ধানকাটা হয়ে গেছে। "ক্ষেতে মাঠে পড়ে আছে খড়” এখন কবিতার লাইনমাত্র। কেন না মণ্ডল ধানের ভাগের সঙ্গে খড়ের ভাগও নেয়। সবই নেয় সে। এদিক ওদিক পড়ে থাকা ধানের শিষ শুধু আলতাদাসী নেয়। আজও নিল।
আলতাদাসী ধানের শিষ নিলে কেউ কিছু বলে না। ওরা জানে, আলতাদাসীর অনেক নেবার, অনেক পাবার কথা ছিল। কিছুই সে নিতে পারেনি। তাই সে ধান নেয় কুড়িয়ে। আঁধারে আসে আলতাদাসী। ঠিক যেন এক প্রেতিনী। প্রেতিনীর মত নিঃশব্দে আসে ও নিঃশব্দে ফিরে যায় ঘরে।
আগে ও শনশন করে বাতাসের আগে আসত, বাতাসের আগে যেত। এখন ও ভরা পোয়াতি। পূর্ণগর্ভ টেনে চলতে কষ্ট হয় ওর। মণ্ডলের নাতিটা ওকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। আলতাদাসীর পেট ছেড়ে বেরোতে যেন বড় ব্যস্ত হযেছে। পেটে ছেলে লাফায়, যেন কিল মেরে বলে, আমি বেরোব।
বেরোবি, মাটিতে পড়বি, এত তোর ব্যস্ততা কিসের? বেরিয়ে কি দেখবি তুই? ধানে চালে মাছে দুধে তেলে কাপড়ে এক সোনার রূপকথা? গোয়ালে গরু, চালে খড়, অঘ্রানে লবান?
তেমন হয়, তেমন হয়, তেমন হয়।
মণ্ডলের বড় ছেলের বউ হবে, সে বউ পোয়াতি হবে, তার ছেলে তেমন অসচ্ছল সুখের সংসার দেখবে।
আমি তো আলতাদাসী, আরকপালী, ছারকপালী। দুলে ঘরের মেয়ে। আজকাল মুনিষ ছেলেও সাইকেল ঘড়ি চায় বলে আমার বর জোটেনা। বাপ নেই, মায়ের সঙ্গে পাট কাজ করি, মণ্ডলদের ধান রুই, ধান কাটি। এমনি করে করে আমি ষোল পেরোই, সতেরো। বৈশাখের ঝড়ে সব ধুলোয় ধুলো, অন্ধকার, বাগানে আম। টোকাই মণ্ডলদের বড় ছেলে আমার কোমর জাপটে আমাকে ঘরে টেনে নিল। ওদের বাড়ির পেছনে আমবাগান, আর সার সার ঘর। একসময়ে ঘরে ঘরে ওদের মাহিন্দার থাকত। এখন ঘরগুলিতে রাখা হয় শুকনো কাঠপাতা, গোবর সার। একটা ঘর আন্দিবুড়ির ঘর। আন্দি এ গ্রামের এক প্রাচীন কুঠে বুড়ি। ওই ঘরে থাকে ও, মণ্ডল বউ তাকে চাল নুন-তেল-আনাজ দেয়।
এটি মণ্ডলগিন্নির মহানুভবতা নয়। আন্দিবুড়ি তার দিদিশাশুডি। মণ্ডলের ঠাকুমা। মণ্ডলবাড়ির ইতিহাস নষ্ট রক্তের ইতিহাস। আন্দি যখন বউ, তার স্বামী থাকত শহরে। বাড়ির এক মাহিন্দারের সাহায্যে পর পর তিনটি ছেলে মেয়ে এনে মণ্ডল বংশকে বাঁচায় আন্দি।
কাজ ফুরালে মাহিন্দারটিকে চুবির দায়ে জেলে পাঠানো হয়। আন্দিকে সেদিন কেউ বের করে দেয়নি বাইরে। যে আন্দি যৌবনে স্বামীসঙ্গ পায়নি, যৌবন ঢলতে তার ওপর স্বামীকৃপা হল। নিজের কুন্ঠরোগ আন্দিকে দিয়ে, গর্ভে এক ছেলে দিয়ে স্বামী মরে যায়।
তারপর ক্রমে ক্রমে দেহ গলে পড়তে আন্দিকে বের করে দেওয়া হয়।
সেও অনেকদিনের কথা। খুবই আশ্চর্য, আন্দি আজও মরেনি। নাকটি তার কোটর, আঙুলগুলি গলে গেছে প্রায, কিন্তু দেহের ধ্বংস একটা সীমা অবধি গিয়ে কেন যেন থেমে গেছে। আন্দি বসে বসে বাগান পাহারা দেয়।
