shabd-logo

ভ্রমণ বিষয়ক রচনা

25 December 2023

0 Viewed 0

লুপ্ত নগরী

ই 'টালির দক্ষিণ প্রদেশ অতি রমণীয়, সমস্ত প্রদেশটি যেন একটি উদ্যান। এইরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সচরাচর দেখা যায় না।

রোমানরা এই প্রদেশে সমুদ্রের উপকূলে সমৃদ্ধিশালী নগর নির্মাণ করিয়া অবকাশের সময় সে স্থানে আমোদপ্রমোদ করিতে আগমন করিত। এইসব নগরের মধ্যে হেরাক্লিয়াম এবং পম্পেই বিশেষ সমৃদ্ধিশালী ছিল।

ভিসুভিয়স্ পর্বত ইহাদের অতি সন্নিহিত; এই পর্বত হইতে কোন বিপদ ঘটিতে পারে, লোকে এরূপ আশঙ্কা করে নাই। তাহারা নির্ভয়ে তাহার চারিপার্শ্বে সুন্দর ফুলফলপূর্ণ বাগান ও সুশোভন বাসস্থান নির্মাণ করিয়া বাস করিতেছিল। ইতিমধ্যে হঠাৎ একদিন ভিসুভিয়স্ অগ্নিবৃষ্টি করিয়া অল্প সময়ের মধ্যে এই দুইটি নগরী পৃথিবী হইতে মুছিয়া লইল!

৭৯ খ্রিঃ অব্দে ২৩ আগস্ট তারিখে প্রথম ভূমিকম্প হইতে আরম্ভ হয়, ভূমিকম্প সাধারণ ঘটনা বলিয়া অধিবাসীরা কিছু মনে করে নাই। পূর্ববৎ সব কার্যই চলিতে লাগিল। রাত্রে নাট্যশালাতে গীতবাদ্য হইতেছে, অতি প্রকাণ্ড আম্পিথিয়েটারে সিংহ ও মানুষে লড়াই হইবে। দর্শকে আমোদভবন পূর্ণ, সকলেই আমোদে মত্ত! এমন সময়ে অকস্মাৎ ভিসুভিয়সের শিখর হইতে অগ্নিশিখা জ্বলিয়া উঠিল। মুহূর্তে আকাশ অগ্নিময় হইয়া গেল! বজ্রধ্বনিতে পৃথিবী পুনঃপুনঃ কম্পিত হইতে লাগিল। ভিসুভিয়াসের গহ্বর হইতে অগণ্য জ্বলন্ত

প্রস্তুর চতুর্দিকে নিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল, তারপর উত্তপ্ত কর্দমবৃষ্টি, তারপর ভস্মবৃষ্টি।

নগরবাসীরা হঠাৎ বজ্রধ্বনি ও অগ্নিপাতে ভীত হইয়া যে যেখানে পারিল পলাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কোথায় পুত্র, কোথায় কন্যা, কোথায় স্ত্রী সকলে ভীতস্বরে ডাকাডাকি করিতে লাগিল। বাহিরে অন্ধকার, তাড়াতাড়ি প্রদীপ জ্বালিয়া রাস্তায় বাহির হইল, কিন্তু হায়! যে আলোকের সাহায্যে তাঁহারা পলায়ন করিবে ভাবিয়াছিল, সে আলোক ভস্মপাতে নিবিয়া গেল। তখন লোক স্রোতে বিচ্ছিন্ন হইয়া তাহারা পথ ভুলিয়া অন্ধকারে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। কেবল যখন ভিসুভিয়সের অগ্নিশিখায় মুহূর্তের জন্য দিক আলোকিত হইতেছিল, তখন সকলে পরস্পরকে দেখিতে পাইতেছিল। তখন তাহারা বুঝিতে পারিতেছিল, যাহাদের লইয়া একত্রে বাহির হইয়াছিল, তাহারা কোথায় হারাইয়া গিয়াছে। কাতর আহ্বানে কেহ আর প্রিয়জনের উত্তর পাইল না।

ক্রমে লোকেরা ক্লান্ত ও হতাশ্বাস হইয়া অবসন্ন হইয়া পড়িল-তখনও ভস্ম পতনের

বিরাম নাই। স্তরে স্তরে ভগ্নস্তূপ উন্নত হইয়া পলাতকদিগের আপাদমস্তক প্রোথিত করিল। পলাতকদের তো এই ভীষণ পরিণাম। কেবল কয়েকজন পলায়ন করিতে চেষ্টা করে নাই,-নগরের রোমান প্রহরীরা নগর রক্ষাতে নিযুক্ত ছিল, তাহাদের নির্দিষ্ট স্থান ত্যাগ করিবার আদেশ পায় নাই। সুতরাং স্বস্থানে সশস্ত্রে দণ্ডায়মান রহিল। প্রায় দুই সহস্র বৎসর পর তাহাদের প্রস্তুরমূর্তিবৎ নিশ্চল দেহ পাওয়া গিয়াছে।

শত শত বৎসর পূর্বে এই নগর দুইটির চিহ্ন বিলুপ্ত হইয়াছিল। ইহাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত লোকে ভুলিয়া গিয়াছিল। খনন করিতে করিতে দৈবাৎ প্রোথিত গৃহের চিহ্ন বাহির হইয়া পড়ে। তখন হইতে ইটালিয় গভর্নমেন্ট নিয়মিতরূপে খনন করিয়া ভস্ম ও কর্দমের স্তূপ পরিষ্কার করিয়াছেন। দুই সহস্র বৎসর পূর্বের নগর এখন মনুষ্যগোচর হইয়াছে।

নেপলস্ হইতে আমরা পম্পেই দেখিতে যাই, কী আশ্চর্য! দুই সহস্র বৎসর ইহার উপর দিয়া গিয়াছে, তবু মনে হয় না, ইহা এত পুরাতন। এই যে রাস্তা দিয়া চলিতেছি এই রাস্তায় সহস্রাধিক বৎসর পূর্বের গাড়ির চাকার দাগ স্পষ্ট রহিয়াছে। বৃষ্টি হইলে রাস্তায় জল জমিত, জুতা যাহাতে না ভিজিয়া যাইতে পাবে, সেজন্য রাস্তার মাঝে মাঝে পাথর বসানো ছিল, এখনও সেই পাথরগুলি যথাস্থানে রহিয়াছে,

রাস্তার পাশ দিয়া জলের পাইপের নলগুলি এখনও দেখা যাইতেছে।

পূর্বে বলিয়াছি, ভস্মচাপে অনেক জীবন্তই সমাহিত হইয়াছিল। তাহাদের দেহ ভম্মে আবৃত হইয়া এতকাল অবিকৃত অবস্থায় রক্ষিত ছিল। একটি গৃহে অনেকগুলি মৃতদেহ দেখিলাম। তাহা দেখিয়া সেই দুর্দিনের ঘটনা যেন চক্ষের সম্মুখে দেখিতে পাইলাম। এই যে পুরুষটি দেখিতেছ, সে একান্ত ক্লান্ত ও অবসন্ন হইয়া উপুড় হইয়া পড়িয়াছিল, হাত তুলিয়া ভস্মপাত হইতে নিজেকে রক্ষা করিবার জন্য বৃথা চেষ্টা করিয়াছিল। তাহার নিকটেই একটি কুকুর যেন যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্ করিতেছে।

নগরের একস্থানে দেখিলাম, রন্ধন-গৃহ হইতে পাচক বাহির হইতে পারে নাই, সে সেস্থানেই রহিয়াছে-উনানে রন্ধনের বস্তু রহিয়াছে, কেবল একটু পুড়িয়া গিয়াছে। রুটিখানি পর্যন্ত যেমন তেমনি রহিয়াছে। অন্যস্থানে একটি স্ত্রীলোক হস্তে অলঙ্কারের বাক্স লইয়া পালাইবার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু ছাদ চাপা পড়িয়া রহিয়াছে। স্কুলের ছাত্র সঙ্গীদিগকে বিদ্রুপ করিয়া প্রাচীরে কি লিখিয়াছিল, সে লেখা এখনও স্পষ্ট রহিয়াছে। রাস্তায় "আমার জন্য ভোট দাও” এরূপ প্রার্থনা আছে। একটি বাড়িতে প্রবেশ করিলাম, সম্মুখে বাহির-বাড়ি, তারপর বৈঠকখানার, আহারের গৃহ, শয়ন গৃহ, পূজার গৃহ, রন্ধন গৃহ। বৈঠকখানার প্রাচীরে নানাপ্রকার চিত্র, আজ পর্যন্ত সে চিত্রের বর্ণ ম্লান হয় নাই। ভাণ্ডার গৃহে জালায় শস্য রক্ষিত হইত সে জালাগুলি তেমনিই আছে!

ঘরের প্রদীপ আমাদের দেশের মাটির প্রদীপের ন্যায়, প্রদীপদানগুলিও সেইরূপ। বাড়ির পশ্চাতে বাগান।

সে কালের থিয়েটার দেখিতে গেলাম, বসিবার বেঞ্চগুলি পাথরের। স্ত্রীলোকের বসিবার জন্য স্থান স্বতন্ত্র ও প্রবেশদ্বার স্বতন্ত্র; থিয়েটারের অনতিদূরেই সৈন্যগার। চারিজন সৈন্য কি অপরাধে কারাগারে বন্দি ছিল। দেওয়াল সংলগ্ন লৌহশৃঙ্খলে তাহাদের পদ আবদ্ধ ছিল, সেই হতভাগ্যদের কঙ্কাল সেইরূপে শৃঙ্খলিত অবস্থাতেই পাওয়া গিয়াছে।

। তারপর রোমানদের স্নানাগারগুলি দেখিতে গেলাম। তাহাদের স্নান করিবার বিশেষ আড়ম্বর ছিল, কখনও কখনও তাহারা দিনের মধ্যে সাতবার পর্যন্ত স্নান করিত। অনেকে সমস্ত দিন এখানে কাটাইত। স্নানাগারের সর্বপ্রথমে একটি বৈঠকখানা গৃহ, এই গৃহে শহরের যে স্থানে যে আমোদ প্রমোদ হইত; তাহার বিজ্ঞাপন থাকিত। স্নানাগারে স্নানের বিভিন্ন প্রকার সরঞ্জাম। এক ঘরে মার্বেলের কৃত্রিম জলাশয়ে শীতল জল পূর্ণ থাকিত, অন্য ঘরে উষ্ণবাষ্প- স্নানের বন্দোবস্ত। স্নানাগারের নিকটেই ব্যায়াম-গৃহ। এই সকল দেখিয়া আমরা সেকা।েএ এক ডাক্তারে গৃহ দেখিতে গেলাম। এই গৃহে অস্ত্রচিকিৎসার বিবিধ অস্ত্র পাওয়া গিয়াছে; সেইসব অস্ত্র এখনকার অস্ত্র হইতে কোন অংশে হীন নহে।

তারপর যেখানে বাজার বসিত সে স্থান দেখিতে গেলাম। এখানে দোকানির দাঁড়িপাল্লা, নানা রকমের অলঙ্কার। বেশভূষার দ্রব্যাদি, পাশা খেলার সরঞ্জাম, এমনকী থিয়েটারের টিকিট পর্যন্ত পাওয়া গিয়াছে। নগরের অনেক অংশ এখনও মাটির নীচে, প্রত্যহ খনন করিতে করিতে নূতন গৃহ বাহির হইতেছে। যেস্থানে খনন হইতেছে আমরা সেস্থানে অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া দেখিলাম। মজুরেরা ভস্মস্তূপ অতি সাবধানে খনন করিয়া দূরে ফেলিতেছে, ছাদ হইতে আবস্তু করিয়া নীচের দিকে অগ্রসর হইতেছে, প্রথমে প্রাচীরের একটু চিহ্ন দেখা যায়, তারপর ক্রমে ক্রমে সমস্ত গৃহ বাহির হইতে থাকে। একে একে গৃহস্থালীর দ্রব্য, বাসনপত্র, অলঙ্কার, এমনকি গৃহস্বামীকে পর্যন্ত পাওয়া যাইতেছে। একস্থানে গৃহস্বামী কুড়ালী দ্বারা দরজা ভাঙ্গিয়া পালাইবার চেষ্টা করিতেছিল-তাহার কঙ্কালের সম্মুখে কুড়ালী পাওয়া গিয়াছে।

আমরা সমস্তদিন পর্যটন করিয়া এই লুপ্ত নগরী দেখিলাম। সন্ধ্যা হইলে ক্ষণিক কাল একটি উচ্চস্থানে বসিয়া নগরটি শেষবার দেখিয়া লইলাম। অদূরে ভিসুভিয়সের শিখর হইতে ধূম উত্থিত হইতেছিল। আমাদের সম্মুখে সমস্ত নগরীটি প্রসারিত। এই স্থান হইতে সমস্ত পথগুলি দেখা যাইতেছিল। রাস্তার দুধারে গৃহশ্রেণি, অট্টালিকা ও মন্দির দেখিতে পাইতেছিলাম। কিন্তু রাজপথে লোক সমাগম নাই। ছেলেবেলা গল্পে এক রাজার দেশের কথা শুনিয়াছিলাম। সে রাজ্যে অশ্বশালায় অশ্ব, হাতীশালে হাতী, রাজগৃহে রাজপুত্র ও রাজকন্যা রহিয়াছে, কিন্তু সকলেই মৃত। তখন সেই গল্পের কথা মনে হইল। মনে হইতে লাগিল, যাহা দেখিতেছি, সবই যেন কল্পনা। এরূপ নিশ্চল, এরূপ জীবনহীন, এরূপ মনুষ্যহীন দেশ কেবল গল্পেই শুনা যায়। কিন্তু হঠাৎ এই পম্পেইর একটি দৃশ্যের কথা মনে হইল। একটি গৃহ ক্রমে ক্রমে ভম্মে ঢাকিয়া যাইতেছিল সেই গৃহে একটি নারী দুহাতে তাহার শিশুটিকে উচ্চে ধরিতে গিয়াছিল। ভস্মস্তূপ ক্রমে-ক্রমে উন্নত হইয়া দুঃখিনী মাতাকে নিমজ্জিত করিতেছিল কিন্তু সেই অগ্নির প্রসার হইতে শিশুকে রক্ষা করিতে হইবে। জ্বলন্ত ভস্মস্তূপ তিল-তিল করিয়া দগ্ধ করিয়াও জননীকে একেবারে অবসন্ন করিতে পারে নাই; কি যেন এক মহাশক্তি, দুঃসহ যন্ত্রণা দমন করিয়া রাখিয়াছিল। মাতার হস্তদুইটি মৃত্যু-যন্ত্রণাতে অবশ হইয়া পড়ে নাই। দুই সহস্র বৎসর পরে সেই উদ্ধোত্থিত করপুটে সন্তানটিকে পাওয়া গিয়াছে। সেই মাতার স্নেহস্পর্শে যেন অতীত বর্তমানের সহিত মিলিয়া গেল। একই দুঃখে, একই স্নেহে, একই মমতায় সেকাল ও একাল, পূর্ব ও পশ্চিম যেন বান্ধা পড়িল। তখন পম্পেইর মৃত রাজা সঞ্জীবিত হইয়া উঠিল, এবং রাজপথ আমার চক্ষে অকস্মাৎ লোকজনে পূর্ণ হইল। 



আগ্নেয়গিরি দর্শন

আমরা মরা রোম নগর দর্শন করিয়া ইটালির পশ্চিম উপকূলে স্থিত নেপস্ শহরে উপস্থিত হইলাম। নেপস্ সমুদ্রতীরে স্থিত। এরূপ সুন্দর শহর ইউরোপে। আর নাই। আমরা যেস্থানে ছিলাম তাহার সম্মুখেই সমুদ্র। ঘোর নীল জলরাশির উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৌকা পাল ভরে যাইতেছে। অনতিদূরে কেপ্রি দ্বীপ।

দুই সহস্র বৎসর পূর্বে রোমের ধনী লোকেরা ইহার নিকটবর্তী স্থানে সুন্দর-সুন্দর উদ্যান ও প্রমোদ ভবন প্রস্তুত করিয়াছিলেন, এখনও তাহা নেপল্সের সৌন্দর্যবৃদ্ধি করিতেছে। নেপস্ শহর এখনও নানাবিধ আমোদপ্রমোদ এবং জনকোলাহলে পরিপূর্ণ। কিন্তু অদূরেই ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি এই সুখের মধ্যে মৃত্যুর বিভীষিকা দেখাইতেছে। আমরা একদিন প্রত্যুষে ভিসুভিয়স দেখিতে রওনা হইলাম। ভিসুভিয়স নেপস্ হইতে ৫ মাইল দূরে অবস্থিত; চারি হাজার ফিট উচ্চ।

আমরা ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়া আগ্নেয়গিরির পাদদেশে উপস্থিত হইলাম; এস্থানের দৃশ্য অতি ভয়ানক। আগ্নেয়গিরি হইতে গলিত প্রস্তরের ঢেউ আসিয়া চারিদিক ঢাকিয়াছে। এখন সেই ঢেউগুলি জমিয়া গিয়াছে বটে, কিন্তু স্থানে স্থানে পাথরগুলি হইতে এখনও ধূম উঠিতেছে। পূর্বে এস্থান হইতে উপরে উঠিতে অশ্বপৃষ্ঠে বা পদব্রজে যাইতে হইত, বন্ধুর পথ ও আগ্নেয়গিরির ভস্মের উপর দিয়া যাইতে অত্যন্ত কষ্ট হইত এবং প্রায় একটি দিন লাগিত। এখন একপ্রকার নূতন ফিউনিকিউলার বা তারের রেল হওয়াতে আধ ঘণ্টার মধ্যে উপরে উঠা যায়।

