মাস আগের এক বিকেলে মন নরম হয়েছিল কামাল হোসেনের। ভাগনে মতিনের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, 'আমি তোমাকে একশোবার বলেছি আমার এমনিতেই লোক বেশি, চাকরি দিতে পারব না। এই কথাটা কানে ঢোকে না কেন?'
মতিন মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল, 'আপনি ছাড়া ঢাকায় আর কোনও আত্মীয় নেই মামা। মা বলল, আর একবার যা, যদি কিছু হয়।'
'কী হবে? তোমার বিদ্যে তো পাস গ্র্যাজুয়েট। রাস্তায় ঢিল মারলে একটা না একটা পাস গ্র্যাজুয়েটের গায়ে লাগবে।' সিগারেটে লম্বা টান দিয়েছিলেন কামাল হোসেন। তারপর বলেছিলেন, 'আফটার অল তুমি আমার বোনের ছেলে। তোমার বাবা আসলে আমি দ্যাখাই করতাম না। একটা লোক এম.এ. পরীক্ষায় ফার্স্টক্লাস পেয়ে গ্রামে গিয়ে স্কুল মাস্টারি করে আমার বোনের লাইফ নষ্ট করে দিয়েছে। ননসেন্স। কাল সকাল দশটায় বাংলা বাজারে আমার দোকানে এসো। দেখি কী করা যায়।'
'সকাল দশটা!' গলা শুকিয়ে গেল মতিনের।
'তখন ঘুম ভাঙে না নাকি।' খিঁচিয়ে উঠলেন কামাল হোসেন।
'আজ্ঞে, আড়িচা ঘাট খোলে সাতটার সময়, নদী পার হয়ে বাস ধরে আসতে দুই-আড়াই
ঘণ্টা লেগে যায়?' মতিন জানাল।
'তুমি আমার কাছে দেশ থেকে আসা যাওয়া কর নাকি।'
'আজ্ঞে, হ্যাঁ।'
টাকা পাও কোথায়? টিকিটের দাম তো অনেক।'
'আজ্ঞে আমার এক বন্ধু বাসের কনডাক্টর। টাকা নেয় না।'
'ঠিক আছে, এখনই বাংলাবাজারে চলে যাও, আমার দোকানে। ওখানে একটা ঘরে তক্তাপোষ আছে, ঘুমাতে পারবে। মা-বাবাকে ফোন করে দিও।'
কামাল হোসেনের বাড়ি বনানীতে। তাঁর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখতে চাননি মতিনের বাবা। তার মতে কামাল অসৎ লোক। প্রকাশনার ব্যবসাটা ভালো চলে বটে আসল রোজগার গার্মেন্ট ব্যবসায়। ওই ব্যবসা সে সততার সঙ্গে করে না। কিন্তু মতিনের মা ভাই-এর কোনও দোষ দেখতে পান না। স্বামীর ভয়ে দীর্ঘদিন ভাই এর সঙ্গে দ্যাখা করতে না পারলেও খবরাখবর রাখেন। তাই বেকার ছেলে যখন হতাশায় ভুগছে তখন স্বামীকে লুকিয়ে ভাই-এর কাছে পাঠিয়েছেন বারংবার। বনানী থেকে বাংলাবাজারে কতক্ষণে পৌঁছোনো যাবে তা কেউ চট করে বলতে পারবে না। এমনিতে ঢাকার রাস্তায় সকাল আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত গাড়ির গতি দশ কিলোমিটারের ওপর ওঠে না। তার ওপর রিকশার দঙ্গল বেড়ে যায় নতুন ঢাকা থেকে পুরোনো ঢাকার রাস্তায় পড়লে। মতিন তার কনডাক্টর বন্ধুর কাছে জেনে এসেছিল তার বাস ছাড়বে সন্ধে ছ'টায়। এখনও গিয়ে সেই বাসে ওঠা যায়। কিন্তু মামা যখন থাকতে বলেছেন তখন একটু আশার আলো দেখতে পাচ্ছে সে। বাস বদলে বদলে সে যখন বাংলাবাজারে পৌঁছোল তখন রাত একটা বাজে। পকেটে তখন মাত্র দশ টাকা পড়ে আছে।
ঢাকার বই ব্যবসার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হল বাংলাবাজার। এখন অবশ্য নিউমার্কেটে বই-এর কিছু দোকান হয়েছে কিন্তু বাংলাবাজার থেকেই গোটা দেশের জেলায় জেলায় বই যায়। যাওয়া- আসার অসুবিধা বলে বেশিরভাগ প্রকাশক ছ'টা বাজলেই দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যান। ঠিকানা খুঁজে খুঁজে 'বিদ্যাসাগর' লেখা সাইনবোর্ড দেখতে পেয়ে পা চালাল মতিন। দোকানের ঝাঁপ পড়ে গেছে কিন্তু ভেতরে আলো জ্বলছে। পাশের একটা দরজা খোলা বলে বোঝা যাচ্ছে।
সে সেই দরজার সামনে পৌঁছে দেখল দুজন লোক বই প্যাক করছে। একজন প্রৌঢ় তার দিকে তাকিয়ে বলল, 'দোকান বন্ধ, কাল আসবেন।'
'আমার মামা এখানে আসতে বলেছেন।'
এবার প্রৌঢ় সোজা হয়ে দাঁড়ান, 'আরে মিএল, কামালভাই পাঁচ ঘন্টা আগে ফোনে বললেন আপনার কথা। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? আর পাঁচ মিনিট পর এলে তো আমাদের পেতেন না।
আসুন, ভেতরে আসুন। মতিন সবিনয়ে বলল, 'আমাকে আপনি করে বলবেন না।'
'হ। কামালভাই কি নিজের মামা? মনে হয় না।' জবাবটা দিয়ে দিল প্রৌঢ়।
কী বলবে মতিন, একটু হাসল।
' পকেটে পয়সা নিশ্চয়ই আছে?'
'হ্যাঁ, দশটা টাকা।'
'বুঝলাম। ওই চেয়ারে বসো।' প্রৌঢ় একটা ড্রয়ার থেকে কিছু টাকা বের করে দ্বিতীয় লোকটিকে দিয়ে বলল, 'বেবি বোর্ডিং 'থেকে একজনের ভাত মাছ নিয়ে আয়, এখন যদি মাছ না পাওয়া যায় ডালের সঙ্গে যত ভর্তা পাবি নিয়ে নিবি। দ্বিতীয় লোকটি বেরিয়ে গেলে প্রৌঢ় বলল, 'এদিকে এসো।'
তিনটে ঘরে প্রচুর বই। তারপরে একট! ছোট্ট ঘর তক্তাপোষের ওপর বিছানা পাতা রয়েছে, ওপাশে বাথরুম।
প্রৌঢ় বলল, 'যাও, হাতমুখ ধুয়ে নাও। ভাত খেয়ে এখানেই খালা রেখে দেবে। ওই বোতলে পানি আছে, ভালো পানি। আমরা বাইরে থেকে তালা মেরে যাব, খুলব সাড়ে ন'টায়। চুপচাপ ঘুমিয়ে থেকো আর সাড়ে ন'টার মধ্যে রেডি হয়ে নেবে। তোমার মামা যেন ঘুমোতে না দ্যাখে।' বাটিতে ভাত-ডাল আর আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, ঢ্যাড়শ ভর্তা নিয়ে এল লোকটা। ৩রা বাইরের আলো নিভিয়ে দরজায় তালা দিয়ে চলে গেলে গোগ্রাসে খেয়ে নিল মতিন। মুখহাত ধুয়ে জল খাওয়ার পর মনে পড়ল মা'র কথা। তার এখানে থেকে যাওয়ার কথা নয়। এতক্ষণে নিশ্চয়ই খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছে মা।
এখানে ঢোকার সময় প্রথম ঘরে সে টেলিফোন দেখেছিল। কিন্তু অন্ধকারে সে কী করে নাম্বার ডায়াল করবে? অতএব আলো জ্বালতেই হল। তাড়াতাড়িতে প্রথমবার রং নাম্বার হল। দ্বিতীয়বারে বাবার গলা পেয়ে সে বলল, সে আজ ঢাকায় কাজে আটকে গেছে।
ঠিক দশটার সময় কামাল হোসেন এলেন। এই অফিসে তাঁর ঘর আলাদা। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। এসেই ডেকে পাঠালেন মতিনকে। আপাদমস্তক দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, 'নাস্তা করেছ?'
'জি না।'
'একদিন নাস্তা না করলে কেউ মরে যায় না।'
ক্ষিদে পেলেও চুপ করে থাকল মতিন।
জি, না।' '
'তোমার নিশ্চয়ই পাসপোর্ট নেই?' তাকালেন কামাল হোসেন।
'আঃ, জি জি কোরো না তো। মোস্ট ইরিটেটিং। শোনো, আমি তোমাকে এখানে চাকরি দিতে পারব না। কিন্তু একটা সাহায্য করতে পারি। মাস দুয়েক পরে নিউইয়র্কে একটা মেলা হবে যেখানে আমরা অংশগ্রহণ করব। গার্মেন্ট ফেয়ার। তিনজন কর্মচারীকে পাঠাচ্ছি স্টলে থেকে বিক্রি করার জন্যে। তুমি যদি চাও তো তাদের একজন হতে পারো। যাতায়াতের ভাড়া হাড়া, থাকা- খাওয়ার খরচ আমি দেব। তবে তার জন্যে তোমাকে পাসপোর্ট বের করতে হবে। পাসপোর্ট পেলে ভিসার জন্য আবেদন করবে। আমেরিকার ভিসা পাওয়া খুব শক্ত ব্যাপার, কাকি দুজন আগে গিয়েছে বলে ওদের অসুবিধে হবে না। মেলা চলবে পাঁচদিন। তারপর ফিরে আসবে সবাই।' কামাল হোসেন বললেন।
'আপনি যা বলবেন।' মতিন একটুও আনন্দিত হচ্ছিল না। এটা কোনও চাকরি নয়। তারপরের ঘটনাগুলো দ্রুত ঘটে গেল। বাড়ি ফিরে মামার নির্দেশমতো সব কাগজপত্র জোগাড়
করে আবার ঢাকায় গিয়ে ফিরে এল সে। আর কী আশ্চর্য ব্যাপার তিন সপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্টের বই এসে গেল তার দেশের বাড়ির ঠিকানায়। মাকে সব কথা খুলে বলেছিল মতিন। মা বলেছিলেন, 'নিশ্চয়ই ওখানে তুই কীরকম কাজ করছিস দেখে কামাল তোকে এখানে চাকরি দেবে। মন দিয়ে কাজ করিস।' কিন্তু তখনই বাবাকে কিছু বলা হল না। মায়ের ভয় হল, জানলে বাবা প্রচণ্ড আপত্তি করবেন। ভিসার জন্যে আবেদন করা হল। মেলা কর্তৃপক্ষ তিনজন কর্মচারীকে যোগ দেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন বলে ভিসা পেতেও অসুবিধে হল না। তবে যেদিন ভিসার ইন্টারভিউ হল তার আগের দিন কামাল হোসেনের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে গিয়ে গার্মেন্ট সংক্রান্ত অনেক তথ্য জানতে হয়েছিল। তার কয়েকটা ভিসা অফিসার জানতে চাওয়ায় উত্তর দিতে অসুবিধে হয়নি মতিনের। সাময়িক ভিসা।
কামাল হোসেন বলেছিলেন, যাওয়ার দুদিন আগে এসে ঢাকায় থাকবে। মেলায় যেসব গার্মেন্টস বিক্রি হবে তা অনেকদিন আগেই জাহাজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁর মনে হয়েছে, মতিনের বিদেশে যাওয়ার উপযুক্ত পোশাক নেই।
শেষ পর্যন্ত মা বাবাকে খবরটা দিলেন। কিন্তু কামাল হোসেনের নামটা বললেন না। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করেছিল মতিন, সুযোগটা পেয়ে গেছে।
বাবা একটু গম্ভীর হলেন, 'কতদিনের জন্য যেতে হবে?'
'সাতদিন।'
'দ্যাখো, ওখানে থেকে যেও না। এখন তো সবাই দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে বাসন ধুয়ে, কুলিগিরি করে বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তুমি নিশ্চয়ই সেরকম কিছু করবে না। যাচ্ছ যাও, দেশটা দেখে এসো।' বাবা বলেছিলেন।
মা খুব খুশি হয়েছিল। বেরুবার সময় জড়িয়ে ধরেছিল। কিন্তু কান্নাকাটি করেনি। শুধু বলেছিল, 'ওখানে গিয়ে যদি পারিস অন্তত একবার ফোন করিস।'
এই প্রথম বাড়ি ছেড়ে বাইরে যাওয়া। তার ওপর বিদেশ, হঠাৎ মন খারাপ হওয়া গুরু হল। তার গ্রামের বন্ধুর! খুব উৎসাহিত, কেউ কেউ ঈর্ষাকাতর। যারা ঢাকায় যাওয়া-আসা করে তারা জানে, চাইলেই আমেরিকায় যাওয়ার ভিসা পাওয়া যায় না। যাওয়ার আগের বিকেলে ওদের
সঙ্গে দ্যাখা করতে গিয়েছিল সে।
আনোয়ার বলল, 'তুই সত্যি আমেরিকায় যাচ্ছিস? বিশ্বাস করতে পারছি না।' 'আমি মিথ্যে বলব কেন?'
'আমার চাচার ছেলে শওকত দশ বছর ধরে চেষ্টা করেও ভিসা পায়নি। কেন যাচ্ছে, কবে ফিরবে, কে খরচ দেবে এসব প্রশ্নের উত্তরে খুশি হয় না ওরা।' আনোয়ার বলল।
ইমন মাথা নেড়েছিল, 'একেবারে সত্যি কথা। আমেরিকান ভিসা আছে এর সম পাসপোর্টের দাম কত জানিস? ছয়-সাত লক্ষ টাকা। আর তুই পেলি আর পেয়ে গেলি? তুই কোথাকার বাদশা, বল?'
মতিন বলেছিল, 'আমি কিছু জানি না। মামাই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মামার কর্মচারী হয়ে ওখানে যাচ্ছি গার্মেন্টস ফেয়ারে কাজ করতে। কয়েকদিনের জন্যে।'
'ও। তাই বল। ফিরে এসে কী করবি?' ইমন জিজ্ঞাসা করেছিল।
'এখনও জানি না।' মাথা নেড়েছিল মতিন।
মামা কি তোকে চাকরি দেবে এখানে?'
'কিছু বলেনি।'
'তা হলে ফিরিস না।'
'তার মানে?' চমকে উঠেছিল মতিন।
ওর মুখের অবস্থা দেখে সবাই হো-হো করে হেসেছিল।
পাশের বাড়ির জাহাঙ্গির চাচার সঙ্গে বাড়িতে ফেরার সময় দ্যাখা হয়ে গেল। তিনি স্কুলের শিক্ষক, জিগ্যেস করলেন, 'মতিন, তুমি শুনলাম আমেরিকায় যাচ্ছ?'
'হ্যাঁ চাচা।'
'বৈধ কাগজপত্র নিয়ে যাচ্ছ তো?"
'হ্যাঁ, চাচা।'
'বাঃ। শুনে ভালো লাগল। সেদিন কাগজে পড়ছিলাম, অনেকেই নাকি অবৈধভাবে সে-দেশ যায়। জাহাজে খালাসির চাকরি নিয়ে সে দেশে পৌঁছে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে ডাঙায় ওঠে কিন্তু আর দেশে ফিরতে পারে না। তারা ভাবে সেদেশে গেলে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাবে। একটা ডলার রোজগার করলে তো সত্তর টাকা হয়ে যাবে। বুঝলে মতিন, ওই টাকার জন্যে সারাজীবনের স্বাধীনতা
বিসর্জন দিয়ে ওদেশে চোরের মতো থাকতে হয়। অসুস্থ হলে চিকিৎসার সুযোগ পায় না। তুমি যে বৈধ কাগজ নিয়ে যাচ্ছ তাতে লাভ এই যে বুক ফুলিয়ে দেশে ফিরতে পারবে।'
জাহাঙ্গির চাচার কথার মধ্যেই ছুটিকে দ্যাখা গেল বাড়ি ফিরতে। জাহাঙ্গির চাচা তাকে বললেন,
'শুনেছিস, মতিনের খবর?'
'শুনব না কেন? গ্রামের সবাই তো শুনেছে। কবে যাওয়া হচ্ছে।'
'কালই ঢাকায় যাব। ওখান থেকে ক'দিন পরে-'
'কোন শহরে যাচ্ছ?'
'নিউইয়র্ক।'
শোনামাত্র জাহাঙ্গির চাচার দিকে তাকাল ছুটি। জাহাঙ্গির চাচা বললেন, 'তোমরা কথা বলো, আমার একটা জরুরি কাজ আছে।'
তিনি চলে গেলে ছুটি বলল, 'তোমার কাছে একটা উপকার চাইব?'
'আমি যদি পারি তাহলে নিশ্চয়ই করব।'
'তোমাকে একটা ঠিকানা দেব। সেখানে গিয়ে একজনের সঙ্গে দ্যাখা করে জিজ্ঞাসা করবে
সে কখনও দেশে ফিরবে কি না?' 'আমি তো সেখানকার রাস্তাঘাট চিনব না। তবে কেউ যদি চিনিয়ে নিয়ে যায় তাহলে নিশ্চয়ই বলতে পারি। কিন্তু—।'
ছুটির চোখ ছোট হল। মতিন বলল, 'আমি কোথায় থাকব আর তিনি কোথায় আছেন তাই তো জানি না। আমাকে পৌঁছেই কাজ শুরু করতে হবে। মেলার স্টলে থাকতে হবে সকাল থেকে
অনেক রাত পর্যন্ত। মেলা শেষ হলেই চলে আসব। ভিসার দিন শেষ হয়ে যাবে।' ছুটি বলল, 'তাহলে থাক। এখান থেকে ফোন করতে অনেক টাকা লাগে। তবু করেছিলাম, কিন্তু সে তখন বাসায় ছিল না। যে ধরেছিল সে নিশ্চয়ই তাকে আমার ফোনের কথা বলেছিল, তিনটি চিঠি দিয়েছি। উত্তর পাইনি। পেলে তোমায় বলতাম নাকি।'
মতিনের খেয়াল হল। 'আমি তো ওকে টেলিফোন করে বলতে পারি মেলায় এসে আমার সঙ্গে দ্যাখা করতে। উনি এলে প্রশ্নটা জিগ্যেস করব।'
হাসি ফুটল ছুটির মুখে, 'বাঃ, এই সহজ কথাটা আমার মনেই আসেনি। দাঁড়াও, আমি ওর নাম ঠিকানা ফোন নম্বর লিখে এনে দিচ্ছি।'
দু'মিনিটের মধ্যেই এনে দিয়েছিল ছুটি। নামটা পড়ে চিনতে পারল না মতিন। ছুটির দিকে তাকাতে সে বলল, 'তুমি চিনবে না। আমি যখন নানির বাড়িতে দুই বছর আগে গিয়েছিলাম তখন আলাপ হয়েছিল। মীরপুরে আমার নানি থাকে।' মুখে লালচে রং লাগল ছুটির।
সে আপত্তি করা সত্ত্বেও মা টিনের সুটকেসের সঙ্গে একটা ছোট্ট বিছানা শতরঞ্চিতে মুড়ে বেঁধে দিয়েছিল। সেই বিছানার ভেতরে বাবার পুরোনো অলেস্টার ঢুকিয়ে বলেছিল, 'এখনও নতুন আছে। ব্যবহার করে না তো। তুই নিয়ে যা। পরলেই আমাদের কথা মনে পড়বে।' শুনে বাবা
হো হো করে হেসেছিলেন।
মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, 'এত হাসির কী হয়েছে?'
'এখন সেখানে গরমকাল। আমাদের ফাল্গুন মাসের মতো গরম। ফাল্গুনে কি আমরা গরমজামা গায়ে চড়াই? আর থাকবে তো মাত্র সাতদিন। ওটা নিয়ে যাওয়া আসাই সার হবে।'
'হোক।' মা বলেছিল, 'কখন কী কাজে লাগে কে বলতে পারে।'
বাবা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'তুমি যে যাচ্ছ, হাতে টাকাপয়সা কিছু দিয়েছে?'
মাথা নেড়েছিল মতিন, না।
'দ্যাখো। বিদেশে নিয়ে গিয়ে কাজ করিয়ে খালি হাতে ফিরিয়ে না দেয়। রাস্তাঘাটে দশ- বিশ টাকা সঙ্গে না রাখলে চলে? তুমি যাওয়ার আগে চেয়ে নেবে।' বাবা উপদেশ দিয়েছিলেন। মা বলেছিল, 'চাইলে যদি বলে ওখানে যাওয়ার পরে দেব, তা হলে কি বলবে যাব না?
তার চেয়ে তুমি ওর হাতে কিছু দিয়ে দাও।'
'নিশ্চয়ই দিতে পারি, কিন্তু তা ওর কাজে লাগবে না।' বাবা বলেছিলেন।
'কেন?' মা বুঝতে পারল না।'
'আমেরিকায় বাংলাদেশের টাকা কেউ নেবে না। ওখানে ডলার চলে। আমি ডলার কোথায় পাব যে দেব?'
মতিনের মনে পড়ল, ঢাকার রাস্তায় সে দোকানের ওপর লেখা দেখেছে, 'টাকার বদলে বিদেশি মুদ্রা দেওয়া হয়।'
কথাটা জানাতে বাবা মাথা নাড়লেন। তারপর আলমারি খুলে গুণে গুণে টাকা দিয়ে বললেন, 'সংসার খরচের টাকা থেকে দিলাম। বুঝে সুঝে খরচ করবে।'
মা বলল, 'যদি তোর হাতে শেষ পর্যন্ত কিছু টাকা এর থেকে বেঁচে যায় তা হলে একটা ছোট্ট বিলেতি সেন্ট আনিস তো। আমার খুব শখ।'
মতিন মাথা নেড়ে হাঁ! বলেছিল।
ঢাকার মুদ্রা-বিনিময় দোকানের কর্মী বাবার দেওয়া টাকা গোনার পর বলল, 'নয় ডলার কুড়ি সেন্ট পাবেন। পাসপোর্ট দেখি।'
কামাল সাহেবের ম্যানেজার দু'দিন ধরে মতিনকে পাখি পড়ার মতো করে বোঝালেন গার্মেন্টসের স্টলে বসে কী কী কাজ করতে হবে। তাকে সতর্ক করে দেওয়া হল, সাহেব মেমরা স্টলে এলে সে যেন কথা না বলে। যা বলার তা বাকি দুজন বলবে। ওরা ইতিমধ্যেই কাজটা করে অভিজ্ঞ হয়ে গেছে।
কামাল সাহেবের একজন লোক তাকে নিয়ে গেল মীরপুরে। সেখানে সন্তায় শাড়ি, প্যান্ট, গেঞ্জি, সার্ট এবং কোট পাওয়া যায়। মাপ নিয়ে দোকানদার বলল, 'আমার দোকানের মাল নিয়ে কেউ যদি বলে মরা সাহেবের গন্ধ আছে তা হলে আমি তার জুতো মুখে নিয়ে হাঁটব।' মতিনের সন্দেহ হলেও মুখে কিছু বলল না, পোশাকগুলো এমন ঝকঝকে চেহারার যে পুরোনো বলে মনেই হয় না।
যাওয়ার দিন কামাল সাহেব তার চেম্বারে ডেকে পাঠালেন। বললেন, 'বসো।' মতিন বসল। কামালভাই বললেন, 'এই যে আজ তুমি আমেরিকা যাবে তা যে আমি ব্যবস্থা করেছি বলেই সম্ভব হচ্ছে তা তোমার মা-বাপ জানে?"
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল মতিন।
'তোমার বাপ তো আমাকে এমন অপছন্দ করে যে নামও মুখে নেয় না। অক্ষমের অহংকার। আমি যা করেছি তা তোমার মায়ের কথা ভেবে। যাক গে, ওখানে গিয়ে দলের সঙ্গে থাকবে। কিন্তু যেদিন মেলা শেষ হয়ে যাবে সেদিন একটু ঘুরতে পার। আমার পরিচিত একটি লোক নাম মুর্শেদ, তোমাকে নিউইয়র্ক শহর ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবে।' কামাল সাহেব একটু থামলেন, 'তোমার জন্যে
যা করলাম তার মূল্য বুঝতে পেরেছ?'
মতিন চুপ করে রইল। সে কী উত্তর দিতে পারে।
'কোটি কোটি টাকার মালিকের ছেলে অনেক চেষ্টা করেও আমেরিকান ভিসা পাচ্ছে না। আর তোমার মতো একটা বেকার ছেলেকে আমি সেখানে যাওয়ার সুযোগ করে দিলাম। আশা করি সারাজীবন কথাটা মনে রাখবে। আর হ্যাঁ, ফিরে এসে দয়া করে আমার কাছে চাকরি চেয়ে ঘ্যানখ্যান
করবে না। যদি আসো, তাহলে জেনো আমার দারোয়ান তোমাকে ঢুকতে দেবে না। যাও।'
মতিনের দুই সঙ্গী তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। দুজনেই বিবাহিত, ছেলে-মেয়ে আছে। একজনের নাম শাজাহান, দ্বিতীয়জনের নাম জিয়াউদ্দিন। অফিসের গাড়িতে তাদের সঙ্গে এয়ারপোর্টে এল মতিন। ডানহাতে টিনের সুটকেস, বাঁ হাতে শতরঞ্চিতে মোড়া বেডিং। এগুলো নিয়ে গাড়িতে ওঠার পরই শাজাহান চোখ কপালে তুলেছিল, 'আরে, তুমি ওই বেডিং বগলে নিয়ে আমেরিকায় যাবে নাকি?'
'ওখানে শোওয়ার জন্যে।' বিড়বিড় করেছিল মতিন।
জিয়া বলেছিল, 'সব আছে, কোনও চিন্তা নেই। ওটা রেখে যাও।'
প্রায় বাধ্য হয়ে বেডিং খুলে বাবার গরমের পোশাক বের করেছিল সে। তাই দেখে আর এক প্রন্থ হাসাহাসির পর শাজাহান বলল, 'ওটা হাতে ঝুলিয়ে নাও। রেখে গেলেই ভালো করতে, কাজে তো লাগবে না।'
জিয়া হাসল, 'টিনের সুটকেসে প্লেনে খাওয়ার জন্যে চিড়ে মুড়ি নিয়েছ তো? প্রায় একদিনের রাস্তা, বেশি থাকলে আমাদের দিও।'
মাথা নেড়ে না বলল মতিন। জিজ্ঞাসা করল, 'এয়ারপোর্টে ওসব কি কেনা যায় না?' দুজনেই হেসে উঠল। বলল, 'আমরা কি ট্রেনে যাচ্ছি যে খাবার নিতে হবে? প্লেনে এত খাবার দেবে যে তুমি খেতে পারবে না।' গাড়িটা যখন এয়ারপোর্টের গেটের দিকে এগোচ্ছিল তখন একটা লম্বা লাইন দেখতে পেল মতিন। বেশিরভাগ ছেলের বয়স একুশ-বাইশের বেশি নয়। পরনে শার্ট আর পাজামা। কেউ কেউ জিনস পরে থাকলেও তা যে বেশ সস্তার তা বোঝা যাচ্ছে। ওদের হাতে সম্ভার সুটকেস এবং শতরঞ্চির বেডিং। এরা কোথায় যাচ্ছে?
জিয়া বলল, 'সবাই মিডল ইস্টে যাচ্ছে চাকরি করতে। যা মাইনে পাবে তার অর্ধেক দালাল নিয়ে নেবে। দেশে কবে ফিরতে পারবে তার ঠিক নেই। কিন্তু এখানকার বাসার লোকের রোজগার বাড়বে।'
বোর্ডিং কার্ড নিয়ে শাজাহন তাদের একটা ফর্ম দিল, 'ভরে নাও।'
ফর্মের একদিকে বাংলা, অন্যদিকে ইংরেজি। দেখে দেখে যা জানতে চায় তা লেখার পর দুটো জায়গায় আটকে গেল মতিন। এক, কী কাজে যাচ্ছে, দুই যেখানে যাচ্ছে সেখানকার ঠিকানা। শাজাহান ঝটপট লিখে দিল।
ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট দেওয়ার পর অফিসার একবার তাকে দেখে আমেরিকার ভিসাটা ভালো করে পরীক্ষা করে স্থাপ মারলেন বেশ জোরে, কিন্তু তাকে কোনও প্রশ্ন করলেন না। ওরা বিশাল হল ঘরে এসে নানান ধরনের দোকান দেখতে পেল। তারপর লম্বা করিডোরের গায়ে নাম্বার লাগানো পরপর গেট।
একটা গেটের সামনে বিভিন্ন বয়সি মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। দেখলেই বোঝা যায় ওরা গ্রাম থেকে এসেছে। কারও কারও চুল থেকে তেল গড়িয়ে আসছে কানের পাশ দিয়ে। মতিন লক্ষ্য করল, প্রত্যেকেই গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে কাগজপত্র আর ব্যাগ হাতে নিয়ে।
জিয়া বলল, 'তুমি এখানে দাঁড়াও, আমরা বিড়ি খেয়ে আসি।'
'এখানে খাওয়া যাবে না?'
'বাপস! সোজা জেলে পাঠিয়ে দেবে। প্লেনেও খাওয়া চলবে না। আসছি।'
ওরা চলে গেলে মতিন চারপাশে তাকাল। সে বাংলাদেশে রয়েছে কিন্তু এখানকার সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। গ্রাম থেকে ঢাকায় এলে প্রথম প্রথম যে চমক জাগত সেটাও ম্লান হয়ে গেল এখানে এসে। স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। সামনের লাইনের সবশেষে রোগা চেহারার যে ছেলেটি দাঁড়িয়েছিল তার দিকে তাকিয়ে হাসল মতিন। ছেলেটি কোনও সাড়া দিল না।
ছেলেটির পাশে গিয়ে মতিন জিজ্ঞাসা করল, 'কোথায় যাচ্ছ?'
'মালোসিয়া।' নামটা ছোট করে বলল ছেলেটি।
'মালোসিয়া?'
'হ্যাঁ। চাকরি পেয়েছি।' বেশ গম্ভীর গলায় বলল ছেলেটি।
'কী চাকরি?'
'কারখানায়।'
এইসময় একটি লোক এগিয়ে এল, 'কিছু বলবেন ভাই?'
'না।' সরে গেল মতিন।
পরে জিয়া বলেছিল, রোজ প্রচুর ছেলেকে মালয়েশিয়া, আরব দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। বেশিরভাগ ছেলে যাচ্ছে শ্রমিকের কাজ নিয়ে। কেউ কেউ খারাপ কথা বললেও এর ফলে দেশের বেকার ছেলের সংখ্যা যে কমে যাচ্ছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
জিয়া এবং শাজাহানের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে ব্যাগ, সুটকেস সার্চ করিয়ে আর-একটা ঘরে ঢুকল মতিন। জিয়া বলল, এরপরে আমাদের প্লেনে ওঠার জন্যে ডাকবে। এই ঘর থেকে বের হলেই মনে করবে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেলে।'
'কেন? প্লেন বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকবে।' মতিন বলল।
'প্লেনের ভেতর ঢোকার পর সেটা একদম মনে হবে না।' জিয়া বলল। এরপর ওরা প্লেনের ভেতর ঢুকে গেল। ঢোকার পর মতিন স্তম্ভিত। একটা লম্বা স্বপ্ন স্বপ্ন ঘর। আলো বেরিয়ে আসছে ওপর থেকে। ওরা তিনজন পাশাপাশি চেয়ারে বসল। তার আগে পেছনে অনেক সারি। ক্রমশ ভরতি হয়ে গেল প্লেনটা। মতিন জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। আলো দ্যাখা যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে আছে প্লেন। সুন্দরী মেয়েরা, যারা তদারকি করছে যাত্রীদের, তাদের বেশ সুন্দরী মনে হল মতিনের। তাদের গ্রামের যেসব মেয়ে সুন্দরী তারা এদের মতো স্মার্ট নয়, এয়ারহোস্টেস এসে বাংলায় বলল কোমরের বেল্ট বেঁধে নিতে। ওটাকে কবজা করতে অসুবিধে হচ্ছিল মতিনের। জিয়া তাকে সাহায্য করল। বলল, 'প্লেন যদি ঝাঁকায় তা হলে বেল্ট থাকলে চোট খাবে না। ঝড় বৃষ্টির মধ্যে পড়লে তো প্লেন ঝাঁকাতেই পারে।'
'সর্বনাশ।' মতিন হাসল।
'তুমি সাতদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে?'
'তার মধ্যে ফিরতে আমি বাধ্য।'
'তা ঠিক। এই সাতদিনের জন্য কত তোমাকে কামাল ভাই দিচ্ছে?'
মাথা নাড়ল মতিন, 'না। কিছুই দেবে না।'
'শালা হারামি।' চাপা গলায় বলল জিয়া। অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই প্লেন গর্জে উঠল। বিশাল প্লেন, অনেকক্ষণ মাটির ওপর দিয়ে ছোটার পর আচমকা আকাশে ডানা মেলল প্লেন। নীচের দিকে তাকানো হল না। মতিন চোখ বন্ধ করল। সে বাংলাদেশ ছেড়ে তখন আকাশে।
মাঝখানে একবার মাটি ছুঁয়ে আবার আকাশে উড়ছিল প্লেন। মতিন অবাক হয়ে মানুষগুলোকে দেখছিল। এত মানুষ পাশাপাশি বসে যাচ্ছে কিন্তু ঝগড়া দূরের কথা কেউ চেঁচিয়েও কথা বলছে না। এয়ারহোস্টেসরা প্রায় নিঃশব্দে খাবার দিয়ে যাচ্ছে এবং যাত্রীরা খাবার নিয়ে বিন্দুমাত্র আপত্তি জানাচ্ছে না। টয়লেটের সামনে লোক লাইন দিয়ে অপেক্ষা করছে কিন্তু আগে ঢোকার চেষ্টা করছে না। মানুষের এত ভালো আচরণ সে কোনওদিন দ্যাখেনি। কেউ সিগারেট দূরের কথা, পান খেয়ে পিক ফেলছে না। এই মানুষগুলোই কি মাটিতে নামার পর অন্যরকম হয়ে যাবে।
জিয়াকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল, 'আরে ভাই, এমনি চুপ করে আছে নাকি? ভয় আছে
প্রত্যেকের মনে।'
'কীসের ভয়?' মতিন জিজ্ঞাসা করল।
'মাটি থেকে কম-সে-কম পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট ওপর দিয়ে প্লেন যাচ্ছে। যদি ইঞ্জিন খারাপ হয়ে যায় তাহলে যা হবে তাই ভেবে ভয় পাচ্ছে সবাই। কিন্তু মুখে সেটা বলছে না।'
জিয়ার কথা শোনার পর মতিনের খেয়াল হল। সিট বেল্ট আঁকড়ে বসল সে। তার পরেই হেসে ফেলল। আকাশ থেকে মাটিতে যদি প্লেন আছড়ে পড়ে তা হলে সিট বেল্ট কী করে বাঁচাবে? এই যে এত মানুষ প্রতিটি সিটে বেল্ট-বন্দি হয়ে বসে আছে, ইঞ্জিন খারাপ হয়ে প্লেনটা যদি শোঁ-শোঁ করে নীচের দিকে নেমে পড়ে তাহলে কারও কিছু করার নেই। আমেরিকা যাওয়ার সময় বড় বড় সমুদ্র পার হতে হয়, তার একটার বুকে যদি প্লেনটা ঢুকে পড়ে তাহলে দমবন্ধ হয়েই মরে যেতে হবে সবাইকে। আবার মাটিতে আছাড় খেলে বোঝার আগেই প্রাণ বেরিয়ে যাবে। শরীরে শিরশিরানি অনুভব করল মতিন। নৌকো ডুবছে দেখে লাফিয়ে জলে নামা যায়। বাস বা ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়লে বাঁচার একটু হলেও সুযোগ থাকে। প্লেনের বেলায় তার বিন্দুমাত্র নেই। আল্লার ওপর ভরসা রাখা ছাড়া কোনও উপায় নেই।
মতিন বাড়াবাড়ি রকমের ধর্মাচরণ করে না। এইজন্যে ঠাকুমা থাকতে খুব ঝামেলা হত। বাবা-মা চাপ দিতেন না। দৈনন্দিন নামাজ পড়া এবং রোজা মেনে চলা ছাড়া বাড়তি কিছু করেনি সে। মাঝে মাঝে বাড়ির বাইরে গেলে সেটুকুও করা হয় না। তবে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কখনও রোজার মাসে দিনের বেলায় খেয়েছে বলে মনে পড়ে না।
মতিন চারপাশে তাকাল, দেখে মনে হল কেউ তার মতো ভাবছে না। এয়ারহোস্টেস এসে পানীয় কী লাগবে জিজ্ঞাসা করতে যে যার পছন্দ বলে নিয়ে নিল। পাশে বসা জিয়া জিজ্ঞাসা করল 'হুইস্কি আছে?'
এয়ারহোস্টেস বলল, 'আছে'।
'তাহলে দ্যান, দুইজনকে দুটা।' জিয়া মতিনকে দেখিয়ে দিল।
'পানি না বরফ?'
'পানি।'
'দু-দুটো লাল সোনালি রঙের টলটলে তরল পদার্থ জিয়ার সামনে ট্রে টেনে রেখে দিল এয়ারহোস্টেস। তারপর পেছনের দিকে এগিয়ে গেল। ওপাশ থেকে শাজাহান বললে, 'একী? আমাকে দেবে না?'
জিয়া মাথা নাড়ল, 'ওই যে বাঁ-দিক দিয়ে যে আসছে তার দায়িত্ব তোকে সেবা করার,' বলে হাসতে লাগল।
মতিন খুব অস্বস্তিতে পড়ল, সে কখনও মদ্যপান করেনি। মদ্যপান করা অত্যন্ত অন্যায় বলেই সে জেনেছে। কিন্তু জিয়াভাই তার জন্যে মদ নিল কেন? জিয়া গ্লাসে চুমুক দিল। মুখ ফিরিয়ে ওপাশের ভদ্রমহিলার দিকে তাকাল মতিন। তাকে যখন এয়ারহোস্টেস জিজ্ঞাসা করেছিল তখন তিনি জবাব
দিয়েছিলেন, 'অ্যাপেল জুস।'
মতিন জিয়াকে বলল, 'জিয়াভাই, আমার জন্যে আপেলের জুস বলেন না!'
জিয়া মাথা নাড়ল, 'আর দেবে না।'
'কেন?'
'মাগনায় দিচ্ছে। তোমাকে একবার হুইস্কি দিলে অন্য কিছু দেবে না'।
'কিন্তু আমি তো হুইস্কি খাই না।' বলতে বলতে মতিন দেখল, শাজাহানও হুইস্কির গ্লাস
নিয়েছে।
'জানি। তাই তো তোমারটা আমি নিয়ে নিলাম।'
'আপনি একাই দুইটা খাবেন?' চমকে উঠল মতিন।
ফিক ফিক হাসি হাসল জিয়া, 'আরে ব্রাদার! আমি এরকম দশ গ্লাস খেতে পারি। তা ছাড়া আপেল জুস যে শুধু আপেলের রস তা আমার মনে হয় না। এক-দু চামচ ভদকা মিশিয়েও দিতে পারে। ভদকা কি জান?'
'না।' মাথা নাড়ল মতিন।
'এক ধরনের সাদা মদ।' জিয়া নিজের গ্লাস শেষ করল।
মজার ব্যাপার। একটুও গরম নেই, আরামে বসে থাকা যাচ্ছে। তার ওপর বিনা পয়সায় মদ, জুস আর অদ্ভুত সব খাবার দিচ্ছে। এরকম মাখন আর চিজের টুকরো প্যাকেট মতিন কখনও দ্যাখেনি। কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতেই আবার খাবার। মতিন অনুমান করল তার প্লেনের ভাড়া বাবদ অনেক টাকা দিতে হয়েছে মামা কামাল হোসেনকে। তার ওপর কি খাটতে হবে বলে টাকা চাওয়া যায়?
জিয়া তাকে দেখিয়ে দিল, কীভাবে টিভির সিনেমা দেখতে হয়। ইংরেজি ছাড়া হিন্দিতেও সিনেমা হচ্ছে। বোঝার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টা অনেক সহজ। কিন্তু তবু ইংরেজি ছবি দেখতে লাগল মতিন। বিদেশে যাওয়ার পরে তো সবসময় ইংরেজি শুনতে হবে। এখান থেকেই কানে শোনার অভ্যেস হয়ে থাকা উচিত।
মাঝে একবার ঘুমিয়ে পড়েছিল সে, জিয়ার ডাকে সোজা হয়ে শুনল, একটু পরেই প্লেন নামবে। সে যেখানে বসে আছে সেখান থেকে বাইরের কিছু দ্যাখা যাচ্ছে না। কিন্তু প্লেনটা যে নীচের দিকে নামছে তা বোঝা যাচ্ছে। তারপর একসময় ঝাঁকুনি খেল সবাই। প্লেন মাটিতে নেমেছে, চাকা গড়িয়ে যাচ্ছে।
জিয়াদের পেছন পেছন হাত ব্যাগ নিয়ে প্লেন থেকে একটা সুড়ঙ্গে ঢুকল সে। অনেকটা যাওয়ার পর সিঁড়ি ভেঙে এবং উঠে যে জায়গায় পৌঁছাল সেটা একটা বিশাল হলঘর। এঁকে বেঁকে মানুষের লাইন চলে গিয়েছে বিভিন্ন কাউন্টারের দিকে। প্রায় আশিজন লোকের পেছনে দাঁড়াল ওরা। জিয়া মতিনকে বলল, 'ওই কাউন্টারে গিয়ে পাসপোর্ট ভিসা দেখাতে হবে। আমরা কেন এসেছি, কতদিন এদেশে থাকব জানতে চাইবে। আমাদের উত্তর পেয়ে খুশি হলে দেশে ঢুকতে দেবে।'
'আমি কী বলব?' কীরকম অসহায় লাগল মতিনের।
'তোমাকে যা শেখানো হয়েছে তাই বলবে। পাসপোর্ট আর যে কাগজটা তোমাকে দ্যাখাতে বলা হয়েছিল সেটা বের করে হাতে রাখো।' শাজাহান বলল।
কত মানুষ। মতিনের মনে হল, হাজার হাজার। সাপের লাইন বানিয়ে এঁকে বেঁকে দাঁড়িয়ে আছে। বেশির ভাগের গায়ের রং কালো বা শ্যামলা। সাদাও আছে অবশ্য। পৃথিবীর সব দেশের মানুষ কি রোজ এভাবে ছুটে আসে আমেরিকায় ঢোকার জন্য?
কথাটা জিজ্ঞাসা করল জিয়াকে। জিয়া বলল, 'দূর। গতবার আমরা এসেছিলাম দিনের বেলায়।
তখনও এরকম লাইন ছিল। সারাদিন-রাত একই রকমের ভিড়।'
'সবাইকে ঢুকতে দেয় ?'
'পাগল। কাগজপত্র ঠিক না থাকলে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।'
'কিন্তু জিয়া ডাই-?
'আবার কী হল?'
'তোমাকে যা প্রশ্ন করেছিল, তুমি বুঝতে পেরেছিলে?'
'আন্দাজ করেছিলাম।'
'জবাব দিতে পেরেছিলে?'
'পাগল। ইংরেজি মাথাতেই আসেনি। ইশারায় বুঝিয়েছিলাম।'
'আমি কী করব?' মতিন অসহায় বোধ করল।
'আমরা যা করব, তাই করবে। আমরা যেহেতু আগে দাঁড়িয়েছি তাই প্রথমে আমাদের ডাকবে। তখন ভালো করে লক্ষ্য করবে।' শাহাজান আশ্বস্ত করল।
প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে ওরা কাউন্টারের কাছাকাছি পৌঁছাল। প্রথমে জিয়া এগিয়ে গেল। একটা কালো সাহেব কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়িয়ে তার পাসপোর্ট পরীক্ষা করল। তারপর কিছু প্রশ্ন করলে জিয়া কাগজটা বের করে সামনে ধরল। অফিসার সেটা পড়ে তাকে প্রশ্ন করলে জিয়া মাথা নড়তে লাগল। তা সত্ত্বেও অফিসার প্রশ্ন করছে দেখে লাইনে দাঁড়ানো বাকি দুজনকে দেখিয়ে দিল। তাকে খানিকটা দূরে দাঁড়াতে ইশারা করল অফিসার। তারপরে শাজাহানকে ডাকল। শাজাহানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল। তাকে জিয়ার পাশে দাঁড়াতে বলে মতিনকে ইশারা করল এগিয়ে যেতে। 'আইডি?' অফিসার হাত বাড়াল।
কিছু বুঝতে না পারলেও একটু আগে দেখার অভিজ্ঞতায় পাসপোর্ট এগিয়ে দিল মতিন।
সেটাকে নানান রকম পরীক্ষা করে অফিসার বলল, 'বাংলাদেশ?"
'ইয়ের স্যার।' চট করে বলে কাগজটা এগিয়ে দিল মতিন।
সেটাতে চোখ বুলিয়ে অফিসার জিগ্যেস করল, 'ইউ উইল লিভ হিয়ার?'
'নো।' প্রবল মাথা নাড়ল মতিন।
'হোয়েন ইউ উইল গো ব্যাক বাংলাদেশ?'
'আফটার দি মেলা।'
হাসল অফিসার। তারপর তিনটি পাসপোর্টেই ছাপ মেরে দিল।
ইমিগ্রেশনের বেড়া ডিঙিয়ে জিয়া বলল, 'তুমি ইংরেজিতে কথা বললে?'
খুব গর্ব হচ্ছিল মতিনের। সে কিছু না বলে হাসল। শাজাহান বলল, 'একেই বলে ছুপা রুস্তম।'
মতিনের খেয়াল হল। হাঁটতে হাঁটতে বলল, 'কিন্তু আমাদের ব্যাগগুলো কোথায়? এখানেই পাওয়া যাওয়ার কথা তো।'
পাওয়া গেল। বেল্ট থেকে ব্যাগ, টিনের সুটকেস, তুলে নিল ওরা। মজা লাগছিল মতিনের। সেই কোথায় ঢাকা বিমানবন্দরে এগুলো জমা দিয়েছিল সে, ঠিকঠাক চলে এল হাজার হাজার মাইল
দূরের শহরে।' যাত্রীরা একটা গর্তে ডলার ফেলে ট্রলি বের করে তার ওপর মালপত্র তুলে বের হচ্ছিল। জিয়া মাথা নাড়ল, 'এমন কিছু ভারী না। আমারটা আমি বইব।'
শাজাহান বলল, 'হ্যাঁ। ফালতু পাঁচ ডলার দিয়ে ট্রলি নেওয়ার দরকার নেই।'
পাঁচ ডলার মানে বাংলাদেশের তিনশো পঞ্চাশ টাকা। অত টাকা দিতে হয় একটা ট্রলির জন্য? ঢাকায় তো বিনা পয়সায় পাওয়া যায়। একথা বলতে জিয়া হাসল, 'এরা তো খুব গরীব। তাই এইভাবে রোজগার করে।'
কাস্টমস লেখা জায়গাটা দিয়ে ওরা যখন বেরিয়ে এল তখন দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অফিসাররা কিছুই বলল না। কিন্তু দুজন হেসে মতিনের দিকে তাকিয়ে। তাদের নজর ওর বাঁ-হাতে ধরা টিনের সুটকেসের দিকে। জিয়া বসল, 'তোমার টিনের সুটকেস দেখে ওরা মজা পাচ্ছে।'
'কেন?'
এ জিনিস আমেরিকায় বোধহয় দেখতে পাওয়া যায় না।'
' গম্ভীর হল মতিন। কী করবে সে, মায়ের মুখের ওপর কিছু বলা যায় না।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বাইরের পৃথিবীটাকে দেখতে পেল সে। একটা রেলিং-এর ওপারে অনেক মানুষ অপেক্ষা করে আছে পরিচিত যারা আসছে তাদের জন্যে। মতিন দেখল এদের বেশিরভাগই ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ অথবা পাকিস্তানের মানুষ।
বাইরে বেরিয়ে এসে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াতেই প্রচুর দামি দামি গাড়ি দেখতে পেল মতিন। বাইরে যতটা নজর যাচ্ছে তার সঙ্গে ঢাকা বিমানবন্দরের বাইরের রাস্তার কোনও মিল নেই। এই হল নিউ ইয়র্ক, আমেরিকায় সবচেয়ে নামকরা জায়গা। কথাটা মনে আসা মাত্রই সে পুলকিত হল।
সে এখন আমেরিকায়।
'সালাম আলাইকুম!' একজন প্রৌঢ় এগিয়ে এসে গুদের সামনে দাঁড়াল।
'আলেকুম সালাম।' জিয়া বলল।
'ঢাকা থেকে আসছেন তো?'
