shabd-logo

লীলাসুন্দর : প্রথম অধ্যায়

13 January 2024

4 Viewed 4

'যোধন মিত্র ভালো করেই জানেন যে, এই পাহাড়ি শহরে তাঁর কোনও বন্ধু নেই। লোকে দু তাঁকে ঈর্ষা করে, তাঁর সম্পর্কে বাঁকা কথা বলে। কিন্তু সেসব বলে তাঁর আড়ালে। এই জেলায় তাঁর চা-বাগান থেকে সবচেয়ে ভালো চা তৈরি হয় এবং সেখানে কখনও শ্রমিক বিক্ষোভ হয়নি। এই না হওয়ার পেছনে দুটো কারণ আছে। দুর্যোধন মিত্র বলেন, মালিক হিসেবে তিনি অত্যন্ত পেশাদার। শ্রমিকদের উৎসাহিত করতে প্রচুর সুযোগ-সুবিধে এবং ভালো মাইনে দিয়ে থাকেন, যা অন্যান্য চা-বাগানে গেলে তারা পাবে না। নিন্দুকদের বক্তব্য হল, শ্রমিকদের মধ্যে যারা নেতা হতে চায় তাদের তিনি কিনে ফেলেন অথবা সরিয়ে দেন। রাতে বাড়ি ফেরার সময় কোথায় তারা হারিয়ে যায় আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই নেতৃত্ব দেওয়ার মানুষ না থাকলে বিক্ষোভ-আন্দোলন কে সংগঠিত করবে।

এই জেলায় ট্রান্সপোর্ট ব্যবসার অর্ধেকটাই দুর্যোধন মিত্র নিয়ন্ত্রণ করেন। বাস-ট্যাক্সি ছাড়াও মালপত্র বহন করার জন্য পাহাড়ি এলাকার উপযুক্ত গোটা দশেক ট্রাক তাঁর আছে।

দুর্যোধন মিত্রের দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ছিল অন্তত থ্রি-স্টার হোটেল তৈরি করার। পাহাড় কেটে আড়াই বছরের চেষ্টায় সেই হোটেল শেষ করেছেন ক'দিন আগে। ওপর-নীচের দুটো রাস্তার পাশ দিয়ে পাঁচতারা হোটেল তৈরি করিয়েছেন বিশেষজ্ঞ আর্কিটেক্টদের পরামর্শ নিয়ে। দেড়শো ঘরের ওই হোটেল যাতে ঠিকঠাক চলে তার জন্য দেশের বিভিন্ন হোটেলে কর্মরত দক্ষ কর্মচারীদের এনেছেন বেশি মাইনে দিয়ে।

দুর্যোধন মিত্রের বাসনা ছিল, এ হোটেল উদ্বোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রী অথবা অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করবেন। তাঁদের পক্ষে সম্ভব না হলে শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী তো রয়েছেনই। এ ব্যাপারে তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রামচন্দ্র বণিক। রামবাবু দশ বছর আগেও এমএলএ ছিলেন। গত দু-বছর ধরে লোকসভার মাননীয় সদস্য। পঁচিশ বছর আগে রামবাবু ছিলেন ট্রান্সপোর্ট ইউনিয়নের তরুণ তুর্কি নেতা। একবার ট্রান্সপোর্টের কর্মচারীরা বেতন বৃদ্ধির দাবি নিয়ে ধর্মঘটের পক্ষে যাচ্ছিল। রামবাবু এসেছিলেন অন্য নেতাদের সঙ্গে দুর্যোধন মিত্রকে হুমকি দিতে; কিন্তু তাঁর কথাবার্তার ধরন খুব পছন্দ হয়ে গেল দুর্যোধন মিত্রের। তিনি দাবি মেনে নিয়ে বললেন, রামবাবুর যুক্তি তাঁকে প্রভাবিত করেছে। শ্রমিকরা খুব খুশি, ধর্মঘট হল না। কিছুদিন বাদে রামবাবুকে ডেকে এনে দুর্যোধন মিত্র বললেন, 'তুমি ভালো বক্তা, আমি তোমার মধ্যে আগুন দেখতে পাচ্ছি। একটা সামান্য ট্রান্সপোর্ট ইউনিয়নের সঙ্গে তুমি নিজেকে জড়িয়ে রাখছ কেন?'

'আমি আর কী করতে পারি?' থতমত হয়ে বলেছিলেন রামবাবু। 'তুমি মূল রাজনীতিতে এসো। এখন কংগ্রসের অবস্থা খুব খারাপ। যিনি এমএলএ আছেন তাঁকে তো প্রায়ই হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। তুমি কয়েকজনকে নিয়ে কলকাতায় গিয়ে দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলো। আমিও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।' দুর্যোধন মিত্র আশ্বাস দিয়েছিলেন।

সেই শুরু। কয়েক বছরের মধ্যে নির্বাচনে জয়ী হলেন রামচন্দ্র বণিক। তাঁর নির্বাচনের সমস্ত খরচ বহন করেছিলেন দুর্যোধন মিত্র। তার হিসাব দেখিয়ে তিনি নতুন এমএলএ-কে বলেছিলেন, 'তোমাকে আরও এগোতে হবে।'

সেই থেকে এই পাহাড়ে যে কথাটা সবাই জেনেছিল এখানে দুর্যোধন মিত্রের কথাই শেষ কথা, রামবাবু সেই কথাতেই পরিচালিত হন। দ্বিতীয়বার এমএলএ হওয়ার পর রামবাবুর দল পাহাড়ের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী হয়ে উঠল। রামবাবু বিধানসভা থেকে লোকসভায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং দলের একজন বিশ্বস্তজনকে এমএলএ করতে চাইলেন। সংঘাত লাগল তখন থেকেই। দুর্যোধন মিত্র লোকটিকে অপছন্দ করা সত্ত্বেও রামবাবু সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। রামবাবু ততদিনে ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে গেছেন এবং দুর্যোধন মিত্রের দাদাগিরি আর মেনে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু এই সংঘাতের খবর বাইরে প্রচারিত হল না। দুর্যোধন মিত্র রামবাবুর সিদ্ধান্তকে হজম করলেন ধৈর্য দেখিয়ে। বাইরের কেউ তাঁর অখুশির কথা জানতে পারল না।

এখনও রামবাবুর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। কিন্তু তিনি সবক্ষেত্রে দূর্যোধন মিত্রকে অস্বীকার করতে পারেন না। পারেন না কারণ দুর্যোধন মিত্রের অর্ধবল বিন্দুমাত্র কমেনি, উলটে বেড়েছে। যে যে উপায়ে সেটা বাড়ছে তা সহজ করতে রামবাবুকেই সাহায্য করতে হয়। অনিচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। রামবাবু ভালোভাবেই জানেন তাঁর জনপ্রিয়তা এখনও দুর্যোধন মিত্রের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করছে। তিনি যে মাঝে মাঝেই রামবাবুর সিদ্ধান্ত মেনে নেন তা নেহাতই একটা ছক, ভবিষ্যতে আরও বড় কিছু পাওয়ার জন্য। দ্বিতীয়ত, রামবাবুর রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে দুর্যোধন মিত্রের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। মোটা টাকা তাদের নির্বাচনী তহবিলে দান করেন তিনি। রামবাবু চাইলেও তাঁর দল দূর্যোধন মিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করবে না।

আজ সকালে রামবাবুর ব্যক্তিগত ফোন বাজল। সুইচ অন করে হ্যালো বললেন তিনি। কোনও নাম্বারের বদলে তাঁর মোবাইলে ফুটে উঠেছে প্রাইভেট নাম্বার শব্দ দুটো। এই ফোন কার তিনি জানেন। তাই সঙ্গে সঙ্গে জুড়ে দিলেন, 'বলুন দানা।'

'তুমি কী কথা বলেছিলে?' দুর্যোধন মিত্র জিজ্ঞাসা করলেন।

'হ্যাঁ দাদা, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বোধহয় আসা সম্ভব হবে না, কিন্তু অর্থমন্ত্রী রাজি হয়েছেন। আপনি এ নিয়ে চিন্তা করবেন না।' রামবাবু বললেন।

'তোমার কথার অর্থ আজকাল আমি বুঝতে পারি না রাম।'

'কেন?'

'তুমি বললে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বোধহয় আসা সম্ভব হবে না। এটা বোধহয় বললে কারণ তিনি এখনও নাকচ করে দেননি। সামান্য হলেও সম্ভাবনা আছে বলেই বোধহয় বললে। অথচ তুমি অর্থমন্ত্রীকে রাজি করিয়ে ফেলেছ। এখন প্রধানমন্ত্রী যদি শেষ পর্যন্ত সময় দেন তাহলে অর্থমন্ত্রীকে কী বলবে? আপনাকে আমাদের দরকার নেই? দুজনকে তো একই কারণে আসতে বলা যাবে না।' রামবাবু বললেন, 'আমার বলাটা ঠিক হয়নি। প্রধানমন্ত্রী আসতে পারবেন না জেনেই আমি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। আগামী সপ্তাহের শেষদিকে উনি তারিখটা জানাবেন।' 'এতদিন অপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি তো জানো আমার হোটেলের কাজ শেষ। রিক্রুটমেন্ট হয়ে গেছে। তুমি এই জেলার নির্বাচিত সাংসদ। তাই তোমার মাধ্যমেই আমি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছি।' আর কথা না বলে টেলিফোন রেখে দিলেন দুর্যোধন।

রামবাবু মুখ বিকৃত করলেন। দুর্যোধন ভেবে নিয়েছেন সামান্য শ্রমিক নেতা থেকে বিধায়ক এবং পরে সাংসদ করে তিনি তাঁকে কিনে নিয়েছেন। এই জেলাতে ওই একটি লোক ছাড়া কেউ তাঁর সঙ্গে এভাবে কথা বলতে সাহসী হয় না। এই সমস্যার কথা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির দু-তিনজন নেতাকে বলেছিলেন তিনি, তাঁরা উপদেশ দিয়েছেন কোনওরকম সংঘাতে যাওয়া বোকামি হবে। তা ছাড়া তাঁদের দলের জন্য শত্রু জমি তৈরি করতে সাহায্য করেছেন দুর্যোধন। তিনি বিরোধিতা করলে দল বিপদে পড়তে পারে।

রামবাবু সেটা জানেন। গত বছর লোকসভার কয়েকজন সাংসদ ব্যাংকক-মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন শুভেচ্ছা সফরে। রামবাবু সেই দলে ছিলেন। কী মতিভ্রম হল, আর একজন তরুণ সাংসদের পাল্লায় পড়ে গোপনে গিয়েছিলেন ম্যাসাজ ক্লিনিকে। নিষিদ্ধ ফলের রস উপভোগ করেছিলেন। ঘটনার কথা দলের কেউ জানতে পারেনি। দেশে ফিরে আসার পর দুর্যোধন মিত্র জানতে চাইলেন সফর কেমন হল? খুব ভালো হয়েছে বলতে ভদ্রলোক নীচু গলায় বলেছিলেন, 'বাঃ। গুড। তবে ম্যাসাজ ক্লিনিকে গিয়ে তুমি ঠিক কাজ করোনি।'

রামবাবুর মনে হয়েছিল তাঁর শরীরে এক ফোঁটাও রক্ত নেই। কথা হচ্ছিল টেলিফোনে, কোনওরকমে চেয়ারে বসে পড়লেন।

'শুনতে পাচ্ছ?' দুযোর্ধন মিত্র জিজ্ঞাসা করলেন। 'হ্যাঁ দাদা।' শুকনো গলায় বলেছিলেন রামবাবু।

'তোমরা হলে জননায়ক। তোমাদের ওপর পাঁচজনের নজর তো থাকবেই। ধরো, যেখানে গিয়েছিলে সেখানে কেউ যদি তোমার ছবি তুলে রাখে তাহলে কী কাণ্ডটাই না ঘটবে। সেই ছবি দেখলে জনগণ তোমাকে ভোট দেবে? পার্টি তোমাকে কি ক্ষমা করবে? একটু ভেবেচিন্তে পা ফেলো।'

'দাদা, আ-আপনি-!

'আরে না না। আমি তোমাকে কেন বিপদে ফেলব! রাখছি।'

সেদিন অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন তিনি। কী করে দূর্যোধন মিত্র জানতে পারলেন তা নিয়ে ভেবে কোনও লাভ নেই। কিন্তু ওই যে ছবির কথা বললেন তা কি এমনি এমনি বললেন? নিশ্চয়ই কেউ তাঁর সে সময়ের ছবি তুলেছে এবং তার কপি জোগাড় করেছেন দুর্যোধন মিত্র। কিন্তু মুখে বললেন বিপদে ফেলবেন না। অতএব, দুর্যোধন মিত্রকে তোয়াজ না করে রামবাবুর উপায় নেই। বেশ কয়েকবার ভেবেছেন, লোকটাকে সরিয়ে দিলে কেমন হয়? পাহাড়ি নির্জন রাস্তার বাঁকে ওঁর গাড়ির ছাদে ওপর থেকে বড় পাথর গড়িয়ে দিলেই কেল্লা ফতে। দুর্যোধন মিত্রের ওপর যাদের রাগ আছে অথচ রামবাবুর কারণে সেটা গিলে ফেলে তাদের দু-একজনকে একটু উস্কে দিলেই কাজটা হয়ে যাবে। পুলিশ ব্যাপারটা দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নেবে। কিন্তু তার পরেই ভাবনাটা মাথা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

দুর্যোধন মিত্র এ পৃথিবীতে না থাকলে কী হবে। ওই ছবিগুলো তো থাকবে। ওঁকে সরাবার আগে ছবিগুলোকে হাতানো দরকার। ওঁর কিছু হয়ে গেলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ না বেরিয়ে আসে। রামবাবুর স্থির করলেন, তিনি সময়ের জন্য অপেক্ষা করবেন। চিরকাল নিশ্চয়ই সময় একরকম থাকবে না। দুর্যোধন মিত্রের বাড়িটিকে স্থানীয় মানুষ শ্বেতপ্রাসাদ বলে। টিলার ওপরে বিশাল সাদা রঙের বাড়ি। বাড়ির সামনে সুন্দর ফুলের বাগান। বাড়ির চারপাশের লোহার রেলিংগুলোও সাদা রং করা। গেটে অষ্টপ্রহর প্রহরী থাকে। কেউ দুর্যোধনের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে গ্রহরী টেলিফোনে তাঁর সেক্রেটারিকে জানায়। সেক্রেটারি দুর্যোধনের সঙ্গে কথা বলে অনুমতি দিলে তবে গেট খোলা হয়।

অপিস থেকে বাড়িতে ফিরে পোশাক পরিবর্তন না করে দুর্যোধন বাড়ির পেছনের সুইমিং পুলের দিকে এগিয়ে গেলেন। বিকেলের এ সময়টায় তাঁর স্ত্রীকে পুলের পাশের ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকতে দেখা যাবে বলে তিনি জানেন। দুর্যোধন দেখলেন পুলের জল টলটল করছে। ভেতরটায় নীল রং থাকায় জলের গায়ে নীলচে ছোপ পড়েছে। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে স্ত্রীর পাশে বসলেন তিনি। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'চমৎকার আবহাওয়া। তবে মাসখানেক বাদে ঠান্ডা পড়ে যাবে। তখন তোমাকে এখানে বসতে হলে গরম পোশাক ব্যবহার করতে হবে।'

মহিলা সুন্দরী। দীর্ঘাঙ্গী। দিল্লি থেকে গ্রাজুয়েশনের পর ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের কোর্স করেছেন। অল্প বয়স থেকেই পুরুষবিদ্বেষী এই মহিলা অবিবাহিত থাকবেন বলে ঠিক করেছিলেন। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে দুর্যোধন মিত্রের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। দুর্যোধনের বয়স তখন পঞ্চান্ন। ছিপছিপে মেদহীন শরীর এবং বিপত্নীক এ মানুষটি মহিলাকে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ করেনি। একজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তাঁর প্রদর্শনীতে এসেছিলেন দুর্যোধন। মোটা টাকার পোশাক কিনেছিলেন। সেদিন আলাপের সময় রাজনৈতিক নেতা বলেছিলেন, দুর্যোধন এক অপূর্ব পাহাড়ি উপত্যকার মুকুটহীন সম্রাট। মৃদু প্রতিবাদ করেছিলেন দুর্যোধন। যাওয়ার আগে আমন্ত্রণ জানিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর শহরে যাওয়ার জন্য।

বেশ কয়েকবার ফোনে অনুরোধ পাওয়ার পর কৃষ্ণা চৌধুরী তাঁর মাকে নিয়ে এসেছিলেন এই পাহাড়ে। যিনি কোনও পুরুষের প্রতি আসক্ত হননি তিনি প্রথম দর্শনেই এ পাহাড়ের প্রেমে পড়ে যান। দুর্যোধনের প্রাসাস, তাঁর আতিথ্য, সৌজন্যবোধ দেখে খুশি হয়। দিল্লিতে ফিরে যাওয়ার তিন মাস পরে দুর্যোধন যখন বিয়ের প্রস্তাব দিলেন তখন দো-মনা করে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে যান কয়েকটা শর্তে। এক, তাঁর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা চলবে না। তার মানে এই নয় যে, তিনি দুর্যোধনকে অসম্মানিত করবেন। দুই, দুর্যোধনের প্রথম পক্ষের স্ত্রীর একমাত্র পুত্র যে আমেরিকায় পড়াশোনা করছে, তার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকবেন না।

দুর্যোধন মেনে নিয়েছেন। তিনটি বছরের বিবাহিত জীবনে কোনও অশান্তি আসেনি। মাঝে মাঝে দিল্লিতে যান কৃষ্ণা, দিন পনেরো থেকে আসেন। তাঁর ওপর দুর্যোধনের সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে। কৃষ্ণা মাথা না তুলে বললেন, 'হঠাৎ?'

বুর্যোধন মিত্র হাসলেন, 'বাড়িতে ঢুকেই মনে হল তোমার সঙ্গে একটু কথা বলে যাই। এ৬৬লে ব্যবসা একা সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে মনে হয় সব ছেড়ে তোমায় নিয়ে পৃথিবীটাকে ভালো করে দেখি।"

এ সময় দুর্যোধন মিত্রে কোটের পকেটে মৃদু বাজনা বাজল।

কৃষ্ণা চোখ সরালেন, 'দেখছ তো, ব্যবসা তোমাকে ছাড়বে না।

সেলফোন বের করে বন্ধ করতে গিয়েও নাম দেখে ওটাকে অন করলেন দূর্যোধন মিত্র, 'কী ব্যাপার।'

'এইমাত্র সরাসরি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হল, সামনের মঙ্গলবার বিকেল তিনটে থেকে চারটে সময় দিয়েছেন। দিল্লি থেকে সকালের ফ্লাইটে আসবেন। নিজের শহরে একটি মিটিং করে এখানে পৌঁছবেন তিনটের সময়। তার মানে মাঝখানে তিনদিন সময় আছে। আমি বলেছি আপনার সঙ্গে কথা বলে কনফার্ম করব। এত বড় ব্যাপার আয়োজন করতে সময়টা একটু কম হয়ে যাচ্ছে না?' রামবাবুর গলায় উদ্বেগ ধরা পড়ল।

'কোনও উপায় নেই। যুদ্ধটা জিততেই হবে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের সঙ্গে আমি কথা বলেই রেখেছিলাম, রাতে কথা বলব। ও হ্যাঁ, আর একটা কথা'

'বলুন দাদা।'

'তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।' সেলফোন বন্ধ করলেন দুর্যোধন। হাসি ফুটল তাঁর মুখে। বললেন, 'দুটো ভালো খবর আছে কৃষ্ণা।"

'তাই?' সোজা হয়ে বসলেন কৃষ্ণা। চোখে কৌতূহল।

'আগামী মঙ্গলবার হোটেল উদ্বোধন করতে স্বয়ং অর্থমন্ত্রী এখানে আসছেন। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন সার্থক হতে চলেছে।'

মাথা নাড়লেন কৃষ্ণা, 'অভিনন্দন। সত্যি এটা আনন্দের খবর। কী নাম রাখছ হোটেলের? ঠিক করতে পেরেছ?'

'তোমার বলা নামটাই পছন্দ করলাম।'

'সত্যি?' হাত বাড়ালেন কৃষ্ণল হাসিমুখে।

সেই হাত ধরে আঙুলের গায়ে ঠোঁটে চাপ দেন দুর্যোধন। 'সত্যি।'

'উদ্বোধনের দিনেই অ্যানাউন্স করবে?'

