shabd-logo

গোহুমনি

13 December 2023

2 Viewed 2

গোহুমন হল গোখরো সাপ। তা বিশাস ভূঁইয়ার বিধবাঁকে সবাই গোহুমনি বলে। নাম একটা ওর ছিল, ঝালো। তা কতকাল ধরেই তো ওর নাম ছিল সোনা দাসীর মা। ছেলে আর মেয়ে হলে কে আর কাকে “ঝালো" বলবে তাই বলো? বলাটা ঠিকও নয়। কেচকি গ্রামের ঝালো ভূঁইন কেন "গোহুমনি" নামে পরিচিত তা জানতে চেয়েছিল লছমন সিং। লছমন সিং ঠিকাদার। ঠিকাদারিতে ওর না কি লাইসেন্ আছে।

একথা অবশ্যই বিশাল ভূঁইয়াব দাদা সাতবান স্বীকার করেনি। সাতবান কেচকির কামিয়া সমাজে একজন মাতব্বর লোক বলে গণ্য হয়, কেননা সে সকলকে নিয়ে দল পাকিয়ে বহোত ঝামেলা তুলে কামিয়ৌতি ছাড়াবার কথা বলে।

কামিযৌতি থেকে খালাস মিলবে, অলীক, ঋণবদ্ধ ক্রীতদাসগুলি দাস অবস্থায় আধপেটা খেয়ে মরবে না, -মুক্ত অবস্থায় অনশনের অধিকার পাবে, সে কথা কামিয়ারা ভাবে না।

ওরা জানে যে পূর্বপুরুষ ঋণ করে থাকে যদি তাহলেও ওরা কামিয়া।

নিজে ঋণ করলে তাহলেও কামিয়া।

পলামুর পাহাড়-জঙ্গল-নদী যতদিনের, কামিয়া-প্রথাও তেমনি পুরনো।

অন্তত তাই ওরা জানত। তবে বোর গ্রামের মাধো সিং খারোয়ার মাঝে মাঝে আসে। সে বলেছে, ওসব মিছে কথা।

-কি মিছে কথা?

-কামিয়ৌতি অত পুরনো নয়।

-কে বলল?

--লেখাপড়া করো জানতে পারবে।

--তুই তো অনেক পড়েছিস, এ মাধো। তুই বল্ল্লা? আমরা লেখাপড়া শিখব, বইকেতাব পড়ব, তবে জানব, তাহলে তো এ জন্মে হবে না।

-পলামুতে আগে চেরো জাতি রাজা ছিল। তারা কাউকে কখনো কামিয়া বানায় নি।

-কে বানাল?

খারোয়ার জাতিও বিদ্রোহ করে আর ইংরেজের সঙ্গে বহোত হি লড়াই করে।

--নীলাম্বর আর পীতাম্বরের নাম তো আমরা জানি। ওরা খারোয়ারই ছিল, তাই নয়?

-হ্যাঁ, হ্যাঁ।

-আর কারা ছিল?

-ভৈয়া! চেরো, খারোয়ার, কোল জাতি, দুসাদ, গঞ্জ, ঘাসি, নাগেসিয়া, পারহাইয়া, এমন অনেক জাতই ছিল। অনেক জাতের মানুষ ছিল। -এখনো তো আছে।

-তা তো আছে।

-এখন সব জাতে কামিয়া।

-সব পরে হয়েছে।

-কবে?

-ওই তো মজা ভৈয়া। রাজপুত, পাঠান, সব এল মোগলদের পিন্টু হয়ে। মরাঠা এল, ইংরেজ এল-ওদের পিটু হয়ে যারা এল, ঔর এ জেলার মানুষদের ঠেঙাল, মারল-তারাই বেইমানির বখশিস পেল যত জাগীর-উগীর।

-তাই তো পেল।

-মহাজন, ব্যবসায়ী, পূজারী-পুরোহিতলোক, সব জমি-মালিক হতে থাকল।

-হাঁ হাঁ, পলামু কিনে নিল ওরা।

-তা ওরা কি হাতে করে জমি চষবে? যে হাতে লাঙল ধরে চাষ করে, তাদের হাত থেকে জমিমালিকানা যখন চলে গেল, তখন তো ওইসব উঁচা জাতের লোকের কামিয়া দরকার হল।

-তাই বলো!

-কামিয়ৌতি আগে ছিল না?

-কেমন করে থাকবে? তুমি যতদিন নিজের... আরে! ধবো না কেন, তুমি জমি মালিক। তুমি কি নিজে চাষ করবে, না লোক রাখবে?

-জরুর নিজে চাষ করব। আবে! জমি তৈরি করব। বীজ ছিটাব, নিড়ান দেব-সব নিজে করব। তখন হাতও চলবে চটপট।

-কিন্তু ব্রাহ্মণ, চাই রাজপুত, এরা?

-বাপ্পে! ওদের তো কামিয়া চাই।

-তবে? বুঝেছ তো?

-হাঁ বেটা, খুব বুঝেছি।

-এখন ভাবতে হবে.. কি, সোনার ভৈয়া?

-বেটা! তুমি যা বললে, তাতে তো বুঝলাম যে পলামুর মাটিতে কামিয়ৌতি বেশিদিনের নয়। তবে এত জলদি এ প্রথা এত বেড়ে গেল?

-ভৈয়া। ধান-গম, কুরযি মকাই চাষ হতে কয়েক মাস লাগে। উখালার বীজ কত তাড়াতাড়ি ছড়ায় আর মাটিকে ঢেকে ফেলে তা বলো।

-মন্দ জিনিস তাড়াতাড়ি বাড়ে।

সাতবানের নাম সাতবাহন না সত্যবান নামের অপভ্রংশ তা জানা খুবই কঠিন। ছোট ভাই বিশালের মতই তার দেহের কাঠামোটা মস্ত বড়। সাতবানের বৈশিষ্ট্য হল ওর বুক পিঠ, কান, আঙুলের গাঁটে লোমের প্রাচুর্য।

মালিক নিম ও করঞ্জা বীজ থেকে তেল পিষে বের করে। সাতবান এই বিক্রীতব্য পণ্যটি সুযোগ পেলেই মাথা ও গায়ে মেখে নেয়। ওর এমন কাজ করার যুক্তি আছে।

গাছগুলো তো কারোই নয়। পঞ্চায়েতী কুয়া ঘিবে গাছগুলি আছে সবকারের জমিতে। মালিক তার ওপর দখল কায়েম করল কেন?

ঠিক আছে। তর্কের খাতিরে মানা গেল যে মালিকের যে কোনো ব্যাপারে দখল ঘোষণা করার রীতি আছে। এটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে।

সাতবান হলদে দাঁতে হ-হ-হ শব্দে হেসে বলে, তাহলে আমিও একটা নিয়ম চালাচ্ছি বলতে পারো। মনিবের নিমতেল পেলেই মাখব, তার ক্ষেতের মূলা, বেগুন পেলে কাঁচা কাঁচাই খেয়ে নেব। সাতবানের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল, সে কোনো ব্যাপার নিয়ে বেশিক্ষণ কথা শুনতে পারে না। ঝটপট কাজের কথায় যেতে চায়।

সাতবানের বউ, ঝালোর বড়জা অথবা জ্যেঠাইন ছিল অন্যরকম। সে সামান্য ঘটনাকেও সবিস্তারে বলতে ভালোবাসত। সাতবান অত কথা শুনতে চাইত না। ফলে ওদের মধ্যে বেশ বিবাদ হত।

মাধোর কথা শুনতে শুনতে সাতবান হাতের তেলোতে খৈনি ডলে নেয়, মুখে দেয়, এবং বলে, বুঝলাম তো সবই। এখন কী করতে হবে তাই বলো।

-কিসের কী করবে?

-কামিয়া কি আমরা থেকেই যাব?

-কী করবে?

-কানুন করে তো এ নিয়ম উঠে গেছে।

মোরি পারহাইয়া বুড়ি হয়ে গেছে এখন। সে পিঠের কাপ্পড় সরিয়ে বলে, এই দাগ? সাতবান?

-হাঁ হাঁ মোরি, ও কথা জানি।

-যখন জোয়ান ছিলাম, তখন...

-মালিক দেগে দিল লোহা পুড়িয়ে।

-তখন আমি জোয়ান। আর... আমাকে যে বাবু বাখনি করতে চেয়েছিল, সেই সরকারি ডাক্তারবাবু বলেছিল যে কামিয়ৌতি বেআইনি করে দিল সরকার। তাতেই তো আমি...

মোরির প্রৌঢ়া মেয়ে বাসনি বলে, খুব ভালো কাজ করছিলে। আমাকে ফেলে পালাচ্ছিলে বাবুর সঙ্গে।

মোরি বলে, কাহে ন ভাগি? তোহার বাপোয়া হমনিকে রোটি দেতের্ করত্ কা?

-তারপর?

মাধো সহাস্যে বলে। কেন না বহুবার শোনা এ কাহিনী। তবু যদি সে না শোনে কাহিনীটি, মোরি বড় দুঃখ পাবে। বারে! মালিক তো আমাকে ধরে ফেলল। কি রে মোরি? কামিয়া হয়ে ভাগছিস তুই? বাবুর জাত উঁচা, জাত মারছিস! বাবুতো কুর্মী ছিল।

--তারপর কী হল?

-আমি বহোত্ হি তেজী সে বললাম যে, বাবু সব বলেছে আমাকে। কামিযৌতি খতম এখন! তখন মালিক হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেল মাটিতে। আর তখন ওর গোরু দাগানো হচ্ছিল। হাসতে হাসতেই আমাকে চেপে ধরে পিঠ দেগে দিল। যা এখন! তোকে ছাপ দিয়ে দিলাম। পালালেই ধরা পড়বি।

-মৈয়া, তুমি কি খুব সুন্দরী ছিলে?

আরে আরে! এ কত শরমের বাত বলছ।...তা, বনের মৌর যেমন পেখম খুলে নাচে, তখন কত না সুন্দর দেখায়। আমিও সুন্দরী ছিলাম ছোটবেলা থেকে। তাতেই নাম হল মোরি।

মোরি সকলের দিকে সগর্বে তাকায়। হতে পারে যে ঘটনাটি যাট-বাষট্টি বছর আগে ঘটেছিল। কিন্তু ঘটেছিল তো! এখন মোরির চেহারা রোগা কাকের মতো, কিন্তু একে সময়ে তো সে সুন্দরী

ছিল।

বাসনি নিজে দিদিমা হয়ে গেছে, এতই তার ব্যস। কিন্তু মার সঙ্গে তার ঝগড়া বা প্রতি কথায মতান্তর, বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে চলছে। এক চালাতেই বসবাস, একই সানকিতে ঘাটো খাওয়া, একই বিডি ভাগ করে টানা, তবু এ বিবাদ শেষ হয় না।

বাসনি বলে, মায়ের লাজশরম খুবই কম। এসব কথা বলতে লাজ লাগে না?

-সাতবান বোঝে, যে এখনি মোরি ও বাসনি ধুন্ধুমার ঝগড়া

শুরু করতে পারে। তাই সে কথার মোড় অন্যদিকে ঘোবায়।

---মোরি মৌসি যখন জোযান ছিল, সেই যাট-পঁয়ষট সাল আগেই কামিয়ৌতি বন্ধু, কানুন হয়েছিল কি রকম? এ কথা কি সত্যি?

--হাঁ হাঁ, কেন সত্যি হবে না? ইংরেজ সরকার তো তেষট্ বছর আগেই বিহার ঔর ওড়িশায় কামিয়ৌতি বন্ধু আইন করেছিল।

-তবে ফের কোন সাত বছর আগে কানুন করল ভারত সরকার? আগে তো কানুন ছিল।

-সে কানুনে কাজ হয় নি।

-এ কানুনে বা কি কাজ হচ্ছে?

সরকারি দপ্তরে অনেক হচ্ছে।

-সে তো মিছা।

-ভৈয়া সাতবান। কামিয়া যদি খালাস চায় তো তাদেরকে এককাট্টা হতে হবে।

-তারপর?

-ছিলো খালাস। সরকার তো বলছে যে বন্ধুয়া লোক খালাস হবে, সকলের অনেক মদত মিলবে। পলামুতে এমন খুবই কম হয়েছে যদিও।

-তুমি বুঝিয়ে দাও তো আমাকে। সব বেটা কামিয়াকে বুঝাব আমি।

মোরি মাধোকে বলে, হাঁ হাঁ। সাতবানকে বুঝিয়ে দাও সব।

এমন এক দায়িত্ব পাবার পর থেকে সাতবানকে সবাই বেশ মাতলব বলে ভাবতে শুরু করেছে। মোরি এ কথাও বলেছে, তুই ছাড়া তো আমাদের নেতা বনবার মতো মানুষও নেই। তা তুই বনে যা হামানিকে লীডর। খাই, চাই না খাই, কামিয়া নেই, আমি এটা জেনে মরতে চাই।

-মৌসি, তুই এখন মরবি না।

-আর কতদিন বাঁচব? --মৌসি, তুই মরলে আমি চবুতরা বানিয়ে দেব, ঔর মিটিন্ ডি করব।

-হাঁ হাঁ, চবুতরা বানাতে সিমেন্ লাগে, ইট লাগে, কত কি লাগে।

--মৌসি! ফরেস আর পি, ডবলু, ডি যত ফলক লাগিয়ে রেখেছে বনে পাহাড়ে, পথের ধারে, ধস্তাধড় খুলে আনব আর গেঁথে দেব। বাসনি বলে, যত কৌটো জমিয়েছে, তাতেই চবুতরা হয়ে যাবে।

টিনের ছোট ছোট কৌটোর ওপর মোরির দুরন্ত আকর্ষণ। কী সুবিধের জিনিসগুলো। জল খাও, চা খাও, চা করো, জল ধরে রাখো, একটু ছাতু বা লবণ ফেলে রাখো। এর কাছে ওর কাছে, মালিকদের ঘরে চেয়ে চেয়ে মোরি অনেক কৌটো জমিয়ে ফেলেছে। বাসনির নাতি-নাতনি তাতে হাত দিলেও বুড়ি ধুন্ধুমার কাণ্ড করে। যে মাচাঙে মোরি ঘুমোয়, তারই একপাশে কৌটোর পাহাড়। ঘুমোবার কালেও হাত দিয়ে দেখে, সবগুলো আছে কি না।

সাতবানকে সবাই মানে, তার আরেক কারণ, ও বিশালের দাদা। বিশাল মরে গেছে বছর তিনেক। তা সবাই জানে। সাতবানের বউও মারা গেছে কবে। সাতবানের ঘব করত, সঙ্গে থাকত, তাতে অবাক হত না কেউ।

এটা খুব লক্ষ্য করার মতো বিষয, যে সাতবান ও ঝালো কখনো তেমন কোনো আগ্রহ দেখায় নি। আর বিশালের জীবিত কালে দুই ভাইযে তেমন ভাব ছিল না। কিন্তু একদিন যখন খবর এল, যে বিশাল মরে গেছে-সাতবান কয়েকদিন পর থেকে বিশালের ছেলে মেয়ের খবর নিতে থাকল।

ঝালো অথবা, সোনার মা, অথবা গেগহুমনি, এখনো এমন ডাঁটো আর শক্তসমর্থ, যে ওর সঙ্গে ওর ভাসুরের কোনো সম্পর্কই নেই, তা বিশ্বাস করাই কঠিন। বিশালের ঘর মালিকের মামলাধীন জমিটির কিনারে। বস্তুত বিশালের ঘর দিয়েই কেচকির লাঠা টোলির শুরু।

