shabd-logo

প্রসঙ্গ জগদীশচন্দ্র

24 December 2023

0 Viewed 0

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসু

রতবর্ষের প্রাচীন গৌরবের কথা উত্থাপিত হইলে আমরা সচরাচর আর্য ঋষিগণের ধর্মোন্নতি এবং আর্য মনীষীগণের দার্শনিক জ্ঞানের কথাই ভাবিয়া থাকি। সংস্কৃত ব্যাকরণ, কাব্য প্রভৃতির কথাও আমরা ভাবিয়া থাকি বটে, কিন্তু প্রধানত পরমার্থতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্ব বিষয় ভারতের প্রাধান্যই সচরাচর আমাদের পূর্বপুরুষগণের গৌরবের বিষয় বলিয়া বিবেচিত হয়। কিন্তু বর্তমান কালে পণ্ডিতগণ যাহাকে বিজ্ঞান বলেন তাহাতেও আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রাধান্যলাভ করিয়াছিলেন। প্রাচীন গ্রিক ও রোমকেরা পাটিগণিতের কোনও উন্নতি করিতে পারেন নাই। এমন কোন সংখ্যাবাচক অঙ্কের দক্ষিণে শূন্য বসাইলে তাহার মান দশ গুণ বৃদ্ধি হয়-ইত্যাকার যে দশমিক পদ্ধতি, সভ্যজগৎ তজ্জন্য প্রাচীন হিন্দুগণেরই নিকট ঋণী। এই পদ্ধতি ব্যতিরেকে পাটিগণিতের কোনো উন্নতি হইতে পারিত না। খ্রিস্টিয় অষ্টম শতাব্দীতে আরবেরা বীজগণিত সম্বন্ধীয় হিন্দুগ্রন্থ অনুবাদ করেন; এবং পাইসা নিবাসী লিউনার্ডো উক্ত বিজ্ঞান আধুনিক ইউরোপে প্রবর্তিত করেন। ত্রিকোণমিতিতেও হিন্দুগণ জগতের প্রথম শিক্ষাদাতা ছিলেন। জ্যামিতির আবিষ্ক্রিয়াও প্রথমে ভারতবর্ষেই হয়। গ্রিকগণ এই বিষয় অধিকতর উন্নতিসাধন করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু এলাহাবাদ মিওর সেন্ট্রাল কলেজের সুযোগ্য অধ্যক্ষ ডাক্তার টিব দেখাইয়াছেন যে ভারতবর্ষেই এ বিদ্যার সূত্রপাত হয়। প্রাচীন হিন্দুগণ স্বাধীনভাবে জ্যোতিষেরও অনেক উন্নতি সাধন করেন। জড় বিজ্ঞানও তাহাদের অনুশীলনের বিষয় ছিল। তাঁহারা নানাবিধ রাসায়নিক দ্রব্য প্রস্তুত করিতে জানিতেন, তন্মধ্যে নিম্নলিখিত দ্রব্যগুলির উল্লেখ করা যাইতে পারে:

স্বর্ণমাক্ষিক, সৌমীরাঞ্জন, হরিতাল, তুখং (ছুঁতে ইতিভাষা) পুষ্পকাশীশ, কাশীশ, লৌহভস্ম, মঞ্জুর, রসকপূর, রসপর্ণটি, স্বর্ণ সিন্দুর, ও মকরধ্বজ।

হিন্দুগণ দ্রাবণ, বাষ্পীকরণ, ভস্মীকরণ, ঊর্ধ্বপাতন, তির্যক পাতন প্রভৃতি রাসায়নিক প্রক্রিয়া অবগত ছিলেন।

উপরে যাহা লিখিত হইল, তাহা হইতেই বুঝিতে পারা যাইবে যে, প্রাচীন হিন্দুগণ কেবল ধ্যানপরায়ণ ছিলেন, সংসারকে মায়াময় ভাবিয়া কেবল আত্মস্থ হইয়া বসিয়া থাকিতেন, তাহা নয়। তাঁহারা নানাবিধ বিজ্ঞানের চর্চা ও উন্নতিসাধন করিয়াছিলেন। কিন্তু যেমন একজন ভূমিশূন্য ব্যক্তির পূর্বপুরুষগণ জমিদার ছিলেন বলিয়াই তাহার উদর পূর্তি হয় না, তেমনি ভারতের পূর্ব গৌরব স্মরণ করিলেই আমাদের সাময়িক দরিদ্রতা দূর হইতে পারে না। গৌরবান্বিত নামের উত্তরাধিকারী হইয়া আলস্যে উদ্যমহীন ভাবে কালযাপন করা অতি হেয়; পূর্বপুরুষগণের যশ উজ্জ্বলতর করিতে না পারি, অন্তত তাহার ঔজ্জ্বল্য রক্ষা করিতে চেষ্টা করা আমাদের একান্ত কর্তব্য।

বহু শতাব্দীর পরাধীনতায় যে জাতির স্ফূর্তিহীনতা, নৈরাশ্য ও অনুদ্যমের উৎপত্তি  হয়, জাতীয় প্রতিভার অবনতির তাহা একটি প্রধান কারণ। তাহার উপর আমাদের দারিদ্র্য,

উপযুক্ত শিক্ষার অভাব এবং শিক্ষা থাকিলেও উপযুক্ত কার্যক্ষেত্রের অভাব আমাদিগকে আরও প্রতিভাবিহীন করিয়া ফেলিয়াছে কিন্তু ব্রিটিশ শাসনে শিক্ষা এবং অন্য'। কোনো কোনো বিষয়ে পূর্বাপেক্ষা সুযোগ উপস্থিত হওয়ায় নানা বিষয়ে আবার ভারতের জাতীয় প্রতিভা পুনরুজ্জীবিত হইবে বলিয়া বোধ হইতেছে।

আজ আমরা যাহার কথা লিখিতে বসিয়াছি তিনি বিজ্ঞানবিষয়ে জাতীয় প্রতিভাকাশে ঊষার রক্তির রেখার মতো। তিনি যাহা করিয়াছেন, তাহার মূল্য প্রভৃত; কিন্তু তিনি যে আশার আলো আমাদের

হৃদয়ে জ্বালিয়াছেন তাহা অমূল্য। তিনি জাতিসমাজে আমাদের মুখ দেখাইবার পথ করিয়াছেন। আমরা অধ্যাপক জগদীশচন্দ্রের জীবনী লিখিতে প্রবৃত্ত হই নাই। আমাদের ক্ষুদ্র কাগজে তদুপযুক্ত স্থান নাই, তদ্ভিন্ন সমসাময়িক ব্যক্তির জীবনচরিত লেখা বড় কঠিন। তাঁহার কার্যের, চরিত্রের ঠিক বিচারক এবং গুণগ্রাহী আমরা হইতে পারি না। যেমন চিত্র বিশেষের সৌন্দর্য অনুধাবন করিতে হইলে, উহা হইতে কিছু দূরে যাইতে হয়, তেমনি কীর্তিমানের কীর্তি ঠিক বুঝিতে হইলে অনেক স্থলেই সময়ের দূরত্বের প্রয়োজন হয়। আব এক কথা-

History is half dream -ay even The man's life in the letters of the man.

সুতরাং প্রকৃত জীবনচরিত লেখা যে কত কঠিন, তাহা সহজেই বলা যাইতে পারে। আমরা বর্তমান প্রবন্ধে অধ্যাপক বসুর জীবনের কয়েকটি স্থূলস্থূল বিষয়ের উল্লেখ করিব মাত্র।

শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু বিক্রমপুরের একটি প্রাচীন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিতার একমাত্র পুত্র। কিন্তু একশ্চন্দ্রতমোহস্তি। তাঁহার ভগিনীগণ সকলেই সুশিক্ষিতা। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েব বি. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া শিক্ষাসমাপনার্থ বিলাত যাত্রা করেন। তাঁহার বন্ধুগণ তাঁহাকে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা করিয়া ভারতীয় সরকারি চিকিৎসা বিভাগে প্রবেশ করিতে পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের মায়া কাটাইতে না পারিয়া কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হন এবং তথায় সুবিখ্যাত ক্যাবেন্ডিস গবেষণাগারে বিজ্ঞান অনুশীলন করেন। তিনি ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে কেম্ব্রিজের বি. এ. এবং লন্ডনের বি. এসসি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কেম্ব্রিজে অবস্থানকালে তিনি পরলোকগত মহাত্মা ফসেট্ সাহেবের প্রীতিলাভ সমর্থ হন। ভারতবর্ষে ফিরিয়া আসিয়া তিনি কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন।

আমি তখন তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণিতে পড়ি। তিনি যখন অধ্যাপনা আরম্ভ করেন, তখন হইতেই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের যান্ত্রিক প্রমাণ প্রদর্শনে বিলক্ষণ নিপুণ হস্ত ছিলেন। সাধারণের মনোরঞ্জক বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া প্রদর্শনে তিনি বরাবরই সিদ্ধহস্ত বলিয়া পরিচিত। আমাদের দেশের শিক্ষা-প্রণালীর একটি দোষ এই যে, ইহাতে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা জন্মিবার কোনো সুযোগ নাই। এই দোষ দূর করিবার জন্য বসু মহাশয়ের বিশেষ আগ্রহ আছে। তিনি একদিন আমাদিগকে সন্ধ্যাকালে তাঁহার বাসায় যাইতে নিমন্ত্রণ করেন। তখন তিনি বউবাজার স্ট্রিটে থাকিতেন। সেখানে আমাদিগের জন্য প্রচুর আহার্য দ্রব্যের আয়োজন ছিল। তিনি আমাদের সহিত নানাবিষয়ক বন্ধুভাবে অমায়িকতার সহিত কথোপকথন করেন, এবং রাস্কিন প্রভৃতি গ্রন্থকারের লেখা কিছু কিছু পড়িয়া শুনান। আমার যতদূর মনে পড়ে, তাহাতে বোধ হয়, নিমন্ত্রিত ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই মিষ্টান্নের গুণ গ্রহণ করিয়াছিল; কিন্তু আমাদের অধ্যাপক যে উদ্দেশ্যে আমাদিগকে ডাকিয়াছিলেন, তাহার মর্ম আমরা কতদূর বুঝিয়াছিলাম, তাহা মনে নাই। আমার দুর্ভাগ্য এই যে তাঁহার বিজ্ঞানোৎসাহ আমার হৃদয়ে সঞ্চারিত হয় নাই।

বসু মহাশয় যখন প্রেসিডেন্সী কলেজে আগমন করেন, তখন উহাতে পদার্থবিদ্যা বিষয়ক যন্ত্রাদি সামান্য রূপই ছিল। ইহারই যত্নে ক্রমে-ক্রমে অনেক উৎকৃষ্ট যন্ত্র ক্রীত হওয়ায় এখন তথায় পদার্থ বিজ্ঞানের অনেক সূক্ষ্ম গবেষণা সম্ভবপর হইয়াছে। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে জগদীশবাবু তাড়িত বিকিরণ সম্বন্ধে গবেষণা আরম্ভ করেন। ওই বৎসর মে মাসে "On the Polarisation of the Electric Ray" সম্বন্ধে তাহার একটি সন্দর্ভ বঙ্গদেশীয় রয়‍্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সমক্ষে পঠিত হয়। বৈজ্ঞানিক জগতে শীঘ্রই এই সকল গবেষণার প্রতি পণ্ডিতবর্গের নজর পড়ে। বর্তমান যুগের প্রধান তাড়িত তত্ত্বঞ্জ লর্ড কেলবিন আপনাকে literally filled with wonder and admiration for so much success in this diffcult and novel experimental problems বলিয়া প্রকাশ করেন। লন্ডনের টাইম্‌স্ পত্র বলেন:

The originality of the achievements is enhanced by the fact that Dr. Bose had to do the work in addition to his incessant duties as professor of Physical Science in Calcutta and with apparatus and appliances which in this country would be deemed altogether inadequate. He had to construct for himself his instruments as he went along. His paper forms the outcome of the two fold line of labour-construction and research.

বসু মহাশয়ের দ্বিতীয় সন্দর্ভ লর্ড রেলি কর্তৃক রয়‍্যাল সোসাইটিতে প্রেরিত হয় এবং উক্ত সমিতির কার্যবিবরণের মধ্যে প্রকাশিত হয়। ইহার বিষয় ছিল "The Determination of the Indices of Refraction for the Electric Ray." এই সকল গবেষণার গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়া রয়্যাল সোসাইটি পার্লামেন্ট প্রদত্ত একটি ফন্ড হইতে বসু মহাশয়কে তাঁহার কার্য সৌকযার্থ কিছু অর্থ সাহায্যের বন্দোবস্ত করেন। বাঙলা গভর্নমেন্ট এই সকল গবেষণার সাহায্যার্থ একটি গবেষণা ফন্ড স্থাপিত করিয়া বসু মহাশয়কে তাহার অধ্যক্ষ করেন। তৎপরে ভারত গভর্নমেন্টের সুপারিশে সেক্রেটারি অব স্টেট এতদ্দেশে বৈজ্ঞানিক শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনার্থ জগদীশ বসুকে ইউরোপে প্রেরণ করেন। তদনুসারে তিনি সস্ত্রীক ইউরোপ যাত্রা করেন।

ইংল্যান্ডে উপস্থিত হইয়া জগদীশ বসু ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের একটি অধিবেশনে "তাড়িত কম্পনের" গুণাবলী নির্ণয়ার্থ একটি পূর্ণাঙ্গ যন্ত্র সম্বন্ধ এক প্রবন্ধ পাঠ করেন। ইউরোপের প্রধান-প্রধান পদার্থবিদগণ তাঁহার শ্রোতা ছিলেন। তাঁহারা তাঁহার প্রবন্ধটি এরূপ আগ্রহের সহিত শুনিয়াছিলেন যে অধিবেশন স্থগিত করিবার সময় উত্তীর্ণ হইয়া গেলেও তাঁহারা তাঁহাকে পাঠ করিয়া যাইতে নির্বন্ধাতিশয় প্রকাশ করেন। অধ্যাপক বসু তাঁহার যন্ত্রের ক্রিয়ার যখন ব্যাখ্যা করিতেছিলেন, তখন লর্ড কেলবিন প্রমুখ বৈজ্ঞানিকগণ ঘন-ঘন করতালি দিয়া আনন্দ জ্ঞাপন করিয়াছিলেন।

গ্লাসগো নগরে লর্ড কেলবিন অতিশয় হৃদ্যতা ও আদরের সহিত তাঁহার অভ্যর্থনা করেন। ভিন্ন-ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আদরের সহিত গৃহীত হন। বিলাতে থাকিতে-থাকিতে তিনি আর একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আবিষ্কার করেন। তিনি এতদ্বিষয়ে একটি প্রবন্ধ রয়‍্যাল সোসাইটিতে পাঠ করেন। প্রবন্ধটির বিষয় "The selective conductivity exhibited by certain Polarizing substances."

ইহার পর তিনি রয়্যাল ইনস্টিটিউসনে শুক্র বাৎসরিক সান্ধ্য বক্তৃতা করিতে আহ্বত হন। যেখানে ডেবি, ফারাডে, এবং টিন্ড্যাল বক্তৃতা করিয়াছিলেন সেখানে একজন ভারতবর্ষীয় অধ্যাপক পদার্থবিদ্যায় অতি দুরূহ একটি বিষয়ে সমবেত ইউরোপীয় প্রধান-প্রধান বৈজ্ঞানিকগণের সম্মুখে বক্তৃতা করিতেছেন ইহাকে একটি বিস্ময়কর ব্যাপার বলা যাইতে পারে।

সোসাইটি অব আর্টস্ নামক সমিতির এক অধিবেশনে তিনি ভারতবর্ষে বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। তিনি উহাতে নিম্নলিখিত প্রস্তাবসমূহ উত্থাপিত করেন:- বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার জন্য বিজ্ঞানের পঠিতব্য বিষয়ের সংখ্যা হ্রাস। বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার স্থাপন, গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক উচ্চতর বিষয়ের অনুশীলনার্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারীগণের জন্য বৃত্তি স্থাপন, এবং সরকারি নানাবিভাগে বৈজ্ঞানিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণের নিয়োগ। উক্ত প্রবন্ধে তিনি ভারতবাসীগণের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার শক্তির প্রমাণস্বরূপ অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র রায় মহাশয়ের পারদ সম্বন্ধীয় আবিষ্ক্রিয়াগুলি উল্লেখ করেন।

শ্রীযুক্ত জ্যোতিভূষণ ভাদুড়ীর রাসায়নিক গবেষণারও উল্লেখ করেন। উক্ত প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি বলেন:

I have not yet said anything of the intellectual hunger that has been created by spread of education, a hunger which is as imperative as that of the physical body. The spectator in a recent article, has well remarked that an educated man in my country wants something absorbing to think about. His intellect is at present left to consume itself, there being no vent for his useless energies. If it could be done he would betake himself "ardently, thirstily, hungrily, to the research into Nature, which can never end yet is always yielding reselts, upon which yet deeper inquiries can be based." We have been called a nation of dreamers. There is a necessity for dreamers to think out the great problems of life and make the world richer by their thoughts. But there is room for workers, too, toilers who by incessant work would increase the bounds of human knowledge. We want to have our share in this work. Our ancestors did at one time contribute to enrich the stock of the world's knowledge, but that is so long past, that it is almost forgotten now. It would perhaps not be an unworthy work for England to help us to take our place again among the intellectual nations of the world."

বিলাতী প্রধান-প্রধান সংবাদপত্রে তাঁহার প্রস্তাবগুলি সমর্থিত হয়। লর্ড লিস্টার, লর্ড কেলবিন প্রভৃতি সুবিখ্যাত বৈজ্ঞানিকগণ ভারতীয় সেক্রেটারি অব স্টেটের নিকট ভারতে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগৃহ স্থাপনার্থ এক আবেদন করেন। সেক্রেটারি অব স্টেটের সহিত অধ্যাপক বসুর যখন সাক্ষাৎ হয়, তখন তিনি সেক্রেটারি মহোদয়কে বলেন যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান কার্যে পরিণত হইলে ভারতবর্ষের আর্থিক অবস্থার বিস্তর উন্নতি হইতে পারে। বর্তমানে ভারতবর্ষের অধিকাংশ লোক জীবনধারণার্থ কৃষিকার্যের উপর নির্ভর করে।

কৃষি বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করে; অথচ বৃষ্টির পরিমাণ অনিশ্চিত। অপরদিকে অনেক ভারতবর্ষীয় যুবক বৈজ্ঞানিক শিক্ষালাভ করিলে কোনো কার্য না পাইলে আলস্যে কালযাপন করে। নানাপ্রকার শিল্পের উন্নতি হইলে ইহারাও কাজ পাইবে এবং ভারতবর্ষের অধিকাংশ অধিবাসীকেও কেবল বৃষ্টির উপর নির্ভর করিতে হইবে না।

জার্মানিতে অধ্যাপক বসুর বিলক্ষণ আদর-অভ্যর্থনা হইয়াছিল। কিল্ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি উহার সদস্যগণের সমক্ষে বক্তৃতা করিবার জন্য আহত হন। বার্লিন নগরে তিনি বহুসংখ্যক বৈজ্ঞানিক শ্রোতার সমক্ষে বক্তৃতা করেন। তৎপরে তিনি হল্ ও হাইডেলবর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন। ফ্রান্সেও তিনি অনেক বৈজ্ঞানিক পরিষদের সমক্ষে বক্তৃতা করিতে নিমন্ত্রিত হন। তাঁহার আবিষ্কৃত তত্ত্বগুলির বৃত্তান্ত ফ্রান্সের প্রধান বৈজ্ঞানিক সভার পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছে। উহার সভ্যগণ তাঁহার অভ্যর্থনা করেন এবং তৎকৃত কার্যের সমুচিত প্রশংসা করেন।

বসু মহাশয় যে যন্ত্র প্রস্তুত করিয়াছেন, তাহা দ্বারা অনেক দুরূহ তত্ত্বের অনুসন্ধান হইতে পারিবে। ফরাসিদেশে এবং আমেরিকায় মিসিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই যন্ত্র বিবিধ নূতন গবেষণার জন্য ব্যবহৃত হইতেছে। দূরে সংবাদ প্রেরণ করিবার জন্যও যে এই যন্ত্র ব্যবহৃত হইতে পারিবে এসম্বন্ধে দুইবৎসর পূর্বে বিলাতের প্রসিদ্ধ Electrician পত্রিকায় এক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। Electrical Engineer-ও এই যন্ত্র সম্বন্ধে লিখিয়াছেন:

It is worth remarking that no secret was at any time made as to its consturction, so that it has been open to all the world to adopt it for practical and possibly money making purposes.

ইম্পিরিয়েল ইনস্টিটিউসনে জগদীশবাবু যে বক্তৃতা করেন তাহার পর বিখ্যাত

বৈজ্ঞানিক স্যার হেনরি রস্কো বলেন:

I am sure I express the feelings of all present when I say that we have been listening to one of the most remarkable and interesting teachers that we had ever heard....I am sure you cannot have listened to what he has said without feeling that the work which he has done has been of the highest order and it shows that Eastern people are equally capable of making great scientific discoveries and of becoming great experimentalists as those who live in the West. Really, if our rulers understood the trend of thoughts and actions in the future they would be rather more willing to place funds at the disposal of men like Dr. Bose for the purpose of rendering service to Science and therefore rendering service to their country. লর্ড রে বলেন:

I am quite sure that we shall envy the students of the Presidency College at Calcutta in having a professor who can explain with such extraordinary lucidity of the most complicated problems of physical science. লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁহার বৈজ্ঞানিক আবিষ্ক্রিয়ার জন্য তাঁহাকে ডি. এস. সি. উপাধি দিয়াছেন।

অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসু সম্বন্ধে বিলাতের বিখ্যাত Spectator পত্রে একটি সুন্দর প্রবন্ধ বাহির হয়। আমরা তাহার কোনো কোনো স্থল উদ্ধৃত করিতেছি:

"There is, however, to our thinking something of rare interest in the spectacle then presented of a Bengalee of the purest descent possibly lecturing in London to an audience of appreciative European Savants upon one of the most recondite branches of the most modern of the Physical Sciences. It suggests at last the possibility that we may one day see an invaluable addition to the great army of those who are trying by acute. observation and patient experiment to wring from nature some of her most jealously guarded secrets."

এস্থলে বলা আবশ্যক যে বিলাতের Spectator ভারতবাসীদিগকে এতকাল অসূয়ার চক্ষে দেখিয়া আসিয়াছেন। উক্ত পত্রের পূর্বমতের এখন সম্পূর্ণ পরিবর্তন হইয়াছে। ভারতবাসীর মানসিক শক্তি সম্বন্ধে এখন লিখিয়াছেন:

"He has justly burning imagination which could extort truth out of a man of apparently disconnected facts a habit of meditation without allowing the mind to dissipate itself such as has belonged to the greatest mathematicians and engineers and a power of persistence which is something a little different from patience such as hardly belonged to any European. We do not know Professor Bose, but if he is like the thoughtful among his countrymen, as of course he must be, we venture to say, that if he cought with his scientific imagination a glimpse of a wonder working 'ray' as yet unknown to man but always penetrating either, and believed that experiment would reveal its properties and potentialities, he would go on experimenting ceaselessly through a long life, and dying hand on his task to some successor, be it son or be it disciple. Just think what kind of addition to the means of investigations would be made by the arrival within the sphere of inquiry of men with the Sunnyasee mind, the mind which utterly controls the body and can meditate or inquire endlessly while life remains, never for a moment losing sight of the object, never for a moment telling it to be obscured by any terrestrial temptatioin. We can see no reason whatever why such a mind, turning from absorption in insoluble problems should not betake itself ardently, thirstily, hungrily, to the research into Nature, upon which yet deeper inquiry can be based. If that happened and Professor Bose is at all events a living evidence that it can happen, that we are not imagining an impossibility that would be the greatest addition ever made to the sum of the mental force of mankind."

জগদীশবাবু বালক বালিকাগণের শিক্ষাকার্যে বিশেষ আগ্রহশীল। শ্রীযুক্ত যোগীন্দ্রনাথ সরকার ও আমি তাঁহারই উৎসাহে শিশুদের জন্য "মুকুল" নামক সচিত্র মাসিকপত্র প্রকাশের উদ্যোগ করি। অল্পদিন হইল তিনি এক পত্রে "মুকুলের" উন্নতি কল্পে আমায় কয়েকটি কথা লিখিয়াছিলেন।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তাঁহার বিশেষ অনুরাগ আছে। আমার যতদূর মনে পড়ে তিনি ইংল্যান্ড হইতে ফিরিয়া আসিয়া "সঞ্জীবনী” পত্রিকায় একটি বাংলা প্রবন্ধ লিখেন। তাহাতে ফসেট্ পরিবারে তিনি যে আদর ও প্রীতি পাইয়াছিলেন তাহার উল্লেখ ছিল। তাহার পর আমি যখন "দাসী'র সম্পাদক ছিলাম তৎকালে উক্ত পত্রিকায় তিনি 'ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে" একটি ও 'কলুঙ্গীর যুদ্ধ' সম্বন্ধে আর একটি প্রবন্ধ লিখেন। পূর্বোক্ত প্রবন্ধ সম্বন্ধে 'সাহিত্য' সম্পাদক নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশ করেন: "ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে", একটি সুন্দর প্রবন্ধ। লেখক কবিতার ভাষায়, গানের ঝঙ্কারে, বিজ্ঞানের গভীর তত্ত্ব গল্পের মত বর্ণনা করিয়াছেন।" এই প্রবন্ধের একটি স্থান এখনও আমার মনে আছে। তাহা এই:

"সেই দুইদিন বহু বন ও গিরি সঙ্কট অতিক্রম করিয়া, অবশেষে তুষার ক্ষেত্রে উপনীত হইলাম। নদীর ধবল সূত্রটি সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর হইয়া এ পর্যন্ত আসিতেছিল। কল্লোলিনীর মৃদুগীত এতদিন কর্ণে ধ্বনিত হইতেছিল। সহসা যেন কোন ঐন্দ্রজালিকের মন্ত্র প্রভাবে সে গীত নীরব হইল। নদীর তরল নীর অকস্মাৎ কঠিন নিস্তব্ধ তুষারে পরিণত হইল। ক্রমে দেখিলাম, স্থানে-স্থানে প্রকাণ্ড ঊর্মিমালা প্রস্তরীভূত হইয়া রহিয়াছে, যেন ক্রিয়াশীল চঞ্চল তরঙ্গগুলিকে কে "তিষ্ঠ" বলিয়া অচল করিয়া রাখিয়াছে। কোন মহাশিল্পী যেন সমগ্র বিশ্বের স্ফটিকখানি নিঃশেষ করিয়া এই বিশাল ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ সমুদ্রের মূর্তি রচনা করিয়া গিয়াছেন।"

তিনি একবার আলমোরা হইতে যে তুষার নদী দেখিতে যান ইহা তাহারই বর্ণনা। ইহার পর তিনি "সাহিত্যে" "আকাশ স্পন্দন ও আকাশ সম্ভব জগৎ” শীর্ষক একটি এবং 'মুকুলে' "গাছেরা কি বলে" শীর্ষক আর একটি প্রবন্ধ লিখেন। সকলগুলিরই ভাষা মনোজ্ঞ, বিশুদ্ধ ও কবিত্বপূর্ণ। বাস্তবিক কবির কল্পনা ও বৈজ্ঞানিকের কল্পনা সচরাচর লোকে যেরূপ বিভিন্ন প্রকারের মনে করিয়া থাকে, তাহা নয়। কী সৌন্দর্য রচনা, কী বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিষ্কার উভয়েই কল্পনার প্রয়োজন। কল্পনা ব্যতিরেকে নূতন কিছু গঠিত বা সৃষ্ট হইতে পারে না। জগদীশ বসুর মুখচ্ছবিও কবিরই মতো। শুষ্ক বৈজ্ঞানিকের মতো নয়। তাঁহার বাংলা সাহিত্যের অনুরাগের কথা বলিলাম। ইহা বলাও বোধ হয় নিষ্প্রয়োজন হইবে না যে তিনি বাংলা ভাষায় কথা কহেন; কারণ, যাঁহারা কখনও জাহাজে উঠেন নাই, এরূপ অনেক ইংরাজি শিক্ষাভিমানী এখনও বাংলা লিখন, পঠন এবং উক্ত ভাষায় পত্রালাপ, এমন কী কথোপকথন পর্যন্ত লজ্জাকর, অত্যন্ত সঙ্কোচের কারণ, মনে করেন। অন্যান্য বিষয়েও জগদীশ বসুর সাহেবি-আনা কম; কিন্তু ইংরাজসুলভ সদগুণের অভাব নাই।

জগদীশবাবু গৃহে ধুতি পরেন: কলেজে ইংরাজের পোশাক পরিয়া আসেন না; হ্যাট পরেন না। হ্যাটটি হজমিগুলি বিশেষ। ইহা দ্বারা বিশেষত রেলের গাড়িতে, জাতি, জন্ম, বর্ণ, শিক্ষা ও পদনত অনেক 'খুঁত' ঢাকিয়া যায়। শুনিয়াছি কোনো কোনো ব্যবসায়ে ও চাকুরিতে ইহা না পরিলে চলে না। অতএব হ্যাটের অগৌরব করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি কেবল জগদীশবাবুর পোশাক বিষয়ক রুচির কথা বলিতেছি।

জগদীশবাবু সৌন্দর্য্যানুরাগী। এ সম্বন্ধে একটি কথা মনে পড়িল। তাঁহার বাড়িতে আমি একবার টেনিসনের 'নির্ঝরিণী' কবিতার বর্ণনানুযায়ী কতকগুলি চিত্র দেখিয়াছিলাম। আমার যতদূর মনে পড়ে সেগুলি তিনি কাশ্মীর ভ্রমণকালে সৌসাদৃশ্য হইতে ফটোগ্রাফ করিয়া তুলিয়া আনিয়াছিলেন।

অধ্যাপক ও ছাত্রের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, তাহার বন্ধন তিনি সর্বদাই স্বীকার করেন। অপর লোকের সহিত ব্যবহারেও তিনি অমায়িক ও নম্র প্রকৃতি। আমি তাঁহাকে 'প্রদীপে' লিখিতে অনুরোধ করায় তিনি এই মর্মে আমায় পত্র লিখিয়াছিলেন-"আমি তোমার কাগজে লিখিতে পারিলে বাস্তবিকই সুখি হইতাম কিন্তু নানাকার্যে জড়িত হইয়া আমি এখন অনেক সুখে বঞ্চিত হইয়াছি। আমি যে কার্যে বৃত হইয়াছি, তাহার কূল-কিনারা দেখিতে পাই না-অনেক সময়েই কেবল অন্ধকারে ঘুরিতে হয়। বহু ব্যর্থ প্রযত্নের পর কদাচ অভীষ্টের সাক্ষাৎ পাই।"