'সিওয়। অর্থমন্ত্রী বোতাম টিপলে পরদা সরে যাবে। তখন নামটা সবাই পড়তে পারবে। হিলটপ।' হাসলেন দুর্যোধন মিত্র, 'আমি তখন ঘোষণা করব যে নামকরণ তুমিই করেছ।'

'সো নাইস অব ইউ। এবার দ্বিতীয় ভালো খবরটার কথা বলো।'

'তুমি কীভাবে নেবে আমি বুঝতে পারছি না।'

কৃষ্ণর কথা না বলে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

দুর্যোধন মিত্র বললেন, 'সুন্দর কলকাতায় আসছে, নেমেই সকালের ফ্লাইট ধরবে। এখানে পৌঁছতে দুপুর হয়ে যাবে। এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠাতে বলেছে।'

সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন কৃষ্ণা। কয়েক পা এগিয়ে রেলিংয়ে হাত দিয়ে জলের দিকে তাকালেন। দুর্যোধন মিত্র স্ত্রীর পাশে চলে এলেন, 'কৃষ্ণা।'

মাথা নাড়লেন কৃষ্ণা, 'এটা তোমার কাছে ভালো খবর হতেই পারে কিন্তু বিয়ের আগে আমি তোমাকে যে শর্ত দিয়েছিলাম সেটা নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি।'

'কিন্তু কৃষ্ণা, আমাদের বিয়ে তিন বছর হয়ে গেছে। তোমার সঙ্গে ওর কোনও কথাই হয়নি। ও ফোনে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল, ভূমি রাজি হওনি, এ তিন বছর আমি ওকে দেশে ফিরতে দিইনি। ও আসুক, ওর সঙ্গে আলাপ করো, হয়তো তোমার ওকে পছন্দ হবে। আফটার অল ও তোমার ছেলে।'

'ছেলে? ওর বয়স কত?'

'সাতাশ।'

'তাহলে তো এগারো বছর বয়সে আমাকে মা হতে হত। তুমি কী করে ভাবতে পারলে একজন সাতাশ বছরের যুবককে দেখে আমার মধ্যে মাতৃভাব জেগে উঠবে? তা ছাড়া তোমার প্রথম

পক্ষের স্ত্রী বা তার সন্তানের ছায়া যেন আমার ওপর না পড়ে, আমি তোমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম।' কৃষ্ণার

চোখ ভিজল।

'আমি চেষ্টা করেছিলাম সুন্দর যেন আমেরিকায় থেকে যায়, কিন্তু..

'কিন্তু...!!

'ওর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং আর এক্সটেন্ড করছে না।'

'কেন?'

'কী বলব! একটি মহিলাঘটিত মামলায় ও অড়িয়ে গিয়েছিল।'

'চমৎকার।'

'আমি সেটা জেনে ওকে খুব ভৎসনা করেছি। ও ক্ষমা চেয়েছে।'

'ওয়েল, তোমাকে একটা অনুরোধ করছি। কাল সকালের দিল্লি ফ্লাইটের টিকিট কেটে দাও। আমি ওখানে অনেক বেশি কমফোর্টেবল থাকব।'

'সে কী। তিনদিন পরে অর্থমন্ত্রী এসে হোটেলের উদ্বোধন করবেন আর তুমি কালই চলে যেতে চাইছ। আর ইউ ম্যাড?'

'এখনও নয়। তবে থাকলে হয়ে যেতে পারি।'

'কৃষ্ণা, প্লিজ, একবার ভেবে দ্যাখো, তুমি চলে গেলে আমি কী ব্যাখ্যা দেব? এত বড় একটা প্রজেক্ট উদ্বোধন করতে স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আসছেন আর আমার স্ত্রী তার দুদিন আগে চলে যাচ্ছেন, কী কৈফিয়ত দেব?'

'সমস্যাটা তোমার, আমার নয়।'

'তুমি আমাকে এত বড় সমস্যায় ফেলে দেবে?'

'আমি কোথায় ফেলছি? সমস্যা তো তুমি তৈরি করছ।'

'আমি কী করে সুন্দরকে বলি যে এখন তুমি এসো না।'

সত্যি তো কী করে বলবে: তার চেয়ে অনেক সহজ আমাকে ছেড়ে দেওয়া।' কৃষ্ণন দ্রুত হেঁটে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন।

মাথা কাজ করছিল না দুর্যোধনের। অর্থমন্ত্রী জানতে চাইবেন মিসেস মিত্র কোথায়? আর কেউ না বলুক রামচন্দ্র বণিক মুখ বন্ধ করে নিশ্চয়ই থাকবে না।

নিজের শোয়ার ঘরে এসে পোশাক পালটে বাথরুমে ঢুকে মিনিট তিনেক স্নান করার পরেও অস্বস্তি গেল না দুর্যোধনের। সেখান থেকে বেরিয়ে একেবারে রাতপোশাক পরে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত এই বাড়ির জানালা সচরাচর খোলা হয় না। প্রবল শীতের সময় ঠান্ডার বদলে গরম হাওয়া মেশিন ছড়িয়ে দেয় বাড়ির সর্বত্র। কাচের আড়াল থেকে দুর্যোধন দেখলেন সামনের পাহাড়ে আলো জ্বলে উঠেছে। অপূর্ব দৃশ্য। কিন্তু ওই দৃশ্য উপভোগ করার মতো মন তাঁর এই মুহূর্তে নেই।

না, কৃষ্ণাকে বাদ দিয়ে হোটেলের উদ্বোধন তিনি ভাবতেই পারছেন না। তাঁর সম্মান একেবারে ধূলোয় লুটিয়ে পড়বে। অথচ সুন্দর এলে কৃষ্ণা এ বাড়িতে থাকবে না। তিনি কৃষ্ণার ওপর একটু বিরক্ত হলেও রাগ করতে পারছেন না। বিয়ের আগে মহিলা যে শর্ত দিয়েছিলেন এটা তার অন্যতম। দুর্যোধন সে সময় এটা মেনেই নিয়েছিলেন।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে যে ঘরে সেলার আছে সেখানে ঢুকতেই উর্দি পরা বেয়ারা ছুটে এলো। দুর্যোধন একটা লম্বা টুলে বসে বললেন, 'লার্জ হুইস্কি।' বেয়ারা পরম যত্নে সেটা তৈরি করে ন্যাপকিনে জড়িয়ে সামনে রাখল। রেখে নম্র গলায় বলল, 'সঙ্গে কী দেব স্যার?'

তখনই দুর্যোধনের খেয়াল হল তাঁর খিদে পেয়েছে। কিন্তু তিনি মাথা নাড়লেন, 'কয়েকটা কাজু দাও। আর আলোগুলো কমিয়ে দিও।'

আদেশ মান্য করে বেয়ারা বেরিয়ে গেলে দুর্যোধন ওই বড় ঘরে একাকী বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর গ্লাসে চুমুক দিলেন। আর একবার কৃষ্ণার সঙ্গে কথা বললে কি লাভ হবে? উত্তরটা তিনি ভালো করেই জানেন। কৃষ্ণার বেডরুম বেশি দূরে নয়। বিয়ের পর থেকেই স্বামী-স্ত্রীর শোয়ার ঘর আলাদা করে নিয়েছিল কৃষ্ণা। যেদিন একত্রে থাকার বাসনা হত সেদিন সন্ধ্যা থেকেই আবহাওয়া পালটে যেত। এই বয়সে মা হতে চায়নি কৃষ্ণা। এখন সন্তান হলে তাকে মানুষ করার মতো পর্যাপ্ত সময় পাবেন না জেনে জোর করেননি দুর্যোধন। কিন্তু এর জন্য তাঁদের মিলনে কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু আজ আবহাওয়া অন্যরকম। এখন ওর ঘরে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। গ্লাস শেষ হল। এ বাড়ির বেয়ারারা শিক্ষিত। তাই আড়ালে থেকেও তাঁরা নজর রাখে প্রভুর ওপর। দ্বিতীয়বার গ্লাস পূর্ণ করে দিয়ে গেল বেয়ারা।

দুটো চুমুক দেওয়ার পর সেলফোন বের করলেন দুর্যোধন। এখন নিউইয়র্কে সকাল সাড়ে দশটা। সন্ধ্যাবেলা কেনেডি এয়ারপোর্ট থেকে দিল্লির ফ্লাইট ধরবে সুন্দর। তারপর প্লেন বদলে কলকাতায়।

নাম্বারটা টিপলেন দুর্যোধন। আড়াই সেকেন্ডের মধ্যেই রিং শুরু হল। বাজছে, বেজেই চলেছে। শেষ পর্যন্ত সেটা থেমে যেতে শুনতে পেলেন তাঁকে বলা হচ্ছে যদি কিছু বলার থাকে তা বলতে, রেকর্ড করে রাখা হবে। খুব বিরক্ত হয়ে লাইন কেটে দিলেন দুর্যোধন।

দ্বিতীয় গ্লাস শেষ হওয়ার পরে আবার মোবাইল চালু করলেন তিনি। রিং হচ্ছে। পাঁচবার বাজার পর ছেলের ঘুমজড়ানো গলা শুনতে পেলেন, 'হু দ্য হেল ইউ আর? ওঃ।'

'সুন্দর!' দাঁতে দাঁত চাপলেন দুর্যোধন।

একটু চুপ করে থেকে গলার স্বর স্বাভাধিক করতে চাইল সুন্দর, 'ওঃ ড্যাডি। তুমি এই সময়ে ফোন করবে ভাবতে পারিনি।'

'সাড়ে দশটা বেজে গেছে অথচ তুমি ঘুমাচ্ছ?'

'কাল লেটনাইট হয়ে গিয়েছিল। রাত তিনটের সময় ফিরেছি।'

'হোয়াট?'

'ওয়েল, ইট ওয়াজ মাই ফেয়ারওয়েল নাইট। সবাই ধরল।' একটু হাসার চেষ্টা করল সুন্দর, 'তুমি নিশ্চয়ই আমাকে রিসিভ করার জন্য এয়ারপোর্টে আসার সময় পাবে না। দরকার নেই, গাড়ি পাঠালেই হবে।'

'সুন্দর, তোমাকে আরও কয়েকদিন নিউইয়র্কে থাকতে হবে।'

'কেন?'

দূর্যোধন জানতেন এই প্রশ্নটা তাঁকে শুনতে হবে। বললেন, 'আমার কিছু দরকার আছে। তুমি সামনের সপ্তাহের মাঝামাঝি টিকিটটা চেঞ্জ করে নাও।'

'ওঃ ড্যাডি, আমি এখানকার সব কিছু ছেড়ে দিয়েছি। এই ফ্ল্যাটের পজেশনও কাল থেকে আমার থাকবে না।'

'এক সপ্তাহের জন্য বাড়িয়ে নাও। এটা আমার ইচ্ছা।'

'তোমার হোটেলের ওপেনিং কবে?'

বিন্দুমাত্র সময় ব্যায় না করে দুর্যোধন বললেন, 'এটা নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী যেদিন সময় দেবেন, তার ওপর।'

'কিন্তু আমি সেদিন ওখানে থাকতে চাই।'

'ভালো কিন্তু তার চেয়ে অনেক জরুরি কারণে তোমার সাতদিন ওখানে থাকা দরকার। ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়েছ যখন, তখন কোনও হোটেলে গিয়ে থাক।'

'জরুরি কারণটা কী তা জানতে পারি?'

'নিশ্চয়ই, ফোনটা বাজলে দয়া করে ভয়েস মেলে পাঠিয়ে দিও না। আর হ্যাঁ, সামনের সপ্তাহের কবে টিকিট পেয়েছ তা আধঘণ্টার মধ্যে আমাকে জানাও। নেটে গেলেই তুমি টিকিট পেয়ে যাবে।'

'আধঘণ্টার মধ্যেই...।' সুন্দরের অনিচ্ছা পরিষ্কার।

'আমি অপেক্ষা করছি।'

মোবাইল অফ করে হাত নাড়ালেন দুর্যোধন। তিনি দুইয়ের বেশি পান করেন না, তা বেয়ারা জানে। দুই শেষ হওয়ায় সে আর সামনে আসেনি। দুর্যোধন শূন্যে হাত নাড়লেন, নেড়ে গ্লাসটা দোলালেন।

তৃতীয় পেগের আধাআধি সময়ে মোবাইল বেজে উঠল। সেটাকে অন করতে সুন্দরের গলা পেলেন, 'নেক্সট উইকের ফ্রাইডেতে। শেষ ফ্লাইট।'

'থ্যাঙ্ক ইউ মাই সন।' ফোন অফ করে উঠে দাঁড়ালেন দুর্যোধন।

অত্যন্ত সতর্ক পায়ে করিডোর দিয়ে হেঁটে কৃষ্ণার দরজার সামনে পৌঁছে গেলেন দুর্যোধন।

না, তাঁর নেশা হয়নি। হলেও সেটা এত সামানা যে কৃষ্ণল টের পাবে না। যে সমস্যাটা পাহাড়ের মতো তাঁর মাথায় চেপে বসে ছিল সেটা নেমে যেতে এখন অনেক হালকা লাগছে নিজেকে। তিনি দরজায় নক করলেন।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুলল যে মেয়েটি সে কৃষ্ণার চব্বিশ ঘণ্টার আয়া। তাঁকে দেখেই কপালে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, 'মেমসাহেবের খুব মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে। আলো নিভিয়ে শুয়ে আছেন।'

'ওষুধ খেয়েছেন?'

'হ্যাঁ।' বলেই মেয়েটি ইতস্তত করল, 'আমি আসছি।'

আয়া ভেতরে চলে গেলে দুর্যোধন ঘরে ঢুকলেন। কৃষ্ণার বেডরুমে যেতে হলে এই ঘর পেরিয়ে যেতে হবে। রাতে শোয়ার সময় ছাড়া আয়া এই ঘরেই থাকে। মিনিট খানেকের মধ্যে আয়া বেরিয়ে এল বেডরুম থেকে, 'উনি আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন স্যার।'

দুর্যোধন ভারী পরদা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলেন হালকা নীল আলো জ্বলছে। কৃষ্ণং শুয়ে আছেন সাদা রাত পোশাক পরে।

দুর্যোধন ডাকলেন, 'কৃষ্ণা'

স্থির গুয়ে থেকে কৃষ্ণা বললেন, 'জরুরি না হলে কাঙ্গ কথা বলব।'

'ওষুধে কাজ হয়নি?'

'এটা জরুরি কথা নয়।'

'কৃষ্ণা, আমি খুব দুঃখিত। আই মিস ইট।'

'ধন্যবাদ।'

বিছানার পাশে চলে এলেন দুর্যোধন, 'এভাবে বলো না। আমি তোমাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না।'

'এসব কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে না।'

'আমি বিয়ের আগে তোমাকে যে কথা দিয়েছি তা রাখব।'

'কীভাবে? তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কাকে তুমি চাও।'

'আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'

'না। নাওনি। আমাকে স্তোকবাক্যে ভোলাতে চাইছ। সুন্দর তোমার ছেলে, তার ওপর তোমার স্নেহ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু আমি একজন সাতাশ বছরের যুবককে নিজের ছেলে বলে ভাবতে পারছি না। লোকে স্টেপমাদারদের দুর্নাম দেয়। কিন্তু তাদের সমস্যার কথা ভাবে না। তার ওপর ওই ছেলে এই বয়সে ওম্যানাইজার হিসেবে যে কুখ্যাতি পেয়েছে তা আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়।'

'তুমি এটা জানলে কী করে?'

'তোমার সঙ্গে পরিচয়ের পর যখন জেনেছিলাম সুন্দর নিউইয়র্কে থাকে তখন আমার এক বান্ধবীকে বলেছিলাম ওর সম্পর্কে খোঁজ নিতে। তার কাছে জেনেছি। একবার জেলে যেতে যেতে বেঁচে গিয়েছে সে। যেসব পুরুষ মেয়েদের নিয়ে খেলা করে, তাদের আমি সহ্য করতে পারি না।

এসো।' কৃষ্ণা বলল।

দুর্যোধন হাত বাড়ালেন। কৃষ্ণার ডান হাতের ওপর আঙুল রেখে বললেন, 'আমি সুন্দরকে আসতে নিষেধ করেছি।'

কপালে ভাঁজ পড়ল কৃষ্ণার, 'কখন বললে?'

'একটু আগে?'

'হঠাৎ?'

'হঠাৎ নয়। ওর এখন এখানে আসার তেমন কোনও প্রয়োজন নেই।'

'কিন্তু কতদিন? ছেলে তো বাবার কাছে আসবেই।'

ঠিক। কিন্তু এলে ওকে হোটেলের স্যুটে থাকতে হবে। এ কড়িতে নয়।'

'যদি কারণ জিগ্যেস করে।'

'উত্তরটা ঠিক তখন দেব। তুমি চিন্তা কোরো না।'

'তোমার নিষেধ ও মেনে নিয়েছে?"

'না মানা ওর পক্ষে সম্ভব নয়।'

'কেন?'

উঠে বসলেন কৃষ্ণা, 'আমার খুব খারাপ লাগছে।'

'নিজেকে ছোট লাগছে। আমার জন্য তোমার এই অসুবিধা হল।'

'মোটেই না।' দুর্যোধন আর পারলেন না। স্ত্রীকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরলেন। কৃষ্ণা স্বামীর মুখে দামি হুইস্কির গন্ধ পেলেন। গন্ধটা তাঁর ভালো লাগল।

মিনিট চারেক পর দুজনে তৃপ্ত হয়ে পাশাপাশি শুয়ে ছিলেন। হঠাৎ খেয়াল হতে দুর্যোধন নীচু গলায় জিগ্যেস করলেন, 'তোমার ওষুধ খেয়েছ তো?'

মাথা নাড়লেন কৃষ্ণা, 'না।'

'মাই গড!'

'চিন্তা করছ কেন?'

'কাল সকালেই ওষুধ খাবে। এখন তো অনেক আধুনিক ওষুধ বেরিয়েছে। আমার উচিত ছিল তোমাকে জিগ্যেস করে নেওয়া।'

'তুমি বড্ড হিসাব করো।'

'আমি কি আমার জন্য ভাবছি।'

'জানি।'

'তুমি মা হতে চাওনি। তিনটে বছর কেটে গিয়েছে। এখন কোনও দুর্ঘটনা ঘটুক তা আমিও চাই না।' দুর্যোধন বললেন।

'দুর্ঘটনা বলছ কেন? তোমার কি ভালো লাগেনি?'

'অবশ্যই।'

'তাহলে এ নিয়ে ভেবো না।'

'যদি কনসিভ করো?'

