shabd-logo

বিধবাবিবাহ

7 January 2024

1 Viewed 1

দ্বিতীয় বারের বিজ্ঞাপন

প্রায় দুই বৎসর অতীত হইল, এই পুস্তক প্রথম প্রচারিত হয়। যে উদ্দেশে প্রচারিত হইয়াছিল, তাহা একপ্রকার সফল হইয়াছে, বলিতে হইবেক; কারণ, যাঁহার। যথার্থ বুভুৎসুভাবে এবং বিদ্বেষহীন ও পক্ষপাতশূন্য হৃদয়ে আছ্যোপান্ত পাঠ করিয়াছেন, কলি যুগে বিধবাবিবাহের শাস্ত্রীয়তা বিষয়ে, তাঁহাদের অনেকেরই সংশয়চ্ছেদন হইয়াছে, এবং ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ জাতীয় বিধবাদিগের পাণিগ্রহণ পর্য্যন্তও হইতে আরম্ভ হইয়াছে।

অনেকানেক দূরস্থ ব্যক্তি পত্র দ্বারা ও লোক দ্বারা অ্যাপি পুস্তক প্রাপ্তির অভিলাষ প্রকাশ করিয়া থাকেন; এই নিমিত্ত পুনরায় মুদ্রিত হইল। পূর্ব্বে যেরূপ মুদ্রিত হইয়াছিল, প্রায় তদ্রূপই মুদ্রিত হইয়াছে; কেবল দুই এক স্থান অস্পষ্ট ছিল, স্পষ্টীকৃত হইয়াছে; দুই এক স্থান অতি সক্ষিপ্ত ছিল, বিস্তারিত। হইয়াছে।

আমি পূর্বব ৰারে 'ব্যস্ততাক্রমে নির্দেশ করিতে বিস্তৃত হইয়াছিলাম যে, দ্বিতীয় পুস্তক সঙ্কলন কালে সর্বশাস্ত্রবিশারদ শ্রীযুত তারানাথ তর্কবাচস্পতি ভট্টাচার্য্য মহাশয় বিস্তর আনুকূল্য করিয়াছিলেন।

আমার পুস্তক সঙ্কলিত, মুদ্রিত, ও প্রচারিত হইবার, কিছু স্ক্রিন পূর্ব্বে, কলিকাতার অন্তঃপাতী পটলড়াঙ্গানিবাসী শ্রীযুত বাবু শ্যামাচরণ দাস, নিজ তনয়ার বৈধব্য দর্শনে দুঃখিত হইয়া, মনে মনে সঙ্কল্প করেন, যদি ব্রাহ্মণ, পণ্ডিতেরা ব্যবস্তা দেন, পুনরায় কন্যার বিবাহ দিবন তদনুসারে তিনি সচেষ্ট হইয়া বিধবাবিবাহের শাস্ত্রীয়তাপ্রতিপাদক এক ব্যবস্থাপত্র সংগ্রহ করেন। ঐ ব্যবস্থাপত্র অবিকল মুদ্রিত এবং পুস্তকের শেষে যোজিত হইল। উহাতে কাশীনাথ তর্কালঙ্কার, শ্রীযুত ভবশঙ্কর বিদ্যারত্ব, রামতনু তর্কসিদ্ধান্ত, ঠাকুরদাস চূড়ামণি, হরিনারায়ণ তর্কসিদ্ধান্ত, মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ প্রভৃতি 'কতকগুলি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের স্বাক্ষর আছে।:

৮ কাশীনাথ তর্কালঙ্কার মহাশয় এতদ্দেশে সর্বপ্রধান স্মার্ড ছিলেন। শ্রীযুত ভূবশঙ্কর বিদ্যারত্ব ও শ্রীযুত রামতনু তর্কসিদ্ধান্ত প্রধান স্মার্ত্ত বলিয়া গণ্য। তর্কসিদ্ধান্ত ভট্টাচার্য্য মলঙ্গানিবাসী দত্ত বাঁবুদিগের বাটীর সভাপণ্ডিত। শ্রীযুত ঠাকুরদাস চূড়ামণি ও শ্রীযুত হরিনারায়ণ তর্কসিদ্ধান্তও এতদ্দের্শের প্রসিদ্ধ পণ্ডিত এবং শ্রীযুত রাজা কমলকৃষ্ণ দেবের সভাসদ। শ্রীযুত মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশও বহুজ্ঞ পণ্ডিত বলিয়া গণ্য। ইনি সুপ্রসিদ্ধ 'শ্রীযুত

কেবল ব্যবস্থা অংশেই অবিকল হইয়াছে এমন নহে, অক্ষরাংশেও অবিকল হইয়াছে; অর্থাৎ, ব্যবঙ্গ অথবা স্বাক্ষর, যাহা যেরূপ অক্ষরে লিখিত আছে, অবিকল নেইরূপ অক্ষরে 'মুদ্রিত হইয়াছে। সুতরাং. ব্যবস্থাদায়ক ভট্টাচার্য্য মহাশয়েরা, স্বাক্ষর 'করি নাই খুলিয়া, অনায়াসে অপলাপ করিতে পারিবেন না। অন্ততঃ, যাঁহারা তাঁহাদের হস্তাক্ষর চিনেন, তাঁহারা বুঝিতে পারিবেন, অমুক অমুক ভট্টাচাৰ্য্য মহাশ স্বাক্ষর করিয়াছেন বটে।

বোকু.প্রসন্নকুমার ঠাকুরের সভাসদু। ইঁহার। সকলেই ঐ ব্যবস্থায়, স্ব স্ব নাম স্বাক্ষর, করিয়াছেন। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই, এক্ষণে প্রায় সকলেই বিধবাবিবাহের বিষম বিদ্বেষী হইয়া উঠিয়াছেন। ইহারা পূর্বেই কি বুঝিয়া বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত ধূলিয়া ব্যবস্থাপত্রে স্ব স্ব নাম স্বাক্ষর করিয়াছিলেন; আর, এক্ষণেই বা কি বুঝিয়। বিধবাবিবাহ অশাস্ত্রীয় বলিয়া বিদ্বেষ প্রদর্শন করিতেছেন, তাহার নিগূঢ় মৰ্ম্ম ইঁহারাই বলিতে পারেন। এ স্থলে ইহাও উল্লেখ কর। আবশ্যক, শ্রীযুত বাবু শ্যামাচরণ দাসের সংগৃহীত ব্যবস্থা শ্রীযুত মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশের নিজের রচিত, এবং ব্যবস্থাপত্র বিদ্যাবাগীশের স্বহস্তলিখিত। কিছু দিন .পরে, যখন ঐ ব্যবস্থাপত্র উপলক্ষে ধিচার উপস্থিত হয়, তখন 'শ্রীযুত তবশঙ্কর বিদ্যারত্ন, বিধবাবিবাহের শাস্ত্রীয়তাপক্ষ রক্ষার নিমিত্ত, নবদ্বীপের প্রধান স্মার্ত শ্রীযুত ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন ভট্টাচার্য্যের সহিত বিচার করেন, এবং বিচারে জয়ী স্থির হইয়া এক জোড়া শাল পুরস্কার প্রাপ্ত হন। এক জন •পরিশ্রম কুরিয়া ব্যবস্থার সৃষ্টি করিয়াছেন, আর এক জন বিলোদী পক্ষের সহিত বিচার করিয়া ঐ ব্যবস্থার প্রামাণ্যরক্ষা করিয়াছেন। কিন্তু কৌতুকের বিষয় এই যে, ইঁহারা উভয়েই এক্ষণে বিধবাবিল্লাহ অশাস্ত্রীয় বলিয়া সর্বাপেক্ষা অধুিরু বিদ্বেষ প্রদর্শন করিয়া থাকেন।

শ্রীযুত বাবু শ্যামাচরণ দাস বিষয়ী লোক, শাস্ত্রজ্ঞ নহেন। তিনি, শ্রীযুত ভরশঙ্কর বিদ্যারত্ন প্রভৃতি পূর্বোক্ত ভট্টাচার্য্য মহাশয়দিগকে ধর্মশাস্ত্রের মীমাংসক জানিয়া, তাঁহাদের নিকট :শাস্ত্রানুযায়িনী ব্যবস্থা প্রার্থনা করিয়াছিলেন, এবং তাঁহারাও সেই প্রার্থনা অনুসারে ব্যবস্থা দিয়াছেন। যদি বিধবাবিবাহ . বাস্তবিক অশাস্ত্রীয় বলিয়া তাঁহাদের বোধ থাকে, অথচ কেবল তৈলবটের লোভে শাস্ত্রীয় বলিয়া ব্যবস্থা দেওয়া হইয়া থাকে, তাহা হইলে যথার্থ ভদ্রের কর্ম্ম করা হয় নাই। আর, যদি বিষ্ণুবাবিবাহ ব্লাস্তবিক শাস্ত্রসম্মত কর্ম-বলিয়া বোধ থাকে, এবং সেই বোধ অনুসারেই ব্যবস্থা দেওয়া হইয়া থাকে, তাহা হইলে এক্ষণে বিধবাবিবাহ অশাস্ত্রীয় বলিয়া তদ্বিষয়ে, বিদ্বেষ প্রদর্শন করাও যথার্থ ভদ্রের কর্ম্ম হইতেছে না।

বৃাহা হউক, আক্ষেপের বিষয় এই যে, ঘাঁহাদের এইরূপ রীতি, সেই মহাপুরুষেরাই এ দেশে ধর্ম্মশাস্ত্রের মীমাংসাকর্তা, এবং তাঁহাদের বাক্যে ও ব্যবস্থায় আস্থা করিয়াই এ দেশের লোকদিগকে চলিতে হয়।

ব্যবস্থা।

শ্রীশ্রীদুর্গা।

পরম পূজনীয় শ্রীযুত ধৰ্ম্মশাস্ত্রাধ্যাপক

মহাশয়গণ সমীপেষু।,

প্রশ্ন। নবশাখজাতীয় কোন ব্যক্তির এক কন্যা বিবাহিতা হইয়া অষ্টম বা নবম বৎসর বয়ঃক্রমে বিধবা হইয়াছে। ঐ ব্যক্তি আপন কন্যাকে দুরূহ বিধবাধৰ্ম্ম ব্রহ্মচর্য্যাদির অনুষ্ঠানে অক্ষমা দেখিয়া পুনর্ব্বার অন্য পাত্রে সমর্পণ করিবার বাসনা করিতেছেন। .এ স্থলে জিজ্ঞাস্য এই ব্রহ্মচর্য্যানুষ্ঠানে অসমর্থা হইলে ঐরূপ 'বিধবার পুনর্ব্বার বিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ 'হইতে পারে কি না আর পুনর্বিবাহানন্তর ঐ বালিকা দ্বিতীয় ভর্তার শাস্ত্রানুমত ভার্য্যা হইবেক কি না এ বিষয়ের যথাশাস্ত্র ব্যবস্থা লিখিতে আজ্ঞা হয়।

উত্তরং। মম্বাদিশাস্ত্রেষু নারীণাং পতিমরণানন্তরং ব্রহ্মচর্য্য- .সহমরণপুনর্ভবণানামুত্তরোত্তরাপকর্ষেণ বিধবাধৰ্ম্মতয়া বিহিতত্বাৎ ব্রহ্মচর্য্য সহমরণরূপাদ্যকল্পদ্বয়েহ সমর্থায়া অক্ষতযোন্যাঃ শূদ্রজাতীয়- মৃতভর্তৃকবালায়াঃ পাত্রান্তরেণ সহ পুনর্বিবাহঃ পুনর্ভবণরূপবিধবা- ধৰ্ম্মত্বেন শাস্ত্রসির এব যথাবিধি সংস্কৃতায়াশ্চ তস্যা দ্বিতীয়ভর্ভূ- ভাৰ্য্যাত্বং সুতরাং শাস্ত্রসিদ্ধং ভবতীতি ধৰ্ম্মশাস্ত্রবিদাং বিদাম্মতম্।

অত্র প্রমাণম্। মৃতে ভর্ত্তরি ব্রহ্মচর্য্যং তদন্বারোহণং বেতি শুদ্ধিতত্ত্বাদিধৃত বিষ্ণুবচনম্। যা পত্যা বা পরিত্যক্তা বিধবা বা স্বয়েচ্ছয়া উৎপাদয়েৎ পুনর্ভূত্বা স পৌনর্ভব উচ্যতে ইতি, সা • চেদক্ষতযোনিঃ স্যাৎ গতপ্রত্যাগতাপি বা। পৌনর্ভবেণ ভর্তা সা পুনঃ সংস্কারমহতীতি চ মনুবচনং। সা স্ত্রী যদ্যক্ষতযোনিঃ সত্যন্য-মাশ্রয়েৎ তদা তেন পৌনর্ভবেণ ভর্তা পুনর্বিবাহাখ্যং সংস্কারমর্ত তীতি কুল্লুকভট্টব্যাখ্যানম্। নোদ্বাহিকেষু মন্ত্রেয় নিয়োগঃ কীর্ত্যতে কচিৎ। ন বিবাহবিধাবুক্তং বিধবাবেদনং পুনরিতি বচনস্তু "দেবরাদ্বা সপিণ্ডাদ। স্ত্রিয়। সম্যন্ড্রিযুক্তয়া। প্রজেপ্সিতাধিগন্তব্যা সন্তানস্থা পরিক্ষয়ে ইতি নিয়োগমুপক্রম্য লিখনান্নিয়োগাঙ্গবিবাহ নিষেধপরং "ন সামান্যতো বিধবাবিবাহনিষেধকমন্যথা পুনর্ভবণপ্রতিপাদকবচন- য়োর্নির্বিষয়ত্বাপত্তিরিতি দত্তায়াশ্চৈব কন্যায়াঃ পুনর্দানং পরস্য চেত্যু- দ্বাহতত্ত্বত্ত্বতবৃহন্নারদীয়বচনং দেবরেণ সুতোৎপদিত্তকন্যা প্রদীয়তে ইতি তদ্ধৃতাদিত্যপুরাণীয় বচনঞ্চ সময়ধৰ্ম্মপ্রতিপাদকতয়া ন. নিত্য- বদনুষ্ঠাননিষেধকং। সত্যামপ্যত্র বিপ্রতিপত্তো প্রকৃতেংক্ষতযোন্যাঃ পুনর্বিবাহ্য প্রস্তুতহাৎ 'দেবরেণ সুতোৎপত্তির্বানপ্রস্থাশ্রমগ্রহঃ: দত্তক্ষতায়াঃ ক্যায়াঃ পুনদীনং পরশস্থ্য বৈ ইতি মদনপারিজাতধৃত- বচনেন সহ তয়োরেকবাক্যত্বেহ ক্ষতযোন্যা বালায়াঃ পুনর্বিবাহং ন তে প্রতিযেদ্ধং শরুতঃ প্রত্যুত ক্ষতযোন্যা বিবাহনিষেধকতয়া ব্যতিয়েকমুখেনাক্ষতযোন্স্যাঃ পুনর্বিবাহমেব ছ্যোতয়ত ইতি। জগন্নাথঃ শরণম্। শ্রীকাশীনাথ শর্ম্মণাম্। রামচন্দ্রঃ শরণং।

শ্রীযুক্তারাম শৰ্ম্মণা।

শ্রীহরিঃ শরণং। শ্রীঠাকুরদাস শৰ্ম্মণাম্।

'কাশীনাথঃ শরণং। শ্রীমধুসূদন শৰ্ম্মণাম্।

শ্রীশঙ্করো জয়তি। * শ্রীহরনাথ শর্ম্মণাম্।

শ্রীবিশ্বেশ্বরো জয়তি।

শ্রীভবশঙ্কর শর্ম্মণাম্।

শ্রীরামঃ শরণম্।

শ্রীরামতনু দেবশর্ম্মণাম্।

শ্রীরামঃ। শ্রীঠাকুর্দাস দেবশর্ম্মণাম্। শ্রীহরিনারায়ণ দেবশর্ম্মণাম্।

ব্যবস্থার অনুবাদ।

প্রশ্ন!নবশাখজাতীয় কোনও ব্যক্তির এক কল্পা বিবাহিতা হইয়া অষ্টম বা নবম বৎসর বয়ঃক্রমে বিধবা হইয়াছে। ঐ ব্যক্তি; আপন কল্লাকে দুরূহ বিধবাঞ্চর্য ব্রহ্মচর্য্যাদির অনুষ্ঠানে অক্ষমা দেখিয়া, পুনর্ব্বার অন্য পাত্রে সমর্পণ করিবার বাসনা করিতেছেন। এ স্থলে জিজ্ঞাস্ত্র এই, ব্রহ্মচর্য্যানুষ্ঠানে অসমর্থা হইলে, ঐরূপ বিধবার পুনর্ব্বার বিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ হইতে পারে কি না; আর, পুনর্ব্বিবাহানস্তর, ঐ মালিকা দ্বিতীয় ভর্তার শাস্ত্রানুমত ভার্য্যা হইবেক কি না; এ বিষয়ে যথাশাস্ত্র ব্যবস্থা লিখিতে আজ্ঞা হয়।

উত্তর। মনু প্রভৃতির শাস্ত্রে, স্ত্রীলোকের পতিবিয়োগের পর, ব্রহ্মচর্য্য, সহমরণ, অথবা পুনর্ব্বিবাহ, বিধবাদিগের ধর্ম্ম বলিয়া বিহিত আছে। সুতরাং, যে শূদ্রজাতীয় অক্ষতযোনি বিধবা ব্রহ্মচর্য্য বা সহমরণ- রূপ দুই প্রধান কল্প অবলম্বন করিতে অক্ষম হইবেক, অন্য পাত্রের সহিত তার পুনরায় বিবাহ অবন্ত শাস্ত্রসিন্ধ, এবং যথাবিধানে বিবাহ সংস্কার হইলে, সেই স্ত্রী দ্বিতীয় পতির স্ত্রী বলিয়া গণিত হওয়াও সুতরাং শাস্ত্রসিদ্ধ হইতেছে। ধৰ্ম্মশাস্ত্রবেত্তা পণ্ডিতদিগের এই মত।

এ বিষয়ে প্রমাণ।-স্কৃতে ভর্ন্তরি ব্রহ্মচর্য্যং তদন্বারোহণং বা। শুদ্ধিতত্ত্বপ্রভৃতিধৃত বিষ্ণুবচন।

পতিবিয়োগ হইলে ব্রহ্মচর্যা কিশ্ব। সহগমন।

যা পত্যা বা পরিত্যক্তা বিধবা বা স্বয়েচ্ছয়া।

উৎপাদয়েৎ পুনর্ভূত্বা স পৌনর্ভব উচ্যতে।

সা চেদক্ষতযোনিঃ স্বস্থ্যাৎ গতপ্রত্যাগতাপি বা। পৌনর্ভবেণ ভর্তা সা পুনঃ সংস্কারমর্হতি ॥ মনুবচন ॥

যে নারী পতিকর্তৃক পরিত্যক্তা অথবা বিধবা হইয়া স্বেচ্ছাক্রমে পুনর্ভু হয়, অর্থাৎ পুনরায় অন্য ব্যক্তিকে বিবাহ করে, তাহার গর্ভে যে পুত্র জন্মে, তাহাকে পৌনর্ভব বলে। যদি সেই স্ত্রী অক্ষতযোনি অথবা গতপ্রত্যাগত! হয়, অর্থাৎ পড়িকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য পুরুষকে জাশ্রয় করে, পরে পুনরায় পতিগৃহে আইসে, তাহার পুনরায় বিবাহ সংস্কার হইতে পারে।

সা স্ত্রী যজ্ঞ্যক্ষতযোনিঃ সত্যন্যমাশ্রয়েৎ তদা তেন পৌনর্ভবেণ ভর্তা পুনর্বিবাহাখ্যং সংস্কারমর্হতি। কুল্লুকভট্টের ব্যাখ্যা। সেই স্ত্রী যদি অক্ষতযোনি হইয়া অন্য ব্যক্তিকে আশ্রয় করে, তাহা, হইলে, ঐ দ্বিতীয় পতির সহিত সেই স্ত্রীর পুনরায় বিবাহসংস্কার হইতে পারে।

নোদ্বাহিকেষু মন্ত্রেষু নিয়োগঃ কীর্ত্যতে কচিৎ। ন বিবাহবিধাবুক্তং বিধবাবেদনং পুনঃ। মনুবচন ॥ বিবাহসংক্রান্ত মন্ত্রের মধ্যে কোনও স্কুলে নিয়োগের উল্লেখ নাই, এবং বিবাহবিধিস্থলে বিধবার বিবাহের উল্লেখ নাই।

এই যে বচন আছে, তন্দ্বারা, নিয়োগের অঙ্গ যে বিবাহ, তাহাসই নিষেধ হইতেছে; কারণ, নিয়োগ প্রকরণ আরম্ভ করিয়া এই বচন লিখিত হইয়াছে; নতুবা, সামান্ততঃ বিধবাবিবাহের নিষেধক নহে। যদি বিধবাবিবাহের' নিষেধক বল, তাহা হইলে, যে দুই বচনে স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বিবাহের বিধি আছে, সেই দুই বচনের স্থল থাকে না।

দত্তায়াশ্চৈব কন্যায়াঃ পুনৰ্দ্দানং পরস্য চ। উদ্বাহতত্ত্বধৃত- বৃহন্নারদীয় বচন।

দত্তা কল্লার পুনরায় অন্য পাত্রে দান।

'দেবরেণ সুতোৎপত্তিদত্তকন্যা প্রদীয়তে। উদ্বাহতত্ত্বধৃত- আদিত্যপুরাণরচন।

দেবর দ্বারা পুত্রোৎপত্তি, দত্তা কন্যার দান। •এই দুই বচন সময়ধৰ্ম্মবোধক, একবারেই বিধবাবিবাহের নিষেধবোধক নহে। যদি এই মীমাংসায় আপত্তি থাকে, তথাপি মদনপারিজাতধৃত-

দেবরেণ সুতোৎপত্তির্বানপ্রস্থাশ্রম গ্রহঃ। দত্তক্ষতায়াঃ কন্যায়াঃ পুনর্দানং পর্য বৈ॥

দেবরম্ভারা পুত্রোৎপত্তি, বানপ্রন্থাশ্রমগ্রহণ, বিবাহিতা ক্ষতযোনি কন্যাগ অন্য পাত্রে পুনদান।

এই বচনের সহিত একবাক্যতা করিলে, ঐ দুই বচন অক্ষতযোনি ক্যার 'পুনর্ব্বিবাহ নিবারণ করিতে পারে না; বরং মদনপারিজাতন্বত ব্লচন, ক্ষতযোনির বিবাহনিষেধ দ্বারা, অক্ষতযোনির পুনর্ব্বিবাহের বোধকই হইতেছে।

তৃতীয় বারের বিজ্ঞাপন

বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না, এ বিষয়ে, ঢাকা অঞ্চলে, অধুনা বিলক্ষণ আন্দোলন হইতেছে; সুতরাং, তথায় অনেক পুস্তকের সবিশেষ আবশ্যকতা হইয়া উঠিয়াছে। দ্বিতীয় বারের মুদ্রিত পুস্তক সকল প্রায় নিঃশেষিত হইয়াছে; এজন্য পুনরায় মুদ্রিত হইল। পূর্ব বারে, এতদ্দেশীয় কতিপয় প্রসিদ্ধ পণ্ডিতের স্বাক্ষরিত এক 'ব‍্যবস্থাপত্র অক্ষর প্রভৃতি সর্বাংশে অবিকল মুদ্রিত হইয়াছিল; এ বারে, অনাবশ্যক বিবেচনায় আর সে রূপে অরিকল মুদ্রিত করা গেল না।

চতুর্থ বারের-বিজ্ঞাপন

এই পুস্তক চতুর্থ বার মুদ্রিত হইল। এ বারে নূতন বিজ্ঞাপন যোজিত করিবার কোনও প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু, কোনও বিশিষ্ট হেতু বশতঃ, কতিপয়, আত্মীয়ের অনুরোধপরতন্ত্র হইয়া, বিজ্ঞাপনস্থলে কিছু বলিতে হইল। ঐ বিশিষ্ট হেতু নিম্নে উল্লিখিত হইতেছে।

২। কেহ কেহু স্থলবিশেষে স্পষ্ট বাক্যে, স্থলবিশেষে কৌশলক্রমে, ব্যক্ত করিয়া থাকেন, বিদ্যাসাগর এই পুস্তকের রচনা মাত্র করিয়াছেন; যে সকল টুক্তি ও প্রমাণ প্রদর্শিত হইয়াছে, তৎসমুদয় অন্যদীয়; অর্থাৎ, তিনি নিজে সে সকল যুক্তি উদ্ভাবিত, কিংবা সে সকল প্রমাণ তত্তৎ গ্রন্থ হইতে বহিষ্কৃত, করিতে পারেন নাই; এ দুই বিষয়ে, তিনি আমার অথবা অমুকের 'সাহায্যে কৃতকার্য্য হইয়াছেন; ইত্যাদি। এই সকল কথা, শুনিয়া আমার কতিপয় আত্মীয় অতিশয় অসন্তুষ্ট হন, এবং নিরতিশয় নির্বন্ধ সহকারে এই অনুরোধ করেন, যখন পুস্তক পুনরায় মুদ্রিত হইবেক, সে সময়ে, পুস্তকসঙ্কলন 'বিষয়ে, তুমি যাঁহার নিকট যে সাহায্য গ্রহণ করিয়াছ, তাহার লবিশেষ নির্দেশ করিতে হইবেক; তাহা হইলে, কাহারও অসন্তোষের কারণ থাকিবেক না।

. ৩। ইতঃপূর্বে, সামান্যাকারে নির্দেশ করিয়াছিলাম, দ্বিতীয় পুস্তক সঙ্কলন কালে, শ্রীযুত তারানাথ তর্কবাচস্পতি ভট্টাচার্য্য মহাশয় যথেষ্ট আনুকূল্য করিয়াছিলেন। কিন্তু, অনবধান বশতঃ, 1 অন্যান্য মহাশয়দিগের কৃত সাহায্যের কোনও উল্লেখ করা হয় নাই। এই অনবধান 'যে সর্বতোভাবে অবৈধ ও দোষাবহ হইয়াছে, তাহার সংশয় নাই। অতএব, এ স্থলে লব্ধ সাহায্যের সবিস্তর পরিচয় দিলে, যে কেবল পূর্ব্বোক্ত আত্মীয়গণের অনুরোধরক্ষা হইতেছে, এরূণ নহে; কর্ত্তব্য কর্ম্মের অননুষ্ঠান-' জন্য প্রত্যবায়েরও সম্পূর্ণ পরিহার হইতেছে।

4 ৪। কলিকাতা'স্থ রাজকীয় সংস্কৃত বিদ্যালয়ের ধর্ম্মশাস্ত্রের ভূতপূর্ব্ব অধ্যাপক সুপ্রসিদ্ধ শ্রীযুত ভরতচন্দ্র শিরোমণি ভট্টাচার্য্য মহাশয় আমার প্রার্থনা অনুসারে নিম্ননিদ্দিষ্ট প্রমাণ গুলি বহিষ্কৃত করিয়া দেন।

১। যতু মাধবঃ যস্তু বাজসনেয়ী স্যাৎ তস্য সন্ধিদিনাৎ পুরা।. ন কাপ্যদ্বাহিতিঃ কিন্তু সদা সন্ধিদিনে হি সা ইত্যাহ তৎ কর্কভাষ্যদেবজানী শ্রীঅনন্তভাষ্যাদিসকল- তচ্ছাখীয় গ্রন্থবিরোধাদ্বহ্বনাদরাচ্চোপেক্ষ্যম্। ৪৫ পৃ০।

২। মাধবস্তু সামান্যবাক্যাম্নির্ণয়ং কুবন্ ভ্রান্ত এব। ৪৬ পৃঃ।

৩। কৃষ্ণা পূর্বোত্তরা শুক্লা দশম্যেবং ব্যবস্থিতেতি মাধবঃ। বস্তুতস্তু মুখ্যা নবমীযুতৈব গ্রাহ্যা দশমী তু প্রকর্তব্যা পদুর্গা দ্বিজসত্তমেত্যাপস্তম্বোক্তেঃ। ৪৫ পৃ০।

৪। নমু মাসি চাশ্বযুজে শুক্লে নবরাত্রে বিশেষতঃ। সম্পূজ্য নবদুর্গাঞ্চ নক্তং কুৰ্য্যাৎ সমাহিতঃ। নবরাত্রাভিধং কৰ্ম্ম নক্তব্রতমিদং স্মৃতম্। ৪৬ পূ০।

৫। অত্র যামত্রয়াদবাক্ চতুর্দশীসমাপ্তো তদন্তে তদুর্দ্ধ গামিন্যাস্ত প্রাতস্তিথিমধ্য এবেতি হেমাদ্রিমাধবাদয়ো ব্যবস্থামাহুঃ তন্ন তিথ্যন্তে তিথিভান্তে বা পারণং যত্র চোদিতম্। যামত্রয়োদ্ধগামিন্যাং প্রাতরেব হি পারণেত্যাদি সামান্যবচনৈরেব ব্যবস্থাসিদ্ধেরুভয়- বিধবাক্যবৈয়র্থ্য, দুস্পরিহরত্বাৎ। ৪৬ পৃঃ।

৬। নচ যদি প্রথমনিশায়ামেকতর বিয়োগস্তদাপি ব্রহ্ম- 'বৈবর্ত্তাদিবচনাদ্দিবাপ্পারণমনস্তভট্টমাধবাচার্য্যোক্তং যুক্তমিতি বাচ্যং ন রাত্রৌ পারণং কুর্মাদৃতে বৈ রোহিণীব্রতাৎ। নিশায়াং পারণং কুর্য্যাৎ বর্জয়িত্বা মহানিশায়িতি সংবৎসর প্রদীপধৃত্য ন রাত্রৌ পারণং কুর্য্যাদৃতে বৈ রোহিণীব্রতাৎ। অত্র নিশ্যপি তৎ কার্য্যং বর্জরিত্বা মহানিশামিতি ব্রহ্মাণ্ডোক্ত্য চ নির্বিবষয়ত্বাপত্তেঃ। ৪৭.পৃ০।

৫। উক্ত বিদ্যালয়ের ব্যাকরণশাস্ত্রের অধ্যাপক সুপ্রসিদ্ধ শ্রীযুক্ত তারানাথ তর্কবাচস্পতি ভট্টাচার্য্য মহাশয় নিম্নলিখিত প্রমাণগুলি বহিষ্কৃত করিয়া দেন।

"১'। নচ কলিনিষিদ্ধস্যাপি যুগান্তরীয়ধৰ্ম্মস্যৈব নষ্টে মৃতে ইত্যাদি পরাশ্বরবাক্যং প্রতিপাদকমিতি বাচ্যং কলাবনুষ্ঠেয়ান্ ধৰ্ম্মানের বক্ষামীতি প্রতিজ্ঞায় তদ্‌গ্রন্থপ্রণয়নাৎ। ৪৩ পূন তর্কবাচস্পতি মহাশয়, আমার প্রয়োজনোপযোগী বোধ করিয়া, বিনা প্রার্থনায় এই প্রমাণুটি উদ্ধৃত করিয়া দিয়াছিলেন।

২। চকার মোহশাস্ত্রাণি কেশবঃ সশিবস্তথা। কাপালং নাকুলং বামং ভৈরবং পূর্বপশ্চিমম্। পাঞ্চরাত্রং পাশুপতং তথা্যানি সহস্রশঃ ॥

৩। শৃণু দেবি প্রবক্ষ্যামি, তামসানি যথাক্রমম্। যেষাং শ্রবণমাত্রেণ পাতিত্যং জ্ঞানিনামপি। প্রথমং হি ময়ৈবোক্তং শৈবং পাশুপতাদিকম্ ॥ ১৪৪ পৃ০।

৪। তথাপি যোহংশো মার্গাণাং বেদেন ন নিরুধ্যতে। সোহংশঃ প্রমাণমিত্যুক্তঃ কেষাঞ্চিদধিকারিণাম্ ॥১৪৫ পৃ০ন

৫। শ্রুতিভ্রষ্টঃ স্মৃতিপ্রোক্ত প্রায়শ্চিত্তপরায়ুখঃ। ক্রমেণ 'শ্রুতিসিদ্ধ্যর্থং ব্রাহ্মণস্তন্ত্রমাশ্রয়েৎ। পাঞ্চরাত্রং ভাগবতং মন্ত্রং বৈখানসাভিধম্। বেদভ্রষ্টান সমুদ্দিশ্য কমলাপতিরুক্তবান্ ॥ ১৪৫ পূ০।

৬। স্বাগমৈঃ কল্পিস্ট্রৈস্তস্ত জনান্ মদ্বিমুখান্ কুরু। মাঞ্চ গোপয় যেন স্থ্যাৎ সৃষ্টিরেযোত্তরোত্তর।। ১৪৫ পৃ০।

এই পুস্তক সঙ্কলনের কিছু কাল পূর্বের উল্লিখিত বচনগুলি কোনও গ্রন্থে দেখিয়াছিলাম; কিন্তু কোন' গ্রন্থে দেখিয়াছি, L তাহা সহসা স্থির করিতে না পারিয়া, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের। নিকট প্রার্থনা করাতে, তিনি এই বচনগুলি বহিষ্কৃত করিয়া দেন।

৭। স্মৃতেবেদবিরোধে তু পরিত্যাগো যথা ভবেৎ।

"তথৈব লৌকিকং বাক্যং স্মৃতিবাধে পরিত্যজেৎ ॥১৮২পৃঃ।'

আমার প্রার্থনা অনুসারে তর্কবাচস্পতি মহাশয় এই বচনটি

বহিষ্কৃত করিয়া দিয়াছেন।

৬। উল্লিখিত বিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক শ্রীযুত গিরিশ-' চন্দ্র বিদ্যারত্ব ভট্টাচার্য্য, আমার প্রার্থনা অনুসারে, আদিপুরাণ, গ্রন্থ দুই বার আমোপান্ত পাঠ করেন, এবং পরাশরভাষ্যধৃত উঢ়ায়াঃ পুনরুদ্বাহং জ্যেষ্ঠাংশং গোবধং তথা। কলৌ পঞ্চ ন কুব্বীত ভ্রাতৃজায়াং কমণ্ডলুম্ ॥ । এই বচন আদিপুরাণে নাই, ইহা অবধারিত করিয়া দেন।

৭। উক্ত বিদ্যালয়ের তৎকালীন বিখ্যাত ছাত্র অতি সুপাত্র রামকমল ভট্টাচার্য্য ও শ্রীযুত রামগতি ন্যায়রত্ন, আমার প্রার্থনা অনুসারে কোনও কোনও গ্রন্থ পাঠ করিয়া, প্রমাণবিশেষের ' অস্তিত্ব ও নাস্তিত্ব বিষয়ে, আমার সংশয়াপনোদন করিয়াছিলেন। সুশীল সুবোধ স্থিরমতি রাগগতি বিশিষ্টরূপ বিছ্যোপঞ্জিন করিয়া এক্ষণে বহরমপুরস্থ রাজকীয় বিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপনা কাৰ্য্য নির্বাহ করিতেছেন। রামকমল দেশের দুর্ভাগ্য ধশতঃ আমাদের সকলকে শোকার্ণর্শ্বে নিক্ষিপ্ত করিয়া অকালে কালগ্রাসে পতিত হইয়াছেন। তিনি অসাধারণ বুদ্ধিমান, অসাধারণ বিদ্যানুরাগী, ও অসাধারণ ক্ষমতাপন্ন ছিলেন; দীর্ঘকাল জীবিত থাকিলে, অনেক অংশে বাঙ্গালাদেশের শ্রীবৃদ্ধিসাধন, ও ব্লাঙ্গালাভাষার সবিস্তর উন্নতি সম্পাদন করিতেন, তাহার কোনও সংশয় নাই।

৮। প্রমাণসঙ্কলনবিষয়ে, আমি যাঁহার নিকট যে সাহায্য লাভ করিয়াছিলাম, তাহার সবিশেষ নির্দেশ করিলাম; এ বিষয়ে, এতদ্ব্যতিরিক্ত কাহারও নিকট কোনও সাহায্য লই নাই ও পাই নাই। এই পুস্তকে সমুদুয়ে ২১৫টি প্রমাণ উদ্ধৃত হইয়াছে; তন্মধ্যে, ১৩টি অন্যদীয়। উপরিভাগে যেরূপ দর্শিত হইল, তদনুসারে, অম্মদীয় ত্রয়োদশ প্রমাণের মধ্যে, ৬টি শ্রীযুক্ত • ভরতচন্দ্র শিরোমণি ভট্টাচার্য্য মহাশয়, আর ৭টি শ্রীযুত তারানাথ তর্কবাচস্পতি ভট্টাচার্য্য মহাশয়, বহিষ্কৃত ক্লরিয়া দিয়াছিলেন।

আর, এই পুস্তকে যে সকল যুক্তি অবলম্বিত হইয়াছে, তৎত্রমুদয় আমার নিজের উদ্ভাবিত, সে বিষয়ে অন্যদীয় সাহায্য গ্রহণের অণুমাত্র আবশ্যকতা ঘটে নাই। এক্ষণে, যে সকল বন্ধুর অনুরোধ বশতঃ, এই বিজ্ঞাপন লিখিত তুইল, তাঁহাদের অসন্তোষকলুষিত চিত্ত প্রসন্ন হইলেই আমি নিশ্চিন্ত হই 'ও' নিস্তার পাই।

কলিকাতা সংবৎ ১৯২৯। ১লা জ্যৈষ্ঠ। }

শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্মা

বিধবাবিবাহ

প্রচলিত হওয়া উচিত কি না।

বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত না থাকাতে যে নানা অনিষ্ট ঘটিতেছে, ইহা এক্ষণে অনেকেরই বিলক্ষণ হৃদয়ঙ্গম হইয়াছে। অনেকেই স্ব স্ব বিধবা কন্যা ভগিনী প্রভৃতির পুনর্ব্বার বিবাহ দিতে উদ্যত আছেন। অনেকে দ্রুত দূর পর্য্যন্ত যাইতে সাহস করিতে পারেন না; কিন্তু, এই ব্যবহার প্রচলিত হওয়া নিতান্ত আবশুক হইয়া উঠিয়াছে, ইহন স্বীকার করিয়া থাকেন। বিধবাবিবাহ শাস্ত্রীয় কি না, এ বিষয়ে, ইতঃপূর্ব্বে, এতদ্দেশীয় কতিপয় প্রধান পণ্ডিতের বিচার হইয়াছিল। কিন্তু, দুর্ভাগ্য ক্রমে, ইদানীন্তন পণ্ডিতেরা বিচারকালে, জিগীষার বশবর্তী হইয়া, স্ব স্ব মত রুক্ষা বিষয়ে এত ব্যগ্র হন যে, প্রস্তাবিত বিষয়ের তত্ত্বনির্ণয় পক্ষে দৃষ্টিপাতমাত্র থাকে না। সুতরাং, পণ্ডিতমণ্ডলী একত্র করিয়া বিচার করাইলে, কোনও বিষয়ের যে নিগূঢ় তত্ত্ব জানিতে পারা যাইবেক, তাহার প্রত্যাশা নাই। পণ্ডিতদিগের পূর্ব্বোক্ত বিচারে, উভয় পক্ষই আপনাকে জয়ী ও. প্রতিপক্ষকে পরাজিত স্থির করিয়াছেন; সুতরাং, •ঐ বিচারে কিরূপ তত্ত্বনির্ণয় হইয়াছে, সকলেই অনায়াসে অনুমান করিতে পারেন। বস্তুতঃ, উল্লিখিত বিচার দ্বারা উপস্থিত বিষয়ের কিছু , মাত্র মীমাংসা হয় নাই, তথাপি, ঐ বিচার দ্বারা এই এক মহৎ ফল দর্শিয়াছে যে, তদবধি অনেকেই এ বিষয়ের নিগূঢ় তত্ত্ব জানিবার নিমিত্ত অত্যন্ত উৎসুক হইয়াছেন। অনেকের এই ঔৎসুক্য দর্শনে, আমি সবিশেষ যত্ন সহকারে এ বিষয়ের তত্ত্বানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম;

এবং, প্রবৃত্ত হইয়া যত দূর পর্য্যন্ত কৃতকার্য্য হইতে পারিয়াছি, সর্ব্ব- সাধারণের গোচরার্থে, দেশের চলিত ভাষায় লিপিবদ্ধ করিয়া, প্রচারিত করিতেছি। এক্ষণে, সকলে পক্ষপাতশূন্য হইয়া পাঠ ও বিচার করিয়া দেখুন, বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না।

'বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না, এ বিষয়ের বিচারে, প্রেবৃত্ত হইতে হইলে, সর্ব্বাগ্রে এই বিবেচনা করা অত্যাবশ্বক যে, এ দেশে বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত নাই; সূতরাং, বিধবার বিবাহ দিতে হইলে এক নূতন প্রশ্না প্রবর্তিত করিতে হইবেক। কিন্তু, বিধবাবিবাহ যদি কর্ত্তব্য কর্ম না হয়, তাহা হইলে কোনও ক্রমে প্রবর্তিত ও প্রচলিত হওয়া উচিত নহে। কারণ, কোন ধৰ্ম্মপরায়ণ ব্যক্তি অকর্ত্তব্য কর্ম্মের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইবেন? অতএব, বিধবাবিবাহ 'কর্তব্য কৰ্ম্ম কি না, অগ্রে ইহার মীমাংসা করা অতি আবশ্যক। যদি, যুক্তি মাত্র অবলম্বন করিয়া, ইহাকে কর্তব্য কর্ম্ম বলিয়া প্রতিপন্ন কর, তাহা হইলে। এতদ্দেশীয় লোকে কখনই ইহা কর্ত্তব্য কর্ম্ম বলিয়া স্বীকার করিবেন না। যদি শাস্ত্রে কর্ত্তব্য কর্ম্ম বলিয়া প্রতিপন্ন করা থাকে, তবেই তাঁহারা কর্তব্য কৰ্ম্ম বলিয়া স্বীকার করিতে ও' তদনুসারে চলিতে পারেন। এরূপ বিষয়ে এ দেশে শাস্ত্রই সর্ব্বপ্রধান প্রমাণ, এবং শাস্ত্রসম্মত কৰ্ম্মই সৰ্ব্বতোভাকে কর্তব্য কৰ্ম্ম বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে। অতএব, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত অথবা শাস্ত্রবিরুদ্ধ কর্ম্ম, ইহার মীমাংসা করাই সর্ব্বাগ্রে আবশ্যক।

বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত অথবা শাস্ত্রবিরুদ্ধ কৰ্ম্ম, বিষয়ের মীমাংসায় প্রবৃত্ত ছুইতে হইলে, অগ্রে ইহাই নিরূপণ করা আবশ্যক যে, যে শাস্ত্রের সম্মত হইলে, বিধবাবিবাহ কর্তব্য কৰ্ম্ম বলিয়া প্রতিপন্ন হইবেক, অথবা যে শাস্ত্রের বিরুদ্ধ হইলে, অকর্তব্য কৰ্ম্ম বলিয়া স্থির হইবেক, সে শাস্ত্র কি। ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কার, দর্শন প্রভৃতি শাস্ত্র এরূপ বিষয়ের শাস্ত্র নহে। ধৰ্ম্মশাস্ত্র বলিরা প্রসিদ্ধ শাস্ত্র সকলই এরূপ বিষয়ের শাস্ত্র বলিয়া সর্ব্বত্র গ্রাঙ্ক হইয়া থাকে। ধৰ্ম্মশাস্ত্র কাহাকে বলে, যাজ্ঞবঝ্যসংহিতাষ্ম। তাহার নিরূপণ আছে। যথা, *মন্বত্রিবিষ্ণুহীরীতযাজ্ঞবন্ধ্যোশনোহঙ্গিরাঃ।"

যমাপস্তম্বসংবর্তাঃ কাত্যায়নবৃহস্পতী ॥ ১।৪॥ পরাশরব্যাসশঙ্খলিখিতা দক্ষগোতমৌ।

শাতাতুপো বশিষ্ঠশ্চ ধর্মশাস্ত্র প্রযোজকাঃ ॥ ১।৫ ॥

মনু, অত্রি, গিষ্ণু, হারীত, যাজ্ঞবক্ষ্য, উশনাঃ, অঙ্গিরা:, যম, আপস্তম্ব, সংবর্ত, কাত্যায়ন, বৃহস্পতি, পরাশর, ব্যাস, শঙ্খ, লিখিত, দক্ষ, গোতম, শাতাতপ, * বশিষ্ঠ, ইহারা ধৰ্ম্মম্মাস্ত্রকর্তা।

• ইহাদের প্রণীত শাস্ত্র ধৰ্ম্মশাস্ত্র (১)। ইহাদের প্রণীত ধৰ্ম্মশাস্ত্রে যে সকল ধৰ্ম্ম নিরূপিত হইয়াছে, ভারতবর্ণীয় লোকে সেই সকল ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া চলিয়া থাকেন। সুতরাং, ঐ সকল ধর্ম্মশাস্ত্রের সম্মত কৰ্ম্ম কর্ত্তধ্য কর্ম্ম, ঐ সকল ধর্ম্মশাস্ত্রের বিরুদ্ধ কৰ্ম্ম অকর্ত্তব্য কৰ্ম্ম। অতএব, বিধবাবিবাহ ধৰ্ম্মশাস্ত্রসম্মত হইলেই কুট্টব্য কৰ্ম্ম বলিয়া অঙ্গীকৃত হইতে পারে; আর, ধৰ্ম্মশাস্ত্রবিরুদ্ধ হইলেই অকর্তব্য কৰ্ম্ম বলিয়া পরিগণিত হইবেক।

এক্ষণে, ইহা দিবেচনা করা আবশ্যক, ঐ সমস্ত ধৰ্ম্মশাস্ত্রে যে সকল ধৰ্ম্ম নিরুপিত হুইয়াছে, সকল যুগেই সে সমুদয় ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া মলিতে হইবুেক কি না। মনুপ্রণীত ধৰ্ম্মশাস্ত্রে এ বিষয়ের মীমাংসা আছে। যথা,

অন্যে কুতযুগে ধৰ্ম্মাস্ত্রেতায়াং দ্বাপরে পরে।

অন্যে বলিযুগে নৃণাং যুগহ্রাসানুরূপতঃ ॥ ১।৫৮ ॥ যুগানুসারে মনুষ্যের শক্তিহ্রাস হেতু, সভঙ্গ যুগের ধর্ম্ম অন্য; ত্রেতা যুগের ধর্ম্ম অন্ত্য; দ্বাপর যুগের ধর্ম্ম অন্ত; কলি যুগের ধর্ম অন্য।

অর্থাৎ, পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগের লোকেরা যে সকল ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া চলিয়াছিলেন, পর পর যুগের লোক সে সকল ধর্ম্ম অবলম্বন কুরিয়া চলিতে সমর্থ নহেন; যেহেতু, উত্তরোত্তর, যুগে যুগে, মনুষ্যের ক্ষমতার হ্রাস হইয়া যাইতেছে। ত্রেতা যুগের লোকদিগের সত্য যুগের ধর্ম্ম, দ্বাপর যুগের লোকদিগের সত্য অথবা ত্রেতা যুগের ধর্ম্ম, অবলম্বন করিয়া চলিবার ক্ষমতা ছিল না। কলি যুগের লোকদিগের সত্য, •ত্রেতা, অথবা দ্বাপর যুগের ধর্ম্ম অবলম্বন' করিয়া চলিতে পারিবার ক্ষমতা নাই। সুতরাং, ইহা স্থির হইতেছে, কলি যুগের লোক পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগের ধর্ম্ম অর্বলম্বন করিয়া চলিতে অক্ষম। এক্ষণে, এই জিজ্ঞাসা উপস্থিত হইতে পারে, তবে কলি যুগের লোকদিগকে কোন ধৰ্ম্ম অব- লম্বন করিয়া চলিতে হইবেক। মনুপ্রণীত ধৰ্ম্মশাস্ত্রে, যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্ম, এই মাত্র নির্দেশ আছে; ভিন্ন ভিন্ন যুগের ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম্মের নিরূপণ করা নাই। অত্রি, বিষ্ণু, হারীত প্রভৃতির ধর্মশাস্ত্রেও যুগভেদে ধৰ্ম্মভেদ নিরূপিত দেখিতে পাওয়া যায় না। ইহাদের ধর্ম্মশাস্ত্রে কতক গুলি ধর্ম্মের নিরূপণ করা মাত্র আছে; কিন্তু যুগে যুগে মনুস্থ্যের ক্ষমতা হ্রাস হওয়াতে, কোন যুগে কোন ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া চলিতে হইবেক, তাহার নির্ণয় হওয়া দুর্ঘট। কোন যুগে কোন ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া চলিতে হইবেক, পরাশর প্রণীত ধর্মশাস্ত্রে সে সমুদয়ের নিরূপণ আছে। পরাশরসংহিতার প্রথম অধ্যায়ে লিখিত আছে,

কৃতে তু মানবা ধৰ্ম্মাস্ত্রেতায়াং গৌতমাঃ স্মৃতাঃ। দ্বাপরে শাঙ্খলিখিতাঃ কলৌ পারাশরাঃ স্মৃতাঃ ।

মমুনিরূপিত যুগ্ম সত্য যুগের ধর্ম, গোতমনিরূপিত ধর্ম ত্রেতা যুগের ধর্ম, শঙ্খলিখিতনিরূপিত ধর্ম দ্বাপর যুগের ধর্ম, পরাশরনিরূপিত ধন্ধু কলি যুগের ধর্ম্ম।

অর্থাৎ, ভগবান্ স্বায়ম্ভুব মনু যে সমস্ত ধর্মের নিরূপণ ক্লরিয়াছেন, সত্য যুগের লোকেরা সেই সকল ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া চলিতেন। ভগবান্ গোতম যে সমস্ত ধর্ম্মের নিরূপণ করিয়াছেন, ত্রেতা যুগের লোকের সেই সকল ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া চলিতেন। ভগবান্ শঙ্খ ও লিখিত যে সমস্ত ধর্ম্মের নিরূপণ করিয়াছেন, দ্বাপর যুগের লোকেরা সেই সকল ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া চলিতেন। আর, ভগবান্ পরাশর যে সমস্ত ধর্ম্মের নিরূপণ করিয়াছেন, কলি যুগের লোকদিগকে সেই সকল ধৰ্ম্ম অবলম্বন কুরিয়া চলিতে হইবেক (২)। অতএব, ইহা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে, ভগবান্ পরাশর কেবল কলি যুগের নিমিত্ত ধৰ্ম্মনিরূপণ করিয়াছেন এবং কলি যুগের লোকদিগকে তাঁহার নিরূপিত ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া চুলিতে হইবেক।

পরাশরসংহিতার যে রূপে আরম্ভ হইতেছে, অহা দেখিলে, কলি যুগের ধর্মনিরূপণই যে পরাশরসংহিতার উদ্দেশ্য, সে বিষয়ে সংশমমাত্র থাকিতে পারে না। যথা,

অথাতো হিমশৈলাগ্রে দেবদারুবনালয়ে। ব‍্যাসমেকা গ্রমাসীনমপৃচ্ছলূষয়ঃ পুরা ॥ মানুষাণাং হিতং ধৰ্ম্মং বর্তমানে কলৌ যুগে। শৌচাচারং যথাবচ্চ বদ সত্যবতীস্থত ।। তৎ শ্রুত্বা ঋষিবাক্যন্ত সমিদ্ধাগ্ন্যর্কসন্নিভঃ। প্রত্যুবাচ মহাতেজাঃ শ্রুতিস্মৃতিবিশারদঃ ।। নচাহং সর্ববতত্ত্বজ্ঞঃ কথং ধৰ্ম্মং বদাম্যহম্। অস্মৎপিতৈব প্রষ্টব্য ইতি ব্যাসঃ সুতোহবদৎ ॥ ততস্তে ঋষয়ঃ সবে ধৰ্ম্মতস্বার্থকাঙিক্ষণঃ।

ঋষিং ব্যাসং পুরস্কৃত্য গতা বদরিকাশ্রমম্ ॥ নানাবৃক্ষসমাকীর্ণং ফলপুষ্পোপশোভিতম্। নদীপ্রস্রবণাকীর্ণং পুণ্যতীর্থেরলঙ্কতম্ ।। মৃগপ্রক্ষিগণাঢ্যঞ্চ দেবর্তায়তন বৃতম্। যক্ষগন্ধর্বসিদ্ধৈশ্চ নৃত্যগীতসমা কুলম্ ।। তস্মিনৃষিসভামধ্যে শক্তিপুত্রং পরাশরম্। সুখাসীনং মহাত্মানং মুনিমুখ্যগণাবৃতম্ ।। কৃতাঞ্জলিপুটো ভূত্বা ব্যাসস্ত ঋষিভিঃ সহ। প্রদক্ষিণাভিবাদৈশ্চ স্তুতিভিঃ সমপূজয়ৎ ॥ অথ সন্তুষ্টমনসা পরাশরমহামুনিঃ। আহ সুস্বাগতংঞ্জহীত্যাসীনো মুনিপুঙ্গবঃ ॥ ব্যাসঃ সুস্বাগতং যে চ ঋষয়শ্চ সমন্ততঃ। কুশলং 'কুশলেত্যুব্জা ব্যাসঃ পৃচ্ছত্যতঃপরম্।। যদি জানাসি মে ভক্তিং স্নেহাদ্বা ভক্তবৎসল। ধৰ্ম্মং কথয় মে তাত অনুগ্রাহ্যো হ্যহং তব ॥ শ্রুতা মে মানবা ধর্ম্মা বাশিষ্ঠাঃ কাশ্যপাস্তণ। গার্গেয়া গৌতমাশ্চৈব তথা চৌশনসাঃ স্মৃতাঃ ॥ অত্রেবিষ্ণোশ্চ সাংবর্তা দাক্ষা আঙ্গিরসাস্তথা। শাতাতপাশ্চ হারীতা যাজ্ঞবন্ধ্যকৃতাশ্চ যে ॥ কাত্যায়নকৃতাশ্চৈব প্রাচেতসক্বতাশ্চ' যে। আপস্তম্বকৃতা এৰ্ম্মাঃ শঙ্খ্য লিখিতস্য চ ৷ শ্রুতা হোতে ভবৎপ্রোক্তাঃ শ্রৌতার্থান্তে ন বিস্মৃতাঃ। অস্মিন্ মন্বন্তরে ধর্ম্মাঃ কৃতত্রেতাদিকে যুগে।। সর্বেব ধৰ্ম্মাঃ কৃতে জাতাঃ সর্বে নষ্টাঃ কলৌ যুগে। চাতুর্বর্ণ্যসমাচারং কিঞ্চিৎ সাধারণং বদ ।।

ব্যাসবাক্যাবসানে তু মুন্নিমুখ্যঃ পরাশরঃ। ধৰ্ম্ম্য নির্ণয়ং প্রাহ সূক্ষ্মং স্থূলঞ্চ বিস্তরাৎ ॥

পূর্ব্ব কালে কতকগুলি ঋষি ব্যাসদেবকে জিজ্ঞাসা করেন, হে সত্যবর্তীনন্দন। কলি যুগে কোনৰ্ম্ম ও কোন আচার মনুষ্যের হিতকর, আপনি তাহা বলুন। 'ব্যাসদেব ঋষিবাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, আমি সকল বিষয়ের তত্ত্বজ্ঞ নহি, আমি কি রূপে ধৰ্ম্ম বলিব। এ বিষয়ে আমার পিতাকেই জিজ্ঞাসা করা কর্তব্য। তখন ঋবিরা ব্যাসদেবের সমভিব্যাহারে পরাশরের আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। ব্যাসদেব ও ঋষিগণ কৃতাঞ্জলিপুটে পরাশরকে প্রদক্ষিণ প্রণাম ও স্তব করিলেন। মহবি পরাশর প্রসন্ন মনে তাঁহাদিগকে স্বাগত জিজ্ঞাসা করিলে, তাঁহারা আত্মকুশল নিবেদন করিলেন। অনন্তর ব্যাসদেব কহিলেন, হে পিতঃ! আমি আপনকার নিকট মহু প্রভৃতিনিররূপিত সভ্য ত্রেতা ও দ্বাপর যুগের ধর্ম্ম শ্রবণ করিয়াছি। যাহা শ্রবণ করিয়াছি, বিস্তৃত হই নাই। সত্য যুগে সকল ধর্ম জন্মিয়াছিল, কলি যুগে সকল ধৰ্ম্ম নষ্ট হইয়াছে। অতএব, চারি বর্ণের সাধারণ ধর্ম কিছু বলুন। ব্যাসবাক্য সমাপ্ত হইলে, মহর্ষি পরাশর বিস্তারিত রূপে ধৰ্ম্ম বলিতে আরম্ভ করিলেন।

পরাশরসংহিতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের আরম্ভেও কলিধৰ্ম্মকথনের প্রতিজ্ঞ স্পষ্ট দুষ্ট হইতেছে। যথা,

অতঃপরং গৃহস্থস্য ধর্মাচারং কলৌ যুগে। ধর্মং সাধারণং শক্যং চাতুব্বর্ণ্যাশ্রমাগতম্। সংপ্রবক্ষ্যাম্যহং পূর্বং পরাশরবচো যথা ॥

অতঃপর গৃহস্থের কলি যুগে অনুষ্ঠেয় ধর্ম ও আচার কীর্ত্তন করিব। পূর্ব্বে পরাশর যেরূপ কহিয়াছিলেন, তদনুসারে চারি বর্ণর ও আশ্রমের অনুষ্ঠানযোগ্য সাধারণ ধর্ম বলিব; অর্থাৎ গুলাকে কাল যুগে যে সকল ধর্ম্মের অনুষ্ঠান করিতে পারিবেক, এরূপ ধৰ্ম্ম কহিব।

এই সমুদায় দেখিয়া, পরাশরসংহিতা যে কলি যুগের ধর্ম্মশাস্ত্র, বিষয়ে আর কোনও আপত্তি অথবা সংশয় করা যাইতে পারে না।

• এক্ষণে ইহা স্থির হইল, পরাশরসংহিতা কলি যুগের ধর্ম্মশাস্ত্র। অতঃপর এই অনুসন্ধান করা আবশ্যক, বিধবাদিগের পক্ষে পরাশর- সংহিতাতে কিরূপ ধৰ্ম্ম নিরূপিত হইয়াছে। উক্ত গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে লিখিত আছে,

নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পাততে পতো। পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরস্থ্যো বিধীয়তে ॥ মৃতে ভর্ত্তরি যা নারী ব্রহ্মচর্য্যে ব্যবস্থিতা। সা মৃতা লভতে স্বর্গং যথা তে ব্রহ্মচারিণঃ ॥ তিস্রঃ কোট্যোংর্দ্ধকোটী চ যানি লোমানি মানবে। তাবৎ কালং বসেৎ স্বর্গং ভত্তারং যামুগচ্ছতি।

'স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলেট ক্লীব স্থির হইলে, সংসারধর্ম পরিত্যাগ করিলে, অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহ করা শাস্ত্রবিহিত। যে নারী, স্বামীর মৃত্যু হইলে, ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করিয়া থাকে, সে দেহান্তে, ব্রহ্মচারী- দিগের ন্যায়, স্বর্গলাভ করে। মনুষ্যশরীরে যে সার্দ্ধ ত্রিকোটি লোম আছে, যে নারী স্বামীর সহগমন করে, তৎসম কাল স্বর্গে বাস করে।

পরাশর কলি যুগের বিধবাদিগের পক্ষে তিন বিধি দিয়াছেন, বিবাহ, ব্রহ্মচর্য্য, সহগমন। তন্মধ্যে, রাজকীয় আদেশক্রমে সহগমনের প্রথা রহিত হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে বিধবাদিগের দুই মাত্র পথ আছে, বিবাহ ও ব্রহ্মচর্য্য; ইচ্ছা হয় বিবাহ করিবেক ইচ্ছা হয় ব্রহ্মচর্য্য করিবেক। কলি যুগে, ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করিয়া দেহযাত্রা নির্ব্বাহ করা বিধবাদিগের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হুইয়া উঠিয়াছে। এই নিমিত্তই, লোকহিতৈষী ভগবান্ পরাশর সর্ব্বপ্রথম বিবাহেরই বিধি দিয়াছেন। সে যাহা হউক, স্বামীর অনুদ্দেশ প্রভৃতি পাঁচ প্রকার বৈগুণ্য ঘাটলে, স্ত্রীলোকের পক্ষে বিবাহের স্পষ্ট বিধি প্রদর্শিত হওয়াতে, কলি যুগে, সেই সেই অবস্থায়, বিধবার পুনর্ব্বার বিবাহ করা শাস্ত্রসম্মত কর্তৃবা কর্ম্ম বলিয়া অবধারিত হইতেছে।

কলি যুগে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রবিহিত কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম স্থির হইল। এক্ষণে এই বিবেচনা করা আবন্তক, বিধবা পুনর্ব্বার বিবাহিতা হইলে, তগর্ভজাত পুত্রের পৌনর্ভৰ সংজ্ঞা হইবেক কি না। পরাশরসংহিতাতেই এ বিষয়ের মীমাংসা আছে। পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগে দ্বাদশবিধ পুত্রের ব্যবস্থা • ছিল। কিন্তু, পরাশর কলি যুগে তিন প্রেকার পুত্র মাত্র বিধান করিয়া- ছেন। যথা,

ঔরসঃ ক্ষেত্রজশ্চৈব দত্তঃ কৃত্রিমক; সুতঃ (৩)।

ঔরস, দত্তক, কৃত্রিম এই তিন প্রকার পুত্র (৪)।

পরাশর কলি যুগে ঔরস, দত্তক, কৃত্রিম, ত্রিবিধ পুত্রের বিধি দিতেছেন, পৌনর্ভবের উল্লেখ করিতেছেন না। কিন্তু, যখন বিধবাবিবাহের বিধি দিয়াছেন, তখন বিবাহিতা বিধবার গর্ভজাত পুত্রকেও পুত্র বলিয়া পরিগ্রহ করিবার বিধি দেওয়া হইয়াছে। এক্ষণে বিবেচনা করা আবশ্যক, ঐ পুত্রকে ঔরস, দত্তক, অথবা কৃত্রিম বলা যাইবেক। উহাকে দত্তক অথবা ক্বত্রিম বলা যাইতে পারে না; কারণ, যদি পরের পুত্রকে, শাস্ত্রবিধান অনুসারে, পুত্র করা যায়, তবে, বিধানের বৈলক্ষণ্য অনুসারে, তাহার নাম দত্তক অথবা কৃত্রিম হইয়া থাকে।

কিন্তু, বিবাহিতা' বিধবার গর্ভে স্বয়ং উৎপাদিত পুত্র পরের পুত্র নহে; এই নিমিত্ত, উহাকে দত্তক অথবা কৃত্রিম বলা যাইতে পারে না। শাস্ত্রকারেরা দত্তক ও কৃত্রিম পুত্রের যে লক্ষণ নিরূপিত করিয়াছেন, তাহা বিবাহিতা বিধবার গর্ভে স্বয়ং উৎপাদিত পুত্রে ঘটিতেছে না। কিন্তু ঔরস পুত্রের যে লক্ষণ নির্দিষ্ট করিয়াছেন, তাহা সম্পূর্ণ রূপে ঘটিতেছে। যথা,

মাতা পিতা, বা দদ্যাতাং যমপ্তিঃ পুত্রমাপদি।

সদৃশং প্রীতিসংযুক্তং স জ্ঞেয়ো দক্রিমঃ সুতঃ ॥৯/১৬৮। (৫) মাতা অথবা পিতা, প্রীত মনে, শাস্ত্রের বিধান অনুসারে, "সজাতীয় পুত্রহীন ব্যক্তিকে যে পুত্র দান করেন, সেই পুত্র গ্রহীতার দত্তক পুত্র।

সদৃশস্ত প্রকুৰ্য্যায়ং গুণদোষবিচক্ষণম্।

পুত্রং পুত্রগুণৈযুক্তং স বিজ্ঞেয়স্তু কৃত্রিমঃ। ৯। ১৬৯। (৫) ঋণদোষবিচক্ষণ, পুত্রগুণযুক্ত যে সজাতীয় ব্যক্তিকে পুত্র করে, সেই পুত্র কৃত্রিম পুত্র।

স্বৈ ক্ষেত্রে সংস্কৃতায়ান্ত স্বয়মুৎপাদয়েদ্ধি যম!

তমৌরসং বিজানীয়াৎ পুভ্রং প্রথমকল্পিকম্ ॥ ৯১১৬৬ ।। (৫) বিবাহিতা সজাতীয়া গ্রীতে স্বয়ং যে পুত্র উৎপাদন করে, সেই পুত্র ঔরস পুত্র এবং সেই মুখ্য পুত্র।

বিবাহিতা প্রজাতীয়া স্ত্রীর গর্ভে স্বয়ং উৎপাদিত পুভ্র ঔরস পুত্র, এই লক্ষণ দ্বিবাহিতা সজাতীয়া বিধবার 'গর্ভে স্বয়ং উৎগাদিত পুত্রে সম্পূর্ণ ঘটিতেছে। অতএব, যখন পুরাশর কলি যুগে বিধবার বিবাহের বিধি দিয়াছেন, এবং দ্বাদশ প্রকারের মধ্যে কেবল তিন প্রকার পুত্রের বিধান করিয়াছেন, এবং যখন বিবাহিতা বিধবার গর্ভে স্বয়ং উৎপাদিত পুত্রে দত্তক ও কৃত্রিম পুত্রের লক্ষণ ঘটিতেছে না, কিন্তু ঔরস পুত্রের লক্ষণ সম্পূর্ণ ঘটিতেছে, তখন তাহাকে অবশ্যই ঔরস পুত্র বলিয়া স্বীকার

করিতে হইবেক। কলি যুগে বিবাহিতা বিধবার গর্ভে স্বয়ং উৎপাদিত

পুত্রকে পৌনর্ভব বলিয়া গণনা করা কোনও ক্রমে পরাশরের অভিপ্রেত

বলিয়া প্রতিপন্ন করা যাইতে পারে না। পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগে, তাদৃশ পুত্রের

পৌনর্ভবসংজ্ঞার ব্যবহার ছিল। যদি কুলি যুগে সেই পুত্রকে পৌনর্ভব বলা আবশ্যক হইত, তাহা হইলে পরাশর, কলি যুগের পুত্রগণনাস্থলে," অবশ্যই পৌনর্ভবের নির্দেশ করিতেন। তরূপ নির্দেশ করা দূরে থাকুক, • পরাশরসংহিতাতে পৌনর্ভব শব্দই নাই। অতএব, কলি যুগে বিবাহিতা বিধবার, গর্ভে স্বয়ং উৎপাদিত, পুত্রকে, পৌনর্ভব না বলিয়া, ঔরস বলিয়া গণনা করিতে হইবেক, তাহার সন্দেহ নাই। • রুলি যুগে বিধবাবিবাহ যে শাস্ত্রবিহিত কর্তব্য কর্ম্ম, তাহা নির্ধারিত হইল। এক্ষণে এই অনুসন্ধান করা আবশ্যক, শাস্ত্রান্তরে কলি যুগে এ বিষরের নিষেধক প্রমাণ আছে কি না। কারণ, অনেকে কহিয়া থাকেন, পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগে বিধবাবিবাহের বিধান ছিল, কলি যুগে এ বিষয় নিষিদ্ধ। কিন্তু যখন পরাশরসঃহিতাতে কেবল কলি যুগের ধর্ম নিরূপিত হইয়াছে এবং, সেই ধর্ম্মের মধ্যে, বিধবাবিবাহের স্পষ্ট বিধি দৃষ্ট হইতেছে, তখন • কলি যুগে বিধবাবিবাহু নিষিদ্ধ কর্ম, এ কথা কোনও ক্রমে গ্রান্থ হইতে পারে না। কলি যুগে বিধবাবিবাহের নিষেধবাদীরা, কোন শাস্ত্র অবলম্বন করিয়া এরূপ কহিয়া থাকেন, তাহা তাঁহারাই জানেন। স্মার্ত ভট্টাচার্য্য রঘুনন্দন উদ্বাহতত্ত্বে বৃহন্নারদীয় ও আদিত্যপুরাণের যে বচন উদ্ধৃত করিয়াছেন, কেহ কেহ উহাকেই কুলি যুগে বিধবাবিবাহের নিষেধক বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা পান। অতএব, এ স্থলে ঐ সকল বচন উদ্ধৃত করিয়া, উহাদের অর্থ ও তাৎপর্য্য প্রদর্শিত হইতেছে।

বৃহন্নারদীয়।

সমুদ্রযাত্রাস্বীকারঃ কমণ্ডলুবিধারণম্। দ্বিজানামসবর্ণাশু কন্যাস্পষমস্তথা ॥

দেবরেণ সুতোৎপত্তিৰ্ম্মধুপর্কে পশোর্বধঃ। মাংসাদনং তথা শ্রাদ্ধে বানপ্রস্থাশ্রমস্তথা ॥ দত্তায়াশ্চৈব কন্যায়াঃ পুনর্দানং পরশ্য চ। দীর্ঘকালং ব্রহ্মচর্য্যং নরমেধাশ্বমেধকৌ। মহাপ্রস্থানগমনং গোমেধঞ্চ তথা মখম্। ইমান্ ধৰ্ম্মান্ কলিযুগে ব্যানাহুৰ্ম্মনীষিণঃ। (৬)

সমুদ্রযাত্রা, কমণ্ডলুদারণ, দ্বিজাতির ভিন্নজাতীয় স্ত্রীর পাণিগ্রহণ, দেবর দ্বারা পুত্রোৎপাদন, মধুপর্কে পশুবধ, শ্রাদ্ধে মাংসভোজন, বানপ্রস্থধর্ম্মের অবলম্বন, এক জনকে কন্যা দান করিয়া সেই কন্যার পুনরায় অন্য বরে দান, দীর্ঘ কাল ব্রহ্মচর্য্যানুষ্ঠান, নরমেধ যজ্ঞ, অশ্বমেধ যজ্ঞ, মহাপ্রস্থানগমন, গোমেধ যজ্ঞ; পণ্ডিতেরা কলি যুগে এই সকুল ধৰ্ম্ম বর্জনীয় কহিয়াছেন।

এই সকল বচনের কোনও অংশেই বিধবাবিবাহের নিয়েধ প্রতিপন্ন হইতেছে না। যাঁহারা, এক জনকে কন্যা দান করিয়া সেই কন্যার পুনরায় অন্ত্য বরে দান, এই ব্যবহারের নিষেধকে বিধবাবিবাহের নিষেধ বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা পান, তাঁহারা ঐ নিষেধের তাৎপর্য্যগ্রহ করিতে পারেন নাই। পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগে এই ব্যবহার ছিল, কোনও ব্যক্তিকে বাগ্দান করিয়া, পরে তদপেক্ষায় উৎকট বর পাইলে, তাহাকেই কন্যা দান করিত। যথা,

সকৃৎ প্রদীয়তে কন্যা হরংস্তাং চৌরদগুভাক্। 'দত্তামপি হরেৎ পূর্ব্বাৎ শ্রেয়াংশ্চেদ্বর আত্রজেৎ ॥ ১।৬৫। (৭)।

কন্যাকে এক বার মাত্র দান করা 'বায়; দান করিয়া হরণ বরিলে, চৌরঙ্গও প্রাপ্ত হয়। কিন্তু, পূর্ব্ব বর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বর উপস্থিত হইলে, দত্তা কন্যাকেও পূর্ব্ব বর হইতে হরণ করিবেক, অর্থাৎ তাহার সহিত বিবাহ না দিয়া, উপস্থিত শ্রেষ্ঠ বরের সহিত কন্যার বিবাহ দিবেক।

পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগে, অগ্রে এক বরে কন্যা দান করিয়া, পরে সেই বর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বর উপস্থিত হইলে তাহাকে কন্যা দান করার এই যে শাস্ত্রানুমত ব্যবহার ছিল, বৃহন্নারদীয়ের বচন দ্বারা ঐ ব্যবহারের নিষেধ হইয়াছে। অতএব, ঐ নিষেধকে কলি যুগে বিধবাবিবাহের নিষেধ বলিয়া বোধ করা কোনও ক্রমে বিচারসিদ্ধ হইতেছে না। আর, যখন পেন্থাশরসংহিতাতে কলি যুগে বিধবাবিবাহের স্পষ্ট বিধি দৃষ্ট হইতেছে, তখন কষ্টকল্পনা করিয়া বৃহন্নারদীয়ের এই বচনকে বিধবাবিবাহের নিষেধক 'বলা কোনও মতে সঙ্কত হইতে পারে না।

আদিত্যপুরাণ।

দীর্ঘকালং ব্রহ্মচর্য্যং ধারণঞ্চ কমগুলোঃ। দেবরেণ সুতোৎপত্তির্দত্তকন্যা প্রদীয়তে ॥ কন্যানামসবর্ণানাং বিবাহশ্চ, দ্বিজাতিভিঃ। আততায়িদ্বিজাগ্র্যাণাং ধর্য্যযুদ্ধেন হিংসনম্ ॥ বানপ্রস্থাশ্রমসহ্যাপি প্রবেশো বিধির্দেশিতঃ। বৃত্তস্বাধ্যায়সাপেক্ষমঘসঙ্কোচনং তথা ॥ প্রায়শ্চিত্তবিধানঞ্চ বিপ্রাণাং মরণান্তিকম্। সংসর্গদোষঃ পাপেষু মধুপর্কে পশোধ্বধঃ ॥ দত্তৌরসেতরেষান্ত পুত্রত্বেন পরিগ্রহঃ। শূদ্রেষু দাসগোপালকুলমিত্রার্দ্ধসীরিণাম্ ॥ ভোজ্যান্নতা গৃহস্থ্য তীর্থসেবাতিদূরতঃ। ব্রাহ্মণাদিষু শূদ্রসস্ত্য' পক্বতাদিক্রিয়াপি চ। ভূমগ্নিপতনঞ্চৈব বৃদ্ধাদিমরণং তথা ॥ এতানি লোকগুপ্ত্যর্থং কলেরাদৌ মহাত্মভিঃ। নিবর্ত্তিতানি কৰ্ম্মাণি ব্যবস্থাপূর্ব্বকং বুধৈঃ (৮) দীর্ঘ কাল ব্রহ্মচর্য্য, কমণ্ডলুধারণ, দেবুর দ্বারা পুত্রোৎপাদন, দত্তা কন্যার দান, দ্বিজাতির অসবর্ণা কন্যার পাণিগ্রহণ, ধৰ্ম্মযুদ্ধে আততায়ী ব্রাহ্মণের প্রাণবধ, বানগ্রন্থাশ্রমাবলম্বন, চরিত্র ও বেদাধ্যয়ন অনুসারে অশৌচসঙ্কোচ, ব্রাহ্মণের মরণান্ত প্রায়শ্চিত্ত, পাতকীর সংসর্গে দোষ, মধুপর্কে পশুবধ, দত্তক ও ঔরস ভিন্ন পুত্র পরিগ্রহ, গৃহস্থ দ্বিজের শূদ্রমধ্যে দাস গোপাল কুঃ মিত্র ও অর্দ্ধসীরীর অন্ন ভোজন, অতি দূর তীর্থ যাত্রা, শুদ্রকর্তৃক ব্রাহ্মণের পাকাদি ক্রিয়া, উন্নত স্থান হইতে পতন, অগ্নিপ্রবেশ, বৃদ্ধাদির মরণ; মহাত্মা পণ্ডিতেরা, লোকরক্ষার নিমিত্তে, কলির আদিতে, ব্যবস্থা করিয়া, এই সকল কর্ম্ম রহিত করিয়াছেন।

এই সকল বচনেরও কোনও অংশে বিধবাবিবারে নিষেধ প্রতিপন্ন হইতেছে না। দত্তা কন্যার দান, এই অংশের নিষেধকে যে বিধবা- বিবাহের নিষেধ বলা যাইতে পারে না, তাহা বৃহল্লারদীয়বচনের ঐরূপ অংশের মীমাংসা দ্বারা প্রতিপাদিত হইয়াছে।

'কেহ কেহ কহিয়া থাকেন, আদিত্যপুরাণে দত্তক ও ঔরস ভিষ 'পুত্র পরিগ্রহের যে নিষেধ আছে, উহা দ্বারাই বিধবাবিবাহের নিষেধ সিদ্ধ হইয়াছে। তাঁহাদের অভিপ্রায় এই যে, পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগে বিবাহিতা বিধবার গর্ভজাত পুত্রকে পৌনর্ভব বলিত; যখন কলি যুগে দত্তক ও ঔরস ভিন্ন পুত্র পরিগ্রহের নিষেধ হইয়াছে, তখন পৌনর্ভবকেও পুত্র বলিয়া পরিগ্রহ করিবার নিষেধ সুতরাং সিদ্ধ হইতেছে। বিবাহ কশ পুত্রের নিমিত্তে; যদি বিবাহিতা বিধবার গর্ভজাত পৌনর্ভবের পুত্রত্ব নিষিদ্ধ হইল, তখন সুতরাং বিধবার বিবাহও নিষিদ্ধ হইল। এই আপত্তি আাপাততঃ বলবর্তী বোধ হইতে পারে, এবং পরাশরসংহিতা না থাকিলে, এই আপত্তি দ্বারাই বিধবাবিবাহের নিষেধ প্রতিপন্ন হইতে পারিত। যাঁহারা, এই আপত্তির উত্থাপন করিয়া, বিধবাবিবাহের নিষেধ সিদ্ধ করিতে যত্ন পান, বোধ করুি পরাশরসংহিতাতে তাঁহাদের দৃষ্টি নাই। পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগে বিবাহিতা বিধবার গর্ভজাত পুত্রের পৌনর্ভৰ সংজ্ঞার ব্যবহার ছিল, যথার্থ বটে। কিন্তু পূর্ব্বে কলি যুগে বিবাহিতা. বিধবার গর্ভজাত পুত্রের পৌনর্ভব সংজ্ঞা বিষয়ে যে আলোচনা করা গিয়াছে, তদ্দ্বারা ইহা' বিলক্ষণ প্রতিপন্ন হইয়াছে, কলি যুগে বিবাহিতা বিধবার গর্ভজাত সন্তান ঔরস পুত্র, পৌনর্ভব নহে। অতএব, যদি তাদৃশ পুত্র পৌনর্ভব না হইয়া ঔরস হইল, তবে দত্তক ও ঔরস ভিন্ন পুত্রের পুত্রত্ব নিষেধ দ্বারা কি রূপে কলি যুগে বিধবাবিবাহের নিষেধ সিদ্ধ হইতে পারে।

