shabd-logo

অগ্নি পরীক্ষা

21 December 2023

0 Viewed 0

১৮১৪ খৃঃ অব্দে ইংরেজ গভর্ণমেন্ট নেপাল রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। জেনারেল মার্ণি কাটামুণ্ডু আক্রমণের জন্য প্রেরিত হইলেন। জেনারেল উড গোরক্ষপুরে ছাউনি করিয়া তরাই প্রদেশ আক্রমণ করিলেন। জেনারেল অক্টারলোনি নেপাল রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে অমরসিংহের সৈন্যের বিরুদ্ধে প্রেরিত হইলেন; আর জেনারেল গিলেস্পি দেরাদুন হইতে কলুঙ্গা আক্রমণ করিতে অগ্রসর হইলেন। এইরূপে নেপাল রাজ্য চারি বিভিন্ন দিক হইতে একেবারে আক্রান্ত হইল। নেপাল রাজ্যের সৈন্যসংখ্যা সমুদয়ে দ্বাদশ সহস্র; তাহার বিরুদ্ধে ইংরেজ গভর্ণমেন্ট ঊনত্রিংশ সহস্র সৈন্য প্রেরণ করিলেন। যুদ্ধের কারণ কি, তাহা অনুসন্ধান করা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়-প্রয়োজনও নাই।

অগ্নিদগ্ধ না হইলে স্বর্ণের পরীক্ষা হয় না। মনুষ্যও অগ্নি দ্বারা পরীক্ষিত হয়। প্রলয়কালে পৃথিবীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাসনা ও বন্ধন ঊর্ণনাভ-তত্ত্বর ন্যায় ছিন্ন হইয়া যায়; বীরপুরুষ তখনই মুক্ত হইয়া আপনার প্রকৃত রূপ প্রকাশ করেন।

যুদ্ধ ঘোষণার সময় নেপাল সীমান্ত প্রদেশে কলুঙ্গা নামক স্থানে অল্পসংখ্যক একদল গোরক্ষ-সৈন্য ছিল। সৈন্যসংখ্যা তিনশত মাত্র। বলভদ্র থাপা তাহাদের অধিনায়ক ছিলেন এস্থানে বহুদিনের পুরাতন একটি দুর্গের ভগ্নাবশেষ ছিল। অস্ত্র শস্ত্রের বিশেষ অভাব। কাহারও তীর, ধনু ও খুড়কী, কাহারও বা পুরাতন বন্দুক-ইহাই যুদ্ধের উপকরণ। এতকাল যুদ্ধের কোন সম্ভাবনা ছিল না, এইজন্য সৈনিকেরা তাহাদের পুত্র-কলত্র লইয়া এই স্থানে বাস করিতেছিল। স্ত্রীলোক ও শিশুর সংখ্যা প্রায় দেড়শত হইবে।

হঠাৎ একদিন সংবাদ আসিল যে, ইংরেজ যুদ্ধ ঘোষণ। করিয়াছে এবং কলুঙ্গা আক্রমণ করিবার জন্য অগ্রসর হইতেছে। বলভদ্র এই সংবাদ পাইয়া পুরাতন ভগ্ন প্রাচীর কোনপ্রকারে সংস্কার করিতে লাগিলেন। গোরক্ষ-সেনাপতি, স্ত্রীলোক ও শিশুগণ লইয়া বিব্রত এবং সৈন্য ও অস্ত্রাভাবে একান্ত বিপন্ন। এমন সময়ে ইংরেজ-সেনাপতি মাউব্রি পঁয়ত্রিশ শত সৈন্য ও বহুসংখ্যক কামান লইয়া সত্বর এই স্থান অবরোধ করিলেন।

যে যুদ্ধে জয়ের আশা থাকে, সে যুদ্ধ অনেকেই করিতে পারে; কিন্তু যাহাতে পরাভব নিশ্চিত, সে যুদ্ধ যুঝিতে অমানুষিক বলের প্রয়োজন।

