shabd-logo

বহুবিবাহ দ্বিতীয় পুস্তক

16 January 2024

3 Viewed 3

যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড যে শাস্ত্রবহির্ভূত ও সাধুবিগর্হিত ব্যবহার, ইহা, বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না, এতদ্বিষয়ক বিচারপুস্তকে, আলোচিত হইয়াছে। তদ্দর্শনে, কতিপয় ব্যক্তি অতিশয় অসন্তুষ্ট হইয়াছেন; এবং, তাদৃশ বিবাহব্যবহার সর্বতোভাবে শাস্ত্রানুমোদিত কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম, ইহা প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত প্রয়াস পাইয়াছেন। আক্ষেপের বিষয় এই, প্রতিবাদী মহাশয়েরা তত্ত্বনির্ণয় পক্ষে তাদৃশ যত্নবান হয়েন নাই, জিগীষার বাঁ পাণ্ডিত্য প্রদর্শন বাসনার বশবর্তী হইয়া, বিচারকার্য্য নির্বাহ করিয়াছেন। কোনও বিষয় প্রস্তাবিত হইলে, যে কোনও প্রকারে প্রতিবাদ করা আবশ্যক, অনেকেই, আছ্যোপান্ত, এই বুদ্ধির অধীন হইয়া চলিয়াছেন। ঈদৃশ ব্যক্তিবর্গের তাদৃশ বিচার দ্বারা, কীদৃশফললাভ হওয়া সম্ভব, তাহা সকলেই অনায়াসে অনুমান করিতে পারেন। আমার দৃঢ় সংস্কার এই, যে সকল মহাশয়েরা, প্রকৃত প্রস্তাবে, ধৰ্ম্মশাস্ত্রের ব্যবসায় বা অনুশীলন করিয়াছেন, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রানুমোদিত ব্যবহার, ইহা কদাচ তাঁহাদের মুখ বা লেখনী হইতে বহির্গত হইতে পারে না।

প্রতিবাদী মহাশয়দিগের সংখ্যা অধিক নহে; সমুদয়ে পাঁচ ব্যক্তি প্রতিবাদে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। পুস্তকপ্রচারের পৌর্বাপর্য্য অনুসারে, তাঁহাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় প্রদত্ত হইতেছে। প্রথম, মুর্শিদাবাদনিবাসী শ্রীযুত গঙ্গাধর কবিরত্ন। কবিরত্ন মহাশয় ব্যাকরণে ও চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রবীণ বলিয়া প্রসিদ্ধ। ধৰ্ম্মশাস্ত্রের ব্যবসায় তাঁহার জাতিধৰ্ম্ম নহে; এবং, তাঁহার পুস্তক পাঠ করিলে, স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, তিনি ধৰ্ম্মশাস্ত্রের বিশিষ্টরূপ অনুশীলন করেন নাই। সুতরাং, ধৰ্ম্মশাস্ত্র সংক্রান্ত বিচারে প্রবৃত্ত হওয়া, কবিরত্ন মহাশয়ের পক্ষে, এক প্রকার অনধিকারচর্চ্চা হইয়াছে; এরূপ নির্দেশ করিলে, বোধ করি, নিতান্ত অসঙ্গত বলা হয় না। দ্বিতীয়, বরিসালনিবাসী শ্রীযুত রাজকুমার ন্যায়রত্ন। শুনিয়াছি, ন্যায়রত্ন মহাশয় ন্যায়শাস্ত্রে বিলক্ষণ নিপুণ; তদ্ভিন্ন, অন্য অন্য শাস্ত্রেও তাঁহার সবিশেষ দৃষ্টি আছে। কিন্তু, আশ্চর্য্যের বিষয় এই, তিনি, এক মাত্র জীমূতবাহনপ্রণীত দায়ভাগ অবলম্বন করিয়া, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ডের শাস্ত্রীয়তাপক্ষ রক্ষা করিতে উদ্যত হইয়াছেন। তৃতীয়, শ্রীযুত ক্ষেত্রপাল 'স্মৃতিরত্ন। স্মৃতিরত্ন মহাশয় অতিশয় ধীরস্বভাব, অন্যান্য প্রতিবাদী মহাশয়- দিগের মত, উদ্ধত ও অহমিকাপূর্ণ নহেন। তাঁহার পুস্তকের কোনও স্থলে, ঔদ্ধত্য প্রদর্শন বা গর্বিত বাক্য প্রয়োগ দেখিতে পাওয়া যায় না। তিনি, শিষ্টাচারের অনুবর্তী হইয়া, শাস্ত্রার্থ সংস্থাপনে যত্ন প্রদর্শন করিয়াছেন। চতুর্থ, 'শ্রীযুত সত্যব্রত সামশ্রমী। সামশ্রমী মহাশয় অল্পবয়স্ক ব্যক্তি; অল্প কাল হইল, বারাণসী হইতে, এ দেশে আসিয়াছেন। নব্য ন্যায়শাস্ত্র ভিন্ন সমুদয় সংস্কৃত শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছেন, এবং সমুদয়ের অধ্যাপনা করিতে পারেন, এই বলিয়া, আত্মপরিচয় প্রদান করিয়া থাকেন।

কিন্তু, তিনি প্রকৃত প্রস্তাবে ধর্ম্মশাস্ত্রের অনুশীলন করিয়াছেন, তদীয় পুস্তক পাঠে, কোনও ক্রমে, তদ্রুপ' প্রতীতি জন্মে না। তাঁহার বয়সে যত দূর শোভা পায়, তদীয় ঔদ্ধত্য তদপেক্ষা অনেক অধিক। সবশেষ শ্রীযুত তারানাথ তর্কবাচস্পতি। তর্কবাচস্পতি মহাশয়, কলিকাতাস্থ রাজকীয় সংস্কৃতবিদ্যালয়ে, ব্যাকরণশাস্ত্রের অধ্যাপনা করিয়া থাকেন; কিন্তু, সর্বশাস্ত্রবেত্তা বলিয়া, সর্বত্র পরিচিত হইয়াছেন। তিনি যে কখনও রীতিমত ধৰ্ম্মশাস্ত্রের অনুশীলন করেন নাই, তদীয় পুস্তক তদ্বিষয়ে সম্পূর্ণ সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। তিনি যে সকল সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, সে সমুদয়ই অপসিদ্ধান্ত। অনেকেই বলিয়া থাকেন, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের বুদ্ধি আছে, কিন্তু বুদ্ধির স্থিরতা নাই; নানা শাস্ত্রে দৃষ্টি আছে, কিন্তু কোনও শাস্ত্রে প্রবেশ নাই; বিতণ্ডা করিবার বিলক্ষণ ক্ষমতা আছে, কিন্তু মীমাংসা করিবার তাদৃশী শক্তি নাই, বলিতে অতিশয় দুঃখ উপস্থিত হইতেছে, তদীয় বহুবিবাহবাদ পুস্তক এই কয়টি কথা, অনেক অংশে, সপ্রমাণ করিয়া দিয়াছে। যাহা হউক, বহুবিবাহবিষয়ক আন্দোলন সংক্রান্ত তদীয় আঁচরণের পূর্বর্বাপর পর্য্যালোচনা করিয়া দেখিলে, চমৎকৃত হইতে হয়। ছয় বৎসর পূর্বে, যখন, বহুবিবাহ প্রথার নিবারণ প্রার্থনায়, রাজদ্বারে আবেদনপত্র প্রদত্ত হয়; তৎকালে, তর্কবাচস্পতি মহাশয় নিবারণপক্ষে বিলক্ষণ উৎসাহী ও অনু- রাগী ছিলেন; এবং, স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া, সাতিশয় আগ্রহ সহ- কারে, আবেদনপত্রে নাম স্বাক্ষর করেন। সেই আবেদনপত্রের স্কুল মর্ম্ম এই; "নয় রৎসর অতীত হইল, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহ ব্যবহারের নিবারণ প্রার্থনায়, পূর্ব্বতন 'ব্যবস্থাপক সমাজে ৩২ খানি আবেদনপত্র প্রদত্ত হইয়াছিল। এই অতি জঘন্য, অতি নৃশংস ব্যবহার হইতে যে অশেষবিধ অনর্থসংঘটন হইতেছে, সে সমুদয় ঐ সকল আবেদনপত্রে সবিস্তর উল্লিখিত হইয়াছে; এজন্য, আমরা আর সে সকল বিষয়ের উল্লেখ করিতেছি না। আমাদের মধ্যে অনেকে ঐ সকল আবেদনপত্রে নাম স্বাক্ষর করিয়াছেন, এবং, ঐ সকল আবেদনপত্রে যে সকল কথা লিখিত হইয়াছে, সে সমুদয় আমরা সকলে অঙ্গীকার করিয়া লইতেছি”। নাম স্বাক্ষর করিবার সময়, তর্কবাচস্পতি মহাশয়, আবেদনপত্রের অর্থ অবগত হইয়া, এই আপত্তি করিয়াছিলেন, পূর্বতন আবেদনপত্রে কি কি কথা লিখিত আছে, তাহা অবগত না হইলে, আমি স্বাক্ষর করিতে পারিব না; পরে, ঐ আবেদনপত্রের অর্থ অবগত হইয়া, নাম স্বাক্ষর করেন। "এ দেশের ধর্মশাস্ত্র অনুসারে, পুরুষ একমাত্র বিবাহে অধিকারী; কিন্তু, শাস্ত্রোক্ত নিমিত্ত ঘটিলে, একাধিক বিবাহ করিতে পারেন; এই শাস্ত্রোক্ত নিয়ম লঙ্ঘন করিয়া, যদৃচ্ছা ক্রমে যত ইচ্ছা বিবাহ করা এক্ষণে বিলক্ষণ প্রচলিত হইয়া উঠিয়াছে”। ঐ সকল আবেদনপত্রে এই সকল কথা লিখিত আছে; এবং, এই সকল কথা বিশিষ্ট রূপে অবগত হইয়া, তর্কবাচস্পতি মহাশয় আবেদনপত্রে নাম স্বাক্ষর করেন। এই সময়েই আমি, বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না, এতদ্বিষয়ক বিচারপুস্তকের প্রথম ভাগ রচনা করিয়া, তাঁহাকে শুনাইয়াছিলাম। শুনিয়া তিনি সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন; এবং, শাস্ত্রের যথার্থ মীমাংসা হইয়াছে, এই বলিয়া, মুক্ত কণ্ঠে, সাধুবাদ প্রদান করিয়াছিলেন। এক্ষণে, সেই তর্কবাচস্পতি মহাশয় বহু বিবাহের রক্ষাপক্ষ অবলম্বন করিয়াছেন; এবং, বহু বিবাহ ব্যবহারকে শাস্ত্রসম্মত কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম বলিয়া, প্রতিপন্ন করিতে উদ্যত হইয়াছেন। .

তদীয় এতাদৃশ চরিতবৈচিত্র্যের মূল এই। আমার পুস্তক প্রচারিত হইবার অব্যবহিত পরেই, শ্রীযুত ক্ষেত্রপালস্মৃতিরত্ন • প্রভৃতি কতিপয় ব্যক্তি, বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রানুমোদিত ব্যবহার, ইহা প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত, এক ব্যবস্থাপত্র প্রচারিত করেন। ঐ সময়ে অনেকে কহিয়াছিলেন, তর্কবাচস্পতি • মহাশয়ের পরামর্শে ও সহায়তায়, ঐ ব্যবস্থাপত্র প্রচারিত হইয়াছে। কিন্তু, আমি তাঁহাকে যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহ ব্যব- হারের বিষম বিদ্বেষী বলিয়া জানিতাম; এজন্য, তিনি বহু বিবাহের রক্ষাপক্ষ অবলম্বন করিয়াছেন, এ কথায় আমার বিশ্বাস জন্মে নাই; বরং, তাদৃশ নির্দেশ দ্বারা, অকারণে, তাঁহার উপর উৎকট দোষারোপ হইতেছে, এই বিবেচনা করিয়াছিলাম। ঐ আরোপিত দোষের পরিহার বাসনায়, উল্লিখিত ব্যবস্থাপত্রের আলোচনা করিয়া, উপসংহার কালে লিখিয়াছিলাম,-

"অনেকের মুখে শুনিতে পাই, তাঁহারা কলিকাতাস্থ রাজকীয় সংস্কৃতবিষ্কালয়ে ব্যাকরণশাস্ত্রের অধ্যাপক শ্রীযুত তারানাথ তর্কবাচস্পতি ভট্টাচার্য্য মহাশূয়ের পরামর্শে ও সহায়তায়, বহুবিবাহবিষয়ক শাস্ত্রসম্মত বিচারপত্র প্রচারিত করিয়াছেন। কিন্তু, সহসা, এ বিষয়ে বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হইতেছে না। তর্কবাচস্পতি মহাশয় এত অনভিজ্ঞ নহেন, যে এরূপ অসমীচীন আচরণে দূষিত হইবেন। পাঁচ বৎসর পূর্ব্বে, যখন, বহু বিবাহের নিবারণ প্রার্থনায়, রাজদ্বারে আবেদন করা হয়, সে সময়ে, তিনি এ বিষয়ে বিলক্ষণ অনুরাগী ছিলেন; এবং, স্বতঃপ্রবৃত্ত হইমা, নিরতিশয় আগ্রহ ও উৎসাহ সহকারে, আবেদনপত্রে নাম স্বাক্ষর করিয়াছেন। এক্ষণে, তিনিই আবার, বহু বিবাহের রক্ষাপক্ষ অবলম্বন করিয়া, এই লজ্জাকর, ঘৃণাকর, অনর্থকর, অধর্ম্মকর ব্যবহারকে শাস্ত্রসম্মত বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে প্রয়াস পাইবেন, ইহা সম্ভব বোধ হয় না"।

আমার আলোচনাপত্রের এই অংশ পাঠ করিয়া, তর্ক- বাচস্পতি মহাশয় ক্রোধে অন্ধ হইয়াছেন, এই কথা শুনিতে পাইলাম; কিন্তু, তুষ্ট না হইয়া, রুষ্ট হইলেন কেন, কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। অবশেষে, সবিশেষ অনুসন্ধান দ্বারা জানিতে পারিলাম, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড রহিত হওয়া আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, কলিকাতাস্থ ধর্ম্মরক্ষিণী সভা উহার নিবারণ বিষয়ে সবিশেষ সচেষ্ট ও সে বিষয়ে ব্রাহ্মণ- পণ্ডিতবর্গের মতসংগ্রহে প্রবৃত্ত হয়েন, এবং, রাজশাসন ব্যতি- রেকে, এই জঘন্য ব্যবহার রহিত হওয়া সম্ভাবিত নহে, ইহা স্থির করিয়া, রাজদ্বারে আবেদন করিবার অভিপ্রায় করেন। তর্কবাচস্পতি মহাশয় এ বিষয়ে সম্পূর্ণ প্রতিবাদী হইয়াছিলেন, এবং, ধৰ্ম্মরক্ষিণী সভা অধর্মাচরণে প্রবৃত্ত হইতেছেন, আর তাঁহাদের সংস্রবে থাকা বিধেয় নহে, এই বিবেচনা করিয়া, ক্রোধভরে সভার সম্বন্ধ পরিত্যঙ্গ করিয়াছেন। আমার আলোচনাপত্র প্রচারিত হইলে, ধর্ম্মরক্ষিণী সভার অধ্যক্ষেরা জানিতে পারিলেন, তর্কবাচস্পতি মহাশয়, কিছু দিন পূর্বে, বহু বিবাহের নিবারণ বিষয়ে সবিশেষ উৎসাহী ও উদ্যোগী ছিলেন, এবং, বহু বিবাহের নিবারণ প্রার্থনায়, আবেদনপত্রে নাম স্বাক্ষর করিয়াছেন। ইতঃপূর্ব্বে, তিনি নিজে যাহা করিয়া- ছিলেন, এক্ষণে, তাঁহারা তাহাই করিতে সচেষ্ট হইয়াছেন; কিন্তু, এই অপরাধে, অধার্ম্মিকবোধে, তাঁহাদের সংস্রর ত্যাগ করা আশ্চর্য্যের বিষয় জ্ঞান করিয়া, তাঁহারা উপহাস করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। আমার লিখন দ্বারা পূর্বব কথা ব্যক্ত না হইলে, ধর্ম্মরক্ষিণী সভার অধ্যক্ষেরা, তর্কব। চস্পতি মহাশয়ের পূর্বতন আচরণ বিষয়ে, বিন্দুবিসর্গও জানিতে পারিতেন না, এবং, এ পর্য্যন্ত তাহা অপ্রকাশ থাকিলে, তাঁহারা তাঁহাকে উপহাস করিবারও পথ পাইতেন না। সুতরাং, আমিই তাঁহাকে অপ্রতিভ করিয়াছি; এবং, আমার দোষেই, তাঁহাকে উপহাসা- স্পদ হইতে হইয়াছে এই অপরাধ ধরিয়া, যার পর নাই কুপিত হইয়াছেন; এবং, আমার প্রচারিত বহুবিবাহবিষয়িণী ব্যবস্থা খণ্ডন করিয়া, আমায় অপদস্থ করিবার নিমিত্ত, বহু- বিবাহবাদ পুস্তক প্রচারিত করিয়াছেন। ধর্ম্মবুদ্ধির অধীন হইয়া, শাস্ত্রার্থ সংস্থাপনে প্রবৃত্ত হইলে, লোক যেরূপ আদর- ণীয় ও শ্রদ্ধাভাজন হয়েন; রোষ বশে বিদ্বেষবুদ্ধির অধীন হইয়া,, শাস্ত্রার্থ বিপ্লাবনে প্রবৃত্ত হইলে, লোককে তদনুরূপ অনাদরণীয় ও অশ্রদ্ধাভাজন হইতে হয়। ফলতঃ, এই অলৌ- কিক আচরণ দ্বারা, তর্কবাচস্পতি মহাশয় যে রাগদ্বেষের নিতান্ত বশীভূত ও নিতান্ত অবিমৃশ্যকারী মনুষ্য, ইহারই সম্পূর্ণ পরিচয় প্রদান করা হইয়াছে।

• তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের বহুবিবাহবাদ সংস্কৃত ভাষায় সঙ্কলিত হইয়াছে; এজন্য, সংস্কৃতানভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ তদীয় গ্রন্থ পাঠে অধিকারী হইতে পারেন নাই। যদি বাঙ্গালা ভাষায় সঙ্কলিত হইত, তাহা হইলে, তিনি, এই গ্রন্থের সঙ্কলন বিষয়ে, যে পাণ্ডিত্যপ্রকাশ করিয়াছেন, দেশস্থ সমস্ত লোকে তাহার সম্পূর্ণ পরিচয় পাইতে পারিতেন। আমার পুস্তকে বহুবিবাহবাদের যে সকল অংশ উদ্ধৃত হইবেক, তাহার অনুবাদ পাঠ করিয়া, তাঁহারা তদীয় পাণ্ডিত্যপ্রকাশের অংশিক পরিচয় পাইতে পারিবেন, সন্দেহ নাই; কিন্তু, উহা দ্বারা, পর্য্যাপ্ত পরিমাণে, পরিতৃপ্ত হওয়া সম্ভব নহে। শুনিয়াছিলাম, সর্বসাধারণের হিতার্থে, বহুবিবাহবাদ, অবিলম্বে, বাঙ্গালা ভাষায় অনুবাদিত ও প্রচারিত হইবেক। দুর্ভাগ্য ক্রমে, এ পর্য্যন্ত তাহা না হওয়াতে, বোধ হইতেছে, তাঁহার। তদীয় বহুবিবাহবিচারবিষয়ক পাণ্ডিত্য- প্রকাশের সম্পূর্ণ পরিচয় লাভে বঞ্চিত রহিলেন। তিনি গ্রন্থারম্ভে প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, "যাঁহারা ধর্ম্মের ত্ত্বেজ্ঞানলাভে অভিলাষী, তাঁহাদের বোধ জন্মাইবার নিমিত্তই আমার যত্ন" (১)। কিন্তু, তদীয় গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষায় সঙ্কলিত হওয়াতে, তাঁহার প্রতিজ্ঞা ফলবতী হইবার সম্ভাবনা নাই। এ দেশের অধিকাংশ লোক সংস্কৃতজ্ঞ নহেন; সুতরাং, তাদৃশ ব্যক্তিবর্গ, ধর্ম্মের তত্ত্বজ্ঞান লাভে অভিলাষী হইলেও, তদীয় গ্রন্থ দ্বারা, কোনও উপকার লাভ করিতে পারিবেন না। বিশেষতঃ, তিনি উপসংহারকালে নির্দেশ করিয়াছেন, "যে সকল সংস্কৃতানভিজ্ঞ ব্যক্তি বিদ্যা- সাগরের বাক্যে বিশ্বাস করিয়া থাকেন, তাঁহার উদ্ভাবিত পদবী বহুদোষপূর্ণ, তাঁহাদের এই বোধ জন্মাইবার নিমিত্তই যত্ন করিলাম” (২)। অতএব, তদীয় সিদ্ধান্ত অনুসারে, যাঁহারা আমা দ্বারা প্রতারিত হইয়াছেন, তাঁহাদের জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলনের নিমিত্ত, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের গ্রন্থ বাঙ্গালা ভাষায় সঙ্কলিত হওয়াই, সর্বতোভাবে, উচিত ও আবশ্যক ছিল। তাহা না করিয়া, সংস্কৃত ভাষায় পুস্তক প্রচারের উদ্দেশ্য কি, বুঝিতে পারা যায় না। এক উদ্যোগে, মীমাংসাশক্তি ও সংস্কৃতরচনাশক্তি এ উভয়ের পরিচয় প্রদান ব্যতীত, গ্রন্থকর্তার অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে কি না, অনুমানবলে তাহার নিরূপণ করা কোনও মতে সম্ভাবিত নহে।

যাহা হউক, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহু বিবাহ ব্যবহারের শাস্ত্রীয়তা প্রতিপাদনে প্রবৃত্ত হইয়া, সর্বশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহাশয়, অশেষ প্রকারে, পাণ্ডিত্য প্রকাশ করিয়াছেন। পাণ্ডিত্য প্রকাশ বিষয়ে, অন্যান্য প্রতিবাদী মহাশয়েরা তাঁহার সমকক্ষ নহেন। পুস্তক প্রকাশের পৌর্বাপর্য্য অনুসারে, সর্বশেষে পরিগণিত হইলেও, পাণ্ডিত্য প্রকাশের ন্যূনাধিক্য অনুসারে, তিনি সর্বাগ্রগণ্য। এরূপ সর্বাগ্রগণ্য ব্যক্তির সর্বাগ্রে সম্মান হওয়া উচিত ও অবশ্যক; এজন্য, তাঁহার উত্থাপিত আপত্তি সকল সর্বাগ্রে সমালোচিত হইতেছে।

তর্কবাচস্পতি প্রকরণ

প্রথম পরিচ্ছেদ।

শ্রীযুত তারানাথ তর্কবাচস্পতি সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, যে মনুবচন অনুসারে, রতিকামনাস্থলে, সবর্ণা বিবাহের নিষেধ প্রতিপাদিত হইয়াছে; আমি, ঐ বচনের প্রকৃত অর্থের গোপন, ও অকিঞ্চিৎ- কর অভিনব অর্থের উদ্ভাবন, পূর্ব্বক, লোককে প্রতারণা করিয়াছি। তিনি লিখিয়াছেন,

"অহো বৈদগ্ধী প্রজ্ঞাবতো বিদ্যাসাগরস্থ্য যদকিঞ্চিৎকরাভি- নবার্থপ্রকাশনেন বহবো লোকা ব্যামোহিতা ইতি (১)।" প্রজ্ঞাবান্ বিদ্যাসাগরের কি চাতুরী! অকিঞ্চিৎকর অভিনব অর্থের উদ্ভাবন দ্বারা অনেক লোককে বিমোহিত করিয়াছেন।

এ বিষয়ে আমার বক্তব্য এই যে, এখন পর্য্যন্ত আমার এই দৃঢ় বিশ্বাস আছে, আমি মনুবচনের যে অর্থ লিখিয়াছি, উহাই ঐ বচনের প্রকৃত, ও চিরপ্রচলিত অর্থ, লোক বিমোহনের নিমিত্ত, আমি, বুদ্ধিবলে, অভিনব অর্থের উদ্ভাবন করি নাই। শাস্ত্রীয় বিচারে প্রবৃত্ত হইয়া, অভিপ্রেত সাধনের নিমিত্ত, শাস্ত্রের প্রকৃত অর্থ গোপন করিয়া, ছল বা কৌশল অবলম্বন পূর্বক, লোকসমাজে কপোলকল্পিত অপ্রকৃত অর্থ প্রচারিত করা নিতান্ত মূঢ়মতি, নিতান্ত নীচপ্রকৃতির কর্ম্ম। আমি, জ্ঞান পূর্ব্বক, কখনও, সেরূপ গর্হিত আচরণে দূষিত হই নাই; এবং, যত দিন জীবিত থাকিব, জ্ঞান পূর্ব্বক, কখনও, সেরূপ গর্হিত আচরণে দূষিত • হইব না। সে যাহা হউক, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের আরোপিত অপবাদ বিমোচনের নিমিত্ত, বিবাদস্পদীভূত মনুবচন, সবিস্তর অর্থ সমেত, প্রদর্শিত হইতেছে।

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং" প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণি। কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ শ্যুঃ ক্রমশোহবরাঃ ॥৩।১২।

দ্বিজাতীনাং ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বৈশ্বানাম্ অগ্রে প্রথমে ধৰ্ম্মার্থে ইতি যাবৎ দারকর্ম্মণি পরিণয়বিধৌ সবর্ণা সজাতীয়া কন্যা প্রশস্তা বিহিতা; তু কিন্তু কামতঃ কামবশাৎ প্রবৃত্তানাং দারান্তর- পরিগ্রহে উদ্যক্তানাং দ্বিজাতীনাম্ ইমাঃ বক্ষ্যমাণাঃ অনন্তর- বচনোক্তা ইতি যাবৎ অবরাঃ হীনবর্ণাঃ ক্ষত্রিয়াবৈশ্যাশূদ্রাঃ ক্রমেণ আনুলোম্যেন শ্যুঃ ভার্য্যাঃ ভবেয়ুঃ।

ৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের, প্রথম অর্থাৎ ধর্মার্থ বিবাহে, তীয়া কন্তা প্রশস্তা, অর্থাৎ বিহিতা; কিন্তু, যাহারা, - বশতঃ, বিবাহ করিতে প্রবৃত্ত হয়, বক্ষ্যমাণ অবরা, অধ:পাক্ত হীনবর্ণা ক্ষত্রিয়া, বৈক্ষা, শূদ্রা, অনুলোম ক্রমে, তাহাদের • ভাৰ্য্যাঁ হইবেক।

প্রথম পুস্তকে, এই বচনের অর্থ সংক্ষেপে লিখিত হইয়াছিল; কিন্তু, সংক্ষেপ নিবন্ধন, ফলের কোনও বৈলক্ষণ্য ঘটে নাই; ইহা প্রদর্শিত করিবার নিমিত্ত, ঐ অর্থ উদ্ধৃত হইতেছে। যথা,

"দ্বিজাতির পক্ষে, অগ্রে সবর্ণা বিহাহই বিহিত। কিন্তু, যাহারা, রতি- কামনায়, বিবাহ করিতে প্রবৃত্ত হয়, তাহারা, অনুলোম ক্রমে, বর্ণান্তরে বিবাহ করিবেক।"

সংস্কৃত ও বাঙ্গালা, উভয় ভাষায় মনুবচনের অর্থ প্রদর্শিত হইল। এক্ষণে সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, আমি শাস্ত্রের অর্থ গোপন অথবা শাস্ত্রের অযথা ব্যাখ্যা করিয়াছি কি না। আমার স্থির সংস্কার এই, যে সকল শব্দে ঐ বচন সঙ্কলিত হইয়াছে; প্রদর্শিত ব্যাখ্যায়, তন্মধ্যে কোনও শব্দের অর্থ গোপিত বা অযথা প্রতিপাদিত হইয়াছে, ইহা কেহই প্রতিপন্ন করিতে পারিবেন না। ফলতঃ, এই ব্যাখ্যা যে এই বচনের প্রকৃত ব্যাখ্যা, সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপন্ন, অথবা ধৰ্ম্মশাস্ত্রব্যবসায়ী, কোনও ব্যক্তি তাহার অপলাপ বা তদ্বিষয়ে বিতণ্ডা করিতে পারেন, এরূপ বোধ হয় না।

এক্ষণে, আমার অবলম্বিত অর্থ প্রাচীন ও চিরপ্রচলিত অর্থ; অথবা, লোক বিমোহনের নিমিত্ত, বুদ্ধিবলে উদ্ভাবিত অভিনব অর্থ; এ বিষয়ে সংশয় নিরসনের নিমিত্ত, বেদব্যাখ্যাতা মাধবাচার্য্যের লিখিত অর্থ উদ্ধৃত হইতেছে;-

"অগ্রে স্নাতকস্থ্য প্রথমবিবাহে দারকর্মণি অগ্নিহোত্রাদৌ ধর্শে সবর্ণা বরেণ সমানো বর্ণো ব্রাহ্মণাদির্য্যাঃ স ব্রাহ্মণী ক্ষত্রিয়স্তম্ভ ক্ষত্রিয়া বৈশ্যস্ত বৈশ্যাও সবর্ণামুড়া পশ্চাৎ রিরংসবশ্চেৎ তদা তেষাম্ . ইমাঃ ক্ষত্রিয়াঙ্কাঃ ক্রমেণ ভাষণঃ স্যুঃ (২)।"

অগ্নিহোত্রাদি ধর্ম সম্পাদনের নিমিত্ত, স্নাতকের প্রথম বিবাহে, সবর্ণা, অর্থাৎ বরের সজাতীয়া কন্দ্রা, প্রশস্তা, যেমন, ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণী, ক্ষত্রিয়ের ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যের বৈস্তা। দ্বিজাতিরা, ধৰ্ম্মকার্য্য সম্পাদনের নিমিত্ত, অগ্রে সবর্ণাবিবাহ করিয়া, পশ্চাৎ যদি রিরংস্থ হয়, অর্থাৎ রতিকামনা পূর্ণ করিতে চায়, তবে অবরা, অর্থাৎ হীনবর্ণা, বক্ষ্যমাণ ক্ষত্রিয়া, বৈচা ও শূদ্রা, অনুলোম ক্রমে, তাহাদের ভার্য্যা হইবেক।

দেখ, মাধবাচার্য্য মনুবচনের যে অর্থ লিখিয়াছেন, আমার লিখিত অর্থ, তাহার ছায়াস্বরূপ; সুতরাং, আমার লিখিত অর্থ, লোক বিমোহনের নিমিত্ত, বুদ্ধিবলে উদ্ভাবিত অর্থ বলিয়া উল্লিখিত হইতে পারে না। এক্ষণে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন,

"ব্যিাসাগরের কি চাতুরী! অকিঞ্চিৎকর অভিনব অর্থের উদ্ভাবন দ্বারা, অনেক লোককে বিমোহিত করিয়াছেন।"

. এই, নির্দেশ সঙ্গত হইতেছে কি না। পরাশরভাষ্যে মাধবাচার্য্য মনুবচনের এবংবিধ ব্যাখ্যা লিখিয়াছেন, ইহা অবগত থাকিলে, সর্বশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহাশয়, অম্লানমুখে, আমার উপর ঈদৃশ অসঙ্গত দোষারোপ করিতে অগ্রসর হইতেন, এরূপ বোধ হয় না। যাহা হউক, আমি, 'প্রকৃত অর্থের গোপন ও অপ্রকৃত অভিনব অর্থের উদ্ভাবন পূর্ব্বক, লোককে প্রতারণা করিয়াছি, তিনি 'এই যে বিষম অপবাদ দিয়াছেন, এক্ষণে, বোধ করি, সে অপবাদ হইতে অব্যাহতি পাইতে পারিব।

তর্কবাচস্পতি মহাশয়, অন্যদীয় মীমাংসায় দোষারোপ করিয়া, যথার্থ শাস্ত্রার্থ সংস্থাপনে প্রবৃত্ত হইয়াছেন; কিন্তু, ঈদৃশ গুরুতর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিয়া, তত্ত্বনির্ণয় নিমিত্ত, যেরূপ যত্ন ও. যেরূপ পরিশ্রম করা আবশ্যক, তাহা করেন নাই; সুতরাং, অভিপ্রেত সম্পাদনে কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। আমি, মনুবচন অবলম্বন করিয়া, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহ ব্যবহারের অশাস্ত্রীয়তা প্রতিপন্ন করিয়াছি; এজন্য, আমার লিখিত অর্থ যথার্থ কি না, তাহার পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত, মনুসংহিতা দেখা আবশ্যক বোধ হইয়াছে; তদনুসারে, তিনি মনুসংহিতা বহিষ্কৃত করিয়াছেন, এবং পুস্তক উদ্ঘাটিত করিয়া, আপাততঃ, মূলে যেরূপ পাঠ ও টীকায় যেরূপ অর্থ দেখিয়াছেন, অসন্দিহান চিত্তে, তাহাকেই প্রকৃত পাঠ ও প্রকৃত অর্থ স্থির করিয়া,তদনুসারে মীমাংসা করিয়াছেন; এই বচন অন্যান্য গ্রন্থকর্তারা উদ্ধৃত করিয়াছেন কি না, এবং যদি উদ্ধৃত করিয়া থাকেন, তাঁহারা কিরূপ পাঠ ধরিয়াছেন এবং কিরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা অনুসন্ধান করিয়া দেখা আবশ্যক বিবেচনা করেন নাই। প্রথমতঃ, তাঁহার অবলম্বিত মূলের পাঠ সমালোচিত হইতেছে।

মূল

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণি। কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো বরাঃ ॥ তর্কবাচস্পতি মহাশয়, কিঞ্চিৎ পরিশ্রম ও কিঞ্চিৎ বুদ্ধিচালনা করিলেই, অনায়াসে প্রকৃত পাঠের ও প্রকৃত অর্থের নির্ণয় করিতে পারিতেন, এবং তাহা হইলে, অকারণে আমার উপর খড়গহস্ত হইয়া, বৃথা বিতণ্ডায় প্রবৃত্ত হইতেন না। তিনি যে, রোষে ও অবিবেকদোষে, সামান্যজ্ঞানশূন্য হইয়া, বিচারকার্য্য সম্পন্ন করিয়াছেন, তাহা দর্শাইবার নিমিত্ত, পদবিশ্লেষ সহকারে, মনুবচন উদ্ধৃত হইতেছে।

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্মণি। সবর্ণা অগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্ন্যুঃ কামতঃ তু প্রবৃত্তানাম্ ইমাঃ স্যুঃ দারকৰ্ম্মণি। ক্রমশো বরাঃ। ক্রমশঃ অবরাঃ।

"ক্রমশঃ অবরাঃ” এই দুই পদে সন্ধি হওয়াতে, পদের অন্তস্থিত ওকারের পরবর্তী অকারের লোপ হইয়া, "ক্রমশো বরাঃ” ইহা সিদ্ধ হইয়াছে। এরূপ সন্ধি স্থলে, পাঠকদিগের বোধসৌকর্য্যের নিমিত্ত, লুপ্ত অকারের চিহ্ন রাখিবার ব্যবহার আছে। কিন্তু, সকল স্থলে, সকলকে সে ব্যবহার অবলম্বন করিয়া চলিতে দেখা যায় না। যদি এ স্থলে লুপ্ত অকারের চিহ্ন রাখা যায়, তাহা হইলে "ক্রমশো হবরাঃ” এইরূপ আকৃতি হয়। লুপ্ত অকারের চিহ্ন পরিত্যক্ত হইলে, "ক্রমশো বরাঃ" এইরূপ আকৃতি হইয়া থাকে। দুর্ভাগ্য ক্রমে, মনুসংহিতার মুদ্রিত পুস্তকে লুপ্ত অকারের চিহ্ন না থাকাতে, সর্বশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহাশয়, "অবরাঃ” এই স্থলে, "বরাঃ" এই পাঠ স্থির করিয়া, তদনুসারে মনুবচনের অর্থ নির্ণয় করিয়াছেন; সুতরাং, তাঁহার অবলম্বিত অর্থ বচনের প্রকৃত অর্থ বলিয়া পরিগৃহীত হইতে পারে না। তাঁহার সন্তোষের নিমিত্ত, এ স্থলে উল্লেখ করা আবশ্যক, "অবরাঃ”, এই পাঠ আমার কপোলকল্পিত, অথবা লোক বিমোহনের নিমিত্ত বুদ্ধিবলে উদ্ভাবিত, অভিনব পাঠ নহে। পূর্বেত্র দর্শিত হইয়াছে, মাধবাচার্য্য পরাশরভাষ্যে, "অবরাঃ” এই পাঠ ধরিয়া, মনুবচনের ব্যাখ্যা করিয়াছেন। পাঠকদিগের সুবিধার জন্য, এ স্থলে তদীয় ব্যাখ্যার ঐ অংশ পুনরায় উদ্ধৃত হইতেছে;-

“ধৰ্ম্মার্থমাদৌ সবর্ণামুঢ়া পশ্চাৎ রিরংসাবশ্চেৎ তদা তেষাম্

"অবরাঃ” হীনবর্ণাঃ ইমাঃ ক্ষত্রিয়াঙ্কাঃ ক্রমেণ ভাৰ্য্যাঃ স্ন্যুঃ।" মিত্রমিশ্রও, "অবরাঃ” এই পাঠ ধরিয়া, মনুর অভিপ্রায় ব্যাখ্যা করিয়াছেন। যথা,

"অতএব মনুনা

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণি।

কামতস্তু প্রবৃত্তানামিয়াঃ স্যুঃ ক্রমশোহবরা ইতি ।।

ক্রামতঃ ইতি "অবরাঃ" ইতি চ বদতা সবর্ণাপরিণয়নমেব মুখ্যমিত্যুক্তম্ (৩)।"

বিশ্বেশ্বরভট্টও এই পাঠ ধরিয়া ব্যাখ্যা কবিয়াছেন। যথা, "অথ দারামুকল্পঃ। তত্র মনুঃ।

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণি। কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ শ্যুঃ ক্রমশোহবরাঃ।

"অবরাঃ" জঘন্যাঃ (৪)।"

জীমূতবাহন, স্বপ্রণীত দায়ভাগগ্রন্থে, "অবরাঃ” এই পাঠ ধরিয়া- ছেন। যথা,

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্ত। দারকৰ্ম্মণি।

কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো "হুবরাঃ” ॥ ফলতঃ, “ক্রমশো বরাঃ” এ স্থলে "অবরাঃ” এই পাঠই যে প্রকৃত পাঠ, সে বিষয়ে, কোনও অংশে, সংশয় করা যাইতে পারে না। যাঁহারা, "ক্রমশঃ বরাঃ” এই পাঠ প্রকৃত পাঠ বলিয়া, বিতণ্ডা করিতে উদ্যত হইবেন, পুস্তকের লুপ্ত অকাচের চিহ্ন নাই, ইহাই তাঁহাদের এক মাত্র প্রমাণ। কিন্তু, লুপ্ত অকারের চিহ্ন না থাকা সচরাচর ঘটিয়া থাকে; সুতরাং, উহা প্রবল প্রমাণ বলিয়া পরিগৃহীত হইতে পারে না (৫)। এ দিকে, জীমূতবাহনপ্রণীত দায়ভাগে, “অবরাঃ” এই পাঠ পূর্বাপর চলিয়া আসিতেছে (৬); আর, মাধবাচার্য্য, মিত্রমিশ্র, ও বিশ্বেশ্বরভট্ট, স্পষ্টাক্ষরে, "অবরাঃ” এই পাঠ ধরিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন। এমন স্থলে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, "বরাঃ" "অবরাঃ," এ উভয়ের মধ্যে, কোন পাঠ প্রকৃত পাঠ বলিয়া পরিগণিত হওয়া উচিত।

তর্কবাচস্পতি মহাশরের অবলম্বিত পাঠ মনুবচনের প্রকৃত পাঠ নহে, তাহা প্রদর্শিত হইল। এক্ষণে, তাঁহার আশ্রয়ভূত টীকার বলাবল পরীক্ষিত হইতেছে।

টাকা

"ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বৈশ্বানাং প্রথমে বিবাহে কর্তব্যে সবর্ণা শ্রেষ্ঠা ভবতি কামতঃ পুনর্বিবাহে প্রবৃত্তানাম্ এতাঃ বক্ষ্যমাণাঃ অনুলোম্যেন শ্রেষ্ঠা ভবেষঃ।"

ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের প্রথম বিবাহে সবর্ণা শ্রেষ্ঠা; কিন্তু, কাম বশতঃ বিবাহপ্রবৃত্তদিগের পক্ষে, বক্ষ্যমাণ কন্তারা অনুলোম ক্রমে শ্রেষ্ঠা হইবেক।

মূলে লুপ্ত অকারের অসদ্ভাব বশতঃ, "অবরাঃ” এই স্থলে "বরাঃ” এই পাঠকে প্রকৃত পাঠ স্থির করিয়া, প্রতমতঃ তর্কবাচস্পতি মহাশরের যে ভ্রম জন্মিয়াছিল, কুল্লুকভট্টের ব্যাখ্যা দর্শনে, তাঁহার সেই ভ্রম সর্ব্বতোভাবে দৃঢ়ীভূত হয়। যেরূপ লক্ষিত হইতেছে, তাহাতে, আমার সামান্য বিবেচনায়, লিপিকর প্রমাদ বশতঃ, কুল্লুকভট্টের টাকায় পাঠের ব্যতিক্রম ঘটিয়াছে; নতুবা, তিনি এরূপ অসংলগ্ন ব্যাখ্যা লিখিবেন, সম্ভব বোধ হয় না।"ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের প্রথম বিবাহে সবর্ণা শ্রেষ্ঠা,” এ স্থলে প্রশস্তা শব্দের শ্রেষ্ঠা এই অর্থ লিখিত দৃষ্ট হইতেছে; কিন্তু প্রশস্ত শব্দ ক্রোষ্ঠ এই অর্থের বাচক নহে। শ্রেষ্ঠ শব্দ তারতম্যবোধক শব্দ, প্রশস্ত শব্দ তারতম্যবোধক শব্দ নহে। শ্রেষ্ঠ শব্দে, সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট, এই অর্থ বুঝায়; প্রশস্ত শব্দে, উৎকৃষ্ট, উচিত, বিহিত, প্রসিদ্ধ, অভিমত, ইত্যাদি অর্থ বুঝায়; সুতরাং, শ্রেষ্ঠ শব্দ ও প্রশস্ত 'শব্দ এক পর্য্যায়ের শব্দ নহে। অতএব, প্রশস্ত শব্দের অর্থ স্থলে শ্রেষ্ঠ শব্দের প্রয়োগ অপপ্রয়োগ। আর, "ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের প্রথম বিবাহে সবর্ণা শ্রেষ্ঠা,” এ লিখনের অর্থও, কোনও মতে, সংলগ্ন হয় না। বিবাহযোগ্যা কন্যা দ্বিবিধা, সবর্ণা ও অসবর্ণা (৭)। প্রথম বিবাহে সবর্ণা শ্রেষ্ঠা, অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্টা, এ কথা বলিলে, অসবর্ণাও প্রথম বিবাহে পরিগৃহীতা হইতে পারে। কিন্তু, অগ্রে সবর্ণা বিবাহ না করিয়া, অসবর্ণা বিবাহ করা শাস্ত্রকারদিগের অভিমত নহে। যথা,

ক্ষত্রবিশূদ্রকন্যাস্তু ন বিবাহ্যা দ্বিজাতিভিঃ।

বিবাহ্য। ব্রাহ্মণী পশ্চাদ্বিবাহ্যাঃ কচিদেব তু (৮) র

দ্বিজাতিরা ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, ও শূদ্রের কন্তা বিবাহ করিবেক না; তাহারা ব্রাহ্মণী অর্থাৎ সবর্ণী বিবাহ করিবেক পশ্চাৎ, অর্থাৎ অগ্রে ব্রাহ্মণী বিবাহ করিয়া, স্থলবিশেষে, ক্ষত্রিয়াধিকন্তা বিবাহ করিতে পারিবেক।

তবে সবর্ণার অপ্রাপ্তি ঘটিলে, অসবর্ণা বিবাহ করিবেক, এরূপ বিধি আছে। যথা, অলাভে কন্যায়াঃ স্নাতকব্রতং চরেৎ অপিবা ক্ষত্রিয়ায়াং

পুত্রমুৎপাদয়েৎ, বৈশ্যায়াং বা শূদ্রায়াঞ্চেত্যেকে (৯)। সজাতীয়া ক্যার অপ্রাপ্তি ঘটিলে, স্নাতকত্রতের অনুষ্ঠান অথবা ক্ষত্রিয়া বা বৈগ্রকন্দ্রা বিবাহ করিবেক। কেহ কেহ শুদ্রকন্তা বিবাহেরও অনুমতি দিয়া থাকেন।

এ. অনুসারে, প্রথম বিবাহ্ণে কথঞ্চিৎ অসবর্ণার প্রাপ্তি কল্পনা করিলেও, প্রথম বিবাহে সবর্ণা শ্রেষ্ঠা, এ কথা সংলগ্ন হইতে পারে না। প্রশস্য শব্দের উত্তর ইষ্ঠপ্রত্যয় হইয়া, শ্রেষ্ঠ শব্দ নিষ্পন্ন হইয়াছে। বহুর মধ্যে একের উৎকর্ষাতিশয় বোধন স্থলেই, ইষ্ঠ প্রত্যয় হইয়া থাকে। এস্থলে সবর্ণা ও অসবর্ণা এই দুই মাত্র পক্ষ প্রাপ্ত হইতেছে, বহু পক্ষের প্রাপ্তি ঘটিতেছে না; 'সুতরাং, প্রথম বিবাহে সবর্ণা শ্রেষ্ঠা, এ কথা বলিলে, সবর্ণা ও অসবর্ণা এ দুয়ের মধ্যে সবর্ণার উৎকর্ষাতিশয়ের প্রতীতি জন্মে; বহুর মধ্যে একের উৎকর্ষাতিশয়ের বোধন সম্ভবে না। কিন্তু, বহুর মধ্যে একের উৎকর্ষাতিশয়বোধনের স্থল ভিন্ন, শ্রেষ্ঠ শব্দ প্রযুক্ত হইতে পারে না। আর, যদিই কথঞ্চিৎ ঐ স্থলে শ্রেষ্ঠ শব্দের গতি লাগে; কিন্তু, “রতিকামনায় বিবাহপ্রবৃত্ত- দিগের পক্ষে, বক্ষ্যমাণ কন্যারা অনুলোম ক্রমে শ্রেষ্ঠা হইবেক," এ স্থলে শ্রেষ্ঠ শব্দের প্রয়োগ নিতান্ত অপপ্রয়োগ; কারণ, এখানে, বহুর বা দুয়ের মধ্যে, একের উৎকর্ষাতিশয়বোধনের কোনও সম্ভাবনা লক্ষিত হইতেছে না। পর বচনে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র চারি বর্ণের কন্যার উল্লেখ আছে; সুতরাং, পূর্বব বচনে, সামান্যাকারে, "বক্ষ্যমাণ ক্যারা" এরূপ নির্দেশ করিলে, কামার্থ বিবাহে, সবর্ণা, অসবর্ণা, উভয়বিধ কন্যাই অভিপ্রেত বলিয়া প্রতীয়মান হইবেক। কামার্থ বিবাহে বক্ষ্যমাণ কন্যা অর্থাৎ সরর্ণা ও অসবর্ণা শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্টা, এরূপ বলিলে, সবর্ণা ও অসবর্ণা ভিন্ন কামার্থ বিবাহের অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট স্থল অনেক আছে, ইহা অবশ্য বোধ হইবেক। কিন্তু, সবর্ণা ও অসবর্ণ। ভিন্ন অন্যবিধ বিবাহযোগ্য কন্যার অসম্ভাব বশতঃ, কামার্থ বিবাহের অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট স্থল ঘটিতে পারে না; এবং, তাদৃশ স্থল না ঘটিলেও, কামার্থ বিবাহে সবর্ণা ও অসবর্ণা সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্টা, এরূপ নির্দেশ হইতে পারে না। সুতরাং, বক্ষ্যমাণ কন্যারা, অর্থাৎ পর বচনে উল্লিখিত সবর্ণা ও অসবর্ণা, অনুলোম ক্রমে শ্রেষ্ঠা, অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্টা, এই ব্যাখ্যা নিতান্ত প্রামাদিক হইয়া উঠে। “ইমাঃ স্যুঃ ক্রমশো বরাঃ,” এ স্থলে "বরাঃ” এই পাঠ অবলম্বন করিলে, বক্ষ্যমাণ সবর্ণা ও অসবর্ণা কন্যারা, অনুলোম ক্রমে, শ্রেষ্ঠা হইবেক, এতদ্ভিন্ন অন্য ব্যাখ্যা সম্ভবে না। কিন্তু, যেরূপ দর্শিত হইল, তদনুসারে তাদৃশী ব্যাখ্যা, কোনও ক্রমে, সংলগ্ন হইতে পারে না। আর, "অবরাঃ” এই পাঠ অবলম্বন করিলে, বক্ষ্যমাণ হীনবর্ণা কন্যারা অর্থাৎ পর বচনে উল্লিখিত ক্ষত্রিয়া, 'বৈশ্যা, শূদ্রা, অনুলোম ক্রমে, ভার্য্যা হইবেক, এই ব্যাখ্যা প্রতিপন্ন হয়; এবং, এই ব্যাখ্যা যে সর্বাংশে নির্দোষ, সে বিষয়ে

অণুমাত্র সংশয় হইতে পারে না। কুল্লুকভট্টের উল্লিখিত ব্যাখ্যা অবলম্বন করিয়া, তর্কবাচ- স্পতি মহাশয় মনুবচনের যে ব‍্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা উদ্ধৃত হইতেছে;-

"অগ্রে স্বোক্তধৰ্ম্মরতিপুত্ররূপবিবাহফলত্রয়মধ্যে শ্রেষ্ঠে ধৰ্ম্মে ইত্যর্থঃ নিমিত্তার্থে সপ্তমী তথাচ ধর্ম্মনিমিত্তে দারকৰ্ম্মণি দারত্ব- সম্পাদকে সংস্কাররূপে ক্রিয়াকলাপে দ্বিজাতীনাং সবর্ণা প্রশস্তা মুনিভিবিহিতা তু পুনঃ কামতঃ রতিকামতঃ বহুপুত্রকামতশ্চ প্রবৃত্তানাং তছপায়সাধনার্থং যত্নবতাং 'দারকর্ম্মণীত্যনুষজ্যতে ইমাঃ বক্ষ্যমাণাঃ সবর্ণাদয়ঃ ক্রমশঃ বর্ণক্রমেণ বরাঃ বিহিতত্বেন শ্রেষ্ঠা: (১০) ।”

দ্বিজাতিদিগের ধর্মার্থ বিবাহে সুবর্ণা বিহিতা, কিন্তু যাহারা রতিকামনা ও বহুপুত্রকামনা বশতঃ বিবাহে যত্নবান হয়, তাহাদের পক্ষে বক্ষ্যমাণ সবর্ণা "প্রভৃতি কন্তা বর্ণ ক্রমে শ্রেষ্ঠা।

দৈববশাৎ, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের লেখনী হইতে, বচনের পূর্বার্দ্ধের প্রকৃত ব্যাখ্যা নির্গত হইয়াছে; যথা, "দ্বিজাতিদিগের ধর্মার্থ বিবাহে সবর্ণা বিহিতা”; কিন্তু, অবশিষ্ট ব্যাখ্যা কুল্লুক- ভট্টের ব্যাখ্যার ছায়াস্বরূপ; সুতরাং, কুল্লুকভট্টের ব্যাখ্যার ঐ অংশে যে দোষ দর্শিত হইয়াছে, তদীয় ব্যাখ্যাতে সেই দোষ সবতোভাবে বর্ত্তিতেছে। তর্কবাচস্পতি মহাশয়, প্রসিদ্ধ বৈয়া- করণ হইয়া, শ্রেষ্ঠ শব্দের প্রকৃত অর্থ অবগত নহেন, ইহা অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয়। তিনি বলিতে পারেন, আমি যেমন দেখিয়াছি, তেমনই লিখিয়াছি; কিন্তু, শাস্ত্রার্থ সংস্থাপনে প্রবৃত্ত হইয়া, “যথা দৃষ্টং তথা লিখিতম,” এ প্রণালী অবলম্বন করিয়া চলা, তাঁহার ন্যায় প্রসিদ্ধ পণ্ডিতের পক্ষে, প্রশংসার বিষয় নহে। যাহা হউক, পূর্বের যেরূপ দর্শিত হইয়াছে, তদনুসারে, "ক্রমশো বরাঃ” এ স্থলে "অবরাঃ” এই পাঠ প্রকৃত পাঠ, সে বিষয়ে আর সংশয় করা যাইতে পারে না। "অবরাঃ” এই পাঠ সত্ত্বে, রতিকামনায় বিবাহ করিতে ইচ্ছা হইলে, সবর্ণা ও অসবর্ণ উভয়বিধ কন্যা বিবাহ করিবেক, এ অর্থ কোনও মতে প্রতিপন্ন হইতে পারে না। অবর শব্দের অর্থ হীন, নিকৃষ্ট; বক্ষ্যমাণ অবরা কথ্যা বিবাহ করিবেক, এরূপ বলিলে, আপন অপেক্ষা নিকৃষ্ট বর্ণের কন্যা বিবাহ করিবেক, ইহাই প্রতীয়মান হয়। পর বচনে সবর্ণা ও অসবর্ণা উভয়বিধ ক্যার নির্দেশ আছে, যথার্থ বটে। কিন্তু, পূর্ব্ব বচনে, বক্ষ্যমাণ কন্যা বিবাহ করিবেক, যদি এরূপ সামান্যংকারে নির্দেশ থাকিত, তাহা হইলে, কথঞ্চিৎ, সবর্ণা ও অসবর্ণা উভয়বিধ কন্যার বিবাহ অভিপ্রেত বলিয়া প্রতিপন্ন হইতে পারিত। কিন্তু, যখন, বক্ষ্যমাণ অবরা কন্যা বিবাহ করিবেক, এরূপ বিশেষ নির্দেশ আছে; তখন, আপন অপেক্ষা নিকৃষ্ট বর্ণের কন্যা, অর্থাৎ অনুলোম ক্রমে অসবর্ণা, বিবাহ করিবেক, ইহাই প্রতিপন্ন হয়, এতদ্ভিন্ন অন্য কোনও অর্থ, কোনও ক্রমে, প্রতিপন্ন, হইতে পারে না। অতএব, রতিকামনায় বিবাহপ্রবৃত্ত ব্যক্তি সবর্ণা ও অসবর্ণা বিবাহ করিবেক, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের এই সিদ্ধান্ত নিতান্ত ভ্রান্তিমূলক। তিনি পাঠে ভুল করিয়াছেন; সুতরাং, অর্থে ভুল অপরিহার্য্য।

কিঞ্চ,

শূদ্রৈব ভাৰ্য্যা শূদ্র্য সাচ স্বাচ বিশঃ স্মৃতে।

তে চ স্বা চৈব রাজ্ঞঃ স্যুস্তাশ্চ স্বা চাগ্রজন্মনঃ ॥৩।১৩। (১১) শুদ্রের এক মাত্র শুদ্রা ভার্য্যা হইবেক বৈশ্যের শুদ্রা, বৈশ্বা; ক্ষত্রিয়ের শুদ্রা, বৈস্তা, ক্ষত্রিয়া, ব্রাহ্মণের শুদ্রা, বৈশ্যা, ক্ষত্রিয়া, ব্রাহ্মণী।

স্থিরচিত্ত হইয়া, কিঞ্চিৎ অভিনিবেশ সহকারে, আলোচনা করিয়া দেখিলে, সর্বশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহাশয়, অনায়াসেই, বুঝিতে পারিতেন, এই মনুবচন পূর্ব বচনে উল্লিখিত কামার্থ বিবাহের উপযোগিনী কন্যার পরিচায়ক' হইতে পারে না। পূর্ব্ব বচনের পূর্ববার্দ্ধে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, ত্রিবিধ দ্বিজাতির প্রথম বিবাহের উপযোগিনী কন্যার বিষয়ে ব্যবস্থা আছে; উত্তরার্দ্ধে, রতিকামনায় বিবাহপ্রবৃত্ত ঐ ত্রিবিধ দ্বিজাতির তাদৃশ বিবাহের উপযোগিনী কন্ঠায় বিষয়ে বিধি দেওয়া হইয়াছে। সুতরাং, সম্পূর্ণ বচন কেবল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, ত্রিবিধ দ্বিজাতির বিবাহবিষয়ক হইতেছে। পূর্ব বচনের উত্তরার্দ্ধে, যে বিবাহের বিধি আছে, যদি পর বচনকে ঐ বিবাহের উপযোগিনী কন্যার পরিচায়ক বল, তাহা হইলে, পর বচনে, "শূদ্রের এক মাত্র শূদ্রা ভাৰ্য্যা হইবেক,” এরূপ নির্দেশ থাকা কিরূপে সঙ্গত হইতে পারে; কারণ, যে বচনে কেবল দ্বিজাতির বিবাহের উপযোগিনী কন্যার নির্বচন হইতেছে, তাহাতে শূদ্রের বিবাহের উল্লেখ, কোনও মতে, সম্ভবিতে পারে না। অতএব, পর বচন পূর্ব্ব বচনে উল্লিখিত কামার্থ বিবাহের উপযোগিনী কন্যার পরিচায়ক নহে।

চারি বর্ণের বিবাহসমপ্তির নিরূপণ এই বচনের উদ্দেশ্য। ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী, ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা, শূদ্রা; ক্ষত্রিয় ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা, শূদ্রা; বৈশ্য বৈশ্যা, "শূদ্রা; শুদ্র এক মাত্র শূদ্রা বিবাহ করিতে পারে; ইহাই এই বচনের অর্থ ও তাৎপর্য্য। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, কোন অবস্থায়, যথাক্রমে, চারি, তিন, দুই বর্ণে বিবাহ করিতে পারে, তাহা পূর্ব বচনে, ব্যবস্থাপিত হইয়াছে; অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ, ধৰ্ম্মকার্য্য সম্পাদনের নিমিত্ত, প্রথমে সবর্ণা, অর্থাৎ ব্রাহ্মণকন্যা, বিবাহ করিবেক; পরে, রতিকামনায় পুনরায় বিবাহ করিতে ইচ্ছা হইলে, অসবর্ণা, অর্থাৎ ক্ষত্রিয়াদি কন্যা, বিবাহ করিতে পারিবেক। ক্ষত্রিয়, ধর্ম্মকার্য্য সম্পাদনের নিমিত্ত, প্রথমে সবর্ণা, অর্থাৎ ক্ষত্রিয়কন্যা, বিবাহ করিবেক; পরে, রতিকামনায় পুনরায় বিবাহ করিতে ইচ্ছা হইলে, অসবর্ণা, অর্থাৎ বৈশ্যাদি কন্যা, বিবাহ করিতে পারিবেক। বৈশ্য, ধর্ম্মকার্য্য সম্পাদনের নিমিত্ত, প্রথমে সবর্ণা, অর্থাৎ বৈশ্যকন্যা, বিবাহ করিবেক; পরে, রতিকামনায় 'পুনরায়, বিবাহ করিতে ইচ্ছা হইলে, অসবর্ণা, অর্থাৎ শুদ্রকন্যা, বিবাহ করিতে পারিবেক। অতএব, ধৰ্ম্মার্থে সবর্ণাবিবাহ, কামার্থে অসবর্ণাবিবাহ, শাস্ত্রকার- দিগের অভিপ্রেত, তাহার কোনও সংশয় নাই।

এই সিদ্ধান্ত প্রাচীন ও চিরপ্রচলিত সিদ্ধান্ত, কিংবা আমার কপোলকল্পিত অথবা, লোকবি মোহনের নিমিত্ত, বুদ্ধিবলে উদ্ভাবিত অভিনব সিদ্ধান্ত, এই সংশয়ের নিরসনবাসনায়, পূর্ব্বতন, গ্রন্থ- কর্ত্তাদিগের মীমাংসা উদ্ধৃত হইতেছে;-

মাধবাচার্য্য কহিয়াছেন,

"লক্ষণ্যাং স্ত্রিয়মুদ্ধহেদিত্যুক্তং তত্রোছহনীয়া কন্যা দ্বিবিধা সবর্ণা চাসবর্ণা চ তয়োরাস্তা প্রশস্তা তদাহ মনুঃ

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণি।

কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ শ্যুঃ ক্রমশোহবরাঃ ॥ অগ্রে স্নাতকস্থ্য প্রথমবিবাহে দারকর্ম্মণি অগ্নিহোত্রাদৌ ধর্ম্মে সবর্ণা বরেণ সমানো বর্ণো ব্রাহ্মণাদির্যস্তাঃ সা যথা ব্রাহ্মণ্য ব্রাহ্মণী ক্ষত্রিয়ন্ত ক্ষত্রিয়া বৈশ্যস্ত বৈশ্যা প্রশস্তা ধৰ্ম্মার্থমাদৌ সবর্ণামূঢ়া পশ্চাৎ রিরংসবশ্চেৎ তদা তেষাম্ অবরাঃ হীনবর্ণাঃ ইমাঃ ক্ষত্রিয়াস্তাঃ ক্রমেণ ভার্য্যাঃ স্ন্যঃ" (১২)। স্বলক্ষণ। ক্যা বিবাহ করিবেক, ইহা পূর্ব্বে উক্ত হইয়াছে। বিবাহযোগ্যা কন্যা দ্বিবিধা, সবর্ণা ও অসবর্ণা; তাহার মধ্যে, সবর্ণা প্রশস্তা; যথা, মনু কহিয়াছেন, "অগ্নিহোত্রাদি ধৰ্ম্ম সম্পাদনের নিমিত্ত, স্নাতকের প্রথম বিবাহে সবর্ণা অর্থাৎ বরের সজাতীয়া কন্যা প্রশস্তা, যেমন ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণী, ক্ষত্রিয়ের ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যের বৈস্তা। দ্বিজাতিরা, ধর্ম্পকার্য্যসম্পাদনের নিমিত্ত, অগ্রে সবর্ণা বিবাহ করিয়া, পশ্চাৎ যদি রিরংক্স হয়, অর্থাৎ রতিকামনা পূর্ণ করিতে চাহে তবে অবরা অর্থাৎ হীনবর্ণা বক্ষমোণ, ক্ষত্রিয়া, বৈস্তা, শূদ্রা অনুলোম ক্রমে তাহাদের ভার্য্যা হইবেক।

মিত্রমিশ্র কহিয়াছেন, "অতএব মনুনা

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণি। কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশোহবরা ইতি। কামতঃ ইতি অবরাঃ ইতি চ বদতা সবর্ণাপরিণয়নমেব মুখ্যমিত্যুক্তম্ (১৩)।"

দ্বিজাতিদিগের ধর্মার্থ বিবাছে সবর্ণা বিহিতা; কিন্তু যাহারা কামতঃ, অর্থাৎ কামবশতঃ, বিবাহ করিতে প্রবৃত্ত হয়, বক্ষ্যমাণ অবরা, অনুলোম ক্রমে, তাহাদের ভার্য্যা হইবেক। এ স্থলে মনু "কামতঃ" ও "অবরাঃ" এই দুই কথা বলাতে, অর্থাৎ কামনিবন্ধন বিবাহস্থলে অসবর্ণা বিবাহের বিধি দেওয়াতে, সবর্ণাপরিণয় মুখ্য বিবাহ, ইহাই উক্ত হইয়াছে।

বিশ্বেশ্বরভট্ট কহিয়াছেন,

"অনুলোমক্রমেণ দ্বিজাতীনাং সবর্ণাপাণিগ্রহণসমনন্তরং ক্ষত্রিয়াদিক্যাপরিণয়ো বিহিতঃ তত্র চ সবর্ণাবিবাহো মুখ্যঃ ইতরস্বমুকল্পঃ (১৪)।

দ্বিজাতিদিগের সবর্ণাপাণিগ্রহণের পর, অনুলোম ক্রমে, ক্ষত্রিয়াদিকন্তাপরিণয় বিহ্নিত হইয়াছে; তন্মধ্যে, সবর্ণাবিবাহ মুখ্য কল্প, অসবর্ণাবিবাহ অনুকল্প।

এইরূপে, সবর্ণাপরিণয় বিবাহের মুখ্য কল্প, অসবর্ণাপরিণয় বিবাহের অনুকল্প, এই ব্যবস্থা করিয়া, বিশ্বেশ্বরভট্ট অনুকল্পের স্থল দেখাইতেছেন,

"অর্থ দারামুকল্পঃ। তত্র মনুঃ সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণি। কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশোহবরাঃ ॥ অবরাঃ জঘন্যাঃ (১৫)।

অতঃপর বিবাহের অনুকল্পপক্ষ কথিত হইতেছে। সে বিষয়ে মনু কহিয়াছেন, দ্বিজাতিদিগের ধর্মার্থ বিবাহে সবর্ণা বিহিতা কিন্তু, যাহারা কামতঃ, অর্থাৎ কাম বশতঃ, বিবাহ করিতে প্রবৃত্ত হয়, বক্ষ্যমাণ অবরা, অনুলোম ক্রমে, তাহাদের ভার্য্যা হইবেক। অবরা অর্থাৎ হীনবর্ণা ক্ষত্রিয়াদিকন্যা।

এক্ষণে সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, ধৰ্ম্মার্থে সবর্ণ্যবিবাহ ও কামার্থে অসবর্ণাবিবাহ শাস্ত্রকারদিগের অভিপ্রেত, মাধবাচার্য্য, মিত্রমিশ্র, ও বিশ্বেশ্বরভট্ট এই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন কি না। অধুনা, বোধ করি, সর্বশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহাশয়ও অঙ্গীকার করিতে পারেন, এই সিদ্ধান্ত প্রাচীন ও চিরপ্রচলিত সিদ্ধান্ত, আমার কপোলকল্পিত,' অথবা লোকবিমোহনের 'নিমিও বুদ্ধিবলে উদ্ভাবিত, অভিনব সিদ্ধান্ত নহে।

ধৰ্ম্মার্থে সবর্ণাবিবাহ বিহিত, আর কামার্থে অসবর্ণাবিবাহ অনুমোদিত, শাস্ত্রান্তরেও তাহার অসন্দিগ্ধ প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। যথা,

সবর্ণা যস্য যা ভাৰ্য্যা ধৰ্ম্মপত্নী হি সা স্মৃতা।

অসবর্ণা তু যা ভার্য্যা কামপত্নী হি সা স্মৃতা (১৬) ॥০

যাহার যে সবর্ণা ভার্য্যা, তাহাকে ধর্মপত্নী বলে; আর, যাহার যে অসবর্ণা ভাৰ্য্যা, তাহাকে কামপত্নী বলে।

এই শাস্ত্র অনুসারে, ধর্ম্মকার্য্য সম্পাদনের নিমিত্ত, বিবাহিতা সবর্ণা স্ত্রী ধৰ্ম্মপত্নী; আর, কামোপশমনের নিমিত্ত, বিবাহিতা অসবর্ণা স্ত্রী কামপত্নী। অতঃপর, ধর্ম্মার্থে সবর্ণাবিবাহ ও কামার্থে অল্পবর্ণাবিবাহ শাস্ত্রকারদিগের সম্পূর্ণ অভিমত, এ বিষয়ে আর সংশয় থাকা উচিত নহে।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

অসবর্ণাবিবাহবিধায়ক মনুবচনের প্রকৃত পাঠ ও প্রকৃত অর্থ আলোচিত হইল; এক্ষণে, অসবর্ণাবিবাহবিধির পরিসংখ্যাত্ব সম্ভব ও সঙ্গত কি না, তাহা আলোচিত হইতেছে। প্রথম পুস্তকে বিধিত্রয়ের যে সংক্ষিপ্ত পরিচয় প্রদত্ত হইয়াছে, পাঠক- বর্গের সুবিধার জন্য, তাহা উদ্ধৃত হইতেছে;-

"রিধি ত্রিবিধ অপূর্ব্ববিধি, নিয়মবিধি ও পরিসংখ্যাবিধি। বিধি ব্যতিরেকে যে স্থলে কোনও রূপে প্রবৃত্তি সম্ভবে না, তাহাকে অপূর্ব্ববিধি' কহে; যেমন, "স্বর্গকামো যজেত,” স্বর্গকামদায় যাগ করিবেক। এই বিধি না থাকিলে, লোকে, স্বর্গলাভ- বাসনায়, কদাচ যাগে প্রবৃত্ত হইত না; কারণ, যাগ করিলে স্বর্গলাভ হয়, ইহা প্রমাণান্তর দ্বারা, প্রাপ্ত নহে। যে বিধি দ্বারা কোনও বিষয় নিয়মবন্ধ করা যায়, তাহাকে নিয়মবিধি বলে; যেমন, "সমে যজেত," সম 'দেশে যাগ করিবেক। লোকের" পক্ষে যাগ করিবার বিধি আছে; সেই যাগ, কোনও স্থানে অবস্থিত হইয়া, করিতে হইবেক লোকে, ইচ্ছানুসারে, সমান, অসমান, উভয়বিধ স্থানেই যাগ করিতে পারিত; কিন্তু, "সমে যজেত" এই বিধি দ্বারা, সমান স্থানে যাগ, করিবেক, ইহা নিয়মবদ্ধ হইল। যে বিধি দ্বারা বিহিত বিষয়ের অতিরিক্ত স্থলে নিষেধ সিদ্ধ হয়, এবং, বিহিত স্থলে, বিধি অনুযায়ী কার্য্য করা সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন থাকে, তাহাকে পরিসংখ্যাবিধি বলে; যেমন, "পঞ্চ পঞ্চনথা ভক্ষ্যাঃ” পাঁচটি পঞ্চনখ ভক্ষণীয়। লোকে, যদৃচ্ছাক্রমে, যাবতীয় পঞ্চনথ জন্তু ভক্ষণ করিতে পারিত; কিন্তু, "পঞ্চ পঞ্চনখা ভক্ষ্যাঃ," এই বিধি দ্বারা, বিহিত শশ প্রভৃতি পঞ্চ ব্যতিরিক্ত, কুক্কুরাদি যাবতীয় পঞ্চনথ জন্তুর ভক্ষণনিষেধ সিদ্ধ হইতেছে। অর্থাৎ, লোকের পঞ্চনথ জন্তুর মাংসভক্ষণে প্রবৃত্তি হইলে, শশ প্রভৃতি পঞ্চ ব্যতিরিক্ত পঞ্চনথ জন্তুর মাংস- ভক্ষণ করিতে পারিবেক না; শশ প্রভৃতি পঞ্চনখ জন্তুর মাংস- ভক্ষণও লোকের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন; ইচ্ছা হয়, ভক্ষণ করিবেক। ইচ্ছা না হয়, ভক্ষণ করিবেক না। সেইরূপ, যদৃচ্ছাক্রমে অধিক বিবাহে উদ্বঘত পুরুষ সবর্ণা অসবর্ণা উভয়বিধ স্ত্রীরই পাণিগ্রহণ করিতে পারিত। কিন্তু, যদৃচ্ছাক্রমে বিবাহে প্রবৃত্ত হইলে, অসবর্ণাবিবাহ করিবেক, এই বিধি প্রদর্শিত হওয়াতে, যদৃচ্ছাস্থলে, অসবর্ণা ব্যতিরিক্ত স্ত্রীর বিবাহনিষেধ সিদ্ধ হইতেছে। অসবর্ণা- বিবাহও লোকের ইচ্ছাধীন; ইচ্ছা হয়, তাদৃশ বিল্লাহ করিবেক; ইচ্ছা না হয় করিবেক না; কিন্তু, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত হইয়া বিবাহ করিতে হইলে, অসবর্ণা ব্যতিরিক্ত বিবাহ করিতে পারিবেক না; ইহাই বিবাহবিষয়ক চতুর্থ বিধির উদ্দেশ্য। এই বিবাহ- বিধিকে অপূর্ব্ববিধি বলা যাইতে পারে না; কারণ, ঈদৃশ বিবাহ রাগপ্রাপ্ত, অর্থাৎ লোকের ইচ্ছা বশতঃ প্রাপ্ত হইতেছে; যাহা কোনও রূপে প্রাপ্ত নহে, তদ্বিষয়ক বিধিকেই অপূর্ব্ববিধি বলে। এই বিবাহবিধিকে নিয়মবিধি বলা যাইতে পারে না; কারণ, ইহা দ্বারা অসবর্ণাবিবাহ, অবশ্যকর্তব্য বলিয়া, নিয়মবন্ধ হইতেছে না। সুতরাং, এই বিবাহবিধিকে, অগত্যা, পরিসংখ্যা- • বিধি বলিয়া অঙ্গীকার করিতে হইবেক (১৭)।"

যে কারণে অসবর্ণাবিবাহবিধির পরিসংখ্যাত্ব স্বীকায় করিতে হয়, তাহা উপরি উদ্ধৃত অংশে বিশদ রূপে প্রতিপাদিত হইয়াছে এজন্য, এস্থলে এ বিষয়ে আর অধিক বলা নিষ্প্রয়োজন। এক্ষণে তর্কবাচস্পতি মহাশয় যে সকল আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন তাহার আলোচনা করা আবশ্যক।

তাঁহার প্রথম আপত্তি এই';

"মানববচনস্ত যৎ পরিসংখ্যাপরত্বং কন্নাতে তৎ কন্স হোতোঃ? ন তাবৎ তন্ত্য পরিসংখ্যাকল্পকং কিঞ্চিৎ বচনান্তরমস্তি, নাপি যুক্তিঃ, নবা প্রাচীনসন্দর্ভসম্মতিঃ ।. তথাচ অসতি পরিসংখ্যা- কল্পকযুক্ত্যাদৌ দোষত্রয়গ্রস্তাং পরিসংখ্যাং স্বীকৃত্য, মানববচনস্ত যৎ দোষত্রয়কলঙ্কপঙ্কে নিক্ষেপণং কৃতং তং কেবলং স্বাভীষ্ট- সিদ্ধিমনীয়ৈব। পরিসংখ্যায়াং হি

শ্রুতার্থস্য পরিত্যাগাদশ্রুতার্থ্য কল্পনাৎ। প্রাপ্তস্থ্য বাধাদিত্যেবং পরিসংখ্যা ত্রিদোষিক। ইতি ।

শ্রুতার্থত্যাগাশ্রুতার্থকল্পনপ্রাপ্তবাধরূপং মীমাংসাশাস্ত্রসিদ্ধং দোষ- ত্রয়ং স্বীকাৰ্য্যং তস্ত চ সতি গত্যন্তস্তরে নৈবাঙ্গীকার্য্যতা (১৮)।"

মনুবচনে যে বিবাহবিধি আছে, উহার যে পরিসংখ্যাত্ব কল্পিত হইতেছে, তাহার হেতু কি। ঐ বিবাহবিধির পরিসংখ্যাত্বকল্পনার প্রমাণস্বরূপ বচনান্তর নাই, যুক্তিও নাই, এবং প্রাচীন গ্রন্থের সম্মতিও নাই। এইরূপ প্রমাণবিরহে, ত্রিদোযগ্রস্ত। পরিসংখ্যা স্বীকার করিয়া, মনুবচনকে যে দোষত্রয়রূপ কলঙ্কপঙ্কে নিক্ষিপ্ত করিয়াছেন, কেবল স্বীয় অভীষ্টসিদ্ধিচেষ্টাই তাহার মূল। পরিসংখ্যাতে শ্রুত অর্থের ত্যাগ, অশ্রুত অর্থের কল্পনা, প্রাপ্ত বিষয়ের বাধ, মীমাংসাশাস্ত্র- সিদ্ধ এই দোষত্রয় স্বীকার করিতে হয়; এজন্য, গত্যন্তরসত্বে পরিসংখ্যা, কোনও মতে, স্বীকার করা যায় না।

মীমাংসকেরা পরিসংখ্যাবিধির যে লক্ষণ নিদ্দিষ্ট করিয়াছেন, যে বিধি সেই লক্ষণে আক্রান্ত হয়, তাহা পরিসংখ্যা বিধি বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে। প্রথম পুস্তকে দর্শিত হইয়াছে, মনুর অসবর্ণাবিবাহবিধি পরিসংখ্যাবিধির সম্পূর্ণ লক্ষণাক্রান্ত। কামার্থে অসবর্ণাবিবাহ রাগপ্রাপ্ত বিবাহ। রাগপ্রাপ্ত বিষয়ে বিধি থাকিলে, বিহিত বিষয়ের' অতিরিক্ত স্থলে নিষেধ বোধনের নিমিত্ত, ঐ বিধির পরিসংখ্যাত্ব অঙ্গীকৃত হইয়া থাকে। সুতরাং, রাগপ্রাপ্ত অসবর্ণাবিবাহ বিষয়ক বিধির পরিসংখ্যাত্ব অপরিহার্য্য ও অবশ্যস্বীকার্য্য হইতেছে; তাহা সিদ্ধ করিবার জন্য অন্যবিধ প্রমাণের অণুমাত্র আবশ্যকতা নাই। "পঞ্চ পঞ্চনথা ভক্ষ্যাঃ” পাঁচটি পঞ্চনখ ভক্ষণীয়, এই বাক্যে পঞ্চনখ ভক্ষণ শ্রুত হইতেছে; কিন্তু, গ্লঞ্চনখের ভক্ষণবিধান এই বাক্যের অভিপ্রেত না হওয়াতে, শ্রুত অর্থের পরিত্যাগ ঘটিতেছে। এই বাক্য দ্বারা, শশ প্রভৃতি পঞ্চ ব্যতিরিক্ত পঞ্চনখের ভক্ষণনিষেধ প্রতিপাদিত হওয়াতে, অশ্রুত অর্থের কল্পনা হইতেছে। আর, রাগপ্রাপ্ত শশ প্রভৃতি পঞ্চ ব্যতিরিক্ত পঞ্চনখ ভক্ষণের বাধ জন্মিতেছে। অর্থাৎ, পঞ্চ- নখভক্ষণরূপ যে অর্থ বিধিবাক্যের অন্তর্গত শব্দ দ্বারা প্রতিপন্ন হয়, তাহা পরিত্যক্ত হইতেছে; শশ প্রভৃতি পঞ্চ ব্যতিরিক্ত পঞ্চনখভক্ষণের নিষেধরূপ যে অর্থ বিধিবাক্যের অন্তর্গত শব্দ দ্বারা প্রতিপন্ন হয় না, তাহা কল্পিত হইতেছে; আর, ইচ্ছা বশতঃ, শশ প্রভৃতি পঞ্চ পঞ্চনখের ন্যায়, তদ্ব্যতিরিক্ত পঞ্চনখের ভক্ষণরূপ যে বিষয় প্রাপ্ত হইয়াছিল, তাহার বাধ ঘটিতেছে। এই রূপে, পরিসংখ্যাবিধিতে দোষত্রয়স্পর্শ অপরিহার্য্য; এজন্য, গত্যন্তর সন্তুবিলে, পরিসংখ্যা স্বীকার করা যায় না। প্রথম পুস্তকে প্রতিপাদিত হইয়াছে, গত্যন্তর না থাকাতেই, অর্থাৎ অপূর্ব্ববিধি ও নিয়মবিধির স্থল না হওয়াতেই, অসবর্ণাবিবাহ- বিধির পরিসংখ্যাত্ব 'ব্যবস্থাপিত হইয়াছে। ফলতঃ, পরিসংখ্যার প্রকৃত স্থল বলিয়া বোধ হওয়াতেই, আমি এই বিধির পরিসংখ্যাত্ব স্বীকার করিয়াছি; স্বীয় অভীষ্টসিদ্ধির নিমিত্ত, কষ্টকল্পনা বা কৌশল অবলম্বন পূর্ব্বক, পরিসংখ্যাত্ব কল্পনা করিয়া, মনুবচনকে অকারণে দোষত্রয়রূপ কলঙ্কপঙ্কে নিক্ষিপ্ত করি নাই।

তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের দ্বিতীয় আপত্তি এই;- "কিঞ্চ, বিবাহ্য রাগপ্রাপ্তত্বাঙ্গীকারে প্রথমবিবাহস্তাপি রাগপ্রাপ্ততয়া সবর্ণাং স্ত্রিয়মুদ্ধহেদিত্যাদিমনুবচনস্লাপি পরি- সংখ্যাপরত্বাপত্তিদুর্ব্বারৈব।' স্বীকৃতঞ্চ বিষ্ফাসাগরেণাপ্যন্ত বাক্যস্তোৎপত্তিবিধিত্বম্ অতঃ স্বোক্তবিরুদ্ধতয়া প্রত্যবস্থানে ত্য বিমৃশ্যকারিতা কথঙ্কারং তিষ্ঠেৎ। যথাচ বিবাহ্য অলৌ- কিকসংস্কারাপাদকত্বেন ন রাগপ্রাপ্তত্বং তথা প্রতিপাদিতং পুরস্তাৎ (১৯)।"

কিন্তু, বিবাহের রাগপ্রাপ্তত্ব অঙ্গীকার করিলে, প্রথম বিবাহেরও রাগপ্রাপ্তত্ব ঘটে; এবং, তাহা হইলে, সবর্ণা স্ত্রীর গাশিগ্রহণ করিবেক, ইত্যাদি মনুবচনেরও, পরিসংখ্যা পরহঘটনা দুর্নিবার হইয়া উঠে। বিদ্যাসাগরও, এই মনুবাক্য অপূর্ব্ব- বিধির স্থল বলিয়া, অঙ্গীকার করিয়াছেন; এক্ষণে স্বোক্তবিরুদ্ধ নির্দেশ করিলে, কিরূপে তাঁহার বিমৃশ্যকারিতা থাকিতে পারে। বিবাহ অলৌকিকসংস্কার- সম্পাদক। এজন্য, উহার রাগপ্রাপ্তত্ব ঘটিতে পারে না, তাহা পুর্ব্বে প্রতিপাদিত হইয়াছে।

বিবাহের রাগপ্রাপ্ত স্বীকার করিলে,

গুরুণানুমতঃ স্নাত্মা সমাবৃত্তো যথাবিধি।

উদ্বহেত দ্বিজো ভার্য্যাং সবর্ণাং লক্ষণান্বিতাম্ ॥৩॥ ৪।

দ্বিজ, গুরুর অনুজ্ঞালাভান্তে, যথা বিধানে স্নান ও সমাবর্তন করিয়া, সজাতীয়া সুলক্ষণা কস্তার পাণিগ্রহণ করিবেক।

এই মনুবচনে প্রথম অর্থাৎ ধৰ্ম্মার্থ বিবাহের যে বিধি আছে, তাহারও পরিসংখ্যাত্ব অনিবার্য্য হইয়া পড়ে; এমন স্থলে,

• সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণি।

কামতত্ত্ব প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশোহবরাঃ । ৩। ১২। "দ্বিজাতিদিগের প্রথম বিবাহে সবর্ণা কন্ঠা বিহিতা; কিন্তু, যাহারা, কাম বশতঃ, বিবাহে প্রবৃত্ত হয়, তাহারা, অনুলোম ক্রমে অসবর্ণা বিবাহ করিবেক।

এই মনুবচনে কামার্থ বিবাহের যে বিধি আছে, তাহার পরি- সংখ্যাত্বপরিহার সুদূরপরাহত। অতএব, বিবাহের রাগপ্রাপ্তত্ব স্বীকার করা পরামর্শসিদ্ধ নহে। ভাদৃশ স্বীকারে একবার আবদ্ধ হইলে, আর কোনও মতে অসবর্ণাবিবাহবিধির পরিসংখ্যাত্ব নিবারণ করিতে পারিবেন না; এই ভয়ে, পূর্বাপরপৰ্য্যালোচনা- পরিশূন্য হইয়া, তর্কবাচস্পতি মহাশয় বিবাহ মাত্রের রাগপ্রাপ্তত্ব অপলাপ করাই শ্রেয়ঃকল্প বিবেচনা করিয়াছেন। কিন্তু, আক্ষেপের বিষয় এই, অপলাপে প্রবৃত্ত হইয়া, কৃতকার্য্য হইতে পারিবেন, তাহার পথ রাখেন নাই। তিনি কহিতেছেন, "বিবাহ অলৌকিক- সংস্কারসম্পাদক; এজন্য, উহার রাগপ্রাপ্তত্ব ঘটিতে পারে না, তাহা পূর্ব্বে প্রতিপাদিত হইয়াছে”। পূর্ব্বে কিরূপে তাহা প্রতিপাদিত হইয়াছে, তৎপ্রদর্শনার্থ তদীয় পূর্ব লিখন উদ্ধৃত হইতেছে,-

“কিঞ্চ, অবিপ্লুতব্রহ্মচর্য্যো যমিচ্ছেন্তু তমাবসেৎ। ইতি মিতাক্ষরাধৃতবাক্যাৎ ব্রহ্মচর্য্যাতিরিক্তাশ্রমমাত্রম্ভৈব রাগপ্রযুক্ত- ত্বাৎ গৃহস্থাশ্রমস্তাপি রাগপ্রযুক্ততয়া তদধীনপ্রবৃত্তিকবিবাহ- স্তাপি রাগপ্রযুক্তত্বেন কাম্যত্বস্তৈবোচিতত্বাৎ (২০)।"

কিঞ্চ, যথাবিধানে ব্রহ্মচর্য্য নির্ব্বাহ করিয়া, যে আশ্রমে ইচ্ছা হয়, সেই আশ্রম অবলম্বন করিবেক; মিতাক্ষরাধৃত এই বচন অনুসারে, ব্রহ্মচর্য্য ব্যতিরিক্ত আশ্রমমাত্রই রাগপ্রাপ্ত; মুতরাং, গৃহস্থাশ্রমও রাগপ্রাপ্ত; গৃহস্থাশ্রমের রাগ- প্রাপ্ততা বশতঃ, গৃহস্থাশ্রম প্রবেশমূলক বিবাহও রাগপ্রাপ্ত; হুতরাং উহা কাম্য বলিয়াই পরিগণিত হওয়া উচিত।

ইচ্ছাময় তর্কবাচস্পতি মহাশয়, যখন যাহা ইচ্ছা হয়, তাহাই বলেন। তদীয় পূর্ব্ব লিখন দ্বারা, "বিবাহের রাগপ্রাপ্তত্ব" প্রতিপাদিত হইতেছে, অথবা "বিবাহের রাগপ্রাপ্তত্ব ঘটিতে পারে না,” তাহা প্রতিপাদিত হইতেছে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখিবেন। সে যাহা হউক, আমি তদীয় যথেচ্ছচার দর্শনে হতবুদ্ধি হইয়াছি। তিনি পূর্বের, দৃঢ় বাক্যে, "বিবাহ রাগপ্রাপ্ত," ইহা প্রতিপন্ন করিয়া আসিয়াছেন; এক্ষণে অনায়াসে, তুল্যরূপ দৃঢ় বাক্যে, "বিবাহ রাগপ্রাপ্ত নহে," ইহা প্রতিপন্ন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন।

বিতণ্ডাপিশাচী স্কন্ধে আরোহণ করিলে, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের দিগ্বিদিক জ্ঞান থাকে না। পূর্বের, যখন ধর্মার্থ বিবাহের নিত্যত্ব খণ্ডন করা আবশ্যক হইয়াছিল, তখন তিনি, বিবাহ মাত্রের রাগপ্রাপ্তত্ব প্রতিপাদনের নিমিত্ত, প্রয়াস পাইয়াছেন; কারণ, তখন বিবাহ মাত্রের রাগপ্রাপ্তত্ব স্বীকার না করিলে, ধর্মার্থ বিবাহের নিত্যত্ব খণ্ডন সম্পন্ন হয় না। এক্ষণে, কামার্থ বিবাহবিধির পরিসংখ্যাত্ব খণ্ডন করা আবশ্যক হইয়াছে; সুতরাং, বিবাহ মাত্রের রাগপ্রাপ্তত্ব খণ্ডনের নিমিত্ত প্রয়াস পাইতেছেন; কারণ, এখন বিবাহ মাত্রের রাগপ্রাপ্তত্ব অস্বীকার না করিলে, কামার্থ বিবাহবিধির পরিসংখ্যাত্ব খণ্ডন সম্পন্ন হয় না। এক্ষণে, সকলে নিরপেক্ষ হইয়া বলুন, এরূপ পরস্পর বিরুদ্ধ লিখন কেহ কখনও এক লেখনীর মুখ হইতে নির্গত হইতে দেখিয়াছেন কি না। পূর্বে দর্শিত হইয়াছে, তর্কবাচস্পতি মহাশয় গ্রন্থারস্তে প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন "যাঁহারা ধর্ম্মের তত্ত্বজ্ঞান লাভে অভিলাষী, তাঁহাদের বোধ জন্মাইবার নিমিত্তই আমার যত্ন". (২১)। অধুনা, ধর্ম্মের তত্ত্বজ্ঞান লাভে অভিলাষীরা, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের পূর্বব লিখনে আস্থা ও শ্রদ্ধা করিয়া, "বিবাহ মাত্রই রাগপ্রাপ্ত,” এই ব্যবস্থা শিরোধার্য্য করিয়া, লইবেন; অথবা, তদীয় শেষ লিখনে আস্থা ও শ্রদ্ধা করিয়া, "বিবাহ মাত্রই রাগপ্রাপ্ত নয়,” এই ব্যবস্থা শিরোধার্য্য করিবেন, ধর্ম্মোপদেষ্টা তর্কবাচস্পতি মহাশয় সে বিষয়ে তাঁহাদের সন্দেহ ভঞ্জন করিয়া দিবেন। আমায় জিজ্ঞাসা করিলে, আমি তৎক্ষণাৎ, অসঙ্কুচিত চিত্তে, এই উত্তর দিব, উভয় ব্যবস্থাই শিরোধার্য্য করা উচিত ও আবশ্যক। মনু কহিয়াছেন,

শ্রুতিদ্বৈধন্ত যত্র স্যাত্তত্র ধর্মাবুভৌ স্মৃতৌ। ২। ১৪।

যে স্থলে শ্রুতিদ্বয়ের বিরোধ ঘটে, তথায় উভয়ই ধৰ্ম্ম বলিয়া ব্যবস্থাপিত।

উভয়ই বেদবাক্য, সুতরাং উভয়ই সমান মাননীয়। বেদবাক্যের পরস্পর বিরোধ স্থলে, বিকল্প ব্যবস্থা অবলম্বন না করিলে,. বেদের মানরক্ষা হয় না। সেইরূপ, এই উভয় ব্যবস্থাই এক লেখনী হইতে নির্গত, সুতরাং উভয়ই সমান মাননীয়। বিকল্প- ব্যবস্থা অবলম্বন পূর্বক, উভয় ব্যবস্থা শিরোধার্য্য করিয়া না লইলে, সর্বশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের মানরক্ষা হয় না।

তিনি কহিয়াছেন,

"বিস্তাসাগরও, এই মনুবাক্য অপূর্ব্ববিধির স্থল বলিয়া, অঙ্গীকার করিয়াছেন; এক্ষণে স্বোক্তবিরুদ্ধ নির্দেশ করিলে, কিরূপে তাঁহার বিমৃশ্যকারিতা থাকিতে পারে।”

এস্থলে বক্তব্য এই যে, উল্লিখিত মনুবচনে ধর্ম্মার্থ বিবাহের যে বিধি আছে, পূর্ব্বে আমি ঐ বিধিকে অপূর্ববিধি, ও ঐ বিধি অনুযায়ী বিবাহকে নিত্য বিবাহ বলিয়া অঙ্গীকার করিয়াছি, এবং এক্ষণেও করিতেছি। তখনও, ঐ বিধি অনুযায়ী বিবাহকে রাগপ্রাপ্ত বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত প্রয়াস পাই নাই; এখনও, ঐ বিধি অনুযায়ী বিবাহকে রাগপ্রাপ্ত বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে প্রবৃত্ত নহি। আর, মনুর রচনান্তরে কামার্থ বিবাহের যে বিধি আছে, পূর্ব্বে ঐ বিধিকে পরিসংখ্যাবি?ি, ও ঐ বিধি অনুযায়ী বিবাহকে রাগপ্রাপ্ত বিবাহ, বলিয়া অঙ্গীকার করিয়াছি, এবং এক্ষণেও করিতেছি। তখনও, ঐ বিধি অনুযায়ী বিবাহ রাগপ্রাপ্ত নহে, ইহা প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত প্রয়াস পাই নাই; এখনও, ঐ বিধি অনুযায়ী বিবাহ রাগপ্রাপ্ত নহে, ইহা প্রতিপন্ন করিতে প্রবৃত্ত নহি। সুতরাং, এ উপলক্ষে আমার বিমৃশ্যকারিতা ব্যাঘাতের কোনও আশঙ্কা বা সম্ভাবনা লক্ষিত হইতেছে না। তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের অন্তঃকরণে অকস্মাৎ ঈদৃশী আশঙ্কা উপস্থিত হইল কেন, বুঝিতে পারিতেছি না। যাহা হউক, আশ্চর্য্যের অথবা কৌতুকের বিষয় এই, তর্ক- বাচস্পতি মহাশয় অন্যের বিমৃশ্যকারিতা রক্ষার নিমিত্ত ব্যস্ত হইয়াছেন; কিন্তু নিজের বিমৃশ্যকারিতা রক্ষা পক্ষে ভ্রূক্ষেপ মাত্র নাই।

