হঠাৎ বড়মাসীর সঙ্গে হাওড়া স্টেশনে বন্দনার যখন দেখা হইয়া গেল তখন বোম্বাই যাওয়া বন্ধ করিয়া তাহাকে বাড়ি ফিরাইয়া আনা মাসীর কষ্টসাধ্য হইল না। তিনি মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে স্বামীর কর্মস্থল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল হইতে দেশে আসিতেছিলেন। মাসীর প্রস্তাবে রাজী হওয়ার আসল কারণটা ছাড়া আরও একটা হেতু ছিল এখানে তাহা প্রকাশ করা প্রয়োজন। বন্দনার ছেলেবেলা হইতে এতকাল সুদূর প্রবাসেই দিন কাটিয়াছে, তাহার শিক্ষা-দীক্ষা সমস্তই সেদিকের, অথচ, যে সমাজের অন্তগর্ত সে, তাহার বৃহত্তর অংশটাই আছে কলিকাতায়, ইহার সহিত আজও তাহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় নাই। সামান্য পরিচয় যেটুকু সে শুধু খবরের কাগজ, মাসিকপত্র ও সাধারণ সাহিত্যের গল্প-উপন্যাসের সহযোগে। কলিকাতায় সর্বদা আনাগোনা যাহাদের, তাহাদের মুখে মুখে অনেক তথ্য মাঝে মাঝে তাহার কানে আসে—অ্যানিটা চ্যাটার্জি এম. এ.. বিনীতা ব্যানার্জি বি.এ. অনুসূয়া, চিত্রলেখা, প্রিয়ম্বদা প্রভৃতি বহু জমকালো নাম ও চমকানো কাহিনী—বিংশ শতাব্দের অত্যাধুনিক মনোভাব ও রোমাঞ্চকর জীবনযাত্রার বিবরণ—কিন্তু ইহার কতটা যে যথার্থ ও কতটা যে বানানো দূর হইতে নিঃসংশয়ে অনুমান করা ছিল তাহার পক্ষে কঠিন। তাই আপন সমাজের কোন চিত্রটা ছিল তাহার মনের মধ্যে অতিরঞ্জিত ঘোরালো, কোনটা বা ছিল অস্বাভাবিক রকমের ফিকা, এই ছবিগুলিই প্রত্যক্ষ পরিচয়ে স্পষ্ট ও সত্য করিয়া লইবার সুযোগ মাসীমার মেয়ে প্রকৃতির বিবাহ উপলক্ষে যখন মিলিল তখন বন্দনা উপেক্ষা করিতে পারিল না, সহজেই সম্মত হইয়া তাঁহার বালিগঞ্জের গৃহে আসিয়া উপস্থিত হইল। আপন দলের বহুজনের সঙ্গে তাঁহাদের জানাশুনা, বিশেষতঃ, প্রকৃতি এখানকার স্কুল- কলেজে পড়িয়াই বি এ পাস করিয়াছে, তাহার নিজের বন্ধু ও বান্ধবীর সংখ্যাও নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর নয় আসিয়া পর্যন্ত এই দলের মাঝখানেই বন্দনার এই কয়দিন কাটিল। পিতা অনাথ রায় বোম্বয়ে ফিরিয়া গেলেন, কিন্তু সুধীর রহিল কলিকাতায়। আসন্ন বিবাহের আনন্দোৎসব নিতাই চলিয়াছে, সেদিন বেলঘরের একটা বাগানে পিকনিক সারিয়া সদলবলে বাড়ি ফিরিবার পথেই সে দ্বিজদাসের সংবাদ লইতে এ বাড়িতে আসিয়া হাজির হইয়াছিল। এই খবরটাই অনুদা সেদিন বিপ্রদাসকে দিয়াছিল। মাসীর বাড়িতে দলের লোকের আসা-যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া, সলা-পরামর্শের কামাই নাই, আজও ছিল অনেকের চায়ের নিমন্ত্রণ। অতিথিগণ আসিয়া পৌঁছিয়াছেন, উপরের ঘরে মহাসমারোহে চলিয়াছে চা খাওয়া। এমন সময়ে বিপ্রদাসের প্রকাণ্ড মোটর আসিয়া গেটের মধ্যে প্রবেশ করিল। ভৃত্যের দল অবহিত হইয়া উঠিল, কিন্তু শোফার দরজা খুলিয়া দিতে যে প্রৌঢ়া স্ত্রীলোকটি অবতরণ করিল তাহার পোশাকের