shabd-logo

বক্তৃতাবলী

26 December 2023

2 Viewed 2

ছাত্রসমাজের প্রতি*

ছাত্রসমাজের সভ্যগণ,

তোমাদের সাদর সম্ভাষণে আমি আপনাকে অনুগৃহীত মনে করিতেছি। তোমবা আমাকে একান্ত বিজ্ঞ এবং প্রবীণ মনে করিতেছ। বাস্তবপক্ষে যদিও জরা আমার বাহিরের অবয়বকে আক্রমণ করিয়াছে কিন্তু তাহার প্রভাব অন্তরে প্রবেশ করিতে পারে নাই। আমি এখনও তোমাদের মতো ছাত্র ও শিক্ষার্থী। এখনও স্কুলে যাইবার পুরাতন গলিতে পৌঁছিলে স্মৃতিদ্বারা অভিভূত হই। আমার শৈশবের শিক্ষক দর্শনে এখনও হৃদয় চিরন্তন ভক্তিপ্রবাহে উচ্ছ্বসিত হয়। তবে তোমাদের অপেক্ষা শিক্ষার জন্য দীর্ঘতর সময় পাইয়াছি; অনেক ভুল সংশোধন করিতে পারিয়াছি এবং অনেকবাব পথ হারাইয়া পরিশেষে গন্তব্য পথের সন্ধান পাইয়াছি। আজ যদি কোনো ভুলচুক কিম্বা দুর্বলতার বিরুদ্ধে তীব্রভাষা ব্যবহার করি তবে মনে রাখিও যে সে সব করাঘাত হইতে নিজেকে কোনোদিন বঞ্চিত করি নাই। কুসুমশয্যায় সুপ্ত থাকিবার সময় অতীত হইয়াছে; কণ্টকশয্যাই আমাদিগকে এখন জাগরিত রাখিবে।

এখন আমাদের দেশে সচরাচর দুই শ্রেণির উপদেষ্টা দেখিতে পাওয়া যায়। কেহ- কেহ আমাদের জাতীয় দুর্বলতাব চিত্র অতি ভাষণরূপে চিত্রিত করেন। যে দেশে এরূপ জাতিভেদ ও দলাদলি, যে দেশ দাসত্বসুলভ বহু দোষে দোষী, যে দেশে পরস্পবে এত হিংসা ও পরশ্রীকাতরতা দেখা যায়, সে দেশে কি কোনোদিন উন্নতি হইতে পাবে? আশ্চর্যের বিষয় এই যে এইরূপ ভয়ানক ভবিষ্যদবাণীর পর তাহাদের নিদ্রার কোনো ব্যাঘাত হয় না। যদি যথার্থই বুঝিয়া থাক যে দেশে এরূপ দুর্দিন আসিয়াছে তবে কেন বদ্ধপরিকর হইয়া তাহার প্রতিবিধান করিতে চেষ্টা কর না। আমি দেখিতে পাই ছাত্রদের মধ্যে, আমাদের নেতারা কেন এ-কাজ করিলেন, কেন এ-কাজ করিলেন না, এরূপ বচসা দ্বারাই সময় অতিবাহিত হয়। পরের কর্তব্য কি তাহা নিষ্পত্তি করিবার আমি কে? ম কি করিতে পারি ইহাই কেবল আমার ভাবিবার বিষয়।

আবার অন্যদিকে একদল আছেন যাহারা অতীতকালের কথা লইয়া বর্তমান ভুলিয়া থাকেন। জ্ঞান ও বিজ্ঞানে আমাদের পূর্বপুরুষদের কিছুই অবিদিত ছিল না। আমাদের পূর্ব ঐশ্বর্য যদি এতই মহান তবে আমাদের অধঃপতনের হেতু কি? ইহার প্রতিবিধান কি নাই? আমরা যদি সেই মহান পূর্বপুরুষদের প্রকৃত বংশধর হই তাহা হইলে আমরা নিঃসন্দেহে পূর্ব গৌরব অধিকার করিতে পারিবই পারিব।

পৃথিবীব্যাপী ভ্রমণ উপলক্ষে আমি দ্বিবিধ জাতীয় চরিত্র লক্ষ্য করিয়াছি। একজাতীয় চরিত্র এই যে, তাঁহারা গতকালের স্মৃতি লইয়া বৃথাগর্বে ভুলিয়া আছেন। পৃথিবী যে স্থাবর নয়, ইহা যে চিরপরিবর্তনশীল একথা তাহাদের বোধগম্য হয় না। এইসব ধর্মাক্রান্তজাতির চিহ্ন পর্যন্ত পৃথিবী হইতে মুছিয়া যাইতেছে। ইজিপ্ট আসীরিয়া এবং ব্যাবিলন-ইহাদের গত স্মৃতি ছাড়া আর কি আছে?

চীনদেশে ভ্রমণকালে সে স্থানের বিখ্যাত কয়েকজন পণ্ডিতের সহিত আমার পরিচয় হয়। তখন জাপান মাঞ্চুরিয়া গ্রাস ব্যাপারে প্রবৃত্ত ছিল। আমি আমার চিনা বন্ধুদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনারা কি করিয়া চীনের স্বাধীনতা রক্ষা করিবেন? তখন তাঁহারা বলিলেন, চীনদেশের মতো যে দেশ বহু প্রাচীনকাল হইতে সভ্যতার শীর্ষস্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছে, সে দেশকে কি সেদিনের জাপান পরাভূত করিতে পারে? বরঞ্চ আমাদের সভ্যতাই জাপানকে পরাস্ত করিবে। এইসব কথা শুনিয়া বুঝিতে পারিলাম যে শীঘ্রই চীনের সৌভাগ্য সূর্য অস্তমিত হইবে।

অন্যদিকে তাঁহাদের প্রতিদ্বন্দ্বী জাপান পুরাতন কথা বলিয়া সময় অপচয় করিতে চাহেন না। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ লইয়া তাঁহারা যথেষ্ট ব্যস্ত। তাঁহাদের নিকট শুনিলাম যে মানবসমাজের নিয়ম আর Law of hydrostatic pressure একই। যে স্থানে pressure বেশি সে স্থান হইতে জলস্রোত অল্প pressure-এর দিকে ধাবিত হয়। জীবনস্রোতও সজীব হইতে নির্জীবের দিকে। পৃথিবীতে সজীব নির্জীবের স্থান অধিকার করিবে।

অথচ সেই জাপানে অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে বিদ্যা ও বুদ্ধিতে ভারতবর্ষীয় ছাত্র সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানিদেরও উপরে উচ্চস্থানে অধিকার করিয়াছে। বিদ্যাবুদ্ধির ত্রুটি নাই, তবে এরূপ দুর্দশা কেন।

আমি আজ ত্রিশ বৎসর যাবৎ শিক্ষকতার কাজ করিয়াছি। ইহার মধ্যে ন্যূনকল্পে দশ হাজার ছাত্রের সহিত আমার পরিচয় হইয়াছে। তাহাদের চরিত্রে কী কী গুণ তাহা জানি আর কী কী দুর্বলতা তাহাও উপলব্ধি করিতে পারিয়াছি। প্রধানত তাহাদের স্বভাব অতি কোমল, সাধারণত তাহারা নম্রপ্রকৃতি, অতি সহজেই তাহাদের হৃদয় অধিকার করা যায়; এক কথায় তাহারা বড় ভালোমানুষ, একবার পথ দেখাইয়া দিলে অনেকেই সেই পথ অনুসরণ করিতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ জলপ্লাবন, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি দুর্ঘটনার সময় ছাত্রদের মধ্যে অদ্ভুত কার্যপরায়ণতা দেখা গিয়াছে। এতগুলি ছেলে কি সুন্দরভাবে নিজেকে organise করিয়াছে। বেশি কথা না বলিয়া অতি সংযতভাবে কি সুন্দররূপে লোকসেবা করিয়াছে। এরূপ শুশ্রূষা করিবার ক্ষমতা, এরূপ ধৈর্য, এরূপ কষ্ট সহিষ্ণুতা, এরূপ অসন্তুষ্টির অভাব সচরাচর দেখা যায় না। আমি যেসব গুণ বর্ণনা করিলাম তাহা পুরুষে প্রায় দেখা যায় না, নারীজাতিই এসব মহৎগুণের অধিকারিণী।

ইহার বিপরীত কেন্দ্রে কোনো কোনো পুরুষ দেখিতে পাওয়া যায় যাহাদের চরিত্র সম্পূর্ণ বিভিন্ন প্রকার। তাঁহাদের ধৈর্য সহিষ্ণুতা একেবারেই নাই, তাঁহারা কিছুই মানিয়া লইতে চাচ্ছেন না। তাঁহারা সর্বদাই অসন্তুষ্ট, তাঁহাদের হৃদয় দুর্জয় ক্রোধে পূর্ণ। এইরূপ লোকের জাতীয় জীবনে স্থান কোথায়?

আমি এইরূপ প্রকৃতির একজনকে জানিতাম তিনি চিরস্মরণীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সমাজের নির্মম বিধানে তাঁহার ক্রোধ সর্বদা উদ্দীপ্ত থাকিত। আশ্চর্য এই যে ক্রোধ ও মমতা অনেকসময় একাধারেই দেখিতে পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগরের ন্যায় কোমলহৃদয় আর কোথায় দেখিতে পাওয়া যায়? তিনি কোনো বিধানই মানিয়া লইতেন না; অসীম শক্তিবলে তিনি একাই সমাজের কঠিন শৃঙ্খল ভগ্ন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

এই প্রকার দুর্দান্ত ও ক্রোধপরায়ণ লোক কখনও কখনও জন্মগ্রহণ করিযা থাকেন। তাহাদের জীবন নিষ্ফলতাতেই পর্যবসিত হয়, তাহাদের ধৈর্য নাই, তাহাদের সহিষ্ণুতা নাই। দেশব্যাপী রোগের সেবা ও পরিচর্যা? পীড়ারও অন্ত নাই, শুশ্রুষারও অন্ত নাই, এরূপ কতকাল চলিবে? ইহার কি প্রতিবিধান নাই? কি করিযা ম্যালেরিয়া দেশ হইতে দূর করা যায়? এরূপ জঙ্গল ও ডোবার মধ্যে মানুষ কি করিয়া বাঁচিতে পারে? ইহার প্রতিকার নিশ্চয়ই আছে।

তাছাড়া আরও শত শত কার্য আছে, সাধারণের মধ্যে শিক্ষা প্রচার, জ্ঞান প্রচার, শিল্প ও বিজ্ঞানের উন্নতি, দেশবিদেশে ভারতের মহিমা বৃদ্ধি করা। দুর্বল ভালমানুষের দ্বারা এসব হইবে না, এইসবের জন্য বিক্রমশীল পুরুষের আবশ্যক, তাহাদের পূর্ণ শক্তির আঘাতে সব বাধাবিঘ্ন মিশিয়া যাইবে।

আর যে শক্তির ক্রোড়ে আমরা এতদিন নিশ্চেষ্ট ও সুপ্তভাবে জীবনযাপন করিয়াছি, জগৎ হইতে সেই শান্তি অপসৃত হইতেছে। শান্তি কোনো জাতির পৈতৃক অথবা চিরসম্পত্তি নহে; বল দ্বারা, শক্তি দ্বারা, জীবন দ্বারা শাস্তি আহরণ করিতে এবং রক্ষা করিতে হয়। বলযুক্ত হও, শক্তিমান হও, এবং তোমাদেব শক্তি দেশের সেবায় এবং দুর্বলের সেবায় নিয়োজিত হউক।



বসু বিজ্ঞান মন্দিরের দশমবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে আচার্য বসুর ভাষণ*

স্থান: বসু বিজ্ঞান মন্দির

'শবৎসর পূর্বে মানবজাতির ভাগ্যাকাশ যখন মহাযুদ্ধের ঘনঘটায় সমাচ্ছন্ন ছিল, সেসময় দ আমি এই বিজ্ঞানমন্দির মানবজাতির কল্যাণে উৎসর্গ করি। এইরূপ মহাসমস্যার সময়ই মানুষ অসত্যের মধ্য হইতে সত্যকে বাছিয়া লইতে পারে এবং যাহা চিরন্তন সত্য তাহারই সাধনায় আত্মনিয়োগ করিতে পারে-তখনই সত্য সাধনার জন্য মন্দির নির্মিত হয়। একক শক্তির পক্ষে যাহা অসম্ভব আমি তাহাই সম্ভব করিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম। এই বিজ্ঞান মন্দির যে নিষ্ঠার স্মৃতি-উৎসব করিতেছে, সে নিষ্ঠার অর্থ এই যে, কেহ যদি কোনো মহৎ কার্যের জন্য সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করে তাহা হইলে বন্ধ দ্বার তাহার নিকট উন্মুক্ত হইবে, যাহা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব তাহা তাহার পক্ষে সম্ভব হইবে। প্রাণী এবং অ-প্রাণী সংক্রান্ত নূতন নূতন বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধান চেষ্টাই এই বিজ্ঞান মন্দিরেব উদ্দেশ্য। জড় পদার্থের মধ্যে যে চৈতন্যের সাড়া পাওয়া গিয়াছে এবং উদ্ভিদজীবন যেরূপ অপ্রত্যাশিত আত্মপ্রকাশ করিয়াছে তাহার ফলে পদার্থ-বিজ্ঞান, শরীর-বিজ্ঞান, ঔষধি-বিজ্ঞান, কৃষি-বিজ্ঞান এবং মনো- বিজ্ঞান সম্বন্ধে অনুসন্ধানের ক্ষেত্র বিশেষরূপে বৃদ্ধি পাইয়াছে। ইহার গুরুত্ব যে শুধু সিদ্ধান্তাত্বক তাহা নহে, ইহার ব্যবহারিক গুরুত্বও আছে।

যাহারা অনন্য তৎপর হইয়া অহৈতুকী জ্ঞানান্বেষণের জন্য চরিত্র বল ও দৃঢ় নিষ্ঠা সহকারে সমগ্র জীবন উৎসর্গ করিতে পারিবে আমি তাহাদিগকেই আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিতে আহ্বান করিয়াছিলাম। জাতিধর্ম, পুং-স্ত্রী নির্বিশেষে চিরকাল সকলের মধ্যে যতদূর সম্ভব জ্ঞান প্রচার এই মন্দিরের আব একটি উদ্দেশ্য। এই বিজ্ঞান মন্দিরের স্বল্প স্থানের মধ্যে যতদূর সম্ভব-সকল দেশের কর্মীকে সুযোগ দেওয়ারও আমার ইচ্ছা আছে। বহু শতাব্দী পূর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান হইতে বিদ্যার্থীগণ আসিয়া নালন্দা এবং তক্ষশীলায় সমবেত হইত, আমি আমার দেশের সেই প্রথারই অনুসরণ করিতেছি।

আমার আশা এই যে এই স্থানে মানবজাতির কল্যাণের জন্য যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কার হইবে, তাহার ফলে এই কথাটি স্বীকৃত হইবে যে, ভারতের দান ভিন্ন জগতের জ্ঞানভাণ্ডার অসম্পূর্ণ থাকিযা যাইবে। আমি আরো আশা করিয়াছিলাম যে, এই বিজ্ঞান মন্দিরের শিক্ষা এবং সাফল্য এদেশের লোকের মধ্যে যে আবিষ্কার ও উদ্ভাবনী শক্তি রহিয়াছে তাহা প্রমাণ করিবে এবং তাহার দেশের নিহীত সম্পদ বৈজ্ঞানিক উপায়ে কাজে লাগাইতে পারিবে।

প্রাণী ও অ-প্রাণী

সত্যের অনুসরণ করিতে করিতে আমি অজ্ঞাতসারে জড়বিজ্ঞান এবং শারীরবিজ্ঞানেব সীমারেখায় আসিয়া পৌঁছাই। আমি সবিস্ময়ে দেখিতে পাই যে, জড় ও চৈতন্যের সীমারেখা ক্রমশ লোপ পাইতেছে। জড়মাত্রই অচেতন নহে। চতুর্দিকে শক্তির খেলা দেখিয়া জড়ও সাড়া দেয়। ধাতব পদার্থ, উদ্ভিদ এবং জীব সকলেই যেন একই নিয়মের অধীন। সকলেই ক্লান্তি ও অবসাদের পরিচয় দেয়, জীবনের পরিচয় দেয়, আবার মৃত্যুর মতো অসাড়তার লক্ষণও তাহারা প্রকাশ করে। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে একথা ঘোষণা করা হয়। এই আবিষ্কারের পূর্ণ মূল্য বুঝিতে দীর্ঘ ২৭ বৎসর সময়ের আবশ্যক হইয়াছে। এবৎসর আমেরিকায় রাসায়নিকদের মহাসভায় ঠিক-ঠিক আমার কথাগুলি পুনরাবৃত্তি করিয়া সভাপতি মহোদয় বলিয়াছেন যে, অ-জৈব ও জৈব জগতে যেমন কোনও পার্থক্য নাই, তেমনি প্রাণী ও অপ্রাণীর মধ্যেও কোনো পার্থক্য নাই বলিয়া বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে একটা বদ্ধমূল ধারণা জন্মিতেছে।

