shabd-logo

বিবিধ রচনা

26 December 2023

0 Viewed 0

নাদির শা-র শাস্তি

ই তিহাস পাঠ করিলে ভারতভূমি যে প্রকৃতই রত্নগর্ভা তাহাতে আর সন্দেহ থাকে না। ধনধান্যের জন্য আমাদের এই মাতৃভূমি বহুকাল হইতে পৃথিবীর অন্যান্য জাতিদের প্রলোভনের বস্তু হইয়া যায়। গ্রিক দেশীয় রাজা আলেকজান্ডার হইতে এ পর্যন্ত কত জাতির যে এদিকে লোভ পড়িয়াছে তাহা বলা যায় না। পারস্য দেশীয় রাজা নাদির শা ভারতবর্ষ হইতে কত ধনরত্ন লুণ্ঠন করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন শুনিলে আশ্চার্যান্বিত হইবে। তিনি প্রথমে একজন দস্যুর নেতা ছিলেন। পরে দল বৃদ্ধি হইলে ছলে ও কৌশলে পারস্যের রাজাকে হত্যা করিয়া, নিজে পারস্যের সিংহাসনে আরোহন করেন। ক্রমে আফগানিস্থান অধিকার করিয়া ভারতের দিকে তাঁর দৃষ্টি পড়িল। তখন মোঘল সাম্রাজ্যের পতনকাল; মহম্মদ শা এই পতনোন্মুখ সাম্রাজ্যের নামমাত্র সম্রাট। এই সময়ে নাদির শা সুযোগ বুঝিয়া ভারতবর্ষ আক্রমণ করিলেন। ১৭৩৯ খিস্টাব্দে তিনি সিন্ধু নদী পার হইয়া কর্ণাল নামক স্থানে মোগলদিগকে পরাস্ত করেন। মহম্মদ শা দেখিলেন নাদির শার সহিত যুদ্ধ অসম্ভব। বিশেষ নূতন রাজ্য অধিকার করা নাদির শার উদ্দেশ্য নহে, ধন সম্পত্তি লাভই তাঁহার ভারতবর্ষ আগমনের প্রধান কারণ। সুতরাং যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া তিনি নাদির শাকে অনেক উপহার দিতে প্রতিশ্রুত হইলেন। নাদির শা ইহাতে যুদ্ধ করিতে বিরত হইয়া অর্থ গ্রহণের জন্য দিল্লিতে আগমন করিলেন। মহম্মদ শা অনেক আড়ম্বরে? সহিত নাদির শা-র অভ্যর্থনা করিলেন, নিজ প্রাসাদে তাঁহার জন্য স্থান নিরুপণ করিয়া দিলেন। প্রথম সম্ভাষণের সময়েই মহম্মদ শার পাগড়িস্থিত কোহিনুর নামক জগদ্বিখ্যাত হারকের প্রতি নাদির শা-র দৃষ্টি পড়িলে, তিনি লোভসম্বরণ করিতে অসমর্থ হইয়া মহম্মদ একে বলিলেন যে, আমাদের দেশের নিয়মানুসারে আপনার সহিত আমার পাগড়ি বদলাই-ে <ইবে। অগত্যা মহম্মদ শা বাধ্য হইয়া পাগড়ির সহিত কোহিনুর নাদির শা-কে দিলেন। কয়েকদিন এইরূপে দিল্লিতে যাপন করিলে, এক রাত্রিতে জনরব উঠিল, যে নাদির শার মৃত্যু হইয়াছে। দিল্লিবাসীরা তখন আপদ গেল ভাবিয়া, নাদির শা-র জনকয়েক সৈন্যদের মৃতদেহ দেখিতে পাইলেন, তখন তাঁহার ক্রোধানল জুলিয়া উঠিল, তারপর কি হইল সে ঘটনা বর্ণনা করিতে এখনও আমাদের শরীর শিহরিয়া উঠে! নাদির শা উন্মত্ত প্রায় হইয়া নিজ সৈন্যদিগকে শহরের সমুদয় লোককে হত্যা করিতে আদেশ করিলেন। তাহারা স্ত্রী, পুরুষ, বালক, বন্ধু, শিশু, যাহাকে নিকটে পাইল, তাহাকেই হত্যা করিতে লাগিল। নাদির শা নিজে রৌসনউদ্দৌলা নামক একটি লাল প্রস্তরের মসজিদের ওপর বসিয়া রক্ত স্রোতপূর্ণ শহরটি দেখিতে লাগিলেন। এক ঘণ্টার মধ্যে ৩০০০০ লোককে হত্যা করা হইল। তখন মহম্মদ শা আর থাকিতে পারিলেন না, অনন্যোপায় হইয়া ওমরাহদের সঙ্গে লইয়া অবনত মস্তকে নাদির শার নিকট নগরবাসীদের জীবন ভিক্ষা করিতে লাগিলেন। নাদির শা মহম্মদ শার অবস্থা দেখিয়া বলিলেন, 'কেবল আপনার অনুরোধে আজ ক্ষমা করিতেছি।' সৈন্যগণ নাদির শার আজ্ঞা পাইয়া ক্ষান্ত হইল বটে, কিন্তু ৫৮ দিন পর্যন্ত নগরবাসীদের ধনসম্পত্তি লুঠ করিতে লাগিল। নাদির শা নিজে শাজাহান কর্তৃক নির্মিত বহু মূল্য ময়ূর সিংহাসন গ্রহণ করিলেন, এই সিংহাসনের মূল্য এক কোটি টাকা ছিল। তিনি কেবল দিল্লি হইতে অর্থ ও রত্নাদিতে ৭০ কোটি টাকা লইয়া যান, তব্দব্যতীত অন্যান্য স্থান হইতে আরও কত কোটি টাকা লুণ্ঠন করিয়াছিলেন, তাহা বলা যায় না। নাদির শা দেশে ফিরিয়া গিয়া, সৈন্যদিগকে তিন মাসের বেতন উপহার দেন এবং এক বৎসর কাল প্রজাদিগের নিকট কর গ্রহণ করেন নাই।

কিন্তু পাপের ধন প্রায় প্রায়শ্চিত্তেই যায়। এত লোকের প্রাণ সংহার করিয়া ও সর্বস্ব লুণ্ঠন করিয়া, নাদির শা অধিকদিন সেই অর্থরাশি ভোগ করিতে পারেন নাই। আর এক ব্যক্তি বলবান হইয়া, তাঁহাকে হত্যা করিয়া তাঁহার সিংহাসন ও সেই সমুদয় অর্থ কাড়িয়া লয়।



অদ্ভুত কৌশল

কি ছুদিন হইল, আমি আমার কোন বন্ধুর নিকটে যোগফল বাহির করিবার একটি নূতন কৌশল শিখিয়াছি। পাঠক পাঠিকাদিগের মধ্যে যদি কেহ তাহা শিখিতে চাও তবে এস! তুমি এই কাগজে পাশাপাশি যাহা ইচ্ছা ৫টি অঙ্ক লিখ। শেষের একটি যেন ৯ কিম্বা ০ না হয়, কি লিখিলে?

৫২৩৪৩? আচ্ছা, এই দেখ, এখন খুলিও না, শেষে খুলিও। আর ৫টি অঙ্ক উপরের অঙ্কের নীচে লেখ, কি

লিখিলে? ২৪৫০৬? আচ্ছা এখন আমি একলাইন লিখি, ৭৫৪৯৩। তুমি আরও এক লাইন লেখ, কি লিখিলে? ৭২৩৫৬। আচ্ছা, হামিও আর একলাইন লিখি, ২৭৬৪৩। এখন যোগ করঙ, কি হইল?

৩৪৩

৫০৬

8

৭৫

৪৯৩

৩৫৬

২৫

২৩৪ ১

২৫২৩৪১? ঠিক তো? এখন তোমার হাতে যে কাগজটি মুড়িয়া দিয়াছিলাম, সেখানি খুলিয়া দেখ তো, তাহাতে কি আছে? ও কি অবাক? উহাতেও ২৫২৩৪১ আছে? দেখো কেমন একলাইন দেখিয়াই আমি আগে যোগফল লিখিয়া দিয়াছি। কেমন করে লিখিলাম জানিতে চাও তো শোনো; ইহার কৌশল বলিতেছি। তুমি যখন ৫২৩৪৩ লিখিলে, অমি তখন একখানি কাগজে এই সংখ্যার আগে ২ বসাইয়া ও শেষ অঙ্ক হইতে ২ বিয়োগ করিয়া যাহা হয়, তাহাই লিখিলাম। তারপর তুমি যখন ২৪৫০৬ লিখিলে, আমি তাহার নীচে ৯ থেকে প্রত্যেক সংখ্যা বাদ যাহা হয়, তাহা লিখিলাম। যেমন ৯ থেকে ২ বাদ ৭ থাকে, ৪ বাদ দিলে ৫ থাকে, ৫ বাদ দিলে ৪, ০ বাদ দিলে ৯ ও ৬ বাদ দিলে ৩ থাকে। তুমি যখন আরও এক লাইন লিখিলে তখন ঠিক আগের মতো ৯ হইতে প্রত্যেক সংখ্যা বাদ দিয়া আমিও শেষ লাইন লিখিলাম। ইহাতেই একটি ঠিক মিলিল, তুমি নিজে একবাব পরীক্ষা করিয়া দেখো, ঠিক হয় কিনা! সঙ্কেতটা কিন্তু আর কাহাকে বলিও না।

বিহারীলাল গুপ্ত

ইকোর্টের জজের পদে নিযুক্ত হওয়া অতিশয় সম্মান ও গৌববের বিষয়। হা সম্প্রতি শ্রীযুক্ত বিহারীলাল গুপ্ত মহাশয তিন মাসের জন্য এই পদে নিযুক্ত হইয়াছেন; পরে ইনি যে এই পদে স্থায়ী হইবেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।

বিহারীবাবু গৌরিভা নিবাসী শ্রীযুক্ত চন্দ্রশেখর গুপ্ত মহাশয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র! ইহাব মাতা মহাত্মা রামকমল সেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র হরিমোহন সেনের কন্যা। ইনি মাতামহ গৃহে সুপ্রসিদ্ধ সেন পরিবারের কলুটোলাস্থ ভবনে জন্মগ্রহণ করেন।

ইহার পিতা পুত্রদিগের চরিত্র ও বিদ্যা শিক্ষা সম্বন্ধে অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন; পুত্রেরা সকলেই বিদ্বান ও সচ্চরিত্র বলিয়া লোকে বিহারীবাবুর মাতাকে বত্নগর্ভা বলিত। বিহাবীবাবু মাতামহেব অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন বলিয়া প্রায় ষোল বৎসর বয়স পর্যন্ত মাতুলালয়ে ছিলেন, এবং মাতুলদের সহিত হেয়ার স্কুলে পাঠারম্ভ করেন।

এই সময় ১০/১২ বৎসর বয়সে সহপাঠী শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্তেব সহিত ইহার সৌহার্দ