জগদানন্দ রায়

জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার

"জ্ঞানাচার্য শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু মহাশয় তাঁহার আবিষ্কারের বিবরণ বিদেশের বৈজ্ঞানিকদিগের নিকটে প্রকাশ করিবার জন্য বৎসরাধিককাল ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপান প্রভৃতি দেশে পরিভ্রমণ করিতেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ হইল তিনি নিরাপদে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন। আবিষ্কারের বিবরণ প্রচারের জন্যই ইহাই তাঁহার প্রথম বিদেশ যাত্রা নয়, আরও তিনবার তাঁহাকে এই উদ্দেশ্য লইয়াই বিদেশে বহির্গত হইতে হইয়াছিল।

নির্জীব ধাতুপিণ্ড আঘাতে উত্তেজনা পাইলে সজীব প্রাণীর ন্যায় সুখ-দুঃখ প্রকাশ করার মতো সাড়া দেয়, ইহাই প্রচার করা বসু মহাশয়ের প্রথম বৈজ্ঞানিক অভিযানের বিষয় ছিল। ইহা পনেরো ষোলো বৎসর পূর্বেকার কথা। জগদীশচন্দ্র ধ্যানমগ্ন মুনির ন্যায় নীরবে যে সাধনা করিতেছেন তাহার ইতিহাস যাঁহাদের জানা আছে, তাঁহাদের কাছে ষোলো বৎসর পূর্বেকার কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিজ্ঞান পরিষদ তখন তাঁহার পরীক্ষাগুলি দেখিয়া অবাক হইয়া গিয়াছিলেন। প্রচলিত বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের সহিত জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কৃত তথ্যগুলি খাপ খায় না। গোঁড়া বৈজ্ঞানিকেরা ঈর্ষান্বিত হইয়া পড়িয়াছিলেন। সংবাদপত্রে ও বৈজ্ঞানিক সাময়িকপত্রে তখন জগদীশচন্দ্রের কথাই প্রকাশ হইত এবং তিনি এক পৃথিবীব্যাপী বিরাট আন্দোলনের সূত্রপাত করিয়াছিলেন। মাদক দ্রব্য প্রয়োগে প্রাণী উত্তেজনার লক্ষণ প্রকাশ করে এবং বিষে মরিয়া যায়, ইহা আমাদের জানা কথা। বিদ্যুতের সাহায্যে প্রাণীর এই সকল অবস্থার কথা শারীরবিদগণ প্রাণীদের দিয়াই লিখাইয়া লইতে পারেন কিন্তু মাদকদ্রব্য প্রয়োগ করিলে যে ধাতুপিণ্ডও উত্তেজনা প্রকাশ করে এবং বিষে জর্জরিত হইয়া মরিয়া যায়, ইহা কাহারো জানা ছিল না। জগদীশচন্দ্রের গবেষণার ফলে ইহা জানিয়াই সকলে চমৎকৃত হইয়াছিলেন।

ইহার পরে জগদীশচন্দ্র আরও দুইবার বিদেশযাত্রা করিয়াছিলেন। সেই সময়ে ইউরোপ ও আমেরিকা প্রভৃতি দেশে প্রাণী ও উদ্ভিদ-সম্বন্ধীয় তাঁহার অনেক আবিষ্কারের কথা প্রচারিত হইয়াছিল। উদ্ভিদের যে সকল জীবন ক্রিয়ার ব্যাখ্যান আধুনিক বড় বড় বৈজ্ঞানিকেরাও দিতে পারেন নাই, বসু মহাশয় সেইগুলিরই অতি সহজ ব্যাখ্যান দিয়া সকলকে বিস্মিত করিয়াছিলেন। তিনি কেবল বক্তৃতা করিয়া ব্যাখ্যান দেন নাই, নিজের পরিকল্পিত অতি সুন্দর- সুন্দর যন্ত্রের সাহায্যে প্রত্যেক উক্তির প্রমাণ দেখাইয়া সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। ইহাতে উদ্ভিদতত্ত্বের অনেক রহস্যের মীমাংসা হইয়া গিয়াছিল।

এবারেও উদ্ভিদের জীবন ক্রিয়ার আরও নূতন-নূতন তত্তপ্রচারের জন্য জগদীশচন্দ্র বিদেশ যাত্রা করিয়াছিলেন। প্রাণীজীবনের যে সকল কার্য কেবল প্রাণীরই বিশেষত্ব বলিয়া জীবতত্ত্ববিদগণ এতকাল মানিয়া আসিতেছিলেন তাহা উদ্ভিদের জীবনেও দেখা যায়, ইহাও প্রমাণিত করা তাঁহার লক্ষ্য ছিল। ভিয়েনা, প্যারিস, অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ, সিকাগো, কলম্বিয়া এবং টোকিয়ো প্রভৃতির বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান পরিষদ সাদরে নিমন্ত্রণ করিয়া তাঁহার আবিষ্কারের বিবরণ শুনিয়াছিলেন।

প্রাচীন বিশ্বাসকে ত্যাগ করিয়া সহজে কেহই নূতনকে গ্রহণ করিতে চায় না। যাহারা বিজ্ঞানের সত্য লইয়া নাড়াচাড়া করেন, তাঁহাদেরও মধ্যে এই প্রকারের গোঁড়ামি বিরল নয়। জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কারগুলি উদ্ভিদতত্ত্ব ও শারীর তত্ত্বের প্রাচীন সিদ্ধান্তের বিরোধী; কাজেই যে সকল প্রবীণ বৈজ্ঞানিক প্রাচীন সিদ্ধান্তে বিশ্বাস করিয়া আসিতেছিলেন, তাঁহাদিগকে নূতনের দিকে টানিয়া আনা সহজ কাজ ছিল না। আচার্য জগদীশচন্দ্র এবারে এই দুঃসাধ্য সাধনেও কৃতকার্য হইয়াছেন। চক্ষুর সম্মুখে শত শত পরীক্ষা দেখাইয়া তিনি যে সকল সত্যের পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন, প্রবীণ বৈজ্ঞানিকেরাও তাহা অগ্রাহ্য করিতে পারেন নাই। জড় ও জীবের দুই বৃহৎ রাজ্যের মাঝামাঝি যে স্থানটি চির-রহস্যের ছিল আমাদের স্বদেশবাসী জগদীশচন্দ্রই যে তাহাতে নূতন আলোকপাত করিয়া সুস্পষ্ট করিয়া তুলিয়াছেন, জগতের সকল বৈজ্ঞানিকই তাহা এখন স্বীকার করিতেছেন। আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মভূমি ইউরোপকে এখানে ভারতের নিকট পরাজয় স্বীকার করিতে হইয়াছে। এখন বিদেশের চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রেই বলিতেছেন, ইউরোপের বৈজ্ঞানিকগণ প্রকৃতিকে এ পর্যন্ত খণ্ড খণ্ড করিয়াই দেখিয়া আসিয়াছেন, কাজেই তাহার সুন্দর পূর্ণ মূর্তিখানি কাহারও নজরে পড়ে নাই। প্রাচ্য বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্রই প্রকৃতিকে দৃষ্টির সীমার মধ্যে আনিয়া তাহার পূর্ণমূর্তি দেখাইবার উপক্রম করিয়াছেন।

আমন্ত্রিত হইয়া জগদীশচন্দ্র ইউরোপ ও আমেরিকার প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাসমিতিতে যে সকল কথা বলিয়াছেন, তাহার বিবরণ এখনও আমাদের হস্তগত হয় নাই। সম্প্রতি ম্যাকোলিয়োর মাগাজিন (Mc Clure magazine) নামক প্রসিদ্ধ সাময়িক পত্রে বসু মহাশয়ের আবিষ্কার সম্বন্ধে যে সকল কথা প্রকাশিত হইয়াছে আমরা পাঠকের নিকটে তাহারই মর্ম উপস্থিত করিতেছি। প্রবাসীর নিয়মিত পাঠক জগদীশচন্দ্রের নূতন ও পুরাতন আবিষ্কারের অনেক কথাই অবগত আছেন। লেখক সেই সকল কথাকেই সংক্ষেপে গুছাইয়া লিখিয়াছেন বলিয়া ইংরাজি প্রবন্ধটি উপাদেয় হইয়াছে।

উপাধি গ্রহণ করিয়া জগদীশচন্দ্র যখন অক্সফোর্ড বিদ্যালয় হইতে বাহিরে আসিয়াছিলেন, তখন জড়বিজ্ঞানের অবস্থা এখনকার মতো ছিল না। তারহীন টেলিগ্রাফ তখন উদ্ভাবিত হয় নাই। ঈথরের তরঙ্গই যে বিদ্যুৎ তাপ এবং আলোক উৎপাদন করে, ইংরেজ বৈজ্ঞানিক ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল সাহেব তাহা কাগজ কলমে প্রমাণিত করিয়া তখন পরলোকগত। কেবল জার্মান পণ্ডিত হার্জ সাহেবই সেই সময়ে ম্যাক্সওয়েলের আবিষ্কারের সূত্র ধরিয়া পরীক্ষা করিতে ছিলেন। হার্জ সাহেবের এই পরীক্ষাগুলি জ্ঞানপিপাসু জগদীশচন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল।

হার্জ সাহেব পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছিলেন, কৃত্রিম উপায়ে বিদ্যুতের তরঙ্গ ঈথরে উৎপন্ন করা হইতে পারে বটে, কিন্তু তাহার পরিচয় আমাদের চক্ষুকর্ণাদি ইন্দ্রিয় গ্রহণ করিতে পারে না। কাজেই ইহার পরিচয় লইতে হইলে কোন প্রকার যন্ত্রের সাহায্য প্রয়োজন। ইংরেজ বৈজ্ঞানিক লজ সাহেব এই কথা শুনিয়া অল্পদিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রটি আবিষ্কার করিয়াছিলেন। তাহাই তখন কোহেয়ার (Coherer) নামে খ্যাত হইয়াছে। কাচের নলে আবদ্ধ ধাতুচূর্ণ যন্ত্রটির প্রধান উপাদান। বিদ্যুতের অদৃশ্য তরঙ্গ ঈথরে উৎপন্ন হইয়া ধাতুচূর্ণে আসিয়া ঠেকিলে ধাতুর বিদ্যুৎ পরিবহণ শক্তি কমিয়া আসিত এবং ইহা দেখিয়াই অদৃশ্য বিদ্যুৎ তরঙ্গের অস্তিত্ব বুঝা যাইত। কিন্তু যন্ত্রটিকে কার্যক্ষম করিবার জন্য প্রত্যেক পরীক্ষার পরে ধাতুচূর্ণগুলিকে ঝাঁকাইয়া না দিলে ফলিত না। যে ধাতুচূর্ণে একবার তরঙ্গের স্পর্শ লাগিয়াছে ওই প্রকারে ঝাঁকাইয়া না দিলে তাহা আর বিদ্যুৎ তরঙ্গের সাড়া দিত না। যাহা হউক, লজ সাহেবের এই যন্ত্রে বৈজ্ঞানিকগণ বিদ্যুৎ তরঙ্গের পরিচয় গ্রহণ করিতে লাগিলেন এবং এই অদৃশ্য তরঙ্গের চালনা করিয়া সংবাদ আদানপ্রদানের সুবিধা খুঁজিতে লাগিলেন। কিন্তু নলে আবদ্ধ ধাতুচূর্ণের পরিচালন শক্তি যেন বিদ্যুৎ-তরঙ্গের স্পর্শে পরিবর্তিত হয় এবং কেনই বা তাহাতে ঝাঁকুনি না দিলে কাজ চলে না এসব প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত থাকিয়া গেল। আমাদের জগদীশচন্দ্রই ইহার কারণ অনুসন্ধানে লাগিয়া গেলেন। ইহাই তাঁহার প্রথম গবেষণা।

কোন্ সূত্রে কোন তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায়, তাহার হিসাবপত্র করিয়া তত্ত্বান্বেষীরা চলেন না। পূর্বোক্ত যে বিষয়টি লইয়া জগদীশচন্দ্র প্রায় ২০ বৎসর পূর্বে গবেষণা আরম্ভ করিয়াছিলেন, তাহাই যে জীবের জীবত্বের ও জড়ের জড়ত্বের মূল কথা বলিয়া দিবে, তাহা তিনিও সেই সময়ে ক্ষণকালের জন্য মনে করিতে পারেন নাই। যাহা হউক বিদ্যুৎ তরঙ্গের স্পর্শে লৌহচূর্ণ কেন বিদ্যুৎ পরিচালনার ধর্ম হারায়, তাহার অনুসন্ধান করিতে গিয়া জগদীশচন্দ্র দেখিয়াছিলেন, প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন পুনঃপুনঃ সঞ্চালনে অসাড় হইয়া যায়, বিদ্যুৎ তরঙ্গের বারবার আঘাতে লৌহচুর্ণও সেই প্রকারে অসাড় হইয়া পড়ে। তাই তাহার ভিতর দিয়া তখন বিদ্যুৎ পরিচালনা হয় না। আবার কাজ পাইতে হইলে, সেই অসাড় ধাতুচূর্ণকে ঝাঁকুনি দিয়া উত্তেজিত করিতে হয়।

আচার্য জগদীশচন্দ্র নিজের এই আবিষ্কারে নিজেই বিস্মিত হইয়া পড়িয়াছিলেন এবং নানা জড় পদার্থের উপর পুনঃপুনঃ আঘাতে উত্তেজনা দিলে কি ফল হয়, তাহা পরীক্ষা করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। প্রাণী দেহের যে সকল ক্রিয়া চোখে দেখিয়া, কানে শুনিয়া বা স্পর্শ করিয়া বুঝা যায় না, প্রাণীতত্ত্ববিদগণ তাহা বিদ্যুৎ প্রবাহের দ্বারা বুঝিতে পারেন। জগদীশচন্দ্র ওই প্রকারে বিদ্যুতের সাহায্য লইয়া জড়ের নানা অবস্থা পরীক্ষা করিতে শুরু করিয়াছিলেন। সজীব প্রাণীর পেশি বা স্নায়ু উত্তেজিত করিলে উত্তেজনা প্রাপ্ত অংশে অতি মৃদু বিদ্যুতের উৎপত্তি হয়: খুব ভালো তড়িৎবীক্ষণযন্ত্রে সেই বিদ্যুৎ ধরা পড়ে। কিন্তু মৃত প্রাণীর দেহে অবিরাম আঘাত দিলেও তাহাকে বিদ্যুৎ জন্মে না। ধাতু লইয়া পরীক্ষা করায় জগদীশচন্দ্র দেখিয়াছিলেন, সজীব প্রাণীর ন্যায় ধাতুও আঘাতের উত্তেজনায় সাড়া দেয়; তাহারও জীবনমরণ, স্ফূর্তি ও ক্লান্তি আছে। কেবল তাহাই নয়, প্রাণীর পেশি যেমন ঠান্ডা পাইলে নিস্তেজ হয়, বিষে মৃতপ্রায় হয় এবং ঔষধে পুনর্জীবিত হয়, ধাতুপিণ্ডেও ওই সকল প্রক্রিয়ায় অবিকল একই ফল প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছিল। সজীব মাংসপেশিতে চিমটি কাটিলে তাহা বেদনায় উত্তেজিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বিদ্যুতের উৎপত্তি হয়। ধাতুপিণ্ডে চিমটি কাটিয়া জগদীশচন্দ্র ঠিক সেই প্রকার বেদনা জ্ঞাপক বিদ্যুতের উৎপত্তি দেখিয়াছিলেন। মাংসপেশীতে পুনঃপুনঃ আঘাত দিলে তাহা অসাড় হইয়া যায়। কিন্তু বিশ্রামের অবকাশ দিলে তাহাতেই সাড়া দিবার শক্তি আবার ফিরিয়া আসে। অবিরাম আঘাত দিয়া জগদীশচন্দ্র ধাতুপিণ্ডেও ঠিক ওই প্রকার অসাড়তা দেখিতে পাইয়াছিলেন এবং বিশ্রামের অবকাশ দিয়া তাহাকেই আবার সসাড় করিয়া তুলিয়াছিলেন। 

আঘাতে সাড়া দেওয়াই জীবের জীবত্ব বলিয়া যে একটি সংস্কার স্মরণাতীত কাল হইতে বদ্ধমূল ছিল, বসু মহাশয়ের আবিষ্কারে তাহার উচ্ছেদ হইয়াছিল। সকলে বুঝিয়াছিলেন, অজৈব পদার্থ মাত্রই মৃত নয়।

এই আবিষ্কারের বিবরণ রয়াল সোসাইটি প্রভৃতি বিজ্ঞান সভায় প্রচারিত হইলে বৈজ্ঞানিকগণ জগদীশচন্দ্রকে কি প্রকারে সম্মানিত করিয়াছিলেন, আমরা পূর্বেই তাহার আভাষ দিয়াছি। আর কোনো গবেষণায় হাত না দিয়া তিনি যদি এইখানে সকল গবেষণা হইতে বিরত হইতেন তাহা হইলে পূর্বোক্ত আবিষ্কারই জগদীশচন্দ্রের নাম বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিত। কিন্তু সম্মানলাভ তাঁহার গবেষণার লক্ষ্য ছিল না। প্রকৃতির কার্যের মূল রহস্য আবিষ্কার করিয়া সমগ্র সৃষ্টির সহিত পরিচয় লাভ করাই তাঁহার জীবনের সাধনা করিয়াছিল। কাজেই এত সম্মান, এত সাধুবাদ তাঁহাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করিতে পারে নাই। তিনি ভাবিতে লাগিলেন ধাতুর সহিত সাধারণ সজীব বস্তুর যখন এত নিকট সম্বন্ধ, তখন সাবধানে পরীক্ষা করিতে পারিলে উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনের কার্যে নিশ্চয়ই অনেক মিল দেখা যাইবে।

উদ্ভিদের জীবনের কার্য পরীক্ষা করিবার জন্য এ পর্যন্ত জীবতত্ত্ববিদগণ অনেক যন্ত্র উদ্ভাবন করিয়াছেন। কিন্তু এই সকল জগদীশচন্দ্রের নিকট এত স্থূল বলিয়া বোধ হইতে লাগিল যে তিনি নিজেই মনের মতো যন্ত্র প্রস্তুত করিতে নিযুক্ত হইলেন। অল্পদিনের মধ্যে অনেক যন্ত্র প্রস্তুত হইল। এগুলি এত কার্যোপযোগী হইল যে শীত গ্রীষ্মে বা আঘাতের উত্তেজনায় দৈহিক অবস্থার যে অতি সামান্য পরিবর্তন হয়, তাহাও উদ্ভিদগণ যন্ত্রের লেখনীর সাহায্যে যন্ত্রসংলগ্ন লিপিফলকে লিখিয়া জানাইতে লাগিল। জগদীশচন্দ্র দেখিলেন, কেবল জীবনমৃত্যু, ক্ষয়বৃদ্ধি প্রভৃতি স্থূল ব্যাপারেই যে প্রাণী ও উদ্ভিদের একতা আছে তাহা নয়; প্রাণীর জীবনের কার্যে যে সকল খুঁটিনাটি ব্যাপার দেখা যায়, সেগুলি উদ্ভিদেও ধরা পড়ে।

চিমটি কাটিলে বা আঘাত দিলে প্রাণীর দেহে বেদনার সঞ্চার হয় এবং তাহার লক্ষণ দেহের আকুঞ্চনে বা বিদ্যুৎ প্রবাহে প্রকাশ পায়। তাহা ফুলকপির ডাঁটায় চিমটি কাটিয়া জগদীশন্দ্র অবিকল সেই প্রকার বেদনাজ্ঞাপক লক্ষণ তাঁহার যন্ত্রে দেখিতে পাইয়াছিলেন। তা ছাড়া বিষ, মাদকদ্রব্য, অবসাদক ও উত্তেজক বস্তু প্রাণীদেহে যে প্রকার ক্রিয়া করে, উদ্ভিদদেহেও যে অবিকল তাহাই করে জগদীশচন্দ্র ইহা প্রত্যক্ষ দেখাইয়াছেন। পরীক্ষাকালে উদ্ভিদগণ যন্ত্রের লেখনী দিয়া দৈহিক অবস্থার কথা নিজেরাই লিখিয়া দেখাইয়াছিল।

শ্রমসাধ্য কাজ বারবার করিতে থাকিলে খুব বলশালী প্রাণীও ক্লান্ত হইয়া পড়ে। তখন তাঁহার বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। বিশ্রামে অবসাদ দূর হইলে, আবার সে শ্রম করিতে পারে। জগদীশচন্দ্র উদ্ভিদকেও ওই প্রকারে পরিশ্রান্ত হইতে দেখিয়াছিলেন এবং বিশ্রামের অবকাল্প দিয়া তাহাকে কার্যক্ষম করিয়া তুলিয়াছিলেন। যে ঘোড়া গাড়ি টানিতে গিয়া বেশি লাফালাফি করে, সে শীঘ্রই পরিশ্রান্ত হয়; কাজেই তাহার বিশ্রামেরও শীঘ্র প্রয়োজন হয়। লজ্জাবতী গাছে বসু মহাশয় ওই প্রকার উত্তেজনাশীল প্রাণীর সকল লক্ষণই দেখিতে পাইয়াছিলেন। সামান্য উত্তেজনায় লজ্জাবতী অধিক সাড়া দিয়া শীঘ্র অবসাদগ্রস্ত হইয়া পড়ে। অন্তত পনেরো মিনিটকাল বিশ্রামের অবকাশ না দিলে সে পূর্বের স্ফূর্তি ফিরিয়া পায় না।

দেহে আঘাত দিলে আঘাতের সঙ্গে-সঙ্গেই প্রাণীরা বেদনা বুঝিতে পারে না। আঘাত- প্রাপ্তি ও বেদনা-অনুভূতির মধ্যে এক একটু সময়ের ব্যবধান থাকে। উদ্ভিদেও আঘাত-প্রাপ্তি ও বেদনা অনুভূতির মধ্যে যে একটু অবকাশ আছে তাহাও জগদীশচন্দ্র তাঁহার যন্ত্রের সাহায্যে দেখাইয়াছেন। এমন সূক্ষ্ম সময় পরিমাপক যন্ত্র এ পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিকই উদ্ভাবন করিতে পারেন নাই।

মদ খাইয়া মানুষ যখন মাতাল হয়, তখন তাহার চালচলন কী প্রকার অদ্ভুত হইয়া দাঁড়ায় তাহা কখনও কখনও পথে ঘাটে দেখা যায়। জগদীশচন্দ্র কিছুকাল আলকোহল বাষ্পের মধ্যে রাখিয়া লজ্জাবতী লতাকে উন্মত্ত করাইয়াছিলেন এবং তাহাতে একে একে মাতালের সকল লক্ষণই দেখিতে পাইয়াছিলেন। গাছের হাত পা নাই, বাকশক্তিও নাই; কাজেই লজ্জাবতী ওই অবস্থায় মাতালের মতো টলিতে পারে নাই বা উচ্ছৃঙ্খলভাবে হাসিকান্না দেখাইতে পারে নাই। কিন্তু যন্ত্রে সে নিজে যে সকল সাড়া লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিল, তাহাতেই মাতালের সকল উচ্ছৃঙ্খলতার লক্ষণ একে-একে প্রকাশ পাইয়াছিল। ঠান্ডা ও নির্মল বাতাসের সংস্পর্শে মাতালের নেশা ছুটিয়া যায়। আলকোহলের বাষ্পপ্রয়োগ বন্ধ কবিয়া লজ্জাবতীকে নির্মল বাতাসে রাখা হইয়াছিল; ইহাতে সে কিছুকালের মধ্যেই প্রকৃতিস্থ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। কেবল মাদকদ্রব্য নয়, যে দ্রব্য প্রাণীদেহে যে ক্রিয়াটি দেখায় উদ্ভিদদেহে প্রয়োগ করায় বসু মহাশয় অবিকল সেই ক্রিয়াই দেখিতে পাইয়াছিলেন।

এ পর্যন্ত জীবতত্ত্ববিদগণ প্রাণী ও উদ্ভিদকে দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক জাতীয় জীব বলিয়া মনে করিয়া আসিতেছিলেন। তাহাদের জীবনের কার্যের মধ্যে যে কোনো ঐক্য আছে তাহা ইহাদের মধ্যে কেহই স্বীকার করিতেন না। বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্রের এই সকল আবিষ্কারে এখন পণ্ডিতেরা বুঝিয়াছেন, প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনের কার্যে কোনো পার্থক্যই নাই; বিধাতা উভয়কেই একই গুণবিশিষ্ট করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন। বিচিত্র অবস্থার মধ্যে পড়িয়া সেই আদিম গুণগুলিই বিচিত্ররূপ গ্রহণ করিয়া আমাদের মোহ উৎপাদন করিতেছে।

এগুলি খুবই উচ্চাঙ্গের কথা। জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের কার্যে কতটা লাগিবে, তাহা চিন্তা করিলে দেখা যায়, এই হিসাবেও আবিষ্কারগুলির মূল্য কম নয়। চিকিৎসার জন্য ঔষধ নির্ণয় করা বড়ই কঠিন কাজ। কোনো পদার্থের রোগ নাশ করিবার শক্তি জানা গেলেও, তাহা মানুষের ওপরে হঠাৎ প্রয়োগ করা যায় না। কাজেই অনেক নিরীহ প্রাণীর উপর দিয়া নূতন ঔষধাদির গুণাগুণ পরীক্ষা করিতে হয়। মানুষের সুবিধার জন্য এই প্রকারে আজকাল যে কত প্রাণীহত্যা করিতে হইতেছে, তাহার ইয়ত্তা নাই। এখন উদ্ভিদের ওপরে পরীক্ষা করিয়া ঔষধের গুণাগুণ বিচার করা চলিবে বলিয়া মনে হইতেছে।

জার্মানির প্রধান উদ্ভিদতত্ত্ববিদ পেফার (Pfeffer) এবং হাবেরলান্ড (Haberlandt) সাহেব নানা পরীক্ষায় লজ্জাবতীর ন্যায় উদ্ভিদেও স্নায়ুমণ্ডলীর অস্তিত্ব ধরিতে পারেন নাই। ইহারা লজ্জাবতীকে ক্লোরোফর্মের বাষ্পে রাখিয়াছিলেন এবং তাহার ডাঁটা পুড়াইয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু তথাপি লজ্জাবতী সাড়া দিতে ছাড়ে নাই। ইহা দেখিয়াই সিদ্ধান্ত হইয়াছিল যে লজ্জাবতীর দেহে স্নায়ুমণ্ডলী নাই; থাকিলে তাহার কার্য ক্লোরোফরমের স্পর্শে ও তাপে লোপ পাইয়া যাইত এবং সঙ্গে-সঙ্গে লজ্জাবতীর সাড়া দেওয়া বন্ধ হইত। আগুনে পোড়া শাখার ভিতর দিয়া উত্তেজনায় চলা ফেরার কারণ দেখাইতে গিয়া ইহারা বলিয়াছিলেন, জলপূর্ণ রবারের নলের একপ্রান্তে চাপ দিলে তাহারা তাহাতে যেমন সেই চাপ নলের অপরপ্রান্তে গিয়া পৌঁছায়, লজ্জাবতীর দেহের উত্তেজনা ঠিক তেমনি করিয়া তাহার ভিতরকার জলের সাহায্যে দগ্ধ শাখার ভিতর দিয়াও চলে।

পেফার ও হাবেরলান্ডের পূর্বোক্ত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করিয়া জগদীশচন্দ্র যেসকল পরীক্ষা দেখাইয়াছেন, ইহা বড়ই আশ্চর্যজনক। তিনি একটি লজ্জাবতী গাছকে চারা অবস্থা হইতে সাবধানে পালন করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। যাহাতে সেটি শীঘ্র-শীঘ্র বাড়িয়া পুষ্টাঙ্গ হয় তাহার জন্য যখন যে ব্যবস্থা প্রয়োজন তখনই তাহা করা হইত এবং যাহাতে উহার পাতায় বা ডালে কোনো প্রকার আঘাত না লাগে তাহার প্রতি সর্বদা দৃষ্টি রাখা হইত। হাত- পা বাঁধিয়া যদি কোনো লোককে পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়ানো যায়, তাহা হইলে লোকটির দেহ বেশ পুষ্ট হয় বটে, কিন্তু তাহার হাত-পা আড়ষ্ট হইয়া যায়। সযত্নে পালিত লজ্জাবতী গাছটির অবস্থাও কতকটা সেই রকমই হইয়াছিল; দেখিলে গাছটিকে খুবই সুস্থ বলিয়া মনে হইত, কিন্তু মৃদু আঘাত উত্তেজনায় সাড়া দিতে পারিত না। ইহা দেখাইয়া তিনি লজ্জাবতীর স্নায়ুর অস্তিত্ব প্রমাণ করিয়াছিলেন। জলই যদি উত্তেজনার বাহক হইত তবে এই পরীক্ষায় গাছে সাড়ার অভাব হইত না। কাজেই স্বীকার করিতে হয়, দেহস্থ জলের চাপ উত্তেজনার বাহক নয়। লজ্জাবতীর দেহে প্রাণীদেহের ন্যায় স্নায়ুজাল বিস্তৃত আছে, তাহাই অনভ্যাসে নিষ্ক্রিয় হইয়া পড়িয়াছিল বলিয়াই লজ্জাবতী সাড়া দেয় নাই।

ব্যবহারের অভাবে স্নায়ুমণ্ডলী বিকল হইলে যাহার হাত-পা আড়ষ্ট হইয়া যায়, তাহাকে জোর করিয়া কিছুদিন চলাফেরা করাইলে স্নায়ু প্রকৃতিস্থ হইয়া পড়ে; তখন সে সুস্থ ব্যক্তিরই ন্যায় হাত-পা নাড়িতে চায়। পূর্বোক্ত অসাড় লজ্জাবতীর দেহে উপর্যুপরি আঘাত দিয়া এবং সর্বাঙ্গে সেঁক দিয়া জগদীশচন্দ্র তাহাকে প্রকৃতিস্থ করিয়াছিলেন। এই অবস্থায় সে সুস্থ গাছের মতোই সাড়া দিতে আরম্ভ করিয়াছিল।

স্নায়বিক শক্তি সকল প্রাণীর সমান নয়। মানুষের মধ্যেই ইহার অনেক বৈচিত্র্য দেখা যায়। এমন লোক আছেন, যাঁহারা স্লেটের উপরে পেনসিল ঘষার শব্দ সহ্য করিতে পারেন না। বালি দিয়া বাসন মাজার সময়ে যে শব্দ হয় তাহাও অনেকের স্নায়ুমণ্ডলীকে পীড়া দেয়। উদ্ভিদ জাতির মধ্যে জগদীশচন্দ্র স্নায়বিক শক্তির এই বৈচিত্র্যও আবিষ্কার করিয়াছিলেন। কতকগুলি গাছ খুব উত্তেজনার মধ্যেও তাহাদের স্নায়ুকে সবল রাখিতে পারে; আবার কতকগুলি দুর্বল মানুষের ন্যায় অল্প উত্তেজনাতেই অধীর হইয়া পড়ে।