' হ্যাঁ' ।
'জিয়া ভাই, শাজাহান ভাই-!'
'হ্যাঁ। আমরা। আপনি?'
'আমার নাম মুর্শেদ। গতবছর যখন আপনারা এসেছিলেন আমি তখন ক্যালিফোর্নিয়াতে ছিলাম। আপনি তা হলে মতিন ভাই?' মূর্শেদ জিজ্ঞাসা করল।
মাথা নাড়ল মতিন। মুখে কিছু বলল না।
'কালই কামালসাহেব কল দিয়েছিলেন। আপনাদের এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে যাওয়ার অর্ডার দিলেন।' মুর্শেদ বলল।
'অর্ডার?' শাজাহান অবাক হল।
'ওই আর কী। মালিক যা বলেন কর্মচারীদের কাছে তা অর্ডার ছাড়া আর কী। এখানে দাঁড়ান, আমি পার্কিং থেকে গাড়ি নিয়ে আসছি।' মুর্শেদ কথা শেষ করেই চলে গেল।
জিয়া বলল, 'এর কথাই কামালভাই বলেছিলেন। মাল তো বেশ চালু।'
'বলল তো কামালভাই-এর কর্মচারী। সাহেব বলল। তাহলে এখানেও কামালভাই-এর ব্যাবসা আছে। আগের বার বুঝতে পারিনি।' শাজাহান বলল।
কিছুক্ষণ পরে গাড়ি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল মুর্শেদ। ডিকিতে মালপত্র রাখার পর জিয়া সামনের সিটে উঠে বসল। পেছনে ওরা। মুর্শেদ ড্রাইভিং সিটে বসে বলল, 'সকলে বেল্ট বেঁধে
ফেলুন নইলে ফাইন দিতে হবে।'
শাজাহান জিজ্ঞাসা করল, 'পেছনে বসলেও বেল্ট বাঁধতে হবে?'
'হ্যাঁ। আগেরবার কোনও গাড়িতে ওঠেননি?'
'না।'
বেশ পরিশ্রম করে বেল্ট বাঁধল মতিন। তারপর কৌতূহলী চোখে চারপাশের দৃশ্য দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে রাস্তাটা চওড়া হয়ে দুটো ভাগ হয়ে গেল। একদিক দিয়ে গাড়ির পর গাড়ি যাচ্ছে, অন্যদিক দিয়ে গাড়ি আসছে। ঢাকার রাস্তায় যেসব রিকশা দ্যাখা যায় তাদের একটাকেও চোখে পড়ছে না।
জিয়া জিজ্ঞাসা করল, 'আমরা তো জ্যামাইকাতে থাকব?'
'না। আগেরবার ওখানে ছিলেন, তাই না?' মুর্শেদ গাড়ি চালাতে চালাতে বলল।
'হ্যাঁ। আকবর ভাই-এর বাসায়।' জিয়া জবাব দিল। 'আকবর ভাই ওই বাড়ি ছেড়ে ব্রংকসে চলে গেছে। আপনারা থাকবেন জ্যাকসন হাইটে।' মুর্শেদ গাড়ি হাইওয়ে থেকে সরিয়ে ডানদিকের একটা সরু রাস্তায় নামিয়ে আনল। এবার দুদিকে ছবির মতো বাড়ি, দোকান দেখতে পেল মতিন।
তিনজনের শোওয়ার ব্যবস্থা একই ঘরে। মাঝে কিচেন এবং টয়লেট। মুর্শেদ ওদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে নিজের ফোন নাম্বার দিল, 'আজ আপনারা রেস্ট নিন। সামনেই বাজার আছে। নিজেরাই রান্না করে খেতে পারেন। ইচ্ছে না থাকলে নীচে নামলেই প্রচুর বাংলা রেস্টুরেন্ট পাবেন। একটু খরচ বেশি পড়বে।'
'মেলার জায়গাটা এখান থেকে কতদূরে?'
'মাত্র তিনটে ব্লক দূরে। হেঁটেই যেতে পারবেন। আপনাদের মালপত্র এসে গেছে। কাল সকালে এসে নিয়ে যাব ওখানে। বেলা বারোটার মধ্যে স্টল সাজিয়ে ফেলবেন। একটার সময় মেলার উদ্বোধন।
আচ্ছা, চলি।' মুর্শেদ চলে গেল।
জিয়া বলল, 'এটা কী হল? আগেরবার তো আকবর ভাই-এর বাসা থেকে দু'বেলা খাবার দিত। বাজার করে খেতে গেলেও তো ডলার লাগবে।'
শাজাহান ততক্ষণে কিচেনে ঢুকে পড়েছে। সেখান থেকেই সে চেঁচিয়ে বলল, 'এখানে সব আছে। লবন, চিনি, চাল, ডাল, আলু, তেল, গ্যাস, থালা-বাসন, গ্লাস। ফ্রিজে কিছু আছে কি না দেখি।'
তার কিছু পরেই তার গলায় উল্লাস শোনা গেল, 'অ্যাই বাপ। ফ্রিজে ডিম আছে দশ-বারোটা, চিকেন আছে, কিন্তু মাছ নেই।'
অবাক হয়ে শুনছিল মতিন।
জিয়া বলল, 'তা হলে সমস্যা নেই, ভাত আর মুরগির মাংস হোক।'
বাইরে বেরিয়ে এল শাজাহান, 'কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে। পেঁয়াজ, রসুন, লঙ্কা। আমি একটু পরে হাত লাগাচ্ছি, তোমরা কিনে আনো?'
'ডলারে কিনতে হবে তো।' জিয়া বলল।
'দ্যাখো যদি বাংলাদেশের টাকা নেয়।' জোরে হাসল শাজাহান।
জিয়া তাকাল মতিনের দিকে, 'তোমার কাছে কত ডলার আছে?'
'নয় ডলার কুড়ি সেন্ট।' মতিন উত্তর দিল।
'অ্যা? মাত্র নয় ডলার নিয়ে তুমি আমেরিকা এসেছ?'
মতিন বুঝল, ব্যাপারটা ঠিক হয়নি। সে মুখ নামাল।
'কামালভাই কিছু দেয়নি?' শাজাহান জিজ্ঞাসা করে।
'না। বলেছেন, মেলা শেষ হলে মুর্শেদভাই ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবেন।'
জিয়া বলল, 'তাই দেখো। চলো।'
জিয়া'য় সঙ্গে দোতলা থেকে বেরিয়ে পিচের রাস্তায় নেমে এল মতিন। এখনও বেলা হয়নি।
বেশিরভাগ দোকান খুলব খুলব করছে। কিছুটা হাঁটার পর দুটো মাঝবয়সি লোককে বাংলায় কথা বলতে শুনল মতিন। আমেরিকার রাস্তায় মানুষ বাংলায় কথা বলে নাকি? জিয়া লোকটার পাশে
দাঁড়াল, 'ভাই বাজারটা কোনখানে?'
'কী কিনবেন? মাছ, মাংস, না সবজি?'
'পেঁয়াজ, রসুন-।'
'ও। ওই পাশের রাস্তায় যান। কোন জেলা?'
'ঢাকা।' জিয়া জবাব দিল।
সঙ্গে সঙ্গে লোকদুটো প্রায় একসঙ্গে হেসে উঠল। জিয়া বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'হাসির কী আছে?'
'রাগ করবেন না ভাই।' দ্বিতীয় লোকটি বলল, 'যাকে জিজ্ঞাসা করি কোন জেলার লোক সেই জবাব দেয়, ঢাকা। যেন ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশে আর কোনও জেলা নেই। মৈমনসিং, ফরিদপুর বাদ দিন, সিলেটের লোকও বলে ঢাকা। রাজধানীর নাম বললে সম্মান বাড়ে বোধহয়।'
জিয়া আর দাঁড়াল না। হাঁটতে লাগল মতিনের সঙ্গে। হাঁটতে হাঁটতে বলল, 'ওই শালাদের কাজ নই। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফকড়ি মারছে। আরে, আমি যদি বলতাম নরসিন্দিতে জন্ম, তাহলে হয়তো জিজ্ঞাসা করত সেটা কোথায়? তার চেয়ে ঢাকা বললে কোনও প্রশ্ন আসবে না। মিথ্যা কথা তো না, আমি বহুবছর ঢাকায় আছি।'
মতিনের মনে হল জিয়ার মনে লোকটার কথা লেগেছে।
ফুটপাথের ওপর বেঞ্চিতে রাখা বড় বড় ঝুড়িতে ওগুলো সাজানো আছে। এত স্বাস্থ্যবান, নিটোল কালচে নীল লম্বা বেগুন কখনও দ্যাখেনি মতিন। একটার ওজন সাড়ে সাতশো গ্রাম হবে। টমেটোগুলির সাইজ কী বড়! কী নেই ঝুড়িগুলোতে, পেঁয়াজ, আলু, আদা, রসুন থেকে শুরু করে ট্যাঁড়শ, ঝিঙে, ফুলকপি, বাঁধাকপি, সব। ফুলকপির মতো দেখতে হালকা নীল সবজিটার নাম ব্রকোলি, ওপরে লেখা আছে। এই সবজি গ্রামের হাটে বিক্রি হয় না। বাস্কেটে মাল তুলে দোকানের ভেতর গিয়ে দাম দিলে ওরা প্যাকেটে ভরে দেবে। জিয়া শাজাহানের নির্দেশ পালন করছিল। কিন্তু মতিন
বলল, 'জিয়া ভাই একটা বেগুন নেন। এত বিশাল, এত মসৃণ বেগুন আমি কখনও দেখিনি।' 'দ্যাখো না, প্রাণভরে দ্যাখো। বাসায় নিয়ে গেলে বেগুনভর্তা কি তুমি বানাবে?' কথাটা বলল বটে তবু জিয়া একটা বড় সাইজের বেগুন তুলে নিল। দোকানে ঢোকার মুখে একটা ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে জিয়া বলল, 'এই দ্যাখো, লাল শাক। কী তাজা। আই বাপ। এক আর্টির দাম দু-ডলার।
মানে দেড়শো টাকা। ভাবা যায়? দেশে শাকওয়ালা দর্শটাকা চাইলেই ঝগড়া বেঁধে যাবে।' কাউন্টারে লোকটা যোগ করে জানাল, দুই ডলার কুড়ি সেন্ট দিতে হবে। জিয়া মাথা নাড়ল, 'দিয়া দাও।'
পার্সের মধ্যে যত্নে রাখা ডলারের নোট এবং কয়েন বের করে দাম মিটিয়ে দিল মতিন।
এখন তার সঞ্চয়ে মাত্র সাত ডলার পড়ে রইল। বেগুন দেখে উল্লসিত শাঙ্গহান। বলল, 'কী সুন্দর দেখতে, কাটতে মায়া হবে: এটায় আমাদের দুদিন চলে যাবে। রাত্রে ভর্তা করব।'
'আমাকে একটা ভাজা দেবেন?' মতিন না বলে পারল না।
আচ্ছা, ঠিক আছে।' বেশ অনিচ্ছায় বলল শাজাহান। '
স্নান করার পরেই সমস্যায় পড়ল মতিন। মাথা ঘুরছে, শরীরটা কেমন কেমন! সে শুয়ে পড়ল তাকে বরাদ্দ করা বিছানায়।
জিয়া বলল, 'ওরকম হয়। প্রথমবার প্লেনে উড়ে এসে আমারও হয়েছিল। শাজাহানভাই- এর
হয়নি। ঘুমাবার চেষ্টা করো। ভাত খেলে সেরে যাবে।'
চোখ বন্ধ করা সত্ত্বেও ঘুম আসছিল না। শরীরের ভেতরে যেন ঢেউ দুলছে। মতিন ভাবতে চেষ্টা করল। সে এখন আমেরিকায় এক বাড়ির বিছানায় শুয়ে আছে। বাংলাদেশ থেকে কত দূরে? সাতসমুদ্র তেরো নদী তো বটেই হাজার হাজার মাইল মাটি এবং মরুভূমি পার হতে হবে সেখানে হেঁটে যেতে হলে। মন কেমন করছিল তার।
সারাটা দিন আধোখুম আধোজাগরণে কেটেছিল মতিনের। মাঝে শাজাহান তাকে জোর করে
তুলে খাইয়ে দিয়েছিল খানিকটা। সন্ধের পরে ঘুম থেকে উঠে সে আবিষ্কার করে ঘরে কেউ নেই। সে অন্ধকারে শুয়ে আছে। ঝটপটিরে উঠে আলো জ্বালতেই বুঝতে পারল ওরা বেরিয়ে গিয়েছে। কোথায় গেল? দরজাটা বন্ধ। কিন্তু ভেতর থেকে নয়। ঠেলতেই বোঝা গেল নড়বে না। হাতল ঘুরিয়েও খোলা গেল না। নিশ্চয়ই বাইরে থেকে চাবি দিয়ে গিয়েছে। তার ঘুম ওরা ভাঙাতে পারেনি বা ভাঙাতে চায়নি।
টয়লেট থেকে মুখ ধুয়ে এসে মাথায় হাত দিল মতিন, এখন কী করা যায়? আর তখনই দরজায় শব্দ হল। কেউ টোকা মারছে কিন্তু বেশ জোরে। মতিন এগিয়ে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। নিশ্চয়ই ওদের দুজন নয়। ওরা এলে চাবি খুলেই ঢুকবে। আবার শব্দ হলে সে সাড়া না দিয়ে
পারল না, 'কে?'
কেউ কিছু বলল। কিন্তু মতিনের কাছে স্পষ্ট হল না।
এবার বাইরে শব্দ হল। তারপরই দরজাটা খুলে গেল। মতিন দেখল তার কাছাকাছি বয়সের একটি মেয়ে অবাক চোখে তাকে দেখছে, 'হ আর ইউ?'
'মাই নেম ইজ মতিন। ফ্রম বাংলাদেশ।'
মেয়েটির ঠোঁটে হাসি ফুটল। ওর পরনে জিনস আর টপ। চুল কাঁধ পর্যন্ত। মেয়েটি এবার জিজ্ঞাসা করল পরিষ্কার বাংলায়, 'আপনাকে ভেতের রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে কেউ গিয়েছে। তালা দেওয়া থাকলে আমার সন্দেহ হত না। মনে হচ্ছিল ভেতরে লোক আছে অথচ দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। ঠিক আছে!
মেয়েটি ঘুরে দাঁড়াতেই মতিন বলল, 'আপনার নাম?'
'টিয়া। পাশের ফ্ল্যাটে থাকি।'
'অনেক দিন আছেন?'
'আড়াই বছর। আপনি আজ এলেন।'
'হ্যাঁ।'
'কী জন্যে এসেছেন? বেড়াতে নিশ্চয়ই না।'
'কাজে। গার্মেন্টস মেলা হবে, সেখানে গার্মেন্টস বিক্রি করতে হবে।'
'কোথায়?'
'তা তো জানি না।'
'ঠিক আছে, খোঁজ নিয়ে নেব। চলি। গুড নাইট।' পাশের ফ্ল্যাটটার দরজায় চাবি ঘুরিয়ে ভেতরে চলে গেল টিয়া।
টিয়া কী করে, এখানে একা থাকে কি না, প্রশ্নগুলো মনে আসছিল। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মেয়েই সুন্দরী কিন্তু টিয়ার দাঁড়ানো, কথা বলার মধ্যে এমন একটা ব্যাপার আছে, যা চট করে দ্যাখা যায় না। দরজা বন্ধ করল মতিন।
শাজাহান এবং জিয়া এল আরও একঘণ্টা পরে। জিয়ার হাতে একটা প্যাকেট। মতিন দরজা খুলে দিতেই জিয়া বলল, 'আরে! যাওয়ার সময় আমরা বাইরে থেকে বন্ধ করলাম, তালা ছিল না বলে লাগালাম না। কিন্তু তুমি ভেতর থেকে খুললে কী করে?'
মতিনের একটু স্মার্ট হওয়ার ইচ্ছে হল। বলল, 'আমি ম্যাজিক জানি।'
শাজাহান বলল, 'দরজায় ধাক্কা দিয়েছিলে নিশ্চয়ই, কেউ এসে খুলে দিয়েছে। যাকগে, এখন
শরীর কেমন?'
'ভালো। কিন্তু আজ আর ঘুম আসবে না।
'সর্বনাশ। আজ রাত্রে ঘুমাতে পারলে কাল দিনের বেলায় কাজ করতে পারবে। তবেই এখানকার দিনরাতের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে।' জিয়া বলল, 'আচ্ছা, আমি দেখছি।'
'আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন?'
'ঘুরতে। সেখানে তোমার যাওয়া উচিত হবে না।' জিয়া হাসল।
সঙ্গে সঙ্গে ধমকাল শাজাহান, 'ভাই, ওসব কথা থাক না।'
'হ্যাঁ। থাক। তাছাড়া তোমার পকেটে এখন মাত্র সাতটা ডলার আছে। দেশে ফেরার আগে ওই দিয়ে যা পারো কিনে নিয়ে যেও।' জিয়া রান্নাঘরে ঢুকে তিনটে গ্লাস বের করে আনল। তারপর প্যাকেট থেকে একটা মদের বোতল বের করে বলল, মতিন, এইটে এক গ্লাস খেয়ে নিলে রাত্রে চমৎকার ঘুম হবে। সকালে উঠে দেখবে শরীরে কোন প্রবলমে নেই।'
'ওটা তো মদ। আমি মদ খাই না।'
'আই বাপ। তুমি কি পাগল?'
'মানে?'
'যে কাজটা তুমি কখনও করোনি তা ভবিষ্যতে করবে না?'
হকচকিয়ে গেল মতিন। কথাটা বলতে পারল না।
'এই যে তুমি আমেরিকায় এসেছ, এটাই তো প্রথমবার, তাই না?'
'হ্যাঁ।' মাথা নাড়ল মতিন।
'আগে কখনও যাইনি বলে আমেরিকায় যাব না, একথা তো বলোনি?' জিয়া হাসল, 'আরে
ভাই বিনা পয়সায় লোকে বিষও খায়, তোমাকে তো দামি জিনিস দিচ্ছি। সবকিছুর স্বাদ জেনে রাখা উচিত। একটু খেলে কোনও সমস্যা হবে না, বরং ঘুম হবে ভালো। সকালে উঠে দেখবে কোনও ঝামেলা নেই।'
শাজাহান রান্নাঘরে ঢুকেছিল। এবার একটা প্লেট ভরতি করে ডিমভাজা নিয়ে এল। বলল, 'মিএল, লেকচার বন্ধ করে মাল ঢালো।'
তিনটে গ্লাসে হুইস্কি আর জল ঢেলে একটা ছোট টেবিলে রাখা হল। প্লেটে একটাই চামচ আর সেটা দিয়েই ডিমভাজার টুকরো কেটে মুখে পুরছে ওরা। দুজনে গ্লাস তুলে চেঁচিয়ে বলল, 'চিয়ার্স।'
বাধ্য হয়ে গ্লাস তুলল মতিন। দেশে থাকতে সে কখনওই মদ খেত না। কিন্তু আমেরিকানরা তো সবার সামনে মদ খায়। একটা ইংরেজি ছবিতে দেখেছে সে। তা হলে আমেরিকায় এসে মদ খেলে নিশ্চয়ই অন্যায় হবে না। তার ওপর যখন জিয়াভাই বলল, এটা খেলে কাল সকালে শরীরটা ঠিক
হয়ে যাবে তখন-।
চুমুক দিল সে। গন্ধটা তেমন খারাপ নয় কিন্তু স্বাদ বিশ্রী। জিভ, গলা গরম হয়ে গেল। শাজাহান গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, 'এই ঘরটা বেশ ভালো, হাতের কাছে সব। আমি যদি হোল লাইফ এই ঘরে থাকতে পারতাম।'
'তোমার বউ-বাচ্চার কী হবে?' জিয়া হাসল।
'আরে ছোড়। আমি যদি এখন মরে যাই তাহলে ওদের যা হবে তখনও তাই হবে। আমার এক চাচাতো ভাই ওদের দ্যাখাশোনা করবে।' শাজাহান বলল।
'তার কী মাথা ব্যথা?'
'আমার সন্দেহ, ধরতে পারিনি এখনও, ব্যাটা আমার বউ-এর সঙ্গে প্রেম করে। যখনই বাসায় আসে তখনই ভাবির জন্যে কিছু না কিছু নিয়ে আসে।'
' পেছনে একটা লাথি চালিয়ে দিতে পারো না?'
পাগল। বাপ-চাচারা জিজ্ঞাসা করবে কেন লাথি মারলি? জবাব দেব কী?' ' 'ছাড়ো ওসব কথা। এই যে মতিনভাই, কেমন লাগছে? জিয়া জিজ্ঞাসা করল। 'ভালো না।' সত্যি কথাটা বলল মতিন।
'প্রথমবার সবাই বলে। পানিতে পা দিয়েছ, ডুব দিয়ে সাঁতার কাটলে তবে তো আরাম হবে।' হো-হো শব্দে হাসতে লাগল জিয়া।
সকালে ঘুম ভাঙতেই মনে হল জিয়াভাই ঠিক বলেছিল। কাল রাত্রে দুই গ্লাস খেয়েছিল সে। সঙ্গে খানিকটা ডিমভাজা। তারপর আর ভাত খায়নি। খেতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু সকালে বুঝতে পারল শরীরে আর কোনও অস্বস্তি নেই। ওষুধটা বেশ ভালো। জিয়া এবং শাজাহান তখনও ঘুমাচ্ছিল। টয়লেট থেকে দাঁত মেজে পরিষ্কার হয়ে হঠাৎ কী মনে হল, দরজা খুলে বাইরে এল মতিন। পাশের দরজাটা বন্ধ। টিয়া নামের মেয়ে ওখানেই থাকে। ওর সঙ্গে আলাপ হওয়ার কথা কাল সঙ্গীদের বলা হয়নি। কাল রাত্রে মদ খেয়ে ওরা মেয়েদের সম্পর্কে অশ্লীল কথা বলছিল বলেই বলতে ইচ্ছে করেনি।
সিঁড়িটা ফাঁকা, এখনও ছায়া ছায়া। ভারী দরজাটা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল সে। এখনও ভালো করে সকাল হয়নি, রাস্তায় লোক বেশ কম। একটু হাঁটতেই ঘুমদুম আওয়াজ শুনতে পেয়ে দেখল বেশ কিছুটা দূরে মাটির অনেক ওপর দিয়ে ট্রেন ছুটে যাচ্ছে। এরকম দৃশ্য কখনও দ্যাখেনি সে। যদি কোনওভাবে লাইন থেকে সরে যায় তাহলে এতবড় ট্রেনটা অনেক নীচে আছড়ে পড়বে।
দৃশ্যটা কল্পনা করতেই শিউরে উঠল মতিন। ওপাশ থেকে আর একটা ট্রেন এল। কিন্তু গতি কমিয়ে সেটা থেমে গেল চোখের আড়ালে। কাছাকাছি কোনও স্টেশন নিশ্চয়ই আছে। আর সেই স্টেশনকে মাটির অনেক ওপরে থাকতে হবে।
সামনেই একটা ছোট্ট মোড়। মতিন দাঁড়াল। দুজন মানুষ বাংলায় কথা বলতে বলতে চলে গেলেন। তাজ্জব ব্যাপার! জায়গাটাকে এখন আমেরিকা বলে ভাবতে অসুবিধে হচ্ছে। এই সময় মতিন টিয়াকে দেখতে পেল। এই সাতসকালে প্যান্ট-শার্ট আর হাতব্যাগ নিয়ে দ্রুত হেঁটে আসছে। কাছাকাছি এসে সে বলল, 'আরে, আপনি।'
'একটু
দেখছিলাম।'
'বেশিদূর যাবেন না; পথ হারিয়ে ফেলবেন।'
'এত সকালে কোথায় যাচ্ছেন?'
'হাসপাতালে।'
'হাসপাতালে? কেউ কি অসুস্থ?'
শব্দ করে হাসল টিয়া, 'না না। আমি হাসপাতালে কাজ করি। ইন্টারপ্রেটার, যেসব বাংলাদেশি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি হন তাদের অনেকেই ইংরেজি বলতে পারে না, ডাক্তার নার্স তাদের সমস্যা বুঝতে পারেন না। আমি তাদের কাছ থেকে জেনে নিয়ে ডাক্তারদের বলি। হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছিল, কাল রাত্রে একজন ভর্তি হয়েছেন কিন্তু তার কী অসুবিধে হচ্ছে বোঝাতে পারছেন না। আমাকে তাই সাতটার মধ্যে পৌঁছতে হবে।' টিয়া বলল।
'হাসপাতাল কত দূরে?'
'কুইন্সে। ট্রেন ধরলে বেশি সময় লাগে না। আচ্ছা, আসি, আবার দ্যাখা হবে।' মাথা নেড়ে এগিয়ে গেল আগের মতো দ্রুত পায়ে।
মুগ্ধ হয়ে গেল মতিন। বাংলাদেশের মেয়ে নিউইয়র্কের হাসতাপাতালে যে কাজ করছে তাতে কত মানুষের উপকার হচ্ছে। তার নিজের তো এই কাজটা করার যোগ্যতা নেই। ইংরেজি ভাষা তার আয়ত্বেও নেই। স্বচ্ছন্দে পড়তে পারে, কিছু বাক্য বলতে পারে কিন্তু সেটা অনুবাদ করে বলতে হয়। স্বচ্ছন্দে বলার অভ্যাস তৈরি হয়নি। টিয়া ওই ব্যাপারে তার থেকে অনেক এগিয়ে আছে।
মুর্শেদ এল ঠিক ন'টার সময়। ততক্ষণে ওরা তিনজন শুধু তৈরি নয়, সেদ্ধ-ভাত খাওয়া হয়ে গিয়েছে। মুর্শেদ ওদের নিয়ে প্রথমে মালখানায় গেল। সেখানে জাহাজে আসা পিচবোর্ডের বাক্সগুলো রাখা ছিল। মুর্শেদ কাগজপত্র দেখিয়ে সেগুলো ছাড়িয়ে একটি ছোট ট্রাকে তোলাল ওদের দিয়ে। তারপর সেই ট্রাকে চেপে ওরা গেল মেলা প্রাঙ্গণে। যাওয়ার পথে মতিন অবাক হয়ে দেখল গাড়ির ভিড় আর আকাশছোঁয়া বাড়ির সারি।
বিশাল হলঘরে প্রচুর স্টল। তার একটা তাদের জন্যে রাখা ছিল। মুর্শেদের সহযোগিতায় খুব দ্রুত বাক্সগুলো থেকে নারী পুরুষদের পোশাক বের করে স্টল সাজানো হল। পেছনের দেওয়ালে কামাল হোসেনের কোম্পানির নাম-ঠিকানা লেখা ফেস্টুন টাঞ্চিয়ে দেওয়া হল। স্টল সাজানো হয়ে গেলে দ্যাখা গেল, ঘড়িতে ঠিক বারোটা বেজেছে।
মুর্শেদ বলল, 'এখন আপনাদের সবাইকে বাইরে যেতে বলবে। ঠিক একটার সময় মেলার উদ্বোধন হবে দরজার ফিতে কেটে। খিদে পেয়েছে?'
জিয়া বলল, 'চা খেতে পারি। এখানে চা পাওয়া যাবে?
'আসুন।'
'কিন্তু সবাই যদি যাই তাহলে, মানে, এগুলো যদি চুরি যায়?'
মুর্শেদ হাসল, 'যাবে না। চারপাশে ক্যামেরা আছে, গার্ড আছে। তা ছাড়া এত সামান্য জিনিস এদেশের মানুষ মেলায় এসে চুরি করে না। রাস্তাঘাটে ছিনতাই যারা করে তারা মেলায় আসে না।'
একটা ব্লক হেঁটে যে দোকানটায় মুর্শেদ ওদের নিয়ে ঢুকল তার নাম ম্যাকডোনাল্ড। গরমজল আলাদা করে নিতে হল, সঙ্গে কাগজের প্যাকেটে চিনি, দুধ, চা। টেবিলে বসে সেগুলো মিশিয়ে চা বানাতে বেশ মজা লাগল। মতিন জিজ্ঞাসা করল, 'চায়ের দাম কত?'
'আশি পয়সা।'
'মাত্র? আমাদের ওখানে ভাঁড়ের চা দুটাকা হয়ে গিয়েছে।'
শোনামাত্র জিয়া এবং শাজাহান খুব হাসতে লাগল। মুর্শেদ বলল, 'ভাই, আমরা এখানে ডলারকে টাকা বলি, সেন্টকে পয়সা। দশ সেন্টে দেশের টাকা সাত টাকা। তার মানে দেশের টাকায়
এই চায়ের দাম ছাপ্পান্ন টাকা।'
' ওরে বাবা।' মুখ থেকে বেরিয়ে এল মতিনের।
মুর্শেদ হাসল, 'এখানকার মানুষ যে যেমনই রোজগার করে তাতে তার কাছে আশি সেন্ট কিন্তু একটুও বেশি বলে মনে হয় না। এদেশে থাকলে দেশের টাকার কথা ভাবলে মন খারাপ হবে। না ভাবাই ভালো।'
বিকেল পাঁচটার পর একটু একটু করে ভিড় বাড়তে লাগল। জিয়া এবং শাজাহান খদ্দেরদের সামলাচ্ছিল, মতিন ওদের সাহায্য করছিল। সে লক্ষ্য করছিল, ক্রেতাদের মধ্যে বেশিরভাগই হয় বাংলাদেশের নয় পাকিস্তানের মানুষ। মহিলাদের সংখ্যাই বেশি। সে ভেবেছিল এই মেলায় আমেরিকান
সাদারাই ভিড় জমাবে।
রাত নটায় যখন মেলা বন্ধ হল তখন বেশ ভালো বিক্রি হয়ে গেছে। যেগুলো হয়নি সেগুলো বাক্সবন্দি করে রাখা হল। বিক্রির অর্থ মুর্শেদকে দিল শাজাহান। তার বদলে মুর্শেদ একটা রসিদ লিখে দিল। নিউইয়র্কে কোনও কোনও ব্যাংক রাত এগারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে। কিন্তু সেগুলোতে অ্যাকাউন্ট না থাকায় ঝুঁকি নিতে হবে মুর্শেদকে। কয়েক হাজার ডলার বাসায় নিয়ে যেতে হবে কাল ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্যে। এই সময় মুর্শেদের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। সে খুব বিনীত গলায় জানিয়ে দিল, আজ মেলা কীরকম হয়েছে এবং বিক্রি থেকে কত ডলার পাওয়া গিয়েছে। সে ফোন বন্ধ করে হাসল, 'বড় সাহেবের ফোন, এখন তো ঢাকায় সকাল।'
হঠাৎ মনে পড়ে গেল মতিনের। সে বলল, 'মুর্শেদভাই, একটা নাম্বার ধরে দেবেন?' 'দেশে ফোন করলে এখান থেকে না করাই ভালো। বেশি খরচ পড়ে। আমি পরে একটা কার্ড দিয়ে দেব। দু'টাকায় একশো মিনিট কথা বলা যায়।
'না, না। দেশে না। এইখানেই একজনকে।'
'নাম্বার কী?'
হিপ পকেটে রাখা কয়েকটা ভাঁজ করা কাগজের একটা খুলল মতিন। ছুটির লিখে দেওয়া নাম্বারটায় চোখ বুলিয়ে কাগজ এগিয়ে দিল সে। মুর্শেদ নাম্বার দেখে দেবে বোতাম টিপে কানে রাখল যন্ত্রটা। তারপরে বলল, 'হ্যালো, এখানে একটু কথা বলুন ভাই।' মতিনকে রিসিভারটা দিতেই সে কানে চেপে বলল, 'হ্যালো। সেলামালুকম! আমার নাম মতিন। কালই এদেশে এসেছি। আপনি
কি ফয়েজভাই?
এপাশ থেকে একটু সরু গলায় জবাব এল, 'হ্যাঁ।'
'আপনার বাসা কি মীরপুরে?'
'হ্যাঁ। একসময় ওখানেই থাকতাম। কী ব্যাপার বলুন?'
'আমরা গার্মেন্টসের মেলায় এসেছি। কয়েকদিন থাকব। আপনি যদি দয়া করে এখানে আসনে তাহলে খুব ভালো হয়। সামনা-সামনি কথা বলব।' মতিন বলল।
'মেলাটা কোথায় হচ্ছে?'
'আমি মুর্শেদভাইকে ফোনটা দিচ্ছি, উনি বলে দেবেন।'
'মুর্শেদভাই কে?'
'যে কোম্পানির হয়ে এসেছি সেই কোম্পানির এখানকার ম্যানেজার।'
কথাটা শুনে মুর্শেদ হেসে ফেলল। তারপর ফোনটা নিয়ে ফয়েজকে ভালোভাবে ঠিকানাটা বুঝিয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'তা হলে কবে আসবেন? কাল তো ছুটির দিন। কালই আসুন। মেলায় ঢুকে একেবারে বাঁ-দিকে চলে আসবেন। কামাল হোসেন ফেস্টুন ঠিক চোখে পড়বে।'
ফোন মাথা নাড়ল মতিন, 'আমি জানি না।'
বন্ধ করে মূর্শেদ মতিনকে জিজ্ঞাসা করল, 'লোকটি কী করে?'
জিয়া জিজ্ঞাসা করল, 'এই যে বললে কথা আছে, অচেনা লোককে কী কথা বলবে?' মতিন দ্বিধায় পড়ল। ছুটির কথা এদের বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছিল না।
শাজাহান বলল, 'তুমি লোকটাকে চেনো না অথচ তার ফোন নাম্বার জেনে ফোন করে আসতে বললে। এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার হলে বলার দরকার নেই।' 'না না, আমার কোনও ব্যাপার নয়।' মাথা নাড়ল মতিন? তারপর ছুটির বলা কথাগুলো
ওদের শোনাল। মুর্শেদ বলল, 'ফোন করেছিল। অন্য কেউ ধরতে পারে, ওকে বলেনি। কিন্তু তিন-তিনটি চিঠি পেয়েও জবাব দেয়নি কেন? মামলা ভালো লাগছে না। দেখি কাগজটা।'
কাগজটা আবার মতিনের কাছ থেকে নিয়ে ঠিকানা পড়ে বলল, 'এখানে আসতে ওর ঘণ্টাখানেক ট্রেনে লাগবে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, লোকটা আসবে না।'
'আসবে না?' অবাক হল মতিন।
'ছুটিকে দেখতে কেমন?'
'ভালো। মানে আমাদের ঘরের মেয়েরা যেমন হয়।'
'ওর বাপের অবস্থা কেমন?'
'সাধারণ।'
'তাহলে তাকে বলে দেওয়া উচিত, সে যেন ফয়েজের জন্যে আর অপেক্ষা না করে। এ ধান্দাবাজ ছেলে, এই দেশ তার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে। দ্যাখো, এখানেই হয়তো কাউকে বিয়ে করে সংসার করছে।' মুর্শেদ বলল।
মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল মতিনের। কিন্তু সে খুব আশা করেছিল ফয়েজ মেলায় আসবে। আসেনি।
রবিবার মেলার শেষদিন। ভিড় বেশি। দেশ থেকে পাঠানো প্রায় সব মালই বিক্রি হয়ে গেছে এই ক'দিনে। তাই আজ ক্রেতাদের ফেরাতে হচ্ছে। বিকেলে মতিনকে অবাক করে টিয়া এল। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, 'একি! স্টল যে ফাঁকা।'
জিয়া বলল, 'হ্যাঁ, আপা। সামনের বছর আরও বেশি স্টক আনব।'
টিয়া মতিনকে বলল, 'তা হলে তো আপনি এখন ফ্রি। চলুন, চা খেয়ে আসি।'
সঙ্গে সঙ্গে শাজাহান এবং জিয়ার চোখ বড় হয়ে গেল। ওরা ভাবতেই পারছিল না টিয়ার মতো স্মার্ট সুন্দরীর সঙ্গে মতিনের পরিচয় আছে। ওদের সম্মতি নিয়ে মতিন টিয়ার সঙ্গে বাইরে বের হল। জিজ্ঞাসা করল, 'ম্যাকডোনাল্ডে যাবেন?'
'না! ওদিকে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে।'
এইসময় দুটো ছেলে বেশ জোরে দৌড়ে আসছিল। তাদের একজন মতিনকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। মাটিতে পড়ে যাওয়া মতিনকে দ্বিতীয়জন তুলে আগের গতিতে চলে গেল। টিয়া চিৎকার করে গলাগালি দিল ওদের। তারপর ব্যস্ত গলায় বলল, 'দেখুন তো, আপনার পকেটে যা ছিল তা ঠিকঠাক আছে কি না।'
ততক্ষণে ধাক্কা সামলেছে মতিন। পকেটে হাত দিতেই সে চমকে উঠল। দ্বিতীয় পকেটে শুধু রুমাল ছিল, এখনও আছে। প্রথম পকেটে পাসপোর্ট এবং পার্সটা ছিল। সেগুলো নেই। সে চোখ তুলে দৃষ্টিসীমার মধ্যে সেই ছেলেগুলোকে দেখতে পেল না।
মতিনের মুখের চেহারা দেখে টিয়া বুঝতে পারল পকেট থেকে কিছু চলে গেছে। সে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'কী ছিল পকেটে?'
'পাসপোর্ট আর টাকার ব্যাগ।' মতিনের গলা ভেঙে গেল।
'সর্বনাশ। পাসপোর্ট পকেটে নিয়ে এসেছিলেন?'
'হ্যাঁ। ওরা বলেছিল সঙ্গে রাখা উচিত।'
'পাসপোর্ট তো ওদের কাজে লাগবে না। চলুন আগে গিয়ে দেখি!'
টিয়াকে অনুসরণ করল মতিন, 'ওরা কারা?'
'ছিনতাই করে। যা পায় তাই নিয়ে নেশার খরচ চালায়।' টিয়া দ্রুত হাঁটছিল। রাস্তাটার বাঁকে এসে চারদিক খুঁজল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, 'এখনই থানায় যেতে হবে। আগে মেলায় চলুন।'
মেলায় এসে পাসপোর্ট পকেটমার হওয়ার ঘটনাটা বলতেই সবাই হায় হায় করে উঠল। জিয়া বলল, 'সর্বনাশ। এখন তুমি বাংলাদেশে যাবে কী করে?'
'মানে?' চমকে উঠল মতিন।
মুর্শেদ বলল, 'ফেরার সময় এয়ারপোর্ট তোমার পাসপোর্ট দেখতে চাইবে? পাসপোর্টের মধ্যে ভিসা আছে। ওটা না দেখালে টিকিট থাকা সত্ত্বেও ওরা বোর্ডিং কার্ড দেবে না। খুব সমস্যা হয়ে গেল।'
টিয়া বলল, 'এখনই থানায় গিয়ে ডায়েরি করতে হবে। ডায়েরি করে বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে জানালে তারা দেশ থেকে ডুপ্লিকেট পাসপোর্ট আনিয়ে দিতে পারে। পাসপোর্ট নাম্বার জানা আছে?'
মাথা নাড়ল মতিন, 'না।'
শাজাহান বলল, 'আমাদের তিনজনের পাসপোর্ট নম্বর আমার কাছে লেখা আছে। চলুন,
থানায় যাই।'
জিয়া বলল, 'কিন্তু আমাদের তো দুদিন পরে প্লেনের টিকিট করা আছে। তার মধ্যে সব কাজ হয়ে যাবে?'
মুর্শেদ মাথা নাড়ল, 'পাগল! থানায় রিপোর্ট করলে মতিনের এদেশে থাকার একটা যুক্তি তৈরি হবে। তারপর বাংলাদেশ দূতাবাস কতদিনে পাসপোর্ট দেশ থেকে আনিয়ে দেয় অথবা দেশ থেকে সত্যতা যাচাই করে এখান থেকেই ডুপ্লিকেট পাসপোর্ট ইস্যু করতে পারে। তবে ওদের কাছে অ্যাপ্লাই করার পর মতিনকে যেতে হবে ইউনাইটেড স্টেটস ইমিগ্রেশন দপ্তরে। ওদের সব জানালে ওরা যদি সন্তুষ্ট হয় তাহলে যতদিন পাসপোর্ট না পাচ্ছে ততদিন এখানে থেকে কিছু রোজগারের জন্যে সাময়িক ওয়ার্ক পারমিট দিতে পারে।'
মুর্শেদের কথাগুলো কানে ঢুকছিল না মতিনের। চোখের সামনের পৃথিবীটা এখন আবছা হয়ে গেছে। চারপাশের মানুষদের অস্তিত্ব তার চেতনায় নেই। তার দেশ, বাংলাদেশের জন্যে তীব্র আবেগে সে খান খান হয়ে যাচ্ছিল।
পুলিশ অফিসার কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকলেন। এতক্ষণ টিয়া তাঁকে সবকথা বলেছে, মতিন এবং মুর্শেদ পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নেড়েছে।
এবার অফিসার আসন ছেড়ে মতিনকে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যেতে বললেন। মুখ গম্ভীর, পুরু ঠোঁট যার নীচেরটা ওপরটাকে শক্ত করে ধরে আছে। মতিন এগোল।
'এই গল্পটা কখন বানালে তোমরা?' খুব নীচু গলায় বললেন অফিসার। মতিন চেষ্টা করল বাংলায় যা বলবে তা ইংরেজিতে অনুবাদ করতে। কিন্তু গোলমাল হয়ে গেল। সে শুধু বলতে পারল, 'নো-নো-নো।'
'কী নো?' চিৎকার করে বললেন অফিসার, 'এসব গল্প বলে কোনও লাভ হবে না। পকেটমার আর কিছু নিল না তোমার পাসপোর্ট নিয়ে গেল। বাঃ।'
টিয়া বলল, 'স্যার, ওর পকেটে পার্স ছিল, সেটাও নিয়েছে।'
'পার্স? কতছিল পার্সে?' অফিসার মতিনকে জিজ্ঞাসা করল।
'সেভেন, সেভেন ডলার্স।' কোনওরকমে বলল মতিন।
'মাইগড! মাত্র সেভেন ডলার্সের জন্যে তোমরা পুলিশ স্টেশনে এসেছ?'
'স্যার, মাই পাসপোর্ট? আই ওয়ান্ট টু গো ব্যাক হোম।'
'হোম? কোথায় থাকো তুমি? পাকিস্তান। ইন্ডিয়া?'
'নো স্যার। বাংলাদেশ।' এবার স্পষ্ট উচ্চারণ করল মতিন।
'ইউ ওয়ান্ট টু গো ব্যাক? বাংলাদেশ? সিওর?'
'ইয়েস স্যার।'
'তা হলে একটা কাগজে ঠিক কী কী কোথায় হয়েছিল লিখে আনো।' মিনিট ছয়েক বাদে টিয়ার লিখে দেওয়া দরখাস্ত অফিসারের সামনে রাখল মতিন। টিয়া বলল, 'স্যার, মতিন যদি পাসপোর্ট ফেরত না পায় তা হলে খুব বিপদে পড়ে যাবে। দুদিন বাদে ওর দেশে ফেরার কথা। প্লেনের টিকিট কাটা আছে। দেশে যেতে না পারলে এখানে ও কোথায় থাকবে, একটু ভেবে দেখুন।'
'ওকে বলো কোনও একটা ক্রাইম করতে। তা হলে অন্তত এক বছরের জন্যে ওর থাকা- খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। তার বেশি ভাবার কোনও ক্ষমতা আমার নেই।'
ডায়েরির নাম্বার দেওয়া স্বীকৃতিপত্র নিয়ে ওরা যখন বেরিয়ে এল, তখন রাত নেমে গেছে। এতক্ষণ মতিনের সঙ্গী শাজাহান এবং জিয়া বাইরে দাঁড়িয়েছিল। পুলিশের কাছে যাবে না বলে ভেতরে ঢোকেনি। শাজাহান জিজ্ঞাসা করল, কী বলল? পাসপোর্ট পাওয়া যাবে?'
মুর্শেদ বিরক্ত হয়ে বলল, 'কী করে বলবে? ওরা কি ম্যাজিক জানে?' জিয়া মাথা নাড়ল, 'তা হলে কী হবে?'
'কাল সকালে বাংলাদেশ দূতাবাসে যেতে হবে। আমি বড় সাহেবকে সব জানিয়ে দিচ্ছি। এখনও বাংলাদেশে ভালো করে সকাল হয়নি। একটু পরে ফোন করব।' মুর্শেদ চিন্তিতগলায় বলল, 'কিন্তু মতিনভাই, কাল সকালে আমি আসতে পারব না। বাংলাদেশ দূতাবাস কোথায় বুঝিয়ে দিলে যেতে অসুবিধা হবে না।'
'আপনি সঙ্গে থাকলে ভালো হয়।'
'আরে জরুরি কাজ না থাকলে তো সমস্যা হত না। আপনি পারবেন?' মুর্শেদ টিয়াকে জিজ্ঞাসা করলে সে বিব্রত হয়ে বলল, 'কাল ভোর থেকে ডিউটি। দুটোর পর যেতে পারি।'
'তখন গেলে কাজ হবে কি না জানি না।'
হাঁটতে হাঁটতেই ওরা বাসায় পৌঁছে গেল। টিয়া আর কথা না বলে ভেতরে ঢুকে গেলে জিয়া অবাক হয়ে বলল, 'আচ্ছা ইনি এই বিল্ডিং এই থাকেন।'
কেউ জবাব দিল না। মুর্শেদ পকেট থেকে দশ ডলারের পাঁচটা নোট বের করে মতিনের হাতে দিল, 'এই দুদিন তো থাকা খাওয়ার সমস্যা হবে না। তারপরে বড় সাহেব যা বলবেন সেইমতো ব্যবস্থা হবে।' তারপর তিন জনকেই কীভাবে দূতাবাসে যেতে হবে বুঝিয়ে দিল সে। বলল, 'সকাল আটটার মধ্যে বেরিয়ে যাবেন।'
মুর্শের চলে গেলে ওরা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই মতিন দেখল টিয়া তাদের ফ্ল্যাটের আধখোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেখে বলল, 'এইমাত্র পুলিশ স্টেশন থেকে ফোন এসেছিল। একটা পাসপোর্ট টুকরো টুকরো অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। নামধাম ছবির পাতাটা ওর মধ্যে নেই।'
জিয়া জিজ্ঞাসা করল, 'আপনাকে ফোন করেছে?'
'হ্যাঁ। ওঁর অ্যাপ্লিকেশনে আমি এই বাড়ির ঠিকানা আর আমার ফোন নাম্বার দিয়েছিলাম। ওগুলো না দিলে পুলিশ অ্যাপ্লিকেশন অ্যাকসেপ্ট করত না।' ফ্ল্যাটের ভেতরে চলে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল টিয়া।
নিজেদের ঘরে ঢুকেই জিয়া বলল, 'নামটা ভালো। টিয়া। একলা থাকে না স্বামী-টামী আছে?' শাজাহান বিচিয়ে উঠল, 'আছে কি নেই তাতে তোমার কী মিএর? একসঙ্গে এসে একজনকে না নিয়ে ফিরব, তার জন্যে কোনও চিন্তা হচ্ছে না তোমার?'
'হচ্ছে। কিন্তু তার জন্যে আমি খাওয়াদাওয়া বন্ধ করব না, টয়লেটেও যাব। বাপ-মা মারা যাওয়ার পর একবছর বউকে চুমো খায় না এমন কোনও গর্দভের নাম বলতে পারো?' জিয়া হাসল, 'মতিনভাই! মিছামিছি ভয় পাচ্ছ। আমি তো বলব তোমার কপাল খুলে গেল।'
মতিন অবাক হয়ে তাকাল।
'এই আমেরিকায় এসে থাকার স্বপ্ন হাজার হাজার ছেলে দ্যাখে। ভিসা পায় না বলে আসতে পারে না। তাই চোরাই পথ ধরে। জাহাজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে ঢোকে, মেক্সিকো থেকে লুকিয়ে বর্ডার পার হয়। কেন করে? না, এখানে এক ডলার রোজগার করলে সেটা দেশের টাকায় সত্তর টাকা হয়ে যাবে। তুমি চুরি করে ঢোকনি। পুলিশের কাছে পাসপোর্ট হারাবার ডায়েরি করেছ, কাল দূতাবাসে গিয়ে রিপোর্ট করবে। অতএব তুমি বৈধভাবে থাকবে এদেশে। আমরা দেশে ফিরে গিয়ে কী করব? দু'হাজার টাকার ইলিশ মাছ জিন্দেগিতে কিনতে পারব না। এই সত্যিটা ভেবে দ্যাখো। তুমি তো বেকার ছেলে। দেশে ফিরে গিয়ে আবার বেকার হবে?'