এক এক গাড়িতে বারোজন লোক বসিতে পারে; এইরূপ একখানা গাড়ি উপরে যায় আর একখানা নীচে আসে। পাহাড়ের গা দিয়া সোজাসুজি উপরে উঠিতে ভয় হয়, তার ছিঁড়িয়া গেলে কি ভয়ানক অবস্থা হয় বুঝিতে পারো। এই গাড়ি যেখানে থামে, সেখান হইতে অগ্নিকুণ্ড পর্যন্ত হাঁটিয়া যাইতে হয়, সে প্রায় ৫/৭ মিনিটের পথ।

একে তো ভস্মের উপর পা দিয়া স্থির রাখা দুষ্কর, তাহাতে আবার আমরা যেদিন গিয়াছিলাম, সেদিন প্রবল বেগে ঝড় বহিতেছিল, আমাদের দাঁড়াইয়া থাকাই দুঃসাধ্য মনে হইতেছিল। বাতাস এরূপ ঠান্ডা, যে হাত, পা ও মুখ একেবারে অবশ হইয়া যাইতে লাগিল।

বহুদিনের আকাঙিক্ষত এই স্থান দর্শন করিতে আসিয়া সুখের পরিবর্তে আমার কষ্টই বোধ হইতে লাগিল! একদিকে আমার সঙ্গী অন্যদিকে আমাদের পথপ্রদর্শক সজোরে আমার হাত ধরিয়া উপরে না লইয়া গেলে, আমার অগ্নিকুণ্ড দেখাই হইত না। অনেক দেশ দেখিয়াছি, অনেক পাহাড়ে উঠিয়াছি এবং অনেক ভ্রমণ ক্লেশ সহ্য করিয়াছি, কিন্তু এই ক্ষুদ্র পাহাড় দেখিবার ক্লেশ চিরদিন স্মরণে থাকিবে। ইতালিয় গভর্নমেন্টের আদেশে এখানে কয়েকজন পথপ্রদর্শক নিযুক্ত আছে, তাহাদের সঙ্গে অগ্নিকুণ্ড দেখিতে যাইবার আদেশ। পথপ্রদর্শকদিগকে সঙ্গে না লইয়া কেহ উঠিতে পারে না। তাহার কারণ এই যে কয়েক বৎসর পূর্বে দুইজন আমেরিকান ভ্রমণকারী কাহাকেও সঙ্গে না লইয়া গহ্বর দেখিতে গিয়া অগ্নিকুণ্ডে পড়িয়া প্রাণ

হারাইয়াছিলেন। আমরা অতি কষ্টে উঠিয়া দেখিলাম, উপরে গহ্বর হইতে গন্ধকের ধূম উঠিতেছে, এক স্থান দিয়া গলিত গন্ধক স্রোত বহিয়া যাইতেছে। আমরা যখন দেখিতে যাই, তখন আগ্নেয়গিরি নিস্তেজ ছিল, তথাপি গন্ধকের ধূমে চারিদিক আচ্ছন্ন ছিল। আঠারোশত বৎসর পূর্বে এই নিদ্রিত গিরি একবার অকস্মাৎ জাগিয়া উঠিয়াছিল। সেই ভয়ানক অগ্নিবৃষ্টিতে সাতটি নগর পৃথিবী হইতে বিলুপ্ত হইয়া যায়।




লন্ডনের গল্প

খন লন্ডনের কথা না জানে এমন লোক অতি অল্পই আছে। পূর্বে যেখানে যাইতে একমাস লাগিত, এখন সেস্থানে ১৬ দিনে যাওয়া যায়। এখন আর বিলাতকে বেশিদূর বলিয়া মনে হয় না, জাহাজ এবং রেল হওয়াতে অত দূরবর্তী স্থানও আমাদের সন্নিকট হইয়াছে।

জাহাজে চড়িয়াই ইংরাজের শৃঙ্খলা ও কার্যকুশলতার শত পরিচয় পাইয়াছিলাম। একটি ছোটখাটো রাজপুরীর ন্যায় সুসজ্জিত জাহাজ শতশত প্রাণী বক্ষে করিয়া, দিনরাত্রি অবিশ্রান্ত চলিয়া অতল সমুদ্র লঙ্ঘন করিতেছে, দেখিলে শতমুখে মানুষের বুদ্ধির প্রশংসা করিতে হয়। সাতশত লোক জাহাজে বাস করিতেছে, অথচ ঠিকসময়ে স্নান আহারাদি সমুদয় চলিতেছে। জাহাজের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক কুঠুবী, এক একটিতে তিন চারি জনের শয়ন করিবার বন্দোবস্ত আছে। তিন-চারি শত লোকের একসঙ্গে আহার করিবার গৃহ, বৈঠকখানা (Drawing room) প্রভৃতি সুন্দর মখমলে সাজানো। টবের মধ্যে ফুলগাছ এইসব গৃহের শোভা বৃদ্ধি করিতেছে। সাত শত লোকের আহার্য ও আবশ্যকীয় সমুদয় দ্রব্যই জাহাজে থাকে। চারি পাঁচ দিন অন্তর কোন বন্দরে জাহাজ আসিলে, কেবল ইঞ্জিনের কয়লা ও আহারের জন্য খাদ্যসামগ্রী লওয়া হয়।

ইংরাজরা জাহাজে নানা প্রকার খেলা ও আমোদে সময় কাটান। সেখানেও ক্রিকেট খেলা, তীর ছোঁড়া, কইটস্ প্রভৃতির সুবন্দোবস্ত আছে। কখনও কখনও মাশুলের উপর বোতল রাখিয়া, বন্দুক ছুঁড়িয়া তাহা ভাঙিবার চেষ্টা করা হয়। এই সকল খেলাতে আবার জাহাজের কর্মচারীদের সহিত জাহাজের আরোহীগণের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। রাত্রে নানাপ্রকার ঐকতানিক বাদ্য সঙ্গীত, আবৃত্তি, নাচ প্রভৃতি হইয়া থাকে। তাহা ছাড়া জাহাজের গতি লইয়াও আন্দোলনের বিরাম নাই। প্রতিদিন জাহাজ কতটা অগ্রসর হয়, তাহা জানিবার জন্য সকলেই ব্যস্ত। গন্তব্যস্থানে পৌঁছিবার পূর্বে যাঁহারা যাঁহারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উচ্চস্থান অধিকার করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে চাঁদা করিয়া প্রাইজ দেওয়া হয়।

ইংরাজ জাতির কাজের সময় যেমন একাগ্রতা, খেলার মধ্যে সেইরূপ একাগ্রতা ও উৎসাহ। তাঁহারা যেখানেই যান যাহাই করুন শারীরিক ব্যায়াম ও আমোদপ্রমোদ কখনই পরিত্যাগ করেন না।

জাহাজ হইতে নামিয়া স্টেশনের মতো এখানে গোলমাল চিৎকার কিছুই নাই। এখানেও নিঃশব্দে কলের মতো কাজ চলিতেছে। আমরা জিনিসপত্র নামাইলাম, একজন মুটে আসিয়া সেগুলি একটা টানা গাড়িতে চাপাইয়া বাহিরে লইয়া গেল এবং যে গাড়ীখানি সম্মুখে ছিল তাহাতে চাপাইয়া দিয়া নিজের পয়সা লইয়া চলিয়া গেল। আমরা আমাদের গন্তব্যস্থান নির্দেশ করিয়া গাড়িতে উঠিয়া বসিলাম। ভাড়াটে গাড়িগুলি সারি সারি রহিয়াছে, যেখানা আগে, তাহারই আগে ভাড়া হইতেছে, এ স্থানেও কোনো গোলমাল নাই।

লন্ডন শহরে সমুদয় কার্যেই এরূপ নিয়ম ও শৃঙ্খলা দেখিলাম, রাস্তায় অসংখ্য গাড়িঘোড়া, লোকজন, বাইসিকল, ছোট ছেলেদের গিরাম্বুলেটার, এবং বৈদ্যুতিক গাড়ি যাতায়াত করিতেছে। প্রথমে এত জনতা দেখিয়া গাড়িতে উঠিতে আমার ভয় হইত। সর্বদাই মনে হইত কোনো দুর্ঘটনা না হয়। কিন্তু সকলেই নিয়ম রক্ষা করিয়া চলেন বলিয়া, দুর্ঘটনা খুব অল্পই ঘটে। গাড়ি চালাইবার যে নিয়ম আছে, সে নিয়ম ভঙ্গ করিবার কাহারও সাধ্য নাই, রাস্তায় জনতা তোমরা কল্পনা করিতে পার না। এত গাড়িঘোড়া যাতায়াত করে, যে সময় সময় চৌরাস্তার মোড় ভিন্ন অন্য স্থান দিয়া রাস্তার অপর পারে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। আমি কতবার এইরূপ রাস্তা পার হইতে গিয়া বিপদে পড়িয়াছি।

চৌরাস্তার মোড়ে পার হইবার বেশ সুবিধা। সে স্থানে সর্বদাই একজন পুলিশ থাকে। পাঁচ ছয় জন লোক একত্র হইবামাত্র সে তাহার এক হাত তুলিয়া অঙ্গুলি ঊর্ধ্বে নির্দেশ করিয়া থাকে। অমনি যত গাড়িঘোড়া মুহূর্তের মধ্যে থামিয়া যায়। উভয় পার্শ্বেই লোক সরিয়া গেলে, পুলিসের লোক হাত নামাইবামাত্র গাড়িঘোড়া পূর্ববৎ চলিতে থাকে। আমি পুলিশের লোকের এই অঙ্গুলি নির্দেশের শক্তি দেখিয়া বিশেষ বিস্মিত হইয়াছিলাম। কথা নাই, বার্তা নাই, অঙ্গুলি সঙ্কেত দেখিবামাত্র শত-শত গাড়ি থামিয়া যাইতেছে, স্বয়ং মহারানির গাড়ি পর্যন্ত এই সংকেতের আজ্ঞা পালন করিতে বাধ্য। সাধারণের যাতায়াতের অসুবিধার জন্য কত অগ্নিবাস ও ট্রামগাড়ি আছে, তথাপি লন্ডনের রাস্তায় লোকজনের ভীড় কমে না। মাটির নীচে সুড়ঙ্গ প্রস্তুত করিয়া রেলের রাস্তা করা হইয়াছে। প্রতি পাঁচ মিনিটে রেলের গাড়ি চলে, তাহাতেও অসংখ্য লোক যাতায়াত করিতেছে, ইহা হইতেই লন্ডনের জনতার কতক পরিচয় পাইবে।

লন্ডন শহরের জাকজমক দেখিয়া আশ্চর্য বোধ হয়। মনে হয় ইংরেজ জাতি সমস্ত পৃথিবী হইতে ধন আহরণ করিয়া এই রাজনগরে সঞ্চয় করিয়া রাখিযাছেন।

ইংরাজকে বেনে বণিকের জাত অথবা দোকানির জাত বলে, একথা সত্য; কারণ এমন সুসজ্জিত দোকানশ্রেণি আর কোথাও দেখা যায় না। সব দোকানেই আয়নার দরজা, সুতরাং তাহার ভিতর দিয়া সমুদয় দেখা যায়। এই সকল দোকান দেখিয়া জিনিস কিনিতে যাহার লোভ না হয় সে মানুষ নহে। প্রতি রাস্তায় কত গহনার দোকান, কত পরিচ্ছদের দোকাĮ, কত মনোহারী জিনিসের দোকান, ঔষধের দোকান, ফুলের দোকান, তাহার সংখ্যা নাই। তাহা ছাড়া চা খাইবাব জন্য এবং আহারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হোটেলও আছে। ফলফুলের দোকানের শোভা ও পরিচ্ছন্নতা বর্ণনা করিতে পারি না। মাছের দোকানগুলিতেও একটুকু গন্ধ নাই, নানাপ্রকার মাছ সুন্দর মার্বেল পাথরের উপর বরফে রক্ষিত।

ইংরাজ জাতি যে সৌন্দর্যের সেবক তাহা সকল কার্যেই দেখিতে পাইলাম। গৃহপালিত পশুপক্ষী প্রভৃতির প্রতি ইহাদের অত্যন্ত যত্ন। কঙ্কালসার জন্তু সে দেশে আমি কখনও দেখি নাই, ঘোড়া, গরু, গাধা, ভেড়া প্রভৃতি সব জন্তু দেখিতে সুশ্রী ও হৃষ্টপুষ্ট। পশুপক্ষী প্রভৃতি গৃহপালিত জন্তুরা সেখানে সন্তানবৎ প্রতিপালিত হয়। আমাদের ইডেন গার্ডেনের ন্যায় লন্ডনের অনেকগুলি উদ্যান আছে। তাহাতে কত সুন্দর সুন্দর পশুপক্ষী প্রতিপালিত হয়। অপরাহ্নে বালক বালিকারা সেই সকল উদ্যানে বেড়াইতে গিয়া, ইহাদিগকে নানাপ্রকার খাদ্যদ্রব্য খাইতে দেয়। উদ্যানস্থ সরোবরে ক্ষুদ্র জাহাজ ভাসাইয়া বালক-বালিকারা নানাপ্রকার খেলা করিয়া থাকে।

দুই প্রহরের সময় এই সকল বাগানে এক অপরূপ দৃশ্য হয়। তখন বালক-বালিকাদের সহিত অতি বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদের সম্মিলন হইয়া থাকে। একদিকে যেমন ঠেলাগাড়িতে ক্ষুদ্র শিশুরা বেড়াইতে আসে, অপর দিকে তেমনই অতি বৃদ্ধ বৃদ্ধারাও ঠেলাগাড়িতে এইসময় বায়ু সেবন করিতে বাহির হয়।

লন্ডনে দেখিবার ও শিখিবার অনেক জিনিস আছে,-কত প্রকার মিউজিয়ম, কত প্রকার পাঠাগার ও লাইব্রেরি, কত প্রকার চিত্রলীলা, গানবাদ্যের জন্য কত প্রকার হল, বড় বড় লোকের কত স্মৃতিচিহ্ন, জাতীয় জীবন উপযোগী কতপ্রকার পুরাতন স্মৃতিপূর্ণ গৃহ। এক একটি স্থান দেখিতে একদিন করিয়া যায়। এই সকল স্থানের বর্ণনা করা সম্ভব নহে, তবে "ব্রিটিশ মিউজিয়াম", "ন্যাশনাল গ্যালারি", ও "ওয়েস্টমিনিস্টার এবি", এই তিনটি স্থানের নাম না করিয়া লণ্ডনের কথা শেষ করা যায় না। ব্রিটিশ মিউজিয়াম নামক পুস্তকাগারে পৃথিবীর অতি পুরাতন ও বহুমূল্য পুস্তক সকল রক্ষিত হয়। তাহা ছাড়া নানা ভাষার প্রধান পুস্তক এমনকী, বঙ্গভাষায় প্রধান পুস্তকও এখানে পাওয়া যায়।

ন্যাশনাল গ্যালারি বা জাতীয় চিত্রশালাতে বহু ব্যয়ে ইংরাজ চিত্রকরদিগের চিত্রগুলি রক্ষিত হইয়াছে।

ওয়েস্টমিনিস্টার এবি-এখানে ইংরাজ রাজত্বের আরম্ভ হইতে এ পর্যন্ত যত রাজা ও যত বীরগণ জন্মিয়াছিলেন, তাঁহাদের সমাধিস্তন্ত ও স্মৃতিচিহ্ন স্থাপিত আছে।

ওয়েস্ট মিনিস্টার এবি

মাদের মধ্যে যাহারা বয়সে বড়, তাহারা হয়তো কবি লংফেলোর জীবনসঙ্গীত নিম্নের লাইন কয়টি পড়িয়াছ-

Lives of great man all remind us.