উদ্ভিদ ও প্রাণীর এই ঐক্য সকলকেই বিস্মিত করিয়াছে। প্রসিদ্ধ উদ্ভিদতত্ত্ববিদগণ বৃক্ষকে স্নায়ুবৰ্জ্জিত মনে করিয়া যে সত্যই ভুল করিয়া আসিতেছিলেন, এখন পণ্ডিতমণ্ডলী তাহা স্বীকার করিতেছেন।

গাছের ডাল পোড়াইলে এবং তাহার গায়ে ক্লোরোফর্মের বাষ্প লাগাইলেও শাখা দিয়া যে উত্তেজনার চলাচল লক্ষ্য করা হইয়াছিল তাহা স্নায়বিক উত্তেজনারই ফল। উদ্ভিদের স্নায়ুজাল দেহের গভীর প্রদেশে বিস্তৃত থাকে, তাই বাহিরে প্রযুক্ত তাপাদি সহসা ভিতরে প্রবেশ করিয়া স্নায়ুমণ্ডলীকে উত্তেজিত করিতে পারে না।

স্নায়ুর সাহায্যে উত্তেজনা প্রবাহিত হইতে একটু সময় লয়। মানবদেহের স্নায়বিক উত্তেজনা প্রতি সেকেন্ডে একশত দশ ফুট করিয়া চলে। কতকগুলি নিম্নশ্রেণির প্রাণীর স্নায়ু এমন অপূর্ণ যে কোনো উত্তেজনাকে তাহা সেকেন্ডে দুই ইঞ্চির অধিক দূরে লইয়া যাইতে পারে না। উদ্ভিদের স্নায়ু থাকিলে তাহার উত্তেজনা-পরিবহণের নির্দিষ্ট বেগ থাকারও সম্ভাবনা। জগদীশচন্দ্র নানা জাতীয় উদ্ভিদের স্নায়বিক বেগও আবিষ্কার করিয়াছেন। সতেজ লজ্জাবতী লতার স্নায়ু সেকেন্ডে চৌদ্দ ইঞ্চি বেগে উত্তেজনা বহন করিতে পারে। গাছ যখন পরিশ্রান্ত হইয়া দুর্বল থাকে তখন এই বেগের পরিমাণ কমিয়া আসে, বিশ্রাম লাভ করিলে সেই বেগই বৃদ্ধি পায়। অনেক নিম্নশ্রেণির প্রাণীর তুলনায লজ্জাবতীর স্নায়ু অধিকতর সবল ও কার্যক্ষম।

আমাদের ঘরকন্নার দিক দিয়া দেখিলে, পূর্বোক্ত আবিষ্কার হইতে অনেক উপকার হইবে বলিয়া মনে হয়। মানুষের স্নায়ুমণ্ডলী কী প্রকারে বিফল হইয়া পক্ষাঘাত প্রভৃতি রোগের উৎপত্তি করে, তাহা আমাদের ঠিক জানা নাই। কাজেই এই সকল ব্যাধির চিকিৎসা পদ্ধতি সম্বন্ধেও আমাদের জ্ঞান নিতান্ত অল্প। তার উপরে উচ্চশ্রেণির প্রাণীর স্নায়ুমণ্ডলী এত জটিল যে, সেই জটিলতা ভেদ করিয়া স্নায়বিক বিকৃতির কারণ নির্ণয় করা অসাধ্য হইয়া দাঁড়ায়। কিন্তু উদ্ভিদের স্নায়ুজাল একেবারে জটিলতা বর্জিত। সুতরাং উদ্ভিদের স্নায়ু কী প্রকারে বিকল হয় এবং সেই বিকলতাকে কী ঔষধ প্রয়োগ করিয়া দূর করা যায়, তাহা নির্ণয় করা কঠিন নয়। মানবদেহের স্নায়বিক পীড়ার চিকিৎসা প্রণালী গাছের চিকিৎসার দ্বারা আবিষ্কৃত হইবে বলিয়া খুবই আশা হইতেছে।

প্রাণীর হৃৎপিণ্ড একটি অদ্ভুত যন্ত্র। ভ্রুণ অবস্থা হইতে মৃত্যুকাল পর্যন্ত ইহার কার্যের বিরাম নাই। ইহাকে চালাইবার জন্য চেষ্টার প্রয়োজন হয় না। ইহা তালে-তালে আপনিই চলিয়া প্রাণীর সর্বাঙ্গে নিয়ত রক্তের প্রবাহ বহাইতে থাকে। শারীর বিজ্ঞানের এত উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও হৃদযন্ত্রের অনেক ব্যাপার আজও রহস্যাবৃত হইয়া রহিয়াছে। সেই সকল রহস্যের মীমাংসা করিতে গেলে প্রাণীর হৃৎপিণ্ডের জটিল যন্ত্রকে ব্যবচ্ছেদ করিয়া পরীক্ষা করিলে চলে না; সরল যন্ত্রের কাজ বুঝিয়া ক্রমে জটিলতার দিকে অগ্রসর হইতে পারিলেই শুভফল পাওয়া যায়।

প্রাণীর হৃদপিণ্ডের ন্যায় কোনো যন্ত্র যে উদ্ভিদদেহে আছে এ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকেরা তাহা জানিতেন না। আচার্য জগদীশচন্দ্র "বনচাঁড়াল" গাছে হৃদপিণ্ডের অনুরূপ একটি অংশ আবিষ্কার করিয়াছেন, এবং তাহা যে হৃদযন্ত্রের মতোই তালে-তালে চলে তাহা দেখাইয়াছেন। বনচাড়ালের পাতার উঠানামার কথা উদ্ভিদবিদগণ জানিতেন। কিন্তু উপযুক্ত যন্ত্রের অভাবে কেন এই গাছের পাতা আপনাআপনি নড়াচড়া করে তাহা নির্ণয় করা হয় নাই। জগদীশচন্দ্র ইহাকে তাঁহার স্বহস্তনির্মিত যন্ত্রে ফেলিয়া এবং তাহার হাতে কলম গুঁজিয়া দিয়া নিজের বৃক্তান্ত নিজেকে দিয়াই লিখাইয়া লইয়াছেন। ইহা হইতে বুঝা যাইতেছে, বনচাড়ালের পাতার নৃত্য এবং প্রাণীর হৃদপিণ্ডের স্পন্দন একই ব্যাপার।

হহৃদযন্ত্রের উপর ঈথর নামক রাসায়নিক দ্রব্যটির অনেক কাজ দেখা যায়। অল্প ঈথরে যন্ত্রের ক্রিয়া বৃদ্ধি পায়; অধিক প্রয়োগ করিলে অবসাদ আসে এবং শেষে ক্রিয়া লোপ পাইয়া যায়। সুস্থ বনচাঁড়ালকে কাচের আবরণের মধ্যে রাখিয়া জগদীশচন্দ্র পরীক্ষা করিয়াছিলেন। অল্প ঈথর বাষ্প পাত্রে প্রবিষ্ট হইবা মাত্র উহার পাতা জোরে-জোরে ওঠানামা করিতে আরম্ভ করিয়াছিল, কিন্তু বাষ্পের পরিমাণ অধিক হইলে সেরকম জোরে পাতা নাড়িতে পারে নাই। 

অধিক ঈথর প্রয়োগে যেমন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া ক্রমে লোপ পাইতে থাকে, গাছটির পাতার নৃত্য সেই রকমে বন্ধ হইয়া আসিয়াছিল।

প্রাণীর হৃদযন্ত্রে ক্লোরোফর্মের যে সকল কাজ দেখা যায়-বনচাঁড়ালে জগদীশচন্দ্র অবিকল সেই সকল দেখিতে পাইয়াছেন। বেশি ক্লোরোফর্ম দিবামাত্র পাতার স্পন্দন বন্ধ হইয়া আসিয়াছিল; তারপরে আধঘণ্টাকাল নানা প্রকারে সেবা শুশ্রুষা করায়, তাহাতে মৃদু স্পন্দন শুরু হইয়াছিল।

প্রাণীর ন্যায় উদ্ভিদেরও হৃদযন্ত্র আছে কিনা, এই প্রশ্নের মীমাংসায় যে জীববিজ্ঞানের খুব গৌবব বৃদ্ধি হইয়াছে একথা আমরা মনে করি না। উদ্ভিদের দেহে হৃদযন্ত্রের ন্যায় কোনো অংশে স্বতঃস্পন্দন ধরা পড়ায় প্রাণীর স্বতঃস্পন্দনের যে ব্যাখ্যান পাওয়া যাইতেছে, তাহাই উল্লেখযোগ্য। প্রাণীর হৃৎপিণ্ড কেন আপনা হইতে স্পন্দিত হয়, জিজ্ঞাসা করিলে প্রাণীবিদগণকে নিরুত্তর থাকিতে দেখা যায়। খুব চাপাচাপি করিয়া ধরিলে তাঁহারা বলেন দেহের ভিতর হইতে শক্তি সঞ্চয় করিয়া যন্ত্র স্বতঃস্পন্দন দেখায়। সেই সঞ্চিত শক্তিই "জীবনী শক্তি"। বলাবাহুল্য, এই ব্যাখানকে কখনই সৎ ব্যাখ্যান বলা যায় না। জগদীশচন্দ্র ইহা গ্রাহ্য করেন নাই। তিনি বলেন, বাহিরের শক্তি দিয়া যে স্পন্দনকে রুদ্ধ করা যায় এবং চালানো যায়. তাহার মূলে ভিতরকার শক্তির কাজ হইতে পারে না; তাঁহার মতে প্রাণী এবং উদ্ভিদের স্বতঃস্পন্দন বাহিরের শক্তিরই কার্য। বাহিরে শক্তির অভাব নাই, জল বাতাস আলোক বিদ্যুৎ সকলই শক্তিময়। ঈথর এবং ক্লোরোফর্ম প্রভৃতি দ্রব্যের শক্তি যেমন বাহির হইতে আসিয়া দেহের ওপবে কার্য দেখায়, সেই প্রকার জলবায়ু ও তাপালোক প্রভৃতির শক্তিও নিয়ত দেহের উপরে পড়িয়া স্বতঃস্পন্দন শুরু করে। জগদীশচন্দ্রের সিদ্ধান্তটি মোটামুটি এই যে, জীবন ধারণের জন্য যতটুকু শক্তির প্রয়োজন উদ্ভিদগণ তাহার চেয়ে অনেক অধিক শক্তি বাহির হইতে সংগ্রহ করিয়া নিজেদের দেহে সঞ্চিত রাখিতে চায় কিন্তু এই প্রকার শক্তিকে সংযত করিয়া রাখার ব্যবস্থা তাহাদের দেহে নাই। কাজেই অতিরিক্ত শক্তি উদ্ভিদের পাতার ওঠানামা প্রভৃতি স্বতঃস্পন্দনে দেখাইয়া ব্যয় কবে।

উদ্ভিদ কী প্রকারে বৃদ্ধি পায়, ইহাও বিজ্ঞানের একটা প্রকাণ্ড সমস্যা। পুঁথিপত্রে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়, কিন্তু তাহাতে মনের খটকা মিটে না। পূর্বোক্ত সিদ্ধান্তের সাহায্যে উদ্ভিদের বৃদ্ধিরও ব্যাখ্যান পাওয়া গিয়াছে।

জগদীশচন্দ্রের নিজের পরিকল্পিত "ক্রেস্কোগ্রাফ" নামক যন্ত্রটি অতি আশ্চর্যজনক। ইহার সাহায্যে তিনি উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অসাধ্য সাধন করিয়াছেন। কোন গাছ প্রতিদিন কতখানি করিয়া বাড়িল, তাহা সপ্তাহে বা মাসের গড় হিসাব করিয়া আমরা বলিতে পারি। বলাবাহুল্য এই প্রকার হিসাব কখনই সূক্ষ্ম হয় না, একটা মোটামুটি আন্দাজ পাওয়া যায় মাত্র। পূর্বোক্ত যন্ত্রটির সাহায্যে গাছ প্রতি সেকেন্ডে কতখানি করিয়া বাড়িতেছে তাহা হাজার লোককে একসঙ্গে দেখানো চলে। সেটি কী প্রকার আশ্চর্যজনক একবার ভাবিয়া দেখুন। কোন্ সার কোন গাছের বৃদ্ধির অনুকূল স্থির করিতে হইলে কৃষিতত্ত্ববিদকে মাসের পর মাস পরীক্ষা করিতে হয়। কিন্তু বসু মহাশয়ের এই যন্ত্রটির সাহায্যে তাহা কয়েক সেকেন্ডে স্থির হইয়া যায়।

বৃদ্ধি রোধ হইলে জীবদেহে ক্ষয়ের শুরু হয় এবং ক্ষয়ের পরিমাণ অধিক হইলে মৃত্যু দেখা দেয়। ইহাই মৃত্যুর নিয়ম। প্রাণীর মৃত্যুকাল নির্ণয় করা কঠিন নয়। মৃত্যুর পূর্বে তাহার সর্বাঙ্গে আক্ষেপ দেখা যায় এবং তারপরে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও দেহযন্ত্র নিশ্চল হইয়া আসে। ইহাই প্রাণীর মৃত্যু। কিন্তু মৃত্যু উদ্ভিদকে এমন ধীরে ধীরে আসিয়া আক্রমণ করে যে ঠিক কোন সময়ে তাহার মৃত্যু হইল, তাহা ঠিক বলা যায় না। পাতা বা ডালের অবস্থা দেখিয়া মৃত্যু ধরা যায় না। মৃত্যুর পরেও অনেকদিন পর্যন্ত শাখা পল্লবকে তাজা দেখিতে পাওয়া যায়। জগদীশচন্দ্র উদ্ভিদের মৃত্যু লক্ষণ অনুসন্ধান করিতে গিয়া তাহাতে প্রাণীর মৃত্যু জ্ঞাপক প্রত্যেক লক্ষণ দেখিতে পাইয়াছেন।

এই প্রসঙ্গে তিনি যে সকল পরীক্ষা দেখাইয়াছেন, তাহা অতি বিস্ময়কর। প্রথমে লজ্জাবতী লতাকে লইয়াই পরীক্ষা চলিয়াছিল। লজ্জাবতীর পাতা যন্ত্রের লেখনীর সহিত সূক্ষ সূতা দিয়া বাঁধা ছিল। পাতা হেলিয়া দুলিয়া উঠিয়া নামিয়া লেখনীর সাহায্যে নিজের অবস্থার কথা নিজেই ঢেউ খেলানো রেখা টানিয়া ব্যক্ত করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। ইহার ধারে লজ্জাবতীর গায়ে তাপ দিবার ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। ঠান্ডায় গাছে ভালো সাড়া পাওয়া যায় না; কাজেই যখন একটু একটু করিয়া তাপ বাড়ানো হইয়াছিল, তখন লজ্জাবতী বেশ জোরে সাড়া দিতে আরম্ভ করিয়াছিল। তখনও সে আসন্ন মৃত্যু কথা বুঝিতে পারে নাই। তাপের পরিমাণ ত্রিশ ডিগ্রি হইতে ক্রমে চল্লিশ এবং তারপরে পঞ্চাশ ও পঞ্চান্ন হইয়া দাঁড়াইলে যন্ত্রের লিপিফলকে সাড়ার পরিমাণ কমিয়া আসিতে লাগিল। বোধ হয় এই সময়েই লজ্জাবতী বুঝিয়াছিল, অবস্থা ভালো নয়। তারপরে উষ্ণতার পরিমাণ সেন্টিগ্রেডের ষাট ডিগ্রি হইবামাত্র, সেই তাপক্লিষ্ট লজ্জাবতী হঠাৎ একটা প্রবল সাড়া দিয়া নিষ্পন্দ হইয়া পড়িয়াছিল।

এই পরীক্ষা দেখিলে মৃতপ্রায় লজ্জাবতীর শেষ প্রবল সাড়াটিকে মৃত্যুর আক্ষেপ (Spasm) ব্যতীত আর কোনো কিছুই বলা যায় কি? একবার নয়, বারবার পরীক্ষা করিয়া জগদীশচন্দ্র ঠিক ষাট ডিগ্রি উষ্ণতার সুস্থ উদ্ভিদ মাত্রকেই মরিতে দেখিয়াছেন। তাজা পাতা পোড়াইতে গেলে তাহা আকুঞ্চিত হইয়া নিজেই নড়াচাড়া করে। কেবল তাপই আকুঞ্চনের একমাত্র কারণ নয়, পাতার মৃত্যু যন্ত্রণার আক্ষেপও ইহার অন্যতম কারণ। উদ্ভিদের এই প্রকার করুণা উদ্দীপক মৃত্যুর বিষয় যে শীঘ্র আবিষ্কৃত হইবে, কোনও বৈজ্ঞানিক কিছুদিন পূর্বে তাহা কল্পনা করিতে পারেন নাই।

একই বোঁটায় অনেক সময়ে বিচিত্র রকমের ফুল ফুটিয়া থাকিতে দেখা যায়। এই সকল ফুলের বর্ণ দিনে-দিনে পরিবর্তিত হয়। পাতাবাহার গাছে দিনে দিনে কত বিচিত্র রঙের একটা ছিটে ফোটা প্রকাশ পায়। আচার্য বসু মহাশয় এগুলির উৎপত্তি প্রসঙ্গে যে সকল কথা বলেন, তাহাও বিস্ময়কর। তাঁহার মতে পুষ্পপত্রের ওই বর্ণ-বৈচিত্র্য তাহাদের মৃত্যু- লক্ষণ। পাতা ও ফুলের দেহের বিশেষ বিশেষ স্থান যখন প্রাণহীন হয়, তখনই সেই সকল স্থানে বিচিত্রবর্ণ প্রকাশ পায়। উদ্ভিদের যে সৌন্দর্যকে আমরা এত আদর করি, তাহা মৃত্যুর বিবর্ণতা ব্যতীত আর কিছুই নয়।

সহ্য গুণ সকলের সমান নয়। যুবক ও সবল ব্যক্তি যে পীড়ার যন্ত্রণা সহ্য করিয়া আরোগ্য লাভ করে তাহাতেই বালক, বৃদ্ধ এবং দুর্বল ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। প্রাণীর এই ধর্মটিও জগদীশচন্দ্র উদ্ভিদে দেখিতে পাইয়াছেন। তিনি সদ্য অঙ্কুরিত গাছে তাপ প্রয়োগ করিয়া দেখিয়াছিলেন তাহার মৃত্যুর জন্য তাপের পরিমাণ ষাট ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়াইতে হয় নাই। 

অল্প তাপেই তাহার মৃত্য হইয়াছিল-এ যেন দুর্বল শিশুর মৃত্যু। সবল ও সুস্থ গাছকে তিনি বিদ্যুতের প্রবাহ দ্বারা প্রথমে দুর্বল করিয়া লইয়াছিলেন এবং পরে তাহাতে তাপ দিয়াছিলেন। দুর্বল গাছ সাঁইত্রিশ ডিগ্রি উষ্ণতায় মরিয়া গিয়াছিল। তারপরে ছুঁতের জল দিয়া একটি গাছকে অসুস্থ করাইয়া তাহাতে তাপ দেওয়া হইয়াছিল; বিয়াল্লিশ ডিগ্রিতেই সে মৃত্যু লক্ষ্মণ দেখাইয়াছিল।

এ পর্যন্ত যে সকল আবিষ্কারের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হইল, তাহার কথা আলোচনা করিলে, জগদীশচন্দ্রের চিন্তার ধারা কোন পথে চলিয়া গবেষণাকে সার্থক করিয়াছে, পাঠক তাহা বুঝিতে পারিবেন। জগৎ যতই বিচিত্র হউক না কেন, তাহা অনুপরমাণু যে একই মহাপ্রাণে প্রাণবান হইয়া আছে, তাহা জগদীশচন্দ্র এই ভারতের অতি প্রাচীন ঋষিবাক্য হইতে জানিতে পারিয়াছিলেন এবং তাহাতে বিশ্বাস করিতেন। এই জন্যই তিনি সজীব-নির্জীব ও প্রাণী উদ্ভিদের বাহ্য অনৈক্যে আস্থা স্থাপন না করিয়া অন্তরের কথা জানিবার জন্য সকলেরই কাছে উপস্থিত হইতে সাহসী হইয়াছিলেন। কেহ কোনও কথা গোপন করে নাই; সকলেই এক বাক্যে বলিয়াছিল-"আমরা সবাই এক"। এখনকার বৈজ্ঞানিক জাতিভেদের দিনে সত্যের সন্ধানে জড় প্রাণী ও উদ্ভিদের দ্বারস্থ হইয়া জগদীশচন্দ্র যে সাহসের পরিচয় প্রদান করিয়াছেন তাহার উপযুক্ত পুরস্কারই তিনি লাভ করিয়াছেন। 

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী

অধ্যাপক জগদীশচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার

আ "বিষ্কার না বলিয়া আবিষ্কারপরম্পরা বলা উচিত। কেন না, গত পাঁচ বৎসর ধরিয়া অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র কর্তৃক নূতন নূতন তথ্যের আবিষ্কার স্রোতের মতো ধারা বাঁধিয়া চলিতেছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলি নূতন তত্ত্বের নির্ণয় হইয়াছে, আবার প্রত্যেক নির্ণীত তত্ত্ব এক-একটা আঁধার দেশ আলোপূর্ণ করিয়া দিয়াছে-বিজ্ঞান-শাস্ত্রের ইতিহাসে ইহার তুলনা যে অত্যন্ত অধিক আছে, তাহা নহে।

আমাদের ছোট মুখে বড় কথা বলিতে ভয় হয়। কিন্তু সত্তর বৎসর পূর্বে যখন লন্ডনের রাজকীয় বিজ্ঞানসমাজের (রয়াল ইনস্টিটিউশনের) প্রাচীরাভ্যন্তর হইতে মাইকেল ফ্যারাডের আবিষ্কারপরম্পরা একের পর এক বাহির হইয়া বৈজ্ঞানিকমণ্ডলীর শ্বাসরোধের উপক্রম করিয়াছিল, সেই সত্তর বৎসরের প্রাচীন ইতিহাস কতকটা মনে আসে। কিন্তু আমাদের এত ছোট মুখে এত বড় কথা না আনাই ভালো।

অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র তাড়িত ঊর্মির অস্তিত্ব ধরিবার জন্য নূতন যন্ত্রের আবিষ্কার করিয়াছেন, প্রথম যখন শোনা যায়, তখন কথাটাতে বিশ্বাস হয় নাই। কেন না, বাঙালির মস্তিষ্কে হাজার চাষ দিয়াও বৈজ্ঞানিক ফসলের উৎপাদন অসম্ভব, ইহা তো একটা ধ্রুব বৈজ্ঞানিক সত্য বলিয়া বহু পূর্বে অবধারিত হইয়া গিয়াছিল।

কিন্তু যখন স্বচক্ষে দেখা গেল, একটা অতি ক্ষুদ্র বাক্সের ভিতর হইতে তাড়িত তরঙ্গ উৎপন্ন হইয়া আর একটা ছোটো বাক্সের ভিতর রক্ষিত লোহার তারের ওপর পতিত হইবামাত্র সেই তারে তাড়িত প্রবাহ উৎপন্ন হইতেছে, এবং প্রবাহকালে কম্পাসের কাঁটা নাড়া হইতে পিস্তলের আওয়াজ পর্যন্ত চলিতে পারিতেছে, তদা নাশংসে বিজয়ায় সঞ্জয়!

বস্তুতই সে দিন বিজয়ের দিন বটে; কেন না, এত অল্প আয়াসে এত বড় দুঃসাধ্য কাজ যে সাধিত হইতে পারে, তাহা ইহার পূর্বে শুনি নাই।

কয়েক বৎসর পূর্বে জার্মান অধ্যাপক হার্জ তাড়িত তরঙ্গের উৎপাদনের ও তাড়িত তরঙ্গের অস্তিত্বের প্রতিপাদনের উপায় বাহির করিয়াছিলেন, এবং পণ্ডিতেরা এই ব্যাপার লইয়া আন্দোলন আলোচনা করিতেছিলেন। কিন্তু সেই অস্তিত্বপ্রতিপাদন যে এত অল্প আয়াসে সম্পাদিত হইতে পারে, তাহা জানিতাম না। যাহাই হউক, বিজ্ঞানের রণক্ষেত্রে সেনানীগণ যেখানে যত দূর অগ্রসর হইতে পারেন নাই, আমাদের স্বদেশিয় এক ব্যক্তি সেখানে অগ্রণী হইয়াছেন, ইহা প্রকৃতই বিজয়বার্তা।

সেই দিন হইতে নূতন নূতন সংবাদ সহকারে ভারতবাসীর এই বিজয়বার্তা পৃথিবী জুড়িয়া ঘোষিত হইতেছে, ইহা অসীম আনন্দের কথা, কিন্তু আনন্দপ্রকাশে যেটুকু স্বাস্থ্যের ও সবলতার প্রয়োজন, সেইটুকু বল ও স্বাস্থ্য বুঝি আমাদের নাই।

ঘটনা বৃহৎ, কিন্তু এই বৃহৎ ঘটনা কীরূপে সংক্ষিপ্ত করিয়া পাঠকগণের সম্মুখে উপস্থিত করিব, তাহা বুঝিতেছি না।

ধাতুদ্রব্য কাহাকে বলে, বুঝাইতে হইবে না; কোন্ জিনিস ধাতু নহে, তাহাও বুঝাইতে হইবে না। ধাতু, যথা-সোনা, রূপা, তামা। ধাতু নহে-জল, বায়ু, ইট, কাঠ। কিন্তু যাহা ধাতু ও যাহা ধাতু নহে, উভয়ের অভ্যন্তরে যে আকাশ নামক সূক্ষ্ম পদার্থ আছে, তাহার স্বরূপ ঠিক বুঝাইয়া না দিলে অনেকেই হয়তো বুঝিবেন না। কিন্তু সে কথা বুঝাইবার এখন সময় নাই। তবে এই পর্যন্ত বলা যাইতে পারে যে, এই সূক্ষ্ম পদার্থ বিশ্ব ব্যাপিয়া বর্তমান, এবং সূর্যমণ্ডল ও নক্ষত্রমণ্ডলী হইতে সংবাদবহন এই আকাশের নিরূপিত কার্য। সূর্যের ও নক্ষত্রের শরীরগত পরমাণুগুলি এই আকাশে যে ধাক্কা দেয়, তাহাই ঢেউ উৎপাদন করিয়া আমাদের চোখে লাগে। সেই ঢেউয়ের ধাক্কা মস্তিষ্কে উপনীত হইলে যে অনুভূতি জন্মে, তাহাকেই বলি আলো ও তাহার অভাবই আঁধার। এবং সেই আলোকের অনুভূতি দ্বারা আমরা সিদ্ধান্ত করিয়া লই, ওইখানে ওটা সূর্য, আর ওইখানে ওটা একটা তারকা। এই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আকাশের স্থিতিস্থাপকতা এত বেশি যে, সেই ঢেউগুলি প্রায় সেকেন্ডে লক্ষ ক্রোশ বেগে আকাশ বাহিয়া চলিয়া থাকে।

আলোকের উৎপাদক শক্তি সেই আকাশের ঢেউ, কিন্তু তাড়িত শক্তি ও চৌম্বক শক্তি নামে আরও দুইটা আমাদের অতিপরিচিত শক্তি আছে, সেই দুইটার সহিত আকাশের কোনো সম্বন্ধ আছে কি না, সত্তর বৎসর পূর্বে তাহা কাহারও কল্পনায় আসে নাই। উপরে যে মনস্বী পুরুষ মাইকেল ফ্যারাডের নাম উল্লেখ করিয়াছি, তাঁহারই আবিষ্কারপরম্পরা প্রথমে সম্ভাবনা দেখাইয়া দেয় যে, সেই আলোকবাহী আকাশপদার্থই তাড়িত শক্তির ও চৌম্বক শক্তিরও আধার হইতে পারে।

তৎপরে মাক্সোয়েল, ফ্যারাডের আবিষ্কৃত তত্ত্বগুলিকে ভিত্তিভূমি করিয়া প্রায় প্রতিপন্ন করেন যে, সেই আকাশ মধ্যে কোনোরূপ টান পড়িলেই তাড়িত শক্তির ও আকাশ মধ্যে কোনোরূপ ঘূর্ণি উৎপন্ন হইলেই চৌম্বক শক্তির উৎপত্তি হয়। একখানা তামার থালা ও একখানা দস্তার থালা উপরি উপরি স্পর্শ করিয়া দুইখানাকে বিচ্ছিন্ন করিলেই, উভয়ের মধ্যগত আকাশে, অর্থাৎ উভয়ের ব্যবধানভূত বায়ুর মধ্যস্থ আকাশে টান পড়ে; তখন আমরা বলি, থালা দুখানা তাড়িতযুক্ত হইয়াছে। এই টানটা বায়ুর মধ্যগত আকাশেই পড়ে, এবং বায়ুর ন্যায় যে সকল দ্রব্য ধাতু নহে, তাহাদের মধ্যস্থ আকাশেই পড়ে; ধাতুদ্রব্যের মধ্যস্থ আকাশে এই টান সংক্রান্ত হয় না। ধাতুর মধ্যে আকাশটা যেন স্থিতিস্থাপকতাবর্জিত; যেন উহা টান সহিতে পাবে না। আর অপধাতু বা অধাতব পদার্থের মধ্যস্থ আকাশ যেন টানসহ। অধাতব পদার্থের আকাশ যে রবারের মতো বা ইস্পাতের মতো, আর ধাতব পদার্থের মধ্যস্থ আকাশ যেন মোমের মতো বা কাদার মতো। ধাতব পদার্থের মধ্যস্থ আকাশে এই টান দিলে সেই আকাশ যেন মোমের মতো বা কাদার কত বা গুড়ের মতো বা জলের মতো সরিয়া যায় ও গড়াইয়া যায়, উহাতে টান পড়ে না; এইরূপে উহাতে তাড়িত প্রবাহ উৎপন্ন হয়। আর অধাতব পদার্থের অভ্যস্তরস্থিত আকাশে টান দিলে উহা রবারের মতো বা স্প্রিং-এর মতো খেঁচিয়া ধরে; উহাতে তাড়িত প্রবাহ জন্মে না।

ধাতুপদার্থের উদাহরণ একটা তামার তার। এই তারের ভিতর আকাশে টান পড়িলে উহা ক্রমেই সরিয়া যায় ও গড়াইয়া যায় ও এইরূপে উহার মধ্যে তাড়িত প্রবাহ জন্মে। 

এই তাড়িত প্রবাহের সাহায্যে আমরা আজকাল টেলিগ্রাফের সংবাদ প্রেরণ করি ও টেলিফোনের শব্দ চালনা করি ও ট্রাম-পথে গাড়ি চালাই ও রাজপথে ও গৃহমধ্যে আলো জ্বালি।

