shabd-logo

ঊনিশতম অধ্যায়

2 November 2023

0 Viewed 0

সকালবেলায় গোরা কাজ করিতেছিল। বিনয় খামকা আসিয়া অত্যন্ত খাপছাড়াভাবে কহিল, "সেদিন পরেশবাবুর মেয়েদের নিয়ে আমি সার্কাস দেখতে গিয়েছিলুম।"


গোরা লিখিতে লিখিতেই বলিল, “শুনেছি।”


বিনয় বিস্মিত হইয়া কহিল, “তুমি কার কাছে শুনলে ?”


গোরা। অবিনাশের কাছে। সেও সেদিন সার্কাস দেখতে গিয়েছিল।


গোরা আর কিছু না বলিয়া লিখিতে লাগিল। গোরা এ খবরটা আগেই শুনিয়াছে, সেও আবার অবিনাশের কাছ হইতে শুনিয়াছে, সুতরাং তাহাতে বর্ণনা ও ব্যাখ্যার কোনো অভাব ঘটে নাই ইহাতে তাহার চিরসংস্কারবশত বিনয় মনের মধ্যে ভারি একটা সংকোচ বোধ করিল। সার্কাসে যাওয়া এবং এ কথাটা এমন করিয়া লোকসমাজে না উঠিলেই সে খুশি হইত।


এমন সময়ে তাহার মনে পড়িয়া গেল কাল অনেক রাত্রি পর্যন্ত না ঘুমাইয়া সে মনে মনে ললিতার সঙ্গে ঝগড়া করিয়াছে। ললিতা মনে করে সে গোরাকে ভয় করে এবং ছোটো ছেলে যেমন করিয়া মাস্টারকে মানে তেমনি করিয়াই সে গোরাকে মানিয়া চলে। এমন অন্যায় করিয়াও মানুষকে মানুষ ভুল বুঝিতে পারে! গোরা বিনয় যে একাত্ম : অসামান্যতাগুণে গোরার উপরে তাহার একটা ভক্তি আছে বটে, কিন্তু তাই বলিয়া ললিতা যে-রকমটা মনে করিয়াছে সেটা গোরার প্রতিও অন্যায় বিনয়ের


প্রতিও অন্যায়। বিনয় নাবালক নয় এবং গোরাও নাবলকের আছি নহে। গোৱা নিঃশব্দে লিখিয়া যাইতে লাগিল, আর ললিতার মুখের সেই তীক্ষ্ম শুটি দুই-তিন প্রশ্ন বার বার বিনয়ের মনে পড়িল। বিনয় তাহাকে সহজে বরফান্ত করিতে পারিল না।


দেখিতে দেখিতে বিনয়ের মনে একটা বিদ্রোহ মাথা তুলিয়া উঠিল। সার্কাস দেখিতে গিয়াছি তো কী হইয়াছে! অবিনাশ কে, যে, সে সেই কথা লইয়া গোরার সঙ্গে আলোচনা করিতে আসে--এবং গোরাই বা কেন আমার গতিবিধি সম্বন্ধে সেই অকালকু স্মাণ্ডের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দেয়। আমি কি গোরার নজরবন্দী! কাহার সঙ্গে মিশিব, কোথায় যাইব, গোরার কাছে তাহার জবাবদিহি করিতে হইবে ! বন্ধুত্বের প্রতি এ যে বিষম উপদ্রব ।


গোরা ও অবিনাশের উপর বিনয়ের এত রাগ হইত না যদি সে নিজের ভীরুতাকে নিজের মধ্যে সহসা স্পষ্ট করিয়া উপলব্ধি না করিত। গোরার কাছে যে সে কোনো কথা ক্ষণকালের জন্যও ঢাকাঢাকি করিতে বাধ্য হইয়াছে সেজন্য সে আজ মনে মনে যেন গোরাকেই অপরাধী করিতে চেষ্টা করিতেছে। সার্কাসে যাওয়া লইয়া গোরা যদি বিনয়ের সঙ্গে দুটো ঝগড়ার কথা বলিত তাহা হইলেও সেটাতে বন্ধুত্বের সাম্য রক্ষিত হইত এবং বিনয় সান্ত্বনা পাইত--কিন্তু গোরা যে গভীর হইয়া মক্ত বিচারক সাজিয়া মৌনর দ্বারা বিনয়কে অবজ্ঞা করিবে ইহাতে ললিতার কথার কাঁটা তাহাকে পুনঃপুনঃ বিধিতে লাগিল। এই সময় মহিম হুঁকা হাতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। ডিবা হইতে ভিজা ন্যাকডার আবরণ


