shabd-logo

তেইশ

3 November 2023

3 Viewed 3

সংসারে বিপদ যে কোথায় থাকে এবং কোন পথে কখন যে আত্মপ্রকাশ করে ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। কাজের মাঝখানে কল্যাণী আসিয়া কাঁদিয়া বলিল, মা. উনি বলছেন ওঁর সঙ্গে আমাকে এখুনি বাড়ি চলে যেতে। ট্রেনের সময় নেই— স্টেশনে বসে থাকবেন সে-ও ভালো, তবু এ-বাড়িতে আর একদণ্ড না।

পুষ্করিণী-প্রতিষ্ঠার শাস্ত্রীয় ক্রিয়া এইমাত্র চুকিয়াছে, এইমাত্র দয়াময়ী মণ্ডপ হইতে বাটীতে আসিয়া পা দিয়াছেন। ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে তিনি থমকিয়া দাঁড়াইলেন, মেয়ের কথাটা ভালো বুঝিতেই পারিলেন না, হতবুদ্ধি হইয়া কহিলেন, কে বলচে তোমাকে যেতে শশধর? কেন?

বড়দা এঁকে ভয়ানক অপমান করেছেন — ঘর থেকে বার করে দিয়েছেন, এই বলিয়া কল্যাণী উচ্ছ্বসিত আবেগে কাঁদিতে লাগিল।

চারিদিকে লোকজন, কোথাও খাওয়ানোর আয়োজন কোথাও পানের আসর, কোথাও ভিখারীদের বাদ-বিতণ্ডা, কোথা ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণের শাস্ত্র-বিচার— অগণিত মানুষের অপরিমেয় কোলাহল, – উহারই মাঝখানে অকস্মাৎ এই ব্যাপার। সতী ও মৈত্রেয়ী উপস্থিত হইল, বন্দনা ভাঁড়ায়ের চাবি দিয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, আত্মীয়-কুটুম্বিনীগণের অনেকেই কৌতূহলী হইয়া উঠিল, শশধর আসিয়া প্রণাম করিয়া বলিল, মা, আমরা চললুম। আসতে আদেশ করিছিলেন, আমরা এসেছিলুম কিন্তু থাকতে পারলুম না।।

কেন বাবা?

বিপ্রদাসবাবু তাঁর ঘর থেকে আমাকে বার করে দিয়েছেন।

তার কারণ?

কারণ বোধ করি এই যে তিন বড়লোক। অহঙ্কারে চোখ কানে দেখতে শুনতে পান না। ভেবেচেন নিজের বাড়িতে ডেকে এনে অপমান করা সহজ; কিন্তু ছেলেকে একটু বুঝিয়ে দেবেন আমার বাবাও জমিদারী রেখে গছেন, সে-ও নিতান্ত ছোট নয়। আমাকেও ভিক্ষে করে বেড়াতে হয় না।

দয়াময়ী ব্যাকুল হইয়া বলিলেন, বিপিনকে আমি ডেকে পাঠাচ্ছি বাবা, কি হয়েছে জিজ্ঞেসা করি। আমার কাজ এখনো শেষ হলো না, ব্রাহ্মণ-ভোজন বাকী, বোষ্টম-ভিক্ষুকদের বিদায় করা হয়নি, তার আগেই যদি তোমরা রাগ করে চলে যাও শশধর, যে পুকুর এইমাত্র প্রতিষ্ঠা করলুম তাতেই ডুব দিয়ে মরবো তোমরা নিশ্চয় জোনো। বলিতে বলিতে তাঁহার দুই চোখে জল আসিয়া পড়িল ।

শাশুড়ীর চোখের জলে বাশেষ ফল হইল না। ভদ্রসন্তান হইয়াও শশধরের আকৃতি ও প্রকৃতি কোনটাই ঠিক ভদ্রোচিত নয়। আছে ঘেঁষিয়া দাঁড়াইতে মন সঙ্কোচ বোধ করে। তাহার বিপুল দেহও বিপুলতর মুখমণ্ডল ক্রুদ্ধ বিড়ালের মত ফুলিতে লাগিল, বলিল, থাকতে পারি যদি বিপ্রদাসবাবু এখানে এসে সকলের সুমুখে হাতজোড় করে আমার ক্ষমা চান। নইলে নয়।

প্রস্তাবটা এতবড় অভাবিত যে শুনিয়া সকলে যেন বিস্ময়ে অবাক হইয়া গেল। বিপ্রদাস ক্ষমা চাহিবে হাতজোড় করিয়া! এবং সকলের সম্মুখে! কয়েক মুহূর্ত সকলেই নির্বাক, সহসা পাংশুমুখে একান্ত অনুনয়ের কণ্ঠে সতী বলিয়া উঠিল, ঠাকুরজামাই, এখন নয় ভাই । কাজকর্ম চুকুক, রাত্তিরে মা নিশ্চয় এর একটা বিহিত করবেন। তোমাকে অপমান করা কি কখনো হতে পারে? অন্যায় করে থাকলে তিনি নিশ্চয় ক্ষমা চাইবেন।

বন্দনার চোখের কোণ-দুটা ঈষৎ স্ফুরিত হইয়া উঠিল, কিন্তু শান্তকণ্ঠে কহিল, তিনি অন্যায় ত কখন করেন না মেজদি!

সতী তাড়া দিয়া উঠিল, তুই থাম বন্দনা অন্যায় সবাই করে।

বন্দনা বলিল, না, তিনি করেন না। শুনিয়া মৈত্রেয়ী যেন জ্বলিয়া গেল, ভীষ্মস্বরে কহিল, কি করে জানলেন? সেখানে ত আপনি ছিলেন না। উনি কি তবে বানিয়ে বলচেন?