তারপথে এই তাড়িত প্রবাহ চলিবার সময় তাহার চতুঃপার্শ্বে বাহিরে বায়ুমধ্যস্থ আকাশে ঘূর্ণাবর্ত উপস্থিত হয়। সেইখানে একটা লোহার কাঁটা ধরিলে লোহার অণুগুলা সেই ঘূর্ণাবর্তে পড়িয়া ঘুরিয়া যায়, কাঁটাটাও ঘুরিয়া গিয়া সেই আবর্তের পাকের অনুকূলে দণ্ডায়মান হয়। এই ব্যাপারের নাম চৌম্বক ব্যাপার, এবং সেই তদবস্থ লোহার কাঁটার নাম চুম্বকের কাঁটা বা কম্পাসের কাঁটা বা দিগদর্শন-শলাকা।

মাক্সোয়েল দেখাইয়াছিলেন, সেই আকাশের কোন অংশে একটা টান দিয়া ছাড়িয়া দিলে, সেই অংশটা কিছুক্ষণ দুলিবার সম্ভাবনা; একটা স্প্রিংকে যেমন টানিয়া ছাড়িয়ে দিলে উহা দুলিতে থাকে। এবং আকাশ যখন বিশ্বব্যাপী, তখন উহার এক অংশে এইরূপ একটা দোলন ঘটাইয়া দিলে সেই আন্দোলনের ধাক্কায় চারিদিকে ঢেউ উঠিয়া দিগ্বিদিকে ছুটিবার সম্ভাবনা। আলোকের ঢেউগুলি যদি আকাশপথে সেকেন্ডে লক্ষ ক্রোশ বেগে চলিতে পারে, তবে এই তাড়িতের টানে উৎপন্ন ঢেউগুলিও ঠিক সেই লক্ষ ক্রোশ বেগেই চলিবার সম্ভাবনা।

মাক্সোয়েল বলিয়াছিলেন, আকাশই যদি তাড়িত শক্তির আধার হয়, তাহা হইলে আকাশে যখন ছোট ছোট আলোকের ঊর্মি চলিয়া থাকে, তবে বড় বড় তাড়িত ঊর্মিরও আকাশপথে চলিবার সম্ভাবনা রহিয়াছে।

সম্ভাবনা আছে বটে, কিন্তু সম্ভাবনাই প্রমাণ নহে। আকাশই তাড়িত শক্তির আধার বটে কি না; আর আধার হইলেও আকাশে সেইরূপ বড় বড় ঢেউ উঠে কি না, তাহা প্রত্যক্ষ প্রমাণ আবশ্যক। আলোক বহন করে যে আকাশ, সেই আকাশই তাড়িত শক্তির আধার না হইতেও পারে। তজ্জন্য স্বতন্ত্র আকাশ বা আকাশতুল্য পদার্থের অস্তিত্ব অসম্ভব নহে। এবং তাড়িতের ঢেউ একটা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অপরিচিত নূতন ব্যাপার-কেবল অনুমান বা যুক্তিবলে ইহার অস্তিত্ব সপ্রমাণ হইতে পারে না, প্রত্যক্ষ নিদর্শন আবশ্যক।

হাৎর্জ সেই প্রত্যক্ষ প্রমাণ উপস্থিত করেন। প্রত্যক্ষ প্রমাণের জন্য দুইটা যন্ত্রের প্রয়োজন; একটাতে তাড়িত তরঙ্গ উৎপাদন করিবে, আর একটাতে উহার অস্তিত্ব প্রতিপাদন করিবে। প্রথম যন্ত্রে আকাশে একবার টান দিয়া ছাড়িয়া দিলেই আন্দোলন জন্মিবে; দ্বিতীয় যন্ত্রে সেই আন্দোলনের ধাক্কা আসিয়া পৌঁছিলে সে কোনও রকমে সাড়া দিবে। আলোকের সঙ্গে তুলনা কর। প্রথমটা যেন দীপশিখা, সেই স্থলে আকাশে ধাক্কা লাগিয়া আলোকতরঙ্গ উৎপন্ন হইতেছে। দ্বিতীয়টা যেন আমাদের চোখ, সেখানে সেই তরঙ্গ প্রতিহত হইয়া আলোকের অস্তিত্ব জ্ঞাপন করিতেছে।

টান দিয়া আকাশে ধাক্কা দিবার উপায় পূর্ব হইতেই বর্তমান ছিল। মেঘের কোলে যখন বিদ্যুৎল্লতা চমক দেয়, তখন আকাশে সহসা ধাক্কা পড়ে। বৈদ্যুতিক যন্ত্রে যখন ছোট স্ফুলিঙ্গ উৎপন্ন হয়, তখনও আকাশে সহসা ধাক্কা লাগে। বিড়ালের গায়ে একটা চাপড় দিলেও যে আকাশে ধাক্কা না লাগে, এমন নহে।

হাৎর্জের বাহাদুরী এই দ্বিতীয় যন্ত্রটির আবিষ্কারে-যে যন্ত্রটি তাড়িত তরঙ্গের পক্ষে চক্ষুরিন্দ্রিয়ের মতো কাজ করে। দূরোৎপন্ন সুদীর্ঘ তাড়িত তরঙ্গ আকাশ বহিয়া এই যন্ত্রে ধাক্কা দিলে সেই যন্ত্রমধ্যেও তাড়িতের খেলা আরম্ভ হয়, এবং সেই তাড়িতের খেলার বিবিধ প্রত্যক্ষ ফল দেখা যায়। তাড়িতের খেলার প্রত্যক্ষ ফল নানাবিধ। আলো জ্বালা হইতে গাড়ি টানা পর্যন্ত তাহার উদাহরণ।

হাৎর্জ এই যন্ত্রের উদ্ভাবন করিয়া দেখান, বাস্তবিকই আকাশের মধ্য দিয়া তাড়িতের ঢেউ চলিয়া থাকে। দূরে একটা ধাতুপৃষ্ঠে তাড়িত প্রবাহ নাচাইয়া দিলে, সেই তাড়িত নৃত্য বায়ুর ব্যবধান অর্থাৎ বায়ুমধ্যস্থ অদৃশ্য আকাশের ব্যবধান ভেদ করিয়া, সেই আকাশপথে সঞ্চালিত হইয়া, দূরস্থিত আর একখানা ধাতুপৃষ্ঠে তাড়িত প্রবাহ নাচাইয়া দেয় ও সেই নর্তনের প্রত্যক্ষ ফল চক্ষুর গোচর করিয়া দেয়। মাক্সোয়েল যাহা জ্ঞানচক্ষুতে দেখিয়াছিলেন, হার্জ তাহা চর্মচক্ষুর বিষয়ীভূত করিয়া দিলেন।

তাড়িত প্রবাহ ও তাড়িত তরঙ্গ, এই দুইটি শব্দ পুনঃপুনঃ ব্যবহার করিয়াছি ও আবার ব্যবহার করিতে হইবে। পাঠকগণকে সাবধান করিয়া দেওয়া উচিত, প্রবাহ ও তরঙ্গ, উভয়ের অর্থে তফাত আছে। প্রবাহের বশে পদার্থ এক মুখে চলে, যেমন-নদীতে স্রোতের জল। আর তরঙ্গের বশে গতি ইতস্তত ঘটে; নদীর তরঙ্গে তরণী উঠা-নামা করে ও দোদুল্যমান হয়। সেইরূপ তাড়িতের প্রবাহে আকাশ একমুখে গড়াইয়া চলে-এই প্রবাহে টেলিগ্রাফের খবর চলে। আর তাড়িতের তরঙ্গে আকাশ ইতস্তত দুলিতে থাকে; দোদুল্যমান হয়। ধাতুফলকের পিঠে তরঙ্গ সংক্রামিত হইলে আকাশ একবার এধার যায়, একবার ওধার যায়। বর্তমান প্রবন্ধের সর্বত্র এই অর্থগত প্রভেদটি মনে রাখা আবশ্যক। তরঙ্গের সহিত প্রবাহের এই পার্থক্য বুঝাইবার জন্য ওপরে 'দোলন', 'আন্দোলন', 'নৃত্য', 'নতন', 'নাচ' প্রভৃতি স্পন্দনবোধক শব্দের ব্যবহার করা গিয়াছে।

এখন দেখা গেল, আকাশমধ্যে ছোট বড় বিবিধ ঊর্মি উৎপন্ন হইয়া সেকেন্ডে লক্ষ ক্রোশ বেগে চলে। ছোট ছোট ঢেউগুলির নাম আলোকতরঙ্গ, বড় বড় ঢেউগুলির নাম তাড়িত তরঙ্গ; ছোট বড় সকল ঢেউ আকাশতরঙ্গ। উপযুক্ত ঊর্মি নির্দেশক যন্ত্র থাকিলেই আমরা সেই সকল উর্মির অস্তিত্ব আবিষ্কার করিতে পারি। আমাদের চক্ষু ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র আকাশতরঙ্গ, যাহার নাম আলোক, তাহার পক্ষে ঊর্মিনির্দেশক যন্ত্রের কাজ করে। উপযুক্ত ঊর্মিনির্দেশক যন্ত্রের অভাবেই হাৎর্জের পূর্বে কেহ বড়-বড় আকাশতরঙ্গের অস্তিত্ব আবিষ্কার করিতে পারেন নাই।

হাৎর্জের পরবর্তীকালে এই ঊর্মিনির্দেশক যন্ত্রের প্রভূত উন্নতিসাধন হইয়াছে। একটা নলের ভিতর লোহার গুঁড়া পুরিলে সেই লৌহচূর্ণের স্তর ভেদ করিয়া তাড়িত প্রবাহ চলিতে পারে না। কিন্তু দূর হইতে আকাশতরঙ্গ আসিয়া এই লোহাচুরে পতিত হইলেই কী জানি, কীরূপে উহার তাড়িতপ্রবাহ-প্রতিরোধের ক্ষমতা কমিয়া যায়; তখন উহার ভিতর দিয়া অবাধে তাড়িত প্রবাহ চলিতে পারে। এই তাড়িত প্রবাহ দ্বারা তখন তুমি চুম্বকের কাঁটা নাড়াইয়া দিতে পারো বা আলো জ্বালিতে পারো বা পিস্তলের আওয়াজ করিতে পারো বা গাড়ি টানিতে পারো। এই লোহাচুরে ঊর্মিনির্দেশক যন্ত্রের কাজ চলিতে পারে। এইরূপ যন্ত্রকে ইংরাজিতে Coherer বলে।

ধাতুচূর্ণের কণিকাগুলির মাঝে কেবল ফাঁক। নিরেট ধাতুপদার্থে তাড়িত প্রবাহ স্বচ্ছন্দে যাইতে পারে, কিন্তু ধাতুচূর্ণে এই ফাঁক পার হইয়া যাইতে পারে না। অধ্যাপক লজ অনুমান করেন যে, আকাশ-তরঙ্গের প্রভাবে কোনো মতে এই ফাঁকগুলি বুজিয়া যায়; কণিকাগুলি পরস্পর সংযুক্ত ও সংহত হয়; তখন তাড়িত প্রবাহ অবাধে চলে। এই cohesion বা সংযোগসাধন বা সংহতিসাধন দ্বারা কাজ করে বলিয়া যন্ত্রের নাম coherer।

ধাতুর গুঁড়া না হইলেই যে ('oherer প্রস্তুত হয় না, এমন নহে। অধ্যাপক জগদীশচন্দ্রের Coherer কতকগুলি তারে নির্মিত হইয়াছিল। তারে-তারে স্পর্শ থাকে, স্পর্শস্থলে তাড়িত তরঙ্গের ধাক্কা পড়িলেই তারের প্রবাহ পরিচালন শক্তি জন্মে।

ফলে যেরূপেই হউক, তাড়িত তরঙ্গেব ধাক্কা পাইলে অপরিচালক দ্রব্যে পরিচালকতা জন্মে, অথবা কুপরিচালক দ্রব্য সুপরিচালক হইয়া যায়। Coherer অর্থাৎ ঊর্মিনির্দেশক যন্ত্রগুলির মূল তথ্য এই।

মার্কনি যে ঊর্মিনির্দেশক যন্ত্র নির্মাণ করিয়াছেন, তদ্বারা ত্রিশ চল্লিশ ক্রোশ বা ততোধিক দূর হইতে সমাগত তাড়িত তরঙ্গ অবলীলাক্রমে ধরা পড়িতেছে।

এইখানে একটা কথা বলিয়া রাখা আবশ্যক। অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র ও ইতালির মার্কনি বিনা তারে সংবাদ প্রেরণে সমর্থ হইয়াছেন, এই বার্তা প্রায় সমকালে প্রচারিত হয়। মার্কনি এই কয় বৎসর মধ্যে বহু ক্রোশ দূর হইতে বিনা তাবে সংবাদ প্রেরণে সমর্থ হইয়াছেন। জগদীশচন্দ্রের যন্ত্র বহু দূর হইতে সংবাদ প্রেরণের জন্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে নাই। তাঁহার বন্ধুগণ এই জন্য কতকটা হতাশ হইয়া পড়িতেছিলেন। জগদীশবাবু তাঁহার বন্ধুগণের নিকট অনুযোগভাগী হইয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার যে সংবাদপ্রেরণের ব্যবসায়ে খ্যাতিলাভে মতি হয় নাই, এ জন্য স্বদেশ কালে তাঁহার মাহাত্ম্য বুঝিতে পারিবে। ব্যবসায়ে লিপ্ত হইলে তাঁহার অর্থাগমের সম্ভাবনা থাকিত বটে, কিন্তু আজ আমরা যেসকল নূতন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সন্ধান পাইয়া চমকিত ও বিস্মিত হইতেছি, সে আশা আমাদিগকে পরিত্যাগ করিতে হইত।

যাহা হউক, তৎকালে জগদীশচন্দ্রের উদ্ভাবিত ঊর্মিনির্দেশক যন্ত্র অতি অদ্ভুত উদ্ভাবনা বলিয়া গৃহীত হইয়াছিল। সেই শ্রেণির বা তদুদ্দেশ্যে নির্মিত আর সকল যন্ত্রই উহার নিকট পরাজয় স্বীকার করিয়াছিল। স্বোপ্তাবিত যন্ত্রের সাহায্যে তিনি তাড়িত তবঙ্গের বিবিধ ধর্মনির্ণয়ে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন; প্রকৃতির বিবিধ গুপ্ত রহস্য আবিষ্কারে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। এবং নিত্য নূতন রহস্য উদঘাটন করিয়া যশস্বী হইতেছিলেন। অচিরে প্রতিপন্ন হইল যে.--আকাশবাহিত তাড়িত তরঙ্গে ও আকাশবাহিত আলোকতরঙ্গে কোন মৌলিক প্রভেদ বতমান নাই।

আলোকতরঙ্গের কতকগুলি বিশেষ ধর্ম আছে। ধাতুপদার্থের মধ্যে আলোকতরঙ্গ প্রবেশ করিতে পারে না। এইজন্য ধাতুপদার্থ অনচ্ছ হয়।

মসৃণ ধাতুনির্মিত প্রাচীরের পিঠে ঠেকিলে আলোকতরঙ্গ প্রত্যাহত হইয়া ফিরিয়া আসে

বা প্রতিফলিত বা পরাবর্তিত হয়।

সান্দ্র পদার্থের মধ্য দিয়া যাইতে হইলে উহার গতির মুখ ঘুরিয়া যায়, অর্থাৎ আলোকরশ্মি তির্যকগামী হইয়া তিরোবতিত হয়।

দেখা গেল যে, আকাশতরঙ্গেও ঠিক এই ধর্ম বতমান।

এই যন্ত্রের সাহায্যে তাড়িত তরঙ্গের যেসকল অজ্ঞাতপূর্ব ধর্ম আবিষ্কৃত হইয়াছিল, তাহা এখন পুরাণ কথা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। তাড়িত তরঙ্গ একপানা বাঁধা কেতাবের পাতার ভিতর দিয়া অবাধে চলিয়া যায়, আর বহিখানা ঘুরাইয়া ধরিলে আর অবাধে যাইতে পারে না; চুলের গোছার ভিতর চলে, ঘুরাইয়া ধরিলে আর অবাধে চলে না; কাষ্ঠদণ্ডের ভিতরে আঁশগুলি কোন মুখে রহিয়াছে, তাহা ঠিক করিয়া বলিয়া দেয়; প্রস্তরখণ্ডের কোনদিকে পরিচালকতা বেশি, কোন্দিকে কম, তাহা ঠিক ধরিয়া দেয়; ইত্যাদি তত্ত্ব চারি-পাঁচ বৎসর পূর্বে নূতন আবিষ্কৃত হইলেও এখন পুরাতন হইয়া পড়িয়াছে। এখন আর তাহার পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নাই। সম্প্রতি তাড়িত তরঙ্গের যে অভিনব ধর্ম বৈজ্ঞানিকগণের চমক লাগাইবার উপক্রম করিয়াছে, তাহার কিঞ্চিৎ বিবরণ দিয়া প্রবন্ধের উপসংহার করা যাউক।

ধাতুচূর্ণ তাড়িত প্রবাহের অপরিচালক, কিন্তু ধাতুচূর্ণের উপর তাড়িত তরঙ্গের ধাক্কা পড়িলে উহার পরিচালকতা সহসা বৃদ্ধি পায়; তখন সেই ধাতুচুর্ণ বাহিয়া তাড়িত প্রবাহ চলিতে পারে। ইহা পুরাণ কথা, এবং ধাতুচূর্ণের এই শক্তি অবলম্বন করিয়া আধুনিক ঊর্মিনির্দেশক Coherer যন্ত্র সকল নির্মিত হইয়াছে। ধাতুচূর্ণের কণিকাগুলির মধ্যে একটা কিছু বিকার উৎপন্ন হয়, যাহার ফলে এইরূপ ঘটে। কণিকাগুলিকে আবার স্বভাবে আনিতে হইলে একটা আঙলের ঠোকা দেওয়া প্রয়োজন হয়; একবার নাড়িয়া দিলে তবে উহারা প্রকৃতিস্থ হইয়া আপনার স্বাভাবিক অপরিচালকত্ব শক্তি পুনঃপ্রাপ্ত হয়।

দুই বৎসর হইল জগদীশচন্দ্র দেখান, এইরূপ নাড়া দেওয়া নিতান্তই আবশ্যক নহে। এমন অনেক ধাতুদ্রব্য আছে, যাহাকে নাড়া না দিলেও আপনা আপনি স্বভাবে ঘুরিয়া আইসে। একটা তারে একটা মোচড় দিলে প্রথমে পাক লাগে, কিন্তু তারটার পাক আবার আপনা হইতেই খুলিয়া যায়, কতকটা সেইরূপ।

ফলে স্থিতিস্থাপক দ্রব্যমাত্রেরই স্থিতিস্থাপকতার একটা সীমা আছে। স্থিতিস্থাপক তারকে মোচড়ান দিলে পাক লাগে, আবার স্থিতিস্থাপকতাগুণে আপনা হইতেই সেই পাক খুলিবারও প্রবৃত্তি থাকে। কিন্তু এই সীমার ভিতরে মোচড় দিলেই পাক খুলে। সীমা ছাড়াইয়া গেলে, আর সে পাক আপনা হইতে খুলে না। তখন জোর করিয়া আবার পাক খুলিতে হয়।

ইস্পাতে ও সীসাতে এইখানে প্রভেদ; কুঞ্চিত করিয়া ছাড়িয়া দিলে আপনা হইতে ইস্পাত ঘুরিয়া আসে। সীসাকে বাঁকাইয়া ধরিলে উহার আকুঞ্চন স্থায়ী হইয়া যায়।

ধাতুপদার্থের অণুগুলোতেও যেন এইরূপ একটা স্থিতিস্থাপকতা ধর্ম আছে। তাড়িত তরঙ্গের ধাক্কা পাইয়া অণুগুলি স্বস্থানচ্যুত হইয়া পড়ে ও আপনার স্থিতিস্থাপতাগুণে আবার স্বস্থানে ঘুরিয়া আসিবার চেষ্টা করে। কিন্তু ধাক্কাটা যদি অতিমাত্রায় প্রবল হইয়া উহাদিগকে স্থিতিস্থাপকতার সীমা ছাড়াইয়া স্থানভ্রষ্ট করিয়া দেয়, তাহা হইলে আর আপনা হইতে ফিরিয়া আসিতে পারে না। তখন জোর করিয়া নাড়া দিয়া আঙুলের ঠেলা দিয়া উহাদিগকে ঘুরাইয়া আনিতে হয়। এই জন্য coherer যন্ত্রে আঙুলের ঠোকর দেওয়া আবশ্যক হয়।

দ্বিতীয় আবিষ্কার আরও বিচিত্র। এ পর্যন্ত জানা ছিল যে, তাড়িত তরঙ্গের ধাক্কা পাইলে ধাতুচূর্ণের তাড়িতপ্রবাহ পরিচালন-ক্ষমতা বাড়িয়া যায়। জগদীশচন্দ্র দেখান, কতিপয় ধাতুর পরিচালনক্ষমতা বাড়ে, কিন্তু অনেক ধাতুর পরিচালনক্ষমতা আবার কমিয়া যায়। এইরূপে "সোনা রূপা আদি করি যত ধাতু আছে", সকলেরই উপর পরীক্ষা করিয়া জগদীশচন্দ্র প্রতিপন্ন করিলেন যে, ধাতুগুলিকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যাইতে পারে; কাহারও পরিচালনশক্তি তাড়িততরঙ্গসংক্ষোভে বাড়িয়া যায়; কাহারও বা কমিয়া যায়। এই তথ্যটি সম্পূর্ণ নূতন তত্ত্ব; ইউরোপে এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব তখন সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল। তাড়িত তরঙ্গের সহিত পরিচালনশক্তির এই সম্বন্ধ কেবল ধাতুবিশেষেই আবদ্ধ নহে, ধাতুপদার্থ মাত্রেই-কেবল ধাতুপদার্থ কেন-ধাতু, অপধাতু বা অধাতু-সকল পদার্থেই অল্পবিস্তর পরিমাণে বর্তমান আছে, তাহা প্রতিপন্ন হওয়ায় জড় পদার্থের একটা নূতন ধর্মের আবিষ্কার হইল বলা যাইতে পারে। মাইকেল ফ্যারাডে বহু দিন পূর্বে পদার্থমাত্রেরই চুম্বকত্ব প্রতিপাদিত করিয়াছিলেন। এই নূতন আবিষ্কারের সহিত সেই প্রাচীন আবিষ্কারের অনেকটা তুলনা হইতে পারে।

গোটা সত্তর মূল পদার্থ এখন রাসায়নিকগণের পরিচিত। ইহাদের সকলেরই পরিচালকতা তাড়িত তরঙ্গের প্রতিঘাতে পরিবর্তিত হয়; ইহা প্রতিপন্ন হইল। আবার কোনো দ্রব্যের পরিচালকতা বাড়ে, কাহারও কমে; এই হ্রাসবৃদ্ধির মাত্রায় আবার তারতম্য আছে। কোনো দ্রব্য বেশি বাড়ে, কাহারও কম বাড়ে; কাহারও বেশি কমে, কাহারও কম কমে; এই হ্রাস বৃদ্ধির মাত্রা অনুসারে মৌলিক পদার্থগুলিকে শ্রেণিবদ্ধ করিয়া সাজাইয়া দেখিলে একটা বিস্ময়কর রহস্য দেখিতে পাওয়া যায়।

রুসিয় রাসায়নিক মেন্দেলিয়েফ পরমাণুর গুরুত্ব অনুসারে মৌলিক পদার্থগুলিকে সাজাইতে গিয়া উহাদের মধ্যে এক বিচিত্র সম্বন্ধের আবিষ্কার করিয়াছিলেন। সত্তরটি মূল পদার্থের মধ্যে পরস্পর একটা অদ্ভুতগোছ জ্ঞাতিসম্পর্ক বর্তমান আছে, মেন্দেলিয়েফের অনুসন্ধানে তাহা প্রকাশ পায়। ক্রুকস্ প্রভৃতি বহু পণ্ডিত সেই জ্ঞাতিসম্পর্কের বিচার করিয়া এই সত্তর প্রকার দ্রব্য কীরূপে একই মূল দ্রব্যের বিকারে অভিব্যক্ত হইয়াছে, তাহার নিরুপণের জন্য কতই না প্রয়াস পাইয়াছেন। বিবিধ প্রাণিজাতির ও উদ্ভিদজাতির মধ্যে জ্ঞাতিসম্পর্কের সন্ধান পাইয়া ডারুইন যেমন এই বিভিন্ন জাতির সৃষ্টিপ্রণালীর আবিষ্কারে কৃতকার্য হইয়াছিলেন, এই সত্তরজাতীয় মূল পদার্থের মধ্যেও সেইরূপ জ্ঞাতিসম্পর্কের স্পষ্ট চিহ্ন দেখিয়া উহাদেরও সৃষ্টিপ্রণালী আবিষ্কারের জন্য তাঁহারা চেষ্টা করিয়াছেন। এই চেষ্টা অদ্যাপি সফল হইয়াছে, বলা যায় না। জড় পদার্থের বিবিধ জাতির সৃষ্টিরহস্য ভবিষ্যতের যে ডারুইন আবিষ্কার করিবেন, তিনি এখনও জন্মগ্রহণ করিয়াছেন কি না, জানি না; কিন্তু জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কৃত সম্পর্ক মেন্দেলিয়েফের আবিষ্কৃত সম্পর্কের সমর্থন দ্বারা তাঁহাদের পথ অনেকটা সুগম করিবে, সন্দেহ নাই।

তাড়িত তরঙ্গের প্রতিঘাতে কোনো বস্তুর পরিচালকতা বাড়ে, কাহারও কমে। কিন্তু এখানেই কথা ফুরাইল না। এই আঘাতের প্রবলতানুসারে আবার একই ধাতুরই পরিচালকতা হয়তো কমে, অথবা বাড়ে। আঘাতের তারতম্যানুসারে কখনও বা বাড়িয়া যায়, কখনও বা কমিয়া যায়। আবার যে সকল ধাতুর পরিচালকতা সহজে বাড়ে কমে না, তাহাকে একটু গরম করিলে আবার বাড়িতে থাকে বা কমিতে থাকে। অণুগুলি যেন জমাট বাঁধিয়া ছিল; উত্তাপ পাইয়া তাহারা কতকটা স্বাতন্ত্র্য লাভ করিল, স্বাতন্ত্র্য লাভ করিয়া হেলিবার দুলিবার অবকাশ পাইল। এখন তাড়িত তরঙ্গের ধাক্কায় তাহারা হয় এদিকে, কিংবা ওদিকে হেলিয়া পড়িবার অবকাশ পাইল।

কেবল যে মৌলিক পদার্থেরই এরূপ তরঙ্গাঘাতে অবস্থাবিকার ঘটে, তাহা নহে। যৌগিক পদার্থেরও এইরূপ তরঙ্গের ঘা পাইয়া প্রতিক্রিয়া উৎপাদনের ক্ষমতা বতমান রহিয়াছে। জগদীশচন্দ্র লোহাভস্ম (সাদা কথায়, লোহার মরীচা) লইয়া তদুপরি তাড়িত তরঙ্গের আঘাত দিয়া উহার অদৃশ্য অণুগুলিকে কীরূপে নাঢাইয়া দিয়াছেন, তাহার বিস্তৃত বর্ণনা নিতান্তই কৌতুকজনক।

তরঙ্গপ্রতিঘাতে ধাতুচূর্ণের পরিচালকতা বৃদ্ধি পায় দেখিয়া খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক লজ সাহেব একটা সিদ্ধান্ত খাড়া করিয়াছিলেন। উপরে তাহার আভাস দিয়াছি। তরঙ্গের ধাক্কা পাইয়া কণিকাগুলির অণুগুলি কতকটা সংহত ও সন্নিকৃষ্ট হয় ও জমাট বাঁধে; যাহারা ছাড়াছাড়ি ছিল, তাহারা কাছাকাছি আসে; ফলে পরিচালকতা বাড়িয়া যায়। এই সংহতি বাড়ে বলিয়াই পরিচালকতা বাড়ে। সংহতির ইংরেজি নাম coherer; এই জন্য ধাতুচূর্ণ-নির্মিত ঊর্মিনির্দেশক যন্ত্র coherer আখ্যা পাইয়াছে।

কিন্তু যদি কোনো দ্রব্যের পরিচালকতা বাড়ে, কাহারও আবার কমে; এবং সেই একই দ্রব্যের পরিচালকতা কখনও বা বাড়ে, কখনও বা কমে; ইহাই যদি স্থির হইল, তাহা হইলে আর সংহতির ব্যাখ্যা অমূলক হইয়া দাঁড়ায়; অধ্যাপক লজের সিদ্ধান্তও ভিত্তিহীন হইয়া পড়ে।

মোট কথায়, তাড়িত তরঙ্গের ধাক্কা খাইলে জড় পদার্থমাত্রেরই, ধাতুই বলো আর অপধাতুই বলো,-জড় পদার্থমাত্রেরই পৃষ্ঠদেশের অণুগুলি বিচলিত ও স্থানভ্রষ্ট হইয়া এদিকে ওদিকে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়ে। এদিকে, বিক্ষিপ্ত হইলে পরিচালনশক্তি বৃদ্ধি পায়; ওদিকে বিক্ষিপ্ত হইলে পরিচালনশক্তি হ্রাস পায়। এই নূতন ব্যাখ্যাই এখন সঙ্গত বোধ হইতেছে।

আবার অণুগুলি স্থানভ্রষ্ট ও বিচলিত হইলেও স্বাভাবিক স্থিতিস্থাপকতাবলে স্বস্থানে ফিরিয়া আসিতে সচেষ্ট থাকে। কাজেই বিচলিত হইলেও কিছুক্ষণ পরে আপনা হইতেই স্বস্থানে ফিরিয়া আসে ও স্বাভাবিক পরিচালনশক্তি ফিরিয়া পায়। প্রবল ধাক্কা পাইলে স্থিতিস্থাপকতা সীমা অতিক্রান্ত হইয়া যায়, তখন আর আপনা হইতে ফিরিতে পারে না; তবে বাহির হইতে কেহ নাড়িযা দিলে বা উত্তাপ প্রয়োগ করিলে, আবার স্বভাবে ফিরিয়া আসে। ফিরিয়া আসিবার সময় কখনও বা স্বস্থান ছাড়িয়া অন্য মুখে কিছুদূর পর্যন্ত চলিয়া যায়। পেন্ডলমকে যেমন ডাহিনে তুলিয়া ছাড়িয়া দিলে স্বস্থানে আসিবার চেষ্টা করে, এবং চেষ্টা করিতে গিয়া আবার বামে উঠিয়া পড়ে, কতকটা সেইরূপ। এইরূপ, যাহা ক্ষণেকের জন্য অতিপরিচালক হইয়াছিল, তাহা আবার ক্ষণেকের জন্য অপরিচালক হইয়া পড়ে।

জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কারস্রোত যদি এই পর্যন্ত আসিয়া থামিয়া যাইত, তাহা হইলেও তাঁহার কার্যের জন্য বিস্মিত হইয়া নিরস্ত হইতে পারিতাম। কিন্তু সেই স্রোত এখন যে নূতন মুখ অবলম্বন করিয়া নূতন পথে চলিয়াছে, তাহাতে কোথায় যে আমাদিগকে লইয়া যাইবে, এবং কোন্ কূলহীন প্রকাণ্ড মহাসাগরে লীন হইয়া আমাদিগকেও ভাসাইয়া দিবে, তাহা বিস্ময় ও চিন্তার বিষয় হইয়া পড়িয়াছে। তিনি যে গঙ্গাপ্রবাহ স্বর্গ হইতে ধরাতলে নামাইয়া আনিবার প্রয়াস করিতেছেন, তাহার স্পর্শলাভে কোন সগরসন্তানের ভস্মরাশি সঞ্জীবিত হইয়া উঠিবে, তাহা বলিতে পারি না; তিনি অগ্রণী হইয়া এই পুণ্যধারার পথপ্রদর্শন করিতেছেন, তিনিও হয়তো জানেন না, ইহার সমাপ্তি কোথায়।

কিন্তু এই প্রসংঙ্গে প্রবৃত্ত হইবার পূর্বে ভূমিকাস্বরূপ দুই একটা পুরাতন কথার আলোচনা আবশ্যক। 

নির্জীব জড়ের ও জীবন্ত জীবের মধ্যে বিবিধ সাদৃশ্য থাকিলেও, উভয়ের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড ব্যবধান আছে, তাহা কেহই অস্বীকার করেন না। জীবদেহে সাধারণ জড়ধর্ম সমুদয়ই বিদ্যমান আছে; তবে জড়ধর্ম ব্যতীত কোনো অসাধারণ ধর্ম বা অতিজড়ধর্ম-যাহা নির্জীব জড়ে বিদ্যমান নাই, এরূপ কোন অসাধারণ ধর্ম-বিদ্যমান আছে কি না, তাহা বিচার্য বিষয় হইয়া রহিয়াছে। জীবদেহে রক্তসঞ্চালন, শ্বাসগ্রহণ, খাদ্য-পরিপাক প্রভৃতি প্রক্রিয়াগুলি সাধারণ জড়বিজ্ঞানের পরীক্ষিত তত্ত্বগুলির সাহায্যে বুঝা যাইতে পারে; কিন্তু তথাপি জীবশরীরের সমগ্র প্রক্রিযা বতমান জড়বিজ্ঞানের সাহায্যে বুঝা যায় না। গতিবিজ্ঞান, আর তাপবিজ্ঞান, আর তাড়িতবিজ্ঞান, আর রসায়নবিজ্ঞান প্রভৃতির সাহায্যে শারীরিক প্রক্রিয়ার অর্থ কতক- কতক বুঝা যায়; কিন্তু সমস্ত বুঝা যায় না।

পণ্ডিতগণের মধ্যে দুই শ্রেণি আছে। এক শ্রেণির পণ্ডিতে বলেন, জীবন-তত্ত্বের সমগ্র ভাগ জড়বিজ্ঞানের সাহায্যে বুঝিবার কখনও সম্ভাবনা নাই। তাপ ও তাড়িত ও রাসায়নিক ক্রিযা ব্যতীত অন্য কোনোরূপ অজ্ঞাত ক্রিয়ার প্রভাবে জীবনযন্ত্র প্রধানত কাজ করে। সেই অজ্ঞাত অপরিচিত শক্তিকে vital force বা জীবনীশক্তি বা এইরূপ একটা আখ্যা দেওয়া যাইতে পারে। উহা জড়বিজ্ঞানের বিষয়ীভূত নহে বা হইবে না। জড় পদার্থে এই জীবনীশক্তি নাই; কাজেই উহা জড়। জীবদেহে উহারই প্রভুত্ব; এই জন্য জীবদেহে জীবন। জীবে ও জড়ে এইজন্য মূলগত বিরোধ।

দ্বিতীয় শ্রেণির পণ্ডিতের মত অন্যরূপ। তাঁহারা স্বতন্ত্র জীবনীশক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করিতে চাহেন না। তাঁহারা বলেন, এখন আমরা জড়বিজ্ঞানের সাহায্যে সমস্ত জীবনক্রিয়া বুঝাইতে পারি না বটে, কিন্তু জড়বিজ্ঞানের উন্নতিসহকারে এমন দিন আসিবে, যখন আমরা প্রাকৃতিক পরিচিত শক্তিসমূহের সাহায্যেই জীবনের কাজ সমস্ত বুঝাইতে পারিব। জীবের ও জড়ের মধ্যে এখন যে ব্যবধান দেখা যাইতেছে, তাহা তখন থাকিবে না। বস্তুত উভয়ের মধ্যে কোনো মূলগত প্রভেদ নাই। জীবদেহে ও জড়দেহে কোনো মৌলিক প্রভেদ নাই। জীববিজ্ঞান কালে জড়বিজ্ঞানেই পরিণত হইবে।

ফলে অনেক সময়ে দেখা যায়, উভয় পক্ষে মতের প্রকৃত অনৈক্য নাই; কেবল অকারণে কথা কাটাকাটি হইয়া বিতণ্ডাব সৃষ্টি হইতেছে। মূলে কেবল কথার অর্থ লইয়া ঝগড়া। এখানেও অনেকটা সেইরূপ।

বর্তমান কালে আমরা জড় উপকরণ লইয়া জীবশরীর নির্মাণ করিতে পারি না, একথা গোপন করিবার প্রয়োজন নাই। অনেক জৈব পদার্থ, ইংরাজিতে যাহাকে অর্গানিক পদার্থ বলে, যথা-ঘি, তেল, চিনি, মদ প্রভৃতি পদার্থ, যাহা সচরাচর প্রাণিদেহে বা উদ্ভিদের দেহ মধ্যে নির্মিত হয়, তাহা আজকাল জড় উপাদানেও নির্মিত হইতেছে। এমন দিন ছিল, এই সকল পদার্থ মানুষে জড় উপাদান লইয়া প্রস্তুত করিতে পারিত না। ঘি-র জন্য গরু ও তেলের জন্য সরিষাগাছ ও চিনির জন্য ইক্ষুদণ্ড ও মদের জন্য দ্রাক্ষালতা প্রভৃতির অনুগ্রহের অপেক্ষায় বসিয়া থাকিতে হইত। কিন্তু আজকালকার রাসায়নিক পণ্ডিতেরা এই সকল জৈব অর্থাৎ জীবজ পদার্থ জড় উপাদান হইতে অবাধে নির্মাণ করিতে পারেন। এইজন্য তাঁহাদের এক সময়ে অত্যন্ত দুরাশা হইয়া পড়িয়াছিল যে, রাসায়নিক পণ্ডিত খানিক কয়লা, আর জল, আর অ্যামোনিয়া উপাদানস্বরূপ গ্রহণ করিয়া ডাল-রুটি, এমন কী, মাছ-মাংস পর্যন্ত তৈয়ার করিয়া ফেলিতে পারিবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁহাদের সে আশা অদ্যাপি ফলবতী হয় নাই। এখনও ডাল রুটি ও মাছ-মাংসের জন্য রসায়নবিদের পরীক্ষাগারে না গিয়া প্রকৃতিদেবীর বৃহত্তর কর্মশালায় উপস্থিত হইতে হয়, এবং শীঘ্র যে সে আশা সফল হইবে, তাহাও বোধ হয় না।

পক্ষান্তরে কিছু দিন পূর্বে অনেক পণ্ডিতের বিশ্বাস ছিল, এবং অদ্যাপি অনেক অপণ্ডিতের বিশ্বাস আছে যে, জড় পদার্থ হইতে কৃমি-কীট, মাছি-মশা প্রভৃতি জীবের উৎপত্তি হইয়া থাকে। যাঁহারা প্রাণিবর্গকে জরায়ুজ, অন্ডজ, স্বেদজ প্রভৃতি শ্রেণিতে বিভক্ত করিয়াছিলেন, তাঁহারাও এই বিশ্বাস হইতে মুক্ত ছিলেন বলা যায় না। কিন্তু অধিক দিনের কথা নহে, এই বিশ্বাসের মূলভিত্তি পর্যন্ত উৎপাটিত হইয়াছে। যতদূর দেখা গিয়াছে, তাহাতে জড় পদার্থ হইতে জীবের উৎপত্তির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। জীব হইতেই নূতন জীব জন্মে; বীজ হইতে গাছ হয় ও বীজ হইতেই জন্তু হয়। এখন জীবতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতগণের ইহাই ধ্রুব বিশ্বাস। স্বেদজ প্রাণীর অস্তিত্বের কোনও প্রমাণ নাই। মানুষ হইতে কটি পর্য্যন্ত সকলেই অন্ডজ।

জীবের উৎপাদন দূরে থাক, যে মশলায় জীবদেহ নির্মিত, ইংরাজিতে যাহাকে প্রোটোপ্লাজম বলে, যাহার বাঙলা পারিভাষিক প্রতিশব্দ খুঁজিয়া মিলিল না, তাহাও এপর্যন্ত জড় উপাদানে নির্মাণ করিবার কোনো উপায়ই দেখা যায় না। সেই প্রোটোপ্লাজম পদার্থ এখনও কোনও রসায়নবিৎ কয়লা, জল ও অ্যামোনিয়ার সাহায্যে নির্মাণ করিতে সমর্থ হন নাই। যদি কখনও সমর্থ হন, তখন জীবের ও জড়ের ব্যবধান দূর হইয়াছে বলিয়া নৃত্য করিবার কারণ মিলিবে; এখন নহে। কাজেই উভয়ের মধ্যে সম্প্রতি প্রকাণ্ড ব্যবধান বিদ্যমান। কিন্তু-

প্রোটোপ্লাজম এখনও নির্মিত হয় নাই, সুতরাং জীবদেহ জড় উপাদানে গঠিত হইলেও সেই জড় উপাদানগুলি লইয়া আমরা জীবদেহ নির্মাণ করিতে পারি না। আমরা পারি না, কিন্তু প্রকৃতি পারেন। নৈসর্গিক কারণে জড় উপাদানেই জীবদেহ গঠিত হইতেছে। উদ্ভিদের শরীর বা জন্তুর শরীর বিশ্লেষণ করিয়া জড় উপাদান ব্যতীত অন্য উপাদান এক কণিকাও খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।

কিন্তু আমরা কিই বা পারি? আমরা জীবদেহনির্মাণে অসমর্থ; জড়দেহনির্মাণেই কি আমরা সমর্থ? যখন আমরা উদজান পোড়াইয়া জল তৈয়ার করি, আর গন্ধক পোড়াইয়া গন্ধকদ্রাবক প্রস্তুত করি, সে নির্মাণ কি আমাদেরই কাজ? এক হিসাবে উহা আমাদের কাজ বটে, আর এক হিসাবে আমাদের কাজ নহে। উদজান আপনা আপনি প্রাকৃতিক ধর্মবশে অম্লজানসংযুক্ত হইয়া পোড়ে ও জলে পরিণত হয়; গন্ধকও আপনা আপনি প্রাকৃতিক ধর্মবশে পুড়িয়া গন্ধকদ্রাবকে পরিণত হয়, আমাদের সেখানে প্রভুত্ব বা কতত্ব কিছুই নাই। কাজেই উহা আমাদের কৃতকর্ম নহে। আমরা জিনিসগুলাকে এমনভাবে সাজাইয়া গোছাইয়া যোজনা করিয়া দিই, উদজানে হাওয়া মিশাইয়া আগুন ধরাইয়া দিই, আর গন্ধকে আগুন ধরাইয়া হাওয়া আর জল মিশাইয়া দিই, তখন উদজান আর গন্ধক আপনা হইতে প্রাকৃতিক ধর্মে পুড়িতে থাকে ও জল তৈয়ার হয় ও গন্ধকদ্রাবক তৈয়ার হয়। এইটুকুই যা আমাদের কর্তৃত্ব। অর্থাৎ, আমাদের যা কিছু কর্তৃত্ব এই যোজনাকার্যে; পাঁচটা উপকরণকে আমরা এইরূপে জোটাইয়া দিয়া থাকি, যাহাতে উহারা আপন আপন ধর্মবশে নূতন-নূতন জিনিসের উৎপত্তি করে।

জীবদেহের নির্মাণ সম্বন্ধেও সেই কথা। জল আর গন্ধকদ্রাবক আমরা জড় উপাদান লইয়া নির্মাণ করি; কিন্তু জড় উপাদান লইয়া জীবদেহ নির্মাণ করিতে পারি না। উভয়ে এই ব্যবধান। কিন্তু সেই ব্যবধানের অর্থ কি? এই নির্মাণের অর্থ কি? নির্মাণ আমরা করি না; নির্মাণ প্রকৃতি করেন; প্রাকৃতিক ধর্মে নির্মাণকার্যে চলে, উভয়ত্রই চলে। আমাদের নির্মাণের নাম যোজনা। একত্র আমরা এই যোজনায় সমর্থ; অন্যত্র এই যোজনাকার্যে অসমর্থ। জীবদেহেও জড় উপাদান ব্যতীত অজড় অপরিচিত অজ্ঞাত উপাদান কিছুই বিদ্যমান নাই। সেই কয়লা আর উদজান আর অম্লজান আর যবক্ষারজান, সমস্তই জড় পদার্থ-নিতান্ত পরিচিত জড় পদার্থ। কিন্তু এই সকল জড় উপাদানগুলিকে কীরূপে যোজনা করিলে প্রোটোপ্লাজম গঠিত হইবে, কীরূপে উপাদানগুলিকে সাজাইয়া গোছাইয়া সমাবেশ করিলে প্রোটোপ্লাজম ও জীবদেহ নির্মিত হইবে-প্রাকৃতিক ধর্মবশে নির্মিত হইবে, তাহা আমরা অদ্যাপি জানি না। এই যোজনাকার্যে আমরা একান্তই অজ্ঞ, কাজেই আমাদের জীবদেহনির্মাণচেষ্টা অদ্যাপি সফল হয় নাই। প্রকৃতিতে এই নির্মাণকার্য চলিতেছে; প্রকৃতির কারখানায় জড়দেহ ও জীবদেহ, উভয়ই আপনাআপনি সর্বদাই নির্মিত হইতেছে। জড় হইতেই জড় নির্মিত হইতেছে ও জীবদেহ হইতে জীবদেহ ও জড়দেহ, উভয়ই নির্মিত হইতেছে। প্রকৃতিতে সেই যোজনাকার্য ঘটে বলিয়া জড়দেহ ও জীবদেহ, উভয়ই নিয়ত গঠিত হইতেছে। জড়দেহের নির্মাণানুযায়ী যোজনাকার্যে আমরা অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছি। কিন্তু জীবদেহ নির্মাণের জন্য যে যোজনার প্রয়োজন, তাহা আমরা এখনও শিখিতে পারি নাই। কাজেই আমরা সেখানে অজ্ঞ, অনভিজ্ঞ, অসমর্থ।

এমন দিন আসিতে পারে, যখন আমরা প্রকৃতির কর্মশালায় কার্যপ্রণালীর অনুসন্ধান ও আলোচনা করিতে-করিতে জানিতে পারিব যে, কীরূপে উপাদানগুলির সমাবেশ করিলে জীবদেহ নির্মিত হইতে পারিবে। তখন অবশ্যই আমরা জীবদেহ "নির্মাণ” করিতে সমর্থ হইব। আবার এমন দিন না আসিতেও পারে; যদি না আসে, তাহা হইলে আমরা জীবদেহগঠনে কখনই সমর্থ হইব না। তাহা হইলে আমাদের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারে রুটি-মাংস কোনও কালেই প্রস্তুত হইবে না। অথবা হয়তো পৃথিবীর নৈসর্গিক অবস্থা এখন এমন পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে যে, আর এখন জড় উপাদানের সেইরূপ সংযোজন-ঘটনাই জীবনীশক্তির সাহায্য ব্যতীত অসাধ্য ব্যাপার হইয়া পড়িয়াছে। এখন কেবল জড়শক্তির সাহায্যে জড় উপাদান হইতে জীবদেহের নির্মাণচেষ্টা পণ্ডশ্রম মাত্র।

সে যাই হউক, আমাদের পক্ষে নির্মাণের অর্থ যোজনা মাত্র, এবং জীবই বল, আর নির্জীবই বল, সর্বত্রই নৈসর্গিক নিয়মে গঠনকার্য চলে, তাহার উপর আমাদের প্রভুত্ব কিছুই নাই। আমরা এক জায়গায় যোজনাকার্যে সমর্থ হইয়াছি, অন্যত্র এখনও হই নাই বা হইতে পারিব না; এই যুক্তির দোহাই দিয়া জীবের ও নির্জীবের মধ্যে একটা দুর্ভেদ্য রহস্যময় প্রাচীর নির্মাণ করিবার আবশ্যকতা আদৌ দেখা যায় না।

আসল কথা, যাঁহারা জীবনী-ক্রিয়া প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নিয়মের অতীত বলিতে চাহেন এবং জীবনীশক্তি নামে একটা অতিপ্রাকৃত শক্তির কল্পনা ছাড়িতে চাহেন না, তাঁহারা সকল সময়ে স্পষ্ট কথা না বলিলেও তাঁহাদের মনের মধ্যে একটা গোল আছে। মনুষ্যজাতির অধিকাংশ লোকে "সৃষ্টিকর্তা" নামক এক সৃষ্টিছাড়া "কি জানি-কি ময়" পদার্থ কল্পনা করিয়া মনের বোঝা লঘু করিবার চেষ্টায় রহিয়াছে। প্রকৃতির কর্মশালায় যখন একটা অদ্ভুত গোছের রহস্যাবৃত যোজনা-ব্যাপার দেখিতে পাওয়া যায়, যেখানে মানুষের চিন্তায় তাহার তথ্যভেদ ও রহস্যভেদ কুলায় না, অথচ মনের বোঝা ভারী হইয়া আসে, তখন মানুষ সেই বোঝাটা এই কল্পিত সৃষ্টিকর্তার ওপরে নিক্ষেপ করিয়া নিজে অব্যাহতি লাভ করে ও বিশ্রামভোগের অবসর পায়। জাগতিক ব্যাপারের সর্বত্র এই সৃষ্টিকর্তার প্রভুত্বের আরোপ করিয়া, স্বয়ং চিন্তায় দায় হইতে মুক্তি পাইয়া অত্যন্ত আরাম পায়; এবং যখনই কোন ব্যক্তি যবনিকা উত্তোলন করিয়া প্রকৃতির কোনও একটা অজ্ঞাত রহস্য ভেদ করিতে চেষ্টা করেন, তখনই সেই মনঃকল্পিত প্রভুর শক্তিসঙ্কোচের আশঙ্কা কবিয়া চিৎকারে ব্রহ্মাণ্ড কম্পিত করিতে থাকে। এই শ্রেণির লোকের জন্য এই কথা বলিয়া রাখা আবশ্যক যে, প্রকৃতির রহস্যাবরণ উন্মোচন করিয়া গুপ্ত তথ্যের আবিষ্কার করিবার, অথবা প্রকৃতির নাটমন্দিরের বিভিন্ন প্রকোষ্ঠের মধ্যস্থ ব্যবধান ভেদ করিবার শক্তি ও অধিকার যখন মানুষের আছে; এবং সেই শক্তি জ্ঞানের ইতিহাসে পুনঃপুনঃ প্রযুক্ত হওয়াতেও যদি সৃষ্টিকর্তার প্রভুশক্তি সঙ্কুচিত না হইযা থাকে, এখনও হইবার কোনও আশঙ্কা নাই। মাধ্যাকর্ষণ ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের আবিষ্ক্রিয়ায় ও অন্যান্য বিবিধ ক্ষুদ্র বৃহৎ তথ্যের আবিষ্কারে পুনঃপুনঃ এই ব্যবধান ভগ্ন হইয়া গিয়াছে; এখন জীব ও নির্জীবের মধ্যে পর্দাটা কেহ তুলিয়া ফেলিলেও বিশ্বব্যাপার বিপর্যস্ত হইবার কোনও আশঙ্কা নাই।

জীবনীশক্তি নামক কোন অজ্ঞাত শক্তির অস্তিত্ব আছে কি না. তাহার বিচারের এখনও সময় হয় নাই। আধুনিক জড়বিজ্ঞান যে কয়টি শক্তির অস্তিত্ব অবগত আছে, তদ্ব্যতীত অন্য কোনো শক্তি যে থাকিবে না, তাহার কোনোই কারণ নাই। তাপ ও তাড়িত ও রাসায়নিক ক্রিয়ার সাহায্যেই যে সমস্ত জীবনীক্রিয়ার তথ্য বুঝানো যাইবে, তাহাও মনে করিবার কোনো কারণ নাই। বিজ্ঞানের ইতিহাসেই নিত্য নূতন শক্তির সহিত, অথবা একই শক্তির অভিনব মুতির সহিত আমাদের নুতন পরিচয় স্থাপিত হইতেছে। তখন জীবনীক্রিয়ার জন্য যদি একটা অভিনব, অচিন্তিতপূর্ব বা অজ্ঞাতপূর্ব শক্তি বা শক্তির অভিনব মূর্তি, কালে আবিষ্কৃত হয়, তাহাতে বিস্ময়ের কোনোই কাবণ নাই। এবং এই শক্তিকে জীবনীশক্তি বা Vital force বা যাহা ইচ্ছা নাম দাও, তাহাতেও কিছুই আসে যায় না। কিন্তু সেই শক্তির কার্যপ্রণালীর সহিত যখন আমাদের পরিচয় হইবে, তখন উহা প্রাকৃতিক নিয়মে পরিচালিত প্রাকৃতিক শক্তি ভিন্ন নিয়মবন্ধনহীন অতিপ্রাকৃত শক্তিরূপে গণ্য হইবে না।

জীবন্ত জড়দেহে আর নির্জীব জড়দেহে প্রধান বিভেদ কতকটা এইরূপ,- ১১) জীবদেহে বাহির হইতে কোনো শক্তি কাজ করিলে উহা সাড়া দেয়। এই সাড়া দিবার ক্ষমতা জীবদেহের প্রধান ও বিশিষ্ট লক্ষণ। চিমটি কাটিলেই মাংসপেশির সঙ্কোচন ঘটে; চোখের স্নায়ুতন্ত্রীতে আলোকতরঙ্গের ধাক্কা লাগিলেই মস্তিষ্কযন্ত্র বিচলিত হইয়া হাত- পায়ের মাংসপেশিতে নাড়িয়া দেয়। কখনও বা সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেয়, তখনই তাহার ফল টের পাওয়া যায়। কখনও বা বহু বৎসর পরে তাহার ফল প্রকাশ পায়। আজ বাহিরের শক্তি সহসা স্নায়ুযন্ত্রে একটা ধাক্কা দিয়া গেল; সেই ধাক্কাটা সম্প্রতি স্নায়ুযন্ত্রে কোনোরূপে আবদ্ধ হইয়া থাকিল। আবার পঞ্চাশ বৎসর পরে স্বপ্নে বা জাগ্রদবস্থায় সেই ধাক্কার ফল সহসা প্রকাশ পাইল। পেশিযন্ত্র ও স্নায়ুযন্ত্রঘটিত যাবতীয় ব্যাপারের মূলে এই সাড়া দিবার ক্ষমতা। এবং এই সাড়া দিবার শক্তি আছে বলিয়াই জীবদেহ জড়জগতের আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষণে সমর্থ। জীবদেহ এমন ভাবে, এমন সময়ে সাড়া দিবার চেষ্টা করে, যাহাতে তাহার মঙ্গল ঘটে, যাহাতে তাহার আত্মরক্ষণ ঘটে। এইরূপ সাড়া দিবার ক্ষমতা, এই respon- siveness জড়দেহে বর্তমান দেখা যায় না। জড়দেহেও বাহ্য শক্তির সংঘাতে সঙ্গে সঙ্গে বিকার জন্মে বটে, কিন্তু তাহা ঠিক এরূপ নহে। উভয়ের মধ্যে অনেকটা তফাত। কীরূপ তফাত, তাহা সহজে অল্প কথায় বুঝানো যায় না। তবে জড়দেহের ও জীবদেহের এবিষয়ে পার্থক্য এত স্পষ্ট যে, এ স্থলে তজন্য বাক্যব্যয়ের প্রয়োজন দেখি না। হার্বার্ট স্পেন্সার জীবনের যে সংজ্ঞা দিয়াছেন, তাহাও প্রধানত এই সাড়া দিবার ক্ষমতার উপর প্রতিষ্ঠিত।

হার্বার্ট স্পেন্সারের মতে বাহ্য ব্যাপারের সহিত আভ্যন্তর ব্যাপারেব সামঞ্জস্য বা সঙ্গতিরক্ষার অবিরাম নিরন্তর প্রয়াসের নামই জীবন। বাহ্য জগৎ হইতে বিবিধ শক্তি জীবদেহকে নিরন্তর আক্রমণ করিতেছে, জীবদেহ আবশ্যকমতো তাহার সাড়া দিয়া, অর্থাৎ আবশ্যকমতো বিলম্বে বা অবিলম্বে আত্মপ্রসার বা আত্মসঙ্কোচ বা আত্মবিকার সাধিত করিয়া, সেই আক্রমণ নিবারণের বা আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষার চেষ্টা করিতেছে। এই প্রতিক্রিয়াব নিরন্তর চেষ্টার নামই জীবন।

(২) জীবদেহের আত্মপোষণের বা বৃদ্ধির ক্ষমতাও জড়দেহ হইতে স্বতন্ত্র। নির্জীব জড় পদার্থ তৈয়ারি মশলা আপন অঙ্গে বাহিরে বাহিরে সংলগ্ন করিয়া বৃদ্ধি পায়। যেমন, একটা মিছরির দানা বা ফটকিরির দানা অথবা একখানা মেঘ বা কুয়াশা। আর জীবদেহ অপূর্ণগঠিত উপাদান অভ্যন্তরে গ্রহণ করিয়া সেই উপাদান হইতে আপনাব শরীরোপযোগী মশলা তৈয়ার করিয়া বৃদ্ধি পায়। গাছের পাতা হাওয়া আর জল আর ভস্ম বাহির হইতে অভ্যন্তরে গ্রহণ করিয়া গাছের দেহ নির্মাণ করে। মনুষ্যদেহ শাকান্ন অভ্যন্তবে গ্রহণ করিয়া মাংস মজ্জা স্নায়ু নির্মাণ করিয়া লয় ও বৃদ্ধি পায়।

(৩) জীবদেহ আপনাকে খণ্ডিত ও বিভক্ত করিয়া বংশ রক্ষা করে ও সন্তান উৎপাদন করে। এক খণ্ড জীবদেহ হইতে বহু খণ্ড জীবদেহ বিচ্ছিন্ন হইয়া থাকে ও পিতৃপুরুষের সমুদয় ধর্ম গ্রহণ করিয়া স্বতন্ত্র জীবনযাত্রা আরম্ভ করে।

প্রধানত জীবদেহের প্রধান লক্ষণ, যে লক্ষণ আশ্রয়ে জীবদেহে ও জড়দেহে প্রভেদ, উল্লিখিত তিনটি। প্রথম-জীবদেহ বাহ্য শক্তির আহ্বানে সাড়া দেয়। দ্বিতীয়-জীবদেহ বাহিরের অপূর্ণগঠিত উপাদান অভ্যন্তরে গ্রহণ করিয়া তাহার পূর্ণতা সাধিত করিয়া বৃদ্ধি পায়। তৃতীয়-জীবদেহ কালে-কালে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া বংশবিস্তার করে ও সন্তান সর্বাংশেই পিতৃধর্ম পাইয়া থাকে।

এতদ্ব্যতীত জন্ম, মৃত্যু ও ব্যাধি, স্বতন্ত্র জীবধর্মস্বরূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে কি না, একটু তর্কের স্থল। জন্মের অর্থ, পিতৃপুরুষ হইতে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন জীবনের আরম্ভ। উহা তৃতীয় লক্ষণের অন্তর্গত। মৃত্যু অর্থে সেই স্বাধীন জীবনের সমাপ্তি। স্পেন্সারের সংজ্ঞানুসারে বাহ্য প্রকৃতির আহ্বানে সাড়া দেওয়া যদি জীবনের প্রধান লক্ষণস্বরূপে ধরা যায়, তাহা হইলে বলা যাইতে পারে, যখন জীব সেই আহ্বানে আর সাড়া দিতে পারে না, তখনই তাহার মৃত্যু। উন্নত জীবমাত্রেরই জীবনের একদিন সমাপ্তি ঘটে, সেদিন বাহির হইতে বিবিধ শক্তি আক্রমণ করিলেও সেই জীব সেই আক্রমণ নিবারণে চেষ্টা করে না; সেই দিন তাহার মৃত্যু। জীবমাত্রের না বলিয়া উন্নত জীবমাত্রের বলিলাম; কেন না, জীবমাত্রেরই মৃত্যু অনিবার্য, তাহা আজিকার দিনে বোধ করি আর বলা চলে না। ওয়াইজমান (Weismann) স্পষ্টভাবে দেখাইয়াছেন, নিকৃষ্টতম জীবের মৃত্যু অনিবার্য নহে; তাহারা প্রকৃতই অমরত্বের অধিকারী। জন্ম ও মৃত্যু গেল; থাকে ব্যাধি। জীব বাহ্য প্রকৃতির আহ্বানে সাড়া দেয়, এরূপে সাড়া দেয়, যাহাতে তাহার আত্মরক্ষা চলে, যাহাতে তাহার মঙ্গল হয়। ফলে জীব এই ক্ষমতার বলে বাহ্য শক্তিকে আপনার জীবনের অনুকূল করিয়া লয়; এই অবস্থার নাম স্বাস্থ্য। আর যখন বাহ্য শক্তি জীবনের প্রতিকূল হইয়া দাঁড়ায়, যখন বাহ্য শক্তির আক্রমণ নিবারণে জীব অংশত অশক্ত হইয়া পড়ে, সেই অবস্থার নাম ব্যাধি। সুস্থ অবস্থায় যাহা জীবনের অনুকূল, ব্যাধির অবস্থায় তাহা প্রতিকূল। সুস্থ অবস্থায় জীব যেমন সাড়া দিতে পারে, ব্যাধির অবস্থায় তেমনটি পারে না। মৃত্যু ও ব্যাধিকে এইভাবে দেখিলে জীবদেহের উল্লিখিত প্রথম লক্ষণের অন্তর্গত করা যাইতে পারে।