দেখিতে দেখিতে ইংরেজ-সৈন্য দুর্গের চারিদিক সেনাজালে আবদ্ধ করিল। বলভদ্র ভাবিতেছিলেন, তাঁহার প্রভু তাঁহাকে সুদিনে কলুঙ্গার সৈন্যাধ্যক্ষ করিয়া পাঠাইয়াছিলেন। এখন ছদ্দিন উপস্থিত। আজ নিমকের পরীক্ষা হইবে।

১৫শে অক্টোবর রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময় ইংরেজ-দূত বলভদ্রের নিকট যুদ্ধপত্র লইয়া আসিল। সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর বলভদ্র শয়ন করিতে গিয়াছেন, এমন সময় ইংরাজ সেনাপতির পত্র আসিল। পত্রে লিখিত ছিল, "এই অসম যুদ্ধে পরাভব স্বীকার করা বীরপুরুষের গ্লানিজনক নহে; গোরক্ষ-সেনাপতির বিনা রক্তপাতে দুর্গাধিকার ত্যাগ করাই শ্রেয়ঃ।” উত্তরে গোরক্ষ-সেনাপতি ইংরেজ-দূতকে বলিলেন, "তোমাদের সুবাদারকে বলিও, আগামীকল্য যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ইহার উত্তর পাইবেন।"

পরদিন প্রতুষে কামানের গোলা এই ধৃষ্টতার প্রত্যুত্তর লইয়া আসিল। চতুদ্দিকে কামানের অগ্নির ধূম অপসারিত হইবার পূর্ব্বেই ইংরেজ-সেনাপতি সমস্ত সেনা লইয়া দুর্গ আক্রমণ করিলেন। কিন্তু প্রস্তর স্তূপের পশ্চাতে এক অদম্য শক্তি প্রচ্ছন্ন ছিল, যাহা কামানের গোলা ভেদ করিতে পারে না। সেই মানসিক মহাশক্তি আজ চকিতে দেখা দিল এবং সুবাদার হইতে সামান্স সেনার হৃদয়ে প্রবেশ করিল। কেবল যোদ্ধার হৃদয়ে নহে-দুর্ব্বল নারী ও নিরুপায় শিশুকেও সেই মহা অগ্নিশিখা উদ্দীপ্ত করিয়া তুলিল।

ইংরেজ-সৈন্য পুনঃ পুনঃ আক্রমণ করিয়াও দুর্গ অধিকার করিতে অক্ষম হইল। পরিশেষে জয়ের আশা নাই দেখিয়া দেরাদুনে প্রত্যাবর্তন করিল।

তাহার পর জেনারেল গিলেস্পি দুর্গ ভগ্ন করিবার উপযোগ নূতন কামান এবং নূতন সৈন্যদল লইয়া মাউব্রির সহিত যোগ দিলেন। স্থির হইল, সৈন্যদল একসময়ে চারিদিক হইতে দুগ আক্রমণ করিবে এবং কামানের গোলাতে দুর্গপ্রাচীর ভগ্ন করিয় অবারিত দ্বারে দুর্গে প্রবেশ করিবে।

২৬শে তারিখের নয় ঘটিকার সময় এই বিরাট আক্রমণ আরদ্ধ হইল; কিন্তু অল্প সময়েই ইংরেজ-সৈন্য পরাহত হইয় প্রত্যাবর্তন করিল। তখন জেনারেল গিলেস্পি স্বয়ং নূত তিন দল সৈন্য লইয়া দুর্গ আক্রমণ করিলেন। একবারে বহু সংখ্যক কামান অগ্নি উদগীরণ করিয়া দুর্গে অনলপূর্ণ গোল নিক্ষেপ করিতে লাগিল।

