shabd-logo

আকাশ-স্পন্দন ও আকাশ-সম্ভব জগৎ

20 December 2023

2 Viewed 2

দৃশ্য জগৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম লইয়া গঠিত,। রূপক অর্থে এ কথা লইতে পারা যায়। এ জগতে অসংখ্য ঘটনাবলীর মূলে তিনটি কারণ বিদ্যমান। প্রথম পদার্থ, দ্বিতীয় শক্তি, তৃতীয় ব্যোম অথবা আকাশ।

পদার্থ ত্রিবিধ আকারে দেখা যায়। ক্ষিত্যাকারে-অর্থাৎ কঠিনরূপে; দ্রবাকারে-অর্থাৎ অপরূপে; বায়বাকারে- অর্থাৎ মরুৎরূপে। জড় পদার্থ সর্ব্বসময়ে শক্তি অথবা তেজ দ্বারা স্পন্দিত হইতেছে। এই মহাজগৎ ব্যোমে দোলায়মান রহিয়াছে। মহাশক্তি অনন্ত চক্রে নিরন্তর ঘূর্ণিত হইতেছে। তাহারই বলে অসীম আকাশে বিশ্বজগৎ ভ্রমণ করিতেছে, উদ্ভুত হইতেছে এবং পুনরায় মিলাইয়া যাইতেছে।

সর্ব্বাগ্রে দেখা যাউক, শক্তি কি প্রকারে স্থান হইতে স্থানান্তরে সঞ্চালিত হয়।

রেলের ষ্টেশনে সঙ্কেত প্রেরণের দণ্ড সকলেই দেখিয়াছেন। একদিকে রজ্জু আকর্ষণ করিলে দূরস্থ কাষ্ঠখণ্ড সঞ্চালিত হয়। এতদ্ব্যতীত অন্য প্রকারেও শক্তি সঞ্চালিত হইতে দেখা যায়। নদীর উপর দিয়া জাহাজ চলিয়া যায়; কলের আঘাতে জল তরঙ্গাকারে বিক্ষিপ্ত হইয়া নদীতটে বারংবার আঘাত করে। এ স্থলে কলের আঘাত তরঙ্গবলে দূরে নীত হয়।

বাদ্যকরের অঙ্গুলিতাড়িত তন্ত্রীও এইরূপে স্পন্দিত হয়। এই

স্পন্দনে বায়ুরাশিতে তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। শব্দজ্ঞান বায়ুতরঙ্গের আঘাতজনিত ।

বাদ্যযন্ত্র ব্যতীতও সচরাচর অনেক সুর শুনিতে পাওয়া যায়। বায়ুকম্পিত বৃক্ষপত্রে, জলবিন্দু পতনে, তরঙ্গাহত সমুদ্রতীরে বহুবিধ সুর শ্রুতিগোচর হয়।

সেতারের তার যতই ছোট করা যায়, সুর ততই চড়া হয়। যখন প্রতি সেকেণ্ডে বায়ু ৩০,০০০ বার কাঁপিতে থাকে তখন কর্ণে অসহ্য অতি উচ্চ সুর শোনা যায়। তার আরও ক্ষুদ্র করিলে হঠাৎ শব্দ থামিরা যাইবে। তখনও তার কাঁপিতে থাকিবে, তরঙ্গ উদ্ভুত হইবে; কিন্তু এই উচ্চ সুর আর কর্ণে ধ্বনি উৎপাদন করিবে না।

কে মনে করিতে পারে যে, শত শত ধ্বনি কর্ণে প্রবেশ করিতেছে আমরা তাহা শুনিয়াও শুনিতে পাই না? গৃহের বাহিরে নিরন্তর অগণিত সংগীত গীত হইতেছে; কিন্তু তাহা আমাদের শ্রবণের অতীত।

জড় পদার্থের কম্পন ও তজ্জনিত সুরের কথা বলিয়াছি। এতদ্ব্যতীত আকাশেও সর্বদা অসংখ্য তরঙ্গ উৎপন্ন হইতেছে।

অঙ্গুলিতাড়নে প্রথমে বাদ্যযন্ত্রে ও তৎপরে বায়ুতে যেরূপ তরঙ্গ হয়, বিদ্যুত্তাড়নেও সেইরূপে আকাশে তরঙ্গ উদ্ভুত হয়। বায়ুর তরঙ্গ আমরা কর্ণ দিয়া শ্রবণ করি, আকাশের তরঙ্গ সচরাচর আমরা চক্ষু দিয়া দেখি।