জন্মে। ইহাদের সেই বন্ধুত্ব আজ পর্যন্ত রহিয়াছে।

বাল্যাবধি ইহাদের দুইজনের শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টান্ত অনুসরণপূর্বক, বিলাত গিয়া সিভিলিয়ান হইবার প্রবল আকাঙক্ষা জন্মে। এখনকার দিনে বিলাত যাওয়া যেমন সহজ তখন তেমন ছিল না। এখন কত পিতা-মাতা আগ্রহ ও উৎসাহেব সহিত পুত্রকে বিদ্যা শিক্ষার্থে ইংলন্ড প্রেরণ করিতেছেন; কিন্তু তখন বন্ধুবান্ধবহীন বিদেশে বিদ্যা শিক্ষার্থ গমন করিবার সংকল্প করা, দুইটি বালকের পক্ষে সামান্য কথা নহে। এই উচ্চ আকাঙক্ষা পোষণ করিয়া ইনি অনুরাগের সহিত পাঠরত হন এবং এন্ট্রেস ও এফ. এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হইয়া বৃত্তি পান। পরে স্বর্গীয় মনোমোহন ঘোষ মহাশয়েব সাহায্যে এই সংকল্প কার্যে পরিণত করিতে সমর্থ হন।

ইহার বন্ধু রমেশচন্দ্র দত্ত ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ইহার সহযাত্রী ছিলেন, ইহারা তিনজনে এক সময়েই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

বাল্যকাল হইতে বিহারীবাবু সাহিত্যানুরাগী; এখনও কঠিন পরিশ্রমের পরে অবসর পাইলেই সাহিত্য চর্চা করিয়া থাকেন। সিভিলিয়ানদের মধ্যে এ দেশীয় ভাষা অনুশীলনের উৎসাহ বর্ধনার্থ গভর্নমেন্ট পারিতোষক দিয়া থাকেন। ইনি সংস্কৃত ও পারস্য ভাষায় উত্তীর্ণ হইয়া বারো হাজার টাকা পারিতোষিক পান।



বন্দির মুক্তি

আমাদের মাদের হাঁসের ঘর হইতে মাসাধিক হইল এক একটি করিয়া হাঁস চুরি হইতেছিল। ছুটিতে বাড়ি আসিবামাত্র আমার প্রতি তাহার কারণ অনুসন্ধান করিবার ভার পড়িল। আমি অনুসন্ধান করিয়া বুঝিলাম, চোরের ইহাতে হাত ছিল না। সন্দেহ হইল, যে ইহা শিয়ালের কর্ম। নিকটে খাল, তাহার দুই পার বনজঙ্গল সমাকীর্ণ। খালের পার দিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে হাঁসের দুই একটি পালক দেখিতে পাইলাম। মাঝে মাঝে বালুকার মধ্যে শিয়ালের পদচিহ্নও দেখা গেল। নিশ্চিন্ত জানিবার জন্য আর একটু ঘুরিতেছি, সহসা কাকের কোলাহল শুনিতে পাইলাম, "চোর দিয়া চোর ধরার" কথা তখন মনে পড়িল। যে দৃশ্য দেখিলাম, তাহাতে সকল সন্দেহ ভাঙিয়া গেল। শিয়াল কি একটা মুখে করিয়া খাল পার হইবার চেষ্টা করিতেছে। সেটা আর কিছু নহে আমাদের আর একটা হাঁস।

কাক জাতির মতন নির্লজ্জ চোর আর নাই। অন্যে চুরি করিলে চোর চোর বলিয়া রব তুলিয়া সকলের আগে পাড়াশুদ্ধ সতর্ক করিতে যেমন প্রস্তুত, চোরামালে ভাগ বসাইতেও তেমন মজবুত। হাঁস লইয়া বাড়ি যাইবার পথে শিয়াল এই কাকমণ্ডলী দ্বারা আক্রান্ত হইয়া বড় বিপদে পড়িল। হয়তো দৌড়িয়া নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছিতে পারিত, কিন্তু কাকের সঙ্গে -সঙ্গে আমার তাড়া খাইয়া বেচারী সেই সদ্যাহত হাঁসটিকে ফেলিয়া জঙ্গলে প্রবেশ করিল।

আমাদের হাঁস চুরির কারণ এখন আর বুঝিতে বাকি রহিল না। শিয়ালের বাসাতে শাবক থাকিতে পারে এবং তাহাদের আহারের জন্যই এইরূপ চুরি হইতেছে মনে হইল। শাবকগণ কোন গর্তে বাস করিতেছে, তাহা অন্বেষণ করা আবশ্যক।

সেদিন সন্ধ্যাকালে আমি কুকুর সঙ্গে লইয়া জঙ্গলে প্রবেশ করিলাম। জঙ্গলে প্রবেশ করিয়াই দূরে শিয়ালের ডাক শুনিলাম। আমার কাজ নহে। বন্য বিড়াল বা অন্য হিংস্র জন্তু কুকুর ডাক শুনিবামাত্র চলিয়া গেল, চারিদিক ঘুরিয়া প্রায় এক ঘণ্টা পরে হাঁপাইতে হাঁপাইতে ফিরিয়া আসিল।

আবার দূরে সেই ডাক। তখন বুঝিলাম সে শিয়াল আমাদিগকে ঠকাইবার চেষ্টা করিতেছে। আমাদের নিকটেই হয়তো কোথাও শিয়ালের বাসা আছে, শৃগাল-দম্পতি আমাকে ভুলাইয়া গর্ত হইতে দূরে লইয়া যাইবার জন্য পালা করিয়া ওইরূপ ডাকিতেছে। সেদিন অনেক রাত্রি হইয়াছিল। সুতরাং বাড়ি ফিরিলাম।

এই শিয়ালটাকে পাড়াতে সকলেই চিনিত। তাহার মুখের মাঝখানে একটা সাদা দাগ ছিল বলিয়া সকলে তাহাকে 'দাগি' নামে ডাকিত। একবার খরগোস চুরি করিতে গিয়া ফাঁদে পড়িয়া তাহার মুখে গুরুতর আঘাত লাগিয়াছিল। অনেকদিন পরে শুকাইল বটে কিন্তু মুখের মাঝখানে সে দাগটা জন্মের মতন রহিয়া গেল।

এই দাগি শিয়াল ও তাহার শিয়ালী যে আমাদের হাঁস ধ্বংস করিতেছে। সে বিষয়ে আর সন্দেহ ছিল না। চোর ধরিবার জন্য তার পরদিন ছোট-ছোট গাছের মধ্যে খুঁজিতে-খুঁজিতে দেখিলাম, কতকগুলি মাটি রাশিকৃত হইয়া রহিয়াছে, কে যেন খুঁড়িয়া রাখিয়াছে। সন্দেহ হইল যে নিকটে নিশ্চয়ই গর্ত আছে। যাঁহারা শিয়ালের গর্ত দেখিয়াছেন, তাঁহারা জানেন যে উহারা সুড়ঙ্গের প্রথম মুখটি বুজাইয়া দেয় ও যাতায়াতের জন্য দূরে গুপ্তস্থানে অন্য একটা মুখ রাখে। খুঁজিতে-খুঁজিতে আমি সেই লুক্কায়িত দ্বারটির অনুসন্ধান পাইলাম ও গর্তের মধ্যে শৃগাল শাবক দেখিতে পাইলাম।

কিছু দূরে একটা পুরাতন বৃক্ষ মাটিতে পড়িয়াছিল, আমরা ছেলেবেলায় ওই গাছটির গায়ে সিঁড়ির ধাপ কাটিয়া তাহার ওপর উঠিয়া অনেকবার খেলা করিয়াছি। ওই গাছটির উপর হইতে গর্তের মুখ দেখা যাইত। আমি লুকাইয়া থাকিয়া সেখান হইতে শিয়াল পরিবারের প্রতিদিনের সংবাদ লইতে লাগিলাম। চারটি ছোট-ছোট ছানা, কখনও বাহিরে আসিয়া খেলা করিত, কখনও বা রৌদ্রের উত্তাপ পোহাইত। বাহিরে কোনরকম শব্দ শুনিবামাত্র মুহূর্তে মধ্যে গর্তে প্রবেশ করিত।

শৃগাল তাহাদের জন্য এক একটি হাঁস চুরি করিয়া বাসার নিকট আসিয়া মৃদু স্বরে ডাকিত, সেই শব্দ শুনিয়া বাচ্চাগুলি তাড়াতাড়ি টলিতে-টলিতে, পড়িতে-পড়িতে বাহিরে আসিত এবং সেই হাঁসের উপর লাফাইয়া পড়িয়া হাঁসটাকে লইয়া কাড়াকাড়ি করিত। মাতা দূরে বসিয়া মহানন্দে তাহা দেখিত। এই জঙ্গলে একটা মস্ত ছুঁচো বাস করিত। দুইটা গাছের গুড়ির নীচে তাহার গর্ত, গাছের গুঁড়ির উপর বসিয়া সে চারিদিক দেখিত, শিয়ালের সাড়া পাইলেই গর্তে ঢুকিয়া পড়িত। ভয়ের কারণ না গেলে আর বাহিরে আসিত না।

একদিন শৃগাল-যুগল স্থির করিল, যে এই ছুঁচোটিকে শিকার করিতে হইবে। তাহারা দুজন আস্তে-আস্তে ছুঁচোর গর্তের দিকে অগ্রসর হইল। শিয়ালী লুকাইয়া রহিল, আর 'দাগি', গাছের নিকট দিয়া আস্তে আস্তে চলিয়া যাইতে লাগিল; ছুঁচো দাগিকে দেখিয়াই গর্তে প্রবেশ করিল এবং গর্তের মুখ হইতে তাহাকে দেখিতে লাগিল। যতক্ষণ দেখা গেল, ততক্ষণ আর বাহির হইল না, এদিকে শিয়ালী পশ্চাৎদিক হইতে লুকাইয়া গুঁড়ির নিকট উপস্থিত হইয়াছে, ছুঁচো তাহা দেখিতে পায় নাই, দাগিকে চলিয়া যাইতে দেখিয়া, যেই ছুঁচো গর্তের বাহিরে আসিল তৎক্ষণাৎ শিয়ালী তাঁহাকে মুখে করিয়া এক আছাড় দিয়া আধমরা করিয়া লইয়া বাসার দিকে দৌড়াইল।

শিয়ালী এত সাবধানে তাহাকে মুখে করিয়াছিল, যে রাস্তাতেই ছুঁচোর সংজ্ঞা লাভ হইতে লাগিল। বাসায় আসিয়া শব্দ করিবামাত্র শাবকগুলি হুড়মুড় করিয়া উপস্থিত হইল এবং সেই আহত জন্তুটির উপর চারিজনে হুঙ্কার করিয়া পড়িল। ছুঁচোর গায়ে তখনও বল ছিল, সে যথাসাধ্য আত্মরক্ষার চেষ্টা করিতে করিতে একটা ঝোপে প্রবেশ করিল। ছানারা তখন কেহ পা ধরিয়া কেহ লেজ টানিয়া বাহির করিতে চেষ্টা করিতে লাগিল, কিন্তু পারিল না, তখন শিয়াল মাতা নিজে গিয়া উহাকে টানিয়া বাহির করিয়া ছানাদের মধ্যে ফেলিয়া দিল। তাহারা মনের মতন শিকার পাইয়া মহা আনন্দে ভোগ করিল। শিয়ালের বাসার নিকটেই মাঠে অনেক ইঁদুর ছিল। শিয়ালী ছানাদের ইঁদুর ধরা শিখাইবার নিমিত্ত ওই স্থানে লইয়া গেল। শিখিবার প্রধান নিয়ম, অনুকরণ করা ও সহজ বুদ্ধি প্রয়োগ করা। শিয়ালীর কয়েকটা সঙ্কেত ছিল তাহা দিয়া শাবকদের জানাইত যে "এখন চুপ করিয়া অপেক্ষা করো অথবা এস, আমার মতো চল।"