We can make our lives sublime; And departing, leave behind us

Footprints on the sands of time. আমার ওয়েস্টমিনিস্টার এবি দেখিয়া স্মরণ হইল, আজ এক বৎসর হইল এ স্থানটি

দেখিয়াছি, কিন্তু সেই প্রশস্ত ও গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃশ্য আজও আমার হৃদয়ে জাগিতেছে। এই প্রকাণ্ড সমাধিমন্দির দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম, যে দেশের মহত্বের এরূপ সম্মান, সে দেশে মহৎ চরিত্র গঠিত হওয়া কিছুই আশ্চর্যের বিষয় নহে।

এই সীমাবদ্ধ স্থানটির মধ্যে ইংলন্ডের সমস্ত রাজাদের সমাধি বা স্মৃতিস্তম্ভ, মহাকবি, লেখক, বহুমনীষী সম্পন্ন রাজনীতিজ্ঞ, মন্ত্রীবাগ্মী; ধর্মবীর এক কথায় গত আট নয় শতাব্দীর বিখ্যাত ইংল্যান্ডবাসীদের দেহাবশেষ এই মহা সমাধিক্ষেত্রে রক্ষিত হইয়াছে। ইংরেজ বালকদিগের অল্পবয়স হইতে এই সকল স্মৃতি চিহ্ন দেখিয়া, হৃদয়ে মহত্বের অনুকরণ স্পৃহা হওয়া স্বাভাবিক। বিদেশবাসী হইয়াও এই স্থান দর্শন করিয়া আমার শরীর রোমাঞ্চিত হইল। যদি ইংরেজ হইতাম, তবে এ স্থান দর্শন করিয়া, জন্মভূমির জন্য আমারও অনুরাগ বৃদ্ধি হইত তাহার সন্দেহ নাই, মহৎ ব্যক্তিদিগের জীবন সীমাবদ্ধ নহে। তাঁহাদের কীর্তি অনন্তকাল জীবিত থাকিয়া স্বদেশবাসীর হৃদয়কে সঞ্জীবিত করে।

আমাদের দেশেও কি মহৎলোক জন্মগ্রহণ করেন নাই? করিয়াছেন বটে, কিন্তু তাঁহাদের মহত্ব আমরা প্রকৃতপক্ষে পূজা বা অনুকরণ করিতে শিখি নাই।

আমাদের দোষেই তাহারা মৃত। কিন্তু এই ওয়েস্টমিনিস্টার এবিতে শতশত অমরগণ এখনও বিচরণ করিতেছেন এবং তাঁহাদের প্রিয় দেশবাসীদের অন্তরে প্রবেশ করিয়া পুনর্জন্ম লাভ করিতেছেন।

ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ইহার শতশত প্রমাণ পাওয়া যায়। যে উইম্বারফোর্স বিদেশবাসীর জন্য জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন, তাঁহার লুপ্ত জীবন ব্রাইটি, ব্রল ও ব্রসেটের জীবনে পুনর্জীবিত দেখা যায়।

এখন আমরা যে ওয়েস্টমিনিস্টার দেখি পূর্বে ইহা একটি অসামান্য মন্দির মাত্র ছিল। ইতিহাসে কথিত আছে, যে ইংলণ্ডের ভূতপূর্ব রাজা এডওয়ার্ড দি কনফেসারের সময় পুরাতন মন্দিরের স্থানে বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়। এড়ওয়ার্ড যখন নর্মান্ডি দেশে নির্বাসিত ছিলেন, তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, যে পুরাতন রাজ্য প্রাপ্ত হইলে, রোমে সেন্টপিটারের মন্দিরে তীর্থ করিতে যাইবেন। এই প্রতিজ্ঞা পালনের সময় আসিলে, প্রধান পুরোহিত পোপ তাঁহাকে অব্যাহতি দিয়া তৎপরিবর্তে ইংলন্ডে সেন্টপিটারের নামে এক মন্দির নির্মাণ করিতে আদেশ করেন। প্রবাদ এই যে, এওয়ার্ড স্বপ্নে সেন্টপিটারের নিকট হইতে এই স্থানে মন্দিরের নির্মাণের আদেশ পান। সে যাহা হউক ১০৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি পুরাতন মন্দিরটির নিকট নূতন একটি মন্দির নির্মাণ করিলেন। তারপর ইংলন্ডে নানাবিধ অন্তর্বিপ্লব হওয়াতে কোনো রাজাই ইহার উন্নতির প্রতি দৃষ্টিক্ষেপ করেন নাই। তৃতীয় হেরির সময় রাজ্যে কতকটা শান্তি স্থাপন হওয়াতে, তিনি এই মন্দিরের শোভা বৃদ্ধি করিতে যত্নশীল হন।

সেইসময় হইতে ভিন্ন-ভিন্ন প্রণালীর স্থপতি কার্যের সমাবেশ দেখা যায়। সেই সকল কারুকার্যের বর্ণনা অসম্ভব। স্থানে-স্থানে এইরূপ কৌশল প্রদর্শিত হইয়াছে যে, সে সকল দর্শন করিয়া হৃদয় মহানভাবে পূর্ণ হয়, এবং মনে হয় প্রতিযুগের শিল্পীগণ হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ ভাবগুলিকে যেন মূর্তিমতী করিয়া এই স্থানকে পরমেশ্বরের অর্চনার উপযোগী করিযাছেন।

ইংলন্ডে কত কত উপাসনা মন্দির আছে, কিন্তু তথাপি বহুদূর হইতে লোকে এই পুরাতন স্মৃতিপূর্ণ মন্দিরে ঈশ্বরের উপাসনা করিতে আসিতেছেন। রাজ্ঞী এলিজাবেথের সময় এই মন্দিরের সংসৃষ্টে একটি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়; এখনও তাহা চলিতেছে। পূর্বে এই মন্দিরে রোমান ক্যাথলিক পুরোহিতরা বাস করিতেন, এখন সেই সকল স্থান শূন্য হইয়া রহিয়াছে। কারণ এলিজাবেথের সময় হইতে প্রটেস্টান্টদের উপর ইহার সম্পূর্ণ ভাব অর্পিত হয়, এখন তাঁহারাই এবি সংলগ্ন গৃহে বাস করেন। কেবল যে, মহাপুরুষের সমাধি ক্ষেত্র বলিয়া এবি প্রসিদ্ধ তাহা নহে। পৃথিবীব কোনো মন্দিরেই এরূপ পার্থিব ও অপার্থিব ভাবের সমাবেশ দেখা যায় না। বহুশতাব্দী পূর্বে এ স্থান রাজনৈতিক ও ধর্মসম্প্রদায়ের তুমুল আন্দোলনের ক্ষেত্র ছিল। আবার এই পার্থিব মন্দিরের আশ্রযে কত পলায়নপর রাজকুমার এবং যোদ্ধা লুক্কায়িত থাকিতেন। এই স্থানে মহাসমারোহে রাজ্যাভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন হইয়া থাকে। কয়েকজন রাজার বিবাহও এই স্থানেই হইয়াছে, আবার এই স্থানেই তাঁহাদের অনন্ত নিদ্রা- ক্ষেত্র।

আমরা প্রধান দ্বার দিয়া প্রবেশ করিয়া প্রথমেই বর্তমান উপাসনালয়ে উপস্থিত হইলাম; ইহারও চতুর্দিকে স্মৃতিস্তম্ভ, মধ্যস্থলে পুরোহিতের জন্য উচ্চ বেদী; তারপর তিন-চারিশত লোকের বসিবার উপযুক্ত আসন, পশ্চাতে সঙ্গীতের জন্য প্রকাণ্ড অর্গাণ যন্ত্র ও গায়কদের বসিবার স্থান। ইহার অদূরে ক্যানিং-ওয়ারেন হেষ্টিংস্ প্রভৃতি ইংরেজ-সাম্রাজ্য বিস্তারে সাহায্যকারী ইংরেজদের স্মৃতিস্তম্ভ দেখিলাম। একটু অগ্রসর হইয়া আমরা কবিদিগের সমাধিক্ষেত্রে উপস্থিত হইলাম। ইংরাজিতে এই স্থানকে Pocts Corridor বলে। এ স্থানেই নাকি এবি দর্শকেরা সর্বাপেক্ষা অধিক সময় যাপন করেন, তাহা আশ্চর্য নহে। কারণ অন্যান্য বীরদিগের কীর্তি স্মরণ করিয়া আমাদের হৃদয় বিপ্লব পূর্ণ হয়, কিন্তু কবিদিগের স্মৃতিস্তম্ভ দেখিয়া মনে হয় যে, আমাদের অনেকদিনের পরিচিত বন্ধুদিগের সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছে। এখানে চসার হইতে আরম্ভ করিয়া টেনিসন পর্যন্ত প্রধান কবিদিগের সমাধিক্ষেত্র দেখিলাম। এ স্থান হইতে আমরা সপ্তম হেনরির মন্দিরে প্রবেশ করিলাম। ইহা এবির সর্বোকৃষ্ট মন্দির, ইহা নির্মাণ করিয়া সপ্তম হেনরি ইংলন্ডে চিরস্মরণীয় হইয়াছেন। এখানে রাজ্যাভিষেকের অতি পুরাতন আসন রক্ষিত আছে, এখনও সেই আসন ব্যবহৃত হয়। কিয়দ্দূরে রাজা জনের লিখিত মেগ্লাকার্টা (magnacharta) দেখিলাম।

এ স্থানে অন্যান্য যে সকল স্মৃতিস্তম্ভ দেখিলাম, এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে তাহা বর্ণনা করা যায় না। দেখিয়া মনে হইল ইংল্যান্ড হইতে বহুদুরে, বিদেশে, বিপদে অতি সামান্য সৈন্য যুদ্ধ করিতে করিতে প্রাণ দিবার সময় কেন ওয়েলিংটন ও নেল্ল্সনের কথা স্মরণ করে। এই স্থানে তাঁহাদের যে ছিন্ন-পতাকা রক্ষিত হইয়াছে, সেই পতাকার গৌরব তাহারা বিপদেও রক্ষা করিতে কৃতসংকল্প হয়। এইরূপ নামহীন, খ্যাতিহীন অজ্ঞাত সামান্য সৈনিকের রক্তে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পৃথিবীতে ব্যক্ত হইতেছে। ইহার মূলে জাতীয় গৌরবের স্মৃতি ও এই ওয়েস্টমিনিস্টার এবিতে সেই জাতীয় মহিমার স্মৃতি জাজ্বল্যমান!


পার্লামেন্ট দর্শন

টে নদী ইংল্যান্ডের রাজধানীর গৌরব রক্ষা করিবার উপযুক্ত। শহরের নিকট তাহার দুই পার্শ্বই বাঁধান, দুইদিকে সুন্দর পাকা রাস্তাতে গাড়ি ঘোড়া লোকজন যাতায়া৩ করিতেছে, এদিকে লন্ডনের দুর্গ প্রভৃতি নানা সুসজ্জিত হর্ম্য বিরাজ করিতেছে। অন্যদিকে হাসপাতাল ও কলকারখানার প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গৃহ রহিয়াছে। নদীর দুইপার্শ্বে-গমনাগমনের জন্য বহু সংখ্যক সেতু নির্মিত হইয়াছে। তদ্ব্যতীত অল্প পয়সাতে যাতায়াতের উপযোগী জাহাজেরও অভাব নাই।

লন্ডন শহর হইতে দূরে টেস্ নদীতে তীরের শোভা অপূর্ব, নানা বৃক্ষলতা ও গ্রাম্য ছবি তাহার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করিতেছে।

এই সকল দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অদূরবর্তী পার্লামেন্ট মহাসভাগৃহ যে কারুকার্য সম্বন্ধে সর্বোকৃষ্ট তাহার সন্দেহ নাই। শিল্প-নৈপুণ্যে ইহা শুধু লন্ডনের কেন, ইউরোপের মধ্যে শ্রেষ্ঠস্থান ভুক্ত।

অনেকদূর হইতে এই গৃহের ঘড়ি থাকিবার উচ্চ চূড়াটি ও অন্যান্য চূড়াগুলি দেখিতে পাওয়া যায়। ইংল্যান্ডে যাইবার পূর্বে এই গৃহ এবং সভার কার্য দেখিবার জন্য অত্যন্ত আগ্রহ ছিল; কিন্তু আমাদের পৌঁছিবার কিয়ৎকাল পরেই গ্রীষ্মাবকাশ উপলক্ষে সভার কার্য স্থগিত হয়। সুতরাং আমি উক্ত সভার কার্য দেখিবার আশা একপ্রকার ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। ঘটনাক্রমে আমাদের ইংল্যান্ড পরিত্যাগ করিতে বিলম্ব হইল, তাহাতেই সভার নূতন সেসনের কার্য আরম্ভ হইল, আমি প্রবেশের পাশ সংগ্রহ করিবার উদ্যোগ করিতে লাগিলাম।

দর্শকদের সভাগৃহে প্রবেশের জন্য পাশ সংগ্রহ করা আবশ্যক। প্রত্যেক সভ্যের তিনখানা পাশ দিবার অধিকার আছে। পুরুষ দর্শকদের বসিবার স্থানটি প্রশস্ত থাকাতে, তাঁহাদের পাশ সংগ্রহ করিতে অধিক কষ্ট হয় না, কিন্তু স্ত্রী-দর্শকদের স্থানটি অতিশয় সঙ্কীর্ণ, তাই-তাহাদের পাশের জন্য সভ্যদের মধ্যে সুরতি খেলা (ballot) হয়। যে যে সভ্যের ভাগ্যে নাম উঠে, তাঁহারাই কেবল পাশ দিতে পারেন। এইজন্য কখনও কখনও পাশ- প্রার্থিনীকে অনেকদিন অপেক্ষা করিতে হয়। সৌভাগ্যক্রমে সার জন লাবক (Sir John Lubbock) মহাশয়ের নিকট হইতে আমি দুইখানা পাশ পাইয়াছিলাম।

পূর্বেই ভারতের মঙ্গলাকাঙক্ষী পার্লামেন্টের সভ্য সোয়ান সাহেবের পত্নী আমাকে উক্ত সভাতে লইয়া যাইতে প্রতিশ্রুত হইয়াছিলেন। নির্দিষ্ট দিনে তিনি নিজের গাড়িতে আমাকে লইয়া গেলেন। মহাসভা গৃহটি একটি প্রাসাদ বিশেষ, কোথা হইতে কোথা প্রবেশ করিলাম, বুঝিতে পারিলাম না। গাড়ি খিলান দরজার নীচ দিয়া প্রকোষ্ঠ হইতে প্রকোষ্ঠান্তরে প্রবেশ করিয়া, অবশেষে এক ক্ষুদ্র দরজার নিকট থামিল। আমরা নামিয়া একটা কল (lift) দ্বারা ত্রিতলে উঠিলাম সেখানে পাশ দেখাইয়া স্ত্রীলোকদের নির্দিষ্ট স্থানে বসিলাম। সে স্থানটি দেখিয়া লখনউ নবাবদের প্রাসাদের অন্তঃপুরের কথা মনে পড়িল। ঠিক তেমনি ছিদ্রবিশিষ্ট প্রাচীর; যাহারা সম্মুখে বসেন, তাঁহারাই কেবল সেই ছিদ্র দিয়া নীচের সমুদয় কার্য দেখিতে পান, পিছনের আসন হইতে দেখিবার সুবিধা নাই, হলের এক পার্শ্বে রক্ষণশীল, অন্যপার্শ্বে উন্নতিশীল সভ্যদের বসিবার স্থান। পশ্চাতের দিকে সভাপতির (speaker) বসিবার উচ্চস্থান। তাঁহার সম্মুখে টেবিলের পার্শ্বে কাগজ-পত্র লইয়া কর্মচারীগণ উপবিষ্ট। উপরে দর্শকের ও খবরের কাগজের রিপোর্টারদের বসিবার গ্যালারি।

সভোরা সকল সময় সভাগৃহে উপস্থিত থাকেন না, যাঁহারা আলোচনা (debate) করেন, তাঁহারা এবং যে বিষয়ে যাঁহাদের বক্তব্য আছে, সে সভ্যেরাই সাধারণত উপস্থিত থাকেন। অন্যান্য সভ্যেরা সর্বদাই ভিতর বাহিবে যাওয়া আসা করেন। যাঁহারা গৃহে উপস্থিত থাকেন, তাঁহাদের মধ্যেও কেহ বা অর্ধশযান অবস্থায় আলোচনা শ্রবণ করেন, বেচারা সভাপতিকে কিন্তু সমস্ত সময় সেখানে বসিয়া থাকিতে হয়।

প্রত্যেক সভ্যই নিজ নিজ স্থানে দাঁড়াইয়া, কথা বলিবার মতো অতি সহজভাবে বক্তৃতা করেন। বক্তৃতার মধ্যে কেবল দরকারি ও জ্ঞাতব্য বিষয় বলিতে হয়-তাহা না হইলে সেখানে চলে না। আমি যেদিন যাই, সেদিন কলকারখানা সম্বন্ধীয় আইন লইয়া আলোচনা চলিতেছিল (Factory Bill)। দেখিলাম, বক্তা প্রকাণ্ড একতাড়া কাগজ হাতে লইয়া বক্তৃতা করিতেছেন এবং মধ্যে মধ্যে কাগজ হইতে দৃষ্টান্ত তুলিতেছেন। শুনিলাম, বক্তা শ্রবজীবীদের প্রতিনিধি। অতি সামান্য অবস্থা হইতে তিনি স্বীয় অধ্যবসায় বলে পার্লামেন্টের সভ্য হইয়া, গরীবদের দুঃখ নিবারণে সর্বদা চেষ্টা করেন। বক্তৃতার বিষয় এই, যে গভর্নমেন্ট আপত্তি না করাতে কলকারখানার স্বত্ত্বাধিকারীগণ অধিক লাভের প্রত্যাশায়, অল্পব্যয়ে সামান্য রকমের গৃহাদি নির্মাণ করিয়া থাকেন, সে সকল গৃহ চাপা পড়িয়া বৎসর অনেক লোক মারা যায়। অতএব এবিষয়ে গভর্নমেন্টের একটা আইন থাকা উচিত।

বক্তা কোন-কোন্ বৎসর কত লোক মারা পড়িযাছে, কত লোক পঙ্গু হইয়াছে, এই সমস্ত উল্লেখ করিয়া তাঁহার মত সমর্থন করিলেন। বিপক্ষীয় সভ্য প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিলেন, যে গভর্নমেন্টের এবিষয়ে হাত দিবার আবশ্যক নাই।

বৎসরে সাত-আটটি লোক হয়তো মারা পড়িতেছে তাহার জন্য এত আন্দোলন। আমরা হইলে ভ্রুক্ষেপ করিতাম না, অদৃষ্টের দোহাই দিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতাম।

এখানকার আলোচনা প্রণালী অতি সুন্দর। বক্তা স্বপক্ষে বলিয়া যাইতেছেন, এমনসময় বিপক্ষীয় সভ্যের কিছু বলিবার আবশ্যক হইলে, তিনি উঠিয়া দাঁড়ান, বক্তা অমনি বসিয়া পড়েন। বিপক্ষীয় সভ্যের বক্তব্য শেষ হইলে; পূর্ব বক্তা উঠিয়া তাহার যুক্তি খণ্ডন করিয়া

(অথবা স্বপক্ষীয় কেহ সেই যুক্তি খণ্ডন করিলে পর) আবার নিজ বক্তব্য বলিতে থাকেন। এবিষয়ের বাদানুবাদ শেষপর্যন্ত শুনিতে আমার যেরূপ আগ্রহ হইয়াছিল, তাহাতে বেশ বুঝিতে পারিলাম, সভ্যেরা সমস্ত রাত্রি জাগিয়াও কীরূপে অক্লান্তভাবে বাদানুবাদ করিয়া করিয়া সময় কাটান।