বায়ুর তরঙ্গ আমরা অনেক সময়ে শুনিতে পাই না। আকাশের তরঙ্গও সর্বসময়ে দেখিতে পাই না।

দুইটি ধাতুগোলক বিদ্যুদ্যন্ত্রের সহিত যোগ করিয়া দিলে গোলক দুইটি বারংবার বিদ্যুত্তাড়িত হইবে এবং তড়িদ্বলে চতুদ্দিকের আকাশে তরঙ্গ ধাবিত হইবে। তার ছোট করিলে, অর্থাৎ গোলক দুইটিকে ক্ষুদ্র করিলে সুর উচ্চে উঠিবে। এইরূপ প্রতিমুহূর্তে সহস্র কম্পন হইতে লক্ষ, লক্ষ হইতে কোটি এবং তাহা হইতে কোটি কোটি কম্পন উৎপন্ন হইবে।

মনে কর, অন্ধকার গৃহে অদৃশ্য শক্তিবলে বায়ু বারংবার আহত হইতেছে। কিছুই দেখা যাইতেছে না, কেবল নিস্তব্ধতা ভেদ করিয়া গভীর ধ্বনি কর্ণে প্রবেশ করিতেছে। কম্পনসংখ্যা যতই বর্দ্ধিত করা যাইবে, সুর ততই উচ্চ হইতে উচ্চতর সপ্তমে উঠিবে। অবশেষে সহসা কর্ণবিদারী সুর থামিয়া নিস্তব্ধতায় পরিণত হইবে। ইহার পর লক্ষ লক্ষ তরঙ্গ কর্ণে আঘাত করিলেও আমরা তাহার কিছুই জানিতে পারিব না।

এক্ষণে বিদ্যুদ্বলে আকাশে তরঙ্গ উৎপন্ন করা যাউক; লক্ষাধিক তরঙ্গ প্রতি মুহূর্তে চতুদ্দিকে ধাবিত হইবে। আমরা এই তরঙ্গান্দোলিত সাগরে নিমজ্জিত হইয়াও অক্ষুণ্ণ থাকিব। সুর ক্রমে উচ্চে উত্থিত হইতে থাকুক; প্রতি সেকেণ্ডে যখন কোটি কোটি তরঙ্গ উৎপন্ন হইবে তখন অকস্মাৎ নিদ্রিত ইন্দ্রিয় জাগরিত হইয়া উঠিবে, শরীর উত্তাপ অনুভব করিবে। সুর আরও উচ্চে উত্থিত হইলে যখন অধিকতর সংখ্যক তরঙ্গ উৎপন্ন হইবে তখন অন্ধকার ভেদ করিয়া রক্তিম আলোক-রেখা দেখা যাইবে। কম্পনসংখ্যার আরও বৃদ্ধি হউক-ক্রমে ক্রমে পীত, হরিৎ, নীল আলোকে গৃহ পূর্ণ হইবে। ইহার পর সুর আরও উচ্চে উঠিলে চক্ষু পরাস্ত হইবে, আলোকরাশি পুনরায় অদৃশ্য হইয়া যাইবে। ইহার পর অগণিত স্পন্দনে আকাশ স্পন্দিত হইলেও আমরা কোনও ইন্দ্রিয়ের দ্বারা তাহা অনুভব করিতে পারিব না।

তবে ত আমরা এই সমুদ্রে একেবারে দিশাহারা! আমরা বধির ও অন্ধ! কি দেখিতে পাই? কি শুনিতে পাই? কিছুই নয়! দুই একখানা ভগ্ন দিক্দর্শন শলাকা লইয়া আমরা মহাসমুদ্রে যাত্রা করিয়াছি।

পূর্ব্বে বলিয়াছি, উত্তাপ ও আলোক আকাশের বৈদ্যুতিক স্পন্দন মাত্র। যে স্পন্দন ত্বক্ দ্বারা অনুভব করি তাহার নাম উত্তাপ; আর যে কম্পনে দর্শনেন্দ্রিয় উত্তেজিত হয় তাহাকে আলোক বলিয়া থাকি। ইহা ব্যতীত আকাশে বহুবিধ স্পন্দন আছে যাহা আমাদের ইন্দ্রিয়গণের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য।

হস্তী-দেহের বিভিন্ন অংশ স্পর্শ করিয়া অন্ধেরা একই জন্তুর বিভিন্ন রূপ কল্পনা করিয়াছিল; শক্তি সম্বন্ধেও আমরা সেইরূপ কল্পনা করি।

