আমি হেথায় থাকি শুধু
গাইতে তোমার গান,
দিয়ো তোমার জগৎসভায়
এইটুকু মোর স্থান।
আমি তোমার ভুবন-মাঝে
লাগি নি নাথ, কোনো কাজে-
শুধু কেবল সুরে বাজে
অকাজের এই প্রাণ ।
নিশার নীরব দেবালয়ে
তোমার আরাধন,
তখন মোরে আদেশ কোরো
গাইতে হে রাজন।
ভোরে যখন আকাশ জুড়ে
বাজবে বীণা সোনার সুরে
আমি যেন না রই দূরে
এই দিয়ো মোর মান।
জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।
ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন।
নয়ন আমার রূপের পুরে
সাধ মিটায়ে বেড়ায় ঘুরে,
শ্রবণ আমার গভীর সুরে
হয়েছে মগন।
তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার
বাজাই আমি বাঁশি।
গানে গানে গেঁথে বেড়াই
প্রাণের কান্নাহাসি।
এখন সময় হয়েছে কি।
সভায় গিয়ে তোমায় দেখি
জয়ধ্বনি শুনিয়ে गान
এ মোর নিবেদন।
প্রেমের হাতে ধরা দেব
তাই রয়েছি বসে;
অনেক দেরি হয়ে গেল,
দোষী অনেক দোষে।
বিধিবিধান-বাঁধনডোরে
ধরতে আসে, যাই যে সরে,
তার লাগি যা শাস্তি নেবার
নেব মনের তোষে।
প্রেমের হাতে ধরা দেব
তাই রয়েছি বসে।
লোকে আমায় নিন্দা করে,
নিন্দা সে নয় মিছে,
সকল নিন্দা মাথায় ধরে
রব সবার নীচে।
শেষ হয়ে যে গেল বেলা,
ভাঙল বেচা-কেনার মেলা,
ডাকতে যারা এসেছিল
ফিরল তারা রোষে।
প্রেমের হাতে ধরা দেব
তাই রয়েছি বসে।
মেঘের 'পরে মেঘ জমেছে,
আঁধার করে আসে।
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
একা দ্বারের পাশে।
কাজের দিনে নানা কাজে
থাকি নানা লোকের মাঝে,
আজ আমি যে বসে আছি
তোমারি আশ্বাসে।
তুমি যদি না দেখা দাও,
কর আমায় হেলা,
কেমন করে কাটে আমার
এমন বাদল-বেলা ।
দূরের পানে মেলে আঁখি
কেবল আমি চেয়ে থাকি,
পরান আমার কেঁদে বেড়ায়
দুরন্ত বাতাসে।
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
একা দ্বারের পাশে।
ওগো মৌন, না যদি কও
না-ই কহিলে কথা।
বক্ষ ভরি বইব আমি
তোমার নীরবতা।
স্তব্ধ হয়ে রইব পড়ে,
রজনী রয় যেমন করে
জ্বালিয়ে তারা নিমেষহারা
ধৈর্যে অবনতা।
হবে হবে প্রভাত হবে
আঁধার যাবে কেটে।
তোমার বাণী সোনার ধারা
পড়বে আকাশ ফেটে।
তখন আমার পাখির বাসায়
জাগবে কি গান তোমার ভাষায়।
তোমার তানে ফোটাবে ফুল
আমার বনলতা?
যেদিন ফুটল কমল কিছুই জানি নাই
আমি ছিলেম অন্যমনে।
আমার সাজিয়ে সাজি তারে আনি নাই।
সে যে রইল সংগোপনে।
মাঝে মাঝে হিয়া আকুল প্রায়,
স্বপন দেখে চমকে উঠে চায়,
মন্দ মধুর গন্ধ আসে হায়
কোথায় দখিন-সমীরণে।
ওগো সেই সুগন্ধে ফিরায় উদাসিয়া
আমায় দেশে দেশান্তে
যেন সন্ধানে তার উঠে নিশ্বাসিয়া
ভুবন নবীন বসন্তে।
কে জানিত দূরে তো নেই সে,
আমারি গো আমারি সেই যে,
এ মাধুরী ফুটেছে হায় রে
আমার হৃদয়-উপবনে।
এবার ভাসিয়ে দিতে হবে আমার
এই তরী।
তীরে বসে যায় যে বেলা,
মরি গো মরি।
ফুল-ফোটানো সারা করে
বসন্ত যে গেল সরে,
নিয়ে ঝরা ফুলের ডালা
বলো কী করি।
জল উঠেছে ছলছলিয়ে
ঢেউ উঠেছে দুলে,
মর্মরিয়ে ঝরে পাতা
বিজন তরুমূলে।
শূন্য মনে কোথায় তাকাস?