আমাকে সমুদয় প্রাসাদটি দেখিতে হইবে, তাই সঙ্গিনীর ইঙ্গিতে অযথা বাধ্য হইয়া সে স্থান ছাড়িলাম। বাহিরে আসিলে সোয়ান সাহেব আমাদের পথ প্রদর্শক হইয়া সঙ্গে চলিলেন। তিনি এতগুলি ঘরের মধ্যে দিয়া লইয়া গেলেন, যে আমার আশ্চর্যবোধ হইতে লাগিল, আমি নিজে নিশ্চয়ই পথ ভুলিতাম। 

অবশেষে অনেক ঘুরিয়া আমরা মহাসভার "লবি" (Lobby) নামক স্থানে উপস্থিত হইলাম। পার্লামেন্ট সভার সমুদয় গৃহের মধ্যস্থিত গুম্বুজাকার স্থানটিকে 'লবি' বলে। এই মধ্যস্থিত স্থান হইতে 'লর্ডদের' সভাগৃহে, 'কমন' বা সাধারণের সভাগৃহে এবং অন্যান্য সমুদয় গৃহে যাওয়া যায়। এখানে অনেক সভ্যের দর্শন পাইলাম, কেহ বা গল্প পরিহাস্য করিতেছেন, কেহ কেহ হাঁটিতে হাঁটিতে নানাপ্রকার তর্ক করিতেছেন-মন্ত্রণাসভা হইতে এখানেই অধিক সভ্য উপস্থিত ছিলেন। ইহার নিকট 'পোল' (Poll) দিবার ঘর। কোনো আলোচ্য বিষয় লইয়া যখন মতভেদ হয়, তখন সভ্যেবা এখানে আসিয়া নিজ নিজ 'ভোট' দেন।

'লবি' পার হইয়া লর্ডদের সভাগৃহে গেলাম। পথে পুরাতন রাজাদের সময়কার নানারকম ছবি দেখিলাম।

লর্ডদের গৃহটি সাধারণদের গৃহ অপেক্ষা ভালোরূপে সজ্জিত; বসিবার আসনগুলি লাল মন্মলে মণ্ডিত; সিংহাসন একধারে রক্ষিত। অনেকদিন এই আসন ব্যবহার হয় না। সাধারণ সভ্যেরা তাহাদের সজ্জাহীন সামান্য গৃহই অধিক পছন্দ করেন। তাঁহারা

বলেন, ওইরূপ গৃহেই বেশ কার্য সম্পন্ন করা যায়।

এই স্থানের মধ্যে 'ওয়েস্টমিনিস্টার হল' (West minister Hall) সর্বাপেক্ষা বৃহৎ। যে মোকদ্দমায় গভর্নমেন্ট বাদী, এখানে তাহার বিচার হয়। আমরা যখন গিয়াছিলাম, তখন এখানে দক্ষিণ আফ্রিকা সম্বন্ধে বিচার চলিতেছিল।

এই স্থানেই ওয়ারেন হেষ্টিংসের বিচার হইয়াছিল, বিখ্যাত বাগ্মী 'বার্ক' (Burke) এবং 'সেরিডেন' (Sheridan) ভারতবাসীদের পক্ষ হইয়া এই স্থানেই ওয়ারেন হেষ্টিংসের বিরুদ্ধে বক্তৃতা ধরিয়াছিলেন। প্রাসাদটি দেখিয়া আমরা নীচে আহারের স্থানে গেলাম। ইংরাজ জাতির আহারের বন্দোবস্ত সব স্থানেই আছে; সভ্যেরা এখানে যাহা আহার করিতে ইচ্ছা করেন, তাহাই কিনিতে পান। আমরা এখানে 'কফি' পান করিয়া টেমস্ নদীতীরস্থ মহাসভা গৃহের সুন্দর বারান্দায় বেড়াইতে গেলাম। গ্রীষ্মকালে অনেক সভ্য বন্ধুবান্ধবসহ এই স্থানে গল্প-সল্প ও আহারাদি করিয়া থাকেন। এখন এই বারান্দাটি সভ্যদের বন্ধু সমাগমে পূর্ণ হইয়া এক অপূর্ব শোভা ধারণ করে।

যে পার্লামেন্টের মন্ত্রণা দ্বারা পৃথিবীর অনেক স্থানের ভাগ্য নির্দিষ্ট হইতেছে, যে পার্লামেন্ট ইংরাজ জাতির ইতিহাস ও সৌভাগ্যের কারণ, সেই পার্লামেন্ট দেখিবার ইচ্ছা অনেকদিন হইতেছিল, তাহা পূর্ণ করিয়া গৃহে ফিরিলাম।

চিতোর দর্শন

খানে ভ্রমণ করিতে বাহির হইলে সর্বত্রই একটা ক্লেশ হয়। প্রায় প্রত্যেকে বড় বড় এস্থানেই দেখা যায়, মুসলমান রাজারা হিন্দুদের প্রাচীন কীর্তি সকল শেষ করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিয়াছেন। কাশীতে গেলে দেখিবে, পুরাতন বিশ্বেশ্বরের মন্দিরটি ভাঙিয়া একজন মুসলমান রাজা সেই স্থানে মসজিদ নির্মাণ করাইয়াছিলেন। এইরূপে কোথাও বা হিন্দুদের দেবমন্দির ভাঙিয়া সেই প্রস্তর দিয়া শহরের দরজা নির্মিত হইয়াছে। গুজরাটের রাজধানী আমেদাবাদ শহরে একবার দেখা গেল যে একটি রাস্তার যে পাথবখানি তোলা যায়, তারাই এক একটি হিন্দুদের দেবমূর্তি। কোথাও মুসলমান রাজা পাথর উলটাইয়া দেবমূর্তিগুলি নীচের দিকে রাখিয়া এই রাস্তাটি বাঁধাইয়াছিলেন। এইরূপ সর্বত্রই হিন্দু কীর্তির ভগ্নাবশেষ দেখিয়া প্রাণ একপ্রকার ক্লেশ হয়; এবং বর্তমান রাজারা যে কত ভালো তাহা বারবার মনে হয়। তাঁহারা কেমন যত্ন করিয়া হিন্দুব ও মুসলমানদিগের প্রাচীন কীর্তি সকল রক্ষা করিতেছেন। এইরূপ যত স্থান দেখিয়া আমাদের মনে ক্লেশ হইয়াছে, তাহাব মধ্যে চিতোর সর্বপ্রধান। চিতোর দেখিয়া আমরা চক্ষের জল রাখিতে পারি নাই। বাল্যকাল হইতে যে চিতোরবাসী রাজপুতদিগের বীরত্বের কথা শুনিয়া আসিতেছি, যে চিতোরের গুণকাহিনি কতই পড়িয়াছি, যে চিতোরের নাম যেন কর্ণে লাগিয়াই রহিয়াছে, সেই চিতোর যখন দেখিলাম, তখন চক্ষের জল ফেলিয়া বলিলাম, "হায়রে, এই কি সেই চিতোর!" বোধ হইল যেন কোন ঘুমের দেশে আসিলাম! যেন পাহাড় পর্বত, বাড়িঘর, গাছপালা, মানুষ পশু সকলেই ঘুমাইতেছে, সকলেই যেন মরিয়া আছে।

তোমবা মধ্য ভারতবর্ষের ম্যাপে চিতোর নগর দেখো। সমুদয় নগরটি একটি পাহাড়ের ওপরে দুর্গের দ্বারা বেষ্টিত। এই দুর্গে বাস করিয়া রাজপুত বীরগণ দিল্লির সম্রাটদিগকেও কাঁপাইয়া তুলিয়াছিলেন। সেসব অদ্ভুত কথা এখানে বলিবার অবসর নাই। তোমাদের মধ্যে যাহাদের বয়স কিছু অধিক, তাহারা টড় সাহেবের প্রণীত "রাজস্থান" নামক গ্রন্থের অনুবাদ পাইলে, তাহাতে চিতোরের রাজপুতদিগের বীরত্বের বিবরণ পড়িয়া দেখিও।

চিতোরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম সুরম্য রাজপুরী বিদ্যমান; উদ্যানে বৃক্ষসকল ফলফুলে ভরিয়া রহিয়াছে; রাজপুরীর সম্মুখে সুন্দর দেবমন্দির, তাঁহার গায়ে বিচিত্র শিল্পকার্য, মধ্যে মহাদেবের মূর্তি, সন্নিকটে একটি সুন্দর জলাশয়, তাহার পার্শ্বে প্রকাণ্ড আম্র-কানন স্থানটিকে ছায়ায় ঢাকিয়া রাখিয়াছে, কিন্তু সকলেই মৃত। রাজবাড়ি, দেবমন্দিব, আম্রকানন সমুদয় জনশূন্য। নগরে রাস্তাঘাট গৃহাদি সমুদয়ই বর্তমান, কিন্তু জনপ্রাণীর দেখা নাই; যেন কে মরণ-কাঠি ছোঁয়াইয়া শহরটিকে মারিয়া রাখিয়াছে। কিন্তু মনুষ্যহীন হইলেও রাজপুত বীরপুরুষ ও রমণীদিগের কীর্তি চিতোরকে জাগ্রত রাখিয়াছে। পৃথিবীর ইতিহাসে একস্থানে এত বীরকীর্তি একত্রিত দেখা যায় না।

চিতোর-দুর্গে উঠিবার পূর্বে চিতোরের পাহাড়ের নিম্নে একটি প্রকাণ্ড মাঠ পার হইয়া যাইতে হয়। এই মাঠেই মুসলমান রাজারা তাবু গাড়িয়া চিতোর অবরোধ করিতেন। এখনও এই মাঠে যুদ্ধে হত মুসলমান সৈনিকদিগের সমাধি সকল বিদ্যমান রহিয়াছে। চিতোর নগর ৫০০ ফিট উচ্চ এক পাহাড়ের উপর স্থিত। ওপরে উঠিবার একটি ভিন্ন পথ নাই; এইজন্যই মুসলমান রাজারা এই দুর্গম ও দুর্ভেদ্য দুর্গ সহজে অধিকার করিতে পারিতেন না।

রাজপুতনার অন্তর্গত মিবারের সূর্যবংশীয় রানারা চিতোরকে তাঁহাদের প্রধান গৌরবস্থল মনে করিতেন। চিতোর শত্রু-হস্তে পড়িলে যতদিন তাহা পুনরায় অধিকার করিতে না পারিতেন ততদিন গভীর দুঃখ ও ক্লেশে কালযাপন করিতেন। রানা প্রতাপ সিংহ চিতোর হারাইয়া কিরূপ দুঃখে কালযাপন করিতেন, তাহার বিবরণ তোমরা হয়তো পাঠ করিয়াছ। প্রতাপ সিংহ যে কঠিন প্রতিজ্ঞা করিয়া, পর্ণ-শয্যায় শয়ন করিতেন, এবং স্বর্ণ পাত্রের পরিবর্তে বৃক্ষপত্রে আহার করিতেন, তাঁহার বংশধরগণ আজিও সেই নিয়মের অনুকরণ করিয়া বিছানার নীচে একগাছি তৃণ এবং স্বর্ণ থালার নীচে বৃক্ষপত্র ব্যবহার করিয়া থাকেন; একথাটাও তোমরা জানো।

আমরা দুর্গে প্রবেশ করিয়া প্রথমেই রাজপ্রাসাদগুলি দেখিলাম, যে হ্রদের সম্মুখে ভীমসিংহ ও পদ্মিনীর প্রাসাদ, সে হ্রদ এখন শুদপ্রায়, হ্রদের মধ্যে পদ্মিনীর বিশ্রামভবন, তাহার চতুর্দিকে এখনও অল্প অল্প জল আছে। এই পদ্মিনীর উপাখ্যান হয়তো তোমরা অনেকেই শুনিয়া থাকিবে। তাহা এই, -দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দিন পদ্মিনীকে হরণ করিবার উদ্দেশ্যে প্রথম চিতোর অবরোধ করেন, অনেকবার অকৃতকার্য হইয়া পরিশেষে ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে চিতোর অধিকার করেন। এই ভীষণ সমরে রানা লক্ষণ সিংহ বংশ রক্ষার নিমিত্ত একমাত্র পুত্র রাখিয়া এগারোটি পুত্রের সহিত রণে প্রাণদান করেন। দুর্গের পূর্বদিকে কুন্তু রানা ও রানা সংগ্রাম সিংহের প্রাসাদ; ইহা যে নানাপ্রকার শিল্পকার্যে শোভিত ছিল তাহা এখনও বোঝা যায়।

রানা সংগ্রামসিংহের সহিত বাবরের যুদ্ধ হয়, বাবর কয়েকবার যুদ্ধে পরাজিত হন, কিন্তু শেষে রানা সঙ্গের জনৈক সৈন্যাধক্ষের বিশ্বাসঘাতকতায় জয়লাভ করেন।

নগরের মধ্যস্থলে রানা কুম্ভের জয়স্তম্ভ এখনও আকাশ ভেদ করিয়া দণ্ডায়মান বহিয়াছে। রানা কুস্ত ১৪৩৯ খিস্টাব্দে মালবদেশের রাজা মহম্মদের সহিত যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া এই কীর্তিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। এই নব তল স্তম্ভটি ১২০ ফিট উচ্চ; এই কীর্তিস্তম্ভ নির্মাণ করিতে দশ বৎসর লাগিয়াছিল। স্তম্ভের গাত্রে বহুবিধ সুন্দর প্রস্তর খোদিত রহিয়াছে। কুম্ভ রানার পত্নী মীরাবাঈ-এর নাম এদেশে বিখ্যাত। মীরা অতিশয় ভক্তিমতী ও ধর্মপরায়ণা নারী ছিলেন। তিনি নানা তীর্থ ভ্রমণ করিয়া চিতোরে প্রত্যাগত হইয়া পুনরায় দ্বারকাপুরী দেখিবার ইচ্ছ প্রকাশ করিলে তাঁহার জন্য এই স্তম্ভ নির্মিত হয়, এরূপ প্রবাদ প্রচলিত থাকাতে, কেহ কেহ ইহাকে মীরাবাঈ-এর স্তম্ভও বলিয়া থাকেন।

আমরা চিতোবের বহুবিধ পুরাতন মন্দির প্রভৃতি দেখিয়া অবশেষে এমন এক স্থানে উপস্থিত হইলাম, যেখানে আসিয়া আর চক্ষের জল রাখিতে পারিলাম না। এই স্থানে পর্বতের গাত্রে এক ক্ষুদ্র মন্দির; পর্বতের গাত্র হইতে নিরন্তর স্ফটিকধারা সমান জলধারা বহির্গত হইয়া মন্দিরস্থিত মহাদেবের মস্তকে পড়িতেছে। এই প্রস্রবনের জল দ্বারা সম্মুখের একটি বাঁধান পুষ্করিণী সর্বদা পূর্ণ হইতেছে। ইহার দক্ষিণে একটি সুড়ঙ্গ পথ দেখিলাম। রাজবাটী হইতে সুড়ঙ্গটি আসিয়াছে। চিতোরের স্বাধীনতার দিনে রাজকন্যাগণ এই পথ দিয়া এখানে আসিয়া পুজা ও স্নান সমাপন করিতেন। তৎপরে যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা এইঃ-১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে আকবর অসংখ্য সৈন্য লইয়া চিতোর আক্রমণ করিলেন। দুর্গস্থ রাজপুতগণ শেষপর্যন্ত প্রাণ দিয়া দুর্গরক্ষা করিবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞ হইলেন, একদিকে যেমন মুসলমানগণ বারবার দুর্গ প্রাচীর ভগ্ন করিতে লাগিলেন, অপরদিকে রাজপুতেরাও রাত্রের মধ্যেই তাহা পুনরায় সংস্কার করিয়া যাইতে লাগিলেন, বহুকাল এইরূপ চলিল। পরিশেষে রাজপুত সৈন্যাধ্যক্ষ জয়মল্ল ও পুত আকবর কর্তৃক নিহত হইলেন, তখন নেতাশূন্য হইয়া আর অধিককাল দুর্গ রক্ষা করিতে পারা যাইবে না জানিয়া, দুর্গস্থিত সমস্ত নরনারী শত্রুর হস্তে আত্মসমর্পণ করা অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয়স্কর মনে করিল। তখন আট হাজার রাজপুত বীর হরিদ্রাবর্ণের পরিচ্ছদ পরিয়া জন্মের মত আত্মীয় স্বজনের নিকট বিদায় লইয়া ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রদলের ন্যায় শত্রু সৈন্য মধ্যে পতিত হইলেন, ও অসামান্য বীরত্বের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। এদিকে রাজপুত নারীগণ দলবদ্ধ হইয়া জ্বলন্ত চিতায় আরোহণ করিলেন। এই ঘটনার উল্লেখ করিয়া একজন বাঙালি কবি যে সুন্দর কবিতাটি লিখিয়াছেন তাহা হইতে আমরা কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃতি করিয়া দিলাম।

"জ্বলজ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ, পরাণ সঁপিবে বিধবা বালা, জ্বলুক-জুলুক চিতার আগুন, জুড়াবে এখনি প্রাণের জ্বালা। শোনরে যবন, শোনরে তোরা, যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে, সাক্ষী হলেন দেবতা তার, এর প্রতিফল ভুগিতে হবে। জ্বলজ্বল চিতা, দ্বিগুণ-দ্বিগুণ, অনলে আহুতি দিব এ প্রাণ, জ্বলুক-জ্বলুক, চিতার আগুন, কেমনে এড়াই কলঙ্ক-ফাঁসি, জ্বলন্ত অনলে হইব ছাই, তবু না হইব তোদের দাসী। দেখত্রে জগৎ, মেলিয়া নয়ন, দেখবে, সতীত্ব-রতন করিতে রক্ষণ, রাজপুত-সতী আজিকে কেমন, সঁপিছে পরাণ অনল-শিখে।"