দুর্গের নামমাত্র যে প্রাচীর ছিল, এই ঝটিকায় তাহা আর রক্ষা পাইল না, গোলার আঘাতে প্রস্তরস্তুপ খসিয়া পড়িতে লাগিল। আক্রান্ত গোরক্ষ-সৈন্যের ভাগ্যলক্ষ্মী এখন লুপ্তপ্রায় কিন্তু এই সময়ে সহসা এক অদ্ভুত দৃশ্য লক্ষিত হইল; ভগ্নস্থানে মুহূর্তমধ্যে এক প্রাচীর উত্থিত হইল। এই নূতন প্রাচীর শুকোমল নারীদেহে রচিত। গোরক্ষ-রমণীগণ স্বীয় দেহ দ্বার প্রাচীরের ভগ্নস্থান পূর্ণ করিলেন। ইহার অনুরূপ দৃশ্য পৃথিবীতে আর কখনও দেখা যায় নাই। কার্থেজের রমণীরা স্বীয় কেশপাশ ছিন্ন করিয়া ধনুর জ্যা রচনা করিয়াছিলেন; কিন্তু রক্তমাংসে গঠিত জীবন্ত শরীর দিয়া কুত্রাপি দুর্গপ্রাচীর নিম্মিত হয় নাই। কেবল প্রাচীর নহে-এই দুর্ব্বল কষ্ট-অসহিষ্ণু দেহ বজ্রবৎ কঠিন ও রণে ভীষণ সংহারক অস্ত্র হইয়া উঠিল।

এই সময়ে জেনারেল গিলেস্পি দুর্গপ্রাচীর অতিক্রম করিতে অগ্রসর হইলেন; কিন্তু অধিক দূর না যাইতেই বক্ষে গুলিবিদ্ধ হইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। তাঁহার অনুগামী সৈন্য তীর ও গুলির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হইয়া পড়িল; ইংরেজ-সৈন্যের ভগ্না- বশেষ দেরাদুন প্রত্যাবর্তন করিল।

ইহার পর দিল্লী হইতে নূতন সৈন্যদল ও বহুসংখ্যক কামান যুদ্ধস্থানে প্রেরিত হইল। ২৪শে নবেম্বর তারিখে এই নূতন সৈন্যদল পুনরায় কলুঙ্গা আক্রমণ করিল।

এবার কামান হইতে গোলাপূর্ণ শেল অনবরত দুর্গে নিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল। ভূমি স্পর্শমাত্র এই শেল ভীষণ রবে শতধা বিদীর্ণ হইয়া চতুদ্দিকে মৃত্যুর করাল ছায়া বিস্তার করিতে লাগিল। এতদিন যোদ্ধায় যোদ্ধায় প্রতিযোগিতা চলিতেছিল; কিন্তু এখন মৃত্যু সর্ব্বগ্রাসীরূপে সর্বত্র বিচরণ করিতে লাগিল- মাতার বক্ষে থাকিয়াও শিশু উদ্ধার পাইল না।

একমাসের অধিককাল কলুঙ্গার অবরোধ আরম্ভ হইয়াছে আহার্য্য সামগ্রী ফুরাইয়া গিয়াছে, যুদ্ধের উপকরণও নিঃশেষিত- প্রায়। এত বিপদের মধ্যেও যোদ্ধারা অবিচলিত চিত্ত। মুমূর্ষু শত্রুকে সমূলে উচ্ছেদ করিবার জন্য সাগরোশ্মির, ন্যায় ইংরেজ-সৈন্য দুর্গোপরি বারংবার পতিত হইতে লাগিল; কিন্তু গোরক্ষ-সৈন্য অমানুষিক শক্তিতে যুদ্ধ করিতে লাগিল। বারুদ ফুরাইলে তীর-ধনু দ্বারা, তাহা ফুরাইলে প্রস্তর নিক্ষেপে শত্রু বিনাশ করিতে লাগিল। এই অসম সংগ্রামে গোরক্ষদেরই জয় হইল। দুর্গাধিকারের কোন আশা নাই দেখিয়া ইংরেজ সৈন্য দেরাদুনে প্রত্যাগমন করিতে আদিষ্ট হইল।

