shabd-logo

বহুবিবাহ

13 January 2024

0 Viewed 0

বিজ্ঞাপন

এ দেশে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত থাকাতে, স্ত্রীজাতির যৎপরোনাস্তি ক্লেশ ও সমাজে অশেষবিধ অনিষ্ট ঘটিতেছে। রাজশাসন ব্যতিরেকে, সেই ক্লেশের ও সেই অনিষ্টের নিবারণের সম্ভাবনা নাই। এজন্য, দেশস্থ লোকে, সময়ে সময়ে, এই কুৎসিত প্রথার নিবারণ প্রার্থনায়, রাজদ্বারে আবেদন করিয়া থাকেন। প্রথমতঃ, ১৬ বৎসর পূর্বে, শ্রীযুক্ত বাবু কিশোরীচাঁদ মিত্র মহাশয়ের উদ্যোগে, বন্ধুবর্গসমবায় নামক সমাজ হইতে, ভারতবর্ষীয় ব্যবস্থাপক সমাজে এক আবেদনপত্র প্রদত্ত হয়। বহুবিবাহ শাস্ত্রসম্মত কার্য্য, তাহা রহিত হইলে, হিন্দুদিগের ধর্ম্মলোপ হইবেক; অতএব, এ বিষয়ে গবর্ণমেন্টের হস্তক্ষেপ করা বিধেয় নহে, এই মৰ্ম্মে, প্রতিকূল পক্ষ হইতেও, এক আবেদনপত্র প্রদত্ত হইয়াছিল। ঐ সময়ে, এই দুই আবেদনপত্রের প্রদান ভিন্ন, এ বিষয়ের অন্য কোনও অনুষ্ঠান দেখিতে পাওয়া যায় নাই।

. ২। দুই বৎসর অতীত হইলে, বর্দ্ধমান, নবদ্বীপ, দিনাজপুর, নাটোর, দিঘাপতি প্রভৃতি স্থানের রাজারা ও দেশস্থ প্রায় যাবতীয় প্রধান লোকে, বহু বিবাহের নিবারণ প্রার্থনায়, ব্যবস্থাপক সমাজে আবেদনপত্র প্রদান করেন। এই সময়ে, দেশস্থ লোকে এ বিষয়ে একমত হইয়াছিলেন, বলা যাইতে পারে; কারণ, নিবারণ প্রার্থনায় প্রায় সকল স্থান হইতেই আবেদনপত্র আসিয়াছিল; প্রতিকূল কথা কোনও পক্ষ হইতে উচ্চারিত হয় নাই। লোকান্তরবাসী সুপ্রসিদ্ধ বাবু রমাপ্রসাদ রায় মহাশয়, এই সময়ে, এই কুৎসিত প্রথার নিবারণ বিষয়ে, যেরূপ যত্নবান হইয়াছিলেন, এবং, নিরতিশয় উৎসাহ সহকারে, অশেষ প্রকারে, যেরূপ পরিশ্রম করিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহাকে সহস্র সাধুবাদ প্রদান করিতে হয়। ব্যবস্থাপক সমাজ বহু- বিবাহনিবারণী ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করিবেন, সে বিষয়ে সম্পূর্ণ আশ্বাস জন্মিয়াছিল। কিন্তু, এই হতভাগ্য দেশের দুর্ভাগ্য ক্রমে, সেই সময়ে রাজবিদ্রোহ উপস্থিত হইল। রাজপুরুষেরা, বিদ্রো- হের নিবারণ বিষয়ে, সম্পূর্ণ ব্যাপৃত হইলেন; বহু বিবাহের নিবারণ বিষয়ে, আর তাঁহাদের মনোযোগ দিবার অবকাশ রহিল না।

৩। এইরূপে এই মহোদেযাগ বিফল হইয়া যায়। তৎপরে, বারাণসীনিবাসী, অধুনা লোকাস্তরবাসী, রাজা দেবনারায়ণ সিংহ সহোদয়, বহু বিবাহের নিবারণ বিষয়ে, সাতিশয় উৎসাহী ও সবিশেষ উদ্যোগী হইয়াছিলেন। এই সময়ে, উদারচরিত রাজা বাহাদুর ভারতবর্ষীয় ব্যবস্থাপক সমাজের সভ্য ছিলেন। তিনি নিজে সমাজে এ বিষয়ের উত্থাপন করিবেন, স্থির করিয়াছিলেন। তদনুসারে তদ্বিষয়ক উদ্যোগও হইতেছিল। কিন্তু, আক্ষেপের বিষয় এই, তাঁহার ব্যবস্থাপক সমাজে উপবেশন করিবার সময় অতীত হইয়া গেল; সুতরাং, তথায় তাঁহার অভিপ্রেত বিষয়ের উত্থাপন করিবার সুযোগ রহিল না।

৪। পাঁচ বৎসর অতিক্রান্ত হইল, পুনরায় বহু বিবাহ নিবারণের উদেঘাগ হয়। ঐ সময়ে, বর্দ্ধমান, নবদ্বীপ প্রভৃতির রাজারা, দেশের অন্যান্য ভূম্যধিকারিগণ, তথ্যতিরিক্ত অনেকানেক প্রধান ব্যক্তি, এবং বহুসংখ্যক লোক, একমতাবলম্বী হইয়া, এ দেশের তৎকালীন লেপ্টেনেন্ট গবর্ণর শ্রীযুক্ত সর সিসিল বীডন মহোদয়ের নিকট আবেদনপত্র প্রদান করেন। মহামতি সর সিসিল বীডন, আবেদনপত্র পাইয়া, এ বিষয়ে বিলক্ষণ অনুরাগপ্রকাশ ও অনুকূল বাক্যপ্রয়োগ করিয়াছিলেন; কিন্তু, উপরিস্থ কর্তৃপক্ষের অনভিপ্রায় বশতঃ, অথবা কি হেতু বশতঃ বলিতে পারা যায় না, তিনি এতদ্বিষয়ক উদ্যোগ হইতে বিরত হইলেন।

৫। শেষ বার আবেদনপত্র প্রদত্ত হইলে, কোনও কোনও পক্ষ হইতে আপত্তি উত্থাপিত হইয়াছিল। সেই সকল আপত্তির মীমাংসা করা উচিত ও আবশ্যক বোধ হওয়াতে, এই পুস্তক মুদ্রিত হইতে আরম্ভ হয়। কিন্তু, এ বিষয় আপাততঃ স্থগিত রহিল, এবং আমিও, ঐ সময়ে অতিশয় পীড়িত হইয়া, কিছু কালের জন্য শয্যাগত হইলাম; সুতরাং, তৎকালে পুস্ত ক মুদ্রিত করিবার আর তাদৃশ আবশ্যকতাও ছিল না, আর, তাহা সম্পন্ন করিয়া উঠি, আমার তাদৃশ ক্ষমতাও ছিল না। এই দুই কারণ বশতঃ, পুস্তক এত দিন অর্দ্ধমুদ্রিত অবস্থায় কালযাপন

৬। সম্প্রতি শুনিতেছি, কলিকাতাস্থ সনাতনধর্ম্মরক্ষিণী সভার সভ্য মহোদয়েরা বহু খিবাহের নিবারণ বিষয়ে বিলক্ষণ উদেষাগী হইয়াছেন। তাঁহাদের নিতান্ত ইচ্ছা, এই অতিজঘন্য, অতিনৃশংস প্রথা রহিত হইয়া যায়। এই প্রথা নিবারিত হইলে, শাস্ত্রের অবমাননা ও ধর্ম্মের ব্যতিক্রম ঘটিবেক কি না, এই আশঙ্কার অপনয়ন জন্য, সভার অধ্যক্ষ মহাশয়েরা ধৰ্ম্মশাস্ত্রব্যবসায়ী প্রধান প্রধান পণ্ডিতের মত গ্রহণ করিতেছেন, এবং রাজদ্বারে আবেদন করিবার অপরাপর উদ্যোগ দেখিতেছেন। তাঁহারা, সদভিপ্রায়প্রণোদিত হইয়া, যে অতি মহৎ দেশহিতকর ব্যাপারে

হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, হয় ত, সে বিষয়ে তাঁহাদের কিছু আনুকূল্য

হইতে পারিবেক, এই ভাবিয়া, আমি এই পুস্তক মুদ্রিত ও

প্রচারিত করিলাম।

৭। শেষ বারের উদ্যোগের সময়, কেহ কেহ কহিয়াছিলেন, রাজপুরুষেরা পরামর্শ দিয়া, কোনও 'ব্যক্তিকে এ বিষয়ে প্রবৃত্ত করিয়াছেন, তাহাতেই, বহু বিবাহের নিবারণ প্রার্থনায়, আবেদন- 'পত্র প্রদত্ত হইয়াছে। কেহ কেহ কহিয়াছিলেন, যাহাদের উদ্যোগে আবেদনপত্র প্রদত্ত হইয়াছে, তাহারা হিন্দুধৰ্ম্মদ্বেষী, হিন্দুধর্ম্মের লোপ করিবার অভিপ্রায়ে, এই উদ্যোগ করিয়াছে। কিন্তু, সনাতনধর্ম্মর ক্ষিণী সভার এই উদ্যোগে তাদৃশ অপবাদ- প্রবর্তনের অণু মাত্র সম্ভাবনা নাই। যাহাতে এ দেশে হিন্দুধর্ম্মের রক্ষা হয়, সেই উদ্দেশে, সনাতনধর্ম্মরক্ষিণী সভা সংস্থাপিত হইয়াছে। ঈদৃশ সভার অধ্যক্ষেরা, রাজপুরুষদিগের উপদেশের বশবর্তী হইয়া, হিন্দুধর্ম্মলোপের জন্ম, এই উদ্যোগ করিয়াছেন, নিতান্ত নির্বোধ ও নিতান্ত অনভিজ্ঞ না হইলে, কেহ এরূপ কহিতে পারিবেন না। তবে, 'প্রস্তাবিত দেশহিতকর বিষয় মাত্রে প্রতিপক্ষতা করা যাঁহাদের অভ্যাস ও ব্যবসায়, তাঁহারা কোনও মতে ক্ষান্ত থাকিতে পারিবেন না। তাঁহারা, এরূপ সময়ে, উন্মত্তের ন্যায়, বিক্ষিপ্তচিত্ত হইয়া উঠেন; এবং, যাহাতে প্রস্তাবিত বিষয়ের ব্যাঘাত ঘটে, স্বতঃ পরতঃ, সে চেষ্টার ত্রুটি করেন না। ঈদৃশ ব্যক্তিরা সামাজিক দোষ সংশোধনের বিষম বিপক্ষ। তাঁহাদের অদ্ভুত প্রকৃতি ও অদ্ভুত চরিত্র; নিজেও কিছু করিবেন না, অন্যকেও কিছু করিতে দিবেন না। তাঁহারা চিরজীবী হউন।

৮। পরিশেষে, সনাতনধর্ম্মরক্ষিণী সভার নিকট প্রার্থনা এই, যখন তাঁহারা এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, সবিশেষ যত্ন ও যথোচিত চেষ্টা না করিয়া, যেন ক্ষান্ত না হয়েন। তাঁহারা কৃতকার্য্য হইতে পারিলে, দেশের ও সমাজের যে, যার পর নাই, হিতসাধন হইবেক, তাহা বলা বাহুল্য মাত্র; সেরূপ সংস্কার না জন্মিলে, তাঁহারা কদাচ এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হইতেন না। বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত থাকাতে, সমাজে যে গরীয়সী অনিষ্ট- পরম্পরা ঘটিতেছে, তদ্দর্শনে, তদীয় অন্তঃকরণে, বহু বিবাহ বিষয়ে, ঘৃণা ও দ্বেষ জন্মিয়াছে; সেই ঘৃণা প্রযুক্ত, সেই দ্বেষ বশতঃ, তাঁহারা এই প্রথার নিবারণ বিষয়ে উদ্যোগী হইয়াছেন, তাহার সংশয় নাই।

কাশীপুর

১লা শ্রাবণ। সংবৎ ১৯২৮। }

} শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্মা

বহুবিবাহ

স্ত্রীজাতি অপেক্ষাকৃত দুর্ব্বল, ও সামাজিক নিয়ম দোষে, পুরুষ- জাতির নিতান্ত অধীন। এই দুর্বলতা ও অধীনতা নিবন্ধন, তাঁহারা, পুরুষজাতির নিকট, অবনত ও অপদস্থ হইয়া, কালহরণ করিতেছেন। প্রভুতাপন্ন প্রবল পুরুষজাতি, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত হইয়া, অত্যাচার ও অন্যায়াচরণ করিয়া থাকেন; তাঁহারা, নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, সেই সমস্ত সহ্য করিয়া, জীবনযাত্রা সমাধান করেন। পৃথিবীর প্রায় সব প্রদেশেই, স্ত্রীজাতির ঈদৃশী অবস্থা। কিন্তু, এই হতভাগ্য দেশে, পুরুষজাতির নৃশংসতা, স্বার্থপরতা, অবিমৃশ্যকারিতা প্রভৃতি দোষের আতিশয্য বশতঃ, স্ত্রীজাতির যে অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহা অন্যত্র কুত্রাপি লক্ষিত হয় না। অত্রত্য পুরুষজাতি, কতিপয় অতিগর্হিত প্রথার অনুবর্তী হইয়া, হতভাগা স্ত্রীজাতিকে, অশেষ প্রকারে, যাতনাপ্রদান করিয়া আসিতেছেন। তন্মধ্যে, বহুবিবাহ প্রথা, "এক্ষণে, সর্বাপেক্ষা অধিকতর অনর্থকর হইয়া উঠিয়াছে। এই অতি জঘন্য, অতি নৃশংস প্রথা প্রচলিত থাকাতে, স্ত্রীজাতির দুরবস্থার ইয়ত্তা নাই। এই প্রথার প্রবলতা প্রযুক্ত, তাঁহাদিগকে যে সমস্ত ক্লেশ ও যাতনা ভোগ করিতে হইতেছে, সে সমুদয় আলোচনা করিয়া দেখিলে, হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যায়। ফলতঃ, এতমূলক অত্যাচার এত অধিক ও এত অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে যে, যাঁহাদের কিঞ্চিৎমাত্র হিতাহিতবোধ ও সদসদ্বিবেকশক্তি আছে, তাদৃশ ব্যক্তি মাত্রেই এই প্রথার বিষম বিদ্বেষী হইয়া উঠিয়াছেন। তাঁহাদের আন্তরিক ইচ্ছা, এই প্রথা, এই দণ্ডে, রহিত হইয়া যায়। অধুনা, এ দেশের যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহাতে রাজশাসন ব্যতিরেকে, ঈদৃশ দেশব্যাপক দোষ নিবারণের উপায়ান্তর নাই। এজন্য, অনেকে উদ্যুক্ত হইয়া, অশেষদোষাস্পদ বহুবিবাহ প্রথার নিবারণের নিমিত্ত, রাজদ্বারে আবেদন করিয়া- ছেন। এ বিষয়ে, কোনও কোনও পক্ষ হইতে, আপত্তি উত্থাপিত হইতেছে। যথাশক্তি সেই সকল আপত্তির উত্তর প্রদানে প্রবৃত্ত হইতেছি।

প্রথম আপত্তি।

এরূপ কতকগুলি লোক আছেন, বহুবিবাহ প্রথার দোষকীর্ত্তন বা নিবারণকথার উত্থাপন হইলে, তাঁহারা খড়গহস্ত হইয়া উঠেন। তাঁহাদের এরূপ সংস্কার আছে, বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রানু- মত ও ধৰ্ম্মানুগত ব্যবহার। যাঁহারা এ বিষয়ে বিরাগ বা বিদ্বেষ প্রদর্শন করেন, তাদৃশ ব্যক্তি সকল, তাঁহাদের মতে, শাস্ত্রদ্রোহী, ধৰ্ম্মদ্বেষী, নাস্তিক ও নরাধম বলিয়া পরিগণিত। তাঁহারা সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছেন, বহুবিবাহ প্রথা নিবারিত হইলে, শাস্ত্রের অবমাননা ও ধৰ্ম্মলোপ ঘটিবেক। তাঁহারা, শাস্ত্রের ও ধর্ম্মের দোহাই দিয়া, বিবাদ ও বাদানুবাদ করিয়া থাকেন, কিন্তু, এ বিষয়ে শাস্ত্রেই বা, কত দূর পর্য্যন্ত, বিধি বা অনুমোদন আছে, এবং পুরুষজাতির উচ্ছৃঙ্খল ব্যবহার দ্বারাই বা, কত দূর পর্য্যন্ত অনার্য্য আচরণ ঘটিয়া উঠিয়াছে, তাহা সবিশেষ অবগত নহেন। এ দেশে সকল ধৰ্ম্মই শাস্ত্রমূলক; শাস্ত্রে যে বিষয়ের বিধি আছে, তাহাই ধৰ্ম্মানুগত বলিয়া পরিগৃহীত; আর, শাস্ত্রে যাহা প্রতিষিদ্ধ হইয়াছে, তাহাই ধৰ্ম্মবহির্ভূত বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। সুতরাং, বিবাহ বিষয়ে শাস্ত্রকারদিগের যে সমস্ত বিধি অথবা নিষেধ আছে, সে সমুদয় পরীক্ষিত হইলেই, বহু- বিবাহকাণ্ড শাস্ত্রানুমত ও ধৰ্ম্মানুগত ব্যবহার কি না, এবং বহুবিবাহ প্রথা নিবারিত হইলে, শাস্ত্রের অবমাননা ও ধৰ্ম্মলোপের আশঙ্কা আছে কি না, অবধারিত হইতে পারিবেক।

দক্ষ কহিয়াছেন, অনাশ্রমী ন তিষ্ঠেতু দিনমেকমপি দ্বিজঃ। আশ্রমেণ বিনা তিষ্ঠন্ প্রায়শ্চিত্তীয়তে হি সঃ ॥ (১) দ্বিজ, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এই তিন বর্ণ, আশ্রমবিহীন হইয়া, এক দিনও থাকিবেক না; বিনা আশ্রমে অবস্থিত হইলে, "পাতকগ্রস্ত হয়।

এই শাস্ত্র অনুসারে, আশ্রমবিহীন হইয়া থাকা, দ্বিজের পক্ষে, নিষিদ্ধ ও পাতকজনক। দ্বিজপদ উপলক্ষণ মাত্র, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, চারি বর্ণের পক্ষেই এই ব্যবস্থা। বামনপুরাণে নির্দিষ্ট আছে,

চত্বার আশ্রমাশ্চৈব ব্রাহ্মণস্য প্রকীর্তিতাঃ। ব্রহ্মচর্য্যঞ্চ গার্হস্থ্যং বানপ্রস্থঞ্চ ভিক্ষুকম্। ক্ষত্রিয়স্যাপি কথিতা আশ্রমাস্ত্রয় এব হি। ব্রহ্মচর্য্যঞ্চ গার্হস্থ্যমাশ্রমদ্বিতয়ং বিশঃ। গার্হস্থ্যমুচিতত্ত্বেকং শূদ্রশ্য ক্ষণমাচরেৎ ।। (২) ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রন্থ, সন্ন্যাস, ব্রাহ্মণের এই চারি আশ্রম নির্দিষ্ট আছে; ক্ষত্রিয়ের প্রথম তিন; বৈশ্যের প্রথম দুই; শূদ্রের গার্হস্থ্য মাত্র এক আশ্রম; সে, হৃষ্ট চিত্তে, তাহারই অনুষ্ঠান করিবেক।

এই ব্যবস্থা অনুসারে, সমুদয়ে ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, সন্ন্যাস, এই চারি আশ্রম। কালভেদে ও অধিকারিভেদে, মনুয্যের পক্ষে, এই আশ্রমচতুষ্টয়ের অন্যতম অবলম্বন আবশ্যক; নতুবা, আশ্রমভ্রংশ নিবন্ধন, পাতকগ্রস্ত হইতে হয়। ব্রাহ্মণ চারি আশ্রমেই অধিকারী; ক্ষত্রিয় ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, এই তিন আশ্রমে; বৈশ্য ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য, এই দুই আশ্রমে; শূদ্র একমাত্র গার্হস্থ্য আশ্রমে অধিকারী। উপনয়ন সংস্কারের পর, গুরুকুলে অবস্থিতি পূর্ব্বক, বিজ্ঞাভ্যাস ও সদাচারশিক্ষাকে ব্রহ্মচর্য্য বলে; ব্রহ্মচর্য্য সমাপনের পদ্ম, বিবাহ করিয়া, সংসার- যাত্রা সম্পাদনকে গার্হস্থ্য বলে; গার্হস্থ্যধর্ম্ম প্রতিপালনের পর, যোগাভ্যাসের নিমিত্ত, বনবাস আশ্রয়কে বানপ্রস্থ বলে; বান- প্রস্থধৰ্ম্ম সমাধানের পর, বিষয়বাসনা পরিত্যাগকে সন্ন্যাস বলে।

মনু কহিয়াছেন,

গুরুণানুমতঃ স্নাত্বা সমাবৃত্তো যথাবিধি।

উদ্বহেত দ্বিজো ভাৰ্য্যাং সবর্ণাং লক্ষণান্বিতাম্ ॥ ৩।৪। বিজ, গুরুর অনুজ্ঞা লাভের পর, যথা বিধানে স্নান ও সমাবর্তন (৩) করিয়া, সজাতীয়া সুলক্ষণা ভাৰ্য্যায় পাণি গ্রহণ করিবেক।

বিবাহের এই প্রথম বিধি। এই বিধি অনুসারে, বিজ্ঞাভ্যাস ও সদাচার শিক্ষার পর, দারপরিগ্রহ করিয়া, মনুষ্য গৃহস্থাশ্রমে প্রবিষ্ট হয়।

ভাৰ্য্যায়ৈ পূর্ব্বমারিণ্যৈ দত্তামীনস্ত্যকুৰ্ম্মণি।

পুনর্দারক্রিয়াং কুর্য্যাৎ পুনরাধানমেব চ। ৫। ১৬৮। (৪) পূর্ব্বমৃতা স্ত্রীর যথাবিধি অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া নির্বাহ করিয়া, পুনরায় দারপরিগ্রহ ও পুনরায় অগ্ন্যাধান করিবেক।

বিবাহের এই দ্বিতীয় বিধি। এই বিধি অনুসারে, স্ত্রীবিয়োগ হইলে, গৃহস্থ ব্যক্তির পুনরায় দারপরিগ্রহ আবশ্যক।

মাপাসাধুবৃত্তা চ প্রতিকূলা চ যা ভবেৎ।

• ব্যাধিতা বাধিবেত্তব্যা হিংস্রার্থত্নী চ সর্ব্বদা । ৯/৮০।(৫) বদি স্ত্রী সুরাপায়িণী, ব্যভিচারিণী, সতত স্বামীর অভিপ্রায়ের বিপরীতকারিণী, চির-রাগিণী, অতি ক্রুরস্বভাবা, ও অর্থনাশিনী হয়, তাহা হইলে অধিবেদন, অর্থাৎ পুনরায় দারপরিগ্রহ, করিবেক।

বন্ধ্যাষ্টমেহ ধিবেছ্যাব্দে দশমে তু মৃতপ্রজা। একাদশে স্ত্রীজননী সম্ভ্যন্তপ্রিয়বাদিনী ॥ ৯। ৮১। (৫)

স্ত্রী বন্ধ্যা হইলে অষ্টম বর্ষে, মৃতপুত্রা হইলে দশম বর্ষে, কন্যা- মাত্রপ্রসবিনী হইলে একাদশ বর্ষে, ও অপ্রিয়বাদিনী (৬) হইলে, কালাতিপাত ব্যতিরেকে, অধিবেদন করিবেক।

বিবাহের এই তৃতীয় বিধি। এই বিধি অনুসারে, স্ত্রী বন্ধ্যা প্রভৃতি অবধারিত হইলে, তাহার জীবদ্দশায়, পুনরায় বিবাহ করা আবশ্যক।

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণি। কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো হবরাঃ । ৩। ১২। শূদ্রৈব ভাৰ্য্যা শূদ্রশ্য সা চ. স্বা চ বিশঃ স্মৃতে। তে চ স্বা চৈব রাজ্ঞশ্চ তাশ্চ স্বা চাগ্রজন্মনঃ । ৩। ১৩। (৭) দ্বিজাতির পক্ষে অগ্রে সবর্ণাবিবাহই বিহিত। কিন্তু, যাহারা,

যদুচ্ছা ক্রমে, বিবাহ করিতে প্রবৃত্ত হয়, তাহারা অনুলোম ক্রমে বর্ণান্তরে বিবাহ করিবেক। ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণী, ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা, শূদ্রা; ক্ষত্রিয়ের ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা, শূদ্রা; বৈশ্বের বৈশ্যা, শূদ্রা; শূদ্রেয় একমাত্র শুদ্রা ভার্য্যা হইতে পারে।

বিবাহের এই চতুর্থ বিধি। এই বিধি অনুসারে, সবর্ণাবিবাহই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্ণের পক্ষে প্রশস্ত কল্প। কিন্তু, যদি কোনও উৎকৃষ্ট বর্ণ, যথাবিধি সবর্ণা বিবাহ করিয়া, যদৃচ্ছা ক্রমে, পুনরায় বিবাহ করিতে অভিলাষী হয়, তবে সে আপন অপেক্ষা নিকৃষ্ট বর্ণে বিবাহ করিতে পারে।

যে সমস্ত বিধি প্রদর্শিত হইল, তদনুসারে বিবাহ ত্রিবিধ, নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য। প্রথম বিধি অনুসারে, যে বিবাহ করিতে হয়, তাহা নিত্য বিবাহ; এই বিবাহ না করিলে, মনুষ্য গৃহস্থাশ্রমে অধিকারী হইতে পারে না। দ্বিতীয় বিধির অনুযায়ী বিবাহও নিত্য বিবাহ; তাহা না করিলে, আশ্রমভ্রংশ নিবন্ধন পাতকগ্রস্ত হইতে হয় (৮)। তৃতীয় বিধির অনুযায়ী বিবাহ নৈমিত্তিক বিবাহ; কারণ, তাহা, স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিমিত্ত বশতঃ, করিতে হয়। চতুর্থ, বিধির অনুযায়ী বিবাহ কাম্য বিবাহ। এই বিবাহ, নিত্য ও নৈমিত্তিক বিবাহের ন্যায়, অবশ্যকর্ত্তব্য নহে; উহা পুরুষের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন; অর্থাৎ, ইচ্ছা হইলে, তাদৃশ বিবাহ করিতে পারে, এই মাত্র। কাম্য বিবাহে কেবল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই বর্ণত্রয়ের অধিকার প্রদর্শিত হওয়াতে, শূদ্রের তাদৃশ বিবাহে অধিকার নাই।

পুত্রলাভ ও ধৰ্ম্মকার্য্যসাধন গৃহস্থাশ্রমের উদ্দেশ্য। দার-

পরিগ্রহ ব্যতিরেকে, এ উভয়ই সম্পন্ন হয় না; এ নিমিত্ত, প্রথম বিধিতে দারপরিগ্রহ, গৃহস্থাশ্রম প্রবেশের দ্বার স্বরূপ, গৃহস্থাশ্রম সমাধানের অপরিহার্য্য উপায় স্বরূপ, নির্দিষ্ট হইয়াছে। গৃহস্থাশ্রম সম্পাদন কালে, স্ত্রীবিয়োগ ঘটিলে, যদি পুনরায় বিবাহ না করে, তবে সেই দারবিরহিত ব্যক্তি আশ্রমভ্রংশ নিবন্ধন পাতকগ্রস্ত হয়; এজন্য, ঐ অবস্থায়, গৃহস্থ ব্যক্তির পক্ষে, পুনরায় দারপরিগ্রহেরু, অবশ্যকর্তব্যতা বোধনের নিমিত্ত, শাস্ত্রকারের। দ্বিতীয় বিধি প্রদান করিয়াছেন। স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব, চিররোগিত্ব প্রভৃতি দোষ ঘটিলে, পুত্র লাভের ও ধর্ম্মকার্য্য সমাধানের ব্যাঘাত ঘটে; এজন্য, শাস্ত্রকারেরা, তাদৃশ স্থলে, স্ত্রী সত্ত্বে; পুনরায় বিবাহ করিবার তৃতীয় বিধি দিয়াছেন। গৃহস্থাশ্রম সমাধানের নিমিত্ত, শাস্ত্রোক্ত বিধান অনুসারে সবর্ণা- পরিণয়নের পর, যদি কোনও উৎকৃষ্ট বর্ণ, যদৃচ্ছা ক্রমে, বিবাহে প্রবৃত্ত হয়, তাহার পক্ষে, অসবর্ণা বিবাহে অধিকার বোধনের নিমিত্ত, শাস্ত্রকারেরা চতুর্থ বিধি প্রদর্শন করিয়াছেন। বিবাহ বিষয়ে, এতদ্ব্যতিরিক্ত, আর বিধি দেখিতে পাওয়া যায় না। সুতরাং, স্ত্রী বিদ্যমান থাকিতে, নির্দিষ্ট নিমিত্ত ব্যতিরেকে, যদৃচ্ছ। ক্রমে, পুনরায় সবর্ণা বিবাহ করা শাস্ত্রকারদিগের অনুমোদিত নহে। ফলতঃ, সবর্ণা বিবাহের পর, যদৃচ্ছা ক্রমে 'বিবাহপ্রবৃত্ত ব্যক্তির পক্ষে, অসবর্ণা বিবাহের বিধি প্রদর্শিত হওয়াতে, তাদৃশ ব্যক্তির, তথাবিধ স্থলে, সবর্ণাবিবাহ নিষিদ্ধ কল্প হইতেছে।

- এরূপ বিধিকে পরিসংখ্যা রলে। পরিসংখ্যা বিধির নিয়ম এই, যে স্থল ধরিয়া। বিধি দেওয়া যায়, তদ্ব্যতিরিক্ত স্থলে নিষেধ সিদ্ধ হয়। বিধি ত্রিবিধ, অপূর্ববিধি, নিয়মবিধি ও পরিসংখ্যা- বিধি। বিধি ব্যতিরেকে যে স্থলে কোনও রূপে প্রবৃত্তি সম্ভবে না, তাহাকে অপূর্ব্ববিধি কহে; যেমন, "স্বর্গকামে। যজেত," স্বর্গকামনায় যাগ করিবেক। এই বিধি না থাকিলে, লোকে, স্বর্গলাভবাসনায়, কদাচ যাগে প্রবৃত্ত হইত না; কারণ, যাগ করিলে স্বর্গলাভ হয়, ইহা প্রমাণান্তর দ্বারা প্রাপ্ত নহে। যে বিধি দ্বারা কোনও বিষয় নিয়মবদ্ধ করা যায়, তাহাকে নিয়মবিধি বলে; যেমন, "সমে যজেত," সম" দেশে যাগ করিবেক। লোকের পক্ষে যাগ করিবার বিধি আছে; সেই যাগ, কোনও স্থানে অবস্থিত হইয়া, করিতে হইবেক; লোকে, ইচ্ছা অনুসারে, সমান, অসমান, উভয়বিধ স্থানেই যাগ করিতে পারিত; কিন্তু, "সমে যজেত,” এই বিধি দ্বারা, সমান স্থানে যাগ করিবেক, ইহা নিয়মবদ্ধ হইল। যে বিধি দ্বারা, বিহিত বিষয়ের অতিরিক্ত স্থলে, নিষেধ সিদ্ধ হয়, এবং বিহিত স্থলে বিধি অনুযায়ী কার্য্য করা সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন থাকে, তাহাকে পরিসংখ্যা বিধি বলে; যেমন, "পঞ্চ পঞ্চনখা ভক্ষ্যাঃ," পাঁচটি পঞ্চনখ ভক্ষণীয়। লোকে, যদৃচ্ছ। ক্রমে, যাবতীয় পঞ্চনখ জন্তু ভক্ষণ করিতে পারিত; কিন্তু, “পঞ্চ পঞ্চনথা ভক্ষ্যাঃ," এই বিধি দ্বারা, বিহিত শশ প্রভৃতি পঞ্চ ব্যতিরিক্ত, কুক্কুর প্রভৃতি যাবতীয় পঞ্চনখ জন্তুর ভক্ষণনিষেধ সিদ্ধ হইতেছে; অর্থাৎ, লোকের পঞ্চনখ জন্তুর মাংস ভক্ষণে প্রবৃত্তি হইলে, শশ প্রভৃতি পঞ্চ ব্যতিরিক্ত পঞ্চনখ জন্তুর মাংস ভক্ষণ করিতে পারিবেক না; শশ প্রভৃতি পঞ্চনখ জন্তুর মাংস ভক্ষণও লোকের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন; ইচ্ছা হয়, ভক্ষণ করিবেক, ইচ্ছা না হয়, ভক্ষণ করিবেক না। সেইরূপ, যদৃচ্ছা ক্রমে অধিক বিবাহে উদ্যত পুরুষ সবর্ণা, অসবর্ণা, উভয়বিধ স্ত্রীরই পাণিগ্রহণ করিতে পারিত; কিন্তু, যদৃচ্ছা ক্রমে বিবাহে প্রবৃত্ত হইলে, অসবর্ণা বিবাহ করিবেক, এই বিধি প্রদর্শিত হওয়াতে, যদৃচ্ছাস্থলে অসবর্ণা ব্যতিরিক্ত স্ত্রীর বিবাহ- নিষেধ সিদ্ধ হইতেছে। অসবর্ণাবিবাহও লোকের ইচ্ছাধীন"; ইচ্ছা হয়, তাদৃশ বিবাহ করিবেক; ইচ্ছা না হয়, করিবেক না; কিন্তু, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত হইয়া বিবাহ করিতে হইলে, অসবর্ণা ব্যতিরিক্ত বিবাহ করিতে পারিবেক না, ইহাই বিবাহবিষয়ক চতুর্থ বিধির উদ্দেশ্য। 'এই বিবাহবিধিকে অপূর্ব্ববিধি বলা যাইতে পারে না; কারণ, ঈদৃশ বিবাহ রাগপ্রাপ্ত, অর্থাৎ লোকের ইচ্ছা বশতঃ প্রাপ্ত হইতেছে; যাহা কোনও রূপে প্রাপ্ত নহে, তদ্বিষয়ক বিধিকেই অপূর্ব্ববিধি বলে। এই বিবাহবিধিকে নিয়মবিধি বলা যাইতে পারে না; কারণ, ইহা দ্বারা অসবর্ণা- বিবাহ অবশ্যকর্ত্তব্য বলিয়া নিয়মবদ্ধ হইতেছে না। সুতরাং, এই বিবাহবিধিকে, অগত্য।, পরিসংখ্যাবিধি বলিয়া অঙ্গীকার করিতে হইবেক (৯)।

বিবাহবিষয়ক বিধিচতুষ্টয়ের স্থূল তাৎপর্য্য এই, প্রথম বিধি অনুসারে, গৃহস্থ ব্যক্তির সবর্ণাবিবাহ অবশ্যকর্ত্তব্য; গৃহস্থ অবস্থায়, স্ত্রীবিয়োগ হইলে, দ্বিতীয় বিধি অনুসারে, সবর্ণাবিবাহ অবশ্যকর্ত্তব্য; স্ত্রী বন্ধ্যা প্রভৃতি স্থির হইলে, তৃতীয় বিধি অনুসারে, সবর্ণাবিবাহ অবশ্যকর্ত্তব্য; সবর্ণা বিবাহ করিয়া, যদৃচ্ছা ক্রমে বিবাহে প্রবৃত্তি হইলে, ইচ্ছা হয়, চতুর্থ বিধি অনুসারে, অসবর্ণা বিবাহ করিবেক, অসবর্ণা ব্যতিরিক্ত বিবাহ করিতে পারিবেক না। কলিযুগে অসবর্ণা বিবাহের ব্যবহার

রহিত হইয়াছে; সুতরাং যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বিবাহের আর স্থল নাই। এক্ষণে, ইহা স্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে, ইদানীন্তন যদৃচ্ছপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড কেবল শাস্ত্রকারদিগের অনুমোদিত নয়, এরূপ নহে, উহা, সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হইতেছে। সুতরাং, যাঁহারা যদৃচ্ছা ক্রমে বহু বিবাহ করিতেছেন, তাঁহারা, নিষিদ্ধ কর্ম্মের অনুষ্ঠান জন্য, পাতকগ্রস্ত হইতেছেন। যাজ্ঞ্যবন্ধ্য কহিয়াছেন,

বিহিত্যাননুষ্ঠানাম্নিন্দিতস্য চ সেবনাৎ।

অনিগ্রহাচ্চেন্দ্রিয়াণাং নরঃ পতনমৃচ্ছতি ॥ ৩। ২১৯।

বিহিত বিষয়ের অবহেলন ও নিষিদ্ধ বিষয়ের অনুষ্ঠান করিলে, এবং ইন্দ্রিয়বশীকরণ করিতে না পারিলে, মনুষ্য পাতকগ্রস্ত হয়! কোনও কোনও মুনিবচনে, এক ব্যক্তির অনেক স্ত্রী বিছা- মান থাকা নির্দিষ্ট আছে, তদ্দর্শনে কেহ কেহ কহিয়া থাকেন, যখন শাস্ত্রে এক ব্যক্তির যুগপৎ বহু স্ত্রী বিদ্যমান থাকার স্পষ্ট উল্লেখ দৃষ্টিগোচর হইতেছে, তখন যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহু বিবাহ শাস্ত্রকারদিগের অনুমোদিত কার্য্য নহে, ইহা কি রূপে পরিগৃহীত হইতে পারে। তাঁহাদের অভিপ্রেত শাস্ত্র সকল এই,-

১। সবর্ণাশু বহুভাৰ্য্যাম্পু বিদ্যমানাশু জ্যেষ্ঠয়া সহ ধৰ্ম্মকার্য্যং কারয়েৎ (১০)। সজাতীয়া বহু ভাৰ্য্যা বিদ্যমান থাকিলে, জ্যেষ্ঠার সহিত ধৰ্ম্ম- কার্য্যের অনুষ্ঠান করিবেক।

২। সর্ববাসামেকপত্নীনামেকা চেৎ পুত্রিণী ভবেৎ। সর্বাস্তাস্তেন পুত্রেণ প্রাহ পুণ্ড্রবর্তীর্মনুঃ ॥৯। ১৮৩। (১১)

মনু কহিয়াছেন, সপত্নীদের মধ্যে যদি কেহ পুত্রবতী হয়, সেই সপত্নীপুত্র দ্বারা তাহারা সকলেই পুত্রবর্তী গণ্য হইবেক।

৩। ত্রিবিবাহং কৃতং যেন ন করোতি চতুর্থকম্। কুলানি পাতয়েৎ সপ্ত ভ্রূণহত্যাব্রতং চরেৎ ॥ (১২) যে ব্যক্তি, তিন বিবাহ করিয়া, চতুর্থ বিবাহ না করে, সে সাত 'কুল পতিত করে, তাহার জন্মহত্যাপ্রায়শ্চিত্ত করা আবশ্যক।