আমরা যে মন্দিরের নিকট বসিয়াছিলাম তাহার সম্মুখেই এই মহা চিতা স্থান। এই দারুণ ঘটনার পর যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া আকবর শাহ যখন চিতোরে প্রবেশ করিলেন, তখন রাজপুর বীরগণের বীরত্বের কথা ভাবিয়া তাঁহার প্রাণ মোহিত হইল। তিনি দেখিলেন, চিতোরে বাধা দিতে আর কেহ নাই। পুরুষেরা সকলে রণক্ষেত্রে মরিয়াছে ও রমণীরা চিতানলে দগ্ধ হইয়াছে। শুনা যায়, এই ঘটনাতে আকবরের প্রাণে এত ক্লেশ হইয়াছিল, যে তিনি দিল্লিতে ফিরিয়া আসিয়া জয়মল্লের ও পুতের প্রস্তর নির্মিত মূর্তি গড়াইয়া নিজের প্রাসাদ সমীপে স্থাপন করিয়াছিলেন।

লখনউ ভ্রমণ

অ "যোধ্যার নাম কে না জানে? রামায়ণ যাঁহারা পড়িয়াছেন, তাঁহাদের মনে অযোধ্যার নাম জন্মের মতো গাঁথিয়া গিয়াছে। কিন্তু সে রামও নাই, সে অযোধ্যাও নাই। এখন অযোধ্যা বা আউড্ প্রদেশে অযোধ্যা নামে একটি পুরাতন নগর পড়িয়া আছে। সেটি হিন্দুদের একটি তীর্থস্থান। সেখানে গেলে সেখানকার পাণ্ডারা রাম-সীতার অনেক চিহ্ন দেখায়। বলে, এখানে শ্রীরামচন্দ্র জন্মিয়াছিলেন, ওই ঘরে সীতাদেবী রন্ধন করিতেন ইত্যাদি। সে সকল কথা সত্য বলিয়া বিশ্বাস হয় না। যাহা হউক যে অযোধ্যা নগরের নাম হইতে অযোধ্যা প্রদেশের নাম হইয়াছে, অনেকদিন হইল সে অযোধ্যা নগর নিবিয়া গিয়াছে, মরিয়া গিয়াছে। তাহার পরিবর্তে লখনউ নগরের বিষয় কিছু বলিতেছি। লখনউ শহর গোমতী নদীর তীরে অবস্থিত। গোমতী গঙ্গারই শাখা; খালের মত শহবটির একপাশ দিয়া বহিয়া যাইতেছে। 

প্রবাদ আছে, রামচন্দ্র বনবাসের পর অযোধ্যায় ফিরিয়া আসিয়া, এই স্থানের শানসভার লক্ষ্মণের উপর দেন, লক্ষ্মণের নাম অনুসারে এই স্থানের নাম লক্ষ্মণপুর হয়, পরে তাহা হইতে লখনউ হয়। হিন্দু রাজাদের সময়ে লখনউ তত বিখ্যাত ছিল না। মুসলমান রাজাদের রাজত্ব সময়েই ইহার শ্রীবৃদ্ধি হয়।

মোগল সম্রাটগণের রাজত্বকালে অযোধ্যা তাঁহাদের শাসনাধীন ছিল। পরে মোগল সাম্রাজ্যের পতন হইলে, বাহাদুর শাহ নাম-মাত্র দিল্লির সম্রাট ছিলেন। ইহারই সময়ে সদৎ খাঁ নামক একজন পারস্য-দেশীয় বণিক সম্রাটের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হইয়া অযোধ্যার শাসনভারপ্রাপ্ত হন। বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর ঘোর অরাজকতা উপস্থিত হয়। অনেক রক্তপাতের পর মহম্মদশাহ নামে একব্যক্তি সম্রাট হয়। এই সময়ে সদৎ আলি খাঁ সুযোগ বুঝিযা স্বাধীনভাবে নবাব উপাধি গ্রহণ করিয়া, অযোধ্যাতে রাজত্ব করিতে আরম্ভ করেন। ইনিই অযোধ্যার প্রথম নবাব। সদৎ আলি খাঁর বংশের লোকেরা ইংরাজদিগের অধিকার সময় পর্যন্ত একশত বৎসর নিরুপদ্রবে অযোধ্যায় রাজত্ব করেন। ক্রমে ইংরাজদের সঙ্গে তাঁহাদের বিবাদ বাঁধিয়া ইংরাজরা প্রসিদ্ধ বক্সারের যুদ্ধে লখনউ-এর তখনকার নবাব সুজাউদৌলাকে পরাস্ত করেন। কিন্তু তখনও দিল্লির সহিত অযোধ্যার নামমাত্র সম্বন্ধ ছিল। ক্রমে-ক্রমে সেই সম্বন্ধ ঘুচাইয়া ইংরাজরা অযোধ্যার নবাবকে আপনাদের করদ রাজরূপে পরিণত করেন। অবশেষে নবাবেরা করপ্রদানে অসমর্থ হওয়াতে এবং অন্যান্য কারণে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে নবাব ওয়াজেদ আলি-শা লর্ড ক্যানিং কর্তৃক রাজ্যচ্যুত হন; এবং অযোধ্যাকে সম্পূর্ণরূপে ইংরাজ গভর্নমেন্টের রাজ্যভুক্ত করা হয়। ওয়াজেদ আলি খাঁ অত্যন্ত সৌখিন ও সঙ্গীতপ্রিয় লোক ছিলেন। তিনি লখনউ ঠুংরি নামে এক বিখ্যাত নূতন সুরের সৃষ্টি কর্তা। ইংরাজেরা তাঁহাকে ধরিয়া আনিয়া কলিকাতার নিকট মেটিয়াবুরুজে বন্দি করিয়া রাখেন। সে সময়ে তাঁহার প্রজারা শোক করিয়া নিম্নলিখিত গানটি বাঁধিয়াছিল।

"নিমক হারামে মুলুক ডবায়,

হজরত প্রাষে হে লণ্ডন কো। ওয়াজেদালসী যুগ যুগ জীয়ে, যিম্নে বনয়ি লখনউ নগরী। মহলমে-মহলমে বেগম রোয়ে, গলি-গলি রোয়ে পাথুরিয়া।"

ওয়াজেদ আলি-শা মৃত্যু পর্যন্ত গঙ্গাতীরে মেটিয়াবুরুজ নামক স্থানে বাস করিতেন। বন্দি অবস্থায়ও তাঁহার আড়ম্বরপ্রিয়তা ও সখের হ্রাস হয় নাই। প্রকাণ্ড অট্টালিকার উপরে পায়রাদিগের বাসস্থান নির্মিত ছিল। পায়রার খেলা দেখিতে ওয়াজেদ আলি-শা বড় ভালোবাসিতেন। হাজার-হাজার পায়রা ঝাঁকে-ঝাঁকে নবাবের অট্টালিকার উপরে উড়িত। তাঁহার সুন্দর উদ্যানটিও একটি দেখিবার স্থান ছিল। তখনও আলিপুরে পশুশালা হয় নাই। নবাবের বাগানের জন্তু সংখ্যা আলীপুরের পশুশালা হইতে সংখ্যায় অল্প হইলেও সেখানে হাঁস ও অন্যান্য পাখির সংখ্যা অনেক অধিক ও নানা প্রকারের ছিল। লখনউ- এর নবাবের বাড়ি, ঘর, পশুশালা প্রভৃতি দেখিয়া তাঁহার আদিস্থান লখনউ দেখিবার ইচ্ছা অনেকদিন হইতে মনে ছিল। লখনউ-এর বাগান, রাজবাড়ী, প্রভৃতি সমুদয় নবাবদের বিলাসিতা ও ঐশ্বর্যের পরিচয় দেয়। লখনউ শহরে অনেকগুলি উদ্যান আছে; তাহার মধ্যে কাইসারবাগ নামক উদ্যানটি বিশেষ প্রসিদ্ধ। ওয়াজেদ আলি-শা এই উদ্যানটিকে ইন্দ্রভবন তুল্য কবিয়া তাহাতে বাস করিতেন। এখন আর ইহার তেমন শোভা নাই। পূর্বে যেখানে বেগমদিগের বাসস্থান ছিল এখন তাহা সৈনিকদের জেল হইয়াছে ও উদ্যানের মধ্যে ক্যানিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। লখনউ-এর পুরাতন রাজভবন 'ছত্রমুঞ্জিলে' এখন সরকারি কাছারি হয়।

'মচ্ছিবাওয়ান' ও 'ইমামবাড়া' লখনউ-এর দুইটি প্রধান দেখিবার উপযুক্ত স্থান। 'মচ্ছিবাওয়ান' একটি মসজিদ। প্রবাদ এই যে এখানে লক্ষ্মণের বাসস্থান ছিল বলিয়া, হিন্দুরা ইহাকে পবিত্রস্থান বলিয়া গণ্য করিতেন, এজন্য হিন্দুদ্বেষী আওরঙ্গজেব এখানে এই মসজিদই নির্মাণ করেন। ইহাতে ৫২টি মাছের ছবি আছে বলিয়া ইহার এই নাম হইয়াছে। এখানে একটি কুপ আছে তাহা প্রায় দ্বিতল গৃহের সমান উচ্চ। 'ইমামবাড়া' আসকউদ্দৌলা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। ইহার পিত! সুজাউদ্দৌলা ইংরাজদিগের নিকট পরাস্ত হইয়াছিলেন। ইহার 'রুমিদরজা' নামক প্রকাণ্ড ফটক কনস্টান্টিনোপল নগরের প্রকাণ্ড ফটকের অনুকরণে নির্মিত। ইহার নিকটে হোসেনাবাদ নামক একটি মসজিদ। আদিল শা নামে এক নবাব ছিলেন, তিনি নিজ সমাধির জন্য এই মসজিদ নির্মাণ করিয়া যান। তাঁহার মৃত্যুর পূর্বে এখানে নৃত্যগীতাদি আমোদ হইত। উপরে বেগমদিগের বসিবার জন্য সুন্দর বন্দোবস্ত ছিল। এত বড় প্রকাণ্ড গৃহ আমরা আর দেখি নাই। আমাদের কলিকাতা টাউন হল হইতেও অনেক বড়। এখন ইহা অকর্মণ্য হইয়া পড়িয়া আছে দেখিয়া বড় দুঃখ হইল। লা মার্টিনিয়ার কলেজের গৃহ লখনউ-এর আর একটি দর্শনীয় স্থান। মার্টিনিয়ার সাহেব নবাবের সৈন্যধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি নবাবের বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন; এবং অনেক অর্থ সঞ্চয় করিয়া যান। প্রথমে এই অট্টালিকা নবাবের ব্যবহারের জন্য নির্মিত হইয়াছিল, পরে ইহাতে মার্টিনিয়ার সাহেবের সমাধি হয়। মার্টিনিয়ারের সমাধির ওপরে ছয়তালা গৃহ দুর্গের ন্যায় উঠিয়াছে, দুই পার্শ্বে কলেজ গৃহ। অট্টালিকাটি ইটালিয়ান ধরনে নির্মিত।

এই সকল অট্টালিকা ব্যতীত সিপাহীবিদ্রোহের ভগ্নাবশেষ বেলিগার্ড বা পুরাতন রেসিডেন্সী একটি দর্শনীয় স্থান। এই স্থানটি একটি উচ্চ ভূমির উপরে স্থাপিত। এখানে স্যার হেনরী লরেন্স সাহেব লখনউবাসী ইংরাজদিগকে লইয়া, বিদ্রোহী সিপাহীদের হাত হইতে আত্মরক্ষা করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। এই স্যার হেনরী লরেন্সের নাম এদেশে বিখ্যাত। তিনি যেমন বীর তেমনিই কর্তব্যপরায়ণ ও তেমনি সদাশয় ব্যক্তি ছিলেন। বেলিগার্ডের ভগ্ন গৃহগুলি ঠিক সেইরূপভাবেই রক্ষিত হইতেছে। কামানের গোলা যেখানে যেখানে লাগিয়াছিল, সেখানে সেখানে বড় বড় ছিদ্র আজিও রহিয়াছে। যে গৃহে কামানের গোলা লাগিয়া লরেন্সের মৃত্যু হইয়াছিল, যেখানে অস্ত্র-শস্ত্র রাখা হইয়াছিল, আহতদিগের জন্য যেখানে হাসপাতাল হইয়াছিল, সে সকল স্থান দেখিলাম। মৃত্তিকার নিম্নে একটি ঘরে শিশু ও রমণীদিগকে রাখা হইয়াছিল। কিন্তু সেখানেও কামানের গোলা প্রবেশ করিয়া কয়েকজনকে বিনষ্ট করে। সেই ঘরে এখনও স্থানে-স্থানে রক্তের দাগ দেখা যায়। ইহার নিকটেই যুদ্ধে হত বীরগণের সমাধিস্থান। নীল, আউটরাম, প্রভৃতি বিখ্যাত যোদ্ধাগণের স্মৃতিস্তম্ভ দেখিলাম। ইংরাজদিগকে বিদ্রোহী সিপাহীদের হস্ত হইতে উদ্ধার করিতে গিয়া স্যার হেনরি লরেন্সের প্রাণ যায়। তাঁহার সমাধির উপরে শুদ্ধ এই কথা লিখিত আছে "ইনি স্বীয় কর্তব্যপালন করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন।" এই সকল দেখিতে-দেখিতে মনে গভীর বিষাদের আবির্ভাব হইল, আমরা বিষাদপূর্ণ হৃদয়ে গৃহে ফিরিলাম।

মাদ্রাজ ভ্রমণ

ম্যাপে দেখিয়া দ পে দেখিয়া বুঝিতে পারিবে, বঙ্গদেশ হইতে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কতদূরে। ভারতবর্ষের দক্ষিণ ভাগ প্রায় সমুদয়ই মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি,' তিন দিকে সমুদ্র। উত্তরে- দাক্ষিণাত্যের কিয়দংশ। এই সীমার অন্তর্গত দেশগুলিকে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কহে। প্রধান নগর মাদ্রাজ শহরটি সমুদ্রতীরে অবস্থিত। মাদ্রাজ যাইবার দুইটি পথ আছে, স্থলপথে যাইতে হইলে, হাওড়া স্টেশনে রেলগাড়িতে উঠিয়া পুনা পর্যন্ত যাইয়া, সেখান হইতে পুনরায় রেলগাড়িতে মাদ্রাজ যাইতে হয়। ইহাতে পথ কষ্ট অধিক, এবং যাইতে প্রায় ছয়দিন লাগে, সমুদ্রপথে বিশেষ কোন কষ্ট নাই, কলিকাতায় জাহাজ উঠিয়া চারিদিনের দিন মাদ্রাজ পৌঁছান যায়। যাঁহাদের পূর্বে সমুদ্র দেখা হয় নাই, তাঁহারা এই সুযোগে সমুদ্র দেখিয়া লইতে পারেন। বাল্যকালে সমুদ্রের বর্ণনা পড়িয়া ও শুনিয়া সমুদ্র দেখিবার ইচ্ছা আমার মনে খুব প্রবল ছিল। সুতরাং সমুদ্রপথেই মাদ্রাজ যাত্রা করিলাম।

জাহাজ চড়িয়া ক্রমে যখন সমুদ্রের নিকটবর্তী হইলাম, তখনকার আনন্দ বর্ণনা করিতে পারি না। নদীর জল যেখানে সমুদ্রের গাঢ় নীল জলের সহিত মিশ্রিত হইয়াছে, সেস্থানে স্পষ্ট দুইটি বিভিন্ন জলস্রোত দেখা যায়, একদিকে নদীর কর্দমময় জল, অপরদিকে সমুদ্রের পরিষ্কার গাঢ় নীল জল, গঙ্গাসাগর ছাড়াইলেই জাহাজের লোকদের তীরের সহিত শেষ দেখা, তারপরই অকুল সমুদ্র! পার নাই, কিনারা নাই-যেদিকে চাই কেবল তরঙ্গ ময় জলরাশি! ঝড় না থাকিলে সমুদ্রযাত্রা বড় সুখকর। রাত্রিতে সমুদ্রের জলে আশ্চর্য দৃশ্য দেখা যাইত। জাহাজের সংঘর্ষণে জলে যেন শত-শত আলো জ্বলিয়া উঠিত। সমুদ্রে একপ্রকার জীবাণু আছে, তাহারা জাহাজের আঘাতে জোনাকির ন্যায় জ্বলিয়া উঠে, তিনদিন, দিনরাত্রি চলিয়া রাত্রিতে জাহাজ মাদ্রাজ পৌঁছিল। রাত্রিতে বন্দরে প্রবেশ করিবার নিয়ম নাই, এজন্য বন্দরের বাহিরে নঙ্গর ফেলিয়া রহিল, আমরা সেই রাত্রেই কেবিনের গবাক্ষ দিয়া মাদ্রাজের আলোকস্তম্ভ দেখিলাম। মাদ্রাজ উপকূলস্থ জলমগ্ন বালুকা দ্বীপের উপর পতিত হইয়া অনেক জাহাজ বিনষ্ট হয় বলিয়া এই আলোকস্তম্ভটি নির্মিত হইয়াছে। পরদিন প্রাতে জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করিল, আমরা তাড়াতাড়ি ডেকের উপর উঠিয়া দেখিলাম, নূতন দেশে আসিয়াছি। ক্ষুদ্র নৌকার সারি পিপীলিকার ন্যায় জাহাজখানিকে ঘিরিয়া ফেলিল। নৌকাগুলি নুতন ধরনের, লোকগুলির চেহারাও বেশ নূতন ধরনের। ছবিতে ইহাদের বেশ ও নৌকার আকৃতি দেখিতে পাইবে। যে নৌকাগুলিকে ৮/১০ জন মাঝি দেখিতেছ, সেগুলি আরোহীদের জন্য, আর পাশাপাশি তিন চারিটা তালগাছ বাঁধা ছোট ছোট নৌকাগুলি জাহাজে খাদ্যাদি আনিবার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই ক্ষুদ্র নৌকাতে চড়িয়াই জেলেরা সমুদ্রে মাছ ধরিতে যায়, এই নৌকার নাম "কাটামারান"। কিরূপে এই কাটামারানে চড়িয়া জেলেরা দিনরাত্রি সমুদ্রে কাটায় ভাবিলে আশ্চর্যবোধ হয়। অভ্যাসবশত ইহাদের মনে কোন ভয় নাই। আর এ নৌকার ডুবিবারও কোন সম্ভাবনা নাই, কারণ যে অবস্থায়ই পড়ুক না কেন, নৌকাগুলি ভাসিবেই। আমি অনেকবার লোকজনসহ নৌকা উলটাতে দেখিয়াছি, কিন্তু কাহারও প্রাণ নষ্ট হয় নাই।