শাজাহান মন দিয়ে জিয়ার কথাগুলো শুনছিল। এবার মাথা নেড়ে বলল, 'কথাটা মিথ্যে নয়। কিন্তু পরিবারকে ছেড়ে থাকাটাও কম কষ্টের নয়। তা ছাড়া থাকবে কোথায়? খাবে কী? এই ঘর তো দুদিন বাদেই ছেড়ে দিতে হবে?'
'আঃ। নানিদের মতো কথা বোলো না তো। পুরুষ মানুষ, বিয়ে-শাদি না করলে ঠিক পাখির মতো। আকাশে উড়লেই দেখতে পায়, কত গাছের ডাল তার জন্যে খালি আছে। ঠিক ব্যবস্থা হয়ে যাবে মতিনভাই। তবে একটা ব্যাপারে সতর্ক থেকে। কখনও কোনও মেয়েমানুষের ফাঁদে পা দিও না। বাস, তা হলে আর কোনও সমস্যা হবে না।' জিয়া এবার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।
ঘুম ভেঙেছিল কাকভোরে। কিন্তু মতিন আজ বের হল না। বের হলে টিয়ার সঙ্গে দ্যাখা হত। কিন্তু কীরকম লজ্জাবোধ হল। তারপর কাল রাত্রে জিয়ার বলা কথাগুলো মনে পড়ল। টিয়ার বাসায় কে কে আছে সে জানে না। টিয়াও বলেনি। কাল টিয়া তার জন্যে অনেক করেছে। সে কথা বলতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে মেয়েটাও সমস্যায় পড়তে পারে।
সকাল আটটায় তৈরি হয়ে দরজায় তালা দিয়ে তিনজনে বের হল। স্টেশনে যাওয়ার সিঁড়ি যেখান থেকে উঠেছে তার বাঁ-দিকে বেশ কয়েকশো দোকান। সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা। একটা দোকানের কাউন্টারের ওপর বোর্ডে লেখা, 'বাংলাদেশে কথা বলুন। দু'ডলারে একশ মিনিট টকটাইম।'
তিনজনে পরামর্শ করে একটা কার্ড কিনে ফেলল। সেলসম্যান বাংলাদেশের ছেলে। ওরা জিজ্ঞাসা করে জানল ওর বাসা খুলনায়। সে দেখিয়ে দিল কী করে কার্ডের নাম্বার ব্যবহার করতে হয়। ওদের মোবাইল ফোন নেই জেনে ছেলেটি নিজেরট' ব্যবহার করতে দিল। প্রথমে জিয়া কথা বলল ওর বড়ভাই-এর সঙ্গে। প্রত্যেকের খবর নিয়ে জানিয়ে দিল কবে দেশে ফিরছে। তারপর শাজাহান তার বাড়ির নাম্বার বলল। ছেলেটি ডায়াল করে দিলে সে কান চেপে শ্বাস বন্ধ করল। ফোনটা বেজে গেল, কেউ ধরল না। দ্বিতীয়বারে বাবার গলা পেগ শাজাহান। জানল, বউ তার ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়িতে চলে গেছে ঝগড়া করে। সে ফোন ফিরিয়ে দিল ছেলেটিকে। এবার মতিনের পালা। সে জিয়ার দিকে তাকাল, 'বাসায় কী বলব?'
'এসব বলার কোনও দরকার নেই। জিজ্ঞাসা করলে বলো ফিরতে বোধহয় দেরি হবে।'
জিয়া উপদেশ দিল।
নাম্বার ডায়াল করার পরে রিং শুরু হল। তারপরেই বাবার গলা 'হ্যালো।'
'আমি মতিন। কোনও অসুবিধে হয়নি আসতে। এখানে ভালো আছি।'
'এত দেরি হল কেন খবরটা জানাতে?'
'ফোন পাইনি।'
'তোমার তো ফেরার সময় হয়ে গেল!'
ঢোঁক গিলল মতিন, 'না, মানে একটু দেরি হবে। আর একটা কাজ শেষ করে যেতে হবে।
আমি ফোন করে জানিয়ে দেব। রাখছি।'
দ্রুত লাইন কেটে দিল সে। সেলসম্যান ছেলেটি অবাক হয়ে বলল, 'ওইভাবে কথা শেষ করলেন কেন?'
'আর মিথ্যে কথা বলতে পারছিলাম না।'
'মিথ্যে কথা বলতে হবে কেন?'
জিয়া বলল, 'প্রাইভেট ব্যাপার ভাই। কত দিতে হবে?'
'তিন ডলার দিন। দু'ডলার কার্ডের জন্যে, এক ডলার এই ফোন ব্যবহার করার জন্যে।'
ছেলেটি গম্ভীর গলায় বসল।
জিয়া মতিনকে বলল, 'দামটা মুর্শেদভাই-এর টাকা থেকে দিয়ে দাও।'
মুর্শেদের দেওয়া ডলার থেকে ট্রেনের টিকিও কেনা হল। এতদিন ট্রেনের আওয়াজই শুনতে পেত মতিন, আজ ট্রেনে উঠে বুঝল এর সঙ্গে দেশের ট্রেনের কোনও তুলনাই চলে না।
মুর্শেদ ঠিকই বলেছিল, ঠিকানা হাতে থাকলে খুঁজে পেতে অসুবিধে হয় না। বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে গিয়ে মনটা শান্ত হল কিছুটা। মতিন দেখল তাদের জাতীয় পতাকা সগর্বে উড়ছে। দুজন বাংলাদেশি অফিসার সামনের রিসেপশনে বসে আছেন। সব কথা বলার পর তাঁরা বললেন, 'আমাদের এখানে প্রায়ই এইরকম সমস্যা নিয়ে অনেকে আসেন। পুলিশের কাছে গিয়ে একটা ডায়েরি করিয়া আনা খুব সহজ ব্যাপার। আপনি ওই ঘরে গিয়ে সেক্রেটারির সঙ্গে দ্যাখা করুন। উনি ফলস কেস হলে আপনাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন। সেটা বুঝে ওঁর কাছে যান।' 'ফসল কেস কেন হবে? কাল বিকেলে দুটো ছেলে আমার পকেট মেরেছে।' মতিন বেশ জোর দিয়ে বলল।
সেক্রেটারির কাছে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া গেল পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে। ভদ্রলোক মধ্য পঞ্চাশের, সুট, টাই এবং মাথায় বিরাট টাক। মতিনের মুখে সমস্ত ঘটনাটা শোনার পর জিজ্ঞাসা করলেন, 'যে পকেটে পার্স ছিল, সেই পকেটেই পাসপোর্ট রেখেছিলেন?
হ্যাঁ।
'অন্য পকেটে রাখেননি কেন?'
হকচকিয়ে গেল মতিন। সে অসহায় চোখে সঙ্গীদের দিকে তাকাল। সেক্রেটারি বললেন, 'আপন'রা সঙ্গে পাসপোর্ট রেখেছেন?' শাজাহান এবং জিয়া একসঙ্গে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। 'যে পকেটে পাসপোর্ট আছে সেই পকেটেই কি পার্স রেখেছেন?'
শাজাহান বলল, 'আমি পার্স ব্যবহার করি না স্যার।'
জিয়া বলল, 'আমিও।'
কাঁধ ঝাঁকালেন সেক্রেটারি। মতিনকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'কত ডলার ছিল পার্সে?'
'সাত ডলার কুড়ি সেন্ট।'
'বাড়িতে কত রেখে গিয়েছিলেন?'
'আমার কাছে আর ডলার ছিল না।'
'মাইগড। মাত্র সাত ডলার নিয়ে আমেরিকায় আছেন।
শাজাহান বলল, 'স্যার, খাওয়া থাকার তো খরচ হচ্ছে না। তা ছাড়া পরশু তো চলে যাওয়ার
কথা, তাই ডলারের দরকার হত না।'
'আপনারা কামাল হোসেন সাহেবের কর্মচারী?'
'হ্যাঁ স্যার।'
'আপনার পাসপোর্টের নাম্বার, কবে ইস্যু হয়েছিল তার ডিটেলস দিয়ে একটি দরখাস্ত লিখুন। তাতে বলুন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডুপ্লিকেট পাসপোর্ট আপনাকে ইস্যু করতে। যান।' 'আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব স্যার?' শাজাহান বলল।
'আমাকে কিছু দিতে হবে না। ও যতদিন দেশে যেতে না পারছে ততদিন কী খাবে, কোথায় থাকবে তাই নিয়ে ভাবুন।' সেক্রেটারি ফাইলে মন দিলেন।
ভাগ্যিস পাসপোর্ট নাম্বার, তারিখ, শাজাহানের কাছে লেখা ছিল। সেইটে দেখে ওরা বাংলায় একটা দরখাস্ত লিখল। সেটা হাতে পেয়ে সেক্রেটারি চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, 'এই পাসপোর্ট জেনুইন কিনা জানতে দেশে পাঠাচ্ছি। ওরা যত তাড়াতাড়ি রিপোর্ট দেবে তত আপনার পক্ষে মঙ্গল হবে। আপনারা দুজন তো দেশে ফিরে যাচ্ছেন। গিয়ে মালিককে বলুন তদ্বির করতে, যাতে দেশ থেকে তাড়াতাড়ি রিপোর্ট আসে। আর হ্যাঁ, আমি এর জেরক্সের ওপর অফিসিয়াল অ্যাকসেপ্টেন্স লিখে দিচ্ছি। ওটা নিয়ে আজই ইউ এস ইমিগ্রেশনের কাছে যান। ওরা যদি স্যাটিসফায়েড হয়, তা হলে আপনাকে টেম্পোরারি ওয়ার্ক পারমিট দেবে। আপনারা বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন!' আধঘণ্টা পরে আবার ডাক এল। সেক্রেটারি একটা খাম এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, 'কতদূর পড়েছেন?'
'বি.এ. পাশ করেছি। ইতিহাসে অনার্স।'
ড্রয়ার থেকে একটা কার্ড বের করে এগিয়ে দিলেন ভদ্রলোক, 'তিন-চারদিন পরে আমাকে ফোন করবেন। বাই দ্য বাই, আপনি ওয়ার্ক পারমিট যদি না পান তা হলে শিকাগোতে চলে যান।'
'শিকাগো।'
'হ্যাঁ। গ্রে হাউন্ডে চলে যেতে পারেন, যদি ভাড়া জোগাড় করতে পারেন। আমেরিকায় বিভিন্ন স্টেটে নিয়মকানুনের তফাত আছে। ওখানে থাকলে অনেক সুবিধা হবে।' মাথা দোলালেন সেক্রেটারি।
এখন দুপুর। শাজাহান বলল, 'এখন বাসায় ফিরে যাওয়াই ভালো।'
মতিন অবাক হল, 'সে কি? ইউ এস ইমিগ্রেশনে যাব না?'
'আমার মনে হচ্ছে সেখানে ভিড় বেশি হবে। তা ছাড়া ওই অফিসটা কোথায় খুঁজে বের
করতেই বিকেল হয়ে যাবে। তার চেয়ে চলো, এখন বাসায় গিয়ে ভাত খাই।'
শাজাহানের কথা শুনে খিঁচিয়ে উঠল জিয়া, 'শালা এই জন্যে বলে ভেতো বাঙালি। এখন বাসায় না গিয়ে একটু ঘুরেটুরে দেখি।'
'তোমার খিদা পায়নি?' শাজাহান প্রশ্ন করে।
জিয়া চারপাশে তাকাল, খানিকটা দূরে একটা চারচাকার গাড়িকে দোকান বানিয়ে খাবার বিক্রি করছে একটা লোক। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে ভেতরে গ্যাস জ্বালিয়ে গরম খাবার দিচ্ছে।
সে সঙ্গীদের নিয়ে দোকানের সামনে হাজির হল। সামনের দেওয়ালে কী কী পাওয়া যাবে তা লেখা থাকে। জিয়া বলল, 'গরম কুত্তার দাম একশো টাকা।'
শাজাহান বলল, 'মানে?'
জিয়া আঙুল তুলে দেখাল 'হট ডগ, এক ডলার ত্রিশ সেন্ট।' শাজাহান সন্দিগ্ধ হল, 'কুকুরের মাংস নাকি?'
সঙ্গে সঙ্গে ভ্যানের ভেতরে দাঁড়ানো লোকটি হো-হো শব্দে হেসে উঠল, মনে হচ্ছে নতুন
আমদানি। কবে আসা হল?'
ওরা তিনজনেই অবাক। জিয়া জিজ্ঞাসা করল, 'আপনি বাঙালি?'
'চিটাগাং। না ভাই, হটডগে গরম কুত্তা নেই। এইটে বিফ দিয়ে তৈরি। দেব নাকি তিনটে?
লোকটি হাসল।
জিয়া সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল।
খেতে খারাপ লাগল না। জিয়া জিজ্ঞাসা করল, 'পানি পাওয়া যাবে?' 'সিওর।' একটা বোতল এগিয়ে দিল লোকটি।
শাজাহান জিজ্ঞাসা করল, 'আপনি কতদিন এই ব্যাবসা করছেন?
'তিন বছর হয়ে গেল। জামাইকায় থাকি। ঘর ভাড়াই পড়ে বারোশো ডলার। এখানেই বিয়ে করেছি। বাংলাদেশের মেয়ে। কী করব। একা থাকা তো যায় না।'
'দেশে কেউ নেই?' মতিন প্রশ্নটা করল।
'সবাই আছে রে ভাই। বাপ মা ভাই বোন, বউ বাচ্চা।'
জিয়া হেসে ফেলল, 'দেশের বউ জানে যে আপনি এখানেও বিয়ে করেছেন?'
'জানবে না কেন? কিছু করার নেই তার। আমি যে তার কাছে মরা মানুষ।'
'তার মানে?' শাজাহান জিজ্ঞাসা করল।
'আমি তো আর দেশে ফিরে যেতে পারব না। পাসপোর্ট নেই। জাহাজ থেকে লাফ
মেরেছিলাম। সাঁতার কেটে মাঝরাতে ডাকায় উঠেছিলাম। এখন হলে পারতাম না।' 'কেন?' মতিন প্রশ্ন করল।
'এখন পাড় থেকে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার সাগরের ভিতরে জাহাজ দাঁড় করায়। ওখানে লাফিয়ে অতটা পানি সাঁতার দেওয়ার ক্ষমতা খুব কম মানুষের আছে। তারপর রাত্তিরবেলায় লাফাতে হয়। কোনও আলো দেখতে পাওয়া যাবে না। ভুল দিকে সাঁতার কাটলে তো আর সকাল হবে না। তারপর এদিকের সমুদ্রে হাঙরের উপদ্রব খুব। এখন তো পাসপোর্ট ছাড়া খুব কম মানুষ আসতে
পারে।' লোকটি বলল, 'সাড়ে চার ডলার হয়েছে আপনাদের।
জিয়া মতিনকে বলল, 'ওটা ওই ডলার থেকে দিয়ে দাও।'
'হিসাব চাইবে কিন্তু-'
'চাইলে যা সত্যি তা বলবে।'
শাজাহান এতক্ষণ শুনছিল। এবার জিজ্ঞাসা করল, 'আপনি বাংলাদেশ দূতাবাসে নিশ্চয়ই গিয়েছিলেন।'
'পাগল! ওরা বুঝত আমি জাহাজ-লাফানো লোক, কোনও হেল্প করত না। হয়তো ভালো মানুষের মতো পুলিশ ডাকত।' মতিনের দেওয়া ডলারের নোট ভাঙিয়ে ব্যালান্স ফেরত দিয়ে দিল লোকটা।
জিয়া জিজ্ঞাসা করল, 'তাহলে আপনি আছেন কী করে এদেশে?'
'আছি!' লোকটা হাসল।
মতিন জিজ্ঞাসা করল, 'আপনি নিশ্চয়ই জানতেন, পাসপোর্ট ছাড়া এদেশে ঢুকলে আর বের
হওয়া যাবে না। দেশে ফিরতে পারবেন না। তা হলে এলেন কেন?' লোকটি মতিনের মুখের দিকে তাকাল, 'কিছু মনে করবেন না ভাই; আপনি কি এখনও বাপের
হোটেলে খান?'
প্রশ্নটা ভালো লাগল না, তবুও মতিন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
'আপনি ভাই বুঝবেন না। দেশে বউ-বাচ্চা থাকা সত্ত্বেও কোনও মাসে পাঁচ-ছ'হাজারের
বেশি কামাই করতে পারিনি। কত ধার করব? কে দেবে ধার? এক দোস্ত পরামর্শ দিল। তাই চলে
এলাম এখানে। এখন এই দোকান চালিয়ে যা রোজগার করি তাতে আমার সংসারের সব খরচ
মিটিয়েও দেশে প্রতিমাসে সাত-আটশো ডলার পাঠাই। ওরা সেটা ভাঙিয়ে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হাজার
টাকা পেয়ে যায়। খুব আরামে আছে ওরা। বড় মেয়েটার বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে। আমি ওখানে থাকসে
ওরা এই আরাম কখনও পেত না।' লোকটি বলল।
মতিন জিজ্ঞাসা করল, 'আপনার নামটা জানতে পারি।'
'হারুণ! এখানে হারুণভাই বললে অনেকেই চিনতে পারবে।'
দূর থেকে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখল ওরা। হঠাৎ মতিন বুঝতে পারল, তার মনে পাসপোর্ট হারাবার শোক এবং ভয় অনেকটা কমে গিয়েছে। আজ নয় কাল সে পাসপোর্ট ফিরে পাবে, কিন্তু হারুণভাই তো জিন্দেগিতে দেশে ফিরতে পারবে না।
সন্ধের পরে মুর্শেদ এল। বলল, 'সাহেব খুব রেগে গিয়েছিলেন পাসপোর্ট হারিয়ে গিয়েছে গুনে। উনি বোধহয় আত্মীয় হন?'
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল মতিন।
'তাই বললেন। আপনার বাব' নাকি ভাববেন উনি প্ল্যান করে আপনাকে আমেরিকায় আটকে রাখতে চান। দুজনের সম্পর্ক বোধহয় ভালো না। মতিন জবাব দিল 'না।'
'আমি বসলাম, আপনার কোনও দোষ নেই। তখন জিজ্ঞাসা করলেন সঙ্গে কে ছিল।" 'আমি ওই মেয়েটির কথা বলতেই রেগে গেলেন খুব: বললেন, বাঃ, এর মধ্যেই সে মেয়ে জুটিয়ে নিয়েছে। যাক গে, বোকাবার পরে একটু শান্ত হলেন তিনি। যখন শুনলেন আপনারা আজ বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়েছেন পাসপোর্টের জন্যে, তখন বললেন শাজাহান ভাইদের হাতে একটা কপি দিয়ে দিতে। উনিও ওখানে তাগাদা দেবেন। কী বলল দূতাবাস?'
শাজাহান বৃত্তান্ত জানাল। কাজটা দেখে খুশি হল মুর্শেদ। বলল, 'এর জেরক্স করে নিতে হবে এক ডজন। খুব দরকারি কাগজ।'
'কাল ইউ এস ইমিগ্রেশনে যেতে হবে।'
'ঠিকানা বুঝিয়ে দিলে যেতে পারবে না?' মুর্শেদ হাসল।
'আপনি সঙ্গে থাকলে ভালো হয়।' মতিন বলল।
"ঠিক আছে। সকাল সাতটায় ট্রেন ধরে সোজা ইউনিয়ন টার্নপাইক স্টেশনে চলে আসবে। প্ল্যাটফর্মে নামতেই আমাকে দেখতে পাবে।'
'কত নম্বর ট্রেনে উঠব?'
'স্টেশনে গিয়ে জিগ্যেস করলেই জেনে যাবে। আর হ্যাঁ, শোনো, তোমার ভাগ্য বেশ ভালো। সাহেব তোমাকে আরও সাতদিন এই ফ্ল্যাটে থাকার অনুমতি দিয়েছেন।'
'জিয়া মাথা নাড়ল, খুব ভালো হল। এই ফ্ল্যাট কার?'
'সাহেবের এক বন্ধুর। ভদ্রলোক মারা গিয়েছেন। ওর স্ত্রীকে খুব সাহায্য করেছেন সাহেব। তাই তিনি সাহেবকে কিছুদিনের জন্যে ফ্ল্যাটটা ব্যবহার করতে দিয়েছেন।' ঘড়ি দেখল মুর্শেদ, 'কী ব্যাপার? আজ আপনারা শুকনো?'
জিয়া হাসল। হাত ঘুরিয়ে বলল, 'পানি শুকিয়ে গেছে।'
'ও। আসেন আমার সঙ্গে। মতিনভাই, কাল সাতটার ট্রেন ধরবে মনে করে।' মুর্শেদ জিয়াকে
নিয়ে বেরিয়ে গেল।
সেদিকে তাকিয়ে শাজাহান বলল, 'জিয়ার এই স্বভাবটা খুব খারাপ। নিজের পয়সায় একবার কিনেছিস, আর কিনবি না, ঠিক আছে। কিন্তু পরের পয়সায় খেতে লজ্জা করছে না? ডাকল আর চলে গেলি। যাই ভাত রাঁধি।'
'শাজাহান ভাই-।'
'বলো।' পেছন ফিরন্স শাজাহান।
'কাল আমি কি একাই যাব?'
'তুমি চাইলে আমরা যেতে পারি। কিন্তু আমাদের যাওয়া আসার খরচ দিলে তোমার ডলার কমে যাবে। পরে খুব দরকার হবে ডলারের।' রান্নাঘারে ঢুকে গেল শাজাহান। পকেট থেকে ফোনের কার্ড বের করল মতিন। এখন কি দেশে ভোর হচ্ছে? কথা বলার উপায় নেই। তার জন্যে একটা ফোনের দরকার হয়। শ্বাস ফেলল সে।
দুই পায়ে শিরশিরানি, তীব্র অস্বস্তি নিয়ে ঠিক সকাল সাতটায় টিকিট কাউন্টারে দিকে এগোচ্ছিল মতিন। ঠিকঠাক পৌঁছোবে কি না, না পৌঁছাতে পারলে এই জায়গা চিনে ফিরতে পারবে কিনা ভাবতেই আরও নার্ভাস হয়ে পড়ছিল। 'হাইমান। গিভ মি টেন বাক।' কথাগুলো কানে যাওয়া মাত্র একটা লম্বা কালো হাত তার
রাস্তা আটকাল। হৃৎপিণ্ড যেন গলায় উঠে এসেছিল। মতিন চোখ তুলে দেখল তার চেয়ে অনেক লম্বা, লিকলিকে রোগা একটা কালো ছেলে
হাত পেতে আছে। বোঝাই যাচ্ছে ভিক্ষে চাইছে ছেলেটা। টেন বাক মানে কত? দশ ডলার।
সাতশো টাকার ভিক্ষে চাইছে ব্যাটা! হঠাৎ সব নার্ভাসনেস চলে গেল, রেগে গেল মতিন। মামার বাড়ি নাকি। সে চিৎকার করল: 'ভ্যাট।'
সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে 'ওকে ওকে' বলে ছেলেটা সামনে থেকে সরে গেল। সেই রাগের ঘোরেই মতিন টিকিট কাটল, প্ল্যাটফর্মে ঢুকে একজনকে জিজ্ঞাসা করল কোন ট্রেন ইউনিয়ন টার্ন পাইকে যাবে। তারপরে সেই ট্রেন এলে উঠে পড়ল।
আর তখনই বেলুন থেকে বাতাস বেরিয়ে যাওয়ার মতো রাগটা উধাও হয়ে গেল। আবার নার্ভাস হয়ে পড়ল সে। এই সকালে ট্রেনের কামরা ভরতি। হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে তার ট্রেনের গতি বুঝে কেবলই মনে হচ্ছিল যদি ইউনিয়ন টার্নপাইক পেরিয়ে যায়।
খানিকবাদে সে কামরার গায়ে লেখা পরপর স্টেশনের নাম দেখতে পেয়ে কাছে গেল। ওই যে ইউনিয়ন টার্নপাইক। সে যেখান থেকে ট্রেনে উঠেছে তারপর চারটে স্টেশন ছাড়ালে ওখানে পৌঁছাবে। পরের স্টেশনে ট্রেন থামামাত্র নামটা মিলিয়ে গিয়ে স্বস্তি এল। ট্রেন ছুটছিল মাটির ওপর দিয়ে। এবার মাটির নীচে নামল।
ইউনিয়ন টার্নপাইকের প্ল্যাটফর্মে নেমে চারপাশে তাকাল মতিন। কোথাও মুর্শেদ নেই। অথচ লোকটা তাকে বলেছিল, প্রথমেই তাকে দেখতে পাওয়া যাবে। মিনিট-পাঁচেক অপেক্ষা করার পর সে ঠিক করল আরও দশ মিনিটের মধ্যে না এলে সে ফিরে যাবে। প্ল্যাটফর্মের এদিকে সে নেমেছিল, উলটোদিকে যে ট্রেনগুলো ফিরে যাচ্ছে তার একটায় উঠলে জ্যাকশন হাইটে পৌঁছে যাওয়া যাবে। কিন্তু তাতে তার কী লাভ হবে? এদেশে বৈধভাবে থাকতে হলে তাকে ইউ এস ইমিগ্রেশনে যেতেই হবে।
ঠিক দশ মিনিটের মাথায় মুর্শেদকে দ্যাখা গেল হস্তদন্ত হয়ে আসতে। সেই সময় আর একটি ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছিল, মতিনকে ইশারা করল তাতে উঠে পড়তে। ট্রেন চলতে শুরু করলে পাশে দাঁড়িয়ে বলল, 'মিসেসের মেজাজ খারাপ, কিছুতেই বেরুতে দেবে না। কোনওমতে ম্যানেজ করে এলাম। বুদ্ধিমানদের বিয়ে করা উচিত নয়।'
মতিন কোনও কথা বলল না। মূর্শেদ তার থেকে বয়েসে অনেক বড়।
ইউ এস ইমিগ্রেশ্ন অফিসে পৌঁছে ওরা হতভম্ব হয়ে গেল। বিশাল লাইন। এই সকালবেলাতেই ঠিক কত লোক দাঁড়িয়ে আছে গোনা যাচ্ছে না। ওরা শুনল, অফিস খুলবে সকাল নটায়। মুর্শেদ বলল, 'কোনও উপায় নেই। তোমাকে দাঁড়াতে হবেই। দাঁড়িয়ে যাও।'
'আপনি?'
'আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তোমার কোনও উপকার হবে না। অফিস খুলতে এখনও অনেক দেরি। তোমার যদি ডাক পড়ে, তা লাঞ্চের আগে পড়বে বলে মনে হয় না। আমি বরং ঘুরে আসি। ঘণ্টা দুই-আড়াই-এর মধ্যে ফিরে আসব। তুমি লাইন ছেড়ে কোথাও যাবে না। খুব খারাপ জায়গা কিন্তু।
মুর্শেদ আবার স্টেশনের দিকে চলে গেল। মতিনের মনে হল লোকটা ওর বউ-এর কাছে ফিরে যাচ্ছে।
বেলা যত বাড়ছে, লাইন তত লম্বা হচ্ছে। মতিনের বেশ মজা লাগছিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে লাইনের মানুষগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে। ঠিক তার সামনে যে মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন তাঁকে নেপালি বলে মনে হচ্ছে। নাক চ্যাপ্টা, চোখ চেরা, ফরসা মুখ তো জাপানি বা চিনাদেরও। সে সাহস করে জিজ্ঞাসা করল, 'আপনি কোন দেশের মানুষ?'
'ভিয়েতনাম।' মহিলা জবাব দিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মাথা নাড়ল মতিন। তার মানে বাংলাদেশের পূর্বদিকে যত দেশ আছে তাদের মানুষদের চেহারা প্রায় একরকম! কিন্তু সে শুনেছিল আমেরিকানরা নাকি ভিয়েতনামে গিয়ে যুদ্ধ করেছে।
ভিয়েতনামিরা নাকি আমেরিকার দাদাগিরি, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করেছে। সে দেশের লোক আমেরিকায় এসে এই লাইনে দাঁড়িয়েছে কেন?
সাদা কালো শ্যামলা হলদেটে মানুষের পর মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এদের সবার বোধহয় তার মতো এদেশে থাকার ব্যাপারে সমস্যা হয়েছে। মতিনের মনে হল, সমস্যাটা তার একার নয়। মনে হওয়ায় স্বস্তি এল।
একটা মাঝবয়েসি লোক। মুখে ক'দিনের না কামানো দাড়ি, পোশাক ময়লা। ভিয়েতনামি মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে তিনি মাথা নেড়ে না বললেন। এবার লোকটি মতিনের সামনে এসে জিজ্ঞাসা করল, 'ইউ ওয়ান্ট টু গো ইন ফোর্থ পজিশন? নাম্বার ফোর? হিয়ার, ইউ হ্যাড টু ওয়েট টিল আফটারনুন। দেয়ার উইদইন হাফ আওয়ার।'
একটু একটু বোঝার পর মতিনের কাছে অর্থ স্পষ্ট হল। এত পেছনে পড়ে না থেকে লোকটা তাকে লাইনের চার নম্বর জায়গায় যেতে বলছে। কিন্তু কেন?
লোকটার ঠোঁটে হাসি ফুটল, 'জাস্ট ফার্ট ডলার।'
'নো।' ফট্ করে বেরিয়ে এল শব্দটা। শোনামাত্র লোকটা পেছনের দিকে চলে গেল। বাংলাদেশে কোথাও খুব ভিড় হলে লাইনের প্রথম দিকের জায়গা বিক্রি হয়। কোনও ভালো স্কুলে যেদিন ভরতির ফর্ম দেওয়া হবে তার আগের সন্ধে থেকে লাইন পড়ে যায়। অনেক গরিব মানুষ সেই লাইনে জায়গা রেখে সকালে যারা আসে তাদের কাছে বিক্রি করে দেয়। আমেরিকাতেও একই ব্যাবসা চলছে? কী কাণ্ড।
অফিস খোলার সঙ্গে সঙ্গে লাইনের লোকেদের টোকেন দেওয়া হয়েছিল। মতিনের নাম্বার বিরাশি। নব্বইয়ের বেশি লোকের সমস্যা ওরা শুনবে না। ফলে বাকি মানুষরা হতাশ হয়ে চলে গেল। মতিন যখন সাতজনের জায়গায় পৌঁছাল তখন লাঞ্চ ব্রেক হয়েছে। কিন্তু মুর্শেদের দ্যাখা নেই।
বিকেল তিনটের সময় সে একট' কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারল। কাউন্টারের ভেতরে একজন সাদা মেমসাহেব আর শ্যামলা রঙের লোক বসে আছে।
মেমসাহেবের ইংরেজি কিছুটা বুঝতে পারল মতিন, 'হোয়াট ইজ ইয়োর প্রবলেম?'
আজ সকালে লেখা অ্যাপ্লিকেশনটা এগিয়ে দিল সে। সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাসের চিঠি এবং পুলিশের ডায়েরি?
কাগজ পড়ে মেমসাহেব পাশের লোকটির সঙ্গে নীচু গলায় কথা বললে তিনি কাগজে চোখ রাখলেন, 'ইউ আর ফ্রম বাংলাদেশ?
'ইয়েস স্যার।' মতিন উচ্চারণ বুঝতে পেরে জবাব দিল।
'আপনি প্ল্যান করে পাসপোর্ট নষ্ট করে পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন। তারপর ডায়েরি করে বাংলাদেশ দূতাবাসকে বোকা বানিয়ে এখানে এসেছেন ওয়ার্ক পারমিটের জন্যে। অন্যায় স্বীকার করুন। না হলে পুলিশ ডাকতে হবে।' স্পষ্ট বাংলায় কথা বললেন ভদ্রলোক।
'না স্যার। এটা একদম সত্যি নয়। আমার আগামীকাল ফিরে যাওয়ার কথা।'
'কেন এসেছিলেন এখানে?"
'গার্মেন্টস মেলায় এসেছিলাম।'
'কে পাঠিয়েছিল?'
'আমার মামা, কামাল হোসেন।'
'কোন কামাল হোসেন? যিনি গার্মেন্টস টাইকুন?'
'জি হ্যাঁ।'
'টেলিফোন নাম্বার কী?'
মনে ছিল, নাম্বারটা ঠিকঠাক বলতে পারল মতিন। সেটা লিখে নিলেন ভদ্রলোক। তারপর ঘড়ি দেখলেন। চাপা গলায় মেমসাহেবের সঙ্গে কথা বলে টেলিফোন নাম্বার টিপলেন। মতিন অনুমান করল, মামাকে ফোন করছেন ভদ্রলোক। কিন্তু এখন তো ভোর হয়নি বাংলাদেশে। এই সময় ফোন পেলে মামা খুব বিরক্ত হবে। সাড়া পাওয়ার পর ভদ্রলোক চাপা গলায় ইংরেজিতে কথা বলতে লাগলেন। নিজের নামটা ওর মুখে উচ্চারিত হতে শুনল সে। কথা শেষ করে রিসিভার রেখে দিয়ে আবার মেমসাহেবের সঙ্গে আলোচনা করলেন ভদ্রলোক। তারপর মতিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তিন নাম্বার কাউন্টারে যান। নেক্সট!'
পাঁচটা বাজতে দশমিনিট আগে কাগজটা হাতে পেল মতিন।
ডুপ্লিকেট পাসপোর্ট দুই মাসের মধ্যে পেতে হবে। ততদিন এদেশে থাকার অনুমতি এবং কাজ করার জন্যে টেম্পোরারি পারমিট দেওয়া হচ্ছে।
খামটাকে পকেটে পুরে বাইরে বেরিয়ে এসে কোথাও মুর্শেদকে দেখতে পেল না মতিন। তার একটুও ভালো লাগছিল না। দু-মাস এখানে একা থাকতে কে চেয়েছে? তাকে কে কাজ দেবে? কী কাজ করতে পারে সে এখানে? ওই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সে কোথায় থাকবে? এসবের বদলে যদি ওরা ওকে দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিত তাহলে সে খুব খুশি হত।
মতিন হাঁটতে লাগল। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। ঘণ্টা তিনেক আগে খুব খিদে পেয়েছিল, এখন আর পাচ্ছে না। সে সোজা স্টেশনে ঢুকে টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে ঢুকল। এখন একটুও নার্ভাস
না হয়ে ট্রেনে উঠল। জ্যাকসন হাইটে ট্রেন থেকে নেমে সিঁড়ি ভেঙে সে যখন অনেক লোকের সঙ্গে ওপরে উঠছে
তখন টিয়াকে দেখতে পেল। টিয়ার পাশে একটি যুবক হাঁটছে। কথা বলতে বলতে ওপরে উঠছে ওরা। মতিন পেছনে থাকায় টিয়া তাকে দেখতে পাচ্ছে না।
ওপরে উঠে মতিন দেখতে পেল যুবক হাত নেড়ে টিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। যুবক কে? টিয়ার সঙ্গে কী সম্পর্ক? টিয়া ওর সঙ্গে বেশ হেসে কথা বলছিল। এখন টিয়া রাস্তা পার হবে বলে সিগন্যাল পরিবর্তনের জন্যে অপেক্ষা করছিল। রাস্তা পার হয়ে আচমকা পেছনে তাকাতেই টিয়া মতিনকে দেখতে পেল। দেখেই দাঁড়িয়ে গেল সে। মতিন কাছে আসতেই টিয়া জিজ্ঞাসা করল, 'একি। আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? সঙ্গে কেউ নেই?
'না। ইউ এস ইমিগ্রেশন গিয়েছিলাম।' মতিন জবাব দিল।
'দুদিন এত কাজের চাপ ছিল যে আপনার খবর নিতে পারিনি। শেপর্যন্ত কী হল?' টিয়া
সাগ্রহে তাকাল। 'সব ঠিকঠাক হয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাস দেশে খবর পাঠিয়েছে। ইউ এস ইমিগ্রেশন টেম্পোরারি ওয়ার্ক পারমিট দিয়েছে দুই মাসের জন্যে।'
'বাঃ। এ তো দারুণ খবর। আপনার আপাতত কোনও চিন্তা থাকছে না। কিন্তু আপনাকে একটুও খুশি দেখাচ্ছে না। কী ব্যাপার বলুন তো?' টিয়া জিজ্ঞাসা করল।
'এসবের বদলে আমি যদি কাল দেশে ফিরে যেতে পারতাম তাহলে খুব ভালো হত।' মাথা নেড়ে হাসল টিয়া, 'আরে, আপনি প্রথমবার আমেরিকায় এসে মেলায় কাটালেন আর পাসপোর্টের ঝামেলা সামলালেন। দেশ দূরের কথা, এই শহরটাকেই একবার ঘুরে দেখলেন না।' বলেই তার খেয়াল হল, 'আজ কখন বেরিয়েছেন আপনি?'
'সকাল সাতটায়।'
'সারাদিনে কিছু খেয়েছেন।'
হাসল মতিন 'সুযোগ পাইনি।'
'কী কাণ্ড! চলুন। এখানে একটা ভালো দোকান আছে। আমারও খিদে পেয়েছে। কিছু খাওয়া যাক
।' টিয়া হাঁটতে লাগল।
'না না। আপনি ব্যস্ত হবেন না। বাসায় গিয়ে খেয়ে নেব।'
'বাসায়। ও। তা বাসায় আপনার সঙ্গীরা যে বসে আছে তা কী করে মনে করছেন? দরজায়
তালা ঝুলতে পারে। চাবি আছে সঙ্গে?'
'না।' মাথা নাড়ল মতিন।
'আসুন।'
পরোটা আর মাংস খেতে খুব ভালো লাগছিল মতিনের। সে বলেই ফেলল, 'খুব মজা লাগছে। এদেশে এই খাবার পাওয়া যায় ভাবতে পারিনি।'
'এদেশে বাংলাদেশের সব কিছু পাওয়া যায়। টিয়া বলল, 'আর নেবেন? পেট নিশ্চয়ই
ভরেনি।' 'না, না। আর নেব না। অনেকক্ষণ খাইনি, এখন বেশি খাওয়া ঠিক না। এই দোকানটা কি ইন্ডিয়ানদের? সে ব্যস্ত কর্মচারীদের দিকে তাকাল।
'নাঃ। এটা পাকিস্তানিদের।'
'কী? আপনি এই দোকানে ঢুকলেন কেন? ছি ছি!'
'কেন? কী হয়েছে?'
'এই পাকিস্তানিরা আমাদের দেশে কী ভয়ংকর অত্যাচার করেছে তা ভুলে গেলেন? এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমাদের দেশের কত মানুষ শহিদ হয়েছেন। ওদের তাড়িয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এসব ভুলে গেলেন?'
চোখ বন্ধ করে শুনছিল টিয়া। এবার হেসে ফেলল, 'আপনার মাথা ঠিক নেই। এই মানুষগুলো কি আমাদের দেশে গিয়ে অত্যাচার করেছে।
'এরা হয়তো করেনি, পাকিস্তানিরা করেছে।'
'বেশ। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে রাজত্ব করেছে দুশো বছর। প্রচুর অত্যাচার করেছিল তারা।
চট্টগ্রামে সূর্যসেন তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন বলে তাঁর ফাঁসি দিয়েছে ওরা। তাহলে ইংল্যান্ডের
ক্রিকেট টিম যখন চট্টগ্রামে গিয়ে ক্রিকেট খেলে, তখন হাজার হাজার মানুষ দেখতে যায় কেন?
তা হলে তো আমাদের ইংরেজি সাহিত্য পড়া উচিত নয়। যা এখন অতীত হয়ে গেছে তাকে কি চিরকাল বাঁচিয়ে রাখা যায়? তা হলে কোনও ভিয়েতনামের মানুষ এদেশে আসত না। চলুন।' দাম মিটিয়ে বেরিয়ে আসার সময় টিয়া এক ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল। ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, 'আবার আসবেন।'
রাস্তায় বেরিয়ে মতিন বলল, 'লোকটাকে দেখে বাঙালি বলে মনে হয় না।'
'ঠিকই। উনি পাকিস্তানের মানুষ। করাচিতে থাকতেন। দশ বছর ঢাকায় ছিলেন বলে ভালো বাংলা বলতে পারেন।' টিয়া হাসল,
এখন রাস্তায় বেশ ভিড়। বাংলা শব্দ শোনা যাচ্ছে চারপাশে। এই জনতার প্রায় সবাই বাংলাদেশের মানুষ। আমেরিকার এই এলাকাকে যেন ওরা বাংলাদেশ করে ফেলেছে। হাঁটতে হাঁটতে টিয়া জিজ্ঞাসা করল, 'কাল আপনার সঙ্গীরা যাচ্ছে।'
'হ্যাঁ।' মাথা নাড়ল মতিন।
'আপনি কোথায় থাকবেন?'
'আমি সাতদিন ওই ফ্ল্যাটেই থাকতে পারব, তার মধ্যে থাকার জায়গা খুঁজতে হবে। আচ্ছা, আমি কী ধরনের কাজ পেতে পারি? দেশে আমি গ্র্যাজুয়েশন করেছিলাম, কিন্তু তার সার্টিফিকেট তো সঙ্গে নেই।' মতিন বলল।
'থাকলেও সেটা কোন কাজে লাগত বলে মনে হয় না। কিছু মনে করবেন না, আপনার ইংরেজিও ভালো না। একটু ভেবে বলব।' টিয়া বলল।
'সেলসম্যানের কাজ-1'
'আপনাকে দিতে চাইবে না। রেস্টুরেন্ট বা স্টোরে যেসব বাংলাদেশি, এশিয়ান কজ করে তাদের অধিকাংশেরই এদেশে থাকার বৈধ কাগজপত্র নেই। তাই মালিকরা ওদের এক্সপ্লয়েট করে। যা ডলার দেওয়া উচিত তার অর্ধেকও দেয় না। আপনার কাছে বৈধ কাগজ আছে। তাই আপনাকে চাকরি দিতে উৎসাহী হবে না। অবশ্য আপনি যদি মিথ্যে কথা বলেন, কাগজপত্র নেই বলে জানান তা হলে চাকরি পেতে পারেন।' টিয়া দাঁড়াল, 'আমি একটু কেনাকাটা করে যাব। পরে দ্যাখা হবে।'
টিয়া এগিয়ে যেতে মতিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। ও যা বলে গেল, তাতে সমস্যা আরও জটিল হয়ে পড়ল। মুর্শেদের সঙ্গে কথা না বলে উপায় নেই। হঠাৎ তার মনে হল টিয়া তাকে অনেক কথা বলেছে কিন্তু নিজের কোনও কথা বলেনি। ওই ফ্ল্যাটে ওর সঙ্গে আর কে থাকে, সেই প্রসঙ্গ তোলেনি। একটু আগে স্টেশনে যে ছেলেটিকে ওর সাথে দ্যাখা গিয়েছে সে কে? কী সম্পর্ক টিয়ার সঙ্গে? এতক্ষণ কথা বলল, খাওয়া হল কিন্তু ছেলেটির কথা বলল না। মতিনেরও মনে হয়েছে, কৌতূহল দ্যাখানো ভালো নয়। কিন্তু মুখে কিছু না বললেও মনে তো প্রশ্ন আসেই।
ফ্ল্যাটটির সামনে এসে অবাক হল মতিন। বাইরে তালা নেই। দরজায় শব্দ করতেই জিয়া এসে খুলল, 'আরে। আমরা ভাবছিলাম তুমি নিউইয়র্কের রাস্তায় হারিয়ে গেছ।'
মুর্শেদ ছিল চেয়ারে বসে। বলল, 'স্যরি ভাই, যেতে পারিনি। বেশি বয়সে বিয়ে করে কী ফেঁসে গেছি। তারপর ভাবলাম, তোমাকে সুযোগ দেওয়া দরকার। যে রাস্তা দিয়ে গিয়েছ সেই রাস্তায় নিশ্চয়ই ফিরতে পারবে। কাজ হল?'
পকেট থেকে খামটা বের করে এগিয়ে দিল মতিন। ভেতর থেকে কাগজ বের করে পড়ার পর উল্লসিত হল মুর্শেদ, 'সাবাস। দু-মাস তোমাকে কেউ ছুঁতে পারবে না।' তারপর অন্য দুজনকে চিঠির বিষয়বস্তু জার্নাল মুর্শেদ।
শাজাহান বলল, 'একদম চিন্তা কোরো না। সাহেব তাঁর ভাগনের পাসপোর্টের ডুপ্লিকেট দু- তিন সপ্তাহের মধ্যে পাঠিয়ে দেবেন। খুব ভালো খবর।'
জিয়া উৎফুল্ল হল, 'বাঃ। মুর্শেদভাই আমাদের আনন্দ করার একটা উপলক্ষ্য হল। মতিনভাই, রেডি হয়ে নাও। পোশাক বদলাও। আজ আমাদের এদেশে শেষ রাত। মুর্শেদভাই আমাদের একটা নাইট ক্লাবে নিয়ে যাচ্ছে।'
শাজাহান বলল, 'মতিন আমাদের সঙ্গে গেলে আপনার সমস্যা হবে না তো?' মুর্শেদ হাসল, 'সাহেব না জানলে কোনও সমস্যা নেই।'
জিয়া বলল, 'আরে' ও কি এখনও বাচ্চা আছে? কবে অ্যাডাল্ট হয়ে গেছে।'
পাচ্ছে।'
মুর্শেদ বলল, 'এটা খুব স্বাভাবিক।'
মতিন মাথা নাড়ল, 'আপনারা যান। আমি খুব ক্লান্ত। সারাদিন দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন ঘুম
খানিকবাদে ওরা বেরিয়ে গেল সেজেগুজে। মতিনকে যেন দরজা খুলতে উঠতে না হয়, তাই বাইরে থেকে তালা দিয়ে গেল।
ভালো করে স্নান করে মতিন জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এখন এই সন্ধে পার হওয়ার পরেও রাস্তায় কত লোক। এই লোকগুলোর একজনকেও সে চেনে না। আগামীকাল শাজাহান- জিয়া ফিরে যাবে বাংলাদেশে! তখন মুর্শেদ ছাড়া কাউকে সে পাবে না। আর মুর্শেদ যে তাকে সময় দেবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তার কাছে এখন যে কয়েকটা ডলার পড়ে আছে তাতে ক'দিন রান্না করে খাওয়া যাবে তা সে নিজেই জানে না। মন খুব মিইয়ে যাচ্ছিল মতিনের।
হঠাৎ সে টিয়াকে দেখতে পেল। দু-হাতে বড় বড় প্যাকেট নিয়ে উলটো ফুটপাথে অপেক্ষা
করছে রাস্তা পার হওয়ার জন্যে। সারাদিন কাজ করেও মেয়েটা বাসার জন্যে বাজার করে নিয়ে আসছে। এত প্রাণ পায় কী করে টিয়া? তার মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের একটা মেয়ে যদি নিউইয়র্কে এসে একা লড়াই করেও হাসিমুখে বেঁচে থাকতে পারে, তা হলে সে পারবে না কেন? এইসময় ওপরের দিকে মুখ তুলল টিয়া। সঙ্গে সঙ্গে হাত নাড়ল মতিন। টিয়া হাসল। আলোর
সংকেত বদল হতেই রাস্তা পেরিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল।
জানলা বন্ধ করল। নিজের বিছানার কাছে সে এসে দাঁড়াতেই দরজায় নক্ হল। সে কয়েক পা এগিয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'কে?'