যাহা দর্শিত হইল, তদনুসারে তর্কবাচস্পতি মহাশয় "পূর্বের স্বীকার করিয়াছেন, বিষাহ মাত্রই রাগপ্রাপ্ত; সুতরাং, কামার্থ বিবাহেরও রাগপ্রাপ্তত্ব স্বীকার করা হইয়াছে। পরে স্বীকার করিয়াছেন, বিবাহের রাগপ্রাপ্তত্ব স্বীকার করিলে, বিবাহবিধির পরিসংখ্যাত্ব স্বীকার অপরিহার্য্য; সুতরাং, পূর্বস্বীকৃত রাগপ্রাপ্ত কামার্থ বিবাহবিষয়ক বিধির পরিসংখ্যাত্ব স্বীকার করা হইয়াছে। এক্ষণে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের নিজের স্বীকার অনুসারে, কামার্থ বিবাহের রাগপ্রাপ্তত্ব, ও কাঁমার্থ বিবাহবিধির পরিসংখ্যাত্ব, প্রতিপন্ন হইতেছে কি না। • তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের তৃতীয় আপত্তি এই ;-

"কিঞ্চ, মহুনা ইমাশ্চেতি ইদমা পুরোবর্ত্তিনীনামেব দারকৰ্ম্মণি বর্ণক্রমেণ বরত্বমুক্তং পুরোবার্ত্তন্তশ্চ ব্রাহ্মণস্ত সবর্ণা ক্ষত্রিয়াদয়ন্তি- অশ্চ, ক্ষত্র্যি সবর্ণা ব্যৈা শূদ্রা চ, বৈশ্যন্ত্য সবর্ণা শূদ্রা চ, শূদ্র্য শুদ্রৈবেতি। তথ্য চ পরিসংখ্যাত্বকল্পনে শ্রুতাভ্য এব সবর্ণাসবর্ণাভ্যঃ অতিরিক্তবিবাহনিষেধপরত্বং বাচ্যং ততশ্চ কথঙ্কারম্ অসবর্ণাতিরিক্তমাত্রং নিষিধ্যেত (২২)।

কিঞ্চ, মনু, "ইমাঃ" অর্থাৎ এই সকল কন্ঠা, এই কথা বলিয়া, বিবাহ বিষয়ে অনুলোম ক্রমে পুরোবর্ত্তিনী অর্থাৎ পরবচনোক্ত কন্ঠাদিগের শ্রেষ্ঠত্ব কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। পুরোবর্ত্তিনী ক্যাসকল এই, ব্রাহ্মণের সবর্ণ। ও ক্ষত্রিয়া প্রভৃতি • তিন ক্ষত্রিয়ের সবর্ণা, বৈস্ত্যা ও পুত্রী, বৈশ্যের সবর্ণা ও শুক্রা; শূদ্রের একমাত্র শূদ্রা। এই বচনের পরিসংখ্যাত্ব কল্পনা করিলে, পরবচনে যে সবর্ণা ও অসবর্ণ। ক্যার নির্দেশ আছে, তদতিরিক্ত ক্যার বিবাহনিষেধ অভিপ্রেত বলিতে হইবেক; অতএব কেবল অসবর্ণাব্যতিরিক্ত কব্জার বিবাহনিষেধ কি প্রকারে প্রতিপন্ন হইতে পারে।

পূর্বের সবিস্তর দর্শিত হইয়াছে, তর্কবাচস্পতি মহাশয় মনুবচনের যে পাঠ ও যে অর্থ স্থির করিয়াছেন, ঐ পাঠ ও ঐ অর্থ বচনের প্রকৃত পাঠ ও প্রকৃত অর্থ নহে। ঐ বচন দ্বারা সবর্ণা ও অসবর্ণা উভয়ের বিবাহ বিহিত হয় নাই; কেবল অসবর্ণার বিবাহই বিহিত হইয়াছে। সুতরাং, ঐ বচনে উল্লিখিত বিবাহবিধির পরিসংখ্যাত্ব স্বীকার করিলে, অসবর্ণা ব্যতিরিক্ত কন্যার বিবাহ নিষেধ প্রতিপন্ন হইবার কোনও প্রতিবন্ধক ঘটিতে পারে না। তর্কবাচস্পতি মহাশয়, সবর্ণা ও অসবর্ণা উভয়বিধ কন্যার বিবাহ মনুবচনের অভিপ্রেত, এই অমূলক সংস্কারের বশবর্তী হইয়াই, এই আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন, মনুবচনের প্রকৃত পাঠ ও প্রকৃত অর্থ অবগত থাকিলে, কদাচ ঈদৃশ অকিঞ্চিৎকর আপত্তি উত্থাপনে প্রবৃত্ত হইতেন না। তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের চতুর্থ আপত্তি এই

"কিঞ্চ পরিসংখ্যায়ামিতর নিবৃত্তিরেব বিহিতা বিধিপ্রত্যয়ার্থা- শ্রয়ত্বম্ভৈব বিহিতত্ত্বাৎ "অশ্বাভিধানীমাদত্তে" ইত্যাদৌ চ অশ্বাতিরিক্তরশনাগ্রহণাভাব ইষ্টসাধনং তাদৃশগ্রহণাভাবেন ইষ্টং ভাবয়েদিতি বা, "পঞ্চ পঞ্চনধান্ ভুঞ্জীত” ইত্যাদৌ চ শশাদি- পঞ্চকভিন্নপঞ্চনথভোজনং ন ইষ্টসাধনম্ ইতি তত্র তত্র বিধ্যর্থঃ ফলিতঃ তত্র চ অশ্বরশনাগ্রহণে শশাদিভোজনে চ তত্তদ্বিধেরৌ- দাসীন্সমেবেত্যেবং পরিসংখ্যাসরণৌ স্থিতায়াং মানববচনে?পি। সবর্ণায়া অসবর্ণায়া বা বিবাহে বিধেরৌদাসী্যমেব বাচ্যং, কেবলং তদতিরিক্তবিবাহাভাব এব বিহিতঃ স্তাৎ তথাচ ক্ষত্রিয়া- দীনামসবর্ণানাং কথং বিবাহসিদ্ধির্ভবেৎ। ততশ্চ ক্ষত্রিয়াদি- বিবাহস্তাবিহিতত্বেন তদগর্ভজাতসন্তানস্তানৌরসত্বাপত্তিঃ (২৩)।”

তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের অভিপ্রায় এই, বিহিত বিষয়ের অতি- রিক্ত স্থলে নিষেধবোধনই পরিসংখ্যাবিধির উদ্দেশ্য, বিহিত বিষয়ের কর্ত্তব্যত্ববোধন ঐ বিধির লক্ষ্য নহে; যদি সেরূপ লক্ষ্য না হইল, তাহা হইলে বিধিব্লাক্যোক্ত বিষয় বিহিত হইল না; যদি বিহিত না হইল, তাহা হইলে উহা, কর্ত্তব্য বলিয়া পরিগৃহীত হইতে পারে না। "পঞ্চ পঞ্চনখা ভক্ষ্যাঃ," পাঁচটি পঞ্চনখ ভক্ষণীয়, এই বিধিবাক্যে যে পঞ্চ পঞ্চনখের উল্লেখ আছে, পরিসংখ্যাবিধি দ্বারা, তথ্যতিরিক্ত পঞ্চনখের ভক্ষণনিষেধ প্রতিপাদিত হইতেছে, শশ প্রভৃতি পঞ্চ পঞ্চনখের ভক্ষণবিধান ঐ বিধিবাক্যের উদ্দেশ্য নহে; সুতরাং, শশ প্রভৃতি পঞ্চ পঞ্চ- নখের ভক্ষণ বিহিত হইতেছে না। সেইরূপ, মনুবচনে কামার্থ বিবাহের যে বিধি আছে, ঐ বিধির পরিসংখ্যাত্ব স্বীকার করিলে, অসবর্ণা ব্যতিরিক্ত স্ত্রীর বিবাহনিষেধ সিদ্ধ হইবেক, অসবর্ণার বিবাহবিধান ঐ বচন দ্বারা প্রতিপাদিত হইবেক না; যদি তাহা না হইল, তাহা হইলে অসবর্ণাবিবাহ বিহিত হইল না; যদি বিহিত না হইল, তাহা হইলে অসবর্ণার গর্ভজাত সন্তান অবৈধ স্ত্রীর সংসর্গে সম্ভূত হইল্ল; সুতরাং, ঔরস অর্থাৎ বৈধ সন্তান বলিয়া পরিগৃহীত হইতে পারে না।

তর্কবাচস্পতি মহাশয় এস্থলে পরিসংখ্যাবিধির যেরূপ সূক্ষ্ম তাৎপর্য্যব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা অদৃষ্টচর ও অশ্রুতপূর্ব। লোকের ইচ্ছা দ্বার। যাহার প্রাপ্তি ঘটে, তাহাকে রাগপ্রাপ্ত বলে; তাদৃশ বিষয়ের প্রাপ্তির নিমিত্ত, বিধির আবশ্যকত। নাই। যদি বিধি থাকে, তাহা হইলে, বিহিত বিষয়ের স্মৃতি- রিক্ত স্থলে নিষেধ সিদ্ধ হয়; অর্থাৎ; যদিও তাদৃশ সমস্ত বিষয় ইচ্ছা দ্বারা প্রাপ্ত হইতে পারে; কিন্তু, কতিপয় স্থল ধরিয়া বিধি দেওয়াতে, কেবল ঐ কয় স্থলে ইচ্ছা অনুসারে চলিবার অধিকার থাকে, তদতিরিক্ত স্থলে নিষেধ বোধিত হয়। পঞ্চনখ ভক্ষণ রাগপ্রাপ্ত; কারণ, লোকে, ইচ্ছা করিলেই, তাহা ভক্ষণ করিতে পারে; সুতরাং, তাহার প্রাপ্তির জন্য, বিধির আব- শ্যকতা নাই। কিন্তু, শশ প্রভৃতি পঞ্চ পঞ্চনখের নির্দেশ করিয়া ভক্ষণের বিধি দেওয়াতে, ঐ পাঁচ স্থলে, ইচ্ছা অনুসারে, ভক্ষণের অধিকার থাকিতেছে; তদতিরিক্ত পঞ্চনখ ভক্ষণ নিষিদ্ধ হইতেছে; উহাদের ভক্ষণে আর অধিকার রহিতেছে না। সুতরাং, পঞ্চ পঞ্চনখা ভক্ষ্যাঃ," এই বিধি দ্বারা, শশ প্রভৃতি পঞ্চ মাত্র পঞ্চনখ ভক্ষণীয় বলিয়া ব্যবস্থাপিত হইতেছে, তদ্ব্যতিরিক্ত যাবতীয় পঞ্চনখ অভক্ষ্য পক্ষে নিক্ষিপ্ত হইতেছে। শশ প্রভৃতি পঞ্চ পঞ্চনখ ভক্ষণ দোষাবহ নহে; কারণ, লোকের ইচ্ছ। বশতঃ তাহাদের ভক্ষণের যে প্রাপ্তি ছিল, শাস্ত্রের বিধি দ্বারা তাহা নিবারিত হইতেছে না; শশ প্রভৃতি'পঞ্চ ব্যতিরিক্ত পঞ্চনখ ভক্ষণ দোষাবহ হইতেছে; কারণ, যাবতীয় পঞ্চনখ ভক্ষণ ইচ্ছা বশতঃ প্রাপ্ত হইলেও, শশ প্রভৃতি পাঁচটি ধরিয়া বিধি দেওয়াতে, তদ্ব্যতিরিক্ত সমস্ত পঞ্চনথের ভক্ষণ একবারে নিষিদ্ধ হইয়াছে। সেইরূপ, কামার্থ বিবাহ স্থলে, লোকের ইচ্ছা বশতঃ, সবর্ণা ও অসবর্ণা উভয়েরই প্রাপ্তি ঘটিয়াছিল; কিন্তু, যদৃচ্ছা ক্রমে বিবাহপ্রবৃত্ত পুরুষ অলবর্ণা বিবাহ করি- বেক, এই বিধি দেওয়াতে, অসবর্ণা ব্যতিরিক্ত স্থলে নিষেধ সিদ্ধ হইতেছে; অসবর্ণা বিবাহ পূর্ববৎ ইচ্ছাপ্রাপ্ত থাকিতেছে; অর্থাৎ, ইচ্ছা হইলে, অসবর্ণা বিবাহ করিতে পারিবেক; কারণ, পূর্বেও ইচ্ছা দ্বারা অসুবর্ণায় প্রাপ্তি ছিল, এবং বিধি দ্বারাও অসবর্ণার প্রাপ্তি নিবারিত হইতেছে না। পরিসংখ্যাবিধির এইরূপ তাৎপর্য্যব্যাখ্যাই সচরাচর পরিগৃহীত হইয়া থাকে। কিন্তু, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের তাৎপর্য্যব্যাখ্যা অনুসারে, শশ প্রভৃতি পঞ্চ পঞ্চনখ ভক্ষণ, ও অসবর্ণা বিবাহ, উভয়ই অবিহিত; সুতরাং, উভয়ই দোষাবহ; শশ প্রভৃতি পঞ্চ পঞ্চনখ ভক্ষণ করিলে, প্রত্যবায়গ্রস্ত হইতে হইবেক; এবং অসবর্ণা বিবাহ করিলে, তাহার গর্ভজাত সন্তান, অবৈধ সন্তান বলিয়া, পরিগণিত হইবেক। তিনি, এস্থলে, পরিসংখ্যাবিধির এরূপ তাৎপর্য্যব্যাখ্যা করিয়াছেন; কিন্তু, পূর্ব্বে সবসম্মত তাৎপর্য্য- ব্যাখ্যা অবলম্বন করিয়া আসিয়াছেন। তথায় স্বীকার করিয়াছেন, পরিসংখ্যাবিধি দ্বারা, বিহিত বিষয়ের অতিরিক্ত স্থলে নিষেধ সিদ্ধ হয়, এবং সেই নিষেধ দ্বারা, বিহিত স্থলে বিধি অনুযায়ী কর্ম্ম করিবার অধিকাঁর অব্যাহত থাকে। যথা,

"রতিসুখস্ত রাগপ্রাপ্তেী তদুপায়্য স্ত্রীগমনস্তাপি রাগগ্রাপ্তেী সত্যাং স্বদারনিরতঃ সদেতি মানববচনন্ত পরদারান্ ন গচ্ছেদিতি পরিসংখ্যাপরতায়াঃ সর্ব্বৈঃ স্বীকারেণ পরদারগমননিষেধাৎ তদ্ব্য- দায়েন অনিষিদ্ধস্ত্রীগমনং শাস্ত্রবিহিতন্ত্রীসংস্কারং বিনানুপপন্নমিত্য- নিষিদ্ধতা প্রয়োজকঃ সংস্কার আক্ষিপ্যতে (২৪)।"

রতিস্থণ ও তাহার উপায়ভূত স্ত্রীগমন রাগপ্রাপ্ত হওয়াতে, "সদা স্বদাবপরায়ণ হইবেক," এই মনুবচুন, পরদারগমন করিবেক না, এরূপ পরিসংখ্যার স্থল বলিয়া, সকলে স্বীকার করিয়া থাকেন; তদনুসারে পরদারগমন নিষেধ বশতঃ, পরদারবর্জন পূর্ব্বক অনিষিদ্ধ স্ত্রীগমন শাস্ত্রবিহিত সংস্কার ব্যতিরেকে সিদ্ধ হইতে পারে না. এই হেতুতে, অনিষিদ্ধতার প্রয়োজক সংস্কার আক্ষিপ্ত হয়।

রতিকামনায় স্ত্রীসম্ভোগ রাগপ্রাপ্ত, অর্থাৎ পুরুষের ইচ্ছাধীন; রতিসুখলাভের ইচ্ছা হইলে, পুরুষ স্ত্রী সম্ভোগ করিতে পারে; স্বস্ত্রী ও পরস্ত্রী উভয় সম্ভোগেই রতিসুখলাভ সম্ভব; সুতরাং, পুরুষ, ইচ্ছা অনুসারে, উভয়বিধ স্ত্রী সম্ভোগ করিতে পারিত; কিন্তু মনু, “সদা স্বদারপরায়ণ হইবেক,” এই বিধি দিয়াছেন। এই বিধি সর্বসম্মত পরিসংখ্যাবিধি। এই বিধি দ্বারা, পরদার বর্জন পূর্বক, স্বদার গমন প্রতিপাদিত হইয়াছে।

এক্ষণে, পরিসংখ্যাবিধি বিষয়ে, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের দ্বিবিধ তাৎপর্য্যব্যাখ্যা উপলব্ধ হইতেছে। তদীয় প্রথম ব্যাখ্যা অনুসারে, বিহিত বিষয়ের অতিরিক্ত স্থলে নিষেধ প্রতিপাদন দ্বারা, বিহিত বিষয়ের অনুষ্ঠান প্রতিপাদিত হয়; সুতরাং, বিধিবাক্যোক্ত বিষয় অবিহিত ও অনুষ্ঠানে প্রত্যবায়জনক নহে। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা অনুসারে, বিহিত বিষয়ের অতিরিক্ত স্থলে নিষেধ প্রতিপাদনই পরিসংখ্যাবিধির উদ্দেশ্য, বিধিবাক্যোক্ত বিষয়ের বিহিতত্বপ্রতিপাদন, কোনও মতে, উদ্দেশ্য নহে; সুতরাং, তাহা অবিহিত ও অনুষ্ঠানে প্রত্যবায়জনক। তর্কবাচ- স্পতি মহাশয়ের দ্বিতীয় ব্যাখ্যা প্রমাণপদবীতে অধিরোহিত হইলে, মনুর স্বদারগমনবিষয়ক সর্বসম্মত পরিসংখ্যাবিধি দ্বারা, পরদারগমন মাত্র নিষিদ্ধ হয়, স্বদারগমনের বিহিতত্ব প্রতিপন্ন হয় না; সুতরাং, স্বদারগমন অবিহিত, ও স্বদারগর্ভসম্ভূত ঔরস সন্তান অবৈধ সন্তান ধলিয়া পরিগৃহীত, হইয়া উঠে। যাহা হউক, এক বিষয়ে এরূপ পরস্পর বিরুদ্ধ ব্যবস্থা প্রায় দৃষ্টিগোচর হয় না। ফলকথা এই, তর্কবাচস্পতি মহাশয় যখন যাহাতে সুবিধা দেখেন, তাহাই বলেন; যাহা বলিতেছি, তাহা যথার্থ শাস্ত্রার্থ কি না; অথবা, পূর্ব্বে যাহা বলিয়াছি, এবং এক্ষণে যাহা বলিতেছি, এ উভয়ের পরস্পর বিরোধ ঘটিতেছে কি না, তাহা অনুধাবন করিয়া দেখেন না। যেরূপ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাতে তাঁহার তদ্রূপ অনুধাবন করিয়া দেখিবার ইচ্ছা আছে, এরূপ বোধ হয় না। বস্তুতঃ, কি শাস্ত্রীয় বিচার, কি লৌকিক ব্যবহার, সব বিষয়েই তিনি সম্পূর্ণ যথেচ্ছচারী।

তর্কবাচস্পতি মহাশয়, অসবর্ণাবিবাহবিধির পরিসংখ্যাত্ব খণ্ডন করিবার নিমিত্ত, এইরূপ আরও দুই একটি আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন; অকিঞ্চিৎকর ও অনাবশ্যক বিবেচনায়, এ স্থলে আর সে সকলের উল্লেখ ও আলোচনা করা গেল না। ষদৃচ্ছা স্থলে যত ইচ্ছা সবর্ণাবিবাহ প্রতিপন্ন করাই তাঁহার উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তই, তিনি অসবর্ণাবিবাহ- বিধির পরিসংখ্যাত্ব খণ্ডনে প্রাণপণে যত্ন করিয়াছেন। তিনি ভাবিয়াছেন, ঐ বিবাহবিধির পরিসংখ্যাত্ব খণ্ডিত ও অপূর্ব্ব- বিধিত্ব সংস্থাপিত হইলেই, যদৃচ্ছা ক্রমে যত ইচ্ছা সবর্ণাবিবাহ নির্বিবাদে সিদ্ধ হইবেক। কিন্তু সে তাঁহার নিরবচ্ছিন্ন ভ্রান্তি মাত্র। মনুবচনের প্রকৃত পাঠ ও প্রকৃত অর্থ কি, সে বোধ না থাকাতেই, তাঁহার মনে তাদৃশ বিষম কুসংস্কার জন্মিয়া আছে। তিনি মানবীয় বিবাহবিধিকে অপূর্ব্ববিধিই বলুন, নিয়ম- বিধিই বলুন, আর পরিসংখ্যাবিধিই বলুন, উহা দ্বারা, কাম স্থলে, অসবর্ণা বিবাহই প্রতিপন্ন হইবেক, যদৃচ্ছা ক্রমে যত ইচ্ছা সবর্ণা ও অসবর্ণ। বিবাহ, কোনও মতে, প্রতিপন্ন হইতে পারিবেক না। তর্কবাচস্পতি মহাশয় মনে করুন, তিনি এই বিবাহবিধির পরিসংখ্যাত্ব খণ্ডনে ও অপূর্বববিধিত্ব সংস্থাপনে কৃতকার্য্য হইয়া- ছেন; কিন্তু, আমি তাহাতে তাঁহার কোনও ইষ্টাপত্তি দেখিতেছি না। পূর্ব্বে নির্বিবাদে প্রতিপাদিত হইয়াছে,

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণি।

কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশোহবরাঃ । ৩। ১২। দ্বিজাতিদিগের প্রথম বিবাহে সবর্ণা ক্যা বিহিতা; কিন্তু যাহারা কাম বশতঃ বিবাহে প্রবৃত্ত হয়, তাহারা অনুলোম ক্রমে অসবর্ণা বিবাহ করিবেক।

এই মনুবচন দ্বারা, যদৃচ্ছা স্থলে, কেবল অসবর্ণারিহিত হইয়াছে। যদি এই বিবাহবিধিকে অপূর্ববিধি বলিয়া অঙ্গীকার করা যায়, তাহা হইলে, কাম বশতঃ বিবাহপ্রবৃত্ত পুরুষ অসবর্ণ কন্যা বিবাহ করিবেক, এইরূপ অসবর্ণাবিবাহের সাক্ষাৎ বিধি পাওয়া যাইবেক; পরিসংখ্যার শ্যায়, অসবর্ণা ব্যতিরিক্ত বিবাহ করিবেক না, এরূপ নিষেধ বোধিত হইবেক না। যদি, কাম স্থলে, সবর্ণা ও অসবর্ণা, উভয়বিধস্ত্রীবিবাহ মনুবচনের অভিপ্রেত হইত, তাহা হইলে, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের ইষ্টসিদ্ধি ঘটিতে পারিত; অর্থাৎ, সবর্ণা ও অসবর্ণা, উভয়বিধস্ত্রীবিবাহের সাক্ষাৎ বিধি পাওয়া যাইত, এবং, তাহা হইলেই, যদৃচ্ছা ক্রমে যত ইচ্ছা সবর্ণা ও অসবর্ণা বিবাহ অনায়াসে সিদ্ধ হইত। কিন্তু, পূর্বে, নিঃসংশয়িত রূপে, প্রতিপাদিত হইয়াছে, অসবর্ণাবিবাহবিধানই মনুবচনের এক মাত্র উদ্দেশ্য; সুতরাং, অপূর্ব্ববিধি কল্পনা করিয়া, সবর্ণা ও অসবর্ণা, উভয়বিধস্ত্রীবিবাহ সিদ্ধ করিবার পথ রুদ্ধ হইয়া আছে। অতএব, অপূর্ববিধি স্বীকার করিলেও, তর্কবাঢ- স্পতি মহাশয়ের কোনও উপকার দর্শিতেছে না; এবং, যদৃচ্ছা ক্রমে বিবাহপ্রবৃত্ত পুরুষ অসবর্ণা বিবাহ করিতে পারে, আমার অবলম্বিত এই চিরন্তন মীমাংসারও, কোনও অংশে, হানি ঘটিতেছে না। আর, যদি এই বিবাহবিধিকে নিয়মবিধি বলা যায়, তাহাতেও, আমার পক্ষে কোনও হানি, এবং তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের পক্ষে কোনও ইষ্টাপত্তি, দৃষ্ট হইতেছে না। নিয়ম- বিধি অঙ্গীকৃত হইলে, ইহাই প্রতিপন্ন হইবেক, যদৃচ্ছা ক্রমে বিবাহপ্রবৃত্ত পুরুষ সবর্ণা ও অসবর্ণা উভয়বিধ স্ত্রীর পাণিগ্রহণ করিতে পারিত; কিন্তু, যদৃচ্ছা ক্রমে বিবাহপ্রবৃত্ত পুরুষ অসবর্ণা বিবাহ করিবেক, এই বিধি প্রদর্শিত হওয়াতে, যদৃচ্ছা স্থলে অসবর্ণা বিবাহ নিয়মবদ্ধ হইল; অর্থাৎ, যদৃচ্ছা ক্রমে বিবাহ করিতে ইচ্ছা ইইলে, হই অসবর্ণা কম্মারই পাণিগ্রহণ করিবেক; সুতরাং যদৃচ্ছ। স্থলে, সবর্ণা ও অসবর্ণা, উভয়রিধস্ত্রীবিবাহের আর পথ থাকিতেছে না। অতএব, পরিসংখ্যা স্বীকার না করিলেও, যদৃচ্ছা স্থলে অসবর্ণা বিবাহ করিতে পারে, এ ব্যবস্থার কোনও অংশে ব্যাঘাত ঘটিতেছে না। সর্বশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহাশয়, কিঞ্চিৎ বুদ্ধিব্যয় করিলে, ও, কিঞ্চিৎ অভিনিবেশ সহকারে, ক্ষণকাল আলোচনা করিয়া দেখিলে, অনায়াসে বুঝিতে পারিবেন, এ বিষয়ে, আমার পক্ষে, অপূর্ব- বিধি, নিয়মবিধি, পরিসংখ্যাবিধি, এ তিন বিধিই সমান; তবে, পরিসংখ্যার প্রকৃত স্থল বলিয়াই, পরিসংখ্যাপক্ষ অবলম্বিত হইয়াছিল, নতুবা, কামার্থে অসবর্ণাবিবাহ শাস্ত্রানুমোদিত, ইহা প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত, এই বিবাহবিধির পরিসংখ্যাত্ব স্বীকারের ঐকান্তিকী আবশ্যকতা নাই।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

প্রথম পুস্তকে নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য ভেদে বিবাহের ত্রৈবিধ্য ব্যবস্থাপিত হইয়াছে। ঐ ত্রৈবিধ্যব্যবস্থা আমার কপোলকল্পিত, শাস্ত্রানুমোদিতও নহে, যুক্তিমূলকও নহে, ইহা প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত, শ্রীযুত তারানাথ তর্কবাচস্পতি, অশেষ প্রকারে, প্রয়াস পাইয়াছেন। তাঁহার মতে, ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, পরিব্রজ্যা, এই চারি আশ্রমের মধ্যে ব্রহ্মচর্য্য আশ্রম নিত্য, অপর তিন আশ্রম কাম্য, নিত্য নহে; গৃহস্থাশ্রম কাম্য, সুতরাং, গৃহস্থা- শ্রমপ্রবেশমূলক বিবাহও কাম্য। তিনি লিখিয়াছেন,

"অবিপ্লুতব্রহ্মচর্য্যো যমিচ্ছেস্তু তমাবসেদিতি মিতাক্ষরাত- বাক্যাৎ ব্রহ্মচর্য্যাতিরিক্তাশ্রমমাত্রস্তৈব রাগপ্রযুক্তত্বাৎ গৃহস্থা- শ্রমস্তাপি রাগপ্রযুক্ততয়া তদধীনপ্রবৃত্তিকবিবাহ্যাপি রাগ- প্রযুক্তত্বেন কাম্যত্বস্তৈবোচিতত্বাৎ (১)।”

যথাবিধানে ব্রহ্মচর্য্য নির্ব্বাহ করিয়া, যে আশ্রমে ইচ্ছা হয়, সেই আশ্রম অবলম্বন করিবেক; মিতাক্ষরাধৃত এই বচন অনুসারে, ব্রহ্মচর্য্য ব্যতিরিক্ত, আশ্রম মাত্রই রাগপ্রাপ্ত; সুতরাং, গৃহস্থাশ্রমও রাগপ্রাপ্ত গৃহস্থাশ্রমের রাগ প্রাপ্ততা বশতঃ, গৃহস্থাশ্রমপ্রবেশমূলক বিবাহও রাগপ্রাপ্ত; সুতরাং, উহা কাম্য বলিয়াই পরিগণিত হওয়া উচিত।

তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের এই সিদ্ধান্ত শাস্ত্রানুযায়ী নহে। মিতাক্ষরাধৃত এক মাত্র বচনের যথাশ্রুত অর্থ অবলম্বন করিয়া, এরূপ অপসিদ্ধান্ত প্রচারিত, করা, তাদৃশ প্রসিদ্ধ পণ্ডিতের পক্ষে, সদ্বিবেচনার কর্ম্ম হয় নাই। কোনও বিষয়ে শাস্ত্রের মীমাংসায় প্রবৃত্ত হইলে, সে বিষয়ে কি কি প্রনাণ আছে, সবি- শেষ অনুসন্ধান করিয়া দেখা আবশ্যক। আপন অভিপ্রায়ের অনুকূল এক মাত্র প্রমাণ অবলম্বন কারয়া, মীমাংসা করায়, স্বীয় অনভিজ্ঞতা প্রদর্শন ব্যতীত, আর কোনও ফল দেখিতে পাওয়া যায় না। যাহা হউক, আশ্রম সকল নিত্য কি না, তাহার মীমাংসা করিতে হইলে, নিত্য কাহাকে বলে, অগ্রে তাহার নিরূপণ করা আবশ্যক। যে সকল হেতুতে নিত্যত্ব সিদ্ধ হয়, প্রসিদ্ধ প্রাচীন প্রামাণিক সংগ্রহকার সে সমুদয়ের নিরূপণ করিয়া গিয়াছেন। যথা,

নিত্যং সদা যাবদায়ুর্ন কদাচিদতিক্রমেৎ। ইত্যুজ্যাতিক্রমে দোষশ্রুতেরত্যাগচোদনাৎ। • ফলাশ্রুতেবীপ্সয়া চ তন্নিত্যমিতি কীর্ত্তিতম্ ॥ যে বিধিবাক্যে নিত্য শব্দ, সদা শব্দ, বা যাবদায়ঃ শব্দ থাকে, অথবা, কদাচ লঙ্ঘন করিবেক না, এরূপ নির্দেশ থাকে, লঙ্ঘনে দোষশ্রুতি থাকে, ত্যাগ করিবেক না এরূপ নির্দেশ থাকে, ফলশ্রুতি না থাকে, অথবা, বীপ্সা অর্থাৎ এক শব্দের দুই বার প্রয়োগ থাকে, তাহাকে নিত্য বলে।

উদাহরণ-

নিত্য শব্দ।

১। নিত্যং স্নাত্বা শুচিঃ কুর্য্যাদ্দেবর্ষিপিতৃতর্পণম্ (২)। স্নান করিয়া, শুচি হইয়া, নিত্য দেবতর্পণ, ঋষিতর্পণ, ও পিতৃতর্পণ করিবেক।

সদা শব্দ।

২। অপুত্রেণৈব কর্ত্তব্যঃ পুত্রপ্রতিনিধিঃ সদা (৩)।

অপুত্র ব্যক্তি সদা পুত্রপ্রতিনিধি করিবেক।

যাবদায়ঃ শব্দ।

৩। উপোয্যেকাদশী রাজন্ যাবদায়ঃ স্ববৃত্তিভিঃ (৪)। হে রাজন, স্বধর্ম্মনিষ্ঠ ব্যক্তিরা, যাবদায়ঃ, অর্থাৎ যাবজ্জীবন, একাদশীতে উপবাস করিবেক।

কদাচ লঙ্ঘন করিবেক না।

৪। একাদশ্যামুপবসেন্ন কদাচিদতিক্রমেৎ (৫)।

একাদশীতে উপবাস করিবেক, কদাচ লঙ্ঘন করিবেক না।

লঙ্ঘনে দোষশ্রুতি।

৫। শ্রাবণে বহুলে পক্ষে কৃষ্ণজন্মাষ্টমীব্রতম্।

ন করোতি নরো যস্তু স ভবেৎ ক্রুররাক্ষসঃ (৬) ॥ যে নর, শ্রাবণ মাসে, কৃষ্ণপক্ষে, কৃষ্ণজন্মাষ্টমীব্রত না করে, সে ক্রুর রাক্ষস হইয়া জন্মগ্রহণ করে।

ত্যাগ করিবেক না। ৬। পরমাপদমাপন্নো হর্ষে বা সমুপস্থিতে। সূতকে মৃতকে চৈব ন ত্যজেদ্দ্বাদশীব্রতম্ (৭) ॥

উৎকট আপদই ঘটুক, বা আহ্লাদের বিষয়ই উপস্থিত হউক, বা জননাশৌচ অথবা মরণাশৌচই ঘটুক, দ্বাদশীব্রত ত্যাগ করিবেক না। ফলশ্রুতি না থাকা।

৭। অথ শ্রাদ্ধমমাবা্যায়াং পিতৃভ্যো দদ্যাৎ (৮)।

অমাবাস্তাতে পিতৃগণের শ্রাদ্ধ করিবেক। বীপ্সা। ৮। অশ্বযুকৃষ্ণপক্ষে তু শ্রাদ্ধং কুর্য্যাদ্দিনে দিনে (৯)।

আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষে, দিন দিন, শ্রাদ্ধ করিবেক।

যে সকল হেতু বশতঃ, বিধির নিত্যত্ব সিদ্ধ হয়, সে সমুদয় দর্শিত হইল। এক্ষণে, আশ্রমবিষয়ক বিধিব্বাক্যে নিত্যত্বপ্রতি- পাদক হেতু আছে কি না, তাহা পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত, ঐ সমস্ত বিধিবাক্য উদ্ধৃত হইতেছে। যথা,

১। বেদানধীত্য বেদো বা বেদং বাপি যথাক্রমম্। অবিপ্লুতব্রহ্মচর্য্যো গৃহস্থ। শ্রমমাবসেৎ ॥ (১০)

যথাক্রমে এক বেদ, দুই বেদ, অথবা সকল বেদ অধ্যয়ন ও যথাবিধি ব্রহ্মচর্য্য নির্ব্বাহ করিয়া, গৃহস্থাশ্রম অবলম্বন করিবেক।

২। চতুর্থমামুষো ভাগমুষিত্বাজ্যং গুরৌ দ্বিজঃ। দ্বিতীয়মায়ুষো ভাগং কৃতদারো গৃহে বসেৎ ॥ (১১)। দ্বিজ, জীবনের প্রথম চতুর্থ ভাগ গুরুকুলে বাস করিয়া, দারপরিগ্রহ পূর্ব্বক, জীবনের দ্বিতীয় চতুর্থ ভাগ গৃহস্থাশ্রমে অবস্থিতি করিবেক।.

৩। এবং গৃহাশ্রমে স্থিত্ব। বিধিবৎ স্নাতকো দ্বিজঃ। বনে বসেতু নিয়তে। যথাবছিজিতেন্দ্রিয়ঃ । (১২)।

স্নাতক দ্বিজ, এইরূপে, বিধি পূর্ব্বক, গৃহস্থাশ্রমে অবস্থিতি করিয়া, সংযত ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া, যথাবিধানে বনে বাস করিবেক।

৪। গৃহস্থস্তু যদা পশ্যেদ্বলীপলিতমাত্মনঃ। অপত্যস্যৈব চাপত্যং তদারণ্যং সমাশ্রয়েৎ। (১৩)।

গৃহস্থ যখন আপন শরীরে বলী ও পলিত, এবং অপত্যের অপত্য দর্শন করি- বেক, তখন অরণ্য আশ্রয় করিবেক।

৫। রনেষু তু বিহুত্যৈবং তৃতীয়ং ভাগমায়ুষঃ। চতুর্থমায়ুষো ভাগং ত্যক্তা সঙ্গান্ পরিব্রজেৎ ॥ (১৪)।

এইরূপে, জীবনের তৃতীয় ভাগ বনে অতিবাহিত করিয়া, সর্ব্ব সঙ্গ পরিত্যাগ পূর্ব্বক, জীবনের চতুর্থ ভাগে পরিব্রজ্যা আশ্রম অবলম্বন করিবেক।

৬। অধীত্য বিধিবদ্বেদান্ পুভ্রানুৎপাদ্য ধৰ্ম্মতঃ।

ইচ্ছা চ শক্তিতো যজ্ঞৈর্মনো মোক্ষে নিবেশয়েৎ ॥ (১৫) নিনি-পূর্ব্বক বেদাধ্যয়ন, ধৰ্ম্মতঃ পুত্রোৎপাদন, এবং যথাশক্তি যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া, মোক্ষে মনোনিবেশ করিবেক।

এই সমস্ত আশ্রমবিষয়ক বিধিবাক্যে ফলশ্রুতি নাই। পূর্ব্বে দর্শিত হইয়াছে, বিধিবাক্যে ফলশ্রুতি না থাকিলে, ঐ বিধি নিত্য বিধি বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে; সুতরাং, এ সমুদয়ই নিত্য বিধি হইতেছে; এবং, তদনুসারে, ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, পরিব্রজ্যা, চারি আশ্রমই নিত্য বলিয়া প্রতিপন্ন হইতেছে।

কিঞ্চ,

১। জায়মানো বৈ ব্রাহ্মণস্ত্রিভিঋণবান্ জায়তে ব্রহ্ম- চর্য্যেণ ঋষিভ্যঃ যজ্ঞেন দেবেভ্যঃ প্রজয়া পিতৃভ্যঃ এষ বা অনূণো যঃ পুত্রী যজ্বা ব্রহ্মচর্য্যবান (১৬)। ব্রাহ্মণ, জন্মগ্রহণ করিয়া, তিন ঋণে বন্ধ হয়; ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা ঋষিগণের নিকট,' যজ্ঞদ্বারা দেবগণের নিকট, পুত্র দ্বারা পিতৃগণের নিকট; যে ব্যক্তি পুত্রোৎ- পাদন, যজ্ঞানুষ্ঠান ও ব্রহ্মচর্য্য নির্ব্বাহ করে, সে ঐ ত্রিবিধ ঋণে মুক্ত হয়।

২। ঋণানি ত্রীণ্যপাকৃত্য মনো মোক্ষে নিবেশয়েৎ। অনপাকৃত্য মোক্ষন্তু সেবমানো ব্রজত্যধঃ।। (১৭)।

তিন ঋণের পরিশোধ করিয়া, মোক্ষে মনোনিবেশ করিবেক ঋণপরিশোধ না করিয়া, মোক্ষপথ অবলম্বন করিলে, অধোগতি প্রাপ্ত হয়।

৩। ঋণত্রয়াপাকরণমবিধায়াজিতেন্দ্রিয়ঃ। রাগদ্বেষাবনিজ্জিত্য মোক্ষমিচ্ছন্ পতত্যধঃ (১৮) ।॥

ঋণত্রয়ের পরিশোধ, ইন্দ্রিয়বর্ণীকরণ, ও রাগছেষজয় না করিয়া, মোক্ষ ইচ্ছা করিলে, অধঃপাতে যায়।

৪। অনধীত্য দ্বিজো বেদাননুৎপাছা তথাত্মজান। অনিষ্টু। চৈব যজ্ঞৈশ্চ মোক্ষমিচ্ছন ব্রজত্যধঃ ।। (১৯)।

বেদাধ্যয়ন, পুত্রোৎপাদন, ও যজ্ঞানুষ্ঠান না করিয়া, দ্বিজ মোক্ষকামনা করিলে অধোগতি প্রাপ্ত হয়।

৫। অনুৎপাহ্য সুতান্ ফ্লেবানসন্ত্য পিতৃংস্তথা। ভূতাদীংশ কথং মৌঢ্যাৎ স্বর্গতিং গন্তুমিচ্ছসি ॥ (२०)

পুত্রোৎপাদন, দেবকার্য্য, পিতৃকার্য্য, ও ভূতরলিপ্রদান না করিয়া, মুঢ়তা বশতঃ, কি প্রকারে, স্বর্গলাভের আকাঙ্ক্ষা করিতেছ।

৬। গুরুণানুমতঃ স্নাত্বা সদারো বৈ দ্বিজোত্তমঃ। অনুৎপাছা সুতং নৈব ব্রাহ্মণঃ প্রব্রজেদগৃহাৎ (২১)।

ব্রাহ্মণ, গুরুর অনুজ্ঞালাভান্তে, সমাবর্তন ও দারপরিগ্রহ পূর্ব্বক, পুত্রোৎপাদন না করিয়া, কদাচ গৃহস্থাশ্রম ত্যাগ করিবেক না।

এই সকল শাস্ত্রে, ঋণত্রয়ের অপরিশোধনে, দোষশ্রুতি দৃষ্ট, হইতেছে। ত্রিবিধ ঋণের মধ্যে, ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা ঋষিঋণের, গৃহস্থা- শ্রম দ্বারা দেবঋণ ও পিতৃঋণের পরিশোধ হয়। সুতরাং, ব্রহ্মচর্য্যের ন্যায়, গৃহস্থাশ্রমও নিত্য হইতেছে।

এক্ষণে সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, গৃহস্থাশ্রমের নিত্যতা অপলাপ করিতে গারা যায় কি না। পূর্ব্বে যে আটটি হেতু প্রদর্শিত হইয়াছে, তাঁহারা প্রত্যেকেই নিত্যত্বপ্রতিপাদক; তন্মধ্যে, আশ্রমব্যবস্থা সংক্রান্ত বিধিবাক্যে দুই হেতু সম্পূর্ণ লক্ষিত হইতেছে; প্রথম ফলশ্রুতিবিরহ, দ্বিতীয় লঙ্ঘনে দোষ- শ্রুতি। সুতরাং, গৃহস্থাশ্রমের 'নিত্যতা বিষয়ে আর কোনও সংশয় থাকিতেছে না।

এরূপ কতকগুলি শাস্ত্র আছে যে, উহারা, আপাততঃ, গৃহস্থাশ্রমের নিত্যত্বপ্রতিবন্ধক বলিয়া প্রতীয়মান হয়; ঐ সমস্ত শাস্ত্র উদ্ধৃত ও তদীয় প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য্য আলোচিত হইতেছে। li

১। চত্বার আশ্রমা ব্রহ্মচারিগৃহস্থবানপ্রস্থপরিব্রাজকাঃ তেষাং বেদমধীত্য বেদো বা বেদান্ বা অবিশীর্ণ- ব্রহ্মচর্য্যো যমিচ্ছেতু তমাবসেৎ (২২)।

ব্রহ্মচর্যা, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, পরিব্রজ্যা, এই চারি আশ্রম; তন্মধ্যে এক বেদ, দুই বেদ, বা সকল বেদ, অধ্যয়ন ও যথাবিধানে ব্রহ্মচর্য্য নির্ব্বাহ করিয়া, যে আশ্রমে ইচ্ছা হয়, সেই আশ্রম অবলম্বন করিবেক।

২। আচার্য্যেণাভ্যনুজ্ঞাতশ্চতুর্ণামেকমাশ্রমম্। আ বিমোক্ষাচ্ছরীরস্থ্য সোহনুতিষ্ঠেদযথাবিধি ।। (২৩)।

দ্বিজ, আচার্য্যের অনুজ্ঞা লাভ করিয়া, যাবজ্জীবন, যথাবিধি, চারি আশ্রমের এক আশ্রম অবলম্বন করিবেক।

৩। গার্হস্থ্যমিচ্ছন ভূপাল কুর্য্যাদ্দারপরিগ্রহম্।

ব্রহ্মচর্য্যেণ বা কালং নয়েৎ সঙ্কল্পপূর্বকম্।

বৈখানসো বাগ ভবেৎ পরিব্রাড়ণবেচ্ছয়া । (২৪)।

হে রাজন। গৃহস্থাশ্রমের ইচ্ছা হইলে, দারপরিগ্রহ করিবেক অথবা, সঙ্কর করিয়া, ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন পূর্ব্বক, কালক্ষেপণ করিবেক; অথবা, ইচ্ছা অনসারে বানীপ্ত আশ্রম কিংবা গরিব্রজ্যা আশ্রম অবলম্বন করিবেক।

এই সকল শাস্ত্র দ্বারা আপাততঃ, গৃহস্থাশ্রমের নিত্যত্বব্যাঘাত প্রতীয়মান হয়। ব্রহ্মচর্য্য সমাধান করিয়া, যে আশ্রমে ইচ্ছা হয়, সেই আশ্রম অবলম্বন করিবেক, এরূপ বলাতে, গৃহস্থাশ্রম প্রভৃতি আশ্রমত্রয় সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন হইতেছে; ইচ্ছাধীন কৰ্ম্ম রাগপ্রাপ্ত; সুতরাং, তাহার" নিত্যহ ঘটিতে পারে না; তাহা কাম্য বলিয়াই পরিগৃহীত হওয়া উচিত। এক্ষণে, আশ্রম বিষয়ে দ্বিবিধ শাস্ত্র উপলব্ধ হইতেছে; কতকগুলি গৃহস্থাশ্রমের নিত্যত্ব- প্রতিপাদক, কতকগুলি গৃহস্থাশ্রমের নিত্যত্বপ্রতিবন্ধক; সুতরাং, উভয়বিধ শাস্ত্র পরস্পর বিরুদ্ধ বলিয়া, আপাততঃ, প্রতীতি জন্মিতে পারে। কিন্তু, বাস্তবিক তাহা নহে। শাস্ত্রকারেরা, অধিকারিভেদে, তাহার মীমাংসা করিয়া রাখিয়াছেন; অর্থাৎ, অধিকারিবিশেষের পক্ষে, গৃহস্থাশ্রমের নিত্যহপ্রতিপাদন, আর, অধিকারিবিশেষের পক্ষে, গৃহস্থাশ্রমের নিত্যত্বনিরাকরণ, করিয়া গিয়াছেন। সুতরাং, অধিকারিভেদব্যবস্থা অবলম্বন করিলেই, আপাততঃ বিরুদ্ধবৎ প্রতীয়মান উল্লিখিত উভয়বিধ শাস্ত্রসমূহের সর্বতোভাবে অবিরোধ সম্পাদিত হয়। যথা,

ব্রহ্মচারী গৃহস্থশ্চ বানপ্রস্থে! যতিস্তথা। ক্রমেণৈবাশ্রমাঃ প্রোক্তাঃ কারণাদন্যথা ভবেৎ । (২৫)

ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানগ্রন্থ, যতি, যথাক্রমে এই চারি আশ্রম বিহিত হইয়াছে; কারণ বশতঃ, অ্যথা হইতে পারে।

এই শাস্ত্রে, প্রথমতঃ, যথাক্রমে, চারি আশ্রম বিহিত হইয়াছে; অর্থাৎ, প্রথমে ব্রহ্মচর্য্য, তৎপরে গার্হস্থ্য, তৎপরে বানপ্রস্থ, তৎপরে, পরিব্রজ্যা, অবলম্বন করিবেক; কিন্তু, পরে, বিশিষ্ট কারণ ঘটিলে, এই ব্যবস্থার অ্যথাভাব ঘটিতে পারিবেক, ইহা নির্দিষ্ট হইয়াছে। সুতরাং, বিশিষ্ট কারণ ঘটনা ব্যতিরেকে, পূর্বব ব্যবস্থার অন্যথাভাব ঘটিতে পারিবেক না, তাহাও অর্থাৎ সিদ্ধ হইতেছে। এক্ষণে, সেই বিশিষ্ট কারণ নিৰ্দ্দিষ্ট হইতেছে। যথা,

সর্বেষামেব বৈরাগ্যং জায়তে সর্বববস্তুযু।

তদৈব সন্ন্যসেদ্বিদ্বানথো পতিতো ভবেৎ ।

পুনর্দারক্রিয়াভাবে মৃতভার্য্যঃ পরিব্রজেৎ।

বনাদ্বা ধৃতপাপো বা পরং পন্থানমাশ্রয়েৎ ॥

প্রথমাদাশ্রমাদ্বাপি বিরক্তো ভবসাগরাৎ।

ব্রাহ্মণে। মোক্ষমন্বিচ্ছন্ ত্যজ্জ্বা সঙ্গান্ পরিব্রজেৎ ॥ (২৬)

যখন সাংসারিক সর্ব্ব বিষয়ে বৈরাগ্য জন্মিবেক, বিদ্বান ব্যক্তি, সেই সময়েই, সন্ন্যাস আশ্রয় করিবেক। অন্তথা, অর্থাৎ তাদৃশ বৈরাগ্য ব্যতিরেকে সন্ন্যাস অবলম্বন করিলে, পতিত হইবেক। গৃহস্থাশ্রমকালে স্ত্রীবিয়োগ ঘাটলে, যদি পুনরায় দারপরিগ্রহ না ঘটে, তাহা হইলে সন্ন্যাস অবলম্বন করিবেক; অথবা, বানপ্রস্থাশ্রম অবলম্বন পূর্বক পাপক্ষয় করিয়া, মোক্ষপথ অবলম্বন করিবেক। সাংসারিক বিষয়ে বৈরাগ্য জন্মিলে, মোক্ষার্থী ব্রাহ্মণ, সর্ব্ব সঙ্গ পরিত্যাগ পূর্ব্বক, প্রথম আশ্রম হইতেই, সন্ন্যাস অবলম্বন করিবেক।।

যস্যৈতানি সুগুপ্তানি জিহ্বোপস্থোদরং শিরঃ। সন্ন্যসেদক্বতোদ্বাহো ব্রাহ্মণোঁ ব্রহ্মচর্য্যবান্ (২৭) ॥

যাহার জিহ্বা, উপস্থ, উদর, ও মস্তক সুরক্ষিত, অর্থাৎ বিক্রয়বাসনায় বিচলিত না হয়, তাদৃশ ব্রাহ্মণ, ব্রহ্মচর্য্য সমাধানাস্তে, বিবাহ, না করিয়াই, সন্ন্যাস অবলম্বন করিবেক।

সংসারমেব নিঃসারং দৃষ্ট। সারদিদৃক্ষয়া। প্রব্রজেদকৃতোদ্বাহঃ পরং বৈরাগ্যমাশ্রিতঃ ।। প্রব্রজেব্রহ্মচর্য্যেণ প্রব্রজেচ্চ গৃহাদপি। বনাদ্বা প্রব্রজে দ্বিদ্বানাতুরো বাথ দুঃখিতঃ (২৮) ॥

.....রকে নিঃসার দেখিয়া, সারদর্শন বাসনায়, বৈরাগ্য অবলম্বন পূর্বক, বিবাহ না করিয়াই, সন্ন্যাস অবলম্বন করিবেক। বিদ্বান, রোগার্ড, অথবা দুঃখার্ত ব্যক্তি ব্রহ্মচর্য্য। শ্রম হইতে, অথবা গৃহস্থাশ্রম হইতে, অথবা বানপ্রস্তাশ্রম হইতে, সন্ন্যাস, অবলম্বন করিবেক।

এই সকল শাস্ত্রে স্পষ্ট দৃষ্ট হইতেছে, সাংসারিক সর্ব বিষয়ে বৈরাগ্য জন্মিলে, গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ না করিয়াও, সন্ন্যাস অবলম্বন করিতে পারে; তাদৃশ কারণ ব্যতিরেকে, গৃহস্থাশ্রমে বিমুখ হইয়া, সন্ন্যাস আশ্রয় করিলে পতিত হয়। ইহা দ্বারা নিঃসংশয়ে প্রতিপন্ন হইতেছে, যে ব্যক্তি সংসারে বিরক্ত হইবেক, সে, গৃহস্থাশ্রম অবলম্বন না করিয়াই, সন্ন্যাস অবলম্বন করিতে পারিবেক; আর, যে ব্যক্তি বিরক্ত না হইবেক, সে তাহা করিতে পারিবেক না, করিলে পতিত হইবেক। সংসারবিরক্ত ব্যক্তি ব্রহ্মচর্য্যের পরেই সন্ন্যাসে অধিকারী; আর, সংসারে অবিরক্ত ব্যক্তি তাহাতে অধিকারী নহে। বিরক্ত ব্যক্তির পক্ষে, গৃহস্থাশ্রমপ্রবেশের আবশ্যকতা নাই; অবিরক্ত ব্যক্তির পক্ষে, গৃহস্থাশ্রমপ্রবেশের আবশ্যকতা আছে। সুতরাং, গৃহস্থাশ্রমের নিত্যত্বব্যবস্থ। অবিরক্তের পক্ষে, গৃহস্থাশ্রমের অনিত্যত্বব্যবস্থা বিরক্তের পক্ষে। জাবালশ্রুতিতে এ বিষয়ের সার দীমাংসা আছে। যথা,

ব্রহ্মচর্য্যং পারসমাপ্য গৃহী ভবেৎ গৃহী ভূত্বা বনী ভবেৎ বনী ভূত্বা প্রব্রজেৎ, যদিবেতরখা ব্রহ্মচর্য্যা- দেব প্রব্রজেৎ গৃহাদ্বা বনাদ্বা যদহরেব বিরজ্যেত। তদহরেব প্রব্রজেৎ (২৯)।

ব্রহ্মচর্য্য সমাপন করিয়া গৃহস্থ হইবেক, গৃহস্থ হইয়া বানপ্রস্থ হইবেক, বানপ্রস্থ হইয়া সন্ন্যাসী হইবেক। যদি বৈরাগ্য জন্মে, ব্রহ্মচর্য্যাশ্রম, কিংবা গৃহস্থাশ্রম, অথবা বানপ্রস্থাশ্রম হইতে সন্ন্যাস আশ্রয় করিবেক। যে দিন বৈরাগ্য জন্মি- বেক, সেই দিনেই সন্ন্যাস আশ্রয় করিবেক।

এই বেদবাক্যে, প্রথমতঃ, যথাক্রমে চারি ধাশ্রমের বিধি, তৎপরে বৈরাগ্য জন্মিলে, যে আশ্রমে থাকুক, সন্ন্যাস অবলম্বনের বিধি, এবং বৈরাগ্য জন্মিবামাত্র, সংসার পরিত্যাগ করিবার বিধি, প্রদত্ত হইয়াছে।

এক্ষণে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, আশ্রম বিষয়ে, বিরক্ত ও অবিরক্ত, এই দ্বিবিধ অধিকারিভেদে ব্যবস্থা করা শাস্ত্রকারদিগের অভিপ্রেত ও অনুমোদিত কি না; এবং, এরূপ অধিকারিভেদব্যবস্থা অবলম্বন করিলে, আপাততঃ বিরুদ্ধবৎ প্রতীয়মান আশ্রমবিষয়ক দ্বিবিধ শাস্ত্রসমূহের সর্বতোভাবে সামঞ্জস্ত হইতেছে কি না। তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের সন্তোষার্থে, এস্থলে ইহাও উল্লিখিত হওয়া আবশ্যক, এই অধিকারিভেদ- ব্যবস্থা আমার কপোলকল্পিত, অথবা লোক বিমোহনের নিমিত্ত, বুদ্ধিবলে উদ্ভাবিত, অভিনব সিদ্ধান্ত নহে। পরাশরভা্যে মাধবাচার্য্য এই সিদ্ধান্ত করিয়া গিয়াছেন। যথা, "যদর্শ জন্মান্তরানুষ্ঠিতসুকৃতপরিপাকবশাৎ বাল্য এব বৈরাগ্যমুপ- জায়তে তদানীমকৃতোদ্বাহো ব্রহ্মচর্য্যাদেব, প্রব্রজেৎ তথাচ জাবালশ্রুতিঃ ব্রহ্মচর্য্যং পরিসমাপ্য গৃহী ভবেৎ গৃহী ভূত্বা বনী ভবেৎ বনী ভূত্বা প্রব্রজেৎ যদিবেতরথা ব্রহ্মচর্য্যাদেব প্রব্রজেৎ গৃহাদ্বা বনাদেতি পূর্ব্বমবি-ক্তং বালং প্রতি আশ্রমচতুষ্টয়ায়" বিভাগেনোপ্যন্ত বিরক্তমুদ্দিশ্য যদিবেতি পক্ষান্তরোপ্যাসঃ ইতরথেতি বৈরাগ্যে ইত্যর্থঃ।

নম্ন ব্রহ্মচর্য্যাদেব প্রব্রজ্যাঙ্গীকারে মনুবচনানি বিরুধ্যেরন্ ঋণানি ত্রীণ্যপাকৃত্য মনো মোক্ষে নিবেশয়েৎ। অনপাকৃত্য মোক্ষন্তু সেবমানো ব্রজত্যধঃ ॥ অধীতা, বিধিবদ্বেদান পুভ্রানুৎপাদ্য ধৰ্ম্মতঃ। ইষ্টু। চ শক্তিতো যজ্ঞৈর্মনো মোক্ষে নিবেশয়েৎ ॥ " অনধীত্য গুরোবেদাননুৎপাদ্য তথাত্মজান।' অনিষ্টু। চৈব যজ্ঞৈশ্চ মোক্ষমিচ্ছন্ ব্রজত্যধ ইতি ॥

ঋণত্রয়ং শ্রুত্যা দর্শিতং জায়মানো বৈ ব্রাহ্মণস্ত্রিভিঋণবান্ জায়তে ব্রহ্মচর্য্যেণ ঋবিভ্যঃ যজ্ঞেন দেবেভ্যঃ প্রজয়া পিতৃভ্যঃ এষ বা অনূণো যঃ পুত্রী যজ্ঞা ব্রহ্মচর্য্যবানিতি। মৈবম্ অবিরক্ত- বিষয়ত্বাদেতেবাং বচনানাম্ অতএব বিরক্তস্ত প্রব্রজ্যায়াং কাল- বিলম্বং নিষেধতি জাবালশ্রুতিঃ যদহরেব বিরজ্যেত তদহরেব প্রব্রজেদিতি” (৩০)।

যদি, জন্মান্তরে অনুষ্ঠিত সুকৃতবলে, বাল্য কালেই বৈরাগ্য জন্মে, তাহা হইলে, বিবাহ না করিয়া, ব্রহ্মচর্য্য আশ্রম হইতেই পরিব্রজ্যা করিবেক। জাবাল- শ্রুতিতে বিহিত হইয়াছে, "ব্রহ্মচর্য্য সমাপন করিয়া গৃহস্থ হইবেক, গৃহস্থ হইয়া বানপ্রস্থ হইবেক, বানপ্রন্থ হইয়া পরিব্রাজক হইবেক। যদি বৈরাগ্য জন্মে, ব্রহ্মঞ্চৰ্য্যাশ্রম, কিংবা গৃহস্থাশ্রম, অথব। বানপ্রস্থাশ্রম হইতে সন্ন্যাস আশ্রয় করিবেক"। প্রথমে, অবিরক্ত অজ্ঞের পক্ষে, কালভেদে আশ্রমচতুষ্টয়ের বিধি প্রদান করিয়া, বিরক্তের পক্ষে, যে কোনও আশ্রম হইতে গরিব্রজ্যা ব礎ম্বনরূপ পক্ষান্তর প্রদর্শিত হইয়াছে।

যদি বল, ব্রহ্মচর্য্যের পন্থ পরিব্রজ্যার অবলম্বন অঙ্গীকৃত হইলে, মনুবাকোর সহিত বিরোধ উপস্থিত হয়। যথা "গুণত্রয়ের পরিশোধ করিয়া, মোক্ষে মনোনিবেশ করিবেক। ঋণ পরিশোধ না করিয়া, মোক্ষপণ অবলম্বন করিলে, অধোগতি প্রাপ্ত হয়। বিধি পূর্ব্বক বেদাধ্যয়ন, ধর্মতঃ পুত্রোৎপাদন এবং যথাশক্তি যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া, মোক্ষে মন্ত্রেরানিবেশ করিবেক। বেদাধ্যয়ন, পুত্রোৎপাদন ও যজ্ঞানুষ্ঠান না করিয়া, দ্বিজ মোক্ষকামনা করিলে, অধোগতি প্রাপ্ত হয়"। বেদে ঋণত্রয় দর্শিত হইয়াছে; যথা, "ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করিয়া, ব্রহ্মচর্যা দ্বারা ঋধিগণের নিকট, যজ্ঞ দ্বারা দেবগণের নিকট, পুত্র দ্বারা পিতৃ গণের নিকট, ঋণে বন্ধ হয়; যে ব্যক্তি পুত্রোৎপাদন, যজ্ঞানুষ্ঠান, ও ব্রহ্মচর্য্য নির্ব্বাহ করে, সে ঐ ত্রিবিধ ঋণে মুক্ত হয়"। এ আপত্তি হইতে পারে না, কারণ, উল্লিখিত মনুবচনসকল অবিরক্ত ব্যক্তির পক্ষে, শুতরাং বিরোধের সম্ভাবনা নাই; এজন্ত, জাবালশ্রুতিতে বিরক্ত ব্যক্তির পরিব্রজ্যা অবলম্বন বিষয়ে কালবিলম্ব নিষিদ্ধ হইয়াছে; যথা, "যে দিন বৈরাগ্য জন্মিবেক, সেই দিনেই সন্ন্যাস আশ্রয় করিবেক"।

যে সমস্ত প্রমাণ প্রদর্শিত হইল, কিঞ্চিৎ অভিনিবেশ সহকারে, সে সমুদয়ের আলোচনা পূর্ব্বক, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, মিতাক্ষরাধৃত এক মাত্র বচনের যথাশ্রুত অর্থ আশ্রয় করিয়া, শ্রীমান তারানাথ তর্কবাচস্পতি মহোদয় 'গৃহস্থা শ্রম কাম্য, নিত্য নহে, এই যে ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহা শাস্ত্রানুমত ও ন্যায়ানুগত হইতে পারে কি না।

যেরূপ দর্শিত হইল, তদনুসারে, বোধ করি, গৃহস্থাশ্রমের নিত্যত্ব একপ্রকার সংস্থাপিত হইল; সুতরাং, "গৃহস্থাশ্রমের রাগপ্রাপ্ততা বশতঃ গৃহস্থাশ্রম প্রবেশমূলক বিবাহও রাগপ্রাপ্ত, সুতরাং উহা কাম্য বলিয়াই পরিগণিত হওয়া উচিত,” সর্ব- শাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি, মহাশয়ের অবলম্বিত এই ব্যবস্থা সম্যক্ আদরণীয় হইতে পারে না।

এক্ষণে, বিবাহের নিত্যত্ব সম্ভব কি না, তাহার আলোচনা করিবার নিমিত্ত, বিবাহবিষয়ক বিধিবাক্য সকল উদ্ধৃত হইতেছে।

১। গুরুণানুমতঃ স্নাত্বা সমাবৃত্তো যথাবিধি।

19 উদ্ধহেত দ্বিজো ভার্যাং সবর্ণাং লক্ষণান্বিতাম্ (৩১) ॥ দ্বিজ, গুরুর অনুজ্ঞালাভাস্তে, যথাবিধানে স্নান ও সমাবর্তন করিয়া, সজাতীয়া সুলক্ষণ। ক্যার পাণিগ্রহণ করিবেক।

২। অবিপ্লতব্রহ্মচর্য্যো লক্ষণ্যাং স্ত্রিয়মুদ্ধহেৎ (৩২)। যথাবিধানে ব্রহ্মচর্য্যনির্ব্বাহ করিয়া, সুলক্ষণ। কস্তার পাণিগ্রহণ করিবেক।

৩। বিন্দেত বিধিবদ্ভাৰ্য্যামসমানার্ষগোত্রজাম্ (৩৩)। যথাবিধি অসমা: গোত্রা, অসমানপ্রবরা কম্ভার পাণিগ্রহণ করিবেক।

৪। গৃহস্থঃ সদৃশীং ভার্য্যাং বিন্দেতান্যপূর্বাং যবীয়সীম্ (৩৪)। গৃহস্থ সজাতীয়া, বয়ঃকনিষ্ঠা, অন্যপূর্ব্বা ক্যার পাণিগ্রহণ করিবেক।

৫। গৃহস্থো বিনীতক্রোধহর্ষে। গুরুণামুজ্ঞাতঃ স্নাত্বা অসমানা- র্যামস্পৃষ্টমৈথুনাং যবীয়সীং সদৃশীং ভার্য্যাং বিন্দেত (৩৫)।

গৃহস্থ, ক্রোধ ও হর্ষ বশীকৃত করিয়া, গুরুর অনুজ্ঞালাভান্তে সমাবর্তন পূর্ব্বক, 'অনমনিপ্রবরা, অক্ষতযোনি, বয়ঃ কনিষ্ঠা, সজাতীয়া ক্যার পাণিগ্রহণ করিবেক।

৬। অথ দ্বিজোহভ্যনুজ্ঞাতঃ সবর্ণাং স্ত্রিয়মুদ্ধহেৎ। কুলে মহতি সম্ভূতাং লক্ষণৈশ্চ সমন্বিতাম্। ব্রাহ্মেণৈব বিবাহেন শীলরূপগুণান্বিতাম্ (৩৬) ।

দ্বিজ, বেদাধ্যয়নানন্তর গুরুর অনুজ্ঞা লাভ করিয়া, ব্রাহ্ম বিধানে, স্বশীলা, সুলক্ষণা, রূপবতী, গুণবতী, মহাকুলপ্রসূতা, সবর্ণা ক্যার পাণিগ্রহণ করিবেক।

৭। গৃহীতবেদাধ্যয়নঃ শ্রুতশাস্ত্রার্থতত্ত্ববিৎ। অসমানার্ষগোত্রাং হি কন্যাং সভ্রাতৃকাং শুভাম্। সর্বাবয়বসম্পূর্ণাং সুবৃত্তামুদ্ধহেন্নরঃ (৩৭) ॥

অনুন্য, যথাবিধি বেদাধ্যয়ন ও অধীত শাস্ত্রের অর্থগ্রহণ করিয়া, অসগোলা, অসমানপ্রবরা, ভ্রাতৃমতী, শুভলক্ষণা, সর্বাঙ্গসম্পূর্ণা, সচ্চরিত্রা কন্যার পাণি গ্রহণ করিবেক।

৮। সজাতিমুদ্ধহেৎ কন্যাং সুরূপাং লক্ষণান্বিতাম্ (৩৮)। সজাতীয়া, স্বরূপা, সুলক্ষণ। ক্যার পাণিগ্রহণ করিবেক।

৯। বুদ্ধিরূপশীললক্ষণসম্পন্নামরোগামুপযচ্ছেত। (৩৯)। বুদ্ধিমতী, স্বরূপা, সুশীলা, সুলক্ষণা, অরোগিণী কস্তার পাণি (হণ করিবেক।

১০। লক্ষণ্যো বরো লক্ষণবতীং কন্যাং যবীয়সী মসপিণ্ডামস- গোত্রজামবিরুদ্ধসম্বন্ধামুপযচ্ছেৎ। (৪০)।

লক্ষণযুক্ত বর লক্ষণবতী, বয়ঃকনিষ্ঠা, অসপিণ্ডা, অসগোত্রা, অবিরুদ্ধসম্বন্ধ। ক্যার পাণিগ্রহণ করিবেক।

১১। কুলজাং সুমুখীং স্বঙ্গীং সুকেশাঞ্চ মনোহরাম্। t সুনেত্রাং সুভগাং ক্যাং নিরীক্ষ্য বরয়েদুধঃ (৪১)।

পণ্ডিত ব্যক্তি সংকুলজাতা, হুমুখী, শোভনাঙ্গী, হক্কেশা, মনোহরা, সুনেত্রা, শুভগ। ক্যা দেখিয়া তাহার পাণিগ্রহণ করিবেক।

১২। সবর্ণাং ভার্য্যামুদ্ধহেৎ (৪২)। সবর্ণা ক্যার পাণিগ্রহণ করিবেক।

১৩। বেদানধীত্য বিধিনা সমাবৃত্তোহপ্ল তত্রতঃ। সমানামুদ্বহেৎ পত্নীং যশঃশীলবয়োগুণৈঃ (৪৩) ।

যথাবিবি বেদাধ্যয়ন ও ব্রহ্মচর্য্যসমাধান পূর্ব্বক সমাবর্তন করিয়া, যশ, নীল, বয়স্ ও গুণে স্বসদৃশী কন্তার পাখিগ্রহণ করিবেক।

১৪। লব্ধাভ্যমুজ্ঞো গুরুতো দ্বিজো লক্ষণসংযুতাম্।- বুদ্ধিশীলগুণোপেতাং কন্যকামণ্যগোত্রজাম্। আত্মনোহবর বর্ষাঞ্চ বিবহেদ্বিধিপূর্বকম্ (৪৪)।

দ্বিজ, গুরুর অনুজ্ঞ। লাভ করিয়া, বিধি পূর্ব্বক, হুলক্ষণা, বুদ্ধিমতী, সুশীলা, গুণবতী, অসগোত্রা, বয়ঃকনিষ্ঠা কন্তার পাণিগ্রহণ করিবেক।

১৫। গুরুং বা সমনুজ্ঞাপ্য প্রদায় গুরুদক্ষিণাম্।

সদৃশানাহরেদ্দারান্ মাতাপিতৃমতে স্থিতঃ (৪৫) । গুরুত্ব অনুজ্ঞা লাভ ও গুরুদক্ষিণা প্রদান করিয়া, পিতা মাতার মতানুবর্তী হইয়া, সজাতীয়া ক্যার পাণিগ্রহণ করিবেক।

১৬। বেদং বেদো চ বেদান্ বা ততোহধীত্য যথাবিধি। অবিশীর্ণব্রহ্মচর্য্যো দারান্ কুব্বীত ধৰ্ম্মতঃ (৪৫) ।

যথাবিধি এক বেদ, দুই বেদ, বা সকল বেদ অধ্যয়ন করিয়া, ব্রহ্মচর্য্য সমাপন পূর্বরুক্ষ, ধর্ম অনুসারে, দারপরিগ্রহ করিবেক।

১৭। সমাবর্ত্য সবর্ণান্ত লক্ষণ্যাং স্ত্রিয়মুদ্ধহেৎ (৪৬)। সমাবর্তন করিয়া, সজাতীয়া, সুলক্ষণা কক্ষার পাণিগ্রহণ করিবেক।

১৮। অপাকৃত্য ঋণঞ্চার্যং লক্ষণ্যাং প্রিয়মুদ্ধহেৎ (৪৭) । ঋষিঋণের পরিশোধ করিয়া, অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য্য নির্ব্বাহ পূর্ব্বক, সুলক্ষণা ক্যার পাণিগ্রহণ করিবেক।

১৯। বেদানধীত্য যত্নেন পাঠতো জ্ঞানতস্তথা। সমাবর্ত্তনপূর্ব্বস্তু লক্ষণ্যাং স্ত্রিয়মুদ্ধহেৎ (৪৮) ।

যত্ন পূর্ব্বক বেদের পাঠ ও অর্থগ্রহ করিয়া, সমাবর্তন পূর্ব্বক, সুলক্ষণ! কন্সার পাণিগ্রহণ করিবেক।

২০। অতঃপরং সমাবৃত্তঃ কুর্য্যাদ্দারপরিগ্রহম্ (৪৯)। অতঃপর, সমাবর্তন করিয়া, দারপরিগ্রহ করিবেক।

২১। সপ্তমীং পিতৃপক্ষাচ্চ মাতৃপক্ষাচ্চ পঞ্চমীম্। উদ্ধহেত দ্বিজো ভাৰ্য্যাং ন্যায়েন বিধিনা নৃপ (৫০) ।

দ্বিজ, পিতৃপক্ষে সপ্তমী ও মাতৃপক্ষে পঞ্চমী ত্যাগ করিয়া, ফায়ানুসারে, যথাবিধি, দারপরিগ্রহ করিবেক।

২২। অসমানার্যেয়ীং ক্যাং বরয়েৎ (৫১)।

অসমানপ্রবরা, কম্ভার পাণিগ্রহণ করিবেক।

২৩। স্নাহা সমুদ্ধহেৎ কন্যাং সবর্ণাং লক্ষণান্বিতাম্ (৫২)। সমাবর্তন করিয়া, সজাতীয়া, হলক্ষণা কন্যার পাণিগ্রহণ করিবেক।

২৪। দারাধীনাঃ ক্রিয়াঃ সর্ববা ব্রাহ্মণ্য বিশেষতঃ। দারান্ সর্ববপ্রযত্নেন বিশুদ্ধাশুদ্ধহেত্ততঃ (৫৩) ।

গৃহস্থাশ্রম সংক্রান্ত যাবতীয় ক্রিয়া স্ত্রী ব্যতিরেকে সম্পন্ন হয় না; বিশেষতঃ' ব্রাহ্মণজাতির। অতএব, সর্ব্ব প্রযত্নে নির্দোষ। কস্তার পাণিগ্রহণ করিবেক।

পূর্বের দর্শিত হইয়াছে, বিধিবাক্যে ফলশ্রুতি না থাকিলে, ঐ বিধি নিত্য বিধি বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে। বিবাহবিষয়ক যে সকল বিধিবাক্য প্রদর্শিত হইল, তাহার একটিতেও ফলশ্রুতি নাই; সুতরাং, বিবাহবিষয়ক বিধি নিত্য বিধি হইতেছে; এবং, সেই নিত্য বিধি অনুযায়ী বিবাহের নিত্যত্বও সুতরাং সিদ্ধ হইতেছে।

পত্নীমূলং গৃহং পুংসাম্ (৫৪)।

পত্নী পুরুষদিগের গৃহস্থাশ্রমের মূল।

• ন গৃহেণ গৃহস্থঃ শ্যাম্ভার্য্যয়া কথ্যতে গৃহী। যত্র ভাৰ্য্যা গৃহং তত্র ভার্য্যাহীনং গৃহং বনম্ (৫৫)।

কেবল গৃহবাস দ্বারা গৃহস্থ হয় না; ভার্য্যার সহিত গৃহে বাস করিলে গৃহস্থ হয়। যেখানে ভাৰ্য্যা, সেই খানে গৃহ ভাৰ্য্যাহীন গৃহ বন।

এই দুই শাস্ত্র অনুসারে, স্ত্রী গৃহস্থাশ্রমের মূল, স্ত্রী ব্যতিরেকে গৃহস্থাশ্রম হয় না, এবং স্ত্রীবিরহিত ব্যক্তি গৃহস্থ বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে না। সুতরাং, অকৃতদার বা মৃতদার ব্যক্তি আশ্রমভ্রষ্ট।

অনাশ্রমী ন তিষ্ঠেত্ত দিনমেকমপি দ্বিজঃ। আশ্রমেণ বিনা তিষ্ঠন্ প্রায়শ্চিত্তীয়তে হি সঃ (৫৬) ॥

দ্বিজ, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য এই তিন বর্ণ, আশ্রমবিহীন হইয়া এক দিনও থাকিবেক না; বিনা আশ্রমে ঋবস্থিত হইলে, পাতকগ্রস্ত হয়।

এই শাস্ত্রে, গৃহস্থ ব্যক্তির, প্রথম অবস্থায়, অথবা মৃতদার অবস্থায়, বিবাহের, অকরণে স্পষ্ট দোষশ্রুতি দৃষ্ট হইতেছে। অষ্টচত্বারিংশদব্দং বয়ো যাবন্ন পূর্য্যতে। পুত্রভার্য্যাবিহীনশ্য নাস্তি যজ্ঞাধিকারিতা (৫৭)

যাবৎ আটচল্লিশ বৎসর বয়স্ পূর্ণ না হয়, পুত্রহীন ও ভাৰ্য্যাহীন ব্যক্তির যজ্ঞে অধিকার নাই।

এই শাস্ত্রেও, আটচল্লিশ বৎসর বয়স পর্য্যন্ত, স্ত্রীবিরহিত ব্যক্তির পক্ষে, বিলক্ষণ দোষশ্রুতি লক্ষিত হইতেছে।

মেখলাজিনদণ্ডেন ব্রহ্মচারী তু লক্ষ্যতে।

গৃহস্থে। দেবযজ্ঞাছৈঘর্নখলোম্বা বনাশ্রিতঃ।

• ত্রিদণ্ডেন যতিশ্চৈব লক্ষণানি পৃথক্ পৃথক্। যস্তৈতল্লক্ষণং নাস্তি প্রায়শ্চিত্তী নচাশ্রমী (৫৮) ।।

মেখলা, অজিন, দণ্ড ব্রহ্মচারীর লক্ষণ; দেবযজ্ঞ প্রভৃতি গৃহস্থের লক্ষণ; নগ, লোম প্রভৃতি বানপ্রস্থের লক্ষণ; ত্রিদণ্ড যতির লক্ষণ: এক এক আশ্রমের এই সকল পৃথক্ পৃথক্ লক্ষণ; যাহার এই লক্ষণ নাই, সে ব্যক্তি প্রায়শ্চিত্তী ও আশ্রমভ্রষ্ট।

এই শাস্ত্রেও, বিবাহের অকরণে, স্পষ্ট দোশ্রুতি লক্ষিত হইতেছে। দেবযজ্ঞ প্রভৃতি কৰ্ম্ম গৃহস্থাশ্রমের লক্ষণ; কিন্তু, স্ত্রীর সহযোগ ব্যতিরেকে, ঐ সকল কৰ্ম্ম সম্পন্ন হয় না; সুতরাং, স্ত্রীবিরহিত ব্যক্তি আশ্রমভ্রষ্ট ও প্রত্যবায়গ্রস্ত হয়।

এক্ষণে সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, এই সকল বচনে বিবাহবিধির লঙ্ঘনে দোষশ্রুতি লক্ষিত হইতেছে কি না। লঙ্ঘনে দোষশ্রুতিও বিধির নিত্যত্বপ্রতিপাদক; সুতরাং, লঙ্ঘনে দোষ: শ্রুতি দ্বারা বিবাহবিধির, ও তদনুযায়ী বিবাহের, নিত্যত্ব সিদ্ধ হইতেছে।

অপরঞ্চ, শাস্ত্রান্তরেও বিবাহবিধির লঙ্ঘনে সুস্পষ্ট দোষ- শ্রুতি দৃষ্ট হইতেছে। যথা, 4

অদারস্য গতিনাস্তি সর্ববাস্ত্যাফলাঃ ক্রিয়াঃ। সুরাচ্চনং মহাযজ্ঞং হীনভার্য্যো বিবর্জ্জয়েৎ ॥

একচক্রো রথো যদ্বদেকপক্ষো যথা খগঃ। অভার্য্যোহপি নরস্তদ্বদযোগ্যঃ সর্ববকৰ্ম্মপু॥ ভার্য্যাহীনে ক্রিয়া নাস্তি ভার্য্যাহীনে কুতঃ সুখম্। ভাৰ্য্যাহীনে গৃহং কস্য তস্মান্তার্য্যাং সমাশ্রয়েৎ ॥ সর্বম্বেনাপি দেবেশি কর্তব্যো দারসংগ্রহঃ (৫৯)।

ভার্য্যাহীন ব্যক্তির গতি শাই; তাহার সকল ক্রিয়া নিষ্ফল; ভার্য্যাহীনের "দেবপূজায় ও মহাযজ্ঞে অধিকার নাই; একচক্র রখ ও একপক্ষ পক্ষীর হ্যায়, ভাৰ্য্যাহীন ব্যক্তি সকল কার্য্যে অযোগ্য; ভার্য্যাহীনের ক্রিয়ায় অধিকার নাই; ভার্য্যাহীনের সুখ নাই; ভাৰ্য্যাহীনের গৃহ নাই; অতএব ভাৰ্য্যা আশ্রয় করি- বেক। হে দেবেশি! সর্ব্বস্বান্ত কন্সিয়াও, দারপরিগ্রহ করিবেক।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

যে সমস্ত শাস্ত্র প্রদর্শিত হইল, তদনুসারে, বোধ করি, বিবাহের নিত্যত্ব একপ্রকার সংস্থাপিত হইতেছে। এক্ষণে, তর্কবাচস্পতি মহাশয় যেরূপে বিবাহের নিত্যত্ব খণ্ডন করিয়াছেন, তাহার আলোচনা করা আবশ্যক। তিনি লিখিয়াছেন,

"অথ বিবাহ্য ত্রৈবিধ্যাবান্তরভেদেযু নিত্যত্বং যছররীক্বতং তৎ কস্মাৎ হেতোঃ কিং তন্বিনা বিবাহস্বরূপাসিদ্ধেঃ উত বিবাহফলা- সিন্ধেঃ উত শাস্ত্রপ্রমাণানুসারিত্বাৎ। না্যদ্বিতীয়েী নিত্যত্বং বিনাপি বিবাহস্বরূপফলানাং সিদ্ধেঃ ন হি নিত্যত্বং বিবাহস্বরূপ্ন- নির্ব্বাহকং কেনাপ্যুররীক্রিয়তে ফলাসিদ্ধিপ্রয়োজকত্বং তু সুর- পরাহতং নিত্যকর্ম্মণঃ ফলনৈয়ত্যাভাবাৎ। তৃতীয়ঃ পক্ষঃ পরিশিষ্যতে তত্রাপীদমুচ্যতে প্রতিজ্ঞামাত্রেণ সাধ্যসিদ্ধেরনভ্যুপ- গমাৎ হেতুভূতপ্রমাণস্ত তত্রানির্দেশাৎ ন ত্য সাধ্যসাধকত্বম্। অথ অকরণে প্রত্যবায়ান্নবন্ধিত্বমেব নিত্যত্বে হেতুরুচ্যতে অকরণে প্রত্যবায়াম্নবন্ধিত্বনির্ণয়স্তাপি বলবদাগমসাধ্যত্বাৎ আগমস্ত চ তত্রানির্দেশাৎ কথঙ্কারং তাদৃশহেতুনা সাধ্যসিদ্ধিঃ নিশ্চিত- হেতোরেব সাধ্যসিদ্ধেঃ প্রয়োজকত্বাৎ প্রত্যুত

যদহরেব বিরজ্যেত তদহরেব প্রব্রজেৎ

ব্রহ্মচর্য্যাদ্বা বনাদ্বা গৃহাদ্বা ইতি শ্রুত্যা বৈরাগ্যমাত্রতঃ, প্রব্রজ্যায়া উক্ত্যা গৃহস্থাশ্রমন্ত্য নিত্যত্ববাধনাৎ।

অবিপ্লুতব্রহ্মচর্য্যো যমিচ্ছেত্ত তমাবসেৎ ইতি প্রাগুক্তবচনেন গৃহস্থাশ্রমাদেঃ ইচ্ছাধীনত্বোক্তেঃ নৈষ্ঠিক- ব্রহ্মচারিণশ্চ গৃহস্থাশ্রম ভাব্য সর্ব্বসম্মতত্বাচ্চ। এবং তন্নিত্যত্বা- ভাবে তদধীনপ্রবৃত্তিকন্তু বিবাহস্ত কথং নিত্যত্বং তাৎ। অনাশ্রমী ন তিষ্ঠেত্ত দিনমেকমপি দ্বিজঃ। আশ্রমেণ বিনা তিষ্ঠন্ প্রায়শ্চিত্তীয়তে হি সঃ ॥

ইতি দক্ষবচনে তু দ্বিজানামাশ্রমমাত্রম্ভ্যৈব অকরণে, প্রত্যবায়ান্ন- বন্ধিত্বকথনেহপি গৃহস্থাশ্রমমাত্র্য নিত্যত্বাপ্রাপ্তেঃ। অত্র চ দ্বিজ পদ্যোপলক্ষণপরত্বং যদভিহিতং তদপি প্রমাণসাপেক্ষত্বাৎ প্রমাণস্ত চানুপন্যাসাছপেক্ষ্যমেব (৬০)।"

বিবাহের ত্রৈবিধ্যের অবান্তরভেদের মধ্যে যে নিত্যত্ব অঙ্গীকৃত হইয়াছে, সে কি হেতুতে, কি তদ্ব্যতিরেকে বিবাহের স্বরূপ অসিদ্ধ হয় এই হেতুতে, কিংবা বিবাহের ফল সিদ্ধ হয় এই হেতুতে, অথবা শাস্ত্রের প্রমাণ অবলম্বন করিয়া, তাহা করা হইয়াছে। তন্মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় হেতু সম্ভবে না, কারণ বিবা হের নিত্যত্ব বাতিরেকে বিবাহের স্বরূপ ও ফল সিন্ধ হইয়া থাকে, নিত্যত্ব বিবাহের স্বরূপনির্ব্বাহক, ইহা কেহই স্বীকার করেন না: নিতাত্ব ব্যতিরেকে বিবাহের ফল অসিদ্ধ হয় এ কথা সুদূরপরাহত, নিত্য কর্ম্মের ফলের নৈয়তা নাই। তৃতীয় পক্ষ অবশিষ্ট থাকিতেছে, সে বিষয়েও বক্তব্য এই, কেবল প্রতিজ্ঞা, দ্বারা সাধ্য সিদ্ধ হয়, ইহা কেহই স্বীকার করেন না: সাধ্যসিদ্ধির হেতুভূত প্রমাণের নির্দেশ নাই, হুতরাং, উহা সাধ্যসাধক হইতে পারে না। যদি বল, অকরণে প্রত্যবায়জনকতা নিত্যত্বের হেতু, কিন্তু অকরণে প্রত্যবায়- জনকতার নির্ণয়ও বলবৎ শাস্ত্র ব্যতিরেকে হইতে পারে না, কিন্তু তথায় শাস্ত্রের নির্দেশ নাই; অতএব কিরূপে তাদৃশ হেতু দ্বারা সাধ্যসিদ্ধ হইতে পারে, নির্ণীত হেতুই সাধ্যসিদ্ধির প্রয়োজক; প্রত্যুত, "যে দিন বৈরাগ্য জন্মিবেক, সেই দিনেই ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য, অথবা বানগ্রন্থ আশ্রম হইতে পরিব্রজ্যা করিবেক। এই বেদবাক্যে বৈরাগ্য জন্মিবামাত্র প্রব্রজ্যা উক্ত হওয়াতে, গৃহস্থাশ্রমের নিত্যত্ব নিরস্ত হইতেছে। "যথাবিধানে ব্রহ্মচর্য্য নির্ব্বাহ করিয়া যে আশ্রমে ইচ্ছা হয় সে আশ্রম অবলম্বন করিবেক"। এই পূর্ব্বোক্ত বচনে গৃহস্থা- শ্রম প্রভৃতি ইচ্ছাধীন এ কথা বলা হইয়াছে; এবং নৈত্তিক ব্রহ্মচারীর গৃহস্থাশ্রম অবলম্বনের আব্যকতা নাই, ইহা সর্ব্বসম্মত। এইরূপে গৃহস্থাশ্রমের 'নিত্যত্ব নিরস্ত হইবাতে, গৃহস্থাশ্রম প্রবেশমূলক বিবাহের নিত্যত্ব কি রূপে হইতে পারে। "দ্বিজ আশ্রমবিহীন হইয়া এক দিনও থাকিবেক না, বিনা আশ্রমে অবস্থিত হইলে পাতকগ্রস্ত হয়" এই দক্ষবচনে দ্বিজাতিদিগের আশ্রমমাত্রের অকরণে প্রত্যবায়জনকতা উক্ত হইলেও, গৃহস্থ। শ্রমমাত্রের নিত্যত্ব সিদ্ধ হইতেছে না।, আর এ স্থলে দ্বিজপদের যে উপলক্ষণপরত্ব ব্যাখ্যাত হইয়াছে, তাহাও প্রমাণসাপেক্ষ, কিন্তু প্রমাণের নির্দেশ নাই; অতএব সৈ কথা অগ্রায়ই করিতে হইবেক।

তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের এই লিখনের অন্তর্গত আপত্তি সকল পৃথক্ পৃথক্ উল্লিখিত ও আলোচিত হইতেছে। প্রথম আপত্তি;-

"বিবাহের ত্রৈবিধ্যের অবান্তরভেদের মধ্যে যে নিত্যত্ব অঙ্গীকৃত হইয়াছে, তাহা কি হেতুতে; কি তদ্ব্যতিরেকে ঝিঁবাহের স্বরূপ অসিদ্ধ হয় এই হেতুতে, কিংবা বিবাহের ফল অসিদ্ধ হয় এই হেতুতে, অথবা শাস্ত্রের প্রমাণ অবলম্বন করিয়া, তাহা করা হইয়াছে।"

এই আপত্তির, অথবা প্রশ্নের, উত্তর এই; আমি, শাস্ত্রের প্রমাণ অবলম্বন করিয়া, বিবাহের নিত্যত্ব নির্দেশ করিয়াছি।

দ্বিতীয় আপত্তি;

"কেবল প্রতিজ্ঞা দ্বারা সাধ্য সিদ্ধি হয়, ইহা কেহই স্বীকার করেন না; সাধ্য সিদ্ধির হেতুভূত প্রমাণের নির্দেশ নাই; সুতরাং উহা সাধ্যসাধক হইতে পারে না।"

অর্থাৎ, বিবাহ নিত্য এই মাত্র নির্দেশ করিলে, বিবাহের নিত্যত্ব সিদ্ধ হয় না; তাহা সিদ্ধ করা আবশ্যক হইলে, প্রমাণ প্রদর্শন আবশ্যক। তাঁহার মতে, আমি, বিবাহ নিত্য, এই মাত্র নির্দেশ করিয়াছি, কোনও প্রমাণ প্রদর্শন করি নাই; সুতরাং, তাহা গ্রাহ্য হইতে পারে না। এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, প্রথম পুস্তকে আমি এ বিষয়ের সবিস্তর বিচার ও প্রমাণ প্রদর্শন করি নাই, তাহার কারণ এই যে, ধৰ্ম্মার্থ বিবাহের নিত্যত্ব সকলেই স্বীকার করিয়া থাকেন, সে বিষয়ে কাহারও বিপ্রতিপত্তি দেখিতে পাওয়া যায় না; সুতরাং, প্রমাণ প্রদর্শন অনাবশ্যক, এই সংস্কার বশতঃ তাহা করি নাই। বস্তুতঃ, আমি সিদ্ধ বিষয়ের নির্দেশ করিয়াছি; সাধ্য নির্দেশ করি নাই। সিদ্ধ বিষয়ের নির্দেশ যেরূপে করিতে হয়, তাহাই করিয়াছি। যথা,

"যে সমস্ত বিধি প্রদর্শিত হইল, তদনুসারে বিবাহ ত্রিবিধ নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য। প্রথম বিধি অনুসারে যে বিবাহ করিতে হয়, তাহা নিত্য বিবাহ; এই বিবাহ না করিলে, মনুষ্য গৃহস্থাশ্রমে অগ্নিকারী হইতে পারে না। দ্বিতীয় বিধির অনুযায়ী বিবাহও নিত্য বিবাহ; তাহা না করিলে আশ্রমভ্রংশনিবন্ধন পাতকগ্রস্ত হইতে হয় (৬১)।"

"পুত্রলাভ ও ধর্ম্মকার্য্য সাধন গৃহস্থাশ্রমের উদ্দেশ্য। দারপরিগ্রহ ব্যতিরেকে এই উভয়ই সম্পন্ন হয় না; এই নিমিত্ত, প্রথম বিল্লিতে, দারপরিগ্রহ, গৃহস্থাশ্রম প্রবেশের দ্বারস্বরূপ, ও গৃহস্থা- শ্রম সমাধানের অপরিহার্য্য উপায়স্বরূপ, নির্দিষ্ট হইয়াছে। গৃহস্থাশ্রম সম্পাদন কালে, স্ত্রীবিয়োগ ঘাটলে, যদি পুনরায় বিবাহ না করে, তবে সেই দারবিরহিত ব্যক্তি আশ্রমভ্রংশ নিবন্ধন পাতকগ্রস্ত হয়; এজন্য, ঐ অবস্থায়, গৃহস্থ ব্যক্তির পক্ষে, পুনরায়' দারপরিগ্রহের অবশ্যকর্তব্যতা বোধনের নিমিত্ত, শাস্ত্র-- কারেরা দ্বিতীয় বিধি প্রদান করিয়াছেন (৬১)।"