আমরা একখানা বড় নৌকা করিয়া তীরে পৌঁছিলাম, এখন বন্দব নির্মিত হওয়াতে তীরে ওঠা সহজ হইয়াছে, কিন্তু পূর্বে তত সহজ ছিল না। এক একবার ঢেউ আসিয়া নৌকা ঠেলিয়া তীরে না লইয়া গেলে, মাঝিদের সাধ্য নাই যে, নৌকা তীরে লইয়া যায়। তাহার পরেও মাঝিদের কাঁধে চড়িয়া শুষ্ক স্থানে নামিতে হয়। এখনও যাহারা বন্দরের টেক্স দিতে না চান, তাঁহারা ওই প্রণালীতে তীরে উঠিতে পারেন। তীরে উঠিয়া প্রথমেই মাদ্রাজীদের ভাষা কানে ঠেকিল। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে চারটি ভাষা প্রচলিত, উত্তর-পূর্ব দিকে তেলেগু ভাষা, দক্ষিণ-পূর্বে তামিল ভাষা, উত্তর-পশ্চিম 'কেনেরিস' এবং দক্ষিণে-পশ্চিমে 'মালায়ালাম'। এই সকল ভাষাকে দ্রাবিড়ী ভাষা বলে। নিজ মাদ্রাজে তামিল ভাষা ব্যবহৃত হয়। কেনেরিস ভাষা ব্যতীত অন্যান্য ভাষাগুলি আমাদের কানে বড় কর্কশ বোধ হয়। ইহাদের ভাষা না জানিলেও বিদেশিদের কলিকাতায় আসিলে, যেমন অসুবিধা হয়, মাদ্রাজে তেমন হয় না, কারণ সকলেই প্রায় কাজ চালান ধরনের একটু ইংরেজি জানে।

তীরে উঠিয়া প্রথম দৃশ্য, মাদ্রাজের দুর্গ "ফোর্ট সেন্ট জর্জ"। ছবিতে এই দুর্গ ও দুর্গের মধ্যস্থিত নিশানস্তম্ভ দেখিতে পাইবে।

ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জের সময় (১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে) এই দুর্গ নির্মিত হয়। প্রথম যখন ইংরাজেরা বাণিজ্য করিবার জন্য রত্নগিরির রাজার নিকট হইতে সামান্য ভূমিখণ্ড গ্রহণ করেন, তখন তাঁহাদের আত্মরক্ষার সামান্য উপায় ছিল মাত্র। মহারাষ্ট্রগণ যখন দাক্ষিণাত্য প্রবল হইয়া উঠিল তখন, (১৭৪১ খ্রিস্টাব্দে) তাহারা মাদ্রাজস্থ ইংরাজদিগকে আক্রমণ করিয়া পরাজিত হন, তাহার পর ১৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে ফরাসীরা একবার মাদ্রাজ অধিকার করেন। পরে ইংরাজেরা ফরাসিদিগকে পরাস্ত করিয়া আত্মরক্ষার জন্য দুর্গ নির্মাণ করিতে আরম্ভ করেন; ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান দুর্গ নির্মিত হয়। ভাবিলে অবাক হইতে হয়, একটি ক্ষুদ্র শহর হইতে কত বড় একটা প্রেসিডেন্সি গঠিত হইয়াছে। সমুদ্র তীরে দুই মাইল জুড়িয়া সেনেট হাউস, হাইকোর্ট, হোটেল, গভর্নমেন্ট হাউস, প্রেসিডেন্সি কলেজ প্রভৃতি সুবৃহৎ অট্টালিকা সকল শোভা পাইতেছে। শহরে উঠিয়া দুর্গ ছাড়াইলেই ব্ল্যাকটাউন বা কাল শহর। এখানে শহরের যত দোকানপাট, অনেকটা কলিকাতার চাঁদনি এবং বড়বাজারের ন্যায়। এই স্থানে অনেক মাদ্রাজি ও ফিরিঙ্গি বাস করে। শহরের এই অংশকে কেন এই কুৎসিত নাম দেওয়া হইয়াছে বুঝিতে পারিলাম না। মাঝে-মাঝে এক একটি ইংরাজ পল্লি-আবার এক একটি গ্রাম ও শস্যক্ষেত্র-এইরূপ ২৭ বর্গমাইল স্থানে শহরটি বিস্তৃত। শহরের মধ্য দিয়া "কুয়াম" নামে খালের ন্যায় একটি ছোট নদী বহিয়া যাইতেছে, শহরের মধ্যে যাতায়াত করিতে হইলে অনেকবার নদীর উপরস্থ সেতু পার হইতে হয়। 

শহরের মধ্যে দেখিবার স্থান "পিপল্স পার্ক" বা জনসাধারণের উদ্যান, মিউজিয়াম এবং বোটানিকেল গার্ডেন, তাহাও কলিকাতার তুলনায় বেশি কিছু নহে। যাঁহারা জাহাজ হইতে নামিয়া শহর ভ্রমণ করিতে বাহির হন, তাঁহারা শহরের ধূলা ও রৌদ্র ভোগ করিয়া মাদ্রাজের যথেষ্ট নিন্দা করেন, কিন্তু যাঁহারা অধিকদিন মাদ্রাজে থাকিয়া মাদ্রাজের অভ্যন্তরস্থ গ্রাম্য শোভা এবং অপরাহ্নে সমুদ্রতীরের শোভা সম্ভোগ করিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট মাদ্রাজ তত খারাপ বোধ হয় না। সমুদ্রতীরে কলিকাতার ইডেন গার্ডেনের ন্যায় বাদ্যস্থান আছে, এখানে অপরাহ্নে শহরের সম্ভ্রান্ত লোকেরা বেড়াইতে আসেন। সমুদ্রতীরে বালুকা রাশির মধ্যে নামিয়া শামুক ভিন্ন-ভিন্ন শ্রেণি অনুসারে বিভক্ত রহিয়াছে, তাহা দেখিলে শামুক কুড়ানো এক নেশা হইয়া দাঁড়ায়। অনেক ইংরাজ বালক-বালিকা এমন কি বড় বড় লোক এই প্রকারে আমোদ লাভ করেন।

মাদ্রাজে স্কুল কলেজেব সংখ্যা কলিকাতার ন্যায় এত অধিক না হইলেও কতকগুলি ভালো ভালো কলেজ আছে। তাহাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ডাক্তার মিলার সাহেবের খ্রিস্টান কলেজ, সরকারি প্রেসিডেন্সি কলেজ ও জনসাধারণের 'পাচিয়াপা' কলেজই প্রধান। 'পাচিয়াপা' নামে একজন মাদ্রাজি ভদ্রলোক কলেজ নির্মাণার্থ ও কলেজের ব্যয় সঙ্কুলনার্থ কয়েক লক্ষ টাকা দান করিয়া যান। কলেজের সংলগ্ন সাধারণের বক্তৃতা প্রভৃতির জন্য "পাচিয়াপার হল" নামে একটি হল আছে। মাদ্রাজিদের আচার-ব্যবহার ও খাদ্য বাঙালিদের হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। জাতি বিচারের কঠিন নিয়মগুলি এখনও রক্ষিত হয়। ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, ক্ষত্রিয়, এই তিন বর্ণ ব্যতীত 'পারিয়া' নামে আর এক নীচ জাতি আছে তাহারা আমাদের দেশের মুচি হইতেও ঘৃণার পাত্র, এই জাতি এখন দলে-দলে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করিয়া নিজেদের উন্নতি সাধন করিতেছে।

সাধারণত মাদ্রাজিরা চামড়ার জুতো ব্যবহার করে না; হয় শূন্য পদে না হয় কটকি জুতার ন্যায় চটি পরিয়া রাস্তায় বাহির হয়। পুরুষেরাও স্ত্রী লোকেদের ন্যায় লম্বা চুল রাখে, কানে অলঙ্কার পরে, কাহারও হাতে বালাও দেখিয়াছি। পুরুষেরা যখন স্নানান্তে অনাবৃত পদে কোট পেন্টলুন পরিয়া চুল শুকাইতে শুকাইতে রাস্তা দিয়া চলিয়া যান তখন সেই দৃশ্য বড় অদ্ভুত দেখায়। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে বঙ্গদেশের ন্যায় স্ত্রীলোকদের অবরোধ প্রথা নাই; সম্ভান্ত পরিবারের স্ত্রীলোকেরা বাহিরে যান না বটে, কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের স্ত্রীলোকদের আবশ্যক মতো বাহিরে যাইতে দেখিয়াছি। ইহাদের মধ্যে কফি খাওয়ার নেশা দেখিয়া আশ্চর্যবোধ হইয়াছিল। সমস্ত দিন ইহাদের বাড়িতে হাঁড়িতে কফি প্রস্তুত থাকে, নিজেরাও বার বার কফি পান করেনই, অতিথি অভ্যাগত আসিলেই তাঁহাদেরও কফি পান করিতে অনুরোধ করেন।

বিস্তৃত শহর বলিয়া বাড়িতে লোকজনের কোলাহল বা গাড়ি ঘোড়ার শব্দ অধিক শুনা যায় না। আমি যখন মাদ্রাজ ছিলাম, তখন রাস্তাতে গ্যাসের আলো ছিল। আজকাল শুনিয়াছি, ইলেকট্রিসিটি দ্বারা ট্রামগাড়ি চালিত হয়, ইহা সত্ত্বেও বাহ্য উন্নতিতে মাদ্রাজ যে বোম্বাই ও কলকাতা অপেক্ষা হীন তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। মাদ্রাজ বিষুবরেখার নিকটে বলিয়া এখানে শীত গ্রীষ্মের বৈষম্য নাই। শীত একেবারেই নাই; সমস্ত বৎসর ধরিয়া একই রকম গ্রীষ্ম। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে মুসলমানদের প্রভাব বেশি না থাকাতে হিন্দুকীর্তি সমুদয় অক্ষুন্ন রহিয়াছে। উত্তর পশ্চিম প্রদেশে যেমন প্রতি শহরে মুসলমানদের নির্মিত হর্মাদি দেখা যায়, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে তেমনি হিন্দুদের দেবালয় প্রভৃতির কারুকার্য ও শিল্পনৈপুণ্য দেখা যায়। বারান্তরে তোমাদিগকে সেই সব স্থানের কথা জানাইবার ইচ্ছা রহিল।

কাশ্মীর

বার পূজার ছুটিতে আমরা কাশ্মীর বেড়াইতে গিয়াছিলাম। কাশ্মীর ভারতের কোনদিকে এবার তাহা ভারতের ম্যাপে দেখো। তোমাদের মধ্যে যাহারা ভ্রমণবৃত্তান্ত ভালোবাস, তাহাদের কৌতূহল উদ্দীপ্ত করিবার জন্য আমাদের এই ভ্রমণবৃত্তান্ত সংক্ষেপে দেওয়া যাইতেছে। ইংলন্ড প্রভৃতি সুসভ্য দেশের বালক-বালিকাগণ বাল্যকাল হইতেই ভ্রমণবৃত্তান্ত পড়িতে ভালোবাসে, তাহার সুফল এই হয় যে, বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া তাহারা নূতন দেশ আবিষ্কারের জন্য প্রাণ পর্যন্ত ত্যাগ করিতে প্রস্তুত হয়। উত্তরমেরুদেশ আবিষ্কার করিবার জন্য স্যর জন ফ্রাঙ্কলিনের মতো কত লোকে অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন। আফ্রিকার নানা স্থান আবিষ্কারের জন্য লিভিংস্টোন সাহেব কত শারীরিক ক্লেশ স্বীকার করিয়াছেন, কতবার মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন। এখনও ন্যানসেন নামক একজন সাহেব গ্রীণল্যান্ডের উত্তরে কি আছে তাহা আবিষ্কার করিবার জন্য অনেক পরিশ্রম করিতেছেন, তাহার ভ্রমণবৃত্তান্ত পাঠ করিলে অত্যন্ত আশ্চর্যবোধ হয়। আমাদের এই ভ্রমণবৃত্তান্ত পাঠ করিয়া একটা না হইলেও আশা করি তোমাদের মধ্যে অনেকবার মনে নানা স্থান ভ্রমণ করিয়া প্রকৃতির শোভা দেখিবার আগ্রহ জন্মিবে।

পূর্বে কাশ্মীর সম্বন্ধে অনেক পুস্তকে অনেক বর্ণনা পড়িয়াছিলাম, শুনিতাম কাশ্মীর নাকি ভূতলে নন্দন কানন। আমার এই সকল কথা অতিরঞ্জিত বলিয়া বোধ হইল। হিমালয়ের অনেক দর্শনীয় স্থান ইহার পূর্বেই দেখিয়াছিলাম। কুমায়ুনের তুষার নদী দেখিতে গিয়া প্রকৃতির যে অপূর্ব সৌন্দর্য দেখিয়াছিলাম, তাহার অধিক সৌন্দর্য যে আব কোথাও আছে তাহা বিশ্বাস হইত না।

রাউলপিণ্ডি পর্যন্ত রেলগাড়িতে যাইতে হয়, তাহার পব টাঙ্গা গাড়িতে চড়িতে হয়। তোমাদের মধ্যে যাহারা পশ্চিমে থাক, তাহারা আবশ্যই এই গাড়ি দেখিয়াছ। তিন-দিন এই টাঙ্গায় চড়িয়া কত পাহাড় পর্বত ও উপত্যকা পার হইলাম। প্রায় ৫ মাইল অন্তর টাঙ্গার ঘোড়া একবার করিয়া বদলানো হয়। এই সকল স্থানে পথিকদের জন্য ধর্মশালা ও খাবার জিনিসের দোকান আছে। এই সকল স্থানে ১০/১৫টা গরুর গাড়ির গরুগুলি বিশ্রাম করিতে-করিতে রোমন্থন করিতেই দেখা যায়। এই নিরীহ পশুগুলি কিরূপে এই সকল গাড়ি ও অসমান পার্বত্য রাস্তা দিয়া এত ভারী বোঝা লইয়া যায়, তাহা ভাবিলে বড় আশ্চর্যবোধ হয়। সকালবেলা ৭/৮টি হইতে ইহারা ধীরে-ধীরে পাহাড়ের উপর উঠিতে থাকে, দু-প্রহরের সময় বিশ্রাম করিয়া আবার ৩/৪টা হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত এইরূপ কার্য করে। গরুর গাড়ি ছাড়া পথে মধ্যে-মধ্যে উটের সারি চলিতেছে দেখা যায়। পাঠানেরা ২/৩ পরিবার হইয়া চলে। উটের পিঠে সমুদয় বোঝা চাপাইয়া দেয়। পথশ্রমে ক্লান্ত স্ত্রীলোকেরা মাঝে মাঝে উটের উপরে চড়িয়া যায়। চলিতে চলিতে শ্রান্ত হইলে ইহারা এক এক স্থানে দীর্ঘ দীর্ঘ ঘাস, পাতা ও কাপড় দিয়া তাঁবু প্রস্তুত করিয়া বিশ্রাম করে এবং উটগুলি চারিদিকে চরিয়া বেড়ায়। টাঙ্গা গাড়িগুলি যেন রাস্তার মালিক, টাঙ্গার বাঁশি বাজিবামাত্র এই উটের সারি গরুরগাড়ি বা এক্কা সকলেই পথ ছাড়িয়া একপাশ গিয়া দাঁড়ায়। টাঙ্গা চলিয়া গেলে পুনরায় মন্থর গমনে চলিতে থাকে। আমরা সমস্তদিন চলিয়া সন্ধ্যাকালে বিশ্রামের জন্য কোন ডাক বাংলোয় আশ্রয় লইতাম। পরদিন আহারাদির পর আবার যাত্রা করিতাম। পথে যে রমণীয় দৃশ্য দেখিতাম, তাহাতে পথের সকল কষ্ট দূর হইত। এক পাহাড় হইতে অন্য পাহাড়ে যাইতে বিচিত্র দৃশ্য করিতাম। কোথাও উচ্চ পর্বতের চূড়াগুলি আকাশভেদ করিয়া রহিয়াছে। কোথাও শস্যপূর্ণশ্যামলক্ষেত্র বেষ্টিত উপত্যকা রহিয়াছে। নদী কোথাও গভীর গর্জন করিয়া ছুটিতেছে। আবার কোথাও শান্তভাবে বহিয়া যাইতেছে। এই রাস্তার প্রত্যেক সুন্দরস্থানের বর্ণনার স্থান হইবে না। পথে পুরাতন শিখদের দুর্গ, কত ভগ্নমন্দির, কত সুন্দর বৃক্ষ দেখিলাম। অবশেষে আমরা ঝিলাম বা বিতস্তা নদীতে নৌকার আশ্রয় লইলাম। সে নৌকা একটা দেখিবার মতো জিনিস, উহাকে ইংরাজিতে House boat বা গৃহনৌকা বলে; ইহাতে ৪/৫টা কুঠুরি।

