shabd-logo

অন্যান্য রচনা

25 December 2023

0 Viewed 0

উদ্ভিদের হৃৎস্পন্দন

[ গত এক বৎসরের মধ্যে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে উদ্ভিদজীবনের ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে তিনটি গূঢ় রহস্য উৎঘাটিত হইয়াছে। এই আবিষ্কার সমগ্র বৈজ্ঞানিক জগৎকে চমৎকৃত করিয়াছে। গতমাসে দার্জিলিং-এর গভনমেন্ট হাউসে লর্ড লিটনের নিমন্ত্রণে যে সভা আহুত হয় তাহাতে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু উদ্ভিদের পেশিমণ্ডল আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন। গত ১৪ অগ্রহায়ণ বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিনের অষ্টম বার্ষিক উৎসব সভায় তিনি উদ্ভিদের হৃৎস্পন্দন ও রস সঞ্চালন সর্বসমক্ষে প্রদর্শন করিয়াছেন। এই প্রবন্ধ ইংরেজি মর্ডান রিভিয়ুতে প্রকাশিত বক্তৃতা ও আচার্য বসুর অন্যান্য প্রবন্ধ অবলম্বনে লিখিত হইল।।

ত্রিশ বৎসর পূর্বে আমি অদৃশ্য বৈদ্যুতিকরশ্মি সম্বন্ধে গবেষণা আরম্ভ করি। হার্জ (Hertz) হইয়া যাইত। দৃশ্য ও অদৃশ্য আলোর প্রকৃতি যে একই তাহা প্রমাণ করিতে হইলে আলোর ঊর্মি খর্ব করা আবশ্যক। আমি যে কল নির্মাণ করিয়াছিলাম তাহা দ্বারা প্রেরিত আকাশ- ঊর্মির দৈর্ঘ্য এক ইঞ্চির ছয় ভাগের এক ভাগ মাত্র। এই আলো আমরা দেখিতে পাই না, হয়তো অন্য জীবে দেখিতে পায়। পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি যে, এই আলোকে উদ্ভিদ উত্তেজিত হইয়া থাকে। অদৃশ্য আলো উপলব্ধি করিবার কোনো বিশ্বাসযোগ্য কল তৎকালে ছিল না। আমা কর্তৃক গ্যালিনা রিসিভর উদ্ভাবিত হওয়াতে বহুদূর হইতে প্রেরিত সংবাদ পাইবার সম্ভাবনা হইল। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে আমি সর্বসমক্ষে বিনা তারে সংবাদ প্রেরণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম। বিদ্যুৎ উর্মি গভর্নরের বিশাল গৃহ এবং আবও দুইটি রুদ্ধ কক্ষ ভেদ করিয়া তৃতীয় কক্ষে নানাভাবে তোলপাড় করিয়াছিল। তাহা একটা লোহার গোলা নিক্ষেপ করিল, পিস্তল আওযাজ করিল এবং বারুদস্তূপ উড়াইয়া দিল।

জীব ও অজীব

তারহীন কল লইয়া পরীক্ষা করিতে-করিতে দেখিলাম হঠাৎ কলের সাড়া কোন অজ্ঞাত কারণে বন্ধ হইয়া গেল। মানুষের লেখাভঙ্গি হইতে তাহার শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি যেরূপ অনুমান করা যায়, কলের সাড়ালিপিতে সেই একই রূপ চিহ্ন দেখিলাম। আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বিশ্রামের পর কলের ক্লান্তি দূর হইল এবং পুনরায় সাড়া দিতে লাগিল। উত্তেজক ঔষধ প্রয়োগে তাহার সাড়া দিবার শক্তি বাড়িয়া গেল এবং বিষ প্রয়োগে তাহার সাড়া একেবারে অন্তর্হিত হইল। যে সাড়া দিবার শক্তি, জীবনের এক প্রধান চিহ্ন বলিয়া গণ্য হইত, জড়েও তাহার ক্রিয়া দেখিতে পাইলাম। এইরূপ বহুর মধ্যে একত্বের সন্ধান পাইয়াছিলাম।

উদ্ভিদের সাড়া

ইহার পরে আমি উদ্ভিদের চেতনা সম্বন্ধে গবেষণায় প্রবৃত্ত হইলাম। তখন সর্ববাদিসম্মত মত এই ছিল যে, উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনধারার মধ্যে প্রভুত পার্থক্য আছে। আহত হইলে প্রাণী দ্রুত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চালনা করে; তাহার হৃদয়যন্ত্র সর্বদা স্পন্দিত হয়। এতদ্ব্যতীত প্রাণী, ইন্দ্রিয়-সাহায্যে বাহ্যদ্রব্য উপলব্ধি করিতে পারে। অপর পক্ষে বৃক্ষাদির সঙ্কোচন বা প্রসারণ করিবার ক্ষমতা নাই, তাহাতে কোনো স্পন্দন নাই, তাহারা স্নায়ুহীন, ইহাই প্রচলিত বিশ্বাস। দুইটি জীবন-ধারা পাশাপাশি প্রবাহিত হইতেছে, অথচ তাহাদের জীবনে কোথাও ঐক্যের চিহ্ন পবিলক্ষিত হয় নাই। এই ভ্রান্ত বিশ্বাস বহুদিন যাবৎ উদ্ভিজ্জীবনের জ্ঞানের পথ রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল। যে দিন এমন যন্ত্র আবিষ্কৃত হইল, যাহার প্রভাবে বৃক্ষ চেতনার সাড়া দিল, সেই দিনই তাহার অজ্ঞাত আভ্যন্তরীণ জীবন যাত্রা প্রণালী অবগত হওয়া সম্ভব হইল। ক্রমে-ক্রমে এই সাড়াকে লেখায় পরিণত করিবার যন্ত্রাদি আবিষ্কার করিতে হইযাছে, সেই লেখা পড়িবার কৌশলাদিও উদ্ভাবন করিতে হইয়াছে। এই নূতন পন্থায় গবেষণার ফলে এই সত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছে যে প্রাণীর জীবন ও উদ্ভিদের জীবন একই প্রকার। মানুষের যেমন হৃৎস্পন্দন আছে, বৃক্ষলতাদিরও ঠিক সেইরূপ হৃৎস্পন্দন আছে। প্রাণী যেমন মৃত্যুমুখে পতিত হইবার সময় মৃত্যুজনিত আক্ষেপ প্রদর্শন করিয়া থাকে, উদ্ভিদও সেইরকম আক্ষেপ জ্ঞাপন করে। আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, উত্তেজক ঔষধ বা বিষের প্রক্রিয়া উভয়ের উপরই একই প্রকার। ইহা হইতে বিজ্ঞ চিকিৎসকগণ মনে করেন যে, উদ্ভিজ্জীবন সম্পর্কিত এই নূতন গবেষণার ফলে ঔষধ বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধিত হইবে। কৃষিকার্যে সাফল্যলাভ করিতে হইলে উদ্ভিদের পরিবর্ধনের ধারা অবগত হওয়া অবশ্য প্রয়োজনীয়। ক্রেস্কোগ্রাফ (Crescograph) যন্ত্রের আবিষ্কার হওয়াতে এই ধারার রহস্যও অনাবৃত হইয়াছে।

সাধনা

এই সমস্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে বহু গবেষণা করিতে হইয়াছে। এক দিনের চেষ্টায় ইহা সম্ভব হয় নাই। বহু বর্ষ একাগ্রতার সহিত সাধনা করিয়াই ইহা লাভ করা সম্ভবপর হইয়াছে। আট বৎসর পূর্বে যখন আমি বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলাম, তখন যাহারা এই গবেষণা কার্যে সমস্ত জীবন নিয়োগ করিবে, যাহারা চরিত্রবল ও দৃঢ় সঙ্কল্প লইয়া কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইবে ও প্রকৃত সত্য উদঘাটন করিতে সমর্থ হইবে কেবল তাহাদিগকেই আমার শিষ্যরূপে গ্রহণ করিয়াছিলাম। ভারতবাসী কোনো কার্যেই অগ্রণী হইতে অক্ষম- এই কলঙ্ক ভারতীয়গণকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে। চিরদিনের জন্য সেই তথাকথিত কলঙ্ক কালিমা মুছাইতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিলাম।

অন্তদৃষ্টি

অতি মহৎ আবিষ্কার করিতে হইলে প্রবল অন্তদৃষ্টি ও সূক্ষ্ম যন্ত্র আবিষ্কার ও নির্মাণের দক্ষতা ও অনুসন্ধান করিবার কৌশল জানা আবশ্যক। অন্তর্দৃষ্টিশূন্য ও উদ্দেশ্যবিহীন অনুসন্ধানের কোনোই সার্থকতা নাই। ভারতের চিন্তা এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যের ফলে ভারত জ্ঞান প্রচার ক্ষেত্রে বিশেষরূপে পারদর্শী। আপাতদৃষ্টিতে বৈষম্যপূর্ণ ঘটনাবলীর মধ্যে ভারতীয় কল্পনাশক্তি ঐক্যের সন্ধান পায়। একাগ্র সাধনার দ্বারা সেই শক্তিকে সুনিয়ন্ত্রিত করা যায়। এই ক্ষমতাই 'আবার মনকে ধৈর্যশীল করে ও সত্যেব অনুসন্ধানে সক্ষম করিয়া তোলে। মনোমন্দিরই প্রকৃত বিজ্ঞানমন্দিব।

উদ্ভিদের আভ্যন্তরীণ প্রাণ যন্ত্রের গূঢ় রহস্য অবগত হইতে হইলে অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা উদ্ভিদের হৃৎস্পন্দন অনুভব করিতে হইবে। এই অন্তদৃষ্টি মাঝে-মাঝে পরীক্ষা করিয়া দেখা কর্তব্য; কারণ অপরীক্ষিত কল্পনা, চিন্তারাশিকে বিপথগামী করে। অনুবীক্ষণ যন্ত্রের দ্বারা যখন কিছু দৃষ্ট হয় না, তখনও আমাদিগকে অদর্শনীয়েব অনুসরণ করিতে হয়। কারণ যাহা আমাদের দৃষ্টিপথের বাহিরে থাকে, তাহার তুলনায় আমরা যতটুকু দেখিতে পাই তাহা একান্তই সামান্য। সেই অদৃশ্যরাজ্যে তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিবার জন্য ক্রেস্কোগ্রাফের (Crescograph) আবিষ্কার করিতে হইয়াছে। এই যন্ত্রের সাহায্যে সমস্ত জিনিসই তাহার আসল মাপ হইতে দশ কোটি গুণ বৃহৎ হয়। তাহাতে দৃষ্টির বহির্ভূত জীবনেব মূল গতি প্রত্যক্ষ করা সম্ভবপর হইয়াছে। এই যন্ত্র ব্যবহার করিতে হইলে হস্ত সম্পূর্ণ রূপ মনের অধীন করিতে হইবে। নচেৎ যন্ত্র অব্যবহার্য হইয়া যায়। দেহের উপব মনের প্রভাব অপরিসীম এবং মনের বল দ্বারা যে সাফল্য লাভ করা সম্ভবপর হইয়াছে তাহা ইন্দ্রজালকেও পরাজিত করিয়াছে। বিশেষ শিক্ষার দ্বারাই এই সমস্ত শক্তির উৎকর্ষ সাধন করা সম্ভব। বিগত আট বৎসরে এই বিজ্ঞানমন্দিরে ২০০টি বিষয়, এই কারণে সাফল্যের সহিত পরীক্ষিত হইয়াছে।

বৃক্ষে রস সঞ্চালন

অন্তর্দৃষ্টি এবং অবিরাম অনুসন্ধিৎসা দ্বারা সুকঠিন সমস্যাসমূহ কি প্রকারে পূরিত হয়, আমার বর্তমান আবিষ্কার তাহারই প্রমাণ। বৃক্ষের অঙ্গপ্রতঙ্গে কি করিয়া রস সঞ্চালিত হয়, এই সমস্যা লইয়া দুই শত বর্ষের অধিক কাল অনুসন্ধান চলিয়াছে, কিন্তু কোনো সুমীমাংসা হয় নাই। মাটি হইতে বহু উচ্চে গাছের উপরে জল উঠে। কি উপায়ে জলের গতি নিরূপিত হয় ইহা বহু দিন ধরিয়া এক সমস্যা ছিল। এই রস সঞ্চালন কি জড় শক্তির প্রভাবে হয় না জীবনশক্তির ফল? এই প্রশ্ন সমাধানের জন্য স্ট্রাসবুর্গার (Strasburger) বৃক্ষে বিষ প্রয়োগ করিয়াছিলেন এবং মনে করিয়াছিলেন যে তাহাতে রস-সঞ্চালনের কোনও ব্যতিক্রম ঘটায় নাই। কাজেই তিনি মত দেন, জীবনশক্তি দ্বারা ওইরূপ রস সঞ্চালন হইতে পাবে না। জড় বিজ্ঞানের মধ্যে ইহার কারণ অনুসন্ধান চলিতে লাগিল-কল্পনার সহিত সত্যের সামঞ্জস্য ঘটাইবার জন্য অদ্ভুত অদ্ভুত যুক্তির অবতারণা করা হইল। কিন্তু সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হইল। এমন কোনো নিদর্শক বাহির করিবার চেষ্টা হইল না, যাহার সাহায্যে রস-সঞ্চালনের নির্দেশ পাওয়া যায়।

