shabd-logo

লীলাসুন্দর : দ্বিতীয় অধ্যায়

16 January 2024

5 Viewed 5

পাহাড়ের মুখে মেধ জড়াতে বেশি সময় লাগে না। সেই মেঘ ভারী হয়ে গেলেই বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে। খানিকটা বর্ষণের পরে আবার সব পরিষ্কার। পাহাড়ের খাঁজে সেই বৃষ্টির জল ভিজিয়ে দিয়েছিল সুন্দরকে। শীতল জল ও হাওয়ার স্পর্শে একটু একটু করে সাড় ফিরে আসছিল শরীরে। যখন জ্ঞান অধ' পরিষ্কার হল তখন শারীরিক যন্ত্রনায় গলায় শব্দ ফুটল, 'আঃ।'

চোখ মেলল সে। বুঝতে পারল তার শরীর ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পাহাড়ের খাঁজে ঝুলছে। একটু অসাবধান হলে পড়ে যেতে হবে অনেক নীচে। কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে রইল সে। এখন বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। শীত শীত করছে খুব। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর শরীরটাকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিয়ে বসার চেষ্টা করল সুন্দর। পাহাড়ের শরীর থেকে খানিকটা পাথর বেরিয়েছিল, তার শরীর ঘষটে ঘষটে সেইখানে পড়ায় প্রাণটা এখনও রয়ে গেছে। হাত-পা থেকে রক্ত বেরিয়েছে প্রচুর। জামা ছিঁড়ে গেছে। সে মুখ তুলে ওপরের দিকে তাকাল। অনেকদূরে আকাশ দেখা যাচ্ছে। এতটা উচুতে সে উঠবে কী করে? সোজা হয়ে দাঁড়ালেও ধরার মতো কোনও অবলম্বন পাবে না। নীচের দিকে তাকাল সুন্দর। পাশেই একটা বহু প্রাচীন গাছ। সেটা নীচ থেকে উঠে আসেনি। পাহাড়ের গায়েই জন্মেছিল। কীভাবে সে অত বড় হল তাই রহস্য। নীচে পাহাড়ের গায়ে পরপর কয়েকটা ধাঁজ রয়েছে। ওপরে ওঠার চেষ্টা করলে ওই সাহায্য পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া ওপরে শরীরটাকে টেনে তুলতে যে শক্তি দরকার এই মুহূর্তে তার নেই। রাত নামবার আগে যদি সে নীচের মাটিতে নেমে যেতে পারে তাহলে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হবে না। সুন্দর নীচের খাঁজে পা দিল। পায়ে জুতো থাকায় ঠিক জুৎ হচ্ছে না। সে নির্দ্বিধায় জুতো খুলে ফেলল।

আধঘন্টার চেষ্টায় সুন্দর যেখানে নেমে এল সেখানে জলের শব্দ পাওয়া গেল। প্রবল স্রোতে নদী বয়ে যাচ্ছে। ওপরে ওঠার চেয়ে নীচে নামা পাহাড়ে সহজ নয়। দুবার পা পিছলে যেতে যেতেও সামলে নিল সে। শেষ পর্যন্ত মরা আলোয় নদীটাকে দেখতে পেল। দেখে মনে জোর এল। নদীর কাছে গেলে তার এ যাত্রায় মৃত্যু হচ্ছে না।

হঠাৎ সুমো গাড়িটার কথা মনে এল। ওই গাড়ির ড্রাইভার ইচ্ছে করেই তাকে ধাক্কা দিয়েছে খাদে ফেলে দেওয়ার জন্যে। অত ভারী গাড়ির ধাক্কা যে তার গাড়ি সহ্য করতে পারবে না তা লোকটা জানত। কিন্তু লোকটা কেন কাজটা করল? বোঝাই যাচ্ছে সে এই পথে ফিরবে এই খবর ওর কাছে ছিল। কিন্তু একজন বিশেষ ড্রাইভারের সঙ্গে তার তো কোনও শত্রুতা নেই। বোঝাই যাচ্ছে কেউ তাকে কাজটার দায়িত্ব দিয়েছে। কে? প্রথমেই দুর্যোধন মিত্রের মুখ মনে পড়ল। লীলাদের কলকাতায় পাঠানোর প্রস্তাব শুনে ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন ভদ্রলোক। লীলাকে কতটাকা দেওয়া হবে তা স্থির করবেন মিস্টার ভার্গব। তার কোনও অধিকার নেই। কিন্তু তাই বলে নিজের ছেলেকে খুন

লোক পাঠাবেন তিনি? মাথা নাড়ল সুন্দর। এটা সে ভাবতে পারছে না।

করতে দ্বিতীয় জন, যিনি এই ক্ষমতা রাখেন, তিনি রামচন্দ্র বণিক। কিন্তু তার সঙ্গে তো ভদ্রলোকের ভালো সম্পর্ক। ইদানীং দুর্যোধন মিত্রকে সহ্য করতে পারছেন না, কবে তাঁর উপকার করেছেন বলে এখনও মাথার ওপর লাঠি ঘোরাচ্ছেন বলে ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন। তার ওপর অর্থমন্ত্রী যেভাবে দুর্যোধন মিত্রকে কবজ করেছেন তাতে রামচন্দ্রের অসন্তোষ আরও বেড়ে গেছে। কিন্তু সুন্দরের সঙ্গে তো তার কোনও বিরোধ নেই। খামোকা তাকে খুন করতে লোক পাঠাবেন কেন?

তৃতীয় মুখটিকে সামনাসামনি কখনও দ্যাখেনি সুন্দর। কৃষ্ণা মিত্র, মিসেস দুর্যোধন মিত্র।

সুন্দরের দ্বিতীয় মা। এখানে আসার পর সে জেনেছে ভদ্রমহিলা নাকি অসামান্যা সুন্দরী। সেই কারণেই অহঙ্কারী। তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী পরিচালিত হন দোর্দণ্ড প্রতাপ শিল্পপতি দুর্যোধন মিত্র। যেখানে বাল্যকাল এবং যৌবনের শুরু কাটিয়েছে সুন্দর সেই বাড়িতে বাস করতে অনুমতি তাকে দেননি দুর্যোধন মিত্রা এবং বুঝতে অসুবিধে হয় না তার পেছনে ভদ্রমহিলার ইচ্ছে অনিচ্ছে কাজ করছে। কিন্তু যতই তার উপস্থিতি ওঁর পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না হোক, দিল্লিতে বসে খবর নিয়ে খুন করতে লোক

বিশ্বাসযোগ্য নয়।

পাঠানো তাহলে কে পাঠিয়েছিল? হঠাৎ মনে হল, সুমোগাড়ির ড্রাইভার ভুল করেনি তো? অন্য কাউকে খুন করার কথা ছিল, ভুল করে তাকেই খুন করার চেষ্টা করেছে। সুন্দরের মনে হল এটাই স্বাভাবিক।

একটা লম্বা গাছের ডাল ধরে ধীরে ধীরে সে যখন নদীর গায়ে নেমে এল তখন আলো নিতু নিতু। নীচু হয়ে হিমশীতল জলে মুখ হাত ধুতে গিয়ে জ্বলুনি টের পেল সুন্দর।

ফোনটা এসেছিল থানায়। গাড়ির নাম্বার দিয়ে বলা হয়েছিল ওটা খাদে পড়ে গেছে। অনেক নীচে গাড়িটাকে জুলতে দেখা গেছে। সাবইনস্পেকটর জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'কোথায় হয়েছে ঘটনাটা।' 'সোনাইঝোরার পাশে।'

'আপনার নাম কি?'

সঙ্গে সঙ্গে লাইনটা কেটে দিয়েছিল সংবাদদাতা। মদ্যপান করে গাড়ি চালিয়ে মাঝে মাঝেই খাদে নেমে যায় গাড়ি। এটা নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু যে খবর দিল সে নিজের পরিচয় দিল না কেন?

সাবইনস্পেকটর ওসি-কে খবরটা জানালেন। ওসি তাকে নাম্বারটা কোন বা কার গাড়ির খোঁজ নিতে বললেন। বিকেলের মধ্যে জানা গেল গাড়িটা কার। ওসি নিজে ছুটলেন দুর্যোধন মিত্রের অফিসে। সেসময় দূর্যোধন দিল্লিতে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন, মিনিট পাঁচেক বাদে ওসিকে ভেতরে ডেকে হেসে বললেন, 'কী এমন জরুরি ব্যাপার যে আপনাকে ছুটে আসতে হল?'

গাড়ির নাম্বার একটা কাগজে লিখে এনেছিলেন ওসি, সেটা টেবিলের ওপর এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, পাবলিক বলছে গাড়িটা আপনাদের কোম্পানির। একটু খোঁজ নিয়ে দেখবেন কে এটা চালাচ্ছিল?"

নাম্বার দেখে বুঝতে পারলেন না সূর্যোধন ঠিক কোন গাড়ি। তাই জিজ্ঞাসা করলেন, 'গাড়িটা কি আপনাদের আইন ভেঙেছে? যদি ভাঙে তাহলে এত সামান্য ব্যাপারে।'

'গাড়িটা খাদে পড়ে গিয়েছে বলে থানায় ফোন এসেছিল। যে ফোন করেছিল সে বলেছে

আগুন জ্বলতে দেখেছে।'

'মাই গড!' সোজা হয়ে বসলেন দুর্যোধন, 'কে ফোন করেছিল?'

'নাম বলেনি। লাইন কেটে দিয়েছিল।'

তৎক্ষণাৎ ইন্টারকমে সেক্রেটারিকে গাড়ির নাম্বার কলে গাড়িটা কে চালাচ্ছিল জানাতে বললেন দুর্যোধন। তারপর উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলেন, কোথায় হয়েছে?"

'বলেছে সোনাইঝোরার পাশে। ওখানে রাস্তাটা বাঁকের মুখে বেশ সরু।'

'আপনারা স্পটে গিয়েছেন?'

'আমার এসআই গিয়েছে। অনেক সময় এই সব উড়ো ফোনে ভুল খবর দেওয়া হয়ে থাকে। আমাদের হ্যারাস করে আনন্দ পায় হয়তো। তাই জানতে এলাম গাড়ি ঠিক আছে কিনা।' ওসি হেসে বললেন।

ইন্টারকমে রিং হল। দুর্যোধন মিত্র রিসিভার তুলে বললেন, 'ইয়েস।' ওপাশের কথা শুনে তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল, 'কি? মাই গড।'

তাঁর মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। কোনওরকমে রিসিভার রেখে তিনি ঠোঁট কাটলেন। ওসি জিজ্ঞাসা করলেন, 'কি হয়েছে?'

চেয়ারের পেছনে মাথা হেলিয়ে দিলেন দুর্যোধন মিত্র, 'না। অসম্ভব। আমি বিশ্বাস করছি না।' তারপর সোজা হয়ে বললেন, 'যে ফোন করেছিল সে বলেছে গাড়িটাকে নীচে পড়ে যেতে দেখেছে? আগুন ধরে গেছে?'

'হ্যাঁ।

'কি গাড়ি তা বলেছে?"

'ना।'

'কখন হয়েছে ঘটনাটা?'

'তা বলেনি।'

'চলুন।' উঠে দাঁড়ালেন দূর্যোধন মিত্র।

'আপনি যাবেন?'

'অফিসার গাড়িটা চালাচ্ছিল আমার ছেলে সুন্দর, বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে আসছিল সে। আমার সঙ্গে দুপুরে কথা হয়েছে তার।'

পুলিশের জিপ দাঁড়িয়েছিল রাস্তার ধারে। ওসির জিপ এল, দুর্যোধন মিত্রের গাড়ি যখন সেখানে পৌঁছলে তখন সন্ধে নেমে গেছে।

সাব ইনস্পেকটার ছুটে এসে ওসিকে বললেন, 'স্যার, ওইটে সোনাইঝোরা, এখন অল নেই। আমি যখন এসেছিলাম তখন কিছুটা আলো ছিল কিন্তু জঙ্গল থাকায় লোকেট করতে পারিনি। তবে একটা গাড়ি এখান থেকে নীচে পড়েছে।'

ওসি জিজ্ঞাসা করলেন, 'কী করে বুঝলেন?'

'ওই যে খাদের দিকের দেওয়ালটা ভেঙে গেছে। ওখানে ঢাকার দাগ আছে। দাগটা টাটকা। কিন্তু কাল সকালের আগে নীচে নামা যাবে না।'

দুর্যোধন মিত্র গাড়ি থেকে নীড়ে নেমে খাদের দিকে তাকিয়েছিলেন। কথাটা কানে যেতে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, 'যদি আপনি আহত অবস্থায় নীচে আটকে থাকেন তাহলে কাল সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন?'

ওসি বললেন, 'ঠিকই। কিন্তু এতটা ওপর থেকে পড়লে বেঁচে যাওয়ার চান্স খুব কম। তা ছাড়া এই অন্ধকারে অনুসন্ধান চালানো কী করে সম্ভব?'

দুর্যোধন বললেন, 'অন্ধকার যাতে বাধা না হয় তার ব্যবস্থা করছি।'

দুর্যোধন তাঁর অফিসকে নির্দেশ দিলেন জেনারেটায়, জোরালো আলোর ব্যবস্থা করতে। তারপর

দমকলকে খবর দিলেন মই দড়ি নিয়ে আসার জন্যে। এসব করার পরেই তাঁর ফোন বেকে উঠল। বোতাম টিপত্রেই রামচন্দ্র বণিকের গলা শুনলেন, 'এইমাত্র দুঃসংবাদ শুনলাম। সুন্দর কি ড্রাঙ্ক ছিল?

'আমি ওর সঙ্গে ছিলাম না।'

'আপনি কোথায়?'

'সোনাইঝোরার পাশে।'

পাইন কেটে দিল রামচন্দ্র, দুর্যোধন ওসিকে বললেন, 'আপনাদের এমপি সাহেব আসছেন।'

জেনারেটার জালিয়ে বড় বড় সার্চ লাইট জ্বেলে নীচের জঙ্গল আলোকিত করা হল। দমকল তাদের মই নামাল নীচে। ইতিমধ্যে রামচন্দ্র বণিক এসে গেছেন। যেসব গাড়ি ওপর নীচে যাতায়াত করছিল পুলিশ তাদের দাঁড়াতে দিচ্ছিল না।

বুর্যোধন মিত্রের পাশে দাঁড়িয়ে রামচন্দ্র বললেন, 'এখানেই যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল তা আপনারা জানলেন কী করে?'

দুর্যোধন ওসিকে দেখালেন, 'ওঁদের কাছে উড়ো ফোন এসেছিল, যে করেছিল সে ওর গাড়ির নাম্বার বলেছিল।'

ই। কিন্তু ব্যাপারটা তো মিথ্যে হতে পারে। কোন গাড়ি পড়ে যাচ্ছে যখন, তখন কি কেউ তার নাম্বার প্লেটের দিকে তাকায়? রামচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন।

ওসি শুনছিলেন, বললেন, 'আমরা কোনও ফাঁক রাখতে চাই না, এখানে কোনও গাড়ি পড়ে গেছে কিনা তা কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জানা যাবে।'

তল্লাশি গুরু হয়ে গেল। দমকলের কর্মীরা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামছেন। চিৎকার চেঁচামেচি চলছে। হঠাৎ রামচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, 'সুন্দরের সঙ্গে আপনার শেষ কখন কথা হয়েছিল?

'সকালের একটু বাদে।'

'অ্যাকসিডেন্টের খবর পাওয়ার পর ওকে ফোন করেছিলেন?'

রামচন্দ্রের দিকে তাকালেন দুযোর্ধন, 'তুমি কি এই সময় রসিকতা করছ?'

'মানে?'

'এই এত উঁচু থেকে কোনও গাড়ি নীচে পড়ে গেলে তার চালক কি ফোন ধরার অবস্থায় থাকবে? থাকলে সে তো নিজেই ফোন করবে।'

ওসি বললেন, 'ঠিক, ঠিক।'

আধঘণ্টা পরে নীচ থেকে শোরগোল ভেসে এল, দমকলের লোকজন গাড়িটাকে দেখতে পেয়েছে। মোবাইলে তাদের নেতা জানিয়ে দিল, ওপর থেকে পড়ার জন্যে ভেঙে দুমড়ে গিয়েছিল গাড়িটা, তার ওপর আগুন ধরে যাওয়ার একটা পিণ্ড পাকিয়ে গিয়েছে। গাড়ির ভেতর যে কেউ থাকুক সে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। কাল সকালের আগে জঙ্গলে ছড়িয়ে যাওয়া হাড় খুঁজে পাওয়া যাবে না। গাড়ির পেছনের নাম্বারপ্লেট পুড়ে দুমড়ে গেলেও নাম্বার পড়া যাচ্ছে বলে ওটাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওসি দমকলের কর্তাকে বললেন, 'নাম্বারটা বলতে বলুন।'

যে নাম্বার নীচ থেকে জানানো হল তাতে আর সন্দেহ রইল না। দুর্যোধন মিত্র এতক্ষণ পরে থরথর করে কেঁপে উঠলেন। তবু শেষ আশায় পকেট থেকে মোবাইল বের করে সুন্দরের নাম্বার টিপলেন। কোনও শব্দ হল না। তিন-তিনবার শব্দহীন থেকে গেল মোবাইল। দাঁড়াতে পারছিলেন না দুর্যোধন মিত্র, কোনওরকমে হেঁটে নিজের গাড়িতে উঠে বসলেন, গাড়ি চলে গেল দুর্ঘটনার জায়গা ছেড়ে।'

রামচন্দ্র কাঁধ ঝাঁকালেন। তারপর ওসিকে বললেন, 'যে লোকটা থানায় ইনফরমেশান দিয়েছিল তাঁকে খুঁজে বের করতে পারবেন।'

'খুব ডিফিকাল্ট। শহরের সমস্ত ড্রাইভারকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব নয়। তবে একটা ব্লু আছে বলে- ওসি থামলেন।

'কি ক্রু? আমাকে বলতে পারেন।'

'যে লোকটা ফোন করেছিল সে একটু তোতলা।"

'বাঃ। তোতলা ড্রাইভার তো শহরে বেশি থাকার কথা নয়।'

'না স্যার। তবে ড্রাইভার যদি এই শহরের না হয় তাহলে খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল হবে।'

ওসি চিন্তিত।

চেতনা ফিরে এল সুন্দরের। নদীর ধার দিয়ে মিনিট দশেক হাঁটার পর সে আর চলতে পারছিল না। মাথা ঘুরছিল, শরীর আর পারছিল না। একটা ঝোপের পাশে বালির ওপর শুয়ে পড়েছিল। পড়ে জ্ঞান হারিয়েছিল। কতক্ষণ ওভাবে ছিল তার জানা নেই। চেতনা ফিরতেই সে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। সামনে জলের শব্দ, পেছনে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। এসব জায়গায় বন্যজন্তু থাকা অস্বাভাবিক নয়। আর তখনই তার মোবাইলের কথা মনে এল। দ্রুত সেটা বের করে বোতাম টিপতে গিয়ে দেখল আলো জ্বলছে না। হিলটপের নাম্বার টিপলেও কোনও শব্দ হল না। তার কাছে এই একটাই রাস্তা ছিল মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার, অন্তত আজ রাত্রে, কিন্তু সেটাও কাজে আসছে না। গাড়ি থেকে ছিটকে পড়ার সময় নিশ্চয়ই আঘাত পেয়েছে যন্ত্রটা, পেয়ে অকেজো হয়ে গিয়েছে। ক্ষিপ্ত হয়ে সে ছুড়ে ফেলল যন্ত্রটাকে। খানিকটা দূরে পাথরে ঠোক্কার খেয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল সেটা।

কিছু করার নেই। তার পক্ষে পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু সে যে এয়ারপোর্ট থেকে শহরে ফিরল না, এনিয়ে দুর্যোধন মিত্র ভাবনাচিন্তা করেননি? ওঁর স্বভাব অনুযায়ী তাকে সামনে দাঁড় করিয়ে অবাধ্যতার জন্যে প্রচুর কথা খরচ না করলে তো শান্তি হওয়ার কথা নয়।'

সুন্দর মাথা নাড়ল। উপায় যখন নেই তখন এখানেই রাত জেগে কাটিয়ে দিতে হবে। একটা গাছের ডাল ভেঙে লাঠি বানিয়ে নিতে হবে আত্মরক্ষার জন্যে। সে ওঠার চেষ্টা করতেই কানে শব্দটা বাজল। রিং হচ্ছে। হ্যাঁ, ঠিক শুনতে পাচ্ছে। মোবাইলের রিং। এখানে কোনও মানুষ নেই তাহলে কার মোবাইল বাজছে। শব্দটা যেদিক থেকে আসছে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে পাথরের ওপর মোবাইলের আলো জ্বলতে দেখতে পেয়ে উল্লসিত হল সে। এটা তার মোবাইল। ছুঁড়ে দিয়েছিল রেগে গিয়ে আর ধাক্কায় আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে যন্ত্রটা। সে ওটাকে তুলে নিয়ে কানে চেপে

বলল, 'হ্যালো।"

'আমি লীলা বলছি। আমরা সবাই আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।'

'আঃ। এসব কথা কেন?'

'মামা বাবাকে বিড়লা হার্ট সেন্টারে আনামাত্র ওঁরা এঁকে ভরতি করে নিয়েছেন, ব্লাড টেস্ট হয়ে গিয়েছে। কাল সকালে অ্যাঞ্জিওগ্রাম হবে। ওরা বলল, আর দেরি করে আনলে হাতের বাইরে চলে

যেতে পারত।'

'ও.কে. লীলা।'

'আপনি নিশ্চয়ই হিলটপে পৌঁছে গিয়েছেন?' লীলা জিজ্ঞসা করল।

'হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। কল ফোন করব।' লাইন কেটে দিল সুন্দর।

এবার একটুও ইতস্তত না করে দুর্যোধন মিত্রের বোতাম টিপল সে।

গাড়ি তখন দুর্যোধন মিত্রের বিশাল প্রাসাদের কাছাকাছি চলে এসেছে। সিটের পেছনে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন তিনি। অদ্ভুত একটা যন্ত্রণা পাক খাচ্ছিল বুকের ভেতরে। এই সময় তার মোবাইল শব্দ করে উঠল, বেশ বিরক্ত হয়ে ওটা পকেট থেকে বের করে চোখের সামনে তুলতেই চমকে সোজা হয়ে বসলেন। সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল। মোবাইল অন করে কথা বলতে গিয়ে

কাশতে হল, গলা পরিষ্কার করার জন্যে, 'সুন্দর?'

'হ্যাঁ।' সুন্দরের গলার স্বর স্পষ্ট।

'তুমি-তুমি কোথায়?'

'নদীর গায়ে। আমার গাড়িটাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।'

'ও মাই গড! ঠেলে ফেলা হয়েছিল মানে?"

'আমি ফিরে গেলে এটা নিয়ে কথা বলতে পারি। কিন্তু আমার পক্ষে আজ ফিরে যাওয়া

সম্ভব নয়। আমি আহত।'

'ও.কে., ও.কে.। যেখান দিয়ে গাড়িটা পড়েছিল তার কতদূরে তুমি আছ?'