যেদিন বাতাসে একটি পাতা নড়িত না, এমন দিনে শিয়ালী ইঁদুর ধরিতে যাইত, কারণ ঘন ঘাসের নীচে যখন ইঁদুরগুলি হাঁটিয়া বেড়ায় তখন ঘাস নড়িবামাত্র জানা যায় যে নীচে ইঁদুর বেড়াইতেছে। শিয়ালী নিঃশব্দে ছানাদের লইয়া অপেক্ষা করিত, ঘাস নড়িলেই লাফাইয়া কামড়াইয়া ধরিত। ছানারা বারম্বার মাতার অনুকরণ করিয়া যখন প্রথম ইঁদুর ধরিল, তখন আহ্লাদে তাহাদের সর্বশরীর কম্পিত হইত, তখন তাহারা নিজের বাহাদুরী দেখিয়া নিজেই মুগ্ধ হইত।

এইরূপে ইঁদুর ধরা বিদ্যা আয়ত্ব হইলে কাঠবিড়ালী শিকার শিক্ষা আরম্ভ হইল। একটা কাঠবিড়ালী নিকটের গাছ হইতে প্রত্যহ কিচিরমিচির করিয়া শিয়ালের ভৎসনা করিত। ছানাগুলি অনেক সময় তাহা সহ্য করিতে না পারিয়া তাহাকে ধরিতে চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু এ পর্যন্ত পারিয়া উঠে নাই। শিয়ালি তাহাদের অকৃতকার্যতা দেখিয়া গাছের নিকট যাইয়া মরার মতো শুইয়া রহিল, কাঠবিড়ালী প্রত্যেক দিনের ন্যায় আজও হইতে যথাবিধি ভৎসনা আরম্ভ করিল। কিন্তু আজ আর শিয়ালীর কোন চিহ্ন দেখিতে পাইল না। হঠাৎ শিয়ালের এত ধৈর্য গুণ দেখিয়া কাঠবিড়ালী অবাক হইয়া গাছ হইতে অন্য গাছে উঠিল। এবার সে গালি দিতে দিতে মস্তকে গাছের বাকলও ফেলিতে লাগিল, কিন্তু কিছুতেই শিয়ালকে রাগাইতে পারিল না, অবশেষে সে আর কৌতূহল সামলাইতে না পারিয়া কি হইয়াছে দেখিবার কিন্তু তথাপি হাঁস চুরি থামিল না। আমার মামার ক্রোধের সীমা রহিল না। তিনি চারদিকে বিষাক্ত মাংস ছাড়াইয়া রাখিলেন, কিন্তু শিয়ালী ঘ্রাণ শক্তি দ্বারা টের পাইয়া, তাহা স্পর্শও করিল না। অবশেষে আমার মামা নিজেই গর্তের অনুসন্ধানে বাহির হইলেন। আমি জানিতাম, কিন্তু তাহা প্রকাশ করি নাই।

জন্য শিয়ালের নিকট যাইবামাত্র মুহূর্ত মধ্যে শিয়াল খপ্ করিয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিল। এতদিনে ইহাদের উপর আমার মায়া বসিয়াছিল কাজেই ইহাদের উপর অত্যাচার করিতে আমার মন উঠিল না। আমার দ্বারা কিছু হইতেছে না দেখিয়া মামা একদিন নিজেই কুকুর ও বন্দুক সঙ্গে করিয়া বাহির হইলেন। সেদিন তাহার হস্তে "দাগি” পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল।

পূর্বে দুইটাতে মিলিয়া কুকুরদের ভুলাইত, এখন সে একা তাহা পারিয়া উঠিল না; সুতরাং, শীঘ্র তাহাদের বাসা প্রকাশ হইল! মামা গর্ত খুঁড়িবার জন্য একজন লোক নিযুক্ত করিলেন, কুকুরগুলি চারিদিকে পাহারা দিতে লাগিল। শিয়ালী তখনও ছানাগুলিকে রক্ষা করিবার আশা ত্যাগ করে নাই। কত রকমে কুকুরদের সে স্থান ভুলাইয়া লইয়া যাইবার চেষ্টা করিল; ভাবিল কুকুরদের দূরে লইয়া গেলেই বুঝি শিশু রক্ষা পাইবে। কিন্তু তাহার সে চেষ্টা সফল হইল না।

খুঁড়িতে খুঁড়িতে গর্তের মধ্যে ৪টি ছানা বাহির হইল। আমি বাধা দিবার আগেই কুড়ালির আঘাতে একটি ও কুকুরদের মুখে ২টি প্রাণ হারাইল। অন্যটিকে আমি অতি কষ্টে কুকুরের হাত হইতে বাঁচাইলাম। সে সময়ে শিয়াল-মাতার অবস্থা দেখিলে পাষাণ প্রাণও গলিয়া যায়। তাহার ভয় কোথায় গেল। সে কেবল ব্যাকুলভাবে নিকটে ঘুরিতে লাগিল। পরম শত্রু মানুষের নিকট যেন সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা করিতে লাগিল। এত নিকটে আসিয়াছিল যে তাহাকে সহজে বধ করা যাইত, কিন্তু পাছে কুকুরের গায়ে গুলি লাগে, এজন্য বন্দুক ব্যবহার করিতে পারা গেল না।

গলায় শিকলি দিয়া ছানাটি উঠানে বাঁধিয়া রাখা হইল। নিকটে একটি কাঠের বাক্স ছিল, মানুষ দেখিলেই সে বাক্সের মধ্যে পলায়ন করিত। কিন্তু যত রাত্রি হইতে লাগিল, ততই সে অস্থির হইয়া পড়িল। অবশেষে কিছুতেই বাঁধন কাটিতে না পারিয়া আবার কাঁদিয়া উঠিল। এই সময়ে দূরে শিয়ালের ডাক শুনিতে পাইলাম। মুহূর্ত মধ্যে শিয়ালী তাহার ছানার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। শিশু লাফাইয়া মাতৃক্রোড়ে আশ্রয় লইল। মাতা শিশুকে লইয়া পলায়ন করিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু কঠিন শিকলির বন্ধনে শিশু বাঁধা রহিয়াছে, সুতরাং নিষ্ফল মনোরথ ও নিরুপায় হইয়া বসিয়া পড়িল। কতক্ষণ পরে দেখিলাম, অবোধ শিশু সমস্ত কষ্ট ভুলিয়া মাতার ও পান করিতেছে। আমি সেখানে যাইবামাত্র সে পলায়ন করিল। দেখিলাম, সে সন্তানের জন্য দুইটি মৃত ইঁদুর রাখিয়া গিয়াছে।

পরদিন জঙ্গলের মধ্যে সেই পুরাতন স্থানে গিয়া দেখিলাম যে, শোকার্ত মাতা মৃত শিশু তিনটিকে গর্ত হইতে বাহির করিয়াছে ও তাহাদের শরীর লেহন করিয়া, পরিষ্কার করিয়া পাশাপাশি রাখিয়াছে। সে তখনও বুঝিতে পারে নাই, যে তাহারা মৃত। তাহাদের আহারার্থে হাঁস মারিয়া আনিয়াছে, কিন্তু আজ তো আর সন্তানের হাঁস লইয়া কাড়াকাড়ি করিল না। মাটির উপরে চিহ্ন দেখিয়া বুঝিলাম, সে সমস্ত রাত্রি মৃত-সন্তানগুলির পার্শ্বে থাকিয়া তাহাদিগকে দুগ্ধ পান করাইবার জন্য ও তাহাদের শীতল দেহ গরম করিবার জন্য বৃথা চেষ্টা করিয়াছে। শেষে বুঝিতে পারিয়া, শোকে মৃত্তিকার উপর লুণ্ঠিত হইয়াছে।

এখন আমাদের ক্ষুদ্র বন্দিটি মাতার সকল স্নেহের অধিকারী হইল। আমাদের উঠানে কুকুর সমস্ত রাত্রি পাহারাতে নিযুক্ত থাকিত। আমার ও চাকরের প্রতি আদেশ হইল যে শিয়ালীকে দেখিবামাত্র গুলি করিতে হইবে। এই শোকার্ত মাতার দুঃখ স্বচক্ষে দেখিয়া, আমার হৃদয় গলিয়া গিয়াছিল, সুতরাং আমি স্থির করিলাম যে তাহাকে দেখিয়াও দেখিব না। আসিবার সমস্ত রাস্তা প্রায় বন্ধ, তথাপি সকল বাধা তুচ্ছ করিয়া সে প্রত্যহ সন্তানের আহারার্থ কিছু আনিত ও একবার তাহাকে বুকে রাখিয়া গরম করিয়া যাইত। আর সে শিশুর ডাকের অপেক্ষায় থাকিত না।

আর একদিন শিয়ালী পুনরায় শিকলি কাটিতে চেষ্টা করিল। তাহাতে যখন অকৃতকার্য হইল, তখন গর্ত খুঁড়িয়া শিকলিটি মাটি চাপা দিয়া মনে করিল, এইবার বুঝি বন্ধন ঘুচিয়াছে। কিন্তু ছানা মুখে করিয়া ছুটিবামাত্র ভুল টের পাইল। গলায় ফাঁসি লাগিয়া বাচ্চাটি কাতর স্বরে কাঁদিয়া বাক্সের মধ্যে ফিরিয়া গেল। এইবার কুকুর শিয়ালীকে তাড়া করিয়াছে। কিন্তু যে কুকুর শিয়ালীর পশ্চাৎ ছুটিল তাহাকে আর বাড়িতে ফিরিতে হইল না। আজ শিয়ালী সুযোগ বুঝিয়া সন্তান বধের প্রতিহিংসার উপায় বাহির করিয়াছে। সে ছুটিয়া রেলের লাইনের উপর দিয়া পলায়ন করিতে লাগিল। কুকুরও পশ্চাৎ-পশ্চাৎ ছুটিল। সেসময়ে রেলের গাড়ী আসিয়াছিল, গাড়ি নিকটে আসিলে শিয়ালী হঠাৎ পাশ কাটাইয়া চলিয়া গেল, কিন্তু কুকুর আপনাকে বক্ষা করিতে পারিল না, গাড়ির চাকার আঘাতে প্রাণ হারাইল।