বন্দনা ক্ষণকাল তাহার প্রতি চাহিয়া থাকিয়া কহিল, বানিয়ে বলার কথা আমি বলিনি। আমি শুধু বলেচি মুখুয্যেমশাই অন্যায় করেন না। মৈত্রেয়ী প্রত্যুত্তরে তেমনি বক্র-বিদ্রূপে কহিল, অন্যায় সবাই করে। কেউ ভগবান নয়। উনি বাবাকেও অসম্মান করতে ছাড়েন নি।

বন্দনা বলিল, তা হলে শশধরবাবুর মত তাঁরও চলে যাওয়া উচিত ছিল, থাকা উচিত ছিল না।

মৈত্রেয়ী তক্ষীতরস্বরে জবাব দিল, সে কৈফিয়ত আপনার কাছে দেবার নয়, মীমাংসা হবে দ্বিজুবাবুর সঙ্গে, যিনি আহ্বান করে এনেছেন।

সতী সরোষে তিরস্কার করিল, তোর পায়ে পড়ি বন্দনা, তুই যা এখান থেকে, নিজের কাজে যা।

শশধর দয়াময়ীকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, আমি কিন্তু ন্যায়-অন্যায়ের দরবার করতে আসিনি মা, এসেছি জানতে আপনার ছেলে জোড়হাতে আমার ক্ষমা চাইবেন কি না? নইলে চললুম—এক মিনিটও থাকবো না। আপনার মেয়ে আমার সঙ্গে যেতে পারেন, না-ও পারেন, কিন্তু তার পরে শ্বশুরবাড়ির নাম যেন না আর মুখে আনেন । এইখানে আজই তার শেষ হয় যেন! এ কি সর্বনেশে কথা! শশধরের পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয়— মেয়ে-জামাইকে বাড়ি আনিয়া এ কি ভয়ঙ্কর বিপদ! সুমুখে দাঁড়াইয়া কল্যাণী কাঁদিতেই লাগিল, পরামর্শ দিবার লোক নাই, ভাবিবার সময় নাই, ত্রাসে লজ্জায় ও গভীর অপমানে দয়াময়ীর কর্তব্য-বুদ্ধি আচ্ছন্ন হইয়া গেল, তিনি কি করিবেন ভাবিয়া না পাইয়া সভয়ে বলিলেন, তুমি একটু থাম বাবা, আমি বিপিনকে ডেকে পাঠাচ্ছি। আমি জানি কোথায় তোমার মস্ত ভুল আছে, কিন্তু এই এক বাড়ি লোকের মধ্যে এ কলঙ্ক প্রকাশ পেলে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে বাছা শশধর কহিল, বেশ, আমি দাঁড়িয়ে আছি, তাঁকে ডাকান। বিপ্রদাসবাবু মিথ্যে করেই বলুন এ কাজ তিনি করেন নি ।

মিথ্যে কথা সে বলে না শশধর, এই বলিয়া দয়াময়ী বিপ্রদাসকে ডাকাইতে পাঠাইলেন। মিনিট পাঁচেক পরে বিপ্রদাস আসিয়া দাড়াইল। তেমনি শান্ত, গম্ভীর ও আত্মসমাহিত। শুধু চোখের দৃষ্টিতে একটা উদাস ক্লান্ত ছায়া-তাহার অন্তরালে কি কথা যে প্রচ্ছন্ন আছে বলা কঠিন।

দয়াময়ী উচ্ছ্বসিত আবেগে বলিয়া উঠিলেন, তোর নামে কি কথা শশধর বলে বিপিন। বলে, তুই নাকি ওকে ঘর থেকে বার করে দিয়েচিস। এ কি কখন সত্যি হতে পারে?

বিপ্রদাস বলিল, সত্যি বৈ কি মা ঘর থেকে সত্যি বার করে দিয়েছিস আমার জামাইকে? আমার এই কাজের বাড়িতে?

হাঁ, সত্যিই বার করে দিয়েছি। বলেচি আর যেন না কখনো ও আমার ঘরে ঢোকে।

শুনিয়া দয়াময়ী বজ্রাহতের ন্যায় নিস্পন্দ হইয়া গেলেন। কিছুক্ষণে এই অভিভূত ভাবটা কাটিলে জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন?

সে তোমার না শোনাই ভালো মা।

সতী স্থির থাকিতে পারিল না, ব্যাকুল হইয়া নিবেদন করিল, আমরা কেউ শুনতে চাইনে, কিন্তু ঠাকুরজামাই কল্যাণীকে নিয়ে এক্ষুনি চলে যেতে চাচ্চেন, এই এক বাড়ি লোকের মধ্যে ভেবে দেখো সে কত বড় কেলেঙ্কারী,- -ওঁকে বলো তোমার হঠাৎ অন্যায় হয়ে গেছে, বলো ওঁদের থাকতে।

বিপ্রদাস স্ত্রীর মুখের প্রতি একমুহূর্ত দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, হঠাৎ অন্যায় আমার হয় না সতী।

হয়, হয়, হঠাৎ একটা অন্যায় সকলেরই হয়। বল না ওঁদের থাকতে।

বিপ্রদাস মাথা নাড়িয়া কহিল, না, অন্যায় আমার হয়নি স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথনের মাঝে দয়াময়ী স্তব্ধ হইয়া ছিলেন, সহসা কে যেন তাঁহাকে নাড়া দিয়া সচেতন করিয়া দিল, তীব্রকণ্ঠে কহিলেন, ন্যায়-অন্যায়ের ঝগড়া থাক। মেয়েজামাই আমার চিরকালের মত পর হয়ে যাবে এ আমি সইবো না। শশধরের কাছে তুমি ক্ষমা চাও বিপিন।