কিয়ৎকাল পূর্ব্বে আমরা চুম্বকশক্তি, বিদ্যুৎ, তাপ ও আলোককে বিভিন্ন শক্তি বলিয়া মনে করিতাম। এখন বুঝিতে পারিতেছি যে, এ সকল একই শক্তির বিভিন্ন রূপ। চুম্বকশক্তি ও বিদ্যুতের সম্বন্ধ সকলেই জানেন। তাপরশ্মি ও আলোক যে আকাশের বৈদ্যুতিক কম্পনজনিত, ইহা অল্পদিন হইল প্রমাণিত হইয়াছে।

আকাশ দিয়া ইহাদের তরঙ্গ একই গতিতে ধাবিত হয়, ধাতুপাত্রে প্রতিহত হইয়া একই রূপে প্রত্যাবর্ত্তন করে, বায়ু হইতে অন্য স্বচ্ছ দ্রব্যে পতিত হইয়া একই রূপে বক্রীভূত হয়। কম্পনসংখ্যাই বৈষম্যের একমাত্র কারণ।

সূর্য্য এই পৃথিবী হইতে নয় কোটি মাইল দূরে অবস্থিত। আমাদের উপরে বায়ুমণ্ডল ৪৫ মাইল পর্য্যন্ত ব্যাপ্ত। তারপর শূন্য। দূরস্থ সূর্য্যের সহিত এই পৃথিবীর আপাততঃ কোনও যোগ দেখা যায় না।

অথচ সূর্য্যের বহ্নিময় সাগরে আবর্ত উত্থিত হইলে এই পৃথিবী সেই সৌরোৎপাতে ক্ষুব্ধ হয়-অমনি পৃথিবী জুড়িয়া বিদ্যুৎস্রোত বহিতে থাকে।

সুতরাং যাহা বিচ্ছিন্ন মনে করিতাম, প্রকৃতপক্ষে তাহা বিচ্ছিন্ন নহে। শূন্যে বিক্ষিপ্ত কোটি কোটি জগৎ আকাশসূত্রে গ্রথিত। এক জগতের স্পন্দন আকাশ বাহিয়া অন্য জগতে সঞ্চালিত হইতেছে।

সূর্য্যকিরণ পৃথিবীতে পতিত হইয়া নানা রূপ ধরিতেছে। সূর্য্যকিরণেই বৃক্ষ বন্ধিত হয়, পুষ্প রঞ্জিত হয়। কিরণরূপ আকাশ-কম্পন আসিয়া বায়ুস্থিত অঙ্গারক অণুগুলি বিচলিত করিয়া বৃক্ষদেহ গঠিত করে। অসংখ্য বৎসর পূর্বের সূর্য্যকিরণ বৃক্ষদেহে আবদ্ধ হইয়া পৃথ্বীগর্ভে নিহিত আছে। আজ কয়লা হইতে সেই কিরণ নির্মুক্ত হইয়া গ্যাস ও বিদ্যুদালোকে রাজবত্ম আলোকিত করিতেছে। বাষ্পযান, অর্ণবপোত এই শক্তিতেই ধাবিত হয়। মেঘ ও বাত্যা একই শক্তিবলে সঞ্চালিত হইতেছে। সূর্য্যকিরণে লালিত উদ্ভিদ ভোজন করিয়াই প্রাণিগণ জীবনধারণ করিতেছে ও বদ্ধিত হইতেছে। তবে দেখা যায় যে, এই ভূপৃষ্ঠের প্রায় সর্ব্ব গতির মূলে সূর্য্যকিরণ। আকাশের স্পন্দন দ্বারাই পৃথিবী স্পন্দিত হইতেছে; জীবনের স্রোত বহিতেছে।

আমাদের চক্ষুর আবরণ ক্রমে ক্রমে অপসারিত হইল।

এক্ষণে আমরা বুঝিতে পারিতেছি যে, এই বহুরূপী বিবিধ শক্তিশালী জগতের মূলে দুইটি কারণ বিদ্যমান। এক, আকাশ ও তাহার স্পন্দন; অপর, জড় বস্তু।

জড় পদার্থ বিবিধ আকারে দেখা যায়। এক সময়ে লৌহবৎ কঠিন, কখনও দ্রব, কখন বায়বাকার, আবার কখনও বা তদপেক্ষা সূক্ষ্মতররূপে দেখিতে পাওয়া যায়। শূন্যে উড্ডীন অদৃশ্য বাষ্প আর প্রস্তরবৎ কঠিন তুষার একই পদার্থ; কিন্তু আকারে কত প্রভেদ!