'অন্ধকারে আমি আন্দাজ করতে পারছি না। কিন্তু কাছাকাছি নদীর ধারেই আছি।'

'তুমি ওখানেই থাকো। আমি তোমাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছি' ফোন বন্ধ করে ড্রাইভারকে দুর্যোধন বললেন, 'গাড়ি ঘোরাও। অ্যাকসিডেন্টের স্পটে নিয়ে চলো।'

তারপর মিস্টার ভার্গবকে ফোন করলেন, 'ওসি-র নাম্বার আমার কাছে নেই। এঁকে ফোনে ধরুন। দমকলের লোকদের যেন ওসি বলেন আমি না যাওয়া পর্যন্ত কেউ স্পট থেকে চলে না যায়।'

'এখনই বলছি স্যার। আমি ভাবতেই পারছি না মিস্টার সুন্দর মিত্র।' 'না না। সে বেঁচে আছে। তাড়াতাড়ি কাজটা করুন। ভার্গবকে থামিয়ে দিয়ে চটজলদি বললেন দুর্যোধন মিত্র।

শেষ পর্যন্ত দমকলকর্মীরা সুন্দরকে ওপরে তুলে আনতে সক্ষম হল। তৎক্ষণাৎ তাকে নিয়ে গাড়ি ছুটল সমতলের নার্সিংহোমের উদ্দেশ্যে। সুন্দরের অবস্থা তখন বেশ খারাপ। সারা শরীর রক্তাক্ত। যন্ত্রণা বেড়ে গেছে। ওসি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইছিলেন কিন্তু দুর্যোধন মিত্র আপত্তি করেছিলেন। প্রশ্ন করার অনেক সময় পাওয়া যাবে কিন্তু আগে ছেলেটার চিকিৎস্য গুরু করা উচিত। মিস্টার ভার্গব সুন্দরের সঙ্গে গেলেন, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলেন দুর্যোধন মিত্র। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ডাক্তারদের হাতে পৌঁছে যাবে সুন্দর। তিনি গেলে শুধু রাতজাগা ছাড়া কিছুই করতে পারবেন না। বরং কাল সকালে নার্সিংহোমে পৌঁছে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। প্রয়োজন হলে সুন্দরকে কলকাতা বা দিল্লিতে চিকিৎসার জন্যে নিয়ে যাওয়া হবে।

বাড়িতে ফিরে এসে পোশাক বদলে একটা বড় হইস্কিতে বরফ ঢেলে সুইমিং পুলের পাশে বসলেন দূর্যোধন। সুন্দরের গাড়ি ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল খাদে, কেউ ওকে খুন করতে চেয়েছিল। গাড়িতে আগুন জ্বলতে দেখে খুনি নিশ্চিত হয়েছে যে সুন্দর বেঁচে নেই। ওই রাস্তা থেকে পড়ে গিয়ে বেঁচে যাওয়া আদৌ স্বাভাবিক ঘটনা নয়। লাক। স্রেফ কপালের জোরে বেঁচে গেছে ছেলেটা।

কিন্তু ওকে কে খুন করবে? দীর্ঘকাল ও এখানে ছিল না। ফলে কারও সঙ্গে শত্রুতাও তৈরি হয়নি। ওকে সরিয়ে দিলে কার লাভ হবে? মাথামুন্ডু ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি। হঠাৎ লীলার কথা মনে এল। লীলা তার হোটেলের একজন সামান্য কর্মচারী। হ্যাঁ, সে যথেষ্ট সুন্দরী, সুন্দর আকর্ষণ বোধ করতেই পারে। কিন্তু অসম স্ট্যাটাসের মেয়ের জন্যে পাগলামি বরদাস্ত করা যায় না। আর এই ব্যাপারটা আর কারও অপছন্দের হতেও পারে। লীলার প্রতি আসক্ত অন্য কেউ ক্ষিপ্ত হতে পারে? এই লীলার চাকরির জন্যে সুপারিশ করেছে রামচন্দ্র বণিক। রামচন্দ্র কি চাইবে সুন্দরের সঙ্গে লীলা জড়িয়ে যাক? কিন্তু যেই করুক নিজে করেনি। ভাড়াটে লোক দিয়ে করিয়েছে। এই শহরে ভাড়াটে খুনি পেতে অসুবিধে হয়নি। দূর্যোধন মিত্র ক্রমশ এই সিদ্ধান্তে এলেন। লীলার কারণেই সুন্দরকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল। সমতলের নার্সিংহোমেও যে সেই চেষ্টা হবে ৯ তা কে বলতে

পারে। তিনি পকেট থেকে মোবাইল বের করে ভার্গরকে ধরলেন।

'কোথায় তোমরা?'

'এই মাত্র পৌঁছে গিয়েছি। ডাক্তাররা সুন্দরের দায়িত্ব নিয়েছেন।' ভার্গৰ বললেন।

'ওর কন্ডিশন ডিটরিয়ট করেনি তো?'

'না স্যার।'

'বেশ। আপনি এখনই জেলার এসপির সঙ্গে যোগাযোগ করুন। ওঁকে আমার পরিচয় দিয়ে বলুন সুন্দরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে। ওকে যারা খাদে ফেলে দিয়েছে তারা নার্সিংহোমেও হামলা করতে পারে।' দুর্যোধন মিত্র নির্দেশ দিলেন।

লাইন কেটে দিয়ে গ্লাসে চুমুক দিলেন তিনি। একবার ভাবলেন দিল্লিতে ফোন করে ব্যাপারটা জানাবেন কিনা। এত বড় ঘটনা না জানালে কৃষ্ণা অপমানিত বোধ করতেই পারে। যদিও সুন্দর সম্পর্কে কৃষ্ণার কোনও আগ্রহ নেই। সংছেলের ব্যাপারে কৃষ্ণা রীতিমতো উদাসীন, তবু…!

স্ত্রীর মোবাইল নাম্বারটা বের করতে যেতেই দুর্যোধনের হাতের যন্ত্র বেজে উঠল। তিনি জানান দিতে ওসি-র গলা শুনতে পেলেন, 'স্যার, আপনাকে বিরক্ত করছি।' 'বলুন।'

'একটু আগে পিলখানার পাশের রাস্তায় একটা ডেডবডি পাওয়া গিয়েছে। কেউ সরাসরি গুলি করেছিল ওকে।' ওসি বললেন।

'তা আমি কি করতে পারি?'

'না না-! আমরা যাকে খুঁজব ভেবেছিলাম, একজন ড্রাইভার যে তোতলা, এই লোকটি ঠিক তাই। ওসি বললেন।

'মানে?' সোজা হয়ে বসলেন দুর্যোধন।

লোকটা সমতলের। দিন দশেক আগে এখানে এসে ঘর ভাড়া নিয়ে ছিল। কথা বলতে গেলে একটু তোতলায়। ওর সম্পর্কে খোঁজ খবর নিচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে প্রমাণ লোপ করতে ওকে খুন করা হয়েছে। ব্যংপারটা বেশ জটিল মনে হচ্ছে বলে আপনাকে জানালাম।' ওসি বললেন, 'রাখছি।'

অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন দূর্যোধন মিত্র। তাহলে এই শহরে তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র করার শক্তি এবং সামর্থ কারও কারও আছে। ব্যাপারটা তিনি ভাবতেই পারছেন না। যারা এটা করছে তারা তো পরোক্ষে তাকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এত সাহস হল কার। যার মুখ মনে হল সে আর যাই করুক সুন্দরকে খুন করার কথা ভাববে না। সুন্দর যখন ছোট তখন থেকে ওকে খুব পছন্দ করত রামবাবু। তাহলে কে এত সাহসী হল? দুর্যোধন মিত্র সিদ্ধান্ত নিলেন, ব্যাপারটা স্রেফ দুর্ঘটনা। পাহাড়ের রাস্তায় এরকম প্রায়ই ঘটে থাকে। বাঁ দিক দিয়ে ওভারটেক করতে গিয়ে ধাক্কা লাগায় ডানদিকের গাড়ি খাদে পড়ে গেছে বহুবার। দ্বিতীয় কোনও গাড়ি না থাকা সত্ত্বেও স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারায় গাড়ি খাদে পড়েছে। দুর্ঘটনার পর নিজে থানায় যেতে ভয় পেয়েছিল বলে ড্রাইভার ফোনে পুলিশকে গাড়ির নম্বরটা দিয়েছে। দুর্ঘটনা হলে এই অবধি স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু পুলিশ জানাচ্ছে সেই তোতলা ড্রাইভারকে একটু আগে খুন করা হয়েছে। এর পরে তো আর অ্যাকসিডেন্ট বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। লোকটাকে যে ব্যবহার করেছিল সে কোনও ঝুঁকি নিতে চায়নি, আসল খুনি কি জেনে গিয়েছিল পুলিশ একজন তোতলা ড্রাইভারের খোঁজ করছে? কী করে জানল? সন্ধের পরে যে কথা হয়েছিল খাদের পাশে দাঁড়িয়ে তা জানতে পারল কী করে?

অস্বস্তি বেড়ে গেল দুর্যোধন মিত্রের।

এই সময় মোবাইল বেজে উঠল। বিরক্ত হয়ে সেটা তুলতেই সোজা হয়ে বসলেন দুয়োধন মিত্র। কৃষ্ণা ফোন করছেন।

কন্ঠস্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে তিনি কথা বললেন, 'হ্যালো।"

'গুড ইভনিং। কৃষ্ণার গলায় খুশি।

'গুড ইভনিং।'

'কোথায় আছ?'

'বাড়িতে। সুইমিংপুলের পাশে।'

'আই অ্যাম মিসিং ইউ।"

'আমিও।'

'তাহলে কালই চলে এসো।

হাসলেন কৃষ্ণ। দুর্যোধন জিজ্ঞাসা করলেন, 'হাসির কী হল?'

'কাল?' মাথা নাড়লেন দুর্যোধন, 'কাল যাওয়া যাবে না।'

তুমি নাকি আমাকে মিস করছ! অথচ তোমার কাছে ওই কাজগুলো আমার চেয়ে অনেক মূল্যবান। যাক গে, আমি কিন্তু কালই চলে যেতে পারি।'

'

সেকি। তোমার একজিবিশন?'

'দুদিন না থাকলে কোনও অসুবিধে হবে না।'

'ও।' চিন্তায় পড়লেন দূর্যোধন। চটজলদি বললেন, 'আমাকে কয়েকদিন, ধরো তিনদিন, খুব ছোটাছুটি করতে হবে। তুমি এলে সঙ্গ দিতে পারব না। তিন দিন পরে আমি নিজেই দিল্লিতে যাব বলে ঠিক করেছি। তখন সাতদিন কমপ্লিট রেস্টে থাকব। নো কাজ।'

'বিশ্বাস করতে পারি?'

'সিওর।'

'আর কি খবর বলো?'

'ব্যস। চলছে।' গলার স্বর স্বাভাবিক রাখতে পারল দূর্যোধন।

'তোমার ছেলে?'

থমকে গেলেন দুর্যোধন। এই প্রশ্ন কেন করছে কৃষ্ণা। ছেলের কথা কখনও জানতে চেয়েছে বলে মনে পড়ছে না।

'এমনি ভালো ছিল। তবে আজ সন্ধেবেলায় একটা ছোট অ্যাকসিডেন্ট করেছে। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালালে মাঝে মাঝে এমন হয়!'

'স্পেশালি যদি কেউ ড্রাঙ্ক হয়ে ড্রাইভ করে!'

'না না, সুন্দর সেসময় ড্রিঙ্ক না করা অবস্থায় ছিল।

'তুমি ভালো বুঝবে। এটা তোমার প্রবলেম। আচ্ছা, বাই!'

আলো নিভে যাওয়া মোবাইলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থামলেন দুর্যোধন মিত্র। কৃষ্ণা মিথ্যে বলেনি। সত্যি তো এটা তাঁর প্রবলেম। আর এই প্রবলেমটা দিনকে দিন আরও জটিল হয়ে উঠছে।

এক্স-রে রিপোর্ট দেখে নার্সিংহোমের ডাক্তাররা অবাক হয়ে গেলেন। যে ছেলেটা গাড়িতে বসা অবস্থায় পাহাড়ি রাস্তা থেকে খাদে গাড়িয়ে পড়তে পড়তে ছিটকে বেরিয়ে পাথরের খাঁজে আটকে গিয়েছিল তার শরীরের বিভিন্ন জায়গার চমড়া থেতলে এবং কেটে রক্ত বের হওয়া ছড়া হাড়গোড় ভাঙেনি। বাঁ-হাতের কনুই-এর হাড়ে একটা চিড় দেখা গেছে বটে কিন্তু সেটা তেমন মারাত্মক নয়। মাথায় বেশ চোট পেয়েছিল কিন্তু স্ক্যান করে দেখা গেল ভেতরে রক্ত জমে যায়নি।

তবে গত রাতে তাকে নার্সিংহোমে নিয়ে আসার সময় যে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলছিল তা ঘুমের ওষুধ খেয়ে পরের দিন ঘুম ভাঙার পর আর বলছে না। চোখও ঘোলাটে। তিনবার জিজ্ঞাসা করলে একটা দুটো শব্দে জানান দিচ্ছে। ডাক্তাররা আলোচনায় বসে সিদ্ধান্ত নিলেন সুন্দরকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো উচিত। এখন অর্থপেডিক সমস্যার বদলে নিউরোলজিক্যাল সমস্যাই প্রবল হয়ে উঠেছে। মিস্টার ভার্গবকে অভিমত জানিয়ে দেওয়া হল।

মিস্টার ভার্গব দুর্যোধন মিত্রর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। সব শুনে দুর্যোধন মিত্র বললেন, 'আপনি ওকে কলকাতায় নয়, দিল্লিতে নিয়ে যান। ওকে আজই ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজিক্যাল মেডিসিনে ভরতি করে দিন। আমি চাই না আপনি হিলটপ ছেড়ে বেশিদিন বাইরে থাকুন। আপনি যদি কাল এখানে ফিরে আসেন তাহলে পরশু আমি দিল্লিতে যাব।'

'ও.কে. স্যার। কিন্তু মনিটারিং-এর জন্যে একজনকে তো দিল্লিতে থাকতে হবে। আপনার পক্ষে সেটা সম্ভব হবে কি?'

'আমাকে চিন্তা করতে দিন।' দুর্যোধন মিত্র লাইন কেটে দিলেন।

দুপুরের ফ্লাইটে মিস্টার ভার্গব স্ট্রেচারে শুইয়ে সুন্দরকে দিল্লিতে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার ওকে ইটিাতে নিষেধ করেছেন, সুন্দরের কথা ইতিমধ্যে দুর্যোধন মিত্র হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়ায় ভরতি হওয়ামাত্র চিকিৎসা শুরু হয়ে গেল। সমস্ত ব্যাপার রিপোর্ট করল মিস্টার ভার্গব দূর্যোধন মিত্রকে। কথা হল, মিস্টার ভার্গব কাল দুপুরের ফ্লাইটে ফিরে যাবেন।

বিকেল হু'টায় সব কর্তব্য শেষ করে মিস্টার ভার্গব সেন্টুর হোটেলে চেক ইন করলেন। হোটেলেটা এয়ারপোর্ট থেকে বেশি দূরে না হওয়ায় ফিরতে সুবিধে হবে। চাবি নেওয়ার সময় লক্ষ করলেন হোটেলের একজিবিশন হলে ছবির প্রদর্শনী চলছে। ঘরে গিয়ে স্নান করে পোশাক বদলে স্রেফ সময় কাটানোর অন্যে মিস্টার ভার্গব লিফটে চেপে নীচে নেমে এলেন। প্রদর্শনী কক্ষে গিয়ে দেখলেন ভালোই ভিড় হয়েছে। আধুনিক চিত্রকলা দেখার অভ্যেস তাঁর নেই। কিন্তু রঙের আধিক্য থাকাতে দেখতে ভালো লাগছিল। ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন তিনি। হঠাৎ চোখ পড়ল দুজন মহিলার ওপর। একজন অন্যজনকে ছবির বিষয় বোঝাচ্ছেন। যাঁকে বোঝানো হচ্ছিল তাঁকে চিনতে অসুবিধে হল না। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মিস্টার ভার্গব বলল, 'গুড ইভনিং ম্যাডাম।' কৃষ্ণল মুখ ফিরিয়ে মিস্টার ভার্গবকে দেখে বেশ অবাক হলেন, 'আপনি। আপনি দিল্লিতে

এসেছেন জানতাম না তো!' এক লহমায় মিস্টার ভার্গব বুঝতে পারলেন আলাপ করতে আসা ঠিক হয়নি। সুন্দর নুর্যোধন মিত্রের ছেলে, তাঁর স্ত্রী-র নয়। কোনওদিন আলোচনা হয়নি, প্রসঙ্গও ওঠেনি। কিন্তু নিজের বাড়ি থাকতে সুন্দরকে যখন হোটেলের ঘরে থাকতে হয় তখন কোথাও যে বিরোধ আছে তা বুঝতে

অসুবিধে হয় না।

কৃষ্ণা তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। মিস্টার ভার্গব ঠিক করলেন সত্যি কথাই বলবেন। সংক্ষেপে ঘটনাটা জানালেন তিনি।

'ওয়াজ হি ড্রাঙ্ক?' কৃষ্ণা নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন।

'সম্ভবত না। আমি গন্ধ পাইনি। ডাক্তাররাও কিছু বলেননি।'

'দিল্লিতে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত কখন হল?'

'আজ সকাল এগারোটায়। স্যার পরও এখানে আসছেন, আমি কাল চলে যাব।'

'কেন?'

'আমার হিলটপে থাকাটা বেশি অরুরি। এখানে যোগাযোগ রাখা ছাড়া আমার তো কিছু করার নেই।' মিস্টার ভার্গব বললেন।

'ওয়েল মিস্টার ভার্গব, আমাকে যখন অফিসিয়ালি জানানো হয়নি ওকে দিল্লিতে নিয়ে আসা হয়েছে তখন আপনাকে অনুরোধ, আপনি ভুলে যান আমার সঙ্গে এই দেখা হওয়ার কথা।' হাসলেন কৃষ্ণা।

'মানে?' বেশ অবাক হলেন মিস্টার ভার্গব।

'আপনি আমাকে ওর দিল্লিতে নিয়ে আসার খবর দিয়েছেন একথা কাউকে বলবেন না।

আপনার সঙ্গে আমার দেখাই হয়নি। ও.কে.?'

মাথা নাড়লেন মিস্টার ভার্গব। তাঁর মাথা কাজ করছিল না, কিন্তু অনুমান করলেন ম্যাডামের কথা অমান্য করলে ভয়ঙ্কর বিপদে পড়ে যাবেন।

রাত ন'টায় ওসির ফোন পেলেন দুর্যোধন মিত্র, 'এই সময় আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত স্যার কিন্তু বাধ্য হয়ে।'

'আপনার বক্তব্য বলুন। ভদ্রলোককে থামিয়ে দিলেন দুর্যোধন মিত্র।'

'যে লোকটাকে আজ গুলি করা হয়েছে সে যে তোতলা ছিল তা কয়েকজন ড্রাইভারের

কাছ থেকে জানা গেছে। লোকটা একটা সুমো গাড়ি চালাতে।'

'সুমোর মালিক কে?'

'সেটাই সমস্যা হয়েছে। গাড়িটার নাম্বার দার্জিলিং মোটর ভেইকিলসের। ওদের অফিস বন্ধ হয়ে গেলেও আমাদের এক সহকর্মী খোঁজ নিয়ে জেনেছেন ওই সুমোর মালিক একজন নেপলি। যে ঠিকানা দেওয়া ছিল সেখানে গিয়ে জানা গেছে ওই নামের কোনও লোকের অস্তিত্ব নেই, অর্থাৎ একেবারে গোড়া থেকেই বেনামে গাড়িটাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।' ওসি বললেন।

'স্ট্রেঞ্জ।' দুর্যোধন মিত্র চাপা গলায় বললেন।

'আর ওই গাড়িটাকে ব্যবহার করার পেছনে নিশ্চয়ই মতলব ছিল। গাড়ি ধরা পড়লেও মালিকের খোঁজ পাওয়া যাবে না। ড্রাইভার তোতলা এই তথ্যটা আমরা না পেলে হয়তো ওকে মেরে ফেলা হত না।' ওসি বললেন।

'গাড়িটাকে পেয়েছেন?'

'হ্যাঁ। আমরা থানায় নিয়ে এসেছি?'

দুর্যোধন মিত্র জিজ্ঞাসা করলেন, 'আপনি কি একা কথা বলছেন?'

'হ্যাঁ, আমার ঘরে আর কেউ নেই।'

'ঠিক আছে। আপনি আপনার থানার লোকদের বলুন যে লোকটা বেনামে সুমো গাড়িটাকে খাটাত তার পরিচয় জানতে পেরেছেন। বলবেন, লোকটা দার্জিলিং-এ থাকে।'

'কিন্তু স্যার কথাটা বাইরে গেলে লোকটা সতর্ক হয়ে যাবে।'

'কোন লোকটা?'

'যার কথা আপনি বলছেন।'

'আমি কারও কথা বলছি না। কিন্তু কথাটা প্রচারিত হলে খুনি ভয় পাবে। ভয় পেয়ে কিছু করে ফেললে আপনি ক্রু পাবেন। আর হ্যাঁ দার্জিলিং-এ গাড়িটা কোন গ্যারাজে রাখা হত সেই খবর নিন। গ্যারাজের মালিকের সঙ্গে গাড়ির ব্যাপারে কে কথা বলতে যেত সেটা জানতে পারবেন।' দুর্যোধন

মিত্র ফোন রাখলেন।

ছেলেটাকে বাঁচাতে হবে। বিড়বিড় করে বললেন দূর্যোধন মিত্র। ইদানীং সে রীতিমতো অবাধ্য হয়ে উঠলেও ওকে এভাবে মরতে দিতে তিনি রাজি নন। ওকে পুত্র হিসেবে অবশ্যই তিনি স্নেহ করেন নাহলে ওর কাজকর্ম তিনি মেনে নিতে পারতেন না। কিন্তু স্নেহের একটা সীমা তিনি রেখেছেন। সুন্দর এখনও

সেই সীমা অতিক্রম করেনি।

তাছাড়া যে লোকটি সুন্দরকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিল তার লক্ষ তো তিনি। সুন্দরের মৃত্যু দিয়ে যে তাঁর ওপর আঘাত করতে চেয়েছে, সুন্দরকে বাঁচিয়ে তুললে সেই লোকটিকে নিজের জিভ গিলতে হবে। ওই লোকটির হদিস পাওয়ার জনো সুন্দরের বেঁচে থাকা দরকার।

ফোন বাজল। তাঁর ব্যক্তিগত নাম্বার বেশি মানুষ জানে না। মোবাইল তুলে দিল্লির নাম্বার দেখলেন তিনি। অচেনা। ফোনটা কৃষ্ণার হতে পারে। ইদানীং ওর শখ হয়েছে নতুন নতুন নাম্বার থেকে ফোন করা। অন্তত এক ডজন সেলফোন কিনে ফেলেছে কৃষ্ণল। ইচ্ছে করেই ফোনটা অন করলেন না দুর্যেবিন। বেজে বেজে থেমে গেল। হঠাৎ মনে হল সুন্দর যেখানে আছে সেখান থেকে ফোনটা কেউ করেনি তো। তার পরেই মাথা নাড়লেন, নাহ্। ওরা তো ভার্গবকেই যা জানাবার তা জানাবে। তাঁর ব্যক্তিগত নাম্বার গুদের জানার কথা নয়।

আবার ফোন বাজল। সেলফোন তুলতেই কৃষ্ণার নাম্বার যা তাঁর পরিচিত তা দেখতে পেয়ে বোতাম টিপে হ্যালো বললেন।

'এই মাত্র তুমি ফোনটা ধরলে না কেন?' কৃষ্ণার গলায় উত্তাপ।

'মাই গড। ওটা তোমার যেফন ছিল। নাম্বারটা আগে কখনও দেখিনি।'

'বাজে কথা বলো না। তোমার পার্সোনাল নাম্বার দিল্লিতে আমি ছাড়া আর কে জানবে?

কেমন আছ?"

'আমি যেমন থাকি!'

'মানে।'

চারপাশে সমূদ্রের ঢেউ-এর মতো সমস্যা, আমি সাঁতবাচ্ছি, তুমি?'

'আমি? ওহো, 'আজ একটা একজিবিশন থেকে ছবি কিনেছি? তুমি অম্বিকা গুপ্তার নাম শুনেছ তো?'

'না। কে ইনি?'

'ওঃ মাই গড। তুমি কোথায় আছ! অম্বিকা এখন ভারতবর্ষের ওয়ান অফ দ্য টপ ফিমেল পেইন্টার। ছবিটা দেখলে তুমি খুব খুশি হবে।' কৃষ্ণা বললেন।

'গিয়ে দেখব!'

'তুমি কবে আসছ?'

'পরশু।' দুর্যোধন মিত্র জিজ্ঞাসা করলেন, 'আমি কি চেক পাঠাব?'

'কী জন্যে?'

'তোমাকে ছবির দাম তো দিতে হবে।'

'টেন পার্সেন্ট ডাউন করেছি। বাকিটা পরের দিকে দিতে হবে। কত জানো?'

দুর্যোধন চুপ করে থেকে বললেন, 'তোমার মন যা পেলে খুশি হয় তার দাম তো টাকা দিয়ে হিসেব করা যাবে না।'

'আঃ। চুপ করো। এগারো লাখ বলেছিল অম্বিকা, আমি দশে রাজি করিয়েছি।'

'গুড। আমি দিল্লিতে পৌঁছেই চেক দিয়ে দেব।'

'তোমাকে কীরকম অন্যমনস্ক লাগছে। কী হয়েছে?' কৃষ্ণা আনতে চাইল।

'আজ সারাদিন ধরে প্রচুর কাজ করেছি, কেউ একথা বলেনি।'

'কী করে বলবে? দুর্যোধন মিত্রের চাটুকাররা প্রশংসা ছাড়া কিছু জানে না।' কৃষ্ণা খুব গাড়

জিজ্ঞাসা করল, 'কী হয়েছে?