এই সকল বচনে এরূপ কিছুই নির্দিষ্ট নাই যে, তদ্দ্বারা, শাস্ত্রোক্ত নিমিত্ত ব্যতিরেকে, পুরুষের ইচ্ছাধীন বহু বিবাহ প্রতিপন্ন হইতে পারে। প্রথম বচনে এক ব্যক্তির বহু ভাৰ্য্যা বিদ্যমান থাকার উল্লেখ আছে; কিন্তু ঐ বহু ভার্য্যা বিবাহ অধিবেদনের নির্দিষ্ট নিমিত্ত নিবন্ধন নহে, তাহার কোনও হেতু লক্ষিত হইতেছে না। দ্বিতীয় বচনে যে বহু বিবাহের উল্লেখ আছে, তাহা যে কেবল পূর্ব্ব পূর্ব স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব নিবন্ধন ঘটিয়াছিল, তাহা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে; কারণ, ঐ বচনে পুত্রহীনা সপত্নীদের বিষয়ে ব্যবস্থা প্রদত্ত হইয়াছে। তৃতীয় বচনে, তিন বিবাহের পর বিবাহাস্তরের অবশ্যকর্ত্তব্যতানির্দেশ আছে। কিন্তু, এই বচন বহুবিবাহবিষয়ক নহে। ইহার স্থল এই,-যে ব্যক্তির ক্রমে দুই স্ত্রী গত হইয়াছে, সে পুনরায় বিবাহ করিলে, তাহার তিন বিবাহ হয়; চতুর্থ বিবাহ না করিলে, তাহার প্রত্যবায় ঘটে। এই প্রত্যবায়ের পরিহারার্থে, বিবাহার্থী ব্যক্তি, প্রথমতঃ, এক ফুলগাছকে স্ত্রী কল্পনা করিয়া, উহার সহিত তৃতীয় বিবাহ সম্পন্ন করে; তৎপরে যে বিবাহ হয়, তাহা চতুর্থ বিবাহের স্থলে পরিগৃহীত হইয়া থাকে। এইরূপ তিন বিবাহ ও চারি বিবাহই এই বচনের উদ্দেশ্য। কেহ কেহ এই ব্যবস্থা করেন, যেখানে তিন স্ত্রী বর্ত্তমান থাকে, সেই স্থলে এই বচন খাটিবেক (১৩)। যদি এই ব্যবস্থ। আদরণীয় হয়, তাহা হইলে, বর্তমান তিন স্ত্রীর বিবাহ অধিবেদনের নির্দিষ্ট নিমিত্ত নিবন্ধন, আর চতুর্থ বিবাহ এই বচনে উল্লিখিত দোষের পরিহাররূপ নিমিত্ত নিবন্ধন বলিতে হইবেক। 'অর্থাৎ, প্রথমতঃ, স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি নিমিত্ত বশতঃ, ক্রমে তিন বিবাহ ঘটিয়াছে; পরে, তিন স্ত্রী বর্তমান থাকিলে, এই বচনে যে চতুর্থ বিবাহের অবশ্যকর্ত্তব্যতার নির্দেশ আছে, তদনুসারে পুনরায় বিবাহ করা আবশ্যক হইতেছে। মনুবচনে অধিবেদনের যে সমস্ত নিমিত্ত নির্দিষ্ট আছে, এই বচনে উল্লিখিত দোষের পরিহার তদতিরিক্ত নিমিত্তান্তর বলিয়া পরিগণিত হইবেক। ফলকথা এই, যখন শাস্ত্রকারেরা, কাম্যবিবাহস্থলে, কেবল অসবর্ণাবিবাহের বিধি দিয়াছেন, যখন ঐ বিধি দ্বারা, পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, যদৃচ্ছ। ক্রমে সবর্ণাবিবাহ সর্ব্বতোভাবে নিষিদ্ধ হইয়াছে, যখন উল্লিখিত বহু বিবাহ সকল অধিবেদনের নির্দিষ্ট নিমিত্ত বশতঃ ঘটা সম্পূর্ণ সম্ভব হইতেছে, তখন যদৃচ্ছা ক্রমে যত ইচ্ছা বিবাহ করা শাস্ত্রকারদিগের অনুমোদিত কার্য্য, ইহা কোনও মতে প্রতিপন্ন হইতে পারে না।

কেহ কেহ কহিয়া থাকেন, যখন, পুরাণে ও ইতিহাসে, কোনও কোনও রাজার যুগপৎ বহু স্ত্রী বিদ্যমান থাকার নিদর্শন পাওয়া যাইতেছে, তখন পুরুষের বহু বিবাহ শাস্ত্রানুমত কৰ্ম্ম নহে, ইহা কিরূপে অঙ্গীকৃত হইতে পারে। ইহা যথার্থ বটে, পূর্ব্বকালীন কোনও কোনও রাজার বহু বিবাহের পরিচয় পাওয়া যায়; কিন্তু, সে সকল বিবাহ যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বিবাহ নহে। রামায়ণে উল্লিখিত আছে, রাজা দশরথের অনেক মহিলা ছিলেন! কিন্তু, তিনি যে যদৃচ্ছা ক্রমে সেই সমস্ত বিষাহ করিয়াছিলেন, কোনও ক্রমে এরূপ প্রতীতি জন্মে না। রামায়ণে যেরূপ নির্দ্দিষ্ট আছে, তদনুসারে তিনি, বৃদ্ধ বয়স পর্য্যন্ত, পুত্রমুখ নিরীক্ষণে অধিকারী হয়েন নাই। ইহা নিশ্চিত বোধ হইতেছে, তাঁহার প্রথম পরিণীতা স্ত্রী বন্ধ্যা বলিয়া পরিগণিতা হইলে, তিনি দ্বিতীয় বার বিবাহ করেন; এবং সে স্ত্রীও পুত্রবতী না হওয়াতে, তাঁহারও বন্ধ্যাত্ব বোধে, রাজা পুনরায় বিবাহ করিয়াছিলেন। এইরূপে, ক্রমে ক্রমে, তাঁহার অনেক বিবাহ ঘটে। অবশেষে, চরম বয়সে, কৌশল্যা, কেকয়ী, সুমিত্রা, এই তিন মহিষীর গর্ভে তাঁহার চারি সন্তান জন্মে। সুতরাং, রাজা দশরথের বহু বিবাহ পূর্ব্ব পূর্ব স্ত্রীর বন্ধ্যাত্বশঙ্কা নিবন্ধন ঘটিয়াছিল, স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে। দশরথ যে কারণে বহু বিবাহ করিয়া- ছিলেন, অ্যান্য রাজারাও, সেই কারণে, অথবা শাস্ত্রোক্ত অন্ত কোনও নিমিত্ত বশতঃ, একাধিক বিবাহ করেন, তাহার সংশয় নাই। তবে, ইহাও লক্ষিত হইতে পারে, কোনও কোনও রাজা, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত হইয়া, বহু বিবাহ করিয়াছিলেন। কিন্তু, তাদৃশ দৃষ্টান্ত দর্শনে, বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রানুমত ব্যাপার বলিয়া প্রতিপন্ন হইতে পারে না। রাজার আচার, সর্বসাধারণ লোকের পক্ষে, আদর্শস্বরূপ পরিগৃহীত হওয়া উচিত নহে। ভারতবর্ষীয় রাজারা, স্ব স্ব অধিকারে, এক প্রকার সর্বশক্তিমান্ ছিলেন। প্রজারা ধর্মশাস্ত্রের ব্যবস্থা অতিক্রম করিয়া চলিলে, রাজা, দণ্ড বিধান পূর্ব্বক, তাহাদিগকে ন্যায়পখে অবস্থাপিত করিতেন। কিন্তু, রাজারা উৎপথপ্রতিপন্ন হইলে, তাঁহাদিগকে ন্যায়পথে প্রবর্তিত করিবার লোক ছিল না। বস্তুতঃ, রাজারা সর্ব বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রোচ্ছ ছিলেন। সুতরাং, যদি কোনও রাজা, উচ্ছৃঙ্খল হইয়া, শাস্ত্রোক্ত নিমিত্ত ব্যতিরেকে, যদৃচ্ছা ক্রমে, বহু বিবাহ করিয়া থাকেন, সর্বসাধারণ লোকে, সেই দৃষ্টান্তের অনুবর্তী হইয়া, বহু বিবাহ করিলে, তাহা কোনও ক্রমে বৈধ বলিয়া পরিগৃহীত হইতে পারে না। মনু কহিয়াছেন,-"

সোহগ্নির্ভবতি বায়ুশ্চ সোহর্কঃ সোমঃ স ধর্ম্মরাট্। স কুবেরঃ স বরুণঃ স মহেন্দ্রঃ প্রভাবতঃ ॥ ৭১৭। বালোছপি নাবনস্তব্যো মনুষ্য ইতি ভূমিপঃ। মহতী দেবতা হোষা নররূপেণ তিষ্ঠতি ॥ ৭।৮।

রাজা প্রভাবে সাক্ষাৎ অগ্নি, বায়ু, সূর্য্য, চন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ, ইন্দ্র। রাজা বালক হইলেও, তাঁহাকে সামান্ত মনুষ্য জ্ঞান করা উচিত নহে। তিনি নিঃসন্দেহ মহতী দেবতা, নররূপে বিরাজ করিতেছেন।

রাজা প্রাকৃত মনুষ্য নহেন। শাস্ত্রকারেরা তাঁহাকে মহতী দেবতা বলিয়া গণ্য করিয়াছেন। অতএব, যেমন দেবতার চরিত্র মনুষ্যের অনুকরণীয় নহে; সেইরূপ, রাজার চরিত্রও, মনুষ্যের পক্ষে, অনুকরণীয় হইতে পারে না। এই নিমিত্ত, যাহা সর্বসাধারণ লোকের পক্ষে সর্বথা অবৈধ, তেজীয়ানের পক্ষে, তাহা দোষাবহ নয় বলিয়া, শাস্ত্রকারেরা ব্যবস্থা দিয়াছেন।,

ফলতঃ যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড যদৃচ্ছাপ্রবৃত্তব্যবহারমূলক মাত্র। এই অতিজঘন্য, অতিনৃশংস ব্যাপার শাস্ত্রানুমত বা ধর্ম্মানুগত ব্যবহার নহে; এবং, ইহা নিবারিত হইলে, শাস্ত্রের অবমাননা বা ধর্ম্মলোগের অণুমাত্র সম্ভাবনা নাই।

দ্বিতীয় আপত্তি।

কেহ' কেহ আপত্তি করিতেছেন, বহুবিবাহপ্রথা নিবারিত হইলে, কুলীন ব্রাহ্মণদিগের আতিপাত ও ধৰ্ম্মলোপ ঘটিবেক। এই আপত্তি ন্যায়োপেত হইলে, বহুবিবাহ প্রথার নিবারণচেষ্টা, কোনও মতে, উচিত কৰ্ম্ম হইত না। কৌলীন্য প্রথার পূর্বাপর পৰ্য্যালোচনা করিয়া দেখিলে, উহা ল্যায়োপেত কি না, তাহা প্রতীয়মান হইতে পারিবেক; এজন্য, কৌলীন্যমর্য্যাদার প্রথম ব্যবস্থা ও বর্ত্তমান অবস্থা সংক্ষেপে উল্লিখিত হইতেছে।

'রাজা আদিসূর, পুভ্রেন্তিযাগের অনুষ্ঠানে কৃতসঙ্কল্প হইয়া, অধিকারস্থ ব্রাহ্মণদিগকে, যজ্ঞ সম্পাদনের নিমিত্ত, আহ্বান করেন। এ দেশের তৎকালীন ব্রাহ্মণেরা আচারভ্রষ্ট ও বেদ- বিহিত ক্রিয়ার অনুষ্ঠানে নিতান্ত অনভিজ্ঞ ছিলেন; সুতরাং, তাঁহারা আদিসূরের অভিপ্রেত যজ্ঞ সম্পাদনে সমর্থ হইলেন না। রাজা, নিরুপায় হইয়া, ৯৯৯ শাকে (১) কান্যকুজরাজের নিকট, শাস্ত্রজ্ঞ ও আচারপূত পঞ্চ ব্রাহ্মণ প্রেরণ প্রার্থনায়, দূত প্রেরণ করিলেন। কান্যকুব্জরাজ, তদনুসারে, পঞ্চ গোত্রের পঞ্চ ব্রাহ্মণ পাঠাইয়া দিলেন-

১ শাণ্ডিল্যগোত্র

২ কাশ্যপগোত্র

৩ বাৎস্যগোত্র

ভট্টনারায়ণ।

দক্ষ।

ছান্দড়।

৪ ভরদ্বাজগোত্র

শ্রীহর্ষ

বেদগর্ভ। (২)

৫ সাবর্ণগোত্র

ব্রাহ্মণেরা, সন্ত্রীক, সভৃত্য, অশ্বারোহণে, গৌড়দেশে আগমন করেন। চরণে চর্মুপাদুকা, সর্বাঙ্গ সূচীবিদ্ধ বস্ত্রে আবৃত; এই- রূপ বেশে, তাম্বুল চর্বণ করিতে করিতে, রাজবাটীর দ্বারদেশে . উপস্থিত হইয়া, তাঁহারা দ্বারবানকে কহিলেন, ত্বরায় রাজার 4 নিকট আমাদের আগমনসংবাদ দাও। দ্বারী, নরপতিগোচরে উপস্থিত হইয়া, তাঁহাদের আগমনসং বাদ প্রদান করিলে, তিনি প্রথমতঃ অতিশয় আহলাদিত হইলেন; পরে, দৌবারিকের মুখে, তাঁহাদের আচার ও পরিচ্ছদের বিষয় অবগত হইয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, এ দেশের ব্রাহ্মণেরা আচারভ্রষ্ট ও ক্রিয়াহীন বলিয়া, আমি দূর দেশ হইতে ব্রাহ্মণ আনাইলাম। কিন্তু, যেরূপ শুনিতেছি, তাহাতে উহাদিগকে আচারপূত বা ক্রিয়ানিপুণ বলিয়া বোধ হইতেছে না। যাহা হউক, আপাততঃ সাক্ষাৎ না করিয়া, উঁহাদের আচার প্রভৃতির বিষয় সবিশেষ অবগত হই, পরে যেরূপ হয় করিব। এই স্থির করিয়া, রাজা দ্বারকানকে কহিলেন, ব্রাহ্মণ ঠাকুরদিগকে বল, আমি কার্য্যান্তরে ব্যাপৃত আছি, এক্ষণে সাক্ষাৎ করিতে পারিব না; তাঁহারা, বাসস্থানে গিয়া, শ্রান্তিদূর করুন; অবকাশ পাইলেই, সাক্ষাৎ করিতেছি।

এই কথা শুনিয়া, দ্বারবান, ব্রাহ্মণদিগের নিকটে আসিয়া, সমস্ত নিবেদন করিল। রাজা অবিলম্বেই তাঁহাদের সংবর্দ্ধনা করিবেন, এই স্থির করিয়া, ব্রাহ্মণেরা, আশীর্ব্বাদ করিবার নিমিত্ত, জলগণ্ডুষ হস্তে দণ্ডায়মান ছিলেন; এক্ষণে, তাঁহার অনাগমনবার্তা শ্রবণে, করস্থিত আশীর্বাদবারি নিকটবর্তী মল্লকাষ্ঠে নিক্ষিপ্ত করিলেন।. ব্রাহ্মণদিগের এমনই প্রভাব, আশীর্ব্বাদবারির স্পর্শ মাত্র, চিরশুষ্ক মল্লকাষ্ঠ সঞ্জীবিত, পল্লবিত, ও পুষ্পফলে সুশোভিত, হইয়া উঠিল (৩)। এই অদ্ভুত ঘটনা তৎক্ষণাৎ নরপতিসমীপে নিবেদিত হইল। রাজা শুনিয়া চমৎকৃত হইলেন। তাঁহাদের আচার ও পরিচ্ছদের কথা শুনিয়া, প্রথমতঃ, তাঁহার মনে অশ্রদ্ধা ও বিরাগ জন্মিয়াছিল; এক্ষণে, বিলক্ষণ শ্রদ্ধা ও অনুরাগ জন্মিল। তখন তিনি, গলবস্ত্র, ও কৃতাঞ্জলি হইয়া, দ্বারদেশে উপস্থিত হইলেন, এবং, দৃঢ়তর ভক্তিযোগ সহকারে, সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিয়া, ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন (৪)। অনন্তর, রাজা, নির্দ্ধারিত শুভ দিবসে, সেই পঞ্চ ব্রাহ্মণ দ্বারা, পুত্রেষ্টিযাগ করাইলেন। যাগপ্রভাবে, রাজমহিষী গর্ভবর্তী। ও যথাকালে পুত্রবতী হইলেন। রাজা, যৎপরোনাস্তি প্রীত হইয়া, নিজ রাজ্যে বাস করিবার নিমিত্ত, ব্রাহ্মণদিগকে, সবিশেষ

নির্বন্ধ সহকারে, অনুরোধ করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণেরা,রাজার নির্বন্ধ উল্লঙ্ঘনে অসমর্থ হইয়া, তদীয় প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, এবং পঞ্চকোটি, কামকোটি, হরিকোটি, কঙ্কগ্রাম, বট- গ্রাম এই রাজদত্ত এক এক গ্রামে, (৫) এক এক জন বসতি করিলেন।

কাল ক্রমে, এই পাঁচ জনের যত্পঞ্চাশৎ সন্তান জন্মিল। ভট্টনারায়ণের ষোড়শ, দক্ষের ষোড়শ, শ্রীহর্ষের চারি, বেদগর্ভের দ্বাদশ, ছান্দড়ের আট (৬)। এই প্রত্যেক সন্তানকে রাজা বাসার্থে এক এক গ্রাম প্রদান করিলেন। সেই সেই গ্রামের নাম অনুসারে, তাঁহাদের সন্তানপরম্পরা অমুকগ্রামীণ, অর্থাৎ অমুকগাঁই, বলিয়া প্রসিদ্ধ হইলেন। শাণ্ডিল্যগোত্রে, ভট্টনারায়ণ- বংশে, বন্দ্য, কুসুম, দীর্ঘাঙ্গী, ঘোষলী, বটব্যাল, পারিহা, কুলকুলী, কুশারি, কুলভি, সেয়ক, গড়গড়ি, আকাশ, কেশরী, মাযচটক, বহুয়ারি, করাল, এই ষোল গাঁই (৭)। কাশ্যপগোত্রে, দক্ষবংশে, চট্ট, অম্বুলী, তৈলবাটী, পোড়ারি, হড়, গুড়, ভূরিষ্ঠাল, পালধি, পাকড়াসী, পূষলী, মূলগ্রামী, কোয়ারী, পলসায়ী, পীতমুণ্ডী, সিমলায়ী, ভট্ট, এই ষোল গাঁই (৮)। ভরদ্বাজগোত্রে, শ্রীহর্ষবংশে, মুথুটী, ডিংসাই, সাহরী, রাই, এই চারি গাঁই (৯)। সাবর্ণগোত্রে, বেদগর্ভবংশে, গাঙ্গুলি, পুংসিক, নন্দিগ্রামী, ঘণ্টেশ্বরী, কুন্দগ্রামী, সিয়ারি, সাটেশ্বরী, দায়ী, নায়েরী, পারিহাল, বালিয়া, সিন্ধল, এই বার গাঁই (১০)। বাৎস্যগোত্রে, ছান্দড়বংশে, কাঞ্জিলাল, মহিন্তা, পূতিতুণ্ড, পিপলাই, ঘোষাল, বাপুলি, কাঞ্জারী, সিমলাল, এই আট গাই (১১)।...

ভট্টনারায়ণ প্রভৃতির আগমনের পূর্বে, এ দেশে সাত শত ঘর ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁহারা, তদবধি, হেয় ও অশ্রদ্ধেয় হইয়া' রহিলেন, এবং, সপ্তশতীনামে প্রসিদ্ধ হইয়া, পৃথক্ সম্প্রদায় রূপে পরিগণিত হইতে লাগিলেন। তাঁহাদের মধ্যে জগাই, ভাগাই, সাগাই, নানসী, আরণ, বালথবি, পিথুরী, মুলুকজুরী, প্রভৃতি গাঁই ছিল। সপ্তশতী পঞ্চগোত্রবহির্ভূত; এজন্য, কান্যকুব্জ হইতে আগত পঞ্চ ব্রাহ্মণের সন্তানেরা, ইঁহাদের সহিত, আহার ব্যবহার ও আদান প্রদান করিতেন না; যাঁহারা করিতেন, তাঁহারাও, সপ্তশরীর ন্যায়, হেয় ও অশ্রদ্ধেয় হইতেন।

কাল ক্রমে, আদিসূরের বংশধ্বংস হইল। সেনবংশীয় রাজারা গৌড়দেশের সিংহাসনে অধিরোহণ করিলেন (১২)। এই বংশে উদ্ভুত সুপ্রসিদ্ধ রাজা বল্লালসেনের অধিকারকালে, কৌলীন্যমৰ্য্যাদা ব্যবস্থাপিত হয়। কান্যকুব্জ হইতে আগত ব্রাহ্মণ- দিগের সম্ভানপরম্পরার মধ্যে, ক্রমে ক্রমে, বিদ্যালোপ ও আচারভ্রংশ ঘটিয়া আসিতেছিল; উহার নিবারণই কৌলীন্য- মর্য্যাদাস্থাপনের মুখ্য উদ্দেশ্য। রাজা বল্লালসেন বিবেচনা করিলেন, আচার, বিনয়, বিদ্যা প্রভৃতি সদ্‌গুণের যথোপযুক্ত পুরস্কার করিলে, ব্রাহ্মণেরা অবশ্যই, সেই সকল গুণের রক্ষা বিষয়ে, সবিশেষ যত্নবান হইবেন। তদনুসারে, তিনি, পরীক্ষা দ্বারা, যাঁহাদিগকে নবগুণবিশিষ্ট দেখিলেন, তাঁহাদিগকে কৌলীন্যমর্য্যাদা প্রদান করিলেন। কৌলীন্য প্রবর্তক নয় গুণ এই-আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থদর্শন, নিষ্ঠা, আবৃত্তি, - তপস্যা, দান (১৩)। আবৃত্তিশব্দের অর্থ পরিবর্ত। পরিবর্ত চারি- প্রকার, আদান, প্রদান, কুশত্যাগ ও ঘটকাগ্রে প্রতিজ্ঞা (১৪)। আদান, অর্থাৎ, সমান বা উৎকৃষ্ট গৃহ হইতে কন্ঠা গ্রহণ; প্রদান, অর্থাৎ, সমান অথবা উৎকৃষ্ট গৃহে কন্যাদান; কুশত্যাগ, অর্থাৎ, কন্যার অভাবে কুশময়ী কন্যার দান; ঘটকাগ্রে প্রতিজ্ঞা, অর্থাৎ, উভয় পক্ষে কন্যার অভাব ঘটিলে, ঘটকের সম্মুখে, বাক্য মাত্র দ্বারা পরস্পর কন্যাদান। সৎকুলে কন্যাদান ও সৎকুল হইতে ক্যাগ্রহণ কুলের প্রধান লক্ষণ; কিন্তু, কন্যার অভাব ঘটিলে, আদানপ্রদান সম্পন্ন হয় না; শুতরাং, কন্যাহীন ব্যক্তি সম্পূর্ণ কুললক্ষণাক্রান্ত হইতে পারেন না। এই দোষের পরি- হায়ের নিমিত্ত, কুশময়ী কন্যান্স, দান ও ঘটক সমক্ষে বাক্য মাত্র দ্বারা পরস্পর কন্যাদানের ব্যবস্থা হয়।

পূর্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে, কান্যকুব্জ হইতে আগত পঞ্চ ব্রাহ্মণের যত্পঞ্চাশৎ সন্তান এক এক গ্রামে বাস করেন। সেই সেই গ্রামের নাম অনুসারে, এক এক গাঁই হয়। তাঁহাদের সন্তাপরম্পরা সেই সেই গাঁই বলিয়া প্রসিদ্ধ হন। সমুদয়ে ৫৬ গাঁই; তন্মধ্যে, বন্দ্য, চট্ট, মুহুটী, ঘোষাল, পৃতিভুণ্ড, গাঙ্গুলি, কাঞ্জিলাল, কুন্দগ্রামী, এই আট গাঁই সর্বতোভাবে নবগুণবিশিষ্ট ছিলেন (১৫), এজন্য কৌলীন্যমর্য্যাদা প্রাপ্ত হইলেন। এই আট গাঁইর মধ্যে, চট্টোপাধ্যায়বংশে, বহুরূপ, সুচ, অরবিন্দ, হলায়ুধ, বাঙ্গাল, এই পাঁচ; পৃতিতুণ্ডবংশে, গোবর্দ্ধনাচার্য্য; ঘোষালবংশে, শির; গঙ্গোপাধ্যায়বংশে, শিশ; কুন্দ গ্রামিবংশে, রোষাকর: বন্দ্যোপাধ্যায়বংশে, জালন, মহেশ্বর, দেবল, বামন, ঈশান, মকরন্দ, এই ছয়; মুখোপাধ্যায়বংশে, উৎসাহ, গরুড়, এই দুই; কাঞ্জিলালবংশে, কামু, কুতূহল, এই দুই; সমুদয়ে এই উনিশ জন কুলীন হইলেন (১৬)। পালধি, পাকড়াশী, সিমলায়ী, বাপুলি, ভূরিষ্ঠাল, কুলকুলী, বটব্যাল, কুশারি, সেয়ক, কুসুম, ঘোষলী, মাষচটক, বস্তুয়ারি, করাল, অম্বুলী, তৈলবাটী, মূলগ্রামী, পুষলী, আকাশ, পলসায়ী, কোয়ারী, সাহরি, ভট্টাচার্য্য, সাটেশ্বরী, নায়েরী, দায়ী, পারিহাল, সিয়ারী, সিদ্ধল, পুংসিক, নন্দিগ্রামী, কাঞ্জারী, সিমলাল, বালী, এই ৩৪ গাঁই অষ্টগুণবিশিষ্ট ছিলেন; এজন্য, শ্রোত্রিয়সংজ্ঞাভাজন হুইলেন (১৭)। পূর্ব্বোক্ত নয় গুণের মধ্যে, ইঁহারা আবৃত্তিগুণে বিহীন ছিলেন; অর্থাৎ, বন্দ্য 'প্রভৃতি আট গাঁই, আদান প্রদান বিষয়ে, যেমন সাবধান ছিলেন; পালধি প্রভৃতি চৌত্রিশ গাঁই, সে বিষয়ে, তদ্রূপ সাবধান ছিলেন না; এজন্য, তাঁহারা কৌলীন্যমৰ্য্যাদা প্রাপ্ত হইলেন না। আর, দীর্ঘাঙ্গী, পারিহা, কুলভী, পোড়ারী, রাই, কেশরী, ঘণ্টেশ্বরী, ডিংসাই, পীতমুণ্ডী, মহিন্তা, গুড়, পিপলাই, হড়, গড়গড়ি, এই চৌদ্দ গাঁই সদাচারপরিভ্রষ্ট ছিলেন; এজন্য, গৌণ কুলীন বলিয়া পরিগণিত হইলেন (১৮)।

এরূপ প্রবাদ আছে, রাজা বল্লালসেন, কৌলীন্যমর্য্যাদা স্থাপনের দিন স্থির করিয়া, ব্রাহ্মণদিগকে, নিত্যক্রিয়ার সমাপনান্তে, রাজসভায় উপস্থিত হইতে আদেশ করেন। তাহাতে কতকগুলি ব্রাহ্মণ এক প্রহরের সময়, কতকগুলি দেড় প্রহরের সময়, আর কতকগুলি আড়াই প্রহরের সময়, উপস্থিত হন। যাঁহারা আড়াই প্রহরের সময় উপস্থিত হন, তাঁহারা কৌলীন্য মর্য্যাদা প্রাপ্ত হইলেন; যাঁহারা দেড় প্রহরের সময়, তাঁহারা শ্রোত্রিয়, আর, যাঁহারা এক প্রহরের সময়, তাঁহারা গৌণ কুলীন, হইলেন। ইহার তাৎপর্য্য এই, প্রকৃত প্রস্তাবে নিত্যক্রিয়া করিতে অধিক সময় লাগে; সুতরাং, যাঁহারা আড়াই প্রহরের সময় আসিয়াছিলেন, তাঁহারা প্রকৃত প্রস্তাবে নিত্যক্রিয়া করিয়াছিলেন; তদ্দ্বারা রাজ। তাঁহাদিগকে সদাচারপূত বলিয়া বুঝিতে পারিলেন; এজন্য, তাঁহাদিগকে প্রধান মর্য্যাদা প্রদান করিলেন। দেড়প্রহরের সময় আগতেরা আচারাংশে ন্যূন ছিলেন, এজন্য ন্যূন মৰ্য্যাদা প্রাপ্ত'হইলেন; আর, এক প্রহরের সময় আগতেরা আচারভ্রষ্ট বলিয়া অবধারিত হইলেন; এজন্য, রাজা তাঁহাদিগকে, হেয়জ্ঞান করিয়া, অপকৃষ্ট ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিগণিত করিলেন।

এই রূপে, কৌলীন্যমর্য্যাদা ব্যবস্থাপিত হইল। নিয়ম হইল, কুলীনেরা কুলীনের সহিত আদান প্রদান সম্পন্ন করিবেন; শ্রোত্রিয়ের কল্পা গ্রহণ করিতে পারিবেন; কিন্তু, শ্রোত্রিয়কে ক্যাদান করিতে পারিবেন না; করিলে, কুলভ্রষ্ট ও বংশজ- ভাবাপন্ন হইবেন (১৯); আর, গৌণ কুলীনের কন্যাগ্রহণ করিলে, এক কালে কুলক্ষয় হইচবক; এই নিমিত্ত, গৌণ কুলীনেরা অরি, অর্থাৎ কুলের শত্রু, বলিয়া প্রসিদ্ধ ও পরিগণিত হইলেন (২০)।

কৌলীন্যমর্য্যাদা ব্যবস্থাপনের পর, বল্লালসেনের আদেশ 'অনুসারে, কতকগুলি ব্রাহ্মণ ঘটক এই উপাধি প্রাপ্ত হইলেন। ঘটকদিগের এই ব্যবসায় নিরূপিত হইল যে, তাঁহারা কুলীন- দিগের স্তুতিবাদ ও বংশাবলীকীর্ত্তন করিবেন এবং.. তাঁহাদের গুণ, দোষ ও কৌলীন্যমৰ্য্যাদা সংক্রান্ত নিয়ম বিষয়ে সবিশেষ দৃষ্টি রাখিবেন (২১)।

কুলীন, শ্রোত্রিয় ও গৌণকুলীন ব্যতিরিক্ত, আর একপ্রকার ব্রাহ্মণ আছেন, তাঁহাদের নাম বংশজ। এরূপ নির্দিষ্ট আছে, ব্রাহ্মণদিগকে শ্রেণীবদ্ধ করিবার সময়, বল্লালের মুখ হইতে বংশজশব্দ নির্গত হইয়াছিল এই মাত্র; বাস্তবিক, তিনি কোনও ব্রাহ্মণদিগকে বংশজ বলিয়া 'স্বতন্ত্র শ্রেণীতে সন্নিবেশিত করেন নাই; উত্তর কালে বংশজব্যবস্থা হইয়াছে। যে সকল কুলীনের ক্যা, ঘটনা ক্রমে, শ্রোত্রিয়গৃহে বিবাহিতা হইল, তাঁহারা কুল- ভ্রষ্ট হইলেন। এই রূপে যাঁহাদের কুলভ্রংশ ঘটিল, তাঁহারা বংশজসংজ্ঞাভাজন ও মর্য্যাদা বিষয়ে গৌণ কুলীনের সমকক্ষ হইলেন; অর্থাৎ, গৌণ কুলীনের কন্ঠা গ্রহণ করিলে, যেমন কুলক্ষয় হইয়া যায়, বংশজকন্যা গ্রহণ করিলেও, কুলীনের সেই- রূপ কুলক্ষয় ঘটে। তদনুসাত্তর, বংশজ ত্রিবিধ, প্রথম, শ্রোত্রিয় পাত্রে কন্যাদাতা কুলীন বংশজ; দ্বিতীয়, গৌণ কুলীনের কন্যা- গ্রাহী কুলীন বংশজ; তৃতীয়, বংশজের কন্যাগ্রাহী কুলীন বংশজ। স্থূল কথা এই, কোনও ক্রমে কুলক্ষয় হইলেই, কুলীন বংশজ- ভাবাপন্ন হইয়া থাকেন (২২)।

কৌলীন্যমৰ্য্যাদা ব্যবস্থাপিত হইলে, এতদ্দেশীয় ব্রাহ্মণেরা পাঁচ শ্রেণীতে বিভক্ত হইলেন-প্রথম, কুলীন; দ্বিতীয়, শ্রোত্রিয়; তৃতীয়, বংশজ; চতুর্থ, গৌণ কুলীন; পঞ্চম, পঞ্চ- গোত্রবহির্ভূত সপ্তশতী সম্প্রদায়।

কাল ক্রমে, গৌণ কুলীনেরা শ্রোত্রিয়শ্রেণীতে নিবেশিত হইলেন, কিন্তু সর্বাংশে শ্রোত্রিয়দিগের সমান হইতে পারিলেন না। প্রকৃত শ্রোত্রিয়েরা শুদ্ধ শ্রোত্রিয়, ও গৌণ কুলীনেরা কষ্ট শ্রোত্রিয়, বলিয়া উল্লিখিত হইতে লাগিলেন। গৌণ কুলীন এই সংজ্ঞাকালে তাঁহারা যেরূপ হেয় ও অশ্রদ্ধেয় ছিলেন, কর্ষ শ্রোত্রিয় এই সংজ্ঞাকালেও সেইরূপ রহিলেন।

কৌলীন্যমর্য্যাদা ব্যবস্থাপনের পর, ১০ পুরুষ গত হইলে দেবীবর ঘটকবিশারদ কুলীনদিগকে মেলবন্ধ করেন। যে আচার বিনয়, বিদ্যা প্রভৃতি গুণ দেখিয়া, বল্লাণ ব্রাহ্মণদিগকে কৌলীন্য মর্য্যাদা প্রদান করিয়াছিলেন, ক্রমে ক্রমে তাহার অধিকাংশই লোপাপত্তি পায়; কেবল আবৃত্তিগুণ মাত্রে কুলীনদিগের যত্ন ও আস্থা থাকে। কিন্তু, দেবীবরের সময়ে, কুলীনেরা এই গুণেও জলাঞ্জলি দিয়াছিলেন। আদানপ্রদানের বিশুদ্ধি বল্লালদত্ত কুল- মর্য্যাদার এক মাত্র অবলম্বন ছিল, তাহাও লয়প্রাপ্ত হয়। যে সকল দোষে এককালে কুল নির্মূল হয়, কুলীন মাত্রেই সেই সমস্ত দোষে দূষিত হইয়াছিলেন। যে যে কুলীন একবিধ দোষে দূষিত, দেবীবর তাঁহাদিগকে এক সম্প্রদায়ে নিবিষ্ট করেন। সেই সম্প্রদায়ের নাম মেল। মেলশব্দের অর্থ দোষমেলন, অর্থাৎ দোষ অনুসারে সম্প্রদায়বন্ধন (২৩)। দেবীবর ব্যবস্থা করেন, দোষ যায়, কুল তায় (২৪)। বল্লাল, গুণ দেখিয়া, কুলমর্য্যাদার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন; দেবীবর, দোষ দেখিয়া, কুলমর্য্যাদার ব্যবস্থা করিলেন। পৃথক্ পৃথক্ দোষ অনুসারে, দেবীবর তৎকালীন কুলীনদিগকে ৩৬ মেলে (২৫) বন্ধ করেন।

তন্মধ্যে ফুলিয়া ও খড়দহ মেলের প্রাদুর্ভাব অধিক। এই দুই মেলের লোকেরাই প্রধান কুলীন বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকেন; এবং এই দুই মেলের লোকেরাই, যার পর নাই, অত্যাচাবকারী হইয়া উঠিয়াছেন। যে যে দোষে এই দুই মেল বদ্ধ হয়, তাহা উল্লিখিত হইতেছে।

• গঙ্গানন্দ মুখোপাধ্যায় ও শ্লীপতি বন্দ্যোপাধ্যায়, উভয়ে এক- বিধ দোষে লিপ্ত ছিলেন; এজন্য, দেবীবর এই দুয়ে ফুলিয়া মেল বন্ধ করেন। নাধা, ধন্ধ, বারুইহাটী, মুলুকজুরী, এই দোষচতু- ষ্টয়ে ফুলিয়া মেল বন্ধ হয়। নাধানামকস্থানবাসী বন্দ্যোপাধ্যা- য়েরা বংশজ ছিলেন; গঙ্গানন্দের পিতা মনোহর তাঁহাদের বাটীতে বিবাহ করেন। এই বংশজক্যাবিবাহ দ্বারা, তাঁহার কুলক্ষয় ও বংশজভাবাপত্তি ঘটে। মনোহরের কুলরক্ষার নিমিত্ত, ঘটকেরা, পরামর্শ করিয়া, নাধার বন্দ্যোপাধ্যায়দিগকে শ্রোত্রিয় করিয়া দিলেন। তদবধি, নাধার বন্দ্যোপাধ্যায়েরা, বাস্তবিক বংশজ হইয়াও, মাষচটক নামে শ্রোত্রিয় বলিয়া পরিগণিত হইতে লাগিলেন। বস্তুতঃ, এই বিবাহ দ্বারা মনোহরের কুলক্ষয় ঘটিয়া- ছিল, কেবল ঘটকদিগের অনুগ্রহে কথঞ্চিৎ কুলরক্ষা হইল। ইহার নাম নাধাদোষ। শ্রীনাথ চট্টোপাধ্যায়ের দুই অবিবাহিতা দুহিতা ছিল। হাঁসাইর্নামক মুসলমান, ধন্ধনামক স্থানে, বলপূর্বক, ঐ দুই কন্যার জাতিপাত করে। 'পরে, এক কন্যা কংসারিতনয় পরমানন্দ পূতিতুণ্ড, আর এক কন্যা গঙ্গাবর বন্দ্যোপাধ্যায় বিবাহ করেন। এই গঙ্গাবরের সহিত নীলকণ্ঠ গঙ্গোর আদান- প্রদান হয়। নীলকণ্ঠ গঙ্গোর সহিত আদানপ্রদান দ্বারা, গঙ্গানন্দও যবনদোগে দূষিত হয়েন। ইহার নাম ধন্ধদোষ (২৬)। বারুই- হাটীগ্রামে ভোজন করিলে, ব্রাহ্মণের জাতিভ্রংশ ঘটিত। কাঁচনার মুখটা অর্জুন মিশ্র ঐ গ্রামে ভোজন করিয়াছিলেন। শ্রীপতি বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার সহিত আদানপ্রদান করেন। এই শ্রীপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহিত আদানপ্রদান দ্বারা, গঙ্গানন্দও সেই দোষে দূষিত হয়েন। ইহার নাম বারুইহাটীদোষ। মঙ্গানন্দের ভ্রাতৃপুত্র শিবাচার্য্য, মুলুকজুরীকন্যা বিবাহ করিয়া, কুলভ্রষ্ট ও সপ্তশতীভাবাপন্ন হয়েন; পরে, শ্রীপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা বিবাহ করেন। ইহার নাম মুলুকজুরীদোষ।