সামান্যতায় ও স্বল্পতায় সকলে বিস্মিত ও বিব্রত হইয়া পড়িল। মোটরের সঙ্গে মানুষটির সামঞ্জস্য নাই। অন্নদার পরনে ছিল সাদা থান, তেমনি একটা সাদা মোটা চাদর গায়ে জড়ানো, পা খালি, হাত খালি, মাথার আচলটা কপালের অর্ধেকটা চাপা দিয়াছে— সে নিজেও যেন সলজ্জ সঙ্কোচে কিছু জড়সড়ো। ভৃত্য-বেহারাদের চাপকান-পাগড়ির সাজসজ্জায় বুঝা কঠিন কে কোন্ দেশের, তথাপি সম্মুখের লোকটাকে বাঙালী আন্দাজ করিয়া অনুদা জিজ্ঞাসা করিল, বন্দনাদিদি বাড়ি আছেন?
সে বাঙালীই বটে, কহিল, হাঁ, আছেন। তাঁরা উপরে চা খাচ্ছেন, আপনি ভেতরে এসে বসুন।
না, আমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি, তাঁকে একটু খবর দিতে পারবে না?
পারবো। কি বলতে হবে বলো গে বিপ্রদাসবাবুর বাড়ি থেকে অন্নদা এসেছে।
বেহারা চলিয়া গেল, অনতিবিলম্বে বন্দনা নীচে আসিয়া অনুদার হাত ধরিয়া ঘরে আনিয়া বসাইল। এমন সে কখনও করে নাই, ভুলিয়া গেল সামাজিক পর্যায়ে এই বিধবা তাহার কাছে অনেক ছোট- ও-বাড়ির দাসী মাত্র। অকারণে তাহার চোখ সজল হইয়া উঠিল বলিল, অনুদি, তুমি যে আমার খবর নিতে আসবে এ আমি মনে করিনি। ভেবেছিলুম আমাকে তোমরা ভুলে গেছো।
ভুলবো কেন দিদি, ভুলিনি। বড়বাবু আপনার কাছে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন বলতে-না অনুদি, আমাকে আপনি বলে ডাকলে আর আমি জবাব দেবো না।
অন্নদা আপত্তি করিল না, শুধু হাসিয়া বলিল, ওদের মানুষ করেছি বলেই 'তুমি' বলে ডাকি, নইলে ও-বাড়ির আমি দাসী বৈ ত নয় ।
বন্দনা বলিল, তা হোক। কিন্তু মুখয্যেমশাই ত এসেছেন পাঁচ-ছ দিন হোল কলকাতায়, নিজে বুঝি একবার আসতে পারতেন না। তিনি ত জানেন আমি বোম্বায়ে যাইনি। হাঁ, আমার মুখে এ খবর তিনি শুনেছেন। কিন্তু জানো ত দিদি তাঁর কত কাজ। এতটুকু সময় ছিল না।
এ কথা শুনিয়া বন্দনা খুশী হইল না, বলিল, কাজ সকলেরই আছে অনুদি। আমরা গিয়েছিলুম বলেই ভদ্রতা রক্ষার ছলনায় তোমাকে তিনি পাঠিয়েছেন, নইলে মনেও করতেন না। তাঁকে বলো গিয়ে আমার মাসীমার তাঁদের মতো ঐশ্বর্য নেই বটে, তবু একবার আমার খোঁজ নিতে এ-বাড়িতে পা দিলে তাঁর জাত যেতো না মর্যাদারও লাঘব হতো না।
এ-সকল অনুযোগের উত্তর অনুদার দিবার নয়। সে ও-বাটীতে যাইবার অনুরোধ করিতে পেল, কিন্তু শুনিবার ধৈর্য বন্দনার নাই, অনুদার অসম্পূর্ণ কথার মাঝখানেই বলিয়া উঠিল, না অনুদি, সে হবে না। কোথাও যাবার আমার সময় নেই। কাল বাদে পরশু আমার বোনের বিয়ে ।
পরশু? হা পরশু।
এ সময় অসুখের সংবাদ দেওয়া উচিত কি না অনুদা ভাবিতেছিল কিন্তু সে তখনি প্রশ্ন করিয়া উঠিল, আমাকে যাবার হুকুমটা দিল কে? ছোটবাবু ত নেই জানি, বড়বাবু বোধ করি? কিন্তু তাঁকে বলো গিয়ে হুকুম চালিয়ে তাঁর অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। আমি খাতকও নই, তাঁর জমিদারির আমলাও নই। আমাকে অনুরোধ করতে হয় নিজে এসে মেজদি ভাল আছেন?