গলায় ' এবার দুর্যোধন মিত্র বললেন, 'ব্যাপারটা ভুল বলোনি। সুন্দরকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে। ওর

একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। রাস্তা থেকে ওর গাড়ি খাদে পড়ে যায় যেটা আমার কছে অবিশ্বাস্য। আট পেগ মদ গিলেও ওর মতো দক্ষ ড্রাইভার এই ভুল করতে পারে না।'

'ওই গড! এখন কেমন আছে ও? তুমি বলেছিলে মাইনর অ্যাকসিডেন্ট।' ওকে রেসক্যু করে আনার পরেও সেন্স ছিল, কথাও বলছিল। তখন বুঝলাম আর একটা গাড়ি ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরেছে ওর গাড়িটাকে। তার জন্যে অ্যাকসিডেন্ট। অবশ্য অ্যাকসিডেন্ট না বলে খুন করার চেষ্টা বলাই উচিত। কিন্তু লোকে জানত অ্যাকসিডেন্ট। যে করিয়েছে সে ভাবতে

পারেনি সুন্দর বেঁচে যাবে। পড়ে গিয়ে মরে গেলে অ্যাকসিডেন্ট ভাবা ছাড়া অন্য সন্দেহ করা যেত না ' দুর্যোধন মিত্র বললেন।

'কে খুন করতে চেয়েছিল?'

হাসলেন দুর্যোধন মিত্র প্রশ্নটা শুনে, 'যে খুন করাতে চেয়েছে, সে অত্যন্ত বুদ্ধিমান।' 'এখন কেমন আছে সুন্দর।'

'ভালো নয়। হঠাৎ ওর অবস্থার অবনতি হয়। কথাও বন্ধ হয়ে যায়। তাই ওকে দিল্লিতে পাঠিয়েছি। চিকিৎসা শুরু হয়ে গেছে। ভার্গব সঙ্গে গিয়েছে।'

'এত সব ঘটে গেল, ওকে দিল্লিতে আনা হল অথচ আমাকে তুমি অন্ধকারে রেখে দিলে? আমি কেউ নই?'

'না না ডার্লিং। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে মাথা কাজ করেনি। তা ছাড়া তুমি একা থাকো, সমস্যায় ফেলতে চাইনি। আর আমাদেরও তো কিছু করার নেই। যা করার তা ডাক্তাররাই

করছেন। আমি ভার্গবকে বলেছি কাল ফিরে আসতে।'

একটু থেমে কৃষ্ণা বললেন, 'ভার্গবকে আজ আমি দেখেছি।'

'ও কোথায়?'

'হোটেলের একজিবিশন রুমে।'

'ওখানে কি করছিল সে?'

'বোধহয় পেইন্টিং দেখতে এসেছিল।'

'ও কিছু বলেনি তোমাকে।'

'আমাকে দূর থেকে দেখেই এমন ভাবে সরে গেল যে আমি কথা বলার সুযোই পাইনি। তুমি আসার আগে যদি কোনও প্রয়োজন হয়, প্লিজ আনিও। গুডনাইট।'

একটু ভাবলেন দুর্যোধন মিত্র। ভার্গবকে তিনি বলেননি কৃষ্ণাকে দেখলে কথা না বলে সরে যেতে হবে। কৃষ্ণার কথা তাঁর মাথায় না থাকায় ভার্গবকে কিছুই বলা হয়নি কিন্তু লোকটা একজিবিশনে গেল কেন? পেইন্টিং দেখতে পছন্দ করে বলে তো তিনি শোনেননি। তা ছাড়া কৃষ্ণাকে সে দেখতে পেয়েছে একথা ভার্গব তাকে টেলিফোনে বলেনি। অদ্ভুত।

সকালে অফিসে যাওয়া মাত্র রিসেপশনিস্ট জানাল রামচন্দ্র বণিক দেখা করতে এসেছেন। টেলিফোন না করে দেখা করতে কেউ এলে বিরক্ত হন দূর্যোধন। কিন্তু আজ হলেন না। রামচন্দ্র ঘরে ঢুকলেন নক করে। হেসে বললেন, 'আমি জানি আমার উচিত ছিল টেলিফোন করে আসা। কিন্তু খবরটা পেয়ে। বসতে পারি?"

'অবশ্যই। কী খবর?"

চেয়ারে বসে রামচন্দ্র বললেন, 'পুলিশ খুব বাড়াবাড়ি করছে। শহরের প্রায় সব ড্রাইভারকে থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে জেরার সময় অত্যাচার করছে। আমরা চাই সুন্দরকে যদি খুন করার চেষ্টা হয় তাহলে খুনি শান্তি পাক। একজন ড্রাইভারকে তো মৃত অবস্থায় পাওয়াও গেছে। সেই যে খুনি তাতে সন্দেহ নেই। তাহলে অন্যান্যদের হ্যারাস করা হচ্ছে কেন?'

দুর্যোধন মিত্র তাকালেন, 'কী আশ্চর্য। তুমি এই অঞ্চলের ক্ষমতাবান এমপি। ফোন তুলে নর্থ বেঙ্গলের আইজি কে বললে এক সেকেন্ডে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ওসি ক্ষমা চাইতে ছুটে যাবে তোমার কাছে। তা না করে তুমি আমার কাছে এলে?'

'আপনি নিশ্চয়ই জানেন প্রধানমন্ত্রী চান না কোনও মন্ত্রী বা এমপি প্রশাসনের কাজে হস্তক্ষেপ করুক। আমি পুলিশকে ফোন করলেই মিডিয়া সেটা ফলাও করে প্রচার করবে। আপনি টিভি দ্যাখেন?'

'খুব কম।'

'কাল দেখেছেন?'

'না।'

'সুন্দরের অ্যাকসিডেন্ট নিয়ে টিভির চ্যানেলগুলো হইচই আরম্ভ করেছে। দুর্ঘটনা নয়, খুন ক্যাপশন দিয়ে তারা অনুষ্ঠান চালাচ্ছে। ফলে প্রশাসন খুব তৎপর হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় আমি যদি ফোন করে বলি শহরের ড্রাইভারদের হ্যারাস করা চলবে না তাহলে ওদের ক্যাপশন হবে এমপি খুনিকে আড়াল করতে চাইছেন। কিন্তু এটা বললে সমস্ত ড্রাইভার ধর্মঘট শুরু করবে। কিন্তু আপনি যদি পুলিশকে বলেন তাহলে কেউ বলতে পারবে না' যে বাবা হয়ে ছেলের খুনিকে আড়াগ

করতে চাইছেন। ধর্মঘটও এড়ানো যাবে।'

'তুমি পুলিশকে ফোন করলে মিডিয়া আনবে কী করে?'

হাসল রামচন্দ্র, 'পুলিশই নিঃশব্দে জানিয়ে দেবে। ওরা তো আমাকে ফাঁসাতে চায়।' 'ঠিক আছে, ভেবে দেখি।'

'সুন্দর নাকি স্টেটমেন্ট দিয়েছে আর একটা গাড়ি এসে জেনেশুনে তার গাড়িতে এত জোরে ধাক্কা দেয় যে সে ব্যালেন্স রাখতে পারেনি তার মানে এটা খুন। আপনি কি কাউকে সন্দেহ করছেন?'

'তোতলা ড্রাইভার বেঁচে থাকলে এতদিনে জানা যেত।' দুর্যোধন জিজ্ঞাসা করলেন, 'তোমার কি কাউকে সন্দেহ হয়?'

'আপনার সাফল্যে 'অনেকেই ঈর্ষান্বিত। কিন্তু তাদের কারও সাহস হবে বলে মনে হয় না। আমি কাল থেকে অন্য কথা ভাবছি।'

'কী সেটা।'

'ওই সুমো গাড়ির মালিকের নাম-ঠিকানা কি পুলিশ বের করেছে।"

'বেসরকারি ভাবে জানা গেছে দার্জিলিং-এর গাড়ি। মালিক একজন নেপালি।'

'লোকটার নাম কি? কোথায় থাকে?'

'যে নামে রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল সেই নামের কেউ ওই ঠিকানায় থাকে না।'

'খুনি নিশ্চয়ই কথাটা জানত।'

'জানত বলেই গাড়িটা ব্যবহার করেছে।'

'কিন্তু লোকটা দার্জিলিং এ থাকে, আমার মনের সন্দেহটা তীব্র হচ্ছে।'

দুর্যোধন তাকালেন রামচন্দ্রের দিকে।

'কিছু মনে করবেন না, এটা আমার নিছক অনুমান। সত্যি নাও হতে পারে। কিন্তু আইন বলছে অপরাধী ধরা পড়ার আগে কেউ সন্দেহের উর্ধ্বে থাকতে পারে না। এই আমি, এমনকী

আপনাকেও সন্দেহ করা উচিত।'

'যা বলতে চাইছ তা বলো।'

'আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন, হিলটপ হোটেলের রিসেপশনিস্ট লীলার সঙ্গে সুন্দরের একটা সুসম্পর্ক তৈরি হচ্ছিল। এ নিয়ে হোটেলের কর্মচারীরা হাসাহাসি করত। সেই লীলা ছুটি নিয়ে গেল দার্জিলিঙে। বোধহয় গিয়ে বাবা-মাকে বলেছে সুন্দরের কথা, আপনার কথা। অমন সুন্দরী মেয়ের বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলেন তাঁরা? সুন্দর তো তাঁদের কাছে আকাশের চাঁদ। সে আপনার একমাত্র পুত্র। আপনার পরে সে এই বিশাল সম্পত্তির মালিক হবে। আহ্লাদে ওরা আটখানা হবেই।' রামচন্দ্র বলল।

'এসবের সঙ্গে খুনের সম্পর্ক কোথায়!'

'আছে। খবরটা চাপা থাকেনি। তার ওপর সুন্দর ছুটে গিয়ে প্লেনের টিকিট কেটে লীলা এবং তার বাবাকে কলকাতায় পাঠিয়েছে চিকিৎসার জন্যে। আপনি ভেবে দেখুন, লীলার মতো সুন্দরী মেয়ের এই বয়স পর্যন্ত কোনও প্রেমিক ছিল না, একি হতে পারে? সুন্দরকে পেয়ে লীলা সেই প্রেমিককে নিশ্চয়ই প্রত্যাখ্যান করেছে। দার্জিলিং-এর একটা সাদামাটা যুবকের পক্ষে সুন্দরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড়ানো অসম্ভব। আহত প্রেমিক অনেক সময় সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়। সে-ই ওই তোতলা লোকটাকে ভাড়া করেছিল বলে আমার ধারণা।'

'ছেলেটার নাম কী?'

'এখনও জানতে পারিনি। লোক লাগিয়েছি। খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারব। লীলার মতো সুন্দরীর যে প্রেমিক ছিল তাকে তো দার্জিলিং-এর পাবলিকের চেনার কথা।'

'তাহলে তোমার মনে হয় এ ব্যাপারে লীলার কোনও ভূমিকা নেই?' 'না। সোনার ডিম দেয় যে হাঁস তাকে কেউ মেরে ফ্যালে না।' রামচন্দ্র বললেন, 'ওসিকে যদি একবার টেলিফোন করেন।' ঠিক তখনই ইন্টারকমে শব্দ হল। রিসিভার তুলতে দুর্যোধন মিত্র শুনলেন, 'স্যার, লোকাল থানার ওসি কথা বলতে চাইছেন।'

দুযেধিন মিত্র বললেন, 'দাও।'

লাইন অন হলে দুর্যোধন মিত্র বললেন, 'গুডমর্নিং অফিসার।'

'গুডমর্নিং স্যার। কিন্তু আমার পক্ষে বোধহয় দিনটা ভালো যাবে না।'

'কেন?'

'যে তোতলা ড্রাইভারকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল সে মরার আগের চব্বিশ ঘণ্টায় করে কার সঙ্গে দেখা করেছিল তার একটা লিস্ট বানাতে বলেছিলাম আমার এসআইকে।' ওসি বললেন।

'ইন্টারেস্টিং।'

'পাঁচজনের নাম পেয়েছি। দার্জিলিং -এর দুজন, এখানে তিনজন।' ওসি বললেন, ড্রাইভারটি সেই ঘটনার পর এখানে এসেই আবার ফিরে যায় দার্জিলিং-এ। সেখানে গিয়ে ওই দুজনের সঙ্গে দেখা করে। কিন্তু দুর্ঘটনার কথা জানায়নি। সে টাকা ধার চেয়েছিল। বলেছিল চব্বিশ ঘণ্টা পরে সে অনেক টাকা পাবে, তখন শোধ করে দেবে। ওই দুজন টাকা ধার দিতে রাজি না হওয়ায় সে এখানে ফিরে আসে। তারপর তো খুনই হয়ে যায়।' ওসি বললেন।

'খুব ভালে! প্রগ্রেস। কিন্তু অফিসার এসব তো আপনার সরকারি তদন্তের কথা। আপনি আমাকে জানাচ্ছেন কেন?' দুযোর্ধন মিত্র জিজ্ঞাসা করলেন।

'তার পেছনে কারণ আছে স্যার। ফোনে সব কথা বলতে চাই না। আজ কখন আপনার

সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে পারি?" 'আমার সেক্রেটারি আপনাকে জানিয়ে দেবে। ওহো, একটা কথা, আপনি ঠগ বাছার জন্যে, গাঁ উজাড় নাই বা করলেন!'

'মানে?'

'এখানকার সব ড্রাইভারদের থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে আপনার জুনিয়াররা হ্যারাস করছে। আমার মনে হয় এটা করার কোনও যুক্তি নেই। দুর্যোধন মিত্র বললেন।

'একটু আগে আমি অর্ডার দিয়েছি। আর কোনও ড্রাইভারকে ডাকা হবে না।'

'থ্যাঙ্ক ইউ অফিসার।' ফোন রেখে দিলেন দুর্যোধন মিত্র। তারপর রামচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'পুলিশ আর ড্রাইভারদের ডাকবে না।"

'অনেক ধন্যবাদ।' রামচন্দ্র উঠে দাঁড়ালেন, 'সুন্দরের চিকিৎসার জন্যে আমি সবকিছু করতে রাজি আছি। আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে হেলথ মিনিস্টারকে বলব যাতে কোনও ত্রুটি না থাকে দেখার জন্যে।'

হাসলেন দুর্যোধন মিত্র, 'দরকার হলে নিশ্চয়ই বলব।'

রামচন্দ্র চলে যাওয়ার পর ঘণ্টাদুয়েক খুব ব্যস্ত ছিলেন দুর্যোধন মিত্র। সেক্রেটারি এসে নেটে আসা মেইলগুলো টেবিলের একপাশে দিলে তিনি বললেন, 'একটা কফি দিতে বলো। বেশ কড়া।

ও হ্যাঁ, ওসি যদি ফোন করেন তাহলে বলবে লাঞ্চের পরে যেন আসেন।'

সেক্রেটারি ঘাড় নাড়ল কিন্তু ইতস্তত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল।

'কিছু বলবে?'

'স্যার। কলকাতা থেকে লীলা দুবার ফোন করেছিল।' 'সীলা? কে লীলা?'

'স্যার, লীলা হিলটপের রিসেপশনিস্ট।' 'ও, হ্যাঁ। কি বলতে চায় সে?'

'প্রথমবার ফোনে ছুটি এক্সটেনশন করতে অনুরোধ করেছিল। আমি বলেছি, ভার্গব সাহেষ এখন দিল্লিতে, তিনি ফিরে এসে সিদ্ধান্ত নেবেন।'

'আচ্ছা'

দ্বিতীয়বারে জুনিয়ার মিত্রের যৌজ করছিল। বলল, ওঁর মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছে না তাই বাধ্য হয়ে অফিসের নাম্বারে ফোন করেছে।' 'তুমি কী বললে?'

'বুঝতে পারলাম লীলা অ্যাকসিডেন্টের খবরটা জানে না। তাই বলেছি, উনি এখন দিল্লিতে আছেন, এখানে ফিরলে জানিয়ে দেব। শুনে খুব হতাশ হল বলে মনে হচ্ছিল।'

৩.কে.। তুমি যেতে পারো।'

মেলগুলো দেখছিলেন। বেশিরভাগই ক্লায়েন্টদের চিঠি। কম্পুটার থেকে বের করা প্রিন্ট আউটগুলোর ওপর তিনি নোট দিলেন কোন অফিসার কোনটা দেখবেন। তারপরের ভার্ণবের মেল দেখতে পেলেন। ভার্গব জানিয়েছেন, সুন্দরের অবস্থা আগের থেকে ভালো বলছেন ডাক্তার কিন্তু তার এখনও জ্ঞান ফেরেনি। তবু নির্দেশমতো আজ দুপুরেই তিনি ফিরে আসছেন। দ্বিতীয়ত, আজ একটু আগে ম্যাডাম মিত্র তাঁকে ফোন করেছিলেন। সুন্দরের দেখাশোনার দায়িত্ব তিনি নিতে চাইছেন। স্যার যদি অনুমতি দেন তাহলে এ ব্যাপারে ভার্গব ফোনে কথা বলতে চান।'

নিজের মোবাইলে ভার্গবের নাম্বার টিপলেন দুর্যোধন মিত্র, 'ইয়েস ভার্গব।'

'স্যার। আই অ্যাম রিয়েলি সরি। কাল আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি। ইন ফ্যাক্ট আমাকে নিষেধ করা হয়েছিল যেন মুখ বন্ধ রাখি। কাল হোটেলের একজিবিশন হলে ম্যাডাম মিত্রের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনিই নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ যখন নিজে থেকেই সুন্দরের দায়িত্ব নিতে চাইলেন তখন আমার মনে হল ব্যাপারটা আপনাকে জানানো উচিত। আমি আবার বলছি, দুঃখিত।'

ভার্গবের গলা কাঁপছিল।

ওয়েস, ভার্গব, আমি আশা করব, ব্যাপারটা আর রিপিট করবে না।'

'

'না স্যার?

'কিন্তু, না, তোমার আজ ফেরার দরকার নেই।'

'ফিরব না স্যার?'

'আজকে এবং আগামিকাল সকালে তুমিই ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলবে। আজ হাসপাতালের ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করবে যাতে সুন্দরের কেবিনের সামনে চব্বিশ ঘণ্টা সিকিউরিটির ব্যবস্থা থাকে। ডাক্তার, নার্স এবং তুমি ছাড়া আর কেউ যেন সুন্দরের কাছে যেতে না পারে। তোমাদের কাছে যেন স্পেশ্যাল আইডেন্টিটি কার্ড থাকে। সেই কার্ড ছাড়া ডাক্তার বা নার্সকে সিকিউরিটির লোক ভেতরে ঢুকতে দেবে না। কাল আমি দুপুরের ফ্লাইটে পৌঁছাব। এয়ারপোর্টে আমার সঙ্গে দেখা করে ওই কার্ড আমাকে দিয়ে তুমি এখানকার ফ্লাইট ধরবে। আমার যাওয়া আর তোমার আসার মধ্যে যে কয়েকঘন্টার ব্যবধান থাকছে তাতে এখানে কোনও বিপ্লব হবে না।

আন্ডারস্ট্যান্ড?'

'ইয়েস স্যার। কিন্তু ম্যাডাম!'

'তুমি দেখছি আজকাল একটু কম বুঝতে পারছ।'

'ও.কে. স্যার। আমি এখনই হাসপাতালে যাচ্ছি।'

মোবাইল বন্ধ করে রুমালে মুখ মুছলেন দূর্যোধন মিত্র। সাদা রুমালটায় আবছা দাগ পড়ল।

লাঞ্চের পরে ওসি এলেন। ভদ্রলোক এখন ইউনিফর্মে আসেননি। দুর্যোধন মিত্র সাধারণ কিছু কথা বলার পর জিজ্ঞাসা করলেন, 'সমস্যাটা কী?'

তোতলা ড্রাইভার দুর্ঘটনা বা খুন করার পর এখানে তিনজন লোকের সঙ্গে দেখা করে। প্রথমে দেখা করে এমপি সাহেবের ড্রাইভারের সঙ্গে।'

'কী কথা হয় ওদের?'

'আমরা এখনও জানি না। ইচ্ছে করেই ওকে জেরা করিনি। তবে এমপি সাহেবের গাড়ি ও চালাত না, তাঁর ফ্যামিলি যে গাড়ি ব্যবহার করত, সেটা চালাত, সেটাও বেশিদিন নয়। আপনি শুনলে অবাক হবেন, ওই লোকটি আগে ম্যাডাম মিত্রের গাড়ি চালাত!'

'তাই।' সত্যি অবাক হলেন দুর্যোধন মিত্র, 'কী নাম?"

'পূরণবাহাদুর। ও সবাইকে বলত ম্যাডাম ওকে ছেলের মতো ভালোবাসেন।'

মনে করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন দুর্যোধন। কৃষ্ণ বাড়িতে পাহাড়ি কর্মচারী রাখা পছন্দ করত। বলত, ওরা খুব কর্তব্যপরায়ণ হয়। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, 'এই লোকটা তো গাড়িটাকে খাদে ফেলে দেয়নি। তাহলে ওকে সন্দেহ করছেন কেন?'

'আমি একবারও বলিনি সন্দেহ করছি। বলেছি ওই লোকটার সঙ্গে তোতলা ড্রাইভার দেখা করেছিল। কি কথা হয়েছিল তা জেরা করলেই জানা যাবে। এই তোতলা ড্রাইভার দার্জিলিং থেকে ফিরে ও যেখানে ভাড়া থাকে তার বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করে বলে যে সে বাইরে চাকরি পেয়ে চলে যাচ্ছে তাই ভাড়াটে হয়ে থাকবে না। বাড়িওয়ালাকে জেরা করে ঠিক এই তথ্য জানতে পেরেছি। লোকটি বাড়িওয়ালাকে জানিয়েছিল পরের দিনই ঘর খালি করে দেবে। এর অর্থ হল সে এখান থেকে চলে যেতে চেয়েছিল। অথচ ও দার্জিলিং-এ বলেছিল তিনদিনের মধ্যে প্রচুর টাকা পাবে। টাকা পেলে সে পরের দিনই চলে যাবে কেন? তিনদিন অন্তত এখানে থাকত। তাহলে কি সে টাকাটা পাবে না বলে জেনেছিল?' ওসি যেন নিজের মনেই কথা বলছিলেন।

'এই পূরণবাহাদুরকে জেরা করছেন না কেন?'

'এবার করব।'

'আর হ্যাঁ, বলেছিলেন, এখানকার তিনজন লোকের সঙ্গে ও কথা বলেছিল। দুজনের ব্যাপারটা

বললেন, তৃতীয়জন কে?' দুর্যোধন মিত্র জিজ্ঞাসা করলেন।

'আমার সমস্যা তো তাঁকে নিয়েই।'

'কে তিনি?'

'এমপি সাহেব।'

'মাই গড। রামচন্দ্র লোকটাকে চিনত?'

'হ্যাঁ স্যার।' লোকটা এমপি সাহেবের কাছে গিয়েছিল। কী কথা হয়েছিল তা একমাত্র এমপি

সাহেবই

বলতে পারেন।'

'জিজ্ঞাসা করুন তাঁকে।"

'স্যার, আমি ভয় পাচ্ছি। ওঁর যা ক্ষমতা, আমাকে বহুদূরের পাহাড়ি নির্জন গ্রামে বদলি

করে দিতে পারেন।'

'আপনি রাজ্য পুলিশের অফিসার, উনি কেন্দ্রের এমপি। কেন ভয় পাচ্ছেন।'

'উনি আইজিকে বললেই কাজ' হয়ে যাবে।'

'বেশ। সেক্ষেত্রে আপনি জেলার এসপি সাহেবকে সব জানান।'

সোজা হয়ে বসলেন ওসি। 'অসম্ভব।' 'উনি তৎক্ষণাৎ এমপি সাহেবকে সব জানিয়ে দেবেন।

আমাকে সাহায্য করুন।'

'বলুন কী সাহায্য করতে পারি?' 'আমাকে যদি এমন জায়গায় বদলি করা

আপনি

হয় যা প্রায় শাস্তি, আপনি আইজি সাহেবকে বলে সেটা বাতিল করে দেবেন। আইজি সাহেব আপনাকে খুব মান্য করেন।' 'এত ক্ষমতা আমার আছে কিনা জানি না অফিসার, কিন্তু আমি চেষ্টা করব।'

আধঘণ্টা পরে দুর্যোধন মিত্র সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিলেন রামচন্দ্রকে ফোনে ধরতে। এক মিনিট বানে সেক্রেটারি জানাল, 'স্যার, উনি ঘণ্টাদেড়েক আগে নীচে নেমে গেছেন, এয়ারপোর্ট থেকে দিল্লির ফ্লাইট ধরবেন। দিল্লিতে পৌঁছালে কি তাঁকে ফোনে ধরব?'

