দ্বার খুলিলে আশমানি গৃহে প্রবেশ করিবামাত্র দিগ্গজের হৃদ্বোধ হইল যে, প্রণয়িনী আসিয়াছেন, ইহার সরস অভ্যর্থনা করা চাই, অতএব হস্ত উত্তোলন করিয়া কহিলেন, "ওঁ আয়াহি বরদে দেবি!”
আশমানি কহিল, এটি যে বড় সরস কবিতা, কোথা পাইলে?"
দি। তোমার জন্য এটি আজ রচনা করিয়া রাখিয়াছি।
আ। সাধ করিয়া কি তোমায় রসিকরাজ বলেছি? দি। সুন্দরি! তুমি বইস; আমি হস্ত প্রক্ষালন করি।
আশমানি মনে মনে কহিল, “আলোপ্পেয়ে! তুমি যে হাত ধোবে? আমি তোমাকে ঐ এঁটো আবার খাওয়াব।”
প্রকাশ্যে কহিল, “সে কি, হাত ধোও যে, ভাত খাও না।"
গড়পতি কহিলেন, "কি কথা, ভোজন করিয়া উঠিয়াছি, আবার ভাত খাব কিরূপে?” আ। কেন, তোমার ভাত রহিয়াছে যে? উপবাস করিবে?
দিগ্গজ কিছু ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিলেন, "কি করি, তুমি তাড়াতাড়ি করিলে।” এই বলিয়া সতৃষ্ণনয়নে অন্নপানে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। আশমানি কহিল, "তবে আবার খাইতে হইবে৷”
দি। রাধে মাধব! গণ্ডূষ করিয়াছি, গাত্রোত্থান করিয়াছি, আবার খাইব?
"হাঁ, খাইবে বই কি। আমারই উৎসৃষ্ট খাইবে।" এই বলিয়া আশমানি ভোজন পাত্র হইতে এক গ্লাস অন্ন লইয়া আপনি খাইল।
ব্রাহ্মণ অবাক হইয়া রহিলেন।
আশমানি উৎসৃষ্ট অন্ন ভোজনপাত্রে রাখিয়া কহিল, “খাও।"
ব্রাহ্মণের বানিষ্পত্তি নাই।
আ। খাও, শোন, কাহাকে বলিব না যে, তুমি আমার উৎসৃষ্ট খাইয়াছ। কেহ না জানিতে
পারিলে দোষ কি?
দি। তাও কি হয়?
কিন্তু দিগ্গজের উদরমধ্যে অগ্নিদেব প্রচণ্ড জ্বালায় জ্বলিতেছিলেন। দিগ্গজ মনে মনে করিতেছিলেন যে, আশমানি যেমন সুন্দর হউক না কেন, পৃথিবী ইহাকে গ্রাস করুন, আমি গোপনে ইহার উৎসৃষ্টাবশেষ ভোজন করিয়া দহ্যমান উদরশীতল করি। আশমানি ভাব বুঝিয়া বলিল, "খাও না খাও, একবার পাতের কাছে বসো।" - দি। কেন? তাতে কি হইবে?
আ। আমার সাধ। তুমি কি আমার একটা সাধ পুরাইতে পার না? দিগ্গজ বলিলেন, “শুধু পাতের কাছে বসিতে কি? তাহাতে কোন দোষ নাই। তোমার কথা রাখিলাম।" এই বলিয়া দিগ্গজ পণ্ডিত আশমানির কথায় পাতের কাছে গিয়া বসিলেন। উদরে ক্ষুধা, কোলে অন্ন, অথচ খাইতে পারিতেছেন না - দিগ্গজের চক্ষে
জল আসিল। আশমানি বলিল, "শূদ্রের উৎসৃষ্ট ব্রাহ্মণে ছুঁলে কি হয়?"
পণ্ডিত বলিলেন, "নাইতে হয়।" আ। তুমি আমায় কেমন ভালবাস, আজ বুঝিয়া পড়িয়া তবে আমি যাব। তুমি আমার কথায় এই রাত্রে নাইতে পার?
দিগ্গজ মহাশয় ক্ষুদ্র চক্ষু রসে অর্ধ মুদ্রিত করিয়া দীর্ঘ নাসিকা বাঁকাইয়া মধুর হাসি আকর্ণ হাসিয়া বলিলেন, "তার কথা কি? এখনই নাইতে পারি।"
আশমানি বলিল, “আমার ইচ্ছা হইয়াছে তোমার পাতে প্রসাদ পাইব! তুমি আপন হাতে আমাকে দুইটি ভাত মাখিয়া দাও।"
দিগ্গজ বলিল, “তার আশ্চর্য কি? স্নানেই শুচি।" এই বলিয়া উৎসৃষ্টাবশেষ একত্রিত করিয়া মাখিতে লাগিল ।
আশমানি বলিল, “আমি একটি উপকথা বলি শুন। যতক্ষণ আমি উপকথা বলিব, ততক্ষণ তুমি ভাত মাখিবে, নইলে আমি খাইব না। দি। আচ্ছা।
আশমানি এক রাজা আর তাহার দুয়ো শুয়ো দুই রাণীর গল্প আরম্ভ করিল। দিগ্গজ হাঁ করিয়া তাহার মুখপানে চাহিয়া শুনিতে লাগিল - আর ভাত মাখিতে লাগিল।
শুনিতে শুনিতে দিপ্লিজের মন আশমানির গল্পে ডুবিয়া গেল-আশমানির হাসি, চাহনি ও নথের মাঝখানে আটকাইয়া রহিল। ভাত মাখা বন্ধ হইল–পাতে হাত লাগিয়া রহিল—কিন্তু ক্ষুধার যাতনাটা আছে। যখন আশমানির গল্প বড় জমিয়া আসিল-দিগ্ গজের মন তাহাতে বড়ই নিবিষ্ট হইল – তখন দিয়জের হাত বিশ্বাসঘাতকতা করিল। - পাত্রস্থ হাত, নিকটস্থ মাখা ভাতের গ্রাস তুলিয়া চুপি চুপি দিরিজের মুখে লইয়া গেল । মুখ হাঁ করিয়া তাহা গ্রহণ করিল। দন্ত বিনা আপত্তিতে তাহা চর্বণ করিতে আরম্ভ করিল। রসনা তাহা গলাধ:করণ করাইল। নিরীহ দিয় জের কোন সাড়া ছিল না। দেখিয়া আশমানি খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। বলিল, "তবে রে বিলে আমার এঁটো না কি খাবি নে?
তখন দিগ্গজের চেতনা হইল। তাড়াতাড়ি আর এক গ্রাস মুখে দিয়া গিলিতে গিলিতে এঁটো হাতে আশমানির পায়ে জড়াইয়া পড়িল। চর্বণ করিতে করিতে কাঁদিয়া বলিল, "আমায় রাখ; আশমান৷ কাহাকেও বলিও না।"