•• বৃহন্নারদীয় ও আদিত্যপুরাণবচনের যেরূপ তাৎপর্য্য ব্যাখ্যাত হইল, .. তদনুসারে ঐ সকল বচন কোনও মতে কলি যুগে বিধবাবিবাহের নিষেধবোধক হইতেছে না। যন্ত্রি নিষেধবাদীরা ঐ ব্যাখ্যাতে সন্তুষ্ট না হইয়া বিধবাবিবাহের শাস্ত্রীয়তা বিষয়ে বিবাদ করেন অর্থাৎ বৃহন্নারদীয় ও আদিত্যপুরাণের ঐ সকল বচনকে বিধবাবিবাহের নিষেধক বলিয়া আগ্রহ প্রদর্শন করেন, তবে এক্ষণে এই কথা বিবেচ্য হইতেছে যে, পরাশরসংহিতাতে বিধবাত্ত্বিবাহের বিধি আছে, আর বৃহন্নারদীয় ও আদিত্যপুরাণে বিধবাবিবাহের নিষেধ আছে ইহার মধ্যে কোন শাস্ত্র বঙ্গবৎ হইবেক; অর্থাৎ, পরাশরের বিধি অনুসারে বিধবাবিবাহ কর্তব্য, কর্ম্ম বলিয়া পরিগণিত হইবেক, অথবা বৃহন্নারদীয় ও 'আদিত্যপুরাণের নিষেধ অনুসারে বিধবাবিবাহকে অকর্তব্য কৰ্ম্ম বলিয়া স্থির করা • যাইবেক। এ বিষয়ের মীমাংসা করিতে হইলে এই অনুসন্ধান করা আবশ্যকু, শাস্ত্রকারেরা শাস্ত্রের পরস্পর বিরোধঙ্গলে তদীয় বলাবল বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। ভগবান্ বেদব্যাসের প্রণীত ধৰ্ম্ম- সংহিতাতে এ বিষয়ের মীমাংসা আছে। যথা,

শ্রুতিস্মৃতিপুরাণানাং বিরোধো যত্র দৃশ্যতে। তত্র শ্রৌতং প্রমাণন্ত তয়োর্দ্বৈধে স্মৃতিব্বরা। (৯) যে স্থলে বেদ স্মৃতি ও পুরাণের পরস্পর বিরোধ দৃষ্ট হইবেক, তথায় বেদই প্রমাণ; আর স্মৃতি ও পুরাণের পরস্পর বিরোধ হইলে, স্মৃতিই প্রমাণ। অর্থাৎ, যে স্থলে কোনও বিষয়ে, বেদে এক প্রকার বিধি আছে, স্মৃতিতে

অন্ত প্রকার, পুরাণে আর এক প্রকার, সে স্থলে কর্ত্তব্য কি, অর্থাৎ, ক্লোন শাস্ত্র অবলম্বন করিয়া চলা যাইবেক; কারণ, মনুষ্যের, পক্ষে তিনই শাস্ত্র; এক শাস্ত্র অবলম্বন করিয়া চলিলে, অন্য দুই শাস্ত্রের অবমাননা করা হয়; এবং শাস্ত্রের অবমাননা করিলে, মনুষ্য অধৰ্ম্মগ্রন্ত হয়। এই নিমিত্ত ভগবান্ বেদব্যাস মীমাংসা করিতেছেন, বেদ স্মৃতি ও পুরাণের পরস্পর বিরোধ হইলে, স্মৃতি ও পুরাণ অনুসারে না চলিয়া বেদ অনুসারে চলিতে হইবেক; আর স্মৃতি ও পুরাণের পরস্পর বিরোধ হইলে, পুরাণ অনুসারে না চলিয়া স্মৃতি অনুসায়ে চলিতে হইবেক। অতএব দেখ, প্রথমতঃ, বৃহন্নারদীয় ও আদিত্যপুরাণের বচনের যেরূপ তাৎপর্য্য ব্যাখ্যাত হইয়াছে, উদ্দ্বারা কোনও মতে বিধবাবিবাহের নিষেধ সিদ্ধ হইতেছে না; দ্বিতীয়তঃ, যদিই ঐ সমস্ত বচনকে কথঞ্চিৎ বিধবাবিবাহের নিষেধক বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে পার, তাহা হইলে পরাশরসংর্কিতার সহিত বৃহন্নারদীয় ও আদিত্যপুরাণের বিরোধ হইল; অর্থাৎ পরাশর কলি যুগে বিধবাবিবাহেরু বিধি দিতে ছেন, বৃহন্নারদীয় ও আদিত্যপুরাণ কলি যুগে বিধবাবিবাহের নিষেধ করিতেছেন। কিন্তু পরাশরসংহিতা স্মৃতি, বৃহন্নারদীয় ও আদিত্যপুরাণ পুরাণ। পুরাণকর্তা স্বয়ং ব্যবস্থা দিতেছেন, স্মৃতি ও পুরাণের পরস্পর বিরোধ হইলে, পুরাণ অনুসারে না চলিয়া স্থতি' অনুসারে, চলিতে, হইবেক। সুতরাং, বৃহন্নারদীয় ও আদিত্যপুরাণে যদিই 'বিধবাবিবাহের নিষের সিদ্ধ হয়, তথাপি তদনুসারে না চলিয়া, পরাশরসংহিতাতে বিধবাবিবাহের যে বিধি আছে, তদনুসারে চলাই কৃর্ত্তব্য স্থির হইতেছে। • অতএব, কলি যুগে বিধবাবিবাহ যে শাস্ত্রবিষ্টিত কর্তব্য কৰ্ম্ম, তাহা, নির্ব্বিাদে সিদ্ধ হইল। এক্ষণে, এই এক আপত্তি উত্থাপিত হইতে পারে, কলি যুগে বিধবাবিবাহ শাস্ত্র অনুসারে কর্তব্য কৰ্ম্ম হইলেও শিষ্টাচারবিরুদ্ধ বলিয়া অবলম্বন করা যাইতে পারে না। এই আপত্তির নিরাকরণ করিতে হইলে ইহারই অনুসন্ধান করিতে হইরেক, শিষ্টাচার কেমন স্থলে প্রমাণ বলিয়া অরলম্বিত হওয়া উচিত। ভগবান্ বশিষ্ঠ স্বীয় সংহিতাতে এ বিষয়ের মীমাংসা করিয়াছেন। যথা, 'লোকে প্রেত্য বা বিহিতো ধৰ্ম্মঃ। তদলাভে শিষ্টাচারঃ প্রমাণম্ (১০)

কি লৌকিক, কি পারলৌকিক, উভয় বিষয়েই শাস্ত্রবিহিত ধৰ্ম্ম অবলম্বনীয়; শাস্ত্রের বিধান না পাইলে, শিষ্টাচার প্রমাণ।

অর্থাৎ, শাস্ত্রে যে ধর্ম্মের বিধান আছে, মনুষ্যকে তাহা অবলম্বন করিয়াই চলিতে হইবেক; আর, যে স্থলে শাস্ত্রে বিধি অথবা নিষেধ নাই, অথচ শিষ্টপরম্পরাম কোনও কর্ম্মের অনুষ্ঠান চলিয়া আসিতেছে, তাদৃশ স্থলেই শিষ্টাচারকে প্রমাণ রূপে অবলম্বন করিয়া, সেই কর্মের অনু- ষ্ঠানকেশাস্ত্রবিহিত কর্ম্মের অনুষ্ঠানতুল্য জ্ঞান করিতে হইবেক। অন্তএব, যখন পরাশরসংহিতাতে কলি যুগে বিধবাবিবাহের স্পষ্ট বিধি দৃষ্ট হুইতেছে, তখন শিষ্টাচারবিরুদ্ধ বলিয়া বিধবাবিবাহকে অকর্ত্তব্য কৰ্ম্ম বলা কোনও ক্রমে শাস্ত্রসম্মত অথবা বিচীরসিদ্ধ হইতেছে না। বশিষ্ঠ, শাস্ত্রে বিধির অসত্তাব স্থলেই, শিষ্টাচারকে প্রমাণ বলিয়া অবলম্বন করার ব্যবস্থা দিয়াছেন। অতএব, কলি যুগে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম, এ ব্লিষয়ে আর কোনও সংশয় অথবা আপত্তি হইতে পারে না।

দুর্ভাগ্যক্রমে বাঁল্য কালে বাহারা বিধবা হইয়া থাকে, তাহারা যাবজ্জীবন যে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে, তাহা, যাঁহাদের কল্লা, ভগিনী, পুত্রবধূ প্রভৃতি অল্প বয়সে বিধবা হইয়াছেন, তাঁহারা বিলক্ষণ অনুভব করিতেছেন। কত শত শত বিধবারা ব্রহ্মচর্য্যনির্ব্বাহে অসমর্থ হইয়া ব্যভিচারদোষে দূষিত ও ভ্রূণহত্যাপাপে লিপ্ত হইতেছে; এবং পতিকূল পিতৃকুল ও মাঞ্ছকুল হুকুল কলঙ্কিত 'করিতেছে। বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত হইলে, অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণার নিবারণ, ব্যভিচারদোষের ও ভ্রূণহত্যাপাপের পরিহার, ও তিন কুলের কলঙ্কবিমোচন হইতে পারে। যাবৎ এই শুভকরী প্রথা প্রচলিত না হইতেছে, তাবৎ ব্যভিচারদোষের ও ভ্রূণ- হত্যাপাপের স্রোত, কলঙ্কের প্রবাহ, ও বৈধব্যযন্ত্রণার অনল, উত্তরোত্তর প্রবল হইতেই থাকিবেক।

পরিশেষে, সর্ব্বসাধারণের নিকট বিনয়বাক্যে আমার প্রার্থনা এই, আপনারা এই সমস্ত অনুধাবন করিয়া, এবং বিধবাবিবাহের শাস্ত্রীয়তা বিষয়ে যাহা প্রর্দশিত হইল, তাহার আষ্ঠোপান্ত বিশিষ্টরূপ আলোচনা, করিয়া দেখুন,

বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না।

কলিকাতা। সংস্কৃত বিদ্যালয়। ১৬ মাঘ। সংবৎ ১৯১১।

} শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্মা।

বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না।

দ্বিতীয় পুস্তক।

বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না, এই প্রস্তাব যৎকালে প্রথম প্রচারিত হয়, তৎকালে আমার এই দৃঢ় সংস্কার ছিল যে, এতদ্দেশীয় লোকে পুস্তকের নাম শ্রবণ ও উদ্দেশ্য অবধারণ মাত্রেই অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করিবেন, আস্থা বা আগ্রহ পূর্ব্বক গ্রহণ ও পাঠ করিবেন না; সুতরাং, পুস্তকের সঙ্কলন বিষয়ে যে পরিশ্রম করিয়াছি, সে সমুদয় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইবেক। কিন্তু, সৌভাগ্য ক্রমে, পুস্তক প্রচারিত হইবা মাত্র, লোকে এরূপ আগ্রহ প্রদর্শন পূর্ব্বক গ্রহণ করিতে আরম্ভ করিলেন যে, এক সপ্তাহের অনধিক কাল মধ্যেই, প্রথম মুদ্রিত দুই সহস্র পুস্তক নিঃশেষে পর্য্যবসিত হইয়া গেল। তদ্দর্শনে উৎসাহান্বিত হইয়া আমি আর তিন সহস্র পুস্তক মুদ্রিত করি। তাহারও অধি- কাংশই, অনধিক দ্বিবসে, বিশেষ ব্যগ্রতা প্রদর্শন পূর্ব্বক পরিগৃহীত হয়। যখন এইরূপ গুরুতর আগ্রহ সহকারে সর্ব্বত্র পরিগৃহীত হইয়াছে, তখন এই প্রস্তাবের' সঙ্কলন বিষয়ে য়ে পরিশ্রম করিয়াছিলাম, আমার সেই পরিশ্রম সম্পূর্ণ সফল হইয়াছে, সন্দেহ নাই।

আহলাদের বিষয় এই যেঃ কি বিষয়ী, কি শাস্ত্রব্যবসায়ী, অনেকেই • অনুগ্রহ প্রদ্বর্শন পূর্ব্বক, উক্ত প্রস্তাবের উত্তর লিখিয়া, মুদ্রিত করিয়া, সর্ব্বসাধারণের গোচরার্থে প্রচারিত করিয়াছেন। যে বিষয়ে সকলে অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করিবেন বলিয়া আমার স্থির সিদ্ধান্ত ছিল, দেই বিষয়ে অনেকে শ্রম ও ব্যয় স্বীকার করিলেন, ইহা অল্প আহ্লাদের বিষয় নহে। বিশেষতঃ, উত্তরদাতা মহাশয়দিগের মধ্যে অনেকেই পদ বিভব ও পাণ্ডিত্য বিষয়ে এতদ্দেশে প্রধান ৰলিয়া গণ্য। যখন এই প্রস্তাব প্রধান প্রধান লোকদিগের পাঠযোগ্য বিচারযোগ্য ও উত্তর- দানযোগ্য হইয়াছে, তখন 'ইহা অপেক্ষা, আমার ও আমার ক্ষুদ্র। প্রস্তাবের পক্ষে অধিক সৌভাগ্যের বিষয় আর কি ঘটিতে পারে।

কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই যে, যে সকল মহাশয়েরা উত্তরদানে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, কি প্রণালীতে এরূপ গুরুতর বিষয়ের বিচার করিতে হয়, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই তাহা বিশিষ্টরূপ অবগত নহেন। কেহ কেহ, বিধবাবিবাহ শব্দ শ্রবণ মাত্রেই, ক্রোধে অধৈর্য্য হইয়াছেন; এবং বিচারকালে ধৈর্য্যলোপ হইলে তত্বনির্ণয়কল্পে যে অল্প দৃষ্টি থাকে, অনেকের উত্তরেই তাহার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। কেহ কেহ, • স্বেচ্ছা পূর্ব্বক, যথার্থ অযথার্থ বিচারে পরাম্মুখ হইয়া, কেকস কতকগুলি অলীক অমূলক আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহারা যে অভিপ্রায়ে তদ্রূপ আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন, তাহা এক প্রকার সফল হুইয়াছে, বলিতে হইবেক। যেহেতু, এতদ্দেশীয় অধিকাংশ লোকই শাস্ত্রজ্ঞ নহেন; সুতরাং, শাস্ত্রীয় কথা উপলক্ষে দুই পক্ষে বিচার উপস্থিত হইলে, উভয়পক্ষীয় প্রমাণ প্রয়োগের বলাবল বিবেচনা করিয়া তথ্যাতথ্য নির্ণয়েও সমর্থ নহেন। তাঁহারা যে কোনও প্রকার আপত্তি দেখিলেই সংশয়ারূঢ় হইয়া থাকেন। প্রথমতঃ, অনেকেই, আমার লিখিত প্রস্তাব পাঠ করিয়া, প্রস্তাবিত বিষয় শাঁস্ত্রসম্মত বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন'; পরে, 'কয়েকটি আপত্তি দর্শন করিয়াই, ঐ বিষয়কে এক বারেই নিতান্ত শাস্ত্রবিরুদ্ধ বলিয়া স্থির করিয়াছেন। অধিকন্তু, বিষয়ী লোকেরা সংস্কৃতজ্ঞ নহেন; সুতরাং সংস্কৃত বচনের স্বয়ং অর্থগ্রহ ও তাৎপর্য্য অবধারণ করিতে পারেন না। তাঁহাদের বোধার্থে ভাষায় অর্থ লিখিয়া দিতে হয়। সেই অর্থের উপর নির্ভর করিয়া তাঁহারা তথ্যাতথ্য নির্ণয় করিয়া থাকেন। এই সুযোগ দেখিয়া, অনেক মহাশয়ই, স্বীয় স্মৃভিপ্রেত সাধনার্থে, অনেক স্থলেই স্বম্বন্বত বচনের বিপরীত অর্থ লিখিয়াছেন, এবং সংস্কৃতানভিজ্ঞ পাঠকবর্গও তাঁহাদের লিখিত অর্থকেই প্রকৃত অর্থ বলিয়া স্থির করিয়াছেন। এ বিষয়ে তাদৃশ পাঠকবর্গকে দোষ দিতে পারা যায় না; কারণ, কোনও ব্যক্তি ধর্ম্মশাস্ত্রের বিচারে *প্ররত্ত হইয়া, ছল' ও কৌশল অবলম্বন পূর্ব্বক, মুনিবাক্যের বিপরীত ব্যাথ্যা লিখিয়া, সর্ব্ব সাধারণের গোচরার্থে অনায়াসে ও অক্ষুব্ধ. চিত্তে প্রচার করিবেন, কেহ আপাতঃ এরূপ বোধ করিতে পারেন না।

অধিক আক্ষেপের বিষয় এই যে, উত্তরদাতা মহাশয়দিগের মধ্যে অনেকেই উপহাসরসিক ও কটুক্তিপ্রিয়। এদেশে উপহাস ও কটূক্তি যে ধৰ্ম্মশাস্ত্রবিচারের এক প্রধান অঙ্গ, ইহার পূর্ব্বে আমি অবগত জ্বিলাম না। যাহা হউক, সকলের এক প্রকার প্রবৃত্তি নহে; সুতরাং, সকলেই এক প্রণালী অবলম্বন করেন নাই। প্রকৃতিবৈলক্ষণ্য প্রবৃত্তি- ভৈদের প্রধান কারণ। কিন্তু, এরূপ গুরুতর বিষয়ে স্ব স্ব প্রকৃতি অনুসারে প্রণালীভেদ অবলম্বন না করিয়া, যেরূপ বিষয় তদনুরূপ প্রণালী অবলম্বন করাই শ্রেয়ঃ কল্প ছিল। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, হাঁহার উত্তরে যে পরিমাণে পরিহাসবাক্য ও কটূক্তি আছে, তাঁহার উত্তর সেই প্লরিমাণে অনেক্রের নিকট আদরণীয় হইয়াছে। অনেকের এবংবিধ উত্তরদান প্রণালী দর্শনে আমার অন্তঃকরণে প্রথমতঃ অত্যন্ত ক্ষোভ জন্মিয়াছিল; কিন্তু, একটি উত্তর পাঠ করিয়া আমার সকল ক্ষোভ এক কালে দূরীভূত হইয়াছে। উল্লিখিত উত্তরে লেখকের নাম নাই; এক বর ঐ উত্তর লিখিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই বর, বয়সে বৃদ্ধ ও সর্ব্বত্র সর্ব্বপ্রধান বিজ্ঞ বলিয়া' বিখ্যাত হইয়াও, উত্তরপুস্তকে মধ্যে মধ্যে উপহাসঙ্গসিকতা ও কটূক্তিপ্রিয়তা প্রদর্শন করিয়াছেন। সুতরাং, আমি সিদ্ধান্ত করিয়াছি, ধৰ্ম্মশাস্ত্রবিচারে প্রবৃত্ত হইয়া, বাদীর প্রতি উপহাসবাক্য ও কটূক্তি প্রয়োগ করা এ দেশে বিজ্ঞের লক্ষণ। অবিজ্ঞের লক্ষণ হইলে, যাঁহাকে দেশশুদ্ধ লোকে একবাক্য হইয়া, সর্ব্বপ্রধান বিজ্ঞ বলিয়া, ব্যাখ্যা করে, সেই মহাশুভর বৃদ্ধ মহাশয় কখনও ঐ প্রণালী অবলম্বন করিতেন না।

.. কিন্তু যিনি যে প্রণালীতে উত্তর প্রদান করুন না কেন, আমি উত্তরদাতা মহাশয়দিগের সকলের নিকটেই আপনাকে যৎপরোনাস্তি উপকৃত স্বীকার করিতেছি, এবং তাঁহাদের সকলকেই মুক্ত কণ্ঠে সহস্র সাধুবাদ দিতেছি। তাঁহারা পরিশ্রয় স্বীকার করিয়া উত্তরদানে প্রবৃত্ত না হইলে ইহাই প্রতীয়মাণ, হইত, এতদ্দেশীয় পণ্ডিত ও প্রধান মহাশরেরা প্রস্তাবিত বিষয় অগ্রাহ্য করিয়াছেন। তাঁহাদের উত্তরদান দ্বারা অন্ততঃ ইহা বিলক্ষণ সপ্রমাণ হুইয়াছে যে, এই প্রস্তাব এরূপ নহে যে এক বারেই উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করিয়া নিশ্চিন্ত থাকা যাইতে পারে। তাঁহারা অগ্রাহ্য করিয়া উত্তর না দিয়া নিশ্চিন্ত থাকিলে, আমি কত ক্ষোভ পাইতাম, বলিতে পারি না। তাঁহারা, আমার লিখিত প্রস্তাবকে অশাস্ত্রীয় বলিয়া সপ্রমাণ করিবার নিমিত্ত, যে কিছু প্রমাণ প্রয়োগ পাওয়া যাইতে পারে, সবিশেষ পরিশ্রম ও সবিশেষ অনুসন্ধান সহকারে, স্ব স্ব পুস্তকে সে সমস্ত উদ্ধৃত করিয়াছেন। যখন নানা ব্যক্তিতে, নানা প্রণালীতে, যত দূর পারেন, আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন, তখন, বিধবাবিবাহের অশাস্ত্রীয়তা পক্ষে যাহা কিছু বলা যাইতে পারে, তাহার এক প্রকার শেষ হইয়াছে, বলিতে হইবেক। এক্ষণে, সেই কয়েকটি আপত্তির মীমাংসা হইলেই, কলি যুগে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রীয় কি না, সে বিষয়ের সকল সংশয় নিরাকৃত হইতে পারিবেক।

প্রতিবাদী মহাশয়েরা স্ব স্ব উত্তরপুস্তকে বিস্তর কথা লিখিয়াছেন; কিন্তু সকল কথাই প্রকৃত বিষয়ের উপযোগিনী নহে। যে সকল কথা প্রকৃত বিষয়ের উপযোগিনী বোধ হইয়াছে, সেই সুরুল কথার যথাশক্তি প্রত্যুত্তয় প্রদানে প্রবৃত্ত হইলাম। আমি এই প্রত্যুত্তর প্রদান বিষয়ে বিস্তর যত্ন ও বিস্তর পরিশ্রম করিয়াছি। পাঠকবর্গের নিকট বিনয়বাক্যে প্রার্থনা এই, তাঁহারা যেন, অনুগ্রহ প্রদর্শন পূর্ব্বক, নিবিষ্ট চিত্তে, এই প্রত্যুত্তর পুস্তক অন্ততঃ এক বার আঘোপান্ত পাঠ করেন, তাহা হইলেই আমার সকল যত্ন ও সকল শ্রম সফল হইবেক।

১-পরাশরবচন

বিবাহিতাবিষয়, বাগ্দত্তাবিষয় নহে।

কেহ কেহ মীমাংসা করিয়াছেন, পরাশরসংহিতার বিবাহবিধায়ক বচনের অভিপ্রায় এই যে, যঙ্গি বাগদত্তা ক্যার বর অনুদ্দেশাদি হয়, তাহা হইলে তাহার পুনরায় অন্ত্য বরের সহিত বিশ্বাহ হইতে পারে; নতুবা, বিবাহিতা বিধবা প্রভৃতি, স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহ হইতে পারে, এরূপ অভিপ্রায় কদাচ নহে। (১)

• এ স্থলে এই বিবেচনা করা আবশ্যক, প্রতিবাদী মহাশয়দিগের এই মীমাংসা সঙ্গত হইতে পারে কি না। পরাশর লিখিয়াছেন,,

নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ। পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরণ্যো বিধীয়তে ॥

স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, ক্লীব স্থির হইলে, সংসারধর্ম পরিত্যাগ করিলে, অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহ শাস্ত্রবিহিত।

(১) ১ আগড়পাড়ানিবাসী শ্রীযুত মহেশচন্দ্র চূড়ামণি।

২ কোননগরনিবাসী

শ্রীযুত দীনবন্ধু ক্যায়াত্ব।

৩ কাশীপুরনিবাসী"

শ্রীযুত শশিজীবন তর্করত্ব।

শ্রীযুত জানকীজীবন ্যায়রত্ব।

৪ আরিয়াদহনিবাসী

শ্রীযুত শ্রীরাম তর্কালঙ্কার।

• পুটিয়ানিবাসী

শ্রীযুত ঈল্লানচন্দ্র "বিদ্যাবাগীশ।

৬ সয়দাবাদনিবাসী

শ্রীযুত গোবিন্দকান্ত বিদ্যাভূষণ।

শীয়ত কষ্ণমোচন আায়পঞ্চানন।

শ্রীযুত রামগোপাল তর্কালঙ্কার।

শ্রীযুত মাধবরাম ন্যায়রত্ন।

শ্রীযুত রাধাকান্ত তর্কালঙ্কার।

৭ জনাইনিবাসী

শ্রীযুত জগদীশ্বর বিদুরত্ব।

৮ আন্দুলীয় রাজসভার সভাপণ্ডিত

শ্রীযুত রামদাস তর্কসিদ্ধান্ত।

৯ ভবানীপুরনিবাসী

শ্রীযুত প্রসন্নকুমার মুখোপাধ্যায়। ১০ শ্রীযুত নন্দকুমার কবিরত্ব।

শ্রীযুত আনন্দচন্দ্র শিরোমণি।

শ্রীযুত গঙ্গানারায়ণ ্যায়বাচস্পতি। শ্রীযুত হারাধন কবিরাজ।

পরাশর এই ঘচনে যে সকল শব্দের বিন্যাস করিয়াছেন, তত্তং শব্দের প্রকৃত অর্থ অনুসারে, উক্ত পঞ্চপ্রকার আপদ ঘটিলে, বিবাহিতা স্ত্রী পুনরায় বিবাহ করিতে পারে, এই অভিপ্রায়' স্বভাবতঃ প্রতীয়মান হর, কষ্ট কল্পনা দ্বারা শব্দের অর্থান্তর কল্পনা না করিলে, অভিপ্রায়ান্তর প্রতিপন্ন হইতে পারে না। বিশিষ্ট হেতু ব্যতিরেকেও শব্দের সহজ অর্থ পরিত্যাগ করিয়া, কষ্ট কল্পনা দ্বারা অর্থান্তর কল্পনা করা যায় না। কিন্তু এ স্থলে তাদৃশ কোনও বিশিষ্ট হেতু উপলব্ধ হইতেছে না। এই নিমিত্ত, ভাষ্যকার' আাধবাচার্য্য, বিধবাবিবাহের বিদ্বেষী হইয়াও, পরাশরবচনকে বিধবা প্রভৃতি বিবাহিতা স্ত্রীর বিবাহবিধায়ক বলিয়া অঙ্গীকার করিয়াছেন। যথা,

পরিবেদনপর্য্যাধানয়োরিব স্ত্রীণাং পুনরুদ্বাহ্যাপি প্রসঙ্গাৎ কচিদভ্যনুজ্জাং দর্শয়তি নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ। পঞ্চস্বাগৎসু নারীণাং পতিরণ্যো বিধীয়তে ॥

পরিবেদন ও পর্য্যাধানের ্যায়, প্রসঙ্গক্রমে, কোনও দোনও স্থলে, স্ত্রীদিগের পুনব্বার বিবাহের বিধি দেখাইতেছেন,

স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, ক্লীব স্থির হইলে, "সংসারধর্ম পরিত্যাগ করিলে, অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহ করা শাস্ত্রবিহিত।

পুনরুদ্বাহমকৃত্বা ব্রহ্মচর্য্যব্রতানুষ্ঠানে শ্রেয়োহতিশয়ং দর্শয়তি মৃতে ভর্ত্তরি যা নারী ব্রহ্মচর্য্যে ব্যবস্থিতা। সা মৃতা লভতে স্বর্গং যথা তে ব্রহ্মচারিণঃ ।।

পুনর্ব্বার বিবাহ না করিয়া, ব্রহ্মচর্য্যব্রতের অনুষ্ঠানে অধিক ফল দেখাইতেছেন, যে নারী, স্বামীর মৃত্যু হইলে, ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করিয়া থাকে, সে দেহান্তে, ব্রহ্মচারীদিগের হ্যায়, স্বর্গ লাভ করে।

ব্রহ্মচর্য্যাদপ্যধিকং ফলমনুগমনে দর্শয়তি

তিস্রঃ কোটেন্টাহাকোটী চ যানি লোমানি মানবে।

তাবৎ কালং বসেৎ স্বর্গং ভুত্তারং যামুগচ্ছতি।

সহগমনে ব্রহ্মচর্য্য অপেক্ষাও অধিক ফল দেখাইতেছেন,

মনুষ্যশরীরে যে সার্দ্ধ ত্রিকোটি লোম আছে, যে নারী স্বামীর সহগমন করে, তৎসম কাল স্বর্গে বাস করে।

• পঞ্চাশরবচন, মাধবাচার্য্যের মতে, বিপ্লবী প্রভৃতি বিবাহিতা স্ত্রীর বিবাহবিধায়ক না হইলে, তিনি বিবাহ না করিয়া ব্রহ্মচর্য্য করিলে অধিক ফল, পর বচনের এরূপ আভাস দিতেন না; কারণ, পূর্ব্ব বচন দ্বারা বিধবা প্রভৃতি বিবাহিতা স্ত্রীর বিবাহবিধি প্রতিপন্ন না হইলে, বিবাহ না কুরিয়া ব্রহ্মচর্য্য করিলে, অধিক ফল, পর বচনের এই অগ্নভাস কি রূপে সঙ্গত হইতে পারে।

নারদসংহিতা দৃষ্টি করিলে, নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে এই বচনোক্ত বিবাহবিধি যে বাগদত্তা বিষয়ে কোনও ক্রমে সন্তবিতে পারে না, ত্বাহা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হইবেক। যথা,

নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ। পঞ্চস্বাস্থৎসু নারীণাং পতিরণ্যে। বিধীয়তে ॥ অস্ট্রেী বর্ষাণ্যপেক্ষেত ব্রাহ্মণী প্রোষিতং পতিম্।' অপ্রসূতা তু চত্বারি 'পরতোংন্যং সমাশ্রয়েৎ ॥ ক্ষত্রিয়া যট্ সমাস্তিষ্ঠেদপ্রসূতা সমাত্রয়ম্। বৈশ্য। প্রসূতা চত্বারি দ্বে বর্ষে দ্বিতরা বসেৎ ॥ ন শূদ্রায়াঃ স্মৃতঃ কাল এষ প্রোষিতযোষিতাম্। জীবতি ক্রয়মাণে.তু স্খাঁদেষ দ্বিগুণো বিধিঃ ॥ অপ্রবৃত্তৌ তু ভূতানাং দৃষ্টিরেখা প্রজাপতেঃ। অতোহ্যগমনে স্ত্রীণামেষ দোষো ন বিছাতে। (২) স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মারলে, ক্লীব স্থির হইলে, সংসারধর্ম্ম পরিত্যাগ করিলে, , অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহ শাস্ত্রবিহিত। স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, ব্রাহ্মণজাতীয়া স্ত্রী আট বৎসর প্রতীক্ষা করিবেক যদি সস্তাম না হইয়া থাকে, তবে চারি বৎসর; তৎপরে বিবাহ করিবেক। ক্ষত্রিয়জাতীয়া স্ত্রী ছয় বৎসর প্রতীক্ষা করিবেক। যদি সন্তান না হইয়া থাকে, তবে তিন বৎসর। বৈগুজ'তীয়া স্ত্রী, যদি সন্তান হইয়া থাকে, চারি বৎসর, নতুবা দুই বৎসর। শুদ্রজাতীয়া স্ত্রীর প্রতীহ'র কালনিয়ম নাই। অনুদ্দেশ সইলেও, যদি জীবিত আছে বলিয়া শুনিতে পাওয়া যায়, তাহা হইলে পূর্ব্বোক্ত কালের দ্বিগুণ কাল প্রতীক্ষা করিবেক। কোনও সংবাদ না পাইলে, পূর্ব্বোজ' কাল নিয়ম। প্রজাপতি ব্রহ্মার এই মত। অতএব, এমন স্থলে স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বায় বিবাহ করা দোষাবহ নহে।

নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে এই বচনে স্বামীর অনুদ্দেশ হওয়া প্রভৃতি পাঁচ প্রকার বৈগুণ্য ঘটিলে, স্ত্রীদিগের পক্ষে পুনর্ব্বার বিবাহের যে বিধি আছে, তাহা কোনও মতে বাগদত্তা বিষয়ে সম্ভবিতে পারে না। কারণ, অনুদ্দেশ স্থলে, সন্তান হইলে এক প্রকার কালনিয়ম, আর সন্তান না হইলে আর এক প্রকার কালনিয়ম, দৃষ্ট হইতেছে। বাগদত্তা বিষয়ে এই বিবাহবিধি হইলে, সন্তান হওয়া না হওয়া এ কথার উল্লেখ কি প্রকারে সম্ভব হইতে পারে। যদি বল, নারদসংহিতার বচন বিধবা প্রভৃতি বিবাহিতা স্ত্রীর বিবাহপ্রতিপাদক হইতেছে বটে, কিন্তু নারদসংহিতা সত্য যুগের শাস্ত্র, কলি যুগের শাস্ত্র নহে; সুতরাং, তদ্বারা কলি যুগে বিধবা প্রভৃতি বিবাহিতা স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহ সিদ্ধ হইতে পারে না। এ বিষয়ে আমার বক্তব্য এই যে, নারদসংহিতা দ্রুত্য যুগের শাস্ত্র, যথার্থ বটে। কিন্তু নারদবচনে যে কুয়েকটি শব্দ আছে, পরাশরবচনেও অবিকল সেই কয়েকটি শব্দ আছে; সুতরাং, নারদবচন দ্বারা যে অর্থ প্রতিপন্ন হইবেক, পরাশরবচন দ্বারাও অবশ্য সেই অর্থই প্রতিপন্ন হইবেক। ইহা কেহই প্রতিপন্ন করিতে পারিবেন না, যুগভেদে অর্থভেদ হয়। সত্য যুগে যে শব্দের যে অর্থ ছিল, কলি যুগেও সেই শব্দের সেই অর্থই থাকিবেক, সন্দেহ নাই। সুতরাং, নারদবচনে ও পরাশরবচনে যখন শব্দাংশে বিন্দু বিসর্গেরও ব্যত্যয় নাই, তখন অর্থাংশেও কোনও ব্যত্যয় ঘটিতে পারে না। ফলতঃ, নষ্টে, মৃতে প্রব্রজিতে এই বচন উজ্জ সংহিতাতেই একরূপ আছে, সুতরাং উভয় সংহিতাতেই নিঃসন্দেহ একরূপ অর্থের প্রতিপাদক হইবেক, তদ্বিষয়ে বিপ্রতিপত্তি করিতে উত্থত হওয়া কেবল অপ্রতিপত্তি লাভ প্রয়াস মাত্র। অতএব নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে এই বচনোক্ত বিবাহবিধি য়ে, ক্লাঁদত্তা কন্যা বিষয়ে ঘাটতে পারে না, তাহা নিঃসংশয়ে প্রতীয়মান হইতেছে।

যাঁহারা পরাশরের বিবাহবিধায়ক বচনকে বাঙ্গত্তাবিষয় বলিয়া ব্যবস্থা করিবার প্রয়াস পান, তাঁহাদের অভিপ্রায় এই যে, কোনও কোনও বচনে বিবাহিতা স্ত্রীর বিবাহ নিষিদ্ধ দৃষ্ট হইতেছে, পরাশরের বচনকে বিবাহিতা স্ত্রীর বিবাহবিধায়ক বলিলে, ঐ সকল বচনের সঙ্গিত্ব বিরোধ হয়; কিন্তু বাগদত্তার বিবাহের বিধি নানা বচনে প্রতিপাদিত দৃষ্ট হইতেছে; সুতরাং, পূর্ব্বোক্ত বিরোধ পরিহারার্থে, বাগদত্তাবিবাহবিধায়ক বচনসমূহের সহিত একবাক্যতা করিয়া, পরাশর বচনকে বান্দত্তাবিষয় বলিয়া ব্যবস্থা করিতে হইবেক। তাঁহাদের মতে, এইরূপ ব্যবস্থা করিলেই, সকল বচনের সহিত ঐক্য ও অবিরোধ হয়। পরাশরবচনকে বাগদত্তাবিষয় বলিলেই, সকল বচনের সহিত অনিরোধ ও ঐক্য হইল, এই স্থির করিয়া প্রতিবাদী মহাশয়েরা পরাশরবচনের বিধবাবিবাহবিধায়কত্ব খণ্ডন করিয়াছেন। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁহাদের প্রতি আমার বক্তব্য এই যে, যেমন কোনও কোনও বচনে বিবাহিতার পুনর্ব্বার বিবাহের নিষেধ দৃষ্ট হইতেছে, সেইরূপ কাশ্যপবচনে বান্দত্তারও • পুনর্ব্বার বিবাহের নিষেধ দুষ্ট হইতেছে। যথা,

সপ্ত পৌনর্ভবাঃ ক্যা বর্জনীয়াঃ কুলাধমাঃ । বাচা দত্তা মনোদত্তা কৃতকৌতুকমঙ্গলা। উদকস্পর্শিতা যাচ. যা চ পাণিগৃহীতিকা। অগ্নিং পরিগতা যা চ পুনৰ্ভূপ্রভবা চ যা। ইত্যেতাঃ কাশ্যপেনোক্তা দহন্তি কুলমগ্নিবৎ ॥ (৩)

• বাগদত্তা অর্থাৎ যাহাকে বাক্য দ্বারা দান করা গিয়াছে, মনোদত্তা অর্থাৎ যাহাকে মনে মনে দান করা গিয়াছে, কৃতকৌতুকমঙ্গলা অর্থাৎ যাহার হস্তে বিবাহসূত্র বন্ধন করা গিয়াছে, উদকস্পর্শিতা অর্থাৎ যাহাকে দান করা গিয়াছে, পাণিগৃহীতিক। অর্থাৎ যাহার পাণিগ্রহণ সম্পন্ন হইয়াছে, অগ্নিংপরিগতা 'অর্থাৎ যাহার কুশণ্ডিকা হইয়াছে, আর পুনভূপ্রভবা অর্থাৎ পুনর্ভুর গর্ভে যাহার জন্ম হইয়াছে, কুলের অধম এই সাত পুনৰ্ভূ কক্সা বর্জনী করিবেক। এই সাত কান্তপোক্ত কন্যা, বিবাহিতা হইলে, অগ্নির হ্যায়, পতিকুল দগ্ধ করে।

দেখ, কাশ্যপ যখন বাগদত্তা ক্যাকেও বিবাহে বুর্জনীয়াপক্ষে নিক্ষিপ্ত করিতেছেন ও পুনর্ভূসংজ্ঞা দিতেছেন, তখন বাগ্দত্তারও বিবাহ সুতরাং নিষিদ্ধ হইয়া উঠিতেছে। কাশ্যপ বাগ্ঙ্গত্তা ও. বিবাহিতা উভয়কেই তুল্য রূপে বর্জন করিবার, বিধি দিতেছেন। যদি, কোনও বচনে বিবা- হিতার পুনর্ব্বার বিবাহের, নিষেধ আছে বলিয়া, পরাশরবচনকে বিবাহিতার পুনর্ব্বার বিবাহবিধায়ক বলা যাইতে না পারে, তবে কাশ্যপবচনে বাগ্দত্তার পুনর্ব্বার বিবাহের নিষেধ সত্ত্বে, বাগ্দত্তারই পুনর্ব্বার বিবাহবিধায়ক কি রূপে বলা যাইতে পারে। অতএব, বাগদত্তাবিষয় বলিয়া ব্যবস্থা করিলেই, সকল বচনের ঐক্য ও অবিরোধ কি রূপে হইল।

যদি এ বিষয়ে সকল বচনের ঐক্য ও অবিরোধ করিতে হয়, তাহা হইলে, পূর্ব্বোক্ত প্রকারে প্রয়াস না পাইয়া, নিম্নলিখিত প্রকারে চেষ্টা করাই যুক্তিসিদ্ধ বোধ হইতেছে।

কাশ্যপ প্রভৃতির বচনে এ বিষয়ে যে 'সকল বিধি অথবা নিষেধ। আছে, তাহাতে কোনও যুগের কথা বিশেষ করিয়া নির্দিষ্ট নাই।' সুতরাং, সকল যুগের পক্ষে সে সামান্ত বিধি অথবা সামান্য নিষেধ হইতেছে। এ বিষয়ে কলি যুগের উল্লেগ করিয়া যে বিধি অথবা নিষেধ আছে,, তাহা কলি যুগের পক্ষে বিশেষ বিধি অথবা বিশেষ নিষেধ হইতেছে। যখন কলি যুগের জন্যে এ বিষয়ে বিশেষ বিধি অথবা বিশেণ। নিষেধ স্বতন্ত্র পাওয়া যাইতেছে, তখন সামান্য বিধি নিষেধের সহিত বিশেষ, বিধি নিষেধের ঐক্য ও অবিরোধের প্রয়াস পাওয়া অনাবশ্বক; কারণ, বিশেষ বিধি নিষেধ দ্বারা সামান্য বিধি নিষেধের বাধই প্রসিদ্ধ আছে। অতএব, এ বিষয়ে যে সকল শাস্ত্রে কলি যুগের উল্লেখ করিয়া বিধি অথবা নিষেধ আছে, তাহাদেরই ঐক্য ও অবিরোধ সম্পাদনে যত্ন পাওয়া উচিত; এবং সেই বিধি নিষেদের ঐক্য ও অবিরোধ সিদ্ধ হইলেই, কলি যুগে বিধবা প্রভৃতি স্ত্রীদিগের বিবাহ বিহিত মুখবা নিষিদ্ধ, তাহা স্থির হইতে পারিবেক।

প্রথমতঃ, যে সকল শাস্ত্রে কলি যুগে বিবাহিতা স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহ নিষিদ্ধ আছে, তাহা নির্দিষ্ট করা যাইতেছে। যথা,

আদিপুরাণ।

উড়ায়াঃ পুনরুদ্বাহং জ্যেষ্ঠাংশং গোবধং তথা। কুলো পঞ্চ ন কুব্বীত ভ্রাতৃজায়াং কমণ্ডলুম্ (৪)

বিবাহিতা স্ত্রীর বিবাহ, জ্যেষ্ঠাংশ, গোবষ, ভ্রাতৃভাৰ্য্যায় পুত্রোৎপাদন, কমণ্ডলু ধারণ, কলি যুগে এই পাঁচ কৰ্ম্ম করিবেক না।

ক্রতু।

দেররাচ্চ সুতোৎপত্তির্দা কন্যা ন দীয়তে। ন যজ্ঞে গোবধঃ কার্য্যঃ কলৌ নচ কমণ্ডলুঃ । (৫)

দেবর দ্বারা পুদ্রোৎপাদন, দত্তা কঞ্চার দান, যজ্ঞে গোবধ, এবং কমণ্ডলুধারণ কলি যুগে করিবেকা।

বৃহন্নারদীয়।

দত্তায়াশ্চৈব কন্যায়াঃ পুনর্দানং পরস্য চ। কলি যুগে দত্তা কস্তাকে পুনরায় অন্ত পাত্রে দান করিবেক না।

আদিত্যপুরাণ।

দত্তা কন্যা প্রদীয়তে। -

কলি যুগে দত্তা কল্পার পুনর্দান নিষিদ্ধ। এই রূপে আদিপুরাণ, ক্রধুসংহিতা, বৃহন্নারদীয় ও আদিত্য পুরাণে সামান্তাকারে বিবাহিতা স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহ নিষিদ্ধ দৃষ্ট হইতেছে। (৬) কিন্তু পরাশরসংহিতাতে,

নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লাবে চ পতিতে পতো। পঞ্চস্বাপৎশু নারীণাং পতিরণ্যো বিধীয়তে।

স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, সংসারধৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিলে, ক্লীব স্থির হইলে, ও পতিত হইলে, স্ত্রীদিগের পুনব্বার বিবাহ শাস্ত্রবিহিত। এই রূপে পাঁচ স্থলে বিবাহিতা স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহ বিহিত দৃষ্ট হইতেছে।

এক্ষণে, কলি যুগে বিবাহিতা স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহের বিধি ও নিষেধ উভয়ই প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে। সকল বচনের ঐক্য ও অবিরোধ করিতে হইলে, আমার মতে এইরূপ মীমাংসা করা কর্তব্য। যথা,- আদিপুরাণ প্রভৃতিতে সামান্তাকারে বিবাহিতার বিবাহ নিষিদ্ধ হইয়াছে; পরাশর অনুদ্দেশ প্রভৃতি স্থলে তাহার প্রতিপ্রসব করিতেছেন; 'অর্থাৎ,' আদিপুরাণ প্রভৃতিতে সামান্তাকারে কলি যুগে বিবাহিতা স্ত্রীর বিবাহের নিষেধ করিতেছেন; কিন্তু পরাশর, পাঁচটি স্থল ধরিয়া, কলি যুগে বিবাহিতা স্ত্রীর বিবাহের বিধি দিতেছেন। সুতরাং, আদিপুরাণ প্রভৃতিতে সামান্তাকারে নিষেধ থাকিলেও, পরাশরের বিশেষ বিধি' অনুসারে, ঐ পাঁচ স্থলে বিবাহ হইতে পারিবেক; ঐ পাচ ভিন্ন অন্ত স্থলে আদিপুরাণ প্রভৃতির নিষেধ থাটিবেক। সামান্য বিধি নিষেধ ও বিশেষ, বিধি নিষেধ স্থলের নিয়মই এই যে, বিশেষ বিধি নিষেধের অতিরিক্ত স্থলে সামান্ত বিধি নিষেধ খাটিয়া থাকে। সুতরাং, পরাশর কলি যুগে, যে পাঁচ স্থলের উল্লেখ করিয়া, বিবাহিতা স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহের বিবি দিতেছেন, তথায় ঐ বিধি প্রতিপালন করিতে হইবেক, তদতিরিক্ত স্থলে, অর্থাৎ স্বামী দুঃশীল ছাতরিত্র অথবা নির্গুণ হইলে ইত্যাদি স্থলে, "আদিপুরাণ প্রভৃতির নিষেধ প্রতিপালন করিয়া চলিতে হইবেক; অর্থাৎ সেই সেই স্কুলে বিবাহিতা স্ত্রীর পুনরায় বিবাহ হইতে পারিবেক না। এইরূপ মীমাংসা করিলে, বিধি ও নিষেধ উভয়েরই স্থল থাকিতেছে, কাহারও বৈয়া ঘাটতেছে না। দেখ, প্রথমতঃ,

স তু যদ্যন্যজাতীয়ঃ পতিতঃ ক্লীব এব বা। বিকৰ্ম্মস্থঃ সগোত্রো বা দাসো দীর্ঘাময়োহপি বা ॥ উঢ়াপি দেয়া সান্যস্মৈ সহাভরণভূষণা। (৭).

যাহার সহিত বিবাহ দেওয়া যায়, সে ব্যক্তি যদি অন্তজাতীয়, পতিত, রীব, যথেচ্ছাচারী, সগোত্র, দাস, অথবা চিররোগী হয়, তাহা হইলে, বিবাহিতা ক্যাকেও, বস্ত্রালঙ্কারে ভূষিতা করিয়া, পুনরায় অন্য পাত্রে সম্প্রদান করিবেক।

'কুলশীল্ববিহীনস্থ্য পণ্ডাদিপত্বিত্য চ। অপস্মারিবিধৰ্ম্ম্য রোগিণাং বেশধারিণাম্। দত্তামপি হরেৎ ক্যাং সগোত্রোঢ়াং তথৈব চ । (৮)

কুলশীলবিহীন, ক্লীবাদি পত্বিত, অপমাররোগগ্রস্ত, যথেচ্ছাচারী, চিররোগী অথবা বেশধারী, এরূপ ব্যক্তির সহিত যে ক্যার বিবাহ দেওয়া যাঁয়, তাহাঁকে এবং সগোত্র কর্তৃক বিবাহিতা কন্যাকে হরণ কত্ত্বিবেক, অর্থাৎ পুনরায় অন্য ব্যক্তির সহিত সেই কন্যার বিবাহ দিবেক। (৯)

নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।

পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতির্যো বিধীয়তে । (১০)

কুলশীলবিহীনঙ্গ পণ্ডাদিপতিতন্ত চ।

অপম্মারিবিধৰ্ম্মন্ত। রাগিণাং বেশধারিণাম্। দত্তামপি হরেৎ কন্যাং সগোত্রোড়াং তথৈব চ।

এই বচন কি বলিয়া বান্দত্তা বিষয়ে ব্যাখ্যা করিয়াছেন, বুঝিতে পারিলাম না। এ বচনের অর্থ এই যে, ক্লেশীলবিহীন, ক্লীব, পতিত প্রভৃতিকে দত্তা হইলেও, কন্যাকে তাদৃশ ব্যক্তি হইতে হরণ করিবেক, অর্থাৎ পুনরায় অন্য ব্যক্তির সহিত সেই কন্যার বিবাহ দিবেক, এবং সগোত্র কর্তৃক উঢ়া কন্যাকেও হরণ করিবেক। কুলশীলহীনাদি স্থলে দত্তা পদ আছে, সুতরাং সে স্কুলে বান্দত্তা বুঝাইতে পারে কিন্তু, সগোত্র কর্তৃক উড়াকে হরণ করিবেক, এ স্থলে উড়া শব্দেও কি বান্দত্তা বুঝাইবেক। দত্তা শব্দে বাপত্তা ও বিবাহিতা উভয়ই বুঝাইতে পারে; কিন্তু উঢ়া শব্দে কোনও কালে বিবাহ নংস্কৃতা ভিন্ন বান্দত্তা বুঝাইতে পারে না। যখন এই বচনের এক স্বণে স্পষ্ট উড়া শব্দ আছে, তখন স্থলাস্তরের দত্তা শব্দেও বিবাহিতা বুঝিতে হইবেক। সুতরাং, এই বচন বিবাহিতা স্ত্রীর বিষয়ে ঘটিতেছে, বান্দত্তার বিষয়ে ঘটিতে পারে না। ন্যায়রত্ন মহাশয় স্বপ্রকাশিত বিধবাবিবাহবাদ পুস্তকের প্রথম খণ্ডে এই বচনের অর্থ লিখেন নাই, কিন্তু, বিধবাবিবাহের অশাস্ত্রীয়তা প্রতিপাদনার্থে, সংবাদজ্ঞানোদয় পত্রে যে প্রস্তাব প্রচার করিয়াছেন, তাহাতে এই বচনের নিম্ননিদ্দিষ্ট ব্যাখ্যা লিখিয়াছেন। যথা,

বান্দানানস্তর, বরের কুল নাই শ্রবণ করিলে, ও শীলতা নাই শ্রবণ করিলে, ও পত্তাদি দোষ জ্ঞাত হইলে, ও পতিত জ্ঞাত হইলে, ও অপন্মারি ও পতিত জানিতে পারিলে, ও কোনও রোগবিশিষ্ট জ্ঞান হইলে, ও বেশধারী অর্থাৎ নেটো জানিতে পারিলে, ও সগোত্র জ্ঞান হইলে, সেই কন্যাকে পিতা অন্য বরকে দিবেন ইতি তাৎপর্য্যার্থ।

এ স্থলে ন্যায়রত্ন মহাশয়, ফগোত্রোঢ়া শব্দের উঢ়া শব্দটি গোপনে রাখিয়া, কেবল সগোত্র এই মাত্র অর্থ লিখিয়াছেন। যদি ভ্রমক্রমে সগোত্রোঢ়া শব্দের সগোত্র এই অর্থ লিখিয়া থাকেন, তবে বিশেষ দোষ দিতে পারা যায় না। কিন্তু, যদি অভিপ্রেত অর্থ সিদ্ধ করিবার বাসনায়, ইচ্ছা পূর্ব্বক উঢ়। শব্দের গোপন করিয়া থাকেন, তাহা হইলে অতি অন্যায় কৰ্ম্ম হইয়াছে।

(১০) নারদসংহিতা। দ্বাদশ বিবাদপদ।

স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, সংসারধর্ম পরিত্যাগ করিলে, ক্লীব স্থির হইলে, অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহ শাস্ত্রবিহিত।

এই রূপে, কাত্যায়ন, বশিষ্ঠ, নারদ, যুগবিশেষ নির্দেশ না করিয়া, সামান্ততঃ সকল যুগের পক্ষে পতি, পতিত, ক্লীব, অনুদ্দেশ, কুলশীলহীন, • যথেচ্ছাচারী, চিররোগী, অপন্থাররোগগ্রুত, প্রব্রজিত, সগোত্র, দাস, অন্তজাতীয় প্রভৃতি স্থির হইলে, অথবা মরিল্পে, বিবাহিতা স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহসংস্কারের অনুজ্ঞা দিতেছেন। তৎপরে,

উড়ায়াঃ পুনরুদ্বাহং জ্যেষ্ঠাংশং গোবধং তথা। "কলো পঞ্চ ন কুব্বীত ভ্রাতৃজায়াং কমণ্ডলুম্ ॥

বিবাহিতা স্ত্রীর বিবাহ, জ্যেষ্ঠাংশ, গোবধ, ভ্রাতৃভার্য্যায় পুত্রোৎপাদন, কমণ্ডলু- • ধারণ, কলি যুগে এই পাঁচ কর্ম্ম করিবেক না।

দেবরাচ্চ সুতোৎপত্তিদত্তা ক্য। ন দীয়তে। ন যজ্ঞে গোৰধঃ কাৰ্য্যঃ কলৌ নচ কমণ্ডলুঃ ॥

কলি যুগে দেবর দ্বারা পুত্রোৎপাদন, দত্তা কন্যার দান, যজ্ঞে গোবধ, এবং

কমণ্ডলুধারণ করিবেক না।

দত্তায়াশ্চৈর কন্যায়াঃ পুনর্দানং পরস্থচে।

কলি যুগে দত্ত। কন্যাকে পুনরায় অন্য পাত্রে দান করিবেক না। দত্তা কন্যা প্রদীয়তে। কলি যুগে দত্তা কন্যার পুনর্দান নিষিদ্ধ। এই রূপে, আদিপুরাণ প্রভৃতিতে সামান্যতঃ কলি যুগের পক্ষে বিবাহিতা

স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহ নিষেধ করিতেছেন। তদনন্তর পরাশর, নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ। পঞ্চস্বাপৎশু ক্বারীণাং পতির্যো বিধীয়তে ।

স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, সংসারধর্ম পরিত্যাগ করিলে, ক্লীব স্থির হইলে, অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহ শক্ষিবিহিত।

পাঁচটি স্থল ধরিয়া, আদিপুরাণ প্রভৃতিকৃত সামান্য নিষেধের প্রতিপ্রসব করিতেছেন, অর্থাৎ পাঁচ স্থলে কলি যুগে বিবাহিতা স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহের অনুজ্ঞা দিতেছেন।

এক্ষণে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন; প্রথমতঃ, কাত্যায়ন প্রভৃতি সংহিতাকর্তা মুনিদের বচনে। কয়েক স্থলে, সামান্ততঃ সকল যুগের পক্ষে, বিবাহিতা স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহের অনুজ্ঞা ছিল। তৎপরে, আদিপুরাণ প্রভৃতিতে, সামান্তাকারে রুলি যুগের পক্ষে বিধাহিতার পুনর্ব্বার বিবাহের নিযেধ হইয়াছিল। তদনন্তর, পরাশরসংহিতাতে, অনুদ্দেশ প্রভৃতি পাঁচটি স্থল ধরিয়া, কলি যুগের পক্ষে, বিবাহিতার পুনর্ব্বার বিবাহের বিশেষ বিধি হইয়াছে। সামান্য বিশেষ স্থলে বিশেষ বিধি নিষেধই বলবান হয়, অর্থাৎ যে যে স্থলে বিশেষ বিধি অথবা বিশ্লেষ নিষেধ থাকে, তদতিরিক্ত স্থলে সামান্ত বিধি অথবা সামান্ত নিষেধ থাটে। প্রথমতঃ, কাত্যায়ন প্রভৃতি মুনিরা, সামান্যতঃ, কোনও যুগের উল্লেখ না করিয়া, কয়েক স্থলে বিবাহিতার পুনর্ব্বার বিবাহের বিধি দিয়াছিলেন। ঐ বিধি, সামান্ততঃ, সকল যুগের পক্ষেই খাটিতে পারিত। কিন্তু, আদিপুরাণ প্রভৃতিতে, কলি যুগের উল্লেখ করিয়া নিষেধ হইয়াছিল; সুতরাং, ঐ নিষেধ কলি যুগের পক্ষে বিশেষ নিষেধ। এই নিমিত্ত, কাত্যায়ন প্রভৃতির সামান্ত বিধি, কলি যুগে না খাটিয়া, কলি যুগ ভিন্ন অন্য তিন যুগে খাটিয়াছে। এবং আদিপুরাণ প্রভৃতিতে, স্থলবিশেষের উল্লেখ না করিয়া, কলি যুগে সামান্যতঃ সকল স্থলেই বিবাহিতার বিবাহের নিষেধ হইয়াছিল। কিন্তু পরাশর, অনুদ্দেশ প্রভৃতি পাচটি 'স্থল ধরিয়া, কলি যুগে বিবাহিতার পুনর্ব্বার বিবাহের বিধি দিয়াছেন; সুতরাং, পরাশরের বিধি বিশেষ বিধি হইতেছে। এই নিমিত্ত, আদিপুরাণ প্রভৃতির সামান্য নিষেধ অনুদ্দেশ প্রভৃতি পাঁচ স্থল ভিন্ন অন্য অন্য স্থলে পাটিবেক। অর্থাৎ, স্বামী পতিত, ক্লীব, অনুদ্দেশ, কুলশীলহীন, যথেচ্ছাচারী, চিররোগী, অপস্থাররোগগ্রস্ত, প্রব্রজিত, মৃত, সগোত্র, দাস, অন্যজাতেীয় ইত্যাদির মধ্যে অনুদ্দেশ, মৃত, প্রব্রজিত, ক্লীব, পতিত এই পাঁচ স্থলে পরাশরের বিশেষ বিধি খাটিবেক; তদতিরিক্ত স্থলে, অর্থাৎ কুলশীলহীন, যথেচ্ছচারী, চিররোগী, অপম্মার- রোগগ্রস্ত, সগোত্র, দাস, অন্ত্যজাতীয় ইত্যাদি স্থলে আদিপুরাণ প্রভৃতির সামান্য নিষেধ খাটুিবেক।

সামান্ত বিশেষ বিধি নিষেধ স্থলে সচরাচর এইরূপ ব্যবস্থাই দেখিতে পাওয়া যায়। যথা,

অহরহঃ সন্ধ্যামুপাসীত।

প্রতিদিন সন্ধ্যাবন্দন করিবেক।

এস্থলে, বেদে সামা্যতঃ প্রত্যহ সন্ধাবন্দনের স্পষ্ট বিধি আছে। কিন্তু, সন্ধ্যাং পঞ্চ মহাযজ্ঞান্ নৈত্যকং স্মৃতিকর্ম্ম চ। তন্মধ্যে হাপয়েত্তেষাং দশাহান্তে' পুনঃক্রিয়। । (১১) অশৌচমধ্যে সন্ধ্যাবন্দন, পঞ্চ মহাযজ্ঞ, ও স্মৃতিবিহিত নিত্য কর্ম করিবেক না, অশৌচান্তে পুনরায় করিবেক।

এস্থলে, জাবালি অন্বোচকালে সন্ধ্যাবন্দনের নিষেধ করিতেছেন। দেখ, বেদে সামান্তাকারে প্রত্যহ সন্ধ্যাবন্দনের বিধি থাকিলেও, জাবালির •বিশেষ নিষেধ দ্বারা, অশৌচকালে দশ দিবস সন্ধ্যাবন্দন রহিত হইতেছে। অর্থাৎ, জাবালির বিশেষ নিষেধ অনুসারে, অশৌচকালীন দশ দিবস ব্যতিরিক্ত স্থলে, বেদোক্ত প্রত্যহ সন্ধ্যাবন্দনের সামান্ত বিধি খাটিতেছে। কিঞ্চ,

ন তিষ্ঠতি তুষঃ পূর্ববাং নোপাস্তে যশ্চ পশ্চিমাম্। স-শূদ্রবদহিষ্কাৰ্য্যঃ সর্ববস্মাৎ দ্বিজকুৰ্ম্মণঃ ॥ ১০৩ ॥ (১২)

যে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্ব প্রাতঃকালে ও সায়ংকালে সন্ধ্যাবন্দন না করে, তাহাকে শূদ্রের ন্যায় সকল দ্বিজকর্ম্ম হইতে বহিষ্কৃত করিবেক।

কিন্তু,

সংক্রান্ত্যাং পক্ষয়োরন্তে দ্বাদশ্যাং শ্রাদ্ধবাসরে।। সায়ং সন্ধ্যাং ন কুব্বীত কৃতে চ পিতৃহা ভবেৎ ।। (১৩) সংক্রান্তি, পুর্ণিমা, অমাবস্তা, ও শ্রাদ্ধদিনে, সায়ংকালে, সন্ধ্যাবন্দন করিবেক না: করিলে পিতৃহত্যার পাতক হয়।

দেখ, মনুসংহিতাতে, প্রাতঃকালে ও সায়ংকালে, সন্ধ্যাবন্দনের নিত্য বিধি ও তদতিক্রমে প্রত্যবায় স্মরণ থাকিলেও, ব্যাসের বিশেষ নিষেধ দ্বারা, সংক্রান্তি প্রভৃতিতে সায়ংসন্ধ্যা রহিত হইতেছে। অর্থাৎ, ব্যাসের বিশেষ নিষেধ অনুসারে, সংক্রান্তি প্রভৃতি ব্যতিরিক্ত দিনে সায়ংসন্ধ্যার সামান্য বিধি খাটিতেছে। বেদে নিষেধ আছে,

মা হিংস্যাৎ সর্ববা ভূতানি। কোনও জীবের প্রাণ হিংসা করিবেক না। কিন্তু বেদের অন্যান্য স্থলে বিধি আছে,

অশ্বমেধেন যজেত।

অশ্ব বধ করিয়া, যজ্ঞ করিবেক।

পশুনা রুদ্রং যজেত। পশু বধ করিয়া, রুদ্রযাগ করিবেক। অগ্নীষোমীয়ং পশুমাল।ভেত? পণ্ড বধ করিয়া, অগ্নি ও সোম দেবতার যাগ করিবেক।

বায়ব্যং শ্বেতমালভেত।

শ্বেতবর্ণ ছাগল বধ করিয়া, বায়ু দেবতার যাগ করিবেক। দেখ, 'বেদে সামান্যাকারে জীবহিংসার স্পষ্ট নিষেধ থাকিলেও, অন্যান্য স্থলের বিশেষ বিধি দ্বারা, যজ্ঞে পশুহিংসা দোষাবহ হইতেছে না। ' অর্থাৎ, বিশেষবিধিবলে, অশ্বমেধ, রুদ্রযাগ প্রভৃতি ব্যতিরিক্ত স্থলে, জীবহিংসার সামান্ত নিষেধ খাটিতেছে। এই নিমিত্তই ভগবান্ মনু কহিয়াছেন,

মধুপর্কে চ যজ্ঞে চ পিতৃদৈরতর্কৰ্ম্মণি।

অত্রৈব পশবো হিংস্যা নান্যত্রেত্যব্রবীষ্মমুঃ ॥ ৫। ৪১ মধুপর্ক, যজ্ঞ, পিতৃকৰ্ম্ম, দেবকর্ম্ম, এই কয়েক স্থলেই পশু, হিংসা করিবেক, অন্যত্র করিবেক না।

অর্থাৎ এই কয়েক বিষয়ে পশুহিংসার বিশেষ বিবি আছে, অতএব এই কয়েক বিষয়ে পশুহিংসা করিবেক, এতদতিরিক্ত স্থলে, জীবহিংসার সামান্স নিষেধশাস্ত্র অনুসারে, পশুহিংসা করিবেক না।

দেখ, যেমন এই সকল স্থলে, সামান্তাকারে স্পষ্ট বিধি ও স্পষ্ট নিষেধ থাকিলেও, বিশেষ বিধি ও বিশেষ নিষেধ অনুসারে স্থলবিশেষে চলিতে হইতেছে, এবং তদতিরিক্ত স্থলে সামান্য বিধি ও সামান্য নিষেধ খাটিতেছে; সেইরূপ, সামান্তাকারে কলি যুগে বিবাহিতার পুনর্ব্বার বিবাহের, নিষেধ থাকিলেও, পরাশরের বিশেষ বিধি অনুসারে, • অনুদ্দেশ প্রভৃতি পাঁচ স্থলে, ঘিবাহিতার পুনর্ব্বার বিবাহ বিহিত হইতেছে। আদিপুরাণ প্রভৃতিতে সামান্যাকারে নিষেধ আছে, পরাশর- সংহিতাতে পাঁচটি স্থল ধরিয়া বিশেষ বিধি আছে; সুতরাং, এই পাঁচ ব্যতিরিক্ত স্থলে, বিবাহের নিষেধ খাটিবেক। এ বিষয়ে সকল বচনের 'ঐক্য ও অবিরোধ করিতে হইলে, এইরূপ মীমাংসা কুরাই সর্ব্বাংশে সঙ্গত ও বিচারসিদ্ধ বোধ হইতেছে।

২-পরাশর বচন কলিযুগবিষয়, যুগান্তর বিষয় নহে।

মাধবাচার্য্য, পরাশরসংহিতার বিধবাদি স্ত্রীর বিবাহব্বিায়ক বচনের ব্যাখ্যা লিখিয়া, পরিশেষে কহিয়াছেন,

অয়ঞ্চ পুনরুদ্বাহো যুগান্তর বিষয়ঃ। তথাচাদিপুরাণম্

উঢ়ায়াঃ পুনরুদ্বাহং জ্যেষ্ঠাংশং গোবধং তথা।

কলৌ পঞ্চ ন কুব্বীত ভ্রাতৃজায়াং কমণ্ডলুমিতি।।

পরাশরের এই পুনর্ব্বার বিবাহের বিধি যুগান্তর বিষয়ে বলিতে হইবেক; যে হেতু, আদিপুরাণে কহিতেছেন, বিবাহিতার পুনর্ব্বার বিবাহ, জ্যেষ্ঠাংশ, গোবধ, ভ্রাতৃভাৰ্য্যায় পুত্রোৎপাদন, এবং কমণ্ডলুধারণ, কলিতে এই পাঁচ কর্ম্ম করি- বেক না।

এক্ষণে বিবেচনা করা আবশ্যক, মাধবাচার্য্য এই যে ব্যবস্থা করিয়া- ছেন, ইহা সঙ্গত কি না। এ স্থলে পরাশরসংহিতার উদ্দেশ্য কি, সংহিতার অভিপ্রায়, এবং মাধবাচার্য্যের আভাস ও তাৎপর্য্যব্যাখ্যা দ্বারা, তাহারই নির্ণয় করা সর্ব্বাগ্রে আবশ্যক বোধ হইতেছে।

সংহিতা।

অথাতো হিমশৈলাগ্রে দেবদারুবনালয়ে। ব্যাসমেকা গ্রমাসীনমপৃচ্ছমূষয়ঃ পুরা ॥ মানুষাণাং হিতং ধৰ্ম্মং বর্তমানে কলৌ যুগে। শৌচাচারং যথাবচ্চ বদ সত্যবতীস্থত ॥

অনন্তর, এই হেতু, ঋষিরা, পূর্ব্ব কালে, হিমালয় পর্বতের শিখরে দেবদারু বনস্থিপ্ত আশ্রমে একাগ্র মনে উপবিষ্ট ব্যাসদেবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, হে সত্যবতীনন্দন! এক্ষণে কলি যুগ বর্তমান, এই যুগে কোন ধর্ম্ম, কোন শৌচ, ও কোন আচার মনুষ্যের হিতকর, তাহা আপনি যথাবৎ বর্ণন করুন।

ভাষ্য।

বর্তমানে কলাবিতি বিশেষণাৎ যুগান্তরধর্মজ্ঞানানন্ত্যম্।

অনন্তর এই শব্দের অর্থ এই যে, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর যুগের ধৰ্ম্ম অবগত হইয়া, • ঋষিরা কলিধৰ্ম্ম জিজ্ঞাসা করিলেন।

ভাষ্য ।

অতঃশব্দে। হেত্বর্থঃ যুগ্মম্মাদেকদেশাধ্যায়িনো নাশেষধৰ্ম্মজ্ঞানং যস্মাচ্চ যুগান্তরধৰ্ম্মমবগত্য ন কলিধৰ্ম্মাবগতিস্তম্মাদিতি।"

এই হেতু, ইহার অর্থ, এই যে, যে হেতু একদেশ অধ্যয়ন করিলে, সমস্ত ধর্ম্মের জ্ঞান হয় না, এবং অন্য অন্য যুগের ধর্ম্ম জানিলে, কলিধৰ্ম্ম জানা হয় না, এই হেতু ঋষিরা জিজ্ঞাসা করিলেন।

ইহা দ্বারা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে, কলি যুগের আরম্ভ হইলে পর, ঋষিরা সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এই তিন যুগের ধৰ্ম্ম অবগত হইয়া, পরিশেষে কলি যুগের ধর্ম্ম অবগত হইবার বাসনায়, ব্যাসদেবের নিকটে আসিয়া, কলিধর্ম্মের বিষয় জিজ্ঞাসা করিতেছেন।

সংহিতা ।

তৎ শ্রুত্বা ঋষিবাক্যন্ত সশিধ্যোহগ্যর্কসন্নিভঃ। প্রত্যুবাচ মহাতেজাঃ শ্রুতিস্মৃতিবিশারদঃ ॥ ন চাহং সর্ববতত্ত্বজ্ঞঃ কথং ধৰ্ম্মং বদাম্যহম্। অস্মৎপিতৈবৎখ্রষ্টধ্য ইতি ব‍্যাসঃ সুতোহবদৎ !

শিষ্যমওলীবেষ্টিতঃ অগ্নি ও সূর্য্য তুল্য তেজস্বী, শ্রুতিস্মৃতিবিশারদ, মহাতেজাঃ ব্যাস ঋষিদিগের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, আমি সকল বিষয়ের তত্ত্বজ্ঞ নহি, কি রূপে ধৰ্ম্ম বলিব; এ বিষয়ে আমার পিতাকেই জিজ্ঞাসা করা কর্তব্য। পুঞ্জ ব্যাস এই কল্প বলিলেন।

ভাষ্য।

নচাহমিতি বদতো ব্যাস্যায়মাশয়ঃ সম্প্রতি কলিধৰ্ম্মাঃ পৃচ্ছ্যন্তে ত্র ন তাবদহং স্বতঃ কলিধৰ্ম্মতত্ত্বং জানামি অস্মৎপিতুরেব তত্র প্রাবীণ্যাৎ অতএব কলৌ পারাশরাঃ স্মৃতা ইতি বক্ষ্যতে। যদি পিতৃপ্রসাদাম্মম তদভিজ্ঞানং তর্হি স এব পিতা প্রষ্টব্যঃ নহি মূলবক্তরি বিমানে প্রণাড়িকা যুজ্যত ইতি।

আমি সকল বিষয়ের তত্ত্বজ্ঞ নহি, ব্যাসদেবের এই কথা বলিযার অভিপ্রায় এই যে, সম্প্রতি তোমরা কলিধৰ্ম্ম জিজ্ঞাসা করিতেছ; কিন্তু আমি নিজে কলিধর্ম্মের তত্ত্বজ্ঞ নহি। এ বিষয়ে আমার পিতাই প্রবীণ। এই নিমিত্তই, কলৌ পারাশরা: বৃতাঃ, অর্থাৎ পরাশর প্রণীত ধর্ম্ম কলি যুগের ধর্ম্ম, ইহা পরে পলিবেন। যগন আমি পিতার প্রসাদেই, কলিধৰ্ম্ম জাঁনিয়াছি, তখন সেই পিতাকেই জিজ্ঞাসা করা কর্তব্য। মূলবক্তা বিদ্যমান থার্কিতে, পরম্পরা স্বীকার কর। উচিত নয়।

ভাষ্য।

এবকারেণা্যস্মর্ত্তারো ব্যাবর্ত্যন্তে। যদ্যপি মম্বাদয়ঃ কলিধৰ্ম্মাভিজ্ঞাঃ তথাপি পরাশরস্যাস্মিন্ বিষয়ে তপোবিশেষবলাৎ অসাধারণঃ কশ্চিদ্রতিশয়ো দ্রষ্টব্যঃ। যথা কাণুমাধ্যন্দিনকাঠককৌথুমতৈত্তি- রীয়াদিশাখাসু কাণাদীনামসাধারণত্বং তদ্বদত্রাবগন্তব্যম্। কলি- ধৰ্ম্মসম্প্রদায়োপেতস্যাপি পরাণরস্তুতস্ত যদা তদ্ধৰ্ম্মগ্রহস্যাভিবদনে সঙ্কোচঃ তদ। কিমু বক্তব্যমন্যেষামিতি।

আমার পিতাকেই জিজ্ঞাসা কর্তব্য এরূপ কহাতে, অন্য স্মৃতিকর্তাদিগের 'নিবারণ হইতেছে। যদিও মনুপ্রভৃতি কলিধৰ্ম্মজ্ঞ বটে; তথাপি, তপ্যাবিশেষ প্রভাবে, পরাশর কলিধর্ম বিষয়ে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক প্রবীণ। যেমন, কাণ, মাধ্যন্দিন, কাঠক, কৌখুম, তৈত্তিরীয় প্রভৃতি শাখার মধ্যে কাণ প্রভৃতি কতিপয়ের প্রাধান্ত আছে, সেইরূপ কলিধর্থ বিষয়ে, সমস্ত স্মৃতিকর্তা দিগের মধ্যে, পরাশরের প্রাধান্ত আছে। ব্যাসদেব, কলিধর্ম্মের সম্প্রদায় প্রবর্তক হইয়াও, স্বপন, পরাশরসত্ত্বে স্বয়ং কলিধৰ্ম্মকথনে সঙ্কুচিত হইতেছেন, তপন অন্য ঋষি- দিগের কথা আর কি বলিতে হইবেক।

ইহা দ্বারা স্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে, পরাশর কলিধৰ্ম্ম বিষয়ে মনুপ্রভৃতি সকল স্মৃতিকর্তা অপেক্ষা অধিক প্রবীণ, এবং পরাশরস্তুতি কলিধৰ্ম্ম- নিরূপণের প্রধান শাস্ত্র।

সংহিতা।

যদি জানাসি মে ভক্তিং স্নেহাদ্বা ভক্তবৎসল।

ধৰ্ম্মং কথয় মে তাত অনুগ্রাহ্যো হ্যহং তব ।।

হে ভক্তবৎসল পিতঃ। যদি আপনি আমাকে ভক্ত বুলিয়া জানেন, অণব্য আমার উপর স্নেহ থাকে, তবে আমাকে ধন্ম উপদেশ দেন; আমি আপনকার অনুগ্রহপাত্র।

এই রূপে, ব্যাসদেব, ধৰ্ম্ম জানিবার নিমিত্ত, পিতাকে জিজ্ঞাসা করিলেন।

ভাষ্য।

নমু সন্তি বহবো মম্বাদিভিঃ প্রোক্তা ধৰ্ম্মাঃ তত্র কো ধৰ্ম্মো ভবতা বুভুৎসিত ইত্যাশঙ্ক্য বুভুৎসিতং পরিশেষয়িতুমুপন্যশস্যতি।

সংহিতা।

শ্রুতা.মে মানবা ধৰ্ম্মা বাশিষ্ঠাঃ কাশ্যপাস্তথা। গার্গেয়। গৌতমীয়াশ্চ তথাঢৌশনসাঃ স্মৃতাঃ ।।

অত্রেবিষ্ণোশ্চ সংবর্তাদ্দক্ষাদঙ্গিরসস্তথা। শাতাতপাশ্চ হারীতা যাজ্ঞবন্ধ্যাস্তথৈব চ ॥ আপস্তম্বকৃতা ধৰ্ম্মাঃ শুঙ্খস্থ্য লিখিতস্য চ। কাত্যায়নকৃতাশ্চৈব তথা প্রাচেতসাম্মুনেঃ ॥ শ্রুতা হোতে ভবৎপ্রোক্তাঃ শ্রুতার্থ। মে ন বিস্মৃতাঃ। অস্মিন্ মন্বন্তরে ধৰ্ম্মাঃ কৃতত্রেতাদিকে যুগে ॥

মহুপ্রভৃতি নিরূপিত অনেক ধৰ্ম্ম আছে, তন্মধ্যে তুমি কোন ধৰ্ম্ম জানিতে চাও, যেন পরাশর ইহা জিজ্ঞাসা করিলেন এই আশঙ্কা করিয়া, ব্যাস, ← জিজ্ঞাসিত ধর্ম্মের কথা পরিশেষে কহিবার নিমিত্ত, প্রথমতঃ অবগত ধর্ম্মের কথা প্রস্তাব করিতেছেন,

আমি আপনকার নিকট মনু, বশিষ্ঠ, কাশ্যপ, গর্গ, গোতম, উশনা, অত্রি, বিষ্ণু, সংবর্ত্ত, দক্ষ, অঙ্গিরা, শাতাতগ, হারীত, যাজ্ঞবক্ষ্য, আপস্তম্ব, শঙ্খ, লিখিত, কাত্যায়ন, ও প্রাচেতস নিরূপিত ধর্ম্ম শ্রবণ করিরাছি। যাহা শ্রাবণ করিয়াছি, বিস্মৃত হই নাই। সে সকল সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এই তিন যুগের

ভাষ্য।

ইদানীং পরিশিষ্টং বুভুৎসিতং পৃচ্ছতি। সংহিতা। সর্বেব ধৰ্ম্মাঃ কৃতে জাতাঃ সর্ব্বে নষ্টাঃ কলৌ যুগে।

চাতুর্বর্ণ্যসমাচারং কিঞ্চিৎ সাধারণং বদ ॥ এক্ষণে, ব্যাসদেব যে ধর্ম্মের বিষয় জানিতে চান, তাহার কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন।

সকল ধৰ্ম্ম সত্য যুগে জন্মিয়াছিল, কলি যুগে সকল ধর্ম্ম নষ্ট হইয়াছে; অতএব, আপনি চারি বর্ণের সাধারণ ধর্ম্ম কিছু বলুন।

ভাষ্য।

বিষ্ণুপুরাণে

বর্ণাশ্রমাচারবর্তী প্রবৃত্তির্ন কলৌ নৃণাম্।

আদিপুরাণেহপি

যস্তু কার্তযুগে ধর্ম্মো! ন কর্ত্তব্যঃ কলৌ যুগে। পাপপ্রসক্তাক্ত যতঃ কলো নার্য্যো নরাস্তথা ॥ অতঃ কলৌ প্রাণিনাং প্রয়াসসাধ্যে ধৰ্ম্মে প্রবৃত্ত্যসম্ভবাৎ সুকরো ধর্ম্মোহ্ত্র বুভুৎসিতঃ।

বিষ্ণুপুরাণে কহিয়াছেন, কলি যুগে মনুষ্যের চারি বর্ণের ও আশ্রমের বিহিত ধর্ম্মের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্তি হয় না।

শাদিপুরাণেও কাইয়াছেন, সত্য যুগে যে ধৰ্ম্ম বিহিত, কলি যুগে সে ধর্ম্মের' অনুষ্ঠান করিতে পারা যায় না: যেহেতু, কি স্ত্রী কি পুরুষ, সকলেই পাপে আসক্ত হইয়াছে।

কলি যুগে কষ্টসাধ্য ধর্ম্মে মনুষ্যের প্রবৃত্তি হওয়া অসম্ভব। এই নিমিত্ত, • পরাশরসংহিতাতে অনায়াসসাধ্য ধর্ম্মের নিরূপণই অভিপ্রেত। .