যোগেশ্বর, পণ্ডিত ও মধু চট্টোপাধ্যায়, উভয়ে একবিধ দোষে লিপ্ত ছিলেন; এজন্য এই দুয়ে খড়দহ মেল বন্ধ হয়। যোগেশ্বরের পিতা হরি মুখোপাধ্যায় গড়গড়িকন্যা, যোগেশ্বর নিজে পিপলাইকন্যা, বিবাহ করেন। মধু চট্টোপাধ্যায় ডিংসাই রায় পরমানন্দের কন্যা বিবাহ করেন। যোগেশ্বর এই মধু চট্টোকে ক্যাদান করিয়াছিলেন।

বংশজ, গৌণ কুলীন ও সপ্তপতী সম্প্রদায়ের কন্যা বিবাহ করিলে, এক কালে কুলক্ষয় ও বংশজভাবাপত্তি ঘটে। ফুলিয়া মেলের প্রকৃতি গঙ্গানন্দ মুখোপাধ্যায়ের পিতা মনোহর বংশজ- কন্যা বিবাহ করেন; গঙ্গানন্দভ্রাতৃপুত্র শিবাচার্য্য মুলুকজুরীকন্যা বিবাহ করেন। খড়দহ মেলের প্রকৃতি যোগেশ্বর পণ্ডিতের পিতা হরি মুখোপাধ্যায় গড়গড়িকন্যা, যোগেশ্বর নিজে পিপলাই- কন্যা, আর মধু চট্টোপাধ্যায় ডিংসাইকল্যা, বিবাহ করেন। মুলুকজুরী পঞ্চগোত্রবহির্ভূত সপ্তশতীসম্প্রদায়ের অন্তর্বর্তী; গড়- গড়ি, পিপলাই ও ডিংসাই গৌণ কুলীন। কুলিয়া ও খড়দহ মেলের লোকেরা কুলীন বলিয়া যে অভিমান করেন, তাহা সম্পূর্ণ ভ্রান্তিমূলক; কারণ, বংশজ, গৌণ কুলীন ও সপ্তশতী কন্যা বিবাহ দ্বারা, বহু কাল, তাঁহাদের কুলক্ষয় ও বংশজভাবাপত্তি ঘটিয়াছে। অধিকন্তু, যবনদোষস্পর্শ বশতঃ, ফুলিয়া মেলের লোকদিগের জাতিভ্রংশ হইয়া গিয়াছে। এইরূপ, সকল মেলের লোকেরাই, কুবিবাহ প্রভৃতি দোষে, কুলভ্রষ্ট ও বংশজভাবাপন্ন হইয়া গিয়াছেন। ফলতঃ, মেলবন্ধনের পূর্ব্বেই, বল্লাল প্রতিষ্ঠিত কুলমর্য্যদার লোপাপত্তি হইয়াছে। এক্ষণে যাঁহারা কুলীন বলিয়া অভিমান করেন, তাঁহারা বাস্তবিক বহু কালের বংশজ। যাঁহারা বংশজ বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকেন, কৌলীন্য প্রথার নিয়ম অনুসারে, তাঁহাদের সহিত ইদানীন্তন কুলাভিমানী বংশজদিগের কোনও অংশে কিছুমাত্র বিভিন্নতা নাই (২৭)।

যেরূপ দর্শিত হইল, তদনুসারে, বহু কাল, রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ- দিগের কৌলীন্যমর্য্যাদা লয়প্রাপ্ত হইয়াছে। কৌলীন্যের নিয়ম অনুসারে, কুলীন বলিয়া গণনীয়, হইতে পারেন, ইদানীং ঈদৃশ ব্যক্তিই অপ্রাপ্য ও অপ্রসিদ্ধ। অতএব, যখন কুলীনের একাত অসম্ভাব ঘটিয়াছে, তখন, বহুবিবাহ প্রথা নিবারিত হইলে, কুলীন দিগের জাতিপাত ও ধৰ্ম্মলোপ ঘটিবেক, এ আপত্তি, কোনও মতে, ন্যায়োপেত বলিয়া অঙ্গীকৃত হইতে পারে না।

দেবীবর যে যে ঘর লইয়া মেল বন্ধ করেন, সেই সেই ঘরে আদানপ্রদান ব্যবস্থাপিত হয়। মেলবন্ধনের পূর্বে, কুলীনদিগের আট ঘরে পরস্পর আদানপ্রদান প্রচলিত ছিল। ইহাকে সর্বব দ্বারী বিবাহ কহিত। তৎকালে, আদানপ্রদানের কিছু মাত্র অসুবিধা ছিল না। এক ব্যক্তির অকারণে একাধিক বিবার করিবার আবশ্যকতা ঘটিত না, এবং কোনও কুলীনকন্যাকেই যাবজ্জীবন, অবিবাহিত অবস্থায় কালযাপন করিতে হইত না এক্ষণে, অল্প ঘরে মেল বন্ধ হওয়াতে, কাল্পনিক কুল রক্ষার জন্য, এক পাত্রে অনেক কন্যার দান অপরিহার্য্য হইয়া উঠিল এই রূপে, দেবীবরের কুলীনদিগের মধ্যে বহু বিবাহের সূত্রপাত্ত হইল।

অবিবাহিত অবস্থায় ক্যার ঋতুদর্শন, শাস্ত্র অনুসারে ঘোরতর পাতকজনক। কাশ্যপ কহিয়াছেন, পিতুর্গেহে চ যা কন্যা রজঃ পশ্যত্যসংস্কৃতা। ভ্রূণহত্যা পিতুস্তস্যাঃ যা কন্যা 'বৃষলী স্মৃতা। যস্ত তাং বরয়েৎ ক্যাং ব্রাহ্মণো জ্ঞানদুর্বলঃ। অশ্রদ্ধেয়মপাংক্তেয়ং তং বিদ্যাদ্বষলীপতিম্ ॥ (২৮) যে অবিবাহিতা কন্তা পিত্রালয়ে রজস্বলা হয়, তাহার পিতা ভ্রূণহত্যাপাপে লিপ্ত হন। সেই কন্ডাকে বৃষলী বলে। যে জ্ঞান- হীন ব্রাহ্মণ সেই কন্তার পাণিগ্রহণ করে, সে অশ্রাদ্ধেয় (২৯) অপাংক্তেয় (৩০) ও বৃষলীপতি।

যম কহিয়াছেন, মাতা চৈব পিতা চৈব, জ্যেষ্ঠো ভ্রাতা তথৈব চ। এয়স্তে নরকং যান্তি দৃষ্টুা কন্যাং রজস্বলাম্ ॥ ২৩ ॥ • যস্তাং বিবাহয়েৎ ক্যাং, ব্রাহ্মণো মদমোহিতঃ।

• অসম্ভাষ্যো হাপাংক্তেয়ঃ স. বিপ্রো বৃষলীপতিঃ ॥ ২৪। (৩১) ক্যাকে অবিবাহিত অবস্থায় রজস্বলা দেখিলে, মাতা, পিতা, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, এই তিন জন নরকগামী হয়। যে ব্রাহ্মণ, অজ্ঞানান্ধ হইয়া, সেই কল্লাকে বিবাহ করে, সে অসম্ভাষ্য, (৩২) অপাংক্তেয় ও বৃষলীপতি।

পৈঠীনসি কহিয়াছেন, যাবন্নোপ্তিছোতে স্তনৌ তাবদেব দেয়া অথ ঋতুমতী ভবতি দাতা প্রতিগ্রহীতা চ নরকমাপ্নোতি পিতৃ- পিতামহ প্রপিতামহাশ্চ বিষ্ঠায়াং জায়স্তে। তস্মাৎ নগ্নিকা দাতব্যা । (৩৩) স্তনপ্রকাশের পূর্ব্বেই কক্তাদান করিবেক। যদি কল্পা বিবাহের পূর্ব্বে ঋতুমতী হয়, দাতা ও গ্রহীতা উভয়ে নরকগামী হয়, এবং পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ বিষ্ঠায় জন্মগ্রহণ করে। অতএব, ঋতুদর্শনের পূর্ব্বেই, ক্যাদান করিবেক।

ব্যাস কহিয়াছেন, যদি সা দাতৃবৈকল্যান্দ্রজঃ পশ্যেৎ কুমারিকা। ভ্রূণহত্যাশ্চ তাবত্যঃ পতিতঃ স্বস্থ্যাত্তদপ্রদঃ ।। (৩৪) যে ব্যক্তি দানাধিকারী, যদি তাহার দোষে কুমারী ঋতুদর্শন করে; তবে, ঐ কুমারী, অবিবাহিত অবস্থায়, যত বার ঋতুমতী হয়, সে তত বার ভ্রূণহত্যাপাপে লিপ্ত, এবং যথাকালে তাহার বিবাহ না দেওয়াতে, পতিত হয়।

অবিবাহিত অবস্থায় কন্যার ঋতুদর্শন ও ঋতুমতী কন্যার পাণি- গ্রহণ এক্ষণকার কুলীনদিগের গৃহে সচরাচর ঘটনা। কুলীনেরা, দেবীবরের কপোলকল্পিত প্রথার অনুবর্তী হইয়া, ঘোরতর পাতক- গ্রস্ত হইতেছেন। ধর্ম্মশাস্ত্র অনুসারে বিবেচনা করিতে গেলে, তাঁহারা বহু কাল পতিত ও ধৰ্ম্মচ্যুত হইয়াছেন (৩৫)।

কুলীনমহাশয়েরা যে কুলের অহঙ্কারে মত্ত হইয়া আছেন, তাহা বিধাতার সৃষ্টি নহে। বিধাতার সৃষ্টি হইলে, সে বিষয়ে স্বতন্ত্র বিবেচনা করিতে হইত। এ দেশের ব্রাহ্মণেরা বিজ্ঞাহীন ও আচারভ্রষ্ট হইতেছিলেন। যাহাতে তাঁহাদের মধ্যে বিস্তা, সদাচার প্রভৃতি গুণের আদর থাকে, এক রাজা তাহার উপায় স্বরূপ কুলমর্য্যাদা ব্যবস্থা, এবং, কুলমর্য্যাদা রক্ষার উপায় স্বরূপ কর্তকগুলি নিয়ম সংস্থাপন, করেন। সেই রাজপ্রতিষ্ঠিত নিয়ম অনুসারে বিবেচনা করিয়া দেখিলে, কুবিবাহ প্রভৃতি দোষে, বহু কাল, কুলীন মাত্রের কুলক্ষয় হইয়া গিয়াছে। যখন, রাজ- প্রতিষ্ঠিত নিয়ম অনুসারে, রাজদত্ত কুলমর্য্যাদার উচ্ছেদ হইয়াছে, তখন, কুলীনম্মন্য মহাপুরুষদিগের ইদানীন্তন কুলাভিমান নির- বচ্ছিন্ন ভ্রান্তি মাত্র। অনন্তর, দেবীবর, যে অবস্থায়, যে রূপে, কুলের ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহাতে কুলীনগণের অহঙ্কার করিবার কোনও হেতু দেখিতে পাওয়া যায় না। কুলীনেরা সুবোধ হইলে, অহঙ্কার না করিয়া, বরং তাদৃশ কুলের পরিচয় দিতে লজ্জিত হইতেন। লজ্জিত হওয়া দূরে থাকুক, সেই কুলের অভিমানে, শাস্ত্রের মস্তকে পদার্পণ করিয়া, স্বয়ং নরকগামী হইতেছেন, এবং পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, তিন পুরুষকে পরলোকে বিষ্ঠাহ্রদে বাস করাইতেছেন। ধন্য রে অভিমান! তোর প্রভাব ও মহিমার ইয়ত্তা নাই। তুই মনুষ্যজাতির অতি বিষম শত্রু। তোর কুহকে পড়িলে, সম্পূর্ণ মতিচ্ছন্ন ঘটে; হিতাহিতবোধ, ধৰ্ম্মাধর্ম্মবিবেচনা একবারে অন্তর্হিত হয়।

কৌলীন্যমৰ্য্যাদা ব্যবস্থাপনের পর, দশ পুরুষ গত হইলে দেবীবর, কুলীনদিগের মধ্যে নানা বিশৃঙ্খলা উপস্থিত দেখিয় মেলবন্ধন দ্বারা নূতন প্রণালী সংস্থাপন করেন। এক্ষণে, মেল বন্ধনের সময় হইতে দশ পুরুষ অতীত হইয়াছে (৩৬); এবং কুলীনদিগের মধ্যে, নানা বিশৃঙ্খলাও ঘটিয়াছে। সুতরাং, পুনরা কোনও নূতন প্রণালী সংস্থাপনের সময় উপস্থিত হইয়াছে প্রথমতঃ, ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে বিশৃঙ্খলা উপস্থিত দেখিয়া, বল্লাল সেন, উহার নিবারণের অভিপ্রায়ে, কৌলীন্যমৰ্য্যাদা সংস্থাপ করেন। তৎপরে, কুলীনদিগের মধ্যে বিশৃঙ্খলা উপস্থিত দেখিয় দেবীবর, উহার নিবারণের আশয়ে, মেলবন্ধন করেন। এক্ষণে কুলীনদিগের মধ্যে, যে অশেষবিধ বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইয়াছে অমূলক কুলাভিমান পরিত্যাগ ভিন্ন, উহার নিবারণের আর উপায় নাই। যদি তাঁহারা সুবোধ, ধর্মভীরু, ও আত্মমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হন অকিঞ্চিৎকর কুলাভিমানে বিসর্জন দিয়া, কুলীননামের কলর বিমোচন করুন। আর, যদি তাঁহারা কুলাভিমান পরিত্যাঃ নিতান্ত অসাধ্য বা একান্ত অবিধেয় বোধ করেন; তবে তাঁহাদের পক্ষে, কোনও নূতন ব্যবস্থা অবলম্বন করা আবশ্যক এ অবস্থায়, বোধ হয়, পুনরায় সর্বদ্বারী বিবাহ প্রচলিত হওয় ভিন্ন, কুলীনদিগের পরিত্রাণের আর পথ নাই। এই পথ অবলম্বন করিলে, কোনও কুলীনের, অকারণে, একাফিক বিবাহের আবশ্য- কতা থাকিবেক না; কোনও কুলীনকন্যাকে, যাবজ্জীবন বা দীর্ঘ কাল, অবিবাহিত অবস্থায় শাকিয়া, পিতাকে নরকগামী করিতে হইবেক না; এবং রাজনিয়ম দ্বারা বহুবিবাহপ্রথা নিবারিত হইলে, কোনও ক্ষতি বা অসুবিধা ঘটিবেক না। এ বিষয়ে কুলীনদিগের ও কুলীনপক্ষপাতী মহাশয়দিগের যত্ন ও মনোযোগ করা কর্তব্য। অনর্থকর, অধর্ম্মকর কুলাভিমানের রক্ষা বিষয়ে, অন্ধ ও অবোধের ন্যায়, সহায়তা করা অপেক্ষা, যে সকল দোষ। বশতঃ, কুলীনদিগের ধর্ম্মলোপ ও যার পর নাই অনর্থসংঘটন হইতেছে, সেই সমস্ত দোষের সংশোধন পক্ষে যত্নবান হইলে, কুলীনপক্ষপাতী মহাশয়দিগের বুদ্ধি, বিবেচনা, ও ধৰ্ম্ম অনুযায়ী কৰ্ম্ম করা হইবেক।

ইদানীন্তন কুলাভিমানী মহাপুরুষেরা কুলীন বলিয়া অভিমান করিতেছেন, এবং দেশস্থ লোকের পূজনীয় হইতেছেন। যদি তদীয় চরিত্র বিশুদ্ধ ও ধৰ্ম্মমার্গের অনুযায়ী হইত, তবে তাহাতে কেহ কোনও ক্ষতিবোধ বা আপত্তি উত্থাপন করিতেন না। কিন্তু, তাঁহাদের আচরণ, যার পর নাই, জঘন্য ও ঘৃণাস্পদ হইয়া উঠিয়াছে। তাঁহাদের আচরণ বিষয়ে লোকসমাজে শত শত উপাখ্যান প্রচলিত আছে; এস্থলে সে সকলের উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। ফলকথা এই, দয়া, ধৰ্ম্মভয়, লোকলজ্জা প্রভৃতি একবারে তাঁহাদের হৃদয় হইতে অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে। কন্যাসন্তানের সুখ দুঃখ গণনা বা হিত অহিত বিবেচনা তদীয় চিত্তে কদাচ স্থান পায় না। ক্যা যাহাতে করণীয় ঘরে অর্পিতা হয়, কেবল সেই বিষয়ে দৃষ্টি থাকে। অথরে অর্পিতা হইলে, কন্যা কুলক্ষয়কারিণী হয়; এজন্য, কন্যার কি দশা ঘটিবেক, সে দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া, যেন তেন প্রকারেণ, কন্যাকে পাত্রসাৎ করিতে পারিলেই, তাঁহারা চরিতার্থ হয়েন। অবিবাহিত অবস্থায়, কন্যা বাটী হইতে বহির্গত হইয়া গেলে, তাঁহাদের কুলক্ষয় ঘটে; বাটীতে থাকিয়া, ব্যভিচারদোষে আক্রান্ত ও ভ্রূণহত্যাপাপে রারংবার লিপ্ত হইলে, কোনও দোষ ও হানি নাই। কথঞ্চিৎ কুলরক্ষা করিয়া, অর্থাৎ নামমাত্রে বিবাহিতা হইয়া, কন্যা বারাঙ্গনাবৃত্তি অবলম্বন করিলে, তাঁহাদের কিঞ্চিৎ মাত্র ক্ষোভ, লজ্জা, বা ক্ষতিবোধ হয় না। তাহার কারণ এই যে, এ সকল ঘটনায় কুললক্ষ্মী বিচলিতা হয়েন না। যদি কুললক্ষনী বিচলিতা ন। হইলেন, তাহা হইলেই তাঁহাদের সকল দিক রক্ষা হইল। কুললক্ষ্মীরও তাঁহাদের উপর নিরতিশয় স্নেহ ও অপরিসীম দয়া। তিনি, কোনও ক্রমে, সে স্নেহ ও সে দয়া পরিত্যাগ করিতে পারেন না। এ স্থলে কুললক্ষ্মীর স্নেহ ও দয়ার একটি আশ্চর্য্য ঊদাহরণ প্রদর্শিত হইতেছে।

অমুক গ্রামে, অমুক নামে, একটি প্রধান কুলীন ছিলেন। তিনি তিন চারিটি বিবাহ করেন। অমুক গ্রামে যে বিবাহ হয়, তাহাতে তাঁহার দুই কন্যা জন্মে। কন্যারা, জন্মাবধি, মাতুলালয়ে থাকিয়া প্রতিপালিত হইয়াছিল। মাতুলেরা ভাগিনেয়ীদের প্রতিপালন করিতেছেন ও যথাকালে বিবাহ দিবেন, এই স্থির করিয়া, পিতা নিশ্চিন্ত থাকিতেন, কোনও কালে, তাহাদের কোনও তত্ত্বাবধান করিতেন না.। দুর্ভাগ্য ক্রমে, মাতুলদের অবস্থা ক্ষুণ্ণ হওয়াতে, তাঁহারা ভাগিনেয়ীদের বিবাহকার্য্য নির্বাহ করিতে পারেন নাই। প্রথমা ক্যাটির বয়ঃক্রম ১৮, ১৯ বৎসর, দ্বিতীয়াটির বয়ঃক্রম ১৫, ১৬ বৎসর, এই সময়ে, কোনও ব্যক্তি ভুলাইয়া তাহাদিগকে বাটা হইতে বাহির করিয়া লইয়া যায়।

প্রায় এক পক্ষ অতীত হইলে, তাহাদের পিতা এই দুর্ঘটনার সংবাদ পাইলেন; এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া, এক আত্মীয়ের সহিত' পরামর্শ করিবার নিমিত্ত, কলিকাতায় উপস্থিত হইলেন। আত্মীয়ের নিকট এই দুঘটনার বৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া, তিনি, পলদর্শ লোচনে, আকুল বচনে, কহিতে লাগিলেন, ভাই, এত কালের পর, আমায় কুললক্ষ্মী পরিত্যাগ করিলেন; আর আমার জীবনধারণ বৃথা; আমি অতি হতভাগ্য, নতুবা কুললক্ষ্মী বাম হইবেন কেন। আত্মীয় কহিলেন, তুমি যে কখনও কন্যাদের কোনও সংবাদ লও নাই; এ তোমার সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত। যাহা হউক, কুলীন ঠাকুর, অনেক ভাবিয়া চিন্তুিয়া, অবশেষে ক্যাপহারীর শরণাগত হইলেন, এবং প্রার্থনা করিলেন, আপনি দয়া করিয়া, তিন মাসের জন্ম, কন্যা দুটি দেন; আমি, তিন মাসের মধ্যে, উহাদিগকে আপনকার নিকট পঁহুছাইয়া দিব। কন্ঠাপহারী যাঁহাদের অনুরোধ রক্ষা করেন, এরূপ অনেক ব্যক্তি, কুলীন ঠাকুরের কাতরতা' দর্শনে ও আর্ন্তবাক্য শ্রবণে অনুকম্পা পরতন্ত্র হইয়া, অনেক অনুরোধ করিয়া, তিন মাসের জন্য, সেই দুই কন্যাকে পিতৃহস্তে সমর্পণ করাইলেন। তিনি, চরিতার্থ হইয়া, তাহাদের দুই ভগিনীকে আপন বসতিস্থানে লইয়া গেলেন, এবং এক ব্যক্তি, অঘরে বিবাহ দিবার জন্য, চুরী করিয়া লইয়া গিয়াছিল; অনেক যত্নে, অনেক কৌশলে, ইহান্তের উদ্ধার করিয়াছি, ইহা প্রচার করিয়া দিলেন। কন্যারা না পলায়ন করিতে পারে, এজন্য, এক. রক্ষক নিযুক্ত করিলেন। সেই রক্ষক, সর্বব ক্ষণ, তাহাদের রক্ষণাবেক্ষণ করিতে লাগিল।

এইরূপ ব্যবস্থা করিয়া, কুলীন ঠাকুর, অর্থের সংগ্রহ ও বরের অন্বেষণ করিবার নিমিত্ত, নির্গত হইলেন; এবং, এক মাস পরে, ভাদ্র মাসের শেষে, বিবাহের উপযোগী অর্থ সংগ্রহ পূর্ব্বক, এক যষ্টিবর্ষীয় বর সমভিব্যাহারে, বাটীতে প্রত্যাগমন করিলেন। বরও, কন্যাদের চরিত্র বিষয়ে, সমস্তই সবিশেষ জানিতে পারিয়াছিলেন; কিন্তু, অগ্রে কোনও অংশে আপত্তি উত্থাপন বা অসম্মতি প্রদর্শন না করিয়া, বিবাহের সময়, উপস্থিত সর্বব জন সমক্ষে, অম্লান মুখে কহিলেন, আমি শুনিলাম, এই দুই কন্যা অতি দুশ্চরিত্রা; আমি ইহাদের পাণিগ্রহণ করিব না। ক্যাকর্তাকে ভয় দেখাইয়া, নিয়মিত দক্ষিণা, অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অধিক প্রাপ্তিই এই অসম্মতি প্রদর্শনের এক মাত্র উদ্দেশ্য। সামান্যরূপ বাদানুবাদ ও উপরোধ অনুরোধের পর, বর, আর বার টাকা পাইলে বিবাহ করিতে পারেন, এরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন। কন্যাকর্তা, এক বিঘা ব্রহ্মত্র ভূমি বন্ধক রাখিয়া, বার টাকা আনিয়া, বরের হস্তে সমর্পণ করিলে, শেষ রাত্রিতে, নির্বিবাদে, কন্যা দ্বয়ের সম্প্রদানক্রিয়া সম্পন্ন হইয়া গেল। কুলীন ঠাকুরের' কুলরক্ষা হইল। যাঁহারা বিবাহ- ক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন, স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, কুললক্ষ্মী বিচলিতা হইলেন না, এই আনন্দে ব্রাহ্মণের নয়নযুগলে অশ্রুধারা বহিতে লাগিল।

পর দিন প্রভাত হইবা মাত্র, বর স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। কতিপয় দিবস অতীত হইলে, বিবাহিতা কুলপালিকারাও অন্তর্হিতা হইলেন। তদবধি, আর কেহ তাঁহাদের কোনও সংবাদ লইলেন না; এবং, সংবাদ লইবার আবশ্যকতাও ছিল না। তাঁহারা পিতার কুলরক্ষা করিয়াছেন; অতঃপর, তাঁহারা যথেচ্ছ- চারিণী বলিয়া সর্বত্র পরিচিত হইলেও, ইদানীন্তন কুলীনদিগের কুলধৰ্ম্ম অনুসারে, আর তাঁহাদের পিতার কুলোচ্ছেদের বা কলঙ্কঘটনার আশঙ্কা ছিল না। বিশেষতঃ, তিনি ক্যাপহারীর নিকট অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, তিন মাসের মধ্যে, কণ্যাদিগকে তাঁহার নিকট পঁহুছাইয়া দিবেন। বিবাহের অব্যবহিত পরেই, প্রতিশ্রুত সময় উত্তীর্ণ প্রায় হয়। এজন্য, সত্যনিষ্ঠ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, উদারচরিত কুলীন ঠাকুর, সেই দুই কন্যা লইয়া, কন্যাপহারীর নিকটে উপস্থিত হইলেন, এবং, সেই কুলপালিকাগিদকে তাঁহার হস্তে প্রত্যর্পণ পূর্বক, তদীয় দয়া ও সৌজন্যের প্রশংসাকীর্তন, ও কৃতজ্ঞ হৃদয়ে ধন্যবাদ প্রদান পূর্ব্বক, প্রতিশ্রুত সময় মধ্যে, কন্যাপ্রত্যর্পণপ্রতিজ্ঞ। হইতে মুক্তিলাভ, ও আনুষঙ্গিক কিঞ্চিৎ অর্থলাভ করিয়া, প্রসন্ন ও প্রফুল্লচিত্তে, গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন।

সে যাহা হউক, কুলীন ঠাকুর কুললক্ষ্মীর স্নেহে ও দয়ায় বঞ্চিত হইলেন না, ইহাই পরম সৌভাগ্যের বিষয়। চঞ্চলা বলিয়া, লক্ষ্মীর বিলক্ষণ অপবাদ আছে; কিন্তু, কুলীনের কুল- লক্ষ্মী সে অপবাদের আস্পদ নহেন।

অনেকেই এই ঘটনার সবিশেষ বিবরণ অবগত হইয়াছিলেন; কিন্তু, তজ্জন্য, কেহ, কখনও, কোনও অংশে, কুলীন ঠাকুরের প্রতি অণুমাত্র অশ্রঙ্গা বা অনাদর প্রদর্শন করেন নাই।

এই সমস্ত অনুধাবন করিয়া, যাঁহারা পূজনীয় কুলীন ঠাকুর- দিগের ও তদীয় অলৌকিক কুলমর্য্যাদার প্রশংসাকীর্তন না করিবেন, এবং এতদ্দেশীয় প্রশংসনীয় সাধুসমাজের শিরোরত্ব মহাপুরুষদিগকে, মুক্তকণ্ঠে, ধন্যবাদ না দিবেন, তাঁহারা নিতান্ত পামর।

তৃতীয় আপত্তি।

কেহ কেহ আপত্তি করিতেছেন, বহুবিবাহপ্রথা রহিত হইলে, ভঙ্গকুলীনদের সর্বনাশ। এক ব্যক্তি অনেক বিবাহ করিতে না পারিলে, তাঁহাদের কৌলীন্যমর্য্যাদার সমূলে উচ্ছেদ ঘটিবেক। এই আপত্তির বলাবল বিবেচনা করিতে হইলে, ভঙ্গকুলীনের কুল, চরিত্র প্রভৃতির পরিচয় দেওয়া আবশ্যক।

পূর্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে, বংশজকন্যা বিবাহ করিলে, কুলী- নের কুলক্ষয় হয়; এজন্য, কুলীনেরা বংশজকন্যার পাণিগ্রহণে পরাম্মুখ থাকেন। এ দিকে, বংশজদিগের নিতান্ত বাসনা, কুলীনে কন্যাদান করিয়া, বংশের গৌরববন্ধন করেন। কিন্তু, সে বাসনা অনায়াসে সম্পন্ন হইবার নহে। যাঁহারা বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন, তাদৃশ বংশজেরাই সেই সৌভাগ্যলাভে অধিকারী। যে কুলীনের অনেক সন্তান থাকে, এবং অর্থলোভ সাতিশয় প্রবল হয়; তিনি, অর্থলাভে চরিতার্থ হইয়া, বংশজকন্যার সহিত পুত্রের বিবাহ দেন। এই বিবাহ দ্বারা, কেবল ঐ পুত্রের কুলক্ষয় হয়; তাঁহার নিজের বা অন্যান্য পুত্রের কুলমর্য্যাদার কোনও ব্যতিক্রম ঘটে না।

এইরূপে, যে সকল কুলীনসন্তান, বংশজকন্যা বিবাহ করিয়া, কুলভ্রষ্ট হয়েন, তাঁহারা স্বকৃতভঙ্গ কুলীন বলিয়া উল্লিখিত হইয়া থাকেন। ঈদৃশ ব্যক্তির, অতঃপর, বংশজকন্যা বিবাহে, আর আপত্তি থাকে না। কুলভঙ্গ করিয়া, কুলীনকে কন্যাদান করা বহুব্যয়সাধ্য; এজন্য, সকল বংশজের ভাগ্যে সে সৌভাগ্য ঘটিয়া উঠে না। কিন্তু, স্বকৃতভঙ্গ কুলীনেরা, কিঞ্চিৎ পাইলেই, তাঁহা- দিগকে চরিতার্থ করিতে প্রস্তুত আছেন। এই সুযোগ দেখিয়া, বংশজেরা, কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ দিয়া সন্তুষ্ট করিয়া, স্বকৃতভঙ্গ পাত্রে কন্যাদান করিতে ব্যগ্র হয়েন; এবং, বিবাহিতা স্ত্রীর কোনও ভার লইতে হইবেক না, অথচ আপাততঃ কিঞ্চিৎ লাভ হইতেছে, এই ভাবিয়া, স্বকৃতভসেরাও, বংশজদিগকে চরিতার্থ করিতে বিমুখ হয়েন না। এইরূপে, কিঞ্চিৎ লাভের লোভে, বংশজকন্যা বিবাহ করা স্বকৃতভঙ্গের প্রকৃত ব্যবসায় হইয়া উঠে।

এতদ্ভিন্ন, ভঙ্গকুলীনদের মধ্যে এই নিয়ম হইয়াছে, অন্ততঃ স্বসমান পর্য্যায়ের ব্যক্তিদিগকে কন্যাদান করিতে হইবেক; অর্থাৎ, স্বকৃতভঙ্গের কন্যা স্বকৃতভঙ্গ পাত্রে দান করা আবশ্যক। তদনুসারে, যে সকল স্বকৃতভঙ্গের অবিবাহিতা, কন্যা থাকে, তাঁহারাও, কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ দিয়া সন্তুষ্ট করিয়া, স্বকৃতভঙ্গ পাত্রে কন্যাদান করেন। স্বকৃতভঙ্গের পুত্র, পৌত্র প্রভৃতির পক্ষেও, স্বকৃতভঙ্গ পাত্রে কন্যাদান করা শ্লাঘার বিষয়; এজন্য, তাঁহারাও, সবিশেষ যত্ন করিয়া, স্বকৃতভঙ্গ পাত্রে কন্যাদান করিয়া থাকেন।

স্বকৃতভঙ্গ কুলীন, এইরূপে, ক্রমে ক্রমে, অনেক বিবাহ, করেন। স্বকৃতভঙ্গের পুত্রেরা, এ বিষয়ে, স্বকৃতভঙ্গ অপেক্ষা নিতান্ত নিকৃষ্ট নহেন। তৃতীয় পুরুষ অবধি বিবাহের সংখ্যা ন্যূন হইতে আরম্ভ হয়। পূর্বে, বংশজকন্যা গ্রহণ করিলে, কুলীন, এককালে কুলভ্রষ্ট ও বংশজভাবাপন্ন হইয়া, হেয় ও অশ্রদ্ধেয় হইতেন; ইদানীং, পাঁচ পুরুষ, পর্য্যন্ত, কুলীন বলিয়া গণ্য ও মান্য. হইয়া থাকেন।

যে সকল হতভাগা কন্য। স্বকৃতভঙ্গ অথবা দুপুরুষিয়া পাত্রে অর্পিতা হয়েন, তাঁহারা যাবজ্জীবন পিত্রালয়ে বাস করেন।

বিবাহকর্ত্তা মহাপুরুষেরা, কিঞ্চিৎ দক্ষিণা পাইয়া, ক্যাকর্ডার কুলরক্ষা অথবা বংশের গৌরববন্ধন করেন, এই মাত্র। সিদ্ধান্ত করা আছে, বিবাহকর্তাকে বিবাহিতা স্ত্রীর তত্ত্বাবধানের, অথবা ভরণপোষণের, ভার বহন করিতে হইবেক না। সুতরাং, কুলীন- মহিলারা, নাম মাত্র বিবাহিতা হইয়া, বিধবা কন্যার' ন্যায়, যাবজ্জীবন, পিত্রালয়ে কালযাপন করেন। স্বামিসহবাসসৌভাগ্য বিধাতা তাঁহাদের অদৃষ্টে লিখেন নাই; এবং, তাঁহারাও সে প্রত্যাশা রাখেন না। কন্যাপক্ষীয়েরা সবিশেষ চেষ্টা পাইলে, কুলীন জামাতা, শ্বশুরালয়ে আসিয়া, দুই চারি দিন অবস্থিতি করেন; কিন্তু, সেবা ও বিদায়ের ত্রুটি হইলে, এ জন্মে আর শ্বশুরালয়ে পদার্পণ করেন না।

কোনও কারণে কুলীনমহিলার গর্ভসঞ্চার হইলে, তাহার পরিপাকের নিমিত্ত, কন্যাপক্ষীয়দিগকে ত্রিবিধ উপায় অবলম্বন করিতে হয়। প্রথম, সবিশেষ চেষ্টা ও যত্ন করিয়া, জামাতার আনয়ন। তিনি আসিয়া, দুই এক দিন শ্বশুরালয়ে অবস্থিত করিয়া, প্রস্থান করেন। ঐ গর্ভ, তাঁহার সহযোগে সম্ভূত বলিয়া, প্রচারিত ও পরিগণিত হয়। 'দ্বিতীয়, জামাতার আনয়নে কৃত- কাৰ্য্য হইতে না পারিলে, ব্যভিচারসহচরী ভ্রূণহত্যা দেবীর আরাধনা। এ অবস্থায়, এ ব্যতিরিক্ত নিস্তারের আর পথ নাই। তৃতীয় উপায় অতি সহজ, ও সাতিশয় কৌতুকজনক। তাহাতে অর্থব্যয়ও নাই, এবং ভ্রূণহত্যাদেবীর উপাসনাও করিতে হয় না। কন্যার জননী, অথবা বাটীর অপর গৃহিণী, একটি ছেলে কোলে করিয়া, পাড়ায় বেড়াইতে যান; এবং, একে একে প্রতিবেশীদিগের বাটীতে, গিয়া, দেখ মা, দেখ বোন, অথবা দেখ বাছা, এইরূপ সম্ভাষণ করিয়া, কথাপ্রসঙ্গে বলিতে আরম্ভ করেন, অনেক দিনের পর, কাল রাত্রিতে জামাই আসিয়াছিলেন; হঠাৎ আসিলেন, রাত্রিকাল, কোথায় কি পাব; ভাল করিয়া খাওয়াতে পারি নাই; অনেক বলিলাম, এক বেলা থাকিয়া, খাওয়া দাওয়া করিয়া যাও; তিনি কিছুতেই রহিলেন না; বলিলেন, আজ কোনও মতে থাকিতে পারিব না; সন্ধ্যার পরেই, অমুক গ্রান্ডমর মজুমদারদের বাটীতে একটা বিবাহ করিতে হইবেক; পরে, অমুক দিন, অমুক গ্রামের হালদারদের বাটীতেও বিবাহের কথা আছে; সেখানেও যাইতে হইবেক; যদি সুবিধা হয়, আসিবার সময়, এই দিক হইয়া যাইব। এই বলিয়া, ভোর ভোর চলিয়া গেলেন। স্বর্ণকে বলিয়াছিলাম, ত্রিপুরা ও কামিনীকে ডাকিয়া আন্; তারা, জামাইর সঙ্গে, খানিক আমোদ আহলাদ করিবেক। একলা যেতে পারিব না বলিয়া, ছুঁড়ী কিছুতেই এল না। এই বলিয়া, সেই দুই কন্যার দিকে চাহিয়া, বলিলেন, এবার জামাই এলে, মা তোরা যাস্, ইত্যাদি। এইরূপে, পাড়ার বাড়ী বাড়ী বেড়াইয়া, জামাতার আগমনবার্ত্ত। কীৰ্ত্তন করেন । পরে স্বর্ণমঞ্জরীর গর্ভসঞ্চার প্রচার হইলে, ঐ গর্ভ জামাতৃকৃত বলিয়া পরিপাক পায়।

এই সকল কুলীনমহিলার পুত্র হইলে, তাহারা দুপুরুষিয়া কুলীন বলিয়া গণনীয় ও পূজনীয় হয়। তাহাদের প্রতিপালন। ও উপনয়নান্ত সংস্কার সকল মাতুলদিগকে করিতে হয়। কুলীন পিতা কখনও তাহাঁদের কোনও সংবাদ লয়েন না ও তত্ত্বাবধান করেন না; তবে, অন্নপ্রাশন আড়ি সংস্কারের সময়, নিমন্ত্রণপত্র প্রেরিত হইলে, এবং কিছু লাভের আশ্বাস থাকিলে, আসিয়া আভ্যুদয়িক করিয়া যান। উপনয়নের পর, পিতার নিকট পুত্রের বড় আদর। তিনি সঙ্গতিপন্ন বংশজদিগের বাটীতে তাহার বিবাহ দিতে আরম্ভ করেন; এবং পণ, গণ প্রভৃতি দ্বারা বিলক্ষণ লাভ করিতে থাকেন। বিবাহের সময়, মাতুলদিগের কোনও কথা চলে না, ও কোনও অধিকার থাকে না। পুত্র যত দিন অল্প- বয়স্ক থাকে, তত দিনই পিতার এই লাভজনক ব্যবসায় চলে। তাহার চক্ষু ফুটিলে, তাঁহার ব্যবসায় বন্ধ হইয়া যায়।' তখন সে, আপন ইচ্ছায়, বিবাহ করিতে আরম্ভ করে; এবং, এই সকল বিবাহে পণ, গণ প্রভৃতি যাহা পাওয়া যায়, তাহা তাহারই লাভ, পিতা তাহাতে হস্তক্ষেপ করিতে পারেন না। কন্যাসন্তান জন্মিলে, তাহার নাড়ীচ্ছেদ অবধি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্য্যন্ত, যাবতীয় ক্রিয়া মাতুলদিগকেই সম্পন্ন করিতে হয়। কুলীনক্যার বিবাহ ব্যয়সাধ্য; এজন্য, পিতা এ বিবাহের সময় সে দিক দিয়া চলেন না। কুলীনভাগিনেয়ী যথাযোগ্য পাত্রে অর্পিতা না হইলে, বংশের গৌরবহানি হয়; এজন্য, মাতুলেরা, ভঙ্গকুলীনের কুল- মর্য্যাদার নিয়ম অনুসারে, ভাগিনেয়ীদের বিবাহকার্য্য নির্বাহ করেন। এই সকল ক্যারা, স্ব স্ব জননীর ন্যায়, নাম মাত্রে বিবাহিতা হইয়া, মাতুলালয়ে কালযাপন করেন।