'না।'

আজ কাজ করতে ভালো লাগছিল না দুর্যোধন মিত্রের। বিকেলের মধ্যেই বাড়ি ফিরে এলেন। চুপচাপ নিজের খাটে শুয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিল রামচন্দ্র এমন কোনও কাজ করতে পারে না যাতে সুন্দরের ক্ষতি হবে। ওকে প্রায় শৈশব থেকে দেখে আসছে সে। কিন্তু তোতলা ড্রাইভার সুন্দরের গাড়িটাকে খাদে ফেলে দিয়ে কেন রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করবে। রামচন্দ্র কি তাকে নির্দেশ দিয়েছিল কাজটা করার জন্যে। এয়ারপোর্ট থেকে সুন্দর যে ফিরছে এ খবর রামচন্দ্র কি ওকে দিয়েছিল। কাজটা হয়ে গেলে মোটা টাকা বকশিশ দেবে বলে আশ্বাস দিয়েছিল রামচন্দ্র? কিন্তু কেন? এসব করে ওর কী লাভ হবে? এমপি হওঃ 'র পর রামচন্দ্র অনেকটা বদলে গিয়েছে। ইদানীং তাঁকেই ঈর্ষা করছে সে। তিনি যে তাকে নীচু 'থেকে ওপরে টেনে তুলেছেন তা ভুলতে চাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাঁকে আহত করতে সুন্দরকে হত্যা করাতে কেন চাইবে রামচন্দ্র? তোতলা ড্রাইভার রামচন্দ্রের কাছে টাকা পায়নি। না পেয়ে ও পালাতে চেয়েছিল কেন? আর এই লোকটার সঙ্গে রামচন্দ্রর যোগাযোগ হল কী করে? এমপি হওয়ার পর তো সাধারণ একটা ড্রাইভারের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক সে তৈরি করবে না। তখনই দুর্যোধন মিত্রের মনে পড়ল পূরণবাহাদুরের কথা। পূরণই কি যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে? তাহলে পুরণ সমস্ত ঘটনা আনে, তিনি বেল টিপলেন।

দু-মিনিট পরে বেয়ারা এলে বললেন, কেয়ারটেকারকে ডেকে দিতে। হস্তদন্ত হয়ে কেয়ারটেকার ঘরের দরজায় পৌঁছালে তিনি খাট থেকে নেমে দাঁড়ালেন, 'এই বাড়িতে পুরণবাহাদুর নামের কোনও ড্রাইভার ছিল?'

'হ্যাঁ স্যার।'

'আশ্চর্য! আমি তাকে চিনতে পারছি না কেন?'

'ও ম্যাডামের একটা গাড়ি চালাত।'

'অ। ওকে ছাড়িয়ে দিয়েছ কেন?'

একটু চুপ করে থেকে কেয়ারটেকার বলল, 'ও খুব বাড়াবাড়ি করছিল। ম্যাডাম ওকে স্নেহ করত বলে কাউকে কেয়ার করত না। যেদিন ম্যাডাম চলে যান সেদিন আমাদের এক নতুন অল্পবয়সি মেডসার্জেন্টের শ্লীলতাহানি করার চেষ্টা করে। অন্য কর্মচারীদের শান্ত করতে বাধ্য হয়েই ওকে ছাড়াতে হয়েছে।'

'আচ্ছা।'

'ও কোথায় আছে জানো?'

'জানি স্যার। এমপি সাহেবের ফ্যামিলির গাড়ি চালাচ্ছে। এখান থেকে যাওয়ার পরে ও

বোধহয় ম্যাডামকে ফোন করে নিজেকে নির্দেক বলে। ম্যাডাম আমাকে ফোনে বলেন, ওঁকে না জানিয়ে ছাড়িয়ে দিয়ে ঠিক করেননি। এর বেশি কিছু বলেননি বলে আমি আপনাকে জানাতে চাইনি।

অবশ্য তার পরেই ও এমপি সাহেবের বাড়িতে কাজ পেয়ে গিয়েছিল।'

'তারপর ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল কোথাও।

'হ্যাঁ স্যার। একদিন বাজারে দেখা হয়েছিল। ব্যঙ্গ করে বলেছিল, ম্যাডাম যতদিন থাকবেন ততদিন ওর কাজের অভাব হবে না। তেমন হলে ও দিল্লিতে গিয়েও কাজ করতে পারে।'

'ঠিক আছে। তুমি যাও।"

কেয়ারটেকার চলে গেলে ওসিকে ফোন করলেন দুর্বোধন মিত্র, 'জেরা হল?' 'না স্যার। এমপি সাহেব বিল্লি চলে গিয়েছেন। ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।' 'পূরণবাহাদুর?'

'অদ্ভুত ব্যাপার স্যার। সে নাকি চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না।'

'ওর বাড়ির লোকজন?'

'নেপালের কোনও একটা গ্রামে ওর বাড়ি। এখানে কেউ নেই।'

ফোন কেটে দিলেন দুর্যোধন মিত্র।

ঠিক বিকেল পাঁচটায় হাসপাতালে পৌঁছালেন কৃষ্ণা মিত্র। সোজা রিসেপশনে গিয়ে জানতে চাইলেন সুন্দর মিত্রকে তিনি কোথায় গেলে দেখতে পাবেন। সে অ্যাকসিডেন্টে আহত হয়ে গতকাল ভরতি হয়েছে। রিসেপশনিস্ট কম্পুটারে দেখে নিয়ে বলল, 'উনি থার্ড ফ্লোরে, আট নহয় কেবিনে আছেন। কিন্তু ম্যাডাম, আপনি ওঁর কে হন?'

'ওয়েল, আমি ওর স্টেপ মাদার।'

'আপনার সঙ্গে যদি কার্ড থাকে তাহলে দেখতে যেতে পারেন।'

'কার্ড? কীসের কার্ড?' অবাক হলেন কৃষ্ণা মিত্র।

'আমাদের অনুরোধ করা হয়েছে হাসপাতাল থেকে ইস্যু করা কার্ড ছাড়া কেউ ওই কেবিনে ঢুকতে পারবেন না। সিকিউরিটি অফিসাররা সেই কার্ড পরীক্ষা করবেন।'

'মাই গড। এসব কেন?'

'মাপ করবেন ম্যাডাম, এর বেশি কিছু আমি জানি না।'

'ওয়েল, আমাকে একটা কার্ড দিন।'

'ম্যাডাম, মাত্র তিনটে কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। দুটো ডাক্তার আর নার্স আর একটা পেশেন্টের গার্জেনের জন্যে। আপনি সেই কার্ডটা ব্যবহার করতে পারেন।'

রিসেপশন থেকে সরে এসে ভার্গবকে ফোন করলেন কৃষ্ণা মিত্র। বেজে যাচ্ছে, যেন অনন্তকাল বেজে যাচ্ছে কিন্তু বদমায়েসটা ফোন অন করছে না। হঠাৎ মরিয়া হয়ে গেলেন কৃষ্ণা মিত্র। লিফটে চড়ে থার্ড ফ্লোরে উঠে এলেন তিনি। আট নম্বর কেবিনের দিকে এগোতেই একজন স্বাস্থ্যবান লোক হাত বাড়িয়ে তাঁকে থামাল, 'ম্যাডাম, কার্ড দেখাইয়ে।'

'কার্ডের দরকার নেই। আমি পেশেন্টের মা।'

'সরি ম্যাডাম আপনি যেই হোন, কার্ড ছাড়া ভেতরে যেতে দিতে পারব না। আর্শন কার্ড নিয়ে আসুন।'

'ভেতরে কেউ আছে? মানে, পেশেন্টের কাছে আর কেউ আছে?' 'সরি ম্যাডাম, এই ব্যাপারে আপনাকে কোনও খবর দিতে পারবই না।'

কৃষ্ণা মিত্র সোজা হাসপাতালের অ্যাডমিনিস্ট্রেটারের ঘরে চলে এলেন। নিজের পরিচয় দিয়ে উত্তেজিত গলায় বললেন, 'আমার ছেলের সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না, আমি আপনাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারি, তা জানেন?'

'এক মিনিট' বলে অ্যাডমিনিস্ট্রেটার কাউকে ফোন করে ব্যাপারটা জেনে নিয়ে বললেন, 'আপনাকে মামলা করতে হলে মিস্টার দুর্যোধন মিত্রের বিরুদ্ধে করতে হবে। তিনি জানিয়েছেন, পেশেন্টকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল। ওটা সাধারণ অ্যাকসিডেন্ট নয়। পুলিশ এনক্যুয়ারি করছে। পেশেন্টের বাবা হিসেবে মিস্টার মিত্র ভয় পাচ্ছেন এই হাসপাতালেও ওর ওপর আক্রমণ হতে পারে। তাই কড়া নিরাপত্তার মধ্যে পেশেন্টকে রাখা হয়েছে।'

'খুন করার চেষ্টা হয়েছিল।'

'নর্থ বেঙ্গলের পুলিশও তাই জানিয়েছে।' অ্যাডমিনিস্ট্রেটার জিজ্ঞাসা করলেন, 'পেশেন্টের যা বয়স তাতে মনে হচ্ছে আপনি ওর নিজের মা নন।'

'ওয়েল, আমি স্টেপ মাদার।'

'ম্যাডাম, আপনি মিস্টার মিত্রের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করুন।'

বাড়িতে ফিরে এসে কৃষ্ণা মিত্র আবার ভার্গবকে ফোন করলেন। এবারও রিং হয়ে গেল। লোকটা ইচ্ছে করেই তাঁর ফোন ধরছে না। সামনে কাজের মেয়েটি এসে দাঁড়াল, 'কফি দেব।' 'না তোমার মোবাইলটা দেখি।'

মেয়েটি অ্যাপ্রনের পকেট থেকে তার মোবাইল ফোন বের করে দিসে তিনি চোখ ছোট করলেন, এত সম্ভার মোবাইল ফোন কখনও ছুঁয়ে দ্যাখেননি তিনি। ভার্গবের নাম্বার ডায়াল করে কানের থেকে একটু দূরে ধরলেন যাতে রিং শোনা যায়। রিং হচ্ছে। এবারও ফোনটা অন করল না ভার্গব। মোবাইল ফোন ফিরিয়ে দিয়ে চিন্তায় পড়লেন কৃষ্ণা মিত্র। ভার্গবের হলটা কি? তাঁকে এড়াতে চেয়েছে বলে চেনা নাম্বারের ফোন সে ধরেনি। কিন্তু এই নাম্বারটা তো ওর অচেনা। এটা ধরল না কেন? অসুস্থ হয়ে পড়ল নাকি? তার পরেই খেয়াল হল। ভার্গবের তো আজই ফিরে যাওয়ার কথা। হয়তো ফ্লাইটে ছিল, এখন গাড়িতে আছে, শুনতে পাচ্ছে না।

আজ মেজাজ গরম ছিল। অপমানের জ্বালা ভুলতে পারছিলেন না মিসেস কৃষ্ণা মিত্র। টিভির সামনে বসে যখন তাঁর তিনটে হুইস্কি খাওয়া হয়ে গেল তখন মোবাইল বেজে উঠল। ঋণ করে সেটা ধরে নাম্বার না দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, 'হ্যালো?"

'ম্যাডাম। ভার্গব বলছি, আপনি আমাকে ফোন করেছিলেন—!' 'এবং, আপনি সেটা ধরেননি। এত সাহস পান কী করে?"

'সরি ম্যাডাম। আমি তখন সুন্দরের কেবিনে ছিলাম। মোবাইল সাইলেন্ট মোডে রাখা ছিল, পেশেন্টের কেবিনে মোবাইল ব্যবহার করা নিষেধ।'

'আপনি সেখানে কতক্ষণ ছিলেন।'

'এইমাত্র বেরিয়েছি। ডাক্তার একটু দেরিতে কেবিনে এসেছিলেন।'

'মিস্টার ভার্গব, সুন্দরের কেবিনের সামনে সিকিউরিটি গার্ড রাখা কার আইডিয়া।'

'ম্যাডাম, আমার নয়।'

'আপনি কি জানেন আজ আমাকে ওই কেবিনে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।'

'দুঃখিত ম্যাডাম। কিন্তু এই ব্যাপারটা আমার এক্তিয়ারে নেই।' ফট করে লাইন কেটে দিলেন কৃষ্ণা মিত্র।

আরও এক পেগ খাওয়ার পর প্রচন্ড রেগে গিয়ে দুর্যোধন মিত্রের নাম্বার টিপলেন তিনি। শুনলেন ফোনের সুইচ অফ করে রেখেছেন দুর্যোধন মিত্র। ল্যান্ড লাইনে ফোন করলেন বাধ্য হয়ে। একটু পরে গলা শুনতে পেয়ে চেঁচিয়ে বললেন, 'সাহেবকে মোবাইল অন করতে বলো।' লোকটি বিব্রত গলায় বলল, 'ম্যাডাম সাহেব ঘুমিয়ে পড়েছেন।'

লীলার বাবার অপারেশন ভালোভাবে হয়েছিল। খুব দ্রুত সেরে উঠছেন ভদ্রলোক। কিন্তু হঠাৎই তাঁর বুকে নতুন করে ব্যথা শুরু হল। আবার তাঁকে হাসপাতালে ভরতি করার পর দেখা গেল অবশিষ্ট টাকাতে চিকিৎসা চালানো সম্ভব নয়। এদিকে অফিস তাকে জানয়ানি ছুটি বাড়ানো সম্ভব হবে কিনা। এত অল্পদিন চাকরি করলে অফিস থেকে লোন পাওয়াও সম্ভব নয়। লীলা কী করবে বুঝতে পারছিল না। ওর মা মনে করিয়ে দিলেন সুন্দরের কথা।

সুন্দর নিজে উদ্যোগী হয়েছিল তাদের কলকাতায় পাঠাতে, বাবার চিকিৎসা করাতে। এ কথা লীলার কাছে পরিষ্কার যে সুন্দর তার সম্পর্কে অত্যন্ত দুর্বল। কিন্তু জুনিয়ার মিত্র সম্পর্কে সে অনেক কথা শুনেছে হিলটপে চাকরিতে যোগ দিয়ে। লোকটা খুবই মদ্যপ, মেয়েঘটিত ব্যাপারে চূড়ান্ত বদনাম আছে। ওর বাবা দুর্যোধন মিত্রের কোনও গুণই সে পায়নি লীলা শুনেছে, ছেলের হালচাল দেখে দুর্যোধন মিত্র তাঁর বিশাল সম্পত্তির কথা ভেবে আবার বিয়ে করেছেন। সেই মহিলা যদিও বয়সে ওঁর থেকে অনেক ছোট কিন্তু দারুণ সুন্দরী।

সুন্দর সম্পর্কে শোনা কথাগুলো লীলাকে ভীত করেছিল। হিলটপেই সুন্দর থাকে, হিলটপ দেখাশোনার দায়িত্ব মিস্টার ভার্গবের সঙ্গে সুন্দরের। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, সুন্দর কখনই তাকে বিরক্ত বা বিব্রত করেনি। ও যে তাকে পছন্দ করে সেটা লীলা বুঝেছিল। সুন্দরী মেয়েদের দিকে ছেলেরা তাকায় এবং তাতে সে অভ্যন্ত। কিন্তু ওই দেখা অবধি থেমেছিল সুন্দর। তার বাবার অসুখের খবর পেয়ে সে যে দার্জিলিং-এ ছুটে আসবে তা ভাবতে পারেনি লীলা। যে সুন্দর এল সে যেন আলাদা মানুষ। যেন তার অনেককালের বন্ধু। তার সঙ্গে ওই বদনামি সুন্দরের কোনও মিল নেই। তবু ওর সাহায্য নিতে অস্বস্তিতে ছিল লীলা। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে নিতে বাধ্য হয়েছিল, কলকাতায় আসার পরে ভয় হচ্ছিল লোকটা যদি চলে আসে। কিন্তু সুন্দর আসেনি। শুধু আসেনি নয়, কোনও যোগাযোগ রাখেনি। সে নিজেই ওকে ফোন করে পৌঁছ সংবাদ দিয়েছিল, সেটা পেয়েও কোনও উত্তেজনা দেখায়নি সুন্দর।

লীলার মামা বললেন, 'দ্যাখ, আমার তো টাকাপয়সা খুব বেশি নেই। ডাক্তাররা বলছে, আর একটা অপারেশন তোর বাবাকে করতে হবে। অপারেশন না করলে হয়তো বছরখানেক উনি এভাবেই বেঁচে থাকতে পারেন। কী করবি?'

লীলা দু-হাতে মুখ ঢাকল, 'ভাবতেই পারছি না মামা।'

লীলার মা বললেন, 'তুই সুন্দরকে বল। ওর কাছে এটা কোনও টাকাই নয়। তুই বল মাইনের টাকা থেকে ধীরে ধীরে শোধ করে দিবি।'

মামা বললেন, 'এ ছাড়া তো তোর বাবাকে বাঁচানোর কোনও পথ নেই। লজ্জা করিস না।' শেষ পর্যন্ত বাধ্য হল লীলা। সুন্দরের নাম্বার ডায়াল করতেই কানে এল, 'সুইচ অফ।' গোটা দিনে বার পনেরো চেষ্টা করেও অন্য কোনও কথা সে শুনতে পেল না, রিং হওয়া তো দূরের কথা। শেষ পর্যন্ত হিলটপের রিসেপশনিস্ট লিলি কাপুরকে ওর ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন করল লীলা।

লিলি কাপুরের তখন ডিউটি ছিল না। হিলটপের স্টাফ কোয়াটার্সে বসে টিভি দেখছিল সে। এবার গলা শুনে জিজ্ঞাসা করল, 'এই! কেমন আছ তুমি?'

'ভালো নয়। বাবা খুব অসুস্থ।'

'ওহো!'

'আমার ছুটির ব্যাপারটার কি হল, জানো?'

'না। মিস্টার ভার্গব আজ দিল্লি থেকে ফিরলে জানা যাবে।'

'তোমাদের সব খবর 'ভালো?'

'এমনিতে সব ঠিকই আছে শুধু, তুমি কি সুন্দর মিত্রের কথা শোনোনি?"

'না। কী হয়েছে?'

'ওকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।'

'কেন?' অবাক হল লীলা।

'অ্যাকসিডেন্ট। আবার কেউ কেউ বলছে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল।'

'সেকী! কবে?' সীলা এবার উত্তেজিত।

দার্জিলিং-এ গিয়েছিল। বিকেলে ফিরে আসছিল। আসার পথে পাহাড়ের বাঁকে নাকি একটা সুমো গাড়ি ধাক্কা দেয়। সন্ধে হয়ে যাওয়ার পর ওকে উদ্ধার করা হয়। তারপর নীচের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে দিল্লিতে ট্রান্সফার করেছে। অত ওপর থেকে গাড়িসমেত পড়ে গিয়েও মির‍্যাকলি বেঁচে গেছে সুন্দর।'

'কবে হয়েছিল ঘটনাটা?' নিস্তেজ গলায় বলল লীলা।

যে তারিখটা বলল সেই তারিখেই সুন্দর তাদের এয়ারপোর্টে এসে সি-অফ করে ফিরে গিয়েছিল। তারপর তারা প্লেন ধরে কলকাতায় যায়।

'এখন কেমন আছে?'

'এখানে খবরটা আসেনি। মিস্টার ভার্গব এসে যদি বলেন তাহলে জানতে পারব?'

'কোন হাসপাতালে আছে সুন্দর?'

লিলি হাসপাতালের নাম বলে হাসল। তোমাকে যেন একটু বেশি ইন্টারেস্টড লাগছে?'

'না না। পরিচিত মানুষের অসুস্থতার কথা শুনলে মন খারাপ হয়। রাখছি।' লাইন কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল সে। হঠাৎ খেয়াল হতেই মোবাইল অন করে ডায়ালড নাম্বারগুলো দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে পেয়ে গেল সুন্দরের নাম্বারটা। সে ফোন করেছিল ঠিক সন্ধে পাঁচটা ছেচল্লিশে। তখন সূর্যের ডুবে যাওয়ার কথা। অথচ লিলি বলল বিকেলে দুর্ঘটনা ঘটেছিল এবং সন্ধের পর সুন্দরকে উদ্ধার করা হয়। তাহলে সম্বের সময় সুন্দর তার সঙ্গে কথা বলল কী করে? যে গাড়িতে বসা অবস্থায় ওপরের রাস্তা থেকে নীচে পড়ে গেল তার পক্ষে তো বেঁচে থাকাই সম্ভব নয়। সীলা স্পষ্ট মনে করতে পারল সুন্দরের শেষ কথাগুলো, 'আমি ঠিক আছি। কাল ফোন করব? যদিও পরের দিন শুধু নয় এই কয়েকদিনেও সুন্দরের ফোন আসেনি, কিন্তু আহত মানুষও অমন স্বাভাবিক গলায় কথা বলতে পারে না। সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে রহস্য অনুমান করল লীলা। কিন্তু কিছুই যদি সুন্দরের না হয়ে থাকে তাহলে হাসপাতালের ডাক্তাররা কেন দিল্লিতে নিয়ে যেতে বলবে? দিল্লির ডাক্তাররা কেন ভরতি করে নেবে? ভার্গব সাহেবই বা কেন দিল্লিতে যাবেন? তার কেবলই মনে হতে লাগল এই সব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র সুন্দরই দিতে পারে।

ক্রমশ মনে ভার অমল। যে মানুষটা তাদের এতটা উপকার করল সে এখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে। মানবিকতার কারণে তার উচিত সুন্দরকে দেখতে যাওয়া। যদিও সে ওখানে গিয়ে কিছুই করতে পারবে না, তবু-।

সন্ধের পরে লীলা হিলটপে ফোন করে জানতে পারল মিস্টার ভার্গব সিরে এসেছেন। সে কথা বলতে চাইলে অপারেটার মিস্টার ভার্গবের সেক্রেটারিকে লাইন দিল, ভদ্রমহিলা কথা বলে মিস্টার ভার্গবকে জানালে তিনি লাইনে এলেন, 'ইয়েস।'

'স্যার আমি লীলা, রিসেপশনিস্ট।'

'ওয়েল লীলা তোমার ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছে। যে ক'দিন চাকরি করেছ তার জন্যে যা ছুটি পাওনা হয় তার চেয়ে বেশি ছুটি তুমি নিয়ে ফেলছ, তোমাকে তিনদিনের মধ্যে জয়েন করতে হবে। আর কিছু?' নির্লিপ্ত গলায় বললেন মিস্টার ভার্গব।

'আমি জানি স্যার। কিন্তু আমার বাবা আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাঁকে আবার হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে। এবার বড়সড় অপারেশন করতে হবে। বাবার একমাত্র সন্তান আমি। আপনি প্লিজ বোঝার চেষ্টা করুন, এই অবস্থায় আমি ওঁকে একা ফেলে যাই কী করে? আবার এই চাকরিটা আমার খুব দরকার। চাকরি চলে গেলে আমাদের জীবনে অন্ধকার নেমে আসবে। স্যার, আমি এসব ভাবতে গিয়ে মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব কী যে করি!' লীলার গলা বন্ধ হয়ে গেল।

শ্বাস ফেললেন মিস্টার ভার্গব, 'আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তোমাকে উইথ পে ছুটি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, যে-কোনও চাকরির মিনিমাম কিছু নিয়ম আছে। আমি তোমার কনো একটা সুবিধে দিচ্ছি। তোমার বাবার অসুখের জন্যে আমরা দুই মাস অপেক্ষা করতে পারি। এই দুই মাসের মধ্যে তিনি সুস্থ হোন বা না হোন তুমি ষাট দিনের মাথায় জয়েন করবে। তার আগে যদি পারো নাথিং বেটার দ্যান দ্যাট। তবে যতদিন ছুটিতে থাকবে ততদিন তুমি উইদআউট পে হয়ে থাকবে। রাইট।' মিস্টার ভার্গব জিজ্ঞাসা করলেন।

'ঠিক আছে স্যার। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।'

হঠাৎ মিস্টার ভার্গবের মনে কয়েকটা প্রশ্ন উকি মারতে সঙ্গে সঙ্গে সেটা কৌতূহলে রূপায়িত হল। লীলা বলল, 'স্যার, আমি রাখছি।'

'দাঁড়াও! তোমার ফোন নাম্বারটা আমাকে বলো।'

লীলা মোবাইল নাম্বার বলার পর লাইন কেটে দিলেন মিস্টার ভার্গব।

কাগজে লিখে নেওয়া দশটা সংখ্যার দিকে তাকালেন মিস্টার ভার্গব। জলীলার কোন এসেছিল

অপারেটার-সেক্রেটারির টেবিল ঘুরে। ওদের দুজনের কেউ যে কান পেতে এতক্ষণ কথা শুনছিল না তার কোনও স্থিরতা নেই।

মিস্টার ভার্গব নিজের মোবাইলের নাম্বার টিপলেন। লীলার মোবাইল বাজছে। তারপরেই ওর গলা শোনা গেল। মিস্টার ভার্গব বললেন, 'লীলা, মিস্টার ভার্গব বলছি। জেনারেল লাইনে তোমার সঙ্গে কয়েকটা বিষয়ে আলোচনা করতে চাইনি। তাই-।

'হ্যাঁ, স্যার, বলুন।'

'তুমি নিশ্চয়ই জানো সুন্দর একটা ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় পড়েছিল।'

'আমি জানতাম না স্যার। আত্মই শুনলাম।"

'শুনে তোমার কি প্রতিক্রিয়া হল।

'আমার খুব খারাপ লাগছে স্যার।'

'শুধু খারাপ লাগছে?'