সেই সব পোড়ো ঘরের একটিতেই আলতাদাসীকে টেনে নিয়ে যায় মণ্ডলের বড়-ছেলে। বৈশাখী ঝড়ের দুপুরে। ঝড়ের পর বৃষ্টি নেমেছিল। ভেজা আঁচল গুছোতো গুছোতে আলতাদাসী ঘরে ফিরেছিল।
তারপর মণ্ডলের ছেলে গোপাল সরাসরি ওর ঘরেই আসত।
অন্তত কয়েক মাস ধরে। সময়টা গোপাল ভালই বেছেছিল। দুলে পাড়ার ডাকাবুকো ছেলেগুলির সবে হাজত বাস হয়েছে মাস ছয়েক কেস চলার পর। ধানকাটার হাঙ্গামায় বন্দী, মামলার সময়ে তারা সবাই ডাকাতি কেসে প্রোমোশন পায়। ওরা গ্রামে থাকলে গোপাল সাহস পেত না।
অন্যেরা নিশ্বাস ফেলে মাথা নেড়েছিল। এ রকমই হয। মণ্ডলদের ছেলে বল, কর্তা বল, পর গোয়ালে জাবনা খাওয়া ওদের অনেক দিনের অভ্যাস।
আলতাদাসীর মা বলত, কি করবি?
আমি জানি?
ছেলে হোক, মেয়ে হোক, একটা তো হবে। তা নিয়ে কি ভিথ্ মেঙে খাবি?
আমি জানি?
তবে কে জানে? তুলসীর বিয়ে কি করে দেব মা?
আমাকে আম কুড়োতে পাঠিয়েছিলে কেন? তখন মনে সী না? এখন এত কথা বলছ?
তুই তো জলাঞ্জলি গেলি। তুলোসীর কি হবে?
তার বিষেব আগে চলে যাব।
যেমন কথা তেমন কাজ। তুলোসীর সঙ্গে গড়াইদের মুনিষ বিশালের বিয়ের আগেই আলতাদাসী চলে গিয়েছিল মানিকের বাড়ি। মানিক জেলে যাবার পর থেকে তার মা বউ বড়ছেলের বাড়ি। মানিকের ঘব ভিটে সব এখন মণ্ডলদের। তবে দখল নেয় নি। একজনের বাসবসতের ভিটেতে চট করে আরেকজন ঘর তোলে না, চাষবাস করে না। ফেলে যাওয়া ভিটের গাছগাছালিতে, কপাট-জানালা উপড়ানো গহ্বরে অনেক দিন অবধি ঘর ছেড়ে যাবার ব্যথা ও বেদনা লেগে থাকে। আরো বহুদিন কাটলে তবে সে ব্যথা বেদনা সবে যায় কিংবা যায় না। পোড়ো ভিটের বোবা কান্নার কথা কেউ লেখে নি, তার কোন দলিল নেই।
আলতাদাসী সেখানেই গিয়ে উঠল। একা একা পোড়ো ঘরে কে থাকে বা? আলতাদাসী থাকে। তার কি ভয় নেই? গোপালের এঁটো ও, ওকে কেউ ঘাটাবে না: যদি সে কথা না মানে তাহলে কি হবে?
তা আমি জানি? তোর মুখে ওই এক কথা।
জানি না বলে ওই কথা বলি। আর কি বলব? তুমি বল, কি করবি? তা আমার কি আগে এমন দশা হয়েছে যে জানব কি করব? তুমি বল, ভিখ মাঙবি? তাই কি জানি" তুমি বল যদি ছয় মাস পোয়াতি না মেনে লোক ঢোকে তাহলে কি হবে? তাই কি আমি জানি? সত্যি কথা বলি, তা তোমার পছন্দ হয় না। আর আমার যা হোক তা হবে তুমি ভাব কেন? তুমি তোমার তুলোসীর বিয়ে দাও গে।
মা অবাক মেনেছিল। গাঁয়ে সবাই অবাক। এ কি মেয়ে মা? পেটের কাঁটা খসালি না, তা না খসালি। তুই তো প্রথম নোস। মণ্ডলরা এমন অনেক মেয়ে নষ্ট করেছে। তারা কেউ মরেছে আত্মঘাতী হয়ে, কেউ ভিখ মাঙতে বেরিয়েছে, কেউ জারজ ছেলেকে নিয়ে গ্রামেই থেকে গেছে।
কেউ হনহনিয়ে গিয়ে মানিকের ভিটেয় ওঠেনি। মানিকের ঘরের চারদিকে লাগাও আরো বাড়ি। কিন্তু তোকে যদি মারতে আসে মণ্ডলরা? তাহলে?