'হলে হবে।' হাসলেন কৃষ্ণা।

'কী বলছ তুমি?' অবাক হয়ে গেলেন দুর্যোধন।

'আজ এখন মনে হচ্ছে আমি মা হতে চাই। আমার নিজের একটা সন্তান হোক। আই উইল প্রে, প্রার্থনা করব।' কৃষ্ণা বিছানা থেকে নেমে গেলেন।

ঠিক বেলা ১১ টায় দুর্যোধন মিত্রের অফিসে মিটিং শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মাননীয় সাংসদ রামচন্দ্র বণিক খবর পাঠিয়েছেন, তাঁর আসতে একটু দেরি হবে। এই দেরিতে আসা একদম পছন্দ করেন না দূর্যোধন। কিন্তু সাংসদ তাঁর কর্মচারী নন যে, তিনি কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেন। নিজেকে মনে মনে বললেন তিনি, 'সহ্য করো, সহ্য করো। উদ্বোধনের আগে মুখে হাসি রাখো।' এখন তাঁর সামনে বসে আছেন শহরের পুলিশপ্রধান, জেলাশাসক, মিত্র ইন্ডাস্ট্রিজের জেনারেল ম্যানেজার আর হিলটপ হোটেলের ম্যানেজার অবিনাশ ভার্গব। ভারতীয় হোটেল ইন্ড্রাস্ট্রিতে ভার্গবকে সবাই এক ডাকে চেনে। এরকম একজন মানুষকে বেশি মাইনে দিয়ে হিলটপের দায়িত্ব দিয়ে দুর্যোধন যে একটুও ভুল করেননি তা এই কয়েক মাসে স্পষ্ট হয়েছে। ঠিক পনেরো মিনিট দেরি করে রামচন্দ্র বণিক ঘরে ঢুকলেন। ঢুকেই বললেন, 'আমাকে মার্জনা করবেন সবাই, দেরির জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।' দুর্যোধন রামচন্দ্রের স্মার্টনেস দেখে হাসলেন, 'বেটার লেট দ্যান নেভার, কাজ শুরু করা যাক। বসুন মিস্টার বণিক।'

বাইরের লোক সামনে থাকলে দূর্যোধন রামচন্দ্রের নাম ধরে ডাকেন না, তুমিও বলেন না। সাংসদকে সম্মান জানিয়ে তিনি নিজেকেই সম্মানিত করেন। দুর্যোধন মিত্র বললেন, 'আপনারা সবাই জানেন, মাননীয় অর্থমন্ত্রী অনুগ্রহ করে আমার হোটেল হিলটপের উদ্বোধনে আসছেন। তবে হিলটপ শুধু আমার হোটেল নয়, এই পাহাড়ের গর্ব হয়ে উঠবে বঙ্গে আশা রাখি। এরকম একটি আধুনিক হোটেল তিন-চারশো মাইলের মধ্যে নেই। যেসব ট্যুরিস্ট থাকার ভালো জায়গার অভাবে এদিকে আসেন না তাঁরা এখন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। অর্থবান ট্যুরিস্ট আরও এলে এখানকার মানুষের রোজগারও বেড়ে যাবে। আমরা অর্থমন্ত্রীকে এই তথ্য দিয়েছি। অর্থমন্ত্রী আসছেন। নীচের এয়ারপোর্টে নামবেন। তাঁর এখানে আসা-যাওয়া এবং থাকার সময় কী ভাবে নিরাপত্তা দেওয়া হবে তা আপনারা নিশ্চয়ই ঠিক করে নিয়েছেন। এ ব্যাপারে আমার সাহায্যের দরকার হলে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।'

জেলাশাসক বললেন, 'মাননীয় অর্থমন্ত্রী যাতে নিরাপদে নীচের এয়ারপোর্ট থেকে এই শহরে আসা-যাওয়া করতে পারেন তার ব্যবস্থা পুলিশ সুপার করেছেন। কিন্তু এখনও কলকাতা থেকে মাননীয় মন্ত্রীর সম্পূর্ণ সফরসূচি আমি পাইনি।'

রামচন্দ্র বণিক বললেন, 'সবে তো কাল বিকেলে ব্যাপারটা ফাইনাল হল, আজ নিশ্চয়ই পেয়ে যাবেন। আমি যতদূর জানি অর্থমন্ত্রী হোটেল উদ্বোধন করে ঠিক এক ঘণ্টা এই শহরে থেকে নীচে নেমে যাবেন। ওই সময়ের মধ্যে তিনি লাঞ্চ সেরে নেবেন। উনি রাত্রিবাস করবেন নীচের সার্কিট হাউসে।'

পুলিশ কমিশনারের মুখে হাসি ফুটল, 'তাহলে তো কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল। ওঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।'

জেলাশাসক বললেন, 'তাহলে মাননীয় অর্থমন্ত্রী এই শহরে এসে পুরোটা সময় হিলটপের ভেতরেই থাকবেন। আমরা কি আজ হোটেলের ভেতরটা দেখে আসতে পারি? অবশ্য যেদিন উনি আসবেন সেদিন ওঁর নিরাপত্তার জন্য হোটেলের ভেতরে চিরুনি তল্লাশি চালাতে হবে।'

'অবশ্যই।' পুলিশ কমিশনার মাথা নাড়লেন।

দুর্যোধন মিত্র হোটেল ম্যানেজারের দিকে তাকালেন, 'আপনার কিছু বলার আছে?'

'না স্যার। হিলটপ এখন একদম তৈরি। ওঁরা যখন ইচ্ছে ডিজিট করতে পারেন।' 'গুড।'

রামচন্দ্র বণিক বললেন, 'কিন্তু আমি আশঙ্কা করছি যেভাবে আপনারা 'ভাবছেন শেষ পর্যন্ত তা সহজ নাও থাকতে পারে।'

'মানে? দুর্যোধন অবাক হলেন।

'আমি একটু আগে খবর পেলাম, যার জন্য আমার এখানে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল, হিলটপের উদ্বোধনকে ঘিরে অসন্তোষের মেঘ জমছে। সেটা বিক্ষোভে পরিণত হতে পারে।' গম্ভীর মুখে বললেন, রামচন্দ্র। জেলাশাসক অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, 'বিক্ষোভ কার বিরুদ্ধে?'

'প্রথমত, হোটেলের বিরুদ্ধে; দ্বিতীয়ত, অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। কারণ তিনি হোটেলটিকে চালু করতে আসছেন।' রামচন্দ্র বললেন। দুর্যোধন খুব রেগে যাচ্ছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল রামচন্দ্র একটা ভয়ের আবহাওয়া তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু তিনি রাগ সংবরণ করে হেসে বললেন, 'মাননীয় সাংসদ যদি একটু বিশদে বলেন। কারা বিক্ষুব্ধ, বিক্ষোভের কারণ কী? আজ সকাল পর্যন্ত আমরা তো এসবের কিছুই শুনিনি।' দুর্যোধনের ওই হাসি যে বানানো তা রামচন্দ্র ভালোভাবে জানেন। বললেন, 'ব্যাপারটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। হিলটপ তৈরি হয়েছে প্রায় তিন বছর ধরে। প্রায় সাতশো শ্রমিকের পরিশ্রম আজ সার্থক হয়েছে। হ্যাঁ, শ্রমিকরা তাদের শ্রমের বিনিময়ে মঞ্জুরি পেয়েছে। কিন্তু আল যখন তারা দেখছে কিছু স্থানীয় ছেলেমেয়েকে বাদ দিলে বেশিরভাব কর্মচারীকে বাইরে থেকে এনে হিলটপে চাকরি নেওয়া হচ্ছে, তখন তারা ক্ষুব্ধ হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তারাও চাকরির দাবি করছে।'

'মাই গড। হোটেল-চাকরি কি মাল বওয়া শ্রমিক বা রাজমিস্ত্রিকে দিয়ে করানো সম্ভব? তাহলে তো হাসপাতাল তৈরির কাজে যে শ্রমিক ছিল সেও পরে ডাক্তারের চাকরির জন্য বিক্ষোভ জানাতে পারে।' দুর্যোধন মিত্র সংযম হারাতে হারাতেও নিজেকে সামলে নিয়ে হাসলেন।

পুলিশ কমিশনার জিগ্যেস করলেন, 'স্যার, ওরা কোন ইউনিয়নের মদত পাচ্ছে?'

'কোনও ইউনিয়ন নয়, সবাই এই ইস্যুতে এক হতে চাইছে।' রামচন্দ্র বললেন। জেলাশাসক বললেন, 'তাহলে তো সমস্যা হয়ে গেল।' দুর্যোধন বিরক্ত হলেন, 'কেন?'

'মাননীয় অর্থমন্ত্রীর আসার পথে যদি শ্রমিকরা বিক্ষোভ দেখায় তাহলে তাদের সরাতে আরও বেশি ফোর্স এনে রাখতে হবে। ওরা যদি রাস্তা আটকে রাখে তাহলে বলপ্রয়োগ করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।' জেলাশাসক বললেন।

পুলিশ কমিশনার বললেন, মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন অযথা বলপ্রয়োগ না করে বুঝিয়ে বলতে।

সেটা কি সম্ভব হবে?'

রামচন্দ্র বললেন, 'আমি ভয় পাচ্ছি, অর্থমন্ত্রীর কাছে খবরটা পৌঁছোল, শোনার পর তিনি এই শহরে প্রোগ্রাম বাতিল করে দিতে পারেন। উনি খুবই শ্রমিকবানী মানুষ। শ্রমিকদের ওপর লাঠিচার্জ ওঁর উপস্থিতিতে হোক-এটা কিছুতেই চাইবেন না।'

জেলাশাসক বললেন, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসা যায় না?'

রামচন্দ্র বললেন, আমি সেই চেষ্টাই করছি। ওরা যদি কোনও ইউনিয়নের মারফত বিক্ষোভ দেখাতে চাইত তাহলে কাজটা সহজ হত।'

দুর্যোধন মিত্র এবার মিত্র ইন্ডাস্ট্রিজের জেনারেল ম্যানেজার সুবর্ণ দত্তের দিকে তাকালেন, 'মিস্টার দত্ত, এ ব্যাপারে কোনও ইনফরমেশন আপনার কাছে নেই?'

'না স্যার।' টাক মাথা দু-পাশে নাড়লেন মিস্টার দত্ত।

'কেন নেই? আমার এত বড় প্রজেক্টকে কিছু লোক বানচাল করে দিতে চাইছে আর আপনি তার কোনও খবরই রাখেন না?'

'বিশ্বাস করুন, কোনও সোর্স থেকেই আমি খবরটা পাইনি। হোটেল তৈরির জন্য কন্ট্রাক্টর- শ্রমিক এসেছিল বিহার থেকে। অনেকগুলো দল এসেছিল। কয়েক মাস কাজ করে একটা দল দেশে ফিরে গেলে আর একটা দল আসত। ওরা বেশিরভাগই আনস্কিলড, খেত-খামারিব বাকি সময়। ওরা যে কী করে বিক্ষুব্ধ শ্রমিক হয়ে ফিরে আসছে তা আমি বুঝতে পারছি না।' মিস্টার দত্ত বললেন। রামচন্দ্র জিগ্যেস করলেন, 'ওদের সঙ্গে স্থানীয় ছেলেরা কাজ করত না?'

'করত। খুব বেশি হলে আশি কি একশো।' মিস্টার দত্ত জবাব দিলেন।

'এই একশো জনের বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন একত্র হলে সংখ্যাটা কোথায় পৌঁছবে তা অনুমান করুন। যাক গে, এখনও যখন মিস্টার মিত্রের কাছে কেউ কোনও ডিমান্ড করেনি তখন অর্থমন্ত্রী আসছেন, নির্বিঘ্নে আসছেন ধরে নিয়ে কাজ করে যাওয়া উচিত হবে। হোটেল তৈরি?'

রামচন্দ্র জিগ্যেস করলেন। দুর্যোধন মিস্টার ভার্গবকে ইশারা করলেন জবাব দিতে।

মিস্টার ভার্গব বললেন, 'হ্যাঁ, উই আর রেডি। এত বড় হোটেলকে সক্রিয় রাখতে যে যে জায়গায় যেমন লোক রাখা দরকার, তা রাখা হয়ে গেছে।'

'টোটাল এমপ্লয়িজ কত?' রামচন্দ্র জিগ্যেস করলেন।

'একশো এগারো।'

'সবাই স্কিল্ড?'

'ইয়েস স্যার।'

জেলাশাসক বললেন, 'মিস্টার মিত্র, আজ এই পর্যন্ত থাক। শ্রমিকদের ব্যাপারটা নিয়ে আমরা একটু খোঁজখবর করছি। দরকার হলে আবার বসতে হবে।'

মিটিং শেষ হল। জেলাশাসক এবং পুলিশ কমিশনারের পরে ম্যানেজাররা বিদায় নিলেন। কিন্তু রামচন্দ্র বণিক ওঠার কোনও উদ্যোগই নিলেন না। পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে জিগ্যেস করলেন, 'দাদা, একটু ধোঁয়া খেতে পারি? পেট ফুলে গেছে।'

উত্তরের অপেক্ষা না করে সিগারেট ধরালেন তিনি। তারপর ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, 'চিন্তা করবেন না, আমি কিছুতেই এই শহরের দুর্নাম হতে দেব না।'

দুর্যোধন লোকটিকে দেখছিলেন। কোনও কথা বললেন না।

সিগারেটে দুটো টান দেওয়ার পর রামচন্দ্র সোজা হলেন, 'ও হ্যাঁ, সুন্দর কবে যেন আমেরিকা থেকে আসছে? আগামিকাল?'

'হঠাৎ তার কথা কেন মনে পড়ল?' দুর্যোধন জিগ্যেস করলেন।

'বাঃ। মিত্র ইন্ডাস্ট্রিজের আগামী দিনের মালিককে ছাড়া নিশ্চয়ই হোটেল চালু হবে না। আপনি ভুলে গেছেন, ওর আসার কথা আপনিই বলেছিলেন।'

'ও এলে কি তোমার সুবিধা হবে?'

'আমার আবার সুবিধা-অসুবিধা। আমার জন্য তো আপনি আছেন। একটা কথা, মিস্টার ভার্গব থাকলে ভালো হত। যদিও উনি বলে গেলেন হোটেলের সব কর্মী নিয়োগ হয়ে গেছে, তবু...।'

বললেন রামচন্দ্র।

'থামলে কেন?'

'খুব সামান্য ব্যাপার। আমার এক বন্ধুর বোন, দাজিলিংয়ে থাকে। বেশ সুন্দরী, বছর একুশ বয়স। ডাউহিল থেকে পাশ করেছে। বাংলা হিন্দি ইংরেজিতে চৌকস। চাকরি খুঁজছে। আমি তো জানতাম না হিলটপে আর কোনও পদ খালি নেই। বলেছিলাম, চেষ্টা করব। রিসেপশনিস্ট হিসেবে ওকে চমৎকার মানাত।'

'রাম, তুমি তো জানো, আমি ডিপার্টমেন্টাল হেডদের ওপর কোনও কিছু চাপিয়ে দিই না; কিন্তু তুমি যখন বলছ তখন আমি মিস্টার ভার্গবকে নিশ্চয়ই অনুরোধ করব। কী নাম মেয়েটির ?' লীলা, লীলা প্রধান।'

'কালকেই যেন সে মিস্টার ভার্গবের সঙ্গে দেখা করে।'

'অনেক ধন্যবাদ দাদা।' সিগারেট নেভাতে গিয়ে অ্যাস্ট্রে না পেয়ে রামচন্দ্র ইতস্তত করেছিলেন। দুর্যোধন বললেন, 'আপাতত জলের গ্লাসে ওটা ফেলে দাও।' তা-ই দিলেন রামচন্দ্র। সঙ্গে সঙ্গে সাদা জল কুৎসিত হয়ে গেল। রামচন্দ্র উঠে দাঁড়াতেই দুর্যোধন বললেন, 'একটু দাঁড়াও রাম।'

রামচন্দ্র চোখ ছোট করে তাকালেন।

'তুমি সেদিন কোনও একটা স্কুলের বিল্ডিং তৈরির জনা ডোনেশন চেয়েছিল, আমার খেয়াল থাকে না সবসময়। দুটো চেক দিচ্ছি। স্কুলের নাম তুমি বসিয়ে নিও।' অ্যাটাচি খুলে চেকবই বের করে পরপর দুটো চেক লিখে সই করে সামনে রাখলেন দুর্যোধন মিত্র, স্কুলের নামটা পরে বসিয়ে দিও। ফর মাই রেকর্ড। আমি চেকে অ্যাকাউন্ট পেয়ি লিখলাম না। কারণ, জানি না, ওদের অ্যাকাউন্ট আছে কি না। থাকলে ক্রস করে দিও।' হাসলেন দুর্যোধন।

এগিয়ে এসে চেক দুটো তুললেন রামচন্দ্র। টাকার অঙ্ক দেখে তিনি হাসলেন। বললেন, 'অজস্র ধন্যবাদ।'

তারপর চেক দুটোকে পকেটে রেখে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

তিনি চোখের আড়ালে যাওয়া মাত্র মোবাইল বের করে নম্বর টিপলেন, 'আমি দুর্যোধন মিত্র বলছি। দুটি চেক নম্বর নোট করে নিন, আপনার কাছে এলে হোল্ড করে রাখবেন আমি না বলা পর্যন্ত।' ব্যাংক ম্যানেজারকে নম্বর দুটো জানিয়ে দিলেন তিনি।

না, কোনও বিক্ষোভ হল না, কেউ কালো পতাকা দেখাল না। মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে দুর্যোধন মিত্র এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে পাহাড়ে উঠে এলেন নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে। আকাশ পরিষ্কার, পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে মেঘ লেগে আছে। গাড়ির পেছনের আসনে অর্থমন্ত্রীর পাশে কৃতার্থ ভঙ্গিতে বসে আছেন দুর্যোধন। সামনের আসনে ড্রাইভারের পাশে অর্থমন্ত্রীর বডিগার্ড। তাঁদের আগে এবং পেছনে গোটাআটেক গাড়ি। সামনের গাড়িতে জেলাশাসকের সঙ্গে রয়েছেন রামচন্দ্র বণিক। অর্থমন্ত্রী প্লেন থেকে নেমে এসে রামচন্দ্রের হাতে হাত মিলিয়ে বলেছেন, 'তোমার অনুরোধ ফেলতে পারলাম না রাম, চলেই এলাম।' রামচন্দ্র গদগদ হয়ে বলেছেন, 'আমি কৃতজ্ঞ। আলাপ করিয়ে দিচ্ছি, ইনি দুর্যোধন মিত্র, হিলটপ ওঁরই পরিকল্পনা।' দুর্যোধন মিত্র গতরাত থেকেই খবর নিয়েছেন। না, কোনও বিক্ষোভের আয়োজন হচ্ছে না।

পাহাড় অশান্ত হবে না। কয়েকজন সমাজবিরোধীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে বটে, তবে তাদের পেছনে কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থন নেই। তবু তাঁর মনে হয়েছিল না আঁচালে বিশ্বাস নেই। যে পুতুলকে তিনি মানুষে পরিণত করেছেন, সে যে কখন শকুনির মতো চাল দেবে, তা কে জানে! আজ সকালে ব্যাংকের ম্যানেজার তাঁকে ফোনে জানিয়েছেন, চেক জমা পড়েছে। তিনি বলেছেন, বিকেল ৪টে পর্যন্ত যেন সেটি ধরে রাখা হয়।

আজ এয়ারপোর্টে অর্থমন্ত্রীর জন্য যখন অপেক্ষা করছিলেন, তখন রামচন্দ্র তাঁকে একলা পেয়ে নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'আপনি কি আপনার ব্যাংককে কোনও ইনস্ট্রাকশন দিয়ে এসেছেন?'

'কেন বলো তো?'

'এই সময়ের মধ্যে অ্যামাউন্টটা ট্রান্সফার হয়ে যাওয়া উচিত ছিল।'

হাসলেন দুর্যোধন মিত্র-'আমার চেক কখনো বাউন্স করে না, নিশ্চিন্ত থাকো। তুমি আমার উপকার করলে, আমি অকৃতজ্ঞ নই।'

রামচন্দ্র আর কথা বাড়াতে পারেননি। কারণ জেলাশাসক এগিয়ে এসেছিলেন। বলেছিলেন, 'আপনি মাননীয় অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে যাবেন তো।'

'অবশ্যই।' জোর দিয়ে বলেছিলেন দুর্যোধন মিত্র।

গাড়ির কনভয় যখন পাহাড়ের প্যাঁচানো রাস্তা ধরে উপরে উঠছিল, তখন অর্থমন্ত্রী বললেন, 'অপূর্ব সুন্দর!'

'হ্যাঁ, এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যি সুন্দর।'

'শুনলাম, এখানকার মানুষের জন্য আপনি অনেক কিছু করেছেন।'

'আরও অনেক কিছু করা উচিত ছিল। আমার আর ক্ষমতা কত। তবে আমরা চাইছি আরও ট্যুরিস্ট আসুক এখানে। পর্যটনের ম্যাপে এখানকার নামটা উঠুক-এ ভাবনা থেকে আমি হোটেসটার পরিকল্পনা করেছিলাম। আপনি উদ্বোধন করছেন। তাই গোটা দেশের মানুষ জেনে যাবে। ট্যুরিস্ট বেশি এলে এখানকার গরিব মানুষজনের রোজগার বেড়ে যাবে।' দূর্যোধন মিত্র নীচু গলায় বললেন।

'আমি পর্যটনমন্ত্রীকে বলব।' অর্থমন্ত্রী বললেন, 'আপনি একবার দিল্লি আসুন। আসার সময় কাগজপত্র তৈরি করে আনবেন।'

শকুনের চোখ শবদেহ সবার আগে দেখতে পায়। অর্থমন্ত্রীর কথায় দুর্যোধন মিত্র টাকার গন্ধ পেলেন অর্থমন্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, 'এখানে জলের সমস্যা আছে?'

'এতকাল বৃষ্টির ওপর নির্ভর করতে হত। কয়েক মাস বৃষ্টি না হলে মানুষের কষ্ট বাড়ত। মিস্টার বণিক এমপি হওয়ার পর উপরের পাহাড়ে দুটো বড় জায়গায় জল ধরে রাখা হচ্ছে। ফলে সমস্যা কিছুটা কমেছে।' দূর্যোধন বললেন।

'দুটো কেন? আরও করা যায় না?'