সে হয় না মা, সে অসম্ভব।

সম্ভব অসম্ভব আমি জানিনে ক্ষমা তোমাকে চাইতেই হবে।

বিপ্রদাস নিরুত্তরে স্থির হইয়া রহিল। দয়ময়ী মনে মনে বুঝিলেন এ অসম্ভবকে আর সম্ভব করা যাইবে না, – ক্রোধের সীমা রহিল না, বলিলেন, বাড়ি তোমার একার নয় বিপিন। কাউকে তাড়াবার অধিকার কর্তা তোমাকে দিয়ে যাননি, ওরা এ বাড়িতে থাকবে ।

বিপ্রদাস কহিল, দেখো মা, আমাকে ডেকে না পাঠিয়ে যদি তুমি এ আদেশ দিতে আমি চুপ করেই থাকতাম, কিন্তু এখন আর পারিনে। শশ থাকলে এ বাড়ি ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হবে। আর ফেরাতে পারবে না। কোটা চাও, বল? জীবনে এমন ভয়ানক প্রশ্নের উত্তর দিতে কোনদিন কেহ তাঁহাকে ডাকে নাই, এতবড় দুর্ভেদ্য সমস্যার সম্মুখীন হইতেও কেহ বলে নাই। একদিকে মেয়ে-জামাই, আর একদিকে দাঁড়াইয়া তাঁহার বিপিন। যে শিশুকে বুকে করিয়া মানুষ করিয়াছেন, যে সকল আত্মীয়ের বড়, আত্মীয়, দুঃখের সান্ত্বনা, বিপদের আশ্রয়—যে ছেলে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয়। এ অমর্যাদা তাহাকে মৃত্যু দিবে কিন্তু সঙ্কল্পচ্যুত করিবে না। বুঝিলেন সর্বনাশের অতলস্পর্শ গহ্বর তাঁর পায়ের নীচে, এ ভুলের প্রতিবিধান নাই, প্রত্যাবর্তনের পথ নাই—পরিণাম ইহার দৈবের মতই অমোঘ, নির্মম ও অনন্যগতি। তথাপি নিজেকে শাসন করিতে পারিলেন না, অদম্য ক্রোধ ও অভিমানের বাত্যায় তাঁহাকে সম্মুখের দিকে ঠেলিয়া দিল, কটুকণ্ঠে বলিলেন, এ তোমার অন্যায় জিন বিপিন। তোমার জন্যে মেয়ে-জামাইকে জন্মের মত পর করে দেব এ হয় না বাছা। তোমার যা ইচ্ছে কর গে। শশধর, এস তোমরা আমার সঙ্গে—ওর কথায় কান দেবার দরকার নেই বাড়ি ওর একার নয়। এই বলিয়া তিনি কল্যাণী ও শশধরকে সঙ্গে লইয়া চলিয়া গেলেন । তাঁহাদের পিছনে পিছনে গেল মৈত্রেয়ী, যেন ইঁহাদেরই সে আপন লোক।

মনে হইয়াছিল সতী বুঝি এইবার ভাঙ্গিয়া পড়িবে। কিন্তু তাঁহার অচঞ্চল দৃঢ়তায় বন্দনা ও বিপ্রদাস উভয়েই বিস্মিত হইল। তাহার চোখে জল নাই কিন্তু মুখ অতিশয় পাঙুর, বলিল, ঠাকুরজামাই কি করেচেন আমরা জানিনে, কিন্তু অকারণে তুমিও যে এতবড় কাও করোনি, তা নিশ্চয় জানি। ভেবো না, মনে মনে তোমাকে আমি এতটুকু দোষও কোন দিন দেব।

বিপ্রদাস চুপ করিয়া রহিল সতী জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি আভাই চলে যাবে?

না, কাল যাবো।

আর আসবে না এ বাড়িতে?

মনে ত হয় না।

আমি? বাসু?

যেতে তোমাদেরও হবে। কাল না পার অন্য কোন দিন ।

না, অন্য দিন নয়, আমরাও কালই যাবো। এই বলিয়া সতী বন্দনাকে জিজ্ঞাসা করিল, তুই কি করবি বলনা, কালই যাবি বন্দনা বলিল, না। আমি ত ঝগড়া করিনি মেজদি, যে দল পাকিয়ে কালই যেতে হবে।

সতী বলিল, ঝগড়া আমিও করিনি, বন্দনা, উনিও না। কিন্তু যেখানে ওঁর জায়গা হয় না সেখানে আমারও না। একটা দিনও না। তোর বিয়ে হলে এ কথা বুঝতিস।

বন্দনা বলিল, বিয়ে না হয়েও বুঝি মেজদি, স্বামীর জায়গা না হলে স্ত্রীরও হয় না। কিন্তু ভুল ত হয়, না বুঝে তাকেই স্বীকার করা স্ত্রীর কর্তব্য, তোমার এ কথা আমি মানব না। শাশুড়ীর প্রতি সতীর অভিমানের সীমা ছিল না, বলিল, স্বামী থাকলে মানতিস । বলিয়াই অশ্রু চাপিতে দ্রুতপদে প্রস্থান করিল।

বন্দনা কহিল, এ কি করলেন মুর্খযোমশাই?

না করে উপায় ছিল না বন্দনা।

কিন্তু মায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ এ যে ভাবতে পারা যায় না | বিপ্রদাস বলিল, যায় না সত্যি, কিন্তু নতুন প্রশ্ন এসে যখন পথ আগলায় তখন নতুন সমাধানের কথা ভাবতেই হয়। এড়িয়ে চলবার ফাঁক থাকে না। তোমার মেজদি আমার সঙ্গে যাবেই—বাধা দেওয়া বৃথা কিন্তু তুমি? আরও দু-চার দিন কি থাকবে মনে করেছো?