পরদিন রাত্রে আবার শিয়ালী সন্তানের জন্য হাঁস মারিয়া আনিল, আবার বুকে করিয়া তাঁহার তৃষ্ণা দূর করিল। সে মনে করিত সে ছাড়া সন্তানের ক্ষুধা দূর করিবার আর কেহ নাই। সেই মৃত হাঁসের অবশিষ্টাংশ দেখিয়া আমার মামা বুঝিলেন, যে শিয়ালী এখনও প্রত্যহ সেখানে আসে। তখন তিনি নিজে পাহারা দিতে আরম্ভ করিলেন, সেই রাত্রিতে শিয়ালী হাঁস মুখে করিয়া যেমন উঠানে পা দিবে, এমনসময় গুডুম-গুডুম বন্দুকের শব্দ শুনিয়া সে হাঁস ফেলিয়া পলাইল। আবার আসিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু আবার বন্দুকের আওয়াজ শুনিয়া চলিয়া গেল। সকলে ভাবিল, আর সে আসিতে সাহস করিবে না, কিন্তু পরদিন শিকলিতে দাঁতে চিহ্ন দেখিয়া জানিলাম, বন্দুকের শব্দে সে ভীত হয় নাই। সন্তানকে দেখা দিয়া আর একবার তাহার বন্ধন মুক্ত করিবার চেষ্টা করিয়া গিয়াছে। এত সাহস ও এত সন্তান-বৎসলতা দেখিয়া কাহার না মনে দয়ার উদয় হয়? আজও কি সে আসিবে? পূর্ব রাত্রিতে গুলির মুখে পড়িয়া কি সে ভীত হয় নাই? আমি মনে মনে এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময়ে শাবকের অস্ফুট ক্রন্দন শুনিলাম ও উঠানে কাল ছায়া দেখিলাম। তবে মা সন্তানকে ত্যাগ করে নাই।

আজ শিয়ালী শিকার করিতে যায় নাই। আজ সে যে করিয়া হউক সন্তানকে মুক্ত করিবেই। সন্তানকে বন্দি দেখিয়া সে কীরূপে নিজে সুখ ভোগ করে? শিকল কাটিতে এতদিন সে বিধিমতো চেষ্টা করিয়াছে, যতরকম উপায় সে জানিত, তাহা প্রয়োগ করিয়াছে, কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য হয় নাই, শত বিপদ ও বাধা সে তুচ্ছ করিয়াছে, কিন্তু সন্তানকে মুক্ত করিতে পারে নাই। তবে এই বন্ধন মুক্ত করিবার একমাত্র উপায় আছে, সুতরাং শিয়ালীকে মরিবার জন্য যে বিষাক্ত মাংস ছড়ানো ছিল, আজ সে তাহার এক অংশ মুখে করিয়া সন্তানকে খাইতে দিল। শৃগাল-শাবক চিরদিনের জন্য বন্ধন মুক্ত হইল। সেদিন হইতে শৃগাল-মাতাকে আর কেহ দেখিতে পাইল না।



ইতর প্রাণীদের দয়া

আমাদের সাধা মাদের সাধারণ ধারণা এই, যে স্নেহ, দয়া, মায়া, মমতা প্রভৃতি বুঝি মানুষেরই একচেটিয়া অধিকার। ইতর প্রাণীদের মধ্যে বুঝি তাহা নাই, তাহারা বুঝি পরস্পরের মধ্যে সর্বদাই নিষ্ঠুর ব্যবহার করে। মানুষ এই অহঙ্কারে অন্ধ হইয়া পশুপক্ষীদিগকে অবজ্ঞা করে, এবং এক সঙ্গে এক জগতে বাস করিয়াও তাহাদের সুখ-দুঃখের প্রতি নিতান্ত উদাসীন থাকে। যে সকল সহৃদয় ব্যক্তি পশু-পক্ষীদের জীবন আলোচনা করিয়াছেন, তাঁহারা দেখিয়াছেন যে তাহাদের জীবনও ঠিক মানুষের মতন সুখ ও দুঃখে পূর্ণ। তাহাদের মধ্যেও স্নেহ দয়া আছে, এমন কী পশুপক্ষীদের জীবন হইতে মানুষের অনেক শিখিবার আছে।

পশুপক্ষীদের মধ্যে মাতৃস্নেহ ও ভালোবাসার দৃষ্টান্ত তোমরা অনেক শুনিয়া থাকিবে। সন্তানদের প্রাণ বাঁচাইবার জন্য পশুপক্ষী-মাতাও আমাদের জননীর ন্যায় প্রাণ দিতে সর্বদাই প্রস্তুত। বানরদের মধ্যে দেখা গিয়াছে যে কোনো বানর-শিশু মাতৃহীন হইলে অন্য বানরী তাহাকে অপত্য নির্বিশেষে লালনপালন করে। পক্ষীযুগলের মধ্যে একের মৃত্যুতে অন্যের গভীর শোকের প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে।

আজ জন্তুদের মধ্যে বন্ধুত্বের একটি দৃষ্টান্ত দিব। তাহাদের মধ্যেও নিঃস্বার্থতা দেখা যায়। আমাদের সাধারণ ধারণা এই যে, পশুপক্ষীদের মধ্যে বৃদ্ধ ও পীড়িতের জন্য দয়া নাই; কিন্তু বাউটন নামক একজন ইংরাজ ভদ্রলোক এক বন্য টিয়ার অদ্ভুত পরসেবার কথা বলিয়াছেন। বন্য-টিয়াটি অন্য জাতীয় একটি পঙ্গু ও শীতে মৃতপ্রায় পাখিকে আশ্রয় দিয়া প্রত্যহ তাহার পালকগুলি পরিষ্কার করিয়া দিত, তাহার জন্য খাদ্যদ্রব্য আহরণ করিয়া আনিত ও তাহাকে অন্য অন্য পাখিদের আক্রমণ হইতে রক্ষা করিত। আর একজন ভদ্রলোক একটি অন্ধ ও বৃদ্ধ পেলিকান পাখিকে হৃষ্টপুষ্ট দেখিয়া অনুসন্ধান দ্বারা জানিলেন যে পালের পাখিদের যত্ন ও সেবাতে তাহার দিন ওইরূপে সুখে কাটিতেছিল। সুবিখ্যাত ডারউইন বলেন যে মুরগিদের মধ্যেও তিনি ওইরূপ অন্ধের সেবা করিতে দেখিয়াছেন।

আমাদের দেশে কাকেরাও স্বজাতীয় অন্ধের সেবা ও যত্ন করিয়া থাকে।

আর একজন ইংরাজ তাঁহার ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখিয়াছেন যে তিনি আবিসিনিয়া দেশে ভ্রমণ করিতে করিতে একদা একপাল বেবুনের (বানর) মধ্যে পড়েন। তাহারা দল বাঁধিয়া স্থানাস্তরে যাইতেছিল, হঠাৎ সম্মুখে মানুষ দেখিয়া দলশুদ্ধ পলায়ন করিলে, কেবল একটি দুর্বল ক্ষুদ্রকায় বেবুন পলাইতে না পারিয়া একটা ক্ষুদ্র পাথরের উপব পড়িয়া রহিল। সেই ইংরাজের কুকুরগুলি তাহাকে ঘিরিয়া ফেলিল, সে চিৎকার করিতে আরম্ভ করিল। ওই ভদ্রলোকটি কুকুরের হাত হইতে তাহাকে রক্ষা করিতে যাইবার পূর্বেই পাল হইতে এক বৃহৎ সবল বেবুন আসিয়া কুকুরগুলিকে তাড়াইয়া সেই ক্ষুদ্রকায় বন্ধুকে পিঠে করিয়া মহা জয়োল্লাস করিতে করিতে চলিয়া গেল। এই বেবুনের মতন বীরত্ব আমাদের কয়জনের আছে? আমাদের কি ইতর প্রাণী হইতে শিখিবার কিছু নাই। এই তো গেল অপেক্ষাকৃত বড় জন্তুর কথা। ক্ষুদ্র পিপীলিকার মধ্যেও বন্ধুত্বের প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। একদল পিপীলিকাকে নানাভাগে বিভক্ত করিয়া ৩/৪ মাস পরে একস্থানে ছাড়িয়া দিলে তাহাদের মধ্যে যে বন্ধু সমাগমের আনন্দ হইতেছে, তাহা বুঝা যায়; সুতরাং ৩/৪ মাসেও ইহারা বন্ধুত্ব বিস্মৃত হয় না ইহা প্রমাণ হইল। অপরিচিত হইলে একজাতীয় পিপীলিকার মধ্যে দেখা হইলেই বিরোধ উপস্থিত হয়। অনেক সময় দেখা গিয়াছে বিরোধী-দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় ভুলক্রমে যদি বন্ধুর সহিত বন্ধুর সংঘর্ষণ ঘটে, তবে টের পাওয়ামাত্র পরস্পরের মধ্যে যেন অনুনয়-বিনয় ক্ষমা প্রার্থনা চলিতে থাকে, তাহা দেখিলেই আশ্চর্য হইতে হয়।

রুধিয়া দেশের একজন প্রাণীতত্ত্ববিদ পণ্ডিত লক্ষ্য করিয়া দেখিয়াছেন যে একটি

পিপীলিকা উদর পুরিয়া আহার করিয়া আসিতেছে, পথে তাহার একজন ক্ষুধার্ত বন্ধুর সহিত

সাক্ষাৎ হইল; অমনি আপনার কুক্ষিস্থ অতিরিক্ত খাদ্য উগরিয়া তাহাকে আহার করিতে দিল। সচরাচর যে সকল শামুক দেখিতে পাও, যাহাকে দেখিবামাত্র কত ছেলে পা দিয়া পিষিয়া মারিয়া ফেলে, ওই শামুকদের মধ্যেও পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করিবার দৃষ্টান্ত দেখা গিয়াছে। একটি সবল, সুস্থ শামুক তাহার দুর্বল নির্জীব বন্ধুর জন্য প্রাচীর পার হইয়া সুখাদ্যপূর্ণ স্থান অনুসন্ধান করিয়া পুনরায় পূর্বস্থানে আসিয়া বন্ধুকে ডাকিয়া লইয়া গিয়াছে; এরূপ দেখা গিয়াছে।

প্রাণীজগতে যাহাদিগকে আমরা ইতর জন্তু বলিয়া ঘৃণা করি, তাহারাও যে দুর্বলের উপর দয়া ও স্নেহপ্রদর্শন করে, এরূপ ভুরি-ভুরি দৃষ্টান্ত দেখা যায়। পাঠক-পাঠিকা! তোমরাও কি তাহাদের নিকট হইতে এই সগুণ শিক্ষা করিবে না? প্রতিদিন তোমরা কত শত-শত জন্তু দেখিতে পাও, তাহাদিগকে কি দুর্বল মনে করিয়া দয়া প্রদর্শন করিবে না?