ধর্মার্থ বিবাহের নিত্যত্ব সিদ্ধ বিষয় বলিয়া, প্রমাণ প্রদর্শন করি নাই বটে; কিন্তু যাহা নির্দেশ করিয়াছি, তাহাতে তদ্বিষয়ক সমস্ত প্রমাণের সার সংগৃহীত হইয়াছে। তর্কবাচস্পতি মহাশয়, ধৰ্ম্মশাস্ত্রব্যবসায়ী হইলে, তাহাতেই সন্তুষ্ট হইতেন, প্রমাণ নির্দেশ নাই, অতএব তাহা অসিদ্ধ ও অগ্রাহ্য, অনায়াসে। এরূপ নির্দেশ 'করিতে পারিতেন না। যাহা হউক, ধৰ্ম্মার্থ বিবাহের নিত্যত্ব বিষয়ে পূর্ব্বে (৬২) যে সকল প্রণাণ প্রদর্শিত হইয়াছে, তদ্দর্শনে বোধ করি তাঁহার সংশয় দূর হইতে পারে।

তৃতীয় আপত্তি;-

"যদি বল, অকরণে প্রত্যবায়জনকতা নিত্যত্বের হেতু, কিন্তু অকরণে প্রত্যবায়জনকতার নির্ণয়ও বলবৎ শাস্ত্র ব্যতিরেকে হইতে পারে না; কিন্তু তথায় শাস্ত্রের নির্দেশ নাই; অতএব কিরূপে তাদৃশ হেতু দ্বারা সাধ্য সিদ্ধি হইতে পারে, নির্ণীত হেতুই সাধ্যসিদ্ধির প্রয়োজক।"

অর্থাৎ, যে কর্ম্মের অকরণে প্রত্যবায় জন্মে অর্থাৎ যাহার লঙ্ঘনে দোষশ্রুতি আছে, তাহাকে নিত্য বলে। কিন্তু অকরণে প্রত্যবায়- জনকতা বিবাহের নিত্যত্বসাধক প্রমাণ উপন্যস্ত হইতে পারে না; কারণ, বিবাহের অকরণে প্রত্যবায় জন্মে, বিশিষ্ট শাস্ত্র- প্রমাণ ব্যতিরেকে তাহার নির্ণয় হইতে পারে না; কিন্তু তাদৃশ শাস্ত্রের নির্দেশ নাই। অতএব, অকরণে প্রত্যবায় জন্মে, এই হেতু দর্শাইয়া, বিবাহের নিত্যত্ব সাধিত হইতে পারে না।

এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, এস্থলেও, তর্কবাচস্পতি মহাশয়, শাস্ত্রব্যবসায়ীর মত, কথা বলেন নাই। বিবাহের অকরণে গৃহস্থ ব্যক্তির প্রত্যবায় জন্মে, ইহাও সর্বসম্মত সিদ্ধ বিষয়; 'এজন্য, অনাবশ্যক বিবেচনায়, প্রথম পুস্তকে তাহার প্রমাণভূত শাস্ত্রের সবিশেষ নির্দেশ করি নাই। তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের প্রবোধনের নিমিত্ত, পূর্বের (৬৩) তাদৃশ শাস্ত্রও সবিস্তর দর্শিত হইয়াছে। তদ্দর্শনে, বোধ করি, তাঁহার সন্তোষ জন্মিতে পারে।

চতুর্থ আপত্তি;-

"যে দিন বৈরাগ্য জন্মিধেক, সেই দিনেই ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য, অথবা বানগ্রন্থ "আশ্রম হইতে পরিব্রজ্যা করিবেক।

এই বেদবাক্যে বৈরাগ্য জন্মিবামাত্র পরিব্রজ্যা উক্ত হওয়াতে, গৃহস্থাশ্রমের নিত্যত্ব নিরস্তু হইতেছে”।

এস্থলে বক্তব্য এই যে, তর্কবাচস্পতি মহাশয়, বেদবাক্যের শেষ অংশ আপন অভিপ্রায়ের অনুকূল "দেখিয়া, ঐ অংশ মাত্র উদ্ধৃত করিয়াছেন। এই বেদবাক্য সমগ্র গৃহস্থাশ্রমের নিত্যত্বপ্রতিপাদন স্থলে প্রদর্শিত হইয়াছে। তথাপি, পাঠকগণের সুবিধার জন্য, পুনরায় উদ্ধৃত হইতেছে। যথা,

ব্রহ্মচর্য্যং পরিসমাপ্য গৃহী ভবেৎ গৃহী ভূত্বা বনী ভবেৎ বনী ভূত্বা প্রব্রজে যদিবেতরথা ব্রহ্মচর্য্যা- দেব প্রব্রজেৎ গৃহাদ্বা বনাদ্বা যদহরেব বিরজ্যেত তদহরেব প্রব্রজেৎ।

ব্রহ্মচর্য্য সমাপন করিয়া গৃহস্থ হইবেক, গৃহস্থ হইয়া বানপ্রস্থ হইবেক, বানপ্রন্থ হইয়া সন্ন্যাসী হইবেক; যদি বৈরাগ্য জন্মে, ব্রহ্মচর্য্যাশ্রম, গৃহস্থাশ্রম, অথবা বানগ্রন্থাশ্রম হইতে পরিব্রজ্যাশ্রম আশ্রয় করিবেক। যে দিন বৈরাগ্য জন্মি- বেক, সেই দিনেই পরিব্রজ্যা আশ্রয় করিবেক।

প্রথমতঃ, যথাক্রমে চারি আশ্রমের ব্যবস্থা আছে; তৎপরে, বৈরাগ্য জন্মিলে, সন্ন্যাস গ্রহণের ব্যবস্থা প্রদত্ত হইয়াছে।

ইহাতে, গৃহস্থাশ্রমের নিত্যত্ব ব্যাহত না হইয়া, নিত্যত্বের সংস্থাপনই হইতেছে, ইহা পূর্ব্বে প্রদর্শিত হইয়াছে, (৬৪) এজন্য এস্থলে আর তাহার উল্লেখ করা গেল না।

পঞ্চম আপত্তি;-

4 "যথাবিধানে ব্রহ্মচর্য্য সমাপন করিয়া, যে আশ্রমে ইচ্ছা হয়, সেই আশ্রম অবলম্বন করিবেক এই পূর্ব্বোক্ত বচনে গৃহস্বাশ্রম, প্রভৃতি ইচ্ছাধীন একথা বলা হইয়াছে।"

এ বচন দ্বারা যে গৃহস্থাশ্রমের নিত্যত্ব ব্যাহত হয় না, তাহা পূর্বের সম্যক্ সংস্থাপিত হইয়াছে।

ষষ্ঠ আপত্তি;-

1 "নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারীর গৃহস্থাশ্রম অবলম্বনের আবশ্বকতা নাই ইহা সর্বসম্মত।" এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী গৃহস্থাশ্রম অবলম্বন করেন না, ইহাতেও গৃহস্থাশ্রমের নিত্যত্ব ব্যাহত হইতে পারে না। সামান্য বিধি অনুসারে, উপনয়নের পর, কিয়ৎ কাল ব্রহ্মচর্য্য করিয়া, গৃহস্থাশ্রম, তৎপরে বানপ্রস্থাশ্রম, তৎপরে পরিব্রজ্যাশ্রম, অবলম্বন করিতে হয়। কিন্তু বিশেষ বিধি অনুসারে, সে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিতে পারে। যেমন, যথাক্রমে চারি আশ্রম ব্যবস্থাপিত হইলেও, বিশেষ বিধি অনুসারে, বৈরাগ্যস্থলে, এক কালে ব্রহ্মচর্য্যের পর পরিব্রজ্যাশ্রম গ্রহণ করিতে পারে, এবং তদ্দ্বারা গৃহস্থাশ্রম প্রভৃতির নিত্যত্ব ব্যাহত হয় না; সেইরূপ, কিয়ৎ কাল ব্রহ্মচর্য্য করিয়া, পরে, ক্রমে ক্রমে, অবশিষ্ট আশ্রমত্রয়ের অবলম্বন ব্যবস্থাপিত হইলেও, বিশেষ বিধি অনুসারে, গৃহস্থাশ্রম প্রভৃতিতে পরাম্মুখ হইয়া, যাবজ্জীবন ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করিলে, গৃহস্থাশ্রম প্রভৃতির নিত্যত্বব্যাঘাত ঘটিতে পারে না। ব্রহ্মচর্য্য বিষয়ে বিশেষ 'বিধি এই;- যদি স্বাত্যন্তিকং বাসং রোচয়েত গুরোঃ কুলে। যুক্তঃ পরিচরেদেন মাশরীর বিমোক্ষণাৎ (৬৫)।

যদি গুরুকুলে যাবজ্জীবন বাস করিবার অভিলাষ হয়, তাহা হইলে, অবহিত হইয়া, দেহত্যাগ পর্য্যন্ত, তাঁহার পরিচ্যা করিবেক।

কিয়ৎ কাল ব্রহ্মচর্য্য করিয়া, গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করিবার সামান্য বিধি থাকিলেও, ইচ্ছ। হইলে, এই বিশেষ বিধি অনুসারে, গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ না করিয়া, যাবজ্জীবন ব্রহ্মচর্য্য করিতে পারে। স্থলবিশেষে, বিশেষ বিধি অনুসারে, নিত্য কর্ম্মের বাধ হয়, এবং সেই বাধ দ্বারা, তত্তৎ কর্ম্মের নিত্যত্ব ব্যাহত হয় না, ইহা 'অদৃষ্টচর ও অশ্রুতপূর্ব নহে।

যাবজ্জীবমগ্নিহোত্রং জুহুয়াৎ (৬৬)।

যাবজ্জীবন অগ্নিহোত্র যাগ করিবেক।

নিত্যং স্নাত্বা শুচিঃ কুৰ্য্যাদ্দেবর্ষিপিতৃতর্পণম্ (৬৭)।

স্নান করিয়া, শুচি হইয়া, নিত্য দেবতর্পণ, ঋষিতর্পণ ও পিতৃতর্পণ করিবেক। ইত্যাদি শাস্ত্রে, যাবজ্জীবন, অগ্নিহোত্র, দেবতর্পণ প্রভৃতি কর্ম্মের নিত্য বিধি আছে। কিন্তু,

সন্ন্যশস্য সর্বকর্মাণি কৰ্ম্মদোষানপানুদন্।

নিয়তো বেদমভ্যস্থ্য পুদ্রৈশ্বর্য্যে সুখং বসেৎ (৬৮)।

সর্ব্বকৰ্ম্ম পরিত্যাগ, কর্ম্মজনিত দোষের অপনোদন, ও বেদশাস্ত্রের অনুশীলন পূর্ব্বক, পুত্রদত্ত গ্রাসাচ্ছাদন দ্বারা জীবনধারণ করিয়া, সংযত মনে সচ্ছন্দে কালযাপন করিবেক।

যথোক্তা্যপি কৰ্ম্মাণি পরিহায় দ্বিজোত্তমঃ।

আত্মজ্ঞানে শমে চ স্যাদ্বেদাভ্যাসে চ যত্নবান (৬৯)।॥ ব্রাহ্মণ, শাস্ত্রোক্ত কৰ্ম্ম সকল পরিত্যাগ করিয়া, আত্মজ্ঞানে, চিত্তস্থৈর্ঘ্যে ও বেদাভ্যাসে যত্নবান্ হইবেক।

ইত্যাদি শাস্ত্রে, পরিব্রাজকের পক্ষে, বেদোক্ত ও ধৰ্ম্মশাস্ত্রোক্ত কৰ্ম্ম পরিত্যাগের বিধি আছে; তদনুসারে, ঐ সকল কৰ্ম্ম পরিত্যক্ত হইয়া থাকে। তন্মধ্যে, অগ্নিহোত্র, দেবতর্পণ প্রভৃতি নিত্য কৰ্ম্ম। পরিব্রজ্যা অবস্থায়, ঐ সকল নিত্য কৰ্ম্ম পরিত্যক্ত হয়; কিন্তু, ঐ পরিত্যাগ জন্য, তত্তৎ কর্ম্মের নিত্যত্ব ব্যাহত হয় না। সেইরূপ, নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী গৃহস্থাশ্রম অবলম্বন করেন না, এই হেতুতে, গৃহস্থাশ্রমের নিত্যত্বব্যাঘাত ঘটিতে পারে না। সপ্তম আপত্তি;-

"অনাশ্রমী ন তিষ্ঠেত্ত দিনমেকমপি দ্বিজঃ। আশ্রমেণ বিনা তিষ্ঠন্ প্রায়শ্চিত্তীয়তে হি সঃ ॥

"দ্বিজ আশ্রমবিহীন হইয়া, এক দিনও থাকিবেক না; বিনা আশ্রমে অবস্থিত হইলে পাতকগ্রস্ত হয়।" এই দক্ষবচনে দ্বিজাতিদিগের আশ্রমমাত্রের অকরণে প্রত্যবায়জনকতা উক্ত হইলেও, গৃহস্থাশ্রমের নিত্যত্ব সিদ্ধ হইতেছে না।"

এই আপত্তি সর্বাংশে তৃতীয় আপত্তির তুল্য। সুতরাং, ইহার আর স্বতন্ত্র সমালোচন অনাবশ্যক।

এই সঙ্গে, তর্কবাচস্পতি মহাশয় এক প্রাসঙ্গিক আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন; সে বিষয়েও কিছু বলা আবশ্যক।

"আর, এ স্থলে দ্বিজপদের যে উপলক্ষণপরত্ব ব্যাখ্যাত হইয়াছে, তাহাও প্রমাণসাপেক্ষ, কিন্তু প্রমাণের নির্দেশ নাই। অতএব সে কথা অগ্রাহ্যই করিতে হইবেক।"

নিতান্ত অনবধান বশতই, তর্কবাচস্পতি মহাশয় এরূপ কথা বলিয়াছেন। দ্বিজপদের যে উপলক্ষণপরত্ব উক্ত হইয়াছে, তাহাও এক প্রকার সিদ্ধ বিষয়; প্রমাণ দ্বারা প্রতিপন্ন করিবার অদৃশী আবশ্যকতা নাই। সে যাহা হউক, সে বিষয়ে "প্রমাণের নির্দেশ নাই,” এ কথা প্রণিধান পূর্বক বলা হয় নাই। প্রথম পুস্তকে যাহা লিখিত হইয়াছে, কিঞ্চিৎ অভিনিবেশ সহকারে, তাহার আলোচনা করিয়া দেখিলে, তর্কবাচস্পতি মহাশয় দ্বিজপঞ্জর উপলক্ষণপরত্বব্যাখ্যার সম্পূর্ণ প্রমাণ দেখিতে পাইতেন। যথা,

"দক্ষ কহিয়াছেন,

অনাশ্রমী ন তিষ্ঠেত্ত দিনমেকমপি দ্বিজঃ। আশ্রমেণ বিনা তিষ্ঠন্ প্রায়শ্চিত্তীয়তে হি সঃ ॥

গিজ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্ণ, আশ্রমবিহীন হইয়া, এক দিনও থাকিবেক না; বিনা আশ্রমে অবস্থিত হইলে, পাতকগ্রস্ত হয়।

এই শাস্ত্র অনুসারে, আশ্রমবিহীন হইয়া থাকা, দ্বিজের পক্ষে, নিষিদ্ধ ও পাতকজনক। দ্বিজপদ উপলক্ষণ মাত্র, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র, চারি বর্ণের পক্ষেই এই ব্যবস্থা।

বামনপুরাণে নির্দিষ্ট আছে,

চত্বার আশ্রমাশ্চৈব ব্রাহ্মণশ্য প্রকীর্ত্তিতাঃ। ব্রহ্মচর্য্যঞ্চ গার্হস্থ্যং বানপ্রস্থঞ্চ ভিক্ষুকম্ ॥ ক্ষত্রিয়্যাপি কথিতা আশ্রমাস্ত্রয় এব হি। ব্রহ্মচর্য্যঞ্চ গার্হস্থ্যমাশ্রমদ্বিতয়ং বিশঃ।

গার্হস্থ্যমুটিতত্ত্বেকং শূদ্রস্থ্য ক্ষণমাচরেৎ ॥

ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য, বানগ্রন্থ, সন্ন্যাস, ব্রাহ্মণের এই চারি আশ্রম নিদ্দিষ্ট আছে; ক্ষত্রিয়ের প্রথম তিন: বৈভ্যের প্রথম দুই; শূদ্রের গার্হস্থামাত্র এক আশ্রম: সে, হৃষ্ট চিত্তে, তাহারই অনুষ্ঠান করিবেক (১০)।"

বামনপুরাণ অনুসারে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের ন্যায়, শূদ্রও আশ্রমে অধিকারী; তাহার পক্ষে গৃহস্থাশ্রম অবলম্বন করিয়া কালক্ষেপণ করিবার বিধি আছে। অতএব, শূদ্রের যখন গৃহস্থা- শ্রমে অধিকার ও তাহা অবলম্বন করিয়া কালক্ষেপণ করিবার বিধি দৃষ্ট হইতেছে, তখন বিহিত আশ্রম অবলম্বন না করা তাহার পক্ষে দোষাবহ, তাহার সন্দেহ নাই। কিন্তু দক্ষবচনে, দোষকীৰ্ত্তন স্থলে, দ্বিজশব্দের প্রয়োগ আছে; দ্বিজশব্দে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এই তিন বর্ণের বোধ হয়; এজন্য, "দ্বিজপদ উপলক্ষণমাত্র, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, চারি বর্ণের পক্ষেই এই ব্যবস্থা," ইহা লিখিত হইয়াছিল; অর্থাৎ, যদিও বচনে দ্বিজ শব্দ আছে, কিন্তু যখন, চারি বর্ণের পক্ষেই, আশ্রমব্যবস্থা দৃষ্ট হইতেছে, তখন আশ্রমলঙ্ঘনে যে দোষশ্রুতি আছে, তাহা চারি বর্ণের পক্ষেই সমভাবে প্রবৃত্ত হওয়া উচিত; এবং, সেই জন্যই, বচনস্থিত দ্বিজ শব্দ, দ্বিজমাত্রের বোধক না হইয়া, আশ্রমাধিকারী চারি বর্ণের বোধক হওয়া আবশ্যক। তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের প্রীত্যর্থে, এস্থলে ইহাও উল্লেখ করা আবশ্যক; এই মীমাংসা আমার কপোলকল্পিত, অথবা লোক বিমোহনের নিমিত্ত, বুদ্ধি- বলে. উদ্ভাবিত, অভিনব মীমাংসা নহে। স্মার্ত্ত ভট্টাচার্য্য রঘুনন্দন, বহু কাল পূর্বে, এই মীমাংসা করিয়া গিয়াছেন; যথা, "দক্ষঃ

অনাশ্রমী ন তিষ্ঠেছু দিনমেকমপি দ্বিজঃ। আশ্রমেণ বিনা তিষ্ঠন্ প্রায়শ্চিত্তীয়তে ত্বসৌ ॥ জপে হোমে তথা দানে স্বাধ্যায়ে বা রতঃ সদা। নার্সৌ ফলং সমাপ্নোতি কুব্বাণোহপ্যাশ্রমচ্যুতঃ ॥

বিষ্ণুপুরাণঞ্চ

ব্রতেষু লোপকো যশ্চ আশ্রমাদ্বিচ্যুতশ্চ যঃ। সন্দংশযাতনামধ্যে পততস্তাবুভাবপি ॥

অত্র আশ্রমাদ্বিচ্যুতশ্চ য ইতি সামান্তেন দোষাভিধানাং শূদ্র ্যাপি তথাত্বমিতি পূর্ব্ববচনে দ্বিজ ইত্যুপলক্ষণম্। শূদ্র্যাপ্যা- শ্রমমাহ পরাশরভাষ্যে বামনপুরাণম্

'চত্বার আশ্রমাশ্চৈব ব্রাহ্মণ্য প্রকীর্ত্তিতাঃ।' ব্রহ্মচর্য্যঞ্চ গার্হস্থ্যং বানপ্রস্থঞ্চ ভিক্ষুকম্। ক্ষত্রিয়শ্যাপি কথিতা আশ্রমাস্ত্রয় এব হি। ব্রহ্মচর্য্যঞ্চ গার্হস্থ্যমাশ্রমদ্বিতয়ং বিশঃ। গার্হস্থ্যমুচিতত্ত্বেকং শূদ্রস্য, ক্ষণমাচরেৎ" (৭১)

উপলক্ষণপরত্বব্যাখ্যা অপ্রমাণ বলিয়া অগ্রাহ্য কুরিয়াছেন। 'বচন দেখিয়া, তাহার অর্থনির্ণয় ও তাৎপর্য্যগ্রহ করিয়া, মীমাংসা করা সকলের পক্ষে সহজ নহে, তাহার সন্দেহ নাই। কিন্তু, এত- দ্দেশের সর্বত্র প্রচলিত উদ্বাহতত্ত্বে দৃষ্টি থাকিলে, উল্লিখিত দ্বিজপদের উপলক্ষণপরত্বব্যাখ্যা অপ্রমাণ বলিয়া অগ্রাহ্য করা যায় না।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

তর্কবাচস্পতি মহাশয় যেরূপে বিবাহের নিত্যত্ব ঋণ্ডন করিয়াছেন, • তাহা একপ্রকার আলোচিত হইল। এক্ষণে, তিনি যেরূপে বিবাহের নৈমিত্তিকত্ব খণ্ডন করিয়াছেন, তাহা আলোচিত হইতেছে।

তিনি লিখিয়াছেন,

"কিমিদং নৈমিত্তিকত্বং কিং নিমিত্ত্বাধীনত্বং নিমিত্তনিশ্চয়োত্তরা- ব্যবহিতোত্তরকর্তব্যত্বং বা ন তাবদায়ঃ কার্য্যমাড়ন্ত কারণ- সাধ্যতয়া সৰ্ব্বস্তৈৰ নৈমিত্তিকস্থাপত্তেঃ এবঞ্চ তদভিমতনিত্য- বিবাহ্যাপি দানাদিপ্রযোজ্যতয়া নিমিত্তাধীনত্বেন নৈমিত্তিকত্বা- পত্তিঃ। ন দ্বিতীয়ঃ পত্নীমরণনিশ্চয়াধীনন্ত তন্মতে নিত্যন্ত দ্বিতীয়বিধ্যনুসারিবিবাহ্যাপি নৈমিত্তিকত্বাপত্তেঃ তন্ত অশৌচা- দেরিব মরণনিমিত্তনিশ্চয়াধীনত্বাৎ। কিঞ্চ তন্মতে তৃতীয়- বিধ্যনুসারিবিবাহ্য নৈমিত্তিকস্তাপি নৈমিত্তিকত্বামুপপত্তিঃ তঞ্চস্ত শুদ্ধকালপ্রতীক্ষাধীনতয়া বক্ষ্যমাণাষ্টবর্ষাদিকাল প্রতীক্ষাসম্ভাবেন চ নিমিত্তনিশ্চয়াব্যবহিতোত্তরং ক্রিয়মাণত্বাভাবাৎ। অন্তচ্চ

নৈমিত্তিকানি কাম্যানি নিপতন্তি যথা যথা। 'তথা তথৈব কার্য্যাণি ন কালস্তু বিধীয়তে ॥ ইত্যুক্তেঃ লুপ্তসংবৎসরমলমাসশুক্রান্তস্তত্বাগুশুদ্ধকালেহপি তৃতীয়- বিধ্যনুসারিণো নৈমিত্তিকন্ত কর্তব্যতাপত্তিঃ নৈমিত্তিকে জাতে- ষ্ট্যাদৌ অশৌচাদেঃ শুদ্ধকালস্ত চ প্রতীক্ষাভাব্য সর্ব্বসম্মতত্বাৎ তৎপ্রতীক্ষণাভাবাপত্তের্হস্তরত্বাৎ। মন্ত্রাদিভিশ্চ বন্ধ্যাষ্টমেহধিবেত্তব্যা দশমে স্ত্রী মৃতপ্রজা।

একাদশে স্ত্রীজননী।

ইত্যাদিনা অষ্টবর্ষাদিকালপ্রতীক্ষাং বদত্তিঃ প্রদর্শিতনৈমিত্তিকত্বং ত্য প্রত্যাখ্যাতম্ (৭২)।"

নৈমিত্তিক কাহাকে বল, কি নিমিত্তাধীন কর্মকে নৈমিত্তিক বলিবে, অর্থবা নিমিত্তনিশ্চয়ের অব্যবহিত উত্তর কালে যাহা করিতে হয়, তাহাকে নৈবিত্তিক বলিবে। প্রথম পক্ষ সম্ভব নহে, কারণ, কার্য্যমাত্রই কারণসাধ্য, সুতরাং সকল কর্ম্মই নৈমিত্তিক হইয়া পড়ে; এবং তাঁহার অভিমত নিত্য বিবাহও দানাদি সাধ্য, সুতরাং নিমিত্তাধীন হইতেছে; এজন্ত উহারও নৈমিত্তিকত্ব ঘটিয়া উঠে। দ্বিতীয় পক্ষও সম্ভব নহে; তন্মতে দ্বিতীয় বিধি অনুযায়ী বিবাহ নিত্য বিবাহ: এই নিত্য বিবাহও নৈমিত্তিক হইয়া পড়ে; কারণ, যেমন অশৌচ প্রভৃতি মরণ- নিশ্চয় জ্ঞানের অধীন, সেইরূপ এই নিত্য বিবাহও পূর্ব্বপত্নীর মরণনিশ্চয়জ্ঞানের অধীন। কিঞ্চ, তন্মতে তৃতীয় বিধি অনুযায়ী বিবাহ নৈমিত্তিক বিবাহ: এই নৈমিত্তিক বিবাহেরও নৈমিত্তিকত্ব ঘটতে পারে না: বিবাহে শুদ্ধ কাল এবং বক্ষ্যমাণ অষ্টবর্ষাদি কাল প্রতীক্ষার আবঙ্গকতা বশতঃ, নিমিত্তনিশ্চয়ের অব্যবহিত উত্তর কালে তাহার অনুষ্ঠান ঘটিতেছে না। অপরঞ্চ, নৈমিত্তিক কাম্য যপনই ঘটিবেক, তখনই তাহার অনুষ্ঠান করিবেক, তাহাতে কালাকাল বিবেচনা নাই।" এই শাস্ত্র অনুসারে, লুপ্ত সংবৎসর, মলমাস, শুক্রান্ত প্রভৃতি অশুদ্ধ কালেও তৃতীয় বিধি অনুযায়ী' নৈমিত্তিক বিবাহের কর্ত্তব্যতা ঘটিয়া উঠে। জাতেষ্টি প্রভৃতি নৈমিত্তিক কর্ম্মে অশৌচাদির ও শুদ্ধ কালের প্রতীক্ষা করিতে হয় না, ইহা সর্বসম্মত। তদনুসারে তদভিমত নৈমিত্তিক বিবাহস্থলেও অশৌচাদির ও শুদ্ধ কালের প্রতীক্ষা করিবার আবম্ভকতা থাকিতে পারে না। আর, "স্ত্রী বন্ধ্যা হইলে অষ্টম বর্ষে, মৃতপুত্রা হইলে দশম বর্ষে, কব্জামাত্র- প্রসবিনী হইলে একাদশ বর্ষে," ইত্যাদি দ্বারা মনু প্রভৃতি, অষ্টবাদি কাল প্রতীক্ষা বলিয়া, বিবাহের নৈমিত্তিকত্ব খণ্ডন করিয়াছেন।

তর্কবাচস্পতি মহাশয়, "নিমিত্তাধীন কৰ্ম্ম নৈমিত্তিক,” এই যে

লক্ষণ নির্দেশ করিয়াছেন, আমার বিবেচনায়, উহাই নৈমিত্তি- কের প্রকৃত লক্ষণ। তত্তৎ কর্ম্মে অধিকারবিধায়ক আগন্তুক' হেতুবিশেষকে নিমিত্ত বলে নিমিত্তের অধীন যে কৰ্ম্ম, অর্থাৎ নিমিত্ত ব্যতিরেকে, যে কৰ্ম্মে অধিকার জন্মে না, তাহাকে নৈমিত্তিক কহে; যেমন জাতকৰ্ম্ম, নান্দীশ্রাদ্ধ, গ্রহণশ্রাদ্ধ প্রভৃতি। জাতকৰ্ম্ম নৈমিত্তিক; কারণ, পুত্রজন্মরূপ নিমিত্ত, ব্যতিরেকে, জাতকল্পে অধিকার জন্মে না; নান্দীশ্রাদ্ধ নৈমি- ত্তিক; কারণ, পুত্রের সংস্কারাদিরূপ নিমিত্ত ব্যতিরেকে, নান্দীশ্রাদ্ধে অধিকার জন্মে না; গ্রহণশ্রাদ্ধ নৈমিত্তিক; কারণ, চন্দ্রসূর্য্যগ্রহণরূপ নিমিত্ত ব্যতিরেকে, গ্রহণশ্রাদ্ধে অধিকার জন্মে না। সেইরূপ, স্ত্রী বন্ধ্যা হইলে, যে বিবাহ করিবার বিধি আছে, ঐ বিবাহ নৈমিত্তিক কারণ, স্ত্রীর বন্ধ্যাত্বরূপ নিমিত্ত ব্যবিরেকে, তাদৃশ, বিবাহে অধিকার জন্মে না; স্ত্রী ব্যভিচারিণী হইলে, যে বিবাহ করিবার বিধি আছে, ঐ বিবাহ নৈমিত্তিক; কারণ, স্ত্রীর ব্যভিচাররূপ নিমিত্ত ব্যতিরেকে, তাদৃশ বিবাহে অধিকার জন্মে না; স্ত্রী চিররোগিণী হইলে, যে বিবাহ করিবার বিধি আছে, ঐ বিবাহ নৈমিত্তিক; কারণ, স্ত্রীর চিররোগরূপ নিমিত্ত ব্যতিরেকে, তাদৃশ বিবাহে অধিকার জন্মে না। এইরূপে, শাস্ত্রকারেরা, নিমিত্তবিশেষের নির্দেশ পূর্বক, পূর্বপরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় বিবাহ করিবার যে সকল বিধি দিয়াছেন, সেই সমস্ত বিধি অনুযায়ী বিবাহ, নৈমিত্তিক বিবাহ; কারণ, তত্তৎ নিমিত্ত ব্যতিরেকে, পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় বিবাহ করিবার অধিকার জন্মে না।

উল্লিখিত নৈমিত্তিক লক্ষণ নির্দেশ করিয়া, তর্কবাচঃস্পতি মহাশয় যে আপত্তি দর্শাইয়াছেন, তাহা-কার্য্যকারক নহে। যথা, "প্রথম পক্ষ সম্ভব নহে, কারণ কাৰ্য্যমাত্রই কারণসাধ্য, সুতরাং সকল কার্য্যই নৈমিত্তিক হইয়া পড়ে। এবং তাঁহার অভিমত নিত্য বিবাহও দানাদিসাধ্য, সুতরাং নিমিত্তাধীন হইতেছে; এজন্য উহারও নৈমিত্তিকত্ব ঘটিয়া উঠে।"

তর্কবাচস্পতি মহাশয় ধৰ্ম্মশাস্ত্র নির্দিষ্ট নিমিত্ত ও নৈমিত্তিক শব্দের প্রকৃত অর্থ অবগত নহেন; এজন্য, ঈদৃশ অকিঞ্চিৎকর আপত্তির উত্থাপন করিয়াছেন। সামান্যতঃ, নিমিত্ত শব্দ কারণবাচী ও নৈমিত্তিক শব্দ কার্য্যবাচী বটে। যথা,

উদেতি পূর্ববং কুসুমং ততঃ ফলং ঘনোদয়ঃ প্রাক্ তদনন্তরং পয়ঃ। নিমিত্তনৈমিত্তিকয়োরয়ং বিধি- স্তব প্রসাদশ্য পুরস্তু সম্পদঃ (৭৩) ।। প্রথম পুষ্প উৎপন্ন হয়, তৎপরে ফল জন্মে। প্রথম মেঘের উদয় হয়, তৎপরে বৃষ্টি হয়; নিমিত্ত ও মৈমিত্তিকের এই ব্যবস্থা; কিন্তু, তোমার প্রসাদের অগ্রেই ফললাভ হয়।

এস্থলে, নিমিত্ত শব্দ কারণবাচী ও নৈমিত্তিক শব্দ কার্য্যবাচী। কিন্তু, ধৰ্ম্মশাস্ত্রনিদ্দিষ্ট নিমিত্ত ও নৈমিত্তিক শব্দ পারিভাষিক, কারণার্থবাচক ও কাৰ্য্যার্থবাচক সামান্য নিমিত্ত ও নৈমিত্তিক শব্দ নহে। পুত্রাদির সংস্কারকালে আভ্যুদয়িক শ্রাদ্ধ করিতে হয়; পুরুষব্যাপার ও শাস্ত্রোক্ত ইতিকর্ত্তব্যতা প্রভৃতি দ্বারা আভ্যুদয়িক শ্রাদ্ধ নিষ্পন্ন হয়; এজন্য, আভ্যুদয়িক শ্রাদ্ধ পুরুষব্যাপার প্রভৃতি কারণসাধ্য হইতেছে। কিন্তু, পুরুষব্যাপার প্রভৃতি, আভ্যুদয়িক শ্রাদ্ধের নিষ্পাদক কারণ হইলেও, উহার নিমিত্ত বলিয়া উল্লিখিত হইতে পারে না; পুত্রাদির সংস্কার উহার নিমিত্ত; 'অর্থাৎ পুত্রাদিন্ন সংস্কার উপস্থিত না হইলে, তাহাতে অধিকার জন্মে না; সুতরাং, পুত্রাদির সংস্কার আভ্যুদয়িক শ্রাদ্ধরূপ কার্য্যে অধিকারবিধায়ক হেতুবিশেষ ও নিমিত্তশব্দবাচ্য হইতেছে; এবং, এই পুত্রাদির সংস্কাররূপ নিমিত্তের অধীন বলিয়া, অর্থাৎ তাদৃশ নিমিত্ত্ব ব্যতিরেকে, তাহাতে অধিকার জন্মে না এজন্য; আভ্যু- দয়িক শ্রাদ্ধ নৈমিত্তিক ক্লার্য্য'। অতএব, "কার্য্যমাত্রই কারণসাধ্য, সুতরাং সকল কার্য্যই নৈমিত্তিক হইয়া পড়ে,” এ কথা প্রণিধান পূর্বক বলা হয় নাই। আর, আমার অভিমত নিত্য বিবাহও দানাদিসাধ্য, সুতরাং উহারও নৈমিত্তিকত্ব ঘটিয়া উঠে; এ কথাও নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। দানাদি বিবাহের নিষ্পাদক কারণ বটে, কিন্তু বিবাহের নিমিত্ত হইতে পারুেনা; কারণ, দানাদি বিবাহে অধিকারবিধায়ক হেতু নহে; সুতরাং, উহারা নিমিত্তশব্দবাচ্য হইতে পারে না। যদি উহারা নিমিত্তশব্দবাচ্য না হইল, তবে আমার অভিমত নিত্য বিবাহের নৈমিত্তিকত্বঘটনার সম্ভাবনা কি।

কিঞ্চ, 'নিমিত্তনিশ্চয়ের অব্যবহিত উত্তরকালে যাহা করিতে হয়, তাহাকে নৈমিত্তিক বলে;", তর্কবাচস্পতি মহাশয় এই যে দ্বিতীয় লক্ষণ নিদ্দিষ্ট করিয়াছেন, তাহা নৈমিত্তিকের সাধারণ লক্ষণ হইতে পারে না। নৈমিত্তিক দ্বিবিধ, নিরবকাশ ও সাবকাশ। যাহাতে অবকাশ থাকে না, অর্থাৎ কালবিলম্ব চলে না, নিমিত্ত ঘটিলেই যাহার অনুষ্ঠান করিতে হয়, তাহাকে নিরবকাশ নৈমিত্তিক বলে; যেমন গ্রহণশ্রাদ্ধ। নিমিত্তযুক্ত কালে নৈমিত্তিক কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে হয়; সুতরাং, যত ক্ষণ গ্রহণ থাকে, সেই সময়েই গ্রহণনিমিত্তক শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান করা আবশ্যক; গ্রহণ অতীত হইয়া গেলে, আর নিমিত্তযুক্ত কাল পাওয়া যায় না; এজন্য, আর সে শ্রাদ্ধ করিবার অধিকার থাকে না; গ্রহণ অধিক ক্ষণ স্থায়ী নহে; এজন্য, উপস্থিত হইবা মাত্র, শ্রাদ্ধের আরম্ভ করিতে হয়; সুতরাং, গ্রহণশ্রাদ্ধে অবকাশ থাকে না; এজন্য, গ্রহণশ্রাদ্ধ নিরবকাশ নৈমিত্তিক। আর, যাহাতে অবকাশ থাকে, অর্থাৎ বিশিষ্ট কারণ বশতঃ কালবিলম্ব চলে, নিমিত্তঘটনার অব্যবহিত' পরেই, যাহার অনুষ্ঠানের ঐকান্তিকী আবশ্যকতা নাই, তাহাকে সাবকাশ নৈমিত্তিক বলে; যেমন, স্ত্রীর বন্ধ্যাত্বনিবন্ধন বিবাহ। স্ত্রীর বন্ধ্যাত্বরূপ নিমিত্তযুক্ত কালে এই বিবাহ করিতে হয়; স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব, গ্রহণরূপ নিমিত্তের ন্যায়, সহসা অতীত হইয়া যাইবেক, সে আশঙ্কা নাই; এজন্য, বিশিষ্ট কারণ বশতঃ বিলম্ব হইলেও, এ বিষয়ে নিমিত্তযুক্ত কালের অসম্ভাব ঘটে'না; সুতরাং, ইহাতে অবকাশ থাকে; এজন্য, স্ত্রীর বন্ধ্যাত্বনিবন্ধন বিবাহ সাবকাশ নৈমিত্তিক। অতএব, "নিমিত্তনিশ্চয়ের অব্যবহিত উত্তরকালে যাহা করিতে হয়, তাহাকে নৈমিত্তিক বলে,” ইহা নিরবকাশ নৈমিত্তিকের লক্ষণ; কারণ, নিরবকাশ নৈমিত্তিকেই কালবিলম্ব চলে না। যথা,

কালেহনন্যগতিং নিত্যাং কুৰ্য্যান্নৈমিত্তিকীং ক্রিয়াম্ (৭৪)।

যে সকল নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্ম অন্যগতি, অর্থাৎ কালান্তরে যাহাদের অনুষ্ঠান চলে না, নিমিত্তঘটনার অব্যবহিত উত্তরকালেই, তাহাদের অনুষ্ঠান করিবেক।

কুর্য্যাৎ প্রাত্যহিকং কৰ্ম্ম প্রযত্নেন মলিমুচে।'

নৈমিত্তিকঞ্চ কুব্বীত সাবকাশং ন যস্তুবেৎ (৭৫)।

প্রত্যহ যে সকল কর্ম্ম করিতে হয়, এবং যে সকল নৈমিত্তিক সাবকাশ নহে; মলমাসেও, যত্ন পূর্ব্বক, তাহাদের অনুষ্ঠান করিবেক।

নৈমিত্তিক সাবকাশ ও নিরবকাশ ভেদে দ্বিবিধ, বোধ হয়, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের সে বোধ নাই; এজন্য, নিরবকাশ নৈমিত্তিকের লক্ষণকে নৈমিত্তিকমাত্রের লক্ষণ স্থির করিয়া রাখিয়াছেন।

উল্লিখিত লক্ষণ নির্দিষ্ট করিয়া, তর্কবাচস্পতি মহাশয় . সর্বপ্রথম এই আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন,

" "তন্মতে. দ্বিতীয় বিধি অনুযায়ী বিবাহ নিত্য বিবাহ; এই নিত্য বিবাহও নৈমিত্তিক হইয়া গড়ে; কারণ, যেমন অশৌচ প্রভৃতি মরণনিশ্চয়জ্ঞানের অধীন, সেই রূপ এই নিত্য বিবাহও পূর্ব্ব- পত্নীর মরণনিশ্চয়জ্ঞানের অধীন"।

ইহার তাৎপর্য্য' এই, পত্নীর মরণনিশ্চয় ব্যতিরেকে, পুরুষ দ্বিতীয় বিধি অনুযায়ী বিবাহে অধিকারী হয় না; এজন্য; এই বিবাহে পত্নীমরণের নিমিত্ততা আছে; সুতরাং, উহা নৈমিত্তিক হইয়া পড়ে, এবং তাহা হইলেই, আমার অভিমত নিত্যত্বের ব্যাঘাত হইল। এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, প্রথম পুস্তকে

"দ্বিতীয় বিধির অনুযায়ী বিবাহও নিত্য বিবাহ; তাহা না করিলে, আশ্রমভ্রংশ নিবন্ধন পাতকগ্রস্ত হইতে হয়" (৭৬)। এই রূপে, প্রথমতঃ এই বিবাহের নিত্যত্ব নির্দেশ করিয়া, পরিশেষে এই বিবাহের নৈমিত্তিকত্ব স্বীকার করিয়াছি। যথা,

"স্ত্রীবিয়োগরূপ নিমিত্ত বশতঃ করিতে হয়, এজন্য এই বিবাহের নৈমিত্তিকত্বও আছে” (৭৬)।

ফলকথা এই, স্ত্রীবিয়োগনিবন্ধন বিবাহ কেবল নিত্য অথবা কেবল নৈমিত্তিক নহে, উহা নিত্যনৈমিত্তিক। লঙ্ঘনে দোষশ্রুতিরূপ হেতু বশতঃ, এই বিবাহের নিত্যত্ব আছে; আর, স্ত্রীবিয়োগরূপ নিমিত্ত্ব বশতঃ করিতে হয়, এজন্য নৈমিত্তিকত্বও আছে। এইরূপ উভয়ধৰ্ম্মাক্রান্ত হওয়াতে, এই বিবাহ নিত্যনৈমিত্তিক বলিয়া পরিগণিত হওয়া উচিত। আমি, প্রথমে এই বিবাহকে নিত্য বিবাহ কলিয়া নির্দেশ করিয়া, টীকায় উহার নৈমিত্তিকত্ব স্বীকার করিয়াছি। কিন্তু, যখন উহার নিত্যত্ব ও নৈমিত্তিকত্ব উভয়ই। আছে, তখন উহাকে, কেবল নিত্য বলিয়া পরিগণিত না করিয়া," নিত্যনৈমিত্তিক বলিয়া পরিগণিত করাই আবশ্যক। এতদনুসারে, বিবাহ নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য ভেদে ত্রিবিধ বলিয়া নির্দিষ্ট না হইয়া, বিবাহ নিত্য, নৈমিত্তিক, নিত্যনৈমিত্তিক, কাম্য ভেদে চতুর্বিধ বলিয়া পরিগণিত হওয়াই উচিত ও আব্যক। সে যাহা হউক, তর্কবাচস্পতি মহাশয়, উপেক্ষা বশতঃ, অথবা অনবধান বশতঃ, আমার লিখনে দৃষ্টিপাত না করিয়াই, এই আপত্তি করিয়াছেন, তাহার সন্দেহ নাই।

তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের দ্বিতীয় আপত্তি এই;

"কিঞ্চ তন্মতে তৃতীয় বিধি অন্যায়ী বিবাহ নৈমিত্তিক বিবাহ, এই নৈমিত্তিক বিবাহেরও নৈমিত্তিকত্ব ঘটিতে পারে না; কারণ বিবাহে শুদ্ধ কালের এবং অষ্ট বর্ষাদি কালের প্রতীক্ষার আবশ্যকতা বশতঃ, নিমিত্তনিশ্চয়ের অব্যবহিত উত্তরকালে তাহার অনুষ্ঠান ঘটিতেছে না।

পূর্বের দর্শিত হইয়াছে, নৈমিত্তিক দ্বিবিধ, সাবকাশ ও নিরবকাশ। সাবকাশ নৈমিত্তিকে কালপ্রতীক্ষা চলে; নিরবকাশ নৈমিত্তিকে কালপ্রতীক্ষা চলে না; তৃতীয় বিধি অনুযায়ী বিবাহ সাবকাশ নৈমিত্তিক; উহাতে কালপ্রতীক্ষা চলিতে পারে। এজন্য, বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিমিত্ত নিশ্চয়ের অব্যবহিত উত্তরকালে অনুষ্ঠান না ঘটিলেও, উহার নৈমিত্তিকত্বের ব্যাঘাত ঘটিতে পারে না। তর্কবাচস্পতি মহাশয়, সাবকাশ নৈমিত্তিকে নিরবকাশ নৈমিত্তিকে লক্ষণ ঘটাইবার চেষ্টা করিয়া, নৈমিত্তিক বিবাহের নৈমিত্তিকত্ব খৃগুনে প্রবৃত্ত হইয়াছেন।

তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের তৃতীয় আপত্তি এই;

"অপরঞ্চ, "নৈমিত্তিষ্ক কৰ্ম্ম যখনই ঘাটবেক, তখনই তাহার অনুষ্ঠান করিবেক, তাহাতে কালাকাল বিবেচনা নাই।" এই শাস্ত্র অনুসারে, লুপ্তসংবৎসর মলমাস শুক্রান্ত প্রভৃতি কালেও তৃতীয় বিধি অনুযায়ী নৈমিত্তিক বিবাহের কর্তব্যতা ঘাটয়া উঠে। জাতেষ্টি প্রভৃতি নৈমিত্তিক কর্ম্মে অশৌচাদির ও শুদ্ধ কালের প্রতীক্ষা করিতে হয় না, ইহা সর্ব্বসম্মত; তদনুসারে ভদভিমত নৈমিত্তিক বিবাহস্থলেও অশৌচাদির ও শুদ্ধ কালের প্রতীক্ষা করিবার আবশ্যকতা থাকিতে পারে না।"

তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের এ আপত্তিও অকিঞ্চিৎকর; কারণ উক্ত বচন নিরবকাশনৈমিত্তিকবিষয়ক নিরবকাশ নৈমিত্তিকেই কালা- কাল বিবেচনা নাই। তৃতীয় বিধি অনুযায়ী বিবাহ সাবকাশ •নৈমিত্তিক। সাবকাশ নৈমিত্তিকে কালাকাল বিবেচনার সম্পূর্ণ আবশ্যকতা আছে। তর্কবাচস্পতি মহাশয়, সাবকাশ নৈমিত্তিকে নিরবকাশ নৈমিত্তিকবিষয়িণী ব্যবস্থ। ঘটাইবার চেস্ট। পাইয়া, অনভিজ্ঞতা প্রদর্শনমাত্র করিয়াছেন।

অপরঞ্চ,

"জাতেষ্টি প্রভৃতি নৈমিত্তিক কর্ম্মে অশৌচাদির ও শুদ্ধ কালের প্রতীক্ষা করিতে হয় না, ইহা সৰ্ব্বসম্মত।"

তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের এই ব্যবস্থা সর্বাংশে সঙ্গত নহে। জাতেপ্তি মলমাসাদি অশুদ্ধ কালেও অনুষ্ঠিত হইতে পারে; সুতরাং, তাহাতে শুদ্ধ কালের প্রতীক্ষা করিতে হয় না, তদীয় ব্যবস্থার এ অংশ সর্বসম্মত বটে। কিন্তু, জাতেষ্টিতে অশৌচান্তের প্রতীক্ষা করিতে হয় না, অর্থাৎ অশৌচকালেও উহার অনুষ্ঠান হইতে পারে; এ ব্যবস্থা তিনি কোথায় পাইলেন, বলিতে পারি না। পুত্র জন্মিলে, জাতেন্তি ও জাতকৰ্ম্ম করিবার, এবং জাত- কর্ম্মের পর বালককে স্তন্য পান করাইবার, বিধি আছে। কিন্তু, জাতেষ্টি করিতে যত সময় লাগে, তত ক্ষণ স্তন্য পান করিতে না দিলে, বালকের প্রাণবিয়োগ অবধারিত; এজন্য, অগ্রে স্বল্পকালসাধ্য জাতকৰ্ম্ম মাত্র করিয়া, রালককে স্তন্য পান করায়; পরে, অশৌচান্তে জাতেন্তি অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। এই ব্যবস্থাই সর্ববসম্মত বলিয়া অঙ্গীকৃত। তর্কবাচস্পতি মহাশয়, বুদ্ধিবলে, অশ্রুতপূর্ব সর্ব্বসম্মত ব্যবস্থা বহিষ্কৃত করিয়াছেন। অশৌচকালেও জাতেষ্টি অনুষ্ঠিত হইতে পারে, ইহা যে সম্পূর্ণ অব্যবস্থা, সে • বিষয়ে প্রমাণ প্রদর্শনের প্রয়োজন নাই; তথাপি তাঁহার প্রীত্যর্থে, জাতেন্তি সংক্রান্ত অধিকরণদ্বয় উদ্ধৃত হইতেছে;-

"অষ্টাদশম্

জন্মানন্তরমেবেন্তির্জাতকৰ্ম্মণি বা কৃতে। নিমিত্তানন্তরং কার্য্যং নৈমিত্তিকমতোহগ্রিমঃ ॥ ১ ॥ জাতকৰ্ম্মণি নির্বৃত্তে স্তনপ্রাশনদর্শনাৎ। প্রাগেবেষ্টৌ কুমারস্য বিপত্তেরূদ্ধমস্ত সা ॥ ২৷৷

পুত্রজন্মনো বৈশ্বানরেষ্টিনিমিত্তহাৎ নৈমিত্তিকন্ত কালবিলম্বা- যোগাৎ জন্মানন্তরমেবেষ্টিরিতি চেৎ মৈবং স্তনপ্রাশনং তাবৎ জাতকৰ্ম্মানন্তরং বিহিতং যদি জাতকৰ্ম্মণঃ প্রাগেব বৈশ্বানরেষ্টি- নিরূপ্যেত তদা স্তনপ্রাশনস্তাত্যন্ত বিলম্বনাৎ পুজো বিপ্যেত তথা সতি পূতত্বাদিক মিষ্টিফলং কস্ত হ্যাৎ তন্মান্ন জন্মানন্তরং কিন্তু জাতকৰ্ম্মণ উর্দ্ধং সেষ্টিঃ” (৭৭)।

অষ্টাদশ অধিকরণ

পুত্রজন্মরূপ নিমিত্ত্ব বশতঃ, বৈশ্বানর যাগ অর্থাৎ জাতোষ্ট করিতে হয়; নৈমিত্তিকের অনুষ্ঠানে কালবিলম্ব চলে না; অতএব, জন্মের পর ক্ষণেই, * জাতেষ্টি করা উচিত, একপ বলিও না; কারণ, জাতকর্ম্মের পর স্তন্য গান • করাইবার বিধি আছে; যদি জাতকর্ম্মের পূর্বে জাতেষ্টির ব্যবস্থা কর, তাহা হইলে স্তন্ত পানের বিলম্বনিবন্ধন, বালকের প্রাণবিয়োগ ঘটে; বালকের প্রাণবিয়োগ ঘটিলে, যাগের ফলভাগী কে হইবেক। অতএব, জন্মের পর ক্ষণেই না করিয়া, জাতকর্ম্মের পর জাভেষ্টি করা অবাক।

"একোনবিংশম্

জাতকৰ্ম্মানন্তরং স্যাদাশৌচাপগমেহথবা! নিমিত্তসন্নিধেরাজ্যঃ কর্ত্তঃ শুদ্ধ্যর্থমুত্তরঃ ॥ ১ ॥ য্যপি জাতকৰ্ম্মানন্তরমেব তদনুষ্ঠানে নিমিত্তভূতং জন্ম সন্নিহিতং ভবতি তথাপ্যশুচিনা পিত্রা অনুষ্ঠয়মানমঙ্গং বিকলং ভবেৎ জাতকৰ্ম্মণি তু বিপত্তিপরিহারায় তাৎকালিকী শুদ্ধিঃ শাস্ত্রেণৈব দর্শিতা মুখ্যসন্নিধেরব্যং বাধিতত্ত্বাৎ শুদ্ধিলক্ষণাঙ্গবৈকল্যং বার- রিতুমাশৌচাদুদ্ধমিষ্টিং কুৰ্য্যাৎ” (৭৭)।

• ঊনবিংশ অধিকরণ

যদিও, জাতকর্ম্মের পর ক্ষণেই, জাতেষ্টির অনুষ্ঠান করিলে পুত্রজন্মরূপ নিমিত্ত সন্নিহিত হয়; কিন্তু পিতা, অশুচি অবস্থায়, যাগের অনুষ্ঠান করিলে, তাহার ফললাভ হইতে পারে না। বালকের প্রাণবিয়োগরূপ অনিষ্ট নিবারণের নিমিত্ত, শাস্ত্রকারেরা, জাতকৰ্ম্ম স্থলে, পিতার তাৎকালিক শুদ্ধি ব্যবস্থা করিয়াছেন। নিঙ্গিত্তসন্নিহিত কালে অনুষ্ঠান কোনও মতে চলিতে পারে না; অতএব, জাতকর্ম্মের পর না করিয়া, কার্য্যসিদ্ধির নিদানতুত শুদ্ধির অনুন্স্যাধে, অশৌচান্তে জাতেষ্টির অনুষ্ঠান করিবেক।

শবরস্বামীও, এইরূপ 'বিচার করিয়া, অশৌচান্তে, পূর্ণিমা অথবা অমাবস্যাতে, জাতেন্তির অনুষ্ঠান করিবেক, এই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। যথা,

“তস্মাদতীতে দর্শাহে পৌর্ণমা্যামমাবাশ্যায়াং বা কুর্য্যাৎ” (৭৮)। অতএব, দশাহ অতীত হইলে, পূর্ণিমা অথবা অমাবস্তাতে করিবেক।

তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের চতুর্থ আপত্তি এই;-

"আর, "স্ত্রী বন্ধ্যা হইলে অষ্টম বর্ষে, মৃতপুজা হইলে দশম বর্ষে, কন্যামাত্রপ্রসবিনী হইলে একাদশ বর্ষে," ইত্যাদি দ্বারা মনু প্রভৃতি, অবৈর্ষাদি কাল প্রতীক্ষা বলিয়া, বিবাহের "নৈমিত্তিকত্ব খণ্ডন করিয়াছেন।"

এই অশ্রুতপূর্ব সিদ্ধান্ত নিতান্ত কৌতুককর। যে বচনে মনু নৈমিত্তিক বিবাহের বিধি দিয়াছেন, ঐ বচনে মনু বিবাহের নৈমিত্তিকত্ব খণ্ডন করিয়াছেন, ইহা বলা অল্প পাণ্ডিত্যের কর্ম্ম নহে। তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের অভিপ্রায় এই, নিমিত্তনিশ্চয়ের 0 অব্যবহিত পরেই যে কার্য্যের অনুষ্ঠান হয়, তাহাই নৈমিত্তিক। কিন্তু, মনু, বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিশ্চয়ের পর, অষ্টবর্ষাদি কাল প্রতীক্ষা করিয়া বিবাহ করিবার বিধি দিয়াছেন; সুতরাং, ঐ বিবাহ নিমিত্তনিশ্চয়ের অব্যবহিত পরেই অনুষ্ঠিত হইতেছে না; এজন্য, উহার নৈমিত্তিকত্ব ঘটিতে পারে না। এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, যদিই মনু, বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিশ্চয়ের পর, বিবাহ বিষয়ে অষ্টবর্ষাদি কালপ্রতীক্ষার বিধি দিয়া থাকেন, তাহা হইলেই, বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিমিত্ত নিবন্ধন বিবাহের নৈমিত্তিকত্ব নিরস্ত হইবেক কেন। পূর্ব্বে প্রদর্শিত হইয়াছে, ঈদৃশ বিবাহ সাবকাশ • নৈমিত্তিক; বিশিষ্ট কারণ বশতঃ, সাবকাশ নৈমিত্তিকে কাল প্রতীক্ষা চলে; সুতরাং, নিমিত্তঘটনার অব্যবহিত পরেই, উহার অনুষ্ঠানের আবশ্যকতা নাই। যদি ইহা স্থির সিদ্ধান্ত হইত, নৈমিত্তিক কৰ্ম্ম মাত্রে, কোনও মতে, কাল প্রতীক্ষা চলে না, *নিমিত্তনিশ্চয়ের অব্যবহিত উত্তর কালেই, তত্তৎকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিতে হয়, তথ্যতিরেকে, ঐ সকল কর্ম্ম কদাচ নৈমিত্তিক বলিয়া পরিগৃহীত হইতে পারে না; তাহা হইলেই, ঐ বচন দ্বারা, উক্ত বিবাহের নৈমিত্তিকত্ব নিরাকৃত হইতে পারিত।

কিঞ্চ, তর্কাচস্পতি মহাশয় ধর্মশাস্ত্রব্যবযায়ী নহেন; সুতরাং, ধৰ্ম্মশাস্ত্রের মর্ম্মগ্রহে অসমর্থ; সমর্থ হইলে, মনু, বন্ধাত্ব প্রভৃতি অবধারণের পর, অষ্টবর্ষাদি কাল প্রতিক্ষা করিয়া, বিবাহ করিবার বিধি দিয়াছেন, এরূপ অসার ও অসঙ্গত কথা তদীয় লেখনী হইতে নির্গত হইত না। শাস্ত্রকারের। বিধি দিয়াছেন, স্ত্রী বন্ধ্যা, মৃতপুভ্রা, বা কন্যামাত্রপ্রসবিনী হইলে, পুরুষ পুনরায় বিবাহ করিবেক। "সুতরাং, বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি অবধারিত না হইলে, পুরুষ, এই বিধি অনুসারে, বিবাহে অধিকারী হইতে পারে না। কিন্তু, বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতির অবধারণের সহজ উপায় নাই। সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায়, কিছু কাল স্ত্রীলোকের সন্তান না হইয়া, অধিক বয়সে সন্তান জন্মিয়াছে; উপর্যুপরি স্ত্রীলোকের কতকগুলি সন্তান মরিয়া, পরে সন্তান জন্মিয়া রক্ষা পাইয়াছে; ক্রমাগত, স্ত্রীলোকের কতকগুলি কন্যাসন্তান জন্মিয়া, পরে পুত্রসন্তান জন্মিয়াছে। এ অবস্থায়, স্ত্রী বন্ধ্যা, মৃতপুত্রা বা কণ্যামাত্রপ্রসবিনী বলিয়া অবধারণ করা সহজ ব্যাপার নহে। রজোনিবৃত্তি না হইলে, স্ত্রীলোকের সন্তানসম্ভাবনা নিবৃত্ত হয় না। অতএব, যাবৎ রজোনিবৃত্তি না হয়, তারৎ স্ত্রী বন্ধ্যা, মৃতপুত্রা, বা. ক্যামাত্রপ্রসবিনী বলিয়া পরিগৃহীত হওয়া অসম্ভব। কিন্তু, স্ত্রীর রজোনিবৃত্তি পর্য্যন্ত অপেক্ষা করিতে গেলে, পুরুষের বয়স অতীত হইয়া যায়; সে বয়সে দারপরিগ্রহ করিলে, সন্তানোৎপত্তির সম্ভাবনা থাকা সন্দেহস্থল। এরূপ নিরুপায় স্থলে, মনু ব্যবস্থা করিয়াছেন, প্রথম ঋতুদর্শন দিবস হইতে আট বৎসর যে স্ত্রীলোকের সন্তান না জন্মিবেক,' তাহাকে বন্ধ্যা, দশ বৎসর যে স্ত্রীলোকের সন্তান হইয়া মরিয়া যাইবেক, তাহাকে মৃতপুভ্রা, আর এগার বৎসর যে স্ত্রীলোকের কেবল কন্যাসন্তান জন্মিবেক, তাহাকে কন্যামাত্রপ্রসবিনী বোধ করিতে হইবেক; এবং তখুন পুরুষের পুত্রকামনায় পুনরায় দারপরিগ্রহ করিবার অধিকার জন্মিবেক। নতুবা, বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি অবধারণের পর আট বৎসর, দশ বৎসর, এগার বৎসর প্রতীক্ষা করিয়া বিবাহ করিবেক, মনুবচনের ওরূপ অর্থ নহে। আর, যদি মনুবচনের ঐরূপ অর্থই তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের নিতান্ত অভিমত হইয়া থাকে, তাহা হইলে, কোন সময়ে, কি উপায়ে, বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি অবধারিত হইবেক, এ ঘিষয়ের মীমাংসা করিয়া দেওয়া সর্বতোভাবে উচিত ছিল; কারণ, বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি অবধারিত হইলেই, অবধারণের দিবস হইতে অষ্টবর্ষাদি কালের গণনা আরম্ভ হইতে পারে। তদ্ব্যতিরেকে তাদৃশ কালগণনা, কোনও মতে, সন্তুবিতে পারে না। লোকে ব্যবস্থা অনুসারে চলিতে পারে, এরূপ পথ না করিয়া, ব্যবস্থা দেওয়া ব্যবস্থাপকের কর্ত্তব্য নহে।

তর্কবাচস্পতি মহাশয় স্থলান্তরে নির্দেশ করিয়াছেন,-

"বিদ্যাসাগরেণ নিত্যনৈমিত্তিককাষ্যভেদেন বিবাহত্রৈবিধ্যং যদভিহিতং তৎ কিং মন্বাদিশাস্ত্রোপলব্ধম্ উত স্বপ্নোপলব্ধম্ অথ স্বশেমুষীপ্রতিভাসলব্ধং বা তত্র

নিত্যং নৈমিত্তিকং কাম্যং ত্রিবিধং স্নানমিয্যতে

ইতি স্নান্য যথা ত্রৈবিধ্যপ্রতিপাদকশাস্ত্রমুপলভ্যতে এবং শাস্ত্রোপলন্তাভাবান্নান্তঃ ন চ তথা শাস্ত্রং দৃপ্ততে ন বা তেনাপু্যুপ- লব্ধম্। গ্রন্থী ভবতি গ্লণ্ডিত ইত্যুক্তিমনুস্বত্য সংস্কৃতপাঠশালাতো গৃহীতশকটভারপুস্তকেনাপি তেন যদি কিঞ্চিৎ প্রমাণমদ্রক্ষ্যত তদা নিরদেক্ষ্যত নচ নিরদেশি। নাপি তত্র ক্যচিৎ সন্দর্ভস্থ্য সম্মতিরস্তি। অতঃ প্রমাণোপন্যাসমস্তরেণ তদ্বচনমাত্রে বিশ্বাস- ভাজঃ সংস্কৃতানভিজ্ঞজনান্ প্রত্যেব তচ্ছোভতে নতু প্রমাণপর- তন্ত্রান্ তান্তিকান্ প্রতি (৭৯)।"

বিদ্যাসাগর নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য ভেদে বিবাহের যে ত্রৈবিধ্য ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহা কি মনুপ্রভৃতিপ্রণীত ধৰ্ম্মশাস্ত্র দেখিয়া করিয়াছেন, না স্বপ্নে পাইয়াছেন, অথবা আপন বুদ্ধিবলে উদ্ভাবিত করিয়াছেন। তন্মধ্যে, "স্নান ত্রিবিধ নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য", স্নানের যেমন ত্রৈবিধ্যপ্রতিপাদক এই শাস্ত্র দৃষ্ট হইতেছে, সেরূপ শাস্ত্র নাই, সুতরাং ঐ ব্যবস্থা শাস্ত্রানুযায়িনী নহে; সেরূপ শাস্ত্র দৃষ্ট হইতেছে না, এবং তিনিও পান নাই। "গ্রন্থী ভবতি পণ্ডিতঃ" যাহার অনেক গ্রন্থ আছে, সে পণ্ডিতপদবাচ্য; এই উক্তির অনুসরণ করিয়া, তিনি সংস্কৃতপাঠশালা হইতে এক গাড়ী পুস্তক লইয়া গিয়াছেন; তাহাতেও যদি কিছু প্রমাণ দেখিতে পাইতেন, তাহা হইলে তাহা নির্দেশ করিতেন, কিন্তু নির্দেশ করেন নাই। এ বিষয়ে কোন গ্রন্থের সম্মতি দেখিতে পাওয়া যায় না। অতএব প্রমাণ প্রদর্শন ব্যতিরেকে অবলম্বিত ঐ ত্রৈবিধ্যব্যবস্থা তদীয় বাক্যে বিশ্বাসকারী সংস্কৃতানভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিকটেই শোভা পাইবেক, প্রমাণপরতন্ত্র তান্ত্রিকদিগের নিকটে নহে।

এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, আমি' মনুপ্রভৃতিপ্রণীত শাস্ত্র অবলম্বন করিয়া, বিবাহের ত্রৈবিধ্য ব্যবস্থা করিয়াছি; ঐ ব্যবস্থা' স্বপ্নে প্রাপ্ত, অথবা বুদ্ধিবলে উদ্ভাবিত নহে। তর্কবাচস্পতি গহাশয় যে মীমাংসা করিয়াছেন, তদনুসারে বিবাহমাত্রই কাম্য; সুতরাং, বিবাহের কাম্যত্ব অংশে তাঁহার কোনও আপত্তি নাই; কেবল, বিবাহের নিত্যত্ব ও নৈমিত্তিকত্ব অংশেই তিনি আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন। ইতঃপূর্বে যে সকল শাস্ত্র প্রদর্শিত হইয়াছে, আমার বোধে, তদ্দ্বারা বিবাহের নিত্যত্ব ও নৈমিত্তি-' কত্ব, নিঃসংশয়িতরূপে, প্রতিপাদিত হইয়াছে। সুতরাং, বিবাহের নিত্যত্ব ও নৈমিত্তিকত্ব ব্যবস্থা শাস্ত্রানুযায়িনী নহে, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের এই নির্দেশ, কোনও মতে, সঙ্গত হইতেছে না।

কিঞ্চ,

“স্নান ত্রিবিধ, নিত্য নৈমিত্তিক কাম্য”, স্নানের যেমন ত্রৈবিধ্য

প্রতিপাদক 'এই শাস্ত্র দৃষ্ট হইতেছে, সেরূপ শাস্ত্র নাই।" তর্কবাচস্পতি মহাশয় ধৰ্ম্মশাস্ত্রব্যবসায়ী হইলে, কখনও এরূপ নির্দেশ করিতে পারিতেন না। কর্ম্মবিশেষ নিত্য, নৈমিত্তিক, বা কাম্য, কোনও কোনও স্থলে, বচনে এরূপ নির্দেশ দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু, অনেক স্থলে, সেরূপ নির্দেশ, নাই; অথচ, সে সকল স্থলে, তত্তৎ কৰ্ম্ম নিত্য, বা নৈমিত্তিক, বা কাম্য বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। বচনে নিত্যত্ব প্রভৃতির নির্দেশ না থাকিলে, কৰ্ম্ম সকল নিত্য প্রভৃতি বলিয়া পরিগণিত হইবেক না, এ কথা বলা যাইতে পারে না। সন্ধ্যাবন্দন নিত্য কৰ্ম্ম বলিয়া পরিগৃহীত; কিন্তু, বচনে নিত্য বলিয়া নির্দেশ নাই। একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধ নিত্য ও নৈমিত্তিক বলিয়া পরিগণিত; কিন্তু, বচনে নিত্য ও নৈমিত্তিক বলিয়া নির্দেশ নাই। একাদশীর উপবাস নিত্য ও কাম্য বলিয়া ব্যবস্থাপিত; কিন্তু বচনে নিত্য ও কাম্য বলিয়া নির্দেশ নাই। যে যে হেতুতে কৰ্ম্ম সকল নিত্য, নৈমিত্তিক, বা কাম্য বলিয়া ব্যবস্থা- পিত হইবেক, শাস্ত্রকারেরা তৎসমুদয় বিশিষ্টরূপে দর্শাইয়া গিয়া- ছেন; তদনুসারে, সর্বত্র নিত্যত্ব প্রভৃতি ব্যবস্থাপিত হইয়া থাকে। স্নান, দান, জাতকৰ্ম্ম, নান্দিশ্রাদ্ধ প্রভৃতি কতিপয় স্থলে বচনে যে নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য এরূপ নির্দেশ আছে, তাহা বাহুল্যমাত্র; তাহা না থাকিলেও, তত্ত্বৎ কর্ম্মের নিত্যত্ব প্রভৃতির নিরূপণ পূর্বেবা- ল্লিখিত সাধারণ নিয়ম দ্বারা হইতে পারিত। বচনে নির্দেশ না থাকিলে, যদি নিত্যত্ব প্রভৃতি ব্যবস্থাপিত হইতে না পারে, তাহা হইলে সন্ধ্যাবন্দন, একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধ, একাদশীর উপবাস, ইত্যা- দির নিত্যত্ব প্রভৃতি ব্যবস্থাপিত হইতে পারে না। বচনে নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য এরূপ নির্দেশ থাকুক, বা না থাকুক, বিধিবাক্যে নিত্যশব্দপ্রয়োগ, লঙ্ঘনে দোষশ্রুতি প্রভৃতি হেতু থাকিলে, সেই বিধি অনুযায়ী কৰ্ম্ম নিত্য বলিয়া পরিগণিত হইবেক; বিধিবাক্যে ফলশ্রুতি থাকিলে, সেই বিধি অনুযায়ী কর্ম্ম কাম্য বলিয়া পরি- গণিত হইবেক; বিধিবাক্যে নিমিত্ত বশতঃ যে কৰ্ম্মের অনুষ্ঠান অনুমত 'হইবেক, তাহা নৈমিত্তিক বলিয়া পরিগণিত হইবেক। "অতএধ, বচনে নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য ইত্যাদি শব্দে নির্দেশ না থাকিলে, বৈধ কর্ম্মের নিত্যত্ব প্রভৃতি সিদ্ধ হয় না, ইহা নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর কথা।

অপিচ,

"এ বিষয়ে কোনও গ্রন্থেরও সম্মতি দেখিতে পাওয়া যায় না”। তর্কবাচ্চস্পতি মহাশয়ের এই নির্দেশ অনভিজ্ঞতার পরিচায়ক মাত্র। বিবাহের নিত্যত্ব বিষয়ে অতি প্রসিদ্ধ প্রাচীন গ্রন্থের সম্মতি লক্ষিত হইতেছে। যথা, "রতিপুত্রধর্মার্থত্বেন বিবাহস্ত্রিবিধঃ তত্র পুত্রার্থো দ্বিবিধঃ নিজ্যঃ কাম্যশ্চ তত্র নিত্যে প্রজার্থে সবর্ণঃ শ্রোত্রিয়ো বরঃ ইত্যনেন সবর্ণা মুখ্যা দর্শিতা (৮০)।"

বিবাহ ত্রিবিধ রত্যর্থ, পুভ্রার্থ ও ধর্মার্থ; তন্মধ্যে পুত্রার্থ বিবাহ দ্বিবিধ নিত্য ও কাম্য; তন্মধ্যে নিত্য পুভ্রার্থ বিবাহে সবর্ণা কন্যা মুখ্যা, ইহা "সবর্ণঃ শ্রোত্রিঙ্গো বরঃ" এই বচন ছায়া দর্শিত হইয়াছে।

এস্থলে বিজ্ঞানেশ্বর, অসন্দিগ্ধ বাক্যে, বিবাহের নিত্যত্ব স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। অতএব, তর্কবাচস্পতি মহাশয়কে অগত্যা স্বীকার করিতে হইতেছে, বিবাহের নিত্যত্বব্যবস্থা বিষয়ে, অন্ততঃ, মিতাক্ষরানামক গ্রন্থের সম্মতি আছে। কৌতুকের বিষয় এই, তিনি মিতাক্ষরার উপরি উদ্ধৃত অংশের

• “রতিপুত্রধর্মার্থত্বেন বিবাহস্ত্রিবিধঃ”। বিবাহ ত্রিবিধ রত্যর্থ, পুভ্রার্থ, ও ধর্মার্থ।

এই প্রথম বাক্যটি বিবাহের কাম্যত্বসংস্থাপনপ্রকরণে প্রমাণ- স্বরূপ উদ্ধৃত করিয়াছেন (৮১); কিন্তু উহার অব্যবহিত পরবর্তী

"তত্র পুত্রার্থো দ্বিবিঃ নিত্যঃ কামাশ্চ"

তন্মধ্যে পুত্রার্থ বিবাহ দ্বিবিধ, নিত্য ও কাম্য।

এই বাক্যে, নিত্য কাম্য ভেদে বিবাহ দ্বিবিধ, এই যে নির্দেশ আছে, অনুগ্রহ করিয়া দিব্য চক্ষে তাহা নিরীক্ষণ করেন নাই।

বিবাহের নৈমিত্তিকত্ব বিষয়েও প্রসিদ্ধ গ্রন্থের সম্মতি দৃষ্ট হইতেছে। যথা,

"অধিবেদনং ভার্য্যান্তরপরিগ্রহঃ অধিবেদননিমিত্তান্ত্যপি স এবাহ"

• স্থরাপী ব্যাধিতা ধূর্ত্তা বন্ধ্যার্থস্যপ্রিয়ংবদা।

স্ত্রীপ্রসূশ্চাধিবেত্তব্যা, পুরুষদ্বেষিণী তথেতি।। (৮২)।

পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় দারপরিগ্রহের নাম অধিবেদন। যে স্বকল নিমিত্ত বশতঃ অধিবেদন করিতে পারে, যাজ্ঞবদ্য তৎসমুদয়ের নির্দেশ করিয়াছেন। যথা, স্ত্রী সুরাপারিণী, চিররোগিণী, ব্যভিচারিণী, বন্ধ্যা, অর্থ- নাশিনী, অপ্রিয়বাদিনী, ক্যামাত্রপ্রসবিনী, ও পতিদ্বেষিণী হইলে, পুনরায় দারপরিগ্রহ করিবেক। .

“অধিবেদনঃ দ্বিবিধং ধর্মার্থং কামার্থঞ্চ তত্র পুত্রোৎপত্ত্যাদি- ধর্মার্থে পূর্ব্বোক্তানি মণ্ডপত্বাদীনি নিমিত্তানি কামার্থে তু ন তান্তপেক্ষিতানি (৮৩)।"

"দ্বিবিধং হ্যধিবেদনং ধৰ্ম্মার্থং কামার্থঞ্চ তত্র পুত্রোৎপত্ত্যাদি- ধৰ্ম্মার্থে প্রাগুক্তানি ম্যপত্বাদীনি নিমিত্তানি কামার্থে তু ন তা্য- পেক্ষিতানি (৮৪) "

অধিবেদন দ্বিবিধ ধর্মার্থ ও কামার্থ; তাহার মধ্যে পুত্রোৎপত্তি প্রভৃতি ধর্মার্থ অধিবেদনে পূর্ব্বোক্ত শুরাপানাদিরূপ নিমিত্তঘটনা আবশুক; কামার্থ বিবাহে সে সকলের অপেক্ষা করিতে হয় না।

"এতন্নিমিত্তাভাবে নাধিবেত্তব্যেত্যাহ আপস্তম্বঃ ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্নে দারে নান্ডাং কুব্বীত (৮৫)।"

আপস্তম্ব, কহিঙ্গাছেন, এই সকল নিমিত্ত না ঘাটলে, অধিবেদন করিতে পারিবেক না; যথা, যে স্ত্রীর সহযোগে ধর্ম্মকার্য্য ও পুত্রলাভ সম্পন্ন হয়, তৎসত্ত্বে অন্য স্ত্রী বিবাহ করিবেক না;"

এক্ষণে

১। "যে সকল নিমিত্ত বশতঃ অধিবেদন করিতে পারে।"

২। "ধর্মার্থ অধিবেদনে পূর্ব্বোক্ত সুরাপানাদিরূপ নিমিত্ত ঘটনা আবশ্যক"। L

৩। "এই সরুল নিমিত্ত না ঘাটলে, অধিবেদন করিতে পারিবেত না"।

ইত্যাদি লিখন দ্বারা, স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিমিত্ত বশতঃ 'কৃত বিবাহের নৈমিত্তিকত্ব বিষয়ে, পরাশরভাষ্য, বীরমিত্রোদয়, ও চতুর্বিংশতিস্মৃতিব্যাখ্যা, এই সকল গ্রন্থের সম্মতি আছে কি না, তাহা সর্বশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহোদয় বিবেচনা করিয়া দেখিবেন।

অপরঞ্চ,

"অতএব প্রমাণপ্রদর্শন ব্যতিরেকে অবলম্বিত ঐ ত্রৈবিধ্যব্যবস্থা তদীয় বাক্যে বিশ্বাসকারী সংস্কৃতানভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিকটেই শোভা পাইবেক, প্রমাণপরতন্ত্র তান্ত্রিকদিগের নিকটে নহে”।

এই বিষয়ে বক্তব্য এই যে, পূর্বে যেরূপ দর্শিত হইল, তদনু সারে বিবাহের ত্রৈবিধ্যব্যবস্থা প্রমাণ প্রদর্শন পূর্ববক, অথবা প্রমাণ প্রদর্শন ব্যতিরেকে, অবলম্বিত হইয়াছে, তাহা সকলে বিবেচনা করিয়া দেখিবেন। তর্কবাচস্পতি মহাশয় সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, আমার অবলম্বিত ব্যবস্থা তান্ত্রিকদিগের নিকটে শোভা পাইবেক না। কিন্তু, আমার সামান্য বিবেচনায়, তান্ত্রিক মাত্রেই ঐ ব্যবস্থা অগ্রাহ্য করিবেন, এরূপ বোধ হয় না। তবে, যাঁহারা তাঁহার মত ঘোর তান্ত্রিক, তাঁহাদের নিকটে উহা গ্রাহ্য হইবেক, এরূপ প্রত্যাশা করিতে পারা যায় না।

বিশ্বাহের নিত্যত্ব ও নৈমিত্তিকত্ব খণ্ডন করিয়া, তর্কবাচস্পতি মহাশয় প্রকরণের উপসংহার করিতেছেন, '

"ইখং বিবাহস্ত কেবলনিত্যত্বং কেবলনৈমিত্তিকত্বঞ্চ ত্রৈবিধ্য- বিভাজকোপাধিতয়া তেন যৎ প্রমাণমন্তরেণৈব কল্পিতং তৎ প্রতিক্ষিপ্তং তচ্চ দ্বিশকটপুস্তকভারাহরণেন উপদেশসহস্রাইসর- ণেন বা তেন সমাধেয়ম্ (৮৬)।"

এইরূপে বিদ্যাসাগর, প্রমাণ ব্যতিরেকেই, ত্রৈবিধ্যবিভাজক উপাধি স্বরূপে, যে বিবাহের কেবলনিত্যত্ব ও কেবলনৈমিত্তিকত্ব কল্পনা করিয়াছেন, তাহা পণ্ডিত হইল। এক্ষণে তিনি, দুই গাড়ী পুস্তক আহরণ অথবা সহস্র উপদেশ গ্রহণ করিয়া, তাহার সমাধান করুন।

তর্কবাচস্পতি মহাশয়, দয়া করিয়া, আমায় যে এই উপদেশ দিয়াছেন, তজ্জন্য তাঁহাকে ধন্যবাদ দিতেছি। আমি তাঁহার মত সর্ববজ্ঞ' নহি; সুতরাং, পুস্তকবিরহিত অথবা উপদেশনিরপেক্ষ হইয়া, বিচারকার্য্য নির্বাহ করিতে পারি, আমার এরূপ সাহস বা এরূপ অভিমান নাই। বস্তুতঃ, তাঁহার উত্থাপিত আপত্তির সমাধানের নিমিত্ত, আমায় বহু পুস্তক দর্শন ও সংশয়স্থলে উপদেশ গ্রহণ করিতে হইয়াছে। তিনি, আত্মীয়তাভাবে, ঈদৃশ উপদেশ প্রদান না করিলেও, আমায় তদনুরূপ কার্য্য করিতে হইত, তাহার সন্দেহ নাই। তর্কবাচস্পতি মহাশয় সবিশেষ অবগত ছিলেন, এজন্য পূর্ব্বে নির্দেশ করিয়াছেন, আমি সংস্কৃত- পাঠশালা হইতে এক গাড়ী পুস্তক আহরণ করিয়াছি (৮৭)।

কিন্তু, দেখ, তিনি কেমন সরল, কেমন পরহিতৈষী; এক গাড়ী পুস্তক পর্য্যাপ্ত হইবেক না, যেমন বুঝিতে পারিয়াছেন, অমনি দুই গাড়ী পুস্তক আহরণের উপদেশ দিয়াছেন। কিন্তু, দুর্ভাগ্য বশতঃ, আমি যে সকল পুস্তক আহরণ করিয়াছি, আমার আশঙ্কা হইতেছে, তাহা দুই গাড়ী পরিমিত হইবেক না; বোধ হয়, অথবা বোধ হয় কেন, একপ্রকার নিশ্চয়ই, কিছু ন্যূন' হইবেক; সুতরাং, সম্পূর্ণ ভাবে, তদীয় তাদৃশ নিরুপম উপর্দেশ পালন করা হয় নাই; এজন্য, আমি অতিশয় চিন্তিত, দুঃখিত, লজ্জিত, কুণ্ঠিত, ও শঙ্কিত হইতেছি। দয়াময় তর্কবাচস্পতি মহাশয়, যেরূপ দয়া করিয়া, আমায় ঐ উপদেশ দিয়াছেন, যেন সেইরূপ দয়া করিয়া, আমার এই অপরাধ মার্জনা করেন। আর, এস্থলে ইহাও নির্দেশ করা আবশ্যক, যদিও তদীয় উপদেশের এ অংশে আমার কিঞ্চিৎ ত্রুটি হইয়াছে; কিন্তু অপর অংশে, অর্থাৎ তাঁহার উত্থাপিত আপত্তির সমাধান বিষয়ে, যত্ন ও পরিশ্রমের ত্রুটি করি নাই। সুতরাং, সে বিষয়ে মহানুভাব তর্কবাচস্পতি মহোদয় আমায় নিতান্ত অপরাধী করিতে পারিবেন, এরূপ বোধ হয় না।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

শ্রীযুত তারানাথ তর্কবাচস্পতি সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, .

