shabd-logo

বিমলার আত্মকথা

9 October 2023

0 Viewed 0

এক জন্মে যে এতটা ঘটতে পারে সে মনেও করা যায় না। আমার যেন সাত জন্ম হয়ে গেল। এই কয় মাসে হাজার বছর পার হয়ে গেছে। সময় এত জোরে চলছিল যে, চলছে বলে বুঝতেই পারি নি। সেদিন হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে বুঝতে পেরেছি।


বাজার থেকে বিদেশী মাল বিদায় করবার কথা যখন স্বামীর কাছে বলতে গেলুম তখন জানতুম এই নিয়ে খানিকটা কথা-কাটাকাটি চলবে। কিন্তু আমার একটা বিশ্বাস ছিল যে, তর্কের দ্বারা তর্ককে নিরস্ত করা আমার পক্ষে অনাবশ্যক। আমার চার দিকের বায়ুমণ্ডলে একটা জাদু আছে। সন্দীপের মতো অতবড়ো একটা পুরুষ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো যে আমার পায়ের কাছে এসে ভেঙে পড়ল-- আমি তো ডাক দিই নি, সে আমার এই হাওয়ার ডাক। আর সেদিন দেখলুম, সেই অমূল্যকে, আহা সে ছেলেমানুষ, কচি মুরলী বাঁশটির মতো সরল এবং সরস, সে আমার কাছে যখন এল তখন ভোরফ্লোকার নদীর মতো দেখতে দেখতে তার জীবনের ধারার ভিতর থেকে একটি রঙ ফুটে উঠল। দেবী তাঁর ভক্তের মুখের দিকে চেয়ে যে কিরকম মুগ্ধ হতে পারেন সেদিন অমুলার দিকে চেয়ে আমি তা বুঝতে পারলুম। আমার শক্তির সোনার কাঠি যে কেমনতরো কাজ করে এমনি করে তো তা দেখতে পেয়েছি।


তাই সেদিন নিজের 'পরে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বজ্রবাহিনী বিদ্যুৎ শিখার মতো আমার স্বামীর কাছে গিয়েছিলুম। কিন্তু, হল কী ? আজ ন বছরে একদিনও স্বামীর চোখে এমন উদাস দৃষ্টি দেখি নি। সে যেন মরুভূমির আকাশের মতো, তার নিজের মধ্যেও একটুখানি রসের বাষ্প নেই, আর যার দিকে তাকিয়ে আছে তার মধ্যেও যেন কোথাও কিছুমাত্র রঙ দেখা যাচ্ছে না। একটু যদি রাগও করতেন তা হলেও বাঁচতুম। কোথাও তাঁকে ছুঁতেও পারলুম না। মনে হল আমি মিথ্যে। যেন আমি স্বপ্ন স্বপ্নটা যেই ভেঙে গেল, অমনি কেবল অন্ধকার রাত্রি।


এতকাল রূপের জন্যে আমার রূপসী জাদের ঈর্ষা করে এসেছি। মনে জানতুম বিধাতা আমাকে শক্তি দেন নি, আমার স্বামীর ভালোবাসাই আমার একমাত্র শক্তি। আজ যে শক্তির মদ পেয়ালা ভরে খেয়েছি, নেশা জমে উঠেছে। এমন সময় হঠাৎ পেয়ালাটা ভেঙে মাটির উপর পড়ে গেল। এখন বাঁচি কী করে !


তাড়াতাড়ি খোঁপা বাঁধতে বসেছিলুম। লজ্জা! লজ্জা! লজ্জা! মেজোরানীর ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় তিনি বলে উঠলেন, কী লো ছোটোরানী, খোঁপাটা যে মাথা ডিঙিয়ে লাফ মারতে চায়, মাথাটা


ঠিক আছে তো ? সেদিন বাগানে স্বামী আমাকে অনায়াসে বললেন, তোমাকে ছুটি দিলুম। ছুটি কি এতই সহজে দেওয়া যায় কিম্বা নেওয়া যায় ? ছুটি কি একটা জিনিস ? ছুটি যে ফাঁকা। মাছের মতো আমি যে চিরদিন আদরের জলে সাঁতার দিয়েছি, হঠাৎ আকাশে তুলে ধরে যখন বললে 'এই তোমার ছুটি -- তখন দেখি এখানে আমি চলতেও পারি নে, বাঁচতেও পারি নে।

আজ শোবার ঘরে যখন ঢুকি তখন শুধু দেখি আসবাব, শুধু আলনা, শুধু আয়না, শুধু খাট। এর উপরে সেই সর্বব্যাপী হৃদয়টি নেই। রয়েছে ছুটি, কেবল ছুটি, একটা ফাঁক। ঝর্না একেবারে শুকিয়ে গেল, পাথর আর নুড়িগুলো বেরিয়ে পড়েছে। আদর নেই, আসবাব !


এ জগতে সত্য আমার পক্ষে কোথায় কতটুকু টিকে আছে সে সম্বন্ধে হঠাৎ যখন এতবড়ো একটা ধাঁধা লাগল তখন আবার দেখা হল সন্দীপের সঙ্গে। প্রাণের সঙ্গে প্রাণের ধাক্কা লেগে সেই আগুন তো আবার তেমনি করেই জ্বলল। কোথায় মিথ্যে? এ যে ভরপুর সত্য, দুই কূল ছাপিয়ে-পড়া সত্য। এই- যে মানুষগুলো সব ঘুরে বেড়াচ্ছে, কথা কচ্ছে, হাসছে-- ঐ যে বড়োরানী মালা জপছেন, মেজোরানী থাকো দাসীকে নিয়ে হাসছেন, পাঁচালীর গান গাচ্ছেন-- আমার ভিতরকার এই আবির্ভাব যে এই-


সমন্তর চেয়ে হাজার গুণে সত্য। সন্দীপ বললেন, পঞ্চাশ হাজার চাই। আমার মাতাল মন বলে উঠল, পঞ্চাশ হাজার কিছুই নয়, এনে দেব! কোথায় পাব, কী করে পাব, সেও কি একটা কথা । এই তো আমি নিজে এক মুহূর্তে কিছু-না থেকে একেবারে সব-কিছুকে যেন ছাড়িয়ে উঠেছি। এমনি করেই এক ইশারায় সব ঘটনা ঘটবে। পারব পারব পারব! একটু ও সন্দেহ নেই।


চলে তো এলুম। তার পর চার দিকে চেয়ে দেখি, টাকা কই? কল্পতরু কোথায় ? বাহিরটা মনকে এমন করে লজ্জা দেয় কেন? কিন্তু তবু টাকা এনে দেবই। যেমন করেই হোক, তাতে গ্লানি নেই। যেখানে দীনতা সেখানেই অপরাধ, শক্তিকে কোনো অপরাধ স্পর্শই করে না। চোরই চুরি করে, বিজয়ী রাজা লুঠ করে নেয়। কোথায় মালখানা, সেখানে কার হাতে টাকা জমা হয়, পাহারা দেয় কারা, এই- সব সন্ধান করছি। অর্ধেক রাত্রে বাহির বাড়িতে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দফতরখানার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কাটিয়েছি। ঐ লোহার গরাদের মুঠো থেকে পঞ্চাশ হাজার ছিনিয়ে নেব কী করে? মনে দয়া ছিল না। যারা পাহারা দিচ্ছে তারা যদি মন্ত্রে ঐখানে মরে পড়ে তা হলে এখনই আমি উন্মত্ত হয়ে ঐ ঘরের মধ্যে ছুটে যেতে পারি। এই বাড়ির রানীর মধ্যে ডাকাতের দল খাঁড়া হাতে নৃত্য করতে করতে দেবীর কাছে বর মাগতে লাগল-- কিন্তু বাইরের আকাশ নিঃশব্দ হয়ে রইল, প্রহরে প্রহরে পাহারা বদল হতে লাগল, ঘন্টায় ঘন্টায় ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজল, বৃহৎ রাজবাড়ি নির্ভয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে রইল।


শেষকালে একদিন অমূল্যকে ডাকলুম। বললুম, দেশের জন্যে টাকার দরকার, খাজাঞ্চির কাছ


থেকে এ টাকা বের করে আনতে পারবে না ?


সে বুক ফুলিয়ে বললে, কেন পারব না ?


হায় রে, আমিও সন্দ্বীপের কাছে এমনি করে বলেছিলুম 'কেন পারব না'। অমূল্যর বুক-ফোলানো


দেখে একটু ও আশ্বাস পেলুম না।


জিজ্ঞাসা করলুম, কী করবে বলো দেখি।


অমূলা এমনি-সব আজগুবি প্ল্যান বলতে লাগল যে, সে মাসিক কাগজের ছোটো গল্পে ছাড়া আর কোথাও প্রকাশ করবারই যোগ্য নয়।


আমি বললুম, না অমূলা, ও-সব ছেলেমানুষি রাখো। সে বললে, আচ্ছা, টাকা দিয়ে ঐ পাহারার লোকদের বশ করব।


টাকা পাবে কোথা ?


সে অম্লানমুখে বললে, বাজার লুঠ ক'রে।

আমি বললুম, ও-সব দরকার নেই, আমার গয়না আছে তাই দিয়ে হবে। অমূল্য বললে, কিন্তু খাজাঞ্চির উপর ঘুষ চলবে না। খুব একটা সহজ ফিকির আছে।


কিরকম ?


সে আপনার শুনে কাজ নেই। সে খুব সহজ।


তবু শুনি।


অমূল্য কোর্তার পকেট থেকে প্রথমে একটা পকেট এডিশন গাঁতা বের করে টেবিলের উপর রাখলে, তার পরে একটি ছোটো পিস্তল বের করে আমাকে দেখালে, আর-কিছু বললে না।


কী সর্বনাশ! আমাদের বুড়ো খাজাঞ্চিকে মারার কথা মনে করতে ওর এক মুহূর্তও দেরি হল না। ওর মুখখানি এমনতরো যে মনে হয়, একটা কাক মারাও ওর পক্ষে শক্ত, অথচ মুখের কথা একেবারে অন্য জাতের। আসল কথা, এই সংসারে বুড়ো খাজাঞ্চি যে কতখানি সত্য তা ও একেবারে দেখতে পাচ্ছে না, সেখানে যেন ফাঁকা আকাশ। সেই আকাশে প্রাণ নেই, বাথা নেই, কেবল শ্লোক আছে : ন হনাতে হন্যমানে শরীরে।


আমি বললুম, বল কী অমূল্য। আমাদের রায়মশায়ের যে স্ত্রী আছে, ছেলেমেয়ে আছে, তার যে-- মন্ত্রী নেই, ছেলেমেয়ে নেই এমন মানুষ এ দেশে পাব কোথায় ? দেখুন, আমরা যাকে দয়া বলি সে


কেবল নিজের 'পরেই দয়া, পাছে নিজের দুর্বল মনে ব্যথা লাগে সেইজন্যেই অন্যকে আঘাত করতে


পারি নে, এই তো হল কাপুরুষতার চূড়ান্ত !