সুরেশদের বাগান

রেশদের বাড়িতে একটা বাগান আছে, এবং বাগানের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র পুষ্করিণী আছে। সু বাগানটি সুরেশদের ভাইবোনের প্রিয়, তাহারা নিজেরা একটু একটু জমি লইয়া তাহাতে নানাপ্রকার ফুলগাছ লাগায়, মালিকে দিয়া জল দেওয়ায়, এবং ফুল হইলে কত আমোদ করিয়া তাহা তুলিয়া ঘর সাজায়। সুরেশদের বাড়িতে ফুলের বড় আদর। সে বাড়ির ছেলেরা গাছপালা ও ফুলপাতার মধ্যে লালিতপালিত হওয়ায় সকলেই ফুল বড় ভালোবাসে, সেই বাগানটিতে এমন গাছ, এমন ফুল, এমন প্রাণী ছিল না, যাহাদের আকৃতি প্রকৃতি তাহারা জানিত না, যদিও কোনো দিন একটা কিছু নূতন দেখিবার জিনিস পাইত, অমনি শিশু মহলে কোলাহল পড়িয়া যাইত ও সকলে মিলিয়া তাহাকে তন্ন তন্ন করিয়া পরীক্ষা করিতে বসিত। এইরূপে সেই বাগানটি যেন তাহাদের একখানা পড়িবার গ্রন্থের মতো হইয়া উঠিয়াছিল।

একদিন সমস্তদিন বৃষ্টির পর বৃষ্টি থামিবামাত্র সুরেশ তাহার ছোট ভগিনী বিনোদিনীকে লইয়া পুকুরের কত জল বাড়িল তাহা দেখিবার জন্য বাগানে গেল। গিয়াই দেখে পুকুরের চারিধারে "কোঁ ক্যাঁ কোঁ" ব্যাঙ ডাকিতেছে। বিনোদিনী জিজ্ঞাসা করিল,- 'ব্যাঙেরা এত ডাকছে কেন?' সুরেশ উত্তর দিলেন, 'অনেকদিন পরে বৃষ্টি হয়েছে কি না, তাই ওদের আনন্দ হয়েছে, এবং আবার শীঘ্র জল হবে বলে আনন্দ করছে।' বিনোদিনী। ওরা কী করে জানলে যে জল হবে?

সুরেশ। ওরা জানতে পারে। সেই যে একজন কৃষক একটা ব্যাং পুষেছিল, সে

কখন জল হবে তা বলে দিত, তা কি শুনিসনি?

বিনোদিনী। ওমা! কখন জল হবে ব্যাঙ কি করে তা জানে? দাদা! একটা ব্যাং ধরো না আমি ব্যাঙ দেখবো।"

সুরেশ দৌড়িয়া বাড়ির ভিতর হইতে একটা চুপড়ি আনিয়া তাহাতে অনেক কষ্টে একটা ব্যাঙ তুলিল। ক্রমে অপরাপর ভাইবোনগুলি আসিয়া জুটিল। সব শিশুতে মিলিয়া ব্যাঙের পরীক্ষা আরম্ভ হইল।

একজন বলিল, “দেখ ভাই, চোখ দুটো দেখ, যেন চশমা পরেছে। সে চশমার ধার যেন সোনা দিয়ে বাঁধানো।" সকলে "তাই বটে, তাই বটে।"

সুরেশ বলিল, 'মাস্টার সেদিন ক্লাসে বলেছেন, যে ব্যাঙের মাথার মধ্যে চক্ষু দুইটি সার, উহাদের মাথার মধ্যে মগজ খুব কম, তাই ব্যাঙগুলি বড় বোকা। আবার দেখো ব্যাঙের ঘাড় একেবারে নাই, মাথা একেবারে পিঠে বসানো।" সেই সময় একটা ছোট মাছি উড়িয়া চুপড়ির মধ্যে বসিবামাত্র ব্যাঙটা জিভ বাহির করিয়া মুহূর্ত মধ্যে তাহাকে গিলিয়া ফেলিল। একজন বলিয়া উঠিল, 'দেখ ভাই ব্যাঙটা কি চালাক কেমন খপ করে মাছিটা খেয়ে ফেলে।' বিনোদিনী-'ওমা! মাছি খেয়েছে, তবে বমি করে মরবে।' অপর একটি শিশু বলিল, 'দূর ওকি মানুষ যে মাছি খেয়ে বমি করবে? ওরা যে পোকামাকড় খায়।' ইতিমধ্যে তাহাদের পিতা সেখানে আসিয়া উপস্থিত।

বিনোদিনী। 'হ্যাঁ বাবা? ব্যাঙটা মাছি খেলে, ওর কি বমি হবে না?'

পিতা হাসিয়া উত্তর করিবেন-কীটপতঙ্গই ওদের খাদ্য। ওইজন্যই তো ওরা আমাদের উপকারী বন্ধু। ব্যাঙ না থাকলে আমরা পোকামাকড়ের কামড়ে অস্থির হয়ে উঠতাম, আর আমাদের গাছপালা সুদয় নষ্ট হয়ে যেত।

পিতা।-ব্যাঙেরা মানুষের বন্ধু এমনকী ওই যে গাছে ছোট টুনটুনি পাখি দেখছ, ওই যে টিপ টিপ করে ডালে ডালে বেড়াচ্ছে, ওরাও মানুষের বন্ধু।

একটি শিশু। কেন, ওরা কি কাজ করে? পিতা!-ওরা মস্ত কাজ করে, কীটপতঙ্গ ধরে খায়, তাহাতে গাছপালা বাঁচে। যারা

গোলাপের বাগান করে তারা অনেক সময় গোলাপ গাছের তলায় চাউল, কড়াই প্রভৃতি দেয়, তাহলে পাখি আসে, পাখি এলেই গোলাপ গাছের পোকা খেয়ে ফেলে, তা না হলে পোকাতে গাছ মেরে ফেলে।

দ্বিতীয় শিশু। ওমা বিধাতার কি সৃষ্টি! তিনি পাখিকে পাঠিয়ে গাছকে বাঁচান!

পিতা। তা বুঝি জানতে না! একবার ফ্রান্সদেশের ভদ্রলোকের মেয়েদের সখ হল যে, তাঁহারা টুপির ওপরে ছোট ছোট মরা পাখি পরিবেন। এই ফ্যাশানের গুণে দেশের হাজার হাজার ছোট পাখি মারা পড়িতে লাগিল। শেষে কয়েক বৎসরের মধ্যেই দেখা গেল, পোকাতে সব শস্য খেয়ে ফেলছে, ফসল আর হচ্ছে না: তখন আইন করিয়া পাখি মারা নিবারণ করিতে হইল।

তৃতীয় শিশু।-ও বাবা! তবে তো ব্যাঙ কি ছোট পাখি মারা উচিত নয়? পিতা। তাতে কি আর সন্দেহ আছে! আর কেনই বা মারবে? যে উপকার ভিন্ন কোনো অপকার করে না, তাকে অকারণ মারা কি পাপ নয়?

বিনোদিনী।বাবা, ব্যাঙটা কি চালাকি করে মাছিটা খেয়েছে যদি দেখতে, তাহলে

কি বলতে।

পিতা। ওরা কি করে খায় শুনবে? আমাদের জিহ্বা যেমন মুখের পশ্চাতে বসানো আমরা কেবল সম্মুখে জিহ্বা বাড়াইতে পারি, ইহাদের তেমন নয়, ইহাদের জিহ্বা মুখের সম্মুখে বসানো এবং ইহারা ইচ্ছামতো সম্মুখে ও পশ্চাতে দুদিকেই জিহ্বা বাড়াইতে পারে। পোকা দেখিবামাত্র সামনের দিকে বাড়াইয়া পোকা ধরিয়া একেবারে পশ্চাতে ঠেলিয়া দিয়া তাহা গিলিয়া ফেলে। চিবাইবার দরকার করে না।

বিনোদিনী। বাবা, ওরা পুকুরের ধারে কেন থাকে?

পিতা। ওদের চামড়া স্পঞ্জের মতো সচ্ছিদ্র, সর্বদা জল টানিয়া লইতেছে, শুষ্ক স্থানে থাকিলে সেই চামড়া শুকাইয়া যায় এজন্য উহারা পুকুর বা ডোবার ধারে থাকে। গ্রীষ্মকালে উহাদের গরমে কষ্ট হয়, জল না হইলে বাঁচিতে পারে না।

বিনোদিনী। আচ্ছা বাবা, ব্যাঙের গা এত ঠান্ডা কেন?

পিতা। তোমরা হয়তো জান যে, আমরা নিশ্বাস দ্বারা বাতাস শরীরের ভিতর টানিয়া লই বলিয়াই আমাদের গা গরম থাকে। ব্যাঙ সচরাচর জলে বাস করে। অধিক পরিমাণে বাতাস উহাদের শরীরে প্রবেশ করে না, এজন্য উহাদের শরীর শীতল। 

বিনোদিনী। আচ্ছা বাবা, ব্যাঙাচি তো মাছের মতো, তা থেকে ব্যাঙ কি করে? পিতা।-পাখি ডিম পাড়িয়া তাহার উপর বসিয়া তা দেয়। কিন্তু ব্যাঙের শরীর যে ঠান্ডা, কি করিয়া নিজেরা ডিম ফুটাইবে? কাজেই তাহারা জলের নীচে ডিম পাড়িয়া চলিয়া আসে; ডিমগুলি উপরে ভাসিয়া গাছের পাতা প্রভৃতি আশ্রয় লয় এবং সূর্যের উত্তাপ পাইয়া ফুটে। ব্যাঙাচি দেখিতে আদবেই ব্যাঙের মতো নয়, বরঞ্চ ছোট ছোট মাছের মতন, কেবল মাথা ও লেজ আছে; জল হইতে উঠাইলে মরিয়া যায়। মাছের মতন ব্যাঙাচির কানকো আছে, তাহা দ্বারা নিশ্বাস ফেলে, আমরা যেমন ফুসফুল দ্বারা জলে নিশ্বাস ফেলিতে পারি না, উহারা তেমন কানকো দ্বারা জলের বাহিরে নিশ্বাস ফেলিতে পারে না।

ব্যাঙাচির মুখও ব্যাঙের মতন সম্মুখে নয়, মাথার নীচে, তাহা দ্বারা ঘাস পাতা খাইয়া বাড়িতে থাকে। ব্যাঙাচি বড় হইয়া ব্যাং হইতে ৪/৬ বা ৮ সপ্তাহ লাগে। দিন-দিন ব্যাঙাচির পরিবর্তন হয়। আস্তে আস্তে লেজের নিকট দুইটি গোঁজ বাহির হয়; এই গোঁজ দুইটি যত বাড়ে লেজটি তত শুষ্ক হইতে থাকে, এই গোঁজ দুইটি হইতে যখন পশ্চাতের পা দুটি গঠিত হয়, তখন লেজটি খসিয়া যায়, এদিকে কাকো শুকাইয়া তাহার পরিবর্তে ফুসফুস প্রস্তুত হইতে থাকে। চক্ষু দুটি বড় হয়, সম্মুখেও দুটি পা বাহির হয়। সেই ক্ষুদ্র ব্যাঙাচির এখন সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটিয়াছে; লেজ খসিয়া তাহার স্থানে পা হইয়াছে; মাথাটি মস্ত হইয়াছে; মুখটি সম্মুখে আসিয়াছে; কাকোর স্থানে ফুসফুস হইয়াছে। এখন সে আর জলে থাকিতে পারে না; এবং জলের ঘাস পাতাতে তাহার আর রুচি হয় না, এখন নিরামিষের পরিবর্তে আমিষ আহারের প্রতিই তাহার লোভ বেশি। কাজেই তাহাকে পূর্ব বাসস্থান ত্যাগ করিয়া স্থলের আশ্রয় লইতে হইয়াছে; তবে সে পুরাতন বাসস্থানকে একেবারে ত্যাগ করিতে পারে নাই; কেই বা পারে?



