shabd-logo

আঠার

2 November 2023

1 Viewed 1

বন্দনা বলিল, খাবার হয়ে গেছে নিয়ে আসি?বন্দনা বলিল, খাবার হয়ে গেছে নিয়ে আসি?

বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, তোমার কেবলি চেষ্টা হচ্চে আমার জাত মারার। কিন্তু সন্ধ্যে আহ্নিক এখনো করিনি, আগে তার উদ্যোগ করিয়া দাও।

আমি নিজে করে দেবো মুখুয্যেমশাই?

নইলে কে আর আছে এখানে যে করে দেবে? কিন্তু মার পুজোর ঘরে যেতে পারবো না গায়ে জোর নেই, এই ঘরে করে দিতে হবে। আগে দেখবো কেমন আয়োজন করো, খুঁত ধরবার কিছু থাকে কিনা, তখন বুঝে দেখবো খাবার তুমি আনবে, না আমাদের বামুনঠাকুর আনবে। শুনিয়া বন্দনা পুলকে ভরিয়া গেল, বলিল, আমি এই শর্তেই রাজী। কিন্তু একজামিনে পাস যদি হই তখন কিন্তু মিথ্যে ছলনায় ফেল করাতে পারবেন না। কথা দিন।

দিলুম কথা। কিন্তু আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে কি তোমার এত লাভ? তা আমি বলবো না, এই বলিয়া বন্দনা দ্রুত প্রস্থান করিল ।

মিনিট দশেকের মধ্যে সে স্নান করিয়া প্রস্তুত হইয়া একটি জলপূর্ণ ঘটি লইয়া প্রবেশ করিল। ঘরের যে দিকটায় খোলা জানালা দিয়া পুরের রোদ আসিয়া পড়িয়াছে সেই স্থানটি জল দিয়া ভাল করিয়া মার্জনা করিয়া নিজের আঁচল দিয়া মুছিয়া লইল, পূজার ঘর হইতে আসন কোশাকুশি প্রভৃতি আনিয়া সাজাইল, ধূপদানি আনিয়া ধূপ জ্বালাইল, তারপরে বিপ্রদাসের ধুতি গামছা এবং হাত-মুখ ধোবার পাত্র আনিয়া কাছে রাখিয়া দিয়া বলিল, আজ সময় নেই ফুল তুলে এনে মালা গেঁথে দেবার, নইলে দিতুম, কাল এ ত্রুটি হবে না। কিন্তু আধ-ঘণ্টা সময় দিলুম, এর বেশি নয়। এখন বেজেছে ন'টা — ঠিক সাড়ে নটায় আবার আসবো। এর মধ্যে আপনাকে কেউ বিরক্ত করবে না, আমি চললুম। এই বলিয়া সে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়া প্রস্থান করিল। বিপ্রদাস কোন কথা না বলিয়া শুধু চাহিয়া রহিল। আধ-ঘণ্টা পরে বন্দনা যখন ফিরিয়া আসিল তখন সন্ধ্যাবন্দনা সমাপ্ত করিয়া বিপ্রদাস একটা আরামচৌকিতে হেলান দিয়া বসিয়াছে।

পাস না ফেল মুখুয্যেমশাই?

পাস ফার্স্ট ডিভিসনে। আমার মাকেও হার মানিয়েছ। কার সাধ্য বলে তোমাকে ম্লেচ্ছ, ম্লেচ্ছদের ইস্কুল-কলেজে পড়ে বি. এ. পাস করেচ।

এবার তা হলে খাবার আনি?

আনো। কিন্তু তার আগে এগুলো রেখে এসো গে, বলিয়া বিপ্রদাস কোশাকুশি প্রভৃতি দেখাইয়া দিল । এ আর আমাকে বলে দিতে হবে না মশাই জানি, বলিয়া পূজার পাত্রগুলি সে হাতে তুলিয়া লইয়াছে এমন সময়ে ঘরের বাহিরে বারান্দায় অনেকগুলি উঁচুগোড়ালি জুতার খুট খুট শব্দ একসঙ্গে কানে আসিয়া পৌঁছিল, এবং পরক্ষণে অন্নদা দ্বারের কাছে মুখ বাড়াইয়া বলিল, বন্দনাদিদি, তোমার মাসীমা- মাসী এবং আরও দুই-তিনটি অল্পবয়সী মেয়ে একেবারে ভিতরে আসিয়া পড়িলেন, বিপ্রদাস দাঁড়াইয়া উঠিয়া অভ্যর্থনা করিল, আসুন।

মাসী বলিলেন, নীচে থেকেই খবর পেলুম বিপ্রদাসবাবু ভালো আছেন—

বিপ্রদাস কহিল, হাঁ, আমি ভাল আছি। আগন্তুক মেয়েরা বন্দনাকে দেখিয়া যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হইল, পায়ে জুতা নাই, গায়ে জামা নাই, ভিজা চুলে গরদের শাড়ী ভিজিয়াছে; এলো কালো চুলের রাশি পিঠের পরে ছড়ানো, দুই হাতে পুজোর জিনিসপত্র, তাহার এ মূর্তি তাহাদের শুধু অদৃষ্টপূর্ব অপরিচিত নয়, অভাবনীয়। বন্দনা বলিল, আপনারা দোর ছেড়ে একটু সরে দাঁড়ান, এগুলি রেখে আসি গে।

একটি মেয়ে বলিল, ছোঁয়া যাবে বুঝি?