*"ইচ্ছায়া নিরঙ্কুশত্বাচ্চ যাবর্দিচ্ছং তাবদ্বিবাহস্তোচিতত্বাৎ (১)।"

• ইচ্ছার নিয়ামক নাই, অতএব যত ইচ্ছা বিবাহ করা উচিত।

এই ব্যবস্থার অথবা উপদেশবাক্যের সৃষ্টিকর্তা তর্কবাচস্পতি মহাশয়কে ধন্যবাদ দিতেছি, এবং আশীর্ব্বাদ করিতেছি, তিনি চিরজীবী হউন, এবং এইরূপ সদ্ব্যবস্থা ও সদুপদেশ দ্বারা, স্বদেশীয়দিগের সদাচারশিক্ষা ও জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন বিষয়ে, সহায়তা করিতে থাকুন। তাঁহার মত সূক্ষ্ম বুদ্ধি, অগাধ বিদ্যা, ও অদ্ভুত সাহস ব্যতিরেকে, এরূপ অভূতপূর্ব ব্যবস্থার উদ্ভব কদাচ সম্ভব নহে। তদপেক্ষা ন্যূনবুদ্ধি, ন্যূনবিছা, ন্যূনসাহস ব্যক্তির, “যত ইচ্ছা বিবাহ করা উচিত," কদাচ ঈদৃশ ব্যবস্থা দিতে সাহস হয় না; তাদৃশ ব্যক্তি, অত্যন্ত সাহসী হইলে, "যত ইচ্ছা বিবাহ করিতে পারে," কথঞ্চিৎ এরূপ ব্যবস্থা দিতে পারেন। যাহা হউক, তিনি যে ব্যবস্থা দিয়াছেন, তাহা কত দূর সঙ্গত, তাহার আলোচনা করা আবশ্যক।

পঞ্চম পরিচ্ছেদে প্রতিপাদিত হইয়াছে, নিত্য, নৈমিত্তিক, নিত্যনৈমিত্তিক, ও কাম্য ভেদে বিবাহ চতুর্বিধ। ব্রহ্মচর্য্য সমাধানের পর, গুরুগৃহ হইতে স্বগৃহ প্রত্যাগমন পূর্ব্বক, যে বিবাহ করিবার বিধি আছে, তাহা নিত্য বিবাহ। যথা,

গুরুণানুমতঃ স্নাত্বা সমাবৃত্তো যথাবিধি।

উদ্বহেত দ্বিজো ভার্য্যাং সবর্ণাং লক্ষণান্বিতাম্ (২)। দ্বিজ, গুরুর অনুজ্ঞালাভাস্তে, যথাবিধানে স্নান ও সমাবর্তন করিয়া, সজাতীয়া সুলক্ষণ। ভার্য্যার পাণিগ্রহণ করিবেক।

পূর্বপরিণীতা স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিমিত্ত বশতঃ, তাহার জীবদ্দশায়, পুনরায় যে বিবাহ করিবার বিধি আছে, তাহা নৈমিত্তিক বিবাহ। যথা,

সুরাপী ব্যাধিতা ধূর্তা বন্ধ্যার্থস্যপ্রিয়ংবদা।

স্ত্রীপ্রসূশ্চাধিবেত্তব্যা পুরুমূদ্বেষিণী তথা (৩) ॥"

যদি স্ত্রী কুরাপায়িণী, চিররোগিণী, ব্যভিচারিণী, বন্ধ্যা, অর্থনাশিনী, অপ্রিয়- বাধিনী, ক্যামাত্রগ্রসবিনী, ও পুতিদ্বেষিণী হয়, তৎসত্ত্বে অধিবেদন, অর্থাৎ পুনরায় দারপরিগ্রহ, করিবেক।'

পুত্রলাভ ও ধৰ্ম্মকার্য্যসাধন গৃহস্থাশ্রমের প্রধান উদ্দেশ্য; পুত্রলাভ ব্যতিরেকে, পিতৃঋণের পরিশোধ হয় না; যজ্ঞাদি ধর্ম্মকার্য্য ব্যতিরেকে, দেবঋণের পরিশোধ হয় না। স্ত্রী বন্ধ্যা, ব্যভিচারিণী, সুরাপায়িণী প্রভৃতি হইলে, গৃহস্থাশ্রমের দুই প্রধান উদ্দেশ্য সম্পন্ন হয় না; এজন্য, শাস্ত্রকারেরা, পূর্ববপরিণীতা স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিমিত্ত ঘটিলে, তাহার জীবদ্দশায়, পুনরায় দারপরিগ্রহের বিধি দিয়াছেন। গৃহস্থাশ্রম 'সম্পাদন কালে, যত বার নিমিত্ত ঘটিবেক, তত বার বিবাহ করিবার অধিকার ও ও আবশ্যকতা আছে। যথা,

অপুভ্রঃ সন্ পুনৰ্দ্দারান্ পরিণীয় ততঃ পুনঃ।

. পরিণীয় সমুৎপাষ্ট নোচেদা পুভ্রদর্শনাৎ।

•বিরক্তশ্চেদ্বনং গচ্ছেৎ সন্ন্যাসং বা সমাশ্রয়েৎ (৪) ।।

প্রথমপরিণীতা গ্রীতে পুত্র না জন্মিলে, পুনরায় বিবাহ করিবেক; তাহাতেও পুত্র না জন্মিলে, পুনরায় বিবাহ করিবেক। এহরূপে, যাবৎ পুত্রলাভ না হয়, তাবৎ বিবাহ করিবেক; আর, এই অবস্থায় যদি বৈরাগ্য জন্মে, বনগমন অর্থীবা সন্ন্যাস অবলম্বন করিবেক।

শাস্ত্রকারেরা, যাবৎ নিমিত্ত ঘটিবেক তাবৎ বিশ্বাহ করিবেক, এইরূপ বিধি প্রদান করিয়া, নিমিত্ত না ঘটিলে, পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায় পুনরায় বিবাহ করিতে পারিবেক না, এইরূপ নিষেধও প্রদর্শন করিয়াছেন। যথা,

ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্নে দারে নাহ্যাং কুব্বীত (৫)।

যে স্ত্রীর সহযোগে ধর্ম্মকাৰ্য্য ও পুত্রলাভ সুপন্ন হয়, তৎসত্ত্বে অন্ত স্ত্রী বিবাহ করিবেক না।

এই শাস্ত্র অনুসারে, পুত্রলাভ ও ধর্ম্মকার্য্য সম্পন্ন হইলে, পূর্ব- পরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় দারপরিগ্রহে পুরুষের অধিকার নাই। পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীর মৃত্যু হইলে, গৃহস্থ ব্যক্তির পুনরায় দারপরিগ্রহ আবশ্যক; এজন্য, শাস্ত্রকারেরা, তাদৃশ স্থলে, পুনরায় যে বিবাহ করিবার বিধি দিয়াছেন, তাহা নিত্যনৈমিত্তিক বিবাহ। যথা,

ভাৰ্য্যায়ৈ পূর্বমারিণ্যৈ দত্ত্বাগ্নীনস্ত্যকৰ্ম্মণি। পুনর্দ্দারক্রিয়াং কুর্য্যাৎ পুনরাধানমেব চ (৬) ॥ পূর্ব্বমৃতা স্ত্রীর যথাবিধি অস্ত্যেষ্টিক্রিয়া নির্ব্বাহ করিয়া, পুনরায় দ্বারপরিগ্রহ ও পুনরায় অগ্ন্যাধান করিবেক।

এইরূপে শাস্ত্রকারেরা, গৃহস্থাশ্রমের প্রধান দুই উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত, নিত্য, নৈমিত্তিক, নিত্যনৈমিত্তিক, এই ত্রিবিধ বিবাহের বিধি প্রদর্শন করিয়া, রতিকামনায়, পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় বিবাহপ্রবৃত্ত ব্যক্তির পক্ষে, যে অসবর্ণাবিবাহের, বিধি প্রদান করিয়াছেন, তাহা কাম্য বিবাহ। যথা, সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্মণি।

কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ শ্যুঃ ক্রমশোহবরাঃ (৭)।

দ্বিজাতিদিগের প্রথম বিবাহে সবর্ণা করা বিহিতা; কিন্তু যাহারা, কাম বশতঃ, বিবাহে প্রবৃত্ত হয়, তাহারা অনুলোম ক্রমে অসবর্ণা বিবাহ করিবেক। রতিকামনায় অসবর্ণাবিবাহে প্রবৃত্ত হইলে, পূর্বপরিণীতা সবর্ণা স্ত্রীর সম্মতিগ্রহণ আবশ্যক। যথা,

একামুৎক্রম্য কামার্থমন্যাং লব্ধং য ইচ্ছতি। সমর্থস্তোষয়িত্বার্থৈঃ পূর্ব্বোঢ়ামপরাং বহেৎ (৮)।

যে ব্যক্তি, স্ত্রী সত্ত্বে, কাম বশতঃ, পুনরায় বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে, সে সমর্থ হইলে, অর্থ দ্বারা পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করিয়া, অন্ত স্ত্রী বিবাহ করিবেক।

শাস্ত্রকারেরা, কামুক পুরুষের পক্ষে, অসবর্ণাবিবাহের বিধি দিয়াছেন বটে; কিন্তু, সেই সঙ্গে, পূর্ব স্ত্রীর সম্মতিগ্রহণরূপ নিয়ম বিধিবদ্ধ করিয়া, কাম্য বিবাহের পথ একপ্রকার রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন, বলিতে হইবেক; কারণ, হিতাহিতবোধ ও সদসদ্বিবেচনাশক্তি আছে, এরূপ কোনও স্ত্রীলোক, অর্থলোভে, চির কালের জন্য, অপদস্থ হইতে, ও সপত্নীযন্ত্রণারূপ নরকভোগ করিতে, সম্মত হইতে পারে, সম্ভব বোধ হয় না।

বিবাহবিষয়ক বিধি সকল প্রদর্শিত হইল। ইহা দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে, গৃহস্থাশ্রমের উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত, গৃহস্থ ব্যক্তির পক্ষে, দারপরিগ্রহ নিতান্ত আবশ্যক। মনু কহিয়াছেন,

অপত্যং ধৰ্ম্মকাৰ্য্যাণি শুশ্রুষা রতিরুত্তমা।

দারাধীনস্তথা স্বর্গঃ পিতৃণামাত্মনশ্চ হ (৯)। পুত্রোৎপাদন, ধৰ্ম্মকার্য্যেৎ অনুষ্ঠান, শুক্রবা, উত্তম রতি, এবং পিতৃলোকের ও আপনার স্বর্গলাভ, এই সমস্ত স্ত্রীর অধীন।

প্রথমবিবাহিতা স্ত্রীর দ্বারা এই সকল সম্পন্ন হইলে, তাহার জীবদ্দশায়, পুনরায়, বিবাহ করা শাস্ত্রকারদিগের অভিমত নহে। এজন্য, আপস্তম্ব তাদৃশ স্থলে স্পষ্ট বাক্যে বিবাহের নিষেধ করিয়া গিয়াছেন। স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি দোষ বশতঃ, পুত্রোৎ- পাদনের অথবা ধৰ্ম্মকার্য্যানুষ্ঠানের ব্যাঘাত ঘটিলে, শাস্ত্রকারেরা, তাদৃশ স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় দারপরিগ্রহের বিধি দিয়াছেন। পুত্রোৎপাদনের নিমিত্ত, যত বার আবশ্যক, বিবাহ করিবেক; অর্থাৎ প্রথমপরিণীতা স্ত্রী পুত্রবর্তী না হইলে, তৎ সঙ্গে বিবাহ করিবেক; এবং দ্বিতীয়পরিণীতা স্ত্রী পুত্রবতী না হইলে, পুনরায় বিবাহ করিবেক; এইরূপে, যাবৎ পুত্রলাভ না হয়, তাবৎ বিবাহ করিবেক। আর, যদি প্রথমপরিণীতা স্ত্রীর সহযোগে, কোনও ব্যক্তির রতিকামনা পূর্ণ না হয়, সে রতিকামনা পূর্ণ করিবার নিমিত্ত, পূর্বপরিণীতা সবর্ণা স্ত্রীর সম্মতি গ্রহণ পূর্বক, অসবর্ণা 'বিবাহ করিবেক। অতএব, পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিমিত্ত বশতঃ, অথবা উৎকট রতিকামনা বশতঃ, গৃহস্থ ব্যক্তির বহু বিবাহ সম্ভব; এই দুই কারণ ব্যতিরেকে, একাধিক বিবাহ, শাস্ত্রানুসারে, কোনও ক্রমে, সম্ভবিতে পারে না। উক্ত প্রকারে বহু বিবাহ দম্ভব হওয়াতে, কোনও কোনও ঋষিবাক্যে, এক ব্যক্তির বহু বিবাহের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। যথা,

অগ্নিশিষ্টাদিশুশ্রূষাং বহুভার্য্যঃ সবর্ণয়া।

কারয়েভদ্বহুত্বং চেজ্জ্যেষ্ঠয়া গর্হিতা ন চেৎ (১০)।

যাহার অনেক ভার্য্যা থাকে, সে ব্যক্তি অগ্নিশুশ্রুষা অর্থাৎ অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞানু ষ্ঠান, ও শিষ্টশুশ্রুষা অর্থাৎ অতিথি অভ্যাগত প্রভৃতির পরিচর্য্যা, সবর্ণা স্ত্রী সমভিব্যাহারে, সম্পন্ন করিবেক; আর যদি সবর্ণা বহুভাৰ্য্যা থাকে, জ্যেষ্ঠা সমভিব্যাহারে সম্পন্ন করিবেক, যদি সে ধৰ্ম্মকার্য্যে অযোগ্যতাপ্রতিপাদক দোষে আক্রান্ত না হয়।

এই রূপে, যে যে স্থলে বহুভার্য্যাবিবাহের, উল্লেখ দৃষ্ট হইবেক, পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিমিত্ত, অথবা উৎকট রতিকামনা, ঐ বহুভার্য্যাবিবাহের নিদান বলিয়া বুঝিতে হইবেক। বস্তুতঃ, যখন পূর্বপরিণীতা স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিমিত্ত ঘটিলে, তাহার জীবদ্দশায়, পুনরায় সবর্ণা বিবাহের বিধি দৃষ্ট হইতেছে; যখন তাদৃশ নিমিত্ত না ঘটিলে, সবর্ণা বিবাহের স্পষ্ট নিষেধ লক্ষিত হইতেছে; এবং, যখন উৎকট রতিকামনার বশবর্তী হইয়া, পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় বিবাহ করিতে উদ্বঘত হইলে, কেবল অসবর্ণা বিবাহের বিধি প্রদত্ত হইয়াছে, তখন যদৃচ্ছাক্রমে যত ইচ্ছা সবর্ণা বিবাহ করা শাস্ত্রকারদিগের অনুমোদিত কার্য্য, ইহা প্রতিপন্ন হওয়া অসম্ভব। অতএব, "ইচ্ছার নিয়ামক নাই, যত ইচ্ছা বিবাহ করা উচিত,” তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের এই সিদ্ধান্ত কত দূর শাস্ত্রানুমত বা ন্যায়ানুগত, তাহা সকলে বিবেচনা করিয়া দেখিবেন। তদীয় সিদ্ধান্ত অনুসারে, বিবাহ করা পুরুষের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন; অর্থাৎ ইচ্ছা 'হয় বিবাহ করিবেক, ইচ্ছা না হয় বিবাহ করিবেক না; অথবা যত ইচ্ছা বিবাহ করিবেক। কিন্তু, পূর্বে প্রতিপাদিত হইয়াছে, চতুর্বিধ বিবাহের মধ্যে নিত্য, নৈমিত্তিক, নিত্যনৈমিত্তিক এই ত্রিবিধ বিবাহ পুরুষের ইচ্ছাধীন নহে; শাস্ত্রকারেরা অবশ্যকর্ত্তব্য বলিয়া উত্ত্বৎ বিবাহের স্পষ্ট বিধি প্রদান করিয়াছেন; এই ত্রিবিধ বিবাহ না করিলে, গৃহস্থ ব্যক্তিকে প্রত্যবায়গ্রস্ত হইতে হয়। তবে, রতিকামনা পূর্ণ করিবার নিমিত্ত, পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীর সম্মতি গ্রহণ পূর্বক, যে অসবর্ণা বিবাহ করিবার বিধি আছে, কেবল ঐ বিবাহ পুরুষের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন, অর্থাৎ ইচ্ছা হইলে তাদৃশ বিবাহ করিবেক, ইচ্ছা না হইলে তাদৃশ বিবাহ করিবেক না; তাদৃশ বিবাহ না করিলে, প্রত্যবায়গ্রস্ত হইতে হইবেক না। অতএব বিবাহ মাত্রই পুরুষের ইচ্ছাধীন, ইহা নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর কথা।

কিঞ্চ, বিবাহ বিষয়ে ইচ্ছার নিয়ামক নাই, ইহা অপেক্ষা * অসার ও উপহাসকর কথা আর কিছুই হইতে পারে না। পুত্র- লাভ ও ধৰ্ম্মকার্য্য সম্পন্ন হইলে, পূর্ব্বদর্শিত আপস্তম্ববচন দ্বারা, পূর্ববপরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় সবর্ণা বিবাহ এক বারে নিষিদ্ধ হইয়াছে; সুতরাং, সে অবস্থায়, ইচ্ছা অনুসারে, পুনরায় বিবাহ করিবার অধিকার নাই। তবে, রতিকামনা- স্থলে অসবর্ণাবিবাহ পুরুষের ইচ্ছার অধীন বটে; কিন্তু সে ইচ্ছায়ও নিয়ামক নাই, এরূপ নহে; কারণ, পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রী সম্মত না হইলে, কেবল পুরুষের ইচ্ছায়, তাদৃশ বিবাহ হইতে পারে না। অতএব, বিবাহবিষয়ে পুরুষ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রেচ্ছ, যত ইচ্ছা হইবেক, তত বিবাহ করা উচিত, ঈদৃশ অণুষ্টচর অশ্রুতপূর্ব অদ্ভুত 'ব্যবস্থা, তর্কবাচস্পতি মহাশয় ভিন্ন, অন্য পণ্ডিতম্ম্য ব্যক্তির মুখ বা লেখনী হইতে নির্গত হইতে পারে, ইহা কোনও মতে সম্ভব, বোধ হয় না। প্রথমতঃ, তর্কবাচস্পতি মহাশয়, শাস্ত্র বিষয়ে, বহুদর্শী' বলিয়া খ্যাতি- লাভ করিয়াছেন বটে; কিন্তু ধৰ্ম্মশাস্ত্রে তাঁহার তাদৃশ অধিকার নাই; দ্বিতীয়তঃ, তিনি স্থিরবুদ্ধি লোক নহেন; তৃতীয়তঃ, ক্রোধে অন্ধ হইয়াছেন, তাহাতে তাঁহার বুদ্ধিবৃত্তি নিরতিশয় কলুষিত হইয়া রহিয়াছে। এই সমস্ত কারণে, বিবাহ- বিষয়ক বিধিবাক্যসমূহের অর্থনির্ণয় ও তাৎপর্য্যগ্রহ করিতে না পারিয়া, এবং, কোনও কোনও স্থলে, বহু জায়া, বহু ভাৰ্য্যা, অথবা ভার্য্যাশব্দের বহুবচনে প্রয়োগ দেখিয়া, ইচ্ছা- ধীন বহু সবর্ণা বিবাহ সম্পূর্ণ শাস্ত্রসিদ্ধ ব্যবহার ও উচিত কৰ্ম্ম বলিয়া ব্যবস্থা প্রচারিত করিয়াছেন।

সপ্তম পরিচ্ছেদ

অতঃপর, তর্কবাচস্পতি মহাশয়, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহের প্রামাণ্য সংস্থাপনের নিমিত্ত, যে লকল প্রমাণ প্রদর্শন করিয়াছেন, তৎসমুদয় ক্রমে উল্লিখিত ও আলোচিত হইতেছে।

"তস্মাদেকো ববীর্বিন্দতে ইতি শ্রুতিঃ, তস্মাদেকশস্য বহেব্যা জায়া ভবন্তি নৈকট্য বহবঃ সহ পতয়ঃ ইতি শ্রুতিঃ,

ভাৰ্য্যাঃ কাৰ্য্যাঃ সজাতীয়াঃ সর্বেষাং শ্রেয়ঃ স্যুরিতি দায়ভাগদ্বতপৈঠীনসিস্থতিশ্চ বিবাহক্রিয়াকৰ্ম্মগতসংখ্যাবিশেষ- বহুত্বং খ্যাপয়ন্তী একস্তানেকবিবাহং প্রতিপাদয়তি (১১)।”

"অতএব, এক ব্যক্তি বহু ভাৰ্য্যা বিবাহ করিতে পারে", এই শ্রুতি; "অতএব, এক বাক্তির বহু ভাৰ্য্যা হইতে পারে, এক স্ত্রীর সহ অর্থাৎ এক সঙ্গে বহু পতি হইতে পারে না", এই শ্রুতি: এবং, "সজাতীয়া ভাৰ্য্যা সকলের পক্ষে মুখ্য কল্প'। দায়ভাগবৃত এই পৈঠীনসিস্মৃতি দ্বারা (১২), বিবাহক্রিয়ার কর্মভূত ভার্য্যা প্রভৃতি পদে বহুবচনসম্ভাব বশতঃ, এক ব্যক্তির অনেক বিবাহ প্রতিপন্ন হইতেছে"।

এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, এক ব্যক্তির অনেক বিবাহ হইতে পারে, ইহা কেহই অস্বীকার করেন না। পূর্ব্বে দর্শিত হইয়াছে, স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিমিত্ত বশতঃ, এক ব্যক্তির বহু সবর্ণা বিবাহ সম্ভব; আর, উৎকট রতিকামনা পূর্ণ করিবার নিমিত্ত, পুরুষ পূর্বপরিণীতা সর্বর্ণা ভার্য্যার জীবদ্দশায়, তদীয় সম্মতি ক্রমে, অসবর্ণা ভাৰ্য্যা বিবাহ করিতে পারে; ইহা দ্বারাও এক ব্যক্তির বহুভার্য্যাবিবাহ সম্ভব। অতএব, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের অবলম্বিত বেদবাক্যদ্বয়ে, যে বহু বিবাহের উল্লেখ আছে, তাহা ধৰ্ম্মশাস্ত্রোক্ত বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিমিত্তনিবন্ধন, অথবা উৎকটরডি- কামনামূলক, তাহার কোনও সংশয় নাই। উল্লিখিত বেদবাক্যদ্বয়ে, সামাল্যাকারে, এক ব্যক্তির বহুভার্য্যাপরিগ্রহ সম্ভব, এতন্মাত্র নির্দিষ্ট আছে; কিন্তু, ধৰ্ম্মশাস্ত্রপ্রবর্ত্তক ঋষিরা, নিমিত্ত বিশেষ নির্দেশ পূর্ব্বক, এক ব্যক্তির বহুভার্য্যাপরিগ্রহের বিধি দিয়াছেন। অতএব, বেদবাক্যনিদ্দিষ্ট বহুভার্য্যাপরিগ্রহ ও ঋষিবাক্যব্যব- স্থাপিত বহুভার্য্যাপরিগ্রহ একবিষয়ক; বেদে এক ব্যক্তির বহুভার্য্যাপরিগ্রহের যে উল্লেখ আছে, ধৰ্ম্মশাস্ত্রে, পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিমিত্ত নির্দেশ পূর্ব্বক, ঐ বহুভার্য্যাপরি- গ্রহের স্থল সকল ব্যবস্থাপিত হইয়াছে। বেদবাক্যের এই তাৎপর্য্যব্যাখ্যা কেবল আমার কপোলকল্পিত, অথবা' লোক বিমোহনার্থে বুদ্ধিবলে উদ্ভাবিত, অভিনব তাৎপর্য্যব্যাখ্যা নহে। পূর্বতন গ্রন্থকর্তারা এই দুই বেদবাক্যের উক্তবিধ তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা করিয়া গিয়াছেন। যথা,

“অথাধিবেদনম্। তদুক্তমৈতবেয়ব্রাহ্মণে

তস্মাদেকস্য বহেব্যা জায়া ভবন্তি নৈকশৈস্য বহবঃ সহ পতয় ইতি। 4

সহশব্দসামর্থ্যাৎ ক্রমেণ পত্যন্তরং ভবতীতি গম্যতে। অতএব নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ। পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতির্যো শিধীয়তে ॥

ইতি মনুনা স্ত্রীণামপি পত্যন্তরং স্মর্য্যতে। শ্রুত্যন্তরমপি তন্মাদেকো বহুবীর্জায়া বিন্দত ইতি।

নিমিত্তান্তাহ যাজ্ঞবন্ধ্যঃ

সুরাপী ব্যাধিতা ধূর্ত্তা বন্ধ্যার্থগ্ন্যপ্রিয়ংবদা। স্ত্রীপ্রসূশ্চাধিবেত্তব্য। পুরুষদ্বেষিণী তপেতি ॥

মমুরপি

মাপাসত্যবৃত্তা চ প্রতিকূলা চ যা ভবেৎ। ব্যাধিতা বাধিবেত্তব্যা হিংস্রার্থত্নী চ সর্বদা ॥ এতন্নিমিত্তাভাবে নাধিবেত্তব্যেত্যাহ আপস্তম্বঃ

ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্নে দারে নাহ্যাং কুর্বীত। অন্যতরাভাবে কার্য্যা প্রাগগ্ন্যাধেয়াদিতি।

অস্তার্থঃ যদি প্রথমোড়া স্ত্রী ধর্ম্মেণ শ্রৌতস্মার্তাগ্নিসাধ্যেন প্রজয়া পুত্রপৌত্রাদিনা চ সম্পন্না তদা না্যাং বিবহেৎ অন্যতরাভাবে অগ্ন্যাধানাৎ প্রাত্বেবাঢ়ব্যেতি অগ্ন্যাধানাং প্রাগিতি মুখ্যকন্নাভি- প্রায়ং নোত্তর প্রতিষেধার্থম্ অধিবেদনশ্য পুনরাধাননিমিত্ততানুপ- পত্তেঃ। নৃত্যন্তরেছপি

অপুত্রঃ সন্ পুনর্দারান্ পরিণীয় ততঃ পুনঃ। পরিণীয় সমুৎপাছা নোচেদা পুত্রদর্শনাৎ। বিরক্তশ্চেদ্বনং গচ্ছেৎ সন্ন্যাসং বা সমাশ্রয়েদিতি ॥

অন্তার্থঃ প্রথমায়াং ভাৰ্য্যায়ামপুভ্রঃ সন্ পুনর্দারান্ পরিণীয় পুত্রামুৎপাদয়েদিতি শেষঃ তস্তামপি পুত্রানুৎপত্তৌ আ পুভ্রদর্শ নাৎ পরিণয়েদিতি শেষঃ। স্পষ্টমন্ত্যৎ (১৩)।

অতঃপর অধিবেদনপ্রকরণ আরব্ধ হইতেছে। ঐতবের ব্রাহ্মণে উক্ত হইয়াছে, "অতএব এক ব্যক্তির বহু ভাৰ্য্যা হইতে পারে, এক স্ত্রীর সহ, অর্থাৎ এক সঙ্গে, বহু পতি হইতে পারে না"। সহ, অর্থাৎ এক সঙ্গে, এই কথা বলাতে, ' ক্রমে অন্য পতি হইতে পারে, ইহা প্রতীয়মান হইতেছে। এই নিমিত্ত, "স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, ক্লীব স্থির হইলে, সংসার ধর্ম পরিত্যাগ করিলে, অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহ করা শাস্ত্রবিহিত"। এই বচন, দ্বারা, মনু স্ত্রীদিগের অন্ত পতির বিধান করিয়াছেন। বেদান্তরেও উক্ত হইয়াছে, "অতএব এক ব্যক্তি বহুভার্য্যাবিবাহ করিতে পারে"। যে সকল নিমিত্ত বশতঃ অধিবেদন করিতে পারে, যাজ্ঞবক্ষ্য তৎসমুদণ্ডের নির্দেশ করিয়াছেন। যথা, "যদি স্ত্রী শুরাপারিণী, চিররোগিণী, ব্যভিচারিণী, বন্ধ্যা, অর্থনাশিনী- অপ্রিয়- বাদিনী, কন্তামাত্রপ্রসবিনী, ও পতিদ্বেষিণী হয়, তৎ সত্ত্বে অধিবেদন অর্থাৎ পুনরায় দারপরিগ্রহ করিবেক"। মনুও কহিয়াছেন, "যদি স্ত্রী শুরাপাঙ্গিনী, ব্যভিচারিণী, সতত স্বামীর অভিপ্রায়ের বিপরীতকারিণী, চিররোগিণী, অতি- ক্রুরস্বভাবা, ও অর্থনাশিনী হয়, তৎ সত্ত্বে অধিবেদন অর্থাৎ পুনরায় দারপরিগ্রহ করিবেক"। আপস্তম্ব কহিয়াছেন, এই সকল নিমিত্ত না ঘটিলে, অধিবেদন করিতে পারিবেক না। যথা, "যে স্ত্রীর সহযোগে ধর্ম্মকার্য্য ও পুত্রলাভ সম্পন্ন হয়, তৎ সত্ত্বে অন্য স্ত্রী বিবাহ করিবেক না। ধর্মকার্য্য অথবা পুষলাভ' সম্পন্ন না হইলে, অগ্ন্যাধানের পূর্ব্বে, পুনরায় বির্ষ।হ করিবেক"। "অগ্ন্যাধানের পূর্ব্বে", এ কথা বলার অভিপ্রায় এই, অগ্রাধানের পূর্ব্বে বিবাহ করা মুখ্যকর। নতুবা অগ্ন্যাধানের পর, বিবাহ করিতে পারিবেক না, এরূপ তাৎপর্য্য নহে; তাহা হইলে অধিবেদন অগ্ন্যাধানের নিমিত্ত বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে না। অন্ত্য স্মৃতিতেও উক্ত হইয়াছে, “প্রথম পরিণীতা স্ত্রীতে পুত্র না জন্মিলে, পুনরায় বিবাহ করিবেক; তাহাতেও পুত্র না জন্মিলে, পুনরায় বিবাহ করিবেক। এইরূপে, যাবৎৎপুত্রলাভ না হয়, তাবৎ বিবাহ করিবেক আর, এই অবস্থায় যদি বৈরাগ্য জন্মে বনগমন অথবা সন্ন্যাস অবলম্বন করিবেক"।

4

10

দেখ, মিত্রমিশ্র, অধিবেদনপ্রকরণের আরম্ভ করিয়া, সর্বপ্রথম, তর্কবাচ্চস্পতি মহাশয়ের অবলম্বিত বেদবাক্যদ্বয়কে অধিবেদনের প্রমাণস্বরূপ বিন্যস্ত করিয়াছেন; তৎপরে; যে সকল নিমিত্ত ঘটিলে, অধিবেদন করিতে পারে, তৎপ্রদর্শনার্থ যাজ্ঞবন্ধ্যবচন ও মনুবচন উদ্ধৃত করিয়াছেন পরিশেষে, ঐ সকল নিমিত্ত না ঘটিল্লে, অধিবেদন করিতে পারিবেক না, ইহা আপস্তম্ববচন দ্বারা 'প্রতিপন্ন করিয়া গিয়াছেন। এক্ষণে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, উল্লিখিত বেদবাক্যদ্বয়ে যে বহুভার্য্যাপরিগ্রহের নির্দেশ আছে, মিত্রমিশ্রের মতে, ঐ বহুভার্য্যাপরিগ্রহ অধিবেদনের নিৰ্দ্দিষ্টনিমিত্তনিবন্ধন হইতেছে কি না।

"অথ দ্বিতীয়বিবাহবিধানম্। তত্র শ্রুতিঃ তস্মাদেকো বহুবীর্জায়া বিন্দত ইতি। শ্রত্যন্তরমপি

তস্মাদেকসস্থ্য বব্যো জায়া ভবতি নৈকস্থ্যৈ বহবঃ সহ পতয় ইতি।

তদ্বিষয়মাহাপস্তম্বঃ

ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্নে দারে নাহ্যাং কুব্বীত। অন্যতরাভাবে কাৰ্য্যা প্রাগগ্ন্যাধেয়াদিতি ॥ অ্যার্থঃ যদি প্রাগূঢ়া স্ত্রী ধর্ম্মেণ প্রজয়া চ সম্পন্না তদা না্যাং বিবহেৎ অন্যতরাভাবে অগ্ন্যাধানাৎ প্রাক্ বোঢ়ব্যেতি। ত্রিভি- ঋণবান্ জায়ত ইতি; নাপুত্রস্ত লোকোহস্তি ইতি শ্রুতেঃ; স্মৃতিশ্চ,

অপুভ্রঃ সন্ পুনর্দারান্ পরিণীয় ততঃ পুনঃ। পরিণীয় সমুৎপা্য নোচেদা পুভ্রদর্শনাৎ। বিরক্তশ্চেদ্বনং গচ্ছেৎ সন্ন্যাসং বা সমাশ্রয়েৎ।।

যাজ্ঞবন্ধ্যঃ

সুরাপী ব্যাধিতা ধূর্ত। বন্ধ্যার্থস্যপ্রিয়ংবদা। স্ত্রীপ্রসূশ্চাধিবেত্তব্যা পুরুষদ্বেষিণী তথা (১৪)

অতঃপর দ্বিতীয়বিবাহপ্রকরণ আরব্ধ হইতেছে। এ বিষয়ে বেদে উক্ত হইয়াছে। "অতএব এক ব্যক্তি বহু ভাৰ্য্যা বিবাহ, করিতে পারে"। বেদান্তরেও উক্ত হইয়াছে, "অতএব এক ব্যক্তির বহু ভাৰ্য্যা হইতে পারে; এক স্ত্রীর সহ, অর্থাৎ এক সঙ্গে, বহু পতি হইতে পারে না" এ বিষয়ে আপস্তম্ব কহিয়াছেন, "যে স্ত্রীর সহযোগে ধৰ্ম্মকাৰ্য্য ও পুত্রলাভ সম্পন্ন হয়, তৎসত্ত্বে অন্ত স্ত্রী বিবাহ করিবেক না। ধৰ্ম্মকার্য্য অথবা পুত্রলাভ সম্পন্ন না হইলে, অগ্ন্যাধানের পূর্ব্বে পুনরায় বিবাহ করিবেক"। "ত্রিবিধ ঋণে ঋণগ্রস্থ হয়", "অপুত্র ব্যক্তির সদগতি হয় না", এই দুই বেদবাক্য তাহার প্রমাণ; স্মৃতিতেও উক্ত হইয়াছে, "প্রথম পরিণীতা স্ত্রীতে পুত্র না জন্মিলে, পুনরায় বিবাহ করিবেক; তাহাতেও পুত্র না জন্মিলে পুনরায় বিবাহ করিবেক। এই রূপে, যাবৎ পুত্রলাভ না হয়, তাবৎ বিবাহ করিবেক; আর, এই অবস্থায় যদি বৈরাগ্য জন্মে, বদগমন অথবা সন্ন্যাস অবলম্বন করিবেক"। যাজ্ঞবক্ষ্য কহিয়াছেন, "যদি স্ত্রী সুরা- পারিন, চিররোগিণী, ব্যভিচারিণী, বন্ধ্যা, অর্থনাশিনী, অপ্রিয়বাদিনী, ক্যামাত্র- প্রসবিনী, ও পতিদ্বেষিণী হয়, তৎসত্ত্বে অধিবেদন অর্থাৎ পুনরায় দারপরিগ্রহ করিবেক।

এক্ষণে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের অবলম্বিত বেদবাক্যদ্বয়ে যে বহুভার্য্যাপরিগ্রহের নির্দেশ আছে, মিত্রমিশ্রের ন্যায়, অনন্তভট্টের মতেও, 'ঐ বহুভার্য্যাপরিগ্রহ অধিবেদনের নিদ্দিষ্টনিমিত্তনিবন্ধন হইতেছে কি না।

কিঞ্চ,

"তম্মাদেকসশস্য বহেব্যা জায়া ভবন্তি নৈকস্থ্যৈ বহবঃ

সহ পতয়ঃ”।

অতএব এক র‍্যক্তির বহু ভাৰ্য্যা হইতে পারে, এক স্ত্রীর সহ, অর্থাৎ এক সঙ্গে,

'বহু পতি হইতে পারে না।

এই বেদাংশ যে উপাখ্যানের উপসংহারস্বরূপ, তাহা সমগ্র উদ্ধৃত হইতেছে; তদৃষ্টে, বোধ করি, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের বিতণ্ডা- প্রবৃত্তি নিবৃত্ত হইতে পারে।

“ঋক্ চ বা ইদমশ্রে সাম চাস্তাম্। সৈব নাম ঋগাসীৎ অমো নাম সাম। সা বা ঋক্ সামো- পাবদৎ মিথুনং সম্ভবাব প্রজাত্যা ইতি। নেত্যব্রবীৎ সাম জ্যায়ান্ বা অতো মম মহি- মেতি। তে দ্বে ভুত্বোপাবদতাম্। তেন প্রতি চন সমবদত। তান্ত্রিস্রো ভৃত্বোপাবদন। যৎ তিস্রো ভূত্বোপাবদন তত্তিস্থভিঃ সমভরৎ। যত্তিস্বভিঃ সমভবৎ তস্মাত্তিস্বভিঃ স্তবস্তি তিস্বভিরুদ্গায়স্তি। তিস্বভির্হি সাম সম্মিতং ভবতি। তস্মাদেকশ্য বব্যো জায়া ভবস্তি • নৈকশৈস্য বহবঃ সহ পতয়ঃ (১৫)।"

পূর্ব্বে ঋক্ ও সাম পৃথক্ ছিলেন। ঋৎকর নাম সা, সামের নাম অম। ঋক্ সামের নিকটে গিয়া বলিলেন, আইস, আমরা সন্তানোৎপাদনের নিমিত্ত উভয়ে সহবাস করি। সাম কহিলেন, না; তোমার অপেক্ষা আমার মহিমা অধিক। তৎপরে দুই ঋক্ প্রার্থনা করিলেন। সাম তাহাতেও সম্মত হইলেন না। অনস্তর তিন ঋক্ প্রার্থনা করিলেন; যেহেতু তিন ঋক্ প্রার্থনা করিলেন, এজন্ত সাম তাঁাদের সহবাসে সম্মত হইলেন। যেহেতু সাম তিন ঋকের সহিত মিলিত হইলেন, এজ্য সামগেরা তিন ঋক্ দ্বারা যজ্ঞে স্তুতিগান করিয়া থাকেন। এক সাম তিন ঋকের তুল্য। অতএব এক ব্যক্তির বহু ভাষ্যা হইতে পারে, এক স্ত্রীর একসঙ্গে বহু পতি হইতে পারে না।

এই বেদাংশকে প্রকৃত উপাখ্যানের আকারে পরিণত করিয়া, তদীয় তাৎপর্য্য ক্যাখ্যাত হইতেছে। "সামনাথ বাচস্পতির ঋক্ষুন্দরী, ঋমোহিনী, ঋবিলাসিনী নামে তিন মহিলা ছিল। একদা, ঋক্ষুন্দরী, সামনাথের নিকটে গিয়া, সন্তানোৎপত্তির নিমিত্ত, সহবাস প্রার্থনা করিলেন। তুমি নীচাশয়া অথবা নীচ- কুলোপ্তবা, আমি তোমার সহিত সহবাস, করিব না, এই বলিয়া, সামনাথ অস্বীকার করিলেন। পরে ঋক্ষুন্দরী ও ঋমোহিমী' উভয়ে প্রার্থনা করিলেন; সামনাথ তাহাতেও সম্মত হইলেন না। অনন্তর, ঋক্ষুন্দরী, ঋমোহিনী, ঋত্বিলাসিনী, তিন জনে সমবেত হইয়া প্রার্থনা করিলে, সামনাথ তাঁহাদের সহিত সহবাসে সম্মত হইলেন”। এই উপাখ্যান দ্বারা ইহাই প্রতিপন্ন হইতে পারে, সামনাথ বাচস্পতির তিন মহিলা ছিল; কোনও কারণে বিরক্ত হইয়া, তিনি তাহাদের সহবাসে পরাম্মুখ ছিলেন। অবশেষে, তিন জনের বিনয় ও প্রার্থনার বশীভূত হইয়া, তাহাদের সহিত সহবাস করিতে লাগিলেন। নতুবা, বাচস্পতি মহাশয় এক বারে তিন মহিলার পাণিগ্রহণ করিলেন, ইহা এ উপাখ্যানের উদ্দেশ্য হইতে পারে না; কারণ, অবিবাহিতা বালিকারা, অপরিচিত বা পরিচিত পুরুষের নিকটে গিয়া, সন্তানোৎপাদনের নিমিত্ত বিবাহপ্রার্থনা করিবেক, ইহা কোনও মতে সম্ভব বা সঙ্গত বোধ হয় না। যদি বিবাহিতার সহবাস অভিপ্রেত না বলিয়া, অবিবাহিতার বিবাহ অভিপ্রেত বল, এবং তদ্দ্বারা এক ব্যক্তির একবারে তিন বা তদয়িক বিবাহ শাস্ত্রসম্মত বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে প্রবৃত্ত হও; তাহা হইলে, এক ব্যক্তি একবারে 'তিনের ন্যূন বিবাহ করিতে পারে না, এই সিদ্ধান্ত অপরিহার্য্য হইয়া উঠে; কারণ, বিবাহপক্ষ অভিপ্রেত হইলে, "যত্তিস্রো ভূত্বোপাবদন তত্তিস্থভিঃ সমভবৎ" এ অংশের

যেহেতু তিন জনে প্রার্থনা করিলেন, এজন্স সামনাথ তাঁহাদের পাণিগ্রহণ করিলেন,

এই অর্থ প্রতিপন্ন হইবেক; এবং তদনুসারে, একবারে তিন মহিলা বিবাহপ্রার্থিনী না হইনে, বিবাহ করা বেদবিরুদ্ধ ব্যবহার কলিয়া পরিগণিত হইবেক; কারণ, সামনাথ একাকিনী ঋক্- সুন্দরীর, অথবা ঋক্ষুন্দরী ও ঋমোহিনী উভয়ের, প্রার্থনায় তাঁহাদিগকে বিবাহ করিতে সম্মত হয়েন নাই; পরিশেষে, ঋগুন্দরী, ঋমোহিনী, ও ঋবিলাসিনী তিন জনের প্রার্থনায় তাঁহাদের পালিগ্রহণ করিয়াছিলেন। ফলতঃ, এই বেদবাক্য অবলম্বন করিয়া, পুরুষ যদৃচ্ছাক্রমে, ক্রমে ক্রমে, বা একবারে, বহু ভাৰ্য্যা বিবাহ করিতে পারে, এরূপ মীমাংসা করা, আর এই বেদবাক্য মনু, যাজ্ঞবন্ধ্য, আপস্তম্ব প্রভৃতি ধৰ্ম্মশাস্ত্রপ্রবর্তক ঋষিগণের দৃষ্টিপথে পতিত হয় নাই, অথবা তাঁহারা এই বেদ- বাক্যের অর্থবোধ ও তাৎপর্য্যগ্রহ করিতে পারেন নাই, এজন্য নিমিত্তনির্দেশ পূর্ব্বক, পূর্বপরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় বিবাহের বিধিপ্রদর্শন ও নিমিত্ত না ঘটিলে বিবাহের নিষেধ প্রদর্শন করিয়াছেন, এরূপ অনুমান করা নিরবচ্ছিন্ন অনভিজ্ঞতা- প্রদর্শন মাত্র।

তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের অবলম্বিত বেদবাক্যরূপ প্রমাণের অর্থ ও তাৎপর্য্য প্রদর্শিত হইল। এক্ষণে, তাঁহার অবলম্বিত স্মৃতিবাক্যের অর্থ ও তাৎপর্য্য প্রদর্শিত হইতেছে।

“ভার্য্যাঃ সজাতীয়াঃ সর্বেষাং শ্রেয়শ্যঃ স্যুঃ”।

সজাতীয়া ভাৰ্য্যা সকলের পক্ষে মুখ্য কল্প।

এই পৈঠীনসিবচনে ভাৰ্য্যা এই পদে বহুবচন আছে; ঐ বহুবচনবলে, তর্কবাচস্পতি মহাশয় যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুভাৰ্য্যাবিবাহ শাস্ত্রানুমত ব্যবহার বলিয়া, প্রতিপন্ন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। কিন্তু, কিঞ্চিৎ স্থিরচিত্ত হইয়া অনুধাবন করিয়া দেখিলে, তিনি অনায়াসেই বুঝিতে পারিতেন, পৈঠীনসি এক ব্যক্তির, বহু- ভাৰ্য্যাবিধান অভিপ্রায়ে ভার্য্যাশব্দে বহুবচনের প্রয়োগ করেন নাই। বস্তুতঃ, ঐ বহুবচনপ্রয়োগ এক ব্যক্তির বহুভার্য্যাবিবাহের পোষক নহে। “ভার্য্যাঃ," এস্থলে ভার্য্যা শব্দে যেরূপ বহুবচনের প্রয়োগ আছে, “সর্বেষাম্,” এস্থলে সর্বব শব্দেও সেইরূপ বহুবচনের প্রয়োগ আছে। "সর্বেষাম্”, সকলের, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এই তিন বর্ণের, সজাতীয়া ভাৰ্য্যা মুখ্য কল্প। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এই তিন বর্ণের বোধনার্থে, সর্বব, শব্দে যেরূপ বহুবচন আছে, সেইরূপ, তিন বর্ণের স্ত্রী বুঝাইবার

অভিপ্রায়ে, ভার্য্যা শব্দেও বহুবচন প্রযুক্ত হইয়াছে। উদ্বহেত দ্বিজো ভাৰ্য্যাং সবর্ণাং লক্ষণান্বিতাম্। ৩।৪।

দ্বিজ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্ব শুল্কক্ষণ। সবর্ণা ভাৰ্য্যা বিবাহ করিবেক। এই মনুবচনে দ্বিজ ও ভার্য্যা শব্দে একবচন থাকাতে, যেরূপ অর্থের প্রতীতি হইতেছে;

"উদ্বহেরন্ দ্বিজা ভার্য্যাঃ সবর্ণা লক্ষণান্বিতাঃ।” প্রদর্শিত প্রকারে, মনুবচনে দ্বিজ ও ভার্য্যা শব্দে বহুবচন থাকিলেও, অবিকল সেইরূপ অর্থের প্রতীতি হইত, তাহার কোনও সংশয় নাই। সমান ন্যায়ে,

ভাৰ্য্যাঃ সজাতীয়াঃ সর্বেবষাং শ্রেয়শ্যঃ স্যুঃ।

এই পৈঠীনসিবচনে ভার্য্যা ও সর্বব শব্দে বহুবচন থাকাতে, যেরূপ অর্থের প্রতীতি হইতেছে;

ভাৰ্য্যা সজাতীয়া সর্ববশ্য শ্রেয়সী স্যাৎ।

প্রদর্শিত প্রকারে, পৈঠীনস্বিচনে ভাৰ্য্যা ও সব শব্দে একবচন থাকিলেও, অবিকল সেইরূপ অর্থের প্রতীতি, হইত, তাহারও কোনও সংশয় নাই।' সংস্কৃত ভাষায় যাঁহাদের বিশিষ্টরূপ বোধ ও অধিকার আছে, তাদৃশ ব্যক্তি মাত্রেই এইরূপ বুঝিয়া থাকেন। তর্কবাচস্পতি মহাশয়, মহাপণ্ডিত বলিয়া, নবীন পন্থা অবলম্বন করিয়াছেন। মহাপণ্ডিত মহোদয়ের প্রবোধনার্থে, এ স্থলে ইহাও উল্লেখ করা আবশ্যক, এই মীমাংসা আমার কপোলকল্পিত, অথবা লোক বিমোহনার্থে বুদ্ধিবলে উদ্ভাবিত, অভিনব মীমাংসা নহে। পূর্বতন প্রসিদ্ধ গ্রন্থকর্ডারাও, ঈদৃশ স্থলে, এইরূপ ব্যাখ্যাই করিয়া গিয়াছেন; যথা,

"তথাচ যমঃ

ভাৰ্য্যাঃ সজাত্যাঃ সর্বেষাং ধৰ্ম্মঃ প্রথমকল্পিক ইতি।

অম্লমর্থঃ সমাবৃত্তস্থ্য ত্রৈবণিকস্থ্য প্রথমবিবাহে সবৰ্ণৈৰ প্রশস্তা” (১৬)।

যম কহিয়াছেন, "সজাতীয়। ভাষ্যা সকলের পক্ষে মুখ্য কল্প"। ইহায় অর্থ এই, সমাবৃত্ত অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য্যসমাধানাস্তে গৃহস্থাশ্রমপ্রবেশোলুপ ত্রৈবণিকের, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্বের প্রথম বিবাহে সবর্ণাই প্রশস্তা।

দেখ, এই যমবচনে, পৈঠীনসিবচনের ন্যায়, "ভার্য্যাঃ" "সর্বেষাম্," এ স্থলে ভার্য্যা শব্দে ও সব শব্দে বহুবচন আছে; কিন্তু মিত্রমিশ্র, “সবর্ণৈব," "ত্রৈবর্ণিক্য,” এই একবচনান্ত'পদের প্রয়োগ পূর্ব্বক, ঐ দুই বহুবচনান্ত পদের ব্যাখ্যা লিখিয়াছেন। ভার্য্যাপদের বহুবচন যদি বহুভার্য্যাবিবাহের বোধক হইত, তাহা হইলে তিনি, "সজাত্যাঃ ভার্য্যাঃ, ইহার পরিবর্তে, "সবর্ণৈব”, এবং "সর্বেষাম্”, ইহার পরিবর্তে, "ত্রৈবর্ণিকস্থ্য”, এরূপ এক্লবচনান্ত পদের প্রয়োগ করিতেন না; কিন্তু তাদৃশ পদের প্রয়োগ 'করিয়া, ঈদৃশ স্থলে, একবচন ও বহুবচনের। অর্থগত ও তাৎপর্য্যগত কোনও বৈলক্ষণ্য নাই, তদ্বিষয়ে সম্পূর্ণ সাক্ষ্যপ্রদান করিয়াছেন। দায়ভাগধৃত পৈঠীনসিবচন ও বীর- মিত্রোদয়ধৃত যমবচন সর্বাংশে তুল্য; যথা,

পৈঠানসিবচন

ভাৰ্য্যাঃ সজাতীয়াঃ লবেযাং শ্রেয়শ্যঃ সূর্যঃ।

যমবচন

ভাৰ্য্যাঃ সজাত্যাঃ সর্বেষাং ধৰ্ম্মঃ প্রথমকল্পিকঃ। যদি বীরমিত্রোদয়ে পৈঠীনসিবচন উদ্ধৃত হইত, তাহা হইলে, মিত্রমিশ্র ঐ বচনের যমবচনের তুল্যরূপ ব্যাখ্যা করিতেন, তাহার কোনও সংশয় নাই। ফলকথা' এই, এরূপ স্থলে, একবৃচন ও বহুবচনের অর্থগত কোনও বৈলক্ষণ্য নাই, উভয়ই এক অর্থ প্রতিপন্ন করিয়া থাকে।

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্ম্মণি। ৩। ১২। দ্বিজাতিদিগের প্রথম বিবাহে সবর্ণা বিহিতা।'

এই মনুবচন যমবচন ও পৈঠীনসিবচনের তুল্যার্থক; কিন্তু, ঐ দুই ঋষিবাক্যে ভার্য্যা শব্দে যেমন বহুবচন আছে, মনুবাক্যে সবর্ণা শব্দে, সেরূপ বহুবচন না থাকিয়া, একবচন আছে; অথচ তিন ঋষিবাক্যে এক অর্থই প্রতীয়মান হইতেছে। ইহা দ্বারাও নিঃসংশয়ে প্রতিপন্ন হইতেছে, ঈদৃশ স্থলে, একবচন ও বহুবচনের অর্থগত কোনও বৈলক্ষণ্য নাই। আর, ইহাও দেখিতে পাওয়া যায়, পূর্ববর্ত্তী ঋষিবাক্যে যে শব্দ বহুবচনে প্রযুক্ত হইয়াছে, তৎপরবর্তী ঋষিবাক্যে সেই শব্দেই একবচন প্রযুক্ত হইয়াছে, অথচ উভয় স্থলেই এক অর্থ প্রতিপন্ন হইতেছে, বিভক্তির বুচনর্ভেদ নিবন্ধন অর্থগত কোনও বৈলক্ষণ্য খটিতেছে না। যথা,

যদি স্বাশ্চাবরাশ্চৈব বিন্দেরন্ যোষিতো দ্বিজাঃ। তাসাং বর্ণক্রমেণৈব জ্যৈষ্ঠ্যং পূজা চ বেশ্ম চ (১৭)।

যদি দ্বিজেরা স্বা অর্থাৎ সজাতীয়া স্ত্রী, এবং অবরা অর্থাৎ জন্তজাতীয়া স্ত্রী, বিবাহ করে, তাহা হইলে বর্ণক্রমে সেই সকল স্ত্রীর জ্যেষ্ঠতা, সম্মান, ও বাসগৃহ হইবেক।

"ভৰ্ত্তঃ শরীরশুশ্রূষাং ধর্ম্মকার্য্যঞ্চ নৈত্যকম্।

স্বা চৈব কুর্য্যাৎ সর্বেষাং নান্যজাতিঃ কথঞ্চন (১৭) ।।

স্বামীর শরীরপরিচর্য্যা ও নিত্য ধৰ্ম্মকার্য্য দ্বিজাতিদিগের স্বা অর্থাৎ সজাতীয়া স্ত্রীই করিবেক, অন্তজাতীয়া কদাচ করিবেক না।

দেখ, পূর্ব্বনিদ্দিষ্ট মনুবাক্যে "স্বাঃ", "অবরাঃ”, এই দুই পদে বহুবচন আছে, আর তৎপরবর্তী মনুবাক্যে "স্বা", "অন্যজাতিঃ", এই দুই পদে একবচন আছে; অথচ উভয়ত্রই এক অর্থ প্রতিপন্ন হইতেছে। ফলতঃ, কোনও বিষয়ে যে সকল স্পষ্ট বিধি ও স্পষ্ট নিষেধ আছে, তাহাতে দৃষ্টিপাত না করিয়া, কেবল বিভক্তির একবচন, দ্বিবচন, বহুবচন অবলম্বন পূর্ববক, ধৰ্ম্মশাস্ত্রের মীমাংসা করা নিরবচ্ছিন্ন ব্যাকরণব্যবসায়ের পরিচয় প্রদান মাত্র।

এ বিষয়ে তর্কবাচস্পতি মহাশয় যে যুক্তি প্রদর্শন করিয়া- ছেন, তাহাও উদ্ধৃত ও আলোচিত হইতেছে;

"ন চ প্রত্যেকবর্ণাভিপ্রায়েণ বহুবচনমুপাত্তমিতি শঙ্ক্যম্ প্রত্যেক- বর্ণাভিপ্রায়কত্বে সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণীতি মানববচন ইব ভাৰ্য্যা কার্য্যেত্যেকবচন নির্দেশেনৈব' তথার্থাবগতৌ বহুবচননির্দেশবৈয়্যাপত্তেঃ” (১৮)। "

'পৈঠীনসিবাক্যস্থিত ভাৰ্য্যা শব্দে, প্রত্যেক বর্ণের অভিপ্রায়ে, বহুবচন প্রযুক্ত হইয়াছে, এ আশঙ্কা করিও না। যদি প্রত্যেক বর্ণের অভিপ্রায়ে হইত, তাহা হইলে, "দ্বিজাতিদিগের প্রথম বিবাহে সবর্ণা বিহিতা", এই মনুবাদো সবর্ণা শব্দে যেমন একবচন আছে, পৈঠানসিবাক্যস্থিত জাৰ্য্যা শব্দেও সেইরূপ একবচন থাকিলেই তাদৃশ অর্থের প্রতীতি সিদ্ধ হইতে পারিত; সুতরাং বহুবচননির্দেশ ব্যর্থ হইয়া পড়ে। 6

তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের উল্লিখিত মনুবাক্য ও পৈঠানসিবাক্য সর্বাংশে তুল্য, উভয়ের অর্থগত ও উদ্দেশ্যগত কোনও বৈলক্ষণ্য নাই। যথা,

মন্ত্রবচন

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং, প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণি। দ্বিজাতিদিগের প্রথম বিবাহে সবর্ণা বিহিতা।

পৈঠানসিবচন

4

ভাৰ্য্যাঃ সজাতীয়াঃ সর্বেবষাং শ্রেয়শ্যঃ স্যুঃ।

দ্বিজাতিদিগের সজাতীয়া ভাৰ্য্যা বিবাহ মুখ্য কল্প।

তবে, উভয় ঋষিবাক্যের এই মাত্র বৈলক্ষণ্য লক্ষিত হইতেছে, মনুবাক্যে সবর্ণা শব্দে একবচন আছে; পৈঠীনসিবাক্যে ভার্য্যা শব্দে' বহুবচন আছে। পৈঠীনসিবাক্যস্থিত ভার্য্যা শব্দে যে বহুবচন আছে, তর্কবাচস্পতি মহাশয়, ঐ বহুবচনের বলে, সিদ্ধান্ত করিতেছেন, পুরুষ একবারে বহু তাৰ্য্যা বিবাহ করিতে পারে; তাঁহার মতে, ঐ বহুবচন প্রত্যেক বর্ণের অভিপ্রায়ে ব্যবহৃত হয় নাই, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, তিন বর্ণের ভার্য্য। বুঝাইবার নিমিত্ত, বহুবচন প্রযুক্ত হইয়াছে, এরূপ নহে। মনুবাক্যে সবর্ণা শব্দে একবচন আছে, অথচ সবর্ণা শব্দ দ্বারা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, তিন বর্ণের ভার্য্যা বুঝাইতেছে; তিন বর্ণের ভার্য্যা বুঝাইবার অভিপ্রায় হইলে, পৈঠীনসিবাক্যেও, ভাৰ্য্যা শব্দে একবচন থাকিলেই, তাহা নিষ্পন্ন হইতে পারে; সুতরাং, বহুবচন প্রয়োগ নিতান্ত ব্যর্থ হইয়া পড়ে। অতএব, বহুবচনপ্রয়োগের বৈয়্যপরিহারের নিমিত্ত, একবারে বহুভার্য্যা- বিবাষ্ট্রই পৈঠীনসির অভিপ্রেত বলিয়া ব্যাখ্যা করিতে হইবেক। এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, পৈঠীনসিবাক্যস্থিত ভার্য্যা শব্দ বহুবচনান্ত দেখিয়া, যদি বহুভার্য্যাবিবাহ পৈঠীনসির অভিপ্রেত বলিয়া ব্যবস্থা করিতে হয়; তাহা হইলে, সমান ন্যায়ে, মনু- বাক্যস্থিত সবর্ণা শব্দ একবচনান্ত দেখিয়া, একভার্য্যাবিবাহ মনুর অভিপ্রেত বলিয়া ব্যবস্থা করিতে হইবেক; এবং তাহা হইলে, মনুবচনের ও পৈঠীনসিবচনের বিরোধ উপস্থিত হইল; মনু যে স্থলে একভার্য্যাবিবাহের বিধি দিতেছেন, পৈঠানসি, অবিকল সেই স্থলে, বহুভার্য্যাবিবাহের বিধি দিতেছেন। এক্ষণে, তর্কবাচ- স্পতি মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করি, কি প্রণালী অবলম্বন করিয়া, এই বিরোধের সমাধা করা যাইবেক; মনুবিরুদ্ধ স্মৃতি গ্রাহ্য নহে, এই পথ অবলম্বন করিয়া, পৈঠীনসিস্মৃতি অগ্রাহ্য করা যাইবেক; কিংবা মনু অপেক্ষা পৈঠীনসির প্রাধান্য স্বীকার করিয়া, মনুস্মৃতি অগ্রাহ্য করা যাইবেক; অথবা, মনু ও পৈঠীনসি উভয়ই তুল্য, তুল্যবল শাস্ত্রদ্বয়ের বিরোধস্থলে, 'বিকল্প পক্ষ অবলম্বিত হইয়া থাকে; এই পথ অবলম্বন করিয়া, বিকল্প- ব্যবস্থার অনুসরণ করা হইবেক; অথবা, অন্যান্য মুনিবাক্যের সহিত একবাক্যতাসম্পাদন করিয়া, ব্যবস্থা করা যাইরেক্। বিবাহবিষয়ক শাস্ত্রসমূহের অবিরোধ সম্পাদিত হইলে, যে ব্যবস্থা স্থিরীকৃত হয়, তাহা ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে প্রদর্শিত হইয়াছে; এস্থলে আর তাহার উল্লেখ করিবার প্রয়োজন নাই।

তর্কবাচস্পতি মহাশয় যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহের যে প্রমাণান্তর প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহা উদ্ধৃত ও আলোচিত হইতেছে। তিনি লিখিয়াছেন,

“চতস্রো ব্রাহ্মণ্য তিস্রো রাজন্য্য দ্বে বৈশ্বস্তেতি পৈঠানসি- বচনন্ত তাৎপৰ্য্যাব্যোতনার্থং দায়ভাগকৃতা জাত্যবচ্ছেদেনেন্যু- ক্তম্ চতুর্জাত্যবচ্ছিন্নতয়া বিবাহং ব্যবস্থাপয়তা চ তেন ঐকৈক- বর্ণায়া অপি পঞ্চাদিসংখ্যা ন বিরুদ্ধেতি ্যোতিতং তচ্চ ইচ্ছায়া নিরঙ্কুশত্বেনৈব প্রাগুক্তবচনজাতেন বিবাহবহুত্বপ্রতিপাদনেন চ সুষ্ঠুক্তমিত্যুৎপন্ডামঃ” (১৯)।

"ব্রাহ্মণের চারি, ক্ষত্রিয়ের তিন, বৈশ্যের দুই," এই পৈঠীনসিবচনের তাৎপর্য্য ব্যক্ত করিবার নিমিত্ত, দায়ভাগকার, "জাত্যবচ্ছেদেন", এই কথা বলিয়াছেন। চারি জাতিতে বিবাহ করিতে পারে, এই ব্যবস্থা করিয়া, প্রত্যেক বর্ণেও পাঁচ প্রভৃতি স্ত্রীবিবাহ দুষ্য নয়, ইহা ব্যক্ত করিয়াছেন। ইচ্ছার নিয়ামক না থাকাতে, এবং পূর্ব্বোক্ত বচন সমূহ দ্বারা বহু বিবাহ প্রতিপন্ন হওয়াতে, আমার বিবেচনায়, দায়ভাগকার অতি সুন্দর তাৎপর্য্যব্যাখ্যা করিয়াছেন।

এস্থলে বক্তব্য এই যে, প্রত্যেক বর্ণে পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগার, বার, তের প্রভৃতি স্ত্রী বিবাহ দূৰ্য্য নয়, দায়ভাগকার পৈঠীনসিবচনের এরূপ তাৎপর্য্যব্যাখ্যা করেন নাই। তিনি, সর্ববশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের মত অসংসাহসিক • পুরুষ ছিলেন না; সুতরাং, নিতান্ত নির্বিবেক হইয়া, যথেচ্ছ ব্যাখ্যা দ্বারা শাস্ত্রের গ্রীবাভঙ্গে প্রবৃত্ত হইবেন কেন। নিরপরাধ দায়ভাগকারের উপর অকারণে এরূপ দোষারোপ করা অনুচিত। • তিনি যে এ বিষয়ে কোনও অংশে দোষী নহেন, তৎপ্রদর্শনার্থ * উদীয় লিখন উদ্ধৃত হইতেছে।

"চতুস্রো ব্রাহ্মণস্যানুপূর্ব্যেণ, তিস্রো রাজন্যস্থ্য দ্বে বৈশ্যশস্য এক। শূদ্রস্থ্য। জাত্যবচ্ছেদেন চতুরাদিসংখ্যা সম্বধ্যতে।"

(পৈঠীনসি কহিয়াছেন,) "অনুলোম ক্রমে ব্রাহ্মণের চারি, ক্ষত্রিয়ের তিন, বৈশ্যের দুই, শূদ্রের এক, ভার্য্যা হইতে পারে।

"এই চারি প্রভৃতি সংখ্যার "জাতাবচ্ছেদেন" অর্থাৎ জাতির সহিত সম্বন্ধ।

অর্থাৎ, পৈঠীনসিবচনে যে চারি, তিন, দুই, এক, এই শব্দচতুষ্টয় আছে, তদ্দ্বারা চারি জাতি, তিন জাতি, দুই জাতি, এক জাতি, • এই বোধ করিতে হইবেক 'অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ চারি জাতিতে, ক্ষত্রিয় তিন জাতিতে, বৈশ্য দুই জাতিতে, শূদ্র এক জাতিতে, বিবাহ করিতে পারে; নতুবা, ব্রাহ্মণ চারি স্ত্রী বিবাহ, ক্ষত্রিয় তিন স্ত্রী বিবাহ, বৈশ্য দুই স্ত্রী বিবাহ, শূদ্র এক স্ত্রী বিবাহ, করিবেক, এরূপ তাৎপর্য্য নহে। দায়ভাগকারের লিখন দ্বারা ইহার অতিরিক্ত কিছুই প্রতিপন্ন হয় না। অতএব, তদীয় এই লিখন, দেখিয়া, প্রত্যেক বর্ণেও পাঁচ প্রভৃতি বিবাহ দূষ্য নয়, দায়ভাগকার এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়াছেন, এই ব্যাখ্যা দ্বারা ধৰ্ম্মশাস্ত্রবিষয়ে পাণ্ডিত্যের পরা কাষ্ঠ। প্রদর্শিত হইয়াছে। নারদ-সংহিতায় দৃষ্টি থাকিলে, সর্বশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহাশয় ঈদৃশ অসঙ্গত তাৎপর্য্যব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হইতেন, এরূপ বোধ হয় না। যথা,

ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশাং শূদ্রাণাঞ্চ পরিগ্রহে। সজাতিঃ শ্রেয়সী ভাৰ্য্যা সজাতিশ্চ পতিঃ স্ত্রিয়াঃ।। ব্রাহ্মণ্যানুলোম্যেন স্ত্রিয়োংন্যাস্তিজ এব তু। শূদ্রায়াঃ প্রাতিলোম্যেন তথান্যে পতয়ন্ত্রয়ঃ ॥ দে ভাষ্যে ক্ষত্রিয়শ্যান্যে বৈশ্যশ্যৈকা প্রকীর্ত্তিতা। বৈশ্যায়া দৌ পতী জ্ঞেয়াবেকোহন্সঃ ক্ষত্রিয়াপতিঃ (২০)।

ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশু, শূদ্র, এই চারি বর্ণের বিবারে, পুরুষের পক্ষে সজাতীয়া ভাষা। ও স্ত্রালোকের পক্ষে সজাতীয় পতি মুখ্য কল্প। অনুলোম সমে ব্রাহ্মণের অন্ত তিন স্ত্রী হইতে পারে। প্রতিলোম ক্রমে শূদ্রার অ্য তিন পড়ি হইতে গারে। ক্ষপ্রিয়ের অন্য দুই ভাধ্যা, বৈশ্বের অন্ত এক ভাষ্য। হইতে গাঁয়ে। বৈশ্বার অন্য দুই পতি, ক্ষত্রিয়ার অধ্য এক পতি হইতে পারে।

দেখ, নারদ সবর্ণা ও অসবর্ণা লইয়া, পুরুষপক্ষে, যেরূপ ব্রাহ্মণের চারি স্ত্রী, ক্ষত্রিয়ের তিন স্ত্রী, বৈশ্যের দুই স্ত্রী, শূদ্রের এক স্ত্রী নির্দেশ করিয়াছেন; সেইরূপ, স্ত্রীপক্ষেও, সবর্ণ ও অসবর্ণ লইয়া, শূদ্রার চারি পতি, বৈশ্যার তিন পতি, ক্ষত্রিয়ার দুই পতি, ব্রাহ্মণীর এক পতি নির্দেশ করিয়াছেন। দায়ভাগকার, পৈঠীনসি- বচননিদ্দিষ্ট চারি, তিন, দুই, এক স্ত্রী বিবাহ স্থলে, যেমন চারি জাতিতে, তিন জাতিতে, দুই জাতিতে, এক জাতিতে বিবাহ করিতে পারে, এই ব্যাখ্যা করিয়াছেন; নারদবচননির্দ্দিষ্ট চারি, তিন, দুই, এক স্ত্রী ও পতি বিবাহ স্থলেও, নিঃসন্দেহ, সেইরূপ ব্যাখ্যা করিতে হইবেক; অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ চারি জাতিতে, ক্ষত্রিয় তিন জাতিতে, বৈশ্য দুই জাতিতে, শূদ্র এক জাতিতে, বিবাহ করিতে পারে; আর, শূদ্রার চারি জাতিতে, বৈশ্যার তিন জাতিতে, ক্ষত্রিয়ার দুই জাতিতে, ব্রাহ্মণীর এক জাতিতে, বিবাহ হইতে পারে। নারদবচনস্থিত চারি তিন প্রভৃতি সংখ্যাবাচক শব্দচতুষ্টয় জাতিপর বলিয়া ব্যাখ্যা করা নিতান্ত আবশ্যক; • নতুবা, শূদ্রা প্রভৃতির চারি, তিন, দুই, এক জাতিতে বিবাহ 'হইতে পারে, এরূপ অর্থ প্রতিপন্ন না হইয়া, শূদ্রা প্রভৃতির চারি, তিন, দুই, এক, পতিবিবাহরূপ অর্থ প্রতিপন্ন হইবেক; অর্থাৎ, শূদ্রার চারি পতির সহিত, বৈশ্যার তিন পতির সহিত, ক্ষত্রিয়ার দুই পতির সহিত, ব্রাহ্মণীর এক পতির সহিত, বিবাহ হইতে পারিবেক। কিন্তু, সেরূপ অর্থ যে শাস্ত্রানুমত ও ন্যায়ানুগত নহে, ইহ। বলা বাহুল্য মাত্র। যাহা হউক, দায়ভাগকার পৈঠীনসিবচনস্থিত চারি, তিন প্রভৃতি সংখ্যাবাচক শব্দচতুষ্টয় জাতিপর বলিয়া ব্যাখ্যা করাতে, তর্কবাচস্পতি মহাশয়, যদৃচ্ছা- ক্রমে, প্রত্যেক বর্ণেও, পাঁচ প্রভৃতি স্ত্রী বিবাহ করা দৃষ্য নয়, এই তাৎপর্য্যব্যাখ্যা করিয়াছেন। এক্ষণে, সর্বাংশে সমান স্থল বলিয়া, নারদবচনস্থিত চারি, তিন প্রভৃতি সংখ্যাবাচক শব্দ- চতুষ্টয়ও জাতিপর বলিয়া অগত্যা ব্যাখ্যা করিতে হইতেছে; সুতরাং, সর্ববাংশে সমান স্থল বলিয়া, সর্বশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহাশয়, স্ত্রীলোকের পক্ষে, যদৃচ্ছাক্রমে, প্রত্যেক বর্ণে পাঁচ প্রভৃতি পতি বিবাহ করা দৃষ্য নয়, এই তাৎপর্য্যব্যাখ্যা করিবেন, তাহার সন্দেহ নাই। তাঁহার ব্যবস্থা অনুসারে, অতঃপর স্ত্রীলোকে, প্রত্যেক বর্ণে, যদৃচ্ছ। ক্রমে, যত ইচ্ছা বিবাহ করিতে পারিবেক। বেদব্যাস কেবল দ্রৌপদীকে পাঁচটি মাত্র পতি বিবাহের অনুমতি দিয়াছিলেন। তর্কবাচস্পতি মহাশয় বেদব্যাস অপেক্ষা ক্ষমতাপন্ন। তিনি একবারে, সর্বসাধারণ স্ত্রীলোককে, প্রত্যেক বর্ণে, যদৃচ্ছ। ক্রমে, যত' ইচ্ছা পতি বিবাহ করিবার অনুমতি দিতেছেন। অতএব, তর্কবাচস্পতি- ' মহাশয়সদৃশ ধৰ্ম্মশাস্ত্রব্যবস্থাপক ভূমণ্ডলে আর নাই, এরূপ নির্দেশ করিলে, বোধ করি, অত্যুক্তিদোষে দূষিত হইতে হয় না।

যাহা হউক, 'এস্থলে নির্দেশ করা'আবশ্যক, দায়ভাগলিখনের উল্লিখিত তাৎপর্য্যব্যাখ্যা তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের নিজ বৃদ্ধি প্রভাবে উদ্ভাবিত হয় নাই; তাঁহার পূর্বে, শ্রীকৃষ্ণ তর্কালঙ্কার, অচ্যুতানন্দ চক্রবর্ত্তী, ও কৃষ্ণকান্ত বিস্তৃাবাগীশ, ঐ তাৎপর্য্যব্যাখ্যা করিয়া গিয়াছেন। যথা,

শ্রীকৃষ্ণ তর্কালঙ্কার

"জাত্যবচ্ছেদেনেতি জাত্যা ইত্যর্থঃ তেন ব্রাহ্মণ্য পঞ্চষব্রাহ্মণলী- বিবাহো ন বিরুদ্ধ ইতি ভাবঃ (২১)।"

"জাত্যবচ্ছেদেন" অর্থাৎ জাতির সহিত, এই কথা বলাতে, ব্রাহ্মণের পাঁচ ছয় ব্রাহ্মণীবিবাহ দূষ্য নয়, এই অভিপ্রায় ব্যক্ত হইতেছে।

অচ্যুতানন্দ, চক্রবর্ত্তী

“জাত্যবচ্ছেদেনেতি তেন ব্রাহ্মণাদেঃ পঞ্চ ষড় বা সজাতীয়া ন বিরুদ্ধা ইত্যাশয়ঃ (২১)।"

"জাত্যবচ্ছেদেন", এই কথা বলাতে, ব্রাহ্মণাদি বর্ণের পাঁচ ছয় সবর্ণা বিবাহ দুখ্য নয়, এই অভিপ্রায় ব্যক্ত হইতেছে।

কৃষ্ণকান্ত বিদ্যাবাগীশ

“জাত্যবচ্ছেদেনেতি তেন ব্রাহ্মণস্য পঞ্চষব্রাহ্মণীবিবাহোংপি ন বিরুদ্ধ ইতি স্থচিতম্ (২১)।"

"জাতাবচ্ছেদেন" এই কথা বলাতে, ব্রাহ্মণের পাঁচ ছয় ব্রাহ্মণী বিবাহও মুয্য

"নয়; এই অভিপ্রায় ব্যক্ত হইতেছে।

• তর্কবাচস্পতি মহাশয়, এই তিন টীকাকারের তাৎপর্য্যব্যাখ্যা নিরীক্ষণ করিয়া, তদীয় নামোল্লেখে বৈমুখ্য অবলম্বন পূর্বক, নিজবুদ্ধিপ্রভাবে উদ্ভাবিত অভূতপূর্ব্ব ব্যাখ্যার ন্যায় পরিচয় দিয়াছেন। বস্তুতঃ, তদীয় ব্যাখ্যা শ্রীকৃষ্ণ," অচ্যুতানন্দ, ও কৃষ্ণকান্তের ব্যাখ্যার প্রতিবিম্ব মাত্র। তন্মধ্যে বিশেষ এই, তাঁহারা তিন জনে, স্ব স্ব বর্ণে পাঁচ ছয় বিবাহ দূষ্য নয়, এই মীমাংসা করিয়াছেন; তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের বুদ্ধি, তাঁহাদের সকলের অপেক্ষা, অধিক তীক্ষ্ণ; এজন্য তিনি, প্রত্যেক বর্ণে পাঁচ প্রভৃতি বিবাহ দৃষ্য নয়, এই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। তর্ক- বাচস্পতি মহাশয় শ্রীকৃষ্ণ, অচ্যুতানন্দ, ও কৃষ্ণকান্তের ব্যাখ্যার অনুসরণ করিয়াছেন; কিন্তু, তাঁহাদের ব্যাখ্যা অনুসৃত হইল বলিয়া, উল্লেখ বা অঙ্গীকার করেন নাই। অনেকে তদীয় এই ব্যবহারকে অন্যায়াচরণের উদাহরণস্থলে উল্লিখিত করিতে পারেন; কিন্তু, তাঁহার এরূপ ব্যবহার নিতান্ত অভিনব ও 'বিস্ময়কর নহে; পরস্ব হরণ করিয়া, নিজস্ব বলিয়া পরিচয় দেওয়া তাঁহার অভ্যাস আছে।

এ স্থলে ইহাও উল্লেখ করা আবশ্যক, রামভদ্র ন্যায়ালঙ্কার, শ্রীনাথ আচার্য্য চূড়ামণি, স্মার্ত্ত ভটাচার্য্য রঘুনন্দন, ও মহেশ্বর ভট্টাচার্য্যও দায়ভাগের টীকা লিখিয়াছেন; কিন্তু, তাঁহারা উল্লিখিত দায়ভাগলিখনের উক্তবিধ তাৎপর্য্যব্যাখ্যা করেন নাই। যাহা হউক, পূর্ব্বনিদ্দিষ্ট নারদবচন দ্বারা ইহা নির্বিবাদে প্রতি- পাদিত হইতেছে, শ্রীকৃষ্ণ তর্কালঙ্কার প্রভৃতি টীকাকার মহাশয়েরা, অথবা সর্বশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহোদয়, স্ব স্ব বর্ণে, অথবা প্রত্যেক বার্ণ, যদৃচ্ছা ক্রমে যত ইচ্ছা বিবাহ করা দৃষ্য নয়, ইহা দায়ভাগকারের অভিপ্রেত বলিয়া যে তাৎপর্য্যব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা কোনও মতে সঙ্গত বা সম্ভব হইতে পারে না (২২)।

(২২) অচ্যুতানন্দ চক্রবর্তী,

"ব্রাহ্মণের পাঁচ ছয় সবর্ণা বিবাহ শূয্য নয়"

এই যে তাৎপর্য্যণ্যাপ্যঃ করিয়াছেন, তাহা কেবল অনবধানমূলক বলিতে হইবেক। তদীয় তাৎপর্য্যব্যাপ্যার মর্ম্ম এই, ব্রাহ্মণ যদুচ্ছা ক্রমে যত ইচ্ছা সবণ বিবাহ করিতে পারে। কিন্তু, তিনি দায়ভাগধুত

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকুম্মণি। কামতম্ভ প্রবৃত্তানামিমাঃ হাঃ ক্রমাশাহবরাঃ। ৩। ১২। দ্বিজাতিদিগের প্রথমবিবাহে সবর্ণা কল্পা বিহিতা, কিন্তু যাহারা কামবশতঃ বিবাহে প্রবৃত্ত হয়, তাহারা অনুলোমভ্রমে অসবর্ণা বিবাহ করিবেক।

এই মনুবচনের যে ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তদ্দ্বারা যদৃচ্ছাস্থলে অসবর্ণীবিবাহমাত্র প্রতিপাদিত হইয়াছে। যথা,

"ইমাঃ বক্ষ্যমাণা: বৈশ্বাক্ষত্রিয়বিপ্রাণাং শূদ্রাবৈশাক্ষত্রিয়াঃ"।

বক্ষ্যমাণ কন্তারা অর্থাৎ বৈশ্য, ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণের শূদ্রা, ব্যৈ। ও ক্ষত্রিয়া। ইহা দ্বারা অচুতোনন্দ স্পষ্টাক্ষরে স্বীকার করিয়াছেন, যদৃচ্ছাক্রমে বিবাহে প্রবৃত্ত হইলে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা ও শূদ্রা ক্ষত্রিয় বৈস্তা ও শূদ্রা; বৈজ্ঞ শূদ্র। বিবাহ করিতে পারে। অতএব, যিনি মনুবচনব্যাখ্যাকালে, যদৃচ্ছাস্থলে, অসবর্ণা বিবাহমাত্র ব্যবস্থাপিত করিয়াছেন; তাঁহার পক্ষে "ব্রাহ্মণের পাঁচ ছয় সবর্ণা বিবাহ দূস্য নয়", এরূপ ব্যবস্থা করা কত দূর সঙ্গত, তাহা সকলে বিবেচনা করিয়া দেখিবেন। ফলতঃ অচ্যুতানন্দকৃত মন্ত্রবচনব্যাখ্যা ও দায়ভাগলিপনের তাৎপর্য্যব্যাখ্যা যে পরস্পর নিতান্ত বিরুদ্ধ, তাহার সন্দেহ নাই।

অষ্টম পরিচ্ছেদ

গাচস্পতি মহাশয়, যে প্রমাণ অবলম্বন পূর্বক, একবারে একাধিক ভার্য্যা বিবাহের, ফ্যবস্থা করিয়াছেন,, তাহা উদ্ধৃত ও আলোচিত হইতেছে।

"তাপ যদি গৃহস্থো দে ভার্য্যে বিন্দেত কথং কুর্য্যাৎ। ইত্যাশঙ্ক্য

যস্মিন্ কালে বিন্দেত উভাবগ্নী পরিচরেৎ

ইত্যুপক্রম্য,

দুয়োর্ভার্য্যয়োরস্বারকয়োর্ন জমানঃ

ইতি বিধানপারিজাতন্ত্রতবৌধারনস্থত্রেণ যুগপন্থার্থ্যাদ্বয়ং তদনু- গুণমগ্নিদ্বয়ঞ্চ বিহিতং দ্বয়োঃ পত্ন্যোরণারব্ধয়োরিতি বদতা চ অগ্নিদ্বয়ে যুগপত্তয়োহোমাদিসম্বন্ধ প্রতীতের্যুগপন্ধিবাহদ্বয়ং স্পষ্ট- মেষ প্রতীয়তে (২৩)।"

"যদি গৃহস্থ দুই ভাগ্যা বিবাহ করে কিরূপ করিবেক," এই আশঙ্কা করিয়া, "যে কালে বিবাহ করিবেক, দুই অগ্নির স্থাপন করিবেক," এইরূপ আরম্ভ করিয়া, "দুই ভাধ্যার সহিত যজমান," বিধানপারিজাতধৃত এই বৌধায়নসূত্রে যুগগর ভার্য্যাদয় ও তদুপযোগী অগ্নিদ্বয় বিহিত হইয়াছে; আর, "দুই পত্নীর সহিত," এই কথা বলাতে, অগ্নিদ্বয়ে যুগপৎ উভয়ের হোমাদিসম্বন্ধ প্রতীতি জন্মিতেছে; সুতরাং, যুগপৎ বিবাহদ্বয় স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে।

সর্ববশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহাশয় বৌধায়নসূত্রের অর্থগ্রহ ও তাৎপর্য্যনির্ণয় করিতে পারেন নাই; এজন্য, যুগপৎ বিবাহদ্বয় স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে, এরূপ অদ্ভুত সিদ্ধান্ত করিয়াছেন।

• তিনি, সমুদয় বৌধায়নসূত্র উদ্ধৃত না করিয়া, সূত্রের অন্তর্গত যে কয়টি কথা আপন অভিপ্রায়ের অনুকূল বোধ করিয়াছেন, সেই কয়টি কথা মাত্র উদ্ধৃত করিয়াছেন। কিন্তু, যখন ধৰ্ম্ম- সংস্থাপনে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তখন এক সূত্রের অতি সামান্য * অংশত্রয় 'মাত্র উদ্ধৃত না করিয়া, সমুদয় সূত্র উদ্ধৃত করা উচিত ও আবশ্যক ছিল; তাহা হইলে, কেবল তদীয় আদেশের ও উপদেশের উপর নির্ভর না করিয়া, আবশ্যক বোধ হইলে সকলে স্ব স্ব বুদ্ধির পরিচালনা করিয়া, সূত্রের অর্থনির্ণয় ও তাৎপর্য্যগ্রহ করিতে পারিতেন। এস্থলে দুটি কৌশল অবলম্বিত হইয়াছে; প্রথম, সমুদয় সূত্র উদ্ধৃত না করিয়া, সূত্রের অন্তর্গত কতিপয় শব্দ মাত্র উদ্ধৃত করা; দ্বিতীয়, কেহ সমুদয়' সূত্র দেখিয়া, সূত্রের অর্থবোধ ও তাৎপর্য্যনির্ণয় করিয়া, প্রকৃত বৃত্তান্ত জানিতে না পারে; এজন্য, যে গ্রন্থে এই সূত্র উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহার নাম গোপন পূর্বক, গ্রন্থান্তরের নাম নির্দেশ করা। তিনি লিখিয়াছেন,

"ইতি বিধানপারিজার্ভম্বতবৌধায়নসূত্রেণ”।

বিধানপারিজাতধৃত এই বৌধায়নসূত্রে।

কিন্তু, বিধানপারিজাতে এই বৌধায়নসূত্র উদ্ধৃত দৃষ্ট হইতেছে না। যাহা হউক, বৌধায়নসূত্রের প্রকৃত অর্থ ও তাৎগ্য কি, তাহা প্রদর্শিত হইতেছে।

যদি কোনও ব্যক্তি, শাস্ত্রোক্ত নিমিত্ত বশতঃ, পুনরায় বিবাহ করে, তবে সে পূর্বব বিবাহের অগ্নিতে দ্বিতীয় বিবাহের হোম করিবেক, নূতন অগ্নি স্থাপন করিয়া, তাহাতে হোম করিতে পারিবেক না। কিন্তু, যদি, কোনও কারণ বশতঃ,

পূর্বর অগ্নিতে হোম করা না ঘটিয়া উঠে, তাঁহা হইলে, নূতন অগ্নিতে হোম করিয়া, পূর্ব্ব অগ্নির সহিত ঐ'অগ্নির মিলন করিয়া দিবেক। এই অগ্নিবয়মেলনের দুই পদ্ধতি; প্রথম পদ্ধতি অনুয়ারে, প্রথমতঃ যথাবিধি স্থণ্ডিলে দুই অগ্নির স্থাপন করিয়া, অগ্নে, পূর্বব পত্নীর সহিত,, প্রথম বিবাহের অগ্নিতে হোম কবিবেক; পরে, সমিধের উপর ঐ অগ্নির ক্ষেপণ করিয়া, দ্বিতীয় বিবাহের অগ্নির সহিত মেলন পূর্ব্বক, দুই পত্নীর সহিত সমবেত হইয়া, হোম করিবেক। এই পদ্ধতি শৌনক ও আশ্বলায়নের বিধি অনুযায়িনী। দ্বিতীয় পদ্ধতি অনুসারে, প্রথমতঃ, যথাবিধি, স্থণ্ডিলে দুই অগ্নির স্থাপন করিয়া, অগ্রে, দ্বিতীয়পত্নীর সহিত, দ্বিতীয় বিবাহের অগ্নিতে হোম করিবেক; পরে, সমিধের উপর ঐ অগ্নির ক্ষেপণ করিয়া, প্রথম বিবাহের অগ্নির সহিত মেলন পূর্ববক, দুই পত্নীর সহিত সমবেত হইয়া, হোম করিবেক। এই পদ্ধতি বৌধায়নের বিধি অনুযায়িনী। শৌনক ও আশ্বলায়নের বিধি অনুসারে, অগ্রে, পূর্ব্ব পত্নীর সহিত, প্রথম বিবাহের অগ্নিত্বে হোম করিতে হয়; বৌধায়নের বিধি অনুসারে, অগ্রে, দ্বিতীয় পত্নীর সহিত, দ্বিতীয় বিবাহের অগ্নিতে হোম করিতে হয়। দুই পদ্ধতির এই অংশে বিভিন্নতা ও মন্ত্রগত বৈলক্ষণ্য আছে। বীরমিত্রোদয়, বিধানপারিজাত, নির্ণয়সিন্ধু, এই তিন গ্রন্থে এ বিষয়ের ব্যবস্থ। আছে, এবং অবলম্বিত ব্যবস্থার প্রমাণভূত শাস্ত্রও উদ্ধৃত হইয়াছে। যথাক্রমে, তিন গ্রন্থের লিখন উদ্ধৃত হইতেছে; তদ্দর্শনে, সকলে এ বিষয়ের সবিশেষ বৃত্তান্ত জানিতে পারিবেন, এবং তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের মীমাংসা সঙ্গত কি না, তাহাও অনায়াসে স্থির করিতে পারিবেন।

বীরমিত্রোদয়

"অথাধিবেদনেহগ্নিনিয়মঃ তত্র কাত্যায়নঃ সদারোহ ন্যান্ 'পুনৰ্দ্দারামুদ্বোঢ়ং কারণান্তরাৎ। যদীচ্ছেদগ্নিমান কর্তৃং ক হোমোহস্ত বিধীয়তে। স্বাগ্লাবের ভবেন্ধোমো লৌকিকে ন কদাচনেতি ॥ স্বাথৌ পূর্ব্বপরিগৃহীতেহয়ৌ তদভাবে লোঁকিকেহয়ৌ যদা লৌকিকেহয়ৌ তদা পূর্ব্বেণাগ্নিনা অন্ত্যাগ্নেঃ সংসর্গঃ কাৰ্য্যঃ”। অতঃপর অধিবেদনের অগ্নিনিয়ম উল্লিখিত হইতেছে। কাত্যায়ন কহিয়াছেন, "যদি সাগ্নিক গৃহস্থ, নিমিত্ত বশতঃ, পূর্ব্ব স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় দারপরিগ্রহের ইচ্ছা করে, কোন অগ্নিতে সেই বিবাহের হোম করিবেক। প্রথম বিবাহের অগ্নিতেই ঐ হোম করিতে হইবেক, লৌকিক অর্থাৎ নূতন, অগ্নিতে কদাচ করিবেক না।" প্রথম বিবাহের স্বগ্নির অভাব ঘাটলে, লৌকিক অগ্নিতে করিবেক; যদি লৌকিক অগ্নিতে করে, তাহা হইলে পূর্ব্ব অগ্নির সহিত। ঐ অগ্নির মেলন করিতে হইবেক।

"অথ ক্বতাধিবেদনস্থ্য অগ্নিন্বয়সংসর্গবিধিরভিধীয়তে। শৌনকঃ অথাগ্ন্যোগৃহগুয়োর্যোগং সপত্নীভেদজাতয়োঃ। সহাধিকার সিদ্ধ্যর্থমহং বক্ষ্যামি শৌনকঃ॥ অরোগামুদ্বহেৎ ক্যাং ধৰ্ম্মলোপভয়াৎ স্বয়ম্। কৃতে তত্র বিবাহে চ ব্রতান্তে তু পরেহহনি ॥ পৃথক্ স্থণ্ডিলয়োরগ্রী সমাধায় যথাবিধি। তন্ত্রং কৃত্বাজ্যভাগান্তমন্বাধানাদিকং ততঃ। জুহুয়াৎ পূর্ব্বপত্ন্যগ্নৌ তয়াম্বারব্ধ আহুতীঃ ॥ অগ্নিমীলে পুরোহিতং সূক্তেন নবর্চ্চেন তু। সমিধ্যেনং সমারোপ্য অয়ন্তে যোনিরিত্যুচা। প্রত্যবরোহেত্যর্নয়া কনিষ্ঠাগ্নৌ নির্ধায় তম্। আজ্যভাগাস্তুতন্ত্রাদি কৃত্বারভ্য তদাদিতঃ।

সমুম্বারব্ধ এতাভ্যাং পত্নীভ্যাং জুহুয়াদ্ভূতম্। চতুগৃহীতমেতাভিঋভিঃ ষড়ুভির্যথাক্রমম্। অগ্নাবগ্নিশ্চরতীত্যগ্নিনাগ্নিঃ সমিধ্যতে। অস্তীদমিতি তিস্বভিঃ পাহি নো অগ্ন একয়া। ততঃ স্নিষ্টকূদারভ্য, হোমশেষং সমাপয়েৎ। গোযুগং দক্ষিণা দেয়া শ্রোত্রিয়ায়াহিতাগ্নয়ে। পত্ন্যোরেকা যদি মৃতা দগ্ধা তেনৈব তাং পুনঃ। আদধীতান্যয়া সার্দ্ধমাধানবিধিন। গৃহীতি ॥

অয়ঞ্চাগ্নিসংসর্গো লৌকিকামৌ বিবাহহোমপক্ষে পূর্ব্বপত্নাথৌ বিবাহহোমপক্ষে তু নায়ং সংসর্গবিধিঃ বিবাহহোমেনৈর সংসৃষ্টত্বাৎ

অঃপর, অধিবেদনকারীর পক্ষে অগ্নিদ্বয়মেলনের যে বিধি আছে, তাহা নির্দিষ্ট হইতেছে। শৌনক কহিয়াছেন, "স্ত্রীদিগের সহাধিকার সিন্ধির নিমিত্ত, সপত্নী- ভেদনিমিত্তক গৃঙ্গ অগ্নিদ্বয়ের মেলনবিধি কহিতেছি। ধৰ্ম্মলোপভয়ে অরোগা কঞ্চার পাণিগ্রহণ করিবেক। বিবাহ সম্পন্ন হইলে, ব্রতাস্তে, পর দিবসে, যথা- বিধি, পৃথক্‌ দুই স্থণ্ডিলে দুই অগ্নির স্থাপন করিয়া, পৃথক্ অস্বাধান প্রভৃতি আজ্য- ভাগ পর্য্যন্ত কৰ্ম্ম সম্পাদন পূর্ব্বক, পুর্ব পত্নীর সহিত সমবেত হইয়া, "অগ্নিমীলে পুরোহিতম্", ইত্যাদি নব মন্ত্র দ্বারা প্রথম বিবাহের অগ্নিতে আহতি প্রদান করি- - বেক; পরে, "অয়ং তে যোনিঃ", এই মন্ত্র দ্বারা, সমিধের উপর ঐ অগ্নির ক্ষেপণ + করিয়া, "প্রত্যবরোহ" এই মন্ত্র দ্বারা, কন্সিষ্ঠাগ্নিতে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিবাহের অগ্নিতে ক্ষেপণ, পূর্ব্বক, প্রথম হইতে আজ্যভাগাস্ত কর্ম্ম করিয়া, উভয় পত্নীর সহিত সমবেত হইয়া, হোম করিবেক; অনন্তর, "অগ্নাবগ্নিশ্চরতি", "অগ্নিনাগ্নিঃ সমিধ্যতে", এই দুই, "অন্তীদম্", ইত্যাদি তিন, "পাহি নো অগ্ন একয়া", এই এক, এই হয় মন্ত্র দ্বারা, চতুগৃহীত স্বতের আহুতি দিবেক; তৎপরে, খিষ্টকুৎ প্রস্তুতি কৰ্ম্ম করিয়া, হোমশেষ সমাপন করিবেক, এবং আহিতাগ্নি শ্রোত্রিয়কে গোযুগল দক্ষিণা দিবেক। যদি, পত্নীদ্বয়ের মধ্যে, একের মৃত্যু হয়, সেই অগ্নি দ্বারা ভাহার সাহ করিয়া, গৃহস্থ, আধানবিধি অনুসারে, অ্য স্ত্রীর সহিত পুনরায় আধান করিবেক।" দ্বিতীয়বিবাহহোম লৌকিক অগ্নিতে সম্পাদিত হইলেই, উক্তপ্রকার অগ্নিমেলনের আব্যকতা; পূর্ব বিবাহের অগ্নিতে সম্পাদিত হইলে, উহার আবশ্যকতা নাই; কারণ, বিবাহহোম দ্বারাই অগ্নিসংসর্গ নিষ্পন্ন হইয়া যায়।

বিধানপারিজাত

"অথ সাগ্নিক্য দ্বিতীয়াং ভাৰ্য্যা মুঢ়বতোহগ্নিদ্বয়ণংসর্গবিধানম্।

আশ্বলায়নগৃহ্যশরিশিষ্টে

অথানেকভার্য্য্য যদি পূর্বগৃহ্যাগ্নাবেব অন- স্তরবিবাহঃ স্যাৎ তেনৈব সা তস্য সহ প্রথময়া ধৰ্ম্মাগ্নিভাগিনী ভবতি। যদি লৌকিকে পরি ণয়েৎ তং পৃথক্ পরিগৃহ্য পূর্ব্বেণৈকীকুর্য্যাৎ। তৌ পৃথগুপসমাধায় পূর্ববস্মিন্ পূর্ব্বয়া পত্ন্যা অম্বারক্কো অগ্নিমীলে পুরোহিতমিতি সূক্তেন প্রত্যচং হুহা অগ্নে ত্বং ন ইতি সূক্তেন উপ- স্থায় অয়ং তে যোনিঋত্বিয় ইতি তং সমিধ- মারোপ্য প্রত্যবরোহ জাতবেদ ইতি দ্বিতীয়ে অবরোহা আজ্যভাগান্তং কৃত্বা উভাভ্যামম্বা- রন্ধে। জুহুয়াৎ অগ্নিনাগ্নিঃ সমিধ্যতে ত্বং হহগ্নে অগ্নিনা পাহি নো অগ্ন একয়েতি তিস্বভিঃ অস্তীদমধিমন্থনমিতি চ তিস্থভিরর্থৈনং পরি- চরেৎ। মৃতামনেন সংস্কৃত্য অন্যয়। পুনরাদ- ধ্যাৎ যথাযোগং বাগ্নিং বিভজ্য তদ্ভাগেন সংস্কৃৰ্য্যাৎ। বহ্বীনামপ্যেবমগ্নিযোজনং কুর্য্যাৎ। গোমিথুনং দক্ষিণেতি।

শৌনকোহপি

অথাগ্ন্যোগৃহগুয়োর্যোগং সপত্নীভেদজাতয়োঃ।

সহাধিকারসিন্ধ্যর্থমহং বক্ষ্যামি শৌনকঃ ॥ অরোগামুদ্ধহেৎ কন্যাং ধৰ্ম্মলোপভয়াৎ স্বয়ম্। কৃতে তত্র বিবাহে চ ব্লতান্তে তু পরেহহনি। পৃথক্ স্থণ্ডিলয়োরগ্রী সমাধায় যথাবিধি। তন্ত্রং কুহাজ্যভাগান্তমন্বাধানাদিকং ততঃ। জুহুয়াৎ পূর্বপত্ন্যয়ৌ তয়াম্বারব্ধ আহুতীঃ। অগ্নিমীলে পুরোহিতং সূক্তেন নবর্চ্চেন তু। সমিধ্যেনং সমারোপ্য অয়ং তে যোনিরিত্যচা। প্রত্যবরোহেত্যনয়া কনিষ্ঠাগ্নৌ নিধায় তম্। আজভাগান্ততন্ত্রাদি কৃত্বারভ্য তদাদিতঃ। সমম্বারব্ধ এতাভ্যাং পত্নীভ্যাং জুহুয়াঘৃতম্। চতুগৃহীতমেতাভিঋভিঃ ষড়ভিযথাক্রমম্। অগ্নাবগ্নিশ্চরতীত্যগ্নিনাগ্নিঃ সমিধ্যতে। অন্তীদমিতি তিস্বভিঃ পাহি নো অগ্ন একয়া। ততঃ স্বিষ্টকৃদারভ্য হোমশেষং সমাপয়েৎ। গোযুগং দক্ষিণা দেয়। শ্রোত্রিয়ায়াহিতাগ্নয়ে ॥ পত্ন্যোরেকা যদি মৃতা দগ্ধা তেনৈব তাং পুনঃ। আদধীতান্যয়া সার্দ্ধমাধানবিধিনা গৃহীতি।"

অতঃপর কৃতদ্বিতীয়বিবাহ সাগ্নিকের অগ্নিষয়ের সংসর্গবিধান দর্শিত হইতেছে। আগলায়নগৃহপরিশিষ্টে উক্ত হইয়াছে; "যদি দ্বিভার্য্য ব্যক্তির দ্বিতীয় বিবাহ পূর্ব্ব বিবাহের অগ্নিতেই।সম্পন্ন হয়, তদ্দ্বারাই সে তাহার পূর্ব্বপত্নীর সহিত ধর্মকার্য্যে সহাধিকারিণী হইবেক। যদি লৌকিক অগ্নিতে বিবাহ করে, উহার পুস্তুক্ পরিগ্রহ করিয়া, পূর্ব্ব অগ্নির সহিত মেলন করিবেক। দুই অগ্নির পৃথক স্থাপন করিয়া, পূর্ব্বপত্নীর সহিত সমবেত হইয়া, "অগ্নিমীলে পুরোহিতম্", এই সূক্ত দ্বারা, পূর্ব্ব অগ্নিতে প্রতি মন্ত্রে হোম করিয়া, "অগ্নে ত্বং নঃ", এই স্বক্ত স্বারা উপস্থাপন পূর্ব্বক, "অয়ং তে যোনিঋত্বিয়", এই মন্ত্র দ্বারা, সখিধের উপর ক্ষেপণ করিয়া, "প্রত্যবরোহ জাতবেদঃ", এই মন্ত্র দ্বারা, দ্বিতীয় স্মৃগ্নিতে ক্ষেপণ, পূর্ব্বক, আজ্যভাগাস্ত কর্ম করিয়া, উভয় পত্নীর সহিত সমবেত হইয়া, হোম করিবেক; অনস্তর, "অগ্নিনাগ্নিঃ সমিধ্যতে", "বং অগ্নে অগ্নিনা", "পাহি নো অগ্ন একপ্না", এই তিন, এবং "অন্তীঙ্গমধিমন্থনম্", ইত্যাদি তিন মন্ত্র দ্বারা, সেই অগ্নিতে আহতিদান করিবেক। এই অগ্নি দ্বারা মৃতা স্ত্রীর সংস্কার করিয়া, অন্ত স্ত্রীর সহিত পুনর্বার অগ্ন্যাধান করিবেক, অথবা যথাসম্ভব অগ্নির বিভাগ করিয়া, এক ভাগ দ্বারা সংস্কার করিবেক। বহুস্ত্রীপলেও, এইরূপে অগ্নিমেলন করিবেক। গোযুগল দক্ষিণা দিবেক।"

শৌনকও কহিয়াছেন, "স্ত্রীদিগের সহাধিকার সিদ্ধির নিমিত্ত, সপত্নীভেদ- নিমিত্তক গৃহ্য অগ্নিদ্বয়ের মেলনবিধি কহিতেছি। ধৰ্ম্মলোপভয়ে অয়োগা কস্তার পাণিগ্রহণ করিবেক। বিবাহ সম্পন্ন হইলে, এতাস্তে, পর দিবসে, যথাবিধি, পৃথক্ দুই স্থণ্ডিলে দুই অগ্নির স্থাপন করিয়া, পৃথক্ অন্বাধান প্রভৃতি আজ্যভাগ পর্য্যন্ত কৰ্ম্ম সম্পাদন পূর্ব্বক, পূর্ব্ব পৃথ্বীর সহিত সমবেত হইয়া, "অগ্নিমীলে পুরোহিতম্", ইত্যাদি নব মন্ত্র দ্বারা, প্রথম বিবাহের অগ্নিতে আহুতি প্রদান করিবেক। পরে, "অয়ং তে যোনিঃ", এই মন্ত্র দ্বারা, সমিধের উপর ঐ অগ্নির ক্ষেপণ করিয়া, "প্রত্যবরোহ", এই মন্ত্র দ্বারা, কনিষ্ঠাগ্নিতে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিবাহের অগ্নিতে ক্ষেপণ পূর্ব্বক, প্রথম হইতে আজ্যভাগাস্ত কর্ম করিয়া, উভয় পত্নীর সহিত সমবেত হইয়া, হোম করিবেক, অনন্তর "অগ্নাবগ্নিশ্চরতি", "অগ্নিনাগ্নিঃ সমিধ্যতে", এই দুই, "অন্তীদম্", ইত্যাদি তিন, "পাহি নো অগ্ন একয়া", এই এক, এই ছয় মন্ত্র দ্বারা, চতুগৃহীত যুতের আহুতি দিয়েক; তৎপরে, পিষ্টকৃৎ প্রভৃতি কেৰ্ম্ম করিয়া, হোমশেষ সমাপন করিবেক, এবং আহিতাগ্নি শ্রোত্রিয়কে গোযুগল দক্ষিণা দিবেক। যদি, পত্নীদ্বয়ের মধ্যে, একের মৃত্যু হয়, সেই অগ্নি দ্বারা তাহার দাহ করিয়া, গৃহস্থ, আধানবিধি অনুসারে, অন্য স্ত্রীর সহিত পুনরায় আধান করিবেক।"