এ সম্বন্ধে গবেষণা করিয়া আমি দেখাইলাম যে উদ্ভিদের পত্র রস-সঞ্চালনের নির্দেশক। রসের দ্রুত-সঞ্চালনের সঙ্গে সঙ্গেই বৃক্ষের পাতা সতেজ হইয়া ঊর্ধ্বে উঠে এবং সঞ্চালনে বাধা পড়িলে পাতা ঢলিয়া পড়ে। পাতার গতিবিধি এত সূক্ষ্ম যে সহজে তাহা লক্ষীভূত হয় না। আমি অপ্টিক্যাল লিভার (Optical lever) দ্বারা এই অসুবিধা দূর করিলাম। এই যন্ত্রের একটি দণ্ডেব একদিক একটি সূত্র দ্বারা পাতার সহিত বাঁধা থাকে। দণ্ডটির সহিত একটি দর্পণ সংলগ্ন থাকে। পাতার গতিবিধি এই দর্পণে প্রতিফলিত হয়। এইরূপ পাতার অতি সামান্য উত্থান পতন এই যন্ত্রের সাহায্যে অতি সহজেই পাঁচহাজার গুণ পরিবর্ধিত আকারে দেখা যায়। এই গবেষণার ফলে স্ট্রাসবুর্গারের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। *

নাড়ীর স্পন্দন প্রতিফলিত আলোকরশ্মির সাহায্যে বড় করিয়া দেখাইতে পারা যায়। কব্জির নিকটস্থ নাড়িটি বাহিরেই অবস্থিত, সুতরাং নাড়ীর স্পন্দন সাধারণ অবস্থায় প্রতি মিনিটে ৭২ বার হয়। উত্তেজনার ফলে হৃদযন্ত্র সতেজ হয় ও তাহাতে রক্তের চাপ বৃদ্ধি হয়। রেকর্ডারে (Recorder) ঊর্ধ্বরেখা অধোরেখা হইতে দীর্ঘতর দেখা যায়। পক্ষান্তরে অবসাদের সময় অধোরেখা দীর্ঘতর হয় এবং রক্তের চাপ কমিয়া যায়। কিন্তু এই নাড়ী মাংসপেশিতে নিমজ্জিত থাকিলে স্পন্দন অনুভূত হয় না বা রক্তচাপ নির্ণয় করা যায় না। এখন প্রশ্ন হইতে পারে যে প্রাণীর রক্তচাপের মতন বৃক্ষের রস চাপ কি বর্ধিত কিংবা অবসন্ন হয়? এই অনুসন্ধান স্বভাবতই ব্যর্থ চেষ্টা বলিয়া মনে হইবে। প্রত্যেক স্পন্দনের দরুন যে সঙ্কোচ প্রসারণ হয় অত্যুৎকৃষ্ট অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও তাহা পরিলক্ষিত হয় না। তাহা ছাড়া অন্যান্য পেশির মধ্যে বৃক্ষ হৃদয় নিমজ্জিত। সুতরাং এই অদৃশ্য ও অবোধ্যকে কি করিয়া দৃশ্যমান করা সম্ভব হইবে?

উদ্ভিদের হৃদয় সন্ধান

তবে বৃক্ষের হৃদয় কোথায়? এই তথ্য প্রথমে আমার নূতন উদ্ভাবিত বিদ্যুৎ শলাকা দ্বারা আবিষ্কৃত হইল। নিস্পন্দিত পেশির সহিত বৈদ্যুতিক সংস্পর্শ ঘটাইলে তাড়িতমান যন্ত্র নিঃস্পন্দ থাকে। কিন্তু যদি ইহার সহিত স্পন্দমান হৃদযন্ত্রের সংস্পর্শ ঘটে, তাহা হইলে ওই স্পন্দনের অনুরূপ বৈদ্যুতিক স্পন্দন প্রতিফলিত হয়। বৃক্ষের হৃদয়ের অধিষ্ঠান স্থান নির্ণয় করিবার নিমিত্ত আমি বৃক্ষের কাণ্ডের ধাপে-ধাপে বৈদ্যুতিক শলাকা প্রবিষ্ট করাইয়া দেখিয়াছিলাম যে, যে মুহূর্তে ওই শলাকা স্পন্দমান স্তরের সংস্পর্শে আসে সেই মুহূর্তে বৈদ্যুতিক সাড়া পাওয়া যায়। ওই সাড়া গ্যালভ্যানোগ্রাফ (Galvanoigraph) যন্ত্রে লেখা হয়। প্রত্যেকটি জীবকোষ প্রসারণকালে নিম্নদেশ হইতে জল চুষিয়া লয় এবং সঙ্কোচের সময় উহা ঊর্ধ্বে নিক্ষেপ করে। উদ্ভিদের হৃদয়যন্ত্র নিম্নশ্রেণির জীবের হৃদয়যন্ত্রেরই অনুরূপ।

হৃদয়-স্পন্দন অনুভব করার যন্ত্র

ইহার পর অন্য সমস্যা মনে উদিত হইল। বিদ্যুৎ শলাকা প্রবেশ না করাইয়া বাহির হইতে বৃক্ষের হৃদয়-স্পন্দন কি কোনোদিন আমাদের অনুভূতি গ্রাহ্য হইবে? যখন স্পন্দিত রসপ্রবাহ বৃক্ষে সঞ্চারিত হয় তখন প্রত্যেক ঢেউ বৃক্ষকে ক্ষণিকের জন্য প্রসারিত করে; ঢেউটি চলিয়া গেলে বৃক্ষ পুনরায় পূর্ব আকার ধারণ করে। এই অদৃশ্য ও অস্পৃশ্য স্পন্দন মনুষ্য-প্রত্যক্ষ গোচর করিবার জন্য কল্পনারও অতীত অনুভব যন্ত্র আবিষ্কার করিতে হইয়াছে। এই অনুভব যন্ত্রে দুইটি দস্ত আছে-একটি স্থির, আর একটি চালনশীল। বৃক্ষটি এই দণ্ড দুইটির মধ্যে অবস্থাপিত করিলে, প্রসারণ তরঙ্গ, চালনযোগ্য দণ্ডখানিকে বাহিরের দিকে ঠেলিয়া দেয়। তবে ইহা চোখে দেখা যায় না। এই সঙ্কোচন প্রসারণ এক ইঞ্চির দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগেরও কম। সুতরাং আমার ম্যাগনেটিক অ্যামপ্লিফায়ার (Magnetic Amplifier) যন্ত্রের দ্বারা এই প্রসারণ-সঙ্কোচনকে এক কোটিগুণ বাড়াইতে হইয়াছে। এই যন্ত্রের চুম্বকের সহিত সংলগ্ন দর্পণে প্রতিফলিত আলোকরশ্মি দূরস্থিত যবনিকায় পতিত হয়। বৃক্ষটির হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে-সঙ্গে এই আলোকরশ্মি আলোড়িত হইতেছে। উত্তেজক বা ক্লান্তিজনক ঔষধ প্রয়োগের ফলে এই আলোড়নের গতি বৃদ্ধি অথবা ক্ষয়প্রাপ্ত হইতেছে। জীবনী শক্তির অদৃশ্য গতিবিধি কম্পিত আলোকরেখা দ্বারা জীবনের গূঢ় রহস্য জগৎসমক্ষে এইরূপ সর্বপ্রথমে প্রচারিত করিল।

অভাব ও দৈন্য

বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য মানুষের ভার লাঘব করা। দৈন্য এবং অভাব আসিয়া জাতীয় জীবনকে মৃত্যুপথে লইয়া যাইতেছে। দেশের আর্থিক উন্নতি সাধন করিতে হইলে কৃষি এবং শিল্প উভয়েরই উন্নতি সাধন করা আবশ্যক। ইহা করিতে হইলে বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করিতেই হইবে। আমি প্রমাণ করিয়াছি যে অনুসন্ধান এবং আবিষ্কারের ফলে ভারতবাসী বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধন করিতে পারে। যেমন আর্থিক দুরবস্থা ইউরোপে অশান্তি আনয়ন করিয়াছে-ভারতের আর্থিক সমস্যাই ভারতবর্ষের সমস্ত অশান্তির মূল। দেশের মৃত্তিকানিহিত স্বাভাবিক ঐশ্বর্য উদ্ধার করিবার একমাত্র উপায়-দেশের বহুসংখ্যক যুবককে উন্নত প্রণালীর বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তাহাদিগকে দেশের কাজে ব্যাপৃত করা। উদ্যোগী শক্তিশালী ব্যক্তির পক্ষে বিস্তৃত কর্মক্ষেত্রে রহিয়াছে। দেশের লোক যখন বৃথা আত্মকলহে ব্যাপৃত, এই সুযোগে বাহির হইতে বহু জাতি আসিয়া ভারতের ধনরত্ন লুঠিয়া লইতেছে।

আমরা কি ভুলিয়া গিয়াছি, যে অকূল জলধি এবং হিমাচল সমগ্র পৃথিবীর প্রতিযোগিতা হইতে আমাদিগকে রক্ষা করিতে পারিবে না। ধরিত্রী মাতা যেমন পাপভার বহন করিতে অসমর্থ, প্রকৃতি জননী ও সেইরূপ অসমর্থ জীবনের ভার বহন করিতে বিমুখ। দেহের মৃত্যুই আমাদের পক্ষে সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ নহে। ধ্বংসশীল শরীর মৃত্তিকায় মিশিয়া গেলেও জাতীয় আশা ও চিন্তা ধ্বংস হয় না। মানসিক শক্তির ধ্বংসই প্রকৃত মৃত্যু। তাহা একেবারে আশাহীন এবং চিরন্তন।

বীরধর্ম

অবিরাম চেষ্টা ও বিরুদ্ধ শক্তির সহিত যুঝিয়া এবং মনের শক্তি বৃদ্ধি করিয়াই দেশের ও জগতের কল্যাণসাধন করিতে পারিব-নিশ্চেষ্ট হইয়া নহে। যে দুর্বল এবং যে জীবন- সংগ্রাম হইতে পৃষ্ঠভঙ্গ দিয়াছে, সে কাপুরুষ। সে দান করিবার অধিকারী নহে কারণ তাহার দান করিবার কিছুই নাই। যে বীরের ন্যায় সংগ্রামে যুঝিয়াছে এবং জয়যুক্ত হইয়াছে, কেবল সেই-ই তাহার জয়লব্ধ বিত্ত দান করিতে পারে এবং সেই দান দ্বারা জগৎকে সমৃদ্ধিশালী করিতে পারে। ভারতের গৌরব এবং জগতের কল্যাণ ইহাই আমাদের চিরাসাধনা হউক।

উদ্ভিদের প্রাণযন্ত্র *

প 'ঞ্চবিংশতি বর্ষ পূর্বে প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, উদ্ভিদ- জীবনের অনুসন্ধানের ফলে প্রাণী জীবনের অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হইবে। উদ্ভিদ ও প্রাণী এই দুই-এর জীবন-ক্রিয়ার মধ্যে আপাত দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কোনো প্রাণীকে আঘাত করিলে সে শিহরণ দ্বারা আঘাতের অনুভূতি জ্ঞাপন করে। কিন্তু উদ্ভিদের অঙ্গে ক্রমাগত আঘাত করিলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। প্রাণীর চেতনেন্দ্রিয় আছে, বাহিরের আঘাতের ফলে উত্তেজনার স্পন্দন ইহাদের স্নায়ুমণ্ডলীর মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়া বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গাদি আন্দোলিত করে। উদ্ভিদের এইরূপ কোনো সম্প্রবাহক স্নায়ুমণ্ডলী নাই বলিয়াই বিজ্ঞানমণ্ডলীর এত দিন বিশ্বাস ছিল। প্রাণীদেহে একটি স্পন্দনশীল যন্ত্র আছে। রক্ত সঞ্চালন করিবার জন্য জীবদেহের মধ্যে এই যন্ত্র অবিরাম স্পন্দিত হইতেছে। উদ্ভিদের এইরূপ কোনো যন্ত্র আছে এরূপ কেহ অনুমান করিতে পারেন নাই। সুতরাং সকলে মনে করিতেছে যে, যদিও এই দুইটি জীবন-প্রবাহ পাশাপাশি বহিয়া যাইতেছে, তথাপি তাহাদের মধ্যে কুত্রাপি কোনো ঐক্য নাই। এই মত সম্পূর্ণ ভ্রান্ত-এইসব ভ্রান্ত মতই এতদিন জ্ঞানের উন্নতির পথ রোধ করিয়াছিল।