হাঁ, বলিয়া বন্দনা চলিয়া গেল ।

ক্ষণেক পরে সে সেই বেশেই ফিরিয়া আসিয়া বিপ্রদাসের চেয়ারের ধার ঘেঁষিয়া দাঁড়াইল। মাসী বলিলেন, আমাদের না জানিয়ে তুমি চলে এলে সেজন্যে রাগ করিনে, কিন্তু আজ তোমার বোনের বিয়ে— তোমাকে যেতে হবে।

মেয়ে দুটি বলিল, আমরা আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছি।

বন্দনা বলিল, না মাসীমা, আমার যাওয়া হবে না।

সে কি কথা বন্দনা। না গেলে প্রকৃতি কত দুঃখ করবে জানো?

জানি, তবু আমি যেতে পারবো না।

শুনিয়া মাসী বিস্ময় ও ক্ষোভে অধীর হইয়া বলিলেন, কিন্তু এই জন্যেই তোমার বোম্বায়ে যাওয়া হল না, — এই জন্যেই তোমার বাবা আমার কাছে তোমাকে রেখে গেলেন। তিনি শুনলে কি বলবেন বলো ত সেই মেয়েটি বলিল, তা ছাড়া সুধীরবাবু — মিস্টার ডাটা — ভারী রাগ করেছেন। আপনার চলে আসাটা তিনি মোটে পছন্দ করেন নি ।

বন্দনা তাহার দিকে চাহিল, কিন্তু জবাব দিল মাসীকে, বলিল, আমি না গেলে প্রকৃতির বিয়ে আটকাবে না, কিন্তু গেলে মুখুয্যেমশায়ের সেবার ত্রুটি হবে। এঁকে দেখবার এখানে কেউ নেই ।

কিন্তু উনি ত ভাল হয়ে গেছেন। তোমাকে যেতে বলা ওঁর উচিত। এই বলিয়া মাসী বিপ্রদাসের দিকে চাহিলেন। বিপ্রদাস হাসিয়া কহিল, ঠিক কথা। আমার যেতে বলাও উচিত, বন্দনার যাওয়াও উচিত। বরঞ্চ না গেলেই অন্যায় হবে।

বন্দনা মাথা নাড়িয়া কহিল, না অন্যায় হবে আমি মনে করিনে। বেশ আপনি বলচেন যেতে, আমি যাবো। কিন্তু রাত্রেই চলে আসবো, সেখানে থাকতে পারবো না। এ অনুমতি মাসীমাকে দিতে হবে।

একটা রাতও থাকতে পারবে না?

না।

আচ্ছা তাই হবে, বলিয়া মাসী মনে মনে রাগ করিয়া দলবল লইয়া প্রস্থান করিলেন।

বিপ্রদাস বলিল, দেখলে ত তোমার মাসীমা রাগ করে চলে গেলেন কিন্তু হঠাৎ এ খেয়াল হলো কেন?

বন্দনা বলিল, রাগ করে গেলেন জানি, কিন্তু শুধু খেয়ালের বশেই যেতে চাইচি নে তা নয়। ওদে যা-কিছু সমস্তর উপরে আমার বিতৃষ্ণা ধরে গেছে। তাই ওখানে আর যেতে চাইনে মুখুয্যেমশাই । এটা একটু বাড়াবাড়ি বন্দনা।

সত্যিই বাড়াবাড়ি কিনা বলা শক্ত। আমি সর্বদাই নিজেকে নিজে জিজ্ঞাসা করি, অথচ, বেশ বুঝতে পারি ওদের মধ্যে গিয়ে আমার না থাকে সুখ, না থাকে স্বস্তি একবার বোম্বায়ের একটা কাপড়ের কালের কারখানা দেখতে গিয়েছিলুম, কেবলি আমার সেই কথা মনে হতে থাকে, তার কত কল কত ঢাকা আশেপাশে সামনে পিছনে অবিশ্রাম ঘুরচে—একটু অসাবধান হলেই যেন ঘাড়-মুড় গুঁজড়ে তার মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলবে। ও-সব দেখতে যে ভাল লাগে না তা নয়, তবু মনে হয় বেরুণতে পারলে বাঁচি । কিন্তু আর দেরি করবো না, আপনার খাবার আনি গে, বলিয়া বাহির হইতে গিয়াই চোখ পড়িল দ্বারের সম্মুখে পায়ের ধূলা, জুতোর দাগ; থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, খাবার আনা হল না মুখুয্যেমশাই, একটু সবুর করতে হবে। চাকর দিয়ে এগুলো আগে ধুইয়ে ফেলি, এই বলিয়া সে ঘর হইতে বাহির হইতেছিল, বিপ্রদাস সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, এত খুঁটিনাটি তুমি শিখলে কার কাছে বন্দনা?

শুনিয়া বন্দনা নিজেও আশ্চর্য হইল, বলিল, কে শেখালে আমার মনে নেই মুখুয্যেমশাই, বলিয়া একটু চুপ করিয়া রহিল, বোধ হয় কেউ শেখায় নি। আমার

আপনিই মনে হচ্চে, আপনাকে সেবা করার এ-সব অপরিহার্য অঙ্গ, না করলেই ত্রুটি হবে। এই বলিয়া সে চলিয়া গেল ।

বিকালের দিকে অভ্যন্ত এবং যথোচিত সাজসজ্জা করিয়া বন্দনা বিপ্রদাসের ঘরের খোলা দরজার সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিল, মুখুয্যেমশাই, চললুম বোনের বিয়ে

দেখতে। মাসী ছাড়লেন না বলেই যেতে হচ্চে। বিপ্রদাস কহিল, আশীর্বাদ করি তুমিও যেন শীঘ্র এই অত্যাচারের শোধ নিতে পারো। তখন ঐ মাসীকে পঞ্জাব থেকে হিঁচড়ে বোম্বায়ে টেনে নিয়ে যেও। 