তখন কি হবে তা আমি জানি?
পোড়ো ঘরে চাটাইয়ের শয্যে হল। আবার আলতাদাসী পাট কাজে গেল গড়াইদের বাড়ি। আবার কাঠ কুড়োতে গেল মণ্ডলদের আমবাগানে। বেশির ভাগ গাছ আফলা হয়ে গেছের গাছগুলো সব আন্দিবুড়ির। মণ্ডলদের ভোগে কাজে লাগে না। আর। ওই জ্বালানি জোগায়, ব্যস। পাঁচ শরিকে বিবাদ। নইলে আম বাগান কবে ওরা বেচে দিত।
আলতাদাসী হাঁপিয়ে মরে কাঠ কুড়োতে, খানিক জিরোয়।
আন্দিবুড়ি বলে, এ কে এলি? আলতাদাসী?
আলতাদাসী জবাব দেয় না।
শুনেছি তোকে নষ্ট করেছে গোপাল?
আলতাদাসী জবাব দেয় না।
জমি চেয়ে নে, টাকা চেয়ে নে। ছেলে মানুষ করতে হবে না? পেট থেকে পড়বে ছেলে, খেতে দিতে হবে না?
আলতাদাসী জবাব দেয় না।
সবে রক্তের দোষ, জন্মের দোষ রে! কোনো ছেলেটা মা-বোন মানতে জানে না।
আলতাদাসী জবাব দেয় না।
পোড়ো ঘরে আগড় নেই। রাতে ভয় ভয় করে। আলতাদাসী রাত কাটায় বসে, ঘুমোয় ভোরের সুবাতাসে। রাতে বসে বসে মনের মধ্যেই পাক খায় সাপ। সাপের বিষে বড় জ্বালা, স্মৃতিতে বড় জ্বালা।
-দে দেব, ধান জমি দেব এই এত্ত জমি।
আলতাদাসীর চোখ জ্বালা করে।
-লিখে পড়ে দেব।
আলতাদাসীর মন জ্বালা কবে।
-ঘর তুলে দেব, চৌচালা ঘর।
আলতাদাসী ভীষণ রাগে তুষের আগুনে পোড়ে। পুড়ে পুড়ে জ্বলে জ্বলে ওর রাত কাটে।
দু দিন না যেতে তুলোসী আসে, তুলসীদাসী। ঘরে চল্ দিদি। মণ্ডলকর্তা বলছে।
কেন?
রেগে গেছে খুব। বলছে, তোর বা কি মতলব আছে, তাতেই এসে এখানে উঠেছিস্।
তুই যা।
যাবি না?
না।
মাকে বলি গে, তুই যাবি না?
বলিস।
মণ্ডলকর্তা বলেছে, তুই তাদের বিপদে ফেলতে চাস। তাতেই এসে ডাকাতপাড়ায় উঠেছিস।
কাকে বলেছে?
মাকে।
মা এসেও সেই কথাই বলে যায়। ভীষণ, ভীষণ রেগে গেছে মণ্ডলকতা, আর সে রেগে গেছে বলেই মা ভয় পাচ্ছে খুব। মণ্ডলকর্তা মানছে না যে গোপালই আলতাদাসীর অজাত সন্তানের বাপ। সে বলচে, নগনের বেটি আলতাদাসীর অজাত সন্তানের বাপ। সে বলছে, নগনের বেটি আলতাদাসী কোথায় কার সঙ্গে নষ্ট হয়েছে। এখন সে দোষ গোপালের ঘাড়ে চাপাতে চায় বলে এই নাটক করছে। এই ভাবে নাটক করে আলতাদাসী আর নগেনের বউ মোচড় দিয়ে কিছু বের করে নিতে চায়। সে গুড়ে বালি। মণ্ডলকর্তার এখনো বেঁচে আছে।
মণ্ডলকর্তার রাগ হওয়া স্বাভাবিক। গ্রামের মেযে বউ মানে নি মণ্ডলরা। যখন ইচ্ছে ভোগ করেছে। জারজ সন্তানের জন্মও দিয়েছ সে সব মেয়ে বউ। কিন্তু কখনো কেউ গিয়ে অন্যত্র ওঠেনি।
আলতাদাসী বলে, ঘরে যাও।
মারে যদি তোকে?