গৃহমধ্যে নিশ্চল বায়ু দেখিতে পাওয়া যায় না। উহার অস্তিত্ব সহসা আমরা কোন ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উপলব্ধি করিতে পারি না। কিন্তু এই অদৃশ্য সূক্ষ্ম বায়ুরাশিতে আবর্ত্ত উত্থিত হইলে উহা বিভিন্ন গুণ ধারণ করে। আবর্ত্তময় অদৃশ্য বায়ুর কঠিন আঘাতে মুহূর্ত্তমধ্যে গ্রাম-জনপদ বিনষ্ট হইবার কথা সকলেই জানেন।

জড় পদার্থ আকাশের আবর্ত্ত মাত্র। কোন কালে আকাশ- সাগরে অজ্ঞাত মহাশক্তিবলে অগণ্য আবর্ত উদ্ভুত হইয়া পরমাণুর সৃষ্টি হইল। উহাদের মিলনে বিন্দু, অসংখ্য বিন্দুর সমষ্টিতে জগৎ, মহাজগৎ উৎপন্ন হইয়াছে।

আকাশেরই আবর্ত জগৎরূপে আকাশ-সাগরে ভাসিয়া রহিয়াছে।

জাম্মাণ কবি রিক্টার স্বপ্নরাজ্যে দেবদূতের সাক্ষাৎ পাইয়া- ছিলেন। দেবদূত কহিলেন, "মানব, তুমি বিশ্ব-রচয়িতার অনন্ত রচনা দেখিতে চাহিয়াছ-আইস, মহাবিশ্ব দেখিবে।" মানব দেবস্পর্শে পৃথিবীর আকর্ষণ হইতে বিমুক্ত হইয়া দেবদূত সহ অনন্ত আকাশপথে যাত্রা করিল! আকাশের উচ্চ হইতে উচ্চতর স্তর ভেদ করিয়া তাহারা ক্রমে অগ্রসর হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে সপ্তগ্রহ পশ্চাতে ফেলিয়া মুহূর্তের মধ্যে সৌরদেশে উপনীত হইল। সূর্য্যের ভীষণ অগ্নিকুণ্ড হইতে উত্থিত মহাপাবকশিখা তাহাদিগকে দগ্ধ করিল না। পরে সৌররাজ্য ত্যাগ করিয়া সুদূরস্থিত তারকার রাজ্যে উপস্থিত হইল। সমুদ্রতীরস্থ বালুকণার গণনা মনুষ্যের পক্ষে সম্ভব, কিন্তু এই অসীমে বিক্ষিপ্ত অগণ্য জগতের গণনা কল্পনারও অতীত। দক্ষিণে, বামে, সম্মুখে, পশ্চাতে দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করিয়া অগণ্য জগতের অনন্ত শ্রেণী! কোটি কোটি মহাসূর্য্য প্রদক্ষিণ করিয়া কোটি কোটি গ্রহ ও তাহাদের চতুদ্দিকে কোটি কোটি চন্দ্র ভ্রমণ করিতেছে। উর্দ্ধহীন, অধোহীন, দিহীন অনন্ত! পরে এই মহাজগৎ অতিক্রম করিয়া আরও দূরস্থিত অচিন্ত্য জগৎ উদ্দেশে তাহারা চলিল। সমস্ত দিক আচ্ছন্ন করিয়া কল্পনাতীত নূতন মহাবিশ্ব মুহূর্তে তাহাদের দৃষ্টিপথ অবরোধ করিল। ধারণাতীত মহাব্রহ্মাণ্ডের অগণ্য সমাবেশ দেখিয়া মানুষ একেবারে অবসন্ন হইয়া কহিল, "দেবদূত! আমার প্রাণবায়ু বাহির করিয়া দাও! এই দেহ অচেতন ধূলিকণায় মিশিয়া যাউক। অসহ্য এ অনন্তের ভার! এ জগতের শেষ কোথায়?" 1

তখন মেখদূত কহিলেন, "তোমার সম্মুখে অনন্ত নাই। ইহাতেই কি তুমি অবসন্ন হইয়াছ? পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখ, এ জগতের আরম্ভও নাই।"

শেষও নাই, আরম্ভও নাই।

মানুষের মন অসীমের ভার বহিতে পারে না। ধূলিকণা হইয়া কিরূপে অসীম ব্রহ্মাণ্ডের কল্পনা মনে ধারণা করিব?