অঙ্গসঞ্চালনই প্রাণের লক্ষণ। অজৈব পদার্থও এই সচলতার লক্ষণ প্রকাশ করিয়া থাকে, এই দেখুন একটি পুকুর। ওপরে শেওলা ভাসিতেছে। জলের মধ্যে অজৈব পদার্থের জীব জড়াইয়া দিলাম, দেখুন তাহারা প্রাণীর মতো কেমন দৌড়াদৌড়ি করিতেছে। আমি জলের উপরিভাগ জমাইয়া দিতেছি, দেখুন ভাসমান বরফ দেখা যাইতেছে। বরফের হ্রদে এই বীজগুলির চলচ্ছক্তি রুদ্ধ হইয়াছে।

খণ্ডসত্য সংগ্রহ করিয়া ভারতীয়গণ কখনও সন্তুষ্ট থাকে না। একটা তথ্য আবিষ্কার করিলেই সে নিশ্চিন্ত হয় না। অমনি তাহার মনে প্রশ্ন ওঠে, বিশ্বসৃষ্টির সহিত এই ব্যাপারের কি সম্পর্ক? আপাতদৃষ্টিতে পারস্পরিক বিরোধী সত্যগুলির সংযোগসূত্র কোথায় তাহার সন্ধানে সে ব্যস্ত হয়। বহু কষ্টে সে যে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করিয়াছে সে সমস্ত একত্র করিয়া সে বহুর মধ্যে ঐক্য উপলব্ধি করে।

উদ্ভিদ ও প্রাণী

জড় ও সুব্যক্ত প্রাণী জগতের অন্তরালে রহিয়াছে, অব্যক্তপ্রাণ উদ্ভিদের রাজ্য। সকলের জন্যই একটা অস্পষ্ট ধারণা আছে যে, উদ্ভিদের প্রাণ আছে; কিন্তু সাধারণ প্রাণীর মতোই কি তাহাদের প্রাণক্রিয়া নিষ্পন্ন হয়? বিশেষজ্ঞগণ সকলেই বলেন যে, উদ্ভিদের প্রাণক্রিয়া একটু স্বতন্ত্র রকমের। প্রাণীদেহের তন্ত্রীগুলির সংকোচ, প্রসারণ প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য আছে। সাধারণ উদ্ভিদ নাকি আঘাতে সাড়া দেয় না, তাহাদের নাকি কোন স্পন্দমান তন্ত্রী নাই। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক। এই সমস্ত ভ্রমাত্মক ধারণাই উদ্ভিদ জীবনের কার্যকলাপ সম্বন্ধে অনুসন্ধানের পথ রোধ করিয়া রাখিয়াছে।

১৯০১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে রয়াল সোসাইটির সম্মুখে আমি দেখাই যে, বৈদ্যুতিক প্রবাহের আঘাতে সকল উদ্ভিদই সাড়া দেয় এবং তাহা হইতেই উদ্ভিদের অস্তিত্বের প্রাণ প্রমাণ হয়; কিন্তু সে সময় আমার উক্তি প্রচলিত মতবাদের বিরোধী ছিল বলিয়া ঘোর বিতর্ক উপস্থিত হয়।

নূতন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে প্রচলিত মতবাদকে অস্বীকার করা ভিন্ন উপায় নাই, যিনি নূতন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করিতে চাহেন, তিনি তাহা জানেন; সুতরাং আমি আশা করি নাই যে, আমার মতবাদ জীবিতকালেব মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করিবে। কিন্তু যে প্রাণশক্তি একটা জাতিব ভাগ্যনিয়ন্ত্রণ করে, সে শক্তির ইচ্ছা অন্যরূপ। যে মহাশক্তি আমাকে আমার চেষ্টায় নিরত রাখিয়াছে এবং যাহার ফলে আমি সত্য প্রতিষ্ঠা করিতে সমর্থ হইয়াছি, আমি সেই মহাশক্তির নিকট মস্তক অবনত করিতেছি।

আমার আবিষ্কারের ফল এতকাল প্রচলিত মতবাদের এত বিরোধী যে, আমার উদ্ভাবিত যন্ত্রগুলি ঠিক কিনা, তৎসম্বন্ধে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বসন্তকালে "টাইমস্" পত্রিকায় এক বিতর্ক উপস্থিত হয়। রয়াল সোসাইটির কতিপয় বিশিষ্ট সদস্য লইয়া গঠিত একটি কমিটি আমার যন্ত্রগুলি পরীক্ষা করেন। খ্যাতনামা পদার্থবিদ স্যার উইলিয়াম এবং খ্যাতনামা শবীরতত্ত্ববিদ উইলিয়াম বেলিস এই কমিটিতে ছিলেন। তাঁহারা রিপোর্ট করেন যে, আমার "ম্যাগনেটিক ক্রেস্কোগ্রাফ' নামক যন্ত্র উদ্ভিদের সাড়ার লক্ষণ এক কোটিগুণ বড় করিয়া দেখাইতে সমর্থ, ইহা তাঁহারা নানাপ্রকারে পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছেন। অক্সফোর্ড ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের শ্রোতারা আমার আবিষ্কারের কিরূপ প্রশংসা করিয়াছেন তাহা আপনাদের স্মরণ আছে।

নিম্নলিখিত উদ্ভিদতত্ত্ববিদ্গণ বিশেষ খ্যাতনামা বার্লিনের হাবারল্যান্ডে, ভিয়েনার মলিশ, প্রাগের প্রিগসিম এবং নেমেক, জেনেভার সোদাৎ, প্যারিসের মাঙ্গিন, রাশিয়ার টিমিরিয়াজেফ এবং ইংলন্ডেব ভাইন্স। আমার আবিষ্কারের ফলে প্রাণ রহস্যের যে, নূতন দ্বার উদঘাটিত হইয়াছে তাহা ইহারা সকলেই স্বীকার করেন। ইংলন্ডের প্রবীণ বৈজ্ঞানিক এবং চিন্তাশীলগণ ভারত সরকারের নিকট একখানা আবেদন করিয়া জানাইয়াছেন যে জ্ঞান প্রচারে ভারতের যে গৌরব ছিল সেই গৌরব পুনঃ প্রতিষ্ঠায় এই বিজ্ঞান মন্দিরের একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে।...

কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে ভাষণ

[ভাষণটি ইং ১৯২৫ সালের ২১ ডিসেম্বর তারিখের। পরদিন ২২.১২.১৯২৫ তারিখে ভাষণটি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। নীচের ভাষণটি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ভাষণের অংশবিশেষ। ১৯২৫ সালের ১৬ নভেম্বর তারিখে এই বক্তৃতা প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে লক্ষ্ণৌ থেকে পণ্ডিত মদনমোহন মালবীয় একটি সুন্দর চিঠি লেখেন জগদীশচন্দ্রকে। চিঠিটি হল।]

Lucknow 1925 16th November,

Dear Sir Jagadish,

It seems an age since you visited the Hindu University. I write to day to request you to be good enough to repeat your visit and to deliver the Convocation address at the next Convocation which will be held on the 19th proximo. I hope you will accept the invitation. I need hardly say that we shall all be grateful for it. I hope the date will suit you. Kindly favour me with a reply by wire or letter at the "Benares Hindu University," where I hope to reach after two days. Kindly convey my invitation to Lady Bose also. I hope she too will come. I hope you are both quite well. Looking forward to the pleasure of meeting you.

Dr. Sir Jagadish Chandra Bose Calcutta, F.R.S.

Yours Sincerely S/d M. M. Malaviya

/১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পণ্ডিত মদনমোহন মালবীয় কাশী-হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেন। ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদবোধন উপলক্ষেও আচার্য জগদীশচন্দ্র ভাষণ দেন।]

.......বীজাভ্যন্তরস্থিত প্রত্যেক বীজাণুর একদিন বিশাল বটবৃক্ষে পরিণত হইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে। অঙ্কুর যেমন একদিকে দৃঢ় হইয়া দাঁড়াইবার জন্য মাটির বুক চিরিয়া মূল প্রবেশ করাইয়া দেয়, অন্যদিকে তেমনি সে আলোকের সন্ধানে মাথা তুলিয়া আকাশের দিকে ধাবিত হয়-পত্রমণ্ডিত শাখাপ্রশাখা চতুর্দিকে ছড়াইয়া দেয়।

সর্বপ্রকার সংগ্রামে জয়ী হইবার এই শক্তি বৃক্ষ কোথা হইতে পায়? তাহার জন্মস্থান হইতে; পরিবর্তন বোধ ও তৎসঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষায়-তাহার জন্মস্মৃতি হইতেই সে এক ক্ষমতা পায়। ওই স্থান এবং স্থানীয় যাহা কিছু তাহা হইতেই সে জীবনীশক্তি পায়। এই সমস্ত হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া যে হতভাগ্য, বিদেশি চিন্তাধারায় এবং বিদেশি পন্থায় পরিবর্ধিত হয় তাহার চরমগতি কোথায়? মৃত্যু তাহার পশ্চাদ্ধাবিত হইতেছে। ধ্বংসই তাহার একমাত্র পরিণতি।

আমাদের জাতীয় জীবনে এইরূপ কোনো শক্তি আছে কিনা, যদ্বারা আমরা সর্বদাই নবীন জীবন লাভ করিতে পারি? আমাদের অতীত কি কেবল স্মৃতিতেই পর্যবসিত হইবে, না আমাদের নবীন জীবন সঞ্চারের শক্তিস্বরূপ হইবে? অতীতের এই নিহিত শক্তি যে জাগরূগ আছে, তাহার প্রমাণ বিদ্যার এই প্রাচীন পীঠস্থানে চারহাজার বৎসর ধরিয়া অবিরত বিদ্যার চর্চা হইয়া আসিতেছে; সুতরাং দেখা যাইতেছে যে, ভারতীয় সত্যতার মধ্যে এমন একটা নিহিত শক্তি আছে, যাহা কালের সর্ববিধ্বংসী ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করিতে সমর্থ হইয়াছে। যে সভ্যতা অসংখ্য পরিবর্তন সহ্য করিয়া আজও মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে, যে সভ্যতা মিশরের, অ্যাসিরিয়ার এবং ব্যাবিলনের সভ্যতার উত্থানপতন দেখিয়া আজও বাঁচিয়া আছে, যে সভ্যতা অতীতের সেই দৃঢ় বিশ্বাস লইয়া ভবিষ্যতের দিকে মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইয়া আছে, সেই সভ্যতার মধ্যে এই শক্তি নিশ্চয়ই নিহিত আছে।

এই চিন্তায়ই যেন আমরা আত্মতৃপ্তি লাভ না করি, কারণ আমাদের জাতীয় জীবনে এখন ভাঁটা পড়িয়াছে। আমাদের সম্মুখে যে বিপদ উপস্থিত, তাহা অতীতের বিপদ হইতেও কঠোরতর। অতীতে আমাদের কি শক্তি ছিল এবং বর্তমানে কেন আমরা সে শক্তি হারাইলাম, তাহা আমাদিকে জানিতে হইবে।

বিদ্যার অনুসরণ

সমালোচকগণের মতে স্থায়ী জ্ঞান প্রসারে ভারত অপটু। তাঁহারা বলেন যে যেখানে শাস্ত্রের আদেশ মুক্তির ওপরে প্রভুত্ব করে, যে দেশ আয়তনে এত বৃহৎ এবং বহুধা বিভক্ত তথায় সত্য-জ্ঞানের প্রচার সম্ভব নহে। অপর পক্ষ আবার ঠিক ইহার উলটা কথা বলেন। কাহার কথা ঠিক? পশ্চিমে দ্বারকা হইতে আরম্ভ করিয়া পূর্বে পুরী এবং দক্ষিণে রামেশ্বরম হইতে উত্তরে কেদারনাথ পর্যন্ত ভারতের সমস্ত ভূভাগ ভ্রমণ করিবার পর আমি বুঝিতে পারিলাম, কোন্ শক্তি এই দেশকে সংযত রাখিয়াছিল।

প্রাচীন আদর্শ

শাস্ত্রের গোঁড়ামির মতো বিদ্যার প্রসারের প্রতিবন্ধক আর কিছুই নাই। সকলেই জানেন যে, গ্যালিলিওকে বাধ্য হইয়া স্বমত পরিত্যাগ করিতে হইয়াছিল, ব্রুনোকে পোড়াইয়া মারা হইয়াছিল। কয়েকমাস মাত্র পূর্বে উন্নতিশীল আমেরিকায় অভিব্যক্তিবাদ প্রচার করায় এক ব্যক্তির সাজা হইয়াছে।

ধর্মের একদেশদর্শিতা ভারতের বিদ্যানুশীলনের প্রতিবন্ধক হইয়াছে কি না? সকলেই জানেন যে, এখানে দুইটি বিভিন্ন চিন্তাধারা পাশাপাশি বাড়িয়া উঠিয়াছিল। এই দুইটি চিন্তাধারা দুই পথে ধাবিত হইয়াছিল--একটি ভক্তির, বিশ্বাসের পথ-আর একটি জ্ঞানের মুক্তির পথ। কাহারও মতবাদের জন্য কাহাকেও দণ্ডিত করা হইত না। এই দেশের লোক মনে করিত যে, যিনি সৃষ্টির নিতা নূতন রহস্যে আমাদিগকে সমাবৃত রাখিয়াছেন—যিনি ধূলিকণার পরমাণুর মধ্যে বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য নিহিত করিয়াছেন, তিনিই আমাদিগের মধ্যে জ্ঞানের পিপাসা দিয়া রাখিয়াছেন।

পুরাকালে চার বিদ্যার প্রতীকস্বরূপ এই বিদ্যাপীঠে চারটি প্রদীপ রাখা হইত, অতি দূর স্থান হইতে আসিযাও যদি কেহ এই স্থানেব পণ্ডিতদিগকে তর্কে পরাজিত করিতে পারিতেন, তবে এই প্রদীপ নির্বাপিত করা হইত। আবার বিজয়ীকে পরাজিত করিতে পারিলে তবে এই প্রদীপ পুনঃ প্রজ্বলিত হইত। স্বাধীন চিন্তার উৎকৃষ্টতর উদাহরণ ইহা হইতে আর কি হইতে পারে?