একটু চুপ করে থেকে লীলা বলল, 'আমার পক্ষে এর বেশি বলা সম্ভব নয়।'

'হুম"।

'উনি এখন কেমন আছেন স্যার?'

'আই ডোন্ট নো। ডাক্তাররা স্পষ্ট বলছে না। আচ্ছা, আমরা জেনেছি ও তেমার সঙ্গে দেখা করতে দার্জিলিং-এ গিয়েছিল। পুলিশ তোমার সঙ্গে কথা বলতে সেখানে যায় কিন্তু তোমাদের বাড়ি তালাবন্ধ ছিল। লোক্যাল পিপল বলেছে তোমরা চিকিৎসার জন্যে কলকাতা গিয়েছ। যাকগে, তুমি

সুন্দরকে শেষ দেখেছ কোথায়?' '

স্যার, উনি বাগডোগরা এয়ারপোর্টে সি-অফ করতে এসেছিলেন।'

'তোমরা প্লেনে গিয়েছিলে কলকাতায় ?'

'হ্যাঁ, স্যার। উনিই জোর করে টিকিট কিনে দিয়েছিলেন। বাবার শরীরের অবস্থা দেখে ওঁর

মনে হয়েছিল ট্রেনে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।' লীলা বলল। 'তুমি কি ওকে দার্জিলিং-এ যেতে বলেছিলে?'

'না স্যার, আমি ভাবতেই পারিনি উনি দার্জিলিং-এ আসবেন।'

'তুমি কি এখান থেকে যাওয়ার আগে ওকে দার্জিলিং-এ যাচ্ছ বলে গিয়েছিলে?'

'না স্যার। হিলটপে চাকরির সময় আমি কখনও ওঁর সঙ্গে কথা বলিনি।'

'এটা কি বিশ্বাসযোগ্য লীলা? যার সঙ্গে তুমি কখনও কথা বলোনি, যার স্ট্যাটাসের সঙ্গে তোমার কোনও তুলনাই চলে না, সে শুধু তোমার বাবা অসুস্থ গুনে এতটা পথ একা ড্রাইভ করে চলে গেল? শুধু গেল না, তোমাদের প্লেনের টিকিট কেটে কলকাতায় পাঠাল? কেউ বিশ্বাস করবে?'

'স্যার আমিও ভাবতে পারিনি।'

'এয়ারপোর্টে ওর সঙ্গে কেউ ছিল?'

'না স্যার। ওহো! মনে পড়েছে। আমরা যখন এয়ারপোর্টে যাচ্ছিলাম তখন আপনি আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি তখন আপনাকে প্লেনে যাওয়ার ব্যাপারটা জানাই, আপনার নিশ্চয়ই মনে পড়ছে?'

'হ্যাঁ। পড়ছে। দার্জিলিং-এ সুন্দর কোথায় ছিল? তোমাদের বাড়িতে?'

'না স্যার। উনি সকালে ঝড়ের মতো আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন।'

'আচ্ছা লীলা, সুন্দর কি তোমাকে কিছু বলেছিল? কোনও আশংকার কথা। কেউ তাকে ফলো করছে কিনা-এইসব?'

'না স্যার। লীলা বলল, ওঁকে খুব স্বাভাবিক দেখেছিলাম।'

'লীলা তোমার কি মনে হয়, কেন সে আচমকা তোমাদের সাহায্য করল?"

'এটা ওর মহানুভবতা বলে মনে হয়েছে।'

'ও কি তোমাকে কোনও অ্যাপ্রোচ করেছে? আই মিন, আবেগের কথা-।'

'না স্যার।'

'তোমার সঙ্গে ওর শেষ কথা তাহলে এয়ারপোর্টেই হয়?

'না স্যার। আমার সঙ্গে টেলিফোনেও কথা বলেছিলেন।'

'টেলিফোনে? কখন? প্লেনে তো ফোন ব্যবহার করতে দেয় না।'

'আমরা কলকাতায় পৌঁছাবার পরে ওঁর সঙ্গে কথা বলি।'

'মাই গড। সেটা কখন?' মিস্টার ভার্গব সোজা হয়ে বসলেন।

'সন্ধের একটু পরে। সময়টা পাঁচটা ছেচল্লিশ।'

ইম্পসিবল। তার আগেই অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেছে।' মিস্টার ভার্গব বললেন, 'একটা মানুষ ওপরের রাস্তা থেকে গাড়িতে বসা অবস্থায় নীচের খাদে পড়ে গেলে বেঁচে থাকার কথা ভাবাই যায় না। যদি বা বাঁচে তাহলে তার জ্ঞান থাকবে না, হাড়গোড় ভেঙে যাবে। সে তোমার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলবে কী করে?'

'স্যার। উনি কথা বলেছিলে। মোবাইলটা অনেকক্ষণ ধরে বেজেছিল। তারপর ওঁর গলা শুনতে পেয়ে আমি পৌঁছ সংবাদ দিয়েছিলাম। এঁর গলার স্বর শুনে আমি প্রশ্ন করায় বলেছিলেন, 'আমি ঠিক আছি। কাল ফোন করব। তখন একবারও মনে হয়নি উনি ভয়ঙ্কর আহত।'

'তুমি সত্যি কথা বলছ?'

'হ্যাঁ স্যার। আমার মোবাইলে ওঁর ওই সময়ের নাম্বার স্টোর করা আছে।'

'ও.কে। থ্যাঙ্ক ইউ লীলা। আমি প্রার্থনা করছি যাতে তোমার বাবা দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। দরকার হলে আবার যোগাযোগ করব।'

'একটা কথা বলব স্যার?'

'ইয়েস।'

'আমি কি অফিস থেকে লোন পেতে পারি? বাবার অপারেশনের জন্যে।'

'আমি কাল তোমাকে জানাব। বাই।'

এয়ারপোর্ট থেকে সোজা হসপিটালে চলে এসেছিলেন দুর্যোধন মিত্র। প্লেন থেকে নেমে বাইরে বেরুতেই ভার্গবের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। দ্রুত কিছু বলে, স্পেশ্যাল ভিজিটিং কার্ডটা দিয়ে 'ভার্গব ছুটেছিল তার ফ্লাইট ধরতে।

ছেলের বিছানার পাশে বসে নিজেকে নিরাসক্ত রাখার চেষ্টা করলেন দুর্যোধন মিত্র। মুখ ব্যান্ডজে মোড়া। দুটো হাতেও ব্যান্ডেজ। নাকের অক্সিজেনের নল আপাতত খোলা কিন্তু স্যালাইন চলছে। চোখেও ব্যান্ডেজ। বাকি শরীরটা কম্বলে ঢাকা।

নার্স পাশে এসে বললেন, 'আপনার ছেলে?'

মৃদু মাথা দোলালেন দুর্যোধন মিত্র।

'অদ্ভুত ফাইটিং স্পিরিট। অন্য কোনও ছেলে হলে দিল্লিতে নিয়ে আসা যেত কিনা সন্দেহ। কাল রাত থেকে চমৎকার ইমপ্রুভমেন্ট হচ্ছে। জ্ঞান আসছে, চলে যাচ্ছে। ডাক্তার আশা করছেন আজ থেকে স্টেডি হবেন।' নার্স বললেন।

'কথা বলেছে?'

'বোঝা যায়নি। মে বি আমি বাংলা ভাষা জানি না বলে বুঝতে পারিনি। মনে হয় কাল আমরা ওকে বুঝতে পারব।'

'ওর চোখে ব্যান্ডেজ কেন?'

'হেমারেজ হয়েছিল। কিন্তু ওগুলো ক্লিয়ার হয়ে যাবে।' নার্স সরে গেল সামনে থেকে! দুর্যোধন মিত্র দেখলেন ঘরের লাগোয়া টয়ল্টে বাথরুম আছে। এই ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সিকিউরিটির মুখোমুখি হতে হবে। আজ তাঁকেও ওরা আটকেছিল। কার্ড দেখার পর আইডেন্টিটি কার্ড দেখে নামের সঙ্গে ছবি মিলিয়ে নিয়েছিল। তারপর ওদের কাছে যে ভিজিটার লিস্ট আছে তার সঙ্গে আবার চেক করার পর ভেতরে আসতে দিয়েছিল সর্বাঙ্গ সার্চ করার পরে। হসপিট্যাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ভার্গব এই ব্যবস্থা করে গেছে। খুশি হয়েছেন দুর্যোধন মিত্র। ভার্গবের ওপর আস্থা বেড়ে গেল।

চেয়ার ছেড়ে উঠে টয়লেটে গেলেন দুর্যোধন মিত্র। ওপাশে একটা দরজা। আর সেই দরজাটা বন্ধ। বন্ধ করা হয়েছে ওধার থেকে। অর্থাৎ ওথায় থেকে দরজা খুলে যে কেউ এই টয়লেটে ঢুকতে পারে। অস্বস্তি হচ্ছিল তাঁর। ভার্গবের এটা দেখা উচিত ছিল। দরজাটা এধার থেকে বন্ধ করার ব্যবস্থা থাকা উচিত।

তিনি বেডের কাছে চলে আসতেই দেখলেন নার্স সুন্দরের টেম্পারেচার দেখছেন দেখা হয়ে গেলে ভদ্রমহিলা যখন নোট করছেন তখন সমস্যাটা ওকে বললেন দুর্যোধন মিত্র।

নার্স বেশ অবাক হয়ে গেলেন প্রথমে। তারপর বললেন, 'এটা জমাদারের যাওয়া আসার পথ। রোজ দুবেলা পরিষ্কার করে যায়। এদিক দিয়ে বন্ধ থাকলে জমাদার আসবে কী করে?' 'একেবারে ঠিক কথা। কিন্তু সেক্ষেত্রে বাইরে সিকিউরিটি থাকলেও এই ঘরে লোক ঢুকতে পারে যার হাতে আমার ছেলের পরিণতি খারাপ হবেই।'

'আমি ভাবিনি স্যার। দাঁড়ান।' পকেট থেকে একটা ওয়াকিটকি বের করে কাউকে নার্স অনুরোধ করলেন আসার জন্যে। আর তখনই সুন্দর একটা কাতর শব্দ উচ্চারণ করল যার কোনও অর্থ নেই। দূর্যোধন কাছে এগিয়ে গেলেন, 'ইয়েস সুন্দর, আমি এখানে। তোমার পাশে। এভরিথিং উইল বি অলরাইট।'

আবার ঘুমে তলিয়ে গেল সুন্দর। হসপিটালের কেয়ারটেকার এসেছেন, বাইরের সিকিউরিটি জানাতে এঁরা বাইরে এলেন। দুর্যোধন মিত্র সমস্যার কথা জানাতে লোকটি বললেন, 'ওই দরজায় তালাচাবি দেওয়া আছে। যে কেউ ঢুকতে পারবে না।'

'যারা ঢুকতে চায় তাদের কাছে কোনও তালাচাবি বাধা হতে পারে না। আপনারা যদি ব্যবস্থা না করেন তাহলে কিছু ঘটে গেলে-' শেষ করলেন না দুর্যোধন মিত্র।

আধঘন্টার মধ্যে দরজার এদিকেও খিল, ছিটাকানি লাগিয়ে দেওয়া হলে স্বস্তি পেলেন দুর্যোধন। জমাদার এসে নক করলে তার পরিচয় জেনে নার্স দরজাটা খুলে দেবেন। সিকিউরিটির একজন তখন সেখানে থাকবে।

ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললেন দুর্যোধন মিত্র। ভদ্রলোক বেশ আশাবাদী। বললেন, 'মাথায় চোট তেমন লাগেনি বলেই মনে হচ্ছে সুস্থ হয়ে যাবেন উনি। তবে তিনটি অপারেশন করতে হবে। পাঁজরার হাড় ভেঙেছে। দুটো পায়েই কম্পাউন্ড ফ্র্যাঙ্কার হয়েছে। আপনি একবার অফিসকে কন্টাক্ট করবেন। পুলিশ আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।'

দুযোর্ধন হসপিট্যালের অফিস সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন। ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা করলেন তাকে। ইতিমধ্যে অর্থমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বলা হয়েছে পেশেন্টের স্পেশ্যাল কেয়ার নিতে। পেশেন্ট যে বিশাল শিল্পপতির একমাত্র সন্তান তা তাঁরা জানেন। সুন্দরের ব্যাপারে তিনি দুবেলা খোঁজ নিচ্ছেন।

হি ইজ অল মোস্ট আউট অব ডেঞ্জার। একটা ছোট সমস্যা আছে। সেটা পুলিশকে নিয়ে। দুঘটনায় আহত হয়ে আসা পেশেন্টের কথা, পুলিশকে জানানো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। তাই জানানো হয়েছিল। দুর্ঘটনা যেখানে হয়েছিল সেখানকার পুলিশ তদন্ত করছে জানার পর এঁদের আর কৌতূহল ছিল না। তদন্তকারী পুলিশ অফিসারকে ফোন করে ভেরিফাই করার পর ওরা চুপ করে থাকত। সমস্যা তৈরি হল মিস্টার ভার্গব যখন সিকিউরিটির ব্যবস্থা করলেন। স্পেশ্যাল কার্ড ছাড়া কাউকে পেশেন্টের কাছে যেতে দেওয়া হচ্ছে না মানে পেশেন্ট পার্টি ভয় পাচ্ছে পেশেন্টের ওপর অ্যাটাক হতে পারে। যেহেতু দিল্লিতে পেশেন্ট রয়েছে তাই পুলিশ এ ব্যাপারটা নিয়ে বিশদে কথা

বলতে চাইছে।'

দুর্যোধন মিত্র বললেন, 'নিশ্চয়ই। আমার কথা বলতে আপত্তি নেই।'

'আপনি কোথায় উঠেছেন।'

হোটেলের নাম বললেন দুর্যোধন মিত্র। বললেন, 'আজকের সন্ধে আমি হোটেলেই থাকব। ফোন করতে বলবেন প্লিজ।'

সন্ধে সোওয়া সাতটায় রিসেপশন থেকে জ'নাঙ্গ একজন পুলিশ ইন েপকটার তাঁর সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন। পাঠিয়ে দিতে বললেন দুর্যোধন মিত্র।

ইনস্পেকটার মধ্যবয়স্ক। সামনে বসে ধানাই পানাই না করে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলেন, 'আপনার কি মনে হচ্ছে সুন্দরের গাড়ির খাদে পড়ে যাওয়া দুর্ঘটনা নয়?'

'হ্যাঁ। আমরা লোকাল থানায় সেই রকম ডায়েরি করেছি।'

'আপনার মনে হচ্ছে দিল্লির হাসপাতালেও সে নিরাপদ নয়?'

'এটা খুব স্বাভাবিক।'

'কেন?'

যারা ওকে খুন করার চেষ্টা করেছিল তারা চাইবে না ও মুখ খুলুক। কথা বলতে পারলে পুলিশ হয়তো খুনির কথা জানতে পারবে।'

'কিন্তু স্যার আপনারা যে শহরে থাকেন সেটা একটা সাধারণ ছোট পাহাড়ি শহর। সেখানে যারা খুন করতে চেষ্টা করেছিল তারা দিল্লিতে কী করে সক্রিয় হবে। সেই ক্ষমতা কী করে পাবে?' ইনস্পেকটার জিজ্ঞাসা করলেন।

'আপনি নিশ্চয়ই এই প্রবাদটা শুনেছেন, পঙ্গুও প্রাণের দায়ে পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া খুনিদের যে দিল্লিতে যোগাযোগ নেই তা তো আমি জানি না। হয়তো খুব শক্তিশালী আন্ডারওয়ার্ল্ডের দল ওদের সঙ্গে আছে।'

'আই সি' একটু ভাবলেন ইনস্পেকটার, 'অপনার কী কোনও ধারণা আছে, ওকে খুন করে

খুনিদের কি লাভ হবে?'

'স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে যারা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে খুন করতে চেয়েছিল তারা টাকা নিয়েছিল।

এ ছাড়া কোনও স্বার্থ নেই।'

'তার মানে কেউ ওদের পাঠিয়েছিল?'

শ্যই। তবে ওদের নয়, একজনই গিয়েছিল গাড়ি নিয়ে। সে-মারা গিয়েছে।'

তাবে?

তাকে মেরে ফেলা হয়েছে?'

র খুনি ধরা পড়েছে?'

যতদূর জানি, না।'

আপনি কাকে কাকে সন্দেহ করেন?'

হসে ফেললেন দুর্যোধন মিত্র, 'আপনারাই তো বলেন, কেউ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়, তাহলে

সর সন্দেহ করতে হয়।'

'তবু কোনও ব্যক্তিবিশেবকে?'

'নাঃ। মাথা নাড়লেন দুর্যোধন মিত্র।'

'আপনার সন্তান কি এই একটি?'

'হ্যাঁ।'

'আপনার অবর্তমানে সুন্দরই সমস্ত অধিকার পাবে?'

'যদি সে ঠিক পথে চলে।'

'বেঠিক পথে চলার কোনও ইঙ্গিত পেয়েছেন।' 'এটা একেবারেই ব্যক্তিগত প্রশ্ন অফিসার।"

'সরি। আপনার বর্তমান স্ত্রীর সঙ্গে সুন্দরের সম্পর্ক কেমন?'

'আমি তো কোনও বিরোধের কথা শুনিনি।'

মিস্টার মিত্র, আমরা জেনেছি আপনার স্ত্রী এখন দিল্লিতে আছেন। এখানে ওঁর স্থায়ী থাকার জায়গা আছে। সেখানে না থেকে আপনি দিল্লিতে এলে হোটেলে ওঠেন কেন?' ইনস্পেকটার জিজ্ঞাসা করলেন।

'যদিও এটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন, তবু-। ইনস্পেকটার, আমাদের দেশে ছেলেরা স্ত্রী-র বাপের বাড়িতে গেলে তিনরাত্রের বেশি বাস করে না। তা ছাড়া শ্বশুরবাড়িতে যত স্বাচ্ছন্দ থাক, থাকতে গেলে অস্বস্তি হবেই।' হাসলেন দুর্যোধন মিত্র।

মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ইনস্পেকটার 'আমরা জেনেছি আমাদের ফিনান্স মিনিস্টারের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে। আপনাদের ওখানকার এমপি দিল্লিতে বেশ পরিচিত। কিন্তু ছেলের নিরাপত্তার ব্যাপারে এঁদের সাহায্য আপনি নেননি। সাধারণত এরকম হয় না। বিশেষ কারণ আছে কি?"

'অন্যকে বিরক্ত না করে যতটা পারি নিশ্চয়ই চেষ্টা করি।' উঠে দাঁড়ালেন দুর্যোধন মিত্র। ইনস্পেকটার যাওয়ার আগে নিজের কার্ড দিয়ে বলে গেলেন যদি কোনও কিছু জানাবার প্রয়োজন হয় তাহলে তাঁকে যেন দুর্যোধন মিত্র জানান।

রাত সাড়ে ন'টায় দুর্যোধন মিত্র পরিপাটি সেঙ্গে নীচে নামলেন। ঘরে বসে না থেকে রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে পার্টিতে পৌঁছাতেই হই হই করে এগিয়ে এল মিস্টার বিজয় কাপুর। ভারতবর্ষের অন্যতম সিমেন্ট কোম্পানির মালিক কাপুরের সাথে চমৎকার ব্যবসার সম্পর্ক দুর্যোধন মিত্রের। কাপুর বললেন, 'মিস্টার মিত্র, আপনি দিল্লিতে এসেছেন অথচ আমি জানিই না। কী আশ্চর্য

ব্যাপার, কবে এসেছেন?'

আজই। কেমন আছেন?'

ঈশ্বরের ইচ্ছায় খারাপ সময় এখনও আসেনি। যাচ্ছেন কোথায়?'

'তেমন কোনও উদ্দেশ্য নেই।'

'দেন, আমার সঙ্গে চলুন।' হাত ধরলেন কাপুর।

'কোথায়?'

'আমার বন্ধু মিস্টার বনসল একটা অ্যাওয়ার্ড পেরেছেন। তার জন্যে খুব সিলেকটেড কয়েকজনকে ডেকে পার্টি দিচ্ছেন। আপনিও চলুন।'

'সেকী? ভদ্রলোককে আমি চিনি না। আপনি কী করে আশা করছেন একেবারে অনাহুত হয়ে আমি ওই পার্টিতে যাব।' দুর্যোধন মিত্র মাথা নাড়লেন।

মিস্টার কাপুর মোবাইলে কারও সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে জিজ্ঞাসা করলেন, 'কতদিন থাকবেন দিল্লিতে।'

'ঠিক বুঝতে পারছি না'। আমার ছেলে খুব অসুস্থ। ওর এখানে চিকিৎসা চলছে। ও সামান্য সুস্থ হলেই চলে যেতে হবে। আপনি জানেন, ওখানে কাজের চাপ কত?'

'সে তো জানি। রাজধানী ছেড়ে রাজা বেশিদিন বাইরে থাকতে পারে না।'

কাপুরের কথা শেষ হওয়ামাত্র সুবেশ এক প্রবীণ ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, 'ওয়েল কাপুর।'

'বনসল, ইনি মিস্টার মিত্র। নর্থবেঙ্গলে বিশাল ব্যবসা এঁর। আমার অনেকদিনের পরিচিত।

আজ এখানে হঠাৎ দেখা হওয়ায় আমি অনুরোধ করেছিলাম তোমার পার্টিতে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু উনি অনাহুত হয়ে যেতে চাইছেন না।' কথাগুলো বলে হাসলেন বিজয় কাপুর। মিস্টার বনসল করমর্দন করলেন দুর্যোধন মিত্রের সঙ্গে 'মিস্টার মিত্র। কাপুর আর আমি

আলাদা নই। ওর বলা মানে আমার বলা, তবু আমি ইনভাইট করলে যদি আপনি পায়ের ধুলো দেন তাহলে খুশি হব।'

'থ্যাঙ্কস। আজ থাক।'

'দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনি নর্থবেঙ্গলের বিজনেশ টাইকুন মিস্টার দুর্যোধন মিত্র নন তো? যদি

তাই হন তাহলে আপনার সঙ্গে আমার পরোক্ষ পরিচয় আছে।'

'মানে।' অবাক হয়ে গেলেন দুর্যোধন মিত্র।

কাপুর বললেন, 'তোমার অনুমান ঠিক বনসল, উনিই দুর্যোধন মিত্র।'

'ওঃ মাই গড। আপনার স্ত্রী কৃষ্ণা আমার স্ত্রী-র বান্ধবী।'

'আচ্ছা।' দুর্যোধন অস্বস্তিতে পড়লেন।

'ইনফ্যাক্ট কৃষ্ণার আজ পার্টিতে আসার কথা ছিল। কিন্তু দুপুরে উনি আমার স্ত্রীকে যোন করে জানান যে হঠাৎ খুব মাথা ধরেছে। মাঝে মাঝে ওঁর নাকি মাইগ্রেনের অ্যাটাক হয়। ওটা হলে

তো আসা সম্ভব নয়।' বনসল বললেন।

কাপুর জিজ্ঞাসা করলেন, 'মিসেস মিত্র এখন কেমন আছেন?'

'আমি কাল ওঁদের বাড়িতে যাব। আজ এত ব্যস্ত ছিলাম।

'এঁর ছেলের ট্রিটমেন্ট চলছে এখানে, সেকারণে খুব ব্যস্ত। কাপুর বনসলকে জানালেন। বনসল জিজ্ঞাসা করলেন, 'এখন কেমন আছে?'