ওপাশে কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। তারপর মহিলা কণ্ঠ শুনতে পেল, 'আমি।'
তৎক্ষণাৎ বুঝতে অসুবিধে হল না, কন্ঠস্বর টিয়ার। সে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতে চেষ্টা করেও পারল না। তখন মনে পড়ল, শাজাহান বাইরে থেকে তালা দিয়ে গিয়েছে। তালাটা কড়ায় লাগালে সামান্য ফাঁক হত, ওটা দরজার গায়ে সাঁটা হুড়কোতে লাগানোয় সেই সুযোগ বন্ধ।
'আপনি কি একা?' টিয়ার কন্ঠস্বর।
'তা হলে বাইরে তালা লাগানো কেন?' কী জবাব দেবে মতিন। 'আচ্ছা, চলি।' টিয়া চলে গেল। বন্ধ দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে রইল মতিন।
পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে।
জিয়াভাই এবং শাজাহানভাই হাত নাড়তে নাড়তে সিকিউরিটির ঘেরাটোপে ঢুকে গেল। বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠল মতিনের। ওই দুজনের সঙ্গে তারও তো আজ ঢাকার ফেরার কথা ছিল। গার্মেন্টসের মেলায় ব্যবসা করতে কামাল হোসেন তাদের পাঠিয়েছিল নিউইয়র্কে। কাজ শেষ করে ওরা ফিরে যাচ্ছে দেশে, সে যেতে পারল না। তার পাসপোর্টটা যে ওভাবে পকেটমার তুলে নেবে সে কল্পনাও করতে পারেনি। আর পাসপোর্ট ছাড়া তো প্লেনে উঠতেই দেবে না। কামাল হোসেন তার মামা। বিশাল ব্যবসা। কিন্তু বাবার সঙ্গে সম্পর্ক খুব খারাপ। মুখ দ্যাখাদেখি বন্ধ। এই যে সে ভাগ্যচক্রে নিউইয়র্কে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছে, কামাল হোসেন ঠিকই বলেছেন, বাবা ভেবে নেবেন এটা তাঁর মামার চক্রান্ত। মুর্শেদভাই বলল, 'চলে, না যাই।'
এই মুর্শেদভাই লোকটা একটু অন্যরকম, কামাল হোসেনের আমেরিকার ব্যবসার ম্যানেজার। কিন্তু সবসময় মনে হয় উনি টেনশনে আছেন। পাসপোর্ট হারাবার পর উনি পরামর্শ দিয়েছিলেন বলেই তার হাতে এদেশে অন্তত দু-মাস থাকার বৈধ-কাগজ রয়েছে। কিন্তু লোকটা এমন মুখ করে থাকে যে ওকে জিজ্ঞাসাই করা যাচ্ছে না, যতদিন দেশ থেকে নতুন পাসপোর্ট না আসছে ততদিন সে কী করে থাকবে? সাতদিনের জন্যে যে ফ্ল্যাটে ছিল সেখানে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তারপর? পকেটে যা আছে তাতে ক'দিন খেতে পারবে?
মুর্শেদের পাশে হাঁটছিল মতিন। বিশাল হল ঘর। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের ভিড় এখানে। আসবার সময় দেখেছে ঢাকায় বিমানবন্দরে টিকিট হাতে না থাকলে ঢুকতে দেওয়া হয় না। এখানে সেই নিয়ম নেই। শাজাহান ভাইদের সঙ্গে তারাও স্বচ্ছন্দে ভেতরে ঢুকেছিল। ওরা লাইন দিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে মালপত্র এয়ার হাউসের হাতে জমা করে দিয়ে ঝড়ো হাত-পা হল। বিশাল মেলার মতো হলঘর ঘুরে ওরা যখন সিকিউরিটি জোনের দিকে এগিয়ে গেল তখনও ওরা সঙ্গে ছিল। দেশের নিয়ম যদি এখানে চালু থাকত তা হলে রাস্তা থেকেই বিদায় জানাতে হত।
গরম জল কিনে চা চিনি দুধ মিশিয়ে একটা টেবিলে মূর্শেদ বসল। মতিনের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, 'আমার খুব খারাপ লাগছে। তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু মাত্র দুটো রুম। একটায় আমরা থাকি অন্যটায় বাচ্চারা। তা ছাড়া, কিছু মনে করো না, আমার
স্ত্রী একটু রাগী প্রকৃতির।
'ও।' চায়ের কাপ তুলল মতিন।
'আমাদের বয়সের ডিফারেন্স বেশ বেশি।' কেমন উদাস উদাস গলায় বলল মুর্শেদ। মতিন দেখল তাদের টেবিলের অন্য প্রান্তের চেয়ারে এসে বসলেন এক মহিলা। গায়ের
রং তামাটে। কিন্তু প্রচুর সেজেছেন। পরনে বিচিত্র রঙের লম্বা ঝুলের স্কার্ট। ঠোঁটে পুরু রং, চোখ এঁকেছেন সময় নিয়ে। চোখাচোখি হতে হাসলেন। ইনি কোন দেশের মানুষ? মুর্শেদ লক্ষ্য করেছিল। বলল, 'তাকিও না। ইংরেজি জানে বলে মনে হয় না।'
'তা হলে এখানে আছে কী করে?'
'নিউইয়র্ক এমন একটা শহর যেখানে কোনও ভাষা না জানলেও চলে যায়।'
'ইনি কোন দেশের?'
'সাউথ আমেরিকার কোনও দেশ হবে।'
'এই জায়গাটা অদ্ভুত।' মতিন বলল, 'বোধহয় পৃথিবীর সব দেশের লোক এখানে আছে।' চা খাওয়া হয়ে গেলে কাগজের কাপগুলো তুলে গারবেজে ফেলতে গেল মুর্শেদ, সেইসময়
মহিলা সরু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, 'পাকিস্তানি?'
'নোঃ। আই অ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ।' উঠে দাঁড়াল মতিন।
টেবিল থেকে সরে আসতেই মুর্শেদ ফিরে এল।
মতিন জিজ্ঞাসা করল, 'আচ্ছা, আমাকে কি পাকিস্তানিদের মতো দেখতে?'
'না তো। কেন?'
'ওই মহিলা আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন আমি পাকিস্তানি কি না?'
'ও বোধহয় বাংলাদেশ বা ইন্ডিয়ার নাম শোনেনি, পাকিস্তানের নাম জানে?
'আশ্চর্য! পাকিস্তানের সৈন্যদের আমাদের দেশের মানুষ তাড়িয়েছে, তাদের চামচা রাজাকারদের
আমি ঘৃণা করি, আর আমাকেই কিনা?'
'শোনো মতিন। এটা নিউইয়র্ক। এখানে সবকথা এক কান দিয়ে শুনবে আর অন্য কান দিয়ে বের করে দেবে। চলো।' মুর্শেদ এগোল।
ট্রেন থেকে নামল না মুর্শেদ। একশোটা ডলার তার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, 'তুমি তো রাস্তা চেনো, চলে যাও। চেষ্টা কর যাতে একটা কাজ জোটাতে পার। জ্যাকসন হাইটে প্রচুর দোকান। পেতে অসুবিধে হবে না। পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে মতিনকে দিল সে, 'এটাও রেখে দাও।'
'আপনি যাবেন না?"
'আমি ফোনটাকে সুইচ্-অফ করে রেখেছি নইলে পাঁচ মিনিট অন্তর গর্জন করত। কিছু মনে কোরো না,' মুর্শেদ বলল।
প্ল্যাটফর্মে নেমে সিঁড়ি ভেঙে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে ওপরে উঠে আসতে কোনও অসুবিধে হল না। ওপরে ওঠার পর পরিচিত জায়গা দেখতে পেল মতিন। সে এমন ভাবে হাঁটতে লাগল যেন তার বাবার রাস্তা দিয়ে হাঁটছে।
দুপাশে নানান ধরনের দোকান। রাত হয়ে যাওয়া জ্যাকসন হাইটের ফুটপাথে মানুষের ভিড় এখনও কমেনি, হাঁটতে হাঁটতে একটি নারীকে সে বলতে শুনল, 'নো, আই ডোন্ট লাভ ইউ।' চমকে দেখার চেষ্টা করল মতিন, কে এমন কথা বলছে? সে হতভম্ব হয়ে গেল? তার পেছনে একটি যুবক ছাড়া কেউ নেই। যুবকটি বেশ রোগা, মাঝারি, লম্বা, কানে দুল এবং ঘাড়ের পেছনের চুল গার্ডারে মোড়া। গলার স্বর একবারে মেয়েদের মতো। সে দাঁড়িয়ে পড়তেই যুবক পাশে এসে গেল। সরু গলায় বলল, 'হাই! আর ইউ লোনলি? একটা চোখ ছোট করল সে।
বোকার মতো সত্যি কথা বলে ফেলল মতিন। 'হ্যাঁ, ইয়েস।'
'লেটস গো। জ্যাস্ট টু ব্লক ওয়াকিং। ইউ উইল বি হ্যাপি মাই ডিয়ার। নট-মাচ, হান্ড্রেড বাক্।' ছেলেটি মতিনের হাত ধরতে চাইল।
ঝট করে হাত সরিয়ে নিল। বলে কী ছেলেটা তারপর হন হন করে হাঁটতে লাগল সে। পেছন পেছন আসছিল ছেলেটা তারপর দাঁড়িয়ে পড়ল হতাশ হয়ে।
হাঁটার সময় কোনদিকে হাঁটছে তা খেয়াল করেনি মতিন। ছেলেটার কাছ থেকে দ্রুত দূরে সরে যেতে শুধুই জোরে হেঁটে গেছে। যখন বুঝল ধারে কাছে ছেলেটা নেই, সে নির্জন ফুটপাথে একা দাঁড়িয়ে আছে তখন স্থির হল, হাঁপাচ্ছিল সে। সেটা কমে গেলে হঠাৎ মতিনের মনে হল ছেলেটা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আর ইউ লোনলি? কী আশ্চর্য! এই বিশাল দেশের বিরাট শহরে সে তো একাই, একদম একা।
রাত বাড়ছিল। মতিন বুঝতে পারছিল সে বাড়িতে ফেরার পথ গুলিয়ে ফেলেছে। এই ক'দিনে সে যে পথ দিয়ে যাতায়াত করেছে তা খুঁজে বের করতে হাঁটতে লাগল সে। কিন্তু ক্রমশ মনে হতে লাগল আরও দূরে চলে যাচ্ছে। সে যে ঘরে ছিল তার জানলা থেকে পথের উলটোদিকে তাকালে বড় মল ছিল। মলের বাইরে লম্বা বেঞ্চিতে ঝুড়ি ভরতি সবই দ্যাখা যেত। টিয়াকে ওখান
থেকেই রাস্তা পার হতে দেখেছিল।
টিয়ার দ্যাখা যদি পাওয়া যেত। সে যে ঘরে থাকে তার পাশের ঘরেই টিয়ার বাস, এমন কিন্তু আলাপ নয় যে তাকে ঘরে ডেকে নিয়ে যাবে। কিন্তু এখন সে টিয়ার কথা ভাবছে কেন? তাকে তো বাড়ির পথ খুঁজতে হবে।
দুজন শাড়িপরা মহিলাকে দেখে মতিন ভাবল ওদের জিজ্ঞাসা করা যাক। কিন্তু ঠিকানাটাই মুখস্থ করে রাখেনি। কী জিজ্ঞাসা করবে ওদের? পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একজন বললেন, 'দেখি, কাল আবার আসব। যদি ইলিশ পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে মুর্শেদের দেওয়া কার্ডটার কথা মনে পড়তেই সে চট করে বের করে দেখে নিল, একটা টেলিফোন নাম্বার রয়েছে। একটু দ্রুত হেটে মহিলাদের পাশে গিয়ে সে করুণগলায় বলল, 'আপা, একটা উপকার করবেন, প্লিজ।'
এবার দ্বিতীয় মহিলা হাত নাড়লেন, 'না, টাকা দিতে পারব না।'
'আমি টাকা চাইছি না। যে বাসায় উঠেছিলাম তার পথ হারিয়ে ফেলেছি। এই কার্ডের নাম্বারে ফোন করে যদি বলে দেন।'
প্রথম মহিলা হাসলেন, 'কবে এসেছেন?'
'এক সপ্তাহ হয়নি।'
'কোথায় থাকতেন, কোন জেলায়?'
'ঢাকায়।'
দ্বিতীয় মহিলা বললেন, 'বাংলাদেশ থেকে যে-ই আসে বলে ঢাকা থেকে আসছি। ঢপ দেওয়ার জায়গা পায় না। আপনি এখানে বাসা থেকে একা বেরিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অথ্য ঠিকানা সঙ্গে রাখেননি, চিনতেও পারছেন না? অদ্ভুত।'
প্রথম মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, 'আপনার সঙ্গে মোবাইল নেই?'
'না।' মাথা নাড়ল মতিন।
কার্ডটা নিয়ে প্রথম মহিলা নাম্বারটা দেখলেন, 'কী নাম আপনার?'
'মতিন।'
"ইনি কে হন?'
'আমার মামার ব্যবসার ম্যানেজার।'
'আপনার মামার নাম কী?'
'কামাল হোসেন।'
দ্বিতীয় মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, 'কোন কামাল হোসেন?'
'উনি ঢাকায় ব্যবসা করেন।'
'তিনি নিশ্চয়ই গার্মেন্টস মার্চেন্ট কামাল হোসেন নন?'
'আপা, তিনিই আমার মামা।"
'দ্বিতীয় মহিলা কিছু বলার আগেই প্রথম মহিলা তাঁর মোবাইলের বোতাম টিপলেন, 'আপনি কি মুর্শেদ ভাই? ওঃ, এখানে কথা বলুন। ফোনটা মতিনের হাতে দিয়ে প্রথম মহিলা বললেন,
একজন মহিলা-।' '
মতিন বেশ নার্ভাস গলায় হ্যালো বলল।
'আপনি কে? কী চাই?'
'আজ্ঞে, আমি মতিন। ঢাকা থেকে এসেছি। মুর্শেদভাই আছেন?' 'একটু আগে যে মেয়েটা কথা বলল সে কে?'
'আমি ওঁকে অনুরোধ করেছিলাম ফোনটা ধরে দিতে!'
'মুর্শেদ ওকে চেনে?'
'না-না!'
'মুর্শেদকে কী দরকার?'
'আমি কয়েকদিন আগে ঢাকা থেকে এসেছি। এখন রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। মূর্শেদভাই-এর
কাছ থেকে ঠিকানাটা জেনে নিতাম।'
'মিথ্যে কথা! তারা সব আজ দেশে ফিরে গেছে।'
'আমি যেতে পারিনি' আমি কামাল হোসেন সাহেবের ভাগিনা।'
'ও মা। এতক্ষণ বলেননি কেন? আপনাকে বললে বুঝবেন না। ওই মেয়েটাকে দিন। আর হ্যাঁ, ওর সঙ্গে আলাপ হল কী করে?' গলার স্বর এখন খুব নরম।
'এই রাস্তায়। এঁকে ফোন করতে রিকোয়েস্ট করেছিলাম।' মোবাইল ফোন প্রথম ভদ্রমহিলার
হাতে দিয়ে সে ইশারা করল কথা বলতে।
ঠিকানার হদিশ পেয়ে প্রথম ভদ্রমহিলা হেসে বললেন, 'আপনি বেশিদূরে আসেননি। এই পথ ধরে সোজা চলে যান, প্রথম মোড় ছেড়ে দেবেন, দ্বিতীয় মোড়ে গিয়ে ডানদিকে হাঁটলেই একটা বড় মল দেখতে পাবেন, বাইরে সবজি রাখা আছে, সেখানেই আপনার বাসা। ওখানে গেলে চিনতে
পারবেন?
'হ্যাঁ। অনেক ধন্যবাদ। আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।' হাত জোড় করে বলল মতিন। দুই মহিলা হাসতে হাসতে চলে গেলেন।
বাড়িটাকে খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। ওপরে উঠে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালাল মতিন। তারপর জামা-প্যান্ট পরেই শুয়ে পড়ল বিছানায়। কেবলই মনে হচ্ছিল তার কাছে যদি মুর্শেদের কার্ডটা না থাকত? এখন থেকে যখনই বের হবে এই বাড়ির ঠিকানা কাগজে লিখে নিয়ে বের হবে। তবে সেটা তো মাত্র সাতদিনের জন্যে। তারপর। এই ঘর তো ছেড়ে দিতে হবে।
মতিন মাথা নাড়ল। তারমধ্যে নিশ্চয়ই মামা ডুপ্লিকেট পাসপোর্ট পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেবেন। মুর্শেদ বলেছিল বউ এর কারণে সে ফোন সুইচ অফ করে রেখেছে। বাপরে বাপ। কী ভয়ংকর মহিলা। কিন্তু ফোনটা বউ-এর কাছে দিয়ে লোকটা কোথায় গেল। অবশ্য মামার নাম শোনার পর মহিলার গলার স্বর একদম বদলে গিয়েছিল। বন্ধুরা বলত, মেয়েরা অভিনেত্রী হয়েই নাকি জন্মায়।
সে চারপাশে তাকাল। আজ দুপুর পর্যন্ত শাজাহান আর জিয়াভাই এখানে ছিল। তখন একটুও একা মনে হত না নিজেকে। এখন ওরা প্লেনের সিটে বসে আছে। আর সে-। খিদে পাচ্ছে বলে বোধ করল মতিন। উঠে ফ্রিজ খুলে দেখল দুপুরের উচ্ছে-ভাত আর আলুভর্তা রেখে গিয়েছে শাজাহান ভাই। সে ওগুলো বের করে মাইক্রোওভেনে গরম করে নিয়ে খেতে বসে গেল। কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ভর্তা আর ভাত মুখে তুলতে বেশ আরাম হল। কাল থেকে তাকে রান্না করতে হবে।
দরজায় শব্দ হতে ঘুম ভেঙে গেল মতিনের। ধড়মড়িয়ে উঠে দেখল ঘড়িতে সাড়ে নটা গেজে গেছে। সে শুয়েছিল লুঙ্গি এবং গেঞ্জি পরে। ভোরের দিকে শীত শীত করায় বিছানার চাদরটা দিয়ে শরীর ঢেকেছিল। এখন বিছানা থেকে নেমে চেঁচিয়ে বলল, 'এক মিনিট, খুলছি।' শব্দটা থেমে
গেল।
এত দ্রুত মুখ ধোয়া এবং শার্ট-প্যান্ট পরে নেওয়ার কথা আগে ভাবেনি মতিন। কিন্তু নিউইয়কে তো অচেনা মানুষের সামনে লুঙ্গি পরে দাঁড়ানো যায় না। আর চেনা মানুষ টিয়া যদি দরজার ওপারে থাকে তা হলে তো কথাই নেই।
দরজা খুলতেই মুর্শেদ এগিয়ে এল, 'কি ব্যাপার? নেশা করে ঘুমাচ্ছিলে নাকি? বেল বাজালাম সাড়া পেলাম না। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছি আর ভাবছি পুলিশকে ডাকব কি না।'
'একটু বেশি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!' লজ্জিত গলায় বলল মতিন
'এই যে, এসো।' পেছন ফিরে ডাকল মুর্শেদ। মতিন দেখল সালোয়ার কামিজ পরা একজন মহিলা হাসিমুখে এগিয়ে আসছে সিঁড়ির মুখ থেকে।
মুর্শেদ বলল, 'তোমার ভাবি।'
তাড়াতাড়ি দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে মতিন বলল, 'আসলাম আলেকুম।'
মহিলা মাথা নাড়লেন, 'আলেকুম আসলাম।"
মতিন বলল, 'আসুন, ভেতরে আসুন।'
ঘরে ঢুকে মুর্শেদের বউ বলল, 'আপনি তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। কাল শুনলাম রাস্তা হারিয়ে ঘুরে মরছেন, এখন দেখছি ঘুমের মধ্যে মরে থাকছেন। এরকম মানুষের পক্ষে নিউইয়র্কে সামলে থাকা সমস্যার হবে।'
'কোনও সমস্যা নেই। কয়েকদিন পরেই তো সে চলে যাচ্ছে।' মুর্শেদ বলল। 'ভাই চুপ করো। আমাদের দেশের লোকদের ষোলো মাসে বছর হয়। পাসপোর্ট পেলে তো যাওয়ার প্রশ্ন। তবে আপনার সুবিধা আছে, কামাল হোসেন সাহেব আপনার মামা। তাই দশমাসেও বছর হতে পারে।'
তিনজনে বসার পর মুর্শেদের বউ বলল, 'চা করার ব্যবস্থা আছে?'
'হ্যাঁ। আপনারা বসুন, আমি এক্ষুনি করে আনছি-!'
'আপনি বসুন। ইনি খুব ভালো চা করেন, যাও না, চা করে নিয়ে এসো।'
মুর্শেদ আড়চোখে বউকে দেখে উঠে দাঁড়াল।
মতিন বলল, 'চলুন, মুর্শেদভাই, আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি!'
'আরে! আপনি তো কয়েকদিন আছেন এখানে। ও আপনার চেয়ে এই ঘরের সব কিছু বেশি জানে। বসুন।' বেশ জোরে বলল মুর্শেদের বউ।
মতিন বলল, 'আপনারা কি কোন কাজে বেরিয়েছেন?'
'কাজ? হ্যাঁ। কাল আপনার সঙ্গে কথা বলার পর ওকে বললাম, চলো দেখে আসি ঘর খুঁজে পেয়েছে কিনা।' হাসল মুর্শেদের বউ।
'কাল আপনি খুব উপকার করেছেন ভাবি।'
'অ্যাই? আপনি ভাবি বলবেন না। আমার একটা নাম আছে,' তারপর গলা তুলে মুর্শেদের বউ হুকুম করলেন, 'আমার নামটা ওকে বলে দাও তো?'
রান্নাঘর থেকে মুর্শেদের গলা ভেসে এল, 'সুলতানা।'
হাসল সুলতানা, 'নামের পর আবার আপা বলবেন না' আপনি আমাকে সুলতানা বলেই ডাকবেন মতিন।'
কথাগুলো মেনে নিতে অসুবিধে হচ্ছিল মতিনের। মুর্শেদের বউ, যার নাম সুতলানা, তার থেকে অন্তত ছয়-সাত বছরের বড়। হ্যাঁ, মুর্শেদ তাকে ঠিকই বলেছিল, ওদের মধ্যে অন্তত পনেরো বছরের পার্থক্য। ছয়-সাত বছরের বড় মহিলাকে ভাবি বা আপা না বলে নাম ধরে ডাকার শিক্ষা বা অভ্যেস মতিনের নেই। কথাগুলো সুলতানা নীচু গলায় বলেনি। রান্নাঘরে থাকলেও মুর্শেদের কানে অবশ্যই গিয়েছে। কিন্তু কোনও প্রতিবাদ শুনতে পেল না মতিন। তার মনে হল, বউ যা
ইচ্ছে তাই বলে, মুর্শেদ বাধা দেয় না।
'আপনি এখানে কতদিন আছেন?'
'দশ বছর। আগে থাকতাম ডালাসে। চার বছর। বিয়ের পর স্বামী নিয়ে গিয়ে রান্নার কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এখানে তো নানান রকমের শাকসবজি, মাছ খুব টাটকা পাওয়া যায় অথচ তিনি রান্না জানতেন না বলে খেতে পেতেন না। আমাকে তিনবেলা রাঁধতে হত।' হাসল সুলতানা।
'তিনবেলা?'
'সকালের নাস্তা, দুপুর আর রাত্রের খাবার।'
'চার বছর পরে কার অ্যাকসিডেন্ট হল, সাতদিন হাসপাতালে থাকার পর মারা গেলেন তিনি। আমাকে কখনও কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাননি। ওর মৃত্যুর পর দুই দেওর এসে ঘর-বাড়ি দখল করল। আমাকে থাকতে দিল দয়া করে। কিন্তু আইন মানলে আমারই সব পাওয়া উচিত। কিন্তু আমাকে পরামর্শ দেওয়ার, পাশে দাঁড়ানোর কেউ ছিল না। দেশে খবর পিয়েছিল। বাবা অনেক চেষ্টা করেও ভিসা পাননি, পেলেই বা কী হত? আদালতে যাওয়ার ক্ষমতা তো তাঁর ছিল ন'।'
হাসল সুলতানা।
কষ্টের কথা, দুঃখের কথা বলার পর হাসি কী করে আসে? মতিন ভাবল, এটা নিখুক অভ্যেস
অথবা ঠিক হাসি নয়। কিন্তু মুর্শেদ তো বেঁচে আছে। অথচ উনি বললেন বিয়ের চার বছর পরে স্বামী মরে গেছে দুর্ঘটনায়, তাহলে কি মুর্শেদ দ্বিতীয় স্বামী?
সুলতানা বলল, 'কী ভাবছেন বুঝতে পেরেছি। আমাকে ঘাড় থেকে নামাতে দেওররা এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে তারা ঠিক আপনার মুর্শেদ ভাই-এর খবর পেয়ে গেল। ওর স্ত্রী ওকে তালাক দিয়ে আর একজনকে বিয়ে করে কানাডায় চলে গিয়েছে। আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। কিন্তু তখন আমার গ্রীনকার্ড হয়নি। এই দেশে থাকলে হলে ওটা দরকার হয়। দেখলাম লোকটা খুব একটা
খারাপ নয়। বিয়ে হয়ে গেল।'
এইসময় চা নিয়ে এল মুর্শেদ। টেবিলে রেখে বলল, 'সব গল্প শেষ?' সুলতানা বলল, 'প্রথম আলাপ হল, 'আমাকে ওর জানা উচিত।'
চা খেতে খেতে মূর্শেদ বলল, 'এখনই চাকরি খোঁজার দরকার নেই। সাহেবের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। উনি খুব রেগে গিয়েছিলেন খবরটা শুনে। আজ বললেন, যাতে পাসপোর্টের অনুমতি ওখান থেকে এখানকার দুতাবাসে পাঠানো যায়, তাহলে যত তাড়াতাড়ি পারেন চেষ্টা করবেন। সেক্ষেত্রে এখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসই টেম্পোরারি পাসপোর্ট ইস্যু করে দেবে। সেটা পেলে ইউ এস ইমিগ্রেশন থেকে কাগজটা দেখিয়ে ছাপ মারিয়ে নিতে অসুবিধে হবে না। কালকের টিকিটটা ক্যানসেল করে ওপেন রেখেছি। ওই টিকিটেই ফিরে যেতে পারবে।'
সুলতানা জিজ্ঞাসা করল, 'তাহলে মতিন এখন কী করবে?'
'এখনই কাজ খোঁজার দরকার নেই। শহরটাকে ঘুরে দ্যাখো।' মুর্শেদ বলল।
খানিকক্ষণ কথা বলার পর মুর্শেদ বলল, 'আমাকে একবার জ্যামাইকায় যেতে হবে। একটা পার্টি টাকা দেবে বলেছে। তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে?'
'আমি গিয়ে কী করব? তোমার কাজের সঙ্গে আমি নেই। আমি বাসায় যাব।'
'তা হলে ওঠ। মতিন, যাচ্ছি।' মুর্শেদ উঠে দাঁড়াল।
'আশ্চর্য ব্যাপার, তুমি যাচ্ছ তোমার কাজে, আমাকে উঠতে বলছ কেন?' সুলতানা প্রতিবাদ করল, বলার সময় তার হাত ঘুরল।
মুর্শেদ হাসল, 'ঠিক আছে, ঠিক আছে।' তারপর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সুলতানা হাসল, 'আগে পুরুষ মানুষ যা বলত তা মুখ বুজে মেনে নিতাম। অপছন্দ হলেও মানতে বাধ্য হতাম। এখন তা করি না। তোমার কথা বল।' 'আমার আর কী কথা আছে!' মতিন সোজা হয়ে বসল। 'আরে, দেশে কী কর, কে কে আছে-!
'মা-বাবা আছেন? পড়াশুনা শেষ করেও চাকরি পাচ্ছি না।'
'ওমা! যার মামা অত বড় ব্যবসায়ী, অত লোক তার আন্ডারে কাজ করে, সে চাকরি পাচ্ছে
না, কেউ বিশ্বাস করবে? নাকি মামার দেওয়া চাকরি নিতে চাও না?' সুলতানা প্রশ্ন করল।
'না। তা নয়। চাওয়া হয়নি, এই আর কী!'
'সেই মামাই তো আমেরিকায় পাঠাল?'
'হ্যাঁ।'
'আচ্ছা, দেশে ফিরে চাকরি পেলে কত মাইনে পাবে?' সুলতানা সোজা হল, 'পনেরো-বিশ- ত্রিশ হাজার। তার বেশি নিশ্চয়ই নয়। শুনেছি, দেশে এখন এক কেজি ইলিশের দাম নাকি হাজার টাকা। ওই মাইনেতে পোষাবে?'
'কী আর করা যাবে?'
'একটু বুদ্ধি খেলাও। দেশের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে চান্স পায়না আমেরিকায় আসার। ভিসা দেয় না, তুমি এসে গেছ, সুযোগটা কাজে লাগাও। এখানে তুমি দিনে চল্লিশ ডলার রোজগার কর তাহলে ছুটির দিন বাদ দিলে মাসে এক হাজার। সেটা দেশের টাকায় সত্তর হাজারের ওপরে। বল, টাকাটা কি দেশে গেলে পাবে, সুলতানা উত্তেজিত। 'কিন্তু পাসপোর্ট পেলেই তো আমাকে চলে যেতে হবে।'
'পাসপোর্ট নিয়েও তুমি থেকে যেতে পার।'
'কী করে?'
'না গেলেই হল। এদেশে কেউ কারও খবর রাখে না।'
সঙ্গে সঙ্গে ভয় এল মনে। নাঃ, এ নিয়ে আর কথা না বলাই ভালো। সে বলল, 'ভেবে দেখি। আচ্ছা, আপনারা কোথায় থাকেন?'
'বেশি দূরে না। কুইন্সে।' সুলতানা বলল, 'ভেবে আমাকে জানিও। আমার এক বান্ধবীর হাসব্যান্ড গ্যাস স্টেশনে চাকরি করে। ওকে বলতে পারি। আর হ্যাঁ, তুমি আমার মোবাইল নাম্বারটা রাখো, তোমার মোবাইল নেই?'
'না।'
'বাচ্চলে! চল, বের হবে।' জোর দিয়ে বলল সুলতানা।
'কোথায়?' অবাক হল মতিন।
ঘড়ি দেখল সুলতানা, 'খুলে গেছে, চল, একটু হাঁটাহাঁটি করি।'
ঘরে তালা দিয়ে বেরুনোর সময় টিয়ার ঘরের দরজার দিকে তাকাল মতিন। দরজা বন্ধ। টিয়া নিশ্চয়ই কাজে বেরিয়ে গেছে।
জ্যাকসন হাইটের এই না সকাল না দুপুর সময়টায় রাস্তায় মানুষের ভিড় জমেনি। দুপুরের পর তো মেলা বসে যায়। মতিন লক্ষ্য করল সুলতানা বেশ লম্বা। এই মহিলা বিয়ের প্রথম কয়েক বছর গৃহবন্দি হয়েছিল, দেখলে বোঝাই যায় না। হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেল সুলতানা। মোবাইলের
বোতাম টিপে কথা বলল, 'কোথায় তুমি?' উত্তর শুনে বলল, 'আমার বাসায় ফিরতে একটু দেরি হবে। আসার আগে ফোন কোরো।' তারপর ফোন রেখে বলল, 'নিউইয়র্ক শহরটা খুব বড়। ট্রেনে এখান থেকে ম্যানহাটন যেতেই এক ঘণ্টা লেগে যায়।' মতিন সহজ হল? বলল, 'ঢাকাতেও তাই। দুপুরের পর গুলনান থেকে বাংলা আকাদেমি যেতে অনেক সময় তার বেশি সময় লাগে। রাত্রে লাগে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট।'
'তার মানে?' চোখ কপালে
তুলল সুলতানা।
'আপনি নিশ্চয়ই অনেকদিন দেশে যাননি?'
'এখানে আসার পর আর যাইনি।'
'তখন শুনেছিলাম একবার দেশে ফিরে গেলে আর এদেশে আসা যাবে না। নতুন করে ভিসা নিতে হবে যা পাওয়া নাকি সম্ভব নয়।' সুলতানা বলল:
'এখন?'
'এখন আমার গ্রীনকার্ড হয়ে গেছে। যতবার ইচ্ছে যেতে পারি, কিন্তু কার কাছে যাব? আব্বা,
আম্মা নেই। এক বোন ছিল, সে এখন টরেন্টোয়।' 'তাই আপনি জানেন না। ঢাকার রাস্তায় এখন এত গাড়ি আর রিকশা চলে যে সবসময় ট্রাফিক জ্যাম হয়ে থাকে। কখনই ঠিক সময় কোথাও যাওয়া যায় না।
সুলতানা হাসল, 'তা হলে তো তোমার এখানেই থেকে যাওয়া উচিত। তুমি এখানে একটু দাঁড়াও, আমি আসছি।'
সুলতানা কাচের দরজা ঠেলে পাশের দোকানে ঢুকে গেল। ফুটপাথ থেকে মতিন দেখতে পেল দোকানের মালিক খুব হেসে হেসে সুলতানার সঙ্গে কথা বলছেন। সে চারপাশে তাকাল। এই জায়গাটাকে প্রায় বাংলাদেশ বলেই মনে হচ্ছে। মাঝেমাঝেই বাংলা শব্দ কানে আসছে। দোকানগুলো হয় ভারতীয়দের নয় পাকিস্তানির অথবা বাংলাদেশের মানুষদের। এখানে ইংরেজি না জানলেও কোনও অসুবিধে নেই।
এইসময় চারটে ছেলেকে সে দেখতে পেল। জিনস, গেঞ্জি, হাতে উল্কি এবং কানে দুল।
তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওরা দাঁড়িয়ে গেল। একজন ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করল, 'ট্যুরিস্ট?
মাথা নাড়ল মতিন, 'নো।'
'বাংলাদেশ?'
'ইয়েস।'
সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় প্রশ্ন হল, 'থাকার ইচ্ছা আছে নাকি? থাকলে বল, সেলাম। কুইক, কুইক, জলদি বল।' ছেলেটা মস্তক নাড়ল।
ওদের মধ্যে যে বড় সে ছেলেটাকে ধমকালো, 'ফালতু ঝামেলা। চল।' বলে সুলতানা যে দোকানে ঢুকেছে তার দরজায় টোকা মারল। মতিন দেখলে তাকে যে ছেলেটি প্রশ্ন করছিল সে ইশারায় কাছে ডাকছে। কয়েক পা যেতেই ছেলেটা বলল, 'আমাদের পেছনে দাঁড়াও। চুপচাপ।'
দোকানের মালিক ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন কাচের দরজা ঠেলে, 'কী ব্যাপার?' বড় ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল, 'আপনার সঙ্গে কখনও হুজ্জতি করেছি ভাই?'
'আমি কি একথা বলেছি?' ভদ্রলোক গম্ভীর।
'তাহলে পুলিশ আমাকে ডেকে ওয়ার্নিং দিল কেন?'
'কেন দিল আমি জানি না।' মাথা নাড়লেন মালিক।
'আপনি রফিকের দলকে টাকা দিয়েছেন?'
'এসব কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেন? কোথায় প্রত্যেক মাসে এসে টাকা নিয়ে যাও, আমি এ নিয়ে কিছু বলেছি?' রেগে গেলেন ভদ্রলোক।
'দেখুন ভাই, আমরা এমনি এমনি টাকা নিই না। কোনও ঝামেলা হলে পুলিশ আসার আগেই আমরা ম্যানেজ করি। এশিয়ানদের পাড়া বলে তে! পুলিশ এখানে আসতেই চায় না। রাত্রে এই রাস্তার সব দোকানগুলোকে আমরাই গার্ড দিই। কি দিই না। অথচ আপনি বলেছেন আমরা হুজ্জতি করে তোলা আদায় করি। খুব খারাপ ব্যাপার। আমরা আপনার উপকার করছি আর আপনি দোষ দিচ্ছেন। দলের কারও মাথা গরম হয়ে গেলে সে যদি পাথর ছোঁড়ে তাহলে এই কাচ ভাঙবে, কত লোকসান হবে আপনার, বলুন তো? এবার কথা বলার সময় একটু ভাববেন। দিন।'
'দিন মানে? এখনও দুদিন বাকি আছে?'
'অ্যাডভান্স দিন, দিতে তো হবেই।'
ভদ্রলোক পকেট থেকে পার্স বের করে একটা একশো ডলারের নোট এগিয়ে দিতেই ছেলেটা খপ করে নিয়ে বলল, আরও পাঁচশ দিন।'
'তার মানে? একশো দেওয়ার কথা হয়েছিল।'
'ঠিক। গুণে দেখুন। চার থেকে পাঁচ হয়েছি। লোকের রোজগার বাড়ে, পঁচিশ করে ভাগ হত, এটা ভাগ করলে কুড়ি করে পাব। পঁচিশ দিলে লস হয় না। যা বাজার, সবই তো জানেন। তার ওপর পুলিশের ব্যাপারটা।
ভদ্রলোক একটু চিন্তা করে পঁচিশ ডলার দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। মতিন দেখল তিনি আগের মতন সুলতানার সঙ্গে হেসে কথা বলছেন। ছেলেগুলো চলে গেল! দ্রুত
দোকানের সামনে থেকে সরে এল সে। ওরা ওকে দেখিয়ে পাঁচশ ডলার বেশি আদায় করল। ঢাকায় যারা তোলা তোলে তাদের প্রায়ই পুলিশ ধরে, খুব পেটায় বলে শুনেছে। ছাড়া পেলে আবার একই কাজ করে তারা। সেই দলের কয়েকজন নিউইয়র্কে চলে এসেছে নাকি?
একটু পরে সুলতানা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, 'খিদে পায়নি?' পাচ্ছিল। এক কাপ চা কি রাত্রের খিদে দূর করতে পারে। 'চল। ম্যাকডোনাল্ডে যাই। আমার ওখানে খেতে খুব ভালো লাগে।'
ম্যাকডোনাল্ড শব্দটি প্রথম শুনল মতিন। সেটা কীরকম জায়গা? নিশ্চয়ই খাবার পাওয়া যায় কিন্তু তার দাম কি খুব বেশি? মতিনের মনে হল তার কাছে যে ডলার আছে তা দিয়ে সে স্বচ্ছন্দে খাবারের দাম দিতে পারে। সুলতানাকেই তার খাওয়ানো উচিত। মহিলা তাকে সময় দিচ্ছেন এটাই তো অনেক।
হাঁটতে হাঁটতে ছেলেগুলোর কথা বলল মতিন। সঙ্গে সঙ্গে রেগে গেল সুলতানা, 'একদম কথা বলবে না ওদের সঙ্গে। বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো হনুমান ওরা। কোনও পিছুটান নেই যাদের তাদের হারাবার ভয়ডর থাকে না। জেলে থাকলেও যা বাইরেও তা। কী করে যে এদেশে থেকে গেছে তা আল্লাই জানেন।'
'ওরা তোলা তোলে?'
'সব দোকানদার যদি এককাট্টা হত তাহলে তোলার বদলে পটল তুলত।' মুখ বেঁকাল সুলতানা, 'ওদের দেখলেই দূর থেকে এড়িয়ে যাবে।'
'এম' লেখা রেস্টুরেন্টটাই ম্যাকডোনাল্ড। সুন্দর রঙিন টেবিলে মতিনকে বসিয়ে তার জিম্মায় ব্যাগ রেখে সুলতানা চলে গেল কাউন্টারে। মতিন ভাবল, নিশ্চয়ই অর্ডার দিতে গেছে। ওয়েটার যখন বিল নিয়ে আসবে তখন সে জোর করে পেমেন্ট করবে। দূর থেকে সে দেখতে পেল কাউন্টারের ওপরের বোর্ডটাকে। তাতে নানানরকমের খাবার আর তাদের দাম লেখা। বেশিরভাগ দামই দেড় থেকে আট ডলারের মধ্যে। তাকে বলা হয়েছে এখানে একটা ডলারকে সত্তর টাকা ভাববে না। একটা টাকাই ভাববে? সেরকম ভাবলে তো দেড় টাকা আট টাকা এখানকার খাবারের দাম।
সুলতানা ফিরে এল একটা ট্রে-র ওপর দুরকমের খাবার আর কফির গ্লাস নিয়ে। উলটোদিকে
বসে বলল, 'এখানকার আলুভাজা খেতে খুব মজা।'
সরু লম্বা লম্বা হলদেটে আলুভাজা এই প্রথম দেখল সে। জিজ্ঞাসা করল মতিন, 'এখানে এগুলোর নাম কী?'
'ফুড ফ্রাই। এটা হল চিকেন বার্গার। এদেশে যাকে হ্যাম বার্গার বলে তাতে কিন্তু হ্যাম থাকে না, খাও।'
সত্যি খেতে বেশ মজা লাগল। খাওয়া শেষ হলে মতিন কাউন্টারের দিকে তাকাচ্ছিল। কাউকে বিল নিয়ে আসতে দ্যাখা যাচ্ছে না। আশেপাশের টেবিলে বসে যারা খাচ্ছিল তারা খাওয়া শেষ করে ট্রে-টাকে একটা বড় কাঠের বাক্সের পেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে গেল। সুলতানাকে জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল কিন্তু দেখতে পেল ব্যাগ খুলে কিছু বের করছে মহিলা। একটা ছোট্ট সুন্দর মোবাইল ফোন বের করে মতিনের হাতে দিল সুলতানা, 'এখন থেকে এটা তুমি ব্যবহার করবে। বিকেলের পর অ্যাক্টিভেটেড হয়ে যাবে। আমার নাম্বারটা দিয়ে দিচ্ছি, ফোন চালু হলে সেভ করে নেবে।' 'আপনি এইটে এখন কিনলেন?' তাজ্জব হয়ে গেল মতিন।
'এদেশে ফোন ছাড়া একমিনিটও থাকা যায় না।'
'কত দাম নিল?'
'তাতে তোমার দরকার কী।'
'সেকি? না, না, এটা ঠিক নয়।'
'কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক তা তোমার থেকে আমি ভালো বুঝি।'
'কিন্তু।'
'বেশ, তুমি যখন এদেশ থেকে যাবে তখন আমাকে ফেরত দিয়ে যেও।'
ভালো করে যন্ত্রটাকে দেখস মতিন, 'খুব সুন্দর।' সুলতানা বলল, 'প্রথম নাম্বারটা হবে আমার। তবে পরে যখন আরও নাম্বার এসে যাবে তখন আমি পিছিয়ে যাব।'
'কেন?'
'আমার নামের প্রথম অক্ষর হল 'এস'। তার আগের অক্ষরগুলো তো সামনে চলে যাবে। তোমার পছন্দ হয়েছে তো?'
'খুব সুন্দর। কিন্তু আপনি আমার জন্যে এত ডলার খরচ করলেন বলে খারাপ লাগছে।' সুলতানা হেসে উঠল, 'ধরে নাও, ইনভেস্ট করলাম।'
'এখানে কারও সঙ্গে খোলা মনে কথা বলতে পারি না। তোমার মুর্শেদভাই তো আমার সঙ্গে ভাসুর শ্বশুরের মতো মুখ করে থাকেন। এখন থেকে তোমার সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারব। ওটা পকেটে রেখে দাও।' বলেই যেন খেয়াল হল সুলতানার, 'তুমি এখানে এসে বাসায় কথা বলেছ?'
'হ্যাঁ। শাজাহানভাই বলেছে ফিরে গিয়ে মা-বাবাকে সব কথা বুঝিয়ে বলবে।'
'ঠিক আছে। তবু তুমি ফোনটা চালু হলে নাম্বারটা ওদের দিয়ে দিও। এই বাক্সটা রাখো, এখানে তোমার ফোনের নাম্বার লেখা আছে।'
বাক্সের মধ্যে যন্ত্রটাকে ঢুকিয়ে পকেটে রাখল মতিন।
'আর কিছু খাবে?'
'না। আচ্ছা, বিল দিতে আসবে না?'
'বিল? এখানে খাবার দেওয়ার সময় কাউন্টারেই পেমেন্ট নিয়ে নেয়।'
খুব হতাশ হল মতিন, তার উচিত ছিল সুলতানার সঙ্গে কাউন্টারে যাওয়া। দ্বিতীয়বার এই
করবে না।
ভুল
'তোমার গার্ল ফ্রেন্ডের নাম কী?' সুলতানা ঠোক মোচড়াল।
'গার্ল ফ্রেন্ড?' খুব অবাক হল মতিন, 'কেউ তো নেই।'
'ধ্যাৎ! মিথ্যে কথা। এরকম হ্যান্ডসাম ছেলেকে কোনও মেয়ে ভালো না বেসে আছে তা আমি বিশ্বাস করি না।' সুলতানা জোর দিয়ে বলল।
'বিশ্বাস করুন, কারও সঙ্গে ওই সম্পর্ক আমার হয়নি।'
'কাউকে গার্ল ফ্রেন্ড বানাবার ইচ্ছে হয়নি?'
'না। ভেবেছিলাম, চাকরি না পাওয়ার আগে ওসব করব না।'
সুলতানা একটু ভাবল, 'তোমাকে কয়েকটা কথা বলি, এখানে একা থাকবে, আমেরিকায় মেয়েমানুষের অভাব নেই। দেশের মেয়েদের মতো তারা লজ্জা, সংকোচের মধ্যে বাস করে না।
যা করতে চায় সরাসরি করে। কিন্তু ইন্ডিয়া আর আমাদের দেশের মেয়েদের মন এখানকার খানিকটা
আর ওখানকার খানিকটা নিয়ে গোলমালে থাকে। এই মেয়েদের এড়িয়ে চলবে তুমি।'
মতিন হাসল, 'আমি তো আর ক'দিন আছি-!'
'যদি অনেকদিন থাকতে হয় তখন আমার কথা ভুলো না! চলো।'
'ওরা ম্যাকডোনাল্ড থেকে বেরিয়ে এল। মতিন জিজ্ঞাসা করল, 'আপনি কি এখন বাসায়
ফিরবেন?'
'হ্যাঁ। তুমি?'
মতিন মাথা নাড়ল, 'ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকব।'
'তা কেন? ট্রেনে উঠে ম্যানহাটন চলে যাও। স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখে এসো। তা ছাড়া
কত রকমের মানুষ রাস্তায় হাঁটছে, তাদের দ্যাখো।' 'আপনার ফোন প্রাণ পেলে ওসব করব।'
'তা হলে আঞ্চ আমি যাই।' কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে মুখ ফেরাল সুলতানা, 'মতিন, এরপর থেকে আমাকে আর আপনি বলবে না। তুমি বলো।'
মতিন দেখল সুলতান' ধীরে ধীরে চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে।
দুপুরে খাওয়ার চিন্তা নেই, ম্যাকডোনাল্ডের খাবারে পেট ভরে থাকায় বিকেল অবধি ঘুমিয়ে কাটাল মতিন। ঘুম থেকে উঠে চা বানাতে গিয়ে বোতলটাকে চোখে পড়ল চিনির কৌটো সরাবার সময়। জিয়াভাই রেখে গেছে। বোতলের নীচে ইঞ্চিটাক সোনালি তরল পদার্থ পড়ে আছে। ওদের কথাবার্তায় বুঝেছে যে ঢাকায় নাকি এই ধরনের মদ খাওয়ার সুযোগ ওরা পায় না। তা হলে এমন মূল্যবান বস্তু ওরা ফেলে চলে গেল কেন? আর খাওয়ার মতো ক্ষমতা কি ছিল না?
জানলা খুলে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তাটা দেখল মতিন। বেশ ভিড় এখন। অলস ভঙ্গিতে অনেকেই দাঁড়িয়ে গল্প করছে ফুটপাথে। তার মতো এদেরও কি কোনও কাজকর্ম নেই? হঠাৎ ছেলেটার ওপর নজর গেল তার। এই ছেলেটাই আজ সকালে তাকে প্রশ্ন করছিল। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাচ্ছে, ওর সঙ্গীদের দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ একটা চিৎকার কানে এল। মতিন দেখল ছেলেটা চমকে বাঁ-দিকে তাকিয়েই ডানদিকে দৌড়োতে লাগল ভিড়ের ফাঁক গলে। তারপরই চার-পাঁচ জনকে দ্যাখা গেল ছেলেটাকে ধাওয়া করতে। দৌড়বার সময় যেসব গালাগাল দিচ্ছে ওরা তা একেবারেই বাংলা ছাড়া কিছু নয়। ক্রমশ চোখের আড়ালে চলে গেল ওরা। ছেলেটা ধরা পড়ল কিনা কে জানে। ধরা পড়লে নিশ্চয়ই বেদম মার খাবে, দ্বিতীয় দলের শারীরিক ভাষা সেরকমই ছিল। কী অন্যায় করেছে ছেলেটা? মতিনের মনে পড়ল, ওরা দোকানের মালিককে যে রফিকের দলের কথা বলেছিল তারাই ধাওয়া করছে না তো। ছেলেটার সঙ্গীরা কোথায়? একবার রাস্তায় নেমে দেখলে হয়। ঠিক তখনই সাইরেনের আওয়াজ কানে এল। দু-দুটো পুলিশের গাড়ি ছুটে গেল ওদিকে। ফুটপাথের মানুষজন একটু আগের ঘটনায় বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, পুলিশের গাড়ি দ্যাখামাত্র পরিবেশ বেশ শান্ত হয়ে গেল।
জানলা থেকে সরে আসার মুহূর্তে টিয়াকে দেখতে পেল মতিন। ওপাশের ফুটপাথে রাস্তা পার হওয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। এখন ওর পরনে প্যান্ট আর জ্যাকেট, সম্ভবত কাজ থেকে আসছে। টিয়া মুখ তুলতেই চোখাচোখি হল। হাত নাড়ল মতিন, টিয়াও দ্যাখাদেখি হাত নাড়তেই ট্রাফ্রিকের আলো পালটালো। রাস্তার এদিকে চলে আসায় তাকে আর দেখতে পেল না মতিন।
আধঘণ্টা বাদে মতিনের মনে হল একবার ফুটপাথ ধরে হেঁটে এলে হয়। জামাপ্যান্ট পরে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই রিং শুনতে পেল, মোবাইল বাজছে। সে খুব অবাক হল। তার মোবাইল বাজছে? দেশের বন্ধুরা বলে অ্যাক্টিভেটেড হতে অনেক সময় লাগে। সে টেবিলের ওপর থেকে যন্ত্রটা তুলে একটা নাম্বার দেখতে পেল। বোতাম টিপতেই সুলতানার গলা শুনতে
পেল, 'এই যে, কী করা হচ্ছে?'