ইহা দ্বারা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে, মনুপ্রভৃতিনিরূপিত ধৰ্ম্ম সত্য, ত্রেতা, ও দ্বাপর যুগের ধর্ম্ম; জ্বলি যুগে ঐ সমস্ত ধর্ম্মের অনুষ্ঠান করা অসাধ্য; এই নিমিত্ত, ব্যাসদেব পরাশরকে, 'মন্টুষ্যেরা কলি যুগে অনায়াসে অনুষ্ঠান করিতে পারে, এরূপ ধর্ম্মের বিষয় জিজ্ঞাসা করিলেন।

সংহিতা।

ব্যাসবাক্যাবসানে তু মুনিমুখ্যঃ পরাশরঃ!

ধৰ্ম্মস্থ্য নির্ণয়ং প্রাহ সূক্ষ্মং স্কুলঞ্চ বিস্তরাৎ ॥

ব্যাসবাকা সমাপ্ত হইলে, মুনিশ্রেষ্ঠ পরাশর ধর্ম্মের শুক্ষ্ম ও স্কুল 'নির্ণয় বিস্তারিত কহিতে আরম্ভ করিলেন।

ইহা দ্বারা স্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে, ব্যাসদেবের প্রার্থনা শুনিয়া, পুত্র- বৎসল পরাশর কলি যুগের ধর্ম্ম কহিতে আরম্ভ করিলেন।

সংহিতা।

পরাশরেণু চাপ্যুক্তং প্রায়শ্চিত্তং বিধীয়তে। পরাশরের উক্ত প্রায়শ্চিত্তও বিহিত হয়।

ভাষ্য।

পরাশর গ্রহণস্তু কলিযুগাভিপ্রায়ং সর্বেস্বপি কল্লেযু পরাশরস্মৃতেঃ কলিযুগধৰ্ম্মপক্ষপাতিত্বাৎ প্রায়শ্চিত্তেঙ্গপি কলিবিষয়েষু পুরাশরঃ • প্রাধান্যেনাদরণীয়ঃ।

কলি যুগের অভিপ্রায়ে পরাশরের নামগ্রহণ করা হইয়াছে; যে হেতু, সকল 'কল্পেই কেবল কলি যুগের ধর্ম্ম নিরূপণ করাই পরাশরসংহিতার উদ্দেশ্য; কলি যুগের প্রায়শ্চিত্ত বিষয়েও পরাশরকে প্রধান রূপে সান্ত করিতে হইবেক।

ইহা দ্বারা নিঃসংশয়ে প্রতিপন্ন হইতেছে, কলি যুগের ধর্ম্ম নিরূপণ করাই পরাশরের উদ্দ্যে, এবং কলি যুগের ধর্মবিষয়ে অন্ত্য মুনির অপেক্ষা পরাশরের মত প্রধান।

এক্ষণে, সকলে স্থির চিত্তে বিবেচনা করিয়া দেখুন, পরাশরের যে কয়েকটি বচন ও ভাষ্যকার মাধবাচার্য্যের যে কয়েকটি আভাস ও তাৎপৰ্য্যব্যাখ্যা উদ্ধৃত হইল, তদনুসারে কেবল কলি যুগের ধর্ম নিরূপণ করাই যে পরাশরসংহিতার উদ্দেশ্য, ইহা স্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে কি না।

এই রূপে, যখন কেবল কলি যুগের ধর্ম্ম নিরূপণ করাই পরাশর- সংহিতার উদ্দেশ্য স্থির হইতেছে, তখন ঐ সংহিতার আদ্যোপান্ত গ্রংই যে কলিধৰ্ম্মনির্ণায়ক, তাহা সুতরাং স্বীকার করিতে হইবেক। আর, সমুদায় গ্রন্থকে কলিধর্ম্মনির্ণায়ক স্বীকার করিয়া, কেবল বিধবাদি স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহবিধায়ক বচনটিকে অনন্ত যুগের বিষয়ে বলা কোনও মতে সঙ্গত হইতে পারে না। বিশেষতঃ, যখন কলি যুগের আরম্ভ হইলে পর, ঋষিরা, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর যুগের ধর্ম্ম অবগত হইয়া, কলি যুগের 'ধর্ম্ম ও আচার জিজ্ঞাসা করিলেন, তখন পরাশর, আ্যোপান্ত কলি যুগের ধর্ম নিরূপণ করিয়া, তন্মধ্যে কলি ভিন্ন অন্য অন্য অতীত যুগের কেবল একটি ধর্ম্ম বলিবেন, ইহা কি রূপে সঙ্গত হইতে পারে। অতএব, পরাশর বিধবা প্রভৃতি স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহ যে কেবল কলি যুগের নিমিত্ত বিধান করিয়াছেন, তাহার কোনও সংশয় নাই। ইতঃপূর্ব্বে যেরূপ দর্শিত হইল, তদনুসারে মাধবাচার্য্যই নিজে, বচনের আভাস দিয়া ও তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা করিয়া, কেবল কলি যুগের ধর্মনিরূপণ করা পরাশরসংহিতার উদ্দেশ্য, এই মীমাংসা করিয়া- ছেন। মৃতরাং, যাহা সংহিতাকর্তার অভিপ্রেত নহে, এবং মাধবাচার্য্যের নিজ আভাস ও তাৎপর্য্যব্যাখ্যারও অনুযায়ী নহে, এরূপ ব্যবস্থাকে ক্ষি রূপে সঙ্গত বলা যাইতে পারে।

মাধবাচার্য্য, বিবাহ ব্রহ্মচর্য্য সহমরণ বিষএক বচনত্রয়ের যে আভাল দিয়াছেন, বিবাহবিধায়ক বচনকে যুগান্তর বিষয় বলিলে, ঐ তিন আভাসও কোনও ক্রমে সংলগ্ন হয় না। যথা,

কোনও কোনও স্কুলে স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহের বিধি দেখাইতেছেন, স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে ইত্যাদি। পুনর্ব্বার বিবাহ না করিয়া, ব্রহ্মচর্যা ব্রতের অনুষ্ঠানে অধিক ফল দেখাইতেচ্ছন, যে নারী স্বামীর মৃত্যু হইলে ইত্যাদি। সহগমনে ব্রহ্মচর্য্য অপেক্ষাও অধিক ফল দেপ।ইতেছেন, মনুষ্যশরীরে ইত্যাদি।

মাধবাচার্য্য যেরূপ ব্যবস্থা করিয়াছেন, তদনুসারে বিবাহ অন্য অন্য যুগের ধর্ম্ম, কেবল ব্রহ্মচর্য্য ও সহমরণ কলি যুগের ধৰ্ম্ম; সুতরাং, ব্রহ্মচর্য্য ও সহমরণ বিধায়ক বচনের সহিত বিবাহবিধায়ক বচনের কোনও সংস্রব থাকিতেছে না। অর্থাঃ, পরাশর স্ত্রীদিগের পক্ষে পুনর্ব্বার বিবাহের যে বিধি দিয়াছেন, তাহা পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগাভিপ্রায়ে; কলি যুগের বিধবাদিগের নিমিত্ত, কেবল ব্রহ্মচর্য্য ও সহমরণের বিধান করিয়াছেন। যদি যুগান্তর বিষয়ে ব্যবস্থা করিয়া, মাধবাচার্য্য কলি যুগের বিধবাদিগের পক্ষে পুনর্ব্বার বিবাহের প্রসক্তিই না রাখিলেন, • তবে পুনর্ব্বার বিবাহ না করিঙ্গ, ব্রহ্মচর্য্য ব্রতের, অনুষ্ঠান করিলে অধিক ফল, ব্রহ্মচর্য্যবিষয়ক বচনের এই আভাস কি রূপে সংলগ্ন হইতে পারে। মাধবাচার্য্যের মতে বিবাহ অন্য অন্য যুগের ধর্ম্ম, ব্রহ্মচর্য্য কলি যুগের ধর্ম্ম। জুতরাং, কলি যুগে, পুনর্ব্বার বিবাহ না করিয়া, • ব্রহ্মচর্য্য করিলে অধিক ফল এ কথা নিতান্ত অসঙ্গত হইয়া উঠে। • স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহ করা শাস্ত্রবিহিত; পুনর্ব্বার বিবাহ না করিয়া ব্রহ্মচর্য্য করিলে অধিক ফল; সহগমনে 'ব্রহ্মচর্য্য অপেক্ষাও অধিক ফল; এই তিন কথার পরস্পর যেরূপ সম্বন্ধ দৃষ্ট হইতেছে, তাহাতে এই তিনই ঘে এক যুগের বিষয়ে, তাহার কোনও সন্দেহ নাই। অতএব, যুদি পুনর্ব্বার বিবাহকে কলি যুগের ধর্ম্ম না বলিয়া যুগান্তরের ধর্ম্ম বল, ব্রহ্মচর্য্য ও সংগমনকেও যুগান্তরের ধর্ম্ম বলিয়া অগত্যা স্বীকার করিতে হইবেক। আর, ব্রহ্মচর্য্য ও সহগমনকে কলিধৰ্ম্ম বলিয়া স্বীকার করিলে, পুনর্ব্বার বিবাহকেও করিধৰ্ম্ম বলিয়া অগত্যা স্বীকার করিতে হইবেক। নতুবা, এরূপ পরস্পরসম্বদ্ধ বিষয়ত্রয়ের একটিকে যুগান্তরবিষয় বলা, আর অপর দুটিকে কলিযুগবিসয় বলা; নিতান্ত অসংলগ্ন হইয়া উঠে। ফলতঃ, মাধবাচার্য্য, বিবাহবিধিকে যুগান্তরবিষয় বলিয়া ব্যবস্থা করিবার নিমিত্ত, এত ব্যগ্র হইয়াছিলেন যে, সংহিতাকর্তা ঋষির অভিপ্রায় দূরে থাকুক, আপনি যে আভাস দিলেন, তাহাই পূর্ব্বাপর সংলগ্ন হইল কি না, এ অনুধাবন করিয়া দেখেন নাই।

"মাধবাচার্য্য স্বয়ং লিখিয়াছেন, ফলি যুগে মনুষ্যের কষ্টসাধ্য ধৰ্ম্মে প্রবৃত্তি হওয়া অসম্ভব, এই নিমিত্ত পরাশরসংহিতাতে অনায়াসসাধ্য ধৰ্ম্মনিরূপণই অভিপ্রেত। পরাশরও, বিবাহ অনায়াসসাধ্য বলিশ, সর্ব্বসাধারণ বিধবার পক্ষে সর্ব্বপ্রথম বিবাহের অনুজ্ঞা দিয়াছেন। তৎপরে, ব্রহ্মচর্য্য তদপেক্ষা অধিক কষ্টসাধ্য বলিয়া, যে নারী ব্রহ্মচর্য্য করিবেক, সে স্বর্গে যাইবেক, এই বলিয়া ব্রহ্মচর্য্যনির্ব্বাহক্ষম স্ত্রীর পক্ষে ব্রহ্মচর্য্যের অনুজ্ঞা দিয়াছেন। সহগমন সর্ব্বাপেক্ষা অধিক কষ্টসাধ্য বলিয়া, যে নারী সহগমন করিবেক, সে অনন্ত কাল স্বর্গে বাস করিবেক, এই বলিয়া সৰ্ব্বশেবে সহগমনসমর্থ স্ত্রীর পক্ষে সহগমনের অনুজ্ঞা দিয়াছেন। কিন্তু মাধৰাচাৰ্য্য অনায়াসসাধ্য বিবাহধর্ম্মকে যুগান্তর- বিষয় বলিয়া ব্যবস্থা করিতেছেন, এবং অবশিষ্ট দুই কষ্টসাধ্য ধৰ্ম্মকে কলি যুগের পক্ষে রাখিতেছেন। এক্ষণে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, কলি যুগে মনুষ্যের কষ্টসাধ্য ধৰ্ম্মে প্রবৃত্তি হওয়া অসম্ভব, এই নিমিত্ত। পরাশরসংহিতাতে অনায়াসসাধ্য ধৰ্ম্মনিরূপণই অভিপ্রেত, মাধবাচার্য্যের এই কথা কি রূপে সংলগ্ন হইতে পারে। কারণ, যে কলি যুগের লোকের ক্ষমতা, পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগের লোকের অপেক্ষা, কত শত অংশে হ্রাস হইয়া গিয়াছে, কষ্টসাধ্য দুই ধৰ্ম্মকে, সেই কলি যুগের পক্ষে রাখিলেন, আর অনায়াসসাধ্য ধৰ্ম্মটি যুগান্তরবিষয়, কলি যগের নিম্নিত অভিপ্রেত নহে, এই ব্যবস্থা করিলেন। পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগের লোকদিগের অধিক ক্ষমতা ছিল, তাঁহারা যে অনায়াসসাধ্য ধর্ম্মে অধিকারী ছিলেন, সেই অনায়াসসাধ্য ধৰ্ম্মে কলি যুগের অল্পক্ষমতাশালী লোকে অধিকারী নহেন, এ অতি বিচিত্র কথা। বস্তুতঃ, যখন কলি যুগের লোকদিগের, পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগের লোকদিগের অপেক্ষা, ক্ষমতার অনেক হ্রাস হইয়াছে, সুতরাং কষ্টসাধ্য ধর্ম্মে প্রবৃত্তি হওয়া অসম্ভব, এবং যখন পরাশর, কলি যুগের ধর্ম লিখিতে আরম্ভ করিয়া, সর্ব্বপ্রথম সর্ব্বসাধারণ বিধবা স্ত্রীদিগের পক্ষে সর্ব্বাপেক্ষা অনায়াসসাধ্য বিবাহধর্ম্মের অনুজ্ঞা দিয়াছেন, তখন বিবাহধৰ্ম্ম সেই কলি যুগের বিধবার জন্যে 'অভিপ্রেত নহে, এই ব্যবস্থা কোনও মতে যুক্তিমার্গাহুয়ারিণী, অথবা সংহিতাকর্তার অভি- প্রায়ানুযায়িনী, হইতে পারে না।

পরাশরবচনের যুগান্তরবিষয় ব্যবস্থা যে সংহিতাকর্তার অভিপ্রায়: বিরুদ্ধ, তাহা ভট্টোজিদীক্ষিতের লিপি দ্বারাও স্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে।। যথা,

নচ কলিনিষিদ্ধ্যাপি যুগান্তরীয়ধর্ম্মস্তৈব নষ্টে' মূতে ইত্যাদিপরাশরবাক্যং প্রতিপাদকমিতি বাচ্যং কলা- বনুষ্ঠেয়ান্ ধৰ্ম্মানেব বক্ষ্যামীতি প্রতিজ্ঞায় তদ্‌ গ্রন্থ- প্রণয়নাৎ। (১৩)

নষ্টে মৃতে এই পরাশরবচন দ্বারা কালানষিদ্ধ যুগান্তরীয় ধর্ম্মেরই বিধান হইয়াছে, এ কথা বল। যাইতে পারে না; কারণ, কলি যুগের অনুষ্ঠের ধর্মই বলিব এই প্রতিজ্ঞা করিয়া, পরাশরসংহিতার সঙ্কলন করা হইয়াছে।

"মাধবাচার্য্যের যুগান্তরুবিষয় ব্যবস্থা যে সংহিতাকর্তা ঋষির অভিপ্রায়- বিরুদ্ধ, এবং স্বয় তিন বচনের যে আভাস দিয়াছেন তাহারও বিরুদ্ধ, সে বিষয়ে কোনও সংশয় থাকিতেছে, না। এক্ষণে তিনি, যে প্রমাণ অবলম্বন করিয়া, ঐ ব্যবস্থা কুরিয়াছেন, তাহারও বলাবল বিবেচনা করা আবন্তক; তাহা হইলে, ঐ ব্যবস্থা কত দূর সঙ্গত, তাহা 'প্রতীয়মান হইবেক।

• বিবাহবিধায়ক পরাশরবচন যে অন্ত অন্য যুগের বিষয়ে, কলি, যুগের বিষয়ে নহে, ইহা মাধবাচার্য্য সংহিতার অভিপ্রায়, বা বচনের অর্থ, অথবা তাৎপর্য্য দ্বারা প্রতিপন্ন করিতে পারেন নাই; কেবল আদি- পুরাণের এক বচন অবলম্বন করিয়া, ঐ ব্যবস্থা কুরিয়াছেন। তাঁহার অভিপ্রায় এই বোধ হয়, যদিও পরাশরসংহিতা কলি যুগের ধর্ম্মশাস্ত্র, এবং বদিও তাহাতে বিধবাদি স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহের বিধি আছে; কিন্তু আদিপুরাণে কলি যুগে বিবাহিতা স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহ নিষিদ্ধ দৃষ্ট হইতেছে; অতএব, পরাশরের ঐ বিধিকে, কলি যুগের বিষয়ে না বলিয়া, যুগান্তরবিষয়ে বলিতে হইবেক। কিন্তু ইহাতে দুই আপত্তি উপস্থিত হইতেছে। প্রথমতঃ, আদিপুরাণের নাম দিয়া যে বচন উদ্ধৃত করিয়াছেন, আদিপুরাণ আদ্যন্ত পাঠ কর, ঐ বচন দেখিতে পাইবে না। 'বিশেষতঃ, আদিপুঘ্রাণ যে প্রণালীতে সঙ্কলিত দৃষ্ট হইতেছে, তাহাতে ঐরূপ বচন তন্মধ্যে থাকাই অসম্ভব। সুতরাং, মাধবাচার্য্যের শ্বত বচন অমূলক বোধ হইতেছে। অমূলক বচন অবলম্বন করিয়া, যে ব্যবস্থা করা হইয়াছে, ঐ ব্যবস্থা কি রূপে প্রামাণিক হইতে পারে। দ্বিতীয়তঃ, যদিই ঐ বচনকে আদিপুরাণের বলিয়া স্বীকার করা যায়, তাহা হইলেও তদৃষ্টে পরাশরবচনের সঙ্কোচ করা উচিত কৰ্ম্ম হয় নাই। প্রথমতঃ, পরাশরসংহিতা স্মৃতি, আদিপুরাণ পুরাণ। প্রথম পুস্তকে ইহা বিলক্ষণ প্রতিপন্ন হইয়াছে, (১৪) স্মৃতি ও পুরাণের পরস্পর বিরোধ হইলে, স্মৃতিই বলবতী হইবেক; অর্থাৎ, সে স্থলে, পুরাণের মত গ্রাহ্য না করিয়া, স্মৃতির মতই গ্রাহ করিতে হইবেক। তদনুসারে, পুরাণের বচন দেখিয়া, স্মৃতিবচনের সঙ্কোচ করা যাইতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ, পূর্ব্বে যেরূপ দর্শিত হইয়াছে, (১৫) তদনুসারে সামান্ত বিশেষ ব্যবস্থা করিলেও, আদিপুরাণের বচনানুসারে পরাশরবচনের সঙ্কোচ না হইয়া, পরাশরের 'বচনানুসারে আদিপুরাণের বচনেরই সঙ্কোচ করা সম্যক্ সঙ্গত ও বিচারসিদ্ধ বোধ হয়। আদিপুরাণবচন সামান্য শাস্ত্র, পরাশর- বচন বিশেষ শাস্ত্র। সামান্য শাস্ত্র দ্বারা বিশেষ শাস্ত্রের বাধ অথবা সঙ্কোচ না হইয়া, বিশেষ শাস্ত্র দ্বারাই সামান্ত শাস্ত্রের বাধ ও সঙ্কোচ হইয়া থাকে।

••অতএব দেখ, মাধবাচার্য্য পরাশরের বিবাহবিধিকে যে যুগান্তরবিষয় বলিয়া ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহা প্রথমতঃ সংহিতাকর্তার অভিগ্রায়ের বিরুদ্ধ হইতেছে; দ্বিতীয়তঃ, স্বয়ং যে আভাস দিয়াছেন, তাহার বিরুদ্ধ হইতেছে; তৃতীয়তঃ, যে প্রমাণ অবলম্বন করিয়া 'ঐব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহা অমূলক হইতেছে; চতুর্থতঃ, ঐ প্রমাণ সমূলক হইলেও, স্মৃতি পুরাণের বিরোধস্থলে স্মৃতি প্রধান, এই ব্যাসকৃত মীমাংসার বিরুদ্ধ হইতেছে; পঞ্চমত:, 'বিশেষ শাস্ত্র দ্বারা সামা্য শাস্ত্রের বাধ হয়, এই সর্ব্বসম্মত মীমাংসার বিরুদ্ধ হইতেছে। ফলতঃ, সর্ব্বপ্রকারেই যুগান্তর- বিষয় ব্যবস্থা অসঙ্গত স্থির হইতেছে।

এক্ষণে এই আপত্তি উপস্থিত হইতে পারে, মাধনাচাৰ্য্য অতি প্রধান পণ্ডিত ছিলেন, সুতরাং, তিনি যে ব্যবস্থা করিয়া গিয়াছেন, তাহা পঙ্গত কি অসঙ্গত, এ বিবেচনা না করিয়া, গ্রাহ্য করাই কর্তব্য। এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, মাধবাচার্য্য অতিপ্রধান পণ্ডিতও বটে এবং সর্ব্বপ্রকারে মাঁন্তও বটে; কিন্তু তিনি ভ্রমপ্রমাদশূক্ত ছিলেন না, এবং তাঁহার লিখিত সকল ধ্যবস্থাই বেদবৎ প্রমাণ হয় না। যে যে স্থলে তৎকৃত ব্যবস্থা অসঙ্গত স্থির হইয়াছে, সেই সেই স্থলে তদুত্তরকালের । গ্রন্থকর্তারা তৎকৃত ধ্যবস্থার খণ্ডন করিয়াছেন। যথা,

যত্ত মাধজ্ঞ যন্ত্র বাজসনেয়ী স্যাৎ তথ্য সন্ধিদিনাৎ পুরা। ন কাপ্যস্বাহিতঃ কিন্তু সদা সন্ধিদিনে হি সা ইত্যাহ তৎ কর্কভাষ্যদেবজ্ঞানী শ্রী অনন্তভাষ্যাদিসকলতচ্ছাখীয় গ্রন্থ-

বিরোধাদ্বহ্বনাদরাচ্চোপেক্ষ্যম্। (১৬)

মাধবাচার্য্য যাহা কহিয়াছেন, তাহা অগ্রাহ্ন; যেহেতু, কর্কভাষ্য, দেবজানী, অনন্তভাষ্য প্রভৃতি বাজসনেয় শাখা সংক্রান্ত সমস্ত গ্রন্থকর্তার মতের বিরুদ্ধ

ও অনেকের অনাদৃত।

মাধবস্তু সামান্যবাক্যাম্নির্ণয়ং কুবন্ ভ্রান্ত এব। (১৭) মাধবাচার্য্য, সামান্ত বাক্য অনুসারে নির্ণয় করিতে গিয়া, ভ্রান্তিজালে পতিত হইয়াছেন।

কৃষ্ণা পূর্বোত্তর। শুক্লা দশম্যেবং ব্যবস্থিতেতি মাধবঃ। বক্তৃতস্তু মুখ্যা নবমীযুতৈব গ্রাহ্য। দশমী তু' প্রকর্ত্তব্যা সদুর্গা দ্বিজসত্তমেত্যাপস্তম্বোক্তেঃ। (১৮)

মাধবাচাৰ্য্য এই ব্যবস্থা করেন; কিন্তু বস্তুতঃ তৎকৃত ব্যবস্থা গ্রাহ্য না করিয়া, এইরূপ ব্যবস্থাই গ্রাঞ্চ করিতে হইবেক।

ননু মাসি চাশযুজে শুক্রে নবরাত্রে বিশেষতঃ। সম্পূজ্য নবদুর্গাঞ্চ নক্তং কুর্য্যাৎ সমাহিতঃ। নবরাত্রাভিধং কৰ্ম্ম নক্তব্রতমিদং স্মৃতম্। আরম্ভে নবরাত্র্যেত্যাদিস্কান্দাৎ মাধবোক্তেশ্চ নক্তমেব প্রধানমিতি চেৎ ন নবরাত্রোপ- বাসতঃ ইত্যাদেরমুপপত্তেঃ। (১৯)

যদি বল, স্কন্দপুরাণে আছে এবং মাধবাচার্য্যও কহিয়াছেন, অতএব এই ব্যবস্থাই ভাল; তাহা হইলে, অ্যান্ড্য শাস্ত্রের উপপত্তি হয় না।

অত্র যামত্রয়াদবাক্ চতুর্দশীসমাপ্তেী তদন্তে তদূর্দ্ধ- গামিন্যান্ত প্রাতস্তিথিমধ্য এবেতি মোদ্রিমাধবাদয়ো ব্যবস্থামাহুঃ তন্ন তিথ্যন্তে তিথিভান্তে বা পারণং যত্র চোদিতম্। যামত্রয়োদ্ধগামিন্যাং প্রাতরেব হি পারণে- আদি সামান্যবচনৈরেব ব্যবস্থাসিদ্ধেরুভয়বিধবাক্য- বৈয়র্থশ্য দুষ্পরিহরত্বাৎ (২০)।

হেমাদ্রি মাধবাচার্য্য প্রভৃতি এই ব্যবস্থা স্থির করিয়াছেন, কিন্তু তাহা গ্রাহ্য নহে, যে হেতু উভদ্ধবিধ বাকের বৈয়্য দুর্নিবার হইয়া উঠে

নচ যদি প্রথমনিশায়ামেকতর বিয়োগস্তদাপি ব্রহ্মবৈবর্ত্তা- দিবচনাদ্দিবাপারণমনন্তভট্টমাধবাচার্য্যোক্তং যুক্তমিতিবাচ্যং ন রাত্রৌ পারণং কুর্য্যাদৃতে বৈ রোহিণীব্রতাৎ। নিশায়াং। পারণং কুর্য্যাৎ বর্জয়িত্বা মহানিশামিতি সংবৎসর প্রদীপ- ধৃতস্য ন রাত্রৌ পারণং কুর্য্যাদৃতে বৈ রোহিণীব্রতাৎ। অত্র নিশ্যপি তৎ কার্য্যং বর্জয়িত্বা মহানিশামিতি ব্রহ্মাণ্ডোক্তশস্য চ নিবিষয়ত্বাপত্তেঃ। (২১)

যদি বল অনস্তভট্ট ও মাধবাচার্য্যের ব্যবস্থা ভাল, তাহা হইলে অ্যান্ত শাস্ত্র নির্ব্বিষয় হইয়া পড়ে, অর্থাৎ তাহাদের আর স্থল থাকে না।

দেখ, কমলাকরভট্ট ও স্মার্ত ভট্টাচার্য্য রঘুনন্দন যে যে স্থলে মাধবা চার্য্যের ব্যবস্থা অসঙ্গত বোধ করিয়াছেন, সেই সেই স্থলে, "প্রমা •প্রয়োগ প্রদর্শন পূর্ব্বক, তাহার খণ্ডন করিয়া গিয়াছেন। সুতরাং মাধবাচার্য্যের ব্যবস্থা অসঙ্গত হইলেও, তাহাই মান্য করিয়া, তদনুসারে চলিতে হইবেক, এ কথা কোনও মতে সঙ্গত ও বিচারসিদ্ধ নহে।

৩-পরাশরের

বিবাহবিধি মনুবিরুদ্ধ নহে।

প্রতিবাদী মহাশয়েরা প্রায় সকলেই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, বিধবা- বিবাহ মনুবিরুদ্ধ। তাঁহাদের অভিপ্রায় এই যে, পরাশর নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে এই বচনে কলি যুগে বিধবাদি স্ত্রীদিগের পক্ষে যে বিধি দিয়াছেন, যদি তাহা যথার্থই বিবাহের বিধি হয়, তথাপি মনুবিরুদ্ধ বলিয়া গ্রাহ করা যাইতে পারে না; যে হেতু বৃহস্পতি মহিয়াছেন,

বেদার্থোপনিবন্ধুত্বাৎ প্রাধান্যং হি মনোঃ স্মৃতম্। মস্বর্থবিপরীতা যা সা স্মৃতির্ন প্রশস্যতে। মনু স্বীয় সংহিতাতে বেদার্থ সঙ্কলন করিয়াছেন; অতএব তিনি প্রধান। মমুর বিপরীত স্মৃতি প্রশস্ত নহে।

এই বৃহস্পতিবচন দ্বারা মনুর প্রাধান্ত ও তদ্বিরুদ্ধ স্মৃতির অগ্রাহ্যতা দৃষ্ট হইতেছে। ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণেও কথিত আছে,

মনুর্ব্বৈ যৎ কিঞ্চিদবদৎ তম্ভেষজম্। মনু যাহা কহিয়াছেন, তাহা মহৌষধ।

এ স্থলেও, বেদে মনুস্মৃতিকে মহৌষধ অর্থাৎ প্রধান বলিয়া ব্যাখ্যা করা হইয়াছে। অতএব পরাশরের বিবাহবিধি যখন ণেই মনুস্মৃতির বিরুদ্ধ হইতেছে, তখন তাহা কি রূপে গ্রাহ্য করা যাইতে পারে।

প্রতিবাদী মহাশয়দিগের এই আপত্তি বিচারসিদ্ধ বোধ হইতেছে না; কারণ বৃহস্পতি, যুগবিশেষের নির্দেশ না করিয়া, মমুস্কৃতির প্রাধান্য ও তদ্বিরুদ্ধ স্মৃতির অপ্রশস্ততা ফীর্ত্তন করিয়াছেন। কিন্তু পরাশর মনুসংহিতাকে সত্য যুগের প্রধান শাস্ত্র বলিয়া মীমাংসা করিতেছেন; সুতরাং, বৃহস্পতিবচনে বিশেষ নির্দেশ না থাকিলেও, পরাশরবচনের সহিত ঐক্য করিয়া, মনুস্মৃতির প্রাধান্ত ও তদ্বিরুদ্ধ স্মৃতির অপ্রশস্ততা সত্য যুগের বিষয়ে বালতে হইবেক। অর্থাৎ, সত্য যুগে মনুসংহিত সর্ব্বপ্রধান স্মৃতি ছিল, এবং মনুস্থতির বিরুদ্ধ হইলে, অন্যান্য স্মৃতি অপ্রশস্ত বলিয়া পরিগণিত, সুতরাং অগ্রাহ্য, হইত। নতুবা, কলি যুগেও, মনুস্থতির বিপরীত হইলে, শূন্যান্য স্মৃতি অগ্রাহ্য হইবেক, এরূপ নহে। বুরং বিষয় বিশেষে মনুবিরুদ্ধ স্মৃতি গ্রাহ্য হইতেছে, এবং তদনুযায়ী ব্যবহারও ভারতবর্ষের সর্ব্ব প্রদেশে প্রচলিত আছে, তাহার প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে। যথা,

মনু কহিয়াছেন,

ত্রিংশদ্বর্ষে। বহেৎ কন্যাং হৃদ্ব্যাং দ্বাদশবার্ষিকীম্। এ্যস্টবর্ষোৎষ্টবর্ষাং বা ধর্ম্মে সীদতি সত্বরঃ। ৯ ॥ ৯৪ ॥ লাঞ্চার বয়স ত্রিশ বৎসর, সে দ্বাদশবর্ষবয়স্ক। কস্তাকে বিবাহ করিবেক। কিংবা যাহার বয়স চব্বিশ বৎসর, সে অষ্টবর্ষবয়স্ক। ক্যাকে বিবাহ করিবেক।

* এই কালনিয়ম অতিক্রম করিয়া বিবাহ করিলে, ধর্ম্মভ্রষ্ট হয়।

এ স্থলে মনু বিবাহের দুই প্রকার কালনিয়ম করিতেছেন, এবং এই দ্বিবিধ কালনিয়ম লঙ্ঘন করিলে ধৰ্ম্মভ্রষ্ট হয়, তাহাও কহিতেছেন। কিন্তু, অঙ্গিরা কহিয়াছেন,

অষ্টবর্ষা ভবেগৌরী নবরর্ষা তু রোহিণী। দশমে কন্যকা প্রোক্তা অত উর্দ্ধং রজস্বলা ॥ তস্মাৎ সংবৎসরে প্রাপ্তে দশমে কন্যকা বুধৈঃ। প্রদাতব্যঙ্গ প্রযত্নেন ন দোষঃ কালদোষতঃ । (২২) অষ্টবর্ষবয়স্কা ক্যাকে গৌরী বলে, ব্লববর্ষবয়স্তু। কন্স্যাকে রোহিণী বলে, দর্শবর্ষ- বয়স্ক। কন্যাকে কষ্ট। বলে; তৎপরে কন্তাকে রজস্বলা বলে। অতএব, দশম বৎসর উপস্থিত হইলে, পণ্ডিতেরা যত্নশীল হইয়া কন্ঠ। দান করিবেন, তখন আর কালদোষজ্য দোষ নাই।

এ স্থলে, অঙ্গিরা অষ্টম, নবম, ও দশম বর্ষকে বিবাহের প্রশস্ত কাল বলিয়া নির্দিষ্ট করিতেছেন, এবং দশম বৎসরে, কালদোষ পর্য্যন্ত গণনা না করিয়া, যত্নশীল হইয়া, কন্যার বিবাহ দিতে কহিতেছেন। কিন্তু পুরুষের পক্ষে, কি চব্বিশ বৎসর, কি ত্রিশ বৎসর, কোনও কালনিয়মই রাখিতেছেন না। এক্ষণে বিবেচনা কর, অঙ্গিরার স্মৃতি মনুস্মৃতির বিরুদ্ধ হইতেছে কি না। মনু দ্বাদশ ও অষ্টম বর্ষক্টে কন্যার বিবাহের প্রশস্ত কাল বলিয়া বিধি দিতেছেন, এবং তাহার অন্যথা করিলে ধৰ্ম্ম- ভ্রষ্ট হয়, বলিতেছেন। কিন্তু অঙ্গিরা অষ্টম, নবম, ও দশম বর্ষকে বিবাহের প্রশস্ত 'কাল বলিতেছেন, এবং দশম বৎসরে, কালাকাল নিবেচনা না করিয়া, যত্ন পাইয়া কন্তার বিবাহ দিবার বিধি দিতেছেন। ইহার মতে দ্বাদশ বর্ষ কোনও মতেই বিবাহের প্রশস্ত কাল হইতেছে না। এক্ষণে বিবেচনা করিয়া দেখ, এ স্থলে সকলে মনুর মতানুসারে চলিতেছেন, কি অঙ্গিরার মতানুসারে। আমার বোধ হয়, এ স্থলে মনুর মত আদরণীয় হইতেছে না। মনুর মতানুসারে চলিতে গেলে, দ্বাদশবর্ষীয়া কন্ডার ত্রিশ বৎসর বয়সের বরের সহিত, ও অষ্টবর্ষীয়া কন্যার চব্বিশ বৎসর বয়সের বরের সহিত, বিবাহ দিতে হয়, নতুবা ধর্ম্মভ্রষ্ট হইতে হয়। কিন্তু ইদানীং, কাহাকেই বিবাহকালে এই নিয়ম অবলম্বন করিয়া চলিতে দেখা যায় না। বরং অষ্টম বর্ষ, নবম বর্ষ, দশম বর্ষ বিবাহের প্রশস্ত কাল, অঙ্গিরার এই মতানুসারেই সকলকে চলিতে দেখা যাইতেছে। অতএব, স্পষ্ট দৃষ্ট হইতেছে, বিবাহস্থলে, মনুর মত আদরণীয় না হইয়া, তদ্বিরুদ্ধ অঙ্গিরার মতই সৰ্ব্বত্র গ্রাহ্য হইতেছে।

মধু কহিয়াছেন,

এক এবৌরসঃ পুত্রঃ পিত্র্যশ্য বসুনঃ প্রভুঃ।

শেষাণামানৃশংস্যার্থং প্রদ্যাত্ত প্রজীবনমু ॥ ৯। ১৬৩ ॥ • ষষ্ঠস্তু ক্ষেত্রজস্যাংশং প্রদ্যাৎ পৈতৃকাদ্ধনাৎ। ঔরসো বিভজন্ দায়ং পিত্র্যং পঞ্চমমেব বা ॥ ৯। ১৬৪ ঔরসক্ষেত্রজৌ পুত্রৌ পিতৃরিষ্ণশ্য ভাগিনো।

*. দশাপরে তু ক্রমশো গোত্র রিক্সাংশভাগিনঃ ॥৯। ১৬৫ ॥ এক ঔরস পুত্রই সমস্ত পৈতৃক ধনের অধিকারী; সে দয়া করিয়া অন্যান্য পুত্রদিগকে গ্রাসাচ্ছাদন দিবেক। কিন্তু ঔরস পিতৃধন বিভাগকালে ক্ষেত্রজ ভ্রাতাকে পৈতৃক ধনের যক্ত অথবা পঞ্চম অংশ দিবেক। ঔরস আর ক্ষেত্রজ 'পুল পিতৃধনের অধিকারী। দত্তক প্রভৃতি আর দশবিধ পুল, পূর্ব্ব পূর্বোর অভাবে, গোত্রভাগী ও ধনাংশভাগী হইবেক।

যদি এক ব্যক্তির ঔরস, ক্ষেত্রজ্ঞ, দত্তক, কৃত্রিম প্রভৃতি বহুবিধ পুত্র থাকে, তাহা হইলে ঔরস, ক্ষেত্রজকে পৈতৃক ধন্সের পঞ্চম অথবা যন্ত্র অংশ মাত্র দিয়া, স্বপ্নং সমস্ত ধন গ্রহণ করিবেক। দত্তক প্রভৃতিকে 'দয়া করিয়া গ্রাসাচ্ছাদন মাত্র দিবেক। আর, যদি ঔরস পুত্র ন থাকে, ক্ষেত্রজ পুত্র সমস্ত ধনের অধিকারী হইবেক। ক্ষেত্রজ না থাকিলে, দত্তক সমস্ত ধনের অধিকারী হইবেক। এই রূপে মন্ত্র, ঔরস প্রভৃতি বহুবিধ পুত্র সত্ত্বে, ঔরসকে সমস্ত পৈতৃক ধনের স্বামী, ক্ষেত্রজকে কেবল পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ অংশ মাত্রের অধিকারী, এবং দত্তক প্রভৃতিকে গ্রাসাচ্ছাদন মাত্রের অধিকারী কহিতেছেন, এবং পূর্ব্ব পূর্ব্ব পুত্রের অভাবে, পর পর পুত্রের অধিকার বিধান করিতেছেন।

কিন্তু কাত্যায়ন কহিয়াছেন, •• উৎপন্নে দ্বৌরসে পুত্রে তৃতীয়াংশহরাঃ সুতাঃ।

সবর্ণা অসবর্ণান্ত গ্রাসাচ্ছাদনভাগিনঃ ॥

ঔরস পুত্র উৎপন্ন হইলে, সজাতীয় ক্ষেত্রজ দত্তক প্রভৃতি পুত্রের। পৈতৃক ধনের তৃতীয়াংশ পাইবেক, অসদাতীয়েরা গ্রাসাচ্ছাদন মাত্র প্রাপ্ত হইবেক।

•এ স্থলে, কাত্যায়ন 'সজাতীয় ক্ষেত্রজ দত্তক প্রভৃতির পৈতৃক ধনের তৃতীয়াংশে অধিকার, আর অসজাতীয়দিগের গ্রাসাচ্ছাদন মাত্রে অধি- কার, বিধান করিতেছেন। এক্ষণে বিবেচনা কর, কাত্যায়নস্মৃতি মনুস্বতির বিরুদ্ধ হইতেছে কি না। মনু কেবল ক্ষেত্রজকে যষ্ঠ অথবা পঞ্চম অংশ দিবার অনুমতি করিতেছেন, দত্তক প্রভৃতিকে গ্রাসাচ্ছাদন মাত্র। কিন্তু, কাত্যায়ন সজাতীয় ক্ষেত্রজ, দত্তক, কৃত্রিম, পৌনর্ডব প্রভৃতি সকলকেই তৃতীয়াংশ দিবার বিধি দিতেছেন। মনুর মতে, ঔরস ত্বে, দত্তক পুত্র গ্রাসাচ্ছাদন মাত্রে অধিকারী (২৩); কাত্যায়নের মতে, ঔরস সত্ত্বে, দত্তক পৈতৃকধনের তৃতীয়াংশে অধিকারী। এক্ষণে অনু- সন্ধান করিয়া দেখ, এ স্থলে সকলে মনুর মতানুসারে চলিতেছেন, কি কাত্যায়নের মতানুসারে। 'আমার বোধ হয়, এ স্থলে, মনুস্মৃতি আদরণীয় না হুইয়া, মনুবিরুদ্ধ কাত্যায়নস্মৃতিই গ্রাহ্য হইতেছে। 'অর্থাৎ, এক্ষণে ঔরস সত্ত্বে দত্তক গ্রাসাচ্ছাদন মাত্র না পাইয়া, পৈতৃক ধনের তৃতীয়াংশের "অধিকারী হইয়া থাকে। যদি বৃহস্পতিবচনের এরূপ তাৎপর্য্য হর যে, কলি যুগেও মনুবিরুদ্ধ স্মৃতি গ্রাহ্য নহে, ভাহা হইলে এ স্থলে কাত্যায়নস্মৃতি কি রূপে গ্রাহ হইতেছে। L

অতএব, যখন কার্য্য দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণ হইতেছে, কলি যুগে বিষয়- বিশেষে মদুবিরুদ্ধ স্মৃতি সৰ্ব্বত্র গ্রাহ্য হইতেছে, এবং যখন পরাশরও মমুনিরূপিত ধৰ্ম্ম সত্য যুগের ধর্ম্ম বলিয়া মীমাংসা করিতেছেন, তখন মনুসংহিতার বৃহস্পতিপ্রোক্ত সর্ব্বপ্রাধান্ত ও মনুবিরুদ্ধ স্মৃতির অগ্রাহতা অগত্যা সত্যযুগ বিষয়ে বলিতে হইবেক। নতুবা, পরাশরসংহিতার মীমাংসা অনুসারে, যুগভেদে এক এক সংহিতার প্রাধান্ত স্বীকার না করিয়া, সকল যুগেই মনুস্মৃতিয় সর্ব্ব প্রাধান্ত ব্যবস্থাপিত করিধে, বৃহস্পতি বচন নিতান্ত অসংলগ্ন হইয়া উঠে। কারণ, পূর্ব্বে যেরূপ দর্শিত হইল, তদনুসারে ইদানীং মনুস্কৃতির বিরুদ্ধ স্মৃতি, অপ্রশস্ত না হইয়া, বিলক্ষণ প্রশস্তই হইতেছে। সুতরাং,

মম্বর্থবিপরীতা যা সা স্মৃতির্ন প্রণস্ততে।

মনুবিরুদ্ধ স্মৃতি প্রশস্ত নহে।

এ কথা কি রূপে সংলগ্ন হইতে পারে। আর,

বেদার্থোপনিবন্ধুত্বাৎ প্রাধান্যং হি মনোঃ স্মৃতম্। মনু বেদার্থ সঙ্কলন করিয়াছেন, অতএব মঞ্জু প্রধান।

প্ল কথাই বা কি রূপে সংলগ্ন হইতে পারে। কারণ, মঞ্জু স্বীয় সংহিতাতে *বেদার্থ সঙ্কলন করিয়াছেন, আর যাজ্ঞবন্ধ্য, পরাশর প্রভৃতি কি স্বস্ব • সংহিতাতে বেদার্থ সঙ্কলন করেন নাই। তাঁহারা কি স্ব স্ব সংহিতাতে বেদবিরুদ্ধ কপোল্লুকল্পিত বিষয় সকলের সঙ্কলন করিয়া গিয়াছেন। তাঁহারা বেদ জানিতেন না, তাহাও নহে; এবং স্ব স্ব সংহিতাতে বেদার্থ সঙ্কলন করেন নাই, তাহাও নহে। মহু স্বীয় সংহিতাতে যোগ বেদার্থ সঙ্কলন করিয়াছেন, যাজ্ঞবন্ধ্য পরাশর প্রভৃতি সংহিতাকর্তারাও স্বস্ব সংহিতাতে, সেইরূপ, বেদার্থ সঙ্কলন করিয়াছেন; তাহার কোনও সংশয় নাই। সুতরাং, বেদার্থসঙ্কলনরূপ্ত, যে হেতু দর্শাইয়া, বৃহস্পতি মনুস্মৃতির প্রাধান্য কীর্ত্তন করিতেছেন; সেই বেদার্থসঙ্কলনরূপ হেতু যখন সকল সংহিতাতেই সমান বর্তিতেছে; তখন মনু প্রধান, অন্ত্যান্ত সংহিতাকর্তারা অস্ত্রধান, এ ব্যবস্থা কি রূপে যুক্তিসিদ্ধ হইতে পারে। কারণ, ব্লে হেতুতে এক সংহিতা প্রধান হইতেছে, সেই হেতু সত্ত্বেও, • অন্যান্য সংহিতা অপ্রধান হইবেক কেন। ফলতঃ, লোকে যখন সকল ঋষিকেই সর্ব্বজ্ঞ ও ভ্রমপ্রমাদশূন্ত বলিয়া স্বীকার করিয়া থাকেন, এবং যখন সকল ঋষিই স্ব স্ব সংহিতাতে বেদার্থ সঙ্কলন করিয়াছেন; তখন সকল ঋষিকেই সমান জ্ঞান করিতে হইবেক। সকল সংহিতাকর্তাকে সমান জ্ঞান করিতে হইবেক, এই মীমাংসা আমার কপোলকল্পিত নহে। মাধবাচার্য্যও পরাশরভা্যে এই মীমাংসাই করিয়াছেন। যথা,

অস্তু বা কথঞ্চিন্মনুস্মৃতেঃ প্রামাণ্যং তথাপি প্রকৃতায়াঃ পরাশরস্মৃতেঃ কিমায়াতং তেন নহি মনোরিব পরাশরস্ত মহিমানং কচিদ্বেদঃ প্রখ্যাপয়তি তস্মাত্তদীয়স্মৃতের্দু- নিরূপং প্রামাণ্যম্।

ভাল, মনুস্কৃতির প্রামাণ্য কথজিৎ সিদ্ধ হইল, তাহাঁতে পরাশরস্তুতির কি হইবেক; কারণ, বেদে কোনও স্থলে, মনুর ্যায়, পরাশরের মহিমা কীর্তন করিতেছেন না। অতএব পরাশরস্কৃতির প্রামাণ্য নিরূপণ করা কঠিন।

এই আশঙ্কা উত্থাপন করিয়া, মাধবাচার্য্য মীমাংসা করিতেছেন, নচ পরাশরমহিম্নোহ শ্রৌতত্বং স হোরাচ ব্যান্সঃ পারাশ্য ইতি শ্রুতৌ পরাশরপুত্রত্বমুপজীব্য ব্যাসশ্য স্তুতত্বাৎ। যদা সর্বসম্প্রতিপন্নমহিম্নো বেদব্যাস্যাপি স্তুতয়ে পরাশরপুত্রত্বমুপজীব্যতে তদা কিমু বক্তব্যমচিন্ত্যমহিমা পরাশর ইতি। তস্মাৎ পরাশরোহপি মনুসমান এর। এষ এব ন্যায়ো বশিষ্ঠাত্রিযাজ্ঞবন্ধ্যাদিযু যোজনীয়ঃ।

বেদে পরাশরের মহিমা কীর্ত্তন করেন নাই, এরূপ নহে; পরাশরপুত্র ব্যবস। বালয়াছেন, এ স্কুলে বেদে পরাশূরের পুত্র বলিয়া ব্যাসের প্রশংসা করিয়াছেন। বেদব্যাসের মহিমা সকলেই স্বীকার করিয়া থাকেন; যখন পরাশরের পুত্র বলিয়া, বেদে সেই, বেদব্যাসের মহিমা কীর্তিত হইতেছে, তখন পরাশরের যে অচিন্তনীয় মহিমা, এ কথা আর কি বলিতে হইবেক। অতএব, পরাশরও মনুর সমান, সন্দেহ নাই; বশিষ্ঠ, অত্রি, যাজ্ঞবক্য প্রভৃতিতেও এই যুক্তির যোজনা করিতে হইবেক। অর্থাৎ বেদে তাঁহাদেরও মহিমা কীর্ত্তিত আছে, সুতরাং তাঁহারাও মনুর সমান।

অতএব, যখন সকল সংহিতাকর্তা ঋষিই সর্ব্বজ্ঞ ও ভ্রমপ্রমাদশূন্য বলিয়া অঙ্গীকৃত হইয়া থাকেন; যখন সকলেই স্ব স্ব সংহিতাতে বেদার্থ সঙ্কলন করিয়াছেন; এবং যখন বেদেও সকলের মহিমা কীর্ত্তিত আছে; তখন সকল ঋষিই সমান মান্ত, তাহার কোনও সন্দেহ নাই। তবে বিশেষ এই, যুগভেদে এক এক সংহিতা প্রধান রূপে পরিগণিত হইবেক, এইমাত্র। সত্য যুগে মনুসংহিতা প্রধানু, ত্রেতা যুগে গোতমসংহিতা প্রধান, দ্বাপর যুগে শঙ্খলিখিতসংহিতা প্রধান, কলি যুগে পরাশরসংহিতা প্রধান। অতএব, যখন মনুসংহিতা এবং পরার্শরসংহিতা ভিন্ন ভিন্ন যুগের শাস্ত্র হইল; তথন উভয়ের পরস্পর বিরোধপ্রসক্তিই কি রূপে থাকিতে পারে।

যাহা প্রদর্শিত হইল, তদনুসারে ইহা নির্ধারিত হইতেছে, মনুসংহিতা, সত্য যুগের প্রধান শাস্ত্র, পরাশরসংহিতা কলি যুগের প্রধান শাস্ত্র; সুতরাং এ উভয়ের পরস্পর বিরোধপ্রসক্তিই নাই; বৃহস্পতি যে মনু- সংহিতার সর্ব্বপ্রাধান্য ও তদ্বিরুদ্ধ স্মৃতির অগ্রাহ্যতা কহিয়াছেন, তাহা দ্রুত যুগের বিষয়ে'; আর, ইদানীন্তন কালে মনুবিরুদ্ধ স্মৃতি গ্রাঙ্গ হইয়া থাকে। সুতরাং, পরাশরোক্ত বিধবা প্রভৃতি স্ত্রীর বিবাহবিধি মনুবিরুদ্ধ 'হইলেও, কলি যুগে গল্পহ্য হইবার কোনও বাধা নাই।

এক্ষণে ইহাও বিবেচনা করা আবশ্যক, বিধবা 'প্রভৃতি স্ত্রীর পুনর্ব্বার" বিবাহ মনুসংহিতার অথবা অ্যান্ড সংহিতার বিরুদ্ধ কি না। মনু কহিয়াছেন,"

যা পত্যা বা পরিত্যক্তা বিধবা বা স্বয়েচ্ছয়া।

উৎপাদয়েৎ পুনর্ভূত্বা স পৌনর্ভব উচ্যতে। ৯। ১৭৫। যে নারী, পতিকর্তৃক পরিত্যক্তা অথবা বিধবা হইয়া, স্বেচ্ছাক্রমে পুনর্ভু হয়, অর্থাৎ পুনরায় অন্ত ব্যক্তিকে বিবাহ করে, তাহার গর্ভে যে পুত্র জন্মে তাহাকে

পৌনর্ভব বলে।

বিষ্ণু কহিয়াছেন,

অক্ষতা ভূমঃ সংস্কৃতা পুনর্ভুঃ। (২৪) যে অক্ষতযোনি স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহসংস্কার হয়, তাহাকে পুনর্ভু বলে। যাজ্ঞবন্ধ্য কহিয়াছেন,

অক্ষতা চ ক্ষতা চৈব পুনর্ভূঃ সংস্কৃতা পুনঃ ॥ ১। ৬৭।

কি অক্ষতযোনি কি ক্ষতযোনি, কে স্ত্রীর পুন্নব্বার বিবাহসংস্কার হয়, তাহটিক পুনর্ভু বলে।

বশিষ্ঠ কহিয়াছেন, যা চ ক্লীবং পতিতমূলাত্তং বা ভর্ত্তারমুৎসৃজ্য অন্যং পতিং বিন্দতে মৃতে বা সা পুনৰ্ভূর্ভবতি। (২৫)

যে স্ত্রী ক্লীব, পতিত বা উন্মত্ত পতিকে পরিত্যাগ করিয়া, অথবা পতির মৃত্যু হইলে, অন্ত ব্যক্তিকে বিবাহ করে, তাহাকে পুনর্ভু বলে।

এই রূপে, মনু, বিষ্ণু, যাজ্ঞবন্ধ্য ও বশিষ্ঠ পুনর্ভুধৰ্ম্ম কীর্ত্তন করিয়াছেন, অর্থাৎ গতি পতিত, ক্লীব বা উন্মত্ত হইলে, কিংবা পতি মরিলে, অথবা ত্যাগ করিলে, স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহসংস্কারের বিধি দিয়াছেন।

...কেহ কেহ কহিয়াছেন, মনু প্রভৃতি যে পৌনর্ভব পুত্রের কথা কহিয়াছেন, সে কেবল সেইরূপ পুত্র উৎপন্ন হইলে, তাহার কি নাম হইবেক, এইমাত্র, নির্দেশ কয়িয়াছেন, নতুবা তাদৃশ পুত্র যে শাস্ত্রীয় পুত্র, ইহা তাঁহাদের অভিমত নহে (২৬)। এই মীমাংসা মীমাংসকের কপোলকল্পিত, শাস্ত্রানুগত নহে। কারণ, যাঁহাদের সংহিতাতে পুত্রবিষয়ক বিধি আছে, তাঁহারা সকলেই পৌনর্ভবকে শাস্ত্রীয় পুত্র বলিয়া পরিগণিত করিয়াছেন। মনু, ঔরস প্রভৃতি দ্বাদশবিধ পুত্রের লক্ষণ নির্দেশ করিয়া, পরিশেষে কহিয়াছেন,

ক্ষেত্রজাদীন হুতানেতানেকদশ যথোদিতান্।

পুত্রপ্রতিনিধীনাহুঃ ক্রিয়ালোপান্মনীষিণঃ ॥ ৯। ১৮০। যথাক্রমে ক্ষেত্রজ প্রভৃতি যে একাদশবিধ পুত্রের লক্ষণ নিদ্দিষ্ট হইল, ঔরস পুত্রের অভাবে শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়ার লোপের সম্ভাবনা ঘাটলে, মুনিরা তাহাদিগকে পুত্রপ্রতিনিধি কীৰ্ত্তন করিয়াছেন।

এবং,

শ্রেয়সঃ শ্রেয়সোহভাবে পাপীয়ানূষ্ণমর্হতি। ৯। ১৮৪। পূর্ব পূর্ব্ব 'উৎকৃষ্ট পুত্রের অভাবে, পর পর নিকৃষ্ট পুত্র ধনাধিকারী হইবেক। যাজ্ঞবন্ধ্যও, ঔরস প্রভৃতি দ্বাদশবিধ পুত্রের লক্ষণ নির্দেশ করিয়া, কহিয়াছেন,

পিণ্ডদোহংশহরশ্চৈষাং পূর্বাভাবে প্রঃ পরঃ। ২। ১৩২।

এই দ্বাদশবিধ পুত্রের মধ্যে, পূর্ব্ব পূর্ব্ব পুত্রের অভাবে, পর পর পুত্র শ্রাদ্ধাধি কারী ও ধনাধিকারী হইবেক।

এই রূপে, মনু ও যাজ্ঞবন্ধ্য যথন পৌনর্ভবকে শ্রাদ্ধাধিকারী ও ধনাধিকারী কীর্ত্তন করিয়া গিয়াছেন, তখন পৌনর্ভব শাস্ত্রীয় পুত্র নহে, এ কথা নিতান্ত অশ্রদ্ধেয়।

কেহ কেই কহিয়া থাকেন, মনু দ্বাদশবিধ পুত্রের গণনা স্থলে পৌনর্ভবকে দশম স্থানে কীর্ত্তন করিয়াছেন; সুতরাং, পৌনর্ভব অতি অপকৃষ্ট পুত্র হইতেছে। এ স্থলে বক্তব্য এই যে, মুন্নুর মতে পৌনর্ভব অপকৃষ্ট হইতেছে বল্টে, কিন্তু যাজ্ঞবন্ধ্য, বশিষ্ঠ ও বিষ্ণুর মতে অপকৃষ্ট A পুত্র নহে। তাঁহারা পৌনর্ভবকে দত্তক পুত্র অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ বলিয়া কীর্ত্তন করিয়াছেন। যাজ্ঞবন্ধা পৌনর্ভবকে যষ্ঠ ও দত্তককে সপ্তম কীৰ্ত্তন করিয়াছেন; এবং পূর্ব্ব পূর্ব্ব পুত্রের অভাবে পর পর পুত্র শ্রাদ্ধাধিকারী ও ধনাধিকারী বলিয়া বিধান দিয়াছেন। তদনুসারে, পৌনর্ভব দত্তকের পূর্ব্বে শ্রাদ্ধাধিকারী ও ধনাধিকারী হইতেছে; সুতরাং, পৌনর্ভব দত্তক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুত্র হইল। বশিষ্ঠ পৌনর্ভবকে চতুর্থ বলিয়া কীর্ত্তন করিয়াছেন। যথা,

পৌনর্ভবশ্চতুর্থঃ। (২৭)

• পৌনর্ভব চতুর্থ।

এই রূপে, বশিষ্ঠ, পৌনর্ভবকে প্রথম শ্রেণীর ছয় পুত্রের মধ্যে চতুর্থ কীর্ত্তন করিয়া, দত্তককে দ্বিতীয় শ্রেণীর ছয় পুত্রের মধ্যে দ্বিতীয় কীর্তন করিয়াছেন। যথা,

দত্তকো দ্বিতীয়ঃ। (২৮)

দত্তক দ্বিতীয়।

বিষ্ণুও পৌনর্ভবকে চতুর্থ ও সত্তকে অষ্টম কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। যথা, পৌনর্ভবশ্চতুর্থঃ। (২৯) দত্তকশ্চাস্টমঃ। (২৯)

পৌনর্ভৰ চতুর্থ।

দত্তক অষ্টম।

এই পুত্রগণন। করিয়া পরিশেষে কহিয়াছেন,

এতেষাং পূর্ববঃ পূর্ববঃ শ্রেয়ান্স এব দায়হরঃ স চান্ড্যান্

বিভৃয়াৎ। (৩০)

ইহাদের মধ্যে পূর্ব্ব পূর্ব্ব পুত্র শ্রেষ্ঠ, সেই ধনাধিকারী: সে অন্ত অন্য পুত্র- দিগের ভরণ পোষণ করিবেক।

অতএব দেখ, মনুর মতে পৌনর্ভব দশম স্থানে নির্দিষ্ট, সুতরাং অপকৃষ্ট বলিয়া পরিগণিত হইলেও, যাজ্ঞবন্ধ্যের মতে সপ্তম, আর বশিষ্ঠ ১৪ বিষ্ণুর মতে চতুর্থ স্থানে নির্দিষ্ট, ও দত্তক পুত্র অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নুত্র বলিয়া পরিগণিত, হইয়াছে।' মনুসংহিতা সত্য যুগের প্রধান শাস্ত্র; সুতরাং, সেই যুগেই, পৌনর্ভব নিকৃষ্ট পুত্র বলিয়া পরিগণিত হইত। সর্ব্ব যুগের নিমিত্ত ঐ ব্যবস্থা হইলে, পৌনর্ভবকে যাজ্ঞবন্ধ্য সপ্তম স্থানে, এবং বিষ্ণু ও রশিষ্ঠ চতুর্থ স্থানে, কদাচ গণনা করিতেন না। অতএব যখন মনু, যাজ্ঞবঝ্য, বিষ্ণু ও বশিষ্ঠ, পৌনর্ভব দৰ্ম্ম কীর্ত্তন দ্বারা, বিধবা প্রভৃতি স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহ সংস্কারের বিধান করিতেছেন, তখন বিধবার বিবাহ মনু অথবা অন্তান্ত্য মুনির মতের" বিরুদ্ধ, এ কথা কোনও মতে সঙ্গত ও বিচারসহ হইতেছে না। বোধ হয়, মনুর 'অথবা অন্তান্ত্য মুনির সংহিতাতে বিশেষ দৃষ্টি নাই বলিয়াই, অনেকে মনু প্রভৃতির মতের বিরুদ্ধ বলিয়া কীর্ত্তন করিয়া- ছেন; নতুবা, সবিশেষ জানিয়াও, এরূপ অলীক ও অমূলক কথা লিখিয়া প্রচার করিয়াছেন, এরূপ বোধ হয় না।

বস্তুতঃ, যেরূপ দর্শিত হইল, তদনুসারে বিধবার বিবাহ মন্ত্র প্রভৃতির মতের বিরুদ্ধ নয়। তবে মহু প্রভৃতির মতে দ্বিতীয় বার বিবাহিতা স্ত্রীকে পুনৰ্ভূ ও তগর্ভজাত পুত্রকে পৌনর্ভব বলিত; পরাশরের মতানুসারে, কলি যুগে তাদৃশ স্ত্রীকে পুনভূ ও তাদৃশ পুত্রকে পৌনর্ভব বলিয়া গণনা করা যাইবেক না, এই মাত্র বিশেষ। কলি যুগে তাদৃশ স্ত্রীকে পুনস্ট্ বলা অভিমত্ব হইলে, পরাশর অবন্তই পুনর্ভু সংজ্ঞায় নির্দেশ করিয়া যাইতেন; এবং তাদৃশ পুত্রকে পৌনর্ভব বলা অভিমত হইলে, অবশ্যই পুত্রগণনাস্থলে পৌনর্ভবের উল্লেখ করিতেন। তাদৃশ স্ত্রী যে পুনর্ভূ বলিয়া পরিগণিত হইবেক না, এবং তাদৃশ পুত্রকে জে পৌনর্ভব না বলিয়া ঔরয় বলিয়া গণনা করিতে হইবেক, তাহা ইদানীন্তন কালের লৌকিক ব্যবহার দ্বারাও বিলক্ষণ সপ্রমাণ হইতেছে। দেখ, যদি বান্দান করিলে পর, বিবাহ সংস্কার নির্ব্বাহ হইবার পূর্ব্বে, বরের মৃত্যু হয়, অথবা কোনও কারণে সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া যায়; তাহা হইলে, ঐ কন্যার পুনরায় অন্য বরের সহিত বিবাহ হইয়া থাকে।.. যুগান্তরে এ রূপে বিবাহিতা ক্যাকে পুনর্ভু ও তৎগর্ভজাত পুভ্রকে। পৌনর্ভব বলিত। যথা

সপ্ত পৌনর্ভবাঃ কন্যা বর্জনীয়াঃ কুলাধমাঃ। বাচা দত্তা মনোদত্তা কৃতকৌতুকমঙ্গল।। উদকম্পর্শিতা যা চ যা চ পাণিগৃহীতিকা। অগ্নিং পগিত। যা চ পুনর্ভূপ্রভবা চ যা। ইত্যেতাঃ কাশ্যপেনোক্তা দহন্তি কুলমগ্নিবৎ ॥

U ধন্দত্ত। অর্থাৎ যাহাকে বাক্য দ্বারা দান করা গিয়াছে, মনো দত্ত। অর্থাৎ যাহাকে মনে মনে দান করা গিয়াছে, কৃতকৌতুকমঙ্গলা অর্থাৎ যাহার হস্তে বিবাহ সূত্র বন্ধন করা গিয়াছে, উদকম্পর্শিতা অর্থাৎ যাহাকে যথাবিধি দান করা গিয়াছে, পাণিগৃহীতিকা অর্থাৎ যাহার পাণিগ্রহণ নিব্বাহ হইয়াছে, অগ্নিং পরিগতা অর্থাৎ যাহার কুশণ্ডিকা হইয়াছে, আর পুনভূপ্রভব। অর্থাৎ পুনর্ভুর গর্ভে যাদ্ধার জন্ম হইয়াছে, কুলের অধম এই সাত পুনভূ' কন্যা বজ্জন করিবেক। এই সাত কান্তপোক্তা কন্যা বিবাহিতা হইলে, অগ্নির ন্যায়, পতিতুল ভগ্নসাৎ করে।

এক্ষণে, বান্দতা, মনোদত্তা, ক্বতকৌতুকমঙ্গলা, পুনর্ভূপ্রভবা এই চারি- প্রকার পুনর্ভুর বিবাহ সচরাচর প্রচলিত হইয়াছে, অর্থাৎ বান্দান, মনে মনে দান ও হস্তে বিবাহসূত্রবন্ধনের পর বর মরিলে, অথবা কোনও কারণে সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া গেলে, সেই ক্যার পুনরায় অন্ত্য বরের সহিত বিবাহ হইয়া থাকে, এবং এই রূপে বিবাহিতা পুনর্ভু কন্ডার গর্ভজাত কন্যারও বিবাহ হইয়া থাকে। পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগে, এই রূপে বিবাহিতা ক্যাদিগকে পুনর্ভু ও তদপূর্ভজাত পুত্রদিগকে পৌনর্ভৰ বলিত। কিন্তু এক্ষণে এতাদৃশ স্ত্রীদিগকে পুনর্মু বলা যায় না ও তগর্ভজাত পুত্রদিগকেও পৌনর্ভব বলা যায় না। সকলেই তাদৃশ স্ত্রীকে সর্ব্বাংশে প্রথমবিবাহিত স্ত্রীতুল্য, ও তাদৃশ পুত্রকে সর্ব্বাংশে 'ঔরসতুল্য, জ্ঞান- করিয়া থাকেন। তাদৃশ পুত্রেরা ঔরসের ন্যায় জনক জননী' প্রভৃতির শ্রাদ্ধাদি করে এবং ঔরসের ন্যায় জনক জননী প্রভৃতির ধনাধিকারী হয়। বস্তুতঃ, সর্ব্ব প্রকারেই ঔরস বলিরা পরিগৃহীত হইয়া থাকে, কেহ ভুলিয়াও পৌনর্ভব বলিয়া গণনা করেন না। অতএব দেখ, যুগতরে যে সাত প্রকার পুনর্ভূ ও পৌনর্ভব ছিল, তন্মধ্যে চারি প্রকার ইদানীং প্রচলিত আছে, 'তাহারা পুনর্ভূ অথবা পৌনর্ভব বলিরা পরিগণিত হয় না। তাদৃশ স্ত্রী প্রথমবিবাহিতা স্ত্রীর ন্যায় পরিগণিত ও তাদৃশ পুত্র ঔরস বলিয়া সর্ব্বত্র পরিগৃহীত হইয়াছে। অবশিষ্ট তিন প্রকার পুনর্ভুরও বিবাহ প্রচলিত হইলে, সমান ন্যায়ে, তাহাদের প্রথম বিবাহিত স্ত্রীতুল্য পরিগণিত ও তগর্ভজাত পুত্রের ঔরসু বলিয়া পরিগৃহীত হইবার বাধা কি। অতএব, যখন পরাশরের অভিপ্রায়ানুসারে যুগান্তরীয় পুনর্ভু প্রথমবিবাহিত স্ত্রীতুল্য ও যুগান্তরীয় পৌনর্ভব ঔরস বলিয়া স্থির হইতেছে, এবং লৌকিক ব্যবহারেও যখন যুগান্তরীয় চতুর্বিধ পুনর্ভু প্রথমবিবাহিত স্ত্রীতুল্য ও চুতুবিন্ধু পৌনর্ভব ঔরস বলিয়া পরিগৃহীত দৃষ্ট হইতেছে; তখন পুনর্ব্বার বিবাহিতা বিধবা প্রভৃতি স্ত্রী ও তগর্ভজাত পুত্র, যুগান্তরে পুনর্ভু ও পৌনর্ভৰ বলিয়া পরিগণিত হইলেও, কলি যুগে প্রথমবিবাহিতা স্ত্রীর তুল্য পরিগণিত ও তাদুশ পুত্র ঔরস বলিয়া পরিগৃহীত হইবেক, তাহার বাধা কি।

কল যুগে দ্বিতীয় বার বিবাহিতা স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র যে ঔরস বলিয়া পরিগৃহীত হইবেক, মহাভারতেও তাহার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। ঐরাবতমাষক নাগরাজের এক কন্তা ছিল, ঐ কন্যা বিধবা, হইলে, নাগরাজ অর্জুনের সহিত তাহার বিবাহ দেন। অর্জুনের ঔরসে সেই দ্বিতীয় বার বিবাহিতা কন্যার গর্ভে ইরাবান্ নামে যে পুত্র জন্মে, সেই পুত্র অর্জুনের ঔরস পুত্র বলিয়া স্পষ্ট নির্দেশ আছে। যন্ত্রী,

অর্জুনস্যাত্মজঃ শ্রীমানিরাবান্নাম বীর্য্যবান। 'সুতায়াং নাগরাজস্থ্যজ্জাতঃ পার্থেন ধীমত। ॥ ঐরাবতেন সা দত্তা হনপত্যা মহাত্মনা। • পতৌ হতে সুপর্ণেন কৃপণা দীনচেতনা ॥ ভাৰ্য্যার্থং তাঞ্চ জগ্রাহ পার্থঃ কামবশানুগাম্ ।। (৩১)

নাগরাজের ক্যাতে অর্জুনের ইরাবান্ নামে এক শ্রীমান ধীৰ্য্যবান পুত্র জন্সেন •শুপর্ণ কর্তৃক ঐ কস্তার পতি হত হইলে, নাগরাজ মহাত্মা ঐরাবত সেই দুঃখিতা বিন্ধা পুত্রহীন। কন্সা অর্জুনকে দান করিলেন। অর্জুন, সেই বিবাহা- ঘিনী কন্তার পাণিগ্রহণ করিলেন।

অজানাম্নজ্জুশ্চাপি নিহতং পুদ্রমৌরসম্।

জঘান সমরে শূরান রাজ্ঞস্তান ভীষ্মরক্ষিণঃ ।। (৩১) অর্জুন, ঐ ঔরঙ্গ পুত্রকে হত জানিতে না পারিয়া, ভীষ্মরক্ষক পরাক্রান্ত রাজাদিগকে যুদ্ধে প্রহার করিতে লাগিলেন।

ইহা দ্বারা ইহাই সপ্রমাণ হইতেছে, পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগের পৌনর্ভৰ কলি যুগের প্রথমাবধিই ঔষ্মস্ বলিয়া পরিগণিত ও পরিগৃহীত হইতে আরম্ভ হইয়াছে।

এক্ষণে ইহা বিবেচনা করা আবশ্যক, প্রতিবাদী মহাশয়েরা, মনুসংহিতা হইতে যে. সকল বচন উদ্ধৃত করিয়া, বিধবার বিবাহ মনুসংহিতাবিরুদ্ধ বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, সে সকল বচনের অর্থ ও তাৎপর্য্য কি। তাঁহারা,ন দ্বিতীয়শ্চ সাধ্বীনাং ক্বচিন্তুৰ্ত্তোপদিতে। ৫। ১৬২। এবং দ্বিতীয় অর্থাৎ পর পুরুষ সাধ্বী স্ত্রীদিগের পক্ষে কোনও শাস্ত্রে ভর্তা বলিয়া উপদিষ্ট নহে।

এই বচনার্দ্ধ উদ্ধৃত করিয়া, বিধবাবিবাহ মন্ত্রবিরুদ্ধ বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন। কিন্তু, ইহার অর্থ ও তাৎপর্য্য পর্যালোচনা করিলে, তাঁহাদের অভিপ্রায় কোনও মতে সম্পন্ন হইতে পারে না। যথা,

মৃতে ভর্ত্তরি সাধ্বী স্ত্রী ব্রহ্মচর্য্যে ব্যবস্থিতা।

স্বর্গং গচ্ছত্যপুত্রাপি যথা তে ব্রহ্মচারিণঃ ॥ ৫। ১৬০। অপত্যলোভাদু যা তু স্ত্রী ভর্ত্তারমতিবর্ত্ততে। সেহ নিন্দামবাপ্নোতি পতিলোকাচ্চ হীয়তে ॥ ৫। ১৬১। -.. নান্যোৎপন্না প্রজ্ঞাস্তীহ ন চাপ্য্যপরিগ্রহে।

ন দ্বিতীয়শ্চ সাধ্বীনাং কচিস্তুৰ্ত্তোপদিশ্যতে ॥ ৫। ১৬২।।

স্বামী মরিলে, সাদী স্ত্রী, ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করিয়া, কালক্ষেপ করিলে, পুত্র ব্যতিরেকেও স্বগে যায়। যেমন, নৈষ্টিক ব্রহ্মচারীরা পুত্র ব্যতিরেকেও স্বর্গে যান। যে নারী পুত্রের লোতে ব্যভিচারিণী হয়, সে নিন্দা প্রাপ্ত হয়, এবং পতিলোক হইতে ভ্রষ্ট হয়। পর পুরুষ জারা উৎপন্ন পুশু পুত্র নহে; পর ভাৰ্য্যায় উৎপন্ন পুত্র পুত্র নহে এবং দ্বিতীয় অর্থাৎ পর পুরুষ, সাধ্বী স্ত্রী দ্বিগের পক্ষে, ভর্তা বলিয়া কোনও শাস্ত্রে উপদিষ্ট নহে।

অর্থাৎ,

অনন্তাঃ পুত্রিণাং লোকাঃ নাপুত্র্য লোকোহস্তীতি শ্রুয়তে। (৩২)

পুক্রবান্ লোকেরা অনন্ত স্বর্গ প্রাপ্ত হয়; অপুদ্রের স্বর্গ নাই, বেদে এই নির্দেশ আছে।