'খায়; কিন্তু পাহাড়ের শক্ত মাটি-পাথর খুঁড়ে গর্ত করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, খরচও অনেক।

তাতে জল জমবে অনেক, কিন্তু সেই জল তো সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করা যাবে না। তবে একটা উপায় আছে খরচ তুলে নেওয়ার।' দুর্যোধন সবিনয়ে বললেন।

অর্থমন্ত্রী তাকালেন। তাঁর চোখে প্রশ্ন ফুটে উঠল।

'স্যার, তিনটি পাহাড়কে কোনওরকমে যুক্ত করতে পরলে যে বিশাল জল আমরা পাব, তাতে অনায়াসে হাজার হাজার মাছ চাষ করা সম্ভব হবে। সেই মাছ বিক্রি করলে খরচ অনায়াসেই উঠে যাবে।' দুর্যোধন মিত্র বললেন।

'ইন্টারেস্টিং। ফলে প্রচুর মানুষের কাজ হবে।'

'নিশ্চয়ই।'

'আপনি আর দেরি করবেন না। যত তাড়াতাড়ি পারেন দিল্লিতে চলে আসুন। আপনার ভাবনাচিন্তা আমার ভালো লাগছে।' অর্থমন্ত্রী বললেন।

দুর্যোধন মিত্র আর কথা বললেন না। কখন থামতে হয় তিনি জানেন। এখন তাঁর চোখের সামনে কোটি কোটি টাকার মাছ। বিদেশে রফতানি করলে টাকাগুলো ডলার-ইউরো-পাউন্ড হয়ে যাবে।

প্রচারিত ছিল খবরটা, ব্যবস্থাও ছিল। শহরে ঢোকার পথের দুপাশে জড়ো হওয়া মানুষ অর্থমন্ত্রীকে অয়ধ্বনি দিল। ফুল ছুড়ল।

গাড়ির কনভয় এসে দাঁড়াল হিলটপের সামনে। অর্থমন্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে সেদিকে তাকিয়ে বললেন, 'বাঃ।'

টিভির ক্যামেরাম্যান, সাংবাদিকদের দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করছিল পুলিশবাহিনী। জেলাশাসক, পুলিশ সুপার, রামচন্দ্র বণিক এবং রাজনৈতিক নেতারা অর্থমন্ত্রীকে ঘিরে এগোতে লাগলেন হিলটপের গেট পেরিয়ে মূল দরজার দিকে। দুর্যোধন মিত্র ততক্ষণে চলে গিয়েছেন সেখানে। দরজার এপাশ থেকে ওপাশে সুন্দর ফিতে টানানো। মিস্টার ভার্গব হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর পাশে দু-মহিলা হোটেলকর্মী। একজনের হাতে ছোট্ট ট্রে'র ওপর কাঁচি রাখা। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দুর্যোধন অবাক হলেন। এত সুন্দরী মেয়েকে ভার্গব পেল কোথায়।

অর্থমন্ত্রী এসে যেতেই দুর্যোধন মিত্র তাঁকে অনুরোধ করলেন ফিতে কাটার জন্য। সুন্দরী হেসে ট্রে এগিয়ে দিলে অর্থমন্ত্রী তার দিকে তাকালেন, মাথা নাড়লেন, তারপর কাঁচি তুলে ফিতে কাটলেন প্রথম চেষ্টায়। হাততালির ঝড় উঠল। অর্থমন্ত্রীকে একটি হ্যান্ডসেট এগিয়ে দিলেন ভার্গব। দুর্যোধন মিত্র বললেন, 'স্যার, দয়া করে অ্যানাউন্স করুন।'

অর্থমন্ত্রীর গলা মাইকে শোনা গেল-'আমি হিলটপ হোটেলটির উদ্বোধন করলাম।'

ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ, হাততালি, জনতার গলায় আনন্দ।

দুর্যোধন অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই মিস্টার ভার্গব বললেন, 'আপনি একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিন স্যার, তাতেই হবে।'

লম্বা স্ট্যান্ডের চারপাশে অনেক প্রদীপের সলতে তেলে ভেজানো। অর্থমন্ত্রী ট্রে থেকে লাইট'র তুলে নিয়ে তার একটার মুখে আগুন ধরালেন। তাঁকে অনুসরণ করলেন বাকিরা।

অর্থমন্ত্রী এবং নির্বাচিত অতিথিদের নিয়ে দুর্যোধন মিত্র এগিয়ে গেলেন ব্যাঙ্কোয়েট হলের দিকে। সেখানে দরজায় সিল্কের সাদা শাড়ি, জামা পরে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানালেন শ্রীমতী কৃষ্ণা মিত্র।

দুর্যোধন নীচু গলায় অর্থমন্ত্রীকে বললেন, 'আমার স্ত্রী, কৃষ্ণা।'

অর্থমন্ত্রী নমস্কার জানালেন, 'আপনাকে দেখে কথাটা মনে আসছে।'

'কী কথা?' কৃষ্ণা হাসলেন।

'যে কোনও সফল মানুষের পেছনে একজন মহিলার অবদান থাকে।'

কৃষ্ণা আবার হাসলেন, 'ধন্যবাদ। আপনি কষ্ট করে এসেছেন বলে আমি কী বলে ধন্যবাদ দেব জানি না। আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগছে।'

দুর্যোধন মিত্র বললেন, 'কৃষ্ণল দিল্লিতে বড় হয়েছে।'

'আচ্ছা!' অর্থমন্ত্রী মাথা নাড়লেন।

দশ মিনিট পর জমজমাট ব্যাঙ্কোয়েট হলে অর্থমন্ত্রী বক্তৃতা শুরু করলেন। পাহাড়ের অর্থনীতি, এখানকার মানুষের জন্য পরিকল্পনা ইত্যাদির ব্যাপারে মাননীয় সাংসদ রামচন্দ্র বণিকের সঙ্গে আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। বললেন, এখানে হিলটপের মতো হোটেলের বিশেষ প্রয়োজন ছিল। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য বিদেশি বা অন্য ট্যুরিস্টদের দরজা খুলে দেওয়ায় দুর্যোধন মিত্রকে ধন্যবাদ দিলেন। সবশেষে বললেন, 'শ্রী মিত্রের কিছু পরিকল্পনা নিয়ে গাড়িতে আসার সময় আলোচনা হচ্ছিল। সেগুলো ঠিকমতো করা গেলে এখানকার মানুষের আয় অনেক বেড়ে যাবে।' তিনি হিলটপের সাফল্য কামনা করলেন।

বক্তৃতার পর অতিথিদের লাঞ্চের আমন্ত্রণ জানানো হল। অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে দুর্যোধন মিত্র, কৃষ্ণা মিত্র এবং রামচন্দ্র বণিক বসলেন ভিআইপি এনক্লোজারে।

চেয়ারে বসে অর্থমন্ত্রী বললেন, 'হিলটপ-খুব মানানসই নাম।'

দুর্যোধন মিত্র বললেন, 'নামটা কৃষ্ণার দেওয়া।'

সপ্রশংস চোখে তাকালেন অর্থমন্ত্রী-'বাহ। মিসেস মিত্র কি সাহিত্যচর্চা করেন?'

কৃষ্ণা মাথা নাড়লেন-'না! কিন্তু আপনি আমাকে কৃষ্ণা বললে আমার ভালো লাগবে। আমি ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে সামান্য কাজ করেছি।'

'আই সি। কিন্তু এখানে থেকে চর্চা রাখতে পারছেন?'

'মাসে দুবার দিল্লি যেতে হয়...!'

অর্থমন্ত্রী দুর্যোধনের দিকে তাকালেন-'মিস্টার মিত্র, এবার যখন আসবেন, তখন মিসেসকে খাবারের প্রশংসা করলেন অর্থমন্ত্রী। কথা দিলেন সময় পেলেই আবার আসবেন।

নিয়ে দেখা করবেন।'

কৃষ্ণা বললেন, 'আপনি ব্যস্ত মানুষ, নইলে বলতাম আজ থেকে যান।' অর্থমন্ত্রী বললেন, 'আজ বিকেলে সমতলে একটা মিটিং আছে। কী করব বলো, আমার স্ত্রী ঠিকই বলেন।'

'কী বলেন?'

'আমার কোনও ব্যক্তিগত জীবন নেই।' অর্থমন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন।

অর্থমন্ত্রী চলে গেলে দুর্যোধন মিত্র ব্যাংককে জানিয়ে দিলেন চেক রিলিজ করে দিতে। টিভির কল্যাণে সারাদেশে হিলটপের নাম ছড়িয়ে পড়ল। তৃতীয় দিনেই ভার্গব জানালেন, 'প্রচুর ফোন পাচ্ছি। খুব ভালো বুকিং হচ্ছে।'

'আপনি নজর রাখবেন, স্ট্যান্ডার্ড যেন ঠিক থাকে।'

'আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার।'

'ও হ্যাঁ, উদ্বোধনের দিন যে মেয়েটি ট্রে হাতে দরজায় দাঁড়িয়েছিল, তাকে আপনি কোথায় পেলেন?' দুর্যোধন মিত্র জিজ্ঞাসা করলেন।

'স্যার, মেয়েটিকে তো আপনি রেফার করেছিলেন।'

'আমি? কী আশ্চর্য! ওকে তো আমি চিনিই না।'

'সে কী! মেয়েটি বায়োডাটা নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করল। তখন হোটেলের সব পোস্টে লোক নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে বলল, আপনি ওকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন। আর কথা বলে আমার মনে হয়েছিল, ওকে দিয়ে ভালো কাজ হবে। ইনফ্যাক্ট, এই দুদিন ও খুব এফিসিয়েন্টলি কাজ করেছে। আপনার রেফারেন্স বলে আমি আউট অব টার্ন ওকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছি।' ভার্গব বললেন।

'মেয়েটির নাম কী?'

লীলা প্রধান। শি ইজ ফ্রম দার্জিলিং।'

এবার মনে পড়ে গেল দুর্যোধন মিত্রের। রামচন্দ্র এ মেয়েটির কথা তাঁকে বলেছিলেন, ওঁর বন্ধুর বোন? কিন্তু মেয়েটি যে এত্ত সুন্দরী, তা তিনি অনুমান করতে পারেননি।

'ও কি সত্যি কথা বলেনি।' ভার্গবের গলায় সন্দেহ।

মাথা নাড়লেন দুর্যোধন মিত্র-ঠিকই বলেছে। আমিই ভুলে গিয়েছিলাম।' ভার্গব খুশি হলেন-'মেয়েটিকে একটু ঘষামাজা করলে হোটেলের অ্যাসেট হয়ে যাবে স্যার।'

রাতে কৃষ্ণার কাছে কথাটা বললেন দুর্যোধন। কৃষ্ণা হাসলেন-'আমি মেয়েটিকে লক্ষ করেছি। সত্যি সুন্দরী। দেখো, হোটেলের প্রতি আকর্ষণ না বেড়ে যায়।'

'তুমি কি পাগল হয়ে গেলে।'

শুনেছি ছেলেরাই এসব ক্ষেত্রে পাগল হয়।'

'আমি ছেলে নই, বয়স্ক পুরুষ।' কথাটা বলতেই সুন্দরের মুখ মনে পড়ল দুর্যোধনের। সঙ্গে

সঙ্গে অস্বস্তি জন্ম নিল তাঁর মনে।

দিনসাতেক পর সন্ত্রীক দিল্লি গেলেন দুর্যোধন মিত্র। পাহাড়ে জলাধার এবং মৎস্য প্রকল্পের ব্লু প্রিন্ট ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে তৈরি করিয়ে নিয়েছিলেন। এ ব্যাপারটা নিয়ে তিনি রামচন্দ্র বণিকের সঙ্গে একবারও আলোচনা করেননি। দিল্লিতে আসার আগে অর্থমন্ত্রীর আপ্তসহায়কের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে কবে কখন দেখা করবেন, তার সময় স্থির করে নিয়েছেন।

দিল্লিতে এলে এখনও হোটেলে ওঠেন দুর্যোধন। কৃষ্ণা চলে যান তাঁর বাপের বাড়িতে। এই নিয়ে তাঁদের কোনও সমস্যা হয় না। টেলিফোনেই যোগাযোগ থাকে। স্থির হয়েছে, পরের দিন অর্থমন্ত্রীর বাসভবনে যখন দুযেধিন যাবেন, তখন কৃষ্ণাকে তাঁর বাসস্থান থেকে তুলে নেবেন।

বেশ কয়েক মাস ধরে দিল্লিতে তার পরিকল্পিত ডিজাইনে তৈরি পোশাকের এক্সিবিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন কৃষ্ণ। তাঁর মা এ কাজটির তদারকি করেন। দিন পনেরো পর এক্সিবিশন শুরু। কৃষ্ণার মা তাঁকে পরামর্শ দিলেন, ওই সময় অর্থমন্ত্রী বিদেশে থাকবেন। তাই তাঁকে অনুরোধ করে যদি প্রধানমন্ত্রীকে রাজি করানো যায় প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করতে, তাহলে ব্যাপক প্রচার হবে।

পরের সন্ধ্যায় দুর্যোধন কৃষ্ণাদের বাড়িতে এসে এক কাপ কফি পান করলেন। কুশল বিনিময়ের পর তিনি যখন অর্থমন্ত্রীর বাড়ির দিকে যাচ্ছেন, তখন তাঁর মোবাইল বেজে উঠল। ওটা অন করে হ্যালো বলতেই সুন্দরের গলা শুনতে পেলেন-'ড্যাডি, তোমার কাছ থেকে কোনও ইনফরমেশন না পাওয়ায় ঠিক করলাম, আজই ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ধরব। এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠিও।'

দুর্যোধন মিত্র কোনও জবাব না দিয়ে ফোন সুইচ অফ করে দিলেন। 'কে? খুব বিরক্ত হয়েছ বলে মনে হচ্ছে।' পাশে বসে কৃষ্ণা হাসলেন।

'যত্ত আজেবাজে ফোন-এই মোবাইল টেলিফোন যেমন সাহায্য করে, তেমনি মাঝেমধ্যে জঞ্জাল বলে মনে হয়।' দুর্যোধন স্বস্তি পেলেন। কৃষ্ণা বোঝেননি কার ফোন এসেছিল। কিন্তু এখন তাঁর পক্ষে সুন্দরের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ নেই। তা ছাড়া তাকে ভারতে আসার ব্যাপারে কতদিন তিনি ঠেকিয়ে রাখবেন?

অর্থমন্ত্রী দুর্যোধন মিত্রের পরিকল্পনাবিষয়ক কাগজপত্র নিয়ে চোখ বুলিয়ে তাঁর আপ্তসহায়ককে দিয়ে বললেন, 'এগুলো কালই শ্রীনিবাসনের কাছে পাঠিয়ে দেবে। বলবে, পরশু ওর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করব।'

চা খেতে খেতে অর্থমন্ত্রী বললেন, 'প্রজেক্টের খরচ কত হবে, সে ব্যাপারে আনুমানিক বাজেট করেছেন?'

'আরেকটু সময় লাগবে স্যার। তবে যা-ই হোক, তিন বছর থেকে রিটার্ন আসতে শুরু করবে এবং দশ বছরের মাথায় পুরো টাকা উঠে যাবে।'

'গুড। আপনার প্রজেক্ট যদি আমরা অ্যাপ্রুভ করি, তাহলে বিজ্ঞাপন দিয়ে টেন্ডার চাইতে হবে। নইলে বিরোধীরা দুর্নীতির গন্ধ পাবে।'

'সেক্ষেত্রে স্যার, কাজটা আমি নাও পেতে পারি।' দুর্যোধন বললেন।

'আপনার অ্যাডভান্টেজ হচ্ছে, আপনি ওখানে থাকেন, পাহাড়কে ভালো করে চেনেন। বাইরের কেউ কম টাকার টেন্ডার দিয়েছে বলে তাকেই কাজটা দেওয়া হবে এমন ভাবছেন কেন? আমরা অ্যাপ্লিকেন্টদের যোগ্যতাও বিচার করব। তা ছাড়া এটা যে আপনার ব্রেন চাইল্ড, সে কথাও আমি মনে রাখব।'

'থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।'

অর্থমন্ত্রী এবার কৃষ্ণার দিকে তাকালেন- 'নিজের বাড়িতে ফিরে কেমন লাগছে?'

'খুব ভালো। আপনাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?'

'অবশ্যই।'

'আগামী মাসের ৩ তারিখে আমার এক্সিবিশন।'

'৩ তারিখ?'

'হ্যাঁ, আপনি কী দিল্লিতে তখন থাকবেন?'

পসপন্ড করেছি।'

'বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে ইউনাইটেড নেশনসে যেতে হবে বলে আমারটা '

ও!' কৃষ্ণা একটু চিন্তায় পড়ল?

'কী? আবার উদ্বোধন করতে হবে না কি? ডিজাইনের প্রদর্শনীর উদ্বোধন আমাকে দিয়ে না করিয়ে কোনও নামকরা ফিল্ম স্টারকে দিয়ে করানোই তো ভালো।'

কৃষ্ণা বললেন, 'আমি তাদের কাউকে চিনি না।'

'আমি মুম্বাইয়ের দু-একজনকে অনুরোধ করতে পারি।'

' ও! খুব ভালো হয়। আপনাকে আমি কষ্ট দিচ্ছি।'

'একদম নয়। সৌন্দর্যের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সমন্বয় দেখলে ঈশ্বরও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, আমি কোন ছা'র।'

ফেরার সময় খবরটা জানালেন দুর্যোধন মিত্র।

শুনে কৃষ্ণা অবাক-'ওমা, কাল তো এখানে এলে। আবার কালই ফিরে যাবে? 'শুনলে তো, নতুন প্রজেক্টের বাজেট তৈরি করতে হবে।'

'কত টাকার প্রজেক্ট হতে পারে?'

'আই ডোন্ট নো। হয়তো হাজার কোটি টাকা।'

'এত টাকা!'

ই। সরকারের কাছ থেকে লোন নিতে হবে। দশ বছরে শোধ করার পর ওরা কী চুক্তি করে, তার ওপর সব নির্ভর করছে। শোনো, তুমি এই এক্সিবিশনের ব্যাপারে কোনও কার্পণ্য করবে না। আমি তোমাকে আপাতত দশ লাখ টাকার চেক পাঠিয়ে দিচ্ছি। মুম্বাইয়ের স্টারদের পেছনে তো অনেক খরচ করতে হবে। যদি আরও দরকার হয় জানিও।' দুর্যোধন মিত্র বললেন।

কৃষ্ণা হাসলেন- 'অনেক ধন্যবাদ। তোমাকে চেক পাঠাতে হবে না।'

'কেন?'

'এক্সিবিশনের খরচ চালানোর সামর্থ্য আমার আছে। তুমি আসার আগেই আমি তো একাই ছিলাম, তাই না?'

দুর্যোধন গম্ভীর হলেন। কৃষ্ণা টাকা নিলে তাঁর ভালো লাগত। হয়তো সুন্দর আসছে বলেই কৃষ্ণাকে টাকা দেওয়াটা জরুরি মনে হয়েছিল তাঁর। কিন্তু এখন এ নিয়ে আর কথা বললেন না তিনি।

শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবেচিন্তে ফিরে যাওয়াটা একদিন পিছিয়ে দিলেন দূর্যোধন মিত্র। নিউইয়র্ক থেকে সন্ধ্যার ফ্লাইট ধরলে দিল্লিতে সুন্দর নামবে আগামীকাল রাতে। সে সময় পাহাড়ে যাওয়ার কোনও প্লেন নেই। ওকে ফ্লাইট ধরতে হবে আগামী পরশু সকালে। গোটা রাত নিশ্চয়ই এয়ারপোর্টে বসে সে কাটাবে না। ডোমেস্টিক ফ্লাইট ধরার জন্য এয়ার হোটেল দেবে না। নিজের পয়সায় হোটেলে থাকবে। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি পাঁচতারা হোটেলে ওকে যেতে হবে। একদিন দিল্লিতে থেকে ওর সঙ্গে একই ফ্লাইটে ফেরার কথা ভাবলেন দুর্যোধন। দিল্লিতে বাকি যে কাজগুলো ছিল তার কয়েকটা শেষ করার পর ওঁর খেয়াল হল কৃষ্ণাকে জানানো হয়নি তিনি দিল্লিতেই থেকে গেছেন। বিকেলে ফোন করতেই কৃষ্ণা জিগ্যেস করলেন, 'তুমি কোথায়?'

'আর কী বলব, এমন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম যে ফ্লাইট মিস করেছি। মাথা এমন গরম হয়ে গিয়েছিল যে তোমাকে জানাবার কথা মনে ছিল না। আই অ্যাম সরি। দুর্যোধন বললেন।

'আমি তোমাকে এই তিন বছরে বোধহয় খানিকটা চিনতে পেরেছি।'

'মানে?' হকচকিয়ে প্রশ্ন করলেন দূর্যোধন।

'তুমি ঘুমের অন্য ফ্লাইট মিস করবে এটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। যাকগে, তাহলে তুমি কি কাল ফিরে যাচ্ছ?'

