shabd-logo

নেপোর বই

16 December 2023

0 Viewed 0

এক

এটা কিন্তু সত্যিকার নেপোর বই নয়। আসন্ন বইটিকে নেপো নিয়ে চলে গিয়েছিল। পরে যখন পাওয়া গেল, দুমড়োনো, মুচড়ানো, আঁচড়ানো, কামড়ানো, খিমচোনো, কাদামাখা, কালো কালো থাবার দাগ লাগা, কোনো কাজেই লাগে না। কিচ্ছু পড়া যায় না, মাঝে মাঝে খোবলানো ছ্যাঁদা। ভাগ্যিস তাতে কিছু লেখা ছিল না, নইলে হয়েছিল আর কি। শুধু মলাটটাই ভালো ছিল আর তাই দিয়েই গুপি এই বালি কাগজের খাতাটাকে বাঁধিয়ে দিয়েছে। হলদে মলাট, তার ওপর বেগনি কালি দিয়ে লেখা 'নেপোর বই'। নইলে নেপো কিছু এমন সৎ বেড়াল নয় যে ওর নামে বইয়ের নাম রাখব। সৎ হলে আর ওর ল্যাজটা -সে যাক গে। মোট কথা ওজুদা বলেছিলেন বইয়ের নাম রাখতে পানুপুরাণ।

আমার নাম পানু, আমার বয়স বারো। সাত মাস আগে বাস থেকে পড়ে গিয়ে আমার শিরদাঁড়ার হাড় জখম হয়েছিল। সেই থেকে আমি হাঁটতে পারি না। তবে একটু একটু করে গায়ে জোর পাচ্ছি আর ডাক্তারবাবু বলেন আমি নাকি চেষ্টা করলেই হাঁটতে পারব, কিন্তু আসলে তা পারি না। আমার একটা দু-চাকাওয়ালা ছোট গাড়ি আছে, দাদু করিয়ে দিয়েছেন, তাতে করে আমি বাড়িময় ঘুরে বেড়াই। তাতে বসেই আমি আমাদের তিন তলার ফ্যাটের প্রত্যেকটি জানলা দিয়ে রাস্তা দেখি। তা যদি না দেখতাম তা হলে আর এ বই লিখবার দরকারই হত না। কিছু টের-ই পেতাম না ।

বেশির ভাগ সময় আমি নিজের ঘরে থাকি আর নিজের জানলা দিয়ে দেখি। আমার ঘরে দুটো জানলা। একটার নিচে, বাইরে কার্নিসের উপর লম্বা টিনের টবে বড় মাস্টার আমাকে গাছ-গাছলা করতে শিখিয়েছেন। অদ্ভুত চেহারার সব কাঁটা গাছ, কি সুন্দর ফুল ফোটে। অথচ রোদ লাগলেও মরে না, গরমের সময়ও শুকোয় না। রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে গুণে এক মগ জল দিতে হয়।

অন্য জানলার নিচে ভজুদার টব, তাতে ধনেপাতা, রসুন, কাঁচালঙ্কা, তোমাটো ফলাই। বড় মাস্টারের পোড়া বৌ-ও নাকি ওঁদের ছাদের কোণে জলের ট্যাঙ্কের পাশে গাছ গজায়, বেল, যুঁই, রজনীগন্ধা; কুমড়ো গাছে কুমড়ো হয়, মাটির হাঁড়ির তলা ফুটো করে তাতে পুঁই ডাঁটা হয়। বৌকে কেউ নাকি চোখে দেখে নি। তবে দূর থেকে জানলা দিয়ে ওর ঘোমটাপরা মাথা দেখতে পাই। আগে নাকি বৌ পরমাসুন্দরী ছিল, দূর থেকে লোকে তাকে দেখতে আসত। তারপর আধখানা মুখ পুড়ে কালি হলে পর আর কারো সামনে বেরোয় না। তাই নিয়ে বড় মাস্টার কত দুঃখ করেন। বলেন সংসারের সব-ই অসার।

বড় মাস্টার প্রত্যেক রবিবার বিকেলে আমাকে গল্প বলতে আসেন। ঐ সময় আমাদের বাড়ির সবাই বেড়াতে চলে যায়, খালি রামকানাই থাকে। সে আমাদের জন্যে চা আর মাছের কচুরি, মেটুলির ঘুগনি, এই সব করে দেয়। আটটার সময় বাড়ির লোকেরা ফিরে এলে, বড় মাস্টার বাড়ি যান।

পাশেই বাড়ি; আসলে ছাপাখানা। আমাদের বাড়ির গলি দিয়ে মাপলে আট ফুট তফাতে। একটা ঘোরানো লোহার সিঁড়ি ও-বাড়ির চারতলা থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে একতলা অবধি নেমে গেছে। সেটা থেকে মাপলে আরো কাছে। গুপি বলে আমাদের ঘোরানো সিড়ি থেকে রং মিস্ত্রিদের একটা তক্তা ফেলে ও নাকি ওদের ঘোরানো সিঁড়িতে গিয়ে উঠতে পারে। তবে বড় মাস্টার থাকেন পাঁচতলার উপরে ছাদের কোলে দুটো ঘরে, ঘোরানো সিঁড়ি অত দূর ওঠে না। বড় মাস্টার ছাপাখানার ভিতরের সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেন।