তুলিয়া একটা পান বিনয়ের হাতে দিয়া কহিলেন, "বাবা বিনয়, এ দিকে তো সমস্ত ঠিক--এখন  তোমার হুড়োমশায়ের কাছ থেকে একখানা চিঠি পেলেই যে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। তাঁকে তুমি চিঠি লিখেছ তো ?”


এই বিবাহের তাগিদ আজ বিনয়কে অত্যন্ত খারাপ লাগিল, অথচ সে জানিত মহিমের কোনো দোষ নাই--তাঁহাকে কথা দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু এই কথা দেওয়ার মধ্যে সে একটা দীনতা অনুভব করিল। আনন্দময়ী তো তাহাকে একপ্রকার বারণ করিয়াছিলেন তাহার নিজেরও তো এ বিবাহের প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিল না--তবে গোলেমালে ক্ষণকালের মধ্যেই এ কথাটা পাকিয়া উঠিল কী করিয়া ? গোরা যে ঠিক তাড়া লাগাইয়াছিল তাহা তো বলা যায় না। বিনয় যদি একটু মনের সঙ্গে আপত্তি করিত তাহা হইলেও যে গোরা পীড়াপীড়ি করিত তাহা নহে। কিন্তু তবু সেই তৰুটুকুর উপরেই ললিতার খোঁচা আসিয়া বিধিতে লাগিল। সেদিনকার কোনো বিশেষ ঘটনা নহে, কিন্তু অনেক দিনের প্রভুত্ব ইহার পশ্চাতে আছে। বিনয় নিতান্তই কেবল ভালোবাসিয়া এবং একান্ত ভালোমানুষি-বশত গোৱার আধিপতা অনায়াসে সহ্য করিতে অভ্যস্ত হইয়াছে। সেইজন্যেই এই প্রভুত্বের সম্বন্ধই বন্ধুত্বের মাথার উপর চড়িয়া


বসিয়াছে। এতদিন বিনয় ইহা অনুভব করে নাই, কিন্তু আর তো ইহাকে অস্বীকার করিয়া চলে না। তবে শশিমুখীকে কি বিবাহ করিতেই হইবে ?


বিনয় কহিল, "না, খুড়োমশায়কে এখনো চিঠি লেখা হয় নি।


মহিম কহিলেন, “ওটা আমারই ভুল হয়েছে। এ চিঠি তো তোমার লেখবার কথা নয়--ও আমিই


লিখব। তাঁর পুরো নামটা কী বলো তো বাবা।"


বিনয় কহিল, “আপনি বাস্ত হচ্ছেন কেন ? আশ্বিন-কার্তিকে তো বিবাহ হতেই পারবে না। এক অঘ্রান মাস--কিন্তু তাতেও গোল আছে। আমাদের পরিবারের ইতিহাসে বহুপূর্বে অঘ্রান মাসে করে কার


কী দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেই অবধি আমাদের বংশে অপ্রানে বিবাহ প্রভৃতি সমস্ত শুভকর্ম বন্ধ আছে।”


মহিম হুঁকোটা ঘরের কোণের দেয়ালে ঠেস দিয়া রাখিয়া কহিলেন, “বিনয়, তোমরা যদি এ-সমস্ত মানবে তবে লেখাপড়া শেখাটা কি কেবল পড়া মুখস্থ করে মরা ? একে তো পোড়া দেশে শুভদিন খুঁজেই পাওয়া যায় না, তার পরে আবার ঘরে ঘরে প্রাইভেট পাঁজি খুলে বসলে কাজকর্ম চলবে কী করে ?"


বিনয় কহিল, "আপনি ভাদ্র-আশ্বিন মাসই বা মানেন কেন?”


