তুমি অকস্মাৎ
আমায় কিছু দাও গো' বলে
বাড়িয়ে দিলে হাত।
এ কী কথা রাজাধিরাজ,
"আমায় দাও গো কিছু!
শুনে ক্ষণকালের তরে।
রইনু মাথা নিচু।
তোমার কী-বা অভাব আছে
ভিখারী ভিক্ষুকের কাছে।
এ কেবল কৌতুকের বশে
আমায় প্রবঞ্চনা।
ঝুলি হতে দিলেম তুলে
একটি ছোটো কণা।
যবে পাত্রখানি ঘরে এনে
উজাড় করি— এ ক
ভিক্ষামাঝে একটি ছোটো
সোনার কণা দেখি।
দিলেম যা রাজ-ভিখারীরে
স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে,
তখন কাঁদি চোখের জলে
দুটি নয়ন ভরে
তোমায় কেন দিই নি আমার
সকল শূন্য করে।
তখন রাত্রি আঁধার হল,
সাঙ্গ হল কাজ-
আমরা মনে ভেবেছিলেম
আসবে না কেউ আজ।
মোদের গ্রামে দুয়ার যত
রুদ্ধ হল রাতের মতো,
দু-এক জনে বলেছিল,
"আসবে মহারাজ।'
আমরা হেসে বলেছিলেম,
"আসবে না কেউ আজ।
দ্বারে যেন আঘাত হল
শুনেছিলেম সবে,
আমরা তখন বলেছিলেম,
"বাতাস বুঝি হবে।
নিবিয়ে প্রদীপ ঘরে ঘরে
শুয়েছিলেম আলসভরে,
দু-এক জনে বলেছিল,
'দূত এল-বা তবে।'
আমরা হেসে বলেছিলেম,
'বাতাস বুঝি হবে।'
নিশীথরাতে শোনা গেল
কিসের যেন ধ্বনি।
ঘুমের ঘোরে ভেবেছিলেম
মেঘের গরজনি।
ক্ষণে ক্ষণে চেতন করি
কাঁপল ধরা থরহরি,
দু-এক জনে বলেছিল,
"চাকার ঝনঝনি।'
ঘুমের ঘোরে কহি মোরা,
“মেঘের গরজনি।'
তখনো রাত আঁধার আছে,
বেজে উঠল ভেরী,
কে ফুকারে, “জাগো সবাই,
আর কোরো না দেরি।'
বক্ষ 'পরে দু হাত চেপে
আমরা ভয়ে উঠি কেঁপে,
দু-এক জনে কহে কানে,
'রাজার ধ্বজা হেরি।'
আমরা জেগে উঠে বলি,
“আর তবে নয় দেরি।'
কোথায় আলো, কোথায় মালা
কোথায় আয়োজন।
রাজা আমার দেশে এল
কোথায় সিংহাসন।
হায় রে ভাগ্য, হায় রে লজ্জা,
কোথায় সভা, কোথায় সজ্জা।
দু-এক জনে কহে কানে,
"বৃথা এ ক্রন্দন-
রিক্ত করে শূন্যঘরে
করো অভ্যর্থন।
ওরে, দুয়ার খুলে দে রে,
রাজা, শঙ্খ বাজা!