কুলীনভগিনী ও কুলীনভাগিনেয়ীদের বড় দুর্গতি। তাঁহা- দিগকে, পিত্রালয়ে অথবা মাতুলালয়ে থাকিয়া, পাচিকা ও পরিচারিকা উভয়ের কর্ম্ম নির্বাহ করিতে হয়। পিতা যত দিন জীবিত থাকেন, তত দিন কুলীনমহিলার নিতান্ত দুরবস্থা ঘটে না। পিতার দেহাত্যয়ের পর, ভ্রাতারা সংসারের কর্তা হইলে, তাঁহারা অতিশয় অপদস্থ হন। প্রখরা ও মুখরা ভ্রাতৃভার্য্যারা তাঁহাদের উপর, যার পর নাই, অত্যাচার করেন। প্রাতঃকালে নিদ্রাভঙ্গ, রাত্রিতে নিদ্রাগমন, এ উভয়ের অন্তর্বর্তী দীর্ঘ কাল, উৎকট পরিশ্রম সহকারে, সংসারের সমস্ত কার্য্য করিয়াও তাঁহারা, সুশীলা, ভ্রাতৃভার্য্যাদের নিকট, প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারেন না। ভ্রাতৃভার্য্যারা, সর্বদাই, তাঁহাদের উপর খড়গহস্ত। তাঁহাদের অশ্রুপাতের বিশ্রাম নাই বলিলে, বোধ হয়, অত্যুক্তি- দোষে দূষিত হইতে হয় না। অনেক সময়, লাঞ্ছনা সহ্য করিতে না পারিয়া, প্রতিবেশীদিগের বাটীতে গিয়া, অশ্রুবিসর্জন করিতে 'করিতে, তাঁহারা আপন অদৃষ্ট্রের দোষকীৰ্ত্তন ও কৌলীন্যপ্রথার গুণকীর্ত্তন করিয়া থাকেন; এবং, পৃথিবীর মধ্যে কোথাও স্থান থাকিলে চলিয়া যাইতাম, আর ও বাড়ীতে মাথা গলাইতাম না, এইরূপ বলিয়া, বিলাপ ও পরিতাপ করিয়া, মনের আক্ষেপ মিটান। উত্তরসাধকের সংযোগ ঘটিলে, অনেকানেক বয়স্থা কুলীনমহিলা, যন্ত্রণাময় পিত্রালয় ও মাতুলালয় পরিত্যাগ করিয়া, বারাঙ্গনাবৃত্তি অবলম্বন করেন।

ফলকথা এই, কুলীনমহিলাদিগের যন্ত্রণার পরিসীমা নাই। যাঁহারা, কখনও, তাঁহাদের অবস্থার বিষয়ে দৃষ্টিপাত করিয়াছেন, তাঁহারাই বুঝিতে পারিয়াছেন, ঐ হতভাগা নারীদিগকে কত ক্লেশে কালযাপন করিতে হয়। তাঁহাদের যন্ত্রণার বিষয় চিন্তা করিলে, হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যায়; এবং, যে হেতুতে তাঁহাদিগকে ঐ সমস্ত দুঃসহ ক্লেশ ও যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইতেছে, তাহা বিবেচনা করিয়া দেখিলে, মনুষ্যজাতির উপর অত্যন্ত অশ্রদ্ধা জন্মে। এক পক্ষের অমূলক অকিঞ্চিৎকর গৌরবলাভলোভ, অপর পক্ষের কিঞ্চিৎ অর্থলাভলোভ, সমস্ত অনর্থের মূল কারণ; আর, এ উভয় পক্ষ ভিন্ন, দেশস্থ যাবতীয় লোকের এ বিষয়ে ঔদান্ত অবলম্বন উহার সহকারী কারণ। যাঁহাদের দোষে কুলীনকন্যাদের এই দুরবস্থা, যদি তাঁহাদের উপর সকলে অশ্রদ্ধা ও বিদ্বেষ প্রদর্শন করিতেন, তাহা হইলে, ক্রমে এই অসঙ্গ অত্যাচারের নিবারণ হইতে পারিত। অশ্রদ্ধা ও বিদ্বেষের কথা দূরে থাকুক, অতাচারকারীরা দেশস্থ লোকের নিকট, যার পর নাই, মাননীয় ও পূজনীয়। এমন স্থলে, রাজদ্বারে আবেদন ভিন্ন, কুলীনকামিনীদিগের দুরবস্থাবিমোচনের কি উপায় হইতে পারে। পৃথিবীর কোনও প্রদেশে, স্ত্রীজাতির ঈদৃশী দুরবস্থা দেখিতে পাওয়া যায় না। যদি ধৰ্ম্ম থাকেন, রাজা বল্লালসেন ও দেবীবর' ঘটকবিশারদ, নিঃসন্দেহ, নরকগামী হইয়াছেন। ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশে, এবং পৃথিবীর অপরাপর প্রদেশেও, বহুবিবাহ- প্রথা প্রচলিত আছে। কিন্তু, তথায় বিবাহিতা নারীদিগকে, এতদ্দেশীয় কুলীনকামিনীদের মত, দুর্দ্দশায় কালযাপন করিতে হয় না। তাহারা স্বামীর গৃহে বাস করিতে পায়; স্বামীর অবস্থানুরূপ গ্রাসাচ্ছাদন পায়; এবং, পৰ্য্যায় ক্রমে, স্বামীর সহবাসও লাভ করিয়া থাকে। স্বামিগৃহবাস, স্বামিসহবাস, স্বামিদত্ত গ্রাসাচ্ছাদন কুলীনকন্যাদের স্বপ্নের অগোচর।

এ দেশের ভঙ্গকুলীনদের মত, পাষণ্ড ও পাতকী ভূমণ্ডলে নাই। তাঁহারা দয়া, ধৰ্ম্ম, চক্ষুলজ্জা, ও লোকলজ্জায় একবারে বর্জিত। তাঁহাদের চরিত্র আত বিচিত্র। চরিত্র বিষয়ে তাঁহাদের উপমা দিবার স্থল নাই। তাঁহারাই তাঁহাদের এক মাত্র উপমা- স্থল। কোনও প্রধান ভঙ্গকুলীনকে কেহ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, ঠাকুরদাদা মহাশয়! আপনি অনেক বিবাহ করিয়াছেন, সকল স্থানে যাওয়া হয় কি। তিনি অম্লান মুখে উত্তর করিলেন, যেখানে ভিজিট (১) পাই, সেই খানে যাই। গত দুর্ভিক্ষের সময়, এক জন ভঙ্গকুলীন অনেকগুলি বিবাহ করেন। তিনি লোকের নিকট আস্ফালন করিয়াছিলে, এই দুর্ভিক্ষে কত লোক অন্নাভাবে মারা পড়িয়াছে; কিন্তু, আমি কিছুই টের পাই নাই; বিবাহ করিয়া সচ্ছন্দে দিনপাত করিয়াছি।-গ্রামে বারোয়ারিপূজার উ্যোগ হইতেছে। পূজার উদ্ব্যোগীরা, ঐ বিষয়ে চাঁদা দিবার জন্য, কোমও ভঙ্গকুলীনকে পীড়াপীড়ি করাতে, তিনি, চাঁদার টাকা সংগ্রহের জন্য, একটি বিবাহ করিলেন।- বিবাহিতা স্ত্রী স্বামীর সমস্ত পরিবারের ভরণপোষণের উপযুক্ত অর্থ লইয়া গেলে, কোনও ভঙ্গকুলীন, দয়া করিয়া, তাঁহাকে আপন আবাসে অবস্থিতি করিতে অনুমতি প্রদান করেন; কিন্তু, সেই অর্থ নিঃশেষ হইলেই, তাঁহাকে বাটী হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দেন।-পুত্রবধুর ঋতুদর্শন হইয়াছে। সে যাঁহার কন্যা, তাঁহার নিতান্ত ইচ্ছা, জামাতাকে আনাইয়া, কন্যার পুনর্বিবাহ- সংস্কার নির্ব্বাহ করেন। পত্র দ্বারা বৈবাহিককে আপন প্রার্থনা জানাইলেন। বৈবাহিক, তদীয় পত্রের উত্তরে, অধিক টাকার দাওয়া করিলেন। কন্যার পিতা তত টাকা দিতে অনিচ্ছু বা অসমর্থ হওয়াতে, তিনি পুভ্রকে শ্বশুরালয়ে যাইতে দিলেন না; সুতরাং পুত্রবধুর পুনর্বিবাহসংস্কার এ জন্মের মত স্থগিত রহিল।-বহুকাল স্বামীর মুখ দেখেন নাই; তথাপি কোনও ভঙ্গকুলীনের ভার্য্যা, ভাগ্যক্রমে, "গর্ভবতী হইয়াছিলেন। ব্যভি- চারিণী ক্যাকে গৃহে রাখিলে, জ্ঞাতিবর্গের নিকট অপদস্থ ও সমাজচ্যুত হইতে হয়; এজন্য, তাহাকে গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করা পরামর্শ স্থির হইলে, তাহার হিতৈষী আত্মীয়, এই সর্বনাশ নিবারণের অন্য কোনও উপায় দেখিতে না পাইয়া, অনেক চেষ্টা করিয়া, তদীয় স্বামীকে আনাইলেন। এই মহাপুরুষ, অর্থলাভে চরিতার্থ হইয়া, সব সমক্ষে স্বীকার করিলেন, রত্ন- মঞ্জরীর গর্ভ আমায়ু সহযোগে সম্ভত হইয়াছে।

ভঙ্গকুলীনের চরিত্র বিষয়ে, এ স্থলে, একটি অপূর্ব্ব উপাখ্যান কীর্ত্তিত হইতেছে। কোনও ব্যক্তি, মধ্যাহ্ন কালে, বাটীর মধ্যে আহার করিতে গেলেন; দেখিলেন, যেখানে আহারের স্থান হইয়াছে, তথায় দুটি অপরিচিত স্ত্রীলোফ বসিয়া আছেন। একটির বয়ঃক্রম প্রায় ৬০ বৎসর, দ্বিতীয়াটির বয়ঃক্রম ১৮, ১৯ বৎসর। তাঁহাদের আকার ও পরিচ্ছদ দুরবস্থার একশেষ প্রদর্শন করিতেছে; তাঁহাদের মুখে বিষাদ ও হতাশতার সম্পূর্ণ লক্ষণ সুস্পষ্ট লক্ষিত হইতেছে। ঐ ব্যক্তি স্বীয় জননীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মা ইঁহারা কে, কি জন্যে এখানে বসিয়া আছেন। তিনি বৃদ্ধার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কহিলেন, ইনি চট্ট রাজের স্ত্রী, এবং অল্পবয়স্কাকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, এটি তাঁহার কন্যা। ইঁহারা, তোমার কাছে, আপনাদের দুঃখের পরিচয় দিবেন বলিয়া, বসিয়া আছেন।

চট্টরাজ দুপুরুষিয়া ভঙ্গকুলীন; ৫, ৬ টি বিবাহ করিয়া- ছেন। তিনি ঐ ব্যক্তির নিকট মাসিক বৃত্তি পান; এজন্য, তাঁহার যথেষ্ট খাতির রাখেন। তাঁহার ভগিনী, ভাগিনেয়, ও ভাগিনেয়ীরা তাঁহার বাটীতে থাকেন; তাঁহার কোনও স্ত্রীকে কেহ কখনও তাঁহার বাটীতে অবস্থিতি করিতে দেখেন নাই।

সেই দুই স্ত্রীলোকের আকার ও পরিচ্ছদ দেখিয়া, ঐ ব্যক্তির অন্তঃকরণে অতিশয় দুঃখ উপস্থিত হইল। তিনি, আহাম বন্ধ করিয়া তাঁহাদের উপাখ্যান শুনিতে বসিলেন। বৃদ্ধা কহিলেন, আমি চট্টরাজের ভার্য্যা; এটি তাঁহার কন্যা, আমার গর্ভে জন্মিয়াছে। আমি পিত্রালয়ে থাকিতাম। কিছু দিন হইল, আমার পুত্র কহিলেন, মা, আমি তোমাদের দুজনকে অন্ন বস্ত্র দিতে পারিব না। আমি বলিলাম, বাছা বল কি; আমি তোমার মা, ও তোমার ভগিনী; তুমি অম্ল না দিলে, আমরা কার কাছে যাইব। তুমি এক জনকে অন্ন দিবে, আর এক জন কোথায় যাইবেক; পৃথিবীতে অন্ন দিকার লোক আর কে আছে। এই কথা শুনিয়া, পুত্র কহিলেন, তুমি মা, তোমায় অন্ন বস্ত্র, যেরূপে পারি, দিব; উহার ভার আমি আর লইতে পারিব না। আমি রাগ করিয়া বলিলাম, তুমি কি উহাকে বেশ্যা হইতে বল। পুত্র কহিলেন, আমি তাহা জানি না; তুমি উহার বন্দোবস্ত কর। এই বিষয় লইয়া, পুত্রের সহিত আমার বিষম মনান্তর ঘটিয়া উঠিল; এবং, অবশেষে, আমায় কন্যা সহিত বাটী হইতে বহির্গত হইতে হইল।

কিছু দিন পূর্ব্বে শুনিয়াছিলাম, আমার এক মাস্তত ভগিনীর বাটীতে একটি পাচিকার প্রয়োজন আছে। আমরা উভয়ে ঐ পাচিকার কর্ম্ম করিব, মনে মনে এই স্থির করিয়া, তথায় উপ- স্থিত হইলাম। কিন্তু, আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে, ২, ৪ দিন পূর্ব্বে, তাঁহারা পাচিকা নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তখন, নিতান্ত হতাশ্বাস হইয়া, কি করি, কোথায় যাই, এই চিন্তা করিতে লাগিলাম। অমুক গ্রামে আমার স্বামীর এক সংসার আছে, তাহার গর্ভজাত সন্তান, চটের কারবার করিয়া, বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন হইয়াছেন; তাঁহার দয়া ধর্ম্মও আছে। ভারিলাম, যদিও আমি বিমাতা, এ বৈমাত্রেয় ভগিনী; কিন্তু, তাঁহার শরণাগত হইয়া দুঃখস্থানাইলে, অবশ্য দয়া করিতে পারেন। এই ভাবিয়া, অবশেষে, তাঁহার ** নিকটে উপস্থিত হইলাম, এবং সমস্ত কহিয়া, কাঁদিতে কাঁদিতে, তাঁহার হস্তে ধরিয়া বলিলাম, বাবা, তুমি দয়া না করিলে, আমাদের আর গতি নাই।

আমার কাতরতা দর্শনে, সপত্নীপুত্র হইয়াও, তিনি যথেষ্ট স্নেহ ও দয়া প্রদর্শন করিলেন, এবং কহিলেন, যত দিন তোমরা বাঁচিবে, তোমাদের ভরণপোষণ করিব। এই আশ্বাসবাক্য শ্রবণে, আমি আহলাদে গদগদ হইলাম। আমার চক্ষুতে জলধারা বহিতে লাগিল। তিনি যথোচিত যত্ন করিতে লাগিলেন। কিন্তু, তাঁহার বাটীর স্ত্রীলোকেরা সেরূপ নহেন। এ আপদ আবার কোথা হইতে উপস্থিত হইল, এই বলিয়া, তাঁহারা, যার পর নাই, অনাদর ও অপমান করিতে লাগিলেন। সপত্নীপুত্র ক্রমে ক্রমে সবিশেষ সমস্ত অবগত হইলেন; কিন্তু, তাঁহাদের অত্যাচার নির্ধারণ করিতে পারিলেন না। এক দিন, আমি তাঁহার নিকটে গিয়া সমুদয় বলিলাম। তিনি কহিলেন, মা, আমি সমস্ত জানিতে পারিয়াছি; কিন্তু, কোনও উপায় দেখি- তেছি না। আপনারা কোনও স্থানে গিয়া থাকুন; মাস মাস, আমার নিকট লোক পাঠাইবেন; আমি আপনাদিগকে কিছু কিছু দিব।

এই রূপে নিরাশ্বাস হইয়া, কন্যা লইয়া, তথা হইতে বহির্গত হইলাম। পৃথিবী অন্ধকারময় বোধ হইতে লাগিল। অবশেষে ভাবিলাম, স্বামী বর্তমান আছেন, তাঁহার নিকটে যাই, এবং দুরবস্থ। জানাই, যদি তাঁহার দয়া হয়। এই স্থির করিয়া, পাঁচ সাত দিন হইল, এখানে আসিয়াছিলাম। আজ তিনি স্পষ্ট জবাব দিস, আমি তোমাদিগকে এখানে রাখিতে, বা অন্ন বস্ত্র দিতে তাঁহারব না। অনেকে বলিল, তোমায় জানাইলে, কোনও কাশ ছুঁইতে পারে; এজন্য, এখানে আসিয়া বসিয়া আছি।

ঐ ব্যক্তি শুনিয়া ক্রোধে ও দুঃখে অতিশয় অভিভূত হইলেন, এবং অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, তিনি, চট্টরাজের বাটীতে গিয়া, যথোচিত ভৎসনা করিয়া বলিলেন, আপনকার আচরণ দেখিয়া, আমি চমৎকৃত হইয়াছি। আপনি, কোন বিবেচনায়, তাঁহাদিগকে বাটী হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিতেছেন। আপনি তাঁহাদিগকে বাটীতে রাখিবেন কি না, স্পষ্ট বলুন। ঐ ব্যক্তির ভাবভঙ্গী দেখিয়া, বৃত্তিভোগী চট্টরাজ ভয় পাইলেন, এবং কহিলেন, তুমি বাটীতে যাও, আমি ঘরে বুঝিয়া পরে তোমার নিকটে যাইতেছি।

অপরাহ্ণ কালে, চট্টরাজ ঐ ব্যক্তির নিকটে আসিয়া বলিলেন, যদি তুমি তাহাদের হিসাবে, মাস মাস, কিছু দিতে সম্মত হও, তাহা হইলে আমি তাহাদিগকে বাটীতে রাখিতে পারি। ঐ ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ স্বীকার করিলেন, এবং তিন মাসের দেয় তাঁহার হস্তে দিয়া কহিলেন, এই রূপে তিন তিন মাসের টাকা আগামী দিব; এতদ্ভিন্ন, তাঁহাদের পরিধেয় বস্ত্রের ভার আমার উপর রহিল। আর কোনও ওজর করিতে না পারিয়া, নিরুপায় হইয়া, চট্টরাজ, স্ত্রী ও কন্যা লইয়া, গৃহ প্রতিগমন করিলেন। তিনি নিজে দুঃশীল লোক নহেন। কিন্তু, তাঁহার ভগিনীরা দুদ্দান্ত দস্যু; তাঁহাদের ভয়ে ও তাঁহাদের পরামর্শে, তিনি স্ত্রী ও কন্যাকে পূর্বোক্ত নির্ঘাত জবাব দিয়া- ছিলেন। বৃত্তিদাতা ক্রুদ্ধ হইয়াছেন, এবং মাসিক আর কিছু দিবার অঙ্গীকার করিয়াছেন, এই কথা শুনিয়া, ভগিনীরাও অগত্যা সম্মত হইলেন। চট্টরাজ, কখনও, কোনও স্ত্রীকে আনিয়া নিকটে রাখিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলে, ভগিনীরা খড়গহস্ত হইয়া উঠিতেন। সেই কারণে, তিনি কস্মিন্ কালেও, আপন অভিপ্রায় সম্পন্ন করিতে পারেন নাই। ভঙ্গকুলীনদিগের ভগিনী, ভাগিনেয়, ও ভাগিনেয়ীরা পরিবারস্থানে পরিগণিত; স্ত্রী, পুত্র, কন্যা প্রভৃতির সহিত তাঁহাদের কোনও সংস্রব থাকে না।

যাহা হউক, ঐ ব্যক্তি, পূর্বোক্ত ব্যবস্থা করিয়া দিয়া, স্থানা- স্তরে গেলেন, এবং যথাকালে অঙ্গীকৃত মাসিক দেয় পাঠাইতে লাগিলেন। কিছু দিন পরে, বাটীতে গিয়া, তিনি, সেই দুই হতভাগা নারীর বিষয়ে, অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন, চট্টরাজ ও তাঁহার ভগিনীরা স্থির করিয়াছিলেন, বৃত্তিদাতার অঙ্গীকৃত নূতন মাসিক দেয় পুরাতন মাসিক বৃত্তির অন্তর্গত হইয়াছে; আর তাহা কোনও কারণে রহিত হইবার নহে; তদনুসারে, চট্টরাজ, ভগিনীদের উপদেশের অনুবর্তী হইয়া, স্ত্রী ও কন্যাকে বাটী হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিয়াছেন; তাঁহারাও, গত্যন্তরবিহীন হইয়া, স্থানান্তরে গিয়া, অবস্থিতি করিতেছেন। কন্যাটি সুশ্রী ও বয়স্থা, বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছেন; এবং, জননীর সহিত, সচ্ছন্দে দিনপাত করিতেছেন।

এই উপাখ্যানে ভঙ্গকুলীনের আচরণের যেরূপ পরিচয় পাওয়া যাইতেছে, অতি ইতর জাতিতেও সেরূপ লক্ষিত হয় না। প্রথমতঃ, এক মহাপুরুষ বৃদ্ধ মাতা ও বয়স্থা ভগিনীকে বাটী হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন। পরে, তাঁহারা স্বামী ও পিতার শরণাগত হইলে, সে মহাপুরুষও তাঁহাদিগকে বাটী হইতে বহিষ্কৃত করিলেন। এক ব্যক্তি, দয়া করিয়া, সেই দুই দুর্ভগার গ্রাসাচ্ছাদনের ভারবহনে অঙ্গীকৃত হইলেন, তাহাতেও স্ত্রী ও কন্যাকে বাটীতে রাখা পরামর্শসিদ্ধ হইল না। স্বামী ও উপযুক্ত পুত্র সত্ত্বে, কোনও ভদ্রগৃহে, বৃদ্ধা স্ত্রীর কদাচ এরূপ দুর্গতি ঘটে না। পিতা ও উপযুক্ত ভ্রাতা বিজ্ঞমান থাকিতে, কোনও ভদ্রগৃহের কন্যাকে, নিতান্ত অনাায় ন্যায়, অন্নবস্ত্রের নিমিত্ত, বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করিতে হয় না। ঐ কন্যার স্বামীও বিদ্যমান আছেন কিন্তু, তাঁহাকে এ বিষয়ে অপরাধী করিতে পারা যায় না। তিনি স্বকৃতভঙ্গ কুলীন। যাহা হউক, আশ্চর্য্যের বিষয় এই, ঈদৃশ, দোষে দূষিত হইয়াও, চট্টরাজ ও' তাঁহার উপযুক্ত পুত্র লোক সমাজে হেয় বা অশ্রদ্ধেয় হইলেন না।

ভঙ্গকুলীনের কুল, চরিত্র প্রভৃতির পরিচয় প্রদত্ত হইল। এক্ষণে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, এক ব্যক্তি অনেক বিবাহ করিতে না পারিলে, ঈদৃশ কুলীনের অপকার বা মানহানি ঘটিবেক, এই অনুরোধে, বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত থাকা উচিত ও আবশ্যক কি না। প্রথমতঃ, মেলবন্ধনের পূর্ব্বে, তাঁহাদের পুরাতন কুল এককালে নির্মূল হইয়া গিয়াছে; তৎপরে, বংশজকন্যাপরিণয় দ্বারা, পুনরায়, তদীয় কপোলকল্পিত নূতন কুলের লোপাপত্তি হইয়াছে। এইরূপে, দুই বার, যাঁহাদের কুলোচ্ছেদ ঘটিয়াছে, তাঁহাদিগকে কুলীন বলিয়া গণ্য করিবার, এবং তদীয় শশবিষাণসদৃশ কুলমর্য্যাদার আদর করিবার, কোনও কারণ বা প্রয়োজন লক্ষিত হইতেছে না; তাঁহাদের অবৈধ, নৃশংস, লজ্জাকর আচরণ দ্বারা, সংসারে যেরূপ গরীয়সী অনিষ্টপরম্পরা ঘটিতেছে, তাহাতে তাঁহাদিগকে মনুষ্য বলিয়া গণনা করা উচিত নয়। বোধ হয়, এক উদ্যমে, • তাঁহাদের সমূলে উচ্ছেদ করিলে, অধৰ্ম্মগ্রন্ত হইতে হয় না। সে বিবেচনায়, তদীয় অকিঞ্চিৎকর কপোলকল্পিত কুলমর্য্যাদার হানি অতি সামান্য কথা। যাহা হউক, তাঁহাদের কুলক্ষয় হইয়াছে, সুতরাং তাঁহারা কুলীন নহেন; তাঁহারা কুলীন নহেন, সুতরাং তাঁহাদের কৌলীন্যমর্য্যাদা নাই; তাঁহাদের কৌলীন্য- মর্য্যাদা নাই, সুতরাং, বহুবিবাহ প্রথা নিবারণ দ্বারা, কৌলীন্ত- মর্য্যাদার উচ্ছেদসম্ভাবনাও নাই।

এ স্থলে ইহা উল্লেখ করা আবশ্যক, এরূপ কতকগুলি ভঙ্গকুলীন আছেন, যে বিবাহব্যরসায়ে তাঁহাদের যৎপরোনাস্তি দ্বেষ। তাঁহারা বিবাহব্যবসায়ীদিগকে অতিশয় হেয় জ্ঞান করেন। নিজে, প্রাণাস্তেও, একাধিক বিবাহ করিতে সম্মত নহেন; এবং, যাহাতে এই কুৎসিত প্রথা রহিত হইয়া যায়, সে বিষয়েও চেষ্টা করিয়া থাকেন। উভয়বিধ ভঙ্গকুলীনের আচরণ পরস্পর এত বিভিন্ন, যে তাঁহাদিগকে এক জাতি বা এক সম্প্রদায়ের লোক বলিয়া, কোনও ক্রমে, প্রতীতি জন্মে না। দুর্ভাগ্য ক্রমে, উক্তরূপ ভঙ্গকুলীনের সংখ্যা অধিক নয়। যাহা হউক, তাঁহাদের ব্যবহার দ্বারা, বিলক্ষণ প্রতিপন্ন হইতেছে, বিবাহব্যবসায় পরিত্যাগ, ভঙ্গকুলীনের পক্ষে, নিতান্ত দুরূহ বা অসাধ্য ব্যাপার নহে। চতুর্থ আপত্তি।''

কেহ কেহ আপত্তি করিতেছেন, কিছু কাল পূর্বে, এ দেশে কুলীন ব্রাহ্মণদিগের অত্যাচার ছিল। তখন, অনেকে অনেক বিবাহ করিতেন। এখন, এ দেশে সে অত্যাচারের প্রায় নিবৃত্তি হইয়াছে; যাহা কিছু অবশিষ্ট আছে, অল্প দিনের মধ্যেই, তাহার সম্পূর্ণ নিবৃত্তি হইবেক। এমন স্থলে, বহু বিবাহের নিবারণ বিষয়ে রাজশাসন নিতান্ত নিষ্প্রয়োজন।

• এক্ষণে কুলীনদিগের পূর্ববৎ অত্যাচার নাই, এই নির্দেশ সম্পূর্ণ প্রতারণা বাক্য; অথবা, যাঁহারা সেরূপ নির্দেশ করেন, কুলীনদিগের আচার ও ব্যবহার বিষয়ে, তাঁহাদের কিছু মাত্র অভিজ্ঞতা নাই। পূর্বে, বিবাহ বিষয়ে, কুলীনদিগের যেরূপ অত্যাচার ছিল, এক্ষণেও তাঁহাদের তদ্বিষয়ক অত্যাচার সর্বতো- ভাবে, তদবস্থই আছে; কোনও অংশে, তাহার নিবৃত্তি হইয়াছে, এরূপ বোধ হয় না। এ বিষয়ে বৃথা বিতণ্ডা না করিয়া, কতকগুলি বর্তমান কুলীনের দাম, বয়স, বাসস্থান, ও বিবাহসংখ্যার পরিচয় প্রদত্ত হইতেছে।

হুগলী জিলা।

নাম

ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

ভগবান্ চট্টোপাধ্যায়

পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

বয়স

৫৫

বিবাহ

৮০

৭২ ৬৪

৬২

৫৫

বাসস্থান

বসো

দেশমুখো

চিত্রশালি

নাম

মধুসূদন মুখোপাধ্যায়

বিবাহ

বয়স

বাসস্থান

৫৬

চিত্রশালি

তিতুরাম গাঙ্গুলি

৫৫

१०

রামময় মুখোপাধ্যায়

৫২

৫০

তাজপুর

বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়

শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায় নবকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

৫০

৬০

ভুঁইপাড়া

৫০০

৬০

পাখুড়া

৫০

৫২

ক্ষীরপাই

ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

88

৫২

আঁকড়িশ্রীরামপুর

যদুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

৪১

89

চিত্রশালি

শিবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

৪৫

তীর্ণা

রামকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

৫০

কোননগর

ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়

৫৫

দণ্ডিপুর

নবকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

৩৬

88

গৌরহাটী

রঘুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

৩০

খামারগাছী

শশীশেখর মুখোপাধ্যায়

৩০

৬০

তারাচরণ মুখোপাধ্যায় ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

৩০

৩৫

বরিজহাটী

২৮

80

গুড়প

শ্রীচরণ মুখোপাধ্যায়

২৭

সাঙ্গাই

কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়

২৫

80

খামারগাছি

ভবনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় মহেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

২৩

80

জাঁইপাড়া

গিরিশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রসন্নকুমার চট্টোপাধ্যায়

পার্বতীচরণ মুখোপাধ্যায়

যদুনাথ মুখোপাধ্যায়

২২

৩৫

খামারগাছি

২২ ৩৪

কুচুণ্ডিয়া

২১

৩৫

কাপসীট-

২০

80

ভৈটে

২০

৩৭

মাহেশ

নাম

কৃষ্ণপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

বিবাহ

বয়স

বাসস্থান

২০

বসন্তপুর

হরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

২০

80

রঞ্জিতবাটী

রমানাথ চট্টোপাধ্যায়

২০

৫০

গরলগাছা

অন্নদাচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

২০

৪৫

ভৈটে

দীননাথ চট্টোপাধ্যায়

*৩৯

২৮

বসন্তপুর

রামরত্ন মুখোপাধ্যায়

১৭

৪৮

জয়রামপুর.

কেদারনাথ মুখোপাধ্যায়

১৭

৩২

মাহেশ

দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়

১৬

২০

চিত্রশালি

গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

১৬

৩৫

মহেশ্বরপুর

অভয়চরণ বন্দ্যোপাধ্যায়

১৫

৩০

মালিপাড়া

অন্নদাচরণ মুখোপাধ্যায়

১৫

৩৫

• গোয়াড়া

শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়

১৫

৩৫

সোঁতিয়া

জগচ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়

১৫

খামারগাছী

অঘোরনাথ মুখোপাধ্যায় হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়

১৫

৩৬

ভুঁইপাড়া

১৫

৩২

মোগলপুর

ননীগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়

১৫

২৪

পাতা

যদুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

১৫

২২

দীননাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

১৫

২৫

বেলেসিকরে

ভুবনমোহন মুখোপাধ্যায়

১৫

২০

ভৈটে

কালীপ্রসাদ গাঙ্গুলি

১৫

৪৫

পশপুর

সূর্য্যকান্ত মুখোপাধ্যায়

৯৫

৩৫

রামকুষ্মার মুখোপাধ্যায় কৈলাসচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

১৪

৩২

ক্ষীরপাই

১৪

৪৫

মধুখণ্ড

কালীকুমার মুখোপাধ্যায়

১৪

২১

সিয়াখালা

নাম

শ্যামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়

বিবাহ

বয়স

বাসস্থান

১৫

৫০

চুঁচুড়া

মাধবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

১৩

৫০

হরিশ্চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

১৩

গরলগাছা

কার্তিকেয় মুখোপাধ্যায়

১২

৩০

দেওড়া

যদুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

L

৩০

তাঁতিসাল

মোহিনীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ১২

৩০

মালিপাড়া

সাতকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়

১২

ব্রজরাম চট্টোপাধ্যায়

১২

২৫

চন্দ্রকোনা

কৈলাসচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

১২

৩২

কৃষ্ণনগর

রামতারক বন্দ্যোপাধ্যায়

১২

২৮

জয়রামপুর

কালিদাস মুখোপাধ্যায়

১২

80

ভুঁইপাড়া

বিশ্বস্তর মুখোপাধ্যায়

১২

৩০

বলাগড়

তিতুরাম মুখোপাধ্যায়

১২

নতিবপুর

প্রসন্নকুমার গাঙ্গুলি

১২

৩৬

গজা

মনসারাম চট্টোপাধ্যায়

১১

৬৫

ভঞ্জপুর

আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়

১১

১৮

তাঁতিসাল

প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়

১১

৩০

লক্ষ্মীনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

১০

২৫

গরলগাছা

বিজ্ঞাবতীপুর

শিবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

১০

৪৫

কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

১০

৩০ 80

ভৈটে

রামকমল মুখোপাধ্যায়

১০

নিত্যানন্দপুর

কালীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

১০

২৮

বৈঁচী

দ্বারকানাথ মুখোপাধ্যায়

১০

২৫

মতিলাল মুখোপাধ্যায়

১০

৪৫

ঐ নাম

ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

• বিবাহ

বয়স

বাসস্থান

১০

৪৫

ধসা

দুর্গারাম বন্দ্যোপাধ্যায় ১০

৫০

শ্যামবাটী

যজ্ঞেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রসন্নকুমার চট্টোপাধ্যায় ১০

১০

৪৫

আনুড়

৩৫

বেঙ্গাই

চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় • ۰,১০

৩০

বৈতল

প্রতাপচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ১০

80

বসন্তপুর

কৈলাসচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

১০

80

সিয়াখালা

রামচাঁদ মুখোপাধ্যায়

৩৬

যদুপুর

কৈলাসচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

৩০

নপাড়া

সূর্য্যকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

৮ ৮ ৪৫

গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় চুনিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়

b

৩২

কালীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

80

মোল্লাই

গণেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় দিগম্বর বন্দ্যোপাধ্যায়

দেওড়া

৩৫

গুড়প

.

কালিদাস মুখোপাধ্যায়

80

মালিপাড়া

যাদবচন্দ্র গাঙ্গুলি

৩৫

বহরকুলী

মাধবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

২৫

সিকরে

কেদারনাথ মুখোপাধ্যায়

৩২

বরিজহাটী

ঈশ্বরচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

৪৫

পাতুল

শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়

৪৫

জয়রামপুর

হরিশ্চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

৬০

শ্যামবাটী

রামচাঁদ চট্টোপাধ্যায়

80

ভঞ্জপুর

ঈশ্বরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

৩২

قلمনাম

দিগম্বর মুখোপাধ্যায়,

বিবাহ

বয়স

বাসস্থান

৩৬ রত্নপুর

কুড়ারাম মুখোপাধ্যায় দুর্গাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

৩২

নতিবপুর

৬২

মথুরা

বৈকুন্ঠনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

৩৪

বসন্তপুর ভুরসুবা।

শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায়

৩৫

রামসুন্দর মুখোপাধ্যায়

৫০

আঁটপুর

বেণীমাধব গাঙ্গুলি

৫০

চিত্রশালি

শ্যামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়

৩০

মোগলপুর

নবকুমার মুখোপাধ্যায়

২২

চন্দ্রকোনা

যদুনাথ মুখোপাধ্যায় চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ৬ ৩০

৩০

বাখরচক

বসন্তপুর

উমাচরণ চট্টোপাধ্যায়

80

রঞ্জিতবাটী

উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

২৬

নন্দনপুর

গঙ্গানারায়ণ মুখোপাধ্যায়

৩০

গৌরহাটী

ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

৩২

পশপুর

কালাচাঁদ মুখোপাধ্যায় ৫ মনসারাম চট্টোপাধ্যায় ৫

৫০

সুলতানপুর

৪৫

তারকেশ্বর

গঙ্গানারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়

২২

আমড়াপাট

বিশ্বম্ভর মুখোপাধ্যায়

80

বালিগোড়

ঈশ্বরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

৩৫

তারকেশ্বর

মাধবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

80

তালাই

ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়

২৬

টেকর

হরশম্ভু বন্দ্যোপাধ্যায়

80

মাজু

নীলাম্বর বন্দ্যোপাধ্যায়

৩২

সন্ধিপুর

নাম

বয়স,

বিবাহ

বাসস্থান

বালিডাঙ্গা

কালিদাস মুখোপাধ্যায়

ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

দ্বারকানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

৩৬

গৌরাঙ্গপুর

৩০

কৃষ্ণনগর

সীতারাম মুখোপাধ্যায়

৩৫

চন্দ্রকোনা

রামধন মুখোপাধ্যায়

নবকুমার মুখোপাধ্যায়

ধৰ্ম্মদাস মুখোপাধ্যায়

সূর্য্যকুমার মুখোপাধ্যায়

চন্দ্রকোনা

বরদা

নারীট

বরদা

শরচ্চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

নপাড়া

দণ্ডিপুর

৪৩

৩৫

২৬

১৯

১৮

অনুসন্ধান দ্বারা যত দূর ও যেরূপ জানিতে পারিয়াছি, তদনুসারে কুলীনদিগের বিবাহসংখ্যা প্রভৃতি প্রদর্শিত হইল। সবিশেষ অনুসন্ধান করিলে, আরও অনেক বহুবিবাহকারীর নাম পাওয়া যাইতে পারে। ৪, ৩,২ বিবাহ করিয়াছেন, এরূপ ব্যক্তি অনেক; বাহুল্যভয়ে, এ স্থলে তাঁহাদের নাম নির্দিষ্ট হইল না। হুগলী জিলাতে বহুবিবাহকারী কুলীনের যত সংখ্যা, বর্দ্ধমান, নবদ্বীপ, যশর, বরিসাল, ঢাকা প্রভৃতি জিলাতে তাহা অপেক্ষা ন্যূন নহে; বরং, কোনও জিলায় তাদৃশ কুলীনের সংখ্যা অধিক। কুলীনদিগের বিবাহের যে সংখ্যা প্রদর্শিত হইল, তাহা ন্যূনাধিক হইবার সম্ভাবনা। যাঁহারা অধিকসংখ্যক বিবাহ করিয়াছেন, তাঁহারা নিজেই স্বকৃত বিবাহের প্রকৃত সংখ্যা অবধারিত বলিতে পারেন না। সুতরাং, অন্যের তাহা অবধারিত জানিতে পারা সহজ নহে। বিবাহের যে সকল সংখ্যা নির্দিষ্ট হইয়াছে, যদি কোনও স্থলে প্রকৃত সংখ্যা তাহা অপেক্ষা অধিক হয়, তাহাতে কোনও কথা নাই; যদি ন্যূন হয়, তাহা হইলে কুলীনপক্ষপাতী আপত্তিকারী মহাশয়েরা অনায়াসে বলিবেন, আমি ইচ্ছা পূর্বক সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া নির্দেশ করিয়াছি। কিন্তু, আমি সেরূপ করি নাই; অনুসন্ধান দ্বারা যাহা জানিতে পারিয়াছি, তাহাই নির্দেশ পূর্বর্বক কোনও বৈলক্ষণ্য করি নাই। করিয়াছি; জ্ঞান

প্রসিদ্ধ জনাই গ্রাম কলিকাতার ৫, ৬ ক্রোশ মাত্র অন্তরে অবস্থিত। এই গ্রামের যে সকল ব্যক্তি একাধিক বিবাহ করিয়াছেন, তাঁহাদের পরিচয় স্বতন্ত্র প্রদত্ত হইতেছে.।

নাম

বিবাহ

বয়স

মহানন্দ মুখোপাধ্যায়

১০

৩৫

যদুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

১০

২৯

আনন্দচন্দ্র গাঙ্গুলি

৫৫

৫০

৬৪

১৮

২৬

৪৫

২৭

৫০

দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি

ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়

চন্দ্রকান্ত মুখোপাধ্যায়

্যামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়

8

দীননাথ চট্টোপাধ্যায়

8

ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়

8

নীলকণ্ঠ বন্দ্যোপাধ্যায়

8

সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

8

ত্রিপুরাচরণ মুখোপাধ্যার

২৯

৩৫

কালিদাস গাঙ্গুলি

৩২

২৬

নাম

বিবাহ্,

বয়স

দীননাথ গাঙ্গুলি

১৯

কালীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়

ক্ষেত্রমোহন চট্টোপাধ্যায়

কালীপদ মুখোপাধ্যায় মাধবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

80

80

৩৫

নবকুমার মুখোপাধ্যায়

৪৩.