আলতাদাসী বলে, বেশ চেঁচিয়েই বলে, মার দিলে মার খাবে।
এ কথা সে একেবারেই বলে না। আবাবও বলে। চুরি ডাকাতি ঠেকাতে গ্রামে যখন কমিটি হয, পঞ্চায়েত প্রধান আর ঝাণ্ডাবাহী ছেলেবা আসে মিটিং করতে। সেই মিটিংযে হনহনিয়ে চলে যায় আলতাদাসী। একটু দূরে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে নিজের কলঙ্কের কথা। নামটা বেশ স্পষ্ট করে বলে গোপালের আব মণ্ডলেব। রুক্ষ চুল ওড়ে ওর, বলে, ছেলের পাপ গর্ভে বইছি, বাপ বলছে ঠেঙাব। এর ফয়সালা করে দিয়ে যাও।
ফয়সালা হয় না, মণ্ডলদের মুখ হাসে। আর গ্রামের অন্তাজ পাড়ায় এর ফলে আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া হয়। দীর্ঘ সময়কাল ধবে দেওযানি ও ফৌজদারী মামলা চালিয়ে মণ্ডল ওদের কোমর ভেঙে দিয়েছিল। মামলার রায় ওদের বিপক্ষে যায়। ফলে ওরা ভাগ্যবাদী হয়ে হতাশায় ভেসে চলেছিল। রাগে হতাশায় পাগল পাগল আলতাদাসী যখন ঘর ছেড়ে আসে, কেউ এসে তার পাশে দাঁড়ায়নি। কিন্তু আলতাদাসী যখন মনের জ্বালায় কথাগুলো বলে এল ওরা যেন ছাই সরিয়ে নিজেদের কণা কণা মনুষ্যত্ব খুঁজে পেল।
কাজ হোক না হোক, এমন করে বলল তো! বলা যায়, তাহলে বলা যায়।
সেদিনই সন্ধ্যায় সনাতনের মা এসে আতলাদাসীর কাছে শুল। তার বড় ছেলে শুল দাওয়ায়। পরদিন গড়াইদের পাটকাজ করার সময়ে ভগীরথের বোন ওকে সঙ্গে নিয়ে গেল। তারপর একদিন সনাতনের মা বলল, ভরা মাসে তুই ধান কাটতে যাস নে মা। মা ছেলে দুজনে দু ঠাঁই হ, তারপর আবার খাটিস।
আলতাদাসীর অজাত সন্তানকে বাঁচানো এখন যেন সনাতনের মায়ের দায়। গর্ভের সেই শিশু আব গোপন লজ্জার স্মারক নয়, পাপের ফল নয়। ওই শিশুকে ঘিরে গ্রামে খুব তাড়াতাড়ি শিবির ভাগ হয়ে গেল। ভগীরথের বোন প্রথম সে কথা ঘোষণা করে এল। গড়াইদের বাডির গোযাল কাড়তে গিয়ে।
ভগীরথেব বোন তেনযনীর মুখে বড় ধার। গড়াইগিন্নি ওকে জলপানের মুড়ি ঢেলে দিয়ে বলল, নগনের মেয়েকে ঘবে তুললি কেন রে?
তুলব না কেন?
কেলেঙ্কাবি করে এল, তাকে নিয়ে ঢলাঢলি-
কি হয়েছে?
অন্যায় নয় সেটা?
একশো বার অন্যায়। গোপাল মোড়লের অন্যায়। তোমাদের ঘরের ছেলেরা আমাদের ঘরের মেয়ে বউয়ের লালচে মরে, সেটা অন্যায় হয় না? যত দোষ নগনের মেয়ের? বলি পেটের ওটা কি শূন্য হতে এল?
