ভেবেছিনু মনে যা হবার তারি শেষে
যাত্রা আমার বুঝি থেমে গেছে এসে।
নাই বুঝি পথ, নাই বুঝি আর কাজ,
পাথেয় যা ছিল ফুরায়েছে বুঝি আজ,
যেতে হবে সরে নীরব অন্তরালে
জীর্ণ জীবনে ছিন্ন মলিন বেশে।
কী নিরখি আজি, এ কী অফুরান লীলা,
এ কী নবীনতা বহে অন্তঃশীলা।
পুরাতন ভাষা মরে এল যবে মুখে,
নবগান হয়ে গুমরি উঠিল বুকে,
পুরাতন পথ শেষ হয়ে গেল যেথা
সেথায় আমারে আনিলে নূতন দেশে।
চাই গো আমি তোমারে চাই
তোমায় আমি চাই
এই কথাটি সদাই মনে
বলতে যেন পাই।
আর যা-কিছু বাসনাতে
ঘুরে বেড়াই দিনে রাতে
মিথ্যা সে-সব মিথ্যা ওগো
তোমায় আমি চাই। --
রাত্রি যেমন লুকিয়ে রাখে
আলোর প্রার্থনাই -
তেমনি গভীর মোহের মাঝে
তোমায় আমি চাই।
শান্তিরে ঝড় যখন হানে
শান্তি তবু চায় সে প্রাণে,
তেমনি তোমায় আঘাত করি
তবু তোমায় চাই।
জীবন যখন শুকায়ে যায়
করুণাধারায় এসো।
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়,
গীতসুধারসে এসো।
কর্ম যখন প্রবল আকার
গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার,
হৃদয়প্রান্তে হে নীরব নাথ,
শান্তচরণে এসো।
আপনারে যবে করিয়া কৃপণ
কোণে পড়ে থাকে দীনহীন মন,
দুয়ার খুলিয়া হে উদার নাথ,
রাজ সমারোহে এসো।
বাসনা যখন বিপুল ধুলায়
অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায়
ওহে পবিত্র, ওহে অনি,
রুদ্র আলোকে এসো।
দীর্ঘকাল অনাবৃষ্টি, অতি দীর্ঘকাল,
হে ইন্দ্ৰ, হৃদয়ে মম। দিক্চক্রবাল
ভয়ংকর শূন্য হেরি, নাই কোনোখানে
সরস সজল রেখা কেহ নাহি আনে
নববারিবর্ষণের শ্যামল সংবাদ।
যদি ইচ্ছা হয়, দেব, আনো বজ্রনাদ
প্রলয়মুখর হিংস্র ঝটিকার সাথে।
পলে পলে বিদ্যুতের বক্র কশাঘাতে
সচকিত করো মোৱ দিগদিগন্তর।
সংহরো সংহরো, প্রভো, নিস্তব্ধ প্রখর
এই রুদ্র, এই ব্যাপ্ত, এ নিঃশব্দ দাহ
নিঃসহ নৈরাশ্যতাপ। চাহো নাথ, চাহো
জননী যেমন চাহে সজল নয়ানে
পিতার ক্রোধের দিনে সন্তানের পানে
PAGE-5
আমি সুদূর-পানে চেয়ে চেয়ে ভাবি আপন-মনে।
হেথা তৃণে আসন মেলে-
তুমি হঠাৎ কখন আসবে হেথায় বিপুল আয়োজনে
তোমার রথের পরে সোনার ধ্বজা বালবে ঝলমল,
তোমার সকল আলো জ্বেলে।
সাথে বাজবে বাঁশির তান—
তোমার প্রতাপ-ভরে বসুন্ধরা করবে টলমল,
আমার উঠবে নেচে প্রাণ।
তখন পথের লোকে অবাক হয়ে সবাই চেয়ে রবে,
তুমি নেমে আসবে পথে;
হেসে দু হাত ধরে ধুলা হতে আমায় তুলে লবে -
তুমি লবে তোমার রথে।
আমার ভূষণবিহীন মলিন বেশে ভিখারিনীর সাজে
তোমার দাঁড়াব বাম পাশে,
তখন লতার মতো কাঁপর আমি গর্বে সুখে লাজে
সকল বিশ্বের সকাশে।
ওগো, সময় বয়ে যাচ্ছে চলে, রয়েছি কান পেতে
কোথা কই গো চাকার ধ্বনি।
তোমার এ পথ দিয়ে কত-না লোক গর্বে গেল মেতে
কতই জাগিয়ে রमরনি।
তবে তুমিই কি গো নীরব হয়ে রবে ছায়ার তলে,
তুমি রবে সবার শেষে-
হেথায় ভিখারিনীর লজ্জা কি গো ঝরবে নয়নজলে।
তারে রাখবে মলিন বেশে?