গভীর রাতে এসেছে আজ
আঁধার ঘরের রাজা।
বজ্র ডাকে শূন্যতলে,
বিদ্যুতেরই ঝিলিক ঝলে,
ছিন্ন শয়ন টেনে এনে
আঙিনা তোর সাজা।
ঝড়ের সাথে হঠাৎ এল
দুঃখরাতের রাজা।
ভেবেছিলাম চেয়ে নেব,
চাই নি সাহস করে
সন্ধেবেলায় যে মালাটি।
গলায় ছিলে পরে—
আমি চাই নি সাহস করে।
ভেবেছিলাম সকাল হলে
যখন পারে যাবে চলে
ছিন্ন মালা শয্যাতলে
রইবে বুঝি পড়ে।
তাই আমি কাঙালের মতো
এসেছিলেম ভোরে—
তবু চাই নি সাহস করে।
এ তো মালা নয় গো, এ যে
তোমার তরবারি
জ্বলে ওঠে আগুন যেন,
বজ্র-হেন ভারী—
এ যে তোমার তরবারি।
তরুণ আলো জানলা বেয়ে
পড়ল তোমার শয়ন ছেয়ে,
ভোরের পাখি শুধায় গেয়ে '
কী পেলি তুই নারী"।
নয় এ মালা, নয় এ থালা,
গন্ধজলের ঝারি,
এ যে ভীষণ তরবারি।
তাই তো আমি ভাবি বসে
এ কী তোমার দান।
কোথায় এরে লুকিয়ে রাখি
নাই যে হেন স্থান।
এ কী তোমার দান।
শক্তিহীনা মরি লাজে,
এ ভূষণ কি আমায় সাজে।
রাখতে গেলে বুকের মাঝে
ব্যথা যে পায় প্রাণ।
তবু আমি বইব বুকে
এই বেদনার মান
নিয়ে তোমারি এই দান।
আজকে হতে জগৎমাঝে
ছাড়ব আমি ভয়,
আজ হতে মোর সকল কাজে
তোমার হবে জয়-
আমি ছাড়ব সকল ভয়।
মরণকে মোর দোসর করে
রেখে গেছ আমার ঘরে,
আমি তারে বরণ করে
রাখব পরান-ময়।
তোমার তরবারি আমার
করবে বাঁধন ক্ষয়।
ছাড়ব সকল ভয়।
তোমার লাগি অঙ্গ ভরি
করব না আর সাজ।
নাই-বা তুমি ফিরে এলে
ওগো হৃদয়রাজ।
করব না আর সাজ।
ধুলায় বসে তোমার তরে
কাঁদব না আর একলা ঘরে,
তোমার লাগি ঘরে-পরে
মানব না আর লাজ।
তোমার তরবারি আমায়
সাজিয়ে দিল আজ,
আমি করব না আর সাজ।
সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি
তারায় তারায় খচিত,
স্বর্ণে রত্নে শোভন লোভন জানি
বর্ণে বর্ণে রচিত।
খড়গ তোমার আরো মনোহর লাগে।
বাঁকা বিদ্যুতে আঁকা সে
গরুড়ের পাখা রক্তরবির রাগে
যেন গো অস্ত-আকাশে।
জীবন-শেষের শেষ জাগরণসম
ঝলসিছে মহাবেদনা
নিমেষে দহিয়া যাহা-কিছু আছে মম
তীব্র ভীষণ চেতনা।
সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি
তারায় তারায় খচিত -
খড়গ তোমার, হে দেব বজ্রপাণি,
চরম শোভায় রচিত।
খন তুমি শুধালে নাম
পেলেম বড়ো লাজ,
তোমার মনে থাকার মতো
করেছি কোন্ কাজ।
তোমায় দিতে পেরেছিলেম
একটু ভূষার জল,
এই কথাটি আমার মনে
রহিল সম্বল।
কুয়ার ধারে দুপুরবেলা
তেমনি ডাকে পাখি,
তেমনি কাঁপে নিমের পাতা-
আমি বসেই থাকি।
এখনো ঘোর ভাঙে না তোর যে
মেলে না তোর আঁখি,
কাটার বনে ফুল ফুটেছে রে
জানিস নে তুই তা কি।
ওরে অলস, জানিস নে তুই তা কি।
জাগো এবার জাগো,
বেলা কাটাস না গো।
কঠিন পথের শেষে
কোথায় অগম বিজন দেশে
ও সেই বন্ধু আমার একলা আছে গো,
দিস নে তারে ফাঁকি।
চিরজীবন দিস নে তারে ফাঁকি।
জাগো এবার জাগো,
বেলা কাটাস না গো।
প্রখর রবির তাপে
নাহয় শুষ্ক গগন কাঁপে,
নাহয় দগ্ধ বালু তপ্ত আঁচলে
দিক চারি দিক ঢাকি।
পিপাসাতে দিক চারি দিক ঢাকি
মনের মাঝে চাহি
আনন্দ কি নাহি।
বাজবে তোরে ডাকি ।
পায়ে পায়ে দুখের বাঁশরি
বাজবে তোরে ডাকি।
জাগো এবার জাগো,
বেলা কাটাস না গো।
তাই তোমার আনন্দ আমার ’পর
তুমি তাই এসেছ নীচে।
আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে।
আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা,
আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা,
মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে
তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে।
তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে
তবু আমার হৃদয় লাগি
ফিরছ কত মনোহরণ বেশে
প্রভু নিত্য আছ জাগি।।
তাই তো, প্রভু, হেথায় এল নেমে,
তোমারি প্রেম ভক্ত প্রাণের প্রেমে,
মূর্তি তোমার যুগল-সম্ম
সেথায় পূর্ণ প্রকাশিছে।