'একটু বেটার।'

'তাহলে চলুন দশমিনিট থেকে নাহয় চলে আসবেন।' বনসল এমন গলায় অনুরোধ করলেন যে না বলা আর সম্ভব হল না দুর্যোধন মিত্রের পক্ষেও।

ওঁরা হোটেলের সুদৃশ্য যে ঘরে ঢুকলেন সেখানে মৃদুস্বরে বাজনা বাজছে, বেশ কিছু নারীপুরুষ পানীয় গ্লাস হাতে নিয়ে কথা বলছেন। বনসলের ইশারায় ওয়েটার স্কচ নিয়ে গেল দুর্যোধন মিত্র এবং কাপুরকে।

কাপুর বললেন, 'এঁরা সবাই বিখ্যাত শিল্পপতি। দুজন এমপি-কেও দেখছি। ওপাশের সোফায় বসে গল্প করছেন শিল্প দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী।'

নুযোর্ধন মিত্র বললেন, 'বিল্লিতে এটাই সুবিধে। পার্টিতে গেলে অনেককেই মিট করা যায়।' কাপুর হাসলেন, 'মাসে দুবার দিল্লিতে আসুন, তাতে বিজনেস বাড়বে।'

এই সময় বনসল তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এসে দুর্যোধন মিত্রের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। মহিলা একটু স্বাস্থ্যবতী, মুখটি খুব মিষ্টি। বললেন, 'কৃষ্ণাকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি। আপনাদের বিয়ের সময় আমি বিদেশে ছিলাম বলে আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়নি। আমার নাম দিব্যা।'

'খুব ভালো লাগল 'আলাপ করে। প্রথম গ্লাস শেষ করে দ্বিতীয় গ্লাস নিলেনও দূর্যোধন মিত্র। বনসল ও কাপুর তখন অন্য এক অতিথিকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। দিব্যা বললেন, 'আপনি দিল্লিতে এলে হোটেলে ওঠেন, কৃষ্ণাদের বাড়িতে জাস্ট বেড়াতে যান, কৃষ্ণার

মুখে শুনেছি।'

'ঠিক

শুনেছেন।'

'আজ কৃষ্ণা কেন এল না বুঝতে পারছি না। গতকালও ওর সঙ্গে একটা পার্টিতে দেখা হয়েছিল। আপনাদের ওখানকার এক এমপিকে নিয়ে এসেছিল।'

'মিস্টার রামচন্দ্র বণিক।' হাসলেন দুর্যোধন মিত্র।

'হ্যাঁ, বেশ ভালো মানুষ। তখনও কৃষ্ণা বেশ গম্ভীর ছিল কিন্তু বলেনি ওর মাইগ্রেনের পেইন

শুরু হয়েছে।'

'আমি

আপনার কথা এঁকে বলব।'

মিসেস দিব্যা কনসলকে চলে যেতে হল অতিথিদের আপ্যায়ন করতে। দুর্যোধন মিত্র দেখলেন কাপুর বা বনসল কাছাকাছি নেই। গ্লাস নামিয়ে রেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলেন তিনি। রেস্টুরেন্টে ঢুকে সামান্য ডিনার শেষ করে নিজের ঘরে ফিরে আসতেই দেখলেন টেলিফোনের মেসেজ। লাইট জ্বলছে। বোতাম টিপতেই শুনতে পেলেন, 'দিস ইজ ভার্গব স্যার। পুলিশ লীলার কলকাতার হোয়ার অ্যাবাউটস জানতে চাইছে। ওকে প্রশ্ন করবে সুন্দরের ব্যাপারে। কী করব?'

মেসজে ডিলিট করে কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ বসলেন। না ভার্গবের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, যতক্ষণ তিনি কথা না বলবেন ততক্ষণ ভার্গব পুলিশকে কিছু জানাবে না। কিন্তু লীলার কলকাতার ফোন নাম্বার বা ঠিকানা ভার্গব পেল কি করে? মেয়েটা কি হিলটপের অফিসে যোগাযোগ করেছিল?

দশ মিনিট পরে নিজের মোবাইলে তিনি কৃষ্ণা মিত্রের নাম্বারগুলোয় চাপ দিলেন। গুনলেন, 'দি এয়ারটেল নাম্বার ইউ আর ট্রাইং টু রিচ ইজ সুইচড্ অফ।'

বাধ্য হয়ে ওদের ল্যান্ড লাইন নাম্বারে ফোন করলেন তিনি। নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছেন কৃষ্ণা। মাথায় যন্ত্রণা হলে যে ওষুধ খেতে হয় তাতে ঘুম আসাই স্বাভাবিক। ওঁর ফোনে যদি মিস কল অ্যালার্ম না থাকে তাই। রিং হচ্ছিল। একটি অবাঙালি মহিলা কন্ঠ হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল, 'কাকে চাই?"

'কৃষ্ণা আছে?'

'মেমসাব বাড়িতে নেই। কে বলছেন?'

লাইন কেটে দিসেন দুযোর্ধন মিত্র। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, তিনি দিল্লিতে এলে এই হোটেলে যে ওঠেন তা কৃষ্ণল ফানেন। জানে বলেই, কি বনসন্সের পার্টিতে এলেন না। মাথা ধরাটা স্রেফ বাহানা। নইলে এই রাত্রে মোবাইল সুইচ অফ করে কেন বাড়ির বাইরে থাকবেন।

অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। অস্বস্তিটা বেড়ে গেল এই ভেবে যে কৃষ্ণা এখানে রামচন্দ্র বণিকের সঙ্গে ঘুরছেন। এদের মধ্যে এতটা সত্তাব কবে থেকে হল?

সকাল সাড়ে ন'টায় সুন্দরের কাছে গেলেন দুর্যোধন মিত্র। তাঁকে দেখে নিয়মমতো পরীক্ষা করে সিকিউরিটির একজন বলল, 'স্যার, দুজন লোক পেশেন্টের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। ওদের কাছে স্পেশ্যাল কার্ড ছিল না বলে আমরা ঢুকতে দিইনি।'

'সেকী! ওরা এই অবধি এল কী করে? রিসেপশন বাধা দেয়নি?"

'স্যার, আমরা খবর নিয়েছি। ওরা অন্য পেশেন্টের কাছে যাবে বলে ডিজিটার্স কার্ড দেখিয়ে ওপরে উঠেছিল।'

'থ্যাঙ্ক ইউ, অনেক ধন্যবাদ।'

ভেতরে ঢুকতেই নার্স এগিয়ে এলেন, 'গুড মর্নিং, মিস্টার মিত্র।'

'গুড মর্নিং।'

'আপনাকে একটা সুখবর নিচ্ছি। আপনার ছেলের সেন্স ফিরে আসছে, আজ একটা শব্দ কয়েকবার বলেছে ও।'

'কী শব্দ? বুঝতে পেরেছেন?'

'হ্যাঁ, ইটস এ নেম।' ও কয়েকবার 'লীলা' নামটা উচ্চারণ করেছে।'

চমকে উঠলেন দূর্যোধন মিত্র। জীবন ও মৃত্যুর মাঝাখানে যে দাঁড়িয়ে এত শব্দ এত নাম থাকা সত্ত্বেও তার মনে লীলা নামটা কেন আসবে? ভালো করে খোঁজ নিয়েছেন তিনি। নিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন। সুন্দরের দার্জিলিং-এ ছুটে গিয়ে লীলাদের কলকাতায় পাঠানোর ব্যাপারটা একটা তাৎক্ষণিক আবেগের প্রকাশ মাত্র। মেয়েটার সঙ্গে হিলটপে থাকার সময় কথা বলা দূরের কথা, পরিচয় পর্যন্ত ছিল না। মেয়েটা কলকাতায় পৌঁছানোর আগেই বোধহয় ওই দুর্ঘটনা ঘটে যায়। কোনও রকম প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সুযোগই হয়নি।

তাহলে সুন্দর কেন লীলার নামটা ঘোরের মধ্যে উচ্চারণ করছে? নার্স জিজ্ঞাসা করলেন, 'স্যার, লীলা কে? আপনার পরিচিত?'

না বলতে গিয়েও পারলেন না দুর্যোধন মিত্র। মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে জানালেন, হ্যাঁ, পরিচিত।

"তাঁকে এখানে নিয়ে আসা যাবে?' নার্স জিজ্ঞাসা করলেন।

'কেন?' চমকে উঠলেন দুর্যোধন মিত্র।

'ডাক্তার আপনার সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলবেন।' নার্স জানালেন।

আধঘন্টা পরে ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে দুর্যোধন মিত্র জানলেন, সুন্দরের শরীর চমৎকার

সাড়া দিচ্ছে ওষুধে। কিন্তু তার মাথা তেমন চোট না পাওয়া সত্ত্বেও স্বাভাবিক হতে পারছে না। মাথা ঠিক হয়ে গেলে অপারেশনের কথা ভাবা হবে।

'ওর মাথার স্ক্যানিং রিপোর্টে কিছু পাওয়া যায়নি?'

'খুব মাইনর। তার জন্যে ওষুধই যথেষ্ট।' ডাক্তার বললেন, 'কিন্তু কাল থেকে পেশেন্ট একটা শব্দ উচ্চারণ করছে। হয়তো ওই নামটাই তার মনে পড়ছে। আজ বিকেলের মধ্যেই ওর সেন্স পরিষ্কার হয়ে যাবে। এই লীলা নামের মেয়েটি কোথায় থাকেন?' ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন।

'যতদূর জানি এখন কলকাতায় আছে।'

'তাঁকে অনুরোধ করলে তিনি দিল্লিতে আসবেন?'

'যতদূর জানি বাবার চিকিৎসার জন্যে ওরা কলকাতায় গিয়েছে।' দুর্যোধন মিত্র বললেন, তা ছাড়া-।'

তিনি বাক্য শেষ করলেন না শুনে ডাক্তার তাঁর মুখের দিকে তাকালেন।

একটু অস্বস্তি নিয়েই দুর্যোধন মিত্র বললেন, 'মেয়েটি আমার হোটেলের একজন সামান। রিসেপশনিস্ট। আমাদের সঙ্গে ওর দূরত্বটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আমার ছেলে ঘোরের মধ্যে ওর নাম উচ্চারণ করছে এখবর চাউর হলে আমাদের ওখানে আলোচনার বিষয় হবে।'

ডাক্তার একটু ভাবলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, 'এত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও নিশ্চয়ই ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট হয়েছিল। আর সেটা তো একদিনে হয় না। আপনারা সতর্ক করেননি কেন?'

'ডক্টর। ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট যদি হয়ে থাকে তাহলে তা একদিনে হয়েছে। মেয়েটির কলকাতায় যাওয়ার দিন। তার আগে ওদের আলাপ ছিল না।'

'সেকী?'

'আমিও একই রকম অবাক হচ্ছি।'

'কিন্তু, আমি আপনার অবস্থা বুঝতে পারছি। তবু বলছি, মহিলাকে পেশেন্টের স্বার্থে 'আমাদের দরকার। ওকে যত তাড়াতাড়ি পারেন এখানে নিয়ে আসুন।'

ঘণ্টাখানেক নিজের সঙ্গে তর্ক করলেন বুর্যোধন মিত্র। লীলাকে দিল্লিতে আসার প্রস্তাব দেওয়া মানে সে ধরে নেবে তাকে মিত্র পরিবার স্বীকৃতি দিতে ইচ্ছুক। এটা কখনই সম্ভব নয়। গোলাপের বাগানে একটা ঘেঁটুফুলের চারা পুঁতে দিলে তা থেকে ঘেঁটু ফুলই হবে, গোলাপ জন্মাবে না। কিন্তু ডাক্তারের কথাও ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। সুন্দর যে অবস্থায় এখন আছে তা বেশিদিন চললে তার শরীর সুস্থ হয়তো হবে কিন্তু মনের জড়তা যদি না চলে যায় তাহলে অগর্ব হয়ে থাকতে হবে ওকে। এই সমস্যাটার সমাধান যদি লীলা এলে সম্ভব হয়-!

শেষ পর্যন্ত ভার্গবকে ফোন করলেন দুর্যোধন মিত্র।

লীলার টেলিফোন নাম্বারের বোতাম টিপতেই ওটা বাজল এবং ওর গলা শোনা গেল। ভার্গব বললেন, 'লীলা, দিস ইজ ভার্গব।'

'ইয়েস স্যার।' ফোনটা লীলা কল্পনা করেনি।

'তোমার বাবার অবস্থা কিরকম।'

'ভালো নয় স্যার। ডাক্তাররা প্রেশার দিচ্ছেন আর একটা মেজর অপারেশনের জন্যে। প্রায় চার লক্ষ টাকার ধাক্কা। তার ওপর অন্যান্য খরচ আছে। আমি কী করব বুঝতে পারছি না স্যার।' লীলার গলা খুব করুণ শোনাল।

'এত আপসেট হয়ে পড়ছ কেন? তোমার বাবার আর হসপিট্যালের নামটা আমাকে বলো।'

লীলা জানাল।

'আজ একটু পরে আমাদের অফিস হাসপাতালের সঙ্গে কন্টাক্ট করছে। তোমার বাবার অপারেশনের যাবতীয় খরচ অফিস বহন করবে।'

'স্যার।' আনন্দে চিৎকার করে উঠল লীলা।

'ইয়েস। আমাদের কলকাতার অফিসের মিস্টার সেন দেখাশোনা করবেন।'

'কী বলে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাব-!'

'কৃতজ্ঞতা আমাকে কেন জানাচ্ছে? আমার এত ক্ষমতা নেই। ইউ মাস্ট বি গ্রেটফুল টু মিস্টার দুর্যোধন মিত্র। তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অবশ্য তার বদলে তিনি তোমার কাছে একটা সাহায্য চাইছেন। ভার্গব বললেন।

'আমার কাছ থেকে?' অবাক হল লীলা।

'হ্যাঁ। তুমি জানো সুন্দর খুব অসুস্থ। দিল্লিতে তার চিকিৎসার উন্নতি খুব ধীরে ধীরে হচ্ছে। মাঝে মাঝে যখন জ্ঞান আসছে তখন সে কার নাম বলছে, জানো?'

'কার নাম?'

'তোমার। ডাক্তার চাইছেন, এই সময় তুমি যদি ওর বিছানার পাশে থাকো, ওর সঙ্গে কথা বলো, তাহলে দ্রুত উন্নতি হবে সুন্দরের।'

'আমি? আমি কী করে যাব?'

'যাবে। কারণ কলকাতায় তোমার বাবার চিকিৎসার সব দায়িত্ব নিয়েছি আমরা। ওখানে তোমার কিছু করার নেই।' ভার্গব বললেন।

'কিন্তু স্যার-।'

'মিস্টার মিত্র তোমার বাবার জন্যে এতটা করছেন আর তুমি তাঁর ছেলের জন্যে এটুকু করতে পারবে না। ভেবে নাও, তুমি একজন নার্স, পেশেন্টকে সুস্থ করার জন্যে দিল্লিতে যাচ্ছ। পেশেন্ট সুস্থ হলেই ফিরে আসবে। লীলা, ক্লিজ, না বলো না।'

'ঠিক আছে স্যার।'

'তাহলে মিস্টার সেন তোমাকে টিকিট পৌঁছে দেবেন। আজই দিল্লিতে পৌঁছে দেখবে ড্রাইভার তোমার নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তোমাকে হসপিট্যালে পৌঁছে দেবে। তুমি সোজা ডক্টর সানতানির সঙ্গে দেখা করবে। বাই।'

ডক্টর সানতানি প্রবীন মানুষ। তাঁর সামনে লীলা গিয়ে বসতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, 'কোনও মানুষ যখন ঘোরের মধ্যে একজন মহিলার নাম উচ্চারণ করে তখন সে তাকে খুব কাছের মানুষ বলে ভাবে। আপনার সঙ্গে সুন্দর মিত্রের সম্পর্ক নিশ্চয়ই খুব গভীর হয়ে ছিল।'

'না স্যার। আমরা মাত্র একদিন কথা বলেছিলাম।'

'অদ্ভুত ব্যাপার। আপনার দিক থেকে ওঁর সম্পর্কে কোনও ইমোশন্যাল অনুভূতি আছে কি?' সোজা হয়ে বসল লীলা। তারপর বলল, 'ওঁর ব্যবহার, আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। হি ইজ, একদম আলাদা মানুষ।'

'ও.কে.! সেক্ষেত্রে যদি আপনাকে একটু অভিনয় করতে হয় তাহলে প্লিজ করবেন। সুন্দর আপনার কাছে সান্ত্বনা, সমবেদনা, প্রেরণা চাইবে। সেটুকু দেবেন।'

গীলার স্পেশ্যাল কার্ড করিয়ে রেখেছিলেন দূর্যোধন মিত্র। অতএব সিকিউরিটির বেড়া ডিঙিয়ে কেবিনে ঢুকতে অসুবিধে হল না। সুন্দরকে দেখে অবাক হয়ে গেল লীলা। গোটামুখে কালো দাঁড়ি, চোখ বন্ধ। গলা পর্যন্ত সাদা চাদরে ঢাক'। নার্স বললেন, 'আপনি নিশ্চয়ই জানেন আপনাকে এখানে চবিবশ ঘণ্টাই থাকতে হবে। পাশের অ্যান্টি রুমে ডিভান রয়েছে। ওখানে বিশ্রাম নিতে পারেন। আপনার খাবার এখানেই এনে দেওয়া হবে।

'কেন?'

'ফর সিকিউরিটি রিজন।'

'মানে?'

'যারা পেশেন্টকে খুন করতে চেয়েছিল তারা এখানেও আসতে পারে ভেবে কোনও ফাঁক রাখা হয়নি। আপনি পাশের ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করে নিন।'

মানুষটা শুয়ে আছে প্রায় মৃতদেহের মতো। রাত তখন দুটো। পাশের ঘরের ডিভানে শুয়েছিল লীলা, গোঙানির আওয়াজ কানে আসতেই উঠে বসল। এ-ঘরে এসে দেখল কোণের চেয়ারে নার্স বসে ঢুলছে। আওয়াজটা বের হচ্ছে সুন্দরের মুখ থেকে। আচমকা থেমে গেল সেটা। আর সে স্পষ্ট শুনতে পেল, 'লীলা লী' ।  সমস্ত শরীরে কাঁটা ফুটল, একটি অর্ধমৃত মানুষের শরীর থেকে তার নাম বেরিয়ে এল! এই অবস্থাতেও সুন্দর তার নাম বী করে উচ্চারণ করছে? সে এগিয়ে গেল, সুন্দরের মুখের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে নীচু স্বরে বলল, 'আমি এই তো আমি', সুন্দরের চোখ বন্ধ হয়ে গেছে আবার। চেতনা লোপ পেয়ে গেছে।

আরও কয়েকবার ডাকল লীলা। ওপাশ থেকে নার্সের গলা ভেসে এল, 'এখন উনি শুনতে পাবেন না। যান শুনে পড়ুন।'

সন্ধের মুখে দুর্যোধন মিত্র টেলিফোন করলেন স্ত্রীকে। ফোনটা এবার কৃষ্ণাই ধরলেন। গলার স্বর শুনে হাসলেন, 'শেষ পর্যন্ত তোমার সময় হল?'

'হ্যাঁ। খুব ব্যস্ত ছিলাম। মাইগ্রেনের যন্ত্রণা কমেছে।'

'মাইগ্রেন? জানলে কী করে?'

'তোমার বান্ধবী বললেন, এত যন্ত্রণা যে শয্যাশায়ী ছিলে। তার নেমন্তন্ন রাখতে পারোনি। এখন কেমন আছ?'

'ভালো।' কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলেন, 'তোমার ছেলের খবর কী?'

'চিকিৎসা চলছে।'

'তা তো জানি।'

'সে তো জানবেই।'

'তোমার কথার মধ্যে অন্যরকম সুর পাচ্ছি!'

'সেটা তোমার কান গুনছে।'

'তোমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাই।'

'কৃষ্ণা, কথা এমন ধারালো যে বলতে বলতে কখন কাকে ক্ষত-বিক্ষত করবে কেউ জানে না।

না বলাই বোধহয় ভালো।'

'এসব বাজে কথা। তুমি কি এখন আসবে?'

'না। আমি খুব টায়ার্ড।'

'তাহলে আমি যাচ্ছি।'

'এসো। একা আসবে?'

'মানে?'

'শুনলাম দিল্লিতেও তুমি সঙ্গী পেয়ে গেছ।'

'তুমি আমাকে অপমান করতে পারো না।'

'ও.কে.। এসো।' টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন দুর্যোধন মিত্র।

কৃষ্ণা এসেন একঘন্টা পরে। এখন রাত আটটা। দুর্যোধন দেখলেন কৃষ্ণা সেজে এসেছেন। শাড়ি না, স্কার্ট পরেছেন, গলার অনেকটাই উন্মুক্ত। হোটেলের ঘরে বসে বললেন, 'তুমি কি এটা ঠিক করলে?'

'কোনটা?'

'একটা পাতি রিসেপশনিস্ট মেয়েকে সুন্দরের কেবিনে ঢুকিয়ে দিলে কারণ সে ঘোরের মধ্যে তার নাম আওড়াচ্ছিল: ছিঃ-।'

'মেয়েটি ওখানে একা নেই কৃষ্ণা, নার্সও রয়েছে।'

'সো হোয়াট?' কৃষ্ণা বললেন, 'কেন ওকে আনতে হল? আমাকে অবিশ্বাস করে ওখানে ঢুকতে দাওনি, ওকে কী করে  দিলে ?

'ডাক্তারের পরামর্শে।' মাথা নাড়লেন দুর্যোধন মিত্র, 'বলো, কি বলতে এসেছ?'

'তোমার সম্পত্তির মোট পরিমাণ কত।'

'জানি না।'

'হতেই পারে না।'

'কেন জানতে চাইছ?'

'আমি তোমার সঙ্গে কোনও বিরোধ চাই না। তোমার স্থাবর সম্পত্তির ওপর আমার কোনও লোভ নেই। শুধু অস্থাবর সম্পত্তির ঠিক অর্ধেক তুমি আমার নামে ট্রান্সফার করে দাও, আমি তোমাকে মুক্তি

দেব।' কৃষ্ণা বললেন।

'যদি মুক্তি না চাই?'

'আমি আর পারছি না।' কৃষ্ণা মাথা নাড়লেন, 'তোমায় অসহ্য লাগছে।'

'ও। তাহলে পুরো ব্যাপারটা ভাবতে হবে।'

'কোন ব্যাপারটা?'

'সুন্দর লীলাদের এয়ারপোর্টে ছেড়ে যখন ফিরছিল তখন একটা সুমোগড়ি তার গাড়িকে ধাক্কা মেরে খাদে ফেলে দেয়। যাদের এই পরিকল্পনা ছিল তারা ভেবেছিল ওখান থেকে পড়লে কেউ বাঁচতে পারে না। কিন্তু যখন জানা গেল সুন্দর মরেনি তখন সেই সূমোগাড়ির ড্রাইভারকে মেরে ফেল হল। ব্যস, প্রমাণ শেষ। কিন্তু যখন জানা গেল তার দু-তিনদিন আগে সেই ড্রাইভারকে একজনের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে যে তাকে অনেক টাকা পাইয়ে দেবে এবং সেটা পেলেই ড্রাইভার অন্য কোথাও চলে যাবে। কে সেই লোক? তারও হদিস পাওয়া গেল। লোকটা আমাদের বাড়িতে কাজ করত। বিশেষ করে তোমার কাজ। একটা পরিচারিকার শ্লীলতাহানি করার জন্যে তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর আশ্চর্য। তাকে চাকরি দিল আমার তৈরি রামচন্দ্র বণিক। আমাদের স্বনামধন্য এমপি। কিন্তু তার খোঁজে পুলিশ গিয়ে শুনল সেই লোক হাওয়া হয়ে গিয়েছে। অনুমান

করা হচ্ছে সে দিল্লিতে এসেছে।'

দুর্যোধন মিত্র থামলেন।

উঠে দাঁড়ালেন কৃষ্ণ। 'তুমি এসব কথা আমাকে বলছ কেন?'

'আমি ভাবছি। বলতে পারো জোরে জোরে ভাবছি।'

'আমি এসব জানি না। তোমাকে একদিন সময় দিলাম। তারপর আমাকে জানাবে।' কৃষ্ণা দরজার

দিকে এগোলেন।

'আমার মনে হয় এখন তোমার বাড়ি ফেরা উচিত নয়।'

'মানে?'

দিল্লির পুলিশ হন্যে হয়ে লোকটাকে খুঁজছে। আজ বিকেলেও তাকে হাসপাতালে নাকি দেখা গেছে। তুমি কি তার কাছেই লীলার খবর জেনেছ?' চোখ বন্ধ করলেন কৃষ্ণা। যেন নিজেকে সংযত করলেন, তারপর বললেন, 'তুমি কী চাইছ?'

'শান্তি? আমি কোনও সংঘাত চাই না, রেষারেষি না। আমার ছেলে প্রচণ্ড অসুস্থ, আমি চাই সে সুস্থ হয়ে উঠুক। তবে, তাকে যে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে তাকে শাস্তি পেতে হবে।' 'সুন্দরকে যে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল তার প্রমাণ কি? একটি ড্রাইভারকে খুন করা হয়েছে অথবা আর একজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানেই সুন্দরকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল এ কথা মানতে আমি রাজি নই।' মাথা নাড়লেন কৃষ্ণা। 'ওটা দুর্ঘটনা না খুন তা সঠিক বলতে পারত সুন্দর। কিন্তু তার পক্ষে আর কখনই কথা বলা সম্ভব নয়।'

'এই তথ্য পেলে কোথায়?'