মাসীর ওপর রাগ নেই, কিন্তু আপনাকে হিচড়ে টেনে নিয়ে যাবো। ভয় নেই গাড়িভাড়া আমরাই দেবো, আপনার নিজের লাগবে না। এই বলিয়া বন্দনা

হাসিয়া কহিল, ফিরতে আমার রাত হবে. কিন্তু সমস্ত ব্যবস্থা করে গেলুম, অন্যথা হলে এসে রাগ করবো।

করবে বৈ কি! না করলেই সকলে আশ্চর্য হবে। ভাববে, শরীর ভালো নেই, বিয়েবাড়িতে খেয়ে বোধ হয় অসুখ করেছে। বন্দনা হাসিমুখে মাথা নাড়িয়া বলিল, হয়েছে আমার গুণ-ব্যাখ্যা করা: কিন্তু সে কথা যাক, আপনি সন্ধ্যে-আহ্নিক করতে নীচে যাবেন না যেন। অনুদি এই ঘরেই সব এনে দেবে। তার আধ-ঘণ্টা পরেই ঠাকুর দিয়ে যাবে খাবার, এক ঘণ্টা পরে বড় ওষুধ দিয়ে আলো নিবিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে চলে যাবে। এই হুকুম সকলকে দিয়ে গেলুম। বুঝলেন?

হাঁ বুঝেছি।

তবে চললুম।

যাও। কিন্তু চমৎকার মানিয়েছে তোমাকে বন্দনা, এ কথা স্বীকার করবোই। কারণ, যে পোশাকটা পরেছো এইটেই হ'লো তোমার স্বাভাবিক, যেটা এখানে পরে থাকো সেটা কৃত্রিম।

সে কি কথা মুখুয্যেমশাই, ওরা বলে মেয়েদের জুতো পরা আপনি দেখতে পারেন না।

ওরা ভুল বলে, যেমন বলে তোমার হাতে আমি খেতে পারিনে।

বন্দনা বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিল, ভুল হবে কেন মুখুয্যেমশাই, আমার হাতে খেতে সত্যিই ত আপনার আপত্তি ছিল।

বিপ্রদাস বলিল, আপত্তি ছিল, কিন্তু আপত্তিটা সত্যিকারের হলে সে আজও থাকতো যেতো না। কথাটা বন্দনা বুঝিল না, কিন্তু বিপ্রদাসের উক্তি অসত্য বলিয়া মনে করাও কঠিন, বলিল, দ্বিজুবাবু একদিন বলেছিলেন দাদার মনের কথা কেউ জানতে পারে না, যেটা শুধু বাইরের তাই কেবল লোকে টের পায়; কিন্তু যা অন্তরের তা অন্তরেই চাপা থাকে, মুখুয্যেমশাই এ কি সত্যি?

উত্তরে বিপ্রদাস শুধু একটু হাসিল, তারপরে বলিল, বন্দনা, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। যদি সত্যিই থাকতে সেখানে ইচ্ছা না হয় থেকো না — চলে এসো। চলেই আসবো মুখুয্যেমশাই, থাকতে সেখানে পারবো না। এই বলিয়া বন্দনা আর বিলম্ব না করিয়া নীচে নামিয়া গেল।

পরদিন সকালে দেখা হইলে বিপ্রদাস বিজ্ঞাসা করিল, বোনের বিয়ে নির্বিঘ্নে সমাধা হলো ।

হাঁ হলো— বিঘ্ন কিছু ঘটেনি।

নিজের জিদই বজায় রইলো, মাসীর অনুরোধ রাখলে না? কত রাত্রে ফিরলে?

রাত্রি তখন তিনটে। মাসীর কথা রাখা চলল না, রাত্রেই ফিরতে হলো। একটুখানি থামিয়া বোধ হয় বন্দনা ভাবিয়া লইল বলা উচিত কিনা, তার পরেই সে বলিতে লাগিল, মাত্র কয়েক ঘণ্টা ছিলুম কিন্তু কাজ করে এসেচি অনেক। এক বছরে যা করতে পারিনি মিনিট পাঁচ- ছয়েই তা হয়ে গেল। সুধীরের সঙ্গে শেষ করে এলুম।

বিপ্রদাস আশ্চর্য হইয়া বলিল, বলো কি!

হ্যাঁ, ভাই। কিন্তু ওকে অকূলে ভাসিয়ে দিয়ে আসিনি। আজ সকালে যে মেয়েটিকে দেখেছিলেন তার নাম হেম। হেমনলিনী রায়। ওর জিম্মাতেই সুধীরকে দিয়ে এলুম। আবার আমার সেই বোম্বায়ের কলের কথাই মনে পড়ে, তার মতো ওদের ওখানেও ভালবাসার টানা-পোড়েনে দেখতে দেখতে মানুষের ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে। আবার ভাঙ্গেও তেমনি।