এমন সময়ে গুপ্তচর আসিয়া সংবাদ দিল যে, কলুঙ্গার দুর্গে পানীয় জল নাই। দুর্গের বাহিরে এক নির্ঝরিণী হইতে গোরক্ষেরা রাত্রির অন্ধকারে জল লইয়া যায়। এই জল বন্ধ করিতে পারিলেই তৃষ্ণাতুর শত্রু নিরুপায় হইয়া পরাভূত হইবে

নির্ঝরিণীর জল বন্ধ করা হইল। ইহার পর দুর্গমধ্যে যে ভীষণ যন্ত্রণা উপস্থিত হইল তাহা কল্পনারও অতীত-আহত ও মুমূর্ষু নরনারী এবং শিশুর "জল; জল" এই আর্তনাদ কেবল মৃত্যুর আগমনেই নীরব হইল। 4

এদিকে ইংরেজেরা শত্রুকে এইরূপ বিপন্ন দেখিয়া সিংহ- শিশুদিগকে জীবন্ত শৃঙ্খলবদ্ধ করিবার জন্য সচেষ্ট হইলেন। 

দুর্গের চতুদ্দিকে সৈন্যপাশ দৃঢ়ীকৃত হইল। অবরুদ্ধ দুর্গের বহির্গমন পথে বহুসংখ্যক সৈন্য সন্নিবেশিত হইল। তাহারা দিবারাত্রি পথ অবরোধ করিয়া রহিল।

গোরক্ষ-সৈন্যের সংখ্যা প্রথমে তিনশত ছিল, মাসাধিক কাল যুদ্ধের পর সত্তর জন মাত্র রহিল। চারিদিন পর্য্যন্ত ইহাদের কেহ একবিন্দু জল স্পর্শ করে নাই, অনশন ও তৃষ্ণা নীরবে সহ্য করিয়াছে-তাহারা এ সকল কষ্ট অকাতরে সহ্য করিতেছিল, কিন্তু নারী ও শিশুর আর্তনাদ ক্রমে অসহ্য হইয়া উঠিল। শত্রুর হস্তে দুর্গ সমর্পণ করিলেই এই দারুণ কষ্ট শেষ হয়। কিন্তু হস্তের তরবারি শত্রুর পদে স্থাপন, প্রাণ থাকিতে হইবে না। জীবন থাকিতে কোন উপায় নাই-জীবন দিয়াই বা কি উপায় আছে? সম্মুখে চারিদিক বেষ্টন করিয়া লোহিত রেখার জাল ক্রমে সঙ্কীর্ণ হইতেছে। সেই রেখার মধ্যে মধ্যে অসিজ বর্ণ কামানের বিকট মূত্তি দেখা যাইতেছে। এই জালে কি আবব্ধ হইতে হইবে? অথবা জীবনবিন্দু এই রক্তিমা ক্ষণিকের জন্য গাঢ়তর করিবে? তবে তাহাই হউক!

রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময় হঠাৎ দুর্গের দ্বার খুলিয়া গেল। যে দ্বার সঙ্গীন ও কামানের গোলার আঘাতে উদ্ঘাটিত হয় নাই, আজ তাহা স্বতঃই উন্মুক্ত হইল। আত্মবলিদানে উন্মুক্ত সেই সত্তরটি বীর-মুষ্টিপ্রমাণ কৃষ্ণ মেঘের ন্যায়-অগণিত শত্রুদলের উপর পতিত হইল এবং অসির আঘাতে পথ কাটিয়া মুহূর্তে অদৃশ্য হইল।

