shabd-logo

রুদালী

11 December 2023

3 Viewed 3

টাহাড গ্রামটিতে গঞ্জ ও দুসাদবা সংখ্যাগুরু। শনিচরী জাতে গঞ্জ। গ্রামের আব সকলের মত শনিচরীর জীবনও কেটেছে অসুমার দারিদ্র্যে। শনিবারে জন্মেছিল বলে ওর কপালে এত দুঃখ, একথা এতদিন ওব শাশুড়ি বলত। যতদিন বলত, তখন শনিচরী ছিল বউ। মুখ তেমন খোলেনি। শাশুড়ি যখন মরে তখনো শনিচরী বউ মানুষ। শাশুড়িকে জবাবটা ওর দেওয়া হয়নি। এখন মাঝে মাঝেই ওর কথাটা মনে পড়ে। একা, আপন মনে ও বলে, ওঃ! শনিবারে জন্মালে শনিচরী নাম হয়, বউ অপয়া হয়। তুমি তো সোরি ছিলে, কোন সুখে জীবনটা কাটল? সোফ্রি, বুধুয়া, মুংরি, বিরি, কার জীবনটা সুখে কাটে?

শাশুড়ি মরতে শনিচরী কাঁদেনি। ওর বর আর ভাশুর, শাশুড়ির দুই ছেলেকেই হাজতে পুরেছিল মালিক মহাজন রামাবতার সিং। এক টাল গম চুরি যেতে রামাবতার এমন ক্ষেপে যায়, যে টাহাড়ের যত দুসাদ, যত গঞ্জ পুরুষ, সকলকেই দেয় জেলে পুরে। শাশুড়ি শোখজ্বরে ভুগে ভুগে, খেতে দে! খেতে দে! বলতে বলতে হা অন্ন! জো অন্ন! বলতে বলতে মরে গিয়েছিল হেগে মুতে। ঝিমঝিমে বর্ষার রাত ছিল। শনিচরী আর তার জা মিলে বুড়িকে মাটিতে নামিয়েছিল। রাত পোহালে দোষ লেগে যাবে, ঘরে নেই এক খুঁচি গম, প্রায়শ্চিত্তের কড়ি আসবে কোত্থেকে? রাতের মড়া যাতে রাতে বেরোয় সে জন্যে শনিচরীই সেই বর্ষার রাতে প্রতিবেশীদের ডাকতে বেরিয়েছিল। হাতে পায়ে ধরে সকলকে আনতে, বুড়িকে দাহ করার ব্যবস্থা করতে শনিচরী এত ব্যস্ত ছিল, যে কাঁদবার সময় হয়নি। হয়নি তো হয়নি! বুড়ি যে জ্বালা দিয়ে জ্বালিয়ে গেছে, কাঁদলেও তো শনিচরীর আঁচল ভিজত না।

বুড়ি একলা থাকতে পারত না জীয়ন্তে। মরেও একা থাকতে পারেনি। তিন বছর যেতে না যেতে ভাশুর, জা, সবাই সাফ। রামাবতার সিং তখন গ্রাম থেকে দুসাদদের, গঞ্জদের তাড়াবে বলে উঠেপড়ে লেগেছে। তাড়িয়ে দেবে রামাবতার, সেই ভয়েই শনিচরী তখন কাঁটা হয়ে থাকত। ভাশুর আর জা মরতেও কাঁদা হয়নি। কাঁদবে, না লাশ জ্বালাবার, সস্তায় শ্রাদ্ধ সারবার কথা ভাববে? এ গ্রামে দুঃখী মানুষ সবাই। প্রতিবেশীর দুঃখ বোঝে। তাই টক দই, ভুরা চিনি আর ধেনো চিড়ে পেয়ে খুশি হয়ে যায়। শনিচরী আর ওর বর যে কাঁদেনি, তাতেও সবাই বলে, কাঁদতে কি পারে এখন? তিন বছরে তিনটে মরল। চোখের জল বুকে পাথর হয়ে জমে যাচ্ছে! শনিচরী মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। মালিক হজৌরের খেত ঠেঙিয়ে যে খুদকুঁড়ো আনা, তাই এতগুলো মানুষের সম্বল। দুটো মানুষ মরল, ভাল হল। নিজেরা পেট ভরে খাবে!

স্বামী মরতে কাঁদবে না, তা তো ভাবেনি শনিচরী! অথচ, এমন কপাল ওর ঠিক তাই ঘটল। তখন ওদের একমাত্র ছেলে বুধুয়া বছর ছয়েকের। শনিচরী ছেলেকে ঘরে রেখে অসীম উদ্যমে, সংসারটা বেঁধে তোলবার জন্যে, চলে যায় মালিকের বাড়ি। দমাদম্ কাঠ চ্যালা করে দেয়, গরুর ঘাস এনে দেয়, ফসলের মৌসুমে স্বামীর সঙ্গে খেতে গিয়ে ফসল কাটে। ভাশুরকে তার শ্বশুরের দেওয়া জমিটুকুতে ঘরখানা সবে তুলেছে দুজনে। দেওয়ালে শনিচরী চিত্র এঁকেছে। উঠোনে বেড়া দেবে বুধুয়ার বাপ, উঠোনে লঙ্কা, বেগুন আবাদ করবে। শনিচরী হুজুরাইনের কাছ থেকে বকনা বাছুর পালানি নেবে, সব ঠিক। শনিচরীর বর বলল, চল, তোহরিতে বৈশাখী মেলা দেখে আসি। শিবঠাকুরকে পূজাও দেব। সাতটা টাকা তো জমেছে।

মেলা খুব জমেছিল। বড় বড় রহিস লোকরা শিবের মাথায় ঢালছিল ঘড়া ঘড়া দুধ। সেই দুধ কয়েকদিন ধরে মাটিকাটা চৌবাচ্চায় জমছিল। টক দুর্গন্ধ উঠছিল দুধ থেকে, মাছি ভনভন করছিল। পাণ্ডাকে টাকা দিয়ে সেই দুধ গেলাস গেলাস খেয়ে অনেকের হায়জা হয়, অনেকে মরে। বুধুয়ার বাপও মরেছিল হায়জায়। তখনো আংরেজরাজ। গোরমেনের লোক সব হায়জা রোগীকে টেনে টেনে হাসপাতালের তাঁবুতে নিয়েছিল। তাঁবু মাত্র পাঁচটা। রুগী ষাট সত্তর জন। তাঁবুর চারদিকে ছিল কাঁটাতারের বেড়া। শনিচরী আর বুধুয়া বেড়ার এ পাশে বসেছিল। বসে বসেই শনিচরী জেনে যায়, বুধুয়ার বাপ মরে গেল। কাঁদতে সময় দেয়নি গোরমেনের লোক। লাশগুলো তারাই স্বালায়। শনিচরী আর বুধুয়াদের টেনে নিয়ে গিয়ে হাতে কলেরার সুই দেয়। তাতে যা ব্যথা হয়, সেই ব্যখাতেই মা ছেলে খুব কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে শনিচরী কুরুডা নদীর তিরতিরে জলে স্নান করে মেটে সিঁদুর মুছে, হাতের চুড়ি ভেঙে গ্রামে ফেরে। গালার চুড়িগুলো নতুন। মেলায় গিয়ে পরেছিল। তোহরিতে শিবমন্দিরের এক পাণ্ডা বলে, এখান থেকে আদ্যপিণ্ড দিয়ে যা। বিভুঁয়ে এসে মরল বুধুয়ার বাপ। - তার কথাতে, পাঁচ সিকে দক্ষিণা দিয়ে বুধুয়ার হাত দিয়ে বালি আর সত্তুর পিণ্ড দেওয়ায় শনিচরী। কিন্তু তা নিয়ে গ্রামে কি কম ঝড় উঠেছিল! মোহনলাল ব্রাহ্মণ, রামাবতারের স্থাপিত বিগ্রহের সেবক, সে বলেছিল, ওঃ! বালির পিণ্ডি নদীর জলে! বুধুয়া যেন রামচন্দ্র। বালি দিয়ে দশরথের পিণ্ড দিচ্ছে!

বরান্তোন বলল যে!

তোহরির ব্রাহ্মণ জানবে টাহাড়ের মানুষের কিরিয়াকরণের নিয়ম? তার কথায় পিণ্ডি দিয়ে তুই আমার মাথাটা হেঁট করে দিয়ে এলি তো?

মোহনলালকে তুষ্ট করতে, রামাবতারের কাছে "পাঁচ বছর খেতে বেগারী খেটে পঞ্চাশ টাকা শোধ করব' খতে টিপসই দিয়ে কুড়ি টাকা নিতে, সে টাকায় বুধুয়ার বাপের শ্রাদ্ধ করতে, শ্রাদ্ধ মিটতে কচি ছেলে নিয়ে হা ভাত! জো ভাত! করতে এমন ব্যস্ত থাকে শনিচরী, যে বুধুয়ার বাপের জন্যে আর কাঁদা হয়নি। একদিন ঘোর গ্রীষ্মে পুড়তে পুড়তে রামাবতারের খেতে নিড়িনি দিতে দিতে শনিচরী হঠাৎ নিড়িনি ফেলে একটা পিপল্ গাছের ছায়ায় বসেছিল গিয়ে। অন্য মজুরদের বলেছিল, আজ আমি বুধুয়ার বাপের জন্যে কাঁদব। বুক ফাটিয়ে কাঁদব।

আজই কাঁদবি কেন? দুলন গঞ্জ বলেছিল।

তোরা মজুরি নিয়ে ঘর যাবি। আমি খত লিখে বসে আছি। আমি যাব চাবটি ভুট্টার ছাতু নিয়ে। তাই কাঁদব। আমার কান্না পায় না?

সেই দুঃখে কাঁদবি। এতোয়াকে টানছিস কেন?

তু বহোৎ খচড়াই লাটুয়াকে বাপ।

হিসেব করে দেখেছিস? এক বছর হয়ে গেল। এক সাল!

হাঁ রে।

এক সাল সে নেই?

পেটের জ্বালায় সময় যায়।

আমি যদি মরতাম।

বুধুয়া কোথায় যাবে? পাগলামি করিস না। শোন্ খত যা লিখেছিস তা লিখেছিস। এখন দেখ, আমি কাজ করি জিরিয়ে জিরিয়ে। যদ্দিন কাজ, তদ্দিন মজুরি। তুই জান সড়িয়ে ও হারামীর খেত সাফ করছিস কেন? জিরেন নে। যদ্দিন কাজ, তদ্দিন জলখাই।

সেদিনও শনিচরীর কাঁদা হয়নি।

গ্রামসমাজে সব কিছু সকলের চোখে পড়ে। শনিচরী যে কাঁদেনি, তা নিয়ে অনেক কথা হয়। শনিচরী সে সব কথা কানেও নেয়নি। রামাবতার সিংয়ের খতের টাকা শোধ হচ্ছিল না, বোধ হয় শোধ হতও না। কিন্তু শনিচরী তখন একটা কালো এঁড়েকে দেখাই ভালাই করছিল। আসরফির মা ওর হেফাজতে এঁড়েটা রেখে গয়াজী গিয়েছিল। তখনি রামাবতারের খুড়ো মরে, আর মৃত্যুকালে ওই এঁড়েটার ল্যাজ বুড়োকে ধরিয়ে দেওয়া হয়। বৈতরণী পারের অব্যর্থ ওষুধ। শনিচরী দেখে ঘরে অনেক লোক। রামাবতারের কুটুম স্বজন সব। শনিচরীর মাথায় হঠাৎ খচড়াই খেলে। সে দোরের বাইরে দাঁড়িয়ে হেঁকে বলে, গোড় লাগি গরিবের মা বাপ! গরিব শনিচরী আপনাদের সেবায় লাগল আজ! তা একটা আর্জি। সে খতের টাকা শুষে গেছে বলে লিখে দিন!

খুড়ো মরা মানে আরো পঞ্চাশ বিঘা সরেস জমি হাতে আসা। রামাবতার কি জানি কেন, শনিচরীর কথা মেনে নেয়। এ নিয়ে পরে রামাবতারকে অনেক কথা শুনতে হয়। অন্য জোতদার মহাজনরা বলেছিল, খতের টাকা শোধ গেছে বলে মেনে নিল যখন, তখন থেকে অদ্ভুৎদের রবরবা বেড়ে চলেছে। টাকাটা কিছু নয়। নাগরার ধুলোর চেয়েও মূলাহীন। কিন্তু খতটা হল সেই জোয়াল, যা কাঁধে নিয়ে বলদগুলো খেটে চলে।

রামারতার বলত, বুড়ো মরছে, মনে দুঃখ, খুব উদ্দাস লেগে গিয়েছিল ভাই। মনে হচ্ছিল, যে যা চায়, তাকে তাই দিয়ে নিজে সন্ন্যাসী হয়ে চলে যাই।

রামাবতারের ছেলে লছমনের যখন বিয়ে হয়, তখন রামাবতার শনিচরীদের কাছ থেকে বিয়ের বাদ্যিবাজনার খরচ আদায় করেছিল।

এই সব ভাবতে ভাবতে আব পেটের ধান্দা করতে করতে শনিচরী কাঁদতে ভুলে যাচ্ছিল। বুধুয়া বড় হল। বাপের মতই দারিদ্র্যের জোয়াল কাঁধে নিল। বিয়ে হয়েছিল শৈশবে। বউ ঘর করতে এল। বুধুয়ারও ছেলে হল একটা। বউ যেন ডাইনি। হাটের মানুষদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে কি খেয়ে আসত কে জানে! দিনে দিনে ফুলে ফেঁপে উঠল বউ। রামাবতারের ছেলে লছমনের গমের বোরা বইতে বইতে বুধুয়াকে ধরল চেনা রোগে। খোঁখী রোগ। যক্ষ্মা। রাতে জ্বর হয়, ভোরে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। কাশির সঙ্গে রক্ত। চোখের নিচে কালি। দেখে দেখে শনিচরীর বুকে চিতার আগুন হা হা করে আকাশ পানে ছড়িয়ে দেয় যে বাতাস, সেই বাতাস বইত। বুধুয়ার দিকে চাইলেই শনিচরী বুঝতে পারত। বুধুয়াকে আঁকড়ে ধরে সংসারটা বেঁধে তোলার আকাঙ্ক্ষাটাও তার পুরবেনা। ছোট আকাঙ্ক্ষাগুলোও পূর্ণ হয়নি ওর। কাঠের কাঁকই কিনবে একটা, কেনা হয়নি। গালার চুড়িগুলো এক বছর হাতে রাখবে, রাখা হয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আকাঙক্ষাব চেহারা বদলায়। ছেলে বউ কামাই করবে। ওদের মেহনতের অন্ন শনিচরী খাবে, শীতের রোদে বসে নাতির সঙ্গে এক সানকি থেকে খাবে ছাতু ও গুড়। এই আকাঙ্ক্ষাটা বড্ড বড় মাপের হয়ে গিয়েছিল কি? সেই জন্যেই কি বুধুয়া এখন তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে?