তাহাতে খাট, চেয়ার, টেবিল প্রভৃতি সকল আবশ্যকীয় জিনিস আছে। আবার শীত নিবারণের জন্য আগুন জ্বালিবার স্থান ও ধোঁয়া বাহির হইবার জন্য চিমনি আছে। আমরা বৃষ্টি বা শীত পড়িলে চিমনিতে আগুন জ্বালিয়া তাহার চারিদিকে বসিয়া গল্প করিতাম বা পুস্তকাদি পাঠ করিতাম। এখন সেই নৌকাগুলি যেমন নূতন রকমের ইহাদের চালাইবার ধরনও সেইরূপ। স্রোতের বিপরীতদিকে যাইবার সময় মাঝিরা গুণ-টানিয়া লইয়া যায়। স্রোতের দিকে যাইবার সময় বেশিরভাগ স্রোতেই ভাসাইয়া লয়। কখনও কখনও লগি দিয়া চালায়। এই লগি চালানকে তাহারা বল্লম লাগান বলে। বড় বড় নৌকাতে প্রায়ই দাঁড় ব্যবহার করে না। নৌকার ভিতরে থাকিয়া নৌকা চলিতেছে কিনা বুঝিতে পারা যায় না। মাঝিরা সন্ধ্যা হইলে আর নৌকা চালায় না। মাঝিরা পরিবার লইয়া নৌকাতেই থাকে এবং পুরুষ এমনি ৫/৬ বৎসরের শিশুরাও নৌকা চালাইতে সাহায্য করে। আমরা নৌকাতে উঠিয়া দ্বিতীয়দিনে উলার নামে একটা প্রকাণ্ড হ্রদ পার হইলাম, এই হ্রদটি মাঝিরা খুব ভোর রাত্রিতে পার হইতে আরম্ভ কবে এবং বড় নৌকার পার হইতে ৬/৭ ঘণ্টা লাগে। মাঝিরা বিকালবেলা কোন ক্রমেই এই হ্রদ পার হইতে চায় না। বিকালবেলা এখানে প্রায়ই ঝড় হয় এবং ঝড় হইলে বড়-বড় ঢেউ উঠিতে থাকে। একবার নাকি একজন মুসলমান নবাব মাঝিদের নিষেধ না শুনিয়া বিকালবেলাই হ্রদ পার হইতে চেষ্টা করিয়া কিছুদূর গিয়াই ঝড়ে পড়িয়া বহুসংখ্যক অনুচরসহ জলমগ্ন হইয়াছিলেন।

কাশ্মীরী মাঝিরা ঝড়কে বড় ভয় করে, একদিন একটু সামান্য বাতাস হওয়াতে বিতস্তা নদীতে অল্প অল্প ঢেউ উঠিতেছিল। মাঝিবা তখনই চিৎকার করিয়া, তাড়াশাড় নৌকা বাঁধিয়া ফেলিল এবং সেদিন আর নৌকা চালাইল না। ইহাদের এত ভয়ের কারণ বুঝিতে পারিলাম, না; কারণ নদীটি শরৎকালে এমন ছোট যে, এপারে বসিয়াও ওপারের লোকের সঙ্গে কথা বলা যায় এবং তাহাতে এত অল্প জল যে হাঁটিয়া পার হওয়া যায় তবে সকলস্থানে জল সমান নয় বলিয়া বোধ হয় কেহ হাঁটিয়া পার হইতে চেষ্টা করে না।

আমরা উলার হ্রদ পার হইয়া, পুনরায় বিতস্তা নদীতে পড়িলাম, যতক্ষণ এই হ্রদের মধ্যে ছিলাম, ততক্ষণে মনে হইতেছিল যেন, আমরা সমুদ্র-বক্ষে আছি; বহুদূরে পর্বতমালা দেখা যাইতেছিল, আমরা সমুদ্রের ন্যায় অকুল জলরাশির মধ্য দিয়া যাইতেছিলাম। এখনও সেই প্রকাণ্ড হ্রদ ও দূরবর্তী গিরিশৃঙ্গের দৃশ্য মনে হইলে হৃদয় স্তম্ভিত হয়।

বিতস্তা নদীতে আসিয়াই, মাঝিরা চা খাইবাব জন্য বক্সিস চাহিল, হ্রদ পার হইতে অত্যন্ত পরিশ্রম হয় বলিয়া এবং নির্বিঘ্নে হ্রদ পার হইয়া বিশেষ সৌভাগ্যের কথা বলিয়াই বোধ হয় এই প্রথা চলিত হইয়াছে।

নদীর দুই পারেই সুন্দর শ্যামল শস্যক্ষেত্র এবং অনেক দূরে মাঝে-মাঝে কৃষকদিগের

কুটীর। এক একটা ক্ষেত্রের পর দূর হইতে বৃক্ষশ্রেণি দেখিলে, বুঝিতাম কৃষকপল্লি নিকটেই।

এই ক্ষুদ্র প্রশান্ত নদীর তীরস্থিত কৃষকের গ্রামগুলি দেখিলে নূতন দেশে নুতন শান্তিময় কাজে

আসিয়াছি বলিয়া মনে হইত।

নদীর দুই ধারে পাহাড়ের সারি। ইহাকে পীলাঞ্জল শ্রেণি কহে। পাহাড়গুলি চিরবরফে ঢাকা রহিয়াছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখর সর্বদা বরফে আচ্ছন্ন থাকে। কিন্তু মেঘের জন্য সকল দিন তাহা দেখিবার সুবিধা ঘটে না। দার্জিলিং থাকিতে যেদিন কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারবৃত শৃঙ্গ দেখিতে পাইতাম, সেদিন কত আনন্দ হইত। কাশ্মীরে দিবানিশি এই বরফে আচ্ছন্ন শৃঙ্গগুলি দেখা যায়। যতদূর দৃষ্টি চলে দিগন্তব্যাপী বরফের স্তূপ। এই বরফ রাশিতে সূর্যকিরণ পড়িলে এক নূতন সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়। কখনও সোনালি রঙে, কখনও উজ্জ্বল রৌপ্য বর্ণে, আবার কখনও বা গোলাপি আভাতে ঝকঝক করিতে থাকে।

পরদিন আমরা সম্বল নামক স্থানে রাত্রিযাপন করিলাম। দূর হইতে প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড চেনার গাছ দেখিয়া বুঝিলাম গ্রাম নিকটেই। চেনার গাছগুলি অনেকটা অশ্বত্থগাছের মতো; তাহা হইতেও অনেক দীর্ঘ ও বিস্তৃত। কাশ্মীর ভিন্ন আর কোথাও এই গাছ জন্মে না। এখানে ইহাকে বৃক্ষরাজ (Royal trec) বলে। বাজার আদেশ ভিন্ন কেহ ইহার ডাল ভাঙিতে পারে না। সম্বলে রাত্রিযাপন করিয়া আমরা পরদিন প্রত্যুষে মানসবল নামক একটি হ্রদ দেখিতে গেলাম। এই হ্রদে প্রবেশ করিবার পথ বড় সঙ্কীর্ণ। আমাদের নৌকা বড় বলিয়া আমরা হাঁটিয়া যাওয়াই স্থির করিলাম। পাহাড়েব উপরে কয়েকটি গ্রাম ও শস্যক্ষেত্র পার হইয়া- মানসবলে পৌঁছিলাম। হ্রদের পারে অল্প জলের মধ্যে অনেকগুলি দেশীয় ক্ষুদ্র ঘোড়া হাঁসের মতো জলের মধ্যে মাথা ডুবাইয়া-ডুবাইয়া কি খাইতেছে দেখিয়া আমাদের বড় হাসি পাইল। পরে জানিলাম ইহারা এক প্রকার জলজ উদ্ভিদ খাইতেছে। মানসবলের তট দিয়া হাঁটিয়া গিয়া আমরা ফকিরের গুহাতে উপস্থিত হইলাম। বহুদিন পূর্বে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকট এই গুহার কথা শুনিয়া অবধি ইহা দেখিবার খুব ইচ্ছা ছিল। মহর্ষি যখন কাশ্মীরে বেড়াইতে যান, তখন এই সাধু জীবিত ছিলেন এবং প্রত্যহ এক কোদালি মাটি কাটিয়া নিজের সমাধি প্রস্তুত করিতেছিলেন। আমরা গিয়া শুনিলাম যে, দুই বৎসর হইল সাধুর মৃত্যু হইয়াছে। তাঁহাকে গুহাতে কবরস্থ না করিয়া নিকটবর্তী কোনো স্থানে সমাধি দেওয়া হইয়াছে। তাঁহার সমাধির উপরে পেয়ারা, আপেল, পিচ প্রভৃতি নানাবিধ গাছ রোপিত হওয়াতে স্থানটি অত্যন্ত রমণীয় হইয়াছে। আমরা আলোক লইযা গহ্বরটি দেখিলাম। গুহাটি ২০/২৫ হাত লম্বা। আসিবার সময় সাধুর পুত্র আমাদিগকে অনেক ফল উপহার দিলেন। জেলে ডিঙ্গির মতো ছোট নৌকায় আমরা মানসবল ত্যাগ করিয়া গৃহনৌকাতে ফিরিলাম। হ্রদের জল এত নির্মল ও স্বচ্ছ যে, হ্রদের নীচে অবস্থিত সবুজবর্ণ শেওলাগুলি পর্যন্তও স্পষ্ট দেখা যাইতেছিল। এই হ্রদের মধ্যে স্থানে-স্থানে পদ্মবন। যখন পদ্মগুলি ফুটে তখন না জানি হ্রদের শোভা আরও বৃদ্ধি পায়। হ্রদের একপার্শ্বে নূরজাহানের প্রমোদ কাননের ভগ্নাবশেষ দেখিলাম; কাশ্মীরের মধ্যে যে যে স্থান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত, সেই সেই স্থানে নূরজাহান প্রমোদভবন নির্মাণ করিয়াছিলেন, এখনও শ্রীনগরে সেইসকল গৃহ সুরক্ষিত আছে।

পরদিন পূর্বাহ্নে সাদিপুর নামক স্থানে পৌঁছিলাম। এখানে সিন্ধু নামে ক্ষুদ্র নদী বিতস্তার সহিত মিলিত হইয়াছে। মিলনের মধ্যস্থলে জলের মধ্যে একটি কৃত্রিম দ্বীপে একটি চেনার বৃক্ষ রোপিত আছে। দুই নদীর সঙ্গম-স্থল বলিয়া এস্থান কাশ্মীরবাসীদিগের নিকট পবিত্র বলিয়া গণ্য। তাহারা এখানে স্নান ও পূজা করিয়া কৃতার্থ হন। সন্ধ্যার সময় নৌকার ছাতে বসিয়া সুদূরে বহুগৃহে সমাকীর্ণ নগর দেখিতে পাইলাম, বুঝিলাম, উহাই শ্রীনগর কাশ্মীরের রাজধানী। কাশ্মীরের মহারাজ গ্রীষ্মকালে এবং শীতকালে জম্বুতে বাস করেন। শ্রীনগর শহরটি বিতস্তা নদীর দুই পারে তিনমাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। সাধারণত নৌকাতেই উভয় পারে যাতায়াত সম্পন্ন হয়, উভয় পারে অসংখ্য নৌকা। গাড়ির পরিবর্তে শ্রীনগরে নৌকাই ব্যবহৃত হয়। উভয় পারে যাতায়াতের সুবিধার জন্য ৭টি সেতু আছে বটে, কিন্তু নৌকার প্রচলনই অধিক। এক একটি ধনীর নৌকা দেখিবার মত জিনিস। নানাবর্ণে চিত্রিত ও কারুকার্যে মণ্ডিত নৌকার মধ্যে কাশ্মীরি পণ্ডিতেরা বেশভূষা করিয়া বিচিত্র আসনে বসিয়া আছেন, এবং ২০/২৫ জন মাঝি তালে তালে দাঁড় ফেলিয়া বিদ্যুৎবেগে শত শত নৌকার মধ্য দিয়া নৌকা বাহিয়া যাইতেছে, দেখিতে খুব সুন্দর।

আমাদের নৌকা শ্রীনগরে উপস্থিত হওয়া মাত্র ব্যবসায়ীরা নৌকা করিয়া তামা, রূপা ও কাগজের বাসনপত্র ও কাশ্মীরি শাল লইয়া আমাদের নৌকার চারিদিকে আসিয়া উপস্থিত হইল। নৌকাতে বসিয়াই আমরা কাশ্মীরের সমুদয় শিল্পদ্রব্য দেখিলাম।

শ্রীনগরের যেদিকে ইংরাজেরা বাস করেন, সেদিকটা খুব পরিষ্কার; চেনার, সফেদা প্রভৃতি গাছ সারি সারি থাকাতে সেই স্থানের খুব শ্রীবৃদ্ধি হইয়াছে। স্থানটির নাম মুন্সীবাগ। শ্রীনগরের নিকটে তাঁবু ফেলিয়া অনেক সাহেব বাস করেন, তাঁহাদের ব্যবহারের জন্য মহারাজ সুন্দর সুন্দর স্থান নিরূপণ করিয়া দিয়াছেন।

আমরা পরদিন ডাল হ্রদ দেখিতে গেলাম। ইহা একটি প্রকাণ্ড হ্রদ, বিতস্তা নদী হইতে ডালহ্রদে যাইবার জন্য খাল কাটানো আছে। অনেকে ডালহ্রদে বেড়াইতে যান; ইহা শ্রীনগরের একটি প্রধান দর্শনীয়স্থান। এই হ্রদের পারে সালিমার বাগ, নাসিম বাগ, নিসাত বাগ প্রভৃতি সুন্দর সুন্দর প্রাচীন উদ্যান রহিয়াছে। সালিমার বাগ নূরজাহানের আদেশে নির্মিত হইয়াছিল। হ্রদ হইতে সালিমার বাগে প্রবেশ করিবার জলপ্রণালীর দুই পার্শ্বে সারি-সারি উইলো গাছ জলে নুইয়া পড়িয়াছে। সেস্থান দিয়া আমাদের ছোট নৌকা সালিমার বাগে প্রবেশ করিল। লাহোরের সালিমার বাগের আদর্শে এই উদ্যান নির্মিত হয়। সেরূপ সিড়ির ধাপের মতন ৭টি ধাপে এই বাগান নির্মিত। প্রমোদগৃহের চারিপার্শ্বে ফোয়ারা পড়িবার বন্দোবস্ত পূর্বের মতনই রহিয়াছে। গৃহে বসিয়াই হ্রদের সৌন্দর্য এবং অদূরে বরফের শোভা সম্ভোগ করা যায়। আমরাও এই সৌন্দর্য উপভোগ করিতে করিতে, পুরাতনকালের কথা স্মরণ করিয়া সালিমারে শিল্পচাতুর্যের এবং নূরজাহানের রুচির প্রশংসা করিতে লাগিলাম। আর একদিকে পরিমহল নামে মুসলমানদের সময়ের একটি মানমন্দির আছে। তাহার নিকটে চসমাসহি নামে বিখ্যাত নির্ঝরিণী। পূর্বে এই নির্ঝরিণীর জল কেবল শ্রীনগরের সম্ভ্রান্ত লোকেরা পান করিতেন; এখন এই জল নল দিয়া শ্রীনগর শহরে লওয়া হইয়াছে, এবং সকলই তাহা পান করিতে পারে।

ডাল হ্রদের আর একদিকে একটি গ্রামে হাজরত বাল্ নামে একটি মসজিদ আছে। এখানে মহম্মদের মাথার চুল রক্ষিত আছে বলিয়া প্রমাদ আছে। নির্দিষ্ট সময়ে এখানে বহুলোকের সমাগম হয়। ডাল হ্রদে প্রবেশ করিতেই ডানদিকে 'টা সলিমিন' নামক ক্ষুদ্র পর্বত। ইহার শিখরে একটি পুরাতন মন্দির আছে, কেহ কেহ বলেন এই মন্দিরটি শঙ্করাচার্য্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত; এজন্য ইহার আর এক নাম শঙ্করাচার্য। এই পাহাড়ে উঠিলে শ্রীনগর শহরটি পরিষ্কার দেখা যায়। ডাল হ্রদ হইতে আর একটি ক্ষুদ্র পর্বতে যাওয়া যায়; তাহার নাম হরি পর্বত। এই পর্বতের উপর মহারাজার দুর্গ, তাঁহার অস্ত্র-শস্ত্রও এখানে রক্ষিত হয়। ডাল হ্রদের মধ্যেও অনেক পদ্মবন; কয়েকদিন হইল ফুল ফুটিয়া গিয়াছে মনে হইল। ফুলের বোঁটাগুলি তখনও পাতার মধ্যে খাড়া রহিয়াছে। তাহা ছাড়া এই হ্রদে ভাসমান ক্ষেত্র (Floating gardens) এক অপূর্ব জিনিস; পানা ও শেওলার ওপর মাটি ফেলিয়া এই বাগান প্রস্তুত করা হইয়াছে; ইহাতে তরমুজ, ফুটি, বিলাতি বেগুন প্রভৃতি তরকারি প্রস্তুত হয়, মালি ইচ্ছামত এই ক্ষেত হ্রদের যেস্থানে ইচ্ছা হইয়া যাইতে পারে। এই হ্রদটি এত বড় যে, একদিনে ইহার দর্শনীয় স্থানগুলি দেখা যায় না। শ্রীনগর হইতে আমরা ইসলামাবাদে গেলাম। পথে অবন্তীপুর ও পান্ডর্তণ নামক দুইস্থানে প্রাচীন মন্দির দেখিতে নামিয়াছিলাম। ইসলামাবাদ কাশ্মীরের একটি প্রধান বাণিজ্যস্থান; ঝিলাম নদী এখান হইতেই বড় হইয়াছে; ইহার পর আর নৌকাতে যাওয়া না। আমরা ইসলামাবাদ হইতে ডান্ডিতে ভাওয়ান, মার্তণ্ড, আচ্ছাবল, ভেরানাগ প্রভৃতি স্থানে দেখিতে গিয়াছিলাম। ভাওয়ান ইসলামাবাদের অতি নিকটে, এখানে অনেক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বাস, এখানে একটি প্রস্রবনের জল বাঁধাইয়া তাহাতে অনেক মাছ রাখা হইয়াছে, অমরনাথ যাত্রীরা এই রাস্তাতে যান এবং এখানে বিশ্রাম করেন। যাত্রীদের জন্য পস্রবনের পাশে একটি ধর্মশালা নির্মিত হইয়াছে। পাহাড়ের নীচ হইতে ক্রমাগত জল বাহির হইতেছে দেখা যায়।