সন্দ্বীপের মুখের বুলি বালকের মুখে শুনে বুক কেঁপে উঠল। ও যে নিতান্ত কাঁচা, ভালোকে ভালো বলে বিশ্বাস করবারই যে এর সময়। আহা, ও যে বাঁচবার বয়েস, বাড়বার বয়েস। আমার ভিতরে মা জেগে উঠল যে ! নিজের দিক থেকে আমার ভালোও ছিল না, মন্দও ছিল না, ছিল কেবল মরণ মধুর রূপ ধরে কিন্তু যখন এই আঠারো বছরের ছেলে এমন অনায়াসে মনে করতে পারলে একজন বুড়োমানুষকে বিনা দোষে মেরে ফেলাই ধর্ম তখন আমার গা শিউরে উঠল। যখন দেখতে পেলুম ভর মনে পাপ নেই তখন ওর এই কথার পাপ বড়ো ভয়ংকর হয়ে আমার কাছে দেখা দিলে। যেন বাপমায়ের অপরাধকে কচি ছেলের মধ্যে দেখতে পেলুম।


বিশ্বাসে উৎসাহে ভরা বড়ো বড়ো ঐ দু'টি সরল চোখের দিকে চেয়ে আমার প্রাণের ভিতর কেমন করতে লাগল। অজগর সাপের মুখের মধ্যে ঢুকতে চলেছে, একে কে বাঁচাবে ? আমার দেশ কেন সত্যিকার মা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এই ছেলেটিকে বুকে চেপে ধরছে না ? কেন একে বলছে না, এরে বাছা, আমাকে তুই বাঁচিয়ে কী করবি তোকে যদি বাঁচাতে না পারলাম ?


জানি জানি, পৃথিবীর বড়ো বড়ো প্রতাপ শয়তানের সঙ্গে রফা করে বেড়ে উঠেছে, কিন্তু মা যে আছে


একলা দাঁড়িয়ে এই শয়তানের সমৃদ্ধিকে তুচ্ছ করবার জন্যে। মা তো কার্যসিদ্ধি চায় না, সে সিদ্ধি


যতবড়ো সিদ্ধিই হোক, মা যে বাঁচাতে চায়। আজ আমার সমস্ত প্রাণ চাচ্ছে এই ছেলেটিকে দুই হাতে টেনে ধরে বাঁচাবার জন্যে। কিছু আগেই ওকে ডাকাতি করতে বলেছিলুম, এখন যতবড়ো উল্টো কথাই বলি সেটাকে ও মেয়েমানুষের দুর্বলতা বলে হাসবে। মেয়েমানুষের দুর্বলতাকে ওরা তখনই মাথা পেতে নেয় যখন সে


পৃথিবী মঙ্গাতে বসে। অমূল্যকে বললুম, যাও, তোমাকে কিছু করতে হবে না, টাকা সংগ্রহ করবার ভার আমারই উপর।

যখন সে দরজা পর্যন্ত গেছে তাকে ডাক দিয়ে ফেরালুম বললুম, অনা, আমি তোমার দিদি।


পৃথিবী মজাতে বসে। অমূল্যকে বললুম, যাও, তোমাকে কিছু করতে হবে না, টাকা সংগ্রহ করবার ভার আমারই উপর।


আজ ভাইফোঁটার পাঁজির তিথি নয়, কিন্তু ভাইফোঁটার আসল তিথি বছরে তিন শো পঁয়ষটি দিন। আমি তোমাকে আশীর্বাদ করছি, ভগবান তোমাকে রক্ষা করুন।


হঠাৎ আমার মুখ থেকে এই কথা শুনে অমূল্য একটু থমকে রইল। তার পরেই প্রণাম করে আমার পায়ের ধুলো নিলে। উঠে যখন দাঁড়ালো তার চোখ ছলছল করছে। ভাই আমার, আমি তো মরতেই বসেছি, তোমার সব বালাই নিয়ে যেন মরি-- আমা হতে তোমার


কোনো অপরাধ যেন না হয়। অমূলাকে বললুম, তোমার পিস্তলটি আমাকে প্রণামী দিতে হবে।


কী করবে দিদি ?


মরণ প্র্যাকটিস করব।


এই তো চাই দিদি, মেয়েদেরও মরতে হবে, মারতে হবে। এই বলে অমূল্য পিলটি আমার হাতে


দিলে।


অমূল্য তার তরুণ মুখের দীপ্তিরেখা আমার জীবনের মধ্যে নূতন ঊষার প্রথম-অরুণলেখাটির মতো এঁকে দিয়ে গেল। পিস্তলটাকে বুকের কাপড়ের ভিতর নিয়ে বললুম, এই রইল আমার উদ্ধারের শেষ সম্বল, আমার ভাইফোঁটার প্রণামী। নারীর হৃদয়ে যেখানে মায়ের আসন আমার সেইখানকার জানলাটি হঠাৎ এই একবার খুলে


গিয়েছিল। তখন মনে হল, এখন থেকে বুঝি তবে খোলাই রইল।


কিন্তু শ্রেয়ের পথ আবার বন্ধ হয়ে গেল, প্রেয়সী নারী এসে মাতার স্বস্তায়নের ঘরে তালা লাগিয়ে


দিলে। পরের দিনে সন্দীপের সঙ্গে আবার দেখা। একটা উলঙ্গ পাগলামি আবার হৃৎপিণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে নৃত্য শুরু করে দিলে। কিন্তু এ কী এ ! এই কি আমার স্বভাব ? কখনোই না।


এই নির্লজ্জকে এই নিদারুণকে এর আগে কোনোদিন দেখি নি। সাপুড়ে হঠাৎ এসে এই সাপকে আমার আচলের ভিতর থেকে বের করে দেখিয়ে দিলে কিন্তু কখনোই এ আমার আচলের মধ্যে ছিল না, এ ঐ সাপুড়েরই চাদরের ভিতরকার জিনিস। অপদেবতা কেমন করে আমার উপর ভর করেছে! আজ আমি যা-কিছু করছি সে আমার নয়, সে তারই লীলা ।


সেই অপদেবতা একদিন রাঙা মশাল হাতে করে এসে আমাকে বললে, আমিই তোমার দেশ, আমিই তোমার সন্দীপ, আমার চেয়ে বড়ো তোমার আর কিছুই নেই, বন্দেমাতরং। আমি হাত জোড় করে বললুম, তুমিই আমার ধর্ম, তুমিই আমার স্বর্গ, আমার যা-কিছু আছে সব তোমার প্রেমে ভাসিয়ে দেব। বন্দেমাতরং !


পাঁচ হাজার চাই ? আচ্ছা, পাঁচ হাজারই নিয়ে যাব। কালই চাই? আচ্ছা, কালই পাবে। কলঙ্কে দুঃসাহসে ঐ পাঁচ হাজার টাকার দান মদের মতো ফেনিয়ে উঠবে; তার পরে মাতালের উৎসব; অচলা পৃথিবী পায়ের তলায় টলমল করতে থাকবে, চোখের উপর আগুন ছুটবে, কানের ভিতর ঝড়ের গর্জন জাগবে, সামনে কী আছে কী নেই তা বুঝতেই পারব না; তার পরে টলতে টলতে পড়ব গিয়ে মরণের মধ্যে সমস্ত আগুন এক নিমিষে নিবে যাবে, সমস্ত ছাই হাওয়ায় উড়বে-- কিছুই আর বাকি থাকবে না।


টাকা কোথায় পাওয়া যেতে পারে সে কথা এর আগে কোনোমতেই ভেবে পাচ্ছিলুম না। সেদিন তীব্র উত্তেজনার আলোতে এই টাকাটা হঠাৎ চোখের সামনে প্রত্যক্ষ দেখতে পেলুম। ফি বছর আমার স্বামী পুজোর সময় তাঁর বড়ো ভাজ আর মেজো ভাইকে তিন হাজার টাকা করে প্রণামী দিয়ে থাকেন। সেই টাকা বছরে বছরে তাঁদের নামে ব্যাঙ্কে জমা হয়ে সুদে বাড়ছে। এবারেও নিয়মমত প্রণামী দেওয়া হয়েছে, কিন্তু জানি টাকাটা এখনো ব্যাঙ্কে পাঠানো হয় নি। কোথায় আছে তাও আমার জানা। আমাদের শোবার ঘরের সংলগ্ন কাপড় ছাড়বার ছোটো কুঠরির কোণে লোহার সিন্দুক আছে, তারই মধ্যে টাকাটা তোলা হয়েছে।


ফি বছরে এই টাকা নিয়ে আমার স্বামী কলকাতার ব্যাঙ্কে জমা দিতে যান : এবারে তাঁর আর যাওয়া হল না। এইজন্যেই তো দৈবকে মানি। এই টাকা দেশ নেবেন বলেই আটক আছে। এ টাকা ব্যাঙ্কে নিয়ে যায় সাধ্য কার ? আর এই টাকা আমি না নিই এমন সাধাই বা আমার কই ? প্রলয়ংকরী খর্পর বাড়িয়ে দিয়েছেন ; বলছেন, আমি ক্ষুধিত, আমাকে দে! আমি আমার বুকের রক্ত দিলুম, ঐ পাঁচ হাজার টাকায়। মা গো, এই টাকা যার গেল তার সামান্যই ক্ষতি হবে, কিন্তু আমাকে এবার তুমি একেবারে ফতুর করে নিলে।


এর আগে কতদিন বড়োরানী-মেজোরানীকে আমি মনে মনে চোর বলেছি; আমার বিশ্বাসপরায়ণ স্বামীকে ভুলিয়ে তাঁরা ফাঁকি দিয়ে কেবল টাকা নিচ্ছেন, এই ছিল আমার নালিশ ; তাদের স্বামীদের মৃত্যুর পরে অনেক সরকারি জিনিসপত্র তাঁরা লুকিয়ে সরিয়েছেন, এ কথা অনেকবার স্বামীকে বলেছি। তিনি তার কোনো জবাব না করে চুপ করে থাকতেন। তখন আমার রাগ হত : আমি বলতুম, দান করতে হয় হাতে তুলে দান করো, কিন্তু চুরি করতে দেবে কেন ? বিধাতা সেদিন আমার এই নালিশ শুনে মুচকে হেসেছিলেন, আজ আমি আমার স্বামীর সিন্দুক থেকে ঐ বড়োরানীর মেজোরানীর টাকা চুরি করতে চলেছি।


রাত্রে আমার স্বামী সেই ঘরেই তাঁর জামাকাপড় ছাড়েন, সেই জামার পকেটেই তাঁর চাবি থাকে। সেই চাবি বের করে নিয়ে লোহার সিন্দুক খুললুম। অল্প যে একটু শব্দ হল, মনে হল সমস্ত পৃথিবী যেন জেগে উঠল। হঠাৎ একটা শীতে আমার হাত-পা হিম হয়ে বুকের মধ্যে ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকল।


লোহার সিন্দুকের মধ্যে একটা টানা দেরাজ আছে। সেইটে খুলে দেখলুম নোট নেই, কাগজের মোড়কে ভাগ করা যিনি সাজানো। প্রতি মোড়কে কত গিনি আছে, আমার কত দরকার, সে তখন


হিসেব করবার সময় নয়। কুড়িটি মোড়ক ছিল, সব ক'টা নিয়েই আমার আঁচলে বাঁধস্সুম। কম ভারী নয়! চুরির ভারে আমার মন যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হয়তো নোটের তাড়া হলে সেটাকে এত বেশি চুরি বলে মনে হত না। এ যে সব সোনা!