বউয়ের দিকে চেয়ে চেয়ে, ওকে দোষ দিতে গিয়েও পারত না শনিচরী। বুধুয়ার বউ, নাতির মা তাকে কেমন করে রুক্ষ কথা বলে শনিচরী? বুধুয়া সবই বুঝত। একদিন বলেছিল, মা ওকে কিছু বলিস না।

কাকে?

তোর বউকে।

এ কথা বললি কেন?

বুধুয়া শীর্ণ ও শুভ্র হাসি হেসেছিল। বলেছিল, মা! ও হাটে সব বেচতে গিয়ে পয়সা চুরি করে? এটাসেটা কিনে খায়, সবই তো জানি। ভূখের জন্যে করে মা।

ওকে কি আমি খেতে দিই না?

ওর খিদেটা বেশি যে!

মানুষ কত কথা বলে।

জানি মা। কেন বলে তাও জানি। কিন্তু আমার আর এ নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগে না। য়ো কা জানেগী মা, তুই আর আমি কত কষ্টে সংসারটুকু...

বুধুয়া কাশতে শুরু করেছিল। শনিচরী ওর বুকে হাতে বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল, ভগবানকে আর ডাকি না রে। ভগবান থাকলে তোর ব্যামো আমাকে দিত।

না মা। তুই থাকলে আমার ছেলে বাঁচবে।

আমি যে আমার ছেলে বাঁচা চাই!

কপাল চাপড়ে উঠে গিয়েছিল শনিচরী। উঠোনে আলো করে দিয়েছে বুধুয়া। ভিণ্ডি, বেগুন, মুলো, লঙ্কা, কুমড়ো। নানাবিধ সবজি। লছমনের বাগান থেকে চারা এনে, বীজ এনে বুধুয়া এই সবজির খেতটুকু করেছে। বউ তার ডবকা। বউয়ের খিদে বেশি। বউ খুব ঝুঁকেছিল, সেও যাবে লছমনের খেতে কাজ করতে। তার পেট ভরতে চায় না। নিজের খাবার যোগাড় সে নিজেই করবে। বুধুয়া সব কথাই শুনেছিল। বলেছিল, ছেলেটা হয়ে যাক! তারপর যা চাস, করবার ব্যবস্থা করে দেব।

বড়দ্র খেটেছিল বুধুয়া। উঠোন ঘিরেছিল কাঁটাঝোপের বেড়ায়। উঠোন কোদাল কুপিয়েছিল। চুরি করে সার আনত লছমনের খেত থেকে। বাঁকে বয়ে জল আনত নদী থেকে তাতের সময়। কয়েক মাসেই সেজে উঠেছিল উঠোনটা। শনিচরী হেসে বলেছিল, এ খুব ভাল হল বুধুয়া। তোর বাপও এ রকম সব খেত করতে চেয়েছিল রে।

নাতি হল। নাতির দেড় মাস বয়স হতেই বউ জেদ ধরল সে খাটতে যাবে। বুধুয়া বলল, যাবি। হাটবারে সবজি বেচতে যাবি। মালিকের খেতে যেতে হবে না। মালিকের খেতে কাজ করলে যুবতী মেয়েরা ঘরে ফেরে না।

ইশ, কোথায় যায়?

প্রথম ভাল ঘরে, তারপর বাণ্ডীটোলিতে। এ নিয়ে আর কথা বললে মাথা নামিয়ে দেবে ধড় থেকে।

বউ হাটে গিয়েছিল।

শনিচরী বলেছিল, হাটে পাঠালি বুধুয়া? নয় ও ঘরে থাকত, আমি যেতাম।

না মা। তুই আর আমি খেতে খাটতাম, ও তো ঘরে থাকত। কোন দিন দেখেছিস ও রেঁধেবেড়ে রেখেছে, জল এনে রেখেছে, ঘরদোর ঝাড়ু দিয়েছে?

না।

শনিচরী আর বুধুয়া দুজনেই জেনেছিল, বউয়েব মন বসবে না রোগা বরে, দুঃখের সংসারে। শনিচরী বউকে বলেছিল, ও আর কতদিন! চোখে মুখে কালি পড়েছে। যতদিন থাকে, একটু সমঝে চলিস।

বউ সে কথা অক্ষরে অক্ষরে মানে। বুধুয়া যতদিন থাকল, সেও ততদিন ছিল। ছেলের ছয় মাস বয়েস তখন। বুধুয়ার সেদিন, সেদিন কেন, কয়েকদিন ধরেই খুব বাড়াবাড়ি যাচ্ছিল। বৈদ্যের ওষুধেও কাজ হয়নি। শনিচরী বউকে বলেছিল বুধুয়ার কাছে থাকতে। নিজে গিয়েছিল, দৌড়ে দৌড়েই গিয়েছিল বৈদ্যের কাছে অন্য ওষুধ চাইতে। ওষুধে আর কাজ হবে না জেনেও ওষুধ আনতেই গিয়েছিল ও। বৈদ্যের বাড়ি মাইলখানেক দূরে। মাগো! ভাবলে কেমন লাগে, অতখানি পথ কেমন করে দৌডেছিল ও? কিন্তু বৈদ্য ছিল না ঘরে, হাটে গিয়েছিল। ঘরে ফিরতেই শনিচরী, "ওষুধ দাও, ওষুধ দাও" বলে মাথা কুটেছিল। বিরক্ত হয়ে বৈদ্য বলেছিল, ছোট জাতের ধৈর্য সহ্য থাকে না। ছেলের অবস্থা যদি অতই খারাপ হবে, বউ হাটের দিকে ছুটছে কেন? নিশ্চয় ভাল আছে তোর ছেলে।

ঘরে ফিরে শনিচরী বুধুয়াকে জীবিত দেখেনি, বউকে ঘরে দেখেনি। বাচ্চাটা তার ঘরে কাঁদছিল।

বউ আর ফেরেনি। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বুধুয়ার দাহের ব্যবস্থা করা, বউ পালাবার কেচ্ছা চাপা দিতে ছুটাছুটি করা, এই সব করতে গিয়ে বুধুযার জন্যেও কাঁদা হল না। কাঁদতে পারত না শনিচরী। কেমন যেন ধন্দ ধরে বসে থাকত। তারপর চোখ বুজে শুয়ে পড়ত।

গ্রামের মানুষ দেইজি-কেজেতে মেতে থাকে। বুধুয়ার মৃত্যুর পর সেই মানুষেরই আরেক রকম চেহারা দেখেছিল শনিচরী। বুধুয়ার ছেলে হরোয়াকে নিয়ে ও হিমশিম খেত। বুধুয়া যে নেই, তাও যেন ভুলে যেত শনিচরী। কবে যে বুধুয়া ছিল না তাই ওর মনে থাকত না। যখনকার কথা যতদিনের কথা মনে পড়ে, ততদিনই -বুধুয়া ছিল যেন ওর সঙ্গে। শনিচরী যখন মালিক মহাজনের খেতে কাজ করত, বুধুয়া ঘরদোর সাফ করে জল এনে রাখত নদী থেকে। খেত কুড়োনো মাটিমাখা গম বা ভুট্টা নদীর জলে ধুয়ে আনত। 'শান্ত, বুঝদার, দুঃখী মাযের ছেলে। সব সময়ে থাকত বুধুয়া, কেমন করে শনিচরী মেনে নেবে, যে আর তাকে রাতে উঠে জল গরম করে খাওয়াতে হবে না বুধুয়াকে? স্বপ্নাদা মলম মাখাতে হবে না বুধুয়ার বুকে! বুধুয়ার ছেলেটা পড়ে পড়ে কাঁদত।

একদিন দুলনের বউ, ধাতুয়া লাটুয়ার মা, এ তল্লাটে বিখ্যাত ঝগড়ুটে মেয়েমানুষ, এসে দাঁড়াল। ছেলেটাকে তুলে নিল বুকে।

কি করিস! অ ধাতুয়ার মা! হরোয়াকে নিয়ে যাই।

কেন?

ধাতুয়ার বউয়ের কোলে ছেলে। তার দুধ খাবে। কেনে? আমার নাতি, আমি মানুষ করব।

সবাই সবাইয়ের ছেলে নাতিকে মানুষ করে, তুইও করবি। কিন্তু ধাতুয়ার বাপ বলল, কাজ ধরেছে একটা।

কোথায়?

গোরমেন রেললাইনে মেবামতি করবে। ঠিকাদারের কাছে ধাতুযার বাপ ফুরন নিয়েছে বিশটা মজুর দেবে।

তুই যাবি নাই?

গৈয়া গাভীন্ হায। তা ছাড়া মালিকের ঘরে পূজা। জঙ্গল সাফাই, রান্নার কাঠ চেলা করা- বেগারী কামও আছে।

দুলন গঞ্জ! বহোত্ শানদার খচড়া বুড্ডা। কাজে মাতিয়ে আমাকে....

সে যা বুঝিস্।

ধাতুয়ার বউয়ের কাছে দুধ খেয়ে প্রাণে বাঁচল হরোয়া। যতদিন ঠিকাদারী কাজ চলে, শনিচরীর ঘরে উনুন জ্বলেনি। শনিচরীর রুটি ও আচার দুলনের সঙ্গেই দিয়ে দিত দুলনের বউ। যত আটা খরচ হয়, সব পরে শোধ করে দেয় শনিচরী। কিন্তু সব ঋণ কি শোধ হয়?

দুলনরা দেখেছিল, পরভু গঞ্জ বলেছিল, একেবারে একলা হয়ে গেলে। সম্পর্কে জ্যেঠাইন্ হও, না হয় তোমার ঘরের দোর-জানালা-চালা এনে আমার উঠোনে ঘর তুলে দিই?

নাটুয়া দুসাদ শনিচরীর উঠোনের সবজি হাটে বেচে দিত। গ্রামের মানুষ সে সময়টা এইভাবে এসে না দাঁড়ালে শনিচরী কি বাঁচত? বুধুয়ার কসবী বউটার কথা কেউ বলত না। তবে শনিচরী জেনেছিল। হাটে যারা এক টাকায় চার রকম দাওয়াই বেচে, সেই সব দাওযাইওয়ালাদের একজনই বউকে বুঝিয়েছিল! বউকে গয়া-- আরা ভাগলপুর দেখাব নৌটঙ্কী সিনেমা সার্কাস দেখাবে- রোজ পুরীকচৌরি খাওযাবে। সে লোকের সঙ্গেই গেছে বউ।

ছেলেটাকে নিয়ে যায় নি কেন?

শনিচরীর মনে হত, ছোটবেলায় দেখা মোতির মায়ের কথা। মোতিকে নিতে চেয়েছিল মালিক, মোতির মা দেয়নি। মোতি পালিয়ে যায় লাইনের কুলি যোগাবার ঠিকাদারের সঙ্গে। মোতির মা শনিচরী মায়ের জাঁতার গম ভাঙতে আসত আর বলত, মালিকের হাতে মেয়ে দিলে তবু দেখতে পেতাম মুখখানা।

শনিচরী তা বলে না। গেল যখন, ওইভাবে হারিয়ে গেছে। সেই ভাল নইলে মালিকের ঘরে সে থাকত রানী হয়ে। শনিচরী আর হরোয়া বাইরে গোলাম খাটত, সে ভারি অপমানের কথা হত। তাছাড়া, শনিচরী আগেকার অভিজ্ঞতা থেকে জানে। বউও কাজ করলে গ্রামের লোক তাকে নামে না হলেও কাজে একঘরে করত। তেমন হলে গ্রামে থাকা চলবে ন্য। নিরন্ন ও রাঁকা দরিদ্রের বড় দরকার অন্য নিরন্ন রাঁকাদের মদত। সে মদত না থাকলে মালিকের পাঠানো দুধ ঘি খেয়েও গ্রামে বাস চলে না।

আস্তে আস্তে শনিচরী সহজ ও স্বাভাবিক হল। হরোয়াকে মানুষ করল, সাধ্যমত যত্নে। গ্রামের বুড়োবুড়ি, প্রবীণ ও প্রৌঢ়, সবাই হরোয়াকে বলত, বহোত্ দুখ কী তোয়া নানী। উস্কো দুখ মত্ দিয়া করো ও হরোয়া।

হরোয়া মাথা নিচু করে শুনে যেত। ওর বয়স বছর চোদ্দ হতে শনিচরী ওকে নিয়ে গিয়েছিল। রামাবতার সিংয়ের ছেলে লছমন সিং এখন মালিক মহাজন। হাজার। মালিক পরোয়ার। অন্য জমানা এখন। মালিকও নতুন জমানায় নতুন রকম। লছমন সিং খেতমজুর, ছোট জাত ও কিষাণদের শায়েস্তা করতে এখন মস্তান রাখে। ঘোড়াচড়া, বন্দুক চালানো মস্তান! রামাবতার লাথ মারত, নাগরা পেটাত। কিন্তু মন ভাল থাকলে ওদের সঙ্গে গল্পও করত। লছমন সিং বাপের ওসব আচবণকে মনে করে দুর্বলতা। যথেষ্ট দূরত্ব রেখে চলে ও।

শনিচরী তার কাছেই গিয়েছিল। বলেছিল, সবই তো জানো মালিক। শনিচরীর চেয়ে দুর্ভাগী জন্মায়নি কখনো। এই ছেলেটা আমার নাতি। একে একটা কাজকর্ম দাও। নইলে বাঁচব না।

লছমন সিংয়ের বোধহয় মনটা ভাল ছিল সে সময়ে। সে বলেছিল, হাটে আমার দোকানে মাল বইবে। ঝাড়ু পানি করবে। মাসে দু টাকা পাবে ঔর পেটখোরাকি। হজৌর কা কিরপা।

শনিচরী নাতিকে নিয়ে উঠে এসেছিল। মোহনলালের কাছ থেকে ঠাকুরের প্রসাদ এনে মাদুলিতে ভরে, সে মাদুলি গলায় বেঁধে তবে হরোয়াকে পাঠিয়েছিল হাটে।

অনেক কথা বলেছিল। হাটে অনেকে গরু মোষ আনে। সেখানে যাস না হরোয়া। ভৈষা লাখ মারলে মরে যাবি।

নায় নানী।

কোনো মন্দ লোকের কথা শুনিস না।

নায় নানী।

প্রথম কয়েক মাস খুব মন দিয়ে কাজ করত হারোয়া। মাইনের টাকা দিত নানীকে। জলপানির ছাতু, গুড়, বয়ে বয়ে আনত। খেয়ে মেখে চেহারা ফিরেছিল ক্রমে। ক্রমে মন আনচান্ হল! একবার টাকা দিল না, একটা রঙিন গেঞ্জি কিনল। আরেকবার কিনল একটা প্লাস্টিকের মাউথ অর্গান। সেবার খুব ধমক-ধামক করেছিল শনিচরী। তারপর স্বয়ং লছমন যখন বলল, হারোয়া দোকানে থাকে ন্য, সর্বদা ম্যাজিওয়ালাদের পেছন পেছনে ঘোরে- তখন শনিচরী হরোয়াকে কসে মেরেছিল। বলেছিল, বেচাল করবি তো তোর পা কেটে দেব। ঘরে বসিয়ে খাওযাব, তবু কুপথে যেতে দেব না।

আবার কিছুদিন মন দিয়ে কাজ করল হরোয়া। তারপর পালিয়ে গেল। নাটুয়া এসে বলল, ম্যাজিকওয়ালাদের সঙ্গে চলে গেছে হবোষা।

যাক্ গে।

"যাক গে” বললেও শনিচরী ঘরে বসে থাকে নি। হাট থেকে হাটে মেলা থেকে মেলায় খুব খুঁজেছিল। নাতির জন্যে কাঁদার কথা মনেই হয়নি ওর। এ রকমই যে হবে, তাই মনে হয়েছিল। সেই সময়ে হরোয়াকে ফিরে পাবার আশা যখন নেই আর মনে, হঠাৎ দেখা বিনির সঙ্গে। বিনি ওর ছোটোবেলার খেলুড়ী। কালো কম্বলের ঘাগরা পরত বলে সবাই বলত কালীকমলী বিনি। একটা পোঁটলা কাঁধে হনহনিয়ে হাঁটছিল বিনি। হাঁটতে হাঁটতে শনিচরীর

গায়ে ঠেলা দেয় ও অসাবধানে।

কেরে তুই? চোখের মাথা খেয়েছিস? চোখের মাথা তোর বাপ খেয়েছে।

কি বললি?

ওইতো শুনলি।

চমৎকার একটা যুদ্ধ বাধছিল। শনিচরীর খুব ভাল লাগছিল। জমাটি ঝগড়া একখানা করলে মনের বহু জঞ্জাল কেটে যায়, সাফ হয়ে যায় সব।

ধাতুয়াব মা সেইজন্যেই কাকচিলের সঙ্গেও ঝগড়া করে। ঝগড়া করলে মন ভাল থাকে, শরীর ভাল থাকে, দেহের রক্ত বন্দুকেব গুলির মত দমাদম চলতে থাকে। কিন্তু দুজনে দুজনের দিকে চাইতেই বিনি বলেছিল, এ কি! তুই শনিচবী না?

তুই, তুই কে?

বিনি। কালীকমলী বিঘ্নি।

বিনি?

হ্যাঁ রে!

তোর তো সেই লোহারডগাতে বিয়ে হয়েছিল।

আজ কতকাল আছি জুজুভাতুতে। জুজুভাতু? আর আমি থাকি টাহাড়ে! এক বেলার পথ গো, তবু দেখা হয়নি কখনো!

চল, বসি কোথাও।

দুজনে একটা পিপল গাছের ছায়ায় বসল, দুজনেই দুজনকে আড়ে আড়ে দেখছিল। দুজনেই নিশ্চিন্ত হল, ওর অবস্থা আমার চেয়ে ভাল নয়। বিনিরও হাতে-গলায়-কপালে-শনিচরীর মতই-গয়না বলতে উলকির দাগ। অভ্যাস বশে দুজনেরই কানের ছিদ্রে শোলা

গোঁজা। শনিচরী ও বিনি বিড়ি ধরাল। দুজনের চুলই রুক্ষ।

শনিচরী কি হাটে এসেছিলি?

না রে। নাতিকে খুঁজতে এসেছিলাম। শনিচরী অতি সংক্ষেপে হরোয়ার কথা, নিজের কথা, সবই বলল। বিনি সব শুনে বলল, দুনিয়া থেকে মমতা চলে গেল না কি? না, তোর-আমার কপাল দোষ?

শনিচরী অনেক দুঃখে হাসল। বলল, স্বামী নেই, ছেলে নেই, নাতিটা যেখানে থাক, প্রাণে বেঁচে থাকুক।

বিনি বলল, তিন মেয়ের পর এক ছেলে। ছেলের বাপ মরেছে কবে, বিনিই ছেলেকে মানুষ করেচে, পরের বাছুর পালানি নিয়ে ক্রমে ক্রমে চারটে গাই, দুটো দুধেলা ছাগল, স-ব করেছে। বিয়ে দিয়েছে ছেলেকে, আবার ছেলের গওনার সময় গ্রামকে দই-চিড়ে-গুড় খাইয়েছে মহাজনের কাছে ধার করে।

তারপর?

মহাজন এখন সেই ঋণের দায়ে ঘরবাড়ি নিয়ে নিচ্ছে। ছেলে যাচ্ছে শ্বশুরাল।

"শ্বশুরাল" বলে বিনির থুথু ফেললে। বলল, শ্বশুরের ছেলে নেই। আর দুটো জামাইয়ের মত ছেলেও তার গোলাম হবে। বললাম, গরু বেচে ধার শোধ করি। ছেলে গাই-গরু নিয়ে শ্বশুরাল রেখে এসেছে। আমিও বিনি আমি ছাগল দুটো এই হাটে বেচলাম। ছেলে জানে না। বাস, ট্যাকে কুড়ি টাকা নিয়ে চললাম।

কোথায় যাবি?

কে জানে? তোর ছেলে নামে যশে নেই। আমার ছেলে থেকেও

নেই। চলে যাব ডালটনগঞ্জ, কি বোখারো, কি গোমো? ভিক মাঙৰ টিশনে। শনিচরী নিশ্বাস ফেলল। বলল, আমার সঙ্গে চল। দুখানা ঘর,

যেন হা-হা করছে। ঘরে ঘরে শোবার মাচা। বুধুয়া করেছিল। আজও উঠোনে ভিণ্ডি-মিরচা-বাইগন হয়। আমার টাকা ফুরোলে পরে? তখন দেখা যাবে। তোর টাকা তোর থাকুক। শনিচরী এখনো আধপেটা কামাই করে।

তাই চল। হ্যাঁ রে, জলের সুখ আছে?

নদী। পঞ্চায়েতী কুয়োটার জল বড় তেতো।

একটু দাঁড়া।

আবার হাটে গেল বিনি, ফিরে এল একটু বাদে। বলল, উকুন মারা ওষুধ কিনে নিলাম। মিট্টি কা তেলের সঙ্গে মাথায় ঘষে মাথা ধুয়ে ফেলব। যত মনের জ্বালা, তত কি উকুনের জ্বালা?

পথ চলতে চলতে বিনি বলল, নাতনিটা হয়তো রাতে কাঁদবে।

আমার কাছে ঘুমোত!

শনিচরী বলল, কয়েকদিন। তারপর ভুলে যাবে।

শনিচরীর ঘর দেখে বিনি খুব খুশি। তখনি জল ছিটিয়ে ঘরদোর ঝাড়ু দিল। নদী দেখতে গেল, জল আনল এক গামলা। বলল, আজ রাতে উনোন জ্বালব না। রুটি আর আচার নিয়েই বেরিয়েছিলাম।

বিনি ঘোর সংসারী। দু'দিনেই শনিচরীর ঘর ও উঠোন নিকোল ও। সোডা-সাবানে নিজেব আর শনিচরীর কাপড় কাচল। কাঁথা ও মাদুর রোদে দিল। নিজের সংসারেব দখল বউয়ের হাতে চলে যাচ্ছিল বলে ইদানীং ও কোন কাজকর্মে যেত না। সেটা অভিমানে, কিন্তু বউ বলত, ওর শাশুড়ী কামচোরা। সংসারের নেশা মানুষকে, বিনির মত দুঃখী মানুষকেও অবাস্তব স্বপ্নাশ্রয়ী করতে পারে। এখানে কতদিন থাকবে ঠিক নেই, শনিচরীর সংসার- বিনি একদিন কোদাল নিয়ে উঠোন কোপাতে শুরু করল। বলল, একটু খাটলে সবজি হবে খুব।

উকুনের ওষুধে শনিচরীর মাথা থেকেও শরণাগত জীবগুলি নির্বংশ হল। টানা ঘুমে রাত কাটিয়ে উঠে শনিচরী বুঝল, উকুনের কামড়ে ঘুম হত না, মনের জ্বালায় নয়। মনে যত জ্বালা থাকুক, খাটাখাটুনির শরীরে ঘুম আসে।

বিনির টাকায় দুজনে ক'দিন খেল। ওদের টাকাও ফুরাল, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল শনিচরীর। সেদিনই দুলনের ছোট একটা বাছুরকে নেকড়ে ধরে নিয়ে গেল। লাকড়া তাড়াবার উত্তেজনায় সবাই যখন মেতেছে, তখনি খবর এল স্থানীয় আরেক জোতদার ভৈরব সিংকে কে বা কারা যেন, একটি জমিতে কেটে রেখে গেছে। জমিটি গোটা দশেক দেওয়ানী মামলার জন্ম দিয়েছে। ভৈরবের মৃতদেহ ধারণ করে জমিটি ফৌজদারীতে প্রোমোশান পেল। গ্রামে সবাই জেনে যায়। সবাই জানল ভৈরবের বড় ছেলেই খুনটি করিয়েছে। বৈমাত্র ভাইদের প্রতি বাপের অত্যধিক স্নোহাধিক্য দেখে সে নিজের আখের বিষয়ে স্বাভাবিক কাবণেই দুশ্চিন্তিত হয়েছিল। ভৈরবের বড় ছেলে পিতৃহত্যার দায়ে সৎ ভাইদের নামে মামলা আনবে বলে শাসাল। সৎ ভাইরা দাদার নামে মামলা করবে বলে লছমন সিংয়ের মদত চাইতে গেল। লছমন বলল, চল, আমি যাচ্ছি। জমিটিতে তারও সবিশেষ লোভ ছিল।

অতান্ত নাটকীয় ভঙ্গিতে লছমন অকুস্থলে দেখা দিল। ছেলেদের লজ্জা দিয়ে সে মর্মভেদী দুঃখে বলতে লাগল, হায় চাচা! রাজা তুমি, স্বঘরে, মরবে। আজ কেন তুমি গাটিতে পড়ে আছ? কিসের দুঃখ তোমার?

ছেলেদের দিকে চেযে বলল, তোমরা কি মানুষ? কে মেরেছে তা দিয়ে কি হবে? চাচা যে মরে গেল সেটাই হল প্রধান ও শেষ কথা। হায় চাচা! তুমি থাকতে ছোট সাত কখনো মাথা তোলে নি। দুসাদ গঞ্জর ছেলে তোমার ভয়ে পড়তে যায় নি সরকারি স্কুলে। আজ কে সে-সব দেখভাল করবে।

ছেলেদের দিকে চেয়ে বলল, এখন আসল কাজ চাচার সম্মান রেখে সদগতি করা। ওঁকে ঘরে নাও, পুলিসকে খবর দাও। লেকিন সেখানে কোনো নাম উঠাবে না। লাশ তোহরি যাবে না, চেরাই ফাড়াই হবে না। যে ভাবে চাচা মরলেন, ও হো হো, বীরের মৃত্যু। কিন্তু যে ভাবে চাচা মরলেন, সে ভাবে তো তাঁর মরার কথা নয়? মানুষ অনেক কথা বলবে। তাই সদগতি তব কিরিয়া কাজ উচিত শোর মচাকে কর। চাচাকে বড় পালঙ্কে সাজিয়ে রাখো ঔর আমাদের রাজপুত সমাজকে খবর দাও।

তারপর ছেলেদের আড়ালে সরিয়ে নিয়ে বলল, নিজেদের বিবাদ ভুলে যাও। আমার বাবা নেই। চাচা গেল তো ইন্দ্র পতন হল। আমাদের সমাজের সকলকে ডাকো। এখন নিজেদের বিবাদ উঠাবার সময় নয়। মখন সিং, দৈতারি সিং, গোল পাকাবার মানুষ অনেক আছে।

লছমন সিং এই কাজে মেতে থাকল বলে শনিচবী তাকে ঘরে পেল না। ঘরে এসে গালে হাত দিয়ে বসল ও। তারপর বিনিকে বলল, চল, দুলনের কাছে যাই। টেটিয়া বুড়া, বহোত কিরকিচা আদমি। কিন্তু দিমাগটা খুব সাফাই। ও ঠিক একটা পথ বাতলাবে।

সব শুনে মেলে দুলন বলল, কামাইয়ের পথ থাকতে উপোস করে মরে কে?

-কৈছন কমাই?

--বুধুয়ার মা! কামাইয়ের পথ কি থাকে? মালিক-মহাজনের থাকে, দুসাদ-গঞ্জর থাকে? পথ তৈরি করে নিতে হয়। কত টাকা

লিয়ে এসেছিল সহেলী?

-বিশ টাকা।

-বি-শ-টা-কা?

-হ্যাঁ! আঠারো টাকার খেয়েছি। -আমি হলে এ টাকা হাতে থাকতে থাকতে স্বপ্নে মহাবীরজি পেতাম।

-কা বোল? হাঁ লালুয়াকে বাপ?

--কায়? হমানি কে বোল সমঝত্ নায়?

-কা বোলত্?

-টাকা হাতে থাকতে-থাকতে কুরুডা নদীর পাড় থেকে আমি একখানা ভাল পাথর আনতাম। তাতে তেল-সিঁদুর মাখিয়ে বলতাম, স্বপ্নে মহাবীরজি পেয়েছি।

-আমি যে ছাই স্বপ্নই দেখি না।

-আরে মহাবীরজি পেয়ে গেলে দেওতার ল্যাজ ধরে স্বপ্ন আসে আসত?

---হায় বাবা!

--তোকে সবাই চেনে। তোকে দিয়ে জুত হত না। তোর সহেলী নতুন মানুষ, ও বললে আমরা মেনে নিতাম। তারপর মহাবীরজি নিয়ে তোহরির হাটে বসতিস। প্রণামী মিলত।

-দেওতাকে নিয়ে খচড়াই? এমনিতেই মহাবীরজির চেলাদের জ্বালায় গাছে ফল থাকে না।

--খচড়াই মনে করলে খচড়াই। নইলে খচড়াই কিসের! তোর হল মহাপাপী মন। তাতেই ভাবছিস খচড়াই।

-কৈছন? আঁ লাটুয়াকে বাপ?

কৈছন! বুঝিয়ে দিচ্ছি।

--বল?

---লছমনের মা বুড়ির বাত রোগ আছে?

-জরুর।

-তিনি আমাকে দশ টাকা দিয়ে বললেন, চাস থেকে দৈবী

তেল এনে দে। চাস ভি গেলাম না, ঘর তেকে তেল ভি দিয়ে এলাম দু দিন বাদে, তক্তি খচড়াই হল না, কেন কি আমার মনে কোন খচড়াই না হ্যায়। সে তেল মাখল কাল, আজই বুড়ি লোটা নিয়ে অঢ়র খেতে পায়খানা করতে গেল। মন চাঙ্গা তো কাঠ মে গঙ্গা। দেখ, বুধুয়াকে মা, পেটের চেয়ে বড় ভগবান নেই। পেটের জন্যে সব কাজ করা যায়, রামজি মহারাজের বাত।

দুলনের বউ ওপাশ থেকে বলল, বুঢ়া যদি মালিকের খেত থেকে কুমড়ো ছিঁড়ে আনে, তখনো বলে, এ রামজি মহারাজের বাত। বিনি বলল, আমাদের বিপদ। তার আসান কিসে হবে? বুদ্ধি দাও একটা, আমরা দুই বুড়ি।

বারোহি গ্রামের ভৈরব সিং মরেছে?

-হা। ছেলে বাপকে মেরেছে।

---তাতে তোমাদের কি? টাকার ঘরে মা ছেলেকে মারে ছেলে মাকে মারে। যে মরবার সে মরেছে। আমাদের ঘরে মরলে আপনজন কাঁদে। ওদের নাতেদাররা সন্দুকের কুঞ্জি সরায়। কাঁদার কথা ভুলে যায়। যাক, আমাদের মালিক গিয়ে মাথা দিয়েছে। এখন ভৈরবের লাশ দাহ হবে। কাল দুপুরে লাশ বেরোবে। ওদেব চাই বোনেবালী রুদালী। দুটো রাণ্ডী এনেছে। মালিক মহাজন মরলে রাণ্ডী আসে কাঁদতে। রাণ্ডী দুটো হয়তো ভৈরবেরই ছিল কবে, এখন শুকনো কাক। তারা জুতের নয়। তোরা যা, কাঁদবি, লাশের সঙ্গে যাবি। টাকা পাবি, চাল পাবি। কিরিয়া কাজের দিন কাপড় ঔর খাবার পাবি।

শনিচরীব ভেতবে যেন ভূমিকম্প হল। সে বলল, কাঁদব? আমি? তুই জানিস না? কান্না আসে না আমার চোখে? দু চোখ জ্বলে গেছে আমার?

দুলন নিস্পৃহ কঠিন গলায় বলল, বুধুয়াকে মা! যে কান্না তুই বুধুয়ার জন্যে কাঁদিস নি, তা কাঁদতে বলছি না তোকে। এ হল রুজির কান্না। দেখবি, যেমন করে গম কাটিস-মাটি বয়ে নিস, তেমনি করে কাঁদতেও পারছিস।

-আমাদের নেবে কেন?

-দুলন আছে কেন? ভাল মত রুদালী না পেলে ভৈরবের মান থাকবে কেন? মালিক-মহাজন লাশ হয়ে গেলেও তার সম্মান চাই। ভৈরবের বাপ রামাবতার, এরা যে রাণ্ডীদের রাখত তাদের দোল্ করত। সেই মমতায রাণ্ডীরা এসে কেঁদে গিয়েছিল ওরা মরলে। ভৈরব দৈতারি মখন, লছমন এদেরও রাণ্ডী আছে। কিন্তু খেতমজুর ঔর রাণ্ডী, সকলকে এরা পায়ের নিচে রাখে! তাতেই রুদালী জোটে না। খতরনাক খচড়াই সব! সবসে হারামি য়ো গম্ভীর সিং। রাণ্ডী রাখল, সে ঘরে মেয়ে হল। রাণ্ডী থাকতে মেয়েকে দুধে-ঘিয়ে রাখত। রাণ্ডী মরতে মেয়েকে বলল, তোকে পুষব না আর। বাণ্ডীর মেয়ে রাণ্ডী, কাজ করে খা গিয়ে।

-ছি ছি!

-সে মেয়ে তো তোহরিতে রাণ্ডী বাজারে পড়ে আছে। পাঁচ টাকার রাণ্ডী এখন পাঁচ পয়সার রাষ্ট্রী। ভাল কথা, বুধুয়ার বউও তো তোহরিতে। ওই এক হালত্।

-তার কথা কে শুনতে চায়?

-দুলন বলল, কালো কাপড় পরবি।

---তাই তো পরি।

দুলনই ওদের নিয়ে গেল। যেতে যেতে, বিনি বলল, এ রকম কাজ মাঝেমধ্যে, তাবপব মালিকের খেতী কাম জুটে তো ভাল, নয় পাথর ভাঙার কাজ-দুটো পেই চলে যাবে।

শনিচরী বলল, গাঁয়ে কথা হবে না?

-হলে হবে।

ভৈরব সিংয়ের গোমস্তা বচ্চনলাল দুলনকে চিনত। লছমন ওকেই শবযাত্রার আনুষঙ্গিক সব ব্যবস্থার ভার দিয়েছে। সব কিছু ইন্তেজাম করা চারটিখান কথা নয়। বচ্চনের নিজের সংসারে দুটো কোদাল, একটা আলনা আর পেতলের বাটলোই দরকার দুখানা। এগুলো কিরিয়া কাজের ফর্দে ঢোকাতে হবে, মহা দুশ্চিন্তা। শনিচরীদের দেখে ও পানি পেল। বলল, তিন টাকা করে পাবি।

দুলন বলল, মহারাজ মরে গেল, তার রুদালী তিন টাকা? পাঁচ টাকা হজৌর।

-কেন?

-যা কাঁদবে হজৌর শুনলে আপনি বখশিশ দেবেন। লছমনজি বলেছেন, দশ-বিশ যা লাগে, কাঁদবার লোক চাই। এ বাবদে দুশো টাকা মঞ্জুর আছে।

গোমস্তা নিশ্বাস ফেলল। দুলন কেমন করে সব খন্থর জানতে পারে কে জানে!

-পাঁচ টাকাই দের। যা, বাইরে গিয়ে বোস।

-ঔর চাল ভি দেবেন এক পাই।

-গম দেব।

--চাল দেবেন হজৌর।

দেব।

-এখন ওদের জলপানি দিন পেট ভরে। ভাল করে না খেলে কাঁদতে পারবে কেন!

--দুলন! কটা হারামি মরে তুই জন্মেছিলি তাই ভাবি। যা, বাইরে যা। জলপানি দিচ্ছি।

ভৈরব সিংয়ের বড় ভৈরবী বলে পাঠালেন, যারা রুদালী, তাদের

পেট ভরে চিড়ে-গুড় দাও। প্রসাদের বাপ কোনো জিনিসের অভাব

রেখে যান নি।

পেট ভরে চিড়ে-গুড় খেতে-খেতে শনিচরী বুঝল, কান্না বেচে তাকে খেতে হবে বলেই চোখের জল তোলা ছিল।

রাণ্ডী দুজন প্রথমে এই দেহাতী বুড়িদের আমল দেয় নি। কিন্তু শনিচরী ও বিনি এমন তারস্বরে কাঁদল, এমন সাজিয়ে সাজিয়ে বলল ভৈরব সিংয়ের গুণের কথা, যে বাজারী রাণ্ডীরা ঘোল খেয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে শ্মশানে গেল শনিচরী ও বিনি। কাঁদতে কাঁদতে ফিরল। এ দিনে নগদ বিদায় পাঁচ টাকা ও আড়াই সের চাল একেকজন। বচ্চন বলে দিল, কিরিয়ার দিন আবার আসবি।

কিরিয়ার দিন মিলল কাপড় ও খাবার। পুরি-কচৌরি-বেসনের লাড্ডু। শনিচরী ও বিনি খাবার বেঁধে নিয়ে গেল বাড়ি। শনিচরী দুলনের বউকে কিছু দিয়েও এল। দুলন সব খবরাখবর নিল। বলল, বচ্চন হারামি এ বাবদ দুশো টাকা পেয়েছিল, কুড়ি টাকায় কাজ সারল।

--সে তো হবেই লাট্টযাকে বাপ।

-তোর সহেলীকে বলে দে, হাটে যায়-আসে নিয়মিত। হাটে যাবে, সব দোকানই মালিক মহাজনদের। দোকানে-দোকানে ঘুরলেই খবর পাওয়া যাবে মালিকদের ঘরে কার অসুখ, কে মরছে। নইলে খবর মিলবে না। এরপর যখন যাবি, সেখানে বলবি, আমিই ঔর-ঔর রুদালী এনে দেব।

-কৈছন?

-তোরি যাবি। রাণ্ডী বাজার।

-হায় ভগবান!

---তোর সহেলী যাবে?

—বিনি বলল, যাব।

দুলন বলল, এত রাণ্ডী কি ছিল? এইসব রাজপুত মালিক-মহাজন চারদিকে? তাতেই রাণ্ডীর ছড়াছড়ি।

দুলনের বউ বলল, রাণ্ডী চিরকাল আছে।

-না, চিরকাল এখানে ছিল না। যত মন্দ জিনিস সব ওরা এনেছে।

ওরাও চিরকাল আছে।

-না, আগে ছিল এ মুলুক, ছোটনাগপুরের রাজাদের এক শরিকের। তখন এখানে পাহাড় জঙ্গল, ঔর আদিবাসী লোকদের টোলি। তখন, সে অনেক অনেক আগে। তাই তহশীলে কোল লোকরা বলোয়া করে।

দুলন যে কাহিনীটি বলে, তা খুবই দ্যোতক এবং কেমন করে দুর্ধর্ষ রাজপুতরা এই আদিবাসী ও অন্ত্যজ অধ্যুষিত অঞ্চলে ঢুকে পড়ে জমিদার থেকে শুরু করে জোতদার-মহাজন, মাসিক পরোয়ার হয়ে বসে, তা বোঝার পক্ষে খুবই সহায়ক। এই রাজপুতরা ছিল ছোটনাগপুরের রাজার শরিকের সেনাবাহিনীর লোক। শ' দুয়েক বছর আগে এদের নানাবিধ অত্যাচারে অতিষ্ঠ কোলরা বিদ্রোহ করে।

কোল বিদ্রোহ দেখা দিতে না দিতেই রাজা দেন এদের লেলিয়ে।

কোল বিদ্রোহ দমন করার পরেও এদের সামরিক জোশ কমে না।

এরা মেরেই চলে নিরীহ কোলদের। জ্বালিয়ে চলে শান্ত গ্রামগুলি।

হরদা এবং ডোনকা মুণ্ডা তখন আবার কাঁড়ে শান দিতে থাকে।

আবার কোল বিদ্রোহ ঘটাব উপক্রম ঘটে। তখন রাজা এই রাজপুতদের নামিয়ে দেন বসতিবিরল টাহাড় অঞ্চলে। বলে দেন, মাথার ওপর তরোয়াল ঘুরিয়ে ছোঁড়। যতদূর গিয়ে তরোয়াল পড়ল, ততদূর পর্যন্ত জমির দখল নাও। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অবধি তরোয়াল ছুঁড়ে চল। তোমরা সাত সর্দার, এইভাবে যত জমি পেলে, তত জমি নিজে চাষবাস কব।

তখনি রাজপুতরা নেমে পড়ে টাহাড়ে এবং সেই থেকে এখানে ওদের জোত। শতক থেকে শতকে এদের জোতজম' বেড়েছে বই কমেনি। এখন এরা জোতজমা বাড়ায় তবে তরোয়াল ছুঁড়ে নয়। বন্দুকের গুলি মানুষের গায়ে ছুঁড়ে এবং জ্বলন্ত মশাল মানুষের বসতিতে ছুঁড়ে দিয়ে। এখন এ অঞ্চলে যারা আছে, তারা পরস্পরের সঙ্গে একদিন সম্পর্কিত ছিল, আজ সম্পর্কের সূত্র ক্ষীণ। তবে পদমর্যাদায় সবাই সমান হতে চায়।

জীর্ণ খাপরার চাল-শোভিত মলিন মেটে বাড়ির টোলিতে অন্ত্যজদের বাস। আদিবাসীদের বসতিও গরীব চেহারার। এর মাঝে-মাঝে মালিকদের বিশাল মকান। মালিকদের মধ্যে মামলা ও রেষারেষি থাকতে পারে কিন্তু মালিকশ্রেণী কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে এক। লবণ, কেরোসিন, পোস্টকার্ড ছাড়া এদেব প্রায়ই কিছু কিনতে হয় না। হাতি, ঘোড়া, মহিষ বাথান, উপপত্নী, জারজ সন্তান, উপদংশ বা অন্য যৌন ব্যাধি "বন্দুক যাব জমি তার" বিশ্বাস সকলেরই অল্পবিস্তব আছে। গৃহবিগ্রহ আছে অগুনতি। দেবতারা এদেব সমর্থক। এরা সকলেই গৃহবিগ্রহদেব নামে জমি দেবত্ত করে রেখেছে। আবার ব্যক্তি হিসেবে আলাদা বৈশিষ্ট্যও আছে। দৈতারি সিংয়েব পায়ে ছয়টা আঙুল। বনোযারি সিংয়ের বউয়ের গয়লাদোষ। নাথুনি সিংযের বাড়িতে স্টাফ করা বাঘ।

এদের কথা মনে করিয়ে দিয়ে দুলন বলল, এদেব মান সম্মম্মান রাখতে রুদালী ঔরত চাই। বাস্, লাইন ধরিয়ে দিলাম, এখন লড়ে মা।

শনিচবী ও বিনি মাখা নাঙল। ওদের জীবনে সহজে কিছু মেলে না। ভুট্টার ঘাটো ও নিমক যোগাড় করতে জান নিকলে যায়। কি সন্তানজন্মে, কি স্বামীমরণে এরা মহাজনের কাছে বাধা। স্বশ্রেণীর কাছে মান রাখবার জন্যে এরা মৃত্যু নিয়ে বর্ণর পরচ করে। সে খরচের কিছুটা শনিচরীর ঘরেও আসুক।

শনিচরী ও বিনি লড়ে গেল। সবই লড়াই এ জীবনে। বিনি এ গ্রামেব মেয়ে নয়। কিন্তু আশ্চর্য সহজে ও গ্রামজীবনের একজন হয়ে গেল। ফসল বোনা ও কাটার সময় পুরনো খেতমজুর খাটল লছমনের কাছে। অন্য সময়ে চলে গেল হাটে-বাজারে, বাস স্টপের দোকানে। ওই খবর আনলে কে মরছে মালিক বাড়িতে। কার শ্বাস উঠছে। তারপর দুজনে কালো থান কেচেকুচে নিল। সেই থান পরল। আঁচলে বেঁধে নিল আটা-ভাজা চূরন।

সেই চুরন খেতে-খেতে দুই বুড়ি হনহনিয়ে হাজির মালিক-বাড়ি। মালিকের গোমস্তার সঙ্গে কথা বলল শনিচরী। কথার বয়ানও বাঁধা-কান্না যা কাঁদব হজৌর, তাতে রামনাম শোনা যাবে না। পাঁচ টাকা করে নেব, ঔর চাল। কিরিয়াকাজের দিন খাবার নেব, কাপড় নেব। দর কষবেন না, দর কমবে না। আরো রুদালী চান তো এনে দেব।

গোমস্তাও মেনে নিল সব। না নিলে উপায় কি? ভৈরব সিংয়ের শবযাত্রায় এদের দেখার পর সবাই এদেরই চায়। এরা পেশাদার। দুনিয়াদারী এখন শৌখিনের নয়, পেশাদারের। খেতমজুরদের হিসেব নয়-ছয় করতে, চক্রবৃদ্ধি সুদের অঙ্ক বাড়াতে গোমস্তাদের দক্ষতা দশ টাকা মাস মাইনেতেই তাদের চাষ-গেরস্তী, হাল-বলদ, চাইলে একাধিক বউ। অনাত্মীয মৃতের জন্যে কাঁদাও পেশাদারী কারবার। এ কাববারে বড়-বড় শহরে পেশাদারী বেবুশোরা লড়ে যায়। শনিচরী এ অঞ্চলে এ পেশায় এসেছে। জায়গাটি শহর নয়। তোহরিতে বেবুশ্যেও অগণন নয়। তাই শনিচরী যা বলবে, মানতে হবে।

শুধু কাঁদলে একরকম রেট।

কেঁদে লুটোলে পাঁচটাকা এক সিকে।

কেঁদে লুটিয়ে মাথা ঠুকলে পাঁচ টাকা দু সিকে।

কেঁদে বুক চাপড়ে শ্মশানে গিয়ে শ্মশানে লুটোপুটি খেলে ছয় টাকা দিতে হবে।

কিরিয়াতে কাপড় চাই। সে কাপড় কালো থান হলেই ভাল। এ হল রেট। তারপর, রাজালোক তুমি চালের সঙ্গে ডাল-নিমক তেল দিলে না হয়! লক্ষ্মী বেঁধেছ ঘরে, ও চাল তেল তোমার গায়ে লাগবে না। কিন্তু শনিচরী তোমার নামযশ গাইবে দিকে দিকে।

সুন্দর চলতে লাগল কারবার। ভৈরব সিংয়ের শবযাত্রায যারা কেঁদেছিল, তাদের আনাটা যেন মানের লড়াই হয়ে দাঁড়াল। ক্রমে লাল এবং সাউরাও ডাকতে লাগল শনিচরীকে। গোকুল লালার বাবা মরতে গোকুল বলেছিল, কিরিয়া অবধি রোজ আসবি যাবি শনিচরী।

বোজই গোকুল ওদেব ছাতু ও গুড় দিত। বলত, তোদের দিলে পুণ্য হবে।

গোকুল কাপডও দিয়েছিল ভাল। মালিক-মহাজনদের মত সবচেযে সম্ভাব জন্মা কাপড় খোঁজেনি। বিনি সে কাপড দুটো হাটে বেচে দেয়।

গোকুলের বাত্তি পাওনাথোওনার কথা শুনে দুলন বলল, এ বেশ ভাল কথা মনে হল। এরপর যেখানে যাবি, সেখানে কিবিয়া পর্যন্ত যাওয়া আসাটা রাখিস। রুদালী দেখলে তারাও কিছু না কিছু দেবে। এ সময়ে কেউ অত তিসার কষে না।

-- হ্যাঁ, তারাও দেবে।

শনিচরী অবজ্ঞা জানাতে তামাকের ধোঁয়া ছাড়ল। বলল, ে বাপ ভাই মরলে চোখে জল পড়ে না, কিরিয়ার খরচের হিসার কষে? গঙ্গাধর সিংয়ের মত লোক জেঠা মরতে মুদায় ঘিউ মাখাল না, দালদা মাখাল, তা জান?

---ওরা নিজেরা কাঁদলে তোদের কি হবে?

-একটু কাঁদতে ত পারে।

- যাক। কাজের কথা শোন্।

বল।

বড়লোকের কাণ্ড। নাথুনি সিংয়ের মা কিন্তু মরছে। নাথুনির ঘব তো দূরে। নাথুনি বলেছে, তোদের পান্ডা লাগাতে।

- মরছে! মরে নি তো!

-- আাবে নাথুনির কথা শুনলে তবে বুঝবি এদের মনে কত পাপ থাকে।

নাগুনি সিংদেব যত জমিজমা সবই তো ওর মায়ের দৌলতে। ওর মা কে, তা জানিস!

- না। তোমার মত এ তল্লাটের সকলের কুলুজি কুঠিব খবর কে রাখে তাই বল--- ওর মা হল পরাক্রম সিংয়ের একমাত্র বেটি। পরাক্রম সিংয়ের জুলুম ছিল কত! যখন ছোট ছিলাম তখন দেখেছি খাজনাই জ্বলম উঠিয়ে ওর প্রজা, বুড়ো হাঁথিরাম মাহাতোকে ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে, ঘোড়া ছুট করিয়ে পরাক্রম সিং হাঁথিদামকে মেরে ফেলে।

-আমিও শুনেছি।

---পরাক্রমেব সহ সম্পত্তি পায় নাঙ্গুনিব মা। সেই মাব দৌলতে ওর যত বোলবোলা আর গরম। সেই মা আজ কতদিন খোঁখীর ব্যামোতে ভুগছে। কাশলে তাজা খুন ওঠে। রোগা না কি খুব ছোঁয়াচে।

--না না, রঙযার তো হযেছিল।

-- বুধুয়া ছিল ভাল লোক! নাথুনির মা 'সশশ্চয় মন্দ লোক?

-সে যাক্ গে। কি বলছিলে!

নাথুনি এমন যোগা ছেলে, সে মাকে উঠোনের ওপাশে একটা ঘর তুলে তাতে রেখে দিযেছে। খাটিয়ার সঙ্গে একটা বামছাগাস বেঁধে দেখে দিয়েছে, বাস্, ওহিতত্ ইলাজ। না হেকিমী না কবিবার্জা বৈদা চিকিৎসা না ডাক্তারী সৃই ইলাজ। এখনো বুডি বেঁচে। নাধুনি চন্দন কাঠ, শাল কাঠ আনাচ্ছে, খুব ধুম উগকে মাকে স্বালাবে! মা মবলে কবিযাতে দানের কাপড় আসছে গাঁট-গাঁন। কিরয়াতে ব্রাহ্মণকে খাওয়াবে বলে ঘি চিনি-ডাল-আটা এনে মৌজুদ করছে। বাসনও দেবে, বাসন আনাচ্ছে।

--হা ভগবান, এখনো তো মবেনি।

মা সারাদিন হেগে-মুতে পড়ে থাকে। বিকেলে একবাব মোতি দুসাদিন সাফ কবে দেয়। এখন দুসাদিন ছুঁলে মায়েব জাত যাচ্ছে না। একটা দাই ঠিক কবেছে। সে বাত্রে বুড়ির ঘরে ঘুমোয়। মা বেঁচে আছে, তাকে বাঁচাতে একটা টাকা খবচ করবে না, কিন্তু মাকে দাহ করতে, মায়ের কিবিয়া করতে তিরিশ হাজার টাকা খরচ করবে নাখুনি।

-তাই বলছে?

--খুব চিল্লাচ্ছে। তাই তো বলি ওদের উল্টা হিসাব। জিন্দা মানুষকে দেখবে না মবে গেলে ধুমধামে কিবিযাকাজ করে মান উঠাবে। এই শীতে বুড়ির গা থেকে রেজাইটা টেনে নিয়ে কাঁথা দিয়েছে। বুড়ি তাড়াতাড়ি মরলে নাথুনি বাঁচে। এদেব ব্যস্তি নিয়মিত যাস কিরিয়া অবধি।

-যদি কিছু না দেয়?

-দেবে রে দেবে। না দিলে নাখুনি গোকুল সালার কাছে হেরে যাবে না? নিন্দে হবে ওব জাতভাইদের কাছে।

কথায় বলে, মাঘের শীত বাঘের গায়ে। মাঘের শীতে ঠাণ্ডা লেগে নাখুনির মা মরে যায়। কিবিয়া অবধি যান আসে শনিচরী। নাথুনির তিন বউ। বড় বউ বিরস বদনে শনিচরীদের আটা ও গুড দেয় রোজ। বলে, বুড়ো হয়ে মবেছে, তার কিরিযাতে অত খরচ কেন?

নাথুনির মেজ বউ অত্যন্ত ধনী জোতদারের একমাত্র মেয়ে। ধনী জোতদারের একমাত্র মেয়েকে বাপ বিয়ে কবেছেল বলে নাথুনি মাতৃধনে ধনী। সেও অনুরূপ বিয়ে করতে চেয়েছিল। কপাল মন্দ, বড় বউ ও ছোট বউ একতমা নয়। একতমা একা মেজবউ। সে আবার স্বামীর ঘরকে গরীবের ঘর মনে করে ও সতীনদের বিষনজরে দেখে। বাগের কারণ হল বড় ও ছোট বউ ছেলের মা, সে মেয়ের মা। অতএব লোকচক্ষে হেয়। বড় বউয়ের কথা শুনে সে ধারাল হেসে বলে, কিরিযাতে তিরিশ হাজার টাকা কি একটা টাকা হল? শত বছর বাঁচুক আমার বাপ, কিন্তু তিনি মরলে দেখিয়ে দেব কিরিয়া কাকে বলে।

বড় বউ বলে, তা তো খরচ করতেই হবে। তোর পিসির নাপিত- দোষ হয়েছিল সে কলঙ্ক ঢাকতে হবে না?

-- হাসালে দিদি! আমার পিসির নাপিতদোষ? আমার পিসের নাম যে গয়া শহরে সবাই জানে। তোমার বোন যে ভাশুরের ঘর করে বিধবা হয়ে, সে কথা তো বলছ না?

এই থেকে তুমুল কলহ বাধে কিন্তু মেজ বউ পুণ্যবর্তী। তার কথা ভগবান শোনেন এবং বসন্ত রোগে মরতে বসে মেজ বউয়ের বাপ। মেজ বউ শনিচরীকে ডেকে পাঠায়। বলে, শনি মঙ্গলের মড়া দোসর খোঁজে এ কথা সত্যি! নইলে শাশুড়ি মরল, সঙ্গে সঙ্গে আমার বাবাব চেচক হল কেন? শোন্ শনিচরী, এই একটা টাকা বখশিশ।

---চেচক?

--হ্যাঁ রে।

শনিচরী খুবই ন্যাকা সাজে ও বলে, তবে যে শুনি আপনাদের, উঁচা জাতের চেচক হয় না? চেচক হয় শুধু নিচু জাতে? আমাদের ঘরে! সেইজন্যে তো আমরা গোরমেনের টিকা ভি নিই, ঔর দেওতার পূজাও লাগিয়ে দিই।

-গোরমেনের টিকা গোরক্ত।

এ কথা বলেই নাথুনির মেজ বউ টিকা প্রসঙ্গে ছেদ টানে ও বলে, তুই তো তখন ছিলি? বড় বউয়ের সঙ্গে আমার গরম-গরম কথা হল? তা, যে কথা সে কাজ আমার। বাপ বিনে কেউ নেই আমার। এখানে বাস করি শত্রুপুরীতে। ছেলের মা যারা, তাদেরই আদর যত, আমি তো মেয়ের মা।

-আপনারও আদর আছে।

-সে কি আমার আদর? আমার বাপ মোহর সিংয়ের টাকার আদর। বাপ আমাকে দূরে বিয়ে দিতে চায়নি, তাতেই তো সতীনের ঘর করছি। নইলে চৌহান রাজপুত আমরা, এ ঘরে বিয়ে হয়?

-কপালে যা লেখ্য আছে।

-তাই সত্যি রে। শোন, আমি চললাম বাপের কাছে। তুই আর বিনি তো যাবি, আরো বিশটা বাণ্ডী নিয়ে যেতে হবে। তাদের দেব একশো টাকা, ঔর চাল। তোদের দুজনের পঞ্চাশ টাকা ঔর চাল। কিবিয়াতক্ ওখানেই থাকবি, খাবিদাবি, ঔর কিরিয়াতে কাপড়লাত্তা নিয়ে তবে আসবি।

--হুজুবাইন, আপনার বাবা তো মরেন নি।

পচে গেছে গা, খুব জোয়ান দেহ, অত দুধ-ঘি খাওযা শরীর। অমন শরীর ছেড়ে প্রাণ বেরোতে চায়? আমার শাশুড়ি মরতে তোদের মোটা চাল, খেসাবিব ডাল দিয়েছিল।

ঔর তেল, লবণ, মির্চা।

--কত দিয়েছিল তা আমি সনি না? আমার বড় সতীনের হাতটা যে কত বড়, সে কি আমার জানা নেই? আমি দেব চাল, ডাল, তেল, লবণ, আলু অর গুড়।

---হুজুরাইন গরিবের মা-বাপ।

-তবে হ্যাঁ, কান্নার মত কান্না হওয়া চাই।

-কাঁদব, ঔর মাটিতে লুটাব?.

-মাটিতে লুটাবি? -মাটিতে লুটাব, ঔর মাতাও ঠুকব।

-মাথাও ঠুকবি!

-কপাল কেটে যাবে?

কপাল কেটে যাবে।

-আরো পাঁচ পাঁচ তোদের দুজনের। টাকাটা কোনো ব্যাপার নয় শনিচরী। আমার বাপের দাহ ঔর কিরিয়া এমন হবে, যে গল্প রয়ে যাবে মুল্লুকে। দেখে আমার স্বামী আর সতীনরা হিংসেয় জ্বলে পুড়ে মরে। আমি এক বাপের এক মেয়ে। বাপ যা রেখে যাচ্ছে, তার মান রেখে কিরিয়াদাহ করে দেখিয়ে দেব। রোজ রুপোর গেলাসে দুধ খেয়েছে, জওয়ানীতে রাণ্ডী রেখেছে, বুড়ো হলেও রাণ্ডী রেখেছে। বিলাইতি বিনে মদ খায় নি। আমাকে দুঃখ দেবে নতুন বউ, তাই মা মরে গেলে বিয়ে করেনি।

-কিছু টাকা দিন, বাজারী রাণ্ডী শেকে আগাম দিতে হবে। ওরা কি কম খচড়াই?

নে।

সমগ্র ব্যাপারটি বহুমুখী হযে দাঁড়িয়েছিল। মালিক মহাজনের ঘরে মানুষ মরলে দাহ কিরিয়াতে যত খরচ হয়, তার মান নিমেযে উঠে যায়। রুদালীদের সম্মানও ওঠে। ফলে ববাদ্দের বাইবে যে খরচ হয়, তা তুষে নেয় মালিকরা দুসাদ, ধোবি, গঞ্জ, কোলদের ঘাড় ভেঙে। সর্ব অর্থেই মোহর সিংয়ের অন্ত্যেষ্টি গল্পকথা হয়ে দাঁড়ায় এবং খরচের সিংহভাগ নিয়ে যায় ব্রাহ্মণরা। নাথুনির বউ আর স্বামীগৃহে ফেরে না। শ্বশুরের সম্পত্তি যাতে নাথুনি না পায়, সেজন্যে মেয়েদের বিয়েতে অসাগর খরচ করতে থাকে। অবশ্য তা কয়েক বছর বাদে।

শনিচরী তার সৌভাগ্যের কথা দুলনকে বলল। দুলন ফচফচ করে বিশ্রী হেসে বলল, কলিযারিতে সবাই ইউনাইন করে! তা রুদালী ঔর রাণ্ডীদের নিয়ে তু ভি ইউনাইন বনা দে এক? তু বন যা পিসিডেন!

-হায় রাম!

--এখন বাজারিয়া রাণ্ডী খোঁজ গে!

-কৈছন?

বিঘ্নি হুঁকো নামিয়ে বলল, এনে দেব বাণ্ডী। মালিক-মহাজন যত মেয়েকে নষ্ট করে তারা বাস্ত্রী হয়।

-দূর, ওরা একটা আলাদা জাত।

- না, না। তুই জানিস না।

- তোইরিতে হাটবারে গেলে মেলাই রাণ্ডী।

মূলনের কি মনে পড়ল, বলল, আবে শনিচরী, নওয়াগড়ের গম্ভীর সিংকে জানিস?

বাবা! তা জানব না? হাঁথি চড়ে সে দেওয়ালীর মেলায় ঘুরে? এই এত বড় নাক আব গলায় ঘ্যাগ।

---খুব খারাপ কাজ করল।

-- নতুন কি কাজ কবল?

--ওর তো বাঁধা বা গুঁ। মোতিযা তাকে বউয়েব সম্মানে রেখেছিল।

মোতিযার মেয়ে গুলবদনকে কপাব মল পরিয়ে কোলে নাচাত। মোতিফা মরে যেতে গুলবদনকে শাদী দেবে বলেছিল। আজ দেখি সেই গুলবদন তোহ্র যাচ্ছে। কেঁদে কেঁদে চোখ লাল। বলল, জনম দিতে জানে, পালপোষ করতে শেখেনি। বের করে দিল আমাকে। আমি শুধালাম, কেন? ও বলল, বুড়ার ভাতিজা খুব নাখারা জুড়েছে কতদিন। বলতে গেলাম, তা আঁখ মোটা করে বলল, মা মরে গেছে তিন মাহিনা, তুই কেন ঘর জুড়ে বসে আছিস? ভাতিজা কি বলে শুনতে হলে শোন, নয়তো চলে যা। রাণ্ডীর মেয়ে তোষ ভাতের অভাব কি? -বহোৎ হারামি তো?

দুলন গলা ঝেনে কাশল। বলল, আমার মনে দুখ উঠে গেল। গুলবদন বলল, ওর ভাতিজার কাছে থাকব, নিজের মেয়েকে এ কথা বলতে পারত? ঔর থাকি যদি, আমার সন্তান হবে না? তারাও একদিন লাথ খেয়ে বেরোবে ত? তাই হবে, বাজারে যাব।

শনিচরী নিশ্বাস ফেলে বলল, অমন রূপ! ওকে কোনো শেঠ তুলে নিয়ে যাবে।

বিনি বিজ্ঞের মত বলল, নিজের মাকে দেখেছে, ও কি আর বাঁধা রানি হবে?

বিনি গেল তোরি। ফিরে এসে বলল, বাপ রে, মাই রে! টাকা পাবে বলতে রাণ্ডীদের ভিড় জমে গেল।

-দেখলি ওদের?

দেখলাম?

-কেমন দেখলি?

-চার আনার রাণ্ডী সব, বুড়ো হয়ে গেছে। কষ্ট খুব। তক্তি সুমা পরে ডিবরি নিয়ে দাঁড়াতে হয়। বুড়ো মরেছে জানলেই চলে আসবে। ভাল কথা!

-কি?

বুধুয়ার বউ, তোর বেটার বউকেও দেখলাম।

তোহরিতে?

-হ্যাঁ। তোর চেয়েও বুড়ো হয়ে গেছে।

---থাক ওর কথা।

-ও নিজেই পরিচয় দিল। আজ দশ বছর ওখানে আছে।

ছেলের কথা শুধাল।

-তুই কি বললি?

-কি বলব? কেন বলব? কথাই বলিনি। -বেশ করেছিস।

ধূধুলের তরকারি আর আটার লিট্রি খেতে-খেতে শনিচরীর বউয়ের কথা মনে পড়ল। খিদেটা খুব বেশি ছিল। কোন্ বছর যায়? সে বছর লাইনে হাতির পাল উঠেছিল আর একটা দাঁড়ানো ইঞ্জিনও ফেলে দেয়। বুধুয়া মরার বছর। ওই টোকো আম গাছটা ছিল এতটুকুন, এখন ফল দিচ্ছে। দশ বছব তোহরিতে। ভাল হয়েছে হারোয়া ভেগে গেছে কোথা। মায়ের পরিণতি জেনে যায় নি।

-না না, তাই ফেলিস কখনো?

খাওয়ার পর দুজনেই তামাক খেল। শনিচরী বলল, ওর করম! বুধুয়া মরলেও আমি ওকে ফেলতাম না।

-খুব গরিব দেখলি?

--খুব।

শনিচরীর মুখে আর কথা যোগাল না।

তারপর মোহর সিং মরল।

বিশাল ধুমধামে কিরিযা হল। রাণ্ডী বুডিরা শনিচরী আর বিনিকেই নমস্কার করে বলল, হুজুরাইন! আবার দরকার হলে পাত্তা চালিয়ে দিও। এসে যাব।

শনিচবী আর বিনি কাপড়ের সঙ্গে ফনফনে পেতলের সরা আর বাঁশের ছাতাও পেয়েছিল। বিনি সেগুলো হাটে বেচে দেয়। টাকা হাতে থাকতে-থাকতেই পোকা-কাটা ভুট্টা কেনে বোরা বোঝাই। বলে, জাঁতায় পিষলে আটা হবে, ভাঙলে দালিয়া হবে, বুঝলি?

ক্রমে জীবনটায় শৃঙ্খলা আসে। কেউ মরলে বাঁধা রোজগার। নইলে বাকি সময় আধাপেটা সিকিপেটা খাও। না জুটলে? কোই পরোয়া নেহী। বছরে একটা-দুটোর বেশি কাঁদার বরাত জোটে না। কাজেই সকলের মত জুটলে খেতমজুর খাট, নয়তো মালিকের খেত মুড়োও, জঙ্গলে গিয়ে মূল-কন্দ খোঁজ, সকলের মত। বিনিই সকলকে অবাক করে দিল। ছেলেকে দেখতে গেল না একবার, শনিচরীর উঠোনে লঙ্কা গাছ আব্জে লঙ্কা বেচল হাটে। তারপর বলল, রসুন বুনে দেখতে হবে। রসুন বিকোয় ভাল।

ক্রমেই ওদের সুনাম বাড়ল। শনিচরীদের সবাই ডাকতে থাকল। হ্যাঁ, পয়সা নেষ। কিন্তু সত্যিই মাথা ঠোকে, সত্যিই গড়াগড়ি খায় মাটিতে। আর মৃতের যশোগাথা যে কতরকমে গেয়ে কাঁদে। শুনলে মৃতের আপনজনদের মনে হতে থাকে যে মরেছে, সে হাড়-বজ্জাত, শয়তানের দোসব নয়। সে স্বর্গের দেবতা, ছলতে ধরাধামে জন্মেছিল। চমৎকার চলছিল সব। দু বছর খুবই মন্দ যায়। নাথুনির বড় বউয়ের ভাই শোথজ্বরে মরতে বসেছিল, হাসপাতালে গিয়ে সেরে আসে। শনিচরীদের প্রত্যক্ষ মহাজন লছমনেব বিমাতার আচরণ আবো মর্মান্তিক। বাতস্বরে নিশ্চিত ছিল মৃত্যু, কিন্তু কোত্থেকে এক সর্বনেশে বৈদ্য এসে তাকে বাঁচিয়ে তুলল।

শনিচরী নিশ্বাস ফেলে বলল, নসিব!

নাপিত পারশনাথও খুব অসন্তুষ্ট হল। বলল, য়ে ধবম কী বাত না হ্যায়।

---কৈছন?

--দেখ না তু, বুধুয়াকে মা! আগে আগে মানুষের রোগভোগ হলে মানুষ মরত। জনম কে সাথ সাথ মরণ ভি চলনা চাহিয়ে। নইলে ধরতির কাম চলে? অসুখ হলে বুড়ো মানুষ মরবে! তা না, ডাক্তার বৈদ্য হেকিম, সবাই বুড়োগুলোকে বাঁচিয়ে তুলছে? এ তো ঠিক কাজ নয় বুধুয়াকে মা!

শনিচরী নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমার কি বল? জন্মে-বিয়েতে-মরণে তুমি আছ। বিয়ের কথা পাড়তেও তোমাকে লাগে। কিন্তু আমার কি অবস্থা হল তা বল? বিখনি কিন্তু হতাশ হল না। বলল, সময় হয়নি তাতেই মরল না। সময় হলে কি কেউ থাকবে?

দুলন বলল, এ কিছু নয় রে। আগের চেয়ে আজকাল বেশি খাস, তাতেই একটু এদিক ওদিক হতে চিন্তা হচ্ছে। মালিক-মহাজনকে দেখিস ন্য? লছমন সিংয়ের সৎ মা তো গম বেচা টাকা দেখলে কাঁদতে বসত। এ বছর গম হয়েছে, বেচে টাকা পেলাম। আগামী সনে যদি তেমন গম না হয?

শনিচরী বলল, যাও, সব কথায় কি তামাশা চলে?

তারপর শনিচরীব কপাল খুলল, এই বছর। বিখান হাসতে হাসতে এসে বলল, খুব ভাল খবর।

কি?

--সে কমে বলতে হবে।

খরবটা কি?

-ব্যগ করছিস?

-কি খবব তা বলবি তো?

-- গম্ভীর সিং তো মবছে।

-কে বলল"

বিনি সব খুলে বলল। খবরটা দিয়েছে পাশে নাই। নার্সিতের দেওয়া খবর মিছে হয় না। নাপুনির মায়ের খোঁখীর ব্যামো হয়েছিল, শনিচবার মনে আছে নিশ্চয়।

হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আছে খুব। বলুক না বিখনি।

নাগুনি তাব থাকে যেভাবে রেখেছিল, সে নিয়ম এখন ঘরে ঘবে চলছে। খোঁখী মানে বাজলক্ষা। শিবের অসাধ্য যোগ। এ রোগ যাকে ধরেছে, তাকে চিকিৎসা করালে স্বয়ং শিবঠাকুরকে অপমান করা হয়। গম্ভীর সিংয়ের আপন বলতে কেউ নেই। ভাতিজা সব পরে বুড়োর খোঁার্থী রোগ এবতে ভাতিজা তাহাতি উঠোনে পর তুলেছে। গম্ভীর সিংকে সেখানে রেখেছে। রামছাগল এনে ঘরে বেঁধেছে। রামছাগল দেখে গম্ভীর সিং বলেছে, ঘরে বস্তু বাঁধলে তো কেউ বাঁচে না। আমি কি বাঁচব না? না বাঁচলে এমন কিরিয়া করবি, যে দেখে সবাই তাজ্জব বনে যায়। সবাই শোচে যে হ্যাঁ, মানুষ একটা মরেছে বটে।

-তারপর কি হল? বিনি বলুক?

গম্ভীর সিং খুবই আজীব লোক। এখন সে ওষুধবিষুধ ছেড়ে রোজ পুজো হোম যজ্ঞ করাচ্ছে। ওর বউ জেদ করে ডাক্তার এনেছিল। ডাক্তারও ভরসা দিচ্ছে না।

-মরেনি তো এখনো?

-মরবে তো। ভাতিজার করাব নেই কিছু! বুডো ভকিলকে ডেকে কিরিয়া কাজে লাখ টাকা খরচ করতে বলেছে।

-কেন?

--বলছে টাকা সব ফুরিয়ে রেখে যাব। ভাতিজা জোতজমা চাষ করিয়ে যা পারে করুক। আমার ছেলেপিলে নেই। ওই বজ্জাতের জন্যে নগদ টাকা রেখে যাব না।

-তা হলে?

-আজ না হোক কাল, বুড়ো মরবে।

- ততদিন?

- -আমি একবার ঘুরে আসি।

-কোথায় যাবি?

--রাঁচি।

রাঁচি? কেন?

-আর বলিস কেন? হাটে আমার দেওরপোর সঙ্গে দেখা।

সে বলে, চাচী, একবার চল। তার মেয়ের বিয়ে।

-মেয়ের বিয়ে?

বিনি নিশ্বাস ফেলে বলল, বলছে সে বিয়েতে নাকি সে হতভাগাও আসবে। আমার ছেলেটা। তুই বলবি, ছেলেকে দেখতে চাস তো ঘরের কাছে তার শ্বশুরালে যা? সে আমি যাব না। কিন্তু দেওরপোর বাড়ি গিয়ে একবার দেখে এলে কেউ কিছু বলতে পারবে না। সেও জানবে না যে তাকে দেখতে এসেছি।

শনিচরী বলল, এ কথা বললে আমি বলব না কিছু। ছেলেকে দেখবি বলছিস। তবে ঝটপট আসবি তো? না, থেকে যাবি সেখানে?

-তা থাকি কখনো? ঘর ছেড়ে বেরিযেছিলাম, পথে তোর সঙ্গে দেখা। সেদিন তুই না থাকলে আমি কি করতাম?

--গম্ভীর সিংয়ের কথাটা মনে রাখিস।

-আরে আমি চারদিনের মাথায় ফিরব।

মাইল তিনেক হেঁটে গেলে বাস রাস্তা। শনিচরী ততখানি পথ গিযে বিনিকে তুলে দিল বাসে। বলল, সিটে বসলে আট টাকা। মেঝেতে বসে চলে যা, দুটো টাকা দিস।

গ্রামে ফেরার পথে শনিচবী বুঝল, এ রকম উত্তেজনার ঘটনা তার জীবনে আর ঘটেনি। তাবই সহেলী বিনি, যে হাঁটা পথ ছাড়া অন্য পথ জানে না, সে বাসে চেপে রাঁচি চলে গেল? দেওরপোর মেয়ের বিয়ে দেখবে বলে? মানুষের দেওরপো থাকে কাছেভিতে। রাঁচির মত বড় শহরে থাকে?

শনিচরী সকলের গল্প করতে করতে এল। সবাই বলল, শনিচরীর জীবনে সবটাই হল নিদারুণ দুঃখ। তবে বিনিকে পাওয়া একটা আশীর্বাদ ওর পক্ষে। কি খাটিয়ে পিটিয়ে বুড়ি! শনিচরীর ঘরের চেহারাই ফিরে গেছে এখন। একেই বলে নিয়তির খেলা। কোথায় বাড়ি, কোথাকার কে সেই হল আপনজন। যেন কোন গাছের বাকল কোন গাছে জোড়া লাগল। ঘরে ফিরে শনিচরীর যেন মন বসে না আর। অবশেষে ও গেল জঙ্গলে জ্বালানি কুড়োতে। শুকনো ডালপালা বয়ে নিয়ে এল খানিক। বিনি কখনো খালি হাতে ফেরে না। নয় দুটো শুকনো ডাল, নয় একটা পথে পড়ে থাকা দড়ি, নয় এক তাল গোবর, যা হয় কিছু একটা ঘরে ঢোকে। এখন ওর মাথায় ঢুকেছে, কারো একটা বকনা বাছুব পেলে পালানি নেবে। শনিচরী ভেবে পায় না, এই বুড়ো বয়সে সংসারে এত মায়া কেন ওর!

কয়েকদিন এইভাবে গেল। গম্ভীর সিংয়ের অবস্থা প্রত্যাশিতভাবে মন্দ হতে থাকল। সেখানে গেল শনিচবী একদিন। গোমস্তার সঙ্গে সব কথাবার্তা বলে নিল। কথায় বার্তায় এখন জানা গেল, বলা হচ্ছে খোঁখীর ব্যামো। কিন্তু গম্ভীর সিং মরছে অন্য রোগে। অসুমার নারী সঙ্গ করবার ফলে দেহে ঘৃণ্য রোগ। শরীর গলে পচে যাচ্ছে। সেই জন্যেই এত যাগযজ্ঞের ঘটাপটা। বোগের স্বালাতেই ওষুধ-বিষুধ না খেয়ে গম্ভীর সিং মবণকে কাছে ডাকছে।

-- শুক্লপক্ষে 'মরতে চায়। গোমস্তা বলল।

-কৈছন? শনিচরাও তাজ্জব। মালিক-মহাজন সব পারে, তা বলে ইচ্ছে হলে শুক্লপক্ষেই মনতে পাবে"

- কে জানে? গোমস্তা দার্শনিক মন'পপ্ততায় বলল, শুক্লপক্ষে মরলে সিধে বৈকুণ্ঠে। কৃষ্ণপক্ষে মালে যুধিষ্ঠিরের মত প্রথমে নরকদশন, তাবপরে স্বর্গবাস।

পুরাণের চবিত্রগুলি সম্পর্কে শনিচরীর বিশেষ গর্ভীর জ্ঞান নেই। তবু তাদের মহত্ব বিষয়ে তার আনুগতা আছে। ক্যালেন্ডারে যুধিষ্ঠিরের ছবি দেখার ফলে তার মনে ত্রিলোক কাপুর ও যুধিষ্ঠির, অভি ভট্টাচার্য ও শ্রীকৃষ্ণ ইত্যাদি ইত্যাদি একাকার। শনিচরী তাই অবাক হয়ে বলে, কৈছন? হাঁ হুজুর, মালিক-পরোয়ার কা যুধিষ্ঠির হ্যায়? গোমস্তা এই অজ্ঞ স্ত্রীলোককে শান্ত কন্ঠে বুঝিয়ে দেয়।

মালিক-মহাজন যা বলে, তাই হয়। পাপ এবং পুণ্য হল দেখার ভুল। দুষ্ট লোক বলবে, যে মালিক-পরোয়ার, বাপ বেঁচে থাকতে ডাকাতি করেছে অংরেজ আমলে, স্বাধীন ভারতে একাধিক লাশ স্বহস্তে ফেলেছে, লছমনের বাপের ঘোড়া চুরি করেছে, দুসাদটোলি স্বহস্তে জ্বালিয়েছে, যে মেয়েছেলেদেব বহুজনকে নষ্ট করেছে, সে মহাপাপী। মালিক নিজে তা মনে করে না। তাই কি পাপে তার মহাব্যাধি হল, তা জানার জন্যে বাড়িতে জ্যোতিষী-গণকের মেলা বসেছে।

-কুছ পাত্তা মিলা?

-কা পাত্তা?

-য়ো পাপ কা?

-জরুর। গাভীন একটি গরুকে বালককালে মালিক ঠ্যাঙা ছুড়ে মেরে ফেলেছিল। এই একমাত্র পাপ।

তবুও বলি, ইচ্ছে হলেই মালিক শুক্লপক্ষে মরবে?

-নিশ্চয়। এখন অবধি দেখলাম না, মালিক যা চেয়েছে তা হয়নি। তবে এও বলে দিচ্ছি, মালিক যা করছে, তা খুব ভাল করছে। ওই ভাতিজার হাতে পড়লে সম্পত্তি উঠে যাবে লাটে।

-কেন?

-মালিক যা করেছে, অদ্ভুত হলেও সব হিন্দু ঘরে। কোন মেয়েটা অহিন্দু নয়। ভাতিজার রাণ্ডী তো মুসলমান।

-হায় রাম!

-তৈরী থাকিস বাপু। অ্যাদ্দিন চাকরি করলাম। কিরিয়া হয়ে গেলে আর এখানে থাকছি না। কিরিয়াও হবে, আমিও চলে যাব। মালিক বলেছেন, মোহর সিংয়ের দাহ ঔর কিরিয়া যেন মানুষ ভুলে না যায়, এমন ব্যাপার করতে হবে।

-জান লড়িয়ে দেব হুজুর।

শনিচরী ফিরে এল।

বাড়ি ফিরল দুর্ভাবনা নিয়ে, দিনে দিনে ছয়দিন হল। বিনির ব্যাপার কি? গ্রামটাও ওদের অজগ্রাম। বাইরের জগতের সঙ্গে কাজ কারবার নেই মোটে। বাসে চড়ে কেউ কোথাও যায় না। রাঁচি থেকে বিনির খবর কে এনে দেবে? নিশ্বাস ফেলে শনিচরী কাঁথা বিছানা রোদে দিল। চারটি ভুট্টা জাঁতায় ভাঙল। তারপর গেল পঞ্চায়েতী চালাঘর মেরামত করতে। এ কাজে মেহনত দেওয়া বাধ্যতামূলক। সর্বদা দেখাশোনা না করলে মাটির ঘর দিমাগ লেগে ঝুরঝুরে হয়ে যায়। সে কাজ সেবে চারটি ডালপালা মাথায় বয়ে ঘরে এসে বোঝা নামিয়ে তবে ও লোকটাকে দেখল।

অচেনা লোক। মাথা নেড়া, খালি পা।

-বিনি মরে গেছে?

শনিচরী যেন নিমেষে বুঝল সব, আব প্রশ্ন করল। বলল, তুমি তার দেওরপো?

-স্ত্রী?

শনিচরীর ভেতরে তখনি ধস নামল। কিন্তু বহু মৃতা, বহু বঞ্চনা, বহু অবিচারে গঠিত ওর ধৈর্য ও সংযম। ও আগন্তুককে বসতে বলল। নিজেও বসল, চুপ করে রইল বহুক্ষণ। তারপর আস্তে বলল, কতদিন হল?

-চারদিন।

শনিচরী আঙুলে গুনে দেখে বলল, সেদিন আমি গম্ভীর সিংয়ের বাড়িতে। কি হয়েছিল?

-হাপানি থেকে বুকে কফ বসে গেল।

-এখান থেকে যেতে না যেতেই?

-পথে ঠাণ্ডাই শরবত খেয়েছিল।

-তারপর?

মনে পড়ছে রঙিন শরবত, হজমি গুলি, বেলের মোরব্বা, এ সব কিনে খাবার দিকে বিনির বড় লোভ ছিল।

-তারপর হাঁপানি উঠে গেল। আমার শালা হাসপাতালের কাজ করে। ডাক্তার দেখালাম, সুই ইলাজ করালাম।

-আমি কোনদিন তা করিনি।

বেনেতে দোকানে ঝাঁটা চালিয়ে জখম করে আরশোলা ধরত শনিচরী। মেটে হাঁড়িতে আরশোলা সিদ্ধ করে জলটা খেতে দিত। বিনির হাঁপের টান কমে যেত।

-ওর ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

--সে আর এল কোথায়? এখন তাকেও খবর দিয়ে যাব। জেঠাইন কি আপনার কাছে কিছু রেখে গিয়েছিল?

-কিছু না। জেঠাইন বলছ, মরল ও তোমার কাছে, তার কেউ আছে বলেই তো জানি না। পথে পথে ঘুরছিল....

-- আমিও জানি না। জানলে নিয়ে যেতাম।

---এখন এস বাছা। বাসে যাবে, বাস রাস্তাও দূরে।

--লোকটি চলে গেল। শনিচরী এখন একা বসে অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করল। কি হচ্ছে মনে" দুঃখ? না, দুঃখ নয় ভয়। স্বামী মরেছে, ছেলে মরেছে, নাতি চলে গেছে, বউ পালিয়েছে, দুঃখ শনিচবীর জীবনে কবে ছিল না? তখন এমন আগ্রাসী ভয় হয়নি ত? বিনি মবে যেতে ওর পেশায় চোট পড়ল, ভাতে হাত পড়ল, তাতেই ভয় হচ্ছে। ভয় হচ্ছে কেন? বয়স হয়ে গেছে বলে। শনিচরীদের জীবন, পারলে শেষ নিশ্বাস অবধি খেটে চলার জীবন। বয়স মানে জরা। জরা মানে কাজ করতে না পারা। কাজ করতে না পারা মানে মৃত্যু। শনিচরীর নিজের মাসি বুড়ো হয়ে গিয়েছিল। এত বুড়ো, যে পোঁটলার মত তাকে তুলে ঘরে নিতে হত। শীতের দিনে রোদ পোহাতে তাকে বাইরে বসিয়ে সবাই কাজে গিয়েছিল। এসে দেখে বুড়ি মরে কাঠ হয়ে আছে।

শনিচরী তেমন মৃত্যু চায় না। মরবে কেন? স্বামী মরল, ছেলে মরল, শনিচরী কি দুঃখে মরেছিল? দুঃখে মানুষ মরে না। প্রচণ্ড শোকের পরও মানুষ ক্রমে স্নান করে, খায়। লঙ্কা চারা খাচ্ছে দেখলে ছাগল তাড়ায়। মানুষ সব করে। কিন্তু না খেতে পেলে মানুষ মরে যায়। শনিচরী এত শোকে যখন মরেনি, বিখনির শোকে মরবে না। দুঃখ আছে খুব, কিন্তু কাঁদবে না শনিচরী। পয়সা, চাল, নতুন কাপড় না পেলে কাঁদাটা বাজে বিলাসিতা।

শনিচরী দুলনের বাড়ি গেল।

দুলন ব্যাপারটির সম্যক গুরুত্ব বুঝল। বলল, দেখ বুধুয়াকে মা। জমির দখল ছাড়তে নেই, তা তোহার লিয়ে য়ো রোনা-কাম জমিন হ্যায়। দখল ছাড়া চলবে না। তুই মজাটা দেখছিস না? একেক জন মরছে, তোরা যাচ্ছিস, ওরা কান্নাকাটির ক্লাঁকজমক নিয়ে মানের লড়াই লড়িয়ে দিয়েছে। গম্ভীর সিংকেই দেখ না। ওর যে রোগ হয়েছে, তাতে ডাক্তারি ইলাজ করলে মানুষ সারে। ও সে চেষ্টাই করছে না। মরলে জাঁকজমকের কথা ভাবছে।

-ওদের কিসে মান, কিসে লড়াই, ওরাই জানে।

-তোকেও জানতে হবে।

-জেনে কি করব?

-বুধুয়ার বাপ মরতে তার মজুরি কাজ করিস নি মালিকের খেতখামারে?

-জরুর।

-বিনি মরতে তার কামও করবি।

-কৈছন?

-নিজে যাবি। দুলন রেগে চেঁচিয়ে বলল, তোর রুটির ব্যাপার।

নিজে যাবি।

-তোহরি?

-হ্যাঁ, তোহরি। যাবি, রাণ্ডী যোগাড় করবি। নইলে গম্ভীর সিংয়ের ভাতিজা আর গোমস্তা সব টাকা মেরে দেবে।

-আমি যাব!

-জরুর।

-সেখানে যে.....

--বুধুয়ার বউ আছে এই তো?

-তুমি জান?

--জরুর। তো কা, য়ো ভি এক বরবাদী রাণ্ডী হ্যায় না? ওকেও ডাকবি।

-ওকেও?

--জরুর। ওরও খেতে পরতে হয় না? রাণ্ডী ডেকে কাঁদানো এক মজার খেলা। মালিক মহাজনের টাকা পাপের টাকা। তার রয় ক্ষয় নেই। পাক না চারটি বাজারিয়া রাণ্ডীরা। তাদেরও ত মালিক মহাজন রাণ্ডী বানিয়ে কতজনাকে লাথ মারে, মারে না?

-মারে।

কে কেমন রাণ্ডী হয়েছে সব কথা শনিচরী জানে না। কিন্তু মনে পড়ল পেটের জ্বালায় বুধুয়ার বউ ঘর ছেড়েছিল, গুলবদন গম্ভীর সিংয়ের ভাতিজাকে ভাই মনে করেছিল। কিন্তু গম্ভীর সিং বা ভাতিজা ওকে রাণ্ডী ছাড়া কিছু ভাবে নি। সব যেন বড্ড গোলমেলে। শনিচরী সব ভেবে দিশা করতে পারে না। কিন্তু দুলন কি বলছে?

অত পাপ পুণ্য দেখতে যাস না বুধুয়ার মা। পাপ-পুণ্য মালিকদের এক্তিয়ারের জিনিস। ওরাই সে হিসেব ভাল বোঝে। তুই আমি বুঝি খিদের হিসাব।

-সাচ বাত।

-তবে আর কি, চলে যা।

-গ্রামে সবাই মন্দ বলবে না আমাকে?

দুলন অতি দুঃখে হাসল। বলল, পেটের জন্যে কোন কাজ করলে, তাতে বুরাই দেকে কে?

শনিচরী ওর কথা বুঝল।

গম্ভীর সিং মারা গেল দিন সতেরো বাদে। ওর শ্বাস উঠেছে যখন, তখনি গোমস্তা শনিচরীকে খবর পাঠায়। শনিচরী বলে পাঠাল, আমি যাব, লোক নিয়ে যাচ্ছি।

শনিচরী কালো থানটা পরে নিল, চলে গেল তোহরি। লোককে জিগ্যেস করে রাণ্ডী পট্টির সন্ধান নিতে একটুও লজ্জা হল না ওর। পেটের হিসাব সবচেয়ে বড় হিসাব। ডাকতে ডাকতে ঢুকল ও, রূপা, বুধনি, সোমরি, গাঙ্গু! কাঁহা হ্যায় তু সব? আয় আয়, রুদালী কাম আছে।

চেনা-চেনা বেশ্যারা সব একে একে এল। ভিড় জমে গেল সেখানে। অনেক মানুষ। দিন পাঁচ টাকার বেশ্যা থেকে দিন এক সিকের বেশ্যা।

-হুজুরাইন আপ্?

-বিনি মরে গেছে যে। শনিচরী হাসল। তারপর ভিড়েব পেছনে চেনা-চেনা মুখ দেখে বলল, বুধুয়ার বউ? বহু তুইও আয়, গুলবদন, তুইও চল। গম্ভীর সিং মরছে, কেঁদে টাকা নিয়ে ওদের মুখে নুন ঘষে দে। লজ্জা কি? যা পারিস উসুল করে নে। চল চল। সব মাথাপিছু পাঁচ টাকা, সবাই চাল পাবি, কিরিয়াতে কাপড়।

বেশ্যাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। যুবতী বেশ্যারা বলল, আমরা?

-সবাই চল। বুড়ো হলে এ কাজ তো করতে হবে, আমি থাকতে থাকতে তোদের হাতেখড়ি করে দিই?

অসম্ভব মজা পেল সবাই। শনিচরীকে মোড়া পেতে বসাল গাঙ্গু। রূপা চা কিনে আনল, বিড়ি। কিসের যেন উত্তেজনা। তারপর সবাই চলল নওয়াগড়।

গম্ভীর সিংয়ের ভাতিজা, গোমস্তা, সবাই দেখে তাজ্জব বনে গেল। গোমস্তা হিসহিসিয়ে বলল, রাণ্ডীটোলী ঝেটিয়ে এনেছিস? প্রায় একশো রাণ্ডী?

শনিচরী বলল, কাঁয় নেই? মালিক বলেছে, কিস্স্সা-কাহিনী হয এমন শোর মচাবি। তা দশটা রাণ্ডীতে কিস্স্সা কাহিনী হয়? সর সর, আমাদের কাজ আমাদের করতে দাও। মালিক এখন আমাদের।

গম্ভীরের লাশে ঘা পচা গন্ধ। ওর পেটফোলা লাশ ঘিরে রুদালী রাণ্ডীরা মাথা কুটে কাঁদতে লাগল। গোমস্তার চোখ ফেটে দুঃখে জল এল। কিছুই বাঁচবে না গো। ওই মাথা কুটাকুটিটা শনিচরীর খচড়াই। মাথা কুটলে দুনো টাকা! ভাতিজা আর গোমস্তা দাঁড়িয়ে বইল অসহায় দর্শক। মাথা কুটতে কুটতে, কাঁদতে কাঁদতে, গুলবদন শুকনো চোখ বিশ্রীভাবে মটকে ভাতিজ্ঞার দিকে চেযে হাসল। তারপর কান পেতে শনিচরীর কাঁদা শুনে দোহার ধরল।


4
Articles
রুদালী
0.0
মহাশ্বেতা দেবীর "রুদালি" একটি মর্মস্পর্শী ছোট গল্প যা গ্রামীণ ভারতের প্রান্তিক সম্প্রদায়ের একজন মহিলা সানিচারীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। সানিচারী, একজন দরিদ্র মহিলা, তার জীবনের কষ্টগুলি মোকাবেলা করার জন্য একজন পেশাদার শোক বা রুদালি হয়ে ওঠে। তিনি রুদালিদের একটি দলে যোগদান করেন যারা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শোক প্রকাশ করতে এবং মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশ করার জন্য ভাড়া করা হয়। সানিচারীর জীবন দারিদ্র্য, ক্ষতি এবং সামাজিক নিপীড়নের দ্বারা চিহ্নিত। আখ্যানটি শোষণ ও বৈষম্যের মুখোমুখি হওয়া নিম্নবর্ণের মহিলার সংগ্রামের বর্ণনা দেয়। রুদালিরা ভারতের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক সংগ্রামকে মূর্ত করে। শনিচারীর আবেগ শোকের মুখোশের নীচে চাপা পড়ে, ব্যক্তি পরিচয়ের দমনকে প্রতিফলিত করে। গল্পটি সামাজিক অবিচার, লিঙ্গ ভূমিকা এবং দারিদ্র্যের অমানবিক প্রভাবের থিমগুলি অন্বেষণ করে। উচ্চ বর্ণের ব্যক্তিদের সাথে সানিচারীর মিথস্ক্রিয়া ভারতীয় সমাজে প্রচলিত গভীর-মূল কুসংস্কারগুলিকে তুলে ধরে। বর্ণনাটি দারিদ্র্য এবং শোষণের চক্রকে স্থায়ী করে এমন পদ্ধতিগত সমস্যাগুলির সমালোচনা হিসাবে কাজ করে। "রুদালি" হল প্রতিকূলতার মুখে মানুষের স্থিতিস্থাপকতার একটি শক্তিশালী অন্বেষণ এবং ভারতীয় সমাজে বর্ণ, শ্রেণী এবং লিঙ্গের জটিল ইন্টারপ্লে।
1

ভূমিকা

9 December 2023
0
0
0

এই বইয়ে সংকলিত গল্পগুলি অনেক আগে লেখা। "নৈখতে মেঘ" বইয়ে "রুন্দালি", "দৌলতি" বইয়ে "গোহুমনি" আছে। "টুংকুড়" আমার অনেক গল্পের মত আজও কোন সংকলনে প্রকাশিত হয়নি। নিজের লেখার বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগী থাকতে পারি ন

2

রুদালী

11 December 2023
1
0
0

টাহাড গ্রামটিতে গঞ্জ ও দুসাদবা সংখ্যাগুরু। শনিচরী জাতে গঞ্জ। গ্রামের আব সকলের মত শনিচরীর জীবনও কেটেছে অসুমার দারিদ্র্যে। শনিবারে জন্মেছিল বলে ওর কপালে এত দুঃখ, একথা এতদিন ওব শাশুড়ি বলত। যতদিন বলত, তখন

3

টুং-কুড়

13 December 2023
1
0
0

ধানকাটা হয়ে গেছে। "ক্ষেতে মাঠে পড়ে আছে খড়” এখন কবিতার লাইনমাত্র। কেন না মণ্ডল ধানের ভাগের সঙ্গে খড়ের ভাগও নেয়। সবই নেয় সে। এদিক ওদিক পড়ে থাকা ধানের শিষ শুধু আলতাদাসী নেয়। আজও নিল। আলতাদাসী ধানের শিষ

4

গোহুমনি

13 December 2023
1
0
0

গোহুমন হল গোখরো সাপ। তা বিশাস ভূঁইয়ার বিধবাঁকে সবাই গোহুমনি বলে। নাম একটা ওর ছিল, ঝালো। তা কতকাল ধরেই তো ওর নাম ছিল সোনা দাসীর মা। ছেলে আর মেয়ে হলে কে আর কাকে “ঝালো" বলবে তাই বলো? বলাটা ঠিকও নয়। কেচকি

---