shabd-logo

শশুগুলা

25 November 2023

4 Viewed 4

শশুগুলা

এক নিবিড় অরণ্য ছিল। তাতে ছিল বড় বড় বট, সারিসারি তাল তমাল, পাহাড় পর্বত, আর ছিল- ছোট নদী মালিনী।

মালিনীর জল বড় স্থির-আয়নার মতো। তাতে গাছের ছায়া, নীল আকাশের ছায়া, রাঙা মেঘের ছায়া-সকলি দেখা যেত। আর দেখা যেত গাছের তলায় কতগুলি কুটিরের ছায়া।

নদীতীরে যে নিবিড় বন ছিল তাতে অনেক জীব জন্তু ছিল। কত হাঁস, কত বক, সারাদিন খালের ধারে, ১(৩৮) বিলের জলে ঘুরে বেড়াত। কত ছোট ছোট পাখি, কত টিয়াপাখির ঝাঁক গাছের ডালে ডালে গান গাইত, কোটরে কোটরে বাসা বাঁধত। দলে দলে হরিণ, ছোট ছোট হরিণ-শিশু, কুশের বনে, ধানের খেতে, কচি ঘাসের মাঠে খেলা করত। বসন্তে কোকিল গাইত, বর্ষায় ময়ূর নাচত।

এই বনে তিন হাজার বছরের এক প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় মহর্ষি কথদেবের আশ্রম ছিল। সেই আশ্রমে জটাধারী তপস্বী কথ আর মা-গৌতমী ছিলেন, তাঁদের পাতার কুটির ছিল, পরনে বাকল ছিল, গোয়াল-ভরা গাই ছিল, চঞ্চল বাছুর ছিল, আর ছিল বাকল-পরা কতগুলি ঋষিকুমার।

তারা কথদেবের কাছে বেদ পড়ত, মালিনীর জলে তর্পণ করত, গাছের ফলে অতিথিসেবা করত, বনের ফুলে দেবতার অঞ্জলি দিত।

আর কি করত?

বনে বনে হোমের কাঠ কুড়িয়ে বেড়াত, কালো গাই ধলো গাই মাঠে চরাতে যেত। সবুজ মাঠ ছিল তাতে গাইবাছুর চরে বেড়াত, বনে ছায়া ছিল তাতে রাখাল- ঋষিরা খেলে বেড়াত। তাদের ঘর গড়বার বালি ছিল, ময়ূর গড়বার মাটি ছিল, বেণুবাঁশের বাঁশি ছিল, বটপাতার ভেলা ছিল; আর ছিল-খেলবার সাথী বনের হরিণ, গাছের ময়ূর; আর ছিল-মা-গৌতমীর মুখে দেবদানবের যুদ্ধকথা, তাত কন্থের মুখে মধুর সামবেদ গান।

সকলি ছিল, ছিল না কেবল-আঁধার ঘরের মানিক- ছোট মেয়ে-শকুন্তলা। একদিন নিশুতি রাতে অপ্সরী মেনকা তার রূপের ডালি-দুধের বাছা-শকুন্তলা মেয়েকে সেই তপোবনে ফেলে রেখে গেল। বনের পাখিরা তাকে ডানায় ঢেকে বুকে নিয়ে সারা রাত বসে রইল।

বনের পাখিদেরও দয়ামায়া আছে, কিন্তু সেই মেনকা পাষাণীর কি কিছু দয়া হল!

খুব ভোরবেলায় তপোবনের যত ঋষিকুমার বনে বনে ফল ফুল কুড়তে গিয়েছিল। তারা আমলকীর বনে আমলকী, হরীতকীর বনে হরীতকী, ইংলী ফলের বনে ইংলী কুড়িয়ে নিলে; তারপরে ফুলের বনে পূজার ফুল তুলতে তুলতে পাখিদের মাঝে ফুলের মতো সুন্দর শকুন্তলা মেয়েকে কুড়িয়ে পেলে। সবাই মিলে তাকে কোলে করে তাত কথের কাছে নিয়ে এল। তখন সেই সঙ্গে বনের কত পাখি, কত হরিণ, সেই তপোবনে এসে বাসা বাঁধলে।

শকুন্তলা সেই তপোবনে, সেই বটের ছায়ায় পাতার কুটিরে, মা-গৌতমীর কোলে-পিঠে মানুষ হতে লাগল। তারপর শকুন্তলার যখন বয়স হল তখন তাত কণ্ব পৃথিবী খুঁজে শকুন্তলার বর আনতে চলে গেলেন। শকুন্তলার হাতে তপোবনের ভার দিয়ে গেলেন।