বিপ্রদাস তেমনি বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল—ব্যাপারটা হলো কি? সুধীরের সঙ্গে হঠাৎ শেষ করে আসার মানে? বন্দনা কহিল, শেষ করার মানে শেষ করা। কিন্তু তাই বলে ওখানে হঠাৎ বলেও কিছু নেই। এদের তাল অসম্ভব দ্রুত বলেই বাইরে থেকে 'হঠাৎ' বলে ভ্রম হয়, কিন্তু আসলে তা নয়। সুধীর আমাকে ডেকে বললে আমার অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে। বললুম, কি অন্যায় হয়েছে সুধীর? সে বললে, কাউকে না বলে— অর্থাৎ তাকে না জানিয়ে অকস্মাৎ এ বাড়িতে চলে আসা আমার খুব গর্হিত কাজ হয়েছে। বিশেষতঃ, সেখানে বিপ্রদাসবাবু ছাড়া আর কেউ নেই যখন। বললুম, - সেখানে অনুদাদিদি আছে। সুধীর বললে, কিন্তু সে দাসী ছাড়া আর কিছু নয়। আমি বললুম, ও বাড়িতে তাঁকে দিদি বলে সবাই ডাকে। শুনে সেই হেম মেয়েটি মুখ টিপে একটু হেসে বললে, পাড়াগাঁয়ে ও-রকম ডাকার রীতি আছে শুনেচি, তাতে দাসী-চাকরের অহঙ্কার বাড়ে, আর কিছু বাড়ে না। তারা নিজেরাও বড় হয়ে ওঠে না। সুধীর বললে, এঁদের কাছে তুমি বলেচো যে এখানে থাকতে পারবে না, রাত্রেই ফিরে যাবে; কিন্তু সে-বাড়িতে তোমার একলা থাকাটা আমরা কেউ পছন্দ করিনে। তোমার বাবা শুনলেই বা কি বলবেন? বললুম, বাবা কি বলবেন সে ভাবনা তোমার নয়, আমার। কিন্তু আরও যারা পছন্দ করেন না তাঁদের মধ্যে কি তুমি নিজেও আছ। হেম বললে, নিশ্চয়ই আছেন। সকলকে ছাড়া ত উনি নয়। এই মেয়েটার পায়েপড়া মন্তব্যর উত্তর দিতে ইচ্ছে হল না, তাই সুধীরকে বললুম, তোমার এ কথার জবাবে আমিও বলতে পারতুম যে অনর্থক ছুটি নিয়ে তোমার কলকাতায় থাকাটা আমিও পছন্দ করিনে, কিন্তু সে কথা আমি বলব না। তুমি যে নোংরা ইঙ্গিত করলে তা ইতর-সমাজেই চলে, কিন্তু তোমাদের বড়-দলেও সে যে সমান সচল এ আমি জানতুম না, কিন্তু আর আমার সময় নেই, গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে, আমি চললুম। সেই মেয়েটা বলে উঠল, যা অশোভন, যা অনুচিত তার আলোচনা ছোট-বড় সকল দলেই চলে জানবেন । বললুম, আপনারা যত খুশি আলোচনা চালান আপত্তি নেই। আমি উঠলুম। সুধীর হঠাৎ কেমন ধারা যেন হয়ে গেল, — মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল, – নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, তোমার মাসীমাকেও জানিয়ে যাবে না? বললুম, তাঁকে জানানোই আছে বিয়ে হয়ে গেলেই আমি চলে যাবো যত রাতই হোক। সুধীর বললে, কাল তোমার সঙ্গে কি একবার দেখা হতে পারবে? বললুম, না। সে বললে, পরশু? বললুম, পরশুও না।

তার পরের দিন না, তার পরের দিনও নয়।

করে তোমার সময় হবে?

সময় আমার হবে না।

কিন্তু আমার যে একটা বিশেষ জরুরী কথা আলোচনা করবার আছে?

তোমার হয়ত আছে কিন্তু আমার নেই। এই বলে উঠে পড়লুম।

সুধীর আমাকে যে চেনে না, তা নয়, সঙ্গে এগিয়ে আসতে সাহস করলে না, সেইখানেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি গাড়িতে এসে বসলুম। বিপ্রদাস ঈষৎ হাসিয়া কহিল, এর মানে কি শেষ করে দেওয়া বন্দনা? একটুখানি কলহ সন্দেহ যদি থাকে দেখা হলে তোমার মেজদিকে জিজ্ঞেসা করে নিও।

বন্দনা হাসিল না, গম্ভীর হইয়া বলিল, কাউকে জিজ্ঞেসা করার প্রয়োজন নেই মুখুয্যেমশাই, আমি জানি আমাদের শেষ হয়ে গেছে, এ আর ফিরবে না।

তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া বিপ্রদাস হতবুদ্ধি হইয়া রহিল, বলো কি বন্দনা, এত বড় জিনিস কি কখনও এত অল্পেই শেষ হতে পারে? সুধীরের আঘাতটাই একবার ভেবে দেখো দিকি।

বন্দনা বলিল, ভেবে দেখেছি মুখুয্যেমশাই। এ আঘাত সামলাতে সুধীরের বেশী দিন লাগবে না, আমি জানি ঐ হেম মেয়েটি তাকে পথ দেখিয়ে দেবে। কিন্তু আমি নিজের কথা ভাবছিলুম। শুধু যে গাড়িতে বসেই ভেবেছি তা নয়, কাল বিছানায় শুয়ে সমস্ত রাত আমি ঘুমোতে পারিনি। অস্বস্তি বোধ করেচি সত্যি, কিন্তু কষ্ট আমি পাইনি।

কষ্ট পাবে রাগ পড়ে গেলে। তখন এই সুধীরের জন্যেই আবার পথ চেয়ে থাকবে, এই বলিয়া বিপ্রদাস হাসিল এ হাসিতেও বন্দনা যোগ দিল না, শান্তভাবে বলিল, রাগ আমার নেই। কেবল এই অনুতাপ হয় যে, চলে আসার সময়ে যদি কঠিন কথা আমার মুখ দিয়ে বার না হতো। দেখিয়ে এলুম যেন দোষ তাঁর — জানিয়ে এলুম যেন মর্মাহত হয়ে আমি বিদায় নিলুম। কিন্তু তা ত সত্যি নয় – এই মিথ্যে আচরণের জন্যেই শুধু লজ্জা বোধ করি মুখুয্যেমশাই, আর কিছুর জন্যে নয়। তাহার কথার শেষের দিকে চোখ যেন সজল হইয়া আসিল। বিপ্রদাসের মনের বিস্ময় বহুগুণে বাড়িয়া গেল, এ যে ছলনা নয় এতক্ষণে সে বুঝিল। বলিল, সুধীরকে তুমি কি সত্যিই আর ভালবাসো না?