মহিম কহিলেন, “আমি মানি বুঝি কোনোকালেই না। কী করব বাবা--এ মুলুকে ভগবানকে না মানলেও বেশ চলে যায়, কিন্তু ভাদ্র-আশ্বিন বৃহস্পতি-শনি তিথি-- -নক্ষত্র না মানলে যে কোনোমতে ঘরে টিকতে দেয় না। আবার তাও বলি--মানি নে বলছি বটে, কিন্তু কাজ করবার বেলা দিন-ক্ষণের অন্যথা হলেই মনটা অপ্রসন্ন হয়ে ওঠে-- দেশের হাওয়ায় যেমন ম্যালেরিয়া হয় তেমনি ভয়ও হয়, ওটা কাটিয়ে উঠতে পারলুম না।


বিনয়। আমাদের বংশে অড্রানের ভয়টাও কাটবে না। অন্তত খুড়িমা কিছুতেই রাজি হবেন না। এমনি করিয়া সেদিনকার মতো বিনয় কোনোমতে কথাটা চাপা দিয়া রাখিল।


বিনয়ের কথার সুর শুনিয়া গোরা বুঝিল, বিনয়ের মনে একটা দ্বিধা উপস্থিত হইয়াছে। কিছুদিন হইতে বিনয়ের দেখাই পাওয়া যাইতেছিল না। গোরা বুঝিয়াছিল বিনয় পরেশবাবুর বাড়ি পূর্বের চেয়েও আরো ঘন ঘন যাতায়াত আরম্ভ করিয়াছে। তাহার পরে আজ এই বিবাহের প্রস্তাবে পাশ কাটাইবার চেষ্টায় গোরার মনে খটকা বাধিল।

সাপ যেমন কাহাকেও গিলিতে আরম্ভ করিলে তাহাকে কোনোমতেই ছাড়িতে পারে না। গোৱা তেমনি তাহার কোনো সংকল ছাড়িয়া দিতে বা তাহার একটু-আধটু বাদ দিতে একেবারে অক্ষ বলিলেই হয়। অপর পক্ষ হইতে কোনো বাধা অথবা শৈথিলা উপস্থিত হইলে তাহার জেদ আরো চড়িয়া উঠিতে থাকে। বিধাগ্রস্ত বিনয়কে সবলে ধরিয়া রাখিবার জন্য গোরার সমস্ত অন্তঃকরণ উদ্যত হইয়া উঠিল।


গোরা তাহার লেখা ছাড়িয়া মুখ তুলিয়া কহিল, "বিনয়, একবার যখন তুমি দাদাকে কথা দিয়েছ


তখন কেন ওঁকে অনিশ্চিতের মধ্যে রেখে মিথ্যে কষ্ট দিচ্ছে ?


বিনয় হঠাৎ অসহিষ্ণু হইয়া বলিয়া উঠিল, “আমি কথা দিয়েছি--না তাড়াতাড়ি আমার কাছ থেকে কথা কেড়ে নেওয়া হয়েছে ?


গোরা বিনয়ের এই অকস্মাৎ বিদ্রোহের লক্ষণ দেখিয়া বিস্মিত এবং কঠিন হইয়া উঠিয়া কহিল,


কথা কে কেড়ে নিয়েছিল ? “


বিনয় কহিল, "তুমি


গোৱা। আমি তোমার সঙ্গে এ সম্বন্ধে আমার পাঁচ-সাতটার বেশি কথাই হয় নি তাকে বলে কথা কেড়ে নেওয়া!


বস্তুত বিনয়ের পক্ষে স্পষ্ট প্রমাণ কিছুই ছিল না--গোৱা যাহা বলিতেছে তাহা সত্য কথা অল্পই হইয়াছিল এবং তাহার মধ্যে এমন কিছু বেশি তাগিদ ছিল না যাহাকে পীড়াপীড়ি বলা চলে--তবুও এ কথা সত্য, গোরাই বিনয়ের কাছ হইতে তাহার সম্মতি যেন লুঠ করিয়া লইয়াছিল। যে কথার বাহা প্রমাণ অল্প সেই অভিযোগ সম্বন্ধে মানুষের ক্ষোভও কিছু বেশি হইয়া থাকে। তাই বিনয় কিছু অসংগত


রাগের সুরে বলিল, "কেড়ে নিতে বেশি কথার দরকার করে না।"


গোরা টেবিল ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “নাও, তোমার কথা ফিরিয়ে দাও। তোমার কাছ থেকে ভিক্ষে করেই নেব না দস্যুবৃত্তি করেই নেব এতবড়ো মহামূল্য কথা এটা নয় ।"


পাশের ঘরেই মহিম ছিলেন--গোৱা বস্তুস্বরে তাঁহাকে ডাকিল, “দাদা!”