নির্ণয়সিন্ধু

"দ্বিতীয়বিবাহহোমে অগ্নিমাহ কাত্যায়নঃ

• সদারোহশ্যান্ পুনৰ্দ্দারামুদ্বোঢ়ং কারণান্তরাৎ। যদীচ্ছেদগ্নিমান্ কর্তৃং ক হোমোহস্য বিধীয়তে। স্বাগ্লাবের ভবেদ্ধোমো লৌকিকে ন কদাচন ॥

.. ত্রিকাণ্ডমগুনোহপি আছ্যায়াং বিদ্যমানায়াং দ্বিতীয়ামুদ্বহেছ্যাদি। তদ। বৈবাহিকং কৰ্ম্ম কুৰ্য্যাদাবসথেহগ্নিমান্ ॥ শুদর্শনভাষ্যে তু দ্বিতীয়বিবাহহোমো লৌকিক এব ন পূর্ব্বো- লাসন ইত্যুক্তম্ ইদঞ্চাসম্ভবে তত্র চাগ্নিদ্বয়সংসর্গঃ কাৰ্য্যঃ তদাহ শৌনকঃ

অথাগ্ন্যোগৃহগুয়োর্যোগং সপত্নীভেদজাতয়োঃ। সহাধিকারসিদ্ধ্যর্থমহং বক্ষ্যামি শৌনকঃ ॥ অরোগামুদ্ধহেৎ কল্যাং ধৰ্ম্মলোপভয়াৎ স্বয়ম্। কৃতে তত্র বিবাহে চ ব্রতান্তে তু পরেহহনি। পৃথক্ স্থণ্ডিলয়োরগ্নী সমাধায় যথাবিধি। তন্ত্রং কৃত্বাজ্যভাগান্তমন্বাধানাদিকং ততঃ। জুহুয়াৎ পূর্বপত্ন্যগ্নৌ তয়াম্বারব্ধ আহুতীঃ। অগ্নিমীলে পুরোহিতং সূক্তেন নবর্চ্চেন তু। সমিধ্যেনং সমারোপ্য অয়ং তে যোনিরিতাচা। প্রত্যবরোহেত্যনয়া কনিষ্ঠাগ্লো নিধায় তম্। আজ্যভাগান্ততন্ত্রাদি কৃত্বারভ্য তদাদিতঃ। সমম্বারব্ধ, এতাভ্যাং পত্নীভ্যাং জুহুয়াদ্বতম্। চতুগৃহীতমেতাভিঋভিঃ ষড়ভিযথাক্রমম্। অগ্নাবগ্নিশ্চরতীত্যগ্নিনাগ্নিঃ সমিধ্যতে। অস্তীদমিতি তিস্বভিঃ পাহি নো অগ্ন একয়া। ততঃ স্বিষ্টকূদারভ্য হোমশেষং সমাপয়েৎ। গোযুগং দক্ষিণা দেয়া শ্রোত্রিয়ায়াহিতাগ্নয়ে। পত্ন্যোরেকা যদি মৃতা দগ্ধা তেনৈব তাং পুনঃ। আদধীতান্যয়া সার্দ্ধমাধানবিধিনা গৃহীতি ॥

বৌধায়নসূত্রে তু

অথ যদি গৃহস্থে। দ্বে ভার্য্যে বিন্দেত কথং তত্র কুৰ্য্যাদিতি যস্মিন্ কালে বিন্দেত উভাবগ্নী পরি- চরেৎ অপরাগ্নিমুপসমাধায় পরিস্তীর্য্য, আজ্যং বিলাপ্য শ্রুচি চতুগৃহীতং গৃহীত্বা অস্বারকায়াং জুহোতি নমস্তে ঋষে গদাব্যধায়ে ত্বা স্বধায়ৈ ত্বা মান ইন্দ্রাভিমতত্ত্বদৃষ্টু। রিষ্টাং স এব ব্রহ্মন্নবেদ সুস্বাহেতি অথ অয়ং তে যোনিঋক্ষিয় ইতি সমিধি সমারোপয়েৎ 'পূর্বাগ্নিমুপসমাধায় জুহ্বান উদ্বুধ্যস্বাগ্ন ইতি সমিধি সমারোপ্য পরিস্তীর্য্য শ্রুচি চতুগৃহীত্বা দ্বয়োর্ডার্য্যয়োরম্বা- ররূয়োর্যজমানোহভিম্বশতি যো ব্রহ্মা ব্রাহ্মণ ইত্যেতেন সূক্তেনৈকং চতুগৃহীতং জুহোতি আগ্নিমুখাৎ কৃত্বা পকাং জুহোতি সম্মিতং সঙ্কল্লেথামিতি পুরোনুবাক্যামনূচ্য অগ্নে পুরীয্যে ইতি যাজ্যয়া 'জুহোতি অথাজ্যাহতী- • রুপজুহোতি পুরীয্যমস্তমিত্যন্তাদনুবাক্যশস্য স্বিষ্টকৃৎ প্রভৃতিসিদ্ধমাধেনুবরদানাৎ অথা- গ্রেণাগ্নিং দর্ভস্তম্বে হুতশেষং নিদধাতি ব্রহ্মজ- জ্ঞানং পিতা বিরাজানিতি দ্বাভ্যাং সংসর্গ- বিধিঃ কার্য্যঃ।"

যে অগ্নিতে দ্বিতীয় বিবাহের হোম করিতে হয়, কাত্যায়ন তাহার নির্দেশ করিয়াছেন, "যদি সাগ্নিক গৃহস্থ, নিমিত্ত বশতঃ, পূর্ব্ব স্ত্রীর জীবদ্দশায, পুনরায় দারপরিগ্রহের ইচ্ছা করে, কোন অগ্নিতে সেই বিবাহের হোম করিবেক। প্রণম বিবাহের অগ্নিতেই ঐ হোম করিতে হইবেক, লৌকিক অর্থাৎ নূতন অগ্নিতে কদাচ করিবেক না"। ত্রিকাণ্ডমগুনও কহিয়াছেন, "যদি সাগ্নিক গৃহস্থ, "প্রথমা স্ত্রী বিদ্যমান থাকিতে, দ্বিতীয়া স্ত্রী বিবাহ করে, তাহা হইলে আৎসথ অগ্নিতে বিবাহসংক্রান্ত কর্ম করিবেক"। সুদর্শনণ্ডায্যে নির্দিষ্ট আছে, দ্বিতীয় বিবাহের হোম লৌকিক অগ্নিতেই করিবেক, পূর্ব্ব বিবাহের অগ্নিতে নহে। . অলম্ভব পক্ষে এই ব্যবস্থা। এ পক্ষে অগ্নিদ্বয়ের মেলন করিতে হয়; শৌনক তাহার বিধি দিয়াছেন, "স্ত্রীদিগের সহাধিকার সিদ্ধির নিমিত্ত, সপত্নীভেদ। নিমিত্তক গৃহ্য অগ্নিদ্বয়ের মেলনবিধি কহিতেছি। ধর্ম্মলোপভয়ে অরোগা ক্যার পাণিগ্রহণ করিবেক। বিবাহ সম্পন্ন হইলে, ব্রতাস্তে, পর দিবসে, যথাবিফি পৃথক্ দুই স্থণ্ডিলে দুই অগ্নির স্থাপন করিয়া, পৃথক্ অন্বাধান প্রভৃতি আজ্যভাগ পর্য্যন্ত কর্ণ, সম্পাদন পূর্ব্বক, পূর্ব্ব পত্নীর সহিত সমবেত হইয়া, "অগ্নিমীলে পুরোহিতম্", ইত্যাদি নব মন্ত্র দ্বারা, প্রথম বিবাহের অগ্নিতে আহতি প্রদান করিবেক। পরে, "অয়ং তে যোনিঃ", এই মন্ত্র দ্বারা, সমিধের উপর ঐ অগ্নির ক্ষেপণ করিয়া, "প্রত্যবরোহ", এই মন্ত্র দ্বারা, কনিষ্ঠাগ্নিতে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিবাহের অগ্নিতে ক্ষেপণ পূর্বক, প্রথম হইতে আজাভাগাস্ত কর্ম্ম করিয়া, উভয় পরীর সহিত সমবেত হইয়া, হোম করিবেক; অনন্তর, "অগ্নাবগ্নিশ্চরতি", "অগ্নিনাগ্নিঃ সমিধ্যতে", এই দুই, "অস্তীদম্" ইত্যাদি তিন, "পাহি মো অগ্ন একয়া", এই এক, এই ছয় মন্ত্র দ্বারা, চতুগৃহীত স্বতের আহতি দিবেক; তৎপরে, পিষ্টকৃৎ প্রভৃতি কর্ম্ম করিয়া, হোমশেষ সমাপন করিবেক, এবং আহিভাগ্নি শ্রোত্রিয়কে গোযুগল দক্ষিণা দিবেক। যদি, পত্নীদ্বয়ের মধ্যে, একের মৃত্যু হয়, সেই অগ্নি দ্বারা তাহার দক্ষ করিয়া, গৃহস্থ, আধানবিধি অনুসারে, অন্ত্য স্ত্রীর সহিত পুনরায় আধান করিবেক"।

কিন্তু, বৌধায়নসূত্রে, অগ্নিদ্বয়ের মেলনপ্রক্রিয়া প্রকারান্তরে উক্ত হইয়াছে: ষণা, "যদি গৃহস্থ দুই ভার্য্যার পাণিগ্রহণ করে, সে স্থলে কিরূপ করিবেক? বৎ- কালে বিবাহ করিবেক, উভয় অগ্নির স্থাপন করিবেক; অপরাগ্নির, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিবাহের অগ্নির, স্থাপন ও পরিস্তরণ করিয়া, ঘৃত গলাইয়া, শুচে চারি বার মৃত গ্রহণ করিয়া, "নমস্তে গুবে গদাব্যধায়ৈ ত্বা স্বধায়ৈ বা মান ইন্দ্রাভিমতত্ত্বদৃষ্ট। রিষ্টাং স এব ব্রহ্মন্নবেদ হস্বাহা," এই মুস্ত্র দ্বারা, কনিষ্ঠা স্ত্রীর সহিত সমবেত হইয়া, আহুতি দিবেক; পরে, "অয়ং তে যোনিঋত্বিয়ঃ", এই মন্ত্র দ্বারা, সমিধের উপর ক্ষেপণ করিবেক। অনন্তর, পূর্ব্ব অগ্নির, অর্থাৎ প্রথম বিবাহের অগ্নির, স্থাপন পূর্ব্বক আহুতি দিয়া, "উষুধ্যস্ব অগ্নে", এই মন্ত্র দ্বারা, সমিধের উপর ক্ষেপণ ও পরিস্তরণ করিয়া, শুচে চারি বার স্বত লইয়া, উভয় ভাৰ্য্যার সহিত সমবেত হইয়া, যজমান হোম করিবেক; "যো ব্রহ্মা ব্রহ্মণঃ", এই যন্ত্র দ্বারা, এক বার চতুগৃহীত ঘৃত আহতি দিবেক; অনস্তর, অগ্নিমুর্খ প্রভৃতি কৰ্ম্ম করিয়া, চরুহোম করিবেক "সম্মিতং সঙ্করেথাম্", এই অনুবাক্যামন্ত্র উচ্চারণ করিয়া, "অগ্নে পুরীধ্যে", এই যাজ্যামন্ত্র দ্বারা, হোম করিবেক; পরে, ঘৃতের আহুতি দিয়া, হোম করিবেক "পুরীয্যমস্তম্", এই অনুবাক্যের শেষভাগ হইণ্ডে। শিষ্টকৃৎ প্রভৃতি ধেমুদক্ষিণ। পর্য্যন্ত কৰ্ম্ম করিবেক; "ব্রহ্মজজ্ঞানং পিতা বিরাজস্ এই মন্ত্রোচ্চারণ পূর্ব্বক, শুচের অগ্রভাগ দ্বারী, হুতশেষ অগ্নি গ্রহণ করিয়া, ঈর্ভস্তম্বে স্থাপন করিবেক। এইরূপে অগ্নিদ্বয়ের সংসর্গ বিধান করিবেক।

তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের উল্লিখিত বৌধায়নসূত্র, এবং সর্বাংশে সমানার্থক শৌনকবচন ও আশ্বলায়নসূত্র, সমগ্র প্রদর্শিত হইল। এক্ষণে, শাস্ত্রত্রয়ের অর্থ ও তাৎপর্য্য পৰ্য্যালোচনা পূর্ব্বক, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, বৌধায়নসূত্র দ্বারা যুগপৎ বিবাহদ্বয়বিধান প্রতিপন্ন হইতে পারে কি না। শৌনক ও আশ্বলায়ন যেরূপ কৃতদ্বিতীয়বিবাহ ব্যক্তির বিবাহ সংক্রান্ত অগ্নিদ্বয়ের মেলন- প্রক্রিয়া নির্দেশ করিয়াছেন; বৌধায়নও তাহাই করিয়াছেন, তাহার অতিরিক্ত কিছুই বলেন নাই। তবে, পূর্বের দর্শিত হইয়াছে, শৌনক ও আশ্বলায়ন, অগ্রে পূর্বপত্নীর সহিত প্রথম বিবাহের অগ্নিতে হোম করিয়া, অগ্নিদ্বয়ের মেলন পূর্ব্বক, দুই পত্নীর সহিত সমবেত হইয়া, হোম করিবেক, এই বিধি দিয়াছেন; বৌধায়ন, অগ্রে দ্বিতীয় পত্নীর সহিত দ্বিতীয় বিবাহের অগ্নিতে হোম করিয়া, অগ্নিদ্বয়ের মেলন পূর্বক, দুই পত্নীর সহিত সমবেত হইয়া, হোম করিবেক, এই বিধি প্রদান করিয়াছেন। এতদ্ব্যতিরিক্ত, প্রদর্শিত শাস্ত্রত্রয়ের, কোনও অংশে, উদ্দেশ্যগত কোনও বৈলক্ষণ্য নাই। অতএব, বৌধায়ন "এক বারে দুই ভাৰ্য্যা বিবাহের বিধি দিয়াছেন, এরূপ অনুভব করিবার কোনও হেতু লক্ষিত হইতেছে না। তর্কবাচস্পতি মুহাশয়, সূত্রের অন্তর্গত যে তিনটি বাক্য অবলম্বন করিয়া, যুগপৎ বিবাহদ্বয় প্রতিপন্ন করিতে প্রয়াস' পাইয়াছেন, উহাদের • অর্থ ও তাৎপর্য্য পৰ্য্যালোচিত হইতেছে। তাঁহার অবলম্বিত প্রথম বাক্য এই;

"যদি গৃহস্থোপদ্বে ভার্য্যে বিন্দেত.।"

যদি গৃহস্থ দুই ভাৰ্য্যা বিবাহ করে।

এস্থলে, সামান্যাকারে, দুই ভার্য্যা বিবাহের নির্দেশ মাত্র আছে; এক বারে দুই ভার্য্য। বিবাহ, কিংবা ক্রমে দুই ভার্য্যা বিবাহ, বুঝাইতে পারে, এরূপ কোনও নিদর্শন নাই; সুতরাং, একতর পক্ষ নির্ণয় বিষয়ে আপাততঃ সংশয় উপস্থিত হইতে পারে। কিন্তু, সূত্রের মধ্যে পূর্বর্বাগ্নি, অপরাগ্নি, এই যে দুই শব্দ আছে, তদ্দ্বারা সে সংশয় নিঃসংশয়িত রূপে অপসারিত হইতেছে। পূর্ববাগ্নি শব্দে পূর্ব্ব বিবাহের অগ্নি বুঝাইতেছে; অপরাগ্নি শব্দে দ্বিতীয় বিবাহের অগ্নি বুঝাইতেছে। যদি এক বারে বিবাহদ্বয় বৌধায়নের অভিপ্রেত হইত, তাহা হইলে, পূর্নর্বাগ্নি ও অপরাগ্নি, • এই দুই শব্দ সূত্র মধ্যে সন্নিবেশিত থাকিত না। এই দুই শব্দ ব্যবহৃত হওয়াতে, বিবাহের পৌর্বাপর্য্যই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, বিবাহের যৌগপ্য; কোনও মতে, প্রতিপন্ন হইতে পারে না। তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের অবলম্বিত দ্বিতীয় বাক্য এই;

"উভাবগ্নী পরিচরেৎ"

দুই অগ্নির স্থাপন করিবেক। অগ্নিদ্বয়মেলন প্রক্রিয়ার প্রারম্ভে, প্রথমতঃ ঐ অগ্নিদ্বয়ের যে স্থাপন করিতে হয়, এই বাক্য দ্বারাঁ তাহারই বিধি দেওয়া হইয়াছে; নতুবা, দুই বিবাহের উপযোগী দুই অগ্নি বিহিত হইয়াছে, ইহা এই বাক্যের অর্থ নহে। পূর্ববদর্শিত শৌনকবচনে ও আশ্বলায়নসূত্রে দৃষ্টি থাকিলে, সর্ববশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহাশয় কদাচ সেরূপ অর্থ করিতেন না। ঐ দুই শাস্ত্রে, অগ্নিদয়-- মেলনপ্রক্রিয়ার উপক্রমে, অগ্নিদ্বয়স্থাপনের যেরূপ ব্যবস্থা আছে; বৌধায়নসূত্রেও,, অগ্নিদ্বয়মেলন প্রক্রিয়ার উপক্রমে, অগ্নিন্বয়- স্থাপনের সেইরূপ ব্যবস্থা প্রদত্ত হইয়াছে। যথা,

শৌনকবচন

"পৃথক্ স্থণ্ডিলয়োরগ্রী সমাধায় যথাবিধি,". যথাবিধি পৃথক্ দুই স্থণ্ডিলে দুই অগ্নির স্থাপন করিয়া।

আশ্বলায়নসূত্র "তৌ পৃথগুপসমাধায়”। দুই অগ্নির পৃথক্ স্থাপন করিয়া। বৌধায়নসূত্র "উভাবগ্নী পরিচরেৎ" দুই অগ্নির স্থাপন করিবেক। সুতরাং, এই বাক্য দ্বারা বিবাহের যৌগপ্য প্রতিপন্ন হইতে পারে, এরূপ কোনও লক্ষণ লক্ষিত হইতেছে না। তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের অবলম্বিত তৃতীয় বাক্য এই;

"দ্বয়োর্ভার্য্যয়োরম্বারব্ধয়োর্যজমানোহভিমূশতি"

'দুই ভাৰ্য্যার সহিত সমবেত হইয়া, যজমান হোম করিবেক। অগ্নিদ্বয় মেলনের পর, দুই পত্নীর সহিত সমবেত হইয়া, মিলিত অগ্নিদ্বয়ে যে আহুতি দিতে হয়, এই বাক্য দ্বারা তাহাই উক্ত হইয়াছে। যথা, শৌনকবচন

"সমিধ্যেনং সমারোপ্য অয়ং তে যোনিরিত্যুচা। প্রত্যবরোহেত্যনয়া কনিষ্ঠাগ্নৌ নিধায় তম্। আজ্যভাগান্ততন্ত্রাদি কৃত্বারভ্য তদাদিতঃ। সমম্বারব্ধ এতাভ্যাং পত্নীভ্যাং জুহুয়াত্ত্বতম্ ।"

"জয়ং তে যোনিঃ", এই মন্ত্র দ্বারা, সমিধের উপর ঐ অগ্নির ক্ষেপণ করিয়া, "প্রত্যবরোহ", এই মন্ত্র দ্বারা, কনিষ্ঠাগ্নিতে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিবাহের অগ্নিতে ক্ষেপণ পূর্ব্বক, প্রথম হইতে আজ্যভাগান্ত কৰ্ম্ম করিয়া, উভয় পত্নীর সহিত সমবেত হইয়া, হোম করিবেক।

আশ্বলায়নসূত্র

"অয়ং তে যোনিঋত্বিয় ইতি তং সমিধমারোপ্য প্রত্যবরোহ জাতবেদ ইতি দ্বিতীয়েহবরোহা আজ্যভাগান্তং কৃত্বা উভাভ্যামম্বারক্কো জুহুয়াৎ।"

"অয়ং তে যোনিঋত্বিয়ঃ", এই মন্ত্র দ্বারা, সমিধের উপর ঐ অগ্নির ক্ষেপণ করিয়া, "প্রত্যবরোহ জাতবেদঃ", এই মন্ত্র দ্বারা, দ্বিতীয় অগ্নিতে ক্ষেপণ পূর্ব্বক, আজ্য- ভাগা কৰ্ম্ম করিয়া, দুই পত্নীর সহিত সমবেত হইয়া, হোম করিবেক।

বৌধায়নসূত্র

"তায়ং তে যোনিঋত্বিয় ইতি সমিধি সমারোপয়েৎ পূর্ব্বাগ্নিমুপসমাধায় জুহ্বান উদ্বুধ্যস্বাগ্ন ইতি সমিধি সমারোপ্য পরিস্তীর্য্য শ্রুচি চতুগৃহীত্বা দয়ো- ভার্য্যয়োরম্বারব্ধয়োর্যজমানোহভিমূশতি”।

"অয়ং তে যোনির্ধত্বিয়ঃ", এই মন্ত্র দ্বারা, সমিথের উপর (অপরাগ্নির) ফে করিবেক; অনন্তর, পূর্ব্বাপ্নির অর্থাৎ প্রথম বিবাহের অগ্নির স্থাপন পূর্ব্বক, আহতি দিয়া, "উষুধ্যস্ব অগ্নে", এই মন্ত্র দ্বারা, সমিধের উপর ক্ষেপণ ও পরিস্তরণ করিয়া, ত্রুচে চারি বার ঘৃত লইয়া, দুই পত্নীর সহিত সমবেত হইয়া, যজমান হোম করিবেক।

ইহা দ্বারাও, বিবাহের যৌগপছা, কোনও মতে, প্রতিপন্নহইতে পারে না। সর্বশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহাশয় ধর্মশাস্ত্রব্যবসায়ী হইলে, এ বিষয়ে এতাদৃশী অনভিজ্ঞতা প্রদর্শিত হইত না।

কিঞ্চ, সম্ভব অসম্ভব বিবেচনা করিবার শক্তি থাকিলে, তর্কবাচস্পতি মহাশয় বিবাহের যৌগপ্য প্রতিপাদনে প্রবৃত্ত ও যত্নবান হইতেন না। যথাবিধি বিবাহ করিতে হইলে, এক বারে দুই বিবাহ, কোনও ক্রমে, সম্পন্ন হইতে পারে না। বিশেষতঃ, দুই স্থানের দুই কন্যার, এক সময়ে, এক পাত্রের' সহিত, বিবাহকার্য্য নির্বাহ হওয়া অসম্ভব। মনে কর, "ইচ্ছার নিয়ামক নাই, অতএব যত ইচ্ছা বিবাহ করা উচিত,” এই ব্যবস্থাদাতা তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের পুনরায় বিবাহ করিতে 'ইচ্ছা জন্মিল; তদনুসারে, কাশীপুরের এক কন্যা, ভবানীপুরের এক কন্ঠ, এই বিভিন্নস্থানবর্ত্তিনী দুই কন্যার সহিত, বিবাহসম্বন্ধ স্থির হইল। এক্ষণে, বহুবিবাহপ্রিয় তর্কবাচস্পতি মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করি, শাস্ত্রোক্ত পদ্ধতি অনুসারে, এক বারে, এই দুই কন্যার পাণিগ্রহণ সম্পন্ন করিতে পারেন কি না। তুর্কবাচস্পতি মহাশয় কি বলেন,, বলিতে পারি না; কিন্তু, তদ্ভিন্ন ব্যক্তিমাত্রেই বলিবেন,'এরূপ বিভিন্ন স্থানন্বয়ে স্থিত কন্যাদ্বয়ের, এক বারে, এক পাত্রের সহিত বিবাহ, কোনও মতে, সন্তুবিতে পারে না। বস্তুতঃ, বিভিন্ন গ্রামে, বা বিভিন্ন ভবনে, অথবা এক ভবনের বিভিন্ন স্থানে, দুই বিবাহের অনুষ্ঠান হইলে, এক ব্যক্তি দ্বারা, এক সময়ে, দুই কন্যার পাণিগ্রহণ কি রূপে সম্পন্ন হইতে পারে, তাহা অনুভবপথে আনীত করিতে পারা যায় না। আর, যদিই, এক অনুষ্ঠান দ্বারা, দুই ভগিনীর, এক পাত্রের সহিত, এক সময়ে, বিবাহ সম্পন্ন হওয়া কথঞ্চিৎ, সম্ভব হইতে পারে; কিন্তু, শাস্ত্রকারেরা তাদৃশ বিবাহের পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন। যথা,

ভ্রাতৃযুগে স্বস্বযুগে ভ্রাতৃস্বস্বযুগে তথা।

ন কুৰ্য্যাম্মঙ্গলং কিঞ্চিদেকস্মিন্ মণ্ডপেহহনি (২৪) । এক মণ্ডপে, এক দিবসে, দুই ভ্রাতার, কিংবা দুই ভগিনীর, অথবা ভ্রাতা ও ভগিনীর, কোনও শুভ কাৰ্য্য করিবেক না।

এই শাস্ত্র অনুসারে, এক দিনে, এক মণ্ডপে, দুই ভগিনীর বিবাহ 'হইতে পারে না।

নৈকজন্যে তু কন্যে দ্বে পুত্রয়োরেকজন্যয়োঃ। ন পুত্রীদ্বয়মেকস্মিন্ প্রদছ্যাত্ত কদাচন (২৫) এক ব্যক্তির দুই পুত্রকে দুই কস্তা দান, অগ্নবা এক পাত্রে দুই কস্তা দান, কদাচ করিবেক না।

এই শাস্ত্র অনুসারে, এক পাত্রে দুই কন্যাদান স্পষ্টাক্ষরে নিষিদ্ধ হইয়াছে।

পৃথমাতৃজয়োঃ কার্য্যো বিবাহত্ত্বেকবাসরে। একস্মিন্ মণ্ডপে কার্য্যঃ পৃথন্বেদিকয়োস্তথা। পুষ্পপট্রিকয়োঃ কার্য্যং দর্শনং ন শিরস্থয়োঃ 1 ভগিনীভ্যামুভাভ্যাঞ্চ যাবৎ সুপ্তপদী ভবেৎ (২৬)।

দুই বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ও দুই বৈমাত্রেয় ভগিনীর, এক দিনে, এক মণ্ডপে, পৃথক্ পৃথক্ বেদিতে, বিবাহ হইতে পারে। বিবাহকালে ক্যাদের মস্তকে যে পুষ্প পড়িকা বন্ধন করে, সপ্তপদীগমনের পূর্ব্বে দুই ভগিনী পরস্পর সেই পুষ্পপট্রিকা দর্শন করিবেক না।

এই শাস্ত্র অনুসারে, দুই বৈমাত্রেয় ভগিনীর, এক দিনে, এক মণ্ডপে, বিবাহ হইতে পারে। কিন্তু, বিবাহাজ কর্ম্মের অনুষ্ঠান পৃথক পৃথক বেদিতে ব্যবস্থাপিত হওয়াতে, এবং পূর্ববনিদ্দিষ্ট, নারদবচনে, এক পাত্রে দুই কন্যাদান নিষিদ্ধ হওয়াতে, বৈমাত্রেয় ভগিনীদ্বয়েরও, এক সময়ে, এক পাত্রের সহিত, বিবাহ সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নহে। এইরূপে, এক দিনেন, এক মণ্ডপে, এক পাত্রের সহিত, ভগিনীদ্বয়ের বিবাহ নিষিদ্ধ হওয়াতে, বহুবিবাহ- প্রিয় তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের আশালতা ফলবতী হইবার কোনও সম্ভাবনা লক্ষিত হইতেছে না। যাহা হউক, বহুদর্শন নাই, বিবেকশক্তি নাই, প্রকরণজ্ঞান নাই; সুতরাং, বৌধায়ন- সূত্রের প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য্য কি, তাহা স্থির করিতে পারেন নাই; এ অবস্থায়, “যদি দুই ভার্য্যা বিবাহ করে," "দুই 'অগ্নির স্থাপন করিবেক," "দুই ভার্য্যার সহিত সমবেত হইয়া আহুতি দিবেক", ইত্যাদি স্থলে, দুই এই সংখ্যাবাচক শব্দের প্রয়োগ দর্শনে মুগ্ধ হইয়া, এক ব্যক্তি এক বারে দুই ভার্য্যা বিবাহ করিতে পারে, এরূপ অপসিদ্ধান্ত অবলম্বন করা নিতান্ত আশ্চর্য্যের বিষয় নহে।

নবম পরিচ্ছেদ

তর্কবাচস্পতি মহাশয়, যুদৃচ্ছা প্রবৃত্ত বহুবিবাহব্যবহারের শাস্ত্রীয়তা 'প্রতিপাদনে প্রবৃত্ত হইয়া, এক ঋষিবাক্যের যেরূপ অদ্ভুত পাঠ ধরিয়াছেন ও অদ্ভুত ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তদ্দর্শনে স্পষ্ট প্রতীয়- মান হইতেছে, তিনি, স্বীয় অভিপ্রেত সাধনের নিমিত্ত, নিরতিশয় ব্যগ্রচিত্ত হইয়া, একবারে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হইয়াছেন। ঐ পাঠ, ঐ ব্যাখ্যা, ও তমূলক সিদ্ধান্ত সকল, প্রদর্শিত করিবার নিমিত্ত; তদীয় লিখন উদ্ধৃত হইতেছে।

"ইদানীং ক্রমশো বহুবিবাহে কালবিশেষো নিমিত্তবিশেষ- শাভিধীয়তে। তত্র মনুনা

জায়ায়ৈ পূর্বমারিণ্যৈ দত্ত্বাগ্নীনস্ত্যকৰ্ম্মণি। পুনৰ্দ্দারক্রিয়াং কুর্য্যাৎ পুনরাধানমেব চ।

ইতি দারমরণরূপ একঃ কালঃ অভিহিতঃ। অত্র বিশেষয়তি বিধানপারিজাতঃত্ববৌধায়নসূত্রম্

ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্নে দারে না্যাং কুব্বীত

অন্যতরাভাবে কার্য্যা প্রাগগ্ন্যাধেয়েতি।

দারাণামভাবঃ অদারম্ অর্থাভাবেংব্যয়ীভাবঃ ততঃ সপ্তম্যা বহুলমলুক্। সম্পন্নং সম্পত্তিঃ ভাবে ক্তঃ। ধৰ্ম্মস্ত অগ্নিহোত্রা- দিকন্ত গৃহস্থকর্তব্যন্ত যাবদ্ধৰ্ম্মন্ত প্রজায়াশ্চ সম্পত্তৌ সত্যাং দারাভারে অন্তাং স্ত্রিয়ং ন কুব্বীত নান্তামুহুহেদিত্যর্থঃ। কিন্তু বনং মোক্ষং বাশ্রয়েৎ

ঋণত্রয়মপাকৃত্য মনো মোক্ষে নিবেশয়েৎ ইতি

মমুনা ঋণত্রয়াপাকরণে মোক্ষাধিকারিত্বসূচনাৎ

• জায়মানো বৈ পুরুষস্ত্রিভিঋণৈঋণী ভবতি ব্রহ্মচর্য্যেণ ঋষিভ্যঃ যজ্ঞেন দেবেভ্যঃ প্রজয়া পিতৃভ্য ইতি

ঋষ্যাদিত্রয়ণ্য বেদাধ্যর নাগ্নিহোত্রাদিযাগে পুত্রোৎপত্তিভিরপা- * করণাৎ যাবদগৃহস্থকর্তব্যকরণাচ্চ ন দারান্তরকরণং তৎ ফলস্ত্য ধৰ্ম্মপুভ্রাদেঃ কৃতত্বাৎ। কিন্তু যদি ন রাগনিবৃত্তিস্তদা তৎফলার্থ- বিবাহকরণং ভঙ্গ্যোক্তম্। ধৰ্ম্মপ্রজেতি বিশেষণাচ্চ 'রতিফল- বিবাহস্ত তদা কর্তব্যতেতি গম্যতে 'অন্যথা ধৰ্ম্মপ্রজেতি নাভি- দধ্যাৎ তথাচ ঋণত্রয়শোধনে অনুপযোগিতয়া তত্তৎ ফলমুদ্দিশ্য ন বিবাহান্তরকরণমিতি সিদ্ধম্। অন্যতরাভাবে ধৰ্ম্ম প্রজয়োমধ্যে একতরাভাবে ধৰ্ম্মাভাবে পুদ্রাভাবে বা অন্ত্যা কাৰ্য্যা প্রায়ৎ অগ্নিরাধেয়ো যয়া তথা কার্য্যেত্যর্থঃ। এবঞ্চ মহুনা দ্বিতীয়- বিবাহে যদ্দারমরণকালঃ উক্তঃ তস্ত অন্যতরাভাববিষয়কত্বং ন তু জায়ামরণমাত্রে এব জায়ান্তরকরণবিষয়কত্বম্। ততশ্চ মন্ত্রবচনেন জায়ামরণে জায়ান্তরকরণং যৎ প্রাপ্তং তৎ ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পত্তৌ নিষিধ্যতে "প্রাপ্তং হি প্রতিষিধ্যতে" ইতি ন্যায়াৎ তথাচ মনুবচনস্ত অবকাশবিশেষদানার্থমেব অন্যতরাভাবে ইত্যাদি প্রতীকং প্রবৃত্তম্। এতেন ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্নে দারে না্যাং কুব্বীতেতি প্রতীকমাত্রং ধৃত্বা উত্তরপ্রতীকং নিগৃহ্য যৎ ধৰ্ম্মপ্রজা- সম্পন্নযুক্তদারসত্ত্বে দারান্তরকরণনিষেধকতয়া কল্পনং তদতীব অযুক্তিকং দারেষু সংস্থ দারান্তরকরণং যদি তন্মতে কচিৎ প্রাপ্তং হ্যাৎ তদা তৎ প্রতিষিধ্যেত। প্রাগগ্ন্যাধেয়েতি বচনা- ঙ্কৈতদ্বিবাহন্ত সবর্ণাবিষয়কত্বে স্থিতে কামতঃ প্রবৃত্তিবিবাহ- বিষয়কত্বেন ন প্রাপ্তিসম্ভবঃ তন্মতে কামতো বিবাহ্য অসবর্ণা- মাত্রপরত্বাৎ। কিঞ্চ ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্ন ইত্যুক্ত্যা তদর্থবিবাহমাত্র- বিষয়কত্বাবগমেন রত্যর্থবিবাহবিষয়কত্বকল্পনমপ্যযুক্তিকং তৎপদ- বৈয়্যাপত্তেঃ উভয়ফলসিদ্ধৌ দারসত্ত্বে দারান্তরকরণং নিষিধ্য তদেকতরাভাবে ধৰ্ম্মাভাবে পুত্রাভাবে চ দারসত্ত্বে দারান্তরকরণং কথমেকমাত্র বিবাহবাদিমতে সঙ্গতং স্তাং। তন্মতে পুত্রাভাবে দারসত্ত্বে দারান্তরকরণস্ত "বিহিতত্বেহপি অগ্নিহোত্রাদিযাবৎ- কর্তব্যধৰ্ম্মাভাবেহপি পুভ্রণত্বে চ দারান্তরকরণস্ত নিষিদ্ধত্বাৎ। এতেন সতি চ অদারে ইতি ছেদেনৈব সর্ব্বসামঞ্জস্তে "দারাক্ষতলাজানাং বহুত্বঞ্চ" ইতি পুংস্বাধিকারীয়ং পাণিনীয়ং লিঙ্গানুশাসনমুল্লঙ্ঘ্য দারশব্দন্ত একবচনান্ততাস্বীকারঃ অগতিক- গতিতয়া হেয় এব" (২৭)শ

ইদানীং ক্রমশঃ বহুবিবাহবিষয়ে কালবিশেষ ও নিমিত্তবিশেষ উক্ত হইতেছে। সে বিষয়ে মন্টু, "পূর্ব্বমৃতা স্ত্রীর যথালিধি অস্ত্যেষ্টিক্রিয়া নির্ব্বাহ করিয়া, পুনরায় দারপরিগ্রহ ও পুনরায় অগ্ন্যাধান করিবেক", এইরূপে স্ত্রীবিয়োগরূপ এক কাল নির্দেশ করিয়াছেন। বিধানপারিজাতকৃত বৌধায়নসূত্রে এ বিষয়ের বিশেষ ব্যবস্থা আছে। যথা, "অগ্নিহোত্রাদি গৃহস্থকর্ত্তব্য সমস্ত ধৰ্ম্ম ও পুত্রলাত সম্পন্ন হইলে, যদি স্ত্রীবিয়োগ ঘটে, তাহা হইলে আর বিবাহ করিবেক না"। কিন্তু বানপ্রস্থ অথবা পরিব্রজ্যা আতাম আশ্রয় করিবেক। যেহেতু, "ঋণত্রয়ের পরিশোধ করিয়া, মৌক্ষে মনোনিবেশ করিবেক"; এইরূপে মনু, ঋণত্রয়ের পরিশোধ হইলে, মোক্ষবিষয়ে অধিকার বিধান করিয়াছেন। আর, "পুরুষ জন্মগ্রহণ করিয়া, তিন গুণে কী হয়, ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা ঋষিগণের নিকট, • যজ্ঞ দ্বারা দেবগণের নিকট, পুত্র দ্বারা পিতৃগণের নিকট", এই ত্রিবিধ ঋণ বেদাধ্যয়ন, অগ্নিহোত্রাদি যাগ, ও পুত্রোৎপত্তি দ্বারা পরিশোধিত হওয়াতে, গৃহস্থকর্তব্য সমস্ত সম্পন্ন হইতেছে; সুতরাং, আর বিবাহ করিবার আবম্ভকতা থাকিতেছে না যেহেতু, বিবাহের ফল ধর্ম পুত্র প্রভৃতি সম্পন্ন হইয়াছে। কিন্তু যদি বিষয়বাসনা নিবৃত্তি না হয়, তবে তাহার ফললাভের নিমিত্ত বিবাহ করিবেক, ইহা ভঙ্গিক্রমে উক্ত হইষ্মাছে। ধৰ্ম্ম ও প্রজা এই বিশেষণবশতঃ, রতিকামনামূলক বিবাহ সে সময়ে করিতে পারে, ইহা প্রতীয়মান হইতেছে, নতুবা ধৰ্ম্ম ও প্রজা এ কথা বলিতেন না। ঋণত্রয় শোধনের নিমিত্ত উপযোগিতা না থাকাতে, সে ফলের উদ্দেশে আর বিবাহ করিবেক না, ইহা সিদ্ধ হইতেছে। "অদ্ভুতরের অভাবে অর্থাৎ ধৰ্ম্ম ও পুত্রের মধ্যে একের অভাব ঘটিলে, অন্ত্য স্ত্রী বিবাহ করিয়া, তাহার সহিত অগ্ন্যাধান করিবেক"। অতএব মনু দ্বিতীয় বিবাহের স্ত্রীবিয়োগরূপ যে কাল নির্দেশ করিয়াছেন,, ধর্ম ও পুত্রের মধ্যে একের অভাবস্থলেই তাহা অভিপ্রেত; নতুবা স্ত্রীবিয়োগ হইলেই পুনরায় বিবাহ করিবেক, এরূপ 'তাৎপর্য্য নহে। মনুবচন দ্বারা, শ্রীবিয়োগ হইলে, পুনরায় বিবাহ করিবার যে অধিকার হইয়াছিল, "যাহার প্রাপ্তি থাকে তাহার নিষেধ হয়", এই ্যায় অনুসারে, ধৰ্ম্ম ও পুত্র সম্পন্ন হইলে, সেই অধিকারের নিষেধ হইতেছে। মনুবচনের অবকাশবিশেষদানের নিমিত্ত, বৌধায়নবচনের উত্তরার্দ্ধ আরব্ধ হইয়াছে। অতএব পূর্ব্বাদ্ধমাত্র ধরিয়া, উত্তরাদ্ধের গোপন করিয়া, "যে স্ত্রীর সহযোগে ধর্ম্মকাৰ্য্য ও পুত্রলাভ সম্পন্ন হয়, তৎসত্বে অন্য স্ত্রী বিবাহ করিবেক না", এইরূপে তাদৃশ্ স্ত্রী সন্ধে যে দারাস্তর পরিগ্রহ নিষেধ কল্পনা, তাহা অতীব যুক্তিবিরুদ্ধ; যদি তাঁহার মতে দারসত্ত্বে দারান্তর পরিগ্রহের প্রাপ্তিসম্ভাবনা থাকিত, তাহা হইলে তাক্বার নিষেধ হইতে পারিত। পূর্ববং অগ্ন্যাধান করিবেক এই কথা বলাতে, এ বচন সবর্ণা বিবাহবিষয়ক হইতেছে; সুতরাং উহা কামার্থ বিবাহবিষয়ক হইতে পারে না; কারণ, তাঁহার মতে কামার্থ বিবাহ কেবল অসবর্ণাবিষয়ক। কিঞ্চ, ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্নে এই কথা বলাতে, এই নিষেধ ধর্মার্থ ও পুভ্রার্থ বিবাহবিষয়ক বলিয়া বোধ হইতেছে; হৃতরাং কামার্থবিষয়ক বলিয়া কল্পনা করাও যুক্তিবিরুদ্ধ; কারণ, ঐ দুই পদের বৈয়্য ঘটে; উভয় ফলের দিচ্ছি হইলে, দারসত্ত্বে দারান্তর পরিগ্রহ নিষেধ করিয়া, উভয়ের মধ্যে একের অভাব ঘটিলে, ধর্ম্মের অভাবে অথবা গুদ্রের অভাবে, দারণত্বে দারান্তর পরিগ্রহ একবিবাহবাদীর মতে কি রূপে সঙ্গত হইতে পারে। তাঁহার মতে, পুত্রের অভাবে, দারসত্ত্বে দারাত্তর পরিগ্রহ বিহিত হইলেও, অগ্নিহোত্রাদি সমস্ত কর্তব্য, ধর্ম্মের অভাবেও, পুত্রসত্ত্বে দারান্তর পরিগ্রহ নিষিদ্ধ হইয়াছে। অতএব, "অদারে", এইশপ পদচ্ছেদ দ্বারাই সর্ব্বসামঞ্জস্ত হইতেছে; এমন স্থলে, "দারাক্ষতলাজানাং বহত্বক", পুংলিঙ্গাধিকারে পাণিনিকৃত এই লিঙ্গানুশাসন লঙ্ঘন করিয়া, দার- শব্দের একবচনাস্ততা স্বীকার একবারেই হেয়; কারণ, গত্যন্তর না থাকিলেই, তাহা স্বীকার করিতে হয়।

তর্কবাচস্পতি মহাশয়, কষ্টকল্পনা দ্বারা, আপস্তম্বসূত্রের ( অভিনব অর্থান্তর প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত প্রয়াস পাইয়াছেন, তাহা সঙ্গত কি না, এবং, সেই অর্থ অবলম্বন করিয়া, যে সকল ব্যবস্থা প্রদান করিয়াছেন, তাহাও শাস্ত্রানুমত ও ন্যায়ানুগত কি না, তাহার আলোচনা করা আবশ্যক। প্রথমতঃ সূত্রের প্রকৃত অর্থ প্রদর্শিত হইতেছে।

ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্নে দারে নাহ্যাং কুব্বীত। ২। ৫। ১১। ১২। • অন্যতরাভাবে কার্য্যা প্রাগগ্ন্যাধেয়াৎ। ২। ৫। ১১। ১৩। (২৮)

"ধর্ম্মপ্রজায়ম্পন্নে দারে", ধর্মযুক্ত ও প্রজাযুক্ত দারসত্ত্বে, অর্থাৎ যাহার সহযোগে ধৰ্ম্মকাৰ্য্য নির্ব্বাহ ও পুত্রলাভ হইয়াছে, তাদৃশ স্ত্রী বিদ্যমান থাকিতে, "ন অ্যাং কুব্বীত" অন্য স্ত্রী করিবেক না, অর্থাৎ আর বিবাহ করিবেক না: "অন্যতরাভেেত্র"," অন্ততরের অভাবে, স্পর্থাৎ উভয়ের মধ্যে একের অসম্ভাব ঘাটলে, অর্থাৎ ধর্ম্মকার্য্যনির্ব্বাহ অথবা পুত্রলাভ না হইলে, "কাৰ্য্যা প্রাক্ অগ্ন্যাধেয়াৎ" অগ্ন্যাধানের পূর্ব্বে করিবেক, অর্থাৎ অগ্ন্যাধানের পূর্ব্বে অধ্য স্ত্রী বিবাহ করিবেক। অর্থাৎ যে স্ত্রীর সহযোগে ধর্ম্মকার্য্য ও পুত্রলাভ সম্পন্ন হয়, তৎসত্ত্বে অন্ত স্ত্রী বিবাহ করিবেক না। ধর্ম্মকার্য্য অথবা পুত্রলাভ সম্পন্ন না হইলে, অগ্ন্যাধানের পূর্ব্বে, পুনর্ব্বার বিবাহ করিবেক।

এই অর্থ আমার কপোলকল্পিত, অথবা লোক বিমোহনার্থে • বুদ্ধিন্বলে উদ্ভাবিত, অভিনব অর্থ নহে। যে সকল শব্দে এই দুই সূত্র সঙ্কলিত হইয়াছে, কষ্টকল্পনা ব্যতিরেকে, তদ্দ্বারা অন্য অর্থের প্রতীতি হইতে পারে না। এজন্য, যে যে পূর্বতন গ্রন্থকর্তারা, স্ব স্ব গ্রন্থে, ঐ দুই সূত্র উদ্ধৃত করিয়াছেন, তাঁহারা সকলেই ঐ অর্থ অবলম্বন করিয়া গিয়াছেন। যথা, "এতন্নিমিত্তাভাবে নাধিবেত্তব্যেত্যাহ আপস্তম্বঃ ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্নে দারে নান্যাং কুব্বীত। অন্যতরাভাবে কার্য্যা প্রাগগ্ন্যাধেয়াদিতি।

অন্তার্থঃ যদি প্রথমোড়া স্ত্রী ধর্ম্মেণ শ্রৌতস্মার্ভাগ্নিসাধ্যেন প্রজয়া' পুত্রপৌত্রাদিনা, চ সম্পন্না তদা নাড়াং বিবহেৎ অন্ততরাভাবে অগ্ন্যাধানাং প্রাক্ বোঢ়ব্যেতি (২৯)"।

আপস্তম্ব কহিয়াছেন, এই সকল নিমিত্ত না ঘটিলে, অধিবেদন করিতে পারিবেক না। যথা,

ধর্মপ্রজাসম্পন্নে দারে না্যাং কুব্বীত।

অন্যতরাভাবে কার্য্যা প্রাগগ্ন্যাধেয়াৎ।

ইহার অর্থ এই, যদি প্রথম বিবাহিতা, স্ত্রী শ্রুতিবিহিত ও স্মৃতিবিহিত অগ্নিসাধ্য ধর্ম্মকার্য্য নির্ব্বাহের উপযোগিনী ও পুত্রপৌভ্রাদিসন্তানশালিনী হয়, তাহা হইলে অন্ত স্ত্রী বিবাহ করিবেক না। অন্ত্যতয়ের অভাবে, অর্থাৎ ধৰ্ম্মকার্য্য অথবা পুত্রলাভ সম্পন্ন না হইলে, অগ্ন্যাধানের পূর্ব্বে বিবাহ করিবেক। "তদ্বিষয়মাহ আপস্তম্বঃ

ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্নে দারে না্যাং কুব্বীত।

অন্যতরাভাবে কার্য্যা প্রাগগ্ল্যাধেয়াদিতি।

অ্যার্থঃ যদি প্রাগূঢ়া স্ত্রী ধর্ম্মেণ প্রজয়া চ সম্পন্না তদা নান্ড্যাং বিবহেৎ অন্যতরাভাবে অগ্নমধানাৎ প্রাক্ বোঢ়ব্যেতি (৩০)"। এ বিষয়ে আপস্তম্ব কহিয়াছেন,

ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্নে দারে নাখ্যাং কুব্বীত। অন্যতরাভাবে কার্য্যা প্রাগগ্ন্যাধেয়াৎ। ইহার অর্থ এই, যদি প্রথম বিবাহিতা স্ত্রী ধৰ্ম্মসম্পন্না ও পুত্র- সম্পন্না হয়, তাহা হইলে অন্য স্ত্রী বিবাহ করিবেক না। অন্ত্য- তরের অভাবে, অর্থাৎ ধৰ্ম্মকাৰ্য্য অথবা পুত্রলাভ সম্পন্ন না হইলে, অগ্ন্যাধানেন পূর্ব্বে বিবাহ করিবেক।

কুহুকভট্ট,

বন্ধ্যাস্টমেহধিবেছ্যাব্দে দশমে তু মৃতপ্রজা।' একাদশে স্ত্রীজননী সম্ভ্যত্ত্বপ্রিয়বাদিনী ॥ ৯। ৮১।

স্ত্রী বন্ধ্য। হইলে অষ্টম বর্ষে, মৃতপুত্রা হইলে দশম বর্ষে, ক্যামাত্রপ্রসবিনী হইলে একাদশ বর্ণে, অপ্রিয়বাদিনী হইলে কালাতিপাত ব্যতিরেকে, অধিবেদন করিবেক।

এই মনুবচনের ব্যাখ্যাস্থলে, আপস্তম্বসূত্র উদ্ধৃত করিয়াছেন। যদিও তিনি মিত্রমিশ্র ও অন্তভট্টের ন্যায়, সূত্রের ব্যাখ্যা করেন নাই; কিন্তু যেরূপে উদ্ধৃত করিয়াছেন, তদ্দ্বারা ততুল্য অর্থ প্রতিপন্ন হইতেছে। যথা,

"অপ্রিয়বাদিনী তু সঞ্চ এব য্যপুভ্রা ভবতি পুভ্রবত্যাক্ত ত্যাং ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্নে দারে না্যাং কুব্বীত

অন্যতরাপায়ে তু.কুব্বীত। ইত্যাপস্তম্বনিষেধাৎ অধিবেদনং ন কার্য্যম্”।

• অপ্রিয়বাদিনী হইলে, কালাতিপাত ব্যতিরেকেই, যদি সে পুত্রহীনা হয়; সে পুত্রবর্তী হইলে, অধিবেদন করিবেক না, কারণ আপস্তম্ব,

অন্যতরাপায়ে তু কুব্বীত।

ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্নে দারে না্যাং কুব্বীত ধৰ্ম্মসম্পন্না ও পুত্রসম্পন্না স্ত্রী সত্ত্বে অন্ত্য স্ত্রী বিবাহ করিবেক না, কিন্তু ধৰ্ম্ম অথবা পুত্রের ব্যাঘাত ঘটিলে করিবেক; এই রূপ নিষেধ করিয়া গিয়াছেন।

দেখ, মিত্রমিশ্র, অনন্তভট্ট, ও কুল্লুকভট্ট, ধৰ্ম্মসম্পন্না ও পুত্রসম্পন্না স্ত্রী বিদ্যমান থাকিলে, আর বিবাহ করিতে পারিবেক না, আপস্তম্বসূত্রের' এই অর্থ অবলম্বন করিয়া গিয়াছেন। তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের ন্যায়, “অদারে” এই পাঠ, এবং "স্ত্রীবিয়োগ ঘটিলে” এই অর্থ, অবলম্বন করেন নাই। এই দুই আপস্তম্বসূত্রের তাৎপর্য্য এই, গৃহস্থ ব্যক্তি, শাস্ত্রের বিধি অনুসারে, এক স্ত্রীর পাণিগ্রহণ করিয়াছে'; যদি ঐ স্ত্রী দ্বারা ধৰ্ম্মকার্য্যনির্বাহ ও পুত্রলাভ হয়, তাহা হইলে সে ব্যক্তি, 'ঐ স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায়, বিবাহ করিতে পারিবেক না। কিন্তু, যদি ঐ স্ত্রীর এরূপ কোনও দোষ। ঘটে, যে তাহার সহিত ধৰ্ম্মকার্য্য করা বিধেয় নহে; কিংবা, ঐ স্ত্রী বন্ধ্যা, মৃতপুভ্রা, বা ক্যামাত্রপ্রসবিনী হয়, অর্থাৎ তাহা দ্বারা বংশরক্ষা ও পিণ্ডসংস্থানের উপায় না হয়; তাহা হইলে, তাহার জীবদ্দশায়, পুনরায় দারপরিগ্রহ আবশ্যক। মনু ও যাজ্ঞবন্ধ্য, বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিমিত্ত নির্দেশ করিয়া, পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় বিবাহ করিবার যেরূপ বিধি দিয়াছেন, আপস্তম্বও, ধৰ্ম্মকার্য্য ও পুত্রলাভের ব্যাঘাতরূপ নিমিত্ত নির্দেশ করিয়া, তদনুরূপ বিধি প্রদান করিয়াছেন; অধিকন্তু, ধর্ম্মকার্য্যের উপযোগিনী ও পুণ্ড্রবর্তী স্ত্রী বিদ্যমান থাকিলে, পুনরায় দারু পরিগ্রহ করিতে পারিবেক না, এরূপ স্পষ্ট নিষেধ করিয়া গিয়াছেন। সুতরাং, আপস্তম্বের ঐ নিষেধ দ্বারা, তাদৃশ স্ত্রীর জীবদ্দশায়, যদৃচ্ছা ক্রমে বিবাহ করিবার অধিকার থাকিতেছে না। ধৰ্ম্মসংস্থাপনপ্রবৃত্ত তর্কবাচস্পতি মহাশয় দেখিলেন, আপ- স্তম্বসূত্রের যে সহজ অর্থ চিরপ্রচলিত আছে, তদ্দ্বারা তাঁহার অভিমত যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহরূপ পরম ধর্ম্মের ব‍্যাঘাত ঘটে; এজন্য, কোনও রূপে অর্থান্তর কল্পনা করিয়া, ধর্ম্মরক্ষা ও দেশের অমঙ্গল নিবারণ করা আবশ্যক। এই প্রতিজ্ঞায় আরূঢ় হইয়া, ধর্ম্মভীরু, দেশহিতৈষী তর্কবাচস্পতি মহাশয়, অদ্ভুত বুদ্ধিশক্তির প্রভাবে, আপস্তম্বসূত্রের অদ্ভুত পাঠান্তর ও অদ্ভুত অর্থান্তর কল্পনা করিয়াছেন। তিনি

ধৰ্ম্ম প্রজাসম্পন্নে, দাঁরে নাহ্যাং কুব্বীত। এই সূত্রের অন্তর্গত "দারে" এই পদের পূর্ব্বে, লুপ্ত অকারের কল্পনা করিয়াছেন; তদনুসারে,

ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্নে হদারে নাহ্যাং কুব্বীত।

এইরূপ পাঠ হয়। এই পাঠের অনুযায়ী অর্থ এই, "ধর্ম্মকার্য্য- নির্ব্বাহ ও পুত্রলাভ হইলে, যদি অদার অর্থাৎ স্ত্রীবিয়োগ ঘটে, তবে 'অ্য স্ত্রী বিবাহ করিবেক না"। এইরূপ পাঠান্তর ও এইরূপ অর্থান্তর কল্পনা করিয়া, তর্কবাচস্পতি মহাশয় যে ইষ্ট- লাভের চেষ্টা করিয়াছেন, তাহা তদ্দ্বারা সিদ্ধ বা প্রতিষিদ্ধ হইতেছে, তাহা অনুধাবন করিয়া দেখেন নাই। আপস্তম্বসূত্রের চিরপ্রচলিত পাঠ ও অর্থ অনুসারে, প্রথমবিবাহিতা স্ত্রীর দ্বারা 'ধর্ম্মকীর্য্যনির্বাহ ও পুত্রলাভ হইলে, তাহার জীবদ্দশায়, পুনরায় ক্লিবাহ করিবার অধিকার নাই। তর্কবাচস্পতি মহাশয় যে পাঠান্তর ও অর্থান্তর কল্পনা করিয়াছেন, তদনুসারে, ধৰ্ম্মকার্য্য- নির্বাহ ও পুত্রলাভ হইলে যদি স্ত্রীবিয়োগ ঘটে, তাহা হইলেও আর বিবাহ করিবার অধিকার থাকে না। এক্ষণে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, চিরপ্রচলিত পাঠ ও অর্থ দ্বারা ধেনিষেধ প্রতিপন্ন হইয়া থাকে, আর তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের কল্পিত পাঠ ও অর্থ দ্বারা, যে নূতন নিষেধ প্রতিপন্ন হইতেছে, এ উভয়ের মধ্যে কোন নিষেধ বলবত্তর হইতেছে। পূর্বব নিষেধ দ্বারা, পুত্রবর্তী ও ধৰ্ম্মকার্য্যোপযোগিনী স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় বিবাহ করিবার অধিকার রহিত হইতেছে; তাঁহার উদ্ভাবিত নূতন নিষেধ দ্বারা, পুণ্ড্রবর্তী ও ধর্ম্মকার্য্যোপযোগিনী স্ত্রীর মৃত্যু হইলেও, পুনরায় বিবাহ করিবার অধিকার রহিত হইতেছে। যে অবস্থায়, স্ত্রীর মৃত্যু হইলেও, পুনরায় বিবাহ করিবার অধিকার থাকিতেছে না, সে অবস্থায়, স্ত্রী বিদ্যমান থাকিলে, যদৃচ্ছে। ক্রমে, যত ইচ্ছা বিবাহ করিবার অধিকার থাকা কত দূর শাস্ত্রানুমত বা ন্যায়ানুগত হওয়া সম্ভব, তাহা সকলে অনায়াসে বিবেচনা করিতে পারেন। অতএব, আগস্তম্বের গ্রীবাভঙ্গ করিয়া, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের কি ইষ্টাপত্তি হইতেছে, বুঝিতে পারা যায় না। তিনি এই আশঙ্কা করিয়াছিলেন, পুণ্ড্রবর্তী ও ধৰ্ম্মকার্য্যোপযোগিনী স্ত্রীর জীবদ্দশায় পুনরায় বিবাহ করিবার সাক্ষাৎ নিষেধ বিঘ্নমান থাকিলে, তাদৃশ স্ত্রী সত্ত্বে, যদৃচ্ছা ক্রমে, যত ইচ্ছা বিবাহ করিবার পথ থাকে না। সেই পথ প্রবল ও পরিষ্কৃত করিবার আশয়ে, আপস্তম্বসূত্রের অদ্ভুত অর্থ উদ্ভাবিত করিয়াছেন। কিন্তু, উদ্ভাবিত অর্থ দ্বারা, ঐ পথ, পরিষ্কৃত না হইয়া, বরং অধিকতর রুদ্ধ হইয়া উঠিতেছে; তাহা অনুধাবন করিতে পারেন নাই।

অবলম্বিত অর্থের সমর্থন করিবার নিমিত্ত, তর্কবাচস্পতি মহাশয় যে যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহা এই,

"পুরুষ জন্ম গ্রহণ করিয়া তিন ঋণে ঋণী হয়, ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা ঋষিগণের নিকট, যজ্ঞ দ্বারা দেবগণের নিকট, পুত্র দ্বারা পিতৃ- গণের নিকট।" এই ত্রিবিধ ঋণ বেদাধ্যয়ন, অগ্নিহোত্রাদি যাগ ও পুত্রোৎপত্তি দ্বারা পরিশোধিত হওয়াতে, গৃহস্থকর্তব্য সমস্ত সম্পন্ন হইতেছে, সুতরাং আর বিবাহ করিবার আবশ্যকতা থাকিতেছে না।" এই যুক্তি, পুত্রলাভ ও ধর্ম্মকার্য্যনির্বাহ হইলে, স্ত্রীবিয়োগস্থলে যেরূপ খাটে; স্ত্রীবিদ্যমানস্থলেও অবিকল সেইরূপ খাটিবেক, 'তাহার কোনও সংশয় নাই। উভয়ত্র ঋণপরিশোধন রূপ হেতু তুণ্যরূপে বর্ত্তিতেছে; সুতরাং, আর বিবাহ করিবার আবশ্যকতা না থাকাও উভয় স্থলেই, তুল্যরূপে বর্তিতেছে। অতএব, এই যুক্তি দ্বারা, ধৰ্ম্মসম্পন্না ও পুত্রসম্পন্ন। স্ত্রী বিদ্যমান থাকিলে, আর বিবাহ করিতে পারিবেক না, এই চিরপ্রচলিত অর্থের বিলক্ষণ সমর্থনই হইতেছে।

এইরূপ অদ্ভুত পাঠান্তর ও অর্থান্তর কল্পনা করিয়া, তর্ক- বাচস্পতি মুহাশয়, যে অদ্ভুত ব্যবস্থা প্রচার করিয়াছেন, তাহা উল্লিখিত ও আলোচিত হইতেছে।

"বিধানপারিজাতন্বত বৌধায়নসূত্রে এ বিষয়ের বিশেষ ব্যবস্থা আছে। যথা, "অগ্নিহোত্রাদি গৃহস্থকর্তব্য সমস্ত ধৰ্ম্ম ও পুত্রলাভ সম্পন্ন হইলে, যদি স্ত্রীবিয়োগ ঘটে, তাহা হইলে আর বিবাহ করিবেক না”। কিন্তু বানপ্রস্থ অথবা পরিব্রজ্যা আশ্রম আশ্রয় করিবেক; যেহেতু, “ঋণত্রয়ের পরিশোধ করিয়া মোক্ষে মনে।- নিবেশ করিবেক", এইরূপে মনু, ঋণত্রয়ের পরিশোধ হইলে, মোক্ষ বিষয়ে অধিকার বিধান করিয়াছেন"।

ধৰ্ম্ম ও পুত্রলাভ সম্পন্ন হইলে, যদি স্ত্রীবিয়োগ ঘটে, তাহা হইলে আর বিবাহ না করিয়া, বানপ্রস্থ অথবা পরিব্রজ্যা অবলম্বন করিবেক, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের এই ব্যবস্থা কোনও অংশে শাস্ত্রানুসারিণী নহে। আশ্রম বিষয়ে দ্বিবিধ ব্যবস্থা স্থিরীকৃত আছে (৩১)। প্রথম ব্যবস্থা অনুসারে, যথাক্রমে চারি আশ্রমের অনুষ্ঠান আবশ্যক; অর্থাৎ, জীবনের প্রথম ভাগে ব্রহ্মচর্য্য, দ্বিতীয় ভাগে গার্হস্থ্য, তৃতীয় ভাগে বানপ্রস্থ, চতুর্থ 'ভাগে পরিব্রজ্যা, অবলম্বন করিবেক। দ্বিতীয় ব্যবস্থা অনুসারে, যাহার বৈরাগ্য জন্মিবেক, সে ব্রহ্মচর্য্য সমাপনের পর, যে অবস্থায় থাকুক, পরিব্রজ্যা অবলম্বন করিবেক। এক ব্যক্তি গৃহস্থাশ্রয়ে প্রবেশ ও দারপুরিগ্রহ করিয়াছে, পুত্রোৎপাদনের পূর্বেই তাহার বৈরাগ্য জন্মিল; তখন তাহাকে, 'পুত্রোৎপাদনের অনু- রোধে, আর সংসারাশ্রমে থাকিতে হইবেক না; যে দিন বৈরাগ্য জন্মিবেক, সেই দিনেই, সে ব্যক্তি পরিব্রজ্যা আশ্রয় করিবেক। বৈরাগ্যপক্ষে, ঋণপরিশোধের অনুরোধে, তাহাকে এক দিনও গৃহস্থাশ্রমে থাকিতে হইবেক না; আর, বৈরাগ্য, না জন্মিলে, যে আশ্রমের যে কাল নিয়মিত আছে, তাবৎ কাল সেই সেই আশ্রম অবলম্বন করিয়া থাকিতে হইবেক। সুতরাং, অবিরক্ত ব্যক্তিকে জীবনের দ্বিতীয় ভাগ, অর্থাৎ পঞ্চাশ বৎসর বয়স পর্য্যন্ত, গৃহস্থাশ্রমে থাকিতে হইবেক; নতুবা, কিছু কাল ধৰ্ম্মকার্য্য করিলে ও পুত্রলাভ হইলে পর, স্ত্রীবিয়োগ ঘটিলেই তাহাকে গৃহস্থাশ্রম পরিত্যাগ করিতে হইবেক, শাস্ত্রের এরূপ অর্থ ও তাৎপর্য্য নহে। ফলকথা এই, পরিব্রজ্যা অবলম্বনের দুই নিয়ম; প্রথম নিয়ম অনুসারে, যথাক্রমে ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ এই তিন আশ্রম নির্বাহ করিয়া, জীবনের চতুর্থ ভাগে উহার অবলম্বন; আর, দ্বিতীয় নিয়ম অনুসারে, যে আশ্রমে যে অবস্থায় থাকুক, বৈরাগ্য জন্মিলে তদ্দণ্ডে উহার অবলম্বন। বৈরাগ্য না জন্মিলে, পঞ্চাশ বৎসরের পূর্ব্বে, গৃহস্থাশ্রম পরি- ত্যাগের বিধি ও ব্যবস্থা নাই; সুতরাং, পুত্রলাভ ও ধর্ম্মকার্য্য নির্বাহ হইলেও, স্ত্রীবিয়োগ ঘটিলে, গৃহস্থাশ্রমে থাকিতে ও পুনরায় দারপরিগ্রহ করিতে হইবেক; কেবল স্ত্রীবিয়োগ ঘটিয়াছে বলিয়া, সে অবস্থায়, বিনা বৈরাগ্যে, গৃহস্থাশ্রম পরি- ত্যাগ করিলে, অথবা গৃহস্থাশ্রমে থাকিয়া দারপরিগ্রহে বিমুখ হইলে, প্রত্যবায়গ্রস্ত হইতে হইবেক। তন্মধ্যে বিশেষ এই, আটচল্লিশ বৎসর বয়স হইলে, যদি স্ত্রীবিয়োগ ঘটে, সে স্থলে আর দারপরিগ্রহ করিবার স্মাবশ্যকতা নাই। যথা,

চত্বারিংশদ্বৎসরাণাং সাষ্টানাঞ্চ পরে যদি।

স্ত্রিয়া বিযুজ্যতে কশ্চিৎ স তু রপ্তাশ্রমী মতঃ (৩২)। আর্টচল্লিশ বৎসরের, পর, যদি কোনও ব্যক্তির স্ত্রীবিয়োগ ঘটে, তাহাকে রপ্তাশ্রমী বলে।

রণ্ডাশ্রমী অর্থাৎ স্ত্রীবিরহিত আশ্রমী (৩৩)। গৃহস্থাশ্রমের স্বল্প মাত্র কাল অবশিষ্ট থাকে; সেই স্বল্প কালের জন্য, আর তাহার দারপরিগ্রহের আবশ্যকতা নাই; অর্থাৎ সে অবস্থায় দারপরিগ্রহ না করিলে, তাহাকে আশ্রমভ্রংশ নিবন্ধন প্রত্যবায়গ্রস্ত হইতে হইবেক না। আর,

ঋণানি ত্রীণ্যপাকৃত্য মনো মোক্ষে নিবেশয়েৎ।

ঋণত্রয়ের পরিশোধ করিয়া, মোল্ডে মনোনিবেশ করিবেক। এই বচন দ্বারা মশু, গৃহাশ্রমে অবস্থানকালে; পুত্রলাভের পর স্ত্রীবিয়োগ ঘটিলে, মোক্ষ পথ অবলম্বন করিবার বিধি দিয়াছেন, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের এই নির্দেশ মনুসংহিতায় সবিশেষ দৃষ্টি না থাকার পরিচায়ক মাত্র; কারণ, মশু, নিঃসংশয়িত রূপে, যথাক্রমে আশ্রমচতুষ্টয়ের বিধি প্রদান করিয়াছেন। যথা, চতুর্থমায়ুষো ভাগমুষিত্বা্যং গুরো দ্বিজঃ। দ্বিতীয়মায়ুষো ভাগং কৃতদারো গৃহে বসেৎ ॥ ৪।১। দ্বিজ, জীবনের প্রথম চতুর্থ ভাগ গুরুকুলে বাস করিয়া, দারপরিগ্রহ পূর্বক, জীবনের, দ্বিতীয় চতুর্থ ভাগ গৃহস্থাশ্রমে অবস্থিতি করিবেক।

এবং গৃহাশ্রমে স্থিত্বা বিধিবৎ স্নাতকো দ্বিজঃ।

বনে বসেতু নিয়তো যথাবদ্বিজিতেন্দ্রিয়ঃ ॥ ৬। ১। স্নাতক দ্বিজ, এই রূপে বিধি পূর্ব্বক গৃহস্থাশ্রমে অধস্থিতি করিয়া, সংযত ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া, যথাবিধানে বনে বাস করিবেক।

বনেষু তু বিহৃত্যৈবং তৃতীয়ং ভাগমায়ুষঃ। চতুর্থমায়ুষো ভাগং ত্যক্তা সঙ্গান্ পরিব্রজেৎ ॥ ৬। ৩৩। এই রূপে জীবনের তৃতীয় ভাগ বনে অতিবাহিত করিয়া, সর্ব্ব সঙ্গ পরিত্যাগ পূর্ব্বক, জীবনের চতুর্থ ভাগে পরিব্রজ্যা আশ্রম অবলম্বন করিবেক।

যিনি, এইরূপ সময়বিভাগ করিয়া, যথাক্রমে আশ্রমচতুষ্টয় অবলম্বনের ঈদৃশ স্পষ্ট বিধি প্রদান করিয়াছেন; তিনি গৃহস্থা- শ্রম সম্পাদন কালে, পুত্রলাভের পর স্ত্রীবিয়োগ ঘটিলে, আর দারপরিগ্রহ না করিয়া, এককালে চতুর্থ আশ্রম অবলম্বনের বিধি দিবেন, ইহা কোনও মতে সঙ্গত বা সম্ভব হইতে পারে না।

উল্লিখিত প্রকারে দারপরিগ্রহের নিষেধ ও মোক্ষপথ অব-

লম্বনের ব্যবস্থা স্থির করিয়া, তর্কবাচস্পতি মহাশয় কহিতেছেন, "কিন্তু যদি বিষয়বাসনা নিবৃত্তি না হয়, তবে তাহার ফললাভের নিমিত্ত বিবাহ করিবেক, ইহা ভঙ্গিক্রমে উক্ত হইয়াছে।"

এ স্থলে তিনি স্পষ্ট বাক্যে স্বীকার করিতেছেন, পুত্রলাভ ও ধর্ম্মকার্য্যনির্বাহের পর স্ত্রীবিয়োগ ঘটিলে, যদি ঐ সময়ে বৈরাগ্য না জন্মিয়া থাকে, তাহা হইলে, মোক্ষপথ অবলম্বন না করিয়া, পুনরায় বিবাহ করিবেক। এক্ষণে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, কষ্টকল্পনা দ্বারা আপস্তম্বসূত্রের পাঠান্তর ও অর্থান্তর কল্পনা করিয়া, তর্কবাচস্পতি মহাশয় কি অধিক লাভ করিলেন। চিরপ্রচলিত ব্যবস্থা অনুসারে, গৃহস্থাশ্রমসম্পাদন কালে স্ত্রী- বিয়োগ ঘটিলে, বৈরাগ্য স্থলে মোক্ষপথ অবলম্বন, বৈরাগ্যের অদাবস্থলে পুনরায় দারপরিগ্রহ, বিহিত আছে; তিনি, অদ্ভুত বুদ্ধিশক্তির প্রভাবে, যে অদ্ভুত ব্যবস্থার উদ্ভাবন করিয়াছেন, তদ্দ্বারাও তাহাই বিহিত হইতেছে।

• তিনি তৎপরে কহিতেছেন,

"ধৰ্ম্ম ও পুত্র এই বিশেষণ বশতঃ রতিকামনামূলক বিবাহ সে সময়ে করিতে পারে, ইহা প্রতীয়মান হইতেছে।"

তদীয় এই ব্যবস্থা যার পর নাই কৌতুককর। পুত্রলাভ ও ধৰ্ম্ম- কার্য্যনির্বাহ হইলে, যদি স্ত্রীবিরোগ ঘটে, তবে "বানপ্রস্থ অথবা পরিব্রজ্যা আশ্রম আশ্রয় করিবেক", এই ব্যবস্থা করিয়া, “রতি- কামনামূলক বিবাহ সে সময়ে করিতে পারে", এই ব্যবস্থাস্তর প্রদান করিতেছেন। তদনুসারে, আপস্তম্বসূত্র দ্বারা ইহাই প্রতিপন্ন হইতে পারে, পুত্রলাভ ও ধর্ম্মকার্য্য নির্বাহের পর স্ত্রীবিয়োগ ঘটিলে, ধৰ্ম্মার্থে ও পুত্রার্থে বিবাহ না করিয়া, বানপ্রস্থ অথবা পরিব্রজ্যা আশ্রম অবলম্বন করিবেক, কিন্তু রতিকামনামূলক বিবাহ সে সময়ে করিতে পারিবেক। সুতরাং, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের উদ্ভাবিত অদ্ভুত ব্যাখ্যা ও অদ্ভুত ব্যবস্থা অনুসারে, অতঃপর রতিকামনামূলক বিবাহ করিয়া, সেই স্ত্রীর সমভিব্যাহারে, মোক্ষপথ অবলম্বন করিতে ইরেক! সেৱাদাসী সঙ্গে লইয়া, মোক্ষপথ অবলম্বন করা নিতান্ত মন্দ বোধ হয় না; তাহাতে ঐহিক ও পারত্রিক উভয় রক্ষা হইবেক।

"অতএব মনু দ্বিতীয় বিবাহের স্ত্রীবিয়োগরূপ যে কাল নির্দেশ করিয়াছেন, ধৰ্ম্ম ও পুত্রের মধ্যে একের অভাব স্থলেই তাহা... অভিপ্রেত, নতুবা স্ত্রীবিয়োগ হইলেই পুনরায় বিবাহ করিবেক, এরূপ, তাৎপর্য্য নহে"।

তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের এই তাৎপর্য্যব্যাখ্যা শাস্ত্রানুসারিণী নহে! বৈরাগ্য না জন্মিলে, আটচল্লিশ বৎসর বয়সের পূর্ব্বে, স্ত্রীবিয়োগ হইলে, পুনরায় বিবাহ করিতে হইবেক, এৰ্ম্ম ও পুত্র উভয়ের সম্ভাবও তাহার প্রতিবন্ধক হইতে পারিবেক না। "যদি বিয়ে- বাসনা নিবৃত্তি না হয়, তবে তাহার ফললাভের নিমিত্ত বিবাহ করিবেক,” এই ব্যবস্থা করিয়া তর্কবাচস্পতি মহাশয় স্বয়ং তাহা স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। আর, যদি বৈরাগ্য জন্মে, ধৰ্ম্ম ও পুত্রের মধ্যে একের অসম্ভাবের কথা দূরে থাকুক, উভয়ের অসম্ভাব স্থলেও, আর বিবাহ না করিয়া, মোক্ষপথ অবলম্বন করিবেক। স্ত্রীবিয়োগের ত কথাই নাই, স্ত্রী বিদ্যমান থাকিলেও, সে অবস্থায় মোক্ষপথ অবলম্বন করিবেক।

"অতএব, পূর্ব্বার্দ্ধ মাত্র ধরিয়া উত্তয়ার্দ্ধের গোপন করিয়া, "যে স্ত্রীর সহযোগে ধর্ম্পকার্য্য ও পুত্রলাভ সম্পন্ন হয়, তৎসত্ত্বে অন্ত স্ত্রী বিবাহ করিবেক না," এইরূপে তাদৃশ স্ত্রীসত্ত্বে যে দারান্তর পরিগ্রহ নিষেধ কল্পনা তাহা অতীব যুক্তিবিরুদ্ধ; যদি তাঁহার মতে দারসত্ত্বে দারান্তর পরিগ্রহের প্রাপ্তি সম্ভাবনা থাকিত, তাহা হইলে তাহার নিষেধ হইতে পারিত"।

এ স্থলে বক্তব্য এই যে, আমি আপস্তম্বসূত্রের পূর্বার্দ্ধ মাত্র- ধরিয়া, উত্তরার্দ্ধের গোপন করিয়া, কপোলকল্পিত অর্থের প্রচার দ্বারা লোককে প্রতারিত করি নাই। আপস্তম্বীয় ধৰ্ম্মসূত্রে দৃষ্টি নাই; এজন্ম, তর্কবাচস্পতি মহাশয়, দুই সূত্রকে এক সূত্র জ্ঞান করিয়া, পূর্ববার্দ্ধ ও উত্তরার্দ্ধ-শ্রব্দ ব্যবহার করিয়াছেন।

ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্নে দারে না্যাং কুব্বীত। ২। ৫। ১১। ১২।

ইহা দ্বিতীয় প্রশ্নের, পঞ্চম পটলের, একাদশ খণ্ডের দ্বাদশ সূত্র। আর,

অন্যতরাভাবে কার্য্যা প্রাগগ্ন্যাধেয়াৎ। ২। ৫। ১১। ১৩।

ইহা দ্বিতীয় প্রশ্নের, পঞ্চম পটলের, একাদশ খণ্ডের ত্রয়োদশ সূত্র। 'দ্বাদশ সূত্রের অর্থ এই,

যে স্ত্রীর সহযোগে ধর্ম্মকার্য্য ও পুত্রলাভ সম্পন্ন হয়, তৎসত্ত্বে অন্ত স্ত্রী বিবাহ করিবেক না।

ত্রয়োদশ সূত্রের অর্থ এই,,

ধৰ্ম্মকাৰ্য্য অথবা পুত্রলাভ সম্পন্ন না হইলে, অগ্ন্যাধানের পূর্ব্বে পুনরায় বিবাহ করিবেক।

দ্বাদশ সূত্র অনুসারে, ধৰ্ম্মকাৰ্য্য ও পুত্রলাভ সম্পন্ন হইলে, স্ত্রীসত্ত্বে দারান্তরপরিগ্রহ নিষিদ্ধ হইয়াছে; ত্রয়োদশ সূত্র অনুসারে, ধৰ্ম্মকার্য্যনির্বাহ ও পুত্রলাভ এ উভয়ের, অথবা উভয়ের মধ্যে একতরের, অভাব ঘটিলে, স্ত্রীসত্ত্বে দারান্তর- পরিগ্রহ বিহিত হইয়াছে। এই দুই সূত্র পরস্পর বিরুদ্ধ অর্থের প্রতিপাদক নহে; বরং পর সূত্র পূর্ব সূত্রের প্লোষক হইতেছে। ..এমন স্থলে, উত্তরার্দ্ধের, অর্থাৎ পর সূত্রের, গোপন করিবার কোনও অভিসন্ধি বা আবশ্যকতা লক্ষিত হইতে পারে না। পুত্রলাভ ও ধৰ্ম্মকার্য্য সম্পন্ন হইলে, স্ত্রীসত্ত্বে পুনরায় বিবাহ করিবার অধিকার নাই, এতন্মাত্রের নির্দেশ করা আবশ্যক হইয়াছিল; এজন্য, দ্বিতীয় ক্রোড়পত্রে পূর্ব্ব সূত্র মাত্র উদ্ধৃত হইয়াছিল; নিষ্প্রয়োজন বলিয়া, পর সূত্র উদ্ধৃত হয়. নাই। নতুবা, ভয়প্রযোজিত অথবা দুরভিসন্ধিপ্রণোদিত হইয়া, পর সূত্রের গোপন পূর্বক, পূর্বব সূত্র মাত্র উদ্ধৃত করিয়া, স্বেচ্ছা অনুসারে, অর্থান্তরকল্পনা করিয়াছি, এরূপ নির্দেশ করা নির- বচ্ছিন্ন অনভিজ্ঞতার পরিচয়প্রদান মাত্র।

"এইরূপে তাদৃশ স্ত্রীসত্বে যে দারান্তর পরিগ্রহ নিষেধ কল্পনা, তাহা অতীব যুক্তিবিরুদ্ধ।”

এ স্থলে বক্তব্য এই যে, তাদৃশন্ত্রীসর্ষে দারান্তরপরিগ্রহের নিষেধ। আমার কপোলকল্পিত নহে। সর্ববপ্রথম, মহর্ষি আপস্তম্ব ঐ নিষেধের কল্পনা করিয়াছেন; তৎপরে, মিত্রমিশ্র, অনন্তভট্ট, ও কুল্লুকভট্ট, আপস্তম্বের ঐ নিষেধকল্পনা অবলহন পূর্ব্বক, ব্যবস্থা করিয়া গিয়াছেন। আমি নূতন কোনও কল্পনা করি নাই।

"যদি তাঁহার মতে দারসত্বে দারান্তরপরিগ্রহের প্রাপিনস্তাবনা থাকিত, তাহা হইলে, তাহার নিষেধ হইতে পারিত।"

এ স্থলে বক্তব্য এই যে, আমার মতে, দারসত্ত্বে দারান্তরপরি- গ্রহের প্রাপ্তিসম্ভাবনা নাই, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের এই নির্দেশ সম্পূর্ণ কপোলকল্পিত। আমার মতে, অর্থাৎ আমি শাস্ত্রের যেরূপ অর্থবোধ ও তাৎপর্য্যগ্রহ কৃরিতে পারিয়াছি তদনুসারে, দুই প্রকারে, দারসত্ত্বে দারান্তরপরিগ্রহের প্রাপ্তিসম্ভাবনা আছে; প্রথম, স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি শাস্ত্রোক্ত নিমিত্ত নিবন্ধন দারান্তর পরিগ্রহ; দ্বিতীয়, রতিকামনামূলক রাগপ্রাপ্ত দারান্তরপরিগ্রহ। স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিমিত্ত ঘটিলে, শাস্ত্রের বিধি অনুসারে, দারসত্ত্বে দারান্তরপরিগ্রহ আবশ্যক; আর, উৎকট রতিকামনার, বশবর্তী ইইয়া, কামুক পুরুষ দারসত্ত্বে দারান্তর পরিগ্রহ করিতে পারে।- আপস্তম্ব, পূর্বোল্লিখিত দ্বাদশ সূত্র দ্বারা, পুত্রলাভ ও ধৰ্ম্মকার্য্যনির্বাহ হইলে, 'দারসত্ত্বে দারাস্তরপরিগ্রহের নিষেধ করিয়াছেন; আর, ত্রয়োদশ সূত্র দ্বারা, পুত্রলাভ অথবা ধৰ্ম্মকার্য্য নির্বাহের, ব্যাঘাত ঘটিলে, দারসত্ত্বে দারান্তরপরিগ্রহের বিধি দিয়াছেন তদনুসারে, ইহাই স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে, পুত্রার্থে ও ধর্ম্মার্থে ভিন্ন অন্য কোনও কারণে, দারসঙ্গে দারান্তর- • পরিগ্রহে অধিকার নাই। মনু প্রভৃতি, যদৃচ্ছাস্থলে, পূর্বপরিণীতা সবর্ণা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, রাগপ্রাপ্ত অসবর্ণাবিবাহের অনুমোদন করিয়াছেন; তাদৃশ বিবাহ আপস্তম্বের অভিমত বোধ হইতেছে না; এজন্য, তদীয় ধৰ্ম্মসূত্রে, রতিকামনামূলক অসবর্ণাবিবাহ, অসবর্ণাগর্ভসম্ভূত, পুত্রের অংশনির্ণয় প্রভৃতির কোনও উল্লেখ • দেখিতে পাওয়া যায় না।

"তাঁহার মতে পুত্রের অভাবে দারসত্ত্বে দারান্তর পরিগ্রহ বিহিত হইলেও, অগ্নিহোত্রাদি সমস্ত কর্তব্য ধর্ম্মের অভাবেও, পুত্রসত্বে • দারান্তর পরিগ্রহ নিষিদ্ধ হইয়াছে"।

এ স্থলে বক্তব্য এই যে, পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীর সহযোগে, অগ্নি- হোত্রাদি গৃহস্থকর্ত্তব্য ধৰ্ম্মকার্য্য সম্পন্ন না হইলেও, পুভ্রসত্ত্বে দারান্তরপরিগ্রহ নিষিদ্ধ; অর্থাৎ, পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রী দ্বার। ধৰ্ম্ম- কার্য্য নির্বাহের ব্যাঘাত ঘটলেও, কেবল পুত্রলাভ হইয়াছে বলিয়া, ধর্ম্মকার্য্যের অনুরোধে, আর দারপরিগ্রহ করিতে "পারিবেক না; 'আমি কোনও স্থলে এরূপ কথা লিখি নাই। তর্কবাচস্পতি মহাশয়, কি মূল অবলম্বন করিয়া, অনায়াসে এরূপু অসঙ্গত নির্দেশ করিলেন, বুঝিতে পারা যায় না। এ বিষয়ে পূর্ব্বে যাহা লিখিয়াছি, তাহা উদ্ধৃত হইতেছে;

• "পুত্রলাভ ও ধৰ্ম্মকার্য্যসাধন গৃহস্থাশ্রমের উদ্দেশ্য। দারপরিগ্রহ ব্যতিরেকে এ উভয়ই সম্পন্ন হয় না; এই নিমিত্ত, প্রথম বিধিতে দারপরিগ্রহ গৃহস্থাশ্রমপ্রবেশের দ্বারস্বরূপ ও গৃহস্থাশ্রমসমাধানের অপরিহার্য্য উপারস্বরূপ নির্দিষ্ট হইয়াছে। গৃহস্থাশ্রমসম্পাদন কালে, স্ত্রীবিয়োগ ঘাটলে, যদি পুনরায় বিবাহ না করে, তবে.. সেই দারবিরহিত ব্যক্তি আশ্রমভ্রংশ নিবন্ধন পাতকগ্রস্ত হয়; এজন্য, ঐ অবস্থায়, গৃহস্থ ব্যক্তির পক্ষে, পুনরায় দারপরিগ্রহের অবর্তকর্তব্যতাবোধনের নিমিত্ত, শাস্ত্রকারেরা দ্বিতীয় বিধি প্রদান করিয়াছেন। স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব, চিরয়োগিত্ব প্রভৃতি দোষ ঘাটলে, পুত্রলাভ ও ধর্মকার্য্যসাধনের ব্যাঘাত ঘটে; এজন্য, শাস্ত্র- কারেরা, তাদৃশ স্থলে, স্ত্রীসত্ত্বে পুনরায় বিবাহ করিবার তৃতীয় বিধি দিয়াছেন" (৩৪)।

এই লিখন দ্বারা, ধর্ম্মকার্য্যনির্বাহের ব্যাঘাত ঘটিলেও, পুভ্রসত্ত্বে দারান্তরপরিগ্রহ করিতে পারিবেক না, এরূপ নিষেধ প্রতিপন্ন হয় কি না, তাহা সকলে বিবেচনা করিয়া দেখিবেন।

"অতএব, "অদারে," এইরূপ ছেদ দ্বারাই সর্ব্বসামঞ্জস্য হইতেছে। এমন স্থলে "দারাক্ষতলাজানাং বহুত্বঞ্চ" পুংলিঙ্গাধিকারে পাণিনি-" কৃত এই লিঙ্গানুশাসন লঙ্ঘন করিয়া, দারশব্দের একবচনান্ততা- স্বীকার একবারেই হেয়; কারণ, গত্যন্তর না থাকিলেই, তাহা স্বীকার করিতে হয়"।

তর্কবাচস্পতি মহাশয়, সর্বসামঞ্জস্থ্যসম্পাদনমানসে, “অদারে” এইরূপ পাঠান্তর কল্পনা করিয়াছেন। কিন্তু, তাঁহার কল্পিত পাঠান্তর দ্বারা, কিরূপ সর্বসামঞ্জস্য সম্পন্ন' হইয়াছে, তাহা ইতিপূর্বের সবিস্তর দর্শিত হইয়াছে। এক্ষণে, অবলম্বিত পাঠা- স্তরের যথার্থতার সমর্থন করিবার নিমিত্ত, তিনি ব্যাকরণ- বিরোধরূপ যে প্রমাণ প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহার বলাবল বিবেচিত হইতেছে। তাঁহার উল্লিখিত

দারাক্ষতলাজানাং বহুত্বঞ্চ। ৭২। (৩৫)

দার, অক্ষত, ও লাজশব্দ পুংলিঙ্গ ও বহুবচনান্ত হয়।

এই সূত্র অনুসারে, দার শব্দ বহু বচনে প্রযুক্ত হওয়া আবশ্যক; 'কিন্তু, আপস্তম্বসূত্রের চিরপ্রচলিত ও সর্বসম্মত পাঠ অনুসারে, "দার” এই স্থলে, দার শব্দ সপ্তমীর এক বচনে প্রযুক্ত হইয়াছে। তর্কবাচস্পতি মহাশয় দার শব্দের একবচনান্ত প্রয়োগ, পাণিনি- • বিরুদ্ধ বলিয়া, এককারেই অগ্রাহ্য করিয়াছেন। পাণিনি দার শব্দ্বের বহু বচনে প্রয়োগ নিয়মবদ্ধ করিয়াছেন বটে; কিন্তু, আপস্তম্ব, স্বীয় ধৰ্ম্মসূত্রে, সে নিয়ম অবলম্বন করিয়া চলেন নাই। বোধ হয়, পাণিনির সহিত তাঁহার বিরোধ ছিল; এজন্য, তদীয় ধৰ্ম্মসূত্রে, দার শব্দ, সকল স্থলেই, কেবল এক বচনে প্রযুক্ত দৃষ্ট হইতেছে। যথা,

১। মতিরমাচার্য্যদারঞ্চেত্যেকে। ১। ৪। ১৪। ২৪'।

২। স্তেয়ং কৃত্বা সুরাং পীহা গুরুদারঞ্চ গত্বা। ২। ৯। ২৫। ১০।

৩। সদা নিশায়াং দারং প্রত্যলঙ্কুব্বীত। ১। ১১। ৩২। ৬। ।

৪। ঋতৌ চ সন্নিপাতো দারেণানুব্রতম্। ২।১। ১। ১৭।

৫। অন্তরালেহপি দার এব। ২৯ ১। ১। ১৮।

৬। দারে প্রজায়াঞ্চ উপস্পর্শনভাষা বিস্রস্তুপূর্ববাঃ

*** পরিবর্জ্জয়েৎ। ২।২।৫।১০০

৭। বিদ্যাং সমাপ্য দারং কৃত্বা অগ্নীনাধায় কৰ্ম্মাণ্যারভতে সোয়াবরা্যানি যানি ক্রয়ন্তে। ২। ৯। ২২। ৭।

৮। অবুদ্ধিপূর্ব্বমলঙ্কতো যুবা পরদারমনুপ্রবিশন্ কুমারীং বা বাচা বাধ্যঃ। ২।০১০। ২৬। ১৮। ৯। দারং চাস্থ্য কর্শয়েৎ। ২। ১০। ২৭। ১০।

আমাদের মানবচক্ষুতে, এই সকল সূত্রে, "দারঃ”, “দারম্”, "দারেণ", "দারে", এই রূপে দার শব্দ প্রথমা, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, ও সপ্তমীর একবচনে প্রযুক্ত দৃষ্ট হইতেছে। সর্বশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের দিব্য চক্ষুতে কিরূপ লক্ষিত হয়,, বলিতে পারা যায় না।

ধৰ্ম্মপ্রজাসম্পন্নে দারে না্যাং 'কুব্বীত। ২। ৫। ১১। ১২। এ স্থলে, দার শব্দ সপ্তমীর একবচনে প্রযুক্ত আছে। কিন্তুঃ তর্কবাচস্পতি মহাশয়, পাণিনিকৃত নিয়মের অলঙ্ঘনীয়তা, স্থির করিয়া, আপস্তম্বীয় ধর্ম্মসূত্রে দার শব্দের একবচনান্ত প্রয়োগরূপ যে দোষ ঘটিয়াছে, উহার পরিহারবাসনায়, “দারে” এই পদের পূর্বে এক লুপ্ত অকারের কল্পনা করিয়াছেন। এক্ষণে, পূর্ব- নিদ্দিষ্ট নয় সূত্রে যে দার শব্দের একবচনান্তপ্রয়োগ আছে, উল্লিখিত প্রকারে, দয়া করিয়া, তিনি তাহার সমাধান করিয়া না দিলে, নিরবলম্ব আপস্তম্ব অব্যাহতিলাভ করিতে পারিতেছেন না। আপাততঃ যেরূপ লক্ষিত হইতেছে, তাহাতে সকল স্থলে লুপ্ত অকারের কল্পনার পথ আছে, এরূপ বোধ হয় না। অতএব, প্রসিদ্ধ বৈয়াকরণ ও প্রসিদ্ধ সর্বশাস্ত্রবেত্তা তর্কবাচস্পতি মহাশয়, অদ্ভুত বুদ্ধিশক্তির প্রভাবে, কি অদ্ভুত প্রণালী অবলম্বন করিয়া, পাণিনি ও আপস্তম্বের বিরোধভঞ্জন করেন, তাহা দেখিবার শুরু, নিরতিশয় কৌতূহল উপস্থিত হইতেছে। দয়াময় তর্কবাচস্পতি মহাশয় কি এত সৌজন্য প্রকাশ করিবেন, যে এ বিষয়ে আমাদের কৌতূহলনিবৃত্তি করিয়া দিবেন।

সচরাচর সকলে অবগত আছেন, ঋষিরা লিঙ্গ, বিভক্তি, বচন প্রভৃতি বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রেচ্ছ ছিলেন, সে বিষয়ে অন্যদীয় নিয়মের অনুবর্তী হইয়া চলেন নাই। এজন্য, পাণিনিপ্রভৃতিপ্রণীত প্রচলিত ব্যাকরণ অনুসারে, যে সকল প্রয়োগ অপপ্রয়োগ বলিয়া পরিগণিত হয়, ঋষিপ্রণীত গ্রন্থে সে সকল প্রয়োগ আর্ষ বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে; অর্থাৎ ঐ সকল প্রয়োগ যখন ঋষির মুখ বা লেখনী হইতে নির্গত হইয়াছে, তখন তাহা অপ- প্রয়োগ নহে। পাণিনি ও আপস্তম্ব উভয়েই ঋষি। পাণিনির মতে; দার শব্দ বহু বচনে প্রযুক্ত হওয়া আবশ্যক; আপস্তম্বের মতে, দার শব্দ এক বঙ্গনে প্রযুক্ত হওয়া দোষাবহ নহে। ফলকথা এই; ঋষিরা সকলেই সমান ও স্বস্বপ্রধান ছিলেন। কোনও ঋষিকে "অপর ঋষির, প্রতিষ্ঠিত নিয়মের অনুবর্তী হইয়া চলিতে হইত না। সুতরাং, আপস্তম্বকৃত প্রয়োগ, পাণিনিবিরুদ্ধ হইলেও, হেয় বা অশ্রদ্ধেয় হইতে পারে না। যিনি যে বিষয়ের ব্যবসায়ী, সে বিষয়ে, স্বভাবতঃ, তাঁহার অধিক পক্ষপাত থাকে। তর্ক- বাচস্পতি মহাশয় বহু কালের ব্যাকরণব্যবসায়ী; সুতরাং, অন্যান্য শাস্ত্র অপেক্ষা, ব্যাকরণে অধিক পক্ষপাত থাকিলে, তাঁহাকে দোষ দিতে পারা যায় না। অতএব, ব্যাকরণের নিয়ম- রক্ষার পক্ষপাতী হইয়া, ধৰ্ম্মশাস্ত্রের গ্রীবাভঙ্গে প্রবৃত্ত হওয়া, তাঁহার পক্ষে, তাদৃশ দোষের বা আশ্চর্য্যের বিষয় নহে।

'দশম পরিচ্ছেদ।

যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহব্যবহারের, শাস্ত্রীয়তাপ্রতিপাদন প্রয়াসে, সর্ববশাস্ত্রবেত্ত। তর্কবাচস্পতি মহাশয় যে লকল প্রমাণ প্রদর্শিত করিয়াছেন, উহাদের অর্থ ও তাৎপর্য্য আলোচিত হইল। তদনু- সারে, ইহা নিঃসংশয়ে প্রতিপন্ন হইতেছে, তাঁহার অভিমত যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহরূপ পরম ধর্ম শাস্ত্রানুমোদিত ব্যবহার নহে। শাস্ত্রানুযায়িনী বিবাহবিষয়িণী ব্যবস্থা এই;..