অণুবীক্ষণে ক্ষুদ্র বিন্দুতে বৃহৎ জগৎ দেখা যায়। বিপর্য্যয় করিয়া দেখিলে জগৎ ক্ষুদ্র বিন্দুতে পরিণত হয়। অণুবীক্ষণ বিপর্য্যয় করিয়া দেখ। ব্রহ্মাণ্ড ছাড়িয়া ক্ষুদ্র কণিকায় দৃষ্টি আবদ্ধ কর।

আমাদের চক্ষুর সমক্ষে জড়বস্তু মুহূর্তে মুহূর্ত্তে কত বিভিন্ন রূপ ধারণ করিতেছে। অগ্নিদাহে মহানগর শূন্যে বিলীন হইয়া যায়। তাহা বলিয়া একবিন্দুও বিনষ্ট হয় না। একই অণু কখন মৃত্তিকাকারে, কখন উদ্ভিদাকারে, কখন মনুষ্যদেহে, পুনরায় কখন অদৃশ্য বায়ুরূপে বর্তমান। কোন বস্তুরই বিনাশ নাই।

শক্তিও অবিনশ্বর। এক মহাশক্তি জগৎ বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে; প্রতি কণা ইহা দ্বারা অনুপ্রবিষ্ট। এ মুহূর্তে যাহা দেখিতেছি, পরমুহূর্তে ঠিক তাহা আর দেখিব না। বেগবান নদীস্রোত যেরূপ উপলখণ্ডকে বার বার ভাঙ্গিয়া অনবরত তাহাকে নূতন আকার প্রদান করে, এই মহাশক্তি-স্রোতও সেইরূপ দৃশ্য জগৎকে মুহূর্তে মুহূর্তে ভাঙ্গিতেছে ও গড়িতেছে। সৃষ্টির আরম্ভ হইতে এই স্রোত অপ্রতিহত গতিতে প্রবাহিত হইতেছে। ইহার বিরাম নাই, হ্রাস নাই, বৃদ্ধি নাই। সমুদ্রের এক স্থানে ভাঁটা হইলে অন্য স্থানে জোয়ার হয়। জোয়ার ভাঁটা উভয়ই এক কারণজাত; সমুদ্রের জলপরিমাণ সমানই রহিয়াছে। এক স্থানে যত হ্রাস হয়, অপর স্থানে সেই পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এইরূপ জোয়ার ভাঁটা-ক্ষয় বৃদ্ধি-তরঙ্গের ন্যায় চতুদ্দিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।

শক্তির তরঙ্গেও এইরূপ-ক্ষয় বৃদ্ধি! প্রত্যেক বস্তু এই তরঙ্গ দ্বারা সর্ব্বদা আহত হইতেছে, উপলখণ্ড ভাঙ্গিতেছে ও গড়িতেছে। শক্তিপ্রক্ষিপ্ত উন্মিমালার দ্বারাই জগৎ জীবন্ত রহিয়াছে।

এখন জড়-জগৎ ছাড়িয়া জীব-জগতে দৃষ্টিপাত করি। বসন্তের স্পর্শে নিদ্রিত পৃথিবী জাগরিত করিয়া, প্রান্তর বন আচ্ছন্ন করিয়া উদ্ভিদ-শিশু অন্ধকার হইতে মস্তক তুলিল। দেখিতে দেখিতে হরিৎ প্রান্তর প্রসূনিত। শরৎকাল আসিল, কোথায় সেই বসন্তের জীবনোচ্ছ্বাস? পুষ্প বৃন্তচ্যুত, জীর্ণ পল্লব ভূপতিত, তরুদেহ মৃত্তিকায় প্রোথিত। জাগরণের পরেই নিদ্রা!

আবার বসন্ত ফিরিয়া আসিল; শুষ্ক পুষ্পদলে আচ্ছাদিত, বীজে নিহিত, নিদ্রিত বৃক্ষ-শিশু পুনরায় জাগিয়া উঠিল। বৃক্ষ মৃত্যুর আগমনে জীবনবিন্দু বীজে সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছিল। সেই বিন্দু হইতে বৃক্ষ পুনর্জীবন লাভ করিল।

সুতরাং দেখা যাইতেছে, প্রতি জীবনে দুইটি অংশ আছে। একটি অজর, অমর; তাহাকে বেষ্টন করিয়া নশ্বর দেহ। এই দেহরূপ আবরণ পশ্চাতে পড়িয়া থাকে।

অমর জীববিন্দু প্রতি পুনর্জন্মে নূতন গৃহ বাঁধিয়া লয়। সেই আদিম জীবনের অংশ, বংশপরম্পরা ধরিয়া বত্তমান সময় পর্য্যন্ত চলিয়া আসিয়াছে। আজ যে পুষ্প-কলিকাটি অকাতরে বৃত্তচ্যুত করিতেছি, ইহার অণুতে কোটি বৎসর পূর্বের জীবনোচ্ছ্বাস নিহিত রহিয়াছে।