বন্দনা বলিল, কতদিন থাকতে হবে আমি জানিনে। কিন্তু নতুন প্রশ্ন আপনার যতই আসুক আমি কিন্তু সেই পুরনো পথেই তার উত্তর খুঁজে ফিরবো- যে পথ প্রথম দিনটিতে আমার চোখে পড়েছিল, যেদিন হঠাৎ এসে এ বাড়িতে দাঁড়িয়েছিলুম, যার তুলনা কোথাও দেখিনি, যা আমার মনের ধারা দিয়েছে চিরকালের মতো বদলে। বিপ্রদাস ইহার উত্তর দিল না, শুধু ওষ্ঠপ্রান্তে তাহার একটুখানি ম্লান হাসির আভাস দেখা দিল। সে হাসি যেমন বেদনার তেমনি নিরাশার। কহিল, আমি বাইরে চললুম বন্দনা, আবার দেখা হবে।

অশ্রুবাষ্পে বন্দনার চোখ ভরিয়া উঠিয়াছে; বলিল, দেখা যদি হয় তখন শুধু দূর থেকে আপনাকে প্রণাম করবো। কঠোর আপনার প্রকৃতি, কঠিন মন, না আছে স্নেহ, না আছে ক্ষমা। তখন বলতে যদি না পারি, সুযোগ যদি না হয় এখুনি বলে রাখি মুখুয্যেমশাই, যাদের নিয়ে চলে আমাদের ঘরকন্না, হাসিকান্না, মান-অভিমান তাদের নিয়েই যেন চলতে পারি, তাদেরই যেন আপনার বলে এ জীবনে ভাবতে শিখি। আলেয়ার আলোর পিছনে আর যেন না পথ হারাই। একটু থামিয়া বলিল, দূরে থেকে যখনি আপনাকে মনে পড়বে তখনি একান্তমনে এই মন্ত্র গ্রুপ করবো— তিনি নির্মল, তিনি নিষ্পাপ, তিনি মহৎ। মনের পাষাণফলকে তাঁর লেশমাত্র দাগ পড়ে না। জগতে তিনি একক, কারো আপন তিনি নয়,—সংসারে কেউ তাঁর আপন হতে পারে না। এই বলিয়া দু'চোখে আঁচল চাপিয়া সে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল ।

সেদিন কাজকর্ম চুকিল অনেক রাত্রে। এ গৃহের সুশৃঙ্খলিত ধারায় কোথাও কোন ব্যাঘাত ঘটিল না। বাহির হইতে কেহ জানিতেও পারিল না সেই শৃঙ্খলের সবচেয়ে বড় গ্রন্থিই আজ চূর্ণ হইয়া গেল। প্রভাত হইতে অধিক বিলম্ব নাই, কর্মক্লান্ত বৃহৎ ভবন একান্ত নীরব,— যে যেখানে স্থান পাইয়াছে নিদ্রামগ্ন,—ভাঁড়ারের গুরু দায়িত্ব সমাপন করিয়া বন্দনা শ্রান্তপদে নিজের ঘরে যাইতেছিল, চোখে পড়িল ওদিকের বারান্দার পাশে ছিজদাসের ঘরে আলো জ্বলিতেছে। দ্বিধা জাগিল এমন সময়ে যাওয়া উচিত কিনা, কাহারো চোখে পড়িলে সুবিচার সে করিবে না, নিন্দা হয়ত শতমুখে বিস্তারলাভ করিবে, কিন্তু থামিতে পারিল না, যে উদ্বেগ তাহাকে সারাদিন চঞ্চল ও অশান্ত করিয়া রাখিয়াছে সে তাহাকে ঠেলিয়া লইয়া গেল। রুদ্ধদ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া ডাকিল, দ্বিজুবাবু এখনো জেগে আছেন?

ভিতর হইতে সাড়া আসিল, আছি। কিন্তু এমন সময়ে আপনি যে ?

আসতে পারি?

স্বচ্ছন্দে।

বন্দনা দ্বার ঠেরিয়া ভিতরে ঢুকিয়া দেখিল রাশীকৃত কাগজপত্র লইয়া দ্বিজদাস বিছানায় বসিয়া। জিজ্ঞাসা করিল, আজকের হিসেব বুঝি। কিন্তু হিসেব ত পালাবে না দ্বিজুবাবু, এত রাত জাগলে শরীর খারাপ হবে যে।

দ্বিজদাস বলিল, হলে বাঁচতুম, এগুলো চোখে দেখতে হতো না। খরচ অনেক হয়ে গেছে বুঝি? দাদার কাছে গুরুতর কৈফিয়ত দিতে হবে?

দ্বিজদাস কাগজগুলা একধারে ঠেলিয়া দিয়া সোজা হইয়া বসিল, বলিল, চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি চ। শ্রীগুরুর কৃপায় সেদিন আর এখন আমার নেই বন্দনা দেবী, যে দাদার কাছে কৈফিয়ত দেবো। এখন উলটে কৈফিয়ত চাইবো আমি। বলবো, লাও শিগগির হিসেব জলদি লাও রূপেয়া — কোথায় কি করেছো বলো।

বন্দনা অবাক হইয়া বলিল, ব্যাপার কি?