এই শাস্ত্র অনুসারে, পুত্রহীনা হইলে স্বর্গ হয় না, এই ভয়ে, এবং পুত্রবর্তী হইলে, স্বর্গপ্রাপ্তি হয় এই লোভে, বাভিচারিণী হইয়া যে স্ত্রী অন্য পুরুস দ্বারা পুত্রোৎপাদনে প্রবৃত্তা হয়, সে নিন্দিতা ও স্বর্গস্রষ্টা  হয়; যে হেতু, অবিধানে পর পুরুষ দ্বারা উৎপন্ন পুল্ল পুত্র বলিয়া পরিগণিত নহে। যদি বল, স্ত্রী যে পর পুরুষ দ্বারা পুত্র উৎপন্ন করিয়া লইবেক, তাহাকেই তাহার পতি বলিব। কিন্তু তাহা শাস্ত্রের অভিমত নহে; কারণ, পর পুরুষ সাধ্বী স্ত্রীদিগের পক্ষে ভর্তা বলিয়া কোনও শাস্ত্রে উপদিষ্ট নঙ্গে। অর্থাৎ, স্বর্গলাভলোভে স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত হইয়া, অবিধানে, যে "পর পুরুষ দ্বারা পুত্রোৎপাদনের চেষ্টা করিবেক, সেই পর পুরুষকে প্রতি বলিয়া স্বীকার করা শাস্ত্রের অভিপ্রেত নহে। যে হেতু, যথাবিধানে যে পুরুষের সহিত পাণিগ্রহণ সংস্কার হয়, শাস্ত্রে তাহাকেই" পতিশব্দে নির্দেশ করিয়াছেন। অতএব, প্রতিবাদী মহাশয়দিগের উদ্ধৃত পূর্ব্বনিদ্দিষ্ট বচনার্দ্ধের তাৎপর্য্য এই যে, বিধবা স্ত্রী, পুত্রলোভে ব্যভি চারিণী হইয়া, অবিধানে যে পর পুরুষে উপগতা হইবেক, সেই পর পুরুষ তাহার পতি বলিয়া পরিগণিত হইতে পারিবেক না। গতবা, যঞ্জাবিধানে বিবাহসংস্কার হইলেও, স্ত্রীদিগের দ্বিতীয় পতি হইতে পারে না, এরূপ তাৎপর্য্য কদাচ নহে। তাহা হইলে মনু স্বয়ং পুত্র প্রকরণে যে পৌনর্ভব পুত্রের বিধান দিয়াছেন এবং পৌনর্ভবকে পিতার শ্রাদ্ধাধি- কারী ও ধনাধিকারী কীর্ত্তন করিয়াছেন, তাহা কিরূপে সংলগ্ন হইবেক।

প্রতিবন্দী মহাশয়েরা,

•• ন বিবাহধিধাবুক্তং বিধবাবেদ পুনঃ। ৯। ৬৫।

বিবাহবিধিস্থলে বিধবার পুনর্ব্বার বিবাহ উক্ত নাই।

প্রকরণ পৰ্য্যালোচনা না করিয়া, এই বচনার্দ্ধের যথাশ্রুত অর্থ গ্রহণ •পূর্ব্বক, বিধবার বিবাহ মনু বিরুদ্ধ বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার দ্বিতীয় • চেষ্টা পাইয়াছেন। কিন্তু এই বন্ধনকে একবারে বিধবাবিবাহনিষেধক স্থির করিলে, পুত্রপ্রকরণে মনুর পৌনর্ভববিধান কিরূপে সংলগ্ন হইবেক, তাহা তাঁহারা অনুধাবন করিয়া দেখেন নাই। এই বচনার্দ্ধকে পৃথক্ গ্রহণ করিলে, তাঁহাঁদের অভিমত অর্থ কথঞ্চিৎ সিদ্ধ হইতে পারে; কিন্তু প্রকরণ পৰ্য্যালোচনা ও তাৎপর্য্য অনুধাবন করিলে, তাহা কোনও ক্রমে সিদ্ধ হইতে পারে না। যথা, দেবরাদ্বা সপিণ্ডাদা স্ত্রিয়া সম্য নিযুক্তয়া।

প্রজেপ্সিতাধিগন্তব্যা সন্তানস্থ্য পরিক্ষয়ে ॥ ৯। ৫৯। বিধবায়াং নিযুক্তস্ত ঘৃতাক্তো বাগ্যতো নিশি। একমুত্পাদয়েৎ পুত্রং ন দ্বিতীয় কথঞ্চন ॥ ৯। ৬০। দ্বিতীয়মেকে প্রজনং মন্যস্তে স্ত্রীযু তদ্বিদঃ। অনিবৃত্তং নিয়োগার্থং পশ্যস্তো ধৰ্ম্মতস্তয়োঃ ॥ ৯। ৬১। বিধবায়াং নিয়োগার্থে নিৰ্বত্তে তু যথাবিধি; গুরুবচ্চ স্নষাবচ্চ বর্ত্তেয়াতাং পরস্পরম্ ॥ ৯। ৬২। নিযুক্তৌ যৌ বিধিং হিত্ব। বর্ভেয়াতান্ত কামতঃ। তাবুভৌ পতিতৌ স্ব্যাতাং সুযাগগুরুতত্মগৌ ॥ ৯। ৬৩। 'নান্যস্মিন্ বিধবা নারী নিয়োক্তব্য। দ্বিজাতিভিঃ। অভ্যস্মিন্ হি নিযুঞ্জানা ধর্ম্মং হন্যুঃ সনাতনম্ ॥ ৯। ৬৪। নোদ্বাহিকে মন্ত্রেষু, নিয়োগঃ কীর্ত্যতে কচিৎ। ন বিবাহবিধাবুক্তং বিধবাবেদনং পুনঃ ॥ ৯। ৬৫। অয়ং দ্বিজৈর্হি বিদ্বপ্তিঃ পশুধৰ্ম্মে। বিগর্হিতঃ। বর্ণানাং সঙ্করং চক্রে কামোপহতচেতনঃ ॥ ৯। ৬৭। ততঃ প্রভৃতি যো মোহাৎ প্রমীতপতিকাঃ প্রিয়ম্।

মনুষ্যাণামপি প্রোক্তো বেগে রাজ্যং প্রশাসতি ॥ ৯। ৬৬। স মহীমখিলাং ভুঞ্জন রাজর্ষি প্রবরঃ পুরা।

• নিযোজয়ত্যপত্যার্থং তং বিগর্হন্তি সাধবঃ ॥ ৯। ৬৮। সন্তানের অভাবে, যথাবিধানে নিযুক্ত। স্ত্রী দেবর দ্বারা বা সপিণ্ড দ্বারা অভিলষিত পুত্র লাভ করিবেক। ৫৯। নিযুক্ত ব্যক্তি, স্বতাক্ত ও মৌনাবলম্বী হইয়া, রাত্রিতে সেই বিধবার গর্ভে একমাত্র পুত্র উৎপাদন করিবেক, কদাচ দ্বিতীয় নহে। ৬০। একমাত্র পুত্র দ্বারা ধর্ম্মতঃ নিয়োগের উদ্দেশ্য সম্পন্ন হয় না বিবেচনা করিয়া, নিয়োগশাস্ত্রজ্ঞ মুনিরা বিধবা স্ত্রীতে দ্বিতীয় পুত্রোৎপাদনের অনুমতি দেন। ৬১। বিধবাতে যথাবিধামে নিয়োগের উদ্দেশ্য সম্পন্ন হইলে পর, পরস্পর পিতার হ্যাঁর ও পুত্রবধূর ন্যায় থাকিবেক। ৬২। যে স্ত্রী ও পুরুষ নিযুক্ত হইয়া, বিধি লঙ্ঘন পূর্ব্বক, স্বেচ্ছানুসারে চলে, তাহারা পতিত এবং পুত্রবধূগামী ও গুরুতল্পগামী হইবেক। ৬৩। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈঞ্চ পুত্রোৎ পাদনার্থে বিধবা নারীকে অন্ত পুরুষে নিযুক্ত করিবেক না। অন্ত পুরুষে নিযুক্ত করিলে, সনাতন ধর্ম্ম নষ্ট করা হয়। ৬৪। বিবাহসংক্রান্ত মন্ত্রের মধ্যে রুকানও স্থলে, নিয়োগের উল্লেখ নাই, এবং বিবাহবিধিস্থলে বিধবার বেদনের উল্লেখ নাই। ৬৫ ॥ শাস্ত্রজ্ঞ দ্বিজেরা এই পশুধর্ম্মের নিন্দা করিয়াছেন। বেণের রাজ্যশাসন কালে, মনুষ্যদিগের মঙ্গ্য এই ব্যবহার প্রচলিত হইয়াছিল। ৬৬॥ সেই রাজর্বিশ্রেষ্ঠ, পূর্ব্ব কাতল, সমস্ত পৃথিবীর অধীশ্বর ভূঁইয়া এবং কাম দ্বারা হতবুদ্ধি হইয়া, বর্ণসঙ্কর প্রচলিত কুরিয়াছিলেন। ৬০। তদবধি যে ব্যক্তি.. মোহাব্ধ হইয়া, পচ্ছিীনা স্ত্রীকে পুত্রোৎপাদনার্থে পরপুরুণে নিযুক্ত করে, সে সাধুদিগের নিকট নিন্দনীয় হয়। ৩৮।

.. এক্ষণে বিবেচনা করিয়া দেখ, এই প্রকরণের আদ্যোপান্ত অনুধাবন করিলে, ক্ষেত্রজ পুত্রের বিধি নিষেধ বোধ হয়, অথবা বিধবাবিবাহের বিবি নিষেধ বোধ হয়। প্রথম বচনে সন্তানাভাকে ক্ষেত্রজ পুত্রোৎ- পাদনের বিষয় উপক্রম করিয়া, সর্বশেষ বচনে ক্ষেত্রজপুত্রোৎপাদন প্রকরণের উপসংহার করিতেছেন। সুতরাং, যখন উপক্রমে ও উপসংহারে ক্ষেত্রজ পুলের বিধি ও নিষেধ তেথা যাইতেছে, এবং যখন তন্মধ্যবর্তী সকল বচনেই তৎসংক্রান্ত কথা লক্ষিত হইতেছে, তখন এই প্রকরণ যে কেবল ক্ষেত্রজ পুত্রোৎপাদনবিষয়ক তাহাতে কোনও সংশয় হইতে পারে না। যে বচন অবলম্বন করিয়া, প্রতিবাদী মহাশয়েরা বিধবার • বিবাহ মনুবিরুদ্ধ বাঁঞ্জয়া প্রতিপন্ন করিতে চান, তাহার পূর্ব্বার্দ্ধেও ক্ষেত্রজ পুত্রোৎস্নাদনীর্থ আদেশবোধক স্পষ্ট নিয়োগ শব্দ আছে; হুতরাং, অপরার্দ্ধে যে অস্পষ্ট বেদন শব্দ আছে, তাহারও পাণিগ্রহণরূপ অর্থ না করিয়া, প্রকরণ বশতঃ, ক্ষেত্রজ পুত্রোৎপাদনার্থ গ্রহণরূপ অর্থই করিতে হইবেক। এই ঔবদন শব্দ যে বিদধাতুনিষ্পন্ন, সেই বিদধাতু দ্বারা, পাণিগ্রহণ ও ক্ষেত্রজ পুত্রোংপাদনার্থে গ্রহণ, উভয় অর্থই প্রতি- পন্ন হইয়া থাকে। বিবাহ প্রকরণে থাকিলে, পাণিগ্রহণবোধক হয়; নিয়োগপ্রকরণে থাকিলে, ক্ষেত্রজপুত্রোৎপাদনীর্থে গ্রহণবোধক হয়। যথা,

ন সগোত্রাং ন সমানপ্রবরাং ভার্য্যাং বিন্দেত। (৩৩)

সমানগোত্রা, মানপ্রবরা কষ্টাকে বেদন করিবেক না।" দেখ, এ স্থলে বিন্দেত এই যে বিদধাতুর পদ আছে, তাহাতে বিবাহ- প্রকরণ বলিয়া পাণিগ্রহণরূপ অর্থ প্রতিপন্ন হইতেছে।

যশস্য। ত্রিয়েত ক্যায়া বাচা সত্যে কৃতে পডিঃ। তাঁমনেন বিধানেন নিজো বিন্দেত দেবরঃ। ৯। ৬৯। যথাবিধ্যধিগম্যেনাং শুক্লবস্ত্রাং শুচিত্রতাম্। মিথো ভজেদা প্রসবাৎ সকৃৎ সকৃদৃতাবৃর্তো ॥ ৯। ৭০। (৩৪)

বান্দান করিলে পর, বিবাহের পূর্ব্বে, যে কস্তার পতির মৃত্যু হয়, তাহাকে তাহার দেবর, এই বিধানে বেদন করিবেক। বৈধব্যলক্ষণধারিণী সেই ক্যাকে দেবর, যথাবিধানে গ্রহণ করিয়া, সন্তান না হওয়া পর্যান্ত, প্রত্যেক ঋতুকালে, এক এক বার গমন করিবেক।

দেখ, এ স্থলে, নিয়োগ প্রকরণ বলিয়া, বিদধাতু দ্বারা ক্ষেত্রজপুত্রোৎ- পাদনার্থে, গ্রহণ বুঝাইতেছে। অতএব,

ন বিবাহবিধাবুক্তং বিধবাবেদনং পুনঃ।

বিবাহবিধি স্থলে বিধবার বেদন উক্ত নাই। এ স্থলে বিদধাতুনিষ্পন্ন যে বেদন শব্দ আছে, তাহারও, নিয়োগপ্রকরণ বলিয়া, ক্ষেত্রজপুত্রোৎপাদনার্থে গ্রহণরূপ অর্থই করিতে হইবেক। বস্তুতঃ, বেদন শব্দের এরূপ অর্থ না করিলে, এ স্থল সঙ্গতই হইতে পারে না।

নোদ্বাহিকেযু মন্ত্রেষু নিয়োগঃ কীর্ত্যতে ক্বচিৎ। ন বিবাহবিধাবুক্তং বিধবাবেদনং পুনঃ ॥

বিবাহসংক্রান্ত মন্ত্রের মধ্যে নিয়োগের উল্লেখ নাই।

বিবাহবিধি স্থলে বিধবার ক্ষেত্রজপুত্রোৎপাদনার্থ গ্রহণও উক্ত নাই। এই অর্থ যেরূপ সংলগ্ন হইতেছে, অপর অর্থ সেরূপ সংলগ্ন হয় না। যথা,

বিবাহসংত্রশস্ত মন্ত্রের মধ্যে নিয়োগের উল্লেখ নাই।

বিবাহবিধি স্থলে বিশ্ববার পুনর্ব্বার বিবাহ উক্ত নাই। মনু নিয়োগধর্ম্মের নিষেধে প্রবৃত্ত হইয়াছেন; সুতরাং, ঐ বচনে নিয়োগের নিষেধ করিতেছেন; বিবাহসংক্রান্ত য়ে সুকল মন্ত্র আছে, তন্মধ্যে কোনও মন্ত্রে বিধবার নিয়োগের উল্লেখ নাই; আর বিবাহের • বিধিস্থলে 'ক্ষেত্রজপুত্ত্বোৎপাদনার্থ গ্রহণেরও উল্লেখ নাই। অর্থাৎ, নিয়োগ দ্বারা পুত্রোৎপাদন হয়; পুত্রোৎপাদন বিবাহের কার্য্য; সুতরাং, মনু নিয়োগকে বিবাহবিশেষস্বরূপ গুণনা করিয়া লইতেছেন এবং বিবাহের মন্ত্রের মধ্যে ও বিবাহবিধির মধ্যে নিয়োগের ও নিয়োগ- ধৰ্ম্মানুসারে পুত্রোৎপাদনার্থে গ্রহণের কথা নাই; এই নিমিত্ত, অশাস্ত্রীয় বলিয়া নিষেধ করিতেছেন। নতুবা, নিয়োগপ্রকরণের বচনে পূর্ব্বাদ্ধে ক্ষেত্রজপুত্রোৎপাদন নিষেধ, অপরার্দ্ধে অনুপস্থিত অপ্রাকরণিক বিধবা- বিবাহের নিষেধ করিবেন, ইহা কিরূপে সংলগ্ন হইতে পারে। নিয়োগপ্রকরণে, বিবাহসংক্রান্ত মন্ত্রের মধ্যে নিয়োগের উল্লেখ নাই, এ কথা বিলক্ষণ উপযোগী ও সঙ্গত হইতেছে; কিন্তু নিয়োগপ্রকরণে, বিবাহবিধি স্থলে বিধবার পুনর্ব্বার বিবাহ উক্ত নাই, এ কথা নিতান্ত অনুপযোগী ও অপ্রাকরণিক হইতেছে। নিয়োগের বিধি নিষেধ মীমাংসা হলে, বিধবাবিবাহের নিষেধের কথা অকস্মাৎ উত্থাপিত হইবেক ক্লেন। ফলতঃ, এ স্থলে বিবাহ শব্দ নাই, বেদন শব্দ আছে; বেদন শব্দে পাণিগ্রহণও বুঝায়, ক্ষেত্রজপুল্লোৎপাদনার্থে গ্রহণও বুঝায়। প্রকরণ- বশতঃ, বেদন শব্দে এখানে ক্ষেত্রজপুত্রোৎপাদনার্থে গ্রহণই বুঝাইবেক, তাহার কোনও সংশয় নাই। বস্তুতঃ, এ স্থলে বেদন শব্দের বিবাহ • অর্থ স্থির করিয়া, বিধবাবিবাহের নিষেধ প্রতিপাদনে উদ্যত হওয়া কেবল প্রকরণজ্ঞানের অসদ্ভাব প্রদর্শনমাত্র।

এই প্রকরণ যে কেবল নিয়োগধর্ম্মের বিধি নিষেধ বিষয়ে, বিধবা- বিবাহের বিধি অথবা নিষেধ বিষয়ে নহে। ভগবান্ বৃহস্পতির মীমাংসায় দৃষ্টি করিলে, সে বিষয়ে আর কোনও সংশয় থাকিতে পারে না। যথা,

উক্তো নিয়োগো মমুনা নিসিদ্ধঃ স্বয়মেব তু। যুগহ্রাসাদশক্যোহয়ং কর্তুম্যৈবিধানতঃ ।। তপোজ্ঞানসমাযুক্তাঃ কৃতত্রেতাদিকে নরাঃ। দ্বাপরে চ কলৌ নৃণাং শক্তিহানিহি নিৰ্ম্মিতা ॥ অনেকধা কৃতাঃ পুত্রা ঋষিভির্যে পুরাতনৈ"। ন শক্যাস্তেহধুনা কর্তৃং শক্তিহীনৈরিদন্তনৈঃ । (৩৫)

একু স্বয়ং নিয়োগের বিধি দিয়াছেন, স্বয়ংই নিষেধ করিয়াছেন। যুগহ্রাস প্রযুক্ত, অঞ্চেরা যথাবিধানে নিয়োগ নির্ব্বাহ করিতে পারে না। সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর যুগে মনুষ্যেরা তপস্তা ও জ্ঞান সম্পন্ন ছিল; কিন্তু কলিতে মনুষ্যের শক্তিহানি হইয়াছে। পূর্বকালীন ঋষিরা যে নানাবিধ পুত্র করিয়া গিয়াছেন, ইদানীন্তন শক্তিহীন লোকেরা সে সকল পুত্র করিতে পারে না।

অর্থাৎ, মনু নিয়োগপ্রকরণের প্রথম পাঁচ বচনে নিয়োগের স্পষ্ট বিধি দিতেছেন, এবং অবশিষ্ট পাঁচ বচনে নিয়োগের স্পষ্ট নিষেধ করিতে- ছেন। এক বিষয়ে এক প্রকরণে এক জনের বিধি ও নিষেধ কোনও মতে সঙ্গত হইতে পারে নাঁ। এই নিমিত্ত, ভগবান্ বৃহস্পতি মীমাংসা করিয়াছেন, মনু নিয়োগের যে বিধি দিয়াছেন, তাহা সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর যুগের অভিপ্রায়ে; আর নিয়োগের যে নিষেধ করিয়াছেন, তাহা কলি যুগের অভিপ্রায়ে। অতএব দেখ, বৃহস্পতি মনুসংহিতার নিয়োগপ্রকরণের যেরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তদনুসারে নিয়োগধর্ম্মের বিধি নিষেধই যে এই প্রকরণের নিকৃষ্টার্থ, তাহাতে কোনও সন্দেহ থাকিতেছে না।

এ স্থলে ইহাও উল্লেখ করা আবশ্যক, নারদসংহিতা মনুসংহিতার  অবয়বশ্বরূপ। নারদ মর্মুপ্রণীত বৃহৎ সংহিতার সংক্ষেপ করিয়াছিলেন, বলিয়া, উহার নাম নারদসংহিতা হইয়াছে। যেমন, বর্তমান প্রচলিত মনুসংহিতা, ভৃগুপ্রোক্ত বলিয়া, ভৃগুসংহিতা নামে উল্লিখিত হইয়া থাকে। নারদসংহিতার আরম্ভে লিখিত আছে,

'ভগবান্ মনুঃ প্রজাপতিঃ সর্বভূতানুগ্রহার্থমাচারস্থিতি- হেতুভূতং শাস্ত্রং চকার। তদেতৎ শ্লোকশতসহস্রমাসীৎ। তেনাধ্যায়সহস্রেণ মনুঃ প্রজাপতিরুপনিবন্ধ্য দেবর্ষয়ে নারদায় প্রাযচ্ছৎ। স চ তস্মাদধীত্য মহত্ত্বান্নায়ং গ্রন্থঃ সুকরো মনুস্তাণাং ধারয়িতুমিতি দ্বাদশভিঃ সহস্রৈঃ সঞ্চিক্ষেপ তচ্চ' সুমতয়ে ভার্গবায় প্রাযচ্ছৎ। সচ তস্মাদধীত্য তথৈবায়ুহ্রাসাদল্লীয়সী 'মনুয়্যাণাং শক্তি রিতি জ্ঞাত্বা চতুর্ভিঃ সহস্রৈঃ সঞ্চিক্ষেপ। তদেতৎ সুমতিকৃতং মনুষ্য। অধীয়তে বিস্তরেণ শতসাহস্রং দেবগন্ধর্ব্বাদয়ঃ। যত্রায়মাছাঃ শ্লোকো ভবতি আসীদিদং তমোভূতং ন প্রাজ্ঞায়ত কিঞ্চন। তর্তঃ স্বয়ম্ভূর্ভগবান্ প্রাদুরাসীচ্চতুর্মুখঃ ॥ ইত্যেবমধিকৃত্য ক্রমাৎ প্রকরণাৎ প্রকরণমমুক্রান্তম্। তত্র তু নবমং প্রকরণং ব্যবহারো নাম য্যেমাং দেবর্ষির্নারদঃ সূত্রস্থানীয়াং মাতৃকাং চকার।

ভগবান্ মন্থ প্রজাপতি, সর্ব্বভূতের হিতার্থে, আচাররক্ষার হেতুভূত শীস্ত্র করিয়াছিলেন। সেই শাস্ত্র লক্ষ শ্লোকে রচিত। মনু প্রজাপতি সেই শাস্ত্র, সহস্র অধ্যায়ে সঙ্কলন করিয়া, দেবর্ষি নারদকে দেন। দেবর্ষি, মনুর নিকট সেই শাস্ত্র অধ্যয়ন, করিয়া, বহুকিস্তৃত গ্রন্থ মনুষ্যের অভ্যাস করা দুঃসাধ্য ভাবিয়া, দ্বাদশ সহস্র শ্লোকে সংক্ষেপে সারসংগ্রহ করেন। এই সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ তিনি ভৃগুবংশীয় সুমতিকে দেন। সুমতি, দেবর্ষির নিকট অধ্যয়ন করিয়া, এবং আবুহ্রাসসহকারে মনুষ্যের শক্তিহ্রাস হইতেছে দেখিয়া, চারি সহস্র শ্লোকে সংক্ষেপে সারসংগ্রহ করিলেন। মনুষ্যেরা সেই সুমতিকৃত মনুসংহিতা অধ্যয়ন করে। দেব গন্ধর্ব্ব প্রভৃতির লক্ষশ্লোকময় বিস্তৃত গ্রন্থ পাঠ করেন। তাহার প্রথম শ্লোক এই,

এই জগৎ অন্ধকারময় ছিল, কিছুই জানা যাইত না।

তদনন্তর ভগবান'চতুর্মুখ ব্রহ্মা আবির্ভূত হইল্কেন। এই রাগে আরম্ভ করিয়া, ক্রমে প্রকরণের পর প্রকরণ আশ্বব্ধ হইয়াছে; তন্মধ্যে নবম প্রকরণ ব্যবহার। দেবর্ষি নারদ সেই ব্যবহারপ্রকরণের এই প্রস্তাবনা করিয়াছেন।

দেখ, নারদসংহিতা মনুসংহিতার সারভাগমত্রে হইতেছে। নারদ লক্ষশ্লোকময় বৃহৎ মনুসংহিতার সার সঙ্কলন করিয়াছেন। পূর্ব্বে দর্শিত হইয়াছে, (৩৬) এই নারদপ্রোক্ত সংহিতাতে, অনুদ্দেশ প্রভৃতি পাঁচ স্থলে সীদিগের পুনর্ব্বার, বিবাহের বিধি আছে। সুতরাং, অনুদ্দেশ প্রভৃতি পাঁচপ্রকার বৈগুণ্য ঘাটলে, স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহ করিবার বিধি কেবল পরাশরের বিধি নহে, মনুরও বিধি হইতেছে। এই নিমিত্তই, মাধবাচার্য্যও পরাশরভাষ্যে নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে এই বচনকে মনুবচন বলিয়া উদ্ধৃত করিয়াছেন। যথা,

মনুরপি

নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ। পঞ্চস্বাপৎশু নারীণাং পতিরন্যো বিধীয়তে ॥ মমুও কহিয়াছেন,

স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, সংসারধর্ম পরিত্যাগ করিলে, ক্লীব স্থির হইলে, অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহ শাস্ত্রবিহিত।

অতএব, বিধবার বিবাহ, মশুর মতের বিরুদ্ধ না হইয়া, মনুর মতের অনুযায়ীই হইতেছে। ফলতঃ, যখন পরাশর, অবিকল মনুবচন স্বীয় সংহিতায় উদ্ধৃত করিয়া, বিধবাবিবাহের বিধি দিয়াছেন, তখন বিধবা- বিবাহকৈ মন্থবিরুদ্ধ বলিয়া ব্যাখ্যা করিতে উত্থত হওয়া বিড়ম্বনামাত্র।

৪- পরাশরের বিবাহবিধি বেদবিরুদ্ধ নহে।

কেহ কেহ (৩৭) পরাশরের বিবাহবিধিকে বেদবিরুদ্ধ বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা পাইয়াছেন। তাঁহাদের অভিপ্রায় এই যে, বেদ এ দেশের সর্ব্বপ্রধান শাস্ত্র; বদি পরাশরের বিবাহবিধি সেই সর্ব্বপ্রধান শাস্ত্র বেদের বিরুদ্ধ হয়, তাহা হইলে কি রূপে গ্রাহ্য করা যাইতে পারে। ভগবান্ বেদব্যাস মীমাংসা করিয়াছেন,

শ্রুতিস্মৃতিপুরাণানাং বিরোধো যত্র' দৃশ্যতে। তত্র শ্রৌতং প্রমাণস্তু তয়োর্দ্বৈধে স্মৃতিবরা।

যে স্থলে বেদ, স্মৃতি ও পুরাণের পরস্পর বিরোধ দৃষ্ট হইবেক, তথায় বেদই প্রমাণ; আর, স্মৃতি ও পুরাণের পরস্পর বিরোধ হইলে, স্মৃতিই প্রমাণ। প্রতিবাদী মহাশয়দের ধৃত বেদ এই, ষদেকস্মিনু যুপে দ্বে রশনে পরিব্যয়তি তস্মাঁদেকো দ্বে জায়ে বিন্দেত। যন্নৈকাং রশনাং দ্বয়ো煎পয়োঃ পরিব্যয়তি তস্মান্নৈকা ছৌ পতী বিন্দেত ॥ যেমন এক যুপে দুইরজ্জু বেষ্টন করা যায়, সেইরূপ এক পুরুষ দুই স্ত্রী বিবাহ করিতে পারে। যেমন এক রজ্জু ছুই যুপে বেষ্টন করা যায় না, সেইরূপ এক স্ত্রী দুই পুরুষ বিবাহ করিতে পারে না।

এই বেদ অবলম্বন করিয়া, তাঁহারা সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, স্ত্রীলোকের পুনর্ব্বার বিবাহবিবি বেদবিরুদ্ধ।"

এ স্থলে বক্তব্য এই যে, প্রতিবাদী মহাশয়েরা, এক স্ত্রী দুই পুরুষ বিবাহ করিতে পারে না, ইহা দৃষ্টি করিয়া, স্ত্রীলোকের পুনর্ব্বার বিবাহের বিধি বেদবিরুদ্ধ, এই যে মীমাংসা করিয়াছেন, তাহা বেদের অভি- প্রায়ানুযায়িনী নহে। উল্লিখিত বেদের তাৎপর্য্য এই যে, যেমন এক যুপে দুই রজ্জু এক কালে বেষ্টন করা যায়; সেইরূপ, এক পুরুষ দুই বা তদধিক স্ত্রী এক কালে বিবাহ করিতে পারে। আর, যেমন এক রজ্জু দুই যুপে এককালীন বেষ্টন করা যায় না; সেইরূপ, এক স্ত্রী দুই পুরুষ এককালীন বিবাহ করিতে পারে না। নতুবা, পতি মরিলেও, • স্ত্রী অন্য পুরুষকে বিবাহ করিতে পারে না, এরূপ তাৎপর্য্য নহে। এই তাৎপর্য্যব্যাখ্যা কেবল আমার কপোলকল্পিত নহে। মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ যে এক বেদবাক্য উদ্ধৃত করিয়াছেন, এবং ঐ বেদবাক্যের যে ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তদ্দ্বারা ঐরূপ তাৎপর্য্যই সুস্পষ্ট 0 প্রতীয়মান হইতেছে। যথা,

নৈকশস্থ্যা বহবঃ সহ পতয়ঃ।

এক স্ত্রীর এককালীন বহু পতি হইতে পারে না।

সহেতি যুগপদ্বহুপতিত্বনিষেধো বিহিতো ন তু সময়ভেদেন। (৩৮).

এই বেদ দ্বারা এক স্ত্রীর এককালীন বহুপতিবিবাহ নিষিদ্ধ হইতেছে, নতুবা সময়ভেদে বহুপতিবিবাহ দোষাবহ নহে।

অতএব, প্রতিবাদী মহাশয়েরা, বিধবাবিবাহকে বেদবিরুদ্ধ বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত, যে প্রয়াস পাইয়াছেন, তাহা সফল হইতেছে না। প্রতিবাদী মহাশয়দিগের ইহা বিবেচনা করা আবশ্যক ছিল, যদি বিধবাবিবাহ এককালেই বেদবিরুদ্ধ হইড, তাহা হইলে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এই তিন যুগে বিধবা বিবাহের প্রথা, প্রচলিত থাকিত না।

৫-বিবাহবিধায়ক বচন

পরাশরের, শঙ্খের নহে।

A

কেহু মীমাংসা করিয়াছেন, পরাশরের যে বচন অবলম্বন কারয়া, বিধবাবিবাহের ব্যবস্থা করা হইয়াছে, সেই বচনঃ-শঙ্খের, পরাশরের নহে; পরাশর দৃষ্টৎস্তবিধায় স্বীয় সংহিতাতে ঐ বচন উদ্ধৃত করিয়া- ছেন। (৩৯)

পরাশরসংহিতার বিবাহবিধায়ক বচনের এরূপ মীমাংসা করিবার তাৎপর্য্য এই যে, ঐ বচন যদি পরাশরের না হইল, তাহা হইরুল্ম আর ক্ষলি যুগে বিধবা প্রভৃতি স্ত্রীদিগের বিবাহের প্রসক্তিই থাকিল না; সুতরাং, কলি যুগে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ হইল না। প্রতিবাদী মহাশয় স্বয়ং সংস্কৃতজ্ঞ নহেন, এক প্রসিদ্ধ স্মার্ত্ত ভট্টাচার্য্যের (৪০) ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করিয়া, এই মীমাংসা করিয়াছেন। কি প্রণালীতে এই মীমাংসা করিয়াছেন, তৎপ্রদর্শনার্থ তদীয় পুস্তকের কিয়দংশ উদ্ধৃত হইতেছে।

কলিধৰ্ম্ম উপক্রমে শ্রীযুত বিদ্যাসাগর লিখিত, তন্মনোনীত, বিধবাবিবাহের প্রতিপাদক, অন্যমূলক পরাশরবচনের মর্মার্থ জ্ঞাত হইবার বাসনাতে আমি, বিশিষ্ট পণ্ডিত দ্বারা অবগত হইয়া, তন্মম্মার্থ নিয়ে যত্নে প্রকাশ করিতেছি। প্রথমতঃ, শ্রীবুত বিদ্যাসাগর ভট্টাচার্য, যে পরাশরসংহিতাধৃত এক বচন মাত্র অবলম্বন করিয়া, কলি যুগে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ ও অনিবার্য্য অবধার্যা করিয়াছেন, তাহার পূর্ব্বাপৰ্য্যাবলোকন করিয়া তাৎপৰ্য্য নিশ্চয় করিলে, অবশ্যই নিবাৰ্য্য হইবেক।

জ্যেষ্ঠো ভ্রাতা খদা তিষ্ঠেদাধানং নৈব চিন্তয়েৎ।

অনুজ্ঞাতস্তু কুব্বীত শঙ্খহস্থ্য বচনং যথা ।। নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতো। পঞ্চস্বাপৎস্থ নারীণাং পতিরন্যে। বিধীয়তে ॥

জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা র্যাকিতে, অগ্ন্যাধান চিন্তাও করিবেন না; অনুমতি থাকিলে

করিবেন; এই সমুদয় কহিয়া, দৃষ্টান্ত দৃষ্ট করাইতেছেন। শঙ্খ্য বচনং যথা নষ্টে মৃতে ইত্যাদি। পতি অনুদ্দেশ হইলে, মৃত হইলে, সন্ন্যাস আশ্রম করিলে, ক্লীব অবধারিত

হইলে, ও পতিত হইলে, এই পঞ্চ আপদবিষয়ে স্ত্রীদিগের অন্ত্য পতি বিধেয়

হইতেছে ইতি।

এতাদৃশ বচনে শাস্ত্রনিষিদ্ধ কর্ম্মের কর্তব্যতা বোধ হওয়ায় ভগান্ পরাশর মুনি চিন্তা করিলেন, আপত্কালে ঐরূপ কর্তব্যতা আর কোথাও বিধেয় হইয়াছে কি না; তৎপ্রতিপোষক দৃষ্টান্ত দ্বাপর যুগের ধর্ম্মপ্রতিপাদক যে শঙ্খ ক্ষবি নষ্টে স্থতে ইত্যাদি বচন দ্বারা বিধান করিয়াছেন যে সন্তান উৎপত্তি স্বারা পতি এবং আপনাকে স্বর্গগামী করাইবার নিমিত্ত আপত্কালে অতি নিষিদ্ধ যে পত্যস্তত্ব আশ্রয় করা তাহাও করিবেন; এই কথা; শঙ্খস্ত বচনং যথা বলিয়া অবিকল শঙ্খবচনকে দেখাইতেছেন ইত্যাদি।

শঙ্খ্য বচনং যথা বলিয়া, অবিকল শঙ্খবচন দেখাইতেছেন, প্রতিবাদী মহাশয় এইরূপ কহাতে, আপাততঃ অনেকেরই এই প্রতীতি জন্মিতে পারে, নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে এই বচন শঙ্খসংহিতাতে অবিকল আছে; বস্তুতঃ তাহা নহে; এই বচন শঙ্খসংহিতাতে নাই। তবে প্রতিবাদী মহাশয়, কি ভাবিয়া শঙ্খন্ত্য বচনং যথা বলিয়া, অবিকল শঙ্খবচন দেখাইতেছেন, বলিলেন, বুঝিতে পারিলাম না। যাহা হউক, ও স্থলের ওরূপ ব্যাখ্যা নহে; প্রকৃত ব্যাখ্যা এই,'

জ্যেষ্ঠো ভ্রাতা যদা তিষ্ঠেদাধানং নৈব চিন্তয়েৎ।

অনুজ্ঞাতস্তু কুব্বীত শঙ্খশ্য বচনং যথা ॥ জোই, ভ্রাতা বিদ্যমান থাকিতে, কনিষ্ঠ অগ্ন্যাধান করিবেক না; কিন্তু অনুমতি পাইলে করিবেক, শঙ্খের এই মত।

ইহাই এই বচনের প্রকৃত ব্যাখ্যা পরবচনের সহিত এ বচনের কোনও • সম্বন্ধ 'নাই। নতুবা, শঙ্খ্য বচনং যথা বলিয়া পরাশর শঙ্খবচন দৃষ্টান্ত • বিধায় স্বীয় সংহিতায় উদ্ধৃত করিয়াছেন, এরূপ তাৎপর্য্য নহে।

যদি অমুক্য বচনং যথা এই কথা আর কোনও সংহিতাতে না থাকিত, তাহা হইলেও কথঞ্চিৎ প্রতিবাদী 'মহাশয়ের ব্যাখ্যা সংলগ্ন হইতে পারিত। অগ্ন্যাধান বিষয়েই অত্রিসংহিতার কিয়দংশ উদ্ধৃত হইতেছে; তদৃষ্টে পাঠকবর্গ বিবেচনা করিতে পারিবেন, প্রতিরাদী মহাশয়ের ব্যাখ্যা সংলগ্ন হইতে পারে কি না। যথা,

জ্যেষ্ঠে। ভ্রাতা যদা নষ্টো নিত্যং রোগসমন্বিতঃ। • অনুজ্ঞাতস্তু কুব্বীত শঙ্খশ্য বচনং যথা। নাগ্নয়ঃ পরিবিন্দন্তি ন বেদা ন তপাংসি চ। নচ শ্রাদ্ধং কনিষ্ঠে বৈ বিনা চৈবাভ্যনুজ্ঞয়া ॥

• জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অনুদ্দেশ অথবা চিররোগী হইলে, কনিষ্ঠ অনুমতি লইয়া অগ্ন্যাধান করিবেক, শঙ্খের এই মত। জ্যেষ্ঠের অনুমতি ব্যতিরেকে, কনিষ্ঠকৃত অগ্ন্যাধান, বেদাধ্যয়ন, তপস্তা, শ্রাদ্ধ সিদ্ধ হয় না।

এ স্থলে, শঙ্খন্ত্য বচনং যথা, এই ভাগের পর, নষ্টে মুতে প্রব্রজিতে এই বচল থাকিলে, দৃষ্টান্তবিধায় শঙ্খবচন উদ্ধৃত করিবার কথা কথঞ্চিৎ সঙ্গত হইতে পারিত। যদি বল, শঙ্খন্ত বচনং যথা, এই ভাগের পর, নাগ্নয়ঃ পরিবিন্দস্তি, এই যে বচন আছে, ঐ বচনই শঙ্খের দৃষ্টান্ত- বিধায় অত্রিসংহিতায় উদ্ধৃত হইয়াছে; তাহাও সঙ্গত হইতে পারে না; "যেহেতু, নাগ্নয়ঃ পরিক্লিন্দস্তি, এই বচনার্থ, দৃষ্টান্ত স্বরূপে প্রতীয়মান না 'হইয়া, পূর্ব্ববচনার্থের হেতু স্বরূপে ব্যিস্ত দৃষ্ট হইতেছে। অত্রিসংহিতার অন্য স্থলেঞ্জ শঙ্খহ্য বচনং যথা, এইরূপ আছে। যথা,

গোত্রাহ্ম হিতানাঞ্চ পতিতানাং তথৈবচ।

অগ্নিনা ন চ সংস্কারঃ শঙ্খস্থ্য বচনং যথা ॥

যশ্চাণ্ডালীং দ্বিজে। গচ্ছেৎ কথঞ্চিৎ কামমোহিতঃ।

ত্রিভিঃ কৃচ্ছুৈবিশুধ্যেত প্রাজাপত্যানুপূর্ব্বশঃ।।॥ গো এবং ব্রাহ্মণ কর্তৃক হত ও পতিতদিগের অগ্নিসংস্কার করিবেক না, শঙ্খের

এই মত। যে দ্বিজ, কামমোহিত হইয়া, চাণ্ডালী গমন করিবেক, সে প্রাজাপত্যবিধানে তিন কৃচ্ছু দ্বারা শুদ্ধ হইবেক।

এ স্থলেও, শঙ্খস্ত বচনং যথা, এই রূপ লিখিত আছে। কিন্তু পরবচনকে শঙ্খবচন বলিয়া দৃষ্টান্তবিধায় উদ্ধৃত বলা কোনও ক্রমে সংলগ্ন হইয়া উঠে না। পূর্ব্ব বন্ধুত্তের সহিত পর বচনের কোনও সংস্রব নাই। দুই বচনে দুই বিভিন্ন বিষয় নির্দিষ্ট দৃষ্ট হইতেছে। কিঞ্চ,

পৃষ্টা রজস্বলান্যোন্যং ব্রাহ্মণ্যা ব্রাহ্মণী চ যা। একরাত্রং নিরাহারা পঞ্চগব্যেন শুধ্যতি ॥ পৃষ্টা রজস্বলান্যোন্সং ব্রাহ্মণ্যা ক্ষত্রিয়া চ যা। ত্রিরাত্রেণ বিশুদ্ধিঃ শ্যাদ্ব্যাসশ্য বচনং যথা । পৃষ্টা রজস্বলান্যোন্যং ব্রাহ্মণ্যা বৈশ্যসম্ভবা। চতুরাত্রং নিরাহারা পঞ্চগব্যেন শুধ্যতি ॥ পৃষ্টা রজস্বলান্যোন্যং ব্রাহ্মণ্যা শুদ্রসম্ভবা। ষড়াত্রেণ বিশুদ্ধিঃ শ্যাব্রাহ্মণী কামকারতঃ ।। অকামতশ্চরেদ্দৈবং ব্রাহ্মণী সর্ববতঃ পৃশেৎ। চতুর্ণামপি বর্ণানাং শুদ্ধিরেযা প্রকীর্তিতা । (৪১)।

ব্রাহ্মণী যদি রজস্বলা ব্রাহ্মণীকে পূর্ণ করে, একরাত্র নিরাহারা হইয়া পঞ্চগব্য দ্বারা শুদ্ধা হইবেক।

ব্রাহ্মণী যদি রজস্বলা ক্ষত্রিয়াকে স্পর্শ করে, ত্রিরাত্রে শুদ্ধা হইবেক, ব্যাসের এই মত।

ব্রাহ্মণী যদি রজস্বলা বৈস্তাকে স্পর্শ করে, চারি রাত্রি নিরাছারা থাকিয়া পঞ্চগব্য দ্বারা শুদ্ধা হইবেক।

ব্রাহ্মণী যদি রজস্বলা "ক্ষুদ্রাকে স্পর্শ করে, ছয় রাত্রে শুদ্ধা হইবেক। ইচ্ছ। পূর্ব্বক স্পর্শ করিলে এই বিধি। দৈবাৎ স্পর্শ করিলে, দৈব প্রায়শ্চিত্ত করিবেক। চারি বর্ণের এই শুদ্ধিব্যবস্থা নির্দিষ্ট হইল।

প্রতিবাদী মহাশয়ের ব্যাথ্যানুসারে, এ স্থলে তৃতীয় বচন ব্যাসবচন বুলিয়া উদ্ধৃত হইয়াছে বলিতে হয়, কারণ, পূর্ব্ব বচনের শেষে, ব্যাসন্ত বচনং যথা, এই কথা লিখিত আছে। কিন্তু, দ্বিতীয় বচনের শ্লেষে, ব্যাস্য বচনং যথা, আছে বলিয়া, তৃতীয় বচনকে ব্যাসবচন বলিয়া দৃষ্টান্তবিধায় উদ্ধৃত করিয়াছেন, বলিবার পথ নাই; যেহেতু, পাঁচ বচনেই এক এক স্বতন্ত্র ব্যবস্থা নিদ্দিষ্ট হইয়াছে।

আর, যদিও অঙ্গ সংহিতাতে, অমুকস্ত্য বচনং যথা বলিলে, কথঞ্চিৎ অন্যের বচন দৃষ্টান্তবিধায় উদ্ধৃত হইয়াছে বলিয়া ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু, অপঃ খরনখস্পৃষ্টাঃ পিবেদাচমনে দ্বিজঃ। সুরাং পিবতি সুব্যক্তং যমশ্য বচনং যথা ॥

যদি ব্রাহ্মণ গর্দভের নখস্পৃষ্ট জলে আচমন করে, তাহা হইলে, স্পষ্ট হুরাপান করা হয়, যমের এই মত।

স্তেয়ং কৃত্বা সুবর্ণস্থ্য রাজ্ঞে শংসেত মানবঃ। ততো মুষলমাদায় স্তেনং হুন্যাত্ততো নৃপঃ।।॥ ১২০ ॥ যদি জীবতি স স্তেনস্ততঃ স্তেয়াৎ প্রমুচ্যতে। অরণ্যে চীরবাসা বা চরেৎ ব্রহ্মহণো ব্রতম্। ১২১ ॥ সমালিঙ্গেৎ স্ত্রিয়ং বাপি দীপ্তাং কৃত্বায়সা কৃতাম্। এবং শুদ্ধিঃ কুতা স্তেয়ে সংৰৰ্ত্তবচনং যথা ॥ ১২২ ॥

মনুষ্য শুবর্ণ অপহরণ করিয়া রাজার নিকট কহিবেক; রাজা মুষল লইয়া চোরকে প্রহার করিবেন। যদ্ধি চোর জীবিত থাকে, অপহরণ পাপ হইতে মুক্ত হয়। অথবা চীর পরিধান করিয়া, অরণ্যে প্রবেশিয়া, ব্রহ্মহত্যার প্রায়শ্চিত্ত করিবেক। কিংবা লৌহময়ী স্ত্রী প্রতিকৃতিকে, অগ্নিতে প্রদীপ্ত করিয়া, আম্মিঙ্গন * কুরিবেক। এইরূপ করিলে, সুবর্ণাপহরণপাপ হইতে মুক্ত হয়, সংঘর্ডের এই মত। এই দুই স্থলে, অন্যের বচন দৃষ্টান্তবিধায় উদ্ধৃত্ত হইয়াছে, ইহা বলিবার কোনও উপায় দেখিতেছি না। কারণ, যম ও সংবৰ্ত্ত, স্ব স্ব সংহিতাতেই, যমস্ত বচনং যথা, এবং সংকর্তবচনং যথা, এরূপ কহিয়াছেন।

বস্তুতঃ, যে যে স্থলে অমুকস্ত বচনং যথা এই কথা লিখিত থাকে, তথায় অমুকের এই মত এই অর্থই অভিপ্রেত, পরবর্তী বচন দৃষ্টান্ত- বিধায় অন্য সংহিতা হইতে উদ্ধৃত হইয়াছে, এমন অর্থ অভিপ্রেত নহে। যদি সে তাৎপর্য্যে অমুক্য বচনং যথা বলা হইত, তাহা হইলে যম ও সংবর্ত স্ব স্ব সংহিতাতে, যমন্ত্য বচনং যথা, সংবর্তবচনং যথা, এরূপ কহিতেন না! বোধ করি, প্রতিবাদী মহাশয়, নিতান্ত ব্যগ্র হইয়া, অর্থ ও' তাৎপর্য্য অনুধাবন না করিয়াই, পরাশরংহিতার মর্ম্ম ব্যাখ্যা করিয়াছেন।

অতএব, নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে এই বচন শঙ্খের, পরাশরের নহে; সুতরাং, বিধবা প্রভৃতি স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহ দ্বাপর যুগের আপদ্ধৰ্ম্ম হইল, কলি যুগের ধর্ম্ম নহে; এই ব্যবস্থা সংস্থাপন করিবার নিমিত্ত, প্রতিবাদী মহাশয় যে প্রয়াস পাইয়াছেন, তাহা সফল হইতেছে না।

৬-বিবাহবিধায়ক বচন

পরাশরের, কৃত্রিম নহে।

-

কেহ মীমাংসা করিয়াছেন (৪২)

১ কলি যুগে বিধবাবিবাহ যদি পরাশরের সম্মত হটুত, তাহা হইলে তিনি বৈধব্যদশাকে দণ্ড বলিয়া ব্যাখ্যা করিতেন না।

২ স্বামী ক্লীর হইলে, স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহ করা যদি পরাশরের অভিমত হইত, তাহা হইলে পরাশরসংহিতাতে ক্ষেত্রজ পুত্রের বিধান থাকা কি রূপে সম্ভব হইতে পারে; কারণ, স্ত্রী ক্লীব স্বামী পরিত্যাগ

• করিয়া বিবাহ করিলে, পরের স্ত্রী হইল; ক্লীবের স্ত্রী রহিল না;

সুতরাং ক্লীবের ক্ষেত্রজপুত্রোৎপাদনের সম্ভাবনা থাকিল না।

৩ অতএব বিবাহবিধায়ক বচন পরাশরের নহে; পরাশরের হইলে পূর্ব্বাপর বিরোধ হইত না। ভারতবর্ষের দুরবস্থা কালে, হিন্দু রাজাদিগের ইচ্ছানুসারে, ঐ কৃত্রিম বচন সংহিতামধ্যে নিবেশিত • হইয়াছে।

কলি যুগে বিধবাবিবাহ পরাশরের সম্মত হইলে, তিনি বৈধব্য দশাকে দণ্ড বলিয়া বিধান করিতেন না, এ কথার তাৎপর্য্য এই যে, যদি পতির মৃত্যু হইলে পর, স্ত্রী পুনর্ব্বার বিবাহ করিতে পারে, তবে এস পতিবিয়োগে দুঃখিতা হইবে কেন; যদি দুঃখের কারণ না হুইল, তবে বিধবা, হওয়া কি রূপে দণ্ড বলিয়া ব্যাখ্যাত হইতে পারে। এই আপত্তি কোনও মতে বিচারসিদ্ধ হইতেছে না; কারণ, পুনর্ব্বার বিবাহের সম্ভাবনা আছে বলিয়া, পতিবিয়োগ হইলে, স্ত্রী যে তদ্বিরহে অসম্ভ যাতনা ও দুঃসহ ক্লেশ পাইবে না, ইহা নিতান্ত অনুভবকিরুদ্ধ।

দেখ, পুরুষেরা, যত বার স্ত্রীবিয়োগ হয়, তত বারই বিবাহ করিতে পারে, এবং প্রায় করিয়াও থাকে; অথচ, স্ত্রীবিয়োগ হইলে, পুরুষ আপনাকে হতভাগ্য বোধ করে, শোকে একান্ত কাতর ও মোহে নিতান্ত বিচে'নে হয়। যখন পুনর্ব্বার বিৱাহের সম্ভাবনা অথবা নিশ্চয় সত্ত্বেও, পুরুষ স্ত্রীবিয়োগে এত শোকাভিভূত হয়, 'তখন যে স্ত্রীজাতির মন, প্রণয়াস্বাদন ও শোকানুভব বিষয়ে, পুরুষের অপেক্ষা অনেক, অংশে শ্রেষ্ঠ, সেই স্ত্রী, পুনর্ব্বার বিরাহের সম্ভাবনা থাকিলে, পতি- 'বিয়োগকে অতিশয় ক্লেশকর অথবা অতিশয়, 'দুর্ভাগ্যের বিষয় বোধ করিবেক না, ইহা কোনও মতে সুম্ভব হইতে পারে না। ফলতঃ, যে স্ত্রীপুরুষসম্বন্ধ সংসারাশ্রমে সকল সুখের নিদান, সেই স্ত্রী পুরুষ উভয়ের মধ্যে একের মৃত্যু হইলে, অপরের অসহ্য ক্লেশ হইবেক, ইহার সন্দেহ কি। তবে যাবজ্জীবন বৈধব্য ভোগ করিতে হইলে, যত যাতনা, কিছু কালের নিমিত্ত হইলে, তত যাতনা নহে, যথার্থ বটে। কিন্তু কিছু কালও যে অস্য যাতনা ভোগ করা দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাহার কোনও সন্দেহ নাই। আর, প্রথম স্ত্রীর বিয়োগের পর, যদি পুরুষ দ্বিতীয়বার বিবাহ করে, এবং সেই নব প্রণয়িনীর প্রণয়পাশে বন্ধ হয়, তথাপি সে পূর্ব্ব প্রণয়িনীর প্রণয় ও অনুরাগের বিষয় একবারে বিস্তৃত হইতে পারে না। যখন যখন ঐ পূর্ব্ব বৃত্তান্ত তাহার স্মৃতিপথে আরূঢ় হয়, তখনই তাহার চিরনির্ব্বাণ শোকানল, অন্ততঃ, কিয়ৎ ক্ষণের নিমিত্ত প্রদীপ্ত হইয়া উঠে। অতএব, স্ত্রীজাতির সৌভাগ্যক্রমে, যদি বিধবা- বিবাহের প্রথা প্রচলিত হইয়া উঠে, তাহা হইলে স্ত্রী, পুনর্ব্বার বিবাহের সম্ভাবনা আছে বলিয়া, পতিবিয়োগে দুঃখিতা হইবেক না, এবং, পুনরায় বিবাহ করিয়া পর স্বামীর প্রণয়িনী হইলে, পূর্ব্বস্বামীর প্রণয় ও অনুরাগ একবারে বিস্তৃত হইবেক, অথবা সময়বিশেষে স্মরণ হইলে, তাহার হৃদয়ে শোকানলের সঞ্চার হইবেক না, এ কথা, কোনও ক্রমে হৃদয়ঙ্গম হয় না। যদি বল, যে স্ত্রী দরিদ্র, ব্যাধিত, মূর্খ স্বামীর প্রতি • অনাদর ও অশ্রদ্ধা (দর্শন করে, সে তাদৃশ স্বামীর মৃত্যু হইলে, তন্বিয়োগে দুঃখিতা হইবেক কেন। সুতরাং, ঈদৃশ স্থলে বৈধব্যদশাকে। দণ্ড বলিয়া বিধান করা কি রূপে সংলগ্ন হইতে পারে। এ আপত্তিও বঙ্গত হইতে পারে না। কারণ, এতাদৃশ স্থলে স্ত্রীকে প্রিয়বিয়োগজন্য হঃখ অনুভব করিতে হইবেক না, যথার্থ বটে; কিন্তু বৈধব্যনিবন্ধন চার যে সমন্ত অসহ্য যন্ত্রণা আছে, তাহার ভোগ কে নিবারণ করিবেক। বিশেষতঃ, স্ত্রী, দরিদ্র প্রভৃতি স্বামীকে অনাদর করিয়া, একবার মাত্র বিধবা হইয়া নিস্তার পাইতেছে না; ঐ অপরাধে তাহাকে পুনঃ পুনঃ বিধবা হইতে হইতেছে। অন্য অন্য বারে, তাহাকে বৈধব্যনিবন্ধন সর্ব্বপ্রকার যন্ত্রণাই ভোগ করিতে হইবেক। অতএব, পুনর্ব্বার বিবাহের সম্ভাবনা থাকিলে, বৈধব্য দশাকে দণ্ড স্বরূপে নির্দেশ করা যাইতে পারে না, এ কথা বিচারসিদ্ধ হইতেছে না; সুতরাং বিবাহবিধায়ক বচনের সহিত এ বচনের বিরোধ ঘটিতেছে না। "বিধবা হওয়া কোনও মতে ক্লেশকর না হইলেই, 'বৈধব্য দশাকে দণ্ড বলিয়া ব্যাখ্যা করা অসঙ্গত হইতে পারিত, এবং তাহা হইলেই উভয় বচনের পরস্পর বিরোধ উপস্থিত হইত।

আর, ইহাও বিবেচনা করা আবঞ্চক,

দরিদ্রং ব্যাধিতং মূর্খং ভৰ্ত্তারং যা ন মল্ল্যতে।

সা মৃতা জায়তে ব্যালী-বৈধব্যঞ্চ পুনঃ পুনঃ । যে নারী দরিদ্র, রোগী, মূর্খ স্বামীর প্রতি অনাদর প্রদর্শন করে, সে মরিয়া সর্পী হয় এবং পুনঃ পুঃ বিধবা হয়।

ঋতুস্নাতা তু যা মারী ভারং নোপসর্পতি। . সা মৃতা নরকং যাতি বিধবা চ পুনঃ পুনঃ ॥

যে নারী ঋতুস্নান করিয়া স্বামীর সেবা না করে, সে মরিয়া নরকে যায় ও পুনঃ পুনঃ বিধবা হয়।

অদুষ্টাপতিতাং ভার্য্যাং যৌবনে যঃ পরিত্যজেৎ।" সপ্ত জন্ম ভবেৎ স্ত্রীত্বং বৈধব্যঞ্চ পুনঃ পুনঃ ॥

যে ব্যক্তি অদুষ্ট অপতিত ভাৰ্য্যাকে যৌবন কালে পরিত্যাগ করে, সে সাত জন্ম স্ত্রী হয় ও পুনঃ পুনঃ বিধবা হয়।

এই তিন বচনেই যখন পুনঃ পুনঃ বিধবা হয় লিখিত আছে, তখন বিধবাবিবাহ। নধায়ক বচনের সহিত বিরোধ না হইয়া, বরং এই তিন বচন দ্বারা বিধবাবিবাহের পোষকতাই হইতেছে। বিধবার পুনর্ব্বাব বিবাহের বিধান না থাকিলে, স্ত্রীর পুনঃ পুনঃ বিধবা হওয়া কি রূপে সম্ভবিতে পারে। প্রতিবাদী মহাশয়, পুনঃ পুনঃ বিধবা হয়, এই স্থলে, প্রতিজন্মে বিধবা হয়, এইরূপ ব্যাখ্যা লিখিয়াছেন। কিন্তু ঐ ব্যাখ্যা প্রথম বচনে সম্যক্ সংলগ্ন হইতেছে না; কারণ, মরিয়া যখন সর্পী হইল, তখন জন্মে জন্মে বিধবা হইয়া বৈধব্য যন্ত্রণা ভোগ করিবার সম্ভাবনা কোথায় রহিল। তৃতীয় বচনেও পুনঃ পুনঃ এই দুই পদের প্রয়োগ নিতান্ত ব্যর্থ হইয়া উঠে; যেহেতু, সপ্ত জন্ম ভবেৎ স্ত্রীত্বং বৈধব্যঞ্চ, সাত জন্ম স্ত্রী ও বিধবা হয়, এই মাত্র কহিলেই চরিতার্থ হয়, পুনঃ পুনঃ এই দুই পদের কোনও প্রয়োজন থাকে না। সাত জন্ম স্ত্রী ও বিধবা হয় বলিলেই, প্রতিজন্মে বিধবা হয়, সুতরাং বোধ হইয়া যায়। সাত জন্ম স্ত্রী হয় ও পুনঃ পুনঃ বিধবা হয়, ইহাতে প্রতি জন্মেই পুনঃ পুনঃ বিধবা হয়, ইহাই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। সুতরাং, ইহা বিধবার বিবাহের বিরোধক না হইয়া, বরং বিলক্ষণ পোষকই হইতেছে। আর ইহাও অনুধাবন করা আবশ্যক, পুনঃ পুনঃ শব্দে বারংবার এই অর্থই বুঝায়, জন্মে জন্মে এ অর্থ বুঝায় না। পুনঃ পুনঃ কহিতেছে, পুনঃ পুনঃ দেখিতেছে, পুনঃ পুনঃ লিখিতেছে, ইত্যাদি যে যে স্থলে পুনঃ পুনঃ শব্দের প্রয়োগ থাকিবেক, সর্ব্বত্রই বারংবার এই অর্থই

বুঝাইবেক। তবে যে বিষয় এক জন্মে ঘটিয়া উঠে না, সেই বিষয়ে

পুনঃ পুনঃ শব্দের প্রয়োগ থাকিলে, তাৎপর্য্যাধীন জন্মে জন্মে এই অর্থ

বুঝাইতে পারে; যেমন, পুনঃ পুনঃ নরকে যায় বলিলে, জন্মে জন্মে

নরকে যায়, এই অর্থ তাৎপর্য্যবশতঃ প্রতীয়মান হয়। তাহার কারণ

এই যে, এক জন্মে বারংবার নরকগমন সম্ভব নহে; সুতরাং প্রতিজন্মে 'নরক গমন হয়, এইরূপ অর্থ বোধ হয়। এস্থলেও, পুনঃ পুনঃ শব্দের বারংবার এই অর্থই বুঝাইতেছে; জন্মে জন্মে এ অর্থ শব্দের অর্থ নহে; তাৎপর্য্যাধীন ঐ অর্থ প্রতীয়মান হয় মাত্র। সেইরূপ, যদি পরাশরসংহিতাতে বিধবা প্রভৃতি স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহ্ণের বিধি না থাকিত, তাহা হইলে, এক জন্মে পুনঃ পুনঃ বিধবা হওয়া সম্ভব হইত না; সুতরাং, তাৎপর্য্যাধীন, জন্মে জন্মে বিধবা হয়, এইরূপ অর্থ করিতে হইত। কিন্তু যখন পরাশরসংহিতাতে বিধবা প্রভৃতি স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহের বিধি আছে, তখন এক জন্মেই পুনঃ পুনঃ বিধবা হওয়া সম্পূর্ণ সম্ভব হইতেছে; সুতরাং, পুনঃ পুনঃ শব্দের জন্মে জন্মে *এ অর্থ করিবার কোনও আবন্তকতা থাকিতেছে না। পুনঃ পুনঃ শব্দের বারংবার এই অর্থ এক জন্মে অসঙ্গত না হইলে, জন্মে জন্মে এ অর্থ করিতে হয় না।

ক্লীব স্বামী পরিত্যাগ করিয়া, স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহ করা পরাশরের * সম্মত হইলে, পরাশরসংহিতাতে ক্ষেত্রজ পুত্রের বিধান থাকা কি রূপে সম্ভব হইতে পারে, এই আপত্তিও বিচারসিদ্ধ হইতেছে না। স্ত্রী ক্লীব পতি ত্যাগ করিয়া বিবাহ করিতে পারে, যধার্থ বটে; কিন্তু যদি বিবাহ না করে, অথরা বিবাহের পূর্ব্বে, পূর্ব্ব স্বামীর বংশরক্ষার্থে, তদীয় অনুমতিক্রমে, শাস্ত্রবিধান অনুসারে, নিযুক্ত ব্যক্তি দ্বারা ক্ষেত্রজ- পুত্রোৎপাদন আবশ্যক হইলে, অনায়াসে সম্পন্ন হইতে পারে। আর, স্বামী, পুত্রোৎপাদন না করিয়া মরিবার সময়, যদি স্ত্রীকে ক্ষেত্রজ- পুত্রোৎপাদনের অনুমতি দিয়া যান, তাহা হইলেও, যদি ঐ স্ত্রী পুনর্ব্বার বিবাহ করে, ঐ বিবাহের পূর্ব্বে, পূর্ব্ব স্বামীর বংশরক্ষার্থে, ক্ষেত্রজ পুত্রের উৎপাদন সম্পন্ন হইতে পারে। আর, পরাশর যে পাঁচ বিষয়ে স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহের বিধি দিয়াছেন, সেই সেই বিষয়ে, যদিই ক্ষেত্রজপুত্রোৎপাদন নিতান্ত অসম্ভব বল, তাহাতেই বা ক্ষতি কি। তাহা হইলেও, ক্ষেত্রজপুত্রোৎপাদনের স্থলের অভাব হইতেছে না। যেহেতু, স্বামী চিররোগী হইলে, অথবা স্বামীর বীজ পুত্রোৎপাদনশক্তি- বর্জিত হইলে, বংশরক্ষার্থে, তদীয় নিদেশক্রমে, শাস্ত্রবিধান অনুসারে, নিযুক্ত ব্যক্তি দ্বারা ক্ষেত্রজপুত্রোৎপাদন সম্ভব হইতে পারে। অতএব, স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহের বিধান থাকিলে, ক্ষেত্রজপুত্রোৎপাদনের বিধান থাকা সম্ভব নহে, এই আপত্তি উত্থাপন করিয়া, বিবাহবিধায়ক বচনের সহিত বিরেয়ণ ঘটনা কোনও ক্রমে বিদ্বারসহ হইতেছে না। অপরঞ্চ, প্রথম পুস্তকে, নন্দ পণ্ডিতের মতানুসারে, ক্ষেত্রজশব্দঘাটিত পুত্রবিষয়ক বচনের যেরূপ ব্যাখ্যা করা গিয়াছে, তদনুসারে, পরাশরমতে, কলি যুগে ঔরস, দত্তক, কৃত্রিম এই ত্রিবিধ পুত্রমাত্র প্রতিপন্ন হয়, ক্ষেত্রজ পুত্রের বিধান সিদ্ধ হয় না। যাহা হউক, ক্ষেত্রজ পুত্রের বিধান সিদ্ধ হউক, আর না হউক, কোনও পক্ষেই, এই বচনের বিবাহ বিধায়ক বচনের সহিত বিরোধ স্থাপন হইতে পারে না।

পরাশর যে বচনে বৈধব্য দশাকে দণ্ড বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন, এবং যে বচনে ক্ষেত্রজ শব্দ আছে, ঐ দুই বচনের সহিত বিবাহবিধায়ক বচনের বিরোধ ঘটাইয়া, এবং এক জনের গ্রন্থে পরস্পর বিরুদ্ধ বরুন থাকা সম্ভব নহে, এই আপত্তি উত্থাপন করিয়া, প্রতিবাদী মহাশয় বিবাহবিধায়ক বচনকে কৃত্রিম নির্ধারিত করিয়াছেন; এবং ঐ কৃত্রিম বচন, ভারতবর্ষের দুরবস্থাকালে, হিন্দুরাজাদিগের ইচ্ছানুসারে, সংহিতা- মধ্যে নিবেশিত হইয়াছে, এই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। কিন্তু, যখন ঐ তিন বচনের পরস্পর বিরোধ মাই, তখন পরস্পর বিরোধরূপ আপত্তি উত্থাপন করিয়া, বিবাহবিধায়ক বচনকে কৃত্রিম বলিবার, এবং সময়- বিশেষে, ব্যক্তি বিশেষের ইচ্ছানুসারে, সংহিতামধ্যে নিবেশিত হইয়াছে বলিয়া সিদ্ধান্ত করিবার, অধিকার নাই। মাধবাচার্য্য বহু কালের লোক; তিনি, পরাশরসংহিতার ব‍্যাখ্যাকান্দ্রে ঐ বচনের আভাস দিয়াছেন ও ব্যাখ্যা করিয়াছেন। তিনি ঐ বচনকে কৃত্রিম বলিয়া জানিতেন না। অতএব, প্রতিবাদী মহাশয়কে, অন্ততঃ, ইহা স্বীকার করিতে হইবেক, নিদানপক্ষে, মাধবাচার্য্যের সময়ে, ঐ বচন কৃত্রিম বলিয়া পরিগণিত ছিল না। আর, আপন মতের বিপরীত হইলেই, যদি ক্বত্রিম বলিতে আরম্ভ করা যায়, তাহা হইলে, লোকের মত এত ভিন্ন ভিন্ন যে, প্রায় সকল বচনই ক্রমে ক্রমে কৃত্রিম হইয়া উঠিবেক।

৭-পরাশরের বচন

বিবাহবিধায়ক, বিবাহনিষেধক নহে।

কেহ মীমাংসা করিয়াছেন, পরাশর বিবাহের বিধি দেন নাই। পতিরন্তো বিধীয়তে, এই স্থলে বিধীয়তে পদের পূর্ব্বে অকার ছিল লোপ হইয়াছে, তাঙ্গতে ন বিধীয়তে এই অর্থ লাভ হইতেছে। ন বধীয়তে বলিলে, বিধি নাই এই অর্থ বুঝায়। সুতরাং, পরাশরবচনে, বিধবার বিবাহের বিধি না হইয়া, নিষেধই সিদ্ধ হইতেছে। (৪৩)

এইরূপ কল্পনা দ্বারা, স্পষ্ট বিধিবাক্যকে নিষেধপ্রতিপাদক বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করা অসাধ্যসাধন প্রয়াস মাত্র। প্রতিবাদী মহাশয়ের অভিপ্রেত নিষেধপ্রতিপাদন, কোনও মতে, সঙ্গত বা সংহিতা- কর্তা ঋষির অভিপ্রেত বলিয়া প্রতিপন্ন হইতে পারে না। বোধ হয়, নারদসংহিতায় দৃষ্টি থাকিলে, প্রতিবাদী মহাশয় এরূপ নিষেধ কল্পনা করিতে কদাচ প্রবৃত্ত হইতেন না। কারণ, নষ্টে মুতে প্রব্রজিতে, এই 'বরুনের বিধীয়তে এই স্থলে যদি অবিধীয়তে এইরূপ বলেন, এবং তদ্বারা বিধবা প্রভৃতি স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহের নিষেধ প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা পান, তাহা হইলে, অনুদ্দেশ প্রভৃতি স্থলে, ব্রাহ্মণজাতীয়া স্ত্রী, সন্তান হইলে আট বৎসর, নতুবা চারি বৎসর, প্রতীক্ষা করিয়া অ্য 'ব্যক্তিকে বিবাহ করিবেক, এ এ কথা কি রূপে সঙ্গত হইতে পারে (৪৪)। নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে, এই বচনে বিবাহের বিধি সিদ্ধ না হইলে, তৎপরবচনে অনুদ্দেশস্থলে আট বৎসর, অথবা চারি বৎসর, প্রতীক্ষা করিয়া বিবাহ করিবেক, এই বিশেষ বিধি দেওয়া নিতান্ত উন্মত্তের : কথা হইয়া উঠে। তদ্ব্যতিরিক্ত, বিধীয়তে ভিন্ন'অবিধীয়তে এরূপ পদ- প্রয়োগ কুত্রাপি দৃষ্ট হয় না। ব্যাকরণ অনুসারে, আখ্যাতিক পদের সহিত নক্সমাস হয় না; সুতরাং, এরূপ পদ অসিদ্ধ ও অপ্রসিদ্ধ, ইহা প্রতিবাদী স্বাশয় স্বয়ং স্বীকার করিয়াছেন। পরিশেষে, উপায়ান্তর অবলম্বন করিয়া, ব্যাকরণ অনুসারে পদ সিদ্ধ করিবার নিমিত্ত, যে প্রয়াম পাইয়াছেন, তাহাও সফল হইয়া উঠে নাই। আধ্যাতিক পদের সহিত নঞসমাস হয় না, এই নিমিত্ত, ভয় পাইয়া, তিনি নসমাসের প্রণালী পরিত্যাগ করিয়া কহিয়াছেন, বিধীয়তে এই আধ্যাতিক পদের সহিত নঙ্গমাস হইয়াছে এরূপ নহে; অর্থাৎ, বিধীয়তে এই আখ্যাতিক পদের সহিত নিষেধবাচক ন শব্দের সমাস করিয়া, ন স্থানে অ হইয়া, অবিধীয়তে এই পদ হয় নাই; অ এই এক নিষেধবাচক যে অব্যয় শব্দ আছে, তাহাই বিধীয়তে পদের পূর্ব্বে স্বতন্ত্র এক পদস্বরূপ আছে, এবং ব্যাকরণের সূত্র অনুসারে, অন্ত্যো এই পদের অন্তস্থিত ওকারেন পর অ এই পদের লোপ হইয়াছে। কিন্তু, ব্যাকরণের এক সূত্রে যেমন পদের অন্তস্থিত একার ও ওকারের পরবর্তী অকারের লোপের বিধি আছে; সেইরূপ, ব্যাকরণের সূত্রান্তরে, (৪৫) একস্বর অব্যয়ঃ শব্দের সন্ধিনিষেধ আছে; অর্থাৎ অআইঈ উ ঊ প্রভৃতি একস্বর অব্যয় শব্দের সন্ধি ও সন্ধিবিহিত লোপ দীর্ঘ আকারব্যত্যয় প্রভৃতি কোশও কার্য্য হয় না। সুতরাং, অবিধীয়তে এ স্থলে অ এক স্বতন্ত্র পদ কল্পনা করিলে, ব্যাকরণ অনুসারে, ঐ অকারের লোপ হইতে পারে না। অতএব, প্রতিবাদী মহাশয়, আপন অভিপ্রেত অর্থ সিদ্ধ করিবার নিমিত্ত, একান্ত ব্যগ্র হইয়া, যেমন পদের অন্তস্থিত একার ও ওকারের পরবর্তী অকারের লোপবিধায়ক সূত্রের অনুসন্ধান করিয়াছিলেন; সেইরূপ, একস্বর অব্যয় শব্দের সন্ধিনিষেধক সূত্রটির বিষয়েও অনুসন্ধান করা আবশ্যক ছিল। যদি বলেন, খ্যাকরণে একস্বর অব্যয় শব্দের সন্ধিনিষেধ আছে বটে, কিন্তু ঋষিরা ব্যাকরণের বিধিনিষেধ প্রতিপালন।

করিয়া চলেন না; সুতরাং, ব্যাকরণে, একম্বর অব্যয় শব্দের সন্ধিনিষেধ থাকিলেও, ঋষিবাক্যে তাদৃশ সন্ধি হইবার বাধা কি। তাহা হইলে, প্রতিবাদী মহাশয়ের প্রতি আমার জিজ্ঞাস্ত এই যে, ব্যাকরণে আধ্যাতিক পদের সহিত নঞ্জসমাসের নিষেধ থাকিলে, ঋষিবাক্যে তাদৃশ নক্সমাস হইবার বাধা কি। ফলতঃ, প্রতিবাদী মহাশয়, যখন ব্যাকরণে আধ্যাতিক পদের সহিত নসমাসের নিষেধ দেখিয়া, ব্যাকরণের নিয়ম লঙ্ঘন পূর্ব্বক, ঋষিবাক্যে নঙ্গমাস করিতে অসম্মত হইয়া, ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে পদ সিদ্ধ করিতে উত্থত হইয়াছেন;' তখন ব্যাকরণে একস্বর অব্যয় শব্দের সন্ধিনিষেধ দেখিয়া, এক্ষণে গত্যন্তর নাই ভাবিয়া, ঋষিবাক্যে একস্বর অব্যয় শব্দের সন্ধি স্বীকার পূর্ব্বক, ব্যাকরণের নিয়ম লঙ্ঘন স্বীকারে প্রবৃত্ত হইলে, নিতান্ত অবৈয়াকরণের কর্ম্ম করা হয়।

• প্রতিবাদী মহাশয় এই অসঙ্গত কল্পনার পোষকস্বরূপ কহিয়াছেন, যদি অবিধীয়তে না বলিয়া, বিধীয়তে বল, অর্থাৎ পরাশরবচনে বিবাহের নিষেধ না বলিয়া, বিবাহের বিধি প্রতিপন্ন করিতে উত্থত হও, তাহা হইলে পরাশরসংহিতাঁর পূর্ব্বাপর বিরুদ্ধ হইয়া উঠে। পরাশরু স্ত্রী- লোকের বৈধব্যদশাকে, অপরাধবিশেষের দণ্ড বলিয়া উল্লেখ ও ঋতুমতী কন্ঠা বিবাহে দোষ কীর্ত্তন করিয়াছেন্স। বিধবার বিবাহ পরাশরের অভিমত হইলে, তিনি কখনই বৈধব্যদশাকে দণ্ড বলিয়া বিধান, অথবা ঋতুমতীবিবাহে দোষ কীর্ত্তন করিতেন না।

: বৈধব্যদশাকে দণ্ড বলিয়া বিধান করাতে, বিধবার বিবাহবিধায়ক বচনের সহিত বিরোধ হইতে পারে কি না, তাহা পূর্ব্বে প্রদর্শিত 'হইয়াছে (৪৬)। এক্ষণে ঋতুমতীবিবাহে দোষ কীৰ্ত্তন থাকাতে, পূর্ব্বাপর বিরুদ্ধ হইতে পারে কি না, তাহার বিচার করা আবশ্যক। প্রতিবাদী মহাশয়ের অভিপ্রায় এই বোধ হয়, বিধবার বিবাহ প্রচলিত হইলে, যে সকল বিধবা কন্যার ঋতু দর্শন হইয়াছে, তাহাদেরও বিবাহ হইবেক। কিন্তু, যখন পরাশর তাদৃশ কম্ভার বিবাহে দোষ কীৰ্ত্তন করিয়াছেন, তখন বিধবাবিবাহ কি রূপে পরাশরের অভিপ্রেত হইতে পারে। অভিপ্রেত ইলে, তাদৃশ কল্পাবিবাহকারী ব্যক্তি তাঁহার মতে নিন্দনীয় ও প্রায়শ্চিত্তাই হইত না।

প্রতিবাদী মহাশয়ের এই আপত্তি কোনও মতে সঙ্গত ও বিচারসহ হইতেছে না; কারণ, পরাশর ঋতুমতী কন্যার বিবাহে যে দোষকীর্তন করিয়াছেন, তাহা কন্তার প্রথম বিবাহপক্ষে, বিধণা প্রভৃতির বিবাহ- পক্ষে নহে; ঐ প্রকরণের পূর্ব্বাপর পর্য্যালোচনা করিলে, ইহাই নিঃসন্দেহে প্রতীয়মান হয়। যথা,