সেই রাত্রে নিজের ঘরে যখন চোর হয়ে ঢুকতে হল তখন থেকে এ ঘর আমার আর আপন রইল না। এ ঘরে আমার কত বড়ো অধিকার। চুরি করে সব খোয়ালুম।


মনে মনে জপতে লাগলুম, বন্দেমাতরং, বন্দেমাতরং ! দেশ, আমার দেশ, আমার সোনার দেশ ! সব সোনা সেই দেশের সোনা, এ আর কারো নয়।


কিন্তু রাত্রের অন্ধকারে মন যে দুর্বল হয়ে থাকে। স্বামী পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছিলেন, চোখ বুজে তাঁর ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে গেলুম। অন্তঃপুরের খোলা ছাদের উপর গিয়ে সেই আঁচলে বাঁধা চুরির উপর বুক দিয়ে মাটিতে পড়ে রইলুম, সেই মোড়কগুলো বুকে বাজতে লাগল। নিস্তব্ধ রাত্রি আমার শিয়রের কাছে তর্জনী তুলে রইল। ঘরকে তো আমি দেশ থেকে স্বতন্ত্র করে দেখতে পারলুম না। আজ ঘরকে লুটেছি, দেশকেই লুটেছি। এই পাপে একই সঙ্গে ঘর আমার ঘর রইল না, দেশও হয়ে গেল পর। আমি যদি ভিক্ষে করে দেশের সেবা করতুম এবং সেই সেবা সম্পূর্ণ না করেও মরে যেতুম, তবে সেই অসমাপ্ত সেবাই হত পূজা, দেবতা তা গ্রহণ করতেন। কিন্তু চুরি তো পূজা নয়; এ জিনিস কেমন করে দেশের হাতে তুলে দেব। চোরাই মালে দেশের ভরা ডোবাতে বসলুম গো! নিজে মরতে বসেছি, কিন্তু দেশকে আকড়ে ধরে তাকে সুদ্ধ কেন অশুচি করি।


এ টাকা লোহার সিন্দুকে ফেরবার পথ বন্ধ। আবার এই রাত্রে সেই ঘরে ফিরে গিয়ে সেই চাবি নিয়ে সেই সিন্দুক খোলবার শক্তি আমার নেই। আমি তা হলে স্বামীর ঘরের চৌকাঠের কাছে অজ্ঞান হয়ে


পড়ে যাব। এখন সামনে রাস্তা ছাড়া রাস্তাই নেই । কত টাকা নিলুম তাই যে বসে বসে শুনব, সে আমি লজ্জায় পারলম না। ও যেমন ঢাকা আছে তেমনি ঢাকা থাক, চুরির হিসেব করব না।


শীতের অন্ধকার রাত্রে আকাশে একটুও বাষ্প ছিল না; সমস্ত তারাগুলি ঝক ঝক করছে। আমি ছাদের উপর শুয়ে শুয়ে ভাবছিলুম দেশের নাম করে ঐ তারাগুলি যদি একটি একটি মোহরের মতো আমাকে চুরি করতে হত, অন্ধকারের বুকের মধ্যে সঞ্চিত ঐ তারাগুলি, তার পরদিন থেকে চিরকালের জন্যে রাত্রি একেবারে বিধবা, নিশীথের আকাশ একেবারে অন্ধ, তা হলে সে চুরি যে সমস্ত জগতের কাছ থেকে চুরি হত। আজ আমি এই-যে চুরি করে আনলুম এও তো ঢাকা-চুরি নয়, এ যে আকাশের চিরকালের আলো চুরিরই মতো; এ চুরি সমস্ত জাতের কাছ থেকে চুরি, বিশ্বাস চুরি, ধর্ম-চুরি।


তাদের উপর পড়ে রাত্রি কেটে গেল। সকালে যখন বুঝলুম আমার স্বামী এতক্ষণে উঠে চলে গেছেন তখন সর্বাঙ্গে শাল মুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের দিকে চললুম। তখন মেজোরানী ঘটিতে করে তাঁর বারান্দার টবের গাছ-ক'টিতে জল দিচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, ওলো ছোটোরানী, শুনেছিস খবর?


আমি চুপ করে দাঁড়ালুম, আমার বুকের মধ্যে কাঁপতে লাগল। মনে হতে লাগল, আঁচলে বাঁধা


মিনিগুলো শালের ভিতর থেকে বড়ো বেশি উঁচু হয়ে আছে। মনে হল, এখনই আমার কাপড় ছিঁড়ে গিনিগুলো বারান্দাময় ঝন ঝন করে ছড়িয়ে পড়বে, নিজের ঐশ্বর্য চুরি করে ফতুর হয়ে গেছে এমন চোর আজ এই বাড়ির দাসী-চাকরদের কাছেও ধরা পড়ে যাবে।


মেজোরানী বললেন, তোদের দেবীচৌধুরানীর দল ঠাকুরপোর তহবিল লুঠ করবে শাসিয়ে বেনামি চিঠি লিখেছে।


আমি চোরের মতোই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম। আমি ঠাকুরপোকে বলছিলুম তোমার শরণাপন্ন হতে। দেবী, প্রসন্ন হও গো, তোমার দলবল ঠেকাও। আমরা তোমার বন্দেমাতরমের শিন্নি মানছি। দেখতে দেখতে অনেক কাগুই তো হল, এখন


দোহাই তোমার ঘরে সিঁদটা ঘটতে দিয়ো না। আমি কিছু না বলে তাড়াতাড়ি আমার শোবার ঘরে চলে গেলুম। চোরাবালিতে পা দিয়ে ফেলেছি,


আর ওঠবার জো নেই, এখন যত ছটফট করব ততই ডুবতে থাকব।

এ টাকাটা এক্ষনি আমার আঁচল থেকে খসিয়ে সন্দীপের হাতে দিয়ে ফেলতে পারলে বাঁচি, এ বোঝা আমি আর বইতে পারি নে, আমার পাজর যেন ভেঙে যাচ্ছে। সকালবেলাতেই খবর পেলুম সন্দীপ আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আজ আর আমার সাজসজ্জা ছিল না, শাল মুড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে চলে গেলুম।


ঘরের মধ্যে ঢুকেই দেখি সন্দীপের সঙ্গে অনুলা বসে আছে। মনে হল আমার মানসম্ভ্রম যা-কিছু বাকি ছিল সমস্ত যেন ঝিম ঝিম করে আমার গা বেয়ে নেবে গিয়ে পায়ের তলা দিয়ে একেবারে মাটির মধ্যে চলে গেল। নারীর চরম অমর্যাদা ঐ বালকের সামনে আজ আমাকে উদ্‌ঘাটিত করে দিতে হবে। আমার এই চুরির কথা এরা আজ দলের মধ্যে বসে আলোচনা করছে। এর উপরে অল্প একটু খানিও আবরু রাখতে দেয় নি !


পুরুষমানুষকে আমরা বুঝব না। ওরা যখন ওদের উদ্দেশ্যের রথ টানবার পথ তৈরি করতে বসে তখন বিশ্বের হৃদয়কে টুকরো টুকরো করে ভেঙে পথের খোওয়া বিছিয়ে দিতে ওদের একটুও বাধে না। ওরা নিজের হাতে সৃষ্টি করবার নেশায় যখন মেতে ওঠে তখন সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে চুরমার করতেই ওদের আনন্দ। আমার এই মর্মান্তিক লজ্জা গুদের চোখের কোণেও পড়বে না, প্রাণের পরে দরদ নেই ওদের, ওদের যত বজ্রতা সব উদ্দেশ্যের দিকে। হায় রে, এদের কাছে আমি কেই বা বন্যার মুখের কাছে একটা মেঠো ফুলের মতো।


কিন্তু আমাকে এমন করে নিবিয়ে ফেলে সন্দীপের লাভ হল কা? এই পাঁচ হাজার টাকা? কিন্তু আমার মধ্যে পাঁচ হাজার টাকার চেয়ে বেশি কিছু ছিল না কি ? ছিল বৈকি। সেই খবর তো সন্দীপের কাছেই শুনেছিলুম, আর সেই শুনেই তো আমি সংসারের সমস্তকে তুচ্ছ করতে পেরেছিলুম। আমি আলো দেব, আমি জীবন দেব, আমি শক্তি দেব, আমি অমৃত দেব, সেই বিশ্বাসে সেই আনন্দে দুই কুল ছাপিয়ে আমি বাহির হয়ে পড়েছিলুম। আমার সেই আনন্দকে যদি কেউ পূর্ণ করে তুলত তা হলে আমি মরে গিয়েও বাঁচতুম, আমার সমস্ত সংসার ভাসিয়ে দিয়েও আমার লোকসান হত না।


আজ কি এরা বলতে চায় এ সমস্তই মিথ্যে কথা ? আমার মধ্যে যে দেবী আছে ভক্তকে বরাভয় দেবার শক্তি তার নেই ? আমি যে গান শুনেছিলুম, যে গান শুনে স্বর্গ হতে ধুলোয় নেমে এসেছিলুম, সে কি এই ধুলোকে স্বর্গ করবার জন্যে নয় ? সে কি স্বৰ্গকেই মাটি করবার জন্যে ?