শকুন্তলার আপনার মা-বাপ তাকে পর করলে, কিন্তু যারা পর ছিল তারা তার আপনার হল। তাত কথ তার আপনার, মা-গৌতমী তার আপনার, ঋষিবালকেরা তার আপনার ভাইয়ের মতো। গোয়ালের গাইবাছুর- সে-ও তার আপনার, এমন-কি-বনের লতাপাতা তারাও তার আপনার ছিল। আর ছিল-তার বড়ই আপনার দুই প্রিয়সখী অনসূয়া, প্রিয়ম্বদা; আর ছিল একটি মা-হারা হরিণ-শিশু-বড়ই ছোট-বড়ই চঞ্চল। তিন সখীর আজকাল অনেক কাজ-ঘরের কাজ, অতিথি-সেবার কাজ, সকালে-সন্ধ্যায় গাছে জল দেবার কাজ, সহকারে মল্লিকালতার বিয়ে দেবার কাজ; আর শকুন্তলার দুই সখীর আর একটি কাজ ছিল-তারা প্রতিদিন মাধবীলতায় জল দিত আর ভাবত, কবে ওই মাধবীলতায় ফুল ফুটবে, সেই দিন সখী শকুন্তলার বর আসবে।

এ-ছাড়া আর কি কাজ ছিল?-হরিণ-শিশুর মতো নির্ভয়ে এ-বনে সে-বনে খেলা করা, ভ্রমরের মতো লতা- বিতানে গুন্-গুন্ গল্প করা, নয় তো মরালীর মতো মালিনীর হিম জলে গা ভাসানো; আর প্রতিদিন সন্ধ্যার আঁধারে বনপথে বনদেবীর মতো তিন সখীতে ঘরে ফিরে আসা-এই কাজ।

একদিন-দক্ষিণ বাতাসে সেই কুসুমবনে দেখতে দেখতে প্রিয় মাধবীলতার সর্বাঙ্গ ফুলে ভরে উঠল। আজ সখীর বর আসবে বলে চঞ্চল হরিণীর মতো চঞ্চল অনসূয়া প্রিয়ম্বদা আরো চঞ্চল হয়ে উঠল। 

4
Articles
শকুন্তলা
0.0
"শকুন্তলা" হল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি ক্লাসিক উপন্যাস, যা প্রাচীন ভারতীয় পুরাণের একটি চরিত্র শকুন্তলার গল্পকে চিত্রিত করেছে। আখ্যানটি শকুন্তলার জীবনকে অনুসরণ করে, যাকে তার পিতামাতা পরিত্যাগ করেছিলেন এবং ঋষি কণ্ব দ্বারা একটি নির্জন বনে বেড়ে ওঠেন। যখন সে বড় হয়, সে রাজা দুষ্যন্তের সাথে দেখা করে এবং তারা প্রেমে পড়ে, যার ফলে একটি গোপন বিয়ে হয়। তবে এক অভিশাপের কারণে দুষ্যন্ত শকুন্তলাকে ভুলে যায়। গল্পটি ট্রায়াল এবং ক্লেশের সাথে উন্মোচিত হয়, যার মধ্যে একটি জাদুকরী আংটি হারিয়ে যাওয়া এবং পাওয়া যায়। অবশেষে, অভিশাপ তুলে নেওয়া হয়, এবং দম্পতি আবার একত্রিত হয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "শকুন্তলা" ঐতিহ্যগত ভারতীয় শৈল্পিকতা এবং গল্প বলার সংমিশ্রণের জন্য পালিত হয়, যা প্রেম, নিয়তি এবং প্রাচীন গল্পের নিরবধি প্রকৃতিকে ধারণ করে।
1

শশুগুলা

25 November 2023
0
0
0

শশুগুলা এক নিবিড় অরণ্য ছিল। তাতে ছিল বড় বড় বট, সারিসারি তাল তমাল, পাহাড় পর্বত, আর ছিল- ছোট নদী মালিনী। মালিনীর জল বড় স্থির-আয়নার মতো। তাতে গাছের ছায়া, নীল আকাশের ছায়া, রাঙা মেঘের ছায়া-সকলি দেখা যেত।

2

দুশ্চিন্তা

25 November 2023
0
0
0

যে-দেশে ঋষির তপোবন ছিল, সেই দেশের রাজার নাম ছিল-দুষ্মন্ত। সেকালে এত বড় রাজা কেউ ছিল না। তিনি পুব- দেশের রাজা, পশ্চিম-দেশের রাজা, উত্তর-দেশের রাজা, দক্ষিণ-দেশের রাজা, সব রাজার রাজা ছিলেন। সাত- সমুদ্র-

3

তপোবনে

25 November 2023
0
0
0

রাজা রাজ্যে চলে গেলেন, আর শকুন্তলা সেই বনে দিন গুনতে লাগল। যাবার সময় রাজা নিজের মোহর আংটি শকুন্তলাকে দিয়ে গেলেন, বলে গেলেন-'সুন্দরী, তুমি প্রতিদিন আমার নামের একটি করে অক্ষর পড়বে, নামও শেষ হবে আর বনপথ

4

রাজপুরে

25 November 2023
0
0
0

দুর্বাসার শাপে রাজা শকুন্তলাকে একেবারে ভুলে বেশ সুখে আছেন। সাত ক্রোশ জুড়ে রাজার সাত মহল বাড়ি, তার এক এক মহলে এক এক রকম কাজ চলছে। প্রথম মহলে রাজসভা-সেখানে সোনার থামে সোনার ছাদ, তার তলায় সোনার সিংহাসন;

---