পথে মার্তণ্ড নামে একটি পুরাতন মন্দির দেখিলাম। ইহা সহস্র বৎসর পূর্বে সূর্যের পূজার নিমিত্ত প্রস্তুত হইয়াছিল। এখনও তাহার ভগ্নাবশেষ রহিয়াছে, এই মন্দির দেখিলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, কাশ্মীর দেশ সমগ্রই এককালে একটি প্রকাণ্ড হ্রদ ছিল; চতুর্দিকে জলের মধ্যে উচ্চতম শিখরে এই মন্দির নির্মিত হইয়াছে। আচ্ছাবল ও ভেরানাগ, এই দুইস্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবর্ণনীয়; এই দুইস্থানেও নূরজাহানের প্রমোদ-গৃহ আছে। আমাদের সময় বেশি না থাকাতে এখান হইতেই আমাদের ফিরিতে হইল নতুবা কাশ্মীরে দর্শনীয় আরও অনেকস্থান আছে। যদি আবার কখনও যাইবার সুবিধা হয়, তবে সেই সব স্থানের বিষয় তোমাদিগকে জানাইব।


ভেনিস

ই টালিতে ভ্রমণ করিবার সময় একদিন অপরাহ্নে আমাদের রেলগাড়ি জলরাশির মধ্যে সুদীর্ঘ সেতুর উপর দিয়া ধীরে ধীরে গমন করিতেছিল।

প্রথমত এই দৃশ্যে একটু উদ্বিগ্ন হইলাম। পরে কৌতূহল ও বিস্ময়ে সেই ফেনিল জলরাশির সৌন্দর্য অনুভব করিতে লাগিলাম। দেখিতে দেখিতে সন্ধ্যা হইল, আমাদের গাড়ি স্টেশনে পৌঁছিল। অন্যান্য স্টেশনে ঘোড়ার গাড়ি থাকে কিন্তু এখানে গাড়ি চলে না। অন্যান্য শহরের ন্যায় এখানে রাস্তা নাই-একস্থান হইতে অন্যস্থানে যাইতে হইলে, খাল দিয়া যাইতে হয়। নৌকা এদেশের বাহন। এদেশের নৌকাকে 'গণ্ডোলা' বলে। স্টেশনে অনেক গণ্ডোলা যাত্রীদের আশায় অপেক্ষা করিতেছিল। মাঝিরা দেখিতে দেখিতে আমাদের জিনিসপত্র নৌকায় উঠাইয়া লইল। রাত্রিকালে অপরিচিত জলরাশির মধ্য দিয়া কোথায় যাইতেছি ভাবিয়া শঙ্কিত হইলাম। নৌকাখানি কিন্তু অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নিঃশব্দে বৃহৎ খাল হইতে ছোট ছোট কতকগুলি খাল অতিক্রম করিয়া হোটেল অভিমুখে চলিল।

এই জলময় নগরটির উৎপত্তির বৃত্তান্ত শুনিলে আরব্য উপন্যাসের গল্প বলিয়া মনে হইবে। সমুদ্রে প্রবাল-দ্বীপ যেমন একটু একটু করিয়া পরে বৃহৎ হইয়াছে। ভেনিস শহরটিও সেইরূপ সমুদ্র মধ্যে সৃষ্ট হইয়াছে। এখন ভেনিসকে 'এড্রিয়াটিক সাগরের রানি' বলে, কিন্তু পূর্বে ইহার অস্তিত্বই ছিল না।

মনুষ্য স্বীয় বুদ্ধিবলে ওই এড্রিয়াটিক সাগরের সহিত যুদ্ধ করিয়া সমুদ্র মধ্যে ভেনিস শহর নির্মাণ করিয়াছে। মানুষ-মানুষের নিকট জমি কাড়িয়া লয়, কিন্তু মানুষ সমুদ্র হইতে তাহার অংশ কাড়িয়া লইয়া রাজ্য বৃদ্ধি করে, এমন কখনও শুনিয়াছ কি? ভেনিস তাহার দৃষ্টান্ত।

'আল্প' ও 'টাইরল' হইতে ছয়টি স্রোতস্বিণীর জল এস্থানে সাগরের সহিত মিলিত হইত, ক্রমে তাহাদের মৃত্তিকা ও বালুকার স্তূপ জমিয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ গঠিত হইতে লাগিল। ভাঁটার সময় দ্বীপগুলি ভাসিয়া উঠিত, আবার জোয়ারের সময় ডুবিয়া যাইত। এরূপ স্থানে কেহ ইচ্ছা করিয়া বাস করে না, কিন্তু বিপদে পড়িলে লোকের বুদ্ধি খুলিয়া যায়। ভেনিস নামে এক জাতীয় লোক পাহাড় হইতে শত্রুর তাড়নায় পলায়ন করিয়া এই জলমগ্ন দ্বীপে আশ্রয় লয়। তাহারা চতুর্দিকে কাঠের খুঁটি পুঁতিয়া দ্বীপগুলিকে বাসস্থানের উপযুক্ত করিয়া লইল। চারিদিকে জল, সুতরাং শত্রুরা এখানে তাহাদিগকে আক্রমণ করিতে পারিল না।

* ক্রমে লোকসংখ্যা বাড়িতে লাগিল সেই সঙ্গে-সঙ্গে শহরটিও বাড়িতে লাগিল। এরূপে ক্ষুদ্র স্থানটি বৃহৎ হইয়া উঠিল। তখন সকলে মিলিয়া একজন রাজা মনোনীত করিয়া, বাণিজ্য ও রাজ্যবিস্তার করিতে মনোনিবেশ করিল।

রাজা প্রথমে দেশরক্ষার বন্দোবস্ত করিলেন। সেতু দ্বারা দ্বীপগুলি একত্র করা হইল, যাতায়াতের সুবিধাব জন্য খাল কাটানো হইল। সমুদ্রের ঢেউ যাহাতে শহরটিকে ভাসাইয়া না লইতে পারে, এজন্য বড় বড় বাঁধ প্রস্তুত হইল। ভেনিস অতি শীঘ্রই বাণিজ্যে প্রাধান্য লাভ করিল

ক্রমে প্রচুর ঐশ্বর্য লাভ করিয়া ভেনিস ইউরোপের সকল জাতির মধ্যে প্রধানস্থান অধিকার করিল। তেরোশত বৎসর অতুল খ্যাতি ও প্রাধান্য লাভ করিয়া ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে এই দেশ ফরাসিদের হস্তগত হয়। ভেনিসের ইতিহাস পাঠ করিলেও তাহার পুরাতন কীর্তির কথা শুনিলে চমৎকৃত হইতে হয়।

আমরা একখানি ক্ষুদ্র নৌকা লইয়া শহর ভ্রমণে বাহির হইলাম। পূর্বেই বলিয়াছি, ভেনিসে ঘোড়ার গাড়ি নাই, নৌকা ভেনিসবাসীদের প্রধান বাহন। এই নৌকাগুলির বিষয় কিছু লিখিতেছি। এক এক জন মাঝি কালো কাপড় পরিয়া, এক-একখানি দাঁড় হাতে লইয়া, কালো মখমলে মণ্ডিত এই গন্ডোলাগুলিকে অতি ক্ষিপ্রগতিতে চালাইয়া থাকে। পূর্বে নগরবাসীরা নিজ-নিজ গণ্ডোলা বহুমূল্য আস্তরনে সজ্জিত করিত, কিন্তু কোনো কারণে আটশত বৎসর পূর্বে নিয়ম হইল, যে সকল গন্ডোলাই কৃষ্ণবর্ণ কাপড়ে আচ্ছাদিত করিতে হইবে। সেই অবধি এখন পর্যন্ত গণ্ডোলাগুলি কালো মখমলে মণ্ডিত। কেবলমাত্র বিদেশিরা রাজদূতের গণ্ডোলা রঙ্গিনবস্ত্রে আচ্ছাদিত। ভেনিসবাসীরা ষড়যন্ত্র করিতে বিশেষ পটু। অন্ধকার রাত্রিতে কালো রঙের নৌকায় নিঃশব্দে যাতায়াত করে, কেহ লক্ষ্য করিতে পারে না। অন্যদিকে বিদেশি রাজদূতের নৌকা বিশেষরূপে সজ্জিত বলিযা, তাহার গতিবিধি সহজেই জানা যায়। মাঝিরা এক এক দাঁড় লইয়া কত দ্রুত গতিতে যাতায়াত করে, তাহা দেখিলে আশ্চর্য হইতে হয়। বহুসংখ্যক নৌকার মধ্যে অবাধে চলিয়া যায়, কোনো বিপদ ঘটে না।

আমরা 'সেন মার্কো' নামক স্থানে গেলাম। ইহা একটি চতুষ্কোণ উন্মুক্ত স্থান। ইউরোপে এই স্থানটি অতিশয় বিখ্যাত। এই স্থানে সন্ধ্যার সময় সম্ভ্রান্ত লোকের সমাগম হয়; হাজার হাজার লোক সন্ধ্যাকালে এখানে আসিয়া চা, কফি পান করেন ও গল্প করেন। ভেনিস শহর ভ্রমণ করিতে বাহির হইলে, প্রতিপদে প্রস্তরস্তম্ভে ঐতিহাসিক কীর্তি দেখা যায়। এই স্থানটির চতুর্দিকেই ঐতিহাসিক চিহ্নে পূর্ণ। একদিকে 'কেম্পেনিল' নামক উচ্চস্তম্ভ। উহা আমাদের

মনুমেন্ট অপেক্ষা অনেক উচ্চ। অনেক সিঁড়ি বাহিয়া আমরা উপরে উঠিলাম। নেপোলিয়ান ভেনিস জয় করিয়া অশ্বপৃষ্ঠেই এই দুর্গম সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়াছিলেন।

সেন মার্কোর চারিদিকে দোকান, এই সকল দোকানে নানারকম মনোহারী দ্রব্য সাজানো। তাহার মধ্যে ভিনিসিয় কাচ জগদ্বিখ্যাত। সেই সকল কাচের দ্রব্যের রঙ কিরূপ সুন্দর তাহা বর্ণনা করা যায় না, যেন রামধনু খেলিতেছে।

এই সকল দোকানে বেড়াইতে বেড়াইতে দেখিতে পাইলাম, প্রাঙ্গণ অসংখ্য পারাবতে পূর্ণ হইতেছে; শুনিলাম রাজকোষ হইতে ইহাদিগকে প্রত্যহ দুই ঘটিকার সময় আহার্য দেওয়া হয়।

বহুশত বৎসর পূর্বে কপোতের সাহায্যে ভেনিসবাসীরা একবার বিপদ হইতে উদ্ধার পাইয়াছিল। সেই অবধি নগরের অধিবাসীগণ ইহাদের সযত্নে প্রতিপালন করেন। আমরা এই স্থান হইতে সন্নিহিত রাজপ্রাসাদ দেখিতে গেলাম।

এই রাজবাটীতে বিখ্যাত চিত্রকরদিগের চিত্র, পুরাতনকালের অস্ত্র ও যুদ্ধ সজ্জাদি এবং পুরাতন পুস্তকাদি সযত্নে রক্ষিত। একস্থানে আমরা ছয়শত বৎসরের অতি পুরাতন একখানি ম্যাপ দেখিলাম। সেই ম্যাপের সহিত আধুনিক ম্যাপের অনেক প্রভেদ। কারণ তখন পৃথিবীর বৃত্তান্ত খুব কমই জানা ছিল। ভূগোল বিবরণ লিখিতে তখনকার ছাত্রদের আর অধিক পরিশ্রম করিতে হইত না।

রাজপ্রাসাদের দ্বারে প্রকাণ্ড সিংহমূর্তি, শহরের অন্যান্য স্থানেও সিংহমূর্তি স্থাপিত আছে। কাহারও নামে বে-নামা দরখাস্ত কিম্বা অন্য অভিযোগ আনিতে হইলে, কাগজে লিখিয়া এই সকল সিংহমূর্তির মুখ-গহ্বরে নিক্ষেপ করিলে তাহা রাজদরবারে পৌঁছিত। এই প্রকারে কত নির্দোষ ব্যক্তি বিনা অপরাধে ঘোরতর অত্যাচার সহ্য করিত তাহার সংখ্যা করা যায় না।

যাহার নামে মিথ্যা অভিযোগ হইয়াছে, হঠাৎ সে একদিন অদৃশ্য হইত। অন্ধকার রাত্রে গুপ্তচর তাহাকে ধরিয়া কারাগারে নিক্ষেপ করিত, পরদিন গুপ্ত-মন্ত্রণা গৃহে তাহার দণ্ড স্থির হইত। রাজার নামে ১০ জন মন্ত্রীই সমুদয় বিচার করিতেন। আমরা সেই ভীষণ মন্ত্রণা-গৃহ দেখিতে গেলাম। এখানে কত হতভাগ্য যাতনা ভোগ করিয়াছে, মনে করিলে শরীর কাঁপিয়া উঠে। আমাদের দেশের নবাবি আমলের নিষ্ঠুরতার কথা অনেক শুনা যায়, কিন্তু ইউরোপে ২/১ শত বৎসর পূর্বে বিচারের নামে কত নৃশংস অত্যাচার হইত, তাহা কল্পনা করা যায় না।

মন্ত্রণা-গৃহটি খালের এক পারে। বন্দিগণ খালের অপর পার হইতে একটি সেতুর উপর দিয়া আনিত হইত, যে হতভাগ্য একবার এই সেতু অতিক্রম করিত তাহার মৃত্যু নিশ্চয়!

সেতু পার হইবার সময় সে শেষবার এই পৃথিবী দেখিয়া লইত। এইজন্য এই সেতু Bridge of Sights বলিয়া অভিহিত।

বন্দিরা মন্ত্রণা-গৃহ হইতে নিকটস্থ কারাগারে নীত হইত, সেই কারাগার যেন সাক্ষাৎ যমপুরী!-মাটির নীচে বায়ু ও আলোক প্রবেশ করিবার পথ নাই। প্রাচীর সংলগ্ন শৃঙ্খলে বন্দি আবদ্ধ থাকিত, কেবল মৃত্যুর আঘাতে সেই শৃঙ্খল ভগ্ন হইত।

আমরা এই স্থান হইতে যখন বাহিরে ফিরিয়া আসিলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। অস্ত প্রায় সূর্যের কিরণে আড্রিয়াটিকের জল ঝকমক করিতেছিল। দূরে সারি সারি নৌকার শ্রেণি। লোকে বিচিত্র বেশে দলে দলে ভেনিসিয়ান গণ্ডোলাতে বায়ু সেবনে বাহির হইয়াছে। কোনো কোনো নৌকা গায়কদলে পূর্ণ, তাহাদের কণ্ঠোখিত মধুর সঙ্গীতে আকাশ প্রতিধ্বনিত হইতেছিল।

5
Articles
জগদীশচন্দ্র সেরা রচনা সম্ভার
0.0
শ্রী জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা কিছু উল্লেযোগ্য অবিস্মরণীয় কাহিনী নিয়ে রচিত একটি অব্যক্ত জীবন প্রসারিত রচনা কাহিনী সমগ্র।
1

প্রসঙ্গ জগদীশচন্দ্র

24 December 2023
0
0
0

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসু রতবর্ষের প্রাচীন গৌরবের কথা উত্থাপিত হইলে আমরা সচরাচর আর্য ঋষিগণের ধর্মোন্নতি এবং আর্য মনীষীগণের দার্শনিক জ্ঞানের কথাই ভাবিয়া থাকি। সংস্কৃত ব্যাকরণ, কাব্

2

অন্যান্য রচনা

25 December 2023
0
0
0

উদ্ভিদের হৃৎস্পন্দন [ গত এক বৎসরের মধ্যে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে উদ্ভিদজীবনের ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে তিনটি গূঢ় রহস্য উৎঘাটিত হইয়াছে। এই আবিষ্কার সমগ্র বৈজ্ঞানিক জগৎকে চমৎকৃত করিয়াছে। গতমাসে দার্জিলিং-এর গভনম

3

ভ্রমণ বিষয়ক রচনা

25 December 2023
0
0
0

লুপ্ত নগরী ই 'টালির দক্ষিণ প্রদেশ অতি রমণীয়, সমস্ত প্রদেশটি যেন একটি উদ্যান। এইরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সচরাচর দেখা যায় না। রোমানরা এই প্রদেশে সমুদ্রের উপকূলে সমৃদ্ধিশালী নগর নির্মাণ করিয়া অবকাশের সময়

4

বিবিধ রচনা

26 December 2023
0
0
0

নাদির শা-র শাস্তি ই তিহাস পাঠ করিলে ভারতভূমি যে প্রকৃতই রত্নগর্ভা তাহাতে আর সন্দেহ থাকে না। ধনধান্যের জন্য আমাদের এই মাতৃভূমি বহুকাল হইতে পৃথিবীর অন্যান্য জাতিদের প্রলোভনের বস্তু হইয়া যায়। গ্রিক দেশী

5

বক্তৃতাবলী

26 December 2023
0
0
0

ছাত্রসমাজের প্রতি* ছাত্রসমাজের সভ্যগণ, তোমাদের সাদর সম্ভাষণে আমি আপনাকে অনুগৃহীত মনে করিতেছি। তোমবা আমাকে একান্ত বিজ্ঞ এবং প্রবীণ মনে করিতেছ। বাস্তবপক্ষে যদিও জরা আমার বাহিরের অবয়বকে আক্রমণ করিয়াছে

---