সন্দীপ আমার মুখের দিকে তার তীব্র দৃষ্টি রেখে বললে, টাকা চাই রানী। অমূলা আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল, সেই বালক, সে আমার মায়ের গর্ভে জন্মায় নি বটে, কিন্তু সে তার মায়ের গর্ভে জন্মেছিল-- সেই মা, সে যে একই মা। আহা, ঐ কচি মুখ, ঐ স্নিগ্ধ চোখ, ই তরুণ বয়েস। আমি মেয়েমানুষ, আমি ওর মায়ের জাত, ও আমাকে বললে কিনা আমার হাতে বিষ তুলে দাও', আর আমি ওর হাতে বিষই তুলে দেব !


টাকা চাই রানী!--


রাগে লজ্জায় আমার ইচ্ছে হল সেই সোনার বোঝা সন্দীপের মাথার উপর ছুঁড়ে ফেলে দিই। আমি কিছুতেই আচলের গিরে যেন খুলতে পারছিলাম না, থরথর করে আমার আঙুলগুলো কাঁপতে লাগল। তার পর টেবিলের উপর সেই কাগজের মোড়কগুলো যখন পড়ল তখন সন্দীপের মুখ কালো হয়ে উঠল। সে নিশ্চয় ভাবলে ঐ মোড়কগুলোর মধ্যে আধুলি আছে। কী ঘৃণা! অক্ষমতার উপরে কী নিষ্ঠুর অবজ্ঞা। মনে হল ও যেন আমাকে মারতে পারে। সন্দীপ ভাবলে, আমি বুঝি ওর সঙ্গে দূর করতে বসেছি, ওর পাঁচ হাজার টাকার দাবি দু-তিন শো টাকা দিয়ে রফা করতে চাই। একবার মনে হল, এই মোড়কগুলো নিয়ে ও জানলার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। ও কি ভিক্ষুক ? ও যে রাজা। অমূল্য জিজ্ঞাসা করলে, আর নেই রানীদিদি ?


করুণায় ভরা তার গলা। আমার মনে হল আমি বুঝি চীৎকার করে কেঁদে উঠব। প্রাণপণে হৃদয়কে যেন চেপে ধরে একটু কেবল ঘাড় নাড়লুম। সন্দীপ চুপ করে রইল, মোড়কগুলো ছুঁলেও না, একটা কথাও বললে না । চলে যাব ভাবছি, কিন্তু কিছুতেই আমার পা চলছে না। পৃথিবী দু ফাঁক হয়ে আমাকে যদি টেনে


নিত তা হলেই এই মাটির পিণ্ড মাটির মধ্যে আশ্রয় পেয়ে বাঁচত।


আমার অপমান ঐ বালকের বুকে গিয়ে বাজল। সে হঠাৎ খুব একটা আনন্দের ভান করে বলে উঠল. এই কম কী! এতেই ঢের হবে। তুমি আমাদের বাঁচিয়েছ রানীদিদি।


বলেই সে একটা মোড়ক খুলে ফেললে, গিনিগুলো ঝক, থাক করে উঠল। এক মুহূর্তে সন্দ্বীপের মুখের যেন একটা কালো মোড়ক খুলে গেল। তারও মুখ-চোখ আনন্দে ঝৰু, ঝাক করতে লাগল। মনের ভিতরকার এই হঠাৎ উল্টো হাওয়ার দমকা সামলাতে না পেরে সে চৌকি থেকে লাফিয়ে উঠে আমার কাছে ছুটে এল। কী তার মতলব ছিল জানি নে। আমি বিদ্যুতের মতো অমূল্যের মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখলুম, হঠাৎ একটা চাবুক খেয়ে তার মুখ যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে। আমি আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে সন্দীপকে ঠেলা দিলুম। পাথরের টেবিলের উপর মাথাটা তার ঠক করে ঠেকল, তার পরে সেখান থেকে সে মাটিতে পড়ে গেল, কিছুক্ষণ তার আর সাড়া রইল না। এই প্রবল চেষ্টার পরে আমার শরীরে আর একটুও বল ছিল না, আমি চৌকির উপরে বসে পড়লুম। অমূলোর মুখ আনন্দে দীপ্ত হয়ে উঠল, সে সন্দীপের দিকে ফিরেও তাকালে না, আমার পায়ের ধুলো নিয়ে আমার পায়ের কাছে বসল। ওরে ভাই, ভরে বাছা, তোর এই একটুিকু আজ আমার শূন্য বিশ্বপাত্রের শেষ সুধাবিন্দু। আর আমি পারলুম না, আমার কান্না ভেঙে পড়ল। আমি দুই হাতে আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলুম। মাঝে মাঝে আমার পায়ের উপর অগুলোর করুণ হাতের স্পর্শ যতই পাই আমার কান্না ততই ফেটে পড়তে চায়।


খানিকক্ষণ পরে সামলে উঠে চোখ খুলে দেখি যেন একেবারে কিছুই হয় নি এমনিভাবে সন্দীপ টেবিলের কাছে এসে গিনিগুলো কমালে বাঁধছে। অমূল্য আমার পায়ের কাছ থেকে উঠে দাড়ালো, ছলছল করছে তার চোখ।


সন্দীপ অসংকোচে আমাদের মুখের দিকে চোখ তুলে বললে, ছ হাজার টাকা। অমূলা বললে, এত টাকা তো আমাদের দরকার নেই সন্দীপবাবু। হিসেব করে দেখেছি, সাড়ে তিন


হাজার টাকা হলেই আমাদের এখনকার কাজ উদ্ধার হবে।


সন্দীপ বললে, আমাদের কাজ তো কেবলমাত্র এখনকার কাজই নয়। আমাদের যা দরকার তার কি সংখ্যা আছে ? অমূল্য বললে, তা হোক, ভবিষ্যতে যা দরকার হবে তার জন্যে আমি দায়ী, আপনি ঐ আড়াই


হাজার টাকা রানীদিদিকে ফিরিয়ে দিন। সন্দীপ আমার মুখের দিকে চাইলে। আমি বলে উঠলুম, না না, ও টাকা আমি আর ছুঁতেও চাই নে। ও নিয়ে তোমাদের যা-খুশি তাই করো।

সন্দীপ অমূল্যের দিকে চেয়ে বললে, মেয়েরা যেমন করে দিতে পারে এমন কি পুরুষ পারে ? অমূল্য উচ্ছ্বসিত হয়ে বললে, মেয়েরা যে দেবী ! সন্দীপ বললে, আমরা পুরুষরা বড়ো জোর আমাদের শক্তিকে দিতে পারি, মেয়েরা যে আপনাকে


দেয়। ওরা আপনার প্রাণের ভিতর থেকে সন্তানকে জন্ম দেয়, পালন করে, বাহির থেকে নয়। এই


দানই তো সত্য দান। এই বলে সন্দীপ আমার দিকে চেয়ে বললে, রানী, আজ তুমি যা দিলে এ যদি কেবলমাত্র টাকা হত তা হলে আমি এ ছ'তুম না, তুমি আপনার প্রাণের চেয়ে বড়ো জিনিস দিয়েছ।


মানুষের বোধ হয় দুটো বুদ্ধি আছে। আমার একটা বুদ্ধি বুঝতে পারে সন্দীপ আমাকে ভোলাচ্ছে, কিন্তু আমার আর-একটা বুদ্ধি ভোলে। সন্দীপের চরিত্র নেই, সন্দ্বীপের শক্তি আছে। সেইজন্যে ও যে


মুহূর্তে প্রাণকে জাগিয়ে তোলে সেই মুহুর্তেই মৃত্যুবাণও মারে। দেবতার অক্ষয় স্তূণ ওর হাতে আছে, কিন্তু তৃণের মধ্যে দানবের অস্ত্র। সন্দীপের রুমালে সব গিনি ধরছিল না : সে বললে, রানী, তোমার একখানি কমাল আমাকে দিতে


পার ? আমি রুমাল বের করে দিতেই রুমালটি নিয়ে সে মাথায় ঠেকালে, তার পরেই আমার পায়ের কাছে বসে পড়ে আমাকে প্রণাম করে বললে, দেবী, তোমাকে এই প্রণামটি দেবার জন্যেই ছুটে এসেছিলুম, তুমি আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলে। তোমার ঐ ধাক্কাই আমার বর। ঐ ধাক্কা আমি মাথায় করে নিয়েছি। বলে মাথায় যেখানে লেগেছিল সেইখানটা আমাকে দেখিয়ে দিলে।


আমি কি সত্যি ভুল বুঝেছিলুম ? সন্দীপ কি দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে তখন আমাকে প্রণাম করতেই


এসেছিল ? তার মুখে চোখে হঠাৎ যে মত্ততা ফেনিয়ে উঠল সে তো, মনে হল, অমূলাও দেখতে


পেয়েছিল। কিন্তু স্তবগানে সন্দীপ এমন আশ্চর্য সুর লাগাতে জানে যে তর্ক করতে পারি নে, সত্য


দেখবার চোখ যেন কোন আফিমের নেশায় বুজে আসে। সন্দীপকে আমি যে আঘাত করেছি সে আঘাত


সে আমাকে দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিলে, তার মাথার ক্ষত আমার বুকের ভিতরে রক্তপাত করতে লাগল। সন্দীপের প্রণাম যখন পেলুম আমার চুরি তখন মহিমান্বিত হয়ে উঠল। টেবিলের উপরকার চিমনিগুলি সমস্ত লোকনিন্দাকে ধর্মবৃদ্ধির সমস্ত বেদনাকে উপেক্ষা করে ঝক ঝক্ করে হাসতে লাগল। আমারই মতো অমুলোরও মন ভুলে গেল। ক্ষণকালের জন্যে সন্দীপের প্রতি তার যে শ্রদ্ধা প্রতিরুদ্ধ হয়েছিল সে আবার বাধামুক্ত হয়ে উছলে উঠল, আমার পূজায় এবং সন্দীপের পূজায় তার হৃদয়ের পুষ্পপাত্রটি পূর্ণ হয়ে গেল। সরল বিশ্বাসের কী স্নিগ্ধসুধা ভোরবেলাকার শুকতারার আলোটির মতো তার চোখ থেকে বিকীর্ণ হতে লাগল। আমি পূজা দিলেম, আমি পূজা পেলেন, আমার পাপ জ্যোতির্ময় হয়ে উঠল। অমূলা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বললে, বন্দেমাতরং !