'ওঃ! আপনি।'
'তার মানে? আমি ছাড়া আর কেউ কি তোমার নাম্বার জানে?'
'না-না। মানে-!!
'এই প্রথম ফোন তো?'
'হ্যাঁ।'
'সেভ করে রাখো। পরে কথা বলব।' লাইন কেটে দিল সুলতানা।
হঠাৎই মন ভালো হয়ে গেল মতিনের। মোবাইল ফোন রেখে দিল।
সন্ধেবেলার জ্যাকসন হাইটের রাস্তা জমজমাট। এত মানুষ কিন্তু কেউ তার পরিচিত নয়। সে মানুষের ভিড়ে মিশে আছে কিন্তু পাশের লোকটাও তার অচেনা। তবু এখানে এত মানুষের সঙ্গে হাঁটতে ভালো লাগছে। হঠাৎ একটা দোকানের কাচে বিজ্ঞপ্তিটা দেখতে পেল মতিন, 'হেল্প ওয়ান্টেড।' ওরা সাহায্য চাইছে। এত বড় দোকান কিসের সাহায্য চাইতে পারে। হঠাৎ মনে হল ওরা কাজের লোক চাইছে না তো। সে দোকানটা পেরিয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে সেভেন্টি ফোর স্টেশনের সামনে এসে দাঁড়াল। মাঝে-মাঝেই একগাদা লোক যখন বেরিয়ে আসছে একসঙ্গে তখন বুঝতে পারা যাচ্ছে ট্রেন এল। লোকগুলো চলে গেলে কয়েক মিনিটের জন্যে আবার চুপচাপ। মতিন দাঁড়িয়েছিল ফুটপাথে। সে তাকাচ্ছিল কিন্তু কিছুই দেখছিল না। আর কয়েকদিনের মধ্যে সে ডুপ্লিকেট পাসপোর্ট পেয়ে গেলে দেশে ফিরে যেতে পারবে। সুলতানাভাবি যদিও তাকে থেকে যেতে বলছে, এখানে কোনও একটা গ্যাস স্টেশনে কাজ পাইয়ে দেবে, গ্যাস স্টেশনটা কী জিনিস সে বুঝতে পারছে না। এখানে চাকরি করলে দেশ থেকে অনেক বেশি রোজগার করতে পারবে। কিন্তু কাজের বাইরে তার সময় কাটবে কী করে? সে বোবা হয়ে থাকবে নাকি?
'হাই।' পাশ থেকে গলার স্বর ভেসে আসতে তাকাল মতিন। বেশ দেখতে ভালো কিন্তু খুব উগ্র সাজ করা একটা সাদা মেয়ে, যাকে দেশে সবাই মেমসাহেব বলবে, দাঁড়িয়ে হাসছে। হাতে সিগারেট।
মতিন বোকাবোকা হাসি হাসল।
'ডু ইউ হ্যাভ লাইট?'
'
লাইট? লাইট মানে আলো। ও কি আগুন চাইছে? দেশলাই? লাইটার। সে দ্রুত মাথা নাড়ল,
নো। সরি।'
'দ্যাটস ওকে। ইউ লিভ হিয়ার?'
মাথা নাড়ল মতিন। অনুবাদ করেও স্বস্তি পেল না বলতে।
'অ্যালোন?'
একা থাকি কি না জিজ্ঞাসা করছে। মতলবটা কী? সে মাথা নেড়ে না বলল।
ইউ ফলো মি। জাস্ট টু ব্লক। ওকে?' মেয়েটি হাসল, 'আই নেভার চিট মাই ক্লায়েন্ট। জাস্ট থ্রি হান্ড্রেট ডলার। ফলো মি!'
মেয়েটি হাঁটতে লাগল উলটোদিকে। ততক্ষণে মস্তিষ্কে বার্তা পৌঁছে গিয়েছে মতিনের। সে দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে ঘরের পথ ধরল। তারপরেই মনে হল মেয়েটা যদি তাকে অনুসরণ করে তাহলে ঘরে পৌঁছে যাবে। সে আরও জোরে হেঁটে সেই দোকানটার সামনে পৌঁছে যেতেই কাচের দরজা
ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
'ইয়েস! ইউ আর ফ্রম?' একজন প্রৌঢ় এগিয়ে এল।
'বাংলাদেশ।'
'গুড। কবে এসেছেন ভাই?' পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞাসা করলেন প্রৌঢ়।
'কয়েকদিন হল।'
'কাজ খুঁজছেন? আপনার কি এদেশে থাকার ভিসা আছে?'
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল মতিন। পাসপোর্টটা সঙ্গে না থাক, এখানে থাকার সরকারি অনুমতিপত্র
তো সঙ্গে আছে।
'সরি। তাহলে আপনাকে কাজ দিতে পারব না। আপনি অন্য জায়গায় দেখুন।'
অবাক হয়ে গেল মতিন, 'কেন?'
দুপাশে মাথা দোলাল প্রৌঢ়, 'আমি আপনাকে কৈফিয়ত দেব না। যান।'
মতিন বাধ্য হল বেরিয়ে আসতে। কয়েক পা হাঁটতেই তার মনে পড়ল টিয়ার কথাগুলো। টিয়া বলেছিল কাগজপত্র না থাকলে এখানে সহজে চাকরি পাওয়া যায়। কারণ সেক্ষেত্রে মালিক যা খুশি তাই পারিশ্রমিক দিতে পারে। তোমার ইচ্ছে হলে করো না হলে কেটে পড়। এদেশে থাকার যাদের বৈধ অধিকার নেই, সারাক্ষণ ধরা পড়ার ভয়ে থাকে অথচ পেট চালাতে হবে তারা অনেক অল্প মাইনেতেই কাজে ঢুকে যায়। যার বৈধ-কাগজ আছে তাকে নিতে হলে মালিককে অনেক বেশি মাইনে দিতে হবে। কোন মালিক সেটা চাইবে।
রাত বাড়ছে। ফুটপাথে দাঁড়িয়েছিল মতিন। হঠাৎ পাশে এসে দাঁড়াল একজন, 'হাই।'
মুখ ফিরিয়েই ছেলেটিকে চিনতে পারল। সেই তোলাবাজদের একজন যাকে বিকেলবেলায় তাড়া করেছিল অন্যদলের লোকজন, মতিন হাসল। পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে এগিয়ে ধরল ছেলেটা। মতিন মাথা নাড়ল। ছেলেটি কাঁধ নাচিয়ে নিজে একা ধরালেন। তারপর জিজ্ঞাসা করল, 'কোনও ফ্রেন্ড নাই?'
'না।' মতিন রাস্তা দেখল।
'এখানে কোথায় বাসা?'
সতর্ক হল মতিন। বলল, 'বড়ভাই-এর চেনা-লোকের কাছে থাকি।'
'তখন তোমাকে দেখিয়ে এক্সট্রা রোজগার হয়ে গেল।' ধোঁয়া ছাড়ল ছেলেটি।
'একটু আগের ওরা কেন ধাওয়া দিয়েছিল?'
'শালারা আমাদের শত্রু। এলাকা দখল করতে চায়। আজ পুলিশ সব ক'জনকে ধরেছে। কয়েক হপ্তা মার খাবে। আমার নাম লিটন। তোমার নাম?'
'মতিন।'
'চল, এক জায়গায় যাই।'
'কোথায়?'
'কাছেই? বকুল আপার আড্ডা বলি আমরা।'
'কী হয় সেখানে?'
'আরে ভাই। এত প্রশ্ন কর কেন? খাওয়া-দাওয়া, গল্প। আজ বকুল আপার আড্ডা ফাঁকা আছে। দলের সবাই ম্যানহাটনে গিয়েছে।' বলে খুক খুক করে হাসল সে।
'হাসছ কেন?'
'তুমি কখনও ম্যানহাটনে গিয়েছ?'
'না।'
'ওঃ। ওখানে কি-হোল আছে। নেকেড মেয়েরা ড্যান্স করে। তাই দেখতে ওরা গিয়েছে। আমার ভালো লাগে না। এক ডলার গর্তে ফেললে এইটুকু জানলা ফাঁক হয়। আধ মিনিট দেখতে না দেখতেই ওটা বন্ধ হয়ে যায়। দেখতে হলে আবার পয়সা ফেল।' ছেলেটা যার নাম লিটন, ঠোঁট
ওলটালো, 'শালারা কল বানিয়েছে।'
'তুমি যা বুঝেছ, ওরা তা বোঝেনি কেন?'
'ওদের চুলকায়। রোজগার হলেই খরচ করতে হবে। চলো।'
'আজ থাক। আর একদিন যাব। শরীরটা ঠিক নেই।' মতিন বলল।
'গেলে খুব মজা পাবে। আমি রোজ বিকেল পাঁচটায় ওই সিনেমা হলের সামনে থাকি।'
লিটন চলে গেল।
বাড়িতে ফিরে এল মতিন। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে ঘবের তালা খুলতে গিয়ে অভ্যেসে ওপাশের দরজার দিকে তাকাতেই দেখল সেটা আধখোলা। যতবার এর আগে সে তাকিয়েছে, বন্ধ দেখেছে দরজাটা। মতিন দাঁড়াল। ঠিক তখনই এক ভদ্রলোক ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। বেশ রাশভারি চেহারার বয়স্ক মানুষ। গম্ভীর মুখে যখন হেঁটে নেমে গেলেন তখন তাঁর হাতে স্টেথো দেখতে পেল মতিন। ডাক্তার। ডাক্তার এসেছিল কেন?
পায়ে পায়ে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল সে. ভেতরে আলো জ্বলছে। উকি মারতেই বড় ঘরটা নজরে এল। সুন্দর সাজানো। দরজায় শব্দ করল মতিন। দ্বিতীয়বারে সাড়া এল ভেতরের ঘর থেকে। তারপরে টিয়া বেরিয়ে এল। পরনে সাদা জিনস আর রঙিন গেঞ্জি। তাকে দেখে টিয়ার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল, 'আপনি?'
'না-মানে কিছু হয়েছে?'
গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে টিয়া জানাল, হ্যাঁ, হয়েছে। তারপর ভেতরের ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল, 'আমার ছেলের খুব জুর।' অবাক না হওয়ার চেষ্টা করল মতিন। জিজ্ঞাসা করল, 'ডাক্তার কী বললেন?'
'ওষুধ দিয়ে গেলেন। বললেন, কালকের মধ্যে জ্বর না কমলে হাসপাতালে ভরতি করতে হবে। এখানে কোন ডাক্তারকে ডাকলেই বাড়িতে পাওয়া যায় না। গালিবকে তো চেম্বারে নিয়ে যাওয়া যাবে না। অনেকদিনের পরিচিত বলে উনি এলেন।' টিয়া বলল।
'ওষুধ কি নিয়ে আসতে হবে?'
টিয়া হেসে ফেলল, 'আপনি ওষুধের দোকান চিনবেন না। আপনাকে একটা রিকোয়েস্ট করব?'
'নিশ্চয়ই।'
'আমি ছেলেকে একা ফেলে রেখে ওষুধ কিনতে যাচ্ছিলাম। আল্লা ঠিক সময়ে আপনাকে এখানে পাঠিয়েছেন। আপনি একটু বসবেন? আমার বেশি সময় লাগবে না।' অনুরোধ করার সময় টিয়াকে অন্যরকম দেখাল।
'নিশ্চয়ই। দোকানটা কোথায় বলে দিলে আমিই যেতে পারতাম।'
'না। আপনি দরজা বন্ধ করে বসুন। ও এখন ঘুমোচ্ছে। যদি জেগে ওঠে তাহলে কথা বলবেন। মানুষের গলার স্বর শুনলে ও চুপ করে থাকে।'
ঘরের ভেতর ঢুকেই আবার বেরিয়ে এল টিয়া। সম্ভবত টাকা এবং প্রেসক্রিপশন নিয়ে এল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নীচু গলায় বলে গেল, 'দরজাটা বন্ধ করে দিন।'
টিয়া চলে গেলে দরজা বন্ধ করে ওই ঘরের একটা সোফায় বসল মতিন। দেখে মনেই হয়নি টিয়া বিবাহিতা। ওর হাঁটাচলা, ব্যবহার ঠিক অবিবাহিতা মেয়ের মতন। শুধু বিবাহিতা নয়, টিয়া ছেলের মা। ওর স্বামী কোথায়? নিউইয়র্কের বাইরে থাকেন নিশ্চয়ই। টিয়া বাচ্চাকে নিয়ে এই শহরে একাই থাকে? সেটা কী করে সম্ভব? ওকে তো রোজ ভোরে কাজে যেতে হয়, ফেরে শেষ-বিকেলে। ছেলে নিশ্চয়ই এই ফ্ল্যাটে অতক্ষণ একা থাকে না! অবশ্য ছেলের বয়স কত তা সে জানে না। ঠিক তখনই কানে এল একটা শব্দ। তার মানে মতিনের বোধগম্য হল না। কিন্তু শব্দটা টিয়ার ছেলের গলা থেকেই বেরিয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কষ্ট হলে বাচ্চারা যেরকম আওয়াজ জ্বরের ঘোরে করে থাকে সেরকম নয়।
জুতো খুলে চেয়ার ছেড়ে নিঃশব্দে পাশের ঘরের দরজায় চলে এল মতিন। এটা শোওয়ার ঘর। কিন্তু বিছানা শূন্য। তারপরেই নজরে এল। ঘরের একপাশে ছোট্ট খাটে বাচ্চাটা শুয়ে আছে। তার গলা পর্যন্ত কম্বলে ঢাকা। আশ্চর্য ব্যাপার খাটের চারপাশে অন্তত দেড়ফুট উঁচু রেলিং দেওয়া আছে। মতিন ঝুঁকে ছেলেটিকে দেখছিল। তৎনই ছেলেটি দ্বিতীয়বার আওয়াজ করল। গোঙানির মতো ছিটকে উঠল শব্দটা। মনে পড়ে যাওয়াতে মতিন কথা বলল, 'খুব কষ্ট হচ্ছে? এখনই তোমার মা ওষুধ এনে তোমাকে খাইয়ে দেবে। দেখবে আর কোনও কষ্ট থাকবে না। একটু সহ্য কর। তুমি তো খুব ভালো ছেলে। তাই না?'
ছেলেটা মুখ ফেরাল। ফোলা ফোলা মুখ। চোখ খুলল, সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করল। মতিন বলল, 'তোমার নাম তো গালিব। কী সুন্দর নামঃ' ছেলেটা আবার চোখ খুলল। মতিন হাত বাড়িয়ে ওকে স্পর্শ করেই বুঝতে পারল জ্বর বেশ বেশি। এই ছেলের বয়স ছয়, অন্তত মুখ দেখে তাই মনে হচ্ছে কিন্তু শরীরটা এত্ত ছোট কেন। সে ওর যে হাতটা কম্বলের বাইরে চলে এসেছিল সেটা স্পর্শ করতেই দেখল তার আঙুলটাকে মুঠোয় নিয়েছে বেচারা। কচি অথচ উত্তপ্ত মুঠোর স্পর্শ থেকে নিজের আঙুল সরিয়ে না নিয়ে খাটের পাশে মেঝের ওপর বসে পড়ল সে। তারপর ছেলেটা মুখ হাঁ করলেই সে কথা বলে যাচ্ছিল 'আর কানে যাওয়া মাত্র মুখ বন্ধ হচ্ছিল, ওর কী ধরনের জ্বর হয়েছে মতিন জানে না। তার মনে পড়ল বছর দুয়েক আগে তার নিজের খুব জ্বর আসে। তখন ডাক্তার মাকে বলেন মাথা ধুইয়ে দিতে এবং শরীর থেকে লেপ সরিয়ে ফেলতে। বলেছিলেন, 'শরীরের ভেতর তো যথেষ্ট উত্তাপ তৈরি হয়েছে, আবার লেপ ঢাকা দিয়ে বাইরে থেকে উত্তপ্ত করছেন কেন?' লেপ সরিয়ে নেওয়ার পর দ্যাখা গেল দ্রুত জুর কমে আসছে।
বেল বাজল। মতিন আঙুল ছাড়াতে গিয়ে দেখল জোর না করলে সেটা করা সম্ভব নয়। ততক্ষণে দ্বিতীয়বার বেল বেজেছে। মতিন বাধ্য হল নিজেকে মুক্ত করতে। দরজা খুললে টিয়া ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, 'কোনও অসুবিধে হয়নি তো?'
'বিন্দুমাত্র নয়। গালিবের সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গেছে।' মতিন হাসল
'তার মানে?' অবাক হয়ে তাকাল টিয়া।
'ও আমার আঙুল ধরার পর ছাড়তে চাইছিল না।'
'স্ট্রেঞ্জ।' টিয়ার ঠোঁটে হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল।
ওষুধ জলে গুলে অনেক কথা বলে ছেলেকে খাইয়ে দিল টিয়া। চুপচাপ দৃশ্যটা দেখল মতিন।
তারপর নিজের অভিজ্ঞতার কথাটা জানাল।
টিয়া অবাক হয়ে বলল, 'সত্যি? ডাক্তার তো একথা বললেন না।'
'ওর যদি শীত না লাগে, তাহলে করলে উপকার হবে।'
একটু ভাবল টিয়া, তারপর ছেলের শরীর থেকে লেপ তুলে নিয়ে একটা পাতলা চাদর ছড়িয়ে দিল। ততক্ষণে দেখতে পেয়েছে মতিন। ছেলেটির নিম্নাঙ্গ স্বাভাবিক তো নয়ই। দুটো পা ঠিকঠাক তৈরি হয়নি। খানিকক্ষণ ছেলের কপালে হাত বোলাল টিয়া মৃদু স্বরে কথা বলতে বলতে। সেই কথাগুলোর তেমন কোনও মানে নেই। মতিন দেখল ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল গালিব। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে মাথা পেছনে হেলিয়ে বেশ জোরে শ্বাস ফেলল টিয়া।
তারপর স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল, 'আপনাকে কষ্ট দিলাম।' 'মোটেই না। আমি তো ঘরে চুপ করে বসে থাকতাম।'
'একটু কফি করি?'
দেশে থাকতে কফি খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়নি. চা খেতেই অভ্যস্ত সে। কিন্তু এখন মনে হল বোধহয় কফি বানানো চায়ের চেয়ে সহজ। সে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
বাইরের ঘরের সোফায় সে যখন বসে তখন টিয়া কিচেনে। এই ফ্ল্যাটকে কী বলে? একটা শোওয়ার আর একটা বসার ঘর। পাশেই সে যেখানে আছে সেখানে দ্বিতীয় ঘর নেই? এই ঘর বেশ সাজানো। গালিবের বাবা কোথায়? ভদ্রলোক নিশ্চয়ই খবর পেয়েছেন। ক্রমশ তার মনে হতে লাগল মায়েরা বাবাদের চেয়ে সন্তানের ঝামেলা বেশি সামলায়। কিন্তু এই প্রতিবন্ধী ছেলেকে একলা রেখে সারাদিন টিয়া বাইরে থাকে কী করে? তাহলে ওর স্বামী নিশ্চয়ই সে সময় বাড়িতে থাকেন। তাই বা কী করে হবে, ভদ্রলোককে কাজকর্ম করতে বাইরে যেতে হয়।
ট্রেতে দুটো কফির কাপ আর প্লেটে বিস্কুট নিয়ে টেবিলে রেখে উলটোদিকে বসল টিয়া, 'দেখুন, ভালোলাগে কি না। আমি তো চা-কফি খাই না। কেউ এলে কফির কথা মনে আসে।' চুমুক দিয়ে মতিন বলল, 'না-না, ভালো হয়েছে।'
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটার পর প্রশ্নটা না করে পারল না মতিন, 'ওর কবে থেকে জ্বর এসেছে?'
'আজ থেকেই।'
'ওর বাবা জানেন?'
'না।'
অবাক হয়ে তাকাল মতিন। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল টিয়া। একটু ভাবল। তারপর বলল,
'আমরা এখন একসঙ্গে থাকি না।'
মতিন কথা বলল না। তার মন খারাপ হয়ে গেল।
'আমি জানি ও বাবাকে খুব মিস করে। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। ছাড়াছাড়ির সময় ছেলের দায়িত্ব নিতে চায়নি।' টিয়া বলল। সে
'আপনাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে?'
'হ্যাঁ। গালিব নাবালক বলে আমি ওর অভিভাবকত্বের জন্যে কোর্টে অ্যাপিল করেছিলাম।
সে কনটেস্ট করেনি।'
'কোথায় থাকেন তিনি?'
'কাছেই। কুইন্সে।'
'ছেলের সঙ্গে দ্যাখা করেন না?'
'করেন। প্রত্যেক শুক্রবারের বিকেলে।'
'এখানে আসেন?'
'না।' টিয়া উঠে দাঁড়াল, 'আপনি রাত্রে কোথায় খাবেন?'
মতিন বুঝতে পারল টিয়া এ বিষয়ে আলোচনা করতে চাইছে না। কিন্তু যে ছেলের পায়ের ওই অবস্থা তাকে এখানে না এলে কী করে ভদ্রলোক দেখতে পাবেন? প্রশ্নটা মনে হলেও সে মুখ
বন্ধ রাখল।
'এই যে মশাই, শুনতে পাচ্ছেন?' টিয়া আবার বলল।
'হ্যাঁ। ওহো। ঘরে চাল-আলু রেখে গেছেন শাজাহানভাইরা, তাই ফুটিয়ে নেব।' উঠে দাঁড়াল
মতিন।
'ওই কাজটা না হয় কাল করবেন। মুরগির মাংস করা আছে, ভাত রেডি করতে কয়েক মিনিট। এখানেই খেয়ে নেবেন। বসুন।' টিয়া হাত নাড়ল।
'অসুবিধে হবে না তো!'
হেসে ফেলল টিয়া। বলল, 'সেই গল্পটা পড়েননি?'
'কোন গল্প?'
'ওই যে ওয়াসিংটনে একই অফিসে কাজ করত একটি বাঙালি ছেলে আর সাদা মেয়ে। কাজ করতে করতে যখন ওদের ভাব হয়ে গেল তখন এক শনিবারের ডিনারে বাড়িতে ছেলেটিকে ডাকল মেয়েটি। গুছিয়ে নিজের মতো রান্না করল। ছেলেটি এল সন্ধেবেলায়। ফুল নিয়ে। মেয়েটি খুশি হল। বসার পরে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, 'তুমি কী নেবে? চা-কফি।'
ছেলেটি বলেছিল, 'তোমার যা ইচ্ছে।' মেয়েটি বলেছিল, 'বারে! খাবে তুমি, তোমার ইচ্ছেটাই বল।'
ছেলেটি ভাবল নিজের ইচ্ছে বললে মেয়েটি যদি অসুবিধায় পড়ে তাই সে আবার একই কথা বলল, 'তোমার ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে।'
ছেলেটি যখন কিছুতেই বলছে না তখন মেয়েটি ভেতরের ঘরে গিয়ে চা বানাল, কফি তৈরি করল। তারপর একটা ট্রে-তে সেই দুটো কাপ বসিয়ে গ্লাসে হুইস্কি, রাম, ব্লান্ডি, ওয়াইন আলাদা করে ঢেলে নিয়ে এসে রাখল ছেলেটির সামনে। বলল, 'আমার ইচ্ছে তুমি এর সবকটাই খেয়ে নাও।'
ছেলেটি ভাবল, মেয়েটির ইচ্ছে পূর্ণ করা উচিত। সে একে একে সবক'টাই গলায় ঢালল। তারপরই তার বমি পেয়ে গেল। বেসিনে কিছুটা উগরে দেওয়ার পরেও শরীর এত খারাপ করতে লাগল যে বিছানায় শুয়ে পড়ল। পড়ামাত্র সে ঘুমে তলিয়ে গেল।
মেয়েটির খারাপ লাগছিল কিন্তু রাগ কমছিল না। তার মনে হচ্ছিল, একটা মানুষের নিজস্ব কোনও ইচ্ছে থাকবে না? অন্য লোক যা বলবে তাই মেনে নেবে? এরকম ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যায়? তারপর ভাবল, ওর ঘুম ভাঙলে সে দুঃখ প্রকাশ করবে। কিন্তু মেয়েটি সোফায় বসেই একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার ঘুম ভাঙল ভোর পাঁচটায়। উঠে দেখল ছেলেটি বেরিয়ে গেছে। তারপর থেকে ওদের সম্পর্ক তৈরি দূরের কথা, বাক্যালাপও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।' একটানা গল্পটা বলে গেল টিয়া।
মতিন বলল, 'আসলে আমরা ভাবি যে খাওয়াচ্ছে তার পরিশ্রমটা কম হোক।'
টিয়া কিচেনে চলে গেল।
দশ মিনিট পরে ফিরে এসে টিয়া জিজ্ঞাসা করল, 'আমার কাছে আধ-বোতল ওয়াইন আছে। নেবেন?'
'না না, ওসব খাইনা আমি।' হাত নাড়ল মতিন।
'আপনার সঙ্গীরা চলে গেল, এখন কী করবেন?'
'মনে হয় কয়েকদিনের মধ্যে ডুপ্লিকেট পাসপোর্ট পেয়ে যাব।' 'এই ক'দিনটা ঠিক কতদিন তা তো জানেন না!'
'হ্যাঁ। কিন্তু-।'
'আচ্ছা, দেশের মানুষ আমেরিকায় আসার সুযোগ চেয়েও পায় না, আর আপনি এখানে এসেও ফিরে যেতে চাইছেন কেন?'
'এখানে থেকে আমি কী করব বলুন! আমি তো বিশেষ কোনও কাজ জানি না। জানেন, আজ একটা দোকানের বাইরে লোক চাই বোর্ড দেখে ভেতরে ঢুকেছিলাম। ওরা বেশ ভালো ব্যবহার করছিল প্রথমে কিন্তু যেই জানল এদেশে থাকার বৈধ কাগজ আমার আছে তখনই প্রায় অপমান করে তাড়িয়ে দিল। বুঝলাম, এখানে আমাকে কেউ কাজ দেবে না।' মতিন বলল।
'কথাটা আপনাকে আগেই বলেছিলাম। যার কাগজ নেই তাকে ঘণ্টায় তিন ডলার দিয়ে খাটানো যায়। কোনও প্রতিবাদ করলেই চাকরি খতম। কম টাকা পাচ্ছে বলে সে পুলিশের কাছে যেতে পারে না। গেলে বৈধ কাগজ ছাড়া এদেশে আছে বলে পুলিশ তাকেই জেলে পাঠাবে। আর বৈধ কাগজ থাকলে অন্তত আট ডলার ঘণ্টায় দিতে হবে। না দিলে পুলিশ এসে মালিককে ধরবে। তাই অবৈধ কর্মচারীদের পছন্দ করে মালিকরা।' টিয়া বলল, 'কিন্তু দোকানের কর্মচারী হওয়া ছাড়াও অন্য কাজও তো আছে।'
'যেমন?'
'এই দেখুন, আমি হাসপাতালের মহিলা রুগিদের সমস্যার কথা ডাক্তারদের বলি। ওই মহিলারা কেউ ইংরেজি বলতে পারে না। আমি বলি তাই ঠিকঠাক চিকিৎসা হয়। মেল ওয়ার্ডেও অনেক বাংলাদেশি পেশেন্ট আছেন, হিন্দিভাষী পেশেন্ট আসেন যাঁরা একবিন্দু ইংরেজি বলতে পারেন না। আপনি যদি বলেন আপনার জন্যে চেষ্টা করতে পারি। আমাদের হাসপাতালের মেল ওয়ার্ডে যিনি ইন্টারপ্রেটার ছিলেন তিনি খুব অসুস্থ হয়ে গেছেন।'
'কিন্তু ওদের সমস্যার কথা শুনে ডাক্তারকে ইংরেজিতে বলতে হবে তো।'
'হ্যাঁ।'
'আমরা দেশে ইংরেজি বলতে অভ্যস্ত নই।'
'লিখতে পড়তে জানেন তো?'
'হ্যাঁ, তা জানি।'
'তা হলে চেষ্টা করলে বলতেও পারবেন। কয়েকদিন একটু অসুবিধে হলেও পরে রপ্ত হয়ে যাবে। এবার খেতে দিই?'
'একটু পরে।'
'স্যার, আমাকে ভোর পাঁচটায় উঠতে হয়।'
'কেন? অত ভোরে কেন?'
'উঠে ছেলেকে রেডি করতে হয়। অনেক সময় লাগে। তারপর রান্না সেরে দুজনে খেয়ে নিজে তৈরি হই। দেরিতে ঘুমাতে গেলে সব গোলমাল হয়ে যাবে।' বলেই খেয়াল হল টিয়ার, 'কাল অবশ্য ছুটির দিন।'
'আপনি চলে গেলে গালিব এখানে কার কাছে থাকে?'
'এখানে তো থাকে না।' মাথা নাড়ল টিয়া।
'তা হলে-?'
'ঠিক সাতটায় ওর বাস আসে, স্কুলের বাস, বাসের লোক ওকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নীচে নিয়ে গিয়ে বাসে বসিয়ে দেয়। ওদের স্কুলটা প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের জন্যে। সারাটা দিন ও সেখানে কাটায়। খায়, ঘুমায়। ঠিক সন্ধে সাড়ে ছ'টায় ওরাই ওকে বাসায় পৌঁছে দেয়। আমি যেখানেই থাকি তার আগে বাসায় ফিরে আসি।' টিয়া বলল, 'আজ ছেলে জ্বর নিয়ে ফিরল। শুনলাম ওদের আজ এক ফুট জলের সুইমিং পুলে বসিয়েছিল। সবাই উঠে গেলেও ইনি জোর করে সেখানে বসেছিল। বোধহয় সেই কারণেইー!' টিয়া শ্বাস ফেলল।
খাবার টেবিলে সাজাল টিয়া। রান্না ভালো। মতিনের বেশ মজা লাগল খেতে। খেতে খেতে মতিনের মনে পড়ে যাওয়ায় গল্পটা বলল টিয়াকে।
'আপনার সঙ্গে আবার কথা বলল?' টিয়া অবাক।
'হ্যাঁ। ছেলেটার নাম লিটন। দ্বিতীয়বারে কথা বলার সময় মনেই হচ্ছিল না ও তোলাবাজদের একজন।
' মতিন বলল।
'আমার মনে হয় ওদের এড়িয়ে চলাই ভালো।
'ওদেরও নিশ্চয়ই বৈধ কাগজ নেই।'
'জানি না। থাকলেও থাকতে পারে। তবে পুলিশের খাতায় নিশ্চয়ই নাম আছে। তবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ভালো যেমন থাকে মন্দও থাকে। কার কতটা আছে তা না জানতে চাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।' টিয়া বলল।
যাওয়ার আগে গালিবকে দেখতে গেল মতিন। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। কপালে হাত রেখে বুঝল
জ্বর অনেক কমে গেছে।
সেটা পরীক্ষা করে টিয়া হাসল, 'আপনার ওষুধে কাজ হয়েছে?'
'আমার ওষুধ?' অবাক হল মতিন।
'আপনিই তো কম্বলটাকে সরিয়ে দিতে বললেন!' হাসল টিয়া।
বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল মতিন, 'কোনও দরকার হলে ডাকবেন।'
'বাঃ!' এরকম কথা অনেকদিন শুনিনি।'
'গালিবের, কিছু মনে করবেন না, পোলিও হয়েছিল?'
মাথা নাড়ল টিয়া, 'নো।' ও যখন পেটে তখন পড়ে গিয়েছিলাম, আমাকে এত জোরে ধাক্কা দেওয়া হয়েছিল, থাক সেসব কথা। গুড নাইট।' যেন নিজেকে আড়াল করতেই দরজা বন্ধ করে দিল টিয়া।
নিজের ঘরের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে সেটা বন্ধ করে আলো জ্বালাল মতিন। এর মধ্যেই এই ঘরে সে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। অন্ধকারেও স্বচ্ছন্দে সে হাঁটতে পারছে। জামাপ্যান্ট ছেড়ে বাথরুমে যেতেই রিং শুনতে পেল মতিন। তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে মোবাইলটা তুলে দেখল চেনা নাম্বার।
'হ্যালো।'
'আর হ্যালো। কী দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে তুমি,' সুলতানা বলল।
'কেন?'
'আবার কেন জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে। নাও, কথা বল।'
তার পরেই মুর্শেদের গলা শুনতে পেল, 'কোথাও গিয়েছিলে?'
'হ্যাঁ। এই রাস্তায়-
'বেশি দূরে না যাওয়াই ভালো। খাওয়া হয়েছে?'
'হ্যাঁ।'
'কী খেলে?'
'ভাত আর মুরগির মাংস।'
'ওখানকার দোকানে এগুলো না খাওয়াই ভালো। অনেক বেশি দাম নেয়। ম্যাকডোনাল্ডে গিয়ে খাওয়ার অভ্যেস কর। আজ তোমার ভাবি তো ম্যাকডোনাল্ড চিনিয়ে দিয়েছে।' মুর্শেদ গম্ভীর গলায় বলল।
মতিন জিজ্ঞাসা করল, 'দেশ থেকে কোনও খবর পেয়েছেন?'
'না। সাহেব লোক পাঠিয়েছিলেন। এখান থেকে কোনও অনুরোধ এখনও যায়নি।'
'সেকি? তা হলে কী আমি কাল গিয়ে খোঁজ নেব? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মতিন।
'কাল ছুটির দিন। কাউকে পাবে না। তা ছাড়া তোমার কেসটার আগে নিশ্চয়ই আরও অনেক কেস পেন্ডিং রয়েছে। এত অধৈর্য হলে চলবে কেন? এখানে কি তোমার খুব অসুবিধে হচ্ছে?' মতিন উত্তর দিল না। তার খুব খারাপ লাগছিল।
মুর্শেদ বলল, 'ঠিক আছে, বলছি।'
ফোনটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকল মতিন। দেশ-এর সঙ্গে তার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম মুর্শেদ আর মুর্শেদের সঙ্গে এই ফোন। লোকটা কাজ থাকলে তার কাছে নাও আসতে পারে। সেক্ষেত্রে এই ফোনটাই কথা বলিয়ে দিতে পারে। দেশে ফেরার চিন্তা এত প্রবল হয়ে উঠল যে সে এই মুহূর্তে টিয়ার কথা একদম ভুলে গেল।
সকালে স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিল, মতিন। সে ঠিক করল আজ নিউইয়র্কের যাবতীয় দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ঘুরে দেখবে। একদিনে যতটা হয়, তাতে সময় কেটে যাবে। দরজায় তালা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে দেখতে পেল টিয়ার ঘরের দরজা বন্ধ। আজ ছুটির দিন, টিয়া নিশ্চয়ই ঘরেই আছে। গালিব কেমন
আছে, তার খোঁজ নেওয়া দরকার। কাল যাকে অসুস্থ দেখে এল আজ তার খোঁজ না নেওয়া অভদ্রতা হবে। সে এগিয়ে গিয়ে 'বেলের বোতামে চাপ দিল। দ্বিতীয়বার চাপ দেওয়ার আগে দরজা খুলে গেল। একগাল হেসে টিয়া বলল, 'ওম্মা। আপনি! আমি ভেবেছিলাম কেয়ার-টেকারের লোক এসেছে। আসুন।'
চোখ সরিয়ে নিল মতিন। টিয়ার পরনে এখন খুব খাটো হাফ প্যান্ট আর নাভির ওপরে জামা গেঞ্জি, চুলগুলো মাথার ওপর চূড়ো করে বাঁধা। এই চেহারায় ওকে দেখে অস্বস্তি হচ্ছিল। সে ঘরে না ঢুকেই জিজ্ঞাসা করল, 'গালিব এখন কেমন আছে?' 'আসুন না নিজের চোখে দেখবেন।' একপাশে সরে গেল টিয়া।
এর পরে না ঢুকে পারা যায় না। দরজার পাশে জুতো খুলে রেখে শোওয়ার ঘরের দরজায় গিয়ে অবাক হল মতিন। বিছানায় বালিসে ঠেস দিয়ে বসে হাতে রিমোট নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে গালিব। সেখানে কার্টুন চলছে। দেখতে দেখতে হেসে উঠল একবার।
'দেখুন, কাল জুরে প্রায় বেঁহুশ ছিল, আর আজ সকালে সে কথা কেউ ভাববে?' বলতে বলতে টিয়া ভেতরে ঢুকে বলল, 'এক মিনিট, গালিব, একটু বন্ধ করো টিভি। ও। গালিব, তুমি
তো ভালো ছেলে, আমার কথা শোনো, প্লিজ!' এবার বেশ বিরক্ত হয়ে ছেলে তাকাল মায়ের দিকে কিন্তু রিমোট টিপে টিভি বন্ধ করল
না।
টিয়া বলল, 'এই আঙ্কল কাল রাত্রে তোমাকে খুব হেল্প করেছেন, তোমার সঙ্গে কথা বলেছেন। একবার হাই বলো!'
মতিন লক্ষ্য করল গালিবের মাথা শরীরের তুলনায় বেশ ছোট। মায়ের কথা শোনার পর কয়েক সেকেন্ড ভাবল, তারপর মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখল, 'ড্যাড?'
টিয়া বলল, 'নো। ড্যাড নয়। আঙ্কল!'
মতিন এবার জিজ্ঞাসা করল, 'কেমন আছ গালিব?'
'অ্যাঃ! অ্যাঃ!' মুখটা ভ্যাটকাল, বালক।
'তুমি দিন দিন খুব অসভ্য হয়ে উঠেছ। চলুন, ওঘরে গিয়ে বসি। ও দেখুক কার্টুন।' কথাটা
কানে যেতে ছেলে যে খুশি হল তা মতিন লক্ষ্য করল। বাইরের ঘরে এসে সোফায় বসল না মতিন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করল, 'ও কি কথা বলতে পারে না?'
'কয়েকটা শব্দ যা আমি বুঝতে পারতাম, এখন ওর টিচার বুঝতে পারে।'
'জন্ম থেকেই?'
'জন্মাবার সময় শরীর ওরকম ছিল, কথা বলার সময় এলে ধরা পড়ল।' টিয়া বলল, 'বসুন।
এত সকালে তৈরি হয়ে কোথায় বের হচ্ছেন?'
প্রসঙ্গ পালটানোয় খুশি হল মতিন, 'এতদিন এখানে আছি, ভালো করে কিছুই দেখিনি। হুট করে চলে যেতে হবে ডুপ্লিকেট পাসপোর্ট পেলে। তাই ভাবলাম আজ নিউইয়র্ক শহরটাকে ঘুরে
দেখি।'
'কোথায় যাবেন? কী কী দেখবেন?'
নিউইয়র্কে আসার আগে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছিল তা উগরে দিল মতিন। শুনে টিয়া
হাসল।
'আপনি হাসছেন কেন?'
'আপনি তো রাস্তাঘাট চেনেন না। জিজ্ঞাসা করে করে যেতে হবে। স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখে সবচেয়ে উঁচু বাড়িটায় কী করে পৌঁছোবেন? জানেন না। আর নিউইয়র্ক এত বড় শহর যে ট্রেনে
চেপে পায়ে হেঁটে একটা কিছু ভালো করে দেখতে না দেখতেই দিন শেষ হয়ে যাবে।' টিয়া বলল।
'তা হলে-!'
'আমি আপনাকে লিখে দিচ্ছি। আজ স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখে ম্যানহাটনটা ঘুরে আসুন।' পাশের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ছোট্ট প্যাডে কিছু লিখে মতিনের হাতে দিল টিয়া, 'কোন কোন ট্রেনে যেতে হবে লিখে দিয়েছি। ট্রেন থেকে কোথায় নামতে হবে তাও। নেমে একটু হাঁটতে হবে। ওখান থেকে কীভাবে ম্যানহাটনে যাবেন তাও লিখে দিয়েছি। আপনার সঙ্গে মোবাইল থাকলে ভালো হত। সমস্যায় পড়লে ফোন করতেন।'
'আমি একটা মোবাইল ফোন পেয়েছি।'
'অ্যাঁ! বাঃ। নাম্বারটা বলুন।'
'আমি নাম্বারটা ঠিক জানি না।'
'ও মাই গড! ঠিক আছে, আমার নাম্বারটা ডায়াল করুন।'
টিয়া যা যা নাম্বার বলে গেল তার বোতাম টিপল মতিন। পরদায় সেই নাম্বারগুলো ফুটে ওঠার পরেই টিয়ার ফোনে রিং শুরু হল।
টিয়া বলল, 'কেটে দিন। আমি নাম্বারটা সেভ করে রাখছি।'
সেটা করার পর মতিনের হাত থেকে যন্ত্রটা নিয়ে নিজের নাম্বার এন্ট্রি করিয়ে দিল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, 'এই ফোন কোথায় পেলেন?'
সত্যি কথা বলতে গিয়ে একটু ঘুরিয়ে বলল মতিন, 'মুর্শেদভাই আর সুলতানাভাবি দিয়েছেন। দেশে যাওয়ার সময় ফেরত দিয়ে যেতে হবে।'
'সঙ্গে কত টাকা নিয়েছেন?
'ওই, যা ছিল, সব।'
'পাগল! তিরিশ কি চল্লিশ ডলারের বেশি নেবেন না। নিউইয়র্ক শহরটাকে আপনার যদি মনে হয় স্বর্গরাজ্য তা হলে ভুল করবেন। কখন কে পকেট মারবে, কেউ এসে ছিনতাই করবে জানার আগেই সেটা হয়ে যাবে। ঘরে রেখে যান।' টিয়া বলল।
'একদম ভাবিনি একথা। আসলে ঘরে রেখে যেতে ভয় করছিল, যদি চুরি হয়ে যায়।' 'আপনার পাসপোর্ট যদি ঘরে রেখে যেতেন তাহলে এতক্ষণে বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াতে পারতেন।' টিয়া হাসল, 'ঘুরে এসে বলবেন কী কেমন দেখলেন!'
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মতিন ভাবছিল, দেশে কোনও মেয়েকে এখনকার টিয়ার পোশাকে সে কখনও দ্যাখেনি। শুনেছে, শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েদের কেউ কেউ খুব মড পোশাক পরে। তাদের সে চোখে দ্যাখেনি। কিন্তু তাদের পাড়ায় টিয়াকে যদি এই পোশাকে দ্যাখা যেত তা হলে কত কথাই না হত। প্রথমে তার অস্বস্তি হলেও পরে সেটা চলে গিয়েছিল। টিয়াকে আর
অস্বাভাবিক মনে হয়নি।
স্টেশনে উঠে টিয়ার লেখা কাগজটা ভালো করে দেখল সে। তারপর টিকিট কিনে প্ল্যাটফর্মে ঢুকল, আজ ছুটির দিন বলেই বোধহয় তেমন লোক নেই প্ল্যাটফর্মে। সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে 'এফ' লেখা ট্রেনটা চলে এল। বেশি যাত্রী নেই কামরায়। আরাম করে বসল সে। এই যে ট্রেনে চেপে নিউইয়র্ক শহরের ওপর এবং নীচ দিয়ে সে একা যাচ্ছে, কিছুদিন আগেও ভাবতে পারত না। প্রথমবার একা যাওয়ার সময় যে ভয় ভয় ভাব ছিল এখন সেটা আর নেই।
পরের স্টেশনে লোকদুটো উঠল। দুটো কালো ছেলে, খুব স্মার্ট, সুগঠিত শরীর, চকরা-বকরা পোশাক, চোখে কালো চশমা। সঙ্গে সাউন্ড বক্স আর গিটার। উঠেই দুজনে গান গাইতে লাগল। ওদের গলা এবং বাজনা গমগম করতে লাগল কামরায়। ওরা এভাবে গান গাইছে কেন? একটা গান শেষ হতেই দু-মাথা থেকে টুপি খুলে ঘুরতে লাগল যাত্রীদের সামনে। যাত্রীরা যে যা পারছিল দিয়ে দিচ্ছিল টুপিতে। হঠাৎ এক বৃদ্ধা মাথা নেড়ে বললেন, আমি তোমাদের দশ ডলার দেব।' 'সো নাইস অফ ইউ মাম্।'
'কিন্তু তোমাদের পরের স্টেশনে নেমে যেতে হবে। ওই বিকট শব্দে আমার শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধা চেঁচিয়ে বললেন।
সঙ্গে সঙ্গে দুজন মাথা নীচু করল। পরের স্টেশনেই নেমে গেল ওরা। নামার আগে বৃদ্ধার কাছ থেকে নোটটা নিল না। ট্রেন আবার চালু হলে উলটোদিকের এক যাত্রী বললেন, 'আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
বৃদ্ধা বললেন, 'ধন্যবাদটা আপনাকে দেওয়ার সুযোগ যদি করে দিতেন তাহলে খুশি হতাম।' বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
মতিন হেসে ফেলল। এত ভদ্রভাবে যে ভৎসনা করা যায় তা সে জানত না। কিন্তু সেইসঙ্গে মনে পড়ল দেশেও ট্রেন বা বাসে মানুষ একতারা বাজিয়ে ভিক্ষে করে। আগে পল্লিগীতি গাইত ওরা। অন্ধ গায়ক চেঁচিয়ে গাইত ভাঙা গলায়। কিছুদিন আগে ঢাকায় গিয়ে শুনেছে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে এখন ভিক্ষে চাওয়া হচ্ছে। তাহলে এই ব্যাপারটা সব দেশেই রয়েছে। চেহারা, পোশাক এবং যন্ত্রপাতির বিরাট তারতম্য আছে।
টিয়ার লেখা কাগজ-অনুসরণ-করে স্ট্যাচু অফ লিবার্টির দিকে হাঁটা শুরু করা মাত্র পকেটে রাখা মোবাইল বেজে উঠল। সে ওটা বের করে বোতাম টিপে হ্যালো বলতেই সুলতানার গলা শুনল, 'তুমি কি এখনও ঘুমাচ্ছ?'
'না না। আমি এখন রাস্তায়। স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখতে যাচ্ছি।'
'ও মাই গড! হঠাৎ এত সাহসী হয়ে গেলে। ঠিক আছে, দ্যাখা হয়ে গেলে আমাকে একটা কল দিয়ো।' লাইন কেটে দিল সুলতানা।
কিছুটা পথ হাঁটার পর কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে আচমকা জল দেখতে পেল মতিন। বিরাট নদী। নদীর মাঝখানে বেশ উঁচু বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে মূর্তিটি তা এখান থেকে স্পষ্ট নয়, নদীর ধারে যেতে গেলে একটা পার্ক পেরিয়ে যেতে হবে। সেখানে বেশ কিছু মানুষকে দ্যাখা যাচ্ছে। বোধহয় স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখতে এসেছেন সবাই। মতিন এগোচ্ছিল। রাস্তার পাশে চলমান গাড়ির ওপর কিছু লোক দোকান সাজিয়ে বসে আছে।
খাবারের স্টলটার সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল মতিন। তারপর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'সালাম আলেকুম।'
লোকটি তখন দোকান সাজাচ্ছিল। মুখ তুলে অবাক চোখে তাকাল। তারপর মাথা নাড়ল,
'আলেকুম সালাম।'
'কেমন আছেন হারুণভাই?'