পরদিন প্রত্যুষে ইংরেজ-সৈন্য যোদ্ধ-পরিত্যক্ত দুর্গে প্রবেশ করিল। প্রবেশ করিয়া যাহা দেখিল, তাহাতে তাহাদের উল্লাস বিষাদে পরিণত হইল। এই কি দুর্গ-না শ্মশান? এই শব- কবন্ধ মণ্ডিত ভূমিতে কি প্রকারে মানুষ এতদিন বাস করিয়াছে? আহত, জীবিত ও মৃতের কি ভয়ানক সমাবেশ! এই যে সম্মুখে সুবাদারের মৃত শরীর পড়িয়া রহিয়াছে, ইহার ক্রোড়ে লুক্কায়িত চারি বৎসরের একটি শিশু কাঁদিতেছে। তাহার একটু অগ্রে একটি স্ত্রীলোক মৃতবৎ পড়িয়া রহিয়াছে, তাহার দুই উরু ভেদ করিয়া কামানের গোলা চলিয়া গিয়াছে। অদূরে বহু ছিন্ন হস্তপদ চতুদ্দিকে বিক্ষিপ্ত দেখা যাইতেছে-এস্থানে শেল পড়িয়া বিদীর্ণ হইয়াছিল। নিকটে কয়েকটি শিশু রক্তাপ্লুত হইয়া ভূমিতে লুন্ঠিত হইতেছে-এখনও তাহাদের প্রাণবায়ু বাহির হয় নাই। চতুদ্দিকে কেবল 'জল জল' এই কাতর ধ্বনি!

বলভদ্র সত্তরটি সঙ্গী লইয়া যেতগড়ের দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। ইংরেজ-সৈন্য এই দুর্গ অবরোধ করিয়াছিল; কিন্তু অধিকার করিতে পারে নাই। তারপর বলভদ্র সৈন্যের আধিপত্য গ্রহণ করেন এবং নেপাল যুদ্ধ শেষ হইলে স্বদেশে তাঁহার তরবারির আর আবশ্যক নাই দেখিয়া সঙ্গীদের সহিত রণজিৎ সিংহের শিখ-সৈন্যে প্রবেশ করেন।

এই সময়ে রণজিৎ সিংহ আফগান যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। একবার তাঁহার একদল সৈন্য বহুসংখ্যক আফগান কর্তৃক আক্রান্ত হয়। অনেকে পলায়ন করিয়া প্রাণরক্ষা করিল, কেবল সত্তরটি সেনা রণভূমি ত্যাগ করিল না। এই কয়টি সেনা শ্রেণীবদ্ধ হইয়া শত্রুর দিকে মুখ করিয়া অটল পর্ব্বতের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিল। ইহারা অনেক বিপদের সময় পাশাপাশি দাঁড়াইয়াছে, আজ এই শেষবার সুবাদার ও সিপাহী এক শ্রেণী হইয়া দাঁড়াইল। দূর হইতে কামান গর্জন করিতেছিল। এক এক বার সেই জীমূত-নাদ পর্ব্বত ও উপত্যকা প্রতিধ্বনিত করিতেছিল-সেই সঙ্গে শ্রেণীর মধ্যে এক একটি স্থান শূন্য হইতে লাগিল; কিন্তু শ্রেণী টলিল না। পরিশেষে পাশাপাশি সত্তরটি শবদেহ অনন্তশয্যায় শায়িত হইল। জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড ধরায় পতিত হইয়া চিরশান্তি লাভ করিল।

ইংরেজ-সৈন্য কলুঙ্গা অধিকার করিয়া দুর্গ সমভূমি করিল। এখন পূর্ব্ব দুর্গস্থানে বন্ধুর প্রস্তরস্তুপ দৃষ্ট হয়। সেই দারুণ যুদ্ধের লীলাভূমিতে এখন গভীর নির্জনতা বিরাজিত। মৃত্যুর এপারেই ঝটিকা, পরপারে চিরশান্তি। মরণের পরপার হইতেই বোধ হয় কোন শান্তিময় আত্মা এই রণস্থলে আবির্ভূত হইয়া জেতৃগণের বাঁরহৃদয়ে করুণ রস সঞ্চার করিয়া দিয়াছিলেন।