না। একদিন ত বাসতে? এত সহজে এ ভালবাসা গেল কি করে? এত সহজে গেল বলেই এত সহজে এর উত্তর পেলুম। নইলে আপনার কাছে মিথ্যে বলতে হত। এই বলিয়া সে কিছুক্ষণ নীরবে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আপনি জানতে চাইলেন কোন দিন সুধীরকে ভালোবেসেছিলুম কি না! সেদিন ভারতুম সত্যিই ভালোবাসি। কিন্তু তার পরেই আর একজন পড়লো চোখে—সুধীর গেল মিলিয়ে এখন দেখি সেও গেছে মিলিয়ে । শুনে হয়ত আপনার ঘৃণা হবে, মনে হবে এমন তরল মন ত দেখিনি। আমি জানি মেয়েদের এ লজ্জার কথা,–কোন মেয়েই এ স্বীকার করতে চায় না—এ যেন তাদের চরিত্রকেই কলুষিত করে দেয়। হয়ত আমিও কারো কাছে মানতে পারতুম না, কিন্তু কেন জানিনে, আপনার কাছে কোন কথা বলতেই আমার লজ্জা করে না।

বিপ্রদাস চুপ করিয়া রহিল। বন্দনা বলিতে লাগিল, হয়ত এই আমার স্বভাব, হয়ত এ আমার বয়সের স্বধর্ম, অন্তর শূন্য থাকতে চায় না, হাতড়ে বেড়ায় চারিদিকে। কিংবা, এমনিই হয়ত সকল মেয়েরই প্রকৃতি, ভালোবাসার পাত্র যে কে সমস্ত জীবনে খুঁজেই পায় না। এই বলিয়া স্থির হইয়া মনে মনে কি যেন ভাবিতে লাগিল, তার পরেই বলিয়া উঠিল, কিংবা হয়ত খুঁজে পাবার জিনিস নয় মুখুয্যেমশাই— এটা মরীচিকা।

বিপ্রদাস তেমনই মৌন হইয়া রহিল। বন্দনার যেন মনের আগল খুলিয়া গেছে, বলিতে লাগিল, এই সুধীরের সঙ্গেই এক বছর পূর্বে আমার বিবাহ স্থির হয়ে গিয়েছিল, শুধু তার মায়ের অসুখ বলেই হতে পারেনি। কাল ঘরে ফিরে এসে ভাবছিলুম বিয়ে যদি সেদিন হয়ে যেতো, আজ কি মন আমার এমনি করেই তাকে ঠেলে ফেলে দিতো? মনকে শাসনে রাখতুম কি দিয়ে ধর্মবুদ্ধি দিয়ে? সংস্কার দিয়ে? কিন্তু অবাধ্য মন শাসন মানতে যদি না চাইতো কি হতো তখন। যাদের মধ্যে এই কটা দিন কাটিয়ে এলুম ঠিক কি তাদের মতন? এমনি ষড়যন্ত্র আর লুকোচুরিতে মন পরিপূর্ণ করে শুকনো হাসি মুখে টেনে টেনে লোক ভুলিয়ে বেড়া তুম? এমনি পরস্পরের নিন্দে করে, হিংসে করে, শত্রুতা করে? কিন্তু, আপনি কথা কইচেন না কেন মুখুয্যেমশাই?

বিপ্রদাস বলিল, তোমার মনের মধ্যে যে ঝড় বইচে তার ভয়ানক বেগের সঙ্গে আমি চলতে পারবো কেন বন্দনা, কাজেই চুপ করে আছি। বন্দনা বলিল, না সে হবে না, এমন করে এড়িয়ে যেতে আপনাকে আমি দেবো না। জবাব দিন।

কিন্তু শান্ত না হলে জবাব দিয়ে লাভ কি? তোমার আজকের অবস্থা যে স্বাভাবিক নয় এ কথা তুমি বুঝতে পারবে কেন?

কেন পারবো না মুখুয্যেমশাই, বুদ্ধি ত আমার যায়নি। যায়নি কিন্তু ঘুলিয়ে আছে। এখন থাক। সন্ধ্যের পরে সমস্ত কাজকর্ম সেরে আমার কাছে এসে যখন স্থির হয়ে বসবে তখন বলবো। পারি তখনি এর জবাব দেবো।

তবে সেই ভালো, এখন আমারও যে সময় নেই—এই বলিয়া বন্দনা বাহির হইয়া গেল। বস্তুতঃ, তাহার কাজের অবধি নাই। সকালে ছুটি লইয়া অনুদা কালীঘাটে গেছে, সে কাজগুলাও আজ তাহারই কাঁধে পড়িয়াছে। কত চাকর-বাকর, কত ছেলে এখানে থাকিয়া স্কুল কলেজে পড়ে, তাহাদের কত রকমের প্রয়োজন। কাজের ভিড়ে তাহার মনেও পড়িল না সে সারারাত্রি ঘুমায় নাই, সে আজ ভারী ক্লান্ত।

সন্ধ্যার পরে বিপ্রদাসের রাত্রির খাওয়া সাঙ্গ হইল, নীচের সমস্ত ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করিয়া বন্দনা তাহার শয্যার কাছে আসিয়া একটা চৌকি টানিয়া বসিল, বলিল, মুখুয্যেমশাই, একটা কথার সত্যি জবাব দেবেন বিপ্রদাস বলিল, সচরাচর তাই ত দিয়ে থাকি। প্রশ্নটা কিং বন্দনা বলিল, মেজদিদিকে আপনি কি সত্যিই ভালবাসেন ? ছেলেবেলায় আপনাদের বিয়ে হয়েছে- সে কতদিনের কথা কখনো কি এর অন্যথা ঘটেনি?