'আছি। এখনও আছি। আপনাকে ঠিক-
'কয়েকদিন আগে আপনার দোকানে আমরা তিনজন খাবার কিনেছিলাম।'
'এত লোক আসে।' বিড়বিড় করল হারুন।
'ওই যে আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছিল হটডগ মানে কুকুরের মাংস কিনা!' মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল মতিন।
'ওহো! হ্যাঁ।' হা হা করে হাসল হারুণ, 'মনে পড়ে গেছে। দেশের মানুষরা কত অদ্ভুত ধারণা নিয়ে থাকে। তা তারা কোথায়?'
'দেশে ফিরে গেছে।'
'আপনি কি এখানে কিছুদিন থাকবেন?'
'আমাকে তুমি বলবেন। আমি আপনার থেকে অনেক ছোট। আমি ফিরতে পারিনি পাসপোর্ট পকেটমার হয়ে গিয়েছে বলে। আবার আবেদন করেছি ডুপ্লিকেটের জন্যে। পেলে ফিরে যাব।' মতিন বলল।
'বেশি আশা করবে না। সরকারি কাজ তো, ছত্রিশ মাসে বছর হয়। তা এখানে কী মনে করে? স্ট্যাচু দেখবেন?'
'হ্যাঁ।'
'ওই পানির ধারে দাঁড়ালে ভালো দেখতে পাবেন না। দূরত্বটা তো অনেকখানি। ওই ওপাশে স্টিমার ঘাটা আছে। পনেরো মিনিট অন্তর স্টিমার যায় স্যাটার্ন আইল্যান্ড। যাওয়র সময় স্ট্যাচুর খুব কাছ দিয়ে যায়। ওটায় উঠে যান। ভালো দেখতে পাবেন।'
'স্যাটার্ন আইল্যান্ড মানে?'
হাসল হারুণ প্রশ্ন শুনে, 'শয়তানের দ্বীপ না, নামটাই ওইরকম? প্রচুর মানুষ ওখানে থাকে। অফিস, ব্যাবসাও আছে। স্টিমারে চেপে যাতায়াত করে সবাই।' হারুণ কথা শেষ করতেই খদ্দের এসে গেল। তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল সে। মতিনের মনে হল এখান থেকে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক। বেশ খিদে পাচ্ছে। সে গলা তুলে বলল, 'হারুণভাই, আমাকে একটা হটডগ দেবেন।'
খাবার বানাতে বানাতে মাথা নাড়ল হারুণ। চারপাশে তাকাল মতিন। এখানেও একই ব্যাপার। গোটা পৃথিবীর মানুষ যেন জড়ো হয়েছে স্ট্যাচু দেখতে। ওই স্ট্যাচু যে মশাল ধরে আছে তা স্বাধীনতার প্রতীক।
হঠাৎ যেন খদ্দের বেড়ে গেল হারুণের দোকানে। তাদের সামলে একটু সময় নিল সে মতিনকে খাবার দিতে। ওটা খাওয়ার পর বোতলটা এগিয়ে দিল হারুণ। খানিকটা জল খাওয়ার পরেই মতিন দেখল একটা সতেরো-আঠারো বছরের ছেলে যার মাথা নাড়া, কানে দুল, পরনে গেঞ্জি আর হাঁটুর নীচ অবধি প্যান্ট দোকানের পেছনে এসে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে হারুণভাই খিঁচিয়ে উঠল, 'এতক্ষণে টাইম হল? কখন আসতে বলেছিলাম। কতবার বলেছি বাইরে গিয়ে দ্যাখো কত ধানে কত চাল, তবু যাবে না। বাপের ঘাড়ে বসে তবলা বাজাবে!'
'সরি!' কাঁধ ঝাঁকাল ছেলেটা।
হারুণভাই তাকাল মতিনের দিকে, 'পৃথিবীতে থাকার সময় মানুষ যে পাপ করে তার শাস্তি আল্লা তাকে বেঁচে থাকার সময়েই দিয়ে যান। কথাটা জানেন?'
মতিন হাসল, 'শুনেছি।'
'এটা আমার সেই শাস্তি। উগরাতে পারি না, গিলতেও পারি না।' তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, 'আকবর ভাই এসে অপেক্ষা করে চলে গিয়েছে। আবার আসবে দু-ঘণ্টা পরে। তুই এক কাজ কর। একে নিয়ে স্টিমারে চেপে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখিয়ে আন। ভাই, এই ছেলের নাম রাসেল।'
মতিন বলল, 'আমি মতিন।'
'স্টিমার ভাড়াটা রাখ।' ছেলের হাতে নোট দিল হারুন।
সঙ্গে সঙ্গে রাসেল মতিনকে বলল, 'লেটস গো।'
হাঁটা শুরু করে রাসেল জিজ্ঞাসা করল, 'আর ইউ ফ্রম ঢাকা?'
'হ্যাঁ। ইয়েস।'
'আর ইউ অন ট্যুর?'
কী বলবে মতিন বুঝতে না পেরে মাথা নাড়ল হ্যাঁ।'
'হাই, গিভ মি এ ফ্ল্যাগ।'
'কী?'
'আঃ!' দুটো আঙুল ঠোঁটের সামনে নিয়ে গিয়ে টান দিয়ে রাসেল বোঝাল সে সিগারেট
চাইছে।
'আমি সিগারেট খাই না।'
'শিট্।' বলে চেঁচাল রাসেল। কথাটার মানে বুঝল না মতিন।
নদীর কাছে এসে রাসেল বলল, 'হাউ অ্যাবাউট হায়ারিং এ বোট? ইউ ক্যান কিস হার!'
'কিস? কাকে?'
'দি স্ট্যাচু।'
'তুমি কি পাগল?'
'আমি? নো! ইউ পিপল আর ম্যাড। আই ডোন্ট নো হোয়াই পিপল কাম হিয়ার টু ওয়াচ দ্য স্ট্যাচু! গিভ মি টেন বাকস।'
'বাকস?'
'ইউ কান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড ইংলিশ? ডলার, ডলার।'
চটজলদি পকেট থেকে নোটগুলো বের করে দশ ডলার রাসেলকে দিতেই সে চলে গেল টিকিট কাউন্টারের দিকে।
সামনেই স্টিমারটা দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীরা টিকিট দেখিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে, নীচের তলায় গাড়ি ঢুকছে একের পর এক। পদ্মার লঞ্চে গাড়ি ওঠে, যাত্রীও। কিন্তু এখানকার মতো আধুনিক নয়। স্টিমারটা হুইল বাজাল।
ব্যস্ত হয়ে মতিন তাকাল। হারুণভাই-এর ছেলে রাসেলকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। যেদিকে ছেলেটি গিয়েছিল সেদিকে এগিয়ে টিকিট কাউন্টারটা দেখতে পেল কিন্তু রাসেল নেই।
গেল কোথায় ছেলেটা। ঠিক তখনই স্টিমারটা ঘাট ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মিনিট দুয়েক পরে আর একটা স্টিমার ওপার থেকে এসে ঘাটে লাগাতে যাত্রীরা নেমে এল পিলপিল করে। তারপর
গাড়ি উঠে এল একের পর এক। মতিন বুঝতে পারছিল না সে কী করবে। পরের স্টিমারটা ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে। বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে মতিন টিকিট কাটল। দুই ডলার লাগল রিটার্ন টিকিটের দাম। রাসেলকে ওর বাবা টাকা দিয়েছিল টিকিট কাটার জন্যে। তার কাছ থেকে দশ ডলার নিয়েছিল সে। অথচ তার দ্যাখা পাওয়া যাচ্ছে না।
টিকিট দেখিয়ে স্টিমারের ওপরের ডেকে উঠে এল মতিন। বসার বেঞ্চি রয়েছে। এই স্টিমারটায় ভিড় হয়নি। টিয়া লিখেছে এই নদীটার নাম হাডসন। কিন্তু দেখলে সমুদ্র বলে মনে হয়। সে ডানদিকে তাকাতেই মুগ্ধ হয়ে গেল। ছবির মতো বড় বড় বাড়ি যেন আকাশটাকে সাজিয়ে রেখেছে। এমন দৃশ্য জীবনে কখনও দ্যাখেনি। এই সময় ফোন বেজে উঠতেই অন করল মতিন। সুলতানাভাবি।
'কী গো? কোথায়?'
'স্টিমারে। স্ট্যাচু দেখতে যাচ্ছি।'
'বাঃ। তার আগে তাকিয়ে দ্যাখো ম্যানহাটন স্কাই লাইন। ওই দৃশ্য কোথাও দেখতে পাবেনা।
সঙ্গে কোনও মেয়ে জুটে যায়নি তো?'
'ধ্যেৎ!' লজ্জা পেল মতিন।
'তোমাদের এই পুরুষজাতটাকে একটুও বিশ্বাস করি না বাবা। রাখছি।'
ফোন অফ করল মতিন। সুলতানাভাবি একটু বেশি কথা বলে কিন্তু মনটা বেশ ভালো। কথাবার্তাও আটপৌরে।
স্টিমার চলছে জলে ঢেউ তুলে। রেলিং-এ ভর রেখে দাঁড়িয়ে মতিন দেখছিল স্ট্যাচু এগিয়ে আসছে। তরপর খুব কাছাকাছি চলে এলে মুগ্ধ হয়ে দেখল সে। এই সময় পেছন থেকে কথা ভেসে এল, 'আমাদের দেশের লোক বলে মনে হচ্ছে না। বোধহয় পাকিস্তানি? হিন্দিতে বলো, বুঝতে পারবে।'
'পাকিস্তানিরা তো উর্দু বলে।'
'আঃ। একই হল।'
মতিন পেছন ফিরে দেখল দুটি মানুষ তাকে দেখছে। দুজনেরই বয়স হয়েছে। বৃদ্ধার পরনে সাদা শাড়ি।
'আপনারা আমাকে কিছু বলছেন?' মতিন জিজ্ঞাসা করল।
'আরে। ইনি তো বাংলা বলছেন! আপনি বাঙালি? বৃদ্ধা উল্লসিত।
'আমি বাঙালি!'
এবার বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন, 'তুমি কি ওই দ্বীপে থাক বাবা? মাথা নাড়ল মতিন, 'না। কেন বলুন তো।'
'আমাদের মেয়ের খোঁজে এসেছি। যে ঠিকানা পেয়েছি সেটা ওই দ্বীপের একটা রাস্তায় আছে। আমরা তো কাউকে চিনি না, তুমি যদি ওই দ্বীপে থাকতে তা হলে-!'
মতিন মাথা নাড়ল, 'এখানে ঠিকানা থাকলে বাড়ি খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। আমার হাতে এখন কোনও কাজ নেই। যদি চান তা হলে আপনাদের সঙ্গে যেতে পারি।'
বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা খুব খুশি হলেন। ততক্ষণে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি ছাড়িয়ে গেছে স্টিমার।'
বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন, 'তোমার নাম কী বাবা?'
'আমি মতিন। বাংলাদেশ থেকে এসেছি।
'বাংলাদেশ? কোথায়। কোন জেলায়?
মতিন নাম বলতেই বৃদ্ধ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, 'আরে। ওর পাশের গ্রামেই তো আমার ঠাকুরদা থাকতেন। আমি যখন ছয় বছরের তখন বাবার সঙ্গে কলকাতায় চলে এসেছিলাম। পনেরো
বছর বয়সে একবার গিয়েছিলাম। ওঃ, খুব আনন্দ হচ্ছে তোমাকে দেখে।'
বৃদ্ধা হাসলেন, 'দ্যাখো, কতদূরে এসে দেশের লোকের সঙ্গে দ্যাখা হয়ে গেল।'
'আপনারা ইন্ডিয়ার কলকাতায় থাকেন?'
'হ্যাঁ ভাই,' বৃদ্ধ জবাব দিলেন, 'আমাদের বাড়ি কৃষ্ণনগরে। জেলা নদীয়া। আমাদের জেলার
গেদের গায়েই বাংলাদেশ আরস্ত।'
'এখানে কবে এসেছেন?'
'তিনদিন হয়ে গেল। সবাই নিষেধ করেছিল আসতে। ওঁর এক আত্মীয়ের ছেলের বাড়িতে উঠেছি। সে-ই এয়ারপোর্ট থেকে এনেছিল। কিন্তু বেচারা এত ব্যস্ত থাকে যে আমাদের সময় দিতে
পারে না। তাই নিজেরাই বেরিয়ে পড়েছি।' বৃদ্ধ বললেন।
'ভিসা পেতে অসুবিধে হয়নি?'
'হ্যাঁ। খুব। প্রথমবার ফিরিয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয়বারে উনি এমন কান্নাকাটি শুরু করলেন মেয়ের জন্যে, বোধহয় না দিয়ে পারল না।'
স্টিমার ঘাটায় এলেন কী করে?'
'যার বাড়িতে উঠেছি সে তার গাড়িতে চাপিয়ে এখানে নামিয়ে দিল। ম্যানহাটনের কাছে
তার অফিস। বলেছে, বিকেল সাড়ে পাঁচটায় এসে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।' বৃদ্ধ বললেন। 'আপনারা মেয়ের খোঁজে এসেছেন বললেন!' মতিন দেখল একটা স্থলভূমি এগিয়ে আসছে। ওটাই নিশ্চয়ই স্যাটার্ন আইল্যান্ড। তার রিটার্ন টিকিট তাই নেমে বেরিয়ে আবার আর একটা স্টিমারে
উঠতে পারবে।
বৃদ্ধের মুখে ছায়া ঘনাল। ততক্ষণে স্টিমার ঘাটে পৌঁছে গিয়েছে। মাটিতে নেমে যাওয়ার
জন্যে ব্যস্ত হয়েছে যাত্রীরা। দ্রুত হাঁটতে গিয়ে মতিন দেখল বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাল রাখতে পারছেন না। সে গতি কমিয়ে দিয়ে ওঁদের সঙ্গে যীরে ধীরে নীচে নেমে এল।
একটু ইটিতেই দুপাশে দোকানপাট, দেখে বোঝা যায় ব্যবসা করার এলাকা। মতিন বলল, 'যদি ঠিকানাটা দেন তাহলে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারি।'
বৃদ্ধ একটা কাগঞ্জ বের করে মতিনের হাতে দিলেন।
বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন, 'তুমি কি এখনই ফিরে যাবে বাবা?'
মতিন মাথা নাড়ল, 'না। বলেছি তো, আমার কোনও তাড়া নেই।'
তারপর একটি পুলিশের কাছে গিয়ে ঠিকানাটা দেখাল মতিন?' পুলিশ বলল, 'ফার অ্যাওয়ে। টেক এ ক্যাব।'
ফিরে এসে সে বৃদ্ধকে বলল কথাটা। তিনি বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'কী করবে?' বৃদ্ধা বেশ জোরে জোরে বললেন, 'এতদূরে এসেছি যখন তখন শেষ দেখে ফিরব।'
বৃদ্ধ ইতস্তত করলেন, 'কিন্তু আমরা একা একা, ট্যাক্সি নিয়ে যেতে বলছে।' ক্যাব শব্দটির মানে এতক্ষণে বুঝতে পারল মতিন। হেসে বলল সে, 'কেন চিন্তা করছেন, আমি তো সঙ্গে আছি।'
'ও। আছো। তা হলে যাওয়া যেতে পারে।' বৃদ্ধ বললেন।
একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল। তার কাছে গিয়ে ড্রাইভারকে ঠিকানা লেখা কাগজটা দেখালে সে ইশারা করল উঠে বসতে। পেছনের সিটে ওদের দুজনকে বসিয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসল মতিন। ট্যাক্সি চলতে শুরু করলে মতিন জিজ্ঞাসা করল, 'অনেকদিন মেয়ের খোঁজ পাননি বোধহয়!'
'পাঁচ বছর!' বৃদ্ধা জবাব দিলেন, 'কোন চিঠি দূরের কথা, ফোনও করেনি।'
বৃদ্ধ বললেন, 'আমি বলেছিলাম, ধরে নাও মেয়ে মরে গেছে। কিন্তু ইনি সেকথায় কানই দিলেন না। দিন রাত কান্না।'
'এরকম কেন হল?' মতিন জিজ্ঞাসা না করে পারল না।
'প্রেম করে বিয়ে। ছেলে আমেরিকায় চাকরি করে। বছরে একবার যেত। তখনই আলাপ। পরে জানতে পারলাম। বাপ-মা নেই। দূর সম্পর্কের এক মামা থাকেন কলকাতায়। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে বিয়ে দিলাম। তার ছয় মাস পরে ভিসা পেল মেয়ে। জামাই টিকিট পাঠালে একাই চলে এল। আসার সময় ওই ঠিকানাটা দিয়ে এসেছিল। ফোন নাম্বারও। অনেক ফোন করেছি দেশ
থেকে, ফোন বাজেনি। ইনি জেদ ধরলেন, নিজের চোখে দেখে যেতে চান।' বৃদ্ধ বললেন। 'আমি কিছু চাই না। সে বেঁচে আছে না মরে গেছে, এটুকুই জানতে চাই।' বৃদ্ধার গলার স্বর খুব
করুণ শোনাল।
'আপনারা ইন্ডিয়ার বাঙালি?' আচমকা প্রশ্ন করল ট্যাক্সি ড্রাইভার।
বৃদ্ধ পেছন থেকে জবাব দিলেন, 'হ্যাঁ। আপনি বাংলা জানেন?'
'আমি বাঙালি। সিলেটের মানুষ ছিলাম।'
'আপনাকে দেখলে মনেই হয় না আপনি বাঙালি।' মতিন বলল, 'আমি বাংলাদেশের মানুষ। ঢাকার
কাছেই থাকি।'
'তাই? আপনাদের সম্পর্ক কী?'
মতিন বলল, 'আমরা বাঙালি। তবে পথেই আলাপ।'
'ভালো লাগল। তা চাচা, আপনার জামাই কি ইন্ডিয়ার লোক?'
'হ্যাঁ। কলকাতার ছেলে ছিল একসময়।'
'চলেন, দেখি।'
কুড়ি মিনিট চলার পর বড় রাস্তা ছেড়ে পাড়ার রাস্তায় গাড়ি ঢুকল। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর একটি বাড়ির গায়ে নাম্বারটা দেখতে পেয়ে গেল ড্রাইভার। বলল, 'এই বাড়ি। কিন্তু!' লোকটা গাড়ি থেকে নেমে বেল বাজাল। পরপর তিনবার। ততক্ষণে ওঁরা নেমে দাঁড়িয়েছেন গাড়ি থেকে। ড্রাইভার বলল, 'বাসায় কেউ নেই বলে মনে হচ্ছে। ছুটির দিনে বোধহয় বাইরে গিয়েছে।'
পাশের বাড়ির দরজার সামনে বেশ বৃদ্ধ এক আমেরিকান সাহেব দাঁড়িয়ে ছিলেন। ড্রাইভার তাঁর কাছে গিয়ে অন্যরকম উচ্চারণে জিজ্ঞাসা করল, 'স্যার, এই বাড়িতে লোকজন থাকে তো?' মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ, 'থাকে। একজন ইন্ডিয়ান আর তার ফিলিপিনসের বউ দুটো বাচ্চা নিয়ে থাকে। ওরা কারও সঙ্গে কথা বলে না।'
'কতদিন ধরে আছে ওরা?'
'প্রায় সাত বছর।'
'কোনও ইন্ডিয়ান মহিলাকে এই বাড়িতে দেখেছেন?'
'আমি দেখিনি। তবে আমার স্ত্রী বলেছিল একটি ইন্ডিয়ান মেয়েকে ওই বাড়িতে এনেছিল লোকটা। বহু বছর আগে। তাকে আর দেখতে পাওয়া যায়নি। চলে গিয়েছে নিশ্চয়ই। আর কোনও ইন্ডিয়ান মেয়েকে আমরা দেখিনি।' বৃদ্ধ মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেলেন।
ফিরে এসে ড্রাইভার বলল, 'বুড়োর তো কোনও কাজ নেই। গাড়ি থামলেই বেরিয়ে এসে দ্যাখে কে এল। আপনাদের মেয়ে এখানে থাকলে ওর চোখ এড়াবে না।'
মতিন বলল, 'তাছাড়া এখানে তো একজন ইন্ডিয়ান তার ফিলিপিনের বউ নিয়ে থাকে।' বৃদ্ধ বললেন, 'তাহলে ঠিকানাটা ভুল লিখেছে। কী করবে?'
'ওই ইন্ডিয়ান লোকটার নামটা জানা যাবে?'
'যার অন্যদেশি বউ-বাচ্চা আছে তার নাম জেনে কী করবে।' ধমক দিলেন বৃদ্ধ। সঙ্গে সঙ্গে দুটো হাত মুখে চেপে কেঁদে উঠলেন বৃদ্ধ্য।
'কী হচ্ছে? চুপ কর।' বৃদ্ধ বললেন।
ড্রাইভার বললেন, 'আমার মনে হয় আপনাদের থানায় যাওয়া উচিত।'
'খানা?' বৃদ্ধ হতভম্ব।
'দেখুন, যে ঠিকানাটা পেয়েছিলেন সেখানে একজন ইন্ডিয়ান থাকে। লোকটা বাঙালি হতেও পারে। হলে তার কাছ থেকে আপনার মেয়েজামাই-এর খবর পেতে পারেন।' পুলিশ এই লোকটার খোঁজখবর দিতে পারে।' ড্রাইভার বলল।
'কিন্তু থানা কোথায় তা তো জানি না। তা ছাড়া বাবা আমি এখানকার মানুষের বল্য ইংরেজি বুঝতে পারি না। তার চেয়ে তুমি যেখান থেকে আমাদের তুলেছিলে সেখানেই নামিয়ে দাও। আমরা ফিরে যাব।' বৃদ্ধ বললেন।
বৃদ্ধা মাথা নাড়লেন। না। উনি ঠিক বলেছেন। আমরা থানায় যাব।'
'আশ্চর্য!' বৃদ্ধ বিরক্ত হলেন, 'তুমি সেখানে গিয়ে ইংরেজিতে সব কথা ওদের বুঝিয়ে বলতে পারবে?"
ড্রাইভার হাসল, 'ঠিক আছে, চলুন। আমি আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি।'
বৃদ্ধ বললেন, 'কিন্তু ট্যাক্সির ভাড়া কত ডলার উঠবে?'
ড্রাইভার বলল, 'আমি গাড়ি থামানোর সময় মিটার অফ করে দিয়েছিলাম' এখন যা উঠে আছে তাই দেবেন। উঠুন।
পুলিশ অফিসারটি তরুণ। তিনজনকে সামনে বসিয়ে ড্রাইভার সব কথা তাঁকে বলতেই তিনি কমপিউটারের সামনে গিয়ে বসলেন। ফিরে এসে বললেন, 'মিস্টার আর পি সেন, ম্যারেড উইদ টু কিডস, ফিলিপিনো ওয়াইফ।'
বৃদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন, 'রমাপ্রসাদ সেন। ওই, ওই!'
মতিন জিজ্ঞাসা করল, 'উনি আপনার মেয়ের জামাই?'
'মেয়ের কেন হবে? আমাদের জামাই।' বৃদ্ধ বললেন।
ড্রাইভার আবার কথাগুলো বললে অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, 'আপনাদের এই বিয়ের কোনও প্রমাণ আছে?'
কথাটা বৃদ্ধকে ড্রাইভার বুঝিয়ে দিলে তিনি হাতের ব্যাগ খুলে একটা সার্টিফিকেট এগিয়ে
দিয়ে বললেন, 'ভাগ্যিস এই ম্যারেজ সার্টিফিকেটটা এনেছিলাম!' সেটায় চোখ বুলিয়ে অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, 'মিস্টার সেন এবং তার ফ্যামিলি বাড়িতে
নেই যখন-তখন অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।' মতিন বলল, 'আচ্ছা, একজন ইন্ডিয়ান মহিলাকে পাশের বাড়ির মহিলা বাড়িতে ঢুকতে
দেখেছেন কিন্তু বেরোতে দেখেননি। তিনি বাড়িতেই থেকে যাননি তো?' ড্রাইভার কথাগুলো তর্জমা করলে অফিসার হেসে উঠলেন, 'ইটস নট পসিবল। তিনি তো চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দেননি। আমি ওই দিকের যেসব অফিসার রাউন্ড দিচ্ছে তাদের জানিয়ে দিচ্ছি মিস্টার সেন এলেই যেন আমাকে খবর দেয়। আপনারা পরে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। এই নিন কার্ড।' সার্টিফিকেট ফেরত দিলেন তিনি।
কার্ড হাতে নিয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সঙ্গে ওরা বাইরে বেরিয়ে এল। বৃদ্ধা বলল, 'আমার মন বলছে রমাপ্রসাদ তৃণাকে মেরে ফেলেছে। বউবাচ্চা থাকা সত্ত্বেও যে বিয়ে করতে পারে। ও মাগো।'
'ওইরকম দুম করে বিয়ে করে বসল মেয়েটা।' বৃদ্ধ বলল।
'তখন তোমাকে বলেছিলাম ছেলেটা কেমন তার খোঁজখবর নাও।' 'বললেই হল। আমেরিকায় আমার কে আছে যে খোঁজ দেবে।'
এই সময় অফিসার বেরিয়ে এলেন থানা থেকে। পুলিশের গাড়ির দিকে যেতে যেতে চিৎকার করে বললেন, 'ফলো মি।'
ড্রাইভার বলল, 'নিশ্চয়ই ওর ফিরে আসার খবর পেয়েছে। চলুন, চলুন।'
বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ অফিসার সোজা বেল টিপলেন। একটু বাদেই নিরীহ চেহারার এক ভদ্রলোক দরজা খুলল। তাঁর পরণে এখনও বাইরে যাওয়ার পোশাক।
'আপনি মিস্টার আর পি সেন?'
"হ্যাঁ। কী ব্যাপার?' ইংরেজিতেই জবাব এল।
'আপনি ওই ওল্ড ম্যান এবং লেডিকে চেনেন?'
বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে দেখলেন ভদ্রলোক, 'না। কে ওরা?'
বৃদ্ধ চেঁচিয়ে উঠলেন, 'কে ওরা? রমাপ্রসাদ, তুমি আমাদের চেন না?'
'সরি। আমি আপনাদের কখনও দেখিনি।'
'আপনি বিবাহিত?' অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন।
'হ্যাঁ। আমার দুটো বাচ্চাও আছে। ওরা এই মুহূর্তে আমার শ্বশুরবাড়িতে আছে। আজই রেখে এলাম।'
'আপনার বাড়িটা একটু ঘুরে দেখব।'
'কেন?' হঠাৎ ভদ্রলোক রেগে গেলেন, 'আপনার কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে? ওটা ছাড়া আপনি বাড়িতে ঢুকতে পারেন না।'
'আমি তো বলিনি সার্চ করব। বলেছি ঘুরে দেখব। মিস্টার সেন, এঁরা যে অভিযোগ করেছেন এবং তার যে প্রমাণ দাখিল করেছেন তাতে আপনাকে আমি স্বচ্ছন্দে অ্যারেস্ট করতে পারি। আপনি কি আমাকে ওয়ারেন্ট নিয়ে আসতে বাধ্য করবেন?'
'অফিসার। আপনি একতরফা কয়েকটা পাগলের কথা শুনেছেন। আমি এদের কাউকেই কখনও দেখিনি।
'ঠিক আছে, আমি কি আপনার স্ত্রীর ছবি দেখতে পারি?' অফিসার তাকালেন।
'সিওর। শুধু আপনি ভেতরে এসে বসুন, আমি দেখাচ্ছি।'
অফিসারকে বসার ঘরে বসিয়ে পাশের ঘর থেকে একটি ফ্রেমে বাঁধানো ছবি এনে সামনে ধরলেন মিস্টার সেন।
'কবে বিয়ে হয়েছিল আপনাদের?'
'সাত বছর হয়ে গেল আমরা একসঙ্গে আছি।'
'সরি স্যার, আপনাকে বিরক্ত করতে বাধ্য হয়েছিলাম।'
ইটস অলরাইট, আপনি আপনার কর্তব্য করেছেন।' হাসলেন মিস্টার সেন।
' এইসময় বাড়ির ভেতর থেকে কুকুরের চিৎকার ভেসে এল। কুকুরটা বাইরে বের হতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।
'আপনার বাড়িতে কুকুর আছে?' অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন।
'হ্যাঁ, মানে, আমার কুকুর নয়, এক বন্ধু বাইরে গিয়েছে, রাখতে দিয়েছিল।'
'ওকে বাড়িতে বন্দি করে রেখে আপনারা বাইরে গিয়েছিলেন, সঙ্গে নিয়ে যাননি কেন?' অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন।
'এখনও ওটা আমাদের পোষ মানেনি, শুনছেন তো কীরকম চেঁচাচ্ছে।'
'ওকে বাইরে আনুন, বোধহয় কষ্ট পাচ্ছে বেচারা।'
'না অফিসার। ও কামড়ে দিতে পারে।'
'কী কুকুর। ডাক শুনে মনে হচ্ছে স্পিজ।'
'হ্যাঁ। স্পিজ।'
'আমাকে কামড়াবে না। স্পিজের সঙ্গে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। চলুন কোন ঘরে আছে ও?'
'আপনি মিছিমিছি আমার বাড়ির ভেতরে নাক গলাচ্ছেন অফিসার।'
'এক্ষেত্রে মিছিমিছি নয়। গৃহপালিত জত বিপদে পড়েছে কি না দ্যাখা আমার কর্তব্য। দয়া করে আপত্তি করবেন না। চলুন।'
মিস্টার সেন বাধ্য হয়ে অফিসারকে বেসমেন্টের বন্ধ দরজার সামনে নিয়ে এলেন। কুকুরটার ডাক
আরও স্পষ্ট হল।
মিস্টার সেন বললেন, 'আপনি এখানে অপেক্ষা করুন। আমি নিয়ে আসছি।'
দরজা খুলে এক পা নীচে নামামাত্রই কুকুরটা ঝাঁপিয়ে পড়ল মিস্টার সেনের ওপরে। পড়ে যেতে যেতে কোনওরকমে নিজেকে সামলালেন ভদ্রলোক। কুকুরটা আবার দৌড়ে ফিরে গেল নীচে। অফিসার সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে এসে ডাকলেন, 'কাম অন বেবি, কাম অন!'
একটা কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে মাটির নীচের ওই ঘরে। কুকুরটা সোজা গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে যার পাশে তাকে দেখে চমকে উঠলেন অফিসার, 'ছ আর ইউ?'
মতিন এবং ড্রাইভারের সাহায্য নিয়ে মহিলাকে ওপরে যখন নিয়ে আসা হল তখন দ্যাখা
গেল তিনি আলো সহ্য করতে পারছেন না। দু-হাতের আড়ালে চোখ রেখে পায়ে পায়ে হাঁটছেন। বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে আসামাত্র তাঁরা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন, 'বৃদ্ধা কাঁদলেন, 'এ কী চেহারা হয়েছে তোর। এ কী অবস্থা?'
মিস্টার সেনকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। প্রায় দেড়ঘণ্টা ধরে সমস্ত অভিযোগ বৃদ্ধ, বৃদ্ধা এবং তাঁদের মেয়েকে দিয়ে লিখিয়ে পুলিশ জানাল তাঁদের এখনই দেশে ফিরে যাওয়া চলবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মামলা আদালতে তুলবে তারা, সেখানে তাঁদের প্রয়োজন হবে। নিউইয়র্কের ঠিকানা, ফোন নাম্বার নিয়ে নিল পুলিশ। মিস্টার সেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এক, বিবাহিত হয়েও সেটা চেপে গিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন। দুই, সেই দ্বিতীয় স্ত্রীকে বাড়িতে এনে বেসমেন্টে রেখে রান্না করিয়েছেন, বেবিসিটারের কাজ করিয়েছেন, কখনই সূর্যের আলো দেখতে দেননি। এইসব অপরাধের জন্যে এঁকে অন্তত দশ বছর জেলে থাকতে হবে।
ট্যাক্সি ড্রাইভার ওঁদের যখন স্টিমার ঘাটায় পৌঁছে দিল তখন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। ড্রাইভার বলল, 'শাস্তিতে যান। যখনই স্যাটার্ন আইল্যান্ডে আসবেন আমাকে একটা কল দেবেন।' দুটো কাগজের টুকরোতে নিজের মোবাইল ফোনের নাম্বার লিখে দিল সে। বৃদ্ধ পকেট থেকে দুশো ডলার বের করে এগিয়ে ধরলেন, 'আজ তুমি যা করেছ বাবা তার ঋণ কখনও শোধ করতে পারব না। এইটে রাখো।'
'আপনি কী বলেন! বাঙালি হয়ে বাঙালির জন্যে এটুকু করতে পারব না? ওটা রাখুন, এখন আপনাদের সামনে অনেক খরচ আছে।' ড্রাইভার হাসল।
'কিন্তু এতক্ষণ সময় গেল, তেল পুড়িয়ে গেলে এলে-।'
চাচা। গাড়িটা আমার ঠিক আছে, বিশ টাকা দিন।'
'বিশ টাকা?'
'ওই হল, কুড়ি ডলার। তাতেই সব হয়ে যাবে।'
স্টিমারে বৃদ্ধা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলেন। বৃদ্ধ বললেন, 'সমস্যায় পড়ে গেলাম। যতদিন মামলার রায় না বের হচ্ছে ততদিন তো এখানে থাকতে হবে। ছয় মাসের ভিসা দিয়েছে। কিন্তু যেখানে আছি সেখানে তো এতদিন থাকা যাবে না।'
'ফিরে গিয়ে আবার আসা যাবে না?' বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন?'
'তোমার কি মাথা খারাপ?' খিঁচিয়ে উঠলেন বৃদ্ধ, 'প্লেনের ভাড়া কত তা কি ভুলে গেছ? কী যে করি।'
মতিন চুপচাপ শুনছিল, 'যাঁর বাড়িতে আছেন তাঁকে বলুন কম পয়সায় ঘর ভাড়া করে দিতে। নিজেরা রান্না করে খাবেন।'
'একটা ঘরের ভাড়া কীরকম?'
'আমি জানি না। তবে খোঁজ নিয়ে বলতে পারি।'
মতিন সুলতানার নাম্বারটা টিপল। সঙ্গে সঙ্গে সুলতানার গলা, 'বাপস' এতক্ষণে মনে পড়ল। প্রাণভরে স্ট্যাচু দেখলে? আমি বাজি রাখতে পারি, ওটা যদি কোনও পুরুষমানুষের স্ট্যাচু হত তাহলে এক মিনিটেই দেখা হয়ে যেত।'
'আমাকে একটা খবর দেবেন?"
'বলো।'
'আচ্ছা, বাথরুম রান্নাঘর সমেত একটা ঘরের ভাড়া ক্ত হবে?'
'এ্যা? তুমি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকবে?'
'না না। অন্যের জন্যে। ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন দুজন বয়স্ক মানুষ।'
'অ। এর মধ্যেই তাদের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল?' হাসল সুলতানা, 'কোন জায়গায় থাকবে তার ওপর ভাড়া কমবেশি হবে। কুইন্সে মাসে আটশোর নীচে পাওয়া যাবে না। আবার জ্যামাইকায় পাঁচ-ছয়শোতেও পাওয়া যেতে পারে। তুমি কোথায়?'
'বাসায় ফিরছি।'
'ফিরে কল দিও।'
ফোন বন্ধ করে খবরটা দিল মতিন।
বৃদ্ধ বললেন, 'দেশ থেকে টাকা আনাতে হবে। ওই ভাড়া হলে কয়েকমাস নিশ্চয়ই থাকতে পারব। তুমি আমাদের ঘরটাকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে?'
'আমার মোবাইল ফোনের নাম্বার রাখুন। দুদিন পরে ফোন করবেন।'
নাম্বারটা লিখে বৃদ্ধ বললেন, 'থ্যাঙ্ক ইউ মতিন।'
বৃদ্ধা বললেন, 'তোমার এতদিনের ভুল ভাঙল তো?'
'কী ভুল?' বৃদ্ধ ভ্রু কোঁচকালেন।
'কবে কোন মুসলমান তোমার বাবার ঘরবাড়ি কেড়ে নিয়েছিল বলে ওদের তুমি সহ্য করতে পারতে না। আমি কতবার বলেছি, নজরুল ইসলামও তো মুসলমান ছিলেন। মহম্মদ রফি, তালাত মামুদরাও তো তাই। কানে তোলনি কথাগুলো। আজ দেখলে তো, এরা না থাকলে আমরা কখনও মেয়েকে ফিরে পেতাম? কী দরকার ছিল ওদের আমাদের জন্যে সময় নষ্ট করার? বলো?' বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন। মতিন হাসল, 'সব জাতের মধ্যে ভালো যেমন আছে মন্দও আছে। কোনও কোনও হিন্দু নিশ্চয়ই খুব খারাপ লোক। তার মানে এই নয় সব হিন্দুই খারাপ।'
বৃদ্ধ হাত বাড়িয়ে মতিনকে স্পর্শ করলেন, 'তোমরা আমার ভুল ভাঙিয়ে দিলে মতিন। না হলে আজ আমরা তৃণাকে খুঁজে পেতাম না।'
মতিন বলল, 'মেয়েকে পাওয়ার আনন্দে আপনারা ভুলে গেছেন উনি কখন খেয়েছেন তা জিজ্ঞাসা করতে।'
তৃণা মায়ের কাঁধে মুখ রেখে বসেছিল, শুনে কেঁদে উঠল।
বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন, 'কাঁদছিস কেন?'
কান্না গিলতে গিলতে তৃণা বলল, 'শুধু রাত্রে খেতে দিত। একবেলা।'
মতিন দেখল স্ট্যাচু এগিয়ে আসছে, সে কিছুটা হেঁটে এপাশ-ওপাশ তাকাতেই খাবারের
স্টলটা দেখতে পেল। প্যাটিস, কেক, প্যাস্ট্রির সঙ্গে কোল্ড ড্রিঙ্ক বিক্রি করছে। সে একটা ফ্রুট কেক আর কোল্ড ড্রিঙ্ক কিনল চার ডলার দিয়ে। তারপর ফিরে এসে বৃদ্ধাকে বলল, 'আপাতত খেয়ে নিতে বলুন। শরীর ভালো লাগবে।'
বৃদ্ধা খুশি হয়ে মেয়ের হাতে দিলেন। তৃণা একটু ইতস্তত করে খেতে শুরু করলে বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, 'কত লেগেছে?'
'ভুলে গেছি।' হাসল মতিন।
'সত্যি, তোমাদের কী বলে।'
'কিছুই বলতে হবে না।'
কেক পুরোটা খেতে পারল না তৃণা। কিন্তু তার মুখের চেহারা অনেকটা পালটে গেল। মতিনের দিকে তাকিয়ে নীচু গলায় বলল, 'ধন্যবাদ।'
এপারে নেমে মতিন জিজ্ঞাসা করল, 'আপনারাও তো অনেকক্ষণ খাননি। চলুন, এখানে বাংলাদেশের একজন খুব ভালো হটডগ বানায়।'
বৃদ্ধা বললেন, 'না বাবা। আমরা বাড়িতে গিয়েই খাব।
বোধহয় তৃণার অসুবিধের কথা ভেবেই একটা ট্যাক্সি ধরলেন বৃদ্ধ। বললেন, 'মতিন, তুমি কোনদিকে যাবে? আমাদের দিকে হলে সঙ্গে চলো।'
মতিন মাথা নাড়ল, 'আমি মাটির ওপরের কিছুই চিনি না। তাই ট্রেনে যাব।' টেলিফোনে যোগাযোগ করবেন বলে এঁরা চলে গেলেন।
হারুণভাই তার চলমান দোকানের পেছনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। এখন কোনও খদ্দের নেই। মতিনকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, 'এতক্ষণ কোথায় কি ছিলেন?'
'ওই দ্বীপে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। একটা হটডগ দিন।' মতিন বলল।
'ওখানে তো কিছু দেখার নেই। স্ট্যাচু কেমন লাগল?' হারুণ জিজ্ঞাসা করল। 'ভালো।' মতিন জিজ্ঞাসা করল, 'রাসেল কোথায়?'
'কোথায় মানে? সে তো আপনার সঙ্গে গেল। এত দেরি হবে জানলে আমি ওকে পাঠাতাম না। আমার টয়লেটে যাওয়ার খুব প্রয়োজন।'
'কিন্তু রাসেল আমার সঙ্গে যায়নি।'
'বলেন কী?' চোখ কপালে তুলল হারুণ।
রাসেলের ব্যাপারটা খুলে বলল মতিন। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিপ্ত হয়ে গেল হারুণ, 'হারামজাদা একদম নষ্ট হয়ে গেছে। আপনার কাছে দশ ডলার নিয়ে নিশ্চয়ই গাঁজা খাচ্ছে পার্কের কোনও কোণে বসে। এই ছেলে আমাকে একদম বরবাদ করে দিল। কিছুতেই তাড়াতে পারি না ওর মায়ের জন্যে। ছি ছি ছি।' বলে ক্যাশবাক্স থেকে দশ ডলারের নোট নিয়ে মতিনের হাতে গুঁজে দিল হারুণ, 'সরি ডাই।'
নোটটা নিল মতিন, বলল, 'আপনার টয়লেটে কতটা সময় লাগবে?'
'কেন?'
'ততক্ষণ আমি দোকান পাহারা দিতে পারি।'
'কাস্টমার আসলে কী করবেন?'
'আপনি যেভাবে খাবার গরম করে দেন সেইভাবে দেব।'
মতিনের কথা শুনে হাসল হারুণ, 'থ্যাঙ্কস ভাই। আপনাকে খাবার বিক্রি করতে হবে না। আপনি শুধু দাঁড়িয়ে থাকুন। এখানে অনেক চ্যাংরা আছে, দেখবেন তারা যেন কিছু তুলে নিয়ে না যায়।'
'ঠিক আছে।'
হারুণের যে প্রয়োজন বেশ হয়েছিল তা ওর হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গিতেই বোঝা গেল। মতিন দোকানের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। পরিচিত কেউ এখানে নেই। যদি টিয়া তাকে দেখত নিশ্চয়ই খুব হাসত।
ভাবতেই দুটো মেয়ে এসে দাঁড়াল দোকানের সামনে। অল্প বয়সি কালো মেয়ে। কিন্তু তাদের
অঙ্গে শরীর দেখানো পোশাক। মতিন গম্ভীর হল।
একজন বলল, 'হাই।'
মতিন মাথা নাড়ল। হাই শব্দটা বলতে গিয়েও পারল না।
'উই হ্যাভ লস্ট আওয়ার ওয়ালেট। বাট উই আর হাংরি। প্লিজ হেল্প আস।' বলতে বলতে মেয়েটা বাঁ-চোখ ছোট করল। অন্য মেয়েটি হেসে উঠল শব্দ করে, 'নাইস গাই। পারহ্যাপস পাকিস্তানি।'
সঙ্গে সঙ্গে রাগ হয়ে গেল মতিনের, 'সরি। দিগ ইজ নট মাই শপ।'
'আর ইউ সিওর?' প্রথম মেয়েটি বলল, 'দেন, বাই ফর আস।'
ইউ ওয়েট। দি শপকিপার ইজ কামিং।' মতিন বলল।
প্রথম মেয়েটি তার নাভির দুপাশে লাগানো রিং দুটোয় বাঁধা হলদে সুতো একটানে খুলে ফেলে জিজ্ঞাসা করল, 'দেন, হু আর ইউ?'
কী উত্তর দেবে, মতিন ভেবে পাচ্ছিল না। তখনই হারুণভাই-এর চিৎকার ভেসে এল, 'কথা বলবেন না ভাই, এরা ভয়ঙ্কর মেয়েমানুষ।' কাছে এসে মতিনের হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, 'থ্যাঙ্ক- ইউ ভাই, আপনি যান।' বলতে বলতে একটু ঠেলে দিল হারুণভাই। মতিন বুঝতে পারল সে ওখানে পাকুক তা মানুষটা চাইছে না। সে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে পেছনে তাকিয়ে চমকে উঠল। মেয়েদুটো তার পেছন পেছন আসছে। সে আরও গতি বাড়িয়ে দিল।
পাতালরেলের স্টেশনে ঢুকে পড়ে খানিকটা স্বস্তি পেল মতিন। এ কীরকম মেয়েমানুষ? 'এফ' ট্রেন আসতেই উঠে পড়ল সে। সিটে বসতে না বসতেই সুলতানার টেলিফোন এল, 'কোথায় এখন?'
'ট্রেনে। বাসায় ফিরছি। এইমাত্র উঠলাম।' মতিন বলল। 'তা হলে তুমি ইউনিয়ন টার্নপাইকে নেমে এসো।'
'সেটা কী?'
'বুন্ধু কোথাকার। ওটা একটা স্টেশন। নাম অ্যানাউন্স করলেই নেমে পড়বে। আমি ওখানে থাকব।' লাইন কেটে দিল সুলতানা।
একটু পরেই দিন ফুরিয়ে যাওয়ার কথা। দিনভর অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে, এখন ঘরে ফিরে আরাম করতে ইচ্ছে করছে, তাছাড়া সারাদিনে একটা হটডগ ছাড়া কিছু পেটে পড়েনি। স্টিমার থেকে নেমে আর একটা খেতে চেয়েছিল কিন্তু রাসেলের প্রসঙ্গ ওঠার পর হারুণভাই এত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে ওটা দেওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিল।
অনেকগুলো স্টেশন পার হওয়ার পর ইউনিয়ন টার্নপাইক স্টেশনের নাম কানে আসতেই উঠে দাঁড়াল সে।
প্ল্যাটফর্মের বাইরে আসতেই সুলতানাকে দেখতে পেল মতিন। আজ সুলতানার পরনে প্যান্ট এবং টপ। একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে ওকে। মুখোমুখি হতেই সুলতানা জিজ্ঞাসা করল, 'কতক্ষণ খাওনি?'
হেসে ফেলল মতিন, 'অনেকক্ষণ।' 'চলো, আমিও আজ সারাদিন খাইনি।'
'কেন?'
'একা খেতে ইচ্ছে করছিল না।'
'মুর্শেদভাই ছিল না?'
'না। তিনি আজ জরুরি কাজে ফিলাডেলফিয়াতে গিয়েছেন। ফিরতে অনেক রাত হবে। স্টেশন
থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগল সুলতানা?
'এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?'
'চলো না।'
মতিন দেখল রাস্তাঘাট বেশ নির্জন। ছবির মতো। ছিমছাম বাড়ি দুই পাশে। সে জিজ্ঞাসা করল 'এদিকে ম্যাকডোনাল্ড নেই।'
'থাকবে না কেন। তবে তার চেয়ে ভালো খাবারের জায়গা আছে। তোমার কেমন লাগছে পাড়াটা। আমাদের দেশের মতো মোটেই না।' সুলতানা হাসল।
সুন্দর একটা দোতলা বাড়ি। নীচের দরজার তালা খুলল সুলতানা। বলল, 'এসো।' 'এটা কাদের বাড়ি?'
'আমাদের। দরজাটা বন্ধ করে দাও।'
সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে এল মতিন সুলতানার পেছন পেছন। একটা মাঝারি হল ঘরে সোফা রয়েছে ছয় জনের জন্যে। পাশে কিচেন, ওদিকে ব্যালকনি।
'বসো। আমি এখনই আসছি।' করিডোর দিয়ে অন্যদিকে চলে গেল সুলতানা। মতিন দেখল ঘরটাকে। বঙ্গবন্ধুর বড় ছবি দেওয়ালে। তার নীচে খাওয়ার টেবিল। মুর্শেদভাই মামার কোম্পানিতে কাজ করে। বোঝাই যাচ্ছে খুব খারাপ মাইনে পায় না। অথচ মামা কোনওদিন তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। সুলতানা বেরিয়ে এল পোশাক বদলে। হাঁটুর নীচ অবধি যে পোশাকটা সে পরেছে তা
ঠিক নাইটি নয় অথচ কী বলা যায় বুঝতে পারল না মতিন। অনেক আগে বাঙালি মা-মাসিরা এইরকম পোশাকের ওপর শাড়ি পরত। কিন্তু সুলতানা সেটা পরেনি। সুলতানা এখন রান্নাঘরে, 'কী কী দেখলে বলো।' মতিন তার অভিজ্ঞতার কথাগুলো একে একে বলল। তৃণার কথা শোনার পর সুলতানা বলল, 'বেচারা। কী শয়তান লোকটা। এখানে কাজের লোক পাওয়া যায় না, যারা করে তারা কয়েক ঘণ্টার জন্যে অনেক টাকা নেয়। বেবিসিটারের কাছে বাচ্চা রাখলেও বেশ খরচ। তাই কেউ কেউ দেশ থেকে বিয়ে করে লোক নিয়ে আসে এখানে। আয়া কাম রাঁধুনির কাজ করায়। এই লোকটা তো ক্রিমিন্যাল, মেয়েটাকে বন্দি করে রেখেছিল। ওর ফাঁসি হওয়া উচিত।'
রাসেলের কথা শুনে বলল, 'কিছু করার নেই। এদেশে জন্মালে এরকম হওয়াই তো স্বাভাবিক। তবে বাপ-মায়েরও দোষ আছে।'
দুটি কালো মেয়ের কথা শুনে বলল, 'বেঁচে গেছ। এসো।'
খাবারের প্লেট টেবিলে এনে রাখল। মতিন উঠে এসে দেখল ভাত, ভর্তা, ডাল, মুরগির মাংস আর চাটনি সাজিয়ে দিয়েছে সুলতানা। নিজেও তাই নিয়ে বলল, 'খেতে পারবে কিনা জানি না। শুরু কর।'
তৃপ্তি করে খেল মতিন। বলল, 'খুব মজা লাগল।'
'থ্যাঙ্ক ইউ।'
প্লেট বাটি সিঙ্কে রেখে হাত ধুয়ে ধপ করে মতিনের পাশে বসল সুলতানা, 'এই, তুমি সিগারেট খাও?'