মহিম শশব্যস্ত হইয়া ঘরে আসিতেই গোৱা কহিল, “দাদা, আমি তোমাকে গোড়াতেই বলি নি যে


শশিমুখীর সঙ্গে বিনয়ের বিবাহ হতে পারে না আমার তাতে মত নেই।”


মহিম। নিশ্চয় বলেছিলে। তুমি ছাড়া এমন কথা আর কেউ বলতে পারত না। অন্য কোনো ভাই হলে ভাইঝির বিবাহপ্রস্তাবে প্রথম থেকেই উৎসাহ প্রকাশ করত।


গোরা। তুমি কেন আমাকে দিয়ে বিনয়ের কাছে অনুরোধ করালে ? মহিম। মনে করেছিলুম তাতে কাজ পাওয়া যাবে, আর কোনো কারণ নেই।


গোরা মুখ লাল করিয়া বলিল, "আমি এ-সবের মধ্যে নেই। বিবাহের ঘটকালি করা আমার ব্যবসায় না, আমার অন্য কাজ আছে ।"


এই বলিয়া গোৱা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। হতবুদ্ধি মহিম বিনয়কে এ সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করিবার পূর্বেই সেও একেবারে রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। মহিম দেওয়ালের কোণ হইতে হুঁকাটা তুলিয়া লইয়া চুপ করিয়া বসিয়া টান দিতে লাগিলেন।


গোরার সঙ্গে বিনয়ের ইতিপূর্বে অনেক দিন অনেক ঝগড়া হইয়া গিয়াছে, কিন্তু এমন আকস্মিক প্রচণ্ড অগ্ন্যুৎপাতের মতো ব্যাপার আর কখনো হয় নাই। বিনয় নিজের কৃত কর্মে প্রথমটা স্তম্ভিত হইয়া গেল। তাহার পরে বাড়ি গিয়া তাহার বুকের মধ্যে শেল বিধিতে লাগিল। এই ক্ষণকালের মধ্যেই গোরাকে সে যে কত বড়ো একটা আঘাত দিয়াছে তাহা মনে করিয়া তাহার আহারে বিশ্রামে রুচি রহিল


না। বিশেষত এ ঘটনায় গোরাকে দোষী করা যে নিতান্তই অদ্ভুত ও অসংগত হইয়াছে ইহাই তাহাকে


দগ্ধ করিতে লাগিল; সে বার বার বলিল, "অন্যায়, অন্যায়, অন্য "


বেলা দুইটার সময় আনন্দময়ী সবে যখন আহার সারিয়া সেলাই লইয়া বসিয়াছেন এমন সময় বিনয় আসিয়া তাঁহার কাছে বসিল। আজ সকালবেলাকার কতকটা খবর তিনি মহিমের কাছ হইতে


পাইয়াছিলেন। আহারের সময় গোরার মুখ দেখিয়াও তিনি বুঝিয়াছিলেন, একটা ঝড় হইয়া গেছে। বিনয় আসিয়াই কহিল, 'মা, আমি অন্যায় করেছি। শশিমুখীর সঙ্গে বিবাহের কথা নিয়ে আমি আজ সকালে গোরাকে যা বলেছি তার কোনো মানে নেই।"


আনন্দময়ী কহিলেন, "তা হোক বিনয় মনের মধ্যে কোনো একটা ব্যথা চাপতে গেলে ঐরকম করেই বেরিয়ে পড়ে। ও ভালোই হয়েছে। এ ঝগড়ার কথা দুদিন পরে তুমিও ভুলবে, গোরাও ভুলে যাবে।"


বিনয়। কিন্তু, মা, শশিমুখীর সঙ্গে আমার বিবাহে কোনো আপত্তি নেই, নেই কথা আমি তোমাকে জানাতে এসেছি।


আনন্দময়ী। বাছা, তাড়াতাড়ি ঝগড়া মেটাবার চেষ্টা করতে গিয়ে আবার একটা ঝঞ্ঝাটে পোড়ো না।