তাই বলছি? তবে কি বলছ? বুঝি না মা তোমার কথা। তুমিও আমার কথা বোঝ না। তুমি নয় বাবুকে শুধোও।
এ কথায় গড়াইগিন্নি চুপ। গড়াইকর্তা একই বাড়িতে দীর্ঘকাল বিধবা ভাইবউযেব সঙ্গে বাস করেছেন। তেনয়নী সেই খোঁচাটাই দিয়ে গেল। তোমাদেব ঘরে ভাসুর-ভাদ্রবউ একসঙ্গে থাকলে কেলেঙ্কারি হয় না। আমাদের নির্দোষী মেয়েকে বাবুরা নষ্ট কবলে কেলেঙ্কারি!
কথাটি গড়াইগিন্নিকে হজম করতে হল। বাড়িতে জামাই আছে।
এ সব কথা তিনি মোটে চান না। তেনযনী সুযোগ পেয়ে বলল।
এ বাড়িতে বিধবা ছোটগিন্নির হঠাৎ কবে ছেলে হল, তোমবা বললে
স্বপ্নে শিব এসেছিল। তাতেই কেলেঙ্কাবি হল না। আমাদের ঘরে
স্বপ্নে শিবঠাকুবও আসে না। তাতেই কেলেঙ্কাবি হয়। ভদ্রলোকে
ছোটলোকে তফাত থাকবে না? শিল্ব যে ছোটজাতের ঘর চেনে
না।
গডাইকর্তা সব শুনে বললেন, এখন ওদেব দিন পড়েছে, বলছে। তবে মণ্ডল অমন চেটাং চেটাং করতে গিয়ে আমাদের মুখও পুড়িয়েছে। সেই থেকেই এত কথা।
আলতাদাসী এত সবের কাবণ। আলতাদাসীব কপালে যা ঘটেছে,
তাতে ও ছাইকুডানি, পাঁশকুডানি তাতে ও পথে ফেলা এঁটো শালপাতা
বই তো নয়। তাই হত। কিন্তু সবটুকু ঘটল এমন সমযে, যখন
গ্রামেব লোকগুলির মনের জমিনে এলোমেলো নানা বীজের পোড়তলা। এই মানুষ, এই মানবজমিনে শুধু বঞ্চনা ও নিপীড়নের আবাদ চলে। ফলে অদ্ভুত সব বীজেব অঙ্কুর গজায়।
এক আশ্চর্য সমযে আলতাদাসী পোয়াতি হয়। দীর্ঘদিন এখানে সেই রাজনীতির আন্দোলন। দশ বছর আগে বাতাস অন্যরকম ছিল। কিন্তু কোথায় কোথায় পঞ্চাযেত আপিস ঘেরাও হচ্ছে। হাইকোর্টের ইনজাংশন উপেক্ষা করে বর্গাদার ধান কাটবে বলে বাঁকানো কাস্তেতে শান দিচ্ছে। এসব কথা হাওয়ায় ভাসে। ওকডার বীজ যেন, যেখানে পড়বে সে জমি যত রুক্ষ হোক, ওকড়ার বন গজাবে।
এখন আলতাদাসীকে ঘিরে সন্ধ্যেবেলা আশ্চর্য সব কথা বলে কেউ কেউ। ভয় আর হতাশার নিচে কথাগুলি বেঁচে ছিল কে জানত!
