পরদিন প্রদোষকালে জগৎসিংহের অবস্থান-কক্ষে আয়েষা, ওসমান আর চিকিৎসক পূর্ববৎ নিঃশব্দে বসিয়া আছেন; আয়েষা পালঙ্কে বসিয়া স্বহস্তে ব্যজনাদি করিতেছেন; চিকিৎসক ঘন ঘন জগৎসিংহের নাড়ী দেখিতেছেন; জগৎসিংহ অচেতন; চিকিৎসক কহিয়াছেন, সেই রাত্রে জ্বরত্যাগের সময়ে জগৎসিংহের লয় হইবার সম্ভাবনা, যদি সে সময় শুধরাইয়া যান, তবে আর চিন্তা থাকিবে না, নিশ্চিত রক্ষা পাইবেন। জ্বর-বিশ্রামের সময় আগত, এই জন্য সকলেই বিশেষ ব্যগ্র চিকিৎসক মুহূর্মুহু: নাড়ী দেখিতেছেন, "নাড়ী ক্ষীণ," "আরও ক্ষীণ", "কিঞ্চিৎ সবল", ইত্যাদি মুহূর্মুহু: অস্ফুটশব্দে বলিতেছেন। সহসা চিকিৎসকের মুখ কালিমাপ্রাপ্ত হইল। বলিলেন, "সময় আগত।" আয়েষা ও ওসমান নিস্পন্দ হইয়া শুনিতে লাগিলেন। হকিম নাড়ী ধরিয়া রহিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে চিকিৎসক কহিলেন, "গতিক মন্দ।" আয়েষার মুখ আরওম্লান হইল। হঠাৎ জগৎসিংহের মুখে বিকট ভঙ্গী উপস্থিত হইল; মুখ শ্বেতবর্ণ হইয়া আসিল; হস্তে দৃঢ়মুষ্টি বাঁধিল; চক্ষে অলৌকিক স্পন্দন হইতে লাগিল; আয়েষা বুঝিলেন, কৃতান্তের গ্রাস পূর্ণ হইতে আর বিলম্ব নাই। চিকিৎসক হস্তস্থিত পাত্রে ঔষধ লইয়া বসিয়াছিলেন; এরূপ লক্ষণ দেখিবামাত্রই অঙ্গুলি দ্বারা রোগীর মুখব্যাদান করাইয়া ঐ ঔষধ পান করাইলেন। ঔষধ ওষ্ঠোপ্রান্ত হইতে নির্গত হইয়া পড়িল; কিঞ্চিৎ উদরে গেল। উদরে প্রবেশমাত্রেই রোগীর দেহের অবস্থা পরিবর্তিত হইতে লাগিল; ক্রমে মুখের বিকট ভঙ্গী দূরে গিয়া কান্তি স্থির হইল, বর্ণের অস্বাভাবিক শ্বেতভাব বিনষ্ট হইয়া ক্রমে রক্তসঞ্চার হইতে লাগিল; হস্তের মুষ্টি শিথিল হইল; চক্ষু স্থির হইয়া পুনর্বার মুদ্রিত হইল। হকিম অত্যন্ত মনোভিনিবেশপূর্বক নাড়ী দেখিতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ দেখিয়া সহর্ষে কহিলেন, "আর চিন্তা নাই; রক্ষা পাইয়াছেন।"
ওসমান জিজ্ঞাসা করিলেন, "জ্বরত্যাগ হইয়াছে? ভিষক কহিলেন, "হইয়াছে।”
আয়েষা ও ওসমান উভয়েরই মুখ প্রফুল্ল হইল। ভিষক কহিলেন, “এখন আর কোন চিন্তা নাই, আমার বসিয়া থাকার প্রয়োজন করে না; এই ঔষধ দুই প্রহর রাত্রি পর্যন্ত ঘড়ী ঘড়ী খাওয়াইবেন।” এই বলিয়া ভিষক প্রস্থান করিলেন। ওসমান আর দুই চারি দণ্ড বসিয়া নিজ আবাসগৃহে গেলেন। আয়েষা পূর্ববৎ পালঙ্কে বসিয়া ঔষধাদি সেবন করাইতে লাগিলেন রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরের কিঞ্চিৎ পূর্বে রাজকুমার নয়ন উন্মীলন করিলেন। প্রথমেই আয়েষার সুখপ্রফুল্ল মুখ দেখিতে পাইলেন। চক্ষুর কটাক্ষভাব দেখিয়া আয়েষার বোধ হইল, যেন তাঁহার বুদ্ধির ভ্রম জন্মিতেছে, যেন তিনি কিছু স্মরণ করিতে চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু যত্ন বিফল হইতেছে। অনেকক্ষণ পরে আয়েষার প্রতি চাহিয়া কহিলেন, “আমি কোথায়?" দুই দিবসের পর রাজপুত্র এই প্রথম কথা কহিলেন আয়েষা কহিলেন, “কতলু খাঁর দুর্গে।"
রাজপুত্র আবার পূর্ববৎ স্মরণ করিতে লাগিলেন, অনেকক্ষণ পরে কহিলেন, “আমি কেন এখানে?”