জ্ঞানের অনুশীলন কোনো বিশেষ প্রদেশে নিবদ্ধ ছিল না। পশ্চিমে তক্ষশিলায়, উত্তরে নালন্দায় এবং দক্ষিণে কাঞ্চীপুরে বহু শতাব্দী ধরিয়া জ্ঞানের দীপশিখা প্রজ্বলিত ছিল। জ্ঞানপ্রচারেও কোনপ্রকার ভৌগোলিক বাধা ছিল না। আচার্য শঙ্কর তর্কসংগ্রামে দক্ষিণ হইতে আরম্ভ করিয়া এক একটি দেশকে পরাজিত করিয়া উত্তর ভারতবর্ষ পর্যন্ত পৌঁছিয়াছিলেন। কয়েকখানি মাত্র তালপাতার পুঁথি সম্বল করিয়া বঙ্গদেশ হইতে মনীষীগণ দুর্লঙঘ্য হিমালয় পর্বত অতিক্রম করিয়া তিব্বত, চিন এবং সুদূর প্রাচ্যে জ্ঞান প্রচারে গমন করিয়াছিলেন। প্রেম এবং সেবার আকাঙক্ষাই তাঁহাদিগকে এই কার্যে অনুপ্রেরিত করিযাছিল। যাঁহারা ইতিহাস পাঠ করেন, তাঁহারাই জানেন যে, ভারতীয় সভ্যতা কত বিভিন্ন জাতিকে তাহার দেহে লীন করিয়া লইয়াছে। তাহাদেরই সম্মিলিত চেষ্টায় ভবিষ্যতের বৃহত্তর ভারত গড়িয়া উঠিবে।

আমাদের অধঃপতন

যদি আমরা কেবলমাত্র অতীতের স্মৃতি লইয়াই বসিয়া থাকি, তবে নিষ্ক্রিয়তার ফলেই আমাদিগকে ধরণীর পৃষ্ঠ হইতে লুপ্ত হইতে হইবে। অবিরত কর্মের দ্বারা আমরা আমাদের উত্তরাধিকারের মর্যাদা রক্ষা করিতে পারি। আমাদের পূর্ব-পিতৃগণ সর্বদেশী ছিলেন, এই কথা বলিয়া তাঁহাদের সম্মান বৃদ্ধি করিতে পারি না। তাঁহারা কত যুগ-যুগাস্তবের অবিরত চেষ্টার দ্বারা বিদ্যামন্দির গঠিত করিয়া তুলিয়াছিলেন, তাহা আমরা সম্যক উপলব্ধি করিতে পারিয়াছি কি? বহু শতাব্দীর চেষ্টার ফল আজ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত কতকাল যে অতীত হইয়াছে আমরা তাহার ধারণাও করিতে পারি না। জ্ঞানের এই উৎকর্ষের পরও তাঁহারা বলিয়াছেন যে, বেদ যদি সত্যের বিরোধী হয়, তাহা হইলে বেদকে পর্যন্ত পরিত্যাগ করিতে হইবে- এতটা মহত্ব তাহাদের ছিল। তাঁহারা সর্বদাই জড় জগতে অজ্ঞাত কারণরাশির অনুসন্ধান করিবার উপদেশ দিয়াছেন। তাঁহাদের ছিল প্রকৃত সন্ন্যাসীর তেজ। জ্ঞানের অনুসরণে এই তেজের দ্বারা তাঁহারা শারীর বৃত্তিকে নিরোধ করিতে পারিতেন। অভীষ্টকে তাঁহারা কদাপি বিস্মৃত হইতেন না-পার্থিব প্রলোভন কখনও তাঁহাদিগের দৃষ্টি নিরোধ করিতে পারিত না।

আজ সেই তেজেব অভাব ঘটিয়াছে। আমাদের জীবনে আজ যে অবসাদ আসিয়াছে। মৃত্যুর অগ্রদূত সেই অবসাদকে ঝাড়িয়া ফেলিয়া আমাদিগকে নবজীবন লাভ করিতেই হইবে। এই সঞ্জীবনী শক্তি আমাদিগকে আমাদের মধ্য হইতেই পাইতে হইবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় চেতনার মধ্যে সেই জাগরণের সাড়া পাওয়া যাইতেছে।

বর্তমান যুগসিন্ধতে ভারতের দান

জ্ঞান কোনো জাতি বিশেষের সম্পত্তি নহে। অতীতে ভারত জগতের সমৃদ্ধিবর্ধন করিতে তাহাব সর্বশ্রেষ্ঠ দেয় দান করিয়াছে। সেই শক্তি কি চিরতবে অন্তর্হিত হইযাছে? বৈজ্ঞানিক জ্ঞান প্রচারেল কথাই ধরা হউক। বৃহৎ আবিষ্কারের জন্য জ্বলন্ত অন্তর্দৃষ্টি, আবিষ্কারের ক্ষমতা এবং বিশেষ হস্ত কৌশলের আবশ্যক হয়। উদ্দেশ্যবিহীন অনুসন্ধানে কোনো বিশেষ ফল হয় না। আবার অবাধ কল্পনা বাজে কল্পনার সৃষ্টি করে। খাঁটি অনুসন্ধানকারীকে নিজের চিন্তাধারাকে বাহ্য জগতের সত্যেব সহিত মিলাইযা দেখিতে হয়। সত্যের কষ্টি পাথরে তাহার কল্পনাব পরখ করিয়া লইতে হয়, ভুল হইলেই নির্দয়ভাবে সেই কল্পনা পরিত্যাগ করিতে হয়।

এই আত্মসংবরণের পথে তাহাকে এক বিস্ময়কর জগতের দিকে অগ্রসব হইতে হয়। দৃশ্যমান আলোক যখন শেষ হয়, তখনও তাহাকে অদৃশ্যের পশ্চাৎ অনুসরণ করিতে হয়। যেখানে কিছু শোনা যায় না, সেখানে তাহাকে অশ্রুত-ধ্বনির অনুসরণ করিতে হয়। আমাদের বাহ্যেন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধ ক্ষমতায় প্রতিহত না হইয়া তখন সে অতি সূক্ষ্ম যন্ত্রের আবিষ্কার কবে।

আমাদের বিপদ

দেশের সম্মুখে দুইটি ভীষণ বিপদ উপস্থিত। প্রথম বিপদ বিদেশীব পীড়ন এবং আভ্যন্তরীণ অশান্তি। শাস্তি ছাড়া রাষ্ট্রীয় উন্নতি সম্ভব নহে। যদি বিদ্যার্থীরা বিশ্ব বিদ্যালয়ের সেনাদলে ভরতি না হয়, তবে নাগরিক হিসাবে তাহাদের প্রাথমিক কর্তব্যে ত্রুটি হইবে। কঠোরতা এবং শৃঙ্খলা রক্ষা শিক্ষা করা তাহাদের কর্তব্য; কারণ কেবলমাত্র তদ্দ্বারাই তাহারা মনুষ্যত্ব (মানুষ অমরত্ব) লাভ করিতে পারিবে।

দ্বিতীয় বিপদ আবও সমূহ এবং সর্বত্র প্রসারিত। অন্যত্র যেমন, এখানেও তেমন বেকার সমস্যা দারুণ অশান্তির সৃষ্টি করিয়াছে, এখানে অশান্তি একটু বেশি, এইমাত্র পার্থক্য। শান্তির সময়ে যাহা ধীরে ধীরে গড়িয়া উঠে, ক্ষুধার তাড়নায় হতাশ হইয়া লোকে তাহা নষ্ট করিয়া ফেলে, আমাদের দেশে এত খনিজ ধনবত্ন নিহিত থাকা সত্ত্বেও আমাদিগকে যে এই অবস্থায় পড়িতে হইয়াছে, ইহা অতীব শোচনীয়। অনবরত এই মিথ্যা প্রচাবিত হইয়া আসিয়াছে যে, কোনো বৃহৎ আবিষ্কার করিতে আমরা সক্ষম নহি। এই অপবাদ ফলেই কেহ খনিজ কারখানার কার্যে উদ্যোগী হইতে সাহসী হয় নাই। এই অপবাদ যে মিথ্যা, তাহা প্রমাণিত হইয়াছে। আজকাল এমন সমস্ত যুবক আছে, যাহাদিগকে উপযুক্তরূপে পরিচালিত শিক্ষাগারে শিক্ষাদান করিলে তাহারা সমোপযুক্ত শিক্ষা লাভ করিতে সমর্থ হয়। আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন প্রত্যেক দেশের মত আমাদের কর্তব্য উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশীর মুখাপেক্ষী না হওয়া।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাবৃদ্ধি

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাবৃদ্ধি বিদ্যাচর্চার প্রসারের পরিচায়ক, কিন্তু ইহাতে বিপদও আছে। প্রথম হইতেই এই বিপদ হইতে সাবধান থাকিতে হইবে। জ্ঞান প্রচারই একমাত্র লক্ষ্য না হইযা সাম্প্রদায়িক মতদ্বৈধ ইহাতে বৃদ্ধি পাইতে পারে, ফলে বিদ্যাপীঠসমূহ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচারের কেন্দ্রে পরিণত হইতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবর্তে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েব মধ্যে মৈত্রী থাকা কর্তব্য! প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় এক একটি বিষয়ে বিশেষ শিক্ষা দান করিতে পারেন। অধ্যাপক এবং বিদ্যার্থীদের এক বিশ্ববিদ্যালয় হইতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সুবিধা থাকা কর্তব্য।

বিদ্যার্থীদের প্রতি

আমি চিরকালই বিদ্যার্থী। বয়োবৃদ্ধি সত্ত্বেও আমি দুঃসাধ্য কার্যের অনুসরণে যুবকের মতো বল পাই। জীবিকা হিসাবে আমি শিক্ষকতা গ্রহণ করি নাই, সর্বশ্রেষ্ঠ বৃত্তি বলিয়াই ইহা গ্রহণ করিয়াছি। সমগ্র ভারতের ছাত্র সম্প্রদায় আমাকে তাহাদের সুহৃদ, পথপ্রদর্শক বলিয়া মনে করে, এই দুর্লভ সৌভাগ্য আমার লাভ হইয়াছে। প্রতিদানে আমি আমার সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাভিন্ন আর কিছু দেওয়ার নাই। আমি তোমাদের দুর্বলতার কথা বলিব না; আমি তোমাদের শক্তির উদ্বোধন করিতে চাহি, সুতরাং যাহা সহজ, আমি তাহা তোমাদের উপস্থিত করিব না, যাহা কঠিন, তাহাই তোমাদিগকে গ্রহণ করিতে সর্বতোভাবে উপদেশ দিব। তোমাদিগের উত্তরাধিকার তোমাদিগকে সাহায্য করুক, কিন্তু তোমরা অতীতের দাস না হইয়া পূর্ব পুরুষগণের জ্ঞানরাশির প্রকৃত উত্তরাধিকারী হও।

নানাপ্রকার আশঙ্কা তোমাদের মনকে আন্দোলিত করিতেছে। বিদ্যায়তনে যে শৃঙ্খলা রক্ষা করিতে হয়, তাহাকে অনেকেই পীড়ন বলিয়া মনে করিয়া তাহার হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইবার আশা করিতেছে। তোমরা একবার ভাবিয়া দেখিয়াছ কি যে, সেই নিরোধ করিবার শক্তিই সর্বাপেক্ষা বৃহৎশক্তি। তোমাদের জীবনের এই সময়েই তোমাদিগকে এই নিরোধ শক্তি লাভ করিতে হইবে।

স্বাধীন চিন্তাকে দমন করিয়া রাখিতে পারে এমন শক্তি কি কোথাও আছে? বহু বৎসরের আত্মনিয়োগের ফলে তোমরা ভবিষ্যৎ জীবন গঠন করিবার শক্তি লাভ করিবে। পোশাক পরিচ্ছদ নহে-বিপদের ঘাত-প্রতিঘাতই তোমাদিগের দেহকে শক্ত করিয়া তুলিবে। বৃথা কথা বলিয়া শক্তির অপচয় করিও না। অপরকে উপদেশ দিতে যাইও না, নিজের উপদেশ নিজে পালন করিও। যে দুর্বল সকলের সহিত সংগ্রামে যোগ দেয় না, সে কিছু পায়ও না, তাহার দিবারও কিছু নাই। জীবনে যে সংগ্রাম করিয়াছে এবং জয়ী হইয়াছে, সেই তাহাব অভিজ্ঞতা দ্বারা জগৎকে সমৃদ্ধশালী করিতে পারে, এই বীরভূমি ভারতবর্ষে অতীতকালে কর্মেরই প্রশংসা করা হইত, নিষ্ক্রীয়তার নহে। এমনকি ভারতের যুদ্ধক্ষেত্রেই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানের উন্মেষ হইয়াছিল। সকলের জন্য যে সুখ আমরা দিতে পারি না, তাহা প্রকৃত সুখ নহে। দেশের আহ্বান যখন সর্বত্র প্রতিধ্বনিত হইতে থাকে, তখন আমরা অলসভাবে বসিয়া থাকিতে পারি না-ব্যক্তিগত মুক্তি পর্যন্ত কামনা করিতে পারি না।

মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে ভাষণ

৩ নভেম্বর ১৯২৭ (আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত)

[এই বক্তৃতা প্রদানের জন্য মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য অধ্যাপক ব্রজেন্দ্রলাল শীল জগদীশচন্দ্রকে আমন্ত্রণ জানান।

University of Mysore Seal RAJATANTRA PRAVINA

Dr. B. N. Seal Vice-Chancellor

Mysore

Dated The 2nd Oct, 1927

My Dear Sir Jagadish,

I have very great pleasure in conveying to you the invitation of His Highness the Chancellor of the University to deliver the Address at the next convocation to be held at Mysore on the 3rd November. The University will feel it a great honour if you kindly accept the invitation.

I need hardly add that the accepting the invitation you will be conferring a personal obligation upon me. For "auld long Syne," do kindly consent.

Yours Sincerely Brajendra Nath Scal

আপনাদের সানুগ্রহে আমন্ত্রণ পাইয়া আমি নূতন করিয়া বুঝিতে পারিলাম যে, অতীতে যেমন ছিল বর্তমানেও তেমনি ভারতবর্ষে সারস্বত সমাজের মধ্যে একটা ঐক্য রহিয়াছে। মহাদেশের প্রাচীন বিদ্যার গৌরব পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য আমি গত ৩৪ বৎসর যাবৎ যে চেষ্টা করিয়া আসিতেছি, তৎপ্রতি আপনাদের সহানুভূতিবশতই বোধ হয় আপনারা অনুগ্রহপূর্বক আমাকে এই সমাবর্তন সংস্কারে অভিভাষণ দিবার জন্য আমন্ত্রণ করিয়াছেন। আমি বহু পূর্বে শিক্ষকতা আরম্ভ করিয়াছিলাম-বৃত্তি হিসেবে নহে, সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রত হিসাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি প্রাপ্তির পরও যাহাদের উচ্চাকাঙক্ষা তৃপ্ত হয় নাই, সে সমস্ত যুবকদিগকে পরিচালিত করিয়া মনুষ্যত্ব লাভে সাহায্য করাকে জীবনের ব্রত করা অপেক্ষা মহত্তর কিছু ধারণা আমি করিতে পারি নাই।

আমার সম্মুখে আমি তরুণ ছাত্রদিগকে দেখিতেছি, তাহারা কঠোর জীবনযাত্রা আরম্ভ করিতে যাইতেছে। জীবনে যখন নৈরাশ্য আসিবে তখন কোন্ আদর্শ তোমাদিগকে উৎসাহিত করিয়া তুলিবে? আজিকার দিনে দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণের জন্য যুবক শক্তির উপর সর্বাপেক্ষা অধিক দাবির আবশ্যক হইয়াছে। সুতরাং আজ আমি তোমাদের দৌর্বল্যের কথা বলিব না, আমি আজ তোমাদের শক্তির উদ্বোধন করিব-যাহা সর্বাপেক্ষা সহজ সাধ্য সে আদর্শ আজ আমি তোমাদের সম্মুখে ধরিব। তোমরা সত্যান্বেষী-সত্যের সন্ধান করিতে হইলে তোমাদিগকে যে কঠোরতার মধ্য দিয়া অতিক্রম করিতে হইবে, সেই কঠোরতর কথাই আমি তোমাদিগকে গুনাইব। এই কঠোরতা সহ্য করিতে অতীত তোমাদিগকে সাহায্য করিবে - আমি তোমাদিগকে অতীতের দাস হইতে বলিতেছি না, আমি বলিতেছি,-তোমাদিগকে অতীত জ্ঞান গরিমার প্রকৃত উত্তরাধিকারী হইতে।

আমার জীবনযাত্রার প্রারম্ভে আমি প্রায়ই শুনিতাম যে, ভারতবর্ষ প্রাচীন দার্শনিকের দেশ, এজন্যই ভারতবর্ষের যাহা কিছু গৌরব সে গৌরবও লোপ পাইয়াছে। লুপ্ত গৌরবের পুনরুদ্ধার হইবে। এ সমস্ত কথায় আমি নিরুৎসাহ হইয়া পড়িয়াছিলাম।

তোমরা হয়তো জিজ্ঞাসা করিবে যে, আমার ভ্রান্তি কি করিয়া দূর হইল, বিরাট বিঘ্ন অতিক্রম করিবার অধ্যবসায় আমি কোথা হইতে পাইলাম। আমার উত্তর এই যে, আমার কার্যই ছিল আমার শিক্ষক, ব্যর্থতাই আমাকে আবশ্যক উৎসাহ দিয়াছে এবং অতীতের অভিজ্ঞতাই ছিল আমার উৎসাহের চির উৎস।

আমার বিশ্বাস এই যে, যাহা আমাদের সভ্যতায় স্বত সংশ্লিষ্ট নহে আমাদের জাতীয় জাগরণের উপযুক্ত শক্তি আমরা তাহা হইতে পাইতে পারি না। এই মহাসত্যের গুরুত্ব বলিয়া শেষ করা যায় না।

যাহা অসম্ভব বা যাহা শুধু অন্য দেশেই সম্ভব, সে সমস্ত বিষয়ের কথা আজ তোমাদিগকে শুনাইব না। ভারতবর্ষ যাহা করা যাইতে পারে এবং যাহা করা হইয়াছে তাহার কথাই আমি তোমাদিগকে শুনাইব। তোমাদিগকে যে সমস্ত বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হইতে হয় আমাকেও সেই সমস্ত বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হইতে হয়। তোমরা যখন নৈরাশ্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত হইবে তখন তোমরা এই কথাটি স্মরণ রাখিও যে, বহু বর্ষ অধ্যবসায় সহকারে বিঘ্নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিবার পূর্বে আমি আশার ক্ষীণ আলোকরেখাও দেখিতে পাই নাই। আমার এই বিশ্বাস ছিল যে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার নিকট পরাজয় স্বীকার করায় মনুষ্যত্ব নাই, অসীম সাহসে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সম্মুখীন হইয়া তাহাকে পরাজিত করাই প্রকৃত মনুষ্যত্ব। আমি জানি যে, পূর্বে যাহা হইয়াছে ভবিষ্যতেও তাহা হইবে, অতীতকে শুধু স্বপ্নের স্মৃতি বলিয়া উপেক্ষা করিলে চলিবে না।