আর একটা কথা আছে। দেহপুষ্টিকে আমরা দ্বিতীয় লক্ষণ ও বংশবৃদ্ধিকে তৃতীয় লক্ষণ বলিয়া বলিয়াছি। কিন্তু আধুনিক জীবতাত্ত্বিকগণের বিবেচনায় এই দুইটি লক্ষণের মধ্যে কোনো মূলগত বিভেদ নাই। বংশবৃদ্ধি দেহপুষ্টিরই একটা অবান্তর ভেদ মাত্র, আধুনিক জীববিদ্যা এইরূপ সিন্ধান্তে উপনীত হইয়াছে। নিম্নতম পর্যায়ের জীবে আত্মপুষ্টি ও বংশবৃদ্ধি, এই উভয় ব্যাপারের মধ্যে সীমানির্দেশ প্রায় অসাধ্য। এই সকল জীবের শরীর কেবল একটি মাত্র কোষে নির্মিত। খাদ্য গ্রহণ সহকারে এই কোষটি অর্থাৎ জীবের দেহটি ক্রমে পুষ্টি পায় ও বৃদ্ধি পায়। বৃদ্ধিসহকারে একটা সীমায উপস্থিত হইবামাত্র তাহার সমগ্র শরীরটি ভাঙিয়া দ্বিধাবিভক্ত হয়; একটি কোষ হইতে দুইটি কোষ নির্মিত হইয়া দুইটি স্বাধীন জীবের উৎপত্তি করে। এক পিতৃপুরুষ আপনাকে দ্বিধা বিভক্ত করিয়া দুইটি সন্তানের উৎপাদন করে। পিতা বৃদ্ধ হইয়া সন্তানে পরিণত হয় মাত্র। কেবল নিকৃষ্ট জীবে কেন, উন্নত জীবের মধ্যেও এই প্রণালী বতমান। গাছ বৃদ্ধি পাইয়া শাখা বিস্তার করে। সেই শাখাকে ছেদন করিয়া পৃথক্ ভাবে রোপণ করিলে শাখাই আবার স্বতন্ত্র বৃক্ষে পরিণত হয়। ফলে বংশপুষ্টি ও আত্মপুষ্টির মধ্যে মূলগত ভেদ বাহির করা যায় না। সুতরাং উল্লিখিত তিনটি লক্ষণকে দুইটি মাত্র লক্ষণে আনা যাইতে পারে। এবং এই দুই লক্ষণ থাকায় জড়দেহে ও জীবদেহে ব্যবধান।

জড়ে ও জীবে এখন এই দুই বিষম ব্যবধান বর্তমান। জগদীশচন্দ্রের নূতনতম আবিষ্টিয়ায় ইহার মধ্যে একটা ব্যবধান, অর্থাৎ প্রথম ব্যবধান দূর হইবার উপক্রম হইয়াছে।

জীবদেহের এই বাহ্য শক্তির প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা, এই সাড়া দিবার ক্ষমতা, এই responsiveness, জীবদেহের প্রত্যেক অংশেই ও প্রত্যেক অঙ্গেই বর্তমান। এই খণ্ড মাংসপেশি লইয়া বা একটা স্নায়ুতন্ত্রী লইয়া তাহাতে চিমটি কাটিলেই ইহা বুঝা যায়। শরীরবিদ্যার যে কোনো পুস্তক উদঘাটন করিলেই মাংসপেশীর ও স্নায়ুতন্ত্রীর এই সাড়া দিবার শক্তি সম্বন্ধে বিবিধ তত্ত্ব পাঠকগণ দেখিতে পাইবেন। দুই চারিটার এখানে উল্লেখ করিব।

১। একখানা মাংসপেশিতে একটা ধাক্কা দিলেই উহা একটু পরে খানিকটা সঙ্কুচিত হয়। ধাক্কার পরেই সঙ্কোচ, তার পর ক্রমশ স্বভাবে ফিরিয়া আসে। 

২। এই সঙ্কোচের একটা সীমা আছে। প্রবল ধাক্কায় সঙ্কোচনমাত্রা এই সীমায় পৌঁছে; তারপর ধাক্কা দিলে আর সীমা ছাড়ায় না।

৩। একবারে প্রবল ধাক্কা না দিয়া সামান্য আঘাত দিলে খানিকটা সঙ্কোচ হয়। আবার আঘাতে আর একটু সঙ্কোচ, আবার আঘাতে আর একটু। পরপর আঘাতে সঙ্কোচ একটু একটু করিয়া বাড়ে। কিন্তু প্রথম আঘাতে যতটা বাড়ে, দ্বিতীয় আঘাতে তত নহে; তৃতীয়ে আরও কম; চতুর্থে আরও কম। এইরূপে সেই সীমায় পৌঁছিলে সঙ্কোচ আর বাড়ে না।

প্রথম আঘাতে এতখানি সঙ্কোচ ঘটে, দ্বিতীয় আঘাতে ততখানি ঘটে না, জীবাঙ্গের এই গুণের ফল বিবিধ। এক সের বোঝার উপরে আর এক সের বোঝা স্পষ্ট ভার বাড়ায়। কিন্তু এক মণ বোঝার উপর এক সের বোঝা চাপাইলে আর তেমন ভার বোধ হয় না। শাকের আঁটি স্বতন্ত্র ভাবে ভারী, কিন্তু বোঝার উপর শাকের আঁটি নগণ্য। আবার আঁধার ঘরে প্রদীপের আলো কত উজ্জ্বল, কিন্তু সূর্যালোকে প্রদীপের সেই আলোর উজ্জ্বলতা কোথায়? শরীরবিদ্যা শাস্ত্রে Fechner's Law Weber's Law** নামে যে আঘাত ও প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কসূচক নিয়ম আছে, তাহার মূল এই।

৪। আঘাতের পর আঘাত, সঙ্কোচের পর একটু সঙ্কোচ। কিন্তু এই আঘাতের পর আঘাত খুব তাড়াতাড়ি দিলে, সঙ্কোচন ব্যাপার আর বিরামের অবসর পায় না। এক টানে সঙ্কোচ ঘটে। মাংসপেশি একবারে ধনুষ্টঙ্কারে আক্রান্ত হইয়া পড়ে।

৫। আঘাত যখন খুব প্রবল হয়, তখন সঙ্কোচনের মাত্রা পরম বা চরম সীমায় পৌঁছে; এবং প্রবল আঘাতে এই পরম সঙ্কোচলাভের পর মাংসপেশি আর সহজে স্বভাবে ফিরিয়া আসিতে পারে না। তখন ধাক্কা দিলেও আর প্রতিক্রিয়া ঘটে না। মাংসপেশিটা যেন প্রবল আঘাতে শ্রান্ত হইয়া পড়ে, এই অবস্থার নাম ক্লান্তির অবস্থা বা শ্রান্তির অবস্থা। কালক্রমে এই শ্রান্তির অপনোদন ঘটে; সঙ্কুচিত মাংসপেশি তখন ধীরে-ধীরে স্বভাবে প্রত্যাবৃত্ত হয়। মাংসপেশি বা স্নায়ুযন্ত্র বা মস্তিষ্ক, জ্ঞানেন্দ্রিয়ই বলো, আর কর্মেন্দ্রিয়ই বলো, শ্রমাতিশয্যে এই ক্লান্তিলাভ জীবদেহের প্রত্যেক অঙ্গেরই সাধারণ ধৰ্ম্ম, এবং বিশ্রাম দ্বারা ক্লান্তির অপনোদনও নিত্য ঘটনা। উত্তাপপ্রয়োগে বা মর্দনে ক্লান্ত মাংসপেশির স্বাস্থ্যলাভ ঘটে।

৬। শীঘ্রই হউক, আর বিলম্বেই হউক, মাংসপেশি আবার স্বভাবে প্রত্যাবৃত্ত হয়। মৃদু আঘাতের পর তখনই ফিরিয়া আসে, প্রবল আঘাতের পর বিলম্বে সুস্থ হয়। কিন্তু বিষময় পদার্থের সান্নিধ্য এই স্বভাবপ্রাপ্তিতে ও স্বাস্থ্যলাভে বিলম্ব ঘটায়। অথবা যে পদার্থের অস্তিত্ব এই স্বাস্থ্যলাভের অন্তরায় হয়, উহারই নাম বিষ। আর যে পদার্থ স্বাস্থ্যলাভের অনুকূল, তাহারই নাম ঔষধ।

ফলে জীবদেহমধ্যে বাহ্য পদার্থ বিদ্যমান থাকিয়া কখনও বিষের, কখনও বা ঔষধের কাজ করে। যাহা স্বাস্থ্যলাভের প্রতিকূল, তাহা বিষ; যাহা স্বাস্থ্যলাভের অনুকূল, তাহা ঔষধ। কোন্ দ্রব্য অবসাদক, কোন্ দ্রব্য উত্তেজক। আবার একই দ্রব্য মাত্রাভেদে কখনও বা উত্তেজক, কখনও অবসাদকের কাজ করে; মাত্রাভেদে বিষ বা ঔষধের ফল জন্মায়। হোমিওপ্যাথির আচার্যেরা বলিবেন, যাহা মাত্রাধিক্যে বিষবৎ, তাহাই ন্যূন মাত্রায় পরম ভেষজ। 

আঘাতে ও উত্তেজনায় মাংসপেশির উল্লিখিতরূপ বিবিধ প্রতিক্রিয়া ঘটে। বিবিধ বাহ্য শক্তির প্রয়োগে মাংসপেশি ভিতর হইতে নানারূপে সাড়া দেয়। অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র গত সেপ্টেম্বর মাসে ব্রাডফোর্ড নগরে সমবেত ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের এবং গত মে মাসে লন্ডন রয়াল ইস্টিটিউশনে বৈদেশিক বৈজ্ঞানিকমণ্ডলীর সমীপে যে নূতন আবিষ্কারবার্তা প্রচার করিয়াছেন, তাহাতে প্রকাশ পাইয়াছে যে, এইরূপ প্রতিক্রিয়াশক্তি কেবল জীবদেহেই আবদ্ধ নহে। জড়দেহেরও ঠিক এইরূপ প্রতিক্রিয়াশক্তি বতমান আছে। আঘাতে ও উত্তেজনায় মাংসপেশি বা স্নায়ুতন্ত্রী যেমন সাড়া দেয়, তাড়িত তরঙ্গের আঘাতে নির্জীব জড়পদার্থ ঠিক সেই একই রকমে সাড়া দিতে পারে।

জীবদেহে ও নির্জীব জড়দেহে প্রভেদ কিসে, জিজ্ঞাসা করিলে মোটামুটি এই উত্তর দেওয়া যাইতে পারে:

১। জড়দেহ পরিণত উপাদানযোগে বাহির হইতে বৃদ্ধি পায়। জীবদেহ অপরিণত অপূর্ণগঠিত উপাদান বাহির হইতে সংগ্রহ করিয়া অভ্যন্তরে গ্রহণ করে ও তাহাকে পুণর্গঠিত করিয়া স্বয়ং বৃদ্ধি পায়; এবং বৃদ্ধি পাইতে পাইতে আপনি বিভক্ত হইয়া বা আপনার কিয়দংশ বিচ্ছিন্ন করিয়া নূতন জীবের উৎপাদন করে। এই দুই ব্যাপারের নাম আত্মপুষ্টি ও বংশপুষ্টি। বিসদৃশ বস্তু দেহ মধ্যে গ্রহণ করিয়া বৃদ্ধির নাম আত্মপুষ্টি; ও আপনাকে ছিন্ন করিয়া সদৃশ বস্তুর উৎপাদনের নাম বংশপুষ্টি; উভয় ব্যাপারই মূলত অভিন্ন; জীবদেহে উভয়ই বর্তমান; জড়দেহে একেরও অস্তিত্ব নাই।

২। জড়দেহ বাহ্য শক্তির উত্তেজনায় বিকৃত হয় ও প্রতিক্রিয়াও উৎপাদন করে বটে, কিন্তু তাহাতে উহার শুভাশুভ কিছুই নাই। জীবদেহ বাহ্য শক্তির আক্রমণে বিকৃত হইয়া সাড়া দেয়; এবং সেই বাহ্য শক্তিকে আপনার স্বাতন্ত্র্য রক্ষার অনুকূল করিয়া লইতে চায়। এই সাড়া দেওয়ার অবিরাম চেষ্টা, এই আক্রমণ নিবারণের নিরন্তর প্রয়াসের নামই জীবন। যখন উচিত মতো সাড়া দিতে পারে না, আক্রমণনিবারণপ্রয়াস যখন সম্পূর্ণ সফল হয় না, তখন বাহ্য শক্তি জীবনের অনুকূল না হইয়া প্রতিকূল হয়, তখনকার অবস্থা ব্যাধি; এবং যখন সাড়া দিবার ক্ষমতা চিরতরে লোপ পায়, যখন বাহ্য শক্তির আক্রমণ আর নিরস্ত হয় না, তখন মৃত্যু।

সংক্ষেপে এই দুইটা বিষয়ে জড়দেহে ও জীবদেহে পার্থক্য আছে। সে পার্থক্য কীরূপ? বৃদ্ধি পাইবার ক্ষমতা যে জড়ের একবারে নাই, এমন নহে। বায়ু মধ্যে মেঘের শরীর ক্রমে বৃদ্ধি পায়। পর্বতশীর্ষে তুষারশৈল ক্রমে বৃদ্ধি পায়, চিনির শরবতে মিছরির দানা ক্রমে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই জড়দেহের বৃদ্ধি ও জীবদেহের বৃদ্ধি (আত্মপুষ্টি ও বংশপুষ্টি), উভয়ের মধ্যে এতটা প্রভেদ যে, উভয় বৃদ্ধিকে এক পর্যায়ে ফেলিতে সাহস হয় না। সেইরূপ আবার বাহ্য শক্তির আহ্বানে নির্জীব জড়ও যে সাড়া না দেয়, এমন নহে। বাত্যাবলে শৈলশিখর ভূমিসাৎ হয়, ভূকম্পে ধরাপৃষ্ঠ কম্পিত ও বিদীর্ণ হয়; পর্বতবক্ষে যুগব্যাপী নৈসর্গিক উৎপাতের চিহ্নসকল অঙ্কিত রহিয়া যায়। এ সমস্তই বিকার বা বিক্রিয়া; কিন্তু জীবদেহে বিকার বা বিক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুকূল প্রতিকার বা প্রতিক্রিয়া আছে; তাহার অনুরূপ প্রতিক্রিয়া নির্জীব জড়ে খুঁজিয়া মেলে না। এই প্রতিক্রিয়াই জীবন, এই প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতাই স্বাস্থ্য, এই প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতার আংশিক বিলোপে ব্যাধি ও পূর্ণ বিলোপে মৃত্যু। জড়ের স্বাস্থ্য বা ব্যাধি বা মৃত্যু কাব্যের ভাষাতে স্থান পাইয়াছে কি না জানি না, কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষাতে উহার এত দিন স্থান ছিল না। কিন্তু জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কারে বোধ করি, উহা বিজ্ঞানের ভাষাতেও স্থান পাইতে চলিল।

লোহাভস্মের মতো নিতান্ত নির্জীব জড পদার্থের ওপর তাড়িত তরঙ্গের ধাক্কা দিয়া জগদীশচন্দ্র দেখাইয়াছেন,-

১। তরঙ্গের উত্তেজনায় উহার পরিচালন ক্ষমতা সহসা বাড়িযা যায়। এক ধাক্কায়

বাড়ে; আবার ক্রমশ স্বাভাবিক পরিচালকতা ফিবিয়া আসে। ২। পরিচালনশক্তির বৃদ্ধির একটা সীমা আছে, প্রবল ধাক্কায় পরিচালন মাত্রা সেই সীমায় পৌঁছে; তখন আর ধাক্কা দিলে বাড়ে না।

৩। ধাক্কার পর ধাক্কা দিলে প্রতি আঘাতে পরিচালন ক্ষমতা একটু-একটু করিয়া বাড়িয়া যায়। কিন্তু প্রথম ধাক্কায় যতটা বাড়ে, দ্বিতীয় আঘাতে ততটা নহে, তৃতীয় আঘাতে আরও কম ইত্যাদি।

৪। পুনঃপুনঃ দ্রুতগতিতে আঘাতের পর আঘাত দিয়া বিরামের অবকাশ না দিলে পরিচালন শক্তি এক টানে আপনার নিদিষ্ট সীমা পর্যন্ত বাড়িয়া যায়। ইহাই জড় পদার্থের

৫। প্রবল আঘাতে পরিচালন শক্তি একবারে চরম সীমায উপস্থিত হয়। তখন আর আঘাত দিলেও কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া হয় না। ইহাই জড় পদার্থের ক্লান্তিলাভ। ইহাই উহার সাময়িক ব্যাধি, এবং এই ব্যাধির ফল স্থায়ী হইলেই মৃত্যু। আবার একটা নাড়া দিলে অথবা একটু গরম করিলে স্বভাবে প্রতিনিবৃত্ত হয়। প্রচলিত coherer যন্ত্রে তাড়িত তরঙ্গের আঘাতে এই ক্লান্তির অবস্থা ঘটে, নাড়া না দিলে সেই ক্লান্তির অপনোদন হয় না।

৬। নির্জীব জড়দেহেও বিভিন্ন দ্রব্য প্রবেশ লাভ করিয়া কখনও অবসাদকেব, কখনও বা উত্তেজকের মতো কাজ করে ও কোনো দ্রব্যে সেই জড়দেহের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ক্ষমতা বাড়াইয়া দেয়, কোন দ্রব্যে কমাইয়া দেয়। কোনটা বিষের মতো কাজ কবিযা স্বভাবপ্রাপ্তির অন্তরায় হয়; কোন দ্রব্য ঔষধের কাজ করিয়া স্বভাবপ্রাপ্তির অনুকূল হইয়া থাকে। একই দ্রব্য মাত্রাভেদে কখনও অবসাদক, কখনও বা উত্তেজক হইয়া থাকে।

তাড়িতোর্মির উত্তেজনায় জড় দ্রব্য বিকৃত হয়, ইহা পূর্বেই আবিষ্কৃত হইয়াছিল- কিন্তু সেই বিকৃত অবস্থা হইতে স্বভাবপ্রাপ্তিঘটনায় জড়দেহে ও জীবদেহে এমন সাদৃশ্য রহিয়াছে, তাহা অধ্যাপক জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কৃত সত্য। জড়দেহে বিকারপ্রাপ্তির ও স্বভাবপ্রাপ্তির নিয়ম যে জীবদেহের বিকারপ্রাপ্তির ও স্বভাবপ্রাপ্তির অনুরূপ, তাহা ইতিপূর্বে কেহ জানিত না। জগদীশচন্দ্র গত বৎসর শ্রাবণ মাসে বিলাত যাইবার পূবেই জড়ের ও জীবের মধ্যে এই অচিন্তিতপূর্ব সাদৃশ্যের আবিষ্কার করিযাছিলেন। গত বৎসর সেপ্টেম্বর মাসে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সম্মুখে তিনি যে প্রবন্ধ পাঠ করেন, তাহাতেই এই সমস্ত আবিষ্কারপরম্পরা সমবেত বৈজ্ঞানিকমণ্ডলীর সম্মুখে প্রথমে উপস্থিত হয়। তৎপরে তিনি লন্ডন রয়াল সোসাইটিতে আরও কতিপয় প্রবন্ধ পাঠাইয়াছেন ও রয়াল ইনস্টিটিউশনে নিমন্ত্রিত হইয়া আপনার আবিষ্কারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ সাধারণের সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছেন। ওই সকল প্রবন্ধের যতটুকু বিবরণ এদেশে উপনীত হইয়াছে, তাহাতে বুঝিতে পারা যায়, তিনি বিজ্ঞানের গহনবনে যে নূতন মার্গ প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহাতে তাঁহার পুরোমুখ যাত্রা অদ্যাপি অব্যাহত রহিয়াছে। দিগ্বিজয়ী বীরের মতো তিনি যাত্রাকালে মরুপৃষ্ঠে অন্তোধারার উৎস খুলিয়া দিতেছেন, "নাব্যা নদী "কে "সুপ্রতরা" করিয়া ও কুঠারঘাতে "বিপিন"সকলকে "প্রকাশ" করিয়া পুরোমুখে অগ্রগামী হইতেছেন।

আঘাত পাইলে মাংসপেশি সঙ্কুচিত হয়; স্নায়ুতন্ত্রীতে সঙ্কোচন-পরিবর্তে তাড়িত প্রবাহের উৎপত্তি ঘটে। মাংসপেশির সঙ্কোচন লাভের প্রণালী ও স্নায়ুতন্ত্রীর তাড়িত বিকার লাভের প্রণালী ঠিক একই নিয়মের অনুসরণ করে। শরীরবিদ্যাশাস্ত্রে এই সাদৃশ্যের উল্লেখ আছে। কিন্তু স্নায়ুতন্ত্রীর সহিত একটা তামার তারের যে সাদৃশ্য আছে, তাহার উল্লেখ কোনও শাস্ত্রেই নাই। একটা স্নায়ুর সূতার একপ্রান্তে আঘাত দিলে উহাতে তাড়িত প্রবাহ জন্মে, তাহা শরীরতত্ত্বজ্ঞ মাত্রই জানেন; কিন্তু একটা তামার তারের একপ্রান্তে আঘাত দিলে, একটা মোচড় দিলে, যে তাড়িত প্রবাহের উৎপত্তি ঘটে, তাহা কেহ জানিত না।

আবার আঘাতপরম্পরায় স্নায়ুসূত্রে তাড়িত প্রবাহ একটা চরম সীমায় উপস্থিত হয়; সেই সীমা আর ছাড়ায় না। সেইরূপ আঘাত-পরম্পরায় তার মধ্যে তাড়িত প্রবাহ একটা চরম পরিণামের প্রতি অগ্রসর হয়, সেই চরম পরিণাম ছাড়ায় না, ইহা ইতিপূর্বে কেহ জানিত না। অতিশয় উত্তাপের বা অতিশয় শৈত্যের প্রয়োগে স্নায়ুতন্ত্রী মৃতকল্প হইয়া পড়ে, তখন আর উত্তেজনা সত্ত্বেও প্রতিক্রিয়া ঘটে না, উহা সকলেই জানিত। কিন্তু একটা নির্জীব ধাতুময় তারের তাড়িত প্রতিক্রিয়াশক্তি যে উত্তাপযোগে বা শৈত্যযোগে লোপ পায়, তাহা কেহ জানিত না। দ্রব্যগুণে স্নায়ুতন্ত্রীর উত্তেজনা বাড়ে; আবার দ্রব্যগুণে স্নায়ুতন্ত্রী অবসন্ন হয়; তাহাও সকলে জানিত। কিন্তু নির্জীব ধাতুপদার্থনির্মিত একটা তার যে দ্রব্যগুণে উত্তেজিত বা অবসন্ন হয়, উহার প্রতিক্রিয়াশক্তি বাড়িয়া যায় বা কমিয়া যায়, তাহা কে জানিত? ঔষধের উপকারিতা ও বিষের অপকারিতা, মদের মাদকতা ও আফিমের অবসাদকতা, এতদিন জীবন্ত পদার্থের জীবনীশক্তির বিশেষণস্বরূপে প্রযুক্ত হইত। জড়দেহের প্রতি ওই সকল বিশেষণপ্রয়োগ শশবিষাণ বা বন্ধ্যাপুত্রের মতো নিরর্থক হইত, সন্দেহ নাই। কিন্তু এখন হইতে জড়দেহের প্রতি ওই সকল বিশেষণপ্রয়োগ অর্থশূন্য হইবে না।

প্রবন্ধ অত্যন্ত দীর্ঘ হইয়া পড়িল; আলোকসম্পাতে চক্ষুরিন্দ্রিয় কীরূপে আহত হয়, তৎসম্বন্ধে জগদীশচন্দ্র অনেকগুলি নূতন সংবাদ বৈজ্ঞানিকগণের নিকট উপস্থিত করিয়াছেন। আলোকতরঙ্গের আঘাতে আবার চক্ষুর ভিতরে স্নায়ুযন্ত্র যেরূপ বিকার লাভ করে, আলোকতরঙ্গ ও তাড়িততরঙ্গ উভয়েরই আঘাত পাইয়া জগদীশচন্দ্রের নির্মিত কৃত্রিম চক্ষু তদনুরূপ বিকার প্রাপ্ত হয়। চক্ষু, দর্শনক্রিয়া সম্পাদনের জন্য যন্ত্র মাত্র; কিন্তু সেই যন্ত্রের আভ্যন্তরিক ক্রিয়াপ্রণালী কীরূপ, তাহা শরীরবিদ্যাশাস্ত্র ঠিক জানে না; এখন সেই কাজকর্মের প্রণালী বুঝিবার পথ বোধ হয় বাহির হইতে পারে। কিন্তু এই বৃহৎ কথার প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়া পাঠকগণের আর সহিষ্ণুতা পরীক্ষা করিব না।

জগদীশচন্দ্রের পরীক্ষিত ও আবিষ্কৃত তত্ত্বগুলি বৈজ্ঞানিকসমাজে শেষপর্যন্ত কীরূপে গৃহীত হইবে, বলা যায় না। বৈজ্ঞানিকসমাজে একটা বাহির হইতে উত্তেজনার আঘাত পড়িয়াছে, সন্দেহ নাই। কিন্তু বৈজ্ঞানিকসমাজ-শরীর সেই উত্তেজনায় কীরূপ সাড়া দিবে জানি না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান অতি দ্রুতবেগে উন্নতি লাভ করিয়াছে; কিন্তু স্থিতিশীলতায় বৈজ্ঞানিকসমাজের কোথাও প্রতিদ্বন্দ্বী নাই। কেহ কোনো নূতন তত্ত্ব অন বৈজ্ঞানিকসমাজ সেই ব্যক্তিকে কতকটা সন্দেহের, কতকটা আশ সহিত নূতন সত্যকে সহসা অঙ্গীকার করিতে চাহেন না। অজ্ঞাতকুলশীল অপরি মনোরম বেশে আসুক, বৈজ্ঞানিকসমাজ তাহাকে বাস দান করিতে স্বভ' তেই কুণ্ঠিত হইয়া থাকেন। জ্বলন্ত আগুনে উহার "বিশুদ্ধি" বা "শ্যামিকা" পরীক্ষা না এয়া উহাকে গ্রহণ করেন না। এইরূপ অগ্নিপরীক্ষার পর যাহা সত্য, তাহা উজ্জ্বলতর হইয়া বাহির হয়; আর যাহা অসত্য, তাহা অগ্নিপরীক্ষায় ভস্ম মাত্র রাখিয়া যায়। জগদীশচন্দ্রের পরীক্ষিত তত্ত্বগুলিও এইরূপ অগ্নিপরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত হইয়াছে। সেই অগ্নিপরীক্ষার পর উহার আকার কীরূপ হইবে, সে বিষয়ে আমাদের বাক্যব্যয় ধৃষ্টতা মাত্র।

এই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলে জড়ের ও জীবের মধ্যে অন্যতর প্রধান ব্যবধান দূর হইবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। জড়ের ও জীবের মধ্যে দুইটি প্রধান ব্যবধান রহিয়াছে, পূর্বে উল্লেখ করিয়াছি। বাহ্য প্রকৃতির উত্তেজনায় জীবদেহ প্রতিক্রিয়া উৎপাদন করে। জীবদেহ অনুক্ষণ অবিরামে বাহ্য জগতের প্রতি এই প্রতিক্রিয়া প্র. করিতেছে; এই প্রয়োগকার্যে অবিরাম চেষ্টাই জীবন। জড়দেহেও যদি সেই প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা বতমান থাকে, জড়দেহ যদি বাহ্য শক্তির উত্তেজনায় বিকার লাভ করিয়া সাড়া দেয়, জড়দেহ যদি বাহ্য শক্তির আঘাতে উত্তেজিত বা অবসন্ন, ব্যাধিগ্রস্ত বা রোগমুক্ত হয়, তাহা হইলে জড়ের ও জীবের মধ্যে অন্তত একটা ব্যবধান তিরোহিত হইবে। আর একটা ব্যবধান তখনও অভগ্ন রহিবে, তাহা বলা আবশ্যক। জীব, বাহ্য জগৎ হইতে খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করিয়া আত্মপোষণ করে ও আত্মপুষ্টিসহকারে বংশবৃদ্ধি সাধন করিয়া স্বয়ং সংসার হইতে অবসর লয়, আপনার বংশধরে আপন ধর্মের সংক্রমণ করিয়া তাহার প্রতি জীবনের খেলা খেলিবার ভার দিয়া যায়; জীবের এই অপর লক্ষণ, এই বিশিষ্ট জীবধর্ম, তখনও জড়ের ও জীবের মধ্যে ব্যবধানস্বরূপে প্রজ্ঞার চক্ষু আবৃত রাখিয়া সম্প্রদায়বিশেষকে আরও কিছুদিন সান্ত্বনা প্রদান করিবে।

'সাহিত্য', ১৩০৮ ভাদ্র



রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী অধ্যাপক বসুর নবাবিষ্কার

ক লকাতা শহরের দৈনন্দিন মৃত্যুসংখ্যা প্রত্যহ খবরের কাগজে বাহির হয়। সাত দিনের সংবাদ একত্র করিয়া এইরূপ তালিকা প্রস্তুত করা যাইতে পারে:-

তারিখ

মৃত্যুসংখ্যা

১লা বৈশাখ

২রা বৈশাখ

৫০

৪৫

৩রা বৈশাখ

৬২

৪ঠা বৈশাখ

१०

৫ই বৈশাখ

৬ই বৈশাখ

৩৫

৬০

৭ই বৈশাখ

৫৫

এই তালিকা দেখিলে কোন্ দিন কত লোক মরিয়াছে, জানা যায়। তালিকার পরিবর্তে রেখা দ্বারা দৈনন্দিন মৃত্যুসংখ্যা-নির্দেশ চলিত পারে।

१०

৬০

৫০-

80

৩০

২০-

১০-

• ঘ

• গ

৬৭

১ চিত্র

১ম চিত্রে দুইটি রেখা পরস্পর লম্বভাবে অবস্থিত। একটি রেখা সময়নির্দেশক, উহাতে ১ হইদ্ভূত ৭ পর্যন্ত তারিখের অঙ্ক লেখা আছে। অন্য রেখাটি মৃত্যুসংখ্যা নির্দেশক, উহাতে ১০ হইতে ৭০ পর্যন্ত মৃত্যুসংখ্যা অঙ্কিত আছে।

১০ অঙ্ক ও ২০ অঙ্কের মাঝের স্থানটুকু দশ ভাগে বিভক্ত করিলে ১১, ১২ হইতে ১৯ পর্যন্ত অঙ্ক পাওয়া যাইতে পারে। চিত্র কদাকার হইবার ভয়ে ওই সকল চিহ্ন দেওয়া হয় নাই। পাঠকগণ মনে-মনে ঐরূপ ভাগ করিয়া লইতে পারেন।

১ হইতে ৭ পর্যন্ত তারিখ নির্দেশক অঙ্কের ওপর ক, খ ইত্যাদি ক্রমে ছ পর্যন্ত সাতটি বিন্দু রহিয়াছে। এক এক অঙ্কের উপর এক এক বিন্দু। ৩ অঙ্কের ওপর গ, ৬ অঙ্কের ওপর চ, ইত্যাদি।