হাঁ আছেন।
আর সকলে?
অন্নদা বলিল, খবর এসেছে ছেলের অসুখ। কার অসুখ, বাসুর? কি হয়েছে তার? সে আমি ঠিক জানিনে দিদি।
বন্দনা চিন্তিত মুখে বলিল, ছেলের অসুখ তবু নিজে না গিয়ে মুখুয্যেমশাই এখানে বসে আছেন যে বড়ো? মামলা-মকদ্দমা আর টাকাকড়ির টানটাই কি হলো তাঁর এত বেশি অনুদি? একটা হিতাহিত বোধ থাকা উচিত।
অন্নদা বলিল, টাকার টান নয় দিদি, আজ দুদিন থেকে তিনি নিজেও শয্যাগত। ছেলের অসুখে সেখানে তারা বিব্রত, খবর দেওয়াও যায় না, অথচ এখানে দত্তমশাই পর্যন্ত নেই—তিনি গেছেন ঢাকায়, একা আমি মুখ্যু মেয়েমানুষ কিছুই বুঝিনে, ভয় হয় অসুখটা পাছে শক্ত হয়ে ওঠে। বিপিনের কখনো কিছু হয় না বলেই ভাবনা। বিয়েটা চুকে গেলে একবার পারবে না যেতে দিদি?
শঙ্কায় বন্দনার মুখ বিবর্ণ হইয়া উঠিল,- -ডাক্তার এসেছেন? কি বলেন তিনি? বললেন, ভয় নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে অন্য ডাক্তার ডাকতেও বলে গেলেন। অনুদার চোখ জলে ভরিয়া গেল, বদনার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, এ দু'টো দিন যেমন করে হোক কাটাবো, কিন্তু বিয়ে ঢুকে গেলেও যাবে না? আমাদের ওপর রাগ করেই থাকবে? তোমাদের কোথায় কি ঘটেছে আমার জানবার কথা নয়, জানিও নে, কিন্তু এ জানি আর যে-ই দোষ করে থাক বিপিন কখনো করেনি তাকে না জানলে হয়ত ভুল হয়, কিন্তু জানলে এ ভুল হবে না দিদি।
বন্দনা ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল, চলো আমি যাচ্ছি। এখুনি যাবে?
হ্যাঁ, এখুনি বৈ কি।
বাড়িতে বলে যাবে না। এঁরা ভাববেন যে।
বলতে গেলে দেরি হবে অনুদি, তুমি এসো। এই বলিয়া সে উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া মোটরে গিয়া বসিল। বেহারাকে ইঙ্গিতে কাছে ডাকিয়া বলিয়া দিল, মাসীমাকে জানাইতে সে মেজদির বাড়িতে চলিল, সেখানে বিপ্রদাসবাবুর অসুখ! বন্দনা আসিয়া যখন বিপ্রদাসের ঘরে প্রবেশ করিল তখন বেলা গেছে কিন্তু আলো জ্বালার সময় হয় নাই। বিপ্রদাস বালিশগুলা জড়ো করিয়া দেওয়ালে হেলান দিয়া বিছানায় বসিয়া, মুখ দেখিয়া মনে হয় না যে অসুখ গুরুতর। মনের মধ্যে স্বস্তি বোধ করিয়া বলিল, মুখুয্যেমশাই, নমস্কার করি। মেজদি উপস্থিত থাকলে রাগ করতেন, বলতেন, গুরুজনের পায়ের ধুলো নিয়েই প্রণাম করতে। কিন্তু ছুঁতে ভয় করে পাছে ছোঁয়া যান!