অষ্টবর্ষা ভবেদ গৌরী নববর্ষ। তু রোহিণী। দশবর্ষা ভবেৎ কন্যা অত উর্দ্ধং রজস্বলা। প্রাপ্তে তু দ্বাদশে বর্ষে যঃ ক্যাং ন প্রযচ্ছতি। মাসি মাসি রজস্তস্যাঃ পিবস্তি পিতরঃ স্বয়ম্। মাতা চৈব পিতা চৈব জ্যেষ্ঠো ভ্রাতা তথৈব চ। ত্রয়স্তে নরকং যান্তি দৃষ্টু। ক্যাং রজস্বলাম্॥, যস্তাং সমুন্বহেৎ কন্যাং ব্রাহ্মণোহজ্ঞানমোহিতঃ। অসম্ভায্যে। অপাঙ্ক্তেয়ঃ স জ্ঞেয়ে। বৃষলীপতিঃ ॥ যঃ করোত্যেকরাত্রেণ বৃষলীসেবনং দ্বিজঃ।

স ভৈক্ষ্যভুগ্‌ জপন্নিত্যং ত্রিভিব্বর্ষৈকিশুদ্ধ্যতি । অষ্টবর্ষা ক্যাকে গৌরী বলে; নববর্ষা কল্পাকে, রোহিণী বলে; দশবর্ষীয়া কন্তাকে কস্তা বলে; তৎপরে, অর্থাৎ একাদশাদি বর্ষে, কক্তাকে রজস্বলা বলে। দ্বাদশ বর্ষ উপস্থিত হইলে, যে কস্তাদান না করে, তাহার পিতৃলোকেরা মাসে মাসে সেই কঞ্চার ঋতুকালীন শোণিত পান করেন। কন্তাকে রজস্বলা দেখিলে, মাতা, পিতা ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তিন জন নরকে যান। যে ব্রাহ্মণ, অজ্ঞানান্ধ হইয়া, সেই কন্তাকে বিবাহ করে, সে অসম্ভাষ্য, অপাংক্তেয় ও বৃষলীপতি, অর্থাৎ তাহার সহিত সম্ভাষণ করিতে নাই, এক পংক্তিতে বসিয়া ভোজন করিতে নাই, এবং তাহার সেই স্ত্রীকে বৃষ্ণলী বলে। যে দ্বিজ এক রাত্রি বৃষলী

সেবন করে, সে তিন বৎসর প্রতিদিন ভিক্ষান্নভক্ষণ ও জপ করিয়া শুদ্ধ হয়। অষ্টম, নবম, দশম বর্ষে কন্যা দান করিবেক দ্বাদশ বর্ষ উপস্থিত হইলে কল্পাদান না করিলে, পিতা, মাতা ও জ্যেষ্ঠ শ্রাতার নরক চুয়, এবং যে ঐ কন্যাকে বিবাহ করে, সে নিন্দনীয় ও প্রায়শ্চিত্তাই হয়; এ কথা যে কেবল প্রথম বিবাহের পক্ষে, তাহাতে কোনও সন্দেহ হইতে পারে না। প্রতিবাদী মহাশয়, এই প্রকরণের পাঁচ বচনের মধ্যে, শেষ দুই বচন মাত্র আপন অভিপ্রেত বিষয়ের পোষক দেখিয়া উদ্ধৃত করিয়াছেন, এবং বিধবার বিবাহপক্ষে ঘটাইবার চেষ্টা করিয়াছেন। কোনও প্রকরণের দুই বচন, এক বচন, অথবা বচনার্দ্ধ, চেষ্টা করিলে, সকল বিষয়েই ঘটাইতে পারা যায়; কিন্তু প্রকরণ পৰ্য্যালোচনা করিলে, সেইরূপ ঘটনা নিতান্ত অঘটনঘটনা হইয়া উঠে। আার, পূর্ব্বদর্শিত নারদসংহিতাতে যখন সন্তান হইলেও স্ত্রীলোকের বিবাহের বিধি আছে, এবং

অক্ষতা চু ক্ষতা চৈব পুনর্ভূঃ সংস্কৃতা পুনঃ। কি অক্ষতযোনি, কি ক্ষতযোনি, যে স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহ সংস্কার হয়, তাহাকে পুনর্ভু বলে।

এই যাজ্ঞবন্ধ্যবচনে যখন ক্ষতযোনিরও বিবাহসংস্কারের অনুজ্ঞা দৃষ্ট হইতেছে, তখন বিবাহের পূর্ব্বে কল্লার ঋতুদর্শন হইলে, পিতৃপক্ষে ও • পতিপক্ষে যে সকল তোষকীৰ্ত্তন আছে, সে সমস্ত দোষ ঘটাইবার বৃথা চেষ্টা পাইয়া, বিধবালিবাহক্তক নিষিদ্ধ বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে উদ্যত হওয়া কোনও ফলদায়ক হইতে পারে না।

৮-দীর্ঘতমার নিয়ম স্থাপন বিধবাবিবাহের নিষেধবোধক নহে।

কেহ কহিয়াছেন (৪৭), অপরঞ্চ পঞ্চম বেদ মহাভারতের আদিপর্ব্বতে ইহলোকে স্ত্রীলোকের এক পতি মাত্র নিয়ম সংস্থাপন করিয়াছেন। যথা

দীর্ঘতমা উবাচ। অদ্যপ্রভৃতি মৰ্য্যাদা ময়া লোকে প্রতিষ্ঠিতা। এক এব পতিনার্য্যা যাবজ্জীবং পরায়ণম্ ॥ ৩১ ॥ মৃতে জীবতি বা তস্মিন্নাপরং প্রাপুয়ান্নরম্। অভিগম্য পরং নারী পতিষ্যতি ন সংশয়ঃ । ৪২ ॥

মহর্ষি দীর্ঘতমা কহিয়াছেন। আমি অদ্যাবধি লোকেতে মর্য্যাদা স্থাপিতা করিলাম। নারীর কেবল এক গতি হইবেক যাবজ্জীবন তাহাকে আশ্রয় করিবে। সেই পতি মরিলে কিংবা জীবিত থাকিলে নারী অন্ত নরকে প্রাপ্ত! হইবে না। নারী অন্ত পুরুষকে গমন করিলে নিঃসন্দেহ পতিতা হইবে।

ইহা কহিবার তাৎপর্য্য এই যে, যখন মহাভারতে, স্ত্রীলোকের পক্ষে, যাবজ্জীবন একমাত্র পতিকে অবলম্বন করিয়া, কালক্ষেপণ করিবার নিয়ম ও তদতিক্রমে নরক গমনের ব্যবস্থা দৃষ্ট হইতেছে, তখন স্ত্রী পুনর্ব্বার বিবাহ করিতে পারে, এরূপ কথা, কি রূপে সঙ্গত হইতে পারে।

প্রতিবাদী মহাশয়, দীর্ঘতমার নিয়মস্থাপন দৃষ্টে, স্ত্রীদিগের যথা- বিধানে পুনর্ব্বার বিবাহের নিষেধ বোধ করিলেন কেন, বলিতে পারি না। দীর্ঘতমার বাক্যের যথার্থ অর্থ এই যে, আজ অবধি আমি 'লোকে এই নিয়ম স্থাপন করিলাম যে, কেবল পতিই স্ত্রীলোকের 'যাবজ্জীবন পরায়ণ হইবেক, অর্থাৎ স্ত্রী পতিপরায়ণা হইয়াই জীবন কাল ক্ষেপণ করিবেক। স্বামী মরিলে, অথবা জীবিত থাকিলে, স্ত্রী অন্য পুরুষে উপগতা হইবেক না; অন্য পুরুবে উপুল্লতা হইলে, নিঃসন্দেহ পতিতা হইবেক। এ স্থলের তাৎপর্য্য এই যে, স্ত্রী কেবল পতিকে অবলম্বন করিয়া জীবনযাপন করিবেক, স্বামীর জীবদ্দশায়, অথবা মরণানন্তর, অন্য পুরুষে উপগতা অর্থাৎ ব্যভিচারিণী হইলে, পতিতা হইবেক।

পূর্ব্ব কালে, ব্যভিজ্ঞারদোব দোষু বলিয়া গণ্য ছিল না, ইহা মহা- 'ভারতের ইলান্তরে সুস্পষ্ট লক্ষিত হইতেছে। যথা,

ঋতাবুতৌ রাজপুত্রি স্ত্রিয়া ভর্তা পতিব্রতে। নাতিবর্ত্তব্য ইত্যেবং ধর্ম্মং ধৰ্ম্মবিদো বিদুঃ ॥ শেষেষন্যেষ কালেষু স্বাতন্ত্র্যং স্ত্রী কিলার্হতি। ধর্ম্মমেবং জনাঃ সন্তঃ পুরাণং পরিচক্ষতে ॥ (৪৮)

পাণ্ডু কুস্তীকে কহিতেচ্ছন, হে পতিব্রতে রাজপুত্রি! ধর্মক্তেরা ইহাকে ধর্ম্ম বলিয়া জানেন যে, প্রত্যেক ঋতুকালে স্ত্রী স্বামীকে অতিক্রম করিবেক না: অবশিষ্ট অন্য অঙ্ক সময়ে, স্ত্রী সচ্ছন্দচারিণী হইতে পারে: সাধু জনেরা এই প্রাচীন ধর্ম্মের কীর্ত্তন করিয়া থাকেন।

অর্থাৎ, ঋতুকালে স্ত্রী, সন্তানশুদ্ধির নিমিত্ত, স্বামীরই সেবা করিবেক, • অন্য পুরুষে উপগতা হইবেক না; ঋতুকাল ভিন্ন অন্য সময়ে, স্ত্রী ব্লচ্ছন্দে অন্ত পুরুষে উপুণতা হইতে পারে। এই ব্যবহার, পূর্ব্বকালে, সাধুসমাজে ধৰ্ম্ম বলিয়াও পরিগৃহীত ছিল। স্ত্রীজাতির এই সচ্ছন্দ বিহারের যে প্রথা পূর্ব্বাবধি প্রচলিত ছিল, দীর্ঘতমা, সেই প্রথা রহিত করিবার নিমিত্ত, নিয়মস্থাপন করিয়াছেন। দীর্ঘতমা স্পষ্ট কহিতেছেন, স্বামী জীবিত থাকিতে, অণুবা স্বামী মরিলে, স্ত্রী অন্ত্য পুরুষে উপগতা হইবেক না, অন্য পুরুষে উপগতা হঈলে, পতিতা হইবেক। ইহা দ্বারা স্ত্রীর অন্য পুরুষে উপগতা অর্থাৎ ব্যভিচারিণী হইবার নিবারণই স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে; নতুবা, শাস্ত্রের বিধানুসারে, পুরুষান্তরকে আশ্রয় কীঙ্গত, পারিবেক না, এমন তাৎপর্য্য নহে। ঐ প্রকরণের পূর্ব্বাপর পর্য্যালোচনা করিলে, চিরপ্রচলিত ব্যতিচার ধর্ম্মের নিষেধ ভিন্ন; যথাবিধানে পুরুষান্তরাশ্রয়ণ অর্থাৎ পত্যন্তর গ্রহণের নিষেধ বোধ হয় না। যথা,

পুত্রলাভাচ্চ সা পত্নী ন তুতোষ পতিং তদা। প্রদ্বিষন্তীং পতির্ভার্য্যাং কিং মাং দেক্ষীতি চাব্রবীৎ।

প্রদ্বেষ্যুবাচ ।

ভাৰ্য্যায়া ভরণান্তর্ত্ত। পালনাচ্চ পতিঃ স্মৃতঃ। অহং ত্বাং ভরণং কৃত্বা জাত্যন্ধং সস্তুতং সদা। নিত্যকালং শ্রমেণার্তা ন ভরেয়ং মহাতপঃ। তস্যাস্তদ্বচনং শ্রুত্বা ঋষিঃ কোপসমন্বিতঃ। প্রত্যুবাচ ততঃ পত্নীং প্রদ্বেষীং সসুতাং তদা। নীয়তাং ক্ষত্রিয়কুলং ধনার্থশ্চ ভবিষ্যতি।

প্রদ্বেষ্যুবাচ । হুয়া দত্তং ধনং বিপ্র নেচ্ছেয়ং দুঃখকারণম্। যথেস্টং কুরু বিপ্রেন্দ্র ন ভরেয়ং স্থা পুরা ॥ দীর্ঘতমা উবাচ। "

অদ্য প্রভৃতি মৰ্য্যাদা ময়া লোকে প্রতিষ্ঠিতা। এক এব পতির্নার্য্য। যাবজ্জীবং পরায়ণম্ ॥ মৃতে জীবতি বা তস্মিন্নাপরং প্রোপুয়ান্নরম্। অভিগম্য পরং মারী পতিষ্যতি ন সংশয়ঃ । অপতীনান্ত নারীণামদ্য প্রভৃতি পাতকম্।

*যছাস্তি চেদ্ধনং'সর্ববং বৃথাভোগ। ভবন্ত তাঃ। অকীর্ত্তিঃ পরিবাদাশ্চ নিত্যং তাসাং ভবস্তু বৈ ।। ইতি তদ্বচনং শ্রুত্বা ব্রাহ্মণী ভূশকোপিতা। গঙ্গায়াং নীয়তামেষ পুভ্রা ইত্যেবমূত্রবীৎ ॥ লোভমোহাভিভূতাস্তে পুভ্রান্তং গৌতমাদয়ঃ। বদ্ধোড়পে পরিক্ষিপ্য গঙ্গায়াং সমবাস্বজন । কম্মাদহ্মশ্চ বৃদ্ধশ্চ ভর্ত্তব্যোংয়মিতি স্মহ।. চিন্তয়িত্বা ততঃ ক্রুরাঃ প্রতিজন্মরথো গৃহাম্ ॥ (৪৯)

দীর্ঘতমার পত্নী, পুত্রলাভ হেতু, আর পতির সন্তোষ জন্মাইতেন না। তথন দীর্ঘতমা পত্নীকে দ্বেষ করিতে দেখিয়া কহিলেন, কেন তুমি আমাকে থেব কর। প্রদ্বেষী কহিলেন, স্বামী স্ত্রীর ভরণ পোষণ করেন, এই নিমিত্ত তাহাকে ভর্তা • বলে, এবং পালন করেন, এই নিমিত্ত পতি বলে। কিন্তু তুমি জন্মান্ধ; আমি, তোমার ও তোমার পুত্রগণের ভরণ পোষণ করিয়া, সতত যৎপরোনাস্তি ক্লেশ পাইতেছি; আর আমি শ্রম করিয়া তোমাদের ভরণ পোষণ করিতে পারিব না। গৃহিণীর এই বাক্য শুনিয়া, ঋষি কোপাবিষ্ট হইয়া নিজ পত্নী প্রস্বেধী ও পুত্রগণকে কহিলেন, আমাকে রাজকুলে লইয়া চল, তাহা হইলে ধন লাভ হইবেক। প্রদ্বেষী কহিলেন, আমি তোমার উপার্জিত ধন চাহি না, তোমার যাহা ইচ্ছা হয় কর; আমি পূর্বের মত ভরণ পোষণ করিব না। দীর্ঘতমা কহিলেন, আজ অবধি আমি লোকে এই নিয়ম স্থাপন করিলাম, কেবল পতিই স্ত্রীলোকের যাবজ্জীবন পরায়ণ হইবেক। স্বামী মরিলে, অথবা জীবিত থাকিতে, স্ত্রী অন্য পুরুষে উপগতা হইবেক না; অন্ত্য পুরুষে উপগতা হইলে, নিঃসন্দেহ পতিতা হুইবেক। আজ অবধি যে সঙ্কল স্ত্রী, পতিকে ত্যাল করিয়া অন্ত পুরুষে উপগতা হইবেক, তাহাদের পাতক হইবেক; সমস্ত ধন থাকিতেও, তাহারা ভোগ করিতে পাইবেক না, এবং নিয়ত তাহাদের অষশ ও অপবাদ হইবেক। ব্রাহ্মণী, দীর্ষতমার এই বাক্য শ্রবণে অত্যন্ত কুপিতা হইয়া, পুত্রদিগকে কহিলেন, "ইহাকে গঙ্গায় ভাসাইয়া দাও। গৌতম প্রভৃতি পুত্রেরাও, লোভে ও মোহে অভিভূত হইয়া, পিতাকে ভেলায় বাঁধিয়া, এবং অন্ধ ও বৃদ্ধকে কেন ভরণ পোষণ করিব এই বিবেচনা করিয়া, গঙ্গায় ক্ষেপণ করিল, এবং তৎপরে গৃহে প্রত্যাগমন করিল।

ইহাতে স্পষ্ট দৃষ্ট হইতেছে, দীর্ঘতমার ব্রাহ্মণী জন্মান্ধ পতির ভরণ পোষণ করিতে অত্যন্ত কষ্ট পাইতেন, আর কষ্ট সহ্য করিতে না পারিয়া, অতঃপর তাঁহার ভরণ পোষণ করিতে অসম্মতা হইলেন। তদ্দর্শনে দীর্ঘতমা কুপিত হইয়া এই নিয়ম স্থাপন করিলেন, কেবল পতিই স্ত্রীলোকের 'যাবজ্জীবন পরায়ণ হইবেক; স্ত্রী, গতির প্রতি অনাদর করিয়া, অন্য পুরুষে উপগতা হইলে, পতিতা হইবেক। তিনি, আপনার প্রতি স্বস্ত্রীর অনাদর দেখিয়া মনে ভাবিয়াছিলেন, এ আমাকে পরিত্যাগ করিয়া, পুরুষান্তর অবলম্বন পূর্ব্বক, স্বেচ্ছানুসারে সম্ভোগসুখে কাল হরণ করিবার পথ দেখিতেছে। এই কারণে কুপিত হইয়া, স্ত্রীদিগের চিরপ্রচলিত স্বেচ্ছাবিহার রহিত করিবার নিমিও, এই নিয়ম স্থাপন করিলেন। পূর্ব্ব কালে, স্ত্রীজাতির স্বেচ্ছাবিহার সাধুসমাজে সনাতন ধৰ্ম্ম বলিয়া পরিগণিত ছিল, কেহ উহাতে দোষ দর্শন' করিতেন না। তদনুসারে, দীর্ঘতমার পত্নী সেই সনাতন ধর্ম্ম অবলম্বন করিলে, সাধুসমাজে নিন্দনীয় ও অধৰ্ম্মগ্রন্ত হইতেন, না। এই নিমিত্ত, দীর্ঘতমা নিয়ম করিলেন, অতঃপর যে স্ত্রী অন্ত্য পুরুষে উপগতা অর্থাৎ ব্যভিচারিণী হইবেক, সে পতিতা ও অপবাদগ্রস্তা হইবেক। যদি দীর্ঘতমার নিয়ম স্থাপনের এরূপ তাৎপর্য্য বল যে, স্ত্রী কোনও মতেই, অর্থাৎ শাস্ত্রের বিধানানুসারেও, পুরুবাস্তুরাশ্রয়ণ 'অর্থাৎ পত্যন্তর গ্রহণ করিতে পারিবেক না, তাহা হইলে যে দীর্ঘতমা এই নিয়ম স্থাপন করিলেন, তিনিই স্বয়ং এই নিয়ম স্থাপনের অব্যবহিত পরে, কি রূপে বলি রাজার মহিষী সুদেষ্ণার গর্ভে ক্ষেত্রজপুত্রোৎপাদনের ভার গ্রহণ করিলেন। যথা,

সোহমুস্রোতস্তদা বিপ্রঃ প্লবমানো যদৃচ্ছয়া। জগাম সুবহুন দেশানন্ধস্তেনোভূপেন হ॥

তন্তু রাজা বলিনাম সর্বধর্মবিদাং বরঃ। অপশ্যন্মজ্জনগতঃ স্রোতসাভ্যাসমাগতম্।। জগ্রাহ চৈনং ধৰ্ম্মাত্মা বলিঃ সত্যপরাক্রমঃ। জ্ঞাত্বৈবং সচ বত্রেহর্থ পুত্রার্থে ভরতর্ষভ ॥ সন্তানার্থং মহাভাগ ভার্য্যাম্পু মম মানদ। পুত্রান ধৰ্ম্মার্থকুশলানুৎপাদয়িতুমর্হসি ।। এবমুক্তঃ ম তেজস্বী তং তথেত্যুক্তবানৃষিঃ। তস্মৈ স রাজা স্বাং ভার্য্যাং সুদেষ্ণাং প্রাহিণোত্তদা ৫ (৫০)

সেই অন্ধ ব্রাহ্মণ, স্রোতে ভাসিতে ভাসিতে, নানা দেশ অতিক্রম করিলেন। সবধর্ম্মজ্ঞশ্রেষ্ঠ রাজা বলি সেই কালে গঙ্গায় স্নান করিতেছিলেন, তিনি স্রোত দ্বার। নিকটাগত সেই ব্রাহ্মণকে দেখিতে পাইলেন, এবং তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করিয়া, *সবিশেষ অবগত হইয়া, পুত্রের নিমিত্ত এই প্রার্থনা করিলেন, হে মহাভাগ! আপনি আমার ভার্য্যাতে ধৰ্ম্মপরায়ণ কার্য্যদক্ষ পুত্র উৎপাদন করুন। তেজস্বী দীর্ঘতমা, এই রূপে প্রার্থিত হইয়া, অঙ্গীকার করিলেন। তখন রাজা স্বীয় ভাৰ্য্যা সুদেষ্ণাকে তাঁহার নিকট প্রেরণ করিলেন।

অতএব দেখ, যদি দীর্ঘতমার নিয়মস্থাপনের এরূপ অভিপ্রায় হইত শাস্ত্রের বিধানানুসারেও, স্ত্রীর পুরুষান্তরসেবন পাতিত্যজনক হইবেক, তাহা হইলে তিনি, স্বয়ং নিয়মকর্তা হইয়া, কখনই বলিরাজার ভাৰ্য্যায় পুস্রোৎপাদনে সম্মত হইতেন না; অবশ্যই পুদ্রপ্রার্থী বলি- রাজাকে পুত্রোৎপাদনার্থে স্বস্ত্রীর পরপুরুষে নিয়োগ নিবারণ করিতেন। আর, মহাভারতেরই হলান্তরে দৃষ্ট হইতেছে, (৫১) অর্জুন নাগরাজ ঐরাবতের বিধবা ক্যার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন। যদি বিধবা প্রভৃতি স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহের নিষেধ দীর্ঘতমার নিয়মস্থাপনের উদ্দেশ্য হইত, তাহা হইলে, ঐ নিয়মস্থাপনের পর, নাগরাজ ঐরাবত অর্জুনকে বিধবা কন্যা দান করিতেন না, এবং অর্জুনও নাগরাজের বিধবা কন্যার পাণিগ্রহণে সম্মত হইতেন না। বস্তুতঃ, পুত্রাভাবে ক্ষেত্রজপুত্রোৎপাদন ও পতিবিয়োগে স্ত্রীর পত্যন্তরগ্রহণ শাস্ত্রবিহিত; সুতরাং, উক্ত উভয় বিষয়ের সাংস্র দীর্ঘতমার লোকব্যবহারমূলক অশাস্ত্রীয় ব্যভিচারধর্ম্মের নিবারক নিয়ম স্থাপনের কোনও সংস্রব ঘটিতে পারে না। অতএব, স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে, দীর্ঘতমা পূর্ব্বকালাবধি প্রচলিত ব্যভিচার- দোষের নিবারণার্থেই নিয়মস্থাপন করিয়াছিলেন।

উদ্দালক মুনির পুত্র শ্বেতকেতুও, ব্যভিচারধর্ম্মের নিবারণার্থে, এইরূপ

নিয়ম স্থাপন করিয়াছিলেন। যথা,, অনাবৃতাঃ কিল পুরা স্ত্রিয় আসন বরাননে। কামচারবিহারিণ্যঃ স্বতন্ত্রাশ্চারুহাসিনি। তাসাং ব্যুচ্চরমাণানাং কৌমারাৎ সুভগে পতীন্। নাধৰ্ম্মোহ ভূদ্বরারোহে স হি ধৰ্ম্মঃ পুরাভবৎ ।। প্রমাণদৃষ্টে। ধৰ্ম্মোহয়ং পূজ্যতে চ মহর্ষিভিঃ। উত্তরেষু চ রস্তোরু কুরুদ্ব্যাপি পূজ্যতে। স্ত্রীণামনুগ্রহকরঃ স হি ধৰ্ম্মঃ সনাতনঃ ॥ অস্মিংস্তু লোকে নচিরান্মাদেয়ং শুচিস্মিতে। স্থাপিতা যেন যম্মাচ্চ তন্মে বিস্তরতঃ শৃণু ॥ বন্ধুবোদ্দালকো নাম মহর্ষিরিতি নঃ শ্রুতম্। শ্বেতকেতুরিতি খ্যাতঃ পুত্রস্তস্যাভবম্মুনিঃ ॥ ম্যাদেয়ং কৃতা তেন ধর্ম্ম্যা বৈ শ্বেতকেতুনা। কোপাৎ কমলপত্রাক্ষি যদর্থং তং নিবোধ মে॥ শ্বেতকেতোঃ কিল পুরা সমক্ষং মাতরং পিতুঃ। জগ্রাহ ব্রাহ্মণঃ পাণৌ গচ্ছাব ইতি চাত্রবীৎ ॥ ঋষিপুত্রস্ততঃ কোপং চকারামর্ষচোদিতঃ। মাতরং তাং তথা দৃষ্টু। নীয়মানাং বলাদিব ।।

ক্রুদ্ধং তন্তু পিতা দৃষ্টা শ্বেতকেতুমুবাচ হ। মা তাত কোপং কার্যীস্তমেষ ধৰ্ম্মঃ সনাতনঃ ॥ অনাবৃতা হি সর্বেষাং বর্ণানামঙ্গনা ভুবি। যথা গাম্ভ স্থিতাস্তাত স্বে স্বে বর্ণে তথা প্রজাঃ ॥ ঋষিপুত্রোহথ তং ধৰ্ম্মং শ্বেতকেতুর্ন চক্ষমে। চকার চৈব মর্য্যাদামিমাং স্ত্রীপুংসয়োর্তুবি। মানুষেষ্ণু মহাভাগে নত্বেবাহ্যেযু জন্তুন্নু ৮. তদাপ্রভৃতি মৰ্য্যাদা স্থিতেয়মিতি নঃ শ্রুতম্ ॥ *ব্যুচ্চরন্ত্যাঃ পতিং নার্য্যা অ্যপ্রভৃতি পাতকম্। ভ্রূণহত্যাসমং ঘোরং ভবিষ্যত্যসুখাবহম্। ভার্য্যাং তথা বুচ্চরতঃ কৌমারব্রহ্মচারিণীম্। পতিব্রতামেতদেব ভবিতা পাতকং ভুবি। পত্যা নিযুক্তা যা চৈব পত্নী পুভ্রার্থমেবচ। ন করিষ্যতি তস্যাশ্চ ভবিষ্যতি তদেব হি॥ ইতি তেন পুরা ভীরু মর্য্যাদ। স্থাপিতা বলাৎ। উদ্দালকস্য পুত্রেণ ধর্ম্ম্যা বৈ শ্বেতকেতুনা ।। (৫২)

পাণ্ডু কুস্তীকে কহিতেছেন, হে সুমুখি। চারুহাসিনি! পূর্ব্ব কালে স্ত্রীলোকেরা অরুন্ধা, স্বাধীনা ও সচ্ছন্দবিহারিণী ছিল। পতিকে অতিক্রম করিয়া পুরুষান্তরে উপগতা হইলে, তাহাদেলা অধৰ্ম্ম হইত না। পূর্ব্ব কালে এই ধৰ্ম্ম ছিল; ইহা প্রামাণিক ধর্ম্ম; ঋষিরা এই দৰ্ম্ম মাস্ত করিয়া থাকেন; উত্তর কুরু দেশে অদ্যাপি এই ধৰ্ম্ম, মার্ক্স ও প্রচলিত আছে। এই সনাতন ধর্ম্ম স্ত্রীদিগের পক্ষে অত্যন্ত অনুকূন্স। যে ব্যক্তি যে কারণে লোকে এই নিয়ম স্থাপন করিয়াছেন, তাহা বিস্তারিত কহিতেছি, শুম। শুনিয়াছি, উদ্দালক নামে মহর্ষি ছিলেন; খেতকেতু নামে তাঁহার এক পুত্র জন্মে। সেই খেতকেতু, যে কারণে কোপা- বিষ্ট হইয়া, এই ধৰ্ম্মযুক্ত নিয়ম স্থাপন করিয়াছেন, তাহা শুন। একদা উদ্দালক, শ্বেতকেতু ও খেতকেতুর জননী তিন জনে উপবিষ্ট আছেন। এমন সময়ে, এক ব্রাহ্মণ আসিয়া খেতকেতুর মাতার হস্তে ধরিলেন, এবং এস যাই বলিয়া, একান্তে লইয়া গেলেন। ঋষিপুত্র, এই রূপে জননীকে নীয়মানা দেখিয়া, সহ্য করিতে পারিয়া, অভান্ত কুপিত হইলেন। উদ্দালক শ্বেতকেতুকে কুপিত 3 দেখিয়া কহিলেন, বৎস! কোপ করিও না, এ সনাতন ধর্ম। পৃথিবীতে সকল বর্ণেরই স্ত্রী অরক্ষিতা। গোজাতি যেমন সচ্ছন্দবিহার করে, মনুষ্যেরাও সেই। রূপ স্ব স্ব বর্ণে সচ্ছন্দবিহার করে। ঋষিপুত্র শ্বেতকেতু, সেই ধৰ্ম্ম সঙ্গ করিতে না পারিয়া, পৃথিবীতে স্ত্রী পুরুষের সম্বন্ধে এই নিয়ম স্থাপন করিয়াছেন। হে মহাভাগে! আমগ্ন, শুনিয়াছি, তদবধি এই নিয়ম মনুষ্যজীতির মধ্যে প্রচলিত আছে, কিন্তু অনন্ত অন্য জন্তুদিগের মধ্যে নহে। অতঃপর যে নারী পতিকে অতিক্রম করিবেক, তাহার ভ্রূণহত্যাসমান অসুখজনক ঘোর পাতক জন্মিবেক। আর, যে পুরুব বাল্যাবধি সাধুশীলা পতিব্রত। পত্নীকে অতিক্রম করিবেক, তাহারও ভূতলে এই পাতক হইবেক। এবং যে স্ত্রী, পতি কর্তৃক পুক্তার্থে নিযুক্তা হইয়া, তাঁহার আজ্ঞ। প্রতিপালন না করিবেক, তাহারও এই পাতক হইবেক। হে ভয়শীলে। সেই উদ্দালকপুত্র শ্বেতকেতু, বল পূর্ব্বক, পূর্ব্ব কালে এই ধর্ম্মযুক্ত নিয়ম স্থাপন করিয়াছেন।

দীর্ঘতমার নিয়মস্থাপনের যেরূপ তাৎপর্য্য ব্যাখ্যাত হইল, তাহাই সম্যক্‌ সঙ্গত বোধ হইতেছে। আর, যদি এই তাৎপর্য্যব্যাখ্যায় অসন্তুষ্ট হইয়া, ঐ নিয়মস্থাপনকে একান্তই বিবাহিতা স্ত্রীর বিবাহনিষেধক বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে প্রয়াস পাও, তাহা হইলেও কলি যুগে বিধবা- বিবাহের শাস্ত্রীয়তা নিরাক্কত হইতে পারে না। স্বীকার করিলাম, দীর্ঘতমা বিবাহিতা স্ত্রীর পুনরায় বিবাহ নিবারণার্থেই নিয়ম স্থাপন করিয়াছেন; কিন্তু তিনি যুগবিশেষের নির্দেশ করেন নাই। সুতরাং ঐ নিয়ম সামান্ততঃ সকল যুগের পক্ষেই স্থাপিত হইয়াছে, বলিতে হইবেক। কিন্তু পরাশর, বিশেষ করিয়া, কলি যুগের পক্ষে বিধি দিয়াছেন। সুতরাং, পরাশরের বিশেষ বিধি দীর্ঘতমার সামান্য বিধি অপেক্ষা বলবান্ হইতেছে। আর, যদি, দীর্ঘতমার নিয়মস্থাপনকে সামান্যতঃ সকল যুগের পক্ষে না বলিয়া, কেবল কলিযুগবিষয়ক বলিয়া অঙ্গীকার করা যায়, তাহাতেও ক্ষতি হইতে পারে না; কারণ, দীর্ঘতমা, স্থলবিশেষ নির্দেশ না করিয়া, সামান্ততঃ কলি যুগে বিবাহিতা স্ত্রীর বিবাহ নিষেধ করিয়াছেন; কিন্তু পরাশর বিশেষ করিয়া পাঁচটি স্থল ধরিয়া বিধি দিয়াছেন। সুতরাং, দীর্ঘতমার নিয়মস্থাপন সামান্য বিধি ও পরাশরের বিধান বিশেষ ব্লিধি হইতেছে। সামান্ত বিরি ও বিশেষ নিধি, এ উভয়ের মধ্য বিশেষ বিধিই বলবান হয়, ইহা পূর্ব্বে সুস্পষ্ট রূপে প্রতিপাদিত হইয়াছে। অতএব, সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে, দীর্ঘতমার নিয়মস্থাপন কদাচ কলি যুগে বিধবাবিবাহের নিষেধ- প্রতিপাদক হইতে পারে না।

৯-বৃহৎ পরাশরসংহিতা বিধবাবিবাহের নিষেধিকা নহে।

কেহ কহিয়াছেন (৫৩), পরাশর স্বয়ং বৃহৎপরাশরসংহিতাতে পঞ্চমা- ধ্যায়ে বক্ষ্যমাণ, বচনে পুনর্ব্বিবাহিতা বিধবা প্রভৃতির দোষাবধারণ করিয়াছেন, ইহাতে পরাশরমতে বিধবাবিবাহের, বিধিকল্পনা প্রতারণা মাত্র।

অন্যদত্তা তু যা নারী পুনরণ্যায় দীয়তে। ত্যা অপি ন ভোক্তব্যং পুনর্ভূঃ কীর্ত্তিতা হি সা । উপপতেঃ শুতো যশ্চ যশ্চৈব দিধিপতিঃ।

পরপূর্ব্বাপতির্জাতা ব্যাঃ সবে প্রযত্নতঃ। ইত্যাদি যে স্ত্রী অঞ্চকে বস্তা হইয়াছে, তাহাকে পুনর্ব্বার অন্তকে দান করিলে, তাহার অম্ল অভক্ষণীয়; যেহেতু সে পুনর্ভু অর্থাৎ পুনর্ব্বার বিবাহিতা কথিত। হইয়াছে। যে উপপতির পুত্র, এবং বে দুই বার বিবাহিত স্ত্রীর পতি, এবং 'তাহার ঔরসজাত সন্তান; ইহারা সকলে দেব পৈত্র্য কর্ম্মে যত্ন পূর্ব্বক বর্জনীয়।

বৃহৎপরাশরসংহিতাতে পুনর্ব্বিবাহিতা বিধবার দোষকীর্তন আছে; অতএব, পরাশরমতে বিধবাবিবাহের বিধিকল্পনা: প্রতারণা মাত্র, এই কথা, বিশেষ অনুধাবন না করিয়াই বলা হইয়াছে। কারণ, যদি কলি যুগে 'বিধবাবিবাহের বিধি না থাকিত, তাহা হইলে কলি যুগে বিধবা- বিবাহের সম্ভাবনাই থাকিত না। যখন বৃহৎপরাশরসংহিতাতে পুনর্বার বিবাহিতা বিধবার অন্নভক্ষণের নিষেধ দৃষ্ট হইতেছে, তখন বিধবা- বিবাহ কলি যুগের ধৰ্ম্ম বলিয়া সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে। যদি কলি যুগে বিধবাবিবাহের "প্রসক্তিই না. থাকিত, তাহা হইলে পুনর্ব্বার বিবাহিতা বিধবার অন্নভক্ষণের নিষেধও থাকিত না। সম্ভাবনা না থাকিলে, নিষেধের আবশ্যকতা থাকে না। অতএব, বৃহৎপরাশরসংহিতায় বিবাহিতা বিধবার অন্নভক্ষণ নিষেধ দ্বারা, বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ বলিয়া বোধু না জন্মিয়া, বরং বিহিত বলিয়াই বিলক্ষণ প্রতীতি জন্মে। পরাশর- সংহিতার, নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে, এই বচনে পাঁচ স্থলে বিধবার পুনর্ব্বার বিবাহের যে বিধি দৃষ্ট হইতেছে (৫৪), তাহা যথার্থ বিবাহের বিধি কি না, এ বিষয়ে যাঁহাদের সংশয় আছে, বৃহৎপরাশরন্সংহিতার, অন্যদত্তা জু যা নারী, এই বচনে বিবাহিতা বিধবার অন্নভক্ষণ নিষেধ দর্শন দ্বারা, তাঁহাদের সে সংশয়েন্স নিরাকরণ হইতে পারিবেক। ফলতঃ, প্রতিবাদী মহাশয়, বৃহৎপরাশরসংহিতার বচন দ্বারা বিধবাবিবাহব্যবস্থার খণ্ডনে উত্থত হইয়া, বিলক্ষণ পোষকতাই করিয়াছেন।

• যদি বল, যখন বিধবা স্ত্রী বিবাহ করিলে, তাহার অন্নভক্ষণ নিষিদ্ধ দৃষ্ট হইতেছে, তখন বিধবার বিবাহ কোনও ক্রমে বিধেয় বলিয়া স্বীকার করা যাইতে পারে না। এ আপত্তিও বিচারসিদ্ধ বোধ হইতেছে না। যদি অষ্টবর্ষীয়া কন্যা বিধবা হয়, এবং সে পুনরায় বিবাহ না করিয়া যাবজ্জীবন, প্রকৃত ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন পূর্ব্বক, কালযাপন করে, তাহারও অগ্নভক্ষণ নিষিদ্ধ দৃষ্ট হইতেছে। যথা,

অবীরায়াস্ত যো ভুক্তে স ভুক্তে পৃথিবীমলম্। (৫৫) যে অধীরার অল্প ভক্ষণ করে, সে পৃথিবীর মল ভক্ষণ করে।

দেখ, অল্প ভক্ষণ নিষেধ কল্পে, বিবাহিতা ও ব্রহ্মচারিণী উভয়বিধ বিধবারই তুল্যতা দৃষ্ট হইতেছে; সুতরাং, পুনর্ব্বার বিবাহিতা বিধবাকে, বালবিধবা ব্রহ্মচারিণী অপেক্ষা, অধিক হেয় জ্ঞান করিবার, এবং - বিবাহিতা বিধবার অন্নভক্ষণ নিষেধকে বিধবীবিবাহের নিষেধসূচক বলিবার, কোনও বিশিষ্ট হেতু উপলব্ধ হইতেছে না।

উপপতেঃ সুতো যশ্চ যশ্চৈব দিধিষুগতিঃ। পরপূর্ব্বাপতির্জাতা ব্যাঃ সবে প্রযত্নতঃ ॥

যে উপপতির পুত্র, এবং যে দুইবার বিবাহিত স্ত্রীর পতি, এবং তাহার ঔরস-

জাত সন্তান, ইহাবা সকলে দৈব পৈত্রা কর্ম্মে যত্ন পূর্ব্বক 'বর্জনীয়। প্রতীবাদী মহাশয় এই বচনের যেরূপ পাঠ ধরিয়াছেন, এবং যেরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন, উভয়েরই কিঞ্চিৎ বৈলক্ষণ্য আছে। তিনি, পর- পূর্ব্বাপতির্জাতাঃ, এই যে পাঠ উদ্ধৃত করিয়াছেন, তাহা কোনও মতে সংলগ্ন হইতে পারে না; কারণ, পরপূর্ব্বাপতিঃ এবং জাতাঃ উভয়ই প্রথমান্ত পদ আছে। বিশেষ্য বিশেষণ ভিন্ন স্থলে, দুই প্রথমান্ত পদেন অন্বয় হয় না। কিন্তু এ স্থলে বিশেষ্য বিশেষণ স্থল বলিবার পথ নাই; যেহেতু, পরপূর্ব্বাপতিঃ এই পদ একবচনান্ত, ও জাতাঃ এই পদ বহু- বচনাস্ত, আছে। সঙ্খ্যাবাচকভিন্ন স্থলে একবচনান্ত ও বহুবচনান্ত পদের বিশেষ্যবিশেষণভাবে অন্বয় হয় না। উদ্দেশ্য বিধেয় অথবা প্রকৃতি বিকৃতি স্থল বলিয়া, মীমাংসা করাও সম্ভব নহে। বস্তুতঃ পরপূর্ব্বাপতির্জাতাঃ, এরূপ পাঠ নহে, পরপূর্ব্বাপতির্যশ্চ, এই পাঠই সংলগ্ন ও প্রকরণানুযায়ী বোধ হয়। মনুসংহিতাতে, দৈব পৈত্র্য কৰ্ম্মে বর্জনীয় স্থলে, দিধিযুপতি ও পরপূর্ব্বাপতি, এই উভয়ের উল্লেখ আছে। যথা,

ঔরভ্রিকো মাহিষিকঃ পরপূর্ব্বাপতিস্তথা। প্রেতনিহারকশ্চৈব বর্জ্যাঃ সর্ব্বে প্রযত্নতঃ । ৩। ১৬৬ ॥ মেষব্যবসায়ী, মহিষব্যবসায়ী, পরপুর্ব্বাপতি এবং প্রেতনির্ধারক অর্থাৎ ধন গ্রহণ ... পূর্ব্বক অন্তের শবদাহাদিকারী, ইহারা দৈব পৈত্র্য কর্ম্মে যত্ন পূর্ব্বক বর্জনীয়। এ স্থলে মমু পরপূর্ব্বাপতিকেই দৈব পৈত্র্য কর্ম্মে যত্ন পূর্ব্বক বর্জনীয় কহিয়াছেন, পরপূর্ব্বাপতির ঔরসজাত পুত্রের কথা কহিতেছেন না।

আর,

ভ্রাতুর্মূত্য ভার্য্যায়াং যোহনুরজ্যেত কামতঃ। ধর্ম্মেণাপি নিযুক্তায়াং স জ্ঞেয়ো দিধিপতিঃ। মনু। ৩৭ ১৭৩ ॥

যে ব্যক্তি মৃত ভ্রাতার নিয়োগধর্মানুসারে নিযুক্তণ ভাৰ্য্যাতে, বিধি লঙ্ঘন

পূর্ব্বক, ইচ্ছানুসারে অনুরক্ত হয়, তাহাকে দিধিষুপতি বলে।

মনু দৈব পৈত্র্য কার্য্যে বর্জনীয় দিধিপতির যেরূপ পরিভাষা করিয়াছেন, তদনুসারে দিধিষুপত্তি শব্দে দ্বিতীয় বার বিবাহিতা স্ত্রীর পতি এ অর্থ বুঝায় না; যে ব্যক্তি, নিয়োগধর্ম্মানুসারে মৃত ভ্রাতার ভ্যর্য্যায় পুত্রোৎ- পাদনে নিযুক্ত হইয়া, বিধিলঙ্ঘন পূর্ব্বক, সম্ভোগে প্রবৃত্ত হয়, তাহাকেই দিধিপতি বলে, এবং সেই দিধিষুপতিই দৈব পৈত্র্য কর্ম্মে যত্ন পূর্ব্বক বর্জনীয়। আর, পরপূর্ব্বাপতি শব্দেও এস্থলে দ্বিতীয় বার বিবাহিতা স্ত্রীর পতি বুঝাইবেক না; যে নারী, অপকৃষ্ট স্বামী পরিত্যাগ করিয়া, উৎকৃষ্ট পুরুষকে আশ্রয় করে, তাহাকে পরপূর্ব্বা বলে; সেই পরপূর্ব্বার যে পতি, তাহার নাম পরপূর্ব্বাপতি। যথা,

পতিং হিত্বাপকৃষ্টং স্বমুৎকৃষ্টং যা নিষেবতে। নিন্দ্যৈর সা ভবেল্লোকে পরপূর্ব্বেতি চোচ্যতে। মনু। ৫। ১৬৩ ॥ যে নারী, স্বীয় অপকৃষ্ট পতি পরিত্যাগ করিয়া, উৎকৃষ্ট পুরুষকে আশ্রয় করে,

সে লোকে নিন্দনীয়া হয়, এবং তাহাকে পরপূর্ব্বা বলে। অতএব প্রতিবাদী মহাশয় বৃহৎপরাশরসংহিতার যে বচন উদ্ধৃত করিয়া- চ্ছেন, তাহার প্রকৃত পষ্ঠ ও প্রকৃত অর্থ এই,

উপপতেঃ সুতো যশ্চ যশ্চৈব দিধিধূপতিঃ। পরপূর্বর্বাপতির্যশ্চ ব্যাঃ সবে প্রযত্নতঃ ॥

যে ব্যক্তি উপপতির সন্তান, অর্থাৎ উপপতি দ্বারা উৎপাদিত হয়; যে ব্যক্তি দিধিযুগতি, অর্থাৎ নিয়োগধৰ্ম্মানুসারে ভাতৃভাৰ্য্যায় পুত্রোৎপাদনে নিযুক্ত হইয়া, বিধিলঙ্ঘন পূর্ব্বক, সম্ভোগে প্রবৃত্ত হয়; আর যে ব্যক্তি পরপূর্ব্বাপতি, অর্থাৎ স্ত্রী, অপকৃষ্ট পতি ত্যাগ করিয়া, উৎকৃষ্টবোধে থে পুরুষকে আশ্রয় করে; ইহারা সকলে দৈব পৈত্র্য কর্ম্মে যত্ন পূর্ব্বক বর্জনীয়।

এইরূপ প্লাঠ ও এইরূপ অর্থ সর্ব্ব প্রকারে সংলগ্ন হয়। কারণ, উপপতি- সন্তান, দিধিযুপতি ও পরপূর্ব্বাপতি, ইহারা সকলেই অত্যন্ত নিন্দনীয়; এজন্য যত্ন পূর্ব্বক বর্জনীয় বলিয়াছেন। আর, যদি দৈব পৈত্র্য কর্ম্মে বর্জনীয় স্থলে, দিধিযুপতি ও পরপূর্ব্বাপতি, এই ছয়ের মনুক্ত পারিভাষিক অর্থ গ্রহণ না করিয়া, দিধিপতি, ও পরপূর্ব্বাপতি উভয় শব্দেরই ' দ্বিতীয় বার বিবাহিতা স্ত্রীর পতি এই অর্থ বল, তাঁহা হইলে দিধিপতি ও পরপূর্ব্বাপতি এই উভয় শব্দ ধরিয়া বর্জন করিবার প্রয়োজন কি; দিধিযুপতি অথবা পরপূর্ব্বাপতি এ উভয়ের এক শব্দ ধরিয়া বর্জন করিলেই, দ্বিতীয় বার বিবাহিতা স্ত্রীর পতির বর্জন হইতে পারিত। যখন দুই শব্দ ধরিয়াঃ স্বতন্ত্র বর্জন করা হইয়াছে, তখন এ স্থলে দুই শব্দের মনূক্ত পারিভাষিক অর্থই গ্রহণ করিতে হইবেক। বৃহৎপরাশরসংহিতার দৈব পৈত্র্য কর্ম্মে বর্জনীয় প্রকরণের আরম্ভে লিখিত আছে, সংশয় উপস্থিত হইলে, মনুবাক্য অবলম্বন করিয়া অর্থ নির্ণয় করিতে হয়। যথা,

দাঢ়্যার্থং দৃশ্যতে রূঢ়েমানবং লিঙ্গমেব চ।

রূঢ় শব্দের অর্থের দৃঢ়ীকরণ বিষয়ে, মনুবাক্যই অবলম্বনীয় দৃষ্ট হইতেছে। অতএব, এ স্থলে দিধিষুপতি ও পরপূর্ব্বাপতি এই দুই শব্দের মনুক্ত পারিভাষিক অর্থই যে গ্রহণ করিতে হইবেক, সে বিষয়ে কোনও সংশয় করা যাইতে পারে না।

অতএব প্রতিবাদী মহাশয়, পরপূর্বর্ণাপতির্জাতাঃ, এই যে পাই ধরিয়াছেন, এবং দ্বিতীয় বার বিবাহিতা স্ত্রীর পতি ও তাহার ঔরসজাত সন্তান এই যে অর্থ লিখিয়াছেন, তাহা কোনও ক্রমে সংলগ্ন ও প্রমাণ- সিদ্ধ হইতেছে না।

প্রতিবাদী মহাশয় কহিয়াছেন, পরাশর স্বয়ং বৃহৎপরাশরসংহিতাতে পুনর্ব্বিবাহিতা বিধবা প্রভৃতির দোষাবধারণ করিয়াছেন। অতএব, এ স্থলে ইহাও উল্লেখ করা আবশ্যক যে, বৃহৎপরাশরসংহিতা পরাশরের প্রণীত কি না, সে বিষয়ে সম্পূর্ণ সংশয় আছে। পরাশরসংহিতা ও বৃহৎপরাশরসংহিতা, এ উভয় গ্রন্থের বিষয় নিবিষ্ট চিত্তে বিশিষ্টরূপ আলোচনা করিয়া দেখিলে, বৃহৎপরাশরসংহিতা পরাশরের প্রণীত, ইহা কোনও মতে প্রতিপন্ন হইয়া উঠে না। পরাশরসংহিতাতে লিখিত আছে,

ব্যাসবাক্যাবসানে তু মুনিমুখ্যঃ পরাশরঃ। ধৰ্ম্ম্য নির্ণয়ং প্রাহ সূক্ষনং স্কুলঞ্চ বিস্তরাৎ ।

ব্যাসবাক্য সমাপ্ত হইলে, মুনিশ্রেষ্ঠ পরাশর, বিস্তারিত রূপে, ধর্ম্মের স্বপ্ন স্থূল নির্ণরু বল্লিতে আরম্ভ করিলেন।

এই রূপে পরাশর, ধৰ্ম্মকথনে প্রবৃত্ত হইয়া, ব্যাসদেবকে সম্বোধন করিয়া কহিতেছেন,

শৃণু পুত্র প্রবক্ষ্যামি শৃণ্বন্তু মুনয়স্তথা।

হে পুত্র! আমি ধৰ্ম্ম বলিব, শ্রবণ কর; এবং মুনিরাও শ্রবণ করুন। ইহা দ্বারা পরাশরসংহিতা যে পরাশরের স্বয়ং প্রণীত তাহা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে। কিন্তু, বৃহৎপরাশরসংহিতাতে লিখিত আছে, পরাশর, ব্যাসবাক্য শ্রবণ করিয়া, চারি আশ্রমের নিমিত্ত এবং চারি বর্ণের হিতের নিমিত্ত, বর্তমান কলি যুগের উপযুক্ত যে শাস্ত্র কহিয়াছিলেন, এক্ষণে সুব্রত তাহা কহিবেন।

পরাশরো ব্যাসবচোহবগম্য যদাহ শাস্ত্রং চতুরাশ্রমার্থম্। যুগানুরূপঞ্চ সমস্তবর্ণহিতায় বৃক্ষ্যত্যথ সুব্রতস্তৎ ॥

শক্তিসূনোরমুজ্ঞাতঃ সুতপাঃ সুব্রতগ্বিদম্। চতুর্ণামাশ্রমাণাঞ্চ হিতং শাস্ত্রমথাব্রবীৎ ॥ পরাশরের অনুজ্ঞা পাইয়া, অল্পস্বী হুব্রত চারি আশ্রমের হিতকর এই শাস্ত্র কহিয়াছেন।

ইহা দ্বারা স্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে, বৃহৎপরাশরসংহিতা পরাশরের স্বয়ং প্রণীত নহে, পরাশর ব্যাসদেবকে যে সকল ধৰ্ম্ম কহিয়াছিলেন,' সুব্রতনামা এক ব্যক্তি, পরাশরের অনুজ্ঞা পাইয়া, সেই সমস্ত ধৰ্ম্ম কহিয়ানে।

এক্ষণে আমরা দুই সংহিতা প্রাপ্ত হইতেছি, এক সংহিতা পরাশরের স্বয়ং প্রণীত বলিয়া পরিগৃহীত, অপর সংহিতা, 'পরাশরের অনুমত্যপু- সারে, সুব্রতনামক এক ব্যক্তির সঙ্কলিত বলিয়া উল্লিখিত। পরাশর- সংহিতা যে পরাশরের স্বয়ং প্রণীত, তাহার প্রমাণ পরাশরসংহিতার আরম্ভ দেখিলেই প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে; এবং বিজ্ঞানেশ্বর, বাচস্পতি- মিশ্র, কুবের, শূলপাণি, রঘুনন্দন প্রভৃতি প্রামাণিক গ্রন্থকর্তারাও তদ্বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করিতেছেন। তাঁহারা সকলেই, পরাশরের নাম দিয়া, যে সমস্ত বচন উদ্ধৃত করিয়াছেন, তাহা পরাশর প্রণীত পরাশরসংহিতাতে প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে, এবং মাধবাচার্য্যও পরাশর প্রণীত পরাশর- সংহিতার ভাষ্য লিখিয়া গিয়াছেন। সুতরাং, যে সমস্ত কারণ থাকিলে, গ্রন্থের প্রামাণ্য স্বীকার করিতে হয়, পরাশর প্রণীত পরাশরসংহিতাতে সে সমস্ত পৰ্য্যাপ্ত পরিমাণে উপলব্ধ হইতেছে। কিন্তু বৃহৎপরাশর- সংহিতার বিষয়ে সেরূপ কোনও কারণ উপলব্ধ হইতেছে না। বিজ্ঞানেশ্বর প্রভৃতি গ্রন্থকর্তাদিগের গ্রন্থের কোনও স্থলেই, বৃহৎপরাশ্বরসংহিতার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় নাঁ, এবং কেহ ভাষ্য লিখিয়াও যান নাই। আর, বৃহৎপরাশরসংহিতার বিষয়ে, প্রামাণ্যব্যবস্থাপক কোনও হেতু উপলব্ধ হয় না এই মাত্র নহে, বরং যদ্বারা প্রামাণ্য বিষয়ে সংশয় জন্মিতে পারে, এরূপ হেতুও উপলব্ধ হইতেছে।

'প্রথমতঃ, সুব্রত কহিয়াছেন, পরাশর ব্যাসদেবকে যে সমস্ত ধৰ্ম্ম কহিয়াছিলেন, আমি লোকহিতার্থে সেই সমস্ত ধর্ম্ম কহিতেছি। ইহা দ্বারা ইহাই প্রতীয়মান হয়, সুব্রত বৃহৎপরাশরসংহিতাতে পরাশরোক্ত ধৰ্ম্ম সকল সঙ্কলন করিয়াছেন। কিন্তু, উভয় সংহিতার আদ্যোপান্ত L অনুধাবন করিয়া দেখিলে, পরস্পর বিস্তর বিভিন্নতা দৃষ্ট হয়। পরাশর স্বয়ং যাহা কহিয়াছিলেন, তাহা পরাশরসংহিতাতে সঙ্কলিত আছে; কিন্তু' বৃহৎপরাশরসংহিতাতে তদতিরিক্ত অনেক কথা দৃষ্ট হইতেছে। বৃহৎপরাশরসংহিতাতে শ্রাদ্ধ, শাস্তি, ধ্যানযোগ, দানধৰ্ম্ম, রাজধৰ্ম্ম, আশ্রমধৰ্ম্ম প্রভৃতি বিষয়ের বিশেষ নিরূপণ আছে; পরাশরসংহিতাতে এ সমস্ত বিষয়ের উল্লেখ নাই। যদি সুব্রত বৃহৎপরাশরসংহিতাতে কেবল পরাশরোক্ত ধৰ্ম্মমাত্র সঙ্কলন করিয়া থাকেন, তাহা হইলে বৃহৎপরাশর সংহিতাতে পরাশরসংহিতার অতিরিক্ত কথা থাক! কি "রূপে সম্ভব হইতে পারে। আর, যদিও অতিরিক্ত কথা থাকা কথঞ্চিৎ সম্ভৰ বল, কিন্তু বৃহৎপরাশরসংহিতাতে পরাশরসংহিতার বিরুদ্ধ কথা থাকা কোনও ক্রদে সম্ভব হইতে পারে না। অনুসন্ধান কুরিয়া দেখিলে, বৃষ্ণংপরাশরসংহিতাতে পরাশরসংহিতার বিপরীত ব্যবস্থা অনেক আছে। যথা,

পরাশরসংহিতা।

জন্মকৰ্ম্মপরিভ্রষ্টঃ সন্ধ্যোপাসনবর্জিতঃ।. নামধারকবিপ্রস্তু দশাহং সূতকী ভবেৎ । ৩ অ॥ জাতকৰ্ম্মাদিসংস্কারহীন, সন্ধ্যোপাসনাশূক্ত, নামমাত্র ব্রাহ্মণের দশাহ অশৌচ চইবেক।

বৃহৎপরাশর সংহিতা।

সন্ধ্যাচারবিহীনে তু সূতকে ব্রাহ্মণে ধ্রুবম্।

অশৌচং দ্বাদশাহং স্থাদিতি পরাশরোহব্রবীৎ ॥ ৬ অ॥ পরাশর কহিয়াছেনঃ সন্ধ্যোপাসনারহিত ও সদাচারহীন ব্রাহ্মণের দ্বাদশীহ অশৌচ হইবেক।

পরাশরসংহিতা। দশরাত্রেস্বতীতেষু ত্রিরাত্রাচ্ছুদ্ধিরিষ্যতে। ততঃ সংবৎসরাদুর্দ্ধং সচেলঃ স্নানমাচরেৎ ॥ ৩ অ॥

দশ রাত্রি অতীত হইলে পর শ্রবণ করিলে, বিদেশহ ব্যক্তি ত্রিরাত্রে শুদ্ধ হইবেক, সংবৎসরের পর সদ্যঃশৌচ।

বৃহৎপরাশর সংহিতা।

দেশান্তরগতে জাতে মৃতে বাপি সগোত্রিণি।

শেষাহাণি দশাহাব্বাক্ সদ্যঃশৌচমতঃ পরম্ ॥ ৬ অ বিদেশস্থ ব্যক্তি, দশাহের মধ্যে, জননাশৌচ ও মরণাশৌচের কথা শ্রবণ করিলে, অবশিষ্ট দিন অশৌচ থাকিবেক দশাহের পর সদ্যঃশৌচ।

পরাশরসংহিতা।

ব্রাহ্মণার্থে বিপন্নানাং গোবন্দী গ্রহণে তথা। আহবেষু বিপন্নানামেকরাত্রস্তু সূতকম্ ॥ ৩ অ॥ ব্রাহ্মণার্থে অথবা গো এবং বন্দী গ্রহণার্থে অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে হত হইলে, এক রাত্রি অশৌচ হইবেক।

• বৃহৎপরাশর সংহিতা। গোদ্বিজার্থে বিপন্ন। যে আহবেষু তথৈব চ। তে যোগিভিঃ সমা জ্ঞেয়াঃ স্যঃশৌচং বিধীয়তে। ৯ অ॥ যাহারা গোব্রাহ্মণার্থে অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে হত হইবেক, তাহারা বোগীর তুল্য, তাহাদের মরণে সদ্যঃশৌচ।

পরাশরসংহিতাতে নামমাত্র ব্রাহ্মণের দশাহ অশৌচ, বৃহৎপরাশর- সংহিতাতে, দ্বাদশাহ অশৌচ, বিহিত আছে। পুর।শরসংহিতাতে, দশ- রাত্র 'অতীত হইলে পর শ্রবণ করিলে, বিদেশস্থ ব্যক্তির ত্রিরাত্রাশৌচ, বৃহৎপরাশরসংহিতাতে সদ্যঃশৌচ, বিহিত দৃষ্ট হইতেছে। গোব্রাহ্মণার্থে অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে হত হইলে, পরাশরসংহিতাতে একরাত্রাশৌচ, বৃহৎ- পরাশরসংহিতাতে সদ্যঃশৌচ, বিহিত আছে। এই সকল ব্যবস্থা যে পরস্পর বিপরীত, বোধ করি প্রতিবাদী মহাশয়ও স্বীকার করিবেন। দুই সংহিতাতে এইরূপ পরস্পর বিপরীত ব্যবস্থা বিস্তর আছে, অনাবশ্বক বিবেচনায় এস্থলে সে সমস্ত উল্লিখিত হইল না। যদি শুব্রত বৃহং- পরাশরসংহিতাতে পরাশরোক্ত ধৰ্ম্ম মাত্র সঙ্কলন করিয়া থাকেন, তাহা হইলে উভয়সংহিতার ব্যবস্থা পরস্পর এত বিপরীত হইল কেনশ ফলতঃ, এই দুই সংহিতা এক জনের প্রণীত, অথবা এক জনের উক্ত ধর্ম্মের সংগ্রহ, ইহা কদাচ হইতে পারে না।

দ্বিতীয়তঃ, পরাশরভাষ্যের লিখন দ্বারা স্পষ্ট প্রতীত হইতেছে, মাঁধবা- চার্য্যের সময় বৃহৎপরাশরসংহিন্তা প্রচলিত ছিল না। দ্বিতীয়াধ্যায়ের ব্যাখ্যা সমাপ্ত করিয়া, মাধবাচার্য্য কহিয়াছেন, '

যদ্যপি স্মৃত্যন্তরে দিব অত্রাপি বর্ণধৰ্ম্মানস্তরমাশ্রমধৰ্ম্ম। বক্তমুচিতাস্তথাপি ব্যাসেনাপৃষ্টয়াদাচার্য্যেণোপেক্ষিতাঃ। অস্মাভিস্ত শ্রোতৃহিতার্থায় তেহপি ব্যন্তে।

যদিও, অম্লান্ত সংহিতার ্যায়, পরাশরসংহিতাতেও বর্ণধর্মনিরূপণের পর আশ্রমধৰ্ম্ম নিরূপণ করা উচিত ছিল; কিন্তু ব্যাসদেব আশ্রমধর্ম্মের কথা জিজ্ঞাসা করেন নাই, এই নিমিত্ত আচার্য্য (পরাশর) তাঁহা উপেক্ষা করিয়া ছেন। কিন্তু আমরা শ্রোতৃত্বর্গের হিতার্থে সে সমুদায় বর্ণন করিতেছি।

পরাশর আশ্রমধৰ্ম্ম কীর্ত্তন করেন নাই বলিয়া, ভাষ্যকার, অ্যাস্থ্য ঋষির •সংহিতা' হইতে সংঙ্কলন পূর্ব্বক, আশ্রমধৰ্ম্ম বর্ণন করিয়াছেন। কিন্তু বৃহৎ- পরাশরসংহিতাতে বিস্তারিত রূপে আশ্রমধর্ম্মের বর্ণন আছে। যদি মাধবাচার্য্যের সময়ে বৃহৎপরাশরসংহিতা প্রচলিত থাকিত, তাহা হইলে তিনি, ব্যাসদেব জিজ্ঞাসা করেন নাই, এই নিমিত্ত পরাশর আশ্রমধৰ্ম্ম ১ কীর্তন করেন নাই, 'এরূপ কথা কহিতেন না। এবং, অ্যাস্থ্য, ঋষির সংহিতা হইতে সঙ্কলন করিয়া, পরাশরসংহিতার ন্যূনতা পরিহার করি- তেন না। পরাশরোক্ত আশ্রমধৰ্ম্ম তদীর সংহিতাস্তরে সঙ্কলিত সত্ত্বে, ভাষ্যকারের এরূপ নির্দেশ, ও, অ্যান্য মুনির সংহিতা হইতে সঙ্কলন করিয়া পরাশরের ন্যূনতা "পরিহারে যত্ন করা, কোনও ক্রমে সঙ্গত হইতে পারে না। অতএব, ইহা নিঃসংশয়ে প্রতিপন্ন হইতেছে, মাধবাচার্য্যের সময়ে বৃহৎপরাশরসংহিতা নামে গ্রন্থ প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত ছিল না।

অতএব দেখ, যখন বিজ্ঞানেশ্বর, বাচস্পতিমিশ্র, চণ্ডেশ্বর, শূলপাণি, কুবের, হেমাদ্রি, রঘুনন্দন প্রভৃতি প্রামাণিক গ্রন্থকর্তাদিগের গ্রন্থে বৃহৎ- পরাশরসংহিতার নামগন্ধও পাওয়া যায় না; যখন মাধবাচার্য্যের সময়ে বৃহৎপরাশরসংহিতানামক গ্রন্থের অস্তিত্ব সপ্রমাণ হইতেছে না; এবং যখন বৃহৎপরাশরসংহিতাতে সর্ব্বসম্মত পরাশরসংহিতার অতিরিক্ত ও বিপরীত কথা অনেক লক্ষিত হইতেছে; তখন বৃহৎপরাশরসংহিতাকে,, পরাশর প্রণীত অথবা পরাশরোক্তধৰ্ম্মণংগ্রহ বলিয়া, কোনও মতেই অঙ্গীকার করিতে পারা যায় না। এই নিমিত্তই, বৃহৎপরাশরসংহিতা অমূলক ও অপ্রামাণিক গ্রন্থ বলিয়া; চিরন্তন প্রবাদ আছে। অতএব, প্রতিবাদী মহাশয়, পরাশর স্বয়ং বৃহৎপরাশরসংহিতাতে পুনর্ব্বিবাহিতা বিধবা প্রভৃতির দোষাবধারণ করিয়াছেন, এই যে নির্দেশ করিতেছেন, তাহা কিছুমাত্র অনুধাবন না করিয়াই করা হইয়াছে, সন্দেহ নাই। প্রতিবাদী মহাশয়, বৃহৎপরাশরসংহিতার যে দুই বচন উদ্ধৃত করিয়া, কলি যুগে বিধবাবিবাহের নিষেধসাধনে উত্থত হইয়াছেন, ঐ দুই বচনের প্রকৃত অর্থ ও যথার্থ তাৎপর্য্য অনুধাবন করিয়া দেখিলে, তদ্বারা কলি যুগে বিধবাবিবাহ প্রতিষিদ্ধ বলিয়া প্রতিপন্ন হইতে পারে না। আর, যদিই ঐ দুই বচন দ্বারা কণঞ্চিৎ বিধবাবিবাহের নিষেধ প্রতিপন্ন হইত, তাহা হইলেও, কোনও ক্ষতি' হইতে পারিত না; কারণ, অমূলক অপ্রামাণিক সংহিতা অবলম্বন করিয়া, সর্ব্বসম্মত প্রামাণিক সংহিতার ব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করা, কোনও ক্রমে বিচারসিদ্ধ ও গ্রাহ্য হইতে পারে না।

১০-পরাশরসংহিতা

কেবল কলিধৰ্ম্মনির্ণায়ক,

* অন্যান্য যুগের ধর্ম্মনির্ণায়ক নহে।

কেহ কেহ এই আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন, পরশিরসংহিতাতে যে . কেবল কল্লি যুগের ধর্ম্ম নিরূপিত হইয়াছে, এমত নহে; অন্যান্য যুগের ধর্মও নিরূপিত আছে (৫৬)। এ আপত্তির তাৎপর্য্য এই যে, যদি ইহা স্থির হয়, পরাশরসংহিতাতে অন্যান্য যুগেরও ধৰ্ম্ম নিরূপিত আছে, তাহা হইলে, পরাশর বিধবা প্রভৃতি স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহের যে বিধি দিয়াছেন, তাহা কলি যুগের ধৰ্ম্ম না হইয়া অন্যান্য যুগের ধর্ম্ম হইবেক; তাহা হইলে, আর বিধবাবিবাহ কলি মুগের শাস্ত্রবিহিত কৰ্ম্ম হইল না। পরাশরসংহিতাতে অশ্বমেধ, শূদ্রজাতির মধ্যে দাস, নাপিত, গোপাল প্রভৃতির অন্নভক্ষণ, চরিত্র ও বেদাধ্যয়ন প্রভৃতি কারণে ব্রাহ্মণাদির অশৌচসঙ্কোচ প্রভৃতি কতিপয় বিষয়ের বিধি আছে। প্রতিবাদী মহাশয়েরা, এ সমস্ত সত্য প্রভৃতি যুগ ত্রয়ের ধর্ম্ম, কলি যুগের ধর্ম্ম নহে, এই নিশ্চয় করিয়া, এই আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন। কিন্তু পূর্ব্বে (৫৭) যেরূপ দর্শিত হইয়াছে, তদনুসারে কেবল কুলি যুগের ধর্ম নিরূপণ করাই পরাশরসংহিতার উদ্দেশ্য। সুতরাং, পরাশরসংহিতাতে যে কলি ভিঙ্গ অন্য যুগের ধর্ম নিরূপিত হইবেক, তাহা কোনও মতেই সম্ভব নহে। অতএব, সংহিতার অভিপ্রায় দ্বারা, অশ্বমেধ, প্রভৃতি কৰ্ম্ম যুগান্তরের ধর্ম্ম বলিয়া প্রতিপন্ন হইতে পারে না। তবে আদিপুরাণ, বৃহন্নারদীয়পুরাণ ও আদিত্যপুরাণে অশ্বমেধ প্রভৃতি কলি যুগে নিষিদ্ধ বলিয়া যে উল্লেখ আছে, তাহা দেখিয়হি প্রতিবাদী মহাশয়েরা অশ্বমেধ প্রভৃতি কর্ম্মকে যুগান্তরের ধর্ম্ম বলিয়া নিশ্চয় করিয়াছেন। অর্থাৎ, পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগে অশ্বমেধ প্রভৃতি ধৰ্ম্ম প্রচলিত ছিল; "কিন্তু, কোনও কোনও শাস্ত্রে, অশ্বমেধ প্রভৃতি কলি যুগে নিষিদ্ধ দৃষ্ট হইতেছে; সুতরাং, সে সমুদায় কলি যুগের ধর্ম্ম। হইতে পারে না। যখন পরাশরসংহিতাতে সেই অশ্বমেধ প্রভৃতি ধর্ম্মের বিধি আছে, তখন পরাশরসংহিতাতে কলি ভিন্ন অন্ত যুগের ও ধৰ্ম্ম নিরূপিত হইয়াছে, তাহা সুতরাং প্রতিপন্ন হইতেছে।

এই আপত্তির নিরাকরণ করিতে হইলে, অগ্রে ইহাই নিরূপণ করা আব্যক, আদিপুরাণে, বৃহন্নারদীয়পুরাণে ও আদিত্যপুরাণে যে সকল নিষেধ আছে, সে সমুদয় কলি যুগে নিষেধ বলিয়া পূর্ব্বাপর প্রতিপালিত হইয়া আসিয়াছে কি না। আমাদের দেশে আচার ব্যবহারাদির ইতিহাস গ্রন্থ নাই; সুতরাং, এ বিষয়ে অনুসন্ধান করিয়া সম্পূর্ণ রূপে কৃতকার্য্য হওয়া অসম্ভব। কিন্তু, সবিশেষ অনুসন্ধান করিয়া, যত দূর কৃতকার্য্য হইতে পারা যায়, তদনুসারে ইহা স্পষ্ট প্রমাণ হইতেছে, আদিপুরাণ, বৃহন্নারদীয়পুরাণ ও আদিত্যপুরাণের ঐ সমস্ত নিষেধ প্রতিপালিত হয় নাই। ঐ তিন গ্রন্থে যে সকল ধৰ্ম্ম কলি যুগে নিষিদ্ধ বলিয়া নির্দেশ আছে, কলি যুগে সে সকল ধর্ম্মের অনুষ্ঠান হইয়াছে,, তাহার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। যখন, নিষেধ সত্ত্বেও, সেই সকল ধর্ম্মের অনুষ্ঠান হইয়া আসিয়াছে, তখন ঐ সকল নিষেধ প্রকৃত রূপে প্রতিপালিত হইয়াছে, ইহা কি প্রকারে প্রতিপন্ন হইতে পারে। বিবাহিতার বিবাহ, জ্যেষ্ঠাংশ, সমুদ্রযাত্রা, কমণ্ডলুধারণ, দ্বিজাতির ভিন্নজাতীয়ন্ত্রীবিবাহ, দেবর দ্বারা পুত্রোৎপাদন, মধুপর্কে পশুবধ, শ্রাদ্ধে মাংসভোজন, বানপ্রস্থ ধর্ম্ম, এক জনকে, কন্তা দান করিয়া সেই ক্যার পুনরায় অন্য বরে দান, দীর্ঘ কাল ব্রহ্মচর্য্য, গোমেধ, নরমেধ, অশ্বমেধ, মহাপ্রস্থানগমন, অগ্নিপ্রবেশ, ব্রাহ্মণের মরণান্ত প্রায়শ্চিত্ত, দত্তক ও ঔরস ভিন্ন পুত্রপরিগ্রহ, চরিত্র ও বেদাধ্যয়ন অনুসারে অশৌচসংকোচ, শূদ্রজাতি মধ্যে দাস, নাপিত, গোপাল প্রভৃতির অন্নভক্ষণ, ইত্যাদি কতকগুলি ধৰ্ম্ম কলি যুগে নিষিদ্ধ বলিয়া আদিপুরাণে, বৃহন্নারদীয়পুরাণে ও আদিত্যপুরাণে উল্লেখ আছে। তন্মধ্যে কলি যুগে অশ্বমেধ, অগ্নি- প্রবেশ, কমগুলুধারণ অর্থাৎ যতিধৰ্ম্ম, দীর্ঘ কাল ব্রহ্মচর্য্য, সমুদ্রযাত্রা, মহাপ্রস্থানগমন ও বিবাহিতার রিবাহ এই কয় ধর্ম্মের অনুষ্ঠান হইয়াছে, তাঁহার স্পষ্ট প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে। যথা,

কলি যুগের ৬৫৩ বৎসর গত হইলে, পাণ্ডবেরা ভূমণ্ডলে প্রাদুর্ভূত হইয়াছিলেন (৫৮)। কিন্তু তাঁহারা যে অশ্বমেধ যজ্ঞ ও মহাপ্রস্থান গমন করিয়াছিলেন, তাহা সৰ্ব্বত্র এরূপ প্রসিদ্ধ আছে যে, সে বিষয়ে প্রমাণপ্রদর্শন অনাব্যক। আর পূর্ব্বে (৫৯) দর্শিত হইয়াছে, তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন নাগরাজ ঐরাবতের বিধবা কন্যার পাণিগ্রহণ করিয়া- ছিলেন।

বিক্রমাদিত্যের পূর্ব্বে, শুদ্রক নামে এক রাজা ছিলেন, তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ ও অগ্নিপ্রবেশ করিয়াছিলেন, তাহার প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। যথা,

ঋথেদং সামবেদং গণিতমথ কলাং বৈশিকীং হস্তিশিক্ষাং চাত্বা শবপ্রসাদধ্যপন্বততিমিরে চক্ষুষী চোপলভ্য।

রাজানং বীক্ষ্য পুত্রং পরমসমূদয়েনাশ্বমেধেন চেষ্টা লব্ধ। চায়ুঃ শতাব্দং দশদিনসহিতং শূদ্রকোহগ্নিং প্রবিষ্টঃ ।।(৬০)

শুদ্রক ঋগ্বেদ, সামবেদ, গণিতশাস্ত্র, চতুঃষষ্টি কলা ও হস্তিশিক্ষা বিদ্যা অধ্যয়ন করিয়া, মহাদেবের প্রসাদে নির্মূল জ্ঞানচক্ষু লাভ করিয়া, পুত্রকে রাজ্যে অতি- যিক্ত দেখিয়া, মহাসমারোহে অশ্বমেধ যজ্ঞ করিয়া, এবং এক শত বৎসর দর্শ দিবস আয়ু লাভ করিয়া, অগ্নিপ্রবেশ করিয়াছেন। (৬১)

রাজা প্রবরসেন চারি বার অশ্বমেধ করিয়াছিলেন, তাহার বিলক্ষণ প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। তিনি দেবশর্ম্মাচার্য্যনামক ব্রাহ্মণকে যে 'ভূমি দান করিয়াছিলেন, সেই দানের শাসনপত্রে, তাঁহার চারি বার অশ্বমেধ করিবার স্পষ্ট উল্লেখ আছে (৬২)। যথা,

চতুরশ্বমেধযাজিনে। বিষ্ণুরুদ্রসগোত্র্য সম্রাজঃ কাটকানাং মহারাজশ্রী প্রবন্ধসেনসহ্য ইত্যাদি।

অশ্বমেধচতুষ্টয়কারী, বিষ্ণুরুদ্র রাজার বংশোন্তব, কাটকদেশের অধীশ্বর, মহারাজ শ্রীপ্রবরসেন ইত্যাদি।

প্রবরসেনের পূর্ব্ব পুরুষেরা দশ বার অশ্বমেধু, করিয়াছিলেন, তাহাও ঐ শাসনপত্রে নির্দিষ্ট আছে। যথা,

দশাশ্বমেধাবভূথস্নাতানাম্।

দশ বার অশ্বমেধ করিয়াছেন। .কশ্মীরাধিপতি রাজা মিহিরকুল অগ্নিপ্রবেশ করিয়াছিলেন, তাহারও প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। যথা,

স বর্ষসপ্ততিং ভুজ্বা ভুবং ভূলোকভৈরবঃ। ভূরিরোগাদ্দিস্তবপুঃ প্রাবিশজ্জাতবেদসম্ ॥ ৩১৪ ।। (৬৩)

উগ্রস্বভাব রাজা মিহিরুকুল, ৭০ বৎসর রাজ্যভোগ করিয়া, নানা রোগে * শাক্রান্ত হইয়া, অগ্নি প্রবেশ করিয়াছেন।