১। গৃহস্থ ব্যক্তি, গৃহস্থাশ্রমের উদ্দেশ্যসাধনের নিমিত্ত, সবর্ণা- বিবাহ করিবেক।

২। প্রথমপরিণীতা স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি দোষ ঘটিলে, তাহার

জীবদ্দশায়, পুনরায় সবর্ণাবিবাহ করিবেক। ৩। আটচল্লিশ বৎসর বয়সের পূর্বে স্ত্রীবিয়োগ হইলে, পুনরায়

সবর্ণাবিবাহ করিবেক।

৪। সবর্ণা কন্যার অপ্রাপ্তি ঘটিলে, অসবর্ণাবিবাহ করিতে পারিবেক।

৫। কাম বশতঃ পুনরায় বিবাহ করিতে ইচ্ছা হইলে, পূর্ব্ব- পরিণীতা সবর্ণা স্ত্রীর সম্মতি গ্রহণ পূর্বক, অসবর্ণাবিবাহ করিবেক।

শাস্ত্রে, এতদ্ব্যতিরিক্ত স্থলে, বিবাহের বিধি ও ব্যবস্থা নাই। এই পঞ্চবিধ ব্যতিরিক্ত বিবাহ সর্বতোভাবে শাস্ত্রনিষিদ্ধ। তর্কবাচস্পতি মহাশয়, স্বপ্রদর্শিত শ্রুতিবাক্য ও স্থস্মৃতিবাক্যের যে সকল কপোলকল্পিত ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তদ্দ্বারা যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহব্যবহারের শাস্ত্রীয়তা প্রতিপন্ন হওয়া কোনও মতে সম্ভাবিত নহে। কিন্তু, তিনি স্বীয় অভিপ্রেত সাধনে সম্পূর্ণ কৃতকার্য্য হইয়াছেন, ইহা স্থির করিয়া, অবলম্বিত মীমাংসার প্লোষকতা করিবার অভিপ্রায়ে, লিখিয়াছেন,

''শিষ্টাচারোংপি শ্রুতিস্কৃত্যোবর্ণিতবিষয়ত্বমুছোলয়ুতি। তথা চ তে হি শিষ্টা দর্শিতবিষয়কত্বমেব শ্রুতিস্বত্যোরবধার্য্য যুগপন্থহু- 'স্মাৰ্য্যাবেদনে প্রবৃত্তা ইতি পুরাণাদৌ উপলভ্যতে (৩৬)।"

সদৃচ্ছাঙ্গমে যত ইচ্ছা বিবাহ করা শ্রুতি ও স্মৃতির অনুমোদিত, ইহা শিষ্টাচার দ্বারাও সমর্থিত হইতেছে। পূর্ব্বকালীন শিষ্টেরা, শ্রুতি ও স্মৃতির উক্তপ্রকার তাৎপর্য্য অবধারণ করিয়া, একবারে বহুভাৰ্য্যাবিবাহে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, ইহা পুরাণাদিতে দৃষ্ট হইতেছে।

যদি যুদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহ শ্রুত্তি ও স্মৃতির অনুমোদিত হইত, তাহা হইলে শিষ্টাচার দ্বারা তাহার সমর্থনপ্রয়াস সফল হইতে পারিত। কিন্তু পূর্বে সবিস্তর দর্শিত হইয়াছে, তাদৃশ বিবাহ- কাণ্ড শাস্ত্রানুমোদিত ব্যবহার নহে; সুতরাং, শিষ্টাচার দ্বারা তাহার সমর্থনপ্রয়াস সম্পূর্ণ নিষ্ফল হইতেছে; কারণ, শাস্ত্রবিরুদ্ধ • শিষ্টাচার প্রমাণ বলিয়া পরিগৃহীত নহে। মনু কহিয়াছেন,

আচারঃ পরমো ধৰ্ম্মঃ শ্রুত্যুক্তঃ স্মার্ড এব চ। ১। ১০৯।

বেদবিহিত ও স্মৃতিবিহিত আচারই পরম ধৰ্ম্ম।

শাস্ত্রকারদিগের অভিপ্রায় এই, যে আচার শ্রুতি ও স্মৃতির বিধি অনুযায়ী, তাহাই পরম ধৰ্ম্ম; লোকে তাদৃশ আচারেরই অনুসরণ করিবেক; তদ্ব্যতিরিক্ত অর্থাৎ শ্রুতিবিরুদ্ধ বা স্মৃতিবিরুদ্ধ আচার আদরণীয় ও অনুসরণীয় নহে; তাদৃশ আচারের অনুসরণ করিলে, প্রত্যবায়গ্রস্ত হইতে হয়। অনেকে, শাস্ত্রীয় বিধি ও নিষেধের প্রতিপালনে অসমর্থ হইয়া, অবৈধ আচরণে দূষিত হইয়া থাকেন। এ কালে যেরূপ দেখিতে পাওয়া যায়, পূর্ব কালেও সেইরূপ ছিল; অর্থাৎ, পূর্ব্ব কালেও, অনেকে, শাস্ত্রীয় বিধি ও নিষেধের, প্রতিপালনে অসমর্থ হইয়া, অবৈধ আচরণে দূষিত হইতেন,। তবে, পূর্বকালীন লোকেরা তেজীয়ান্ ছিলেন; এজন্য, অবৈধ আচরণ নিবন্ধন প্রত্যবায়গ্রস্ত হইতেন নান তাঁহারা অধিকতর শাস্ত্রজ্ঞ ও ধৰ্ম্মপরায়ণ ছিলেন; সুতরাং তাঁহাদের আমার সর্বাংশে নির্দোষ, উহার অনুসরণে দোষস্পর্শ হইতে পারে না; এরূপ ভাবিয়া, অর্থাৎ পূর্বকালীন লোকের আচার মাত্রই সদা- চার, এই বিবেচনা করিয়া, তদনুসারে চলা উচিত নহে। গোতম কহিয়াছেন,

দৃষ্টো ধৰ্ম্মব্যতিক্রমঃ সাহসঞ্চ মহতাম্। ১। ১।

মহৎ লোকদিগের ধর্ম্মলঙ্ঘন ও অবৈধ আচরণ জেপিতে পাওয়া যায়। আপস্তম্ব কহিয়াছেন,

দৃষ্টো ধর্ম্মব্যতিক্রম, পাহসঞ্চ মহতাম্।। ১।১৩।৮।

তেষাং তেজোবি, সেণ ৫০০গয়ে। ন বিদাতে।২/৬/১৩/৯।. তদন্বীক্ষ্য প্রযুঞ্জানঃ ৮১১৭১১২১৬। ১৩। ১০।

মহৎ লোকদিগের ধর্ম্মলঙ্ঘন ও অবৈধ অ।১। ১৮নিতে পাওয়া যায়। তাঁহার। শ্রীযাম্, তাহাতে তাহাদের প্রত্যবায় নাই। সাধারণ লোকে, তদ্দর্শনে তদনু- শীই চলিলে, এককালে উৎসন্ন হয়।

বৌধায়ন কহিয়াছেন,

অনুবৃত্তন্তু যদ্দেবৈমুনিভির্যদনুষ্ঠিতম্।

• নানুষ্ঠেয়ং মনুষ্যেস্তদুক্তং কর্ম্ম সমাচরেৎ (৩৭)।

দেীগণ ও মুনিগণ যে সকল কণ্ঠ করিয়াছেন, সশুযোর পক্ষে তাহা করা কর্তব্য নহে; তাহারা শাস্ত্রোক্ত কর্মই করিবেক।

শুকদেব কহিয়াছেন,

ধৰ্ম্মব্যতিক্রমো দৃষ্ট ঈশ্বরাণাঞ্চ সাহসম্।

তেজীয়সাং ন দোষায় বঙ্গেঃ সর্বভুজো যুখা ॥ ৩০ ॥ নৈতৎ সমাচরেজ্জাতু মনসাপি হানীশ্বরঃ।

বিনশ্যত্যাচরন্ মৌচ্যাদদ্বথা রুদ্রোহব্ধিজং বিষম্ ॥ ৩১ ৷৷

*ঈশ্বরাণাং বঢ়ঃ সত্যং তথৈবাচরিতং কচিৎ।

তেষাং যৎ স্ববচোফুক্তং বুদ্ধিমাংস্তত্তদাচরেৎ ।। ৩২ ।। (৩৮)

প্রভাবশালী, শুক্তিসিগের ধর্ম্মলঙ্গন ও অবৈধ আচরণ দেখিতে পাওয়া যায়। সর্ব্বভোজী অগ্নির ্যায়, তেজীয়ানদিগের তাহাতে দোষস্পর্শ হয় না। ৩০। সামাক্ত ব্যক্তি, কদাচ, মনেও তাদৃশ কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিবেক না; মূঢ়তা বশতঃ অনুষ্ঠান করিলে, বিনাশ প্রাপ্ত হয়। শিব সমুদ্রোৎপন্ন বিষ পান করিয়া ছিলেন; সামান্ত লোক বিষ পান করিলে, বিনাশ অবধারিত। ৩১। প্রভাবশালী ব্যক্তিদিগের উপদেশ মাননীয়, কোনও কোনও ছলে তাঁহাদের আচারও মান- নীয়। তাঁহাদের যে সমস্ত আচার তাঁহাদের উপদেশবাক্যের অনুযায়ী, বুদ্ধিমান্ বাক্তি সেই সকল আচারের অনুসরণ করিবেক।

এই সকল শাস্ত্র দ্বারা স্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে, পূর্বকালীন মহৎ ব্যক্তিদের আচার মাত্রই সদাচার নহে। তাঁহাদের যে সকল আচার শাস্ত্রীয় বিধি ও নিষেধের অনুযায়ী, তাহাই সদাচার; আর, তাঁহাদের যে সকল আচার শাস্ত্রীয় বিধি ও নিষেধের বিপরীত, তাহা সদাচারশব্দবাচ্য নহে। পূর্ব্বে প্রতিপাদিত হই- য়াছে, বিবাহ বিষয়ে যথেচ্ছচার শাস্ত্রীয় বিধি ও নিষেধের বিপরীত ব্যবহার; সুতরাং, পূর্ব্বকালীন লোকদিগের 'তাদৃশ যথেচ্ছচার সদাচার বলিয়া পরিগৃহীত করা ও তদনুসারে চুলা কদাচ উচিত নহে।'

তর্কবাচস্পতি মহাশয়, স্বকৃত মীমাংসার সমর্থনমানসে, যুক্তি--" প্রদর্শন করিতেছেন,

"যদি কশ্যপাদয়ঃ স্বয়ং স্মৃতিপ্রণেতারং বহুভাৰ্য্যাবেদনমশাস্ত্রীয় মিতি জানীয়ঃ কথং তত্র প্রবর্ত্তেরন্। অতম্ভেষামাচারদর্শনেনৈব উপদর্শিতপ্রকার এব শাস্ত্রার্থঃ না্যথেত্যবধার্য্যতে” (৩৯)।

"যদি নিজে ধৰ্ম্মশাস্ত্রপ্রবর্তক ক্যগপ্রভৃতি বহুভার্য্যাবিবাহ অশাস্ত্রীয় বোধ করি- তেন, তাহা হইলে, কেন তাহাতে প্রবৃত্ত হইতেন। অতএব, তাঁহাদের আচার দর্শনেই অবধারিত হইতেছে, আমি যেরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছি, তাহাই যথার্থ শাস্ত্রার্থ।

ইহার তাৎপর্য্য এই, যাঁহারা লোকহিতার্থে ধর্ম্মশাস্ত্রের সৃষ্টি করিয়াছেন, তাঁহারা কখনও অশাস্ত্রীয় কৰ্ম্মে প্রবৃত্ত হইতে পারেন না। সুতরাং, তাঁহাদের আচার অবশ্যই সদাচার। যখন শাস্ত্রকর্তা কশ্যপ প্রভৃতির বহু বিবাহের নিদর্শন পাওয়া যাইতেছে, তখন বহুভাৰ্য্যাবিবাহ সম্পূর্ণ শাস্ত্রসম্মত; শাস্ত্রবিরুদ্ধ হইলে, তাঁহারা তাহাতে প্রবৃত্ত হইতেন না। এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, তর্ক- বাচস্পতি মহাশয়ের এই মীমাংসা কোনও অংশে ন্যায়ানুসারিণী নহে। ইতঃপূর্বের দর্শিত হইয়াছে, আপস্তম্ব বৌধায়ন প্রভৃতি ধর্ম্মশাস্ত্রপ্রবর্ত্তক ঋষিরা স্পষ্ট বাক্যে কহিয়াছেন, দেবগণ, ঋষি- গণ, বা অন্যান্য মহৎ ব্যক্তিগণ, সকল সময়ে ও'সকল বিষয়ে, শাস্ত্রীয় বিধি ও নিষেধের প্রতিপালন করিয়া চলিতেন না; সুতরাং, তাঁহাদের আচার মাত্রই সদাচার বলিয়া পরিগৃহীত ও অনুসৃত হওয়া উচিত নহে; তাঁহাদের যে সকল আচার শাস্ত্রানু মোদিত, তাহাই সদাচার বলিয়। পরিগৃহীত হওয়া উচিত। অতএব, যখন বহুভার্য্যাবিবাহ শাস্ত্রানুমোদিত ব্যবহার বলিয়া প্রতিপন্ন হইতেছে না, তখন দেবগণ, ঋষিগণ প্রভৃতির ধহুবিবাহ- রংবহারদর্শনে, তাদৃশ ব্যবহারকে শাস্ত্রসম্মত বলিয়া মীমাংসা করা, কোনও অংশে, সঙ্গত হুইতে পারে না। এজন্যই মাধবাচার্য্য কহিয়াছেন,

• "নমু শিষ্টাচারপ্রামাণ্যে স্বছহিতৃবিবাহোহপি প্রসজ্যেত প্রজা- পতেরাচরণাং তথাচ শ্রুতিঃ প্রজাপতির্বৈ স্বাং দুহিতরমভ্যধ্যায়- দিতি মৈবং ন দেবচরিতং চরেদিতি ন্যায়াৎ অতএব বৌধায়নঃ অনুবৃত্তন্তু যদ্দেবৈৰ্ম্মনিভির্যদনুষ্ঠিতম্। নানুষ্ঠেয়ং মনুয্যৈস্তদুক্তং কৰ্ম্ম সমাচরেঙ্গিতি” (৪০)।

শিষ্টাচারের প্রামাণ্য স্বীকার করিলে, নিজকজ্ঞাবিবাহও দোষাবহ হইতে পারে না: কারণ, ব্রহ্মা তাহা করিয়াছিলেন। বেদে নির্দিষ্ট আছে,

প্রজাপতির্বৈ স্বাং দুহিতরমভ্যধ্যায়ৎ (৪১)।

ব্রহ্মা নিজ কন্তার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন।

এরূপ বলিও না; কারণ, দেবচরিত্রের অনুকরণ করা শ্যায়ানুগত নহে। এজন্যই বৌধায়ন কহিয়াছেন, "দেবগণ ও মুনিগণ যে সকল কর্ম্ম করিয়াছেন, মনুষ্যের পক্ষে তাহা করা কর্তব্য নহে; তাহারা শাস্ত্রোক্ত কর্মই করিবেক"।

ধৰ্ম্মশাস্ত্রপ্রবর্ত্তক ঋষিদিগের মধ্যে অনেকেরই অবৈধ আচরণ দেখিতে পাওয়া যায়। তাঁহারা ধৰ্ম্মশাস্ত্রপ্রবর্ত্তক, এই হেতুতে, তদীয় অবৈধ আচরণ শিষ্টাচার বলিয়া পরিগৃহীত হইতে পারে না। বৃহস্পতি ও পরাশর, উভয়েই ধৰ্ম্মশাস্ত্রপ্রবর্ত্তক; বৃহস্পতি, কামার্ত হইয়া, গর্ভবর্তী ভ্রাতৃভার্য্যার সম্ভোগ, আর পরাশর, কামার্ত্ত হইয়া, অবিবাহিতা দাশকন্যার সম্ভোগ, করেন। ধর্ম্মশাস্ত্র- প্রবর্ত্তক বলিয়া, ইঁহাদের এই অবৈধ আচরণ শিষ্টাচারস্থলে পরিগৃহীত হওয়া উচিত নহে। অতএব, ধৰ্ম্মশাস্ত্রপ্রবর্ত্তক হইলে, অবৈধ আচরণে প্রবৃত্ত হইতে পারেন, না, এ কথা নিতান্ত হেয় এ অশ্রদ্ধেয়। ধৰ্ম্মশাস্ত্র প্রবর্ত্তক কশ্যপ প্রভৃতি বহুভাৰ্য্যাবিবাহে প্রভৃত্ত হইয়াছিলেন; তাঁহাদের তাদৃশ আচারদর্শীন, বহুভার্য্যাবিবাহ-,: পক্ষই যথার্থ শাস্ত্রার্থ বলিয়া অবধারিত হইতেছে, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের এই মীমাংসা শাস্ত্রানুযায়িনী ও ন্যায়ানুসারিণী 'হইতে পারে কি না, তাহা সকলে বিবেচনা ফরিয়া দেখিবেন। ফলকথা এই, শিষ্টাচারবিশেষকে প্রমাণস্থলে পরিগৃহীত করা আবশ্যক হইলে, ঐ শিষ্টাচার শাস্ত্রীয় বিধি ও নিষেধের অনুযায়ী কি না, তাহার সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখা কর্তব্য; নতুবা, ইদানীন্তন লোকের যথেচ্ছ ব্যবহারকে শাস্ত্রমূলক আচার বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায়ে, পূর্বকালীন লোকের যথেচ্ছ ব্যবহারকে অবিগীত শিষ্টাচার স্থলে প্রতিষ্ঠিত করিয়া, তাহার দোহাই দিয়া, তদনুসারে শাস্ত্রের তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা করা পণ্ডিতপদবাচ্য ব্যক্তির, কদাচ উচিত নছে।

তর্কবাচস্পতি মহাশয়, যদৃচ্ছ। প্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ডের শাস্ত্রীয়তা প্রতিপাদন করিবার নিমিত্ত, যে সমস্ত শাস্ত্র ও যুক্তি প্রদর্শিত করিয়াছেন; সে সমুদয় একপ্রকার আলোচিত হইল। সে বিষয়ে আর অধিক আলোচনার প্রয়োজন নাই। কেহ' কেহ, এক সামান্য কথা উপলক্ষে, তাঁহার উপর দোষারোপ করিয়া 'থাকেন, সে বিষয়ে কিছু বলা আবশ্যক; এজন্য, আত্ম- বক্তব্য নির্দেশ করিয়া, তর্কবাচস্পতিপ্রকরণের উপসংহার করিতেছি। তিনি গ্রন্থারম্ভে প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, ধৰ্ম্মতত্ত্বং বুভুৎসূনাং বোধনায়ৈব মৎস্কৃতিঃ।

তেনৈব কৃতকৃত্যোহস্মি ন জিগীষাস্তি লেশতঃ ॥

যাঁহারা ধর্ম্মের তত্ত্ব জ্ঞানলাভে অভিলাষী, তাঁহাদের বোধ জন্মাইবার নিমিত্তই

আামার যত্ন; তাহা হইলেই আমি কৃতাৰ্থ হই; জিগীষার লেশ মাত্র নাই। অনেকে কহিয়া থাকেন, "জিগীষার লেশ মাত্র নাঁই,” তর্ক- বাচস্পতি মহাশয়ের এই নির্দেশ, কোনও মতে, ন্যায়ানুগত নহে। তিনি, বাস্তবিক জিগীষার বশবর্তী হইয়া, এই গ্রন্থের রচনা ও প্রচার করিয়াছেন; এমন স্থলে, জিগীষা নাই বলিয়া পরিচয় দেওয়া, কোনও প্রকারে, উচিত কৰ্ম্ম হয় নাই। এ বিষয়ে আমার বক্তব্য এই যে, যাঁহারা এরূপ বিবেচনা করেন, কোনও কালে, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের সহিত তাঁহাদের আলাপ বা স্নহবাস ঘটিয়াছে, এরূপ বোধ হয় না। তিনি, জিগীষার বশবর্তী হইয়া, গ্রন্থের প্রচার করিয়াছেন, এরূপ নির্দেশ করা নিরবচ্ছিন্ন অর্বাচীনতা প্রদর্শন মাত্র। জিগীষা তমোগুণের কার্য্য। যে সকল ব্যক্তি, একবার, স্বল্প কাল মাত্র, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের সংস্রবে আসিয়াছেন, তাঁহারা মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করিয়া থাকেন, তাঁহার শরীরে তমোগুণের সংস্পর্শ মাত্র নাই। যাঁহারা, অনভিজ্ঞতা বশতঃ, তদীয় বিশুদ্ধ চরিতে ঈদৃশ অসম্ভাবনীয় দোষারোপ করিয়া থাকেন, তাঁহাদের প্রবোধনের নিমিত্ত, বহুবিবাহবাদগ্রন্থের কিঞ্চিৎ অংশ উদ্ধৃত হইতেছে; -তদৃষ্টে তাঁহাদের ভ্রমবিমোচন হইবেক, তাহার সংশয় নাই।

"ইত্যেবং পরিসংখ্যাপরত্বরূপাভিনবার্থকল্পনয়া স্বাভীষ্টসিদ্ধয়ে অসবর্ণাতিরিক্তবিবাহনিষেধপরত্বং যৎ ব্যবস্থাপিতং তন্নির্মূলং নির্ভুক্তিকং, স্বকপোলকল্পিতং প্রাচীনসন্দর্ভাসম্মতং পরিসংখ্যা- সরণ্যনমুসূতং বহুবিরোধগ্রস্তঞ্চ প্রমাণপরতন্ত্রৈস্তান্ত্রিকৈরশ্রদ্ধেয়- মেব। তন্ত নিবারণার্থং যদ্যপি প্রয়াস এবানুচিতঃ তথালি পণ্ডিতন্মন্যন্ত স্বাভীষ্টসিদ্ধয়ে তত্রাগ্রহবতঃ পরিসংখ্যারূপার্থকল্পন- রূপাবলেপবতশ্চ তঞ্চাবলেপখগুনেন তদ্বাক্যে বিশ্বাসবতাং সংস্কৃতপরিচয়শূন্যানাং তছদ্ভাবিতপদব্যা বহুলদোষগ্রস্ততাবোধ- নায়ৈব প্রযত্নঃ ক্বতঃ” (৪২)।

এই রূপে পরিসংখ্যাপরত্বরূপ অভিনব অর্থের কল্পনা দ্বারা, স্বীয় অভাঁষ্টসিদ্ধির নিমিত্ত, অসবর্ণা ব্যতিরিক্ত বিবাহ করিতে পারিবেক না, এই যে ব্যবস্থা প্রচার করিয়াছেন, তাহা নির্মূল, যুক্তিবিরুদ্ধ, স্বকপোলকল্পিত, প্রাচীন গ্রন্থের অসম্মত পরিসংখ্যাপদ্ধতির বিপরীত, বহুবিরোধপূর্ণ; অতএব প্রমাণপরতন্ত্র তান্ত্রিক- দিগের একবারেই অশ্রদ্ধেয়। তাহার পওনার্থে যদিও প্রয়াস পাওয়াই অনুচিত; তথাপি, পণ্ডিতাভিমানী স্বীয় অভীষ্টসিদ্ধির নিমিত্ত সে বিষয়ে আগ্রহপ্রকাশ করিয়াছেন, এবং পরিসংখ্যারূপ অর্থ কল্পনা করিয়া গর্বিত হইয়াড়েন; তাঁহার গর্ব্ব খণ্ডন পূর্ব্বক, যে সকল সংস্কৃতানভিজ্ঞ ব্যক্তি তাঁহার বাক্যে বিশ্বাস করিয়া থাকেন, তাঁহার উদ্ভাবিত পদবী বহুদোষপূর্ণ, তাঁহাদের এই বোধ জন্মাইবার নিমিত্তই যত্ন করিলাম।

"ইখমসৌ ত্য শেমুধীপ্রতিভাসঃ তদ্বাক্যে বিশ্বাসভাজঃ সংস্কৃত- ভাষাপরিচয়শূন্তান জনান্ ভ্রময়ন্নপি অন্মত্তকচক্রে নিপতিতঃ ভূশমনুযোগদণ্ডেন ভ্রাম্যমাণঃ ন কচিদ্বিশ্রান্তিমাসাদয়িখ্যতি C উপযাস্ততি চ দুর্গমে অতিগভীরে শাস্ত্রজলাশয়ে অস্মত্তকাবষ্টত্ত্বেন সাতিশয়রয়শালিসলিলাবর্তেন পরিবর্ত্যমানোলুপবৎ বংভ্রম্যমাণ- ভাবম্, নাপ্যতি চ তলং কুল্লং বা, আপৎস্ততে' চাম্মৎপ্রদর্শিতয়া প্রমাণানুসারিণ্যা যুক্ত্যা বাত্যয়া ঘূর্ণায়মানধূলিচক্রমিব নিরালম্ব- পথম্। অতঃ কূলকলনায় উপদেশকান্তরকর্ণধারাবলস্কনেন সদ্যক্তিতরণিরনুসরণীয়া অবলম্ব্যতাং বা বিশ্রাস্ত্যৈ অবলম্বান্তরম্। অথ যুক্ত্যনাদরেণ স্বেচ্ছয়া তথা প্রতিভাসশ্চেৎ স্বেচ্ছাচারিণা- মের সমাদরায় প্রভবন্নপি ন প্রমাণপদবীমবলম্বতে" (৪৩)।

. এই ত তাঁর বুদ্ধিপ্রকাশ। যে সকল সংস্কৃতভাষাপরিচয়শুক্ত লোক তদীয় বাকে। বিশ্বাস করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগকে ঘূর্ণিত করিয়াছেন বটে; কিন্তু নিজে আমার তর্করূপ চক্রে নিপতিত ও প্রশ্নরূপ দও 'দ্বারা ঘূর্ণ্যমান হইয়া, কোনও স্থানে বিশ্রাম লাভ করিতে পারিবেন না; তৃণ যেমন সাতিশয় বেগশালী সলিলাবর্ষে পতিত হইয়া, ঘূর্ণিত হইতে থাকে; সেইরূপ আমার তর্কবলে দুর্গম অতিগভীর শাস্ত্ররূপ জলাশয়ে অনবরত ঘূর্ণিত হইতে থাকিবেন; তল অথবা কূল পাইবেন না; বাস্ত্যাবশে ঘূর্ণমান ধূলিমণ্ডলের জায়, আমার প্রদর্শিত প্রমাণানুসারিণী যুক্তি দ্বারা আকাশমার্গে উডডীয়মান হইবেন। অতএব, ঝুল পাইরার নিমিত্ত, অন্ত উপদেশকরূপ কর্ণধার অবলম্বন করিয়া, সদ্যক্তিরূপ তরণির অনুসরণ করিতে, অথবা বিশ্রামের নিমিত্ত অন্ত অবলম্বন আশ্রয় করিতে হইবেক। আর, যদি যুক্তিমার্গ অগ্রাহ্য করিয়া, স্বেচ্ছাবশতঃ তাদৃশ বুদ্ধি প্রকাশ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে স্বেচ্ছাচারীদিগের নিকটেই আদরণীয় হইবেক, প্রমাণ বলিয়া পরিগণিত হইতে পারিবেক না।

. তর্করাচস্পতি মহাশয়ের গ্রন্থ হইতে দুটি স্থল উদ্ধৃত হইল। এই দুই অথবা এতদনুরূপ অন্য অন্য স্থল দেখিয়া, যাঁহারা মনে করিবেন, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের গর্বব, বা ঔদ্ধত্য, বা জিগীষা, আছে, তাঁহাদের ইহকালও নাই, পরকালও নাই।

ন্যায়রত্নপ্রকরণ

বরিসালনিবাসী শ্রীযুত রাজকুমার শ্যায়রত্ন, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহু- বিবাহকাণ্ডের শাস্ত্রীয়তাপক্ষ রক্ষা করিবার নিমিত্ত, যে পুস্তক। প্রচারিত করিয়াছেন, উহার নাম "প্রেরিত তেঁতুল”। ন্যাবুরত্ব। মহাশয়, যে অভিপ্রায়ে, স্বীয় পুস্তকের ঈদৃশ রসপূর্ণ নাম রাখিয়াছেন, তাহা বিজ্ঞাপনে ব্যক্ত করিয়াছেন। বিজ্ঞাপনের

ঐ অংশ উদ্ধৃত হইতেছে; "বাহারা সাগরের রসাস্বাদন করিয়া বিকৃতভাব' অবলম্বন করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে প্রকৃতভাবস্থ করিবার নিমিত্ত এই তেঁতুল প্রেরিত হইল বলিয়া "প্রেরিত তেঁতুল" নামে গ্রন্থের নাম নির্দিষ্ট হইল"।

স্বপ্রচারিত বিচারপুস্তকের এইরূপ নামকরণানস্তর, কিঞ্চিৎ কাল রসিকতা করিয়া, ন্যায়রত্ন মহাশয়, জীমূতবাহনকৃত দায়ভাগের ও দায়ভাগের টীকাকারদিগের লিখন মাত্র অবলম্বন পূর্ববক, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহব্যবহারের শাস্ত্রীয়তা সংস্থাপনে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। যথা,

"এক পুরুষের অনেক নারীর পাণিগ্রহণ করা উচিত কি না, এই বিষয় লইয়া নানাপ্রকার বিবাদ চলিতেছে। কতকগুলি ব্যক্তি বলিতেছে উচিত, আর কতকগুলি বলিতেছে উচিত না। আমরা এপর্য্যন্ত কোন বিষয় লিপিবদ্ধ করি নাই। সম্প্রতি উল্লি- খিত বিষয়ের বিবরণযুক্ত একখানি পুস্তক প্রাপ্ত হই। জানি- লাম বহুবিবাহ অনুচিত, ইহারই পোষকতার জন্য নানাবিধ ভাবযুক্ত সুললিত বঙ্গভাষাতে অনেকগুলি রচনা করা হইয়াছে। . সে সব রচনার আলোচনাতে সকলেই সন্তোষ লাভ করিবেন সন্দেহ নাই, কিন্তু যাহারা সংস্কৃতশাস্ত্রব্যবসায়ী এবং মনু প্রভৃতি সংহিতার রসাস্বাদন করিয়াছেন এবং জীমূতবাহনকৃত দায়ভাগের নবম অধ্যায় টীকার সহিত অধ্যয়ন করিয়াছেন, তাঁহারা বলিতেছেন, এমন যে উত্তমরচনারূপ দুগ্ধসমূহ তাহাকে "কামতস্ত প্রবৃত্তানামিমাঃ হাঃ ক্রমশো বরাঃ শুদ্রৈব ভাৰ্য্যা শূদ্রস্ত" ইত্যাদি বচনের নুতন অর্থরূপ গোমুত্রদ্বারা একবারে অগ্রাহ করিয়াছে; না হইবেই বা কেন "যার কর্ম্ম তারে সাজে অন্ত্যের যেন লাঠি বাজে" এই কারণই নিম্নভাগে, জীমূতবাহনকৃত দায়ভাগের নবম অধ্যায়ের টীকার সহিত কতিপয় পংক্তি উদ্ধৃত করা গেল” (১)।

দায়ভাগলিখন দ্বারা, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহব্যবহারের সমর্থন হওয়া কোনও মতে সম্ভব নহে, ইহা তর্কবাচস্পতি প্রকরণের সপ্তম পরিচ্ছেদে, বিশদ রূপে, প্রতিপাদিত হইয়াছে (২); এ স্থলে আর তাহার নূতন আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। শ্রীযুক্ত রাজ- কুমার শ্যায়রত্ন ধর্মশাস্ত্রের বিশিষ্টরূপ অনুশীলন করেন নাই; এজন্য এত আড়ম্বর করিয়া, দায়ভাগের দোহাই দিয়াছেন। তিনি যে দায়ভাগের দোহাই দিতেছেন, সেই দায়ভাগেরই, প্রকৃত প্রস্তাবে, অনুশীলন করিয়াছেন, এরূপ বোধ হয় না; কারণ দায়ভাগে দৃষ্টি থাকিলে,

কামভস্ত প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো বরাঃ।

মনুবচনের এরূপ পাঠ ধরিতেন, না। তিনি, এক মাত্র দায়ভাগ অবলম্বন করিয়া, প্রস্তাবিত বিষয়ের মীমাংসায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন, অথচ দায়ভাগকার মনুবচনের কিরূপ পাঠ ধরিয়াছেন, তাহা অনুধাবন করিয়া দেখেন নাই। ন্যায়রত্ন মহাশয়, আলস্য পরিত্যাগ পূর্বক, দায়ভাগ উদঘাটিত করিলে, দেখিতে পাইবেন, “ক্রমশো বরাঃ” এ স্থলে "বরাঃ” এই কয়টি অক্ষরের পূর্বে একটি লুপ্ত অকারের চিহ্ন আছে।, যাহা হউক, মনুবচনের.. প্রকৃত পাঠ ও প্রকৃত অর্থ কি, তাহা তিনি, তর্কবাচস্পতি, 4 প্রকরণের প্রথম পরিচ্ছেদের আরস্তভাগে দৃষ্টিপাত করিলে, অবগত হইতে পারিবেন।

ন্যায়রত্ন মহাশয় যেরূপে অসবর্ণাবিবাহবিধির পরিসংখ্যাত্ব খণ্ডনে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তাহা উদ্ধৃত হইতেছে!..

"এই স্থলে পরিসংখ্যা করিয়া য়ে, কি প্রকারে সবর্ণার কামতঃ বিবাহ নিষেধ এবং অসবর্ণার কর্তব্যতা প্রতিপাদন করিয়াছেন তাহা অন্মদাদির বুদ্ধিগম্য নহে। আমরা "তাশ্চ স্বা চাগ্র- জন্মনঃ” ইহা দ্বারা এইমাত্র বুঝিতে পারি যে, সেই অর্থাৎ ক্ষত্রিয়া, বৈস্তা, শূদ্রা স্বা অর্থাৎ ব্রাহ্মণী ইহারাই কামতঃ বিবা- হিতা হইবে। এই স্থলে ব্রাহ্মণী পরিত্যাগ করা কোন্ শাস্ত্রীয় পরিসংখ্যা তাহা সংখ্যাশূন্য বুদ্ধিতে বুঝিতে পারেন। পঞ্চনয ভোজন করিবে এই স্থলে পরিসংখ্যা দ্বারা ইহাই প্রতিপন্ন হইয়াছে যে, পঞ্চনথের ইতয় রাগপ্রাপ্ত কুকুরাদি ভক্ষণ করিবে না ইহাতে পঞ্চনথির মধ্যে কাহারও নিষেধ বুঝায় না। সেইরূপ প্রকৃত স্থলেও ব্রাহ্মণী, ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা, শুদ্রা ইহা ভিন্নের কামৃতঃ বিবাহ করিতে পারিবে না, ইহাই বোধ করিয়া এইক্ষণে পরি- সংখ্যালেখক মহাশয়ের উচিত যে, ঐ বিষয়ে বিশেষ রূপে প্রকাশ করুন তবেই আমরা নিঃসন্দেহ হইতে পারি এবং জিজ্ঞাসুদিগের নিকটে তাহার অভিপ্রায়ও বলিতে পারি" (৩)।

এই বিষয়ে রক্তব্য এই যে,

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্মণি। কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ শ্যুঃ ক্রমশোহবরাঃ । ৩। ১২। শুদ্রৈব ভার্য্যা শূদ্রস্থ্য সাঢ় স্বা চ বিশঃ স্মৃতে। তে চ স্বা চৈব রাজ্ঞঃ শ্যুস্তাশ্চ স্বা চাগ্রজন্মনঃ ॥ ৩। ১৩।

এহ দুই মনুবচনের অর্থ ও তাৎপর্য্য কি, পরিসংখ্যা কাহাকে বলে, এবং মনুবচন পরিসংখ্যাবিধির প্রকৃত স্থল কি না, এই তিন বিষয়, তর্কবার্চস্পতিপ্রকরণের প্রথম পরিচ্ছেদে, সবিস্তর আলোচিত হইয়াছে। পরিসংখ্যাবিধি দ্বারা, কি প্রকারে, রাগপ্রাপ্তস্থলে, সর্বর্ণার বিবাহনিষেধ ও অসবর্ণার বিবাহবিধান প্রতিপন্ন হয়, ঐ প্রকরণে দৃষ্টিপাত করিলে, অনায়াসে অবগত হইতে পারিবেন (৪)। ন্যায়রত্ন মহাশয় লিখিয়াছেন, “এই স্থলে পরিসংখ্যা করিয়া যে কি প্রকারে সবর্ণার কামতঃ বিবাহ নিষেধ এবং অসবর্ণার কর্ত্তব্যতা প্রতিপাদন করিয়াছেন তাহা অম্মদাদির বুদ্ধিগম্য নহে”। এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, তিনি * পরিসংখ্যাবিধির যেরূপ তাৎপর্য্যব্যাখ্যা করিয়াছেন, তদ্দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে, পরিসংখ্যা কাহাকে বলে, তাঁহার সে বোধ নাই; সুতরাং, যদৃচ্ছাস্থলে, পরিসংখ্যা দ্বারা, কি প্রকারে, সবর্ণাবিবাহের নিষেধ ও অসবর্ণাবিবাহের কর্তব্যতা প্রতিপন্ন হয়, তাহা বুদ্ধিগম্য হওয়া সম্ভব নহে। সেই তাৎপর্য্যব্যাখ্যা এই; "পঞ্চনখ ভোজন করিবে স্থলে পরিসংখ্যা দ্বারা ইহাই প্রতিপন্ন হইয়াছে যে, পঞ্চনখের ইতর রাগপ্রাপ্ত কুকুরাদি ভক্ষণ কুরিবে 'না ইহাতে পঞ্চনখির মধ্যে কাহারও নিষেধ বুঝায় না"।

শাস্ত্রের মীমাংসায় প্রবৃত্ত হইয়া, পরিসংখ্যাবিধি বিষয়ে ঈদৃশ অনভিজ্ঞতাপ্রদর্শন অত্যন্ত আশ্চর্য্যের বিষয়। পরিসংখ্যাবিধির লক্ষণ এই,

স্ববিষয়াদন্যত্র প্রবৃত্তিবিরোধী বিধিঃ পরিসংখ্যাবিধিঃ (৫)।' যে বিধি দ্বারা বিহিত বিষয়ের অতিরিক্ত স্থলে নিষেধ সিদ্ধ হয়, তাহাকে পরিসংখ্যাবিধি বলে।

উদাহরণ এই,

পঞ্চ পঞ্চনখা ভক্ষ্যাঃ । পাঁচটি পঞ্চনথ ভক্ষণীয়।

লোকে, যদৃচ্ছা ক্রমে, যাবতীয় পঞ্চনখ জন্তু' ভক্ষণ করিতে পারিত। কিন্তু, "পাঁচটি পঞ্চনখ ভক্ষণীয়,” এই বিধি দ্বারা, বিহিত শশ প্রভৃতি পঞ্চ ব্যতিরিক্ত কুকুরাদি যাবতীয় পঞ্চনখ জন্তুর ভক্ষণ নিষেধ সিদ্ধ হইতেছে। শশ, কচ্ছপ, কুক্কুর, বিড়াল, বানর প্রভৃতি বহুবিধ পঞ্চনখ জন্তু আছে, তন্মধ্যে,

ভক্ষ্যাঃ পঞ্চনখাঃ সেধাগোধাকচ্ছপশল্লকাঃ।

শশশ্চ ॥ ১। ১৭৩। (৬)

সেধা, গোধা, কচ্ছপ, শল্লক, শশ, এই পাঁচ পঞ্চনণ ভক্ষণীয়। এই শাস্ত্র দ্বারা, শশ প্রভৃতি 'পঞ্চ পঞ্চনখ ভক্ষণীয় বলিয়া বিহিত হইতেছে, এবং এই পঞ্চ ব্যতিরিক্ত কুকুর, বিড়াল, বানর প্রভৃতি 4 যাবতীয় পঞ্চনখ জন্তু অভক্ষ্যপক্ষে নিক্ষিপ্ত হইতেছে। অতএব, "পঞ্চনখ' ভোজন করিবে এই স্থলে পরিসংখ্যা দ্বারা ইহাই প্রতি- পন্ন হইতেছে যে, পঞ্চনখের ইতর রাগপ্রাপ্ত কুকুরাদি ভক্ষণ করিবে না ইহাতে পঞ্চনথির মধ্যে কাহারও নিষেধ বুঝায় না," ন্যায়রত্ন মহাশয়ের এই সিদ্ধান্ত কিরূপে সংলগ্ন হইতে পারে, বুঝিতে পারা যায় না। "পঞ্চনখের ইতর' রাগপ্রাপ্ত কুকুরাদি • ভক্ষণ করিবে না," এই লিখন দ্বারা ইহাই প্রতিপন্ন হয়, কুকুর প্রভৃতি জন্তু পঞ্চনথমধ্যে গণ্য নহে; আর, "ইহাতে পঞ্চনখির মধ্যে কাহারও নিষেধ বুঝায়'না," এই লিখন দ্বারা ইহাই প্রতি- "পন্ন হয়, পঞ্চনখ জন্তু মাত্রই ভক্ষণীয়, পঞ্চনখ জন্তুর মধ্যে একটিও নিশিদ্ধ নয়। ইহা দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে, পঞ্চনখ জন্তু কাহাকে বলে, এবং পঞ্চনখভক্ষণবিষয়ক বিধির আকার কিরূপ, এবং ঐ বিধির অর্থ ও তাৎপর্য্য কি, ন্যায়রত্ন মহাশয়ের সে বোধ নাই। আর, "এক্ষণে পরিসংখ্যালেখক মহাশয়ের উচিত যে, ঐ বিষয়ে বিশেষরূপে প্রকাশ করুন, তবেই আমরা নিঃসন্দেহ হইতে পারি"; এ স্থলে বক্তব্য এই যে, তর্কবাচস্পতি প্রকরণের প্রথম পরিচ্ছেদে, পরিসংখ্যাবিধির বিষয় সবিস্তর আলোচিত হইয়াছে। ন্যায়রত্ন মহাশয়, অনুগ্রহ পূর্বক, ও অভিনিবেশ সহ- কারে, ঐ স্থল দৃষ্টিগোচর করিবেন, তাহা হইলেই, বোধ করি, নিঃসন্দেহ হইতে পারিবেন।

ন্যায়রত্ন মহাশয় লিখিয়াছেন,

. "আমাদের ঐ পরিসংখ্যার বিষয়ে বিশেষরূপে জানিতে ইচ্ছার কারণ এই, কোন প্রসিদ্ধ পণ্ডিত স্মার্ভের মধ্যে শিরোমণি বহু- দর্শী, প্রাচীন মহাত্মাও ঐ পরিসংখ্যা দর্শন করিয়া "যথার্থ ব্যাখ্যা হইয়াছে এটা বড়ই উত্তম অর্থ হইয়াছে” এইরূপ বার বার মুক্তকণ্ঠে কহিয়াছেন। তিনিই বা কি বুঝিয়া ঈদৃশ প্রশংসা করিলেন"? (৭)।

"এ স্থলে বক্তব্য এই যে, পরিসংখ্যাবিধির স্বরূপ পরিজ্ঞানের নিমিত্ত যথার্থ ইচ্ছু হইলে, এত আড়ম্বর পূর্ব্বক, পুস্তক প্রচারে প্রবৃত্ত না হইয়া, “প্রসিদ্ধ পণ্ডিত, স্মার্ভের মধ্যে শিরোমণি, বহু- দর্শী, প্রাচীন মহাত্মার" নিকটে উপদেশ গ্রহণ করিলেই, হ্যায়' রত্ন মহাশয় নিঃসন্দেহ হইতে পারিতেন। তাঁহার উল্লিখিত প্রসিদ্ধ পণ্ডিত সামান্য ব্যক্তি নহেন। ইনি 'কলিকাতাস্থ রাজকীয় সংস্কৃত- বিদ্যালয়ে, ত্রিশ বৎসর, ধর্ম্মশাস্ত্রের অধ্যাপনাকাৰ্য্য সম্পাদন, পূর্ববক, রাজদ্বারে অতি মহতী প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন, এবং দীর্ঘকাল, অবাধে, ধর্ম্মশাস্ত্রের ব্যবসায় করিয়া, অদ্বিতীয় স্মার্ত্ত বলিয়া সর্ববত্র পরিগণিত হইয়াছেন। ন্যায়রত্ন মহাশয় ইঁহার নিকট অপরিচিত নহেন। বিশেষতঃ, যৎকালে বহুবিবাহবিচার- বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন, সে সময়ে, সংস্কৃত বিদ্যালয়ে, ঐ প্রসিদ্ধ পণ্ডিতের সহিত প্রতিদিন তাঁহার সাক্ষাৎ হইত। তত্ত্ব- নির্ণয় অভিপ্রেত হইলে, তিনি, সন্দেহভঞ্জনের ঈদৃশ সহজ উপায় পরিত্যাগ করিয়া, পুস্তক প্রচারে প্রবৃত্ত হইতেন না। তদীয় লিখনভঙ্গী দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে, তাঁহার মতে, মহা- মহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত ভরতচন্দ্র শিরোমণি পরিসংখ্যাবিধির অর্থ-, বোধ ও তাৎপর্য্যগ্রহ করিতে পারেন নাই; এজন্যই তিনি, "যথার্থ ব্যাখ্যা হইয়াছে এটী বড়ই উত্তম অর্থ হইয়াছে," আমার অবলম্বিত ব্যাখ্যার এরূপ প্রশংসা করিয়াছেন। "তিনিই বা কি বুঝিয়া ঈদৃশ প্রশংসা করিলেন?" তদীয় এই প্রশ্ন দ্বারা তাহাই সুস্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে। যাহা হউক, ন্যায়রত্ন মহাশয় নিজে পরিসংখ্যাবিধির যেরূপ অর্থবোধ ও তাৎপর্য্যগ্রহ করিয়াছেন, তাহা 'ইতঃপূর্বে সবিশেষ দর্শিত হইয়াছে। ঈদৃশ ব্যক্তি, সর্বমান্য শিরোমণি মহাশয়কে অনভিজ্ঞ ভাবিয়া, শ্লেষোক্তি করিবেন, আশ্চর্য্যের বিষয় নহে।

.."প্রেরিত, তেঁতুল" পুস্তকে এতদ্ভিন্ন এরূপ আর কোনও কথা লক্ষিত হইতেছে না, যে তাহার উল্লেখ বা আলোচনা করা আবশ্যক; এজন্য, এই স্থলেই ন্যায়রত্নপ্রকরণের উপসংহার করিতে হইল।

• স্মৃতিরত্নপ্রকরণ

শ্রীযুত ক্ষেত্রপাল স্মৃতিরত্ব যে পুস্তক প্রচারিত 'করিয়াছেন, উহার. নাম “বহুবিবাহবিষয়ক বিচার”। যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাঞ্জ শাস্ত্রবহির্ভূত ব্যবহার বলিয়া, আমি যে ব্যবস্থা প্রচারিত কুরিয়া- ছিলাম, স্মৃতিরত্ন মহাশয়ের পুস্তকে তদ্বিষয়ে কতিপয় আপত্তি উত্থাপিত হইয়াছে। ঐ সকল আপত্তি যথাক্রমে উল্লিখিত ও আলোচিত হইতেছে। তদীয় প্রথম আপত্তি এই,-

"এই সকল লিখন দেখিয়া সন্দেহ ও আপত্তি উপস্থিত হইতেছে, একমাত্র 'সবর্ণাবিবাহকে নিত্য বিবাহ ও ভার্য্যার বন্ধ্যাত্বাদি কারণবশতঃ বহুসবর্ণাবিবাহকে নৈমিত্তিক বিবাহ বলিয়াছেন। আর যদৃচ্ছাক্রমে অসবর্ণাবিবাহকে কাম্য বিবাহ বলিয়াছেন। ইহা দ্বারা সুস্পষ্ট বোধ হইতেছে যে, উক্ত নিত্য নৈমিত্তিক সবর্ণাবিবাহ হইতে কাম্য অসবর্ণাবিবাহ সম্পূর্ণরূপে পৃথক্" (১)। "উক্তস্থলে আবার বলিয়াছেন' সবর্ণাবিবাহই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই 'তিন বর্ণের পক্ষে প্রশস্ত কল্প এবং বলিয়াছেন আপন অপেক্ষা নিকৃষ্ট বর্ণে বিবাহ করিতে পারে। ইহাতে বোধ হইতেছে সবর্ণাবিবাহ প্রশস্ত, অসবর্ণাবিবাহ অপ্রশস্ত। কিন্তু সবর্ণাবিবাহ নিত্য ও নৈমিত্তিক, অসবর্ণ্যবিবাহ কামা, ইহা বলিলে ঐ দুই বিবাহ প্রশস্ত ও অপ্রশস্ত বলিয়া মীমাংসা, করিতে পারা যায় না। উভয় বিবাহকে নিত্য বা নৈমিত্তিকই বলুন, অথবা উভয় বিবাহকে কাম্যই বলুন। নতুবা প্রশস্ত অপ্রশস্ত বলিয়া মীমাংসা কোন মতেই হইতে পারে না” (২)।

"কোন কোন স্থলে প্রশস্ত অপ্রশস্ত রূপে মীমাংসিত হইয়াছে; যেমন প্রায় অধিকাংশ দেবপূজাতেই একটি বিধি আছে। রাত্রীতরত্র পূজয়েৎ, রাত্রির ইতর কালে অর্থাৎ দিবসে পুজা করিবে, আবার সেই স্থলেই আর একটি বিধি আছে; পূর্ব্বাহ্ণে পূজয়েৎ দিবষের তিন ভাগের প্রথম ভাগের নাম পূর্ব্বাহ্ণ, দ্বিতীয় ভাগের নাম মধ্যাহ্ণ, তৃতীয় ভাগের নাম অপরাহ্ণ। ঐ পূর্ব্বাহ্ণে পূজা করিবে, দিবসের অপর দুইভাগে অর্থাৎ মধ্যাহ্ণে ও অপরাহ্ণে পূজা করিলে, যে ফল হয়; পূর্ব্বাহ্ণে করিলে, সেই ফলই উৎকৃষ্ট, হয়। অতএব মধ্যাহ্ণে বা অপরাহ্ণে, পূজা অপ্রশস্ত পূর্ব্বাহ্ণে পূজা প্রশস্ত, ইহাকেই প্রশস্ত অপ্রশস্ত বলা যায়। ভিন্ন ভিন্ন কর্ম্মের প্রথম কল্প অনুকল্প বা প্রশস্ত অপ্রশস্ত বলিয়া, কোন মীমাংসকের মীমাংস্কা দেখা যায় না” (৩)।

স্মৃতিরুত্ব মহাশয়ের উত্থাপিত এই আপত্তির উদ্দেশ্য এই, পূর্বতন গ্রন্থকর্তারা কর্ম্মবিশেষকে, অবস্থাভেদে প্রশস্তশব্দে, অবস্থাভেদে অপ্রশস্তশব্দে, নির্দেশ করিয়াছেন। যেমন তাঁহার উল্লিখিত উদাহরণে, দেবপূজারূপ কৰ্ম্ম, পূর্ববাহ্ণে অনুষ্ঠিত হইলে, প্রশস্ত- শব্দে, মধ্যাহ্ণে বা অপরাহ্ণে অনুষ্ঠিত হইলে, অপ্রশস্তশব্দে, নিদ্দিষ্ট হইয়া থাকে। এ স্থলে দেবপূজারূপ এক কৰ্ম্মই, পূর্বাহ্ণে ও উদিতর সময়ে অর্থাৎ মধ্যাহ্ণে অথবা অপরাহ্ণে অনুষ্ঠানরূপ অবস্থাভেদ বশতঃ, প্রশস্ত ও অপ্রশস্ত শব্দে নির্দ্দিষ্ট হইতেছে। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন কৰ্ম্ম প্রশস্ত ও অপ্রশস্ত শব্দে নির্দিষ্ট হওয়া অদৃষ্টচর ও অশ্রুতপূর্ব। অতএব, সবর্ণাবিবাহ প্রশস্ত কল্প, আর অসবর্ণাবিবাহ অপ্রশস্ত কল্প, আমি এই যে নির্দেশ করিয়াছি, স্মৃতিরত্ন মহাশয়ের মতে তাহ। অসঙ্গত; কারণ, সবর্ণাধিবাহ নিত্য ও নৈমিত্তিক বলিয়া, এবং অসবর্ণাবিবাহ কাম্য বলিয়া, ব্যবস্থাপিত হইয়াছে; নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য, এই ত্রিবিধ বিবাহ এক কৰ্ম্ম বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে না।

এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, স্মৃতিরত্ন মহাশয়, সবিশেষ প্রণি- ধান পূর্ব্বক, এই আপত্তির উত্থাপন করিয়াছেন, এরূপ বোধ হয় না। তাঁহার উদাহৃত দেবপূজারূপ কৰ্ম্ম, যদি পূর্ব্বাহ্ণে অশু- ষ্ঠিত হইলে প্রশস্ত শব্দে, আর তদিতর কালে অর্থাৎ মধ্যায়ে বা অপরাহ্ণে অনুষ্ঠিত হইলে অপ্রশস্ত শব্দে, নির্দিষ্ট হইতে পারে, তাহা হইলে বিবাহরূপ কৰ্ম্ম, সবর্ণার সহিত অনুষ্ঠিত হইলে প্রশস্ত শব্দে, আর অসবর্ণার সহিত অনুষ্ঠিত হইলে অপ্রশস্ত শব্দে, নির্দ্দিষ্ট হইবার কোনও বাধা ঘটিতে পারে না। যেমন, এক দেবপূজারূপ কৰ্ম্ম, অনুষ্ঠানকালের বৈলক্ষণ্য অনুসারে, প্রশস্ত ও অপ্রশস্ত বলিয়া উল্লিখিত হইয়া থাকে; সেইরূপ, এক বিবাহরূপ কৰ্ম্ম, পরিণীয়মান কন্যার জাতিগত বৈলক্ষণ্য অনুসারে, প্রশস্ত ও অপ্রশস্ত শব্দে নির্দিষ্ট না হইবার কোনও কারণ লক্ষিত হইতেছে না। দেবপূজা দ্বিবিধ, প্রশস্ত ও অপ্রশস্ত; পূর্ববাহ্ণে অনুষ্ঠিত দেবপূজা প্রশস্ত; মধ্যাহ্ণে বা অপরাহে অনুষ্ঠিত দেবপূজা অপ্রশস্ত; বিবাহ দ্বিবিধ, প্রশ্নস্ত ও অপ্রশস্ত; সবর্ণার সহিত অনুষ্ঠিত, বিবাহ প্রশস্ত; অসবর্ণার সহিত অনুষ্ঠিত বিবাহ অপ্রশস্ত। এই দুই স্থলে কোনও বৈলক্ষণ্য লক্ষিত হইতেছে না। যদি নিত্য, নৈষি- ত্তিক, 'কাম্য, এই সংজ্ঞাতেদ বশতঃ, এক বিবাহকে ভিন্ন ভিন্ন কৰ্ম্ম বলিয়া নির্দেশ করিতে হয়, তাহা হইলে, পৌর্বাহিক, মাধ্যাত্মিক, আপরাব্লিক,' এই সংজ্ঞাভেদ বশতঃ, এক দেবপূজী ভিন্ন ভিন্ন কর্ম্ম বলিয়া পরিগণিত না হইবেক কেন। এক ব্যক্তি পূর্বাহ্ণে দেবপূজা করিয়াছে; স্মৃতিরত্ন মহাশয় ঐ পূর্বাহ্ণ কৃত দেবপূজাকে প্রশস্ত শব্দে 'নির্দিষ্ট করিবেন, তাহার সংশয় নাই; অন্য এক ব্যক্তি অপরাহ্ণে দেবপূজা করিয়াছে; স্মৃতিরত্ন মুহাশয় এই অপরাহকৃত দেবপূজাকে অপ্রশস্ত শব্দে' নির্দিষ্ট করিবেন, তাহার সংশয় নাই। প্রকৃত রূপে বিবেচনা করিতে গেলে, দুই পৃথক সময়ে দুই পৃথক ব্যক্তির কৃত দুই পৃথক দেব- পূজা, এক কৰ্ম্ম বলিয়া পরিগণিত না হইয়া, ভিন্ন ভিন্ন কৰ্ম্ম বলিয়া পরিগণিত হওয়াই উচিত বোধ হয়।

কিঞ্চ,

ব্রাহ্মে। দৈবস্তথৈবার্ষঃ প্রাজাপত্যস্তথাসুরঃ।

গান্ধবো রাক্ষসশ্চৈব পৈশাচম্পাষ্টমোহধমঃ ॥ ৩।২১ ॥ ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আকুর, গান্ধর্ব্ব, রাক্ষস, ও সকলের অধম পৈশাচ অষ্টম।

এই অষ্টবিধ বিবাহ (৪) নিদ্দিষ্ট করিয়া, মনু, চতুরো ব্রাহ্মণ্যাঘ্যান প্রশস্তান্ কবয়ো বিদুঃ।। রাক্ষসং ক্ষত্রিয় শ্যৈকমাসুরং বৈশ্যশূদ্রয়োঃ । ৩। ২৪।

ধর্মার্থে 'বরের নিকট হইতে এক বা দুই গোযুগল গ্রহণ করিয়া, বিধি পূর্ব্বক যে কন্যাদান, তাহাকে আর্য বিবাহ বলে।

সহোতৌ চরতাং ধর্ম্মমিতি বাচানুভাষ্য চ!

• ক্যাপ্রদানমভ্য্য প্রাজাপত্যো বিধিঃ স্বতঃ ॥ ৩। ৩০।

উভয়ে একসঙ্গে ধৰ্ম্মানুষ্ঠান কর, বাক্য দ্বারা এই নিয়ম করিয়া, অর্চনা পূর্বক ধে কল্লাদান, তাহাকে প্রাজাপত্য বিবাহ বলে।

জ্ঞাতিভ্যো দ্রবিণং দত্ত্বা কন্যায়ৈ চৈব শক্তিতঃ। কন্যাপ্রদানং স্বাচ্ছন্দ্যাদাহরো ধৰ্ম্ম উচ্যতে । ৩। ৩৯'।

গেচ্ছা অনুসারে, কন্যার পিতৃপক্ষকে এবং কন্দ্রাকে যথাশক্তি ধন দিয়া, ক্যাগ্রহণ, তাহাকে আসুর বিবাহ বলে।

ইচ্ছয়াহ্যোন্ডসংযোগঃ ক্যায়াশ্চ বরন্ত চ।

গান্ধর্ব্বঃ স তু বিজ্ঞেয়ো মৈথুন্সঃ কামসম্ভবঃ । ৩। ৩২। পরস্পর ইচ্ছা ও অনুরাগ বশতঃ, বর ও কন্যা উভয়ের যে মিলন তাহাকে গান্ধর্ব্ব

বিবাহ বলে। হত্বা ছিত্বা চ ভিত্বা চ ক্রোশন্তীং রুদতীং গৃহাৎ।

প্রসহ্য ক্যাহরণং রাক্ষসো বিধিরুচ্যতে । ৩০ ৩৩।

ক্যাপক্ষীয়দিগের প্রাণবধ, অঙ্গচ্ছেদ, ও প্রাচীরভঙ্গ করিয়া, পিতৃগৃহ হইতে, বল পূর্ব্বক, বিলাপকারিণী রোদনপরায়ণা কল্লার যে হরণ, তাহাকে রাক্ষুস বিবাহ বলে।

সুপ্তাং মত্তাং প্রমত্তাং বা রহো যত্রোপগচ্ছতি।

স পাপিষ্ঠো বিবাহানাং পৈশাচচাষ্টমোহধমঃ ॥ ৩। ৩৪। নির্জন প্রদেশে সুপ্তা, মত্তা, বা অসাবধানা কণ্যাকে যে সম্ভোগ করা, তাহাকে পৈশাচ বিশ্বাহ বলে। এই বিবাহ নিরতিশয় পাপকর ও সর্ব্ব বিবাহের অধম।

• বিবাহধর্ম্মজ্ঞেরা ব্যবস্থা করিয়াছেন, প্রথমনিদ্দিষ্ট চারি বিবাহ ব্রাহ্মণের পক্ষে

প্রশস্ত; ক্ষত্রিয়ের পক্ষে এক মাত্র ব্রাক্ষস, বৈশ্ব ও শূদ্রের পক্ষে আহর।

ব্রাহ্মণের পক্ষে ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, এই চতুর্বিধ বিবাহ প্রশস্ত বলিয়া ব্যবস্থা করিয়াছেন; সুতরাং,' আসুর, গান্ধব, রাক্ষস, পৈশাচ,; অবশিষ্ট এই চতুর্বিধ বিবাহ ব্রাহ্ম- ণের পক্ষে অপ্রশস্ত হইতেছে। যদি, ব্রাহ্মণের পক্ষে, ব্রাহ্ম •প্রভৃতি চতুর্বিধ বিবাহ প্রশস্ত, ও আসুর প্রভৃতি চতুর্বিধ'বিবাহ অপ্রশস্ত, বলিয়া নিদ্দিষ্ট হইতে পারে; তাহা হইলে, দ্বিজাতির পক্ষে, নিত্য ও 'নৈমিত্তিক বিবাহ প্রশস্ত, আর কাম্য বিবাহ অপ্রশস্ত, বলিয়া নির্দিষ্ট হইবার কোনও বাধা নাই। আর, যদি নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য, এই ত্রিবিধ বিবাহ ভিন্ন ভিন্ন কৰ্ম্ম বলিয়া পরিগণিত হয়, এবং উজ্জন্য নিত্য ও নৈমিত্তিক বিবাহ প্রশস্ত কল্প, কাম্য বিবাহ অপ্রশস্ত কল্প, বলিয়া উল্লিখিত হইতে না পারে; তাহা হইলে, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্ষ, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধব, রাক্ষস, পৈশাচ, এই অষ্টবিধ বিবাহও ভিন্ন ভিন্ন কৰ্ম্ম বলিয়া পরিগণিত হইবেক; এবং তাহা হইলেই, ব্রাহ্ম প্রভৃতি চতুর্বিবধ বিবাহ প্রশস্ত কল্প, আসুর প্রভৃতি চতুর্বিধ বিবাহ অপ্রশস্ত কল্প, এই মানবীয় ব্যবস্থা, স্মৃতিরত্ন মহাশয়ের মীমাংসা • অনুসারে, নিতান্ত অসঙ্গত হইয়া উঠে। অতএব, স্মৃতিরত্ন মহাশয়কে অগত্যা স্বীকার করিতে হইতেছে, হয় নিত্য, নৈষ্পিত্তিক, কাম্য, এই সংজ্ঞাভেদ বশতঃ, বিবাহ ভিন্ন ভিন্ন কর্ম্ম বলিয়া পরিগণিত হইবেক না; নয় অবস্থার বৈলক্ষণ্য বশতঃ, নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য, এই সংজ্ঞাভেদে ভিন্ন ভিন্ন কর্ম্ম বলিয়া পরিগণিত হইলেও, নিত্য ও নৈমিত্তিক বিবাহ প্রশস্ত কল্প, আর কাম্য বিবাহ অপ্রশস্ত কল্প, বলিয়া, উল্লিখিত হইতে পারিবেক।

স্মৃতিরত্ব মহাশয়ের সন্তোষের নিমিত্ত, এ বিষয়ে এক্ প্রামাণিক গ্রন্থকারের লিখন উদ্ধৃত হইতেছে;

"অনুলোমক্রমেণ দ্বিজাতীনাং সবর্ণাপাণিগ্রহণসমনস্তরং ক্ষত্রি- য়াদিক্যাপরিণয়ো বিহিতঃ, তত্র চ সবর্ণাবিবাহো মুখ্যঃ ইতর- অনুকল্পঃ"" (৫)।

দ্বিজাতিদিগের, সবর্ণাপাণিগ্রহণের পর, অনুলোম ক্রমে ক্ষত্রিয়াদি কল্পাপরিণয় বিহিত হইয়াছে; তন্মধ্যে সবর্ণা বিবাহ মুখ্য কল্প, অসবর্ণা বিবাহ অনুকল্প। এ স্থলে বিশ্বেশ্বরভট্ট সবর্ণাবিবাহকে প্রশস্ত কল্প, অসবর্ণা- বিবাহকে অপ্রশস্ত কল্প, বলিয়া স্পষ্ট, বাক্যে নির্দেশ করিয়া- ছেন। অতএব,

"সবর্ণাবিবাহ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্ব এই তিন বর্ণের পক্ষে, প্রশস্ত কল্প। কিন্তু, ধদি কোনও উৎকৃষ্ট বর্ণ, যথাবিধি সবর্ণাবিবাহ, করিয়া, যদৃচ্ছা ক্রমে, পুনরায় বিবাহ করিতে অভিলাষী হয়, তবে সে আপন অপেক্ষা নিকৃষ্ট বর্ণে বিবাহ করিতে পারে" (৬)।

এই লিখন উপলক্ষ করিয়া, স্মৃতিরত্ন মহাশয়, সবর্ণাবিবাহ প্রশস্ত কল্প, অসবর্ণাবিবাহ-অপ্রশস্ত কল্প, এই ব্যবস্থার উপর যে দোষারোপ কুরিয়াছেন, তাহা সম্যক সঙ্গত বোধ হইতেছে

না।

স্মৃতিরত্ন মহাশয়ের উত্থাপিত দ্বিতীয় আপত্তি এই;- "চারি ইত্যাদি জাতীয় সংখ্যা বলাতে ব্রাহ্মণের পাঁচ হুয়টী ব্রাহ্মণী বিবাহ শাস্ত্রবিরুদ্ধ নহে, এইটা দায়ভাগকর্তার অভি- প্রেত অর্থ" (৭)।

এবিষয়ে, বক্তব্য এই যে, দায়ভাগলিখন অথবা দায়ভাগের টীকাকারদিগের লিখন দ্বারা, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহব্যবহারের . সমর্থন সম্ভব ও সঙ্গত কি না, তাহা তর্কবাচস্পতি প্রকরণের সপ্তম পরিচ্ছেদে প্রদর্শিত হইয়াছে; এ স্থলে আর তাহার আলোচনার প্রয়োজন নাই (৮)।

স্মৃতিরত্ন মহাশয়ের তৃতীয় আপত্তি এই;

২। "আর ঐ অসবর্ণাবিবাহবিধিকে পরিসংখ্যাবিধি, পরিসংখ্যা বিধির নিয়ম এই যে স্থল ধরিয়া বিধি দেওয়া যায় তথ্যতিরিক্ত স্থলে নিষেধ সিদ্ধ বলিয়াছেন; হুতরাং যদৃচ্ছা ক্রমে অসবর্ণাবিবাহকে ধরিয়া বিধি দেওয়াতে, তদ্ব্যতিরিক্ত সবর্ণাবিবাহের নিষেধ সিদ্ধ হয়, এরূপ বিধির নিয়ম কুত্রাপি দেখা যায় না” (৯)।

এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, পরিসংখ্যাবিধির স্বরূপ প্রভৃতি বিষয়ের সবিশেষ পর্য্যালোচনা না করিয়াই, স্মৃতিরত্ন মহাশয় এই আপত্তির উত্থাপন করিয়াছেন। তর্কবাচস্পতি প্রকরণের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে, এই বিষয় সবিশেষ আলোচিত হইয়াছে। তাহাতে দৃষ্টিপাত করিলে, যদৃচ্ছাস্থলে, পরিসংখ্যা দ্বারা, সবর্ণাকিবাহের নিষেধ সিদ্ধ হয় কি না, তাহা, তিনি অবগত হইতে পারিবেন (১০)।

“বহুবিবাহবিষয়ক বিচার" পুস্তকে আলোচনাযোগ্য আর কোনও কথা লক্ষিত হইতেছে না; এজন্য, এই স্থলেই, স্মৃতি- রত্নপ্রকরণের উপসংহার করিতে হইল।

সামশ্রমিপ্রকরণ

যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুত্রিবাহকাণ্ড শাস্ত্রানুমোদিত ব্যবহার, ইহা প্রতি- পন্ন করিবার নিমিত্ত, শ্রীযুত সত্যব্রত সামশ্রমী যে পুস্তক প্রচারিত করিয়াছেন, উহার নাম "বহুবিবাহবিচারসমালোচনা"। আমি, প্রথম পুস্তকে, বহুবিবাহ রহিত হওয়ার ঔচিত্যপক্ষে যে সকল কথা লিখিয়াছিলাম, সে সমুদয়ের খণ্ডন করাই এ পুস্তকের উদ্দেশ্য। সামশ্রমী মহাশয়, এই উদ্দেশ্যসাধনে কত দূর কৃতকার্য্য হইয়াছেন, তাহার আলোচনা করা আবশ্যক। প্রথমতঃ, তিনি, বহুত্রিবাহের শাস্ত্রীয়তাসংস্থাপনের নিমিত্ত, অসবর্ণাবিবাহবিদায়ক মনুবচনের যে অদ্ভুত ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা উদ্ধৃত ও আলোচিত হইতেছে।

"বিদ্যাসাগর মহাশয়, প্রথম আপত্তি খণ্ডনে প্রবৃত্ত হইয়া বহুবিবাহ শাস্ত্রনিষিদ্ধ প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা পাইয়াছেন, কিন্তু তাহা বোধ হয় তাদৃশ মহৎ ব্যক্তির উক্তি না হইলে বিচার্য্যই হইত না।

(মনু) "সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণি। কামতন্ত্র প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো বরাঃ” ॥ ৩। ১২॥ কামত অসবর্ণাবিবাহে প্রবৃত্ত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈধ্যজাতির বিবাহকার্য্যে প্রথমতঃ সবর্ণা প্রশস্ত। এবং যথাক্রমে (অনুলোম) পাণিগ্রহণই প্রশংসনীয়" (১)।

মনুবচনের এই ব্যাখ্যা কিরূপে' প্রতিপন্ন বা সংলগ্ন হইতে পারে, বুঝিতে পারা যায় না। অন্ততঃ, যে সকল শব্দে এই বচন সঙ্কলিত হইয়াছে, তদ্দ্বারা তাহা প্রতিপন্ন হওয়া, কোনও মতে, সম্ভব নহে। আমার অবলম্বিত অর্থের অপ্রামাণ্য প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত, সাতিশয় ব্যগ্রচিত্ত হইয়া, সামশ্রমী মহাশয়, সুম্ভব অসম্ভব বিবেচনা বিষয়ে, নিতান্ত বহির্মুখ হইয়াছেন; এজন্য, মনুবচনের চিরপ্রচলিত অর্থে উপেক্ষাপ্রদর্শন করিয়া, কষ্টকল্পনা দ্বারা, অর্থান্তর প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত প্রয়াস 'পাইয়াছেন। তাঁহার অবলম্বিত পাঠের ও অর্থের সহিত বৈলক্ষণ্য- প্রদর্শনের নিমিত্ত, প্রথমতঃ বচনের প্রকৃত পাঠ ও প্রকৃত অর্থ প্রদর্শিত হইতেছে।

পূর্ববার্দ্ধ

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণি। দ্বিজাতিদিগের প্রথম বিবাহে সবর্ণা কন্তা বিহিতা।

উত্তরার্দ্ধ

কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো হবরাঃ।

কিন্তু, যাহারা, কামবশতঃ, বিবাহে প্রবৃত্ত হয়, তাহারা অনুলোম ক্রমে অসবর্ণ। বিবাহ করিবেক।

এই পাঠ ও এই অর্থ মাধবাচার্য্য, মিত্রমিশ্র, বিশ্বেশ্বরভট্ট প্রভৃতি পূর্ব্বতন প্রসিদ্ধ পণ্ডিতেরা অবলম্বন করিয়া গিয়াছেন। সামশ্রমী মহাশয় যে অভিনব ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা বচন দ্বারাও প্রতিপুন্ন হয় না, এবং সম্যক সংলগ্নও হয় না। তাঁহার অবলম্বিত অর্থ বচন দ্বারা প্রতিপন্ন হয় কি না, তৎপ্রদর্শনার্থ, বচনস্থিত প্রত্যেক পদের অর্থ ও সমুদিত অর্থ প্রদর্শিত হইতেছে।

সবর্ণাগ্রে

সবর্ণ। অগ্রে

দ্বিজাতীনাং

প্রশস্তা

দারকৰ্ম্মণি।

দ্বিজাতীনাং

প্রশস্তা

দারকর্ম্মণি।

সবর্ণ। প্রথমে

দ্বিজাতিদিগের

বিহিতা

বিবাহে

দ্বিজাতিদিগের প্রথম বিবাহে সবর্ণা বিহিতা।

কামতস্তু

প্রবৃত্তানামিমাঃ

ক্রমশো হবরাঃ ॥

কামতঃ তু প্রবৃত্তানাম্ ইমাঃ

স্যুঃ

ক্রমশঃ অবরাঃ।

কাম' বশতঃ কিন্তু প্রবৃত্তদিগের এই সকল হইবেক ক্রমশঃ অবরা।

কিন্তু কাম বশতঃ বিবাহপ্রবৃত্তদিগের অনুলোম ক্রমে এষ্ট সকল (অর্থাৎ পরবচনোক্ত)। অবর। (অর্থাৎ অসবর্ণা কন্তারা) ভাৰ্য্যা হইবেক।

এক্ষণে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, "কামত অসবর্ণারিবাহে প্রবৃত্ত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যজাতির বিবাহকার্য্যে প্রথমতঃ সবর্ণা প্রশস্ত। এবং যথাক্রমে অনুলোমপাণিগ্রহণই প্রশংসনীয়"; সামশ্রমী মহাশয়ের এই অর্থ বচন দ্বারা প্রতিপন্ন হইতে পারে কি না। উপরিভাগে যেরূপ দর্শিত হইল, তদনুসারে, বচনের পূর্ববার্দ্ধ দ্বারা, প্রথম বিবাহে সবর্ণার বিহিতত্ব, ও উত্তরার্দ্ধ দ্বারা, কাম বশতঃ বিবাহপ্রবৃত্ত ব্যক্তিবর্গের পক্ষে, অসবর্ণাবিবাহের কর্তব্যত্ব, বোধিত হইয়াছে; সুতরাং, পূর্ব্বার্দ্ধ ও উত্তরার্দ্ধ পরস্পর- বিভিন্ন অর্থের প্রতিপাদক, সর্ব্বতোভাবে পরস্পর নিরপেক্ষ, বিভিন্ন বাক্যদ্বয় বলিয়া স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে। কিন্তু, সামশ্রমী মহাশয় পূর্ব্বার্দ্ধ সমুদয় ও উত্তরার্দ্ধের অর্ধাংশ, অর্থাৎ বচনের প্রথম তিন চরণ লইয়া এক বাক্য, আর উত্তরার্দ্ধের দ্বিতীয় অর্দ্ধ, অর্থাৎ বচনের চতুর্থ চরণ মাত্র লইয়া এক বাক্য ব্যবস্থিত করিয়াছেন; যথা,

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণি।

কামতত্ত্ব প্রবৃত্তানাম্ ।।

কামত অসবর্ণাবিবাহে প্রবৃক্ত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যজাতিব সিবাহকার্য্যে প্রথমতঃ সবর্ণ। প্রশস্ত।

ইমাঃ স্যুঃ ক্রমশো বরাঃ। এবং যথাক্রমে অনুলোমপাঁণিগ্রহণই প্রশংসনীয়।

• এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, "কামতস্তু প্রবৃত্তানাং," "কাল বশতঃ কিন্তু প্রবৃত্তদিগের,” এই স্থলে "কিন্তু” এই অর্থের বাচক যে "তু" শব্দ আছে, সামশ্রমী অহাশয়ের ব্যাখ্যায় তাহা এক বারে • পরিত্যক্ত হইয়াছে। সর্বসম্মত চিরপ্রচলিত অর্থে ঐ "তু" • শব্দের সম্পূর্ণ আবশ্যকতা, সুতরাং সম্পূর্ণ সার্থকতা আছে। সামশ্রণী মহাশয়ের ব্যাখ্যায়, ঐ "তু" শব্দের অণুমাত্র আবশ্যকতা • লক্ষিত হইতেছে না; এজন্য, উহা একবারে পরিত্যক্ত হইয়াছে; সুতরাং, উহার সম্পূর্ণ বৈয়র্থ্য ঘটিতেছে। আর, "প্রবৃত্ত” এই শব্দের, “অসবর্ণাবিবাহে প্রবৃত্তয়, এই অর্থ লিখিত হইয়াছে। প্রকরণ বশতঃ, "প্রবৃত্ত” শব্দের, "বিবাহপ্রবৃত্ত”, এ অর্থ প্রতিপন্ন হইতে পারে; কিন্তু, "অসবর্ণাবিবাহে প্রবৃত্ত," এই অসবর্ণা শব্দ বল পূর্ববক সন্নিবেশিত হইয়াছে। আর, "ইমাঃ স্ন্যুঃ ক্রমশোহবরাঃ”, এই সকল হইবেক ক্রমশঃ অবরা”, এই অংশ - দ্বারা, “এবং যথাক্রমে অনুলোমপাণিগ্রহণই প্রশংসনীয়,” এ অর্থ 'কিরূণ্ডে প্রতিপন্ন করিলেন, তিনিই তাহা বলিতে পারেন। প্রথমতঃ, “এবং যথাক্রমে" এ স্থলে, "এবং" এই অর্থের বোধক কোনও শব্দ মূলে লক্ষিত হইতেছে না। মূলে তাদৃশ শব্দ নাই, এবং চিরপ্রচলিত অর্থেও তাদৃশ শব্দের আবশ্যকতা নাই। কিন্তু, সামশ্রফী মহাশয়ের ব্যাখ্যায়, "এবংশব্দ" প্রবেশিত না হইলে, পূর্বাপর সংলগ্ন হয় না; এজন্য, মূলে না থাকিলেও, ব্যাখ্যাকালে, কল্পনাবলে, তাদৃশ শব্দের আহরণ করিতে হইয়াছে। আর, • "ক্রমশঃ”, এই পদের, "অনুলোম ক্রমে", এই অর্থ প্রকরণ বশতঃ লব্ধ হয়; এজন্য, এই অর্থই পূর্বাপর প্রচলিত আছে।

সচরাচর, "ক্রমশঃ”, এই পদের, "যথাক্রমে", এই অর্থ হইয়া থাকে। সামশ্রমী মহাশয়, এস্থলে ঐ অর্থ অবলম্বন করিয়াছেন। কিন্তু, যখন, "ক্রমশঃ", এই পদের, "যথাক্রমে", এই অর্থ অবলম্বিত হইল, তখন, "অনুলোমপাণিগ্রহণই", এ স্থলে, বচন, স্থিত কোন শব্দ আশ্রয় করিয়া, অনুলোমশব্দ প্রযুক্ত হইয়াছে, তাহা দেখাইয়া দেওয়। আবশ্যক ছিল। যদিও, "ক্রমশঃ”, এই পদের, স্থলবিশেষে "যথাক্রমে", স্থলবিশেষে "অনুলোম ক্রমে", ইত্যাদি অর্থ প্রতিপন্ন হইয়া থাকে; কিন্তু, এক স্থলে; এক "ক্রমশঃ” এই পদ দ্বারা, দুই অর্থ, কোনও ক্রমে, প্রতিপন্ন হইতে। পারে না। আর, "অনুলোমপাণিগ্রহণই প্রশংসনীয়,” এ স্থলে, "প্রশংসনীয়”, এই অর্থ, বচনের অন্তর্গত কোনও শব্দ দ্বারা, প্রতিপন্ন হইতে পারে না। বোধ হইতেছে, “ক্রমশো হবরাঃ”, এ স্থলে, "অবরাঃ”, এই পাঠ বচনের প্রকৃত পাঠ, তাহা তিনি অবগত নহেন; এজন্য, "অবরাঃ” এ স্থলে, "বরাঃ” এই পাঠ স্থির করিয়া, ভ্রান্তিকূপে পতিত হইয়া, "প্রশংসনীয়”, এই অর্থ লিখিয়াছেন। মনুবচনের প্রকৃত পাঠ ও প্রকৃত অর্থ কি, তাহা, তর্কবাচস্পতি প্রকরণের প্রথম পরিচ্ছেদে, সবিস্তর আগাচিত হইয়াছে, সামশ্রমী মহাশয়, কিঞ্চিৎ শ্রম স্বীকার পূর্বক, ঐে স্থলে (২) দৃষ্টিযোজনা করিলে, সবিশেষ অবগত হইতে পারিবেন। এক্ষণে, মনুবচনের দ্বিবিধ অর্থ উপস্থিত; প্রথম চিরপ্রচলিত, দ্বিতীয় সামশ্রমিকল্পিত। যেরূপ দর্শিত হইল, তদনুসায়ে চির- প্রচলিত অর্থে, বচনস্থিত প্রত্যেক পদের সম্পূর্ণ সার্থকতা থাকিতেছে; সামশ্রমিকল্পিত অর্থে, বচনে অধিকপদতা, ন্যূনপর্দতা, কষ্টকল্পনা প্রভৃতি উৎকট দোষ ঘটিতেছে। এমন স্থলে, কো অর্থ প্রকৃত অর্থ বলিয়া অবলম্বিত হওয়া উচিত, তাহা সকলে বিবেচনা করিয়া দেখিবেন। ফলকথা' এই, তাঁহার অবলম্বিত অর্থে, বচনের অন্তর্গত পদসমূহ দ্বারা, প্রতিপন্ন হওয়া, কোনও মতে, সম্ভব নহে।

এক্ষণে, ঐ অর্থ সংলগ্ন হইতে পারে কি না, তাহা আলোচিত হইতেছে। তিনি লিখিয়াছেন, "কামত অসবর্ণাবিবাহে প্রবৃত্ত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য জাতির বিবাহকার্য্যে প্রথমতঃ সবর্ণা প্রশস্ত"। গৃহস্থ ব্যক্তিকে, গৃহস্থাশ্রমসম্পাদনের নিমিত্ত, প্রথমে সবর্ণাবিবাহ করিতে হয়, ইহা সর্বশাস্ত্রসম্মত ও সর্ববাদিসম্মত। তবে, সবর্ণা কন্ট্যার অপ্রাপ্তি ঘটিলে, অসবর্ণাবিবাহের বিধি ও ব্যবস্থা আছে; সুতরাং, সবর্ণা' কন্যার প্রাপ্তি সম্ভবিলে, গৃহস্থ ব্যক্তিকে, গৃহস্থধৰ্ম্মনির্বাহের নিমিত্ত, সবর্ণাবিবাহই করিতে হয়। তদনুসারে, এক ব্যক্তি, গৃহস্বধর্ম্মনির্বাহের নিমিত্ত, প্রথমে যথাবিধি সবর্ণাবিবাহ করিয়াছে। তৎপরে, কাম বশতঃ, ঐ ব্যক্তির অসবর্ণাবিবাহে ইচ্ছা হইল। এক্ষণে, সামশ্রমী মহাশয়ের ব্যাখ্যা অনুসারে, অসবর্ণা বিবাহ করিবার পূর্ব্বে, সে ব্যক্তিকে অগ্রে আর একটি সবর্ণা বিবাহ করিতে হইবেক। তর্কবাচস্পতি- প্রকরণে বিশদরূপে প্রতিপাদিত হইয়াছে, ধৰ্ম্মার্থে সবর্ণাবিবাহ, ও কামার্থে অসবর্ণাবিবাহ, শাস্ত্রকারদিগের অনুমোদিত কার্য্য; তদনুসারে, অগ্রে সবর্ণাবিবাহ অবশ্যকর্ত্তব্য; সবর্ণাবিবাহ করিয়া, কাম বশতঃ পুনরায় বিবাহ করিতে ইচ্ছা হইলে, অসৰ্ব্বাবিবাহ করিবেক, কদাচ সবর্ণাবিবাহ করিতে পারিবেক না; সুতরাং, • যদৃচ্ছা স্থলে, সবর্ণাবিবাহ একবারে নিষিদ্ধ হইয়াছে। এমন স্থলে,

কাম বশতঃ অসবর্ণাবিবাহে ইচ্ছা হইলে, দ্বিজাতিদিগকে অগ্রে আর একটি সবর্ণা বিবাহ করিতে হইবেক, এ কথা নিতান্ত'হেয় ও অশ্রদ্ধেয়। আর; যদি তদীয় ব্যাখ্যার এরূপ তাৎপর্য্য হয়, দ্বিজাতিদিগের পক্ষে প্রথমে সবর্ণাবিবাহই কর্তব্য; তৎপরে,.' • কাম বশতঃ বিবাহ করিতে ইচ্ছা হইলে, অসবর্ণাবিবাহই কর্ত্তব্য; তাহা হইলে, তদর্থে এতাদৃশ বক্র পথ আশ্রয় করিবার কোনও প্রয়োজন ছিল না; কারণ, চিরপ্রচলিত সহজ অর্থ দ্বারাই, তাহা সম্যক সম্পন্ন হইতেছে। বোধ হয়, সামশ্রমী মহাশয়. ধৰ্ম্মশাস্ত্রের বিশিষ্টরূপ অনুশীলন করেন নাই; তাহা করিলে, কেবল বুদ্ধিবল অবলম্বন পূর্বর্বক, অকায়ণে, মনুবচনের ঈদৃশ অসঙ্গত ও অসম্ভব অর্থান্তরকল্পনায় প্রবৃত্ত হইতেন না।

সামশ্রমী মহাশয়, বচনের এইরূপ অর্থের কল্পনা করিয়া, ঐ অর্থের বলে, যে তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা এই;- "ব্যিাসাগর মহাশয় এই বিধিটিকে পরিসংখ্যা করিয়া নিষেধ- বিধির কল্পনা করিয়াছেন, কিন্তু কি আশ্চর্য্য! এই বিধিটি কি নিয়ামক হইতে পারে না? ইহা দ্বারা কি অগ্রে সবর্ণাবিবাহই কর্তব্য ও অনুলোমবিবাহই কর্তব্য এই দুইটি নিয়ম বিধিবদ্ধ হইতেছে না? অসবর্ণাবিবাহ করিতে ইচ্ছা হইলে প্রথমে সবর্ণাবিবাহ 'করিতেই হইবে এবং পরে যথাযথ হীনবর্ণা বিবাহ করিবে এইটি কি ঐ বিধির প্রকৃত ভাব নহে? (৩)।"

এ স্থলে বক্তব্য এই যে, তর্কবাচস্পতি প্রকরণের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে প্রতিপাদিত হইয়াছে, মশুবচনোক্ত বিবাহবিধিকে অপূর্ব্যবিধিই বল, নিয়মবিধিই বল, পরিসংখ্যাবিধিই বল, আমার পক্ষে তিনই সমান; তবে পরিসংখ্যার প্রকৃত স্থল বলিয়া বোধ হওয়াতেই, পরিসংখ্যাপক্ষ অবলম্বিত হইয়াছিল (৪)। অতএব, যদি সামশ্রমী মহাশয়ের পরিসংখ্যায় নিতান্ত অরুচি থাকে; এবং এই বিবাহ- "বিধিকে নিয়মবিধি বলিয়া স্বীকার করিলে, তাঁহার সন্তোষ জন্মে, তাহা হইলে আমি তাহাতেই সম্মত হইতেছি; আর নিয়মবিধি স্বীকার করিয়া তিনি প্রথমে যে ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহাও • অঙ্গীকার করিয়া লইতেছি। তাঁহার ব্যবস্থা এই; "ইহা দ্বারা •কি অগ্রে সবর্ণাবিবাহ কর্ত্তব্য ও অনুলোমবিবাহই কর্ত্তব্য এই দুইটি নিয়ম বিধিবদ্ধ হইতেছে না?” পূর্বে দর্শিত হইয়াছে, •মনুবচনের পূর্বার্দ্ধ দ্বারা, "অগ্রে সবর্ণাবিবাহ কর্ত্তব্য", এই অর্থই প্রতিপন্ন হয়, অণর, "অনুলোমবিবাহই কর্তব্য" অর্থাৎ কাম বশতঃ বিবাহ 'করিতে ইচ্ছা হইলে, অনুলোম ক্রমে অসবর্ণাবিবাহ কর্ত্তরা; মনুবচনের উত্তরার্দ্ধ দ্বারা, এই অর্থই প্রতিপন্ন হয়। অতএব, যদি সামশ্রমী মহাশয়ের ঐ মীমাংসার এরূপ তাৎপর্য্য হয়, তাহা হইলে তদীয় ঐ মীমাংসায় কোনও আপত্তি নাই; কারণ, নিয়মবিধি অবলম্বিত হইলে,

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্মণি। দ্বিজাতিদিগের প্রথম বিবাহে সবর্ণা কল্লা বিহিতা।

এই পূর্ববার্দ্ধ দ্বারা

দ্বিজাতিরা প্রথম বিবাহে সবর্ণা কন্তারই পাণিগ্রহণ করিবেক। এই অর্থ প্রতিপন্ন হইবেক। আর,

কামতত্ত্ব প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো হবরাঃ।

কিন্তু, কাম বশতঃ বিবাহ প্রবৃত্ত দ্বিজাতিরা, অনুলোম ক্রমে, অসবর্ণা রিবাহ করিবেক।

এই উত্তরার্দ্ধ দ্বারা,

কাম বশতঃ বিবাহপ্রবৃত্ত দ্বিজাতিরা, অনুলোম ক্রমে, অসবর্ণা কক্তারই পাণি- গ্রহণ করিবেক। L

এই অর্থ প্রতিপন্ন হইবেক। কিন্তু, “অসবর্ণাবিবাহ করিতে ইচ্ছা হইলে প্রথমে সবর্ণাবিবাহ করিতেই হইবে এবং পরে যথাযথ হীনবর্ণা বিবাহ করিবে এইটি কি ঐ বিধির প্রকৃত ভাব নহে?" ভাবব্যাখ্যা, কোনও অংশে, সঙ্গত হইতে পারে না; কারণ, ইতঃ পূর্বের যেরূপ দর্শিত হইয়াছে, তদনুসারে মনুবচন দ্বারা