'তুমি আমাকে সুন্দরের সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়ার ব্যবস্থা করেছ। কিন্তু সম্পর্কে সে আমার সন্তান। তার খবর নিতে আমার ইচ্ছে করে। তুমি তো ওই ইচ্ছেটাকে মেরে ফেলতে পারো না। আমি হাসপাতালের ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। জেনেছি, সুন্দরের পক্ষে আর কখনই উঠে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। কারণ তার মস্তিষ্ক আর কখনই কাজ করবে না। এই অবস্থায় নিজের শত্রু তৈরি করে প্রতিহিংসা পরায়ণ হওয়া কি উচিত হবে? আচ্ছা।'

কৃষ্ণা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

কৃষ্ণা বাইরে বেরিয়ে এসেই মোবাইলে ফোন করলেন লিফটে নামতে নামতে। নীচে নেমে কানেকশন পেলেন, 'তোমাকে বলেছিলাম লোকটাকে দিল্লি নিয়ে এসে ঠিক করোনি।'

ওপাশ থেকে প্রশ্ন, 'কেন?'

'দুযোর্ধন মিত্র ওর গতিবিধি জানেন। ওকে এখনই দিল্লির বাইরে চলে যেতে বল। ও আজ রাত্রেই নেপালে চলে যাক।' কৃষ্ণা বললেন।

'বেশ।'

'তুমি কবে ফিরে যাবে?'

'পার্লামেন্ট চলছে।'

'ও। এতদিন হয়ে গেল কিন্তু কিছুই করা সম্ভব হল না। মেয়েটা তো এসে গেল।'

'কোনও লাভ হবে না। সুন্দর আর কখনও কথা বলবে না।'

'আমি অস্বস্তিতে আছি। দুযোর্ধন মিত্রকে নার্ভাস বলে মনে হল না।'

'ধৈর্য-ধরুন ম্যাডাম।'

'আর কতদিন?'

'আর আটচল্লিশ ঘন্টা।'

লাইন কেটে দিলেন কৃষ্ণা মিত্র।

ভোর রাত। বাইরে যে সকাল হচ্ছে হাসপাতালের ভেতরের কেবিনে তার কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। লীলা চেয়ার টেনে সুন্দরের পাশে এসে বসেছিল। ওপাশের কোণে নার্স ঘুমোচ্ছে। সুন্দরের শীর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে লীলার খুব খারাপ লাগছিল। কি পালটে গেল মানুষটা। তার সহকর্মীরা কত গল্প শুনিয়েছে এই লোকটির চরিত্রহীনতার। কিন্তু দার্জিলিং-এ প্রথম আলাপের পর থেকে একবারের জন্যেও তার সঙ্গে মিল খুঁজে পায়নি সে। একেবারে নির্লিপ্ত হয়ে তার সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের জবাব সে যেমন জানতে চায়নি তেমনি সুন্দরও যেচে দিতে উদ্যোগী হয়নি। আজ মানুষটা কী অসহায়।

কপালে আঙুল রাখল লীলা। ঠান্ডা স্পর্শ। একটু বাদেই মাথাটা নড়ে উঠল। ঠোঁট নড়তে লাগল তিরতির করে। লীলা কাছাকাছি মুখ নিয়ে গেল, 'আমি লীলা!' ঠোঁট স্থির হয়ে গেল। মুখ ভাবলেশহীন। লীলা কয়েকবার ফিসফিসিয়ে ডাকল কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। খুব আস্তে আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছিল লীলা, সুন্দরের চোখে, কপালে ঠোঁটে।

নার্সের নাম মারিয়া গোমেস। বাড়ি ছিল গোয়ায়। সেখানেই নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে চাকরি জীবন শুরু। ধীরে ধীরে উন্নতি। অনেকগুলো ভালো হাসপাতাল ঘুরে শেষ পর্যন্ত দিল্লির এই নামি হাসপাতালে ভালো মাইনের চাকরি পাওয়ায় একমাত্র মেয়ে জুলিয়াকে দামি স্কুলে ভরতি করতে পেরেছেন। মিস্টার গোমেসের সঙ্গে তার বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল তিন বছর আগে যখন জুলিয়ার বয়স চার। লোকটা কিছুতেই তার অতিরিক্ত মদ্যপানের অভ্যেস ছাড়তে রাজি হয়নি। 

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে একটা অটো নিয়ে করোলবার্গে আসতে বড়জোর আধঘণ্টা লাগে। মারিয়া অটো ছেড়ে গলির মধ্যে ঢুকল যখন তখন ঘড়িতে সাড়ে সাতটা। সাড়ে আটটায় জুলিয়ার স্কুলবাস আসবে। পার্বতী ওকে তার মধ্যে তৈরি করে দেবে। পার্বতী বিহারের বউ, এখানে স্বামী মরে যাওয়ার পর ভাসছিল। খবর পেয়ে মারিয়া তাকে নিয়ে এসেছিল। অনেক ঘষে মেজে নিজেদের মতো করে নিয়েছে।

বেল বাজাতেই যেভাবে দরজা খুলল পার্বতী এবং কেঁদে উঠল তাতে চোখ কপালে উঠল মারিয়ার। কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করায় পার্বতী কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। অনেক ধমক খাওয়ার পর সে জানতে পারল, জুলিয়াকে খুঁজে পাচ্ছে না।

পায়ের তলায় মাটি নড়ে গেল মারিয়ার। প্রশ্ন করে করে জানতে পারল পড়ার ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে জুলিয়া বাইরের ঘরে বসে টিভি দেখছিল। সেসময় পার্বতী কিচেনে। তখন যেন টিভির আওয়াজের সঙ্গে বেল বাজার আওয়াজ কানে এসেছিল পার্বতীর। প্রথমে সে ভেবেছিল ওটা টিভিতেই বেজেছে। মিনিট পাঁচেক বাদে হাতের কাজ শেষ করে সে বাইরের ঘরে এসে দেখতে পেল, দরজা ভেজানো, জুলিয়া নেই। দ্রুত নীচে নেমে চারদিকে খুঁজেও সে মেয়েটাকে দেখতে পায়নি। কিন্তু সামনের দোকানের লালা বলল জুলিয়া নাকি একটি লোকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে গেছে। লোকটির সঙ্গে একজন স্ত্রীলোকও ছিল।

মারিয়া পাগল হয়ে গেল। দু-তিনবার তন্নতন্ন করে শুধু পাড়াটা নয়, গোটা আজমল বাঁ রোড দেখে এল। কোথাও জুলিয়া নেই। তার পরই টেলিফোনটা এল।

'মিসেস গোমেস?'

'ইয়েস!' শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম মারিয়ার।

'আমি বুঝতে পারছি বাড়িতে ফিরে মেয়েকে না দেখে আপনি খুব আপসেট!'

'আপনি, আপনি কে?'

'আপনার মেয়ে আমার কাছে আছে। ওকে আপনি ফিরে পেতে চান?'

'নিশ্চয়ই। কেন? কেন ওকে নিয়ে গেছেন? আমি কারও কোনও ক্ষতি করিনি তো।'

'না করেননি। আপনি কি মেয়েকে না পাওয়ার কথা পুলিশকে জানিয়েছেন?'

'না! কিন্তু一!'

'প্লিজ, এই ভুলটা দয়া করে করবেন না।'

'আপনি কেন আমার মেয়েকে নিয়ে গেছেন?'

'খুব সহজ। আপনাকে একটা কাজ করে দিতে হবে। করে দিলেই আপনি মেয়েকে ফেরত পেয়ে যাবেন। আমরা ওকে বেশিক্ষণ কাঁদাতে চাই না।'

'ও কাঁদছে?'

'খুব স্বাভাবিক। তাই না?'

'কেন আমার মেয়েকে কাঁদাচ্ছেন আপনি, আপনাকে আমি চিনিই না।'

'আমি চিনি।'

'কী কাজ করতে হবে?'

'খুব সিম্পল। হাসপাতালে আপনি একটি অর্ধমৃত পোশেন্টকে অ্যাটেন্ড করেন। মাত্র তিনজন

নার্সের ওই কেবিনে যাওয়ার অনুমতি আছে। বাকি দুজনের যথেষ্ট বয়স হয়েছে, কোনও পিছুটান নেই। তাই আপনাকেই বেছে নিতে হল। হ্যাঁ, আপনার ডিউটি আবার কখন শুরু হচ্ছে?' 'রাত ন'টায়।'

'তার মধ্যে আপনি জেনে যাবেন আপনাকে কী করতে হবে। রাজি আছেন?'

' 'হ্যাঁ ।

'গুড। অন্য কিডন্যাপারদের মতো কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি আপনার মেয়েকে আটকে রাখব না। আপনি যখন কথা দিয়েছেন তখন ওকে আজই ফেরত দেব। কিন্তু কথার খেলাপ হলে।'

'আমি চেষ্টা করব।

লাইন কেটে গেল। মারিয়া দ্রুত ওই নাম্বারে ডায়াল করে শুনল ওটা এসটিডি বুথ।

জুলিয়া ফিরল মিনিট চল্লিশেক পরে। একা: ঝাঁপিয়ে পড়ল মারিয়া, 'কোথায় গিয়েছিলি? কার সঙ্গে গিয়েছিলি? কেন গিয়েছিলি?

'বারে। আঙ্কল আন্টি এসে বলল ড্যাডের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে এখনই আমাকে দেখতে চায়, দেরি হলে আর দেখতে পাবে না!'

'পার্বতীকে বলে যাসনি কেন?'

'ওরা এত তাড়া দিল!'

'দেখা হয়েছে?"

'না। গিয়ে শুনলাম ড্যাড মারা গিয়েছে। আই ফেল্ট সো ব্যাড।'

'নো। তোর ড্যাডের কিছুই হয়নি। ওরা খারাপ লোক। তোকে কিডন্যাপ করেছিল।'

'ওমা! কিডন্যাপ করলে আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে কেন? কেন এত তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে যাবে? মাঝখান থেকে আমার স্কুলে যাওয়া হল না।' জুলিয়া ভেতরে চলে গেল। মারিয়া বুঝল তার কিছু করার নেই।

সকালে স্নান করে পোশাক বদলে লীলা চুপচাপ বসেছিল। তার কেবলই মনে হচ্ছিল যে এভাবে সে কতদিন থাকবে? বাবার অপারেশন হল কিনা, হলে কেমন আছেন, তার কোনও খবরই সে পাচ্ছে না। কিন্তু সুন্দরের দিকে তাকাতেই মন নরম হয়ে যাচ্ছিল। সিকিউরিটির মারফত তার ব্রেকফাস্ট এল। যে বয়স্কা নার্স ডিউটিতে ছিলেন তিনি এগিয়ে এসে বললেন, 'দাঁড়াও।'

তারপর ট্রে তুলে খাবারের ঘ্রাণ নিয়ে বললেন, 'ঠিক আছে। যেতে পারো। এটা করতে হল বলে কিছু মনে কোরো না। আমার ওপর এটা করার নির্দেশ আছে।' খাওয়া শেষ হতে না হতেই নার্স ডাকলেন, প্লিজ,

কাম।' অ্যান্টি রুম থেকে কেবিনে ছুটে গিয়ে লীলা দেখল সুন্দর আবার অস্থির হয়েছে, তার মাথা দুপাশে বারংবার ঘুরছে। লীলা ওর মুখের কাছে গিয়ে বলল, 'কী হয়েছে? বলো, আমি লীলা। আমি লীলা!'

মাথাটা স্থির হল। লীলা আবার বলল, 'আমি লীলা।'

'লী-লা।' ফিসফিস শব্দ বের হল সুন্দরের দুটো ঠোঁটের ফাঁক থেকে।

'হ্যাঁ, লীলা!'

'লীলা!' ঠোঁটের কাছে প্রশান্তির ছাপ।

'প্লিজ, তাকাও। সুন্দর, আমি লীলা, লীলা।'

চোখ কুঁচকে গেল, পাতা নড়ল কয়েকবার। ওদিকে তখন নার্স ইন্টারকমে উত্তেজিত গলায় বলছেন, 'ডক্টর প্লিজ কাম কুইক, হি ইজ রেসপনসিং।' সীলা ততক্ষণে সুন্দরের ডান হাত দু-হাতের মুঠোয় নিয়ে ফেলেছে, 'চোখ খোলো, চোখ খোলো, প্লিজ।'

'লীলা।' শব্দটা বেরুনো মাত্রই আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেল সুন্দর। বেশ কয়েকবার ডাকাডাকিতেও কাজ হল না।

এই সময় ডাক্তার কেবিনে ঢুকলেন হস্তদন্ত হয়ে। সমস্ত শোনার পর ভদ্রলোক তখনই সুন্দরের ব্রেন স্ক্যান করার ব্যবস্থা করলেন। ঘণ্টাখানেক পরে তাঁর চেম্বারে দূর্যোধন মিত্রের সঙ্গে তিনি কথা বসছিলেন। অত্যন্ত উত্তেজিত ভদ্রলোক। আগের রিপোর্টের সঙ্গে প্রচুর পার্থক্য দেখা দিয়েছে। এবং সেগুলো ভালোর দিকে। চিকিৎসাশাস্ত্রে এরকম ঘটনা লাখে একটাই হয়। এভাবে চললে-!

বুর্যোধন মিত্র জিজ্ঞাসা করলেন, 'কী করে হল?'

'আমরা সবাই ওই মেয়েটির কাছে গ্রেটফুল মিস্টার মিত্র। আমি নিশ্চিত ওর জন্যে এই মির‍্যাকল সম্ভব হয়েছে। ওকে এখানে নিয়ে এসে আপনি যে কী ভালো করেছেন তা বলার নয়।' 'ডক্টর।' গম্ভীর গলায় বললেন দুর্যোধন মিত্র।

'ইয়েস!'

'সুন্দরের এই পরিবর্তনের কথা কে কে জানে?'

'যে নার্স ডিউটিতে আছেন, ওই লীলা নামের মেয়েটি আর আমি। কেন?'

'নার্স 'নিশ্চয়ই বাড়িতে যাবেন?"

'হ্যাঁ।'

'এঁকে বলে দিন এই ইমপ্রুভমেন্টের কথা যেন উনি কাউকে না বলেন, বরং বলবেন অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। আপনাকেও তাই বলতে অনুরোধ করছি।'

কিন্তু কেন?' '

'আপনি জানেন ওর জীবন বিপন্ন। যারা ওর মৃত্যু চায় তারা জানে ও বাঁচবে না। উলটোটা হচ্ছে জানলে ওরা মরিয়া হয়ে উঠবে।'

'ও।'

'প্লিজ ডক্টর।'

'ও.কে.!!

দুর্যোধন মিত্র ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে আসতেই মোবাইলে আওয়াজ হল। দুর্যোধন

মিত্র বললেন, 'হ্যালো!'

'মিস্টার মিত্র।'

'ইয়েস।'

'আমি দিল্লি পুলিশের অফিসার, আমাকে আপনি চেনেন।'

'হ্যাঁ বলুন অফিসার।'

'আপনি ওপরের লাউঞ্জে অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।'

মোবাইল অফ করে কোণের ডিভানে বসলেন দুর্যোধন মিত্র। অফিসার উঠে এলেন সিঁড়ি বেয়ে। সামনে এসে বললেন, 'গুড মর্নিং। বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। আপনার মন নিশ্চয়ই আগের

থেকে অনেক ভালো।'

দুর্যোধন কথা না বলে তাকিয়ে থাকলেন।

অফিসার হাসলেন, 'খারাপ খবর বাতাসের আগে ছোটে হয়তো, ভালো খবরও চাপা থাকে না, হয়তো তার গতি কম।'

'কী বলতে চাইছেন?'

'আপনার ছেলেকে সুস্থ করার জন্যে একজন মহিলাকে কলকাতা থেকে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু এখানেই মুশকিল হয়েছে। দিল্লির কনটপ্লেসের থানায় ডায়েরি করা হয়েছে যে আপনি ভয় দেখিয়ে জোর করে তাকে এখানে এনে আটকে রেখেছেন।'

'জোর করে? ভয় দেখিয়ে?' অবাক হয়ে গেলেন দুর্যোধন মিত্র। 'তার সঙ্গে ধোকা করা হয়েছে, ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে। ওর বাবার চিকিৎসার খরচ দিয়ে আপনি ওকে এখানে আসতে বাধ্য করেছেন।'

'অফিসার, আমি কাউকে ভয় দেখাইনি, ব্ল্যাকমেইল করিনি, আটকে রাখিনি।'

'বেশ। মেয়েটির স্টেটমেন্ট দরকার।'

'আপনি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন।'

'নিশ্চয়ই। কিন্তু ততক্ষণ আপনি হাসপাতাল ছেড়ে যাবেন না।'

অফিসার চলে গেলে দুর্যোধন মিত্রের মনে হল কে ডায়েরি করেছে তা অফিসার বললেন না। না জিজ্ঞাসা করলে এঁরা নিজে থেকে জানান না।

আধঘণ্টা পরে ফিরে এলেন অফিসার, 'থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার মিত্র। আপনার কথাই ঠিক। আমরা মিসেস মিত্রকে জানিয়ে দেব।'

'মিসেস মিত্র?' উঠে দাঁড়ালেন দুর্যোধন মিত্র।

'বলতে খারাপ লাগছে, অভিযোগটা তাঁরই ছিল।'

'উনি নিজে কমপ্লেন করেছেন?'

'না। একজন এমপি-র মাধ্যমে। ছেড়ে দিন। এবার আপনি যেতে পারেন।'

গোটা দিন ধরে কৃষ্ণা মিত্রকে ফোন করে দুর্যোধন মিত্র শুনে গেলেন ওটা সুইচ অফ করে রাখা আছে। শেষ পর্যন্ত রামচন্দ্র বণিককে ফোন করলেন তিনি।

'রামবাবু!'

'একি দাদা, হঠাৎ আমাকে বাবু বলছেন কেন?'

'লীলাকে আমি ব্ল্যাকমেইল করে এখানে এনেছি এ কথা পুলিশকে না জানিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলে পারতে।' দুর্যোধন মিত্র বললেন?

'পুলিশ কি বলেছে আমি তাদের জানিয়েছি?'

আর কথা বাড়ালেন না দুর্যোধন মিত্র। ফোন রেখে দিয়ে আফশোশ ছল, কেন যে টেলিফোন করতে গেলেন! উত্তরটা যে এইরকম হবে তা জানাই ছিল।

গলি থেকে বেরিয়ে সামনে দাঁড়ানো অটোয় উঠে হাসপাতালের ঠিকানা বললেন মারিয়া। এখন সন্ধে পার হয়ে গেছে। পার্বতীকে বারংবার বলে এসেছেন, যে কেউ বেল বাজাক সে যেন দরজা না খোলে।

হুহু করে অটো ছুটে যাচ্ছিল নির্জন রাজপথ দিয়ে। সাধারণত অটোওয়ালাদের সটকাটগুলো চিনিয়ে দিতে হয় কিন্তু এ দেখা যাচ্ছে সব জানে। তাকে হাসপাতালের সামনে নামিয়ে দিতেই তিনি ভাড়া এগিয়ে দিলেন। লোকটা হিন্দিতে বলল, 'ম্যাডাম, ভাড়া আমি পেয়ে গেছি। উলটে আপনাকে কিছু দেওয়ার আছে।' পকেট থেকে একটা খাম বের করে মারিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়েই সে সজোরে অটো চালিয়ে চলে গেল।

মারিয়া এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিল যে হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে খাম না খুলে সে সোজা ভেতরে চলে এসেছিল। লকার রুমে ঢুকে সে থাম ছিঁড়ে চিঠি বের করেছিল। চিঠির সঙ্গে একটা ছোট্ট ট্যাবলেট রাখা ছিল। কাউকে উদ্দেশ্য না করে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে আজ রাত দুটো থেকে তিনটের মধ্যে ট্যাবলেটটা গুঁড়ো করে এমনভাবে স্যালাইনের বোতলে ঢেলে দিতে হবে যা বাইরে থেকে বোঝা না যায়। যদি সেটা করতে অসুবিধে হয় তাহলে গ্লাসের সামান্য জলে গুলে তরলপদার্থ পেশেন্টকে খাইয়ে দিতে হবে। দেওয়ার পরে গ্লাস এমন ভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে যাতে তার গায়ে ওষুধের কোনও চিহ্ন না থাকে। এ সবই তাকে শুধু মেয়ের নিরাপত্তার কারণে করতে হবে না, আগামীকাল সন্ধ্যার মধ্যে তার বাৎসরিক বেতনের পরিমাণ টাকা বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে।

চিঠিটা ইংরেজিতে লেখা। কম্পিউটারে টাইপ করা। যে লিখেছে তার কোনও হদিস নেই। মারিয়ার মেরুদণ্ড আচমকা বরফ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি একটা চেয়ারে বসে পড়ল সে। এই সময় আর একজন নার্স লকার রুমে ঢুকে তাকে দেখে এগিয়ে এল, 'কী হয়েছে মারিয়া?'

মাথা নেড়ে মারিয়া জানাল তার কিছু হয়নি।

'তোমার হাতে ওটা কী?'

'ও কিছু নয়।' দ্রুত চিঠিটাকে ব্যাগ ঢুকিয়ে ফেলল সে।

'কিন্তু তোমাকে খুব অসুস্থ মনে হচ্ছে।'

'না-না। ঠিক আছি।' উঠে দাঁড়ালেন মারিয়া।

টয়লেটে গিয়ে মুখে জল দিয়ে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে মারিয়া স্থির করল, না। কিছুতেই সে ট্যাবলেটটা সুন্দরকে দেবে না।

কেবিনে ঢুকে মারিয়া দেখল লীলা সুন্দরের মাথার পাশে বসে আছে। বয়স্কা নার্স যিনি দ্বিতীয় শিফটের ডিউটিতে এসেছিলেন, বললেন, 'আজ চারবার চোখ খুলেছে পেশেন্ট। ডাক্তার নির্দেশ দিয়েছেন আর কোনও ইমঞ্চভমেন্ট দেখলেই যেন তাঁকে খবর দেওয়া হয়।'

মারিয়া এগিয়ে গিয়ে লীলার মাথায় হাত রাখল, 'ডিনার করেছ।'

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল লীলা।

'যাও, ওঘরে গিয়ে রেস্ট নাও। আমি তো এসে গেছি।'

লীলা তবু নড়ল না। নিজের চেয়ারে বসে ওদের দেখছিল মারিয়া। এই ছেলেটাকে মেরে ফেলে কার লাভ হবে? আজ যদি সে ওঁদের কথা না শোনে তাহলে জুলিয়ার জীবন বিপন্ন হবে,

এটা ওরা বুঝিয়ে দিয়েছে। মারিয়া উঠে সোজা টয়লেটে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। এক মুহূর্ত ভেবে বাড়িতে ফোন করল। ফোন বাজছে। তারপর পার্বতীর গলা, 'হ্যালো।'

'পার্বতী সব ঠিক আছে?'

'হ্যাঁ, সব ঠিক আছে।'

'জুলিয়ার খাওয়া হয়েছে?'

'হ্যাঁ।'

'তুমি কখনই দরজা খুলবে না।'

'ঠিক আছে।'

ফোন কেটে দিয়ে কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মারিয়া। তারপর মন শক্ত করে নাম্বারটা ডায়াল করল। বহুদিন আগে নাম্বারটা পেয়ে মনে হয়েছিল যদি কখনও দরকার হয় তাই সেভ করে রাখি। আজ ওটা কাজে লাগাতে হবে।

ওপাশ থেকে হেঁড়ে গলায় কেউ প্রশ্ন করল, 'হ্যালো?'

রাত বারোটা নাগাদ চোখের পাতা কাঁপল সুন্দরের। ঝুঁকে পড়ল লীলা, 'সুন্দর, সুন্দর আমি লীলা, লীলা।'

ধীরে ধীরে চোখ খুলল সুন্দর। কিন্তু সেই চোখ কিছু দেখছে না। দু-হাতে লীলা মুখ ঘুরিয়ে নিল নিজের দিকে, 'সুন্দর! আমি লীলা।'

'লীলা!'

'হ্যাঁ, সুন্দর, আমি লীলা।'

'লীলা!' ঠোঁটের কোণে কি হাসি ফুটল?

'আমি তোমার পাশে আছি সুন্দর!'