! আমি বলিয়াছি যে, আমার কার্যই ছিল আমার শিক্ষক। বহু বর্ষ অবিরত সত্যান্বেষণের ফলে আমি এই জ্ঞান লাভ করিয়াছি। এই জ্ঞান বলেই আমি, কঠোর বৈজ্ঞানিক উপায়ের মধ্য দিয়া এই সত্য সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, সর্বপ্রকার প্রাণের ধারা একই প্রকার। প্রাণের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি কিভাবে হয় তাহার রহস্য আমি ভেদ করিয়াছি, সে কথা আমি তোমাদিগকে বলিব। 

উদ্ভিদের প্রাণ

বৃক্ষকে অগণিত ব্যষ্টি সমষ্টি লইয়া গঠিত একটি রাষ্ট্রের সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। সমষ্টির কল্যাণের জন্য এই ব্যষ্টিগুলির বিভিন্ন অঙ্গ এক একটা নির্দিষ্ট কর্তব্য সম্পাদন করিয়া থাকে। তাহাদের মধ্যে কোথাও অসামঞ্জস্য ঘটিলেই বৃক্ষরাষ্ট্রের অনিষ্ট হয। বৃক্ষটি স্বীয় ভূমিতে দৃঢ় মূল থাকে বলিয়াই বাঁচিয়া থাকে, ভূমি হইতেই সে নিজের পুষ্টি ও সমস্ত বিপদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিবার উপযোগী শক্তি সংগ্রহ করে। বাহিরের আঘাত তাহাকে কখনও পরাজিত করিতে পারে না, তাহাতে তাহার ভিতরের সুপ্ত শক্তিই জাগ্রত হয়। বাহ্যিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সে আবার নিজের শক্তি নূতন করিয়া গুছাইয়া লয়। অধিকন্তু তাহার জন্মভূমি হইতেও সে শক্তি লাভ করে। বীজাভ্যন্তরস্থ প্রত্যেক অঙ্কুর কোষের মধ্যে মহাবটের ভবিষ্যৎ নিহীত রহিয়াছে। এই শক্তি বৃক্ষ কোথা হইতে পায়? এই শক্তি সে পায তাহার জন্মভূমি হইতে, অবস্থানুসারে পরিবর্তনশীলতা হইতে এবং অতীতের স্মৃতি হইতে। এই যে প্রাণের মহাশক্তি, ইহা জন্মভূমি এবং জন্মস্মৃতিরই দান। যে হতভাগ্য এই জন্মভূমি ও জন্মস্মৃতির কথা বিস্মৃত হইয়া ভিন্নরূপে চিন্তা ও জীবনধারার মধ্যে বর্ধিত হইতে চাহে তাহার গতি কি? প্রতিপদে মৃত্যু তাহাকে অনুসরণ করিতেছে, ধ্বংসই তাহার অনিবার্য পরিণতি।

সুতরাং ভারতবর্ষে যদি কোনো স্থায়ী কল্যাণ করিতে হয়, তাহা হইলে ভারতবর্ষের সভ্যতার মধ্যে যাহা নিজস্ব তাহাই জাগ্রত করিতে হইবে। এই জাগৃতির ফলে একটা মহাশক্তি বন্ধনমুক্ত হইবে এবং ভারতে মহাজাগরণ আনয়ন করিবে। এই জাগরণের শক্তি আমাদের মধ্যে, উদ্বুদ্ধ জাতির মধ্যে সে শক্তির পূর্বাভাস দেখা যাইতেছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

জ্ঞানের গরিমা এবং জ্ঞান প্রচার করিযা জগৎকে সমৃদ্ধশালী করিবার শক্তি দ্বারাই একটা জাতীয় জীবনের পূর্ণ অভিব্যক্তি লাভ হয়। যে জাতি সে শক্তি হারাইয়াছে, যে শুধু পরের নিকট হইতে অনুগ্রহই নয়, পরকে কিছুই দেয় না, সে জাতির জীবন শেষ হইয়া আসিয়াছে। কৃত্রিম উপায়ে একটা বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বৃদ্ধি কর, যায় না, কোনো সনন্দ বলেও তাহার প্রতিষ্ঠা স্থায়ী করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যার্থীরা জগৎকে যাহা দিবে তাহার উপরই তাহার প্রতিষ্ঠা নির্ভর করিবে। সুতরাং জীবন্ত এবং শক্তিশালী হইতে হইলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রথম আদর্শ হওয়া কর্তব্য, অভিব্যক্তি, এবং সেই অভিব্যক্তির মধ্য দিয়া রাষ্ট্রসঙ্ঘে ভারতকে স্বীয় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা।

সমালোচকগণ বলেন, যে, ভারতবাসীর মধ্যে জ্ঞানের অনুশীলন এবং শিক্ষাপ্রচার করিবার যোগ্যতা ভারতবর্ষের নাই। তাঁহারা বলেন যে, ভারতে সার্বজনীন আদর্শ নাই, বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত অধিবাসীদের মধ্যে কোন সংযোগসূত্র নাই, তাহার অতীত ও বর্তমানের অব্যাহত পরস্পর্য নাই-আছে শুধু অসহিষ্ণু শাস্ত্রের অনুশাসন, যুক্তির পরিবর্তে শাস্ত্রের আদেশ -কল্পনা প্রিয় বলিয়া ভারতবাসীরা সত্যজ্ঞান পথে অগ্রসর হইতে পারে না; বিজ্ঞানের অনুশীলন সম্পূর্ণ পাশ্চাত্য, ভারতীয় সভ্যতার সহিত তাহার সামঞ্জস্য নাই-এই সমস্ত উক্ত অজ্ঞতাপ্রসূত এবং সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

ভারতের সর্বজনীনভাব

প্রাচীন ভারতে রাজপুত্র এবং সাধারণ প্রজার পুত্রকে গুরুগৃহে একই প্রকার আড়ম্বরবিহীন জীবনযাপন করিতে হইত। এরূপ ব্যবস্থা অন্য কোনো দেশে আছে বলিয়া আমি জানি না। আমাদের মহাকাব্যে আমরা দেখিতে পাই যে, তিন হাজার বৎসর পূর্বে হস্তিনাপুর রাজসভার সম্মুখে একটি বিরাট অস্ত্র পরীক্ষা হইয়াছিল। সূতপুত্র কর্ণ রাজপুত্র অর্জুনকে শক্তি পরীক্ষায় আহ্বান করিয়াছিলেন। অর্জুন ঘৃণাভরে এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিয়াছিলেন-'যাহার কোনো বংশমর্যাদা নাই, রাজপুত্র তাহার সহিত অস্ত্র বিনিময় করেন না।' প্রত্যুত্তরে কর্ণ বলিয়াছিলেন- 'আমিই আমার বংশের প্রতিষ্ঠাতা, আমার কার্যই আমার আভিজাত্যের পরিচয়।' নিজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে মানুষের নিজের অধিকারের দাবি বোধ হয় এই সর্বপ্রথম।

আমার যখন শিক্ষারম্ভ হয় তখন সৌভাগ্যক্রমে আমার পিতা আমাকে কোনো ইংরেজি বিদ্যালয়ে না পাঠাইয়া বাংলা পাঠশালায় পাঠাইয়াছিলেন। তথায় কৃষক পুত্ররা ছিল আমার সহপাঠী, তাহাদের নিকট হইতে আমি শ্রমের প্রকৃত মর্যাদা উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলাম। তাহারা চাষ করিয়া সবুজ ক্ষেতে সোনার ফসল জন্মাইত, তাহাদের সহিত থাকিয়া আমার প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা জন্মে। বিশাল নদীর মধ্যে এবং এদো পুকুরে যে সমস্ত আশ্চর্য জীব বাস করে ধীবর বালকেরা তাহাদের গল্প আমাকে শুনাইত। তখন হইতেই প্রতি পদে আমি একটা অদ্ভুত আবেগ অনুভব করিতাম। সহপাঠীদের সহিত গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া দেখিতে পাইতাম, আমার জননী আমাদের আগমন প্রতীক্ষা করিতেছেন। আমার মাতা ছিলেন নিষ্ঠাবতী হিন্দু, আমার সহপাঠীদের মধ্যে কেহ কেহ "অস্পৃশ্য" ছিল, তাহাতে কিন্তু মায়ের কোনও বিরক্তি হইত না। তিনি সকলকেই নিজের পুত্রের মতো আদর করিয়া খাওয়াইতেন। সত্য সত্য মায়ের প্রাণ এইভাবে মাতৃস্নেহ বিলাইয়া কাঙালকে স্বীয় ক্রোড়ে আশ্রয় দিতে পারে। এই সুকুমার বয়সে আমাকে কেন বাংলা পাঠশালায় দেওয়া হইয়াছিল আজ আমি তাহার তাৎপর্য উপলব্ধি করিতে পারিতেছি। তথায় আমি মাতৃভাষা শিক্ষা করিয়াছিলাম, নিজে চিন্তা করিতে শিখিয়াছিলাম এবং আমাদের মহাকাব্যগুলির মধ্য দিয়া আমি আমাদের জাতীয় সভ্যতার অধিকার লাভ করিয়াছিলাম।

এইভাবেই অতীত ভারতের সর্বজনীনভাব বিদ্যামান ছিল। বিক্রমাদিত্যের সভা ছিল রাষ্ট্রচালক, বিভিন্ন বিদ্যার প্রতিনিধিস্বরূপ "নবরত্ন" না থাকিলে সে সভা পূর্ণ হইত না। প্রজা রাজাকে সম্মান করিত, রাজশক্তির ভয়ে নহে, রাজা প্রজার মন ও হৃদয় রঞ্জন করিতেন বলিয়াই। দেশীয় রাজ্যগুলিতে ভারতের এই বৈশিষ্ট্য যেন চিরকাল বিরাজমান দেখিতে পাই।

ভারতে বিদ্যাচর্চার ধারা

শিক্ষা প্রচারে ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা ভারতে কখনও কোনো বিঘ্ন উৎপাদন করিতে সমর্থ হয় নাই। অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করিলে দেখিতে পাই, অমর আচার্যগণ আজিও জীবিত থাকিয়া আমাদিগকে উৎসাহিত করিতেছেন। দেখিতেছি, আচার্য শঙ্কর পাণ্ডিত্য প্রভাবে দিগ্বিজয়ে বাহির হইয়া দক্ষিণ হইতে আরম্ভ করিয়া উত্তর ভারতের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত সমস্ত দেশ জয় করিয়া চলিয়াছেন। দেখিতেছি বঙ্গদেশের পণ্ডিতগণ কয়েকখানি তালপাতার পুঁথি মাত্র সম্বল লইয়া হিমালয় পর্বত অতিক্রম করিতেছেন-উদ্দেশ্য তিব্বত, চীন ও সুদূর প্রাচ্যে জ্ঞানালোক প্রচার। এই যে বিদ্যার অনুশীলন, তাহা কখনও কোনো বিশেষ প্রদেশে নিবদ্ধ ছিল না! বহু শতাব্দী ধরিয়া ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই জ্ঞান প্রজ্জ্বলিত ছিল। আচার্যের খ্যাতির দ্বারা আকৃষ্ট হইয়াই সুদূর দেশ হইতে বিদ্যার্থীগণ আসিয়া আচার্যগৃহে সমবেত হইত। সেই প্রাচীন রীতি অদ্যাপি লুপ্ত হয় নাই। কারণ, বর্তমানকালেও চিন্তানায়কগণ দেশের একপ্রান্ত হইতে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত পরিভ্রমণ করিতেছেন এবং ঐক্য ও জাতিবন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখিতেছেন। ঠিক ঠিক ভাবে যাঁহারা ইতিহাস পাঠ করিয়াছেন তাঁহারা বুঝিতে পারিয়াছেন যে, যে সমস্ত বিভিন্ন জাতি ও প্রকৃতির লোক এদেশে আসিয়া এদেশকে নিজের মনে করিয়াছে, তাহাদিগকে এদেশ কি মহাশক্তি বলে নিজের করিয়া লইয়াছে। তাহাদেরই মিলিত চেষ্টায় ভবিষ্যতের বৃহত্তর ভারত গড়িয়া উঠিবে।

জ্ঞানচর্চার স্বাধীনতা

একথা সত্য যে আচারের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকিলে নূতন সত্য গ্রহণ করা যায় না, সত্যান্বেষণের পক্ষে ইহা অপেক্ষা বড় বিঘ্ন আর নাই। একথা বলা যায় যে, এই সংকীর্ণতার ভাব প্রাচ্য হইতে পাশ্চাত্যেই অধিকতর প্রকট। গ্যালিলিওকে যে বাধ্য হইয়া সত্য কথা প্রত্যাহার করিতে হইয়াছিল এবং ব্রুনোকে যে আগুনে পুড়িয়া মরিতে হইয়াছিল ইহা সর্বজনবিদিত! এই অসহিষ্ণুতা পাশ্চাত্যে অদ্যাপি বিদ্যমান রহিয়াছে। ডারুইনের ঊর্ধ্বত্তন বাদ শিক্ষা দেওয়া দণ্ডনীয়। বিজ্ঞানক্ষেত্রেও এরূপ একটা গণ্ডি আছে! কোন বড় আবিষ্কারই আবিষ্কারকের জীবনকালে আদৃত হইতে দেখা যায় না।

এদেশে শাস্ত্রানুশাসনের গণ্ডি জ্ঞানচর্চাকে সংকীর্ণ সীমায় আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল কিনা তৎসম্বন্ধে ইহা বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, এই দেশেই দুইটি স্বতন্ত্র চিন্তাধারা পাশাপাশি বাড়িয়া উঠিয়াছিল। একটি শাস্ত্রাদেশের উপর প্রতিষ্ঠিত ভক্তিবাদ অপরটি যুক্তিবাদ-প্রত্যক্ষ প্রমাণই তাহার ভিত্তি। ভক্তিবাদীরা বোধ হয় একথা বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, যদি তাহাদের অনুগ্রহের ওপর ভগবানের অস্তিত্ব নির্ভর করিতে হয়, তবে তাহাতে ভগবানের অবমাননা করা হয়, এজন্যই বোধহয় যুক্তিবাদের সৃষ্টি।

আমাদের পূর্বপুরুষগণ সর্বদর্শী ছিলেন, সুতরাং জ্ঞানের আর প্রসার সম্ভব নহে! এরূপ অন্যায় দাবি অবশ্য আমাদের করা কর্তব্য নহে। আমাদের পূর্বপুরুষগণ অবিরত পরিশ্রমের ফলে ধীরে ধীরে জ্ঞানের মন্দির গড়িয়া তুলিয়াছিলেন। তাঁহাদের অতটা সাফল্য সত্ত্বেও একথা বলিবার মতো উদারতা তাঁহাদের ছিল যে, সত্যের সহিত না মিলিলে বেদও অগ্রাহ্য। এই যে সত্যান্বেষণের স্বাধীনতা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পাইয়াছি, তাহা অস্বীকার করার অর্থ- কপট দেশভক্তি।

অতীত ভারতের দান

কোনও একটা বিশেষ জাতির উপরই জগতের জ্ঞানের প্রসার নির্ভর করে, একথা বলার মতো অজ্ঞতা আর নাই। সমগ্র জগৎ পরস্পর নির্ভরশীল, যুগযুগান্তের চিন্তাধারা অব্যাহতভাবে প্রবাহিত হইয়া মনুষ্যজগৎকে সমৃদ্ধশালী করিয়া তুলিয়াছে। এই পরস্পর নির্ভরশীলতাই মানবসভ্যতাকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে।

জ্ঞানের উন্নতি একমাত্র পাশ্চাত্যের দান, একথা বলার অর্থ ইতিহাসের কদর্থ করা। রাষ্ট্রনীতির উন্নতিও পাশ্চাত্যের দান-একথাও অসত্য। মহীশূর রাজ্যের দুইজন কর্মচারী অসীম ধৈর্য বলে অতীতের আবরনোন্মচন করিতে সমর্থ হইয়াছেন ইহা মহীশূরের পক্ষে গৌরবের কথা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাভারতীয় চেষ্টার ফলেই প্রাচীন হিন্দুদের বিজ্ঞানচর্চার দিকে লোকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছে। ডাক্তার শ্যামা শাস্ত্রী যে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র বাহির করিয়াছেন তাহাও একটি মহৎ দান।