'হ্যাঁ।'

'ফোন কোরো।'

মোবাইল অফ করে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থাকলেন দুর্যোধন। কৃষ্ণা স্পষ্টই বলে দিস এই ফিরে না যাওয়ার পেছনে অন্য কারণ আছে। কারণটা কি তা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছে না। পারলে নিশ্চয়ই বিরক্ত হত। কিন্তু কেন হবে? ওর শর্ত ছিল, সুন্দরের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকবে না। কিন্তু বাবা হয়ে তিনি ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন না এমন কথা তো দেননি। তিনি যে কথা দিয়েছেন তা অবশ্যই রাখার চেষ্টা করবেন। এর জন্য সুন্দরের সঙ্গে তাঁকে কথা বলতে হবে। এবং সেই বলাটা খুব প্রীতিকর হবে না। কৃষ্ণা সে কথা ভাবার প্রয়োজন মনে করছে না। নিউইয়র্কের ফ্লাইটটা দুবাই হয়ে দিল্লিতে পৌঁছল রাত দশটা নাগাদ। ওই ফ্লাইটেই সুন্দরের। টিকিট আগের দিন যখন কাটা ছিল তখন দিন পিছিয়ে নিলে একই সময়ে তাকে দিল্লিতে নামতে হবে। হোটেল থেকে গাড়ি নিয়ে দুর্যোধন মিত্র ঠিক সময়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে খোঁজ নিয়ে জানলেন প্লেন দু'মিনিট আগেই নেমে গেছে। অবশ্য ইমিগ্রেশন করে ভেতরে ঢুকে বেল্ট থেকে সুটকেস নিয়ে বের হতে অন্তত আধঘণ্টা লেগে যাবে।

বেশ কয়েক বছর পরে ছেলেকে দেখবেন বলে একটু উত্তেজনাবোধ করছিলেন দুর্যোধন। তাঁর পাঠানো টাকার কোনও হিসাব সুন্দর দিত না বলে ফোনে রাগারাগি করেছেন। যা খরচ হওয়া উচিত তার চেয়ে অনেক বেশি কী করে খরচ হয় তা তিনি বুঝতে পারতেন না। কথাটা বললেই সুন্দর এড়িয়ে যেত। অবশ্য একমাত্র ছেলের এই বেহিসেবিপনা শেষ পর্যন্ত উপেক্ষা করেছেন দুর্যোধন। কিন্তু মহিলাঘটিত ব্যাপারে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে জানতে পেরে খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন। ছেলেকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেনি জেনে আমেরিকা যাত্রা বাতিল করেন। সুন্দর ফোনে তাঁকে জানিয়েছিল যে তার এক পাকিস্তানি বন্ধুর প্রথম বান্ধবী আত্মহত্যা করায় পুলিশ তাকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। তার মতো অনেককেই করেছে। এটা একটা রুটিন চেকআপ ছাড়া কিছু নয়। বিশ্বাস করেছিলেন দুর্যোধন।

মিনিট ত্রিশ পরে যাত্রীরা বেরুতে পারল। গেটের এপাশে তাদের আত্মীয়বন্ধুদের ভিড়, স্বাগত জানাতে এসেছে সবাই। ভিড়ের শেষে দাঁড়িয়ে দুর্যোধন মিত্র লক্ষ রাখছিলেন বেরুবার দরজার ওপর। তাঁকে দেখে খুব অবাক হয়ে যাবে সুন্দর। বলবে, 'হোয়াট এ সারপ্রাইজ ড্যাডি। তুমি আমাকে রিসিভ করতে এত কষ্ট করলে কেন?'

ছেলের মুখে এমন কথা শুনলে যে-কোনও বাবাই বুশি হবে।

দুর্যোধন উদগ্রীব হয়ে দেখছিলেন। এই সময় সুন্দর ট্রলি নিয়ে বেরিয়ে এল। এসে চারধারে তাকাতে থাকল। দুর্যোধন এগিয়ে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন। জিন্স আর গেঞ্জি পরা একটা শরীর দৌড়ে পৌঁছে গেছে সুন্দরের কাছে। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরেছে। মেয়েটি গাল ছোঁয়াল সুন্দরের গালে। তারপর দুজনে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে চলে গেল পার্কিং লটের দিকে। স্তম্ভিত দুর্যোধনের ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগল। তিনি দেখলেন ওরা একটা লাল গাড়িতে চড়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গেল।

পরদিন ভোরে এয়ারপোর্ট এসে চেকিং করলেন দুর্যোধন মিত্র। বোর্ডিং কার্ড হাতে নিয়ে কী মনে হল, কাউন্টারে বসে থাকা মেয়েটিকে প্রশ্ন করলেন, 'আচ্ছা, সুন্দর মিত্র নামে একজন কি এই ফ্লাইটে যাচ্ছেন?'

মেয়েটি কম্পিউটার টিপে মাথা নাড়ল, 'সরি স্যার, এই নামের কেউ এক্সিকিউটিভ ক্লাসে নেই। এক সেকেন্ড অমি ইকোনমি ক্লাস চেক করছি!'

সেটা দেখার পর মেয়েটি বলল, 'না স্যার। এই নামের কেউ নেই।'

অবাক হলেন দুর্যোধন মিত্র। নিউইয়র্ক থেকে দিল্লিতে নেমে থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা না করে এসে ওর নাম লিস্টে থাকত। নিজেকে খুবই প্রতারিত বলে মনে হচ্ছিল তাঁর।

দুপুরের মধ্যে পাহাড়ি শহরে পৌঁছে গেলেন তিনি। নীচের এয়াপোর্টে নেমে অবিনাশ ভার্গবকে ডেকে পাঠালেন।

মিস্টার ভার্গব চলে এলেন পনেরো মিনিটের মধ্যে দুর্যোধন মিত্র তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'হিলটপের খবর কী?”

'খুব ভালো। মনে হচ্ছে সামনের ফেস্টিভ মাছের বুকিং দু-তিনদিনের মধ্যে ক্লোজ করতে হবে। বাইরে থেকেও বুকিং আসছে।' মিস্টার ভার্গব বললেন।

'আপনার কাছে আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে।'

'স্যার, এভাবে বলছেন কেন!'

'বলছি এই কারণে আমি আপনার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চাই না। আমার ছেলে সুন্দর এতদিন ইউএসএ-তে ছিল। ম্যানেজমেন্ট করেছে। আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে ও হিলটপে জয়েন করুক।'

'আপনার ছেলে হিসটপে এলে তো খুব ভালো হবে।'

'কিন্তু ও আপনার অধীনে কাজ করবে। ধরুন, ওকে আপনি যদি সেলস অ্যান্ড প্রমোশনের দায়িত্ব দেন 'তাহলে কেমন হয়? ওর কাজের ব্যাপারে আপনার কাছে ওকে কৈফিয়ত দিতে হবে।

আমার ছেলে বলে কোনও অ্যাডভান্টেজ নিতে ওকে দেবেন না।'

'এটা কি আপনার রিকোয়েস্ট?'

একটু ভাবলেন দুর্যোধন মিত্র। তারপর বললেন, 'এটা আমার পলিসি।'

'তাহলে ঠিক তা-ই হবে স্যার।'

'আর একটা কথা। হোটেলের ওপরে যে স্টাফরুম আছে তার একটায় ওকে থাকতে দেবেন।

আমি চাই ও হিলটপেই থাকুক।'

'স্যার, স্টাফদের জন্য রুমগুলো তো খুব সাদামাটা। ওঁর অসুবিধে হবে।' মিস্টার ভার্গব বললেন, 'আপনি চাইলে গেস্টদের ঘরগুলো থেকে...।'

থামিয়ে দিলেন দুর্যোধন মিত্র, 'মিস্টার ভার্গব, আপনি কোথায় থাকেন?'

'স্টাফদের একটা ঘরে।'

'আপনার যদি অসুবিধে না হয় ওরও হবে না। হওয়া উচিত নয়। গেস্টদের রুমগুলো থেকেই তো রেভিনিউ আসছে, তাই না? আচ্ছা, আপনি যেতে পারেন।'

উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার ভার্গব, মিস্টার মিত্র কবে আসবেন?'

'মিস্টার মিত্র? ও, ওকে আপনি সুন্দর বলবেন। আপনি অনেক সিনিয়র। কবে আসবে? আই ডোন্ট নো। তবে আসবে নিশ্চয়ই' দূর্যোধন মিত্র বললেন।

মিস্টার ভার্গব বিদায় নিতেই ইন্টারকমে পি-এ বলল, স্যার, আপনার একটা কল এসেছে,

দিল্লি থেকে।'

'কী নাম বলেছে'

'বললেন, এস মিটার।"

ফোন তুললেন দুর্যোধন, "হ্যালো।'

'হাই ড্যাড, আমি এখন দিল্লিতে।'

'কখন এলে? গম্ভীর গলায় জানতে চাইলেন দুর্যোধন মিত্র।

'কাল মিডনাইটে। ঠিক ছিল, আজ সকালের ফ্লাইট ধরব। কিন্তু জেট ল্যাগ হয়ে গিয়েছে, রাতে ঘুমাতে পারিনি, ভোরে ঘুমিয়ে পড়ায় ফ্লাইট মিস করেছি।'

'ও।' মনে মনে চড় মারলেন দুর্যোধন।

'আমি কাল সকালের ফ্লাইট ধরছি।'

তোমার জেট ল্যাগ হয়েছে বললে। ওটা তিন-চারদিন থাকে। ঠিক হয়ে গেলে এসো। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই।'

'তুমি বলছ? ও.কে.! থ্যাঙ্ক ইউ ড্যাডি।' লাইন কেটে দিল সুন্দর।

দাঁতে দাঁত চাপলেন দুর্যোধন। মিথ্যে কথাগুলোকে গিলতে কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। তিনি নিশ্চিত সুন্দর ওই মেয়েটির জন্য আগে থেকেই প্ল্যান করেছিল। আজ ওর সঙ্গে থাকবে বলেই ওর নাম ফ্লাইটের লিস্টে ছিল না। কে ওই মেয়ে? কী নাম? সুন্দরের সঙ্গে ওর আলাপ কীভাবে হল? সুন্দর তো কখনও দিল্লিতে থাকেনি। সুন্দর যদি ওকে বিয়ে করতে চায় তাহলে তিনি বাধা দেবেন না। মোবাইলের বোতাম টিপলেন দুর্যোধন, রিং হল, 'আমি এখন অফিসে। তুমি কোথায়?'

কৃষ্ণা বললেন, 'বাড়িতে। একজিবিশনের ওপেনিংয়ে আসবে তো?'

'অবশ্যই।' হাসলেন দুর্যোধন।

গাড়ি গিয়েছিল এয়ারপোর্টে। ড্রাইভার সেখান থেকে সুন্দরকে নিয়ে নির্দেশমতো চলে এল

হিলটপে। হোটেলের সামনে গাড়ি থেকে নেমে কোমরে দুই হাত রেখে পাঁচতলা বিশাল হোটেলটির দিকে তাকিয়ে সুন্দর বলল, 'বাহ।'

ড্রাইভার বনেট খুলে দিতে হোটেলের দারোয়ান সুটকেস দুটো নামাচ্ছিল। সুন্দর আপত্তি করল, 'এখানে কেন? নামাতে হবে না, বাড়িতে যাবে ওগুলো।'

দ্বিতীয় দারোয়ান সামনে এসে সেলাম করে বলল, 'বড় সাহেব অফিস রুমে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন স্যার।'

তাকে অনুসরণ করে হোটেলের লবিতে পা দিয়ে খুব খুশি হল সুন্দর। যে-কোনও আধুনিক হোটেলের সঙ্গে পাল্লা দেবে হোটেলের লবি। সে রিসেপশন ডেস্কের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। স্বপ্নেও সে এমন সুন্দর নারী দ্যাখেনি। ইউনিফর্ম পরে ডেস্কের ওপাশে দাঁড়িয়ে একজন ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলছে যে, সে কি এই পৃথিবীর মেয়ে? দারোয়ানকে ছেড়ে ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেল সুন্দর। ওপাশে যে ছেলেটি সুট পরে কম্পিউটারে কাজ করছিল সে এগিয়ে এল, 'ইয়েস স্যার।' 'হু ইজ শি?' ইশারায় তখনও কথা বলছিল মেয়েটি।

'শি ওয়ার্কস হিয়ার।'

'হুম।' মেয়েটিকে 'আর একবার দেখে সে জিজ্ঞাসা করল, 'মিস্টার দুর্যোধন মিত্রকে এখন

কোন ঘরে পাওয়া যাবে?'

'উনি অফিসে আছেন। আপনার পরিচয়?'

'আমি ওঁর ছেলে।'

'আই সিঃ আই অ্যাম সরি স্যার। আপনাকে 'আমি চিনতে' পারিনি।

ইশারায় একজন বেয়ারাকে ডেকে নীচু গলায় রিসেপশনিস্ট বলল বড় সাহেবের কাছে নিয়ে

যেতে। যাওয়ার আগে হেসে জিগেস করল, 'নাউ, ওর নামটা নিশ্চয় জানতে পারি?'

"সিওর স্যার: লীলা, লীলা প্রধান।' তাড়াতাড়ি বলল রিসেপশনিস্ট।

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে সুন্দর দেখল দুর্যোধন মিত্র ল্যাপটপে চোখ রেখে বসে আছেন।

সে বলল, 'হাই ভ্যাড।'

চোখ তুললেন দুর্যোধন। 'ও, এসে গেছ। বসো।'

সুন্দর বসল। ল্যাপটপ বন্ধ করলেন দুর্যোধন, 'জেট ল্যাগ?'

'নেই।'

'শুড। হোটেল কেমন লাগছে।'

'ঘর দেখিনি। লবি ফ্যান্টাস্টিক।'

'আমি চাই তুমি হিলটপকে ভালোবাসো। নিজেকে এর সঙ্গে গুড়াও।'

'গিভ মি এ চান্স ড্যাড।'

'নিশ্চয়ই' বলা মাত্র দরজায় শব্দ হল। দুর্যোধন সোজা হয়ে দেখলেন দরজা খুলেছেন মিস্টার

ভার্গব।

'কাম ইন মিস্টার ভার্গব। মিট মাই সান সুন্দর।'

'হ্যালো।' হাত বাড়ালেন মিস্টার ভার্গব, 'অবিনাশ ভার্গব।'

'হ্যালো।' হাত মেলাল সুন্দর।

দুর্যোধন মিত্র বললেন, 'মিস্টার ভার্গব ভারতবর্ষের হোটেল ইন্ডাস্ট্রিজে অত্যন্ত পরিচিত নাম।

এই হোটেলের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি ওঁর হাতে তুলে দিয়েছি।'

'আই সি।'

'আমি ওঁকে অনুরোধ করেছি তোমাকে বিশেষ দায়িত্ব দিতে। তুমি যেহেতু এমবিএ করেছ তাই সেলস আর প্রমোশনটা দেখার দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে। তোমার কাজের রিপোর্ট তুমি মিস্টার ভার্গবকে নিয়মিত দেবে। নাউ টেল মি, ইন্ডিয়ান মানিতে পার অ্যানাম কত হলে তুমি খুশি হাবে?'

হাঁ হয়ে গেল সুন্দর, 'তুমি কি চাইছ আমি পেরোলে থাকি?' 

'অফকোর্স। তুমি পরিশ্রম করবে অথচ টাকা নেবে না, তা কি হয়?'

'হিলটপ কি প্রাইভেট ওনারশিপ বিজনেস?'

'নো। প্রাইভেট লিমিটেড।'

'আমি কি শেয়ারহোল্ডার নই?'

'অবশ্যই নয়। তোমার পারফরমেন্স দেখার পর আমি ওটা নিয়ে ভাবব।'

হবে।'

কাঁধ নামাল সুন্দর। টেবিলে আঙুল ঠুকল দুবার। তারপর বলল, 'আমাকে একটু চিন্তা করতে

'টেক ইওর টাইম।'

মিস্টার ভার্গব বললেন, 'স্যার আমাকে কি এখন প্রয়োজন আছে?'

'ওহো, নো। আপনি নিশ্চয়ই যেতে পারেন।

মিস্টার ভার্গব চলে গেলে সুন্দর বলল, 'আমি তোমাকে বুঝতে পারি না।'

'ইটস সিম্পল। না বোঝার কিছু নেই।'

'আমি আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করে এসে নিজেদের হোটেলে আর একজনের অধীনে চাকরি করব?'

'অন্যায় কী?'

'আমি এত ইনএফিশিয়েন্ট?'

হাসলেন দুর্যোধন, 'তোমার সম্বল একটা ডিগ্রি। বাস্তব অভিজ্ঞতা কি আছে? শুধু থিওরি

দিয়ে হোটেল চালানো যায় না। তার জন্য অভিজ্ঞতার দরকার হয়। ভার্গবের কাছে কাজ শিখলে তুমি-ই লাভবান হবে। ও হ্যাঁ, তোমার থাকার ব্যবস্থা হিলটপেই হয়েছে।

'হিলটপে?'

""এতে হোটেলের সঙ্গে তোমার অ্যাটাচমেন্ট বাড়বে।'

'তুমি চাইছ আমি বাড়িতে না থাকি?'

'আমি চাই তুমি হোটেলে থাকো, তার ফলে এখানকার কর্মীরা আরও সিরিয়াস হবে। যাও

বিশ্রাম নাও।'

'কোথায় যাব?'

বেল টিপে বেয়ারাকে ডাকলেন দুর্যোধন, 'সাহেবকে ওর ঘরে পৌঁছে দিয়ে এসো।' তারপর

ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'যাওয়ার আগে তোমার অফিসরুমটা দেখে যেও। কোনও সাজেশন

থাকলে মিস্টার ভার্গবকে বলো।'

সুন্দর উঠে দাঁড়াল। তাকে অত্যন্ত বিরক্ত এবং বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। বেয়ারার পেছনে বাইরে এসে সে এক মুহূর্ত দাঁড়াল। বেয়ারা ততক্ষণে ওপাশের একটা ঘরের দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে। ইচ্ছে হচ্ছিল না তবু পা বাড়াল সুন্দর।

মাঝারি সাইজের ঘর। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট। দেয়ালের রং চোখের আরাম দিচ্ছে। টেবিল- চেয়ার চমৎকার। বসল সে। না, এই ঘরটি সম্পর্কে অভিযোগ জানানোর কোনও উপায় নেই। কিন্তু দূর্যোধন মিত্রের

হঠাৎ কি হল? এত আধুনিক হয়ে পেলেন কী করে? ইন্টারকমের বোতাম টিপল সে। প্রায় সঙ্গে

সঙ্গে অপারেটরের গলা পাওয়া গেল, 'ইয়েস স্যার।' 'মিস্টার অবিনাশ ভার্গব।' গম্ভীর গলায় বলল, সুন্দর।

একটু বাদেই মিস্টার ভার্গবের গলা শুনতে পেল সে, 'ইয়েস মিস্টার মিত্র। কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো।'

'আপাতত না। অফিস ঠিকই আছে। আমার নামে কি গাড়ি অ্যালট করা হয়েছে?' সুন্দর জিগ্যেস করল।

'অফকোর্স।'

'আরও কয়েকটা ব্যাপারে কথা বলা দরকার।'

'আপনি বহুদূর থেকে এসেছেন। আজকের দিনটা রেস্ট নিন। কাল সকালে কথা বলা যাবে।' মিস্টার ভার্গব বললেন।

ফোন রেখে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল সুন্দর। বেয়ারা দাঁড়িয়ে ছিল, তাকে জিগ্যেস করল, "'ড্যাডি এখনও ঘরে আছে?'

'না স্যার, উনি হেড অফিসে চলে গিয়েছেন।'

'কখন আসেন রোজ?'

'রোজ তো আসেন না, আর একেকদিন একেক সময় আসেন।'

মাথা নাড়ল সুন্দর। তারপর লবিতে চলে এল। সেই সুন্দরী, যার নাম লীলা, একা দাঁড়িয়ে কাজ করছিল। সে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মিষ্টি হাসল, 'গুড আফটারনুন স্যার।'

'আমি কী বলব? তুমি না আপনি?'

একটু গম্ভীর হয়ে গেল লীলা, 'তুমি বলতে পারেন।'

"তুমি কোথায় থাকো?"

'ওপরে। স্টাফরুমে।'

'নিশ্চয়ই এই শহরের মেয়ে নও।'

'না স্যার। আই অ্যাম ফ্রম দার্জিলিং।'

'তাই বল। এখানে তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে আশাই করা যায় না। বাই দ্য ওয়ে, আমার

পরিচয়

জানো?'

"হ্যাঁ স্যার, গুনেছি।'

'না। আমাকে তুমি স্যার কলবে না। আমার নাম সুন্দর। নাউ লীলা আই নিড এ কার। আমার নামে নাকি একটা অ্যালট করা হয়েছে?'