খেজুর পাতার চেটাই বোনে মেয়ে পুরুষে। বুনতে বুনতে হঠাৎ ভগীরথ বলে, মধু হাঁসদা কি মরত? ওই লক্ষ্মীকান্ত বেরা পুলিস নিয়ে গিয়েছিল।
ঘটনাটি এগারো বছরের না হোক দশ বছরের পুরনো। লক্ষ্মীকান্ত বেরার কথা বলে ভগীরথ আর সেই সঙ্গেই বলে, বেরা, মণ্ডল, গড়াই সব এক গোয়ালের গরু। এখানে কোনো মধু মাস্টার নেই বলে কোনো হাঙ্গামা হয় না।
তেনয়নী বলে, তখন ক'বছর কোনো জনা আমাদের মেয়ে বউ নিয়ে টানাটানি করেনি। ভয় পেয়েছে কত।
সনাতনের মা বলে, মতেউরকে মনে আছে! শশীবাবুর গলায় পা রেখে জিভ টেনে কবুল করাল। প্রসাদীকে নষ্ট করেছি, যেমন যেমন, দশ বিঘা জমি দেব।
আদায় হয়েছিল।
আমার জনা'ই আর সব ছেলেদের মিছে মামলায় ফাঁসাল যে। ওরা বলে আদালতের নিষেধ মানি না, ধান কাটব ঘরে নেব, তাতেই
তো! নইলে ওরা থাকলে... এইসব চিন্তা ভাবনায় ফসল ওদের মনে বীজ থেকে অঙ্কুর, বাঙ্কুর থেকে গাছ, গাছের ফসল হয়, সে ফসল পাকে।
আর ধান পাকে।
আলতাদাসী যায় ধান কুড়োতে। ওকে ধান কাটতে দেয় না কেউ। তবু ও কুড়োয়। না, তোমরা দিচ্ছ বলেই হাত পেতে নেব না। যত পারি কুড়িয়ে আনব।
আর এমনি ধান কাটতে কাটতে ওরা চেয়ে দেখে ওদের বড় সাধ ভালবাসার চার বিঘা জমি। এক লপ্তে চার বিঘা জমি। এড়ানচেড়ান অযত্নের চাষ। এই জমি নিয়েই মামলা বিরোধ সব। নিজের দখল রাখতে মণ্ডল মাহিন্দার দিয়ে চাষ করিয়েছে। অযত্নের চাষ। তবু ধান, তবু পাকা ধান। মাহিন্দার কাটবে, না ভাড়া করা মুনিষ?
ধান কাটাব সমযে মণ্ডল দাঁড়িয়ে থাকে। হিংস্র চোখে দেখে আলতাদাসীকে। এখন আলতাদাসীর হাতে লোহার কড়া। সনাতনের মা পরিয়ে দিয়েছে। আলতাদাসীর মান এনে দিয়েছে। মণ্ডলের চোখে বিষ, এখন তুই ভরা পোয়াতি, লোহা থাকলে ভয় নেই যা যা, আপদবালাই দূরে যা।
এই ঝড়ে পড়া ধান কুড়োতে কুড়োতে, কাস্তের ঘায়ে কেটে পড়া ধানের শিষ কুড়াতে কুড়াতে আলতাদাসীর ব্যথা ওঠে। কি কাণ্ড মা, কি কাণ্ড! ধরাধরি করে ঘরে নেবে কি, ব্যথায় আলতাদাসী ওলট পালট খায়। তেনয়নী ছুটে আসে ধামা নিয়ে। ধামা উপুড করে চেপে ধরুক আলতাদাসী, ব্যথায় জোর আসবে। কাঁদিস না মা কাঁদিস না, কান্না চাপ, তাড়াতাড়ি ছেলে হবে। মেয়েরা ঘিরে ধরে আলতাদাসীকে। তুলোসীদাসী আনে বাঁশের চেঁচাড় আর শক্ত সুতো। ধানকাটা শেষ না হতে মাঠটি হয় আলতাদাসীর সন্তানের শয্যা।
পুরুষরা দূরে সরে বিড়ি ধরায় ও অবাক মেনে মহাখুশিতে বলে, খুব হয়েছে মণ্ডলের। এখন মাঠ তো অণ্ডচ হল।
পুজো দাও, শুদ্ধ কর।
ভগীরথ বলে দূর! মাঠ অণ্ডচ হয় না। কেন? কেন?
তিনি ধান বিয়োচ্ছেন, এ ছেলে বিয়োচ্ছে-তিনি কি অশুচ হচ্ছেন!
জ্ঞানের কথা রাখো দেখি। মণ্ডলের দণ্ড হোক খানিক।
আজ ওরা নিজেরাই নিজেদের ছুটি দেয় ও দূর থেকে মণ্ডলকে আসতে দেখে ফুকুড়ি করে শিয়াল ডাক ডেকে ওঠে। তারপব সমস্বরে হেঁকে, আলতাদাসীর ছেলে হল, মণ্ডলকতার নাতি হল, এবার আমরা মিঠাই খাব গো! বলে এক সঙ্গে দুদ্দাড় পালায়। মণ্ডলকতাব কানে কথাগুলো ঠিকই যায। ভীষণ রাগে ফুঁসতে থাকে সে।
কি হয়েছে, কোথায় হয়েছে?