সকল বাতাস সকল আকাশ
ওই পারের ওই বাঁশির সুরে
উঠে শিহরি ।
আজি শ্রাবণ ঘন গহন মোহে
গোপন তব চরণ ফেলে
নিশার মতো নীরব ওহে
সবার দিঠি এড়ায়ে এলে।
প্রভাত আজি মুদেছে আঁখি,
বাতাস বৃথা যেতেছে ডাকি,
নিলাজ নীল আকাশ ঢাকি
নিবিড় মেঘ কে দিল মেলে।
কূজনহীন কাননভূমি,
দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে,
একেলা কোন্ পথিক তুমি
পথিকহীন পথের 'পরে।
হে একা সখা, হে প্রিয়তম,
রয়েছে খোলা এ ঘর মম,
সমুখ দিয়ে স্বপনসম
যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে;
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার,
পরানসখা বন্ধু হে আমার।
আকাশ কাঁদে হতাশ-সম,
নাই যে ঘুম নয়নে মম,
দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম,
চাই যে বারে বার।
পরানসখা বন্ধু হে আমার।
বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই,
তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।
সুদূর কোন্ নদীর পারে,
গহন কোন্ বনের ধারে
গভীর কোন্ অন্ধকারে
হতেছ তুমি পার।
পরানসখা বন্ধু হে আমার।
দিবস যদি সাঙ্গ হল, না যদি গাহে পাখি,
ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে।
এবার তবে গভীর করে ফেলো গো মোরে ঢাকি
অতি নিবিড় ঘন তিমিরতলে।
স্বপন দিয়ে গোপনে ধীরে ধীরে
যেমন করে ঢেকেছ ধরণীরে,
যেমন করে ঢেকেছ তুমি মুদিয়া-পড়া আঁখি,
ঢেকেছ তুমি রাতের শতদলে।
পাথেয় যার ফুরায়ে আসে পথের মাঝখানে,
ক্ষতির রেখা উঠেছে যার ফুটে,
বসনভূষা মলিন হল ধুলায় অপমানে
শকতি যার পড়িতে চায় টুটে
ঢাকিয়া দিক তাহার ক্ষতব্যথা
করুণাঘন গভীর গোপনতা,
ঘুচায়ে লাজ ফুটাও তারে নবীন ঊষাপানে
জুড়ায়ে তারে আঁধার সুধাজলে।
মাঝে মাঝে কভু যবে অবসাদ আসি
অন্তরের আলোক পলকে ফেলে গ্রাসি,
মন্দপদে যবে শান্তি আসে তিল তিল
তোমার পূজার বৃত্ত করে সে শিথিল
ম্রিয়মাণ তখনো না যেন করি ভয়,
তখনো অটল আশা যেন জেগে রয়
তোমা-পানে।
তোমা- 'পরে করিয়া নির্ভর
সে শ্রান্তির রাত্রে যেন সকল অন্তর
নির্ভয়ে অর্পণ করি পথধূলিতলে
নিদ্রারে আহ্বান করি। প্রাণপণ বলে।
ক্লান্ত চিত্তে নাহি তুলি ক্ষীণ কলরব
তোমার পূজার অতি দরিদ্র উৎসব।
রাত্রি এনে দাও তুমি দিবসের চোখে,
আবার জাগাতে তারে নবীন আলোকে।
সে যে পাশে এসে বসেছিল
তবু জাগি নি।
কী ঘুম তোরে পেয়েছিল।
হতভাগিনী।
এসেছিল নীরব রাতে
নীলাখানি ছিল হাতে,
স্বপনমাঝে বাজিয়ে গেল
গভীর রাগিণী।
জেগে দেখি দখিন-হাওয়া
পাগল করিয়া
গন্ধ তাহার ভেসে বেড়ায়।
আঁধার ভরিয়া।
কেন আমার রজনী যায়
কাছে পেয়ে কাছে না পায়
কেন গো তার মালার পরশ
বুকে লাগে নি।
কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো।
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
রয়েছে দীপ না আছে শিখা,
এই কি ভালে ছিল রে লিখা
ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো।
বিরহানলে প্রদীপখানি জ্বালো।
বেদনাদূতী গাহিছে, “ওরে প্রাণ,
তোমার লাগি জাগেন ভগবান।
নিশীথে ঘন অন্ধকারে
ডাকেন তোরে প্রেমাভিসারে,
দুঃখ দিয়ে রাখেন তোর মান।
তোমার লাগি জাগেন ভগবান।”
গগনতল গিয়েছে মেঘে ভরি,
বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি।
এ ঘোর রাতে কিসের লাগি
পরান মম সহসা জাগি
এমন কেন করিছে মরি মরি।
বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি।
বিজুলি শুধু ক্ষণিক আভা হানে,
নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।
জানি না কোথা অনেক দূরে
বাজিল গান গভীর সুরে,
সকল প্রাণ টানিছে পথপানে।
নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।
কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো।
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
ডাকিছে মেঘ, হাঁকিছে হাওয়া,
সময় গেলে হবে না যাওয়া,
নিবিড় নিশা নিকষখন কালো।
পরান দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বালো।
জড়ায়ে আছে বাধা, ছাড়ায়ে যেতে চাই,
ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে।
মুক্তি চাহিবারে তোমার কাছে যাই
চাহিতে গেলে মরি লাজে।
জনি হে তুমি মম জীবনে শ্রেয়তম,
এমন ধন আর নাহি যে তোমা-সম,
তবু যা ভাঙাচোরা ঘরেতে আছে পোৱা
ফেলিয়া দিতে পারি না যে।
তোমারে আবরিয়া ধুলাতে ঢাকে হিয়া
মরণ আনে রাশি রাশি,
আমি যে প্রাণ ভরি তাদের ঘৃণা করি
তবুও তাই ভালোবাসি।
এতই আছে বাকি, জমেছে এত ফাঁকি,
কত যে বিষণ্ণতা, কত যে ঢাকাঢাকি,
আমার ভালো তাই চাহিতে যবে যাই।
ভয় যে আসে মনোমাঝে।