উদ্ভিদ-জীবনীতত্ত্বের অনুসন্ধিৎসুর পক্ষে প্রতিপদেই প্রবল বিঘ্ন, কারণ উদ্ভিদের জটিল জীবনী ক্রিয়ার পরিচয় জানিতে হইলে ইহার প্রাণ-অণুর সন্ধান করা ও তাহার স্পন্দনের স্বরূপ অবহিত হওয়া আবশ্যক। যখন অণুবীক্ষণের দৃষ্টি ব্যর্থ হয় তখন আমাদিগকে অদৃশ্যের পথ অনুসরণ করিতে হয় এবং সেইজন্য এমন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্রসমূহ আবিষ্কার করা আবশ্যক যাহার সাহায্যে আলোকউম্মি অপেক্ষাও ক্ষুদ্রতর স্পন্দন দৃষ্টিগোচর করা ও তাহার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভবপর নয়। আমার বিজ্ঞান মন্দিরে স্বয়ংলেখ যন্ত্রের আবিষ্কার দ্বারা এই দুরূহ কার্য সম্পন্ন হইয়াছে। এই যন্ত্র সাহায্যে ক্ষুদ্রতম জীবন স্পন্দন এক কোটি হইতে পাঁচ কোটি গুণ বর্দ্ধিতরূপে দৃষ্ট হয়। সাধারণ অণুবীক্ষণের সাহায্যেই একটা নূতন জগৎ আবিষ্কৃত হইয়াছে, এই সূক্ষ্মাতিতম সূক্ষ্ম অণুবীক্ষণের সহায়তায় ভবিষ্যতে বহুবিধ অত্যাশ্চর্য সন্ধান পাওয়া যাইবে। আমার আবিষ্কৃত এই যন্ত্র সমূহ প্রাণী জীবনের অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করিতে সক্ষম হইয়াছে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে গবেষণা করিয়া আমি এই সিন্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, যাবতীয় প্রাণ-যন্ত্রের ক্রিয়া একই নিয়মে চালিত হইতেছে।

ইউরোপে বিজ্ঞান-অভিযান

আমার আবিষ্কৃত যন্ত্র সমূহের অসাধারণ ক্ষমতা ও বিজ্ঞান মন্দিবে গবেষণা প্রসূত বৈজ্ঞানিক সত্যসমূহ জীবনীরাজ্যের অনেক অজ্ঞাত রহস্য উদঘাটনে সমর্থ হইয়াছে। ইহার ফলে আমি ইউরোপের বিখ্যাত বিজ্ঞানানুশীলন কেন্দ্র সমূহ হইতে বক্তৃতা দেওযার ও আমার অনুসন্ধান প্রণালী প্রদর্শন করাইবার জন্য আমন্ত্রিত হই। বিদেশে এই সকল সূক্ষ্ম যন্ত্রসমূহ নিরাপদে একস্থান হইতে অন্যস্থানে লইয়া যাওয়া অতীব দুরূহ হইয়াছিল। অন্যের হস্তে এই সমস্ত যন্ত্র দেওয়া যায় না, কারণ সামান্য অসাবধানতার দরুন যন্ত্রগুলি একেবারে নষ্ট হইয়া যাইতে পারে। কাজেই অনেক স্থলে আমাকেই উহা একস্থান হইতে অন্য স্থানে বহন করিয়া লইয়া যাইতে হইয়াছে। ইংল্যান্ডে আমি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ও সোসাইটি অব আর্টসের সমক্ষে বক্তৃতা প্রদান করি। তৎপরে রয়েল সোসাইটি অব মেডিসিন কর্তৃক অনুরুদ্ধ হইয়া আমি উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহে নানাবিধ ঔষধের সমক্রিয়া সম্বন্ধীয় একটি গবেষণামূলক বিষয় ব্যাখ্যান করি। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিদাঘ বাসরে "বিজ্ঞানের উন্নতিতে ভারতের দানের গুরুত্ব" সম্বন্ধে বক্তৃতা প্রদান করি। আমার বক্তৃতার বিষয়গুলি যন্ত্রাদির সাহায্যে দেখাইবার ফলে সর্বত্রই বিপুল উৎসাহের সঞ্চার হইয়াছিল। অক্সফোর্ড ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সমক্ষে যে বক্তৃতা প্রদান করি তাহার সম্পূর্ণ অংশ তৎক্ষণাৎ বেতার সাহায্যে জগতের নানা স্থানে প্রেরিত হইয়াছিল এবং পরদিন প্রাতঃকালেই ইউরোপ ও আমেরিকার সমস্ত কাগজে উহা প্রকাশিত হইয়াছিল। আমার গবেষণা প্রসূত তথ্যসমূহ শুধু জগতের বৈজ্ঞানিকমণ্ডলীর নহে সাধারণেরও চিত্তাকর্ষণ করিতে সমর্থ হইয়াছে তাহার প্রমাণও পাইয়াছি। শীঘ্রই আমার উদ্ভিদতত্ত্বের আবিষ্কার সমূহ সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজ ভাষায় লিখিত হইয়া আমেরিকা ও ইউরোপে একসঙ্গে প্রকাশিত হইবে।

গত বৎসর বেলজিয়ামের সম্রাট ভারত ভ্রমণ কালে বসুবিজ্ঞান মন্দিরের গবেষণাকার্য দেখিয়া বিশেষ প্রীত হন। তিনি সেই সময়েই আমাকে বেলজিয়ামে প্রাণিতত্ত্ব সম্বন্ধে বক্তৃতা দিবার জন্য অনুরোধ করিয়াছিলেন। এবার তাঁহারই উদ্যোগে বেলজিয়ামের ফন্দেশিও ইউনিভারসেতায়ারে (Foundation Universatataire) আমার প্রাণিতত্ত্ব বিষয়ক একটি ধারাবাহিক বক্তৃতার আয়োজন করা হইয়াছিল। বক্তৃতা সভায় সপারিষদ সম্রাট ও বেলজিয়মের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের অধ্যাপকমণ্ডলী উপস্থিত ছিলেন। যাহাতে আমার পরীক্ষাকার্য সাফল্যমণ্ডিত হয় এই জন্য রাজকীয় উদ্যানে পূর্ব হইতেই নানা প্রকার পরীক্ষাপোযোগী উদ্ভিদ জন্মানো হইয়াছিল।

প্যারিসের সোর্বোন ((Sorboune) এবং ন্যাচারেল হিস্ট্রি মিউজিয়মে আমার বক্তৃতা হয়। এখানেও বিজ্ঞ চিকিৎসকবর্গ ও বিশিষ্ট প্রাণিতত্ত্ববিদগণ আমার আবিষ্কৃত তত্ত্বসমূহের বিশেষ প্রশংসা করেন। ল্যাটিন ভাষাভাষী দেশসমূহে আমার আবিষ্কার সম্বন্ধে সবিশেষ পরিচয় পাইবার জন্য আগ্রহ জাগিয়াছে, তাহার ফলে বিখ্যাত ফরাসি বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ প্রকাশক গথিয়ার ভিলার্স (Gauthier Vallars) আমার রচিত পুস্তকগুলির ফরাসি সংস্করণ প্রকাশ করিতেছেন।

অতঃপর আমি জেনিভার বিশ্বরাষ্ট্র সংঘ কর্তৃক আমন্ত্রিত হইয়া আন্তর্জাতিক বিদ্বজ্জন সম্মিলনীতে যোগদান করি। জেনিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে সেখানে আমার একটি বিশেষ ধারাবাহিক বক্তৃতার আয়োজন করা হইয়াছিল। সেই বক্তৃতা সভায় অধ্যাপক লরেঞ্জ (Lorenz), আইনস্টাইন প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক উপস্থিত ছিলেন। এই সময়েই জগৎ- বিজ্ঞান-ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করিবার জন্য বসুবিজ্ঞান মন্দিরের দানের গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়া জেনিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর ভারত সচিবকে লিখিয়াছেন যে, আমার ত্রিশ বর্ষব্যাপী সাধনার ফল, তাঁহাদের সশ্রদ্ধ প্রশংসা অর্জন করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, এই যুগান্তকারী মৌলিক গবেষণা সমূহ তাঁহাদের মনে একটি প্রবল আকাঙক্ষা জাগরিত করিয়াছে যে, নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক জগতে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সংস্পর্শ আরও ঘনিষ্ঠতর হউক।

বিশ্বরাষ্ট্র সঙ্ঘের অন্তর্গত আন্তর্জাতিক বিদ্যামন্দিরের পক্ষ হইতে মসিঁয়ে লুসার (M. Luchair) বলেন যে, সকল প্রকার প্রাণক্রিয়া যে একই ধরনের তাহার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দেখিয়া তাঁহারা চমৎকৃত হইয়াছেন। তাঁহারা এখন সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করিতে সক্ষম হইয়াছেন যে, মনীষীদের চিন্তা প্রণালীর ভিতর ঐক্য রহিয়াছে এবং মানুষের প্রতিভাপ্রগতি কোনোরূপ ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ নহে ও কোনো প্রকার বাধা নিষেধ মানব মনের অগ্রসরশীল গতিকে রুদ্ধ করিয়া রাখিতে পারে না। যে ভারতবর্ষকে তাঁহারা এতদিন কেবল কল্পনাপ্রবণ বলিয়া মনে করিতেন এখন তাঁহারা স্বীকার করিতেছেন যে, সেই সকল কল্পনাই বহু যুগান্তকারী আবিষ্কার করাইতেছে। সুতরাং তাঁহাদের স্থির বিশ্বাস যে, আন্তর্জাতিক বিদ্বজ্জন সম্মিলনীর প্রচেষ্টায় বিভিন্ন দেশের মনীষীবর্গের যে ভাবের আদান-প্রদানের আয়োজন হইতেছে তাহার ফলে মানবসভ্যতার শৈশব লীলা-নিকেতন এশিয়ার বহুদিনের পুঞ্জীভূত চিন্তরাশি বিশ্বজগতের নিকট উন্মুক্ত হইবে।

সুবিজ্ঞ সমালোচকবর্গের নিকট হইতে এইপ্রকার উচ্চ প্রশংসা আশ্চর্য বলিতে হইবে কারণ পাশ্চাত্য দেশে এতদিনের প্রচলিত মত এই যে, "ভারতবর্ষ শুধু ঐন্দ্রজালিক ও তান্ত্রিকদের সাধনাক্ষেত্র।" এইরূপ অসম্ভব ও ভ্রান্ত ধারণা অপসারিত করিতে আমার অনেক সময় লাগিয়াছে। এবং এক্ষণে ভারতবাসীর বৈজ্ঞানিক দক্ষতা সর্ববাদীসম্মত হইয়াছে। জ্ঞান- বিজ্ঞানের প্রসার প্রচেষ্টায় ভারতবাসীর বিপুল প্রয়াস, জীবন বিজ্ঞানের রহস্য অবগত হইবার নিমিত্ত ভারতীয় কারিগরের সুপরিকল্পিত ও সুনির্মিত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্রসমূহের আবিষ্কার এবং প্রাণিতত্ত্ব সম্পর্কিত যুগান্তকারী আবিষ্কার সমূহ জগৎ সভায় ভারতের স্থান অতি উচ্চে নির্দিষ্ট করিয়াছে।

জীবন-মৃত্যু রেখা

মৃত্যুর লক্ষণ কি এবং জীবন-মৃত্যু দ্বন্দ্বের সন্ধিস্থল সঠিক ধরা যায় কিনা আমি এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই। আমি এমন কয়েকটি সঠিক উপায় নির্ণয় করিয়াছি যাহা দ্বারা মরণোম্মুখ উদ্ভিদ তাহার মৃত্যুরেখা নিজেই অঙ্কিত করিতে পারে। চারা গাছকে প্রথমে ঈষদুষ্ণ জলে ডুবাইয়া রাখা হইল। জলের উষ্ণতা ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি করা হইল। জলের উষ্ণতা বৃদ্ধি হইয়া ক্রমে ৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে উঠিল। গাছটি আর উত্তাপ সহ্য করিতে পারিল না, কারণ ৬০ ডিগ্রি উষ্ণতা গাছটির পক্ষে মারাত্মক। ফলে সাধারণ প্রাণীর মৃত্যুকালীন বিক্ষেপের মতন গাছটিরও ভীষণ বিক্ষেপ আরম্ভ হইল। জীবন-মৃত্যু, সংগ্রামের এই সন্ধিক্ষণে গাছ হইতে একটি প্রবল বিদ্যুৎতরঙ্গ বাহির হইয়া আসিল।

অনুসন্ধানরত হইয়া আমি উদ্ভিদ সম্বন্ধে যে সকল তত্ত্ব অবগত হইয়াছি তাহা অতীব বিস্ময়কর। একটি চারাগাছকে উষ্ণজলে ডুবাইয়া রাখিলাম তাহার প্লাবনশীলতা ক্রমে হ্রাস পাইতে থাকিল ও জল ক্রমে ৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উত্তপ্ত হইলে তাহার জীবনী লক্ষণ একেবারে লোপ হইল এবং চারাগাছটি জলে ডুবিয়া গেল।

বৃক্ষের স্নায়ুমণ্ডলী

উদ্ভিদের স্নায়ুমণ্ডলী আছে এ কথা অনেকে বিশ্বাস করিতে চাহিতেন না। আমাব গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত হইয়াছে যে, বৃক্ষের বেশ স্নায়ুমণ্ডলী আছে এবং বৃক্ষে চেতনার স্পন্দন যে ভাবে সঞ্চালক-স্পন্দনে পরিণত হয় তাহা হইতেই বেশ ধরা যায় যে বৃক্ষের স্নায়ুমণ্ডলী অতীব জটিল। পরিমাণ ওজন করিবার কোনো যন্ত্র না থাকায় অতীতে বহু ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক মতবাদ সৃষ্টি করিয়াছিল।