কিন্তু স্তবের বাণী তো সব সময় শুনতে পাই নে। নিজের মনের ভিতর থেকে নিজের পরে নিজের শ্রদ্ধাকে বাঁচিয়ে রাখবার সম্বল আমার যে কিছুই নেই। আমার শোবার ঘরে ঢুকতে পারি নে। সেই লোহার সিন্দুক আমার দিকে ভ্রূকুটি করে থাকে, আমাদের পালঙ্ক আমার দিকে যেন একটা নিষেধের হাত বাড়ায়। আপনার ভিতরে আপনার এই অপমান থেকে ছুটে পালাতে ইচ্ছে করে : কেবলই মনে হয় সন্দীপের কাছে গিয়ে আপনার স্তব শুনি গে। আমার অতলস্পর্শ গ্লানির গহ্বর থেকে জগতে সেই একটুমাত্র পূজার বেদী জেগে আছে সেখান থেকে যেখানেই পা বাড়াই সেইখানেই শুনা। তাই দিনরাত্রি ঐ বেদী আকড়ে পড়ে থাকতে চাই। স্তব চাই, স্তব চাই, দিনরাত্রি স্তব চাই। ঐ মদের পেয়ালা একটুমাত্র খালি হতে থাকলেই আমি আর বাঁচি নে। তাই সমস্ত দিনই সন্দীপের কাছে গিয়ে তার কথা শোনবার জন্যে আমার প্রাণ কাঁদছে; আমার অস্তিত্বের মূলাটুকু পাবার জন্যে আজ পৃথিবীর মধ্যে সন্দীপকে আমার এত দরকার ।


আমার স্বামী দুপুরবেলা যখন খেতে আসেন আমি তাঁর সামনে বসতে পারি নে : অথচ না বসাটা এতই বেশি লজ্জা যে সেও আমি পারি নে, আমি তাঁর একটু পিছনের দিকে এমন করে বসি যে তাঁর সঙ্গে আমার মুখোমুখি ঘটে না। সেদিন তেমনি করে বসে আছি, তিনি খাচ্ছেন, এমন সময় মেজোরানী এসে বসলেন; বললেন, ঠাকুরপো, তুমি ঐ সব ডাকাতির শাসানি-চিঠি হেসে উড়িয়ে দাও, কিন্তু


আমার ভয় হয়। আমাদের এবারকার প্রণামীর টাকাটা তুমি এখনো ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে দাও নি ?


আমার স্বামী বললেন, না, সময় পাই নি।


মেজোরানী বললেন, দেখো ভাই, তুমি বড়ো অসাবধান, ও টাকাটা-- স্বামী হেসে বললেন, সে যে আমার শোবার ঘরের পাশের ঘরে লোহার সিন্দুকে আছে। যদি সেখান থেকে নেয় বলা যায় কি ?


আমার ও ঘরেও যদি চোর ঢোকে তা হলে কোনদিন তোমাকেও চুরি হতে পারে। ওগো, আমাকে কেউ নেবে না, ভয় নেই তোমার নেবার মতো জিনিস তোমার আপনার ঘরেই আছে। না ভাই, ঠাট্টা না, তুমি ঘরে টাকা রেখো না।


সদর-খাজনা চালান যেতে আর দিন-পাঁচেক আছে, সেই সঙ্গেই ও টাকাটা আমি কলকাতার ব্যাঙ্কে


পাঠিয়ে নেব।


দেখো ভাই, ভুলে বোসো না, তোমার যেরকম ভোলা মন কিছুই বলা যায় না।


২এ ঘর থেকে যদি টাকা চুরি যায় তা হলে আমারই টাকা চুরি যাবে, তোমার কেন যাবে বউরানী ? ঠাকুরপো, তোমার ঐ সব কথা শুনলে আমার গায়ে জ্বর আসে। আমি কি আমার তোমার ভেদ করে কথা কচ্ছি ? তোমারই যদি চুরি যায় সে কি আমাকে বাজবে না ? পোড়া বিধাতা সব কেড়ে নিয়ে আমার যে লক্ষ্মণ দেওরটি রেখেছেন তাঁর মূল্য বুঝি আমি বুঝি নে ? আমি ভাই তোমাদের বড়োরানীর মতো দিনরাত্রি দেবতা নিয়ে ভুলে থাকতে পারি নে, দেবতা আমাকে যা দিয়েছেন সেই আমার দেবতার চেয়েও বেশি। কী লো ছোটোরানী, তুই যে একেবারে কাঠের পুতুলের মতো চুপ করে রইলি ? জান ভাই ঠাকুরপো, ছোটোৱানী মনে ভাবে আমি তোমাকে খোশামোদ করি। তা, তেমন দায়ে পড়লে খোশামোদই করতে হত। কিন্তু, তুমি কি আমাদের তেমনি দেওর যে খোশামোদের অপেক্ষা রাথ ? যদি হতে ঐ মাধব চক্রবর্তীর মতো তা হলে আমাদের বড়োরানীরও দেবসেবা আজ ঘুচে যেত, আধপয়সাটির জন্যে তোমার হাতে পায়ে ধরাধরি করেই দিন কাটত। তাও বলি, তা হলে ওর উপকার


হত, বানিয়ে বানিয়ে তোমার নিন্দে করবার এত সময় পেত না। এমনি করে মেজোরানী অনর্গল বকে যেতে লাগলেন, তারই মাঝে মাঝে ছেচকিটা ঘন্টটা চিংড়িমাছের মুড়োটার প্রতিও ঠাকুরপোর মনোযোগ আকর্ষণ করা চলতে থাকল। আমার তখন মাথা ঘুরছে। আর তো সময় নেই, এখনই একটা উপান করতে হবে। কী হতে পারে, কী করা যেতে পারে, এই কথা যখন বার বার মনকে জিজ্ঞাসা করছি তখন মেজোরানীর বকুনি আমার কাছে অত্যন্ত অসহা বোধ হতে লাগল। বিশেষত আমি জানি মেজোরানীর চোখে কিছুই এড়ায় না ; তিনি ক্ষণে ক্ষণে আমার মুখের দিকে চাচ্ছিলেন, কী দেখছিলেন জানি নে, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল আমার মুখে সমস্ত কথাই যেন স্পষ্ট ধরা পড়ছিল।


দুঃসাহসের অন্ত নেই। আমি যেন নিতান্ত সহজ কৌতুকে হেসে উঠলুম বলে উঠলুম, আসল কথা, আমার পরেই মেজোরানীর যত অবিশ্বাস, চোর ডাকাত সমস্ত বাজে কথা। মেজোরানী মুচকে হেসে বললেন, তা ঠিক বলেছিস লো, মেয়েমানুষের চুরি বড়ো সর্বনেশে। তা,


আমার কাছে ধরা পড়তেই হবে, আমি তো আর পুরুষমানুষ নই। আমাকে ভোলাবি কী দিয়ে ? আমি বললুম, তোমার মনে এতই যদি ভয় থাকে তবে আমার যা কিছু আছে তোমার কাছে নাহয় জামিন রাখি, যদি কিছু লোকসান করি তো কেটে নিয়ো।


মেজোরানী হেসে বললেন, শোনো একবার, ছোটোরানীর কথা শোনো। এমন লোকসান আছে যা ইহকাল-পরকালে জামিন দিয়ে উদ্ধার হয় না।


আমাদের এই কথাবার্তার মধ্যে আমার স্বামী একটি কথাও বললেন না। তাঁর খাওয়া হয়ে যেতেই তিনি বাইরে চলে গেলেন, আজকাল তিনি আর বিশ্রাম করতে ঘরের মধ্যে বসেন না।


আমার অধিকাংশ দামি গয়না ছিল রাজাদির জিম্মায়। তবু আমার নিজের কাছে যা ছিল তার দাম


ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার কম হবে না। আমি সেই গয়নার বাক্স নিয়ে মেজোরানীর কাছে খুলে


দিলুম : বললুম, মেজোরানী, আমার এই গয়না রইল তোমার কাছে। এখন থেকে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার। মেজোরানী গালে হাত দিয়ে বললেন, ওমা, তুই যে অবাক করলি! তুই কি সত্যি ভাবিস তুই


আমার টাকা চুরি করবি এই ভয়ে রাজে আমার ঘুম হচ্ছে না ? আমি বললুম, ভয় করতেই বা দোষ কী? সংসারে কে কাকে চেনে বলো মেজোরানী।


মেজোরানী বললেন, তাই আমাকে বিশ্বাস করে শিক্ষা দিতে এসেছ বুঝি ? আমার নিজের গয়না কোথায় রাখি ঠিক নেই, তোমার গয়না পাহারা দিয়ে আমি মরি আর কি। চার দিকে দাসী চাকর ঘুরছে, তোমার ও গয়না তুমি নিয়ে যাও ভাই। মেজোরানীর কাছ থেকে চলে এসেই বাইরের বৈঠকখানা ঘরে অমূল্যকে ডেকে পাঠালুম। অমূলার


সঙ্গে সঙ্গে দেখি সন্দীপ এসে উপস্থিত। আমার তখন দেরি করবার সময় ছিল না : আমি সন্দীপকে বললুম, অমূলার সঙ্গে আমার একটু বিশেষ কথা আছে, আপনাকে একবার--


সন্দীপ কাষ্ঠহাসি হেসে বললে, অমূলাকে আমার থেকে আলাদা করে দেখ না কি ? তুমি যদি আমার কাছ থেকে ওকে ভাঙিয়ে নিতে চাও তা হলে আমি ওকে ঠেকিয়ে রাখতে পারব না।


আমি এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম। সন্দীপ বললে, আচ্ছা বেশ, অমূলার সঙ্গে তোমার বিশেষ কথা শেষ করে নিয়ে তার পরে আমার সঙ্গেও একটু বিশেষ কথা করার অবসর দিতে হবে কিন্তু, নইলে আমার হার হবে। আমি সব মানতে পারি, হার মানতে পারি নে। আমার ভাগ সকলের ভাগের বেশি। এই নিয়ে চিরজীবন বিধাতার সঙ্গে লড়ছি। বিধাতাকে হারাব, আমি হারব না।


তীব্র কটাক্ষে অমূল্যকে আঘাত করে সন্দ্বীপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অমূল্যকে বললুম, লক্ষ্মী ভাই আমার, তোমাকে একটি কাজ করে দিতে হবে। সে বললে, তুমি যা বলবে আমি প্রাণ দিয়ে করব দিদি।

শালের ভিতর থেকে গয়নার বাক্স বের করে তার সামনে রেখে বললুম, আমার এই গয়না বন্ধক দিয়ে হোক, বিক্রি করে হোক, আমাকে ২ হাজার টাকা যত শীঘ্র পার এনে দিতে হবে। অমূল্য ব্যধিত হয়ে বলে উঠল, না দিদি, না, গয়না বিক্রি বন্ধক না, আমি তোমাকে ছ হাজার টাকা এনে দেব।