কেবল তাহাই নহে। প্রতি জীবের সম্মুখেও বংশপরম্পরাগত

অনন্ত জীবন প্রসারিত।

সুতরাং বর্তমান কালের জীব অনন্তের সন্ধিস্থলে দণ্ডায়মান। তাহার পশ্চাতে যুগযুগান্তরব্যাপী ইতিহাস ও সম্মুখে অনন্ত ভবিষ্যৎ।

আর মনুষ্য? প্রথম জীবকণিকা মনুষ্যরূপে পরিণত হইবার পূর্ব্বে কত পরিবর্তনের মধ্য দিয়া আসিয়াছে! অসংখ্য বৎসরব্যাপী, বিভিন্ন শক্তিগঠিত, অনন্ত সংগ্রামে জয়ী জীবনের চরমোৎকর্ষ মানব!

আজ সেই কীটাণুর বংশধর দুর্বল জীব স্বীয় অপূর্ণতা ভুলিয়া অসীম বল ধারণ করিতে চাহে। আকাশ হইতে বিদ্যুৎ আহরণ করিয়া স্বীয় রথে যোজনা করে। অজ্ঞান ও অন্ধ হইয়াও পৃথিবীর আদিম ইতিহাস উদ্ধার করিতে উৎসুক হয়। ঘন তিমিরাবৃত যবনিকা উত্তোলন করিয়া ভবিষ্যৎ দেখিবার প্রয়াসী হয়।

যদি কখনও সৃষ্ট জীবে দৈবশক্তির আবির্ভাব সম্ভব হয় তবে ইহাই সেই দৈবশক্তি।

অধিক বিস্ময়কর কাহাকে বলিব? বিশ্বের অসীমতা, কিম্বা এই সসীম ক্ষুদ্র বিন্দুতে অসীম ধারণা করিবার প্রয়াস-কোন্টা অধিক বিস্ময়কর?

পূর্ব্বে বলিয়াছি, এ জগতের আরম্ভও নাই, শেষও নাই। এখন দেখিতেছি, এ জগতে ক্ষুদ্রও নাই, বৃহৎও নাই।

জীবনের চরমোৎকর্ষ মানব! এ কথা সব সময়ের জন্য ঠিক নয়। যে শক্তি আদিম জীববিন্দুকে মনুষ্যে উন্নীত করিয়াছে, যাহার উচ্ছ্বাসে নিরাকার মহাশূন্য হইতে এই বহুরূপী জগৎ ও তদ্বৎ বিস্ময়কর জীবন উৎপন্ন হইয়াছে, আজিও সেই মহাশক্তি সমভাবে প্রবাহিত হইতেছে। উর্দ্ধাভিমুখেই সৃষ্টির গতি; আর সম্মুখে অন্তহীন কাল এবং অনন্ত উন্নতি প্রসারিত।

20
Articles
অব্যক্ত
0.0
শ্রী জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা কিছু ছোট ছোট অবিস্মরণীয় কাহিনী নিয়ে রচিত একটি অব্যক্ত জীবন প্রসারিত কাহিনী সমগ্র।
1

যুক্তকর

20 December 2023
0
0
0

পুরাতন লইয়াই বর্তমান গঠিত, অতীতের ইতিহাস না জানিলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অজ্ঞেয়ই রহিবে। পুরাতন ইতিহাস উদ্ধার করিতে হইলে সেকালে সর্ব্বসাধারণের দৈনন্দিন জীবন কিরূপে অতিবাহিত হইত, তাহা জানা আবশ্যক। লোক- পরম্

2

আকাশ-স্পন্দন ও আকাশ-সম্ভব জগৎ

20 December 2023
0
0
0

দৃশ্য জগৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম লইয়া গঠিত,। রূপক অর্থে এ কথা লইতে পারা যায়। এ জগতে অসংখ্য ঘটনাবলীর মূলে তিনটি কারণ বিদ্যমান। প্রথম পদার্থ, দ্বিতীয় শক্তি, তৃতীয় ব্যোম অথবা আকাশ। পদার্থ ত্রিবিধ

3

গাছের কথা

20 December 2023
0
0
0

গাছেরা কি কিছু বলে? অনেকে বলিবেন, এ আবার কেমন প্রশ্ন? গাছ কি কোনও দিন কথা কহিয়া থাকে? মানুষেই কি সব কথা ফুটিয়া বলে? আর যাহা ফুটিয়া বলে না, তাহা কি কথা নয়? আমাদের একটি খোকা আছে, সে সব কথা ফুটিয়া বলিতে