তেনযনী চিল চীৎকারে বলে, আলতাদাসীর ছেলে হয়েছে গো। এদিকে এস না।
মণ্ডলকর্তা রাগে এখন দিশেহারা। বটে! আছড়ে মেরে ফেলব সাপের ডেকো, আছডে মারব। বলে সে তেডে আসে। এখন তাকে খ্যাপা মোষের মতই দেখায়। বড় ভীষণ রাগ মণ্ডলকতার, বড় ভ্যাল সে। তেনয়নীরা সমস্বরে চেঁচায়, সনাতন রে! ভগীরথ!
সনাতনরা আসে, আসে ১ণ্ডল কর্তার মুনিষ মাহিন্দাররা। তেনযনীরা আলতাদাসীকে আগলে রাখে।
কি হয়েছে, কি হল? আমরা বাশ আনতে যাচ্ছিলাম, খাটুলিতে আলতাদাসীকে ঘরে নেব।
অবসন্ন, বক্তাক্ত আলতাদার্সা মাটিতে শুয়েই হাত তুলে দেখায় মণ্ডলকর্তাকে। বলে, ছেলে মাবতে এসেছে।
মারবে! ছেলে!
ভগীরথ মণ্ডলকতার কনুই ধবে টেনে ৬ পাশে সরায। বলে, এদিকে এসো কর্তা। কোথায় যাচ্ছেন?
মেরে ফেলব ওটাকে। বতন কোথায়, হারাণ? রতন ও হারাণ মণ্ডলের মাহিন্দার। তাদের দেখা যায় না। মণ্ডলকে
ভগীরথ এখানে ধরে থাকে ও সনাতন বলে, তারা কেউ নেই কর্তা। মণ্ডলের মাথায় রক্তাক্ত কুয়াশা ক্রমে সরতে থাকে। কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সে। সনাতন ও ভগীরথ তার এত কাছ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে কেন? মণ্ডল কনুইটা ছাড়িয়ে নেয় ঝটকা মেরে। হারাণ, রতন, তার ছেলে গোপাল, কেউ আসে না কেন? সনাতনের ভাই জনাই, ভগীরথের ছেলে বিজয়, সকলকে মণ্ডল সেদিনই হাজতবাসী করেছে। জজ রায় দিলে মণ্ডল কি করবে? মজিদ শেখ ফসফস করে বিড়ি টানছে। ওর ভাগ্নে আর ভাইও ওই বিতর্কিত জমিতে বর্গা দাবীদার। ধান ক্ষেতে নিমনিমে সন্ধ্যায় এতগুলো শত্তুরের মাঝে সে কি করছে।
কিন্তু ভয় পেয়েছে তা একবাব বুঝতে দিযেছে কি মণ্ডল, খুঁটি তোমার নড়ে গেল। সেদিন নগেনেব মেয়ের অকথা কুকথাঁব ফলে দশটা গ্রামে তার মুখ হেসেছে। দশটা গ্রামের লোকই ছিল সেখানে একজন দু'জন করে। সেদিন মুখ পুড়েছে, সেই থেকে লোকজনের চোখের চাহনি দুর্বোধ্য হচ্ছে, করা যেন কোথায় আন্দোলন করছে জোরদার, বারবার থানা ঘেরাও করছে, কর্মীদের ধরলে তাদেব খালাস করে আনছে-এদের চোখগুলোতে যেন হুমকি থাকে-না, মণ্ডল এখন ভয়ের কথা জানতে দেবে না।
পথ ছাড় সনাতন, যাই।
সনাতনবা কথা বলে না। চেয়ে থাকে।
পথ ছাড়।
ওরা চেয়ে থাকে।
পথ... ছাড়....
মজিদ বলে, না কর্তা।
পথ ছাড়বি না?
ভগীরথ বলে, আগে তুমি ফয়সলা কর।
কিসের?
কিসের তা ভালই বুঝছ। আমরা মেয়ে পুরুষে বিশজনা থানায় সাক্ষী দেব যে তোমার ছেলে নগেনের মেয়েকে নষ্ট করেছে। সে কথা সেদিন বহুতজনে শুনেছে।
সবাই বলে, তারাও বলবে।
ভগীরথের মনে বিজয়ের ক্রুদ্ধ, অসহায় মুখ ভাসে। এখন ওর গলা চড়াতে থাকে, তারপর তুমি নগেনের বউকে হুমকি দিয়েছে, সে কথাও সবাই জানে।
হেই ভগীরথ! শোন....