কিন্তু অতীত গৌরবে সন্তুষ্ট থাকিলেই আমাদের চলিবে কি? সমালোচকগণ বারংবার বলিয়াছেন যে, আমাদের অতীত গৌরব যাহাই হউক না কেন, ভারতের জাতীয় জীবনে নবজাগরণ অসম্ভব। তাঁহারা বলেন যে, সাফল্য আমাদের কদাচিৎ হইয়াছে, ব্যর্থতাই আমাদের বেশি। আমার উত্তর এই যে, ব্যর্থতা তো অস্থায়ী, সফলতাই শেষ পর্যন্ত স্থায়ী। যাহা অতি স্পষ্ট তাহাই আমরা দেখিতে পাই না। মনুষ্য চক্ষুর অগোচর যে মহাশক্তি রহিয়াছে, যে শক্তি মানুষকে আকাঙক্ষা পূরণে চেষ্টিত করে, সে শক্তি আমরা উপলব্ধি করিতে পারিতেছি না। আমরা যদি ভালো করিয়া ভাবিয়া দেখি তবে বুঝিতে পারিব যে, কার্যকারণের সম্বন্ধ যেমন নিত্য, জয়-পরাজয়ের সম্বন্ধও তেমনি নিত্য। আমাদের একথা উপলব্ধি করিতে হইবে যে, ব্যর্থতার পশ্চাতে রহিয়াছে একটা মহাশক্তি, সে শক্তি যখন পরিচালিত হয় তখনই আসে সাফল্য।

আধুনিক বিজ্ঞানে ভারতের দান

বিজ্ঞান প্রাচ্যেরও নহে, পাশ্চাত্যেরও নহে, ইহা বিশ্বজনীন। তথাপি ভারতবর্ষ উত্তরাধিকাসূত্রে বংশ পরম্পরায় যে ধীশক্তি পাইয়াছে, তাহার দ্বারা সে জ্ঞানপ্রচারে বিশেষ করিয়া সক্ষম। যে জ্বলন্ত কল্পনা বলে ভারতবাসী পরস্পর বিরোধী ঘটনাবলীর মধ্য হইতে সত্য বাছিয়া লইতে পারে, সে কল্পনাই আবার ভারতবাসী সংযত করিতে পারে। এই মনঃসংযমই সত্যান্বেষণের শক্তি দিয়া থাকে।

সত্যান্বেষণের জন্য দুইটি পথ আছে। একটি অন্তদর্শন, অপরটি প্রত্যক্ষ পরীক্ষা। উদ্দেশ্যবিহীন গবেষণায় কোনো বিশেষ ফল লাভ হয় না, অসংযত কল্পনা আকাশকুসুমের সৃষ্টি করে। সুতরাং কল্পনা ও অনুসন্ধিৎসা সমানভাবে থাকা চাই।

বৃক্ষের প্রাণ সম্বন্ধে অনুসন্ধিৎসুর অসুবিধা এই যে, বৃক্ষের প্রাণক্রিয়া মনুষ্য চক্ষুর অগোচরে বৃক্ষের অভ্যন্তরে নির্বাহ হইয়া থাকে। বৃক্ষের কলাকৌশল জানিতে হইলে অনুসন্ধিৎসুকে স্বয়ং বৃক্ষের হৃদক্রিয়া উপলব্ধি করিতে হইবে। তাহার জটিল প্রাণক্রিয়া বুঝিতে হইল্,ে ক্ষুদ্রতম প্রাণাণু বা 'প্রাণ-কোষের" সন্ধান করিতে হইবে। এবং সেই কোষের স্পন্দন অনুভব করিতে হইবে। এজন্য আমাকে অতি সূক্ষ্মযন্ত্র আবিষ্কার করিতে হইয়াছে। অণুবীক্ষণ যন্ত্রে কোনো জিনিসকে মাত্র কয়েক হাজার গুণ বড় করিয়া দেখা যায়। এই যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলেই বিজ্ঞান রাজ্যে একটা নবযুগের সূচনা হইয়াছে। "ক্রোস্কোগ্রাফ" নামক যন্ত্র উদ্ভাবন করিয়াছি, তাহাতে কোনো জিনিসকে পাঁচ কোটিগুণ বড় করিয়া দেখা যায়। এই যন্ত্র উদ্ভাবনের ফলে একটা নূতন জগতের বিরাট রহস্য প্রকাশিত হইয়াছে, উদ্ভিদ স্বয়ং নিজের আভ্যন্তরীণ প্রাণক্রিয়া প্রকাশ করিয়া দিতেছে।

সংযতভাবে তথ্যানুসরণের পথে অগ্রসর হইতে হইতে অনুসন্ধিৎসু একটা আশ্চর্যের রাজ্যের দিকে চলিয়া থাকে। আলোকের শেষ রশ্মি যখন লোপ পায় তখনও তাহাকে অদৃষ্টের অনুসরণ করিতে হয়। যখন শব্দের ধ্বনি শেষ হয় তখনও সে শব্দের স্পন্দন শুনিতে পায়। এইভাবে সে অদৃশ্যপূর্ব একটা নূতন জগতের সন্ধান পায়, অশ্রুতপূর্বকে শুনিতে পায়। সে তথায় এমন একটা প্রাণের সন্ধান পায়, যাহা আমাদের প্রাণের মতোই সুখদুঃখ ভোগ করে। মানুষের কর্মেন্দ্রিয় অপরিপূর্ণ, সেই অপরিপূর্ণতাকে অগ্রাহ্য কবিয়া মানুষ যে অজানিত মহাসাগরে অনুসন্ধান করিবার মতো একটি চিন্তাতরণী নির্মাণ করিতে সমর্থ হইয়াছে ইহা কি আশ্চর্যের কথা নহে। অনুসন্ধিৎসুর এই সন্ধানযাত্রার মাঝে মাঝে সে নূতন নূতন আশ্চর্যের সন্ধান পায়। এ পর্যন্ত যে মায়ায় মুগ্ধ হইয়া সে জগতের মহাস্পন্দন অনুভব করিতে অসমর্থ হইয়াছে, এই সমস্ত নূতন আশ্চর্যের দ্বারা তাহার সে মায়ার বিনাশ হয়। অন্তদর্শন এবং বহিঃ পরীক্ষার মিলনের ফলে সর্বপ্রকার প্রাণক্রিয়ার ঐক্য প্রমাণিত হইয়াছে, একই প্রকারের অভিব্যক্তির মধ্যে যে যবনিকা ছিল তাহা অন্তর্হিত হইয়াছে। উদ্ভিদ এবং প্রাণীর প্রাণক্রিয়া যে একই প্রকার তাহা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।

মনঃসংযোগ

প্রথমে যে সমস্ত বিঘ্ন দুর্লঙঘ্য বলিয়া মনে হইয়াছিল, বহুবর্ষ চেষ্টার ফলে সেই সমস্ত বিঘ্ন অতিক্রম করার পর এই সমস্ত আশ্চর্য ব্যাপার আমার নিকট পরিস্ফুট হইয়াছে। ভারতসুলভ মনঃসংযমই পরিণামে জয়ী হইয়াছে। অনুসন্ধিৎসুর পথ সুগম নহে। তাহাকে লোহার শরীর মন লইয়া অবিশ্রান্ত সংগ্রামে অগ্রসর হইত হয়। সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভ, জয়- পরাজয়কে সমান মনে করিয়া জীবনকে আহুতি দিতে হয়। সুলভ সাফল্যের লোভ তাহার বীরহৃদয়কে আকৃষ্ট করে না। দুর্লভের অনুসরণে ব্যর্থতার দুঃখই তাহাকে আকৃষ্ট করিয়া থাকে।

আবিষ্কার ও উদ্ভাবন

আমি যখন অনুসন্ধান আরম্ভ করি, তখন একথা বলা হইত যে. আমাদের ছাত্ররা হস্ত কৌশলে নিপুণ নহে, ভারতবাসীর আবিষ্কার ও উদ্ভাবনী শক্তি নাই। বহুবর্ষের অবিশ্রান্ত চেষ্টার ফলে প্রমাণিত হইয়াছে যে ইচ্ছাশক্তি সহায়ে অতিক্রম করা যায় না এমন কোনো বিঘ্ন নাই। যখন কেহ একটা মহান উদ্দেশ্যে আত্মোৎসর্গ করে তখন তাহার নিকট রুদ্ধগৃহের কপাট খুলিয়া যায়, অসম্ভব সম্ভব হয়। যে জাতি অতীতকালে হস্ত নৈপুণ্যে জগৎকে বিস্মিত করিয়াছে সে জাতি এখনও লোপ পায় নাই, ইহাই ছিল আমার বিশ্বাস। আমার কারুশিল্পীদিগকে বিশ্বাস করিয়া, তাহাদিগকে একটা জাতীয় গৌরব প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করিয়া তুলিলাম। যে সমস্ত সূক্ষ্ম যন্ত্র জগতকে স্তম্ভিত করিয়া দিয়াছে তাহা আমার বিজ্ঞান মন্দিরে শিক্ষাপ্রাপ্ত কারুশিল্পীগণই নির্মাণ করিয়াছে। ইউরোপে ও আমেরিকার সর্বত্র এই সমস্ত যন্ত্র অনেকবার প্রদর্শিত হইয়াছে, দক্ষ যন্ত্রশিল্পীগণকে অনুরূপ যন্ত্র নির্মাণের সর্বপ্রকার সুযোগ দেওয়া হইয়াছে, তাঁহারা স্বীকার করিয়াছেন যে আমাদের যন্ত্রশিল্পীদের হস্তনৈপুণ্যের কাছাকাছি অগ্রসর হইতেও তাঁহারা সমর্থ নহেন। বর্তমানকালে বলা হইয়া থাকে যে, আমাদের দেশ বিশেষ কোন শিল্পোন্নতি করিতে সমর্থ নহে, এজন্যই এই কথা বিশেষ করিয়া বলিবার প্রয়োজন।

উপযোগিতা

প্রায়ই আমাকে প্রশ্ন করা হয় যে, উদ্ভিদ জীবনের রহস্যভেদের চেষ্টা করিয়া লাভ কি? ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে যখন আমি প্রথম বেতার বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবাহিত শক্তি সহায়ে দূরাবস্থিত একটি যন্ত্রকে পরিচালিত করিয়াছিলাম এবং একটি মাইন ফাটাইয়াছিলাম সেদিনও আমাকে এই প্রশ্ন করা হইয়াছিল। বহুদুরে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রেরণ সমস্যাও আমার বিজ্ঞানাগারে উদ্ভাবিত "গ্যালিনা রিসিভার" নামক যন্ত্র দ্বারা সমাধান হইয়াছিল।

উদ্ভিদ জীবনের রহস্যভেদের উপযোগিতা সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, "ক্রেস্কোগ্রাফ" যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে বৃক্ষের আয়তন বৃদ্ধির হার নির্ণয়ের চেষ্টা হইতেছে। ব্যবহারিক কৃষিতে ইহা বিশেষ প্রয়োজন। প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে ঔষধির সমক্রিয়া সম্বন্ধেও অনুসন্ধান চলিতেছে। ফলে ভারতের অনেক ঔষধ সম্বন্ধে অনুসন্ধান আরম্ভ হইয়াছে। নবোদ্ভাসিত 'রেজনেন্ট কার্ডিওগ্রাফ' বৃক্ষের হৃদস্পন্দন ঠিক ঠিক ভাবে ধরিতে সমর্থ। অবসাদের সময় বিভিন্ন ঔষধি প্রয়োগের দ্বারা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া কীভাবে বর্ধিত হয় তাহাও এই যন্ত্রের সাহায্যে নির্ণয় করা যায়। এই সমস্ত অনুসন্ধানের ফলে ভারতীয় গাছপালা হইতে মনুষ্যজাতির উপকারের জন্য বহু নুতন ঔষধ প্রস্তুত হইবার সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে।

শিক্ষা প্রচারে ভারতের চেষ্টা

সম্প্রতি আমি লোকানোতে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে যোগ দিয়াছিলাম। সেই সম্মেলন বুঝিতে পারিয়াছেন যে, প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি পুরাতন হইয়া গিয়াছে, এখন নূতন পদ্ধতি প্রবর্তনের সময় আসিয়াছে। যে শিক্ষা পদ্ধতি লোককে চিরকাল দাস করিয়া রাখে তাহা অনিষ্টকর না হইয়া পারে না। ভারতীয় ছাত্রগণ শিক্ষালাভের জন্য ইউরোপে যাইবে ইহা অপেক্ষা লজ্জাকর কিছুই নাই, তাহাতে অনেক বিপদও আছে। আমরা কেন নিজেদের দেশেই শিক্ষাক্ষেত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করিব না? এই ধারণা লইয়াই আমি আমার বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছি। আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে নালন্দা এবং তক্ষশীলায় যে জন্য বিদ্যার্থীগণ আসিয়া সমবেত হইত আমি সেই আদর্শের পুনরুজ্জীবন প্রয়াসী। আমার সে স্বপ্ন বহুলাংশে সফল হইয়াছে। আমি যাহা করিতে সমর্থ হইয়াছি এই উন্নতিশীল রাজ্য তাহা অপেক্ষা অনেক বেশি করিতে পারিবে এ আশা আমি করি। আপনাদিগকে অটল বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হইতে হইবে। সেই বিশ্বাসের আবশ্যকতা প্রতিপন্ন করিবার জন্য ভারতীয় চেষ্টায় ভারতীয় বিদ্যার্থী দ্বারা কি কার্য হইয়াছে তাহা সংক্ষেপে বিবৃত করিলাম।

অর্থনৈতিক সমস্যা

পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেমন, ভারতেরও তেমনি অর্থসংকট দেখা দিয়াছে। ভারতে এই সংকট প্রবল বলিয়াই সমস্যা কঠিন দেখা যাইতেছে। ক্ষুধার তাড়ণায় লোকে অসহিষ্ণু হইয়া উঠে এবং শান্তির প্রতিষ্ঠান নষ্ট করিয়া দেয়। অতীব দুঃখের কথা এই যে আমাদের দেশে এত সম্পদ নিহিত থাকা এবং শিল্পোন্নতির সম্ভাবনা সত্ত্বেও আমাদিগকে এই অবস্থায পড়িতে হইয়াছে। আমরা কিছু আবিষ্কার করিতে পারি না, কিছু উদ্ভাবন করিতে পারি না- এইরূপ বাজে কথা বলিয়া এতদিন আমাদের সমস্ত চেষ্টার পথ রুদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে। এক্ষণে এই উক্তির অসারতা প্রমাণিত হইয়াছে।

অন্যান্য দেশে শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক এবং ব্যবসায়ীগণ দেশের ধনবৃদ্ধির চেষ্টায় নিযুক্ত হয়। নরওয়ে এবং ডেনমার্কের মত ছোটো ছোটো দেশেও আমি কোনো অর্থকষ্ট দেখি নাই; অথচ প্রাকৃতিক সম্পদে ওই সমস্ত দেশ ভারতবর্ষ অপেক্ষা সম্পন্ন নহে। তাহাদের দেশে সর্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা আছে, তথায় সর্ববিষয়ে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় রহিয়াছে, দাবিদ্রা তথায় নাই বলিলেই চলে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে দেশের সম্পদ কাজে লাগাইয়া তাঁহারা এই অদ্ভুত ব্যাপার সম্ভব করিয়া তুলিয়াছেন। আমরা কি তাঁহাদের উদাহরণ দেখিয়া শিক্ষালাভ করিতে পারি না? শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রয়োজনের জন্য আমাদেরও কর্তব্য বিদেশের উপব নির্ভর না করা। ইহা করিতে হইলে দূরদর্শী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার আবশ্যক। কিন্তু এই অত্যাবশ্যক ব্যাপারে রাষ্ট্রশক্তির একটা বিশেষ উপেক্ষা দেখা যায়। মহীশূর রাজা এইদিকে দৃষ্টি দিয়াছেন, ইহা সুখের কথা।

কূটচক্র

মানুষ যখন তাহার দৃষ্টি সম্মুখে প্রসারিত এই বিস্তীর্ণ সাগর ও আকাশ দেখিতে পাইল তখন সে ছুটিয়া বাহির হইল। তরঙ্গায়িত সাগর বহিয়া সে পৃথিবী ঘুরিয়া আসিল। আকাশের স্পর্ধার আহ্বান সে গ্রহণ করিল, সাহসের দ্বারা আকাশ জয় করিয়া অবারিত শূন্যমার্গ প্রতিষ্ঠা করিল। মানুষ স্রষ্টা, এই সমস্ত আশ্চর্য ব্যাপারই মানুষের অজেয় ঐশী শক্তির সাক্ষ্য দিতেছে। যে দুর্বল নিজের ঐশী শক্তির কথা বিস্মৃত হয়, সে হীন নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন করে। যে লোক স্বীয় চেষ্টার দ্বারা জয়ী হইয়াছে, একমাত্র সেই নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা জগতকে সমৃদ্ধ করিয়া তুলিতে পারে।