বিপ্রদাস কিছুই না বলিয়া শুধু একটু হাসিল। বন্দনা বলিল, ডেকে পাঠিয়েছেন কেন, – সেবা করতে? অনুদি বলছিলো, ওষুধ খাওয়াবার সময় হয়েছে। কিন্তু একি ব্যাপার! ডাক্তারি ওষুধের শিশি যে কবরেজের বড়ি কৈ? ডাক্তার ডাকার বুদ্ধি দিলে কে আপনাকে? বিপ্রদাস কহিল, আমাদের চলতি ভাষায় ডেপো বলে একটা কথা আছে তার মানে জানো বন্দনা?
বন্দনা বলিল, জানি মশাই জানি। মানুষ হয়ে যারা মানুষকে ঘেন্না করে, ছোঁয় না তাদের বলে। তাদের চেয়ে বড় ডেপো সংসারে আর কেউ আছে নাকি? বিপ্রদাস বলিল, আছে। যাদের সত্যি-মিথ্যে যাচাই করবার ধৈর্য নেই, অকারণে নির্দোষীকে হুল ফুটিয়ে যারা বাহাদুরি করে তারা। তাদের দলের মস্তবড় পাণ্ডা তুমি নিজে।
অকারণে কোন্ নির্দোষী ব্যক্তিটিকে হুল ফুটিয়েছি আপনি বলে দিন ত শুনি?
আমাকে বলে দিতে হবে না বন্দনা, সময় এলে নিজেই টের পাবে।
আচ্ছা, সেই দিনের প্রতীক্ষা করে রইলুম, এই বলিয়া বন্দনা খাটের কাছে একটা চৌকি টানিয়া লইয়া বসিল, বলিল, এখন বলুন নিজে কেমন আছেন?
ভালো আছি, কিন্তু জ্বরটা রয়েছে। রাত্রে আর একটু বাড়বে বলে মনে হয়।
কিন্তু আমাকে ডেকে পাঠালেন কেন? আমাকে আপনার কিসের দরকার?
দরকার আমার নয়, অনুদিদির, সে-ই ভয় পেয়েছে। তার মুখে শুনলুম, পরক্ষ তোমার বোনের বিয়ে, চুকে গেলে একদিন এসো। আমার জরানি তোমার মেজদি, কিছু খবর পাঠিয়েছেন, সেগুলো তোমাকে শোনাবো।
আজ পারেন না?
না, আজ নয়।
বন্দনা মিনিট-দুই চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, তার পরে কহিল, মুহুয্যেমশাই, অসুখ আপনার বেশি নয়, দু'দিনেই সেরে উঠবেন। আমি জানি আমাকে প্রয়োজন নেই, তবুও আপনার সেবার ভান করেই আমি থাকবো, সেখানে ফিরে যাবো না। আমার তোরঙ্গটা আনতে লোক পাঠিয়ে দিয়েছি, আপনি আপত্তি করতে পারবেন না। বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, কিসের আপত্তি বন্দনা, তোমার থাকার? কিন্তু বোনের বিয়ে যে!
বিয়ে ত আমার সঙ্গে নয়— আমি না গেলেও বোনের বিয়ে আটকাবে না।
সত্যি থাকবে না বিয়েতে?
না।
কিন্তু এরই জন্যে যে কলকাতায় রয়ে গেলে?
