আমার মিলন লাগি তুমি
আসছ কবে থেকে।
তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়
রাখবে কোথায় ঢেকে।
কত কালের সকাল-সাঁঝে
তোমার চরণধ্বনি বাজে,
গোপনে দূত হৃদয়মাঝে
গেছে আমায় ডেকে।
ওগো পথিক, আজকে আমার
সকল পরান ব্যেপে
থেকে থেকে হরষ যেন
উঠছে কেঁপে কেঁপে।
যেন সময় এসেছে আজ,
ফুরালো মোর যা ছিল কাজ
বাতাস আসে হে মহারাজ,
তোমার গন্ধ মেখে।
পথ চেয়ে তো কাটল নিশি,
লাগছে মনে ভয়-
সকালবেলা ঘুমিয়ে পড়ি
যদি এমন হয়।
যদি তখন হঠাৎ এসে
দাঁড়ায় আমার দুয়ার-দেশে!
বনচ্ছায়ায় ঘেরা এ ঘর
আছে তো তার জানা—
ওগো, তোরা পথ ছেড়ে দিস,
করিস নে কেউ মানা।
যদি-বা তার পায়ের শব্দে
ঘুম না ভাঙে মোর
শপথ আমার, তোরা কেহ
ভাঙাস নে সে ঘোর।
চাই নে জাগতে পাখির রবে
নতুন আলোর মহোৎসবে,
চাই নে জাগতে হাওয়ায় আকুল
বকুল ফুলের বাসে-
তোরা আমায় ঘুমোতে দিস
যদিই-বা সে আসে।
ওগো, আমার ঘুম যে ভালো
গভীর অচেতনে-
যদি আমায় জাগায় তারি
আপন পরশনে।
ঘুমের আবেশ যেমনি টুটি
দেখব তার নয়নদুটি
মুখে আমার তারি হাসি
পড়বে সকৌতুকে—
সে যেন মোর সুখের স্বপন
দাঁড়াবে সম্মুখে।
সে আসবে মোর চোখের 'পরে
সকল আলোর আগে,
তাহারি রূপ মোর প্রভাতের
প্রথম হয়ে জাগে।
প্রথম চমক লাগবে সুখে
চেয়ে তারি করুণ মুখে
চিত্ত আমার উঠবে কেঁপে
তার চেতনায় ভরে-
তোরা আমায় জাগাস নে কেউ,
জাগাবে সেই মোরে।
তখন আকাশতলে ঢেউ তুলেছে
পাখিরা গান গেয়ে।
তখন পথের দুটি ধারে
ফুল ফুটেছে ভারে ভারে,
মেঘের কোণে রঙ ধরেছে
দেখি নি কেউ চেয়ে।
মোরা আপন মনে ব্যস্ত হয়ে
চলেছিলেম ধেয়ে।
মোরা সুখের বশে গাই নি তো গান,
করি নি কেউ খেলা।
চাই নি ভুলে ডাহিন-বাঁয়ে,
হাটের লাগি যাই নি গাঁয়ে,
হাসি নি কেউ, কই নি কথা,
করি নি কেউ হেলা।
মোরা ততই বেগে চলেছিলেম
যতই বাড়ে বেলা।
শেষে সূর্য যখন মাঝ-আকাশে,
কপোত ডাকে বনে-
তপ্ত হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে
শুকনো পাতা বেড়ায় উড়ে,
বটের তলে রাখালশিশু
ঘুমায় অচেতনে,
আমি জলের ধারে শুলেম এসে
শ্যামল তৃণাসনে।
আমার দলের সবাই আমার পানে
চেয়ে গেল হেসে।
চলে গেল উচ্চশিরে,
চাইল না কেউ পিছু ফিরে
মিলিয়ে গেল সুদূর ছায়ায়
পথতরুর শেষে।
তারা পেরিয়ে গেল কত যে মাঠ,
কত দূরের দেশে!
ওগো ধন্য তোমরা দুখের যাত্রী,
ধন্য তোমরা সবে।
লাজের ঘায়ে উঠিতে চাই,
মনের মাঝে সাড়া না পাই,
মগ্ন হলেম আনন্দময়
অগাধ অগৌরবে
পাখির গানে, বাঁশির তানে,
কম্পিত পল্লবে।
আমি মুগ্ধতনু দিলেম মেলে
বসুন্ধরার কোলে।
বাঁশের ছায়া কী কৌতুকে
নাচে আমার চক্ষে মুখে,
আমের মুকুল গন্ধে আমায়
বিধুর করে তোলে—
মুদে আসে মৌমাছিদের
গুঞ্জন কল্লোলে।
সেই রৌদ্রে ঘেরা সবুজ আরাম
মিলিয়ে এল প্রাণে।
ভুলে গেলেম কিসের তরে
বাহির হলেম পথের 'পরে,
ঢেলে দিলেম চেতনা মোর
ছায়ায় গন্ধে গানে-
ধীরে ঘুমিয়ে পালেম অবশ দেহে
কখন কে তা জানে।
শেষে গভীর ঘুমের মধ্য হতে
ফুটল যখন আঁখি,
চেয়ে দেখি, কখন এসে
দাঁড়িয়ে আছ শিয়রদেশে
তোমার হাসি দিয়ে আমার
অচৈতন্য ঢাকি—
ওগো, ভেবেছিলেম আছে আমার
কত-না পথ বাকি।
মোরা ভেবেছিলেম পরানপণে
সজাগ রব সবে-
সন্ধ্যা হবার আগে যদি
পার হতে না পারি নদী,
ভেবেছিলেম তাহা হলেই
সকল ব্যর্থ হবে।
যখন আমি থেমে গেলেম, তুমি
আপনি এলে কবে।
তব সিংহাসনের আসন হতে
এলে তুমি নেমে,
মোর বিজন ঘরের দ্বারের কাছে
দাঁড়ালে নাথ থেমে।
একলা বসে আপন-মনে
গাইতেছিলেম গান,
তোমার কানে গেল সে সুর
এলে তুমি নেমে,
মোর বিজন ঘরের দ্বারের কাছে
দাঁড়ালে নাথ থেমে।
তোমার সভায় কত-না গান
কতই আছেন গুণী;
গুণহীনের গানখানি আজ
বাজল তোমার প্রেমে।
লাগল বিশ্বতানের মাঝে
একটি করুণ সুর,
হাতে লয়ে বরণমালা
এলে তুমি নেমে,
মোর বিজন ঘরের দ্বারের কাছে
দাঁড়ালে নাথ থেমে।
আমি ভিক্ষা করে ফিরতেছিলেম
গ্রামের পথে পথে,
তুমি তখন চলেছিলে
তোমার স্বর্ণরথে।
অপূর্ব এক স্বপ্ন-সম
লাগতেছিল চক্ষে মম
কী বিচিত্র শোভা তোমার,
কী বিচিত্র সাজ।
আমি মনে ভাবতেছিলেম,
এ কোন্ মহারাজ।
আজি শুভক্ষণে রাত পোহালো
ভেবেছিলেম তবে,
আজ আমারে দ্বারে দ্বারে
ফিরতে নাহি হবে।
বাহির হতে নাহি হতে
কাহার দেখা পেলেম পথে,
চলিতে রথ ধনধান্য
ছড়াবে দুই ধারে—
মুঠা মুঠা কুড়িয়ে নেব,
নের ভারে ভারে।
সহসা রথ থেমে গেল
আমার কাছে এসে,
আমার মুখপানে চেয়ে
নামলে তুমি হেসে।
দেখে মুখের প্রসন্নতা
জুড়িয়ে গেল সকল ব্যথা,
হেনকালে কিসের লাগি