আজ জাতীয় জীবনে একটা আশ্চর্য দৌর্বল্য ও অবসাদ দেখা দিয়াছে। অবিলম্বে ইহার প্রতিকার না করিলে ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। দুর্বল ও জীর্ণের প্রতি প্রকৃতির কোনো দয়া নাই।

জীবনধারণের জন্য, যতটুকু আবশ্যক, অলস প্রকৃতির লোক ততটুকু সংগ্রহ করিয়াই

সন্তুষ্ট থাকে। তাহাতে তাহার কর্মশক্তি হ্রাস পায়। সে ব্যাধিকে বাধা দিতে পারে না। ফলে

জীবনীশক্তি কমিয়া যায়, তারপর আসে দারিদ্রা, শেষে মৃত্যু। এইভাবে কূটচক্র ঘুরিতেছে। কিন্তু পাশ্চাত্যে এরূপ দেখা যায় না। জাতির মহাদুর্দিনেও তাহারা কর্মশক্তি বজায় রাখিয়াছে। তাহাদের শ্রমের বলে তাহারা জাতিকে স্বচ্ছল করিয়া তুলিতেছে।

দুইয়ের পার্থক্যের উদাহরণস্বরূপ আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলিতেছি। আমার পুরাতন ছাত্রদের মধ্যে অনেকেরই বিজ্ঞানের প্রতি একটা বিশেষ অনুরাগ ছিল। কিন্তু তাহারা তাহাদের এই স্বাভাবিক অনুরাগ বিসর্জন দিয়া আইনব্যবসায় অবলম্বন করিতে বাধ্য হইয়াছে। আদালতে যাইয়া অনিশ্চিত ভাগ্যের অনুসরণ ভিন্ন যেখানে প্রতিভা দেখাইবার অন্য উপায় নাই, সে দেশ যে কি দুর্দশায় পড়িয়াছে এবং সে দেশে যে কি দারুণ সমস্যা উপস্থিত হইয়াছে তাহা অন্ধ ভিন্ন সকলেই দেখিতে পায়।

জাপানের গভর্নমেন্ট প্রতিভাবান ছাত্রের মধ্যে কি যত্ন লইয়া থাকেন তাহা দেখিবার সুযোগ আমার ঘটিয়াছিল। প্রতিভাবান ছাত্রদিগকে জাপানের গভর্নমেন্ট দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ বলিয়া মনে করেন। আমি দেখিয়াছি যে, প্রতিভাবান ছাত্ররা প্রধান প্রধান কর্মচারীদের সহিত ব্যত্তিগতভাবে পরিচিতি। ইউরোপ এবং আমেরিকায় জাপানি ছাত্রদের শিক্ষার এমন ব্যবস্থা করিয়া থাকেন যে, দুই বৎসরের মধ্যে তাহারা খ্যাতনামা শিক্ষকদের নিকট হইতে স্ব-স্ব বিষয়ে পূর্ণ শিক্ষা লাভ করে। দেশে ফিরিয়া তাহারা বেকার বসিয়া থাকে না। জাপান গভর্নমেন্ট পূর্ব হইতেই তাহাদের জীবিকার ব্যবস্থা করিয়া রাখেন। তাহারাও প্রতিভা খাটাইবার পূর্ণ সুযোগ পায়।

আদর্শ দেশীয় রাজ্য

মহাশুর রাজ্য যে আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া এই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছেন এবং প্রজাদের মঙ্গলের জন্য যে সমস্ত চেষ্টা করিতেছে এক্ষণে আমি সে আদর্শের কথা আলোচনা করিব। বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিল্পোন্নতির চেষ্টা বিচ্ছিন্ন নহে। একটিকে বাদ দিয়া অপরটি দ্বারা রাষ্ট্রের কল্যাণ সম্ভব নহে। অবশ্য অন্যান্য এমন অনেক দেশ আছে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগেই লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় সম্ভব। কিন্তু আমাদের অত টাকা ব্যয় করিবার সামর্থ নাই; কিন্তু সেজন্য পশ্চাৎপদ হইলে চলিবে না। অজেয় শক্তিসম্পন্ন মানুষের মন কি কিছুই করিতে পারে না? অবসাদ দূর করো, দৌর্বল্য পরিহার করো। স্মরণ রাখিও ভারতবর্ষই আমাদের কর্মক্ষেত্র, এস্থানেই আমাদের কর্তব্য সম্পাদন করিতে হইবে, অন্য কোথাও নহে। সামান্য সম্বলে আমাদের পূর্বপুরুষগণ বিরাট কার্য করিয়া গিয়াছেন, আমরা সেকথা ভুলিয়া না যাই।

যাঁহারা দূরে আছেন তাঁহারাই বুঝিতে পারেন যে, জাতি গঠনের জন্য এই রাজ্য কতটা চেষ্টা করিতেছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রজাদের সমস্ত সংবাদ রাখেন। প্রজাদের স্বচ্ছলতা রাজ্যেরই গৌরব। এই রাজ্যেই ভারতীয় রাষ্ট্র চালকগণ স্ব-স্ব প্রতিভার পরিচয় দিবার সুযোগ পাইয়াছেন। রেলপথ প্রসার করিয়া, কোলার স্বর্ণখনির উন্নতি করিয়া, জল সিঞ্চনের ব্যবস্থা করিয়া, শিব সমুদ্রম জলস্রোত হইতে বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করিয়া স্যার শিবস্বামী আয়ার যে প্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন, তাহা দেখিলে বিস্ময়ে মুগ্ধ হইতে হয। অর্থের দ্বারা এই সমস্ত কার্যের মূল্য নির্ধারণ সম্ভব নহে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত যুবকদিগের প্রতিভার পরিচয় দিবার যে সুযোগ দেওয়া হইয়াছে তাহার পরিমাণ সহজ নহে। অন্যতম মন্ত্রী স্যার বিশ্বেশ্বরায়া ভদ্রাবতী লৌহ কারখানা এবং অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান খুলিয়াছেন। দেখা যাইতেছে যে, এই রাজ্যের অধিবাসীরা স্বপ্নলোকে বাস করে না, স্বপ্নকে সত্য করিয়া তুলিবার মতো ধৈর্য ও শক্তি তাহাদের আছে। তাহাদের এই উৎসাহের উৎস কোথায়? দেশপ্রেম এবং রাষ্ট্রের প্রতি অনুরুক্তিই এই উৎস।

শিক্ষা ও অনুসন্ধিৎসা

শিক্ষাদান ও অনুসন্ধিৎসা পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সংবদ্ধ। শুধু পুরাতন সিন্ধান্ত সম্বন্ধে বক্তৃতা করিয়াই শিক্ষা দেওয়া চলে না। অনেক সময় এই সমস্ত সিদ্ধান্ত ভিত্তিহীন বলিয়া প্রমাণিত হয়। বড়লোকের কথাকেই অভ্রান্ত সত্য বলিয়া ধরিয়া লইতে শিক্ষা দেওয়ার মতো অনিষ্ট নাই। বিদ্যার্থীকে নিজে সত্য আবিষ্কারে উদ্বুদ্ধ করাই আচার্যের প্রধান কর্তব্য। এরূপ আচার্য সহজে মিলে না। সেরূপ আচার্য আপনাদিগকে খুঁজিয়া বাহিব কবিতে হইবে এবং তাঁহাকে কার্যের সুবিধা দিতে হইবে। নিজেদের জন্য সর্বদা বিশেষ সুবিধা খুঁজিয়া বেড়াইবে, এমন একটা শিক্ষিত জাতির সৃষ্টি যেন আপনারা না করেন। একমাত্র জ্বলন্ত প্রদীপই আলোক বিতরণ করিতে সমর্থ। এইরূপ আচার্যের অধীনে থাকিয়া ধৈর্য এবং প্রতিপদে সতর্কতা শিক্ষা করিবে। বিদ্যার্থীবা আচার্যের অংশস্বরূপ হইয়া উঠিবে এবং বংশ পরম্পরায় সত্য ও প্রীতির বিতরণ করিবে। সে প্রীতির ভাব কখনও নাশ হইবে না। আমরা মরিয়া যাইব। রাজ্য ধ্বংস হইতে পারে, কিন্তু তাহারা যে সত্য ও প্রীতি বিলাইয়া যাইবে তাহা ধ্বংস হইবে না। সত্য চিরকাল বাঁচিয়া থাকিবে। কারণ, সত্য অবিনাসী।

ছাত্রদের প্রতি উপদেশ

মানব জাতির কল্যাণের জন্য জ্ঞানের প্রচার ও প্রয়োগ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রধান কার্য, অবশ্য ইহাই একমাত্র কার্য নহে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা বিভিন্ন মানবজাতির আদর্শ চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসিয়া থাকি। মানুষের সাময়িক ত্রুটি দেখিয়া আমাদের নিরুৎসাহ হইলে চলিবে না। মানুষের মহত্ব দেখিয়াই আমাদিগকে উৎসাহিত হইতে হইবে। সংগ্রাম হইতে দূরে থাকিয়া নহে, সংগ্রামে যোগ দিয়াই আমরা মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সেবা করিতে পারিব। দেশ আজ তোমাদিগকেই সর্বাপেক্ষা বেশি চাহিতেছে। এই সময়ে জন্মগ্রহণ করিয়া তোমরা ধন্য হইয়াছ, সে কথা স্মবণ রাখিও। তোমরা যে সভ্যতার অধিকারী তাহা যুগযুগান্ত ধরিয়া বাঁচিয়া আছে, অলস নিষ্ক্রিয় থাকিয়া তোমরা সে সভাতা নষ্ট করিও না। মানবজাতির দুঃখ নিবারণের জন্য যুগযুগান্ত ধরিয়া যে আহ্বান তোমাদের নিকট আসিয়াছে তোমরা সে আহ্বানে সাড়া দাও। দুঃখ এবং দুঃখের কারণ নিবারণই ক্ষাত্রধর্ম। প্রত্যেকে ক্ষত্রিয় হও। পৃথিবী মানুষের দুঃখের রঙ্গক্ষেত্র, সে দুঃখের অংশ কে লইবে? কে গুরুভার বহন করিবে, দুর্বল না সবল?

অতীত ভারতে কর্মকেই প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে, অবসাদকে নহে। যুদ্ধক্ষেত্রেই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানালোক উদ্ভাসিত হইয়াছে। যে সুখে আমরা অপরকে অধিকারী করিতে সমর্থ নহি, আমরা সে সুখের অধিকারী নহি। সুতরাং আমি তোমাদিগকে শক্তিমন্ত্রে আহ্বান করিতেছি। আমি তোমাদিগকে অমর আশায় উদ্বুদ্ধ করিতেছি। এই আশা আমাদিগকে চিরদিন সঞ্জীবিত রাখিবে। ভারতীয় সভ্যতার মধ্যে একটা অদ্ভুত শক্তি নিহীত আছে। যে সভ্যতা নীল উপত্যকার সভ্যতাকে, এসেরিয়া ও ব্যাবিলনের সভ্যতাকে প্রজ্বলিত ও নির্বাপিত হইতে দেখিয়াও বাঁচিয়া আছে, সে সভ্যতার মধ্যে নিশ্চয়ই একটা স্বতঃশক্তি নিহীত আছে--অতীতের অটল বিশ্বাস লইয়া সে সভ্যতা আজ ভবিষ্যতের দিকে চাহিযা আছে।


ট্রপিক্যাল মেডিসিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি এবং বৈজ্ঞানিকদের সমক্ষে বক্তৃতা

স্থান: বসু বিজ্ঞান মন্দির ৬. ১২. ১৯২৭ সাল

সর্বপ্রকার প্রাণক্রিয়ার সমক্রিয়া প্রতিপন্ন করিবার উদ্দ্যেশ্যে আমি আমার অনুসন্ধান আরম্ভ করি। যদি এই সমক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা যায়, তবে বিজ্ঞান রাজ্যে একটা বিরাট রহস্যের দ্বারোদঘাটন হইবে। জীবদেহের যে সমস্ত জটিল সমস্যা আমরা সমাধান করিতে সমর্থ হই না, উদ্ভিদ দেহের অনুরূপ ক্রিয়া দেখিয়া সে সমস্ত সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হইবে। উদ্ভিদ ও জীবের প্রাণের সমক্রিয়া কি করিয়া প্রতিপন্ন করা যায়? নিছক কল্পনা যতই আনন্দদায়ক হউক না কেন, তাহাতে কোনো ফল হইবে না। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের কঠোর পথে অনুসরণ করিতে হয়। নানাপ্রকার কৌশলে মৃক উদ্ভিদকে দিয়াই স্বীয় প্রাণক্রিয়ার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করাইবার ব্যবস্থা করা হইয়াছে।

[৭. ১২. ২৭ আনন্দবাজার পত্রিকা।]

অবয়ব ও অবয়বের কার্য: প্রাণীদেহের প্রত্যেকটি অবয়ব সমগ্র দেহের এক-একটি বিশেষ কার্য সম্পন্ন করিয়া থাকে। বিভিন্ন শ্রেণির পাকযন্ত্রের কার্য তুলনা করিলে এই কথাটি স্পষ্টতররূপে বুঝিতে পারা যাইবে। পাকযন্ত্রের কার্য হইতেছে পাচকরস নিঃসরণ দ্বারা ভুক্তদ্রব্যকে দ্রবীভূত করিয়া হজম করা। Sundew নামক কীটভুক উদ্ভিদের পত্রগুলিব মধ্যে কতকগুলি গুঁয়া থাকে, সেই শুয়াগুলি একপ্রকার টক রস নিঃসরণ করে। এই রসের মধ্যে কীটপতঙ্গ আটক পড়িয়া যায়। পরে কীটপতঙ্গ যখন ছাড়া পাইবার জন্য হস্তাদি বিক্ষেপ আরম্ভ করে, তখন অন্যান্য শুয়াগুলি শিকারকে আরও শক্ত করিয়া ধরিয়া থাকে। অতঃপর কীটগুলি দ্রবীভূত হইয়া যায়, শুধু কঙ্কালগুলি অবশিষ্ট থাকে। সম্পূর্ণ উন্মুক্ত পাকস্থলীর কার্যের নিদর্শন এই ক্ষেত্রে দেখা গেল; কিন্তু প্রাণীদেহের অভ্যন্তরস্থ পাকস্থলীর কার্য এত সহজ নহে। যাহা হউক, পচনক্রিয়ার ক্ষমতা দেখিয়া, ডারুইনের অনুসন্ধান লব্ধ তথ্য প্রকাশের পর সকলেই স্বীকার করিয়াছেন যে, কীটভুক উদ্ভিদের পাকস্থলী আছে। Venus নামক গাছের পাতার দুইটি অর্ধাংশ মিলিয়া একটি ফাঁদের আকার ধারণ করে। ঠিক যেন বৃক্ষটি মুখব্যাদান করিয়া থাকে, যেই কোনো কীট ওই ফাঁদে পড়ে অমনি পাতাটি বুজিয়া যায়। Nepenthe-র পাকযন্ত্র একটি থলিয়ার আকৃতি। ইহার পাকযন্ত্র কতকটা প্রাণীদেহের পাকযন্ত্রের অনুরূপ। এইরূপ যদি উদ্ভিদ জীবনে অনুসন্ধান করা যায়, তবে দেখা যায় যে, সকল সহজে যন্ত্র কীভাবে ধীরে ধীরে জটিল যন্ত্রে পরিণত হইয়াছে।

প্রাণীদেহে তিনপ্রকার কোষ আছে-পেশি-কোষ, স্নায়ু-কোষ এবং স্বতঃস্পন্দনশীল কোষ। উদ্ভিদদেহেও অনুরূপ ক্রিয়াশীল কোনো কোষ আছে কিনা, তাহা অনুসন্ধান করিয়া দেখা আবশ্যক। আমি পূর্বে বক্তৃতা প্রসঙ্গে উদ্ভিদের নাড়ির সংকোচন প্রসারণ কার্য দেখাইয়াছি, এক্ষণে শুধু রক্ত বা রস সঞ্চালন ক্রিয়া দেখাইলেই চলিবে। প্রাণীদেহে কতগুলি কোষ আছে, যাহাদের স্বতঃসংকোচন বিস্ফোরণের দ্বারা এই কার্য হইযা থাকে। উদ্ভিদদেহে এরূপ কোন স্বতঃসংকোচন বিস্ফোরণশীল কোষ আছে কিনা?