বৃক্ষের জন্ম ও মৃত্যু

জীবিত ও মৃতের প্রভেদ

সজীব ও নির্জীব বস্তুতে কি প্রভেদ জানো? মৃত ও জীবিত জন্তুর মধ্যে কি-কি ভিন্নতা বলিতে পারো? একখানা কাষ্ঠ ও একটি জীবন্ত বৃক্ষে কি পার্থক্য? জীবন বর্ধনশীল আর মরণ ক্ষয়শীল। মৃত জিনিস কোনদিন বাড়ে না, যার মধ্যে কোনরূপ গতি কি স্পন্দন নাই, তাকে আমরা মৃত বলি। যাহা জীবিত তাহা ক্রমাগত বাড়িতেছে-যাহার বৃদ্ধি স্থগিত হইয়া যায় তাহার ক্ষয় হইতে আরম্ভ হয়। মৃত্যু ক্রমশ নিকটে আইসে।

পাণ্ডবদিগের বনবাসকালে একবার যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণের সহিত অরণ্যে যাইতে-যাইতে পথ হারাইয়া ফেলিয়াছিলেন। তৃষ্ণায় অতি কাতর হইয়া প্রথমত সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতাকে জলাশয়ে পাঠাইয়া দেন। সহদেব অন্বেষণ করিতে করিতে এক সরোবর দেখিতে পাইলেন। এই যক্ষ সেই সরোবর অধিকার করিয়া বসিয়াছিল।

পাণ্ডুপুত্র জল আনিতে যাইতেছেন দেখিয়া যক্ষ কহিল অগ্রে আমার কয়টি প্রশ্নের উত্তর দেও, পরে জল পান করিও। নতুবা জল স্পর্শ করিলেই প্রাণ হারাইবে। পাণ্ডুপুত্র এই কথা শুনিয়া জল পান করিতে যাইয়া যক্ষের শাপে প্রাণ হারাইলেন। এদিকে সহদেব ফিরিয়া আসিতে বিলম্ব করিতেছেন দেখিয়া যুধিষ্ঠির তৎপশ্চাতে নকুল, অর্জুন ও ভীমকে একে একে পাঠাইতে লাগিলেন। তাঁহাদের সকলেরই এক দশা ঘটিল। যক্ষের প্রশ্নের উত্তর না দিয়া এবং তাহার বাক্য অবহেলাপূর্বক জলস্পর্শ করিয়া একে একে চারিটি ভাই সেই যক্ষের মায়াবলে সরোবরের তীরে মৃত অবস্থায় পড়িয়া রহিলেন।

অতঃপর যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের অন্বেষণ করিতে করিতে সরোবর তীরে উপস্থিত হইলেন। তখন যক্ষ তাহাকে কয়েকটি প্রশ্ন করিলেন। যক্ষ জিজ্ঞাসা করিলেন। কে জন্মিয়া স্পন্দিত হয় না?

যুধিষ্ঠির কহিলেন অণ্ড জন্মিয়া স্পন্দিত হয় না। জীবিত বস্তু সচরাচর গতিশীল। অণ্ডে জীবন লুক্কায়িত থাকে, অথচ জীবনের লক্ষণ যে গতি ও বৃদ্ধি দেখা যায় না। বীজে নিদ্রিত জীবন

যেমন অণ্ডে জীবন ঘুমাইয়া থাকে, উত্তাপ পাইলে অণ্ড হইতে জীবশিশু জন্ম লাভ করে। সেইরূপ বীজে বৃক্ষশিশু লুক্কায়িত থাকে, মৃত্তিকা, উত্তাপ ও জল পাইলে বীজ হইতে বৃক্ষশিশুর জন্ম হয়।

বীজানুতে প্রকাণ্ড বটবৃক্ষ

বীজের ওপরে এক কঠিন আবরণ তদ্বারা বৃক্ষশিশু আবৃত থাকে। বীজের আকার নানাপ্রকার, কোনোটি অতি ক্ষুদ্র কোনোটা অতি বৃহৎ। বীজের আকার হইতে বৃক্ষের আকার নির্ণয় করা যায় না। প্রকাণ্ড বটবৃক্ষ সরিষার অপেক্ষা ক্ষুদ্র বীজ হইতে উৎপন্ন হয়। কে মনে করিতে পারে এই ক্ষুদ্র বিন্দুর মধ্যে ভবিষ্যতের প্রকাণ্ড বৃক্ষ লুক্কাইয়া আছে। কে বীজ বপন করে?

তোমরা হয়তো কৃষকদিগকে শস্য বপন করিতে দেখিয়াছ। মানুষেরা কেবল বীজ বপন করে এমন নহে। অনেক সময়ে পাখিরা ফল খাইয়া অনেক দূরদেশে বীজ লইয়া যায়। এই প্রকারে সমুদ্রের মধ্যে জনমানব শূন্য দ্বীপে বীজ উত্তপ্ত হয়। এতদ্ভিন্ন অনেক বীজ বাতাসে উড়িয়া অতি দূর দেশে ছড়াইয়া পড়ে। শিমূল ফুল যখন পাকিয়া উঠে তখন এক-একটি বীজ তুলার উপর ভর করিয়া বাতাসে অনেক দূর চলিয়া যায়। এই প্রকারে দিবারাত্রি দেশ- দেশান্তরে বীজ বপন হইতেছে।

প্রত্যেকে বীজ হইতে বৃক্ষ উৎপন্ন হইবে কিনা কেহ বলিতে পারে না, হয়তো কঠিন প্রস্তরের উপর বীজ পড়িল। সেখানে আর অঙ্কুর বাহির হইতে পারিল না। কঠিন প্রস্তরে কি করিয়া ক্ষুদ্র শিশু পালিত হইবে। অঙ্কুরোদগমের জন্য উত্তাপ, জল ও মৃত্তিকার আবশ্যক।

বীজের জীবনী শক্তি

যেখানেই পড়ুক না কেন বহুকাল পর্যন্ত বৃক্ষশিশু বীজের মধ্যে নিরাপদে নিদ্রিত থাকে যতদিন বাড়িবার উপযুক্ত স্থান না পায় ততদিন উপরকার দৃঢ় আবরণ বর্মের ন্যায় বৃক্ষশিশুকে বাহিরের বিপদ হইতে রক্ষা করে। শুনিতে পাই মিশর দেশে পিরামিডের মধ্যে শস্যের বীজ পাওয়া গিয়াছে। সেগুলি প্রায় ৬০০০ বৎসর পুরাতন। সেই বহু পুরাতন বীজ মাটিতে বপন করিলে পর, তাহা হইতে শস্য উৎপন্ন হইয়াছে। "অপার তাহার করুণা"

কী আশ্চর্য কথা। এত সহস্র বৎসর শিশু ঘুমাইয়াছিল। মৃত্তিকা স্পর্শে জাগিয়া উঠিল। এতদিন কে ইহাদের জীবন রক্ষা করিয়াছিল। কার প্রাসাদে মৃত্যু আসিয়া ইহাদিগকে গ্রাস করিতে পারে নাই। পণ্ডিতেরা বলেন একটি ক্ষুদ্র পক্ষী শাবকেও বিধাতার (প্রকৃতির) স্নেহ দৃষ্টির অন্তরালে হয় না। বীজের জীবন একটি পক্ষীর জীবন হইতে অনেক ক্ষুদ্র। পক্ষীরা চেতন, বীজ অচেতন। তবু দেখো বিধাতা (প্রকৃতি) তাহার ঘুমন্ত প্রাণটুকুকে কেমন যত্নে রক্ষা করেন।

ধাত্রী ক্রোড়ে শিশু

ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বীজ পক্ক হয়। আম, লিচু, প্রভৃতির বীজ বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে হয়। ধান যব ইত্যাদি শস্য আশ্বিন কার্তিক মাসে পক্ক হয়। মনে কর একটি গাছের বীজ আশ্বিন মাসে পাকিয়াছে। আশ্বিন মাসের শেষে দু-একদিন প্রচণ্ড ঝড়ে গাছগুলি মূল পর্যন্ত কাঁপিতে থাকে। তাহার পাতা ছিন্ন ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাখা ভগ্ন হইয়া চারিদিকে পড়িতে থাকে। এই সময়ে বীজগুলি বিক্ষিপ্ত হয়। প্রবল বাতাসের বেগে কোথায় লইয়া যায় কে বলিতে পার? মনে কর একটি বীজ সমস্ত দিনরাত্রি মাটিতে লুটাইতে লুটাইতে একটি মৃত্তিকা স্তূপের নীচে অথবা একখণ্ড ভগ্ন ইষ্টকের নীচে আশ্রয় লইল। কোথায় ছিল, কোথায় আসিয়া পড়িল, ক্রমে ক্রমে ধূলি মৃত্তিকা আসিয়া তাহাকে আচ্ছাদন করিল-এখন হইতে সে মানুষের চক্ষু হইতে অন্তর্ধান হইল।

মনুষ্য চক্ষুর আড়াল হইল বটে, কিন্তু বিধাতার (প্রকৃতির) চক্ষুর অন্তরালে যায় নাই। পৃথিবী ধাত্রীর ন্যায় তাহাকে ক্রোড়ে লইল। সে মৃত্তিকার আবরণে বাহিরের শীত ও ঝঞ্ঝাপাত হইতে রক্ষা পাইল। এখন অদৃশ্য হইয়া বীজটি নিদ্রিত হইয়া রহিল। মাসের পর মাস কাটিয়া গেল, শীত অবসানে বসন্ত আসিল। তারপর বর্ষার আরম্ভে দু-একদিন বৃষ্টি হইল। জল স্পর্শে ঘুমন্ত শিশু জাগিয়া উঠিল। এখন আর লুকাইয়া থাকিবার প্রয়োজন নাই। বাহিরের আলোক শিশুকে বলিতেছে "আলোকে আইস উপরে সূর্যকিরণ দেখিবে। আর ঘুমাইও না।" আস্তে আস্তে বীজের বাহিরের আবরণটি খসিয়া পড়িল, দুটি কোমল পাল্লার মধ্য হইতে অঙ্কুর বাহির হইল। অঙ্কুরের এক অংশ নীচের দিকে যাইয়া মৃত্তিকা দৃঢ়রূপে ধরিয়া রহিল। আর এক অংশ মাটি ভেদ করিয়া আলো লক্ষ্য করিয়া উপরে উঠিল। তোমরা কি অঙ্কুর উঠিতে দেখিয়াছ? মনে হয়, শিশুটি যেন ক্ষুদ্র মস্তক তুলিয়া বিস্ময়ের সহিত নূতন রাজ্য উকি দিয়া দেখিতেছে।



কুমুদিনীর নিশি জাগরণ

[বসু বিজ্ঞান মন্দিবে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুব ভাষণের সাবাংশ। জগদীশচন্দ্র বসু ও চাকচন্দ্র ভট্টাচার্য যুগ্মনামে প্রকাশিত।