'না।'
'শুড। সিগারেটের গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না। পেট ভরেছে?'
'খুব।'
'আমার ভরেনি।'
'আরও একটু খেলেন না কেন?'
'তুমি কম খেলে আমি বেশি কী করে খাব। ঠিক আছে, এদিকে তাকাও, আমার দিকে তাকাও।' মতিনের মুখ দু-হাতে নিজের দিকে ফেরাল সুলতানা। তারপর তার ঠোঁটে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুলতানা। কীরকম অবশ হয়ে গেল মতিন। ততক্ষণে মুখ সরিয়ে নিয়ে সুলতানা বলল, 'লবণ ছাড়া ভর্তা খেলাম।'
মতিনের মুখ থেকে বের হল, 'অ্যাঁ।'
'আমি চুমু খেলাম কিন্তু পেলাম না। ভাল্লাগে না।'
'আমি ঠিক-!'
'এর আগে কোনও মেয়েকে চুমু খাওনি?'
'না।'
কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল সুলতানা। তারপর মতিনের কাঁধে হাত রেখে বলল, 'তুমি খুব ভালো। আচ্ছা, আমাকে তুমি খারাপ ভাবছ, না?'
'না, ঠিক তা নয়-
'তাহলে!'
'মুর্শেদভাই জানলে নিশ্চয়ই খুব রাগ করবে।'
মাথা নাড়ল সুলতানা, 'তোমার মুর্শেদভাই এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। আমাকে বিয়ে করার সময় হয়তো ওর মন অন্যরকম ছিল, কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই আমার দিকে তাকালেই ভেবেছে আমি আগের স্বামীর সঙ্গে একইরকম আচরণ করেছি। সে আমাকে যেভাবে আদর করবে তা আর একজন আগেই আমার সঙ্গে করে গেছে। আচমকা পালটে গেল সে। একইসঙ্গে থাকি, কোনও ঝগড়া-ঝাঁটি নেই, কিন্তু কোনও শারীরিক সম্পর্ক রাখেননি। আমার খুব রাগ হয়। ওর ওপর খামোখা বকাঝকা করি, চোখ রাঙাই, আসলে ওই রাগটা অন্যভাবে প্রকাশ করি। কিন্তু আর পারছি না।'
'ওকে সব বুঝিয়ে বলেন না কেন?'
'বলে কোনও লাভ হবে না। জানো, আমার যে বান্ধবীর কথা তোমায় বলেছিলাম, যার স্বামী গ্যাস স্টেশনে চাকরি করে, তার সঙ্গে ওর ইদানীং বন্ধুত্ব হয়েছে। ওর দুটো বাচ্চা, দেখতে সাধারণ, আমার চেয়ে অনেক খারাপ, তবু তার প্রেমে পড়েছে। অথচ আমার বান্ধবীও তো একজনের স্ত্রী, তাকে দেখে কিন্তু ওর মনে হয় না সে-কথা।' সুলতানা বলল।
'আপনি হয়তো ভুল ভাবছেন।'
'মোটেই না। বান্ধবীই আমাকে সব কথা বলে। আমি চুপচাপ শুনি। বান্ধবী বলে কী করব, বল। আমি বলে দিয়েছি, তোর যা ইচ্ছে, আমি একটুও দুঃখিত নই।' হেসে উঠল সুলতানা।
'একথা বলেছেন?'
'হ্যাঁ, কারণ, সে তো বান্ধবীকে বিয়ে করতে পারবে না।' সুলতানা দুহাতে জড়িয়ে ধরল মতিনকে, 'তুমি বলো, আমি কি বিশ্রী দেখতে?'
শ্বাস নিল মতিন, 'না না। একদম নয়।'
ছেড়ে দিল মতিনকে সুলতানা। বলল, 'থ্যাঙ্ক ইউ। মতিন, আমার কোনও বন্ধু নেই। এতদিন ভাবতাম সংসারই করব। এখন সময় কাটছে না। তাই ভাবছি চাকরি করব। কিন্তু তাতেও তো
একাকিত্ব কাটবে না। তুমি আমার বন্ধু হবে?'
'আমি তো আপনার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট।'
'বয়স বন্ধুত্বের মধ্যে বাধা হতে পারে না।'
'তাহলে আমি খুশি হব।'
হাতে হাত মেলাল সুলতানা, 'চা খাবে? বানাই?'
সুলতানা কিছুতেই ছাড়ল না, মতিনকে সে স্টেশনে পৌঁছে দেবেই। বলল, 'এই রাস্তায় রোজ একা হেঁটে যাই, আজ তোমার সঙ্গে হাঁটতে ভালো লেগেছিল, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যখন হেঁটে আসব তখন সেই ভালো লাগাটা নিয়ে ফিরব।'
ছবির মতো রাস্তা। খানিকাট হাঁটার পরে বাঁ-দিকে ঘুরতেই ডানদিকের রেলিং ঘেরা বাগানটার দিকে হাত তুলে সুলতানা বলল, 'ওটা সমাধিক্ষেত্র। কত মানুষ মৃত্যুর পর ওখানকার কবরে শুয়ে আছে। আমার ওখানে যেতে খুব ভয় করে।'
'কেন? ভূতের ভয়ে?'
'না না। গেলেই মনে হয় আমি একদিন এরকম একটা কবরে শুয়ে থাকব। ধীরে ধীরে আমার শরীরের সব নষ্ট হয়ে শুধু হাড়গুলো সেখানে থাকবে। ভাবলেই বুক কীরকম করে ওঠে। তাই যাই না।' সুলতানা বলল, 'আমি বেঁচে থাকতে চাই।'
মতিন কিছু বলল না। ছেলেবেলায় পড়া কবিতার লাইনগুলো মনে পড়ল, 'জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?' কিন্তু মুখে কিছু বলল না। তার মনে হল একা একা থাকলে হয়তো
মানুষের মনে মৃত্যুচিন্তা এসে যায়। রাস্তা থেকে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে পাতাল-স্টেশনে। সেখানে পৌঁছে মতিন বলল, 'আর নীচে নামতে হবে না।'
সুলতানা হাসল, 'আচ্ছা, তুমি আমাকে ফোন করো না কেন?'
'করব।'
হঠাৎ মতিনের দুটো হাত নিজের হাতে ধরে সুলতানা বলল, 'এখন থেকে আমরা খুব ভালো 1% হলাম তো?'
মতিন হাসল, 'হ্যাঁ। হলাম।'
ট্রেনে বসে ভাবছিল মতিন। জীবনে এই প্রথম কোনও নারী তাকে চুম্বন করল। সুলতানার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়নি, তার দিক থেকে কোনও দুর্বলতাও নেই, এই অবস্থায় চুমু খেতে তার ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু সে একটুও বিরক্ত হয়নি। উপভোগ যেমন করেনি তেমনি মন্দ ভাবনাও মনে আসেনি। বয়সে তার চেয়ে বড় হলেও সুলতানাকে বন্ধু ভাবতে এখন তার অসুবিধে হচ্ছে না।
দোতলায় উঠে টিয়ার ঘরের দিকে তাকাল মতিন। দরজা বন্ধ। সে নিজের ঘরের দরজা খুলল। বেশ ক্লান্ত লাগছে।
ঘরে ঢুকে জামাপ্যান্ট ছেড়ে সোজা স্নান করতে চলে গেল সে। শরীরে জলের ছোঁয়া লাগামাত্র একটু শীত-শীত অনুভূতি হল যা সকালেও হয়নি। তবে কি শীত চলে আসছে আমেরিকায়।
এক বিন্দু খিদে নেই। শেষ বিকেলে খাওয়ার পর সেটা হওয়াও সম্ভব নয়। শুয়ে পড়ল মতিন। আঃ, কী আরাম! আজ সারাদিনে কত কী ঘটনা ঘটে গেল। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে কোনও খবর এসেছে কি না জানা হল না। খবর হলে মুর্শেদভাই জানতে পারবে মামার কাছ থেকে। মুর্শেদভাই- এর ফোন সে পায়নি। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল মতিনের। খবর হলে মুর্শেদভাই নিশ্চয়ই সুলতানাভাবী জানাত। সুলতানাভাবিকে একবার ফোন করবে নাকি! আড়ষ্ট হল মতিন। বন্ধুত্বের প্রথম দিনেই সে দেশে চলে যাওয়ার খবর জানতে চাইছে শুনলে তিনি নিশ্চয়ই দুঃখিত হবেন। শ্বাস ফেলল মতিন
। তখনই দরজায় শব্দ হল।
'কে?' উঠে বসল মতিন।
সাড়া এল না। বিস্মিত মতিন দরজা খুলতেই দেখল টিয়া দাঁড়িয়ে হাসছে।
'আরে!'
'কখন এলেন?'
'এই একটু আগে। গালিব এখন কেমন আছে?'
'ভালো। কার্টুন দেখছে। এখন তাকে বিরক্ত করা চলবে না।'
'ভেতরে আসবেন না?'
'না। আমি রান্না করছি। চিতল মাছ ভালোবাসেন?'
'খুব।'
'তাহলে আজ রাত্রে আমার ওখানে খাবেন।'
'আজ রাত্রে।' ইতস্তত করল মতিন।
'কোনও অসুবিধে আছে?'
'হ্যাঁ। মানে, আজ প্রায় বিকেলবেলায় ভাত খেয়েছি। পেট একদম ভরতি।'
'ওঃ তা হলে ফ্রিজে রেখে দেব। সকালে যাওয়ার সময় দিয়ে যাব। আপনি খেয়ে নেবেন। আসছি।' টিয়া ফিরে গেল তার ঘরে।
ঘুমিয়ে পড়েছিল মতিন। মোবাইলটা বেশ কিছুক্ষণ বাজতে তার ঘুম ভাঙল। চটজলদি যন্ত্রটাকে অন করে সে 'হ্যালো' বলল।
'তোমার কাছে এটা আশা করিনি মতিন। এটা কী করলে? ছিঃ। মুর্শেদের গলা শুনল সে।
জিজ্ঞাসা করল, 'আমি বুঝতে পারছি না-
'পারছ না। মিথ্যে কথা তো বলবেই। তুমি আজ আমার বাড়িতে আসোনি? নিশ্চয়ই না বলবে?' মুর্শেদভাই-এর গলা অন্যরকম লাগল মতিনের।
'হ্যাঁ। গিয়েছিলাম। সুলতানাভাবী বলেছিলেন, তাই।'
'একজন মহিলা একা বাড়িতে আছে জানার পরে কীরকম পুরুষ তার বাড়িতে যায়? ছি ছি। সুলতানার মনে কোনও পাপ নেই, সে সব বলেছে আমাকে।'
'কী বলেছেন ভাবি?'
'সেকথা আমার মুখ দিয়ে শুনতে চাও? আচ্ছা লম্পট তো। আমি কামাল সাহেবকে সব কথা বলছি।' ফোন রেখে দিল মুর্শেদ।
হতভম্ব হয়ে বসে থাকল মতিন। এটা কীরকম হল। সে নিজে ওই বাড়িতে যায়নি। সুলতানাভাবী প্রায় জোর করেই তাকে নিয়ে গিয়েছে। তাকে ভাত খাইয়েছে। তারপর চমু খাওয়ার সময় তার কোনও ভূমিকা ছিল না। অথচ এসব কথা মুর্শেদভাই ফিরতেই তার কানে তুলে দিয়েছে? ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে সুলতানভাবি।
মতিনের খুব ইচ্ছে করছিল সুলতানার সঙ্গে কথা বলতে। তার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করল কেন সে? বন্ধু বলে হাত মিলিয়ে ছুরি মারল কেন? কিন্তু এখন ফোন করলে মুর্শেদভাই ফোন ধরবে। না ধরলেও তার সামনে কথা বলতে বোধহয় সুলতানাভাবী পারবে না। মামাকে এসব কথা জানাবে বলেছে মুর্শেদভাই। শুনলে মামা নিশ্চয়ই খুশি হবে না। উলটে মাকে জানিয়ে অন্য ধরনের আনন্দ পাবে। বাবার সঙ্গে সম্পর্ক তো খারাপ, আরও খারাপ করবে।
কী করবে বুঝতে পারছিল না সে। রাত বাড়ছে, কিন্তু তার ঘুম আসছিল না। মনে হচ্ছিল, এক দৌড়ে যদি এদেশ থেকে সে পালিয়ে যেতে পারত।
মধ্যরাতে ফোনটা বাজল। অবাক হয়ে ওটা অন করতে মতিন টিয়ার গলা শুনতে পেল, 'আপনি কি এখনও জেগে আছেন?'
'হ্যাঁ।'
'কী আশ্চর্য! শুয়ে পড়ুন। রাত অনেক হয়েছে। আমার কিচেনের জানালা দিয়ে আপনার ঘরের জানালার আলো দেখতে পেলাম, 'গুড নাইট।' আলো নিভিয়ে দিল মতিন।
ঘুম ভাঙল মোবাইলের আওয়াজে। সে ঝটপট উঠে অচেনা নাম্বার দেখতে পেল। ওটা অন করতেই ইংরেজিতে প্রশ্ন শুনল, 'আর ইউ মতিন?'
'হ্যাঁ, ইয়েস!'
'মতিন, তোমার বাবার সঙ্গে আমার যা-ই হয়ে থাক আমি তাকে একটা ব্যাপারে শ্রদ্ধা করি, তিনি অত্যন্ত সৎচরিত্রের মানুষ। তুমি গতকাল যে কাজটা করেছ তা যদি আমি তাঁকে বলি তিনি প্রথমে বিশ্বাস করবেন না। ভাববেন, আমি তাঁর ছেলের নামে বানিয়ে বদনাম দিচ্ছি। আর যদি বিশ্বাস করেন তা হলে হার্ট ফেল করবেন। মুর্শেদ আমার খুব বিশ্বস্ত কর্মচারী। তুমি তার ক্ষতি কেন করেছ--এই প্রশ্ন আমি করব না। কারণ, আমি জানি এক হাতে তালি বাজে না। কিন্তু তুমি এদেশে ফিরে এসে সুবোধ বালকের মতো মুখ করে ঘুরে বেড়াবে তাও আমি চাইনা। সেক্ষেত্রে মুর্শেদ তোমার বাবাকে সব কথা জানিয়ে দেবে।'
মতিন ঢোঁক গিলল, তার মামা কামাল হোসেন কথা বলছেন।
তিনি আবার বললেন, 'এক্ষেত্রে আমার মনে হচ্ছে তোমার দেশে ফিরে আসা উচিত নয়। তা ছাড়া এসে তুমি তোমার বাবা-মায়ের কী কাজে লাগবে? আমি তোমাকে এসব শোনা সত্ত্বেও একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। শিকাগোতে আমার ব্যবসার কাজ যে দেখত তার বয়স হয়েছে। আর পারছে না। তুমি তার কাছে চলে যাও। কাজগুলো শিখে নাও। আপাতত তুমি বাইশশো ডলার মাসে পাবে। তা থেকে যতটা পারো বাবা-মা'কে পাঠালে তাদের উপকার হবে।'
'কিন্তু দেশ থেকে ডুপ্লিকেট পাসপোর্টের অর্ডার এসে গেলে।'
'আসবে না।' গম্ভীর গলায় বললেন কামাল সাহেব।
'তাহলে আমি এখানে থাকব কী করে?'
'ওরা যে কাগজটা দিয়েছে তা রিনিউ করে যাবে। শিকাগো শহরের ইমিগ্রেশন আইন নিউইয়র্কের মতো কড়া নয়। এখন বলো, রাজি আছ কি না?'
'মামা, বিশ্বাস করুন আমি কিছু করিনি।'
'এসব কথা আমাকে বলে লাভ নেই। যদি রাজি থাকো তাহলে মুর্শেদের সঙ্গে যোগাযোগ কর, সে কীভাবে শিকাগোতে যাবে বলে দেবে।' লাইনটা কেটে দিলেন কামালসাহেব।
মিথ্যে, মিথ্যে, প্রচণ্ড মিথ্যে কিন্তু তাই মামা বিশ্বাস করলেন। মামা নিশ্চয়ই তার ফিরে যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেবেন। আর যদি যায় তাহলে মুর্শেদের কথা শুনলে বাবার কী হবে তা ভাবতেও
পারছিল না মতিন।
কিছুক্ষণ পরে সে বাইরে বেরিয়ে দেখল টিয়ার ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। এখন এই নিউইয়র্ক শহরে একটাও লোক নেই যার সঙ্গে আলোচনা করা যায়।
মতিনের কান্না এল। নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল সে।
বেলা বাড়ছিল। স্নান সেরে বাইরে বের হল মতিন। এখন তার কাছে সবই বিরক্তিকর বলে মনে হচ্ছে। মামার নির্দেশ না মানলে তিনি যা করবেন তা সে কিছুতেই হতে দিতে চায় না। বাবা তাঁকে সমর্থন করেন না, কালোবাজারি, অর্থপিশাচ অমানুষ হিসেবে মনে করেন। ভাই-এর প্রতি টান থাকলেও মা বাবার বিরোধিতা করতে পারেনি কারণ মানুষটি অত্যন্ত সৎ। সেই মাথা নিশ্চয়ই মুর্শেদভাইকে দিয়ে বাবার সব স্বপ্ন চুরমার করে দেবেন। সে যদি বাবার পা ধরে বলে ওই অভিযোগ মিথ্যে তাহলেও বাবা বিশ্বাস করবেন না। বলবেন, কেউ নিজের স্ত্রীর নামে কলঙ্ক বানিয়ে বলে না।
'আরে ভাই! খবর কী? মনে হয় খুব চিন্তায় আছ।'
ফুটপাথে দাঁড়িয়েছিল মতিন, মুখ ফিরিয়ে দেখল লিটন দাঁড়িয়ে। জিনসের ওপর অনেকরকম কথা লেখা গেঞ্জি ওর পরনে। মতিন বলল, 'না-মানে-, কিছু না।'
'আমাদের দলের দুজনকে আর ওদের দলের সবাইকে পুলিশ ধরেছে। হয়ে গেল। অন্তত এক বছর বিহাইন্ড দ্য বার।' লিটন বলল।
'তোমাকে ধরল না কেন?'
হা-হা করে হাসল লিটন, আমি তখন ব্রুকলিনে গিয়েছিলাম। তাছাড়া পুলিশ আমার নাম জানে ফয়েজুর, লিটন জানে না। ওরা ফয়েজুরকে খোঁজ করেছিল, কেউ বলতে পারেনি সে কে। ভাবছি কিছুদিন নিউইয়র্কের বাইরে গিয়ে থাকব।'
'কোথায় যাবে?'
বুঝতে পারছি না। টেক্সাসে আমার খালাতো ভাই থাকে। ভাইটা ভালো কিন্তু তার বউটা দুদিনের বেশি থাকলে খারাপ ব্যবহার করবে।' লিটন মাথা নাড়ল। বকুল আপার সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছি। ওর অনেক চেনাজানা। যাবে নাকি?'
'কোথায়?'
'বকুল আপার বাসায়। এর আগের দিন তো গেলে না। ভালো লাগবে।' কিছুই যখন করার নেই তখন যেতে আপত্তি কী!
চারটে ব্লক হেঁটে একটা পুরোনো চেহারার বাড়িতে ঢুকল লিটন, বাড়িটার গঠন ঢাকার বাড়ির মতো। সিঁড়ির দুপাশে ফ্ল্যাটের দরজা। দোতলার একটি দরজার বেল বাজাল লিটন। দরজা খুললেন যিনি তিনি বেশ বৃদ্ধ। দাঁড়াতে অসুবিধে হচ্ছে তাঁর, লিটনকে দেখে বললেন, 'ও।' তারপর কোনওরকমে ভেতরের ঘরে ঢুকে গেলেন।
সঙ্গে সঙ্গে নারী কণ্ঠ ভেসে এল, 'কে এল?'
লিটন জবাব দিল, 'আমি লিটন, আমরা।'
সোফায় বসতে বলল লিটন। মতিন বসে দেখল ঘরটিতে সোফা ছাড়া কোনও আসবাব নেই, শূন্য দেওয়াল। মিনিটখানেক বাদে যে মহিলা এলেন তাঁর বয়স বোঝা যাচ্ছে না তবে এককালে যে ডানপিটে সুন্দরী ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। বেশ লম্বা, শরীর ভারী, মুখটি খুব মিষ্টি। এসেই বললেন, 'ওম্মা লিটন যে। এ কে? কী ভালো লাগছে।'
'ওর নাম মতিন। কিছুদিন হল এদেশে এসেছে।'
'বাঃ। চমৎকার। ছাপ আছে না নেই?' মতিনের দিকে তাকালেন তিনি।
মানে বুঝতে পারল না মতিন। ভদ্রমহিলা হেসে গড়িয়ে পড়লেন প্রায়। 'এখন তো কেউ চট করে ভিসা ছাড়া ঢুকতে পারে না। তবে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও অনেকে থেকে যায়।
তোমার কী অবস্থা ভাই।'
মতিন সংক্ষেপে তার কাহিনি শোনালে ভদ্রমহিলা গালে আঙুল দিলেন, 'কী সর্বনাশ। তবু
মন্দের ভালো যে থাকার পারমিট পেয়েছ।'
লিটন জিজ্ঞাসা করল, 'আমার কিছুদিন বাইরে থাকা দরকার। কোথায় যাই আপা?' 'জাহান্নামে।' বলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন বকুল আপা।
'কীভাবে যাব যদি বলে দেন।' লিটন বলল।
'নেকু। লস অ্যাঞ্জেলসে যাও।'
'ওরে ব্বাবা। অত টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে পারব না।' । কবে যাবে?'
'তা হলে আটলান্টিক সিটিতে যাও
'যেদিন বলবেন। আজ বললে আজই। কিন্তু গিয়ে কোথায় উঠব?'
'ইকবালভাইকে ফোন করে দিচ্ছি। সিজার ক্যাসিনোতে রেস্টুরেন্ট আছে। তা ছাড়া ট্যক্সি ভাড়া খাটায়। একসময় আমার সঙ্গে প্রেম করত। পুরোনো প্রেমিকরা খুব কথা শোনে। কতদিন
থাকবে?' বকুল 'আপা জিজ্ঞাসা করলেন।
'এখানে হাওয়া ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত, ধরুণ ছয়-সাত মাস।'
'ইকবালভাইকে বলতে হবে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে।' মতিনের দিকে তাকালেন বকুল আপা, 'তুমি এখন কী করছ?'
'কিছু না।'
'কী মজা। এই সুযোগে দেশটাকে দেখে নাও। মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখানে এখনও কোনও বান্ধবী হয়নি। তাই তো?'
মাথা নেড়ে না বলে হাসল মতিন। তারপর বলল, 'আমাকে বোধহয় শিকাগোতে যেতে হবে। যতদিন দেশে ফেরার কাগজপত্র না আসে ততদিন ওখানে একটা কাজের ব্যবস্থা হয়েছে।' 'শিকাগো?' বকুল আপা মাথা নাড়েন, 'খুব ভালো শহর। কী হাওয়া। ওখানে আমার এক বান্ধবী থাকে। স্কুলে পড়ায়। ডিভোর্সি, একমাত্র মেয়েকে নিয়ে থাকে। ওর বাসায় এক্সট্রা ঘর আছে। বললে তোমাকে পিজি রাখতে পারে। দাঁড়াও।' উঠে ভেতরে চলে গেলেন বকুল আপা।
লিটন বলল, 'দেখলে, বকুল আপা কত হেল্পফুল। ভাবছি, আটলান্টিক সিটিতে না গিয়ে তোমার সঙ্গে শিকাগোতে গেলে কেমন হয়!'
'আটলান্টিক সিটি কত দূরে?'
আড়াই ঘণ্টা লাগে বাসে, ক্যাসিনোর শহর। দিন রাত জুয়া খেলা হয়। আমাদের দেশের অনেক মানুষ ওখানে কাজ করে।'
বকুলআপা ফিরে এসে একটা কাগজ মতিনকে দিলেন, 'নাম ঠিকানা ফোন নাম্বার লিখে দিলাম। দরকার হলে ফোন করবে। কিন্তু লিটন, আমাকে এখনই বের হতে হবে। আমার কর্তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আজ চেক আপের ডেট।'
লিটন উঠে দাঁড়াল। তাকে দেখে মতিন।' জিজ্ঞাসা করল, 'উনি কি অসুস্থ?'
'এমন কিছু না, বয়সের জন্যে। দেখলে তো, দরজা খুলে দিল।'
হতভম্ব হয়ে গেল মতিন। এই মহিলার অত বৃদ্ধ স্বামী?
বাইরে বেরিয়ে এসে লিটন বলল, 'আচ্ছা চলি। পৃথিবীটা খুব ছোট। নিশ্চয়ই একদিন কোথাও না কোথাও আবার দ্যাখা হয়ে যাবে। হাত মেলাও।'
ওরা হাত মেলাল।
বাড়ির কাছে ফিরে আসতেই ফোন বেজে উঠল। সুলতানাভাবী। খুব রাগ হয়ে গেল মতিনের। প্রথমে ভাবল ফোন অন করবে না, বেজে যাক। কিন্তু ফুটপাথের লোকেরা তার দিকে তাকাচ্ছে রিং শুনে। বাধ্য হয়ে বোতাম টিপল মতিন-'হ্যালো'। 'তুমি কোথায়?' সুলতানার গলায়
একটুও জড়তা নেই।
'রাস্তায়।' মতিন বলল।
'কী ছেলেরে বাবা! আমরা তোমার সঙ্গে দ্যাখা করতে এসে দেখি দরজা বন্ধ।'
'আমি আসছি।' ফোন বন্ধ করল মতিন।
সুলতানাভাবী আমরা শব্দটা বলল কেন? তা হলে কি একা আসেনি? মুর্শেদভাই তো ওর সঙ্গে নিশ্চয়ই আসবেন না। কে এসেছে সঙ্গে?
ঘরের দরজা খুলতে না খুলতে ওরা এসে গেল। নিশ্চয়ই ফুটপাথের কোথাও অপেক্ষা করছিল। মতিনকে ঢুকতে দেখে অনুসরণ করেছে। মতিন শ্বাস ফেলল, সুলতানাভাবীর সঙ্গে মুর্শেদভাই এসেছে।
ভেতরে ঢুকে সুলতানাভাবী হাসতে হাসতে বলল, 'তুমি দেখছি এরমধ্যে নিউইয়র্ক শহরটা ভালো চিনে নিয়েছ। ভাবলাম ফোন না করে এসে তোমাকে সারপ্রাইজ দেব, উলটে নিজেরাই বোকা বনে গেলাম।'
এত স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছেন মহিলা যে মতিন ঠিক বুঝতে পারছিল না। মুর্শেদভাই অন্যদিনের মতো শাস্ত। যেন কিছুই হয়নি।
মতিন বলল, 'বলুন।'
মুর্শেদ বলল, 'সাহেব চাইছেন তোমাকে একটা দায়িত্ব দিতে। দেশে ফেরার কাগজপত্র যতদিন না আসে ততদিন এখানে না বসে থেকে শিকাগোতে গিয়ে কাজটা করতে। তা ছাড়া এখানে থাকার সময় তো শেষ হয়ে আসছে। যদি আজই শিকাগোতে চলে যাও তো ভালো হয়। অবশ্য তুমি যাবে কিনা তা তোমার ওপর নির্ভর করছে।
'এ কথা মামা বলেছেন?'
'হ্যাঁ, যদি যাও তা হলে মাসে বাইশশো টাকা মাইনে পাবে। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে। যদি রাজি না হও তাহলে কথামতো দু'দিন পরে এই ঘর ছেড়ে দিয়ে নিজের ব্যবস্থা করে নেবে। তোমার ফেরার টিকিটটা আমি ওপেন করে রেখেছি। কাগজ পেলে টিকিট কনফার্ম করে নিও।' মুর্শেদ বলল।
সুলতানা বলল, 'কী হবে দেশে গিয়ে। শিকাগো এখান থেকে বেশি দূরে নয়। তুমি কাজটা নিয়ে নাও।'
মতিন খানিক্ষণ ভাবল। ওরা চুপচাপ তাকিয়ে আছে তার দিকে। কী করা যায়? এই ঘর ছেড়ে দিয়ে থাকবে কোথায়? টিয়াকে বলা যায় কিন্তু ওরও তো অসুবিধে থাকতে পারে। ক'দিন পরে যখন হাত খালি হয়ে যাবে তখন কী করবে?
আচমকা মতিন মরিয়া হল, 'মুর্শেদভাই, আমি কোনও দোষ করিনি। সুলতানাভাবী, আপনি বলুন, আমি কি কিছু করেছি?"
সুলতানা বলল, 'আরে! একথা বলছ কেন? কে বলেছে তুমি দোষ করেছ?'
মুর্শেদ বলল, 'এই প্রসঙ্গ থাক মতিন।' 'এই অভিযোগের জন্যেই তো আমার এমন অবস্থা।' মতিন বলল।
সুলতানা অবাক হয়ে বলল, 'আমি কিছু বুঝতে পারছি না, কে অভিযোগ করেছে?' তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'তুমি কিছু জানো?'
'না আমার বস্ যা বলতে বলেছেন তাই বলছি। কী করতে চাও মতিন?'
' । বেশ, মামা যখন চাইছেন তখন আমি শিকাগোতেই যাব।'
'বাঃ । এই তো, খুব ভালো হল।' হেসে উঠল সুলতানাভাবী।
মুর্শেদ পকেট থেকে একটা খাম বের করল, 'এর মধ্যে বাস ভাড়া, কিছু অ্যাডভান্স, যার সঙ্গে দ্যাখা করবে তার ঠিকানা রয়েছে। আমি টেলিফোনে তাঁকে বলে দেব, তুমি ট্রেন ধরে পোর্ট অফ অথরিটিতে চলে যাবে। রাত্রে ওখান থেকে শিকাগোর বাস ধরলে কাল সকালে পৌঁছে যাবে। আচ্ছা, আমরা চলি।'
ওরা উঠল। সুলতানাভাবী বলল, 'ভালোই হল। এখন থেকে ছুটি পেলে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া যাবে।'
দরজার কাছে গিয়ে মুর্শেদ বলল, 'ওহো। সুলতানা, তোমার মোবাইলটা ফেরত নিয়ে নাও। আর হ্যাঁ, চাবিটা নীচের গ্রোসারি শপে দিয়ে যেও, পরে নিয়ে নেয়।'
'দিয়েছিলে। তখন ওর কেনার ক্ষমতা ছিল না। এখন ও ভালো মাইনে পাবে। মোবাইল কিনতে অসুবিধে হবে না।' মুর্শেদ বলল।
'ওটা যে আমি ওকে দিয়েছি।' সুলতানা প্রতিবাদ করল। 'না-না।' মাথা নাড়লেন সুলতানাভাবী। মতিন এগিয়ে গিয়ে ওর হাতে মোবাইলটা দিয়ে বলল, 'উনি ঠিক বলেছেন?' মাথা নীচু করে যন্ত্রটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সুলতানা। 'জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল মতিন। স্বাভাবিক রাস্তা। সুলতানাদের দেখতে পেল না।
হঠাৎ মনে হল, সুলতানার ফোন নাম্বার তার মুখস্থ নেই, তার নিজেরও কোনও নাম্বার নেই। তাই ইচ্ছে করলেও যোগাযোগ করা যাবে না। মুর্শেদভাই নিশ্চয়ই স্ত্রীকে তার ঠিকানা জানাবে না।
কিন্তু সুলতানাভাবীর ব্যবহার, কথাবার্তা শুনে মনেই হয়নি এইসব ঘটনার কথা তার জানা।
সরল গলায় স্বামীকে সব বলেছিল বোধহয়। স্ত্রীকে একটা কথাও না বলে মুর্শেদভাই কামাল হোসেনকে ব্যাপারটা জানিয়েছেন। তাই সুলতানাভাবী অন্ধকারেই থেকে গেছেন। স্ত্রীর ওপর রাগ এইভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে মিটিয়ে নিলেন মুর্শেদভাই।
বিকেল শেষে ব্যাগ নিয়ে ঘরে তালা দিয়ে যখন বের হচ্ছে তখন সিঁডি ভেঙে ওপার এল টিয়া। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'একী কোথায় যাচ্ছেন?"
'শিকাগোতে।'
'হঠাৎ?'
'একটা চাকরি পেয়ে গেলাম।'
'বাঃ। আমাকে ফোন করবেন কিন্তু।'
'আমার মোবাইল নেই, হারিয়ে গিয়েছে।'
'সে কী!' চট করে ব্যাগ থেকে কাগজ বের করে নিজের নাম্বার লিখে দিল টিয়া। বলল, 'আপনি যোগাযোগ রাখলে খুব খুশি হব। আপনার মতো মানুষের দ্যাখ্য আমি এই প্রথম পেয়েছি। ঠোঁট কামড়ে টিয়া চলে গেল নিজের ঘরের তালা খুলতে।
বিষন্ন বিকেলে ব্যাগ হাতে জ্যাকসন হাইটের ফুটপাথ ধরে স্টেশনের দিকে হাঁটছিল মতিন। ট্রেনে করে পোর্ট অথরিটির বাস টার্মিনাল, তারপর নতুন জীবনে।
গ্রেহাউন্ড বাসে চেপে একা একা যাওয়ার কথা দু'সপ্তাহ আগেও কল্পনা করেনি মতিন। করলে তখন দিশেহারা হয়ে যেত। আজ মনে হল, পরিস্থিতি মানুষকে কী করাতে পারে তা আগাম জানা যায় না। বিশাল পোর্ট অথরিটির বিভিন্ন দরজা থেকে গ্রেহাউন্ড বাস ছাড়ছে প্রতি আধঘণ্টায় এক এক শহরের উদ্দেশ্যে। প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে নাজেহাল হয়ে শেষপর্যন্ত এক বৃদ্ধ কালো মানুষের সাহায্যে সে সঠিক কাউন্টারে পৌঁছোতে পেরেছিল। টিকিট কাটলেই বাসে জায়গা পাওয়া যাবে না। লাইন দিতে হবে। সিট ভরতি হয়ে গেলে পরের বাসের জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
রাত দশটার বাসে উঠতে পেরেছিল মতিন। নরম আসন, শীততাপনিয়ন্ত্রিত বাস, একটুও ঝাঁকুনি নেই। তার পাশে বসে একটি সাদা যুবক কানে তার ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করে পেছনে হেলান দিয়ে সেই যে গান শোনা শুরু করেছিল, গোটা পথে আর খোলেনি। নিউইয়র্ক শহরের ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে যখন বাস হাইওয়ে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল মতিন।
সকাল সাড়ে আটটায় শিকাগো শহরের গ্রেহাউন্ড টার্মিনাসে বাস যখন স্থির হয়ে গেল তখন যাত্রীরা নামছে দেখে মতিনও নামল। বাসের পেট থেকে যাত্রীদের মালপত্র নামিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। নিজেরটা চিনতে পেরে তুলে নিল সে। তারপর সুনসান রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তার পকেটে এখন তিনটে কাগজ। একটায় মুর্শেদভাই-রে লেখা নাম ঠিকানা ফোন নাম্বার। দ্বিতীয়টা বকুলআপার লেখা ঠিকানা ফোন নাম্বার, তৃতীয়টা টিয়ার ফোন নাম্বার। তিনটে কাগজই তার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। সে মুর্শেদের কাগজটা বের করল। চৌত্রিশের একের বি মিডো রিজ ড্রাইভ ওয়েস্ট, ন্যাপের ভিল। জায়গাটা কতদূরে এবং কীভাবে যাবে বুঝতে পারছিল না সে। মুর্শেদভাই যে ডলার দিয়েছে তা থেকে ট্যাক্সি ভাড়া অবশ্যই দেওয়া যায়। কিন্তু সেটা যদি অনেক হয় তা হলে খরচ করা কি উচিত হবে? কিন্তু মতিন দেখল ধারে কাছে কেউ নেই। যারা বাস থেকে নেমেছিল তারা সবাই চলে গিয়েছে।
এইসময় একটা গাড়ি এসে খানিকটা দূরে দাঁড়াল। যিনি চালাচ্ছিলেন তিনি নেমে দাঁড়াতেই মতিন বুঝতে পারল ওই লোকটি বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া-পাকিস্তান অথবা শ্রীলঙ্কার। বেশ বৃদ্ধ, সে এগিয়ে গিয়ে ইংরেজিতে বলার চেষ্টা করল, 'মাফ করবেন, আমি এখানে নতুন, মিডো রিজ ড্রাইভ
ওয়েস্ট নামের রাস্তায় কীভাবে যেতে পারি? যদি একটু বলে দেন।' 'আমি ওখানেই ফিরে যাব। একটু অপেক্ষা করুন।' বৃদ্ধ বাংলায় বললেন। 'আপনি বাঙালি?' অবাক হল মতিন। 'হান্ড্রেন্ড পারশেন্ট। যদিও চল্লিশ বছর এই শহরে আছি।'
তারপর কিছুটা সময় চলে গেল। ভদ্রলোক এপাশ-ওপাশে তাকাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করলেন, 'আপনি কোন শহর থেকে আসছেন?'
'নিউইয়র্ক।'
'ও, নিউইয়র্কের বাসটা পৌঁছে গেছে। আপনার নাম কী?'
'মতিন।'
'আই সি। আমার নাম আজাদ। মনে হচ্ছে আপনি আমার কাছেই এসেছেন। মুর্শেদ বলল আপনি রাত্রের গ্রেহাউন্ডে আসছেন। ভাবলাম, প্রথম দিন, আপনাকে রিসিভ করি। আপনি আসায় খুব খুশি হলাম।' হাত বাড়ালেন করমর্দনের জন্যে। মতিন পুলকিত।
হাত মিলিয়ে বলল, 'উঃ, আপনি আমার খুব উপকার করলেন। কীভাবে যাব ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষপর্যন্ত ট্যাক্সি নিতে হত।'
'সেটাই তো স্বাভাবিক ব্যাপার। চলুন। আপনার সঙ্গে এটা ছাড়া আর মালপত্র নেই?'
'না।' মতিন বলল, 'আপনি আমাকে তুমি বলুন।' গাড়িতে বসে মতিন দেখল বৃদ্ধ খুব সতর্ক হয়ে চালাচ্ছেন। কিছুতেই স্পিড বাড়াচ্ছেন
না। অন্য গাড়িগুলো ওভারটেক করে চলে যাচ্ছে।
আজাদ বললেন, 'যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আমি আর পারছিলাম না। মনে করছি মাসখানেক
লাগবে আপনাকে কাজগুলো বোঝাতে। তারপর আমার ছুটি। আমার স্ত্রীর ইচ্ছে ছেলের কাছে চলে যাওয়ার। সে থাকে কানাডার টরেন্টো শহরে। আমার ইচ্ছে দেশে গিয়ে থাকার। দ্যাখা যাক।' ভালো লাগল মতিনের। চল্লিশ বছর এদেশে থাকার পরেও বৃদ্ধ দেশে ফেরার কথা ভাবছেন। সে মনে মনে গাইল, 'ও আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।'
শেষ পর্যন্ত ঘুমন্ত শহর জেগে উঠল। এখন গাড়িতে বসেও শীত-শীত করছিল মতিনের, বাসের নিয়ন্ত্রিত উত্তাপ থেকে বেরিয়ে এসে সে বুঝতে পারেনি কিন্তু হাওয়া বইতে শুরু হওয়ার পরেই অনুভব করছিল চিনচিনে ঠান্ডা চামড়ায় লাগছে। বৃদ্ধ আজাদের পরণে হাফ সোয়েটারের ওপর জ্যাকেট। বুড়ো মানুষ বলেই অতিরিক্ত সতর্কতা।
এখন তারা শহরের মধ্যে। দুপাশে বড় বড় বাড়ি। রাস্তায় গাড়ির ভিড় বাড়ছে। যদিও ফুটপাথে খুব কম মানুষ দ্যাখা যাচ্ছে। একটা বাড়ির গায়ে লাগানো পার্কিং প্লেসে গাড়ি দাঁড় করালেন আজাদ। বললেন, 'নেমে এসো।'
ব্যাগ নিয়ে বৃদ্ধকে অনুসরণ করে বাড়িটির দোতলায় উঠল মতিন। চারটে দরজা। একটা দরজার ওপর বোর্ড ঝুলছে, 'কে হোসেন অ্যান্ড কো।'
বেল বাজালে দরজাটা খুলল যে তার বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। কালো মানুষ, বলল, 'গুড মর্নিং, স্যার।'
আজাদ বললেন, 'গুড মর্নিং। মিট ইওর নিউ বস, মিস্টার মতিন। হি ইজ এ ক্লোজ রিলেটিভ অফ আওয়ার নাম্বার ওয়ান। মতিন, এর নাম জন। আমাদের হেল্পিং হ্যান্ড। অফিসের কাজ করার জন্যে একটি মেয়ে আছে। জন, কল জুলিয়া। জুলিয়া ইন্ডিয়ান ক্রিশ্চান।'
জন বলল, 'শী কলড ফাইভ মিনিটস বিফোর। আই থিংক শী ইজ অন দ্য ওয়ে।' জন এগিয়ে এসে হাত বাড়াল মতিনের দিকে, 'ওয়েলকাম স্যার। আই উইল বি অলওয়েজ অ্যাট ইওর সার্ভিস।'
কী বলবে বুঝতে না পেরে মতিন বল, 'থ্যাঙ্ক ইউ।'
আজাদ অফিসঘর ঘুরিয়ে দেখালেন। ঘর বলতে, আজাদের চেম্বার এবং জুলিয়ার কাজ করার জায়গা। জনের জন্যেও টেবিল আছে। আজাদ বললেন, 'তুমি এই একমাস আমার সঙ্গেই চেম্বার শেয়ার করবে। আমি চলে গেলে ওটা তোমার। আর হ্যাঁ, চেম্বারের ভেতরে আর একটা ছোট ঘর আছে। দেখে যাও।'
মতিন দেখল, সেই ঘরে একটা ডিভান পাতা। পাশে অ্যাটাচড বাথ।
আজাদ বললেন, 'সারারাত জার্নি করে এসেছ। স্নান করে বিশ্রাম নাও। কী খেতে চাও বললে জন এনে দেবে। ওই ঘরে বেশিদিন তো থাকতে পারবে না, খুব তাড়াতাড়ি একটা ভালো থাকার জায়গা খুঁজে নাও।'
মতিন বলল, 'আমি তো এখানকার কিছুই চিনি না।'
'চেনার দরকার নেই। নেটে গেলেই অনেক রুমরেন্টের খবর, পিজির বিজ্ঞাপন দেখতে পাবে। জুলিয়াকে বললে সে প্রিন্ট আউট দেখিয়ে দেবে।' আজাদ বললেন।
আধঘণ্টার মধ্যে স্নান সেরে জনের এনে দেওয়া চিকেন বার্গার খেয়ে শুয়ে পড়ল সে। ডিভানটা লম্বায় তার শরীরের সমান। পা গুটিয়ে রাখতে হচ্ছিল। বাথরুমে গরম-ঠান্ডা জল আছে, না হলে স্নান করা যেত না। সে ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে শরীরে জড়িয়ে নিল শোওয়ার সময়। কিন্তু রাত্রে একটা কম্বল না হলে থাকা অসম্ভব।
কিন্তু মতিন ঠিক বুঝতে পারছিল না, আজাদ তাকে সরাসরি এখানে এনে তুললেন কেন? উনি যেখানে থাকেন সেখানে কি একটাই ঘর? চল্লিশ বছর ধরে কেউ একটা ঘরে থাকতে পারে না। ওঁর মাইনে নিশ্চয়ই অনেক বেশি, গাড়িও চালাচ্ছেন, কিন্তু মালিকের ভাগনে হওয়া সত্ত্বেও তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন না। সেখানে সে অনেক আরামে থাকতে পারত। ওঁর স্ত্রী নিশ্চয়ই ভাত ডাল ভর্তা রান্না করেন। সুলতানাভাবি বা টিয়া তাকে যত্ন করে খাইয়েছে। ওঁর স্ত্রী কি সেটা করতে চাননি? না কি, তাঁর ওপর নির্দেশ আছে বলে আজাদ তাকে বাসায় নিয়ে গেলেন না। মতিনের মনে হল এইটেই সত্যি। মামা না জানতে পারে, কিন্তু মুর্শেদভাই নির্দেশ পাঠাতে পারে। মুর্শেদভাই চাইবে তাকে অনেকরকম ভাবে জব্দ করতে। শ্বাস ফেলল মতিন। কী কাজ তাকে করতে হবে এখানে তা সে জানে না। যে কাজই হোক, খুব দ্রুত শিখে নিতে হবে।
এইঘরে বাইরের আলো ঢোকে না। তাই ঘুম ভাঙার পরেও সময় বুঝতে পারল না মতিন। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আজাদের চেম্বারে পা দিয়ে দেখল তিনি নেই। বাইরের হলে বেরিয়ে আসতেই দেখতে পেল একজন মহিলা কম্প্যুটারে কাজ করছে। ওপাশ থেকে জনের গলা ভেসে এল, 'গুড আফটারনুন স্যার।'
সঙ্গে সঙ্গে মহিলা মুখ ঘোরাল। শ্যামলা গায়ের রং কিন্তু মুখটা মিষ্টি। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, 'গুড আফটারনুন স্যার। আই অ্যাম জুলিয়া।'
মাথা নাড়ল মতিন, বলল, 'প্লিজ সিট ডাউন।'
জুলিয়া বসলে সে মনে মনে অনুবাদ করে বলল, 'মাই নেম ইজ মতিন। সো, প্লিজ কল মি মতিন।'
'থ্যাঙ্ক ইউ থ্যাঙ্ক ইউ।' বেশ জোরে হাসতে হাসতে বলল, 'জন।' 'হোয়ার ইজ মিস্টার আজাদ?' মতিন জিজ্ঞাসা করল।
'হি লেফট।' জুলিয়া একটা খাম নিয়ে এগিয়ে এল, 'দিজ ইজ ফর ইউ। মিস্টার আজান টোল্ড মি টু গিভ ইউ। ইট কেম থু মেইল।'
মতিন খামটা খুলে প্রিন্ট আউট বের করল। তার নাম লেখা, ইউ আর হিয়ার বাই অ্যাপয়ন্টেড...। তার এই চাকরির অফিসিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। জুলিয়া দাঁড়িয়েছিল, মতিন বলল, 'থ্যাঙ্ক ইউ।'
'ডু ইউ নিড দি লিস্ট অফ পিজি অর রুমরেন্ট লিস্ট রাইট নাউ?'
জুলিয়ার প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল মতিন। এবং তখনই তার মনে পড়ল বকুলআপার কথা।
বকুলআপা তার এক পরিচিত শিক্ষিকার নাম ঠিকানা ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছিলেন যোগাযোগ করতে। সে মাথা নাড়ল, 'নো, নট টুডে।'
জুলিয়া বলল, 'মিস্টার আজাদ বলেছেন কোম্পানির ব্যবসার ব্যাপারটা আপনাকে একটু ব্রিফ করে দিতে। আপনি কি এখন শুনতে চান?'
'বেশ, বলুন!'
'আপনি কি চেম্বারে বসবেন?'
'না। এখানেই বসা যাক।' জুলিয়ার চেয়ারের পাশের চেয়ারে বসল মতিন। জন কাছে এসে বলল, 'মিস্টার মতিন, একটু চা বা কফি বানাই?'