নীলমণি গাঙ্গুলি

৪৮

কালীকুমার মুখোপাধ্যায়

৫৫

চন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি

শ্রীনাথ চট্টোপাধ্যায়

৩ ৪৩

৫০

হারানন্দ মুখোপাধ্যায়

৬০

প্যারীমোহন চট্টোপাধ্যায়

80

সূর্য্যকুমার মুখোপাধ্যায়

ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

৫৫

সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

৫৫

চন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায় চন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়

৬০

২৫

রমানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

২৫

হরিনাথ মুখোপাধ্যায়

৬২

রাজমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়

৫৭

ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়

৫০

দীননাই মুখোপাধ্যায়

৫০

বিশ্বস্তর মুখোপাধ্যায়

৫০

রাজকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

৫০

নাম

প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় চন্দ্রকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

কালীকুমার গাঙ্গুলি

বিবাহ

বয়স

৩৫

৩২

২৫

4

আশুতোষ গাঙ্গুলি

२०

যদুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

২ ২ ৩৩

دی

নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

কেদারনাথ মুখোপাধ্যায়

২৮

গৌরীচরণ মুখোপাধ্যায় ভগবান্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়

২৮

৩২

দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি

২ .৩০

কালীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়

৩২

হরিহর গাঙ্গুলি

৩৫

কামাখ্যানাথ মুখোপাধ্যায়

২৮

প্যারীমোহন গাঙ্গুলি

৩৩

কালিদাস মুখোপাধ্যায়

চন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়

নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

৩৫

২৮

২৪

নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়

২৮

দীননাথ মুখোপাধ্যায়

৩০

যদুনাথ গাঙ্গুলি

২৭

বিশ্বেশ্বর মুখোপাধ্যায়

২৭

গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

২৭

চন্দ্রকুমার গাঙ্গুলি

২১

মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

২১

নাম

প্রিয়নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

যোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

বিবাহ,

বয়স

২৪

২০

এক্ষণে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, বিবাহ বিষয়ে কুলীনদিগের অত্যাচারের নিবৃত্তি হইয়াছে কি না। এখন যেরূপ অত্যাচার হইতেছে, পূর্ব্বে ইহা অপেক্ষা অধিক ছিল, এরূপ বোধ হয় না; বরং, পূর্ব্ব অপেক্ষা এক্ষণে অধিক অত্যাচার হইতেছে, ইহাই সম্পূর্ণ সম্ভব। পূর্ব্বে অধিক টাকা না পাইলে, কুলীনেরা কুলভঙ্গে সম্মত ও প্রবৃত্ত হইতেন না। অধিক টাকা দিয়া, কুলভঙ্গ করিয়া, কন্যার বিবাহ দেন, এরূপ ব্যক্তিও অধিক ছিলেন না। এ কারণে, স্বকৃতভঙ্গের সংখ্যা তখন অপেক্ষাকৃত অনেক অল্প ছিল। কিন্তু, অধুনাতন কুলীনেরা, অল্প লাভে সন্তুষ্ট হইয়া, কুলভঙ্গ করিয়া থাকেন। আর, কুলভঙ্গ করিয়া, কন্যার বিবাহ দিবার লোকের সংখ্যাও এক্ষণে অনেক অধিক হইয়াছে। পূর্ব্বে, কোনও গ্রামে কেবল এক ব্যক্তি কুলভঙ্গ করিয়া ক্যার বিবাহ দিতেন। পরে তাঁহার পাঁচ পুত্র হইল। তাঁহারা সকলে, কন্যার বিবাহ বিষয়ে, পিতৃদৃষ্টান্তের অনুবর্তী হইয়া চলিয়াছেন। এক্ষণে, সেই পাঁচ পুত্রের পুত্রদিগকে, কুলভঙ্গ করিয়া, কন্যার বিবাহ দিতে হইতেছে। সুতরাং, যে স্থানে, কেবল এক ব্যক্তি, কুলভঙ্গ করিয়া, কন্যার বিবাহ দিতেন; সেই স্থানে, এক্ষণে; সেই প্রথা অবলম্বন করিয়া চলিবার লোকের সংখ্যা অনেক অধিক হইয়াছে। মূল্যও অল্প, গ্রাহকের সংখ্যাও অধিক; এজন্য, কুলভঙ্গ ব্যবসায়ের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধিই হইতেছে। সুতরাং, স্বকৃতভঙ্গের সংখ্যা এখন অনেক অধিক; এবং, উত্তরোত্তর, অধিক বই ন্যূন হওয়া সম্ভব নহে। স্বকৃতজ্ঞঙ্গেরা অধিক বিবাহ করিতেছেন; এবং, স্থানে স্থানে, তাঁহাদের যে কন্যার পাল জন্মিতেছে, তাহাদিগকে স্বকৃতভঙ্গ পাত্রে অর্পণ করিতে হইতেছে। এমন স্থলে, বিবাহ- বিষয়ক অত্যাচারের, বৃদ্ধি ব্যতীত, হ্রাস কিরূপে সম্ভব হইতে পারে, বুঝিতে পারা যায় না'। বাহা হউক, কুলীনদিগের বিবাহবিষয়ক অত্যাচারের প্রায় নিবৃত্তি হইয়াছে, যাহা কিছু অবশিষ্ট আছে, অল্প দিনেই, তাহার সম্পূর্ণ নিবৃত্তি হইবেক, এ কথা সম্পূর্ণ অলীক।

কলিকাতাবাসী নব্য সম্প্রদায়ের অধিকাংশ ব্যক্তি পল্লী- গ্রামের কোনও সংবাদ রাখেন না; সুতরাং, তত্রত্য যাবতীয় বিষয়ে তাঁহারা সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ; কিন্তু তৎসংক্রান্ত কোনও বিষয়ে অভিপ্রায় প্রকাশের প্রয়োজন হইলে, সম্পূর্ণ অভিজ্ঞের ন্যায়, অসঙ্কুচিত চিত্তে, তাহা করিয়া থাকেন। তাঁহারা, কলিকাতার ভাবভঙ্গী দেখিয়া, তদনুসারে পল্লী- গ্রামের অবস্থা অনুসন্ধান করিয়া লয়েন। ঐ সকল মহোদয়েরা বলেন, এ দেশে বিদ্যার সবিশেষ চর্চ্চা হওয়াতে, বহুবিবাহ • প্রভৃতি কুপ্রথার প্রায় নিবৃত্তি হইয়াছে।

এ কথা যথার্থ বটে, বহু কাল ইঙ্গরেজী বিদ্যার সবিশেষ অনুশীলন ও ইঙ্গরেজজাতির সহিত ভূয়িষ্ঠ সংসর্গ দ্বারা, কলিকাতায়, ও কলিকাতার অব্যবহিত সন্নিহিত স্থানে, কুপ্রথা ও কুসংস্কারের, অনেক অংশে, নিবৃত্তি হইয়াছে; কিন্তু, তদ্ব্যতিরিক্ত সমস্ত স্থানে, ইন্সরেজী বিদ্যার অদৃশ অনুশীলন হইতেছে না, ও ইঙ্গরেজজাতির সহিত তদ্রূপ ভূয়িষ্ঠ সংসর্গ ঘটিতেছে না; সুতরাং, সেই সেই স্থানে, কুপ্রথা ও কুসংস্কারের প্রাদুর্ভাব তদবস্থই রহিয়াছে। ফলতঃ, পল্লীগ্রামের অবস্থা, কোনও অংশে, কলিকাতার মত হইয়াছে, এরূপ নির্দেশ নিতান্ত অসঙ্গত। কার্য্যকারণভাবব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টি করিলে, এরূপ সংস্কার কদাচ উদ্ভুত হইতে পারে না। কলিকাতায়, যে কারণে, যত কালে, যে কার্য্যের উৎপত্তি হইয়াছে; যে সকল স্থানে যাবৎ সেই কারণের তুত কাল সংযোগ না ঘটিতেছে; তাবৎ তথায় সেই কার্য্যের উৎপত্তি প্রত্যাশা করা যাইতে পারে না। কলিকাতায় যত কাল ইঙ্গরেজী বিদ্যার যেরূপ অনুশীলন ও ইঙ্গরেজজাতির সহিত যেরূপ ভূয়িষ্ঠ সংসর্গ হইয়াছে; পল্লী- গ্রামে যাবৎ, সর্বতোভাবে, ঐরূপ না ঘটিতেছে, তাবৎ তথায় কলিকাতার অনুরূপ ফল লাভ, কোনও মতে, সম্ভবিতে পারে না। যাহা হউক, কলিকাতার ভাবভঙ্গী দেখিয়া, তদনুসারে পল্লীগ্রামের অবস্থা অনুমান করা নিতান্ত অব্যবস্থা।

ফলকথা এই, কোনও বিষয়ে মত প্রকাশের প্রয়োজন হইলে, সে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ না হইয়া, তাহা করা পরামর্শসিদ্ধ নহে। সবিশেষ অনুসন্ধান ব্যতিরেকে, কেহ কোনও বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হইতে পারেন না। বহুবিবাহপ্রথা বিষয়ে সবিশেষ, অনুসন্ধান করিলে, ঐ জঘন্য ও নৃশংস প্রথার অনেক নিবৃত্তি হইয়াছে, উহা আর পূর্বের মত প্রবল নাই, পরপ্রতারণা যাঁহার উদ্দেশ্য নহে, তাদৃশ ব্যক্তি কদাচ ঈদৃশ করিতে পারেন না। ঈর্ষ্যার পরতন্ত্র, বা বিদ্বেষবুদ্ধির অধীন, অথবা কুসংস্কারবিশেষের বশবর্তী হইয়া, প্রস্তাবিত কোনও বিষয়ের প্রতিপক্ষতা করা মাত্র যাঁহার মুখ্য উদ্দেশ্য, তিনি সে বিষয়ের বিশেষজ্ঞই হউন, আর সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞই হউন, যাহা স্বপক্ষ সমর্থনের, বা পরপক্ষ খণ্ডনের, উপযোগী জ্ঞান করিবেন, তাহাই সচ্ছন্দে নির্দেশ করিবেন; যাহা নির্দেশ করিতেছেন, তাহা সম্পূর্ণ অবাস্তব হইলেও, তাহাকেই সে বিষয়ের প্রকৃত অবস্থা বলিয়া কীর্ত্তন করিতে, কিছু মাত্র সঙ্কুচিত হইবেন না। কোনও ব্যক্তি, সদভিপ্রায়প্রবর্ত্তিত হইয়া, কার্য্য বিশেষের অনুষ্ঠান করিলে, উক্তবিধ ব্যক্তিরা ঐ অনুষ্ঠানকে, অসদভিপ্রায় প্রণোদিত বলিয়া, অম্লান মুখে নির্দেশ করেন; কিন্তু, আপনারা যে, ঈর্ষ্যা অথবা জিগীষার বশবর্তী হইয়া, অতথ্য নির্দেশ দ্বারা, অস্থ্যের চক্ষে ধূলিমুষ্টি প্রক্ষেপ করিতেছেন, তাহা একবারও ভাবিয়া • দেখেন না।

পঞ্চম আপত্তি।

কেহ কেহ আপত্তি করিতেছেন, বহুবিবাহ প্রথা নিবারিত হইলে, কারুস্থজাতির আছ্যরসের ব্যায়াত ঘটিবেক। এই আপত্তি অভি দুর্বল ও অকিঞ্চিৎকর। আছ্যরস না হইলে, কায়স্থ- দিগের জাতিপাত ও ধর্ম্মলোপ হয় না; এবং, বিবাহবিষয়েও; কোনও অসুবিধা ঘটে না।

কায়স্থজাতি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত; প্রথম কুলীন, দ্বিতীয় মৌলিক। ঘোষ, বস্তু, মিত্র, এই তিন ঘর কুলীন কায়স্থ। মৌলিক দ্বিবিধ, সিদ্ধ ও সাধ্য। দে, দত্ত, কর, পালিত, সেন, সিংহ, দাস, গুহ, এই আট ঘর সিদ্ধ মৌলিক; আর, সোম, রুদ্র, পাল, নাগ, ভঞ্জ, বিষ্ণু, ভদ্র, রাহা, কুণ্ড, সুর, চন্দ্র, নন্দী, শীল, নাথ, রক্ষিত, আইচ প্রভৃতি যে বায়ত্তর ঘর কায়স্থ, আছেন, তাঁহারা সাধ্য মৌলিক। সাধ্য মৌলিকেরা, মর্য্যাদা বিষয়ে, সিদ্ধ মৌলিক অপেক্ষা, নিকৃষ্ট। সিদ্ধ মৌলিকেরা সম্মৌলিক, সাধ্য মৌলিকেরা, বায়ত্তরিয়া বলিয়া, সচরাচর উল্লি- খিত হইয়া থাকেন।

কায়স্থজাতির বিবাহের স্কুল ব্যবস্থা এই; কুলীনের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে কুলীনকন্যা বিবাহ করিতে হয়; মৌলিককন্যা বিবাহ করিলে, তাঁহার কুলভ্রংশ ঘটে; কিন্তু, প্রথম কুলীনকন্যা বিবাহ করিয়া, মৌলিকক্যা বিবাহ করিলে, কুলের কোনও ব্যাঘাত ঘটে না। কুলীনের অপর পুত্রেরা মৌলিককন্যা বিবাহ করিতে পারেন; এবং, সচরাচর, তাহাই করিয়া থাকেন। মৌলিক মাত্রের কুলীন পাত্রে কন্যাদান, ও কুলীনকন্যা বিবাহ, করা আবশ্যক। মৌলিকে মৌলিকে আদানপ্রদান হইলে, জাতিপাত ও ধৰ্ম্মলোপ হয় না; কিন্তু, তাদৃশ আদান প্রদানকারীদিগকে কায়স্থসমাজে কিছু হেয় হইতে হয়। ৬০, ৭০ বৎসর পূর্ব্বে, মৌলিকে মৌলিকে বিবাহ নিতান্ত বিরল ছিল না; এবং, নিতান্ত দোষাবহ বলিয়াও পরিগৃহীত হইত না।

মৌলিকেরা কুলীনের দ্বিতীয় পুত্র প্রভৃতিকে কন্যাদান করিয়া থাকেন। কিন্তু, কতিপয় মৌলিক পরিবারের সঙ্কল্প এই, কুলীনের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে কন্যাদান করিতে হইবেক। কুলীনের জ্যেষ্ঠ পুত্র, প্রথমে, মৌলিককন্যা বিবাহ করিতে পারেন না। কুলীনকন্যা বিবাহ দ্বারা যাঁহার কুলরক্ষা হইয়াছে, মৌলিক কায়স্থ, অনেক যত্ন ও অনেক অর্থব্যয় করিয়া, তাঁহাকে কন্যা দান করেন। কুলীনের জ্যেষ্ঠ পুত্র, এই রূপে, মৌলিকগৃহে যে দ্বিতীয় দারপরিগ্রহ করেন, তাহার নাম আন্তরস; আর, যে সকল মৌলিকের গৃহে এইরূপ বিবাহ হয়, তাঁহাদিগকে আছ্যরসের ঘর বলে।

মৌলিকেরা, আছারস করিয়া, অনেক যত্নে, জামাতাকে গৃহে রাখেন। তাহার কারণ এই বোধ হয়, কুলীনের জ্যেষ্ঠ সন্তান পিতৃমর্য্যাদা প্রাপ্ত হয়। আছ্যরসপ্রিয় মৌলিকদিগের উদ্দেশ্য এই, তাঁহাদের দৌহিত্র সেই মর্য্যাদার ভাজন হইবেক। কিন্তু, যে ব্যক্তির দুই বিবাহ, তাহার কোন স্ত্রী প্রথম পুণ্ড্রবর্তী হইবেক, তাহার স্থিরতা নাই। পূর্ব্বপরিণীতা কুলীনকন্যার অগ্রে পুত্র জন্মিলে, আছ্যরসের উদ্দেশ্য বিফল হইয়া যায়। জামাতাকে পূর্ব্বপরিণীতা কুলীনকন্যার নিকটে যাইতে না দেওয়া, সেই উদ্দেশ্যসাধনের এক মাত্র উপায়। এজন্য, জামাতাকে সন্তুষ্ট করিয়া গৃহে রাখা নিতান্ত আবশ্যক হইয়া উঠে। তাদৃশ স্থলে, পূর্ব্বপরিণীতা কুলীনকন্য। স্বামীর মুখ দেখিতে পান না। বস্তুতঃ, তাদৃশী কুলীনকন্যাকে, নাম মাত্রে বিবাহিতা হইয়া, বিধবা কন্যার ন্যায়, পিত্রালয়ে কালযাপন করিতে হয়। কুলীন জামাতাকে বশে রাখা বিলক্ষণ ব্যয়সাধ্য; এজন্য, যে সকল আছ্যরসপ্রিয় • মৌলিকের অবস্থ। ক্ষুণ্ণ হুইয়াছে, তাঁহারা সে বিষয়ে কৃতকার্য্য হইতে পারেন না; সুতরাং, আছ্যরসের মুখ্য ফল লাভ তাঁহাদের ভাগ্যে ঘটিয়া উঠে না। ঈদৃশ স্থলে, কুলীনের জ্যেষ্ঠ পুত্র, কুলীনকন্যা ও মৌলিককন্যা উভয়কে লইয়া, সংসারযাত্রা নির্বাহ করেন।

পূর্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে, আছ্যরস না করিলে, মৌলিকের জাতিপাত বা ধৰ্ম্মলোপ হয় না; এবং, বিবাহ বিষয়েও, কিছু মাত্র অসুবিধা ঘটে না। কুলীনের মধ্যম প্রভৃতি পুত্রকে কন্যা- দান করিলেই, মৌলিকের সকল দিক রক্ষা হয়। এজন্য, প্রায় সকল মৌলিকেই তাদৃশ পাত্রে কন্যাদান করিয়া থাকেন। আমি কুলীনের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে কন্যাদান করিয়াছি, নিরবচ্ছিন্ন এই অভিমানসুখলোভের বশবর্তী হইয়া, কেবল কতিপয় মৌলিক- পরিবার আছারস করেন। কিন্তু, তুচ্ছ অভিমানসুখের জন্য, পূর্ব্বপরিণীতা নিরাপরাধা কুলীনকন্যার সর্বনাশ করিতেছেন, ক্ষণ কালের জন্যেও, সে বিবেচনা করেন না। যে দেশে, আপন কন্যার হিতাহিত বিবেচনার পদ্ধতি নাই; সে দেশে, পরের কন্যার হিতাহিত বিবেচনা সুদূরপরাহত।

যে সকল আছারসপ্রিয় পরিবার নিঃস্ব হইয়াছেন, এবং, অর্থ ব্যয় করিয়া, প্রকৃত প্রস্তাবে, আ্যরস করিতে সমর্থ নহেন; তাঁহাদের পক্ষে, আছ্যরস, অশেষ প্রকারে, বিলক্ষণ বিপদের স্বরূপ হইয়া উঠিয়াছে। তাঁহাদের আন্তরিক ইচ্ছা এই, আছারসপ্রথা এই দণ্ডে রহিত হইয়া যায়। রাজশাসন দ্বারা এই কুৎসিত প্রথার উচ্ছেদ হইলে, তাঁহারা পরিত্রাণ বোধ করেন; কিন্তু, স্বয়ং সাহস করিয়া পথপ্রদর্শনে প্রবৃত্ত হইতে পারেন না। যদি তাঁহারা, আছ্যরসে বিসর্জন দিয়া, কুলীনের দ্বিতীয় প্রভৃতি পুত্রে কুন্মাদান করিতে আরম্ভ করেন, তাঁহাদের জাতিপাত বা ধৰ্ম্মলোপ হইবেক না; তবে, আছরস করিল না, অথবা করিতে পারিল না, বলিয়া, প্রতিবেশীরা, তাঁহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া, নিন্দা ও উপহাস করিবেন; কেবল, এই নিন্দার ও এই উপহাসের ভয়ে, তাঁহারা আছ্যরস হইতে বিরত হইতে পারিতেছেন না। স্পষ্ট কথা বলিতে হইলে, আমাদের দেশের লোক বড় নির্বোধ, বড় কাপুরুষ।

রাজশাসন দ্বারা বহুবিবাহ প্রথা নিবারিত হইলে, আছ্যরসের ব্যাঘাত ঘটিবেক, সন্দেহ নাই; কিন্তু, কতিপয় মৌলিকপরি- বারের তুচ্ছ অভিমানসুখের ব্যাঘাত ভিন্ন, কায়স্থজাতির, কোনও অংশে, কোনও অসুবিধা বা অপকার ঘটিবেক, তাহার কোনও সম্ভাবনা লক্ষিত বা অনুমেয় হইতেছে না। আদ্যরস, কায়স্থ- জাতির পক্ষে, অপরিহার্য্য ব্যবহার নহে। এই ব্যবহার, অশেষ প্রকারে, অনিষ্টকর ও অধর্ম্মকর, তাহার সন্দেহ নাই। যখন, এই ব্যবহার রহিত হইলে, কোনও অংশে, কায়স্থজাতির অহিত, অধৰ্ম্ম, বা অন্যবিধ অসুবিধা বা অপকার ঘটিতেছে না; তখন, উহা বহুবিবাহ নিবারণের আপত্তিস্বরূপে উত্থাপিত বা পরি- গৃহীত হওয়া, কোনও মতে, উচিত বা ন্যায়ানুগত নহে। আর, যদি রাজনিয়ম দ্বারা, বা অন্যবিধ কারণে, অকারণে একাধিক বিবাহ করিবার প্রথা রহিত হইয়া যায়, তাহা হইলেও, আছ্য- রসের এককালে উচ্ছেদ হইতেছে না। কুলীনের যে সকল জ্যেষ্ঠ সন্তানের স্ত্রীবিয়োগ ঘটিবেক, তাঁহারা আছ্যরসের ঘরে দারপরিগ্রহ করিতে পারিবেন। যাহা হউক, এই আছারসের ব্যাঘাত ঘটিবেক; অতএক, বহুবিবাহ প্রথা নিবারিত হওয়া উচিত নহে; ঈদৃশ আপত্তি উত্থাপন করা কেবল আপনাকে উপহাসা- স্বাদ করা মাত্র।

ষষ্ঠ আপত্তি।

কেহ কেহ আপত্তি করিতেছেন, এ দেশে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত থাকাতে, অশেষবিধ অন্বিষ্ট ঘটিতেছে, সন্দেহ নাই। যাহাতে তাহার নিবারণ হয়, সে বিষয়ে, সাধ্যানুসারে, সকলের যথোচিত যত্ন ও চেষ্টা করা নিতান্ত উচিত ও আবশ্যক। কিন্তু, বহুবিবাহ সামাজিক দোষ; সামাজিক দোষের সংশোধন সমাজের লোকের কার্য্য; সে বিষয়ে গবর্ণমেন্টকে হস্তক্ষেপ করিতে দেওয়া, কোনও ক্রমে, বিধেয় নহে।

এই আপত্তি শুনিয়া, আমি, কিয়ৎ ক্ষণ, হাস্য সংবরণ করিতে পারি নাই। সামাজিক দোষের সংশোধন সমাজের লোকের কার্য্য, এ কথা শুনিতে, আপাততঃ, অত্যন্ত কর্ণসুখকর। যদি এ দেশের লোক সামাজিক দোষের সংশোধনে প্রবৃত্ত ও যত্নবান হয়, এবং অবশেষে কৃতকার্য্য হইতে পারে, তাহা অপেক্ষা সুখের, আহলাদের, সৌভাগ্যের বিষয় আর কিছুই হইতে পারে না। কিন্তু, দেশস্থ লোকের প্রকৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি, বিবেচনাশক্তি প্রভৃতির, অশেষ প্রকারে, যদ্রূপ পরিচয় পাওয়া গিয়াছে, এবং অদ্যাপি পাওয়া যাইতেছে, তাহাতে তাঁহারা সমাজের দোষ- সংশোধনে যত্ন ও চেষ্টা করিবেন; এবং, সেই যত্নে, সেই চেষ্টায়, ইষ্টসিদ্ধি হইবেক; সহজে সে প্রত্যাশা করিতে পারা যায় না। ফলতঃ, কেবল আমাদের যত্নে ও চেষ্টায়, সমাজের সংশোধনকার্য্য সম্পন্ন হইবেক; এখনও, এ দেশের সে দিন, সে সৌভাগ্যদশা উপস্থিত হয় নাই; এবং, কত কালে উপস্থিত হইবেক, দেশের বর্তমান অবস্থা দেখিয়া, তাহা স্থির বলিতে পারা যায় না। বোধ হয়, সে দিন, সে সৌভাগ্যদশা, কস্মিন্ কালেও, উপস্থিত হইবেক না।

যাঁহারা এই আপত্তি করেন, তাঁহারা নব্য সম্প্রদায়ের লোক'। নব্য সম্প্রদায়ের মধ্যে, যাঁহারা অপেক্ষাকৃত বয়োবৃদ্ধ ও বহুদর্শী হইয়াছেন; তাঁহারা, অর্বাচীনের ন্যায়, সহসা, এরূপ অসার কথা মুখ হইতে বিনির্গত করেন না। ইহা যথার্থ বটে; তাঁহারাও, এক কালে, অনেক বিষয়ে, অনেক আস্ফালন করিতেন; সমাজের দোষসংশোধন ও সমাজের শ্রীবৃদ্ধিসাধন তাঁহাদের জীবনের এক মাত্র উদ্দেশ্য, এ কথা, সর্বব ক্ষণ, তাঁহাদের মুখে নৃত্য করিত। কিন্তু, এ সকল পঠদ্দশার ভাব। তাঁহারা, পঠদ্দশা সমাপন করিয়া, বৈষয়িক ব্যাপারে প্রবৃত্ত হইলেন। ক্রমে ক্রমে, পঠদ্দশার ভাবের তিরোভাব হইতে লাগিল। অবশেষে, সামাজিক দোষের সংশোধন দূরে থাকুক, স্বয়ং, সেই সমস্ত দোষে সম্পূর্ণ লিপ্ত হইয়া, সচ্ছন্দ চিত্তে কালযাপন করিতেছেন। এখন তাঁহারা বহুদর্শী হইয়াছেন; সমাজের দোষসংশোধন, সমাজের শ্রীবৃদ্ধিসাধন, এ সকল কথা, ভ্রান্তি ক্রমেও, আর তাঁহাদের মুখ হইতে বহির্গত হয় না; বরং, ঐ সকল কথা শুনিলে, বা কাহাকেও ঐ সকল বিষয়ে সচেষ্ট হইতে দেখিলে, তাঁহারা উপহাস করিয়া থাকেন।

এই সম্প্রদায়ের অল্পবয়স্কদিগের এক্ষণে পঠদ্দশার ভাব চলিতেছে। অল্পবয়স্ক দলের মধ্যে, যাঁহারা অল্প বয়সে বিদ্যালয় পরিত্যাগ করেন, তাঁহাদেরই আস্ফালন বড়। তাঁহাদের ভাবভঙ্গী দেখিয়া, অনায়াসে, লোকের এই প্রতীতি জন্মিতে পারে, তাঁহার! সমাজের দোষসংশোধনে ও শ্রীবৃদ্ধিসম্পাদনে প্রাণ সমর্পণ করিয়াছেন। কিন্তু, তাঁহারা যে মুখমাত্রসার, অন্তরে সম্পূর্ণ অসার, অনায়াসে, সকলে তাহা বুঝিতে পারেন না। তাদৃশ ব্যক্তিরাই, উন্নত ও উদ্ধত বাক্যে, কহিয়া থাকেন, সমাজের দোষসংশোধন সমাজের লোকের কার্য্য; সে বিষয়ে গবর্ণ- মেন্টকে হস্তক্ষেপ করিতে দেওয়া বিধেয় নহে। কিন্তু, সমাজের দোষসংশোধন কিরূপ কার্য্য; এবং, 'কিরূপ সমাজের লেকি, অন্যদীয় সাহায্য নিরপেক্ষ হইয়া, সমাজের দোষ সংশোধনে সমর্থ; যাঁহাদের সে বোধ ও সে বিবেচনা আছে, তাঁহারা, এ দেশের বর্ত্তমান অবস্থা দেখিয়া, কখনই, সাহস করিয়া, বলিতে পারেন না, আমরা কোনও কালে, কেবল আত্মযত্নে ও আত্মচেষ্টায়, সামাজিক দোষের সংশোধনে কৃতকার্য্য হইতে পারিব। আমরা অত্যন্ত কাপুরুষ, অত্যন্ত অপদার্থ; আমাদের হতভাগা সমাজ অতিকুৎসিত দোষপরম্পরায় অত্যন্ত পরিপূর্ণ। এ দিকের চন্দ্র ও দিকে উঠিলেও, এরূপ লোকের ক্ষমতায়, এরূপ সমাজের দোষসংশোধন, কস্মিন্ কালেও, সম্পন্ন হইবার নহে। উল্লিখিত নব্য প্রামাণিকেরা কথায় বিলক্ষণ প্রবীণ; তাঁহাদের যেরূপ বুদ্ধি, যেরূপ বিস্তা, যেরূপ ক্ষমতা, তদপেক্ষা অনেক অধিক উচ্চ কথা কহিয়া থাকেন। কথা বলা যত সহজ, কাজ করা তত সহজ নহে।

সামাজিক দোষের সংশোধনে অত্রত্য লোকের প্রবৃত্তি ও ক্ষমতা বিষয়ে, দুটি উদাহরণ প্রদর্শিত হইতেছে। প্রথম, ব্রাহ্মণজাতির ক্যাবিক্রয়; দ্বিতীয়, কায়স্থজাতির পুত্রবিক্রয়। ব্রাহ্মণজাতির অধিকাংশ শ্রোত্রিয় ও অনেক বংশজ কন্যা বিক্রয় করেন; আর, সমুদায় শ্রোত্রিয় ও অধিকাংশ বংশজ, কন্যা ক্রয় করিয়া, বিবাহ করেন। এই ক্রয় বিক্রয়, শাস্ত্র অনুসারে, অতি গর্হিত কৰ্ম্ম; এবং, প্রকারান্তরে বিবেচনা করিয়া দেখিলে, অতি জঘন্য ব্যবহার। শাস্ত্রকারেরা কহিয়াছেন, ক্রয়ক্রীতা চ যা কন্যা পত্নী সা ন বিধীয়তে। তস্যাং জাতাঃ সুতাস্তেষাং পিতৃপিণ্ডং ন বিছাতে । (১) . ক্রয় করিয়া যে কন্যাকে বিবাহ করে, সে পত্নী নহে; তাহার *গর্ভে যে সকল পুত্র জন্মে, তাঁহারা পিতার পিণ্ডদানে অধিকারী * নয়।

ক্রয়ক্রীতা তু যা নারী ন সা পত্ন্যুভিধীয়তে। নস। দৈবে ন সা পৈত্র্যে দাসীং তাং কবয়ো বিদুঃ। (২) ক্রয় করিয়া যে নারীকে বিবাহ করে, তাহাকে পত্নী বলে না; সে দেবকার্য্যে ও পিতৃকার্য্যে বিবাহকর্তার সহধর্ম্মচারিণী হইতে পারে না; পণ্ডিতেরা তাহাকে দাসী বলিয়া গণনা' করেন।

শুক্লেন যে প্রযচ্ছন্তি স্বসুতাং লোভমোহিতাঃ। আত্মবিক্রয়িণঃ পাপা মহাকিল্বিষকারিণঃ। পতন্তি নরকে ঘোরে স্বস্তি চাসপ্তমং কুলম্ । (৩)

যাহারা, লোভ বশতঃ, পণ লইয়া কন্যাদান করে, সেই আত্ম- বিক্রয়ী পাপাত্মা মহাপাতককারীরা ঘোর নরকে পতিত হয়, এবং উর্দ্ধতন সাত পুরুষকে নরকে নিক্ষিপ্ত করে।

বৈকুণ্ঠবাসী হরিশম্মার প্রতি ব্রহ্মা, কহিয়াছেন, ষঃ কন্যাঝিক্রয়ং মূঢ়ে। লোভাচ্চ কুরুতে দ্বিজ।

স গচ্ছেন্নরকং ঘোরং পুরীষহ্রদসংজ্ঞকম্ ॥

বিক্রীতায়াশ্চ ক্যায়া যঃ পুত্রো জায়তে দ্বিজ।

স চাণ্ডাল ইতি জ্ঞেয়ঃ সর্ববধর্ম্মবহিষ্কৃতঃ ॥ (8) হে দ্বিজ, যে মূঢ়, লোভ বশতঃ, ক্যা বিক্রয় করে, সে পুরীষহ্রদ নামক ঘোর নরকে যায়। হে দ্বিজ' বিক্রীতা ক্যার যে পুত্র জন্মে, সে চাণ্ডাল, তাহার কোনও ধর্ম্মে অধিকার নাই।

দেখ! কন্যাক্রয় করিয়া বিবাহ করা, শাস্ত্র অনুসারে, কত দূষ্য। শাস্ত্রকারেরা তাদৃশ স্ত্রীকে পত্নী বলিয়া, ও তাদৃশ স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানকে পুত্র বলিয়া, অঙ্গীকার করেন না; তাঁহা- দের মতে, তাদৃশ স্ত্রী দাসী; তাদৃশ পুত্র সর্ববধৰ্ম্মবহিষ্কৃত চাণ্ডাল। সস্ত্রীক হইয়া ধৰ্ম্মকার্য্যের অনুষ্ঠান কবিতে হয়; কিন্তু, শাস্ত্র অনুসারে, তাদৃশ স্ত্রী, ধর্ম্মকার্য্যে, স্বামীর সহচারিণী হইতে পারে না। লোকে, পিণ্ডপ্রত্যাশায়, পুত্র প্রার্থনা করে; কিন্তু, শাস্ত্র অনুসারে, তাদৃশ পুত্র পিতার পিণ্ডদানে অধিকারী নহে। আর, যে ব্যক্তি অর্থলোভে কন্যা বিক্রয় করে, সে চিরকালের জন্য নরকগামী হয়, এবং পিতা, পিতামহ প্রভৃতি উর্দ্ধতন সাত পুরুষকে নরকে নিক্ষিপ্ত করে।

অর্থলোভে কন্যা বিক্রয় ও কন্যা ক্রয় করিয়া বিবাহ করা অতি জঘন্য ও ঘোরতর অধর্ম্মকর ব্যবহার, ইহা সকলেই স্বীকার করিয়া থাকেন। যাঁহারা কন্ঠা বিক্রয় করেন, এবং যাঁহারা, ক্যা ক্রয় করিয়া, বিবাহ করেন, তাঁহারাও, সময়ে সময়ে, এই ক্রয়বিক্রয় ব্যবসায়কে অতি ঘৃণিত, অতি জঘন্য, ব্যবহার বলিয়া কীর্ত্তন করিয়া থাকেন। এই ব্যবহার, যার পর নাই, অধর্ম্মকর ও অনিষ্টকর, তাহাও সকলের বিলক্ষণ হৃদয়ঙ্গম হইয়া আছে।

যদি, সামাজিক দোষের সংশোধনে, আমাদের প্রবৃত্তি ও ক্ষমতা

থাকিত, তাহা হইলে, এই নিরতিশয় কুৎসিত কাণ্ড, এত দিন,

এ প্রদেশে প্রচলিত থাকিত না। ব্রাহ্মণজাতির ক্যার্বিক্রয় ব্যবসায় অপেক্ষা, কায়স্থজাতির পুত্রশিক্রয় ব্যবসায় আরও ভয়ানক ব্যাপার। মধ্যবিধ ও হীনাবস্থ কায়স্থজাতির কন্য। হইলেই সর্বনাশ। কন্যার যত বয়োবৃদ্ধি হয়, পিতার সর্বব শরীরের শোণিত শুষ্ক হইতে থাকে। যার ক্যা, তার সর্বনাশ; যার পুত্র, তার পৌষ মাস। বিবাহের সম্বন্ধ উপস্থিত হইলে, পুত্রবান ব্যক্তি, অলঙ্কার, দানসামগ্রী প্রভৃতি উপলক্ষে, পুত্রের এত মূল্য প্রার্থনা করেন যে, মধ্যবিধ ও হীনাবস্থ কায়স্থের পক্ষে, কন্যাদায় হইতে উদ্ধার হওয়া দুর্ঘট হয়। এ বিষয়ে, বরপক্ষ এরূপ নির্লজ্জ ও. নৃশংস ব্যবহার করেন যে, তাঁহাদের উপর অত্যন্ত অশ্রদ্ধা জন্মে। কৌতুকের বিষয় এই, কন্যার বিবাহ দিবার সময়, যাঁহারা শশব্যস্ত ও বিপদগ্রস্ত হয়েন; পুত্রের বিবাহ দিবার সময়, তাঁহাদেরই আর একপ্রকার ভাবভঙ্গী হয়। এইরূপে, কায়স্থেরা, কন্যার বিবাহের সময়, মহাবিপদ, ও পুত্রের বিবাহের সময়, মহোৎসব, জ্ঞান করেন। পুত্রবিক্রয় ব্যবসায় যে অতি কুৎসিত কর্ম্ম, তাহা কায়স্থ মাত্রে স্বীকার করিয়া থাকেন; কিন্তু, আপন পুত্রের বিবাহের সময়, সে বোধও থাকে না, সে বিবেচনাও থাকে না। আশ্চর্য্যের বিষয় এই, যাঁহারা নিজে সুশিক্ষিত ও পুত্রকে সুশিক্ষিত করিতেছেন, এ ব্যবসায়ে তাঁহারাই নিতান্ত নির্দয়, ও নিতান্ত নির্লজ্জ। যে বালক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবে- শিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছে, তাহার মূল্য অনেক; যে তদপেক্ষা উচ্চ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছে, তাহার মূল্য তদপেক্ষা অনেক অধিক; অধিক; যাহারা তদপেক্ষাও অধিকব্যি হইয়াছে, তাহাদের সহিত কন্যার বিবাহ প্রস্তাব করা, অনেকের পক্ষে, অসংসাহসিক ব্যাপার। আর, যদি তদুপরি ইষ্টকনিৰ্ম্মিত বাসস্থান ও গ্রাসাচ্ছাদনের সমাবেশ থাকে, তাহা হইলে, সর্বব- নাশের ব্যাপার। বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন না হইলে, তাদৃশ-স্থলে বিবাহের কথা উত্থাপনে অধিকারই নাই। অধিক আশ্চর্য্যের বিষয় এই, এই ব্যবসায়ের, পল্লীগ্রাম অপেক্ষা, কলিকাতায় অত্যন্ত অধিক প্রাদুর্ভাব। সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য্যের বিষয় এই, ব্রাহ্মণজাতির কন্যার মূল্য ক্রমে অল্প হইয়া আসিতেছে; কায়স্থ- জাতির পুত্রের মূল্য, উত্তরোত্তর, অধিক হইয়া উঠিতেছে। যদি বাজার এইরূপ থাকে, অথবা আরও গরম হইয়া উঠে; তাহা হইলে, মধ্যবিঘ্ন ও হীনাবস্থ কায়স্থপরিবারের অনেক কন্যাকে, ব্রাহ্মণজাতীয় কুলীনকন্যার ন্যায়, অবিবাহিত অবস্থায় থাকিতে হইবেক।