আয়েষা প্রথমে নিরুত্তর হইয়া রহিলেন; পরে কহিলেন, “আপনি পীড়িত।"
রাজপুত্র ভাবিতে ভাবিতে মস্তক আন্দোলন করিয়া কহিলেন, "না না, আমি বন্দী হইয়াছি।"
এই কথা বলিতে রাজপুত্রের মুখের ভাবান্তর হইল।
আয়েষা উত্তর করিলেন না; দেখিলেন, রাজপুত্রের স্মৃতিক্ষমতা পুনরুদ্দীপ্ত হইতেছে।
ক্ষণপরে রাজপুত্র পুনর্বার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে?”
"আমি আয়েষা।”
"আয়েষা কে?"
"কতলু খাঁর কন্যা।"
রাজপুত্র আবার ক্ষণকাল নিস্তব্ধ রহিলেন; এককালে অধিকক্ষণ কথা কহিতে শক্তি নাই। কিয়ৎক্ষণ নীরবে বিশ্রাম লাভ করিয়া কহিলেন, "আমি কয়দিন এখানে আছি?" "চারি দিন।”
"গড় মান্দারণ অদ্যাপি তোমাদিগের অধিকারে আছে?" "আছে।"
জগৎসিংহ আবার কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম করিয়া কহিলেন, “বীরেন্দ্রসিংহের কি হইয়াছে? "বীরেন্দ্রসিংহ কারাগারে আবদ্ধ আছেন, অদ্য তাঁহার বিচার হইবে।"
জগৎসিংহের মলিন মুখ আরও মলিন হইল। জিজ্ঞাসা করিলেন, "আরআর পৌরবর্গ কি অবস্থায় আছে?”
আয়েষা উদ্বিগ্না হইলেন। কহিলেন, “সকল কথা আমি অবগত নহি । রাজপুত্র আপনা আপনি কি বলিলেন। একটি নাম তাঁহার কণ্ঠনির্গত হইল, আয়েষা তাহা শুনিতে পাইলেন, "তিলোত্তমা।"
আয়েষা ধীরে ধীরে উঠিয়া পাত্র হইতে ভিষদণত্ত সুস্বাদু ঔষধ আনিতে গেলেন; রাজপুত্র তাঁহার দোদুল্যমান কর্ণাভরণসংযুক্ত অলৌকিক দেহমহিমা নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। আয়েষা ঔষধ আনিলেন; রাজপুত্র তাহা পান করিয়া কহিলেন, "আমি পীড়ার মোহে স্বপ্ন দেখিতাম, স্বর্গীয় দেবকন্যা আমার শিয়রে বসিয়া শুশ্ৰুষা
করিতেছেন, সে তুমি, না তিলোত্তমা?" আয়েষা কহিলেন, “আপনি তিলোত্তমাকে স্বপ্ন দেখিয়া থাকিবেন।"