রাজা মিহিরকুল, সসৈন্য সিংহলে গিয়া, 'সিংহলেশ্বরকে রাজ্যভ্রষ্ট করিয়া- ছিলেন, ইহা দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণ হইতেছে, তৎকালে সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ বলিয়া গণ্য হইত না১ যথা,

স জাতু দেবীং সংবীত সিংহলীশুককঞ্চুকাম্। হেমপাদাঙ্কিতকুচাং দৃষ্টু। জজ্বাল মম্যুনা ॥ ২৯৬ ॥ সিংহলেষু নরেন্দ্রাঘিমুদ্রাঙ্কঃ ক্রিয়তে পটঃ।

ইতি কঞ্চুকিনা পৃষ্টেনোক্তো যাত্রাং ব্যধাত্ততঃ । ২৯৭ ॥

তৎসেনাকুস্তিদানাস্তোনিম্নগাকৃতসঙ্গমঃ। যমুনালিঙ্গনপ্রীতিং প্রপেদে দক্ষিণার্ণবঃ ॥ ২৯৮ ॥ স সিংহলেন্দ্রেণ সমং সংরম্ভাদুদপাটয়ৎ।

চিরেণ চরণস্পৃষ্টপ্রিয়ালোকনজাং রুষম্ ॥ ২৯৯ ॥ (৬৪) রাজমহিষী সিংহলদেশীয়বস্তুনির্ম্মিত কাঁচুলী পরিয়াছিলেন; তাঁহার শুনোপরি স্বর্ণময় পদচিহ্ন দেখিয়া, রাজা মিহিরকুল কোপানলে জ্বলিত হইলেন। কফুকীকে জিজ্ঞাসা করাতে, সে কহিল, সিংহল দেশের বস্ত্রে সেই দেশের রাজার পদচিহ্ন মুদ্রিত করে। ইহা শুনিয়া তিনি যুদ্ধযাত্রা করিলেন। তদীয় সেনাসংক্রান্ত হস্তিগণের গণ্ডস্থলনির্গত মদজল, নদীপ্রবাহের ক্লায়, অনবরত পতিত হওয়াতে, দক্ষিণ সমুদ্র যমুনার আলিঙ্গনপ্রীতি প্রাপ্ত হইল। রাজা মিহিরকুল, সিংহলেশ্বরের সহিত সংগ্রাম করিয়া, মহিষীর স্তনমণ্ডলে তদীয় চরণস্পর্শ জনিত কোণের শাস্তি করিলেন।

রাজা জয়াপীড়ের দূত লঙ্কায় গিয়াছিলেন, তাহার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে; সুতরাং, ইহাও সমুদ্রযাত্রা প্রচলিত থাকার অপর এক প্রমাণ হইতেছে। যথা,

সান্ধিবিগ্রহিকঃ সোহথ গচ্ছন্ পোতচ্যুতোহম্বুধৌ। প্রাপ পারং তিমিগ্রাসাত্তিমিমুৎপাট্য, নির্গতঃ ॥ ৫০৩॥ (৬৫)

সেই রাজদূত গমনকালে নৌকা হইতে সমুদ্রে পতিত হন। এক তিমি তাঁহাকে গ্রাস করে। পরে তিনি, তিমির উদর বিদীর্ণ করিয়া নির্গত হইয়া, সমুদ্র পার হন।

কাশ্মীরাধিপতি রাজা মাতৃগুপ্ত যতিধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়াছিলেন, তাহার প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। সথা,

অথ বারাণসীং গত্বা কৃতকাষায়সংগ্রহঃ। সর্ববং সন্ন্যস্থ্য সুকৃতী মাতৃগুপ্তোহ ভবদযতিঃ । ৩২২ ।। (৬৬)

অনন্তর পুণ্যবান্ মাতৃউপ্ত, সমুদায় সাংসারিক বিষয় ত্যাগ, বারাণসী গমন, ও কাবায় বস্ত্র পরিধান করিয়া, যতিধৰ্ম্ম অবলম্বন করিলেন। (৬৭)

রাজা শুবস্তু, ১০১৮ সংবতে, হর্ষদেবনামক শিবের এক অট্টালিকা নির্মাণ করাইয়া দেন। ঐ অট্টালিকা নিৰ্ম্মাণের প্রশস্তিপত্রে, রাজা আাবুজ্জীবন ব্রহ্মচর্য্য করিয়াছিলেন বলিয়া, স্পষ্ট উল্লেখ আছে। যথা,

আজন্মব্রহ্মচারী দিগমলবসনঃ সংষতাত্মা তপস্বী

শ্রীহর্ষারাধনৈকব্যসনশুভমতিস্ত্যক্তসংসারমোহঃ। আসীদ্যো লব্ধজন্মা নবতরবপুষাং সত্তমঃ শ্রীশুবস্তু- স্তেতনদং ধৰ্ম্মবিত্তেঃ সুঘটিতবিকটং কারিতং হর্ষহর্ম্ম্যম্ ॥ (৬৮) যে সুবস্তু যাবজ্জীবন ব্রহ্মচারী, দিগম্বর, সংযত, তপস্বী, হর্ষদেবের আরাধনে একান্তরত, সংসারমায়াশুক্ত, সার্থজন্মা ও সুপুরুষ ছিলেন, তিনি ধৰ্ম্মার্থে হস • দেবের সুগঠন, প্রকাণ্ড অট্টালিকা নির্মাণ করাইয়া দিয়াছেন।

আসীন্নৈষ্ঠিকরূপো যো দীপ্তপাশুপতব্রতঃ।

যিনি নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী ও পরম শৈব ছিলেন।

এই রূপে স্পষ্ট দৃষ্ট হইতেছে যে, কলিযুগে অশ্বমেধ, মহাপ্রস্থান- গমন, ঋগ্নিপ্রবেশ, যতিধৰ্ম্ম, সমুদ্রযাত্রা, দীর্ঘ কাল ব্রহ্মচর্য্য, বিবাহিতার "বিবাহ, এই ক্ষয় ধর্ম্মের অনুষ্ঠান হইয়া আসিয়াছে। কলি যুগের ইদানীন্তন কালের লোক অপেক্ষা, পূর্ব্বতন কালের লোকেরা শাস্ত্র অধিক জানিতেন ও শাস্ত্র অধিক মানিতেন, তাহার কোনও সন্দেহ। নাই। কিন্তু তাঁহাক্স, আদিপুরাণ প্রভৃতির নিষেধ না মানিয়া, অশ্বমেধ অগ্নিপ্রবেশ প্রভৃতি.করিয়া গিয়াছেন। সুতরাং, স্পষ্ট প্রমাণ হইতেছে, তৎকালীন লোকেরা, পুরাণের নিষেধের অনুরোধে, স্মৃতিবিহিত কর্ম্মের অনুষ্ঠানে পরাম্মুখ হইতেন না।

আদিত্যপুরাণে লিখিত আছে,

এতানি লোকগুপ্ত্যর্থং কলেরাদৌ মহাত্মভিঃ। নিবর্ত্তিতানি কর্ম্মাণি ব্যবস্থাপূর্ব্বকং বুধৈঃ ।। মহাত্মা পণ্ডিতেরা, লোকরঞ্জার নিমিত্ত, কলির আদিতে, ব্যবস্থা করিয়া,

অশ্বমেধ প্রভৃতি ধৰ্ম্ম রহিত করিয়াছেন। মহাত্মা পণ্ডিতদিগের ব্যবস্থার প্রামাণ্যার্থে, পরিশেষে লিখিত আছে,

সময়শ্চাপি সাধুনাং প্রমাণং বেদবস্তুবেৎ।

সাধুদিগের ব্যবস্থাও বেঙ্গবৎ প্রমাণ হয়।

এরূপ শাসন সত্ত্বেও, যখন পূর্ব্বকালীন লোকেরা, পুরাণের নিষেধে অনাদর করিয়া, অশ্বমেধ প্রভৃতির অনুষ্ঠান করিয়া গিয়াছেন, তখন ঐ সকল নিষেধ নিষেধ বলিয়া গণ্য ও মান্স ছিল না, তাহার কোনও সংশয় নাই। তদ্ব্যতিরিক্ত, আদিত্যপুরাণে দত্তক ও ঔরস ভিন্ন পুত্র পরিগ্রহের নিষেধ, আছে। কিন্তু কাশী প্রভৃতি অঞ্চলের লোকেরা অ্যাপি কৃত্রিম পুল করিয়া থাকেন। এই নিমিত্তেই, নন্দপণ্ডিত দত্তক- মীমাংসা গ্রন্থে ব্যবস্থা করিয়াছেন,

দত্তপদং কৃত্রিমন্ত্যাপু্যুপলক্ষণম্ ঔরসঃ ক্ষেত্রজশ্চৈব দত্তঃ

কৃত্রিমকঃ সুত ইতি কলিংৰ্ম্মপ্রস্তাবে পরাশরস্মরণাৎ।

অর্থাৎ, যদিও, আদিত্যপুরাণের নিষেধ অনুসারে, কলি যুগে দত্তক ও ঔরস এই দুইমাত্র পুত্রের বিধান থাকিতেছে; কিন্তু, যখন রাশর কলিধৰ্ম্মপ্রস্তাবে কৃত্রিম পুত্রেরও বিধান দিয়াছেন, তখন কলি যুগে কৃত্রিম পুত্রও বিধেয়।

অতিদূর তীর্থযাত্রা নিষিদ্ধ বলিয়া উল্লিখিত দৃষ্ট হইতেছে; কিন্তু। ইহা কাহারও অবিদিত নাই যে, অ্যাপি বহু ব্যক্তি অতিদূরতীর্থযাত্রা করিয়া থাকেন। আর, ব্রাহ্মণের মরণান্ত প্রায়শ্চিত্তের নিষেধও নিষেধ- মাত্র লক্ষিত হইতেছে, কারণ, যে সুবিখ্যাত উদয়নাচার্য্য, বৌদ্ধদল পরাজয় পূর্ব্বক, বৈদিক ধর্ম্মের সংস্থাপন করিয়াছিলেন, তিনি তুষানলে প্রাণত্যাগ করেন। আর, অতি অল্প দিন হইল, বারাণসীধামে এক 'প্রধান' ব্যক্তি (৬৯), পাপক্ষয় কামনায় প্রায়োপবেশননামক অনাহারে 'প্রাণত্যাগরূপ মরণান্ত প্রায়শ্চিত্ত করিয়াছেন।

অতএব, যখন পরাশর, কলি যুগের পক্ষে, অশ্বমেধের বিধি দিয়াছেন, এবং কলি যুগে, সময়ে সময়ে, রাজারা অশ্বমেধ করিয়া গিয়াছেন, তাহার স্পষ্ট প্রমাণু পাওয়া যাইতেছে, তখন অশ্বমেধ, সত্য প্রভৃতি তিন যুগের ্যায়, কলি যুগেরও ধৰ্ম্ম হইতেছে। সেইরূপ, অশৌচসঙ্কোচও যখন পরাশরসংহিতাতে কলিধৰ্ম্ম বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে, তখন তাহাও কলি যুগের ধর্ম্ম, তাহার কোনও সন্দেহ নাই। তবে এ কালে ব্রাহ্মণদিগকে অশৌচসঙ্কোচ করিতে দেখা যায় না; 'তাহার কারণ এই, যে ব্রাহ্মণ নিত্য অগ্নিহোত্র ও নিত্য বেদাধ্যয়ন করেন, পরাশর তাঁহার পক্ষেই অশৌচসঙ্কোচের বিধি দিয়াছেন। যথা,

একাহাৎ শুধ্যতে বিপ্রো যোহগ্নিবেদসমন্বিতঃ। হাৎ কেবলবেদস্তু দ্বিহীনো দশভিদিনৈঃ ॥

যে ব্রাহ্মণ নিত্য অগ্নিহোত্র ও বেদাধ্যয়ন করিয়া থাকেন, তিনি এক দিনে শুদ্ধ হয়েন; যিনি কেরুল বেদাধ্যয়ন করেন, তিনি তিন দিনে; আর যিনি উভয়হীন, তিনি দশ দিনে শুদ্ধ হয়েন।

ইন্দ্রানীন্তন কালে যখন অগ্নিহোত্র ও বেদাধ্যয়নের প্রথা নাই, তখন সুতরাং তন্নিবন্ধন অশৌচসঙ্কোচের প্রন্থাও নাই। আর, শূদ্রজাতির মধ্যে দাস, নাপিত, গোপাল প্রভৃতির অন্নভোজন যখন কলিধৰ্ম্ম বলিয়া পরাশরসংহিতাতে উল্লিখিত আছে, তখন তাহাও যে কলি যুক্তার ধর্ম, তাহার কোনও লন্দেহ নাই। যদি বল, দাস, গোপাল প্রভৃতি শূদ্রের অন্নভোজন যদি, 'পরাশরের মতানুসারে কলি যুগে বিধেয় হয়, তাহা হইলে, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি তিন শ্রেষ্ঠ বর্ণ কি ঐ সকল শুদ্রজাতির অন্নভক্ষণ করিতে পারিবেন। আমার বোধ হয়, অবন্ত পারিবেন, এবং সচরাচর সঙ্কলে করিয়াও থাকেন; এবং, পরাশরের দাস, গোপাল প্রভৃতির অল্পগ্রহণবিধায়ক বচন এবং তৎপূর্ব্ববর্তী দুই বচনের তাৎপর্য্য অনুধাবন করিয়া দেখিলে, প্রতিবাদী মহাশয়েরাও সম্মত হইবেন, তাহার কোনও সন্দেহ নাই। যথা,

শুষ্কান্নং গোরসং স্নেহং শূদ্রবেশ্মন আগতম্।

পক্কং বিপ্রগৃহে পূতং ভোজ্যং তন্মনুরব্রবীৎ ॥

শুষ্ক অন্ন অর্থাৎ অপক তণ্ডুলাদি, গোরস অর্থাৎ দুগ্ধাদি, এবং স্নেহ অর্থাৎ। তৈলাদি, শূদ্রগৃহ হইতে আনীত হইয়া, ব্রাহ্মণগৃহে গরু হইলে পবিত্র হয়: মন সেই অন্ন ভক্ষনীয় কহিয়াছেন।

ব্রাহ্মণ শূদ্রের দত্ত অপক তণ্ডুলাদি, গৃহে আনিয়া পাক করিয়া ভক্ষণ করিতে পারেন, ইহা এই বচন দ্বারা প্রতিপাদিত হইতেছে; সুতরাং, শূদ্রগৃহে পাক করিয়া ভক্ষণ করিলে দোষ আছে, তাহাও অর্থাৎ সিদ্ধ হইতেছে।

আপৎকালে তু বিপ্রেণ ভুক্তং শূদ্রগৃহে যদি।

মনস্তাপেন শুধ্যেত দ্রুপদাং বা শতং জপেৎ ॥

আপৎকালে, ব্রাহ্মণ যদি শুদ্রগৃহে ভোজন করেন, তাহা হইলে, মনস্তাপ অথবা দ্রুপদ মন্ত্রের শত বার জপ দ্বারা শুদ্ধ হন।

আপৎকালে শূদ্রগৃহে পাক করিয়া ভোজন করা বিশেষ দোষাবহ নহে, ইহা এই বচন দ্বারা প্রতিপাদিত হইতেছে। সুতরাং, আপস্ ভিন্ন কালে, শূদ্রগৃহে পাক করিয়া ভোজন করা দোষাবহ, তাহাও অর্থাৎ সিদ্ধ হইতেছে।

দাসনাপিতগোপালকুলমিত্রার্দ্ধসীরিণঃ। এতে শূদ্রেষু ভোজ্যান্না যশ্চাত্মানং নিবেদয়েৎ ॥ শূদ্রের মধ্যে দাস, নাপিত, গোপাল, কুলমিত্র, অর্দ্ধসীরী ও শরণাগত ইহারা ভোজ্যান্ন, অর্থাৎ ইহাদের দত্ত তণ্ডুলাদি, ইহাদের গৃতে পাক করিয়া, ভোজন করিতে পারা যায়।

এই তিন বচন দ্বারা এই অর্থ প্রতিপন্ন হইতেছে, ব্রাহ্মণ শূদ্রের দত্ত অপক তণ্ডুলাদি শূদ্রগৃহে পাক করিয়া ভোজন করিলে, শুদ্রান্ন ভোজন 'করা হয়; শূদ্রদত্ত অপক তণ্ডুলাদি, স্বগৃহে আনিয়া পাক করিলে, তাহা শুদ্রান্ন হয় না। আপৎকালে, শূদ্রগৃহে, শূদ্রদত্ত তণ্ডুলাদি পাক করিয়া ভোজন করা যাইতে পারে। কিন্তু, কি আপদ, কি অনাপদ, সকল সময়েই, দাস, নাপিত, গোপাল প্রভৃতির গৃহে তদ্দত্ত তণ্ডুলাদি পাঠক করিয়া ভোজন করা দোষাবহ নহে।

এক্ষণে সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, কলি যুগে এরূপ শুদ্রার গ্রহণের বাধা কি। কেহই এরূপ শূদ্রার গ্রহণে দোষগ্রহণ করিবেন না। কেহ কেহ শূদ্রার শব্দে শূদ্রের পাক করা অন্ন এই অর্থ বুঝিয়াছেন; কিন্তু, এ স্থলের শূদ্রার শব্দে শূদ্রের পাক করা অন্ন অভিপ্রেত নহে; তাহা হইলে, আদিত্যপুরাণে, প্রথমতঃ দাস, গোপাল প্রভৃতি শূদ্রের অন্ন ভোজন নিষেধ করিয়া, কিঞ্চিৎ পরেই, পুনরায়, শুদ্রকর্তৃক ব্রাহ্মণ প্রভৃতি তিন বর্ণের অন্ন পাকাদি নিষেধ করা হইত না (৭০)। 'অব্য- বহিত পরেই, যখন শূদ্রের পক্ক অন্ন নিষিদ্ধ দৃষ্ট হইতেছে, তখন পূর্ব্ব নিষেধ, অগত্যা, অপক তণ্ডুলাদিরূপ অন্ন বলিয়া স্বীকার করিতে হইবেক। আর ইহাও অনুধাবন করা আবশ্যক, শাস্ত্রের শূদ্রের অপক তণ্ডুলাদিকেই শূদ্রার বলে। যথা,

আমং শূদ্রশ্য পকান্নং পকমুচ্ছিষ্টমুচ্যতে। (৭১)

শূদ্রের অপক্ষ অন্নকে পক অন্ন, ও পক্ক অন্নকে উচ্ছিষ্ট অন্ন, বলে।

শুদ্রান্ন শব্দের যেরূপ অর্থ ও তাৎপর্য্য ব্যাখ্যাত হইল, স্মাৰ্ত্ত ভট্টাচার্য্য রঘুনন্দনের শুদ্রায়বিচার দ্বারাও তাহাই প্রতিপন্ন হইতেছে। যথা, আমমন্নং দত্তমপি ভোজনকালে তগৃহাবস্থিতং শূদ্রাঙ্গম'।

তথাচাঙ্গিরাঃ

শূদ্রবেশ্মনি বিপ্রেণ ক্ষীরং বা যদি বা দধি।

নিবৃত্তেন ন ভোক্তব্যং শূদ্রায়ং তদপি স্মৃতম্ ॥ নিরত্তেন শূদ্রান্নান্নিবৃত্তেন। অপি শব্দাৎ সাক্ষাৎ ঘৃততণ্ডুলীদি। স্বগৃহাগতে পুনরঙ্গিরাঃ

যথা-য়তস্ততো হ্যাপঃ শুদ্ধিং যান্তি নদীং গতাঃ।

শূদ্রাদ্বিপ্রগৃহেষন্নং প্ররিষ্টন্তু সদা শুচি ॥ প্রবিষ্টেহপি স্বীকারাপেক্ষামাহ পরাশরঃ

তাবস্তুবতি শূদ্রান্নং যাবন্ন স্পৃশতি দ্বিজঃ।

দ্বিজাতিকরসংস্পৃষ্টং সর্ববং তদ্ধবিরুচ্যতে । স্পৃশতি গৃহ্বাতীতি কল্পতরুঃ। তচ্চ সম্প্রোক্ষ্য গ্রাহ্যমাহ বিষ্ণুপুরাণম্ সম্প্রোক্ষয়িত্বা গৃহ্লীয়াৎ শূদ্রান্নং গৃহমাগতম্।

তচ্চ পাত্রান্তরেণ গ্রাহ্যমাহাঙ্গিরাঃ

স্বপাত্রে যচ্চ বিন্যস্তং দুগ্ধং যচ্ছতি নিত্যশঃ। পাত্রান্তরগতং গ্রাহ্যং দুগ্ধং স্বগৃহ আগতম্ ॥ এতেষু স্বগৃহ আগতস্যৈব শুদ্ধত্বং তগৃহগতস্য শূদ্রান্নদোষভাগিত্বং

প্রতীয়তে। (৭২)

শূদ্রদত্ত অপক তণ্ডুলাদিও, ভোজনকালে শূদ্রগৃহূস্থিত ছুইলে, শুদ্রায় হয়; যেহেতু অঙ্গিরা কহিয়াছেন, শূদ্রার্জনিবৃত্ত 'ব্রাহ্মণ শুদ্রগৃহে দুগ্ধ, দধি পর্য্যন্ত ভোজন করিবেন না; যেহেতু তাহাও শুদ্রান্ন। স্বগৃহাগত তণ্ডুলাদি বিষয়ে অঙ্গিরা কহিয়াছেন, যেমন জল, যে সে স্থান হইতে"আসিয়া নদীতে পড়িলেই শুদ্ধ হয়; সেইরূপ, তণ্ডুলাদি শুদ্রগৃহ হইতে ব্রাহ্মণগৃহে প্রবিষ্ট হইলেই শুদ্ধ হয়। পরাশর হিয়াছেন, শুদ্রান্ন ব্রাহ্মণগৃহে প্রবিষ্ট হইলেও স্বীকারের অপেক্ষা রাখে। যথা, ব্রাহ্মণ যাবৎ না গ্রহণ করেন, তাবৎ শুদ্রান্নই থাকে, ব্রাহ্মণের হস্ত দ্বারা গৃহীত হইলে, সমস্ত শুদ্ধহয়। বিষ্ণুপুরাণে, কহিয়াছেন, শূদ্রান্ন প্রক্ষালন করিয়া গ্রহণ করিতে হয়; যথা, শুদ্রান্ন স্বগৃহে আসিলে প্রক্ষালন করিয়া লইবেক। অঙ্গিরা কহিয়াছেন, শূদ্রান্ন পাত্রান্তর করিয়া লইতে হইবেক যথা, শূদ্র আপন পাত্রস্থ করিয়া যে দুগ্ধ দান করে, সেই দুগ্ধ স্বগৃহে আগত হইলে, পাত্রান্তর কেরিয়া গ্রহণ করিবেক। এই সকল বচনে ইহাটু প্রতিপন্ন হইতেছে, শূদ্রদত্ত তগুলাদি স্বগৃহে আসিলেই শুব্ধ হয়, শূদ্রগৃহস্থিত হইলে শূদ্রান্ন দোষ হয়।

অতএব, পরাশরসংহিতাতে অশ্বমেধ প্রভৃতির বিধি দেখিয়া, এবং ঐ সমস্ত অন্যান্য যুদ্ধোর ধৰ্ম্ম, কলি যুগের ধৰ্ম্ম নহে, ইহা স্থির করিয়া, পরাশর কেবল কলি যুগের ধৰ্ম্ম নিরূপণ করেন নাই, কলি ভিন্ন ১. অন্যান্য যুগেরও ধৰ্ম্ম নিরূপণ করিয়াছেন, সুতরাং, পরাশরসংহিতা কেবল কলিধৰ্ম্মনির্ণায়ক নহে; এরূপ মীমাংসা করা কোনও ক্রমে বিচারসিদ্ধ হইতেছে না।

১১-পরাশরসংহিতার

আদ্যোপান্ত কলিধৰ্ম্মনির্ণায়ক,

কেবল প্রথম দুই অধ্যায় কলিধর্মনির্ণায়ক নহে।

কেহ কেহ এই মীমাংসা করিয়াছেন, পরাশর, কেবল প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ে, কলি যুগের ধর্ম নিরূপণ করিয়া, তৃতীয় অবধি গ্রন্থ সমাপ্তি পৰ্য্যন্ত দশ অধ্যায়ে, সর্ব্বযুগসাধারণ ধৰ্ম্ম নিরূপণ করিয়াছেন; এবং নিম্নলিখিত কয়েকটি কথা এই মীমাংসার হেতুস্বরূপ বিজ্ঞাস করিয়াছেন। প্রথমতঃ, প্রথমও দ্বিতীয় অধ্যায়ে বারংবার কলি শব্দে প্রয়োগ আছে; দ্বিতীয়তঃ, তৃতীয় অবধি দ্বাদশ পর্য্যন্ত কোনও অধ্যায়েই কলি শব্দ নাই, বরং অশ্বমেধ প্রভৃতি কলি ভিন্ন অন্যান্য যুগের ধর্ম্ম নিরূপিত দৃষ্ট হইতেছে; তৃতীয়তঃ, গ্রন্থ সমাপ্তিকালেও, আমি কলি ধৰ্ম্ম কহিলাম বলিয়া, উপসংহার করেন নাই; বরং দ্বিতীয়াধ্যায়ের শেষে কলি ধৰ্ম্ম কথনের উপসংহার করিয়াছেন। (৭৩)

পূর্ব্বে (৭৪) যেরূপ দর্শিত হইয়াছে, তন্দ্বারা ইহা বিলক্ষণ প্রতিপন্ন হইয়াছে যে, কেবল কলি যুগের ধৰ্ম্ম নিরূপণ করাই পরাশরসংহিতার উদ্দেশ্য। প্রতিবাদী মহাশয়েরাও, প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ে কলি যুগের ধৰ্ম্ম নিরূপণ করা হইয়াছে বলিয়া, কলিধৰ্ম্মনিরূপণ পরাশরসংহিতার উদ্দেণ্ড, ইহা আংশিক স্বীকার করিয়াছেন। এক্ষণে অনুসন্ধান করা আবশ্যক, পূর্ব্বতন গ্রন্থকর্তারা পরাশরসংহিতা বিষয়ে, কিরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন।

মাধবাচার্য্য কহিয়াছেন,

সর্ব্বেদ্বপি কল্লেষু পরাশরস্মৃতেঃ কলিযুগধর্ম্মপক্ষপাতিত্বাৎ। সকল করেই, কলি যুগের ধর্ম নিরূপণ করাই পরাশরসংহিতার উদ্দ্যে।

এ স্থলে পরাশরস্থতি কলি যুগের শাস্ত্র বলিয়া যেরূপ স্পষ্ট উল্লেখ আছে, তদ্দ্বীরা আ্যোপান্ত গ্রন্থই কলিধৰ্ম্মবিষয়ক, ইহাই সুস্পষ্ট প্রতীয়মান •হয়; নতুবা, কেবল প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায় কলি যুগের পক্ষে, অবশিষ্ট দশ অধ্যায় সর্ব্বযুগলক্ষে, এরূপ বোধ হয় না। নন্দপণ্ডিত কহিয়াছেন,

দত্তপদুং কৃত্রিমস্তাপু্যুপলক্ষণম্ ঔরসঃ ক্ষেত্রজশ্চৈব দত্তঃ কৃত্রিমকঃ মৃত ইতি কলিধৰ্ম্মপ্রস্তাবে পরাশরস্মরণাৎ।

কেবল দত্তক পদ আছে বটে, কিন্তু কৃত্রিম পুত্রপ্ত' বুঝিতে হইবেক। যেহেতু, "পরাশর কলিধর্ম প্রস্তাবে কৃত্রিম পুত্রেরও বিধি দিয়াছেন। পরাশরের এই পুত্রবিষয়ক বচন চতুর্থ অধ্যায়ে আছে', সুতরাং, নন্দ- পণ্ডিতের মতে, চতুর্থ অধ্যায়ও কলিধৰ্ম্মনিরূপণপক্ষে হইতেছে।

ভট্টোজিদীক্ষিত কহিয়াছেন,

নচ. কলিনিষিদ্ধস্ল্যাপি যুগান্তরীয়ধৰ্ম্মস্তৈব নষ্টে মৃতে ইত্যাদি পরাশরবাক্যং প্রতিপাদকমিতি বাচ্যং কলাবমু- ষ্ঠেয়ান্ ধৰ্ম্মানেব বক্ষ্যামীতি প্রতিজ্ঞায় তদ্‌গ্রন্থপ্রণয়নাৎ।

নষ্টে স্থতে এই পরাশরের বচন দ্বারা কলি নিষিদ্ধ যুগান্তরীয় ধর্মেরই বিধান হইয়াছে, এ কথা বলা যাইতে পারে না; কারণ, কেবল কলি যুগের অনুষ্ঠেয় ধৰ্ম্মই নিরূপণ করিব, এই প্রতিজ্ঞা করিয়া, পরাশরসংহিতা সঙ্কলন করা হইয়াছে।

ভট্টোজিদীক্ষিত, বিবাদাস্পদীভূত বিবাহবিষয়ক বচনের বিচারস্থলেই, এরূপ লিখিতেছেন; সুতরাং, তাঁহার মতে, আস্তোপান্ত কেবল কলি যুগের ধর্ম নিরূপণ করাই পরাশরসংহিতার উদ্দ্যে স্থির হইতেছে।

যস্তু পতিতৈব্রহ্মহাদিভিঃ সহ সংবৎসরং সংসর্গং কৃত্বা স্বয়মপি পতিতস্তস্থ্য প্রায়শ্চিত্তং মনুরাহ"

যে। যেন পতিতেনৈষাং সংসর্গং যাতি মানবঃ।

স তস্যৈব ব্রতং কুৰ্য্যাৎ সংসর্গস্থ্য বিশুদ্ধয়ে ইতি ॥ আচার্য্যস্ত কলিযুগে সংসর্গদোষাভাবমভিপ্রেত্য সংসর্গ- প্রায়শ্চিত্তং নাভ্যধাৎ।

যে ব্যক্তি ব্রহ্মহত্যাকারী প্রভৃতি পতিতদিগের সহিত সংবৎসর সংসর্গ করিয়া স্বয়ং পতিত হয়, মনু তাহার প্রায়শ্চিত্ত কহিতেছেন; যথা,

সে ব্যক্তি ইহাদিগের মধ্যে যে পতিতের সহিত সংসর্গ করে, সে সংসর্গ- দোষক্ষয়ের নিমিত্ত সেই পতিতের প্রায়শ্চিত্ত করিবেক। কিন্তু আচার্য্য (পরাশর), কলি যুগে সংসর্গদোষ নাই, এই অভিপ্রায়ে সংসর্গ-

দোষের প্রায়শ্চিত্ত বলেন নাই।

কলি যুগে সংসর্গদোষ নাই, এই নিমিত্ত পরাশর সংসর্গদোষের প্রায়শ্চিত্ত বলেন নাই; ভাষ্যকারের এই লিপি দ্বারা, আ্যোপান্ত কেবল কলি যুগের ধর্ম নিরূপণ করাই পরাশরসংহিতার উদ্দ্যে, ইহা সুস্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে। পরাশরসংহিতার শেষ নয় অধ্যায়ে প্রায়শ্চিত্ত নিরূপণ আছে; সুতরাং, কেবল প্রথম দুই অধ্যায় মাত্র কলিধৰ্ম্মবিষয়ক না হইয়া, সমুদায় গ্রন্থই কলিধৰ্ম্মনির্ণায়ক তাহা স্পষ্ট প্রমাণ হইতেছে।

এই রূপে, কলি যুগের ধর্ম্ম নিরূপণ করাই যে, পরাশরসংহিতার উদ্দেশ্য, তাহা স্পষ্ট দৃষ্ট হইতেছে। অতএব, কেবল প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায় মাত্র কলিধৰ্ম্মবিষয়ক, তদ্ভিন্ন দশ অধ্যায় সৰ্ব্বযুগসাধারণ ধৰ্ম্ম বিষয়ক, ইহা কেবল অপ্রামাণিক অকিঞ্চিৎকর কল্পনা মাত্র।

পরাশরসংহিতার প্রথম অধ্যায় গ্রন্থের উপক্রমণিকাস্বরূপ; সুতরাং, তাহাতে কলি ও কলিধৰ্ম্ম নিরূপণের কথা বারংবার আছে। দ্বিতীয়া- ধ্যায়ের আরম্ভেও, অতঃপর কলি যুগের ধর্ম্ম ও আচার বর্ণন করিব বলিয়া, এক বার মাত্র কলি শব্দের প্রয়োগ আছে; তৎপরে আর কলি শব্দ প্রয়োগের আবশ্যকতা নাই, এই নিমিত্ত, তদনন্তর আর কোনও স্থলেই কলি শব্দ প্রযুক্ত হয় নাই; সুতরাং, তৃতীয় অবধি নয় 'অধ্যায়ে, কলি শব্দ নাই বলিয়া, কেবল প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়কে কলিধৰ্ম্মবিষয়ক ও তদ্ভিন্ন সমুদায় গ্রন্থ সৰ্ব্বযুগসাধারণধৰ্ম্মবিষয়ক বলিয়া মীমাংসা করা, কি রূপে সঙ্গত হইতে পারে। আর, তৃতীয় অধ্যায়ে যে অশৌচসঙ্কোচ ও অগ্নিপ্রবেশের বিধি আছে, এবং একাদশ অধ্যায়ে যে দাস, গোপাল প্রভৃতি শূদ্রের অন্ন ভোজনের এবং দ্বাদশে যে অশ্বমেধের বিধি আছে, সে সমুদায় যুগান্তরীয় ধৰ্ম্ম, কলি যুগের ধর্ম্ম নহে, এই নিশ্চয় করিয়া, তৃতীয় অবধি দ্বাদশ পর্য্যন্ত গ্রন্থ কলিধৰ্ম্ম বিষয়ে নহে, এই ব্যবস্থা যে সঙ্গত হইতে পারে না, তাহা পূর্ব্বে (৭৫) প্রতিপাদিত হইয়াছে। আর, গ্রন্থসমাপ্তিকালে, কলিধৰ্ম্ম বলিলাম বলিয়া, উপসংহার নাই, যথার্থ বটে; কিন্তু, যখন কলিধৰ্ম্ম বলিব বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়া, ধৰ্ম্ম নিরূপণ করিতে আরম্ভ হইয়াছে, তখন গ্রন্থ- সমাপ্তিকালে, কলিধৰ্ম্ম বলিলাম বলিয়া, নির্দেশ না থাকিলে, কি ক্ষতি হইতেছে। উপক্রমে যখন কলিধৰ্ম্ম কথনের প্রতিজ্ঞা আছে, তখন উপসংহারে কলিধৰ্ম্মসমাপ্তির কোনও উল্লেখ না থাকিলেও, কলিধৰ্ম্ম বলা হইল ব্যতিরিক্ত আর কি বুঝাইতে পারে। আর, যেমন গ্রন্থ- সমাপ্তিকালে, কলিধৰ্ম্ম কথনের উপসংহার নাই, সেইরূপ, সকল যুগের ধৰ্ম্ম বলিলায় বলিয়াও, উপসংহার নাই। যদি কলিধৰ্ম্ম কথনের উপসংহার নাই বলিয়া, সমুদায় গ্রন্থ কলিধৰ্ম্মনির্ণায়ক না বলা যায়, তবে সর্ব্বযুগ- সাধারণ ধর্ম কথনের উপসংহার না থাকিলে, সর্ব্বযুগধর্ম্মনির্ণায়ক বলিয়া কিরূপে বলা যাইতে পারে। বিশেষতঃ, গ্রন্থের আরম্ভে, যেরূপ কলিধৰ্ম্ম কথনের প্রতিজ্ঞা দৃষ্ট হইতেছে, সেইরূপ, তৃতীয় অধ্যায়ের আরম্ভে, সর্ব্বযুগসাধারণ ধৰ্ম্ম কথুনের প্রতিজ্ঞা দৃষ্ট হইতেছে না। অতএব, যখন উপক্রমে ও উপসংহারে সর্ব্বযুগসাধারণ ধৰ্ম্ম কথনের কোনও উল্লেখ নাই, তখন শেষ দশ অধ্যায় সর্বযুগসাধারণধৰ্ম্মনির্ণায়ক, এ কথা নিতান্ত অমূলক ও একান্ত অযৌক্তিক।

এক্ষণে ইহা বিবেচনা করা আবশ্যক, প্রতিবাদী মহাশয়েরা, দ্বিতীয়া- ধ্যায়ের শেষে কলিধৰ্ম্ম কথনের উপসংহার যেরূপে প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা পাইয়াছেন, তাহা সঙ্গত হইতে পারে কি না। তাঁহাদের লিখন অবিকল নিয়ে উদ্ধৃত হইতেছে। যথা,

এই উপক্রম অর্থাৎ গ্রন্থের প্রকরণে কলিধর্ম্ম কথনের প্রতিজ্ঞা করিয়া দ্বিতীয়া- ধ্যায় সম্যক্ কথনানস্তর অধ্যায়সমাপ্তিকালে কলিধর্ম কথনের উপসংহার অর্থাৎ আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি করিয়াছেন। যথা

ভবস্ত্যল্লায়ষস্তে বৈ পতন্তি নরকেষু চ।

চতুর্ণামপি বর্ণানামেষ ধৰ্ম্মঃ সনাতনঃ ॥

ইতি পারাশরং ২ অং।

কলি ধর্ম্মে অর্থাৎ কলি যুগানুরূপ ধর্মের সমাচরণে লোক সকল অল্পায়ু হইবেক। এবং অবিরত পাপ কর্ম্মের সমাচরণ নিমিত্ত মরণানস্তর নরকে পতিত হইবে। অতএব কলি কালে চাতুব্বর্ণের এই ধৰ্ম্মই সনাতন। অর্থাৎ ইহারা নিরন্তর পাপকর্মকেই ধৰ্ম্ম বলিয়া গ্রহণ করিবে।

পণ্ডিতেরাই বিবেচনা করিবেন যে, এই শ্লোক কলিধৰ্ম্ম কথনরূপ প্রকরণের উপসংহার কি না।

এ স্থলে বক্তব্য এই যে, প্রতিবাদী মহাশয়েরা যেরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন, ঐ বচনের ঐ ব্যাখ্যা যথার্থ ব্যাখ্যা হইলে, কলিধর্ম্মের উপসংহার হইল বলিয়া, বিবেচনা করিবার কোনও বাধা ছিল না। কিন্তু উহা নিতান্ত বিপরীত ব্যাখ্যা, প্রকৃত ব্যাখ্যা নহে। তাঁহারা দুই বচনার্দ্ধকে এক বচন রূপে উদ্ধৃত করিয়াছেন। তন্মধ্যে পরবচনার্দ্ধের সহিত পূর্ব্ববচনার্দ্ধের কোনও মতে কোনও সংস্রব ঘটিতে পারে না'। যে বচনের অর্দ্ধ লইয়া, পরবচনের সহিত যোজনা করিয়া, বিপরীত ব্যাখ্যা করত, প্রতিবাদী মহাশয়েরা কলিধৰ্ম্ম কথনের উপসংহার স্থির করিয়াছেন, সে বচন এই,

বিকৰ্ম্ম কুব্বতে শূদ্রা দ্বিজশুশ্রুষয়োঙ্কিতাঃ। ভবন্ত্যল্লায়ুষন্তে বৈ পতন্তি নরকেষু চ। (৭৬)

শূদ্রেরা যদি, খিজসেবাপক্ষান্মুখ হইয়া, কৃষি বাণিজ্যাদি রূপ কৰ্ম্ম অবলম্বন করে, তাহা হইলে তাহারা অল্লায়ু হয় এবং নরকে গতিত হয়।

অবশিষ্ট অর্দ্ধ বচন ভাষ্যকারের আভাস ও তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা সহিত উদ্ধৃত হইতেছে। যথা,

*ইত্থং বর্ণচতুষ্টয়সাধারণং 'জীবনহেতুং ধর্ম্মং প্রতিপাদ্য

নিগময়তি

চতুর্ণায় পি বর্ণানামেষ ধৰ্ম্মঃ সনাতনঃ।. এই রূপে চারি বর্ণের জীবিকানির্ব্বাহোপযোগী ধর্ম্ম কহিয়া, সমন্বয় করিতেছেক; চারি বর্ণেরই এই সনাতন ধর্ম্ম। অতীতেষপি কলিযুগেযু বিপ্রাদীনাং কৃষ্যাদিকমস্তীতি

সূচয়িতুং সনাতন ইত্যুক্তম্। যত বার কলি যুগ অতীত হইয়াছে, সকল বারেই, ব্রাহ্মণ প্রভৃতির কৃষি প্রভৃতি আছে, ইহা জানাইবার নিমিত্ত, সনাতন এই শব্দ দিয়াছেন। এক্ষণে স্পষ্ট দৃষ্ট হইতেছে, দ্বিতীয়াধ্যায়ে পরাশর, চারি বর্ণের জীবিকা- নির্ব্বাহোপযোগী কৃষি, ব্লাণিজ্য, শিল্পকর্ম প্রভৃতি ধৰ্ম্ম নিরূপণ করিয়া,

চতুর্ণামপি বর্ণানামেষ ধৰ্ম্মঃ সনাতনঃ।

চারি বর্ণেরই এই সনাতন ধর্ম্ম। এই বলিয়া, জীবিকানির্ব্বাহোপযোগী ধৰ্ম্ম নিরূপণের প্রকরণ সমাপ্ত করিলেন; কলিধৰ্ম্ম নিরূপণ সমাপ্ত করিলেন, ইহা কোনও মতে প্রতিপন্ন হইতেছে না।

বিকৰ্ম্ম কুর্ব্বতে শূদ্রা দ্বিজ শুশ্রুষয়োন্কিতাঃ।

ভবস্ত্যল্লায়ষস্তে বৈ পতস্তি নরকেষু চ।

যদি শূদ্রেরা, দ্বিজসেবাপরান্মুখ হইয়া, কৃষি বাণিজ্যাদি করে, তাহা হইলে, তাহারা অল্লায় হয় ও নরকে প্রতিত হয়। প্রতিবাদী মহাশয়েরা এই বচনের উত্তরার্দ্ধকে পূর্ব্বলিখিত বচনার্দ্ধের 'সহিত যোজনা করিয়াছেন। যথা, ভবন্ত্যল্লায়ুষস্তে বৈ পতন্তি নল্পকেষু চ।

চতুর্ণামপি বর্ণানামেষ ধৰ্ম্মঃ সনাতনঃ ॥

তাহারা অল্লায়ু হয় ও নরকে পতিত হয়। চারি বর্ণেরই এই সনাতন ধৰ্ম্ম। প্রতিবাদী মহাশয়েরা, চারি জনে যুক্তি করিয়া, এই দুই বচনার্জকে এক বচন করিয়া লইয়াছেন, এবং আপনাদিগের মনোমত অর্থ লিখিয়াছেন। যথা,

কলিধর্ম্মে অর্থাৎ কলি যুগানুরূপ ধর্ম্মের সমাচরণে লোক, সকল অল্লায়ু হইবেক এবং অবিরত পাপকর্ম্মের সমাচরণ নিমিত্ত মরণানস্তর নরকে পতিত হইবেক। অতএব কলি কালে চাতুর্বর্ণের এই ধর্ম্মই সনাতন। অর্থাৎ ইহারা নিরস্তর পাপকর্মকেই ধৰ্ম্ম বলিয়া গ্রহণ করিবে।

তাঁহারা, অনেক স্থলেই, এইরূপ কল্পিত অর্থ লিথিয়াছেন। কিন্তু, ধৰ্ম্মশাস্ত্রের বিচারে প্রবৃত্ত হইয়া, ছল ও কৌশল অবলম্বন করা অতি অন্যায়। পাঠকবর্গের অধিকাংশ মহাশয়ই সংস্কৃতজ্ঞ নহেন; তাঁহাদের বোধার্থেই, ভাষায় সংস্কৃত বচনের অর্থ লিখিতে হয়। তাঁহারা যখন ভাষা ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করেন, তখন প্রত্যেক বচনের প্রকৃত ব্যাখ্যা লেখাই সর্ব্বাংশে উচিত কৰ্ম্ম। লোক ভুলাইবার নিমিত্ত, কল্পিত ব্যাখ্যা লেখা সাধু লোকের উচিত নদে। যাহা হউক, প্রতি- বাদী মহাশয়েরা, পূর্ব্বোক্ত দুই বচনার্দ্ধের যে ব্যাখ্যা লিখিয়া, কলিধৰ্ম্ম কথনের উপসংহার প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করিয়াছেন, যদি তাঁহারা ঐ ব্যাখ্যাকে প্রকৃত ব্যাখ্যা বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে পারেন, তাহা হইলে আর আর স্থলে যে সকল কল্লিত ব‍্যাখ্যা লিখিয়াছেন, সে সমুদায়কে প্রকৃত ব্যাখ্যা, ও কলি যুগে বিধবাবিবাহকে অশাস্ত্রীয় কৰ্ম্ম বলিয়া, স্বীকার করিতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করিব না।

প্রতিবাদী মহাশয়েরা যে রূপে কলিধৰ্ম্ম কথনের উপসংহার অর্থাৎ আকাঙ্ক্ষানিবৃত্তি প্রতিপন্ন করিতে, যত্ন করিয়াছেন, তাহা যে কোনও ক্রমে সিদ্ধ হইয়া উঠে নাই, তাহা প্রদর্শিত হইল। এক্ষণে, তাঁহারা, কলিযুগান্তরূপ ধর্ম্মের সমাচরণে লোক অল্লাযু হয় ও নরকে যায়, এই যে ব্যাখ্যা লিখিয়াছেন, অহাতে অনেকের এই প্রতীতি জন্মিতে পারে যে, পরাশর দ্বিতীয় অধ্যায়ে যে সকল কলিধৰ্ম্ম কীর্ত্তন করিয়াছেন, সে সকল পাপকর্ম্ম, উহাদের অনুষ্ঠানে লোক অল্লায়ু হয় ও নরকে যায়; সুতরাং, পরাশরোক্ত কলিধৰ্ম্ম, আয়ুঃক্ষয়কর ও নরক্রসাধন বলিয়া পল্লিত্যাগ করাই কর্তব্য। প্রতিবাদী মহাশয়েরা দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষ ছই বচনার্দ্ধের যেরূপ কল্পিত ব্যাখ্যা লিখিয়াছেন, তাহার উপর নির্ভর করিলে, অনেকেরই এই ভ্রম জন্মিতে পারে; এই নিমিত্ত, পরাশরসংহিতার দ্বিতীয় অধ্যায় 'আ্যোপান্ত নিয়ে, ভাষ্যকারের আভাস ও তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা সহিত, উদ্ধৃত হইতেছে।

পূর্বাধ্যায়ে আমুস্মিকধৰ্ম্মঃ প্রাধান্যেন প্রবৃত্তঃ অয়ন্ত ঐহিকজীবনহেতুধৰ্ম্মঃ প্রাধান্যেন প্রবর্ত্ততে। তত্রাদাব- ধ্যায়প্রতিপাদ্যমর্থং প্রতিজানীতে

অতঃপরং গৃহস্থস্থ্য কৰ্ম্মাচারং কলৌ যুগে।

ধর্মং সাধারণং শক্ত্যা চাতুর্বর্ণ্যাশ্রমাগতম্ ॥ সম্প্রবক্ষ্যাম্যহং পূর্ববং পরাশরবচো যথা। অতঃপরম্ আমুস্মিক প্রধানধৰ্ম্মকথনাদনস্তরং ষটকৰ্ম্মা- ভিরতঃ সন্ধ্যাস্নানমিত্যাদিনা ঙ্গি আমুস্মিকফলে ধর্ম্মে- ২ভিহিতে সতি ঐহিকফলশস্থ্য কৃষ্ণ্যাদিধৰ্ম্ম্য বুদ্ধিস্থত্বাৎ তদভিধানস্য যুক্তোহবসরঃ। বক্ষ্যমাণসহ্য কৃষ্যাদিধৰ্ম্মস্থ্য ব্রহ্মচারিবনস্থযুতিম্বসম্ভবমভিপ্রেত্য তদ্যোগ্যমাশ্রমিণং দর্শয়তি গৃহস্থসেশ্যতি। কৃতত্রেতাদ্বাপরেষু বৈশ্যস্থ্যৈব কৃষ্ণ্যাদাবধিকারে। নতু গৃহস্থমাত্র্য বিপ্রাদেঃ অতো বিশিনষ্টি কলৌ যুগে ইতি। কর্ম্মশব্দে। লোকে ব্যাপারমাত্রে প্রযুজ্যতে আচারশব্দশ্চ ধৰ্ম্মরূপে শাস্ত্রীয় ব্যাপারে কৃষ্যাদেস্ত যুগান্তরেষু কৰ্ম্মত্বং কলাবা-

চার মিত্যুভয়রূপত্বমস্তি। কৃষ্যাদেঃ সাধারণধৰ্ম্মত্বমুপ- পাদয়তি চাতুর্বর্ণ্যাশ্রমাগতমিতি। পরাশরশব্দেনাত্র অতীতকল্লোৎপন্নো বিবক্ষিতঃ এতদেবাভিব্যঞ্জয়িতুং পূর্ব্বমিত্যুক্তং পূর্ণবকল্প সিদ্ধং পরাশরবাক্যং কলিধর্ম্মে কৃষ্যাদৌ যথা বৃত্তং তথৈবাহং সম্প্রবক্ষ্যামি। অতঃ সম্প্রদায়াগতত্বাৎ কৃষ্যাদেরাচারতায়াং ন বিবাদঃ কর্ত্তব্য ইত্যাশয়ঃ। শিষ্টাচারং শিক্ষয়িতুং শক্ত্যা সম্প্র- "বক্ষ্যামীত্যুক্তং নতু কস্মিংশ্চিদ্ধৰ্ম্মে স্বস্থ্যাশক্তিং ছ্যোত-

য়িতুং কলিধৰ্ম্মপ্রবীণশস্থ্য পরাশরশস্থ্য তত্রাশক্ত্যসম্ভবাৎ। পূর্ব্বাধ্যায়ে পারলৌকিক ধর্ম প্রাধান্ত রূপে নির্ণীত হইয়াছে; এক্ষণে জীবিকা- নির্ব্বাহোপযোগী ঐহিক ধৰ্ম্ম প্রাধান্য রূপে নির্ণীত হইতেছে। তন্মধ্যে এই অধ্যায়ে যে বিষয় নির্ণয় করিবেন, তাহাই প্রথম প্রতিজ্ঞা করিতেছেন। পূর্ব্ব পরাশরবাক্য অনুসারে অতঃপর গৃহস্থের কলি যুগে অনুষ্ঠেয় কৰ্ম্ম ও আচার যথাশক্তি বলিব। যাহা বলিব, তাহা চারি বর্ণের ও আশ্রমের সাধারণ ধৰ্ম্ম।

পূর্ব্ব পরাশরবাক্য অনুসারে, অর্থাৎ পূর্ব্বকল্পে, পরাশর যেরূপ কলিধৰ্ম্ম কহিয়াছেন, তদনুসারে। অতঃপর অর্থাৎ পারলৌকিক যটকৰ্ম্ম সন্ধ্যা স্নান প্রভৃতির প্রধান রূপে কথনানর। বক্ষ্যমাণ কৃষি বাণিজ্য প্রভৃতি ধৰ্ম্ম ব্রহ্মচারী, বানপ্রস্থ ও যতিতে সম্ভবে না; এই নিমিত্ত, গৃহস্থের বলিয়া কহিতেছেন। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর যুগে, বৈঞ্চ জাতিরই কৃষি বাণিজ্যাদি ধর্মে অধিকার, ব্রাহ্মণাদি যাবতীয় গৃহস্থের নহে; এই নিমিত্ত, কলি যুগে। 'বলিয়া কহিতেছেন; অর্থাৎ কলি যুগে চারি বর্ণই কৃষি বাণিজ্যাদি করিতে পারেন।

প্রতিজ্ঞাতং ধৰ্ম্মং দর্শয়তি

ষট্ কর্ম্মসহিতো বিপ্রঃ কৃষিকৰ্ম্ম চ কারয়েৎ।

ষট্ কৰ্ম্মাণি পূর্ব্বোক্তানি যাজনাদীনি সন্ধ্যাদীনি চ ভৈঃ সহিতো বিপ্রঃ শুশ্রুষকৈঃ শুদ্রৈঃ কৃষিং কারয়েৎ। নচ  যাজনাদীনাং জীষনহেতুত্বাৎ কিমনয়া কৃষ্যেতি বাচ্যং * কলৌ জীবনপৰ্য্যাপ্ততয়া যাজনাদীনাং দুর্লভত্বাৎ। প্রতিজ্ঞাত ধৰ্ম্ম কহিতেছেন,

ব্রাহ্মণ, যজন, বাজন, প্রভৃতি ষট্ কর্ম্মে সম্পন্ন হইয়া, সেবক শূদ্র দ্বারা কৃষি *কর্ম করাইবেন।

যদি বল ব্রাহ্মণের জীবিকা নির্ব্বাহের যাজন, অধ্যাপন, প্রতিগ্রহ, এই তিন উপায় আছে, কৃষি কর্ম্মের প্রয়োজন কি; তাহার উত্তর এই, কলি যুগে যাজনাদি দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ হওয়া দুর্ঘট, এই নিমিত্ত পরাশর কৃষিকার্শ্বর বিধান দিয়াছেন।

কৃষৌ ব্যান্ বলীবদানাহ

• ক্ষুধিতং তৃষিতং শ্রান্তং বলীবর্দং ন যোজয়েৎ।

হীনাঙ্গং ব্যাধিতং ক্লীবং বৃষং বিপ্রো ন বাহয়েৎ। কৃষি কর্ম্মে যেরূপ বলীবর্দ নিযুক্ত করা উচিত নহে, তাহা কহিতেছেন; ব্রাহ্মণ ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, ক্লান্ত বলীবর্দ্ধ লাঙ্গলে যোজিত করিবেক না। আর অঙ্গহীন, রুগ্ন ও ক্লীব বৃষকে লাঙ্গল বহাইবেক না।

কীদৃশস্তর্হি বলীবদাঃ কৃষৌ যোজ্যা ইত্যাহ স্থিরাঙ্গং নীরুজং তৃপ্তং সুনদং ষণ্ডবজ্জিতম্। বাহয়েদ্দিবস্যার্দ্ধং পশ্চাৎ স্নানং সমাচরেৎ ॥

তবে কি প্রকার বৃষ কৃত্বিকর্ম্মে নিযুক্ত করিবেক, তাহা কহিতেছেন; স্থিরাঙ্গ অর্থাৎ পদবৈকল্যাদিরহিত, স্বস্থ, ক্ষুধা তৃষ্ণাদি পীড়াশূন্য, শ্রমহীন, সমর্থ বৃষকে প্রথম দুই প্রহর লাঙ্গল বহাইবেক, পশ্চাৎ স্নান করাইবেক।

কৃষৌ ফলিতসস্থ্য ধান্য্য বিনিয়োগমাহ

স্বয়ং কৃষ্টে তথা ক্ষেত্রে ধান্যৈশ্চ স্বয়মর্জ্জিতৈঃ। নির্ব্বপেৎ পাকষজ্ঞাংশ্চ ক্রতুদীক্ষাঞ্চ কারয়েৎ। কৃষিকর্ম্মে যে শস্ত উৎপন্ন হইবেক, তাহার বিনিয়োগ কহিতেছেন; স্বয়ং কুষ্ট ক্ষেত্রে যে শক্ত উৎপন্ন হইবেক, সেই শক্ত দ্বারা 'পঞ্চ যজ্ঞ ও অগ্নিষ্টোমাদি যজ্ঞ করিবেক।

কৃষীবলশ্য তিলাদিধান্যসম্পন্নশস্য ধনলোভেন প্রসক্ত- স্তিলাদিবিক্রয়স্তং নিবারয়তি

তিলা রসা ন বিক্রেয়া বিক্রেয়া ধান্যতৎসমাঃ ॥ বিপ্রস্যৈবংবিধা বৃত্তিস্তৃণকাষ্ঠাদিবিক্রয়ঃ ॥

যদি ধান্তেররহিতস্থ্য তিলবিক্রয়মন্তরেণ' জীবনং ধৰ্ম্মে। 'বান সিধ্যেৎ তদা তিলা ধান্যান্তরৈর্বিনিমাতব্যা ইত্যভি- প্রেত্য বিক্রেয়। ধান্যতৎসমা ইত্যুক্তং যাৰপ্তিঃ প্রস্বৈস্তিলা দত্তাস্তাবন্তিরেব ধান্যান্তরমুপাদেয়ং নাধিকমিত্যর্থঃ।

তিল প্রভৃতি শক্ত্যসম্পন্ন কৃষিজীবী ব্যক্তি, বনলোভে, তিলাদি বিক্রয় করিলেও করিতে পারে, এই নিমিত্ত নিষেধ করিতেছেন; ব্রাহ্মণ তিল ও বৃত, দধি, মধু প্রভৃতি রস বিক্রয় করিবেক না। কিন্তু, যদি অন্ত শক্ত না থাকে, তিল বিক্রয় ব্যতিরেকে জীবিকানির্ব্বাহ অথবা ধৰ্ম্ম কৰ্ম্ম সম্পন্ন না হইয়া উঠে, তাহা হইলে, তিলতুল্য পরিমাণে শস্তান্তর বিনিময়রূপ বিক্রয় করিবেক এবং তৃণ কাষ্ঠাদি বিক্রয় করিবেক।

ইদানীং কৃষাবানুষঙ্গিকস্ত পাপপুনঃ প্রতীকারং বক্তং প্রথমতস্তং পাপ্যানং দর্শয়তি

ব্রাহ্মণশ্চেৎ কৃষিং কুর্য্যাৎ তন্মহাদোষমাপুয়াৎ।

কৃষৌ হিংসায়া অবর্জনীয়ত্বাৎ সাবধানশ্যাপি কৃষীবলশ্য দোষোহনুষজ্যত ইতি।

ইদানীং কৃষিকর্মে আনুষঙ্গিক যে পাপ আছে, তাহার প্রতীকার কহিবার নিমিত্ত, প্রথমতঃ সেই পাপ প্রদর্শন করিতেছেদ; ব্রাহ্মণ যদি কৃষি কৰ্ম্ম করে, তাহা হইলে মহাদোষ প্রাপ্ত হয়। কৃষক যত কেন সাবধান হউক না, কৃষিকর্ম্মে অব্যই জীবহিংসা ঘটে, সুতরাং দোষ আছে।

উক্তশ্য দোষসস্থ্য মহত্ত্বং বিশদয়তি

সংবৎসরেণ যৎ পাপং মৎস্যঘাতী সমাপুয়াৎ।

অয়োমুখেন কাষ্ঠেন তদেকাহেন লাঙ্গলী ॥ * উক্ত । মহত্ব স্পষ্ট করিতেছেন;

মংস্তঘাতী ব্যক্তি সংবৎসরে যে পাপ প্রাপ্ত হয়, কৃষক লৌহমুখ কাষ্ঠ অর্থাৎ লাঙ্গল দ্বারা এক দিনে সেই পাপ প্রাপ্ত হয়।

উক্তনীত্যা কর্ধকমাত্র্য পাপপ্রসক্তৌ বারয়িষ্ণুং বিশিনষ্টি পাশকো মৎস্যঘাতী চ' ব্যাধঃ শাকুনিকস্তথা। অদাতা কর্ষকশ্চৈব সর্ব্বে তে সমভাগিনঃ ॥

যথা পাশকাদীনাং পাপং মহৎ এবমদাতুঃ কর্ষক্যেত্যর্থঃ।

পূর্ব্বোক্ত দ্বারা কৃষক মাত্রেরই পাপগ্রসক্তি হইয়াছিল, তাহা বারণ করিবার নিমিত্ত, বিশেষ করিয়া কহিতেছেন;

পাশক, মৎস্যঘাতী, ব্যাধ, শাকুনিক, অদাতা কৃষক, ইহারা সকলে সমান

পাপভাগী।

যেমন পাশক প্রভৃতির মহৎ পাপ জন্মে, সেইরূপ অদাতা কৃষকের; অর্থাৎ কৃষক, দানশীল হইলে, তাদৃশ পাপগ্রস্ত হয় না।

যদর্থং কৃষীবল্য পাপ্পা দর্শিতস্তমিদানীং প্রতীকারমাহ বৃক্ষং ছিত্ত্বা মহীং ভিত্ত্বা হত্বা চ কৃমিকীটকান্। কর্ষকঃ খলঘজ্ঞেন সর্ববপাপৈঃ প্রমুচ্যতে ॥

ছেদনভেদনহননৈর্যাবন্তি পাপানি নিষ্প্যন্তে তেষাং সর্বেষাং খলে ধান্যদানং প্রতীকারঃ। যে প্রতীকার কথনের নিমিত্ত, পূর্ব্বে কৃষকের পাপ দর্শিত হইয়াছে, এক্ষণে সেই প্রতীকারের কথা কহিতেছেন;

কৃষক, বৃক্ষচ্ছেদ, ভূমিভেদ, ও কৃমিকীটবধ করিয়া, যে সমস্ত পাপে লিপ্ত হয়, খলষজ্ঞ দ্বারা সেই সকল পাপ হইতে মুক্ত হয়। এছদ, ভেদ, বধ দ্বারা' যে সমস্ত পাপ জন্মে, খলে অর্থাৎ থামারে ধাক্ত দান করিলে, সেই সমস্ত পাপের প্রতীকার হয়। এই ধান্ত দানের নাম খলযক্ত।

খলযজ্ঞাকরণে প্রত্যবায়মাহ

যো ন দছ্যাদ্দ্বিজাতিভ্যো রাশিমূলমুপাগতঃ। স চৌরঃ স চ পাপিষ্ঠে। ব্রহ্মপ্পং তং বিনির্দিশেৎ ॥

খলষজ্ঞের অকরণে প্রত্যবায় কহিতেছেন;

যে কৃষক, উপস্থিত থাকিয়া, আগত দ্বিজদিগকে থলস্থিত ধাস্তরাশির কিয়দংশ দান না করে, সে চোর, সে পাপিষ্ঠ, ডাহাকে ব্রহ্মগ্ন বলে।

দাতব্যস্থ্য ধানন্ত্যস্থ্য পরিমাণমাহ

রাজ্ঞে দত্ত্বা তু ষড়ভাগং দেবানাঞ্চৈকবিংশকম্। বিপ্রাণাং ত্রিংশকং ভাগং সর্বপাপৈঃ প্রমুচ্যতে ॥

দাতব্য শক্তের পরিমাণ কহিতেছেন; রাজাকে ষষ্ঠ ভাগ, দেবতাদিগকে একবিংশ ভাগ, এবং ব্রাহ্মণদিগকে ত্রিংশ ভাগ, দান করিয়া, সকল পাপ হইতে মুক্ত হয়।

বিপ্রশস্থ্য সেতিকর্তব্যাং কৃষিমুক্তা বর্ণান্তরাণামপি তামাহ

ক্ষত্রিয়োহপি কৃষিং কৃত্বা দেবান্ বিপ্রাংশ্চ পূজয়েৎ।

বৈশ্যঃ শূদ্রস্তথা কুৰ্য্যাৎ কৃষিবাণিজ্যশিল্পকম্ ॥ কৃষিবদ্বাণিজ্যশিল্পয়োরপি কলৌ বর্ণচতুষ্টয়সাধারণধৰ্ম্মত্বং দর্শয়িতুং বাণিজ্যশিল্পক মিত্যুক্তম্।

ব্রাহ্মণের ইতিকর্তব্যতাসহিত কৃষিকৰ্ম্ম কহিয়া, অ্যান্ত বর্ণের কৃষিকর্ম্মের বিধান করিতেছেন;

ক্ষত্রিয়ও, কৃষিকৰ্ম্ম করিয়া, দেবতা ও ব্রাহ্মণের পুজা করিবেক। এবং বৈশ্য

ও শুদ্র কৃষি, বাণিজ্য, ও শিল্পকর্ম করিবেক। কৃষির স্তায়, বাণিজ্য ও শিল্পকর্মও কলি যুগে চারি বর্ণের সাধারণ ধৰ্ম্ম, ইহা দেখাইবার নিমিত্ত, বচনে বাণিজ্যশিল্পকস্ কহিয়াছেন।

"যদি শূদ্রশ্যাপি কৃষ্যাদিকমভ্যুপগম্যতে তর্হি তেনৈব জীবনসিদ্ধেঃ কলৌ দ্বিজশুশ্রূষা পরিত্যাজ্যেত্যাশঙ্ক্যাহ

বিকৰ্ম্ম কুব্বতে শূদ্রা দ্বিজশুশ্রুষয়োঙ্কিতাঃ। ভবন্ত্যল্লায়ুষস্তে বৈ নিরয়ং যান্ত্যসংশয়ম্ ॥

লাভাধিক্যেন বিশিষ্টজীবনহেতুত্বাৎ কৃষ্যাদিকং বিকর্ম্মে- ত্যুচ্যতে দ্বিজশুশ্রূষয়। হু জীর্ণবস্ত্রাদিকমেব লভ্যত ইতি ন লাভাধিক্যম্ অতোহধিকলিপ্সয়া কৃষ্যাদিকমের কুর্ববন্তে। যদি দ্বিজশুশ্রূষাং পরিত্যজেয়ুস্তদা তেষামৈহিক- মামুস্মিকঞ্চ হীয়েত।

যদি শূদ্রেরও কৃষিকৰ্ম্ম প্রভৃতি বিহিত হয়, তবে শুদ্বারাই জীবিকা নির্ব্বাহ হইলে, কলিতে শূদ্র কি দ্বিজশুশ্রূষা পরিত্যাগ করিবেক, এই আশঙ্কা করিয়া কহিতেছেন; শূদ্রেরা, দ্বিজসেবা পরিত্যাগ করিয়া, কৃষি প্রভৃতি কর্ম্ম করিলে, অন্নায়ু হয় ও নিঃসন্দেহ নরকে যায়। দ্বিজসেবা দ্বারা কেবল উচ্ছিষ্ট অম্ল ও জীর্ণ বস্ত্রাদি মাত্র লাভ হয়, অধিক লাভের প্রত্যাশা নাই: এই নিমিত্ত, শূদ্র- জাতি যদি, অধিক লাভলোভে, কৃষি প্রভৃতি কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইয়া, এক বারেই দ্বিজসেবা পরিত্যাগ করে, তাহা হইলে তাহাদের ঐহিক পারলৌকিক উভয় নষ্ট হয়।

ইত্থং বর্ণচতুষ্টয়সাধারণং জীবনহেতুং ধর্ম্মং প্রতিপাচ্চ নিগময়তি

চতুর্ণামল্লি বর্ণানামেষ ধৰ্ম্মঃ সনাতনঃ। অতীতেষপি কলিযুগেযু বিপ্রাদীনাং কৃষ্ণ্যাদিকমস্তীতি

সূচয়িতুং সনাতন ইত্যুক্তেম্। এই রূপে, চারি বর্ণের সাধারণ জীবিকানির্ব্বাহোপযোগী ধর্ম নিরূপণ করিয়া, উপসংহার করিতেছেন,

চারি বর্ণেরই এই সনাতন ধর্ম্ম। অতীত কলি যুগ সকলেও ব্রাহ্মণাদির কৃষি প্রভৃতি ধৰ্ম্ম ছিল, ইহা কহিবার নিমিত্ত, ধর্ম্মের সনাতন এই বিশেষণ দিয়াছেন: অর্থাৎ, চারি বর্ণের এই সনাতন ধৰ্ম্ম বলাতে, ব্যক্ত হইতেছে, সকল কলি যুগেই ব্রাহ্মণাদি, জীবিকা নির্ব্বাহার্থে, কৃষিকৰ্ম্ম করিয়া থাকে।

এক্ষণে পাঠকবর্গের নিকট বিনয়বাক্যে প্রার্থনা এই যে, আপনারা পরাশরসংহিতার দ্বিতীয় অধ্যায় আদ্যোপান্ত দৃষ্টি করিলেন; এখন বিবেচনা করিয়া দেখুন, "কলিধৰ্ম্মে অর্থাৎ কলিযুগান্তরূপ ধর্ম্মের সমাচরণে লোক অন্নায়ু হইবেক এবং অবিরত পাপকর্ম্মের সমাচরণ নিমিত্ত মরণানন্তর নরকে পতিত হইবেক; অতএব, কলি কালে চাতুব্বর্ণের এই ধৰ্ম্মই সনাতন; অর্থাৎ ইহারা নিরন্তর পাপকর্ম্মকেই ধৰ্ম্ম বলিয়া গ্রহণ করিবে," প্রতিবাদী মহাশয়দিগের এই ব্যাখ্যা ও এইরূপ কলিধৰ্ম্মকথনের উপসংহার, সংলগ্ন ও সঙ্গত হইতে পারে কি না; আর, পরাশর দ্বিতীয় অধ্যায়ে চারি বর্ণের সাধারণ যে ধর্ম্ম নিরূপণ করিয়াছেন, তাহার অনুষ্ঠানে লোক অন্নায়ু ও নরকগামী হইবেক কি না; এবং,

চতুর্ণামপি বর্ণানামেষ ধৰ্ম্মঃ সনাতনঃ। চারি বর্ণেরই এই সনাতন ধর্ম্ম।

এই বচনার্দ্ধের

অতএব, কলি কালে চাতুব্বর্ণের এই ধর্ম্মই সনাতন। অর্থাৎ ইহারা নিরস্তর পাপকৰ্ম্মকেই ধর্ম বলিয়া গ্রহণ করিবে।

প্রতিবাদী মহাশয়দিগের এই ভাবব্যাখ্যাও সঙ্গত হইতে পারে কি না।

১২-পরাশর

কেবল কলিধৰ্ম্মবক্তা, অন্যযুগধর্ম লিখেন নাই।

কেহ কহিয়াছেন,

হাঁ গো মহাশয়! আপনি কি পরাশরসংহিতা আদ্যোপান্ত দৃষ্টি করিয়াছেন না কেবল অনিষ্ট বিষয়েই যথেষ্ট চেষ্টা। শিষ্টসমাজে বিশিষ্ট গণ্য হইতে কি অনিষ্টে নিবিষ্টই উৎকৃষ্ট লক্ষণ। পরাশর কেবল কলিধর্ম্মবক্তা এমত স্থির করিবেন গা অঞ্চযুগধর্ম্মও লিখিয়াছেন।

তজ্জানীহি

ত্যজেদ্দেশং কৃতযুগে ত্রেতায়াং গ্রামমুৎস্বজেৎ। দ্বাপরে কুলমেকন্তু কর্তারন্ত কলৌ যুগে।. কৃতে সম্ভাষণাদেব ত্রেতায়াং স্পর্শনেন চ'। দ্বাপরে অর্থমাদায় কলৌ পততি কৰ্ম্মণা ॥ তপঃ পরং কৃতযুগে ত্রেতায়াং জ্ঞানমুচ্যতে। দ্বাপরে যজ্ঞমেবাহুর্দানমেব কলৌ যুগে ॥

ইত্যাদি বচন দ্বারাই বোধ হইতেছে পরাশর অ্য যুগের ধর্ম নিরূপণ করিয়াছেন। (৭৭)

প্রতিবাদী মহাশয়ের উদ্ধৃত এই তিন বচনে চারি যুগেরই কথা আছে, এই নিমিত্ত তাঁহার বোধ হইজ়াছে, পরাশর অন্ত যুগের ধর্ম্মও মিরূপণ করিয়াছেন। কিন্তু পরাশর, কি অভিপ্রায়ে, এই তিন বচনে ও অন্য কতিপয় বচনে, অন্ত্য যুগের কথা বলিয়াছেন, তাহা নিবিষ্ট চিত্তে অনুধাবন করিয়া দেখিলে, তাঁহার কদাচ, পরাশর অন্ত্যযুগের ধর্মও নিরূপণ করিয়াছেন, এরূপ বোধ হইত না।

অন্যে কৃতযুগে ধৰ্ম্মান্ত্রেতায়াং দ্বাপরে যুগে।

অন্যে কলিযুগে নৃণাং যুগরূপানুসারতঃ ॥ যুগরূপানুসারে, মনুষ্যের সত্য যুগের ধর্ম সকল অ্য, ত্রেতা যুগের ধর্ম্ম সকল অন্ত, দ্বাপর যুগের ধর্ম সকল অ্য, কলি যুগের ধর্ম্ম সকল অন্ত।

পরাশর এই রূপে, যুগানুসারে মনুষ্যের' শক্তি হ্রাস হেতু, প্রত্যেক যুগের ধর্ম্ম সকল ভিন্ন ভিন্ন, এই ব্যবস্থা করিয়া, যুগে যুগে মনুষ্যের শক্তিহ্রাসের ও প্রবৃত্তিভেদের উদাহরণ প্রদর্শন করিবার নিমিত্ত, পর- বর্ত্তী, কতিপয় বচনে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি, এই চারি যুগের কথা লিখিয়াছেন। যথা,

তপঃ পরং কৃতযুগে ত্রেতায়াং জ্ঞানমুচ্যতে। দ্বাপরে যজ্ঞমেবাহুৰ্দ্দানমেব কলৌ যুগে ॥ সত্য যুগে প্রধান ধৰ্ম্ম তপস্তা, ত্রেতা যুগে প্রধান ধর্ম জ্ঞান, দ্বাপর যুগে প্রধান ধৰ্ম্ম যজ্ঞ, কলি যুগে প্রধান ধৰ্ম্ম দান।

সত্য যুগের লোকদিগের সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ক্ষমতা ছিল; এই নিমিত্ত, সর্ব্বাপেক্ষা অধিক কষ্টসাধ্য তপস্তা ঐ যুগের পধান ধর্ম ছিল। কিন্তু পর পর যুগে মনুষ্যের অপেক্ষাকৃত শক্তি হ্রাস হওয়াতে, যথাক্রমে অপেক্ষাকৃত অল্প কষ্টসাধ্য জ্ঞান, যজ্ঞ, দান প্রধান ধৰ্ম্ম বলিয়া ব্যবস্থা- পিত হইয়াছে।

কৃতে তু মানবা ধৰ্ম্মাস্ত্রেতায়াং গৌতমাঃ স্মৃতাঃ। দ্বাপরে শাঙ্খলিখিতাঃ কলৌ পাবাশরাঃ স্মৃতাঃ ॥

। মনুক্ত ধৰ্ম্ম সকল সত্য যুগের ধর্ম্ম, গোতমোক্ত ধর্ম সকল ত্রেতা যুগের ধর্ম্ম, শঙ্খলিখিতোক্ত ধৰ্ম্ম সকল দ্বাপর যুগের ধর্ম, পরাশরোক্ত ধর্ম সকল কলি যুগের ধর্ম।

অর্থাৎ, পর পর যুগে, উত্তরোত্তর মনুষ্যের ক্ষমতা হ্রাস হওয়াতে, মন্থাদিপ্রোক্ত অতি কষ্টসাধ্য ধৰ্ম্ম সকলেস অনুষ্ঠান হইয়া উঠা ছক্ষর; এই নিমিত্ত, অপেক্ষাকৃত অল্প কষ্টসাধ্য ধৰ্ম্মপ্রতিপাদক এক এক ধৰ্ম্ম- শাস্ত্র পর পর যুগের নিমিত্ত ব্যবস্থাপিত হইয়াছে।

ত্যজেদ্দেশং কৃতযুগে ত্রেতায়াং গ্রামমুৎস্বজেৎ।

দ্বাপরে কুলমেকন্তু কর্তারন্ত কলৌ যুগে ॥

সত্য যুগে দেশত্যাগ করিবেক, ত্রেতা যুগে গ্রামত্যাগ করিবেক, দ্বাপর যুগে কুলত্যাগ করিবেক, কলি যুগে কর্তাকে ত্যাগ করিবেক।

অর্থাৎ, সত্য যুগে, যে দেশে পতিত বাস করিত, সেই দেশ পরিত্যাগ করিত; ত্রেতা যুগে, যে গ্রামে পতিত থাকিত, সেই গ্রাম পরিত্যাগ করিত; দ্বাপর যুগে, যে কুলে পতিত থাকিত, সেই কুল পরিত্যাগ করিত; অর্থাৎ, সেই কুলে আদান প্রদানাদি করিত না; কলি যুগে, কর্তাকে নর্থাৎ যে ব্যক্তি পতিত হয়, তাহাকেই পরিত্যাগ করে। সত্য যুগের লোকেরা অনায়াসে পতিতবাসযুক্ত দেশ পরিত্যাগ করিয়া যাইত; কিন্তু ত্রেতা যুগের লোকদিগের তত ক্ষমতা ছিল না, তাহারা দেশ পরিত্যাগ করিয়া যাইতে পারিত না, কেবল পতিত- বাসযুক্ত গ্রাম পরিত্যাগ করিত। দ্বাপর যুগের লোকদিগের তত ক্ষমতা ছিল না, তাহারা গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া যাইতে পারিত না, কেবল যে পরিবারে পতিত থাকিত, তাহাই পরিত্যাগ করিত; অর্থাৎ সেই পরিবারের সহিত আদান প্রদানাদি করিত না। কলি যুগের লোকদিগের তত ক্ষমতা নাই; সুতরাং, তাহারা দেশ ত্যাগ, গ্রাম ত্যাগ, বা স্কুল ত্যাগ করিতে পারে না, কেবল যে ব্যক্তি পতিত হয়, তাহাকেই পরিত্যাগ করিয়া থাকে।