উদ্ভিদ ও প্রাণীর হৃদ্যন্ত্র: একটি সংকোচন প্রসারণশীল যন্ত্রের সাহায্যে প্রাণীদেহের রক্ত সঞ্চালনক্রিয়া নিষ্পন্ন হয়। সেই যন্ত্রটির নাম হৃদ্যন্ত্র। কেঁচো প্রভৃতি নিম্নস্তরের প্রাণীদেহে হৃদ্যন্ত্রটি একটি লম্বমান নালাকৃতি, এই হৃদযন্ত্রের সংকোচন বিস্ফোরণের সহায়ে সঞ্জীবনী রস সঞ্চালিত হয়। উচ্চতর স্তরের প্রাণীর মধ্যেও হৃদ্যন্ত্রটি লম্বাকৃতি। প্রাণীদেহের হৃদ্যন্ত্রস্থিত কোষগুলির বৈশিষ্ট্য স্বতঃস্পন্দনশীলতা, বিভিন্ন অবস্থায় এই স্পন্দনের হ্রাসবৃদ্ধি হয়। কোন কোন উত্তেজক ঔষধির ফলে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া দ্রুত সম্পাদিত হইতে থাকে, ফলে দ্রুত রক্ত সঞ্চালিত হয়। আবার অবসাদজনক ঔষধির ফলে ঠিক বিপরীত ভাব দেখা যায়।

রক্তসঞ্চালন কার্যে প্রত্যক্ষীকরণ: একটি অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে আমি একটি ভেকের রক্তসঞ্চালনের কার্য এই যবনিকার ওপর প্রতিফলিত করিতেছি। দেখুন প্রধান শিরা এবং উপশিরার মধ্য দিয়া কিরূপ দ্রুতগতিতে রক্তধারা প্রবাহিত হইতেছে। আমি এক্ষণে একটি অবসাদজনক ওষধি প্রয়োগ করিতেছি। দেখুন ঠিক বিপরীত ক্রিয়া দেখা যাইতেছে, এই দেখুন রক্তপ্রবাহ একেবাবে বন্ধ হইয়া গেল।

উদ্ভিদদেহে রসসঞ্চালন: এক্ষণে প্রশ্ন এই যে উদ্ভিদদেহের রসসঞ্চালন অনুরূপ হৃদক্রিয়া দ্বারা নিস্পন্ন হয় কিনা? প্রচলিত সিদ্ধান্ত এই যে, উদ্ভিদদেহে রসসঞ্চালন জড়ক্রিয়ার ফল- জীবন্ত কোষের প্রাণ ক্রিয়ার ফল নহে। ইউক্যালিপটাস বৃক্ষে ৪৫০ ফুট পর্যন্ত উর্ধে রসসঞ্চালিত হয়, কোনো জড়যন্ত্রের সাহায্যে এতো উচ্চে জল উত্তোলন করা অসম্ভব। প্রাণ ক্রিয়াদ্বারাই এই কার্য হয় কিনা, তাহা পরীক্ষা করিবার জন্য স্ট্রাসবার্গার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। তাঁহার অনুসন্ধান অসম্পূর্ণ থাকার ফলে এই প্রাণক্রিয়া সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত অনেকটা খর্ব হইয়া পড়ে।

স্ট্যাসবার্গার পরীক্ষা করিয়া দেখাইয়াছিলেন যে, বিষ প্রয়োগ দ্বারা উদ্ভিদদেহে রসসঞ্চালন হ্রাস পায় না। ইহা হইতে তিনি সিদ্ধান্ত করেন যে, যদি উদ্ভিদের দেহে রসসঞ্চালন কার্য জীবিত কোষের সাহায্যেই হইত, তবে বিষক্রিয়ার ফলে কোষগুলির নিশ্চয় মৃত্যু হইত এবং রসসঞ্চালন বন্ধ হইত। অন্যান্য অনেকে অন্ধভাবে এই সিদ্ধান্ত স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। একটু বাদেই আমি আপনাদিগকে যাহা দেখাইব তাহাতে স্ট্রাসবার্গারের সিদ্ধান্ত যে সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক, তাহা প্রমাণিত হইবে। পক্ষান্তরে আমি প্রমাণ করিব যে, জীবন্ত কোষের স্পন্দনশীলতার ফলেই রসসঞ্চালন অব্যাহত থাকে।

উদ্ভিদদেহে কীভাবে রসসঞ্চালিত হয়, আমি এক্ষণে দেখাইতেছি। আমি আরো দেখাইব যে অবস্থায় প্রাণীদেহে রক্তসঞ্চালনের হ্রাসবৃদ্ধি হয়, সে অবস্থায় উদ্ভিদদেহে রসসঞ্চালনেরও হ্রাস-বৃদ্ধি হয়। রসসঞ্চালনের কোন পরিমাপক কোনো সন্তোষজনক উপায় ইতিপূর্বে উদ্ভাসিত হয় নাই। রসসঞ্চালনের বেগ নির্ণয় করিবার জন্য আমি একটি উপায় বাহির করিতেছি। এই উপায়ে উদ্ভিদের পত্রগুলিকেই মাপকাঠি রূপে গ্রহণ করা যায়। জলাভাবে পাতাগুলি হেলিয়া পড়ে, আবার জল পাইলে পাতাগুলি সোজা হইয়া ওঠে; অধিকন্তু কোনও উপায় যদি রসসঞ্চালন বৃদ্ধি করা যায়, তাহা হইলে পাতাগুলি দ্রুত সোজা হইয়া উঠে! আবার অবসাদ জন্মাইয়া রসসঞ্চালন হ্রাস করিলে পাতাগুলি হেলিয়া পড়ে। পাতাগুলির এই উত্থানপতনের হার এত সামান্য যে চক্ষে ধরা সম্ভব নহে, যন্ত্র সাহায্যে এই হারকে বৃহদাকারে প্রতিফলিত করা সম্ভব, আমি তাহাই দেখাইতেছি। এই যে গাছটি দেখিতেছেন। ইহা জলশূন্য স্থানে ছিল, কাজেই পাতাগুলি হেলিয়া পড়িয়াছে। আমি এক্ষণে গাছটিকে জলসিঞ্চন করিতেছি। দেখুন পাতাগুলি সোজা হইয়া উঠিতেছে; কিন্তু এই পাতাগুলি ঠিক একচোটে সোজা হইয়া উঠিতেছে না, কাঁপিতে কাঁপিতে উঠিতেছে। ইহা দ্বারাই অদৃশ্য সংকোচন প্রসারণশীল যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণিত হইতেছে। আমি এক্ষণে পটাশিয়াম ব্রমাইড নামক অবসাদজনক ঔষধি প্রয়োগ করিতেছি। দেখুন, জলসিঞ্চনের ফলে পাতাগুলি যেভাবে সোজা হইয়া দাঁড়াইতেছিল এক্ষণে আর সে ভাব নাই। পাতাগুলি এক্ষণে আবার কাঁপিতে কাঁপিতে হেলিয়া পড়িতেছে।

প্রাণীদেহে কপূর প্রয়োগের ফলে হৃদক্রিয়া বৃদ্ধি পায়। আমি সামান্য কপূর মিশ্রিত জল এই গাছটিকে দিতেছি। দেখুন, দুইটি পরস্পর বিরোধী ক্রিয়ায় কি সংগ্রাম আরম্ভ হইয়াছে। এই দেখুন শেষকালে উত্তেজনা ঔষধটির কার্যই জয়লাভ করিল-প্রতিচালিত আলোকরেখা উর্ধ্বগমন করিয়া রসসঞ্চালন বৃদ্ধির পরিচয় দিতেছে। আমি এক্ষণে গাছটাকে তাড়িতাঘাত করিতেছি। দেখুন তড়িতাঘাতে আমাদের দেহ যেরূপ বিক্ষেপের সঞ্চার হয়, গাছটিতেও সেরূপ বিক্ষেপের সঞ্চার হইল।

উদ্ভিদ হৃদয়ের সন্ধান: এতদ্বারা প্রমাণিত হইতেছে যে, গাছটির মধ্যে নিশ্চয়ই আকর্ষণ- বিকর্ষণ কোষ আছে। যে যন্ত্রের সাহায্যে কোষগুলির এই সংকোচন-প্রসারুণ হয় তাহার অবস্থিতি কোথায়? আমি আমার বৈদ্যুতিক শলাকা (Electric Probe) সহায়ে এই যন্ত্র অর্থাৎ বৃক্ষের হৃদ্যন্ত্রের অবস্থিতির স্থান নির্ণয় করিয়াছি। আমি ধীরে ধীরে বৈদ্যুতিক শলাকাটি গাছটির মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দেখিয়াছি। যে মুহূর্তে শলাকাটি হৃদ্যন্ত্রের সংস্পর্শে আসিয়াছে, অমনি বৈদ্যুতিক স্পন্দন পাওযা গিয়াছে। তারপর যবনিকার উপর প্রতিফলিত আলোকরেখাটি একবার দক্ষিণে, আর একবার বামে দুলিয়া হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়ার আশ্চর্যজনক পরিচয় দিতেছে।

জীবন-মৃত্যু সংগ্রাম: আপনারা দেখিলেন যে, প্রাণীদেহের এবং উদ্ভিদদেহের হৃদক্রিয়া সমপ্রকার। এক্ষণে আমি আরও একটি আশ্চর্যজনক ব্যাপার দেখাই। তাহা প্রাণী এবং উদ্ভিদের হৃদযন্ত্রে ঔষধের সমক্রিয়া। আপনাদের নিকট এই যে গাছটি দেখিতেছেন, এই গাছটিকে ক্লোরোফর্ম প্রয়োগ করা হইয়াছে। যবনিকার আলোকরেখা দেখুন। দেখিতেছেন যে, গাছটি কিভাবে মৃত্যু কবলে পড়িয়া যন্ত্রণায় ছটফট করিতেছে, ঠিক প্রাণীদেহের মতো। দেখুন ক্রমশ সমস্ত যন্ত্রণা শেষ হইয়া আসিল, ঠিক যেন মৃত্যু হইয়াছে। যথা সময়ে যদি যথোপযুক্ত প্রতিক্রিয়াজনক ঔষধি প্রয়োগ করা যায়, তবে গাছটিকে বাঁচানো যাইতে পারে। মৃগনাভি প্রয়োগ করিয়া ঠিক বিপরীত ক্রিয়া দেখানো যাইতে পারে।

The Voice of Life by Jagdish Chandra Bose

Inaugural Address delivered at the Bore Institute on November 30, 1917

I dedicate today this Institute- not merely a Laboratory but a Temple. The power of Physical methods applies for the establishment of that truth which can be realised directly through our senses, or through the vast expansion of the perceptive range by means of artificially created organs. We still gather the tremulous messages when the note of audible reaches the unheard. When human sight fails, we continue to explore the region of the invisible. The little that we can see is as nothing compared to the vastness of that which we cannot. Out of the very imperfection of his senses man has built himself a raft of thought by which he makes daring adventures on the great seas of the Unknown. But there are other truths which will remain beyond even the super-sensitive methods known to science For these we require faith, tested not in a few years but by an entire life. And a temple is erected as a fit memorial for the estibalishment of that truth for which faith was needed. The personal, yet general, truth and faith whose establishment this Institute commemorates is this; that when one dedicates himself wholly for a great object, the closed doors shall open. And the seemingly impossible will become possible for him.

Thirty-two years ago I chose teaching of science as my vocation. It was held that by its very peculiar constitution, the Indian mind would always turn away from the study of Nature to metaphysical speculations. Even had the capacity for inquiry and accurate observation been assumed present, there were no opportunities for their employment; there were no well-equipped laboratorics nor skilled mechanicians. This was all too true. It is for man not to quarrel with circumstances but bravely accept them; and we belong to that race and dynasty who had accomplished great things with simple means.

FAILURE AND SUCCESS

This day twenty-three years ago. I resolved that as far as the whole hearted devotion and faith of one man counted, that would not be wanting, and within six months it came about that some of the most diffcult problems connected with Electric Waves found their solution in my Laboratory, and received high appreciation from Lord Kelvin, Lord Rayleigh and other leading Physicists. The Royal Society honoured me by publishing my discoveries and offering, of their own accord, an appropriation from the special Parliamentary Grant for the advancement of knowledge. That day lighted would continue to burn brighter and brighter. But man's faith and hope require repeated testing. For five years after this the progress was uninterrupted; yet when the most generous and wide appreciation of my work had reached almost the highest point there came a sudden and unexpected change.

LIVING AND NON-LIVING

In the pursuit of my investigations I was unconsciously led into the border region of physics and physiology and was amazed to find boundary lines vanishing and points of contact emerge between the realms of the Living and Non-living. Inorganic matter was found anything but inert; it also was a thrill under the action of multitudinous forces that played on it. A, universal reaction seemed to bring together metal, plant and animal under a common law. They all exhibited essentially the same phenomena of fatigue and depression, together with possibilities of recovery and of exaltation, yet also that of permanent irresponsiveness which is associated with death. I was filled with awe at this stupendous generalisation; and it was with great hope that I announced my results before the Royal Society,

results demonstrated by experiments. But the physiologists present advised me, after my address, to confine myself to physical investigations in which my success had been assured, rather than encroach on their preserve. I had thus unwittingly strayed into the domain of a new and unfamiliar caste system and so offended its etiquette. An unconscious theological bias was also present which confounds ignorance with faith. It is forgotten that He, who surrounded us with this ever-evolving mystery of creation, the ineffable wonder that lies hidden in the microcosm of the dust particle, enclosing within the intricacies of its atomic form all the mystery of the cosmos, has also implanted in us the desire to question and understand. To the theological bias was added the misgivings about the inherent bent of the Indian mind towards mysticism and unchecked imagination. But in India this burning imagination which can extort, new order out of a mass of apparently contradictory facts, is also held in check by the habit of mediation. It is this restraint which confers the power to hold the mind in pursuit of truth, in infinite patience, to wait, and reconsider, to experimentally test and repeatedly verify.

It is but natural that there should be prejudice, even in science against all innovations; and I was prepared to wait till the first incredulity could be overcome by further cumulative evidence. Unfortunately there were other incidents and misrepresentations which it was impossible to remove from this isolating distance. Thus no conditions could have been more desperately hopeless than those which confronted me for the next twelve years. It is necessary to make this brief reference to this period of my life; for one who would devote himself to the search of truth must realise that for him there awaits no casy life, but one of unending struggle. It is for him to cast his life as an offering, regarding gain and loss, success and failure, as one. Yet in my case this long persisting gloom was suddenly lifted. My scientific deputation in 1914, from the Government of India, gave the opportunity of giving demonstrations of my discoveries before the leading scientific societies of the world. This led to the acceptance of my theories and results, and the recognition of the importance of the Indian contribution to the advancement of the world's science. My own experience told me how heavy, sometimes even crushing, are the difficulties which confront an inquirer here in India; yet it made me stronger in my determination, that I shall make the path of those who are to follow me less arduous, and that India is never to relinquish what has been won for her after years of struggle.

THE TWO IDEALS

What is it that India is to win and maintain? Can anything small or circumscribed ever satisfy the mind of India? Has her own history and the teaching of the past prepared her for some temporary and quite subordinate gain? There are at this moment two complementary and not antagonistic ideals before the country. India is drawn into the vortex of international competition. She has to become efficient in every way, through spread of education, through performance of civic duties and responsibilities, through activities both industrial and commercial. Neglect of these essentials of national duty will imperil her very existence; and sufficient stimulus for these will be found in success and satisfaction of personal ambition.

But these alone do not ensure the life of a nation. Such material activities have brought in the West their fruit, in accession of power and wealth. There has been a feverish rush even in the realm of science, for exploiting applications of knowledge, not so often for saving as for destruction. In the absence of some power of restraint, civilisation is trembling in an unstable poise on the brink of ruin. Some complemantary ideal there must to be save man from that mad rush which must end in disaster. He has followed the lure and excitement of some insatiable ambition, never pausing for a moment to think of the ultimate object for which success was to serve as a temporary incentive. He forgot that far more potent than competition was mutual help and co-operation in the scheme of life. And in this country through milleniums, there always have been some who, beyond the immediate and absorbing prize of the hour, sought for the realisation of the highest ideal of life-not through passive renunciation, but through active struggle. The weakling who has refused the conflict, having acquired nothing, has nothing to renounce. He alone who has striven and won, can enrich the world by giving away the fruits of his victorious experience. In India such examples of constant realisation of idcals through work have resulted in the formation of a continuous living tradition. And by her latent power of rejuvenescence she has readjusted herself through infinite transformations. Thus while the soul of Babylon and the Nile Valley have transmigrated, ours still remains vital and with capacity of absorbing what time has brought, and making it one with itself.

The ideal of giving, of enriching, in fine, of self-renunciation in response to the highest call of humanity is the other and complementary ideal. The motive power for this is not to be found in personal ambition but in the effacement of all littlenesses, and uprooting of that ignorance which regards anything as gain which is to be purchased at other's loss. This I know, that no vision of truth can come except in the absence of all sources of distraction, and when the mind has reached the point of rest.

Public life, and the various professions will be the appropriate spheres of activity for many aspiring young man. But for my disciples, I call on these very few, who, realising some inner call, will devote their whole life with strengthened character and determined purpose to take part in that infinite struggle to win knowledge for its own sake and see truth face to face.