আমি বিরক্ত হয়ে বললুম, ও-সব কথা রাখো, আমার আর একটুও সময় নেই। এই নিয়ে যাও


গয়নার বাক্স, আজ রাত্রের ট্রেনেই কলকাতায় যাও, পরশুর মধ্যে ছ হাজার টাকা আমাকে এনে দিতে


হবে। অমূল্য বাক্সের ভিতর থেকে হীরের চিকটা আলোতে তুলে ধরে আবার বিষণ্নমুখে রেখে দিলে : আমি বললুম, এই-সব হীরের গয়না ঠিক দামে সহজে বিক্রি হবে না, সেইজনো আমি তোমাকে যে গয়না দিচ্ছি এর দাম ত্রিশ হাজারেরও বেশি হবে। এ-সবই যদি যায় সেও ভালো, কিন্তু ছ হাজার টাকা আমার নিশ্চয়ই চাই।


অমূলা বললে, দেখো দিদি, তোমার কাছ থেকে এই-যে ছ হাজার টাকা নিয়েছেন সন্দীপবাবু, এর


জন্যে আমি তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করেছি। বলতে পারি নে এ কী লজ্জা। সন্দীপবাবু বলেন, দেশের জন্যে


লজ্জা বিসর্জন করতে হবে। তা হয় তো হবে। কিন্তু এ যেন একটু আলাদা কথা। দেশের জন্যে মরতে


ভয় করি নে, মারতে দয়া করি নে এই শক্তি পেয়েছি; কিন্তু তোমার হাত থেকে এই টাকা নেওয়ার


গ্লানি কিছুতে মন থেকে তাড়াতে পারছি নে। এইখানে সন্দীপবাবু আমার চেয়ে অনেক শক্ত, ওঁর


একতিলও ক্ষোভ নেই। উনি বলেন টাকা যার বাক্সে ছিল টাকা যে সত্যি তারই এই মোহটা কাটানো


চাই নইলে বন্দেমাতরং মত্ত কিসের!


বলতে বলতে অমুলা উৎসাহিত হয়ে উঠতে লাগল। আমাকে শ্রোতা পেলে এর এই-সব কথা বলবার উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। ও বলতে লাগল, গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, আত্মকে তো কেউ মারতে পারে না। কাউকে বধ করা, ও একটা কথা মাত্র। টাকা হরণ করাও সেইরকম একটা কথা। টাকা কার? ওকে কেউ সৃষ্টি করে না, ওকে কেউ সঙ্গে নিয়ে যায় না, ও তো কারো আত্মার অঙ্গ নয়। ও আজ আমার, কাল আমার ছেলের, আর-একদিন আমার মহাজনের। সেই চঞ্চল টাকা যখন তত্ত্বত কারোই নয় তখন তোমার অকর্মণ্য ছেলের হাতে না পড়ে দেশসেবকদের সেবায় যদি লাগে তা হলে তাকে নিন্দা করলেই সে কি নিদিত হবে ?


সন্দীপের মুখের কথা যখন এই বালকের মুখে শুনি তখন ভয়ে আমার বুক কাঁপতে থাকে। যারা সাপুড়ে তারা বাঁশি বাজিয়ে সাপ নিয়ে খেলুক, মরতে যদি হয় তারা জেনেশুনে মরুক। কিন্তু, আহা, এরা যে কাঁচা, সমস্ত বিশ্বের আশীর্বাদ এদের যে নিয়ত রক্ষা করতে চায়, এরা সাপকে সাপ না জেনে হাসতে হাসতে তার সঙ্গে খেলা করতে যখন হাত বাড়ায় তখনই স্পষ্ট বুঝতে পারি এই সাপটা কী ভয়ংকর অভিশাপ | সন্দীপ ঠিকই বুঝেছে-- আমি নিজে তার হাতে মরতে পারি, কিন্তু এই ছেলেটিকে তার হাত থেকে ভাঙিয়ে নিয়ে আমি বাঁচার।


আমি একটু হেসে অমূল্যকে বললুম, তোমাদের দেশসেবকদের সেবার জন্যেও টাকার দরকার আছে বুঝি ? অমূল্য সগর্বে মাথা তুলে বললে, আছে বৈকি। তারাই যে আমাদের রাজা, দারিদ্রো তাদের শক্তিক্ষয় হয়। আপনি জানেন, সন্দীপবাবুকে ফারস্ট ক্লাস ছাড়া অন্য গাড়িতে কখনো চড়তে দিই নে।

রাজভোগে তিনি কখনো লেশমাত্র সংকুচিত হন না। তাঁর এই মর্যাদা তাঁকে রাখতে হয় তাঁর নিজের জন্যে নয়, আমাদের সকলের জন্যে। সন্দীপবাবু বলেন, সংসারে যারা ঈশ্বর ঐশ্বর্যের সম্মোহনই হচ্ছে তাদের সব চেয়ে বড়ো অস্ত্র। দারিদ্র্যব্রত গ্রহণ করা তাদের পক্ষে দুঃগ্রহণ করা নয়, সে হচ্ছে আত্মঘাত।


এমন সময় নিঃশকে সন্দীপ হঠাৎ ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি আমার গয়নার বাক্সর উপর শাল চাপা দিলুম। সন্দীপ বাঁকা সুরে জিজ্ঞাসা করলে, অমূল্যর সঙ্গে তোমার বিশেষ কথার পালা এখনো ফুরোয় নি বুঝি ?


অমূল্য একটু লজ্জিত হয়ে বললে, না, আমাদের কথা হয়ে গেছে। বিশেষ কিছু না। আমি বললুম, না অমূল্য, এখনো হয় নি। সন্দীপ বললে, তা হলে দ্বিতীয়বার সন্দীপের প্রস্থ ?


আমি বললুম, হাঁ।


তা হলে সন্দীপকুমারের পুনঃপ্রবেশ--


সে আজ নয়, আমার সময় হবে না।


সন্দ্বীপের চোখদুটো জ্বলে উঠল বললে, কেবল বিশেষ কাজেরই সময় আছে, আর সময় নষ্ট


করবার সময় নেই!


ঈর্ষা। প্রবল যেখানে দুর্বল সেখানে অবলা আপনার জয়ডঙ্কা না বাজিয়ে থাকতে পারে কি ? আমি


তাই খুব দৃঢ়স্বরেই বললুম, না, আমার সময় নেই।


সন্দীপ মুখ কালি করে চলে গেল। অমূল্য কিছু উদবিগ্ন হয়ে বললে, রানীদিদি, সন্দীপবাবু বিরুক্ত আমি তেজের সঙ্গে বললুম, বিরক্ত হবার ওঁর কারণও নেই, অধিকারও নেই। একটি কথা তোমাকে


হয়েছেন।


বলে রাখি অমূল্য, আমার এই গয়না-বিক্রির কথা তুমি প্রাণান্তেও সন্দীপবাবুকে বলতে পারবে না। অমূল্য বললে, না, বলব না।


তা হলে আর দেরি কোরো না, আজ রাত্রের গাড়িতেই তুমি চলে যাও ।


এই বলে অমূল্যর সঙ্গে সঙ্গেই আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম। বাইরে এসে দেখি বারান্দায় সন্দীপ দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলুম এখনই সে অমূল্যকে ধরবে। সেইটে বাঁচাবার জন্যে তাঁকে ডাকতে হল,


সন্দীপবাবু, কী বলতে চাচ্ছিলেন ?


আমার কথা তো বিশেষ কথা নয়, কেবল বাজে কথা, সময় যখন নেই তখন-- আমি বললুম, আছে সময়।


অমূল্য চলে গেল। ঘরে ঢুকেই সন্দীপ বললে, অমূল্যর হাতে একটা কী বাক্স দিলে, ওটা কিসের


বাক্সটা সন্দীপের চোখ এড়াতে পারে নি। আমি একটু শক্ত করেই বললুম, আপনাকে যদি বলবার


হত তা হলে আপনার সামনেই দিতুম।


তুমি কি ভাবছ অমূলা আমাকে বলবে না ? না, বলবে না।


সন্দীপের রাগ আর চাপা রইল না; একেবারে আগুন হয়ে উঠে কালে, তুমি মনে করছ তুমি আমার উপর প্রভুত্ব করবে। পারবে না। ঐ অমূল্য, ওকে যদি আমার পায়ের তলায় মাড়িয়ে দিই


তা হলে সেই ওর সুখের মরণ হয়, ওকে তুমি তোমার পদানত করবে-- আমি থাকতে সে হবে না। দুর্বল, দুর্বল! এতদিন পরে সন্দীপ বুঝতে পেরেছে ও আমার কাছে দুর্বল। তাই হঠাৎ এই অসংযত রাগ। ও বুঝতে পেরেছে, আমার যে শক্তি আছে তার সঙ্গে জোরজবদস্তি খাটবে না, আমার কটাক্ষের ঘায়ে ওর দুর্গের প্রাচীর আমি ভেঙে দিতে পারি। সেইজন্যেই আজ এই আস্ফালন। আমি একটা কথা না বলে একটুখানি কেবল হাসলাম । এতদিন পরে আমি ওর উপরের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছি; আমার এ জায়গাটুকু যেন না হারায়, যেন না নাবি। আমার দুর্গতির মধ্যেও যেন আমার মান একটু থাকে।


সন্দীপ বললে, আমি জানি তোমার ও বাক্স গয়নার বাক্স। আমি বললুম, আপনি যেমন-খুশি আন্দাজ করুন, আমি বলব না। তুমি অমূলাকে আমার চেয়ে বেশি বিশ্বাস কর ? জান, ঐ বালক আমার ছায়ার ছায়া, আমার


প্রতিধ্বনির প্রতিধ্বনি, আমার পাশ থেকে সরে গেলে ও কিছুই নয় ! যেখানে ও আপনার প্রতিধ্বনি নয় সেইখানে ও অমুলা, সেইখানে আমি ওকে আপনার প্রতিধ্বনির


চেয়ে বিশ্বাস করি। মায়ের পূজা-প্রতিষ্ঠার জন্যে তোমার সমস্ত গয়না আমাকে দিতে প্রতিশ্রুত আছ সে কথা ভুললে


চলবে না। সে তোমার দেওয়াই হয়ে গেছে। দেবতা যদি আমার কোনো গয়না বাকি রাখেন তা হলে সেই গয়না দেবতাকে দেব। আমার যে গয়না