কৃতে সম্ভাষণাদেব ত্রেতায়াং স্পর্শনেন চ। দ্বাপরে ত্বন্নমাদায় কলৌ পততি কৰ্ম্মণা।

সত্য যুগে সম্ভাষণ মাত্রেই পতিত হয়, ত্রেতা যুগে স্পর্শন দ্বারা পতিত হয়, দ্বাপর যুগে অম্লগ্রহণ দ্বারা পতিত হয়, কলি যুগে কৰ্ম্ম দ্বারা পতিত হয়।

অর্থাৎ, সত্য যুগের লোকেরা, পতিতের সহিত সম্ভাষণ করিলে, পতিত হইত, সুতরাং, তৎকালীন লোকেরা পতিত ব্যক্তির সহিত সম্ভাষণ করিত না। ত্রেতা যুগের লোকেরা, পতিতের সহিত সম্ভাষণ করিলে, পতিত হইত না, পতিত ব্যক্তিকে স্পর্শ করিলে পতিত হইত। দ্বাপর যুগের লোকেরা, পতিতের সম্ভাষণে অথবা স্পর্শনে পতিত হইত না, কিন্তু পতিত ব্যক্তির অন্নগ্রহণে পতিত হইত। কলি যুগের লোকেরা পতিতের সম্ভাষণে, স্পর্শনে অথবা অন্নগ্রহণে পতিত হয় না, কিন্তু নিজে পাতিত্যজনক কর্ম্ম হরিলেই পতিত হয়; অর্থাৎ, পতিতের সম্ভাষণাদি পরিত্যাগ করিয়া চলিতে পারে, কলি যুগের লোকদিগের এরূপ ক্ষমতা নাই; সুতরাং, সন্তাষণাদি করিলে পতিত হয় না, নিজে পাতিত্যজনক কৰ্ম্ম করিলেই পতিত হয়।

কৃতে তাৎকালিকঃ শাপস্ত্রেতায়াং দশভিদ্দিনৈঃ। দ্বাপরে চৈকমাসেন কলৌ সংবৎসরেণ তু।

সত্য যুগে, শাপ দিব। মাত্র ফলে; ত্রেতা যুগে, দশ দিনে শাপ ফলে; দ্বাপর যুগে, এক মাসে শাপ ফলে; কলি যুগে, সংবৎসরে শাপ ফলে। অর্থাৎ, সত্য যুগের লোকদিগের এরূপ ক্ষমতা ছিল যে, তাহারা শাপ

দিবা মাত্র ফলিত; কিন্তু, পর পর যুগে, মনুষ্যের শক্তি হ্রাস হওয়াতে, যথাক্রমে ত্রেতা, দ্বাপর, ও কলি যুগে দশ দিন, এক মাস, ও সংবৎসরে ফলে।

অভিগম্য কৃতে দানং ত্রেতাস্বাহুয় দীয়তে।

দ্বাপরে যাচমানায় সেবয়া দীয়তে কলৌ ॥

সত্য যুগে, পাত্রের নিকটে গিয়া, দান করিয়া আইসে; ত্রেতা যুগে, পাত্রকে আহ্বান করিয়া আনিয়া, দান করে দ্বাপর যুগে, নিকটে আসিয়া যাচ্ঞা। করিলে, দান করে; কলি যুগে, আনুগত্য করিলে, দান করে।

অর্থাৎ, সত্য যুগে, মনুষ্যের ধর্ম্মপ্রবৃত্তি এমত প্রবল ছিল যে, দান করিবার ইচ্ছা হইলে, পাত্রের নিকটে গিয়া, দান করিয়া আসিত। ত্রেতা যুগের লোকদিগের ধর্ম্মপ্রবৃত্তি তন্ত প্রবল ছিল না; দান করিবার ইচ্ছা হইলে, পাত্রের নিকটে না গিয়া, তাহাকে ডাকাইয়া আনিয়া, দান করিত। দ্বাপর যুগের লোকদিগের ধৰ্ম্মপ্রবৃত্তি তদপেক্ষাও অল্প ছিল; দান করিবীর ইচ্ছা হইলে, পাত্রের নিকটে গিয়া, অথবা পাত্রকে ডাকাইয়া, দান করিত না, পাত্র আসিয়া যাজ্ঞা করিলে, দান করিত। আর, কলি যুগের লোকদিগের ধর্ম্মপ্রবৃত্তি এত অন্ন যে, পাত্র যাচ্ছা করিলেই হয় না, আনুগত্য না থাকিলে, যাজ্ঞা করিয়াও দীন পায় না।

কৃতে ত্বস্থিগতাঃ প্রাণাস্ত্রেতায়াং মাংসমাশ্রিতাঃ। দ্বাপরে রুধিরঞ্চৈব কলৌ ত্বন্নাদিষু স্থিতাঃ ॥

সত্য যুগে, মনুষ্যের প্রাণ অস্থিস্থিত; ত্রেতা যুগে, মাংসস্থিত; দ্বাপর যুগে, রুধিরস্থিত; কলি যুগে, অন্নাদিস্থিত।

অর্থাৎ, সত্য যুগে, প্রাণ অস্থিস্থিত, অর্থাৎ তপ্যাদি দ্বারা সর্ব্ব শরীর শুষ্ক হইয়া, অস্থিমাত্র অবশিষ্ট থাকিলেও, প্রাণত্যাগ হইত না; ত্রেতা যুগে, প্রাণ মাংসস্থিত, অর্থাৎ অনাহারাদি দ্বারা শরীরের মাংস শুষ্ক হইলে প্রাণত্যাগ হইত; দ্বাপর যুগে, প্রাণ রুধিরস্থিত, অর্থাৎ মাংস শোষণের আবশ্যকতা হইত না, শরীরের শোণিত শুষ্ক হইলেই প্রাণত্যাগ হইত; আর, কলি যুগ, প্রাণ অন্নাদিস্থিত, অর্থাৎ শরীরের শোষণাদির আবশ্যকতা নাই, আহার বন্ধ হইলেই প্রাণত্যাগ ঘটিয়া উঠে।

..এক্ষণে সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, যাহা দর্শিত হইল, তদন্ত- সারে ইহা স্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে কি না যে, পরাশর, যুগানুসারে শক্তিহ্রাসাদি কারণে ধৰ্ম্মভেদ ব্যবস্থা করিয়া, সেই শক্তিহ্রাসাদির উদাহরণ প্রদর্শিত করিবার নিমিত্তই, উল্লিখিত কয়েক বচনে চারি টুগের কথা কহিয়াছেল, নতুবা ঐ সমস্ত বচনে সকল যুগের ধর্ম্ম কহিয়াছেন, এরূপ নহে। প্রতিবাদী মহাশয়, এই প্রকরণের তিনটি মাত্র বচন উদ্ধৃত করিয়া, পরাশর অন্য যুগের ধর্ম্মও নিরূপণ করিয়া- ছেন বলিয়া বোধ করিয়াছেন। কিন্তু স্থিরচিত্তে প্রকরণ পৰ্য্যালোচনা ও তাৎপর্য্য বিবেচনা করিয়া দেখিলে, বোধ করি, কদাচ তাঁহার তাদৃশ বোধ জন্মিত না।

১৩-পরাশর সংহিতায়

চারি যুগের ধর্মোপদেশপ্রদান সপ্রমাণ হয় না।

কেহ কেহ কহিয়াছেন, পরাশরসংহিতায় যে চারি যুগের ধর্ম্ম উপদিষ্ট হইয়াছে, ঐ সংহিতার প্রত্যেক অধ্যায়ের উপক্রম ও উপসংহারে তাহা প্রতীয়মান হয়। যদ্যিাৎ কুতর্কবাদিদিগের ইহাতেও প্রবোধ না জন্মে এ কারণ ঐ সংহিতা হইতে কোন কোন বচন উদ্ধৃত করিয়া চারি যুগের ধৰ্ম্মোপ- দেশপ্রদান সপ্রমাণ কল্পি। প্রথম অধ্যায়ে লেখেন।

কৃতে সম্ভাষণাৎ পাপং ত্রেতায়াঞ্চৈব দর্শনাৎ। দ্বাপরে চান্নমাদায় কলৌ পততি কৰ্ম্মণা ॥

সত্য যুগে পাপীর সহিত আলাপ মাত্রে পাপ জন্মে, ত্রেতা যুগে পাপীকে দর্শন করিলে পাপ জন্মে, দ্বাপর যুগে পাপীর অন্ন ভোজনে পাপ জন্মে, কলি যুগে পাপজনক কর্ম্মাচরণ করিলেই পাপ হয়, অর্থাৎ সংসর্গাদি দোষে পাপ আশ্রয় করে না,

পরে দ্বাদশ অধ্যায়ে লেখেন।

আসনাচ্ছয়নাছ্যানাৎ সম্ভাষাৎ সহভোজনাৎ। সংক্রামন্তীহ পাপানি তৈলবিন্দুরিবান্তসি ॥

যেমন বিন্দুমাত্র তৈল জলে পতিত হইলে, সমুদায় জল ব্যাপে, তদ্রূপ পাপীর সহ উপবেশন, একত্র শয়ন, একত্র গমন, আলাপ ও একত্র ভোজন করিলে, নিষ্পাপ ব্যক্তিকেও পাপ আশ্রয় করে।

পরাশরসংহিতার দ্বাদশ অধ্যায়কে যদি কেবল কলি যুগের ধর্ম্মপ্রতি- পাদক কহেন, তবে উল্লিখিত বচনানুসারে কলি যুগে পাপীর সংসর্গে পাপ জন্মে ইহা সুতরাং স্বীকার করিতে হয়। কিন্তু প্রথমাধ্যায়ে কলি যুগে পাপীর সংসর্গে ও তদর্শনাদিতে পাপ হয় না লিখিয়াছেন।.. অতএব বচন দ্বয়ের পরস্পর বিরোধ হেতু, পরাশরসংহিতায় চারি যুগেরই ধৰ্ম্ম উক্ত হইয়াছে স্বীকার করিতে হয় অথবা পরাশর উন্মত্ত প্রলাপ করিয়াছেন বলিতে হয় (৭৮)।

• 'প্রতিবাদী মহাশয়েরা, মথার্থ তাৎপর্য্য অনুধাবন করিতে না পারিয়াই, প্রথমাধ্যায়ের বচনের সহিত, দ্বাদশাধ্যায়ের বচনের বিরোধ ঘটাইতে উদ্যত হইয়াছেন। প্রথমাধ্যায়ের বচনের তাৎপর্য্য এই যে, সত্য প্রভৃতি যুগে, পতিতের সহিত সম্ভাষণাদি করিলে পতিত হইত; কলি যুগে, পতিতসম্ভাষণ প্রভৃতি দ্বারা পতিত হয় না; স্বয়ং ব্রহ্মবধাদি 'পাতিত্যজনক কৰ্ম্ম করিলেই পতিত হয়; অর্থাৎ, কলি যুগে, সত্য প্রভৃতি যুগের ন্যায়, সংসর্গদোষে পতিত হয় না। দ্বাদশাধ্যায়ের বচনের তাৎপর্য্য এই যে, কলি যুগে, সংসর্গ দোষে পাতিত্য জন্মে না বটে, ক্ষিন্তু পতিতের সহিত সংসর্গ করিলে, কিছু পাপ জন্মিয়া থাকে। সুতরাং, এই দুই বচনের কিরূপে পরস্পর বিরোধ ঘটিতে পারে, তাহা প্রতিবাদী মহাশয়েরাই বলিতে পারেন। তাঁহারা প্রথম বচনের যেরূপ পাঠ ধরিয়াছেন, তাহাতেই স্পষ্ট বোধ হইতেছে, সবিশেষ অনুধাবন না করিয়াই, উক্ত উভয় বুচনের পরস্পর বিরোধ ঘটাইবার চেষ্টা পাইয়া- ছেন। তাঁহাদের ধৃত পাঠ ও কৃত ব্যাখ্যা অনুসারে, সত্য যুগে, পতিতের সহিত সম্ভাষণ করিলে পতিত হয়; ত্রেতা যুগে, পতিত দর্শন করিলে পতিত হয়; দ্বাপর যুগে, পতিতের অন্ন গ্রহণ করিলে পতিত হয়; কলি যুগে, ব্রহ্মবধাদি করিলে পতিত হয়। এ স্থলে প্রতিবাদী মহাশয়দিগের প্রতি আমার জিজ্ঞায় এই যে, ত্রেতা যুগে, পতিত দর্শনে পতিত হইবেক কেন; আমার বোধ হয়, কোনও যুগেই পতিত দর্শনে পতিত হইতে পারে না। বঙনের অভিপ্রায় দ্বারা স্পষ্ট বোধ হইতেছে, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, এই তিন যুগে, উত্তরোত্তর, গুরুতর সংসর্গেরই পাতিত্যজনকতা আছে। কিন্তু, প্রতিবাদী মহাশয়দিগের ধৃত পাঠ অনুসারে, সত্য যুগে, পতিত সম্ভাষণে পতিত হয়; ত্রেতা যুগে, পতিত দর্শনে পতিত হয়। এক্ষণে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, পতিত দর্শনকে, পতিতসম্ভাষণ অপেক্ষা, গুরুতর সংসর্গ বলা যাইতে পারে কি না। প্রতিবাদী মহাশয়েরা কি বলেন, বলিতে পারি না; কিন্তু, আমার বোধ হয়, পতিতসম্ভাষণ অপেক্ষা পতিদর্শন শুরুতর সংসর্গ নহে। সত্য যুগে, যেরূপ সংসর্গে পাতিত্য জন্মে, ত্রেতা যুগে, তদপেক্ষা গুরুতর সংসর্গ না করিলে, পাতিত্য জন্মিতে পারে না। যাহা হউক, আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, প্রতিবাদী মহাশয়দিগের এ স্থল অসংলগ্ন বলিয়াই বোধ হয় নাই। চন্দ্রিকাযন্ত্রের মুদ্রিত পুস্তকে যেরূপ পাঠ দেখিয়াছেন, তাহাই তাঁহারা প্রকৃত পাঠ স্থির করিয়া লইয়াছেন। ঐ বচনের প্রকৃত পাঠ এই,

কৃতে সম্ভাষণাদেব ত্রেতায়াং স্পর্শনেন চ।

দ্বাপরে ত্বন্নমাদায় কলৌ পততি কৰ্ম্মণা ॥ (৭৯)

সত্য যুগে, পতিতের সহিত সম্ভাষণ করিলে পতিত হয়; ত্রেতা, যুগে, পতিতকে স্পর্শ করিলে পতিত হয়; দ্বাপর যুগে, পতিতের অন্নগ্রহণ করিলে পতিত হয়: কলি যুগে, ব্রহ্মবধাদি কর্ম্ম করিলে পতিত হয়।

এক্ষণে, পাঠকবর্গ বিবেচনা করিয়া দেখুন, পর পর যুগে গুরুতর সংসর্গের পাতিত্যজনকতা থাকিতেছে কি না। পতিতের সহিত সম্ভাষণ অপেক্ষা, পতিতকে স্পর্শ করা গুরুতর সংসর্গ হইতেছে; পতিতকে স্পর্শ করা অপেক্ষা, পতিতের অন্নগ্রহণ গুরুতর সংসর্গ হইতেছে। অতএব, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, প্রতিবাদী মহাশয়দিগের, সবিশেষ অনুধাবন না করিয়াই, ঐ বচনের পাঠ ধরা ও ব্যাখ্যা করা হইয়াছে কি না। প্রতিবাদী মহাশয়েরা, কোনও কোনও স্থলে, পরাশরভাষ্যের কোনও কোনও অংশ উদ্ধৃত করিয়াছেন; সুতরাং, উত্তরলিখন কালে, পরাশরভান্ত তাঁহাদের নিকটে ছিল, তাহার সন্দেহ নাই। যখন তাঁহারা, পূর্ব্বোক্ত দুই বচন উদ্ধৃত করিয়া, ঐ উভয়ের পরস্পর বিরোধ ঘটাইবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, তখন ঐ দুই স্থলের ভাষ্যে দৃষ্টিপাত করা অত্যন্ত আবঞ্চক ছিল; তাহা হইলে, বচনের প্রকৃত পাঠও জানিতে পারিতেন, এবং অকারণে বিরোধ ঘটাইতেও উচ্চত হইতেন না। ভাষ্যকার প্রথমাধ্যায়ের বচনের এই ব্যাখ্যা করিয়াছেন, ক্বতাদিধিব কলো পতিতসন্তাষণাদিনা ন স্বয়ং পততি কিন্তু বধাদিকৰ্ম্মণা পতিতো ভবতি।

সত্য প্রভৃতি যুগের ভ্যায়, কলি যুগে, পতিতসন্তাষণাদি দ্বারা পতিত হয় না, কিন্তু বধাদি কৰ্ম্ম দ্বারা পতিত হয়।

পুরে, দ্বাদশাধ্যায়ের বচনের এই আভাস দিয়াছেন,

যস্তু পতিতৈব্রহ্মহাদিভিঃ সহ সংবৎসরং সংসর্গং কৃত্বা স্বয়মপি পতিতস্তম্ভ্য প্রায়শ্চিত্তং মনুরাহ

যো যেন পতিতেনৈষাং সংসর্গং যাতি মানবঃ।

স'তস্তৈব ব্রতং কুৰ্য্যাৎ সংসর্গস্থ্য বিশুদ্ধয়ে ইতি ॥ আচার্য্যন্ত কলিযুগে সংসর্গদোষাভাবমভিপ্রেত্য সংসর্গ- প্রায়শ্চিত্তং নাভ্যধাৎ। সংসর্গদোষ্য পাতিত্যাপাদ- কত্বাভাবেহপি পাপমাত্রাপাদকত্বমস্তীত্যাহ

আসনাৎ শয়নাৎ যানাৎ দম্ভীষাৎ সহভোজনাৎ। সংক্রামস্তি হি পাপানি তৈলবিন্দুরিবাস্তসি ॥

যে ব্যক্তি, ব্রহ্মহত্যাকারী প্রভৃতি গতিতদিগের সহিত, সংবৎসর সংসর্গ করিয়া, স্বয়ং পতিত হয়, মনু তাহার প্রায়শ্চিত্ত কহিয়াছেন, যে ব্যক্তি, ইহাদিগের মধ্যে, যে পতিতের সহিত সংসর্গ করে, সে, সংসর্গ দোষ ক্ষয়ের নিমিত্ত, সেই পতিতের প্রায়শ্চিত্ত করিবেক।

কিন্তু আচার্য্য (পরাশর), কলি যুগে সংসর্গদোষ নাই এই অভিপ্রায়ে, সংসর্গ- দোষের প্রায়শ্চিত্ত বলেন নাই। সংসর্গদোষের পাতিত্যজনকতা না থাকিলেও, সামান্ততঃ পাপজনকতা আছে, ইহা কহিতেছেন, গতিতের সহিত উপবেশন, শয়ন, গমন, সম্ভাষণ ও ভোজন করিলে, জলে তৈলবিন্দুর স্তায়, সংসর্গীতে পাপ সংক্রান্ত হয়।

১৪-কলৌ পারাশরঃ স্মৃতঃ এই পরাশরবাক্য প্রশংসাপর নহে।

কেহ কেহ কহিয়াছেন,

পরাশর যে (কলৌ পারাশরঃ স্বতঃ) কহিয়াছেন, সে প্রশংসাপর বাক্য। এমত প্রায়ই গ্রন্থকারেরা আপন আপন গ্রন্থের আধিক্য বর্ণনা করিয়া থাকেন। 'যথা,

রুতে শ্রুত্যুদিতো মার্গন্ত্রেতায়াং স্মৃতিচোদিতঃ। দ্বাপরে তু পুরাণোক্তঃ কলাবাগমসম্ভবঃ ॥

ইত্যাগমবচনম্।

সত্য যুগে বেদোক্ত ধৰ্ম্ম, ত্রেতা যুগে, মৃত্যুক্ত ধৰ্ম্ম, দ্বাপর যুগে পুরাণোক্ত ধৰ্ম্ম, কলি যুগে আগ্নমোক্ত ধৰ্ম্ম, এতৎ বাক্যকে প্রশংসাপর বোধ না করিলে, শিব উক্তি জন্ম কলি কালে আগম ভিন্ন কোন স্মৃতিই গ্রাহ হইতে পারে না। বঁদি কূটযুক্তি দ্বারা ঐ বচনকে কলি মাত্র ধৰ্ম্ম প্রমাণ কর তবে আগমবাক্যকে প্রতিপন্ন করিতে, তৎপ্রতিপক্ষেরা কেন অশক্ত হইবেন, অর্থাৎ শিবোক্তির প্রাধান্য জন্ত কলিতে স্মৃতি- বাক্যের গ্রাহ্যতা নাই। (৮০)

প্রতিবাদী মহাশয়রা পূর্ব্বোক্ত আগমবাক্যকে আগমশাস্ত্রের প্রশংসাপর স্থির করিয়াছেন, এবং এই আগমবাক্য যেমন প্রশংসাপর, সেইরূপ, কলৌ পারাশরঃ, স্বতঃ, এই পরাশরবাক্যকেও প্রশংসাপর • বলিয়া মীমাংসা করিয়াছেন। কিন্তু আগমশাস্ত্রের উদ্দেশ্য কি, তাহার সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে, ঐ আগমবাক্যকে প্রশংসাপর বলিয়া ব্যাখ্যা করিতেন না। আগমশাস্ত্র মোহশাস্ত্র; লোকমোহনের নিমিত্ত, শিব ও বিষ্ণু আগমশাস্ত্রের সৃষ্টি করিয়াছেন। যথা,

চকার মোহশাস্ত্রাণি কেশবঃ সশিবস্তথা। কাপালং নাকুলং বামং ভৈরবং পূর্বপশ্চিমম্। পাঞ্চরাত্রং পাশুপতং তথান্যানি সহস্রশঃ । (৮১)

বিছু ও শিব কাপাল, নাকুল, বাম, পূর্ব্বভৈরব, পশ্চিমভৈরব, পাঞ্চরাত্র, পাশুপত প্রভৃতি সহস্র সহস্র মোহশাস্ত্র করিয়াছেন।

শৃণু দেবি প্রবক্ষ্যামি তামসানি যথাক্রমম্। যেষাং শ্রবণযাত্রেণ পাতিত্যং জ্ঞানিনামপি। প্রথমং হি ময়ৈবোক্তং শৈবং পাশুপতাদিকম্ ।। (৮২)

দেবি! শ্রবণ কর, যথাক্রমে মোহশাস্ত্র সকল বলিব; যে মোহশাস্ত্রের শ্রবণ- মাত্রে, জ্ঞানীরাও পতিত হয়। শৈব, পাশুপত প্রভৃতি মোহশাস্ত্র আমিই প্রথমতঃ কহিয়াছি।

যানি শাস্ত্রাণি দৃশ্যন্তে লোকেহস্মিন্ বিবিধানি চ। শ্রুতিস্মৃতিবিরুদ্ধানি তেষাং নিষ্ঠা তু তামসী। করাল ভৈরবঞ্চাপি যামলং বামমেবচ এবংবিধানি চান্ড্যানি মোহনার্থানি তানি তু। ময়া সৃষ্টানি চা্যানি মোহায়ৈষাং ভবার্ণবে । (৮৩) এই লোকে বেদবিরুদ্ধ ও স্মৃতিবিরুদ্ধ যে নানাবিধ শাস্ত্র দেখিতে পাওয়া যায়,

সে সমুদয়ের তামসী গতি, অর্থাৎ তদনুসারে চলিলে, অস্তে অধোগতি হয়।

করালভৈরব, যামল, বান্স, ও এইরূপ অভান্ত মোহশাস্ত্র সকল, ভবার্ণবে লোকমোহনের নিমিত্ত, আমি সৃষ্টি করিয়াছি।

এই রূপে, আগমশাস্ত্রকে শ্রুতিস্মৃতিবিরুদ্ধ মোহশাস্ত্র স্থির করিয়া, অধিকারিভেদে কোনও অংশ গ্রাহ্য কহিয়াছেন। যথা,

তথাপি যোহংশো মার্গাণাং বেদেন ন বিরুধ্যতে।

সোহংশঃ প্রমাণমিত্যুক্তঃ কেষাঞ্চিদধিকারিণাম্ ।। (৮৪) তথাপি, অর্থাৎ শ্রুতিশ্রুতিবিরুদ্ধ হইলেও, আগমোক্ত পথের যে অংশ বেদ- বিরুদ্ধ না হয়, কোনও কোনও অধিকারীর পক্ষে, সেই অংশ প্রমাণ। আগমশাস্ত্রের অধিকারী কে, তাহাও নিরূপিত হইয়াছে। যথা, শ্রুতিভ্রষ্টঃ স্মৃতিপ্রোক্তপ্রায়শ্চিত্তপরাম্মুখঃ। ক্রমেণ শ্রুতিসিদ্ধ্যর্থং ব্রাহ্মণস্তন্ত্রমাশ্রয়েৎ। পাঞ্চরাত্রং ভাগবতং মন্ত্রং বৈখানসাভিধম্। বেদভ্রষ্টান সমুদ্দিশ্য কমলাপতিরুক্তবান্।। (৮৫).

বেদভ্রষ্ট এবং স্মৃতিপ্রোক্তপ্রায়শ্চিত্তপরান্মুখ ব্রাহ্মণ, ক্রমে বেদসিদ্ধির নিমিত্ত, তন্ত্রশাস্ত্র আশ্রয় করিবেক। বিষ্ণু, বেদভ্রষ্টদিগের নিমিত্তে, পাঞ্চরাত্র, ভাগবত, বৈখানসমুন্ত্র প্রভৃতি শাস্ত্র কহিয়াছেন।

এইরূপ মোহশাস্ত্র সৃষ্টি করিবার তাৎপর্য্যও পদ্মপুরাণে ব্যাখ্যাত

হইয়াছে। যথা,

স্বাগমৈঃ কল্পিতৈস্তৈস্ত জনান মদ্বিমুখান্ কুরু। মাঞ্চ গোপয় যেন স্যাৎ সৃষ্টিরেষোত্তরোত্তরা। (৮৬) বিষ্ণু শিবকে কহিতেছেন,

তোমার কল্পিত আগমশাস্ত্রসমূহ দ্বারা লোককে আমাতে বিমুখ কর, এবং আমাকে গোপন কর, তাহা হইলে এই স্বষ্টিপ্রবাহ উত্তরোত্তর চলিবেক।

অতএব দেখ, যখন বিষ্ণু ও শিব, উভয়ে পরামর্শ করিয়া, "লোক- মোহনের নিমিত্ত, আগমশাস্ত্রের সৃষ্টি করিয়াছেন; এবং লোকদিগের অনায়াসে মোহ জন্মাইবার নিমিত্ত, শ্রুতি, স্মৃতি ও পুরাণকে পূর্ব্ব পূর্ব যুগের শাস্ত্র স্থির করিয়া দিয়া, কলি যুগের লোদিগকে কেবল আগম- শাস্ত্র অনুসারে চলিবার ব্যবস্থা দিয়াছেন, তখন, কলাবাগমসম্ভবঃ, এই আগমবাক্য, কোনও মতেই, প্রশংসাপর হইতে পারে না। কলি যুগে কেবল আগমশাস্ত্র অনুসারেই চলিতে হইবেক, ইহাই ঐ মোহজনক আগমবাক্যের অর্থ ও তাৎপর্য্য। আর, যখন আগমশাস্ত্র কেবল লোকমোহনের নিমিত্তই সৃষ্ট হইয়াছে, তথন পূর্ব্বোক্ত আগমবাক্য অবলম্বন করিয়া, কলি যুগে, স্মৃতিশাস্ত্রের অপ্রামাণ্য প্রতিপন্ন করিবার সম্ভাবনাও নাই; আগম বেদবিরুদ্ধ মোহনশাস্ত্র, স্মৃতি বেদানুযায়ী ধৰ্ম্মশাস্ত্র। অতএব, পূর্ব্বনির্দিষ্ট আগমবাক্যকে প্রশংসাপর স্থির ও দৃষ্টান্তস্থল গণ্য করিয়া, কলৌ পারাশরঃ স্মৃতঃ, এই পরাশরবাক্যকে প্রশংসাপর বলিয়া মীমাংসা করা, কোনও মতেই, বিচারসিদ্ধ হইতে পারে না।

১৫-মনুসংহিতাতে

চারি যুগের ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্ম নিরূপণ করা নাই।

ধৰ্ম্মশাস্ত্র কাহাকে বলে, যাজ্ঞবন্ধ্যবচনানুসারে তাহার নিরূপণ করিয়া, আমি কহিয়াছিলাম, এক্ষণে ইহা বিবেচনা করা আবশ্যক, এই সমস্ত ধৰ্ম্মশাস্ত্রে যে সকল ধৰ্ম্ম নিরূপিত হইয়াছে, সকল' যুগেই সে সমুদায় ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া চলিতে হইবেক কি না। মনুপ্রণীত ধৰ্ম্মশাস্ত্রের প্রথমাধ্যায়ে বিষয়ের মীমাংসা আছে। যথা,

অন্যে কৃতযুগে ধৰ্ম্মাস্ত্রেতায়াং দ্বাপ্পরে পরে।

অন্যে কলিযুগে নৃণাং যুগহ্রাসানুরূপতঃ ॥ ৮৫ ॥ যুগানুসারে মনুষ্যের শক্তি হ্রাস হেতু, সত্য যুগের ধৰ্ম্ম সকুল অ্য, ত্রেতা যুগের ধর্ম সকল অ্য, দ্বাপর যুগের ধর্ম্ম সকল অ্য, কলি যুগের ধর্ম সকল অহ্য।

এক্ষণে এই জিজ্ঞাসা উপস্থিত হইতে পারে, তবে কলি যুগের লোক- দিগকে কোন ছুৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া চলিতে হইবেক। মনুপ্রণীত ধৰ্ম্মশাস্ত্রে, যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্ম, এই মাত্র নির্দেশ আছে; ভিন্ন ভিন্ন যুগের ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্ম নিরূপণ করা নাই। কোন যুগে কোন ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া চলিতে হইবেক; কেবল পরাশর প্রণীত ধৰ্ম্মশাস্ত্রেই সে সমুদ্রয়ের নিরূপণ আছে। প্রতিবাদী মহাশয়েরা ইহাতে অসন্তুষ্ট হইয়া কহিয়াছেন, কোন্ যুক্তিকে অবলম্বন করিয়া সাহসপূর্ব্বক কহেন বে, মনুপ্রণীত ধৰ্ম্মশাস্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন অর্থাৎ সত্যাদি কলি পর্য্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন যুগের অনুষ্ঠেয় ধর্ম্মের ভিন্নত্ব প্রদর্শন করান নাই। অ্যে কৃত যুগে ধর্মা ইত্যাদি মনুক্তসংহিতার একটী বচনকে ধৃত করিয়াই কি বিমল যুগলায়তন নয়নদ্বয়কে মুদ্রিত করিয়া- ছিলেন। তৎপরে যে চতুর্ভুগের ধর্ম মনু নিরূপণ করিয়াছেন, তাহার প্রতি দৃষ্টিপাতও করেন নাই।

তপঃ পরং কৃতযুগে ত্রেতায়াং জ্ঞানমুচ্যতে। দ্বাপরে যজ্ঞমিত্যাহুর্দানমেকং কলৌ যুগে ॥

ইতি মনুঃ।

সত্য যুগের ধর্ম তপস্তা, ত্রেতা যুগের ধর্ম জ্ঞান, কাপর যুগের ধর্ম যজ্ঞ, কেবল এক দানই কলি যুগের ধর্ম্ম। (৮৭)

প্রতিবাদী মহাশয়দিগের এরূপ লিখিবার তাৎপর্য্য এই যে, ভগবান্ মনু, অন্ত্যে কৃতযুগে ধৰ্ম্মাঃ, এই বচনে যে যুগভুেদে ধৰ্ম্মভেদ ব্যবস্থা করিােছেন, তৎপরবর্তী, তপঃ পরং কৃতযুগে, এই বচনে সেই ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম নিরূপণ করিয়াছেন; সুতরাং, মনুসংহিতাতে ভিন্ন ভিন্ন যুগের, ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্ম নিরূপণ করা নাই, আমার এই কথা নিতান্ত অসঙ্গত হইয়া উঠিল। এ স্থলে আমার বক্তব্য এই যে, প্রতিবাদী মহাশয়েরা এই যে মীমাংসা করিয়াছেন, তাহা কোনও মতেই সঙ্গত হইতে পারে না। পূর্ব্ব বচনে যে যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্ম নির্দেশ আছে, পর বচনে সেই ভিন্ন ভিন্ন যুগের ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্ম নিরূপণ করা হইয়াছে, সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে, ইহা কোনও ক্রমে প্রতিপন্ন হইতে পারে না। বিশেষতঃ, প্রতিবাদী মহাশয়েরা পর বচনের যে অর্থ লিখিয়াছেন, তাহাও ঐ বচনের প্রকৃত অর্থ 'নহে। অতএব, ঐ, দুই বচন, অর্থ সহিত, যথাক্রমে লিখিত হইতেছে; দৃষ্টি করিলে, পাঠকবর্গ অনায়াসে অবগত হইতে পারিবেন, প্রতিবাদী মহাশয়দিগের অভিলষিত মীমাংসা সংলগ্ন হইতে পারে কি না।

অন্যে কৃতযুগে ধৰ্ম্মাক্রেতায়াং দ্বাগরেহপরে।

অন্যে কলিযুগে নৃণাং যুগহ্রাসানুরূপতঃ ॥ ৮৫ ॥

যুগানুসারে মনুষ্যের শক্তি হ্রাস হেতু, সত্য 'যুগের ধর্ম্ম সকল অন্ত, ত্রেতা যুগের ধর্ম্ম সকল অন্ত, দ্বাপর যুগের ধর্ম সকল অ্য, কলি যুগের ধর্ম্ম সকল অন্ত্য।

তপঃ পরং কৃতযুগে ত্রেতায়াং জ্ঞানমুচ্যতে। দ্বাপরে যজ্ঞমেবাহুর্দানমেকং কলৌ যুগে ॥ ৮৬ ॥

সত্য যুগের প্রধান ধৰ্ম্ম তপস্তা, ত্রেতা যুগের প্রধান ধৰ্ম্ম জ্ঞান, দ্বাপর যুগের প্রধান ধর্ম যজ্ঞ, কলি যুগের প্রধান ধর্ম দান।

এক্ষণে, পাঠকবর্গ বিবেচনা করিয়া দেখুন, পূর্ব্ব বচনে, সত্য যুগের ধর্ম্ম সকল অন্ত্য, ইত্যাদি দ্বারা ভগবান্ মনু, ভিন্ন ভিন্ন যুগের ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্ম, এই ব্যবস্থা করিয়াছেন; পর বচনে সত্য যুগের প্রধান ধৰ্ম্ম তপস্তা, ইত্যাদি দ্বারা, সেই ভিন্ন ভিন্ন যুগের ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্ম নিরূপণ করা হইল কি না। পূর্ব্ব বচনে, প্রত্যেক যুগের ধর্ম্ম সকল ভিন্ন, এই নির্দেশ আছে পর বচনে, কোন যুগের প্রধান ধৰ্ম্ম কি, তাহারই নিরূপণ আছে; সুতরাং, পূর্ব্ব বচনের সহিত পর বচনের কোনও সংস্রঘ দৃষ্ট হইতেছে না; কোন যুগের প্রধান ধৰ্ম্ম কি, ইহা নিরূপণ করাতে, ভিন্ন ভিন্ন যুগের ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্ম কিরূপে নিরূপণ করা হইল। বিশেষতঃ, পূর্ব্ব বচনে, ধৰ্ম্ম সকল ভিন্ন, এইরূপ নির্দেশ আছে; সুতরাং, ধৰ্ম্ম সকল বঙ্গতে, সেই যুগের যাবতীয় ধর্ম্মের কথা লক্ষ্ণিত হইতেছে; কিন্তু, পর বচনে কেবল এক এক যুগের এক একটি ধর্ম্ম নির্ভর্দশ করাতে, কি সেই সেই যুগের যাবতীয় ধর্ম্মের কথা বলা হইল। অতএব, যখন পূর্ব্ব বচনে, ধৰ্ম্ম সকল বলিয়া, সেই সেই যুগের সমুদয় ধর্ম্মের উল্লেখ আছে, এবং যখন পর বচনে, সেই সেই যুগের এক একটি মাত্র ধৰ্ম্ম উল্লিখিত হইয়াছে, এবং তাহাও প্রধান ধৰ্ম্ম বলিয়া নির্দিষ্ট হইতেছে, তখন পূর্ব্ব বচনে যে, ভিন্ন ভিন্ন যুগে ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্ম, এই নির্দেশ আছে, পর বচনে সেই ভিন্ন ভিন্ন যুগের ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্ম নিরূপণ করা হইয়াছে, এ কথা কোনও মতে সঙ্গত হইতেছে না।

প্রতিবাদী মহাশয়েরা, তপঃ পরং ক্বতযুগে, এই বচনের, সত্য যুগের ধৰ্ম্ম তপশ্যা, ত্রেতা যুগের 'ধর্ম্ম জ্ঞান, দ্বাপর যুগের ধর্ম্ম ষজ্ঞ, কেবল এক দানই কলি যুগের ধৰ্ম্ম, এই ব্যাখ্যা করিয়াছেন। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, এই তিন যুগের বেলায় ধৰ্ম্ম এই মাত্র কহিয়াছেন, প্রধান ধৰ্ম্ম বলিয়া ব্যাখ্যা করেন নাই; আর, কলি যুগের বেলায়, কেবল এক দানই কলি যুগের ধর্ম, এই বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন। এ স্থলেও, প্রধান শব্দ না দিয়া, কেবল শব্দ দিয়াছেন। এরূপ ব্যাখ্যাকে যথার্থ ব্যাখ্যা বলিয়া স্বীকার করিলে, এই অর্থ প্রতিপঃ হয় যে, সত্য, ত্রেতা, ও দ্বাপর যুগে, যথাক্রমে, তপস্তা, জ্ঞান, ও যজ্ঞ ভিন্ন অন্ত্য ধৰ্ম্ম ছিল না; আর কলিতে, কেবল এক দান ভিন্ন অন্ত কোনও ধৰ্ম্ম নাই। এক্ষণে, পাঠকবর্গ বিবেচনা করিয়া দেখুন, প্রতিবাদী মহাশয়দিগের ব্যাখ্যা সংলগ্ন হইতে পারে কি না। তাঁহাদের মতে, কেবল এক দানই কলি যুগের ধর্ম্ম, অন্য কোনও ধৰ্ম্ম নাই; সুতরাং, ব্রত, উপবাস, জপ, হোম, দেবার্চ্চনা, তীর্থপর্য্যটন প্রভৃতি কলি যুম্ভের ধর্ম্ম নহে। বস্তুতঃ, তপস্তা প্রভৃতি সকলই সকল যুগের ধর্ম্ম; কেবল তপস্তা প্রভৃতি এক একটি সত্য প্রভৃতি এক এক যুগের প্রধান ধৰ্ম্ম, ইহাই মনুবচনের অর্থ ও তাৎপর্য্য। ঐ বচনে, পর ও এক শব্দ তপস্তা প্রভৃতির বিশেষণ আছে। পর ও এক শব্দে প্রধান এই অর্থও বুঝায়, কেবল এই অর্থও বুঝায়। বোধ করি, প্রতিবাদী মহাশয়েরা, ঐ দুই শব্দের কেবল এই অর্থ বুঝিয়া, ঐরূপ বিপরীত ব্যাখ্যা করিয়াছেন। এই বচনস্থ পর ও এক শব্দে, যে কেবল এই অর্থ না বুঝাইয়া, প্রধান এই অর্থ বুঝাইবেক,

ইহা কুহুকভট্টের ব্যাখ্যা দ্বারাও প্রতিপন্ন হইতেছে। যথা যদ্যপি তপঃপ্রভৃতীনি সর্বাণি সর্বযুগেম্বনুষ্ঠেয়ানি তথাপি সত্যযুগে তপঃ প্রধানং মহাফলমিতি জ্ঞাপ্যতে এবমাত্ম- জ্ঞানং ত্রেতাযুগে দ্বাপরে যজ্ঞঃ দানং কলো।

যদিও তপস্তা প্রভৃতি সকলই সকল যুগে অনুষ্ঠান করা কর্তব্য, তথাপি সত্য যুগে তপস্তা প্রধান, অর্থাৎ তপস্তার মহৎ ফল; এইরূপ, ত্রেতা যুগে আত্মজ্ঞান, দ্বাপরে যজ্ঞ, কলিতে দান।

১৬-পরাশর সংহিতাতে

পতিতভাৰ্য্যা ত্যাগ নিষেধ

ও পতিত পতি প্রতি অবজ্ঞা নিষেধ নাই।

কেহ কহিয়াছেন,

১। পরাশরসংহিতাতে পতিত ভাৰ্য্যা ত্যাগ করিতে নিষেধ আছে, সুতরাং, পতিত পতি ত্যাগ করিয়া, পুনর্ব্বার বিবাহ করিবার বিধান সঙ্গত হইতে পারে না।

২। পরাশরসংহিতাতে গলৎকুষ্ঠ্যাদি ব‍্যাধিত পতির প্রতি অবজ্ঞা করিতে নিষেধ আছে, সুতরাং পতিত পতি ত্যাগ ক্লরিয়া অন্য পতি করা পরাশরের অভিপ্রেত হইতে পারে না। (৮৮)।

এ স্থলে আমার বক্তব্য এই যে, পরাশরসংহিতার কোনও অংশেই পতিত ভাৰ্য্যা ত্যাগের, নিষেধ নাই। প্রতিবাদী মহাশয়, কোন বচন দেখিয়া, এই অশপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন, তাহা লক্ষিত হইতেছে না। বোধ হয়,

অদুষ্টাপতিতাং ভার্য্যাং যৌবনে যঃ পরিত্যজেৎ। সপ্ত জন্ম ভবেৎ স্ত্রীত্বং বৈধব্যঞ্চ পুনঃ পুনঃ ॥ যে ব্যক্তি, অদুষ্টা অপতিতা ভাৰ্য্যাকে যৌবনকালে পরিত্যাগ করিবেক, সে

সাত জন্ম স্ত্রী হইয়া জন্মিবেক এবং পুনঃ পুনঃ বিধবা হইবেক। এই বচনে অপতিত ভার্য্যা ত্যাগের যে নিষেধ আছে, প্রতিবাদী মহাশয়, তদৃষ্টেই, পতিত ভাৰ্য্যা ত্যাগের নিষেধ বলিয়া বোধ করিয়া থাকিবেন।

দ্বিতীয় আপত্তির তাৎপর্য্য এই যে, গলৎকুষ্ঠী ও তৎসদৃশ অন্যায় রোগাক্রান্ত ব্যক্তি পতিত। যদি তাদৃশ পতিত পতির প্রতি অবজ্ঞা করিতেও নিষেধ রহিল, তাহা হইলে, পতিত পতিকে এক বারে পরিত্যাগ করিয়া, পুনর্ব্বার বিবাহ করিবেক, ইহা পরাশরের অভিপ্রেত কহিলে, দুই কথা পরস্পর বিরুদ্ধ হইয়া উঠে। প্রতিবাদী মহাশয়ের ব্যাখ্যা অনুসারে, যদিই পরাশরসংহিতাতে গলংকুষ্ঠী প্রভৃতি পতির প্রতি অবজ্ঞা করিবার নিষেধ থাকে, তাহা হইলেও, পতিত পতি ত্যাগ করিয়া, পুনর্ব্বার বিবাহ করিবার বিধি অসঙ্গত হইতে পারে না; কারণ, বিবাহবিধায়ক বচনে পতিত পতি ত্যাগ করিয়া বিবাহ করিবার বিধি আছে; আর, অপর বচনে, গলংকুষ্ঠী প্রভৃতি পতির প্রতি অবজ্ঞা করিতে নিষেধ আছে, পতিত শব্দের প্রয়োগ নব্বই; সুতরাং, বিষয়ভেদ ব্যবস্থা করিলেই, বিরোধ পরিহার হইতে পারে; অর্থাৎ, গলৎকুষ্ঠী প্রভৃতি পতি যদি পতিতের প্রায়শ্চিত্ত করিয়া থাকেন, তাহা হইলেই, তাঁহার প্রতি অবজ্ঞা করিতে নিষেধ আছে; কারণ, প্রায়শ্চিত্ত করিলে, আর তিনি পতিত নহেন। আর, যদি প্রায়শ্চিত্ত না করিয়া, পতিতই থাকেন; তাহা হইলে, তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া বিবাহ

করিতে পারে। সুতরাং, উভয় বচনের আর বিরোধ থাকিতেছে না। কিন্তু, যে বচনে স্বামীর প্রতি অবজ্ঞা করিতে নিষেধ আছে, ঐ বচনে, গলংকুস্তী প্রভৃতি পতিত বুঝায়, এমন শব্দই নাই; সুতরাং, ওরূপ আপত্তিই উত্থাপিত হইতে পারে না। যথা,

দরিদ্রং ব্যাধিতং মূর্খং ভর্তারং যা ন মন্যতে।

সা মৃতা জায়তে ব্যালী বৈধব্যঞ্চ পুনঃ পুনঃ ॥ যে স্ত্রী দরিদ্র, ব্যাধিত, মূর্খ স্বামীর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, সে মরিয়া সর্পী হয় এবং পুনঃ পুনঃ বিধবা হয়।

বোধ করি, প্রতিবাদী মহাশয় ব্যাধিত শব্দে গলৎকুষ্ঠী প্রভৃতি বুঝিয়া- ছেন। কিন্তু, যে যে স্থলে ব্যাধিত শব্দের প্রয়োগ আছে, সর্ব্বত্রই রোগী এই মাত্র অর্থ বুঝায়, পাতিত্যস্বচকরোগাক্রান্ত গলৎকুষ্ঠী প্রভৃতি বুঝায় না। যথা, হীনাঙ্গং ব্যাধিতং ক্লীবং বৃষং বিপ্রো ন বাহয়েৎ। (৮৯)

ব্রাহ্মণ হীনাঙ্গ, ব্যাধিত, ক্লীব কৃষকে লাঙ্গল বহাইবেক না। এ স্থলে ব্যাধিত শব্দে পীড়িত মাত্র বুঝাইতেছে, গলৎকুষ্ঠ্যাদি পতিত বুঝাইতেছে না; অর্থাৎ, ব্রহ্মেণ পীড়িত বৃষকে লাঙ্গল বহাইবেক না। ব্যাধিতঃ কুপিতশ্চৈব বিষয়াসক্তমানসঃ। অন্যথাশাস্ত্রকারী চ.ন বিভাগে পিতা প্রভুঃ । (৯০) ব্যাধিত, কুপিত, বিষয়াসক্ত, এবং অন্যথাশাস্ত্রকারী পিতা ধনবিভাগে ভু নহেন।

অর্থাৎ, পিতাঃ পীড়াবশতঃ বুদ্ধিবিচলিত, অথবা কোনও পুত্রের উপর কুপিত, বা একান্ত বিষয়াসক্ত, কিংবা অন্তথাশাস্ত্রকারী অর্থাৎ যথাশাস্ত্র ভাগ করিয়া দিতে অসম্মত হন, তাহা হইলে তিনি ধনবিভাগে প্রভু নহেন, অর্থাৎ তৎস্কৃত ধনবিভাগ অসিদ্ধ। এ স্থলেও, ব্যাধিত শব্দে পীড়িত মাত্র বুঝাইতেছে, গলংকুষ্ঠী প্রভৃতি পতিত বুঝাইতেছে না। দরিদ্রান স্তর কৌন্তেয় মা প্রযচ্ছেশরে ধনম্। ব্যাধিতস্থৌষধং পথ্যং নীরুজ্য কিমৌষধৈঃ ॥

"হে কুস্তীনন্দন। দরিদ্রের ভরণ কর, ধনবানকে ধন দিও না; ব্যাধিত ব্যক্তির ঔষধ আবশ্যক, নীরোগ ব্যক্তির ঔষধে প্রয়োজন কি।

এ স্থলেও, ব্যাধিত শব্দে পীড়িত মাত্র বুঝাইতেছে, গলৎকুষ্ঠ্যাদি পতিত বুঝাইতেছে না। এই রূপে, যে যে স্থলে, ব্যাধিত শব্দের প্রয়োগ আছে, সৰ্ব্বত্রই পীড়িত এই অর্থ খুঝাইয়া থাকে, কোনও স্থলেই গাতিত্যসূচক রোগাক্রান্ত গলৎকুষ্ঠ্যাদি বুঝায় না। আর, সাহচর্য্য পৰ্য্যালোচনা করিলেও, দরিদ্রং ব্যাধিতং মূর্খম্, এই বচনে ব্যাধিত শব্দে গলৎকুষ্ঠ্যাদিরূপ অর্থ বুঝাইতে পারে না; কারণ, দরিদ্র ও মূর্খের সঙ্গে সামান্ত রোগীর গণনা করাই সম্ভব; গলৎকুষ্ঠ্যাদি পতিতের গণনা করা কোনও ক্রমে সম্ভব হইতে পারে না। আর, অমরসিংহ- প্রণীত অভিধানে, ব্যাধিত শব্দের পর্য্যায় দৃষ্টি করিলেও, ব্যাধিত শব্দে যে সামান্য রোগী বুঝায়, পতিত বুঝায় না, তাহা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। যথা,

আময়াবী বিকৃতো ব্যাধিতোহপটুঃ।

আতুরোহভ্যমিতোংভ্যান্তঃ ।। (৯১)

আর, মনুসংহিতা দৃষ্টি করিলেও, এ স্থলে ব্যাধিত শব্দে যে গলংকুষ্ঠ্যাদি পতিত বুঝাইবেক না, সে বিষয়ে আর কোনও সংশয় থাকিতে পারে না। যথা,

অতিক্রামেৎ প্রমত্তং যা মত্তং রোগাত্তমেব বা। সা ত্রীন্ মাসান্ পরিত্যাজ্যা বিভূষণপরিচ্ছদা ॥ ৯ ॥ ৭৮ ॥ উন্মত্তং পতিতং ক্লীবমবীজং পাপরোগিণম্। ন ত্যাগোহস্তি দ্বিষত্যাশ্চ ন চ দায়াপবর্ত্তনম্ ॥ ৯ ॥ ৭৯ ॥

যে স্ত্রী প্রমত্ত, মত্ত, অথবা রোগার্ড স্বামীর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, তাহাকে, বসন ভূষণ কাড়িয়া লইয়া, তিন মাস পরিত্যাগ করিবেক। ৭৮। যদি স্ত্রী উন্মত্ত, পতিত, ক্লীব, পুত্রোৎপাদনশক্তিহীন, অথবা কুট্যাদিরোগগ্রস্ত পতির প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে; তাহা হইলে, তাহাকে ত্যাগ করিবেক না, ও তাহার ধন কাড়িয়া লইবেক না। ৭৯

এ স্থলে মনু, পূর্ব্ব বচনে রোগার্ড স্বামীর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের দণ্ড বিধান করিয়া, পর বচনে পতিত ও কুষ্ঠ্যাদিরোগগ্রস্ত স্বামীর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনে দণ্ডাভাব লিখিয়াছেন।

অতএব, ব্যাধিত শব্দে যদি গলৎকুষ্ঠ্যাদি পতিত এই অর্থ না বুঝাইল, তবে প্রতিবাদী, মহাশয়, সেই অর্থ অবলম্বন করিয়া, বিবাহবিধায়ক্ বচনের সহিত এই বচনের বিরোধ ঘটাইয়া, যে আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন, সে আপত্তি কি রূপে সঙ্গত হইতে পারে।

১৭- স্মৃতিশাস্ত্রে

অর্থব্রাদের প্রামাণ্য আছে।

কেহ মীমাংসা করিয়াছেন, বিজ্ঞাসাগর মহাশয় যে যে যুক্তি দ্বারা বিধবা স্ত্রীর পুনরায় বিবাহ হওয়া বৈধ থাকা লিখিয়াছেন, তাহা অকিঞ্চনের বিবেচনায় যে যে হেতুতে অযুক্ত তাহা অগ্রে লিখিয়া যে বচনে বিধবাবিবাহ হওয়া বৈধ থাকা তিনি কহেন, অকিঞ্চনের বিবেচনায় তাহার যাহা সদর্থ তাহা তৎপরে লেখা কর্তব্য হইল। তিনি স্বক্বত পুস্তকে।

অন্যে কৃতযুগে ধৰ্ম্মাস্ত্রেতায়াং দ্বাপরেংপুরে।

অন্যে কলিযুগে নৃণাং যুগহাসানুরূপতঃ ॥ মনুসংহিতার এই বচনটা লিখিয়া যুগ ভেদে ধৰ্ম্ম প্রভেদ থাকা বর্ণন করিয়া কোন্ যুগে কোন্ ধৰ্ম্মাবলম্বন করিয়া চলিতে হইবে, কেবল পরাশর প্রণীত ধৰ্ম্ম শাস্ত্রেই সে সমুদায়ের নিরূপণ এতৎ প্রসঙ্গে পরাশরসংহিতার প্রথমাধ্যায়ের

কৃতে তু মানবো ধৰ্ম্মন্ত্রেতায়াং গৌতমঃ স্মৃতঃ। দ্বাপরে শাষ্মলিখিতঃ কলৌ পারাশরঃ স্মৃতঃ ॥

এই শ্লোকটার উল্লেখে "ময়াদিপ্রণীত ধৰ্ম্ম কলিযুগের অননুষ্ঠেয়, কেবল পরাশর প্রণীত ধৰ্ম্মই কলিযুগের অনুষ্ঠেয়, ইহারি যে সংস্থাপন করিয়াছেন, তাহা সঙ্গত হয় না, কারণ এই যে বেদার্থমীমাংসক ভগবান্ জৈমিনি যেরূপ রীতিতে বেদার্থ করিবার উপদেশ দিয়াছেন, তদনুযায়ী বেদামু- সারী স্বত্যাদির অর্থাবধারণও করিতে হইবেক, মীমাংসা শাস্ত্রে ভগবান্ জৈমিনির এই উপদেশ। যথা

আস্নায়্য ক্রিয়ার্থহাদানর্থক্যমতদর্থানাং।

ইহার তাৎপৰ্য্যার্থ এই যে বিধি সমন্বিত বাক্যেরি অর্থাৎ যে বাক্যে কোন বিধি আছে তাহারি প্রামাণ্য হয় ইহাতে অর্থবাদের ব্যর্থতা প্রতিপন্ন হওয়ায় মন্ত্রার্থবাধে পাছে দোষারোপ হয়, তন্নিবারণার্থে ভগবান্ জৈমিনি ইহাই মীমাংসা করিয়াছেন। ইনা

স্তুত্যর্থেন বিধীনাং শ্যঃ।

ইহার তাৎপর্য্য এই যে অর্থবাদ বিধি স্তাবকত্বে অন্বিত হয়, কৃতে তু মানবো ধৰ্ম্মঃ ইত্যাদি বচনে লিঙ্ অথবা লিঙর্থক লোটাদি নাই, অর্থাৎ বিধিবোধক কোনও পদ নাই, সুতরাং তন্বচন স্তাবকত্বে অন্বিত হওয়া ব্যতীত অন্য সিদ্ধান্ত করা যাইতে পারে না।

অতএব কলি যুগের ধর্ম্মবক্তা কেবল ভগবান্ পরাশর ইহা ক্বতে তু ইত্যাদি বচনার্থে নহে, অর্থবাদের প্রামাণ্য না থাকা পূর্ব্বে লিখিয়াছি; পুনরুক্তির প্রয়োজনাভাব। (৯২)

প্রতিবাদী মহাশয়ের অভিপ্রায় এই যে, কলৌ পারাশরঃ স্বতঃ, এ স্থলে বিধিবোধক পদ নাই; অতএব এ বচন অর্থবাদ; সুতরাং, এ বচমের প্রামাণ্য নাই; যদি, কৃতে তু মানবো ধৰ্ম্মঃ, এ বচনের প্রামাণ্য না রহিল, তাহা হইলে, কলি যুগে পরাশরোক্ত ধৰ্ম্ম গ্রাহ্য, এ কথারও প্রামাণ্য রহিল না।

ভগবান্ জৈমিনি, প্রতিবাদী মহাশয়ের উদ্ধৃত পূর্ব্বোক্ত সূত্রদ্বয়ে, যে প্রণালীতে বেদার্থ মীমাংসা করিবার উপদেশ দিয়াছেন, সেই প্রণালীতেই বেদানুযায়ী স্মৃতি প্রভৃতি শাস্ত্রেরও মীমাংসা করিতে হইবেক; প্রতিবাদী মহাশয় ইহার কোনও প্রমাণ প্রদর্শন করেন নাই। কেবল তাঁহার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করিয়া, কলৌ পারাশরঃ স্বতঃ এই ঋষিবাক্যের অপ্রামাণ্য স্বীকার করিতে পারা যায় না। প্রত্যুত, ভগবান্ জৈমিনি, উক্ত দুই সূত্রে, বেদার্থ মীমাংসার যে প্রণালী অবলম্বনের উপদেশ দিয়াছেন, স্মৃতি প্রভৃতির মীমাংসাস্থলে, সে প্রণালী অবলম্বন করিয়া চলিতে হইবেক না, তাহার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। যথা,

অথোচ্যতে স্মৃতীনাং ধৰ্ম্মশাস্ত্রহাত্তাহু ধৰ্ম্মমীমাংসাশু- সর্বব্যা ত্যাংন ক্যাপ্যর্থবাদ্য বাক্যার্থে প্রামাণ্য- 'মত্যুপগম্যত ইতি তদেতদ্বচনং স্মৃতিভক্তম্ম্যশ্য মীমাং- সকম্মন্যশ্য চানর্থায়ৈবস্থ্যাৎ মূষকভয়াৎ স্বগৃহং দগ্ধমিতি স্তায়াবতারাৎ, ক্যচিদর্থবাদ্য স্বার্থে প্রামাণ্যং ভবিষ্য- তীতি ভয়েনার্থবাদৈকপ্রসিদ্ধানাং স্মর্তুণাং মম্বাদীনাং মীমাংসাসূত্রকৃজ্জৈমিনেশ্চ সম্ভাবস্তৈব পরিত্যক্তব্যত্বা- দশেষেতিহাসলোপ প্রসঙ্গাচ্চ। ভূতার্থবাদঃ। (৯৩) তন্মাৎ প্রমাণমেব

যদি বল, স্মৃতিসকল ধর্মশাস্ত্র; হুতরাং, ভগবান্ জৈমিনি ধর্মসীমাংসার যে প্রণালী নির্দেশ করিয়াছেন, তদনুসারেই স্মৃতির মীমাংশ্ম করা কর্তব্য। জমিনিপ্রোক্ত ধৰ্ম্ম মীমাংসার প্রণালীতে অর্থবাদের প্রামাণ্য নাই; অতএব, ভূতির মীমাংসাস্থলেও অর্থবাদের প্রামাণ্য নাই; এরূপ কহিলে, স্মৃতিভক্তও মীমাংসকাভিমানী, উভয়েরই বিপদ উপস্থিত হয়। মুধিকের উৎপাত ভয়ে, জাপন গৃহ দগ্ধ করিয়াছিল, সেই কথা উপস্থিত হইল। কখনও কোনও অনভিমত অর্থবাদের প্রামাণ্য উপস্থিত হইবেক, এই ভয়ে, অর্থবাদমাত্রের প্রামাণ্য অঙ্গীকার করিলে, মনু প্রভৃতি স্মৃতিকর্তা ও মীমাংসাশাস্ত্রকর্তা জৈমিনি কোনও কালে বিদ্যমান ছিলেন, এ কথাও অঙ্গীকার করিতে হয়; কারণ, তাহাদের বিদ্যমানতা বিষয়ে অর্থবাদ ব্যতীত আর কোনও প্রমাণ নাই: এবং সমুদায় ইতিহাসশাস্ত্রের প্রামাণ্য লোশ হয়। অতএব, অবস্থ্যই অর্থবাদের প্রামাণ্য স্বীকার করিতে হইবেক।

অতএব, স্মৃতিশাস্ত্রে অর্থবাদের প্রামাণ্য নাই, সুতরাং, কলৌ পারাশরঃ স্বতঃ, এই অর্থবাদবাক্য অপ্রমাণ; প্রতিবাদী মহাশয়ের এই মীমাংসা সম্যক্ বিচারসিদ্ধ হইতেছে না।

* প্রতিবাদী মহাশয়, কলৌ পারাশরঃ স্বতঃ, এ স্থলে অর্থবাদের প্রামাণ্য লোপের চেষ্টা পাইয়াছেন; কিন্তু, স্থলান্তরে, অর্থবাদের প্রামাণ্য স্বীকার পূর্ব্বক, কহিয়াছেন,

অপিচ ছান্দোগ্যে ব্রাহ্মণে মনুর্ব্বৈ যৎকিঞ্চিদব-ত্তম্ভেষজং ভেষজতায়া ইতি। এই বেদ প্রমাণ এবং বেদার্থোপনিবন্ধুত্বাৎ প্রাধান্তং হি মানোঃ স্বতম্। ময়র্থবিপরীতা বা সা স্মৃতির্ন প্রশ্যতে অন্তার্থঃ বেদার্থ উপ- নিবন্ধন হেতুক সৰ্ব্বস্বত্যপেক্ষা মনুস্থতির প্রাধান্যতা আছে মন্বর্থবিপরীতা স্মৃতি, মাস্ত হয় নী অর্থাৎ অন্য সংহিতার কোনও বচনের যথাশ্রুতার্থ যদি মনুবচনের বিপরীত হয়, তবে মনুবচনের অর্থের সহিত সমন্বয় করিয়া অন্য সংহিতার ঐ বচনের সদর্থোদ্ধার করা কর্তব্য।

এ স্থলে ব্যক্তব্য এই যে, যদি প্রতিবাদী মহাশয়ের মতে, কলৌ পারাশরঃ স্বতঃ, এই অর্থবাদের প্রামাণ্য না থাকে, তবে, প্রাধান্যং হি মনোঃ স্বতম্, এ স্থলেও অর্থবাদের প্রামাণ্য নাই। কলৌ পারাশরঃ স্বতঃ, এ স্থলে যেমন কোনও বিধিবোধক পদ নাই, প্রাধান্তং হি মনোঃ স্বতম্, এ স্থলেও, সেইরূপ কোনও বিধিবোধক পদ নাই। যদি প্রতিবাদী মহাশয়, প্রাধান্তং হি মনোঃ স্মৃতম্, এই অর্থবাদবাক্য অবলম্বন করিয়া, মনুস্থতি সকল স্মৃতি অপেক্ষা প্রধান বলিয়া ব্যাখ্যা করিতে পারেন, তাহা হইলে, কলৌ পারাশরঃ স্বতঃ, এই অর্থবাদবাক্য অনুসারে কলি যুগে পরাশরস্মৃতি অনুসারে চলিতে হইবেক, এ ব্যাখ্যা করিবার বাধা কি। এই দুই অর্থবাদবাক্যের কোনও অংশে কোনও প্রভেদ লক্ষিত হইতেছে না।

১৮-বান্দানের পর

বর অনুদ্দেশাদি হইলে কন্যার পুনর্দান নিষেধ নাই।

কেহ কেহ কহিয়াছেন, যদি বান্দানের পর বর মরিলে, কিম্বা অনুদ্দেশাদি হইলে, বাগদত্তা কল্লার আর বিবাহ হইতে না পারে, তবে বিবাহ হইয়া বিধবা হইলে, পুনর্ব্বার বিরাহ বি রূপে হইতে পারে (৯৪)।

যাহাবা এই আপত্তি উত্থাপন করিযাছেন, তাঁহারা, আমি পূর্ব্ব পুস্তকে বাহা লিখিয়াছিলাম, তাহার তাৎপৰ্য্য অনুধাবন করিয়া দেখেন নাই। কারণ, বান্দানের পর বর অনুদ্দেশাদি হইলে, কল্লার আর বিবাহ হইতে পারে না, আমার লিখনের কোনও অংশ দ্বাবা এরূপ অভিপ্রায় ব্যক্ত হয় না। আমি এই মাত্র কহিয়াছিলাম যে, পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগে, এই ব্যবহার ছিল, কোনও ব্যক্তিকে বান্দান করিয়া, "পরে, তদপেক্ষা উৎকৃষ্ট বর, পাইলে, তাহাকেই কন্যা দান করিত, বৃহন্নার- দাঁয়ের বচন দ্বারা ঐ ব্যবহারের নিদেব হইয়াছে। ইহাব তাৎপৰ্য্য এই যে, যাহাকে বাগ্ঙ্গান করিবেক, তাহাকেই কন্তা দান করিবেক, পরে পূর্ব্ব বর অপেক্ষা উৎকৃষ্ট বর পাইলে, পূর্ব বরকে না দিয়া, উৎকৃষ্ট ধরকে দেওয়া উচিত নহে; অর্থাৎ যাহার নিকট প্রতিশ্রুত হইবেক, তাহাকেই করা দান করিবেক, তাহার অপেক্ষা উৎকৃষ্ট বর পাইলাম । বলিয়া, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিবেক না। এই নিমিত্তই ভগবান, স্বায়স্তুব মহু কহিয়াছেন,

এতত্ত্ব ন পরে চক্রুর্নাপরে জাতু সাধবঃ। যদন্যস্থ্য প্রতিজ্ঞায় পুনরন্যশ্য দীয়তে ॥ ৯ || ১৯ ।

কখনও কোনও সাধু, এক জনের নিকট প্রতিশ্রুত হইয়া, পুনরায় অন্তকে দান করেন নাই।

আমার লিখন দ্বারা এই অভিপ্রায়ই স্পষ্ট প্রকাশ পাইতেছে, কষ্ট কল্পনা করিলেও, বান্দানের পর বর মরিলে, কিংবা অনুদ্দেশাদি হইলে, কন্ঠার আর বিবাহ হইতে পারে না, এরূপ অভিপ্রায় ব্যক্ত হয় না।

১১-পরাশরের

বিবাহবিধি নীচজাতি বিষয়ে নহে।

কেহ, প্রথমতঃ পুরাশরবচনকে বান্দত্তা বিষয়ে প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা পাইয়া, পরিশেষে কহিয়াছেন,

কিংবা নীচ জাতির এই প্রকার স্বামী হইলে অন্ত্য পতি করিবে ইহা পরাশয়ভাষ্যকৃৎ মাধবাচার্য্য লিখিয়াছেন (৯৫)।

এ স্থলে বক্তব্য এই যে, মাধবাচার্য্য, পরাশরভাষ্যের কোনও স্থলেই, বিবাহবিধায়ক বচন নীচজাতিবিষয়ক বলিয়া ব্যবস্থা করেন নাই। প্রতিবাদী মহাশয়, পরাশরভাষ্য না দেখিয়াই, ঐ কথা লিখিয়াছেন, তাহার কোনও সন্দেহ নাই। প্রতিবাদী মহাশয় এ দেশের এক জন বিখ্যাত নৈয়ায়িক পণ্ডিত; পরাশরভাষ্য না দেখিয়া, কেবল অনুমান বলে, অনায়াসে, পরাশরভা্যে এরূপ লেখা আছে বলা, তাঁহার মত বিখ্যাত পণ্ডিতের পক্ষে, অতি অন্যায় কৰ্ম্ম হইয়াছে। ফলতঃ, অনুমান প্রমাণ অবলম্বন করিবার পূর্ব্বে, প্রত্যক্ষ প্রমাণ অবলম্বন করা অতি আবশ্যক ছিল।

২০-পিতা

বিধবা কন্যাকে পুনরায় দান করিতে পারেন।

অনেকে এই আপত্তি করিয়াছেন, ক্যার দানাধিকারী কে হইবেক। পিতা যখন এক বার দান করিয়াছেন, তখন তাঁহার স্বত্ব ধ্বংস হইয়াছে; যদি ক্যাতে আর তাঁহার স্বত্ব না রহিল, তবে তিনি, কি প্রকারে, পুনরায় অন্য ব্যক্তিকে সেই কন্তা দান করিতে। পারেন।

ইদানীং, আমাদের দেশে, দুই প্রকার মাত্র বিবাহ সচরাচর প্রচলিত আছে, ব্রাহ্ম ও আসুর, অর্থাৎ কন্যাদান ও ক্যাবিক্রয়। এই দান ও বিক্রয় শব্দ অন্তান্য স্থলের দান ও বিক্রয় শব্দের সমানার্থক নহে। অন্ত্যান্ত দান ও বিক্রয় স্থলে দৃষ্ট হইতেছে, যে ব্যক্তির যে বস্তুতে স্বত্ব থাকে, সেই সে বস্তুর দান অথব। বিক্রয় করিতে পারে; এক বার দান অথবা বিক্রয় করিলে, সে ব্যক্তির সে বস্তুতে স্বত্ব ধ্বংস হইয়া যায়; সুতরাং, আর সে ব্যক্তির সে বস্তু দান অথবা বিক্রয় করিবার অধিকার থাকে না। ভূমি, গৃহ, উত্থান, গো, অশ্ব, মহিষ প্রভৃতির দানবিক্রয় স্থলে, এই নিয়ম পূর্ব্বাপর চলিয়া আসিতেছে। কিন্তু, এই দান ও বিক্রয়ের সহিত ক্যাসংক্রান্ত দান ও বিক্রয়ের কোনও অংশে সাম্য নাই। ভূমি, ধেনু প্রভৃতি স্থলে, যে ব্যক্তির স্বত্ব থাকে, সেই দান ও বিক্রয় করিতে পারে; যে ব্যক্তির স্বত্ব না থাকে, সে কদাচ দান ও বিক্রয় করিতে পারে না; যদি দৈবাৎ দানাদি করে, সেই দানাদি অস্বামিক্বত বলিয়া অসিদ্ধ হয়। কিন্তু, কন্তাদান স্থলে সেরূপ নিয়ম নহে। বিবাহ স্থলের দান বাচনিক দান। শাস্ত্র- কারেরা দানকে বিবাহবিশেষের অঙ্গ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন মাত্র। এই বিবাহাঙ্গ দান যে কোনও ব্যক্তি করিলেও, বিবাহ নির্ব্বাহ হইয়া থাকে। ক্যাতে যাহার স্বত্ব থাকিবার সম্ভাবনা, সে ব্যক্তি দান করিলেও যেমন বিবাহ সম্পন্ন হয়; যে ব্যক্তির ক্যাতে স্বত্ব থাকিবার কোনও কালে কোনও সম্ভাবনা নাই, সে ব্যক্তি দান করিলেও, বিবাহ সেইরূপ সম্পন্ন হইয়া থাকে। অন্যান্য বস্তুতে যাহার স্বত্ব নাই, সে 'ব্যক্তি কথনও সে বস্তুর দানাধিকারী হয় না; কিন্তু, সজাতীয় ব্যক্তি মাত্রেই বিবাহাঙ্গ ক্যাদানে অধিকারী হইয়া থাকেন। যথা,

পিতা দ্যাৎ স্বয়ং কণ্ঠাং ভ্রাতা বানুমতঃ পিতুঃ। মাতামহো মাতুলশ্চ সকুল্যো বান্ধবস্তথা। দাতা স্বভাবে সর্বেষাং প্রকৃতৌ যদি বর্ত্ততে। ত্যামপ্রকৃতিস্থায়াং কন্যাং দস্যুঃ সজাতয়ঃ । (৯৬)

পিতা স্বয়ং কঞ্চাদান করিবেন; অথবা ভ্রাতা, পিস্তার অনুমতিক্রমে, দান করিবেন এবং মাতামহ, মাতুল, জ্ঞাতি, বান্ধব, কস্তা দান করিবেন। সকলের অভাবে মাতা কন্তা দান করিবেন, যদি তিনি প্রকৃতিস্থা হন; তিনি অপ্রকৃতিস্থ। হইলে, সজাতীয়েরা কস্ত। দান করিবেন।

দেখ, শাস্ত্রকারদিগের যদি এরূপ অভিপ্রায় হইত যে, ভূমিদান, ধেনু- দান প্রভৃতির নিয়ম সকল ক্যাদান স্থলেও খাটিবেক; অর্থাৎ, যাহার স্বত্ব থাকে, সেই দান করিতে পারে; আর যাহার স্বত্ব না থাকে, সে দান করিতে পারে না; তাহা হইলে, জ্ঞাতি, বান্ধব ও সজাতীয়েরা কিরূপে দানাধিকারী হইতে পারেন। কল্লাতে পিতা মাতারই স্বত্ব থাকিবার সম্ভাবনা; মাতামহ, মাতুল, জ্ঞাতি, বন্ধু ও সজাতীয়দিগের স্বত্ব থাকিবার কোনও হতে কোনও সম্ভাবনা নাই। যদি ভূমিদান, ধেনুদান প্রভৃতির হ্যাঁয়, ক্যাদান স্থলে, যাহার স্বত্ব থাকিবেক, সেই দান করিতে পারিবেক, এরূপ নিয়ম হইত, তাহা হইলে, মাতামহাদিকে ক্যাদানে অধিকারী বুলিয়া, শাস্ত্রক্বারেরা নির্দেশ করিতেন না; এবং মাতাই বা সৰ্ব্বশেষে দানাধিকারিণী বলিয়া পরিগণিতা হইতেন কেন;

পিতার পরে, মাতা দানাধিকারিণী বলিয়া পরিগণিত হওয়া উচিত ছিল। বস্তুতঃ, ভূমি, ধেনু প্রভৃতিতে যেরূপ স্বত্ব থাকে, ক্যাতে সেরূপ স্বত্ব নাই। যদি কল্লাতেও সেইরূপ স্বত্ব থাকিত, তাহা হইলে, পিতার অসন্মতিতে অন্যকৃত কল্পাদান, অগ্নমিক্বত বলিয়া, অসিদ্ধ হইতে পারিত। কখনও কখনও এরূপ ঘাটনা থাকে যে, পিতার অজ্ঞাতসারে ও সম্পূর্ণ অসম্মতিতে, অন্ত ব্যক্তিতে কল্লার বিবাহ দেয়। কিন্তু, সে বিবাহ সিদ্ধ হয় কেন। পিতা, স্বত্বাষ্পদীভূত কন্তার অন্ত- কৃত দান অস্বামিকৃত বলিয়া, রাজদ্বারে অভিযোগ উপন্থিত করিয়া, সেই দান অসিদ্ধ করিতে না পারেন কেন। অন্তের ভূমি ও ধেরু অন্য ব্যক্তি দান করিলে, সে দান কখনও সিদ্ধ হয় না। রাজদ্বারে অভিযোগ উপস্থিত করিলেই, সেই দান অস্বামিক্বত বলিয়া অপ্রমাণ হইয়া যায়। অতএব, কন্তাদান স্থলের দান বাচনিক দান মাত্র; ভূমি, ধেনু প্রভৃতির ন্তায় স্বত্বমূলক দান নহে। যদি কক্তাদান, স্বত্বমূলক দান না হইয়া, বিবাহের অঙ্গ বাচনিক দান মাত্র হইল, তখন পিতা, এক বার এক ব্যক্তিকে দান করিয়া, সেই সম্প্রদানের মৃত্যু, অথবা অস্থ্যবিধ কোনও বৈগুণ্য ঘাটলে, সেই কল্পাকে পুনরায় অল্প পাত্রে দান করিতে না পারিবেন কেন। কন্যার প্রথম বিবাহ কালে, পিতা দ্যাৎ স্বয়ং কন্যাম্, ইত্যাদি বচনে দানের যেরূপ বিধি আছে, অন্যান্য বচনে বিবাহিতা কন্যার বিষয়বিশেষে পাত্রান্তরে দান করিবার সেইরূপ স্পষ্ট বিধি দৃষ্ট হইতেছে। যথা,

স তু যদানাজাতীয়ঃ পতিতঃ ক্লীব এব চ।

17 বিকৰ্ম্মস্থঃ সগোত্রো বা দাসো দীর্ঘাময়োহপি বা। উড়াপি দেয়া সান্যম্মৈ সহাভুরণভূষণা । (৯৭)

যাহার সহিত বিবাহ দেওয়া যায়, সে ব্যক্তি যদি অন্তজাতীয়, পতিত, ক্রীব, যথেচ্ছাচারী, সগোত্র, দাস, অথবা চিররোগী হয়; তাহা হইলে, বিবাহিতা কলাকেও, বস্ত্রালঙ্কারে ভূষিতা করিয়া, অন্ত্য পাত্রে দান করিবেক।

দেখ, এ. স্থলে বিবাহিতা কন্যাকেও যথাবিধানে পাত্রান্তরে দান করিবার স্পষ্ট বিধি আছে। যদি এক বার কন্যা দান করিলে, আর কোনও অবস্থায় সেই কন্যাকে পুনরায় পাত্রান্তরে দান করিতে পিতার অধিকার না থাকিত, তাহা হইলে, মহর্ষি কাত্যায়ন পতি, পতিত.. ক্লীব, চিররোগী প্রভৃতি হইলে, বিবাহিতা কন্যার পুনরায় অন্য পাত্রে দান করিবার এরূপ সুস্পষ্ট বিধি দিতেন না। আর, এ বিষয়ে কেবল বিধি মাত্র পাওয়া যাইতেছে, এমন নহে; পিতা বিধবা কন্যাকে পাত্রান্তরে দান করিয়াছেন, তাহারও স্পষ্ট দৃষ্টান্ত পাওয়া যাইতেছে। যুথা,

অর্জুনস্যাত্বাজঃ শ্রীমানিরারান্নাম বীর্য্যবান। সুতায়াং নাগরাজন্য জাতঃ পার্থেন ধীমতা। ঐরাবতেন সা দত্তা হানপত্য। মহাত্মনা। পত্যৌ হতে সুপর্ণেন কৃপণা দীনচেতনা ॥. (৯৮)

নাগরাজের ক্যাতে অর্জুনের ইরাবান্ নামে এক শ্রীমান, বীৰ্য্যমান পুত্র জন্মে। সুপর্ণ কর্তৃক ঐ কন্যার পতি হত হইলে, নাগরাজ মহাত্মা ঐরাবত সেই দুঃখিতা বিষণ্ণা পুত্রহীন। কক্সা অর্জুনকে দান করিলেন।

অতএর দেখ, যখন ক্যাদান, স্বত্বমূলক দান না হইয়া, বিবাহের অঙ্গ বাচনিক দান মাত্র হইতেছে; যখন শাস্ত্রে বিবাহিতা কন্তার পুনরায় যথাবিধানে পাত্রান্তরে দান করিবার স্পষ্ট বিধি দৃষ্ট হইতেছে, এবং যখন বিধবা কন্ঠা পিঞ্জ কর্তৃক পাত্রান্তরে দত্তা হইয়াছে, তাঁহার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে; তখন, কন্যা দান করিলে, পিতার স্বত্ব ধ্বংস হইয়া যায়; সুতরাং, পিতা সেই কন্যাকে পুনরার পাত্রান্তরে দান করিতে পারেন না, এ আপত্তি কোনও মতে বিচার- সিদ্ধ হইতেছে না।

২১-বিধবার বিবাহকালে

পিতৃগোত্র উল্লেখ করিয়া দান করিতে হইবেক।

এক্ষণে বিবেচনা করা আবগুক, বিধবার বিবাহ দিতে হইলে, সম্প্রদান কালে, কোন গোত্রের উল্লেখ করিতে হইবেক। এ বিষয়ের নির্ণয় করিতে হইলে, প্রথমতঃ, গোত্র শব্দের অর্থ কি, তাহারই নিরূপণ করা আবশ্যক।

গোত্র শব্দের অর্থ এই,

বিশ্বামিত্রো জমদগ্নির্ভরদ্বাজে। গোতমঃ অত্রির্বশিষ্ঠঃ কাশ্যপ ইত্যেতে সপ্তর্ষয়ঃ সপ্তর্ষীণামগস্ত্যাষ্টমানাং যদপত্যং তদেগাত্রমিত্যাচক্ষতে। (৯৯)

বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ, গোতম, অত্রি, বশিষ্ঠ, কাগুণ, অগস্ত্য, এই 'অট ঋষির যে সন্তান পরম্পরা, তাহাকে গোত্র বলে।

জমদগ্নির্ভরদ্বাজে। বিশ্বামিত্রাত্রিগোতমাঃ।

বশিষ্ঠকাশ্যপাগস্ত্যা মুনরো গোত্রকারিণঃ।

এতেষাং যাল্যপত্যানি তানি গোত্রাণি মম্বতে ।। (১০০) জমদগ্নি, ভরস্বাজ, বিশ্বামিত্র, অত্রি, গোতম, বশিষ্টঃ কান্তাপ, অগস্ত্য, এই কল্প মুনি গোত্রকারক। ইহাদের সন্তানপরস্পরাকে গোত্র বলে (১০১)। এই উভয় শাস্ত্র অনুসারে, জমদগ্নি প্রভৃতি আট মুনির সন্তানপরস্পরার

(১৯) পরাশরভাষ্যধৃত বৌধারনবচন।

(১০০) পরাশরভাষ্য ও উদ্বাহতত্ত্ব ধৃত স্মৃতি।

(১০১) এতেষাঞ্চ গোত্রাণামবাস্তরভেদাঃ সহস্রসখ্যকাঃ।

পরাশরভাষ্য। দ্বিতীয় অধ্যায়।

এই সকল গোত্রের সহস্র অবাস্তর ভেদ আছে।

নাম গোত্র; সুতরাং, গোত্র শব্দের অর্থ বংশ। অমুক অমুকগোত্র বলিলে, অমুক অমুক মুনির বংশে জন্মিয়াছে, অথবা অমুক মুনি অমুকের বংশের আদিপুরুষ, ইহাই প্রতীয়মান হয়।

এক্ষণে বিবেচনা ফরা আবশ্যক, বিবাহ কালে কিরূপে গোত্রের উল্লেখ হইয়া থাকে। ঋষ্যশৃঙ্গ কহিয়াছেন,

বরগোত্রং সমুচ্চার্য্য প্রপিতামহপূর্ব্বকম্।

নাম সঙ্কীর্ত্তয়েদ্বিদ্বান্ ক্যায়াশ্চৈবমেৰ হি॥ (১০২), বরের প্রপিতামহ পূর্বক গোত্র উচ্চারণ করিয়া, নাম উচ্চারণ করিবেক; কন্তারও এইরূপ।

অর্থাৎ, ব্লরের প্রপিতামহ, পিতামহ, ও পিতার নামোল্লেখ পূর্ব্বক, গোত্র উচ্চারণ করিয়া, তাহার নাম উল্লেখ করিবেক। বরের ভ্যায় কণ্ঠারও প্রপিতামহাদির নাম উচ্চারণ করিয়া, পরিশেষে তাহার গোত্র ও নাম উচ্চারণ করিবেক। অর্থাৎ, কস্তা কাহার প্রপৌত্রী, কাহার পৌত্রী, ও কাহার পুত্রী, এবং কল্লার গোত্র কি, এই সমস্ত কীর্ত্তন করিয়া, কল্লার নাম উচ্চারণ পূর্ব্বক, তাহাকে দান করিবেক। ইহা দ্বারা সুস্পষ্ট ব্যক্ত হইতেছে, ক্যা কাহার প্রপৌত্রী, কাহার পৌত্রী, কাহার পুত্রী, ও কোন বংশে জুন্মিয়াছে; এই সমস্ত কীৰ্ত্তন করিয়া, বিবাহ কালে পরিচয় দেওয়া যায়। সুতরাং, প্রপিতামহ, পিতামহ, পিতা, ও বংশের আদিপুরুষের পরিচয়প্রদান, বিবাহ কালে প্রপিতামহাদির নামোচ্চারণ ও গোত্রোল্লেখের উদ্দ্যে। যখন, বংশের আদিপুরুষের পরিচয় প্রদান মাত্র বিবাহকালীন গোত্রোল্লেখের উদ্দ্যে হইতেছে; তখন, দ্বিতীয় বার বিবাহ কালেও, প্রথম বিবাহের ন্যায়, পিতৃগোত্রেরই উল্লেখ করিতে হইবেক। অন্ত গোত্রে বিবাহ হইয়াছে বলিয়া, দ্বিতীয় বার বিবাহ কালে, পিতৃগোত্র উল্লেখের কোনও বাধা হইতে পারে না; কারণ, যে ব্যক্তি যে বংশে জন্মিবেক, তাহার কোনও অবস্থাতেই তাহার বংশের, বা বংশের আদিপুরুষের, পরিবর্ত হইতে পারে না। মনে কর, কাশ্যপ মুনির বংশোদ্ভবা এক ক্যার শাণ্ডিল্যবংশোদ্ভব এক পুরুষের সহিত বিবাহ হইল; এই বিবাহ দ্বারা, সেই কন্যার কান্ড্যপগোত্রোত্তবত্ব লোপ কিরূপে হইতে পারে। যেমন, বিবাহ হইলে, পিতার পরিবর্ত হয় না, পিতামহের পরিবর্ত হয় না, ও প্রপিতামহের পরিবর্ত হয় না; সেইরূপ, বংশের আদি- পুরুষেরও পরিবর্ত হইতে পারে না; যদি তাহা না হইতে পারিল, তব, বিবাহকালীন গোত্রোল্লেখ সময়ে, পিতৃগোত্রের উল্লেখ না হইবেক কেন। বস্তুতঃ, অন্যগোত্রোত্তব পুরুষের সহিত বিবাহ হইল বলিয়া, স্ত্রীর যে গোত্রের পরিবর্ত হইবেক, ইহা কোনও মতে সম্ভব হইতে পারে না।

এই মীমাংসা কেবল যুক্তিমাত্রাবলম্বিনী নহে। মহর্ষি কাত্যায়ন কহিয়াছেন,

সংস্কৃতায়ান্ত ভাৰ্য্যায়াং সপিণ্ডীকরণাস্তিকম্।

পৈতৃকং ভজতে গোত্রমূর্দ্ধন্তু পতিপৈতৃকম্ ॥ (১০৩) বিবাহসংস্কার হইলে, স্ত্রী সপিণ্ডীকরণ পর্য্যন্ত পিতৃগোত্রে থাকে, সপিত্তীকরণের পর স্বশুরগোত্রভাগিনী হয়।

দেখ, এ স্থলে স্পষ্ট নির্দেশ আাছে, স্ত্রী সপিণ্ডীকরণ পর্য্যন্ত পিতৃগোত্রে থাকে। যদি তৎকাল পর্য্যন্ত পিতৃগোত্রে রহিল, তাহা হইলে, জীবদ্দশায় পুনর্ব্বার বিবাহ কালে, পিতৃগোত্রের উল্লেখ ব্যতীত আর কি সম্ভব হইতে পারে। সপিঞ্জীকরণের পর পতিগোত্রভাগিনী হয়, ইহাও তাৎপর্য্য এই যে, সগোত্র না হইলে পিণ্ডসমন্বয় হয় না। স্ত্রী পতির সগোত্র নহে, সুতরাং পতির সহিত স্ত্রীর পিণ্ডসমন্বয় হইতে পারে না। এই নিমিত্ত, শাস্ত্রকারেরা, পিণ্ডসমন্বয় কালে, স্ত্রীর পতিসগোত্রত্ব কল্পনা করিয়াছেন মাত্র। নতুবা, সপিণ্ডীকরণ হইলেই, স্ত্রীর বংশ অথবা বংশের আদিপুরুষরূপ গোত্রের পরিবর্ত হইয়া যায়, ইহা কদাচ অভিপ্রেত নহে; কাঁরণ, বিবাহের পূর্ব্বে, কিংবা বিবাহের পর, স্ত্রীর যে বংশ ছিল, অথবা যিনি বংশের আদিপুরুষ ছিলেন, সপিণ্ডীকরণ দ্বারা তাহার পরিবর্ত কিরূপে সম্ভব হইতে পারে। যদি বল,

স্বগোত্রাভ্রশ্যতে 'নারী বিবাহাৎ সপ্তমে পদে।

পতিগোত্রেণ কর্তব্যা তস্যাঃ পিণ্ডোদকক্রিয়া ॥ (১০৪) বিবাহাঙ্গ সপ্তপদীপ্তমন হইলে, স্ত্রী পিতৃগোত্র হইতে ভ্রষ্ট হয়। তাহার শ্রাদ্ধ ও তর্পণ পতিগোত্রের উল্লেখ করিয়া করিবেক।

এবং.