বিবাহটা চিরকালের জিনিস, ঝগড়া দুদিনের।


বিনয় কোনোমতেই শুনিল না। সে এ প্রস্তাব লইয়া এখনই গোরার কাছে যাইতে পারিল না। মহিমকে গিয়া জানাইল-- বিবাহের প্রস্তাবে কোনো বিঘ্ন নাই--মাঘ মাসেই কার্য সম্পন্ন হইবে-- খুড়ামহাশয়ের যাহাতে কোনো অমত না হয় সে ভার বিনয় নিজেই লইবে।


মহিম কহিলেন, "পানপটা হয়ে থাক না


বিনয় কহিল, “তা বেশ, সেটা গোরার সঙ্গে পরামর্শ করে করবেন।"


মহিম ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, আবার গোরার সঙ্গে পরামর্শ!"


বিনয় কহিল, "না, তা না হলে চলবে না।


মহিম কহিলেন, “না যদি চলে তা হলে তো কথাই নেই--কিন্তু-"


বলিয়া একটা পান লইয়া মুখে পুরিলেন।

30
Articles
গোড়া
0.0
গোরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উপন্যাস। এটি ১৮৮০-এর দশকে ব্রিটিশ রাজত্বকালের সময়কার কলকাতার পটভূমিতে লেখা। এটি লেখার ক্রমে পঞ্চম এবং রবীন্দ্রনাথের তেরোটি উপন্যাসের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘতম।[১] এটি রাজনীতি এবং ধর্ম নিয়ে দার্শনিক বিতর্কে সমৃদ্ধ উপন্যাস। উপন্যাসে মুক্তি, সর্বজনীনতা, ভ্রাতৃত্ব, লিঙ্গ, নারীবাদ, বর্ণ, শ্রেণি, ঐতিহ্য বনাম আধুনিকতা, নগর অভিজাত বনাম গ্রামীণ কৃষক, ঔপনিবেশিক শাসন, জাতীয়তাবাদ এবং ব্রাহ্মসমাজ নিয়ে লেখা রয়েছে। গোরা উপন্যাস দুই প্রেমিক জুটির দুটি সমান্তরাল প্রেমের গল্প নিয়ে গঠিত: গোরা এবং সুচরিতা, বিনয় এবং ললিতা। এতে উনিশ শতকের শেষদিকে ভারতে প্রচলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার পটভূমিতে তাদের আবেগপূর্ণ ক্রমবিকাশ দেখানো হয়েছে
1

প্রথম অধ্যায়

30 October 2023
0
0
0

শ্রাবণ মাসের সকালবেলায় মেঘ কাটিয়া গিয়া নির্মল রৌদ্রে কলিকাতার আকাশ ভরিয়া গিয়াছে। রাস্তায় গাড়িঘোড়ার বিরাম নাই, ফেরিওয়ালা অবিশ্রাম হাঁকিয়া চলিয়াছে, যাহারা আপিসে কালেঞ্জে আদালতে যাইবে তাহাদের

2

দ্বিতীয় অধ্যায়

30 October 2023
1
0
0

বর্ষার সন্ধ্যায় আকাশের অন্ধকার যেন ভিজিয়া ভারী হইয়া পড়িয়াছে। বর্ণহীন বৈচিত্র্যহীন মেঘের নিঃশব্দ শাসনের নীচে কলিকাতা শহর একটা প্রকাণ্ড নিরানন্দ কুকুরের মতো লেজের মধ্যে মুখ গুজিয়া কুণ্ডলী পাকাইয়া

3

তৃতীয় অধ্যায়

30 October 2023
0
0
0

গোৱা ও বিনয় হাত হইতে নামিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছে এমন সময় গোরার মা উপরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বিনয় তাঁহার পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল। গোরার মা আনন্দময়ীকে দেখিলে গোরার মা বলিয়া মনে হয় না।

4

চতুর্থ অধ্যায়

30 October 2023
0
0
0

মত হিসাবে একটা কথা যেমনতরো শুনিতে হয়, মানুষের উপর প্রয়োগ করিবার বেলায় সকল সময় তাহার সেই একান্ত নিশ্চিত ভাবটা থাকে না-- অন্তত বিনয়ের কাছে থাকে না, বিনয়ের হৃদয়বৃত্তি অত্যন্ত প্রবল। ভাই তর্কের সময