দ্বিজদাস মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত মাথার উপরে তুলিয়া কহিল, ব্যাপার অতীব ভীষণ। মা দয়াময়ী আমাকে দয়া করুন, ভগ্নীপতি শশধর আমার সহায় হোন— সাবধান বিপ্রদাস! তোমাকে এবার আমি ধনেপ্রাণে বধ করবো। আমাদের হাতে আর তোমার নিস্তার নেই।

বন্দনার চিন্তা উদ্দাম হইয়া উঠিল, তবু সে না হাসিয়া পারিল না, বলিল, সব তাতেই হাসি-তামাশা? আপনি কি একমুহূর্ত সিরিয়াস হতে জানেন না দ্বিজুবাবু? দ্বিজদাস বলিল, জানিনে। তবে আনো শশধরকে, আনো না, তারা থাক। দেখবে, হাসি-তামাশা পালাবে চক্ষের নিমেষে সাহারায়, গাম্ভীর্যে মুখমণ্ডল হয়ে উঠবে বুনো ওলের মত ভয়াবহ। পরীক্ষা করুন।

বন্দনা চৌকি টানিয়া লইয়া বসিল, কহিল, আপনি তা হলে শুনেছেন সব?

সব নয়, যৎকিঞ্চিৎ সব জানেন দাদা, কিন্তু সে গহন অরণ্য। আর জানে শশধর। সে বলবে বটে, কিন্তু সমস্ত মিথ্যে করে বানিয়ে বলবে।

বন্দনা ব্যাকুল-কণ্ঠে বলিল, যা জানেন আমাকে বলতে পারেন না দ্বিজুবাবু? আমি সত্যি বড় ভয় পেয়েছি।

দ্বিজদাস কহিল, ভয় পাওয়া বৃথা। দাদার সঙ্কল্প টলবে না, তাঁকে আমরা হারালুম।

দীপালোকে দেখা গেল এইবার অশ্রুজলে দু'চক্ষু তাহার টলটল করিতেছে, ঘাড় ফিরাইয়া কোনমতে মুছিয়া ফেলিয়া আবার সে সোজা হইয়া বসিল।

বন্দনা গাঢ়স্বরে কহিল, বিচ্ছেদ এত সহজেই আসবে দ্বিজুবাবু, সত্যিই ঠেকান যাবে না?

দ্বিজদাস মাথা নাড়িয়া বলিল, না। ও-বস্তু যখন আসে তখন এমনি অবাধে, এমনি দ্রুতই আসে, বারণ কিছুতে মানে না। যার কাঁদবার সে কাঁদে, কিন্তু শেষ ঐখানে। ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিল, আপনি জানতে চাইছিলেন হেতু। বিস্তারিত জানিনে, কিন্তু যতটুকু জানি সে শুধু আপনাকেই বলবো, আর সাহায্য যদি কখনো চাইতে হয়, যেখানেই থাকুন সে কেবল আপনার কাছেই চাইব।

কেবল আমার কাছেই কেন?

তার কারণ হাত যদি পাততেই হয় মহতের দ্বারে পাতাই শাস্ত্রের বিধান ।

কিন্তু মহৎ কি আর কেউ নেই?

হয়ত আছে, কিন্তু ঠিকানা জানিনে। দাদার কথা ভুলবো না, কিন্তু চিরদিন হাত পাতার অভ্যাস ছিল বৌদিদির কাছে, কিন্তু সে পথ বন্ধ হলো। আপনি তাঁর বোন, আমার দাবী তার থেকে।

কিন্তু মা?

দ্বিজদাস বলিল, রথ যখন দ্রুত চলে মা তার অসাধারণ সারথি, কিন্তু ঢাকা যখন কাদায় বসে মা তখন নিরুপায়। নেমে এসে ঠেলতে তিনি পারেন না। সে দুর্দিনে যাব আপনার কাছে। দেবেন না ভিক্ষে? 

ভিক্ষের বিষয় না জেনে বলবো কি করে দ্বিজুবাবু?

সে নিজেও জানিনে বন্দনা, সহজে চাইতেও যাব না। যখন কোথাও মিলবে না, যার শুধু তখনি।

বন্দনা বহুক্ষণ অধোমুখে থাকিয়া মুখ তুলিয়া কহিল, যা জানতে চেয়েছিলুম বলবেন না?

দ্বিজদাস বলিল, সমস্ত জানিনে, যা জানি তাও হয়ত অভ্রান্ত নয়। কিন্তু একটা বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই যে দাদা আজ সর্বস্বান্ত সমস্ত গেছে।

বন্দনা চমকিয়া উঠিল—মুখুয্যেমশাই সর্বস্বান্ত। কি করে এমন হলো দ্বিজুবাবু?

দ্বিজদাস বলিল, খুব সহজেই এবং সে ঐ শশধরের ষড়যন্ত্রে। সাহা চৌধুরী কোম্পানি হঠাৎ যেদিন দেউলে হলো দাদারও সর্বস্ব ডুবল সেই গহ্বরে। অথচ, এ শুধু বাইরের ঘটনা,—যেটুকু চোখে দেখতে পাওয়া গেল। ভিতরে গোপন রইলো অন্য ইতিহাস।

বন্দনা ব্যাকুল হইয়া কহিল, ইতিহাস থাক বিজুবাবু, শুধু ঘটনার কথাই বলুন। বলুন সর্বঙ্গ যাওয়া সত্যি কিনা।

হ্যাঁ, সত্যি। ওখানে কোন ভুল নেই ।

কিন্তু মেজদি? বাসু? তাদেরও কিছু রইলো না নাকি?

না। রইলো শুধু বৌদির বাপের বাড়ির আয়। সামান্য ঐ ক'টা টাকা।

কিন্তু সে ত মুখুয্যেমশাই ছোঁবেন না দ্বিজুবাবু।

না। তার চেয়ে উপোসের ওপর দাদার বেশী ভরসা। যে ক'টা দিন চলে।

উভয়েই নির্বাক হইয়া রহিল। মিনিট কয়েক পরে বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু আপনি? আপনার নিজের কি হলো?