তোমার কথা আমরা নিত্য শুনি, তুমি নয় একদিন শুনলে! আজ তুমি ছেলে মারতে এসেছ। বার বার ঘুঘু ধান খাবে, নিত্য পার পাবে? তাই পায়? মিছে মামলা করে পার পেয়েছ, খুন করে পার পেতে চাও?
ফয়সালা হোক! ফয়সালা! সবাই চেঁচিয়ে ওঠে। এ সময়ে নিতাইবা কাকে যেন টেনে আনে ও হেঁকে বলে, কাজের কাজীকে এনেছি গো সনাতন কাকা! ইনি আবার বন্দুক খুঁজছিল।
গোপালকে ওরা ঠেলে দেয় ও বলে, এই যে!গোপাল ধপাস করে পড়ে যায় ও নিতাই ওকে টেনে দাঁড় করায়। ভগীরথের মাথার আগুন জ্বলে। গোপালকে সে মুনিষখাটা হাতে প্রবল চড় মারে ও বলে, বন্দুক আনছিল, বন্দুক! বাপের কাঁধে হাগে ব্যাটা। কি কর্তা, কবুল করাচ্ছি, শুনবে? কি গোপালবাবু। নগেনের মেয়েকে নষ্ট করেছে কে?
গণধোলাইয়ে ডাকাত নিহত গোছের সংবাদ, যা নিষত পড়া যায়, তা গোপালের মনে ঝলকে ওঠে। সে চেঁচিয়ে ওঠে, আমি, আমি!
তেনয়েনী চিল চিৎকারে বলে, আলতাদাসী বলছে, তাকে জমি দেবে, ঘর তুলে দেবে বলেছিলে?
বলেছিলে?
সনাতনের থাপ্পড়ে গোপালের নাক থেঁতলে যায়! সে কেঁদে ফেলে ও বলে, বলেছিলাম।
মার ব্যাটাকে চেঁচিয়ে ওঠে কে। ভগীরথ বলে, ছেলে কবুল গেল, এখন তুমি বল।
মণ্ডলের চার পাশে সব ধসে পড়তে থাকে। সে বলে, দেব, জমি দেব।
আজ বলছ, কাল থানায় যাবে।
না, যাব না।
সাপের ডেকোকে বিশ্বাস কি! মাহিন্দার হতে তোমাদের বংশ হল, তাকে জেলে ঢোকালে। তুমি টাকা দাও।
কত টাকা?
পাঁচ হাজার টাকা দেবে কর্তা। ভগীরথ নিজের গলা শুনে তাজ্জব বনে যায়। আলতাদাসী তাকে লড়াকু করে ছাড়ল? এ সাহস তার কোথায় ছিল লুকানো? সে বলে, তা হলে জমি হয, ঘর ওঠে, ছেলেটা বেঁচে থাকে।
তাই হবে।
হবে না, হোক। ভগীরথ সকলেব দিকে চেয়ে বলে, যখনকার কথা তখন কাজ না হলে হয় না। ঠাণ্ডা মেরে যায়। তখন যেয়ে পাঁশাদায় পড়লে আমাদের কথা, ওনার কাজ।
সবাই হই হই করে ওঠে। সনাতন মহোল্লাসে বলে, সকালে উঠে নিত্যি গাধা দেখা রে ভগীরথ। আজ দেখেছিলাম। কি দিনটা গেল তাই বল?
দেখো। তোমার গাধা নিত্য পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে যাবে—সবাই হেসে ওঠে।
অনেকক্ষণ কেটে গেছে। আলতাদাসী আজকের রানী। কোলের
কাছে ছেলে নিয়ে খড়ের বিছানায় ঘুমোচ্ছে।
বাইরের ও ঘরের দাওয়ায় বসে পুরুষরা জটলা করে। ভগীরথ বলে, কাল বগুলের কাজ তুলে দিয়ে পরশু থেকে বিবাদী জমিতে
লাগতে হচ্ছে। ধান উঠবে আমাদের ঘরে।
মজিদ শেখ বলে, বিবাদ হলে কি করবে তা ভেবেছ? বিবাদ হবেই হবে।
ভেবেছি।
তোমরা কি ভেবেছ? আমি তো কাল একরামপুব যাচ্ছি। সেখানে ওরা লড়াই লড়ে এ সব কয়সলা করছে।
তুমি কি একলা যাবে? আমরাও যাব।
একরামপুরে এখন আন্দোলন চলছে।