5

পঁচম অধ্যায়

31 October 2023
0
0
0

“ওগো, শুনছ? আমি তোমার পূজোর ঘরে ঢুকছি নে, ভয় নেই। আহ্নিক শেষ হলে একবার ও ঘরে যেয়ো-- তোমার সঙ্গে কথা আছে। দুজন নৃতন সন্ন্যাসী যখন এসেছে তখন কিছুকাল তোমার আর দেখা পাব না জানি, সেইজন্যে বলতে এলুম। ভুলো

6

ষষ্ঠ অধ্যায়

31 October 2023
0
0
0

আজ আহ্নিক ও স্নানাহার সারিয়া কৃষ্ণদয়াল অনেক দিন পরে আনন্দময়ীর ঘরের মেজের উপর নিজের কম্বলের আসনটি পাতিয়া সাবধানে চারি দিকের সমস্ত সংস্রব হইতে যেন বিবিক্ত হইয়া খাড়া হইয়া বসিলেন। আনন্দময়ী কহিল

7

সাতম অধ্যায়

31 October 2023
0
0
0

ভোরে উঠিয়া বিনয় দেখিল রাত্রির মধ্যেই আকাশ পরিষ্কার হইয়া গেছে। সকাল-বেলাকার আলোটি দুধের ছেলের হাসির মতো নির্মল হইয়া ফুটিয়াছে। দুই-একটা সাদা মেঘ নিতান্তই বিনা প্রয়োজনে আকাশে ভাসিয়া বেড়াইতেছে।

8

আঠম অধ্যায়

31 October 2023
0
0
0

এই একটা বাঁধ ভাঙিয়া যাইতেই বিনয়ের হৃদয়ের নূতন বন্যা আরো যেন উদ্দাম হইয়া উঠিল। আনন্দময়ীর ঘর হইতে বাহির হইয়া রাস্তা দিয়া সে যেন একেবারে উড়িয়া চলিল : মাটির স্পর্শে তাহার যেন পায়ে ঠেকিল না ; তাহ

9

নবম অধ্যায়

31 October 2023
0
0
0

উপরে গাড়িবারান্দায় একটা টেবিলে শুভ্র কাপড় পাতা, টেবিল ঘেরিয়া চৌকি সাজানো। রেলিঙের বাহিরে কার্নিসের উপরে ছোটো ছোটো টবে পাতাবাহার এবং ফুলের গাছ। বারান্দার উপর হইতে রাস্তার ধারের শিরীয় ও কৃষ্ণচূড়া

10

দশম অধ্যায়

31 October 2023
0
0
0

খুঞ্চের উপর জলখাবার ও চায়ের সরঞ্জাম সাজাইয়া চাকরের হাতে দিয়া সুচরিতা হাতে আসিয়া বসিল এবং সেই মুহূর্তে বেহারার সঙ্গে গোরাও আসিয়া প্রবেশ করিল। সুদীর্ঘ শুকায় গোরার আকৃতি আয়তন ও সাজ দেখিয়া সকলেই ব

11

একাদশ অধ্যায়

31 October 2023
0
0
0

সেদিন তর্কে গোরাকে অপদস্থ করিয়া সুচরিতার সম্মুখে নিজের জয়পতাকা তুলিয়া ধরিবার জনা হারানের বিশেষ ইচ্ছা ছিল, গোড়ায় সুচরিতাও তাহার আশা করিয়াছিল। কিন্তু দৈবক্রমে ঠিক তার বিপরীত ঘটিল। ধর্ম বিশ্বাস ও স

12

দ্বাদশ অধ্যায়

31 October 2023
0
0
0

বিনয় ও গোরা পরেশের বাড়ি হইতে রাস্তায় বাহির হইলে বিনয় কহিল, "গোরা, একটু আস্তে আস্তে চলো ভাই-- তোমার পা দুটো আমাদের চেয়ে অনেক বড়ো-- ওর চালটা একটু খাটো না করলে তোমার সঙ্গে যেতে আমরা হাঁপিয়ে পড়ি ।

13

তেরো অধ্যায়

1 November 2023
1
0
0

মধ্যাহ্নে গোরার কাছে যাইবার জন্য বিনয়ের মন আবার চঞ্চল হইয়া উঠিল। বিনয় গোরার কাছে নিজেকে নত করিতে কোনোদিন সংকোচ বোধ করে নাই। কিন্তু নিজের অভিমান না থাকিলেও বন্ধুত্বের অভিমানকে ঠেকানো শক্ত। পরেশবাবুর