যে স্থানে জেতা ও বিজিতের দেহধূলি একত্র মিশ্রিত হইতেছিল সেই স্থানে ইংরেজ দুইটি স্মৃতিচিহ্ন স্থাপিত করিল। ইহা অদ্যাপি দৃষ্ট হয়। একটি প্রস্তরফলক জেনারেল গিলেম্পি ও কলুঙ্গা যুদ্ধে হত ইংরেজ-সৈন্যের স্মরণার্থে স্থাপিত; ইহার অদূরে দ্বিতীয় প্রস্তরফলকে লিখিত আছে:-

"আমাদের বীরশত্রু কলুঙ্গা দুর্গাধিপতি বলভদ্র এবং তাঁহার অধীনস্থ বীর সেনা যাঁহারা রণে জীবন তুচ্ছ জ্ঞান করিয়াছিলেন এবং আফগান কামানের সম্মুখীন হইয়া একে একে অকাতরে প্রাণদান করিয়াছিলেন- সেই বীরগণের স্মরণার্থে এই স্মৃতিচিহ্ন স্থাপিত হইল।"


20
Articles
অব্যক্ত
0.0
শ্রী জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা কিছু ছোট ছোট অবিস্মরণীয় কাহিনী নিয়ে রচিত একটি অব্যক্ত জীবন প্রসারিত কাহিনী সমগ্র।
1

যুক্তকর

20 December 2023
0
0
0

পুরাতন লইয়াই বর্তমান গঠিত, অতীতের ইতিহাস না জানিলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অজ্ঞেয়ই রহিবে। পুরাতন ইতিহাস উদ্ধার করিতে হইলে সেকালে সর্ব্বসাধারণের দৈনন্দিন জীবন কিরূপে অতিবাহিত হইত, তাহা জানা আবশ্যক। লোক- পরম্

2

আকাশ-স্পন্দন ও আকাশ-সম্ভব জগৎ

20 December 2023
0
0
0

দৃশ্য জগৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম লইয়া গঠিত,। রূপক অর্থে এ কথা লইতে পারা যায়। এ জগতে অসংখ্য ঘটনাবলীর মূলে তিনটি কারণ বিদ্যমান। প্রথম পদার্থ, দ্বিতীয় শক্তি, তৃতীয় ব্যোম অথবা আকাশ। পদার্থ ত্রিবিধ

3

গাছের কথা

20 December 2023
0
0
0

গাছেরা কি কিছু বলে? অনেকে বলিবেন, এ আবার কেমন প্রশ্ন? গাছ কি কোনও দিন কথা কহিয়া থাকে? মানুষেই কি সব কথা ফুটিয়া বলে? আর যাহা ফুটিয়া বলে না, তাহা কি কথা নয়? আমাদের একটি খোকা আছে, সে সব কথা ফুটিয়া বলিতে

4

উদ্ভিদের জন্ম ও মৃত্যু

20 December 2023
0
0
0

মৃত্তিকার নীচে অনেক দিন বীজ লুকাইয়া থাকে। মাসের পর মাস এইরূপে কাটিয়া গেল। শীতের পর বসন্ত আসিল। তারপর বর্ষার আরম্ভে দুই-এক দিন বৃষ্টি হইল। এখন আর লুকাইয়া থাকিবার প্রয়োজন নাই। বাহির হইতে কে যেন শিশুকে ড

5

মন্ত্রের সাধন

20 December 2023
0
0
0

প্রশান্ত মহাসাগরে অনেকগুলি দ্বীপ দেখা যায়। এই দ্বীপগুলি অতি ক্ষুদ্র প্রবাল-কীটের দেহপঞ্জরে নিৰ্ম্মিত হইয়াছে। বহু সহস্র বৎসরে অগণ্য কীট নিজ নিজ দেহ দ্বারা এই দ্বীপগুলি নির্মাণ করিয়াছে। আজকাল বিজ্ঞানের