যেরূপ দেখিতে ও শুনিতে পাওয়া যায়, কায়স্থ মাত্রে এ বিষয়ে বিলক্ষণ জ্বালাতন হইয়াছেন। ইহা যে অতি লজ্জাকর ও ঘৃণাকর ব্যবহার, সে বিষয়ে মতভেদ দেখিতে পাওয়া যায় না। কায়স্থজাতি, একবাক্য হইয়া, যে বিষয়ে ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রদর্শন করিতেছেন; তাহা অছ্যাপি প্রচলিত আছে কেন। যদি এ দেশের লোকের, সামাজিক দোষের সংশোধনে, প্রবৃত্তি ও ক্ষমতা থাকিত; তাহা হইলে, কায়স্থজাতির পুত্রবিক্রয় ব্যবহার, বহু দিন পূর্বে, রহিত হইয়া যাইত।

এ দেশের হিন্দুসমাজ ঈদৃশ দোষপরম্পরায় পরিপূর্ণ। পূর্ব্বোক্ত নব্য প্রামাণিকদিগকে জিজ্ঞাসা করি, এ পর্য্যন্ত, তাঁহারা তন্মধ্যে, কোন কোন দোষের সংশোধনে, কত দিন, কিরূপ

যত্ন ও কিরূপ চেষ্টা করিয়াছেন; এবং, তাঁজাদের তাদৃশ যত্নে ও তাদৃশ চেষ্টায়, কোন কোন দোষের কত দূর সংশোধন হইয়াছে; আর, এক্ষণেই বা, তাঁহারা কোন কোন দোষের সংশোধনে কিরূপ যত্ন ও 'কিরূপ চেষ্টা করিতেছেন।

বহুবিবাহপ্রথা প্রচলিত থাকাতে, অশেষ প্রকারে, হিন্দু- সাজের অনিষ্ট ঘটিতেছে। সহস্র সহস্র বিবাহিতা নারী, যার পর নাই, যন্ত্রণা ভোগ করিতেছেন। ব্যভিচারদোষের ও ভ্রূণ- হত্যাপাপের স্রোত, প্রবল বেগে, প্রবাহিত হইতেছে। দেশের লোকের যত্নে ও চেষ্টায়, ইহার প্রতিকার হওয়া, কোনও মতে, সম্ভাবিত নহে। সম্ভাবনা থাকিলে, তদর্থে রাজদ্বারে আবেদন করিবার কিছু মাত্র প্রয়োজন থাকিত না। এক্ষণে, বহুবিবাহ প্রথা রহিত হওয়া আবশ্যক, এই বিবেচনায়, রাজদ্বারে আবেদন করা উচিত; অথবা, এরূপ বিষয়ে, রাজদ্বারে আবেদন করা ভাল নয়; অতএব, তাহা চিরকাল প্রচলিত থাকুক, এই বিবেচনায়, ক্ষান্ত থাকা উচিত। এই অতি জঘন্য, অতি নৃশংস প্রথা প্রচলতি থাকাতে, সমাজে যে গরীয়সী অনিষ্টপরম্পরা ঘটিতেছে, যাঁহারা তাহা, অহরহঃ প্রত্যক্ষ করিতেছেন; এবং, তাহা প্রত্যক্ষ করিয়া, যাঁহাদের অন্তঃকরণ, সর্বব ক্ষণ, দুঃসহ দুঃখদহনে দগ্ধ হইতেছে; তাঁহাদের বিবেচনায়, যে কোনও উপায়ে হউক, এই প্রথা রহিত হইলেই, সমাজের মঙ্গল। বস্তুতঃ, রাজশাসন দ্বারা, এই নৃশংস প্রথার উচ্ছেদ হইলে, সমাজের মঙ্গল ভিন্ন অমঙ্গল ঘড়িবেক, তাহার কোনও হেতু বা সম্ভাবনা দেখিতে পাওয়া যায় না। আর, যাঁহারা তদর্থে রাজদ্বারে আবেদন করিয়াছেন, তাঁহাদের যে কোনও প্রকারে, ন্যায়বিরুদ্ধ বা বিবেচনাবহির্মুখ কৰ্ম্ম করা হইয়াছে, তর্ক দ্বারা তাহা প্রতিপন্ন ক্রাও নিতান্ত সহজ বোধ হয় না। আমাদের ক্ষমতা গবর্ণমেন্টের হস্তে দেওয়া উচিত নয়, এরূপ কথা বলা বালকতা প্রদর্শন মাত্র। আমাদের ক্ষমতা কোথায়। ক্ষমতা থাকিলে, ঈদৃশ বিষয়ে, গবর্ণমেন্টের নিকটে যাওয়া কদাচ উচিত ও আবশ্যক হইত না; আমরা নিজেই সমাজের সংশোধনকার্য্য সম্পন্ন করিতে পারিন্ডাম। ইচ্ছা নাই, চেষ্টা নাই, ক্ষমতা নাই, সুতরাং, সমাজের দোষসংশোধন করিতে পারিবেন না; কিন্তু, তদর্থে রাজদ্বারে আবেদন করিলে, অপমানবোধ বা সর্বনাশজ্ঞান করিবেন, এরূপ লোকের সংখ্যা, বোধ করি, অধিক নহে; এবং, অধিক না হইলেই, দেশের ও সমাজের মঙ্গল।

সপ্তম আপত্তি।

কেহ কেহ আপত্তি করিতেছেন, ভারতবর্ষের সর্বব প্রদেশেই, হিন্দু, মুসলমান, উভয়ক্সি সম্প্রদায়ের লোকের মধ্যে, বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত আছে। তন্মধ্যে, কেবল বাঙ্গালাদেশের হিন্দু- সম্প্রদায়ের লোক, ঐ প্রথা রহিত করিবার নিমিত্ত, আবেদন করিয়াছেন। বাঙ্গালাদেশ ভারতবর্ষের এক অংশ মাত্র। এক অংশের এক সম্প্রদায়ের লোকের অনুরোধে, ভারতবর্ষীয় যাবতীয় প্রজাকে অসন্তুষ্ট করা গবর্ণমেন্টের কদাচ উচিত নহে।

এই আপত্তি, কোনও ক্রমে, যুক্তিযুক্ত বোধ হইতেছে না। বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত থাকাতে, বাঙ্গালাদেশে, হিন্দুসম্প্রদায়ের মধ্যে, যত দোষ ও যত অনিষ্ট ঘটিতেছে; বোধ হয়, ভারত- বর্ষের অন্য কোনও অংশে তদ্রূপ নহে; এবং, বাঙ্গালাদেশের মুসলমানসম্প্রদায়ের মধ্যেও, সেরূপ দোষ বা সেরূপ অনিষ্ট দেখিতে ও শুনিতে পাওয়া যায় না। সে যাহা হউক, যাঁহারা আবেদন করিয়াছেন, বাঙ্গালাদেশে, হিন্দুসম্প্রদায়ের মধ্যে, বহুবিবাহনিবন্ধন যে অশেষবিধ উৎকট অনিষ্টসংঘটন হইতেছে, তাহার নিবারণ হয়, এই তাঁহাদের উদ্দেশ্য, এই তাঁহাদের প্রার্থনা। এ দেশের মুসলমানসম্প্রদায়ের লোক বহু বিবাহ করিয়া থাকেন; তাঁহারা চিরকাল সেরূপ করুন; তাহাতে আবেদনকারীদিগের কোনও আপত্তি নাই; এবং, তাঁহাদের এরূপ ইচ্ছাও নহে, এবং প্রার্থনাও নহে, যে গবর্ণমেন্ট, এই উপলক্ষে, মুসলমানদিগেরও বহু বিবাহের পথ রুদ্ধ করিয়া দেন; অথবা, গবর্ণমেন্ট, এক উদ্ভ্যমে, ভারতবর্ষের সর্বপ্রদেশীয় সর্বসাধারণ লোকের পক্ষে, বিবাহ বিষয়ে ব্যবস্থা করুন, ইহাও তাঁহাদের অভিপ্রেত নহে। বহুবিবাহসূত্রে, স্বসম্প্রদায়ের যে অতি মহতী দুরবস্থা ঘটিয়াছে, তদ্দর্শনে তাঁহারা যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইয়াছেন; এবং, সেই দুরবস্থা বিমোচনের উপায়ান্তর না দেখিয়া, রাজদ্বারে আবেদন করিয়াছেন। স্বসম্প্রদায়ের তাদৃশী দুরবস্থার বিমোচন মাত্র তাঁহাদের উদ্দেশ্য। যদি গবর্ণমেন্ট, সদয় হইয়া, তাঁহাদের আবেদন গ্রাহ্য করিয়া, এ প্রদেশের কেবল হিন্দুসম্প্রদায়ের জন্য, বিবাহ বিষয়ে, কোনও ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করেন, তাহাতে এ প্রদেশের মুসলমান সম্প্রদায়, অথবা ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের হিন্দু, মুসলমান, উভয় সম্প্রদায়, অসন্তুষ্ট হইবেন কেন। এ দেশের হিন্দুসম্প্রদায় গবর্ণ- মেণ্টের প্রজা। তাঁহাদের সমাজে, কোনও বিষয় নিরতিশয় ক্লেশকর হইয়া উঠিয়াছে। তাঁহাদের স্বীয় যত্নে ও স্বীয় ক্ষমতায়, সে ক্লেশের নিবারণ হইতে পারে না; অথচ, সে ক্লেশের নিবারণ হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। প্রজারা, নিরুপায় হইয়া, রাজার আশ্রয় গ্রহণ পূর্ব্বক, সহায়তা প্রার্থনা করিয়াছেন। এমন স্থলে, প্রজার প্রার্থনা পরিপূরণ করা রাজার অবশ্যকর্তব্য। এক প্রদেশের প্রজাবর্গের প্রার্থনা অনুসারে, তাঁহাদের হিতার্থে, কেবল সেই প্রদেশের জন্ম, কোনও ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করিলে, হয় ত প্রদেশান্তরীয় প্রজারা অসন্তুষ্ট হইবেন, এই অমূলক, অকিঞ্চিৎকর আশঙ্কা করিয়া, সে বিষয়ে বৈমুখ্য অবলম্বন রাজধৰ্ম্ম নহে।

এরূপ প্রবাদ আছে, ভারতবর্ষের ভূতপূর্ব্ব গবর্ণর জেনেরেল, মহাত্ম। লার্ড বেন্টিক, অতি নৃশংস সহগমনপ্রণা রহিত করিবার নিমিত্ত, কৃতসঙ্কল্প হইয়া, প্রধান প্রধান রাজপুরুষদিগকে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন। তাঁহারা সকলেই স্পষ্ট বাক্যে কহিয়া- 'ছিলেন, এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিলে, ভারতবর্ষের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত, স্বাবতীয় লোক যৎপরোনাস্তি অসন্তুষ্ট হইবেকু, এবং, নিঃসন্দেহ, রাজবিদ্রোহে অভ্যুত্থান করিবেক। মহামতি, মহাসত্ত্ব গবর্ণর জেনেরেল, এই সকল কথা শুনিয়া, ভীত বা হতোৎসাহ না হইয়া কহিলেন, যদি, এই প্রথা রহিত করিয়া, এক দিন আমাদের রাজ্য থাকে, তাহা হইলেও, ইঙ্গরেজ- জাতির নামের যথার্থ গৌরব ও রাজ্যাধিকারের সম্পূর্ণ সার্থকতা হইবেক। তিনি, প্রজার দুঃখদর্শনে, দয়ার্দ্রচিত্ত ও স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া, এই মহৎ কার্য্য সম্পন্ন করিয়াছিলেন। এক্ষণে আমরা সেই ইঙ্গরেজজাতির অধিকারে বাস করিতেছি। কিন্তু, অবস্থার কত পরিবর্ত হইয়াছে। যে ইঙ্গরেজজাতি, স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া, রাজ্যভ্রংশভয় অগ্রাহ্য করিয়া, প্রজার দুঃখবিমোচন করিয়াছেন; এক্ষণে, স্বতঃপ্রবৃত্ত হওয়া দূরে থাকুক, প্রজারা, বারংবার প্রার্থনা করিয়াও, কৃতকার্য্য হইতে পারিতেছে না। হায়।

. "তে কেহপি দিবসা গতাঃ”।

সে এক দিন গিয়াছে।

যাহা হউক, আবেদনকারীদের অভিমত ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করিলে, গবর্ণমেন্ট এ প্রদেশের মুসলমান, বা অন্যান্য প্রদেশের হিন্দু, মুসলমান, উভয়বিধ, প্রজাবর্গের নিকট অপরাধী হইবেন; অথবা, প্রজাবর্গ অসন্তুষ্ট হইবেন, এই ভয়ে অভিভূত হইয়া, আবেদিত বিষয়ে বৈমুখ্য অবলম্বন করিবেন, এ কথা, কোনও মতে, শ্রদ্ধেয় হইতে পারে না। ইঙ্গরেজজাতি তত নির্বোধ, তত অপদার্থ, তত কাপুরুষ নহেন। যেরূপ শুনিতে পাই, তাঁহারা, রাজ্যভোগের লোভে আকৃষ্ট হইয়া, এ দেশে অধিকার বিস্তার করেন নাই; সর্বাংশে এ দেশের শ্রীবৃদ্ধিসাধনই তাঁহাদের রাজ্যাধিকারের সর্বপ্রধান উদ্দেশ্য।

এ স্থলে, একটি কুলীনমহিলার আক্ষেপোক্তির উল্লেখ না করিয়া, ক্ষান্ত থাকিতে পারিলাম না। ঐ কুলীনমহিলা ও তাঁহার কনিষ্ঠা ভগিনীর সহিত সাক্ষাৎ হইলে, জ্যেষ্ঠা জিজ্ঞাসা করিলেন, আবার না কি বহুবিবাহ নিবারণের চেষ্টা হইতেছে। আমি কহিলাম, কেবল চেষ্টা নয়, যদি তোমাদের কপালের জোর থাকে, আমরা এ বারে কৃতকার্য্য হইতে পারিব। তিনি কহিলেন, যদি আর কোনও জোর না থাকে, তবে তোমরা কৃতকার্য্য হইতে পারিবে না; কুলীনের মেয়ের নিতান্ত পোড়া কপাল; সেই পোড়া কপালের জোরে, যত হবে, তা আমরা বিলক্ষণ জানি। এই বলিয়া, মৌন অবলম্বন পূর্বক, কিয়ৎ ক্ষণ, ক্রোড়- স্থিত শিশু কন্যাটির মুখ নিরীক্ষণ করিলেন; অনন্তর, সজল নয়নে, আমার দিকে চাহিয়া কহিলেন, বহুবিবাহ প্রথার নিবারণ হইলে, আমাদের আর কোনও লাভ নাই; আমরা এখনও যে মুখ ভোগ করিতেছি, তখনও সেই সুখ ভোগ করিব; তবে যে হতভাগীরা আমাদের গর্ভে জন্ম গ্রহণ করে; যদি তাহারা, আমাদের মত, চিরদুঃখিনী না হয়, তাহা হইলেও আমাদের অনেক দুঃখ নিবারণ হয়। এইরূপ আক্ষেপ করিয়া, সেই কুলীন- মহিলা কহিলেন, সকলে বলে, এক স্ত্রীলোক আমাদের দেশের রাজা; কিন্তু, আমরা সে কথায় বিশ্বাস করি না; স্ত্রীলোকের রাজ্যে, স্ত্রীজাতির এত দুরবস্থা হইবেক কেন। এই কথা বলিবার সময়, তদীয় ম্লান বদনে বিষাদ ও নৈরাশ্য এরূপ সুস্পষ্ট ব্যক্ত হইতে লাগিল যে, আমি দেখিয়া, শোকে, একান্ত অভিভূত হইয়া, অবিশ্রান্ত অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলাম।

হা বিধাতঃ! তুমি কি কুলীনকন্যাদের কপালে, নিরবচ্ছিন্ন ক্লেশভোগ ভিন্ন, আর কিছুই লিখিতে শিখ নাই। উল্লিখিত কুলীনমহিলার হৃদয়বিদারণ আক্ষেপবাক্য আমাদের অধীশ্বরী করুণাময়ী ইংলণ্ডেশ্বরীর কর্ণগোচর হইলে, তিনি সাতিশয় লজ্জিত ও নিরতিশয় দুঃখিত হন, সন্দেহ নাই।

এই দুই কুলীনমহিলার সংক্ষিপ্ত পরিচয় এই; ইহারা দুপুরুষিয়া ভঙ্গকুলীনের কন্যা এবং স্বকৃতভঙ্গ কুলীনের বনিতা। জ্যেষ্ঠার বয়ঃক্রম ২০, ২১ বৎসর; কনিষ্ঠার বয়ঃক্রম ১৬, ১৭ বৎসর। জ্যেষ্ঠার স্বামীর বয়ঃক্রম ৩০ বৎসর; তিনি, এ পর্য্যন্ত, ১২টি মাত্র বিবাহ করিয়াছেন। কনিষ্ঠার স্বামীর বয়ঃক্রম ২৫, ২৬ বৎসর; তিনি, এ পর্য্যন্ত, ২৫ টির অধিক বিবাহ করিতে পারেন নাই।

উপসংহার।

রাজশাসন দ্বারা বহুবিবাহ প্রথার নিবারণচেষ্টা বিষয়ে, আমি যে সকল আপত্তি' শুনিতে পাইয়াছি, উহাদের নিরাকরণে যথাশক্তি যত্ন করিলাম। আমার যত্ন কতদূর সফল হইয়াছে, বলিতে পারি না। যাঁহারা, দয়া করিয়া, এই পুস্তকে দৃষ্টিপাত করিবেন, তাঁহারা তাহার বিবেচনা করিতে পারিবেন। এ বিষয়ে, এতদ্ব্যতিরিক্ত, আরও কতিপয় আপত্তি উত্থাপিত হইতে পারে; সে সকলেরও উল্লেখ করা আবশ্যক।

প্রথম; কতকগুলি লোক বিবাহ বিষয়ে যথেচ্ছাচারী; ইচ্ছা হইলেই বিবাহ করিয়া, থাকেন। এরূপ ব্যক্তি সকল নিজে সংসারের কর্তা; সুতরাং, বিবাহ প্রভৃতি সাংসারিক বিষয়ে, অন্যদীয় ইচ্ছার বশবর্তী নহ্ণেন। ইঁহারা, স্বেচ্ছা অনুসারে, ২, ৩, ৪, ৫ বিবাহ করিয়া থাকেন। ইঁহারা আপত্তি করিতে পারেন, সাংসারিক বিষয়ে, মনুষ্য মাত্রের সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব ও স্বেচ্ছা অনুসারে চলিবার সম্পূর্ণ ক্ষমতা আছে; প্রতিবেশিবর্গের সে বিষয়ে কথা কহিবার, বা প্রতি- বন্ধক হইবার, অধিকার নাই। একাধিক বিবাহ করিতে, যাঁহাদের ইচ্ছা বা প্রবৃত্তি নাই; তাঁহারা, এক বিবাহে সন্তুষ্ট হইয়া, সংসারযাত্রা নির্বাহ করুন; আমরা তাঁহাদিগকে অধিক বিবাহ করিতে অনুরোধ করিক না। আমাদের * অধিক বিবাহ করিবার ইচ্ছা আছে, আমরা তাহা করিব; সে বিষয়ে, তাঁহারা দোষপ্রদর্শন বা আপত্তি উত্থাপন করিবেন কেন।

দ্বিতীয়; পিতা মাতা পুত্রের বিবাহ দিয়াছেন। বিবাহের পর, কন্যাপক্ষীয়দিগকে, বহুবিধ দ্রব্যসামগ্রী দিয়া, মধ্যে মধ্যে, জামাতার তত্ত্ব করিতে হয়। তত্ত্বের সামগ্রী মনোমত না হইলে, জামাতৃপক্ষীয় স্ত্রীলোকেরা অসন্তুষ্ট হইয়া থাকেন। কোনও কোনও স্থলে, এই অসন্তোষ এত প্রবল ও দুর্নিবার হইয়া উঠে যে, ঐ উপলক্ষে, পুনরায় পুত্রের বিবাহ দেওয়া আবশ্যক হয়।

তৃতীয়; কখনও কখনও, কোনও কারণে, বৈবাহিকদিগের পরস্পর বিলক্ষণ অস্বরস ঘটিয়া উঠে। তথাবিধ স্থলেও, পিতা মাতা, বৈবাহিককুলের উপর আক্রোশ করিয়া, পুনরায় পুত্রের দ্বিবাই দিয়া থাকেন।

চতুর্থ; কোনও কোনও স্থলে, অকারণে, বা অতি সামান্য কারণে, পুত্রবধূর উপর শাশুড়ীর উৎকট বিদ্বেষ জন্মে। তিনি, সেই বিদ্বেষের বশবর্ত্তিনী হইয়া, স্বামীকে সম্মত করিয়া, পুনরায় পুত্রের বিবাহ দেন।

পঞ্চম;-অধিক অলঙ্কার' দানসামগ্রী প্রভৃতি পাওয়া যাইতেছে, এই লোভে পড়িয়া, কোনও কোনও পিতা মাতা, কদাকারা কন্যার সহিত, পুত্রের বিবাহ দেন। সেই কদাকারা স্ত্রীর উপর পুত্রের অনুরাগ না জন্মিলে, পুনরায় তাহার বিবাহ দিতে হয়।

ষষ্ঠ;-অন্য কোনও লোভ নাই, কেবল কুটুম্বিতার বড় সুখ হইবেক; এ অনুরোধেও, পিতা মাতা, পুত্রের হিতাহিত বিবেচনা না করিয়া, তাহার বিবাহ দিয়া থাকেন। অনেক সময়ে, তাদৃশ স্থলেও, পুনরায় পুত্রেয় বিবাহ দিবার আবশ্য- কতা ঘটে।

যদি, রাজশাসন দ্বারা, বহুবিবাহপ্রথা রহিত হইয়া যায়; তাহা হইলে, পুত্রের বিবাহ বিষয়ে, পিতা মাতার যে যথেচ্ছ- চারিতা আছে, তাহার উচ্ছেদ হইবেক। সুতরাং, তাঁহাদেরও, এই প্রথার নিবারণ বিষয়ে, আপত্তি করিবার অধিকার ও আবশ্যকতা আছে। কিন্তু, এ পর্য্যন্ত, কোনও পক্ষ হইতে, তাদৃশ আপত্তি, স্পষ্ট বাক্যে, উচ্চারিত হয় নাই। সুতরাং, ঐরূপ আপত্তির নিরাকল্পণে প্রবৃত্ত হইবার প্রয়োজন নাই।

বহুবিবাহ প্রথার নিবারণ জন্য, আবেদনপত্র প্রদান বিষয়ে, যাঁহারা প্রধান উদেযাগী; কোনও কোনও পক্ষ হইতে, তাঁহা- দের উপর এই অপবাদ প্রবর্ত্তিত হইতেছে যে, তাঁহারা, নাম কিনিবার জন্য, দেশের অনিষ্ট সাধনে উদ্যত হইয়াছেন। এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, বিংশতি সহস্রের অধিক লোক আবেদন পত্রে স্বাক্ষর করিয়াছেন। ইঁহারা সকলে এত নির্বোধ ও এত অপদার্থ নহেন যে, এককালে সদসদ্বিবেচনাশূন্য হইয়া, কতিপয় ব্যক্তির নামক্রয়বাসনা পূর্ণ করিবার জন্য, স্ব স্ব নাম স্বাক্ষর করিবেন। নিম্নে কতিপয় স্বাক্ষরকারীর নাম নিদ্দিষ্ট হইতেছে;- বর্দ্ধমানাধিপতি শ্রীযুত মহারাজাধিরাজ মহাতাপচন্দ্র বাহাদুর নবদ্বীপাধিপতি শ্রীযুত মহারাজ সতীশচন্দ্র রায় বাহাদুর

শ্রীযুত রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ বাহাদুর (পাইকপাড়া) শ্রীযুত রাজা সত্যশরণ ঘোষাল বাহাদুর (ভূকৈলাস)

শ্রীযুত বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় (উত্তরপাড়া) শ্রীযুত বাবু রাজকুমার রায় চৌধুরী (বারিপুর)

শ্রীযুত রাজা পূর্ণচন্দ্র রায় (সাওড়াপুলী)

শ্রীযুত বাবু সারদাপ্রসাদ রায় (চকদিঘী)

শ্রীযুত বাবু যজ্ঞেশ্বর সিংহ (ভাস্তাড়া)

শ্রীযুত রায় প্রিয়নাথ চৌধুরী (টাকী) শ্রীযুত বাবু শিবনারায়ণ রায় (জাড়া)

শ্রীযুত বাবু শম্ভুনাথ পণ্ডিজ্ঞ,

শ্রীযুত বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

শ্রীযুত বাবু রাজেন্দ্র দত্ত

শ্রীযুত বাবু রামগোপাল ঘোষ

শ্রীযুত বাবু নৃসিংহ দত্ত

শ্রীযুত বাবু হীরালাল শীল

শ্রীযুত বাবু গোবিন্দচন্দ্র সেন

শ্রীযুত বাবু শ্যামচরণ মল্লিক

শ্রীযুত বাবু রাজেন্দ্র মল্লিক

শ্রীযুত বাবু হরিমোহন সেন

শ্রীযুত বাবু মাধবচন্দ্র সেন

শ্রীযুত বাবু রামচন্দ্র ঘোষাল শ্রীযুত বাবু ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল

শ্রীযুত বাবু রাজেন্দ্রলাল মিত্র শ্রীযুত বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র

শ্রীযুত বাবু দ্বারকানাথ মল্লিক

শ্রীযুত বাবু দুর্গাচরণ লাহা

শ্রীযুত বাবু কৃষ্ণকিশোর ঘোষ

শ্রীযুত বাবু শিবচন্দ্র দেব

শ্রীযুত বাবু দ্বারকানাথ মিত্র

শ্রীযুত বাবু শ্যামাচরণ সরকার

শ্রীযুত বাবু দয়ালচাঁদ মিত্র

শ্রীযুত বাবু কৃষ্ণদাস পাল

এক্ষণে, অনেকে বিবেচনা করিতে পারিবেন, এই সকল ব্যক্তিকে তত নির্বোধ ও তত অপদার্থ জ্ঞান করা সঙ্গত কি না। বহুবিবাহপ্রপ্তার নিবারণ হওয়া উচিত ও আবশ্যক, এরূপ সংস্কার না জন্মিলে, এবং তদর্থে রাজদ্বারে আবেদন করা পরামর্শসিদ্ধ বোধ না হইলে, ইঁহারা, কেবল অন্যের অনুরোধে, বা অন্যবিধ কারণ বশতঃ, আবেদনপত্রে নাম স্বাক্ষর করিবার লোক নহেন। আর, বহুবিবাহপ্রথা নিবারিত হইলে, দেশের অনিষ্টসাধন হইবেক, এ কথার অর্থগ্রহ, করিতে পারা যায় না। বহুবিবাহ প্রথা যে, যার পর নাই, অনিষ্টের কারণ হইয়া উঠিয়াছে, তাহা, বোধ হয়, চক্ষু কর্ণ হৃদয় বিশিষ্ট কোনও ব্যক্তি অস্বীকার করিতে পারেন না। সেই নিরতিশয় অনিষ্ট- কর বিষয়ের নিবারণ হইলে, দেশের অনিষ্টসাধন হইবেক, আপত্তিকারী মহাপুরুষদের মত সূক্ষ্মদর্শী না হইলে, তাহা বিবেচনা করিয়া স্থির করা দুরূহ। যাহা হউক, ইহা নির্ভয়ে ও নিঃসংশয়ে নির্দেশ করা যাইতে পারে, যাঁহারা, বহুবিবাহ- প্রথার নিবারণের জন্য, রাজদ্বারে আবেদন করিয়াছেন, স্ত্রী- জাতির দুরবস্থাবিমোচন ও সমাজের দোষসংশোধন ভিন্ন, তাঁহাদের অন্য কোনও উদ্দেশ্য বা অভিসন্ধি নাই।

পরিশিষ্ট

পুস্তকের চতুর্থ প্রকরণে, বিবাহব্যবসায়ী ভঙ্গকুলীনদিগের বাস, বয়স, বিবাহসংখ্যার যে. পরিচয় প্রদত্ত হইয়াছে, সে বিষয়ে কিছু বলা আবশ্যক। তাদৃশ ভঙ্গকুলীনদিগের পৈতৃক বাসস্থান নাই; কতকগুলি পিতার মাতুলালয়ে, কতকগুলি নিজের মাতুলালয়ে, কতকগুলি পুত্রের মাতুলালয়ে অবস্থিতি করিয়া থাকেন; আর কতকগুলি কখন কোন আলয়ে অবস্থিতি করেন, তাহার স্থিরতা নাই। সুতরাং, তাঁহাদের যে বাসস্থান নির্দিষ্ট হইয়াছে, কোনও কোনও স্থলে, তাহার বৈলক্ষণ্য লক্ষিত হইতে পারে। তাঁহাদের বয়ঃক্রম বিষয়ে বক্তব্য এই যে, এই বিষয় পাঁচ বৎসর পূর্ব্বে সংগৃহীত হইয়াছিল; সুতরাং, এক্ষণে তাঁহাদের পাঁচ বৎসর অধিক বয়স হইয়াছে; এবং, হয় ত, কেহ কেহ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইয়াছেন। আর, বিবাহসংখ্যা দৃষ্টি করিয়া, কেহ কেহ বলিতে পারেন, অধিকবয়স্কদিগের বিবাহের সংখ্যা যেরূপ অধিক, অল্পবয়স্কদিগের সেরূপ অধিক দৃষ্ট হইতেছে না; ইহাতে বোধ হইতেছে, এক্ষণে বিবাহ- ব্যবসায়ের অনেক হ্রাস হইয়াছে। এ বিষয়ে বক্তব্য এই যে, যাঁহাদের বিবাহের সংখ্যা অধিক, এক দিনে, এক মাসে, বা এক বৎসরে, তাঁহারা তত বিরাহ করেন নাই; তাঁহাদের বিবান্ধের সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছে, এবং সহ্যাপি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইতেছে। ভঙ্গকুলীনেরা, জীবনের অন্তিম ক্ষণ পর্য্যন্ত, বিবাহ করিয়া থাকেন। এই পাঁচ বৎসরে, অল্পবয়স্ক দলের মধ্যে, অনেকের বিবাহসংখ্যা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছে; এবং, ক্রমে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়া, অধিক বয়সে, এক্ষণকার বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিদের সমান হইবেক, সে বিষয়ে কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। অতএব, উভয় পক্ষের বিবাহসংখ্যাগত বর্তমান বৈলক্ষণ্য দর্শনে, ভঙ্গকুলীন- দিগের বিবাহব্যবসায় আর পূর্বের মত প্রবল 'নাই, এরূপ সিদ্ধান্ত করা, কোনও মতে, ন্যায়ানুমোদিত হইতে পারে না।

প্রথম ক্রোড়পত্র

অতি অল্প দিন হইল, শ্রীযুত ক্ষেত্রপাল স্মৃতিরত্ন, শ্রীযুত নারায়ণ বেদরত্ন প্রভৃতি ত্রয়োদশ ব্যাক্তর স্বাক্ষরিত, বহুবিবাহবিষয়ক শাস্ত্রসম্মত বিচার নামে, এক পত্র প্রচারিত হইয়াছে। বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না, এতদ্বিষয়ক বিচারপুস্তক প্রচারিত হইবার পরে, ঐ বিচারপত্র আমার হস্তগত হয়। বহুবিবাহ শাস্ত্রসম্মত ব্যবহার, তাহা রহিত হওয়া কদাচ উচিত নহে; সর্বসাধারণের নিকট, ইহা প্রতিপন্ন করাই এই বিচারপত্র প্রচারের উদ্দেশ্য। স্বাক্ষরকারী মহাশয়েরা, স্বপক্ষ সমর্থনের অভিপ্রায়ে, স্মৃতি ও পুরাণের কতিপয় বচন প্রমাণ রূপে উদ্ধৃত করিয়াছেন। তন্মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রমাণ এই;-

১। একামুদ্রা তু কামার্থম্যাং বোটুং য ইচ্ছতি। • সমর্থস্তোষরিত্বার্থৈঃ পূর্ব্বোঢ়ামপরাং বহেৎ ॥ .