14

চোদ্দশ অধ্যায়

1 November 2023
0
0
0

গোরা যখন মধ্যাহ্নে যাইতে বসিল, আনন্দময়ী আস্তে আস্তে কথা পাড়িলেন, “আজ সকালে বিনয় এসেছিল। তোমার সঙ্গে দেখা হয় নি? গোরা খাবার খালা হইতে মুখ না তুলিয়া কহিল, "হাঁ, হয়েছিল।" আনন্দময়ী অনেকক্ষণ চ

15

পনের তেম অধ্যায়

1 November 2023
0
0
0

রাত্রে গোরা বাড়িতে ফিরিয়া আসিয়া অন্ধকার হাতের উপর বেড়াইতে লাগিল । তাহার নিজের উপর রাগ হইল। রবিবারটা কেন সে এমন বৃথা কাটিতে দিল। ব্যক্তিবিশেষের প্রণয় লইয়া অন্য সমস্ত কাজ নষ্ট করিবার জন্য তো গো

16

ষোড়শ অধ্যায়

1 November 2023
0
0
0

বরদাসুন্দী কহিলেন, “তুমি সুচরিতার বিয়ে দেবে না নাকি ?” পরেশবাবু তাঁহার স্বাভাবিক শান্ত গম্ভীর ভাবে কিছুক্ষণ পাকা দাড়িতে হাত বুলাইলেন -- তার পর মৃদুস্বরে কহিলেন, “পাত্র কোথায় ?” বরদাসুন্দরী কহ

17

সতের্দশ অধ্যায়

1 November 2023
1
0
0

ঘন্টা দুই-তিন নিদ্রার পর যখন গোরা ঘুম ভাঙিয়া পাশে চাহিয়া দেখিল বিনয় ঘুমাইতেছে তখন তাহার হৃদয় আনন্দে ভরিয়া উঠিল। স্বপ্নে একটা প্রিয় জিনিস হারাইয়া জাগিয়া উঠিয়া যখন দেখা যায় তাহা হারায় নাই

18

আঠারো অধ্যায়

2 November 2023
0
0
0

বিনয় আনন্দময়ীর কথা কয়টি ভাবিতে ভাবিতে বাসায় গেল। আনন্দময়ীর মুখের একটি কথাও এপর্যন্ত বিনয়ের কাছে কোনোদিন উপেক্ষিত হয় নাই। সে রাত্রে তাহার মনের মধ্যে একটা ভার চাপিয়া রহিল। পরদিন সকালে উঠিয়া

19

ঊনিশতম অধ্যায়

2 November 2023
0
0
0

সকালবেলায় গোরা কাজ করিতেছিল। বিনয় খামকা আসিয়া অত্যন্ত খাপছাড়াভাবে কহিল, "সেদিন পরেশবাবুর মেয়েদের নিয়ে আমি সার্কাস দেখতে গিয়েছিলুম।" গোরা লিখিতে লিখিতেই বলিল, “শুনেছি।” বিনয় বিস্মিত হইয়া

20

বিশেষ অধ্যায়

2 November 2023
0
0
0

মহিম সেদিন গোৱাকে কিছু না বলিয়া তাহার পরের দিন তাহার ঘরে গেলেন। তিনি মনে করিয়াছিলেন গোরাকে পুনর্বার রাজি করাইতে বিস্তর লড়ালড়ি করিতে হইবে। কিন্তু তিনি যেই আসিয় বলিলেন যে বিনয় কাল বিকালে আসিয়া বি

21

একুশ অষ্টম অধ্যায়

2 November 2023
0
0
0

গোরা তাহার স্বাভাবিক দ্রুতগতি পরিত্যাগ করিয়া অন্যমনস্কভাবে ধীরে ধীরে বাড়ি চলিল। বাড়ি যাইবার সহজ পথ ছাড়িয়া সে অনেকটা ঘুরিয়া গঙ্গার ধারের রাস্তা ধরিল। তখন কলিকাতার গঙ্গা ও গঙ্গার ধার বণিক-সভ্যতার