'আপনি বাইরে গেলেই পেয়ে যাবেন।'

ড্রাইভারকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসল সুন্দর। তারপর তীব্রগতিতে বেরিয়ে গেল হোটেল থেকে। মিনিট দশেকের মধ্যে শহর ছাড়িয়ে সে চলে এল পাহাড়ের ওপাশে। এদিকে ঘরবাড়ি কম, রাস্তা নির্জন। কিছুক্ষণ গাড়ি চালানোর পর একটা বাঁকে সে গাড়ি দাঁড় করাল। তারপর নীচে নেমে সামনে তাকাল। বিশাল খানের শেষে জঙ্গলে মাথাগুলো দেখা যাচ্ছে। সেটা ছড়িয়ে আছে বহুদূর পর্যন্ত। কোথাও কোনও শব্দ নেই। এরকম জনমানবহীন এলাকার একটা হোটেলে তাকে সারাজীবন কাটাতে হবে নাকি? অসম্ভব। মালিকের ছেলে হয়ে সেলস এবং প্রমোশনের দায়িত্ব নিয়ে মাইনে নিতে হবে? কত টাকা দেবে দুর্যোধন মিত্র? বারো লাখ টাকা বছরে। তার মানে চব্বিশ হাচ্ছার ডলার? একটা ট্যাক্সিওয়ালাও নিউইয়র্ক শহরে ওর দ্বিগুণ রোজগার করে। তা ছাড়া হোটেলে বসে সেলসের কাজ দেখা যায় না। ক্লায়েন্ট পেতে হলে তাকে দিল্লিতে অফিস করতে হবে। দুর্যোধন মিত্রকে এটা বুঝতে হবে। না বুঝলে তার পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয়। সুন্দর সিগারেট ধরাল। আমেরিকায় থাকার সময় এই নেশা থেকে সে মুক্ত হয়েছিল বাধ্য হয়ে। সর্বত্র সিগারেটবিরোধী কথাবার্তা। কেউ সিগারেট খেলে তার দিকে মানুষ করুণার চোখে তাকায়। দিল্লিতে নেমে টিনার সঙ্গে দুটো রাত থেকে সিগারেট খেতে ভালো লাগছে। টিনাও সিগারেট খায়। টিনা আর ও সিগারেট একসঙ্গে খায় আলাপ হয়েছিল নিউইয়র্কে। আলাপের দ্বিতীয় দিনেই টিনা বলেছিল, 'হাউ অ্যাবাউট এ বন্ডলেস ফ্রেন্ডশিপ।' উদ্দাম যৌবনের স্বাদ দিয়েছিল টিনা। মুখ চোখ অতি সাধারণ কিন্তু ফিগার অসাধারণ। আর সেটাকে ব্যবহার করতে টিনা জানে। মাস ছয়েক আগে বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে দিল্লিতে ফিরে এসেছিল মেয়েটা। ফোনে যোগাযোগ ছিল। কবে কোন ফ্লাইটে দিল্লিতে নামছে টিনাকে জানিয়েছিল সুন্দর। ওকে পেয়ে দুর্যোধন মিত্রকে জেট ল্যাগের গল্প বানিয়ে বলতে হয়েছিল।

কিন্তু দুর্যোধন মিত্রকে এবার অন্যরকম লাগছে তার। এত ব্যক্তিত্ব ভদ্রলোকের আগে ছিল না। হঠাৎ যেন ভাবনার দিক থেকে পঞ্চাশ বছর এগিয়ে গেছেন। এটা কি ওঁর নতুন স্ত্রীর অবদান? ভদ্রমহিলা নাকি দিল্লির মেয়ে, ফ্যাশন ডিজাইনার। বিয়ের খবরটা সুন্দর বাবার টেলিফোনে জেনেছিল। 'সুন্দর। তোমার মায়ের মৃত্যুর পর আমি একা হয়ে যাই। এই একাকিত্ব ভুলতে ব্যবসায় ডুবে গিয়েও শান্তি পাইনি। দিল্লিতে এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা হল। তিনি অবিবাহিতা, ফ্যাশন

ডিজাইনার। আমরা একমত হয়েছি। তারপর বিয়ে হয়ে গেল।'

কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি সুন্দরের। ওল্ডম্যান বিয়ে করলে তার কী ক্ষতি। এ বয়সে নিশ্চয়ই বাবা হওয়ার সাধ হবে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওই লেডিই দুর্যোধন মিত্রের এই ব্যাপক পরিবর্তনের উদ্যোক্তা। মহিলা বোধহয় তার অস্তিত্ব মানতে পারছেন না। পারছেন না বলে দুর্যোধন মিত্র নিজের ছেলেকে কর্মচারী হিসেবে দেখতে চাইছেন। নিজের বাড়িতে যেতে না দিয়ে হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করেছেন। মাথা গরম হয়ে গেল সুন্দরের। গাড়িতে উঠে সেটাকে ঘুরিয়ে সোজা চলে এল দুর্যোধন মিত্রের প্রাসাদে। গাড়ি থেকে নামতেই পুরোনো দারোয়ান ছুটে এসে সেলাম করল। সুন্দর বলল, '

মেমসাব কে বলো আমি এসেছি।'

'মেমসাব তো এখানে নেই ছোটা সাহেব।'

'কোথায় গেছেন?'

'দিল্লিতে।'

'শিট!' আবার গাড়িতে উঠে বসল সুন্দর।

হোটেলে ফিরে এসে লবিতে পা দিতেই ওর মনে হল তার এত রেগে যাওয়া উচিত হচ্ছে না। তার দেখা সেরা সুন্দরী এই হোটেলে কাজ করছে। ও কাছে থাকলে পৃথিবীর আর কিছুর প্রয়োজন হবে না।

সোজা রিসেপশনে গিয়ে সে বলল, 'আমি জানি না আমার ঘর কোথায়। তুমি কি দয়া করে খুঁজে দেবে?'

লীলা অবাক হয়ে পাশে দাঁড়ানো সহকর্মীর দিকে তাকাল। ছেলেটি বলল, 'স্যার ইওর রুম ইজ ইন ফিফথ ফ্লোর। আপনার লাগেজ ওখানে পৌঁছে গিয়েছে।' সে ইশারায় একজন বেয়ারাকে ডাকল। লোকটা কাছে এলে বলল, 'সাহেবকে ওঁর ঘরে পৌঁছে দিয়ে এসো।' লোকটা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল।

হাসল সুন্দর। বলল, 'থ্যাঙ্ক ইউ লীলা।' তারপর বেয়ারাকে অনুসরণ করল। লিফটে পাঁচতলায় উঠে দেখল নাম্বারবিহীন ঘর আছে অনেক। সে বেয়ারাকে জিজ্ঞাসা করল, 'ভার্গব সাহেব কোথায় থাকেন?'

'বাঁদিকের সেকেন্ড রুম স্যার।'

'ফার্স্ট রুমটা কার?'

'আপনার স্যার।'

একটু ভালো লাগল সুন্দরের, 'বাকি ঘরগুলোতে কারা থাকে?'

'হোটেলের ছেলে স্টাফরা দুজন করে এক ঘরে। শেষ দুটো ঘরে লেডিসরা।'

'সীলা মেমসাব কোন ঘরে থাকেন?'

'একদম শেষটায়।' বেয়ারা দরজা খুলে দাঁড়াল।

'এবার তুমি যেতে পারো।'

বেয়ারা চলে গেলে ঘরে ঢুকল সুন্দর। অনাড়ম্বর ঘর। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সব আছে কিন্তু কোনও বাহুল্য নেই। নিজের সুটকেস দুটো দেখল সে।

ফোন তুলে রুম সার্ভিসে ডায়াল করল। 'সুন্দর মিত্র বলছি।'

'ইয়েস স্যার।'

'আই অ্যাম হাংরি অ্যান্ড আই অ্যাম নট ভেজিটেরিয়ান। আন্ডারস্ট্যান্ড।'

'ইয়েস স্যার।'

'ও হ্যাঁ, হোটেলে ব্লু লেভেল আছে?'

'ইয়েস স্যার।'

'একটা বোতল পাঠিয়ে দিন উইথ লট অব আইস। কুইক।'

সুটকেস খুলে পোশাক বের করে বাথরুমে গিয়ে একটা শাওয়ার নিল সুন্দর। তারপর ঘরে ফিরে টিভি খুলল। নিউজ হচ্ছে। বন্ধ করতে গিয়ে থেমে গেল সে। রামু আঙ্কল। কী বলছে রামু আঙ্কল। শোনার আগেই অন্য খবরে চলে গেল সঞ্চালক। একটা সময় লোকটা ভ্যাগাবন্ড ছিল। ফালতু লেবার। দুর্যোধন মিত্র লোকটাকে প্রথমে নেতা বানালেন। তারপর এমএলএ। এমএলএ থেকে এমপি। বলা যায় না, সামনের বার এমপি থেকে মিনিস্টার বানিয়ে দিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

দরজায় শব্দ হল। সুন্দর বলল, 'ইয়েস।'

বেয়ারা ঘরে ঢুকে পরিপাটি করে খাবার সাজিয়ে, হুইস্কির বোতল খুলে বরফ পাশে দিয়ে

সেলাম করে চলে গেল।

বোনলেস চিকেন মুখে পুরল সুন্দর। বাঃ। রামু কাকা কী বলছিল। এখানে না দিল্লিতে। ইন্টারেস্টিং। সে বোতলটা চোখের সামনে তুলল। এই পাহাড়ি শহরে লেভেল এখন চাইলেই পাওয়া যায়। কে যেন বলছিল, স্কটল্যান্ডে ব্ল‍্যাক লেভেল বছরে যত বোতল তৈরি হয়, ভারতবর্ষে তার দ্বিগুণ বোতল লোকে খালি করে। কোথেকে আসে সেগুলো? এই ব্লু লেভেল জাল না তো? সে বোতলের তলাটা পরীক্ষা করল। না! কোনও ফুটোর দাগ নেই।

তিন পেগ হুইস্কির সঙ্গে বাবার যখন প্রায় শেষ তখন সুন্দর টেলিফোন তুলে অপারেটরকে

বলল,

'রায়ু আঙ্কলকে ধরুন তো।'

'স্যার রামু আঙ্কল কে?'

মাই গড! আপনি এখানে চাকরি করছেন কী করে? হু ইজ ইওর এমপি?'

'ওহো, সরি স্যার, এক্ষুনি দিচ্ছি।'

'অপদার্থ।' বিড়বিড় করল সুন্দর।

কয়েক সেকেন্ড পরে রামচন্দ্রের গলা শুনতে পেল সে, 'ওয়েলকাম ব্যাক? কেমন আছ? ও, অনেকদিন তোমাকে দেখিনি।'

'বাট রামু আস্তল, তোমার জনপ্রিয়তা কি আর আগের মতো নেই?'

'হঠাৎ এই প্রশ্ন?'

'হোটেলের অপারেটরকে বললাম রামু আঙ্কলকে ধরুন, কিন্তু ও জিগ্যেস করল, স্যার রামু আঙ্কল কে? হা-হা-হা।"

'ওরা আমাকে আঙ্কল বললে চিনবে না সুন্দর। রামু ভাইয়া বললে বুঝতে পারত। যাকগে।

তুমি তো হোটেলেই আছ।'

'ইয়েস। ইওর ওল্ডম্যান এখানে থাকতে বলেছে। বাট রামু আঙ্কল, তুমি এখন কী করছ? তোমার সঙ্গে আমার কথা বলা দরকার। প্লিজ কাম হিয়ার।'

'খুব দরকার?'

'খুব।'

ঠিক আছে, ঘণ্টা দুয়েক পরে যাচ্ছি।

'নো নো। রাইট নাউ।"

'আচ্ছা!' হাসলেন রামচন্দ্র বণিক।

সুন্দর যখন পাঁচ পেগে পৌঁছে গেছে তখন তার দরজায় শব্দ হল। সে জড়ানো গলায়

জিগ্যেস করল, 'কে ওখানে?'

রামচন্দ্র বণিক ঘরে ঢুকে হাসলেন, 'ও মাই গড! কতটা খেয়েছ?'

'এই তো। এতটুকু। বসো বসো রামু আস্কল। তোমাকে টিভিতে খুব হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছিল। কেন দেখাচ্ছিল?'

রামচন্দ্র হাসলেন। 'আর ইউ অলরাইট সুন্দর?'

'কেন?' চোখ বড় করল সুন্দর।

'আমার মনে হচ্ছে তুমি খুব টায়ার্ড। আর একটু বেশি ড্রিঙ্ক করে ফেলেছ!'

'নো। আমি টায়ার্ড নই, বেশি ড্রিঙ্কও করিনি।'

'বেশ। কী কথা বলতে চেয়েছ।'

দুর্যোধন মিত্র, মাই ফাদার, লোকটাকে আমি চিনতে পারছি না।' তুমি চেনো?'

'কেন এ কথা মনে হচ্ছে?',

'বলছি, তার আগে বলো, তুমি দুর্যোধন মিত্রের সেকেন্ড ওয়াইফ, মাই স্টেপ মাদার, তাকে

দেখেছ। আলাপ হয়েছে?"

'হ্যাঁ। খুব ভালো ভদ্রমহিলা।'

'তা তো বলবেই।'

'আমি বানিয়ে বলছি না।'

'আমি কী করে আনব? তুমি কে? একটা সাধারণ শ্রমিক ছিলে, ওই লোকটা তোমাকে

নেতা বানিয়েছে, এমএলএ, এমপি। তুমি তো ওর বউয়ের প্রশংসা করবেই।' মুখ ফেরাল সুন্দর।

'সুন্দর, উনি তোমার মা।'

'সরি, আমার একজনই মা অ্যান্ড শি ইজ ভেত।'

'ও.কে। হোয়াট ইজ ইওর প্রবলেম?'

'আরে রামু আঙ্কল, তুমি ইংরেজি বলছ? হোয়াট অ্য: সারপ্রাইজ। গুড। শোনো, আমি এখানে কেন এলাম? দুর্যোধন মিত্র আমাকে ওর এমপ্লয়ি করে দিল। অ্যান্ড আমার বস হল ওই ভার্গব লোকটা। আমাকে থাকতে হবে এই ঘরে। অ্যান্ড দ্যাট বিচ থাকবে ওই প্রাসাদে। আমি এটা মেনে নিতে পারছি না। এটা আমার সমস্যা। তাই না?'

'ই। দ্যাখো সুন্দর, তোমাকে আমি সেই ছোট্টবেলা থেকে জানি। মনে আছে, তুমি আমার সঙ্গে বেড়াতে যেতে খুব ভালোবাসতে। আজ তোমার সমস্যা শুনে আমার খারাপ লাগছে। মিস্টার মিত্রের উচিত ছিল এই হিলটপ হোটেল্টাকে তোমার হাতে তুলে দেওয়া। ওঁর পরে তুমি এই হিলটপ হোটেলের মালিক হবে। একজন কর্মচারীর আন্ডারে তোমাকে কাজ করতে বলা ঠিক হয়নি।' রামচন্দ্র বণিক খুব ধীরে ধীরে বললেন।

'এই কথগুলো তুমি ফাদারকে বলতে পারবে না?"

'কোনও কাজ হবে না। এখন উনি আমার কথা শোনেন না।'

'যাতে শোনেন সেই ব্যবস্থা করো।'

'মানে?'

'পলিটিক্যাল পার্টি তোমার হাতে।'

'ও। আমি তোমাকে বলব মাসখানেক ধৈর্য ধরতে।'

'তাই। বেশ। তাই হবে। হোয়াট অ্যাবাউট এ ড্রিঙ্ক?"

'সরি সুন্দর। গুড নাইট।' রামচন্দ্র বণিক উঠে দাঁড়ালেন।

পরদিন সকাল দশটায় মিস্টার ভার্গবের সঙ্গে কথা বলল সুন্দর। ভারতবর্ষ তো বটেই, পৃথিবীর অন্য দেশে হিলটপের কথা প্রচার করতে টুরিস্টদের আকর্ষণ করতে হলে এই পাহাড়ি শহরে বসে সে কিছুই করতে পারবে না। তার প্রস্তাব দিল্লিতে একটা অফিস খুলতে হবে। তার ফলে বিভিন্ন অ্যাসেম্বলি বা কনস্যুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ছাড়া সর্বভারতীয় কাগজগুলোতে হিলটপ সংক্রান্ত খবর ছাপাতে পারবে। বিজ্ঞাপন দেওয়াও অত্যন্ত দরকার। সাংবাদিকদের এখানে নিয়ে এসে আতিথ্য দিলে তাঁরা ফিরে গিয়ে বিভিন্ন কাগজে বিশদ লিখবেন। এগুলোর ব্যবস্থা দিল্লিতে অফিস থাকলেই সম্ভব হবে।

মিস্টারর ভার্গব সুন্দরের প্রস্তাব উড়িয়ে দিতে পারলেন না। হিলটপের ওয়েবসাইট হলেও ইনকরারি আসছে কিন্তু সুন্দরের প্রস্তাব অনেক বেশি ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হল তাঁর। তবে দেখতে হবে এ বাবদ কী রকম খরচ হবে। তিনি বললেন, 'আপনার ভাবনাটা আমার পছন্দ হয়েছে। আপনি এ ব্যাপারে আপনার বাবার সঙ্গে কথা বলুন।'

'নো। আমি আপনাকে জানালাম, আপনি ওকে রাজি করান।'

মিস্টার ভার্গব হাসলেন, 'বেশ তাই হবে।'

'দ্বিতীয় কথা, আপনি জানেন ক্লায়েন্ট এন্টারটেনমেন্ট একটা জরুরি ব্যাপার। আমি প্রতি

মাসে কত টাকার বিল সই করতে পারি?"

'এখানে কেউ এলে হিলটপেই তাদের নিয়ে বসতে পারেন।'

'বাইরে যেতে হবে। কেউ তো সময় নষ্ট করে এখানে এন্টারটেইন্ড হতে চাইবে না।'

'কত হলে ভালো হয়?'

'অন্তত এক লক্ষ টাকা।'

মিস্টার ভার্গব একটা প্যান্ড টেনে নিয়ে নোট করলেন।

'আমি একজিকিউটিভ ক্লাসে যাতায়াত করতে অভ্যস্ত।'

'ও.কে.।'

'কালকে আমাকে জিগ্যেস করা হয়েছিল আমার এক্সপেক্টেশন কত? ওয়েল, ফোর থাউজেন্ড ডলার পার মাস্থ।"

'আমি মিস্টার মিত্রের সঙ্গে কথা বলে আপনাকে কনফার্ম করব।'

সুন্দর উঠে দাঁড়াল। 'ও হ্যাঁ, আপনারা স্কচ কোথায় পান? কে কেনেন।'

'কেন বলুন তো?'

'কাল রাতে একটা ব্লু লেভেল নিয়েছিলাম। জিনিসটা জেনুইন নয় বলে আমার ধারণা হয়েছে।

আমাদের ইমপোর্ট লাইসেন্স আছে?'

'না।'

'ওটা পাওয়ার ব্যবস্থা করুন।' সুন্দর বেরিয়ে গেল।

দ্রুত সুন্দরের প্রস্তাব এবং দাবিগুলো লিখে মেইল করে দিলেন মিস্টার ভার্গব দুর্যোধন মিত্রের

কাছে।

দশ মিনিট পরে ফোন পেলেন ওঁর পি-এর কাছ থেকে, 'স্যার হেড অফিসে লাঞ্চ পর্যন্ত

থাকবেন। আপনি ফ্রি হলে দেখা করতে বলেছেন।'

মিস্টার ভার্গব বললেন, 'আমি এখনই ওঁর কাছে যাচ্ছি।'

বেশ অস্বস্তি নিয়ে গাড়িতে উঠলেন অবিনাশ ভার্গব।

হোটেলটা ভালো করে ঘুরে দেখল সুন্দর। তারপর লবিতে নেমে এসে রিসেপশনে পৌঁছে সেখল কালকের ছেলেটির সঙ্গে অন্য একটি মেয়ে কাজ করছে, সে মেয়েটিকে জিগ্যেস করল, লীলা কোথায়? ওর সঙ্গে কথা বলা দরকার।'

'স্যার, ওর ডিউটি বিকেল তিনটে থেকে।' মেয়েটি বলল।

মাথা নেড়ে নিজের ঘরে ফিরে এল সে। তারপর অপারেটরকে ফোনে ধরল, 'আমি সুন্দর

মিত্র বলছি।'

'বলুন স্যার।'

'পাঁচতলার স্টাফ রুমগুলোতে কি ফোন আছে?'

'হ্যাঁ স্যার। ডাইরেক্ট ডায়ালিং নেই, এক্সটেনশন আছে।'

'লীলা প্রধানের ঘরের লাইনটা অন করুন।'

একটু পরেই অপারেটর জানাল, 'রিং হচ্ছে স্যার।'

'থ্যাঙ্ক ইউ। এবার আপনি অন্য কাজ করুন। আমি চাই না আমাদের কথাবার্তা তৃতীয় মানুষ

শোনে। আন্ডারস্ট্যান্ড?'

'ও.কে স্যার।'

লীলার গলা গুনতে পেল সুন্দর, 'হ্যালো!'

'শীলা?' সুন্দর জিগ্যেস করল।

'ইয়েস!' চেহারার সঙ্গে চমৎকার মানানসই ওর গলার স্বর।

'আমি সুন্দর। সুন্দর মিত্র।'

'তোমার তো তিনটে থেকে ডিউটি শুরু হবে?'