জলের নল বা স্নায়ু

সকলেই অবগত আছেন যে বাহিরের বিষ বা উত্তেজক দ্রব্য নলের মধ্য দিয়া প্রবাহমান জলের কোনোরূপ পরিবর্তন ঘটাইতে পারে না। নলটির উপর ক্লোরফর্ম প্রদান করিলেও উহার সংজ্ঞা লোপ হইবে না বা জলপ্রবাহ বন্ধ হইবে না এবং ইহার চতুর্দিকে বিষাক্ত ঔষধের প্রলেপ দিলেও উহার কার্যকরী শক্তি লোপ পাইবে না। কিন্তু প্রাণীদেহে এই সমস্ত ঔষধপ্রয়োগে স্থায়িভাবে বা সাময়িকভাবে প্রাণক্রিয়া বন্ধ হইয়া যায়। আমার গবেষণা দ্বারা সম্পূর্ণরূপে প্রমাণ করিতে সমর্থ হইয়াছি যে, প্রাণীদেহের স্নায়ুমণ্ডলী যে উপায়ে উত্তেজনা বহন করে উদ্ভিদের স্নায়ুমণ্ডলীও ঠিক সেইভাবে কার্য করে।

বদ্ধ পতঙ্গ ও উদ্ভিদ-পত্র

কোন পতঙ্গকে আলোকের সম্মুখে বাঁধিয়া রাখিলে সে যেমন একবার উপরে উঠিতে চেষ্টা করে আবার নীচের দিকে উড়িয়া আসে এবং বারংবার দক্ষিণে ও বামে ঘুরিয়া ফিরিয়া আবার আলোকের দিকেই আসে উদ্ভিদ পত্রও আলোকের সম্মুখে ঠিক ওইরূপ করে।

রক্তসঞ্চালন ও উদ্ভিদ রসসঞ্চালন

উদ্ভিদদেহে কি উপায়ে রসসঞ্চালন হয় এই সমস্যা বহুকাল যাবৎ অমীমাংসিত হইয়া

রহিয়াছে। এই রস সঞ্চালন জড় না চৈতন্যের ক্রিয়া? ট্রার্সবার্গার একটি ভ্রমাত্মক সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়া লিখিয়াছিলেন যে বিষক্রিয়ার ফলে বৃক্ষের রসসঞ্চালনে কোনোরূপ বিঘ্ন হয় না। ইহার ফলে অনেকে অনেক প্রকার অনুমান করিয়াছেন, কিন্তু কেহই বিষয়টি ঠিক ভাবে বুঝাইতে সমর্থ হন নাই। জীবনীশক্তিবর্দ্ধক কয়েটি পদার্থ লইয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি যে, ওই সকল পদার্থ প্রয়োগে বৃক্ষকে সঞ্জীবিত করিতে পারা যায় এবং কতকগুলি বিষাক্ত ঔষধ প্রয়োগে সজীব বৃক্ষের প্রাণহানি ঘটে। ইহা হইতে এই সত্য প্রমাণিত হয় যে, একটি স্পন্দনশীল তন্ত্রী সাহায্যে বৃক্ষের রসসঞ্চালন ক্রিয়া সম্পাদিত হয়। এই তন্ত্রটিই বৃক্ষদেহে যুগপৎ হৃদযন্ত্র ও নাড়ীর ক্রিয়া সম্পাদন করে।

মহীলতা (কেঁচো) প্রভৃতি নিম্নস্তরের প্রাণীদেহে একটি লম্বমান প্রত্যঙ্গ আছে। উহার সাহায্যেই উহাদের দেহে সঞ্জীবনী রস সঞ্চালিত হয়। উচ্চস্তরের প্রাণীদেরও একটি বিলম্বিত হৃদযন্ত্র আছে। আমি পরীক্ষা করিয়া ধরিতে পারিয়াছি যে উদ্ভিদদেহে রসসঞ্চালন সম্পূর্ণরূপে জড় ক্রিয়া নহে ইহা চৈতন্য ক্রিয়া এবং প্রাণিদেহে রক্তসঞ্চালন পদ্ধতির সহিত উদ্ভিদ দেহেব রসসঞ্চালন ক্রিয়ার কোণে পার্থক্য নাই। প্রাণীদেহে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়ার নিম্নলিখিত কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যথাঃ

(১) হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক স্পন্দন লক্ষিত হয়।

(২) বিভিন্ন প্রকারের রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগে হৃদযন্ত্রের পরিবর্তন হয়।

(ক) কপূর প্রয়োগে হৃদক্রিয়া বৃদ্ধি পায়।

(খ) পটাশিয়াম ব্রোমাইড প্রয়োগে হৃদক্রিয়ার হ্রাস হয়। (গ) স্ট্রিক্‌ক্লিন অল্পমাত্রায় প্রয়োগ করিলে হৃদক্রিয়ার

বৃদ্ধি হয় এবং বেশি মাত্রায় প্রয়োগ করিলে হৃদক্রিয়া অতি মাত্রায় হ্রাস প্রাপ্ত হয়। (ঘ) বিষাক্ত ঔষধ প্রয়োগে হৃদক্রিয়া একেবারে লোপ পায় এবং রক্ত ও রসসঞ্চালন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হইয়া যায়।

আমার উদ্ভাবিত বৈদ্যুতিক শলাকা দ্বারা উদ্ভিদের হৃদ্যন্ত্রের অধিষ্ঠান স্থল নির্ণিত হইয়াছে। যে সমস্ত পদার্থ প্রযোগে রসসঞ্চালনের হ্রাসবৃদ্ধি হয়, সেই সমস্ত পদার্থ প্রয়োগে বৈদ্যুতিক স্পন্দনেরও হ্রাস-বৃদ্ধি লক্ষিত হয়। সে সকল পরীক্ষা দ্বারা উদ্ভিদ এবং প্রাণীর হহৃদ্যন্ত্রের ঐক্য প্রমাণিত হয় এক্ষণে সেই সমস্ত পরীক্ষার কথা বর্ণনা করিব।

ইলেক্টোম্যাগনেটিক ফাইটোগ্রাফ্

ইতিপূর্বে উদ্ভিদরস কীভাবে সঞ্চালিত হয় তাহা ঠিক করিবার এবং ওই রসাধারার অধিরোহণ বেগ মাপিবার কোনো উপায় ছিল না। আমার মনে হইল যে, একটি বিলম্বিত বৃক্ষপত্রকে প্রসারিত হস্তের মতন ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে কারণ এই পত্রের উত্থান-পতন দৃষ্টে বৃক্ষে রস-সঞ্চালন হইতেছে বলিয়া বোঝা যায়। জলাভাবে যখন বৃক্ষের রস-সংগ্রহ শক্তি কমিয়া যায় তখন পত্রটি ঝুঁকিয়া পড়ে আবার রসসংগ্রহ শক্তি বৃদ্ধি পাইলে উহা সোজা হইয়া উঠে। এই উত্থান-পতন এত ধীবে-ধীরে হয় যে হঠাৎ দেখা যায় না। আমার আবিষ্কৃত বৈদ্যুতিক লেখনী দ্বারা এই উত্থান-পতন খুব বড় করিয়া দেখা যায়। ওই লেখনী অদুরে বিলম্বিত পরদার উপর আলোক বিন্দুপাত করিয়া পত্রের আন্দোলন জ্ঞাপন করে। পটাশিয়াম ব্রোমাইড প্রয়োগে উদ্ভিদের হস্তখানি (বিলম্বিত পত্রটি) যে ঝুঁকিয়া পড়ে, পরদার উপর তাহার আলোক রেখাপাত হয়, আবার উত্তেজক (কফি) প্রয়োগে যে অবসাদগ্রস্ত বৃক্ষে আবার বলসঞ্চার হয় তাহারও রেখাপাত হয়। এই ভাবেই মৌন প্রাণ সুস্পষ্ট সঙ্কেতে স্বীয় অস্তিত্বের ও জীবনযুদ্ধের ইতিহাস লিখিতে সমর্থ হইয়াছে।

কার্ডিওগ্রাম ও স্ফিগমোগ্রাম্

প্রাণীর হৃদ্যন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়া এবং ঔষধ প্রয়োগে ওই ক্রিয়ার পরিবর্তন কার্ডিওগ্রাম যন্ত্র দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা যায়। কিছুদিন পরীক্ষা করিবার পর আমি দেখিতে পাই যে, এই যন্ত্র লিখিত কলের মধ্যে মধ্যে কিছু কিছু ভুল থাকিয়া যায়। কারণ লেখনী ও লিপিধারকের পুনঃপুনঃ ঘর্ষণ হওয়ার ফলে লিখনকার্য বিঘ্ন ঘটে। তাহা ছাড়া উহাতে হৃদ্যন্ত্রের সঙ্কোচন ও প্রসারণের স্থিতিকাল ঠিক ঠিক মাপা যায় না। এই জন্য আমি রেজোনেন্ট রেকর্ডার (Resonant Recorder) নামক যন্ত্র উদ্ভাবন করিয়াছি। উক্ত যন্ত্র সাহায্যে এক সেকেন্ডের এক শতভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে হৃদ্যন্ত্রের কতবার সঙ্কোচন ও প্রসারণ হয় তাহা ধরা যায়।

ফিমোগ্রাফ (Sphygmoraph) নামক যন্ত্র সাহায্যে নাড়ী পরীক্ষা দ্বারাও পরোক্ষভাবে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া পর্য্যবেক্ষণ করা সম্ভব। হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বৃদ্ধি পাইলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় আবার ক্রিয়া হ্রাস হইলে রক্তচাপও হ্রাস হয়। মণিবন্ধের নিকটস্থ শিরাটির স্পন্দন সহজেই ধরা যায় কিন্তু যেখানে শিরাটি স্নায়ুমণ্ডলীর মধ্যে নিমজ্জিত থাকে সেখানে ইহার স্পন্দন উপলব্ধি করা অসম্ভব।

অপ্টিক্যাল স্পিগ্নোগ্রাফ

বৃক্ষের নাড়ী পরীক্ষা কার্য স্বভাবতঃই অসম্ভব বলিয়া মনে হয়। হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়ার জন্যই যদি বৃক্ষে রসসঞ্চালন নিয়ন্ত্রিত হয় তাহা হইলে সর্বোৎকৃষ্ট অণুবীক্ষণ দ্বারা ওই যন্ত্রের সঙ্কোচন প্রসারণের পরিমাণ মাপা সম্ভব নহে। পরন্তু বৃক্ষের প্রাণময় কোষসমূহ উহার অভ্যন্তরে লুক্কায়িত রহিয়াছে। এই অদৃশ্য অব্যক্তকে কি উপায়ে ব্যক্ত করা যায়?

আমি এই অসম্ভবকে সম্ভব করিতে দৃঢ় সঙ্কল্প করিলাম। উদ্ভিদরস যখন কাণ্ড আশ্রয় করিয়া উপরে উঠিতে থাকে সেই সময় বৃক্ষের কীরূপ হৃদস্পন্দন হয় আমি সর্বপ্রথমে তাহাই ধরিতে চেষ্টিত হইলাম। স্পন্দনের সঙ্গে সঙ্গে বৃক্ষের কাণ্ড খুব সামান্যভাবে স্ফীত হয়। স্পন্দন তরঙ্গ প্রবাহিত হইবার পরেই আবার কাণ্ড পূর্বাবস্থা প্রাপ্ত হয়। উদ্ভিদ ও প্রাণীর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াবর্ধক ঔষধ প্রয়োগে বৃক্ষের রসসঞ্চালন বেগ নিশ্চয়ই বৃদ্ধি পাইয়া সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভিদ কাণ্ড স্ফীত হইবে এবং বিপরীত ঔষধ প্রয়োগে বিপরীত ফল দৃষ্ট হইবে। এই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মতম সূক্ষ্ম সঙ্কোচন-প্রসারণ পরিমাপের নিমিত্ত আমাকে অতি সূক্ষ্ম যন্ত্রের উদ্ভাবন করিতে হইয়াছে। প্ল্যান্ট ফিলার (Plant Fecler) বা অপ্টিটিক্যাল্ স্ফিগমোগ্রাফ্ (Optical Sphygmograh) নামক যে যন্ত্র উদ্ভাবন করিয়াছি তাহার সহিত সচল ও অচল দুইটি শলাকা যুক্ত রহিয়াছে। বৃক্ষের কাণ্ডটি এই শলাকাদ্বয়ের মধ্যে স্থাপন করা হয়। সচল শলাকাটির অগ্রভাগ ঈষৎ নাড়িলে যাহাতে সেই স্পন্দন পাঁচ কোটি গুণ বড় করিয়া দেখা যায় এবং তাহার রেখাপাত হয় আমি এইরূপ কৌশল উদ্ভাবন করিয়াছি। মৃত বৃক্ষকে এই শলাকাদ্বয়ের মধ্যে দেখা গিয়াছে যে, তাহাতে আলোক-রেখা নিস্পন্দ অবস্থায় থাকে কারণ মৃত বৃক্ষের হৃদস্পন্দন ক্রিয়া বন্ধ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু জীবিত বৃক্ষের নাড়ীর স্পন্দন আলোক রেখার কম্পন দেখিয়া বোঝা যায়। জীবিত বৃক্ষের নাড়ীর স্পন্দনের হার প্রতি সেকেন্ডে একবার। অবসাদ-প্রদায়ক ঔষধ প্রয়োগে বৃক্ষে রসচাপের হ্রাস পায়; ফলে আলোক রেখা বাম দিকে (মৃত্যুর দিকে) আবর্তিত হয়; আবার উত্তেজক ঔষধ প্রয়োগে আলোক রেখা দক্ষিণ দিকে (জীবনের দিকে) আবর্তিত হয়। এই সঞ্চরমান আলোকরশ্মিই সর্বপ্রথম উদ্ভিদ জীবনের অব্যক্ত উচ্ছ্বাস ও অবসাদ ব্যক্ত করিল।

উপক্ষার (Alkaloids) ও নাড়ী-স্পন্দন প্রাণী ও উদ্ভিদের নাড়ী স্পন্দনে ওষধি ও উপক্ষারের প্রভাব একই প্রকার। যে সমস্ত ঔষধ প্রাণীদেহে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বৃদ্ধি করে ঠিক সেই সমস্ত ঔষধই উদ্ভিদের রসসঞ্চালন শক্তি বৃদ্ধি করে। পক্ষান্তরে অবসাদজনক ঔষধ প্রয়োগে উভয়ের দেহেই অবসাদের লক্ষণ দৃষ্ট হয়।

সর্প বিষের ফল

প্রাণীদেহে অতি সামান্য মাত্রায় গোখুরা সর্পের বিষ প্রয়োগ করিলে মারাত্মক লক্ষণ দেখা যায়। আমি পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি যে, উদ্ভিদ দেহেও সর্প বিষের ক্রিয়া ওইরূপ। ভারতবর্ষে প্রায় সহস্র বর্ষ যাবৎ প্রাণীদেহে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বৃদ্ধি করিবার জন্য সর্প বিষ হইতে প্রস্তুত সূচিকাভরণ ঔষধ ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে, আমি পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি যে, অতি সামান্য পরিমাণ সর্প বিষ উদ্ভিদের হৃদক্রিয়া বৃদ্ধি করে।

জীবন-মৃত্যুর সংগ্রাম

প্রাণযন্ত্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা, অদৃশ্য জগৎকে দৃশ্যমান করা, মৌন জগতের ব্যাকুলতা শ্রবণ করিতে সমর্থ হওয়া-এই সমস্ত অসম্ভব কার্যকে সম্ভব করা কি অত্যাশ্চর্যজনক নহে?

মানুষের জীবন-মৃত্যু সংগ্রাম অতিশয় করুণ-বৃক্ষের জীবন-মৃত্যু সংগ্রামও সেইরূপ করুণ। আমার যন্ত্র সাহায্যে উদ্ভিদ জগতের এই জীবন-মৃত্যু সংগ্রাম লোকচক্ষুর সমক্ষে প্রতিভাত হইয়া উঠিয়াছে। বিষ প্রয়োগের ফলে বৃক্ষ কিরূপ দ্রুতগতিতে মৃত্যু-রেখার দিকে ধাবিত হয় আবার উত্তেজক ঔষধ প্রদান করিলে মরণোম্মুখ উদ্ভিদের প্রাণ কীরূপে আবার আপনার প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে তাহা চক্ষুর সমক্ষে প্রতিফলিত হয়।

অবিচলিত চিত্তে জ্ঞানের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইযা মানুষ এরূপ শক্তি অর্জন করিতে পারে যাহা দ্বারা সে প্রাণযন্ত্রকেও নিয়ন্ত্রিত করিতে পারে এবং নিজের ইচ্ছানুযায়ী উহাকে অবসাদগ্রস্ত বা উত্তেজিত করিতে সমর্থ হয়।

বৃক্ষের অঙ্গভঙ্গী

নুষের অঙ্গভঙ্গি হইতে তাহার ভিতরের অবস্থা বুঝিতে পারা যায়। সকাল বেলা মানুষে তাহার যে আকৃতি থাকে, দিনের শেষে সারাদিনের ক্লান্তি হেতু তাহা পরিবর্তিত হয়। সুখে সে উৎফুল্ল, দুঃখে সে বিবশ। সব জীবজন্তুর মূর্তি ক্ষণে-ক্ষণে পরিবর্তিত হইতেছে। তাহা কেবল ভিতরের পরিবর্তনজনিত নহে। বাহিরের আঘাতেও তাহার অঙ্গভঙ্গি বিভিন্ন হইয়া যায়। তাড়নায় কুপিতা ফণিনী মুহূর্তেই সংহাররূপিণী হইয়া থাকে।

এইরূপে অহরহ ভিতর ও বাহিরের শক্তির দ্বারা তাড়িত হইয়া জীব বহুরূপী হইয়াছে। ভিতরের শক্তির সহিত বাহিরের শক্তির নিরন্তর সংগ্রাম চলিতেছে। আশ্চর্যের বিষয় এই, যে বাহিরের আঘাতের ফলেই ভিতরের শক্তি দিন-দিন পরিস্ফুট হইয়া থাকে।

এক সময়ে ভিতরে কিছুই ছিল না, বাহির হইতে শক্তি প্রবেশ করিয়া ভিতরে সংস্থিত হইয়াছে। যাহা বাহিরে অসীম ছিল, তাহাই ভিতরে সসীম হইল; এবং সেই ক্ষুদ্র তখন বৃহতের সহিত যুঝিতে সমর্থ হয়। সেই ক্ষুদ্র কখনও বাহিরকে বরণ করে, কখনও বা প্রত্যাখ্যান করে। জীবনের এই লীলা বৈচিত্র্যময়ী।

জীবের ন্যায় বৃক্ষের ভঙ্গীও সর্বদা পরিবর্তিত হইতেছে। পাতা কখনও আলোর সন্ধানে উন্মুক্ত হয়, কখনও প্রচণ্ড রৌদ্রতাপ হইতে বিমুখ হয়। এই সকালবেলায় বাগানে বেড়াইতে বেড়াইতে দেখিলাম, যে সূর্যমুখী গাছটি পূর্বগগনের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। পাতাগুলি ঘুরিয়া এরূপে সন্নিবেশিত হইয়াছে, যে প্রত্যেক পাতার উপর যেন সূর্যরশ্মি পূর্ণরূপে পতিত হয়। ইহার জন্য কোনো পাতা উপরের দিকে উঠিয়া থাকে, আর পাশের পাতাগুলি ডান কিংবা বামদিকে পাক খাইয়া সূর্যকিরণ পূর্ণ মাত্রায় আহবণ করে। বৈকালবেলায় দেখিতে পাইলাম, গাছ ও পাতা পশ্চিম গগনোন্মুখ হইয়াছে, ডাল এবং সব পাতাগুলি ঘুরিয়া গিয়াছে। কি শক্তির বলে এই পরিবর্তন ঘটিল? বাহিরের সহিত ভিতরের একী অদ্ভুত সম্বন্ধ! সূর্য তো প্রায় পাঁচকোটি ক্রোশ দূরে, তবে কি রাখিবন্ধনে গাছ দিবাকরের সহিত এইরূপ সম্মিলিত হইল?

উদ্ভিদ বিদ্যা সম্বন্ধীয় পুস্তকে দেখা যায় যে, সূর্যমুখীর এই ব্যবহার 'হিলিও-ট্রোপিজম্' জনিত। হিলিও-ট্রোপিজমের বাংলা অনুবাদ, সূর্যের দিকে মুখ হওয়া। সূর্যমুখী কেন সূর্যের দিকে আকৃষ্ট হয়? কারণ 'সূর্যের দিকে মুখ' হওয়াই তাহার প্রবৃত্তি! যখন কোনো বিষয়ের প্রকৃত সন্ধান না পাইয়া মানুষ উৎকণ্ঠিত হয়, তখন কোনো দুর্বোধ্য মন্ত্রতন্ত্র তাহাকে নিশ্চিন্ত করে। তবে সেই মন্ত্রটি সংস্কৃত, লাটিন কিংবা গ্রিক ভাষায় হওয়া আবশ্যক। সোজা বাঙ্গালায় কিম্বা অন্য আধুনিক ভাষায় হইলে মন্ত্রের শক্তি থাকে না। এইজন্যই গ্রিক হিলিও- ট্রোপিজম্ মন্ত্রে সূর্যমুখীর ব্যবহার বিশদ হইল।

সে যাহাই হউক, ইহার পশ্চাতে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। এইসব অঙ্গভঙ্গী অদৃশ্য জীব বিন্দুর প্রকৃতিগত কোন পরিবর্তন দ্বারাই সাধিত হয়। জীববিন্দুর পরিবর্তন অনুবীক্ষণ যন্ত্রেও অদৃশ্য। তবে কিরূপে সেই অপ্রকাশকে সুপ্রকাশ করা যাইতে পারে? বহু চেষ্টার পর বিদ্যুৎ বলে এই অদৃশ্য জগৎকে দৃষ্টিগোচর করিতে সমর্থ হইয়াছি। এই বিষয়ে দুই একটি কথা পরে বলিব।

কেবল সূর্যমুখীই যে আলোক দ্বারা আকৃষ্ট হয়, এরূপ নহে। টবে বসানো একটি লতা অন্ধকার ঘরে রাখিয়া দিযাছিলাম। রুদ্ধ জানালার একটি রন্ধ্র দিয়া অতি ক্ষুদ্র আলোক রেখা আসিতেছিল। পরের দিন দেখিলাম, সব পাতাগুলি ঘুরিয়া সেই ক্ষীণ আলোকের দিকে প্রসারিত হইয়াছে।

লজ্জাবতী লতাতেও এইরূপ ক্রিয়া দেখিতে পাওয়া যায়। টবে বসানো লতাটি যদি জানালার নিকটে রাখা যায়, তাহা হইলে দেখিতে পাই যে, সব পাতাগুলি ঘুরিয়া বাহিরের আলোর দিকে মুখ করিয়া রহিয়াছে। টব ঘুরাইয়া দিলে পাতাগুলি পুনবায় নূতন করিয়া ঘুরিয়া যায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে পাতাগুলি কেবল উঠে এবং নামে তাহা নয়, কোনগুলি ডানদিকে এবং কোনগুলি বামদিকে পাক খায়। পাতার ডাঁটার গোড়ায় যে স্কুল পেশি দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার দ্বারাই পাতাগুলি ঘুরিয়া থাকে, কখনও উঠানামা করে, কখন ডানদিকে কিংবা কখনও বামদিকে পাক খায়। পূর্বে বিশ্বাস ছিল যে, পাতার গোড়ায় একটি মাত্র পেশি আছে যাহার দ্বারা কেবলমাত্র উঠানামা হয়। কিন্তু আমাদের হাত ঘুরাইতে হইলে অনেকগুলি পেশির আকুঞ্চন এবং প্রসারণের আবশ্যক। অনুসন্ধান করিতে গিয়া জানিতে পারিলাম যে লজ্জাবতীর পাতার মূলে চারিটি বিভিন্ন পেশি আছে, যাহার অস্তিত্ব ইতিপূর্বে কেহই মনে করিতে পারেন নাই। একটি পেশির দ্বারা পাতা উপরের দিকে উঠে, আর একটির দ্বারা নীচের দিকে নামে, অন্য একটির দ্বারা ডান দিকে পাক খায় এবং চতুর্থ পেশির দ্বারা বাম দিকে ঘুরিয়া যায়।

ইহার প্রমাণ কি? প্রমাণ এই যে, পালক দ্বারা উপরেব পেশিটুকুতে সুড়সুড়ি দিলে পাতাটি উপরের দিকে উঠে এবং সেই ঊর্ধ্বগতি যন্ত্রের দ্বারা লিখিত হয়। এক নম্ববের বা চারি নম্বরের পেশিকে এইরূপে উত্তেজিত করিলে পাতাটি বামদিকে বা ডানদিকে পাক খায়, দুই নম্বর বা তিন নম্বরটিকে ওইরূপ উত্তেজিত করিলে পাতা নীচে নামে বা উপরে উঠিয়া যায়। সূর্যের আলো এইরূপে পেশির নানা অংশে নিক্ষেপ করিলে উক্তবিধ সাড়া পাওয়া যায়। তবে সূর্যের আলোক তো সব সময়ে পত্রমূলে পড়ে না, কারণ পাতার ছায়ায় পত্র মূলটি ঢাকা থাকে। লজ্জাবতীর বড় ডাঁটাটির সহিত চারিটি ছোট ডাঁটা সংযুক্ত এবং সেই ছোট ডাঁটার গায়ে অনেক ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র পাতা থাকে। আলো সেই ক্ষুদ্র পাতার উপরেই পড়ে। পড়িবামাত্রই দেখা যায় যে পাতা নড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। কিন্তু পাতার নড়াচড়া তো সেই দূরের স্কুল পেশির আকুঞ্চন প্রসারণ ভিন্ন হইতে পারে না। তবে ছোট পাতাগুলি অনুভব জনিত উত্তেজনায় কি সঙ্কেত কোনো পথ দিয়া দূরে পাঠাইয়া থাকে? এই বিষয়ে অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম যে চারিটি ছোট ডাঁটা হইতে পাতার মূল পর্যন্ত চারিটি স্নায়ুসূত্রে প্রসারিত। তাহা দ্বারাই খবরাখবর পৌঁছিয়া থাকে। এক নম্বরের ক্ষুদ্র পাতাগুলিকে কোনো রূপে উত্তেজিত করিলে একটি মাত্র সূত্র দিয়া পত্রমূলের একনম্বর পেশিতে উত্তেজনা প্রেরিত হয়, অমনি পাতাটি বাম দিকে পাক খাইয়া যায়। চারি নম্বরের পাতাগুলিকে ওইরূপে উত্তেজিত করিলে ডান দিকে পাক খায়। দুই নম্বরের পাতাগুলিকে উত্তেজিত করিলে বড় পাতাটি নীচের দিকে পড়ে। তিন নম্বরের ছোট পাতাগুলিকে উত্তেজিত করিলে উপরের দিকে উঠিয়া যায়। সুতরাং দেখা যায়, পাতার বাহির দিক হইতে ভিতরের দিকে হুকুম পাঠাইবার চারিটি রাশ আছে। কে সেই বলগা টানিয়া সঙ্কেত পাঠায়?

কেবল তাহাই নহে। কোনো নির্দিষ্ট দিকে চালিত করিবার জন্য একটি বলগা টানিলে তাহা সাধিত হয় না। নৌকার একটি দাঁড় টানিলে নৌকা কেবল ঘুরিতে থাকে। দিশাহীন তবে এক দিকের টান! অন্তত দুই দিকের দুইটি সমবেত টান দ্বারা গন্তব্য পথ নির্দিষ্ট হয়। এক সময়ে দুইটি দাঁড় টানা আবশ্যক।

পতঙ্গ আলোর দিকে ছুটিয়া যায়। তাহার দুইটি চক্ষুর উপর আলো পড়ে। প্রত্যেক চক্ষুর সহিত তাহার এক একটি পাখার সংযোগ। একটি চক্ষু অন্ধ হইলে সে আর আলোর দিকে যাইতে পারে না। এক দাঁড়ের নৌকার ন্যায় কেবল ঘুরিতে থাকে। যখন দুইটি চক্ষুর উপর আলো পড়ে, কেবল তখনই দুইটি ডানা একসঙ্গে একই বলে আন্দোলিত হয়, এবং সে সোজাপথে আলোর দিকে ধাবিত হয়। আলো যদি পাশে ঘুরাইয়া রাখা যায়, তাহা হইলে উহা কেবল একটি চক্ষুর উপর পড়ে, সেইজন্য একটি পাখা প্রবল বেগে স্পন্দিত হয় এবং পতঙ্গটি ঘুরিয়া যায়। ঘুরিয়া যখন সোজাসুজি আলোমুখীন হয় এবং আলো দুইটি চক্ষুর উপর সমান ভাবে পড়ে, তখন দুইটি পাখাই সমানভাবে একই শক্তিতে স্পন্দিত হইতে থাকে এবং পতঙ্গ তাহার অভীষ্ট লাভ করে জীবনে কিংবা মরণে!

দুইটি দাঁড়ের দ্বারা তরণী কেবল নদীবক্ষের উপরই গন্তব্য দিকে ধাবিত হইতে পারে। কিন্তু সর্ব-দিগ বিহারী জীব কখনও দক্ষিণে, কখনও বামে, কখনও ঊর্ধ্বে, কখনও বা আধোদিকে ধাবিত হইতে চাহে। এরূপ সর্বমুখী গতি নিরূপণ করিবার জন্য অন্তত চারিটি রশ্মির আবশ্যক।

লজ্জাবতী পাতার প্রতি কোষই আলোক ধরিবার ফাঁদ। সেই আলোর উত্তেজনা এক একটি স্নায়ুসূত্র ধরিয়া পত্রমূলের পেশিতে উপস্থিত হয়। যতক্ষণ না চারিটি ডাঁটার পত্র- সমষ্টি সমান ভাবে আলোকমুখীন হয়, ততক্ষণ চারিটি বলগার টানের ইতর বিশেষ হইয়া থাকে। পত্ররথ তখন দক্ষিণে, কিংবা বামে, ঊর্ধ্বে কিংবা নিম্নে চালিত হয়।

সবিতার রথ

সারথি তবে কে? দিবাকর নিজেকে, কোটি-কোটি অংশে বিভক্ত করিয়া ধরাপৃষ্ঠে অধিষ্ঠিত। জানালার ক্ষুদ্র রন্ধ্র দিয়া সূর্যদেবের শত-শত মূর্তি মেঝেব উপর দেখিতে পাই।

সবিতা তবে প্রতি পত্রকে তাঁহার রথরূপে গ্রহণ করেন। পত্রের চারিটি বলগা তাহারই হস্তে। অনন্ত আকাশ বাহিয়া সীমাহীন তাঁহার গতি। কিন্তু এই অসীম পথ প্রদক্ষিণ করিবার সময়ও ধূলিকণার ন্যায় এই পৃথিবী এবং তাহা হইতে উত্থিত ক্ষুদ্র লতার অতি ক্ষুদ্র পাতাটিরও আহ্বান উপেক্ষা করেন না। নিজের শক্তির দ্বারা প্রতি-জীব বিন্দুকে স্পন্দিত করেন এবং ক্ষুদ্র পাতাটির গতি নিরুপণ করিয়া থাকেন। জীবন ও জীবনের গতির মূলে সেই শক্তিই প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে।

সর্বভূতের চালক তুমি, তোমাব তেজোরশ্মিকে কে উদ্দীপ্ত রাখিতেছেন! 

কচুরিপানা

চুরিপানার (Water Hyacinth) উৎপাতে আমাদের বাংলা দেশের কৃষিকার্যের যে কী প্রকার অনিষ্ট হইতেছে তাহার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। কয়েক বৎসর পূর্বে পূর্ববঙ্গের স্থানে স্থানে এই পানা জন্মিয়া ধীরে-ধীরে বিস্তার লাভ করিতেছিল। ইহার দ্বারা যে কৃষিকার্যের বিঘ্ন হইবে, তখন লোকে তাহা কল্পনা করিতে পারে নাই। এখন পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ কৃষিযোগ্য ভূমিই এই পানায় আচ্ছন্ন হইয়া পড়িতেছে এবং উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গেরও স্থানে স্থানে ইহার উৎপাত অনুভূত হইতেছে। পূর্ববঙ্গের ভূমি উর্বরতার জন্য প্রসিদ্ধ, সেখানকার ভূমিতে সার দিতে হয় না; চাষের হাঙ্গামাও সেখানে খুব কম। তাই সেখানকার জমিতে সোনা ফলিয়া আসিতেছিল। কিন্তু কচুরিপানার উৎপাত যে প্রকারে বৎসরের পর বৎসর চলিতেছে, তাহাতে পূর্ববঙ্গের উর্বরতা যে আর অধিক দিন থাকিবে, তাহা আশা করা যায় না।

কচুরিপানার উৎপাত যে কেবল বঙ্গদেশেই আছে তাহা নহে, আমেরিকাতেও ইহার উৎপাত কম নয়। সেখানে আজও এই উৎপাত নিবারণ করা যায় নাই। ইহা শুনিয়া হয়তো কেহ কেহ বলিলেন-তবে আর কী, যাহাদের এত টাকা, এত আয়োজন, তাহারা যখন পানা নষ্ট করিতে পারিল না, তখন আমাদের চেষ্টা বৃথা। আমরা এই প্রকার উক্তির প্রতিবাদ করিয়া বলিতেছি, আমেরিকা পারিল না বা অপর কোনো দেশ পারিল না বলিয়া আমাদের নিশ্চেষ্ট হইয়া থাকিলে চলিবে না। রাজা ও প্রজা উভয় পক্ষকেই এই উৎপাত নিবারণের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতে হইবে। চেষ্টা ফলবতী হইবেই। এখানে একটি কথা স্মরণ করিতে হইবে, অতি প্রাচীনকালে যখন পৃথিবীতে কেবল উদ্ভিদেরই আধিপত্য ছিল, তখন আমাদেরই পূর্ব পুরুষেরা উদ্ভিদের উচ্ছেদ-সাধন করিয়া অরণ্য ভূমিকে কৃষিক্ষেত্র করিয়া তুলিয়াছিলেন। তখন অরণ্য মানুষের নিকট পরাজয় স্বীকার করিয়াছিল। সুযোগ বুঝিয়া এইক্ষণে উদ্ভিদেরই এক বংশধর মাথা চাড়া দিয়া আজ আবার আধিপত্য বিস্তার করিতে চেষ্টা করিতেছে। মানুষের হাতে অস্ত্রের তো অভাব নাই। উদ্ভিদের সহিত মানুষের এইপ্রকার সংগ্রাম চিরকালই চলিবে। কোনো প্রাণী বা কোনো উদ্ভিদ নিজের বংশ বিস্তার করিয়া সমস্ত পৃথিবীতে দখল করিয়া বসুক ইহা প্রাকৃতিক নিয়ম বিরুদ্ধ। তাই কোন জীব যাহাতে পৃথিবীতে একাধিপত্য স্থাপন করিতে না পারে তাহার জন্য প্রকৃতিতে অনেক ব্যবস্থা আছে। প্রথমত পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতিকূলতায় অনেক জীর মারা যায়। তাহার পরে এক জাতীয় জীব আর এক জাতির সহিত প্রতিযোগিতা করিতে গিয়াও ধ্বংসের পথে অগ্রসর হয়। এই প্রকারে দেখা যায়, মানুষের সহিত পশুর এবং প্রাণীর সহিত উদ্ভিদের নিয়তই সংগ্রাম চলে। ইহার ফলে যে জীব যতই অধিকার পাইবার যোগ্য তাহা আপনা হইতেই পায়। যদি কোনো কারণে কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের দ্রুত বংশ বিস্তারের কোনো বাধা না থাকে, তবে তাহাই হইয়া দাঁড়ায় উৎপাত। অস্ট্রেলিয়াতে খরগোস ছিল না। কয়েক বৎসর পূর্বে সেখানে এক জোড়া খরগোশ ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছিল। এই ক্ষুদ্র জন্তুর বংশবিস্তারে অস্ট্রেলিযাতে এখন এত খরগোশ হইয়া দাঁড়াইয়াছে, যে তাহাদের উৎপাতে কৃষিকার্যের ক্ষতির আশঙ্কা হইতেছে। কোনো এক খেয়ালি লোক ইংলন্ড হইতে এক জোড়া পোকা সংগ্রহ করিয়া আমেরিকায় ছাড়িয়া দিয়াছিলেন, পোকাগুলি নাকি দেখিতে সুন্দর ছিল। অনুকূল অবস্থা পাইয়া সেই পোকাদের বংশধরগুলি এখন আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে ভয়ানক বিস্তার লাভ করিয়াছে। তাহাদের উপদ্রবে মূল্যবান পাইন গাছ লোপ পাইতে বসিয়াছে। ইহাকেই বলে উৎপাত। আমাদের দেশে কচুরিপানাও কতকটা এই বকমেরই উৎপাত হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

আমাদের শৈশব উপাখ্যানের রাজপুত্র ও পাত্রের পুত্র সেই প্রকাণ্ড রাক্ষসটাকে বহু চেষ্টাতেও বিনষ্ট করিতে পারে নাই, কারণ রাক্ষসটার প্রাণপুরুষ ছিল চৌদ্দ হাত জলের তলায় স্ফটিক-স্তম্ভের ভিতরে লুকানো। আমাদের ও অন্য দেশের রাজপুরুষেরা কচুরিপানা বিনাশের জন্য যে সকল চেষ্টা করিতেছেন, তাহা রাজপুত্রের রাক্ষস বিনাশের চেষ্টার মতোই বৃথা হইয়া যাইতেছে। কারণ ইহারা কেহই জানেন না পানা রাক্ষসীর প্রাণপুরুষটা কোথায় লুকানো আছে। এইজন্য লক্ষ্য স্থির না করিয়া লক্ষ্য ভেদের চেষ্টার ন্যায় ইহাদের সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হইতেছে। কচুরিপানার জীবনের ইতিহাস পরীক্ষা করিয়া, কী প্রকারে তাহারা বংশ বিস্তার করে এবং কোন অবস্থা তাহাদের বৃদ্ধির অনুকূল, এই সকল তথ্য প্রথমে সংগ্রহ করা কর্তব্য। এই সকল তথ্য আজও সংগৃহীত হয় নাই। তাই পানা বিনাশের জন্য যে সকল উপায় অবলম্বন করা হইতেছে, সেগুলি অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার ন্যায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হইতেছে। অবৈজ্ঞানিক জনসাধারণ প্রায়ই বিজ্ঞানকে যাদুবিদ্যার কোঠায় ফেলিয়া থাকেন। তাঁহার! যখন কোনো প্রাকৃতিকে উৎপাতে ভীত হইয়া পড়েন, তখন মনে করেন বুঝি বিজ্ঞানই, মন্ত্রবলে উৎপাতের শান্তি করিবে। স্বার্থান্বেষী চতুর লোকেরা সুযোগ ছাড়ে না। তাহারা বৈজ্ঞানিক সাজিয়া নানা আড়ম্ববে জনসাধারণকে প্রতারিত করিয়া স্বার্থসিদ্ধ করে। লোকে ভাবে ইহাই বুঝি বৈজ্ঞানিক প্রণালী। কোনো অজ্ঞাত ব্যাপারের মূল কথা জানিয়া কার্য করিতে গেলে এই ভড়ং পরিত্যাগ না করিলে চলে না। ভড়ং করা বা ভড়ং দেখিয়া মুগ্ধ হওয়া বৈজ্ঞানিক রীতি নয়। যিনি প্রকৃত বৈজ্ঞানিক, তিনি অনুসন্ধানের বাহ্য শাখা-প্রশাখাগুলির প্রতি দৃষ্টিপাত না করিয়া তাহার মূল কোথায় তাহাই দেখিবার জন্য অবিরাম চেষ্টা করেন। কত অবাস্তব ব্যাপার চক্ষুর সম্মুখে আসিয়া তাঁহাকে বিপথগামী করিতে চেষ্টা করে তাহার ইয়ত্তাই হয় না। যে বৈজ্ঞানিক এই সকল অবান্তর ব্যাপারের কুহক কাটাইয়া সোজা পথটি ধরিয়া চলিতে পারেন, তিনিই মূলতত্ত্ব আবিষ্কারে কৃতকার্য হন। আবিষ্কার মাত্রেরই ইহাই মূলমন্ত্র। গাছের রস কী প্রকারে তাহাদের দেহের ভিতর দিয়া উপরের দিকে প্রবাহিত হয়, তাহা এ পর্যন্ত উদ্ভিদবিদ্যার একটি প্রকাণ্ড সমস্যা হইয়া ছিল। পূর্বোক্ত পন্থা অবলম্বন করিয়াই আমি দীর্ঘ কুড়ি বৎসর অবিরাম চেষ্টার পর এখন রস প্রবাহের মূল কারণ জানিতে পারিয়াছি। অবান্তর ব্যাপারগুলিকে ঠেলিয়া ফেলিয়া লক্ষ্য নির্ণয় করা এবং পরে সেই লক্ষ্য পথে অগ্রসর হওয়া আবিষ্কারের মূলসূত্র।

কচুরিপানার গাছটি কীরূপ এখন তাহার আলোচনা করা যাউক। গঙ্গার তীরে সিজবেড়িয়া নামক স্থানের একটি খালে নিবিড় পানা আছে। গাছগুলি কখন কখন দুই হাত পর্যন্ত উচ্চ হয় এবং স্থানে স্থানে সেগুলি এমন নিবিড় ভাবে জলভাগ আচ্ছন্ন করিয়া রাখে যে পানার উপর দিয়া মানুষও হাটিয়া চলিতে পারে। একটি বিচ্ছিন্ন কচুরিপানার গাছ দেখিলে বুঝিতে পারিবেন পাতা সমেত গাছটি যত উচ্চ তাহার শিকড় প্রায় সেইরূপ দীর্ঘ। এক একটি গাছে কখনও কখনও দেড় শতেরও অধিক শিকড় থাকে। কেবল ইহাই নয়, এই পানাগুলি আবার জলের তলায় লতাইয়া চলে এবং ইহাতে তাহাদের বংশ বিস্তার লাভ করে। কিন্তু কচুরি বংশ বিস্তারের ইহাই একমাত্র উপায় নয়। এ সম্বন্ধে আমরা পরে আলোচনা করিব। কচুরিপানার পাতার ডাঁটাগুলিও অদ্ভুত,- সে গুলি ফাঁপা ধরনের, তাই জলে ভাসে।

যাহা প্রত্যক্ষ এবং যাহা হঠাৎ চক্ষুগোচর হয়, মানুষের মন সর্বাগ্রে সেই দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু এই রকমে মনকে বিক্ষিপ্ত করার বিপদ অনেক। ইহাতে আসল কথা চাপা পড়িয়া যায়। বৈজ্ঞানিকেরা বাঁধা নিয়মে কচুরিপানা সম্বন্ধে যে গবেষণা করিয়াছেন, তাহাতে আসলকে ঠেলিয়া ঝুটাকে লইয়াই মারামারি করিয়াছেন। পানার চকচকে পাতা ও ফুলগুলি তাঁহাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল। তাই তাঁহারা সেইগুলি নষ্ট করিতে ব্যস্ত হইয়াছিলেন। ইহাতে পাতা ও ফুল নষ্ট হইয়াছিল কিন্তু গাছ মরে নাই। গাছগুলি যে লম্বা শিকড় চালাইয়া জলের তলা হইতে খাদ্য সংগ্রহ করে তাহা ইহাদের নজরে পড়ে নাই। এই শিকড়গুলিই গাছগুলিকে জীবিত রাখিয়াছিল।

পুষ্করিণী হইতে পানা উঠাইয়া ফেলিলে দেখা যায়, কয়েক মাসের মধ্যে ধীরে- ধীরে তাহা আবার পানায় আচ্ছন্ন হইয়া পড়ে। যে দুই-চারিটা শিকড় জলের তলায় থাকিয়া যায়, সেইগুলিই নূতন পাতার উৎপত্তি করে। জলের ভিতরকার শিকড় নষ্ট করিতে না পারিলে এই শত্রুর বিনাশ নাই। যাঁহারা পানা নষ্ট করিবার জন্য নানা উপায়ে অবলম্বন করেন, তাহাদিগকে এই কথাটি বিশেষভাবে স্মরণ রাখিতে অনুরোধ করিতেছি। কচুরিপানার একটি ক্ষুদ্র শিকড় হাজার হাজার নূতন গাছের সৃষ্টি করিয়া দশবিঘা স্থানকে কয়েক মাসের মধ্যে আচ্ছন্ন করিতে পারে।

এখন কচুরিপানা বিনাশের উপায় কী, তাহার আলোচনা করা যাউক। এ সম্বন্ধে চিন্তা করিলে চারিটি উপায়ের কথা মনে হয়,-

(১) পানার গায়ে ছত্রক জাতীয় (Fungal Parasites) পরাসক্ত জন্মাইয়া তাহাদিগকে

নষ্ট করা।

(২) উত্তপ্ত জলীয়বাষ্প প্রয়োগ করা।

(৩) পানার গায়ে বিষময় দ্রব্য সেচন করা।

(৪) পানাগুলিকে জল হইতে উঠাইয়া নষ্ট করা।

প্রথম উপায় সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলা কঠিন। বিষস্য বিষমৌষধম্ কথাটা সব জায়গায় খাটে না। পানা মারিবার জন্য যে ছত্রকের আমদানি করা হইবে, তাহা ধান, পাট বা অপর গাছের যে ক্ষতি করিবে না, ইহা বলা যায় না। একটা উদাহরণ দিই। সাপ মারিবার জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিস্ অঞ্চলে ভারতবর্ষ হইতে বেজিব আমদানি করা হইয়াছিল। ইহাতে সাপের উপদ্রব কমে নাই, কিন্তু বেজিদের উৎপাতে লোকের হাঁস বা অপর পাখি পোষা দায় হইয়াছে। কাজেই সেখানে এক উপদ্রবের শান্তি করিতে গিয়া আর এক নূতন উপদ্রবকে ডাকিয়া আনা হইয়াছে। পানা মাবিবার জন্য ছত্রকের আমদানি করিলে এই প্রকার বিপদের সম্ভাবনা আছে।

আমেরিকা বিজ্ঞানে খুবই উন্নতি দেখাইয়াছে। আমেরিকার ফ্রাঙ্কলিন বৈদ্যুতিক আবিষ্কারের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। তা ছাড়া ল্যাঙলে আকাশযান উদ্ভাবন করিয়া প্রসিদ্ধ হইয়াছেন। কিন্তু অন্যান্য দেশের ন্যায় আমেরিকাতে ঝুটা বিজ্ঞানের আড়ম্বরে আসল বিজ্ঞান চাপা পড়িতে বসিয়াছে। ইউনাইটেড স্টেট্সে কচুরিপানা নষ্ট করিবার জন্য জলীয়বাষ্প প্রস্তুত করিয়া তাহা নলের সাহায্যে গরম গরম পানার গায়ে লাগানো হইয়াছে। পানা নষ্ট করার এই পদ্ধতির প্রশংসা খববের কাগজে অনেক পড়া গিয়াছে। বহু ব্যয়ে বর্মাতেও এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হইয়াছিল। কিন্তু কোনো স্থানেই সুফল পাওয়া যায় নাই। গরম জলীয় বাষ্প নলের মুখ হইতে বাহির হইয়া কেবল পাতাগুলোকে ছিঁড়িয়া এবং বিবর্ণ করিয়া নষ্ট করিয়াছিল মাত্র, গাছকে মারিতে পারে নাই। আশা ছিল, এই বিফলতা কর্তৃপক্ষকে ভগ্নোৎসাহ করিবে, তাহারা আর জলীয় বাষ্প দিয়া পানা নষ্ট করিবার পক্ষপাতী হইবেন না। কিন্তু তাঁহাদের উৎসাহ অদম্য; সাধারণ উপায়ে গরম জলীয়বাষ্প দ্বারা পানা মরিল না দেখিয়া তাঁহাঁরা কলকারখানা বসাইয়া যতদূর সম্ভব চাপ প্রয়োগে অত্যুষ্ণ জলীয়বাষ্প পানাগাছের উপর প্রয়োগ করিতে লাগিলেন।

ইহারও ফল পূর্ববৎ হইল, পানা মরিল না। আমাদের দেশেও পানা মারার এই অভিনয় অনুকৃত হইযাছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এই প্রকার একটা বৃহৎ আয়োজনে হাত দিবার পূর্বে কত উষ্ণতায় পানা পুড়িয়া মরে তাহার কেহই অনুসন্ধান করিলেন না।

জখম হইলে গাছের পাতা ও ডাল প্রভৃতির অবস্থান্তর ঘটে। দেখিলেই মনে হয় বুঝি গাছটি মরিয়া গিয়াছে। কিন্তু এগুলি সত্যই মৃত্যুর লক্ষণ নয়। গাছের প্রকৃত মৃত্যুর লক্ষণ লইয়া বসুবিজ্ঞান মন্দিরে গবেষণা হইয়া গিয়াছে। কোন্ গাছ জীবিত অবস্থা ছাড়িয়া ঠিক কোন সময়ে মৃত্যুর কোঠায় পা দিল, তাহাও বৈদ্যুতিক উপায়ে সেখানে নিরূপিত হইয়াছে। কচুরিপানা মৃত্যুলেখ যন্ত্রের (Death Recorder) আধারস্থ জলে ডুবাইয়া রাখিয়া জলের উষ্ণতা ধীরে-ধীরে বর্ধিত করা হইয়াছিল। যখন জলের উষ্ণতা সেন্টিগ্রেডের ৬০ অংশ (অর্থাৎ ফারেনহাইটের ১৪০ অংশ) হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, তখন যন্ত্রে পানার মৃত্যুরেখা অঙ্কিত হইয়া পড়িয়াছিল। কচুরিপানা ১৪০ অংশ উত্তাপ দ্বারাই মরিয়া থাকে, তাহা পানা নাশকারী সরকারি কর্মচারীরা জানিতেন না। তাঁহারা যে জলীয়বাষ্প দিয়া পানা নাশ করিতে গিয়া অজস্র অর্থ নাশ করিয়াছেন তাহা উষ্ণতার অভাবে হয় নাই। তাহার কারণ বাষ্প দ্বারা জলের নীচের শিকড় বিনষ্ট হয় নাই। কাজেই উপরকার পাতাগুলি ঝলসাইয়া গেলেও পানা মরে নাই। মৃত্যুকালে যেমন প্রাণীদের সর্বাঙ্গে আক্ষেপ দেখা যায়, উদ্ভিদের মৃত্যু সময়েও ঠিক সেইপ্রকার আক্ষেপের লক্ষণ প্রকাশ পায়। গাছের বৃদ্ধি নষ্ট করে এমন অনেক বিষপদার্থ আমাদের জানা আছে। বিষ মিশ্রিত জল পিচকারির মতো কোনো যন্ত্র দ্বারা পানার গায়ে ছিটাইয়া দিবার ব্যবস্থা আমেরিকায় হইয়াছিল। কিন্তু এই ব্যবস্থাতেও সুফল পাওয়া যায় নাই। নিবিড় পাতার আবরণ ভেদ করিয়া বিষজল গাছের সর্বাঙ্গ সিক্ত করিতে পারে নাই। সিক্ত করিলেও বিষ শিকড়ে প্রবেশ করিতে পারে নাই।

বিষ প্রয়োগের বৈজ্ঞানিক দিকটা আলোচনা করিয়া দেখা যাউক। আমরা পূর্বে দেখিয়াছি, গরম জলীয়বাষ্প পানার পাতাই ঝলসাইয়াছিল, ইহাতে পাতা মরিয়াছিল, কিন্তু জলের তলার শিকড় মরে নাই, কাজেই গাছও মরে নাই। এখন প্রশ্ন হইতে পারে, গাছের পাতায় বিষজল ছিটাইয়া দিলে তাহাতে উহার শিকড় মরিবে কি? সর্বপ্রথম এই প্রশ্নটার মীমাংসা করা উচিত ছিল। কিন্তু তাহা না করিয়া ডগায় বিষ লাগাইলে তাহা গোড়ায় গিয়া পৌঁছিবে, ইহা অনুমান করিয়া কর্তৃপক্ষেরা বিষজল ছিটাইয়া পানা মারিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। "বসুবিজ্ঞান মন্দিরে" এ সম্বন্ধে অনেক গবেষণা হইয়া গিয়াছে। কী প্রকারে উদ্ভিদের দেহের ভিতর দিয়া রস প্রবাহ চলাচল করে তাহা ওই সকল গবেষণার ফলে স্পষ্ট জানা গিয়াছে। এখন সকলেই জানিয়াছেন, উদ্ভিদের প্রয়োগ করিলে, তাহা উহার ভিতরকার রসপ্রবাহের সহিত নীচু হইতে উপর দিকে চলে, বিষ উপর হইতে নিচু দিকে ছুটিয়া আসিতেছে, ইহা কখনও ঘটে না। সুতরাং বুঝিতে হইবে, বিষ দিয়া পানা মারিতে হইলে বিষজল পানার শিকড়ে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এই মোটা কথাটি না জানার জন্য যে সময় ও অর্থের অপব্যয় হইয়াছে তাহা একান্ত শোচনীয়। পূর্বে যে কথাগুলি বলিলাম, তাহা আমরা অনুমানের উপরে নির্ভর করিয়া বলি নাই। পরীক্ষাতে উক্তিগুলির সত্যতা সম্পূর্ণ প্রমাণিত হইয়াছে। শিকড়ে বিষজল প্রয়োগ করিলে তাহা রসপ্রবাহের সহিত উপরকার সর্বাঙ্গে ছড়ায়।