মতিন মাথা নাড়ল, 'চা।'
প্রায় আধঘণ্টা ধরে জুলিয়া তাকে বোঝাল। শিকাগো শহরের যত 'মল' আছে, সেগুলোতে বটেই, ওদিকে ওহাহিও কলম্বাস পর্যন্ত প্রায় তিনশো কিলোমিটারের মধ্যে সব শহরের বড় দোকানগুলোতে জামা-প্যান্ট, স্কার্ট সাপ্লাই দেওয়া এবং অর্ডার ও পেমেন্ট নেওয়ার কাজ এই অফিসকে করতে হয়। এই জন্যে শহরের উপকণ্ঠে একটা গোডাউন ভাড়া নেওয়া হয়েছে। স্টক কমে এলে বা নতুন কিছুর অর্ডার পেলেই ঢাকায় জানিয়ে দিতে হয়। ইমার্জেন্সি থাকলে ফ্লাইটে মাল আসে, না হলে জাহাজে। পেমেন্ট পেলে তা নির্দিষ্ট ব্যাঙ্কে জমা দিতে হয়। মিস্টার কামাল হোসেনের ঢাকার কোম্পানি সব মনিটারিং করে। মাঝে-মাঝে নিউইয়র্কের মিস্টার মুর্শেদের সাহায্য দরকার হয়। এই মুহূর্তে কত পেমেন্ট আউটস্ট্যান্ডিং আছে, কত স্টক গোডাউনে আছে তার লিস্ট কম্প্যুটার থেকে বের করে মতিনকে দেখাল জুলিয়া। বলল, 'মিস্টার আজাদ রিটায়ার করার আগে
আপনাকে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে একে একে আলাপ করিয়ে দেবেন।'
ক্লায়েন্টের লিস্টটা নিয়ে কার কাছে কত পাওনা আছে খুঁটিয়ে দেখল মতিন। মেসির নামে এক মল-এর কাছে এই মুহূর্তে বাইশ হাজার ডলার পাওনা আছে। সে জিজ্ঞাসা করল, 'এটা কতদিন ধরে বাকি আছে?'
'দুই মাস ওরা পেমেন্ট দিতে পারেনি। এ সপ্তাহে কিছু দেবে।'
' এর মধ্যে ওরা অর্ডার দিয়ে মাল নিয়েছে?'
'মিস্টার আজাদ বলেন এটা রোটেশনের ব্যাপার। মাল না দিলে আগের আউটস্ট্যান্ডিং পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।'
'অন্যান্য শহরগুলোতেও কিছু কিছু আউটস্ট্যান্ডিং পড়ে আছে দেখছি।'
'সাধারণত মেইল বা টেলিফোনে তাগাদা দিতে হয় বলে।' কথা শেষ করল না জুলিয়া।
বিকেল পাঁচটায় ওরা চলে গেল। যাওয়ার আগে জন বলল, 'মিস্টার মতিন, আপনি রাত্রে যা খাবেন তা এনে দিয়ে যাব?'
'কাছাকাছি রেস্টুরেন্ট নেই?' মতিন জিজ্ঞাসা করল।
'এক ব্লক দূরে আছে। কিন্তু সন্ধের মধ্যে খেয়ে আসাই ভালো।'
'কেন?'
'রাস্তায় কোনও লোক থাকে না আর রাত্রে শিকাগো শহরের সুনাম নেই।' জুলিয়া শুনছিল। বলল, 'আপনাকে পিজা হাটের নাম্বার লিখে দিচ্ছি। ফোন করলে ওরা দিয়ে যাবে। সন্ধের পরে আপনার বাইরে যাওয়া উচিত নয়। নাম্বারটা লিখে দিয়ে গেল জুলিয়া। দরজা বন্ধ করে চেম্বারে গিয়ে মিস্টার আজাদের চেয়ারে বসল সে। ডান দিকের ড্রয়ারটা টানতেই টুকটাক অনেক কিছুর সঙ্গে একটা সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার দেখতে পেয়ে অবাক হল। মিস্টার আজাদকে আজ একবারও ধূমপান করতে দ্যাখেনি সে। সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়েও খেতে ইচ্ছে করল না মতিনের।
শেষপর্যন্ত সে নিজেই ফোনটা করল। আমেরিকায় ফোন নাম্বার দশ সংখ্যার। কাগজটা দেখে দেখে নাম্বার টিপতেই রিং শুনতে পেল। তারপর মহিলা কন্ঠে শুনতে পেল, হ্যালো!'
মতিন ঢোঁক গিলে বলল, 'বকুলআপ্য এই নাম্বার আমাকে দিয়েছেন!'
'হ্যাঁ, হ্যাঁ, বকুল আমাকে ফোনে বলেছে। আপনার নাম কী যেন!'
'মতিন।'
'হ্যাঁ। আপনি এখন কোথায়?'
'শিকাগোয়।'
'চলে এসেছেন? কোথায় উঠেছেন?'
'অফিসে।'
'অফিস? সেকি! কোন রাস্তায়?'
'রাস্তা? একটু দাঁড়ান।' টেবিলের একপাশে রাখা কোম্পানির নাম ঠিকানা লেখা খাম তুলে
নিয়ে ঠিকানাটা বলল মতিন।
'বুঝতে পেরেছি। ওখানেই থাকবেন? বকুল অবশ্য অন্য কথা বলছিল।'
'না না। এখানে ক'দিন থাকা যায়। আমি ঘর খুঁজছি। নেট থেকে একটা লিস্ট অবশ্য বের
করেছি।' মতিন বলল।
'ঘর আপনি পেয়ে যাবেন কিন্তু রান্না করে খেতে পারবেন তো?'
'সেটা একটু সমস্যার হবে। চেষ্টা করব। তবে পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকতে পারলে সুবিধে হত। আপনার কাছে সেরকম খবর থাকলে-পরে ফোন করে করে জেনে নেব।' মতিন বলল। 'দাঁড়ান, দাঁড়ান। বকুল আমাকে বলেছে যদি আমার এখানে আপনাকে পিজি হিসেবে রাখতে পারি তা হলে ভালো হয়। এখান থেকে আপনার অফিস বেশি দূরে নয়। আপনি এসে দেখে যান, পছন্দ হলে কোনও অসুবিধে নেই। আমি সাধারণত বাড়িতে পিজি রাখি না। কোন মানুষ কীরকম হবে, তারপর বিপদে পড়ব। কিন্তু বকুল একসময় আমার খুব উপকার করেছিল। তাই
ভরসা পাচ্ছি।'
'ঠিক আছে। তা হলে খুব ভালো হয়।'
'আপনি এখন কী করছেন?'
'কিছু না। একা বসে আছি।'
'আপনি টেলিফোনের পাশে থাকুন, আমি পনের মিনিটের মধ্যে আসছি।'
রিসিভার রেখে দিয়ে কাগজটা আর একবার দেখল মতিন। মহিলার নাম রুকসানা। কথাবার্তায় খুব আন্তরিক এবং ভদ্র। নিশ্চয়ই সামনা সামনি এসে কথা বলতে চাইছেন।
মিনিট কুড়ি পরে ফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলতেই শুনল, 'নীচে নেমে আসুন, আমি আপনার অফিসের নীচে গাড়িতে আছি।'
তাড়াতাড়ি উঠে চারপাশে তাকিয়ে দরজার চাবি দেখতে পেল না মতিন। কী করবে এখন? দরজা খোলা রেখে যাওয়া অসম্ভব। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে তার ধড়ে প্রাণ এল। জন যেখানে বসে তার পাশের টেবিলে পাওয়া গেল দুটো চাবি। দরজার চাবির গর্তে দুবার খোলা বন্ধ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নীচে নামল মতিন। একটাই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সালোয়ার কামিজ পরা মধ্যবয়সি মহিলা তাকে দেখে হাসলেন, আপনি মতিন তো?'
'উঠে পড়ুন। আমার নাম নিশ্চয়ই বকুল বলেছে। আমি রুকসানা। উঠুন। হাসলেন মহিলা। বেল্টটা বেঁধে নিন।'
এখন সন্ধে নেমেছে। নিউইয়র্কের মতো শিকাগোর রাস্তায় গাড়ির ভিড় যেমন নেই তেমনি ফুটপাথেও বোধহয় মানুষ হাঁটে না। কিছুক্ষণের মধ্যে বড় বড় বাড়ির ভিড় ছাড়িয়ে এল গাড়ি। এবার হাইওয়ে। পাশাপাশি অনেকগুলো গাড়ি এক মুখে ছুটছে। উলটোদিকে গাড়িগুলো রাস্তার অন্যপ্রান্ত দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এরকম বড় রাস্তা নেই। হঠাৎ একজিট লেখা বোর্ডের পাশ দিয়ে রুকসানা হাইওয়ে ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। একটু পরেই মতিন ছবির মতো রাস্তা আর তার দুপাশে সুন্দর দোতলা বাড়ি দেখতে পেল। বাড়িগুলো বেশ ছাড়া ছাড়া। কোনও বাড়িই ইটের নয়। কাঠের গায়ে চমৎকার রং করা। এরকম একটা বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রুকসানা বললেন, 'এইখানে আমরা থাকি। আসুন।'
চাবি ঘুরিয়ে গা-তালা খুলে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। মতিন দেখল সন্ধে হয়ে গেলেও চারধারে হালকা আলো ছড়িয়ে আছে। কীরকম মায়াবী দেখাচ্ছে চারধার।
নীচেই বসার ঘর। বাঁ-দিক দিয়ে সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে।
রুকসানা বললেন, 'চলুন বাড়িটাকে দেখবেন।'
দোতলায় তিনটে শোওয়ার ঘর, ডাইনিং রুম কাম কিচেন। প্রত্যেক ঘরের লাগোয়া বাথরুম
টয়লেট, নীচে বসার ঘর ছাড়া আর একটি গেস্টরুম, বাথরুম, লাইব্রেরি রয়েছে। রুকসানা গেস্টরুমে ঢুকে বললেন, 'যদি ইচ্ছে করেন তা হলে আপনি এইঘরে থাকতে পারেন। আসুন ডেকে যাই।' পেছনের দরজা খুলে রুকসানা একটা মাঝারি কাঠের ডেকে পা রাখলেন। মাটি থেকে
অনেকটা উঁচুতে এই ডেক। কয়েকটা গার্ডেন চেয়ার আর টেবিল রয়েছে সেখানে। ডেকের সামনে অনেকটা বাগান। সেখানে প্রচুর সবজি এবং ফলের গাছ। লঙ্কা লালচে হয়ে গাছে ঝুলছে। মতিন বলল, 'বাঃ, সুন্দর। এদেশে এরকম বাড়ি আছে তা প্রথম দেখলাম।'
'এ পাড়ায় সব বাড়ির পেছনেই জায়গা আছে। যার শখ আছে সে বাগান তৈরি করে।
বসুন এখানে।' চেয়ার এগিয়ে দিলেন রুকসানা।'
ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। রুকসানা বললেন, 'কী নেবেন? চা না কফি?"
'চা। কিন্তু সেটা আপনাকেই করতে হবে?'
'হ্যাঁ ভাই। এখানে সব কিছু আমাদেরই করতে হয়। ঘর পরিষ্কার, রান্না, কাপড় কাচা থেকে সব। কাজের লোক রাখতে হলে বিশাল বড়লোক হতে হয়।' রুকসানা বললেন, 'এবার বলুন, বাড়ি পছন্দ হয়েছে?'
'বুউব। কিন্তু এখান থেকে অফিসে যাব কী করে?'
'কোনও সমস্যা নেই। দু-মিনিট হাঁটলেই একটা মোড় দেখতে পাবেন। সেখানে বাস দাঁড়ায়। উঠলে আপনার অফিসের সামনে নামতে পারবেন। তবে এখানে বাসের টাইমিং অদ্ভূত। সকাল ছ'টা থেকে দশটা পর্যন্ত কুড়ি মিনিট পরপর বাস পাবেন। দশটার পর থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত ঘণ্টায় একবার বাস যায়। তারপর আবার রাত দশটা পর্যন্ত কুড়িমিনিট বাদে যায়। আপনাকে নিশ্চয়ই সকালে যেতে হবে। কোনও সমস্যা নেই।'
চা খাওয়া হয়ে গেলে রুকসানা যখন কাপ-প্লেট তুলতে যাচ্ছেন তখন মতিন বলল, 'আমারটা আমি ধুয়ে দিচ্ছি।'
'থাক। প্রথমদিনে এটা করতে হবে না।' রুকসানা ওগুলো নিয়ে চলে গেল।
বাড়ি, পরিবেশ খুব ভালো লাগছিল। মহিলার ব্যবহারও। কিন্তু এখানে থাকতে হলে কত ডলার দিতে হবে ভদ্রমহিলা এখনও বলেননি।
একটু পরে রুকসানা একটা ট্রে-তে কিছু স্ন্যাক্স আর কেক নিয়ে এলেন। খোলা ডেকে বসে কেকে কামড় দিয়ে মতিন জিজ্ঞাসা করল, 'কিছু মনে করবেন না, এখানে থাকতে হলে আমাকে কত দিতে হবে?'
'সেটা এখনই না বললে নয়?' ভদ্রমহিলা চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।
'আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে এখানে থাকতে কিন্তু সাধ্যে যদি না কুলায়।'
'আপনি যদি সাড়ে সাতশো টাকা দেন তা হলে কি খুব অসুবিধে হবে?'
মতিন চট করে হিসেব করে নিল। বাইশশো থেকে সাড়ে সাতশো গেলে চোদ্দোশো পঞ্চাশ
থাকবে। অনেক টাকা। সে মাথা নাড়ল, 'ঠিক আছে। কিন্তু সামনের মাসের মাইনে পাওয়ার পর দিতে পারব। তাতে কি অসুবিধে হবে?'
'আপনাকে যখন বকুল পাঠিয়েছে তখন বলব, ঠিক আছে। আপনি বসুন। রাত্রের খাওয়া খেয়ে যাবেন।' রুকসানা চলে গেল।
মতিন বাগানে নামল। এখানে অন্ধকার কখন হয়? সে গাছপালা দেখতে দেখতে খিড়কি দরজার কাছে যেতেই মোটরবাইকের আওয়াজ শুনতে পেল। বাইকটা বাড়ির পাশে থামতেই একটি মেয়ে চিৎকার করে উঠল, 'শিট্। নেভার শো ইওর ফেস। ডার্টি পিগ।' যাকে বলা হল সে বাইক ছুটিয়ে চলে গেল।
কথাগুলোর মানে স্পষ্ট হয়নি মতিনের কাছে। এদের উচ্চারণ বোঝা মুশকিল। মেয়েটিকেও দেখতে পায়নি সে কাঠের বেড়ার এপাশে থাকায়। সে যখন ডেকের দিকে ফিরে আসছে তখনই একটি মেয়ে ভেতর থেকে ডেকের ওপরে এসে দাঁড়াল, পেছনে রুকসানা, 'ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না।'
মেয়েটি কাঁধ নাচাল, 'বাট হোয়াই? কেন পিজি রাখছ?'
'তুমি বুঝবে না।' রুকসানা বলল।
'হাউ মাচ হি ইজ গোয়িং টু পে?'
'আঃ। এসব কথা বোলো না। বকুল আন্টির রিকোয়েস্টে ওকে এই বাড়িতে থাকতে বলেছি।'
'ও মাই গড! অ্যাবসোলিউটলি ফ্রি?'
'না।'
মেয়েটি এগিয়ে এল দু-পা, 'হাই।'
মতিন তাকাল। রুকসানা বললেন, 'ও আমার মেয়ে। রোজি। এবার ফাইন্যাল পরীক্ষা
দিয়েছে।'
মতিন ধীরে ধীরে ডেকের ওপরে উঠে এল। তাকে আপাদমস্তক দেখে শব্দ করে হেসে উঠল, 'মাম, হি সিমস্ টু বি এ পিওর বাংলাদেশি।'
রুকসানা বললেন, 'নিশ্চয়ই। সেইজন্যে ওকে রেসপেক্ট করা উচিত। বাংলাদেশের মানুষের তো বাংলাদেশি হওয়াই উচিত। তোমার মতো হওয়া সম্মানের নয়।'
'আই অ্যাম নট এ বাংলাদেশি। আই অ্যাম আমেরিকান ।' 'আমি তর্ক করতে পারছি না।' রুকসানা ভেতরে চলে গেলেন।
রোজি এবার বাংলায় বলল, 'তাহলে আমাকে রোজ তোমার মুখ দেখতে হবে।'
খুব রাগ হয়ে গেল মতিনের, 'চোখ বন্ধ করে থাকলে দেখতে হবে না।'
'ওয়াও! তুমি কথা বলতে পারো? আমার বাড়িতে আমিই চোখ বন্ধ করে থাকব?'
'খারাপ লাগলে তো অন্য কোনও উপায় নেই।'
'কী করো তুমি?'
'চাকরি।'
'কতদিন এসেছ এদেশে?'
'প্রায় দুই সপ্তাহ।'
'ওইসব জামাপ্যান্ট দেশ থেকে কিনেছ?'
'হ্যাঁ।'
হাসল রোজি, 'গার্ল ফ্রেন্ড আছে?'
হঠাৎ কী মনে হল, মতিন বলল, 'হ্যাঁ। অনেক।'
'সেই মেয়েগুলো মনে হয় অন্ধ।' বলে চলে গেল রোজি বাড়ির ভেতরে। মেয়েটির শরীরের কোথাও বাংলাদেশ নেই। না পোশাকে, না ভঙ্গিতে। রুকসানাকে দেখলে সেটা মনে হয় না। মেয়েকে তিনি এরকম হতে দিয়েছেন কেন?
ডেকের চেয়ারে বসল মতিন। বোঝাই যাচ্ছে রোজি তাকে অত্যন্ত অপছন্দ করছে। এই অবস্থায় এখানে থাকা কতটা স্বস্তির হবে বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু সে মনে মনে বকুল আপার কাছে কৃতজ্ঞ হল। লিটন আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। কয়েক মিনিটের আলাপ, তাতেই ভদ্রমহিলা সুপারিশ করেছেন। অথচ লিটনের ভাবভঙ্গি দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল মহিলা বাড়িতে খারাপ আড্ডা বসান।
রাত্রের খাওয়া ন'টার আগেই খাওয়া হয়ে গেল। রোজি খাওয়ার টেবিলে আসেনি, রুকসানাই মতিনকে সঙ্গ দিলেন। বললেন, 'মেয়ে এসব খাবার খায় না। আমেরিকান মেমসাহেব তো।'
কথা হল, আগামীকাল অফিসের পর রুকসানা মতিনকে নিয়ে আসবেন। শেষপর্যন্ত মতিন জিজ্ঞাসা না করে পারল না, 'রোজি বোধহয় আমার এখানে থাকা পছন্দ করছে না। কী হবে?'
'আপনি আপনার মতো থাকবেন।' গম্ভীর মুখে বললেন রুকসানা।
ওরা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলে মতিন দেখল রাস্তার আলো জ্বলছে। এখন রাত বলেই মনে হচ্ছে। রুকসানা বললেন, 'চলুন, আপনাকে বাস স্টপ দেখিয়ে দিচ্ছি।'
মতিন দাঁড়ল, 'শুনেছি এখানে রাত্রে রাস্তায় হাঁটা নিরাপদ নয়।'
'আমাদের পাড়াগুলোতে কোনও ভয় নেই। ওসব ডাউনটাউনে হয়।'
'আমিও তো ওদিকেই যাব।'
একটু ভাবলেন রুকসানা। তারপর বললেন, 'আপনি দাঁড়ান, আমি রোজিকে বলছি গাড়ি বের করতে।' রুকসানা ভেতরে চলে গেলে মতিন দেখল যে গাড়িতে ওরা এসেছিল সেটা এখন রাস্তায় নেই।
কয়েক মিনিট পরে নীচের গ্যারাজের শাটার খুলে গেল। গাড়িটা বেরিয়ে এলে সে অবাক হয়ে দেখল ড্রাইভিং সিটে রোজি বসে আছে। পাশে এসে বলল, 'কাম অন মিস্টার মতিন।'
রুকসানা বেরিয়ে এলেন বাড়ির মূল দরজা দিয়ে, 'মতিন আপনাকে রোজি পৌঁছে দিয়ে আসছে। আমার আবার রাত্রে গাড়ি চালাতে অসুবিধে হয়। রোজি, ওকে নামিয়ে তুমি কোথাও যাবে না। সোজা বাড়ি চলে আসবে।'
'ওকে! বেবি।' হাসল রোজি।
বাধ্য হয়ে সামনের সিটে বসল মতিন। বসে বেল্ট বেঁধে নিল।
রোজি বলল, 'গুড বয়।'
কিছুক্ষণ চলার পরে রোজি বলল, 'সো, ইউ ডোন্ট হ্যাভ এ গার্ল ফ্রেন্ড। তা হলে অনেক বলতে না। আজ অবধি ক'টা মেয়েকে চুমু খেয়েছ?'
'ইচ্ছে হয়নি।' মতিন জবাব দিল।
'কেন? তুমি কী হোমো?'
কী?' বুঝতে পারল না মতিন। '
'তোমাদের স্কুলে ইংরেজি পড়ায় না?'
'হ্যাঁ। পড়ায়।'
'উঃ।' কাঁধ নাচাল রোজি।
শেষপর্যন্ত শহরে ঢুকে পড়ল গাড়ি। হঠাৎ একটা ছোট ক্যান ছুটে এসে গাড়ির ছাদে পড়ে ওপাশে চলে গেল। শব্দে চমকে উঠল মতিন, 'কী হল?'
'ফান। ওই বাস্টার্ডগুলো ফান করছে।'
'এটা কী ধরনের মজা। ওরা কারা?'
'মাগার। মাগার মানে জানো?' গাড়ি চালাচ্ছিল রোজি।
'না।'
'এখানে গাড়ি থেকে নামলে ওরা তোমার পকেট থেকে সব নিয়ে নেবে।'
'ও। ছিনতাইবাজ। পুলিশ নেই?'
'আছে। তাদের দেখলেই এরা পালায়।' রোজি বলল, 'তুমি কতদিন থাকবে এই শহরে?'
'আমি জানি না।'
'আমাদের বাড়িতে কবে যাবে?'
'কালই যাওয়ার কথা।'
'কিন্তু আমাকে একদম বিরক্ত করবে না। আউটসাইডার হয়ে থাকবে।'
সেটা কীরকম থাকা বুঝতে পারল না মতিন।
রোজি জিজ্ঞাসা করল, 'কোথায় নামবে তুমি?'
'আমার অফিসের সামনে।'
'অফিসটা কোথায়?'
'সমস্যায় পড়ল মতিন। রুকসানাকে সে ঠিকানা বলেছিল একটা খাম দেখে। সেটা বেমালুম
ভুলে গিয়েছে সে। এমকি রাস্তার নামটাও মনে নেই। সে লজ্জিত গলায় বলল, 'সরি, মনে করতে পারছি না। আজই প্রথম এসেছি।'
তা হলে কোথায় নামবেন তা আমাকে বলুন।' '
'কী বলি।' সামনের বাড়িটাকে চেনা বলে মনে হল। ওখান থেকেই সে বেরিয়ে রুকসানার
এই গাড়িতে উঠেছিল। মতিন বলল, 'এখানে আমাকে নামিয়ে দিন।' গাড়ি রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে ইশারায় মতিনকে বসতে বলে রোজি ফোন করল,
'মাম, হি ডাজ নট নো হিজ অ্যাড্রেস।' বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল।
ওপাশের জবাব শুনতে পেল না মতিন। রোজি আবার গাড়ি চালালো। মিনিট আটেক পরে বাড়িটার নীচে পৌঁছে জিজ্ঞাসা করল, 'চেনা মনে হচ্ছে?'
এবার চিনতে পারল সে। মাথা নেড়ে গাড়ি থেকে নামতেই রোজি নামল। রাস্তায় লোক দূরের কথা একটা গাড়িও নেই। মতিনকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে রোজি বলল, 'হোপ ইউ
উইল রিচ ইন ইওর প্লেস। গুড নাইট।'
বলে সে এগিয়ে গিয়ে ফুটপাথে দাঁড়াতেই মতিন দেখতে পেল দুটো ছেলে প্রায় মাটি ফুঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল রোজির ওপর। পড়ে যেতে যেতেও সামলে নিয়ে রোজি চিৎকার করতে লাগল, বাধা দিতে লাগল। দৌড়ে ছুটে এল তিন। প্রথমেই রোগা ছেলেটার ঘাড়ে প্রচণ্ড শক্তি ঘুষি মেরেই পা চালাল সে। ছেলেটি ককিয়ে উঠে পড়ে গেল ফুটপাথে। লম্বা ছেলেটি তখন রোজির গলায় হার ছিঁড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, বাধা দিচ্ছে রোজি। ছেলেটার কোমরের নীচে লাথি মারল মতিন। সে হকচকিয়ে তাকাতেই মুখে ঘুষি মারল। সম্ভবত নাক থেকে রক্ত বের হয়েছিল। ছেলেটা দৌড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। প্রথমজন তখনও ফুটপাথে পড়ে ছটফট করছে। রোজি বলল, 'থ্যাঙ্ক ইউ।'
'তাড়াতাড়ি চলে যান।'
'আপনি আগে উঠে পড়ুন।' দরজা খুলে গাড়িতে ঢুকল রোজি।
ঘরে ঢুকে তালা বন্ধ করে চেয়ারে বসে পড়ল মতিন। জীবনে কখনও সে মারপিট করেনি। কলেজে পড়ার সময় কিছুদিন মুস্তাফা ভাই-এর বক্সিং-এর স্কুলে ভরতি হয়েছিল। মায়ের আপত্তিতে ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু আজ রোজিকে আক্রান্ত হতে দেখে তার কী যে হয়ে গেল, অজানা শক্তি বোধহয় ভর করেছিল তার ওপর। ঘাড়ের কাছে বেশি আঘাত পেলে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। ওই ছেলেটার ওরকম কিছু হলে তাকে পুলিশ খুনের দায়ে ধরবে। ছেলেটা মরে গেছে কিনা তা দেখতে গেলে আবার নীচে নামতে হয়, কিন্তু সাহস হল না মতিনের। শেষবার ওকে দেখেছে ছটফট করতে। তারপরই খেয়াল হল, এই ঘটনার তো কোনও সাক্ষী নেই। তার আঘাতেই যদি ছেলেটা মরে যায় তাহলে সেটা পুলিশের পক্ষে জানতে পারা সম্ভব নয়।
হাত-মুখ ধুয়ে ডিভানে শুয়েও স্থির হতে পারছিল না মতিন। সে যে কখনও এইভাবে কাউকে মারতে পারে তা নিজেই জানত না। একটু পরে বাইরের ঘরের টেলিফোন বেজে উঠল। কার ফোন? এত রাত্রে নিশ্চয়ই তার ফোন আসতে পারে না। সে ভয়ে ভয়ে রিসিভার তুলতেই শুনতে পেল, 'শুয়ে পড়েছিলে?' রোজির গলা।
'না-মানে-।'
'মাম ফোন নাম্বারটা দিল। তুমি আমার খুব উপকার করেছ। আমি ভাবতেই পারিনি তোমার মতো শান্ত ছেলের শরীরে অত শক্তি আছে। থ্যাঙ্ক ইউ ওয়ান্স মোর।'
'আপনি পৌঁছে গিয়েছেন তো?' মতিন প্রশ্ন করল।
'আপনি? বাংলাদেশে কি ছোটরা বড়দের তুমি আর বড়রা ছোটদের আপনি বলে।' মতিন হেসে ফেলে, 'না।'
'তা হলে?'
'ঠিক আছে।'
শব্দ করে হাসল রোজি, 'আমি পৌঁছে গিয়েছি।'
এখন রুকসানা আপার বাড়ি থেকে অফিসে আসতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে মতিন। ওঁর কথায় বাসের জন্যে মাসিক টিকিট করে নিয়েছে। এই বাসে উঠলেই তার দেশের কথা মনে পড়ে। এত আরামের বাস যদি দেশে চলত।
আজাদভাই তাকে নিয়ে রোজ বিভিন্ন ক্লায়েন্টের কাছে যাচ্ছেন, আলাপ করিয়ে দিচ্ছেন। প্রথম প্রথম বেশ অসুবিধে হচ্ছিল কথা বুঝতে, বলতে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সে অনেকটা সড়গড় হয়ে গেল। এই ব্যাপারে জন এবং জুলিয়া খুব সাহায্য করেছে মতিনকে। ওদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে বলতে আড়ষ্টতা ভেঙেছে।
তিন সপ্তাহের মধ্যে ব্যবসার কাজ অনেকটা বুঝে গেল সে। এখন দিনের বেলায় সে একাই ক্লায়েন্ট মিট করতে যায়। বাংলাদেশের কারখানায় তৈরি পোশাক আনন্দের সঙ্গে কিনছে এখানকার মানুষ, দেখেও সুখ হয়। ইতিমধ্যে দুদিন মুর্শেদের সঙ্গে কথা হয়েছে ব্যবসার প্রসঙ্গে । মুর্শেদ হেসেই কথা বলেছে কিন্তু ব্যক্তিগত বিষয়ে একটাও কথা বলেনি। জন তাকে একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিল অফিস থেকে পয়সা নিয়ে গিয়ে। একদিন দেশে ফোন করেছিল দে। বাসায় জানিয়ে দিয়েছে খুব ভালো চাকরি পেয়েছে, সামনের মাস থেকে হাজার ডলার করে পাঠাবে। মা প্রথমে এতদিন চুপচাপ থাকার জন্যে বকাঝকা করলেও খবরটা শুনে খুশি হয়েছিল। টিয়াকেও ফোন করেছে মতিন। গালিব আবার অসুস্থ হয়েছে। তাকে হাসপাতালে ভরতি করতে হয়েছে। টিয়া তাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছে।
রুকসানা আপা খুব যত্ন করেন। সকাল সাতটার সময় সে বেরিয়ে যায়। ফেরে সন্ধ্যার মুখে। ফিরে নিজের ঘরে বসে টিভি দ্যাখে। রাত আটটায় ডিনার করে শুয়ে পড়ে। সপ্তাহের প্রথম পাঁচদিন রোজির সঙ্গে দ্যাখা হয় না। সে বাসায় ফেরে প্রায় রাত এগারোটা-বারোটায়। যেহেতু এই অঞ্চলটা শিকাগো শহরের গায়ে হয়েও একদম আলাদা তাই রাত্রে পথে কোনও খারাপ ঘটনা ঘটে না। সে যখন বাসায় ফেরে তখন মতিন গভীর ঘুমে। যখন অফিসে যায় তখন রোজি ঘুমোচ্ছে।
কিন্তু শনি এবং রবিবার ছুটি থাকে মতিনের। একটু বেলা বাড়লে ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপ নিয়ে আসে রোজি। এসে ডেকে বসে। ছুটির দিনে বাড়ির পেছনের বাগানে সকালটা কাটায়
মতিন। গাছগুলোর যত্ন নেয়। সেই কারণে রুকসানা আপা খুব খুশি।
তখন রোজির সঙ্গে গল্প হয়। এখন রোজি খুব নরম গলায় কথা বলে।
পাশের চেয়ারে বসে মতিন জিজ্ঞাসা করেছিল, 'আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
'ওঃ, সিওর।'
'তুমি রোজ অত রাত্রে বাসায় ফেরো কেন?'
'অত রাত্রে মানে? আমি বারোটার মধ্যে ফিরে আসি। এখানে রাত হয় একটা নাগাদ।
তখন তো বেশি রাত হয় না।' রোজি বলল।
'কী করো অতক্ষণ?'
'ফান। বন্ধুদের সঙ্গে মজা করি।'
'তুমি তাদের একজনকে গালি দিয়েছ, আমি শুনেছি।'
'ওঃ। ওটা একটা স্কাউন্ডেল।'
'কেন?'
কাঁধ নাচাল রোজি, 'হি নো নাথিং একসেপ্ট সেক্স।'
'বাকিরা?'
'আমরা বাইকে স্পিড তুলি, পুলিশ দেখলেই শান্ত। কেউ কেউ বিয়ার খাই, কেউ কোক।
আর লেগপুল করি।' হাসল রোজি।
'রোজ এই এক কাজ করতে বিরক্ত লাগে না?'
'ওয়েল, আমি অফিসে যাই বারোটায়। আর্টটা পর্যন্ত ডিউটি করি। আর তারপর একটু
রিল্যাক্স না করলে চলে? তুমিই বলো।'
মতিন মাথা নাড়ল, 'আমার ব্যান্ড লাক।'
'কেন?'
'সোম থেকে শুক্র, কোনওদিনই রাত্রে তোমার দ্যাখা পাব না।'
হার ম্যাজেস্টির?'
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল রোজি। তারপর জিজ্ঞাসা করল, 'এটা কার ভয়েস? তোমার না
'মানে?'
'মাম একই কথা বলে তো!'
'আমি সেটা জানি না।'
'তুমি চাও আমি মাঝে-মাঝে ছুটির পরে বাসায় চলে আসি?'
'তাহলে একসঙ্গে ডিনার করা যায়।'
হাত বাড়াল রোজি, 'করো।'
'ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে মতিন হাত বাড়াল। সেটাকে মুঠোয় নিয়ে রোজি বলল, 'ডান। কিন্তু তখন গম্ভীর কথা বলবে না।'
'ঠিক আছে।' মতিন হাসল।
প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে রুকসানাকে টাকাটা দিল মতিন। রুকসানা যখন শুনল মতিন দেশে মা-বাবার ঠিকানায় এক হাজার টাকা পাঠাতে চায় তখন খুব অবাক হলেন, 'তারপর তো তোমার হাতে কিছুই থাকবে না।'
'কেন। যা থাকবে তা আমার পক্ষে অনেক।'
'দেশে হাজার টাকা গেলে ওরা তো সত্তর হাজারের বেশি টাকা পাবেন। অবশ্য কিছু
কমিশন বাদ যাবে। আমি বলি কী তুমি আটশো পাঠাও।'
মতিন কিছু বলল না। সে মাসে হাজার পাঠাবে বলে দিয়েছে।
রুকসানা বললেন, 'তুমি খুব ভালো ছেলে মতিন। এদেশের ছেলেরা কেউ এরকম চিন্তা করে কিনা আমি জানি না। তুমি আসার পরে আমার মেয়েটারও ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। একেই বোধহয় বলে সঙ্গগুণ।'
আজাদভাই ব্যবস্থা করে দিলেন। আলাপ করিয়ে দিলেন একজন ধনী বাংলাদেশির সঙ্গে। যাঁকে টাকা দিলে তাঁর লোক মতিনের বাসায় পৌঁছে দেবে।
এবার আজাদভাই অবসর নিলেন। শেষদিন অফিসে বসে বললেন, 'মতিন, কাল থেকে আমার বিশ্রাম। তোমাকে এখন থেকে সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে। প্রতি সপ্তাহে কামালসাহেবকে স্টেটমেন্ট পাঠাবে। তাতে গোডাউনে কত স্টক আছে, কত ক্লায়েন্টদের কাছে দেওয়া হয়েছিল, কত বিক্রি হয়েছে এবং কী ডিম্যান্ড আছে তা যেন প্রতিফলিত হয়। জুলিয়া এ ব্যাপারে খুবই দক্ষ। ওর সাহায্য পাবে তুমি। আশাকরি তুমি অসুবিধেতে পড়বে না। যদি দরকার হয় তা হলে নিশ্চয়ই আমাকে ফোন করবে।'
আজাদভাই চলে যাওয়ায় বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল মতিনের। সে দিনের প্রথম ভাগটা ক্লায়েন্ট ভিজিট করতে লাগল। নতুন কাস্টমার তৈরি হল।
এক সন্ধ্যায় বাস থেকে নেমে বাড়ির দিকে যখন হাঁটছে তখন মতিন অবাক হয়ে দেখল রোজি দাঁড়িয়ে আছে। সে হেসে জিজ্ঞাসা করল, 'কী ব্যাপার?'
'কিছু না।' মাথা নাড়ল রোজি। 'তা হলে এখানে দাঁড়িয়ে আছো। অফিসে যাওনি?'
'না।'
'কেন?'
'আমি খুব ডিসটার্বড।'
'কেন?'
'আমি তোমার কাছে একটা প্রশ্নের উত্তর চাই।'
মতিন তাকাল।
'তুমি আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করো। আমি তোমাকে বুঝতে পারি না। তাই বুঝতে চাই।' রোজি বলল।
মতিন বলল, 'চল হাঁটি। হ্যাঁ কী বুঝতে চাও?' 'তুমি আমার কাছে কী চাও?'
'আমি? এটা মুখে বলতে হবে?' মতিন তাকাল।
'হ্যাঁ। আমি শুনতে চাই।'
'কী আশ্চর্য। আমরা বন্ধু, এই বন্ধুত্বটা চিরকাল থাকুক।'
'ও! ওকে! থ্যাঙ্ক ইউ।' মাথা নাড়ল রোজি।
বাকি পথটা মতিন কিছু কথা বললেই রোজি ই হ্যাঁ ছাড়া কিছুই বলল না। কিন্তু বাড়িতে ঢোকার পর সেই যে ওপরে চলে গেল আর নীচে নামল না। রুকসানা বললেন, 'ওর খুব মাথা ধরেছে বলল। তাই আলো নিভিয়ে শুয়ে আছে।'
পরদিন অফিসে গিয়েই মতিনকে জুলিয়া বলল, 'মুর্শেদসাহেব ফোন করেছিলেন, আপনাকে আসামাত্রই কথা বলতে বলেছেন। খুব জরুরি দরকার।'
মুর্শেদভাইকে ফোন করল মতিন। মুর্শেদ বলল, 'খুব খারাপ খবর মতিন। বড় সাহেব অসুস্থ হয়েছেন।'
'কী হয়েছে মামার?' মতিন জিজ্ঞাসা করল।
'হার্ট অ্যাটাক। নার্সিংহোমে ভরতি আছেন। আই সি ইউ-তে।'
মূর্শেদভাই বলল, 'ডাক্তার বলেছে আটচল্লিশ ঘণ্টা না গেলে কিছুই বলা যাবে না।'
'তা হলে-।'
'কিছুই করতে পারি না আমরা। অপেক্ষা করা ছাড়া।' মুর্শেদ বলল।
'আমি কি হেড অফিসে ফোন করে খোঁজ নিতে পারি?'
'কী খোঁজ নেবে? বুঝতেই পারছ, বড়সাহেবের খারাপ কিছু হলে এই ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। ওঁর ছেলে নেই যে ব্যবসার হাল ধরবে।'
'তা হলে।'
'তা হলে আমাদের একটাই করণীয়। আমরা আর নতুন কোনও অর্ডার দেশে পাঠাব না। যা স্টক আছে তা বিক্রি করে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও রাস্তা নেই। মুর্শেদভাই লাইন কেটে দিল।
দু-হাতে মাথা ধরে বসে থাকল মতিন। জুলিয়া চুপচাপ দূরে দাঁড়িয়ে শুনছিল। সে বাংলা সামান্য বোঝে। জিজ্ঞাসা করল, 'কী হয়েছে?'
'মামার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আই সি ইউ-তে আছেন। উনি আমার মামা। যদি কিছু ওঁর হয়ে যায় তা হলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।' মতিন বলল।
'এখনই এসব ভাবছেন কেন? আমি ওঁকে কয়েকবার দেখেছি। খুব বিচক্ষণ মানুষ। নিশ্চয়ই জানেন তিনি না থাকলে ব্যাবসা কী করলে চালু থাকবে। জুলিয়া বলল। মতিন মাথা নাড়ল, 'আমি জানি না।'
চারদিন পরে ঢাকা থেকে মেল এল। মতিনকে অবিলম্বে নিউইয়র্কের বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। মতিন মরিয়া হল। সে হেডঅফিসে ফোন করল। জানল, কামাল হোসেন সাহেব এখনও নার্সিংহোমে। তবে আই সি ইউ থেকে তাঁকে বের করে আনা হয়েছে। মেল তাঁরই নির্দেশে পাঠানো হয়েছে।
সন্ধ্যাবেলায় রুকসানাকে ব্যাপারটা জানাল মতিন। ভদ্রমহিলা খুব খুশি হয়ে বললেন, 'মনে হচ্ছে তোমার ডুপ্লিকেট পাসপোর্ট এসে গিয়েছে। কালই চলে যাও। তারপর ইউ এস ইমিগ্রেশনে গিয়ে ওয়ার্কিং ভিসা নিয়ে নাও।'
'আমি পাব?'
'নিশ্চয়ই। তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটাই হেল্প করবে।'
'রোজি কোথায়?'
'অফিসে। ফিরবে তো রাত বারোটায়। মাঝখানে পালটে গিয়েছিল, আবার যে কী হল, যে কে সেই!' রুকসানা বললেন।
এবার বাস নয়। অফিসের টাকায় প্লেনের টিকিট কেটে নিউইয়র্কে এল। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় রোজির খোঁজ করেছিল মতিন, কিন্তু সে তখন ঘুমাচ্ছে। রুকসানা বললেন, 'ঠিক আছে, আমি বলে দেব। তুমি তো ভিসা পেতেই ফিরে আসছ।'
বাংলাদেশের দূতাবাসে খবর নিয়ে জানা গেল রুকসানার অনুমানই সত্যি। এতদিন পরে তার আবেদনের জবাবে ডুপ্লিকেট পাসপোর্ট ইস্যু করার অর্ডার এসেছে। অফিসার অত্যন্ত সজ্জন। অতি দ্রুত পাসপোর্ট ইস্যু করে দিলেন। সেখান থেকে মতিন ছুটল ইউ এস ইমিগ্রেশনে। সব কিছু দেখে শুনে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিল, 'আর টেম্পোরারি ভিসা বাড়ানো যাবে না। আগামীকালের মধ্যেই মতিনকে দেশে ফিরে যেতে হবে। আমেরিকায় কাজ করতে হলে মতিনকে ঢাকার আমেরিকান দূতাবাস থেকে ভিসা নিতে হবে।'
মতিন শুধু একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে এসেছিল শিকাগো থেকে। বাধ্য হয়ে মুর্শেদকে টেলিফোন করে পুরো ব্যাপারটা জানাল। মুর্শেদ বলল, 'এ তো ভালো খবর। তুমি এই পাসপোর্টটার জন্যে ব্যাকুল ছিলে। আমার মনে হয় তোমার আজই দেশে যাওয়া উচিত।'
'কিন্তু আমার সমস্ত জিনিসপত্র তো শিকাগোতে।'
'থাক না। যখন আবার আমবে তখন কাজে লাগবে।'
'কিন্তু ফিরব কী করে? আমার কাছে টিকিট নেই।'
'আমার কাছে আছে। আমি ওটা ওপেন করে রেখেছি। তুমি সোজা জে এস কে-তে চলে যাও। আমি আসছি।' ফোন রেখে দিল মুর্শেদ।
নিজেকে খুব অসহায় বলে মনে হচ্ছিল মতিনের। সে টিয়াকে ফোন করল। টিয়ার ফোন সুইচ অফ করা। তারপর রুকসানাকে ফোন করে ব্যাপারটা জানাল। রুকসানা বললেন, 'তুমি যদি মাসখানেকের মধ্যে ফিরে আসো তা হলে আমাকে জানিও। না এলে জিনিসপত্রগুলো তোমার অফিসে পৌঁছে দিয়ে আসব। ভালো ভাবে যেও।
এখন অফিস ছুটি হয়ে যাওয়ার সময়। কিন্তু জুলিয়াকে পেয়ে গেল সে। সব শুনে জুলিয়া বলল, 'আমি প্রে করছি, আপনি যেন ফিরে আসেন স্যার।'
একেবারে রোবটের মতো টিকিটটা মতিনের হাতে তুলে দিয়ে মুর্শেদ বলল, 'তুমি জেনে খুশি হবে তোমার টিকিট কনফার্ম করে দিয়েছি। হ্যাভ এ নাইস জার্নি। যাও, দেরি হয়ে গেছে একটু।'
মা খুব খুশি। বাবা বললেন, 'কবে বাস্তবজ্ঞান হবে? আসতে পারছ না, এ কথাটা আমাদের জানানো দরকার বলে মনে করলে না। যাক গে, শুনলাম তোমার মামা খুব অসুস্থ হয়েছিলেন। তাঁরই অনুগ্রহে তো আমেরিকা দেখে এলে। একবার দ্যাখা করে এসো।' বাবাকে মামার সম্পর্কে এতটা নরম হতে কখনও দ্যাখেনি মতিন। মৃত অথবা অসুস্থ লোকের সঙ্গে বোধহয় কেউ শত্রুতা রাখে না।
বিকেলে মামার বাড়ি থেকে খবর নিয়ে নার্সিংহোমে গেল মতিন। মামার কেবিনে তখন মামি ছাড়াও আরও দুজন। উঁচু বালিশে হেলান দিয়ে মামা আধ-শোওয়া হয়ে আছেন। তাকে
দেখে মামি বললেন, 'মতিন এসেছে।'
মামা তাকালেন। খুব রোগা হয়ে গিয়েছেন। বললেন, 'এসেছ।' 'হ্যাঁ।' মতিন জিজ্ঞাসা করল, 'আপনি কেমন আছেন?'
'আছি। এ যাত্রায় যেতে পারলাম না।'
মামি বললেন, 'আঃ, কী বাজে কথা বল।'
মামা বললেন, 'আজাদভাই তোমার প্রশংসা করেছেন। ওঁর চলে যাওয়ার পরে তুমি ব্যবসা আরও বাড়িয়েছ দেখলাম। আমি এটা আশা করিনি।'
মতিন চুপ করে রইল।
মামা বললেন, 'কাল সকালে অফিসে যেও। জরুরি।'
'আচ্ছা।'
বাইরে বেরিয়ে এসে বেশ স্বস্তি পেল মতিন। মামা যখন তাকে জরুরি দরকারে অফিসে যেতে বলেছেন তখন নিশ্চয়ই এখানেই তার চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। বাড়িতে ফিরে গিয়ে মাকে কথাটা বলতেই তিনি বললেন, 'এখনই তোর বাবাকে কিছু বলিস না। কাল গিয়ে জান কেন যেতে বলল।'
রাত্রে বিছানায় শুয়ে বারংবার মনে পড়ছিল টিয়ার কথা। খুব ভালো মেয়ে টিয়া। প্রতিবন্ধী
বাচ্চাকে নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে কিন্তু তাতে সে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়। এরকম মেয়েকে সে আগে
দ্যাখেনি। মনে পড়ছে রোজির কথা। ইদানীং, রোজি তার সঙ্গে দ্যাখাই করত না। সেই যে সন্ধেবেলায় হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করেছিল, তুমি আমার কাছে কী চাও, কী উত্তর চেয়েছিল সে? যত ইচ্ছেই হোক ভালোবাসার কথা বলার সাহস যে তার হয়নি। তাই কি শুনতে চেয়েছিল সে? পরদিন অফিসে গিয়ে নিজের পরিচয় জানাতেই হইচই পড়ে গেল। চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট তাকে খুব খাতির করে বসালেন। তারপর তার হাতে একটা বন্ধ খাম তুলে দিলেন। মতিন জিজ্ঞাসা করল, 'কী এটা?'
'খুলে দেখুন।'
খামের মুখ ছিঁড়ে চিঠি বের করল মতিন। চিঠিতে লেখা হয়েছে, 'কে হোসেন অ্যান্ড কোম্পানি তাদের আমেরিকার গার্মেন্টস ব্যবসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে মিস্টার মতিন আহমেদকে অনুরোধ করছে। এই ব্যবসায় যা মুনাফা হবে তার চল্লিশ ভাগ মিস্টার মতিন আহমেদ পাবেন, বাকি ষাটভাগ কে হোসেন অ্যান্ড কোম্পানির প্রাপ্য হবে। মিস্টার মতিন আহমেদ কোম্পানির ব্যবসা যেসব আমেরিকান শহরে আছে তার বৈদেশিক কর্তা হিসেবে দ্যাখাশোনা করবেন। এই প্রস্তাবে সম্মত হলে মিস্টার আহমেদকে নিম্ন সাক্ষরকারীর সাক্ষরের পাশে সাক্ষর করতে হবে।' তলায় কে হোসেন কোম্পানির কর্ণধার মিস্টার কামাল হোসেনের সই রয়েছে।
মতিনের মাথার ভেতর আচমকা শূন্য হয়ে গেল। সে কিছুই ভাবতে পারছিল না। চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট বললেন, 'স্যার, আপনার পাসপোর্টটা দরকার। ট্র্যাভেল এজেন্টকে দিতে হবে আমেরিকান ভিসার জন্যে।'
মতিন শূন্যচোখে তাকাল। সে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল।