shabd-logo

স্বপ্নেই এমন হয়

18 January 2024

2 Viewed 2

রারাত মেল ট্রেনে না ঘুমিয়ে বসে থাকতে হয়েছিল। একদিন আগে টিকিট কাটলে এসব সা ট্রেনে শোওয়ার জন্যে বার্থ খালি পাওয়া যায় না। সকালে ট্রেনটা জংশন স্টেশনে দাঁড়ালে প্ল্যাটফর্মে নেমে মিলন জেনেছিল, তাকে এখনও ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করতে হবে। ওপাশে ন্যারো গেজ ট্রেনের লাইন আছে। সেখানে ট্রেন আসবে সাড়ে ন'টায়। ওই ট্রেন তাকে পৌঁছে দেবে বিন্দু নামের স্টেশনে, পাঁচ ঘণ্টা পরে। মেল ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে গেলে চারধার বেশ শান্ত হয়ে গেল। স্টেশনের নোংরা টয়লেটে গিয়ে কোনওমতে পরিচ্ছন্ন হয়ে প্ল্যাটফর্মের চায়ের দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসে এক কাপ চা আর বিস্কুট দিতে বলল মিলন।

বেঞ্চির একপাশে কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা একটা লোক উদাসভঙ্গিতে বসেছিল। সে এবার চা-ওয়ালাকে বলল, 'তাহলে পয়সা না দিলে তুমি আমাকে চা দেবে না?'

চা-ওয়ালা জবাব না দিয়ে মিলনের জন্যে চা বানাতে লাগল।

'হাতি যখন কাদায় পড়ে তখন ব্যাঙও লাথি মারে।'

'তুমি এখন ট্যাকখালির জমিদার। মুখে শুধু কথার খই ফুটছে।' কাপে চা ঢেলে একটা সুজির বিস্কুট আর-একটা প্লেটে রেখে মিলনকে দিল চা-ওয়ালা।

একটু অস্বস্তি হল মিলনের। সেটা কাটাতে না পেরে বলল, 'ওঁকে চা দিন। আমার সঙ্গে দামটা জুড়ে দেবেন।'

'কপাল করেছিলে!' বলে চা-ওয়ালা আবার চা বানাতে লাগল।

'বাবু দেখছি জীবনে অনেক দুঃখ পাবেন।' লোকটা মিলনের দিকে তাকিয়ে বলল।

'কী করে বুঝলেন?' চায়ে চুমুক দিল মিলন।

"আপনার মন নরম।' নইলে আমার জন্যে চা বলতেন না। হাসল লোকটা, 'আগে তো দেখিনি। এদিকে নতুন আসা হল?'

'হ্যাঁ। ছোট ট্রেন ধরে বিন্দু যাব।'

'সর্বনাশ!' শব্দটা যেন ছিটকে বেরিয়ে এল লোকটার মুখ থেকে।

'কেন?'

'তার আগে বলুন, কেন সেখানে যেতে হচ্ছে?'

'বিন্দু থেকে ভটভটি নৌকায় চেপে একটা দ্বীপে যেতে হবে, সেখানে চাকরি পেয়েছি।'

মিলন বলল।

'যাক। তাহলে বিন্দুতে থাকবেন না। বেঁচে গেলেন।'

'কেন ভয় দেখাচ্ছ? কী জান সেটা বলে দিলেই পার।' চা-ওয়ালা চা দিয়ে বলল, 'শুধু নাটক করে কী লাভ!'

চায়ের কাপ ধরে লোকটা বলল, 'বিন্দুর যে-কোনও বাচ্চা কথা বলতে শেখার সময় শিখে ফেলে কী করে মিথ্যে কথা সত্যির মতো বলতে হয়। একটাও মানুষ পাবেন না, যে সত্যি কথা বলে। ছেলেগুলো অলস, মেয়েরাই কাজ করে। ফলে তারা যা খুশি করলে ছেলেরা মেনে নিতে বাধ্য হয়। তা দ্বীপের নাম কী?'

'দারুচিনি।'

'নাম শুনিনি, যাইনি তো কোনওদিন। আপনি ওখানে থাকবেন, যদি সুযোগ পাই ঘুরে আসব।'

লোকটা চা খেতে লাগল।

ছোট ট্রেন প্রবলবিক্রমে ছুটলেও আধঘণ্টা অন্তর থেমে যেতে বাধ্য হচ্ছে স্টেশনের জন্যে। মিলন লক্ষ করছিল যত এগোচ্ছে তত যাত্রী কমে যাচ্ছে কামরার।

বিন্দু স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে এদিক-ওদিক দেখল মিলন। ছোট্ট স্টেশন। বলা হয়েছে, স্টেশন মাস্টারের ঘরের সামনে তার নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে লোকটা দাঁড়িয়ে থাকবে। সেই লোক বাজার-হাট করে তাকে তুলে দেবে ভটভটিতে। স্টেশন মাস্টারের ঘরের সামনে কেউ নেই। অথচ অফিস থেকে তাকে এরকম কথাই বলা হয়েছিল। একটু ইতস্তত করে বাইরে বেরুবার জন্যে ওখানে গিয়ে মিলন দেখল, গেটে কোনও টিকিট চেকার নেই।

স্টেশনের বাইরেটা যে-কোনও গ্রামের মতো। তাকে সাহায্য করার জন্যে যাঁর আসার কথা তিনি আসেননি। একটু আগে মিলন গুনেছিল বিন্দুর লোকজন সত্যি কথা বলে না। কিন্তু কথার খেলাপও যে করে তা লোকটা বলেনি।

এই সময় একটা সাইকেল তীব্র গতিতে বাঁ-দিক থেকে এগিয়ে এসে বেশ শব্দ করে ব্রেক কষে থেমে গেল। সাইকেল থেকে নেমে ওটাকে সঙ্গে নিয়ে যে মেয়েটি স্টেশনের ভেতরে ঢুকে গেল তার বয়স বড়জোর বাইশ কি তেইশ। মিলন একটু কৌতুহলী হয়ে পেছনে ফিরল। শূন্য প্ল্যাটফর্মে কাউকে না পেয়ে মেয়েটা সাইকেল নিয়ে এগিয়ে এল গেটের দিকে। মিলনকে দেখে দাঁড়াল সে, 'ট্রেন এখনও আসেনি?'

'এসে চলে গেছে।' মিলন জানাল।

'বাঃ। ভালোই হয়েছে। লোকটা নিশ্চয় আসেনি, এলে এখানেই দেখতে পেতাম। বিন্দুর জল যার পেটে পড়েনি তার মুখ দেখলেই আমি বুঝতে পারি। ভালো হজম হয় না তো, তাই পেটের রোগে ভোগে বাইরের লোকগুলো। যাকগে, মিছিমিছি কথা বলে সময় নষ্ট করছি! চলি।' সাইকেলে উঠে বসল মেয়েটি।

'কিছু মনে করবেন না। আপনার নাম জানতে পারি?'

'অনামিকা। আর কিছু?'

'আপনার বাবার নাম?'

'আশ্চর্য। কার সঙ্গে দরকার? বাবার সঙ্গে না আমার সঙ্গে?'

'আমাকে বলা হয়েছিল একজন লোক আমাকে এই স্টেশনে রিসিভ করে দারুচিনি দ্বীপে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু তিনি আসেননি।'

'অ। তা আসবে কী করে? ঘুমাচ্ছে যে।'

'ঘুমাচ্ছে মানে? এসময় কেউ ঘুমায়? তা ছাড়া ওঁকে যে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা না করে ঘুমিয়ে পড়লেন?'

'ঘুমের ওপর কারও জোর চলে না। ঘুম হল অর্ধেক মৃত্যু। কথা বাড়াবেন না। আমার পাইকেলের পেছনে উঠে বসুন।'

'আপনার সাইকেলের ক্যারিয়ারে আমি উঠব কেন?'

'ঘাটে যাবেন বলে।'

অগত্যা মিলন সাইকেলের ক্যারিয়ারে উঠে বসল। মেয়েটি পাঁইপাই করে সাইকেল চালাচ্ছে, পাশের লোকজন যে বিন্দুমাত্র কৌতূহলী নয় ওর ব্যাপারে, তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। হঠাৎ সাইকেল থামিয়ে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, 'পকেটে টাকা আছে?'

'কেন?'

'বাজার করে না নিয়ে গেলে দ্বীপের হাওয়া খেয়ে থাকতে হবে। শাকপাতা ছাড়া কিছু জুটবে না সেখানে।'

'অফিস থেকে বলেছিল যে আমাকে ভটভটিতে তুলে দেবে, সে-ই বাজার করে আনবে। ওই লোকটার ঘুম ভাঙলেই কথাটা জানতে পারবেন।'

'এখন ঘুম ভাঙবে না। ভাঙতে-ভাঙতে সূর্য ডুবে যাবে। তখন আবার নতুন করে ঘুমোবার

জন্যে বোতল উপুড় করবে মুখের ওপর।" 'সর্বনাশ। এরকম মাতালকে দায়িত্ব দিলে অফিস লাটে উঠবে।'

'অ্যাই খবরদার! ওকে তুমি মাতাল বলবে না। চেন না, জান না, কোনওদিন চোখে দ্যাখোনি, সে তোমার কাছে মাতাল হয়ে গেল? যাকগে, বাজার করবে তো করো। আমার আর বেগার খাটার সময় নেই।'

মিলন বাজারে ঢুকল। প্রথমে চালের দোকানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'কত করে।' দোকানদার বলল, 'যা দেবেন।'

'মানে?' হকচকিয়ে গেল মিলন। খদ্দেরের ইচ্ছে অনুযায়ী দাম ঠিক হয় নাকি কোথাও? সে বেশ জোরের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, 'আপনি কত দামে বিক্রি করছেন?'

কয়েকপ্রস্থ দরাদরির পরে সে চাল কিনল। সেইসঙ্গে এক সপ্তাহের জন্য যা-যা লাগে সবকিছু। অফিস থেকে বলে দেওয়া হয়েছে দারুচিনি দ্বীপে কিছুই পাওয়া যায় না। মুটের মাথায় বস্তা চাপিয়ে

সে যখন সাইকেলের কাছে এল, তখন মেয়েটি সেখানে নেই। সে অবাক হয়ে দ্বিতীয়জনের দিকে তাকালে লোকটা একগাল হেসে বসল, 'ও সত্যি কথা

একটা লোক বলল, 'ওই সাইকেলে বস্তা বসিয়ে আপনাকে চলে যেতে বলেছে। যান, যান।'

বলছে।'

চট করে মনে পড়ে গেল। বিন্দুর প্রতিটি মানুষ শৈশব থেকে মিথ্যে কথা সত্যির মতো বলতে শেখে। তাহলে ওই দুজনই মিথ্যে বলছে। প্রয়োজনে মিথ্যে যারা বলে তাদের বোঝা যায়, অপ্রয়োজনে কেন বলছে বোধগম্য হয় না।

সে মুটেকে জিজ্ঞাসা করল, 'তুমি নদীর ঘাট পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে?'

মালের ভারে ঝুঁকে দাঁড়ানো মুটে বলল, 'ও বাবা। পারব না।' 'একটু কষ্ট কর না ভাই, টাকা বাড়িয়ে দেব।' মিলন বলল।

'কত বাড়াবেন? এখান থেকে দশ মাইল হাঁটতে হবে। অসম্ভব।' 'দশ মাইল?' অবাক হল মিলন। লোকটা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। এই বোঝা নিয়ে কেউ

দশ মাইল হাঁটতে পারে না। স্বীকার করে নিল মিলন। 'ঠিক আছে। আমি একটা ভ্যানরিকশা ভাড়া করে নিয়ে যাচ্ছি, তার ভাড়া আপনাকে দিতে

হবে। এই ধরুন, আরও একশো টাকা।' মুটে বলল।

'অসম্ভব। অত টাকা আমি দিতে পারব না।'

তাহলে ভাড়া মিটিয়ে আমাকে ছেড়ে দিন বাবু।'

' লোকটা এমন নাছোড়বান্দা যে পুরো ভাড়া না নিয়ে বিদায় হবে না।

জিনিসপত্রগুলো নিয়ে অসহায় হয়ে যখন মিলন দাঁড়িয়ে, তখন একটি প্রৌঢ় এগিয়ে এলেন, 'কোথায়

যাওয়া হচ্ছে বাবা?'

'নদীতে গিয়ে ভটভটি ধরব। যাব দারুচিনি দ্বীপে।'

'হায় কপাল। আজ তো তোমার যাওয়া হবে না।'

'কেন?'

'এখন তো সন্ধে হয়ে এসেছে। নৌকো পাবে না।'

'সন্ধে? কী বলছেন? চারধারে কড়া রোদ আর আপনি বলছেন সন্ধে হয়ে এসেছে?' প্রতিবাদ করল মিলন।

'এখন গরমকাল বলে তুমি রোদ দেখছ, শীতকাল হলে একটু পরে সন্ধ্যাতারা দেখতে আকাশে।' প্রৌঢ় হাসল, 'তারপর যাওয়া কি সোজা কথা! যেতে আসতে মাঝরাত। ওই ভয়ঙ্কর ঢেউ-এ কোনও নৌকো রাত্রে যাবে না।'

'তাহলে উপায় কী?' মিলন বিড়বিড় করল।

'রাতটা বিন্দুতেই কাটিয়ে যাও। তবে একটু সাবধানে থাকতে হবে তোমাকে।'

'কেন?'

'দিনকাল তো ভালো নয়।'

'এখানে হোটেল আছে?'

লোকটি শব্দ করে হেসে বলল, 'পাগল। তবে সত্যি যদি সুস্থভাবে রাত কাটাতে চাও তাহলে আমার বাড়িতে যেতে পার। তুমি তো একদম অচেনা নও।'

অবাক হল মিলন, 'আপনি আমাকে চেনেন?'

'তুমি যার সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে এখানে এলে তাকে তো চিনি। সে তো যাকে-তাকে সাইকেলে বসাবে না। সে যাকে বাবা বলে তাকেও চিনি।'

'হ্যাঁ, ওই ভদ্রলোকই আমাকে সমস্যায় ফেলেছেন। উনি যে সকাল থেকে মদ খেয়ে পড়ে থাকেন তা বোধহয় আমার অফিস জানত না।' মিলন বলল।

'মদ? কী যা তা বলছ? সে কখনও মদ স্পর্শ করেনি। একটা মানুষের নামে অযথা দুর্নাম

দিচ্ছ কেন হে।' লোকটি খেঁকিয়ে উঠল। ঠিক তখনই মেয়েটি ফিরে এসে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করল, 'বাজার হয়েছে?' তারপর

জিনিসপত্র দেখে মাথা নাড়ল, 'বাঃ। বেশ সংসারি দেখছি।' বলে হাত নেড়ে কাউকে ডাকল। মিলন অবাক হয়ে দেখল, যে মুটে তাকে জিনিসপত্রসমেত এখানে দাঁড় করিয়ে পুরো ভাড়া নিয়ে গিয়েছিল সে অম্লানবদনে এগিয়ে এসে বলল, 'কোথায় নিয়া যাব দিদি?'

'নদীর ঘাটে। নৌকায় তুলে দেবে।' মিলন বলল, 'এক মিনিট। ইনি বলছিলেন এখন নাকি নৌকো ছাড়বে না।'

'তা জানি না।' মেয়েটি বলল।

'তা ছাড়া নদী নাকি ওখান থেকে দশমাইল দূরে।'

'একথা কে বলেছে আপনাকে?'

'এই মুটেই বলছিল।'

'বেশ তো। গিয়েই দেখা যাক।'

মেয়েটি সাইকেল চালিয়ে আগে-আগে চলে গেল। মুটের পেছনে মিলন। এই মুটেটাকে নিশ্চয়ই ভাড়া দিতে হবে। মেয়েটি আসার পরেই প্রৌঢ় সরে গিয়েছিল। এখানকার সবাই যে মিথ্যেবাদী তা বুঝতে আর অসুবিধে হচ্ছে না। নইলে বিকেল না হতেই বলে, সন্ধে হয়ে আসছে। মিনিট দশেক হাঁটার পর নদী দেখতে পেল মিলন। বেশ চওড়া নদী। সে মুটেকে জিজ্ঞাসা

করল, 'তুমি যে তখন বললে দশমাইল রাস্তা?'

'আমি বলেছি?' মালপত্র নামিয়ে মুটে পালটা প্রশ্ন করল। 'আশ্চর্য।' মিলন হাঁ হয়ে গেল।

'আপনি ভুল শুনেছেন। আমি বলেছিলাম দশ মিনিটের পথ।'

'তুমি মিথ্যেকথা বলছ।'

'না বাবু। আমি সত্যিকথা বলছি।'

হাল ছেড়ে দিল মিলন। নদীর ধারে ছোট-বড় নৌকো, লঞ্চ দাঁড়িয়ে। কিছু যাত্রী তাদের ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। মেয়েটি ঘুরে এসে বলল, 'তাহলে আপনি আজ দারুচিনি দ্বীপে যাবেনই?'

'সেরকম কথাই আছে।'

'পৌঁছতে কত রাত হবে বলতে পারছি না। নিশ্চয়ই সমস্যায় পড়বেন না?'

'না গেলে বলব কী করে। শুনেছি, আমাকেই সব বুঝে নিতে হবে।'

বের 'বেশ। দেখি, আপনি কী করে বুঝতে পারেন। কোন নৌকো দারুচিনি দ্বীপে যাচ্ছে তা খুঁজে করুন তো!' মেয়েটি এই প্রথম হাসল।

মিলন তাকাল। তারপর এগিয়ে গিয়ে প্রথম নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞাসা করল, 'আপনি কি দারুচিনি দ্বীপে যাচ্ছেন?'

লোকটা চোখ বড় করল, 'বাপরে! সেখানে এখন বিশাল-বিশাল হাঙর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদিকে এগোনোই মুশকিল।'

পরের নৌকোর মাঝি কোনও কথা না বলে মাথা নেড়ে না বলে দিল। মিলন প্রত্যেকটি নৌকো থেকে একই জবাব পেয়ে ফিরে এসে মেয়েটিকে বলল, 'কী আশ্চর্য। এদের কেউ দারুচিনিতে

যাচ্ছে না।'

'তাহলে আপনি কী করে যাবেন?' মেয়েটি হাসল।

'আপনি বলুন। আমি তো এখানকার কিছু জানি না।'

'আমি কেন আপনাকে পরামর্শ দেব?' মেয়েটি আবার হাসল।

'যেহেতু এখানে একমাত্র আপনিই আমার ভরসা। আপনার মতো সুন্দরী মহিলা নিজের কাজ ফেলে এতটা সময় আমাকে দিচ্ছেন যখন, তখন এটুকু আবদার করতেই পারি।' 'আবদার?' মেয়েটি বেশ জোরে হাসল, 'বেশ মন রেখে কথা বলতে পারেন তো। ঠিক

আছে প্রথম নৌকায় উঠে বসুন।'

'প্রথম নৌকা? ওর মাঝি বলল দারুচিনিতে যাবে না।'

'কী বলেছে ঠিকঠাক ভেবে দেখুন।'

মিলন মনে করল। লোকটা বলেছে ওখানে বিশাল-বিশাল হাত্তর ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু একবারও বলেনি সে ওখানে যাবে না। ওর ভয় দেখে মিলন ধরে নিয়েছিল সেকথা। উঃ, চারপাশের লোকজন যদি এত মিথ্যে বলে তাহলে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তো মুশকিল।

প্রথম নৌকায় উঠল মিলন। মুটে মালপত্র তুলে দিলে সে জিজ্ঞাসা করল, 'কত দিতে হবে?' মুটে আকাশের দিকে তাকাল, 'আমি এখন মাটিতে নেই, জলের ওপর নৌকায় আছি। তাই আপনার যা ইচ্ছে তাই দিন।'

অর্থাৎ জলের ওপর দাঁড়িয়ে লোকটা মিথ্যে বলবে না। দশটা টাকা দিতে লোকটা নিরাসক্ত মুখে নেমে গেল। একটু-একটু করে জনাদশেক লোক হল। মিলন লক্ষ করছিল, মাঝিরা একবারও হেঁকে বলছে না কোথায় নৌকো যাচ্ছে। সে পাশের লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল, 'আপনি কোথায় যাচ্ছেন?'

'কুমিরডাঙা।'

মিলনের মনে পড়ল, এরা কেউ সত্যি কথা বলে না।

সে দেখল মেয়েটি তখনও দাঁড়িয়ে আছে ঘাটে। চেঁচিয়ে বলল, 'অনেক ধন্যবাদ।'

'হাঙরের পেটে গেলাম কিনা জানবেন কী করে?' 'নৌকা ফিরে এলে জেনে যাব।' মেয়েটি হাসল।

ইঞ্জিন চালু হল। এখন রোদ নেই, ছায়া ঘন হয়েছে। নৌকা পাড় ছাড়ল। দেখতে-দেখতে বেশ টপকে যাচ্ছে নৌকাটা, মোট ছয়জন মাঝি আছে নৌকাতে। কোনাকুনি গিয়ে উলটো দিকের। পাড়ের কাছাকাছি চলে এল নৌকা। কিছুটা যেতেই একটা ঘাট। কয়েকজন যাত্রী নেমে গেল সেখানে। দুজন উঠল। মিলন জিজ্ঞাসা করে জানল, ঘাটের নাম ভাঙা কপাল। এরকম নাম কোনও জায়গার হয়? মিলনের বিশ্বাস, লোকটা মিথ্যে কথা বলেছে।

আরও আধঘন্টা চলার পর যে ঘাটে নৌকা ভিড়ল সেখানে হারিকেন জ্বলছে। পাশের লোকটা নেমে যাচ্ছিল। মিলন তাকে জিজ্ঞাসা করল, 'এটা কি কুমিরডাঙা?'

লোকটা মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' বলে নেমে গেল।

এই সময় চাঁদ উঠল। ধীরে-ধীরে আলো ছড়াল। নৌকা তখনও ঘাট ছেড়ে যাচ্ছে না। মাঝিরা নেমে গেছে ঘাটে। উসখুস করছিল মিলন। চাঁদ আর-একটু ওপরে উঠলে চারপাশ চনমনে জ্যোৎস্নায় উজ্জ্বল হলে মাঝিরা ফিরে এল। ওদের কথাবার্তা কানে এল মিলনের। একজন বলল, 'এই রাত্রে আর না এগিয়ে ফিরে যাওয়াই ভালো।'

'ভাটার টান চলছে। সোজা টেনে নিয়ে সমুদ্রে ফেলবে। ফিরেই চল।'

নৌকো ছাড়ল। বাতাসে ওদের কথা ডুবে যাওয়ায় আর কিছু শুনতে পেল না মিলন। কিন্তু ওরা এখন বিন্দুতে নিয়ে যাবে নাকি? সে চিৎকার করল, কিন্তু মাঝিদের কানে আওয়াজ পৌঁছল না।

নৌকো খুব দুলছে। নিজের জায়গা ছেড়ে ওদের কাছে উঠে যেতে সাহস পাচ্ছিল না মিলন। ওরা যদি ফিরে যায় তাহলে সে কিছুই করতে পারবে না। বিন্দু যে একটা ভয়ঙ্কর জায়গা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ওখানে কোথায় রাত কাটাবে সে?

জলের দিকে তাকাল। আকাশ থেকে যেন রূপের স্রোত নেমেছে জলে। ক্রমশ ডাঙা মিলিয়ে গেল। এখন আর কূল দেখা যাচ্ছে না। আকাশে তাকাল সে। চাঁদের লাবণ্যে যেন বান ডেকেছে। আকাশ জুড়ে এখন এত তারা যে আকাশটাকেই ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। শহরের আকাশে ওইসব তারাদের দেখা যায় না। একটা মাঝি এগিয়ে এল, 'সামনে সমুদ্র, বাবু শক্ত করে ধরে বসুন।'

'সমুদ্র?' অবাক হয়ে তাকাল মিলন।

'হ্যাঁ। এখন ঢেউ নৌকো নিয়ে খেলবে।'

'তোমরা বিন্দুতে ফিরে যাচ্ছ না?'

'যাওয়াই উচিত ছিল। রাতে নৌকা চালানোর নিয়ম নেই। কিন্তু কাল পূর্ণিমা বলে আজ নদী দিনের মতো পরিষ্কার। দেখতে পাচ্ছি বলে চলছি। তা ছাড়া আপনি দারুচিনিতে যাবেন বলে নৌকায় উঠেছেন। একজন নৌকায় থাকলে তাকে পৌঁছে দেওয়া আমাদের কর্তব্য।' একটা দড়ি ছুড়ে দিল লোকটা, 'এইটে ভালো করে কোমরে জড়িয়ে নৌকার সঙ্গে বেঁধে ফেলুন বাবু।'

মাঝি নিজের জায়গায় ফিরে গেলে দুটো কারণে মিলন খুশি হল। প্রথমত, লোকগুলো কর্তব্যনিষ্ঠ। যাত্রী একজন হলেও তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। দ্বিতীয়ত, যাত্রীর নিরাপত্তার ব্যাপারটা খেয়াল রাখে। মিলন শুনেছে প্লেনের সিটে বসলে কোমরে বেল্ট বাঁধতে হয়। দড়িটাকে কোমরে জড়িয়ে নৌকার সঙ্গে ভালো করে বেঁধে নিল মিলন। পরক্ষণেই মনে হল, নৌকা যদি ডুবে যায় তাহলে তাকেও ডুবতে হবে, সাঁতরে ভেসে থাকার সুযোগ পাবে না।

ক্রমশ ঢেউ বড় হচ্ছে। নৌকা বাঁ-দিকে ডান দিকে হচ্ছে। তারপর সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হল। ঢেউগুলো খ্যাপা ষাঁড়ের মতো গুঁতোতে লাগল নৌকাকে, জল থেকে ওপরে ছুঁড়ে দিচ্ছিল প্রায়ই। নামার সময় মনে হচ্ছিল সোজা জলের নীচে চলে যাবে। যেতে যেতেও আবার ভেসে উঠছিল নৌকা। কিন্তু তার মধ্যে ছিটকে ওঠা জলে ভরে যাচ্ছিল নৌকা। এসব সামলে একটা মাঝি ক্রমাগত জল তুলে ফেলছিল নৌকা থেকে। বমি হয়ে গেল মিলনের। পেটে ব্যথা শুরু হল। সে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। সুটকেস যে ছিটকে গেছে নৌকার অন্যদিকে, তা দেখার মতো হুঁশ ছিল না।

তারপর নৌকাটা স্থির হল। চোখ খুলল মিলন। চাঁদ যেন নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। মুখ ফেরাতেই স্থলভূমি চোখের সামনে ভেসে উঠল। গাছগাছালি দেখা যাচ্ছে। পেছনে তাকাতে সেই ভয়ঙ্কর ঢেউগুলোকে দেখতে পেল। নৌকা এখন পাড়ের দিকে এগোচ্ছে।

মাঝি চেঁচিয়ে বলল, 'বাবু। আপনার দারুচিনি এসে গেছে।'

কোমর থেকে দড়ি খোলার কথা খেয়াল ছিল না, উঠে দাঁড়াতে যেতে টান পড়তে হুঁশ ফিরল। দড়ি খুলে উঠে দাঁড়াতেই একটা মানুষকে দেখতে পেল সে। লাঠি হাতে একটু কুঁজো হয় দাঁড়িয়ে আছে। এত দূর থেকে তাকে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝিরা চিৎকার করতে লাগল তাকে দেখে, 'দাদু, এসে গেছি।'

তীর অবধি গেল না নৌকো। সুটকেস কুড়িয়ে নিয়ে মিলন জিজ্ঞাসা করল, 'কত ভাড়া দিতে হবে?'

'বিশ টাকা।' মিলনের বাজারভরতি থলেটা নামিয়ে দিল সে।

বিনা বাক্যব্যয়ে টাকাটা দিয়ে নৌকো থেকে জলে নামল সে। হাঁটু পর্যন্ত জল ভেঙে সে

বালিতে উঠতেই বৃদ্ধ বললেন, 'আসুন ভাই। এখন থেকে এই জায়গার দেখাশোনার ভার আপনার

ওপর। চেষ্টা করবেন এদের যত্নে রাখতে।'

'আপনি?' জিজ্ঞাসা করল মিলন।

'তিরিশ বছর বয়সে এসেছিলাম। চল্লিশ বছর ধরে এই জল, গাছ, পাহাড়ের সঙ্গে মিলেমিশে ছিলাম। এখন শরীর অশক্ত, তাই ছুটি চেয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত মালিকের ছেলে মালিক হয়ে আমাকে ছুটি দিয়েছেন। জানিয়েছিলেন আজ বদলি লোক আসবে। এলে আমার ছুটি হবে।' বৃদ্ধ হাসলেন।

একজন মাঝি বলল, 'তাই তো আমরা এলাম। রাত হয়েছিল, ঢেউ বাড়ছিল, তবু আপনাকে নিয়ে যেতে না এসে পারলাম না। এতদিন পরে আপনি এই দারুচিনি ছেড়ে যাবেন, আমরা না এলে আপনার কষ্ট হত।' +

মিলনকে বললেন, 'আচ্ছা ভাই, এদের আর দেরি করাব না!'

বৃদ্ধ মাঝি বলল, 'আমরা বুঝে গিয়েছিলাম ইনি আপনার জায়গায় আসছেন। আচ্ছা বাবু, মাঝে- মাঝেই আপনার সঙ্গে দেখা হবে।'

বৃদ্ধ জলে নামতে যাচ্ছিলেন নৌকায় উঠবেন বলে। মিলন পেছন থেকে বলল, 'যাওয়ার সময় আমাকে কোনও উপদেশ দিয়ে যাবেন না?'

হাসলেন বৃদ্ধ, 'একা থাকতে হবে। কিন্তু এই গাছগাছালি পাখিদের সঙ্গে কথা বলবেন। দেখবেন ওরা কথা বোঝে। চোখ-কান খোলা রাখবেন। কাউকে আঘাত করবেন না, তাহলে দেখবেন সবাই আপনাকে বন্ধু বলে ভাববে। চলি।'

নৌকার ইঞ্জিন চালু হল। দেখতে-দেখতে চোখের আড়ালে চলে গেল সেটা। আকাশে তাকাল মিলন। চাঁদ হাসছে।

এখন থেকে এই দ্বীপের দেখাশোনা তাকেই করতে হবে। সেটাই চাকরি। কিন্তু বৃদ্ধ বলে গেলেন না তিনি কোথায় থাকতেন! এতগুলো বছর নিশ্চয়ই কেউ খোলা আকাশের নীচে কাটাত না। অফিস থেকে বলা হয়েছে, সেসবের ব্যবস্থা আছে।

এম.এ. পাস করেও বেকার দশা চলছিল। দুটো টিউশনির টাকায় হাতখরচ চলে। বিভিন্ন অফিসে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্তের-পর-দরখাস্ত দিয়েও কোনও ডাক আসছিল না। সেই সময় কাগজে একটা ছোট্ট বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। 'পরিদর্শক চাই। অভিজ্ঞতার প্রয়োজন জরুরি নয়।' ফোন নাম্বার ছিল। ফোন করতেই বলা হল দেখা করতে।

এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এবং তার দুই ছেলে ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। বৃদ্ধই কথা বলছিলেন। এম.এ.-র সার্টিফিকেট দেখে বললেন, 'আপনি নিশ্চয়ই জানেন না আমরা কোন কাজের জন্যে লোক চাইছি।'

সে মাথা নেড়ে জানিয়েছিল, সে জানে না।

'এমন কাউকে চাইছি যে অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসে। তাকে থাকতে হবে একটি নির্জন দ্বীপের মতো জায়গায়। গাছপালা, পশুপাখিদের ভালোবাসতে হবে। সপ্তাহে একদিনের বেশি মানুষের সঙ্গ পাবে না।' বৃদ্ধ বলেছিলেন।

'কী কাজ করতে হবে?' সে জিজ্ঞাসা করেছিল।

ওই দ্বীপের তিরিশ একর জমির মালিকানা আমাদের। ধান বাদ দিয়ে বহুরকমের ফসল ওখানে

হয়। আছে বেশ কিছু মূল্যবান গাছ। এছাড়া মুরগি এবং হাঁস প্রতিপালিত হয়। প্রতি সপ্তাহে যে

নৌকা ওই দ্বীপে যায় তাতে যেমন দিনযাপনের প্রয়োজনীয় বস্তু পাঠানো হয় তেমনি দ্বীপ থেকে

পাওয়া ফসল, ডিম ইত্যাদি নিয়ে আসা হয়। একমাত্র বর্ষার সময় সমুদ্র-নদী উচ্ছল হলে নৌকা

বন্ধ থাকে। পরিদর্শকের কাজ এই সব ব্যাপার সুষ্ঠুভাবে দেখা। আর হ্যাঁ, কায়িক পরিশ্রমের জন্যে

একটি লোক ওখানে আছে। কিন্তু সে কথা বলতে পারে না। আপনি কি এইরকম নির্জনে চাকরি

করতে যেতে চাইবেন? এক মুহূর্ত চিন্তা করেছিল সে। গাছপালা সে ভালোবাসে। কিন্তু একদম একা থাকা কি সম্ভব? যে লোকটিকে সে পাবে সে তো কথাও বলতে পারে না। কতদূরে সেই দ্বীপ? প্রশ্নটা করতেই বৃদ্ধ বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে সেখানে পৌঁছাতে হবে। তখন সে জানতে পারল দ্বীপের নাম দারুচিনি। সঙ্গে-সঙ্গে অপূর্ব এক ভালোবাসায় আক্রান্ত হল সে। মাথা নেড়ে বলল, 'আমার আপত্তি নেই।' 'বেশ। একটাই শর্ত আছে, যদি আপনার মন না টেকে তাহলে অন্তত দু-মাসের নোটিশ

না দিয়ে চলে আসতে পারবেন না।'

'আমি রাজি।'

'আগেই বলেছি, আপনার জীবনধারণের যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস প্রতি সপ্তাহে নৌকো পৌঁছে দিয়ে আসবে। বর্ষার মুখে সেগুলো কয়েক মাসের জন্যে সঞ্চয় করে রাখতে হবে, এর জন্যে কোনও দাম আপনাকে দিতে হবে না। এছাড়া আপনাকে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হবে। ব্যাংকে যদি অ্যাকাউন্ট না থাকে তাহলে সেটা খুলে দিচ্ছি। প্রতি মাসের এক তারিখে সেই অ্যাকাউন্টে আপনার টাকা জমা পড়বে। আর কাজে যোগ দেওয়ার সময় আপনাকে যে টাকা রাহাখরচ বাবদ দেওয়া হবে তা বেতন থেকে কেটে নেওয়া হবে না।'

'এখন ওখানে কি কেউ নেই?'

'আছেন। দীর্ঘকাল উনি দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু বৃদ্ধ হওয়ার পরে তাঁর শরীর অশক্ত হয়ে পড়েছে বলে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। আপনি দ্বীপে পৌঁছলে তিনি ফিরে আসবেন।' তারপর সাতদিন কেটেছিল। এই চাকরি নিয়ে রওনা হয়েছিল মিলন। একবছর ওখানে থাকলেই ব্যাংকে ষাট হাজার টাকা জমে যাবে। খুশি হয়েছিল সে।

নৌকাটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। বৃদ্ধের সঙ্গে ভালো করে কথা বলা গেল না। গেলে জেনে নিতে পারত এখানকার সুবিধে-অসুবিধেগুলো। কিন্তু এত বছর থাকার পর বৃদ্ধ চলে গেলেন, অথচ সেই বোবা লোকটি তাকে বিদায় জানাতে এল না কেন? এই বোবা লোকটি কে, কোথায় বাড়ি, এখানে কতদিন আছে, তার কিছুই অফিস থেকে জানায়নি তাকে।

এই সময় হাওয়া উঠল। সমুদ্রের বুক থেকে শোঁশোঁ শব্দে সেই হাওয়ারা ছুটে এসে গাছগাছালিকে প্রবলভাবে নাড়াতে লাগল। এই সুটকেস, বাজারভরতি ব্যাগ সামলে কোনদিকে যাবে বলে মিলন যখন দ্বিধায়, তখন সেই লোকটিকে দেখতে পেল। লোকটি একা নয়, তার পাশে চার হাত-পায়ে দৌড়ে আসছে একটা বিশাল সাইজের হনুমান। সামনে এসে লোকটা নীচু হয়ে মাথায় হাত ঠেকাল। মিলন অবাক হয়ে দেখল, হনুমানটা লোকটাকে নকল করল। তারপর বোঝাটা পিঠেয় তুলে সুটকেস ডানহাতে নিয়ে লোকটা হাঁটা শুরু করল।

ওকে অনুসরণ করে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খানিকটা হাঁটার পরে একটা ঘর দেখতে পেল মিলন। ঘরের পাশেই চারটে লম্বা খুঁটির ওপরে আর একটা ঘর। মাটি থেকে অন্তত তিরিশ ফুট উঁচু নিশ্চয়ই হবে। সেই ঘরে পৌঁছবার জন্যে বাঁশের সিঁড়ি খুঁটির সঙ্গে জোড়া রয়েছে।

বাজারের ব্যাগটা নীচের ঘরে নিয়ে গেল লোকটা। তারপর সুটকেস নিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। হনুমানটাও লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি ভাঙল।

নীচের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মিলন দেখল, ভেতরে একটা লম্ফ জ্বলছে। তার আলোয় বুঝতে পারল এখানেই বৃদ্ধ রান্নাবান্না করতেন। কাঠের উনুন, বাসনপত্র, বালতিতে জল ভরা আছে। এই জল নিশ্চয়ই সমুদ্র থেকে নিয়ে আসা হয়নি। এখানে খাওয়ার জলের ব্যবস্থাটা কী জানা দরকার। কিন্তু লোকটাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। ওই হনুমানটার মতোই ও কথা বলতে পারে না। দুটো বড় হাঁড়ির ওপর খালা চাপা ছিল। ও দুটোর ভেতরে কী আছে দেখার জন্যে থালা

সরাতেই একটায় ভাত অন্যটায় মাছের ঝোল দেখতে পেল মিলন। মাছের সঙ্গে কয়েকটা ডিমও আছে। দরজায় শব্দ হতে মুখ ফিরিয়ে বোবা লোকটাকে দেখতে পেল। পরনে একটা খাকি হাফপ্যান্ট ছাড়া কিছু নেই। বয়স চল্লিশের ওপরেই। লোকটা হাত মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে ইশারায় জানতে চাইল, মিলন খাবে কিনা? মিলন মাথা নাড়তেই ঘরে ঢুকে বালতি থেকে এক মগ জল তুলে এগিয়ে দিল। মিলন অনুমান করল লোকটা জল দিচ্ছে হাতমুখ ধোওয়ার জন্যে।

ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে অন্যমনস্ক হয়ে মিলন জিজ্ঞাসা করল, 'এই জল কোথেকে নিয়ে আস? এখানে টিউবওয়েল আছে?'

লোকটা হাত নেড়ে দূরের একটা কিছু দেখাতে লাগল। কিন্তু সেখানে টিউবওয়েল আছে কিনা বুঝতে পারল না মিলন। তবে এই জল বেশ ঠান্ডা এবং মিষ্টি। এবার লোকটা তাকে ইশারায় ওপরে উঠে যেতে বলল। সিঁড়িতে বসে হনুমানটা তাকে লক্ষ করছিল। মিলনকে এগোতে দেখে নেমে পড়ল।

সিঁড়ি বেয়ে ধীরে-ধীরে ওপরে উঠে অবাক হয়ে গেল মিলন। ঘরটা ছোট্ট কিন্তু পরিষ্কার। দুদিকে দুটো জানলা রয়েছে। একপাশে পরিষ্কার বিছানা পাতা, অন্যপাশে একটা জলচৌকি। কোনও চেয়ার-টেবিল নেই। সুটকেসটাকে সে দেখতে পেল জলচৌকির পাশে। এই টঙের ওপর বৃদ্ধ থাকতেন? ওই শরীর নিয়ে এত ওপরে উঠতে পারতেন?

সে জানলার সামনে যেতেই বহুদূর পর্যন্ত দ্বীপটাকে দেখতে পেল। গাছগাছালির পর মাঠমতো জায়গা। তার পরে ছোটখাটো পাহাড়। শব্দ কানে আসতেই মিলন পেছন ফিরে তাকাল। লোকটি থালাভরতি ভাত আর বড় বাটিভরতি মাছ এবং ডিমের ঝোল নিয়ে ঘরে ঢুকে জলচৌকির ওপর রাখল। হেসে ফেলল মিলন। একেই বোধহয় বলে বেড়াল ডিঙোতে না পারা ভাত। সে বলল, 'অত ভাত আমি খেতে পারব না। এটাকে অর্ধেক করে দাও।'

লোকটি অবাক হল। হাত নেড়ে বোঝাতে চাইল, এটা এমন কিছু বেশি নয়। তারপর নীচে নেমে গেল। মিলন দেখল হনুমানটা তাকে পিটপিট চোখে দেখছে। সে হেসে জিজ্ঞাসা করল, 'এই,

তোর নাম কী?' হনুমানটা যেন লজ্জা পেল। একপাশে অদৃশ্য হল সে।

এবার লোকটা আর-একটা হাঁড়ি আর-এক মগ জল নিয়ে ওপরে উঠে এল। মিলন জলচৌকির সামনে বসে অনেকটা ভাত হাঁড়িতে তুলে দিয়ে নিজের পাতে মাছ ডিমের ঝোল ঢেলে নিয়ে বলল, 'আর কিছু লাগবে না আমার। তুমি যেতে পার।'

জিনিসগুলো নিয়ে লোকটা নেমে গেলে ভাতে হাত দিল মিলন। ঝোলভাত মুখে দিয়ে অবাক হয়ে গেল সে। এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় এমন চমৎকার রান্না যে কেউ করতে পারে তা সে আন্দাজই করেনি। নিশ্চয়ই বৃদ্ধ এই রান্না তার জন্যে রেখে গিয়েছেন। একা থাকতে-থাকতে উনি অনেক কিছু শিখে ফেলেছিলেন নিশ্চয়ই। পেট ভরতি হয়ে গিয়েছিল। মগ থেকে জল খেয়ে বাকিটায় হাত-মুখ ধুয়ে নিল জানলার

বাইরে মাথা গলিয়ে। তারপর খালা এবং মগ দরজার পাশে রেখে খেয়াল হল মগে এখনও জল রয়েছে। রাত্রে যদি প্রয়োজন হয় তাই সে মগটাকে তুলে চৌকির ওপর রেখে সুটকেস খুলে একটা বারমুডা বের করে পোশাক পালটে নিল। এখানে আর প্যান্ট-শার্টের দরকার নেই। বারমুডা আর গেঞ্জিতেই বেশি সহজ হয়ে থাকা যাবে।

চটপট।

পরিশ্রান্ত ছিল সে। শুয়ে পড়তেই আরাম হল। জানলা দিয়ে বাতাস ঢুকছে প্রচুর। ঘুম এল

ঘুম ভাঙল আচমকা। ভাঙতেই কান্নাটা শুনতে পেল সে। কাছাকাছি কেউ অদ্ভুত নরম গলায় কাঁদছে। সারা শরীরের রোমকূপগুলো রোমাঞ্চিত হল মিলনের। ওটা যে-কোনও প্রাণীর কান্না তো বুঝতে একটু সময় লাগল। এই আওয়াজেই তার ঘুম ভেঙে ছিল।

সে বিছানা থেকে উঠে জানলায় এল। জ্যোৎস্নায় চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। গাছের পাতাগুলোও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোনও প্রাণীকে চোখে পড়ল না। কান্না যেদিক থেকে ভেসে আসছিল, সেদিকে ভালো করে লক্ষ করলেও জঙ্গলের আড়াল থাকায় সে কিছুই দেখতে পেল না। কিন্তু এই কান্নাটা এমন যে গা-ছমছম করে ওঠে।

এই সময় অনেক দূর থেকে একটা চিৎকার ভেসে এল। সঙ্গে-সঙ্গে কাঁদতে থাকা প্রাণীটির সুর বদলে গেল। বেশ উত্তেজনার সঙ্গে অভিমান মিশিয়ে সে জানান দিতে থাকল তার অস্তিত্ব। দূর থেকে ক্রমশ কাছে চলে এল দ্বিতীয় প্রাণীর আওয়াজ। তারপর চুপচাপ হয়ে গেল চরাচর। শেয়াল নয়, মিলনের মনে হল ওরা নেকড়ে জাতীয় প্রাণী। তাহলে এই দ্বীপে হিংস্র কিছু প্রাণী আছে? তিরিশ একর জমির বাইরে দ্বীপের যে অংশে, তা কতখানি তা সে জানে না। দ্বীপের বিপরীত প্রান্তে সমুদ্র আছে না দীর্ঘ হয়ে কোনও ভূখণ্ডে মিশে গেছে সেটা জানতে হবে। একটা রাতজাগা পাখি বীভৎস চিৎকার করতে-করতে উড়ে গেল। পাখিটার আকৃতি বাজপাখির চেয়ে বড়। মিলনের মনে হল জায়গাটা একেবারে নিরামিষ নয়। বেশ বৈচিত্র্য এখানে ছড়িয়ে আছে। সে আবার রূপসী জঙ্গলের দিকে তাকাল। চারধার এখন শান্ত। কোথাও কোনও আওয়াজ নেই। জানলা থেকে সরে আসার সময় সেই বড় পাখিটাকে দেখতে পেল সে। একটু নীচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। ওই দুই পায়ের মধ্যে ছটফট করছে খরগোশ জাতীয় কোনও প্রাণী। ওটা বড়সড় মেঠো ইঁদুর হলেও হতে পারে। পাখিটা জঙ্গলে মিলিয়ে গেলে মিলন আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘুম যখন ভাঙল তখন এই দ্বীপে ঝোড়ো বাতাস বইছে। এই টঙের ওপর ঘরে ঈষৎ দুলুনি। শুয়ে-গুয়ে জানলার বাইরে তাকাল সে। আকাশের রং কীরকম ঘোলাঘোলা। এখন কটা বাজে? দুটকেসের ওপর খুলে রাখা ঘড়িটাকে দেখতে আলস্য লাগল তার। ঠিক তখনই হনুমানটা ওপরে উঠে এল। ঘরে ঢুকে মিলনের পায়ের কাছে বসে দাঁত বের করে চেঁচাতে লাগল। তারই মধ্যে ঘরের মেঝেতে হাত দিয়ে চড় মারতে লাগল। গতরাত্রে যাকে শান্ত বলে মনে হয়েছিল তাকে এরকম কাণ্ড করতে দেখে অবাক হয়ে উঠে বসল মিলন। জিজ্ঞাসা করল, 'কী হয়েছে?'

প্রশ্নটা কানে যেতে শান্ত হয়ে গেল হনুমানটা। তারপর একবার নীচের দিকে গিয়েই ওপরে উঠে এল। মিলন অবাক হল। কিন্তু হনুমানটা ওই কাজ বারবার করে যাওয়াতে ওর মনে হল, তাকে নীচে নেমে যেতে বলছে ও। সে উঠে দাঁড়াতেই মাথা নেড়ে সোজা নীচে চলে গেল হনুমান। সিঁড়ির মুখে এসে মিলন বুঝল, বেলা হয়ে গিয়েছে। সূর্য অনেক ওপরে চলে গেছে। যেহেতু ঈষৎ মেঘ জমেছে আকাশে তাই রোদ ওঠেনি। হাওয়ারা নীচ দিয়ে বইছে বলে মেঘগুলো নড়ছে না।

ব্রাশে পেস্ট মাখাতে-মাখাতে খেয়াল হল, টিউবটা পেস্টশূন্য হয়ে গেলে ব্রাশ করবে কী দিয়ে? অবশ্য নৌকা এলে মাঝিদের বলে দেওয়া যায় বিন্দু-বাজার থেকে নতুন পেস্ট কিনে নিয়ে আসার জন্যে।

টয়লেট কোথায়? প্রশ্নটা মনে আসতেই হেসে ফেলল মিলন। এরকম নির্জন দ্বীপে সে টয়লেট খোঁজ করছে? মগের জলে মুখ ধুয়ে নিয়ে সে ওখানকার গাছের আড়ালে গিয়ে জল বিয়োগ করল। গ্রামাঞ্চলে লোকে মাঠেই প্রাতঃকৃত্য শেষ করত। কিন্তু তার সেই অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি।

লোকটাকে দেখতে পাচ্ছে না সে। হনুমানটাও উধাও। ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা খাওয়া তার অভ্যাস। রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের কোনও ব্যবস্থাই তার চোখে পড়ল না।

জায়গাটাকে ভালো করে দেখার জন্যে সে পা বাড়াল। একটু পরে বাঁ-দিকে এবং ডানদিকে তারের বেড়া দেওয়া খাঁচা। খাঁচাগুলোতে অনেকগুলো মুরগি ঘুরছে। ওপাশের খাঁচার দরজা খোলা। সেখানে কেউ নেই।

একটু এগোতেই সবজির খেত দেখতে পেল। সদ্য সবুজ পাতা মাটি থেকে মুখ তুলেছে। এগুলো যে লোকটির পরিশ্রমের ফসল তাতে সন্দেহ নেই। এদিকে কলাগাছের সারি, অন্যদিকে ডাব-সুপুরির গাছ। এইসব পরিদর্শনের জন্যে তাকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। ঘুরতে-ঘুরতে অনেক বেলা হয়ে গেল।

মিলন দেখল লোকটা জঙ্গলের ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে আসছে, সঙ্গে হনুমানটা। লোকটার হাতে বেশ মোটাসোটা খরগোশ ঝুলছে। সদ্য মারা হয়েছে ওটাকে। তাকে দেখে দাঁত বের করে হেসে খরগোশ ওপরে তুলে দেখাল লোকটা। তারপর চলে গেল রান্নাঘরের দিকে।

অস্বস্তিতে পড়ল মিলন। এখনও পর্যন্ত খরগোশের মাংস কীরকম খেতে তা সে জানে না। শহরে খরগোশের মাংস পাওয়াও যায় না। কিন্তু ওই প্রাণীটির চেহারা এত আদুরে যে ওকে মেবে মাংস খাওয়ার কথা ভাবলেই খারাপ লাগে।

একবার বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক হয়েছিল ওর। সে হরিণ মেরে মাংস খাওয়ার বিরোধী। কারণ হরিণ অত্যন্ত সুন্দর, অসহায় এবং দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। এক বন্ধু বলেছিল, 'তাহলে হায়েনা অত্যন্ত কুৎসিৎ, ধূর্ত এবং দেখলেই মনে বিরাগ আসে বলে তার মাংস খেতে হবে? মুরগিও

তো আদুরে দেখতে। কোনও-কোনও মোরগ রীতিমতো সুন্দর। তাহলে তার মাংস খাস কী করে।' আর-এক বন্ধু এক ধাপ এগিয়ে বলেছিল, 'তাহলে আর ইলিশ মাছ খাব না। ওরকম সুন্দর, অসহায় এবং আদুরে দেখতে আর কোনও মাছ নেই।'

শেষপর্যন্ত ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, মাছের মতো আদুরে প্রাণী খুব কম আছে এবং সেই কারণে মিলনের মাছ খাওয়া উচিত নয়। এসব কথার প্রতিবাদ সেদিন মিলন করতে পারেনি। তিরিশ একর জমি যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একটি খুঁটি পোঁতা আছে। তার পরেই

জঙ্গলের শুরু। মিলন জঙ্গলে ঢুকবে কিনা ভাবছিল। কাল রাত্রে যাদের চিৎকার কানে এসেছিল তারা যদি হিংস্র হয় তাহলে। পেছনে আওয়াজ শুনে সে দেখল, লোকটা ফিরে আসছে। সঙ্গে

হনুমান। হনুমানের হাতে একটা বড় লাঠি। বেশ কসরৎ করে লাঠিটাকে বয়ে নিয়ে আসছে প্রাণীটা। হনুমানের হাত থেকে লাঠি নিয়ে মিলনকে দিল লোকটা। তারপর ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, সে জঙ্গলের ভেতরে যেতে চায় কিনা?

মিলন মাথা নাড়তে সে কয়েক পা এগিয়ে হনুমানকে ইশারায় ওপরের দিক দেখাল। মিলন দেখল হনুমান তরতর করে নারকেল গাছের ওপরে উঠে গিয়ে গোটা কয়েক কচি ডাব ছিঁড়ে নীচে ফেলে দিল।

লোকটা তার একটা কুড়িয়ে কোমরে হাত দিতে মিলন ছুরিটাকে দেখতে পেল। দড়ি দিয়ে কোমরের সঙ্গে বাঁধা আছে ওটা। দড়ি খুলে ছুরি দিয়ে ডাবের মুখটা কেটে লোকটা এগিয়ে দিল মিলনের দিকে।

চায়ের বদলে ডাবের জল খেয়ে পেট শুধু ভরেই গেল না, বেশ তৃপ্তি হল। জল মিষ্টি এবং ঠান্ডা। লোকটা আর-একটা ভাব এগিয়ে দিতে সে আপত্তি জানাল। পেটে হাত দিয়ে বোঝাল পেট ভরে গেছে।

মিলন অবাক হয়ে দেখল লোকটা শুধু নিজেই ডাবের জল খেলো না, হনুমানটাকেও খেতে দিল। হনুমান দু-হাতে ভাব মুখের ওপর ধরে জল খাচ্ছে না, অনেকটা কাটা ডাবে মুখ ডুবিয়ে জল চোঁ করে খেয়ে নিল। মিলনের মনে হল, ও আর জন্তু নেই।

জঙ্গলের মধ্যে পায়ে চলার পথ। লাঠি থাকায় দুপাশের ডাল-পাতা সরিয়ে হাঁটতে সুবিধে হচ্ছিল। মিলন বুঝতে পারছিল ক্রমশ ওপরের দিকে উঠছে ওরা। অর্থাৎ টিলার দিকে এগোচ্ছে। মাথার ওপরে একগাদা বানর চিৎকার শুরু করেছে অথচ হনুমানটার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই।

একসময় লোকটা দাঁড়িয়ে গিয়ে তাকে ইশারায় ডাকল। মিলন দেখল সামনে আচমকা জঙ্গল শেষ হয়ে গেছে। লোকটার পাশে পৌঁছাতেই সে অবাক হয়ে গেল। সামনেই বিশাল খাল। সমুদ্র থেকে সেটা ভেতরে ঢুকছে। খালের দুপাশে জঙ্গল। এদিকটা বেশ উঁচু বলে জল দেখতে হচ্ছে নীচের দিকে তাকিয়ে। লোকটা হাত তুলে কিছু দেখাতে চাইল। দূর থেকে কিছুই বুঝতে পারছিল না মিলন। আর-একটু এগিয়ে গিয়ে মনে হল, জলের ওপর কিছু ভাসছে, যা জঙ্গলের আড়াল থাকায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। মিলন জিজ্ঞাসা করল, 'ওটা কী?'

লোকটা প্রবলভাবে মাথা নাড়ল। তারপর হাত নেড়ে ওদিকে যেতে নিষেধ করল। কিন্তু

মিলনের আগ্রহ ওই নিষেধের জন্যেই বেড়ে গেল। জঙ্গল এবং জলের মধ্যে যে চিলতে ন্যাড়া

জায়গা রয়েছে সেটা ধরে সে এগোল। লোকটা পেছন-পেছন আসছে কিন্তু তার মুখ থেকে যে গোঙানি বের হচ্ছে সেটা যে আপত্তির, তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না মিলনের। কী আছে ওখানে যে লোকটা যেতে দিতে চাইছে না? একটা জায়গা অবধি এসে লোকটা তার এগোল না। মিলন আর কাছাকাছি গিয়ে দেখল সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই জায়গাটা জল থেকে বেশ উঁচুতে। কিন্তু এবার জঙ্গলের আড়ালে

পড়ে থাকা বস্তুটির বাইরে বেরিয়ে আসা প্রান্ত দেখে ওর সন্দেহ থাকল না ওটা ছোট লঞ্চ জাতীয়

জলযান।

এরকম জায়গায় কে জলযান লুকিয়ে রাখবে? লুকিয়ে রাখছে তার কারণ ওর নব্বই ভাগই জঙ্গলের আড়ালে রাখা হয়েছে যাতে বাইরে থেকে কেউ দেখতে না পায়। এমন হতে পারে ওটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফলে পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছে ওর মালিক। কিন্তু ওর কাছে যেতে লোকটা এত ভয় পাচ্ছে কেন? এই অর্থহীন ভয় কি বৃদ্ধ ওর মনে ঢুকিয়েছেন? এখানে এতদিন যখন ছিলেন তখন বৃদ্ধ নিশ্চয়ই ওর অস্তিত্বের কথা জানেন। তিনি কেন একটা কল্পিত ভয় লোকটার মনে ঢোকাবেন?

প্রায় আধঘন্টা ধরে অনেক কসরৎ করে নীচে নেমে এসে মিলন দেখল তার অনুমান সত্যি। এটা একটা ছোটখাটো লঞ্চ। লঞ্চে উঠতে হলে একটু কাদাজল পেরুতে হবে। পা বাড়াতে গিয়ে সে থমকে গেল। লঞ্চের গা ঘেঁসে অল্প জলের মধ্যে শুয়ে আছে বিশাল আকারের কুমির। সম্ভবত কুমিরও তার অস্তিত্ব টের পেয়ে গিয়েছে। সামান্য নড়ে পাড়ের দিকে মুখটা ঘোরাল ওটা। মিলন এতক্ষণে বুঝতে পারল কেন লোকটা নিষেধ করছিল তাকে। এই খাড়ির মতো বিরাট খালে নিশ্চয়ই প্রচুর কুমির আছে। লঞ্চে যেতে চাইলে কুমিরের পেটে চলে যেতে হবে। যদি একটা লম্বা কাঠের পাটাতন নিয়ে আসা যায় যা বাড়ি থেকে লঞ্চের ডেক পর্যন্ত সেতু তৈরি করবে তাহলেই কুমিরকে এড়িয়ে যাওয়া যায়। হঠাৎ সামনের জলে আলোড়ন হল। মিলন জলের ওপরে কয়েকটা কুমিরকে নাক উচিয়ে স্থির হয়ে ভাসতে দেখল।

ধীরে-ধীরে ওপরে উঠে এল সে। তাকে উঠে আসতে দেখে দূরে দাঁড়ানো লোকটার মুখে হাসি ফুটল।

সূর্য মাথার ওপরে আসার সময়েই দুপুরের খাওয়া শেষ হয়ে গেল। ভাত, মাছ ভাজা আর মাছের ঝোল। তাকে খাবার দিয়ে লোকটা একটা ঝুড়ি হাতে তারের জালের পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল, 'আঁ, আঁ, আঁ।'

গোঙানির আওয়াজ চারপাশে ছড়িয়ে যাওয়া মাত্র অদ্ভুত কাণ্ড হল। আশেপাশের গাছগাছালি, ঝোপ থেকে দলেদলে মুরগি-মোরগ দৌড়ে চলে এল, ঢুকে গেল খাঁচার ভেতরে। লোকটা তাদের উদ্দেশ্যে কুড়ি থেকে শস্যদানা তুলে ছড়িয়ে দিতে লাগল। মুরগিগুলো হুটোপুটি করে খেতে লাগল। খাবার দেওয়া শেষ হলে খাঁচার দরজা বন্ধ করে ওদের শুনতে আরম্ভ করল লোকটা। গোনা শেষ হলে খুশি হয়ে মাথা নাড়ল।

মিলন লক্ষ করল হনুমানটা এখন লোকটার সঙ্গে নেই। ওটা কোথায় গেল? উত্তরটা পেতে দেরি হল না। প্যাকপ্যাক শব্দ করতে করতে কয়েকটা হাঁস ছুটে আসছিল। আর তাদের তাড়িয়ে নিয়ে আসছিল হনুমান। দ্বিতীয় বাঁচায় ওরা ঢুকে গেলে লোকটা ওই খাঁচার দরজা বন্ধ করে দিল।

লোকটা যে চালাঘরে থাকে, সেটা দেখতে পেল মিলন। মাটির ওপর একটা বাঁশের মাচায় বিছানা পাতা। দেওয়াল নেই, মাথায় অবশ্য ছাউনি আছে।

জীবনে প্রথমবার স্নান না করে ভাত খেয়েছে মিলন। খেয়েছে খুব খিদে লেগেছে বলেই। স্নান করতে হলে সমুদ্রে নামতে হবে। অথচ এই সমুদ্রে কুমির অথবা হাঙর আছে কিনা জানা নেই।

লোকটাকে কাছে ডেকে এক মগ জল দেখিয়ে সে ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, এই জল কোথায় পাওয়া যাবে? সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা তাকে নিয়ে চলল জঙ্গলের দিকে। মিনিট কয়েকের মধ্যে ওরা টিলার কিছুটা ওপরে উঠে এল। একটা বড় পাথরের পাশ থেকে নীচের জল ওপরে উঠে আসছে। তারপর ঝরনা হয়ে বয়ে যাচ্ছে খাড়ির জলে মিশে যেতে। এই জলই নিয়ে যায় লোকটা। শুধু খাওয়ার জন্যে নয়, শস্যখেতেও এই জল নিয়ে গিয়ে ছড়ায় সে। মিলন মাথা নাড়ল। সমুদ্রের জলে নিশ্চয়ই চাষ করা যায় না, ফলে লোকটাকে খুব পরিশ্রম করতে হয় দিনভর।

মিলন ঠিক করল, বিকেলে এখানে এই ঝরনায় এসে স্নান করে নেবে।

তারপর সে ঘুরে-ঘুরে মালিকের সম্পত্তি দেখে নিল। খাতা-কলমে এগুলো নথিবদ্ধ করতে হবে। কাল থেকে কাজটা শুরু করবে সে।

ফিরে আসার সময়ে সে একটা গাছের গায়ে দাঁড় করিয়ে রাখা মই দেখতে পেল। কাঠের মই, বেশ শক্ত। বোঝাই যাচ্ছে নৌকোয় নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। মইটাকে দেখে তার মাথায় বুদ্ধিটা চলে এল। সে দেখল লোকটা কাছেপিঠে নেই, বোধহয় ফিরে গেছে তার কাজে। সে মইটাকে তুলে বুঝল ওটা তেমন ভারী নয়। একহাতে মই অন্যহাতে লাঠি নিয়ে সে ধীরে-ধীরে জলের কাছে পৌঁছে গেল। এখনও সূর্য অন্তত ঘণ্টা দুয়েক আকাশে থাকবে।

সে লক্ষ করল বিশাল কুমিরটাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভবত গভীর জলে নেমে খাবার খুঁজছে ওটা। মইটাকে সে সেতুর মতো লঞ্চ এবং মাটির ওপর শুইয়ে দিল। লঞ্চের ডেক নীচে হওয়ায় সিঁড়িটা তেরচা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। নাড়িয়ে চাড়িয়ে সেটাকে ঠিকঠাক দাঁড় করিয়ে লাঠি হাতে নিয়ে প্রথম ধাপে পা দিতেই জলে প্রবল শব্দ হল। দাঁড়িয়ে গেল মিলন? সেই ভয়ঙ্কর চেহারার কুমিরটা ভেসে উঠেছে। তার চোখ মিলনের দিকে। কিন্তু জল থেকে দূরত্বটা এত দূরে যে সে মিলনের নাগাল পাবে না।

ধীরে-ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ডেকে নেমে এল মিলন। নেমে বুঝতে পারল লঞ্চ মোটেই ছোট নয়। বাইরে থেকে গাছপালার আড়াল থাকায় এর আকার বোঝা যায়নি। কিন্তু ডেক থেকে লঞ্চে ঢোকার দরজা বন্ধ।

দূর থেকে লাঠির প্রান্ত দিয়ে দরজাটা ঠেলতে সেটা খুলল না। কিন্তু অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে এল। আওয়াজ একটু কমতেই আবার জোর করে ঠেলল সে। দরজাটা একটু ফাঁক হল। এবং তখনই বেশ বড় সাইজের সাপের মাথা বেরিয়ে এল এই ফাঁক দিয়ে।

দ্রুত লাঠি চালাল মিলন। সাপের মাথায় সজোরে আঘাত করা সত্ত্বেও প্রাণীটি আরও হিংস্র হয়ে শরীর বের করতে লাগল ডেকের ওপর। এখন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার আগেই সাপের খপ্পরে পড়তে হবে।

মরিয়া হয়ে লাঠি দিয়ে সাপের মাথায় আঘাত করতে লাগল সে। সাপটা বিশাল হাঁ করতেই লাঠির প্রান্ত ওর মুখের ভেতর ঢুকিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চাপ তৈরি করল। সাপটা যেভাবে শারীর বাড়াচ্ছিল, তাতে মনে হচ্ছিল লঞ্চটা এবার উলটে যাবে। কিন্তু একটু-একটু করে সেটা নেতিয়ে

পড়ল। তারপর স্থির হয়ে গেল।

সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়েও কিছুক্ষণ লাঠিটা বের করল না মিলন। এত বড়

সাপ সে কখনও দ্যাখেনি। যেমন লম্বা তেমনি মোটা। গায়ের রঙে কালোর ওপর সোনালি ছাপ। সাপের শরীরের অর্ধেকটাই ডেকের ওপর বেরিয়ে এসেছিল। লাঠি বের করে বাকিটাকে টেনে আনতে হিমশিম খেয়ে গেল মিলন। তারপরে সমস্ত শক্তি

দিয়ে সাপটাকে জলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করল। প্রথমে মাথার দিকটা ডেক থেকে ঝুলিয়ে দিতে সক্ষম হল। তারপর বাকি অংশটা যখন লাঠি দিয়ে ঠেলার চেষ্টা করছে তখন অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল।

সেই ভয়ংকর চেহারার কুমিরট। লাফিয়ে জল থেকে অন্তত ফুট তিনেক উঁচুতে মুখ তুলে সাপের মাথাটা দাঁতে চেপে হড়হড় করে পুরো শরীরটা জলে নামিয়ে নিল। তার টানে লঞ্চটা টলমল হয়ে যাচ্ছিল। অন্তত পনেরো-ষোলো ফুট লম্বা সাপটা জলে পড়তেই কুমির গপগপ করে গিলতে লাগল তাকে। কিন্তু অত মোটা সাপকে গিলতে যে সময় সে নিচ্ছিল তার মধ্যেই আর-একটা কুমির এসে লেজের দিকটা গিলতে লাগল। তারপর দুজনেই নেমে গেল জলের নীচে।

লঞ্চ স্থির হলে মিলন দেখল সিঁড়িটা আর উঁচু থেকে নীচুতে নেই। ডেক অনেক ওপরে ভেসে উঠেছে বলে অল্প তেরচা হয়ে আছে সিঁড়িটা। অর্থাৎ সাপের ওজন কমে যাওয়ায় লঞ্চ কিছুটা ভেসে উঠেছে ওপরে। সে জলের দিকে তাকাল। কুমিরগুলোর পক্ষে কোনওমতেই লঞ্চের ডেকে উঠে আসা সহজ নয়।

কিন্তু সাপটা কি লঞ্চের ভেতরে একা ছিল? ওর সঙ্গী বা সঙ্গিণী তো থাকতেই পারে। থাকলে এত ঝাঁকুনি, সাপের হিসহিস আওয়াজ, লাঠির শব্দ পেয়ে তার তো বেরিয়ে আসার কথা। মিলন দরজায় শব্দ করল কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া পেল না। দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে সে ডেকে দাঁড়িয়ে ভেতরে কী আছে দেখার চেষ্টা করল। একটা লম্বা প্যাসেজ ছাড়া কিছু চোখে পড়ল না। সাপটা সম্ভবত দরজার গায়ে শুয়েছিল তাই লাঠির ঠেলায় দরজা খোলেনি। ওর শরীরের চাপেই সেটা প্রথমে অনড় হয়েছিল।

সন্তর্পণে ভেতরে ঢুকল মিলন। বিশ্রী বোটকা গন্ধ নাকে এল। প্যাসেজের শেষে একটা দরজা। দরজাটা বন্ধ এবং মাঝখানের বড় ছিটিকিনি টেনে দেওয়া হয়েছে ওটা বন্ধ রাখার জন্যে। প্যাসেজের ডানদিকে আব-একটা দরজা। সেটাও বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ছিটকিনি খলে মখ বাড়াতে মিলন বুঝতে পারল এটা ইঞ্জিনঘর।

দ্বিতীয় সাপের হদিস পেল না সে। ইঞ্জিনঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী করে ইঞ্জিন চালু করা যায় তা বোঝার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ, শেষপর্যন্ত আন্দাজ করে বোতাম টিপেও কোনও কাজ হল না। ঘরটি থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে দেওয়ালে ইলেকট্রিক মিটারের মতো বাক্স দেখতে পেল মিলন। বাক্সটার গায়ে একটা লিভার উঁচুতে তুলে রাখা আছে। লিভারকে নীচের দিকে টেনে নামিয়ে পাশের একটা সুইচ টিপতেই আলোয় ভরে গেল চারপাশ।

আলোর তেজ দেখে মিলনের মনে হল ব্যাটারিটা এখনও ভালো কাজ করছে। সে প্যাসেজ এল। প্যাসেজের দেওয়ালের সুইচ টিপতে সেখানেও আলো জ্বলল। ভেতরে ঢোকার দরজার ছিটকিনিটা টাইট হয়ে গিয়েছিল। খুলতে কসরৎ করতে হল। দরজা খুলতেই আবার একটা প্যাসেজ।

তার গা-ঘেঁষে তারপর কয়েকটা ঘর। কোনও ঘরে রান্নার ব্যবস্থা করা আছে, কোনওটা শোওয়ার ঘর, কোনওটা বাথরুম। শোওয়ার ঘরের বিছানা এখনও বেশ পরিষ্কার। সবক'টা আলো জ্বেলে রান্নাঘরে ঢুকল সে। কোনায় একটা ফ্রিজ আছে কিন্তু সেটা খালি। ওপাশে গ্যাসওভেন এবং বাসনপত্র। বাঁ-দিকের দেওয়াল আলমারি খুলতেই অনেকগুলো কৌটো দেখতে পেল সে। কৌটোগুলো টিনফুডের, খোলা হয়নি।

এরকম একটা লঞ্চ পরিত্যক্ত করে কারা চলে গেল?

শোওয়ার ঘরে ফিরে গেল সে। কোনায় একটা টেবিল-চেয়ার। টেবিলের ওপর কয়েকটা বই, একটা ডায়েরি। পাশের ওয়ার্ডরোবে প্রচুর শার্টপ্যান্ট ঝুলছে। তার পাশেই একটা ছোট্ট সেলারে তিনটে স্কচ হুইস্কির বোতল। ওগুলো খোলা হয়নি। ডায়েরিটা খুলল মিলন। দ্বিতীয় পাতায় লেখা, মাই স্টেটমেন্ট। তার নীচে মাইকেল মুরহেড। তার পরের পাতা থেকে সুন্দর হাতের লেখা শুরু হয়েছে।

ডায়েরি নিয়ে সব আলো নিভিয়ে, দরজাগুলো ভালো করে বন্ধ করে সিঁড়ি বেয়ে ডাঙায় উঠে এল মিলন। এখন ছায়া ঘনিয়েছে। সূর্য অস্তাচলে। সিঁড়িটা বয়ে নিয়ে মুরগির খাঁচার কাছে ফিরতেই লোকটা ছুটে এসে দু-হাত তুলে নাচতে লাগল। ও যে খুব খুশি হয়েছে, বোঝা যাচ্ছিল। হনুমানও ওকে দেখে লাফাতে লাগল।

সারাদিন স্নান হয়নি। যদিও এখন চাঁদের আলোয় চারপাশ পরিষ্কার তবু সেই ঝরনার কাছে যেতে সাহস হল না। যে সাপটা লঞ্চে বাসা বেঁধেছিল সে নিশ্চয় বাইরে থেকে আসেনি। এই জঙ্গলে তার ভাইবোন নিশ্চয়ই আছে। তা ছাড়া, কাল রাতে শোনা জন্তুর ডাক থেকে বোঝাই যাচ্ছে রাত্রে ওখানে যাওয়া নিরাপদ নয়। যে জল বালতি ভরে লোকটাকে নিয়ে এসেছে, তা স্নান করে নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। আর লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে ঝরনায় গিয়ে ওকে পাহারা দিতে বলে স্নান করতে সে পারবে না।

তখন সমুদ্রের কথা মনে এল। এখানে সারাদিন সমুদ্রের ঢেউগুলোর আওয়াজ একটানা হয়ে যায় বলে কান এত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে যে এতক্ষণ খেয়ালে ছিল না। মিলন ঠিক করল জ্যোৎস্নায় সমুদ্রের জলে স্নান করবে। বেশি দূরে না গেলেই তো হল।

একটা গামছা নিয়ে বারমুডা পরেই সে চলে এল সমুদ্রের পাশে। আকাশ পরিষ্কার, ঢেউগুলো চকচক করছে চাঁদের আলোয়। এখন সমুদ্র বেশ শান্ত। একটা জায়গা বেছে নিয়ে জলে নামতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল মিলন। বালির ভেতর একটা গর্তে কিছু জল জমে ছিল। সেখানে ছটফট করছে কোনও প্রাণী।

কাছে গিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। সিনেমায় দেখেছে, টিভিতে অ্যানিম্যাল ওয়ার্ল্ডেও বহুবার দেখেছে কিন্তু সামনাসামনি এই প্রথম দেখল সে। একটি বাচ্চা ডলফিন। নিশ্চয়ই জোয়ারের সময় সমুদ্রের জলে ওপরে উঠে এসেছিল। জল নেমে গেলে আটকে গেছে এখানে। শিশু ডলফিন সামনে একটা মানুষ দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেল। মায়া হল মিলনের। সে সন্তর্পণে ওটাকে তুলে ধীরে-ধীরে সমুদ্রের জলে নামিয়ে দিল। দু-সেকেন্ড স্থির হয়ে থেকেই ছুট লাগাল গভীর জলের দিকে।

হেসে ফেলল মিলন। তারপর ধীরে-ধীরে কোমর জলে গিয়ে দাঁড়াল। ছোট-ছোট ঢেউ আসছে তীরের দিকে। সে ডুব দিল। আঃ। কী শান্তি। দুদিন স্নান না করা শরীরটা শীতল জলের স্পর্শ পেয়ে যেন তৃপ্ত হল।

হঠাৎ বেহাল হল, কে যেন বলেছিল এদিকে হাঙর আছে। কোনও হাওর যদি জলের নীচ দিয়ে এসে তার পা কামড়ে ধরে তাহলে মৃত্যু নির্ঘাত। সে ধীরে পিছিয়ে আসতে জলে আলোড়ন হল।

ভয় পেয়ে দৌড়ে বালির ওপর পৌঁছে সে পেছনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। হাঙর নয়, সেই বাচ্চা ডলফিনটার সঙ্গে দুটো বড় ডলফিন চলে এসেছে জলের ধার পর্যন্ত। বাচ্চাটা আনন্দে ডিগবাজি খাচ্ছে। বড় দুটো নিশ্চয়ই তার মা-বাবা। তার দিকে অদ্ভূত চোখে তাকিয়ে আছে ওরা।

মিলনের মনে হল ওই চোখে কৃতজ্ঞতা স্পষ্ট:

একটু-একটু করে ডলফিনরা পিছিয়ে গেল। তিনজনেই কিছুটা জায়গা খালি রেখে ঘুরতে লাগল। ডলফিন থাকলে কি হাওর আসে? মিলনের মনে হল ওরা তাকে স্নান করতে দেওয়ার জন্যে পাহারা দিচ্ছে। জলে নামল মিলন। মিনিট পাঁচেক স্নান করে ওপরে উঠে এসে গামছায় গুল মুছতে-মুছতে অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখল। একটা বড় ডলফিন তীরের কাছে এসে মুখ নেড়ে ছুড়ে দিল মাছটাকে। দিয়ে তিনজনেই সমুদ্রের গভীরে চলে গেল।

মাছটা বালির ওপর পাড়ে লাফাচ্ছিল। প্রায় দেড় কেজি ওজনের ভেটকি মাছ। বাচ্চাটাকে সে বাঁচিয়ে দিয়েছে বলে ওর বাবা-মা কী এভাবে কৃতজ্ঞতা জানাল।

মাছটাকে ধরে নিয়ে এল মিলন। ওটাকে দেখে চোখ বড় হয়ে গেল লোকটার। খালি হাতে সমুদ্র থেকে কেউ এত বড় ভেটকি ধরতে পারে বলে তার জানা ছিল না। বারবার হাত নেড়ে জানতে চাইছিল, কী করে সে মাছটাকে ধরল?

গরম-গরম ভাতের সঙ্গে ভেটকি মাছ ভাজা আর মুরগির মাংসের ঝোল খেয়ে নিল মিলন। আজ নীচে রান্নাঘরেই খাওয়া সারল। খাওয়ার পরে মনে হল, মুরগির মাংস রান্না করা উচিত হয়নি লোকটার। সে অনেক চেষ্টার পর লোকটাকে বোঝাতে পারল কথাটা। লোকটা একগাল হাসল। তারপর খাঁচার দিকে হাত নেড়ে দুদিকে মাথা ঘোরাতে ঘোরাতে না কথাটা বুঝিয়ে দিল। তারপর ওপরের দিকে লক্ষ করে দুটো হাত গুলতি ছোঁড়ার মুদ্রা করল। অর্থাৎ সে গুলতি দিয়ে কোনও

পাখি মেরে সেটাকে রেঁধেছে।

মাংসটা ভালো ছিল। কথা বাড়াল না মিলন। লোকটা আজ খরগোশ রাঁধেনি। টঙের ওপরের ঘরে কুপির আলোয় জলচৌকির সামনে বসে ডায়েরি খুলল মিলন। ওপরের তারিখটা আজ থেকে চার বছর তিন মাস আগের। কালো কালিতে মুক্তোর মতো ইংরেজি অক্ষরে লিখেছেন মিস্টার মুরহেড।

...আমরা ঠিক করেছিলাম উপকূল ঘেঁষে লঞ্চ নিয়ে যাব জাপানে। মায়নামারে বেশ সস্তায় লঞ্চটা পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধু কার্লোস চমৎকার সাজিয়েছিল লঞ্চটাকে। ঠিক করেছিলাম, কোনও বন্দর পেলে সেখানে নেমে কাঁচা খাবার কিনে নিয়ে রান্না করে খাব। নইলে পর্যাপ্ত টিনের খাবার তো রইলই। কোনও অবস্থাতেই আমরা তীর থেকে কুড়ি কিলোমিটার বেশি সমুদ্রের গভীরে যাব না প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড় করেছিলাম।

যেদিন রওনা হব তার দুদিন আগে কার্লোসের বান্ধবী সাবিতানি এসে উপস্থিত। ওরা ব্রাজিলের মানুষ। কিন্তু ইংরেজি চমৎকার বলে। সাবিতানি আমাদের সঙ্গে যেতে চায়। দেখলাম কার্লোসেরও সেই ইচ্ছে। কিন্তু সাবিতানির ভিসা বা অন্য প্রয়োজনীয় কাগজ এত তাড়াতাড়ি পাওয়া সম্ভব নয় বলে সে শুধু জাপানে ঢোকার জন্যে ভিসার ছাপ পাশপোর্টে করিয়ে নিল। ঠিক হল পথে কোনও দেশের ডাঙায় সে নামবে না। লঞ্চেই থাকবে।

লঞ্চের ট্যাঙ্ক ভরতি করে নেওয়া হল। এছাড়া কয়েকটা ক্যানেও তেল নিয়ে রাখল কার্লোস। পথে যেখানেই আমরা থামব, তেল নিতে পারব।

সকাল অটিটায় আমরা রওনা হলাম। সুন্দর আবহাওয়া। তীর থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূর দিয়ে আমাদের লঞ্চ আরামসে যাচ্ছিল। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমার খটকা লাগল। কার্লোসকে আমি বছর দুয়েক ধরে চিনি। হাসিখুশি, বছর পঁয়ত্রিশের পরিশ্রমী যুবক। কিন্তু সাবিতানি আসার পরে সে কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। লঞ্চের যাবতীয় কাজ আমি আর কার্লোস করতাম। সাবিতানি দিনের বেলায় চোখে গগলস এঁটে ডেকের ইজিচেয়ার শুয়ে রোদ পোয়াত। সন্ধের পর মদের বোতল

নিয়ে বসত। আমাদের লঞ্চে শোওয়ার জন্যে একটাই কেবিন। আগে ঠিক করেছিলাম পালা করে আমি আর কার্লোস ঘুমাব। যেহেতু লঞ্চের ওপর নজর

রাখার জন্যে একজনকে জেগে থাকা দরকার তাই এই ব্যবস্থায় শোওয়ার জায়গা নিয়ে কোনও সমস্যা হতো না। সাবিতানি এসে যাওয়ায় তাকে শোওয়ার কেবিন ছেড়ে দিতে হল। আমি ভেবেছিলাম কার্লোস তার বান্ধবীর সঙ্গে কেবিনটা ব্যবহার করবে। কিন্তু প্রথম রাতেই সে বলল, 'তুমি ইচ্ছে করলে কিচেনে ঘুমাতে পারো। বিছানা করে দিচ্ছি। আমি রাত্রে জাগব।'

আমি প্রতিবাদ না করে কিচেনেই ঘুমিয়েছিলাম। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। কার্লোস আর সাবিতানির মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া চলছে। যেহেতু সেটা নিজেদের ভাষায় ওরা করছিল, তাই আমি একটুও বুঝতে পারলাম না। আমি আবার শুয়ে পড়লাম। ভোরবেলায় দেখলাম সাবিতানি তার কেবিনে ঘুমাচ্ছে। কার্লোস গালে হাত দিয়ে বসে আছে ডেকের ওপর। আমায় দেখে বলল, 'সাবিতানিকে নেক্সট পোর্টে নামিয়ে দেবে?'

'কেন?'

'ও থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব।'

' কী হয়েছে বলো তো?'

'ও আমার বান্ধবী ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু এখন বলছে ওকে বিয়ে করতে হবে। বিয়ে যদি না করি তাহলে পঞ্চাশ হাজার ডলার ওকে দিতে হবে। কারণ ওই টাকা ও ধার করেছিল, শোধ দিতে হবে।'

'মেয়েটি তো সুন্দরী। বিয়েতে আপত্তি করছ কেন?'

'ডলারের কথা যদি না বলত তাহলে আমি ভেবে দেখতাম। কেউ যদি আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চায় তাহলে আমি মেনে নেব না।'

বেলা এগারোটায় সাবিতানি ডেকে বেরিয়ে এলে কার্লোস শুতে গেল।

একটা মিনি প্যান্টের ওপর ব্রা ছাড়া কিছু নেই ওর শরীরে। সাবিতানি হেসে বলল, 'গুড মর্নিং। কফি পাওয়া যাবে?'

হেসে বললাম, 'আমিও তাই ভাবছিলাম। ইঞ্জিন ছেড়ে যেতে পারছি না। তুমি কি দয়া করে কিচেন থেকে বানিয়ে আনবে?'

একটু ভেবে হাসল মেয়েটা, 'তুমি বলছ, তাই নিয়ে আসছি।'

কিছুক্ষণের মধ্যে সে কফি নিয়ে এল। তারপর আমার সঙ্গে যেভাবে কথা বলতে লাগল তাতে যে কেউ শুনলে ভাববে আমরাই প্রেমিক-প্রেমিকা ।.....

গল্পে জমে গিয়েছিল মিলন। কিন্তু পাতা ওলটাতেই সে অবাক হল। পরপর কয়েকটা গাতা সাদা। তারপর আবার লেখা শুরু হল।

...ব্যাপারটা যে এভাবে ঘটবে, আমি কল্পনা করিনি। গত আড়াই দিনে এক ফোঁটা ঘুমাতে পারিনি কেউ। মৃত্যু আমাদের নিয়ে খেলা করে গেছে। সন্ধের মধ্যে আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল চাপচাপ মেঘে। তারপর ঝড় উঠল। সমূদ্র গেল খেপে। আমাদের লঞ্চটাকে বড়-বড় ঢেউ যেন আকাশে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। তখনই একটা প্রপেলার ভেঙে গেল। এই অবস্থায় লঞ্চ চালানো বোকামি। ভোর পাঁচটাতেও আলো ফুটল না। আমরা বুঝতে পারছিলাম যে ঝড় লঞ্চটা নিয়ে গিয়েছে সমুদ্রের আরও গভীরে।

সাবিতানির ক্রমাগত বমি হচ্ছিল। পরের দিন সমুদ্র একটু শান্ত হলে ওকে ওষুধ দিলাম। দ্বিতীয় প্রপেলারটা লাগাতে হিমশিম খেয়ে গেলাম আমি আর কার্লোস। লঞ্চ চলছিল খুব ধীরগতিতে। গতি বাড়াতে গেলেই বিকট শব্দ করছিল ইঞ্জিন।

দ্বিতীয় সন্ধ্যায় আবার ঝড় উঠল। সাবিতানি শুয়ে ছিল তার কেবিনে। আমি ইঞ্জিনঘরে। কার্লোস ডেকে। হঠাৎ মনে হল লঞ্চটা জলের তলায় তলিয়ে যাচ্ছে। বিপুল জলরাশি আমাদের কয়েক মুহূর্তের জন্যে ঢেকে ফেলল। কিন্তু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তার পরেই আবার ভেসে উঠল লঞ্চটা। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, কার্লোস ডেকে নেই। চিৎকার করলাম। কিন্তু ঝড়ের শব্দের কাছে আমার

গলার স্বর অসহায়। হাওয়ার টানে লঞ্চ কোথায় ছুটে যাচ্ছে, বুঝতে পারছি না। শেষ রাতে ঝড় থামল। সমুদ্র একটু শান্ত হল। ডেকে বেরিয়ে এসে কার্লোসকে দেখতে পেলাম না। বুঝলাম জাহাজ যখন ফলের নীচে চলে যাচ্ছিল, তখন প্রবল ঢেউ এসে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে। অথচ কার্লোসের তখন ওখানে থাকার কথা নয়। সাবিতানি না এলে ওর তখন কেবিনে ঘুমিয়ে থাকার কথা। মনে হল শরীর থেকে সমস্ত শক্তি কেউ বের করে নিয়ে গিয়েছে।

আমরা কোথায় এসেছি জানতে গিয়ে দেখলাম, কম্পিউটার কাজ করছে না। হার্ডওয়্যারের ব্যাপারটা কার্লোস জানত। টেবিলের ওপর ছিল ল্যাপটপটা, ছিটকে চলে গিয়েছে প্যাসেজে। ফলেও ভিজেছে বেশ।

যেখানে লঞ্চ ডুবে যাব-যাব হয়েছিল, সেখানে ফিরে গিয়ে কার্লোসকে খুঁজতে চাইলেও কীভাবে যাব, বুঝতে পারছিলাম না। সাঁতার জানত কার্লোস। কিন্তু এই সমুদ্রে লাইফ জ্যাকেট ছাড়া কতক্ষণ ভেসে থাকা সম্ভব?

বেলা বাড়ল। কিন্তু রোদ উঠল না। আকাশে আবার মেঘ জমছে। আমরা যখন লঞ্চে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম, তখন এরকম ঘটনা ঘটলে কী করব তার একটা ছক করেছিলাম। যেহেতু আমরা তীর থেকে বেশিদূরে থাকব না, তাই ঝড় উঠলেই তীর থেকে মাইল খানেকের মধ্যে চলে আসব। কিন্তু তীরে ভিড়ব না। ঢেউগুলো তীরে ভয়ঙ্করভাবে আছড়ে পড়ে। কিন্তু ঘটনাটা যখন ঘটল তখন আচমকা সবকিছু আমাদের হাতের বাইরে চলে গেল।

আমি ইঞ্জিন বন্ধ রাখলেও বাতাস লঞ্চটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। এভাবে চললে দু-মাসেও আমাদের খাদ্যভাব হবে না এবং ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই কোনও জাহাজ আমাদের উদ্ধার করবে। বেচারা কার্লোস। অভিযানের স্বপ্ন ও-ই আমাকে দেখিয়েছিল।

বেলা এগারোটা নাগাদ সাবিতানি ডেকে চলে এল, 'গুডমর্নিং। উঃ। কী ভয়ংকর ঝড়। আমার তো মনে হচ্ছিল আর বাঁচব না।'

আমি কোনও কথা বললাম না।

'তোমার বন্ধু কোথায়? কিচেনেও তো নেই।'

'খুঁজে দ্যাখো। যদি না পাও তাহলে বুঝতেই পারবে, ওর কী হয়েছে!' বেশ বিষন্ন গলায় বঙ্গমায় আমি।

< গড।' দ্রুত লঞ্চটা ঘুরে এল সাবিতানি, 'লঞ্চে ও নেই।'

গল রাত্রে তুমি যখন ঘুমাচ্ছিলে তখন ঢেউ এসে কার্লোসকে এখান থেকে সমুদ্রের বুকে 'ছে।'

শানামাত্র দু-হাতে মুখ ঢেকে সাবিতানি চলে গেল ভেতরে।

বিকেল বেলায় দু-কাপ কফি আর চিহ্নবিস্কুট নিয়ে ও এল ডেকে। বলল, 'নিশ্চয়ই পেটে কিছু তনি। খেয়ে শক্তি নাও।'

শাক, দুঃখ, কষ্ট যত প্রবল হোক সময় এবং সমস্যা তার ভার আস্তে-আস্তে কমিয়ে দেয় বলে বেচে থাকাটা সহজ হয়। কফি নিলাম।

'আমরা এখন কোনদিকে যাচ্ছি?' সাবিতানি জিজ্ঞাসা করল।

'জানি না।'

'কম্পিউটার কী বলছে?'

'ওটা কাজ করছে না। কম্পাসের নির্দেশমতো আমরা এখন বে অব বেঙ্গলে চলে এসেছি। ঠিক যেদিকে যাওয়ার কথা তার উলটো দিকে।'

'কাছাকাছি কোন দেশের তীর?'

'হয় বাংলাদেশ, নয় ইন্ডিয়া।'

'তাহলে সেদিকেই চলো। আর তো তুমি জাপানে যেতে পারবে না।'

'তা ঠিক। কিন্তু ইঞ্জিন চালালেই গরম হয়ে যাচ্ছে। স্পিড বাড়ালে বিশ্রী শব্দ উঠছে।'

'তুমি তাহলে এইভাবে থাকতে চাও?'

'যতক্ষণ না কোনও সাহায্য আসে। যা থাবার আছে তাতে অনেকদিন চলে যাবে।'

সন্ধে থেকে মদ্যপান শুরু করল সাবিতানি, ডেকের ওপর। দুটো টিনফুড গরম করে মুখ

কেটে নিয়ে এসেছে, চাট হিসেবে খাবে বলে। আমাকেও খেতে অনুরোধ করল কয়েকবার। হঠাৎ কী মনে হল, হয়তো মন দুর্বল ব' শরীর কাহিল হওয়ায় রাজি হলাম। সন্ধে পার হলে সাবিতানিকে শুতে চলে যেতে বললাম। লক্ষ্মী মেয়ের মতো রাজি হল সে। সে গুতে চলে যাওয়ার পরে আকাশে কিছু উড়ে যাচ্ছে বলে আমার মনে হল। আজ জ্যোৎস্রা

নেই, চাঁদ মেঘের আড়ালে, তাই দেখতে পেলাম না কিছু। মনের ভুলও হতে পারে।

কিছুক্ষণ বাদে লঞ্চের ভেতর স্নেকে চিৎকার ভেসে এল সাবিতানির। আমি তাড়াতাড়ি ওর কেবিনে ঢুকে দেখলাম, বিছানার ওপর বসে কাঁপছে সে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, 'কী হয়েছে?' 'আমার খুব ভয় করছে।'

'মনে হচ্ছে মরে যাব। লঞ্চটা ডুবে যাবে।'

'কিছু হবে না ঘুমানোর চেষ্টা করো।'

আমি ফিরে আসছিলাম। কিন্তু সাবিতানি চেঁচিয়ে বলল, 'না। তুমি যেও না। এখন তো

ইঞ্জিন চলছে না। তুমি এখানে থাকলে আমি ঘুমাতে পারব।' ভয় পাওয়া বাচ্চা মেয়েকে যেভাবে বড়রা সান্ত্বনা দেয় সেভাবে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, 'কোনও ভয় নেই। আমি তো আছি।"

হঠাৎ সাবিতানি আমাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরল। তারপর মুখ ঘষতে লাগল আমার বুকে। যদিও আমি অবিবাহিত, কিন্তু নারীসঙ্গ থেকে বঞ্চিত নই। তবে বেশ কিছুদিন আমি কোনও কারণ ছাড়াই নিজেকে আর জড়াইনি। সেদিন ওই মাঝসমুদ্রে লঞ্চের কেবিনে যখন সাবিতানি আগ্রাসী হল, তখন নিজের অজান্তেই সাড়া দিয়ে ফেললাম।

শরীরের ঝড় থেমে গেলে পাশাপাশি শুয়েছিলাম আমরা। সাবিতানি আমার মাথাগ আঙুল বোলাচ্ছিল। হঠাৎ বলল, 'আমাকে তোমার ভালো লেগেছে?'

সঙ্গে-সঙ্গে কার্লোসের মুখ মনে পড়ে গেল আমার। সাবিতানি কি সেই পঞ্চাশ হাজার ডলার পাওয়ার জন্যে আমার ওপর ভর করতে চাইছে? উত্তর না দিয়ে চুপচাপ উঠে ডেকে চলে এলাম।

ডেকে পা দিয়ে আমি স্তম্ভিত। দূরে তটরেখা দেখা যাচ্ছে। অস্পষ্ট গাছপালার রেখা ফিকে অন্ধকারেও বুঝতে পারছি। ঝটপট ইঞ্জিনঘরে চলে গিয়ে ওটাকে চালু করলাম। তারপর ধীরে-ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলাম তীরের দিকে। ইঞ্জিন চালু হতেই বিবস্ত্র অবস্থাতে সাবিতানি ছুটে এল, "কী

হল, ইঞ্জিন চালু করলে কেন?' 'আমরা তীরের কাছে পৌঁছে গেছি।' উল্লসিত হয়ে বললাম।

ছুটে ডেকে চলে গেল সে। তার পরেই সে ফিরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'আমাদের সম্পর্কটা হওয়ায় কপাল ভালো হয়ে গেল। তাই না?'

আমি আপত্তি করলাম না।

তীরের দিকে যাওয়া যাচ্ছে না। ওটাকে দ্বীপ বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কোনও আগুন না জ্বলায় মানুষ আছে বলে মনে হল না। একটু-একটু করে এগিয়ে একটা চওড়া খাড়ি দেখতে পেয়ে তার ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম লঞ্চটাকে। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর প্রপেলারে কিছু জড়িয়ে যেতে শুলে তোলপাড় হল এবং সেটা আটকে গেল। স্থির হয়ে গেল লঞ্চ। ওটাকে নাড়ানো যাচ্ছে না। ধীরে-

ধীরে ঢেউয়ের ধাক্কায় ওটা সরে এল গাছগাছালির ভেতর। এসে আটকে স্থির হল। নতুন জায়গা। হু করে পোকা ঢুকছিল আলো দেখে। তাড়াতাড়ি সব দরজা-জানলা বন্ধ করে দিলাম। সাবিতানি পাড়ে নামতে চাইছিল। কিন্তু তাকে আমি নিষেধ করলাম। দিনের আলো ফোটার আগে নামা ঠিক হবে না। এই দ্বীপে হিংস্র জন্তু বাস করতে পারে।

সাবিতানি বলল, 'তাহলে চলো শুয়ে পড়ি। ভোর হতে দেরি আছে।'

আমি রাজি হলাম। কারণ মাটির গায়ে এসে যাবতীয় উদ্বেগ চলে গিয়েছিল। এমনকি কার্লোসের মুখটাও মনে পড়ছিল না।

সকাল হল। জানলা দিয়ে দেখে বুঝলাম, বেশ জঙ্গুলে দ্বীপ এটা। নিশ্চয়ই বাংলাদেশ অথবা

ইন্ডিয়ার কোনও জায়গা। অনেকক্ষণ লক্ষ করে কোনও বন্য প্রাণীকে দেখতে পেলাম না।

সাবিতানি ডাঙায় ওঠার জন্যে ব্যস্ত হয়েছিল। কিন্তু আমি নিষেধ করলাম। যেহেতু জায়গাটা আমাদের সম্পূর্ণ অপরিচিত, তাই হুট করে পা দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। একটা বেলা অপেক্ষা করে দেখা যাক, আমরা এসেছি বলে এখানে কোনও প্রতিক্রিয়া হয় কিনা।

সাবিতানির এখন খুব আনন্দ। সে রান্না করতে গেল। জোরে জোরে গান গাইছে। এখন আর কার্লোসের কথা তার মাথায় নেই।

আমি কাচের জানলাগুলোতে চোখ রেখেছিলাম। একটা দিক জঙ্গলের জন্যে দেখতে পাচ্ছি

না। আর এক দিকে শুধু রুল। লক্ষ করলাম নদীতে, অবশ্য এটাকে নদী বলা যায় কিনা জানি না, কুমির আছে। মাঝে-মাঝেই তারা মুখ তুলছে আবার ডুবে যাচ্ছে। ইঞ্জিনঘরের জানলা দিয়ে তীরের একাংশ দেখা যাচ্ছিল। সেখানে কোনও প্রাণের অস্তিত্ব নেই।

সাবিতানি এস। এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল, 'আচ্ছা, আমরা দুজনে যদি সারাজীবন এখানেই থাকি, তাহলে কেমন হয়?'

'সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে।' বললাম।

'কেন?'

'আমি ছাড়া কথা বলরে লোক পাবে না। ক'দিনের মধ্যেই ঝগড়া শুরু হবে। দুজন মানুষকে শাস্তিতে বাস করতে হলে কথা বলার আরও সঙ্গী দরকার।'

'তার চেয়ে মাইকেল বলো, আমাকে তোমার পছন্দ হচ্ছে না।'

'না সাবিতানি। তোমাকে অপছন্দ কোনও পুরুষ করবে না।'

'কিন্তু আমি দেশে ফিরতে চাই না। গেলেই পঞ্চাশ হাজার ডলার শোধ করতে হবে। তার চেয়ে যদি এখানে থাকি তাহলে কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না।' সাবিতানি আমাকে জড়িয়ে ধরল।

'কিন্তু এখানে বেশিদিন থাকলে খাবে কী?'

'কিচেনে যা আছে তাতে কয়েকমাস চলে যাবে। আমি না-হয় আর মদ খাব না। জঙ্গলে ঢুকলে কিছু না কিছু পাওয়া যাবেই। নইলে আমরা চাষ করব। হরিণ, শুয়োর বা খরগোশ মারব। তুমি কিন্তু না করো না।'

এসব কথা শুনতে ভালো লাগছিল। এই দ্বীপে মানুষ আছে কিনা জানি না। বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবন এলাকায় প্রচুর দ্বীপ আছে, যেখানে মানুষ থাকতে পারে না। এটা সেরকম হতে পারে। না থাকলে এখান থেকে ফিরে যাব কী করে? আর মানুষ থাকলে নিশ্চয়ই ইন্ডিয়া অথবা বাংলাদেশে যাওয়ার

একটা উপায় হবে।

সাবিতানি আমাকে হঠাৎ অন্দর করতে শুরু করল। আমি মৃদু আপত্তি জানালাম, 'এসব এখন থাক।'

'না। এসো, আমরা মাটিতে পৌঁছেছি বলে সেলিব্রেট করি'

দুপুরে খাওয়া শেষ করার পরেও বাইরে কোনও প্রাণের অস্তিত্ব টের না পেয়ে সাবিতানি বলল, 'তুমি মিথ্যে ভয় পাচ্ছ। চলো', এবার ঘুরে সেখি।'

আপত্তি করার আর কোনও কারণ না থাকায় এগিয়ে গিয়ে ডেকের দরজা খুললাম। চমৎকার হালকা রোদ ছড়িয়ে আছে নদীর ওপর। তীরের গাছপালায়। দেখলাম ডেক থেকে পাড়ে যেতে গেলে জলে নামতে হবে। সেটা বেশ কষ্টকর ব্যাপার। সাবিতানি বলল, 'কী সুন্দর জল। এসো স্নান করি।'

'মাথা খারাপ! ভালো করে লক্ষ করো।' হাতের ইশারায় ওকে দেখালাম।

দুটো বেশ বড় সাইজের কুমির এগিয়ে আসছে লঞ্চের দিকে। তাদের চোখ দুটো জলের

ওপরে, আমাদের দেখছে।

সাবিতানি আঁতকে উঠল, 'সর্বনাশ। যদি আক্রমণ করে?'

'আমবা অনেক উঁচুতে আছি, নাগাল পাবে না। তা ছাড়া, নৌকো বা লঞ্চে থাকলে ওরা সাধারণত আক্রমণ করে না, কিন্তু জলে নামলে ছেড়ে দেবে না।'

'তাহলে আমরা পাড়ে যাব কী করে? লঞ্চটাকে আরও একটু ওপাশে নিয়ে যাওয়া যায়

না?' সাবিতানি পরামর্শ দিল।

ইঞ্জিনঘরে ঢুকে লঞ্চটাকে চালু করতে চাইলাম। কিন্তু একটুও আওয়াজ হল না। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলাম। কিছু একটা বিকল হয়েছে। কার্লোসের কথা মনে এল। ও থাকলে এখনই সারিয়ে ফেলতে পারত।

আবার ডেকে এলাম। সাবিতানি বলল, 'কী হল?'

ইঞ্জিন গোলমাল করছে।'

'ও। এক কাজ করতে পারি। লঞ্চের ছাদে উঠলে ওই গাছটার ডাল ধরা যাবে। বেশ শ৫ ডাল। ওই ভাল ধরে সহজেই পাড়ে নেমে যেতে পারব।'

'ওই একইভাবে ফিরব।'

'যদি তাড়াতাড়ি ফিরতে হয়, যদি কেউ তাড়া করে তাহলে বিপদে পড়বে। তার চেয়ে এক কাজ করা যাক।'

আমি লঞ্চের স্টোররুম থেকে অ্যালুমিনিয়ামের সিঁড়িটা বের করে নিয়ে ডেক থেকে পাড়ে লাগাতে চেষ্টা করে দেখলাম, ওটা একটু ছোট হচ্ছে। কিন্তু ওই প্রান্ত জলের তলায় মাটিতে লাগালে দেখা গেল সিঁড়ির অলের ওপর ধাপ পর্যন্ত নেমে লাফিয়ে ডাঙায় ওঠা যাবে।

বললাম, 'কাছেপিঠে কুমির না থাকলে এভাবেই যাওয়া সহজ হবে।'

সাবিতানি খুশি হয়ে আমাকে চুমু খেল।

ডাঙায় নামার আগে মনে হল, একেবারে খালি হাতে যাওয়াটা ঠিক হবে না। মায়নমারের কাস্টমসের নিয়ম অনুযায়ী আমরা কোনও আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে আনতে পারিনি। যদিও কার্লোসের হাবভাব দেখে সন্দেহ হয়েছিল যে সে ওইরকম কিছু লঞ্চের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। জিজ্ঞাসা করলে হেসেছিল, কিছু বলেনি। ঠিক করলাম লঞ্চের সম্ভাব্য লুকোনোর জায়গাগুলো পরে খুঁজে দেখব।

কুমিরগুলো পাড়ের কাছাকাছি চলে এসেছিল। আমি অ্যালুমিনিয়ামের সিঁড়িটা দেখিয়ে ওদের তাড়াতে চেষ্টা করলাম। ওরা একটু সরে গেল কিন্তু সেটা বেশি দূরে নয়। সাবিতানিকে বললাম, 'এখন চেষ্টা না করলেই ভালো, ওরা যদি ছুটে এসে সিঁড়িটাকে ধাক্কা দেয় তাহলে আর দেখতে হবে না।'

সাবিতানিও একমত হল।

আমরা ডেকের ওপর বসে গল্প করছিলাম। এমন নির্জন জায়গায় বিকিনি পরা সুন্দরী নারীর সঙ্গ পেতে ভালোই লাগছিল।

হঠাৎ সাবিতানি উত্তেজিত হয়ে আমাকে এক ঝাঁক মাছ দেখাল। মাঝারি সাইজের মাছ, যার একটা আমাদের দুজনের পক্ষে দু-বেলার অন্যে যথেষ্ট। কিন্তু ওই মাছ ধরার কোনও ব্যবস্থা লঞ্চে নেই।

সাবিতানি বুদ্ধি বের করল। অ্যালুমিনিয়ামের সিঁড়ির ফাঁকগুলোতে কাপড় এমনভাবে বেঁধে ফেলল যাতে দুটো ধাপের ভেতরের ফাঁকা অংশে ফুলে ফেঁপে থাকে সেটা। পরপর অনেকগুলো ধাপে কাপড় বেঁধে সে তৈরি হল। যেই আর-একটা মাছের ঝাঁক সে দেখতে পেল অমনি সিঁড়িটাকে জলের ভেতর তেরচা করে ডুবিয়ে দিল। জলের স্রোতে কাপড় বেলুনের মতো ফুলে গেল। মাছের ঝাঁকটা ওটাকে পাশ কাটালেও দুটো মাহ ওই কাপড়ের গর্তে ঢুকে গেল নির্বোধের মতো। অমনি সিঁড়ি ওপরে তুলে ডেকে নিয়ে এল সাবিতানি। এগুলোকে আমরা ক্যাটফিশ বলি। খুব সুস্বাদু। মাহু

দুটো পালাতে চাইল, কিন্তু পারল না।

সাবিতানি বলল, 'আজ তোমাকে মাছ ভাজা খাওয়াব।'

খুশি হয়ে বললাম, 'দারুণ লাগবে।'

মাছ দুটোকে ভেতরে রেখে এসে সাবিতানি বলল, 'শোন, তুমি রাজি হয়ে যাও। এখানে খাবারের অভাব নেই। আমরা সারাজীবন শাস্তিতে থাকতে পারব।'

রসিকতা করলাম, 'যখন ছেলেমেয়ে হবে?'

'ওরাও আমাদের সঙ্গে থাকবে। আমরা যা জানি, সব ওদের স্পোব।'

সেই সন্ধেটা চমৎকার কেটেছিল। সাবিতানি মাছ রান্না করল। সঙ্গে হুইস্কি। ঢেউয়ের ধাক্কায়

লঞ্চ দুলছিল। বুঝলাম ওটা জঙ্গলের ভেতরে আরও ঢুকে যাচ্ছে। আমি সিদ্ধান্তে এলাম, এই দ্বীপে মানুষ নেই। থাকলে এতক্ষণে তাদের দেখতে পেতাম। একটা লঞ্চ খাড়িতে ঢুকেছে দেখে তারা নিশ্চয়ই দূরে থাকবে না।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিছানায় যাওয়ার আগে সাবিতানি একবার ডেকে গেল রাত্রের নৃশ্য দেখতে। আমি নিষেধ করেছিলাম। সন্ধের মুখে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সে বলল, 'একটু ঠান্ডা হাওয়া মেখে আসি। তুমিও চল। একটু পরেই চাঁদ উঠবে।'

হাতের কাজ সেরে আমি ডেকের দিকে পা বাড়ালাম।

দেখলাম লঞ্চের একেবারে প্রান্তে বসে আছে সাবিতানি। তার চোখ জলের দিকে। হঠাৎ চোখে পড়ল ওপরের গাছ থেকে কিন্তু একটা দ্রুত নেমে আসছে। আমি চিৎকার করতেই সাবিতানি ঘুরে তাকাল। সঙ্গে-সঙ্গে বেশ মোটা মাথার সরীসৃপ জাতীয় কিছু সাবিতানির মুখ গিলে ওপরের দিকে টানতে লাগল। ওটা যে বিরাট আকারের সাপ, তা বুঝতে পেরে আমি অ্যালুমিনিয়ামের সিঁড়ি দিয়ে ওটাকে আঘাত করতে লাগলাম।

ততক্ষণে সাবিতানির কাঁধ সাপের পেটে চলে গেছে। গাছের ডালে লেজ জড়িয়ে রেখে সে অনায়াসে গিলে ফেলছে মেয়েটাকে। আমি ছুটে গিয়ে সাবিতানির পা ধরে টানতে লাগলাম। কিন্তু ততক্ষণে ওর শরীর প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।

সাপটা এবার লঞ্চের ওপর শরীর নামাল। সঙ্গে-সঙ্গে লঞ্চ জলের নীচে অনেকটা নেমে গেল। স্পষ্ট দেখতে পেলাম সাপের গলা থেকে গেটের ওপর পর্যন্ত চামড়া উঁচু হয়ে আছে। এবার সাপটা আমার দিকে তাকাতেই আমি দৌড়ে ভেতরে ঢুকলাম। কিন্তু প্রথম দরজাটা

বন্ধ করতে পারলাম না সাপের মাথা সেখানে চলে আসায়। ছুটে দ্বিতীয় দরজা বন্ধ করে এপাশে চলে এলাম। এই দরজা সাপের শক্তির কাছে কিছু নয়। হাতের কাছে যা পেলাম তা দিয়ে দরজাটাকে মজবুত করার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ দরজায় শব্দ হল। তারপর সব চুপচাপ। আমি শোওয়ার কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় লুটিয়ে পড়লাম। চোখের সামনে সাবিতানির শরীর ভাসছিল।

এই সাপটা এখানে এল কী করে? এ তো প্রায় অ্যানাকোন্ডা। এই ভূখণ্ডে ওর থাকার কথা নয়।... কতক্ষণ কেবিনের বিছানায় মড়ার মতো পড়েছিলাম জানি না। হঠাৎ বুঝতে পারলাম লঞ্চের সামনের দিকটা অনেকটা নীচু হয়ে গেল। ফলে পেছন দিকটা বেশ ওপরে ভেসে উঠেছে। এখনও গভীর অন্ধকার।

সকালে ইঞ্জিনঘরের মেইন সুইচ অফ করে দিয়েছিলাম প্রতিদিনের অভ্যাসে। আলো জ্বালাতে গেলে ওখানে যেতে হবে। কিন্তু দরজা খুলে প্যাসেজে যেতে সাহস পাচ্ছি না। আমার মনে হচ্ছিল, সাপটা এখন প্যাসেজের ওপর আস্তানা গেড়েছে। ও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে, আমাকে ওই পথ দিয়েই বেরুতে হবে। আমার জন্যে নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে ও।

লঞ্চের এই অংশে বন্দি হয়ে কয়েকদিন থাকা হয়তো সম্ভব। কিন্তু ওপরের জলের ট্যাংক শূন্য হয়ে গেলে পাম্প চালাতে না পারলে সমস্যা শুরু হবে। যা খাবার আছে, তাতে বহুদিন চলে যাবে। হয়তো এর মধ্যে কেউ এসে উদ্ধার করতে পারে আমায়। আমরা জাপানে পৌঁছইনি দেখে কি খোঁজখবর করা হবে না? মিডিয়া নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকবে না। কিন্তু সমস্যা হল, আকাগ থেকে এই নঞ্চ জঙ্গলে ঢুকে থাকায় ওরা দেখতেই পাবে না।

রাতটা কেটে গেল।

একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকছিল না। সাপটার যা শক্তি, তাতে ও স্বচ্ছন্দে দরজা ভেঙে এদিকে আসতে পারে। দরজা ভাঙা ওর পক্ষে খুব সহজ কাজ। কিন্তু সেই চেষ্টাগুল্যে ও করছে না। হয়তো সাবিতানির শরীরটা সম্পূর্ণ হজম না হওয়া পর্যন্ত ও আরাম করছে। একা কিনা তাও বুঝতে পারছি না। সাধারণত এই ধরনের সাপ একাই থাকতে ভালোবাসে। তবে বিশেষ সময় এলে সঙ্গিনীর খোঁজ করে

এই ডায়েরি আমি কেন লিখছি, জানি না। কোনওদিন এটাকে সভ্য সমাজে নিয়ে যেতে পারব কিনা তাও জানা নেই। তবে আমি যদি না থাকি তাহলে যদি কারও হাতে পড়ে, সে বুঝতে পারবে আমি কীরকম মানসিক অবস্থায় রয়েছি।

দিন কাটল, রাতও। মাঝে-মাঝে জানলা খুলে উঁকি মেরে দেখেছি। অলে মাছের ঝাঁক। একটা কুমির সাঁতরে গেল। মনে পড়ল সাবিতানি দুটো মাছ ধরেছিল যার একটা সেইরাত্রে আমরা খেয়েছিলাম। ফ্রিজ খুলতেই দ্বিতীয় মাছটাকে দেখতে পেলাম। ভেতরটা বহুক্ষণ ইলেকট্রিক না থাকা সত্ত্বেও ঠান্ডা রয়েছে। কিন্তু মাছটাকে দেখে আমার খেতে ইচ্ছে করল না। যে ধরেছিল সে নেই। আমি জানলা দিয়ে মাছটা জলে ফেলে দিতেই কোথেকে একটা ছানাকুমির ছুটে এসে ওটাকে গিলে

ফেলল। পরদিন সকালের পর একটা কাণ্ড হল। লঞ্চ দুলতে লাগল, পেছনের এবং সামনের অংশ সমান হয়ে জলের ওপর আগের মতো ভাসল। অর্থাৎ সাপটা লঞ্চ ছেড়ে নেমে গিয়েছে।

আমি উত্তেজিত হলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। সাপটা যদি কিছু দূরে চলে যায়, তাহলে একটা সুযোগ আমি নিতে পারি। লঞ্চ ছেড়ে ডাঙায় নেমে গেলে এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে পারি। কিন্তু যদি কোথাও থাকার জায়গা না পাওয়া যায় তাহলে এই লঞ্চেই ফিরে আসতে হবে আমাকে। তাই যাওয়ার সময় প্যাসেজের এনিকটার দরজা ভালো করে বন্ধ করে যাব। আর সময় নষ্ট না করে এবার উঠতে হবে।...

এরপর ডায়েরির পাতাগুলো একেবারে সাদা।

মিলনের খেয়াল হল প্যাসেজের শেষে ভেতরে যাওয়াটা দরজাটা সে বন্ধ দেখেছিল। মাইকেল মুরহেড নিশ্চয়ই আর লঞ্চে ফিরে যাননি। গেলে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা ডায়েরিতে লিখতেন। যদি ডাঙায় পা দিয়ে থাকেন, তাহলে কিছুক্ষণ হেঁটে জঙ্গল পেরিয়ে এলে এই চাষের জমিতে পৌঁছে গেছেন। তখন বৃদ্ধ এবং কাজের লোকটি নিশ্চয়ই তাকে সাহায্য করেছে।

সকালে কাজের লোকটিকে জিজ্ঞাসা করল মিলন। কিন্তু তার প্রশ্নের কোনও অর্থই লোকটা

ধরতে পারল না। সে যা জিজ্ঞাসা করছে তার জবাবে মাথা নেড়ে না বুঝিয়ে যাচ্ছে লোকটা। তখন ইশারায় সে বোঝাতে চাইল। জঙ্গলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বোঝাল কেউ সেখান থেকে হেঁটে

এসেছে কিনা? এবার সেই একই উত্তর না।

মিলন জিজ্ঞাসা করল, 'তুমি আসার পর কখনও তিনজন মানুষ ছিলে?'

সে মাথা নেড়ে দুটো আঙুল দেখাল।

অর্থাৎ মাইকেল মুরহেড এখানে আসেনি। তাহলে কী হল তাঁর? তিনিও কি সাপের পেটে গিয়েছেন? অথবা কুমিরের? লঞ্চ থেকে নেমেছিলেন কীভাবে? অ্যালুমিনিয়ামের সিঁড়িটা তো চোখে পড়েনি তার। তাহলে কি সেই সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় কুমির তাকে জলে টেনে নিয়ে গিয়েছে? সিঁড়িটাও নিশ্চয়ই অলের তলায় তলিয়ে গেছে। একজন অচেনা মানুষের অন্যে মন বিষণ্ণ হয়ে গেল মিলনের।

কিন্তু কাজ শুরু করতেই হল! খাতায় এখানকার যাবতীয় গাছগাছালি, শস্য, হাঁস এবং মুরগি নথিভুক্ত করল। সামনের সপ্তাহে নৌকো এলে কী-কী বস্তু পাঠানো যেতে পারে তার একটা তালিকা করে লোকটাকে বোঝাল। এখানে বস্তা এবং পিচবোর্ডের বাক্স রাখা আছে। কী করে প্যাক করতে হবে, লোকটা জানে।

ঘুরতে-ঘুরতে জমির শেষপ্রান্তে এসে মিলন দেখল, পরপর কয়েকটা টিনের কৌটো রাখা আছে জঙ্গল বরাবর। কৌটোর ভেতর তরল পদার্থ যে অ্যাসিড তা বুঝতে অসুবিধে হল না। লোকটা

সঙ্গে ছিল। হেসে হাত ভাঁজ করে সাপের ফণা দেখাল।

কাল জঙ্গলে যাওয়ার সময় সে লক্ষ করেনি। এখন লোকটা তাকে দেখাল। পাঁচ হাত দূরে দূরে অ্যাসিড কৌটোয় রাখা হয়েছে। সম্ভবত কার্বলিক অ্যাসিড। লোকটা সাতটা আঙুল তুলে বোঝাল সাতদিন অন্তর অ্যাসিড পালটে দেওয়া হয়।

এতক্ষণে স্পষ্ট হল। এই কার্বলিক অ্যাসিডের জন্যে জমিতে সাপ ঢুকতে পারে না। এই বিশাল সাপটিও নিশ্চয়ই কার্বলিক অ্যাসিড সহ্য করতে পারেনি। বৃদ্ধ ভদ্রলোক এইভাবে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলেন।

আজ দুপুরে খাওয়ার আগে সমুদ্রে স্নান করল মিলন। যখন প্রায় স্নান শেষ, তখনই ডলফিন তিনটে দেখা দিল। বাচ্চাটা তার শরীর ঘেঁষে চলে গেল। মিলনের খুব মজা লাগছিল। ওরা বোধহয় মাছ খেয়েই বেঁচে থাকে। অতএব ওনের খাওয়ার জন্যে সে কিছুই আনতে পারে না। সে পাড়ে উঠে গামছায় শরীর মুছতে-মুছতে দেখল, আজও একটা মাছ ছুড়ে দিল বড় ডলফিনের একজন। এটা একটা পেল্লাই পমফ্রেট মাছ।

মাছ দেখে লোকটা খুব খুশি। গতদিনের করা মাংসের ঝোল আর পমফ্রেট ভাজা দিয়ে তাকে খেতে দিল দুপুরে। বারংবার মাহ দেখিয়ে আঙুল নেড়ে জিজ্ঞাসা করছিল, কী করে মিলন ওটাকে ধরল? মিলন হাসল, কোনও জবাব দিল না।

সারাটা দিন ধরে নিজের এলাকা বুঝে নিয়েছে মিলন। নিতে গিয়ে মনে হয়েছে, এখানে আরও বেশি ফসল ফলানো সম্ভব। হাঁস-মুরগি ছাড়াও ছাগল এনে তাদের বংশবৃদ্ধি করার সুবিধে আছে। এবার নৌকো এলে মালিককে এসব বৃত্তান্ত চিঠি লিখে জানাতে হবে। বদলে বেশ কিছু জিনিস শহর থেকে আনানো দরকার। সেটার তালিকাও করতে হবে।

বিকেল নামতেই আকাশের চেহারা বদলাল। সমুদ্রের ওপর দূর দিগন্তে একটুকরো মেঘ হঠাৎ ঘনিয়ে গেল। অর্থাৎ আজ বৃষ্টি হবে।

বৃষ্টির কথা মনে আসতেই লঞ্চের কথা মনে এল। এখন ওখানে সাপ নেই। নিশ্চিন্তে সুন্দরভাবে থাকা যায় ওখানে। সে জঙ্গলের দিকে তাকাল। এর মধ্যে সেখানে ঘন ছায়া জমে গেছে। এই সময় জঙ্গলে পা রাখা ঠিক নয়। মিলন ঠিক করল কাল দুপুরের পরই সে লঞ্চে চলে যাবে।

সন্ধের পরেই ঝড় উঠল। টঙের ঘরে বসে সেই ভয়ানক দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড ভয় পেল মিলন। সমুদ্রের ওপর দিয়ে ঝড় ছুটে এসে আছড়ে পড়ছে দ্বীপের ওপর। নারকেল গাছগুলোর ঝুঁটি ধরে যেন মাটিতে শুইয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ টঙের ঘরটা কেঁপে উঠল। তারপর মাথার চালটা উড়িয়ে নিয়ে গেল দানববাতাস। টংটা যদি মাটিতে আছড়ে পড়ে তাহলে নির্ঘাত মৃত্যু। সে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামার চেষ্টা করেও থেমে গেল। ঝড় তার শরীরটাকে অবলীলায় উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। অন্ধকারে গাছ পড়ার আওয়াজ হল। মিলন তৈরি থাকল। যদি টং ভেঙে পড়ে তাহলে সে লাফ দেবে। তাতে হাত-পা ভাঙতে পারে কিন্তু উত্তের তলায় চাপা পড়ে মরতে হবে না।

তারপর ধীরে ধীরে ঝড়ের তাণ্ডব কমতে লাগল এবং তখনই সমূদ্রের গর্জন কানে এল। এখানে আসার পরে সমুদ্রের এমন গর্জন শোনেনি মিলন।

সে ধীরে-ধীরে নীচে নেমে এল। এসে অবাক হয়ে গেল। সমুদ্রের জল চলে এসেছে রান্নাঘরের পেছনে। এতটা ওপরে কী করে জল উঠে এল? রান্নাঘরের এবং স্টোররুমের অবস্থা শোচনীয়। দরজা ভেঙে গেছে, একখানা জানলাও। সে লোকটির উদ্দেশ্যে চিৎকার করল। কিন্তু কোনও সাড়া পেল না। ও কথা বলতে পারে না বটে। কিন্তু গোঙানি তো মুখ থেকে বের হয়।

অন্ধকার ঝাপসা দেখাচ্ছে চারপাশ। এই সময় বৃষ্টি নামল হুড়মুড়িয়ে। রান্নাঘরের ভাঙা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল মিলন। বৃষ্টি পড়ছে সপাটে। হঠাৎ মনে হল ঘরের অন্ধকারে কেউ নড়াচড়া করছে। ঝড়ের তাণ্ডবের সময় কোনও বন্যপ্রাণী এখানে আশ্রয় নিতেই পারে। ভয় পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে টঙের নীচে গিয়ে দাঁড়াতে মাথা রক্ষা পেল।

সেই সময় বিদ্যুৎ-এর ঝলকানিতে সে দেখতে পেল রান্নাঘরে ভাঙা দরজায় নিরীহ মুখে হনুমানটা বসে আছে। তার মানে সে যে আওয়াজ পাচ্ছিল তা ওই হনুমানের কারণে। ঘণ্টাখানেক বাদে বৃষ্টি থামলে সে সোঙ্গা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে হনুমানটা যেন আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে কিচিরমিচির শব্দ করতে লাগল। ভেতরে ঢুকে হাতড়ে হাতড়ে কুপি আর দেশলাই খুঁজে নিয়ে আলো জ্বালাতেই অবাক হয়ে গেল মিলন।

ঘরের এক এক কোণে মরার মতো পড়ে ঘুমাচ্ছে লোকটা। সে এগিয়ে গিয়ে জোরে ঝাঁকুনি দিতে কোনওমতে ঘুম ভাঙল। মিলন বলল, 'এত বড় প্রলয় হয়ে গেল আর তুমি ঘুমাচ্ছ?'

লোকটা খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে উঠে বাইরে এসে অদ্ভুত গলায় কাঁদতে লাগল। এই পাতলা অন্ধকারেও সে ঝড়ের তাণ্ডব দেখতে পেয়ে গেছে।

মিলন দেখল, আকাশ ধীরে-ধীরে পরিষ্কার হয়ে গেল। তারা ফুটল। সে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে হতাশ হল। তার শোওয়ার বিছানা ভিজে চপচপ করছে। ওগুলো সরিয়ে কাঠের ওপর চিৎ হয়ে শুতেই আকাশটা যেন চোখের সামনে চলে এল। অগুনতি তারা জ্বলজ্বল চোখে যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। কে বলবে একটু আগে ঝড় এবং বৃষ্টি ওদের মুখ ঢেকে রেখেছিল!

সকাল থেকে মেরামতের কাজ শুরু করেছিল ওরা। মিলন দেখল লোকটার এই ব্যাপারে দক্ষতা আছে। টন্ডের ছাদটা উড়ে খানিকটা দূরে পড়লেও ভেঙে চৌচির হয়নি। সেটাকে কয়েক অংশে খুলে সিঁড়ি বেয়ে ও ওপরে নিয়ে এল। হাত মেলাল লোকটি। ধীরে-ধীরে ছাদ তার নিজের জায়গায় চলে এল। পেরেক পুঁতে সেটাকে শক্ত করল ওরা। ভেজা বিছানা রোদ্দুরে শুকোতে দেওয়া হয়েছিল। তারপর রান্নাঘরের দরজা নিয়ে ব্যস্ত হল লোকটা।

মিলন দেখল যে গাহুগুলো পড়েছে, সেগুলো কেটে পরিষ্কার করতে কত করাতের প্রয়োজন। ওদের আর মাথা তুলে বাঁচার কোনও সম্ভাবনা নেই। তার চেয়ে কিছুদিন পড়ে থাকার পর শুকিয়ে

গেলে কাটতে সুবিধে হবে।

হঠাৎ হনুমানটা একটা উঁচু গাছের ডালে বসে চিৎকার শুরু করল। সঙ্গে লক্ষদ্বম্প। ওর এই আচরণের কারণ বুঝতে পারছিল না মিলন। কিন্তু লোকটা দৌড়ে চলে গেল সমুদ্রের দিকে। তার মুখ থেকে গোঙানি বের হল। ফিরে এসে উত্তেজিত হয়ে হাত নেড়ে মিলনকে ডাকতে লাগল।

মিলন সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে দেখল বহুদুরে কিছু একটা ভাসছে। এখান থেকে সেটা দেশলাই কাঠির চেয়ে বড় বলে মনে হচ্ছে না। তার পরেই সে বুঝতে পারল ওটা একটা নৌকো এবং এদিকে আসছে।

আজ নৌকো দ্বীপে আসবে, একথা তার জানা ছিল না। সে লোকটাকে ইশারায় বোঝাল প্যাক করা ডিম এবং ফলগুলো সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে আসতে। লোকটা সমানে মাথা নাড়তে লাগল। বোঝাল সেটা করার দরকার নেই। ওই নৌকা তাদের জিনিস নিয়ে যাওয়ার নৌকা নয়। মিলন বুঝতে পারল না এত দূর থেকে লোকটা বুঝছে কী করে। নৌকার তীরে ভেড়া পর্যন্ত অপেক্ষা

না করলে বোঝার উপায় নেই।

সমুদ্রের জল কাল রাত্রে বেশ বেড়ে গিয়েছিল। এখনও ঢেউগুলোর চেহারায় রাগী ছাপ আছে। এই ঢেউ ভেঙে নৌকো কী করে আসবে সে ভাবতে পারছিল না।

হঠাৎ নৌকাটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। দিগন্তের কোথাও সেই কালো দাগটা নেই। তার পরেই সেটা ভেসে উঠল ওপরে। সেটা যে নৌকা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অনেকটা এগিয়ে এসেছে ওটা। ঢেউ-এর দোলায় দুলছে, আড়ালে চলে যাচ্ছে আবার দৃশ্যমান হচ্ছে।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে যুদ্ধ করে নৌকাটা পাড়ের কাছে চলে আসতে লোকগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পেল মিলন। ছ'টা পুরুষ এবং একটা মেয়ে ওখানে রয়েছে। বসে থাকা সত্ত্বেও চুল এবং শরীরের গঠন থেকে ও যে মেয়ে তা স্পষ্ট বুঝতে পারল সে। মেয়েটা কোথায় যাচ্ছে? এই দারুচিনি দ্বীপের পরে তো কোনও জনবসতি নেই। আর এই দ্বীপেও মানুষ তো তারা দুজন।

আজ জল বেশি থাকায় নৌকো যখন বালি পর্যন্ত উঠে এল তখন উঠে দাঁড়ানো মেয়েটাকে দেখে অবাক হয়ে গেল মিলন।

নৌকা থেকে নেমে মেয়েটা বলল, 'ও। আপনারা বেঁচে আছেন।'

'মানে?'

'আমরা খবর পেয়েছিলাম আপনারা মরে গেছেন।'

'কে খবর দিল?'

'খবর বাতাসে উড়ে যায়। বাবা বলল, অফিসকে জানাতে হবে যে, লোকটা মরে গেছে বিদেশ বিভূঁইতে এসে। তাই জানাবার আগে তুই একবার দারুচিনিতে গিয়ে নিজের চোখে দেখে আয়। আমার তো একদম ইচ্ছে ছিল না আসার। শুধু বাবার কথা রাখতে আসতে হল। তাও যদি এই মাঝিরা বলত ঝড়ের পরের দিন এখানে আসবে না, তাহলে রক্ষে পেতাম। ওরা এককথায় রাজি হয়ে গেল বলে চলে এলাম।'

এর মধ্যে সত্যি কথা কতটুকু ঠাওর করতে পারল না মিলন। এই মেয়ে মিথ্যে ছাড়া সত্যি বলে না। তাহলে তাদের মরে যাওয়ার খবর বিন্দুতে পৌঁছায়নি। ওর বাবাও ওকে এখানে দেখে যাওয়ার জন্যে পাঠায়নি। তাহলেও ও এল কেন?

'তুমি এখানে কাজ করো?' লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল মেয়েটি।

'ও কানে শুনতে পায় না। তাই আপনার সত্য বা মিথ্যে ওর কাছে এক।'

'মিথ্যে মানে? আপনার ধারণা আমি মিথ্যে বলি? অদ্ভুত লোক।' বলে মেয়েটি এপিয়ে গেল

লোকটিকে ইশারা করে। সম্ভবত দ্বীপ ঘুরে দেখতে চায় সে।

মিলন মাঝিদের জিজ্ঞাসা করল, 'আসতে কষ্ট হয়নি তো?'

'কষ্ট? প্রাণ হাতে করে এসেছি। মেয়েমানুষ এমন কান্নাকাটি করল যে, না বলতে পারলাম না। এখন তাড়াতাড়ি ফিরে না গেলে বিপদে পড়ব।'

'কীসের বিপদ?'

'ভাটার সময় সমুদ্র ভেতরে টানে।'

'কিন্তু ও বলল তোমরা এককথায় রাজি হয়ে এসেছ।' মিলন বলল।

'বিন্দুর মানুষ তো। তার ওপর মেয়েমানুষ। যে জানে সে বিন্দুতে বিয়ের সম্বন্ধ করে না। যাক গে, ওকে বলুন পাঁচ মিনিটের মধ্যে যা কাজ, তা করে ফেলতে। জলে টান পড়েছে।'

মিলন সমুদ্রের তীর ছেড়ে ভেতরে ঢুকল। মেয়েটিকে দেখতে পেল না সে। লোকটাও ধারে- কাছে নেই। রান্নাঘর, স্টোররুম, টঙ্কের ঘর, কোথাও নেই। সে চিৎকার করল, 'আপনি কোথায়? মাঝিরা ডাকছে।' কিন্তু কোনও সাড়া এল না।

মুরগিরা যেখানে থাকে, তার তারের বেড়া নুইয়ে পড়েছিল। সেটাকে সোজা করতে কিছুটা সময় লাগল। কাল রাত্রের ঝড়ে মুরগি এবং হাঁসের কোনও ক্ষতি হয়নি। কারণ, ঝড় ওপর দিয়ে হরে গিয়েছিল।

মিনিট কুড়ি পরে ওদের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসতে দেখল মিলন। মেয়েটার দুই হাত বুকের ওপর কিছু সন্তর্পণে ধরে রেখেছে। কাছে এসে বলল, 'খুব আহত হয়েছে পাখির ছানাটা। আপনাকে দিয়ে যাচ্ছি, বাঁচিয়ে রাখলে আপনার মঙ্গল হবে।'

মিলন বলল, 'তাড়াতাড়ি যান। মাঝিরা ডাকছে।'

'যাচ্ছি। এই জায়গাটা কেমন লাগছে?'

'খুব খারাপ।' একটু রেগে গিয়ে বলল মিলন।

'অ্যাতো ভালো জায়গা, কী সুন্দর গাছপালা, সমুদ্র, তবু আপনার খারাপ লাগছে? আপনারা, যারা শহরে থাকেন, তারা যাচ্ছেতাই লোক।' মেয়েটি বলল।

'তাই নাকি। আপনি এখানে কতদিন থাকতে পারবেন?"

'সারাজীবন। কিন্তু বাবা থাকতেই দেবে না।' বলেই মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, 'আচ্ছা, আমার নামটা মনে আছে আপনার?'

মাথা নাড়ল মিলন, 'না' ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলল সে।

'তা তো থাকবেই না। আমার নাম ঝিনুক। আর ভুলবেন না কিন্তু।'

'আপনি কিন্তু স্টেশনে এসে অন্য নাম বলেছেন।'

ইস্! কী যে বলে। আমি ঝিনুক, ঝিনুক, ঝিনুক।'

'আপনার জন্য মাঝিরা।'

'অপেক্ষা করে থাকবে।'

লোকটি চলে গিয়েছিল সমুদ্রের দিকে। হঠাৎ দৌড়ে এল। এসে হাত নেড়ে গোঙাতে লাগল। ঝিনুক জিজ্ঞাসা করল, 'কী বলছে ও?'

মিলন দ্রুত সমুদ্রের ধারে চলে এল। পাড় ছেড়ে নৌকা ততক্ষণে চলে গিয়েছে অনেক দুরে। বড়-বড় ঢেউ মাঝে-মাঝেই তাকে আড়াল করছে।

সে মুখ ফিরিয়ে বলল, 'ডাটার ভয়ে ওরা অপেক্ষা করে থাকল না।'

'ওমা। তাই তো। এখন কী করে যাব?' ঝিনুক করুণচোখে তাকাল।

'আবার নৌকা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর যদি সাঁতরে যেতে পারেন

তাহলে-

'আপনি আমাকে মেরে ফেলতে চান?'

'আপনাকে আমি অনেকবার বলেছি। আপনি কেয়ার করেননি।

ঝিনুক তার প্যান্টের পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে বোতাম টিপল। তারপর মাথা নাড়ল, 'দূর। এখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না।' সেটটা বন্ধ করে পকেটে রেখে বলল, 'একবস্ত্রে থাকতে হবে এখানে। খেতে পাওয়া যাবে?'

'আমরা যা খাই, তাই পাবেন।'

'শুনুন। আমি একজন অল্পবয়সি মেয়ে আর আপনারা দুজন পুরুষ। হনুমানটাকে নিয়ে ভয় নেই। ওটা মেয়ে হনুমান। দেখবেন, আমার সম্মান যেন হানি না হয়। যদি সেই চেষ্টা করেন, তাহলে বিন্দু পেরিয়ে ট্রেনে উঠতে এ জীবনে পারবেন না। মনে থাকবে তো?' ঝিনুক তাকাল।

'খামোকা আপনার সম্মান নষ্ট করব কেন?'

'ছেলেদের বিশ্বাস নেই। যাক গে, আমার খুব খিদে পেয়েছে'

মিলন লোকটিকে ইশারায় বোঝাল ঝিনুকের খিদে পেয়েছে। ওকে ডিম সেদ্ধ বা ডিমের ওমলেট করে দিতে। লোকটা চলে গেল।

এখন সূর্য অনেকটা পশ্চিমে ঢলেছে। ঝিনুক জিজ্ঞাসা করল, 'আমি কোথায় ঘুমাব? কোন ঘরে?'

'জানিয়ে এলে একটা চেষ্টা করা যেত। এখন হয় রান্নাঘরে ঘুমাতে হবে। নয়তো টঙের

ঘরে।'

'টঙের ঘরে মানে?'

মিলন তাকে টঙের নীচে এনে দেখাল। ঝিনুক ঘাড় উঁচু করে দেখে বলল, 'ওখান থেকে পড়ে যাব না তো?'

'না। বরং অত উঁচুতে ঘুমালে নিরাপদে থাকবেন। উঠে দেখুন।' ঝিনুক ধীরে-ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে ঘর দেখে আনন্দে চিৎকার করল, 'খুব ভালো। আপনি ওপরে আসবেন?'

'এখন না।'

রান্নাঘরে গিয়ে লোকটাকে বোঝাল মিলন, তাকে কী-কী করতে হবে। দুটো ডিম সেদ্ধ আর এক বাটি মুড়ি নিয়ে ওপরে উঠে গেল লোকটা। পেছন-পেছন হনুমানটাও।

হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল মিলনের। ওটা যে একটা হনুমতী, হনুমান নয় তা তার নজরে পড়েনি। কিন্তু প্রাণীটা আর একটু ওপরে উঠতেই সে হাঁ হয়ে গেল। ওর যৌনাঙ্গ বলছে ও অবশ্যই হনুমান। তার মানে ঝিনুক তখন মিথ্যে বলেছে। কীভাবে অবলীলায় মিথ্যে বলে যায় মেয়েটা?

মিলন মনস্থির করল। মেয়েটা যখন টন্ডের ঘরে থাকবে, তখন সে নিশ্চিন্তে লঞ্চে চলে যেতে পারে। আর দেরি করলে অসুবিধে হবে। সেই শক্ত লাঠিটা খুঁজে বের করে সে হাঁটতে শুরু করতেই দেখল হনুমানটা তরতর করে নেমে তার পেছন পেছন আসছে। জমির সীমা পার হওয়ার সময় তার নজরে পড়ল সাপটাকে। অ্যাসিডের কৌটোর পাশে মরে পড়ে আছে কালো লম্বা সাপটা। এটা কেউটে জাতীয় কিছু। হনুমানটা সেই সাপ দেখে চেঁচাতে লাগল। মিলন জঙ্গলে ঢুকে পড়ল।

লাঠি দিয়ে গাছের ডাল সরিয়ে-সরিয়ে সে খাড়ির কাছে যখন পৌঁছাল তখন সূর্য ডুবতে চলেছে। এখনও আলো আকাশে, গাছের মাথায়। কিন্তু দিক ঠিক করতে না পেরে সে লঞ্চ থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে।

আর একটু এগোতেই বেশ বড়সড় চেহারার দুটো জব্ধকে উলটোদিকে ছুটে যেতে দেখল।

বেশ ভয়ে-ভয়ে সে লঞ্চের কাছে পৌঁছে দেখল কাল রাত্রের ঝড়ে ওপরের গাছটা আরও নীচু হয়েছে। একটা ডাল প্রায় নেমে গেছে ছাদের ওপর। সেই গাছ ধরে সে বেশ সহজে চলে এল ডেকের ওপর। সতর্ক হয়ে চারপাশে তাকাল। জলের কুমিরগুলো চারপাশ থেকে ছুটে এসে ভিড় করেছে লঞ্চের পাশে। কিন্তু সেই সাপের কোনও জোড়াকে দেখতে পেল না সে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই সেটা ভালো করে বন্ধ করল মিলন। ইঞ্জিনঘরে ঢুকে সুইচ টিপতেই আলো জ্বলল!

এত কাছে, বড়জোর পঁয়তাল্লিশ পঞ্চাশ মিনিট অঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটলে এমন আরামদায়ক লঞ্চে পৌঁছানো যায় জেনেও তার আগের বৃদ্ধ অথবা লোকটা এটাকে ব্যবহার করেনি শুধু সাপটার ভয়ে। লোকটা এখনও জানে না, সাপটা কুমিরের পেটে চলে গেছে।

মিলন ইঞ্জিনের সামনে দাঁড়াল। ভালো করে দেখে স্টার্ট লেখা বোতামটা টিপতেই লঞ্চ

কেঁপে উঠে ঘড়ঘড় শব্দ শুরু হল। সে বড় হুইলটা বাঁ-দিকে ঘোরাতে লঞ্চ বাঁ-দিকে সরে এল। শব্দটা এত প্রবল যে তাড়াতাড়ি স্টপ লেখা বোতামটা টিপল সে। সঙ্গে-সঙ্গে চারপাশ চুপচাপ হয়ে। গেল। মাইকেল মুরহেড ঠিকই লিখে গেছেন, ইঞ্জিন খারাপ হয়েছে কিন্তু একদম বিকল হয়নি। প্যাসেজের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে সেটাকে বন্ধ করল মিলন। জানলা দিয়ে দেখল, এখনও

দিনের আলো মরেনি। সে রান্নাঘরে ঢুকে একটা টিনফুডের কৌটো তুলে নিল। তারপর টিনকাটার বের করে সেটাকে কাটতে যেতেই ছাদে শব্দ হল। যেন কেউ লাফিয়ে নামল।

সতর্ক হল মিলন। অত্যন্ত শক্তিশালী এবং বুদ্ধিমান জন্তু ছাড়া কেউ লঞ্চের দরজা ভাঙতে পারবে না। সাবিতানিকে যে সাপটা হজম করে ইঞ্জিনযরের পাশের প্যাসেজে বাসা বেঁধেছিল তার পক্ষে ভেতরের দরজা ভেঙে মুরহেডকে আক্রমণ করা অতি সহজ ছিল। কিন্তু দরজাটা বন্ধ দেখায় তার মাথা কাজ করেনি।

শব্দটা এগিয়ে গেল সামনে। মাথায় ওপরে লঞ্চের ছাদে কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তাকে দেখতে যাওয়া নির্বোধের কাজ হবে।

গ্যাস জ্বেলে টিনের খাবার গরম করে খাওয়া শুরু করল মিলন। ঝাল নেই, নূনও কম। এ ধরনের খাবার সে আগে খায়নি। খেতে ভালো লাগছিল না। কিন্তু খাবারটা একটুও নষ্ট হয়নি বলে জোর করে শেষ করল সে।

এখন অন্ধকার নেমে গেছে। শুলেই ঘুম আসবে না। হঠাৎ নজরে পড়ায় মিলন একটা হুইস্কির বোতল তুলে নিয়ে দেখল, মেড ইন গুটল্যান্ড। তাহলে একেই স্কচ হুইস্কি বলে?

একটা গ্লাসে সামান্য তরল পদার্থ ঢেলে বোতলের মুখ বন্ধ করে আগের আয়গায় রেখে দিল মিলন। তারপর চুমুক দিল। প্রথমবার গিলতে গিয়ে মনে হল গলা দিয়ে আগুনের গোলা নামছে। সে মাথা ঝাঁকাল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে একটা ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি হল। সে আর-এক চুমুক দিল। এবার গলায় আগের মতো তাপ লাগল না।

সে একটা মোমবাতি খুঁজে বের করে ওটাকে জ্বালাল। এই লঞ্চে মুরহেডরা প্রচুর মোমবাতি আর লাইটার রেখেছিল। ইঞ্জিনঘরে গিয়ে সুইচ অফ করে মাঝখানের দরজা বন্ধ করে ফিরে এসে গ্লাস তুলল সে। বেশ মৌজ আসছে। এখন লঞ্চে বিদ্যুৎ নেই। কিন্তু মোমবাতির আলোয় আরও বেশি মজা লাগছে।

হঠাৎ আনলায় শব্দ হতে চোখ গেল সেদিকে। কাচের বাইরে লম্বা কিছু ঝুলছে। সাপ? সে কাচের কাছে চোখ নিয়ে গিয়ে দেখল যেটা ঝুলছে সেটা লোমে ঢাকা।

ওটা নড়তেই হেসে ফেলল মিলন। লেজ। নিশ্চয়ই হনুমানের লেজ। অর্থাৎ লঞ্চের ছাদে হনুমানরা আসর জমিয়েছে। গ্লাস শেষ করতেই কেমন ঘুমঘুম ভাব এসে গেল। আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল মিলন।

গোটা রাত একটানা ঘুমিয়ে যখন সে চোখ মেলল, তখন সবে দিনের আলো ফুটেছে। কাল রাত্রে খুব সামান্য ঘুম হয়েছিল। সারাদিন নানান টেনশনে কেটেছিল। তাই এতটা ঘুম ঘুমাতে পারল ভাবতেই হুইস্কির কথা মনে এল। এই ঘুম কি হুইস্কির সৌজন্যে?

জানলার কাছে চলে এল সে। জলের ওপর নদীর আলো সুন্দর দৃশ্য তৈরি করেছে। নদীতে প্রচুর মাছ আছে। সাবিতানি যদি ধরতে পারে, তাহলে তারও পারা উচিত। কিন্তু কোনও ঝুঁকি নিয়ে নয়।

জামাকাপড়, প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো এখানে আনা হয়নি। জল দিয়ে মুখ ধুয়ে বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখল সে। আঙুল দিয়ে চুল ঠিক করে নিল। এখানে থেকে সে রোজ ভোরে জমির কাজ দেখতে যেতে পারে। বিকেলের পর ওখানে কিছু করার নেই। তাই তখন ফিরে এসে এখানে রাতটা আরামে কাটানো যায়। মিলন সেটাই করবে বলে ঠিক করবা। তারপর কিচেনে গিয়ে গ্লাসে জল গরম করে টি-ব্যাগ আর চিনি ফেলে দিয়ে চা বানিয়ে ফেলল। ভালোই লাগল খেতে।

ওদের হনুমানটাই ওর খবর দিল। তাকে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে লাফিয়ে চিৎকার করতে লাগল। বোঝা যাচ্ছিল সে খুব খুশি হয়েছে। ওর চিৎকার শুনে লোকটি ছুটে এল। হাত- পা নেড়ে অবোধ্য শব্দে প্রশ্ন করতে লাগল যার একটা সরল অর্থ, কোথায় গিয়েছিলে রাত্রে?

মিলন ওর কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল। এই সময় কানে এল, 'তাহলে আপনি বেঁচে আছেন।'

ঝিনুকের কথা ওর খেয়ালই ছিল না। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'আপনার কোনও অসুবিধে হয়নি তো?'

'হলে আজ সকালে কী সুরাহা করতেন?' মাথা ঝাঁকাল, 'ধরুন কাল রাত্রে এই লোকটি আমাকে ভোগ করতে চেয়েছিল। এখন শুনে কী করবেন?'

'আমি অবিশ্বাস করব।' জবাব দিল মিলন।

'বাঃ! তাহলে তো কোনও দায় নিতে হয় না। কোথায় ছিলেন কাল রাত্রে? আমি অবশ্য সকালে জানতে পারলাম আপনি ছিলেন না।

"হ্যাঁ।"

'ও আপনাকে এসে বলায় জানলেন?'

'কী ভাষায় বলল?"

'হাত নেড়ে। বোবারা যেভাবে বোঝায়।' ঝিনুক বলল, 'নিশ্চয়ই ওই জঙ্গলের ওপাশে কোনও আদিবাসীদের গ্রাম আছে। সেখানকার কোনও মেয়ের সঙ্গে এই দুদিনেই ভাব জমিয়ে নিয়েছেন।'

'কী করব বলুন। এই জনমানবশূন্য জায়গায় একা থাকা যায়!'

'চমৎকার।' হনহন করে চোখের সামনে থেকে সরে গেল ঝিনুক। ডিমের ঝোল আর অল্প ভাত দিয়ে ব্রেকফাস্ট খাওয়াল লোকটা। ঝিনুক ওই উত্তের ওপরের ঘরে চলে গেছে। সেখানে তার বাবার পৌঁছে দিতে হল।

আজ আলু লাগানো হল। প্রায় দশ কাঠা জমি মসৃণ করে আলু চাষের জন্যে উপযুক্ত রাখা হয়েছিল। স্টোররুম থেকে বস্তাবন্দি কনকে ওঠা আলু আধ হাত ব্যবধানে পুঁতে দিল লোকটা। মিলন তদারকি করল। কাজ শেষ হতে দুপুর গড়িয়ে গেল। এবার লোকটা গেল দুপুরের খাবার রান্না করতে। মিলন টঙের দিকে তাকাল। কীরকম মায়া তৈরি হল মনে। সে ওপরে উঠে দেখল, ঝিনুক

চিত হয়ে শুয়ে আছে।

'শরীর ঠিক আছে তো?' জিজ্ঞাসা করল মিলন।

'বেঠিক হলে নিশ্চয়ই খুশি হবেন।' গুয়ে-গুয়ে জবাব দিল ঝিনুক।

'আপনি আমার ওপর অযথা রাগ করছেন।'

'মোটেই না। নিজেকে অতটা দামি ভাববেন না।'

'মানে?'

'আমি আলতুফালতু লোকের ওপর রাগ করি না।'

'খুশি হলাম।'

'আমার শরীর খারাপ।"

'ও। তাহলে আপনি রেস্ট নিন।' নামার জন্যে নীচে পা নামাল মিলন। সঙ্গে-সঙ্গে উঠে বসল ঝিনুক, 'রেস্ট নিয়ে-নিয়ে শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে থাকা যায়?'

'ও। তাহলে ওই লোকটার সঙ্গে হাত মেলান না। ও এখন রান্না করছে, আপনি নিশ্চয়ই খুব

ভালো রান্না করেন।' মিলন বলল।

'না। খুব খারাপ রান্না করি বলে কেউ খেতে চায় না।'

'তাহলে একটু পরে মুরগিগুলোকে ডেকে খাইয়ে বেড়ার ভেতর নিয়ে আসুন। এটাও একটা

কাজ।'

'আপনি এখন কী করবেন?'

'স্নান করব।'

'স্নান? কোথায়?'

'সমুদ্রে।'

ঝিনুক উঠে দাঁড়াল, 'আমিও স্নান করব। কাল থেকে গায়ে জল না দিয়ে বিশ্রী লাগছে।' এক মুহূর্তে ভাবল মিলন, তারপর বলল, 'আপনি তো সঙ্গে কিছু আনেননি, কীভাবে স্নান

করবেন?'

'এখানে বাথরুম নেই?'

হেসে ফেলল মিলন, 'না।'

'উঃ। যতদিন আবার নৌকা না আসবে ততদিন এইভাবে থাকতে হবে?'

'ওপাশে অঙ্গলের গায়ে একটা ঝরনা আছে। পাবি ছাড়া কিছু নেই ওখানে। নিরাপদে জামাপ্যান্ট ছেড়ে স্নান করতে পারেন।'

'অসম্ভব। ওই লোকটা আছে, হনুমানটা আছে।'

'ওটা তো মেয়ে হনুমান, আপনি বলেছেন।'

নেমে এল মিলন।

বারমুডা পরে আরামসে স্নান করতে-করতে মিলনের খেয়াল হল, ডলফিনদের আজ দেখা যাচ্ছে না। এটা কেন হল? কলে রাত্রের ঝড়, সমুদ্রের উজ্জল হওয়ার সঙ্গে কি ওদের না আসার কোনও সম্পর্ক আছে? হয়তো জোয়ারের সময় বালির ওপরে উঠে এসেছিল, আর ফিরে যেতে পারেনি, অবশ্য সেটা বাচ্চাটার ক্ষেত্রে হতে পারে, মা-বাবা ওই ভুল করবে না। তারচেয়ে বরং ভাবা ভালো ওরা ওই সময় কোনও নিরাপদ জায়গায় চলে গিয়েছিল। এখনও ফিরে আসেনি।

স্নান শেষ করে ওপরে উঠে এসেই মিলন দেখল, ঝিনুক কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে গামছা ব্যবহার করে বারমুডা ছেড়ে প্যান্ট পরে নিতেই ঝিনুক বলল, 'দয়া করে ভিজে বারমুডা আর গামছা রেখে এখান থেকে চলে যান।'

মাথা নাড়ল মিলন, 'বেশ। তবে সাবধানে স্নান করবেন।'

'কেন?'

'আপনি বিন্দুতে আমাকে বলেছিলেন এখানে হাঙর থিকথিক করছে। একটা-দুটোও থাকলে বিপদ হবে।'

'আপনার তো হয়নি।'

'আমি অল্প জলে স্নান করেছি।'

'ঠিক আছে। উপদেশের জন্যে ধন্যবাদ। ও হ্যাঁ, আপনি কি আজ রাত্রেও জঙ্গলে গিয়ে

থাকবেন?'

"হ্যাঁ।'

'আশ্চর্য! আপনার মেয়েমানুষটিকে দেখতে ইচ্ছে করছে।'

মিলন জবাব না দিয়ে ওপরে উঠে এল।

কিছুক্ষণ পরে সমুদ্রের ধার থেকে তীব্র চিৎকার ভেসে এল। মিলন তখন চুল আঁচড়ে একটা শার্ট পরছিল। লোকটাও রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। দুজনেই দৌড়ল সমূদ্রের দিকে।

কোমর জলে দাঁড়িয়ে সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে ঝিনুক। তার পরনে বারমুডা, উর্ধ্বাঙ্গে গামছার আড়াল। ওরা আসতেই সে আঙুল তুলে দেখাল। বালির ওপাশে হনুমানটা বসে আছে। তার হাতে ঝিনুকের ছেড়ে যাওয়া শার্ট-প্যান্ট।

মিলন হেসে ফেলল। মনে-মনে বলল, শেষপর্যন্ত হনুমানই বস্ত্রহরণ করল। লোকটি তার অবোধ্য শব্দে ধমক দিতে হনুমান সুড়সুড় করে নেমে এল জামাপ্যান্ট নিয়ে। যেখানে ছাড়া হয়েছিল সেখানে রেখে চোখের আড়ালে চলে যেতে ওরা ফিরে এল।

খাওয়া শেষ করে মিলন লোকটাকে বোঝাল, সে জঙ্গলে যাচ্ছে। লোকটা হাত নেড়ে আপত্তি জানাল। মিলন হেসে মাথা নাড়ল, 'কোনও ভয় নেই। আমি লঞ্চে থাকব। সেখানে যে সাপটা ছিল, সেটা মরে গেছে।'

সঙ্গে-সঙ্গে লোকটার চোখ বিস্ফারিত হল। সে বিশ্বাস করতে পারছিল না।

লাঠিটা নিয়ে মিলন তার সুটকেস তুলে নিতেই ঝিনুক এগিয়ে এল, 'লঞ্চে থাকবেন মানে। আদিবাসীদের গ্রামে কি লঞ্চ আছে?'

'এখানে কোনও আদিবাসীদের গ্রাম আছে কিনা তা আমার জানা নেই।' 'তাহলে লঞ্চ কোথায় পেলেন?'

'কোনও অভিযাত্রী দলের লঞ্চ ঝড়ে খারাপ হয়ে ওপাশের খাড়িতে ঢুকেছিল। তারা হয় সাপের নয় কুমিরের পেটে চলে গিয়েছে। খালি লঞ্চটা এখনও থাকার বেশ উপযুক্ত। অন্তত এই ঘরগুলোর চেয়ে ঢের ভালো। আমি ওখানে রাত্রে থাকব, সকালে এখানে আসব।'

'বাঃ। আপনি ভালো জায়গায় থাকবেন আর আমি একটা মেয়ে এখানে পড়ে থাকব।'

'এখানে আর যাই হোক বিপদের সম্ভাবনা নেই। ওখানে আছে। জানালা-দরজা বন্ধ করে সারারাত কাটাতে হয়। সাপ-কুমির তো আছেই, আর যারা আছে তাদের সংখ্যা কম নয়। চলি।' 'ঠিক আছে। 'আপনার কথা সত্যি কিনা নিজের চোখে দেখে আসি।' এগিয়ে এল ঝিনুক, 'চলুন।'

'যেতে আসতে কষ্ট হবে। তা ছাড়া ফিরবেন কার সঙ্গে?'

ঝিনুক লোকটির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে যেতে ইশারা করল। লোকটা চটপট মাথা নেড়ে না বলে দিল।

'অসভ্য লোক তো! ঠিক আছে। যাওয়ার সময় রাস্তা চিনে নেব, একা ফিরতে অসুবিধে হবে না। আপনি যদি আমাকে ভীতু ভাবেন তাহলে ভুল ভাববেন। তা ছাড়া আমি ক্যারাটে জানি।' ঝিনুক হাঁটতে শুরু করল।

জঙ্গলের ডালপালা সরিয়ে দুবার যাওয়া-আসা করলেও সহজে পথ চেনা সম্ভব হয় না। মিলন আগে যাচ্ছিল, ঝিনুক তার পেছনে। হঠাৎ ঝিনুক চিৎকার করে সামনের দিকে হাত বাড়াতেই মিলন দেখল গাছের ডালে লেজের পাক দিয়ে ফণা তুলেছে বেশ বড়সড় শঙ্খচূড়। দ্রুত লাঠি চালাল মিলন। সাপটা ছিটকে পড়ল পাশের গাছের ডালে। একটু নড়ে স্থির হয়ে গেল। দু-হাতে মুখ ঢেকেছিল ঝিনুক। তার দিকে তাকিয়ে মিলন বলল, 'আমার প্রাণ বাঁচাবার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।'

'আমি কী করলাম? আপনিই তো মারলেন!' হাত সরাল ঝিনুক।

'এই চিৎকারটায় কোনও কথা ছিল না বলে সত্যিটা বুঝেছিলাম।'

আজ একটু বেশি সময় লাগল। খাড়ির ওপরে এসে ঝিনুক বলল, 'ও হো। কী সুন্দর। সমুদ্র থেকে ওই জল ভেতরে ঢুকছে, না।'

'সুন্দর দূর থেকে মনে হচ্ছে। জলে কুমির ভরতি।'

জলে কে নামতে যাচ্ছে?' '

ওই যে, গাছের আড়ালে কিছু দেখতে পাচ্ছেন?'

' ঝিনুক লক্ষ করে বলল, 'হ্যাঁ, ঘর মতো। ওটাই লঞ্চ?'

'হ্যাঁ। সামনের ডেকটার এপাশে গাছ পড়ে গিয়ে আড়াল করেছে।'

ভেতবটা ঠিকঠাক আছে?' '

'হ্যাঁ। কিন্তু এবার আপনি ফিরে যান। যেতে ঘণ্টাখানেক লাগবে। এখন না গেলে রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের ভেতরে দিয়ে হাঁটতে পারবেন না।'

'আমি একা ফিরে যাব।'

'আপনি তো তাই বলেছেন। একা ফিরতে অসুবিধে হবে না, ক্যারাটে আনেন। অতএব আপনার ভয় নেই। আমি বলছি যত শক্তি থাক অন্ধকার নামার আগেই ফিরে না গেলে-' 'এই সাপের সঙ্গে আমি ক্যারাটে লড়ব?' ঝিনুক মাথা নাড়ল, 'চলুন, লঞ্চের ভেতরটা আগে দেখি। তারপর সিদ্ধান্ত নেব।'

লঞ্চের কাছে এসে হনুমানগুলোকে দেখতে পেল। গাছের ডালে বসে মুখ ভ্যাংচাচ্ছে। মিলন বলল, 'ওই গাছের ডাল ধরে লঞ্চের ছাদে উঠতে হবে। সাবধানে আসুন।' 'ওই হনুমানগুলো?' 'ওরা আছে বলে জানবেন এখানে সাপ নেই।'

মিলনের দেখাদেখি ঝিনুক শেষপর্যন্ত ডেকে পৌঁছেই চিৎকার করল, কী সর্বনাশ। ওরা যে হাঁ করে আছে।'

'সামনে খাবার দেখছে অথচ খেতে পারছে না। কী করবে।' দরজার ছিটকিনি খুলে ভেতরে ঢুকে মিলন ডাকল, 'আসুন। দরজা বন্ধ করব।'

'এখনও তো বাইরে রোদ আছে।'

'আমি কোনও ঝুঁকি নিতে চাই না।'

এখন লঞ্চের ভেতর ছায়ামাখানো আলো।

মিলন বলল, 'প্যাসেজের ওই দরজাটা খুলে ভেতরটা দেখে আসুন। আমি ইঞ্জিনঘরে ঢুকছি'

'এটা ইঞ্জিনঘর।'

'ওটা চালু আছে?'

'না। একটু দেখি।' মিলন বলতেই ঝিনুক ওদিকে এগোল। ইঞ্জিনের ঢাকনাটা খুলল মিলন। এককালে গাড়ির মেকানিজম শেখার চেষ্টা করেছিল পাড়ার গ্যারেজে। সেই বিদ্যে নিয়ে লঞ্চ সারানো যায় না। তবু ইঞ্জিনের বিভিন্ন অংশ খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।

বুঝতে না পেরে স্টার্ট বোতামটা টিপতে ইঞ্জিন চালু হয়েই সেই বিশ্রী শব্দটা উত্তাল হল। মিলন ঢাকা খোলা ইঞ্জিনের ভেতরটা লক্ষ করছিল। ছোট্ট আগুনের ঝলক একটা অংশ থেকে ছিটকে বেরুচ্ছে। তাড়াতাড়ি ইঞ্জিন বন্ধ করে সে বুঝতে পারল ওই জায়গায় যে অংশটি ঘুরছে সেটা বেঁকে গিয়ে আটকে যাচ্ছে পাশের অংশের সঙ্গে। হয়তো ইতিমধ্যে সেটা ভেঙেও গেছে। ভেতর থেকে গরম হালকা ওপরে উঠছে। এখন হাত দেওয়া যাবে না।

ঢাকনা বন্ধ করে মিলনের খেয়াল হল, ছায়া ঘন হয়েছে লঞ্চের ভেতরে। ঝিনুকের কোনও শব্দ নেই। সে সুইচ টিপে লঞ্চের আলো জ্বালাল। প্যাসেজ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখল কেবিনের দরজা বন্ধ। তখনই খেয়াল হল নিজের সুটকেসের কথা। ওটা ভেতরে ঢুকে ইঞ্জিনঘরের দরজার পাশে প্যাসেজে রেখেছিল সে। ফিরে এসে দেখল, সুটকেসটা নেই।

সে কেবিনের দরজায় শব্দ করল, 'আমার সুটকেস কি ভেতরে?'

দরজা খুলে গেল। চমকে পিছিয়ে গেল মিলন। ঝিনুক তার শার্টপ্যান্ট ছেড়ে সুটকেসে রাখা মিলনের বারমুডা 'আর গেঞ্জি পরে ফেলেছে।

হেসে ঝিনুক বলল, 'কেমন দেখাচ্ছে?'

হতাশ মিলন বলল, 'কী বলব!'

'মেমসাহেবরা পরলে তো চোখ বড় করে প্রশংসা করতেন।"

'আপনার কি ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই?'

'আছে।' মাথা নাড়ল ঝিনুক।

'কিন্তু তার কোনও উদ্যোগ দেখছি না।'

'কাল সকালে দেখতে পাবেন। টয়লেট কোথায়?'

হাতের ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল মিলন। ঝিনুক সেদিকে চলে গেল। লঞ্চের স্টোররুমে ঢুকল মিলন। নানারকমের জিনিস এখানে সাজানো। হঠাৎ একটা লম্বা শক্ত বেতের ডগায় গোল আল দেখতে পেল সে। অনেকটা বাস্কেটবল খেলার নেট। সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে-করতে একটা লম্বা টিনের বাক্স দেখতে পেল। অনেকটা বিস্কুটের টিনের মতো। সেটা বেশ কসরত করে খুলতে হল।

খুলে চমকে উঠল মিলন। একটা লম্বা রিভলভার। তার পাশে অনেকগুলো গুলি। রিভলভারটা খুলতেই দেখতে পেল সবক'টা ঘরে গুলি ভরা আছে। বাক্সটার ভেতর ওটা রেখে দিল মিলন। এর কথাই মাইকেল মুরহেড লিখেছিলেন। তিনি সন্দেহ করেছিলেন কার্লোস কাস্টমসকে লুকিয়ে লঞ্চে আগ্নেয়াস্ত্র রেখেছে।

নেট-এর বেতটার দিকে তাকিয়ে মতলবটা এল। প্যাসেজের পাশে কাচের জানলার পাশে এসে দাঁড়াল সে। তারপর জানলার ছিটকিনি খুলে বাইরে তাকাল। আর একটু পরেই অন্ধকার ঘন হয়ে যাবে। নেট লাগানো বেতের মুখটা জলে ডুবিয়ে অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ।

হঠাৎ বেতে টান পড়তেই ওটা জল থেকে তুলে নিয়ে দেখল, বেশ বড়সড় একটা মাছ নেটের ভেতরে ছটফট করছে। ওটাকে ভেতরে টেনে আনতে গিয়ে আর একটু হলে কুমিরের হাঁ মুখে পড়তে যাচ্ছিল মিলন। মাছটাকে প্যাসেজের রেখে দ্রুত জানলা বন্ধ করে ছিটিকিনি তুলে দিল সে। ভেতরে আলো জ্বলতে দেখে, যা এখানকার পোকামাকড় দ্যাখেনি, দল বেঁধে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে।

এটা বেশ ওজনদার ভেটকি মাছ। ওটাকে নিয়ে কিচেনে ঢুকে ছুরি দিয়ে আঁশ ছাড়াতে লাগল সে। এই সময় স্নান শেষ করে গামছায় চুল গুকোতে শুকোতে দরজায় এসে দাঁড়াল ঝিনুক। 'ওমা। মাছ পেলেন কোথায়?'

'জলে।'

'ওখানে তো শুধু কুমির।'

কথা বলল না মিলন। ঝিনুক বলল, 'সরুন। আমি দেখছি।'

'সরি। আমি মাছটাকে ভালোভাবে খেতে চাই। আপনি তো বলেছেন আপনার রান্না খাওয়া যায় না। মিলন পেছন ফিরে বলতে-বলতে আঁশ ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। ঝিনুক সরে গেল শোওয়ার কেবিনের দিকে।

গ্যাস জ্বেলে কড়াইতে তেল গরম করে মাছটাকে ভাজল মিলন। দুজন লোক এই একটা মাছ

খেলে আর কিছুর প্রয়োজন হবে না।

ঝিনুক ফিরে এল, 'লঞ্চের ব্যবস্থা তেমন ভালো নয়।'

'কেন?'

'মাত্র একটা শোওয়ার কেবিন।'

'এই কিচেনেও শোওয়া যায়। আপনি এখানে শোবেন।'

'অসম্ভব। এখানে খাট নেই।'

'তাহলে আমি শোব কোথায়?'

'সেই জন্যেই তো বলছি লঞ্চের ব্যবস্থা ভালো নয়।'

হতাশ হয়ে তাকাল মিলন। তারপর টয়লেট চলে গেল।

এখন চারধারের পৃথিবীটা অন্ধকারে মোড়া। শোওয়ার কেবিনের বিছানায় প মুড়ে বসেছিল

ঝিনুক। মাছের প্লেট সামনে রেখে চেয়ারে বসে মিলন বলল, 'আলো এখন নিভিয়ে দিতে হবে।' 'সে কী! কেন?'

'লঞ্চে তেল কতখানি আছে জানি না। মোমবাতি জ্বালাতে হবে।'

'ভয় লাগবে না?'

'আলো বেশিক্ষণ জ্বললেই বন্যজন্তুরা আকর্ষিত হবে।"

'নিন, খান।'

'ভাজা?'

'এর বেশি বিদ্যে আমার জানা নেই।'

'এখানে চাল আছে।'

'জানি না। খুঁজে দেখিনি।'

মোমবাতি জ্বালল মিলন। তারপরে ইঞ্জিনঘরের সুইচ অফ করে বাইরে তাকাল। লঞ্চ থেকে কয়েক হাত দূরে জঙ্গলের এধারে দুটো লাল চোখ জ্বলছে। এদিকেই তাকিয়ে আছে জন্তুটা। চোখের অবস্থান দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না, ওর চেহারা বেশ বড়সড়। ইঞ্জিনঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই হনুমানদের চিৎকার শুরু হল। তারপর ধপ শব্দ এবং লঞ্চটা দুলে উঠল খানিকটা। ওপরের দিকে তাকাল মিলন। অন্ধটা লাফিয়ে ছাদে নেমেছে। কিন্তু ওর পক্ষে ভেতরে ঢোকা সম্ভব নয়। কেবিনের দরজায় এসে সে দেখল-ঝিনুক বিছানার ওপর উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল, তাকে দেখে আবার বসে পড়ল, '

শব্দ হল!'

'একজন শিকারি এসেছেন আমাদের সন্ধানে। ছাদে নেমেছেন।'

'অন্ধকারে চেনা যায়নি।'

'আপনি দেখেছেন?'

'চোখ জ্বলছিল। দেখেছি।'

বুকে হাত দিয়ে শ্বাস ফেলল ঝিনুক। তার পরই বলল, 'যাই বলুন। বেশ থ্রিলিং ব্যাপার।

অ্যাডভেঞ্চারের মতো।' 'মাহভাজা খান।' একটা মাহুভাজা তুলে নিয়ে চেয়ারে বসল মিলন। মাছভাজা নিয়ে দাঁতের তলায় রাখল ঝিনুক।

মিলন জিজ্ঞাসা করল, 'আপনার বাবা-মা চিন্তা করবেন না?'

'না। বাবাই তো পাঠাল। আমি বাড়িতে না থাকলে মা খুশি হয়।'

'এটা মিথ্যে কথা নিশ্চয়ই।'

'সত্যি কথা। আচ্ছা, আপনি বউকে নিয়ে এলেন না কেন?'

'থাকলে নিয়ে আসতাম।'

'মিথ্যে কথা। ছেলেরা অন্য মেয়ের কাছে বউ এর ব্যাপারটা বলে না।'

'যা ভাবতে পারেন, ভাবুন।

'প্রেমে পড়েননি?'

'পড়েছি। আপনি?'

'না। আমার মুখের জন্যে কেউ প্রেমে পড়তে চায় না।'

'কেন? আপনার মুখ তো বেশ সুন্দর।'

'মিথ্যে বলবেন না। আর আমি এই মুখের কথা বলছি না। মুখের কথার কথা বলছি। সত্যি কথা বলি তো তাই ছেলেরা কেটে পড়ে।'

'তাহলে বিয়ে করেননি?'

'করেছিলাম।'

'আচ্ছা। তিনি কোথায়?'

'নেই। আমি এখন বিধবা।'

হাসতে গিয়েও গম্ভীর হল মিলন। বিয়ে করেনি বললে সত্যি কথা বলতে হবে। তাই নিজেকে বিধবা বলতে হচ্ছে ঝিনুককে।

প্লেটের মাছ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ঝিনুক নামল, 'আমি দেখছি। এক্সট্রা মোমবাতি আছে?' আর-একটা মোমবাতি ধরিয়ে দিল মিলন। সে চলে গেলে মিলন ভাবল, রান্নাঘরে নয়, প্যাসেজে বিছানা করে শুয়ে পড়বে। বিছানা মানে একটা চাদর পেলেই হয়ে যাবে।

মিলন আবিষ্কার করল, একটা লম্বা বাক্সকে খাট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বাক্সের ডালা খুলতেই বেশ কিছু চাদর-বালিশ দেখতে পাওয়া গেল। বাঁ-দিকে অনেকগুলো জামাপ্যান্ট। ডালা বন্ধ করে চেয়ারে বসল মিলন। এখন ক'টা বাজে বোঝা যাচ্ছে না। তার খেয়াল হল ঝিনুকের কাছে মোবাইল সেট রয়েছে। নেটওয়ার্ক না পাওয়া গেলেও ঘড়ি তো সময় দিচ্ছে। সে গলা তুলে ডাকল, 'ঝিনুক?

'বলুন।' ঝিনুক দরজায় এল।

'আপনার মোবাইলে সময় দেখুন তো।'

'না। দেখব না।'

'কেন?'

'এখানে সময় স্থির হয়ে থাক। ওসব সভ্য জগতের ব্যাপার এখানে চলবে না। আচ্ছা, এখন যদি সাতটা অথবা আটটা বাজে, তাহলে আপনার কি লাভ? আপনি কি সময়মতো কোথাও যাবেন?' ঝিনুক হাসল।

বেশ রেগে গেল মিলন। যে মেয়ে মিথ্যে ছাড়া সত্যি বলে না তার মুখে এরকম জ্ঞানের কথা শুনতে তার ভালো লাগছে না। ঝিনুক খাটের ওপর বসল। বসে একটা পায়ের ওপর আর- একটা পা তুলে দিয়ে দুটো হাত শরীরের পেছনের বিছানায় রেখে বেঁকে বসল। মিলন বলল, 'মাছভাজা যদি খেতে ইচ্ছে করে, খেয়ে শুয়ে পড়ুন। শোওয়ার আগে মোমবাতি

নিভিয়ে দেবেন। একটু সরুন।' বাক্স থেকে একটা চাদর আর বালিশ বের করে উঠে দাঁড়িয়ে সে হাত বাড়াল হুইস্কির

বোতলটার জন্যে।

'কোথায় চললেন?'

'শুয়ে পড়তে।'

'কোথায়?'

'যেখানে শোওয়া যায়?'

'মাছের স্যুপ খাবেন না?'

'না। পেট ভরে গেছে।'

ওটা কী?

'খইস্কি। কাল খেয়েছিলাম। ভালো লেগেছিল।'

'ঘুমিয়ে পড়ার পর নিশ্চয়ই খাবেন না?'

'তো।'

'এখানে বসেই খেয়ে নিন। খেয়ে তারপর ঘুমাবেন।'

চাদর-বালিশ বিছানার কোণে রেখে গ্লাসে হুইস্কি ঢালল সে। মনে মনে বলল, সঙ্কোচের কোনও কারণ নেই। সে তো ডেকে আনেনি। কেউ যদি গায়ে পড়ে এসে তার প্রাইভেসি নষ্ট করে তাহলে সে চক্ষুলজ্জা করবে কেন?

দু-চুমুক দেওয়ার পর সে তাকাল। হঠাৎ তার লজ্জা করতে লাগল। বারমুডার সীমানার বাইরে ঝিনুকের পা কেমন চকচক করছে। আজ অবধি সিনেমার বাইরে কোনও মেয়ের এতটা পা সে দ্যাখেনি। চোখ তুলল। ওর পরনে তার গেঞ্জি। একটু বড় হওয়ায় গলার নীচের অনেকটা দেখা যাচ্ছে। না। সে দেখবে না। মুখ ঘুরিয়ে নিল মিলন।

'কী হল?' ঝিনুক বলল।

'আপনাকে দেখা যাচ্ছে না।'

'কেন? আমি অদৃশ্য হয়ে গেছি নাকি?'

'তা বলছি না। এটা খেলে মেয়েদের দিকে তাকাতে নেই। আপনি ওই চাদরটা দিয়ে শরীর ঢেকে বসুন।'

'এই গরমে আমি চাদর মুড়ি দিয়ে বসব? পাগল নাকি?"

'উঃ। তাহলে তাকাতে বলবেন না।'

'ওটা খেয়ে কী হল বলুন তো।'

'কিছু হয়নি।' আবার চুমুক দিল মিলন।

'এইটুকু খেত্রেই উলটোপাল্টা বকছেন। আমি অর্ধেক বোতল খেলেও আপনাকে চাদর মুড়ি দিতে বলব না।'

'অ্যা? আপনি কখনও স্কচ হইস্কি খেয়েছেন?'

'অনেকবার। বাবার সঙ্গে খেয়েছি। বাবা রাগ করেছেন এই বলে যে, তুই অর্ধেক খেয়ে ফেললি।' হাসল ঝিনুক।

'আবার মিথ্যে কথা! বেশ। এক গ্লাস খেয়ে দেখান।

শেষ হয়ে যাওয়া ক্লাসে কিছুটা হুইস্কি ঢেলে এগিয়ে ধরল মিলন। একটু ইতস্তত করেও গ্লাস নিল ঝিনুক। একবার দেখল। তারপর এক চুমুকে নির্জলা হুইস্কি কয়েক ঢোঁক গিলে ফেলল। গ্লাসটা ফেরত দিয়ে বলল, 'এই তো। খেয়ে নিলাম। আমার সঙ্গে পারবেন না।' বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল ঝিনুক।

আবার গ্লাসে হুইস্কি ঢালল মিলন। একবার চুমুক দিতেই ঝিনুক ফিরল একটা সসপ্যান নিয়ে। তাতে মাছের ঝোল টলটল করছে। টেবিলে সেটা রেখে খাটে বসতেই একটু টলে গেল ঝিনুক।

জিজ্ঞাসা করল, 'খাবেন না?'

'খেতে ইচ্ছে করছে না। এখন ঘুম পাচ্ছে?

'তাহলে এখানে শুয়ে পড়ুন।'

'এখানে না। এখানে আপনি। আমি বাইরে।'

এই সময় শোঁশোঁ শব্দ উঠল। লঞ্চটা কেঁপে উঠল থরথর করে। আকাশে যে মেঘ জমেছিল, গুরা বুঝতে পারেনি। মেঘ ডাকল, কাচের জানলা চুইয়ে বিদ্যুতের ঝলক দেখা গেল। আর তখনই মাথার ওপর ছাদে শব্দ হল। কেউ যেন ছাদে নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে।

মিলন উঠে চাদরের জন্য হাত বাড়াতেই ঝিনুক তার হাত ধরল, 'ন', প্লিজ। আমি যদিও ভয় পাইনি, তবু আপনি বাইরে যাবেন না।'

সেই সময় খুব জোরে বাজ পড়ল এবং ঝড়ের দাপটে লঞ্চ দুলে উঠতেই মোমবাতি টেবিলের ওপর পড়ে দপদপ করে নিভে গেল। ঝিনুক দুহাতে জড়িয়ে ধরল মিলনকে। অড়ানো গলায় বলল, 'আমার অবশ্য খুব বেশি ভয় করছে না।'

একটা নারী শরীরের স্পর্শে বাইরের ঝড়টাকে শরীরের ভেতর আবিষ্কার করল মিলন। সে দু-হাতে ঝিনুককে জড়িয়ে গালে ঠোঁট রাখল। যেহেতু এখন বাইরে এবং ভেতরে ঘন অন্ধকার তাই ওরা কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না। লঞ্চটা খুব দুলছে। দুটো শরীর এক হয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওরা বাইরের ঝড়, বৃষ্টির শব্দ, মেঘের গর্জন বিস্তৃত হয়ে গেল। দুটো শরীর পরস্পরকে উম্মাদের মতো অবিষ্কার করে যেতে লাগল। তারপর দুজনেই স্থির হয়ে গেল। হয়তো হুইস্কির প্রতিক্রিয়া ঘুম এনে দিল।

ঘুম ভাঙল যখন তখন বেশ জোর রোদ উঠেছে। মিলন চোখ খুলতেই তড়াক করে উঠে বসল। ঝিনুক পাশ ফিরে তখনও ঘুমাচ্ছে। ওর শরীরে কোনও পোশাক নেই। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াতেই তার কপালে ভাঁজ পড়ল। এটা কী হল? লঞ্চটা নড়ছে কেন?

প্রায় নিঃশব্দে প্যাসেজের জানলার কাছে চলে এল মিলন। কাচের জানলার বাইরে তাকিয়ে সে হতভম্ব। ওপাশের জঙ্গল, মাটি সরে-সরে যাচ্ছে।

সে দৌড়ে দরজাগুলো খুলে ডেকে চলে এল। লঞ্চ যেখানে আটকে ছিল সেখান থেকে ঝড়ের দৌলতে সরে এসেছে খাড়ির মাঝখানে। এখন স্রোতে ভেসে চলেছে জোয়ারের জলে। অর্থাৎ আরও ভেতর দিকে চলেছে লঞ্চ। যদি ভাটার টানে চলত তাহলে এতক্ষণে মাঝ সমুদ্রে দৌড়ে যেত আর তাহলে বাঁচার কোনও উপায় থাকত না।

খাড়িটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। সে ইঞ্জিনঘরে ঢুকে স্টিয়ারিং ঘোরাতে লঞ্চটা একটু বাঁদিকে ঘুরল বলে মনে হল। ইঞ্জিনের ঢাকনা খুলে ঝুঁকে হাত দিয়ে সে আগুন বের হওয়ার অংশটার নাগাল পেয়ে গেল। শরীরের সব শক্তি দিয়ে বেঁকে যাওয়া অংশটাকে সোজা করতে গিয়ে গলদঘর্ম হল। শেষপর্যন্ত সেটা সোজা হল। ঢাকনা বন্ধ করে ইঞ্জিন চালু করতেই সেই বিকট শব্দটা শোনা গেল না। কোনওমতে পাড়ের কাছে নিয়ে গেল সে লঞ্চটাকে।

ঠিক তখনই ঝিনুক এসে দাঁড়াল দরজায়। এখন তার পরনে প্যান্ট আর শার্ট। নিজের পোশাক

পরে নিয়েছে সে।

'কী হল?'

'ঝড়ে লঞ্চটাকে আটকে থাকা জায়গা থেকে বের করে নিয়ে এসেছে। ভাগ্য ভালো যে জোয়ারের জন্যে আমরা ভেতর দিকে ঢুকে পড়েছি।'

'এখন লঞ্চ চলছে?'

'একটু চালু হয়েছে। পরে কী হবে জানি না।'

ডেকে গেল ঝিনুক। তারপর শব্দ করে হাসল। তার পাশে এসে দাঁড়াল মিলন, 'হাসলেন যে।'

'পৃথিবীটা কী সুন্দর।'

'এটা কিন্তু সত্যি কথা।'

'আমি আর মিথ্যে বলব না।'

'এটা মিথ্যে কথা নয় তো?'

দু-হাতে মিলনকে জড়িয়ে ধরল ঝিনুক। তারপর বলল, 'আমি বিয়ে করিনি। তাই বিধবা নই। আমাকে বিশ্বাস করতে পারবে না?'

তখনই নজরে পড়ল মিলনের। বিশাল চেহারার একটা জন্তু পাড়ের জঙ্গলে তৈরি হয়েছে ডেকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। বটি করে ঝিনুককে কোনওমতে ভেতরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করতেই জন্তুটা ডেকে এসে লাফিয়ে পড়ল। বন্ধ দরজার সামনে রাগে গরগর করতে লাগল। আতঙ্কিত ঝিনুক মিলনকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বলল, 'এখান থেকে চলো।'

'কোথায়? বিন্দুতে?'

'না। তোমার বাড়ি যেখানে, সেখানে।' ঝিনুক আদুরে গলায় বলল।

মিলন তাকাল। আমার বাড়ি! যেখানে সে এতকাল থেকে এসেছে সেটা নিশ্চয়ই তার বাড়ি। কিন্তু সেই পলেস্তরা আর ইট বের করা বাড়ির ছোট্ট ঘুপচি ঘরে ঝিনুককে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই শিউরে উঠল সে। মুখ ফিরিয়ে বলল, 'আমি যেখানে থাকব সেটাই তো আমার বাড়ি।'

'তা কেন। এই এখন যেখানে তুমি আছ তার মালিক তো অন্যলোক। তুমি যেখানে এতকাল ছিলে সেই আরগাটা কী রকম?' ঝিনুক জিজ্ঞাসা করল।

'ওখানে তোমাকে মানাবে না ঝিনুক।'

'তাহলে তুমি নিজের জায়গা বানিয়ে নাও। আমি সেটাকে মনের মতো করে সাজাব।'

'বেশ তাই হবে।'

ডেকের ওপর থেকে জন্তুটা যে আবার জঙ্গলে লাফিয়ে চলে গেল সেটা বুঝতে পারল মিলন। লঞ্চটা বেশ ঝাঁকুনি দিয়ে যেন একটু ওপরে উঠল।

ঝিনুক হাসল, 'চলে গেছে।'

ই। কিন্তু ওই জন্তুটার নাম কী? একদম অচেনা মনে হল।'

'আমি তো দেখার সুযোগই পাইনি। তুমি যেভাবে ভেতরে টেনে নিয়ে এলে?'

'নিয়ে না আসলে আমরা দুজনেই এতক্ষণে ওর খাদ্য হয়ে যেতাম। মিলন বলল, 'কিন্তু এখান থেকে জঙ্গলে ঢোকা যাবে না। অথচ এখন জমিতে যাওয়া খুব দরকার?'

ঝিনুকের কাছ থেকে সরে ইঞ্জিনঘরে ঢুকল মিলন, 'বেশ ভয়ে-ভয়ে ইঞ্জিন চালু করতেই সেটা সচল হল। কিছুটা সময় ধরে সে আগুপিছু, গতি বাড়ানো কমানোর পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করল। ইঞ্জিন চালু হলে তেলের কাঁটা লক্ষ্য করল সে। এখনও এক চতুর্থাংশ তেল ট্যাঙ্কে আছে। তাতে কতদূরে যাওয়া যায় সে জানে না।

ঝিনুক চলে এল, 'এই, আমাকে শিখিয়ে দেবে?'

'দূর! আমি নিজেই জানি না। হাতড়ে হাতড়ে চালাবার চেষ্টা করছি।'

'ওমা। যদি ডুবে যায়?'

'সেটা হবে না। তোমাকে ডোবাব না কখনও, সে ভরসা রেখো।' হাসল মিলন।

ধীরে ধীরে লঞ্চ নড়তে লাগল। নড়ামাত্র শব্দটা শুরু হল। যেন কোনও কিছুতে লঞ্চের যন্ত্রাংশ বারবার আটকে যাচ্ছে। সেই আগের জায়গায় ফিরে আসতে অনেকটা সময় লেগে গেল ওদের। ইঞ্জিন বন্ধ করে মিলন বলল, 'চলো। জমিতে ফিরে যাওয়া যাক।'

'যদি ওই জন্তুটা এখানে চলে আসে?'

'মনে হয় এতটা দূরে ও আসবে না। এলে জমিতেও হানা দিত।' দরজা খুলতে গিয়ে খেয়াল হল মিলনের। সে-ভেতরে ঢুকে গিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি আর কয়েকটা টিনফুডের কৌটো প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে ভরে নিতে গিয়ে কী ভেবে আগ্নেয়াস্ত্রটিকে কোমরে গুঁজে নিল।

দরজা খুলে সন্তর্পণে চারপাশ দেখে নিয়ে সে লঞ্চের ছাদে উঠে ওপরের গাছের ডালের সঙ্গে লঞ্চটাকে একটা শক্ত দড়িতে বেঁধে নিল। তারপর ঝিনুককে টেনে তুলল লঞ্চের ওপরে। গাছের ভালে পা রেখে ওরা মাটিতে চলে এল। তারপর মনে পড়তে মুখ ঘুরিয়ে দেখে খুশি হল মিলন। আসার আগে ঝিনুক লঞ্চের দরজা বন্ধ করে এসেছে। ভেতরে ঢুকে বসার সুযোগ কোনও প্রাণী পাবে না।

এখন সূর্য প্রায় মাথার ওপরে। বুনো ঝোপের মাঝখানে পথ করে ওরা হাঁটছিল। এই কয়েকবার যাওয়া-আসা করায় এখন আর অসুবিধে হচ্ছে না। হঠাৎ ওপাশের গাছের মগডালে প্রবল চিৎকার শুরু হতে মিলন দেখল হনুমানটা দু-হাতে ডাল ঝাঁকাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে। বোধহয় ওদের দেখতে পেয়ে ওর মালিককে জানান দিচ্ছে। তারপর দুদ্দাড় করে নেমে গেল।

মিলন হেসে বলল, 'আমরা যে বেঁচে আছি এই খবরটা দিতে ছুটল।'

হঠাৎ ঝিনুকের গলার স্বর বদলে গেল, 'আচ্ছা, আমরা যদি মরে যেতাম তাহলে কি হত?' 'মানে?' অবাক হয়ে তাকাল মিলন।

'ধরো, আমরা দুজনে লঞ্চে ঘুমিয়েছিলাম। ঘুমানোর মধ্যেই একসঙ্গে মারা গেলাম। তাহলে কি হত?' হাসল ঝিনুক।

'তুমি কী ভাবছ?'

'তাহলে আর আমাদের এখানে ফিরতে হত না।'

'তাতে কি লাভ হত? মরে গেলে কি হয় আমরা কেউ জানি না, বেঁচে থাকলে পরস্পরের সান্নিধ্য পাওয়া যায়, তাই না?'

'ছাই যায়। আমাকে তো সেই বিন্দুতে ফিরে যেতে হবে।'

'বিন্দুতে!' জমির মুখটায় এসে দাঁড়িয়ে গেল মিলন, 'কেন?'

'বাঃ। ওখানে আমার বাড়ি না? আমার বাবা-মা-ভাই-বোন ওখানেই তো থাকে। এখানে আমি খোঁজ নিতে এসেছিলাম। পাকাপাকি থাকার কোনও অধিকার তো নেই।'

'সেই অধিকার যদি নিই?'

অবাক হয়ে তাকাল ঝিনুক, 'কেমন করে?'

সঙ্গে সঙ্গে দুটো হাত দুপাশে ছড়িয়ে চিৎকার করল মিলন, 'হে আকাশ-বাতাস, হে সূর্য, হে গাছেরা, সমুদ্র, তোমাদের সবাইকে সাক্ষী রেখে আমি ঘোষণা করলাম ঝিনুক আমার স্ত্রী।' তারপর মুখ ঘুরিয়ে বলল, 'এবার ওদের সাক্ষী রেখে তুমিও বংলা আমি তোমার স্বামী।'

মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসছিল ঝিনুক। এবার সেটা তুবড়ির মতো ফেটে পড়ল। ঘনঘন মাথা নেড়ে কোনওরকমে বলতে পারল, 'পাগল।'

'না। পাগলামি করছি না, সত্যি বলছি।'

'এই সত্যিটা লোকে মানবে কেন?'

'কেন মানবে না?"

'আমাদের সমাজ আছে। বিয়ে হয় সামাজিক নিয়ম মেনে। চিৎকার করে বললাম আর বিয়ে

হয়ে গেল? বাবা-মা মানবে একথা?'

'তাহলে তাঁদের এখানে আসতে বলো। যে নিয়মকানুন তাঁরা চান, সেই মতে আমি তোমাকে বিয়ে করব।'

'এতক্ষণে ঠিক বললে। আমি যাই, গিয়ে ওদের বোঝাই-তারপর।'

'ওঁরা যদি রাজি না হন! তোমাকে এই দ্বীপে পাঠাতে যদি না চান-?'

ঝিনুক জবাব দেওয়ার আগেই লোকটাকে ছুটে আসতে দেখল মিলন। পেছন-পেছন হনুমানটা আসছে। কাছে এসে লোকটা বিচিত্র শব্দ করে হাত-পা নেড়ে সম্ভবত বোঝাতে চাইল কী উদ্বেগে ছিল সে। মিলন মাথা নেড়ে হেসে বলল, 'আমরা লঞ্চে ছিলাম। রাত হয়ে গিয়েছিল বলে ফিরতে পারিনি। তাড়াতাড়ি ভাত বসিয়ে দাও, খুব খিদে পেয়েছে।"

ঝিনুক বলল, 'না। আজ আমি রাঁধব।' তারপর লোকটিকে বলল, 'চলো। আমাকে দেখিয়ে

দাও কী কী জিনিস তোমার আছে।'

ওরা চলে গেলে জমিটাকে ভালো করে দেখতে লাগল মিলন। এখানে ঝিনুকের সঙ্গে থাকতে হলে মালিককে খুশি করার মতো ফসল ফলাতে হবে। কিন্তু এই বালিমাটিতে বেশি ফসল আশা করা ভুল হবে। তরে চেয়ে হাঁস-মুরগি এবং ছাগলের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করলে বেশি লাভ হবে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে অমির বিভিন্ন জায়গা মেপে পরিকল্পনাটা মাথায় নিয়ে নিল মিলন। মোটামুটি একটা আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে যে এই স্বীপে কোনও শেয়াল জাতীয় প্রাণী নেই। থাকলে তারা ইতিমধ্যে সামান্য যেক'টা হাঁস-মুরগি রয়েছে তা থাকতে দিত না। ওই বিদ্যুতের তার বা জেনারেটারের শব্দ বড় জন্তুদের ভয় পাওয়াতে পারে কিন্তু শেয়াল অনেক বেশি ধূর্ত। হাঁস-মুরগির চাষ বাড়ালে এই আশঙ্কা থাকছে না। খিদে পেয়েছিল খুব। রান্নাঘরে গিয়ে উকি মারল সে। উনুনে হাঁড়ি চাপানো, তাতে কিছু ফুটছে। ইতিমধ্যে কোনও একটা আইটেম রান্না হয়ে পিয়েছে। সেটা ঢেকে রাখা হয়েছে এবং হনুমানটা যেন পাহারা দিচ্ছে এমন ভাবে পাশে বসে। ঝিনুক ঘরে নেই। লোকটা হাঁড়ির ঢাকনা খুলে পরীক্ষা করছিল সেদ্ধ হয়েছে কিনা। মিলন তাকে প্রশ্ন করল, 'তুমি কেন? ঝিনুক কোথায়?'

লোকটা হেসে আঙুল এবং ঠাঁটের ইশারায় বোঝাল, রাস্না ঝিনুকই করেছে, সে শুধু নামিয়ে নিচ্ছে। আর ঝিনুক গিয়েছে স্নান করতে, সমুদ্রে।

মিলনের মনে হল তারও স্নান করে নেওয়া দরকার। সমস্ত শরীরে চিটচিটে ঘাম, গতরাতের

অস্বস্তি থেকে মুক্ত হওয়া দরকার। সে বারমুডা পরে গামছা নিয়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেল। বালির আড়ালটা সরে যেতেই আদিগন্ত নীল জলরাশি। মাঝে-মাঝে সাদা ফেনা ছড়িয়ে ঢেউ গড়িয়ে আসছে কিশোরীর মতো। সমুদ্রের সেই ভয়ঙ্কর চেহারার কথা এখন দেখলে কল্পনাতেও আনা যায় না। দূরে বা কাছে কোথাও নৌকো নেই। প্রেমেন্দ্র মিত্রের লাইনগুলো মনে পড়ল, হঠাৎ, 'ভাবি, বলি সাগরের ইচ্ছে। সাদা ফেনা থেকে শাঁখমাজা ডানা মেলে আকাশে তল্লাশ নিচ্ছে।'

মিলন আর-একটু এগিয়েই থমকে গেল। স্বর্ণচাঁপা পিঠে ভেজা রোদ ঝলসে উঠেছে। নিরাবরণ, নিরাভরণ ঝিনুক এই মুহূর্তে সমুদ্রের দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রায় কোমর জলে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে কোথাও কোনও প্রাণ নেই। এমনকি সাগর-পাখিরাও ডানা মেলছে না।

কাল রাত্রে ওই শরীর তার শরীরে মিশে গিয়েছিল। সে শুধু অনুভব করেছিল মাত্র, অন্ধকার লঞ্চেও দেখার সুযোগ পায়নি। এখন মনে হল এই বিশাল সমুদ্র যেন প্রাণ ভরে উপভোগ করছে ঝিনুককে। ঝিনুক সেটা জানে। জানে বলেই স্থির হয়ে আছে কোমর জলে।

হঠাৎ জলে আলোড়ন শুরু হল। ভয় পেয়ে ঝিনুক দৌড়তে চাইল তীরের দিকে। যারা জলের নীচে ছোটাছুটি করছে, তারা যে ডলফিন তা বুঝতে পেরে হেসে ফেলল মিলন। সে চিৎকার করল,

'ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওর' ডলফিন।

সঙ্গে-সঙ্গে হাঁটুজলে চলে আসা ঝিনুক স্থির হয়ে পেছন ফিরল। দুহাতের আড়ালে নিজের বুক রেখে চিৎকার করল সে, 'চলে যাও। এখান থেকে চলে যাও।'

'কেন? এই আকাশ, সাগর এমনকী ওই ডলফিনগুলো যদি দুচোখ ভরে তোমাকে দেখতে পারে, আমাকে কেন চলে যেতে হবে।' চিৎকার করল মিলন।

শরীরে 'উঃ। যা বলছি তাই করো।' কথার মধ্যেই বোধহয় একটা ডলফিন ঝিনুকের পা ছুঁয়ে গেল। ঝিনুক আর দাঁড়াল না। দ্রুত জল ছেড়ে চলে এসে বালির ওপর ফেলে রাখা পোশাক

জড়াতে লাগল।

কাছে এসে মিলন বলল, 'মন ভরেও ভরল না।'

'এখানে এসে চোরের মতো লুকিয়ে দেখা তোমাকে মানায় না।'

'আমাকে কী মানায়?'

'বন্ধ ঘরের অন্ধকারে তো দেখেছ।'

'অন্ধকারে অনুভব করেছি, দেখতে পাইনি।'

'দেখার চোখ থাকলে অন্ধকারেও দেখা যায়।' কথাগুলো বলে হাঁসের মতো হেঁটে ঝিনুক ফিরে গেল। মিলন তাকিয়ে দেখল। তার বুকে এখন একটা আন্ত সাগর কী এক সুখে দুলছে। স্নান সেরে উঠে আসতেই নৌকাটাকে দেখতে পেল মিলন। বহুদূরে একটা কালো বিন্দুর মতো দুলছে। প্রথমে খুব খুশি হয়েছিল সে। নৌকো আসা মানে মূল ভূখণ্ড থেকে খবর আসছে।

সেইসঙ্গে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। সে দৌড়ল।

ঝিনুক তখন শুকনো পোশাক পরে নিয়েছে। বলল, 'ঠান্ডা হওয়ার আগে ভাত খেয়ে নিলে বোধহয় ভালো লাগবে।'

'তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?'

মুখ ঘোরাল ঝিনুক, 'লুকিয়ে দেখা আমি পছন্দ করি না।'

'বাঃ! লুকিয়ে কোথায় দেখলাম। স্নান করতে গিয়ে তোমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। বেশ, আর দেখব না। ওহো, একটা নৌকা আসছে।' মিলন বলল।

'নৌকা!' মুহূর্তেই মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল ঝিনুকের।

'নিশ্চয়ই বিন্দু থেকে আসছে। এবার ওদের হাতে একটা লিস্ট ধরিয়ে দিতে হবে।'

মুখ নামাল ঝিনুক, 'এসো, খেয়ে নাও।'

পোশাক বদলে ভাতের থালা তুলে নিল মিলন। তারপর বুদ্ধিটা মাথায় এল: বাঁশের একটা লম্বা টেবিল তৈরি করতে বেশি কষ্ট হবে না। টেবিলের পাশে বাঁশের বেঞ্চি। সেই বেঞ্চিতে বসে টেবিলে খালা রেখে দিব্যি খাওয়া যাবে।

খাওয়া শুরু করে মিলন বলল, 'বাঃ! দারুণ। দারুণ রাঁধো তো!'

'হুস।' খেতে-খেতে ঝিনুক বলল।

এই সময় হনুমানটা দৌড়ে এসে ওদের সামনে লাফাতে লাগল। আর তার পরেই লোকটা ছুটে এল। হাত নেড়ে দূর্বোধ্য ভাষায় বোঝাতে চাইল নৌকা আসছে। খাওয়া শেষ করে হাত-মুখ ধুয়ে মিল্ক সমুদ্রের দিকে পা বাড়াচ্ছিল। কিন্তু ঝিনুক তার হাত চেপে ধরল, 'আমাকে ভুলে যাবে ना?'

'মানে?'

'আমি চলে গেলে আমার কথা মনে রাখবে?"

'তুমি চলে যাবে মানে?'

'আমি জানি, ওই নৌকা আমাকে নিতে আসছে।'

'নিতে এলেই হল? তুমি বলবে যাবে না।'

স্নান হাসল ঝিনুক, 'তা হয় না। আমি এখানে থাকব কোন অধিকারে? বাবা যদি তোমার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয় তাহলেই আমি এখানে ফিরে আসতে পারি। আমি এখনও বাবার অধীনে।' 'মোটেই তা নয়। তোমার বয়স আঠারোর অনেক ওপরে। জোর করে কেউ তোমাকে নিয়ে যেতে পারে না। বলো তুমি, এখনই ওদের বলবে।'

ঝিনুকের হাত ধরে সমুদ্রের সামনে আসতেই নৌকাটা স্পষ্ট দেখা গেল। জনা চারেক লোক নৌকা

বাইছে, মাঝখানে দুজন বসে আছে।

ঝিনুক নীচু গলায় বলল, 'বাবা নিজে আসছে।'

'কোনজন তোমার বাবা?'

'যার মাথায় টাক।'

নৌকা বালিতে ঠেকে যাওয়ামাত্র মাঝিরা জলে নেমে ওটাকে টেনে অনেকটা ওপরে নিয়ে

এল। মধ্যে বসে থাকা লোকদুটো মাঝিদের সাহায্যে বালিতে পা রাখল। মিলন দেখল ঝিনুক এগিয়ে যাচ্ছে। ওই দুজনের মধ্যে যে মানুষটা একটু মোটাসোটা, টাক মাথা, তার সামনে গিয়ে কিছু বলল। লোকটা মাথা নাড়তে লাগল।

তারপর এগিয়ে এল মিলনের সামনে, 'নমস্কার বাবু। আমি ঝিনুকের বাবা বলে পরিচিত। আপনি চাকরি নিয়ে আসছেন তা অফিস থেকে আমাকে জানানো হয়েছিল। আমি বিন্দুতে অফিসের হুকুম অনুযায়ী কাজ করি। আমার নাম গিরিধারী।'

'নমস্কার।' মিলন বলল।

'কিন্তু আমি সমস্যায় পড়ে গেছি। বিন্দুর সব মানুষ জেনে গেছে যে ঝিনুক এই দ্বীপে রাত কাটিয়েছে। আমার মেয়ে এখনও কুমারী আছে কিনা সেই সন্দেহ তারা করছে।' গিরিধারী বেশ ঘুম-ঘুম গলায় বলল!

সোজা হয়ে দাঁড়াল মিলন। লোকটা তার উত্তরের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। অথ্য ওর দু-চোখ আধবোজা। মিলন জিজ্ঞাসা করল, 'আপনিও কি এক সন্দেহ করছেন?'

'ঘি আর আগুন একসঙ্গে থাকলে যা হওয়ার তা হবেই।'

'সেটা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন।'

'আপনি এতটা সময় ওর সঙ্গে থেকেও বুঝতে পারলেন না ও মিথ্যেবাদী?'

'আমি যদি বলি আপনাদের সন্দেহ অমূলক, তাহলে বিশ্বাস করবেন?' 'বিশ্বাস করলে আপনার সম্পর্কে খারাপ ধারণা তৈরি হবে।'

'তার মানে?'

'এই নির্জন দ্বীপে ওর মতো আগুনমেয়েকে একা পেয়েও আপনি নিরাসক্ত যদি থেকে থাকেন তাহলে সংসার জীবন আপনার জন্যে নয়।'

হাসল গিরিধারী। তারপর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সোকটিকে বলল, নৌকো থেকে মালপত্র নামিয়ে দিতে।

মিলন এই লোকটিকে বুঝতে পারছিল না। তার সঙ্গে ঝিনুকের শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কিনা জানতে চাইছে। না হলে তাকে খারাপ ভাববে। হলে কী বলবে?

নৌকো থেকে দুটো বড় ঝুড়ি নামানো হল। বোবা লোকটি দৌড়ে এসে সেই ঝুড়ির একটা

মাথায় নিয়ে দ্বীপের ভেতরে চলে গেল।

মিলন জিজ্ঞাসা করল, 'আপনি কি এখনই ফিরে যাবেন?'

'নিশ্চয়ই?'

'আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিন।'

'বেশ।'

দ্রুত ফিরে এসে একটা বাগানে তার পরিকল্পনার কথা এবং সেজন্যে যা-যা প্রয়োজন লিখে আবার সমুদ্রের ধারে চলে এল সে। গিরিধারী তখন ঝিনুকের সঙ্গে কথা বলছিল।

তাকে দেখে হেসে বলল, 'মেয়ে বলছে আপনি নাকি দেবতার মতো। ওর দিকে ফিরেও তাকাননি। এমনকি ও যে খেতে পেরেছে বোবা কালাটা খাবার দিয়েছিল বলে। বিন্দুর লোকজন খুব অবাক হয়ে যাবে একথা শুনলে।'

'কেন?' মিলন চোখ ছোট করল।

'আপনার মতো যুবক এসে এই দ্বীপে চাকরি করছে, খবরটা রটে যাওয়ার পর অনেক মেয়ের বাপ ভাবছিল বিয়ের সম্বন্ধ করবে। তারা আর করবে না।'

'কেন?'

উঠে এল গিরিধারী, 'আপনি বয়সে ছেটি। কী আর বলব। এই বয়সে যদি যুবতী মেয়েমানুষকে একা পেয়েও ফিরে না তাকান, তাহলে বুঝতে হবে আপনার শরীরে কোনও সমস্যা আছে। সেটা থাকলে বিয়ে দিয়ে কেউ নিজের মেয়ের সর্বনাশ করতে চায়? হ্যাঁ, বলুন, কী বলছিলেন?' অনেক চেষ্টায় নিজেকে সামলাল মিলন। তারপর বলল, 'এই চিঠিটা হেড অফিসে পাঠাবেন।

খুব জরুরি। ওরা উত্তর দিলে জানিয়ে দেবেন।' গিরিধারী ঝিনুককে ডাকল, 'ও বুকি, এটা রাখ। কালই হেড অফিসের ঠিকানায় পোস্ট করে দিবি। বড্ড ঘুম পাচ্ছে, চল, নৌকোয় উঠি।'

মিলন জিজ্ঞাসা করল 'ঝুড়িতে কী আছে?' 'হেড অফিস থেকে যা-যা বলেছে সব। আচ্ছা।'

গিরিধারী নৌকোর দিকে এগিয়ে গেলে ঝিনুক তার দিকে তাকিয়ে হাসল, 'মিথ্যে বলতে হুল। বুঝলে?'

'আমি কিন্তু কিছু বলিনি।'

'কী করব! পাড়া প্রতিবেশীদের মুখ বন্ধ করতে হবে তো।'

'কিন্তু তোমার বাবা ভেবে নিয়েছেন আমার শরীরে অক্ষমতা আছে।'

'ভালোই তো। আবার আসতে চাইলে বাধা দেবে না। চলি।'

'কবে দেখা হবে?'

'আগে গায়ের ব্যথা কমুক। তারপর ভাবব।' ঝিনুক এগিয়ে গেল নৌকোর দিকে। নৌকো জলে ভাসল। গিরিধারী শুয়ে পড়েছে এর মধ্যে।

ঝিনুক তার দিকে তাকিয়ে আছে। নৌকো এগিয়ে যাচ্ছে। মিলনের মনে হল ঝিনুক তাকে দেখছে না। এই দ্বীপ, দ্বীপের গাছপালা চোখের ভেতর ভরে নিচ্ছে।

দেখতে দেখতে নৌকোটা বিন্দু হয়ে গেল। গিরিধারী বলল, তার মেয়ে মিথ্যেবাদী। কথাটা সত্যি ছিল মিলনের কাছেও। কিন্তু এই দ্বীপে আসার পরে যা-যা ঘটেছে, যেসব কথা বলেছে ঝিনুক, তার সবটাই কি মিথ্যে?

ফিরে এসে মিলন দেখল দুটো বুড়ি থেকে জিনিসপত্র বের করে ফেলেছে বোবা লোকটা।

একটাতে সংসার চালানোর যাবতীয় সামগ্রী, যা অন্তত মাসখানেক তাদের সমস্যায় ফেলতে দেবে না। দ্বিতীয়টায় নানান ধরনের বীজ এবং সারের প্যাকেট। দুপুরটা এগুলো নিয়ে কেটে গেল ওদের। ভেঙে যাওয়া বেড়া, ঘরের ভাঙা কাঠ মেরামত করতে-করতে বিকেল এল।

মিসন আকাশের দিকে তাকাল। মেঘ নেই। একটু পরেই সূর্য ডুবে যাবে। এখনই হাঁটলে হয়তো অন্ধকার নামার আগে লঞ্চে পৌঁছনো যায়। কিন্তু তাঁর ইচ্ছে হল না। ঝিনুকের স্মৃতি ওখানে ছড়ানো। আজ সে চলে গেছে। ওখানে গেলে নিজেকে খুব একা মনে হবে। তার চেয়ে আজ টঙের ওপর শুয়ে থাকা ভালো।

এই সময় হনুমানটা চেঁচাতে-চেঁচাতে সমুদ্রের দিক থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে এল। সোকটা তার ভাষা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে। নইলে সে দ্রুত সমুদ্রের দিকে যাবে কেন? এদের ব্যাপার দেখে কৌতূহলী হয়ে মিলন পা বাড়াল।

একটা ডিঙি নৌকো সমুদ্রের ধার ধরে এগিয়ে আসছে। দুটো লোক নৌকো বাইছে। এই ধরনের অতি সাধারণ নৌকো সমুদ্রের ভেতরে গেলেই ডুবে যাবে। যে লোক দুটোকে নৌকো বাইতে দেখা যাচ্ছে, তাদের পরনে কৌপিন গোছের পোশাক ছাড়া কিছু নেই। নৌকোটা এত হালকা যে হাঁটুজলে চলে আসতে পারল। এবং তখনই নৌকোর খোলের মধ্যে একটি মেয়েকে শুয়ে থাকতে দেখল মিলন।

নৌকোটাকে বালিতে আটকে লোকদুটোর একজন অদ্ভুত ভাষার আবেদনের ভঙ্গিতে কিছু

বলে বারংবার মেয়েটাকে দেখাতে লাগল।

মিলন জিজ্ঞাসা করল, 'কে তোমরা? কোথায় থাকো?'

এবার দ্বিতীয় লোকটা এগিয়ে এল, হাত তুলে ঝাপসা হয়ে আসা একটা দ্বীপ দেখিয়ে দিল। মিল্ম জিজ্ঞাসা করল, 'হিন্দি জানো?'

লোকদুটো পরস্পরের দিকে তাকাল। এই সময় বোবা লোকটা গম্ভীরমুখে এগিয়ে এসে হাত নেড়ে জানতে চাইল, কী হয়েছে! ওরা দুজনেই একসঙ্গে তড়বড় করে যা বলল তার কিছু বুঝতে পারলেও উচ্চারণের জন্যে স্পষ্ট হল না মিলনের কাছে। লোকটা হাত তুলে ওদের থামিয়ে বেশ গম্ভীর মুখে মিলনের সামনে এসে হাতের মুদ্রায় বোঝাতে চাইল, নৌকোয় যে মেয়েটা শুয়ে আছে তার গায়ে খুব জুর। কথা বলতে পারছে না। ওরা ভয় পাচ্ছে মেয়েটা মরে যাবে। ওদের কোনও উপায় নেই বলে এখানে এনেছে। যদি ওষুধ দিয়ে বাঁচানো যায়।

মিলন নৌকোর পাশে চলে গেল। মেয়েটি মাথা এক পাশে হেলাল। সারা শরীর গুটিয়ে রয়েছে। পরনে একটি ছেঁড়া শাড়ি, গায়ে জামা নেই। সে কপালে হাত রেখে চমকে উঠল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে কিছু ওষুধ আছে। জ্বরের অন্যে ক্রোসিন, ক্যালপন্স, মাথা ধরার জন্যে ডিসপ্রিন আর পেট খারাপের জন্যে কিছু ওষুধ। একমাত্র ক্রোসিন খাওয়ানো ছাড়া সে আর কোনও

ওষুধ দিতে পারে না। সে বোবা লোকটাকে বলল, 'ওকে এখান থেকে তুলে রান্নাঘরে নিয়ে চল।' বোবা লোকটা সেই আদেশ ইশারায় ওই দুজনকে জানাতে ওরা ধরাধরি করে মেয়েটাকে রান্নাঘরের মেঝেতে শুইয়ে দিল। মেঝেয় বালির ওপরে ত্রিপলের আড়াল ছিল। মিলন তার ব্যাগ থেকে ক্রোসিন বের করে এক কাপ জলে গুলে মেয়েটির মুখ ফাঁক করে ধীরে ধীরে খাইয়ে দিল।

মেয়েটির চোখ বন্ধ। ওর শরীরে একটা মোটা কাপড় চাপিয়ে দিয়ে বলল, 'ভগবানকে ডাক।

যদি ওষুধে কাজ হয় তাহলে কাল সকালে আনা যাবে।' তারপর বোবা লোকটাকে বলল, 'রাত হয়েছে। আমার খাবার তুমি ওপরে দিয়ে এসো। আমি উঠে যাচ্ছি।'

টঙে বসে মিলন দেখল যে লোকদুটো মেয়েটিকে নিয়ে এসেছিল তারা ঘরের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। বোবা লোকটা ওদের ভাত আর আলু সেদ্ধ দিয়েছিল। তাই ওরা গোগ্রাসে খেয়ে নিয়েছে।

এই টঙে বসে সমুদ্র পরিষ্কার দেখা যায়। আজ সমুদ্র শান্ত। এই লোকদুটো খুব ঝুঁকি নিয়ে মেয়েটিকে নৌকোয় নিয়ে এসেছে। এরিকের শেষ দ্বীপ এই দারুচিনি। আশপাশে কিছু নাম না জানা দ্বীপে মানুষ থাকে। মাছ ধরেই তারা বেঁচে থাকে। কিন্তু সেই বেঁচে থাকাটা একেবারে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। ডাক্তার দূরের কথা, কেউ কখনও ওষুধের নাম শুনেছে বা খেয়েছে বলে মনে হয় ना।

এই যে মেয়েটাকে ওরা এখানে এনেছে শেষ আশার ওপর নির্ভর করে। এই দ্বীপে নৌকো আসে বিন্দু থেকে, শহরের মানুষ এখানে থাকে, এসব তথ্য নিশ্চয়ই ওরা জানে। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে এরা কখনও দ্বীপের বাইরে সমুদ্র ছাড়িয়ে কোথাও যায় না। অন্য দ্বীপে তো নয়ই। হয়তো অনেকে সামান্য অসুস্থ হয়েও ওষুধের অভাবে মারা যায়।

কিন্তু এই মেয়েটির বাবা-কাকার স্নেহ প্রবল বলে ওকে নিয়ে এসেছে এখানে। সে কী করতে পারে? তার ডাক্তারি বিদ্যে নেই। থাকলেও বিনা ওষুধে নিশ্চয়ই ডাক্তারি করা যায় না। নিজের শরীর খারাপ হলে খাবে বলে যে ওষুধ সে নিয়ে এসেছে, তা মেয়েটির কতটা উপকার করবে ঈশ্বরই আনেন।

মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে গেল মিলনের। জঙ্গলের ওপারে নদীর ধার থেকে হুঙ্কার ভেসে আসছে। কোনও চেনা অন্তুর গলার আওয়াজ ওটা নয়। আত্মরক্ষার জন্যে লঞ্চ থেকে রিভলভারটা নিয়ে আসা দরকার। সে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখল বোবা লোকটা জমিতে আগুন জ্বলেছে। তাকে সাহায্য

করছে মেয়েটাকে নিয়ে আসা লোকদুটো। আগুনটা বেশ সকলকে হয়েছে। যত হিংস্র হোক আগুনকে

ভয় পায় না, এমন জানোয়ার বোধহয় নেই।

চিত হয়ে গুল মিলন। আকাল্টা তারায় ভরে গেছে। অথৈ নীলে অঞ্চত্র হিরে জ্বলছে। ঝিনুক চলে গেল। বিন্দুর আকাশে এখন কি এইসব তারাদের এরকম দেখা যাচ্ছে? এই জীবনে ঝিনুকই প্রথম নারী যে সরাসরি তার বুকের ঘর দখল করে নিয়েছে। লঞ্চে রাতের বেলা দিনের বেলা একাকার হয়ে গিয়েছিল। এখন চোখ বন্ধ করলে ঝিনুকের শ্বাসের তাপ, ঠোঁটের গন্ধ সহজেই টের পাচ্ছে সে। কিন্তু বিন্দুতে পৌঁছে ওর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে হলেও সম্ভব নয়। বড় নৌকোয় দক্ষ কয়েকজন মাঝি ছাড়া সমুদ্রের ঢেউগুলো সামলে পৌঁছনো যাবে না ওখানে। বিন্দু থেকে ঝিনুক তার কাছে আসবে। ও যতই মিথ্যে বলুক, মিলন জানে এই কথাটা সত্যি বলেছে ও।

এই যে টন্ডের ওপর শুয়ে আছে সে তারাদের সঙ্গী করে, কয়েকদিন আগে কল্পনা করেনি। এতদিন যে জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিল, অভাবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে-নিতে একসময় অভ্যন্ত হয়ে গিয়েছিল সেই জীবন থেকে নিষ্কৃতির কোনও পথ জানা ছিল না। মানুষ হিসেবে প্রতিদিন নিজের কাছেই একটু একটু করে ছোট হয়ে যাচ্ছিল। হীনম্মন্যতাবোধ ধীরে-ধীরে চেপে বসছিল মনে। একটার-পর-একটা চাকরির আবেদন করে সাড়া না পাওয়ার যন্ত্রণা তাকে কুরেকুরে খাচ্ছিল।

একেবারে হঠাৎই আকাশ থেকে পড়ার মতো এই চাকরিটা তার কাছে এসে গেল। একটি নির্জন দ্বীপে সমুদ্র পেরিয়ে গিয়ে থাকতে হবে যেখানে কোনও সামাজিক জীবন নেই। প্রথমে একটু যে অস্বস্তি হয়নি তা নয়। কিন্তু মন বসেছিল, দেখাই যাক না। আজ সেই মন বলছে, ভালো হয়েছে। এই সমুদ্র, বালিয়াড়ি, ডলফিন, গাছগাছালি, এই পরিত্যক্ত লঞ্চ তার জীবনটাকে চমৎকার বদলে দিয়েছে। শুধু ঝিনুক আসার পরে মনে হচ্ছে তাকে পেলে সে দ্বীপ ছেড়ে কোথাও যাবে না।

সকাল হল। টং থেকে নেমে ঝরনা থেকে এনে রাখা জলে মুখ ধুয়ে দেখল রান্নাঘরের দরজার লোকদুটো বসে তাকে দেখছে। বোবা লোকটা কাছাকাছি ছিল। তাকে ইশারায় ঘরের ভেতর যেতে বলল। সে এগোতে লোকদুটো সরে গেল জায়গা করে দেওয়ার জন্যে।

মেয়েটা শুয়ে ছিল কাল রাতের মতো। একটু ঝুঁকে ওর কপালে হাত রেখে অবাক হল মিলন। জ্বর অনেক কমে এসেছে। এখন একশোর আশেপাশে রয়েছে। সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লোকদুটোকে বলল, 'মনে হচ্ছে ভালো হয়ে যাবে।'

তার হাত নেড়ে কথা বলা থেকেই বোধহয় ওরা আশার খবর পেল। দুজনের মুখে হাসি ফুটল। একজন ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, মেয়েটাকে এখন নিয়ে যেতে পারে কিনা।

মাথা নাড়ল মিলন, না। আরও তিন-চার দিন ওর শুয়ে থাকা উচিত।

লোকদুটো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল। তারপর ধীরে-ধীরে নৌকোয় উঠে এই দ্বীপ ছেড়ে চলে গেল। সঞ্চয় করে রাখা মুরগির ডিম খান ছয়েক সেদ্ধ করে ফেলল মিলন। কাল যে ঝুড়ি এসেছিল, তাতে আলু পেঁয়াজ ছাড়া প্রচুর তরিতরকারি, তেল নুন রয়েছে। খানিকটা চা পাতা আর চিনিও দেখতে পেল সে। কালো চা চিনি মিশিয়ে চুমুক দিয়ে দেখল, মন্দ লাগছে না। তারপর

মেয়েটার পাশে বসে ডাকল, 'এই যে মেয়ে, শুনতে পাচ্ছ? এই যে।' চোখের বন্ধ পাতা সামান্য নড়ল। তারপর অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকল মিলনের দিকে। বোবা লোকটা দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছিল। মিলন বলল, 'এই দুটো ডিম তোমার। আর বাকি দুটো চামচ দিয়ে কেটে কেটে ওকে খাইয়ে দাও। মাঝে-মাঝে চা মুখে দিয়ে দিও, বুঝতে পেরেছ?' সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা দু-হাত নেড়ে আপত্তি জানাল। তারপর নিজের ভাগের ডিম তুলে নিয়ে

বেরিয়ে গেল।

একটা প্লেটে ডিমদুটো, চামচ আর চায়ের কাপ নিয়ে মেয়েটার পাশে বসতেই সে ওর মুখে প্রতিবাদ এবং ভয়ের মিশেল দেখতে পেল। মিলন নরম গলায় বলল, 'ভয় নেই। তোমার শরীর খারাপ হয়েছিল বলে এখানে আনা হয়েছে। এখন তোমাকে কিছু খেতে হবে।'

কথাগুলো যে কোনও কাজে লাগছে না তা বলতে-বলতেই বুঝতে পারছিল মিলন। মেয়েটা চোখ বন্ধ করল। সে ওর কপালে হাত রাখল। মেয়েটা মুখ সরাতে চাইল। শরীরে শক্তি না থাকলেও সে প্রতিবাদ করতে চাইছিল।

বেশ জোর করেই মাথায় হাত বুলিয়ে গেল মিলন। কিছুক্ষণ বাদে মেয়েটা যেন বাধ্য হয়ে মেনে নিল, কিংবা ওর হয়তো একটু আরাম লাগছিল। হাত বোলাবার সময় অবিরাম কথা বলে যাচ্ছিল মিলন নরম গলায়। মেয়েটা আবার চোখ খুলল। সন্দেহের চোখে মিলনকে দেখতে লাগল।

মিলন হাসল, 'তোমার কোনও ভয় নেই। তুমি ভালো হয়ে যাবে।'

মেয়েটার মুখে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।

চামচ দিয়ে এক টুকরো ডিম কেউ নিয়ে মিলন মেয়েটার ঠোঁটের সামনে ধরতেই সে মুখ ঘুরিয়ে নিল। সঙ্গে-সঙ্গে বেশ জোরে ধমক দিল মিলন। মেয়েটা এমন হকচকিয়ে গেল যে ওর মুখ হাঁ হয়ে গেল। চোখ বড়। মিলন চট করে ডিমের টুকরোটা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, 'খাও।' বলে চিবোনোর ভঙ্গি করল।

স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াতে মেয়েটা চিবিয়ে ফেলল। সঙ্গে-সঙ্গে মুখে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠতে মিলন ধমক দিল আবার। প্রায় বকেককে ডিম এবং ক্রোসিন ট্যাবলেট খাইয়ে বলল, 'এবার ঘুমাও।'

টুই ঝুড়ি জিনিসপত্র থেকে বাগানের জন্যে যেগুলো প্রয়োজন সেগুলো বের করে কাজে লেগে গিয়েছিল বোবা লোকটা। বাইরে বেরিয়ে এসে মিলন তাকে দেখিয়ে দিল সে কী চাইছে। মাঝে-মাঝে হাত লাগাল সে।

এই ফাঁকে হনুমানটা একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল। একটা গাছের মগডালে পাখি বাসা করেছিল। তাতে সদ্য ডিম ফুটে বেরিয়ে আসা ছানাদের একটিকে তুলে নীচে নেমে এল। তারপর বেশ মজা পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে দুহাতের পাতায় বাচ্চাটাকে রেখে বোবা লোকটাকে দেখাতে লাগল। কেবা লোকটা অবোধ্য শব্দে ধমকাতে লাগল হনুমানকে। তাতে হনুমান বুঝে গেল, কাজটা ভালো করেনি। বাচ্চাটাকে মাটিতে নামিয়ে সে অপরাধীর মতো মুখ করে একটু দূরে গিয়ে বসল। মাথার ওপরে তখন মা পাখি সমানে চিৎকার করছে আর উড়ছে। মিলন লোকটাকে ইশারায় বলল, ছানা পাখিকে ওর বাসায় রেখে আসতে।

লোকটা মাথা উঁচু করে বাসাটা দেখে হাত নাড়ল। ওই নরম মগডালে তার পক্ষে ওঠা সম্ভব নয়। কথাটা ঠিকই। একমাত্র ওই হনুমান পারে যেখান থেকে এনেছিল সেখানে ছানা পাখিকে পৌঁছে দিতে। কিন্তু ওকে কে বোঝাবে!

ফলে এই দ্বীপের সংসারে আর-একটা প্রাণী বাড়ল। একটা ছোট্ট ঝুড়িতে খাস বিছিয়ে তার জন্যে বিছানা করা হল। সেটাকে ঝুলিয়ে রাখা হল রান্নাঘরের দেওয়ালে। বোবা লোকটা হনুমানকে সঙ্গে নিয়ে কয়েকটা ফড়িং ধরে নিয়ে এসে হাঁ করে থাকা ছানার মুখে একটার ছোট্ট শরীর ঢুকিয়ে দিতে সে গপ করে গিলে ফেলল। হনুমানটা চোখ বড় করে দৃশ্যটা দেখল।

দুপুরে মেয়েটা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। শরীর যে খুবই দুর্বল তা বোঝা যাচ্ছিল। এখন ওর শরীরে শুধু ছেঁড়া শাড়িটা কড়ানো, মিলন অবাক হল। এত অভাব, এত কষ্টের মধ্যে ভগবান কী করে যে ওর শরীরে এত যৌবন নিলেন কে জানে!

দুপুরে আজ শুধু আলু সেদ্ধ, ডাল ভাত আর ডিমের ওমলেট। লোকটা রাঁধছিল। মিলন গেল সমুদ্রে স্নান করতে। প্রায় কোমর জলে পৌঁছে সামনের দিকে তাকিয়ে সে খুশি হল। আজ কোনও বড় ঢেউ সমুদ্রে নেই। তাই বহুদূর পর্যন্ত জলরাশি চোখের সামনে।

প্যাপিলন নামের একটা আশ্চর্য উপন্যাস পড়েছিল সে। একটি লোককে বিনা নোহে স্প্যানিশ সরকার যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দিয়েছিল ডেভিড আইল্যান্ডে। সেখান থেকে কেউ ফিরে আসত না। চারধারে কয়েকশো মাইল ভয়ঙ্কর আতলান্তিক সমুদ্র। তবু লোকটা অনেকবার চেষ্টা করেছে পালাতে।

ধরা পড়ে কঠোর শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গোপনে একটি ডিঙি নৌকো তৈরি করে সে সমুদ্র পার হতে পেরেছিল।

মাথা নাড়ল মিলন। কেউ-কেউ পারে, সবাই নয়। জলে শব্দ হল। সেই বাচ্চা ডলফিনটা তার শরীর ছুঁয়ে খেলায় মেতেছে: ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটিয়ে স্নান শেষ করে ওপরে উঠে এসে পায়ের জল মুছতে গিয়ে দেখল বাচ্চাটা অনেকটা ওপরে উঠে এসেছে। শ্রীর নাড়িয়ে মুখ থেকে একটা ছোট ভেটকি মাহ ছেড়ে দিয়ে আবার জলে ফিরে গেল। ভেটকিটা মুক্তি পেয়ে লাফাচ্ছিল। তার চেষ্টা ছিল গভীর জলে ফিরে যাওয়া, কিন্তু মিলন চট করে ধরে ফেলল তাকে। বালির ওপর মাছটাকে ফেলে দিয়ে শুকনো বারমুডা শরীরে গলিয়ে সে মাছটাকে নিয়ে ফিরে এসে লোকটাকে দিল।

লোকটা দুবার মাথা ঝুঁকিয়ে মাছটাকে নিয়ে পরমানন্দে বসে গেল তার সদ্গতি করার জন্যে। ও যেভাবে মাখা ঝাঁকাল তাতে পরিষ্কার যে খালি হাতে সমুদ্র থেকে মাছ যে ধরে তাকে সে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।

মিলন হাসতে গিয়ে অবাক হয়ে তাকাল। ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়েটা ধীরে-ধীরে সমুদ্রের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। হাঁটতে ওর কষ্ট হচ্ছে বোধহয় প্রাকৃতিক প্রয়োজন এড়াতে পারছে না। একবার মনে হল ওকে সাহায্য করা উচিত। কিন্তু মেয়েটা সঙ্কোচে পড়বে ভেবে স্থির হয়ে থাকল।

কোথায় ছিল হনুমানটা, দৌঁড়ে চলে গেল মেয়েটার কাছে। মেয়েটা হাত নেড়ে তাকে সরে যেতে বলল। হনুমানটাও নাছোড়: সে পাশে-পাশে হাঁটছে। মিলন চিৎকার করতেই হনুমান দাঁড়িয়ে গেল। মেয়েটা চোখের আড়ালে চলে গেল।

প্রায় পনেরো মিনিট পরেও যখন মেয়েটা ফিরে এল না, তখন মিলন এগিয়ে গেল। সমুদ্রের ধারে গিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকাতেই মেয়েটাকে বালির ওপর উঁচু হয়ে বসে থাকতে দেখল। এই বিশাল জলরাশির সামনে ওই ভঙ্গি কী করুণ দেখাচ্ছে। সে ধীরে-ধীরে মেয়েটার পাশে গিয়ে হাত বাড়িয়ে কপাল স্পর্শ করল। না। জ্বর নেই। আশ্চর্য

ব্যাপার। এমন হওয়া বোধহয় অসম্ভব নয়। যে মেয়েটি জীবনের কোনওদিন ওষুধ খায়নি, যার

শরীর কোনও ওষুধের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত নয়, তার শরীরে ক্রোসিনের মতো একটি জ্বর-

ব্যথা কমানো ওষুধ প্রবলভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে। তার ফলে জ্বরে মৃতপ্রায় এই মেয়েটি,

এখন হোঁটে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছে। জ্বরও চলে গেছে। কিন্তু ওর শরীরে সমুদ্রের জোলো

বাতাস লাগছে। যে কাপড়টি ও পরে আছে তাতে এত ফাঁকফোকর যে শরীর ঢাকা পড়ছে না।

মিলন বলল, 'এখানে বসে থেকো না। ওঠো।'

মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই মিলন দেখল দুটো চোখ তো বটেই, গাল জলে ভিজে রয়েছে। মেয়েটা এইভাবে এখানে বসে কাঁদছিল?

সে মাথায় হাত বোলাল, 'সব ঠিক হয়ে যাবে। কালই তুমি তোমার জায়গায় ফিরে যেতে পারবে। তোমার বাবা নিশ্চয়ই নিতে আসবে।'

মেয়েটা চুপচাপ তাকিয়ে থাকল। ভাষা বুঝতে পারেনি ও। মিলন হাতের ইশারায় বোঝাল, সে দূরের ষ্টীপে চলে যেতে পারবে। সঙ্গে-সঙ্গে মেয়েটি মাথা নাড়ল প্রবল বেগে। সে যাবে না।

দ্বিতীয় রাত কেটে গেলে মেয়েটি খানিকটা স্বাভাবিক হল। কাল থেকে আর জ্বর আসেনি বলে ক্রোসিনের বদলে ক্যালপল গুঁড়ো করে জলে মিশিয়ে শুকে খাওয়াল মিলন। এখন আর কোনও আপত্তি জানাচ্ছে না খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে। মিলনের মনে হল আজ ওর স্নান করা উচিত। সমস্ত শরীরে ময়লা শক্ত হয়ে বসে আছে। ইশারায় সেটা বোঝাতে মেয়েটা খুব খুশি হল।

কিন্তু যারা ওকে এখানে পৌঁছে দিয়েছিল, তাদের আর দেখা নেই। মেয়েটা শেষপর্যন্ত বাঁচল না মরল সে খবর নেওয়ার গরজ গুদের নেই। ওরা ওর কোনও পড়ি বা পোশাকও দিয়ে যায়নি। স্নান করে যদি ও ভেজা ছেঁড়া শাড়ি শরীরে জড়ায় তাহলে আবার অসুস্থ হতে বাধ্য। ঝিনুকের ব্যবহার করা বারমুডা আর গেঞ্জি এনে মেয়েটিকে দিল সে। স্নানের পর আপতত এটাই পরুক। কাল থেকে আর একটা ঘটনা ঘটছে এখানে। হনুমানটা আচমকা লোকটার সঙ্গ ছেড়ে মেয়েটার কাছে ঘুরঘুর করছে। এখন ওকে একটুও ভয় পাচ্ছে না মেয়েটা। আড়াল থেকে মিলন গুনেছে, মেয়েটা দুর্বোধ্য ভায়ায় কিছু বলছে আর হনুমান তা শুনতে-শুনতে মাথা নাড়ছে। দেখলে মনে হবে মেয়েটার সব কথা বুঝতে পারছে সে। মেয়েটি যেখানে থাকছে সেখান থেকে নড়ছে না হনুমানটা। তার এতদিনের সঙ্গী বোবা লোকটা বারংবার মুখে আওয়াজ করেও তাকে কাছে আনতে পারছে না।

স্নান করে মেয়েটা যখন সমুদ্র থেকে ফিরে এল, তখন বোবা লোকটাও হাঁ করে থাকল। ছেঁড়া শাড়ির আড়াল যা অনুমানে ছিল তা বারমুডা এবং গেঞ্জির কল্যাণে স্পষ্ট হওয়ায় দেখতে অস্বস্তি হচ্ছে। মেয়েটার কিন্তু কোনও সঙ্কোচ হচ্ছে না। এখন তার মুখ চোখ এবং হাত-পায়ের চামড়া বেশ পরিষ্কার। তামাটে রংটা অনেকটা উজ্জ্বল।

দুপুরের খাওয়ার পর মিলন লোকটাকে ইশারায় বোঝাল, সে লঞ্চে যাচ্ছে। সঙ্গে-সঙ্গে মাথা নেড়ে আপত্তি জানাল লোকটা। বারংবার মেয়েটার দিকে আঙুল তুলে কিছু বলতে চাইল। মিলন বলল, 'মনে হচ্ছে আজ ওর আত্মীয়রা এসে ওকে নিয়ে যাবে। আমি চেষ্টা করব সন্ধের আগেই ফিরে আসতে।'

মেয়েটার দিকে হাত নেড়ে রওনা হল মিলন।

এখন জঙ্গুলে পথ আর অচেনা নয়। লাঠি দিয়ে ডালপাতা সরিয়ে স্বচ্ছন্দে ই'টছিল মিলন। মাঝখানে কয়েক হাত ন্যাড়া জায়গা। সেখানে পা রাখতেই যেন মাটি কুঁড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বিশাল ফণা তুলল সাপটা। তার গায়ের রং কুচকুচে কালো। সাপটা লেজের ওপর দাঁড়িয়ে একটু দুলছে। সরু জিন্ড দুবার বেরিয়ে এল মুখ থেকে। দুজনের

যে দূরত্ব তাতে সাপটা ছোবল মারলে মিলনের পা পেয়ে যাবে।

মিলন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সাপের চোখে চোখ রেখে। সামান্য নড়লেই সাপ ছোবল মারবে। শিরশির করছিল মেরুদণ্ড। সে বুঝতে পারছিল তার কপালে ঘাম জমছে। একটা সেকেন্ডকে অনেকটা সময় বলে মনে হচ্ছিল।

এই সময় মাথার ওপরের গাছের ডাল থেকে কিছু একটা পড়ল তাঁর কাঁধে। ওটা নড়ছে। কিন্তু ওদিকে তাকাতে সাহস পেল না সে।

সাপটা যেন হঠাৎ কিছুটা বিভ্রান্ত। আর সেই সুযোগটাকে কাজে লাগাল মিলন। ডান হাতে ধরা লাঠিটা সঙ্গোত্রে ঢালাল সাপের শরীর লক্ষ করে। এরকম আক্রমণ ভাবতে পারেনি সাপটা। মাজা ভেঙে ঘাসের ওপর পড়ে ছটফট করতে লাগল।

চটপট হাত দিয়ে গলার কাছে উঠে আসা প্রাণীটিকে সজোরে আঘাত করতেই সেটা ছিটকে পড়ল সামনে। একটা লালচে রঙের বড় মাকড়সা। সারা শরীরে শুয়ো। কাঠির ডগায় চেপে ওটাকে মেরে ফেলল সে। সাপটা বোধহয় এটাকে দেখেই মনোসংযোগ হারিয়েছিল।

এর আগেও সাপ এখানে দেখেছে সে। এর চেয়ে ঢের বড় সাপ এই জঙ্গলে বাস করছে। কিন্তু আজ সাপের সঙ্গে চোখাচোখির মুহূর্তগুলো সে সারাজীবনে ভুলবে না।

যেখানে লঞ্চ থাকার কথা সেখানে গিয়ে অবাক হল মিলন। লঞ্চ নেই। কেউ ওই লঞ্চ চালিয়ে নিয়ে যাবে, এমন কোনও সম্ভাবনাই নেই। যাওয়ার সময় সে ওটাকে বেঁধে রেখে গিয়েছিল। তাহলে কী করে এখান থেকে চলে গেল?

জঙ্গল ভেঙে নদীর ধার নিয়ে হাঁটা বেশ মুশকিল কাজ। তবু সেই চেষ্টা করল সে। মিনিট দশেকের মধ্যে ছোট সাপ, বিছে, মাকড়সার কাছ থেকে আত্মরক্ষা করতে হল। নদী যেখানে ঈষৎ বাঁক নিয়েছে, সেখানে জঙ্গলটা যেন হুমড়ি খেয়ে জলে নেমে পড়েছে। তার ভেতরে লঞ্চের পেছন দিকটা দেখতে পেল সে। হয় দড়ি কোনও কারণে ছিঁড়ে যাওয়ায় ভাসতে ভাসতে লঞ্চ ওখানে ঢুকে পড়েছে, নয়তো কেউ ওই জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রেখেছে। দ্বিতীয়টি ঘটনা হলে বুঝতে হবে এই দ্বীপে আরও মানুষ আছে।

দ্বীপে মানুষ থাকলে তারা একবারও জমিতে আসবে না, এটা ভাবা যায় না। এলে তাদের কথা আগের বুড়ো নিশ্চয়ই জানাত। ওইসব মানুষরা, তর্কের খাতিরেও যদি ধরা হয়, বুড়ো এবং বোবা লোকটাকে এড়িয়ে চলত বলে জমির দিকে পা বাড়িয়ে দেখা দেয়নি, তাহলেও তাদের পক্ষে কি একটা লঞ্চ লুকিয়ে রাখা সম্ভব?

লাঠির সাহায্যে পথ কোনওরকমে করে মিলন নদীর বাঁকের জায়গায় চলে আসতে পারল। এখন লঞ্চটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অবশ্যই পেছনের দিক থেকে। গাছের ডালগুলো ওর ওপর আড়াল তৈরি করেছে। কিন্তু পাড় থেকে লঞ্চে ওঠা যাবে না। কারণ দূরত্বটা অনেক। জলে পা দেওয়ার কথাই ওঠে না। কুমিরগুলোকে আশপাশে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

শেষপর্যন্ত নীচু হয়ে থাকা একটা শক্ত ডালে উঠে দাঁড়াল মিলন। ডালটা দুলছে। এবং তখনই পায়ে লাল-লাল পিঁপড়ে পিলপিল করে উঠে কামড়াতে লাগল। দ্রুত কিছুটা এগিয়ে ঝাঁপ দিল মিলন। লাঠিটা লঞ্চের ছাদে পড়ে আটকে রইল। অনভ্যাসের আঘাত সামলে উঠতে কয়েক সেকেন্ড লাগল।

মিলন লাঠি তুলে নিয়ে গুড়ি মেরে সামনের দিকে এগিয়ে লঞ্চের সামনের ডেকে নেমে পড়ল। নামতেই চক্ষু স্থির। ডেকের অনেকটাই কেউ ভেঙে ফেলেছে। ভেতরে ঢোকার দরজা অবশ্য বন্ধু। সেখানে কোনও ভাঙচুর হয়নি।

সরজা খুলে ভেতরে পা দিল মিলন। দিয়েই দরজাটা বন্ধ করল। দুটো পা থেকে পিঁপড়ে ছাড়াতে গিয়ে বুঝল আলো দরকার। লঞ্চের ভেতরটায় তখন সন্ধের অন্ধকার। বাইরে যদিও সূর্য

ডুবে যায়নি, কিন্তু গাছগাছালির মধ্যে বন্দি হয়ে থাকা জানলাবন্ধ লঞ্চে আলো ঢুকছে অতি সামান্য। মোমবাতি কোথায় রেখেছিল জানা ছিল। সেটা জ্বালিয়ে মিলন দেখল দুটো পায়ে প্রচুর চাকাচাকা ফোলা তৈরি হয়েছে। খুব চুলকোচ্ছে। যে ক'টা পিঁপড়ে তখনও সেঁটে ছিল তাদের পা থেকে ফেলে দিবল সে। তারপর দ্বিতীয় ঘরে ঢুকে হুইস্কির বোতল বের করে খানিকটা হুইস্কি ফোলা জায়গাগুলোতে বুলিয়ে দিতে একটু আরাম লাগল।

খাটে পা ঝুলিয়ে বসে চারপাশে তাকাল মিলন। মোমবাতির আলোয় চাবপাশ বেশ রোমান্টিক লাগছে। এই ক'দিনেই লঞ্চের ভেতরটা যেন তার নিজের বাড়িঘর হয়ে গেছে। কিন্তু এখানে লঞ্চ থাকলে সে নিরাপদে থাকবে না। যে জন্ত ওই ডেকের ওপরের অংশ ভেঙেছে সে সহজেই গাছ বেয়ে নেমে আসবে। ভেতরে মানুষ আছে বুঝতে পারলে দরজা ভাঙতে তার কোনও অসুবিধে হবে না। নিশ্চিন্তে থাকতে হলে লঞ্চটাকে এখান থেকে সরাতে হবে। মিলন দ্বিতীয় ঘর থেকে বেরিয়ে ইঞ্জিন ঘরে চলে এল।

সুইচ টিপতেই একশো পাওয়ারের আলো ঝাঁপিয়ে পড়ল। ইঞ্জিন চালুর বোতাম টিপল সে। প্রথমবার কোনও শব্দ হল না। দ্বিতীয়বারে বেশ জোরে আওয়াজ করে উঠল ইঞ্জিন।

লঞ্চের সামনের দিকটা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে রয়েছে। এর আগে সে লঞ্চ চালিয়েছে সামনের নিকে। পেছনে কী করে চালাতে হয় তা অজানা। ফাঁপরে পড়ল মিলন। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে যন্ত্রের গায়ে লেখাগুলো পড়ে হাতল ঘোরাতেই লঞ্চটা দুলে উঠে পেছন দিকে যেতে শুরু করল। কিন্তু সেইসঙ্গে বিকট শব্দ বেরুনতে লাগল ইঞ্জিন থেকে!

শেষপর্যন্ত জঙ্গলের আওতা থেকে বেরিয়ে এল লঞ্চটা। খোলা নদীর বুকে কাঁপতে লাগল ঘরথরিয়ে। ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল মিলন। সঙ্গে-সঙ্গে শান্ত হয়ে গেল জলযান। আলো নিভিয়ে দিল সে। এখন যথেষ্ট আলো ভেতরে ঢুকছে জানলা দিয়ে।

এই নদীতে ঢেউ নেই। স্রোতও। কিন্তু জোয়ারের সময় সমূদ্রের অল যখন ঢোকে তখন তা ভেতরে চলে যায় আবার ভাটার সময় টান পড়ে সমুদ্রের দিকে এগোবার। বাকি সময়টা জল থাকে স্থির। কখন 'ভাটা বা জোয়ার আসবে জানা নেই। তাই এখন যেখানে লঞ্চ রয়েছে, সেখানে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

মিলন লঞ্চটাকে আগের জায়গায় নিয়ে এসে দেখল, যে দড়িতে সে লঞ্চটাকে গাছের ডালের সঙ্গে বেঁধেছিল সেটা ছিঁড়ে গেছে। ছেঁড়া অংশ এখনও গাছের ডালে ঝুলছে। মিলনের মনে পড়ল স্টোররুমে অনেক কিছুর মধ্যে একটা লম্বা কিছু দেখেছিল। সেটা শেকল হতে পারে। মোমবাতি নিয়ে স্টোররুমে গিয়ে খানিকটা খোঁজাখুঁজির পরে বেশ লম্বা একটা শেকল পেয়ে গেল সে।

বাইরে বেরিয়ে এসে গাছের ডালে নয়, গুঁড়ির দিকটায় শেকল জড়িয়ে লঞ্চের সঙ্গে আটকে দিল সে। এর ফলে শেকলটা জলের একটু ওপরে ঝুলে থাকল। ডাঙা এবং লঞ্চের দূরত্ব অন্তত পনেরো ফুট তো বটেই।

যদি কেউ শেকল ধরে আসতে চায় তাহলে তাকে জলে পড়তেই হবে। জলে পড়া মানে কুমিরের পেটে যাওয়া। লঞ্চ থেকে ডাঙায় যেতে হলে শেকল ধরে টান দিলে লঞ্চ এগিয়ে যাবে ওদিকে।

নিশ্চিন্ত হয়ে দরজা ভালো করে বন্ধ করেও ভেতর থেকে গোঁজ দিয়ে রাখল যাতে সহজে কেউ ঢুকতে না পারে। সন্ধে নামছে। এখন অমিতে ফিরে যেতে চাওয়া মানে সরাসরি যমের বাড়ি যাওয়া।

হয়তো মেয়েটাকে এর মধ্যে ওর অভিভাবকেরা নিয়ে গেছে। না নিলেও হনুমানটার সঙ্গে দিব্যি থাকবে। বোবা লোকটা, হনুমান আর এই মেয়েটার একটা মিল আছে। ওদের কথা বলার জন্যে কোনও ভাষার দরকার হয় না।

এ্যাকুয়াগার্ড খুলে জল খেল মিলন। তারপর কিচেনে চলে এসে ডাকলডিমের ওমলেট বানাল। একটা টিনফুড তুলে নিয়ে দেখল, ওপরে টুন' ফিশ লেখা রয়েছে। রাত্রে ভাতের সঙ্গে এই টুনা মাছ চলতে পারে।

সঙ্গে-সঙ্গে পুরোনো অভিজ্ঞতা মনে পড়ে যাওয়ায় খুশি হল সে। ছিপটা খুঁজে বের করে বড়শিতে ওমলেটের টুকরো গেঁথে জানলা খুলে দেখল, কুমিরগুলো আশেপাশের জলে আছে কিনা। জল নিস্তরঙ্গ দেখে সে অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর বড়শি জলে ফেগল। মিনিট খানেক যেতে- না-যেতে সুতোয় টান পড়ল। ছিপ ওপরে তুলতে গিয়ে মিলন বুঝল, বেশ ভারী কিছুর মুখে বড়শি আটকে গেছে।

সে ছিপ নীচে নামাল যাতে সূতো ছিঁড়ে না যায়। ঠিক তখনই প্রবল বেগে একটা ছোট কুমির ছুটে এসে সুতোর পাশ দিয়ে চলে যেতেই ওজনটা কমে গেল। দ্রুত ছিপ ওপরে তুলতেই একটা কাতলা মাছের অর্ধেকটা দেখতে পেল সে।

মাছটাকে ওপরে নিয়ে এসে জানলা বন্ধ করে বুঝল, ওর পেট থেকে লেজের অংশটা কুমিরের পেটে চলে গেছে। বাকি অর্ধেকটা বড়শির কল্যাণে এখনও আটকে রয়েছে। এই অংশের সাইজ দেখে অনুমান করা যায়, অন্তত চার কেজি ওজন ছিল মাছটার। ওটাকে সে কিছুতেই জলের ওপর

থেকে তুলতে পারত না। কুমির তার উপকারই করেছে। এখন কথা হল, কুমিরে কাটা মাছ খাওয়া উচিত হবে কিনা। কুমিরের দাঁতে বিষ থাকে বলে সে শোনেনি। তবু কাটা অংশের এক ইঞ্চিটাক সে ছুরি দিয়ে বাদ দিল। তারপর মাথা ছেড়ে

বাকি অংশের অঁশ ছাড়িয়ে টুকরো করে ভেজে ফেলল। এতে অনেকটা সময় চলে গেল। বাইরে নিস্তব্ধ পৃথিবী। শুধু হাওয়া বইলে জলে শব্দ বাজছে।

ওমলেট এবং মাছ ভাজা নিয়ে আরাম করে বিছানায় বসে হুইস্কির বোতল খুলল মিলন। খানিকটা গ্লাসে ঢেলে জল মিশিয়ে সে হেসে ফেলল। কে বলবে যে এখানে আসার আগে সে এভাবে জমিয়ে মদ খাওয়ার কথা 'ভাবেনি। বিদেশি মদ তো ভাবনায় ছিল না। বস্তুত, মদ খাওয়ার চিন্তা মাথায় আসেনি তখন। অথচ এখন তাকে দেখলে যে কেউ ভাববে, সে এব্যাপারে রীতিমতো দক্ষ।

মসে চুমুক দিয়ে এক টুকরো ওমলেট চিবোতে চিবোতে সে নিজেকে প্রশ্ন করল, আচ্ছা, একেই কি সুখ বলে? অন্যের সাজানো সংসার দিব্যি উপভোগ করছে। আপত্তি করার কেউ নেই। প্রথম যেদিন সমুদ্র পেরিয়ে বালির চরে পা রেখেছিল সেদিন সে জানতই না এসব তার জন্যে অপেক্ষা করছে। ওই উঁচু টপ্তের ওপর রাত্রিবাস করার সময় মনে হয়েছিল পেটের দায়ে মানুষকে কত কী করতে হয়, তাকেও করতে হবে।

মিলন ঠিক করল, রোজ সকালে এখান থেকে বেরিয়ে জমিতে যাবে। সারাদিন কাজ করে বিকেলে ফিরে আসবে। কিছু সবজি, ডিম, মুরগির মাংস লঞ্চে এনে রাখতে হবে। কিন্তু হুইস্কির বোতলগুলো খালি হয়ে গেলে কিছু করার থাকবে না। সে হাসল। হেড অফিসকে যদি সে স্কচ হুইস্কি পাঠাতে বলে তাহলে কি প্রতিক্রিয়া হবে?

তিনবার খাওয়া শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ডিম এবং মাছ ফুরিয়ে গিয়েছিল। এখন আর একটুও খিদে নেই। বাথরুমে যাবে বলে পা বাড়াতেই শরীর ঈষৎ টলল। তার নেশা হয়ে গেল নাকি? যাচ্চলে। সাবধানে বাথরুমে গেল মিলন। না, তেমন কিছু নয়। তবে আর রাত্রে খাওয়ার জন্যে কিছু রান্না করার দরকার হবে না।

মোমবাতির আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ামাত্র ঝিনুকের মুখ মনে হল। ঝিনুক তার সঙ্গে এই বিছানায় শুয়েছিল। এই সময় ঝিনুক থাকলে? বড় শ্বাস পড়ল তার। যদি কোনও মন্ত্র জানা থাকত তাহলে সে ঝিনুককে এই মুহূর্তে উড়িয়ে নিয়ে আসত। মেয়েটার মিথ্যে বলার অভ্যেস থাকলেও তাকে ভালোবেসেছে, এটা ঠিক। ভালো না বাসলে মানুষের হাতের স্পর্শে অত আদর থাকে না।

ঘুমিয়ে পড়েছিল মিলন। হঠাৎ একটা ভয়ঙ্কর চিৎকার তার ঘুম ভাঙিয়ে দিল। এই চিৎকার সে টঙের ওপর শুয়ে শুনেছিল। এই চিৎকাবের পর বোবা লোকটা আগুন জ্বেলেছিল। মিলন বিছানার ওপর উঠে বসল।

দ্বিতীয়বার চিৎকার ভেসে এল কাছাকাছি পড় থেকে। কোনও অস্ত্র রেগে গর্জন করছে।

ও নিশ্চয়ই লঞ্চে তার অস্তিত্ব টের পেয়েছে। জলে নামতে হবে বলে সে এগোতে পারছে না।

এ যা দূরত্ব তা বাঘ বা চিতা হলে লাফিয়ে অতিক্রম করতে পারত। বেশ কিছুক্ষণ পরপর জন্তুটার চিৎকার শোনা যাচ্ছিল।

মিলন নিশ্চিত হল, ও লাফাতে পারে না। পারলে এতক্ষণে নেমে এসে দরজা ভাঙার চেষ্টা করতে পারত। সে রিভলভার তুলে নিয়ে অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে প্রথম ঘর ডিঙিয়ে ইঞ্জিন ঘরে চলে এল। দরজা খুলে ডেকে গিয়ে জন্তুটাকে দেখবে নাকি?

ঠিক সেই সময় ইঞ্জিনঘরের জানলায় ঠক করে শব্দ হল। চমকে সেদিকে তাকাতেই একটা ঝাপসা মুখ আর দুটো চোখ দেখতে পেন্স সে। ভেক থেকে অনেক ওপরে জানলাটা। যেটা খুলে ড্রাইভার লঞ্চ চালায়। যদিও ওখানে লোহার গ্রিল আছে। ওখানে উকি দেবে যে জানোয়ার তাকে অবশ্যই লম্বা হতে হবে।

হঠাৎ মাথায় মতলবটা এল। শব্দের জবাব শব্দ দিয়ে দিলে কেমন হয়? চট করে ইঞ্জিনঘর এবং ডেকের আলো জ্বেলে দিতেই সাপটাকে দেখতে পেল। এতবড় মাথা কোনও সাপের হতে পারে? তখনই ডাঙা থেকে চিৎকারটা আরও প্রবল হয়ে ভেসে আসতেই মিলন বুঝল, চিৎকারটা সাপের গলা থেকে বেরুচ্ছে না। এখন তাকে দুটো শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।

মিলন চটপট ইঞ্জিন চালু করল। কেঁপে উঠল লঞ্চ। বিকট শব্দ বেরুতে লাগল ইঞ্জিন থেকে। সঙ্গে-সঙ্গে সাপটা নেমে গেল ডেকের ওপর। শব্দ হল, নড়ে উঠল লঞ্চটা। অথচ ওটা যখন ডেকে এসে জানলা পর্যন্ত উঠে ছিল তখন শব্দ দূরের কথা, লঞ্চ নড়েনি। এখন এই ইঞ্জিনের শব্দে ও পালাতে পারলে বাঁচে। জানলার কাচের কাছে চোখ নিয়ে গিয়ে মিলন দেখল সাপটা শেকল বেয়ে ডাঙায় যাওয়ার চেষ্টা করছে।

সাহস পেয়ে ডেকের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গুলি চালাতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল মিলন। সাপের মাথাটা ডাঙায় পৌঁছেছে, লেজের অনেকটা ডেকের ওপর।

ঠিক তখনই একটা কালো শরীর ঝাঁপিয়ে পড়ল সাপটার মাথার ওপর। বিশাল শরীর ওপরে তুলে সাপটা আক্রমণকারীকে জড়াতে যেতেই অলে পড়ে গেল।

সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে আসা একটা কুমিরের হাঁ মুখ সাপের শরীরের মাঝখানটা গিলে ফেলতে চাইল। ওপরের জন্তুটা সাপের মাথা মুখে পুরে টানছে প্রবলভাবে, কুমির শরীরের মধ্যভাগ টেনে নামাতে চাইছে বাকিটা। প্রায় দড়ি টানাটানির মতো ব্যাপারটা।

কয়েক সেকেন্ড চলতেই সাপের শরীর দু-টুকরো হয়ে গেল। কুমির তার অংশ নিয়ে জলের তলায় চলে যেতে সেখানে ঘটপুটি শুরু হয়ে গেল। সম্ভবত তার ভাগ বসাতে এসেছে ওর আত্মীয়রা।

ডেকের আলো ডাঙার যে জায়গায় পৌঁছেছে সেখান থেকে সাপটাকে অর্ধেক শরীর তুলে সরে যেতে চাইছিল জন্তুটা। যে অতবড় সাপের মাথা মুখে পুরে ফেলতে পারে অনায়াসে, সে কী পরিমাণ ভয়ঙ্কর হবে তা আন্দাজ করে জন্তুটার মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল। পরপর

দুবার। সঙ্গে-সঙ্গে জন্তুটা দাঁড়িয়ে গেল। মুখ থেকে সাপের মাথাটা বের করে মাটিতে ফেলে দিয়ে সে উন্মাদের মতো চিৎকার করে মিলনকে লক্ষ করে লাফ দিল। তৃতীয় গুলিটা ওর বুকে লাগতেই শরীরটা উলটে জলে পড়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে মহাভোজ শুরু হয়ে গেল কুমিরদের। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সব শান্ত। ঝিঁঝিরা ডাকতে

শুরু করল আবার। ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে না করতেই মিলন দেখল, এই ফাঁকে প্রচুর পোকা ঢুকে পড়েছে আলোর টানে। ইঞ্জিন বন্ধ করে আলো নিভিয়ে সে ভেতরের ঘরে চলে এসে দ্বিতীয় দরজা বন্ধ করল। এখন আলো জ্বালার প্রশ্নই ওঠে না। যারা ঢুকেছিল তারা ইঞ্জিন ঘরে বন্দি থাক। কাল সকালে দেখা যাবে।

বিছানায় বসল মিলন। এরকম আদিম পরিবেশ সহ্য করা মুশকিল। তবে এই ঘটনা নিশ্চয়ই জঙ্গলের অন্য প্রাণীরা দেখেছে। তারা আর কিছুদিনের মধ্যে লঞ্চের কাছাকাছি হবে না। মিলন হুইস্কির বোতলটা টেনে নিয়ে কাঁচা মদের খানিকটা গলায় ঢাকতেই শরীর গরম হয়ে গেল। শুয়ে পড়ল সে।

তখন কত বেলা, দিনের কোন সময় জানে না সে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল, বাইবের পৃথিবীতে আলো নেই। মিলন উঠল। জানলার কাচে মুখ নিয়ে গিয়ে দেখল যদিও এখন দিন কিন্তু সূর্য মেঘের আড়ালে চলে গেছে।

তখনই অদ্ভুত গোঙানির আওয়াজ আর সেইসঙ্গে লঞ্চের ওপর পাথরের টুকরো এসে পড়ল। ঘুমটা ভেঙেছিল ওই পাথরের শব্দে। বুঝতে পেরে সে ইঞ্জিনঘরে চলে এল। তখনই দরজায় শব্দ হল। আর কাচের জানলায় যে মুখটা ভেসে উঠল, সেটা অপরিচিত নয়।

ডেকের দরজা খুলতেই হনুমানটা জানলা থেকে নেমে এসে ডেকের ওপর লাফাতে লাগল আনন্দে। যেন দারুণ কাজ করে ফেলেছে সে। ভাঙার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল মিলন। বোবা লোকটার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটা হাসছে। মেয়েটা তার ভাষায় কিছু বলল। বোবা লোকটার মুখে হাসি।

ইঞ্জিন ঘরে ঢুকে লঞ্চটাকে চালু করতেই বিকট শব্দ বাজল। মিলন দেখতে পেল, ভয় পেয়ে হনুমানটা শেকল বেয়ে সোজা চলে গেছে ওই দুজনের কাছে।

লঞ্চটাকে ধীরে ধীরে ডাঙার কাছে নিয়ে গেল মিলন। সঙ্গে-সঙ্গে বোবা লোকটা, হনুমান এবং মেয়েটা উঠে দাঁড়াল ডেকে। ইঞ্জিন বন্ধ করল মিলন। বোবা লোকটা তার সামনে এসে হাত- পা নেড়ে বোঝাতে চাইল যে সে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বসে থাকতে না পেরে ছুটে

এসেছে দিনের বেলায়। অন্তুটার চিৎকার সে নকল করার চেষ্টা করল মুখে ভয় ফুটিয়ে।

মেয়েটা চুপচাপ দেখছিল। ওর পরনে এখনও তার বারমুডা আর গেঞ্জি। গেঞ্জি ওর বুকের সবটা ঢাকতে না পারায় চোখ সরিয়ে নিল মিলন। তারপর হাত নেড়ে বোঝাল, তার কিছু হয়নি।

সে দিব্যি আরামে এখানে ঘুমিয়েছে।

ওরা তিনজন ঘুরে-ঘুরে লঞ্চটাকে দেখল। এবং তখনই বৃষ্টি নামল। মিলন লঞ্চ চালু করে ডাঙা থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে এল ওটাকে। বৃষ্টি পড়ছে সজোরে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল।

গুলের ওপর বৃষ্টির ফোঁটা শব্দ করে মিলিয়ে যাচ্ছিল।

বোবা লোকটা নিজের বুকে হাত ছুঁইয়ে দূরের দিকে দেখিয়ে বোধহয় জানতে চাইল কী করে জমিতে ফিরে যাবে! মেয়েটা হেসে উঠল খিলখিল করে। বোঝা যাচ্ছে ও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। মিলন বলল, 'বৃষ্টি না থামলে তো যেতে পারব না। আমার খুব খিদে পেয়ে গেছে। তোমরা খেয়েছ?"

বোবা লোকটা মাথা নড়ল। খায়নি।

মোমবাতি জ্বেলে রান্নাঘরে ঢুকে মিলন আবিষ্কার করল, গতরাতের মাছভাঙ্গার অনেকটাই রয়ে গেছে। সে গ্যাস ধরিয়ে ভাতের জল বসিয়ে দিল। বোবা লোকটা অবাক হয়ে দেখছিল। ইশারায় মেয়েটাকে ডাকতে, সে দরজায় এসে গ্যাসের আওয়াজে প্রথমে চমকে গেল। তারপর মিলন ফলে চাল

ছাড়তে সে ব্যাপারটা আঁচ করতে পারল।

ফেনা ভাত, মাহু ভাজা আর টুনামাছের ঝাল কৌটো থেকে বের করে খেতে বসল ওরা। ভাতের মধ্যে ফ্যান থাকায় খেতে অসুবিধে হচ্ছিল না।

খাওয়া শেষ করে প্লেট ধোয়ার পর একটু টুনা মাছ বড়শিতে গেঁথে জানলা দিয়ে গুলে ফেলল মিলন। আকাশ অন্ধকার। জলের রং কালো। বৃষ্টি হয়েই চলেছে। হনুমানটা গম্ভীর মুখে বসে আছে। বোবা লোকটা ওকে যে ভাত খেতে দিয়েছিল, তা খেয়ে নিয়েছে চেটেপুটে।

সুতোয় টান পড়তেই ছিপ ওপরে তুলল মিলন। বেঁকে গেল ছিপের মাথা। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর কুমির এগিয়ে আসার আগেই মাছটাকে ওপরে তুলতে পারল সে। একটা কেজি দেড়েকের ভেটকি মাছ। বড়শি ছাড়িয়ে নিলে লাফাতে লাগল সেটা। মেয়েটা খুশিতে খপ করে ধরল মাছটাকে।

মিলন বলল, 'ওটার আঁশ ছাড়িয়ে কেটে ফেলো।' লোকটা মাছের দখল নিলে মেয়েটা ওর সঙ্গী হল।'

মুরহেডের সংগ্রহ থেকে একটা চুরুট বের করে ধরিয়ে বাইরের ঘরে চলে এল মিলন। বৃষ্টি পড়ে চলেছে সমানে। জমি পাহারা দেওয়ার দরকার নেই, তবু লোক্টার ওখানে থাকা দরকার ছিল। যদি ওই মেয়েটার আত্মীয়রা খোঁজ নিতে আসে, তাহলে কিছু জানতেই পারবে না। অবশ্য এই আবহাওয়ায় সমুদ্রে ডোঙা ভাসাতে নিশ্চয়ই কেউ চাইবে না।

মেয়েটার 'ভাবগতিক দেখে বোঝা যাচ্ছে, লোকটার সঙ্গে ওর বেশ ভাব হয়েছে। লোকটা বোবা হলেও শ্রীর স্বাস্থ্য ভালো। ওরকম ভয়ঙ্কর যৌবন যে মেয়ের শরীরে, ত'র সঙ্গ কি ওকে প্রলুব্ধ করবে না? সেটা কি গতরাতেই হয়ে গেছে? মেয়েটার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে ওদের বিয়ে দেওয়া যেতে পারে। চুরুট টানতে-টানতে মিলন ভাবল, এ ব্যাপারে মেয়েটার অভিভাবকরা এলে কথা বলবে।

দিন কখন শেষ হল, কখন রাত নামল বোঝার আগেই চারপাশ আঁধারে ভরে গেল। জল পড়ছে অঝোরে। হাওয়া নেই বলে বাঁচোয়া। হনুমানটা এই ঘরে ঢুকতেই মিলন তাকে ডাকল, 'এই আয় এখানে।'

পাত্তাই দিল না হনুমান। দরজার কাছে গিয়ে সেটাকে খোলার চেষ্টা করল। মিলন নিশ্চিত ও খুলতে পারবে না। হনুমানটাকে মরিয়া হয়ে উঠতে দেখে কী করবে বুঝে ওঠার সময় লোকটা চলে এল এই ঘরে। তাকে দেখে হনুমান একটু শান্ত হতেই লোকটা মিলনকে ইশারায় বোঝাল, ও দরজা খুলতে চায়! আঙুল দিয়ে হনুমানকে দেখিয়ে হাসল সে।

'এই অন্ধকারে দড়ি বেয়ে কেউ এসে ডেকে বসে থাকতে পারে। দরজা না খুলে ওকে টয়লেটে নিয়ে যাও। নিয়ে এসো ওকে। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।'

ভেতরের ঘরে গিয়ে টয়লেট দেখিয়ে দিয়ে বলল, 'ভালো করে জল ঢেলে দিও। কোনও হনুমান কমোডে বসে পটি করছে তা জীবনে শুনিনি।

লোকটা বুঝিয়ে-টুঝিয়ে হনুমানটাকে টয়লেটে নিয়ে যেতে মিলন দেখল, মেয়েটা তার বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে রয়েছে। আপত্তি জানাতে গিয়েও সে থমকে গেল। মেয়েটা সবে সুস্থ হয়েছে। এখানে আসার ধকলে কাহিল হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

মোমবাতি জ্বালা হয়েছে দুটো ঘরে। বোবা লোকটা হনুমানকে নিয়ে বাইরের ঘরের মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছে চুপটি করে। একটু আগে বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু এখন লঞ্চ দুলছে। মিলন অনুমান করল জোয়ার এসেছে। ঢেউ-এর তালে লঞ্চ যদি পাড়ের দিকে চলে যায়, তাহলে যে-কোনও জন্তু পায়ে হেঁটে উঠে আসতে পারবে। উঠুক। ভরসা দুটো। সহজে দরজা ভাঙতে পারবে না। আর সে এই রাত্রে একা নেই।

এখন সন্ধে পেরিয়েছে অবশ্যই। মিলন কিচেনে ঢুকে ভেটকি মাছের টুকরোগুলো ভেজে অনেকটা ঝোল বানিয়ে ফেলল। তারপর ভাত চাপাল। লোকটা চলে এসেছিল দরজায়। চোখাচোখি হতে দাঁত বের করে হাসল। মিলন জিজ্ঞাসা করল, 'কেমন লাগছে?'

সে ঘাড় নড়ল, 'ভালো।'

কয়েকটা ভাজা মাছ আলাদা রেখেছিল মিলন। ভাত হয়ে গেলে কী করে গ্যাস নিভিয়ে সসপ্যান নামাতে হবে শিখিয়ে দিল সে বোবা লোকটাকে। লোকটা চটপট শিখে ফেলল। এবার মিলন বলল, 'ওই মেয়েটাকে ওখান থেকে ওঠাও। বাইরের ঘরে গিয়ে শুতে বলো। ওটা আমার ঘর।'

লোকটা মাথা নড়ে চলে গেল। একটু পরে গোঙানি কানে এল। মেয়েটাকে বেশ বকেঝকে ঘুম থেকে তুলল লোকটা। তারপর ফিরে এসে মাথা নেড়ে জানাল, কাজটা করে ফেলেছে। ভাতের দিকে নজর রাখতে বলে মাছের প্লেট নিয়ে মিলন শোওয়ার ঘরে এল। একটু শীত-শীত করছে এখন। বৃষ্টি থামার পরই বাতাস বইতে শুরু করেছে। ফলে শীতের আবহাওয়া তৈরি হয়ে গেছে।

সে লক্ষ্য করল মেয়েটা বালিশে মাথা রেখে শোয়নি। বালিশ সযত্নে ওপাশে সরিয়ে রেখেছিল। চাদরটাকে ঝেড়ে পরিষ্কার করে তার ওপর বসল মিলন। হুইস্কির বোতল থেকে গ্লাসে কিছুটা হুইস্কি ঢেলে জল মেশাল। লঞ্চ দুলছে। এদিক ওদিকে যাচ্ছে। কিন্তু দড়ির বাঁধা থাকায় লঞ্চটাকে একটা বিশেষ জায়গায় দুলতে হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবারের ঘষাঘষিতে যদি দড়ি ছিঁড়ে যায়, তাহলে জোয়ারের জল হয়তো পেছনে নিয়ে যাবে। কিন্তু ভাটা শুরু হলে আর দেখতে হবে না।

হেসে ফেলল মিলন। তখন থেকে সে যাকে মড়ি বলে ভেবে চলেছে সেটা যে আর দড়ি নেই, লোহার চেন তা বেমালুম ভুলে গিয়েছে। শেকল ছিঁড়বে না কিছুতেই।

মাছের টুকরো দিয়ে হুইস্কি খেতে খেতে মিলন খেয়াল করেনি, ঘরের দরজায় কখন লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। পাশে হনুমান। লোকটা 'অবাক হয়ে মিলনের হাতে ধরা গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে। মিলন জিজ্ঞাসা করল, 'কী ব্যাপার?'

লোকটা আঙুল তুলে গ্লাস দেখাল। 'এটা হুইস্কি। বিলিতি মদ। ভাত হয়ে গেছে?'

লোকটা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। কিন্তু নড়ল না। 'খেতে ইচ্ছে করছে?' মিলনের মনে মায়া এল।

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল লোকটা।

একটা খালি গ্লাসে সামান্য মদ ঢেলে গুল না মিশিয়ে এগিয়ে ধরল, 'খাও। তুমিই বা বঞ্চিত হবে কেন?'

লোকটা গ্লাস নিয়ে এক ঢোকে তরল পদার্থ গলায় চালান করেই অন্য হাতে বুক আঁকড়ে ধরল চোখ বন্ধ করে। তারপর মাথা ঝাঁকতে-ঝাঁকাতে প্লাস নিয়েই চলে গেল পাশের ঘরে। তার অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হনুমান পেছনে ছুটল।

মিলন হাসল। বোধহয় একবারেই সাধ মিটে গেল লোকটার। কিন্তু একটু পরে মেয়েটাকে ঘরে আসতে দেখে অবাক হল সে। বোকা-বোকা হাসি ওর মুখে, হাতে বোবা লোকটার নিয়ে যাওয়া গ্লাস। আমাদের টেবিলে গ্লাসটা রেখে নিজের ভাষায় কিছু বলল মেয়েটা।

মিলন জিজ্ঞাসা করল, 'হিন্দি জান না?'

মাথা নেড়ে হাসল মেয়েটা। এই দেশের যে-কোনও জায়গার মানুষ অল্প হলেও কিছুটা হিন্দি বুঝতে পারে। ওকে যারা এনেছিল, তাদের মুখে ভাঙা হিন্দি ছিল বলে আবছা মনে পড়ছে। মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে।

মিলন জিজ্ঞাসা করল, 'কিছু চাই?'

মেয়েটা কী বুঝল সে-ই জানে, আঙুল তুলে গ্লাস দেখিয়ে দিল।

অবাক হল মিলন। তারপর ইশারায় বোঝাল, ওটা খেলে মাথা ঘুরবে, পড়ে যাবে।

মেয়েটা শব্দ করে হাসল। তারপর মাথা নেড়ে যেটা বলল, তার বাংলা বোধহয়, কিছু হবে না। আমি আগেও খেয়েছি।

ওকে হুইস্কি দেওয়াটা উচিত হবে কিনা ভাবল মিলন। তারপর অল্প কিছুটা গ্লাসে ঢেলে অল মিশিয়ে দিল।

মেয়েটা গ্লাস তুলে চলে গেল ঘর থেকে।

দ্বিতীয় গ্লাস শুরু করার সময় আবার ফিরে এল মেয়েটা। গ্লাস সামনে রেখে হেসে কিছু বলল। মিলন ধমক দিল, 'না। যথেষ্ট হয়েছে। যাও, ভাত খেয়ে শুয়ে পড়।'

হাসল মেয়েটা। কিন্তু গেল না। মিলন বাধ্য হল, আবার গ্লাস ভরে দিতে। এবার যদি বোবা লোকটা এসে দ্বিতীয়বার খেতে চায় তাহলে তার বোতল শেষ হতে বেশি দেরি হবে না। মেয়েটা দরজায় হেলান দিয়ে চুমুক দিতে লাগল। চোখাচোখি হলেই সে হেসে উঠছে। মিলনের মনে হল, ওর নাম হাসি হলে মন্দ হয় না।

তৃতীয় গ্লাস না নিয়ে ছাড়ল না মেয়েটা। নিয়ে ঘরের মেঝেয় বসে পড়ল। এখন ওর হাসির আওয়াজ বেড়ে গেছে। কথা বলছে আর হাসছে।

হঠাৎ অদ্ভুত সুরে গান ধরল কিছুক্ষণ। গ্লাস শেষ হওয়ার আগেই পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ সরিয়ে নিল মিলন। মোমবাতির আলোয় ওর শরীরের উন্মুক্ত অংশ প্রলোভন তৈরি করছে। সে দ্বিতীয় গ্লাস শেষ করে বাইরের ঘরে এসে দেখল বোবা লোকটা মড়ার মতো ঘুমাচ্ছে। 

পেট ভরে ভাত খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ল মিলন। মেয়েটার দিকে একবারও তাকাল না। সে বুঝতে পেরেছে, তাকালে দুজন যুবতীকে একসঙ্গে প্রতারণা করবে সে।

সকালে চমৎকার রোদ উঠল। নদীর জলে তার প্রতিফলন চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছিল। বোবা লোকটা ঘুম ভাঙিয়েছিল মিলনের। মিলন উঠতেই সে ব্যস্ত হল জমিতে ফিরে যেতে। মেয়েটা তখনও মেঝেতে ঘুমিয়ে রয়েছে। ওকে জাগানো হল।

লঞ্চটাকে চালু করে পাড়ের কাছে নিয়ে যেতে বোবা লোকটা আগে নামল। তার পেছনে হনুমান। ইঞ্জিন বন্ধ করে ডেকে বেরিয়ে মেয়েটাকে দেখতে পেল না মিলন। ওকে ডাকতে গিয়ে কাল রাত্রে ভাবা নামটা মনে পড়ল। সে চেঁচিয়ে ডাকল, 'হাসি, হাসি?'

হাসি সাড়া দিল না। মিলন লঞ্চের ভেতর ঢুকল। দুটো ঘরে হাসি নেই। কিন্তু কিচেনের ভেতর চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

মিলন বিরক্ত হল, 'আরে! এখানে দাঁড়িয়ে কেন? চলো।'

হাসি জোরে মাথা নাড়ল। সে যাবে না।

'যাবে না কেন? এখানে একা থাকা যায় না। চলো!'

মেয়েটা পেছন ফিরে দাঁড়াল। যেন মিলনের কথা সে শুনতে চায় না। ভাঙায় দাঁড়ানো বোবা লোকটার গোঙানি ভেসে এল। সে অধৈর্য হচ্ছে। মিলন হাত বাড়িয়ে হাসির কনুই ধরে টানল, 'তাড়াতাড়ি বলো।'

সেই টানটা হয়তো একটু বেশি জোরে হয়ে গিয়েছিল কারণ হাসির শরীরটা ঘুরে গিয়ে মিলনের সঙ্গে ধাক্কা খেল। যেন বিদ্যুতের স্পর্শ পেল মিলন। হাসি যেন মজা পেয়ে গেছে, এমন ভঙ্গিতে তার দিকে মুখ তুলে হাসল।

ঝট করে সরিয়ে নিল নিজেকে। নিয়ে এক পা পিছিয়ে গিয়ে হাত নেড়ে বেরিয়ে আসতে

বলল মিলন। হাসিহাসিমুখে মাথা নাড়ল, না।

অসহায় বোধ করল মিলন। ওকে নিয়ে যেতে হলে গায়ের জোর দেখাতে হবে। এটা সে কিছুতেই করবে না।

তারপর মনে হল, থাক ও এখানে। দ্রুত হেঁটে ডেকে চলে এসে খেয়াল হল মিলনের। ডেকের দরজা যদি খোলা থাকে, তাহলে ফিরে এসে মেয়েটাকে আর দেখতে পাবে না। ওকে বন্ধ করতে বলেও লাভ নেই। খেয়াল হলেই দরজা খুলে ডেকে দাঁড়াবে।

লঞ্চটা যেহেতু ডাঙার গায়ে লাগানো তাই ভয়ঙ্কর প্রাণী বা বিরাট সাপের খাবার হতে ওর সেরি লাগবে না। মিলন বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে শেকল তুলে দিল। তাতেও ভরসা না করে ডেকের একটা ভাঙা টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে শেকলের হুকে গুঁজে দিল।

ডাঙায় নেমে সে বোবা লোকটাকে বলল, 'ও আসতে চাইছে না। কি করা যাবে।' বোবা লোকটা নির্লিপ্তচোখে একবার লঞ্চটাকে দেখে হাঁটা শুরু করল।

সারাদিন জমিতে কাজ করে গেল ওরা। গত রাত্রে এখানে কেউ না থাকায় কোনও ক্ষতি হয়নি। একফাঁকে ভাতে ভাত ফুটিয়ে নিয়েছিল লোকটা। মেয়েটা আজ সারাদিন অভুক্ত থাকবে। কিছু করার নেই।

দুপুরের খাওয়া শেষ হলে ডোঙাটাকে দেখা গেল। দুটো লোক দাঁড় বেয়ে আসছে। হনুমানটা খবর দিতে ওরা ছুটে এল সমুদ্রের ধারে।

মিলন অস্বস্তিতে পড়ল। মেয়েটা যে লঞ্চে আছে, তা ওদের বোঝাতে জেরবার হতে হবে। কেন এখানে না থেকে লঞ্চে গেল সে, এই প্রশ্ন ওরা করতেই পারে।

ডোঙাটাকে বালিতে তুলে লোকদুটো আভূমি নত হয়ে প্রণাম করল। তারপর ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, মেয়েটা বেঁচে আছে কিনা।

মিলন ইশারায় জানাল, 'একটু ভালো। ওকে দেখতে হলে দূরে যেতে হবে।'

লোকদুটোর মুখ দেখে মনে হল, ওরা খুশি হয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গে ডোঙার মধ্যে থেকে শত্রু শণে গাঁথা গোটাদশেক বেশ বড় আকারের কাঁকড়া বের করে মিলনের পায়ের কাছে রেখে কোনও কথা না বলে লোকদুটো ঢোকা নিয়ে সমুদ্রে ভাসল। দ্রুত দাঁড় বেয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল।

ওদের এই যাওয়ার ভঙ্গিটা যেন পালিয়ে যাওয়া বলে মনে হচ্ছিল মিলনের। অসুস্থ একটা মেয়েকে চিকিৎসার জন্যে নিয়ে এসে ওরা সারারাত ছিল। মেয়েটা একটু ভালোর দিকে দেখে সেই যে চলে গেল আজ আসার সময় পেল।

ইশারায় সে বুঝিয়ে ছিল মেয়েটা এখন ভালো আছে এবং তাকে দেখতে হলে খানিকটা দূরে যেতে হবে। শোনামাত্র কাঁকড়াগুলো উপহার দিয়ে ওরা এভাবে পালিয়ে গেল কেন? তবে কি সুস্থ অবস্থায় মেয়েটাকে ওরা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় না?

সে বোবা লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল, 'ওরা পালাল কেন?'

বোবা লোকটা হাসল। তারপর ইশারায় বোঝাল, ওরা ভেবেছে যে মেয়েটা মরে গেছে। হতভম্ব হয়ে গেল মিলন। তার ইশারার ভুল অর্থ করল ওরা। সে দূরের দিকে হাত দেখিয়েছে মানে ভেবেছে, মেয়েটা মরে গেছে! কিন্তু তাহলে মৃতদেহ দেখতে চাইল না কেন? হঠাৎ হনুমানটা চিৎকার করতে আজব দৃশ্য দেখতে পেল ওরা। কাঁকড়াগুলো নড়ছে দেখে

হনুমানটা কৌতূহলী হয়ে ওদের কাছে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। বোধহয় খেলতে চেয়েছিল। প্রথম কাঁকড়াটার সামনে হনুমানের লেন্দ্র চলে যাওয়ায় সেটা কামড়ে ধরেছে। এখন হনুমান পরিত্রাণের জন্যে লাফাতে দর্শণ্টা বড় কাঁকড়া তার লেজে ঝুলে থাকছে। তাদের ওজনটাও হনুমানের পক্ষে বেশি হয়ে গেছে। লোকটা তড়িঘড়ি গিয়ে হনুমানকে কাঁকড়ামুক্ত করতে সে লাফিয়ে দূরে সরে

গিয়ে ভয়ভয় চোখে তাকাতে লাগল। লোকটা কাজ পেয়ে গেল। তিনটে কাঁকড়া ছাড়িয়ে ভালো করে চচ্চড়ি রেঁধে ফেলল চটপট। বাকিগুলোকে যেমন ছিল তেমনি রেখে দিলে একটা বালতিতে চাপা দিয়ে।

সূর্য পশ্চিমে ঢলতেই মিলন লোকটাকে ইশারা করল, সে লঞ্চে যাবে কিনা? লোকটা মাথা নাড়ল, যাবে না। উলটে একটা বড় বাটিতে কাঁকড়ার চচ্চড়ি দিয়ে দিল সে।

প্রায় দিনে-দিনেই নদীর কাছে পৌঁছে গেল মিলন। জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে লঞ্চটাকে দেখা যাচ্ছে। পা বাড়াতে গিয়েই থমকে গেল। লঞ্চের ছাদে বসে আছে বিশাল আকারের একটা কালো জীব যার আদল অনেকটা হায়েনার মতো। কাল রাত্রে যে গুলি খেয়ে কুমিরের পেটে গিয়েছে এটি বোধহয় তার সঙ্গী। মাঝে মাঝেই লঞ্চের ছাদ আঁচড়াচ্ছে ও। পাড়ের গায়ে লঞ্চ লাগানো বলে ওর পক্ষে লঞ্চে উঠতে অসুবিধে হয়নি। মেয়েটার কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

একটা পাথর তুলে লঞ্চের দিকে ছুঁড়ল মিলন। সেটা ডেকে লেগে জলে পড়তেই জন্তুটা সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর তার গলা থেকে অবিকল গতরাতের অন্তটার আওয়াজ বের হল। এক লাফে সে ডেকে নেমে পড়তেই লঞ্চের সামনের দিকটা ঈধৎ নীচু হয়ে গেল। ক্রুদ্ধ চোখে জন্তুটা জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে এখন।

কোমর থেকে রিভলভার বের করে গুলি চালাল মিলন। সঙ্গে-সঙ্গে লাফিয়ে মাটিতে পড়েই জঙ্গলের উলটো দিকে ঢুকে গেল জন্তুটা। গুলি ওর গায়ে লাগেনি। মিলন আর দেরি করল না। দৌড়ে ডেকে উঠে এসে শেকল খুলে ভেতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর ইঞ্জিন চালু করে যতটা সম্ভব পাড় থেকে দূরে নিয়ে গেল লঞ্চটাকে। আপাতত নিশ্চিন্ত।

শেষ রোদের প্রতিফলন এখন জলে। তাই লঞ্চের ভেতরে অন্ধকার আসেনি। ভেতরের ঘরে ঢুকে মিলন ডাকল, 'হাসি।' কোনও সাড়া এল না।

তার শোওয়ার ঘরের দরজায় এসে থমকে গেল সে। ঘরের মেঝেতে আরামসে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা। তার পাশে পড়ে আছে খালি গ্লাস আর হুইস্কির বোতল। তার মানে সারাদিন মেয়েটা মদ খেয়েছে। এখন আউট হয়ে ঘুমোচ্ছে। খুব রাগ হয়ে গেল ওর। পাশের জলের বোতলের খানিকটা জল ওর মুখে ঢেলে দিল সে। মেয়েটার চোখ একটু পিটপিট করল শুধু।

এখন ওকে জাগানো অসম্ভব। মিলন উঠে কিচেনে চলে এল। কাঁকড়ার বাটি রেখে দিয়ে দেখল, মেয়েটা কিচেন ব্যবহারের কোনও চেষ্টা করেনি। স্বস্তি পেল সে। গ্যাস জ্বালাতে গিয়ে লম্ফটাকেই পুড়িয়ে ফেলত হয়তো।

ডিমের স্টক শেষ হয়ে এসেছে। জমি থেকে কিছু ডিম এখানে এনে রাখতে হবে। বেশ বড় একটা ওমলেট বানাতে-বানাতে ভাবল মিলন। খেয়াল হল, ওপরের বাক্সের মধ্যে টি ব্যাগ যেন দেখেছিল। খুঁজতেই পেয়ে গেল। গরম জলে টি ব্যাগ ডুবিয়ে দিতেই রং পালটে গেল। দুধ চিনি ছাড়া চা অনেকেই খায়।

ওমলেটটা বেশ বড় হয়ে গেছে। অর্ধেকটা কেটে নিয়ে চায়ের কাপ হাতে সে বাইরের ঘরে এসে জানলার পাশে এগুলো রেখে খাওয়া শুরু করল। সূর্য ডুবছে।

এখন মেয়েটাকে কীভাবে ফিরিয়ে দেওয়া যায়? ওর সঙ্গীরা যদি নিতে না আসে তাহলে ওকে সরানোর একটাই উপায় আছে। বিন্দু থেকে নৌকো এলে তার মাঝিদের বলতে হবে, ফেরার সময় মেয়েটাকে যেন ওদের দ্বীপে নামিয়ে দেয়। হয়তো ঘুরপথ হবে, কিন্তু এছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই।

কিন্তু মেয়েটা ফিরে যেতে চাইছিল না কেন? ও যেখানে ছিল সেখানে কি এমন কোনও ঘটনা ঘটেছে, যার জন্যে ও ফিরতে চাইছে না? হয়তো দ্বীপের লোকও সেই কারণে ওকে এখানে পাচার করে নিয়ে দায়মুক্ত হয়েছে। কী ঘটনা? মেয়েটাকে হাজারবার জিজ্ঞাসা করলেও সেটা জানা যাবে না। প্রথমতঃ ভাষায় প্রতিবন্ধকতা, দ্বিতীয়তঃ মেয়েটা হয়তো এড়িয়ে যাবে।

চা এবং ওমলেট খাওয়ার পর মিলন কাগজ-কলম নিয়ে আর-একটা লিস্ট তৈরি করল। রান্নার গ্যাস, তেল, নুন, চিনি, রান্নার মশলা থেকে সাবান কিছুই বাদ গেল না। সেইসঙ্গে সাতদিনের আলু, পেঁয়াজ, আদা আর কাঁচা সবজি। লঞ্চের গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই নতুন গ্যাস সিলিন্ডার চাই। এখন দেশের সব মফস্সল শহরেও ওটা সহজে পাওয়া যায়। বিন্দুতেও নিশ্চয়ই ওর ডিলার আছে। বাকিগুলো জোগাড় করা মোটেই অসুবিধের নয়।

কিন্তু একটা ভাবনা যেন ঠিক মিলছে না। সে ভেবেছিল, বোবা লোকটা হাসিকে পছন্দ করেছে। হাসির কাছে বোবা মানুষ আর কথা বলতে পারার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। ভাবা যদি বুঝতে না পারে তাহলে ইশারায় কথা বলতে হবে। এই ইশারার ব্যাপারে বোবা লোকটা খুব দক্ষ। এক রাত একলা কাটিয়েছিল দুজনে। ফলে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বলে ভেবেছিল মিলন।

কিন্তু আজ স্বচ্ছন্দে হাসিকে লঞ্চে ফেলে রেখে বোবা লোকটা নির্দ্বিধায় নেমে গিয়েছিল। ওখান থেকে ফেরার সময় মিলন ডাকলেও সে আসতে চায়নি। সম্পর্ক তৈরি হলে মনে দুর্বলতা আসত। সারাদিন একা পড়ে থাকা মেয়েটাকে দেখার জন্যে চলে আসাই স্বাভাবিক ছিল। তাহলে ওদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়নি। এক্ষেত্রে, মেয়েটির আত্মীয়রা না' ফিরিয়ে নিলে ওদের বিয়ে দেওয়াটা সম্ভব হবে কী করে?

মিলনের খেয়াল হল, সন্ধে হয়ে গেছে। লক্ষের ভেতর অন্ধকার ঢুকে গেছে। সে কাল রাতের নিভিয়ে রাখা মোমবাতিটা জ্বালতেই ঘরটা মোলায়েম আলোর ভরে গেল। এই ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো র‍্যাকে কিছু বই আছে। সবক'টা ইংরেজি থ্রিলার। এই আলোয় পড়া যাবে না। গেলে চমৎকার সময় কটিত।

দরজায় শব্দ হল। মুখ ফিরিয়ে মিলন দেখল, মাঝখানের দরজায় হেলান দিয়ে হাসি দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি এখনও নেই। চোখ ঢুলুঢুলু, ঠোঁটে হাসি। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মিলন জিজ্ঞাসা করল, 'মদ খেয়েছিলে কেন?'

কোনও জবাব এল না। আবার ফিরল মিলন। ইশারায় মদ খাওয়ার ভঙ্গিটা করে আঙুল তুলে জানতে চাইল, কেন খেয়েছে?

আবা জড়ানো গলায় হাসি যে জবাব দিল তা মিলনের অবোধ্য। সে হাত তুলে চড় মারার ভঙ্গি করতেই হাসি এমনভাবে মাথা নাড়ল, যার অর্থ, সে আর খাবে না।

এরপর আর কী বলার থাকে। খালি পেটে মদ গিলে বমি করেনি এই ঢের। দরজা জুড়ে দাঁড়িয়েছিল হাসি। সেদিকে এগিয়ে হাতের ইশারায় সরতে বলল মিলন। বেশ চেষ্টার পরে হাসি তার শরীর সরাল। পাশ কাটিয়ে এসে কিচেনে ঢুকে বাকি ওমলেট প্লেটে তুলে নিয়ে মিলন ডাকল, 'হাসি, হাসি।'

হাসি এল। লঞ্চের দেওয়াল ধরে-হরে। উলে উঠেই সামলে নিল। কিচেন থেকে একটা টুল বের করে ওর সামনে রেখে মিলন বলল, 'বসো এখানে।'

হাসি হাসল। কিন্তু বসল না। মিলন গজগজ করস, 'আচ্ছা অবাধ্য মেয়ে।'

তারপর প্লেটটা নামিয়ে রেখে এগিয়ে এসে ওর কাঁধের নীচেয় হাত দু-হাতে ধরে জোর করে টুলের ওপর বসিয়ে দিল। হাসির মাথা ঝুঁকে গেল। গেঞ্চির স্ট্র্যাপ সরে যেতে বাঁ-দিকের উদ্ধত বুক দৃশ্যমান হল।

হাত বাড়িয়ে গেঞ্জিটাকে টেনে খানিকটা ঠিক করাতেই হাসি অবাকচোখে মুখ তুলে মিলনকে দেখল। দেখে ঠোঁট কামড়ে গেঞ্জিটাকে আর-একটু ওপরে তুলে শরীর ঢাকার চেষ্টা করল।

এবার মিলন প্লেট এগিয়ে ধরে বলল, 'খাও।'

ঢুলুঢুলু চোখে হাসি ওমলেটটাকে দেখে প্লেট হাতে ধরল। তারপর যেন অনন্তকাল ধরে খেয়ে চলার মতো একটু-একটু করে মুখে তুলে চিবোতে লাগল। মিলন সরে এল ওখান থেকে। মিনিট পাঁচেক পরে মিলন যখন বাইরের ঘরের বন্ধ কাচের জানলায় দাঁড়িয়ে, তখন ওই ঘরে এল হাসি। হাতে শূন্য প্লেট। মিলন জিজ্ঞাসা করল, 'কী চাই?'

'চাই-চাই-চাই-!' শব্ন্সটা তিনবার উচ্চারণ করেই হেসে ফেলল হাসি। তারপর পেটে হাত দিয়ে চিবোনোর ভঙ্গি করে বোঝাল, তার বিদে এখনও যায়নি। আরও খাবার চাই।

ফাঁপরে পড়ল মিলন। সারাদিন অভুক্ত থেকে আধখানা ওমলেটে পেট না ভরাই স্বাভাবিক। ওর খিদে পেয়েছে মানে, নেশা চলে গেছে। এখন ভাত রান্না করে কাঁকড়ার চচ্চড়ি দিলে রাত্রে কী খাবে?

মিলন কিচেনে চলে এল। ড্রাইফ্লুটের টিনটা খুলে তা থেকে দু-মুঠো নিয়ে প্লেটে ঢেলে ডাকল, 'হাসি, হাসি।'

হাসি প্লেট হাতে দরজায় এসে বলল, 'আসি।'

'না। হাসি।' আঙুল তুলে ওর দিকে দেখিয়ে বলল, 'হাসি।'

'হা...আসি।'

'না। হল না। হাসি।'

'হাসি।'

'গুড। তুমি হাসি।'

'হাসি।'

'দয়া করে এগুলো বেয়ে আপাতত থাকো। আর একটু পরে ভাত রেঁধে দেব। তখন পেট ভরে সেগুলো খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।'

মিলন চলে এল তার ঘরে। কাল রাত্রে হাসি ঘরের মেঝেতে ঘুমিয়েছিল। আজ ওর জন্যে একটা বালিশ আর চাদর আলাদা করে রাখল সে। তারপর আবার গেল কিচেনে। কাঁকড়ার চচ্চড়ি গরম করল। নতুন করে ভাত ফোটাল। এগুলো ঘণ্টা দুয়েক গরম থাকবে। আখরোট চিবোতে- চিবোতে হাসি তার কাজকর্ম দেখে যাচ্ছিল। কিছুটা কাজু আর আখরোট টিন থেকে তুলে নিয়ে ঘরে ফিরে আরাম করে খাটে বসল মিলন। তারপর প্রায় তিনভাগ শেষ বোতল থেকে হুইস্কি গ্লাসে ঢেলে জল মেশাল। চুমুক দিতেই শরীরে আরাম ছড়িয়ে পড়ল।

এই যে রোজ হুইস্কি খাচ্ছে সে, এটা কি ঠিক হচ্ছে? নেশায় দাঁড়িয়ে গেলে কী হবে? নিজেকে প্রশ্ন করল। না। হুইস্কির নেশা তাকে দখল করেনি। সারাদিনে একবারও এসব কথা মনে আসে না। এই ঘরে সন্ধের পর সে যে খাচ্ছে, তা স্রেফ একটু মজা পাওয়ার জন্যে। হাসি ঘরে এল। মেয়েটার মুখে হাসি যেন আঠার মতো লেগে থাকে। একবার তাকিয়েই

মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মিলন গ্লাসে চুমুক দিল। হাসি এসে বসল খাটের অন্য প্রান্তে। কিছুক্ষণ উসখুস

করে নীচু গলায় কিছু বসল।

মিলন মাথা নাড়ল, 'তোমার ভাষা আমি বুঝতে পারছি না।'

'না।' শেষ শব্দটা ওর জিভে উচ্চারিত হল।

'হ্যাঁ, না।' গ্লাসে চুমুক দিল মিলন।

হাসি আবার কথা বলল। আবদেরে গলায়। এবার খুব ধীরে-ধীরে। মিলন বোঝার চেষ্টা করল। মুই শব্দটা বুঝতে পারল। মুই মানে আমি। হাসি কি নিজের কথা বলতে চাইছে। মিলন ভাবছিল। বোবা লোকের সঙ্গে কথা বলা যায়। কিন্তু দুটো ভিন্ন এবং পরস্পরের অজানা ভাষা হলে কথা বলা খুব মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।

হঠাৎ হাসি বলল, 'না।'

কপালে ভাঁজ ফেলল মিলন।

আঙুল তুলে বোতল দেখিয়ে হাসি আবার বলল, 'না।'

সঙ্গে-সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল মিলন, 'লজ্জা করে ন' তোমার! ওই খেয়ে সারাদিন আউট হয়ে পড়ে ছিলে মেঝেতে। নেশা কাটতে-না-কাটতেই আবার খেতে চাইছ।'

সঙ্গে-সঙ্গে মিলনের কন্ঠস্বরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একই কথা বলতে লাগল হাসি। অবাক

হয়ে সেটা শোনার পর মিলন মাথা নাড়ল, 'না। দেব না।'

হাসির গলার স্বর নেমে এল। হাত বাড়িয়ে একটা গ্লাস তুলে নীচের দিকটা দেখাল। মুখে কিছু বলল।

এরকম নাছোড়বান্দা মেয়েকে সামান্য হুইস্কি না দিয়ে পারল না মিলন।

জল মেশানো হুইস্কিতে চোখ বন্ধ করে চুমুক দিল হাসি। তারপর এক গাল হেসে যেসব শব্দ বের করতে লাগল, তার অর্থ বোঝার চেষ্টা করেও হাল ছাড়ল মিলন। এটা কী করে সম্ভব? বিন্দু থেকে বিভিন্ন দ্বীপে নৌকো যায়। সেসব হাঁপ থেকে কেনাবেচা করতেও মানুষ বিন্দুতে যায়। নিজেদের আলাদা ভাষা হওয়া সত্ত্বেও মানুষ বাজারচলতি ভাষা শিখে নেয়। সেটা হিন্দি হওয়াই স্বাভাবিক। হাসির দ্বীপের মানুষ এ ব্যাপারে অন্ধকারে আছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

সে ঠিক করল, ওকে কাজ চালাবার মতো বাংলা শেখাতে হবে। অন্তত যতদিন এখানে আছে ততদিন। আর কাল সকালে অতি অবশ জমিতে নিয়ে গিয়ে সেখানেই থাকতে বাধ্য করবে। ওখানে আর যাই হোক, হুইস্কির নাগাল পাবে না।

হঠাৎ সঞ্চটা একটু দুলে উঠল। জলের ধাক্কায় যে দুলুনি এটা তা নয়। একপাশ একটু নীচু হয়েই সোজা হল। তারপর লঞ্চের ছাদে ভারী কিছু হাঁটছে, বোঝা গেল। অবশ্যই কোনও জন্তু! কিন্তু সেটা কী ধরনের? মিলন রিভলভারটাকে হাতের কাছে রাখল।

তৃতীয় প্রাণীর আবির্ভাব টের পেয়েছে হাসিও। কিছুক্ষণ ছাদের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে আওয়াজ শোনার চেষ্টা করছে। হঠাৎ লঞ্চের সামনের দিকের ডেক নীচু হয়ে গেল। তার অর্থ, জন্তটা ওখানে নেমেছে।

সঙ্গে-সঙ্গে প্রথম দরজায় প্রচণ্ড নখের আঁচড়ানি আর বিকট চিৎকার গুরু হল। চিৎকারটা এমন আচমকা এবং ভয়ানক যে হাসি গ্লাস রেখে মিলনের শরীরের পাশে সিঁটিয়ে বসল। ভয়ে সে কাঁপছিল।

বাইরে সাক্ষাৎ মৃত্যুর দূত। যদি দরজা ভেঙে ফেলে, তাহলে ওকে দ্বিতীয় দরজা ভাঙতে হবে। মাঝখানের দরজাটা তাই বন্ধ করে দেওয়া দরকার। মিলন উঠতে যেতেই হাসি তার বাহু ধরে বাধা দিল। মাথা নেড়ে যেতে নিষেধ করল। হাতের রিভলভারটাকে দেখিয়ে ওকে আশ্বস্ত করতে চাইলেও হাসি মিলনের সঙ্গে খাট থেকে নেমে পড়ল।

নিঃশব্দে বাইরের ঘরে এসে দাঁড়াতেই চাপা গর্জন কানে এল। জন্তুটা ওদের গন্ধ এখন ভালোভাবে পেয়ে গেছে। দরজায় আঁচড়ের শব্দ হল। দ্রুত ইঞ্জিনঘরে ঢুকে ইঞ্জিন চালু করতে গিয়ে মিলন আবিষ্কার করল, কোনও আওয়াজ হচ্ছে না। ইঞ্জিনটা এবার সত্যি-সত্যি বিকল হয়ে গিয়েছে। ওর শব্দ দিয়ে জন্তুটাকে ভয় পাওয়ানো যাবে না।

নরজাটা ভেঙে পড়ার আগে কিছু করা দরকার। মিলন ইঞ্জিনের সামনের জায়গাটা ধীরে- ধীরে বুলে ডেকের দিকে তাকাতেই সেই বিশাল কালো জন্তুটাকে দেখতে পেল।

টের পেয়ে লাল চোখ তুলে তাকে দেখছে, দ্রুত রিভলভার চালাল মিলন। জন্তুটা আচমকা বসে পড়ল। দ্বিতীয় গুলি ওর মাথায় লাগতেই শরীরটা এলিয়ে পড়ল ডেকের ওপর। নিজের পিঠ মনে-মনে চাপড়ালো মিলন। জীবনে যে রিভলভার দ্যাখেনি, সে কী অবলীলায় জন্তু হত্যা করছে।

আলো জ্বাসল মিলন। চোখে পড়ল, হাসি দু-হাতে মাথা ঢেকে মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছে। কী হল ওর? তারপর অনুমান করল। রিভলভারের গুলির শব্দ খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছে ওকে। এত কাছ থেকে ওই শব্দ শোনার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই ওর নেই।

মিলন দরজা খুলল। এটা সেই অঙ্কটার দোসর যাকে সাপ আর কুমির ভাগাভাগি করে খেয়েছে। হয়তো আজ মরিয়া হয়ে প্রতিশোধ নিতে এসেছিল। এটা না বাঘ, না নেকড়ে। আবার হায়েনার থেকেও বেশ বড়। একটা লাঠি দিয়ে ওকে ঠেলতে গিয়ে বোঝা গেল, ওর ওজন কম নয়। কোনওরকমে ডেক থেকে লাশটাকে জলে ফেলতে পারল মিলন।

চারপাশ এখন অন্ধকারে ডুবে আছে, ঝিঁঝি ডাকছে একটানা। এই জঙ্গলে আর কত এরকম ওয়ঙ্কর জীব আছে তা ঈশ্বরই জানেন।

ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেও হাসি মুখ থেকে হাত সরাল না। একটু মায়া হল মিলনের। সে নীচু হয়ে ওর হাতদুটো ধরে ওপরে টানল। হাসি কোনওমতে উঠে দাঁড়াল। তার চোখ বন্ধ, শরীরে ঈষৎ কাঁপুনি।

মিলন ওকে ঝাঁকাল, 'আরে। এখন সব ঠিক হয়ে গেছে। ওটা মবে গেছে। আর কোনও ভয় নেই। চোখ খোলো।'

এতগুলো কথা, অথচ মানে বুঝতে পারল না হাসি। তার মাথা ধীরে-ধীরে মিলনের বুকে

নেতিয়ে পড়ল। তারপর দু-হাতে মিলনকে জড়িয়ে ধরল।

অসাড় হয়ে গেল মিলন। হাসির সমস্ত শরীর এখন তার শরীরে লেপ্টে আছে। গলায় গরম শ্বাস পড়ছে, শিরায়-শিরায় উষ্ণ রক্তের স্রোত উত্তাল হচ্ছে তার। ঝিনুক তাকে দীক্ষা দিয়ে গিয়েছে।

এখন সেই অভিজ্ঞতা সহজেই কাজে লাগাতে পারে সে। কিন্তু মেয়েটা এখনও কাঁপছে। এই কাঁপুনি সতর্ক করল মিলনকে। এই মুহূর্তে হাসি অসহায়। তার আশ্রয়ে আছে। ওর অসহায়ত্বের সুযোগ নিলে ঝিনুকের কাছে কী কৈফিয়ত দেবে? ঝিনুক তো তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।

সঙ্গে-সঙ্গে আর-একটি মন বলে উঠল, 'দূর। ঝিনুক মিথ্যেবাদী মেয়ে। যা বলে গেছে, তার সবটাই মিথ্যে। আর কোনওদিন ঝিনুক ফিরে আসবে না। তা ছাড়া, কিনুক যে সতী, তার কি প্রমাণ আছে? যে মেয়ে একদিনের আলাপে অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে প্রেম করতে পারে, শরীরের আনন্দ নিতে পারে, তার জীবনে ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই অনেক পুরুষ এসেছে, চলে গিয়েছে। অতএব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলো মিলন।'

দুই মনের যখন চাপান-উতোর চলছে, তখনই হাসি চোখ খুলল। আঙুল আর মাথা নেড়ে জিজ্ঞাসা করল, 'জন্তুটা কি মরে গেছে?'

মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' বলল মিলন। শোনামাত্র মিলনকে ছেড়ে হাসি চলে গেল শোওয়ার ঘরে। গিয়ে গ্লাস তুলে নিয়ে আরাম করে বসল।

আরও আধঘণ্টা পান করার পরে ওরা দুজনে ভাত এবং কাঁকড়ার বাল পেট ভরে খেয়ে নিল। হাতমুখ ধুয়ে চুরুট ধরাল মিলন। লঞ্চ এখন দুলছে। সম্ভবত জোয়ার এসেছে। লোহার শেকল ছেঁড়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। হাসি নিজের ভাষায় জড়িয়ে-জড়িয়ে কিছু বলে মিলনের বিছানায় চলে গিয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। চুরুট খেতে ইচ্ছে করছিল না আর।

জানলা সামান্য খুলে ওটাকে জলে ফেলে দিল মিলন। তারপর মোমবাতি নিভিয়ে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে একটু ভাবল। না, আজ আর নরম হবে না। মেয়েটাকে জমিতেই থাকতে হবে, যতদিন না কেউ ওকে নিয়ে যেতে আসে। তার পক্ষে লঞ্চের মেঝেতে শোওয়া সম্ভব নয়।

মিলন ডাকল, 'হাসি, উঠে পড়। নীচে নেমে শোও।'

মেয়েটা নড়ল না। বাধ্য হয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকাল সে। তার প্রতিক্রিয়ায় হাসি দেওয়ালের দিকে শরীরটাকে নিয়ে গেল। প্রায় দেওয়াল চেপে শুয়ে থাকল। মরিয়া হয়ে নিলন খাটের এপাশে শরীর এলিয়ে দিল। দুই তৃতীয়াংশ জায়গা ছেড়ে দিয়েছে হাসি। ওর দিকে পেছন ফিরে শুয়ে মিনিটখানেক ধাওয়ার পর অস্বস্তিটা কাটল। মদের প্রতিক্রিয়ায় ঘুম এসে গেল তার।

কখন যে ভোর হয়ে গেছে, বুঝতে পারেনি মিলন। ঘুম ভাঙতেই আলো চোখে পড়ল এবং আবিষ্কার করল, তার কোমরের কাছে মুখ রেখে হাঁটু মুড়ে ঘুমোচ্ছে হাসি। ওকে এখন শিশুর মতো দেখাচ্ছে। মিলন নড়তেই মুখ তুলল। চারপাশে তাকাল। তারপর মিলনকে ডিঙিয়ে খাট থেকে নেমে পড়ল।

দরজার দিকে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল হাসি। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসতে-হাসতে চলে এল খাটের কাছে। চোখ বন্ধ করল মিলন। গেঞ্জি গুটিয়ে গিয়ে ওপরে উঠে গেছে। হাসির উদ্ধত বুক এখন প্রায় উন্মুক্ত। কিন্তু ওব্যাপারে তার কোনও খেয়াল নেই। নীচু হয়ে মিলনের ঠোঁটে চুমু খেত্রে কয়েকটা কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল হাসি। কী কথা বলল, বুঝতে পারল না মিলন। কিন্তু বলার ভঙ্গিতে মনে হল ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে।

সারারাত পাশে শুয়েও মিলন যে সংযম দেখিয়েছে, সেই কারণে কৃতজ্ঞতা? মিলন শ্বাস ফেলল বেশ জোরে। এ সবই ঝিনুকের জন্যে। ঝিনুক বিশ্বাস করবে তো? কোনও পুরুষ ওরকম আগুনের মতো শরীরের পাশে সারারাত শুয়েও কি নির্লিপ্ত থাকতে পারে: আজ লঞ্চটাকে চালু করে পাড়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ইঞ্জিন প্রাহীন। অতএব বাধা হয়ে চেনটা ধরে টানতে হল। সেই টানে লঞ্চ পড়ে এল। সন্ধেবেলায় বড় লাঠি দিয়ে ওটাকে দূরে। সরিয়ে নিতে হবে।

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে প্রায় ছায়ার মতো হাসি মিলনের সঙ্গে হাঁটছিল। পুরো পথ মিলন কোনও কথা বলেনি। জমিতে ঢোকার আগে হনুমানটা গাছের ডালে বসে চেঁচাতে লাগল। ওরা জমিতে পা রাখতেই বোবা লোকটা এগিয়ে এসে হাত নেড়ে যা বোঝাতে চাইল, তা প্রথমে মাথায় ঢোকেনি মিলনের। লোকটা ওকে নিয়ে গেল মুরগির খাঁচার কাছে। খাঁচার বেড়া ভাঙা। একটাও মুরগি নেই। দুটো আধখাওয়া মুরগি পড়ে আছে।

'এর আগে কখনও এমন হয়েছে?' মিলন জিজ্ঞাসা করল।

মাথা নাড়ল লোকটা, না।

'শেয়াল ব্য নেকড়ে হতে পারে। ওদের তো কার্বলিক অ্যাসিডে আটকানো যায় না।'

গোঙানির শব্দ তুলে লোকটা জোরে জোরে মাথা নাড়ল। তারপর হাত দুপাশে ছড়িয়ে বোঝাল, জন্তুটা বেশ বড়। সে টঙে বসে ওটাকে দেখেছে।

আর-একটা দুশ্চিন্তা মাথায় ঢুকল। এতদিন ওই সব অন্তরা এদিকে আসেনি। আজ এল কেন? ধীরে-ধীরে সে সমুদ্রের ধারে গিয়ে দাঁড়াল। দূরে কোনও নৌকো নেই। জলের গভীরতা বেশি নয় বলেই বোধহয় এদিকে জাহাজ দেখা যায় না।

হঠাৎ পায়ের নীচের বালি নড়ে উঠল। প্রথমে অল্প, তারপর এমন ঝাঁকুনি শুরু হল যে মিলন ছিটকে পড়ে গেল। ভূমিকম্প হচ্ছে। সে ওই অবস্থা থেকে উঠে দৌড়ে অমির দিকে আসতেই দেখল টংটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল নীচে। বোৰা লোকটা মাটিতে শুয়ে আছে। হাসি উবু হয়ে বসে তাকে ইশারা করছে, বসে পড়তে।

মিলন পেছন ফিরল। সমূদ্রের জল অনেকটা উঠে এসে আবার নীচে নেমে যাচ্ছে। ভূমিকম্প

হয়েই চলেছে। ওপাশের একটা বড় গাছ ভেঙে পড়ল শব্দ করে। পায়ের তলায় কাপুনি থামলে লোকটা উঠে এল মিলনের পাশে। তারপর হতেজোড় করে ওপরের দিকে তাকিয়ে তার গোঙানির ভাসায় বোধহয় প্রার্থনা করতে লাগল।

হঠাৎ হাসি চিৎকার করে সমুদ্রের দিকে আঙুল তুলল।

সেদিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল মিলন। দিগন্ত দেখা যাচ্ছে না। সেখানে যেন বিশাল পাহাড় জেগে উঠেছে। পাহাড়টা দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে এদিকে।

সামুদ্রিক জলোচ্ছাস! কিছুক্ষণের মধ্যে ওই জলের পাহাড় কাঁপিয়ে পড়বে এই দ্বীপের ওপর। মৃত্যু একেবারে সামনে। আশ্রয় নেওয়ার কোনও জায়গা নেই। লোকটা সেই দৃশ্য দেখে দৌড়ে অমির বাইরের গাছটায় উঠতে গেল। তার পেছন পেছন হনুমানটাও।

আচমকা লঞ্চের কথা মনে এল। যত জলই হোক, লঞ্চ জলে ভাসবে। বাঁচার একমাত্র উপায় লঞ্চের ভেতর আশ্রয় নেওয়া। মিলন চিৎকার করে লোকটাকে বলল তাকে অনুসরণ করতে। তারপর হাসির হাত ধরে দৌড়ল।

গাছের ডালে মুখ হাত ছড়ে গেল। কিন্তু গতি কমাল না মিলন। হাসির হাত ছেড়ে দিয়েছে সে অক্সালে ঢোকামাত্র। হাসিও বুঝে নিয়েছে, মিলন কোথায় যেতে চাইছে। নদীর কাছে পৌঁছবার আগেই পায়ের পাতায় জলের স্পর্শ পেল ওরা।

নদীটাকে এখন চেনা যাচ্ছে না। জল বেড়ে ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে নদী। লঞ্চ উঠে এসেছে পাড়ের গায়ে। চেনটার টনে একপাশে কাৎ হয়ে গেছে। হাসিকে তুলে দিয়ে নিজে লঞ্চে উঠল সে দু-হাতের ওপর ভর করে। তারপর শেকলটা খুলে দিল লঞ্চ থেকে। সঙ্গে-সঙ্গে সোজা হয়ে

গেল লঞ্চ।

মিলন চিৎকার করল। কিন্তু বোবা লোকটার কোনও হদিস নেই। ওপাশের জঙ্গলে নাদ হচ্ছে। তারপর সেই ভয়ঙ্কর দৃশ! জঙ্গলের গাছগুলোর মাথা ছাড়িয়ে প্রবল জলের ঢেউ আছাড়ে পড়ল নদীর ওপর। তার ধাক্কায় লঞ্চ কাগজের নৌকোর মতো চলে এল মাঝ নদীতে। তারপর ক্রোতের টানে ছুটতে লাগল আরও ভিতরে।

মিলন হাসিকে নিয়ে লঞ্চের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। আনলা দিয়ে দেখতে-দেখতে মিলনের মনে হল, তারা এখন ভেলায় বসে আছে। ডুবে যাওয়ার আগে লঞ্চ যেখানে নিয়ে যাবে, সেখানে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। হঠাৎ প্রবল থাকায় লঞ্চ কেঁপে উঠল।

পড়ে যেতে যেতে হাসি তাকে জড়িয়ে ধরল। মিলন অবাক হয়ে দেখল লঞ্চ স্থির হয়ে গিয়েছে। সে বাইরের ডেকে চলে এল হাসিকে ছাড়িয়ে।

একটা বিশাল গাছের ডালের মধ্যে অড়িয়ে গেছে লঞ্চ। গাছটা নদীতে ভাসছিল। একটু মস্তি হল। যাক, এর ফলে ডোবার সম্ভাবনা কমে গেল। সে স্বীপের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল।

দ্বীপটা অদৃশ্য। সেখানে সমুদ্রের জল থইথই করছে। তার মানে বোবা লোকটা আর তার হনুমান আর বেঁচে নেই।

সারাদিন ধরে লঞ্চ স্থির হয়ে থাকল গাছের সঙ্গে। এর মধ্যে ওরা টিনের মাছ আর ভাত ফুটিয়ে খেয়ে নিয়েছে। হাসির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাচ্ছিল মিলন। এত কাণ্ডের পরও মেয়েটার

মুখ থেকে হাসি মুছে যাচ্ছে না।

দুপুর থেকে জল বেড়েছে অনেকটা। মনে হচ্ছিল যে-কোনও মুহূর্তে গাছ থেকে খসে যাবে লঞ্চ। তার ওপর আকাশে মেঘ জমছে দ্রুত। বিকেলের আগেই অন্ধকার নেমে এল। সারাদিন ধরে লঞ্চের যন্ত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছে মিলন। নীচের দিকে কী ক্ষতি হয়েছে তা ওপর থেকে দেখা সম্ভব নয়। আর দেখতে পেলেও সারাবার বিদ্যে তার নেই।

শেষপর্যন্ত একটা ছেঁড়া তার পেয়ে গেল সে। তারটার দুটো মুখ জুড়ে নিয়ে ইঞ্জিন চালুর বোতাম টিপতেই সেটা গর্জন করে উঠল। তাড়াতাড়ি থামিয়ে দিল মিলন। যদি লঞ্চ নড়াচড়া করে, তাহলে গাছের আশ্রয় সরে যাবে।

লঞ্চে কয়েকটা লাইফকেট আছে। লঞ্চ ডুবে গেলে ওগুলো ব্যবহার করা যায়। কিন্তু তাতে

চেপে কতক্ষণ ভেসে থাকতে পারবে তারা?

দ্বীপ যখন জলের তলার, তখন বনের প্রাণীগুলোও সার বেঁচে নেই। কুমিরগুলোর অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে না। চারধার এখন কী ভয়ঙ্কর চুপচাপ। ডেকের দরজা বন্ধ করে ভেতরে এল মিলন। এই জলোচ্ছাস নিশ্চয়ই সুনামির কারণে। গোটা পৃথিবীর মানুষ এতক্ষণে জেনে গিয়েছে, দ্বীপগুলোকে সমুদ্র গ্রাস করেছে। তাহলে কি সরকার উলোগী হবে না, কেউ বেঁচে আছে কিনা খবর নিতে?

দরজায় দাঁড়িয়ে মিলন দেখল হাসিকে। কিছু লুকোবার চেষ্টা করছে হাসি। মুখের হাসির ধরনটা বদলে গিয়েছে। সে ঘরটাকে দেখল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, 'কী হয়েছে?' হাসি মাখা নাড়ল।

ঘরে ঢুকে খাটে বসতেই হাসি পেছনে সুকিয়ে রাখা গ্লাসটাকে দেখাতে বাধ্য হল। রেগে

গেল মিলন, আশ্চর্য! এই অবস্থায় তুমি মদ খাচ্ছে।' গ্লাস কেড়ে নিতে গেল সে। অথচ হাসি দেবে না কিছুতেই গ্লাসের মদ মেঝের ওপর গড়িয়ে

গেল।

গ্লাস ফেলে দিয়ে হাসি জড়িয়ে ধরল মিলনকে। তারপর একের-পর-এক চুমু খেয়ে যেতে লাগল ওর ঠোঁট, গাল, গলায়।

কায়ক সেকেন্ড চলে গেল। মিগনের মনে হল হাসির দুটো ঠোঁট এক হয়ে সাপের ছোবল মারছে। খুব দ্রুত তার রক্তে বিষ ঢেলে দিচ্ছে। একটু সরে যাওয়ার চেষ্টা করল সে। ঝিনুক, ঝিনুক কোথায়? ওর ওখানে, বিন্দুতে কি সুনামি হয়েছে? সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় মন বলল, 'দূর! ঝিনুকের দেখা আর কখনও পাবে না তুমি। সমুদ্র দুদিককেই গ্রাস করে ফেলেছে।' মিলন তাকাল। আবছায়ায় হাসি এখন রহস্যময়ী। তার দিকে চোখের কোণে তাকিয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে তার গেঞ্জিটা তুলে আনল মিলন। আহা, পৃথিইটা কী সুন্দর।

দুজন মানুষ পরস্পরকে সাপের মতো জড়িয়ে শুয়েছিল লঞ্চের কেবিনঘরের খাটে। আগ্নেয়গিরির সব লাভা বের হয়ে গেলে সে মৃতের মতো হয়ে যায়।

মিলনের মনে হচ্ছিল অনন্তকাল এইভাবে থেকে গেলে ভালো হয়। কিন্তু সেইসঙ্গে তার মনে একটা অস্বস্তি কাজ করছিল। মিলনের মুহূর্তে ওটা তেমন সক্রিয় ছিল না। এখন ফিরে এল। সে ধীরে-ধীরে হাতটা হাসির পেটের ওপর নিয়ে গেল। ঠিক মাঝখানে রাখার পর বুঝল, ওটা উঁচু। বেশ উঁচু। একটু টাইট এবং চর্বি নয়।

তাকে হাত বোলাতে দেখে হেসে উঠে বসল হাসি। নিজেই টেনে নিয়ে মিলনের হাত রাখল পেটে। তারপর মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' বলল।

সর্বনাশ। উঠে বসল মিলন। মেয়েটার পেটে বাচ্চা এসে গেছে। এই ক'দিনে সে বিন্দুমাত্র টের পায়নি। হয়তো চার কি পাঁচ মাসের ধূণ ওর পেটে। বাইরে থেকে যা বোঝা যায়নি। হাত

সরিয়ে নিল মিলন।

কিন্তু কার বাচ্চা এটা? ওকে যখন অসুস্থ অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছিল, তখন কি ওর দ্বীপের

মানুষ জানত কথাটা? আর সেটা ওদের অপছন্দ ছিল বলেই কি আর এসে ফিরিয়ে নিয়ে যায়নি? খুব রাগ হয়ে গেল মিলনের। আগে জানা থাকলে গর্ভবর্তীর সঙ্গে কখনও সঙ্গম করত না সে। ব্যাপারটা হাসির জানানো উচিত ছিল।

পঞ্চ দুলছে। হাসি হাতড়ে-হাতড়ে চলে গেল টয়লেটে অদ্ভুত এক পাপবোধে আক্রান্ত হওয়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়েছিল মিলন। ঝড় উঠেছে, সে টের পায়নি।

একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে লঞ্চ ছুটতে লাগল। যখন সোজা ছুটছিল তখন একরকম, যখন মুখ ঘুরে যাচ্ছিল তখন মান হচ্ছিল উলটে ডুবে যাবে। তাড়াতাড়ি বাইরের ঘরে এসে লাইফবেন্ট পরে নিল মিলন। তখনই চলে এল হাসি। হাত বাড়িয়ে সে-ও লাইফবেন্ট নামিয়ে নিয়ে গলায় পরল। বেশ ভালো গয়না পরেছে, এমন ভঙ্গিতে হাসতে লাগল পাশে দাঁড়িয়ে। লঞ্চের ভেতর এখন যথেষ্ট অন্ধকার। বাইরে বিদুৎ ঝলসে উঠতেই মিলন দেখল খোলা গেঞ্জিটা আর পরেনি হাসি।

যদি লঞ্চ ডুবে যায়, তাহলে এই ঘরের মধ্যেই মরে পড়ে থাকতে হবে। জলের তলায় চলে গেলে আর দরজা খুলে বেরুতে পারবে না। মিলন সন্তর্পণে ডেকের দরজা খুলল। বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। জল আছড়ে পড়ছে ডেকের ওপর। লঞ্চটা ছুটছে সামনে।

হাসি পাশে এসে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে জল স্পর্শ করল। তারপর চটপট বারমুডা খুলে ভেতরে রেখে ডেকের ওপর চলে গেল। ওর শরীরে এখন বৃষ্টি। মুহূর্তেই ভিজে গেল চুল, সর্বাঙ্গ। মিলন চিৎকার করে ডাকল, 'হাসি।'

হাসি ঘুরে দাঁড়াল। কিন্তু বলল।

মিলন চিৎকার করল, 'ভেতরে চলে এসো।' হাত নেড়ে ডাকল সে।

হাসি নিজের পোটে হাত রাখল। কিছু বলল।

গেছে।

বাধ্য হয়ে জলে ভিজে ওর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এল। মেয়েটার মুখ থেকে হাসি মুখে গেছে ।

হঠাৎ হাউহাউ শব্দে কেঁদে উঠল হাসি। বারংবার হাত দিয়ে নিজের পেট দেখিয়ে কিছু বলে

গেল।

'আমি তোমার কোনও কথা বুঝতে পারছি না।' মিলন বলল।

আঙুলের ডগায় নিজের পেট দেখিয়ে সেই আঙুলটায় মিলনের বুক ছুঁয়ে মাথা নাড়ল হাসি। যার অর্থ, তুমি এটা পছন্দ করছ না। তারপর চারটে আঙুল দেখিয়ে সে যা বোঝাল তাতে মিলনের কাছে স্পষ্ট হল, চারজন মিলে তাকে ধর্ষণ করেছে। তাকে মেরে ফেলার জন্য কিছু খাওয়াত ওরা। জ্বর আসত।

এখন মিলনও তাকে অপছন্দ করছে: সে কী করবে?

এক ঝটকায় ডেকে চলে গেল হাসি। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে হাত তুলে নাচের ভঙ্গিতে স্নান করতে লাগল।

ঠিক তখনই ঝড়ের ধাক্কায় ঘুরে গেল লঞ্চ। ডানদিকটা কাত হয়ে গেল। মিলনের চোখের সামনে হাসির শরীরটা টুক করে জলে পড়ে গেল। বৃষ্টির শব্দ, হাওয়ার শব্দ ছাপিয়ে চিৎকার কানে এল।

হাসি চিৎকার করে সাহায্য চাইছে। ততক্ষণে লঞ্চ আবার সোজা হয়েছে। কিন্তু নিকষকালো অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। বিরাট ঢেউগুলো ছোবল মারছিল লঞ্চের গায়ে। চিৎকার থেমে গেল।

এখন সকাল। আকাশে সূর্য নেই। লঞ্চটা একটু কাত হয়ে ভেসে যাচ্ছে। মিলন কোনওমতে ঢেকে এসে দাঁড়াল। বৃষ্টি নেই। হাওয়া আছে। চারধারে কোনও মাটির চিহ্ন নেই। কাগ রাত্রে বাতাস লঞ্চটাকে সমুদ্রের ভেতরে নিয়ে এসেছে। এখানে হালকা ঢেউ। চারপাশে কোনও জীবন নেই। সামুদ্রিক পাখিরাও অদৃশ্য।

মিলন বসে পড়ল ডেকে। এইভাবে ভেসে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। যতক্ষণ লঞ্চে খাবার থাকবে, ততক্ষণ খেতে পারবে। অথবা একটা বড় ঢেউ যদি লঞ্চটাকে ডুবিয়ে দেয় তাহলে। কোনদিকে গেলে পায়ের তলায় মাটি পড়বে, সে জানে না। যদি কোনও জাহাজ 'তাকে উদ্ধার করে সেই আশায় অপেক্ষা করা।

অথবা শেষ শ্বাস ফেলার মুহূর্তের অপেক্ষার জন্যে এখন বেঁচে থাকা।

1

লীলাসুন্দর : প্রথম অধ্যায়

13 January 2024
1
0
0

'যোধন মিত্র ভালো করেই জানেন যে, এই পাহাড়ি শহরে তাঁর কোনও বন্ধু নেই। লোকে দু তাঁকে ঈর্ষা করে, তাঁর সম্পর্কে বাঁকা কথা বলে। কিন্তু সেসব বলে তাঁর আড়ালে। এই জেলায় তাঁর চা-বাগান থেকে সবচেয়ে ভালো চা তৈরি হয়

2

লীলাসুন্দর : দ্বিতীয় অধ্যায়

16 January 2024
1
0
0

পাহাড়ের মুখে মেধ জড়াতে বেশি সময় লাগে না। সেই মেঘ ভারী হয়ে গেলেই বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে। খানিকটা বর্ষণের পরে আবার সব পরিষ্কার। পাহাড়ের খাঁজে সেই বৃষ্টির জল ভিজিয়ে দিয়েছিল সুন্দরকে। শীতল জল ও হাওয়ার স্পর্শ

3

সোনার শেকল

17 January 2024
1
0
0

মাস আগের এক বিকেলে মন নরম হয়েছিল কামাল হোসেনের। ভাগনে মতিনের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, 'আমি তোমাকে একশোবার বলেছি আমার এমনিতেই লোক বেশি, চাকরি দিতে পারব না। এই কথাটা কানে ঢোকে না কেন?' মতিন মুখ নীচু করে দ

4

স্বপ্নেই এমন হয়

18 January 2024
1
0
0

রারাত মেল ট্রেনে না ঘুমিয়ে বসে থাকতে হয়েছিল। একদিন আগে টিকিট কাটলে এসব সা ট্রেনে শোওয়ার জন্যে বার্থ খালি পাওয়া যায় না। সকালে ট্রেনটা জংশন স্টেশনে দাঁড়ালে প্ল্যাটফর্মে নেমে মিলন জেনেছিল, তাকে এখনও ঘণ্ট

---