'হ্যাঁ স্যার।'

'তাহলে এখন নিশ্চয়ই রেস্ট নিচ্ছ।'

'স্যার, এনি প্রবলেম।'

'আর কী বলব। এখানে এসে খুষ বোর হচ্ছি। ভাবলাম তুমি যদি ফ্রি থাক তাহলে তোমার সঙ্গে একটু কথা বলি।' হাসল সুন্দর। 'অপত্তি নেই তো?'

'আমি-আমি-!'

'দাঁড়াও, ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। মনে রেখো আমি তোমার বস নই। বরং তুমি আমাকে বন্ধু ভাবলে খুশি হব। বাই।'

রিসিভার নামিয়ে রাখল সুন্দর। আজ এই পর্যন্ত থাক। কোনওরকম তাড়াহুড়ো করতে চায় না সে। একেক খেলার একেক নিয়ম। টিনার সঙ্গে যে নিয়মে খেলতে হয়েছে তা লীলার সঙ্গে খেলা যাবে না। এখানে কিছুটা ধৈর্য ধরতে হবে। ধৈর্য ধরার অভ্যাস তার কখনও ছিল না। আজ মনে হচ্ছে, এরও একটা আলাদা স্বাদ আছে। অন্য ধরনের রোমাঞ্চ। আর শুধু এর জন্যই এই পাহাড়ে থাকা যায়। এই সময় টেলিফোন বাজল। অপারেটর জানাল, 'বড় সাহেবের পি-এ লাইনে আছেন স্যার।' সুন্দর হ্যালো বলতেই পি-এ কথা বলল, 'স্যার, আপনি কি এখনই একবার হেড অফিসে আসতে পারবেন? স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।'

মিস্টার ভার্গব কাগজটা এগিয়ে দিলেন। পাঁচতারা হোটেলের সেল এবং কমিউনিকেশন যেসব অফিসার দেখেন তাঁদের বছরে কত টাকা দেওয়া হয়, খুব ভালো কাজ হলে কী পরিমাণ উৎসাহভাতা তাঁরা পেয়ে থাকেন এবং ক্লায়েন্টদের মনোরঞ্জনের জন্য কত টাকার বিল তাঁরা সই করতে পারেন তার হিসাব ওই কাগজে আছে। হোটেল অনুযায়ী অঙ্কটা একটু বেশি বা কম থাকলেও দুর্যোধন মিত্র লক্ষ করলেন আকাশ-পাতাল পার্থক্য নেই। তারপর জিগ্যেস করলেন, 'এরা ইকোনমি ক্লাসে ট্রাভেল করে?'

'সাধারণত। তবে সিট না পাওয়া গেলে একজিকিউটিভ ক্লাসে।'

পি-এ দরজা খুলল, 'স্যার, উনি এসেছেন।'

'আসতে বলো।' কাগজটা একপাশে সরিয়ে রাখলেন দুর্যোধন মিত্র।

ঘরে ঢুকল সুন্দর। 'গুড মর্নিং ড্যাডি।'

'গুড মর্নিং। হোটেল কেমন লাগল?'

'ভালো, বেশ ভালো।'

'শোনো, মিস্টার ভার্গব তোমার প্রস্তাবগুলো আমাকে জানিয়েছেন।

দিল্লিতে অফিস করার ব্যাপারটা আমারও পছন্দ হয়েছে। গোটা ভারতবর্ষ তো বটেই, বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হলে দিল্লিতে অফিস রাখা দরকার। গুড় আইডিয়া।'

'থ্যাঙ্কস।'

'কিন্তু প্রশ্ন হল, এই বাবদ আমরা কত খরচ করব? হিলটপের এখন যতগুলো ঘর আমরা গেস্টদের দিতে পারি এবং তার সবগুলো যদি ভরতি হয়ে থাকে তাহলে যে ইনকাম হবে তার কতটা আমরা ওই অফিসের জন্য খরচ করতে পারি তা অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট আমাকে আজই দেবে।'

'কিন্তু এটা খুব জরুরি'-সুন্দর বলল।

'আমি তোমার সঙ্গে একমত। কিন্তু ওটা করে হিলটপের এক লক্ষ টাকা আয় বাড়ল অথচ ওই অফিসের জন্য দেড় লক্ষ টাকা খরচ হল, আমি তাহলে এখনই অফিসটা চাইব না। আমরা এক বছর দেখব। রেসপন্স ডালো দেখলে হিলটপের এক্সটেনশন হবে। আরও রুম বাড়বে। তখন খরচটা কাজে লাগাব।'

ড্যাডি, ক্লাসে আমাদের একটা গল্প বলা হত। সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় হরলিক্সের উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়েছিল। কিন্তু ওরা বিজ্ঞাপন দিয়ে গেছে সমানে। সেই বিজ্ঞাপন দেখে লোক দোকানে গিয়ে শুনত ওটা নেই। এর ফলে চাহিদা এত বেড়ে গেল যে যুদ্ধ শেষ হলে প্রোডাক্ট বাজারে যখন বেশি দামে এল তখন বিক্রি বেড়ে গেল হুহু করে।' 'হোটেল হরলিক্স নয়।' হাসলেন দুর্যোধন, 'তবে আমরা একজন স্টাফ নিয়ে একটা ছোট

অফিস দিল্লিতে খুলতেই পারি। দ্বিতীয় পয়েন্ট। তুমি চার হাজার ডলার মাসে চেয়েছ। আমেরিকায়

এটা কিছু নয়। সেখানে এক কাপ চায়ের দাম দেড় ডলার। তা দিয়ে এখানে দশ কাপ চা কেনা

যায়। আমরা তোমাকে প্রথম তিন মাস মাসে ত্রিশ হাজার করে দেব। তোমার কাজের রিপোর্ট ভালো

দেখলে চতুর্থ মাস থেকে ষাট হাজার করে পাবে। ক্লায়েন্টদের এন্টারটেনমেন্টের জন্য তুমি মাসে

এক লক্ষ টাকার বিল সই করতে চেয়েছ। এটা পঁচিশ হাজারের বেশি সম্ভব নয়। প্লেনে তুমি

একঞ্চিকিউটিভ ক্লাসে তখনই যেতে পারবে যখন ইকোনমি ক্লাসে কোনও সিট থাকবে না। ও.কে.?

তুমি এবার যেতে পারো।'

'তুমি কি আমার বক্তব্য শুনতে চাইছ না?'

'ও, আমি ভেবেছিলাম তুমি এসব অ্যাকসেপ্ট করে নিচ্ছ।'

'আমার পক্ষে তোমার এই প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব নয়।'

'ওয়েল। তুমি কি আজই হোটেল থেকে চলে যেতে চাইছ?'

'না, আমি মনে করছি তুমি আমাকে যথেষ্ট মর্যানা নিচ্ছ না।'

'মর্যাদা কেউ কাউকে এমনি দেয় না, ওটা যোগ্যতা দেখিয়ে আদায় করে নিতে হয়। তুমি যদি সেটা করতে পারো তাহলে তোমার প্রস্তাবে আমি আপত্তি আনাব না।' দুর্যোধন মিত্র গম্ভীর মুখে বললেন।

'ওয়েল, আমি কয়েকটা দিন সময় চাইছি।'

'এই কয়দিন তুমি কী করতে চাইছ?'

মিস্টার ভার্গব চুপচাপ শুনছিলেন। এবার কথা বললেন, 'স্যার, আগামী পরশু থেকে গৌহাটিতে ইস্টার্ন ইন্ডিয়া টুরিজম কনফারেন্স শুরু হচ্ছে দু-দিনের। মিস্টার মিত্র যদি সেখানে হিলটপকে রিপ্রেজেন্ট করেন তাহলে খুব ভালো হয়।'

'নিশ্চয়ই।' দুর্যোধন মিত্র বললেন, 'এখানে গেলে হিলটপ প্রচারিত হবে। আপনি হিলটপ সম্পর্কে সমস্ত তথ্য ওকে দিয়ে দিন। অফিসকে বলুন এয়ার টিকিট বুক করতে, হোটেলের রিজার্ভেশন করতে।'

'ও.কে. স্যার। আমি যেতে পারি?'

'হ্যাঁ।'

মিস্টার ভার্গব বেরিয়ে গেলে সুন্দরের দিকে তাকালেন দুর্যোধন। 'কিছু বলবে?'

'তুমি আমার সঙ্গে একজন কর্মচারীর তফাত রাখছ না।'

'দ্যাখো, কাজের জায়গার জন্য ব্যক্তিগত সম্পর্ক গুলিয়ে ফেলো না।'

'কিন্তু আমি তোমার একমাত্র উত্তরাধিকারী।'

'আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন এই ভাবনাটা মাথায় এনো না।'

'কী বলতে চাইছ?'

'ওয়েল, তোমার স্টেপ মাদার তো মা হতে পারেন।'

'মাই গড। আমি এটা কখনও ভাবিনি।'

'এসব কথা না ভাবাই ভালো।' দুর্যোধন মিত্র বললেন, 'আরেকটা কথা। ব্লু লেভেল হুইস্কির

নাম অনেক। এক রাতে হাফ লিটার শেষ করার বিলাসিতা আর কোরো না। তোমার যদি ড্রিঙ্ক

করতে ইচ্ছে হয় ট্রাই ইন্ডিয়ান হুইস্কি। এখন ইন্ডিয়ান হুইস্কির স্ট্যান্ডার্ড বেশ ভালো।'

'তুমি কি আমার ওপর মনিটরিং করছ?'

'হোটেলটাকে আমি আমার হাতের তেলোর মতো দেখতে চাই। আর একটা কথা, রিসেপশনে কাজ করে যে মেয়েটি, কী যেন নাম, হ্যাঁ, লীলা প্রধান, ওর সম্পর্কে তুমি কোনও ইন্টারেস্ট দেখিও না।'

'কেন?' শক্ত মুখে জিজ্ঞাসা করল সুন্দর।

'কেন মানে? তুমি বুঝতে পারছ না?'

'হোটেলের কোনও এমপ্লয়িকে সিকিউরিটি দেওয়া আমার কর্তব্য।'

'বুঝলাম না। আমি এমন কী করেছি যে লীলা বিপদে পড়েছে?'

'একজন সামান্য রিসেপশনিস্ট সম্পর্কে তুমি কেন ইন্টারেস্টেড হবে। তা ছাড়া ওকে

বিকমান্ড করেছে রাম। ও এখানকার এমপি।'

'যদি লীলা মনে করে ওর কোনও সমস্যা হচ্ছে না আমার সঙ্গে কথা বলতে তাহলে নিশ্চয়ই তোমার কিছু বলার থাকবে না।' উঠে দাঁড়াল সুন্দর।

'শোনো, তুমি সময় চেয়েছ, তোমাকে আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দিলাম। পরশু এই সময়ে তোমার মতামত জানাবে।"

'যদি তোমার প্রস্তাব একসেপ্ট না করতে পারি তাহলে আমাকে ওই হোটেল ছেড়ে চলে যেতে হবে?"

'অফকোর্স।'

'কিন্তু কোথায় যাব?'

'সেটা তোমার সমস্যা।'

'গুড। আমাকে কদিন পরে দিল্লিতে যেতে হবে। আমার স্টেপ মাদারের মোবাইল নাম্বারটা দিও তো, ওর সঙ্গে কথা বলব।'

কপালে ভাঁজ পড়ল দূর্যোধন মিত্রের 'কেন?'

'বাঃ। স্টেপ হলেও উনি তো সম্পর্কে আমার মাদার। আমাদের মধ্যে আলাপ-পরিচয় থাকা দরকার।" বেরিয়ে গেল সুন্দর।

দুর্যোধন মিত্র কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। না। এই ছেলেকে আর বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। ও যদি হিলটপের কাজ না করে, এই শহর থেকে চলে যেতে হবে। তখন দিল্লিতে গিয়ে কৃষ্ণার সঙ্গে দেখা করে কী বলবে তা তিনি বুঝতেই পারছেন না। তবে যা বলবে তা নিশ্চয়ই তাঁর পক্ষে যাবে না। দুর্যোধন মিত্র স্থির করলেন, আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করবেন। এখন পর্যন্ত সুরই তো তাঁর একমাত্র সন্তান।

এটা ভাবতেই মনে পড়ে গেল। ব্যাপারটা ঘটেছিল হিলটপের উদ্বোধনের আগে। তারপর প্রায় মাসখানেক কেটে গেছে। শরীরে সন্তান আসছে কিনা তার প্রমাণগুলো এই সময়ের মধ্যে নিশ্চয়ই বোঝা যায়। তাঁর নিজস্ব দ্বিতীয় মোবাইলটা ড্রয়ার থেকে বের করে কৃষ্ণায় নম্বর টিপলেন তিনি।

রিং হচ্ছে। তার পর ওর গলা শুনলেন, 'হ্যালো।'

'কেমন আছো?' দুর্যোধন জিগ্যেস করলেন।

'এটা নতুন নাম্বার?"

'হ্যাঁ। ব্যবহার করি না।'

'তুমি কেমন আছ?'

'ভালো না। একটা কথা জানতে ফোনটা করলাম।'

'বলো।'

'তোমার কি এই ঘটনার পর কোনও শারীরিক পরিবর্তন হয়েছে?' জোরে হেসে উঠলেন

কৃষ্ণল, 'হঠাৎ?' তারপর বললেন, 'সময় হলে জানাব। রাখছি।' ফোন রাখলেন কৃষ্ণা। ঘরে বসে টিভি দেখছিল সুন্দর। এতকাল দেশের বাইরে থেকে ভারতীয় টিভি না দেখে কোনও ধারণাই তৈরি হয়নি তার। এখন স্বল্পবাস মেয়েদের উদ্দাম নৃত্য এমটিভিতে দেখতে দেখতে মোহিত হয়ে পড়ল। ঠিক তখনই টিনার ফোন এল মোবাইলে।

'হাই টিনা।'

"উমম। গিয়ে অবধি একটাও ফোন করোনি?'

'সরি ডার্লিং, এত কাজের চাপ যে শ্বাস নিতে পারছি না।'

'বাট আই অ্যাম মিসিং ইউ।'

'মি টু।'

'তুমি যদি না আসতে পারো তাহলে আমি যেতে পারি।'

'আই উইল লেট ইউ নো।

'কবে?'

'কয়েক দিনের মধ্যে।'

'আমাকে তুমি পাগল করে দিয়েছ।'

'তুমিও। ডার্লিং, সামবডি ইজ নকিং মাই ডোর। আমি পরে ফোন করব।'

রিসিভার রেখেই তার মনে হল এই ফোনের কথাবার্তা দুর্যোধন মিত্রের কানে পৌঁছে যাবে নিশ্চয়ই। যাকগে। স্ব কেয়ার্স। কিন্তু টিনার সঙ্গে একটা কি দুটো রাত মন্দ লাগে না। কিন্তু তার পরেই ক্লান্তি আসে যা মেয়েটা বোঝে না। টিনার সঙ্গে শরীর ছাড়া অন্য কথা বলা যায় না। অন্য কথা? ভাবতেই সীলার মুখ মনে পড়ে গেল। লীলার সামনে কোনও কথা না বলে এক হাজার বছর বসে থাকা যায়। সঙ্গে সঙ্গে লীলাকে ফোন করতে ইচ্ছে হল। গতকালের স্কচের বোতলে অনেকটা এখনও রয়ে গেছে। ক্লাসে একটু ঢেলে নিয়ে চুমুক দিল সে। আজ সরাসরি লীলাকে বলা যাক। যত রাতই হোক ওর ডিউটি শেষ হলে যেন সে এই ঘরে আসে। সে প্রমিজ করবে লীলা না চাইলে ওকে স্পর্শ করবে না। ইটস ডিফারেন্ট গেম। অন্যরকম খেলা। খেলার নিয়মও আলাদা। গতকাল যা করে এসেছে সেই পথেই হাঁটবে না আজ।

দু-পাত্র খেয়ে সে অপারেটরকে চাইল।

'ইয়েস স্যার।'

'একটু আগে দিল্লি থেকে ফোন এসেছিল, আপনি নিশ্চয়ই নোট করেছেন।'

'না স্যার। আপনার কোনও ফোন তো আসেনি।' সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল হল। ভুল হয়ে গেছে।

টিনা ফোন করেছিল তার মোবাইলে। সে বলল, 'ও আই অ্যাম সরি। রিসেপশনে দিন।' রিসেপশন সাড়া দিলে গম্ভীর গলায় বলল, 'সুন্দর মিত্র বলছি। লাঁলা প্রধানকে ফোনটা ধরতে

বলুন।'

'স্যার উনি তো ডিউটিতে নেই।'

'হোয়াট? ওর তো এখন ডিউটি করার কথা।'

'দুপুরে খবর এসেছিল ওঁর বাবা খুব অসুস্থ। গুনে ছুটি নিয়ে লার্জিলিংয়ে চলে গেছেন।'

'কী হয়েছে ওর বাবার?'

'আমি ঠিক জানি না স্যার।'

'ওর মোবাইল নাম্বারটা বলুন।

'বলছি স্যার।' ছেলেটি মোবাইল নাম্বার বললে সুন্দর নোট করে রাখল।

'কখন গিয়েছে?'

'তিনটের সময়। একটু আগে অজিত ম্যানশনে পৌঁছে গিয়েছেন।'

'অজিত ম্যানশন?'

'দার্জিলিংয়ের অজিত ম্যানশনে ওঁর বাবা থাকেন।'

'ও.কে.।'

রিসিভার রেখে দিয়ে লীলার নাম্বারটা মোবাইলে টিপল সুন্দর। কোনও সাড়া পেল না।

দ্বিতীয়বারে শোনা গেল 'দি ডায়ালড নাম্বার ইজ আউট অফ রিচ।' আর এক পাত্র খেল সুন্দর। 'তারপর দিল্লিতে ডলার ভাঙিয়ে যত টাকা পেয়েছিল তা পকেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বাইরে এখন সন্ধ্যা নেমে গেছে।

গাড়ির চাবি পকেটেই ছিল। কাউকে কোনও কৈফিয়ত না দিয়ে সেটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। দার্জিলিং যেতে হলে নীচে সমতল হয়ে যেতে হবে। অন্তত চার ঘণ্টার পথ। এই রাতে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানো একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। হাসল সুন্দর। এই খেলায় বাড়াবাড়িটাই মজা। সমতল ডিঙিয়ে দার্জিলিংয়ের রাস্তায় পড়তেই এমন বৃষ্টি নামল যে গাড়ি থামাতে বাধ্য হল সে। অন্ধকারে বৃষ্টির দেয়াল ভেদ করতে পারছে না হেডলাইট। বসে থাকতে থাকতে ঘুম পেয়ে গেল তার। তিন পেগ হুইস্কি ঘুমটাকে এনে দিল। যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়িতে রাত এগারোটা। এখন এগোলে মাঝরাতে দাজিলিংয়ে পৌঁছবে সে। মোবাইলে নাম্বারটাকে রিপিট করল সে। একই কথা। না, ফিরে যাওয়ার জন্য সে আসেনি। মোবাইল ফোনটা অফ করে নিল সুন্দর।

দার্জিলিং শহরে যখন সে ঢুকল তখন দুটো বাজে। ওই নিশুতি র'তে রাস্তায় একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। দোকান, বাড়িঘরের দরজাগুলো বন্ধ। অজিত ম্যানশন কোথায় জানার জন্য একটা মানুষকেও দেখতে পেল না সে। ডাড়েন ডা রোড ধরে ম্যালের মুখে এসে গাড়ি রাখল সুন্দর। ওপরে তাকাতেই সে খুশি হল। যে বিশাল বাড়ির সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে সেটাই অজিত ম্যানশন। বড় বড় করে লেখা। কিন্তু এই বাড়িতে নিশ্চয়ই অনেক ফ্ল্যাট আছে। তার কোনটায় লীলারা থাকে? দরজায় দরজায় নক করে লোকের ঘুম ভাঙিয়ে জিজ্ঞাসা করটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

গাড়ি নিয়ে সোজা ম্যালের ওপর কাথী হোটেলে চলে এল সে। বড় হোটেলের রিসেপশনে সারা রাত লোক থাকে। ঘর পেতে অসুবিধে হল না তাই।

সুন্দরের ঘুম ভাঙল সকাল আটটায়। টয়লেটেই ব্রাশ-পেস্ট থাকে। একেবারে স্নান করে নিয়ে সে রিসেপশনে এসে ভাড়া মিটিয়ে অজিত ম্যানশনে চলে এল গাড়ি নিয়ে। এখন ম্যাল মানুষভরতি। অজিত ম্যানশনের দোকানগুলো খুলে গেছে। একজনকে জিগ্যেস করতেই লীলাদের ফ্ল্যাটের হদিস

পেয়ে গেল সুন্দর। বেল বাজাতেই দরজা খুলল লীলা। খুলেই চমকে উঠল। সুন্দর দেখল এই সকালে

লীলার পরনে বাসন্তী রঙের সালোয়ার-কামিজ।

'তোমার বাবা এখন কেমন আছেন?"