দ্বিজদাস বলিল, পরম নির্ভয়ে ও নিরাপদে আছি। দাদা আপনি ডুবলেন কিন্তু আমাকে রাখলেন ভাসিয়ে। জলকণাটি পর্যন্ত লাগতে দিলেন না গায়ে। বলবেন, এ অসম্ভব সম্ভব হলো কি করে? হলো মায়ের সুবুদ্ধি, দাদার সাধুতা এবং আমার নিজের শুভ গ্রহের কল্যাণে। গল্পটা বলি শুনুন। এই শশধর ছিল দাদার বাল্যবন্ধু, সহপাঠী। দু'জনের ভালোবাসার অন্ত নেই। বড় হয়ে দাদা এর সঙ্গে দিলেন কল্যাণীর বিয়ে। এই ঘটকালিই দাদার জীবনের অক্ষয় কীর্তি। শোনা গেল, শশধরের বাপের মস্ত জমিদারি, বিপুল অর্থ ও বিরাট কারবার। অতবড় বিত্তশালী ব্যক্তি পাবনা অঞ্চলে কেউ নেই। বছর চারেক গেল, হঠাৎ একদিন শশধর এসে জানালে জমিদারি, ঐশ্বর্য, কারবার অতলে তলাতে আর বিলম্ব নেই, রক্ষা করতে হবে। মা বললেন, রক্ষা করাই উচিত, কিন্তু দ্বি আমার নাবালক, তার টাকায় ত হাত দিতে পারা যাবে না বাবা। সে বললে, বছর ঘুরবে না মা, শোধ হয়ে যাবে। মা বললেন, আশীর্বাদ করি তাই যেন হয়, কিন্তু নাবালকের সম্পত্তি, কর্তার একান্ত নিষেধ ।

কল্যাণী কেঁদে এসে দাদার পায়ে গিয়ে পড়লো। বললে, দাদা বিয়ে দিয়েছিলে তুমিই, আজ ছেলেমেয়ে নিয়ে ভিক্ষে করে বেড়াবো দেখবে তুমি চোখে? মা পারেন, কিন্তু তুমি যেখানে ওঁর ধর্ম, যেখানে ওঁর বিবেক ও বৈরাগ্য, যেখানে উনি আমাদের সকলের বড়, কল্যাণী সেইখানে দিলে আঘাত। দাদা অভয় দিয়ে বললেন, তুই বাড়ি যা বোন, যা করতে পারি আমি করবো। সেই অভয়-মন্ত্র জপতে জপতে কল্যাণী বাড়ি ফিরে গেল। তার পরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত বন্দনা। কিন্তু চেয়ে দেখুন ভোর হয়েছে, এই বলিয়া খোলা জানালার দিকে সে তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল । বন্দনা [উঠিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু ঐ কাগজগুলো আপনার কি? 

দ্বিজদাস বলিল, আমার নির্ভয়ে থাকার দলিল। আসবার সময়ে দাদা সঙ্গে এনেছিলেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি আপনিও কি আমাদের আজই ফেলে চলে যাবেন?

ঠিক জানিনে দ্বিজুবাবু। কিন্তু আর সময় নেই আমি চললুম। আবার দেখা হবে। এই বলিয়া সে ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল ।

26
Articles
বিপ্রদাস
0.0
"বিপ্রদাস" প্রখ্যাত লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি বাংলা উপন্যাস। গল্পটি কেন্দ্রীয় চরিত্র বিপ্রদাসকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে, একটি ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় পরিবারের একজন সংবেদনশীল এবং অন্তর্মুখী যুবক। তিনি রক্ষণশীল মূল্যবোধ এবং সামাজিক নিয়ম দ্বারা চিহ্নিত একটি সমাজে তার স্থান খুঁজে পেতে সংগ্রাম করেন। বিপ্রদাস প্রেম, কর্তব্য এবং ব্যক্তিগত আকাঙ্খার নেভিগেট করার সময় অসংখ্য চ্যালেঞ্জ এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হন। উপন্যাসটি সামাজিক প্রত্যাশা, পারিবারিক চাপ এবং ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার বিষয়বস্তু অন্বেষণ করে। শরৎচন্দ্র দক্ষতার সাথে বিপ্রদাসের মানসিক অশান্তিকে চিত্রিত করেছেন, এটিকে আত্ম-আবিষ্কার এবং সামাজিক সীমাবদ্ধতার একটি মর্মস্পর্শী গল্পে পরিণত করেছেন। "বিপ্রদাস" একটি আকর্ষক আখ্যান যা মানব সম্পর্কের জটিলতা এবং ব্যক্তিগত আকাঙ্খা এবং সামাজিক সামঞ্জস্যের মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে।
1

এক

31 October 2023
0
0
0

বলরামপুর গ্রামের রথতলায় চাষাভুষাদের একটা বৈঠক হইয়া গেল। নিকটবর্তী রেলওয়ে লাইনের কুলি গ্যাং রবিবারের ছুটির ফাঁকে যোগদান করিয়া সভার মর্যাদা বৃদ্ধি করিল এবং কলিকাতা হইতে জনকয়েক নামকরা বক্তা আসিয়া আ

2

দুই

31 October 2023
0
0
0

বিপ্রদান নিজের বসিবার ঘরে ছোটভাইকে ডাকাইয়া আনিয়া বলিলেন, কালকের আয়োজনটা মন্দ হয়নি। অনেকটা চমক লাগাবার মত। War cry-গুলোও বেশ বাছা বাছা, ঝাঁজ আছে তা মানতেই হবে। দ্বিজদাস চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