পলামুর অন্যান্য জায়গার মতো, অন্যান্য সমৃদ্ধ গ্রামের মতো কেচকি হল পথের ধারে। চুনকাম করা সারবার মাটির শক্তপোক্ত বাড়ি, বাহির-দেওয়ালে, গন্ধমাদন বহনরত মহাবীর, বুক চিরে রাম-সীতা দেখানো মহাবীর। রাম-সীতার পায়ের কাছে জোড়হাতে মহাবীর, দেবতা রূপে সিংহাসনে বসা মহাবীর, সমুদ্র লঙ্ঘনরত উড্ডীয়মান মহাবীর, এমন অনেক চিত্র।

বাড়িগুলির মাঝ দিয়ে সরু রাস্তা, তাতে ছাগলের নাদি, মোষের গোময়। গোবর-ঘুঁটে-খড় বিচালির গন্ধ বাতাসে। বাড়ির অন্যদিকে মোটা মোটা খুঁটের চাবড়া।

উঠোনগুলিতে ধান ও গম শুকোয়, ইঁদারায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে জল তোলা হতে থাকে, ঘরগুলির জানালা অনেক উঁচুতে, যথেষ্ট ছোট। ঘরের দরজা, বাড়িতে ঢোকার দরজা খুব পুরু, পোক্ত, আলকাতরা মাখানো। কয়েকটি বাডিতে শোবার ঘরে দেয়ালে বন্দুক আছে।

এমনি গ্রাম পলামুতে যথেষ্ট দেখা যায়। শ' তিনেক বছর ধরে পলামুতে রাজপুত ও ব্রাহ্মণ ও ভূমিহার জমি মালিকরা একভাবে বসবাস করছে। সাধারণত যেমন দেখা যায়, এখানে মালিকরা কয়েক ঘর ব্রাহ্মণকে জমিজমা দিয়ে বসত করিয়েছে। দেবতা ও ভক্তদের মধ্যে যেহেতু সরাসরি যোগাযোগ রাখা অসম্ভব, সেহেতু ব্রাহ্মণদের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখা হয়ে থাকে।

কেচকি গ্রামের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের আনা আবশ্যিক ছিল। মালিকরা সবাই রাজপুত। কেচকিতে সেদিনও এরা ঘোড়া রাখত। এখন সাইকেল রাখে।

এই মকাই-গম-পানচাক্কি মহাবীবের ছবি-খুঁটের স্তুপ যেমন কেচকির এক রূপ, তেমনি তার আরেক চেহারাও আছে।

কেচকির মতো অন্যান্য গ্রামের এমন সব ঘর থেকেই এখন ঠিকাদারেব অধীন ছোট ঠিকাদার, কখনো স্বাস্থ্যসেবক, কোনো প্রাথমিক শিক্ষক বেরোচ্ছে।

মেয়েদের পোশাকে নাইলন ও ছেলেদের ক্ষেত্রে রঙিন চশমা, প্রচণ্ড কেশসজ্জা, সিনথেটিক সুতোর শার্ট প্যান্ট ও স্কুটারের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ব্যাটারিচালিত ক্যাসেটস্টরেকর্ডার, ক্যামেরা, এখন প্রচুর।

এ ভাবে টুকটাক করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বর্তমানে ভারত ঢুকছে পলামুর মানচিত্রের মধ্যযুগে। রাজনীতিক ব্যাপারটা মস্তানরা নিয়ন্ত্রণ করছে।

কেচকির ব্যাপারেও কিছু কিছু এমন ঘটনা ঘটেছে। মালিকদেব ঘরে কেরোসিন স্টোভ দেখা যাচ্ছে। স্কুলে মালিকদের ছেলেবা থোভাবহোত বেশি যাচ্ছে। জবরদস্ত ঠিকাদার বা মস্তান বা বে ওসাধা কেচকি এখনো তৈরি করতে পাবে নি। তবে উকিল একজন হবে। সে পাটনায় আইন পড়ছে।

মালিকদের দুটি ছেলে বাড়িব তহবিল ভেঙে চিত্রতাবকা হবাব দুরাশায বম্বে ঘুরে এসেছে। যদিও পুালস তাদের ফিরিয়ে এনেছে, তবু তারা সাফলাগর্বে গর্বিত। কেন না ফোটোস্টুডিওর সহায়তায় তাবা চিত্রতারকাদের ছবির পাশে নিজেদের চেহাবা বসিয়ে বেশ জমকালো কিছু ছবি নিয়ে ফিবেছে।

কেচকির দলীপ সিং ও রাজবংশ কেশরী সিং-এর পাশে তামিতায় বক্ষন ও রতি অগ্নিহোত্রীব ছবি এখন ওদের বাড়িতে কোলে, দেয়ালে। পাশেই ক্যালেণ্ডার কেটে বাঁধানো মুলগাঁওলর অঙ্কিত রঘুপতিবাদ? ও গণেশ দেবতার ছবি।

দল্লীপ ও রাজবংশের বাবারা খুব গর্বিত। তারা থানা দারোগা, ব্লকবাবু, জঙ্গলবাবু, এমন সব মহান লোকদের ছবিগুলি সগর্বে দেখায়। হাঁ, হাঁ, আমারই ছেলে। অমিতাভ বচ্চনের বহোত ভারি দোস্ত।

দারোগা বলে, হতেই হবে। আমগাছে ডালো আমই ष्ट्रन । নিমফল তো হয় না।

এটা কেচকির ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক ঘটনা। এটাও ঘটনা, যে কেচকির রাজপুতদের মধ্যে দহেজেব কারণে বউকে পুড়িয়ে মারার ব্যাপারও ঘটেছে।

এখানে নয়, দিল্লিতে। গ্রামের সরপর সমুন্দর সিংয়ের ইনজিনিযার জামাই দিল্লিতে এই কাজটি করেছে। পুলিশ কেস করেছে বলে সমুন্দর বড় ক্ষুন্ন। মেয়ে তো ফিরবে না আর। কেস করে ঘরের কেচ্ছা বাজারে ছড়িয়ে কা লাভ হবে?

আফশোস, বড় আফশোস এসব। আগে এ সব নিয়ে শোরগোল হত না। কেচকির জোতদার হিসেবে সমুন্দর সিং লাখ দুই খরচ করেছিল। সে তো শুধু জোতদার নয়, সরপঞ্চও বটে।

সব কিছুর পরেও বলতে হবে যে কেচকির রাজপুত মালিকরা রাজপুত হয়েও তেমন সুবিধে করতে পারছে না পলামুতে। পাবা উচিত ছিল, কেননা পলামুর "চাহে কাংরেস চাহে জত্তা" দুটো রাজনীতিতেই রাজপুত জমিদারবা প্রচন্ড ক্ষমতাধারী।

কেচকির রাজপুতরা সবসুদ্ধ একত্রিশটি পরিবার। এদের যথোপযুক্ত রমরমা হচ্ছে না, তার কারণ নিজেদের মধ্যে ঐক্যের অভাব।

বহুকাল ধরে জমিজমা নিয়ে এরা এ-ওর সঙ্গে যাচ্ছে। এ সত্তাই কখনো দেওয়ানী, কখনো ফৌজদারী। এরা পারতপক্ষে ডালটনগঞ্জ যায় না। গেলে মামলা করতে যায় এবং আরো নতুন কেস ঠুকে দিয়ে আসে। টাউনে যায়, ভকিলের ঘরে নিজ নিজ কেসের গড়ি গাড়ি কাগজ আছে, এ কথা এরা সগৌরবে বলে থাকে। এই সব মামলার কারণ হচ্ছে সাড়ে বাইশ একর জমি-যার পাঁচ একর ঢাঁড ও বানঝারা এবং বাকিটা সরস। জমিটির সাড়ে সতেরো একরই হল সরস। ওখানে ভূপ্রকৃতি এমনই যে এই জমিটির আকার যেন গামলার গলদেশের মতো।

যেটুকু বৃষ্টি পড়ে, তার জল গড়িয়ে নামে। এ অঞ্চলে নাকি নয়া জরিপ হবে, বহু জমি চলে যাবে বনবিভাগের দখলে। সেখানে : মাজভিত্তিক বন সৃজন হবে। সে জন্যে খাল কাটা হবে। সিঁচাই খালের সুবিধা পেলে জমিটি আরো উর্বর হবে।

এই বিতর্কিত ও মামলাধীন ভূমিব কারণে কেচকির মালিকরা বর পিছিয়ে পড়ছে।

এটা পলামুর বৈশিষ্ট্য যে উচ্চবর্ণের লোকবা এককাট্টা হয়ে বসবাস করে। অন্যদের যতটা সম্ভব দূরে ঠেলে বাখে। ফলে লাঠা একটি ডোলি, যা কেচকির মধ্যে পড়ছে।

লাস দূবে। সেখানে ভূঁইহাব, দুসাদ তিনঘব রবিদাস আছে। পাবাহাইযারা একসঙ্গে সাত ঘব। নাগেসিয়ারা সব সময়ে পাহাড়ের ঢালে ঘর বাঁধে। তিন ঘর নাগেসিয়া আছে ঢালে।

এই লাঠা টোলির শেষ যেখানে, বিতর্কিত ভূমিব শুরু স্পোনে। এবই প্রান্তে বিশালেব ঘব। বিশালের বিধবা গোহুমনি সেখানে সোনা ও দানাকে 'নয়ে সপাটে সতেজে বাস করে। "গোশুমনি" নামটি সে বিশেষ একটি ঘটনার পর অর্জন করেছে।

সে ঘটনাটি কেচকির জগতে এমনই বড় ও গুরুত্বপূর্ণ, যে গোৎমনিকে আব কেউ চট করে ঘাঁটাতে যায় না।

গোতমনি মানে মাদী গোখরো। কে ওই মেষের গায়ে হাত দেবে? ও কামড়ে দেবে। ওকে ঘাঁটানো আর সাপের লেজ দিয়ে কান চুলকানো একই কথা।

অনেক মনে করে, যে গোণ্ডমুনি ওরকম খরখরে মেযে বলেই সাতবান ওকে ঘাঁটায় না। এমন যে কেচকি গ্রাম, সেখানেই লক্ষ্মণ সিং সিকেদার এসে হাজির হয় একদিন। সরপঞ্চের কাছে তার আবেদন।

সরপঞ্চ খুব খুশি হয়। লক্ষ্মণ সিং ঠিকেদার যে আসবে, সে কথা তার ভকিল বলেছে। এ কথাও বলেছে যে, ওহি লক্ষ্মণ সিং থেকে কেচকিতে একটা বড় কাজ হবে। বাজপুত মালিকদের মধ্যে একতা আসবে।

-কৈসে?

--আরে? এ কথা বুঝতে হলে তো আমাকে অনেক গোপন কথা ফাঁস করতে হয়।

---বলুন না।

- ভালো কথা। মেয়ের ব্যাপারে কেস কেমন চলছে তা কিছু জানেন?

-না। জানতেও চাই না। আমার মেয়ে তো আব ফিরবে না। পরের ছেলেকে জেলে পাঠালে তো তাকে ফিরে পাব না।

-মেয়ের ব্যাপারে জামাইকে মাফ করতে পারছেন। জামন ব্যাপাবে জ্ঞাতি বন্ধুকে ক্ষমা করতে পারছেন না? ও জমির ব্যাপারে কোনো একজন জিতবে না।

-ভকিল সাব? আপনি কায়স্থ লোক, রাজপুতের গোঁ বুঝলেন না। আমরা বহুতই লড়াকু জাতি। ইতিহাসে পড়ে নেবেন। পলামুতে আমরা আদালতে লড়ে যাই, কখনো লড়াই ছাড়ি না। যে বাজপু পরিবার জমিজমা রাখে, কিন্তু মামলা করে না, তাকে আমরা কাপুরুম বলি।

-আপনাদের হিসাব আলাদা।

-কি যেন বলবেন বলছিলেন?

- দেখুন, এখন আপনাকে বলছি, কিন্তু আপনার মাথায় কি ঢুকবে কিছু?

-বলুন না।

--- বনবিভাগে আমার আত্মীয়স্বজন সব ঠিকাদারি কাজে আছেন। ভগবানের কৃপায় তাঁরা রাঁচি, টাটা, ডাল্টনগঞ্জে সবাই দর্শনধারী বাড়ি বানিয়েছেন, ট্রাকের কারবারও আছে।

-সে তো জানি।

- মনোহর লালের নাম জানেন?

--খুব জানি।

-উনি তো আমার বোনের নন্দাই, ঔর ঠিকাদার মহলে নামী লোক। ওঁরা রাখেন বনের খবর।

-- কী খবর"

-- বহোত দিনে সবকাব বের করেছে খবর যে, আপনাদের ওদিকে অনেক জমি বনবিভাগ নিয়ে নেবে। আর জমি সিচাই করে ওখানে ফবেস নাসাবি প্লান্টেশান করবে। ওই জমিটাও তাতে যাবে।

- ক্ষতিপূরণ কে পাবে?

--দেখুন, এসব হতে হতে দই- তিন বছব লাগবে। আপনারা সবাই কেন দখলদারি দাবি করছেন! মিটমাট করে নিন। তাহলে ক্ষতিপূরণও এসে যায়। সিচাইও আসে।

ভকিল সাব। প্লান্টেশন যদি হল, তবে সিঁচাই দিয়ে আমাদের লাভ"

--সিচাই যখন হবে তখন তো করাবে মনোহর লাল, আর সামনে রাখবে লক্ষ্মণ সিং ঠিকাদারকে। তখন আপনার জমি তো অনেক জল পাবে!

- জনাবা মানবে?

-বুঝাতে থাকুন। লক্ষ্মণ সিং এখন ওদিকে যাবে। সরকারি লৌহ আকর সনিখাদানে লেবার চালান দেবে। লেবার তো আছে আপনার ওখানে।

---লাঠাতে কামিয়া বেশি। যাব কামিয়া নয় তারা যাবে।

--আছে তেমন?

- হাঁ হাঁ, অনেক।

সমুন্দর সিং অন্যমনস্কভাবে বলে কামিয়াদের মধ্যে, আমার কথাक्ष বলতে পাবি... আমার কামিযাদের মধ্যে যদি যেতে চায় কেউ, তো যাবে।

-এটা তো আজীব বাত হল।

--আপনি বুঝবেন না। দিনকাল পালটে যাচ্ছে এখন... এ বছর তো জল নেই, চাষও নেই। কাজও করাতে পারছি না, তাতে লুকমা দিতে বহোত খবচ তের জনকে!

--আপনার তের জন!

-হাঁ...তো কাজেব ফিকিরে ওবা এদিক ওদিক যাচ্ছে। সাতবান বলল, মালিক! সরকার তো ব্লক থেকে রিলিফ থোড়াবহোত দিচ্ছে। আপনি আনান না কিছু। আমবা খেয়ে বার্চি। কাঠ কাটর, নার বেচব, এতে তো চলছে না আর। কেমন খচড়াই তা দেখুন।

-কী, রিলিফ আপনি তুলে নিয়েছেন?

করে!

-- আপনারা তো ওদের পয়জাবে শায়েস্তা রাখেন বলে শুনতে পাই।

--ভকিলসাব! যা সব জায়গায় চলে, যাতে মালিকের ইজ্জত থাকে, তা তো কেচকিতে চলবে না। আমাদের মধ্যেই এ সে ওদেবকে তাতাচ্ছে। বাবার আমলে, আমার আমলেও আগে, কামিয়াবা কখনো কথা বলতে সাহস পায়নি। এখন তো একতা নেই। একজন নাকাল হলে আরেকজন হাসবে। আব আমি যদি সাতবানকে জুতা পেটাই, তো আমার জাতভাই ওকে বুঝাবে যে, টাইনে যা, কেস কবে দিয়ে আয়।  ---হাঁ হাঁ, ও তো জ্ঞান।

- কুশল প্রসাদজি তো আপনার ভাগ্নে!

-হাঁ।

তা উনি সব সময়ে বন্ধুয়াদের হয়ে মালিকের নামে কেস ঠোকেন কেন?

আরে সমুন্দবক্তি! ছেলে খুব শানদাব, ঔব মনে পোডাবহোত আইডিযালিজমও আছে। তাই গরিবের হয়ে লড়ছে।

কী আছে বললেন"

--আদর্শ, আদর্শ।

না না, এ ঠিক নয়। আপনি ওর আত্মীয়, আপনি তো ওকে বুঝাবেন যে ভকিল হলে আদেশ বাসা ঠিক নব। তাতে মক্কেল ভেগে যাবে।

বছে করুক না। স্যস কম, তাদর্শ আছে অনেক। তার আপনাকে বুঝানো খুবই মুশকিল! এমন কেস কবলে ইজ্জত খুব রাডে। ওতি যে মৌথাবনীর কৌয়ার শার্তা সিং দুটো কামিয়াকে ধবে জ্যান্ত ফালাচ্ছিল, সে কেস তো ওই করছে।

ঠিক কাজ করছে না। কিসব কাজ, রাজার কাজ। এই তো আপনি কতবড় বাড়ি করেছেন, গাড়ি কিনেছেন, ছেলেদের বোর্ডিঙে রেখে পড়াচ্ছেন! কুশল যা করছে... ভাবল সাব! কেচকিতে বাজপুত মালিকদের একতা না থাকতে পাবে, কিন্তু আমরা স্বাই ছোট থেকে বড়, সবাই প্লামু জিলা ভূম্যাধিকারী কল্যাণ সংঘের সদস্য আছি, চাঁদা ও দিই।

খুব ভারি সংস্থা।

--খুব। শাহী সিংহের নামে কেসের ব্যাপারে আমবা খুব চটে গেছি.। আর কুশলপ্রসাদকে আমবা জিলা থেকে নিশ্চয় হটাব। ওকে তো কেস আমরা দেব না কখনো। -ইজ্জতদার কেস করতে করতে ও নাম পেয়ে যাবে, দেখবেন।

--যা বুঝেন! আপনারা কায়স্থরা এত লেখাপড়া করছেন বলে বুদ্ধি ঠিক থাকছে না।

সমুন্দরক্তি! জমি ভৈসা আর কামিয়া থেকে তো সকলের ফয়দা উঠবে না।

--এ কথাও ঠিক।

-লক্ষ্মণ সিংকে নিয়ে যান।

এমনি করেই লক্ষণ সিং ঠিকেদার কেচকিতে ঢোকে। তার দেহটি পাকানো, নাগরার শুঁড় পাকানো, গোঁফের ডগা পাকানো, দেখেই মোরি বলল, এ লোকটা কে? দেখে মনে হয় খরাতাপে সিটকানো ভিপ্তি একটা।

ডেডশ অপষ্ট ও শীর্ন হলে যেমন ডগা পাকানো হয়, তেমন দেখতে মৌবিব মন্তব্য বেশ লাগসই হয, সবাই হাসে।

লক্ষ্মণ সিং থাকল সমুন্দরের বাড়িতে। তারপর সমুন্দর, সরপঞ্চ হিসেবে লাঠা টোলিতে গেল বিকেলে। সরপঞ্চ হিসেবে সে সকলকে ডাকতে পাবত। কিন্তু কেচকির বাতাস বর্তমানে খুব ঘোরালো।

নগুনেহাল সিং, ভানুপ্রতাপ সিং, সমুন্দর সিং, সবাই জমিটিব ব্যাপাবে পরস্পরের প্রতিপক্ষ।

কেচকিতে সমুন্দরকে সবপঞ্চ পদ থেকে সবাবাব ব্যাপারে ওরা দুজন এক পক্ষ। নওনেহাল সরপঞ্চ হতে চায়। ভানুপ্রতাপ এখন মুখিয়া আছে, তখনো মুখিয়া থাকবে।

ভানুপ্রতাপও একদিন সরপঞ্চ হতে চাইবে নিশ্চয়। তখন নওনেহালেব বিপক্ষে অন্যদের সঙ্গে জোট করবে।

ভানুপ্রতাপ অধ্যৈা নয়, বোকাও নয়। সে জানে যে এ অঞ্চলে উন্নয়ন পরিকল্পনা আসতে দু-চার বছর দেরি আছে। যখন আসবে, সেই সময়েই টাকা আসবে। তখন সরপঞ্চ হওয়া লাভজনক। এখন চুপচাপ থেকে যাওয়া ভালো। সমুন্দর গ্রামে সকলকে ডাকলে নওনেহাল ও ভানুপ্রতাপ বলে বসতে পারে, যে সরপঞ্চ সকলকে রিলিফ দেবে বলে ডাকছে।

সত্যি বলতে কি মাত্রই একুশ হাজার চারশো ছিযাত্তর টাকা তুলেছিল সমুন্দর।

সবটাই ব্লকে বসে ম্যানেজ হয। ভানুপ্রতাপ পাঁচ হাজার পেয়েছিল। অথচ তারপর থেকে সে আলগা আলগা ভাব দেখাচ্ছে, যে সমুন্দর খানিক চিন্তিত।

ভানু প্রতাপ বলল, সরপঞ্চ রিলিফের টাকায় জামাইকে জমি কিনে দিয়েছে আর তোমাদের উপোসে শুকোচ্ছে।

তাতে খানিকটা হাওযা দূষিত হল।

তারপর সবাই মিলে সবপঞ্চের নামে দুর্নীতির অভিযোগ আনল, কেস কবল।

দরকার কি ঝামেলায় গিয়ে। সবপঞ্চ হিসেবে লাঠা টোলিতে গেলে ওবাও ধন্য হবে। হায়! গ্রামে কেন একতা নেই? ওই জমি কেন সমুন্দরের নয়? সবগুলো ব্যাপার যদি ভালোয় ভালোয় ভালোর দিকে যেত, তাহলে সমুন্দর কি কামিয়াদের এত বাড়তে দিত? যাক্, মহারাবজি যা ইচ্ছা করবেন তাই হবে।

পারা টোলিতে যাবার সময়ে সমুন্দর মাথায় টুপি পরল, হাতে লাঠি নিল। পুরনো আদবকায়দা সবচেয়ে ভালো। সমুন্দর পুরনো পোশাক ছাড়েনি। ধুতি, কৃতা, পায়ে মুচির তৈরি মোটা নাগবা। এক জোড়া বালাও বহোত্ দিন পরে পরল।

নওনেহালরা বোঝে না। জমিজমা, ক্ষেতিবাড়ি করবে-তো প্যান্ট পরবে, শার্ট পরবে, সাইকেল চেপে ঘুববে, এটা কি বেখাপ্পা লাগে না? আর কেমন সব কথা ছোকরাদের!

বিজ্ঞলি আনুন, বিজলি।

---ভৈয়া, কেন?

--বিজলি থেকে সিঁচাই চলবে।

সিচাই!

– দেখুন সরপঞ্চক্তি, সব কথার জবাবে অমন বোকার মতন জবান দেবেন না। বোকা তো আপনি নন।

-ডৈয়া...

-বিজলি তো উন্নয়নের জন্যেই চাই। বিজলি এলে স্যালো চলবে, ডি. টি. বসবে। সিঁচাই আসবে এলাকায়। বিজ্ঞলি তো উন্নয়নের প্রধান উপায়।

-ভৈয়া, তোমবা যা বলছ তা মেনেও নিলাম। কিন্তু তবুও আমি বলব, ঔর ছোব দিয়েই বলব যে, আমার দেশে পুরানা রীতিপ্রথার চাষবাস ভালোই চলে। তাতে অনেক বেশি লোক কাজ পায়!

নওনেহাল অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ভারতবর্ষ এখন কত কিছু করছে, আর্যভট্ অ্যকাশে যাচ্ছে, কপিলদেবরা কত বড় সম্মান আনল... আপনি দেখছি অঞ্চলকে সেই কেরোসিনের বাতি আব ভৈসা গাড়ির যুগেই রেখে দিতে চান।

ভানুপ্রতাপ এসব কথায় যোগ দেয় না কখনো। ও বোঝেনা যে সরপঞ্চ ও নওনেহাল বেকার উদ্দাম খরচ কবে কেন কথা বলে। বিজলি একটা বাস্তবতা। বিজলি আসছে। পথে যখন আছে, তখন কেচকিতেও আসছে। যা আজ না হোক, আগামী কাল হবেই

হবে, তা নিয়ে বকবক করে উদাম খরচ করা বড়ই বোকামি।

সমুন্দর ও লক্ষ্মণ লাঠা টোলির দিকে চলে। ওই তো সেই বিতর্কিত ভূমিখণ্ড, যাকে নিয়ে কেচকির রাজপুত মালিকরা বিভক্ত হয়ে গেছে, মামলা করছে, নিজেদের সময় ও আযুক্ষয় করছে।

তবে এ কথা বলতেই হবে যে, গাই-ছাগল মোষ চরাবার পক্ষে এটি খুব ভালো জায়গা। মাঝে মাঝে বামন বামন পলাশ গাছও আছে। কেচকির মালিকদের চরোযাহা কামিয়াবা গাইছাগল চরাবার পক্ষে একটা ভালো জায়গা পেয়ে গেছে। অন্যান্য গ্রাম থেকে চবোয়াহারা আসত এখানে। এ নিয়ে অনেক ঝগড়াবিবাদ ছিল। তারপর এই এলাকা জুড়ে নিষম হয়ে গেছে যে, এইখানে গাইছাগল চরাতে পারো, সবপঞ্চকে কিছু পয়সা দিয়ে।

বর্ষাব পথ শশ্বতে এই এলাকার বাতাসে হিম এসে যায়। তখন এই জমিতে জন্মায় বন বন কাশফুলের গাছ। কাশ, জিৎতো, ঠারি, এমন সব ঘাসে ও ঝোপঝাড়ে এ জায়গাটি ভবে ওঠে। কাশের ভাঁটি দিয়ে তো ঘরেব বেঙা, গেগতালের আগাড় করে লাঠার লোকেরা। সেজন্যে কাশের ঝোপগুলিকে যথেচ্ছ বড় ও বৃড়ো হতে দেয়া হয়। ভাঁটা মোটা হলে তবেই তো আগড ভালো হবে।

খুব উঁচু হয় ঝোপগুলো। আড়ালে মানুষ লুকাতে পাবে, বাঘও। সমুন্দর নিজে যখন বালক ছিল, তখন ওখানকার কাশঝোপ থেকে বাঘ এসে লারা টৌলির লোকদের ছাগল-গরু নিয়ে যেত। ওই মাঠে ঘাস্ত্রে ও কাশঝোপের আড়ালে বাঘ ঘুমোচ্ছিল। গুনেহালের ঠাকুর্দা শিকার করেছিল। সে খুব শিক্ষার্থী ছিল, ঘোড়া চেপে জমিজমা দেখত, আর অনেক দেশ রেভাত।

সমুন্দবরা অত স্নানে না যে কোথায় বিকানির, কোথায় ভরতপুর, কোথা থেকে ওরা এসেছিল।

সে সবই জানত।

খুব উঁচু কাশের ঝোপ, মানুষ লকাতে পারে। সমুন্দর মৃত বিশাল ভূঁইয়ার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।

--এ গোওমনি! এ সোনাকে মৈয়া!

কা, মালিক!

লাঠা টোলিতে বিকেলের পড়ন্ত আলোতে অতান্ত ছোট একটি ঘরের সামনের উঠোনে দাড়িয়ে যে মেয়েটি ধান ঝাড়ছে কুলোয়, সে হাতের কাজ থামায় না। -সাতবান কোথায়?

-আমি জানি না। এ সোনা, তোর জোঠা কোথায় রে? দেখেছিস না কি তাকে?

বছর ছয়েকের একটি ছেলে তার চেয়ে অনেক শক্তিশালী একটি ছাগলকে ঘবে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে, জোঠা দোকানে গেল। ডেকে আনব?

সমুন্দর বলে, বলে দিস ঘরে যেতে।

-কেন মালিক?

---এহি লছমন বাবু ঠিকেদার। কাজের কথা বলবে।

কী কাজ লক্ষ্মণ গোহুমনিকে দু চোখে পান করছিল। কী কোমব! ময়লা, মোটা কাপডে ও জামায় ঢাকা শরীবের ওঠা নামা না কি চোখ জুড়ানো। মেয়েটি তার দিকেই তাকায়। চোখ্যে হিংস্রতা খুব পরিষ্কার।

-খনিখাদানে কাস।

---সোনার জোটা কী করবে, আমি বা কী করব? আমবা মালিকের কামিয়া।

সমুন্দর যেন এখানে দাড়াতে চায় না। সে বলে, এখন তো আমার কাছে কাজও নেই বে! দুই তিন মাস তোরা খুব পাববি বাইরে যেতে।

--তাকে বলো!

সমুন্দর অন্যমনস্ক ভাঙ্গে পকেট থেকে সুপুরি বের করে গালে দেয় ও বলে, খুব আকাল!

গোহুমনি জবাব দেয় না। কাঁচা দু সের ধান তার প্রাপ্য লুকমা হিসেবে। সে ধান এমন কদা যে কুলোয় ঝেড়ে, তা বাদে কুটে তবে রাঁধতে হয়। সাতবান নিজের ভাগটিও নিয়ে আসছে তাই যা রক্ষে। বনের কাঠ বেচে তেল-নুন কেনো। দোকানী কাঠ রেখে নেয়, সওদা দেয়।

সাতবানের ঘর অন্য প্রান্তে। সাতবান উঠোনে খাটিয়া পেতে দেয়, "মালিক পরোয়ার" বলে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে তাকে। এমন অনেক কিছুই করে, যাতে সমুন্দর মনে মনে খুশি হয়।

কথা শুনে সে বলে, এ তো খুব ভালো কথা মালিক! আপনি আব কষ্ট করবেন না। আমি সকলকে বুঝিয়ে বলব এখন। আপনি ঘরে চলে যান।

--এঁকে আমার ঘরে পৌঁছে দিবি।

-নিশ্চয দেব হুজুর।

সকলকেই বলিস।

হা হা, কামিয়া ঔব ন- কামিয়া।

-- নাগোর্সিযাদেবও বলিস।

-তা তো বলব হুম্ভব। কিন্তু অন্য মালিকবা যদি রেগে যান!

-- তখন কামিয়ারা যাব যার মালিকের কাছে হাত জোড়বে, বলবে যে, মালিক! এখন তো কাজ নেই। সবাই লুকমা দিতে পারছেন না! আমরা এদিক-সেদিক দৌড়াচ্ছি ঔব জঙ্গল ভরোসায় দিন চালাচ্ছি। কৃপা কবে অনুমতি করুন, দুই তিন মাস কাজ করে আসি। ভালো কবে বলবি, কাজ হবে।

---তা বলব মালিক।

-তোরাও টাউনেব তাওয়া খাচ্ছিস, কথা বলতে ভুলে যাচ্ছিস। তোদেরকে মাধো সিং খারোয়ার বুঝাচ্ছে, যে ভারত সবকার তোদের মুক্ত করে দিয়েছে। আরে বাবা! আমার কামিয়াদের তো তামি এখনি খালাস করে দিতে পারি। দেনেওয়ালা আমি, লেনেওযালা কোথায়!

হাঁ হুজুর।

-যত যত করজ জমে আছে, সব দিয়ে দিলেই তোরা খালাস হয়ে যাবি।

-কোথায় পাব মালিক?

-আরে! এ কথাটা বুঝলি না, যে ভারত সরকার তোদের খাওযায় না। মালিকরা খাওযায়। কামিয়ৌতি বন্ধ করবে, তোদের মুক্ত করবে, এসব কথা শুনতে খুব ভালো। কাজের বেলা!

সমুন্দর সিং নাগবা মসস্মসিয়ে চলে যায়। সাতবান বলে, বলুন হজুর। আপনার কী সেবা আমরা গরিববা সাধন করতে পারি?

-কেমন কাজ

ম্যাগনেটাইট খাদানে।

সরকারি, চাই রুংটা

-দুরকমই।

- আমরা কত পাব? সরকারি রেট!

ভৈয়া! মিছে বলব না। সরকারের বেট তো পচিশ ছাল্লিশ টাকা। আমি তোমাদের সাফ কথা বলব। ওই রেট পায় পাক্কা মম্ভব।

-আপনি কাচ্চা মঞ্জুব খুজছেন?

---হ্যাঁ। আড়াই-তিন টাকা দেব বোজ।

---তাতে তো চাল হবে না এক সের।

-- ভেবে দেখো।

মোরি খনখন করে বলে, ভাবলাম, দেখলাম। এখন তো জঙ্গলের কাঠ কেটে আমাদের চাব টাকা হচ্ছে, ঔর তাতেও চলছে না।

সাতবান বলে, আমরা জানি যে এখানে কী হবে! তবে এখন তো লেবার-ঠিকেদার গ্রামে আসে। চাই ইটভাটা, চাই খালাখাদান, চাই অন্য কোনো কাজে লেবার খুঁজে। গরিবের নাসির। ঠিকেদাররা সরকারি রেটই উঠায়, ঔর গরিবকে দুই-চার টাকা দেয়।

---সে অন্যরা করতে পারে...

--আপনি তা করবে না...

- ধরো ওটা খানিক বাড়াতে পাবি।

-বলব সকলকে।

আমি তো তোমাদের সঙ্গে সম্পর্ক করতে চাই। কেননা পরে এই এলাকাতেও কাজ হবে। তখন এলাকার লোকই নিতে চাই। এই সব কাজের জন্যে সম্পর্ক করা দরকার।

- হাঁ বাবু।

---আমি তো লাইসেন নিয়ে ভাববার করি।

---হাঁ বাবু।

-তাহলে সকলকে বোলো।

--বলব, চলুন। পৌঁছে দিই।

লক্ষ্মণকে পৌঁছে দিয়ে এসে সাতবান বলে, বহোত হি সঠাবাক্ত, ধান্ধাবাজ। বলে কী! বাবার লাইসেন নিয়ে কাববার করছে ঔর গৌরি ইলাকায় জঙ্গলের আমলকি, হবর্তকি, শলাতা, ইলাকা ইলাকায় ডিম ওর মুরগি, হাসপাতালে খাবার, সন ও লাইসেন নিয়ে চালান দেয়।

মোরি বলে, এখন চালান দিচ্ছে মানুষ।

--এ কাজে সবচেয়ে বেশি নাফা। মাথা পিছু কোম্পানি দিল ধরো পঁচিশ টাকা। এ তোমাকে দিল তিন টাকা। কোম্পানি বাবু, ইউনিয়ন, সবকে খাইয়ে তখন এক যদি পচি টাকাও থাকে, আব লেবাব থাকে একশো! তাহলে তো এ বোজ পাঁচশো টাকা পাচ্ছে।

আবে, এর লেবার বিশটা থাকলেও বোড় একশো। -হা হা, স্নকর কোনো ধান্ধা আছে। সরপঞ্চ এনেছে যখন!

---সবাই খুঁজে কেমন করে গরিবকে সবচেয়ে কম দিয়ে লাগানো যায়। -এর চেয়ে মালিকের মোষ হলেও ভালো ছিল। গরু আর মোষ তো খেতে পায়।

---মৌসি! গরু আর মেয়ের দাম কত হয় বলো? মানুষের তো দামই হয় না।

-তাও সত্যি।

--তবু বড়ো কষ্ট মানুষের। যে যেতে চায় সে যাবে। বলব

সকলকে।

বাসনি বলল, যদি খেতে পাই, তাহলেই চলে যাব। একবার গেলে আর ফিরব না।

সাতবান বলে, এগুলো কোনো কাজের কথা হচ্ছে না। খালাস নিতে হবে, মদতও আদায় করতে হবে।

মোরি উপসংহারে বলে, এ লোকটা কে? দেখে মনে হয়, খরাতাপে শুকনো ভিণ্ডি একটা!

মন্তব্যটি খুব লাগসই হয়। সবাই হাসে।মোরি সগর্বে বাসনির দিকে তাকায়। দেখো! আমি এখনো শুধু কথা বলেই সকলকে হাসাতে পারি।

সমুন্দরের বাড়িতে কটি, ডাল আচাব ও বেগুনের ভাজি খেযে লক্ষ্মণ একটি বিড়ি ধরায। না, বড়ই তৃপ্তি হয়েছে তার। এখানকার জলও ডালো, ভাকল বলেছে। সে বলেছে, কয়েকবার তোমাকে বাবস্থা করে দিলাম। কোনোটাই তুমি রাখতে পারছ না।

--এখানে সব ঠিক থাকবে।

---এখানে চেপে থাকো, ভালো থাকবে। কেচকি গ্রামের জল খুব হজমি।

-কৈসে?

-হয়তো খনিজ কারণে। পলামুতে খনিজ সম্পদ অনেক। তবু কোনো শিল্প নেই। পলামু কৃষি জেলা হয়েই রয়ে গেল আজও।

ইনডাসটি তো হোনাই চাহিয়ে।

-কেচকিতে যাও। ওখানে নহলাতে লাটা নদীর এক কুত্তী আছে। জল হজমি খুব। এক শিব মন্দিরও আছে। পূজারী জল বেচত, খুবই আশ্চর্য যে সে কুণ্ডী শুকিয়ে গেছে। আর পুরা কেচকির জল মিঠা হয়ে গেছে।

-চেহারা ফিরবে আমার?

- দেখো।

- -আপনার বহোত দ্যা আমার উপর।

-আরে ভৈয়া! যতদিন ঠিকাদারি কবছ, এতদ্দিনে তোমার রাজা হয়ে যাবার কথা। হতে তো পারছ না। ফরেসের মাল বলতে তুমি টোরিতে বসে আঁওলা চালান দিতে থাকলে! আরে! টোরি থেকে লাপরা এসো, দক্ষিণে যাও, বোরা বোরা আঁওলা তো জঙ্গলে মিলছে, পয়সাও লাগে না। না দেখলে শালগাছ, ওঃ!

লক্ষ্মণ এ কথায় বন উসখুস করে। দুই ঠিকেদার ঢুকেছিল টোরি এলাকা। সুন্দরলাল ঠিকেদার লক্ষ্মণকে ভিড়িয়ে দেয় একটি সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে। সেই দুসাদিনকে নিয়ে লক্ষ্মণ থাকে ব্যস্ত এবং পাহাড় জঙ্গলে আমলকি বা আওলা তোলাতে থাকে মহাবীর আয়ুর্বেদীয় প্রতিষ্ঠানের জন্যে! আমলায় নাফা কম।

সুন্দরলাল নিজে লাপরা থেকে যাট-সত্তর বছবেব পাকা শালগাছ কয়েক শত কেনে।

বিদায় বেলা আসে যখন, সুন্দবলাল মোটা টাকা, এবং লক্ষ্মণ জলভরা চোখ নিয়ে লাপরা ছাড়ে। ঘটনাটি এখনো যথেষ্ট মজা দেয় লোককে।

লেবার চালান এখন খুব লাভজনক। সে জগতে ঢোকাই মুশকিল। ভকিলসাব লক্ষ্মণের জন্যে এখনো চেষ্টা করেন, কেননা ভকিলসাবের পত্নী এবং লক্ষ্মণের মা একই মঠে দীক্ষিত, একই গুরুর কাছে। এই গুরু বর্তমানে পলামুর রাজনীতিক নেতারও গুরু। লক্ষ্মণ এবার নতুন করে জীবন শুরু করবেই করবে! সমুন্দরকেও খুশি করে দেবে।

-হাঁ সুমুন্দরজি!

বলুন।

-ওই মেয়ের নাম কি গোহুমনি?

-না... আরো কোনো নাম আছে।

-তাহলে "গোহুমনি" কেন বলা হচ্ছে?

-সে খুব উলটাপালটা কাহিনী।

-বলুন না।

-বলব...! অবশ্য বললেও হয়। কেচকিতে থাকলে, চাই যাওয়া আসা করলে আপনি কারো না কারো কাছে অনেক ঝুটামুটা বাত শুনবেন এ কথা নিয়ে। আমি যা জানি সেটাই সত্যি কথা। এ একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার, ঔর আমার ইজ্জতও যা খেয়েছে, অথচ মহাবীরজির কসম, দুর্গা মাইযের কসম, এতে আমার কোনো দোষ ছিল না।

এ কথা বলে সমুন্দর দেয়ালে প্রলম্বিত ছবিগুলির দিকে তাকায়। ঘরে হারিকেন জ্বলছে! তার আলো দেয়ালেও। সমুন্দর দেখতে চায় মা দুর্গা, বা দুর্গামাইয়া-বেশী ক্যালেণ্ডারের ছবি। কোনো বাস্তব কারণে ক্যালেণ্ডারের দুর্গামাইয়া এবং অতীতের অভিনেত্রী নিরূপা রায়ের মুখে অদ্ভুত সাদৃশ্য। কারণ ব্যাখ্যাসাধ্য। নিরূপা রায় একদা পৌরাণিক হিন্দি ছবিতে দুর্গামাইয়া, গঙ্গামাইয়া, কালীমাইয়া সাজতেন। ক্যালেণ্ডারের ছবি সেসব সিনেমার পোস্টার দেখেই আঁকা।

সমুন্দর দেখতে চায় দুর্গামাইয়ার ছবি! তার চোখ পড়ে রাজবংশ ও রতি অগ্নিহোত্রীর ছবির দিকে। রাজবংশ ও দলীপ, অমিতাভ বচ্চন ও রতি অগ্নিহোত্রীর সঙ্গে নিজেদের পাঞ্চ কর চবি কেচকিতে কয়েকটি উপহারও দিয়েছিল।

ছবিটি সমুন্দরকে বড় বিচলিত করে। সে হারিকেনায় ইয়ে রাখে, এবং ঝালো কেন গোহুমনি হল, তার কাহিনী বলতে থাকে।

সবই মহাবীরজির ইচ্ছায় ঘটেছে।

বিশাল ভূঁইয়ার বউ ঝালো। বিশাল, ঝালো, বিশালের দাদা সাতবান, এরা একলেই সমুন্দরের কামিয়া। ওদেব ঠাকুদা সাতবানের বিয়ে দেবার জন্যে সমুন্দরের বাবার কাছে একষট্টি টাকা ও এক বোরা চাল নেয়। তখন এক মণ চালের দাম সাত টাকা।

এ ভাবেই ওরা কামিযা হয়ে গেল। কামিয়ৌতি তো খতম হয় না কখনো। তাই সাতবানের ঠাকুর্দা, সাতবানের বাবা, সাতবান ও বিশাল, ওদের বউরা, সবাই কামিযা হয়ে থেকে গেল।

বিগত বিশ-বাইশ বছরে ওরা অসুখে, আকালে, বিশালের বিয়েতে, বাপমাযের মৃত্যুতে, যত ধার নিয়েছে, (এমন ধার ওরা নিয়েই থাকে) সবই যোগ হয়েছে সেই আদি করজ্ঞের সঙ্গে।

ওই পরিবারটি উনিশশো একষট্টি সাল থেকে কত কি নিয়েছে, সব মনে আছে সমুন্দরেব।

সাতবানের বিয়েতে একষট্টি টাকা আর এক বোরা চাল।

তারপর সাতবানের মায়ের শোথত্বরে এগারো টাকা। তারপর পেটের ক্ষুধা মিটাতে আধ বোরা কুরথি কলাই। তারপর বিশালের বিয়েতে পঁচিশ টাকা। বাপের দাহ ও শ্রাদ্ধে একুনে বত্রিশ টাকা, আর মায়ের পারলৌকিকে ছেচল্লিশ টাকা।

বাইশ বছর ধরে বারবার ঋণ নিয়ে ওদের ধার এখন দাঁড়িয়েছে একশো পঁচাত্তর টাকা, এক বোরা চাল ও আধ বোরা কুরথি কলাই। পরিমাণটা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ বেড়ে বেড়ে এখন তিনহাজার টাকায পৌঁছেছে। যতবার ধার নিয়েছে, ততবার ওরা টিপছাপ দিয়েছে। ফলে এখন কতকাল যে ওদের দাস হয়ে থাকতে হবে তা বলা কঠিন।

বছর চারেক আগে বিশাল খুব গোল পাকাবার মতলবে ছিল। বিশাল বরাবরই খুব তেজী, খুব পরিশ্রমী, আবার মেজাজটাও খুব কড়া।

বউকে পিটাত। সমুন্দরও কত সময়ে বলেছে, দেখো বিশাল! রাবণবাজা মন্দোদরীকে পিটাতেন। তাতেই তাঁর পতন হয়েছিল। কাহিনী এখানে পৌঁছলে লক্ষ্মণ বাধা দেয় মহোৎসাহে। কেন না ঠিকাদারী কাজে ঘুরতে ঘুরতে সে তেমন ধনদৌলত করতে পারে নি, কিন্তু রামাযণ খুব পড়েছে!

- হাঁ হাঁ, কেমন কথা বললেন বাবরণ বাজা মন্দোদরীকে মাবতেন? একথা কোথায় লিখা আছে?

-বশ্বস্ত দ্বিবেদীর লিখা রামায়ণে।

-এ কথা কেউ লেখে নি।

--কে লিখবে? কে জানে? পলামুতে হাটবাজাবে ওঁব লেখা রামায়ণ বিক্রি হয।

----ওঁর নামও শুনি নি কখনো।

--উনি খুব উচা দরের মানুষ ছিলেন। ঔব স্বপুরুষ লঙ্কায় রাবণরাজার গৃহদেবতার পূজক ছিলেন। তাই অনেক কথা ওঁব রামায়ণে পাবেন, যা বাল্মীকিও জানতেন না। রাবণরাজা তার রানীকে পিটাতেন। এই বামায়ণ পড়লে এ কথাও জানবেন, যে সীতামৈশ বামাচন্দয়িত্ব জন্যে বনবাসের কালে ঠিকসে খানাউনা পাকাতেন না বলে তাঁর এত লাঞ্ছনা হয়। এসব কথা সবাই জানে না।

----খুবই তাজ্জবের বাত।

--নিশ্চয়। বলবন্তব্জিকে দেখলে আপনি কী ভাবতেন কে জানে! টিউকল বসাবার ঠিকাদার, কাটা কাপড়ের দোকান, বলবস্তু দন্তমঞ্জন প্রস্তুতকারক, এ লোকই রামচন্দ্রজি, রাবণরাজা, সকলের খবর জানতেন। এটা খুবই আফশোসের কথা, যে নিজের বউকে পিটাতে গিয়ে উনি পা পিছলে পড়ে গেলেন, মরেও গেলেন।

--যাহোক, বলুন! মরে যাবার কথা কে বলতে পারে যে কার মরণ কেমন ভাবে হবে।

--তাও বলা যায় ঠিকেদারজি! আমার মরণ হবে সাপ কেটে, গণক বলেছেন।

--রাখুন তো ওসব কথা!