বন্দনা কহিল, যাচ্ছিলুম বোম্বায়ে, ষ্টেশন থেকে ফিরে এলুম, কিন্তু ঠিক এই জন্যেই নয়। দূরে থাকি, আপন সমাজের প্রায় কাউকে চিনিনে, মুখে মুখে কত কথা শুনি, গল্প-উপন্যাসে কত কি পড়ি, তাদের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারিনে মনে হয় বুঝি বা আমরা সমাজছাড়া এক ঘরে। মাসীমা ডাকলেন, - ভাবলুম প্রকৃতির বিয়ের উপলক্ষে দৈবাৎ যে সুযোগ মিললো, এমন আর পাবো না। তাই ফিরে এলুম মুখুয্যেমশাই।
বিপ্রদাস সহাস্যে কহিল, কিন্তু সেই বিয়েটাই যে বাকী এখনো। দলের লোকদের চেনবার সুযোগ পেলে কৈ?
সুযোগ পুরো পাইনি সত্যি, কিন্তু যতটা পেয়েচি সে-ই আমার যথেষ্ট
নিজের সঙ্গে এঁদের কতখানি মিললো বন্দনা। শুনতে পারি কিছু বন্দনা হাসিয়া ফেলিল, বলিল, আপনি সেরে উঠুন তার পরে বিস্তারিত করে শোনাবো।
চাকরে আলো জ্বালিয়া দিয়া গেল। শিয়রের জানালাটা বন্ধ করিয়া বন্দনা ঔষুধ খাওয়াইল, কহিল, আর বসে নয়, এবার আপনাকে শুতে হবে। এই বলিয়া এলোমেলো বিছানাটা ঝাড়িয়া পরিষ্কার করিয়া বালিশগুলা ঠিক করিয়া দিল, বিপ্রদাস শুইয়া পড়িলে পা হইতে বুক পর্যন্ত চাদর দিয়া ঢাকিয়া দিয়া বলিল, সেরে উঠে নিজেকে শুদ্ধশুচি করে তুলতে না জানি কত গোবর গঙ্গাজলই না আপনার লাগবে!
বিপ্রদাস দুই হাত প্রসারিত করিয়া বলিল, এত। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, সেবাযত্ন করতেও একটু জানো দেখচি। জানি একটু? না মুখুয্যেমশাই, এ চলবে না। আমাদের সম্বন্ধে আপনাকে আরো একটু খোঁজ-খবর নিতে হবে।
অর্থাৎ-
অর্থাৎ আমাদের নিন্দেই যদি করেন সজ্ঞানে করতে হবে। এমনধারা চোখ বুজে যা-তা বলতে আমি দেবো না। বিপ্রদাসের মুখে পরিহাসের চাপা হাসি, কহিল, এই আমাদেরটা কারা বলনা? কাদের সম্বন্ধে আরও একটু খোঁজ-খবর নিতে হবে যাদের থেকে এইমাত্র পালিয়ে এলে তাদের।
কে বললে আমি পালিয়ে এলুম?
আমি বলচি।
জানলেন কি করে?
জানলুম তোমার মুখ দেখে।
বন্দনা ক্ষণকাল তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া কহিল, দ্বিজুবাবু একদিন বলেছিলেন দাদার চোখে কিছুই এড়ায় না। কথাটা যে কতখানি সত্যি আমি বিশ্বাস করিনি। আপনার অসুখ আমি চাইনে, কিন্তু এ আমাকে সত্যিই উদ্ধার করেছে। সত্যিই পালিয়ে এসে আমি বেঁচে গেছি। যে কটা দিন আপনি অসুস্থ আমি আপনার কাছেই থাকবো, তার পরে সোজা বাবার কাছে চলে যাবে। — মাসীর বাড়িতে আর ফিরবো না। দূর থেকে যাদের দেখতে চেয়েছিলুম তাদের দেখা পেয়ে গেছি, এমন ইচ্ছে আর নেই যে একটা দিনের জন্যেও ওদের মধ্যে গিয়ে কাটিয়ে আসি ।
বিপ্রদাস নীরবে চাহিয়া রহিল। বন্দনা বলিতে লাগিল, ওদের শুধু শাড়ী গাড়ি আর মিথ্যে ভালোবাসার গল্প। কোথায় নৈনি আর কোথায় মুসৌরির হোটেল আমি জানিও নে, কিন্তু ওদের মুখে মুখে তার কি-যে নোংরা চাপা ইঙ্গিত, শুনতে শুনতে ইচ্ছে হতো, কোথাও যেন ছুটে পালিয়ে যাই। আজ এই ঘরের মধ্যে বসে মানে হচ্ছে যেন এই ক'টা দিন অবিশ্রাম এলোমেলো ধুলোবালির ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে আমার দিনরাত কেটেছে। এর ভেতর ওরা বাঁচে কি করে মুখুয্যেমশাই?
