো সন্নোসী দেখতে, খেতে এয়েছিলে?'
'হ্যাঁ গো।'
'নাও, তোমাদের সঙ্গে আমি বকতে পারিনি বাবু। ঠাকুর দর্শনের চেয়ে খাওয়াটা বড় হল? ঐ জন্যে তোমাদের দুষ্টু ঘোচে না, জানলে বাছা? নাও, মুড়ি-বাতাসা নাও দিকি।' কি রাঙা রাঙা মুড়ি, বড় বড় বাতাসা, কিন্তু চিনিবাসের চোখ ফেটে জল আসতে চাইল। ও তো জানে, সকাল থেকে থোড়, মোচা, লাউ, শাক, দুধ, দই কত কি ভারে ভাবে এসেছে। ভগবান জানেন কার জন্যে। এখন হঠাৎ চিনিবাসের ওর মা রূপসীর উপর রাগ হল।
*কেন এবার রামাপূজা করসি না রাজুসী? কেন, আমার পেট ভরে ভাত খেতে সাধ যায় না?'
মা-কে মেরে ধরে শেষ করে মুড়ি-বাতাসা ফেলে দিয়ে চিনিবাস পালিয়ে গেল। অনেক, অনেকক্ষণ সময় গেল। সন্ধ্যের সময় চারিদিকে জোনাকি ফুটছে, ঘন অন্ধকার নেমে আসছে, চিনিবাসের দিদিমা চিনিবাসকে খুঁজে পেল মাঠের ধারে। জলে ডোবা তালগাছটার ডগায় ও চুপ করে বসেছিল। কেঁদেকেটে অবসন্ন, ঘুম পাচ্ছে, ভূতেরও ডয় করছে।
'আয়ী আমার হাত ধর।'
দুজনে জল ছপছপ করতে করতে বাড়ির দিকে যেতে লাগল। যেতে যেতে চিনিবাস বলল, 'গৌরাঙের বানের চে' সে বান ভাল রে আয়ী! তেমন বান আর আসে না? সেই যে, যেমন বানে চিড়ে-মুড়ি-চাল দেয় এত? দুগ্ধ ঘুচে যায়?