-- যা বলছিলাম... আমিই সর্বনাশ করলাম। বিশালকে পাঠালাম সেমরা। বিহার মিনারাল ডেভলপমেন কর্পোবেশানের খাদানে আমার শালার কাছে। সে ওখানে ওভারসিয়ার। ঘর থেকে কিছু পাঠাবার ছিল।

-ওটা চলছে তো?

-খুব চালছে। ঠিকেদারেব লেবারও নিচ্ছে। একশো দরকার তো চারশো বসে থাকছে হাত জোড করে। আপনাকে লাইন করে দেব। আমি পিছনে থাকব, কিন্তু শেযার নিব। লেবার যাতে পান, তাও দেখব।

নিশ্চয। তারপর?

বিশাল তো বহোত খচড়াই। চলে গেল সেমরা বন্ধুযাটোলি। সেস্মরার কামিয়াদের সঙ্গে অনেক জোতানানা করল।

ওহি সেমরায় সরকার কামিয়াদের খালাসও করে, মদতও দেয়। সেই থেকে মচ্ছর যেমন ভনভন করে, তেমনি বন্ধুযা লোকও গুনগুন্ শুরু করছে যে, কামিযৌতে নেহি চলে গা।

-কৈসে ন চলে গা? পলামু জিলায় তো সিরিফ কামিযৌতিই চলে। --ভৈয়া! ভারত সরকার তো জাতপাতের মহিমা বুঝে না। কামিয়ৌতি উঠাচ্ছ কেন? উঁচা জাত কি হাতে লাঙল ধরবে, না বিহার সরকারের রেটে মজুরি দিয়ে চাষবাস করাবে?

-সেই তো কথা!

-বিশাল ফিরে এসে যে কত রকম খচড়াই জুড়ল তা বলতে পারি না। টাউনে যায় আসে। কুশলপ্রসাদ ভকিলের কাছে বুদ্ধি নেয়।

--তাকে আমি জানি।

-নওনেহাল তা কামিয়া মেয়েকে পিটাচ্ছে, তাতে তোমার কী? বিশাল যেয়ে নওনেহালের হাত মুচড়ে ধরল। বুঝন!

-তারপর?

-সকলকে নিয়ে এক কাট্টা হয়ে গেল। বলল, কামিয়ৌতি তো বেআইনি। বেআইনি খাটাবে, আওরত পিটাবে, তা হবে না। এ নিয়ে বহোত ঝামেলা উঠে। শেষে কুশলপ্রসাদের কাছে সেই আওরতকে নিয়ে গিয়ে কেসও করাল।

..... আপনি কী করলেন?

-কী করব? কামিয়ার এমন আস্পর্ধা। আমাদের মধ্যে একতা থাকলে নওনেহালের জন্যে আমি লড়ে যেতাম। একতা একেবারে নেই! আর ওই যে জমির মামলা চলছে, যার যার কামিয়া তার তার সাক্ষী।

-ওখানেই মিটে গেল?

-হ্যাঁ, তখনকার মতো। তারপর বিশালকে বুঝালাম যে এরকম করা ঠিক নয়। ওকে যখন বোঝাব কি শাসন করব, ও তখন বলবে, হাঁ হাঁ মালিক। তুমি যা বলছ তাই ঠিক। তারপরই বিগড়ে যাবে। -তারপর?

মেয়েকে দেখতে গারোয়া গেলাম। ফিরে এসে দেখি বিশাল নেই। কোন্ ঠিকেদারের সঙ্গে কথা বলে ওই সেমরার ওই খাদানে কাজ করতে গেছে গ্রাম থেকে চারটে কামিয়াকে নিয়ে।

--খুব তাজ্জব! সাহস হল কোথা থেকে?

--ঘরের মধ্যে বিভীষণ। ওখানে লেবার ঝামেলা হল। তাতে আমার শালাই ওকে রেখে নিল। বলছি না যে, রাজপুত জাতের মধ্যে একতা নেই?

-আপনি কী করলেন?

---থানায় খবর দিয়ে ধরে আনালাম। কিন্তু দারোগা তো আদিবাসী। মুণ্ডা, তাতে ক্রীশ্চান। সে বলল, কামিয়া প্রথাই বেআইনি। জবরদস্তি আপনি কাউকে গোলাম খাটাতে পারেন না। সেখানেও ইজ্জত চলে গেল। শেষে ব্লক অফিসার থানায় বলে....

-সে দোষ মানল?

--মোটেই না। আমার কাছে খুব চুপ করে থাকল। তারপর একশো টাকা করজ নিল। এ ক-শো টাকা! কা খচড়াই রে বিশাল! সে টাকা নিয়ে রাতে পালাল কেচকি ছেড়ে।

--কোথায়?

--ধানবাদ কয়লা খাদানে।

-সেই কাজই করছে?

--এবার ধর্মের জয় আর অধর্মের পরাজয় হয়ে গেল। কাজ করতে ভেগে গেল, তার তিন মাস বাদে খবর এল, যে খাদান ইলাকায় কোনো রাস্তা বানাবার জন্যে মাটি কাটতে কাটতে মাটির ধস নেমে অনেক লোক মরেছে। বিশালও মরে গেছে।

-মরে গেছে!

-হাঁ জি।

-আপনি কী করলেন?

দেওতা বনে গেলাম। মহাবীরজির ইচ্ছা সবই। ওর বউকে তাড়ালাম না। সেই একশো টাকা তো বিশাল নিয়ে ভেগে যায়। ওকে যদি কিছু দিয়েও থাকে, ওর বউ তা মানল না। সে বলে, যে টিপসহি দিয়ে টাকা নিল তার খাটার কথা। আমি টিপসহি দিলাম না, টাকা নিলাম না, আমি খাটব কেন?

-এও এক কথা।

-সবই মেনে নিলাম।

--গোহুমনি আপনার কামিয়া?

-কামিয়া তো ও ছিল, রযেও গেছে। কিন্তু তখন ওর নাম গোহুমনি হল না। পরে.... আন্দাজ আডাই বছর আগে আমাদের মামলার কারণেই কেচকিতে সরকারি জরিপ তাঁবু পড়ল।

--- হাঁ হাঁ, জমির কথা শুনেছি।

-আমিনবাবু এক সৃষ্টিছাড়া লোক। জমি জরিপ পাটি এলে মালিকরা তাদের চাল-খাসি-ঘি পাঠাবে। আচ্ছা আচ্ছা ঔরতও চাইলে ভেজবে, ওহি কামিয়া-ঘব থেকে। এটা কোনো ভালো নিয়ম নয়, কিন্তু পুরনো আদত, চলছে।

--নয়া আদতও তাই।

---এ আমিনবাবু তো এত বোকা, যে কোনো কিছু নেয় না, মাইনে ওই যৎ সামান্য। তার উপর খুবই খিচখিচা মানুষ। এসেই বলে দিল, চাল-ডাল-আটা কাউকে বিনাপয়সায় দেবেন না। যা দরকার সব কিনে নেব, হিসাব দেবেন।

--- সৎলোক খুব।

-ভৈয়া! তাতেই গণ্ডগোল বাধে জানলেন? সাচ্চা লোক, ঘুষ খায় না, এ রকম বড় অফসর দুটো একটা দেখেছি। কিন্তু নিচু মহলে এত কট্টর বামনাই না আমি দেখেছি, না আর কেউ দেখেছে। বিহারে তো এমন আদত চলে না, ঔর পলামুতে কখনোই চলে না। -তারপর?

--এ নিয়ে ওদের পিওন, চেনপিওন, কানুনগো, সকলের মধ্যে খুব অসন্তোষ ছিল। তশীলদারও এসেছিল। সে পলামুবাসী পাঞ্জাবী। তাব রোখ খুব। সে মেয়েদের লালচ খুব করে। তা ঝালোকে দেখে ও ক্ষেপে যায়।

হাঁ। খুবই সুন্দরী।

ওহি জমিতে তো ওরা লোটা নিয়ে যায়। ঝালোও গিয়েছিল। তর্মক্ষীপদাণ কাশঝোপের পিছন থেকে দেখছিল, সে ওকে জড়িয়ে তারপর?

---বাস! ঝালো তো চেঁচিয়ে উঠল, আর খুবই ঝটাপটি হল। শেষে ঝালো ওর হাতে দাঁত বসিয়ে দেয় বাঘের মতো। তখন তো বহোত গোলমাল বেধে গেল। ঝালোকে শিক্ষা দিবার জন্যে আমি তৈবি হলাম। ওদের জাতে মেয়েদের তো এত ইজ্জত থাকে না।

----কোথায় আর থাকে?

--ঝালো আমিনবাবুর কাছে বিচার চাইল। হ্যাঁ সে এক দৃশ্য বটে। ঝালো কাঁদতে কাঁদতে এল তার বলল, পথের কুত্তীরও যদি কখনো ছুটি মিলে, তবু আমাদের মিলে না। মালিকরা তো আমাদের বিনি পয়সার বেন্ডী করেই রেখেছে। ঔর তোমার সরকারি তশীলদার, একে কোন শান্তি দেবে? ওঃ বাপরে বাপ! কী কাণ্ড!

হাতে কামড়ে দিল?

---সে তো তখন হাতে ব্যাথায় কাঁদছে।

--তারপর?

-আমিনবাবু ওকে মা! বোন! বেটি! বলে যতই মানায়, ও ততই বলে, মা-বোন-বেটি! তোমার মা-বোন-বেটিকে এমন বেইজ্জত করলে যেমন শাস্তি দিতে, তেমন দিতে পারবে? অপরাধী তো একদম চুপ, গুংগা যেন। চুপটি কবে বসে থাকল। বেশ একটা গোল পেকেছে দেখে কামিযা লোকও জুটে গেল। বহোত তামাশা লেগে গেল।

-বাপ বে! এক ভূঁইনকে নিয়ে?

-ডৈযা। পলামুব হাওযা এখন পালটাচ্ছে। গবিব মেযে বলাৎকাব হলে সে কেসও হচ্ছে। আগে এসব হত না। কেউ সাহস কবত না ঝামেলা উঠাতে।

-এখনো তো হয।

-হয, হচ্ছে, এ তো ইলাকাব নিষম। কিন্তু আস্তে আস্তে পালটে যাচ্ছে সব।

--তাবপব।

-আমি তো সবপঞ্চ। আমাকেই সাতবানবা বলল, যে এমন অন্যাযেব বিচাব আপনিও করুন। মেযেদেব উপব বেইজ্জতি যদি চলতে থাকে, তাহলে মাবদাঙ্গা কবে মানুষ ভেগে যাবে ইধাবউধাব। গবিবেব তো ভকিল-উকিল, আদালত পুলিশে কোনো বিশ্বাস নেই। মাবপিটাবে, ভেগে যাবে। আব এও খুব তাজ্জব, যে আমবা অদ্ভূত, আমাদের ছোঁয়া পানি অদ্ভুত, লেকিন আমাদের আওবতবা অদ্ভুত নয়।

-এখন এসব কথা হাওযায় চলছে।

-- আগেকার দিন হলে ঝালোব মাথা নেডা কবে টাউনে পাঠিযে দিতাম বেণ্ডী ঢোলিতে। উঁচাজাতেব বাবু তোকে লালচ কবেছ তো ধন্য কবে দিয়েছে একেবাবে। তা নিয়ে আবাব কথা কিন্তু এখন তো উলটা বাতাস বইছে। তাতেই আমিও বললাম, যে বিচাব হোক।

-বিচাব হল?

-- খুব। আমিনবাবু ওই তশীলদাবকে বহোত হি ডেটে দাবডে ফেবত পাঠাল। ক্যাম্পও তুলে নিল। আব যাবাব কালে সকলেব সামনে ঝালোর মাথায় হাত দিয়ে বলল, মা! সতীত্ব রক্ষার জন্যে তুমি আজ যে কাজ করলে, সে তো অখবরে ছাপাই হবে, সরকার তোমায় পুরস্কার দেবে,এমনটা অন্য রাজ্যে হয়ে থাকে। কিন্তু পলামু বহোত অভিশপ্ত ভূমি। এখানে ভালো কাজ দেখালে খুন হতে হয়। ঔর চোর চোট্টা-দাগাবাজ-ফরাবাজ ধাপ্পাবাজ- বলাৎকারী---হত্যাকারী, সকলের মিলে নাফা সে নাফা, সৎনাম সে সৎনাম। তবুও মৈয়া, তোমাকে দেখে আমার বুক অনেক বড় হয়ে গেছে। চোরবাটেরা তোমার ইজ্জত লুটতে এসেছিল। গোহুমনির মতো ফুঁসে তাকে কেটে দিয়েছ।

-ওহিসে গোহুমনি!

-ওহিসে গোহুমনি।

আমিনের কাছে তখন কেঁদেকেটে পড়েছিল গোহুমনি। এ গ্রামের হালচাল জান না বাবা। আমাকে এখন মালিক লোকরা কত লাঞ্ছনা করবে, কাজ দেবে না। যার দৌলতে কপালে সিঁদুর আর হাতে কাচের চুড়ি পরতাম, সে তো নেই। দুটো সন্তান নিয়ে আমি তো হাওয়ার মুখে তুষের মতো উড়ে যাব কোথায়!

সরপঞ্চকে তখন মনের রাগ বুকে চাপতে হয়েছিল। বলতে হয়েছিল, না, না, কাজ তুই পাবি।

আর ওই বোকা তশীলদারকে গুনে গুনে পঁচিশ টাকা দিতে হয়েছিল। যাবার কালে আমিন বলে যায়, তোমাদের যার যা অভিযোগ আমার কাছে গিয়ে বলবে।

একজন দুজন ভালো লোক এখনো প্রশাসনে আছে। আমি তাদের কাছে ভেজে দেব।

ওই এক বোকা তশীলদারের জন্যে নানা রকম বিপদ ঘটে গেল যাকে বলে। এতকাল ধরে মালিকরা, বাবুরা, পুলিশ, পিওন, ঠিকেদার, মস্তান, ট্রাকচালক, জঙ্গলরক্ষী, সকলেই কামিয়া ও অন্য গরীব মেয়েদের যথেচ্ছ ভোগ করেছে। ভোগ করেছে, বেচে দিয়েছে, রেন্ডী করে দিয়েছে, কত রকমই না করেছে।

ওদের ধরে নিয়ে পেড়ে ফেলার পক্ষে মলত্যাগের পরের সময়টি ছিল উপযোগী।

এখন কেচকি গ্রামের ঘটনার পর সবাই বেশ চমকে গেল। গোহুমনি যদি পারে, তাহলে আমরাও বাধা দিতে পাবব সাহসে কুলালে। এবং গোহুমনির বেলা যদি ক্ষতিপূরণ পঁচিশ টাকা হযে থাকে, তাহলে যত মেষে নিয়ত ধর্ষিত হয়, তারাও তো কামাই করে পঁচিশ টাকা করে।

সকলেই এ নিয়ে অতান্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং এই নবচেতনার ভগীরথ গোহুমনিকে বলে, চল্! সবাই একটু আনন্দ করি।

--কৈসে?