4

উদ্ভিদের জন্ম ও মৃত্যু

20 December 2023
0
0
0

মৃত্তিকার নীচে অনেক দিন বীজ লুকাইয়া থাকে। মাসের পর মাস এইরূপে কাটিয়া গেল। শীতের পর বসন্ত আসিল। তারপর বর্ষার আরম্ভে দুই-এক দিন বৃষ্টি হইল। এখন আর লুকাইয়া থাকিবার প্রয়োজন নাই। বাহির হইতে কে যেন শিশুকে ড

5

মন্ত্রের সাধন

20 December 2023
0
0
0

প্রশান্ত মহাসাগরে অনেকগুলি দ্বীপ দেখা যায়। এই দ্বীপগুলি অতি ক্ষুদ্র প্রবাল-কীটের দেহপঞ্জরে নিৰ্ম্মিত হইয়াছে। বহু সহস্র বৎসরে অগণ্য কীট নিজ নিজ দেহ দ্বারা এই দ্বীপগুলি নির্মাণ করিয়াছে। আজকাল বিজ্ঞানের

6

অদৃশ্য আলোক

20 December 2023
0
0
0

সেতারের তার অঙ্গুলিতাড়নে ঝঙ্কার দিয়া উঠে। দেখা যায়, তার কাঁপিতেছে। সেই কম্পনে বায়ুরাশিতে অদৃশ্য ঢেউ উৎপন্ন হয় এবং তাহার আঘাতে কর্ণেন্দ্রিয়ে সুর উপলব্ধি হয়। এইরূপে তিনের সাহায্যে এক স্থান হইতে অন্য স্

7

পলাতক তুফান (বৈজ্ঞানিক রহস্য)

21 December 2023
0
0
0

প্রথম পরিচ্ছেদ কয়েক বৎসর পূর্ব্বে এক অত্যাশ্চর্য্য ভৌতিক কাণ্ড ঘটিয়াছিল। তাহা লইয়া অনেক আন্দোলন হইয়া গিয়াছে এবং এ বিষয়ে ইউরোপ এবং আমেরিকার বিবিধ বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় অনেক লেখালেখি চলিয়াছে। কিন্তু এ পর্

8

অগ্নি পরীক্ষা

21 December 2023
0
0
0

১৮১৪ খৃঃ অব্দে ইংরেজ গভর্ণমেন্ট নেপাল রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। জেনারেল মার্ণি কাটামুণ্ডু আক্রমণের জন্য প্রেরিত হইলেন। জেনারেল উড গোরক্ষপুরে ছাউনি করিয়া তরাই প্রদেশ আক্রমণ করিলেন। জেনারেল অক্

9

ভাগীরথীর উৎস-সন্ধানে

21 December 2023
0
0
0

আমাদের বাড়ীর নিয়েই গঙ্গা প্রবাহিত। বাল্যকাল হইতেই নদীর সহিত আমার সখ্য জন্মিয়াছিল; বৎসরের এক সময়ে কূল প্লাবন করিয়া জলস্রোত বহুদূর পর্য্যন্ত বিস্তৃত হইত; আবার হেমন্তের শেষে ক্ষীণ কলেবর ধারণ করিত। প্রতিদ

10

বিজ্ঞানে সাহিত্য

21 December 2023
0
0
0

জড় জগতে কেন্দ্র আশ্রয় করিয়া বহুবিধ গতি দেখিতে পাওয়া যায়। গ্রহগণ সূর্য্যের আকর্ষণ এড়াইতে পারে না। উচ্ছৃঙ্খল ধূমকেতুকেও একদিন সূর্য্যের দিকে ছুটিতে হয়। জড় জগৎ ছাড়িয়া জঙ্গম জগতে দৃষ্টিপাত করিলে তাহাদের

11

নির্ব্বাক জীবন

22 December 2023
0
0
0

ঘর হইতে বাহির হইলেই চারিদিক ব্যাপিয়া জীবনের উচ্ছ্বাস দেখিতে পাই। সেই জীবন একেবারে নিঃশব্দ। শীত ও গ্রীষ্ম, মলয় সমীর ও ঝটিকা, বৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি, আলো ও আঁধার এই নির্ব্বাক জীবন লইয়া ক্রীড়া করিতেছে। কত বি