পাণিগ্রহণিকা মন্ত্রাঃ পিতৃগোত্রাপহারকাঃ।

ভর্তুর্গোত্রেণ নারীণাং দেয়ং পিণ্ডোদকং ততঃ । (১০৫) *পাণিগ্রহণসম্পাদক মন্ত্র দ্বারা স্ত্রী পিতৃগোত্র হইতে অপহৃত হয়; তাহার শ্রাদ্ধ ও তর্পণ পতিগোত্রের উল্লেখ করিয়া করিবেক।

এই দুই বচনে, যখন সপ্তপদীগমন অথবা পাণিগ্রহণ হইলে, স্ত্রীর পিতৃগোত্রভ্রংশ নির্দেশ আছে; তখন, দ্বিতীয় বার বিবাহ ক্লালে, পিতৃগোত্র উল্লেখ কি প্রকারে হইতে পারে। এ আপত্তিও বিচারসিদ্ধ হইতেছে না। কাত্যায়নবচনে, যখন স্পষ্টাক্ষরে লিখিত আছে, স্ত্রী সপিণ্ডীকরণের পূর্ব্ব পর্য্যন্ত পিতৃগোঁজে থাকে, তখন সপ্তপদীগমন অথবা পাণিগ্রহণ হইলে, স্ত্রীর পিতৃগোত্র যায়; এ কথা কদাচ সঙ্গত হইতে পারে না। তবে, হারীত ও বৃহস্পতি বচনের তাৎপর্য্য এই যে, সপ্তপদীগমন ও পার্ণিগ্রহণ হইলে, স্ত্রী পিতৃগোত্র হইতে ভ্রষ্ট হয়; অর্থাৎ পিতৃকুলের সহিত সম্বন্ধশূন্য হইয়া পতিকুলে আইসে। বিবাহের পূর্ব্বে, পিতৃকুলের সহিত অশৌচগ্রহণাদিরূপ যে সম্বন্ধ থাকে, বিবাহের পর, পিতৃকুলের সহিত সে সম্বন্ধ রহিত হইয়া যায়। ইহাই বিবাহানস্তর পিতৃগোত্র হইতে ভ্রষ্ট হইবার তাৎপর্য্য। নতুবা, বিবাহ দ্বারা স্ত্রীর বংশের অথবা বংশের আদিপুরুষের পরিবর্ত হইয়া যায়, এরূপ তাৎপর্য্য কদাচ হইতে পারে না; কারণ, পূর্ব্বে যেরূপ দর্শিত হইয়াছে, তদমু- সারে, বংশের অথবা বংশের আদিপুরুষের পরিবর্ত কোনও ক্রমে সম্ভবিতে পারে না।

হারীত ও বৃহস্পতিবচনের উত্তরার্দ্ধে, পিণ্ডোদকদান কালে গতি- গোত্রোল্লেখের যে বিধি আছে, তন্দ্বারাও এই তাৎপর্য্যব্যাখ্যার বিলক্ষণ পোষকতা হইতেছে; কারণ, যদি তাঁহাদের বচনের পূর্ব্বাদ্ধের এরূপ তাৎপর্য্য হইত যে, স্ত্রী বিবাহের পরেই পতিগোত্রভাগিনী হয়, তাহা হইলে, উত্তরার্দ্ধে, পিণ্ডোদকদান কালে, পতিগোত্রোল্লেখের স্বতন্ত্র বিধি দিবার কি আবশ্বকতা ছিল; কারণ, তদ্ব্যতিরেকেও, পিণ্ডোদকদান কালে, পতিগোত্রোল্লেখ, বিবাহের পর স্ত্রীর পতিগোত্রভাগিত্ব বিধান দ্বারাই, সিদ্ধ হইয়াছিল। অতএব, যখন উভয়েই, স্ব স্ব বচনের উত্তরার্দ্ধে, পিণ্ডোদকদান কালে, পতিগোত্রোল্লেখের বিধি দিয়াছেন, এবং কাত্যায়নবচনে, যখন সপিণ্ডীকরণ পর্য্যন্ত স্ত্রী পিতৃগোত্রে থাকে বলিয়া, স্পষ্ট নির্দেশ আছে; তখন, বিবাহের, অব্যবহিত পর ক্ষণ অবধিই, স্ত্রী পতিগোত্রভাগিনী হয়, ঐ উভয় বচনের পূর্ব্বাদ্ধের এরূপ তাৎপর্য্য কদাচ হইতে পারে না। বস্তুতঃ, হারীত ও বৃহস্পতিবচনের উত্তরার্দ্ধের প্রকৃত তাৎপর্য্য এই, যে, পিণ্ডোদকদান কালেই স্ত্রী পতি- গোত্রভাগিনী হয়। আর, পূর্ব্বদর্শিত অনুসারে, যখন স্ত্রীর আদি- পুরুষরূপ গোত্রের পরিবর্ত অসম্ভব হইতেছে, এবং, যথন পিণ্ডসমন্বয়ান্স- রোধে সপিণ্ডীকরণ কালেই স্ত্রীর পতিসগোত্রত্বকুল্লনার আবশ্যকতা দৃষ্ট' হইতেছে, এবং সামান্য পিণ্ডোদকদর্শন কালে স্ত্রীর পতিগোত্রভাগিত্ব- কল্পনার সেরূপ আব্যকতা লক্ষিত হইতেছে না; তখন, হারীত ও বৃহস্পতিবচনস্থ পিণ্ডোদক শব্দ সপিণ্ডীকরণবোধক, তাহার সন্দেহ নাই। এই পিণ্ডোদক শব্দ সপিণ্ডীকরণপর বলিয়া ব্যাখ্যা করিলে, কাত্যায়নবচনের সহিত একবাক্যতা লাভ হইতেছে, এবং যুক্তির সহিতও অবিরোধ সিদ্ধ হইতেছে। আর, বিবাহযোগ্য কন্যা নির্বাচন- স্থলে, পিতৃসগোত্রা ও মাতৃসগোত্রা বর্জনের বিধি আছে। কিন্তু, বিবাহ হইলে, মাতার পতিগোত্রপ্রাপ্তি হয়; সুতরাং, পিতৃসগোত্রাবর্জন দ্বারাই মাতৃসগোত্রাবর্জন সিদ্ধ হওয়াতে, মাতৃসগোত্রার স্বতন্ত্র বর্জন নিতান্ত নিষ্প্রয়োজন হইয়া উঠে। এই আশঙ্কা করিয়া, কোনও কোনও সংগ্রহকর্তারা, মাতৃসগোত্রাবর্জনস্থলীয় মাতৃ শব্দের অর্থ মাতা- মহু, এই যে কষ্টকল্পনা করিয়া গিয়াছেন; তাহারও পরিহার হইতেছে। এক্ষণে এই আপত্তি উপস্থিত হইতে পারে, যদি স্ত্রী সপিণ্ডীকরণ পর্য্যন্ত পিতৃগোত্রে থাকে, তবে বিবাহিতা স্ত্রী জীবদ্দশায় ব্রতাদি করিলে, পতিগোত্রের উল্লেখ করা যায় কেন।

স্ত্রী ব্রতাদি কালে পতিগোত্র উল্লেখ করিয়া থাকে, যথার্থ বটে। কিন্তু, শ্রতাদিস্থলে, গোত্রোল্লেখের কোনও বিধান দেখিতে পাওয়া যায় না। শ্রাদ্ধাদিস্থলে যে গোত্রোল্লেখের বিধান আছে, তাহা দেখিয়াই, লোকে ব্রতাদিস্থলে গোত্রোল্লেখ করিতে আরম্ভ করিয়াছে (১০৬)। সুতরাং, ব্রতাদিস্থলে গোত্রোল্লেখ কেবল ব্যবহারমূলক। পূর্ব্বে দর্শিত হইয়াছে, স্ত্রী সপিণ্ডীকরণ পর্য্যন্ত পিতৃগোত্রে থাকে। অতএব, ব্রতাদি- স্থলে যদিই গোত্রের উল্লেখ করিতে হয়, পিতৃগোত্রের উল্লেখ করাই বিধেয়। কিন্তু বিবাহ দ্বারা, স্ত্রী, পিতৃগোত্র হইতে ভ্রষ্ট হইয়া, পতিগোত্র প্রাপ্ত হয়, পূর্ব্বোক্ত হারীত ও বৃহস্পতি বচনের এই অর্থ স্থির করিয়া, পতিগোত্রোল্লেখের ব্যবহার প্রচলিত হইয়াছে। যদি বল, তবে এত কাল পর্য্যন্ত স্ত্রীলোকেরা, পতিগোত্রের উল্লেখ করিয়া, যে সমস্ত প্রতাদি "করিয়াছে, তাহা কি নিষ্ফল হইবেক। বিবেচনা করিয়া দেখিলে, সে আশঙ্কা করা যাইন্ডে পারে না; কারণ, যখন শাস্ত্রে ব্রতাদিস্থলে গোত্রোল্লেখের আব্যকতা নির্দিষ্ট নাই, সুতরাং, গোত্রের উল্লেখ না করিলে, ক্ষতি হইতে পারে না; তখন পতিগোত্রের উল্লেখ করিলেও, ব্রতাদির নিষ্ফলত্ব আশঙ্কা ঘাটবেক কেন। যদি গোত্রোল্লেখ ব্রতের অঙ্গ বলিয়া শাস্ত্রে নির্দিষ্ট থাকিত, তাহা হইলেই, প্রকৃত প্রস্তাবে গোত্রো- ল্লেখ না হইলে, ব্রতের নিষ্ফলত্ব সম্ভাবনা ঘটিতে পারিত।

যাহা দর্শিত হইল, তদনুসারে ইহা বিলক্ষণ প্রতিপন্ন হইতেছে; স্ত্রী সপিণ্ডীকরণ পর্য্যন্ত পিতৃগোত্রে থাকে; সপিণ্ডীকরণ কালে, পিণ্ড- সমন্বয়ানুরোধে, স্ত্রীর পতিসগোত্রত্ব কল্পনা করিতে হয়; সুতরাং, দ্বিতীয় বার বিবাহ কালে, পিতৃগোত্রের উল্লেখ করিয়া দান করিতে হইবেক। কিন্তু, স্মার্ত ভট্টাচার্য্য রঘুনন্দন, দেশাচারানুরোধে, কাত্যায়নের সুস্পষ্ট বচনে উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়া, হারীত ও বৃহস্পতির অস্পষ্ট বচন অবলম্বন পূর্ব্বক, ব্যবস্থা করিয়াছেন যে, স্ত্রী বিবাহের অব্যবহিত পর ক্ষণ অবধিই পতিগোত্রভাগিনী হয় (১০৭)। যদি এই ব্যবস্থার উপর প্রাপ্তি অঙ্গীকার কর; তাহা হইলেও, দ্বিতীয় বার বিবাহ কালে যে পিতৃগোত্রের উল্লেখ করিয়া দান করিতে হইবেক, এ ব্যবস্থার কোনও ব্যাঘাত ঘটিতে পারে না; কারণ, পূর্ব্বে দর্শিত হইয়াছে, বিবাহ কাঁলে, গোত্রোল্লেখের' অভিপ্রায় এই যে, তদ্বারা, স্ত্রী কোন বংশে জন্মিয়াছে, তাহার পরিচয় প্রদান করা যায়। বিবাহের পর স্ত্রী পতি- গোত্রভাগিনী হয় বলিয়া, সম্প্রদান কালে পতিগোত্রের উল্লেখ করিলে, সে অভিপ্রায় সম্পন্ন হয় না; সুতরাং, পিতৃগোত্রের উল্লেখই সর্ব্বতো- ভাবে বিধেয় বোধ হইতেছে। এই মীমাংসা কেবল আমার কপোলকল্পিত • নহে; শাস্ত্রেও ইহার দুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। যথা,

অমুয্য পৌত্রীঞ্চামুয্য পুত্রীঞ্চামুয্য গোত্রজাম্। ইমাং কল্যাং বরায়াস্মৈ বয়ং তদ্বিবৃণীমহে। শৃণুধ্বমিতি বৈ ক্রয়াদসৌ কন্যাপ্রদায়কঃ ॥-(১০৮)

সমাগত সর্ব্বজন সমক্ষে, কন্সাদাত। ইহা কহিবেক যে, আপনারা শ্রবণ করুন, অবুকের পৌত্রী, অমুকের পুত্রী, অমুকের গোত্রোন্তবা এই ক্যাকে আমরা এই বরে দাম করিতেছি।

গোত্র হইতে অপহ্নতা হয়; তাহার পিণ্ডোদকদান পতিগোত্রের উল্লেখ করিয়। করিবেক। এ স্থলে বৃহস্পতি, পাণিগ্রহণ দ্বারাও গোত্রাপহার হয়, কহিতেছেন। আর কাত্যায়ন, স্ত্রীর বিবাহসংস্কার হইলে পর, সপিণ্ডীকরণ পর্য্যন্ত পিতৃগোত্রে থাকে, পরে পতিগোত্রভাগিনী হয়, ইচ্ছা ক্ষহিয়া যে সপিণ্ডীকরণের গোত্রাপ হারকারণতা কহিয়াছেন, তাহা অন্তশাথাবলম্বীদিগের পক্ষে: কারণ, সেরূপ শিষ্টাচার নাই। অতএব, গোর্ভিলপুত্রে, সপ্তপদীগমনের পর পতিপ্রণাম কালে, যে গোত্রোল্লেখের বিধান আছে, ভট্টনারায়ণ ঐ গোত্র শব্দের পতিগোত্র বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন; সুতরাং, সরলা ও ভবদেবভট্ট যে ঐ গোত্র শব্দের পিতৃ- গোত্র বলিয়া ব্যাখ্যা করেন, তাহা অগ্রাহ।

(১০৮) বৃহদ্বশিষ্ঠসংহিতা। চতুর্থ অধ্যায়।

দেখ, এ স্থলে স্পষ্ট নির্দেশ আছে, আমরা অমুকের গোত্রোত্তবা কন্যা দান করিতেছি; সুতরাং, ক্যা যে গোত্রে জন্মিয়াছে, বিবাহ কালে, সেই গোত্রের উল্লেখ করাই বিচারসিদ্ধ হইতেছে। অমুকের গোত্রো- স্তবা না থাকিয়া, যদি অমুকগোত্রা এই মাত্র অস্পষ্ট নির্দেশ থাকিত, তাহা হইলেও, স্ত্রী বিবাহের পর, পিতৃগোত্র হইতে ভ্রষ্ট হইয়া, পতিগোত্রভাগিনী হয়, সুতরাং, দ্বিতীয় বার বিবাহ কালে পতিগোত্রের উল্লেখ করিতে হইবেক, ইহা কথঞ্চিং প্রতিপন্ন হইতে পারিত। কিন্তু, যত্ন পূর্ব্বনির্দিষ্ট বশিষ্ঠ বচনে, স্পষ্টাক্ষরে নির্দেশ আছে যে, যে গোত্রে জন্মিয়াছে, সেই গোত্রের উল্লেখ করিয়া, সমাগত সর্ব্বজন সমক্ষে পরি- চয় দিয়া, কন্তা দান করিবেক; তখন, সম্প্রদান কালে, পিতৃগোত্র পরিত্যাগ করিয়া, পতিগোত্রের উল্লেখ কোনও মতেই কর্তব্য হইতে। পারে না।


'২২-প্রথম বিবাহের'

মন্ত্রই দ্বিতীয় বার বিবাহের মন্ত্র।

অনেকে এই আপত্তি করিয়াছেন, স্ত্রীর দ্বিতীয় বার বিবাহের মন্ত্র নাই। এই আপত্তি নিতান্ত অমূলক; কারণ, বিবাহসম্পাদক মন্ত্রগণের 'মধ্যে, কোনও মন্ত্রেই এরূপ কথা নাই যে, ঐ সমস্ত মন্ত্র দ্বিতীয় বার বিবাহ কালে খাটতে পারে না; সুতরাং, যে সমস্ত বৈদিক মন্ত্র দ্বারা প্রথম বিবাহ সম্পন্ন হইয়া থাকে, দ্বিতীয় বারের বিবাহও সেই সমুদয় সন্ত্র দ্বারা সম্পন্ন হইবেক।

ইহা পূর্ব্বে নির্ব্বিবাদে প্রতিপন্ন হইয়াছে যে, মহু, বিষ্ণু, যাজ্ঞবন্ধ্য, পরাশর, নারদ ও কাত্যায়ন বিষয়বিশেষে স্ত্রীদিগের পুনরায় বিবাহের অনুমতি দিয়াছেন। কিন্তু, ঐ সমস্ত ঋষি যেমন পুনরায় বিবাহের বিধি দিয়াছেন, সেইরূপ তেন্ত্র মন্ত্রের নির্দেশ করিয়া যান নাই। এক্ষণে, প্রথম বিবাহের মন্ত্র যদি এই বিবাহে না খাটে, তাহা হইলে, ঋষিদিগের তাদৃশ বিবাহের অনুমতি উন্মত্তপ্রলাপবৎ হইয়া উঠে; কারণ, স্ত্রী- পুরুষের সহযোগ, যথাবিধানে মন্ত্র প্রয়োগ পূর্ব্বক সমাহিত না হইলে, বিবাহ শব্দে তাহার উল্লেখ করা যায় না। স্ত্রীপুরুষের ষদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত অবৈধ সংসর্গকে বিবাহসংস্কার বলে না। যদি স্ত্রীদিগের পুনরায় বিবাহ সুদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত সংসর্গ মাত্র হইত, তাহা হইলে, ঋষিরা সংস্কার শব্দে উহার উল্লেখ করিতেন না। মহু কহিয়াছেন,"

যা পত্যা বা পরিত্যক্তা বিধবা বা স্বয়েচ্ছয়া। উৎপাদয়েৎ পুনর্ভূত্বা স পৌনর্ভব উচ্যতে ॥ ৯। ১৭৫# সা চেদক্ষতযোনিঃ স্যাদদ্গতপ্রত্যাগতাপি বা।

পৌনর্ভবেন ভর্তা সা পুনঃ সংস্কারমর্হতি। ৯। ১৭৬ ॥ যে নারী, পতি কর্তৃক পরিত্যক্তা, অথবা বিধবা হইয়া, স্বেচ্ছাক্রমে পুনর্ভু হয়, অর্থাৎ পুনরায় অন্য ব্যক্তিকে বিবাহ করে, তাহার গর্ভে যে পুত্র জন্মে, তাহাকে পৌনর্তব বলে। যদি সেই স্ত্রী অক্ষতযোনি অথবা গতপ্রত্যাগতা হয়, অর্থাৎ পতিকে পরিত্যাগ করিয়া অঞ্চ পুরুষকে আশ্রয় করে, পরে পুনরায় পতিগৃহে আইসে, তাহার বিবাহসংস্কার হইতে পারে। বশিষ্ঠ কহিয়াছেন,

পাণিগ্রাহে মৃতে বালা কেবলং মন্ত্রসংস্কৃতা। সা চেদক্ষতযোনিঃ স্যাৎ পুনঃ সংস্কীরমহতি । ১৭অ ॥ পতির মৃত্যু হইলে, অক্ষতযোনি স্ত্রীর পুনরায় বিবাহসংস্কার হইতে পারে। বিষ্ণু কহিয়াছেন,

অক্ষতা ভূয়ঃ সংস্কৃতা পুনর্ভুঃ। ১৫ অ। বে অক্ষতযোনি স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহসংস্কার হয়, তাহাকে পুনর্ভু বলে। • যাজ্ঞবল্ক্য কহিয়াছেন,

অক্ষতা চ ক্ষতা চৈব পুনর্ভুঃ সংস্কৃতা পুনঃ। ১। ৬৭।

কি অক্ষতযোনি, কি ক্ষতযোনি, যে স্ত্রীর পুনর্ব্বার বিবাহসংস্কার হয়, তাহাকে পুনর্ভু বলে।

অতএব, যখন মনু, বিষ্ণু, বশিষ্ঠ, যাজ্ঞবন্ধ্য প্রভৃতি ঋষিগণ বিষয়- বিশেষে স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহের অনুমতি দিয়াছেন, যখন তাঁহারা ঐ বিবাহকে, প্রথম বিবাহের ন্যায়, সংস্কার বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন, যখন মন্ত্রহীন 'অবৈধ স্ত্রীপুরুষ সংসর্গকে সংস্কার বলা যায় না, যখন ঋষিরা দ্বিতীয় বিবাহের নিমিত্ত স্বতন্ত্র মন্ত্র নির্দেশ করিয়া যান নাই, এবং যখন প্রথম বিবাহের মন্ত্রে এমন কোনও কথাই নাই যে, দ্বিতীয় বিবাহে খাটিতে পারে না; 'তখন প্রথম বিবাহের মন্ত্রই যে দ্বিতীয় বিবাহের মন্ত্র, তদ্বিষয়ে অণুমাত্র সংশয় ঘটিতে পারে না। কেহ কেহ, পাণিগ্রহণিকা মন্ত্রাঃ ক্যাম্বেব প্রতিষ্ঠিতাঃ। নাক্যাসু কচিরূণাং লুপ্তধৰ্ম্মক্রিয়া হি তাঃ ॥৮। ২৬।

বিবাহমন্ত্র কন্ঠাদিগের বিষয়েই প্রযুক্ত হইয়া থাকে, অকস্তাদিগের বিষয়ে নহে,

যেহেতু, তাহাদের ধর্মক্রিয়ায় অধিকার লোপ হইয়াছে।

- এই ঘমু বচন অবলম্বন করিয়া, কহেন, কুমারীবিবাহের মন্ত্র বিধবা- রিবাহে খাটিতে পারে না। এ স্থলে আমার বক্তব্য এই যে, মনুবচনে যে অকন্যা শব্দ আছে, তাহার অর্থ বিধবা নহে। বিবাহের পূর্ব্বে পুরুষের সহিত যাহার সংসর্গ হয়, তাহাকে অকন্যা বলে। এই অকন্ডার বিষয়ে বিবাহের মন্ত্রপ্রয়োগ করিবেক না; কারণ, অবৈধ পুরুষসংসর্গ দ্বারা তাহার ধর্ম্মক্রিয়ার অধিকার লোপ হইয়া যায়। যদি অকন্যা শব্দের অর্থ বিধবা হইত, তাহা হইলে, স্বৰ্ম্মক্রিয়ায় অধিকার লোপ হইয়া যায়, এ কথা কিরূপে সংলগ্ন হইতে পারে; কারণ, ইহা কেহই প্রতিপন্ন করিতে পারিবেন না, বিধবা হইলে, স্ত্রীলোকের ধর্ম্মক্রিয়ায় অধিকার লোপ হইয়া যায়। অতএব, যখন মহুবচনে লিখিত আছে যে, যেহেতু ধৰ্ম্ম ক্রিয়ান্স অধিকার লোপ হইয়া যায়, এজন্য, অকন্যাদের বিষয়ে বিবাহের মন্ত্র প্রযুক্ত হয় না; তখন, মন্ত্রবচনস্থ অকন্যা শব্দ বিধব্লাবাচক নহে, তদ্বিষয়ে কোনও সংশয় নাই। বিধবাদের ধর্ম্মক্রিয়ায় অধিকার লোপের কথা দূরে থাকুক, বরং যে সকল বিধবা, বিবাহ না করিয়া, ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করিবেন, তাঁহাদের পক্ষে, কেবল ধর্ম্মক্রিয়ার অনুষ্ঠান দ্বারাই জীবনজ্বাল যাপন করিবার বিধান আছে।

২৩-বিবাহিতন্ত্রীবিবাহ

বিবাহিতপুরুষবিবাহের ন্যায় অপ্রশস্ত কল্প।

এ স্থলে ইহাও বিবেচনা করা আবগুক,

অবিশ্রুতব্রহ্মচর্য্যো লক্ষণ্যাং স্ত্রিয়মুছহেৎ।

অন্যপূর্বিকাং কাস্তামসপিণ্ডাং যবীয়সীম্ ॥১।৫২॥ (১০৯)

ব্রহ্মচর্য্য পালন করিয়া, সুলক্ষণা, অবিবাহিতা, মনোহারিণী, অসপিণ্ডা, বয়ঃ- কনিষ্ঠা স্ত্রীকে বিবাহ করিবেক।

ইত্যাদি বচনে অবিবাহিতা ক্যাকে বিবাহ করিবার বিধান আছে। এই বিধান দ্বারা ইহাও সিদ্ধ হইতেছে, বিবাহিতা ক্যাকে বিবাহ করিবেক না; সুতরাং, ব্যতিরেকমুখে, বিবাহিতা স্ত্রীকে বিবাহ করা নিষিদ্ধ হইতেছে; যদি নিষিদ্ধ হইল, তবে তাহা প্রচলিত করা কি প্রকারে উচিত হইতে পারে।

এ বিষয়ের মীমাংসা করিতে হইলে, অনুধাবন করিয়া দেখা আব- শাক, বিবাহযোগ্যা কন্ডার নির্ণয় স্থলে, ক্যার অবিবাহিতা বিশেষণ আছে কেন। বিবাহিতা কন্যাকে কদাচ বিবাহ করিবেক না, ঐ বিশেষণের এরূপ তাৎপর্য্যব্যাখ্যা কোনও ক্রমে সঙ্গত হইতে পারে না; কারণ, মনু, যাজ্ঞবন্ধ্য, বিষ্ণু, বশিষ্ঠ, পরাশর প্রভৃতি সংহিতা- কর্তারা, স্ব স্ব সংহিতাতে, বিবাহিতা স্ত্রীর দ্বিতীয় বার বিবাহের অনুজ্ঞা দিয়াছেন। পূর্ব্বনির্দিষ্ট অবিবাহিতা বিশেষণের উল্লিখিত তাৎ- পৰ্য্য ব্যাখ্যাকে বলবর্তী করিয়া, বিবাহিতার বিবাহ এক বারেই নিষিদ্ধ বলিয়া ব্যবস্থা করিলে, সংহিতাকর্তাদিগের বিবাহিতাবিবাহের অনুজ্ঞা প্রদান নিতান্ত অসংলগ্ন ও প্রলাপতুল্য হইয়া উঠে। ফলতঃ, বিবাহযোগ্যা কন্যার স্বরূপনির্ণয়স্থলীয় অবিবাহিতা বিশেষণের প্রকৃত তাৎপর্য্য এই যে, অবিবাহিতা কন্যা বিবাহ করা প্রশস্ত কল্প; আর বিবাহিতা ক্যা বিবাহ করা অপ্রশস্ত কল্প; যেমন, অকৃতদার ব্যক্তিকে কন্যাদান করা প্রশস্ত কল্প; আর কৃতদার ব্যক্তিকে কন্যাদান করা অপ্রশস্ত কল্প। উপরি নির্দিষ্ট যাজ্ঞবন্ধ্যবচনে যেমন অবিবাহিতা ক্যা বিবাহ করিবার বিধি আছে, সেইরূপ,

শ্রুতশীলিনে বিজ্ঞায় ব্রহ্মচারিণেছর্থিনে দেয়া। (১১০)- অধীতবেদ, শীলসম্পন্ন, জ্ঞানবান, অকৃতদার, প্রার্থনাকারী ব্যক্তিকে কস্তা দান করিবেক।

এই বৌধায়নবচনে অকৃতদার ব্যক্তিকে কন্যাদান করিবার বিধি আছে; তদনুসারে, কৃতদার ব্যক্তিকে কন্যাদান করা এক বারে নিষিদ্ধ বিবেচনা করা যাইতে পারে না; কারণ, স্ত্রী মরিলে, অথবা বন্ধ্যাত্বাদিদোষগ্রস্ত হইলে, শাস্ত্রে পুনর্ব্বার দারপরিগ্রহের বিধি আছে। এ স্থলে যেমন, দুই বিধির অবিরোধামুরোধে, প্রশস্ত অপ্রশস্ত রুর বলিয়া মীমাংসা করিতে হইবেক; সেইরূপ, অবিবাহিতা বিবাহিতা স্ত্রী বিবাহ পক্ষেও, প্রশস্ত অপ্রশস্ত কল্প বলিয়া মীমাংসা করিতে হইবেক। বস্তুতঃ, বিবাহিত পুরুষকে বিবাহ করা যেমন অপ্রশস্ত কল্প, বিবাহিতা স্ত্রীকে বিবাহ করাও সেইরূপ অপ্রশস্ত কল্প; এই উভয় পক্ষের মধ্যে কোনও প্রভেদ নাই।

অকৃতদারকে কন্যাদান করা প্রশস্ত কল্প, আর কৃতদারকে ক্যা- দান করা অপ্রশস্ত কল্প, স্মার্ত ভট্টাচার্য্য রঘুনন্দনও এইরূপ মীমাংসা করিয়াছেন। যথা,

বৌধায়নঃ শ্রুতশীলিনে বিজ্ঞায় ব্রহ্মচারিণেছর্থিনে দেয়া। ব্রহ্মচারিণে অজাতন্ত্রীসম্পর্কায়েতি কল্পতরু- যাজ্ঞবন্ধ্যদীপকলিকে। জাতন্ত্রীসম্পর্কশ্য দ্বিতীয়- বিবাহে বিবাহাষ্টকবহির্ভাবাপত্তেস্তদুপাদানং প্রাশ- স্ত্যার্থমিতি তত্ত্বম্। (১১১)

বৌধায়ন কহিয়াছেন, অধীতবেদ, শীলসম্পন্ন, জ্ঞানবান্, অকৃতদার, প্রার্থনাকারী ব্যক্তিকে কল্পা দান করিবেক। এই বচন অনুসারে, কেবল অকৃতদার ব্যক্তিকেই কস্তাদান করিতে হয়; আর কৃতদার ব্যক্তির দ্বিতীয় বিবাহ ব্রাহ্ম প্রভৃতি অষ্টবিধ বিবাহের বহির্ভুত হইয়া পড়ে। অতএব, বৌধায়ন, অকৃতদার পিশেষণ দ্বারা, ইহাই ব্যক্ত করিয়াছেন যে, অকৃতদারকে কল্পা দান করা প্রশস্ত কর।

ফলতঃ, কিঞ্চিৎ অনুধাবন করিয়া দেখিলেই, স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, শাস্ত্র- কারেরা এ সকল বিষয়ে, স্ত্রী ও পুরুষের পক্ষে, একবিধ নিয়মই নির্দ্ধারিত করিয়াছেন। দেখ, প্রথমতঃ, বৈবাহিক সম্বন্ধের উপক্রম কালে, শাস্ত্রে কন্যার যেরূপ কুলশীলাদি পরীক্ষার আবশ্যকতা বিধান আছে, বরেরও সেইরূপ কুলশীলাদি পরীক্ষার আবশ্যকতা বিধান আছে (১১২)।

বিবাহের পর, পতিকে সন্তুষ্ট রাখা, স্ত্রীর পক্ষে, যেমন আব্যক বলিয়া নির্দেশ আছে, স্ত্রীকে সন্তুষ্ট রাখাও, পুরুষের পক্ষে, সেইরূপ আবশ্বক বলিয়া নির্দেশ আছে (১১৩)। স্ত্রী অন্ত পুরুষে উপগতা হইলে, তাহার পক্ষে যে বিষম পাতক স্মরণ আছে, পুরুষ অন্ত নারীতে উপগত হইলে, তাহার পক্ষেও সেই বিষম পীতক স্মরণ আছে (১১৪)। স্ত্রী মরিলে, অথবা বন্ধ্যা প্রভৃতি স্থির হইলে, পুরুষের পক্ষে যেমন পুনরায় বিবাহ করিবার অনুজ্ঞা আছে, পুরুষ মঙ্গিলে, অথবা ক্লীব প্রভৃতি স্থির হইলে, স্ত্রীর পক্ষেও সেইরূপ পুনরায় বিবাহ করিবার অনুজ্ঞা আছে। কৃতম্ভার ব্যক্তিকে বিবাহ করা, স্ত্রীর পক্ষে, যেমন অপ্রশস্ত কল্প হইতেছে, বিবাহিতা স্ত্রীকে বিবাহ করাও, পুরুষের পক্ষে, সেইরূপ অপ্রশস্ত কল্প হইতেছে। ফলতঃ, শাস্ত্রকারেরা, এ সকল বিষয়ে, স্ত্রী ও পুরুষের পক্ষে, সমান ব্যবস্থাই করিয়াছেন। কিন্তু, দুর্ভাগ্যক্রমে, পুরুষজাতির অনবধান দোষে, স্ত্রীজাতি নিতান্ত অপদস্থ হইয়া রহিয়াছে। ভারতবর্ষের ইদানীন্তন স্ত্রীলোকদিগের দুরবস্থা দেখিলে, হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যায়। স্ত্রীজাতিকে সমাদরে ও সুখে রাখার প্রথা প্রায় রহিত হইয়া গিয়াছে। ক্রমে ক্রমে এত দূর পর্য্যন্ত হইয়া উঠিয়াছে যে, অনেকানেক বিজ্ঞ মহাশয়েরা স্ত্রীজাতিকে সুখে ও সচ্ছন্দে রাখা মৃঢ়তার লক্ষণ বিবেচনা করেন। সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে, ইদানীং স্ত্রীজাতির অবস্থা, সামান্য দাস দাসীর অবস্থা অপেক্ষাও, হেয় হইয়া উঠিয়াছে।

মনু কহিয়াছেন,

পিতৃভিভ্রাতৃভিশ্চৈতাঃ পতিভিদেবরৈস্তথা। পূজ্যা ভূষয়িতব্যাশ্চ বহুকল্যাণমীপুভিঃ । ৩।৫৫ ॥ যত্র নার্য্যস্ত পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ। যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ ॥ ৩। ৫৬ ॥ শোচস্তি জাময়ো যত্র বিনশ্যত্যাণ্ড তৎ কুলম্। ন শোচন্তি তু যত্রৈতা বর্দ্ধতে তদ্ধি সর্ববদা ॥ ৩। ৫৭ ॥ জাময়ো যানি গেহানি শপস্ত্যপ্রতিপূজিতাঃ। তানি কৃত্যাহতানীব বিনশ্যন্তি সমস্ততঃ ॥ ৩। ৫৮ ॥

যে সকল পিতা, ভ্রাতা, পতি, দেধর প্রভৃতি মঙ্গল বাঞ্ছা করেন, তাঁহারা স্ত্রীলোকদিগকে সমাদরে রাখিবেন ও বস্ত্রালঙ্কারে ভূষিত করিবেন । ৫৫। যে পরিবারে স্ত্রীলোকদিগকে সমাদরে রাখে, দেবতারা সেই পরিবারের উপর প্রসন্ন থাকেন। আর, যে পরিবারে স্ত্রীলোকদিগের সমাদর নাই, তথায় যজ্ঞ দানাদি সকল ক্রিয়া বিফল হয়। ৫৬। যে পরিবারে স্ত্রীলোকেরা মনোদুঃখ পায়, সেই পরিবার ত্বরায় উচ্ছিন্ন হয়। আর, যে পরিবারে স্ত্রীলোকেরা মনোদুঃখ না পায়, সেই পরিবারের সতত সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি হয়। ৫৭।

স্ত্রীলোক, অনাদৃত হইচ্ছা, যে সকল পরিবারকে অভিশার্শ দেয়, সেই সকল পরিবার, অভিচারগ্রস্তের স্থায়, সর্ব্ব প্রকারে উচ্ছিন্ন হয়। ৩৮।

অনুসন্ধান করিয়া দেখিলে, এ স্থলে, স্ত্রীলোকদিগের প্রতি যেরূপ ব্যব- হার করিবার আদেশ আছে, ইদানীং পুরুষেরা প্রায় সেরূপ ব্যবহার করেন না। এবং সেরূপ ব্যাহার না করিলে, যে বিষময় ফল ভোগের নির্দেশ আছে, সেই ফলভোগ প্রায় সচরাচর প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে।

২৪-দেশাচার

শাস্ত্র অপেক্ষা প্রবল প্রমান নহে।

প্রতিবাদী মহাশয়েরা, যে সমস্ত শাস্ত্র উদ্ধৃত করিয়া, বিধবাবিবাহের শাস্ত্রীয়তাপক্ষ খণ্ডন করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন, সে সমস্ত শাস্ত্রের যথার্থ অর্থ ও প্রকৃত তাৎপর্য্য যথাশক্তি প্রদর্শিত হইল। এক্ষণে, বিধবাবিবাহ প্রচলিত করণ বিষয়ে, তাঁহাদের আর যে এক আপত্তি আছে, সেই আপত্তিরও যথাশক্তি মীমাংসার চেষ্টা করা আবশ্যক। প্রতিবাদী মহাশয়েরা কহিয়াছেন যে, বিধবাবিবাহ যদিও শাস্ত্রসম্মত হয়, তথাপি দেশাচারবিরুদ্ধ বলিয়া প্রচলিত হওয়া উচিত নহে। কলি যুগে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত স্থির হইলেও, দেশাচারবিরোধরূপ আপত্তি উত্থাপিত হইতে পারিবেক; এই আশঙ্কা করিয়া, আমি প্রথম পুস্তকে, প্রমাণ প্রদর্শন পূর্ব্বক, প্রতিপন্ন করিয়াছিলাম (১১৫) যে, শাস্ত্রের বিধি না থাকিলেই, দেশাচারকে প্রমাণ বলিয়া অবলম্বন করিতে হইবেক।

প্রথম পুস্তকে আমি, এক মাত্র বচন দেখাইয়া, দেশাচারকে শাস্ত্র অপেক্ষা দুর্ব্বল কহিয়াছিলাম; "বোধ করি, সেই নিমিত্তই, প্রতিবাদী মহাশয়েরা, সন্তুষ্ট হয়েন নাই; অতএব, তদ্বিষয়ের প্রমাণান্তর প্রদর্শিত হইতেছে। যথা,

ধৰ্ম্মং জিজ্ঞাসমানানাং-প্রমাণং পরমং শ্রুতিঃ।

দ্বিতীয়ং ধৰ্ম্মশাস্ত্রস্ত তৃতীয়ং লোকসংগ্রহঃ । (১১৬)

বাঁহারা ধর্ম জানিতে বাসনা করেন, তাঁহাদের পক্ষে, বেদ সর্ব্বপ্রধান প্রমাণ, ধৰ্ম্মশাস্ত্র দ্বিতীয় প্রমাণ, লোকাচার তৃতীয় প্রবাণ।

এ স্থলে, দেশাচার সর্বাপেক্ষা দুর্ব্বল প্রমাণ বলিয়া পরিগণিত দৃষ্ট হই- তেছে। বেদ ও স্মৃতি দেশাচার অপেক্ষা প্রবল প্রমাণ; সুতরাং, দেশাচার অবলম্বন করিয়া, তদপেক্ষা প্রবল প্রমাণ স্মৃতির ব্যবস্থায় অনাস্থা প্রদর্শন করা, বিচারসিদ্ধ হইতে পারে না।

• ন যত্র সাক্ষাদ্বিধয়ো ন নিষেধাঃ শ্রুতৌ স্মৃতৌ। দেশাচারকুলাচারৈস্তত্র ধর্ম্মো নিরূপ্যতে ॥ (১১৭)

যে স্থলে, বেদে অথবা স্মৃতিতে, স্পষ্ট বিধি অথবা স্পষ্ট নিষেধ না থাকে, সেই স্থলে, দেশাচার ও কুলাচার অনুসারে, ধর্ম্ম নিরূপণ করিতে হয়।

দেখ, এ স্থলে, স্পষ্টাক্ষরে নির্দেশ আছে, যে বিষয়ে শাস্ত্রে বিধি অথবা নিষেধ নাই, সেই বিষয়েই দেশাচার প্রমাণ। সুতরাং দেশাচার দেখিয়া শাস্ত্রের বিধিতে অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা নিতান্ত স্তায়বিরুদ্ধ হইতেছে।

স্মৃতেবেদবিরোধে তু পরিত্যাগো যথা ভবেৎ।

তথৈব লৌকিকং বাক্যং স্মৃতিবাধে পরিত্যজেৎ ।। (১১৮) বেদের সহিত বিরোধ ঘটিলে, যেমন স্মৃতি অগ্রাহ্য হয়; সেইরূপ, স্মৃতির বিপরীত হইলে, দেশাচারকে অগ্রাহ্ন করিতে হইবেক।

এ স্থলে, স্পন্তই বিধি অমছে, স্মৃতির ও দেশাচারের পরস্পর বিরোধ উপস্থিত হইলে, দেশাচার অগ্রাহ্য হইবেক।

অতএব, যখন স্মৃতি শাস্ত্রে কলি যুগে বিধবাবিবাহের স্পষ্ট বিধি আছে, তখন, দেশাচার বিরুদ্ধ বলিয়া, তাহার অকর্তব্যত্ব ব্যবস্থাপন করিতে ঐঞ্চত হওয়া, শাস্ত্রকর্তাদিগের মতের নিতান্ত বিপরীত হইতেছে। (১১৯)

তাহার অতিরিক্ত কথ। নাই; সুতরাং, তাঁহার নিমিত্ত আমাকে আর অতিরিক্ত প্রয়াস পাইতে হয় নাই। ক্যায়রত্ন মহাশয়ের প্রধান আপত্তি দুই, প্রথম পরাশরসংহিতা কলি যুগের শাস্ত্র নহে; দ্বিতীয়,

নোম্বাহিকেবু, মন্ত্রেবু নিয়োগ: কীর্ত্যতে কচিৎ। ন বিবাহবিধাবুক্তং বিধবাবেদনই পুনঃ।

এই মনুবচন অনুসারে, বিধবাবিবাহ বেদবিরুদ্ধ। আমার বোধ হয়, এই দুই

কথারই যথাশক্তি প্রত্যুত্তর প্রদান করিয়াছি।

স্তায়রত্ন মহাশরের পুস্তকে প্রচারিত অন্যান্য উত্তরপুস্তকের অতিরিক্ত কথা নাই, যথার্থ বটে; কিন্তু তিনি, আপন পুস্তকে, এরূপ অসাধারণ কৌশল প্রদর্শন করিয়াছেন যে, তদর্শনে তাঁহার বুদ্ধিমত্তার বিস্তর প্রশংসা করিতে হয়। বোধ হয়, বিধবাবিবাহের বিপক্ষ মহাশয়েরা, তাঁহার পুস্তক পাঠ করিয়া, পরম পুলকিত হইয়াছেন। যাহা হউক, উল্লিখিত মনুবচনানুসারে, বিধবা বিবাহ বেদবিরুদ্ধ, এই কথাই তাঁহার সকল কৌশলের অবলম্বন স্বরূণ। কিন্তু, ঐ মন্তবচন দ্বারা, বিধবাবিবাহ বেদবিরুদ্ধ বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়া উঠে না। সুতরাং, তাঁহার সমস্ত কৌশল নিতান্ত নিরবলম্বন হইয়া পড়িতেছে। সন্ধি ন্যায়রত্ব মহাশয়, যথার্থ পক্ষ অবলম্বন করিয়া, বুদ্ধিকৌশল প্রদর্শনে -দ্যত হইতেন, তাহা হইলে, তাঁহার প্রশংসনীয় বুদ্ধিশক্তির কত প্রভা প্রকাশ পাইত, বলিতে পারা যায় না।

২৫-উপসংহার

দুর্ভাগ্যক্রমে, যাহারা অল্প বয়সে বিধবা হয়, তাহারা যাবজ্জীবন যে অম্লহ যন্ত্রণা ভোগ করে, এবং বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত না থাকাতে, ব্যভিচার দোষের ও ভ্রূণহত্যা পাপের স্রোত যে উত্তরোত্তর প্রবল হইয়া উঠিতেছে, ইহা, বোধ করি, চক্ষু কর্ণ বিশিষ্ট ব্যক্তি মাত্রেই স্বীকার করিবেন। অতএব, হে পাঠক মহাশয়বর্গ! আপনারা, অন্ততঃ কিয়ৎ ক্ষণের নিমিত্ত, স্থির চিত্তে বিবেচনা করিয়া বলুন, এমন স্থলে, দেশাচারের দাস হইয়া, শাস্ত্রের বিধিতে উপেক্ষা প্রদর্শন পূর্ব্বক, বিধবা- বিবাহের প্রথা প্রচলিত না করিয়া, হতভাগা বিধবাদিগকে যাবজ্জীন অসঙ্গ বৈধব্য যন্ত্রণানলে দগ্ধ করা, এবং ব্যভিচার দোষের ও ভ্রূণহত্যা পাপের স্রোত উত্তরোত্তর প্রবল হইতে দেওয়া, উচিত; অথবা, দেশা- চারের অনুগত না হইল, শাস্ত্রের বিধি অবলম্বন পূর্ব্বক, বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত করিয়া, হতভাগা বিধবাদিগের অসঙ্গ বৈধব্যযন্ত্রণা নিরকেরণ, এবং ব্যভিচার দোষের ও ভ্রূণহত্যা পাপের স্রোত নিবারণ করা উচিত। এ উভয় পক্ষের মধ্যে, রুকান পক্ষ অবলম্বন করা শ্রেয়ঃ- কল্প, স্থির চিত্তে বিবেচনা করিয়া আপনারাই তাহার মীমাংসা করুন। আর, আপনারা ইহাও বিবেচনা করিয়া দেখুন, আমাদের দেশের আচার এক বারেই অপরিবর্তনীয় নহে। ইহা কেহই প্রতিপন্ন করিতে পারিবেন না, সৃষ্টিকাল অবধি, আমাদের দেশে আচার পরিবর্ত হয়। নাই, এক আচারই পূর্ব্বাপর চলিয়া আসিতেছে। অনুসন্ধান করিয়া দেখিলে, আমাদের দেশের আচার পদে পদে পরিবর্তিত হইয়া আসিয়াছে। পূর্ব্ব কালে এ দেশে, চারি বর্ণের যেরূপ আচার ছিল, এক্ষণকার আচারের সঙ্গে তুলনা করিয়া দেখিলে, ভারতবর্ষের ইদানী- স্তন লোকদিগকে এক বিভিন্নজাতি বলিয়া প্রতীতি জন্মে। বস্তুতঃ, ক্রমে ক্রমে, আর্চারের এত পরিবর্ত হইয়াছে যে, ভারতবর্ষের, ইদানী- স্তন লোক, পূর্ব্বতন লোকদিগের সস্তানপরম্পরা, এরূপ প্রতীতি হওয়া অসম্ভব। অধিক বলিবার প্রয়োজন নাই, এক উদাহরণ প্রদর্শিত হইলেই, আপনারা বুঝিতে পারিবেন, আমাদের দেশের আচারের কত পরিবর্ত হইয়া উঠিয়াছে। পূর্ব্ব কার্টুল, শূদ্রজাতি ব্রাহ্মণের, সর্হিত একাসনে উপবেশন করিলে শূদ্রের অপরাধের সীমা থাকিত না; এক্ষণে, সেই শূদ্র উচ্চ আসনে উপবেশন করিয়া থাকেন; ব্রাহ্মণেরা, সেবাপরায়ণ ভৃত্যের ন্যায়, সেই শূদ্রাধিষ্ঠিত উচ্চ' আসনের নিম্ন দেশে উপবেশন করেন (১২০)। আর, ইহাও দৃষ্ট হইতেছে, অতি অল্প কালের মধ্যেও, দেশাচারের অনেক পরিবর্ত হইয়াছে। দেখুন, রাজা রাজবল্লভের সময় অবধি, ব্যৈজাতি যজ্ঞোপবীত ধারণ ও পঞ্চদশ দিবস অশৌচ গ্রহণ করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। তাঁহার পূর্ব্বে, বৈদ্যজাতি এক মাস অশৌচ গ্রহণ করিতেন, ও যজ্ঞোপবীত ধারণ করিতেন না; এবং, অ্যাপি অনেক ব্যৈ পূর্ব্ব আচার অবলম্বন করিয়া চলিয়া থাকেন। যাঁহারা নূতন আচার অবলম্বন করিয়া চলিতেছেন, তাঁহা- দিগকে আপনারা দেশাচারপরিত্যাগী সদাচারপরিভ্রষ্ট বলিয়া গণ্য করেন না। দত্তকচন্দ্রিকা গ্রন্থ (১২১) প্রচারিত হইবার পর অবণি, ব্রাহ্মণাদি তিন বর্ণের উপনয়নযোগ্য কাল মধ্যে, আর শূদ্রের বিবাহযোগ্য কাল মধ্যে, গ্রহণ করিলেই, দত্তক পুত্র সিদ্ধ হইতেছে; কিন্তু, তাহার পূর্ব্বে, সকল বর্ণেরই, পাঁচ বৎসরের মধ্যে গ্রহণ করিয়া, চূড়াকরণ সংস্কার না করিলে, দত্তক পুত্র সিদ্ধ হইত না। ঐ সমস্ত দেশাচার, শাস্ত্রমূলক বলিয়া, পূর্ব্বাপর চলিয়া আসিতেছিল; পরে, অন্ত্য শাস্ত্র, অথবা শাস্ত্রের অন্ত ব্যাখ্যা, উদ্ভাবিত হওয়াতে, তাহাদের পরিবর্তে নূতন আচার প্রচলিত হইতে আরম্ভ হইয়াছে। এই সকল স্থলে, নূতন শাস্ত্র অথবা

গ্রন্থ কুবেরনামক প্রাচীন গ্রন্থ কর্তার রচিত বলিয়া প্রচলিত স্মৃতিচন্দ্রিকা নামে যে এক প্রসিদ্ধ প্রাচীন সংগ্রহ গ্রন্থ আছে, তাহা এই কুবেরের সঙ্কলিত। দত্তকচন্দ্রিকা বাস্তবিক কুবেরের রচিত হইলে, অতি প্রাচীন গ্রন্থ বলিয়া অঙ্গীকার করিতে হয়। কিন্তু, ফলতঃ তাহা নহে। দত্তকচন্দ্রিকার বয়ঃক্রম অদ্যাপি একশত বৎসর হয় নাই। প্রসিদ্ধ পণ্ডিত রঘুমণি বিদ্যাভূষণ ভট্টাচার্য্য, এই গ্রন্থ রচনা করিয়া, কুবেরের নাম দিয়া, প্রচারিত করিয়া গিয়াছেন। স্বনামে প্রচারিত না করিয়া, কুবেররচিত বলিয়া পরিচয় দিবার তাৎপর্য্য এই বোধ হয় যে, স্বনামে প্রচার করিলে, দত্তকচন্দ্রিকা, ইদানীন্তন গ্রন্থ বলিয়া, সর্বত্র আদরণীয় হইত না; সুতরাং, কয়েকটি নুতন ব্যবস্থা সঙ্কলন করিবার, নিমিত্ত, যে প্রয়াস পাইয়াছিলেন, তাহাও সফল হইত না। দত্তকচল্লিকার প্রারম্ভে লির্বিত আছে,

মম্বা দিবাক্যবিবুতেষু বিবাদমার্গে বষ্টাদশস্বপি ময়া স্মৃতিচল্লিকায়াম্। কল্যুক্তদত্তকবিধিন বিবেচিতো যঃ সর্ব্বঃ স চাঁত্র বিততো বিবৃতো বিশেষাৎ। আমি, মহু প্রভৃতির বচন প্রমাণে, স্মৃতিচন্দ্রিকাতে অষ্টাদশ বিয়াদ পদেরই নিরূপণ করিয়াছি; কিন্তু কলিযুগোক্ত দত্তকবিধি বিবেচিত হয় নাই; এই গ্রন্থে সে সমুদয় সবিশেষ নিরূপিত হইল। এবং সর্ব্বশেষে নির্দেশ আছে,

ইতি শ্রীকুবেরকৃতা দত্তকচন্দ্রিকা সমাপ্তা। কুবেররচিত দত্তকচন্দ্রিকা সমাপ্ত হইল।

এই রূপে, গ্রন্থের আদি ও অন্ত দেখিলে, দত্তকচন্দ্রিকা কুবেররচিত বলিয়া, শাস্ত্রের নূতন ব্যাখ্যা অনুসারে, পূর্ব্বপ্রচলিত আচারের পরিবর্তে, যে নূতন নূতন আচার প্রচলিত হইয়াছে, যখন আপনারা তাহাতে সম্মতি প্রদান করিয়াছেন; তথন, হতভাগা বিধবাদিগের দুর্ভাগ্যক্রমে, প্রস্তাবিত বিষয়ে সম্মতি প্রদানে এত কাতরতা ও এত কৃপণতা প্রদর্শন করিতেছেন কেন। বিবেচনা করিয়া দেখিলে, প্রস্তাবিত বিষয়, পূর্ব্বোক্ত কয়েক বিষয় অপেক্ষা, সহস্র অংশে গুরুতর। দেখুন, যদি ব্যৈজাতি যজ্ঞোপবীত ধারণ ও পঞ্চদশ দিবস অশৌচ গ্রহণ না করিতেন; এবং পাঁচ বৎসরের অধিকবয়স্ক বালক গৃহীত হইলে, দত্তক পুত্র সিদ্ধ না হইত; তাহা হইলে, লোকসমাজের, কোনও কালে, কোনও অনিষ্ট ঘাটবার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু, প্রস্তাবিত বিষয় প্রচলিত না থাকাতে যে শত শত ঘোরতর অনিষ্ট ঘটিতেছে, তাহা আপনারা অহরহঃ প্রত্যক্ষ করিতেছেন। আপনারা, ইতঃপূর্ব্বে, কেবল শাস্ত্র দেখিয়াই, পূর্ব্বপ্রচলিত আচারের পরিবর্তে, অবলম্বিত নূতন আচারে সম্মতি প্রদান করিয়াছেন; এক্ষণে, যখন শাস্ত্র পাইতেছেন, এবং সেই শাস্ত্র অনুসারে চলিলে, বিধবাদিগের পরিত্রাণ ও শত শত ঘোরতর অনিষ্ট নিবারণের পথ হয়, স্পষ্ট বুঝিতেছেন; তখন আর প্রস্তাবিত বিষয়ে অসম্মতি প্রদর্শন করা আপনাদের কোনও মতেই উচিত নহে। যত ত্বরার সম্মতি প্রদান করেন, ততই মঙ্গল। বস্তুতঃ, দেশাচারের দোহাই দিয়া, আর আপনাদের এ বিষয়ে অসম্মত থাকা অনুচিত। কিন্তু, এখনও আমার আশঙ্কা হইতেছে, আপনাদের মধ্যে অনেকে, দেশাচার শব্দ কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইলে, প্রস্তাবিত বিষয় প্রচলিত হওয়া উচিত কি না, এই বিষয়ের তত্ত্বানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হওয়াও পাতিত্যজনক জ্ঞান করিবেন; এবং অনেকে, মনে মনে সম্মত হইয়াও, কেবল দেশাচারবিরুদ্ধ বলিয়া, প্রস্তাবিত বিষয় প্রচলিত হওয়া উচিত, এ কথা সাহস করিয়া মুখেও বলিতে পারিবেন না। হায়, কি আক্ষেপের বিষয়! দেশাচারই এ দেশের" অদ্বিতীয় শাসনকর্তা, দেশাচারই এ দেশের পরম গুরু; দেশাচারের শাসনই প্রধান শাসন, দেশাচারের উপদেশই প্রধান উপদেশ।

ধন্য রে দেশাচার! তোর কি অনির্বচনীয়র মহিমা! তুই তোর অনুগত ভক্তদিগকে, দুর্ভেষ্ম দাসত্বশৃঙ্খলে বন্ধ রাখিয়া, কি একাধিপত্য করিতেছিস। তুই, ক্রমে ক্রমে আপন আধিপত্য বিস্তার করিয়া, শাস্ত্রের মস্তকে পদার্পণ করিয়াছিস, ধর্ম্মের মর্ম্মভেদ করিয়াছিস, হিতা- হিতবোধের গতিরোধ করিয়াছিস, হ্যায় অন্ত্যায় বিচারের পথ রুদ্ধ করিয়াছিস। তোর প্রভাবে, শাস্ত্রও অশাস্ত্র বলিয়া গণ্য হইতেছে, অশাস্ত্রও শাস্ত্র বলিয়া মা্য হইতেছে; ধৰ্ম্মও অধর্ম্ম বলিয়া গণ্য হইতেছে, অধৰ্ম্মও ধর্ম বলিয়া মান্য হইতেছে। সর্ব্বধর্ম্মবহিষ্কৃত, যথেচ্ছ- চারী দুরাচারেরাও, তোর অনুগত থাকিয়া, কেবল লৌকিকরক্ষাগুণে, 'সর্ব্বত্র সাধু বলিয়া গণনীয় ও আদরণীয় হইতেছে; আর, দোষস্পর্শ- শূন্য প্রকৃত সাধু পুরুষেরাও, তোর অনুগত না হইয়া, কেবল লৌকিকরক্ষায় অযত্নপ্রকাশ ও অনাদর প্রদর্শন, করিলেই, সর্ব্বত্র নাস্তিকের শেষ, অধার্ম্মিকের শেষ, সর্ব্বদোষে দোষীর শেষ বলিয়া গণনীয় ও নিন্দনীয় হইতেছেন। তোর অধিকারে, যাহারা, জাতিভ্রংশকর, ধৰ্ম্ম- লোপকর কর্ম্মের অনুষ্ঠানে সতত রত হইয়া, কালাতিপাত করে, কিন্তু লৌকিক রক্ষায় যত্নশীল হয়, তাহাদের সহিত আহার ব্যবহার ও আদান প্রদানাদি করিলে ধৰ্ম্মলোপ হয় না; কিন্তু যদি কেহ, সতত সৎকর্ম্মের অনুষ্ঠানে রত হইয়াও, কেবল লৌকিক রক্ষায় তাদৃশ যত্নবান না হয়, তাহার সহিত আহার ব্যবহার ও আদান প্রদানাদি "দূরে থাকুক, সম্ভাষণ মাত্র করিলেও, এক কালে সকল ধর্ম্মের লোপ হইয়া যায়।

. হা ধৰ্ম্ম! তোমার মর্ম্ম বুঝা ভার! কিসে তোমার রক্ষা হয়, আর কিসে তোমার লোপ হয়, তা তুমিই জান!

হা শাস্ত্র! তোমার কি দুরবস্থা ঘটিয়াছে! তুমি যে সকল কর্ম্মকে ধৰ্ম্মলোপকর, জাতিভ্রংশকর বলিয়া, ভুয়োডুয়ঃ নির্দেশ করিতেছ, যাহারা, সেই সকল কর্ম্মের অনুষ্ঠানে রত হইয়া, কালাতিপাত করি- তেছে, তাহারাও সর্ব্বত্র সাধু ও ধৰ্ম্মপরায়ণ বলিয়া আদরণীয় হইতেছে; আর, তুমি যে কর্ম্মকে বিহিত ধৰ্ম্ম বলিয়া উপদেশ দিতেছ, অনুষ্ঠান দূরে থাকুক, তাহার কথা উত্থাপন করিলেই, এক কালে নাস্তিকের শেষ, অধার্মিকের শেষ, অর্ব্বাচীনের শেষ, হইতে হইতেছে। এই পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ যে বহুবিধ দুর্নিবার পাপপ্রবাহে উচ্ছলিত হইতেছে, তাহার মূল অন্বেষণে প্রবৃত্ত হইলে, তোমার প্রতি অনাদর, ও লৌকিক রক্ষায় একান্ত যত্ন, ব্যতীত আর কিছুই প্রতীত হয় না।

হা ভারতবর্ষ! তুমি কি হতভাগ্য! তুমি, তোমার পূর্ব্বতন সন্তানগণের আচারগুণে, পুণ্যভূমি বলিয়া সর্ব্বত্র পরিচিত হইয়াছিলে; কিন্তু, তোমার ইদানীন্তন সন্তানেরা, স্বেচ্ছানুরূপ আচার অবলম্বন করিয়া, তোমাকে যেরূপ পুণ্যভূমি করিয়া তুলিয়াছেন, তাহা ভাবিয়া দেখিলে, সর্ব্ব শরীরের শোণিত শুষ্ক হইয়া যায়। কত কালে তোমার দুরবস্থাবিমোচন হইবেক, তোমার বর্তমান অবস্থা দেখিয়া, ভাবিয়া স্থির করা যায় না।

হা ভারতবর্ষীয় মানবগণ! আর কত কাল তোমরা, মোহুনিদ্রায় অভিভূত' হইয়া, প্রমাদশয্যায় শয়ন করিয়া থাকিবে! এক বার জ্ঞান- চক্ষু উন্মীলন করিয়া দেখ, তোমাদের পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ ব্যভিচার দোষের ও ভ্রূণহত্যা পাপের স্রোতে উচ্ছলিত হইয়া যাইতেছে। আর কেন; যথেষ্ট হইয়াছে। অতঃপর, নিবিষ্ট চিত্তে, শাস্ত্রের যথার্থ তাৎপর্য্য ও যথার্থ মৰ্ম্ম অনুধাবনে মনোনিবেশ কর, এবং তদনুযায়ী অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হও; তাহা হইলেই, স্বদেশের কলঙ্ক বিমোচন করিতে পারিবে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যক্রমে, তোমরা চিরসঞ্চিত কুসংস্কারের যেরূপ বশীভূত হইয়া আছ, দেশাচারের যেরূপ দাস হইয়া আছ; দৃঢ় সঙ্কল্প করিয়া, লৌকিক রক্ষা ব্রতে 'যেরূপ দীক্ষিত হইয়া আছ; তাহাতে এরূপ প্রত্যাশা করিতে পারা যায় না, তোমরা হঠাৎ কুসংস্কার বিসর্জন, দেশাচারের আনুগত্যপরিত্যাগ, ও সঙ্কল্পিত লৌকিকরক্ষাব্রতের উত্থাপন করিয়া, যুথার্থ সৎপথের পথিক হইতে পারিবে। অভ্যাসদোষে, তোমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও ধৰ্ম্মপ্রবৃত্তি সকল এরূপ কলুষিত হইয়া গিয়াছে, ও অভি- ভূত হইয়া রহিয়াছে যে, হতভাগা বিধবাদিগের দুরবস্থা দর্শনে, তোমাদের চিরগুষ্ক নীরস হৃদয়ে কারুণ্য রসের সঞ্চার হওয়া কঠিন, এবং ব্যভিচার দোষের ও ভ্রূণহত্যা পাপের প্রবল স্রোতে দেশ উচ্ছলিত হইতে দেখিয়াও, মনে ঘৃণার উদয় হওয়া অসম্ভাবিত। তোমরা প্রাণতুল্য কন্যা প্রভৃতিকে অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণানলে দগ্ধ করিতে সম্মত আছ; তাহারা, দুর্নিবাররিপুবশীভূত হইয়া, ব্যভিচার দোষে দূষিত হইলে, তাহার পোষকতা করিতে সম্মত আছ; ধৰ্ম্মলোপভয়ে জলাঞ্জলি দিয়া, কেবল লোকলজ্জাভরে, তাহাদের রূণহত্যার সহায়তা করিয়া, স্বয়ং সপরিবারে পাপপক্ষে কলঙ্কিত হইতে সম্মত আছ; কিন্তু, কি আশ্চর্য্য! শাস্ত্রের বিধি অবলম্বন পূর্ব্বক, পুনরায় বিবাহ দিয়া, তাহাদিগকে দুঃসহ বৈধব্য যন্ত্রণা হইতে পরিত্রাণ করিতে, এবং আপনাদিগকেও সকল বিপদ হইতে মুক্ত করিতে, সম্মত নহ। তোমরা মনে কর, পতিবিয়োগ হইলেই, স্ত্রীজাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায়; দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয় না; যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা বলিয়া বোধ হয় না; দুর্জয় রিপুবর্গ এক কালে নির্মূল হইয়া যায়। কিন্তু, তোমাদের এই সিদ্ধান্ত যে নিতান্ত ভ্রান্তিমূলক, পদে পদে তাহার উদাহরণ প্রাপ্ত হইতেছ। ভাবিয়া দেখ, এই অনবধানদোষে, সংসারতরুর কি বিষময় ফল ভোগ করিতেছ। হায় কি পরিতাপের বিষয়। যে দেশের পুরুষজাতির দৃশ নাই, ধৰ্ম্ম নাই, ন্যায় অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদ- সদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিকরক্ষাই প্রধান কৰ্ম্ম ও পরম ধৰ্ম্ম; আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলাজাতি জন্ম গ্রহণ না করে। হা অবলাগণ! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্ম গ্রহণ

কর, বলিতে পারি না!

শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্মা।

কলিকাতা। সংস্কৃত বিস্তালয়। ৪ঠা কার্ত্তিক। সংবং ১৯১২।



4
Articles
বিদ্যাসাগরের গ্রন্থাবলী ( দ্বিতীয় খণ্ড )
0.0
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) এমন একটি বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব, যা আজকের দিনে প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। ওনার লেখা একাধিক কিছু রচনা সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এই রচনাবলি বইটি।
1

বিধবাবিবাহ

7 January 2024
0
0
0

দ্বিতীয় বারের বিজ্ঞাপন প্রায় দুই বৎসর অতীত হইল, এই পুস্তক প্রথম প্রচারিত হয়। যে উদ্দেশে প্রচারিত হইয়াছিল, তাহা একপ্রকার সফল হইয়াছে, বলিতে হইবেক; কারণ, যাঁহার। যথার্থ বুভুৎসুভাবে এবং বিদ্বেষহীন ও পক্ষ

2

MARRIAGE OF HINDU WIDOWS.

11 January 2024
0
0
0

PREFACE. In January 1855, I published a small pamphlet in Ben- gali on the marriage of Hindu Widows, with the view to prove that it was sanctioned by the Sastras. To this pamphlet, replies were given

3

বহুবিবাহ

13 January 2024
0
0
0

বিজ্ঞাপন এ দেশে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত থাকাতে, স্ত্রীজাতির যৎপরোনাস্তি ক্লেশ ও সমাজে অশেষবিধ অনিষ্ট ঘটিতেছে। রাজশাসন ব্যতিরেকে, সেই ক্লেশের ও সেই অনিষ্টের নিবারণের সম্ভাবনা নাই। এজন্য, দেশস্থ লোকে, স

4

বহুবিবাহ দ্বিতীয় পুস্তক

16 January 2024
1
0
0

যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড যে শাস্ত্রবহির্ভূত ও সাধুবিগর্হিত ব্যবহার, ইহা, বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না, এতদ্বিষয়ক বিচারপুস্তকে, আলোচিত হইয়াছে। তদ্দর্শনে, কতিপয় ব্যক্তি অতিশয় অসন্তুষ্ট হইয়াছেন; এ

---