3

তিন

31 October 2023
0
0
0

এ বাড়িতে দ্বিজদাস সবচেয়ে বেশী খাতির করিত বৌদিদিকে। তাহার সর্ববিধ বাজে খরচের টাকাও আসিত তাঁহারই বাক্স হইতে। সতী শুধু সম্পর্ক হিসাবেই তাহার বড় ছিল না, বয়সের হিসাবেও মাস কয়েকের বড় ছিল। তাই অধিকাংশ

4

চার

31 October 2023
0
0
0

নিখুঁত সাহেবী-পরিচ্ছদে ভূষিত একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক চেয়ারে বসিয়াছিলেন এবং একটি কুড়ি-একুশ বছরের মেয়ে তাঁহারই পাশে দাঁড়াইয়া দেয়ালে টাঙানো মস্ত একখানি জগদ্ধাত্রী দেবীর ছবি অত্যন্ত মনোযোগের সহিত নিরীক

5

পাঁচ

31 October 2023
0
0
0

বন্দনা স্নানাদি সারিয়া বসিবার ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, পিতা ইতিপূর্বেই প্রস্তুত হইয়া লইয়াছেন। একখানা জমকালোগোছের আরামকেদারায় বসিয়া চোখে চশমা দিয়া সংবাদপত্রে মনোনিবেশ করিয়াছেন। পাশের ছোট্ট টেবিল

6

ছয়

31 October 2023
0
0
0

বন্দনা নীচে আসিয়া দেখিল পিতা হৃষ্টচিত্তে আহারে বসিয়াছেন। সেই বসিবার ঘরের মধ্যেই একখানি ছোট টেবিলের উপর রূপার থালায় করিয়া খাবার দেওয়া হইয়াছে। একজন দীর্ঘাকৃতি অতিশয় সুশ্রী ব্যক্তি অদূরে দাঁড়াইয়

7

সাত

31 October 2023
0
0
0

স্টেশনে পৌঁছিয়া খবর পাওয়া গেল, কোথায় কি একটা আকস্মিক দুর্ঘটনার জন্য ট্রেনের আজ বহু বিলম্ব, – বোধ করি বা একঘণ্টারও বেশী লেট হইবে। - পরিচিত স্টেশনমাস্টারটিও হঠাৎ পীড়িত হওয়ায় একজন মাদ্রাজী রিলিভিং

8

আট

1 November 2023
1
0
0

গণ্ডগোল শুনিয়া পাশের কামরার সহযাত্রী সাহেবরা প্লাটফর্মে নামিয়া দাঁড়াইল, এবং রুক্ষকণ্ঠে সমস্বরে প্রশ্ন করিল, what's up? ভাবটা এই যে, সঙ্গীদের হইয়া তাহারা বিক্রম দেখাইতে প্রস্তুত। বিপ্রদাস অদূরবর্তী

9

নয়

1 November 2023
0
0
0

বন্দনা সকালে উঠিয়া দেখিল এই বাড়িটার সম্বন্ধে সে যাহা ভাবিয়াছিল তাহা নয়। মনে করিয়াছিল পুরুষমানুষের বাসাবাড়ি, হয়ত ঘরের কোণে কোণে জঞ্জাল, সিঁড়ির গায়ে থুথু, পানের পিচের দাগ, ভাঙ্গাচোরা আসবাবপত্র,

10

দশ

1 November 2023
0
0
0

বিপ্রদাস আসনে বসিয়া পুনরায় সেই প্রশ্নই করিল, সত্যিই আবার স্নান করে এলে নাকি? অসুখ করবে যে তা করুক। কিন্তু হাতে না-খাবার ছলছুতা আবিষ্কার করতে আপনাকে দেব না এই আমার পণ। স্পষ্ট করে বলতে হবে, তোমার ছোঁয

11

এগার

1 November 2023
0
0
0

রাত্রের গাড়িতে আসিতেছে মেজদি এবং সঙ্গে আসিতেছে দ্বিজদাস। বন্দনার আনন্দ ধরে না। সেদিন দিদির শ্বশুরবাড়িতে নিজের আচরণের জন্য সে মনে মনে বড় লজ্জিত ছিল, অথচ প্রতিকারের উপায় পাইতেছিল না। আজ অত্যন্ত অনিচ

12

বার

1 November 2023
0
0
0

কৈলাস তীর্থযাত্রায় পথের দুর্গমতার বিবরণ শুনিয়া মামীরা পিছাইয়াছেন, দয়াময়ীর নিজেরও বিশেষ উৎসাহ দেখা যায় না, তথাপি তাঁহার কলিকাতায় কাটিল পাঁচ-ছয়দিন দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট ও গঙ্গাস্নান করিয়া। কাজের

13

তের

1 November 2023
0
0
0

সন্ধ্যা-বন্দনা সারিয়া বিপ্রদাস সেইমাত্র নিজের লাইব্রেরিঘরে আসিয়া বসিয়াছে; সকালের ডাকে যে-সকল দলিলপত্র বাড়ি হইতে আসিয়াছে সেগুলা দেখা প্রয়োজন, এমনি সময়ে মা আসিয়া প্রবেশ করিলেন, হাঁ রে বিপিন, তুই

14

চৌদ্দ

1 November 2023
0
0
0

সন্ধ্যা উত্তীর্ণপ্রায়, বন্দনা আসিয়া দ্বিজদাসের ঘরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া ডাকিল, একবার আসতে পারি দ্বিজবাবু? ভিতর হইতে সাড়া আসিল, পার। একবার নয়, শত সহস্র অসংখ্য বার পার। বন্দনা দরজার পাল্লা দুটা শেষপ

15

পনর

1 November 2023
0
0
0

নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিয়া বন্দনার অত্যন্ত গ্লানি বোধ হইতে লাগিল। সে কি নেশা করিয়াছে যে, নির্লজ্জ উপযাচিকার ন্যায় আপন হৃদয় উদ্ঘাটিত করিয়া সমস্ত আত্মমর্যাদার জলাঞ্জলি দিয়া আসিল। অথচ দ্বিজদাস পুরুষ হ

16

ষোল

2 November 2023
1
0
0

দয়াময়ীর আচরণে বন্দনার প্রতি যে প্রচ্ছন্ন লাঞ্ছনা ও অব্যক্ত গঞ্জনা ছিল সতীকে তাহা গভীরভাবে বিধিয়াছিল। কিন্তু শাশুড়ীকে কিছু বলা সহজ নয়, তাই সে একখানি চিঠি লিখিয়া বোনের হাতে দিবার জন্য স্বামীকে ঘরে

17

সতর

2 November 2023
0
0
0

হঠাৎ বড়মাসীর সঙ্গে হাওড়া স্টেশনে বন্দনার যখন দেখা হইয়া গেল তখন বোম্বাই যাওয়া বন্ধ করিয়া তাহাকে বাড়ি ফিরাইয়া আনা মাসীর কষ্টসাধ্য হইল না। তিনি মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে স্বামীর কর্মস্থল উত্তর-পশ্চিমাঞ

18

আঠার

2 November 2023
0
0
0

বন্দনা বলিল, খাবার হয়ে গেছে নিয়ে আসি?বন্দনা বলিল, খাবার হয়ে গেছে নিয়ে আসি? বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, তোমার কেবলি চেষ্টা হচ্চে আমার জাত মারার। কিন্তু সন্ধ্যে আহ্নিক এখনো করিনি, আগে তার উদ্যোগ করিয়া

19

উনিশ

2 November 2023
0
0
0

পরদিন বিকালের দিকে বন্দনা আসিয়া বলিল, মুখুয্যেমশাই, আবার চললুম মাসীমার বাড়িতে। এবার আর ঘণ্টা-কয়েকের জন্যে নয়, এবার যতদিন না মাসী আমাকে বোম্বায়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারেন ততদিন। অর্থাৎ? অর্থাৎ

20

কুড়ি

2 November 2023
0
0
0

দ্বিজদাস জিজ্ঞাসা করিল, বন্দনা হঠাৎ চলে গেলেন কেন? আমার এসে পড়াটাই কি কারণ নাকি? বিপ্রদাস বলিল, না ওঁর বাবা টেলিগ্রাম করেছেন মাসীর বাড়িতে গিয়ে থাকতে যতদিন না বোহায়ে ফিরে যাওয়া ঘটে। কিন্তু হঠাৎ ম

21

একুশ

2 November 2023
0
0
0

অনেকদিনের পরে বিপ্রদাস নীচের আফিসঘরে আসিয়া বসিয়াছে। সম্মুখে টেবিলের পরে কাগজপত্রের স্তূপ কতদিনের কত কাজ বাকী। দেহ ক্লান্ত, কিন্তু দ্বিজুর ভরসায় ফেলিয়া রাখাও আর চলে না। একটা খেরো-বাঁধানো মোটা থাতা

22

বাইশ

2 November 2023
0
0
0

পরদিন সকালেই সকলে বলরামপুরের উদ্দেশে যাত্রা করিল। বাটীর কাছাকাছি আসিতে দেখা গেল দ্বিজদাস প্রায় রাজসূয় যজ্ঞের ব্যাপার করিয়াছে। সম্মুখের মাঠে সারি সারি চালাঘর — কতক তৈরি হইয়াছে— কতক হইতেছে— ইতিমধ্যে

23

তেইশ

3 November 2023
0
0
0

সংসারে বিপদ যে কোথায় থাকে এবং কোন পথে কখন যে আত্মপ্রকাশ করে ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। কাজের মাঝখানে কল্যাণী আসিয়া কাঁদিয়া বলিল, মা. উনি বলছেন ওঁর সঙ্গে আমাকে এখুনি বাড়ি চলে যেতে। ট্রেনের সময় নেই—

24

চব্বিশ

3 November 2023
0
0
0

মেজদিদিকে জোর করিয়া একটা চেয়ারে বসাইয়া বন্দনা তাহার পায়ে আলতা পরাইয়া দিতেছিল। এই মঙ্গলাচারটুকু অন্নদা তাহাকে শিখাইয়া দিয়া নিজে আত্মগোপন করিয়াছে। তাহার চোখ রাঙ্গা, অবিরত অশ্রুবর্ষণে চোখের পাতা

25

পঁচিশ

3 November 2023
0
0
0

বন্দনার নির্বিঘ্নে বোম্বাই পৌঁছান-সংবাদের উত্তরে দিনকয়েক পরে দ্বিজদাসের নিকট হইতে জবাব আসিয়াছিল যে, সে নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় যথাসময়ে চিঠি লিখিতে পারে নাই। বন্দনা নিজের চোখে যেমন দেখিয়া গেছে সমস্

26

ছাব্বিশ

3 November 2023
0
0
0

ম্যানেজার বিরাজ দত্ত মোটর লইয়া স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন। বন্দনাকে সসম্মানে ট্রেন হইতে নামাইয়া গাড়িতে আনিয়া বসাইলেন । বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, মা আজও বাড়ি এসে পৌঁছল নি দত্তমশাই? না দিদি। মৈত্রেয়ী?

---