বিপ্রদাস বলিল, সে রহস্য আমার জানার কথা নয়। মরুভূমির মধ্যে কবরগুলো যেমন টিকে থাকে বোধ করি তেমনি করে । বন্দনা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, দুঃখের জীবন। ওদের না আছে শান্তি, না আছে কোন ধর্মের বালাই। কিছু বিশ্বাস করে না, কেবলি করে তর্ক । একটু থামিয়া বলিল, খবরের কাগজ পড়ে, ওরা জানে অনেক। পৃথিবীর কোথায় কি নিত্য ঘটাচে কিছুই ওদের অজানা নয়। কিন্তু আমি ত ও-সব পড়তে পারিনে, তাই অর্ধেক কথা বুঝতেই পারতুম না। শুনতে শুনতে যখন অরুচি ধরে যেতো তখন আর কোথাও সরে গিয়ে নিশ্বেস ফেলে বাঁচতুম। কিন্তু তাদের ত ক্লান্তি নেই, তারা বকতে বকতে সবাই যেন মেতে উঠতো।
কিন্তু তোমার বাবা কাছে থাকলে সুবিধে হত বন্দনা। খবরের কাগজের সব খবর তাঁকে জিজ্ঞেস করলেই টের পেতে ওদের কাছে ঠকতে হতো না।
বন্দনা হাসিমুখে সায় দিয়া বলিল, হাঁ, বাবার সে বাতিক আছে। সমস্ত খবর খুঁটিয়ে না পড়ে তাঁর তৃপ্তি নেই। কিন্তু আমাদের মেয়েদের তাতে দরকার কি বলুন ত? কি হবে জেনে পৃথিবীর কোথায় কি দিনরাত ঘটচে!
এ কথা তোমার মেজদির মুখে শোভা পায় বন্দনা, তোমার মুখে নয়। এই বলিয়া বিপ্রদাস হাসিল।
বন্দনা বলিল, তারা কি আমার মেজদির চেয়ে বেশী জানে মনে করেছেন? একটুও না। শূন্য কলসী বলেই মুখ দিয়ে তাদের এত আওয়াজ বার হয়। তাদের আর কিছু না জেনে থাকি এ খবরটা জেনে নিয়েচি মুখুয্যেমশাই।
কিন্তু জ্ঞান ত চাই না চাইনে! জ্ঞানের আস্ফালনে মুখের মধু তাদের বিষ হয়ে উঠচে। জানে তারা আমার মেজদির মতো সবাইকে ভালবাসতে? জানে না। পারে তারা মেজদির মতো ভক্তি করতে? পারে না। ওদের বন্ধুই কি কেউ আছে? মনে হয় কেউ নেই এমনি পরস্পরের বিদ্বেষ। তাদের অভাবটাই কি কম? বাইরের জাঁকজমকে বোঝাই যাবে না ভেতরটা ওদের এত ফোঁপরা। কিসের জন্যে ওদের নিয়ে এত মাতামাতি? সমস্ত ভেতরটা যে একেবারে ঘূণে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, হয়েছে কি বন্দনা, এত রাগ কিসের? কেউ টাকা ঠকিয়ে নেয়নি তঃ না, ঠকিয়ে নেয়নি, ধার নিয়েছে।
কতঃ
বেশি না চার-পাঁচ শ'।