6

অদৃশ্য আলোক

20 December 2023
0
0
0

সেতারের তার অঙ্গুলিতাড়নে ঝঙ্কার দিয়া উঠে। দেখা যায়, তার কাঁপিতেছে। সেই কম্পনে বায়ুরাশিতে অদৃশ্য ঢেউ উৎপন্ন হয় এবং তাহার আঘাতে কর্ণেন্দ্রিয়ে সুর উপলব্ধি হয়। এইরূপে তিনের সাহায্যে এক স্থান হইতে অন্য স্

7

পলাতক তুফান (বৈজ্ঞানিক রহস্য)

21 December 2023
0
0
0

প্রথম পরিচ্ছেদ কয়েক বৎসর পূর্ব্বে এক অত্যাশ্চর্য্য ভৌতিক কাণ্ড ঘটিয়াছিল। তাহা লইয়া অনেক আন্দোলন হইয়া গিয়াছে এবং এ বিষয়ে ইউরোপ এবং আমেরিকার বিবিধ বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় অনেক লেখালেখি চলিয়াছে। কিন্তু এ পর্

8

অগ্নি পরীক্ষা

21 December 2023
0
0
0

১৮১৪ খৃঃ অব্দে ইংরেজ গভর্ণমেন্ট নেপাল রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। জেনারেল মার্ণি কাটামুণ্ডু আক্রমণের জন্য প্রেরিত হইলেন। জেনারেল উড গোরক্ষপুরে ছাউনি করিয়া তরাই প্রদেশ আক্রমণ করিলেন। জেনারেল অক্

9

ভাগীরথীর উৎস-সন্ধানে

21 December 2023
0
0
0

আমাদের বাড়ীর নিয়েই গঙ্গা প্রবাহিত। বাল্যকাল হইতেই নদীর সহিত আমার সখ্য জন্মিয়াছিল; বৎসরের এক সময়ে কূল প্লাবন করিয়া জলস্রোত বহুদূর পর্য্যন্ত বিস্তৃত হইত; আবার হেমন্তের শেষে ক্ষীণ কলেবর ধারণ করিত। প্রতিদ

10

বিজ্ঞানে সাহিত্য

21 December 2023
0
0
0

জড় জগতে কেন্দ্র আশ্রয় করিয়া বহুবিধ গতি দেখিতে পাওয়া যায়। গ্রহগণ সূর্য্যের আকর্ষণ এড়াইতে পারে না। উচ্ছৃঙ্খল ধূমকেতুকেও একদিন সূর্য্যের দিকে ছুটিতে হয়। জড় জগৎ ছাড়িয়া জঙ্গম জগতে দৃষ্টিপাত করিলে তাহাদের

11

নির্ব্বাক জীবন

22 December 2023
0
0
0

ঘর হইতে বাহির হইলেই চারিদিক ব্যাপিয়া জীবনের উচ্ছ্বাস দেখিতে পাই। সেই জীবন একেবারে নিঃশব্দ। শীত ও গ্রীষ্ম, মলয় সমীর ও ঝটিকা, বৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি, আলো ও আঁধার এই নির্ব্বাক জীবন লইয়া ক্রীড়া করিতেছে। কত বি

12

নবীন ও প্রবীণ

22 December 2023
0
0
0

বিশ্বমানবের জ্ঞানের পরিধিকে বিস্তৃত করিতে ভারতবর্ষ যাহা নিবেদন করিয়াছে, তাহার এক বিশিষ্টতা দেখা যায় এই যে, উহা সকল সময়ে ক্ষুদ্র ছাড়িয়া বৃহতের সন্ধান করিয়াছে। অন্য দেশে জ্ঞানরাজ্য এত বিভিন্ন ভাবে বিভক্