তাদৃশ অর্থ প্রতিপন্ন হওয়া সম্ভব নহে। সামশ্রমী মহাশয়ের দ্বিতীয় আপত্তি এই; “একাদশ পৃষ্ঠায় “সর্ব্বাসামেকপত্নীনামেকা চেৎ পুত্রিণী ভবেৎ।

সর্বাস্তাস্তেন পুত্রেণ প্রাহ পুত্রবর্তীমুনুঃ। ৯। ১৮৩।” মনু কহিয়াছেন, সপত্নীদের মধ্যে যদি কেহ পুত্রবর্তী হয়, সেই সপত্নী পুত্র দ্বারা, তাহারা সকলেই পুত্রবর্তী গণ্য হইবেক।

এই বচনের বিষয়ে লিখিত হইয়াছে "দ্বিতীয় বচনে যে বহু- বিবাহের উল্লেখ আছে, তাহা কেবল পূর্ব্ব পূর্ব্ব স্ত্রীর বন্ধ্যাত্মনিব- ন্ধন ঘটিয়াছিল, তাহা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে; কারণ, ঐ বচনে পুত্রহীনা সপত্নীদিগের বিষয়ে ব্যবস্থা প্রদত্ত হইয়ুচ্ছ। এস্থলে আমরা বলি-'একা চেৎ পুত্রিণী ভবেৎ' যদি একজনা পুত্রিণী হয়, এই অনির্দিষ্ট বাক্যানুসারেই পুত্রিণী' স্ত্রী সংঃত্বও বিবাহ প্রতিপন্ন হইতেছে, অন্যথা শেষ পত্নীই পুত্রিণী সুস্থিরই রহিয়াছে-এ স্থলে 'যদি কেহ পুত্রিণী' এই নির্দেশহীন বাক্য কেন প্রযুক্ত হইবে ?" (৫)। T

যদি কেহ পুত্রবর্তী হয়, এই অনিশ্চিত নির্দেশ দর্শনে, সামশ্রমী মহাশয়, পুত্রবর্তী স্ত্রী সত্ত্বেও বিবাহ প্রতিপন্ন হইতেছে, এই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। তাঁহার অভিপ্রায় এই, যদি এই বচনো- ক্লিখিত বহু বিবাহ পূর্বব পূর্ব স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব নিবন্ধন হইত, তাহা হইলে, যদি কোনও স্ত্রী পুত্রবর্তী হয়, এরূপ অনিশ্চিত নির্দেশ না থাকিয়া, বদি কনিষ্ঠ। স্ত্রী পুণ্ড্রবর্তী হয়, এরূপ নিশ্চয়াত্মক নির্দেশ থাকিত; কারণ, পূর্বব পূর্ব স্ত্রী বন্ধ্যা বলিয়া অবধারিত হওয়াতেই, কনিষ্ঠা স্ত্রী বিবাহিত হইয়াছিল; এমন স্থলে, কনিষ্ঠারই পুত্র হইবার সম্ভাবনা; এবং, তন্নিমিত্ত, যদি কনিষ্ঠা পত্নী পুত্রবর্তী হয়, এরূপ নির্দেশ থাকাই সম্ভব; যখন তাহা না থাকিয়া, যদি কোনও পত্নী'পুত্রবর্তী হয়, এরূপ অনিশ্চিত নির্দেশ আছে, তখন জ্যেষ্ঠা প্রভৃতিরও পুত্রবর্তী হওয়া সম্ভব, এবং তাহা হইলেই পুণ্ড্রবর্তী স্ত্রী সঙ্গে বিবাহ প্রতিপন্ন হইল; অর্থাৎ জ্যেষ্ঠা বা অন্য কোনও পূর্ব্ববিবাহিতা স্ত্রী পুত্রবতী হইলে পর, কনিষ্ঠা প্রভৃতি স্ত্রী বিবাহিতা হইয়াছে; সুতরাং, যদৃচ্ছা ক্রমে যত ইচ্ছা বিবাহ মনুবচন দ্বারা সমর্থিত হইতেছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, যদি এক ব্যক্তিয় বহু স্ত্রীর মধ্যে ঝেহ পুত্রবর্তী হয়, সেই পুত্র দ্বারা সকলেই পুত্রবর্তী গণ্য হইবেক, ইহা বলিলে, পুণ্ড্রবর্তী স্ত্রী সত্ত্বে বিবাহ কিরূপে প্রতিপন্ন হয়, বলিতে পারা যায় না। এক ব্যক্তির কতকগুলি স্ত্রী আছে; উন্মধ্যে যদি কাহারও পুত্র জন্মে, সেই পুত্র দ্বারা, তাহারা সকলেই পুত্রবর্তী গণ্য হইবেক, এ কথা বলিলে, সে ব্যক্তির বর্তমান সকল স্ত্রীই পুত্রহীনা, ইহাই প্রতিপন্ন হয়। বস্তুতঃ, পুত্রহীন স্ত্রীসমূহের বিষয়েই এই ব্যবস্থা প্রদত্ত হইয়াছে। অতএব, "পুত্রবর্তী স্ত্রী সত্ত্বেও বিবাহ প্রতিপন্ন হইতেছে,” সামশ্রমী মহাশয়ের এই সিদ্ধান্ত বচনের অর্থ দ্বারা সমর্থিত হইতেছে না। "সপত্নীদের মধ্যে যদি কেহ পুত্রবর্তী হয়,” এ স্থলে "যদি হয়" এরূপ, সংশয়াত্মক নির্দেশ না থাকিয়া, "সপত্নীদের মধ্যে এক জন পুণ্ড্রবর্তী", যদি এরূপ নিশ্চয়াত্মক নির্দেশ থাকিত, তাহা হইলেও বরং পুণ্ড্রবর্তী স্ত্রী সত্ত্বে বিবাহ করিয়াছে, এরূপ অনুমান কথঞ্চিৎ সম্ভব হইতে পারিত। আর, যদি কোনও ব্যক্তি, পূর্বা: পূর্বব স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব আশঙ্কা করিয়া, ক্রমে ক্রমে বহু বিবাহ করিয়া থাকে, সে স্থলে "শেষ পত্নীই পুত্রিণী সুস্থিরই রহিয়াছে,” কেন, বুঝিতে পারা যায় না। সামশ্রমী মহাশয় সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছেন, যখন পূর্ণব পূর্ব স্ত্রীকে বন্ধ্যা স্থির করিয়া, পুনরায় বিবাহ করিয়াছে, তখন কনিষ্ঠা স্ত্রীরই সন্তান হওয়া সম্ভব, পূর্ব পূর্ব স্ত্রীদিগের আর সন্তান হইবার সম্ভাবনা কি। কিন্তু ইহা অদৃষ্টচর ও অশ্রুতপূর্ব নহে যে, পূর্ব স্ত্রীকে বন্ধ্যা স্থির করিয়া, পুত্রার্থে পুনরায় বিবাহ করিলে পর, কোনও কোনও স্থলে, পূর্ব স্ত্রীর সন্তান হইয়াছে; কোনও কোনও স্থলে উভয় স্ত্রীর সন্তান হইয়াছে; কোনও কোনও স্থলে উভয়েই গর্ভধারণে অসমর্থ হইয়াছে। অতএব "শেষ পত্নীই পুত্রিণী সুস্থিরই রাইয়াছে," এই সিদ্ধান্ত নিতান্ত অনভিজ্ঞতামূলক, তাহার সংশয় নাই।' সামশ্রমী মহাশয়ের তৃতীয় আপত্তি এই;

"যদি তাঁহাদের আচরণ অনুকার্য্যই না হইবে, 'তবে

"যাদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ”। ইত্যাদি অর্জুনের প্রতি ভগবছপদেশই বা কি আশয়ে ব্যক্ত হইয়াছিল? ইহাও আমদের সুগম নহে” (৬)।

কৃষ্ণ অর্জুনকে কহিয়াছিলেন, প্রধান লোকে যে সকল কৰ্ম্ম করে, সামান্য লোকে সেই সকল কর্ম্ম করিয়া থাকে; অর্থাৎ প্রধান লোকের অনুষ্ঠানকে দৃষ্টান্তস্থলে প্রতিষ্ঠিত করিয়া, সামান্য লোকে তদনুসারে চলে। পূর্বকালীন দুয়্যন্ত প্রভৃতি রাজারা প্রধান ব্যক্তি; তাঁহারা যদৃচ্ছাক্রমে বহু বিবাহ করিয়াছিলেন; যদি, তাঁহাদের আচরণ দর্শনে, তদনুসারে চলা কর্তব্য না হয়, তাহা হইলে, ভগবান্ বাসুদেব, কি আশযে, অর্জুনকে ওরূপ উপদেশ দিলেন, সামশ্রমী মহাশয় সহজে তাহা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন নাই।

এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, সামশ্রমী মহাশয় ভগবদ্বাক্যের অর্থবোধ ও 'তাৎপর্য্যগ্রহ করিতে পারেন নাই; এজন্য, "তাৰ্জ্জুনের প্রতি ভগবদুপদেশই বা কি আশয়ে ব্যক্ত হইয়াছিল?", তাহা, তাঁহার পক্ষে, “সুগম” হয় নাই। এই ভগবদুক্তি উপদেশবাক্য নহে; উহা, পূর্ব্বগত উপদেশবাক্যের সমর্থনের নিমিত্ত, লোক- ব্যবহারকীর্ত্তন মাত্র। যথা,

তস্মাদসক্তঃ সততং কার্য্যং কৰ্ম্ম সমাচর।

অসঁক্তো হ্যাচরন কৰ্ম্ম পরমাপ্নোতি পূরুষঃ।৭৩। ১৯। (৭)

অতএব, আসক্তিশুগ্ধ হইয়া, সতত কর্তৃব্য কৰ্ম্ম কর। আসক্তিশুন্ত হইয়া কর্ম্ম করিঝে, পুরুষ, মোক্ষপদ পায়।

এইটি অর্জুনের প্রতি ভগবানের উপদেশবাক্য। এইরূপে কর্তব্য 'কর্ম্ম করিবার উপদেশ দিয়া, তাহার ফলকীর্ত্তন ও প্রয়োজন- প্রদর্শন করিতেছেন,

কর্ম্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিত। জনকাদয়ঃ।

লোকসং গ্রহমেবাপি সম্পশ্যন্ কর্তৃমইসি । ৩। ২০, ॥ (৮) জনক প্রভৃতি কৰ্ম্ম দ্বারাই মোক্ষপদ পাইয়াছিলেন। লোকের উপদেশার্থেও তোমার, কর্ম্ম করা উচিত।'

অর্থাৎ, জনক প্রভৃতি, আসক্তিশূন্য হইয়া, কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম করিয়া, মোক্ষপদ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন; তুমিও তদনুরূপ কর, তদনুরাপ, ফল পাইবে। আর, তুমি কর্ত্তব্য কর্ম্ম করিলে, উত্তরকালীন লোকেরা, তোমার দৃষ্টান্তের অনুবর্তী হইয়া, কর্ত্তব্য কর্মের অনুষ্ঠানে রত হইবেক; সে অনুরোধেও, তোমার কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম করা উচিত। আমি কর্ত্তব্য কর্ম্ম করিলে, লোকে আমার দৃষ্টান্তের অনুবর্তী হইয়া চলিবেক কেন; এই আশঙ্কার নিবারণের নিমিত্ত, কহিতেছেন,

যদ্যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ ।

স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ত্ততে। ৩। ২১ । (৮) প্রধান লোকে যে যে কর্ম করেন, সামান্ত লোকে সেই সেই কৰ্ম্ম করিয়া থাকে; তিনি যাহা প্রমাণ বলিয়া অবলম্বন করেন, লোকে তাঁহার অনুবর্তী হইয়া চলে। C

অর্থাৎ, সামান্য লোকে স্বয়ং কর্তৃব্যাকর্তব্যনির্ণয়ে সমর্থনহে; প্রধান লোকে যে সকল কর্ম্ম করিয়া থাকের, বিহিতই হউক, নিষিদ্ধই হউক, সেই সেই কর্ম্মকে দৃষ্টান্তরূপে পরিগৃহীত. করিয়া,' উহাদের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে। অতএব, তাদৃশ লোকদিগের শিক্ষার্থেও, তোমার পক্ষে, কর্ত্তব্য কর্ম্মের অনুষ্ঠানে রত হওয়া আবশ্যক। ঊনবিংশ শ্লোকে, আসক্তিশূন্য হইয়া কর্তব্য কর্ম্ম কর, ভগবান, অর্জুনকে এই যে উপদেশ দিয়াছিলেন, একবিংশ শ্লোক দ্বারা, লোকশিক্ষারূপ প্রয়োজন দর্শাইয়া, সেই উপদেশের সমর্থন করিয়াছেন। এই শ্লোক স্বতন্ত্র উপদেশবাক্য নহে। লোকে সচরাচর যেরূপ করিয়া থাকে, তাহাই, এই শ্লোক দ্বারা, প্রদর্শিত হইয়াছে। এই তাৎপর্যব্যাখ্যা আমার কপোলকল্পিত নহে। সাম- শ্রমী মহাশয়ের সন্তোষার্থে, এই শ্লোকের আনন্দগিরিকৃত ব্যাখ্যা উদ্ধৃত হইতেছে;-

"শ্রুতাধ্যয়নসম্পন্নত্বেনাভিমতো জনো যছাৎ বিহিতং প্রতিযিদ্ধং বা কৰ্ম্মানুতিষ্ঠতি তত্তদেব প্রাকৃতো, জনোহমুবর্ত্ততে"।

যাঁহাকে বেদজ্ঞ ও মীমাংসাদিশাস্ত্রজ্ঞ মনে করে, তাদৃশ ব্যক্তি, বিহিতই হউক, আর নিষিদ্ধই হউক, যে যে কৰ্ম্ম করেন, সামান্য লোকে, তদৃষ্টে, সেই সেই কর্ম্ম করিয়া থাকে।

সামান্য লোকে, সকল বিষয়ে, প্রধান লোকের আচার দেখিয়া, তদনুসারে চলিয়া থাকে; তাঁহাদের আচার শাস্ত্রীয় বিধির ও শাস্ত্রীয় নিষেধের অনুযায়ী কি না, তাহা অনুধাবন করিয়া দেখে না; ইহাই ঐ শ্লোকে উল্লিখিত হইয়াছে; নতুবা, প্রধান লোকে যাহা করিবেন, সর্বসাধারণ লোকের তাহাই করা কর্ত্তব্য, এরূপ উপদে দেওয়া উহার উদ্দেশ্য নহে। সর্ব্ব, বিষয়ে প্রধান লোকের দৃষ্টান্তের, অনুবর্তী হওয়া, সর্বসাধারণ লোকের পক্ষে, শ্রেয়স্কর নহে; কত দূর পর্য্যন্ত তাদৃশ দৃষ্টান্তের অনুসরণ করিয়া চলা উচিত, শাস্ত্রকারেরা সে বিষয়ে সতর্ক করিয়া দিয়াছেন। আপস্তম্ব কহিয়াছেন,

• দৃষ্টো ধৰ্ম্মব্যতিক্রমঃ সাহসঞ্চ মহতাম্। ২। ৬। ১৩০৮। তেষাং তেজোবিশেষেণ প্রত্যবায়োন বিছাতে। ২। ৬। ১৩।৯। তদন্বীক্ষ্য, প্রযুঞ্জানঃ সীদত্যবরঃ। ২। ৬। ১৩। ১০ ॥ প্রধান লোকদিগের ধর্ম্মলঙ্ঘন ও অবৈধ আচরণ দেখিতে পাওয়া যায়। ৮।

তাহার। তেজীয়ান, তাহাতে তাঁহাদের প্রত্যবায় নাই। ৯। সাধারণ লোকে, তদ্দর্শনে তদনুবর্তী হইয়া চলিলে, এক কালে উৎসন্ন হয়। ১০।

শুকদেব কহিয়াছেন,

ধৰ্ম্মব্যতিক্রমো দৃষ্ট ঈশ্বরাণাঞ্চ সাহসম্।

নৈতৎ সমাচরেজ্জাতু মনসাপি হানীশ্বরঃ '

তেজীয়সাং ন, দোষায় বহ্নেঃ সর্বভুজো যথা ॥ ৩৩। ৩ বিনশ্যত্যাচরন্ মৌঢ্যাছ্যথা রুদ্রোহব্ধিজং বিষম্ ॥ ৩৩। ৩১৯" ঈশ্বরাণাং বচঃ সত্যং তথৈবাচরিতং কচিৎ। তেষাং যৎ স্ববচোযুক্তং বুদ্ধিমাংস্ততদাচরেৎ ।। ৩৩। ৩২। (৯)

প্রধান লোকদিগের ধর্ম্মলঙ্ঘন ও অবৈধ আচরণ দেখিতে পাওয়া যায়। সর্ব্ব- ভোজী বহ্নির স্তায়, তেজীয়াদিগের তাহাতে দোষস্পর্শ হয় না।৩৩০। সামান্ত লোকে, কদাচ, 'মনেও তাদৃশ কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিবেক না; মুঢ়তা বশতঃ অনুষ্ঠান করিলে, বিনাশ প্রাপ্ত হয়। শিব সমুদ্রোৎপন্ন বিষপান করিয়াছেন; সামান্ত লোক বিষপান করিলে, বিনাশ অবধারিত। ৩১। প্রধান লোকদিগের উপদেশ মাননীয়; কোনও কোনও স্থলে, তাঁহাদের আচারও মাননীয়। তাঁহাদের যে আচার তদীয় উপদেশবাক্যের অনুযায়ী, বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি সেই সকল আচারের অনুসরণ করিবেক। ৩২।

এই দুই শাস্ত্রে স্পষ্ট দৃষ্ট হইতেছে, প্রধান লোকে অবৈধ আচরণে দূষিত হইয়া থাকেন; এজন্য, তাঁহাদের আচার মাত্রই, সর্বসাধারণ লোকের পক্ষে, সদাচার বলিয়া গণনীয় ও অনুকরণীয় নহে; তাঁহারা যে সকল উপদেশ দেন, এবং তাঁহাদের যে সকল আচার তদীয় উপদেশের অবিরুদ্ধ, তাহারই অনুসরণ করা উচিত। এজন্য, বৌধায়ন, একবারে, প্রধান লোকের আচরণের অনুকরণ রহিত করিয়া, শাস্ত্রবিহিত কর্ম্মের অনুষ্ঠানেরই বিধি

দিয়াছেন। যথা, অনুবৃত্তন্তু যদ্দেবৈমুনিভির্যদনুষ্ঠিতম্।

নানুষ্ঠেয়ং মনুয্যৈস্তদুক্তং কৰ্ম্ম সমাচরেৎ (১০) ।। দেবগণ ও মুনিগণ যে সকল কর্ম্ম করিয়াছেন, মনুষ্যের পক্ষে তাহা করা ••কর্তব্য নহে; তাহারা শাস্ত্রোক্ত কর্মই করিবেক।

এবং, এজন্যই, যাজ্ঞবন্ধ্য কেবল শ্রুতি ও স্মৃতির বিধি অনুযায়ী আচারই অনুকরণীয় বলিয়া বিধিপ্রদান করিয়াছেন। যথা, শ্রুতিস্মৃত্যুদিতং সম্যত্ নিত্যমাচারমাচরেৎ। ১। ১৫৪। যে আচার, সর্ব্বতোভাবে, শ্রুতি ও স্মৃতির বিধি অনুযায়ী সতত তাহারই অনুষ্ঠান করিবেক।

এই সকল ও এতদমুরূপ অন্যান্য শাস্ত্র দেখিলে, উল্লিখিত ভগবদ্বাক্যের অর্থ ও তাৎপর্য্য ক্রি, তাহা, বোধ করি, সামশ্রমী মহাশয়ের "সুগম” হইতে পারে। ভগবদ্বাক্যের অর্থ ও তাৎপর্য্য এই, সাধারণ লোকে, প্রধান লোকের দৃষ্টান্তের অনুবর্তী হইয়া, সচরাচর চলিয়া থাকে; তুমি প্রধান, তুমি কর্তব্য কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিলে, সাধারণ লোকে, তোমার দৃষ্টান্তের অনুবর্তী হইয়া, কর্তব্য কর্ম্ম করিবেক। অতএব, এই লোকশিক্ষার অনুরোধেও, তোমার কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম করা আবশ্যক, তদ্বিষয়ে বৈমুখ্য অবলম্বন কুদাচ উচিত নহে। নতুবা, প্রধান লোকে যাহা করিবেক, সাধারণ লোকের পক্ষে তাহাই কৰ্ত্তব্য বলিয়া উপদিষ্ট হইয়াছে, ভগবদ্বাক্যের এরূপ অর্থ ও এরূপ তাৎপর্য্য নহে; সেরূপ হইলে, শাস্ত্রকারেরা, প্রদর্শিত প্রকারে, প্রধান লোকদিগের ধর্ম্মলঙ্ঘন ও অবৈধ আচরণ কীর্ত্তন পূর্বক, তদীয় আচরণের অনুকরণ বিষয়ে, সর্বসাধারণ লোককে সতর্ক করিয়া দিতেন না। অতএব, দুয়্যন্ত প্রভৃতি প্রধান লোকে, শকুন্তলা প্রভৃতির অলৌকিক রূপ ও লাবণ্য দর্শনে মুগ্ধ হইয়া, যদৃচ্ছা ক্রমে, বহু বিবাহ করিয়াছিলেন; আমরা সামান্য লোক, দুষ্মন্ত প্রভৃতি প্রধান লোকের দৃষ্টান্তের অনুবর্তী হইয়া, যদৃচ্ছা ক্রমে, বহু বিবাহ করা, আমাদের পক্ষে, দোষাবহ নহে; সামশ্রমী মহাশয়ের এই সিদ্ধান্ত শাস্ত্রানুযায়ী বলিয়া কদাচ পরিগৃহীত হইতে পারে না।

সামশ্রমী মহাশয়ের চতুর্থ আপত্তি এই;-

"বহুবিবাহের বিধি অন্বেষণীয় নহে। যখন ইহা আর্য্যাবর্তের' প্রায় সকল প্রদেশে প্রচলিত আছে, শাস্ত্রত নিষিদ্ধ বলিয়া প্রতিপন্ন হইতেছে না, তখন ইহাকে শাস্ত্রসম্মত বলিয়া স্থির- করণার্থ বিশেষশাস্ত্রানুসন্ধানে বা ধীসহকৃত কালব্যয়ে প্রবৃত্ত হওয়া, নিতান্ত নিষ্প্রয়োজন; যাহার নিষেধ নাই অথঢ় ব্যবহার আছে, তাহার বিধি অন্বেষণের কোন আব্যক নাই। তথাপি বহুবিবাহবিষয়কবিচার এইটি শ্রুতমাত্র যে একটি শ্রৌত প্রমাণ হঠাৎ স্বগত হইয়াছিল, তাহার উল্লেখ না করিয়া ক্ষান্ত থাকিতে পারি না" (১১)।

"বহুবিবাহের বিধি অন্বেষণীয় নহে," কারণ, অন্বেষণে প্রবৃত্ত হইলে, কৃতকার্য্য হইবার সম্ভাবনা নাই। "যখন ইহা আর্যাবর্তের প্রায় সকল প্রদেশেই প্রচলিত আছে, শাস্ত্রত নিষিদ্ধ বলিয়া প্রতিপন্ন হইতেছে না, তখন ইহাকে শাস্ত্রসম্মত বলিয়া স্থিরু করণার্থ বিশেষ শাস্ত্রানুসন্ধানে বা ধীসহকৃত কালব্যয়ে প্রবৃত্ত হওয়া নিতান্ত নিষ্প্রয়োজন"। বহুবিবাহ "আর্য্যাবর্তের প্রায় সকল প্রদেশেই প্রচলিত আছে", সামশ্রমী মহাশয়ের এই নির্দেশ অসঙ্গত নহে; কিন্তু "শাস্ত্রত নিষিদ্ধ বলিয়া প্রতিপন্ন হইতেছে না", তিনি এরূপ নির্দেশ করিতে কত দূর সমর্থ, বলিতে পারা যায় না। যিনি ধৰ্ম্মশাস্ত্রের, প্রকৃত প্রস্তাবে, অধ্যয়ন, ও, সবিশেষ যত্ন সহকারে, অনুশীলন করিয়াছেন, তাদৃশ ব্যক্তি,' যথোচিত পরিশ্রম ও বুদ্ধিচালনা পূর্বক, কিছু কাল, অনন্যমনা ।শু অনন্যকৰ্ম্ম! হইয়া, অনুসন্ধান করিলে, এতাদৃশ নির্দেশে সমর্থ হইতে পারেন। সাঁমশ্রমী মহাশয় রীতিমত ধর্ম্মশাস্ত্রের অনুশীলন করিয়াছেন, অথবা, বহুবিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ কি না, এতদ্বিষয়ে যথোপযুক্ত অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছেন, তাহার কোনও নিদর্শন পাওয়া যাইতেছে না। শাস্ত্রের মধ্যে, তিনি তৈত্তিরীয়সংহিতার এক কণ্ডিকা ও মনুসংহিতার চারি বচনের আলোচনা করিয়াছেন; দুর্ভাগ্য ক্রমে, উহাদেরও প্রকৃতরূপ অর্থবোধ ও তাৎপর্য্যগ্রহ করিতে পারেন নাই। তৎপরে, দক্ষ প্রজাপতির এক পাত্রে বহুকন্যাদান ও রাজা দুহ্যস্তের স্বদৃচ্ছা- কৃত বহুবিবাহরূপ প্রমাণ প্রদর্শনের নিমিত্ত, মহাভারতের আদিপর্বব হইতে কতিপয় শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছেন। অতএব, যিনি, যত বড় পণ্ডিত বা পণ্ডিতাভিমানী হউন, তাঁহার, এতন্মাত্র শাস্ত্র অবলম্বন পূর্বক, বহুবিবাহ "শাস্ত্রত নিষিদ্ধ বলিয়া প্রতিপন্ন হইতেছে না”, এরূপ নির্দেশ করিবার অধি- কার নাই। আর, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহ “শাস্ত্রসম্মত বলিয়া 'স্থিরকরণার্থে, বিশেষ শাস্ত্রানুসন্ধানে বা ধীসহকৃত কালব্যয়ে প্রবৃত্ত হওয়া নিতান্ত নিষ্প্রয়োজন"; এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, আমার বিবেচনাতেও তাহা নিতান্ত নিষ্প্রয়োজন; কারণ, ষদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহু বিবাহ শাস্ত্রসম্মত বলিয়া স্থিরীকরণের নিমিত্ত, শাস্ত্রানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া, সমস্ত বুদ্ধিব্যয় ও সমস্ত জীবনক্ষয় করিলেও, তদ্বিষয়ে কৃতকার্য্য হইবার সম্ভাবনা নাই। যাহা হউক, এতক্ষণে তাঁহার অবলম্বিত বেদবাক্য উল্লিখিত হইতেছে।

যদেকস্মিন্ যূপে দ্বে রশনে পরিব্যয়তি তস্মাদেকে। দ্বে, জায়ে বিন্দতে। • যন্নৈকাং রশনাং দ্বয়োযুপয়োঃ পরিব্যয়তি তন্মান্নৈকা ছৌ পতী বিন্দতে (১২)।

যেমন এক যুগে দুই রজ্জু বেষ্টন করা যায়, সেইরূপ, এক পুরুষ দুই স্ত্রী বিবাহ করিতে পারে। যেমন এক রজ্জু দুই গুপে বেষ্টন করা যায় না, সেইরূপ, এক স্ত্রী দুই পুরুষ বিবাহ করিতে পারে না।

এই বেদবাক্য দ্বারা ইহাই প্রতিপন্ন হইতেছে, আবশ্যক হইলে পুরুষ, পূর্ববপরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় দারপরিগ্রহ করিতে পারে; স্ত্রীলোক, পতি বিদ্যমান থাকিলে, আর বিবাহ' করিতে পারে না; উহা দ্বারা যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ডের শাস্ত্রীয়তা প্রতিপন্ন হওয়া সম্ভব নহে। কিন্তু, সামশ্রমী মহাশয় লিখিয়াছেন,

"এ স্থলে যে দৃষ্টান্তে জায়াদ্বয় লাভ করিতে পারা যায়, ঐ দৃষ্টান্তে সমর্থ হইলে শত শত জায়াও লাভ করা যায়; সুতরাং ঐ দ্বিত্ব সংখ্যা বহুত্বের উপলক্ষণমাত্র" (১৩)।

এই মীমাংসাবাক্যের অর্থগ্রহ সহজ ব্যাপার নহে। যাহা উক, বেদ দ্বারা যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ডের সমর্থন হওয়া সম্ভর কি না, তাহা তর্কবাচস্পতি প্রকরণে সবিস্তর আলোচিত। হইয়াছে (১৪); এ স্থলে আর তাহার আলোচনা করা নিষ্প্র- য়োজন। উল্লিখিত বেদবাক্য অবলম্বন পূর্বক, যে ধ্যবস্থা। স্থিরীকৃত 'হইয়াছে, উহার সমর্থনের নিমিত্ত, সামশ্রমী মহাশয় মহাভারতের কতিপয় শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছেন। তাঁহার লিখন এই;-

"এই স্থলে মহাভারতের আদিপর্ব্বান্তর্গত বৈবাহিক পর্ব্বের •কতিপয় শ্লোক উদ্ধৃত করিতেছি এতদৃষ্টে বহুবিবাহ প্রথা কত দূর সুপ্রচলিত ও শাস্ত্রসঙ্গত কি শাস্ত্রবিরুদ্ধ? তাহা স্পষ্টই প্রতিপ্পন্ন হইবে।

যুধিষ্ঠির উবাচ।

"সর্বেকষাং মহিয়ী রাজন্! দ্রৌপদী নো ভবিষ্যতি। "এবং প্রব্যাহৃতং পূর্ববং মম মাত্রা বিশাম্পতে ॥ ১৬। ৯। ২২॥ "অহঞ্চ প্যনিরিষ্টো বৈ ভীমসেনশ্চ পাণ্ডবঃ (১৫)। "পার্থেন বিজিতা চৈষা রত্নভুট্টা সুতা তব । ২৩ ॥ এষ নঃ সময়ো রাজন্! রত্নস্থ্য সহ ভোজনম্। "ন চ তং হাতুমিচ্ছামঃ সময়ং রাজসত্তম ॥ ২৪ ॥

"সর্বেষাং ধৰ্ম্মতঃ কৃষ্ণা মহিষী নো ভবিষ্যতি।

"আনুপূর্ব্যেণ সর্বেষাং গৃহ্লাতু জ্বলনে করান ॥ ২৫ ॥ যুধিষ্ঠির কহিলেন-হে রাজন্! দ্রৌপদী আমাদের সকলেরই মহিষী হইবেন। হে নরীতে। ইতিপূর্ব্বে মন্মাতৃকর্তৃক এইরূপই অভিহিত হইয়াছে। ২২।

আমিও ইহাতে নিবিষ্ট নহি, পাণ্ডুপুত্র ভীমসেনও নিবিষ্ট নহেন তোমার এই ক্যারত্ব পার্থ কর্তৃক বিজিতা হইয়াছেন। ২৩। হে রাজন্। আমাদের এই প্রতিজ্ঞা যে, সকলে মিলিয়া রত্ন ভোজন করিব, হে রাজশ্রেষ্ঠ। এই প্রতিজ্ঞা ত্যাগ করিতে ইচ্ছা করি না। ২৪। কৃষ্ণ ধর্মতঃ আমাদের সকলেরই মহিষী হইবেন, অগ্নিসমীপে যথাপূর্ব্বক সকলেরই পাণিগ্রহণ করুন। ২৫।

দ্রুপদ উবাচ-

"একস্য বহেব্যা বিহিতা মহিষ্যঃ কুরুনন্দন।

"নৈকসস্থ্যা বহবঃ পুংসঃ ক্রয়ন্তে পতয়ঃ কচিৎ। ২৬ ॥

"লোকবেদবিরুদ্ধং ত্বং নাধৰ্ম্মং ধৰ্ম্মবিচ্ছচিঃ।

"কতুমর্হসি কৌন্তেয় কস্মাত্তে বুদ্ধিরীদৃশী ॥ ২৭ ॥ দ্রুপদ বলিলেন-হে কুরুনন্দন! এক পুরুষের এক কালে বহু, 'স্ত্রী বিহিতই আছে, কিন্তু এক স্ত্রীর এক কালে বহুগুথি কোথাও শ্রবণ করি নাই। ২০। হে কৌন্তেয়! তুমি ধর্ম্মবিৎ শুচি হইয়া লোকবেঙ্গবিরুদ্ধ এই অধৰ্ম্ম করিও দা, কেন তোমার এমন বুদ্ধি হইল। ২৭।

এই আখ্যানটি পূর্ব্বোলিখিত শ্রুতিটির সাক্ষাৎ উদাহরণস্বরূপ। সহৃদয় মহোদয়গণ! নিষ্পক্ষান্তঃকরণে দেখিবেন, এই উপাখ্যান- টিতে কি বিবাহান্তরে পত্নীর বন্ধ্যাত্বের বা অসবর্ণাত্বের অপেক্ষা আছে বলিয়া বোধ হয়? পুরুষের বহুবিবাহ কিশস্ত্র- নিষিদ্ধ?" (১৬)।

“এই আখ্যানটি পূর্ব্বোল্লিখিত শ্রুতিটির, সাক্ষাৎ উদাহরণ স্বরূপ”, এ স্থলে সামশ্রমী মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করি, আখ্যানটির একদেশমাত্র উদ্ধৃত না করিয়া, সমুদয় আখ্যানটি উদ্ধৃত করিলে তিনি এরূপ নির্দেশ করিতে পারিতেন কি না। তাঁহার উদ্ধৃত ষড়ুবিংশ শ্লোকে উক্ত হইয়াছে, "এক পুরুষের বহু স্ত্রী বিহিত আছে, এক নারীর বহু পতি কোথাও শুনিতে পাওয়া যায় না”; সুতরাং, ইহা দ্বারা তাঁহার উল্লিখিত বেদবাক্যের সমর্থন হই- তেছে; অর্থাৎ, বেদেও এক পুরুষের দুই বা বহু' ভার্য্যার বিধান, আর স্ত্রীর বহুপতিনিষেধ দৃষ্ট হইতেছে, এবং এই আখ্যানেও তাহাই লক্ষিত হইতেছে; সুতরাং, সামশ্রমী মহাশয় উল্লিখিত জাখ্যানের এই অংশকে তাঁহার অবলম্বিত প্রেস্তুবাক্যের "সাক্ষাৎ উদাহরণস্বরূপ” বলিয়া নির্দেশ করিতে পারেম। কিন্তু, এই আখ্যানের উত্তরভাগে, ঐ বেদবাক্যের সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যবহার প্রতিপাদিত দৃষ্ট হইতেছে। যথা, যুধিষ্ঠির, উবাঢ়,-

নমে বাগনৃতং প্রাহ নাঁধৰ্ম্মে ধীয়তে মতিঃ। বর্ত্ততে হি মনো মেহত্র নৈষোহধৰ্ম্মঃ কথঞ্চন । ক্রয়তে হি পুরাণেহপি জটিলা নাম গৌতমী। ঋষীনধ্যাসিতবর্তী সপ্ত ধর্ম্মভূতাং বরা । তথৈব মুনিজা বাক্ষী তপোভির্ভাবিতাত্মনঃ। সঙ্গতাভূদ্দশ ভ্রাতৃনেকনাম্নঃ প্রচেতসঃ (১৭) ৪

যুধিষ্ঠির কহিলেন,

নামার মুখ হইতে সিঁখ্যাবাক্য নির্গত হয় না; আমার বুদ্ধি অধর্ম্মপথে ধাবিত হয় নাং এ বিষয়ে আমার প্রবৃত্তি হইতেছে। ইহা কোনও মতে অধৰ্ম্ম নহে। পুরাণেও শুনিতে পাওয়া যায়, নিরতিশয় ধৰ্ম্মপরায়ণা গোতমকুলোদ্ভবা জটিল। সপ্ত ঋবির পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন; আর, মুনিকস্তা বাক্ষী প্রচেতা নামক তপঃপরায়ণ দশ ভ্রাতার ভার্য্যা হইয়াছিলেন।

সামশ্রমী মহাশয় যে আখ্যানটিকে উল্লিখিত বেদবাক্যের সাক্ষাৎ উদাহরণস্বরূপ নির্দেশ করিয়াছেন, উপরি নির্দিষ্ট যুধিষ্ঠিরবাক্যও সেই আখ্যানটির এক অংশ। আখ্যানের অন্তর্গত দ্রুপদ রাজার উক্তিতে ব্যক্ত হইতেছে, পুরুষের বহুভাৰ্য্যাবিবাহ বিহিত, স্ত্রীলোকের বহু পতি শুনিতে পাওয়া যায় না; স্ত্রীলোকের বহুপতিবিবাহ অধর্ম্মকর ব্যবহার, ধর্ম্মজ্ঞ ব্যক্তির তাহাতে প্রজ্ঞ হওয়া উচিত নহে। আর, যুধিষ্ঠিরের উক্তিতে, ব্যক্ত হইতেছে, জটিলা ও বাক্ষী, এই দুই মুনিকন্যা, যথাক্রমে, সাত ও দশ পতি বিবাহ করিয়াছিলেন; স্ত্রীলোকের বহুপতিবিবাহ, কোনও মতে, অধর্ম্মকর ব্যবহার নহে। এক্ষণে, সামশ্রমী মহাশয়, স্থির চিত্তে, বিবেচনা করিয়া দেখুন, তাঁহার উল্লিখিত আখ্যানটির যুধিষ্ঠি- রোক্তিরূপ অংশ দ্বারা, তাঁহার অবলম্বিত বেদবাক্যের সমর্থন হইতেছে কি না। বেদবাক্যের পূর্বার্দ্ধে পুরুষের বহুভার্য্যাবিবাহ বৈধ, উত্তরার্দ্ধে স্ত্রীলোকের বহুপতিবিবাহ অবৈধ, বলিয়া উল্লেখ আছে; দ্রুপদ রাজার উক্তি দ্বারা, ঐ উল্লেখের সম্পূর্ণ সমর্থন হইতেছে, সন্দেহ নাই। কিন্তু, যুধিষ্ঠির, বাক্ষী ও জটিলা, এই দুই মুনিকন্যার বহুপতিবিবাহরূপ প্রাচীন আচারের উল্লেখ করিয়া, স্ত্রীলোকের বহুপতিবিবাহ অবৈধ, এই বৈদিক নির্দেশের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ ব্যবহার প্রতিপন্ন করিতেছেন। অতএব, সামশ্রমী মহাশয়কে অগত্যা স্বীকার করিতে হইতেছে, তাঁহার উল্লিখিত আখ্যানের এ অংশ তাঁহার অবলম্বিত "শ্রুতিটির সাক্ষাৎ উদাহরণ- স্বরূপ” নহে; সুতরাং "এই আখ্যানটি পূর্বোল্লিখিত শ্রুতিটির সাক্ষাৎ উদাহরণস্বরূপ," তদীয় এই নির্দেশ সঙ্গত ও সর্বাঙ্গসুন্দর বলিয়া পরিগৃহীত হইতে পারে না। বস্তুতঃ "এই আখ্যানটি” এরূপ না বলিয়া, "এই আখ্যানের অন্তর্গত ষড়বিংশ শ্লোকটি পূর্বোল্লিখিত শ্রুতিটির সাক্ষাৎ উদাহরণস্বরূপ”,, এরূপ নির্দেশ করাই সর্ব্বতোভাবে উচিত ও আবশ্যক ছিল। এ স্থলে ইহাও উল্লেখ করা আবশ্যক, প্রকারান্তরে বিবেচনা করিয়া দেখিলেও, সামশ্রমী মহাশয়ের এই নির্দেশ সম্যক সঙ্গত হইতে পারে না। "তিনি, আখ্যানের যে শ্লোক অবলম্বন করিয়া, ঐরূপ 'নির্দেশ করিয়াছেন, উহা তাঁহার অবলম্বিত "শ্রুতিটির সাক্ষাৎ উদাহরণ- স্বরূপ নহে। ঐ শ্লোক এবং ঐ শ্লোক যে শ্রুতির সাক্ষাৎ উদাহরণ স্বরূপ, উভয় প্রদর্শিত হইতেছে;

একস্য বহেব্যা জায়া ভবন্তি নৈকস্যৈ

বহবঃ সহ 'পতয়ঃ (১৮)।

এক ব্যক্তির বহু ভাৰ্য্যা হইতে পারে, এক স্ত্রীর এক সঙ্গে বহু পতি হইতে পারে না।

একসশস্য বন্ধ্যো বিহিতা মহিষ্যঃ কুরুনন্দন।

নৈকশ্যা বহবঃ পুংসঃ শূয়স্তে পতয়ঃ ক্বচিৎ ॥২৬৷৷ হে কুরুনন্দন! এক পুরুষের বহু ভাৰ্য্যা বিহিত এক স্ত্রীর বহু পতি কোথাও শুনিতে পাওয়া যায় না।

এই শ্লোকটি এই শ্রুতিটির সাক্ষাৎ উদাহরণস্বরূপ বলিয়া নির্দেশ *করিলে, অধিকতর সঙ্গত হয় কি না, সামশ্রমী মহাশয় কিঞ্চিৎ স্থির ও সরল চিত্তে বিবেচনা করিয়া দেখিবেন। সে যাহা হউক, ভারতীয় আখ্যানের যে অংশ আপন অভিপ্রায়ের অনুকূল বোধ হইয়াছে, সামশ্রমী মহাশয়, প্রফুল্ল চিত্তে, তন্মাত্র উদ্ধৃত করিয়াছেন; কিন্তু, যখন তিনি ধৰ্ম্মশাস্ত্রের মীমাংসায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তখন অনুকূল ও প্রতিকূল উভয় অংঙ্গ উদ্ধৃত করিয়া, সমাধান করাই উচিত ও আবশ্যক ছিল। যখন আখ্যানটি পাঠ করিয়াছিলেন, সে সময়ে, প্রতিকূল অংশ তাঁহার দৃষ্টিপথে পতিত হয় নাই, ইহা, কোনও ক্রমে, সম্ভব বা সঙ্গত বোধ হয় না।

"সহৃদয় মহোদয়গণ! নিষ্পক্ষান্তঃকরণে দেখিবেন, এই আখ্যানটিতে কি বিবাহান্তরে পত্নীর বন্ধ্যাত্বের বা অসবর্ণাদের অপেক্ষা আছে বলিয়া বোধ হয়”। এ স্থলে বক্তব্য "এই যে, এই আখ্যানের অন্তর্গত ষড়ুবিংশ শ্লোকে, এক ব্যক্তির একাধিক বিবাহ বিহিত, এতন্মাত্র নির্দেশ আছে; ঐ একাধিক বিবাহ শাস্ত্রোক্ত নিমিত্ত নিবন্ধন, অথবা, যদৃচ্ছামূলক, তাহার কোনও নিদর্শন নাই। এমন স্থলে, "যাঁহারা পক্ষপাতশূন্য হৃদয়ে বিবেচনা করিবেন, তাঁহারা এই অখ্যানটিতে, বিবাহান্তরে পত্নীর বন্ধ্যাত্বের বা অসবর্ণাত্বের অপেক্ষা আছে কি না, কিছুই অবধারিত বলিতে পারিবেন না। এক ব্যক্তির একাধিক বিবাহ রিহিত, এতন্মাত্র নির্দেশ দেখিয়া, একতর পক্ষ নির্ণয় করিয়া, মত প্রকাশ করা বিবেচনাসিদ্ধ হইতে পারে না। যাহা হউক, যদিও এ স্থলে কোনও বিশেষ নির্দেশ নাই; কিন্তু, ধৰ্ম্মশাস্ত্রপ্রবর্তক মনু, যাজ্ঞবন্ধ্য প্রভৃতি মহর্ষিগণ, কৃতদার ব্যক্তির দ্বিতীয় প্রভৃতি বিবাহপক্ষে, স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিমিত্ত নির্দেশ" করিয়া সবর্ণাবিবাহের, এবং যদৃচ্ছাপক্ষে, সবর্ণাবিবাহ নিষেধ পূর্ব্বক অসবর্ণাবিবাহের, বিধি প্রদর্শন করিয়াছেন। এই বিধির সহিত একবাক্যতা সম্পাদন করিয়া দেখিলে, অপক্ষপাতী, মহোদয়দিগকে অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবেক, পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় বিবাহ করিতে হইলে, স্থলবিশেষে স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি শাস্ত্রোক্ত নিমিত্তের, স্থলবিশেষে স্ত্রীর অসবর্ণাত্বের, অপেক্ষা আছে। সামশ্রমী মহাশয় ধর্ম্মশাস্ত্রের বিচারে প্রবৃত্ত হইয়াছেন; এমন স্থলে, প্রকৃত প্রস্তাবে ধর্ম্মশাস্ত্রের উপর নির্ভর করিয়া বিচারকার্য্য নির্বাহ করাই উচিত ও আবশ্যক; পুরাণোক্ত অথবা ইতিহাসোক্ত উপাখ্যানের অন্তর্গত অস্পষ্ট নির্দেশ মাত্র • অবলম্বন পূর্বক, ধৰ্ম্মশাস্ত্রে সম্পূর্ণ উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়া, ঈদৃশ বিষয়ের মীমাংসা করা, কোনও মতে, ন্যায়ানুগত বলিয়া পরি- গৃহীত হইতে পারে না।.

সামশ্রমী মহাশয়ের পঞ্চম আপত্তি এই,-

'ক্রোড়পত্রে বেদরত্নাদিসংগৃহীত প্রমাণদ্বয় উদ্ধৃত হইয়াছে,- ইহাঁর উত্তরে বলা হইয়াছে “মনু কাম্যবিবাহস্থলে অসবর্ণা- বিবাহের বিধি দিয়াছেন ৭" পরং আমরা এইরূপ সমাধানের। মূল পাই না” (০৯)।

এ স্থলে বক্তব্য এই যে, প্রথমতঃ, সামশ্রমী মহাশয় ধর্ম্মশাস্ত্রের রীতিমত অধ্যয়ন ও বিশিষ্টরূপ অনুশীলন করেন নাই; দ্বিতীয়তঃ, তত্ত্বনির্ণয়পক্ষ লক্ষ্য করিয়া, বিচারকার্য্যে প্রবৃত্ত হয়েন নাই; তৃতীয়তঃ, বালস্বভাবসুলভ চাপলদোষেশ্ব আতিশয্য বশতঃ, স্থির চিত্তে শাস্ত্রার্থনির্ণয়ে বুদ্ধিচালনা করিতে পারেন নাই। এই সমস্ত • কারণে, “মনু কাম্যবিবাহস্থলে অসবর্ণাবিবাহের বিধি দিয়াছেন," এরূপ সম্মীধানের মূল পান নাই। মশু, কাম্যবিবাহস্থলে, অসবর্ণা- বিবাহের বিধি দিয়াছেন কি না, এই বিষয়, তর্কবাচস্পতি প্রকরণের প্রথম পরিচ্ছেদে, সবিস্তর আলোচিত হইয়াছে (২০)। সামশ্রমী মহাশয়, স্থিরচিত্ত হইয়া, কিঞ্চিৎ অভিনিবেশ সহকারে, ঐ স্থল 'আলোচনা করিয়া দেখিলে, তাদৃশ সমাধানের মূল পাইতে ' পারিবেন। .

সামশ্রমী মহাশয়ের ষষ্ঠ আপত্তি এই;-

"অপরঞ্চ

এতদ্বিধানং বিজ্ঞেয়ং বিভাগ্যৈকযোনিষু। ববীষু চৈকজাতানাং নানাস্ত্রীয় নিবোধত ॥ অন্ত কুল্লুকভট্টব্যাখ্যা। এতদিতি সমানজাতীয়াসু ভাৰ্য্যান্ড, একেন ভর্তা জাতানাম্ এষ বিভাগবিধির্বোদ্ধব্যঃ। ইদানীং নানাজাতী- য়াসু স্ত্রীযু বন্ধীযু উৎপন্নানাং পুত্রাণাং বিভাগং শৃণুত। সমানজাতীর বহুভার্য্যাতে ব্রাহ্মণ কর্তৃক জনিত বহু পুত্রের বিভাগ এইরূপ জানিবে। সম্প্রতি নানাজাতীয় বহু স্ত্রীতে ক্রাহ্মণ কর্তৃক উৎপাদিত পুত্রগণের বিভাগ শ্রবণ কর।

এবং

সদৃশস্ত্রীযু জাতানাং পুত্রাণামবিশেষতঃ।

ন মাতৃতো জ্যৈষ্ঠ্যমস্তি জন্মতো জ্যৈষ্ঠ্যমুচ্যতে ॥ সমানজাতীয় স্ত্রীসমূহে ব্রাহ্মণকর্তৃক উৎপাদিত পুত্রগণের জাতিগত বিশেষ না থাকিলেও মাতার জ্যেষ্ঠতা প্রযুক্ত পুত্রের জ্যেষ্ঠতা নহে কিন্তু জন্ম দ্বারা জ্যেষ্ঠই জ্যেষ্ঠ।

এই মহুবচনদ্বয় কুল্লুকভট্টের টীকার সহিত উদ্ধৃত হইয়াছে। ইহা দ্বারা কি সকর্তা পুত্রবর্তী ভাৰ্য্যা থাকিতেও পুনঃ সবর্ণাপীরণয় প্রতিপন্ন হইতেছে না? কৈ? ইহার উত্তর কৈ ?" (২১)।

সামশ্রমী মহাশয় স্থির করিয়াছেন, তাঁহার এই আপত্তির উত্তর নাই; এজন্যই, “কৈ? ইহার উত্তর কৈ?", ঈদৃশ, অসঙ্গত আস্ফালন পূর্বক, প্রশ্ন করিয়াছেন। কিন্তু ধৰ্ম্মশাস্ত্রে বোধ ও অধিকার থাকিলে, এরূপ উদ্ধত ভাবে, প্রশ্ন করিতে প্রবৃত্ত হইতেন, সম্ভব বোধ হয় না। সে যাহা হউক, এই দুই বচনে, এরূপ কোনও কথা লক্ষিত হইতেছে না, যে তদ্দ্বারা, সবর্ণা পুত্রবতী ভাৰ্য্যা থাকিতেও, পুনঃ সবর্ণা পরিণয় প্রতিপন্ন হইতে পারে। এই দুই বচনে এতন্মাত্র উপলব্ধ হইতেছে যে, এক ধ্যক্তির সজাতীয়া, অথবা সজাতীয়া বিজাতীয়া,, বহু ভাৰ্য্যা আছে; তাহারা সকলেই, অথবা তন্মধ্যে অনেকেই, পুত্রবর্তী হইয়াছে। মনে কর, এক ব্যক্তি ক্রমে ক্রমে চারি স্ত্রী বিবাহ 'করিয়াছে, এবং চারি স্ত্রীই পুত্রবতী হইয়াছে। কোন সময়ে কাহার পুত্র জন্মিয়াছে, যে ব্যক্তি তাহা অবগত নহেন, তিনি কখনই অবধারিত বলিতে পারিবেন না, যে পূর্ব পূর্ব স্ত্রীর সন্তান হইলে, পুর, পর পর স্ত্রী বিবাহিতা হইয়াছে; কারণ, পূর্বব পূর্ব্ব 'স্ত্রীর সন্তান হইলে, পর, পর পর স্ত্রীর বিবাহ যেরূপ সম্ভব; সকলের বিবাহ হইলে পর, তাহাদের সন্তান হইতে আরম্ভ হওয়াও সেইরূপ সম্ভব। বিশেষজ্ঞ না হইলে, এরূপ স্থলে, একতর পক্ষ নির্ণয় করিয়া নির্ভর্দশ করা সম্ভবিতে পারে না। অতএব, "ইহা দ্বারা কি সবর্ণা পুণ্ড্রবর্তী ভার্য্যা থাকিতেও পুনঃ সবর্ণাপরিণয় প্রতিপন্ন হইতেছে না”, এরূপ নিশ্চয়াত্মক নির্দেশ না করিয়া, "ইহা দ্বারা কি সবর্ণা পুত্রবর্তী ভার্য্যা থাকিতেও পুনঃ সম্বর্ণাপরিণয় সম্ভব, বলিয়া বোধ হইতে পারে না”, এরূপ সংশয়াত্মক নির্দেশ করিলে অধিকতর ন্যায়ানুগত হইত।

ক্লিঞ্চ, আমার মতে, অর্থাৎ আমি যেরূপ শাস্ত্রের অর্থবোধ ও তাৎপর্য্যগ্রহ করিতে পারিয়াছি, তদনুসারে, পুণ্ড্রবর্তী সবর্ণা ভাৰ্য্যা সত্ত্বে পুনরায় সবর্ণাপরিণয় অসিদ্ধ বা অপ্রসিদ্ধ নহে। মনে কর, ব্রাহ্মণজাতীয় পুরুষ সবর্ণাবিবাহ করিয়াছে, এবং ঐ সবর্ণা পুত্রবর্তী হইয়াছে; এই পুত্রবর্তী সবর্ণা ভার্য্যা ব্যভিচারিণী, চিররোগিণী, সুরাপায়িণী, পতিদ্বেষিণী, অর্থনাশিনী বা অপ্রিয়- বাদিনী স্থির হইলে, শাস্ত্রানুসারে, ঐ ব্যক্তির পুনরায় সবর্ণা, 'বিবাহ করা আবশ্যক; সুতরাং, উক্তবিধ নিমিত্ত ঘটিলে, পুত্রবর্তী সবর্ণা সত্ত্বে সবর্ণাপরিণয় সম্পূর্ণ সম্ভব হইতেছে। অতএব, যদি সামশ্রমী মহাশয়ের উল্লিখিত পূর্ব্বনিদ্দিষ্ট মনুবচনদ্বয়ে পুত্রবর্তী। সবর্ণা সত্ত্বে সবর্ণা পরিণয় প্রতিপন্ন হয়, তাহা হইলে ঐ সবর্ণা- পরিণয়, যথাসম্ভব, শাস্ত্রোক্ত নিমিত্ত বশতঃ 'ঘটিয়াছিল, তাহার সন্দেহ নাই। পূর্ব্বপরিণীতা সবর্ণ। ভার্য্যার জীবদ্দশায়, শাস্ত্রোক্ত নিমিত্ত ব্যতিরেকে, যদৃচ্ছা ক্রমে সবর্ণাবিরাহ শাস্ত্রানুসারে নিষিদ্ধ কৰ্ম্ম। তর্কবাচস্পতিপ্রকরণের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে এই বিষয় সবিশেষ আলোচিত হইয়াছে (২২); এ স্থলে আর আলোচনার প্রয়োজন নাই।

পরিশেষে, সামশ্রমী মহাশয়, স্বকৃত বিচারের

“বহুবিবাহ শাস্ত্রনিষিদ্ধ নহে! নহে! নহে!"

এই সারসংগ্রহ প্রচার করিয়াছেন। এ বিষয়ে বক্তব্য, এই যে, তিনি নানা শাস্ত্রে অদ্বিতীয় পণ্ডিত হইতে পারেন; কিন্তু, বহুবিবাহবিচারসমালোচনায় যত দূর পরিচয় পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে, এরূপ দৃঢ় বাক্যে, এরূপ উদ্ধত নির্দেশ করিতে পারেন, ধৰ্ম্মশাস্ত্রে তাঁহার তাদৃশ অধিকার আছে, এরূপ বোধ হয় না। 

কবিরত্নপ্রকরণ

মুরশিদাবাদনিবাসী শ্রীযুত গঙ্গাধর রায় কবিরাজ কবিরত্ন বহুবিধাহ বিষয়ে যে পুস্তক প্রচার করিয়াছেন, তাহার নাম “বহুবিবাহরাহিত্যারাহিত্যনির্ণয়”। যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রবহির্ভূত ব্যবহার বলিয়া, আমি যে ব্যবস্থা প্রচার করিয়া- .ছিলাম, তদ্দর্শনে নিতান্ত অসহিষ্ণু হইয়া, কবিরত্ন মহাশয় তাদৃশ বিবাহব্যবহারের শাস্ত্রীয়তা সংস্থাপনে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। যিনি যে বিষয়ের ব্যবসায়ী নহেন, সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিলে, তাঁহার যেরূপ কৃতকার্য্য হওয়া সম্ভব, তাহা অনায়াসে অনুমান করিতে পারা যায়। কবিরত্ন মহাশয় ধৰ্ম্মশাস্ত্রব্যবসায়ী নহেন; সুতরাং, ধর্ম্মশাস্ত্রের মীমাংসায় বদ্ধপরিকর হইয়া, তিনি কিরূপ কৃতকার্য্য হইয়াছেন; তাহা অনুমান করা দুরূহ ব্যাপার নহে। অনেকেই মনে করেন, ধর্মশাস্ত্র অতি সরল শাস্ত্র; বিশিষ্টরূপ অনুশীলন না করিলেও, ধর্ম্মশাস্ত্রের মীমাংসা করা কঠিন কৰ্ম্ম মহে। এই সংস্কারের বশবর্তী হইয়া, তাঁহারা, উপলক্ষ উপস্থিত 'হইলেই, ধর্ম্মশাস্ত্রের বিচারে ও মীমাংসায় প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন। কিন্তু সেরূপ সংস্কার নিরবচ্ছিন্ন ভ্রান্তি মাত্র। ধৰ্ম্মশাস্ত্র বহুবিস্তৃত 'ও অতি দুরূহ শাস্ত্র। যাঁহারা, অবিশ্রামে ব্যবসায় করিয়া, জীবনকাল অতিবাহিত করিয়াছেন, তাঁহারাও ধর্ম্মশাস্ত্র বিষয়ে পারদর্শী নহেন, এরূপ নির্দেশ করিলে, বোধ করি, অসঙ্গত বলা হয় না। এমন স্থলে, কেবল বিজ্ঞাবলে, বা বুদ্ধিকৌশলে, ধৰ্ম্মশাস্ত্রবিচারে প্রবৃত্ত হইয়া, সম্যক কৃতকার্য্য হওয়া কোনও মতে সম্ভাবিত নহে। শ্রীযুত তারানাথ তর্কবাচস্পতি ও শ্রীযুত গঙ্গাধর কবিরত্ন, ইঁহারা উভয়ে এ বিষয়ে সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থল। উভয়েই প্রাচীন, উভয়েই বহুদর্শী, উভয়েই বিদ্যাবিশারদ বলিয়া বিখ্যাত; উভয়েই যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহব্যবহারের শাস্ত্রীয়তা সংস্থাপনে প্রবৃত্ত হইয়াছেন; কিন্তু, আক্ষেপের বিষয় এই, উভয়েই ধৰ্ম্মশাস্ত্রব্যবসায়ী নহেন; এজন্য, উভয়েই ধৰ্ম্মশাস্ত্র বিষয়ে অনভিজ্ঞতার পরা কাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছেন। যাহা হউক, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রবহির্ভূত ব্যবহার, এই ব্যবস্থা বিষয়ে, কবিরত্ন মহাশয় যে সকল আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন, তাহা ক্রমে আলোচিত হইতেছে।'-

কবিরত্ন মহাশয়ের প্রথম আপতি এই;一 "মন্বাদিবচন নিদর্শন করিয়া বহুবিবাহ রহিত করা লিখিয়াছেন; তাহাতে যদ্যপি শাস্ত্রাবলম্বন করিতে হয়, তবে শাস্ত্রের যথার্থ ব্যাখ্যা করিয়া ব্যবস্থা দিতে হয়। শাস্ত্রার্থ গোপন করিয়া ভ্রান্তিতেই বা অন্যথা ব্যাখ্যা করিয়া ব্যবস্থা দেওয়া উচিত নহে, পাপ হয়। মন্তাদিবচন যে নিদর্শন দেখাইয়াছেন, তাহার ব্যাখ্যা যথার্থ বোধ হইতেছে না।

মনুবচন যথা,

গুরুণানুমতঃ স্নাত্বা সমাবৃত্তো যথাবিধি।

উদ্বহেত দ্বিজো ভার্য্যাং সবর্ণাং লক্ষণান্বিতাম্।। P এই বচনে ব্রহ্মচর্য্যানন্তর ব্রাহ্মণাদি দ্বিজ গুরুর অনুমতিক্রনৈ অবভূথ স্নান করিয়া বিধিক্রমে সমাবর্তন করিয়া সুলক্ষণা সবর্ণা কল্লা বিবাহ করিবে। সবর্ণা লক্ষণান্বিতা এই দুই শব্দ প্রশস্তা- ভিপ্রায়, নতুবা হীনলক্ষণ! কল্লার বিবাহ সম্ভব হয় না। তাহাই পরে বলিয়াছেন এবং পরবচনে প্রশস্তাশব্দ সার্থক হয় না। তদ্বচনং যথা সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্মণি।

কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ শ্যুঃ ক্রমশোবরাঃ ॥

শুদ্রৈব ভাৰ্য্যা শুদ্রস্থ্য সাচ স্বাশ্চ বিশঃ স্মৃতে।

তে চ স্বাচৈব রাজ্ঞশ্চ তাশ্চ স্বা চাগ্রজন্মনঃ ॥ এই বচনদ্বয়ের ব্যাখ্যা করিয়াছেন, দ্বিজাতির পক্ষে অগ্রে সবর্ণাবিবাহই বিক্রিত বিবাহই এই অবধারণ ব্যাখ্যায় অসবর্ণা- বিবাহ অগ্রে বিধি নহে। যদি এই অর্থ হয়, তবে প্রশস্তী শব্দোপাদানের প্রয়োজন কি। সবর্ণৈব দ্বিজাতী নামগ্রে স্তাদ্দার- কর্ম্মণি, এই পাঠে তদর্থ সিদ্ধি হয়। অতএব ও অর্থ যথার্থ নহে। যথার্থ ব্যাখ্যা এই, দ্বিজাতীনামগ্রে দারকর্ম্মণি সবর্ণা স্ত্রী প্রশ্নস্তা ৎ অসবর্ণা তু অগ্রে দারকর্মণি অপ্রশস্তা ন তু প্রতিষিদ্ধা দ্বিজাতীনাং সবর্ণাসুবর্ণাবিবাহস্ত সামান্ততো বিধে- বক্ষ্যমাণত্বাৎ। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্বের ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমানন্তর গার্হস্থাশ্রমকরণে প্রথমতঃ সবর্ণা ক্যা বিবাহে প্রশস্তা, অসবর্ণা কন্যা অপ্রশস্তা কিন্তু নিষিদ্ধা নহে। যে হেতু সবর্ণীসবর্ণে সামান্ততো বিবাহবিধান আছে; প্রশস্তাপদগ্রহণে এই অর্থ ও তাৎপর্য্য জানাইয়াছেন” (১)।

ধর্মশাস্ত্রব্যবসায়ী হইলে, কবিরত্ন মহাশয়, এবংবিধ অসঙ্গত আস্ফালন পূর্বক, ঈদৃশ অদৃষ্টচর ও অশ্রুতপূর্ব ব্যবস্থাপ্রচারে প্রবৃত্ত হইতেন, এরূপ বোধ হয় না। ধৰ্ম্মশাস্ত্রে দৃষ্টি নাই, বহুদর্শন নাই; সুতরাং, মনুবচনের অর্থবোধ ও তাৎপর্য্য গ্রহ • করিতে পারেন নাই; এজন্যই তিনি, আমার অবলম্বিত চির প্রচলিত যথার্থ ব্যাখ্যাকে অযথার্থ ব্যাখ্যা বলিয়া, অবলীলা ক্রমে নির্দেশ করিয়াছেন। 

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণি।

দ্বিজাতিদিগের প্রথম বিবাছে সবর্ণা কস্তা প্রশস্তা।

এই মনুবচনে প্রশস্তাপদ প্রযুক্ত আছে। প্রশস্তশব্দ, অনেক স্থলে, "উৎকৃষ্ট” এই অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। এই অর্থকেই ঐ শব্দের একমাত্র অর্থ স্থির করিয়া, কবিরত্ন মহাশয় ব্যবস্থা করিয়াছেন, যখন দ্বিজাতিদিগের প্রথম বিবাহে সবর্ণা কা প্রশস্তা বলিয়া নির্দেশ আছে, তখন অসবর্ণা কন্যা অপ্রশস্তা, নিষিদ্ধা নহে। কিন্তু, এই ব্যবস্থ। মনুবচনের অর্থ দ্বারাও সমর্থিত নহে, এবং অন্যান্য ঋষিবাক্যেরও সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ। মনুবচনের অর্থ এই, "দ্বিজাতিদিগের প্রথম বিবাহে সবর্ণা কতা প্রশস্তা অর্থাৎ বিহিতা”। সবর্গা কন্যার বিধান দ্বারা, অসবর্ণা কন্যার নিষেধ, অর্থ বশতঃ, সিদ্ধ হইতেছে। প্রশস্তশব্দের এই অর্থ অসিল্ক বা অপ্রসিদ্ধ নহে;

অসপিণ্ডা চ যা মাতুরসগোত্রা চ যা পিতুঃ।

সা প্রশস্তা দ্বিজাতীনাং দারকৰ্ম্মণি মৈথুনে। ৩।৫। যে ক্যা মাতা ও পিতার অসপিণ্ডা ও অসগোত্রা, তাদৃশী কম্বা দ্বিজাতিভিক্ষের বিবাহে প্রশস্তা।

এই মনুবচনে অসপিণ্ডা ও অসগোত্রা কন্যা বিবাহে প্রশস্তা বলিয়া নির্দেশ আছে। এ স্থলে, প্রশস্তাপদের অর্থ বিহিতা; অর্থাৎ অসপিণ্ডা ও অসগোত্রা কন্ঠা বিবাহে বিহিতা। এই বিধান, দ্বারা,, সপিণ্ডা ও সগোত্রা কন্ঠার বিবাহনিষেধ, অর্থ বশতঃ, সিদ্ধ হইয়া থাকে। কিন্তু, কবিরত্ন মহাশয়ের মতানুসারে, এই ব্যবস্থা হইতে পারে, যখন অসপিণ্ডা ও অসগোত্রা কন্যা বিবাহে প্রশস্তা বলিয়া নির্দেশ আছে, তখন সপিণ্ডা ও সগোত্রা ফন্যা বিবাহে অপ্রশস্তা, নিষিদ্ধা নহে; অর্থাৎ সপিণ্ডা ও সগোত্রা কন্যা বিবাহে দোষ নাই। এরূপ ব্যবস্থা যে কোনও ক্রমে শ্রদ্ধেয় নহে, ইহা বলা বাহুল্য মাত্র।

কিঞ্চ, প্রথম বিবাহে অসবর্ণানিষেধ কেবল অর্থ বশতঃ সিদ্ধ নহে; শাস্ত্রে তাদুর্শ বিবাহের প্রত্যক্ষ নিষেধও লক্ষিত হইতেছে। যথা,

ক্ষত্রবিশূদ্রকন্যাস্ত ন বিবাহ্যা দ্বিজাতিভিঃ।

বিবাহ্য। ব্রাহ্মণী পশ্চাদ্বিবাহ্যাঃ কচিদেব তু (২)। দ্বিজাতিরা ক্ষত্রিয়, ব্যৈ, ও শূদ্রের ক্যা বিবাহ করিবেক না: তাহারা ব্রাহ্মণী অর্থাৎ সম্বর্ণা বিবাহ করিবেক; পশ্চাৎ, অর্থাৎ অগ্রে সবর্ণা বিবাহ করিয়া, ফলবিশেষে, ক্ষত্রিয়াধিকস্তা বিবাহ করিতে পারিবেক।

দেখ, এ স্থলে অগ্রে সবর্ণাবিবাহের বিধি ও অসবর্ণাবিবাহের নিষেধ স্পষ্টাক্ষরে প্রতিপাদিত হইয়াছে। আর,

অলাতে কণ্যায়াঃ স্নাতকত্রতং চরেৎ অপিবা ক্ষত্রিয়ায়াং পুত্রমুৎপাদয়েৎ বৈশ্যায়াং বা শুদ্রায়াঞ্চেত্যেকে (৩)। সজাতীয়া কন্তার অপ্রাপ্তি ঘটিলে, স্নাতকব্রতের অনুষ্ঠান অথবা ক্ষপ্রিয়া বা বৈইকন্ত। বিবাহ করিবেক। কেহ কেহ শূদ্রকন্তাবিবাহেরও অনুমতি দিয়া থাকেন। .

• এই শাস্ত্রে, সজাতীয়। কন্তার অপ্রাপ্তিস্থলে, ক্ষত্রিয়াদিকণ্যাবিবাহ বিহিত হওয়াতে, সজাতীয়া কন্যার প্রাপ্তি সম্ভবিলে, প্রথমে • অসবর্ণাবিবাহনিষেধ নিঃসংশয়ে প্রতিপন্ন হইতেছে। এজন্যই নন্দপণ্ডিত, অথ ব্রাহ্মণশ্য বর্ণানুক্রমেণ চতস্রো ভার্য্যা ভবন্তি। ২৪।১। বর্ণানুক্রমে ব্রাহ্মণের চারি ভার্য্যা হইয়া থাকে।

এই বিষ্ণুবচনের ব্যাখ্যাস্থলে লিখিয়াছেন,

"তেন ব্রাহ্মণস্য ব্রাহ্মণীবিরাহঃ প্রমথং ততঃ ক্ষন্দ্রিয়াদিবিবাহঃ অন্যথা রাজ্যাপূর্ব্যাদিনিমিত্ত- প্রায়শ্চিত্তপ্রসঙ্গঃ” (8)

অতএব, ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণীবিবাহ প্রথম কর্তব্য; তৎপরে ক্ষত্রিয়াদিকল্লাবিবাহ: নতুবা, রাজন্তাপুর্ব্বী প্রভৃতি মিমির প্রায়শ্চিত্ত ঘটে।

রাজন্যাপূর্ব্বী প্রভৃতি নিমিত্ত প্রায়শ্চিত্ত এই, ব্রাহ্মণে। রাজ্যাপূর্ব্বী দ্বাদশরাত্রং চরিত্বা নির্বিশেৎ তাঞ্চৈবোগগচ্ছেৎ বৈশ্যাপূরবী তপ্তকৃষ্ণং শূদ্রাপূর্ব্বী কৃচ্ছাতিক্বস্তুম্ (৫)।

যে ব্রাহ্মণ রাজন্তাপুর্ব্বী, অর্থাৎ প্রথমে ক্ষত্রিয়ক্যা বিবাহ করে, সে দ্বাদশ রাত্রব্রতরূপ প্রায়শ্চিত্ত করিয়া, সবর্ণার পাণিগ্রহণ পূর্ব্বক, তাহারই সহিত সহবাস করিবেক; বৈভ্যাপুব্বী হইলে, অর্থাৎ প্রথমে বৈশ্যকস্তা বিবাহ করিলে, তপ্তকৃচ্ছু, শূদ্রাপূর্ব্বী হইলে, অর্থাঃ প্রথমে শূদ্রকল্প। বিবাহ করিলে, কৃষ্ণাতিকৃষ্ণ প্রায়শ্চিত্ত করিবেক।

দেখ প্রথমে অসবর্ণা বিবাহ করিলে, শাস্ত্রকারেরা, প্রায়শ্চিত করিয়া পুনর্ব্বার সবর্ণাবিবাহ ও সবর্ণারই সহিত সহবাস করি- " বার স্পষ্ট বিধি দিয়াছেন। অতএব, প্রথমে অসবর্ণাবিবাহ অপ্রশস্ত, নিষিদ্ধ নহে; কবিরত্ন মহাশয়ের এই ব্যবস্থা, কোনও অংশে, শাস্ত্রানুমত বা ন্যায়ানুগত বলিয়া পরিগৃহীত হইতে পারে না।

"দ্বিজাতিদিগের পক্ষে প্রথমে অসবর্ণাবিবাহ অপ্রশস্ত, নিষিদ্ধ নহে; এই ব্যবস্থা প্রদান করিয়া, দৃষ্টান্ত দ্বারা উহার সমর্থন করিবার নিমিত্ত, কবিরত্ন মহাশয় কহিতেছেন, .

"উদাহরণও আছে। অগস্ত্য মুনি জনকছহিতা লোপামুদ্রাকে প্রথমেই বিবাহ করেন; ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি দশরথের ঔরস ক্যা প্রথমেই বিবাহ করেন। যদি অবিধি হইত তবে বেদবহির্ভূত কর্ম্ম মহর্ষিরা করিতেন না। এবং জৈগীধব্য ঋষি হিমালয়ের একপর্ণা নামে ক্যা প্রথমেই বিবাহ করেন। দেবল ঋষি দ্বিপর্ণা নামে কন্যাকে বিবাহ করেন। হিমালয় পর্ব্বত ব্রাহ্মণ নহে। অতএব অসবর্ণা প্রথম বিবাহে প্রশস্তা নহে নিবিদ্ধাও নহে। ক্ষত্রিয়জাতিও প্রথমে অসবর্ণাবিবাহ করিয়াছেন। যযাতি রাজা শুক্রের ক্যা দেবজানীকে বিবাহ করেন" (৬)।

এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, যখন শাস্ত্রে স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ নিষেধ দৃষ্ট হইতেছে, তখন কোনও কোনও মহর্ষি প্রথমে অসবর্ণা বিবাহ করিয়াছিলেন, অতএব তাদৃশ বিবাহ নিষিদ্ধ নহে, এরূপ অনুমান- সিদ্ধ ব্যবস্থ। গ্রাহ্য হইতে পারে না। সে যাহা হউক, কবিরত্ন মহাশয়ের উল্লিখিত একটি উদাহরণ দেখিয়া, আমি চমৎকৃত হইয়াছি। সেই উদাহরণ এই; "যযাতি রাজা শুক্রের কন্যা দেবজানীকে বিবাহ করেন"। যযাতি রাজা ক্ষত্রিয়, শুক্রাচার্য্য ব্রাহ্মণ; যযাতি ক্ষত্রিয় হইয়া ব্রাহ্মণকন্যা বিবাহ করিয়াছিলেন। কি অশ্চর্য্য! কবিরত্ন মহাশয়ের মতে, এ বিবাহও নিষিদ্ধ ও অবৈধ নহেন ইহা, বোধ করি, এ দেশের সর্ববসাধারণ লোকে অবগত আছেন, বিবাহ দ্বিবিধ অনুলোম বিবাহ ও প্রতিলোম *বিবাহ। উৎকৃষ্ট বর্ণ নিকৃষ্ট বর্ণের কন্যা বিবাহ করিলে, ঐ বিবাহকে অনুলোম বিবাহ, আর, নিকৃষ্ট বর্ণ উৎকৃষ্ট বর্ণের কন্যা বিবাহ করিলে, ঐ বিবাহকে প্রতিলোম বিবাহ বলে। স্থলবিশেষে, অনুলোম বিবাহ, শাস্ত্রবিহিত; সকল স্থলেই, প্রতিলোম, বিবাহ সর্বতোভাবে শাস্ত্রনিষিদ্ধ।

১। নারদ কহিয়াছেন,

আমুলোম্যেন বর্ণানাং যজ্জন্ম স বিধিঃ স্মৃতঃ।

প্রাতিলোম্যেন যজ্জন্ম স জ্ঞেয়ো বর্ণসঙ্করঃ (৭)। ব্রাহ্মণাদিবর্ণের অনুলোম ক্রমে যে জন্ম, তাহাই বিবি বলিয়া পরিগণিত; প্রতিলোম ক্রমে যে জন্ম, তাহাকে বর্ণসঙ্কর বলে।

২। ব্যাস কহিয়াছেন,

অধমাদুত্তমায়ান্ত জাতঃ ক্ষুদ্রাধমঃ স্মৃতঃ (৮) নিকৃষ্ট বর্ণ হইতে উৎকৃষ্টবর্ণার গর্ভজাত সন্তান শূদ্র অপেক্ষাও অধম।

৩। বিষ্ণু কহিয়াছেন,

সমানবর্ণাশু পুত্রাঃ সমানবর্ণা ভবস্তি। ১৬। ১। অনুলোমান্ডু মাতৃবর্ণাঃ। ১৬। ২। প্রতিলোমান্ডু আর্য্যবিগর্হিতাঃ। ১৬। ৩। (৯)

সবর্ণাগর্ভজাত পুত্রেরা সবর্ণ, অর্থাৎ পিতৃজাতি প্রাপ্ত হয়। ১। অনুলোমবিধানে, অসবর্ণাগর্ভজাত পুত্রেরা মাতৃবর্ণ, অর্থাৎ মাতৃজাতি প্রাপ্ত হয়। ২। প্রতিলোম- বিধানে অসবর্ণীগর্ভজাত পুত্রেরা আর্য্যবিগর্হিত, অর্থাৎ ভদ্র সমাজে হেয় হয়।

৪। গোতম কহিয়াছেন,

প্রতিলোমাস্ত ধৰ্ম্মহীনাঃ (১০)।

প্রতিলোমজেরা, ধর্মহীন, অর্থাৎ শ্রুতিবিহিত ও স্মৃতিবিহিত ধর্মে অনধিকারী। 

৩৫। দেবল কহিয়াছেন,

তেষাং সবর্ণজাঃ শ্রেষ্ঠাস্তেভ্যোহ স্বগনুলোমজাঃ। অন্তরালা বহির্বর্ণাঃ প্রথিতাঃ প্রতিলোমজাঃ (১১৩).

'নানাবিধ পুত্রের মধ্যে, সবর্ণজেয়া শ্রেষ্ঠ অনুলোমজেরা সবর্ণজ অপেক্ষা • নিকৃষ্ট, তাহারা অন্তরাল অর্থাৎ পিতৃবর্ণ ও মাতৃবর্ণের মধ্যবর্তী; আর প্রতিলোমজেরা বহির্বর্ণ অর্থাৎ বর্ণধৰ্ম্মবহিষ্কৃত বলিয়া পরিগণিত।

৬। মাধবাচার্য্য কহিয়াছেন,

প্রতিলোমজাস্ত বর্ণবাহ্যত্বাৎ পতিতা অধমাঃ (১২)। প্রতিলোমজেরা বর্ণকর্মবহিষ্কৃত, অতএব পতিত ও অধম।

৭। জীমূতবাহন কহিয়াছেন, প্রতিলোমপরিণয়নং সর্ব্বথৈব ন কার্য্যম্ (১৩)। প্রতিলোমবিবাহ কদাচ করিবেক না।

দেখ, নারদ প্রভৃতি প্রতিলোম বিবাহকে স্পষ্টাক্ষরে অবৈধ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। কবিরত্ন মহাশয়ের উদাহৃত যযাতি- দেবজানীবিবাহ প্রতিলোমবিবাহ হইতেছে। প্রতিলোমবিবাহ ষে • সর্বতোভাবে শাস্ত্রবিগর্হিত ও ধৰ্ম্মবহির্ভূত কর্ম্ম, কবিরত্ন মহাশয়ের সে বোধ নাই; এজন্য তিনি, "ক্ষত্রিয়জাতিও' প্রথম অসবর্ণা বিবাহ করিয়াছেন,” এই ব্যবস্থা নির্দেশ করিয়া, তাহার প্রামাণ্যের নিমিত্ত, যযাতিদেবজানীবিবাহ উদাহরণস্থলে বিন্যস্ত করিয়াছেন।

কবিরত্ন, মহাশয়, ঋষিদিগের প্রাথমিক অসবর্ণ বিবাহের কতিপয় উদাহরণ প্রদর্শন করিয়া, লিখিয়াছেন, "যদি অবিধি • হইত তবে বেদবহির্ভূত কর্ম্ম মহর্ষিরা করিতেন না”। ইহার তাৎপর্য্য এই, মহর্ষিরা শাস্ত্রপারদর্শী ও পরম ধার্মিক ছিলেন; সুতরাং, তাঁহারা অবৈধ আচরণে প্রবৃত্ত হইবেন, ইহা সম্ভব নহে। যখন, তাঁহারা প্রথমে অসবর্ণী বিবাহ করিয়াছেন, তখন তাহা কোন ক্রমে অবৈধ নহে। এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, মহর্ষিরা বা অন্যান্য মহৎ ব্যক্তিরা অবৈধ কৰ্ম্ম করিতে পারেন। না, অথবা করেন নাই, ইহা নিরবচ্ছিন্ন অবোধ ও অনভিজ্ঞের কথা। যখন ধর্ম্মশাস্ত্রের প্রথমে অসবর্ণাবিবাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ দৃষ্ট। হইতেছে, এবং যখন প্রতিলোমবিবাহ সর্ব্বতোভাবে শাস্ত্রবহির্ভূত ও ধৰ্ম্মবিগর্হিত ব্যবহার বলিয়া পরিগণিত হইয়াছে, তখন কোনও কোনও ঋষি 'প্রথমে অসবর্ণাদিবাহ, অথবা কোনও রাজা প্রতিলোমবিবাহ করিয়াছিলেন, অতএব তাহা অবৈধ নহে, যাঁহার ধৰ্ম্মশাস্ত্রে সামান্যরূপ দৃষ্টি ও অধিকার আছে, তাদৃশ ব্যক্তিও কদাচ ঈদৃশ অসঙ্গত নির্দেশ করিতে পারেন না। বৌধায়ন কহিয়াছেন, 3

অনুবৃত্তন্তু যদ্দেবৈমুনিভির্যদনুষ্ঠিতম্।

নানুষ্ঠেয়ং মনুষ্যেস্তদুক্তং কর্ম্ম সমাচরেৎ (১৪) ।। দেবগণ ও মুনিগণ যে সকল কর্ম্ম করিয়াছেন, মনুষ্যের পক্ষে তাই। করা কর্ত্তব্য নহে; তাহার। শাস্ত্রোক্ত কর্মই করিবেক।

ইহা দ্বারা স্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে, দেবতারা ও মুনিরা এরূপ অনেক কৰ্ম্ম করিয়াছেন, যে তাহা মনুষ্যের পক্ষে কোনও মতে কর্তৃবা নহে; এজন্য, মনুষ্যের পক্ষে, শাস্ত্রোক্ত কর্ম্মের অনুষ্ঠানই ব্যবস্থাপিত হইয়াছে।

আপস্তম্ব কহিয়াছেন,

দৃষ্টে। ধৰ্ম্মব্যতিক্রমঃ সাহসঞ্চ মহতাম্। ২। ৬। ১৩।৮৭ তেষাং তেজোবিশেষেণ প্রত্যবায়ো ন বিষ্ণুতে। ২।৬।১৩/৯। তদন্দ্বীক্ষ্য প্রযুঞ্জীনঃ সীদত্যবরঃ। ২। ৬। ১৩। ১০।

হিৎ লোকদিগের ধর্মলঙ্ঘন ও অবৈধ আচরণ দেখিতে পাওয়া যায়। তাঁহারা তেজীয়ান তাহাতে তাঁহাদের প্রতাবায় নাই। সাধারণ লোকে, তদর্শনে তদনুবর্তী হইয়া চলিলে, এককালে উৎসন্ন হয়।

ইহা দ্বারা স্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে, পূর্ব্বকালীন মহৎ লোকে অবৈধ আচরণে দূষিত হইতেন।'তবে তাঁহারা তেজীয়ান্ ছিলেন, এজন্য অবৈধ আচরণ নিবন্ধন প্রত্যবায়গ্রস্ত হইতেন না। এক্ষণে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, "যদি অবিধি হইত তবে বেদ- বহির্ভূত কৰ্ম্ম মহর্ষিরা করিতেন না,” কবিরত্ন মহাশয়ের এই সিদ্ধান্ত. সঙ্গত হইতে পারে কি না। যদি মহর্ষিরা অবৈধ কর্ম্মের অনুষ্ঠান না করিতেন, তবে "মুনিগণ যে সকল কর্ম্ম করিয়াছেন, মনুষ্যের পক্ষে তাহা কর্তব্য নহে,” বৌধায়ন, নিজে মহর্ষি হইয়া, এরূপ নিষেধ করিঞ্জলন কেন; আর, মহর্ষি আপস্তম্বই বা, মহৎ লোকের অবৈধ আচরণ নির্দেশ পূর্বক, "তদ্দর্শনে তদনুবর্তী হইয়া চলিলে, একক্কালে উৎসন্ন হয়,” এরূপ দোষকীৰ্ত্তন করিলেন কেন।

কবিরত্ন মহাশয়ের দ্বিতীয় আপত্তি এই; "তর্হি কিং সুব্বা অসবর্ণা অগ্রে দারকর্ম্মণি তুল্যং দ্বিজাতীনাম- প্রশস্তা ইত্যত আহ

কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশোবরাঃ।

দ্বিজাতির সকল অসবর্ণা প্রথম বিবাহে তুল্য অপ্রশস্তা নহে কিন্তু কামতঃ অর্থাৎ ইচ্ছাক্রমে প্রথম বিবাহে প্রবৃত্ত দ্বিজাতির এই ক্রমে শ্রেষ্ঠ। দৈপ্তের শূদ্রা স্ত্রী অপেক্ষা বৈশ্যা স্ত্রী শ্রেষ্ঠা। ক্ষত্রিয়ের শূদ্রা অপেক্ষা' বৈশ্যা বৈশ্যা অপেক্ষা ক্ষত্রিয়া শ্রেষ্ঠা। ব্রাহ্মণের শূদ্রা অপেক্ষা বৈশ্যা বৈশ্যা অপেক্ষা ক্ষত্রিয়া ক্ষত্রিয়া অপেক্ষা' ব্রাহ্মণী ভাৰ্য্যা শ্রেষ্ঠা। বামতঃ এই শব্দ প্রয়োগ: থাকাতে যে কাম্য বিবাহ এমন নহে” (১৫)।

কবিরত্ন মহাশয় ধৰ্ম্মশাস্ত্রব্যবসায়ী নহেন; সুতরাং মনুবচনের প্রকৃত পাঠ ও প্রকৃত অর্থ অবগত নহেন। জীমূতবাহন প্রণীত দায়ভাগ, মাধবাচার্য্যপ্রণীত পরাশরভাষ্য, মিত্রমিশ্রপ্রণীত বীর- মিত্রোদয়, বিশ্বেশ্বরভট্টপ্রণীত মদনপারিজাত প্রভৃতি গ্রন্থে দৃষ্টি থাকিলে, বচনের প্রকৃত পাঠ জানিতে পারিতেন, এবং, তাহা হইলে, বচনের প্রকৃত অর্থও অবগত হইতে পারিতেন। মনুবচনের যে ব্যাখ্যা লিখিয়াছেন, তাহা তাঁহার সম্পূর্ণ কপোলকল্পিত; আর, বচনে "কামতঃ এই শব্দের প্রয়োগ থাকাতে, যে কাম্য বিবাহ এমন নহে," এই যে তাৎপর্য্যব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহাও সম্পূর্ণ কপোলকল্পিত। তর্কবাচস্পতি প্রকরণের প্রথম পরিচ্ছেদে, এই বিষয় সবিস্তর আলোচিত হইয়াছে (১৬); ঐ অংশে নেত্রসঞ্চারণ করিলে, কবিরত্ন মহাশয় মনুবচনের প্রকৃত পাঠ ও প্রকৃত অর্থ অবগত হইতে পারিবেন।

কবিরত্ন মহাশয়ের তৃতীয় আপত্তি এই ;-

"স্বমত স্থাপনার্থে অপর এক অশ্রুত কথা লিখিয়াছেন দ্বিবাহ ত্রিবিধ নিত্য নৈমিত্তিক কাম্য। নিত্য বিবাহ কি প্রকার বুঝিতে পারিলাম না" (১৭)। 

এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, ধৰ্ম্মশাস্ত্রে দৃষ্টি ও অধিকার নাই; এজন্য, কবিরত্ন মহাশয়, নিত্য 'বিবাহ কি প্রকার, তাহা বুঝিতে পারেন নাই।

"নিত্যকর্ম্মজ্ঞাপনার্থে যাহা লিখিয়াছেন। যথা. নিত্যং সদা যাবদায়ুর্ন কদাচিদতিক্রমেৎ। উপেত্যাতিক্রমে দোষশ্রুতেরত্যাগচোদনাৎ। ফলাশ্রুতেবীপ্সয়া চ তন্নিত্যমিতি কীর্ত্তিতম্ । ইতি সে সকল মিত্যাদিপদপ্রয়োগও বিবাহবিধানবচনে দেখি না (১৮)।"

ধর্ম্মশাস্ত্রে দৃষ্টি ও অধিকার থাকিলে, কবিরত্ন মহাশয় দেখিতে পাইতেন, তাঁহার উল্লিখিত', কারিকায় নিত্যত্বসাধক যে আটটি হেতু নিরূপিত হইয়াছে, তন্মধ্যে ফলশ্রুতিবিরহরূপ হেতু যাবতীয় বিবাহবিধানবচনে জাজ্বল্যমান রহিয়াছে, (১৯)।

"তবে দোষশ্রুতি প্রযুক্ত নিত্য বলিবেন, তাহাই দোষশ্রবণের বচন দর্শিত হইয়াছে, যথা অনাশ্রমী ন তিষ্ঠেত্ত দিনমেকমপি প্লিজু ইত্যাদি কিন্তু সে বচনে দোষশ্রুতি নাই কারণ সে বচনে প্রায়শ্চিত্রীয়তে এই পদপ্রয়োগ আছে তাহার অর্থ প্রায়শ্চিত্তী- বাচরতি প্রায়শ্চিত্তবান্ পুরুষের ন্যায় আচরণ করিতেছেন এ অর্থে প্রায়শ্চিত্তাই দোষ ঋষি বলেন নাই যদি দোষ হইত তবে প্রায়শ্চিত্ত সমাচরেৎ এই বিধি করিয়া লিখিতেন” (২০)।

অনাশ্রমী ন তিষ্ঠেতু দিনমেকমপি দ্বিজঃ। আশ্রমেণ বিনা তিষ্ঠন "প্রায়শ্চিত্তীয়তে" হিসঃ ॥

দ্বিজ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্ণ, আশ্রমবিহীন হইয়া, এক দিনও থাকিবেক না: বিন্না আশ্রমে অবস্থিত হইলে পাতকগ্রস্ত হয়।

এই দক্ষর্বচনে যে "প্রায়শ্চিত্তীয়তে” এই পদ আছে, তাহার অর্থ “প্রায়শ্চিত্তাই দোষভাগী হয়,” অর্থাৎ এরূপ দোষ জন্মে যে তজ্জন্য প্রায়শ্চিত্ত করা আবশ্যক। অতএব, উপরি দর্শিত বচনব্যাখ্যাতে ঐ পদের অর্থ "পাতকগ্রস্ত "হয়” ইহা লিখিত হইয়াছে। বিনা আশ্রমে অবস্থিত হইলে প্রায়শ্চিত্তাই দোষভাগী' হয়, এ কথা বলাতে, আশ্রমের অনবলম্বনে, স্পষ্ট দোষশ্রুতি, লক্ষিত হইতেছে; সুতরাং, আশ্রমাবলম্বন নিত্য কৰ্ম্ম। কিন্তু,.. কবিরত্ন মহাশয়ের মতে, প্রায়শ্চিত্তীয়তে, এই পদ প্রায়শ্চিত্তাই দোষের বোধক নহে; "প্রায়শ্চিত্তী ইব আচরতি, প্রায়শ্চিত্তবান্ পুরুষের ন্যায় আচরণ করিতেছেন," তাঁহার বিবেচনায় ইহাই "প্রায়শ্চিত্তীয়তে” পদের অর্থ, "প্রায়শ্চিত্তাই দোষভাগী হয়", এরূপ অর্থ অভিপ্রেত হইলে, মহর্ষি "প্রায়শ্চিত্তং সমাচরেৎ” "প্রায়শ্চিত্ত করিবেক", এরূপ লিখিতেন। শুনিতে পাই তর্ক- বাচস্পতি মহাশয়ের ন্যায়, কবিরত্ন মহাশয়েরও ব্যাকরণ শাস্ত্রে বিলক্ষণ বিদ্যা আছে; এজন্য, তাঁহার ন্যায়, ইনিও, ব্যাকরণের সহায়তা লইয়া, ধৰ্ম্মশাস্ত্রের গ্রীব্রাভঙ্গে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। প্রথমতঃ, প্রায়শ্চিত্তাইদোষভাগী পুরুষের ন্যায় আচরণ করে, এ কথা বলিলে দোষশ্রুতি সিদ্ধ হয় না, এরূপ নহে। যেরূপ কৰ্ম্ম করিলে, প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয়, যে ব্যক্তি সেরূপ কৰ্ম্ম করে, তাহাকে প্রায়শ্চিত্তাইদোষভাগী বলে। কোনও ব্যক্তি এরূপ কৰ্ম্ম করিয়াছে যে, তজ্জন্য সে প্রায়শ্চিত্তার্হদোষভাগীর তুল্য হইয়াছে; এরূপ, নির্দেশ করিলে, সে ব্যক্তির পক্ষে দোষশ্রুতি সিদ্ধ হয় না, বোধ করি, তাহা কবিরত্ন মহাশয় ভিন্ন অন্যের বুদ্ধিপথে আসিতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ, প্রচলিত ব্যাকরণের নিয়মানুবর্তী হইয়া, বিবেচনা করিতে গেলে, যদিই "প্রায়শ্চিত্তীয়তে” এই পদ দ্বারা "প্রায়শ্চিত্তাই দোষভাগীর তুল্য” এরূপ অর্থই প্রতিপুন্ন হয়, উেক; কিন্তু ঋষিরা, সচরাচর, "প্রায়শ্চিত্তাই দোয়ভাগী হয়" এই অর্থেই এই পদের প্রয়োগ করিয়া গিয়াছেন; যথা,