তাদের নাম জানো ত জানভূম কিন্তু ভুলে গেছি। এই বলিয়া বন্দনা হাসিয়া ফেলিল, কহিল, ছি ছি, এত অল্প পরিচয়েও যে কেউ কারও কাছে টাকা চাইতে পারে আমি ভাবতেও পারিনে। বলতে মুখে বাধে না, লজ্জার ছায়া এতটুকু চোখে পড়ে না, এ যেন তাদের প্রতিদিনের ব্যাপার। এ কি করে সম্ভব হয় মুখুয্যেমশায়? বিপ্রদাসের মুখ গম্ভীর হইল, কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া কহিল, তোমার মনটাকে তারা বড় বিষিয়ে দিয়েছে বলনা, কিন্তু সবাই এমনি নয়, ঐ মাসীমার দলটাই তোমাদের সমস্ত দল নয়। যারা বাইরে রয়ে গেল খুঁজলে হয়ত তাদেরও একদিন দেখা পাবে।
বন্দনা বলিল, পাই ভালোই। তখন ধারণা আমার সংশোধন করবো, কিন্তু যাদের দেখতে পেলুম তারা সবাই শিক্ষিত, সবাই পদস্থ লোকের আত্মীয়। গল্প- উপন্যাসের রঙ-করা ভাষায় সজ্জিত হয়ে এরা দূরে থেকে আমার চোখে কি আশ্চর্য অপরূপ হয়েই না দেখা দিত। মনে গর্বের সীমা ছিল না, ভাবতুম আমাদের মেয়েদের পেছিয়ে পড়ার দুর্নাম এবার ঘুচলো। আমার সেই ভুল এবার ভেঙ্গেচে মুখয্যেমশাই।
বিপ্রদাস সহাস্যে কহিল, ভুল কিসের? এঁরা যে দ্রুত এগিয়ে চলেছেন এ ত মিথ্যে নয়।
শুনিয়া বন্দনা হাসিল, বলিল, না মিথ্যে হবে কেন, সত্যিই। তবু আমার সান্ত্বনা এই যে সংখ্যায় এঁরা অত্যন্ত স্বল্প, — এঁদেরই গড়ের মাঠের মনুমেন্টের ডগায় ঠেলে তুলে হট্টগোল বাধানো যেমন নিষ্ফল তেমনি হাস্যকর। বিপ্রদাস বলিল, এ হচ্চে তোমার আর এক ধরনের গোঁড়ামি। স্বধর্মত্যাগের বিপদ আছে বন্দনা – সাবধান।
বন্দনা এ কথায় কান দিল না, বলিতে লাগিল, এই নগণ্য দলের বাইরে রয়েছে বাঙলার প্রকাণ্ড নারীসমাজ। এদের আমি আজও দেখিনি, বাইরে থেকে বোধ করি দেখাও মেলে না, তবু মনে হয় বাতাসের মতো এরাই আছে বাঙালীর নিশ্বাসে মিশে। জানি, এদের মধ্যে আছে ছোট, আছে বড়, বড়র দৃষ্টান্ত রয়েছে আমার মেজদিতে, তাঁর শাশুড়ীতে, - – এবার কলকাতায় আসা আমার সার্থক হলো মুখয্যেমশাই। আপনি হাসচেন যে?
ভাবছি, টাকার শোকটা মানুষকে কি রকম বক্তা করে তোলে। এ দোষটা আমারও আছে কিনা।
কোন্ টাকার শোক—সেই পাঁচশ'-র?
তাই ত মনে হচ্ছে।
বন্দনা হাসিয়া বলিল, টাকার জন্যে আর ভাবনা নেই। আপনাকে সেবা করার মজুরী হিসাবে ডবল আদায় করে ছাড়বো। আপনি না দেন মায়ের কাছে আদায় হবে অন্নদা ঘরে ঢুকিয়া বলিল, আটটা বাজে, বিপিনের খাবার সময় হলো।
বন্দনা ব্যস্ত হইয়া বলিল, চলো অনুদি যাচ্ছি। কেমন, যাই মুখুয্যেমশাই? "বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, যাও। কিন্তু সেবার ত্রুটি হলে মজুরী কাটা যাবে। ত্রুটি হবে না মশাই, হবে না। বলিয়া সেও হাসিমুখে বাহির হইয়া গেল।