13

বোধন

22 December 2023
0
0
0

শতাধিক বৎসর পূর্ব্বে আমাদের বংশের জননী প্রপিতামহী দেবী তরুণ যৌবনে বৈধব্য প্রাপ্ত হইয়া একমাত্র শিশুসন্তান লইয়া ভ্রাতৃগৃহে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। পুত্রের লালন পালন ও শিক্ষার ভার লইয়া প্রপিতামহী দেবী যখ

14

মনন ও করণ

22 December 2023
0
0
0

পূর্ব্বে বাঙ্গলা মাসিকপত্রে উদ্ভিদ-জীবন লইয়া যে একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলাম, তাহাতে বলিয়াছিলাম যে, উদ্ভিদ-জীবন মানব-জীবনেরই ছায়া মাত্র। সেই প্রবন্ধটি লিখিতে এক ঘণ্টারও অধিক সময় লাগে নাই। কিন্তু সেই বিষয়ট

15

রাণী-সন্দর্শন

22 December 2023
0
0
0

একদিন সম্মুখের গলির মোড়ে দেখিলাম, এক ভিক্ষুক বিকট অঙ্গ-ভঙ্গী করিয়া পথ-যাত্রীর করুণা উদ্রেক করিবার চেষ্টা করিতেছে। লোকটা একেবারেই ভণ্ড; প্রতারণা করিয়া সকলকে ঠকাইতেছে বলিয়া আমার রাগ হইল। এই সময় সেখান দি

16

নিবেদন

22 December 2023
0
0
0

বাইশ বৎসর পূর্ব্বে যে স্মরণীয় ঘটনা ঘটিয়াছিল তাহাতে সেদিন দেবতার করুণা জীবনে বিশেষরূপে অনুভব করিয়া- ছিলাম। সেদিন যে মানস করিয়াছিলাম তাহা এতদিন পরে দেবচরণে নিবেদন করিতেছি। আজ যাহা প্রতিষ্ঠা করিলাম তাহা

17

দীক্ষা

23 December 2023
0
0
0

আমরা সকলেই শিক্ষার্থী, কার্য্যক্ষেত্রে প্রত্যহই শিখিতেছি, দিন দিন অগ্রসর হইতেছি এবং বাড়িতেছি। জীবন সম্বন্ধে একটি মহাসত্য এই যে, যেদিন হইতে আমাদের বাড়িবার ইচ্ছা স্থগিত হয় সেই দিন হইতেই জীবনের উপর মৃত্

18

আহত উদ্ভিদ

23 December 2023
0
0
0

পশ্চিমে কয় বৎসর যাবৎ আকাশ ধূমে আচ্ছন্ন ছিল। সেই অন্ধকার ভেদ করিয়া দৃষ্টি পৌঁছিত না। অপরিস্ফুট আর্তনাদ কামানের গর্জনে পরাহত। কিন্তু যেদিন হইতে শিখ ও পাঠান, গুরখা ও বাঙ্গালী সেই মহারণে জীবন আহুতি দিতে গ

19

স্নায়ুসূত্রে উত্তেজনা-প্রবাহ

23 December 2023
0
0
0

বাহিরের সংবাদ ভিতরে কি করিয়া পৌঁছায়? আমাদের বাহ্যেদ্রিয় চতুদ্দিকে প্রসারিত। বিবিধ ধাক্কা অথবা আঘাত তাহাদের উপর পতিত হইতেছে এবং সংবাদ ভিতরে প্রেরিত হইতেছে। আকাশের ঢেউ দ্বারা আহত হইয়া চক্ষু যে বার্ত্তা

20

হাজির!

23 December 2023
0
0
0

হঠাৎ চীৎকার করিয়া কেহ উত্তর দিল-"হাজির"। কাহাকেও ডাকিতে শুনি নাই, তথাপি অতি করুণ ও ভক্তি উচ্ছ্বসিত স্বরে উত্তর শুনিলাম-“কি আজ্ঞা প্রভু?” কে তোমার প্রভু, কাহার হুকুমে এরূপ উদ্দীপ্ত হইলে? কি আশ্চর্য্য!

---