চুরি যায় সে গয়না দেব কেমন করে ? দেখো, তুমি আমার কাছ থেকে অমন করে ফসকে যাবার চেষ্টা কোরো না। এখন আমার কাজ আছে, সেই কাজ আগে হয়ে থাক, তার পরে তোমাদের ঐ মেয়েলি ছলাকলা-বিস্তারের সময় হবে। তখন সেই লীলায় আমিও যোগ দেব।


যে মুহূর্তে আমি আমার স্বামীর টাকা চুরি করে সন্দীপের হাতে দিয়েছি সেই মূহূর্ত থেকেই আমাদের সম্বন্ধের ভিতরকার সুরটুকু চলে গেছে। কেবলই যে আমারই সমস্ত মূলা ঘুচিয়ে দিয়ে আমি কানা কড়ার মতো সস্তা হয়ে গেছি তা নয়, আমার 'পরে সন্দীপেরও শক্তি ভালো করে খেলবার আর জায়গা পাচ্ছে না-- মুঠোর মধ্যে যা এসে পড়ে তার উপর আর তাঁর মারা চলে না। সেইজন্য সন্দীপের আজ আর সেই বীরের মূর্তি নেই। ওর কথার মধ্যে কলহের কর্কশ ইতর আওয়াজ লাগছে।


সন্দীপ আমার মুখের উপর তার উজ্জ্বল চোখদুটো তুলে বসে রইল, দেখতে দেখতে তার চোখ যেন মধ্যাহ্ন-আকাশের তৃষ্ণার মতো জ্বলে উঠতে লাগল। তার পা দুই-একবার চঞ্চল হয়ে উঠল : বুঝতে পারলুম সে উঠি-উঠি করছে, এখনই সে উঠে এসে আমাকে চেপে ধরবে। আমার বুকের ভিতরে দুলতে লাগল, সমস্ত শরীরের শির দর দর করছে, কানের মধ্যে রক্ত ঝাঁ ঝাঁ করছে, বুঝলুম আর-একটু বসে থাকলে আমি আর উঠতে পারব না। প্রাণপণ শক্তিতে আপনাকে চৌকি থেকে ছিঁড়ে নিয়ে উঠেই নরজার দিকে হুটলুম। সন্দীপের রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠের মধ্যে থেকে গুমরে উঠল, কোথায় পালাও


পরক্ষণেই সে লাফ দিয়ে উঠে আমাকে ধরতে এল। এমন সময় বাইরে জুতোর শব্দ শোনা যেতেই সন্দীপ তাড়াতাড়ি চৌকিতে ফিরে এসে বসল। আমি বইয়ের শেলফের দিকে মুখ করে বইগুলোর নামের দিকে তাকিয়ে রইলুম।


আমার স্বামী ঘরে ঢোকামাত্রই সন্দীপ বলে উঠল, ওহে নিখিল, তোমার শেলফে ব্রাউনিং নেই ? আমি মক্ষীরানীকে আমাদের সেই কলেজ ক্লাবের কথা বলছিলুম--মনে আছে তো ব্রাউনিঙের সেই কবিতাটা তর্জমা নিয়ে আমাদের চার জনের মধ্যে লড়াই ? বল কী, মনে নেই ? সেই যে-- She should never have looked at me,


If she meant I should not love her!


There are plenty... men you call such, I suppose... she may discover And yet leave much as she found them: But I'm not so, and she knew it


All her soul to, if she pleases.


When she fixed me, glancing round them.


আমি হিচড়ে-মিচড়ে তার একটা বাংলা করেছিলুম, কিন্তু সেটা এমন হল না 'গৌড়জন যাহে আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি। এক সময়ে ঠাউরেছিলুম কবি হলেম বুঝি, আর দেরি নেই, বিধাতা দয়া করে আমার সে ফাঁড়া কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু আমাদের দক্ষিণাচরণ, সে যদি আজ নিমক-মহালের ইনস্পেক্টর না হত তা হলে নিশ্চয় কবি হতে পারত, সে বাসা তজমাটি করেছিল-- পড়ে মনে হয় ঠিক যেন বাংলা ভাষা পড়ছি যে দেশ জিয়োগ্রাফিতে নেই এমন কোনো দেশের ভাষা নয়--


আমায় ভালো বাসবে না সে এই যদি তার ছিল জানা তবে কি তার উচিত ছিল আমার পানে দৃষ্টি হানা ? তেমন-তেমন অনেক মানুষ আছে তো এই ধরাধামে (যদিচ ভাই, আমি তাদের গণি নেকো মানুষ নামে)-- যাদের কাছে সে যদি তার খুলে দিত প্রাণের ঢাকা, তবু তারা রইত খাড়া যেমন ছিল তেমনি ফাঁকা। আমি তো নই তাদের মতন সে কথা সে জানত মনে যখন মোরে বাধল ধরে বিন্ধ ক'রে নয়নকোণে।


না মক্ষীরানী, তুমি মিথ্যে খুঁজছ : নিখিল বিবাহের পর থেকে কবিতা-পড়া একেবারে ছেড়ে দিয়েছে, বোধ হয় ওর আর দরকার হয় না। আমি ছেড়ে দিয়েছিলুম কাজের তাড়ায়, কিন্তু বোধ হচ্ছে


যেন 'কাবাজরো মনুষ্যাণাং আমাকে ধরবে ধরবে করছে। আমার স্বামী বললেন, আমি তোমাকে সতর্ক করে দিতে এসেছি সন্দীপ । সন্দীপ বললে, কাবার সম্বন্ধে ?


স্বামী ঠাট্টায় যোগ না দিয়ে বললেন, কিছুদিন ধরে ঢাকা থেকে মৌলবি আনাগোনা করতে আরম্ভ করেছে, এ অঞ্চলের মুসলমানদের ভিতরে ভিতরে খেপিয়ে তোলবার উদ্যোগ চলেছে। তোমার উপর ওরা বিরক্ত হয়ে আছে, হঠাৎ একটা-কিছু উৎপাত করতে পারে।


পালাতে পরামর্শ দাও নাকি ? আমি খবর দিতে এসেছি, পরামর্শ দিতে চাই নে। আমি যদি এখানকার জমিদার হতুম তা হলে ভাবনার কথা হত মুসলমানদেরই, আমার নয়। তুমি আমাকেই উচ্চবিদ্ধ করে না তুলে ওদের দিকে যদি একটু উদ্‌বেগের চাপ দাও তা হলে সেটা তোমার এবং আমার উভয়েরই যোগ্য হয়। জান, তোমার দুর্বলতায় পাশের জমিদারদের পর্যন্ত তুমি দুর্বল করে


তুলেছ ?


সন্দীপ, আমি তোমাকে পরামর্শ দিই নি, তুমিও আমাকে পরামর্শ না নিলে চলত। ওটা বৃথা হচ্ছে।


আর-একটি কথা আমার বলবার আছে। তোমরা কিছুদিন থেকে দলবল নিয়ে আমার প্রজাদের পরে ভিতরে ভিতরে উৎপাত করছ। আর চলবে না, এখন তোমাকে আমার এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। মুসলমানের ভয়ে, না আরো কোনো ভয় আছে ?


এমন ভয় আছে যে ভয় না থাকাই কাপুরুষতা, আমি সেই ভয় থেকেই বলছি তোমাকে যেতে হবে সন্দীপ। আর দিন-পাঁচেক পরে আমি কলকাতায় যাচ্ছি, সেই সময় তোমারও আমার সঙ্গে যাওয়া চাই। আমাদের কলকাতার বাড়িতে থাকতে পার, তাতে কোনো বাধা নেই।


আচ্ছা, পাঁচ দিন ভাববার সময় পাওয়া গেল। ইতিমধ্যে মক্ষীরানী, তোমার মউচাক থেকে বিদায় হবার গুঞ্জনগান করে নেওয়া যাক। হে আধুনিক বাংলার কবি, খোলো তোমার দ্বার, তোমার বাণী লুঠ করে নিই-- চুরি তোমারই, তুমি আমারই গানকে তোমার গান করেছ - না হয় নাম তোমার হল, কিন্তু


গান আমার। এই বলে তার বেসুর-ঘেঁষা মোটা ভাঙা গলায় ভৈরবীতে গান ধরলে-- মধুঋতু নিতা হয়ে রইল তোমার মধুর দেশে।


যাওয়া-আসার কান্নাহাসি হাওয়ায় সেথা বেড়ায় ভেসে।


যার যে জন্য সেই শুধু যায়, ফুল ফোটা তো ফুরোয় না হায়-- ঝরবে যে ফুল সেই কেবলি ঝরে পড়ে বেলাশেষে।


যখন আমি ছিলেম কাছে তখন কত দিয়েছি গান এখন আমার দূরে যাওয়া, এরও কি গো নাই কোনো দান ? পুষ্পবনের ছায়ায় ঢেকে এই আশা তাই গেলেম রেখে--


আগুন ভরা ফাগুনকে তোর কাঁদায় যেন আষাঢ় এসে ।। সাহসের অন্ত নেই, সে সাহসের কোনো আবরণও নেই- একেবারে আগুনের মতো নগ্ন। তাকে


বাধা দেওয়ার সময় পাওয়া যায় না। তাকে নিষেধ করা যেন বজ্রকে নিষেধ করা, বিদ্যুৎ সে নিষেধ হেসে উড়িয়ে দেয়। আমি বাইরে বেরিয়ে এলুম। বাড়ির ভিতরের দিকে যখন চলে যাচ্ছি হঠাৎ দেখি অমূল্য কোথা


থেকে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। বললে, রানীদিদি, তুমি কিছু ভেবো না। আমি চললুম, কিছুতেই নিষ্ফল হয়ে ফিরব না।


আমি তার নিষ্ঠাপূর্ণ তরুণ মুখের দিকে চেয়ে বললুম, অমূল্য, নিজের জন্য ভাবব না, যেন তোমাদের জন্যে ভারতে পারি। অমূল্য চলে যাচ্ছিল. আমি তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলুম, অমূলা, তোমার মা আছেন ?


আছেন। বোন ?


নেই, আমি মায়ের একমাত্র ছেলে। বাবা আমার অল্প বয়সে মারা গেছেন।

যাও তুমি, তোমার মায়ের কাছে ফিরে যাও অমূল্য


দিদি, আমি যে এখানে আমার মাকেও দেখছি আমার বোনকেও দেখছি।


আমি বললুম, অমূল্য, আজ রাত্রে যাবার আগে তুমি এখান থেকে খেয়ে যেয়ো।


সে বললে, সময় হবে না দিদিরানী, তোমার প্রসাদ আমার সঙ্গে দিয়ো আমি নিয়ে যাব।


তুমি কী খেতে ভালোবাস অমূল্য ?