সকল বিন্দুর উচ্চতা সময়-নির্দেশক বেখা হইতে সমান নহে। কোনোটির উচ্চতা অধিক, কোনোটির কম। ঘ-বিন্দু সর্বোচ্চ আছে, আর ঙ-বিন্দু সকলের নিম্নে আছে। কোন বিন্দু কত উঁচুতে আছে, মাপিতে হইলে পাশের মৃত্যুসংখ্যা নির্দেশক রেখায় তাকাইলেই চলিবে। ক-বিন্দুর উচ্চতা ৫০; খ-বিন্দুব উচ্চতা ৪০ ও ৫০-এব মাঝামাঝি অর্থাৎ ৪৫; গ-এর উচ্চতা ৬০-এর একটু বেশি অর্থাৎ ৬২, ঘ-বিন্দুর উচ্চতা ৭০; ঙ-বিন্দুর উচ্চতা আবার ৩৫ মাত্র।

१०

৬০

৫০

৩০

২০

১০

8

২ চিত্র

২য় চিত্রে বিন্দুগুলির মাঝ দিয়া একটা ভাঙা-চুরা বাঁকা রেখা টানা গিয়াছে।

এই রেখার অন্তর্গত কোন্ বিন্দু কত উচ্চে আছে দেখিলেই, কোন্ তারিখে কত লোক মরিয়াছে, স্পষ্ট বুঝা যাইবে।

মনে কর, জানিতে চাই-৬ই তারিখে কত লোক মরিয়াছে। তারিখের অঙ্ক ৬-এর ওপরে রেখাস্থ চ-বিন্দু; চ-বিন্দুর উচ্চতা ৬০; স্থির হইল, ৬ই তারিখে ৬০ জন লোক মরিয়াছে।

তালিকার কাজ এইরূপ রেখা দ্বারা সম্পাদিত হইতে পারে। রেখায় একটা সুবিধা আছে, তালিকায় তাহা নাই। রেখার ওঠা নামা দেখিলেই মৃত্যুর হারের ওঠা-নামা বুঝিতে পারা যায়-রেখাটি যেন চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দেয়, মৃত্যুসংখ্যা কোন্ দিন কত বাড়িয়াছে, কোন দিন কত কমিয়াছে। ৪ঠা তারিখে মৃত্যুর হার একবারে ৭০ পর্যন্ত উঠিয়াছে। তার পরদিন একবারে সহসা ৩৫-এ পতন। কলকাতার যিনি বাসিন্দা, তাঁহাকে এইরূপ রেখা দেখাইলে, তিনি রেখার সহসা ঊর্ধ্বগতি দেখিলে আতঙ্কিত হইবেন; রেখার নিম্নে পতনে, তাঁহার আশ্বাসলাভ ঘটিবে।

আর একটা উদাহরণ লওয়া যাক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক কার্যবিবরণীতে কোন বৎসর কত ছাত্র বি, এ, পাশ করে, তাহার তালিকা বাহির হয়। সেই তালিকার বদলে ৩য় চিত্র দেওয়া গেল। চিত্র দেখিলেই বুঝা যাইবে, কোন্ বৎসরের পাশের ফল কীরূপ।

• "ক" চিহ্নটি চিত্রে উঠে নাই, উহা পঞ্চাশের ঘর ঘেঁষিয়া অবস্থিত এইরূপ ধরিয়া লইতে হইবে।-সম্পাদক।

৮৫ হইতে ৯৫ পর্যন্ত ইংরাজি বৎসরের অঙ্ক; ৮৫ অর্থে ১৮৮৫, ৯৫ অর্থে ১৮৯৫। অন্য রেখায় ১০০ হইতে ৫০০ পর্যন্ত অঙ্ক উত্তীর্ণ ছাত্রের সংখ্যা নির্দেশক। বক্র রেখাটি দেখিয়া কোন বার কত ছাত্র পাশ করিয়াছে, অক্লেশে বুঝা যায়। ৮৫ সালে পাশের সংখ্যা প্রায় ৩১০; ৮৬ ও ৮৭ সালের প্রায় সমান, সাড়ে চারি শতর কাছাকাছি; ৮৮ সালে কিঞ্চিৎ

৫০০

800

৩০০

২০০

১০০

৮৫৮৬৮৭৮৮৮৯৯০ ৯১ ৯২ ৯৩ ৯৪ ৯৫

৩ চিত্র

পতন, প্রায় পৌনে চারিশতে; ৮৯ ও ৯০ দুই বৎসর ক্রমিক উত্থান, ৮৯এ ৪০৯; ৯০এ ৪৩৫; ৯১ সালে একবারে অধঃপতন ৩০৩ সংখ্যায়। আবার ৯৫ পর্যন্ত ক্রমশ উত্থান। ৯৫ সালে উন্নতির সীমা প্রায় পাঁচশত পর্যন্ত।

কলকাতা শহরের মৃত্যুসংখ্যার হিসাব ২৪ ঘণ্টা পরপর পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বৎসর অন্তরে ছাত্রেরা বি. এ. পাশ করে। কিন্তু এমন বিবিধ ঘটনা আছে, যাহা ক্ষণে ক্ষণে

১০০

৯০ ৮০

१०

৬০ ৫০

80

৩০

২০

১০

২৪ ৬৮ ১০১২ ২ ৪ ৬ ৮ ১০১২

পূর্বাহ্ণ

৪ চিত্র

অপরাহ্

পরিবর্তিত হয়; ক্ষণে ক্ষণে তাহার কীরূপ পরিবর্তন হয়, তাহা জানা আবশ্যক হইয়া উঠে। যেমন বায়ুর উষ্ণতা। বায়ুর উষ্ণতা চব্বিশ ঘণ্টায় সমান থাকে না, উহা ক্ষণে-ক্ষণে বদলায়। বড় বড় মানমন্দিরে থার্মোমিটার দ্বারা এই অবিরাম পরিবর্তনের হিসাব রাখা হয়। এবং সেই অবিরাম পরিবর্তন রেখার উত্থান-পতন দ্বারা দেখানো যাইতে পারে। ৪র্থ চিত্রে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে উষ্ণতা কখন কীরূপ ছিল, দেখানো হইতেছে। রাত্রি ১২টা হইতে বেলা ১২টা পর্যন্ত পূর্বাহ্ন; বেলা ১২টা হইতে পররাত্রি ১২টা পর্যন্ত অপরাহ্ন। সময়-নির্দেশক রেখায় পূর্বাহ্নের ও অপরাহ্নেব ঘটিকাচিহ্ন এইরূপে অঙ্কিত আছে। উষ্ণতা-নির্দেশক অপর রেখায় উষ্ণতা অংশ থার্মোমিটারের ডিগ্রি ১০০ পর্যন্ত অঙ্কিত আছে।

রেখার উত্থান পতনে স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে, কোন সময়ে বায়ুর উষ্ণতা কত ডিগ্রি ছিল। রাত্রি বারোটার সময় উষ্ণতা প্রায় ৭৫ ডিগ্রি ছিল, ক্রমশ কমিয়া রাত্রি ৪টার সময় ৬০ ডিগ্রির নীচে নামিয়াছে। আবার ক্রমশ উঠিয়া বেলা ৯টার সময় ৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠিয়াছে। হয়তো সেইসময় একটু মেঘ করিয়াছিল, একটু ঠান্ডা হাওয়া দিয়াছিল। উষ্ণতা সেইরূপ কোনো একটা কারণে বেলা ১২টার সময় আবার কমিয়া যায়। আবার ৪টা বেলার সময় উষ্ণতার মাত্রা ১০০ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠিয়া পড়ে। এইরূপ অহোরাত্র মধ্যে উষ্ণতার হ্রাস- বৃদ্ধি চিত্রস্থিত বক্র রেখাটির উত্থান-পতনের দ্বারা স্পষ্টভাবে নির্দেশিত হইতেছে।

যে কোনো ঘটনার পরিবর্তন বা হ্রাস-বৃদ্ধি এইরূপ রেখা দ্বারা দেখানো যাইতে পারে। অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র এইরূপ কতিপয় রেখা দ্বারা ধাতুপদার্থের আভ্যন্তরিক পরিবর্তন দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছেন। সেই রেখাগুলির অর্থ কী, বুঝাইবার জন্য একখানি ভূমিকা আবশ্যক হইল। যাঁহারা এই প্রণালীর অর্থ জানেন, তাঁহাদের নিকট ভূমিকার প্রয়োজন ছিল না। যাঁহারা এই প্রণালীর অর্থ জানেন না, তাঁহাদের জন্য এই ভূমিকা আবশ্যক। নতুবা জগদীশচন্দ্রের প্রদর্শিত রেখাগুলি তাঁহাদের নিকট অর্থশূন্য বোধ হইবে।

মাংসপেশিতে আঘাত করিলে উহার সঙ্কোচ ঘটে। আঘাতের ফলে একটু খাটো হয়। কতটুকু খাটো হয়, মাপিয়া দেখা চলে। আবার কতটা আঘাতে কতটুকু খাটো হয়-তাহাও মাপিয়া দেখা চলে। এই সঙ্কোচন চিরস্থায়ী হয় না; আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্কোচ ঘটে; আবার একটু পরে মাংসপেশি স্বভাবে ফিরিয়া আসে। একটা ধাক্কা, সঙ্গে সঙ্গে সঙ্কোচবৃদ্ধি, আবার কিছুক্ষণ পরে স্বভাবপ্রাপ্তি। শরীরবিজ্ঞান শাস্ত্রের আলোচনা যাহাদের ব্যবসায়, তাঁহারা এই সকল ব্যাপার পর্যবেক্ষণে দিন কাটান। একটা ধাক্কায় কতক্ষণে কতটুকু সঙ্কোচ ঘটিল, আবার কতক্ষণ পরে স্বভাবপ্রাপ্তি হইল, ঘড়ি ধরিয়া ও মাপকাঠি লইয়া মাপিয়া থাকেন; এবং যাহা দেখেন, তাহা রেখা টানিয়া অন্যকে দেখান।

একখণ্ড মাংসপেশিতে একটা ধাক্কা দিলে, কতক্ষণে কতটুকু সঙ্কোচ ঘটে ও কতক্ষণে আবার স্বভাবপ্রাপ্তি ঘটে, তাহা নিম্নের ৫ক চিত্রে দেখানো গেল। এই চিত্র Brodie's Experimental Physiology পুস্তকের ৫৫ পৃষ্ঠা হইতে গৃহীত। এই চিত্রে ও পরবর্তী চিত্রসকলে লম্বরেখা দুইটি আর অনাবশ্যক বোধে দেওয়া যায় নাই। পাঠকগণ মনে-মনে কল্পনা করিয়া লইবেন, সেই রেখাদ্বয় যেন চিত্রে অদৃশ্যভাবে রহিয়াছে। একটি রেখা ভূমিগত-উহা কালনির্দেশক। অপরটি উহার উপর লম্বরূপে দণ্ডায়মান-উহা সঙ্কোচের মাত্রানির্দেশক।

এ চিত্রে স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে, ধাক্কা পাইয়া সঙ্কোচ ক্রমে বাড়িতেছে; পূর্ণমাত্রায় ওঠার পর আবার সঙ্কোচ কমিয়া গিয়াছে। মাংসপেশি ক্ষণিকের জন্য বিকৃতিলাভের পর আবার প্রকৃতিস্থ হইয়াছে।

জগদীশচন্দ্র দেখাইয়াছেন, তাড়িত তরঙ্গের ধাক্কা বা তদনুরূপ একটা ধাক্কা পাইলে, ধাতুপদার্থ বিকৃতি লাভ করে; উহার তাড়িত-পরিচালনশক্তি সহসা বাড়িয়া যায়। একটা ধাক্কায় ক্ষণেকের মতো বাড়ে মাত্র; আবার কিয়ৎক্ষণ পরে উহা স্বভাবে ফিরিয়া আসে। এই পরিচালনশক্তির বৃদ্ধি ও হ্রাসও রেখার উত্থান-পতন দ্বারা দেখানো যাইতে পারে। জগদীশচন্দ্রও তাহা দেখাইয়াছেন। ৫ খ চিত্রে তাহা প্রদর্শিত হইল।

৫ ক চিত্র

মাংসপেশির অবস্থার উত্থান-পতন, আর ধাতুপদার্থের অবস্থার উত্থান-পতন, উভয়ের সাদৃশ্য কত অদ্ভুত, তাহা ৫ (ক) ও ৫ (খ), দুই চিত্র মিলাইয়া দেখিলেই বুঝা যাইবে।

৫ খ চিত্র

পরবর্তী চিত্রগুলির বোধ করি, বিস্তৃত ব্যাখ্যা আবশ্যক হইবে না। পাঠক মহাশয় আপনি বুঝিয়া লইবেন। কয়েক জোড়া চিত্র অঙ্কিত হইয়াছে। প্রত্যেক জোড়ার মধ্যে প্রথম চিত্র ক-চিহ্নিত ও দ্বিতীয় চিত্র খ-চিহ্নিত করা গেল। ক-চিহ্নিত চিত্রগুলি শরীরবিজ্ঞান শাস্ত্রের গ্রন্থ হইতে গৃহীত; এই সকল চিত্রের কোনটায় মাংসপেশির, কোনটায় বা স্নায়ুসূত্রের বিকারপ্রাপ্তি দেখানো হইয়াছে। খ-চিহ্নিত চিত্রগুলি অধ্যাপক জগদীশচন্দ্রের অঙ্কিত। ধাতুচূর্ণে, ধাতুর তারে ধাক্কা দিয়া, মোচড় দিয়া, তাড়িত তরঙ্গের আঘাত দিয়া উহাতে বিকার উৎপাদন করিলে, সেই বিকারের কীরূপ হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে, কীরূপ উত্থান- পতন ঘটে, তাহা এই সকল চিত্রে দেখানো হইয়াছে। প্রত্যেক জোড়ার ক-এর সহিত খ- এর সাদৃশ্য কত বিস্ময়কর! মাংসপেশি বা স্নায়ুসূত্রের মতো জীবন্ত দ্রব্য যে নানাবিধ বিকার লাভ করে, তাহা সকলেই জানিত; কিন্তু নির্জীব ধাতুচূর্ণ বা ধাতুতন্ত্রীতে যে এমন বিকার উৎপন্ন হয়, তাহা কেহ জানিত না। এবং মাংসপেশির বা স্নায়ুসূত্রের বিকারলাভ ও স্বভাবপ্রাপ্তির সহিত নির্জীব ধাতুপদার্থের বিকারলাভের ও স্বভাবপ্রাপ্তিব এত সাদৃশ্য আছে, তাহাই বা কে জানিত? সকলের অপেক্ষা আশ্চর্য এই, যে দ্রব্য পেশির পক্ষে বা স্নায়ুর পক্ষে মাদক বা উত্তেজক, তাহাই আবার ধাতুপদার্থের পক্ষেও মাদক ও উত্তেজক; যাহা সজীব পদার্থের পক্ষে অবসাদক, নির্জীবের পক্ষেও তাহাই অবসাদক।

এখন আমরা এক এক জোড়া চিত্র পাঠকের সম্মুখে উপস্থিত করিব ও উহার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দিব। ক চিত্রের সহিত খ চিত্রের সাদৃশ্য দেখিয়া, সজীবের ও নির্জীবের সাদৃশ্য পাঠক বুঝিয়া লইবেন।

৬ ক। এক খণ্ড মাংসপেশিতে পুনঃপুনঃ ধাক্কা পড়িলে উহার সঙ্কোচ কীরূপে বাড়ে কমে, বাড়ে কমে, বাড়ে কমে, দেখানো হইতেছে।

৬ খ। ধাতুদ্রব্যে পুনঃপুনঃ ধাক্কা পড়িলে উহার তাড়িত-পরিচালন-শক্তি কীরূপ বাড়ে কমে, বাড়ে কমে, বাড়ে কমে, দেখানো হইতেছে।

৬ক চিত্র

৬ খ চিত্র ৭ ক। পুনঃপুনঃ আঘাতে মাংসপেশি যেন ক্রমশ ক্লান্ত হইয়া আসিতেছে। প্রথম-প্রথম আঘাতে যতটা সঙ্কোচ হইতেছিল, পরের আঘাতে আর ততটা সঙ্কোচ ঘটে না। সঙ্কোচের মাত্রা পরপর আঘাতে কমিয়া আসিতেছে। রেখার উত্থান পতনের মাত্রা ক্রমশ কমিয়া আসিতেছে; তাহার অর্থ-পুনঃপুনঃ উত্তেজনায় মাংসপেশিরা ক্রমশ যেন শ্রান্ত ও অবসন্ন হইতেছে।

৭ ক চিত্র

৭ খ। পুনঃপুনঃ উত্তেজনা পাইয়া ধাতুপদার্থও ক্রমশ ও অবসন্ন হইতেছে।

ww

শ্রান্ত ৮ ক। পুনঃপুনঃ উত্তেজনায় পেশির

ক্রমশ অবসাদপ্রাপ্তি-৭ ক চিত্রেরই অনুরূপ।

৭ খ চিত্র

৮ খ। পুনঃপুনঃ উত্তেজনায় ধাতুদ্রব্যের ক্রমশ অবসাদপ্রাপ্তি-৭ খ চিত্রের অনুরূপ।

৯ ক। প্রথমেই প্রবল আঘাত পাইয়া মাংসপেশি যেন একই আঘাতে অত্যন্ত অবসন্ন হইয়াছে। তার পরের আঘাতে যেন অতি ক্ষীণভাবে সাড়া দিতেছে। আর পূর্বের মতো প্রতিক্রিয়ার যেন ক্ষমতা নাই। তারপর আঘাত থামিলে, ক্রমশ স্বভাবপ্রাপ্তি ও অবসাদলোপ।

৯ খ। ধাতুদ্রব্যের অবস্থাও তদনরূপ- প্রবল আঘাতে ধাতুপদার্থও যেন কাতর ও অবসন্ন, পরের আঘাতগুলিতে তাহার আর পূর্বের মতো সতেজে প্রতিক্রিয়া উৎপাদনের ক্ষমতা নাই।

১০ ক। প্রথম আঘাত এত প্রবল যে,

৮ ক চিত্র

৯ ক চিত্র

৮ খ চিত্র

৯ খ চিত্র

সেই আঘাতে মাংসপেশি একবারে সম্পূর্ণভাবে অবসন্ন; এবার অবসাদের মাত্রা পূর্ণ; আর আঘাতে সাড়া দেয় না। সঙ্কোচ- নির্দেশক, রেখাটি চরম উন্নতি লাভ করিয়া একবারে সোজা চলিয়াছে; আঘাত সত্ত্বেও, উত্তেজনা সত্ত্বেও, কিছুকাল উহার আর উত্থান-পতন নাই। মাংসপেশির এই পূর্ণ অবসাদের অবস্থায় ধনুষ্টঙ্কার ঘটে। ধনুষ্টঙ্কারে মাংসপেশির সঙ্কোচনমাত্রা চরম সীমায় উপস্থিত হয়; তখন উহা এরূপ কাঠিন্য ও জড়তা লাভ করে যে, আর কোনোরূপে কোনো উত্তেজনায় উহাকে কোমল করা যায় না; উহার জড়তার অপনোদন হয় না। আবার কিয়ৎকাল বিশ্রাম লাভের পর এই শ্রান্তি দূর হয়; তখন উহা স্বভাবে ফিরিয়া আসে। ইহাকে রোগমুক্তি বলা যাইতে পারে। উত্তাপপ্রয়োগ, ঔষধপ্রয়োগ প্রভৃতি রোগমুক্তির অনুকূল।

১০ ক চিত্র

১০ খ। ধাতুদ্রব্যের পূর্ণ অবসাদ। প্রবল আঘাতে ধাতুদ্রব্যেরও আর সাড়া দিবার ক্ষমতা থাকে না। উহার পরিচালনশক্তি একবারে পূর্ণমাত্রায় উপস্থিত হইয়াছে। এখন নূতন উত্তেজনায় সে শক্তির আর হ্রাস-বৃদ্ধি নাই। তাড়িতোর্মি প্রদর্শনের জন্য নির্মিত Coherer যন্ত্রে ধাতুদ্রব্যের এই অবসাদপ্রাপ্তি প্রত্যক্ষ দেখা যায়। বিশ্রাম লাভের পর, অথবা উত্তাপ প্রয়োগে এই অবসাদের দশা আবার দূর হয়।

১১ ক। উত্তাপে অবসাদ নষ্ট করে, উত্তাপ রোগমুক্তির অনুকূল। ১১ ক চিত্রের অন্তর্গত উভয় রেখায় ইহা দেখানো হইয়াছে। ৩০ ডিগ্রি উষ্ণতায় মাংসপেশি যেন সতেজে সাড়া দিতেছে; উত্তেজনা পাইবামাত্র অমনি সঙ্কুচিত হইতেছে; আবার ক্ষণমাত্রেই স্বভাবে প্রত্যাবৃত্ত হইতেছে। আর ৬ ডিগ্রি মাত্র গরমে মাংসপেশি যেন দুর্বল ও ক্ষীণ; উত্তেজনা তেমনই; কিন্তু উহার সঙ্কোচমাত্রা কত কম। ধীরে-ধীরে কিঞ্চিৎ সঙ্কোচ লাভ করিয়া আবার ধীরে-ধীরে প্রকৃতিস্থ হইতেছে।

উত্তাপের এই অবসাদ-নাশক শক্তি সকলেই জানেন। দারুণ শীতে শরীর অবসন্ন হয়; উত্তাপে স্ফূর্তি লাভ করে। পরিশ্রমে মাংসপেশি শ্রান্ত ও অবসন্ন হইলে, উষ্ণতাপ্রয়োগে উহার অবসাদ দূর হয়। মাংসপেশির স্মৃতিলাভের জন্য ডাক্তারদের ফোমেন্টেশন প্রয়োগের ব্যবস্থা চিরপ্রসিদ্ধ।

১১ খ। এখানেও দুইটি রেখা; একটিতে ধাতুদ্রব্য গরম- ২১ ডিগ্রি, অন্যটিতে ধাতুদ্রব্য ঠান্ডা-২ ডিগ্রি মাত্র। উভয় রেখায় কত তফাত। গরমে কত তেজ; ঠান্ডায় কত অবসাদ।

১০ খ চিত্র

২০

১১ ক চিত্র

0 ২১

১১ খ চিত্র

১১ খ খ। এই চিত্রের তিনটি রেখা ধাতুদ্রব্যের উষ্ণতার মাত্রাভেদে ত্রিবিধ অবস্থা দেখাইতেছে। প্রথম রেখায় ০ ডিগ্রি, দ্বিতীয়টিতে ৪০ ডিগ্রি ও তৃতীয় রেখায় ১০০ ডিগ্রি গরমে ধাতুর অবস্থা কারূপ থাকে, বুঝা যাইতেছে। ০ ডিগ্রির অপেক্ষা ৪০ ডিগ্রিতে উত্তেজনা MMM যেন কিছু বাড়িয়াছে; আবার ১০০ ডিগ্রিতে যেন একটু অবসন্ন হইয়াছে; অল্প উত্তাপে উত্তেজনা 0° ৪০০ ১০০০

১১ খখ চিত্র

বাড়ে; কিন্তু উত্তাপের আতিশয্য আবার উত্তেজনার বদলে অবসাদ উৎপন্ন করে। ১২ ক। এই চিত্র দেওয়া গেল না। অ্যামোনিয়া অতি পরিচিত উগ্রগন্ধি বাষ্পীয় পদার্থ। অ্যামোনিয়া প্রয়োগে শরীরের কীরূপ অবসাদনাশ ও উত্তেজনা বৃদ্ধি হয়, তাহা সকলেই জানেন।

১২ খ। এই চিত্রে ধাতুদ্রব্যের ওপর অ্যামোনিয়ার ক্রিয়া প্রদর্শিত হইযাছে। বামের রেখার উত্থান-পতনে অ্যামোনিয়া প্রয়োগের পূর্বতন অবস্থা ও ডাহিনের রেখার উত্থান পতনে অ্যামোনিয়া প্রয়োগের পরবর্তী অবস্থা দেখানো হইতেছে। নির্জীব ধাতুপদার্থ আমোনিয়া প্রয়োগে যে এমন উত্তেজিত হইয়া ওঠে, তাহা কে জানিত!

M

১২ খ চিত্র

১৩ ক। বিষ প্রয়োগে স্নায়ুসূত্রের অবস্থান্তরপ্রাপ্তি এই চিত্রে দেখানো হইতেছে। যাহাতে অস্বাভাবিক অবসাদ উৎপাদন করে, তাহাই বিষ। ক্লোরোফর্মের অবসাদক ক্রিয়া সকলেই জানেন। অতিমাত্রায় প্রয়োগে স্নায়ুযন্ত্র অবসন্ন ও নিষ্ক্রিয় হইয়া পড়ে। অধিক মাত্রায় জীবনহানি পর্যন্ত ঘটে। এই চিত্রের বামাংশে ক্লোরোফর্ম প্রয়োগের পূর্বে স্নায়ুসূত্রের স্বাভাবিক উত্তেজিত অবস্থা ও দক্ষিণের অংশে ক্লোরোফর্ম প্রয়োগের পরে অবসন্ন অবস্থা প্রদর্শিত হইয়াছে।

১৩ ক চিত্র

স্নায়ুসূত্রে আঘাত করিলে উহাতে তাড়িত প্রবাহ জন্মে; দ্রুত প্রবাহে স্নায়ুর স্বাভাবিক অবস্থার ও ক্ষীণ প্রবাহে উহার অবসন্ন অবস্থার সূচনা করে। ক্লোরোফর্ম প্রয়োগে স্নায়ু ক্রমে অবসন্ন হয়; উহার আর দ্রুত প্রবাহ উৎপাদনের ক্ষমতা থাকে না। চিত্রে তাহাই দেখানো হইতেছে।

১৩ খ। ধাতুপদার্থে বিষের ক্রিয়া। বামাংশে বিষ প্রয়োগের পূর্বের ও দক্ষিণের অংশে বিষ প্রয়োগের পরের অবস্থা দেখানো হইতেছে।

১৪ খ। এই চিত্রে তিনটি রেখা ধাতুর ত্রিবিধ অবস্থার জ্ঞাপক। প্রথম রেখায় বিষ প্রয়োগের পূর্বতন অবস্থা-ধাতুপদার্থ এখন স্বভাবস্থ; উত্তেজনা পাইলেই সতেজে সাড়া দেয়। দ্বিতীয় রেখায় বিষ প্রয়োগের পরবর্তী দশা-নির্জীব ধাতু এখন সজীবের মতো অবসন্ন- উত্তেজনার প্রতিক্রিয়া ক্ষীণ। তৃতীয় রেখা ঔষধ প্রয়োগের পর-ঔষধ প্রয়োগে অবসাদ দূর হইয়াছে; ধাতু আবার প্রকৃতিস্থ হইয়া উত্তেজনায় সাড়া দিতেছে। ১৪ ক চিত্র দেওয়া আবশ্যক হয় নাই।

১৫ খ। এখানেও তিনটি রেখা। প্রথম রেখা ধাতুদ্রব্যের স্বাভাবিক অবস্থার জ্ঞাপক। অল্পমাত্রায় উত্তেজক দ্রব্যের প্রয়োগে ধাতুদ্রব্য কিরূপে উত্তেজিত হয়, তাহাও দ্বিতীয় রেখায় বুঝা যাইতেছে। অধিক মাত্রায় প্রয়োগে ঔষধও কিরূপে অবসাদে পরিণত হয়, তাহা দেখা যাইতেছে। আফিম, বেলাডোনা, ইপিকাকুয়ানা প্রভৃতি দ্রব্য কীরূপে মাত্রাভেদে স্নায়ু-যন্ত্রের উপর, কখনও ঔষধের, কখনও বিষের কাজ করে, তাহা সর্বজনবিদিত; স্বতন্ত্র চিত্রে তাহা দেখানো গেল না।

১৩ খ চিত্র

১৪ খ চিত্র

১৫ খ চিত্র

১৬ ক। স্নায়ুযন্ত্রের উপর আফিমের ক্রিয়া দেখানো হইয়াছে। বামাংশে প্রয়োগের পূর্বতন, দক্ষিণাংশে পরবর্তী ক্রিয়া দেখানো হইয়াছে।

১৬ খ। ধাতুদ্রব্যে আফিমের তদনুরূপ ক্রিয়া।

জড়দেহে ও জীবদেহে যে কতটা সৌসাদৃশ্য আছে, তাহা উপরি উদ্ধৃত চিত্রগুলি দেখিলেই কতকটা বুঝা যাইবে। এই সাদৃশ্যের বিষয় এতদিন কেহ জানিত না। অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র এই সাদৃশ্যের আবিষ্কার করিয়া বিজ্ঞানশাস্ত্রে একটা নূতন রাস্তা খুলিয়া দিয়াছেন, সে বিষয়ে সংশয়মাত্র নাই। এই নূতন পথ অবলম্বন করিয়া বৈজ্ঞানিকেরা কোনো নূতন দেশে উপস্থিত হইবেন, তাহা এখন কেহই বলিতে পারে না। জীবদেহের মতো জড়দেহ বাহিরের উত্তেজনায় সাড়া দেয়, জীবদেহের ন্যায় জড়দেহ বিষপ্রয়োগে অবসন্ন হয়, আবার ঔষধে তাহার অবসাদ নষ্ট হয়, এই সকল নূতন তত্ত্ব অধ্যাপক জগদীশচন্দ্রের পূর্বে কোনো বৈজ্ঞানিকেরই কল্পনায় আসে নাই। জড়েরও জীবন আছে কি না, এই দুরূহ প্রশ্নের মীমাংসা বিজ্ঞানশাস্ত্রের একটা প্রকাণ্ড সমস্যা। অনেক বড় বড় পণ্ডিত মীমাংসা অসাধ্য বলিয়া একবারে নিরাশ হইয়া বসিয়া আছেন। কোন্ পথে চলিলে এই সমস্যার পূরণ হইতে পারে, তাহার নির্দেশেও এপর্যন্ত কেহ সাহসী হয়েন নাই। জগদীশচন্দ্রের আবিষ্টিয়া পরম্পরা সেই সমস্যার পুরণে কত দূর সফল হইবে, তাহার নির্দেশে আমরা অসমর্থ। কিন্তু তিনি যে নূতন পন্থা আবিষ্কার করিয়া জ্ঞানের আলোকবতিকা হস্তে অজ্ঞানের তমোময় রহস্যাবৃত প্রদেশাভিমুখে একাকী অগ্রণী হইয়াছেন, তজন্য তাঁহার সাহস ও অধ্যবসায় ও কৃতিত্ব বিস্ময় উৎপাদন করিবে, সন্দেহ নাই। তাঁহার মাতৃভূমির বিষাদক্লিষ্ট মুখমণ্ডলে তিনি আনন্দের রেখাপাতে সমর্থ হইয়াছেন; তাঁহার জননীর আশীর্বচন তাঁহার জয়যাত্রার রক্ষাকবচ হউক।