EXTENDED REGIONS OF ENQUIRY

The work already carried out in my laboratory on the response of matter, and the unexpected revelations in plant life, foreshadowing the wonders of the highest anımal life, have opened out very extended regions of inquiry in Physics, in Physiology, in Medicine, in Agriculture and even in Psycology, Problems, hitherto regarded as insoluble, have now been brought within the sphere of experimental investigation. These inquiries are obviously more extensive than those customary either among physicists or physiologists, since demanding interests and attitudes hitherto more or less divided between them. In the study of Nature, there is a necessity of the dual view point, this alternating yet rhythmically unified interaction of biological thought with physical studies, and physical thought with biological studies. The future worker with his freshened grasp of physics, his fuller conception of the inorganic world, as indeed thrilling with "the promise and potency of life" will redouble his former energies of work and thought. Thus he will be in a position to win now the old knowledge with finer seives, to re-search it with new enthusiasm and subtler instruments. And thus with thought and toil and time he may hope to bring fresher views into the old problems. His handling of these will be at once more vital and more kinetic, more comprehensive and unified. The further and fuller investigation of the many and ever-opening problems of the nascent science which includes both Life and Non-Life are among the main purposes of the Institute I am opening today; in these fields I am already fortunate in having a devoted band of disciples, whom I have been training for the last ten years. Their number is very limited, but means may perhaps be forthcoming in the future to increase them. An enlarging field of young ability may thus be available. from which will emerge, with time and labour, individual originality of research, productive invention and some day even creative genius.

But high success is not to be obtained without corresponding experimental exactitude, and this is needed today more than ever, and to- morrow yet more again. Hence the long battery of super-sensitive instru- ments and apparatus, designed here, which stand before you in their cases in our entrance hall. They will tell you of the protracted struggle to get behind the deceptive seeming into the reality that remained unseen;-of the continuous toil and persistence and of ingenuity called forth for overcoming human limitations. In these directions through the ever-increasing ingenuity of device for advancing science, I see at no distant future an advance of skill and of invention among our workers; if this skill be assured, practical applications will not fail to follow in many fields of human activity.

ADVANCEMENT AND DIFFUSION OF KNOWLEDGE

The advance of science is the principal object of this Institute and also the diffusion of knowledge. We are here in the Largest of all the many chambers of this House of Knowledge-its Lecture Room. In adding this feature, and on a scale higherto unprecedented in a Research Institute, I have sought permanently to associate the advancement of knowledge with the widest possible civic and public diffusion of it; and this without any academic limitations, henceforth to all races and languages, to both men and women alike, and for all time coming.

The lectures given here will not be mere repetitions of second-hand knowledge. They will announce, to an audience of some fifteen hundred people, the new discoveries made here, which will be demonstrated for the first time before the public. We shall thus maintain continuously the highest aim of a great Seat of Learning by taking active part in the advancement and diffusion of knowledge. Through the regular publication of the Transacations of the Institute, these Indian contributions will reach the whole world. The discoveries made will thus become public property. No patents will ever be taken. The spirit of our national culture demands that we should for ever be free from the desecration of utilising knowledge for personal gain. Besides the regular staff there will be a selected number of scholars, who by their work have shown special aptitude, and who would devote their whole life to the pursuit of research. They will require personal training and their number must necessarily be limited. But it is not the quantity but quality that is of essential importance.

It is my further wish, that as far as the limited accommodation would permit, the facilities of this Institute should be available to workers from all countries. In this I am attempting to carry out the traditions of my country, which so far back as twenty-five centuries ago, welcomed all scholars from different parts of the world, within the precincts of its ancient scats of learning, at Nalanda and at Taxılla.

THE SURGE OF LIFE

With this widened outlook, we shall not only maintain the highest traditions of the past but also serve the world in nobler ways. We shall be at one with it in feeling the common surgings of life, the common love for the good, the true and the beautiful. In this Institute, this Study an Garden of Life, the claim of art has not been forgotten, for the artist S been working with us, from foundation to pinnacle, and from floor to coing of this very Hall. And beyond that arch, the Laboratory merges imperceptiüly into the garden, which is the true laboratory for the study of Life. There the creepers, the plants and the trees are played upon by their atural environments, sunlight and wind, and the chill at midnight under ne vault of starry space. There are other surroundings also, where the will be subjected to chromatic action of different lights, to invisihe rays, to electrified ground or thunder charged atmosphere. Everywhere they will transcribe in their own script the history of their experience. From his lofty point of observation, sheltered by the trees, the student will watch this panorama of life. Isolated from all distractions, he will learn to attune himself with Nature; the obscuring veil be lifted and he will gradually come to see how community throught out the great ocean of life outweights apparent dissimilarity. Out of discord he will realise the great harmony.

THE OUTLOOK

These are the dreams that wove a network round my wakeful life for many years past. The outlook is endless, for the goal is at infinity. The realisation cannot be through one life or one fortune but through the co- operation of many lives and many fortunes. The possibility of a fuller expansion will depend on very large endownments. But a beginning must be made, and this is the genesis of the foundation of this Institute. I came with nothing and shall return as I came; if something is accomplished in the interval, that wou'd indeed be a privilege. What I have I will offer, and one who had shared with me the struggles and hardships that had to be faced, has wished to bequeath all that is here for the same object. In all my struggling efforts i have not been altogether solitary; while the world doubted, there had been a few, now in the City of Silence, who never wavered in their trust.

Till a few weeks ago it seemed that I shall have to look to the future for securing the necessary expansion of scope and for permanence of the institute. But response is being awakened in answer to the need. The Government have most generously intimated their desire to sanction grants towards placing the Institute on a permanent basis, the extent of which will be proportionate to the public interest in this national undertaking. Out of trany who would feel an interest in securing adequate Endowment, the very first donations have come from two of the merchant princes of Bombay, whom I had been personally unknown.

A note that touched me deeply came from some girl-students of the Western Province, enclosing their little contribution "for the service of our common motherland." It is only the instinctive mother-heart that can truly 

realise the bond that draws together the nurseli ngs of the common homeland. There can be no real misgiving for the future when at the country's call man offers the strength of his life and woman her active devotion; she most of all, who has the greater insight and larger faith because of her life of austereity and self-abnegation.

Even a solitary wayfarer in the Himalayas has remembered to send me a message of cheer and good hope. What is it that has bridged over the distance and blotted out all differences? That I will come gradually to know; till then it will remain cushrined as a feeling. And I go forward to my appointed task, undısmayed by diffculties, companioned by the kind thoughts of my well-wishers both far and near.

INDIA'S SPECIAL APTITUDES IN CONTRIBUTION

TO SCIENCE

The excessive specialisati on of modern science in the West has led to the danger to losing sight of the fundamental fact that there can be but one truth, one science which includes all the branches of knowledge. How chaotic appear the happenings in Nature! Is nature a Cosmos, in which the human mind is some day to realise the uniform march of sequence, order and law? India through her habit of mind is peculiarly fitted to realise the idea of unity, and to see in the phenomenal world an orderly universe. This trend of thought led me unconsciously to the dividing frontiers of different sciences and shaped the course of my work in its constant alternations between the theoretical and the practical, from the investigation of the inorganic world to that of organised life and its multifarious activities of growth, of movement, and even of sensation. On looking over a hundred and fifty different lines of investigations carried on during the last twenty- three years, I now discover in them a natural sequence. The study of Electric Waves led to the devising of methods for the production of the shortest electric waves known and these bridged over the gulf between visible and invisible light; from this followed accurate investigation on the optical properties of invisible waves, the determination of the refractive powers of various opaque substances, the discovery of effect of air film on total reflection and the polarising propertics of strained rocks and of electric tourmalines. The invention of a new type of self-recovering electric receiver made of galena was the forerunner of application of crystal detectors for extending the range of wireless signals. In physical chemistry the detection. for molecular change in matter under electric stimulation, led to a new theory of photographic action. The fruitful theory of stereo chemistry was strengthened by the production of two kinds of artificial molecules, which like the two kinds of sugar, rotated the polarised electric wave either to the right or to the left. Again the 'fatigue' of my receivers led to the discovery of universal sensitiveness inherent in matter as shown by its electric response. It was next possible to study this response in its modification under changing environment, of which its exaltation under stimulants and its abolition under poisons are among the most astonishing outward manifestations. And as a single example of the many applications of this fruitful discovery, the characteristics of an artificial retina gave a clue to the unexpected discovery of "binocular alternation of vision" in man, cach cye thus supplements its fellow by truns, instead of acting as a continuously yoked pair, as hitherto believed.

PLANT LIFE AND ANIMAL LIFE

In natural sequence to the investigation of the response in 'inorganic' matter, has followed a prolonged study of the activities of plant-life as compared with the corresponding functioning of animal life. But since plants for the most part seem motionless and passive, and are indeed limited in their range of movement, special apparatus of extreme delicacy had to be invented, which should magnify the tremor of excitation and also measure the perception period of a plant to a thousandth part of a second. Ultra- microscopic movements were measured and recorded; the length measured being often smaller than a fraction of a single wave-length of light. The secret of plant life was thus for the first time revealed by the autographs of the plant itself. This evidence of the plant's own script removed the long- standing error which divided the vegetable world into sensitive and insensitive. The remarkable performance of the Praying Plam Tree of Faridpore, which bows, as if to prostrate, itself, every evening, is only one of the latest instances which show that the supposed insensibility of plants and still more of rigid trees is to be ascribed to wrong theory and defective observation. My investigations show that all plants, even the trees, are fully alive to changes of environment; they respond visibly to all stimuli even to the slight fluctuations of light caused by a drifting cloud. This series of investigations has completely established the fundamental identity of life- reactions in plant and animal, as seen in a similar periodic insensibility in both, corresponding to what we call sleep, as seen in the death-spasm which takes place in the plant as in the animal. This unity in organic life is also exhibited in that spontaneous pulsation which in the animal is heart-beat; it appears in the identical effects of stimulants, anaesthetics and of poisond in vegetable and animal tissues. This physiological identity in the effect of drugs is regarded by leading physicians as of great significance in the scientific advance of medicine; since here we have a means of testing the effect of drugs under conditions far similar than those presented by the patient, far subtler too, as well as more humane than those of experiments on animals.

Growth of plants and its variations under different treatment is instantly recorded by my crescograph. Authorities expect this method of investigation will advance practical agriculture; since for the first time we are able to analyse and study separately the conditions which modify the rate of growth. Experiments which would have taken months and their results vitiated by unknown changes, can now be carried out in a few minutes.

Returning to pure science, no phenomena in plant life are so extremely varied or have yet been more incapable of generalisation than the "tropic" movements, such as the twining of tendrils, the heliotropic movements of some towards and of others away from light, and the opposite geotropic movements of the root and shoot, in the direction of gravitation or away from it. My latest investigations recently communicated to the Royal Society have established a single fundamental reaction which underlies all these effects so extremely diverse.

THE GREAT MYSTERY

Finally, I may say a word of that other new and unexpected chapter which is opening out from my demonstration of nervous impulse in plants. 

The speed with which the nervous impulse courses through the plant has been determined; its nervous excitability and the variation of that excitability have likewise been measured. The nervous impluse in plant and in man is found exalted or inhibited under identical conditions. We may even follow this parallelism in what may seem extreme cases. A plant carefully protected under glass from outside shocks, looks sleek and flourishing; but its higher nervous function is then found to be atrophied. But when a succession of blows is rained on this effete and bloated specimen, the shocks themselves create nervous channels and arouse anew the deteriorated nature. And is it not shocks of adversity and not cotton-wool protection, that evolve true manhood?

A question long perplexing physiologists and psychologists alike is that concerned with the great mystery that underlies memory. But now through certain experiments I have carried out, it is possible to trace "memory impressions" backwards even in inorganic matter, such latent impressions being capable of subsequent revival. Again, the tone of our sensation is determined by the intensity of nervous excitation that reaches the central perceiving organ. It would theoretically be possible to change the tone or quality of our sensation, if means could be discovered by which the nervous impulse would become modified during transit. Investigation on nervous impluse in plants has led to the discovery of a controlling method, which was found equally effctive in regard to the nervous impulse in animal.

Thus the line of physics, of physiology and of psychology converge and meet. And here will assemble those who would seek oneness amidst the manifold. Here it is that the genius of India should find its true blossoming.

The thrill in matter, the throb of life, the pulse of growth, the impulse coursing through the nerve and the resulting sensations, how diverse are these and yet how unified! How strange it is that the tremor of excitation in nervous matter should not merely be transmitted but transmuted and reflected like the image on a mirror, from a different plane of life, in sensation and in affection, in thought and in emotion. Of these which is more real, the material body or the image which is independent of it? Which of these is undecaying. d which of these is beyond the reach of death?

THE SOUL OF INDIA

It was a woman in the Vedic times, who when asked to take her choice of the wealth that would be hers for the asking inquired whether that would win for her deathlessness. What would she do with it, if it did not raise her above death? This has always been the cry of the soul of India. not for addition of material bondage, but to work out through struggle her self-chosen destiny and win immortality. Many a nation had risen in the past and won the empire of the world. A few buried fragments are all that remain as memorials of the great dynasties that wielded the temporal power. There is, however, another element which finds its incarnation in matter yet transcends its transmutation and apparent destruction: that is the burning flame born of thought which has been handed down through fleeting generations.

Not in matter, but in thought, not in possessions or even in attainments but in ideals, are to be found the seed of immortality. Not through material acquisition but in generous diffusion of ideas and ideals can the true empire of humanity be established. Thus to Asoka to whom belonged this vast empire, bonded by the inviolate seas, after he had tried to ransom the world by giving away to the utmost, there came a time when he had nothing more to give, except one half of an Amlaki fruit. This was his last possession and his anguished cry was that since he had nothing more to give, let the half of the Amlaki be accepted as his final gift.

Asoka's emblem of the Amlaki will be seen on the cornices of the Institute, and towering above all is the symbol of the thunderbolt. It was the Rishi Dadhichi, the pure and blameless, who offered his life that the divine weapon, the thunderbolt, might be fashioned out of his bones to smite evil and exalt righteousness. It is but half of the Amlaki that we can offer now. But the past shall be reborn in a yet nobler future. We stand here today and resume work tomorrow so that by the efforts of our lives and our unshaken faith in the future we may all help to build the greater India yet to be.




5
Articles
জগদীশচন্দ্র সেরা রচনা সম্ভার
0.0
শ্রী জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা কিছু উল্লেযোগ্য অবিস্মরণীয় কাহিনী নিয়ে রচিত একটি অব্যক্ত জীবন প্রসারিত রচনা কাহিনী সমগ্র।
1

প্রসঙ্গ জগদীশচন্দ্র

24 December 2023
0
0
0

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসু রতবর্ষের প্রাচীন গৌরবের কথা উত্থাপিত হইলে আমরা সচরাচর আর্য ঋষিগণের ধর্মোন্নতি এবং আর্য মনীষীগণের দার্শনিক জ্ঞানের কথাই ভাবিয়া থাকি। সংস্কৃত ব্যাকরণ, কাব্

2

অন্যান্য রচনা

25 December 2023
0
0
0

উদ্ভিদের হৃৎস্পন্দন [ গত এক বৎসরের মধ্যে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে উদ্ভিদজীবনের ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে তিনটি গূঢ় রহস্য উৎঘাটিত হইয়াছে। এই আবিষ্কার সমগ্র বৈজ্ঞানিক জগৎকে চমৎকৃত করিয়াছে। গতমাসে দার্জিলিং-এর গভনম

3

ভ্রমণ বিষয়ক রচনা

25 December 2023
0
0
0

লুপ্ত নগরী ই 'টালির দক্ষিণ প্রদেশ অতি রমণীয়, সমস্ত প্রদেশটি যেন একটি উদ্যান। এইরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সচরাচর দেখা যায় না। রোমানরা এই প্রদেশে সমুদ্রের উপকূলে সমৃদ্ধিশালী নগর নির্মাণ করিয়া অবকাশের সময়

4

বিবিধ রচনা

26 December 2023
0
0
0

নাদির শা-র শাস্তি ই তিহাস পাঠ করিলে ভারতভূমি যে প্রকৃতই রত্নগর্ভা তাহাতে আর সন্দেহ থাকে না। ধনধান্যের জন্য আমাদের এই মাতৃভূমি বহুকাল হইতে পৃথিবীর অন্যান্য জাতিদের প্রলোভনের বস্তু হইয়া যায়। গ্রিক দেশী

5

বক্তৃতাবলী

26 December 2023
0
0
0

ছাত্রসমাজের প্রতি* ছাত্রসমাজের সভ্যগণ, তোমাদের সাদর সম্ভাষণে আমি আপনাকে অনুগৃহীত মনে করিতেছি। তোমবা আমাকে একান্ত বিজ্ঞ এবং প্রবীণ মনে করিতেছ। বাস্তবপক্ষে যদিও জরা আমার বাহিরের অবয়বকে আক্রমণ করিয়াছে

---