মায়ের কাছে থাকাল পৌষে পেট ভরে পিঠে খেতুম। ফিরে এসে তোমার হাতের তৈরি পিঠে খাব দিদিরানী।

19
Articles
ঘরে-বাইরে
0.0
ঘরে-বাইরে (১৯১৬) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত একটি উপন্যাস।এটি চলিত ভাষায় লেখা রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৯১৬ সালে সবুজপত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত এই উপন্যাসে একদিকে আছে জাতিপ্রেম ও সংকীর্ণ স্বাদেশিকতার সমালোচনা, অন্যদিকে আছে সমাজ ও প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নারী পুরুষের সম্পর্ক; বিশেষত পরস্পরের আকর্ষণ-বিকর্ষণের বিশ্লেষণ। ঘরে-বাইরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত এই উপন্যাসের প্রকাশকাল ১৯১৬। ১৯৮৪ সালে প্রখ্যাত ভারতীয় চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িত করেন।স্বামী নিখিলেশের প্রতি অনুরাগ সত্ত্বেও এই কাহিনীর নায়িকা বিমলা বিপ্লবী সন্দীপের দ্বারা তীব্রভাবে আকর্ষিত। একদিকে বাইরে জাতীয় আন্দোলনের উত্তেজনা অন্যদিকে তিনটি মানুষের জীবনে টানাপোড়ন - রাজনীতি ও ব্যক্তিগত জীবনের দ্বন্দ্ব এই দুই মিলে উপন্যাস।
1

বিমলার আত্মকথা

7 October 2023
1
0
0

মা গো, আজ মনে পড়ছে তোমার সেই সিথের সিঁদুর, চওড়া সেই লাল পেড়ে শাড়ি, সেই তোমার দুটি চোখ-- শান্ত, স্নিগ্ধ, গভীর। সে যে দেখেছি আমার চিত্তাকাশে ভোরবেলাকার অরুণরাগরেখার মতো। আমার জীবনের দিন যে সেই সোন

2

সন্দীপের আত্মকথা

7 October 2023
0
0
0

যেটুকু আমার ভাগে এসে পড়েছে সেইটুকুই আমার, এ কথা অক্ষমেরা বলে আর দুর্বলেরা শোনে। যা আমি কেড়ে নিতে পারি সেইটেই যথার্থ আমার, এই হল সমস্ত জগতের শিক্ষা। দেশে আপনা-আপনি জন্মেছি বলেই দেশ আমার নয় : দেশকে য

3

নিখিলেশের আত্মকথা

7 October 2023
0
0
0

একদিন আমার মনে বিশ্বাস ছিল ঈশ্বর আমাকে যা দেবেন আমি তা নিতে পারব। এ পর্যন্ত তার পরীক্ষা হয় নি। এবার বুঝি সময় এল। মনকে যখন মনে মনে যাচাই করতুম অনেক দুঃখ কল্পনা করেছি। কখনো ভেবেছি দারিদ্র্য, কখনো

4

বিমলার আত্মকথা

7 October 2023
0
0
0

মা গো, আজ মনে পড়ছে তোমার সেই সিথের সিঁদুর, চওড়া সেই লাল পেড়ে শাড়ি, সেই তোমার দুটি চোখ-- শান্ত, স্নিগ্ধ, গভীর। সে যে দেখেছি আমার চিত্তাকাশে ভোরবেলাকার অরুণরাগরেখার মতো। আমার জীবনের দিন যে সেই সোনার

5

সন্দীপের আত্মকথা

7 October 2023
0
0
0

আমি বুঝতে পারছি একটা গোলমাল বেধেছে। সেদিন তার একটু পরিচয় পাওয়া গেল । নিখিলেশের বৈঠকখানার ঘরটা আমি আসার পর থেকে সদর ও অন্দরে মিশিয়ে একটা উভচরজাতীয় পদার্থ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখানে বাইরের থেকে আমার

6

নিখিলেশের আত্মকথা

7 October 2023
0
0
0

আগে কোনোদিন নিজের কথা ভাবি নি। এখন প্রায় মাঝে মাঝে নিজেকে বাইরে থেকে দেখি। বিমল আমাকে কেমন চোখে দেখে সেইটে আমি দেখবার চেষ্টা করি। বড়ো গম্ভীর, সব জিনিসকে বড়ো বেশি গুরুতর করে দেখা আমার অভ্যাস । আর

7

বিমলার আত্মকথা

7 October 2023
0
0
0

গোড়ায় কিছুই সন্দেহ করি নি, ভয় করি নি ; আমি জানতুম দেশের কাছে আত্ম-সমর্পন করছি। পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণে কী প্রচণ্ড উল্লাস ! নিজের সর্বনাশ করাই নিজের সব চেয়ে আনন্দ এই কথা সেদিন প্রথম আবিষ্কার করেছিলুম।

8

সন্দীপের আত্মকথা

7 October 2023
0
0
0

আমি নিজের লেখা আত্মকাহিনী যখন পড়ে দেখি তখন ভাবি, এই কি সন্দীপ ? আমি কি কথা দিয়ে তৈরি ? আমি কি রক্তমাংসের মলাটে মোড়া একখানা বই ? পৃথিবী চাঁদের মতো মরা জিনিস নয়, সে নিশ্বাস ফেলছে, তার সমস্ত নদীসম

9

নিখিলেশের আত্মকথা

8 October 2023
0
0
0

ভাবের বন্যায় চারি দিক টলমল করছে: কচি ধানের আভা যেন কচি ছেলের কাঁচা দেহের লাবণ্য। আমাদের বাড়ির বাগানের নীচে পর্যন্ত জল এসেছে। সকালের রৌদ্রটি এই পৃথিবীর উপরে একেবারে অপর্যাপ্ত হয়ে পড়েছে, নীল আকাশের

10

বিমলার আত্মকথা

8 October 2023
0
0
0

সেই সময়ে হঠাৎ সমস্ত বাংলাদেশের চিত্ত যে কেমন হয়ে গেল তা বলতে পারি নে। ষাট হাজার সগরসন্তানের ছাইয়ের পরে এক মুহূর্তে যেন ভাগীরথীর জল এসে স্পর্শ করলেন। কত যুগযুগান্তরের ছাই, রসাতলে পড়ে ছিল কোনো আগুনে

11

নিখিলেশের আত্মকথা

8 October 2023
0
0
0

পঞ্চুর স্ত্রী যক্ষ্মায় ভুগে ভুগে মরেছে। পঙ্গুকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। সমাজ হিসেব করে বলেছে, খরচ লাগবে সাড়ে তেইশ টাকা। আমি রাগ করে বললুম, নাই বা করলি প্রায়শ্চিত্ত, তোর ভয় কিসের ? সে ক্লান্ত গো

12

সন্দীপের আত্মকথা

8 October 2023
0
0
0

সেদিন অশ্রুজলের বাঁধ ভাঙে আর কি। আমাকে বিমলা ডাকিয়ে আনলে, কিন্তু খানিকক্ষণ তার মুখ দিয়ে কথা বের হল না, তার দুই চোখ ঝকঝক করতে লাগল। বুঝলুম, নিখিলের কাছে কোনো ফল পায় নি। যেমন করে হোক ফল পাবে সেই অহংক

13

নিখিলেশের আত্মকথা

9 October 2023
0
0
0

আমার নামে কাগজে প্যারাগ্রাফ এবং চিঠি বেরোতে শুরু হয়েছে; শুনছি একটা ছড়া এবং ছবি বেরোবে তারও উদ্যোগ হচ্ছে। রসিকতার উৎস খুলে গেছে, সেইসঙ্গে অজস্র মিথ্যেকথার ধারাবর্ষণে সমস্ত দেশ একেবারে পুলকিত। জানে যে

14

নিখিলেশের আত্মকথা

9 October 2023
0
0
0

আমার নামে কাগজে প্যারাগ্রাফ এবং চিঠি বেরোতে শুরু হয়েছে; শুনছি একটা ছড়া এবং ছবি বেরোবে তারও উদ্যোগ হচ্ছে। রসিকতার উৎস খুলে গেছে, সেইসঙ্গে অজস্র মিথ্যেকথার ধারাবর্ষণে সমস্ত দেশ একেবারে পুলকিত। জানে যে

15

বিমলার আত্মকথা

9 October 2023
0
0
0

এক জন্মে যে এতটা ঘটতে পারে সে মনেও করা যায় না। আমার যেন সাত জন্ম হয়ে গেল। এই কয় মাসে হাজার বছর পার হয়ে গেছে। সময় এত জোরে চলছিল যে, চলছে বলে বুঝতেই পারি নি। সেদিন হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে বুঝতে পেরেছি।

16

নিখিলেশের আত্মকথা

9 October 2023
0
0
0

রাত্রি তিনটের সময় জেগে উঠেই আমার হঠাৎ মনে হয়, যে জাতে আমি একদিন বাস করভূম সে যেন মরে ভূত হয়ে আমার এই বিছানা, এই ঘর, এই-সব জিনিসপত্র দখল করে বসে আছে। আমি বেশ বুঝতে পারলুম মানুষ কেন পরিচিত লোকের ভূতক

17

বিমলার আত্মকথা

9 October 2023
0
0
0

আজ সকালে জলার কলকাতা থেকে ফেরবার কথা। বেহারাকে বলে রেখেছি সে এলেই যেন খবর দেয়। কিন্তু, স্থির থাকতে পারছি নে। বাইরে বৈঠক খানায় গিয়ে বসে রইলুম। অমূলাকে যখন আমার গয়না বেচবার জন্যে কলকাতায় পাঠালুম তখ

18

নিখিলেশের আত্মকথা

9 October 2023
0
0
0

আজ আমরা কলকাতায় যাব। সুখদুঃখ কেবলই জমিয়ে তুলতে থাকলে বোঝা ভারী হয়ে ওঠে। কেননা বসে থাকাটা মিথ্যে সঞ্চয় করাটা মিথ্যে। আমি যে এই ঘরের কর্তা এটা বানানো জিনিস, সত্য এই যে, আমি জীবনপথের পথিক। ঘরের কর্তা

19

বিমলার আত্মকথা

9 October 2023
0
0
0

চলো, চলো, এইবার বেরিয়ে পড়ো সকল ভালোবাসা যেখানে পূজার সমুদ্রে মিশেছে সেই সাগরসংগমে। সেই নির্মল নীলের অতলের মধ্যে সমস্ত পক্ষের ভার মিলিয়ে যাবে। আর আমি ভয় করি নে, আপনাকেও না, আর কাউকেও না। আমি আগুনের

---