22

বিশতম অধ্যায়

3 November 2023
2
0
0

গোলাপ ফুলের একটু ইতিহাস আছে। কাল রাত্রে গোৱা তো পরেশবাবুর বাড়ি হইতে চলিয়া আসিল, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে সেই অভিনয়ে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব ল‍ইয়া বিনয়কে বিস্তর কষ্ট পাইতে হইয়াছিল। এই অভ

23

ত্রয়বিংশ অধ্যায়

3 November 2023
0
0
0

অভিনয়ের অভ্যাস উপলক্ষে বিনয় প্রত্যহই আসে। সূচরিতা তাহার দিকে একবার চাহিয়া দেখে, তাহার পরে হাতের বইটার দিকে মন দেয় অথবা নিজের ঘরে চলিয়া যায়। বিনয়ের একলা আসার অসম্পূর্ণতা প্রত্যহই তাহাকে আঘাত করে

24

চব্বিশতম অধ্যায়

3 November 2023
0
0
0

এইরূপ স্থির হইয়াছিল যে, ইংরেজ কবি ড্রাইডেনের রচিত সংগীত-বিষয়ক একটি কবিতা বিনয় ভাবব্যক্তির সহিত আবৃত্তি করিয়া যাইবে এবং মেয়েরা অভিনয়মঞ্চে উপযুক্ত সাজে সজ্জিত হইয়া কাব্যলিখিত ব্যাপারের মূক অভিনয়

25

পঁচিশ অধ্যায়

3 November 2023
0
0
0

রবিবার দিন সকালে আনন্দময়ী পান সাজিতেছিলেন, শশিমুখী তাহার পাশে বসিয়া সুপারি কাটিয়া স্তূপাকার করিতেছিল। এমন সময় বিনয় আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিতেই শশিমুখী তাহার কোলের আঁচল হইতে সুপারি ফেলিয়া দিয়া তাড়

26

ছাব্বিশ অধ্যায়

3 November 2023
0
0
0

গোরা যখন ভ্রমণে বাহির হইল তখন তাহার সঙ্গে অবিনাশ মতিলাল বসন্ত এবং রমাপতি এই চারজন সঙ্গী ছিল। কিন্তু গোরার নির্ণয় উৎসাহের সঙ্গে তাহারা তাল রাখিতে পারিল না। অবিনাশ এবং বসন্ত অসুস্থ শরীরের ছুতা করিয়া চ

27

সতাশি তমো অধ্যায়

5 November 2023
0
0
0

ম্যাজিস্টেট ব্রাউনলো সাহেব দিবাবসানে নদীর ধারের রাস্তায় পদব্রজে বেড়াইতেছেন, সঙ্গে হারানবাবু রহিয়াছেন। কিছু দূরে গাড়িতে তাঁহার মেম পরেশবাবুর মেয়েদের লইয়া হাওয়া খাইতে বাহির হইয়াছেন। ব্রাউনলো স

28

আঠাশ তমো অধ্যায়

5 November 2023
0
0
0

কোনোপ্রকার অপরাধ বিচার না করিয়া কেবলমাত্র গ্রামকে শাসন করিবার জন্য সাতচল্লিশ জন আসামিকে হাজতে দেওয়া হইয়াছে। ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত সাক্ষাতের পর গোৱা উকিলের সন্ধানে বাহির হইল। কোনো লোকের কাছে খবর প

29

ঊনত্রিশ তমো অধ্যায়

5 November 2023
0
0
0

আজ ছোটোলটি আসিবেন বলিয়া ম্যাজিস্ট্রেট ঠিক সাড়ে দশটায় আদালতে আসিয়া বিচারকার্য সকাল সকাল শেষ করিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিলেন। সাতকড়িবাবু ইস্কুলের ছাত্রদের পক্ষ লইয়া সেই উপলক্ষে তাঁহার বন্ধুকে বাচাই

30

তিরিশ তমো অধ্যায়

5 November 2023
0
0
0

ললিতাকে সঙ্গে লইয়া বিনয় পরেশবাবুর বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল। ললিতার সম্বন্ধে বিনয়ের মনের ভাবটা কী তাহা স্টীমারে উঠিবার পূর্বে পর্যন্ত বিনয় নিশ্চিত জানিত না। ললিতার সঙ্গে বিরোধেই তাহার মন ব্যাপৃ

---