12

নবীন ও প্রবীণ

22 December 2023
0
0
0

বিশ্বমানবের জ্ঞানের পরিধিকে বিস্তৃত করিতে ভারতবর্ষ যাহা নিবেদন করিয়াছে, তাহার এক বিশিষ্টতা দেখা যায় এই যে, উহা সকল সময়ে ক্ষুদ্র ছাড়িয়া বৃহতের সন্ধান করিয়াছে। অন্য দেশে জ্ঞানরাজ্য এত বিভিন্ন ভাবে বিভক্

13

বোধন

22 December 2023
0
0
0

শতাধিক বৎসর পূর্ব্বে আমাদের বংশের জননী প্রপিতামহী দেবী তরুণ যৌবনে বৈধব্য প্রাপ্ত হইয়া একমাত্র শিশুসন্তান লইয়া ভ্রাতৃগৃহে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। পুত্রের লালন পালন ও শিক্ষার ভার লইয়া প্রপিতামহী দেবী যখ

14

মনন ও করণ

22 December 2023
0
0
0

পূর্ব্বে বাঙ্গলা মাসিকপত্রে উদ্ভিদ-জীবন লইয়া যে একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলাম, তাহাতে বলিয়াছিলাম যে, উদ্ভিদ-জীবন মানব-জীবনেরই ছায়া মাত্র। সেই প্রবন্ধটি লিখিতে এক ঘণ্টারও অধিক সময় লাগে নাই। কিন্তু সেই বিষয়ট

15

রাণী-সন্দর্শন

22 December 2023
0
0
0

একদিন সম্মুখের গলির মোড়ে দেখিলাম, এক ভিক্ষুক বিকট অঙ্গ-ভঙ্গী করিয়া পথ-যাত্রীর করুণা উদ্রেক করিবার চেষ্টা করিতেছে। লোকটা একেবারেই ভণ্ড; প্রতারণা করিয়া সকলকে ঠকাইতেছে বলিয়া আমার রাগ হইল। এই সময় সেখান দি

16

নিবেদন

22 December 2023
0
0
0

বাইশ বৎসর পূর্ব্বে যে স্মরণীয় ঘটনা ঘটিয়াছিল তাহাতে সেদিন দেবতার করুণা জীবনে বিশেষরূপে অনুভব করিয়া- ছিলাম। সেদিন যে মানস করিয়াছিলাম তাহা এতদিন পরে দেবচরণে নিবেদন করিতেছি। আজ যাহা প্রতিষ্ঠা করিলাম তাহা

17

দীক্ষা

23 December 2023
0
0
0

আমরা সকলেই শিক্ষার্থী, কার্য্যক্ষেত্রে প্রত্যহই শিখিতেছি, দিন দিন অগ্রসর হইতেছি এবং বাড়িতেছি। জীবন সম্বন্ধে একটি মহাসত্য এই যে, যেদিন হইতে আমাদের বাড়িবার ইচ্ছা স্থগিত হয় সেই দিন হইতেই জীবনের উপর মৃত্

18

আহত উদ্ভিদ

23 December 2023
0
0
0

পশ্চিমে কয় বৎসর যাবৎ আকাশ ধূমে আচ্ছন্ন ছিল। সেই অন্ধকার ভেদ করিয়া দৃষ্টি পৌঁছিত না। অপরিস্ফুট আর্তনাদ কামানের গর্জনে পরাহত। কিন্তু যেদিন হইতে শিখ ও পাঠান, গুরখা ও বাঙ্গালী সেই মহারণে জীবন আহুতি দিতে গ

19

স্নায়ুসূত্রে উত্তেজনা-প্রবাহ

23 December 2023
0
0
0

বাহিরের সংবাদ ভিতরে কি করিয়া পৌঁছায়? আমাদের বাহ্যেদ্রিয় চতুদ্দিকে প্রসারিত। বিবিধ ধাক্কা অথবা আঘাত তাহাদের উপর পতিত হইতেছে এবং সংবাদ ভিতরে প্রেরিত হইতেছে। আকাশের ঢেউ দ্বারা আহত হইয়া চক্ষু যে বার্ত্তা

20

হাজির!

23 December 2023
0
0
0

হঠাৎ চীৎকার করিয়া কেহ উত্তর দিল-"হাজির"। কাহাকেও ডাকিতে শুনি নাই, তথাপি অতি করুণ ও ভক্তি উচ্ছ্বসিত স্বরে উত্তর শুনিলাম-“কি আজ্ঞা প্রভু?” কে তোমার প্রভু, কাহার হুকুমে এরূপ উদ্দীপ্ত হইলে? কি আশ্চর্য্য!

---