তাই গাছটির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নীচের দিক হইতে মরিতে আরম্ভ করে। বিষ প্রয়োগে কেবল যে কচুরিপানারই এই প্রকারে মৃত্যু ঘটে তাই নয়। একটি সতেজ চন্দ্রমল্লিকার গাছের মূলে বিষ প্রয়োগ করিলে রসের সহিত গোড়ার বিষ উপরের সর্বাঙ্গে ব্যাপ্ত হইয়া গাছটিকে মারিয়া ফেলে।

গাছের গোড়ায় বিষ প্রয়োগ না করিয়া তাহা আগায় লাগাইলে কি হয়, এখন দেখা যাক। আগায় বিষজল ছিটাইয়াই কচুরিপানা মারিবার চেষ্টা হইয়াছিল। লোহা বা অপর ধাতব বস্তুর আগা গরম করিলে ক্রমে তাহার গোড়া গরম হইয়া পড়ে। উদ্ভিদের দেহের ভিতর দিয়া বিষ এই প্রকারে প্রবাহিত হয় কি? আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, হয় না। প্রত্যক্ষ পরীক্ষাতেও আমাদের এই উক্তির সত্যতা প্রমাণিত হয়। কচুরিপানার একটি ডাঁটা সমেত পাতাকে বিষজলের ভিতরে ডুবাইয়া রাখা হইয়াছিল। তাহাতে দেখা গিয়াছিল বিষ নীচের দিকে নামে নাই-যে পাতাটি বিষের সংস্পর্শে আসিয়াছিল কেবল তাহাই মরিয়া বিবর্ণ হইয়াছিল। কেবল কচুরিপানাতেই যে ইহা দেখা যায়, তাহা নহে, চন্দ্রমল্লিকার একটা ডাঁটাকে ঠিক ওই প্রকারে বিষের সংস্পর্শে রাখিয়া অবিকল ওই ফলই পাওয়া গিয়াছিল।

আম্বুরা এ পর্যন্ত যে আলোচনা করিলাম তাহা হইতে বুঝা যাইবে, কচুরিপানার বিনাশকে লোকে যে একটা মহাসমস্যা বলিয়া মনে করিয়া আসিতেছিল এখন তাহা মনে করার হেতু নাই। পাতা, ফুল বা ফল নষ্ট করিলে ইহা মরিবে না। শিকড় দিয়া ইহারা বংশ বিস্তার করে-সেই শিকড়গুলিকে নষ্ট করার চেষ্টাই এখনকার কর্তব্য। আমরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অনুসন্ধান করিয়া যাহা জানিতে পারিয়াছি, তাহাতে আমাদের গভর্নমেন্ট সাবধান হইতে পারিবেন। আশা করি, সাধারণের অর্থ আর মিথ্যা আড়ম্বরে ব্যয়িত হইবে না।

কি করিয়া পানা বিনাশের কাজ আবস্ত করা উচিত ইহা বোধ হয় অনেকে জানিতে চাহেন। আমার এসম্বন্ধে এই মত যে কচুরিপানা জল হইতে সংগ্রহ করিয়া নষ্ট কবাই আমাদের এখনকার কর্তব্য। ইহাতে খরচপত্র আছে জানি, কিন্তু এই খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় অল্পই হইবার কথা। তা ছাড়া এই শ্রম ও অর্থব্যয় বৃথা হইবে না। দেশের টাকা প্রজাদেব সাহায্যেই ব্যয়িত হইবে। কচুরিপানা নষ্ট হইলে কৃষিকার্যে যে লাভ হইবে তাহার তুলনায় এই ব্যয় অতি সামান্য। একই সময়ে সকলের সমবেত চেষ্টায় এক একটি স্থান একবারে পানা বর্জিত করিতে হইবে। নচেৎ কাছাকাছি জায়গা হইতে পানা আসিয়া পরিষ্কৃত স্থান আবার আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিবে। কচুরিপানা যে কি সর্বনাশ করিতেছে কৃষিজীবীরা তাহা বুঝিয়াছেন এবং ইহা বুঝিয়া যাহাতে সকলে বাধ্য হইয়া একত্র পানানাশের চেষ্টা করিতে পারেন, তাহার জন্য আইন জারির প্রার্থনা করিতেছেন। আইন মাত্রেই কঠিন ও নির্মম। কিন্তু যাহাতে আইনের অপব্যবহার না হয়, তাহার জন্য যে সতর্কতা অবলম্বন একেবারে অসম্ভব, তাহা বলিতে পারি না। প্রথম কয়েক বৎসর ইহা আমাদের শিক্ষাদানের কাজ করিবে। সকলে একত্র খাটিয়া পরস্পরের উপকার করিবার পথ মুক্ত করিতেছি এই ভাবটি মনে বদ্ধমূল করাকে শিক্ষাই বলিতে হয়। এই শিক্ষাতেই রাষ্ট্রীয় কার্যভার গ্রহণের যোগ্যতা লাভ করা যায়। যাহা হউক, রাজা ও প্রজার সমবেত চেষ্টাতেই ভবিষ্যতে উৎপাতের শান্তি হইবে।

'বসু বিজ্ঞান মন্দিরে' অনেক গুরুতর গবেষণা চলিতেছিল। সেই কার্য বন্ধ রাখিয়া আমরা কচুরিপানা সম্বন্ধে গবেষণায নিযুক্ত হইয়াছিলাম। এখন আমরা আমাদের নির্দিষ্ট কার্যে যোগ দিব। কচুরিপানা সম্বন্ধে গবেষণা আজও শেষ হয় নাই, শেষ কবিতে হইলে কয়েকজন ব্যক্তিকে এই কার্যে নিযুক্ত করিতে হইবে। তাহাদিগকে এই উদ্ভিদের জীবনের খুঁটিনাটি সকল ব্যাপারের ইতিহাস সংগ্রহ করিতে হইবে এবং তাহাবা কী প্রকারে বংশবিস্তার করে তাহা আরও ভালো করিয়া অনুসন্ধান করিতে হইবে। তাহার পরে দেখিতে হইবে কচুরিপানাগুলিকে জল হইতে উঠাইয়া আমাদের কোনো লাভজনক কার্যে ব্যবহার করিতে পারা যায় কিনা। এই প্রকারে ব্যবহার করা সম্ভবপর হইতে পারে; তাহা হইলে পানা তুলিবার খরচা উহাতে আদায় হইয়া যাইবে। যাহারা এই সকল অনুসন্ধানের কার্যে নিযুক্ত হইবেন, তাহাদের সত্যই সে সম্বন্ধে যোগ্যতা আছে কিনা তাহা সর্বাগ্রে দেখার প্রয়োজন হইবে। এই ব্যাপারে নিযুক্ত ব্যক্তিদের কেবল বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকেই প্রাধান্য দিলে চলিবে না। সুবিবেচনা করিয়া হাতেকলমে কাজ করিবার দক্ষতা ইহাদের থাকা চাই। তাহা ছাড়া যাহাতে নির্দিষ্ট সময়ান্তে তাঁহাদের গবেষণার কার্যবিবরণী প্রকাশিত হয়, তাহার ব্যবস্থাও রাখিতে হইবে। জনসাধারণ ও বিশেষজ্ঞেরা ইহাতে তাঁহাদের কার্য কোন্ পথে চলিতেছে জানিতে পারিবেন এবং কার্যের সমালোচনা করিবারও সুযোগ পাইবেন। সম্প্রতি একজন সহকারী বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি কল্পনা করিতেছেন, কচুরিপানাকে কাগজ প্রস্তুতের মুখ্য উপাদান স্বরূপে নাকি ব্যবহার করিতে পারা যায়। যে কোনো উদ্ভিজ বস্তুকে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় কাগজ প্রস্তুতের উপাদান করিয়া তোলা কঠিন নয়। 

এই প্রক্রিয়ার খরচা উঠাইয়া সেই উপাদানে এখনকার মতো সস্তায় কাগজ বিক্রয় করা সম্ভব হইবে কিনা, ইহা সর্বাগ্রে দেখা কর্তব্য। তাহা না করিলে সাধারণের চক্ষে ধূলি দেওয়া হয়। কিছুদিন পূর্বে আর একটি জনরব শুনিয়াছিলাম, কোনো বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি নাকি আর কতগুলি উদ্ভিজ সামগ্রীকে লাভজনক কার্যে ব্যবহার করিবার উপায় আবিষ্কার করিয়াছেন। আজকাল আর তাহার কথা শুনিতে পাই না।

যাহা হউক, কচুরিপানা আমাদিগকে যে বিপদের সম্মুখীন করিয়াছে তাহা সামান্য নয়। ঘোর বিপদের সময়েই লোকে একত্র হয় এবং একত্র হইয়া বিপদ নিবারণের চেষ্টা করে এবং বিপদই যে মনুষ্যত্বকে জাগাইয়া তুলিয়া কাজে লাগায় তাহার আভাস তখন তাহারা প্রত্যক্ষ করে। এই মনুষ্যত্বই বিপদের সহিত সংগ্রাম করিয়া তাহাকে খর্ব করে এবং শেষে জয়ী হয়। অতীত যুগে এই মানুষই বহু বাধাবিঘ্ন জয় করিয়া এই পৃথিবীকে শ্যামল শসাক্ষেত্রে ঢাকিয়া ফেলিয়াছিল এবং তাহাতে সোনার ফসল ফলাইয়াছিল। আজ আবার সেই মানুষকেই আলস্য ত্যাগ করিয়া কর্মপটু ও মিতব্যয়ী হইয়া এবং পরস্পরের সহিত মিলিয়া যাহা সমস্ত মানবের অকল্যাণ তাহার বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে হইবে। তাহাতে অকল্যাণ দূর হইবে এবং সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে দণ্ডায়মান হইবার বল সঞ্চিত হইবে।

5
Articles
জগদীশচন্দ্র সেরা রচনা সম্ভার
0.0
শ্রী জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা কিছু উল্লেযোগ্য অবিস্মরণীয় কাহিনী নিয়ে রচিত একটি অব্যক্ত জীবন প্রসারিত রচনা কাহিনী সমগ্র।
1

প্রসঙ্গ জগদীশচন্দ্র

24 December 2023
0
0
0

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসু রতবর্ষের প্রাচীন গৌরবের কথা উত্থাপিত হইলে আমরা সচরাচর আর্য ঋষিগণের ধর্মোন্নতি এবং আর্য মনীষীগণের দার্শনিক জ্ঞানের কথাই ভাবিয়া থাকি। সংস্কৃত ব্যাকরণ, কাব্

2

অন্যান্য রচনা

25 December 2023
0
0
0

উদ্ভিদের হৃৎস্পন্দন [ গত এক বৎসরের মধ্যে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে উদ্ভিদজীবনের ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে তিনটি গূঢ় রহস্য উৎঘাটিত হইয়াছে। এই আবিষ্কার সমগ্র বৈজ্ঞানিক জগৎকে চমৎকৃত করিয়াছে। গতমাসে দার্জিলিং-এর গভনম

3

ভ্রমণ বিষয়ক রচনা

25 December 2023
0
0
0

লুপ্ত নগরী ই 'টালির দক্ষিণ প্রদেশ অতি রমণীয়, সমস্ত প্রদেশটি যেন একটি উদ্যান। এইরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সচরাচর দেখা যায় না। রোমানরা এই প্রদেশে সমুদ্রের উপকূলে সমৃদ্ধিশালী নগর নির্মাণ করিয়া অবকাশের সময়

4

বিবিধ রচনা

26 December 2023
0
0
0

নাদির শা-র শাস্তি ই তিহাস পাঠ করিলে ভারতভূমি যে প্রকৃতই রত্নগর্ভা তাহাতে আর সন্দেহ থাকে না। ধনধান্যের জন্য আমাদের এই মাতৃভূমি বহুকাল হইতে পৃথিবীর অন্যান্য জাতিদের প্রলোভনের বস্তু হইয়া যায়। গ্রিক দেশী

5

বক্তৃতাবলী

26 December 2023
0
0
0

ছাত্রসমাজের প্রতি* ছাত্রসমাজের সভ্যগণ, তোমাদের সাদর সম্ভাষণে আমি আপনাকে অনুগৃহীত মনে করিতেছি। তোমবা আমাকে একান্ত বিজ্ঞ এবং প্রবীণ মনে করিতেছ। বাস্তবপক্ষে যদিও জরা আমার বাহিরের অবয়বকে আক্রমণ করিয়াছে

---