সঙ্গে সঙ্গে ডানহাতের আঙুল নড়ল সুন্দরের। সেটা আলতো করে ধরল লীলা, 'তুমি ভালো হয়ে যাবে।'

টয়লেট থেকে বেরিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দৃশ্যটা দেখছিল মারিয়া। হুঁশ ফিরতেই ইন্টারকমে কথা বলল, 'ডক্টর, হিজ সেন্স ইজ কামিং।'

পরের পনেরো মিনিট কেবিনে দুজন ডাক্তার তাঁদের যাবতীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে পরামর্শ করার পর স্থির করলেন একটা ছোট অপারেশন করতে হবে। সে কারণে অফিসকে বলা হল দূর্যোধন মিত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। দেখা গেল দুর্যোধন মিত্রের মোবাইলের সুইচ অফ, হোটেলের অপারেটার জানাল ল্যান্ড লাইনে কেউ রেসপন্স করছে না। অথচ অপারেশন করতে মিস্টার মিত্রের সম্মতি দরকার।

তার কিছু আগে হাসপাতাল থেকে দুফার্লং দূরের পুলিশ স্টেশনের সামনে গাড়িটা থেমেছিল,

দুর্যোধন মিত্র গাড়ি থেকে নামতেই পুলিশ অফিসার এগিয়ে এলেন, 'গুড মর্নিং, মিস্টার মিত্র।' 'কী ব্যাপার? এত রাত্রে আমাকে এখানে ডেকে আনলেন কেন?' দুর্যোধন মিত্র বিরক্ত।

'ভেতরে আসুন, বলছি।'

যে ঘরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল সেখানে ঢুকে চমকে উঠলেন তিনি।

'এঁকে কি আইডেন্টিফাই করতে পারছেন?'

'অবশ্যই। আমার ওখানে কাজ করত। ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।'

ঠিক। তারপরে ও মিস্টার রামচন্দ্র এমপি-র কাছে চাকরি পায়।'

'অফিসার, ওকে জেরা করুন, ও-ই বলতে পারে কে আমার ছেলেকে খুন করতে চেয়েছিল।

খুনি ওকেই কাজে লাগিয়েছিল।' দুর্যোধন মিত্র উত্তেজিত।

'আপনি বসুন মিস্টার মিত্র।'

দুর্যোধন মিত্র চেয়ারে বসলে অফিসারের ইঙ্গিতে আর একজন অফিসার যাঁদের ঘরে নিয়ে এলেন তাঁদের দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। মিসেস কৃষ্ণা মিত্র এবং রামচন্দ্র বণিককে ঘরে এনে দুদিকে বসানো হল।

অফিসার বললেন, 'আপনাদের তিনজনকে এসময়ে এখানে আনার জন্যে দুঃখিত। গত দুদিন আমি নর্থবেঙ্গলে ছিলাম। ওখান থেকে ফিরে এসে মনে হল আপনাদের সঙ্গে কথা বলা দরকার। সেটাই গুরু করি।'

রামচন্দ্র বললেন, 'আপনার মতো এসপি লেভেলের অফিসারের সঙ্গে আমি কথা বলতে বাধ্য নই। আর কথা যদি বলতে হয় সেটা আমার ল-ইয়ার বলবেন।'

'মাননীয় এমপি মশাইকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি আমি ওপর তলায় নির্দেশে কাজ করছি। তা ছাড়া আমি তো আপনাদের কথা বলতে একবারও বলিনি। চা বা কফি?' তিনজনের কেউ মুখ খুললেন না।

অফিসার বললেন, 'সুন্দরকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল না ওটা স্রেফ দুর্ঘটনা তা নিয়ে আমার ধন্দ ছিল। কিন্তু সুন্দরের ভাঙাচোরা গাড়ির গায়ে সুমোর বডির রং পাওয়া যওয়ার পরও ওটা দুর্গটনা না অন্য কিছু, সেই সন্দেহ থেকেই যায়। দুর্ঘটনা হলে বেঁচে যাওয়া ড্রাইভার তৎক্ষণাৎ সবাইকে জানাত। হতে পারে তার ওপর দোষ পড়বে ভেবে সে চেপে যাচ্ছে। কিন্তু সুমো গাড়ির ব্রেক এবং স্টিয়ারিং একদম ঠিক ছিল। তাহলে দুর্ঘটনা ঘটল কেন? সুন্দরের গাড়ি ছিল গাছের দিকে। সে নিশ্চয়ই নিজে থেকে ধাক্কা খেয়ে খাদে পড়বে না!'

দুই। সুমোর ড্রাইভারকে খুন করা হল। তার মানে লোকটাকে অন্য কেউ কাজে লাগিয়েছিল। কে সে? সুমোর ড্রাইভার ভাড়ার গাড়ি চালাত। তদন্তে জানা গিয়েছে দুর্ঘটনার আগে এবং পরে সে ওই লোকটির সঙ্গে দেখা করেছে। আমাদের জেরায় ওই লোকটি তা স্বীকার করেছে।' ঘরের আর এক কোণে জড়সড় হয়ে বসা নেপালিটিকে দেখালেন অফিসার, 'কিন্তু ও এখনও আমাদের জানায়নি কেউ ওকে সুমো গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নির্দেশ দিয়েছিল কিনা।' তিন। সুন্দরের মৃত্যুতে কার লাভ হত? প্রথম সন্দেহ, মিসেস কৃষ্ণা মিত্র। মিস্টার মিত্রের পরে সুন্দরই ওই বিপুল সম্পত্তির মালিক হবে। দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে মিসেস মিত্র যা পাবেন তাতে তাঁর মন ভরবে না। সুন্দর না থাকলে পুরোটাই তাঁর দখলে যাবে।'

'এটা মিথ্যে, একদম মিথ্যে অভিযোগ।' কৃষ্ণা মিত্র চিৎকার করলেন।

'হয়তো। কিন্তু কোনও ল-ইয়ারের অনুপস্থিতিতে কথা না বলাই বোধহয় উচিত। হ্যাঁ, এই উদ্দেশ্যে তাঁর প্রিয় কর্মচারীকে মিস্টার মিত্রের কেয়ারটেকার বরখাস্ত করার পরে তিনি রামচন্দ্র বণিক মশাই-এর কাছে চাকরির জন্যে সুপারিশ করেন। তাহলে ধরে নিতে হবে ওই লোকটি সুন্দরহত্যা ষড়যন্ত্রের অন্যতম শরিক।'

চার। এবার শ্রীরামচন্দ্র বণিক। খুব সামান্য অবস্থা থেকে তিনি শ্রমিক আন্দোলনের নেতা হিসেবে যখন পরিচিত হচ্ছিলেন তখন মিস্টার দুর্যোধন মিত্র তাঁকে স্নেহ করতে শুরু করেন। একমাত্র ত'রই অনুগ্রহে প্রথমে এমএলএ, পরে এমপি হন মিস্টার বণিক। কিন্তু এতসব হওয়া সত্ত্বেও ওই এলাকায় যে-কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হলে তাঁকে মিস্টার মিত্রের কথা শুনতে হত। ফলে তাঁর মনে হীনমন্যতার জন্ম নেয়। মনে মনে মিস্টার মিত্রকে শত্রু বলে ভেবে নেন। আর সেই মানসিকতা থেকে আঘাত হানতে তাঁর পক্ষে সুন্দরকে বেছে নেওয়া খুব স্বাভাবিক।'

পাঁচ। সমস্যার সমাধান এই ভাবে ভাবলে খুব সহজ হয়ে যায়। কিন্তু মুশকিল হয়ে যাচ্ছে কয়েকটা ব্যাপারে। সুন্দর যে রাত্রে দার্জিলিং-এ পৌঁছেছিল তা মিসেস মিত্র, মিস্টার মিত্র অথবা মিস্টার বণিক জানতেন না। হিলটপের কারও জানা ছিল না। সে দার্জিলিং-এ আছে তা মিস্টার মিত্র জানতে পারেন। তিনি পুলিশকে সুন্দরের নিরুদ্দেশের কথা জানিয়েছিলেন। তারাই জানিয়েছিল। সুন্দর যখন তাঁকে ফোন করে তখন তিনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বলেন। সুন্দর শোনেনি। সম্ভবত সে তার বাবাকে জানায় যে লীলাদের বাগডোগরা এয়ারপোর্টে পৌঁছে তবে ফিরবে।

সুন্দর যে বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে ফিরছে তা মিস্টার মিত্র ছাড়া আর কারও জানা ছিল না।'

এই সময় ফোন বেজে উঠল অফিসারের। সেটা শুনে মোবাইল এগিয়ে দিলেন তিনি দুর্যোধন মিত্রের দিকে, 'ইমিডিয়েটলি সুন্দরকে অপারেশন করতে চান ডাক্তাররা। ওয়া আশা করছেন এর ফলে সে বেঁচে যাবে। আপনার ওপিনিয়ন চাইছেন।'

দুর্যোধন মিত্রের হাত কাঁপছিল। মোবাইল নিয়ে হ্যালো বলে ওদিকের বক্তব্য শুনলেন চুপচাপ। তারপর শ্বাস ফেলে বললেন, 'যা ভালো মনে করেন করুন।' ওপাশ থেকে ডাক্তার কিছু বললেন। দুর্যোধন মিত্র বললেন, 'কিন্তু আমি এখন হোটেলে নেই।' জবাবটা শুনে স্নান হেসে রিসিভারটা এগিয়ে দিলেন তিনি। অফিসার বললেন, 'ও.কে, ডক্টর, উই আর হিয়ার।'

'আমি যে এই সময় পুলিশ স্টেশনে থাকব তা আপনি হাসপাতালকে জানিয়ে দিয়েছিলেন?'

'হ্যাঁ। যদি আপনাকে ওদের দরকার হয়!'

মোবাইল বন্ধ করে অফিসার বললেন, 'হ্যাঁ যেখানে আমরা শেষ করেছিলাম। সুন্দর যে বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে পাহাড়ে একা গাড়ি চালিয়ে আসছে এই খবর না জানা থাকলে কেউ একে খুনের পরিকল্পনা করতে পারে না। এয়ারপোর্ট থেকে দুর্ঘটনাস্থলে আসতে অন্তত আড়াইঘন্টা সময় লাগে। মাঝখানে নীচের সমতলের শহর পার হতে হয়। এই সময়ের মধ্যে খুনিকে সব ব্যবস্থা করতে হয়েছে। অচেনা ড্রাইভারের ওপর দায়িত্ব দিলে সে হয়তো সুন্দরকে চিনতেই পারত না। অতএব সেরকম একজনকে পাঠানো হয়েছিল আপনাদের শহর থেকে। দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে তার কুড়ি মিনিট লেগেছিল। তার আগের সময়টায় খুনি বা তার লোক ওকে কী করতে হবে তা বুঝিয়েছে। লোকটি সুমো গাড়ি নিয়ে কুড়ি মিনিট নীচে নেমে গাড়ি ঘুরিয়ে অপেক্ষা করছিল সুন্দরের জন্যে। সুন্দর নিশ্চয়ই ওপরে ওঠার সময় সুমোটাকে দেখতে পেয়েছিল, কথা হয়েছিল কিনা তা আমরা জানি না। আমি বলতে চাইছি সুন্দরের ওই সময়ে ফিরে আসার খবর যার জানা ছিল একমাত্র তার পক্ষেই খুন করা সম্ভব। মাপ করবেন মিস্টার মিত্র, সন্দেহের কাঠগড়ায় আপনাকে দাঁড় না করানো ছাড়া আমার কোনও উপায় নেই।'

সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধন মিত্র চেঁচিয়ে উঠলেন, 'ননসেন্স। কি যা তা বলছেন? ওই সুমোর ড্রাইভারকে আমি চিনিই না।'

'এটা প্রমাণ সাপেক্ষ।

ছাড়া আপনি কি উন্মাদ। আমার একমাত্র সন্তানকে আমি খুন করব?'

'তা 'ইতিহাসে এরকম ঘটনা প্রচুর আছে। আপনার মতো ধনী শিল্পপতি, বিশাল হোটেলের মালিক, ভারতবর্ষের এক প্রান্তে থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ, আপনার বিশাল সম্মান আপনি কোনও কিছুর বিনিময়ে হারাতে চান না। আপনার ছেলে একটা সাধারণ রিসেপশনিস্টের রূপে পাগল হয়ে তার বাবার চিকিৎসার জন্যে দার্জিলিং ছুটে যাচ্ছে এটা আপনার কাছে বরদাস্ত করা সম্ভব ছিল না। তবু, যদিও বা করতেন, সে নিজের টাকায় তাদের প্লেনে করে কলকাতায় পাঠাচ্ছে মানে মেয়েটির সঙ্গে অনেকদূর জড়িয়ে গেছে। ভবিষ্যতে ওই মেয়েকে যদি সে বিয়ে করে তাহলে আপনার পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলে আপনি কিছুই করতে

পারতেন না।' অফিসার বললেন।

এই সময় রামচন্দ্র বণিক হাত তুললেন।

'আপনি কিছু বলতে চান?' অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন। 'হ্যাঁ। আমি ওদের পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ। সুন্দর ছেলেটি আমেরিকায় পড়তে গিয়ে নারীঘটিত ব্যাপারে বারংবার জড়িয়ে ছিল। এই চরিত্রহীন ছেলের ব্যাপারে অত্যন্ত বিরক্ত ছিলেন মিস্টার মিত্র। ওকে সংশোধন করার শেষ চেষ্টায় আমেরিকা থেকে নিয়েও এসেছিলেন। কিন্তু এখানে এসে সে কোনও কাজই করত না। শোনা যায়, হিলটপ হোটেলের ঘরে বসে মদ্যপান করত। এসব কারণে ছেলের ওপর ভয়ঙ্কর অসন্তুষ্ট ছিলেন উনি।' রামচন্দ্র বললেন।

'মিসেস মিত্র। আপনার কিছু বলার আছে?'

'আমাদের বিয়ের সময় সুন্দর আমেরিকায় ছিল। তাকে আনা হয়নি। আমি জিজ্ঞাসা করাতে উনি বলেছিলেন সে এসে সমস্যা তৈরি করতে পারে। আমি যতদিন, যতবার এই শহরে ছিলাম তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেননি তিনি। সুন্দরকে হোটেলেই থাকতে হত। ছেলের সম্পর্কে ওর কোনও স্নেহ-মায়া ছিল না। উনি প্রায়ই বলতেন আমার সন্তান হলে সে-ই উত্তরাধিকারত্ব পাবে। কিন্তু কাউকে বঞ্চিত করে আমি সুখী হতে চাইনি।' গলা ডিজে গেল কৃষ্ণা মিত্রের।

ঠিক তখনই একজন অফিসার ঘরে ঢুকে তার তদন্তকারী অফিসারকে নীচু গলায় কিছু বলে একটা ফাইল এগিয়ে দিলেন। তাতে চোখ বুলিয়ে ভদ্রলোক দুর্যোধন মিত্রের কাছে ফাইলটা নিয়ে গিয়ে বললেন, 'হাসপাতাল থেকে পাঠিয়েছে, অপারেশনের আগে আপনার সই দরকার। সইটা আমাদের সামনে করা হয়েছে বলে জানাতে হবে।'

দুর্যোধন মিত্র সই করে দিলেন। ফাইলটা অফিসারকে ফিরিয়ে দিলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। তদন্তকারী অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, 'মিস্টার মিত্র, আপনার কিছু বলার আছে?' 'হাঁ, আপনি এতক্ষণ যা বললেন সবই আপনার কল্পনাপ্রসূত।'

'ওয়েল। সেটা আদালতে প্রমাণ করবেন। ওয়েল মিসেস মিত্র, মিস্টার বণিক, আপনাদের কষ্ট দেওয়ার জন্যে দুঃখিত। আপনারা এখন যেতে পারেন আর যাওয়ার সময় এই বেচারাকে সঙ্গে নিয়ে যান, একে আর আমাদের প্রয়োজন নেই। অফিসার নেপালি লোকটাকে ইশারা করলেন।'

রামচন্দ্র বণিক জিজ্ঞাসা করলেন, 'মিস্টার মিত্র-?'

'ওকে আরও প্রশ্ন করার দরকার। উনি আমাদের কাস্টডিতে থাকবেন।'

'নো।' চেঁচিয়ে উঠলেন দূর্যোধন মিত্র, 'আমি আমার ল-ইয়ারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।' 'তার জন্যে অনেক সময় পাবেন মিস্টার মিত্র।'

বাইরে বেরিয়ে এসে রামচন্দ্র বললেন, 'ওঃ, বুকের ওপর থেকে পাথরটা নেমে গেল।'

'যা বলেছ। হত্যার চেষ্টার জন্যে কত বছর জেল হয়? মিসেস মিত্র জিজ্ঞাসা করলেন। 'ইট ডিপেন্ডস। দশ তো হবেই। রামচন্দ্র বললেন, 'এখন থেকে আপনাকে আমাদের শহরে থাকতে হবে। আপনি কি আপনার গাড়িতে যাবেন?' 'আমি? ঠিক আছে, আপনার সঙ্গেই যাচ্ছি। আমারটা আমাদের ফলো করুক। এই লোকটাকে

নিয়ে এখন কী করা যায়?'

'ওকে নিউদিল্লি স্টেশনে নামিয়ে দেব। এই, পেছনে উঠে বস।'

রামচন্দ্র গাড়ি চালাচ্ছিল। পাশে মিসেস মিত্র। পেছন থেকে লোকটা বলল, 'সাব্।'

'আবার কি হল?

'আমি এখান থেকে নেপালে চলে যাব।'

'যাও। রঙ্গৌল হয়ে যেতে পারো।'

'তাহলে এখন টাকাটা দিয়ে দিন।'

'কীসের টাকা?'

'আপনি পাঁচ হাজার দিয়েছেন। আরও পঁয়তাল্লিশ দেওয়ার কথা। মেমসাবও পঞ্চাশ দেবেন বলেছিলেন। ওই টাকা পেলে গ্রামে গিয়ে ক্ষেতি করে জীবন কাটাতে পারব।'

'আমি যা বলেছিলাম তুমি সেই কাজ করোনি।'

কী করে করব? হাসপাতালে ঢুকতেই পারিনি।' '

নিউদিল্লি স্টেশনের সামনে পৌঁছে পকেট থেকে একটা দশ হাজারের বান্ডিল বের করে শোকটার দিকে ছুড়ে দিয়ে রামচন্দ্র বলল, 'নেমে যাও।'

'সাব, আপনি বেইমানি করছেন।'

'কী? এত বড় কথা? তুমি কি চাও তোমার অবস্থা ওই সুমো গাড়ির ড্রাইভারের মতো

হোক? যাও, নেমে যাও।' বেশ জোরে ধমক দিল রামচন্দ্র বণিক।

লোকটি চুপচাপ নেমে গেল।

কৃষ্ণা বললেন, 'এখন ক'টা বাজে?'

'আড়াইটে বেজে গেছে।'

'লেটস গো টু সাম প্লেস। এরকম রাত সেলিব্রেট না করলে ভালো লাগবে না।'

'থ্যাঙ্ক ইউ। কিন্তু ম্যাডাম, আপনার শরীর যদি খারাপ হয়?'

'শরীর?'

'শুনেছি মিত্র পরিবারের বংশধর আসছে।'

সঙ্গে সঙ্গে সজোরে হেসে উঠলেন মিসেস কৃষ্ণা মিত্র। রামচন্দ্র গাড়ি চালাতে চালাতে অবাক চোখে তাকাল।

'আই অ্যাম অলরাইট। ওটা বলে দুর্যোধনকে শেষ চেষ্টা করেছিলাম মডিফাই করার।' আবার হাসলেন মহিলা, 'আমি কি পাগল!'

হোটেল সিজার্সের সামনে গাড়ি থামাতেই ঘড়িতে তিনটে বাজল। এখানকার নাইট ক্লাব ভোর চারটে পর্যন্ত খোলা থাকে। হোটেলের কর্মচারীর হাতে গাড়ির চাবি দিয়ে দু পা এগোতেই ভূত দেখার মতো দাঁড়িয়ে গেলেন মিসেস কৃষ্ণা মিত্র। তাঁর দৃষ্টি লক্ষ্য করে পেছন ফিরলেন রামচন্দ্র বণিক।

অফিসার এগিয়ে এলেন, 'এই ভোরে আপনারা নিশ্চয়ই একটু আনন্দ করতে এসেছেন! কিন্তু সরি, আমি সেটা অ্যালাও করতে পারছি না।'

'মানে? আপনি কি বলছেন? চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস কৃষ্ণা মিত্র।

এই সময় আর একটা গাড়ি এসে পেছনে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে একজন পুলিশ সাবইনস্পেকটর যাকে টেনে বের করে আনল তাকে দেখে দুজনের চোখ বড় হয়ে গেল।

অফিসার এগিয়ে গিয়ে ইনস্পেকটরকে বললেন, 'ওটা নিয়ে নিয়েছেন?' 'হ্যাঁ স্যার। এই যে।' একটা ছোট্ট যন্ত্র এগিয়ে দিলেন ইনস্পেকটর।

সেটা নিয়ে দ্বিতীয় গাড়ি থেকে রেকর্ড প্লেয়ার বের করে চালিয়ে দিতেই রামচন্দ্রর গলা শোনা গেল, 'ওঃ, বুকের ওপর থেকে পাথরটা নেমে গেল।'

খানিকটা শোনানোর পর অফিসার বললেন, 'মিস্টার রামচন্দ্র বণিক, মিসেস কৃষ্ণা মিত্র, সুন্দর মিত্রকে হত্যার চেষ্টার জন্যে আপনাদের অ্যারেস্ট করা হচ্ছে। এই লোকটি নিশ্চয় প্রাণের দায়ে রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়েছে। আমি জানতাম আপনাদের সঙ্গে এমন সব কথা হবে যা ভবিষ্যতে আমাদের কাজে লাগবে। আপনারা একবারও ভেবে দেখলেন না যে ওকে ছেড়ে দেওয়ার কোনও যুক্তি নেই। তবু ছেড়েছিলাম। ছেড়েছিলাম এই রেকর্ডারটা দিয়ে। ইনস্পেকটর, আপনি আপনার কাজ করুন।'

তিনদিন আগে অপারেশন হয়ে গেছে। ডাক্তার খুব আশাবাদী। আজ চোখ খুলল সুন্দর। ডাক্তার ইশারায় লীলাকে কাছে ডাকলেন। সীলা পাশে এসে দাঁড়াতেই সুন্দরের ঠোঁটে হাসি ফুটল। হাত বাড়িয়ে লীলার হাত ধরল সে। তারপর ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, 'তোমার বাবা কেমন আছেন?"

লীলা জবাব দিতে পারল না। কিন্তু পেছন থেকে দুর্যোধন মিত্রের গলল ভেসে এল, 'হি ইজ অলরাইট মাই সন। অপারেশন সাকসেসফুল। আমি ওঁদের অনুরোধ করেছি ডাক্তাররা পারমিশন দিলেই যেন আমাদের শহরে অতিথি হয়ে আসেন।'

'অতিথি?' সুন্দর তাকাল।

'এখনও পর্যন্ত তো ওঁদের অতিথিই বলতে হবে।'

ডাক্তার বললেন, 'উই আর গ্রেটফুল টু সীলা। ওর জন্যেই সব সম্ভব হল। আমি কি সবাইকে অনুরোধ করতে পারি এই কেবিনের বাইরে যেতে? নার্স, আপনিও চলুন।'

সঙ্গে সঙ্গে কেবিন খালি হয়ে গেল। কেবিনের ভেতর এখন শুধু লীলা এবং সুন্দর।


1

লীলাসুন্দর : প্রথম অধ্যায়

13 January 2024
1
0
0

'যোধন মিত্র ভালো করেই জানেন যে, এই পাহাড়ি শহরে তাঁর কোনও বন্ধু নেই। লোকে দু তাঁকে ঈর্ষা করে, তাঁর সম্পর্কে বাঁকা কথা বলে। কিন্তু সেসব বলে তাঁর আড়ালে। এই জেলায় তাঁর চা-বাগান থেকে সবচেয়ে ভালো চা তৈরি হয়

2

লীলাসুন্দর : দ্বিতীয় অধ্যায়

16 January 2024
1
0
0

পাহাড়ের মুখে মেধ জড়াতে বেশি সময় লাগে না। সেই মেঘ ভারী হয়ে গেলেই বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে। খানিকটা বর্ষণের পরে আবার সব পরিষ্কার। পাহাড়ের খাঁজে সেই বৃষ্টির জল ভিজিয়ে দিয়েছিল সুন্দরকে। শীতল জল ও হাওয়ার স্পর্শ

3

সোনার শেকল

17 January 2024
1
0
0

মাস আগের এক বিকেলে মন নরম হয়েছিল কামাল হোসেনের। ভাগনে মতিনের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, 'আমি তোমাকে একশোবার বলেছি আমার এমনিতেই লোক বেশি, চাকরি দিতে পারব না। এই কথাটা কানে ঢোকে না কেন?' মতিন মুখ নীচু করে দ

4

স্বপ্নেই এমন হয়

18 January 2024
1
0
0

রারাত মেল ট্রেনে না ঘুমিয়ে বসে থাকতে হয়েছিল। একদিন আগে টিকিট কাটলে এসব সা ট্রেনে শোওয়ার জন্যে বার্থ খালি পাওয়া যায় না। সকালে ট্রেনটা জংশন স্টেশনে দাঁড়ালে প্ল্যাটফর্মে নেমে মিলন জেনেছিল, তাকে এখনও ঘণ্ট

---