-চল্, মদ খাই একটু করে।

--ছি ছি! আজ মালিকরা খুব বেশি অপমান হয়েছে। আজ বরং সাবধানে থাকার কথা। রাতবিরেতে কোনো চোটও উঠাতে পারে।

বাসনি ঝরঝর করে কাঁদে ঘরে এসে। মার কাছে বসে কাঁদে।

-হায় মা! হায় মা! একবার ধরম নিলে পচিশ টাকা যদি হয়, তাহলে সরপঞ্চের কাছে আমার এক মাসে দশ পনেরো বার পঁচিশ টাকা পাওনা হয়। আর নওনেহালের ঠাকুর্দার কাছে তোর পাওনা হয়-চুপ কর্, চুপ কর্, কে কোথায় শুনবে! তখন সত্যনাশ হবে, সর্বনাশ হবে।

-না মৈয়া! চুপ করতে বলিস না।

সাহস করে ঝালো রুখে দাঁড়াল তো বড় কাজ করেছে। আমাদের ইজ্জতও বেড়ে গেল। মালিকবা তো এও মানে না যে ঘরে আমাদের ছেলেমেয়ে আছে কি না। রেন্ডীকাজে পয়সা মিলে এ তো তেমন হল না। এ তো জরিমানা আদায় করল ঝালো! এ টাকায় ইমান আছে, না কি বলো?

-কাঁদিস না অমন কবে। নে, বিড়ি খা।

মোরি তাব টিনের কৌটোর সাম্রাজ্য হাতড়ে হাতড়ে বিড়ি বেব কবে, মেয়েকে দেয়। তারপর বলে, আয! তোর উকুন চারটি বেছে দেই। তুই আমার উকুন পবে বেছে দিস।

---হাঁ, দিই! হাট থেকে উকুন মারা ওষুধ আনব। সবচেযে ভালো তাই।

কালো, যে নাকি বিশালকে বহু, সোনাকে মৈয়া, সে কেমন করে গোহুমনি হল, সে কাহিনী সবিস্তরে বলে সমুন্দর।

উপসংহারে বলে, ওর ব্যাপারে আমার তো এমন বেইজ্জত হয়েছে যে, ও যদি চলে যায় কাজ করতে, তাহলে আমি রাচি।

স্বামী তো নেই।

- না।

--আর বিয়ে করতে পারে"

--যুব পাবে। করছে কোথায় দেখুন না! আমাদের সমাে কোনো একতা নেই বলে এমন হচ্ছে। একতা থাকলে এল মালিকের অপমানে শোধ নিতে সকল মাফিক কখে সেত।

-- সরপঞ্চড়ি! লেবার তো মেলা খুব দরকার। ধরুন না আশেপাশে ম্যাগনেটাইট লেত আকর খনি কতগুলো। কংটা, বি.এম.ডি.সি. বি.সি.সি.এল, সবাই চালাচ্ছে।

----নাফা থাকে?

--নাফা না থাকলে চালাচ্ছে? -তাও তো বটে।

-রেটও অনেক। একশো কিউবিক ফুট হিসাবে মজুরি হল, নরম মাটি কাটলে পঁচিশ টাকা ষোল পয়সা। নরম পাথর কাটলে একত্রিশ টাকা ছেচল্লিশ পয়সা। শক্ত পাথরে ছেচল্লিশ টাকা পঁচাত্তর পয়সা।

-এ তো অনেক।

-পার্মেন্ট লেবার তো নেই কোথাও। থাকলেও যৎসামান্য। কাজ করবে বদলি লেবার। তার মধ্যে বাচ্চা ছেলেও অনেক ঢুকাব। সরকারি রেটে কোম্পানি দিবে। কেননা কোম্পানির লোকজন, ইউনিয়ন, সবাই বাট্টা পাবে। আমার নাফাও থাকবে।

-এরা কী পাবে?

-দুই থেকে পাঁচ। এদেরকে দশ-পনেরো দিলে আমাদের কিছু থাকবে না।

-এরা যায় তো ভালো। নয় তো লেবার আপনি কতই পাবেন। একে গরিব, তাতে খরায় সব জ্বলে আছে।

--কামিয়া লোক নিলে এই সুবিধা যে ওরা ভাগতে পাবে না, ভয় পায়। নইলে এখন চারদিকে যত ঠিকেদার ঘুরছে, বাইরে নিয়ে চলে যাচ্ছে। পাবে তো ফুটা পয়সা, কিন্তু বড় বড় কথা শুনে চলে যাচ্ছে। খুব কষ্টে থাকে, খেতে পেলেও ভালো।

-খুব জানি। ভাদ্র মাসে চলে আসবে যত দালাল। মাথার চুল থেকে উকুন কি দেখা যায়? এরাও তেমন লুকিয়ে পলামুতে ছড়িয়ে পড়ে। খুব খানাপিনা করাবে, লোভ দেখাবে, আগাম টাকা দিবে। তারপর কালীপূজা দিওয়ালির পর পরব পূজা সেরে সব ভাগবে পাটনা-ছাপরা-আরা-কলকাতা।

--কামিয়া লোকও ভাগে?

-তাও ভাগে। ওদের তো ধরমবোধ নেই যে আমি মালিকের বাঁধা গুলাম! ----না না, আমি দেখছি। আপনিও কোসিস করুন। আপনার কোনো খরচ নেই, যা হয় তাই নাফা।

কামিয়ৌতি তো ওহি কারবারই ছিল।

-এখনতো আছে।

---থাকতে পারত। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো একতা নেই বলে এত ঝামেলা।

সমুন্দর কথা বলে চলে যায়। লক্ষ্মণকে বড় উতলা করে রেখে যায। ধানবাদের কাছে মাটি কাটা! মাটির পাঁজা ধসে অনেক লেবার মরে গেল। সব এখান-ওখান থেকে আনা ছুটা লেবার ছিল।

এই একটা কাজের জন্যেই তার বদনাম হযে গেছে অনেক। একথা ভকিলসার একবাবও উল্লেখ করে নি। কিন্তু ঘটনাটি সবসময়েই দুজনের মনেই ছিল।

মাটিকাটা কাজ ছিল। লাভ তো মাটিতে। আধঘণ্টা খাটবে, আর একশো কিউবিক ফিট চৌকা কাটলে সেই হিসেবে বাইশ টাকা মজুবি।

এখন ভারতভূমে এমন ছুটা ফুরনবাঁধা মজুর লোকের কোনো হিসাব নেই। কাজ হবে খবব পেলেই সব চলে আসে। সবাই জানে, যে আটঘণ্টা কেন, বারো-শেদ ঘণ্টা খাটতে হবে। সবাই এও জানে যে হাতে পাবে সামান্য। খোরাকি পাবে। তারপর ঠিকেদার বলবে যে, তোরা বাইশ টাকা তো রেজ পেটে খেয়েছিস। যা, দশ পনেরো টাকা দয়া করে দিচ্ছি।

এভাবে ঠকবে জেনেও ওবা, রাঁচি, হাজারিবাগে, সাঁওতাল পরগনা, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, পলামু থেকে আসে। আসে, যায়,- আসে, যায়- মানুষের হিসাব নেই কোনো।

তো খুব কম সময়ে অনেক মাটি কাটবার ছিল। তখন লক্ষ্মণ মাটির পাঁজার পিছনে বাঁশ পুঁতে দেয়। বাঁশের আগে রুমালে মুড়ে একশো টাকার নোট বেঁধে দেয়। ওই বাঁশ অবধি মাটির পাঁজা উঠাও, আর যাদের হিম্মতে হবে তারা নোট জিতে নাও।

মাটি কাটা হচ্ছে, রেজা ও বালকরা উঠাচ্ছে, ফেলছে। সে লোকটা, নাম তার বিশালই তো, সে বলে, নেহি হোগা।

-কা নেহি হোগা?

ঠিকেদারকে উপেক্ষা করে মজুরদেরকে বিশাল বলেছিল, ঠিকেদার চল্লিশ মজুর লাগিয়েছে। মাথা পিছু খরচ করছে পাঁচ টাকা। ওর থাকছে সতেরো টাকা। তা ওভারসিযার পাচ্ছে পাঁচ টাকা। ওর থাকছে বারো টাকা। ভৈয়া। বহনো। আমাদের রোজানি হয় আটশো আশি টাকা। ওভারসিয়ার পায় দুইশো, ও পায় চারশো আশি একেক দিন।

--হাঁ হাঁ, তাই তো পায়।

--এখন নোট বেঁধে লোভাচ্ছে। ভৈয়া, ইধার বনি গাহারা খ্যদ, উধাব বনি নরম গিলা মাটির পাহাড়। এ কাজ সুস্তির কাজ, ব্যস্তির নয়। টাকা তুলতে আমরা ব্যস্তি হয়ে যাব তো মাটির ধস নেমে যবে।

-- ফুট!

ঠিকেদার ধমকে বলেছিল। আব সেদিনই সে কুলীধাওড়ায় অনেক মদ পাঠায়। সকলকে বলে, বিশাল ভয় দেখাচ্ছে। ওর কথা মেনো না। হিম্মতসে এ কাম খতম করো। ট্রাকে তুলে নিয়ে যাব চামসার্ডি। সেখানে পথ বানাবে। আমাকে ধরেছ তো কানের অভাব হবে না। কুলাধাওড়ায় এ নিয়ে খুব জল্পনা হয়। বড় অভাবে এসেছি। জানোযারের মতো ঝোপাড়িতে থাকছি, আর ভাত পিঁয়াজ খাচ্ছি। একশো টাকা পেলে ঠিকেদারের কাছে আরো চাঁদা নেব, তারপর মাংস ভাত খাব।

-তোরা মরবি।

না বিশাল, "না" বলিস না।

নিব।

---পুরা হিসাব রাখছি' আমি, ঠিকেদারের কাছ থেকে পুরা হিসাব কেচকির যুবকরা বলেছিল, বিশাল পারবে। ও কাউকে ভয় পায় না।

-হিসাব নিয়ে ডেগে যাব।

ঠিকেদার বলেছিল, গেলেই হল? আমার কাছে ও তিনমাস কাজ করবে, চুক্তি হয়েছে।

এ কথা শুনে বিশাল বলেছিল, এ খুবই তাজ্জব বাত। মালিকও বলে তুই টিপসহি দিয়েছিস, বাঁধা আছিস। তুমি বলো, আমি টিপসহি দিয়েছি, বাঁধা আছি। বিশাল ভূঁইয়ার তো কিছুই নেই। না জমি, না নিজের ঘর, তাকে কেন করজেশর্তে বেঁধে ফেলছ সবাই? এ কেমন ধান্ধা তোমাদের? তোমার শর্ত-টর্ত মানি না আমি। ডেগে গেলে করতে পার কিছু?

এই লেবার দল ছিল খুব মিশ্রিত। সাঁওতাল পরগনার সাঁওতালরা বলেছিল, আমাদের মতো বউ ছেলে নিয়ে এলি না কেন? তাহলে তোর মন বসত।

-আমরা তো কামিয়া।

-কেমন?

-মালিকের কাজের গোলাম।

---কেমন করে?

-সে অনেক পুরনো কথা। এহি মানো যে তোমার বাবার বাবা দশ-বিশ টাকা করজ নিল তো আজও তুমি গোলাম খাটছ আর সেই করজ আজ হাজার টাকা।

সাঁওতাল পরগনার ছেলেরা অনেক প্রবীণ। অনেক জায়গায় গিয়েছে তারা খাটতে। নন্দ মুর্মু তো নবম শ্রেণী অবধি পড়েছে। সে বলে, এমন প্রথা আগেও ছিল আর এমন সব কারণেই আমাদের জাতির সিধু কানু যুদ্ধ করেছিল।

-কত আগে?

-ধরো দেড়শ বছর, বা কিছু কম। এর নাম ছিল বেগার প্রথা। -উঠে গেছে?

—নাম বদলেছে, ওঠে নি। ভৈয়া! ঠিকেদাবেব কাছে পুবা হিসাব চাইবে যখন, আমবাও থাকব। চাইলেই হাঙ্গামা হবে, তবু যা পাই।

-শও টাকাব নোটের কথায় ভুলো না। মাটি পিছনে তো নেই, খাদেব কিনাবায পাহাড বনে গেছে।

লক্ষ্মণ ঠিকেদাব সবই জেনেছিল আব পবদিন ও দুশো টাকাব দুটো নোট বেঁধে ওদেব মৌত জাবি কবে দেয়। দুটো নোট দেখে লোকগুলিব জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পেয়ে যায় যেন। খাদেব ভিতবে লোক, মানুষ মাটিব স্তূপে! অতজনেব ঠেলাঠেলিতে মাটিতে ধস্ নেমেছিল।

--ভৈষা! বাঁচাকে, আদমি বাঁচাকে—বিশালেবা আর্তনাদটি হঠাৎ চাপা পড়ে। কত পুরুষ, কতজন পিঠে বাচ্চাবাঁধা মেযে মানুষ, কতজন বালক-বালিকা, কে তাব হিসেব করছে। ঠিকেদার দুর্ঘটনা দেখেই গুরুত্ব বোঝে। ওভাবসিযাব তাকে ঠেলতে থাকে। ভাগ যাইও, চামডা বচাও, পুলিস আযেগি, লেবব ঝামেলা উঠেগি,-ভাগো! এখন যা ঝামেলা হবে, সে ম্যাও সামলানো তোমার সাধ্য নয়।

লক্ষ্মণ সিং ঠিকেদার বোঝে যে ওটা লাখ কথার এক কথা।

-কে তোমাকে বলেছিল নোট দেখাতে?

ভাবলাম, লোভেব চোটে ওবা....

-ভৈয়া' লোভে তো কাব্যে ভালো হয় না। ঠিকেদাবী কামে এমন ভুল আব কোবো না।

কাব্য এসেছিল কাবা মাবা গেল? কোথায় তাদেব ঠিকানা" থাকে না, থাকে না কিছুই হিসেবে। যদিও এমন সব ঠিকেদাবের মজুববা নতুন কামিযোতি প্রথায় ওডিশাব জঙ্গল থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ, পলামুব গ্রাম থেকে ধানবাদ, ট্রাকে ট্রেনে বাসে নিযত চলে আব চলে।

এদেব জন্যে দিল্লিতে উচ্চপর্যায়ে সম্মেলন হয, পাশ হয বহিবাগত শ্রমিক বিষয়ক আইন। সরকারি মজুরি, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও বাসস্থান বাবস্থা, আটঘণ্টা কাজ, এমন সব প্রতিশ্রুতি তাতে থাকে।

কোথাও মাটিতে ধস নামে, কোথাও কয়লাখ্যদানে, কোথাও বাড়ি ভেঙে পড়ে।

হিসেব নেই, ক্ষতিপূরণ নেই, একদিনের হইচইও কপালে জোটে না। আবার ঠিকেদার, আবার কাজের সন্ধান। পেটে খেতে পাব তো বাবু?

বাঁশে নোট বাঁধা রেখে মজুরদের তাতাবার চমকপ্রদ খবর হতে পারত, হয় না।

তবে লক্ষ্মণের খুব বদনাম হয়ে যায়, খুব। ইলাকা ছেড়ে পালাবার কালে ট্রেনে বসে ওর মনে হয, এটা খুবই শান্তির কথা, যে লোকটি বহোত ঝুটঝামেলা পাকাতে পারত সেও মরে গেছে। বিশাল ভূঁইয়া। বিশাল এবং তার তিন সঙ্গীই গেছে।

আব একটা খুব আপশোসের কথা যে, যাকে তাকে হাজির করে, মৃতদের দাবীদার হিসাবে তাদের প্রমাণ করে ওই ওভাবসিযার মৃতদের ক্ষেত্রে কিছু ক্ষতিপূরণ বের করে নেয়, টাকাও মেরে দেয়।

এরকমই নিয়ম, এমনই হয়ে থাকে।

আর এটাও খুব অদ্ভুত যে তাবসরেও সেই ওভারসিহাবই বাকি লেবারের হাতে পিটাই খায়, তাকেও পাওয়া যায় অম্লান অচৈতন্য অবস্থায়।

ওভারসিয়ার শুধুই পিটাই খেল। লক্ষ্মণ থাকলে তাকে তো মেরেই ফেলত।

আর এ কেমন ভাগ্যের কৌতুক যে সে আসবে কেচকি গামে। আসবে লেবারের খোঁজে। এবং দেখতে পারে বিশাল ভূঁইয়ার বিধবাকে।

গোহুমনি। গোহুমনিই বটে! খাওয়া নেই, মাখা নেই, শরীরে তবু ঝিলিক দিচ্ছে। সমগ্র ব্যাপারটি লক্ষ্মণ সিং ঠিকেদারকে যথেষ্ট ধাক্কা দিয়েছে। তারপর তাকে আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হচ্ছে। সেইজন্যেই ভকিলসাবের কাছে আসা।

এটা বড়ই লজ্জার কথা, যে বারে বারে তাকে ভকিলসাবের কাছেই দৌড়াতে হয়। ছোট-ঠিকেদার লাইনে সবাই বলছে এখন, তুমি শান্তিস্বত্যেন করাও। কাল যে লাফাঙ্গা লাকড়া ছেলে সিনেমার টিকিট বেলাক করত এবং মা-মাসি থেকে ছোকরি যে কোনো মেয়ে দেখলেই "জিসকি বিবি মোটি" গাইত, ছোট ঠিকেদারী পেযে আজই সে কত উন্নতি করে ফেলেছে। তুমি তো সুযোগ কম পাচ্ছ না। তোমার কিচ্ছু হচ্ছে না কেন?

বস্তুত, তুমি একটা ক্ষতি করছ দেশের। ঠিকেদাবরা দেশ গড়ছে, ঠিকেদারী এখন ভারতের যুবসমাজের কাছে সব চেয়ে লোভনীয় পেশা। তোমাকে দেখলে তো লাফাঙ্গা লাকডাদের বুক দমে যাবে। তারা আর আসবে না ঠিকেদারী লাইনে।

তা, কেঁচে গণ্ডুষ করতে হলে নতুন ইলাকা সব চেয়ে ভালো। এসব কারণেই কেচকি চলে আসা। কিন্তু সেখানে বিশালের ঘর কে জানত?

এখন ইটভাটা বলো, কোনো নির্মাণ প্রকল্প বলো, বড় বড় কারখানা বলো সবইতো ঠিকাদারের লেবার। কত হিসেব রাখতে পারো তোমরা, কে কোথা থেকে আসে। যত গরিবের জন্যে দীপান্বিতার বিজ্ঞাপন, তত গরিবের নাভিশ্বাস। ততই হতাশ ও মরিয়া গরিব কাজের খোঁজে ছড়িয়ে পড়ছে।

না, এখানে কেউ ঘটনাটির কথা জানে না।

লক্ষ্মণ এমন তীব্র আবেগে বিশালের কথা ভাবতে থাকে বলেই আজ রাতে মৃতের জগৎ থেকে অবয়ব নিয়ে উঠে আসে বিশাল ভূঁইয়া।

বারবারই সে আসতে চাইছে, আসছে। কিন্তু এখনো সামনে আসছে না। মৃত ও জীবিতের জগতের মধ্যেকার সীমারেখা বড়ো দুর্ভেদ্য।

বিশাল ভূঁইয়া মৃতলোক থেকে ফিরে আসতে পারত কি না কে জানে! কিন্তু ঝালো তো তাকে কামনা করত, সবসময়ে কামনা করত। সাতবান চাইত সে ফিরে আসুক, মোরি চাইত সে ফিরে আসুক।

সকলের মিলিত আবেগের তীব্রতা বিশালকে ডাকতে থাকে। বিশাল সে ডাক শুনতে পায়। মৃত যদি জীবিতের কাছে আসতে চায়, তাহলে সে অন্ধকারই খুঁজবে। অন্ধকারের মতো বন্ধুকে আছে?

লাম টোলিব জগতে শুরু হয নড়াচাড়া। লক্ষ্মণ সিং ঠিকেদারের কথায় কাজ হয়। নওনেহাল, ভানুপ্রতাপ, গজানন, রামপরতাব এমন সব মালিকদের সঙ্গে বসে সমুন্দর সিং।

-আমরা কাক্ত দিতে পাবছিনা সব-সময়ে। আকাশ জল না দিলে চাষ নেই, কাজও নেই।

-হ্যাঁ, সস্ব জায়গাতে একই হাল।

-সিঁচাই চাই, সিচাই।

-এমন সিঁচাই, যাতে সম্বৎসর জল পাই।

---জল পেলে তিনটে চাষ হবে।

কামিয়ারা তো কাঠ কাটতে, পাথর ভাঙতে, বালিব সিকেদারের হয়ে বালি উঠাতে যাচ্ছেই।

-হাঁ হাঁ, যাচ্ছে!

রামপরতাব যে কোনো কথাই খুব রেগে বলে। সে কেঁঝে উঠল, আর এদিক-ওদিক থেকে পাঁচ রকম বুদ্ধি নিয়ে আসছে। মাথা গরম করছে।

গজানন ঠাণ্ডা মাথার লোক। সে বলল, আজকাল তো আমার নাগর। মোটে ছিঁড়ে না। বেটাদের পিটাতাম, সেসব তো এখন বন্ধ। ডানুপ্রতাপ মুখিয়া এবং সময়ের তালে তাল দিয়ে চলতে জানে। সে বলল, এটা ভালো যে আমরা পিটাই না। পিটাই মারাই যারা অতিরিক্ত করেছে, তাদের কারণেই কাগজপত্রে খবর বেরিয়ে পলামুর নামে কলঙ্ক উঠেছে।

সমুন্দর বলে, আমাদের মাঝে একতাও নেই, ঔর কামিয়ারা তার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। পাঁচ জায়গায় খাটতে গেলে বাইরের লোকজনের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পায়, বেকার বদবুদ্ধি মাথায় ঢোকে। এ ঠিকেদার সকলকে একই জায়গায় বাখবে, শাসনে থাকবে...দুই-তিন মাস...

-যারা যারা যেতে চায়, যাক।

-- আরো কথা ছিল।

--বলুন না।

-এমন হতে পারে, যে ফরেস্ থেকে ওই মামলাধীন ভূমি নিয়ে নিল।

নিয়ে নিল?

-- হতে পারে। জবিপে যদি দেখা যায় যে ওটা সরকাবেরই ছিল, তাহলে নেরে।

--এ আপনার কোনো কৌশল।

ভৈয়া! এ প্রসঙ্গে আমি কোনো কথা বলব না। আপনাবা যে যেমনভাবে পারবেন, খবর নিবেন।

-- আপনার কাছে কোনো খবর আছে?

--শুনছি যে এমন হতে পারে।

-- হলে কী হবে?

--ক্ষতিপূরণ পাব!

--সরকার জমি নিলে তো ক্ষতিপূরণ পাবারই কথা। কিন্তু এমন

মামলা ও জমিতে যে, দেবে কাকে?

---মালিককে।

-এখানে কে মালিক? এটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। যত দাবীদার সবাই নিজকে নিজকে দাবীদার বললে কিছুই হবে না।

-তবে কী করা যাবে?

-নিজেরা ভাবুন, খবরতালাশ নিন। এক হতে পারে যে সবাই মামলা উঠাব, একসাথে ক্ষতিপূরণ বেটে নিব। কিন্তু রোহিত বর্মা যদি ল্যান্ডরেভিনিউ কমিশনে আসে, তাহলেই মুশকিল।

-কেন?

পুরানো কাগজ ঘাঁটলে দেখা যাবে ও জমি আদিবাসীদের। আর কোন আদিবাসীদের?

সবাই এ সংবাদে সবিশেষ চমকিত হয। রোহিত বর্মা অত্যন্ত সৎ, অত্যন্ত কড়া ও পাকা অফিসার। সে যে কোনো সময়ে দেড়শো বছরের পুবানো দলিল বের করতে পারে। আদিতে ওই জমি আদিবাসীব থাকলে পববর্তী সকল হস্তান্তরই আইনের চোখে বেআইনি। খুবই সুখের কথা যে, আইনের একদা পবিত্র চোখে দীর্ঘকাল ছানি পড়েছে, গ্লুকোমা হয়েছে।

-আদিবাসীর...কোন্ আদিবাসীর, সবপঞ্চজি?

-পারহাইয়া ও নাগেসিযাদের। কেচকি খণ্ডই তাদের। আমরা তো কোনো কোনো জমির খাজনা এখনো মোরির বাপের নামে দিই। আর যে নাগেসিয়ারা পাহাডের ঢালে থাকছে পাহাডিয়া ইঁদুবের মতন, ওরা ওই জমির মালিক।

-তবে তো জল বহুত ঘোলা।

-আমরা একতাবদ্ধ হয়ে থাকলে ঠিক বেরিয়ে যাব, লেকিন সবই সকলে ভাবুন।

সকলেই বোঝে যে এসব গোপন রহস্য প্রকাশ করে সরপঞ্চ হাতে পেল তুরুপের তাস। গজানন বলে, হাঁ হাঁ কাজ করতে যাক। আপনি ওই গোহুমনিকে পাঠান। ও থাকলে পরে গ্রামে ঘরে ইজ্জত রাখা বাহোত্ হি মুশকিল।

সমুন্দর বলে, তা কি জানি না? মাগী এমন সতীপনা দেখাচ্ছে যেন ও জলন্কী মৈয়া। কোনো ছোঁড়াটোড়া যদি ফুসলেও ওকে বের করে নিত তো বাঁচতাম।

ভানুপ্রতাপ বলে, কোনো মতে টাউনে নিতে পারলে তো ভালো দামে বিকে যাবে।

নওনেহাল মুচকে হেসে বলে, ঠিকেদারজি ইচ্ছে করলেই পারেন। আপনার তো সেব্য ধরম করতে একটা লোক দরকার হবে। গ্রামে এসে ঠিকদার কি উপবাসী থাকবে?

লক্ষ্মণ সিং বলে, তোবা তোবা! ও সব কথা বলবেন না। তবে কাজের কথা বলব। আর কাজের কথা পাকা হলে মেয়েদের জন্যে শাড়ি ছেলেদের জন্যে ধুতি দেব। তাতেও অনেক কাজ হয়।

--ও গোহুমনি! সাবধানে যাবেন কাছে।

-কাটতে পারে, এমন কাছে যাব না।।

এভাবেই কেচকি ও লাঠা টোলিতে অবস্থা বদলাতে থাকে। যারা এই সমগ্র ভূখণ্ডের মালিক, সেই নাগেসিয়া ও পারহাইয়াবা রাজী হয়ে যায় লক্ষ্মণের সঙ্গে যেতে। মোরি বলে, বাসনি! তুই যা। আমি থাকি, বাচ্চাদের দেখব এখন।

কামিয়ারা বেশ কিছু লোক রাজী হয়। ঘরে তো উপোস। সেখানে কেমন কাজ হয় দেখে আসি।

রাজী হয় না সাতবান, রাজী হয় না গোহুমনি।

লক্ষ্মণ সিং তার কথা রাখে। যারা যাবে, প্রত্যেককে দেয় নতুন ধুতি, নতুন কাপড়, পরিবার খরচার জন্যে দশ টাকা। দামগুলি লিখে রাখে নামের পাশে। একদিন এগুলি পাওনা থেকে কাটান যাবে। আজ দেওয়া হয় নিঃশর্ত দান হিসেবে। গোহুমনির জন্যে একটি হলদে কাপড় নিয়ে ও গোহুমনির ঘরে যায়। আস্তে আস্তে বলে, কথা ছিল।

-কী কথা?

-কি করে শুরু করি...

-লাজ লাগছে?

--সত্যিকারের গোহুমনির মতো করিস না তো? কাজ করতে যাবি না কেন?

-আমার ইচ্ছে।

ঘরে পড়ে শুকাবি?

কপালে থাকলে তাই হবে।

-আমাকে দেখাশুনা করার কাজ করবি?

--কী করতে হবে?

আমি তো ঠিকাদারিতে ব্যস্ত থাকব সারাদিন। এই রেঁধে দিল..একটু দেখলি...

গোহুমনি চোখ কুঁচকে কি ভাবে।

-তোকে টাউন দেখাব, টাউন।

-টাউন..দেখি, ভেবে দেখি।

-এই কাপড়টা...

-না বাবু! পনেরো টাকার কাপড়, হাত নেই, বহর নেই, এ তো আমরা হাটেই কিনি।

---ভালো কাপড় নিবি, ভালো কাপড়?

-তুমি দেবে?

---নিশ্চয়!

গোহুমনি হাসতে শুরু করে। বলে, যাও বাবু। এখন ছেলেদের জ্যেঠা আসবে।

-আমি ভালো কাপড় আনব, তোকে নিয়ে যাব এখান থেকে। 

-কেন?

-তোকে দেখে...

বুঝেছি, এখন যাও।

পবে সব কথা শুনে সাতবান বলে, এটা ঠিক হয়নি। ও হযতো আবাব আসবে।

--আসুক। এবাব এলে ওব গলাটা কেটে ছেলেমেয়ে নিয়ে পালাব।

-পালাবি কোথায, লাঠা ছেডে

-পালাব না।

- না। আব এখন আমবা দুবলা হয়ে গেলাম। কত লোক চলে যাচ্ছে। মালিকেবা না খচড়াই কবে।

- কামিয়া থেকে ভিখাবিও স্বাধীন।

-হাঁ, তাই তো।

এখন মালিকবাই বলছে, যাও। বাইবে কাজ কবো। কেন না তাবা কাজ দিতে পাবছে না। না কাজ, না লুকমা, যাও তোমবা ঠিকেদাবের সঙ্গে। আব তোমার ভাইবা কাজ নিয়ে চলে গেল বলে কত দোষ হল।

তোব জন্যে ডব লাগছে এখন।

-কেন'

এমন একপাশে ঘব' আমি তো বিশাল নই। সোনা আব দানিব জন্যে জীবনটা দিতে পাবি। তাতে কি তোদেব জীবনটা বাঁচবে।

ওবা গ্রাম ছেডে চলে যাক। তখন মোবি, বাসনিব ছেলেমেযে তুমি, সব এখান থেকো।

--তাই থাকতে হবে। ঠিকাদাবটা এলে?

-আমি ঠেকাব।

সাতবান চলে যায়। মাচানের নিচে ছাগল। মাচানে সোনা ও দানিব পাশে গোহুমনি। প্রত্যেহেব মতে আজও সে প্রার্থনা কবে, মৃতলোক থেকে ফিবে আসুক বিশাল।

সবাই বলেছে যে, বিশাল মৃত। কেউ বলেনি যে বিশালেব মৃতদেহ দেখেছে। গ্রামেব শম্ভু বাওত ছিল সেখানে। সে বলে, সবই দলিত ও পিষ্ট দেহ। তবে লম্বা চওড়া জনই বিশাল।

সে বিশ্বাস কর্বোন, সাতবান বিশ্বাস কবেনি। তবু ধবে নেয়া গেল যে সে মৃত।

এমন কাতব হয়ে এসো। এসো। বললে তো মৃত লোক দেখা দেখ। গোহুমনি তাই কাতব ব্যাকুলতায় বিশালকে ডাকে আব ডাকে। তাবল্পব কাদে, তাবপব ঘুমায়।

আাব বিশাল আসে।

মৃত বাত্তি আসতে পাবে গন্ধকাবে। সে অন্ধকাবে আসে। দিনে লুকিয়ে থাকা, অন্ধকাবে পথ চলা। খেয়ে না খেয়ে পথ চলা। চলতে চলতে আজ ভোবেই পৌঁছে গিয়েছিল এই জমিতে। কাশেব ঝোম্পে মধ্যে পডে থেকেছে মডাব মতন। জল-পিপাসায় ভাঙ্গা ভাঙ্গা হয়েছে। সন্ধে হতে তবে দহে নেমে দুর্গন্ধ থকথকে জল খেয়েছিল খানিক। সত্ত্ব ওব কাছে আছে। কিন্তু সন্তু খেলে তো জল চাই। ঘবের কাছে এসে এভাবে আটকে থাকা বড্ড কষ্ট।

বাত হল। আকাশে তাবাগুলো খুবছে। বিশাল পোঁটলাটি বগলদাবা কবে নিচু হযে এগোয়। কাছে আসছে ঘব, কাছে আসছে।

- সোনাকে মৈয়া।

গোহুমনি চোখ খোলে না। একেবাবে সাড়া দিতে নেই। যদি অন্য কেউ হয"

-এ সোনাকে মৈষা। এই ঝালো, কী খচড়াই করছিস" আমি... আমি- তুমি।

-নয় তো কে রে গাধী? বুড়ি বকরি, খচড়ি কাঁহিকা? গাধী! খচড়ি! বুড়ি বকরি! কত চেনা-চেনা শব্দ, কত চেনা গলা। হেসে কেঁদে অস্থির হয়ে ঝালো দরজা খোলে ও বিশালের গলা ধরে ঝুলে পড়ে, তুমি...। তুমিই তো! তুমিই তো!

---পানি দে পহিলে! পিয়াসে ছাতি ফেটে গেল।

এক ঘড়া জলই বিশাল খেয়ে নেয়। তারপর ঝালোকে বলে, বাইরে চল্ বাচ্চারা উঠে যাবে।

-উঠুক!

-না না, বাইরে চল্।

ঝালো হারিকেন নেয়। দুজনে হাত ধরাধরি করে দৌড়ায়। বড় বড় কাশঝোপ, কাঁকড়, পাথর জমি, বিশাল কালোকে জড়িয়ে ধরে।

-তুই ভেবেছিলি, আমি মরে গেছি?

-ইস্! কক্ষনো বিশ্বাস করি নি। সোনার জোঠা করে নি, মোরি করে নি।

-হাতের সোহাগ-চুড়ি তো ভেঙেছিস।

---খবরটা এল..পাঁচজনে ভেঙে দিল.. চুড়ি ভাঙলে কী হবে? চুড়ি তো পরা যাবে আবার।

-তা যাবে।

---কী হয়েছিল?

--আরে! মাটি চাপা পড়ে তো আমি মরি নি। কেমন করে

বেঁচেছিলাম তাও জানি না। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিল এগারো দিন পরে। তখন আর সেই জায়গায় ঢুকতে পারি নি। একে তো রটিয়ে দিয়েছে যে বিশাল ভূঁইয়া মরে গেছে। -শম্ভু রাওত বলল। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি নি। কেন কি শম্ভু রাওত বলল, ও তুমিই। লেকিন মুর্দার মাথায় চুল বহোত কম।

--তাহলে সেই সাঁওতাল হবে।

-সোনাব জ্যেঠা আব আমি। আমাদের মনে খুব শান্তি হযে গেল। তোমার মাথাভবা চুল ঘন কত। কিন্তু তাবপবে তিন বছব কেনো পাত্তা নেই, তাতেই...

-ভাবলি যে এবাব মবেছে, তবে সাঙ্গা কবি।

-ও! দশটা সাঙ্গা করতে পাবতাম।

---কবলি না কেন?

- ভূমি এসে ঢিপাবে না?

- আবে, আমি তো সে কাজেব জাযগায় ঢুকতেই পাবছি না। পুলিশে পুলিশে ঘেবাও। আমি কাছাকাছি লুকিয়ে থাকছি যে, সিঁবেদাককে মাবব, আর ওভাবসিযাবকে। তা ঠিকেদার তো ভেগে গেছে। ওভাবসিযাব বেটা কোম্পানি থেকে মোটা ক্ষতিপূরণ আদায় করতে লোগছে।

তোমার নামেও)

সবাব নামে। ধবলাম তাকে। টাকা দাও, নয় তো জানে মেরে দেব। সে চেচাতে লেগে গেল। দিলাম মাশয় বড় বসিয়ে। বাস। মরে গেল বলে মালুম হ। এখন বুব লামকে ধরতে পারলে কোম্পানি তো আমাকে ফার্সিতে ঝুলাকে, বাস ভেগাসলাম।

পালিয়ে বেড়াচ্ছিলে

হা বে। গেথা টাস্তান'ব, কোথা কলকাতা, কোথা পাটনা', কাজ পাচ্ছি তো চলে যাচ্ছি। তাবপব সাতদিন আগে নাচিতে ওহি ওভাবস্যিাবকে দেখলাম। এই কোগা, লাঠি ধবে যাচ্ছে। ও আমাকে দেখেনি। কিন্তু একে তাকে পুছতাছ কবে জানলাম ওই হচ্ছে তববিশাল ওভাবসিযাব। দেখ কাণ্ড' ও মরে নি। আব আমি যেন ভূতের ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে..

এতদিন লাগল আসতে ?

এখানকার হালচাল জানি না। ওই ওভারসিয়ার আব ঠিকেদার এখানে কোনো ঝামেলা করেছে কিনা জানি না। তাতেই সাবধানে সাবধানে..

-যাক্! তুমি তো এসে গেছ।

-হ্যাঁ, ঘবে চল্।

চলো।

দাদাব ঘবে যাই। ছেলেরা দেখলে সকালে হাললা তুলবে।

- যাবে। তাই চলো!।

--সেও তো বহোত ভাবছে, তাই না?

বহোত্। ঠিকেদার।

-চল্, পবে শুনব।

সাতবানের ঘবে চলে যায় ওবা। সাতবানে বলে, সত্ত্ব খুা, ঘুমা। কাল কথা হবে।

মালিক সেই শও টাকার দাম উঠাবে।

-- কিসের শও টাকা কালই বলে দিচ্ছি। না কেউ সিকেদারের সঙ্গে নাব, না কামিযৌতি পাটর আব। এখন তুই এসেছিস বুকে সাহস বেডে গেছে আমার, জানলি বিশাল কামিযৌতি খতম করবে"

কোথাও কোথাও করেছে। হোত চেষ্টায় করেছে। আামবাই বা পাবব না কেন"

এখন তো খুব তাকাল।

আমবা কবে খাই '

হ্যাঁ, যা করতে হবে, তা ভাঙাতাডি..

--মাধো সিংয়ের কাছে যাই আগে।

- তাড়াহুড়ো কবে লাভ নেই দাদা। এখন আমি এসে গেছি, এবাবে সব করে ফেলল্প। -হ্যাঁ, মালিকরা আছে...

-খবর নিয়েছি টাউনে। সকলের টিপ দিয়ে দরখাস্ত একটা সদরে।

-অনেক, অনেক কাজ...

বিশাল ঘুমিয়ে পড়ে। কয়েক ঘণ্টা আগেও সে ছিল মৃত, এখন সে জীবিত। সাতবান ও ঝালো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। সবাই বলাবলি করত, সাতবান ও ঝালো কেন, ঘর বেঁধে নেয় না। এমনটা তো অস্বাভাবিক নয়। একা সাতবান ও ঝালো জানত যে তা হয় না, হতে পারে না। কেননা ওরা কখনো মানে নি যে বিশাল মরে গেছে।

--ঘব যাক্ সোনার মৈযা, ঘর যাক।

দোবে আগড় দিক সোনার জোঠা, আগড় দিক।

--সোনা যেন আমার থালাটা নিয়ে আসে।

না। এখন থেকে ও ঘরেই খাওয়া দাওয়া হবে।

সাতবান বিডি ধবায়। ঝালো বেরিয়ে আসে। এ ভাবেই একটি নিরুচ্চার, ভাবি প্রগাঢ় হৃদয সম্পর্কের অবসান ঘটে। সাতবান এতদিন বড় যত্নে, বড় স্নেহে খালোদের আগলে রেখেছিল।

পরদিন বেলা হতে থাকে, নতুন বঙরুট কুলি রেজারা তখনো আসে না। সবাই নতুন কাপড় পরেছে। তারপর কেন গেছে গোহুমনিদের বাড়ি, কে জানে!

ওই টাকা, আগামের টাকা দিয়ে চাল নুন তেল মশলা কিনেছে। মোবি পারহাইয়া একটি শুওর বেঁধে টেনে নিয়ে গেল। ঢোলই বা বাজছে কেন? সমুন্দর হতাশ ক্রোধে বলে, পোকামাকড়ত। ওখানে বোধহয় সাতবান আর গোমনির সাঙ্গা লাগিয়ে দিল। চলুন তো দেখা যাক! এদের ভালো করবে কে? লাখ আর পয়জারেই ভালো থাকে ওরা।

ঢোলক বাজাচ্ছে, গান হচ্ছে, সবই দূর থেকে শোনা যায়। নওনেহাল, ভানুপ্রতাপ, সমুন্দর, লক্ষ্মণ সবাই এগোয়। ভানুপ্রতাপ বলে, কাজে চলে যাবে তাই খানাপিনা করে নিচ্ছে। এরা তো যা পায় তাই উড়ায়, তাতেই দুহু ঘুচে না।

গোহুমনির উঠোনে আনন্দ, মহা আনন্দ। গোহুমনির হাতে চুড়ি, দু কপালে সিঁদুর। মোরি বুড়ো শরীর বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে সাতবানের সঙ্গে নাচছে। বেশ কিছু বোতল চলেছে ও চলছে। সমুন্দর মাথা নাড়ে। সাতবান আর গোহুমনি। সেই সাঙ্গাই করলি। মাঝে তিন বছর সতীত্ব দেখালি।

তারপরই ওরা চমকে, থমকে দাঁড়াল। ঢোলক গলায় প্রমত্তচরণে প্রসন্ন হেসে এগিয়ে আসে বিশাল ভূঁইয়া।

-বিশাল, তুই!

বিশাল এখন ভীষণ মাতাল।

-হাঁ মালিক। সেই শও রুপেয়ার কোনো হিসাব দিব না। আমার কামিয়ৌতি খতম।

এবার সে লোমশ, লম্বা হাতটি বাড়ায়। আইও, আইও বাবা লছমন সিং ঠিকেদার। খোড়া হিসাব তোমার সঙ্গে তো আছে। সতেরোটা জান লছমনবাবু?

লক্ষ্মণ সিং ঠিকেদার বোঝে, তার নিয়তি তাকে ধরে ফেলেছে। সে সমুন্দরের দিকে চায়। লাঠা টোলির লোকেবা মালিকদের, লক্ষ্মণকে ঘিরে ঘন হয়ে চেপে আসে। সকলকে জ্যান্ত গোহুমন মনে হয়। নিঃশ্বাসে মৃত্যু।

4
Articles
রুদালী
0.0
মহাশ্বেতা দেবীর "রুদালি" একটি মর্মস্পর্শী ছোট গল্প যা গ্রামীণ ভারতের প্রান্তিক সম্প্রদায়ের একজন মহিলা সানিচারীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। সানিচারী, একজন দরিদ্র মহিলা, তার জীবনের কষ্টগুলি মোকাবেলা করার জন্য একজন পেশাদার শোক বা রুদালি হয়ে ওঠে। তিনি রুদালিদের একটি দলে যোগদান করেন যারা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শোক প্রকাশ করতে এবং মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশ করার জন্য ভাড়া করা হয়। সানিচারীর জীবন দারিদ্র্য, ক্ষতি এবং সামাজিক নিপীড়নের দ্বারা চিহ্নিত। আখ্যানটি শোষণ ও বৈষম্যের মুখোমুখি হওয়া নিম্নবর্ণের মহিলার সংগ্রামের বর্ণনা দেয়। রুদালিরা ভারতের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক সংগ্রামকে মূর্ত করে। শনিচারীর আবেগ শোকের মুখোশের নীচে চাপা পড়ে, ব্যক্তি পরিচয়ের দমনকে প্রতিফলিত করে। গল্পটি সামাজিক অবিচার, লিঙ্গ ভূমিকা এবং দারিদ্র্যের অমানবিক প্রভাবের থিমগুলি অন্বেষণ করে। উচ্চ বর্ণের ব্যক্তিদের সাথে সানিচারীর মিথস্ক্রিয়া ভারতীয় সমাজে প্রচলিত গভীর-মূল কুসংস্কারগুলিকে তুলে ধরে। বর্ণনাটি দারিদ্র্য এবং শোষণের চক্রকে স্থায়ী করে এমন পদ্ধতিগত সমস্যাগুলির সমালোচনা হিসাবে কাজ করে। "রুদালি" হল প্রতিকূলতার মুখে মানুষের স্থিতিস্থাপকতার একটি শক্তিশালী অন্বেষণ এবং ভারতীয় সমাজে বর্ণ, শ্রেণী এবং লিঙ্গের জটিল ইন্টারপ্লে।
1

ভূমিকা

9 December 2023
0
0
0

এই বইয়ে সংকলিত গল্পগুলি অনেক আগে লেখা। "নৈখতে মেঘ" বইয়ে "রুন্দালি", "দৌলতি" বইয়ে "গোহুমনি" আছে। "টুংকুড়" আমার অনেক গল্পের মত আজও কোন সংকলনে প্রকাশিত হয়নি। নিজের লেখার বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগী থাকতে পারি ন

2

রুদালী

11 December 2023
1
0
0

টাহাড গ্রামটিতে গঞ্জ ও দুসাদবা সংখ্যাগুরু। শনিচরী জাতে গঞ্জ। গ্রামের আব সকলের মত শনিচরীর জীবনও কেটেছে অসুমার দারিদ্র্যে। শনিবারে জন্মেছিল বলে ওর কপালে এত দুঃখ, একথা এতদিন ওব শাশুড়ি বলত। যতদিন বলত, তখন

3

টুং-কুড়

13 December 2023
1
0
0

ধানকাটা হয়ে গেছে। "ক্ষেতে মাঠে পড়ে আছে খড়” এখন কবিতার লাইনমাত্র। কেন না মণ্ডল ধানের ভাগের সঙ্গে খড়ের ভাগও নেয়। সবই নেয় সে। এদিক ওদিক পড়ে থাকা ধানের শিষ শুধু আলতাদাসী নেয়। আজও নিল। আলতাদাসী ধানের শিষ

4

গোহুমনি

13 December 2023
1
0
0

গোহুমন হল গোখরো সাপ। তা বিশাস ভূঁইয়ার বিধবাঁকে সবাই গোহুমনি বলে। নাম একটা ওর ছিল, ঝালো। তা কতকাল ধরেই তো ওর নাম ছিল সোনা দাসীর মা। ছেলে আর মেয়ে হলে কে আর কাকে “ঝালো" বলবে তাই বলো? বলাটা ঠিকও নয়। কেচকি

---