বৈ জ্ঞানিকের আগেই কবি আসব লইযাছেন। "ফুল্ল জ্যোৎস্না পুলকিত যামিনী"-তে কুমুদিনীর উল্লেখ ও দিবসে "নির্মল উজ্জ্বল" সূর্যকরের প্রভাবে নলিনীর বিকাশ দেখিয়া" কবি গাহিলেন:

"গিরো ময়ূরাঃ গগনে পয়োদাঃ লক্ষান্তরে ভানুঃ জলে চ পদ্মাম্। ইন্দুদ্বিলক্ষে কুমুদস্য বন্ধু- যো যস্য মিত্রং নহি তস্য দূরম।।"

কবি এইখানে থামিলেন। কিন্তু বৈজ্ঞানিকও কবির ন্যায় এই বৈচিত্রময় ব্রহ্মাণ্ডে এক মহান ছন্দ এবং বিরাট ঐক্যের সন্ধানে ফিবিতেছেন। তাই বৈজ্ঞানিক মন তমসাবৃত অমানিশায় কুমুদিনীর স্বরূপ দেখিবার ভার লইলেন; প্রদীপ হাতে কাছে আসিয়া বিশেষভাবে নিরীক্ষণ করিয়া সেই ঘোর অন্ধকারে প্রিয়সখার আদর্শজনিত কোন চিহ্নই তিনি কুমুদিনীতে দেখিতে পাইলেন না। বৈজ্ঞানিক দেখিলেন কুমুদ্বন্ধু আকাশে দেখা দিল আর না দিল প্রতিরাত্রেই কুমুদের সেই একই উন্মেষ-সেই একই উল্লাস; আরও দেখিলেন যে রবিকর স্পর্শমাত্রেই কুমুদিনীর সঙ্কোচ ঘটে না, তাহার সুষুপ্তি আসে সূর্যোদয়ের অনেক পরে।

একখানি ফরাসি অভিধানে কাঁকড়া সম্বন্ধে লেখা ছিল-কাঁকড়া একটি ছোট লাল মাছ যাহা পিছন দিকে চলে। অভিধানকার কাঁকড়ার এই বর্ণনা যথাযথ হইয়াছে কিনা জানিবার জন্য প্রসিদ্ধ প্রাণীতত্ত্ববিদ কুভিয়ার-এর নিকট যান; কুভিয়ার শুনিযা বলিলেন-চমৎকার হইয়াছে, শুধু এইটুকু তফাত কাঁকড়া মাত্রেই ছোট নয়, সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত ইহা লাল নয়। ইহা মাছ নয় এবং আর যেদিকে যাউক ইহা পিছনে চলে না, এই যা প্রভেদ, নচেৎ বর্ণনা একেবারে হুবহু হইয়াছে। কবি বর্ণিত কুমুদিনীর প্রণয়েতিহাসও অনেকটা এইরূপই। চন্দ্র না উঠিলেও কুমুদ ফোটে এবং সূর্য উঠিলেই ইহা মুদিয়া যায় না।

"বেলা গেল সন্ধ্যা হল ফুল ঝিঙ্গার ফুল" গান শুনিয়া আর এক জাতীয় পুষ্পের বিকাশে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। গঙ্গার ধারে সিবেড়িয়ার বাগানে খানিকটা জায়গায় মালি ঝিঙ্গা গাছ দিয়াছিল। সকালের সেই বাগানকে আর অপরাহ্নে যেন চেনাই যায় না। সূর্যের অস্তাচল গমনের সঙ্গে সঙ্গে সদ্য প্রস্ফুটিত ঝিঙ্গাফুল নবরং-এ রঞ্জিত হইয়া এক অপূর্ব শোভা ধারণ করে। এখানেও ফুলগুলি সমস্ত রাত্রি প্রস্ফুটিত থাকিয়া সকালবেলা মুদ্রিত হয়।

উদ্ভিদের নিদ্রা ও জাগরণ সম্বন্ধে গত অর্ধশতাব্দী ধরিয়া বৈজ্ঞানিকগণের মধ্যে অনেক আলোচনা হইয়া গিয়াছে। তাঁহাদের অনেকে মনে করেন যে ঘুমানো বা জাগা উদ্ভিদের সম্পূর্ণ খেয়াল মাত্র।

কুমুদ রাত্রে ফোটে এবং দিনে বন্ধ হয়-কারণ সে এই রূপই করিয়া থাকে; আর পদ্ম দিনে ফোটে রাত্রে মুদিয়া যায়, কারণ পদ্ম এ বিষয়ে কুমুদের ঠিক উলটা করে। একবার এক প্রশ্ন উঠিয়াছিল-

তিলঞ্চ সরিষা চৈব উভয়ে তৈলদায়িকা। তর্পণে তিল দরকার, সরিষা নাস্তি কি কারণে।। তাহার উত্তর আসিয়াছিল-

ঢাকঞ্চ ঢোলকঞ্চৈব উভয়ে বাদ্যদায়িকে। গাজনে ঢাক দরকার; ঢোল নাস্তি যে কারণে।।

কুমুদ ও পদ্মের ফোটা সম্বন্ধে অনেকটা এই রকমের কৈফিয়ত মিলিত।

কিন্তু এ সম্বন্ধে এই কী শেষ কথা থাকিবে? কয়েক বৎসর ধরিয়া এখানে এ বিষয়ে অনেকগুলি পরীক্ষা গ্রহণ করা হইয়াছে। সেই সকল পরীক্ষার ফল হইতে কি তথ্যে উপনীত হওয়া যায় দেখা যাউক।

টবসুদ্ধ একটা গাছকে কাত করিয়া গাছের ডালটিকে যদি মাটির সহিত শোয়াইয়া রাখা যায় তো দেখা যায় ডালটা বাঁকিয়া মাথা উঁচু করিয়া উঠিতেছে। পৃথিবীর টানের বিরুদ্ধে গাছ এইরূপ করিয়া থাকে। এইরূপ বাঁকিয়া উপরে উঠিবার শক্তি কোন গাছে খুব বেশি, কোথাও বা উহা খুব কম।

মাধ্যাকর্ষণের ক্রিয়া ব্যতীত উদ্ভিত আলোক স্পর্শে পাতা উঠাইয়া নামাইয়া নানা রকমে সাড়া দিয়া থাকে। কোথাও পাতা বাঁকিয়া আলোকের দিকে অগ্রসর হয়, আবার কোন গাছে উহারা আলোক হইতে দূরে যাইবার জন্য ঘাড় বাঁকাইয়া থাকে। একটি মাদার গাছের পাতার উপর আলো ফেলা হইল, পাতাটি এতক্ষণ অন্ধকারে চুপ করিয়াছিল। আলোক পাইবা মাত্র মন পুলকিত হউক বা যাহাই হউক এক মিনিট দেড় মিনিটের মধ্যেই উপর দিকে বাঁকিতে লাগিল। কিন্তু লজ্জাবতী এইরূপ অবস্থায় যেন লজ্জায় মাথা হেঁট করে।

পৃথিবীর আকর্ষণ ও আলোকজনিত উত্তেজনা, মাত্র এই দুইটি শক্তি যদি উদ্ভিদের উপর কাজ করিত, তাহা হইলেও উহাদের সমবেত শক্তি গাছের মধ্যে কত বিভিন্ন প্রকারের পরিবর্তন সংঘটিত করিত। কোথাও একটি শক্তি অপরটির বিপরীত দিকে কাজ করিতেছে, কোথাও বা তাহারা পরস্পর সহায়তা করিতেছে; এবং প্রত্যেক শক্তির ক্রিয়ার পরিমাণ কত বিভিন্ন। সুতরাং কোনো উদ্ভিদে এই দুইটি ভিন্ন শক্তির সমবেত ফল দেখিয়াই বলা চলে না। কোন্টা কতটুকু কাজ করিতেছে; তজ্জন্য পৃথক পরীক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে। কৃপণ ১৫ টাকা রোজগার করিয়া তাহার মধ্যে ১০, টাকা জমায়; দাতা ১৫০০ টাকা রোজগার করিয়া আবার মাসের শেষে ধার করে; সুতরাং সঞ্চয়ের পরিমাণ দেখিয়া কোনো গৃহস্থের আয় ব্যয়ের পরিমাণ দেওয়া চলে না; তজ্জন্য তাহার হিসেবের খাতা দেখিতে হইবে।

প্রথমত দেখা যাউক এই পাতা খোলা বা পাতা বন্ধ পৃথিবীর আকর্ষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ফলে ঘটিতেছে কিনা। একটি অর্ধপ্রস্ফুটিত কুমুদফুল লওয়া হইল; পাপড়িগুলি যদি উপরের দিকে উঠে তো ফুলটি মুদিয়া যাইবে, যদি নীচের দিকে নামে তো উহা আরও খুলিবে; কিন্তু ঠিক বিপরীত হইবে যদি ফুলটিকে মাথা নীচু ও ডালটি উঁচু করিয়া ধরিয়া রাখা যায়; তখন পাপড়িগুলির উপরে উঠার ফলে ফুলটি আরও খুলিয়া যাইবে এবং নীচে নামিলে ফুলটি বন্ধ হইবে। সুতরাং একটি ফুলকে যদি মাথা নীচু করিয়া রাখা যায় তো যখন তাহার ফুটিবার কথা তখন সে বুজিয়া যাইবে। যখন তাহার মুদিবার কথা তখন সে খুলিয়া যাইবে। পরীক্ষায় দেখা গিয়াছে যে সোজাই দাঁড়াক বা উলটিয়া থাকুক যখন ফুটিবার কথা তখনই কুমুদ ফোটে। তাহার কোন ব্যতিক্রম ঘটে না।

সুতরাং কুমুদ যে মাধ্যাকর্ষণের উত্তেজনায় ফোটে না তাহা দেখা গেল। এইবার

আলোর ক্রিয়ার ফল অনুসন্ধান করা যাউক।

একটি সূক্ষ্ম যন্ত্র নির্মিত হইল যাহাতে পরীক্ষাকারীব সাহায্য ব্যতিরেকে তাহার অনুপস্থিতিতেও ফুলের পাপড়ির উঠানামা মিনিটের পর মিনিট ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিনের পর দিন স্বতঃই লিপিবদ্ধ হইতে চলিল। দেখা গেল সূর্য উঠিলেই রবিকর স্পর্শে কুমুদিনী মুদ্রিতা হয় না, বেলা ১০/১১ টার পর তাহার পাপড়ি বুজিয়া আসে।

সুতরাং ইহা আলোকের উত্তেজনার ফলেও নয়। ফুলের এই নিজ লিখিত লিপির সাক্ষ্য হইতে একটা জিনিস লক্ষ্য করা যায় সে উহা সন্ধ্যা ৬টার সময় খুলিতে আরম্ভ করে, এবং রাত্রি ১০টার সময় সম্পূর্ণরূপে খুলিয়া যায়। আর বেলা ১০ টার সময় সম্পূর্ণরূপে বুজিয়া যায়। আরও দেখা যায় সন্ধ্যার সময় হইতে তাপমাত্রা যন্ত্রের পারদ বেশি নামিতে থাকে। কুমুদিনীর দিবানিদ্রা এবং রাত্রিজাগরণ তবে কী বাহিরের উত্তাপ ও শৈত্যের ফলে?