'ভালো নয়।'

'ডাক্তার দেখেছেন?'

'হ্যাঁ। কলকাতায় নিয়ে যেতে বলেছেন।'

'অসুখটা কোথায়?'

'হার্টের প্রবলেম।'

'কীভাবে নিয়ে যাবে?'

'আর একটু পরে কাউন্টার খুললে ট্রেনের টিকিট পেতে চেষ্টা করব। এনজেপি থেকে ট্রেন

ছাড়ে।'

'কলকাতার কাউকে চেনো?'

আমার মামা থাকেন।'

'আমি ওঁকে দেখতে পারি?'

'আপনি হঠাৎ?'

'এর জবাব আমি দেব না। কাল বিকেলে খবরটা পেয়ে গাড়ি নিয়ে আসছিলাম। রাস্তায়

বৃষ্টি হওয়ায় আটকে যাওয়ায় মাঝরাতে দার্জিলিংয়ে পৌঁছেছি। না হলে কাল রাতেই আসতাম। চলো।' প্রৌঢ় ভদ্রলোক গুয়ে ছিলেন খাটে। লীলা আলাপ করিয়ে দিয়ে তার বাবাকে বলল, 'হিলটপের এমডির ছেলে উনি'

ভদ্রলোক হাতজোড় করলেন, 'আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। রামচন্দ্র বণিকের সুপারিশে মেয়ে ওখানে কাজ পেয়েছে। নতুন কাজ। তবু আমার অসুস্থতার খবর পেয়েই ওকে ছুটি দিয়েছেন আপনারা। মালিকের ছেলে হয়েও আমাকে দেখতে এসেছেন, এরকমটা আজকাল দেখা যায় না!'

'আপনি কথা বলবেন না। আপনি লীলার মা।'

ঘরে ঢোকা এক প্রৌঢ়া মাথা নাড়লেন।

'আপনারা তৈরি হয়ে নিন। আমি আসছি।' ঘর থেকে বেরিয়ে এল সুন্দর। পেছন পেছন এসে লীলা জিগ্যেস করল, 'কোথায় যাচ্ছেন?'

'প্লেনের টিকিট কাটতে। দুটোয় ফ্লাইট আছে। তিনটের মধ্যে উনি পৌঁছে যাবেন। আপনার মামাকে বলুন নার্সিং হোমের ব্যবস্থা করে এয়ারপোর্টে আসতে। সরি স্যার, প্লেনের টিকিট আমরা অ্যাফোর্ড করতে পারব না' 'করতে হবে না। এটা হিলটপ বোস্টন দেবে।'

আধঘন্টার মধ্যে তিনটি প্লেনের টিকিট কিনে এনে সুন্দর বলল, 'আমাদের মিনিট দশেকের মধ্যে বেরুতে হবে। মামাকে ফোন করে ছিলেন?'

'হ্যাঁ ওর বন্ধু আছে, বিড়লা রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু।' লীলা

'কিন্তু কী?'

'আপনি যে এখানে এসেছেন তা হোটেলে বলেননি?'

'কেন?'

'আমার ফোনটা কাল থেকে কাজ করছিস না। একটু আগে বাজল। হোটেল থেকে বাবার অবস্থা জানতে চাইছিল। আপনি প্লেনের ব্যবস্থা করছেন শুনে ওরা অবাক হল। বলল, কাল থেকে আপনাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আপনার বাবা পুলিশকে জানিয়েছেন।'

হাসল সুন্দর। বলল, 'ওঁদের নিয়ে নীচে আসুন। আমি গাড়িতে আছি।' নীচে নামল সে। মোবাইল অন করে দুর্যোধন মিত্রের নাম্বার টিপল, 'সরি ড্যাড। 'তাড়াহুড়োতে

তোমাকে বলে আসিনি।'

'আমি এইমাত্র খবর পেলাম তুমি দার্জিলিংয়ে লীলার বাড়িতে আছ।'

'না। এখন আমি গাড়িতে।'

'আমি তোমাকে নিষেধ করেছিলাম।'

'ও ড্যাডি।'

'তুমি এক্ষুনি চলে এসো।"

'যাব। তুমি পুলিশকে বলে দাও আমি প্রিছি। ওদের বাগডোগরায় নিয়ে গিয়ে ফ্লাইটে তুলে

দিয়ে ফিরে যাব।'

হু ইন্দ্র পেয়িং নিস এয়ারফেয়ার?'

'অবশ্যই হিলটপ।'

'নো। লীলা যে চাকরি করে তাতে ও প্লেনের খরচ পেতে পারে না।'

'কলকাতার ডাক্তার যদি বলে অপারেশন করতে হবে তাহলে-!'

'মিস্টার ভার্গব ঠিক করবেন লীলা কতটা সাহায্য পেতে পারে।'

'মালিকের ছেলের কোনও কথার দাম নেই?'

'এই ক্ষেত্রে নয়।'

ফোন কেটে দিল সুন্দর। তারপর সেট অফ করে দিল।

মা-বাবাকে পেছনের সিটে বসিয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসল লীলা। গাড়ি চলতে শুরু করলে লীলা বলল, 'মামা ফোন করেছিলেন, এয়ারপোর্টে আসছেন।'

লীলার মা বললেন, 'বাবা, দেবদূতের গল্প ছেলেবেলায় শুনেছি, আজ নিজের চোখে দেখলাম। আমরা কাল হতাশায় ভেঙে পড়েছিলাম। আজ যেন আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।' 'আমি একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু সকালে আপনারা কি কিছু খেয়েছেন?' 'ওকে কমপ্ল্যান আর বিস্কুট দিয়েছিলাম।'

কার্শিয়াং টুরিস্ট লজ থেকে অনেকগুলো চিকেন স্যান্ডউইচ আর কফি কিনে দিল সুন্দর। লীলা জিজ্ঞাসা করল, হিলটপের সঙ্গে কথা হয়েছে?'

'হ্যাঁ। হয়ে গেছে।'

বলামাত্র ফোন বাজল। লীলা নাম্বার দেখে বলল, 'মিস্টার ভার্গব।'

'কথা বলো। কিন্তু আমাকে বলতে বলো না।' সুন্দর হাসল।

'হ্যালো।' রিং থামিয়ে কথা বলগ লীলা। গাড়ি চালাতে চালাতে আড়চোখে তাকাল সুন্দর। লীলা বলল, 'ইয়েস স্যার। ও.কে. স্যার। কলকাতায় হার্ট স্পেশালিস্ট আজই দেখাতে চাই বলে উনি ফ্লাইটে যেতে বললেন। বাগডোগরা থেকে দুটোর সময় ফ্লাইট। টিকিট পেয়ে গেছি। ও.কে. স্যার।'

মোবাইল ব্যাগে রেখে দিল লীলা। 'কে'। জিগ্যেস করল সুন্দর।

'মিস্টার ভার্গব জানতে চাচ্ছিলেন।'

'কী?'

'আপনি আমাদের লিফট দিচ্ছেন কি-না। বললেন, বাবার অসুখের ব্যাপারটা জানিয়ে এখনই ছুটির অ্যাপ্লিকেশন মেইল করতে। আমরা কীভাবে কলকাতায় যাচ্ছি তা জানতে চাইলেন।' লীলা তাকাল, 'আপনি ওদের কিছু জানাননি স্যার?'

'চিন্তা কোরো না। ফিরে গিয়ে জানিয়ে দেব।'

'মিস্টার ভার্গব খুব গম্ভীর গলায় কথা বলছিলেন।'

'আমার ওপর ছেড়ে দাও।"

পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে বাগডোগরা এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেল ওরা। আজ কোনও বিশেষ কারণে ভিজিটর্সদের ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। তার টিকিট বিক্রির কাউন্টারও বন্ধ। একটা ট্রলিতে সুটকেসগুলো চাপিয়ে দিয়ে সুন্দর বলল, 'আপনারা ভেতরে পিয়ে চেক ইন করুন। আমি অপেক্ষা করছি।'

ওরা ভেতরে ঢুকে গেল। সুন্দর লক্ষ করল যেতে যেতে লীলা একবার মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখে গেল। পাশে দাঁড়ানো একজন পুলিশ সুন্দরকে বলল, 'ওপাশের সিঁড়ি দিয়ে ওপরের রেস্টুরেন্টে চলে যান। বোর্ডিং কার্ড নিয়ে ওঁরা ওখানে যেতে পারবেন। ধন্যবাদ জানিয়ে সিঁড়ির খোঁজে এগোল সুন্দর।

দোতলায় উঠে সে নীচের হলঘরটাকে দেখতে পেল। কাউন্টারগুলোর সামনে লাইন পড়েছে। লীলাকে দেখা গেল, সুটকেসগুলো ওজন যন্ত্রে তুলে দিচ্ছি। তারপর বোর্ডিং কার্ড নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে হেঁটে সিঁড়ির কাছে চলে এল লম্বা খাড়া সিঁড়ি। সুন্দর চিৎকার করে বলল, 'লিফট আছে কি-না খোঁজ নাও।'

মুখ তুলে উপরে সুন্দরকে দেখে অবাক হয়ে গেল লীলা। কিন্তু লীলার বাবা মাথা নাড়লেন। তাঁকে ধীবে ধীরে উপরে নিয়ে এল লীলা। ভিজিটর্স আর প্যাসেঞ্জারদের আলাদা করতে একটা কাঠের গেট রয়েছে। সিকিউরিটি ঢেকে যাওয়ার জন্য মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছিল। মা বাবাকে দূরে দাঁড় করিয়ে কাঠের গেটের ওপাশে এসে দাঁড়াল লীলা, 'আপনি যা করলেন তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ স্যার।'

'কিছুই করিনি। লীলা, তোমার মাকে এখানে আসতে বলো, আমাকে তো যেতে দেবে না।'

লীলা পেছনের দিকে তাকিয়ে একটু জোরে বলল, 'মা, একটু আসবে? লীলার মা এগিয়ে এলেন। সুন্দর বলল, 'সময় ছিল না তৈরি হওয়ার। কোনও প্রস্তুতি ছাড়া আপনারা কলকাতায় যাচ্ছেন। এটা রাখুন।'

পকেট থেকে মোটা খাম বের করে এগিয়ে দিল সুন্দর। 'এটা কী?' থামটা হাতে নিয়ে জিগ্যেস করলেন লীলার মা।

'সামান্য টাকা আছে। আপনাদের সামনে অনেক খরচ। ওটা একবার দিন।'

সীলার মা খামটা ফেরত দিলে তার ওপর নিজের মোবাইল নাম্বার লিখে দিল সে। তারপর ওটা আবার ফিরিয়ে দিয়ে বলল, 'প্রাথমিক কিছু খরচ এটা দিয়ে করা যাবে কিন্তু নার্সিং হোম যদি কোনও প্যাকেজ দেয় তাহলে সেই অ্যামাউন্টটা সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফোন করে জানিয়ে দেবেন।' হঠাৎ কেঁদে ফেললেন লীলার মা, 'তুমি এত ভালো। আমাদের চেনো না আনো না তবু। কী ভাবে তোমার ঋণ শোধ করব জানি না।'

'আশ্চর্য। আমার মা ছেলেবেলায় মারা গিয়েছিলেন। আপনাকে মা ভেবে যদি সামান্য কিছু করি তাহলে আপনি ঋণ শোধ করার কথা ভাববেন? যান। উনি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন।' হাসল সুন্দর।

মাইকে বারংবার যাত্রীদের অনুরোধ করা হচ্ছিল সিকিউরিটি চেক করাতে। লীলা কাঠের গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে বলল, 'আমি আজ অবধি কারও কাছে কোনওরকম ফেবার নিইনি। জানি না আমার এই চাকরিটা থাকবে কি-না? আপনার সম্পর্কে কিছু কথা শুনেছিলাম যার সঙ্গে এই ব্যবহারের কোনও মিল নেই। থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।'

লীলা চলে যাচ্ছিল, সুন্দর তাকে ডাকল, 'লীলা!'

লীলা দাঁড়াল, ফিরে তাকাল।

'আমার একটা অনুরোধ রাখবে?'

মুখ তুলল লীলা। চোখে ঔৎসুক্য।

'আমাকে এখন থেকে আর স্যার বোলো না। সুন্দর বলবে।'

একটু ভাবল, মাথা নাড়ল, তারপর মা-বাবাকে নিয়ে সিকিউরিটি চেকিংয়ের দিকে এগিয়ে

গেল। ওরা চোখের আড়ালে চলে না যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকল সুন্দর। তারপর রেস্টুরেন্টে ঢুকে রানওয়ের দিকে কাচের জানালার পাশে টেবিলে বসল। রানওয়েটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একটা মাঝারি সাইজের প্লেন দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ পরিষ্কার। ওয়েটার এলে সে একটা ভাবল ডিমের ওমলেট আর টোস্ট দিতে বলল। সঙ্গে কফি।

খুব ভালো লাগছিল সুন্দারর। মহিলাদের সঙ্গে অনেক খেলা খেলেছে সে। ক্রিকেটের পরিভাষায় কোনওটা টোয়েন্টি-টোয়েন্টি, কোনওটা ওয়ান ডের পঞ্চাশ ওভারের। সেগুলো শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যায়। চটজলদি একটা উত্তেজনার আগুন পোয়ানো যার নিট ফল। কখনও টেস্ট ম্যাচ খেলেনি সে। এই খেলার মজাই আলাদা। তাড়াহুড়ো নেই, ক্লাসিক্যাল বাজনার মতো আলাপ থেকে শুরু। গোড়ায় পৌঁছনোর আগে অনেক চড়াই-উতরাই ডিপ্তোতে হয়। টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে নিতে জানতে হয়। এই খেলায় দিতে শিখতে হয়। স্পিন বোলিংয়ে কাজ হচ্ছে না, স্পিনারকে ডাকো। স্পিনার কাজে আসছে না, আচমকা স্লো বোলারকে ডাকো। ফিল্ডিং ছড়িয়ে দাও বাউন্ডারির কাছাকাছি। বোলারকে বলো ফুলটস দিতে। দুটো না হয় বাউন্ডারি হবে, তৃতীয়টায় অবধারিত ক্যাচ উঠবে। আজ আবধি কেউ তাকে বলেনি, কীভাবে তোমার ঋণ শোধ করব, জানি না। আহা। শুনতেই মন পবিত্র হয়ে গেল। মন যে পবিত্র হয় তা আগে জানত না সুন্দর। খাবার এল। খেতে খেতে সুন্দর দেখল এয়ারপোর্ট বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে যাত্রীরা লাইন দিয়ে এয়ারক্রাফটের দিকে এগোচ্ছে।

এবার লীলাদের খেতে পেল সে। লীলা তার বাবার হাত ধরে এগোচ্ছে। পেছনে ওর মা। ধীরে ধীরে ওরা পৌঁছে গেল সিঁড়ির কাছে। বোর্ডিং কার্ড দেখিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে লাগল। সুন্দর হাত তুলল। নিশ্চয়ই ভেতরে ঢোকার আগে ঘুরে তাকাবে লীলা। তখন তাকে হাত নাড়তে দেখলে

খুশি হবে।

কিন্তু ওরা ভেতরে ঢুকে গেল। একটু নিরাশ হল সুন্দর। কফি শেষ করতেই প্লেনের চাকা গড়াতে লাগল। তারপর পূর্বে উড়ল বিমান। চোখের নিমেষে আড়ালে চলে গেল।

নীচু গলায় সুন্দর বলল, 'গুড বাই সীলা। যাত্রা শুভ হোক।'

বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে সুন্দরের গাড়ি যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন আঁড়াল থেকে বেরিয়ে এল একজন, মোবাইল কানে চেপে নীচু গলায় বলল, 'উনি এইমাত্র এয়ারপোর্ট ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।'

বাগডোগরা থেকে বেরিয়ে শিলিগুড়িতে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে আকাশে মেঘ জমল। পাহাড়ের রাস্তায় পড়ার আগে টিপটিপিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। মন খুব ভালো হয়ে আছে এখন। ভালো কাজ করলে মন যে আনন্দিত হয় তা আজ বেশি করে বুঝেছে সে।

রাস্তা সুনসান। দুপাশে ফরেস্টের বড় বড় গাছ। পেছনে একটা সুমো গাড়ি আসছে। এখন খড়িতে তিনটে বাজলেও মেঘ ও বৃষ্টির কারণে আলো কমে এসেছে। কী বলবেন মিস্টার দুর্যোধন মিত্র? একজন সামান্য কর্মচারীকে সাহায্য করার জন্য তাকে হিলটপ থেকে তাড়িয়ে দেবেন? দিতে চাইলেও পারবেন না। রামু অঞ্চল তার পক্ষে থাকবেন। অবশ্য এখনই, বাবার সঙ্গে যুদ্ধে যেতে চায় না সুন্দর। প্রাথমিক গালাগালগুলোকে না হয় হজম করে নেবে সেং শত্রুর শক্তি যাচাই না করে যুদ্ধে নামা উচিত নয়। এই শক্তির কতটা মিসেস দুর্যোধন মিত্রের হাতে তা জানা দরকার। নাঃ। এখন আর কোনও নোংরামিতে যেতে ইচ্ছে করছে না। তেমন হলে সে মিস্টার দুর্যোধন মিত্রকে বলবে, আমি তোমার সব কথা মেনে নেব, শুধু লীলাকে স্ত্রী হিসেবে পেতে দাও। স্ত্রী হিসেবে। হাসল সুন্দর। কীরকম সজ্জা লজ্জা লাগল।

সুমোটা তাকে ওভারটেক করছে। কিন্তু একি! বড় গাড়িটা তার গাড়ির গায়ে চলে আসছে

কেন? তীব্র হর্ন বাজাল সে। আর তখনই সুমো গাড়ি তার গাড়িকে ধাক্কা মারল। ধাক্কাটা এত জোরে যে সামলাতে পারল না সুন্দর, গাড়িটা উলটে খাদের গায়ের গাছগুলোকে নিয়ে নীচে নেমে যেতে লাগল। ধাক্কায় ড্রাইভিং সিটের পাশে দরজা খুলে গেল সশব্দে। গাড়িটা ঠোক্কর খেতে খেতে নীচে নামছে। তাকাল সুন্দর। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠে জ্ঞান হারাল সে। শরীরটা ঝুলে রইল পাহাড়ের খাঁজে। গাড়ি ততক্ষণে নীচে আছড়ে পড়েছে। প্রচণ্ড শব্দ হল। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল।

সুমো গাড়ির ড্রাইভার উপরের রাস্তা থেকে সেই শব্দ শুনতে পেল, আগুনও দেখল। হাসি ফুটে উঠল 'তার মুখে।

বৃষ্টির মধ্যে সুমো গাড়িটা এগিয়ে গেল পাহাড়ি শহরের দিকে।

1

লীলাসুন্দর : প্রথম অধ্যায়

13 January 2024
1
0
0

'যোধন মিত্র ভালো করেই জানেন যে, এই পাহাড়ি শহরে তাঁর কোনও বন্ধু নেই। লোকে দু তাঁকে ঈর্ষা করে, তাঁর সম্পর্কে বাঁকা কথা বলে। কিন্তু সেসব বলে তাঁর আড়ালে। এই জেলায় তাঁর চা-বাগান থেকে সবচেয়ে ভালো চা তৈরি হয়

2

লীলাসুন্দর : দ্বিতীয় অধ্যায়

16 January 2024
1
0
0

পাহাড়ের মুখে মেধ জড়াতে বেশি সময় লাগে না। সেই মেঘ ভারী হয়ে গেলেই বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে। খানিকটা বর্ষণের পরে আবার সব পরিষ্কার। পাহাড়ের খাঁজে সেই বৃষ্টির জল ভিজিয়ে দিয়েছিল সুন্দরকে। শীতল জল ও হাওয়ার স্পর্শ

3

সোনার শেকল

17 January 2024
1
0
0

মাস আগের এক বিকেলে মন নরম হয়েছিল কামাল হোসেনের। ভাগনে মতিনের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, 'আমি তোমাকে একশোবার বলেছি আমার এমনিতেই লোক বেশি, চাকরি দিতে পারব না। এই কথাটা কানে ঢোকে না কেন?' মতিন মুখ নীচু করে দ

4

স্বপ্নেই এমন হয়

18 January 2024
1
0
0

রারাত মেল ট্রেনে না ঘুমিয়ে বসে থাকতে হয়েছিল। একদিন আগে টিকিট কাটলে এসব সা ট্রেনে শোওয়ার জন্যে বার্থ খালি পাওয়া যায় না। সকালে ট্রেনটা জংশন স্টেশনে দাঁড়ালে প্ল্যাটফর্মে নেমে মিলন জেনেছিল, তাকে এখনও ঘণ্ট

---