বিপ্রদাস অবাক হইয়া গেল। এমন কথা যে কাহারও মনে আসিতে পারে সে কল্পনাও করে নাই। কিন্তু আপনাকে সামলাইয়া লইয়া সহাস্যে কহিল, তোমার মেজদিদিকেই বরঞ্চ এ প্রশ্ন জিজ্ঞেসা করো।

বন্দনা বলিল, তিনি জানবেন কি করে? আপনার আসল মনের কথা ত শুনেচি কেউ জানতে পারে না। না বলতে চান বলবেন না, আমি একরকম করে বুঝে নেবো, কিন্তু বললে সত্যি কথাই আপনাকে বলতে হবে।

সত্যি কথাই বলবো, কিন্তু আমাকে কি তোমার সন্দেহ হয়?

হয়। আপনি অনেক বড় মানুষ, কিন্তু তবুও মানুষ । মনে হয় কোথায় যেন আপনি ভারী একলা, সেখানে আপনার কেউ সঙ্গী নেই। এ কথা কি সত্যি নয়?

বিপ্রদাস এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিল না, বলিল, স্ত্রীকে ভালবাসা যে আমার ধর্ম বন্দনা ।

বন্দনা বলিল, ধর্ম যতদূরে প্রসারিত ততদূর আপনি খাঁটি, কিন্তু তার চেয়েও বড় কি সংসারে কিছু নেই।

দেখতে ত পাইনে বন্দনা।

বন্দনা বলিল, আমি দেখতে পাই মুখুয্যেমশাই। বলবো সে কথা ?

বিপ্রদাসের মুখ সহসা যেন পাণ্ডুর হইয়া উঠিল, বলিষ্ঠ গৌরবর্ণ মুখে যেন রক্তের লেশ নাই, দুই হাত সম্মুখে বাড়াইয়া বলিল, না, একটি কথাও নয় বন্দনা। আজ তোমার ঘরে যাও, কাল হোক, পরশু হোক, – আবার যখন প্রকৃতিস্থ হয়ে আলোচনার বুদ্ধি ফিরে পারে তখন এর জবাব দেবো। কিংবা হয়তো আপনিই তখন বুঝবে, ঐ যারা তোমার মাসীর বাড়িতে বুদ্ধিকে তোমার আচ্ছন্ন করেছে তারাই সব নয়। ধর্ম যাদের কাছে অত্যাজ্য তারাও আছে, জগতে তারাও বাস করে। না না, আর তর্ক নয়, – তুমি যাও।

বন্দনা বুঝিল, এ আদেশ অবহেলার নয়। এই হয়ত সেই বস্তু যাহাকে বাড়িসুদ্ধ সকলে ভয় করে। বন্দনা নিঃশব্দে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।


26
Articles
বিপ্রদাস
0.0
"বিপ্রদাস" প্রখ্যাত লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি বাংলা উপন্যাস। গল্পটি কেন্দ্রীয় চরিত্র বিপ্রদাসকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে, একটি ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় পরিবারের একজন সংবেদনশীল এবং অন্তর্মুখী যুবক। তিনি রক্ষণশীল মূল্যবোধ এবং সামাজিক নিয়ম দ্বারা চিহ্নিত একটি সমাজে তার স্থান খুঁজে পেতে সংগ্রাম করেন। বিপ্রদাস প্রেম, কর্তব্য এবং ব্যক্তিগত আকাঙ্খার নেভিগেট করার সময় অসংখ্য চ্যালেঞ্জ এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হন। উপন্যাসটি সামাজিক প্রত্যাশা, পারিবারিক চাপ এবং ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার বিষয়বস্তু অন্বেষণ করে। শরৎচন্দ্র দক্ষতার সাথে বিপ্রদাসের মানসিক অশান্তিকে চিত্রিত করেছেন, এটিকে আত্ম-আবিষ্কার এবং সামাজিক সীমাবদ্ধতার একটি মর্মস্পর্শী গল্পে পরিণত করেছেন। "বিপ্রদাস" একটি আকর্ষক আখ্যান যা মানব সম্পর্কের জটিলতা এবং ব্যক্তিগত আকাঙ্খা এবং সামাজিক সামঞ্জস্যের মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে।
1

এক

31 October 2023
0
0
0

বলরামপুর গ্রামের রথতলায় চাষাভুষাদের একটা বৈঠক হইয়া গেল। নিকটবর্তী রেলওয়ে লাইনের কুলি গ্যাং রবিবারের ছুটির ফাঁকে যোগদান করিয়া সভার মর্যাদা বৃদ্ধি করিল এবং কলিকাতা হইতে জনকয়েক নামকরা বক্তা আসিয়া আ

2

দুই

31 October 2023
0
0
0

বিপ্রদান নিজের বসিবার ঘরে ছোটভাইকে ডাকাইয়া আনিয়া বলিলেন, কালকের আয়োজনটা মন্দ হয়নি। অনেকটা চমক লাগাবার মত। War cry-গুলোও বেশ বাছা বাছা, ঝাঁজ আছে তা মানতেই হবে। দ্বিজদাস চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

3

তিন

31 October 2023
0
0
0

এ বাড়িতে দ্বিজদাস সবচেয়ে বেশী খাতির করিত বৌদিদিকে। তাহার সর্ববিধ বাজে খরচের টাকাও আসিত তাঁহারই বাক্স হইতে। সতী শুধু সম্পর্ক হিসাবেই তাহার বড় ছিল না, বয়সের হিসাবেও মাস কয়েকের বড় ছিল। তাই অধিকাংশ

4

চার

31 October 2023
0
0
0

নিখুঁত সাহেবী-পরিচ্ছদে ভূষিত একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক চেয়ারে বসিয়াছিলেন এবং একটি কুড়ি-একুশ বছরের মেয়ে তাঁহারই পাশে দাঁড়াইয়া দেয়ালে টাঙানো মস্ত একখানি জগদ্ধাত্রী দেবীর ছবি অত্যন্ত মনোযোগের সহিত নিরীক

5

পাঁচ

31 October 2023
0
0
0

বন্দনা স্নানাদি সারিয়া বসিবার ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, পিতা ইতিপূর্বেই প্রস্তুত হইয়া লইয়াছেন। একখানা জমকালোগোছের আরামকেদারায় বসিয়া চোখে চশমা দিয়া সংবাদপত্রে মনোনিবেশ করিয়াছেন। পাশের ছোট্ট টেবিল

6

ছয়

31 October 2023
0
0
0

বন্দনা নীচে আসিয়া দেখিল পিতা হৃষ্টচিত্তে আহারে বসিয়াছেন। সেই বসিবার ঘরের মধ্যেই একখানি ছোট টেবিলের উপর রূপার থালায় করিয়া খাবার দেওয়া হইয়াছে। একজন দীর্ঘাকৃতি অতিশয় সুশ্রী ব্যক্তি অদূরে দাঁড়াইয়

7

সাত

31 October 2023
0
0
0

স্টেশনে পৌঁছিয়া খবর পাওয়া গেল, কোথায় কি একটা আকস্মিক দুর্ঘটনার জন্য ট্রেনের আজ বহু বিলম্ব, – বোধ করি বা একঘণ্টারও বেশী লেট হইবে। - পরিচিত স্টেশনমাস্টারটিও হঠাৎ পীড়িত হওয়ায় একজন মাদ্রাজী রিলিভিং

8

আট

1 November 2023
1
0
0

গণ্ডগোল শুনিয়া পাশের কামরার সহযাত্রী সাহেবরা প্লাটফর্মে নামিয়া দাঁড়াইল, এবং রুক্ষকণ্ঠে সমস্বরে প্রশ্ন করিল, what's up? ভাবটা এই যে, সঙ্গীদের হইয়া তাহারা বিক্রম দেখাইতে প্রস্তুত। বিপ্রদাস অদূরবর্তী

9

নয়

1 November 2023
0
0
0

বন্দনা সকালে উঠিয়া দেখিল এই বাড়িটার সম্বন্ধে সে যাহা ভাবিয়াছিল তাহা নয়। মনে করিয়াছিল পুরুষমানুষের বাসাবাড়ি, হয়ত ঘরের কোণে কোণে জঞ্জাল, সিঁড়ির গায়ে থুথু, পানের পিচের দাগ, ভাঙ্গাচোরা আসবাবপত্র,

10

দশ

1 November 2023
0
0
0

বিপ্রদাস আসনে বসিয়া পুনরায় সেই প্রশ্নই করিল, সত্যিই আবার স্নান করে এলে নাকি? অসুখ করবে যে তা করুক। কিন্তু হাতে না-খাবার ছলছুতা আবিষ্কার করতে আপনাকে দেব না এই আমার পণ। স্পষ্ট করে বলতে হবে, তোমার ছোঁয

11

এগার

1 November 2023
0
0
0

রাত্রের গাড়িতে আসিতেছে মেজদি এবং সঙ্গে আসিতেছে দ্বিজদাস। বন্দনার আনন্দ ধরে না। সেদিন দিদির শ্বশুরবাড়িতে নিজের আচরণের জন্য সে মনে মনে বড় লজ্জিত ছিল, অথচ প্রতিকারের উপায় পাইতেছিল না। আজ অত্যন্ত অনিচ

12

বার

1 November 2023
0
0
0

কৈলাস তীর্থযাত্রায় পথের দুর্গমতার বিবরণ শুনিয়া মামীরা পিছাইয়াছেন, দয়াময়ীর নিজেরও বিশেষ উৎসাহ দেখা যায় না, তথাপি তাঁহার কলিকাতায় কাটিল পাঁচ-ছয়দিন দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট ও গঙ্গাস্নান করিয়া। কাজের

13

তের

1 November 2023
0
0
0

সন্ধ্যা-বন্দনা সারিয়া বিপ্রদাস সেইমাত্র নিজের লাইব্রেরিঘরে আসিয়া বসিয়াছে; সকালের ডাকে যে-সকল দলিলপত্র বাড়ি হইতে আসিয়াছে সেগুলা দেখা প্রয়োজন, এমনি সময়ে মা আসিয়া প্রবেশ করিলেন, হাঁ রে বিপিন, তুই

14

চৌদ্দ

1 November 2023
0
0
0

সন্ধ্যা উত্তীর্ণপ্রায়, বন্দনা আসিয়া দ্বিজদাসের ঘরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া ডাকিল, একবার আসতে পারি দ্বিজবাবু? ভিতর হইতে সাড়া আসিল, পার। একবার নয়, শত সহস্র অসংখ্য বার পার। বন্দনা দরজার পাল্লা দুটা শেষপ

15

পনর

1 November 2023
0
0
0

নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিয়া বন্দনার অত্যন্ত গ্লানি বোধ হইতে লাগিল। সে কি নেশা করিয়াছে যে, নির্লজ্জ উপযাচিকার ন্যায় আপন হৃদয় উদ্ঘাটিত করিয়া সমস্ত আত্মমর্যাদার জলাঞ্জলি দিয়া আসিল। অথচ দ্বিজদাস পুরুষ হ

16

ষোল

2 November 2023
1
0
0

দয়াময়ীর আচরণে বন্দনার প্রতি যে প্রচ্ছন্ন লাঞ্ছনা ও অব্যক্ত গঞ্জনা ছিল সতীকে তাহা গভীরভাবে বিধিয়াছিল। কিন্তু শাশুড়ীকে কিছু বলা সহজ নয়, তাই সে একখানি চিঠি লিখিয়া বোনের হাতে দিবার জন্য স্বামীকে ঘরে

17

সতর

2 November 2023
0
0
0

হঠাৎ বড়মাসীর সঙ্গে হাওড়া স্টেশনে বন্দনার যখন দেখা হইয়া গেল তখন বোম্বাই যাওয়া বন্ধ করিয়া তাহাকে বাড়ি ফিরাইয়া আনা মাসীর কষ্টসাধ্য হইল না। তিনি মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে স্বামীর কর্মস্থল উত্তর-পশ্চিমাঞ

18

আঠার

2 November 2023
0
0
0

বন্দনা বলিল, খাবার হয়ে গেছে নিয়ে আসি?বন্দনা বলিল, খাবার হয়ে গেছে নিয়ে আসি? বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, তোমার কেবলি চেষ্টা হচ্চে আমার জাত মারার। কিন্তু সন্ধ্যে আহ্নিক এখনো করিনি, আগে তার উদ্যোগ করিয়া

19

উনিশ

2 November 2023
0
0
0

পরদিন বিকালের দিকে বন্দনা আসিয়া বলিল, মুখুয্যেমশাই, আবার চললুম মাসীমার বাড়িতে। এবার আর ঘণ্টা-কয়েকের জন্যে নয়, এবার যতদিন না মাসী আমাকে বোম্বায়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারেন ততদিন। অর্থাৎ? অর্থাৎ

20

কুড়ি

2 November 2023
0
0
0

দ্বিজদাস জিজ্ঞাসা করিল, বন্দনা হঠাৎ চলে গেলেন কেন? আমার এসে পড়াটাই কি কারণ নাকি? বিপ্রদাস বলিল, না ওঁর বাবা টেলিগ্রাম করেছেন মাসীর বাড়িতে গিয়ে থাকতে যতদিন না বোহায়ে ফিরে যাওয়া ঘটে। কিন্তু হঠাৎ ম

21

একুশ

2 November 2023
0
0
0

অনেকদিনের পরে বিপ্রদাস নীচের আফিসঘরে আসিয়া বসিয়াছে। সম্মুখে টেবিলের পরে কাগজপত্রের স্তূপ কতদিনের কত কাজ বাকী। দেহ ক্লান্ত, কিন্তু দ্বিজুর ভরসায় ফেলিয়া রাখাও আর চলে না। একটা খেরো-বাঁধানো মোটা থাতা

22

বাইশ

2 November 2023
0
0
0

পরদিন সকালেই সকলে বলরামপুরের উদ্দেশে যাত্রা করিল। বাটীর কাছাকাছি আসিতে দেখা গেল দ্বিজদাস প্রায় রাজসূয় যজ্ঞের ব্যাপার করিয়াছে। সম্মুখের মাঠে সারি সারি চালাঘর — কতক তৈরি হইয়াছে— কতক হইতেছে— ইতিমধ্যে

23

তেইশ

3 November 2023
0
0
0

সংসারে বিপদ যে কোথায় থাকে এবং কোন পথে কখন যে আত্মপ্রকাশ করে ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। কাজের মাঝখানে কল্যাণী আসিয়া কাঁদিয়া বলিল, মা. উনি বলছেন ওঁর সঙ্গে আমাকে এখুনি বাড়ি চলে যেতে। ট্রেনের সময় নেই—

24

চব্বিশ

3 November 2023
0
0
0

মেজদিদিকে জোর করিয়া একটা চেয়ারে বসাইয়া বন্দনা তাহার পায়ে আলতা পরাইয়া দিতেছিল। এই মঙ্গলাচারটুকু অন্নদা তাহাকে শিখাইয়া দিয়া নিজে আত্মগোপন করিয়াছে। তাহার চোখ রাঙ্গা, অবিরত অশ্রুবর্ষণে চোখের পাতা

25

পঁচিশ

3 November 2023
0
0
0

বন্দনার নির্বিঘ্নে বোম্বাই পৌঁছান-সংবাদের উত্তরে দিনকয়েক পরে দ্বিজদাসের নিকট হইতে জবাব আসিয়াছিল যে, সে নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় যথাসময়ে চিঠি লিখিতে পারে নাই। বন্দনা নিজের চোখে যেমন দেখিয়া গেছে সমস্

26

ছাব্বিশ

3 November 2023
0
0
0

ম্যানেজার বিরাজ দত্ত মোটর লইয়া স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন। বন্দনাকে সসম্মানে ট্রেন হইতে নামাইয়া গাড়িতে আনিয়া বসাইলেন । বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, মা আজও বাড়ি এসে পৌঁছল নি দত্তমশাই? না দিদি। মৈত্রেয়ী?

---