১। অকুব্বন্ বিহিতং কৰ্ম্ম নিন্দিতঞ্চ সমাচরম্।

প্রসজংশ্চেন্দ্রিয়ার্থেযু প্রায়শ্চিত্তীয়তে নরঃ ॥ ১১।৪৪। (২১) বিহিত কর্ম্মের ত্যাগ ও নিষিদ্ধ কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিলে, এবং ইন্দ্রিয়সেবায় অতিশয় আসক্ত হইলে, মনুষ্য "প্রায়শ্চিত্তীয়তে"।

এ স্থলে কবিরত্ব মহাশয় কি "প্রায়শ্চিত্তীয়তে” এই পদের “প্রায়শ্চিত্তর্হিদোষভাগী হয়" এরূপ অর্থ বলিবেন না। যে ব্যক্তি বিহিত কৰ্ম্ম ত্যাগ করে ও নিষিদ্ধ কর্ম্মের অনুষ্ঠানে রত হয়, সে প্রায়শ্চিত্তাইদোষভাগী, অর্থাৎ তজ্জন্য তাহাকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয়, ইহা, বোধ করি, কবিরত্ন মুহাশয়কে অগত্যা স্বীকার করিতে হইতেছে; কারণ, বিহিতবর্জন ও নিষিদ্ধসেবন, এই দুই কথাতেই যাবতীয় পাপজনক কৰ্ম্ম অন্তর্ভূত রহিয়াছে।

২। শূদ্রাং শয়নমারোপ্য ব্রাহ্মণো যাত্যধোগতিম্। প্রায়শ্চিত্তীয়তে চাপি বিধিষ্কৃষ্টেন কর্ম্মণা (২২)। ব্রাহ্মণ, শূদ্রা বিবাহ করিয়া, অধোগতি প্রাপ্ত হয়; এবং শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুসারে, "ক্লায়শ্চিত্তীয়তে"।

৩। যস্তু পত্ন্যা সমং রাগান্মৈথুনং কামতশ্চরেৎ।

তদ্‌ব্রতৎ তস্য লুপ্যেত প্রায়শ্চিত্তীয়তে দ্বিজঃ (২৩)।

যে দ্বিজ, বানপ্রস্থ অবস্থায়, রাগ ও কাম বশতঃ, স্ত্রীসম্ভোগ করে, তাহার ব্রতলোপ হয়, সে ব্যক্তি "প্রায়শ্চিত্তীয়তে"।

এই দুই স্থলেও, বোধ করি, কবিরত্ন মহাশয়কে স্বীকার করিতে। হইতেছে, “প্রায়শ্চিত্তীয়তে” এই পদ "প্রায়শ্চিত্তাইদোষভাগী হয়,” এই অর্থে প্রযুক্ত হইয়াছে। বোধ হয়, ইহাতেও কবিরত্ন মহাশয়ের পরিতোষ জন্মিবেক না; এজন্য, এ বিষয়ে স্পষ্টতর। প্রমাণান্তর প্রদর্শিত হইতেছে।

অনাশ্রমী সংবৎসরং প্রাজাপত্যং কৃচ্ছং চত্রিত্বা' আশ্রমমুপেয়াৎ দ্বিতীয়েহতিকৃচ্ছুং তৃতীয়ে কৃচ্ছ্বচ্ছাতি- কৃষ্ণম্ অত উর্দ্ধং চান্দ্রায়ণম্ (২৪)।

যে ব্যক্তি সংবৎসরকাল আশ্রমবিহীন, হইয়া থাকে, সে প্রাজাপত্য কৃচ্ছ প্রায়শ্চিত্ত করিয়া, আশ্রম অবলম্বন করিবেক; দ্বিতীয় বৎসরে, অতিকৃষ্ণ, তৃতীয় বৎসরে কৃচ্ছাতিকৃচ্ছু, তৎপরে চান্দ্রায়ণ করিবেক।

এই শাস্ত্রে এক বৎসর, দুই বৎসর, তিন বৎসর, অথবা তদপেক্ষা অধিক কাল, বিনা আশ্রমে, অবস্থিত হইলে, পৃথক পৃথক প্রায়শ্চিত্ত, ও প্রায়শ্চিত্তের পর আশ্রমাবলম্বন, অতি স্পষ্টাক্ষরে ব্যবস্থাপিত হইয়াছে; সুতরাং আশ্রমবিহীন ব্যক্তি প্রশ্নচিত্তাহ- দোষভাগী হয়, সে বিষয়ে সংশয় বা আপত্তি করিবার আর প্রথ থাকিতেছে না। অতএব, 'যদিও, কবিরত্ন মহাশয়ের অধীত। ব্যাকরণ অনুসারে, অন্যবিধ অর্থ প্রতিপন্ন হয়; কিন্তু, হারীত- বচনের সহিত একবাক্যতা করিয়া, দক্ষবচনস্থিত "প্রায়শ্চিত্তীয়তে". এই পণের "প্রায়শ্চিত্তাহদোষভাগী হয়", এই অর্থই স্বীকার করিতে হইতেছে। বস্তুতঃ, ঐ পদের ঐ অর্থই প্রকৃত অর্থ। বৈয়াকরণকেশরী কবিরত্ন মহাশয়ের ধর্মশাস্ত্রে দৃষ্টি নাই, বহুদর্শন নাই, তত্ত্বনির্ণয়ে প্রবৃত্তি নাই, কেবল, কুতর্ক অবলম্বন পূর্ব্বক, প্রস্তাবিত বিষয়ে প্রতিবাদ করাই প্রকৃত, উদ্দেশ্য; এই সমস্ত কারণে, প্রকৃত অর্থও অপ্রকৃত বলিয়া প্রতীয়মান হইয়াছে। শাহা হউক, এক্ষণে সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, বিনা আশ্রমে অবস্থিত হইলে, পাপস্পর্শী হয় কি না, এবং, সেই 'পাপ বিমো- চনের নিমিত্ত, প্রায়শ্চিত্ত করা আবশ্যক কি না; আর, অপক্ষ- পতে হৃদয়ে বিচার করিয়া বলুন, "বিনা আশ্রমে অবস্থিত হইলে প্রায়শ্চিত্তীয়তে", এ স্থলে "প্রায়শ্চিত্তাইদোষ ঋষি বলেন নাই”, এই তাৎপর্য্যব্যাঙ্গ্যা সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞতামূলক, কবিরত্ন মহাশয়ের ইহা স্লীকার করা উচিত কি না।

"এই শাস্ত্রার্থপ্রযুক্ত পূর্ব্ব পূর্ব কালে অনৈক ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, • "বৈশ্যেরা সমাবর্তন করিয়াও বিবাহ না করিয়া স্নাতক হইয়া থাকিতেন তাহার নিদর্শন পরাশর ও ব্যাস ঋষ্যশৃঙ্গের পিতা বিবাহ করেন নাই এবং ব্যাসপুত্র শুকের চারি পুত্র হরি কৃষ্ণ প্রভু গৌর তাঁহারাও বিবাহ করেন নাই ঐ পর্য্যন্ত বশিষ্ঠবংশ সমাপ্ত এবং যুধিষ্ঠির যুবরাজ হইয়া বহুদিন পরে জতুগৃহদাহে পলায়ন করিয়া চতুর্দশ বর্ষ পরে দ্রৌপদীকে বিবাহ করেন এই সকল অনাশ্রমে দোষাভাব দেখিতেছি যদি দোষ থাকিত তবে সে সকল মহাত্মা ধার্মিক লোকে, বিবাহ না করিয়া কালক্ষেপণ করিতেন না" (২৫)।

আশ্রম অবলম্বন না করিলে দোষ হয় না, দক্ষবচনের এই অর্থ স্থির কুরিয়া, অবলম্বিত অর্থের প্রামাণ্যার্থে, কবিরত্ন মহাশয়, মে সকল ঋষি ও রাজা বিবাহ'করেন নাই, তন্মধ্যে কতকগুলির নামকীর্ত্তন করিয়াছেন; এবং কহিয়াছেন, "এই সকল অনাশ্রমে দোষাভাব দেখিতেছি, যদি দোষ থাকিত তবে সে সকল মহাত্মা • ধার্ম্মিক লোকে বিবাহ না করিয়া কালক্ষেপণ করিতেন না"। ইতঃপূর্বে দর্শিত হইয়াছে, কবিরত্ন মহাশয়, দক্ষবচনের ব্যাখ্যা করিয়া, বিনা আশ্রমে অবস্থিত হইলে দোষ নাই, এই যে সিদ্ধান্য করিয়াছেন, তাহা সম্পূর্ণ ভ্রান্তিমূলক। তৎপূর্বের ইহাও দর্শিত, হইয়াছে, পূর্বকালীন মহৎ লোকে অবৈধ আচরণে দূষিত। হইতেন; তবে তাঁহারা তেজীয়ান্ ছিলেন, এজন্য অবৈধ আচরণ নিবন্ধন প্রত্যবায়গ্রস্ত হইতেন না। অতএব, যখন পূর্ববদর্শিত শাস্ত্রসমূহ দ্বারা ইহা নির্বিবাদে প্রতিপাদিত হইতেছে যে, আশ্রমবিহীন হইয়া থাকা অবৈধ ও পাতকজনক; তখন, পূর্ব- কালীন কোনও কোনও মহৎ লোকের আচার দর্শনে, আশ্রমের অনবলম্বনে দোষস্পর্শ হয় না, এরূপ সিদ্ধান্ত করা স্বীয় অনভিজ্ঞ- তার পরিচয় প্রদান মাত্র। বোধ হয়, কবিরত্ন মহাশয়, কথকদিগের মুখে পৌরাণিক কথা শুনিয়া, যে সংস্কার করিয়া রাখিয়াছেন; সেই সংস্কারের বশবর্তী হইয়াই, এই অদ্ভুত সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। যে ব্যক্তি নিজে শাস্ত্রজ্ঞ, তাঁহার, মুখ হইতে এরূপ অপূর্ব্ব সিদ্ধান্তবাক্য নির্গত হওয়া সম্ভব নহে। কোনও সম্পন্ন ব্যক্তির বাটীতে মহাভারতের কথা হইয়াছিল। কথা সমাপ্ত হইবার কিঞ্চিৎ কাল পরেই, বাটীর কর্ত্তা জানিতে পারিলেন, তাঁহার গৃহিণী ও পুত্রবধূ ব্যভিচারদোষে দূষিতা হইয়াছেন। তিনি, সাতিশয় রূপিত হইয়া, তিরস্কার করিতে আরম্ভ করিলে, গৃহিণী উত্তর দিলেন, আমি কুস্তী ঠাকুরাণীর, পুত্রবধূ উত্তর দিলেন, ক্লামি দ্রৌপদী ঠাকুরাণীর, দৃষ্টান্ত দেখিয়া চলিয়াছি। যদি বহুপুরুষসম্ভোগে দোষ থাকিত, তাহা হইলে ঐ দুই পুণ্যশীলা প্রাতঃস্মরণীয়! রাজমহিষী তাহা করিতেন না। তাঁহারা প্রত্যেকে পঞ্চ পুরুষে উপগতা ৭২১

হইয়াছিলেন; আমরা তাহার অতিরিক্ত করি নাই। বাটীর কর্তা, গৃহিণী ও পুত্রবধূর উত্তরবাক্য শ্রবণগোচর করিয়া, যেমন আপ্যায়িত হইয়াছিলেন; আমরাও, কবিরত্ন মহাশয়ের পূর্ব্বোক্ত শিদ্ধান্তবাক্য দৃষ্টিগোচর করিয়া, তদনুরূপ আপ্যায়িত হইয়াছি। শাস্ত্র দেখিয়া, তাহার অর্থগ্রহ ও তাৎপর্য্যনির্ণয় করিয়া, মীমাংসা করা স্বতন্ত্র; আর, শাস্ত্রে কোন বিষয়ে কি বিধি ও কি নিষেধ আছে, তাহা না জানিয়া, পুরাণের কাহিনী শুনিয়া, তদনুসারে মীমাংসা করা স্বতন্ত্র।

"তাহাতেও যদি দোষশ্রুতি বলেন তবে সে অনাশ্রমী ন তিষ্ঠেদিত্যাদি বচন সাগ্নিক দ্বিজের প্রকরণে নিরগ্নি দ্বিজ বিষয় নহে যদি এক্ষণে ঐ বচন নিরগ্লি বিষয় কেহ লিখিয়া থাকেন তিনি ঐ ঋষির মূলসংহিতা না' দেখিয়া লিখিয়াছেন" (২৬)।

যদি কেহ উল্লিখিত দক্ষবচনকে নিরগ্নিদ্বিজবিষয় বলিয়া ব্যবস্থা করিয়া থাকেন, তিনি ঋষির মূলসংহিতা দেখেন নাই; কবিরত্ব মহাশয়, কি সাহসে, ঈদৃশ অসঙ্গত নির্দেশ করিলেন, বলিতে পারা যায় না। তিনি নিজে, মূলসংহিতা দেখিয়া, ব্যবস্থা স্থির করিয়াছেন, তাহার কোনও লক্ষণ লক্ষিত হইতেছে না; কারণ, মুলসংহিতায় এরূপ কিছুই উপলব্ধ হইতেছে না যে, ঐ বচনকে নিরগ্নিদ্বিজবিষয় বলিয়া ব্যবস্থা 'করিলে, ন্যায়ানুগত হইতে পারে না। কবিরত্ন মহাশয়, কি প্রমাণ অবলম্বন করিয়া, শুরূপ লিখিয়াছেন, তাহা প্রদর্শন করা উচিত ও আবশ্যক ছিল। ফলকথা এই, দক্ষসংহিতায় আশ্রম বিষয়ে যে ব্যবস্থা আছে, তাই। সর্বসাধারণ দ্বিজাতির পক্ষে; তাহাতে সাগ্নিক বা নিরগ্নি বলিয়া কোনও বিশেষ দেখিতে পাওয়া যায় না। যখন আশ্রমের অনবলম্বনে দোষশ্রুতি সিদ্ধ হইতেছে, তখন ঐ বচন উভয় পক্ষেই সম ভাবে ব্যবস্থাপিত হওয়া উচিত ও আবশ্যক। যথা,

১। স্বীকরোতি যদা বেদং চরেছেদব্রতানি চ। ব্রহ্মচারী ভবেত্তাবদূর্দ্ধং স্নাতো ভবেদগৃহী ॥ যত দিন বেদাধ্যয়ন ও আনুষঙ্গিক ব্রতাচরণ কয়ে, তত দিন ব্রহ্মচারী: তৎপরে সমাবর্তন করিয়া গৃহস্থ হয়।

২। দ্বিবিধো ব্রহ্মচারী তু স্মৃতঃ শাস্ত্রে মনীষিভিঃ। উপকুব্বাণকস্তাছ্যো দ্বিতীয়ো নৈষ্ঠিকঃ স্মৃতঃ। পণ্ডিতেরা শাস্ত্রে দ্বিবিধ ব্রহ্মচারী নির্দেশ করিয়াছেন, প্রথম উপকুব্বাণ, দ্বিতীয় নৈষ্ঠিক।

৩। যো গৃহাশ্রমমাস্থায় ব্রহ্মচারী ভবেৎ পুনঃ।

ন যতিন বনস্থশ্চ সর্ব্বাশ্রমবিবর্জিতঃ ॥ যে ব্যক্তি, গৃহস্থাশ্রম অবলম্বন করিয়া, পুনরায় ব্রহ্মচারী হয়, যতি অথবা বানগ্রন্থ না হয়, সে সকল আশ্রমে বর্জিত।

৪। অনাশ্রমী ন তিষ্ঠেত্ত দিনমেকমপি দ্বিজঃ।

আশ্রমেণ বিনা তিষ্ঠন্ প্রায়শ্চিত্তীয়তে হি সঃ ॥ দ্বিজ, আশ্রমবিহীল হইয়া, এক দিনও থাকিবেক না, বিনা আশ্রমে অবস্থিত হইলে, পাতকগ্রস্ত হয়।

৫। জপে হোমে তথা দানে স্বাধ্যায়ে চ রতস্তু যঃ । নাৗে তৎফলমাপ্নোতি কুব্বাণোহপ্যাশ্রমচ্যুতঃ। আশ্রমচ্যুত হইয়া জপ, হোম, দান, অথবা বেদাধ্যয়ন করিলে, ফলভাগী হয় না।

৬। এতেষামানুলোম্যং স্যাৎ প্রাতিলোম্যং-ন বিদ্যুতে ।

প্রাতিলোম্যেন, যো যাতি ন তস্মাৎ পাপক্বত্তমঃ ॥

৭। মেখলাজিনদণ্ডেন ব্রহ্মচারী তু লক্ষ্যতে। গৃহস্থো দেবষজ্ঞাছ্যৈনখলোম্ব। বনাশ্রিতঃ । ত্রিদণ্ডেন যতিশ্চৈব লক্ষণানি পৃথক্ পৃথক। যস্যৈতল্লক্ষণং নাস্তি প্রায়শ্চিত্তী ন চাশ্রমী (২৭)

মেখলা, অজিন, ও দণ্ড ব্রহ্মচারীর লক্ষণ; দেবযজ্ঞ প্রভৃষ্টি গৃহস্থের লক্ষণ; নখ, লোফ গভৃতি বানপ্রন্থের লক্ষণ: ত্রিদও যতির লক্ষণ; এক এক আশ্রমের এই সকল পৃথক পৃথক লক্ষণ; যাহার এ লক্ষণ নাই; সে ব্যক্তি প্রায়শ্চিত্তী ও আশ্রমত্রই।

আশ্রম বিষয়ে, মহর্ষি দক্ষ যে সকল বিধি ও নিষেধের কীৰ্ত্তন করিয়াছেন, সে সমুদয় প্রদর্শিত হইল। তিনি এ বিষয়ে ইহার অতিরিক্ত কিছুই বলেন নাই। এক্ষণে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, এই কয় বচনে যে ব্যবস্থা আছে, তাহা সর্বসাধারণ দ্বিজাতির পক্ষে সম ভাবে বর্ত্তিতে পারে না, মূলসংহিতায় এরূপ কোনও কথা লক্ষিত হইতেছে কি না; দক্ষোক্ত আশ্রমব্যবস্থা সাগ্নিক দ্বিজাতির পক্ষে, নিরগ্নি দ্বিজাতির পক্ষে নহে, এই ব্যবস্থা কবিরত্ন মহাশয়ের কপোলকল্পিত কি না; আর, "যদি এক্ষত্রেঐ বচন নিরগ্নিবিষয় কেহ লিখিয়া থাকেন তিনি ঐ ক্লষির মূলসংহিতা না দেখিয়া লিখিয়াছেন," তদীয় এতাদৃশ • উদ্ধত নির্দেশ নিতান্ত নির্মূল অথবা নিতান্ত অনভিজ্ঞতামূলক সলিয়া পরিগণিত হওয়া উচিত কি না।

"সাগ্নিক ব্যক্তির স্ত্রীর যদি পূর্ব্বে মৃত্যু হয় তবে তাহার সেই স্ত্রীকে ঐ অগ্নিহোত্র সহিত সেই অগ্নিতে দাহন করিতে হয় তবে তিনি তখন অগ্নিহোত্র রহিত হইয়া ক্ষণমাত্র থাকিবেন না কারণ নিত্যক্রিয়া লোপ হয় অতএব দ্বিতীয় বিবাহ করিয়া অগ্নিগ্রহণ করিবেন এক দিবসও অনাশ্রমী থাকিবেন না এই অভিপ্রায়ে ঐ বচন লিখিয়াছেন। যদি নিরগ্নিবিষয়েও বলেন তবে দিনমেকং ন তিঠেৎ ইহা সঙ্গত হয় না কারণ নিরগ্নি দ্বিজের দশাহ দ্বাদশাহ পক্ষাশৌচ। অশৌচ মধ্যে দ্বিতীয় বিবাহ কি প্রকারে বিধি হইতে পারে কারণ দিনমেকং ন তিষ্ঠেত্ত 'এই বচন নিরপ্তির পক্ষে সঙ্গত হয় না সাগ্নিক পক্ষে উত্তম সাগ্নিক অভি- প্রায়ে এই বচন কারণ অগ্নিবেদ উভয়ান্বিত দ্বিজের স্যঃশৌচ অতএব দিনমেকং ন তিষ্ঠেত্ত এই বচন সঙ্গত হয় কারণ সেই বেদাগ্নি যুক্ত ব্যক্তি সেই স্ত্রীকে দাহন করিয়া গান করিলে শুদ্ধ হয় পরে বিবাহ করিতে পারে প্রমাণ পরাশর সংহিতার বচন। একাহাজ্জুধ্যতে বিপ্রো যোহগ্নিবেদসমন্বিতঃ।। হাৎ কেবলবেদস্তু দ্বিহীনো দশভির্দিনৈঃ” (২৮) 1

যে দ্বিজ, বৈবাহিক অগ্নি রক্ষা করিয়া, প্রতিদিন তাহাতে যথানিয়মে হোম করে, এবং মৃত্যু হইলে সেই অগ্নিতে যাহার দাহ হয়, তাহাকে সাগ্নিক বলে; আর যে ব্যক্তির তাহা না ঘটে, তাহাকে নিরগ্নি বলে; অর্থাৎ যাহার বৈবাহিক অগ্নি রক্ষিত থাকে, সে সাগ্নিক; আর, যাহার বৈবাহিক অগ্নি ব্লক্ষিত না থাকে, সে নিরগ্নি। বিবাহকালে যে অগ্নির স্থাপন করিয়া বিবাহের হোম অর্থাৎ কুশণ্ডিকা করে, তাহার নাম বৈবাহিক, অগ্নি। সচরাচর, বিবাহের হোম করিবার নির্মিত্ত, নূতন অগ্নির স্থাপন করে; কিন্তু, কোনও কোনও পরিবারের রীতি এই, পুত্র। জন্মিলে, অরণি মন্থন পূর্বক অগ্নি উৎপন্ন করিয়া, সেই অগ্নিতে আয়ুষ্য হোম করে, এবং সেই অগ্নি রক্ষা করিয়া তাহাতেই সেই পুত্রের চূড়াকরণ, উপনয়ন, পাণিগ্রহণ নিমিত্তক হোমকার্য্য সম্পাদিত হয়। যাহার জন্মকালীন অগ্নিতেই জাতকৰ্ম্ম অবধি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়। পর্য্যন্ত নিষ্পন্ন হয়, সেই প্রকৃত সাগ্নিক বলিয়া পরিগণিত। বেদবিহিত অগ্নিহোত্র, দর্শপূর্ণমাস প্রভৃতি হোম সাগ্নিকের পক্ষে অনুল্লঙ্ঘনীয় নিত্যকর্ম্ম। সর্ববসাধারণের পক্ষে ব্যবস্থা আছে, জননাশোর্ট ও মরণাশৌচ ঘটিলে, ব্রাহ্মণ দশ দিন, ক্ষত্রিয় দ্বাদশ দিন, বৈশ্য পঞ্চদশ দিন শাস্ত্রোক্ত কুৰ্ম্মের 'অনুষ্ঠানে অনধিকারী হয়। কিন্তু, সাগ্নিকের পক্ষে সদ্যঃশৌচ, একাঁহাশৌচ প্রভৃতি অশৌচসঙ্কোচের বিশেষ ব্যবস্থা আছে; তদনুসারে কোনও সাগ্নিক স্নান করিয়া সেই দিনেই, কোনও সাগ্নিক দ্বিতীয়, দিনে, ইত্যাদি প্রকারে বেদবিহিত অগ্নিহোত্রাদি কতিপয় কার্য্য করিতে পারে, তদ্ভিন্ন অন্য অন্য শাস্ত্রোক্ত কর্ম্মের অনুষ্ঠানে অধিকারী হয় না; অর্থাৎ অগ্নিহোত্র প্রভৃতি কতিপয় বেদবিহিত কর্ম্মের অনুরোধে, কেবল তত্তৎ কর্ম্মের অনুষ্ঠান- কালে শুচি হয়, তত্তৎ কৰ্ম্ম সমাপ্ত হইলেই, পুনরায় সে ব্যক্তি অশুচি হয়; সুতরাং, শাস্ত্রোক্ত অন্যান্য কৰ্ম্ম করিতে পারে না। যথা,

১। প্রত্যূহেন্নাগ্নিষু ক্রিয়াঃ। ৫।৮৪। (২৯) অশৌচকালে অগ্নিক্রিয়ার অর্থাৎ অগ্নিহোত্রাদি হোমকার্য্যের ব্যাঘাত করি- বেক না।

১৭ বৈভানৌপাসনাঃ কাৰ্য্যাঃ ক্রিয়াশ্চ শ্রুতিচোদনাৎ। ৩১ ১৭। (৩০)

পবেদবিধান বর্ণতঃ, অশৌচকালে বৈতান অর্থাৎ অগ্নিহোত্রাদি হোম এবং উপাসন অর্থাৎ সায়ংকালে ও প্রাতঃকালে কর্তব্য হোম করিবেক।

৩। অগ্নিহোত্রার্থং স্নানোপস্পর্শনাৎ শুচিঃ (৩১)।

অগ্নিহোত্রের অনুরোধে, স্নান ও আচমন করিয়া শুচি হয়। ৪। উভয়ত্র দশাহানি সপিণ্ডানামর্শৌচকম্। স্নানোপস্পর্শনাভ্যাসাদগ্নিহোত্রার্থমইতি (৩২)

উভয়ত্র, অর্থাৎ জননে ও মরণে, সপিওদিগের দাহ অশৌচ; কিন্তু, স্নান ও আচমন করিয়া, অগ্নিহোত্রে অধিকারী হয়।

৫। স্মার্ত্তকৰ্ম্মপরিত্যাগো রাহোরণ্যত্র সূতকে। শ্রৌতে কৰ্ম্মণি তৎকালং স্নাতঃ শুদ্ধিমবাপুয়াৎ (৩৩) ।। গ্রহণ ব্যতিরিক্ত অশৌচ ঘাটলে, স্মৃতিবিহিত কর্ম্ম পরিত্যাগ করিবেক। কিন্তু, বেদবিহিত কর্ম্মের অনুরোধে, স্নান করিয়া তৎকালমাত্র শুচি হইবে।

৬। অগ্নিহোত্রাদিহোমার্থং শুদ্ধিস্তাৎকালিকী স্মৃতা। পঞ্চযজ্ঞান্ ন কুব্বীত হ্যশুদ্ধঃ পুনরেব সঃ (৩৪) ।

অগ্নিহোত্র প্রভৃতি হোমকার্য্যের অনুরোধে, তাৎকালিক শুদ্ধি হয়; অর্থাৎ অগ্নিহোত্রাদি করিতে যত সময় লাগে, তাবৎ কাল মাত্র শুচি হয়। কিন্তু পঞ্চযজ্ঞ করিবেক না। কারণ, সে ব্যক্তি পুনরায় অশুচি হয়।

৭। সূতকে কৰ্ম্মণাং ত্যাগঃ সন্ধ্যাদীনাং বিধীয়তে। হোমঃ শ্রেীতে তু কর্তব্যঃ শুল্কান্নেনাপি বা ফলৈঞ্চ (৩৫) ॥

অশৌচকালে সন্ধ্যাবন্দন প্রভৃতি কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিবেক; কিন্তু শুষ্ক অন্ন অথবা ফল দ্বারা শ্রৌত অগ্নিতে হোম করিবেক।

৮। হোমস্তত্র তু কর্ত্তব্যঃ শুষ্কান্নেন ফলেন বা। পঞ্চযজ্ঞবিধানন্ত ন কার্য্যং মৃত্যুজন্মনোঃ । ৪৪ ॥ (৩৬) মরণাশৌচ ও জননাশৌচ ঘাটলে শুষ্ক অন্ন অথবা ফল দ্বারা হোমকীর্য্য করিবেক, কিন্তু পঞ্চযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিবেক না।

৯। পঞ্চযজ্ঞবিধানস্ত ন কুর্য্যাস্মৃতজন্মনোঃ। হোমং তত্র প্রকুব্বীত শুষ্কান্নেন ফলেন বা (৩৭) ॥

মরণাশোঁচ ও জননাশৌচ ঘটিলে, পক্ষষজ্ঞের অনুষ্ঠান করিবেক না; কিন্তু, শুধ অন্ন অথবা ফল দ্বারা হোমকাধ্য করিবেক।

১০। নিত্যানি নিবর্ত্তেরন্ বৈতানবর্জ্জম্ (৩৮)। অশৌচকঞ্জল, বৈতান অর্থাৎ বেদবিহিত অগ্নিহোত্র প্রভৃতি ভিন্ন, যাবতীয় নিত্য কর্ম্ম রহিত হইবেক।

এই সকল শাস্ত্র দ্বারা স্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে, সাগ্নিক দ্বিজের পক্ষে, যে অশৌচসঙ্কোচের ব্যবস্থা আছে, তাহা কেবল বেদ- বিহিত অগ্নিহোত্র প্রভৃতি কতিপয় কর্ম্মের জন্য; সেই সকল কৰ্ম্ম করিতে যত সময় লাগে, তাবৎ কাল মাত্র শুচি হয়; সে সকল সমাপ্ত হইলেই, পুনরায় অশুচি হয়; দশাহ প্রভৃতি অশৌচের নিয়মিত কাল অতীত না হইলে, এককালে অশৌচ্ হইতে মুক্ত হয় না; এজন্য, ঐ সময়ে, পঞ্চ যজ্ঞ, সন্ধ্যাবন্দন প্রভৃতি প্রত্যহকর্ত্তব্য নিত্য কর্ম্মের অনুষ্ঠানও নিষিদ্ধ হুইয়াছে; এবং, এই জন্যই, স্মার্ত ভট্টাচার্য্য রঘুনন্দন, অশৌচসঙ্কোচের বিচার করিয়া, ঐরূপ ব্যবস্থাই অবলম্বন করিয়াছেন। যথা,

“তস্মাৎ, সগুণানাং তত্তৎকৰ্ম্মণ্যেবাশৌচসঙ্কোচঃ সর্বাশৌচনিবৃত্তিস্তু দশাহাদ্যুদ্ধমিতি হারলতা- মিতাক্ষরারত্নাকরাঢ্যুক্তং সাধীয়ঃ (৩৯)।

অতএব, সগুণ দিগের (৪০) তণ্ডৎ কর্ম্মেই অশৌচসঙ্কোচ, সর্ব্ব প্রকারে অশৌচ- নিবৃত্তি দশাহাদির পর; হারলতা, মিতাক্ষরা, রত্নাকর প্রভৃতি গ্রন্থে এই যে ব্যবস্থা অবধারিত হইয়াছে, তাহাই প্রশস্ত

এইরূপ স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ শাস্ত্র, এবং এইরূপ চিরপ্রচলিত' সর্বব- সম্মত ব্যবস্থা সত্ত্বেও, কবিরত্ন মহাশয় ব্যবস্থা করিয়াছেন, সগুণ দ্বিজের সর্ব বিষয়ে স্যঃশৌচ; অশৌচ ঘটিলে, স্নান করিবা মাত্র, তিনি, এককালে অশৌচ হইতে মুক্ত হইয়া, সর্ববপ্রকার শাস্ত্রোক্ত কর্ম্মের অনুষ্ঠানে অধিকারী হয়েন; অন্য অন্য কর্ম্মের কথা দূরে থাকুক, ব্যবস্থাপক কবিরাজ মহাশয় বিবাহ পর্য্যন্ত করিবার ব্যবস্থা দিয়াছেন। কিন্তু, যে অবস্থায়, শাস্ত্রকারেরা, সগুণের লক্ষে, অবশ্যকর্ত্তব্য সন্ধ্যাবন্দন, পঞ্চযজ্ঞানুষ্ঠান প্রভৃতি নিত্য .কর্ম্মের নিষেধ করিয়া গিয়াছেন, সে অবস্থায়, বিবাহ করা কত দূর সঙ্গত, তাহা সকলে বিবেচনা করিয়া দেখিবেন। কবিরত্ন মন্ত্রশয়, স্বাবলম্বিত ব্যবস্থার প্রমাণস্বরূপ, নিম্নদর্শিত পরাশর- . বচন উদ্ধৃত করিয়াছেন,

একাহাৎ শুধ্যতে "বিপ্রো" যোহগ্নিবেদসমন্বিতঃ।

ত্রানৎ কেবলবেদস্তু দ্বিহীনো দশভির্দিনৈঃ (৪১) । যে "বিপ্র" অগ্নিযুক্ত ও বেদযুক্ত, সে এক দিনে শুদ্ধ হয়; যে কেবল বেদযুক্ত, সে তিন দিনে শুদ্ধ হয়; আর, যে দ্বিহীন, অর্থাৎ উভয়ে বর্ণিত, সে দশ দিনে শুদ্ধ হয়।

এই বচন অবলম্বন করিয়া, কবিরত্ন মহাশয় সদ্যঃশৌচের ব্যবস্থা করিয়াছেন। কিন্তু, এই বচনে, সগুণের পক্ষে, একাহাশৌচ ও হাশৌচের ব্যবস্থ। দৃষ্ট হইতেছে, সদ্যঃশৌচবিধানের কোনও চিহ্ন লক্ষিত হইতেছে না। বোধ করি, তিনি, বচনস্থিত একাহ শব্দের অর্থগ্রহ করিতে না পারিয়া, স্যঃশৌচ ও একাহাশৌচ, •এ উভয়কে এক পদার্থ স্থির করিয়া, সভ্যঃশৌচের ব্যবস্থা দিয়াছেন। কিন্তু, সদ্যঃশৌচ ও একাহাশৌচ, এ উভয় সর্বাতো- 'ভাবে বিভিন্ন পদার্থ। অশৌচ ঘটিলে, যে স্থলে স্নান ও আচমন করিলেই শুচি হয়, তথায় সদ্যঃশৌচ শব্দ; আর,, যে স্থলে এক • দিন, অর্থাৎ অহোরাত্র, অশুচি থাকিয়া, পর দিন স্নান ও.আচমন করিয়া শুচি হয়, তথায় একাহ শব্দ ব্যবহৃত হইয়া থাকে।

বচনে একাহ শব্দ আছে, সাঃশৌচ শব্দ নাই। দক্ষসংহিতায় দৃষ্টি থাকিলে, কবিরত্ন মহাশয় ঈদৃশ অদৃষ্টচর, অশ্রুতপূর্বব ব্যবস্থ অবলম্বন' করিতেন, এরূপ বোধ হয় না। যথা,

A

সহ্যঃশৌচং তথৈকাহন্ত্র্যহশ্চতুরহস্তথা। ষড়দশদ্বাদশাহঞ্চ পক্ষে। মাসস্তথৈব চ ॥ মরণাস্তং তথা চান্যৎ পক্ষান্ত দশ সূতকে। উপন্যাসক্রমেণৈব বক্ষ্যাম্যহমশেষতঃ ।। গ্রন্থার্থতো বিজ্ঞানাতি বেদমঙ্গৈঃ সমন্বিতম্। সকল্পং সরহস্যঞ্চ ক্রিয়াবাংশ্চেন্ন সূতকম্ ॥ একাহাৎ শুধ্যতে বিপ্রো যোহগ্নিবেদসমন্বিতঃ। হীনে হীনতরে চাপি ত্যহশ্চতুরহস্তথা। তথা হীনতমে চাপি ষড়হঃ পরিকীর্ত্তিতঃ ।। জাতিবিপ্রো দশাহেন দ্বাদশাহেন ভূমিপঃ। বৈশ্যঃ পঞ্চদশাহেন শূদ্রো মাসেন শুষ্যতি । ব্যাধিতশস্থ্য কদর্য্যস্থ্য ঋণগ্রস্তশ্য সর্বদা। ক্রিয়াহীনস্য মূর্খস্থ্য স্ত্রীজিতস্থ্য বিশেষতঃ। ব্যসনাসক্তচিত্তস্থ্য পরাধীনস্থ্য নিত্যশঃ। স্বাধ্যায়ব্রতহীনস্থ ভস্মান্তং সূতকং ভবেৎ। নাসূতকং কদাচিৎ স্যাছ্যাবজ্জীবস্তু সূতকম্ ॥ এবং গুণবিশেষেণ সূতকং সমুদাহৃতম্ (৪২)

১ সদ্যঃশৌচ, ২ একাহাশৌচ, ৩ হাশৌচ, ৪ চতুরহাশৌচ, বড়হাশোঁচ, ৬ দশাহাশৌচ, ৭ দ্বাদশাহাশোঁচ, পঞ্চদশাহাশৌচ, ৯ মাসাশৌচ, ১০ মরণাস্তা- শৌচ, অশৌচ বিষয়ে এই দশ পক্ষ ব্যবস্থাপিত আছে। উপন্যাস ক্রমে, অর্থাৎ যাহার পর যাহা নির্দিষ্ট হইয়াছে তদনুসারে, তৎসমুদয় প্রদর্শিত হইতেছে।

১যে ব্যাক্ত সংকল্প, সরহন্ত, সাঙ্গ বেদের অভ্যাস ও অর্থগ্রহ করিয়াছে, সে ব্যক্তি যদি ক্রিয়াবান্ হয়, তাহার সদা শৌচ। ২- যে ব্রাহ্মণ অগ্নিযুক্ত ও বেদ- • যুক্ত হয়, সে একাহে শুদ্ধ হয়। ৩-৪-৫-যাহারা অগ্নি ও বেদে হীনু, হীনতর, হীনতম, তাহারা যথাক্রমে তিন দিনে, চারি দিনে, ছয় দিনে শুদ্ধ হয়। ৬-ষে ব্যক্তি জাতিবিষ্ণু অর্থাৎ ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ মাত্র করিয়াছে, কিন্তু যথা নিয়মে কর্তব্য কর্মের অনুষ্ঠান করে না, সে দশাহে শুদ্ধ। হয়। ৭- তাদৃশ ক্ষত্রিয় দ্বাদশাহে শুদ্ধ হয়। ৮-তাদৃশ ব্যৈ পঞ্চদশাহে শুদ্ধ হয়। ৯-শুদ্র এক মাসে শুদ্ধ হয়। ১০-যে ব্যক্তি চিররোগী, কৃপণ, সর্ব্বদা ঋণগ্রস্ত, ক্রিয়াহীন, মূর্ণ, স্ত্রীবণীভূত, বাসনাসক্ত, সতত পরাধীন, বেদাধ্যয়নবিহীন, তাহার মরণাস্ত অশৌচ; সে বাক্তি এক দিনের স্তন্তেও শুচি নয়, সে যাবজ্জীবন অশুচি। গুণের ন্যূনাধিক্য অনুসারে, অশৌচের ব্যবস্থা নির্দিষ্ট হইল।

এক্ষণে সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, সম্ভ্যঃশৌচ ও একাহাশৌচ, এই দুই এক পদার্থ বলিয়া পুরিগণিত হইতে পারে কি না। মহর্ষি দক্ষ অশৌচের দশ পক্ষ গণনা করিয়াছেন, তন্মধ্যে সৎশৌচ প্রথম পক্ষ, একাহাশৌচ দ্বিতীয় পক্ষ; যে ব্যক্তি সাঙ্গ বেদে সম্পূর্ণ কৃতবিদ্য ও ক্রিয়াবান, তাহার পক্ষে সহ্যঃশৌচ, আর যে ব্যক্তি অগ্নিযুক্ত ও বেদযুক্ত, তাহার পক্ষে একাহাশৌচ, ববস্থা- পিত হইয়াছে।

অতঃপর, কবিরত্ন মহাশয়কে অগত্যা স্বীকার করিতে হইতেছে, সম্ভ্যঃশোঁচ ও একাহাশৌচ এক পদার্থ নহে; সুতরাং, দক্ষসংহিতার স্বর্ণয়, পরাশরবচনে অগ্নিযুক্ত ও বেদযুক্ত ব্রাহ্মণের পক্ষে. যে একাহাশৌচের বিধি আছে, তাহা অবলম্বন করিয়া, “অগ্নিবেদ উভয়ান্বিত দ্বিজের সদ্যঃশৌচ,” এই ব্যবস্থা প্রচার কুরা নিতান্ত অনভিজ্ঞের কর্ম্ম হইয়াছে। কবিরত্ন মহাশয়, ঐ বচনের সহিত একবাক্যতা করিয়া,

অনাশ্রমী ন তিষ্ঠেতু দিনমেকমপি "দ্বিজঃ”। "ছিল" আশ্রমবিহীন হইয়া এক দিনও থাকিবেক না।

এই দক্ষবচনের ব্যাখ্যা করিতে উদ্যত হইয়াছেন। তাঁহার ব্যাখ্যা • অনুসারে, পরাশরবচনে, সাগ্নিক দ্বিজের পক্ষে, সদ্যঃশৌচ বিহিত হইয়াছে; আর, দক্ষবচনে, বিনা আশ্রমে এক দিনও থাকিতে নিষেধ আছে; সুতরাং, স্ত্রীবিয়োগ হইলে, তাদৃশ দ্বিজ, স্ত্রীর। দাহান্তে স্নান ও আচমন করিয়া, শুচি' হইয়া, সেই দিনেই বিবাহ করিতে পারে। কিন্তু উপরি ভাগে যেরূপ দর্শিত হইল, তদনুসারে তাঁহার অবলম্বিত পরাশরবচন একাহাশৌচবিধায়ক, সদ্যঃশৌত- বিধায়ক নহে; সদ্যঃশৌচবিধায়ক না হইলে,, উভয়, বচনের একবাক্যতা, কোনও ক্রমে, সম্ভবিতে গারে না। আর, কবিরত্ন মহাশয়ের ইহাও অনুধাবন করিয়া দেখা আবশ্যক ছিল, দক্ষবচনে দ্বিজ শব্দ প্রযুক্ত আছে; দ্বিজ শব্দ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্ণের বাচক; সুতরাং, দক্ষবচনে ত্রিবিধ দ্বিজের পক্ষে ব্যবস্থা প্রদত্ত হইয়াছে। কিন্তু, পরাশরবচনে বিপ্র শব্দ প্রযুক্ত আছে; বিপ্র শব্দ ব্রাহ্মণমাত্রবাচক; সুতরাং, পরাশরবচনে কেবল ব্রাহ্মণের পক্ষে ব্যবস্থা প্রদত্ত হইয়াছে, ত্রিবিধ দ্বিজের পক্ষে ব্যবস্থা প্রত্তে হয় নাই; এজনাও, এই দুই বচনের এক- বাক্যতা ঘটিতে পারে না। আর, সাগ্নিক বিশেষের পক্ষে সদ্যঃশৌচের ব্যবস্থা আছে, যথার্থ বটে; কিন্তু সেই সাগ্নিক দ্বিজ, স্ত্রীর দাহান্তে স্নান ও আচমন করিয়া শুচি হইয়া, সেই দিনেই বিবাহ করিতে পারে, কবিরত্ন মহাশয়ের, এ বাবস্থা অত্যন্ত বিস্ময়কর; কারণ, অশৌচসঙ্কোচব্যবস্থার উদ্দেশ্য এই যে, শাস্ত্রক।রেরা, যে সকল কর্ম্মের নাম নির্দেশ করিয়া, সদ্যঃ- শৌচের বিধি দিয়াছেন, কেবল তত্তৎ কর্ম্মের জন্যই, সে ব্যক্তি, তত্তৎ কালে, শুচি হয়, তত্তৎ কৰ্ম্ম সমাপ্ত হইলেই, পুনরায় অশুচি হয়; সে সময়ে সন্ধ্যাবন্দন, পঞ্চযজ্ঞানুষ্ঠান প্রভৃতি নিত্য . কর্ম্মেরও বাধ হইয়া থাকে; এ অবস্থায় দারপরিগ্রহ বিধিসিদ্ধ, ইহা কোনও মতে সম্ভবিতে পারে না। ফলকথা এই, কবিরত্ন মহাশয়, ধৰ্ম্মশাস্ত্র বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ; অশৌচসঙ্কোচের উদ্দেশ্য কি, তাহা জানেন না, দক্ষবচন ও পরশরবচনের অর্থ ও তাৎপর্য্য কি, তাহা জানেন না; এজন্যই এরূপ অসঙ্গত ও অশ্রুতপূর্ব ব্যবস্থা প্রচার করিয়াছেন। যাহার যে শাস্ত্রে বোধ ও অধিকার না থাকে, নিতান্ত অর্বাচীন না হইলে, সে ব্যক্তি, সাহস করিয়া, মে শাস্ত্রের মীমাংসায় হস্তক্ষেপ করে না। কবিরত্ন মহাশয়, প্রাচীন ও বহুদর্শী হইয়া, কোন বিবেচনায়, অনধীত, অননুশীলিত ধর্মশাস্ত্রের মীমাংসায় হস্তক্ষেপ করিলেন, বুঝিতে পারা যায় না। যাহা হউক, কবিরত্ন মহাশয়ের, অদ্ভুত ব্যবস্থার উপযুক্ত দৃষ্টান্তস্বরূপ যে একটি সামান্য উপাখ্যান স্মৃতিপথে আরূঢ় হইল, তাহা এ স্থলে উদ্ধৃত না করিয়া, ক্ষান্ত হইতে পারিলাম না।।

"যাঁর' যে শাস্ত্র কিঞ্চিন্মাত্রও অধীত নয় সে শাস্ত্রেতে তাহার উপদেশ গ্রাহ্য করিবেক না ইহার কথা। এক রাজার নিকটে বিপ্রাভাস নামে এক ৰ্যৈ থাকে সে চিকিৎসাতে উত্তম তাহার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হইলে পর ঐ রাজা রামকুমার নামে তৎপুত্রকে তাহার পিতৃপদে স্থাপিত করিলেন। ঐ ভিষপুত্র রামকুমার ব্যাকরণ সাহিত্য কিঞ্চিৎ পড়িয়া ব্যুৎপন্ন ছিল কিন্তু বৈদ্যকাদি শাস্ত্র কিঞ্চিন্মাত্রও পঠিত ছিল না রাজান্ন- গ্রহেতে "স্বপিতৃপদাভিষিক্ত হওয়াতে রোগীরা চিকিৎসার্থে "তাহার সন্নিধিতে যাওয়া আসা করিতে লাগিল। পরে এক দিবস এক নেত্ররোগী ঐ রামকুমার বৈজ্ঞপুত্রের নিকটে আসিয়া কহিল হে বৈদ্যপুত্র গ্রামি অক্ষিপীড়াতে অতিশয় পীড়িত আছি দেখ আমাকে এমন কোন ঔষধ দাও যাহাতে আমার নয়নব্যাধি শীঘ্র উপশম পায়। রুগ্ননেত্রের এই বাক্য শ্রবণ করিয়া ঐ • চিকিৎসক젖ত অতি বড় এক পুস্তক আনিয়া খুলিবামাত্র এক বচনার্দ্ধ দেখিতে পাইল সে বচনার্দ্ধ এই

"নেত্ররোগে সমুৎপন্নে কর্ণৌছিত্ত্বা কটিং দহেৎ।" ইহার অর্থ নেত্ররোগ হইলে নেত্ররোগীর কর্ণদ্বয় ছেদন করিয়া লৌহ তপ্ত করিয়া তাহার কাটতে দাগ দিবে এই বচনার্দ্ধ পাইয়া ঐ ভিষনন্দন নেত্ররোগীকে কহিল হে রুগ্নাক্ষ এই প্রতীকারে তোমার ব্যাধির ক্ষুদ্র শাস্তি হইবে যেহেতুক গ্রন্থ মুকুলিত করামাত্রেই এ ব্যাধির ঔষধের প্রমাণ পাওয়া গেল এ বড় সুলক্ষণ। রোগী কহিল সে কি ঔষধ ভিষক্সস্তান কহিল তুমি শীঘ্র বাটী গিয়া এই প্রয়োগ কর তীক্ষ্ণধার শাণিত এক ক্ষুর অনিয়া স্বকীয় দুই কর্ণ কাটিয়া সন্তপ্ত লৌহেতে দুই পাছাতে দুই দাগ দেও তবে তোমার চক্ষুঃপীড়া আশু শান্ত হইবে ইহা " শুনিয়া ঐ লোচনরোগী আর্ততাপ্রযুক্ত কিঞ্চিন্মাত্র বিবেচনা না করিয়া তাহাই করিল।

অনন্তর রোগী এক পীড়োপশমনার্থ চেষ্টাতে অধিক পীড়াঙ্গয়ে অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া ঐ বৈশ্বের নিকটে পুনর্ব্বার গেল ও তাহাকে কহিল হে বৈদ্যপুত্র নেত্রের জ্বালা যেমন তেমনি পাছার আলায় মরি। ব্যৈপুত্র কহিল ভাই কি করিবে রোগ হুইলে সহিষ্ণুতা করিতে হয় আমি শাস্ত্রানুসারে তোমাকে ঔষধ, দিয়াছি আতুর হইলে কি হবে "নহি সুখং দুঃখৈব্বিনা লভ্যতে”। এইরূপে রোগী ও বৈ্যেতে কথোপকথন হইতেছে ইতিমধ্যে অত্যুপ্তম এক চিকিৎসক তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। ঐ যমসহোদর রামকুমার নামে মূর্খ ব্যৈতনয়ের পল্লবগ্রাহি পাণ্ডিত্যপ্রযুক্ত। সাহসের বিশেষ অবগত হইয়া কহিল ওরে ব্যলীক সর্ব্বনাশ করিয়াছিস্ এ রোগীটাকে খুন করিলি এ বচনার্দ্ধ অশ্ব চিকিৎসার মনুষ্যপর নয়। দেশ কাল পাত্র অবস্থা ভেদে চিকিৎসার বিশেষ 'আছে তোর প্রকরণ জ্ঞান নাই এ শাস্ত্র তোর পড়া নয় কুব্যুৎ- পত্তিমাত্র বলে অপঠিত শাস্ত্রের ব্যবস্থা দিস্ যা যা উত্তম গুরুর স্থানে বৈদ্যক শাস্ত্রের অধ্যয়ন কর "সঙ্কেতবিদ্যা গুরুবক্তগম্যা" ইহা কি তুই কথন শুনিস্ নাই। এইরূপে ঐ চিকিৎসকবৎসুকে পবিত্র ভৎসন করিয়া 'ঐ ক্লিন্নাক্ষ রোগীকে যথাশাস্ত্র ঔষধ প্রদান করিয়া নীরোগ করিল" (৪৩)।

শ্রীযুত রামকুমার কবিরাজের ব্যবস্থা, আর শ্রীযুত গঙ্গাধর কবিরাজের ব্যবস্থা, এ উভয়ের অনেক অংশে সৌসাদৃশ্য আছে কি না, সকলে অনুধাবন করিয়া দেখিবেন। কবিরত্ন মহাশয়ের চতুর্থ আপত্তি এই,

নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারীর বিবাহই নাই' (৪৪)। 'আপত্তির উদ্দেশ্য এই, নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী, বিবাহ না করিয়া, যাবজ্জীবন ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন পূর্বক, কাল যাপন করেন। বিবাহ ও গৃহস্থাশ্রম, নিত্য হইলে, নিত্য কর্ম্মের ইচ্ছাকৃত পরিত্যাগ জন্য, তিনি প্রত্যবায়গ্রস্ত হইতেন। অতএব, বিবাহ নিত্য নহে। এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী দারপরিগ্রহ করেন না, এই হেতুতে বিবাহের বা গৃহস্থাশ্রমের নিত্যত্ব ব্যাঘাত হয় না, ইহা তর্কবাচ্চস্পতিপ্রকরণে আলোচিত হইয়াছে (৪৫)।

• কবিরত্ন মহাশয়ের সন্তোষার্থে প্রমাণান্তর উল্লিখিত হইতেছে। য্যৈতানি সুগুপ্তানি জিহ্বোপস্থোদরং করঃ। সন্ন্যাসসময়ং কৃত্বা ব্রাহ্মণো ব্রহ্মচর্য্যয়া। তস্মিন্নেব নয়েৎ কালমাচার্য্যে যাবদায়ুষম্। 

তদভাবে চ তৎপুত্রে তচ্ছিধ্যে বাথ তৎকুলে। ন বিবাহো ন সন্ন্যাসে। নৈষ্ঠিকস্য বিধীয়তে ॥ ইমং যে। বিধিমাস্থায় ত্যজেদ্দেহমতন্দ্রিতঃ। নেহ, ভূয়োহপি জায়েত ব্রহ্মচারী দৃঢ়ব্রতঃ (৪৬) ॥

যে ব্যক্তির জিহ্বা, উপন্থ, উদর ও কর সুরক্ষিত অর্থাৎ বিষয়ানুরাগে বিচলিত না হয়, তাদৃশ ব্রাহ্মণ, ব্রহ্মচর্যা অবলম্বন পূর্ব্বক, সর্বত্যাগী হইয়া, সেই গুরুর নিকটেই যাবজ্জীবন কালযাপন করিবেক। গুরুর অভাবে গুরুপুত্রের নিকট, তদভাবে তদীয় শিষ্য অথবা তৎকুলোৎপন্ন ব্যক্তির নিকট। নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারীব বিবাহ ও সন্ন্যাস বিহিত নহে। যে দৃঢ়ব্রত ব্রহ্মচারী, অবহিত ও অনলস হইয়া, এই বিধি অবলম্বন পূর্ব্বক, দেহত্যাগ করে, তাহার পুনর্জন্ম হয় না।

এই শাস্ত্রে নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারীর বিবাহ নিষিদ্ধ হইয়াছে। সামান্য- শাস্ত্র অনুসারে, ব্রহ্মচর্য্য সমাপনের, পর, গুরুর অনুমতি লইয়া, গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ ও দারপরিগ্রহ করিতে হয়। বিশেষশাস্ত্র অনুসারে, ইচ্ছা ও ক্ষমতা হইলে, যাবজ্জীবন ব্রহ্মচর্য্য করিতে পারে। যে যাবজ্জীবন ব্রহ্মচর্য্য করে, তাহাকে নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী বলে। যথা,

যস্তুপনয়নাদেতদা নৃত্যোব্রতমাচরেৎ।

স নৈষ্ঠিকো ব্রহ্মচারী ব্রহ্মসাযুজ্যমাপুয়াৎ (৪৭) । যে ব্যক্তি, উপনয়ন অবধি মৃত্যুকাল পর্য্যস্ত, এই ব্রতের অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য্যের অনুষ্ঠান করে, সে নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী; সে ব্রহ্মসাযুজ্য প্রাপ্ত হয়।

ব্রহ্মচর্য্য সমাপনের পর বিবাহের বিধি প্রদত্ত হইয়াছে। নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারীর ব্রহ্মচর্য্য সমাপ্ত হয় না, সুতরাং বিবাহে অধিকার জন্মে না। বিবাহ করিলে, ব্রতভঙ্গ হয়, এ জন্যই, নৈষ্টিক ব্রহ্মচারীর পক্ষে, বিবাহ নিষিদ্ধ দৃষ্ট হইতেছে। এমন স্থলে, নৈষ্টিক ব্রহ্মচারী বিবাহ করেন না বলিয়া, বিবাহের নিত্যত্ব ব্যাঘাত হইতে পারে না। শাস্ত্রকারের। অবিরক্ত ব্যক্তির পক্ষেই ' গৃহস্থাশ্রমের ও গৃহস্থাশ্রম প্রবেশমূলক বিবাহের নিত্যত্বব্যবস্থা করিয়াছেন। তর্কবাচস্পতিপ্রকরণের তৃতীয় পরিচ্ছেদে আছ্যো- .পান্ত, বিবাহের নিত্যত্ব, নৈমিত্তিকত্ব, ও কাম্যত্ব সংস্থাপনে নিযোজিত হইয়াছে। কবিরত্ন মহাশয়, আলস্য ত্যাগ কুরিয়া, ঐ পরিচ্ছেদে দৃষ্টিবিন্যাস করিলে, বিবাহের নিত্যত্ব সিদ্ধ হয় .কি নাঁ, তাঁহার সবিশেষ অবগত হইতে পারিবেন।

কবিরত্ন মহাশয়ের পঞ্চম আপত্তি এই,

"অসবর্ণাবিবাহু যদি দ্বিজাতিদিগের পূর্ব্বে বিধিই নাই এই ব্যাখ্যা করেন তবে বিষ্ণুক্ত চন সঙ্গত হয় না। বিষ্ণুবচন কিঞ্চিৎ '•লিখিয়াছেন শেষ গোপন করিয়া রাখিয়াছেন ইহা কি উচিত। শাস্ত্রের যথার্থ ব্যাখ্যা করিতে হয়।

বিষ্ণুবচন যথা

•: সবর্ণাস্থ বহুভার্য্যাহু বিদ্যমানাসু জ্যেষ্ঠয়া সহ ধর্ম্মং কুৰ্য্যাৎ।

এই পর্য্যন্ত লিখিয়া শেষ লিখেন নাই। শেষটুক লিখিলেও ব্যাখ্যা সঙ্গত হয় না। উহার শেষ এই। .

মিশ্রাসু চ কনিষ্ঠয়াপি সবর্ণয়া। সবর্ণাভাবে হানন্তরয়ৈবাপদি চ। নত্বেব দ্বিজঃ শূদ্রয়া। দ্বিজস্য ভাৰ্য্যা শূদ্রা তু ধর্ম্মার্থে ন ভবেৎ কচিৎ। রত্যর্থমেব সা তস্থ্য রাগান্ধসস্থ্য প্রকীর্ত্তিতা ইতি ॥

এই বিষ্ণুৰচনে। মিশ্রাস্থ চ কনিষ্ঠয়াপি সবর্ণয়া। এই লিখাতে ব্রাহ্মণের অগ্রে বিবাহ ক্ষত্রিয়া অথবা বৈশ্যা হইতে পারে পরে সর্বর্ণা বিবাহ হইতে পারে। তাহা হইলে মিশ্রবর্ণ বহুভাৰ্য্যা হয় কিন্তু ক্ষত্রিয়া জ্যেষ্ঠা তবে কি ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ার সহিত ধৰ্ম্মা- চরণ করিবে। এবং ক্ষত্রিয়ের অগ্রন্ত্রী বৈশ্যা পরে ক্ষত্রিয়া তাহার জ্যেষ্ঠা বৈশ্যার সহিত কি ধর্মাচরণ করিবে। তাহাতেই কহিয়াছেন মিশ্রান্ত কনিষ্ঠয়াপি সবর্ণয়া। সবর্ণা নিষ্ঠা স্ত্রীর সহিতেই ধৰ্ম্মাচরণ করিবে” (৪৮)। ১

কবিরত্ন মহাশয়ের উল্লিখিত বিষ্ণুবচন যে অভিপ্রায়ে উদ্ধৃত ও ব্যাখ্যাত হইয়াছিল, তৎপ্রদর্শনার্থ প্রথম পুস্তকের কিয়দংশ উদ্ধৃত হইতেছে;-

"কোনও কোনও মুনিবচনে, এক ব্যক্তির বহু স্ত্রী বিদ্যমান থাকা নির্দিষ্ট আছে, তদ্দর্শনে কেহ কেহ কহিয়া থাকেন, যখন শাস্ত্রে এক ব্যক্তির যুগপৎ বহু স্ত্রী বিদ্ধমান থাকার স্পষ্ট উল্লেখ দৃষ্টি- গোচর হইতেছে, তখন যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহ শাস্ত্রকারদিগের অনুমোদিত কাৰ্য্য নহে, ইহা কিরূপে পরিগৃহীত হইতে পারে।" তাঁহাদের অভিপ্রেত শাস্ত্র সকল এই,-

১। সবর্ণাস্থ বহুভাৰ্য্যাস্থ বিদ্যমানাহু জ্যেষ্ঠয়া সহ..... ধর্মকার্য্যং কারয়েৎ।

সজাতীয়া বহু ভাৰ্য্যা বিদ্যমান থাকিলে, জ্যেষ্ঠার সহিত ধর্মকার্য্যের অনৃষ্ঠান করিবেক" (৪৯)। ৬

এইরূপে বহুভার্য্যাপরিগ্রহের" প্রমাণভূত কতিপয় বচন প্রদর্শন করিয়া লিখিয়াছিলাম,

"এই সকল বচনে এরূপ কিছুই নির্দিষ্ট নাই যে তত্ত্বীয়া, শাস্ত্রোক্ত নিমিত্ত ব্যতিরেকে, পুরুষের ইচ্ছাধীন বহু বিবাহ প্রতিপন্ন হইতে পারে। প্রথম বচনে (কবিরত্ন মহীশয়ের উল্লি-" থিত বিষ্ণুবচনে) এক ব্যক্তির বহুভার্ষ্যা বিদ্যমান থাকার উল্লেখ আছে; কিন্তু ঐ বহুভার্য্যাবিবাহ অধিবেদনের নির্দিষ্ট নিমিত্ত- নিবন্ধন নহে, তাহার কোনও হেতু লক্ষিত হইতেছে না” (৫০)।

বিষ্ণু প্রথম বুচনে ব্যবস্থা করিয়াছেন, যদি কোনও ব্যক্তির সর্বর্ণা ধহু ভার্য্যা থাকে, সে জ্যেষ্ঠা ভার্য্যার সহিত, ধর্ম্মকার্য্যের অনুষ্ঠান করিবেক; অনন্তর, দ্বিতীয় বচনে ব্যবস্থা করিয়াছেন, যদি, সবর্ণা, অসবর্ণা, বহু ভাৰ্য্যা থাকে, তাহা হইলে, সবর্ণা অসবর্ণী:অপেক্ষা বয়ঃকনিষ্ঠ। হইলেও, তাহারই সহিত ধৰ্ম্মকার্য্য • করিবেক। যথা,

. মিশ্রামু চ কনিষ্ঠয়াপি সবর্ণয়া।

সবর্ণা, অসবর্ণা, বহু ভার্য্যা বিদামান্দ থাকিলে, সবর্ণা বয়ঃকনিষ্ঠা হইলেও, তাহারই সহিত ধৰ্ম্মকার্য্য করিবেক।

এ স্থলে দৃষ্ট হইতেছে, সবর্ণা অপেক্ষা অসবর্ণা বয়োজ্যেষ্ঠা; তদ্দ্বারা ইহা প্রতিপন্ন হইতে পারে, সবর্ণার পূর্বের অসবর্ণার পাণিগ্রহণ সম্পন্ন হইয়াছে; সুতরাং, প্রথম বিবাহে অসবর্ণা নিষিদ্ধ। নহে, ইহা সিদ্ধ হইতেছে। এই স্থির করিয়া, কবিরত্ন মহাশয় লিখিয়াছেন, আমি, বিষ্ণুবচনের শেষ অংশ গোপন পূর্বক, পূর্ব অংশের অযথার্থ ব্যাঙ্গ্যা করিয়া, লোককে প্রতারণা ' করিয়াছি। এ স্থলে বক্তব্য এই যে, সবর্ণা, অসবর্ণা, বহু ভার্য্যার • সমবায়ে, সবর্ণা স্ত্রী বয়ঃকনিষ্ঠ। হওয়া তিন প্রকারে ঘটিতে পারে; প্রথম, অগ্রে অসবর্ণা বিবাহ করিয়া, পরে সবর্ণাবিবাহ; দ্বিতীয়, প্রথমে সবর্ণাবিবাহ, তৎপরে অসবর্ণাবিবাহ, অনন্তর • পূর্বপরিণীতা সবর্ণার মৃত্যু হইলে, পুনরায় সবর্ণাবিবাহ; তৃতীয়, প্রথমে অতি অল্পবয়স্ক। সবর্ণাবিবাহ, তৎপরেই অধিকবয়স্কা অসবর্ণাবিবাহ (৫১)। ইতঃপূর্ব্বে নির্বিবাদে প্রতিপাদিত হইয়াছে, প্রথমে অসবর্ণাবিবাহ সর্বতোভাবে শাস্ত্রবহির্ভূত ও ধৰ্ম্মবিগর্হিত। কর্ম্ম। অতএব, যখন প্রথমে অসবর্ণাবিবাহ সর্ব্বতোভাবে বিধি, বিরুদ্ধ কৰ্ম্ম বলিয়া স্থিরীকৃত আছে, এবং যখন বিষ্ণুবচনে। বয়ঃকনিষ্ঠা সবর্ণার উল্লেখ অন্য দুই প্রকারে সম্পূর্ণ, সম্ভর হইতেছে, তখন ঐ উল্লেখ মাত্র অবলম্বন করিয়া, প্রথমে অসবর্ণা- বিবাহ নিষিদ্ধ নহে, এরূপ সিদ্ধান্ত নিতান্ত অসঙ্গত, তাঁহার সংশয় নাই।

কবিরত্ন মহাশয় স্বীয় বিচারপুস্তকের শাস্ত্রীয় অংশের সমাপন করিয়া, উপসংহার করিতেছেন, "

“এই সকল শাস্ত্রদৃষ্টিতে আমার বুদ্ধিসিদ্ধ বহুবিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ অশাস্ত্রিক নহে। তবে যদি বহুবিবাহ রহিতের বাসনা সিদ্ধ করিতে হয় তবে শাস্ত্রাবলম্বন ত্যাগ করুন। শাস্ত্রের যথার্থ ব্যাখ্যা না করিয়া, মূর্খদিগকে বুঝাইয়া শাস্ত্রসম্মত কৰ্ম্ম বলিরা প্রকাশ করার আব্যক কি (৫২)"।

"এই সকল শাস্ত্রদৃষ্টিতে আমার বুদ্ধিসিদ্ধ বহুবিবাহ শাস্ত্র- সিদ্ধ অশাস্ত্রিক নহে”।-কবিরত্ন মহাশয়, ধৰ্ম্মশাস্ত্রবিচারে প্রবৃত্ত হইয়া, বুদ্ধির যেরূপ পরিচয় দিয়াছেন, তাহা ইতঃপূর্বের সবিস্তর। 

দর্শিত হইয়াছে। অতএব, বহুবিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ অশান্ত্রিক নহে, "ইহা তাঁহার বুদ্ধিসিদ্ধ, তদীয় এই নির্দেশ কত দূর আদরণীয় ▶ হওয়া উচিত, তাহা সকলে বিবেচনা করিয়া দেখিবেন!-"তবে যদি বহুবিবাহ রহিতের বাসনা সিদ্ধ করিতে হয় তবে শাস্ত্রাবলম্বন 'ত্যাগ করুন"।-যিনি কোনও কালে, ধর্মশাস্ত্রের অধ্যয়ন ও অনুশীলন করেন নাই; সুতরাং, ঋষিবাক্যের অর্থবোধে ও তাৎপর্য্য গ্রহে সম্পূর্ণ অসমর্থ; তাদৃশ ব্যক্তির মুখে ঈদৃশ উপদেশ- বাক্য শ্রবণ করিলে, শরীর পুলকিত হয়। অন্যমনাঃ ও • অনন্যকৰ্ম্মা হইয়া, জীবনের অবশিষ্ট ভাগ ধর্মশাস্ত্রের অনুশীলনে অতিবাহিত করিলেও, তাঁহার ঈদৃশ উপদেশ দিবার অধিকার জন্মিবেক কি না, সন্দেহস্থল এমন স্থলে, অর্থগ্রহ ব্যতিরেকে, এই চারিটি বচন অবলম্বন করিয়া, ধৰ্ম্মশাস্ত্রের পারদর্শী হৃইয়াছি এই ভাবিয়া, “শাস্ত্রাবলম্বন পরিত্যাগ করুন," অম্লান মুখে এতাদৃশ উপদেশ দিতে উদ্যত হওয়া সাতিশয় আশ্চর্য্যের ও নিরতিশয় কৌতুকের বিষয় বলিতে হইবেক। "শাস্ত্রের যথার্থ ব্যাখ্যা না করিয়া ব্যাখ্যান্তর করিয়া মূর্খাদিগকে বুঝাইয়া শাস্ত্রসম্মত কৰ্ম্ম বলিয়া প্রকাশ করার আবশ্যক কি”। -যদি এরূপ রাজাজ্ঞা প্রচারিত থাকিত, শ্রীযুত গঙ্গাধর রায় কবিরত্ন যে স্মৃতিবচনের যে অর্থ যথার্থ বা অযথার্থ বলিয়া অভিপ্রায় প্রকাশ করিবেন; অদ্যাবধি, দ্বিরুক্তি না করিয়া, ঐ বচনের ঐ অর্থ যথার্থ বা অযথার্থ বলিয়া, ভারতবর্ষবাসী লোকদিগকে শিরোধার্য্য করিতে হুইবেক; তাহা হইলে, আমি যে সকল ব্যাখ্যা লিখিয়াছি, সে সমস্ত যথার্থ নহে, তদীয় এই সিদ্ধান্ত নির্বিবাদে অঙ্গীকৃত হইতে পারিত। কিন্তু, সৌভাগ্য ক্রমে, সেরূপ রাজাজ্ঞা প্রচারিত নাই; সুতরাং, অকুতোভয়ে নির্দেশ করিতেছি, আমি, শাস্ত্রের অযপার্থ ব্যাখ্যা লিখিয়া, লোককে প্রতারণা করিবার নিমিত্ত প্রয়াস পাই নাই। পূর্বের নির্দেশ করিয়াছি, এবং এক্ষণেও নির্দেশ করিতেছি, কবিরাজ মহাশয় ধৰ্ম্মশাস্ত্রে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। চিকিৎসা ( বিষয়ে কিরূপ বলিতে পারি না; কিন্তু ধৰ্ম্মশাস্ত্র বিষয়ে তাঁহার, কিছুমাত্র নাড়ীজ্ঞান নাই। এজন্যই, নিতান্ত নির্বিবেক হইয়া, এরূপ গর্বিবত বাক্যে এরূপ উদ্ধত, এরূপ অসঙ্গত, নির্দেশ করিয়াছেন। আর,-“মূর্খদিগকে বুঝাইয়া”,-তদীয় এই লিখন দ্বারা ইহাই প্রতিপন্ন হইতেছে, বিষয়ী লোক মাত্রেই মুখে; সেই মূর্খদিগের চক্ষে ধূলিপ্রক্ষেপ করিবার নিমিত্ত, আমি, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত- বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রবহির্ভূত কৰ্ম্ম বলিয়া, অলীক অশাস্ত্রীয় ব্যবস্থা প্রচারিত করিয়াছি। কবিরত্ন মহাশয়ের মত কতকগুলি লোক আছেন; তাঁহারা বিষয়ী লোকদিনকে মূর্খ স্থির করিয়া রাখিয়: ছেন; কারণ, বিষয়ী লোক সংস্কৃত ভাষা জানেন না। তাঁহাদের মতে, সংস্কৃতভাষার ব্যাকরণ না পড়িলে, লোক পণ্ডিত বলিয়া গণনীয় হইতে পারে না; তাদৃশ লোক, অসাধারণ বুদ্ধিমান ও বিদ্যাবিশারদ বলিয়া সর্ববত্র প্রতিষ্ঠিত হইলেও, তাঁহাদের নিকট মূর্খ বলিংগ পরিগণিত হইয়া থাকেন। পক্ষান্তরে, যে সকল মহাপুরুষ, সংস্কৃতভাষার ব্যাকরণ পাঠ' ও অন্যান্য শাস্ত্র স্পর্শ করিয়া, বিদ্যার অভিমানে, জগৎকে তৃণ জ্ঞান করেন, বিষয়ী লোকে, তাদৃশ পণ্ডিতাভিমানী দিগকে মূর্খের চূড়ামণি ও নির্বোধের শিরোমণি বলিয়া, ব্যবস্থা স্থির করিয়া রাখিয়া- ছেন। এ' স্থলে, কোন পক্ষ শ্যাষ্ট্রবাদী, তাহার মীমাংসা করিবার প্রয়োজন নাই।



উপসংহার

'শ্রীযুত তারানাথ তর্কবাচস্পতি প্রভৃতি প্রতিবাদী মহাশয়েরা, শুদৃচ্ছা প্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ডের শাস্ত্রীয়তাপক্ষ সমর্থন করিবার নিমিত্ত, যে সমস্ত শাস্ত্র ও যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছেন, সে সমুদয় সবিস্তর আলোচিত হইল। যদৃচ্ছাক্রমে যত ইচ্ছা বিবাহ করা, • কোনও ক্রমে শাস্ত্রকারদিগের অভিপ্রেত নহে, ইহা যাহাতে দেশস্থ সুর্বসাধারণ লোকের হৃদয়ঙ্গম হয়, এই আলোচনাকার্য্য সেই রূপে নির্বাহিত করিবার নিমিত্ত, প্রয়াস পাইয়াছি; কিন্তু, * দূর কৃতকার্য্য হইয়াছি, বীলতে পারি না। তবে, এক কথা, সাহস পূর্বক, বলিতে পারা যায়, ঈদৃশ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিয়া, যদ্রূপ যত্ন ও স্বদ্রূপ পরিশ্রম করা উচিত ও আবশ্যক, সাধ্যানুসারে সে ধিযুয়ে ত্রুটি করি নাই। যে সকল মহাশয়েরা, কৌতূহলাবিষ্ট হইয়া, অথবা আমার প্রতি দয়াপ্রকাশ করিয়া পরিশ্রম স্বীকার পূর্ব্বক, কিঞ্চিৎ অভিনিবেশ সহকারে, এই পুস্তক আছোপান্ত অবলোকন করিবেন, আমার যত্ন ও পরিশ্রম, কিয়ৎ অংশেও, সফল হইয়াছে; অথবা সর্বাংশেই বিফল হইয়াছে, তাঁহারা তাহার বিচার ও মীমাংসা করিতে পারিবেন। আমি এই মাত্র বলিতে পারি, পূর্ব্বে, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রবহির্ভূত ও ধর্ম্মবিগর্হিত ব্যবহার বলিয়া আমার যে সংস্কার জন্মিয়াছিল, • সাতিশয় অভিনিবেশ সহকারে, বিবাহ সংক্রান্ত শাস্ত্রসমূহের সবিশেষ অনুশীলন করাতে, সেই সংস্কার সর্বতোভাবে দৃঢ়ীভূত হইয়াছে। ক্রমাগত, কিছু কাল, এই বিষয়ের আলোচনা করিয়া, আমার এত দূর পর্য্যন্ত বিশ্বাস জন্মিয়াছে যে, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রসিদ্ধ ব্যবহার, ইহা কেহই প্রতিপন্ন করিতে পারিবেন না, এরূপ নির্দেশ করিতে ভয়, সংশয়, বা সঙ্কোচ উপস্থিত হইতেছে না। ফলতঃ, আমার সামান্য বুদ্ধিতে, যত দূর, শাস্ত্রের অর্থবোধ ও তাৎপর্য্যগ্রহ করিতে পারিয়াছি, তদনুসারে, . যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রসম্মত ব্যবহার বলিয়া সমর্থিত হওয়া সম্ভব নহে।

যদৃচ্ছা ক্রমে যত ইচ্ছা বিবাহ করা শাস্ত্রকারদিগের অনুমত ও অনুমোদিত কার্য্য, ইহা প্রতিপন্ন করিতে উদ্যত হইলে, যে কেবল ধৰ্ম্মশাস্ত্র বিষয়ে-স্বীয় অনভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ পরিচয় দেওয়া হয় এরূপ নহে, নিরপরাধ শাস্ত্রকারদিগকেও নিতান্ত নৃশংস ও নিতান্ত নির্বিবেক বলিয়া প্রতিপন্ন করা হয়। যদৃচ্ছা প্রবৃও বহুবিবাহকাণ্ড যে যার পর নাই লজ্জাকর, ঘৃণাকর, ও অনর্থকর ব্যবহার, তাহা প্রমাণ দ্বারা প্রতিপন্ন করিবার প্রয়োজন নাই। আমার বোধে, যে সকল মহাত্মারা, জগতের হিতের নিমিত্ত, শাস্ত্রপ্রণয়ন করিয়াছেন, তাঁহার।, তাদৃশ ধৰ্ম্মবহির্ভূত লোকবিগর্হিত বিষয়ে, অনুমতি প্রদান বা অনুমোদনপ্রদর্শন করিয়া গিয়াছেন, ইহা মনে করিলে মহাপাতক জন্মে। বস্তুতঃ, মানবজাতির... হিতাহিত ও কর্তৃব্যাকর্ত্তব্য নিরূপণ করিবার নিমিত্ত, যে শাস্ত্রের সৃষ্টি হইয়াছে, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহরূপ পিশাচব্যবহার সেই শাস্ত্রের বিধি অনুযায়ী কার্য্য, ইহা কোনও মতে সম্ভব হইতে পারে না। ফলতঃ, যাঁহারা একবারে শ্যায় অন্তায় বোধশূন্ড, সদসদ্বিচারশক্তিবর্জিত, এবং সম্ভব অসম্ভব ও সঙ্গত অসঙ্গত' বিবেচনা বিষয়ে বহির্মুখ নহেন, ধৰ্ম্মশাস্ত্রে অধিকার থাকিলে, এবং তত্ত্বনির্ণয়পক্ষ লক্ষ্য হইলে, তাদৃশ ব্যক্তিরা, যদৃচ্ছাক্রমে বর্ত ইচ্ছা বিবাহ করা শাস্ত্রানুমোদিত কার্য্য, ঈদৃশ ব্যবস্থা প্রচারে প্রবৃত্ত হইতে পারেন, এরূপ বোধ হয় না।

শাস্ত্রে দ্বিবিধ মাত্র অধিবেদন অনুমত ও অনুমোদিত দৃষ্ট দুইতেছে; প্রথম ধর্ম্মার্থ অধিবেদন, দ্বিতীয় কামার্থ, অধিবেদন। .পূর্বপরিণীতা পত্নী বন্ধ্যা ব্যভিচারিণী, সুরাণায়িণী, চিররোগিণী প্রভৃতি স্থির হইলে, শাস্ত্রকারেরা পুরুষের পক্ষে পুনরায়, দার- পরিগ্রহের অনুমতি দিয়াছেন। সেই অনুমতির অনুবর্তী হইয়া, পুরুষ কে দারপরিগ্রহ করে, উহার নাম ধৰ্ম্মার্থ অধিবেদন। পুত্রলাভ ও ধৰ্ম্মকার্য্যসাধন গৃহস্থাশ্রমের প্রধান উদ্দেশ্য। স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি দোষ ঘটিলে, ঐ দুই প্রধান উদ্দেশ্যের সমাধান হয় না। দুই প্রধান উদ্দেশ্য সমাহিত না হইলে, গৃহস্থ বক্তেকে প্রত্যবায়গ্রস্ত হইতে হয়। এজন্য, শাস্ত্রকারেরা তাদৃশ স্থলে অধিবেদনের অনুমতি প্রদান করিয়া গিয়াছেন। আর, পূর্বপরিণীতা পত্নীর সহযোগে, রতিকামনা পূর্ণ না হইলে, ধনবান ক্লামুক পুরুষের পক্ষে, শাস্ত্রকারেরা অসবর্ণাপরিণয়ের অনুমোদন করিয়াছেন।' সেই অনুমোদনের অনুবর্তী হইয়া, কেবল কামোপ- শমনবীসনীয়, কামুক পুরুষ, অনুলোম ক্রুসের বর্ণান্তরে যে দারপরিগ্রহ করে, উহার নাম কামার্থ অধিবেদন। নিবিষ্ট চিত্তে, শাস্ত্রের তাৎপর্য্য পর্য্যালোচনা করিয়া দেখিলে, স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, শাস্ত্রোক্ত নিমিত্ত ঘটনা ব্যতিরেকে, পূর্ব্বপরিণীতা পত্নীকে •অপদস্থ বা অপমানিত করা' শাস্ত্রকারদিগের অভিমত বা অভি- • প্রেত নহে। ঘ। কামোপশমনের নিমিত্ত নিতান্ত আবশ্যক হইলে, তাঁহারা, কামুক পুরুষের পক্ষে, অসবর্ণা পরিণয়ের অনুমোদন করিয়াছেন বটে; কিন্তু, পূর্বপরিণীতা সবণী সহধর্ম্মিণীর সন্তোষ- সম্পাদন ও সম্মতিলাভ ব্যতিরেকে, তাদৃশ অধিবেদনে অধিকার

বিধান করেন নাই; সুতরাং, কামার্থ অধিবেদনের পথ এক 'প্রকার রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন, বলিতে হইবেক; কারণ, পূর্ব্বপরিণীতা সহধর্ম্মিণী, সন্তুষ্ট চিত্তে, স্বামীর দারাম্ভরপরিগ্রহে সম্মতি দিরেন, ইহা কোনও মতে সম্ভব নহে। আর, যদিই কোনও অর্থলোভিনী সহধর্ম্মিণী, অর্থলাভে চরিতার্থ হইয়া; তাদৃশ, সম্মতি প্রদান করেন এবং তদনুসারে, ওঁ।হার স্বামী অসবর্ণা বিবাহ করিলে, উত্তর কালে তন্নিবন্ধন তাঁহার ক্লেশ, অসুখ,, বা অসুবিধা ঘটে, সে তাঁহার নিজের দোষ! আর, যুদি পূর্বর পরিণীতা সবর্ণা সহধর্ম্মিণীর সম্মতিনিরপেক্ষ হইয়া, অথবা এক বারেই শাস্ত্রীয় বিধি ও শাস্ত্রীয় নিয়েধ উল্লঙ্ঘন করিরা, যথেচ্ছাচারী ধার্ম্মিক মহাপুরুষেরা স্বেচ্ছাধীন বিবাহ করিতে আলুপ্ত করেন, এবং 'ধর্ম্মশাস্ত্রানভিজ্ঞ সর্ববজ্ঞ বিজ্ঞ মহাপুরুষেরা তাদৃশ অধ বিবাহকে বৈধ বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে প্রবৃত্ত হয়েন, তজ্জন্য লোকহিতৈষী নিরীহ শাস্ত্রকারেরা, কোনও অংশে, অপরাধী হইতে পারেন না। তাঁহারা পূর্ব্বপরিণীতা সবর্ণা সহধর্ম্মিণীকে ধর্ম্মপত্নী, শব্দে আর, কামোপশমনের নিমিত্ত, অনন্তরপরিণীতা অসবর্ণা ভার্য্যাংক কামপত্নী শব্দে নির্দেশ করিয়াছেন।" শাস্ত্র অনুসারে, ধৰ্ম্মপত্নী গৃহস্থকর্ত্তব্য, যাবতীয় লৌকিক বা পারলৌকিক বিষয়ে সহাধিকারিণী; কামপত্নী কেবল কামোপশমনের উপ যোগিনী; সুতরাং, শাস্ত্রকারেরা কামপত্নীকে উপপত্নীবিশেষ বলিয়। পরিগণিত করিয়াছেন। ফলতঃ, অসবর্ণা কামপত্নী, কোনও অংশে; সবর্ণা ধর্মপত্নীর প্রভিন্নদিনী বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে; তাঁহারা তাহার পৃথ রাখেন নাই। এ স্থলে ইহাও উল্লেখ করা আবশ্যক, কামুক পুরুষ, কেবল কামোপশমনের নিমিত্ত, দারান্তর পরিগ্রহ করিতে পারে, এ বিষয়ে ধর্ম্মশাস্ত্র প্রবর্তকদিগের ঐকমত্য নাই। মহর্ষি আপস্তম্ব, অসন্দিগ্ধ বাক্যে, পুত্রবর্তী ও ধৰ্ম্মকা্যোপযোগিনী পত্নী স嘩ে, একবারে দারান্তর পরিগ্রহের নিষেধ করিয়া রাখিয়াছেন। কেবল কামোপশমনের, নিমিত্ত, পুরুষ পুনরায় বিবাহ করিতে পারে, তদীয় ধৰ্ম্মসূত্রে 'তাহার 'কোনও চিহ্ন দেখিতে পাওয়া যায় না।

: যাহা হউক, যে দ্বিবিধ অধিবেদন উল্লিখিত হইল, এতদ্ব্যতি- রিক্ত স্থলে, শাস্ত্র অনুসারে, পূর্ব্বপরিণীতা সবর্ণা সহধর্ম্মিণীর জীবদ্দশায় পুনরায় দারপরিগ্রহ করিবার অধিকার নাই। যিনি যত ইচ্ছা বিতণ্ডা করুন, যিনি যত ইচ্ছা পাণ্ডিত্যপ্রকাশ করুন, যদৃচ্ছ। ক্রমে ফত ইচ্ছা বিবাহ করা শাস্ত্রকারদিগের অনুমত বা অনুমোদিত কার্য্য, ইহা কেনিও মতে প্রতিপন্ন হইবার নহে। শস্ত্রের অর্থ না বুঝিয়া, অথবা বিপরীত অর্থ বুঝিয়া, কিংবা, অভিপ্রেতসিন্ধির নিমিত্ত, স্বেচ্ছানুরূপ অর্থান্তর কল্পনা করিয়া, শাস্ত্রের দোহাই দিয়া, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড বৈধ বলিয়া ব্যবস্থা প্রচার করিলে, নিরপরাধ শাস্ত্রকারদিগকে নরকে নিক্ষিপ্ত করা হয়।' لود

'এই স্থলে, সমাজস্থ সর্বসাধারণ লোক সম্ভাষণ করিয়া, 'কিছু আবেদন করিবার নিতান্ত, বাসনা ছিল; কিন্তু, শারীরিক ও মানসিক উভয়বিধ অসুস্থতার আতিশয্য বশতঃ, যথোপযুক্ত প্রকারে তৎসম্পাদন অসাধ্য বিবেচনা করিয়া, সাতিশয় ক্ষুব্ধ 0 হৃদয়ে, সে বাসনায় বিসর্জন দিয়া, নিতান্ত অনিচ্ছা পূর্ব্বক, বিরত হইতে হইল।

- কলিকাতা। ১লা চৈত্র। সংবৎ ১৯২৯।

} শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্মা




পরিশিষ্ট

এই পুস্তকের ৫০২ পৃষ্ঠায়, নিম্ননির্দিষ্ট বচন, সবর্ণা যস্য যা ভাৰ্য্যা ধৰ্ম্মপত্নী হি সা স্মৃতা। অসবর্ণা তু যা ভার্য্যা কামপত্নী হি সা স্মৃতা। এবং, ৫৪০, ৫৪১ পৃষ্ঠায়, নিম্ননির্দিষ্ট বচন সকল,

অদার্য গতিনাস্তি সর্বাস্ত্যাফলাঃ ক্রিয়াঃ। সুরাচ্চনং মহাযজ্ঞং হীনভা্যো বিবর্জ্জরেৎ ॥ একচক্রো রথো যদ্বদেকপক্ষে। যথা খগঃ। অভার্য্যোহপি নরস্তদ্বদযোগ্যঃ সর্বকর্ম্মস্থ ॥ ভাৰ্য্যাহীনে ক্রিয়া নাস্তি ভার্য্যাহীনে কুতঃ সুখম্। ভাৰ্য্যাহীনে গৃহ কস্য তন্মান্তার্য্যাং সমাশ্রয়েৎ ॥ সর্বম্বেনাপি দেবেশি কর্তব্যো দারসংগ্রহঃ ॥

F মৎস্তসূক্ত মহাতান্ত্রর একত্রিংশ পটল হইতে উদ্ধৃত হইয়াছে। কিন্তু, কলিকাতার কতিপয় স্থানে ও কৃষ্ণনগরের রাজবাটীতে যে পুস্তক আছে, তাহাতে প্রথম ৩৪ পটল নাই। তদ্দর্শনে বোধ হইতেছে, এ প্রদেশে মৎস্যসূক্ত তন্ত্রের যে সকল পুস্তক আছে, সমুদায়ই আদিখণ্ডিত।' যদি কেহ, কৌতূহলপরতন্ত্র হইয়া, মূল- পুস্তকে এই সকল বচনের অনুসন্ধান করেন, এতদ্দেশীয় পুস্তকে একত্রিংশ পটলের অসম্ভাব বশতঃ, তিনি তাহা দেখিতে পাইবেন না; এবং, হয় ত, মনে করিবেন, এই সকল বচন অমূলক, আমি রর্চনা করিয়া প্রমাণরূপে প্রদর্শিত করিয়াছি। যাঁহাদের মনে সেরূপ সন্দেহ উপস্থিত হইবেক, তাঁহারা, স্থানান্তর বা দেশান্তর ন্তর হইতে পুস্তক সংগ্রহ করিয়া, সন্দেহভঞ্জনের চেষ্টা রুরিবেন, তদ্রূপ প্রত্যাশা করিতে পারা যায় না। এজ্য, নির্দেশ করিতেছি, অধুনা লোকান্তরবাসী খড়দহনিবাসী প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস মহোদয়ের স্লাদেশে, প্রাণতোষণী নামে যে গ্রন্থ সঙ্কলিত ও প্রচারিত হইয়াচ্ছে, অনুসন্ধানকারী মহাশয়েরা, ঐ গ্রন্থের ৪৫ পূত্রের ১ পৃষ্ঠায়, এই সকল বচন প্রমাণরূপে পরিগৃহীত হইয়াছে, দেখিতে পাইবেন। এ অঞ্চলে মূলপুস্তকের অসদ্ভাব স্থলে, উল্লিখিত বচনসমূহের অমূলকত্বশঙ্কাপরিহারের ইহা অপেক্ষা বিশিষ্টতর উপায়ান্তর প্রদর্শিত হইতে পারে না। এ স্থলে ইহাও উল্লেখ করা আবশ্যক প্রাণজোনসীতে ফেরূপ পাঠ ধৃত হইয়াছে, কদীহার সহিত মিলাইয়া দেখিলে, আমার পুস্তকে প্রথম বচনের পূর্বাঙ্কে পাঠের কিছু বৈলক্ষণ্য লক্ষিত হইবেক; কিন্তু, ঐ বৈলক্ষণ্য অতি সামান্য; তজ্জন্য, অর্থের কোনও বৈলক্ষণ্য ঘটিতে পারে না। বিশেষতঃ, বিবেচনা করিয়া দেখিলে, আমার ধৃত পাঠই অধিকতর, সঙ্গত ও সম্ভব কলিয়া প্রতীয়মান হয়। যথা প্রাণতোষণীধৃত পাঠ।

সবর্ণা ব্রাহ্মণী যা তু ধৰ্ম্মপত্নী চ সা স্মৃতা। অসবর্ণা চ যা ভার্য্যা কামপত্নী তু সা স্মৃতা ॥

আমার ধৃত পাঠ। সবর্ণা যস্য যা ভাৰ্য্যা ধৰ্ম্মপত্নী হি সা স্মৃতা। অসবর্ণা তু যা ভাৰ্য্যা কোমপত্নী হি সা স্মৃত।॥

দ্বিতীয় খণ্ড সমাপ্ত।

FAMILY

PRINTED BY UPENDRA NITH CHAKRAVARI

AT THE SANSKRIT PRESS.

NO., 62, AMHERST STREET, CALCUTTA, 1895,


4
Articles
বিদ্যাসাগরের গ্রন্থাবলী ( দ্বিতীয় খণ্ড )
0.0
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) এমন একটি বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব, যা আজকের দিনে প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। ওনার লেখা একাধিক কিছু রচনা সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এই রচনাবলি বইটি।
1

বিধবাবিবাহ

7 January 2024
0
0
0

দ্বিতীয় বারের বিজ্ঞাপন প্রায় দুই বৎসর অতীত হইল, এই পুস্তক প্রথম প্রচারিত হয়। যে উদ্দেশে প্রচারিত হইয়াছিল, তাহা একপ্রকার সফল হইয়াছে, বলিতে হইবেক; কারণ, যাঁহার। যথার্থ বুভুৎসুভাবে এবং বিদ্বেষহীন ও পক্ষ

2

MARRIAGE OF HINDU WIDOWS.

11 January 2024
0
0
0

PREFACE. In January 1855, I published a small pamphlet in Ben- gali on the marriage of Hindu Widows, with the view to prove that it was sanctioned by the Sastras. To this pamphlet, replies were given

3

বহুবিবাহ

13 January 2024
0
0
0

বিজ্ঞাপন এ দেশে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত থাকাতে, স্ত্রীজাতির যৎপরোনাস্তি ক্লেশ ও সমাজে অশেষবিধ অনিষ্ট ঘটিতেছে। রাজশাসন ব্যতিরেকে, সেই ক্লেশের ও সেই অনিষ্টের নিবারণের সম্ভাবনা নাই। এজন্য, দেশস্থ লোকে, স

4

বহুবিবাহ দ্বিতীয় পুস্তক

16 January 2024
1
0
0

যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড যে শাস্ত্রবহির্ভূত ও সাধুবিগর্হিত ব্যবহার, ইহা, বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না, এতদ্বিষয়ক বিচারপুস্তকে, আলোচিত হইয়াছে। তদ্দর্শনে, কতিপয় ব্যক্তি অতিশয় অসন্তুষ্ট হইয়াছেন; এ

---