পূর্বের ওই যন্ত্রটির গায়ে আর একটি যন্ত্র লাগাইয়া দেওয়া হইল যাহাতে ফুলের ওই লিপির পাশে পাশে সমস্ত দিনরাত্রির তাপ পরিবর্তনের সংবাদ লিপিবদ্ধ হইতে লাগিল। দিনের পর দিন এইরূপ লিপিসাক্ষ্য গ্রহণ করা হইল। পরে মিলাইয়া দেখা গেল যে দুইটি লিপিই সম্পূর্ণ এক, মিশাইলে চেনাই যায় না যে দুইটিতে দুইটি বিভিন্ন বিষয় লিপিবদ্ধ হইয়াছে।

সুতরাং দেখা গেল যে কুমুদের ফোটা বা বন্ধ হওয়া একমাত্র বাহিরের তাপের দ্বারাই সংঘটিত হয়; এবং যে কারণে ফরিদপুরের খেজুর গাছ সন্ধ্যায় মাথা নোয়ায় এবং প্রাতঃকালে সোজা হইয়া দাঁড়ায়, সেই একই কারণে সমস্ত পৃথিবীর কুমুদ রাত্রে বিকশিত হইয়া দিবসে সঙ্কুচিত হইয়া পড়ে এবং সেই কারণে গঙ্গার ধারে সিবেড়িয়ার বাগানে মধ্যাহ্নে ও সায়াহ্নে ঝিঙ্গাফুলের রূপ বৈচিত্র্য দেখা যায়।

পরীক্ষায় দেখা গিয়াছে, যে দিনের বেলায় কুমুদের চারিদিকে যদি রাত্রের শৈত্য বজায় রাখা যায়, তো দিবসেও রাত্রের ন্যায়ও কুমুদ প্রস্ফুটিত থাকে, পক্ষান্তরে রাত্রে যদি উহার চতুর্দিকে দিনের উত্তাপ সমপরিমাণে রাখিতে পারা যায় তো আকাশে পূর্ণচন্দ্রের আবির্ভাব হইলেও কুমুদিনী মুখ তুলিয়া চাহিবে না।

কিন্তু একটা কথা, কুমুদিনী যখন বিকশিতা তখন নলিনী মলিনী কেন, আবার কমলিনীর উন্মীলনে কুমুদিনী মুদ্রিতা কেন? বাহিরের উত্তাপ বা শৈত্য কিরূপে দুইটিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থায় লইয়া যাইতেছে?

একখণ্ড লৌহকে সমলম্ব একখণ্ড তাম্রের সহিত সংলগ্ন করিয়া উভয়কে উত্তাপ দিতে আরম্ভ করা হইল; তাপে উভয়েই বাড়িবে, কিন্তু সমতাপে তাম্র সমলম্ব লৌহ অপেক্ষা অধিক বাড়ে, অথচ প্রত্যেকটি ধনুকের ন্যায় বাঁকিয়া যাইবে, যেটি বেশি বাড়ে সেইটি থাকিবে বাহিরে, যেটি কম বাড়ে সেইটি থাকিবে ভিতরে। সেইরূপ গাছের একদিক আর একদিক অপেক্ষা বাড়িলে পাতাটি ধনুকের মতো হইবে।

বাহিরের উত্তাপ বা শৈত্যের সহিত গাছের বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক আছে কি না দেখিবার জন্য, নবনির্মিত ম্যাগনেটিক ক্রেস্কোগ্রাফ যাহা অত্যধিক শক্তিশালী অণুবীক্ষণের দৃষ্টির অতীত, গাছের বৃদ্ধিকে কোটি গুণ পরিবর্ধিত করিয়া চোখের সম্মুখে ধরে। সেই ক্রেস্কোগ্রাফে একটি গাছ বসানো হইল; গাছ তাহার সাধারণ অবস্থায় বাড়িতে লাগিল। ঠান্ডা বরফ জল চারিদিকে দেওয়া হইল। দেখিতে দেখিতে উহার বৃদ্ধি একেবারে বন্ধ হইয়া গেল। এইবার বরফজল ফেলিয়া গরমজল দেওয়া হইল। গাছ তাহার সহজ অবস্থা অপেক্ষা অধিকতর দ্রুতবেগে বাড়িতে লাগিল।

বাহিরের উত্তাপে কুমুদের পাপড়ি বাড়িতে থাকিবে, কিন্তু এই পাপড়ির বাহিরের সবুজ দিকটা ভিতরের সাদা দিকটা অপেক্ষা বেশি কমণীয়, সুতরাং বাহিরটা ভিতর অপেক্ষা বেশি বাড়িবে। ফলে সমস্ত পাপড়িটা ধনুকের আকার লইবে-সবুজ দিকটা থাকিবে বাহিরে, সাদা দিকটা থাকিবে ভিতরে, সুতরাং ফুলটি একেবার মুদিয়া যাইবে। দিনে ফোটে এইরূপ একটি ফুল লওয়া হইল, দেখা গেল পাপড়ির ভিতরটা উহার বাহির অপেক্ষা কোমল, সুতরাং, এক্ষেত্রেও পাপড়িটি বাঁকিবে, তবে এবার উলটাদিকে বাঁকিবে, ফলে বাহিরের উত্তাপের প্রভাবে উহা আরও খুলিয়া যাইবে।

সুতরাং, একই উত্তেজনা যে ভিন্ন জাতীয় পুষ্পকে বিভিন্ন রূপ প্রদান করে তাহা কেবলমাত্র তাহাদের আভ্যন্তরিক গঠনবৈচিত্র্যের ফলে।

উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতে নিম্নতম প্রাণীর সাড়া দিবার ক্ষমতা সম্বন্ধে এ পর্যন্ত ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত ছিল। জীবমাত্রেই বাহিরের যাবতীয় আঘাতে সর্বদাই বিক্ষুব্ধ। কেবল উদ্ভিদকে যেদিকে নাড়াও সে সেই দিকেই নড়িবে, যেদিক বাড়িবার সে শুধু সেই দিকেই বাড়িবে। বহির্জগতের আমাদের সাড়া দিবার কোনো ক্ষমতা তাহার নাই। কেবল লজ্জাবতীর ন্যায় কয়েকটি স্পন্দনকারী উদ্ভিদ ভিন্ন, যাবতীয় উদ্ভিদই নীরব নিস্পন্দ এবং এই অস্পন্দনতাই যেন উদ্ভিদের বিশেষ ধর্ম এই কথাই মনে করা হইত। কিন্তু উদ্ভিদকে কত অবস্থা পরম্পরায় মধ্যেই না বাড়িতে হইয়াছে। নিয়ত পরিবর্তনশীল আলো ও অন্ধকার, তাপ ও শৈত্য, পৃথিবীর আকর্ষণ ঝঞ্ঝা কতই না তাহাকে সংক্ষুব্ধ করিয়াছে, কতভাবেই না সে তাহার অন্তর্নিহিত বেদনা জ্ঞাপন করিয়াছে কিন্তু মানবচক্ষু তাহা দেখিতে পায় নাই। তাই এমন সূক্ষ্মযন্ত্র আবিষ্কার করিবার প্রয়োজন হইল যাহার সাহায্যে উদ্ভিদ আপনি আপনার অদৃশ্য বেদনার কাহিনি নিজ হাতে লিখিয়া দিতে পারে এবং তাহা এমন ভাষায় লিখিবে যাহা আমরা বুঝিতে পারি। কেবলমাত্র তখনই এই প্রশ্নের মীমাংসা সম্ভব হইল যে উদ্ভিদমাত্রেই, না কেবলমাত্র লজ্জাশীলা লতা, বাহিরের আঘাত উত্তেজনায় অভিভূত হয়। আজ সেই লিপির সাক্ষ্যে আমরা বলিতে পারি যে, এই ভূমণ্ডলে শুধু মানবই যে বাহিরের আঘাত উত্তেজনায় আক্রান্ত হইতেছে তাহা নয়, নীরব উদ্ভিদও সমভাবে উহা অনুভব করিতেছে এবং কত কাল কত যুগ ধরিয়া কত অশ্বত্থ বট কত তাল তমাল সেই আঘাত উত্তেজনার ইতিহাস নিজেদের দেহে বহন করিতেছে।


5
Articles
জগদীশচন্দ্র সেরা রচনা সম্ভার
0.0
শ্রী জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা কিছু উল্লেযোগ্য অবিস্মরণীয় কাহিনী নিয়ে রচিত একটি অব্যক্ত জীবন প্রসারিত রচনা কাহিনী সমগ্র।
1

প্রসঙ্গ জগদীশচন্দ্র

24 December 2023
0
0
0

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসু রতবর্ষের প্রাচীন গৌরবের কথা উত্থাপিত হইলে আমরা সচরাচর আর্য ঋষিগণের ধর্মোন্নতি এবং আর্য মনীষীগণের দার্শনিক জ্ঞানের কথাই ভাবিয়া থাকি। সংস্কৃত ব্যাকরণ, কাব্

2

অন্যান্য রচনা

25 December 2023
0
0
0

উদ্ভিদের হৃৎস্পন্দন [ গত এক বৎসরের মধ্যে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে উদ্ভিদজীবনের ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে তিনটি গূঢ় রহস্য উৎঘাটিত হইয়াছে। এই আবিষ্কার সমগ্র বৈজ্ঞানিক জগৎকে চমৎকৃত করিয়াছে। গতমাসে দার্জিলিং-এর গভনম

3

ভ্রমণ বিষয়ক রচনা

25 December 2023
0
0
0

লুপ্ত নগরী ই 'টালির দক্ষিণ প্রদেশ অতি রমণীয়, সমস্ত প্রদেশটি যেন একটি উদ্যান। এইরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সচরাচর দেখা যায় না। রোমানরা এই প্রদেশে সমুদ্রের উপকূলে সমৃদ্ধিশালী নগর নির্মাণ করিয়া অবকাশের সময়

4

বিবিধ রচনা

26 December 2023
0
0
0

নাদির শা-র শাস্তি ই তিহাস পাঠ করিলে ভারতভূমি যে প্রকৃতই রত্নগর্ভা তাহাতে আর সন্দেহ থাকে না। ধনধান্যের জন্য আমাদের এই মাতৃভূমি বহুকাল হইতে পৃথিবীর অন্যান্য জাতিদের প্রলোভনের বস্তু হইয়া যায়। গ্রিক দেশী

5

বক্তৃতাবলী

26 December 2023
0
0
0

ছাত্রসমাজের প্রতি* ছাত্রসমাজের সভ্যগণ, তোমাদের সাদর সম্ভাষণে আমি আপনাকে অনুগৃহীত মনে করিতেছি। তোমবা আমাকে একান্ত বিজ্ঞ এবং প্রবীণ মনে করিতেছ। বাস্তবপক্ষে যদিও জরা আমার বাহিরের অবয়বকে আক্রমণ করিয়াছে

---