কথা ছিল এক-তরীতে কেবল তুমি আমি
যার অকারণে ভেসে কেবল ভেসে,
ত্রিভুবনে জানবে না কেউ আমরা তীর্থগামী
কোথায় যেতেছি কোন্ দেশে সে কোন্ দেশে।
কূলহারা সেই সমুদ্র-মাঝখানে
শোনার গান একলা তোমার কানে,
ঢেউয়ের মতন ভাষা-বাঁধন-হারা সেই রাগিণী শুনবে নীরব হেসে।
আমার line
আজো সময় হয় নি কি তার, কাজ কি আছে বাকি?
ওগো ওই-যে সন্ধ্যা নামে সাগরতীরে।
মলিন আলোয় পাখা মেলে সিন্ধুপারের পাখি আপন কুলায়-মাঝে সবাই এল ফিরে।
কখন তুমি আসবে ঘাটের 'পরে
বাঁধনটুকু কেটে দেবার তরে।
অস্তরবির শেষ আলোটির মতো
তরী নিশীথমাঝে যাবে নিরুদ্দেশে।
তখন করি নি, নাথ, কোনো আয়োজন:
বিশ্বের সবার সাথে, হে বিশ্বরাজন
অজ্ঞাতে আসিতে হাসি আমার অন্তরে।
কত শুভদিনে; কত মুহূর্তের পরে
অসীমের চিহ্ন লিখে গেছ! লই তুলি
তোমার স্বাক্ষর-আঁকা সেই ক্ষণগুলি।
দেখি তারা স্মৃতি-মাঝে আছিল ছড়ায়ে
কত-না ধূলির সাথে, আছিল জড়ায়ে।
ক্ষণিকের কত তুচ্ছ সুখদুঃখ ঘিরে।
হে নাথ, অবজ্ঞা করি যাও নাই ফিরে
আমার সে ধুলাস্তূপ খেলাঘর দেখে!
খেলা-মাঝে শুনিতে পেয়েছি থেকে থেকে
যে চরণধ্বনি আজ শুনি তাই বাজে
জগৎসংগীত-সাথে চন্দ্রসূর্য-মাঝে।
page 9
তোরা শুনিস নি কি শুনিস নি তার পায়ের ধ্বনি,
ওই যে আসে, আসে, আসে।
যুগে যুগে পলে পলে দিনরজনী। আপন-মনে খ্যাপার মতো
সে যে আসে, আসে, আসে।
গেয়েছি গান যখন যত
সকল সুরে বেজেছে তার
আগমনী
সে যে আসে, আসে, আসে।
কত কালের ফাল্গুন-দিনে বনের পথে
সে যে আসে, আসে, আসে ।
কত শ্রাবণ-অন্ধকারে মেঘের রথে
সে যে আসে, আসে, আসে।
দুখের পরে পরম দুখে
তারি চরণ বাজে বুকে,
সুখে কখন বুলিয়ে সে দেয়
পরশমণি।
সে যে আসে, আসে, আসে।