১৬ ক চিত্র

১৬ খ চিত্র




অমলচন্দ্র হোম

আমেরিকায় আচার্য জগদীশচন্দ্র

র্কিন যুক্তরাজ্যের অন্তর্গত আইওযা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম মা অধ্যা পর অধ্যাপক শ্রীযুক্ত সুধীন্দ্র বসু বর্তমান ইংরাজি মাসের "মর্ডান বিভিমু" পত্রিকায় আমেরিকায় আচার্য জগদীশচন্দ্রেব কার্যকলাপ ও কথাবার্তার এক বৃত্তান্ত প্রকাশ করিয়াছেন। আমরা নিম্নে তাহার অনুবাদ প্রকাশ করিলাম।

আমেরিকায় অবস্থানকালে দেশের এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্ত পর্যন্ত সকল স্থান হইতে বক্তৃতা করিবার জন্য অনুরোধপত্র ও টেলিগ্রামে আচার্য জগদীশচন্দ্রকে একেবারে আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছিল। নানা বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক সভা ও কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বক্তৃতার জন্য তাঁহার এত নিমন্ত্রণ আসিয়াছিল যে যদি প্রতিদিন দুইবার করিয়া বক্তৃতা করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব হইত তবু এক বৎসরেও সে সমস্ত নিমন্ত্রণ বক্ষা করিয়া উঠিতে পারিতেন কিনা সন্দেহ। জগদীশচন্দ্র মোটে কয়েক সপ্তাহ মাত্র আমেরিকায় ছিলেন।

নিউইয়র্কের বিজ্ঞান-পরিষদ বিজ্ঞানোন্নতি বিধায়িনী সমিতি ব্রুকলিনের কলা ও বিজ্ঞান মণ্ডলী ফিলাডেলফিয়ার দর্শনসভা এবং বিজ্ঞান-পরিষদ ও উদ্ভিদবিজ্ঞান সমিতি কতক একযোগে আহুত সভা প্রভৃতি নানা বিদ্বমণ্ডলীর সম্মুখে আচার্য জগদীশচন্দ্র বক্তৃতা করিয়াছেন। ইহা ছাড়া তিনি হার্ভার্ড কলম্বিয়া, আইওয়া, ইলিনয়, শিকাগো, মিশিগান ও উইসকন্সিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁহার অত্যাশ্চার্য আবিষ্কার সম্বন্ধে বক্তৃতা করিয়া সকলকে বিস্ময় পুলকিত করিয়া দেন।

যে সমস্ত বৃহৎ ও সমজদার শ্রোতৃমণ্ডলী আমেরিকার নানাস্থানে তাঁহার সংবর্ধনা করিয়াছেন ওয়াশিংটন শহরের কসমোপলিটন ক্লাবের নিমন্ত্রণে সমবেত জনমণ্ডলী তাহাদের মধ্যে অন্যতম। সে সভা আরম্ভ হইবার কথা ছিল সন্ধ্যা আটটায়। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের বহু পূর্ব হইতেই প্রকাণ্ড সভাগৃহ লোকে লোকারণ্য হইয়া গেল, দাঁড়াইবার স্থান পর্যন্ত আর কোথাও রইল না। অনেক বড়-বড় লোকে জানালার ওপর চড়িলেন কিংবা মাটিতেই বসিয়া পড়িলেন। টেলিফোনের আবিষ্কর্তা ডক্টর গ্রাহাম বেল সভা বসিবার কুড়িমিনিট আগে আসিয়াছিলেন কিন্তু দরজার গোড়ায় লোকের এমন ভিড় জমিয়াছিল যে তিনি অতি কষ্টেসৃষ্টেও হলের অর্ধেকের বেশি অগ্রসর হইতে পারিলেন না। কিন্তু অদম্য উৎসাহী টেলিফোনের আবিষ্কর্তা বেলের উৎসাহ ও আগ্রহ এতটুকুও কমিল না। জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতার পরদিন সন্ধ্যাকালে তিনি তাঁহার গৃহে আচার্যের সম্মানার্থ ওয়াশিংটনের কয়েকজন খ্যাতনামা পণ্ডিতকে নিমন্ত্রণ করিয়া তাহাদের সহিত তাঁহার পরিচয় করাইয়া দিয়াছিলেন।

আচার্য বসু মহাশয় মার্কিনবাসীর নিকট সর্বত্র আন্তরিক অভ্যর্থনা লাভ করিয়াছেন। এমন কী যুক্তরাজ্যের স্টেট সেক্রেটারি বিখ্যাত কর্মী ও বাগ্মী উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টে জগদীশচন্দ্রকে তাঁহার আবিষ্কার দেখাইবার জন্য নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। বলাবাহুল্য, এ সম্মান-সৌভাগ্য সকলের ঘটিয়া উঠে না। আচার্যবর যেখানেই তাঁহার বিচিত্রসরল যন্ত্রতন্ত্র লইয়া দেখা দিয়াছেন যেখানেই তাহার অদ্ভুত আবিষ্কার দেখাইয়াছেন, সেখানেই সকলে তৎক্ষণাৎ বুঝিতে পারিয়াছে তিনি কত বড় বিজ্ঞানবিদ, আজ আমেরিকার সকলে একবাক্যে স্বীকার করিতেছেন যে জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার শরীরতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব সম্বন্ধে একটা নূতন দিক খুলিয়া দিয়াছে এবং সম্ভবত মনস্তত্ত্বরাজ্যেও যুগান্তর উপস্থিত করিবার সম্ভাবনা রাখে।

আচার্য বসু মহাশয়ের আবিষ্কার সম্বন্ধে আমেরিকার অনেক মাসিকে এবং দৈনিকে বহু প্রবন্ধ, রহস্য-চিত্র, এবং এমনকী কবিতা পর্যন্ত প্রকাশিত হইয়াছে। তিনি যখন নিউইয়র্কে যান তখন "নিউইয়র্ক টাইমস”-এ Song to Sensitive নামে তাহার আবিষ্কার সম্বন্ধে এক কবিতা বাহির হয়। "নিউইয়র্ক টাইমস” মার্কিন যুক্তরাজ্যের একখানি শ্রেষ্ঠ দৈনিক পত্রিকা।

ইউরোপে জগদীশচন্দ্র ভিয়েনা ও পারীতে বক্তৃতা করেন। পারী হইতে জার্মানি যাইবার আয়োজন করিতেছিলেন এমন সময় যুদ্ধ বাধিল। কাজেই আর যাওয়া হইল না। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে তিনি লন্ডনে রয়েল ইনস্টিটিউট, ইম্পিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স, রয়েল সোসাইটি অব মেডিসিন এবং অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমক্ষে বক্তৃতা করেন।

ইংল্যান্ডে তাহার আবিষ্কার সম্বন্ধে খুব উৎসাহ দেখা দিয়াছিল। তিনি যখন লন্ডনে ছিলেন তখন, ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী সার আর্থার ব্যালফুর, রয়েল ইনস্টিটিউটের সভাপতি সার উইলিয়াম ক্রুকস্, অধ্যাপক জেমস মারে রাজবৈদ্য সার জেমস রিড, বিখ্যাত নাট্যকার বার্নাড শ', ভারত সচিব লর্ড ক্রু প্রভৃতি ইংরেজ মনীষীগণের নিকট তাঁহার গৃহ ও গবেষণাগার মুসলমানের নিকট মক্কাতীর্থের ন্যায় আদরণীয় হইয়া উঠিয়াছিল।

জগদীশচন্দ্র বাগ্মী নন এবং বাগ্মী হইবার জন্যও তাহার কোন আগ্রহ নাই। কিন্তু তাহার বক্তৃতা বেশ সুষ্পষ্ট, জোরালো ও মনোজ্ঞ। তাহার বক্তৃতার ভঙ্গীটিও বড় সুন্দর। বক্তৃতাকালে তিনি একেবারে সভামঞ্চের প্রান্তভাগে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইয়া আসেন, তারপর বাম হাতখানি পশ্চাৎ দিকে নিবদ্ধ করিয়া স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া কিছুক্ষণ শ্রোতৃমণ্ডলীর দিকে চাহিয়া থাকেন। সভা তখন একেবারে এমন নিস্তব্ধ যে সূচিপতনের শব্দটি পর্যন্ত শোনা যায়। আগ্রহান্বিত নরনারী তাঁহার বক্তৃতার প্রথম কথাটি শুনিবার জন্য ঝুঁকিয়া পড়েন। শ্রোতৃমণ্ডলীকে যথাবিহিত সম্বোধনের পর কোনওরূপ বাহুল্য ভূমিকা সৃষ্টি না করিয়া তিনি সোজাসুজি আপনার বক্তৃতা বিষয় বলিতে আরম্ভ করেন। বাগ্মিতাসূচক কোনোরূপ অঙ্গভঙ্গী তাহার নাই। অতি সাদাসিধাভাবে অতিশয় আন্তরিকতার সহিত মৃদু কণ্ঠস্বরে তিনি আপনার আশ্চর্য আবিষ্কারের কথা বলিয়া যান। রবার্ট বার্নস তাঁহার প্রাত্যাইক নীরস কর্ম হইতে কবিতার সৃষ্টি করিতেন। আচার্য জগদীশও তাঁহার বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষ্কারের মধ্যে কাব্য নাটক ও মহাকাব্য রচনা করিয়া তুলেন। তাঁহার বিচিত্র আবিষ্কারের আনন্দে তিনি একেবারে আত্মহারা, তিনি যাহা বলেন তাহা পরিপূর্ণ অন্তরের অন্তস্থল ভেদ করিয়া উঠে। সাধা গলা ব্যবসাদার বক্তার বোলচাল ও কলাকৌশলের অবকাশ তাহার নাই। কিন্তু তবু শ্রোতারা এমন তন্ময় হইয়া তাহার কথা শুনিতে থাকেন যে করতালি দিতে পর্যন্ত ভুলিয়া যান।

মার্কিন সংবাদপত্রের রিপোর্টারেরা বসুমহাশয়কে লইয়া মহা ফাঁপরে পড়িয়াছিলেন। তাহাদের পক্ষে সে বড় কঠিন ঠাঁই, তাঁহার ধরাছোঁয়া পাওয়া বড়ই শক্ত। আচার্য জগদীশচন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া কোনো কথা বাহির করা অপেক্ষা টোকিও, পেট্রোগাড কিংবা লন্ডনের দশ-পাঁচজন রাজনীতি ধুরন্ধরকে আটিয়া উঠা সহজসাধ্য। বসুমহাশয় লোকচক্ষুর দৃষ্টির সমক্ষে থাকিতে মোটেই ভালোবাসেন না। বিশেষত মার্কিন সাধারণের সমক্ষে প্রকাশ হইতে তাঁহার বড়ই ভয়। যখনই তিনি বুঝিতে পারেন যে খবরের কাগজের লোক তাঁহার নিকট হইতে কিছু কথা বাহির করিয়া কাগজে মস্ত একটা গল্প ফাঁদিবার চেষ্টায় তাহার পিছু লইয়াছে তখনই তিনি একেবারে মুখ বন্ধ করিয়া ফেলেন। যদি তাঁহাকে কেহ এমন কোনো কথা জিজ্ঞাসা করে যাহার উত্তর দেওয়া তিনি সঙ্গত মনে করেন না, তাহা হইলে তিনি কোন কথা না বলিয়া শুধু একটু হাসেন। কিন্তু এমন সৌজন্যের সহিত এ কাজটি করেন যে কেহই তাহাতে অপরাধ লইতে পারেন না। আর বাস্তবিকই বসুমহাশয়কে এজন্য দোষ দেওয়া যাইতে পারে না-কেন না আমেরিকার সংবাদপত্রের ওপর আস্থা হারাইবার কারণ তাহার যথেষ্ট আছে। অল্পদিন পূর্বে ডেট্রয়েটের একখানি সংবাদপত্র আচার্যবরের Plant Response বা উদ্ভিদের সাড়া নামক গ্রন্থের এক অধ্যায় এমন বেমালুমভাবে প্রবন্ধাকারে ছাপাইয়া দিয়াছিল যে মনে হয় যেন সেটি ওই কাগজেরই জন্য বসুমহাশয় কর্তৃক বিশেষভাবে লিখিত।

জগদীশচন্দ্রের আকৃতিকে এমন একটা কী আছে যাহা সকলকে আকর্ষণ করে। কবির মতো তাঁহার ঈষৎশুভ্র ঘনকুষ্ণিত কেশরাশি প্রশস্ত ললাটের দুই পার্শ্বে স্তরে-স্তরে বিন্যস্ত। তাঁহার নিবিড়কৃষ্ণ জ্বলন্ত চক্ষুর দীপ্তিতে যেন সামান্য একটু গর্বের লেশ মাখানো। তাঁহার সুশ্রী ও ভাবব্যঞ্জকপূর্ণ মুখখানি উচ্চবংশজাত ধীমান ও আত্মশক্তিতে নির্ভরশীল পুরুষের মতো। তাঁহার বক্ষ প্রশস্ত, স্কন্ধ বিস্তৃত, স্বাস্থ্য সুন্দর ও পাদবিক্ষেপ ধীর ও দৃঢ়। যদিও তাঁহার দেহে ও মুখে প্রৌঢ়তার চিহ্ন দেখা দিয়াছে, তবুও তাহার কাজ করিবার শক্তি ও উৎসাহ যথেষ্ট আছে।

নেপোলিয়ান একবার ইংরেজ রাজনৈতিক ফক্স ও পিটের চরিত্র বর্ণনার প্রসঙ্গে বলিয়াছিলেন ফক্সের হৃদয় তাহার প্রতিভাকে দীপ্ত রাখিয়াছিল, আর পিটের প্রতিভা তাহার হৃদয়কে শুকাইয়া ফেলিয়াছিল। আচার্য জগদীশের প্রতিভা পিটের মতো নয়, ফক্সের মতো। অসামান্য প্রতিভাশালী হইলেও তাঁহার হৃদয়খানি শুষ্ক নহে, পরন্তু মানবত, সহমর্মিতা ও প্রেম প্রবণতায় পূর্ণ। মানবের ভ্রাতৃত্ব তাহার নিকট কেবল একটা উচ্চভাবে কথামাত্র নয় সজীব ও সত্য আদর্শ, ধনীনির্ধন, উচ্চনীচ, সকল অবস্থার লোকের সঙ্গে তিনি সমানভাবে মিশিয়া সুখীজনের সুখেতে হাসিয়া ও দুঃখীর দুঃখে অশ্রু ফেলিয়া আপনার মহৎ হৃদয়ের পরিচয়ে সকলকে মোহিত করেন।

ভারতবর্ষ জগদীশচন্দ্রের অন্তরের ধ্যানমন্ত্র। যেখানে যতদূরেই তিনি থাকুন না কেন, ভারতের মঙ্গল চিন্তা তাহার চিত্তের অনেকখানি অংশ জুড়িয়া থাকে। আর এই কারণেই বোধ হয় তিনি আমেরিকা প্রবাসী ভারতসন্তানগণের নিকট এত শ্রদ্ধা এত সমাদর লাভ করিয়াছিলেন। আমেরিকায় যেখানেই তিনি গিয়াছেন সেখানেই তথাকার "হিন্দুস্থান সমিতি" তাঁহার সংবর্ধনা করিয়াছে। তাঁহার উপদেশ ও পরামর্শ প্রার্থনা করিয়াছে। আচার্য জগদীশচন্দ্রও তাঁহাদিগকে বারংবার বিশেষ করিয়া বলিয়াছেন-'জীবনের একটা নির্দিষ্ট আদর্শ ঠিক করিয়া যতদিন না সে আদর্শ বাস্তবে ও সত্যে পরিণত হয় ততদিন ক্রমাগত অবিরাম চেষ্টা করিতে থাক। ইচ্ছাশক্তি থাকিলে কিছুই অসম্ভব বা অসাধ্য নয়, দুঃখক্লেশ স্বীকার না করিয়া কখনও কোনও বড় কাজ হয় নাই। সুতরাং যদি বড় কিছু করিতে চাও তবে দুঃখকষ্ট নির্যাতন ও লাঞ্ছনা সমস্তই নীরবে সহ্য করিতে হইবে। কিন্তু মনে রাখিও ওই দুঃখ নির্যাতনের মধ্য দিয়া কৃতকার্য লাভ করাই তোমাদের গৌরব অধিকার। বড় হইবার সম্ভাবনা প্রত্যেকের মধ্যেই সমানভাবে বর্তমান। প্রতিভার সুশৃঙ্খলার সহিত কঠোর পরিশ্রমে কাজ করিয়া যাওয়া ভিন্ন প্রতিভা আর কিছুই নহে। যদি ইচ্ছা কর তবে তুমিও প্রতিভাশালী হইতে পারো।'

বসুমহাশয় যখন কথা বলেন তখন খুব ধীরভাবে বলেন। কথায় জোর দিবার জন্য তিনি শূন্যে হাতও ছোড়েন না বা টেবিলও চাপড়ান না। অথচ যেন কি এক বিচিত্র উপায়ে তাহার আন্তরিকতা সমস্ত কথাবার্তার মধ্যে ফুটিয়া ওঠে।

ভারতীয় ছাত্রদিগকে সম্বোধন করিয়া তিনি বলেন-'স্বদেশের কোনো না কোনো একটা কাজে তোমরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করো, শুধু নিজে মানুষ হইয়াই তৃপ্ত হইও না, অপরকেও মানুষ হইয়া উঠিতে সাহায্য করো। জীবনটা নিতান্তই ছোট-কাজেই বৃথা সময় নষ্ট করিবার অবকাশ বা অধিকার কাহারো নাই। মাধুর্যে, আলোকে ও কর্মনিষ্ঠতায় এই জীবনকে পূর্ণ ও সার্থক করিয়া তোলাই তোমাদের আদর্শ হউক।'

আচার্য জগদীশচন্দ্র ধনী হইবার আকাঙ্খা করেন না। তাঁহার মতে অর্থ সঞ্চয় বা ব্যাবসাবাণিজ্যে কৃতকার্যতাই মানুষের শক্তির সত্য বা প্রকৃত পরিচয় নয়, পৃথিবীতে টাকা জিনিসটাকেই তিনি পরম বস্তু বলিয়া মনে করেন না। খেতাব পদবির প্রতিও তাঁহার কোন আকর্ষণ নাই। তিনি বলেন, বিজ্ঞানের খাতিরেই বিজ্ঞান চর্চা করা উচিত, কোনোরূপ পুরস্কারের আশায় নয়। কোনো একটা বড় কাজ করিয়াই একথা ভাবিও না যে সমস্ত পৃথিবীর লোক অমনি একেবারে সেটিকে স্বীকার করিয়া লইয়া আনন্দোল্লাসে মত্ত হইয়া উঠিবে এবং চারিদিকে তোমার জয়-জয়কার পড়িয়া যাইবে।

ভারতের একতা সমস্ত ভারতবাসীর এক মহাজাতিতে পরিণত হইবার কথা কহিবার সময় জগদীশচন্দ্র যেন তাহার সমস্ত শক্তি মনীষা ও প্রাণ তাহাতে ঢলিয়া দেন। এ সম্বন্ধে তাহার বক্তব্য এই, সর্ব প্রথমে তোমার সাধনার বস্তু হউক খাঁটি ভারতসন্তান হওয়া। তাহার পর সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতাকে ছাড়াইয়া উঠিয়া ভারতবর্ষের একত্বকে ধারণা করিতে শিক্ষা করা। ভারতে এক প্রদেশ আর এক প্রদেশ হইতে শ্রেষ্ঠ, এক প্রদেশবাসী আর এক প্রদেশবাসী হইতে বেশি বুদ্ধিমান এরূপ মত ধারণা পোষণ নিতান্ত নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। নবগঠিত ভারতে পাঞ্চাবি, মারাঠি, কিংবা বাঙালি থাকিবে না-থাকিবে কেবল ভারতবাসী।

একদিন কোনো ধনী বিকানীরবাসীর এক পুত্র আচার্য বসু মহাশয়ের Autograph বা হাতের লেখার জন্য তাহার হোটেলে দেখা করিতে যান। জগদীশচন্দ্র তাহাকে জানাইলেন যে তিনি সচরাচর তাহার হাতের লেখা কাহাকেও দেন না এবং দিলেও তার মূল্য খুব বেশি লইয়া থাকেন, এই কথা বলিয়া বণিক পুত্রটিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আচ্ছা তুমি আমায় কত দিবে? উত্তর আসিল আমি ভারতের সেবায় আমার জীবন দিব। যুবকের এই উত্তর শুনিয়া জগদীশচন্দ্র কি করেন তাহা দেখিবার জন্য সকলে তাঁহার দিকে ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকাইলেন। আচার্যবরের চক্ষু আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তিনি বিকানীর যুবককে সম্বোধন করিয়া তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিলেন-'এই নাও আমার হাতের লেখা।'

আমাদের দেশের যুবকদের আমেরিকায় শিক্ষালাভ সম্বন্ধে তাহার মত জিজ্ঞাসা করাতে জগদীশচন্দ্র বলেন-'আমার মতে বি. এস. সি. পাশ না করিয়া আমাদের দেশের কোন ছাত্রেরই এ দেশে শিক্ষালাভের জন্য আসা উচিত নয়। ছাত্রদের চরিত্রও ক্ষমতার দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া কেবল দলে দলে জাহাজ বোঝাই করিয়া তাহাদিগকে এদেশে পাঠানো কোনও মতেই সমীচীন নয়। সংখ্যায় বেশি ছাত্র না পাঠাইয়া কয়েকজন বাছা-বাছা ভালো ছাত্র পাঠানো বাঞ্ছনীয়।

আমেরিকার বিদ্যালয় ভালো কি ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয় ভালো, বসু মহাশয়কে এই প্রশ্ন করাতে তিনি বলেন ইংরেজ ও মার্কিন দুই বিশ্ববিদ্যালয়েই আমার ভালো লাগে। উভয়েরই সুবিধা এবং অসুবিধা দুই-ই আছে। তবে আমার মনে হয় আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অর্থবল বেশি এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারগুলির বন্দোবস্ত আরও ভালো। মার্কিন যুক্তরাজ্যে অনেক মেধাবী অধ্যাপক আছেন। কিন্তু তাহাদের বড় বেশি খাটানো হয় বলিয়া বোধ হয়। অন্তত তাহারা তাহাদের ছাত্রদের অপেক্ষা বেশি পরিশ্রম করেন। আমেরিকা গণতান্ত্রিক দেশ, কাজেই সাধারণ লোকের পক্ষে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষালয়গুলিতে প্রবেশ লাভ ইংল্যান্ডের অপেক্ষা অধিক। সহজসাধ্য। কিন্তু এই নূতন দেশের পশ্চাতে সূচির কালের সঞ্চিত ইতিহাস বা 'ট্রাডিসন' নাই।

আচার্য জগদীশচন্দ্রের সহিত তাঁহার পত্নী ও প্রাইভেট সেক্রেটারি আমেরিকায় আসিয়াছেন। তাঁহার পত্নী অতি রমনীয়া ও ধীরস্বভাবা মহিলা। যে সমুদয় ভারতবাসী বিদেশে বেড়াইতে আসেন তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই যেমন বিদেশি পরিচ্ছদ পরিধান করেন বসুজায়া তেমন করেন নাই। তিনি তাঁহার জাতীয় পরিচ্ছদ বজায় রাখিয়াছিলেন। গোলাপি রঙের জ্যাকেটের উপর তাঁহার স্তরবিন্যস্ত জরিপাড় শাড়ি বড়ই সুশ্রী ও শোভন দেখায়। তাঁহার উন্নত ললাট সুন্দর ঘন কেশরাশিতে মণ্ডিত, তাঁহার চক্ষু দুটি এক অপূর্ব আলোকে পূর্ণ। বসুজায়ার জন্ম ও শিক্ষা যদিও ভারতবর্ষে তথাপি পাশ্চাত্যসমাজে তিনি বেশ স্বচ্ছন্দভাবে চলাফেরা করিয়া থাকেন।

আচার্য পত্নীর কথা কহিবার শক্তি বড়ই চমৎকার এবং তাঁহার কণ্ঠস্বরটিও অতি মনোরম। ইউরোপ আমেরিকার ভিতরকার জীবনটির সহিত তাঁহার পরিচয় থাকায় যখনওই তিনি সে সম্বন্ধে কোনো কথা বলেন, তখনই তাহা শুনিবার জন্য বড়ই আগ্রহ হয়।

পাশ্চাত্যসভ্যতার বাহিরের জাঁকজমক বসুজায়ার নয়ন ধাঁধিয়া দেয় নাই। তাঁহার মতে পাশ্চাত্য দেশবাসীরা অর্থের পূজায়, ভোগের লালসায়, খেতাবের আকাঙ্খায় উন্মত্তপ্রায় -সামাজিক দ্বন্দ্বসংঘর্ষে নিরন্তর ব্যতিব্যস্ত। যেমন পূর্বদেশে তেমনি পশ্চিমদেশে জাতিভেদ। পশ্চিমের জাতিভেদ অর্থের ওপর, আর পূর্বের জাতিভেদ জন্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত-এই মাত্র যা তফাত। পশ্চিম যে পথে চলিয়াছে সে পথ বেশিদিন আর চলিতে পারিবে না। দু-দিন আগেই হৌক, দুদিন পরেই হৌক তাহাকে ফিরিতেই হইবে। তখন আর একবার তাহাকে পূর্ব জগতের নিকট আসিয়া দাঁড়াইতে হইবে।

শ্রীমতী বসুজায়া ভারতবর্ষকে ভালোবাসেন বটে, কিন্তু তাই বলিয়া অন্য দেশকে বিদ্বেষের চক্ষে দেখেন না। তাঁহার মনে বিদ্বেষের লেশও নাই। এমন কী যে সমুদয়, সঙ্কীর্ণমনা ভারতপ্রত্যাগত খ্রিস্টিয় মিশনারি ভারতের মিথ্যা কুৎসা রচনা করিয়া বেড়ান তাহাদের প্রতি পর্যন্ত তাঁহার কোনো বিদ্বেষভাব নাই। তিনি তাঁহাদের কৃপানেত্রে দেখিয়া থাকেন এই পর্যন্ত।

ভারতনারী শিক্ষা সম্বন্ধে আলোচনা বসুজায়ার বড়ই মনোমতো। ওই বিষয়টি তাঁহার বিশেষ প্রিয়। গুজব এই, তিনি নাকি আমাদের দেশে প্রচলনের জন্য আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের স্ত্রীশিক্ষাবিধি বিশেষভাবে অধ্যয়ন ও আলোচনা করিতেছেন। ইতিমধ্যেই তিনি তাঁহার বিদ্যালয়ের কার্যে সাহায্যের জন্য উইসকন্সিস বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক মার্কিন মহিলাকে নিযুক্ত করিয়াছেন।

একদিন মধ্যাহ্ন আহারকালে আলোচনা প্রসঙ্গে ইউরোপিয় ও মার্কিন মেয়েদের কথা উঠিল। বসুজায়ার মতে ইউরোপের মেয়েদের অপেক্ষা আমেরিকার মেয়েরা বেশি স্বাধীনচেতা, উদারমনা ও চিত্তানন্দদায়িনী। একজন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন-'আপনি কি ইউরোপিয় ও ভারতবর্ষীয়দের মধ্যে বিবাহ হওয়া বাঞ্ছনীয় মনে করেন? বিদ্যুতের মতো উত্তর আসিল- 'কখনওই নয়। বিদেশিরা আমাদের সঙ্গে কোনো মতেই একীভূত হইতে কিংবা আমাদের আদর্শ ও সভ্যতার মর্ম গ্রহণ করিতে পারে না। আমাদের জীবনের ভিতরকার সৌন্দর্য পাশ্চাত্যদের চোখে পড়ে না। ভারতবাসী ও ইউরোপিদের মধ্যে বিবাহ কখনই সুখের হইতে পারে না, এবং এরূপ বিবাহকে কোনো মতেই প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।'

এই কথা শুনিয়া প্রশ্নকর্তা বলিলেন-'কেন আপনি তো মার্কিন মেয়েদের এইমাত্র খুব প্রশংসা করিতেছিলেন? তাহাদের সঙ্গে যদি-'

বসুজায়া হঠাৎ বাধা দিয়া বলিলেন-'হ্যাঁ, তা বটে। কিন্তু আপনাদের মার্কিন মেয়েরা বড় বাবু। দরিদ্র ভারতমাতা তাহার বিলাসিতার খরচ জোগাইবেন কি করিয়া?' এই কথা শুনিয়া সকলে চুপ করিয়া গেলেন।



5
Articles
জগদীশচন্দ্র সেরা রচনা সম্ভার
0.0
শ্রী জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা কিছু উল্লেযোগ্য অবিস্মরণীয় কাহিনী নিয়ে রচিত একটি অব্যক্ত জীবন প্রসারিত রচনা কাহিনী সমগ্র।
1

প্রসঙ্গ জগদীশচন্দ্র

24 December 2023
0
0
0

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসু রতবর্ষের প্রাচীন গৌরবের কথা উত্থাপিত হইলে আমরা সচরাচর আর্য ঋষিগণের ধর্মোন্নতি এবং আর্য মনীষীগণের দার্শনিক জ্ঞানের কথাই ভাবিয়া থাকি। সংস্কৃত ব্যাকরণ, কাব্

2

অন্যান্য রচনা

25 December 2023
0
0
0

উদ্ভিদের হৃৎস্পন্দন [ গত এক বৎসরের মধ্যে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে উদ্ভিদজীবনের ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে তিনটি গূঢ় রহস্য উৎঘাটিত হইয়াছে। এই আবিষ্কার সমগ্র বৈজ্ঞানিক জগৎকে চমৎকৃত করিয়াছে। গতমাসে দার্জিলিং-এর গভনম

3

ভ্রমণ বিষয়ক রচনা

25 December 2023
0
0
0

লুপ্ত নগরী ই 'টালির দক্ষিণ প্রদেশ অতি রমণীয়, সমস্ত প্রদেশটি যেন একটি উদ্যান। এইরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সচরাচর দেখা যায় না। রোমানরা এই প্রদেশে সমুদ্রের উপকূলে সমৃদ্ধিশালী নগর নির্মাণ করিয়া অবকাশের সময়

4

বিবিধ রচনা

26 December 2023
0
0
0

নাদির শা-র শাস্তি ই তিহাস পাঠ করিলে ভারতভূমি যে প্রকৃতই রত্নগর্ভা তাহাতে আর সন্দেহ থাকে না। ধনধান্যের জন্য আমাদের এই মাতৃভূমি বহুকাল হইতে পৃথিবীর অন্যান্য জাতিদের প্রলোভনের বস্তু হইয়া যায়। গ্রিক দেশী

5

বক্তৃতাবলী

26 December 2023
0
0
0

ছাত্রসমাজের প্রতি* ছাত্রসমাজের সভ্যগণ, তোমাদের সাদর সম্ভাষণে আমি আপনাকে অনুগৃহীত মনে করিতেছি। তোমবা আমাকে একান্ত বিজ্ঞ এবং প্রবীণ মনে করিতেছ। বাস্তবপক্ষে যদিও জরা আমার বাহিরের অবয়বকে আক্রমণ করিয়াছে

---