মদনপারিজাতন্বতস্তুতিঃ।

যে ব্যক্তি, এক স্ত্রী বিবাহ করিয়া, রতিকামনায় অন্ত স্ত্রী বিবাহ করিতে ইচ্ছা করেন, তিনি সমর্থ হইলে, পূর্ব্বপরিণীতাকে অর্থ

দ্বারা তুষ্টা করিয়া, অপর স্ত্রী বিবাহ করিবেন। ২। একৈব ভার্য্যা স্বীকার্য্য। ধর্ম্মকর্মোপযোগিনা। . প্রার্থনে চাতিরাগে চ গ্রাহমানেকা অপি দ্বিজ ।

স্বতন্ত্রগার্হস্থ্যধৰ্ম্ম প্রস্তাবে ব্রহ্মাগুপুরাণম্।

ধর্মকর্মোপযোগী ব্যক্তিদিগের এক ভাৰ্য্যা স্বীকার করা কর্তব্য, কিন্তু উপযাচিত হইয়া কেহ কন্যা প্রদানেচ্ছু হইলে, অথবা রতিবিষয়ক সাতিশয় অনুরাগ থাকিলে, তাঁহারা অনেক ভাৰ্য্যাও গ্রহণ করিবেন (১)।

এই দুই প্রমাণ দর্শনে, অনেঙ্কের অন্তঃকরণে, বহুবিবাহ শাস্ত্রানুগত ব্যবহার বলিয়া, প্রতীতি জন্মিতে পারে; এজন্য, এ বিষয়ে, কিছু বলা আবশ্যক হইতেছে। বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না, এতদ্বিষয়ক বিচারপুস্তকে দর্শিত হইয়াছে (২), শাস্ত্রকারেরা, বিবাহ বিষয়ে, চারি বিধি দিয়াছেন; সেই চারি বিধি অনুসারে, বিবাহ ত্রিবিধ নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য। প্রথম বিধির অনুযায়ী বিবাহ নিত্য বিবাহ; এই বিবাহ না করিলে, মনুষ্য গৃহস্থাশ্রমে অধিকারী হইতে পারে না। দ্বিতীয় বিধির অনুযায়ী বিবাহও নিত্য বিবাহ; তাহা না করিলে, আশ্রমভ্রংশ নিবন্ধন পাতকগ্রস্ত হইতে হয়। তৃতীয় বিধির অনুযায়ী বিবাহ নৈমিত্তিক বিবাহ; কারণ, তাহা স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব, চিররোগিত্ব প্রভৃতি নিমিত্ত বশতঃ করিতে হয়। চতুর্থ বিধির অনুযায়ী বিবাহ কাম্য বিবাহ; এই বিবাহ, নিত্য ও নৈমিত্তিক বিবাহের ন্যায়, অবশ্যকর্ত্তব্য নহে; উহা পুরুষের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন; অর্থাৎ, ইচ্ছা হইলে, তাদৃশ বিবাহ করিতে পারে, এই মাত্র। 

পুত্রলাভ ও ধৰ্ম্মকার্য্যসাধন গৃহস্থাশ্রমের উদ্দেশ্য। দারপরি- গ্রহ ব্যতিরেকে, এ উভয় সম্পন্ন হয় না'; এ নিমিত্ত, প্রথম বিধিতে, দারপরিগ্রহ গৃহস্থাশ্রমপ্রবেশের দ্বারস্বরূপ, ও গৃহস্থা- শ্রমসমাধানের অপরিহার্য্য উপায়স্বরূপ, নিদ্দিষ্ট হইয়াছে। গৃহস্থাশ্রম সম্পাদনকালে, স্ত্রীবিয়োগ ঘটিলে, যদি পুনরায় কিবাহ না করে; তবে সেই দারবিরহিত ব্যক্তি আশ্রমভ্রংশ নিবন্ধন পাতকগ্রস্ত হয়; এজন্য, ঐ অবস্থায়, গৃহস্থ ব্যক্তির পক্ষে, পুনরায় দারপরিগ্রহের অবশ্যকর্ত্তব্যতা বোধনের নিমিত্ত, শাস্ত্রকারেরা দ্বিতীয় বিধি প্রদান করিয়াছেন। স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব, চিররোগিত্ব প্রভৃতি দোষ ঘটিলে, পুত্রলাভ ও ধর্ম্মকার্য্যসাধনের ব্যাঘাত ঘটে; এজন্য, শাস্ত্রকারেরা, তাদৃশ স্থলে, স্ত্রীসত্বে, পুনরায় বিবাহ করিবার তৃতীয় বিধি দিয়াছেন। গৃহস্থাশ্রম সমাধানের নিমিত্ত, শাস্ত্রোক্ত বিধান অনুসারে সবর্ণা পরিণয়ের পর, যদি কোনও উৎকৃষ্ট বর্ণ, যদৃচ্ছা ক্রমে, বিবাহে প্রবৃত্ত হয়; তাহার পক্ষে অসবর্ণাবিবাহে অধিকার বোধনের নিমিত্ত, শাস্ত্রকারেরা চতুর্থ বিধি প্রদর্শন করিয়াছেন; এবং, এই বিধি দ্বারা, তাদৃশ ব্যক্তির, তথাবিধ স্থলে, সবর্ণাবিবাহ এক বারে নিষিদ্ধ হইয়াছে।

স্মৃতিরত্ন, বেদরঞ্জ প্রভৃতি মহাশয়দিগের অবলম্বিত প্রথম ও দ্বিতীয় প্রমাণে, যে বিবাহের বিধি পাওয়া যাইতেছে, তাহা কাম্য বিবাহ; কারণ, প্রথম প্রমাণে, “যে ব্যক্তি, এক স্ত্রী বিবাহ করিয়া, রতিকামনায় অন্য স্ত্রী বিবাহ করিতে ইচ্ছা করেন”; এবং, দ্বিতীয় প্রমাণে, "রতিবিষয়ক সাতিশয় অনুরাগ থাকিলে, তাঁহারা অনেক ভার্য্যাও গ্রহণ করিবেন"; এইরূপে, কাম্য বিবাহের স্পষ্ট পরিচয় প্রদত্ত হইয়াছে। রতিকামনা ও রতিবিষয়ক সাতিশয় অনুরাগ বশতঃ, যে বিবাহ করা হইবেক, তাহা কাম্য বিবাহ ব্যতিরিক্ত নামান্তর দ্বারা উল্লিখিত হইতে পারে না। মনু, কাম্য বিবাহের স্থলে, অসবর্ণাবিবাহের বিধি দিয়াছেন; এবং, সেই বিধি দ্বারা, উথাবিধ স্থলে, সবর্ণাবিবাহ এক বারে নিষিদ্ধ হইয়াছে। সুতরাং, স্মৃতিরত্ন, বেদরত্ন প্রভৃতি মহাশয় দিগের অবলম্বিত প্রথম ও দ্বিতীয় প্রমাণ দ্বারা, ইহাই প্রতিপন্ন হইতেছে, যে ব্যক্তি, সবর্ণ। বিবাহ করিয়া, রতিকামনায় পুনরায় বিবাহ করিতে উদ্যত হয়, সে অসবর্ণা বিবাহ করিতে পারে; নতুবা, যদৃচ্ছা ক্রমে বিবাহপ্রবৃত্ত ব্যক্তি, রতিকামনা পূর্ণ করিবার নিমিত্ত, পূর্ব্বপরিণীতা সজাতীয়া স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় সজাতীয়া বিবাহ করিবেক, ইহা কোনও ক্রমে প্রতি- পন্ন হইতে পারে না। মদনপারিজাতধৃত স্মৃতিবাক্যে ও ব্রহ্মাণ্ড- পুরাণবচনে, সামান্য আকারে, কাম্য বিবাহের বিধি আছে; তাদৃশবিবাহাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি সবর্ণা বা অসবর্ণা বিবাহ করিবেক, তাহার কোনও নির্দেশ নাই। মনু কাম্য বিবাহের বিধি দিয়াছেন, এবং তাদৃশবিবাহাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি অসবর্ণা বিবাহ করিবেক, স্পষ্টাক্ষরে নির্দেশ করিয়াছেন। এমন স্থলে, মনুবাক্যের সহিত একবাক্যতা সম্পাদন করিয়া, উল্লিখিত স্মৃতিবাক্য ও পুরাণবাক্যকে অসবর্ণা বিবাহবিষয়ক বলিয়া ব্যবস্থা করাই প্রকৃত শাস্ত্রার্থ, সে বিষয়ে, কোনও অংশে, কিছু মাত্র, সংশয় বা আপত্তি হইতে পারে না। অতএব, ঐ দুই প্রমাণ অবলম্বন করিয়া, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহ কাণ্ড শাস্ত্র- সম্মত ব্যবহার, ইহা প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করা নিতান্ত নিষ্ফল প্রয়াস মাত্র।

স্মৃতিরত্ন, বেদরত্ন প্রভৃতি মহাশয়দিগের অবলম্বিত তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, অষ্টম, নবম, ও দশম প্রমাণ অস্বর্ণাবিবাহবিষয়ক বচন। অসবর্ণাবিবাহ ব্যবহার বহু কাল' রহিত হইয়াছে; সুতরাং, এ স্থলে, সে বিষয়ে কিছু বলিবার প্রয়োজন নাই। তাঁহাদের অবলম্বিত অবশিষ্ট প্রমাণে, এক ব্যক্তির অনেক স্ত্রী বিদ্যমান থাকার উল্লেখ আছে; কিন্তু, উহা দ্বারা, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রসম্মত বলিয়া প্রতিপন্ন হইতে পারে না। ঐ সকল প্রমাণ সর্ববাংশে পরস্পর এত অনুরূপ যে, একটি প্রদর্শিত হইলেই, সকলগুলি প্রদর্শিত করা হইবেক; এজন্য, এ স্থলে একটি মাত্র উদ্ধৃত হইতেছে;-

৭। সর্ববাসামেকপত্নীনামেকা চেৎ পুত্রিণী ভবেৎ।

সর্ববাস্তাস্তেন পুত্রেণ প্রাহ পুত্রবর্তীষ্মনুঃ । (৩) সজাতীয়া বহু স্ত্রীর মধ্যে, যদি একটি স্ত্রী পুত্রবতী হয়; তবে, সেই পুত্র দ্বারা, সকল স্ত্রীকেই মন্ত্র পুত্রবর্তী কহিয়াছেন। এই মনুবচনে, অথবা এতদনুরূপ অন্যান্য মুনিবচনে, এরূপ কিছুই নিদ্দিষ্ট নাই যে, তদ্দ্বারা, শাস্ত্রোক্ত নিমিত্ত ব্যতিরেকে, লোকের ইচ্ছাধীন বহুভার্য্যাবিরাহ প্রতিপন্ন হইতে পারে। উল্লিখিত বচনসমূহে, যে বহুভার্য্যাবিবাহের পরিচয় পাওয়া যাইতেছে, তাহা অধিবেদনের নির্দিষ্ট নিমিত্ত নিবন্ধন, তাহার সন্দেহ নাই (৪)।

ফলকথা এই, যখন শাস্ত্রকারেরা, কাম্য বিবাহের স্থলে, কেবল অসবর্ণাবিবাহের বিধি দিয়াছেন; যখন ঐ বিধি দ্বারা, পূর্বপরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, যদৃচ্ছা ক্রমে সবর্ণাবিবাহ সর্বতোভাবে নিষিদ্ধ হইয়াছে; যখন উল্লিখিত বিবাহ সকল অধিবেদনের নিদ্দিষ্ট নিমিত্ত বশতঃ ঘটা সম্পূর্ণ সম্ভব হই- তেছে; তখন, যদৃচ্ছা ক্রমে, যত ইচ্ছা বিবাহ করা শাস্ত্রকার- দিগের অনুমোদিত কার্য্য, ইহা কোনও মতে প্রতিপন্ন হইতে পারে না। বস্তুতঃ, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত' বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রানুমত ব্যবহার নহে। আর, তাদৃশ বহুবিবাহকাণ্ড ন্যায়ানুগত ব্যবহার কি না, সে বিষয়ে কিছু বলা নিতান্ত নিষ্প্রয়োজন। বহুবিবাহ যে অতিজঘন্য, অতিনৃশংস ব্যবহার, কোনও মতে ন্যায়ানুগত নহে, তাহা, যাঁহাদের সামান্যরূপ বুদ্ধি ও বিবেচনা আছে, তাঁহারাও অনায়াসে বুঝিতে পারেন। ফলতঃ, যে মহাপুরুষেরা স্বয়ং বহুবিবাহপাপে লিপ্ত, তদ্ব্যতিরিক্ত কোনও ব্যক্তি, বহু- বিবাহ ব্যবহারের রক্ষা বিষয়ে, চেষ্টা করিতে পারেন; অথবা, অন্য কেহ বহুবিবাহপ্রথা নিবারণের উদ্যোগ করিলে, দুঃখিত হইতে পারেন; কিংবা, তাহা নিবারিত হইলে, লোকের ধৰ্ম্মলোপ বা দেশের সর্বনাশ হইল, মনে ভাবিতে পারেন; এত দিন, আমার সেরূপ বোধ ছিল না। বলিতে কি, স্মৃতি- রত্ন, বেদরত্ন প্রভৃতি মহাশয়দিগের অধ্যবসায় দর্শনে, আমি বিস্ময়াপন্ন হইয়াছি। বহুবিবাহ নিবারণের চেষ্টা হইতেছে দেখিয়া, তাঁহারা সাতিশয় দুঃখিত ও বিলক্ষণ কুপিত হইয়া- ছেন; এবং, ধর্ম্মরক্ষিণী সভার অধ্যক্ষেরা এ বিষয়ে চেষ্টা করিতেছেন বলিয়া, তাঁহাদের প্রতি স্বেচ্ছাচারী, শাস্ত্রানভিজ্ঞ, কুটিলমতি, অপরিণামদর্শী প্রভৃতি কটূক্তি প্রয়োগ করিয়াছেন। আমার বোধে, এ ভাবে এ বিচারপত্র প্রচারিত করা, স্মৃতিরত্ন, বেদরত্ন প্রভৃতি মহাশয়দিগের পক্ষে, সুবোধের কার্য্য হয় নাই। 

অনেকের মুখে শুনিতে পাই, তাঁহারা, কল্কিাতাস্থ রাজকীয় সংস্কৃতবিদ্যালয়ে ব্যাকরণশাস্ত্রের অধ্যাপক শ্রীযুত তারানাথ তর্ক- বাচস্পতি ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের পরামর্শে, সহায়তায়, ও উত্তেজনায়, বহুবিবাহবিষয়ক শাস্ত্রসম্মত বিচারপত্র প্রচারিত করিয়াছেন। কিন্তু, সহসা এ বিষয়ে বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হইতেছে না। তর্কবাচস্পতি মহাশয় এত অনভিজ্ঞ নহেন যে, এরূপ অসমীচীন আচরণে দূষিত হইবেন। পাঁচ বৎসর পূর্বে, যখন, বহুবিবাহ প্রথার নিবারণ প্রার্থনায়, রাজদ্বারে আবেদন করা হয়; সে সময়ে, তিনি এ বিষয়ে বিলক্ষণ অনুরাগী ছিলেন; এবং, স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া, নিরতিশয় আগ্রহ ও উৎসাহ সহকারে, আবেদনপত্রে নাম স্বাক্ষর করিয়াছেন। এক্ষণে, তিনিই আবার, বহু বিবাহের রক্ষাপক্ষ অবলম্বন করিয়া, এই লজ্জাকর, ঘৃণাকর, অনর্থকর, অধৰ্ম্মকর ব্যবহারকে শাস্ত্রসম্মত বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে প্রয়াস পাইবেন, ইহা সম্ভব বোধ হয় না।

কাশীপুর

২৪এ শ্রাবণ। সংবৎ ১৯২৮।

}. শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্মা

দ্বিতীয় ক্রোড়পত্র।

আমার দৃঢ় সংস্কার এই, এ দেশে যে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত আছে, তাহা যদৃচ্ছাপ্রবৃত্তব্যবহারমূলক, শাস্ত্রানুমত ব্যবহার নহে।। তদনুসারে, বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না, এতদ্বিষয়ক বিচারপুস্তকে, তাদৃশ বিবাহকাণ্ড শাস্ত্রনিষিদ্ধ বলিয়া প্রদর্শিত হইয়াছে। কিন্তু, কলিকাতাস্থ সংস্কৃতকালেজে, ব্যাকরণশাস্ত্রের অধ্যাপক, শ্রীযুত তারানাথ তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের, ও কাব্য- শাস্ত্রের অধ্যাপক শ্রীযুত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের মতে, তাদৃশ বহুবিবাহব্যবহার শাস্ত্রানুমত কার্য্য। ইঁহারা এ বিষয়ে স্বস্ব অভিপ্রায় প্রচারিত করিয়াছেন। তর্কবাচস্পতি মহাশয় ও বিদ্যাভূষণ মহাশয়, উভয়েই, প্রসিদ্ধ পণ্ডিত। ঈদৃশ পণ্ডিতদ্বয়ের বিপরীত ব্যবস্থা দর্শনে, লোকের অন্তঃকরণে, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহু- বিবাহকাণ্ড শাস্ত্রানুমত ব্যবহার বলিরা, প্রতীতি জন্মিতে পারে; এজন্য, এ বিষয়ের আলোচনা করা আবশ্যক।

প্রথমতঃ, শ্রীযুত তারানাথ তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের বহুবিবাহ- বিষয়ক অভিপ্রায় উদ্ধৃত ও আলোচিত হইতেছে-

"সম্প্রতি কল্যাণভাজন শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র ব্যিাসাগর ভট্টাচার্য্য মহোদয় বহুবিবাহবিষয়ক যে একথানি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করিয়াছেন, তাহার উপসংহারে লিখিত আছে "অনেকের মুখে শুনিতে পাই, তাঁহারা কলিকাতাস্থ রাজকীয় সংস্কৃতবিদ্যালয়ে ব্যাকরণশাস্ত্রের অধ্যাপক শ্রীযুত তারানাথ তর্কবাচস্পতি ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের পরামর্শে, সহায়তায়, ও উত্তেজনায়, বহুবিবাহবিষয়ক শাস্ত্রসম্মত বিচারপত্র প্রচারিত করিয়া- ছেন। কিন্তু, সহসা, এ বিষয়ে বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হইতেছে না।" বিজ্ঞাসাগর ভট্টাচার্য্যের সহিত আমার যে প্রকার চিরপ্রণয়, আত্মীয়তা ও সম্বন্ধ আছে তাহাতে পরমুখে শ্রবণ মাত্রেই উহা প্রচার না করিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করা উচিন্ত ছিল। এককালে শোনা কথা প্রচার করা "ব্যিাসাগরসদৃশ ব্যক্তির উপযুক্ত ও কর্তব্য হয় না। তিনি কি জানেন না যে তাঁহার কথার মূল্য কত? যাহা হউক বিস্তাসাগরের হঠকারিতাদর্শনে আমি বিস্থিত ও আন্তরিক দুঃখিত হইয়াছি। ফলতঃ বিস্তাসাগর মিথ্যাবাদী লোক দ্বারা বঞ্চিত ও মোহিত হইয়াছেন। আমি উক্ত বিষয়ে পরামর্শ, সহায়তা ও উত্তেজনা কিছুই করি নাই। তবে প্রায় একমাস গত হইল, সনাতনধৰ্ম্মরক্ষিণী সভা পরিত্যাগ করিবার কয়েকটা কারণ মধ্যে বহুবিবাহ শাস্ত্রসম্মত ইহার প্রামাণ্যার্থে একটী বচন উদ্ধৃত করিয়া লিখিয়াছিলাম, যে বহুবিবাহ শাস্ত্রসম্মত বিষয়, তাহার রহিতকরণ বিষয়ে ধৰ্ম্মসভার হস্তক্ষেপ করা অন্তায়, তাহাতেই যদি বিস্তাসাগরের নিকটে কেহ সহায়তা করা কহিয়া থাকে বলিতে পারি না। কিন্তু সম্পাদক মহাশয়! বহুবিবাহ যে শাস্ত্রসম্মত ইহা আমার চিরসিদ্ধান্ত আছে এবং বরাবর কহিয়া আসিতেছি এবং এক্ষণেও কহিতেছি যে, বহু বিবাহ সর্ব্বদেশপ্রচলিত, সর্ব্বশাস্ত্রসম্মত ও চিত্রপ্রচলিত, তদ্বিষয়ে বিস্তাসাগরের মতের সহিত আমার মতের ঐক্য না হওয়ায় দুঃখিত হইলাম। তিনি বহু বিবাহের অশাস্ত্রীয়তা প্রতি- পাদনার্থে যেরূপ শাস্ত্রের অভিনব অর্থ ও যুক্তির উদ্ভাবন করিয়াছেন, অবশ্য বুদ্ধির প্রশংসা করিতে হয়; কিন্তু বিবেচনা করিয়া দেখিলে ঐ অর্থ ও যুক্তি শাস্ত্রানুমোদিত বা সঙ্গত বলিয়া বোধ হয় না। এস্থলে ইহাও বক্তব্য যে, বহুবিবাহ শাস্ত্রসম্মত হইলেও ভঙ্গকুলীন ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে যে প্রণালীতে উহা সম্পন্ন হুইয়া আসিতেছিল এবং কৃতক পরিমাণে এপর্য্যন্ত প্রচলিত আছে তাহা অত্যন্ত ঘৃণাকর লজ্জাকর ও নৃশংস, ইহা বিলক্ষণ আমার অন্তরে জাগরূক আছে এবং উহার নিবারণ হয় ইহাতে আমার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল এবং আছে। অধিক কি এই জন্য ৫। ৬ বৎসর গত হইল "তৎকালে উপায়ান্তর নাই বিবেচনা করিয়া সামাজিক বিষয়. হইলেও" নিরতিশয় আগ্রহ ও উৎসাহ সহকারে স্বতঃ প্রবৃত্ত হইয়া ঐ বিষয়ের নিবারণার্থে আইন প্রস্তুত করিবার জন্য রাজদ্বারে আবেদনপত্রেও স্বাক্ষর করিয়া তদ্বিষয় সম্পাদনার্থ বিশেষ উদ্যোগী ছিলাম, কিন্তু এক্ষণে দেখিতেছি, বিদ্যাচর্চ্চার প্রভাবে বা যে কারণে হউক ঐ কুৎসিত বহুবিবাহপ্রণালী অনেক পরিমাণে ন্যূন হইয়াছে। আমার বোধ হয় অল্পকাল মধ্যে উহা এককালে অন্তর্হিত হইবে অতএব তজ্জন্য আর আইনের আব্যকতা নাই। সকল সময়ে, সকল আইন আবশ্যক হয় না। এই নিমিত্তই ব্যবস্থাপক সমাজ হইতে বর্ষে বর্ষে আইন পরিবর্তিত হয়।

শ্রীতারানাথ তর্কবাচস্পতি। (১)"

এস্থলে, তর্কবাচস্পতি মহাশয়, বহু বিবাহ শাস্ত্রসম্মত ব্যবহার বলিয়া, তাঁহার চিরসিদ্ধান্ত আছে, এই মাত্র নির্দেশ করিয়াছেন; সেই সিদ্ধান্তকে প্রমাণ দ্বারা প্রতিপন্ন করেন নাই। গত ১৬ই শ্রাবণ, তিনি ধর্ম্মরক্ষিণী সভায় যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহাতে শাস্ত্র ও যুক্তি প্রদর্শিত হইয়াছে। উল্লিখিত পত্রের তৎসংক্রান্ত অংশ এই,-

“একামুঢ়া তু কামার্থম্যাং বোটুং য ইচ্ছতি।

সমর্থন্তোষয়িত্বার্থৈঃ পূর্ব্বোঢ়ামপরাং বহেৎ ॥ এই মদনপারিজাতন্বত স্মৃতিবাক্য দ্বারা নির্ণীত আছে যে, যে ব্যক্তি এক স্ত্রী বিবাহ করিয়া কামার্থে অন্য স্ত্রী বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে ঐ ব্যক্তি সমর্থ হইলে অর্থ দ্বারা পূর্ব্বপরিণীতাকে তুষ্টা করিয়া অপরা স্ত্রীকে বিবাহ করিবে। এইমত' শাস্ত্র থাকায় এবং দক্ষপ্রজাপতির ক্যাগণ ধৰ্ম্ম প্রভৃতি মহাত্মাগণ এককালে বিবাহ করা, যাজ্ঞবন্ধ্য' প্রভৃতি মুনিগণ এবং দশরথ যুধিষ্ঠিরাদি রাজগণ এমত সাচার করিয়াছিলেন তাহা বেদ ও পুরাণে সুপ্রসিদ্ধ আছে ঐ মত অবিগীত শিষ্টাচার- পরম্পরানুমোদিত বহু বিবাহ শাস্ত্রসম্মত তাহা অবস্থত হইয়াছে এবং এতদ্দেশীয় কুলীন বা অন্য মহাত্মাগণ এবং অন্যান্য বহুদেশীয় হিন্দুসমাজ- গণে এই আচার প্রচলিত আছে তাহা নিবারণার্থে একটা ব্যবস্থা করা হইয়াছে।"

তর্কবাচস্পতি মহাশয়কে অবশ্য স্বীকার করিতে হইবেক, মদনপারিজাতধৃত স্মৃতিবাক্যে যে বিবাহের বিধি দৃষ্ট হইতেছে, তাহা কাম্য বিবাহ। মনু, কাম্য, বিবাহ স্থলে, অসবর্ণাবিবাহের বিধি দিয়াছেন; ঐ বিধি দ্বারা, তথাবিধ স্থলে, সবর্ণাবিবাহ একবারে নিষিদ্ধ হইয়াছে। সুতরাং, মদনপারিজাতধৃত স্মৃতি- বাক্য দ্বারা ইহাই প্রতিপন্ন হইতেছে, যে ব্যক্তি, যথাবিধি সবর্ণাবিবাহ করিয়া, যদৃচ্ছা ক্রমে, পুনরায়, বিবাহ করিতে উদ্যত হয়, সে অসবর্ণা বিবাহ করিতে পারে; নতুবা, যদৃচ্ছা ক্রমে বিবাহপ্রবৃত্ত ব্যক্তি, রতিকামনা পূর্ণ করিবার নিমিত্ত, পূর্ব্বপরিণীতা সজাতীয়া স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায়, সজাতীয়া বিবাহ্ন করিবেক; ইহা, কোনও মতে, প্রতিপন্ন হইতে পারে না। মদনপারিজাতধৃত স্মৃতিবাক্যে, সামান্য আকারে, কাম্য বিবাহের বিধি আচ্ছে; তাদৃশ বিবাহাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি সবর্ণা বা অসবর্ণা বিবাহ করিবেক, তাহার কোনও উল্লেখ নাই। মনু কাম্য বিবাহেরু বিধি দিয়াছেন; এবং, তাদৃশ বিবাহাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি অসবর্ণা বিবাহ করিবেক, স্পষ্টাক্ষরে নির্দেশ করিয়াছেন। এমন স্থলে, মনুবাক্যের সহিত একবাক্যতা সম্পাদন করিয়া, মদনপারিজাতধৃত স্মৃতিবাক্যকে অসবর্ণাবিবাহবিষয়ক বলিয়া, ব্যবস্থা করাই প্রকৃত শাস্ত্রার্থ, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সংশয় বা আপত্তি হইতে পারে না। সুতরাং, মদনপারিজাতধৃত স্মৃতিবাক্য দ্বারা, তর্কবাচস্পতি" মহাশয়ের অভিমত যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুসবর্ণা- বিবাহ ব্যবহারের শাস্ত্রীয়তা, কোনও মতে, প্রতিপন্ন হইতেছে না।

যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহু বিবাহের কর্তব্যতা বিষয়ে, শাস্ত্ররূপ প্রমাণ প্রদর্শন করিয়া, অবিগীত শিষ্টাচার রূপ প্রমাণ দ্বারা, তাহার পোষকতা করিবার জন্য, তর্কবাচস্পতি মহাশয় দেবগণ, ঋষিগণ, ও পূর্ব্বকালীন রাজগণের আচারের উল্লেখ করিয়াছেন। অতএব, কিরূপ আচার প্রমাণ বলিয়া পরিগৃহীত হওয়া উচিত, তাহার আলোচনা করা আবশ্যক।

মনু কহিয়াছেন,

আচারঃ পরমো ধৰ্ম্মঃ শ্রুত্যুক্তঃ স্মার্ত্ত এব চ। ১। ১০৯। বেদবিহিত ও স্মৃতিবিহিত আচারই পরম ধৰ্ম্ম।

শাস্ত্রকারদিগের অভিপ্রায় এই, যে আচার বেদ ও স্মৃতির বিধি অনুযায়ী, তাহাই পরম ধৰ্ম্ম; লোকে তাদৃশ আচারেরই অনুষ্ঠান করিবেক; তদ্যতিরিক্ত অর্থাৎ বেদবিরুদ্ধ বা' স্মৃতি- বিরুদ্ধ আচার আদরণীয় ও অনুসরণীয় নহে। ঈদৃশ আচারের অনুসরণ করিলে, প্রত্যবায়গ্রস্ত হইতে হয়। অনেকে, শাস্ত্রীয় বিধি নিষেধ প্রতিপালনে অসমর্থ হইয়া, অবৈধ আচরণে দূষিত হইয়া থাকেন। এ কালে যেরূপ দেখিতে পাওয়া যায়, পূর্ব্ব কালেও সেইরূপ ছিল; অর্থাৎ, পূর্ব্ব কালেও অনেকে, শাস্ত্রীয় বিধি নিষেধ প্রতিপালনে অসমর্থ হইয়া, অবৈধ আচরণে, দূষিত হইতেন। তবে, পূর্ব্বকালীন লোকেরা তেজীয়ান ছিলেন; এজন্য, অবৈধ আচরণ নিমিত্ত, প্রত্যবায়গ্রস্ত হইতেন না। 

তাঁহারা অধিকতর শাস্ত্রজ্ঞ ও ধর্ম্মপরায়ণ ছিলেন; সুতরাং, তাঁহাদের আচার সর্বাংশে নির্দোষ; তাহার অনুসরণে দোষ- স্পর্শ হইতে পারে না; এরূপ ভাবিয়া, অর্থাৎ, পূর্ব্বকালীন লোকের আচার মাত্রই সদাচার, এই বিবেচনা করিয়া, তদনু- সারে, চলা উচিত নয়। তাঁহাদের যে আচার শাস্ত্রনিষিদ্ধ, তাহা অনুসরণীয় নহে; তাহার অনুসরণ করিলে, সাধারণ লোকের অধঃপাত অবধারিত।

আপস্তম্ব কহিয়াছেন,

দৃষ্টে। ধৰ্ম্মব্যতিক্রমঃ সাহসঞ্চ পূর্বেষাম্। ৮। তেষাং তেজোবিশেষেণ প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে। ৯। তদন্বীক্ষ্য প্রযুঞ্জানঃ সীদত্যবরঃ। ১০। (১)

পূর্ব্বকালীন লোকদিগের ধর্ম্মলঙ্ঘন ও অবৈধ আচরণ দেখিতে পাওয়া যায়। তাঁহারা তেজীয়ান্, তাহাতে তাঁহাদের প্রত্যবায় নাই। সাধারণ লোকে, তদীয় আচরণ_দর্শনে, তদনুবর্তী হইয়া চলিলে, এককালে উৎসন্ন হয়।

অতএব ইহা অবধারিত হইতেছে, বেদ ও স্মৃতির বিধি অনুযায়ী আচারই সাধারণ লোকের অনুসরণীয়, বেদ ও স্মৃতির বিরুদ্ধ আচার অনুসরণীয় নহে। বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না, এতদ্বিষয়ক বিচারপুস্তকে যেরূপ দর্শিত হইয়াছে, তদনুসারে, শাস্ত্রনির্দিষ্ট নিমিত্ত ব্যতিরেকে, যদৃচ্ছা ক্রমে বিবাহ করা স্মৃতিবিরুদ্ধ আচার। অতএব, যদিও ধৰ্ম্ম প্রভৃতি দেবগণ, যাজ্ঞবন্ধ্য প্রভৃতি মুনিগণ, যুধিষ্ঠির প্রভৃতি রাজগণ, যদৃচ্ছা ক্রমে, একাধিক বিবাহ করিয়া থাকেন; সাধারণ লোকের সে বিষয়ে তদীয় দৃষ্টান্তের অনুবর্তী হইয়া চলা কদাচ উচিত নহে। এমন স্থলে; দেবগণ, ঋষিগণ, ও পূর্ব্বকালীন রাজগণের যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহ ব্যবহার, সাধারণ লোকের পক্ষে, আদর্শ স্বরূপে প্রবর্ত্তিত করা বহুজ্ঞ পণ্ডিতের' কর্তব্য নয়। বেদব্যাখ্যাতা মাধবাচার্য্য, শিষ্টাচারের প্রামাণ্য বিষয়ে, যে মীমাংসা করিয়া- ছেন, তাহা উদ্ধৃত হইতেছে।

যো মাতুলবিবাহাদৌ শিষ্টাচারঃ সমান বা।

ইতরাচারবন্মাত্বমমাত্বং স্মার্ত্তবাধনাৎ ॥ ১৭ ॥

স্মৃতিমূলো হি সর্বত্র শিষ্টাচারস্ততোহত্র চ।

অনুমেয়া স্মৃতিঃ স্মৃত্যা বাধ্যা প্রত্যক্ষয়া তুসা ॥ ১৮ ।। (২) মাতুলক্যাবিবাহ প্রভৃতি বিষয়ে যে শিষ্টাচার দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার প্রামাণ্য আছে কি না। অ্যান্ড শিষ্টাচারের ভ্যায়, ঐ সকল শিষ্টাচারের প্রামাণ্য থাকা সম্ভব; কিন্তু, স্মৃতি- বিরুদ্ধ বলিয়া, উহাদের প্রামাণ্য নাই। শিষ্টাচার মাত্রই স্মৃতিমূলক; এজন্য, এস্থলে, শিষ্টাচার দ্বারা, স্মৃতির অনুমান করিতে হইবেক; কিন্তু, অনুমান সিদ্ধ স্মৃতি, প্রত্যক্ষসিদ্ধ স্মৃতি দ্বারা, বাধিত হইয়া থাকে।

ভদ্রসমাজে যে ব্যবহার প্রচলিত থাকে, উহাকে শিষ্টাচার বলে। শাস্ত্রকারেরা সেই শিষ্টাচারকে, বেদ ও স্মৃতির ন্যায়, ধৰ্ম্ম বিষয়ে প্রমাণ বলিয়া পরিগৃহীত করিয়াছেন। সমুদয় শিষ্টাচার স্মৃতিমূলক; অর্থাৎ, শিষ্টাচার 'দেখিলেই বোধ করিতে হইবেক, উহা স্মৃতির বিধি অনুসারে প্রবর্ত্তিত হইয়াছে। শিষ্টাচার দ্বিবিধ, প্রত্যক্ষসিদ্ধস্মৃতিমূলক, ও অনুমানসিদ্ধস্মৃতি- 

মূলক। যেখানে, দেশবিশেষে, কোনও শিষ্টাচার প্রচলিত আছে, এবং স্মৃতিশাস্ত্রে তাহার মূলীভূত স্মৃতিও দেখিতে পাওয়া যায়; সেখানে, ঐ শিষ্টাচার প্রত্যক্ষসিদ্ধস্মৃতিমূলক। জার, যেখানে কোনও শিষ্টাচার' প্রচলিত আছে, কিন্তু তাহার মূলী- ভূত স্মৃতি দেখিতে পাওয়া যায় না; তথায়, ঐ শিষ্টাচার দর্শনে, এই অনুমান করিতে হয়, ঐ শিষ্টাচারের মূলীভূত স্মৃতি ছিল, কাল ক্রমে তাহা লোপ প্রাপ্ত হইয়াছে; এইরূপ শিষ্টাচার অনুমানসিদ্ধস্মৃতিমূলক। প্রত্যক্ষসিদ্ধ স্মৃতি তঅনুমান- সিদ্ধ স্মৃতির বাধক; অর্থাৎ, যেখানে দেশবিশেষে কোনও শিষ্টাচার দৃষ্ট হইতেছে, কিন্তু স্মৃতিশাস্ত্রে ঐ শিষ্টাচারমূলক ব্যবহার নিষিদ্ধ হইয়াছে; তথায়, প্রত্যক্ষসিদ্ধ স্মৃতির বিরুদ্ধ বলিয়া, ঐ শিষ্টাচারের প্রামাণ্য নাই। দক্ষিণ দেশের কোনও কোনও স্থলে, ভদ্রসমাজে মাতুলক্যাপরিণয়ের ব্যবহার আছে; সুতরাং, মাতুলকন্যাপরিণয় সেই সেই স্থলের শিষ্টাচার। কিন্তু, স্মৃতিশাস্ত্রে মাতুলক্যাপরিণয় সর্বতোভাবে নিষিদ্ধ হইয়াছে; এজন্য, ঐ শিষ্টাচার প্রত্যক্ষসিদ্ধ স্মৃতির বিরুদ্ধ। প্রত্যক্ষসিদ্ধ স্মৃতির বিরুদ্ধ শিষ্টাচার, অনুমানসিদ্ধ স্মৃতি দ্বারা, প্রমাণ বলিয়া প্রতিপন্ন, ও পরিগৃহীত হইতে পারে না। পরিণয়রূপ শিষ্টাচারের প্রামাণ্য নাই। অতএব, মাতুলকন্যা- সেইরূপ, এতদ্দেশীয় যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত, বহুবিবাহ ব্যবহার শিষ্টাচার বটে; কিন্তু, উহা প্রত্যক্ষসিদ্ধ স্মৃতির বিরুদ্ধ; সুতরাং, উহা অবিগীতশিষ্টাচার- শব্দবাচ্য, অথবা ধর্ম বিষয়ে প্রমাণ বলিয়া প্রবর্ত্তিত ও পরি- গৃহীত হওয়া উচিত নহে। দেবগণের ও পূর্বকালীন রাজগণের আচার মাত্রই অবিগীত শিষ্টাচার বলিয়া পরিগণিত ও ধৰ্ম্ম বিষয়ে প্রমাণ বলিয়া পরিগৃহীত হইলে, কন্যাগমন, গুরুপত্নী- হরণ, মাতুলকন্যাপরিণয়, পাঁচ জনের একস্ত্রীবিবাহ প্রভৃতি ব্যবহার প্রচলিত হইতে পারিবেক।

অতএব, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের অবলম্বিত স্মৃতিবাক্য ও উল্লিখিত শিষ্টাচার দ্বারা, যদৃচ্ছা'প্রবৃত্ত বহুবিবাহব্যবহার শাস্ত্র- সম্মত বলিয়া, কোনও মতে, প্রতিপন্ন হইতেছে না। যদি ইহা অপেক্ষা বলবত্তর প্রমাণান্তর না থাকে, তাহা হইলে তাঁহার চিরসিদ্ধান্ত অভ্রান্ত হইতেছে না। ফলকপা এই, "বহুবিবাহ যে শাস্ত্রসম্মত ইহা আমার চিরসিদ্ধান্ত আছে, এই মাত্র নির্দেশ করিয়া, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের ক্ষান্ত হওয়া ভাল হয় নাই; প্রবল প্রমাণ পরম্পরা দ্বারা, স্বীয় সিদ্ধান্তের সমর্থন করা সর্বতোভাবে উচিত ছিল।

তর্কবাচস্পতি মহাশয় কহিয়াছেন,

"বরাবর কহিয়া আসিতেছি এবং এক্ষণেও কহিতেছি যে বহুবিবাহ সর্ব্বদেশপ্রচলিত, সর্বশাস্ত্রসম্মত ও চিরপ্রচলিত।"

এ বিষয়ে বক্তব্য এই, তিনি বরাবর কহিয়া আসিতেছেন এবং এক্ষণেও কহিতেছেন; এতদ্ভিন্ন, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহ সর্বক শাস্ত্রসম্মত, এ বিষয়ের আর কোনও প্রমাণ দেখিতে পাওয়া যায় না। বহুবিবাহ যে সর্বশাস্ত্রসম্মত নহে, তর্কবাচস্পতি মহাশয় স্বয়ং সে বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান' করিয়াছেন। যদি যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড সর্বশাস্ত্রসম্মত হইত, তাহা হইলে, তর্কবাচস্পতি মহাশয়, নিঃসংশয়, সর্বব শাস্ত্র হইতেই, ভূরি ভূরি প্রমাণ উদ্ধৃত করিতেন; অনেক কষ্টে, অনেক অনুসন্ধানের পর, অপ্রচলিত সামান্য সংগ্রহগ্রন্থ হইতে, এক মাত্র বচন' উদ্ধৃত করিয়া, নিশ্চিন্ত ও সন্তুষ্ট হইতেন না। ফলকথা এই, মন্টু, বিষ্ণু, বশিষ্ঠ, গোতম, যাজ্ঞবন্ধ্য, আপস্তম্ব, পরাশর, বেদব্যাস প্রভৃতির প্রণীত ধৰ্ম্মসংহিতা গ্রন্থে স্বমতের প্রতিপোষক প্রমাণ দেখিতে না পাইয়া, তাঁহাকে অগত্যা মদনপারিজাতের শরণাগত হুইতে হইয়াছে।

তুর্কবাচস্পতি মহাশয় লিখিয়াছেন,

"তিনি (বিদ্যাসাগর) বহুবিবাহের অশাস্ত্রীয়তা প্রতিপাদনার্থে যেরূপ শাস্ত্রের অভিনব অর্থ ও যুক্তির উদ্ভাবন করিয়াছেন, অব্য বুদ্ধির প্রশংসা করিতে হয়; কিন্তু বিবেচনা করিয়া দেখিলে ঐ অর্থ ও যুক্তি শাস্ত্রানুমোদিত বা সঙ্গত বলিয়া বোধ হয় না।"

এ স্থলে বক্তব্য এই, বহুবিবাহবিষয়ক বিচারপুস্তকে, বিবাহ সংক্রান্ত ছয়টি মাত্র মনুবচন উদ্ধৃত হইয়াছে। তন্মধ্যে, কোন বচনের অর্থ তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের অভিনব বোধ হইয়াছে, বুঝিতে পারিলাম না। যে সকল শব্দে ঐ সকল বচন রচিত হইয়াছে, সে সকল শব্দ দ্বারা অন্যবিধ অর্থ প্রতিপন্ন হইতে পারে, সম্ভব বোধ হয় না। তর্কবাচস্পতি মহাশয় কহিতেছেন, আমার লিখিত অর্থ ও যুক্তি শাস্ত্রানুমোদিত বা সঙ্গত নহে। কিন্তু, আক্ষেপের বিষয় এই, তাঁহার মতে, কিরূপ অর্থ ও কিরূপ যুক্তি সঙ্গত ও শাস্ত্রানুমোদিত, তাহার কোনও উল্লেখ করেন নাই। এরূপ শিষ্টাচার আছে, যাঁহারা অন্যকৃত অর্থ ও যুক্তির উপর দোষারোপ করেন, তাঁহারা স্বাভিমত প্রকৃত অর্থ ও প্রকৃত যুক্তি প্রদর্শন করিয়া থাকেন। তর্কবাচস্পতি মহাশয়, যখন, আমার লিখিত অর্থ ও যুক্তির উপর দোষারোপ করিতেছেন, তখন, শিষ্টাচারের অনুবর্তী হইয়া, স্বাভিমত প্রকৃত অর্থ ও প্রকৃত যুক্তির পরিচয় দেওয়া উচিত ছিল। তাহা হইলে, উভয় পক্ষের অর্থ ও যুক্তি দেখিয়া, কোন পক্ষের অর্থ ও যুক্তি সঙ্গত ও শাস্ত্রানুমত, লোকে তাহা বিবেচনা করিতে পারিতেন। নতুবা, কেবল তাঁহার মুখের কথায়, সকলে আমার লিখিত অর্থ ও যুক্তি, অগ্রাহ্য করিবেন, এরূপ বোধ হয় না। তর্কবাচস্পতি মহাশয় সোমপ্রকাশে প্রচার করিয়াছেন,

"বহুবিবাহ শাস্ত্রসম্মত হইলেও ভঙ্গকুলীন ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে যে প্রণালীতে উহা সম্পন্ন হইয়া আসিতেছিল, এবং কতক পরিমাণে এ পর্য্যন্ত প্রচলিত আছে, তাহা অত্যন্ত ঘৃণাকর্ম, লজ্জাকর ও নৃশংস, ইহা বিলক্ষণ আমার অন্তরে জাগরূক আছে এবং উহার নিবারণ হয় ইহাতে আমার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল এবং আছে।" ধর্ম্মরক্ষিণীসভায় লিখিয়াছেন,

• "এতদ্দেশীয় কুলীন বা অন্য মহাত্মাগণ এবং অন্যান্যদেশীয় হিন্দু

সমাজগণে এই আচার প্রচলিত আছে।"

এক স্থলে, 'কুলীনদিগের বহুবিবাহব্যবহার অত্যন্ত ঘৃণাকর, লজ্জাকর, ও নৃশংস বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে; অপর স্থলে, কুলীনেরা মহাত্মা বলিয়া পরিগণিত হইয়াছেন; তাঁহাদের বহু- বিবাহব্যবহার শিষ্টাচাররূপে প্রবর্তিত হইয়াছে। তর্কবাচস্পতি মহাশয় ধর্ম্মরক্ষিণী সভায়, যে পত্র লিখিয়াছেন, তাহা পাঠ করিলে, বহুবিবাহকারী কুলীনমাত্রই মহাত্মা ও পূজনীয়, এই বোধ হয়; ভঙ্গকুলীনদিগের উপর তাঁহার ঘৃণা ও দ্বেষ আছে, কোনও ক্রমে, সেরূপ প্রতীতি জন্মে না। যথা-

"৫, ৬ বৎসর গত হইল তৎকালে উপায়ান্তর নাই বিবেচনা করিয়া সামাজিক বিষয় হইলেও নিরতিশয় আগ্রহ ও উৎসাহ সহকারে স্বতঃ প্রবৃত্ত হইয়া ঐ বিষয়ের নিবারণার্থে আইন প্রস্তুত করিবার জন্য রাজদ্বারে আবেদনপত্রেও স্বাক্ষর করিয়া তদ্বিষয় সম্পাদনার্থ' বিশেষ উদ্যোগী ছিলাম। এক্ষণে দেখিতেছি বিদ্যাচর্চ্চার প্রভাবে বা যে কারণে হউক ঐ কুৎসিত বহুবিবাহপ্রণালী অনেক পরিমাণে ন্যূন হইয়াছে। আমার বোধ হয় অল্পকাল মধ্যে উহা এককালে অন্তর্হিত হইবেক অতএব তজ্জন্য আর আইনের আবশ্যকতা নাই।"

"প্রায় একমাস গত হইল সনাতনধৰ্ম্মরক্ষিণী সভা পরিত্যাগ করিবার কয়েকটি কারণমধ্যে বহুবিবাহ শাস্ত্রসম্মত বিষয় ইহার প্রামাণ্যার্থে একটি বচন উদ্ধৃত করিয়া লিখিয়াছিলাম যে বহুবিবাহ শাস্ত্রসম্মত বিষয়, তাহার রহিতকরণবিষয়ে ধর্ম্মসভার হস্তক্ষেপ করা অন্যায়।"

• এস্থলে বক্তব্য এই, তর্কবাচস্পতি মহাশয় যে কারণে, যে অভিপ্রায়ে, যে বিষয়ে উদ্‌্যোগী হইয়াছিলেন, সনাতনধৰ্ম্মর ক্ষিণী সভাও নিঃসংশয়, সেই কারণে, সেই অভিপ্রায়ে, সেই বিষয়ে উদ্যোগী হইয়াছেন। তবে, উভয়ের মধ্যে বিশেষ এই, তর্ক- বাচস্পতি মহাশয় প্রতিভাবলে বুঝিতে পারিয়াছেন, কুলীনদিগের বিবাহ সংক্রান্ত অত্যাচার, অল্প কাল মধ্যে, একবারে অন্তর্হিত হইবেক; অতএব, আইনের আর আবশ্যকতা নাই; ধৰ্ম্মরক্ষিণী সভার অনভিজ্ঞ অধ্যক্ষদিগের অদ্যাপি সে বোধ জন্মে নাই। আর, ইহাও বিবেচনা করা উচিত, যৎকালে তর্কবাচস্পতি মহাশয়, স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া, নিরতিশয় আগ্রহ ও উৎসাহ সহকারে, বহুবিবাহব্যবহারের নিবারণ প্রার্থনায়, আবেদনপত্রে নাম স্বাক্ষর করিয়াছিলেন, সে সময়ে উহা নৃশংস, ঘৃণাকর, লজ্জাকর ব্যাপার ছিল; এক্ষণে, সময়গুণে, উহা "সর্ববশাস্ত্রসম্মত” “অবিগীতশিষ্টাচার পরম্পরানুমোদিত” ব্যবহার হইয়া উঠিয়াছে। সুতরাং, তর্কবাচস্পতি মহাশয় নৃশংস, ঘৃণাকর, লজ্জাকর বিষয়ের নিবারণে উদ্যোগী হইয়াছিলেন; সনাতনধৰ্ম্মরক্ষিণী সভা সর্ববশ্বাস্ত্রসম্মত, অবিগীতশিষ্টাচারপরম্পরানুমোদিত ব্যবহারের উচ্ছেদে উদ্যত হইয়াছেন। ঈদৃশ অন্যায্য অনুষ্ঠান দর্শনে, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের বিশুদ্ধ অন্তঃকরণে, অবশ্য বিরাগ জন্মিতে পারে। সনাতনধর্ম্মরক্ষিণী সভার ইহাও বিবেচনা করা আবশ্যক ছিল, বিদ্যাচর্চ্চার প্রভাবে, অথবা তর্কবাচস্পতি মহাশয়- কৃত উদ্যোগের ও নামস্বাক্ষরের প্রভাবে, যখন, পাঁচ বৎসরে, বহুবিবাহ সংক্রান্ত অত্যাচারের, অনেক পরিমাণে, নিবৃত্তি হইয়াছে; তথন, অল্প পরিমাণে যাহা কিছু অবশিষ্ট আছে, আর আড়াই বৎসরে, নিতান্ত না হয়, আর পাঁচ বৎসরে তাহার সম্পূর্ণ নিবৃত্তি হইবেক, তাহার আর কোনও সন্দেহ নাই। এমন স্থলে, এই আড়াই বৎসর অথবা পাঁচ বৎসর কাল অপেক্ষা করা ধর্ম্মরক্ষিণী সভার পক্ষে সর্বতোভাবে বিধেয় ছিল; তাহা হইলে, অকারণে, তাঁহাদিগকে তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের কোপে পতিত হইতে হইত না।

এক্ষণে, শ্রীযুত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের বহুবিবাহ- বিষয়ক অভিপ্রায় উদ্ধৃত ও আলোচিত হইতেছে,-

"বহুবিবাহ যে এ দেশের শাস্ত্রনিষিদ্ধ নয়, এ দেশের ব্যবহারই তাহার প্রধান প্রমাণ। শাস্ত্রপ্রতিষিদ্ধ হইলে উহা কখন এরূপ প্রচরদ্রূপ পাকিত না। যুক্তিও এই কথা কহিয়া দিতেছে। এ দেশের পুরুষেরা চিরকাল স্বৈরব্যবহারী হইয়া আসিয়াছেন। আপনাদিগের সুখস্বচ্ছন্দ ও সুবিধার অন্বেষণেই চিরকাল ব্যস্ত ছিলেন, স্ত্রীজাতির সুখদুঃখাদির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন নাই। এতাদৃশ স্বার্থপর পুরুষেরা স্বহস্তে শাস্ত্রকর্তৃত্বভার প্রাপ্ত হইয়া যে আপনাদিগের একটি প্রধান ভোগপথ রুদ্ধ করিয়া যাইবেন, ইহা কোন ক্রমেই সম্ভাবিত নহে। বেদ, পুরাণ, স্মৃতি, কাব্যাদি ইহার প্রামাণ্য প্রতিপাদন করিতেছে। যথা-

যদেকস্মিন্ যুপে দ্বে রশনে পরিব্যয়তি, তন্মাদেকো ছে। জায়ে বিন্দেত। যন্নৈকাং রশনাং, ছয়োধুপয়োঃ পরিব্যবয়তি, তন্মান্নৈকা ছৌ পতী বিন্দেত। বেদ।

কামতস্ত প্রবৃত্তানামিতি দোষান্নত্বথ্যাপনার্থং নতু দোষাভাব এব। তদাহতুঃ শঙ্খলিখিতো। ভাৰ্য্যাঃ কাৰ্য্যাঃ সজাতীয়াঃ শ্রেয়ন্ত্যঃ সর্ব্বেষাৎ স্থারিতি পূর্ব্বঃ কল্পঃ, ততোহমুকল্পঃ চতস্রো ব্রাহ্মণস্তানুপূর্ব্বেণ, তিস্রো রাজন্যস্ত, স্বে ব্যৈস্ত, একা' শূদ্রন্ত। জাত্যবচ্ছেদেন চতুরাদিসংখ্যা সম্বধ্যতে। ইতি দায়ভাগঃ।

• জাত্যবচ্ছেদেনেতি তেনু ব্রাহ্মণাদেঃ পঞ্চ ষড় বা সজাতীয়া ন . বিরুদ্ধা ইত্যাশয়ঃ। অচ্যুতানন্দকৃততট্টীকা।

রোহিণী বসুদেবন্ত ভার্য্যাস্তে নন্দগোকুলে। অন্ত্যাশ্চ: কংসসংবিগ্রা বিবরেষু বসন্তি হি। ভাগবত।

বেত্রবতি! বহুধনত্বাৎ বহুপত্নীকেন তত্রভবতা (ধনমিত্রেণ বণিজা) ভবিতব্যং। বিচার্য্যতাং যদি কাচিদাপন্নসত্ত্বা স্তাৎ তন্ত ভার্য্যাসু। শকুন্তলা।

শাশুড়ী রাগিণী, ননদী বাধিনী, সতিনী নাগিনী বিষের ভরা। ভারতচন্দ্র।” (১)

অ্য বিদ্যাভূষণ মহাশয় কহিতেছেন, "বহুবিবাহ যে এ দেশের শাস্ত্রনিষিদ্ধ নয়, এ দেশের ব্যবহারই তাহার প্রধান প্রমাণ; শাস্ত্রপ্রতিষিদ্ধ হইলে উহা কখন এরূপ প্রচরদ্রূপ থাকিত না”। তদীয় ব্যবস্থার অনুবর্তী হইয়া, কল্য, অন্য এক মহাশয় কহিবেন, কন্যাবিক্রয় যে এ দেশের শাস্ত্রনিষিদ্ধ নয়, এ দেশের ব্যবহারই তাহার প্রধান প্রমাণ; শাস্ত্রপ্রতিষিদ্ধ হইলে, উহা কখনও এরূপ প্রচরদ্রূপ থাকিত না। তৎপর দিন, দ্বিতীয় এক মহাশয় কহিবেন, ভ্রূণহত্যা যে এ দেশের শাস্ত্র- নিষিদ্ধ নয়, এ দেশের ব্যবহারই তাহার প্রধান প্রমাণ; শাস্ত্রপ্রতিষিদ্ধ হইলে, উহা কখনও এরূপ প্রচরদ্রূপ থাকিত না।

তৎপর দিন, তৃতীয় এক মহাশয় কহিবেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া যে এ দেশের শাস্ত্রনিষিদ্ধ নয়, এ দেশের ব্যবহারই তাহার প্রধান প্রমাণ; শাস্ত্রপ্রতিষিদ্ধ হইলে, উহা কখনও এরূপ প্রচরদ্রূপ থাকিত না। তৎপর দিন, চতুর্থ এক মহাশয় কহিবেন, কপটলেখ্য প্রস্তুত করা যে এ দেশের শাস্ত্রনিষিদ্ধ নয়, এ দেশের ব্যবহারই তাহারু প্রধান প্রমাণ; শাস্ত্রপ্রতিষিদ্ধ হইলে, উহা কখনও এরূপ প্রচরদ্রূপ থাকিত না। তৎপর দিন, পঞ্চম এক মহাশয় কহিবেন, বিষয়কৰ্ম্মস্থলে উৎকোচগ্রহণ বা অন্যায্য উপায়ে অর্থোপার্জন যে এ দেশের শাস্ত্রনিষিদ্ধ নয়, এ 'দেশের ব্যবহারই তাহার প্রধান প্রমাণ; শাস্ত্রপ্রতিষিদ্ধ হইলে, উহা কখনও এরূপ প্রচরদ্রূপ থাকিত না। এইরূপে, যে সকল দুষ্ক্রিয়া বিলক্ষণ প্রচলিত আছে, তৎসমুদয় শাস্ত্রানু- যায়ী ব্যবহার বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়া উঠিবেক। বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের এই ব্যবস্থা, অনেকের নিকট, নিরতিশয় আদরভাজন হইবেক, তাহার সন্দেহ নাই।

বিদ্যাভূষণ মহাশয়, তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের মত, উদ্ধত ও অবিমৃশ্যকারী নহেন। তিনি, তাঁহার ন্যায়, স্বীয় সিদ্ধান্তকে নিরবলম্বন রাখেন নাই; অদ্ভুত যুক্তি দ্বারা উহার বিলক্ষণ সমর্থন করিয়াছেন। সেই অদ্ভুত যুক্তি এই,-

"এ দেশের পুরুষেরা চিরকাল স্বৈরব্যবহারী হইয়া আসিয়াছেন আপনাদিগের সুখস্বচ্ছন্দ ও সুবিধার অন্বেষণেই চিরকাল ব্যস্ত ছিলেন, স্ত্রীজাতির সুখদুঃখাদির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন নাই। এতাদৃশ স্বার্থপর পুরুষেরা স্বহস্তে শাস্ত্রকর্তৃত্বভার প্রাপ্ত হইয়া যে আপনাদিগের একটি প্রধান ভোগপথ রুদ্ধ করিয়া যাইবেন, ইহা কোনও ক্রমেই সম্ভাবিত নহে।" বিদ্যাভূষণ মহাশয়, স্বপক্ষ সমর্থনে সাতিশয় ব্যগ্র হইয়া, উচিত অনুচিত বিবেচনায় এককালে জলাঞ্জলি দিয়াছেন। 'যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রকারদির্গের অনুমোদিত কার্য্য, ইহা প্রতিপন্ন করা তাঁহার 'নিতান্ত আবশ্যক হইয়া উঠিয়াছে; এবং তদর্থে এই অদ্ভুত যুক্তি উদ্ভাবিত করিয়াছেন যে, ভারত- বর্ষীয় শাস্ত্রকারেরা স্বার্থপর, সথেচ্ছাচারী, ও ইন্দ্রিয়মুখপরায়ণ ছিলেন; স্ত্রীজাতির সুখদুঃখাদির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন নাই। বিবাহ বিষয়ে যথেচ্ছচার অব্যাহত না থাকিলে, ইন্দ্রিয়সুখাসক্তি চরিতার্থ হইতে পারে না; সুতরাং, তাঁহারা, বিবাহ বিষয়ে যথেচ্ছচার নিষিদ্ধ করিয়া, পুরুষজাতির প্রধান ভোগসুখের পথ রুদ্ধ করিয়া যাইবেন, ইহা সম্ভব নয়; অতএব, বিবাহবিষয়ক যথেচ্ছচার শাস্ত্রকারদিগের অনভিমত কার্য্য, ইহা কোনও মতে সম্ভাবিত নহে।

পণ্ডিতের মুখে কেহ কখনও এরূপ বিচিত্র মীমাংসা শ্রবণ করিয়াছেন, এরূপ বোধ হয় না। বিদ্যাভূষণ মহাশয়, সুশিক্ষিত ও সুপণ্ডিত হইয়া, নিতান্ত নিরীহ, নিতান্ত নিরপরাধ শাস্ত্রকার- দিগের বিষয়ে, যেরূপ নৃশংস অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা অদৃষ্টচর ও অশ্রুতপূর্ব।

শাস্ত্রে, স্ত্রীলোকদিগের প্রতি, যেরূপ ব্যবহার করিবার ব্যবস্থা আছে, তাহা প্রদর্শিত হইতেছে;

মনু কহিয়াছেন,

পিতৃভিভ্রাতৃভিশ্চৈতাঃ পতিভিদেবরৈস্তথা। পূজ্যা ভূষয়িতব্যাশ্চ বহু কল্যাণমীপুভিঃ ॥ ৩। ৫৫ ॥ যত্র নার্য্যন্ত পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ। যত্রৈতাক্তন পূজ্যন্তে সর্ববাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ ॥ ৩। ৫৬ # শোচন্তি জাময়ো যত্র বিনশ্যত্যাশু তৎ কুলম্। ন শোচন্তি তু যত্রৈতা বর্দ্ধতে তদ্ধি সর্বদা ॥ ৩। ৫৭॥ জাময়ো যানি গেহানি শপষ্ট্য প্রতিপূজিতাঃ। তানি কৃত্যাহতানীব বিনশ্যন্তি সমন্ততঃ ॥ ৩। ৫৮।

আত্মমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী পিতা, ভ্রাতা,' পতি, ৬ দেবর স্ত্রীলোকদিগকে সমাদরে রাখিবেক ও বস্ত্রালঙ্কারে ভূষিত করিবেক । ৫৫ । যে পরিবারে স্ত্রীলোকদিগকে সমাদরে রাখে, দেবতারা সেই পরিবারের প্রতি প্রসন্ন থাকেন। আর, যে পরিবারে স্ত্রীলোক- দিগের সমাদর নাই, তথায় যজ্ঞ দান আদি সকল ক্রিয়া বিফল হয় ॥ ৫৬॥ যে পরিবারে স্ত্রীলোকেরা মনোদুঃখ পায়, সে পরিবার ত্বরায় উৎসন্ন হয়; আর, যে পরিবারে স্ত্রীলোকেরা মনোদুঃখ না পায়, সে পরিবারের সতত সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি হয় ॥ ৫৭। স্ত্রীলোক, অনাদৃত হইয়া, যে সমস্ত পরিবারকে অভিশাপ দেয়, সেই সকল পরিবার, অভিচারগ্রস্তের ন্যায়, সর্ব্ব প্রকারে উৎসন্ন হয় ।। ৫৮ ॥

পরাশর কহিয়াছেন,

ভোজ্যালঙ্কারবাসোভিঃ পূজ্যাঃ স্যুঃ সর্ববদা স্ত্রিয়ঃ। যথা কিঞ্চিন্ন শোচন্তি নিত্যং কার্য্যং' তথা নৃভিঃ । ৪১ ॥ আয়ুর্বিত্তং যশঃ পুদ্রাঃ স্ত্রীপ্রীত্যা স্যনৃণাং সদা। নশ্যন্তি তে তদপ্রীতৌ তাসাং শাপাদসংশয়ম্ ॥৪।৪২ ॥ প্রিয়ো যত্র তু পূজ্যন্ত্রে, সর্ববদা ভূষণাদিভিঃ। পিতৃদেবমনুষ্যাশ্চ মোদন্তে তত্র বেশ্মনি ॥ ৪। ৪৩ ॥ প্রিয়স্তষ্টাঃ শ্রিয়ঃ সাক্ষাক্রষ্টাশ্চেদ্দষ্টদেবতাঃ। বর্দ্ধয়ন্তি কুলং তুষ্টা নাশয়ন্ত্যবমানিতাঃ ॥ ৪। ৪৪ ॥ 

নাবমা্যাঃ প্রিয়ঃ সপ্তিঃ পতিশ্বশুরদেবরৈঃ।

পিত্রা মাত্রা চ ভ্রাত্রা চ তথা বন্ধুভিরেব চ ॥৪:৪৫ (১) আহার, অলঙ্কার, ও পরিচ্ছদ দ্বারা স্ত্রীলোকদিগের সর্ব্বদা সমাদর করিবেক। যাহাতে তাহারা কিঞ্চিন্মাত্র মনোদুঃখ না পায়, পুরুষদিগের সর্ব্বদা সেইরূপ ব্যবহার করা উচিত । ৪১ ॥ • স্ত্রীলোকেরা সন্তুষ্ট থাকিলে, পুরুষদিগের অবিচ্ছেদে আয়ু, ধন, . যশ, পুত্র লাভ হয়; তাহারা অসন্তুষ্ট হইলে, তাহাদের শাপে, তৎসমুদয় নিঃসংশয় ক্ষয় প্রাপ্ত হয় । ৪২। যে পরিবারে স্ত্রীলোকেরা ভূষণাদি দ্বারা সর্ব্বদা সমাদৃত হয়, দেবগণ, পিতৃগণ, মনু্যগণ সেই পরিবারের প্রতি প্রসন্ন থাকেন । ৪৩। স্ত্রীলোক তুষ্ট থাকিলে সাক্ষাৎ লক্ষ্মী, রুষ্ট হইলে দুষ্টদেবতা স্বরূপ; তুষ্ট থাকিলে, কুলের শ্রীবৃদ্ধি হয়; অবমানিত হইলে, কুলের ধ্বংষ হয় ॥ ৪৪। সচ্চরিত্র স্বামী, শ্বশুর, দেবর, পিতা, মাতা, ভ্রাতা,

ও বন্ধুবর্গ কদাচ স্ত্রীলোকদিগের অবমাননা করিবেক না ॥৪৫॥ যদি এই ব্যবস্থা উল্লঙ্ঘন করিয়া, পুরুষজাতি স্ত্রীজাতির প্রতি অসদ্ব্যবহার করেন, তাহাতে শাস্ত্রকারেরা অপরাধী হইতে পারেন না।

শাঁস্ত্রে, বিবাহ বিষয়ে, যে সমস্ত বিধি ও নিষেধ প্রবর্তিত হইয়াছে, সে সমুদয় প্রদর্শিত হইতেছে

১। গুরুণানুমতঃ সাঁত্বা সমাবৃত্তো যথাবিধি।

উদ্বহেত দ্বিজো ভাৰ্য্যাং সবর্ণাং লক্ষণান্বিতাম্ ॥ ৩।৪। (২) 811 দ্বিজ, গুরুর অনুজ্ঞালাভান্তে, যথাবিধানে স্নান ও সমাবর্তন (৩) করিয়া, সজাতীয়া সুলক্ষণা ভার্জার পাণিগ্রহণ করিবেক। 

২। ভার্য্যায়ৈ পূর্ব্বমারিণ্যৈ দত্ত্বাগ্নীনস্ত্যকৰ্ম্মণি।

পুনর্দারক্রিয়াং কুর্য্যাৎ পুনরাধানমেব চ ॥ ৫।১৬৮ ।। (৪) পূর্ব্বমৃতা স্ত্রীর যথাবিধি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নির্ব্বাহ করিয়া, পুনরায় দাঁরপরিগ্রহ ও পুনরায় অগ্ন্যাধান করিবেক।

৩। মদ্যপাসাধুবৃত্তা চ প্রতিকূলা চ যা ভবেৎ। ব্যাধিতা বাধিবেত্তব্যা হিংস্রার্থঘ্নী চ সর্বদা ॥ ৯।৮০০ (৪)'

যদি স্ত্রী সুরাপায়িণী, ব্যভিচারিণী, সতত স্বামীর অভিপ্রায়ের বিপরীতকারিণী, চিররোগিণী, অতিক্রুরস্বভাবা, ও অর্থনাশিনী হয়, তৎসত্ত্বে অধিবেদন, অর্থাৎ পুনরায় দারপরিগ্রহ করিবেক।

৪। বন্ধ্যাষ্টমেইধিবেছ্যাব্দে দশমে তু মৃতপ্রজা। একাদশে স্ত্রীজননী সদ্যস্বপ্রিয়বাদিনী ॥ ৯। ৮১ ।। (৪)

স্ত্রী বন্ধ্যা হইলে অষ্টম বর্ষে, মৃতপুত্রা হইলে দশম বর্ষে, কন্যা- মাত্র প্রসবিনী হইলে একাদশ বর্ষে, অপ্রিয়বাদিনী হইলে কালাতিপাত ব্যতিরেকে, অধিবেদন করিবেক।

৫। ধৰ্ম্ম প্রজাসম্পন্নে দারে নান্ড্যাং কুব্বীত। ১২। (৫)

যে স্ত্রীর সহযোগে ধৰ্ম্মকার্য্য, ও পুত্রলাভ সম্পন্ন হয়, তৎসত্ত্বে অন্য স্ত্রী বিবাহ করিবেক না।

৬। সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্মণি। কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশোহবরাঃ ॥৩। ১২॥ (৬)

দ্বিজাতির পক্ষে অগ্রে সবর্ণাবিবাহই বিহিত। কিন্তু, যাহারা রতিকামনার বিবাহ করিতে প্রবৃত্ত হয়, তাহারা অনুলোম ক্রমে বর্ণান্তরে বিবাহ করিবেক।

৭। একামুৎক্রম্য কামার্থমন্যাং লব্ধং য ইচ্ছতি। সমর্থস্তোযয়িত্বার্থৈঃ পূর্ব্বোঢ়ামপরাং বহেৎ ॥ (৭)

যে ব্যক্তি স্ত্রীসত্বে রতিকামনায় পুনরায় বিবাহ করিতে ইচ্ছা কুরে, সে সমর্থ হইলে, অর্থ দ্বারা পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করিয়া, অন্য স্ত্রী বিবাহ করিবেক।

দেখ, প্রথম বচন দ্বারা, গৃহস্থাশ্রম প্রবেশ কালে, প্রথম বিবা- হেঁর বিধি প্রদত্ত হইয়াছে; দ্বিতীয় বচন দ্বারা, স্ত্রীবিয়োগ হইলে, পুনরায় বিবাহের বিধি দর্শিত হইয়াছে; তৃতীয় ও চতুর্থ বচন দ্বারা, স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি দোষ ঘটিলে, তাহার জীবদ্দশায়, বিবাহাস্তর বিহিত হইয়াছে; পঞ্চম বচন দ্বারা, ধৰ্ম্মকার্য্য ও পুত্রলাভ সম্পন্ন হইলে, পূর্বপরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় সজাতীয়াবিবাহ একবারে নিষিদ্ধ হইয়াছে; যষ্ঠ বচন দ্বারা, যে ব্যক্তি স্ত্রীসত্ত্বে রতিকামনায় পুনরায় বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে, তাহার পক্ষে অসজাতীয়া বিবাহের বিধি প্রবর্ত্তিত হইয়াছে; সপ্তম বচন দ্বারা, রতিকামনায় বিবাহ করিতে ইচ্ছা হইলে, পূর্ব্বপরিণীতা সজাতীয়া স্ত্রীর সম্মতি গ্রহণ পূর্ব্বক, অসজাতীয়া বিবাহ করিবেক, এই ব্যবস্থ। প্রদত্ত হইয়াছে। বিবাহ বিষয়ে এই সমস্ত বিধি ও নিষেধ জাজ্বল্যমান রহিয়াছে। সে দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া, লোকে, শাস্ত্রীয় বিধি নিষেধ লঙ্ঘন পূর্বক, বিবাহ বিষয়ে যে যথেচ্ছচার করিতেছে, তদ্দর্শনে শাস্ত্রকারেরা, স্বার্থপরতা ও যথেচ্ছাচারিতার অনুবর্তী হইয়া, শাস্ত্র প্রণয়ন করিয়াছেন, অম্লান মুখে এ উল্লেখ করা ধৰ্ম্মশাস্ত্র বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞতা ও নিরতিশয় প্রগল্পতা প্রদর্শন মাত্র।

উল্লিখিত যুক্তি প্রদর্শন করিয়া, বিদ্যাভূষণ মহাশয়, স্বীয় সিদ্ধান্তের অধিকতর সমর্থনার্থ, বেদ, "স্মৃতি, পুরাণ, সংস্কৃত কাব্য, ও বাঙ্গালা কাব্য হইতে প্রমাণ উদ্ধৃত করিয়াছেন। তাঁহার উদ্ধৃত বেদবাক্যের অর্থ এই, যেমন যজ্ঞকালে এক যুপে দুই রজ্জু বেষ্টন করা যায়, সেইরূপ এক পুরুষ দুই স্ত্রী বিবাহ করিতে পারে; যেমন এক রজ্জু দুই যুপে বেষ্টন করা যায় না, সেইরূপ এক স্ত্রী দুই পুরুষ বিবাহ করিতে পারে না। এই বেদবাক্য দ্বারা ইহাই প্রতিপন্ন হইতেছে যে, আবশ্যক হইলে, এক ব্যক্তি, পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, পুনরায় বিবাহ করিতে পারে। ইহা দ্বারা যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ডের শাস্ত্রীয়তা, অথবা শাস্ত্রকারদিগের স্বার্থপরতা ও যথেচ্ছাচারিতা, কত দূর সপ্রমাণ হইল, বলিতে পারি না। দায়ভাগধৃত শঙ্খ- লিখিতবচন, সর্ব্বাংশে, অসবর্ণাবিবাহপ্রতিপাদক মনুবচনের তুল্য; সুতরাং, যদৃচ্ছাস্থলে, পূর্ব্বপরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, সজাতীয়াপরিণয় নিষেধবোধক; অতএব, উহা দ্বারা যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ডের শাস্ত্রীয়তা, অথবা শাস্ত্রকারদিগের সার্থপরতা ও যথেচ্ছাচারিতা, সপ্রমাণ হওয়া সম্ভব নহে। দায়ভাগের টীকাকার অচ্যুতানন্দ কহিয়াছেন, "জাত্যবচ্ছেদেন” এই কথা বলাতে, ব্রাহ্মণাদি বর্ণের পাঁচ কিংবা ছয় সজাতীয়া বিবাহ দূয্য নয়, এই অভিপ্রায় ব্যক্ত হইতেছে। শঙ্খলিখিতবচনে লিখিত আছে, অনুলোম ক্রমে ব্রাহ্মণের চারি, ক্ষত্রিয়ের তিন, বৈশ্যের দুই, শূদ্রের এক ভার্য্যা হইতে পারে। দায়ভাগকার লিখিয়াছেন, এই বচনে যে চারি, তিন, দুই, এক শব্দ আছে, তদ্দ্বার! চারি জাতি, তিন জাতি, দুই জাতি, এক জাতি, এই বোধ হইতেছে; অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ চারি জাতিতে, ক্ষত্রিয় তিন জাতিতে, বৈশ্য দুই জাতিতে, শূদ্র এক জাতিতে, বিবাহ করিতে পারে। অচ্যুতানন্দ দায়ভাগের এই লিখনের ভাবব্যাখ্যাস্থলে লিখিয়াছেন, পাঁচ কিংবা ছয় সজাতীয়া বিবাহ দূষ্য নয়। মনুর বিবাহবিষয়ক চতুর্থ বিধি দ্বারা, যদৃচ্ছাস্থলে, সজাতীয়াবিবাহ একবারে নিষিদ্ধ হইয়াছে; ইহা অনুধাবন করিয়া দেখিলে, অচ্যুতানন্দ পূর্ব্বোক্ত প্রকারে ভাবব্যাখ্যা করিতেন, এরূপ বোধ হয় না। যাহা হউক, ঋষিবাক্যে অনাস্থা প্রদর্শন করিয়া, আধুনিক সংগ্রহকার বা টীকাকারের কপোলকল্পিত ব্যবস্থায় আস্থা প্রদর্শন করা বুদ্ধিবৃত্তি ও ধৰ্ম্মপ্রবৃত্তির দুরবস্থা প্রদর্শন মাত্র। ভাগবতপুরাণ হইতে যে শ্লোক উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহার অর্থ এই, বস্তুদেবের ভাৰ্য্যা রোহিণী নন্দালয়ে আছেন, তাঁহার অন্য ভার্য্যারা কংসভয়ে অলক্ষ্য প্রদেশে কালহরণ করিতেছেন। বসুদেবের বহুবিবাহ যদৃচ্ছা নিবন্ধন হইতে পারে। বিবাহ বিষয়ে তিনি শাস্ত্রের বিধি উল্লঙ্ঘন করিয়াছিলেন; তজ্জন্য শাস্ত্রকারেরা অপরাধী হইতে পারেন না। পূর্ব্বে দর্শিত হইয়াছে, শাস্ত্রকারদিগের মতে, পূর্ব্বকালীন লোকের ঈদৃশ যথেচ্ছ ব্যবহার অবৈধ ও সাধারণ লোকের অনুকরণীয় নহে। পাছে কেহ তদীয় তাদৃশ অবৈধ আচরণের অনুসরণ করে, এজন্য তাঁহারা সর্বসাধারণ লোককে সতর্ক করিয়া দিয়াছেন। সুতরাং, ইহা দ্বারাও যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রসম্মত বলিয়া প্রতিপন্ন, অথবা শাস্ত্রকারেরা স্বার্থপর ও যথেচ্ছচারী বলিয়া পরিগণিত, হইতে পারেন না। অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকের উদ্ধৃত অংশ দ্বারা প্রতিপন্ন হইতেছে, সত্যযুগে ধনমিত্র নামে এক ঐশ্বর্য্যশালী বণিক অনেক বিবাহ করিয়াছিলেন; আর, বিদ্যাসুন্দরের উদ্ধৃত অংশ দ্বারা প্রতিপন্ন হইতেছে, ইদানীন্তন স্ত্রীলোকের সতিন থাকে যদি এরূপ বিতণ্ডা উপস্থিত হইত, এ দেশে কেহ কখনও, কোনও কারণে, পূর্যব পরিণীতা স্ত্রীর জীবদ্দশায়, বিবাহ করেন নাই, তাহা হইলে, শকুন্তলা ও বিদ্যাসুন্দরের উদ্ধৃত অংশ দ্বারা, ফলোদয় হইতে পারিত। লোকে, শাস্ত্রীয় নিষেধ লঙ্ঘন করিয়া, যদৃচ্ছাক্রমে বহুবিবাহ করিয়া থাকেন, তাহা অহরহঃ প্রত্যক্ষ হইতেছে। সেই অশাস্ত্রীয় ব্যবহারের দৃষ্টান্ত দ্বারা, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহ এ দেশের শাস্ত্রনিষিদ্ধ নয়, অথবা শাস্ত্রকারেরা, স্বার্থপরতা ও যথেচ্ছচারিতার অনুবর্তী হইয়া, শাস্ত্র প্রণয়ন করিয়াছেন, ইহা প্রতিপন্ন হইতে পারে না। এ দেশের লোকে, কোনও কালে, কোনও বিষয়ে, শাস্ত্রের ব্যবস্থ। উল্লঙ্ঘন করিয়া চলেন না; তাঁহাদের যাবতীয় ব্যবহার শাস্ত্রীয় বিধি ও শাস্ত্রীয় নিষেধ অনুসারে নিয়মিত; যদি ইহা স্থির সিদ্ধান্ত হইত, তাহা হইলে, এ দেশের লোকের ব্যবহার দর্শনে, হয় ত যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রনিষিদ্ধ নয়, এরূপ সন্দেহ করিলে, নিতান্ত অন্যায় হইত না। কিন্তু, যখন যাদৃচ্ছিক বহুবিবাহব্যবহার শাস্ত্রকারদিগের মতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হইতেছে, তখন তাদৃশ ব্যবহার দর্শনে, উহা শাস্ত্রনিষিদ্ধ নয়, এরূপ মীমাংসা করা কোনও মতে সঙ্গত হইতে পারে না। তবে, এ দেশের লোক, অনেক বিষয়ে, শাস্ত্রের নিষেধ লঙ্ঘন করিয়া চুলিয়া থাকেন; সুতরাং, বিবাহ বিষয়েও তাঁহারা তাহা করিতেছেন, এজন্য, তাহা বিশেষ দোষাবহ হইতে পারে না; এরূপ নির্দেশ করিলে, বরং তাহা অপেক্ষাকৃত ন্যায়ানুগত বলিয়া পরিগণিত হইতে পারিত। 

উপসংহার

পরিশেষে আমার বক্তব্য এই,

সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকৰ্ম্মণি।

* কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশোহবর ৩।১২৷৷ দ্বিজাতির পক্ষে, অগ্রে সবর্ণ্যবিবাহই বিহিত। কিন্তু, যাহারা রতিকামনায় বিবাহ করিতে প্রবৃত্ত হয়, তাহারা, অনুলোম ক্রমে, বর্ণান্তরে বিবাহ করিবেক।

এই মনুবচনে যে বিধি পাওয়া যাইতেছে, তাহা পরিসংখ্যা বিধি। এই পরিসংখ্যা বিধি দ্বারা, পূর্ব্বপরিণীতা সজাতীয়া স্ত্রীর জীবদ্দশায়, যদৃচ্ছা ক্রমে, পুনরায় সজাতীয়াবিবাহ সৰ্ব্বতোভাবে নিষিদ্ধ হইয়াছে। ঐ বিধি পরিসংখ্যা বিধি নহে, যাবৎ ইহা প্রতিপন্ন না হইতেছে, তাবৎ বহুবিবাহ “সর্বশাস্ত্রসম্মত" অথবা "শাস্ত্রনিষিদ্ধ নয়,” ইহা প্রতিপন্ন হওয়া অসম্ভব। অতএব, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহব্যবহার সর্বশাস্ত্রসম্মত,, অথবা শাস্ত্রনিষিদ্ধ নয়, ইহা প্রতিপন্ন করা যাঁহাদের উদ্দেশ্য, তাঁহাদের ঐ বিবাহ- কিধির পরিসংখ্যাত্ব খণ্ডন করা 'আবশ্যক। তাহা না করিয়া, যিনি যত ইচ্ছা বিতণ্ডা করুন, যিনি যত ইচ্ছা বেদ, স্মৃতি, পুরাণ, শকুন্তলা, বিজ্ঞাসুন্দর প্রভৃতি গ্রন্থ হইতে প্রমাণ উদ্ধৃত করুন, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড সর্বশাস্ত্রসম্মত, অথবা শাস্ত্র- নিষিদ্ধ নয়, ইহা কোনও ক্রমে প্রতিপন্ন করিতে পারিবেন না। বৃথা বিবাদে ও বাদানুবাদে, নিজের ও কৌতূহলাক্রান্ত পাঠক- গণের সময়নাশ ব্যতিরিক্ত আর কোনও ফল নাই।

কাশীপুর।

১লা আশ্বিন। সংবৎ ১৯২৮।

} শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্মা



4
Articles
বিদ্যাসাগরের গ্রন্থাবলী ( দ্বিতীয় খণ্ড )
0.0
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) এমন একটি বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব, যা আজকের দিনে প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। ওনার লেখা একাধিক কিছু রচনা সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এই রচনাবলি বইটি।
1

বিধবাবিবাহ

7 January 2024
0
0
0

দ্বিতীয় বারের বিজ্ঞাপন প্রায় দুই বৎসর অতীত হইল, এই পুস্তক প্রথম প্রচারিত হয়। যে উদ্দেশে প্রচারিত হইয়াছিল, তাহা একপ্রকার সফল হইয়াছে, বলিতে হইবেক; কারণ, যাঁহার। যথার্থ বুভুৎসুভাবে এবং বিদ্বেষহীন ও পক্ষ

2

MARRIAGE OF HINDU WIDOWS.

11 January 2024
0
0
0

PREFACE. In January 1855, I published a small pamphlet in Ben- gali on the marriage of Hindu Widows, with the view to prove that it was sanctioned by the Sastras. To this pamphlet, replies were given

3

বহুবিবাহ

13 January 2024
0
0
0

বিজ্ঞাপন এ দেশে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত থাকাতে, স্ত্রীজাতির যৎপরোনাস্তি ক্লেশ ও সমাজে অশেষবিধ অনিষ্ট ঘটিতেছে। রাজশাসন ব্যতিরেকে, সেই ক্লেশের ও সেই অনিষ্টের নিবারণের সম্ভাবনা নাই। এজন্য, দেশস্থ লোকে, স

4

বহুবিবাহ দ্বিতীয় পুস্তক

16 January 2024
1
0
0

যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড যে শাস্ত্রবহির্ভূত ও সাধুবিগর্হিত ব্যবহার, ইহা, বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না, এতদ্বিষয়ক বিচারপুস্তকে, আলোচিত হইয়াছে। তদ্দর্শনে, কতিপয় ব্যক্তি অতিশয় অসন্তুষ্ট হইয়াছেন; এ

---