ঐখানে উনি প্রফ দেখেন, তাই ঘর পান। সন্ধ্যেবেলায় ছাপাখানার বড় সাহেবরা চলে গেলে, তাদের গাড়ির শেডে মাস্টারের নাইট স্কুল বসে, তার জন্যে সামান্য মাইনে পান। কষ্টেসৃষ্টে দিন চলে, বড় মাস্টার বলেছেন। অথচ এককালে কি বড়লোকামিটাই না করেছেন। শুনে কষ্ট হয়।

রবিবার ছাড়া রোজ সকালে ভজুদা এসে আমাকে তিন ঘন্টা পড়ান, আটটা থেকে এগারোটা। ক্লাসের বই নিয়ে ঠেসে পড়ান, ইংরিজী, অঙ্ক, বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল, হিন্দী, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান। কি না জানেন ভজুদা। ছবি দেওয়া মোটা মোটা বই এনে আশ্চর্য সব ছবি দেখান। মরুভূমির বালিতে চাপা পড়া হেলিওপোলিসের রাস্তার প্রাচীন কালের রথের চাকার দাগ, আরো কত কি!

ভজুদা খুব ভালো, কিন্তু বেজায় কড়া। আমি তো বাড়িতে বসেই বার্ষিক পরীক্ষা পাস করে উপরের ক্লাসে উঠেছি। এ বছর সাতজন নতুন নতুন ছেলে ভরতি হয়েছে আমাদের ক্লাসে। তাদের কাউকে অবিশ্যি এখনো দেখি নি, গুপির কাছে সব খবর পেয়েছি।

গুপি আমার বন্ধু। প্রত্যেক রবিবার আর ছুটির দিনে সে আমাকে দেখতে আসে। বড় মাস্টারের গল্প শোনে, অদ্ভুত সব গল্প। ওঁর সত্যিকার অভিজ্ঞতার কাহিনী। বর্মার গল্প; প্রশান্ত মহাসাগরে আশ্চর্য সব দ্বীপের গল্প, যার কথা কেউ জানে না। সমুদ্রে ঝড়ের গল্প, জাহাজডুবির গল্প, যুদ্ধের গল্প, ভয়ঙ্কর সব অগ্নিকান্ডের গল্প: উত্তরমেরু দক্ষিণমেরুর কথা। মেক্সিকো, ব্রেজিন, কোথায় যান নি বড় মাস্টার, ব্যবসার খাতিরে! তারপর বৌ পুড়ল, মাস্টারের বাঁ ঠ্যাং কাটা গেল, ঘোরাঘুরি ঘুচল। 'একদিন যে মানুষ লক্ষ লক্ষ টাকার কারবার করত, আজ সে সামান্য কটা টাকার জন্যে সরকারি ছাপাখানায় কপালে একজোড়া ম্যাগনিফাইং চশমা এটে প্রুফ দেখে আর সন্ধ্যেবেলা নাইট স্কুল চালায়।'

এই অবধি বলে-পা ঠুকে বড় মাস্টার হেসে বললেন, 'তাতে কোনো দুঃখ নেই, একটু সময় পেলেই নিজের জীবনের সত্যিকার অভিজ্ঞতাগুলো লিখে ফেলব। প্রকাশকরা দু পাতা পড়লেই লুফে নেবে। তখন আমার লাখপতি হওয়া ঠেকায় কে! তোকেও কিছু টাকা দেব।'

মাস্টারের বাঁ ঠ্যাং হাঁটুর নিচে থেকে কাটা। তার জায়গায় চামড়ার স্ট্র্যাপ আর বগলেস দিয়ে একটা কাঠের ঠ্যাং আঁটা। দেখতে অনেকটা টেবিলের পায়ার মতো। মাঝে মাঝে গল্প বলতে বলতে বেশি হাত পা ছুড়লে সেটা ফস করে বেরিয়ে আসে। অনেক কষ্টে আবার পরাতে হয়। আমরা সাহায্য করি, মাস্টার ঘেমে নেয়ে ওঠেন। নাকি বড্ড লাগে। অনেক দিন আগে নাকি প্রশান্ত মহাসাগরে বাকি পা'-টা হাঙ্গরে খেয়েছিল। অনেক কষ্টে দু মাইল সাঁতরে তবে প্রাণে বেঁচেছিলেন। তা-ও বাঁচতেন না। ভাগ্যক্রমে হঠাৎ শোঁ শোঁ করে সাইমন ঝড় উঠল, তিনতলার সমান ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল! প্রাণের ভয়ে শিকার ছেড়ে হাঙ্গর সমুদ্রের তলায় ডুব দিল। অবিশ্যি ঠ্যাংটা সঙ্গে নিতে ভুলল না। বড় মাস্টার খোলাম- কুচির মতো ঢেউয়ের সঙ্গে উঠতে পড়তে লাগলেন।

ভাগ্যিস একটা বড় তেল ট্যাঙ্কারের দয়ালু কাপ্তেন ঠিক সেই সময় তাঁকে দেখতে পেয়ে, পঞ্চাশ মণ তেল ঢেলে ঢেউ শান্ত করে, তাঁকে জাহাজে টেনে তুলেছিলেন, নইলে সে যাত্রা হয়ে গিয়েছিল আর কি! ঐ জাহাজেরি রান্নাঘরের একটা ভাঙা টেবিলের পায়া। স্মৃতিচিহ্নস্বরূপে মাস্টার ওটাকে এখনো রেখেছেন। এ ঠ্যাংটা আসলে নাবিকদের দয়ার নইলে ছাপাখানার বড় সাহেবের চিঠি নিয়ে গেলে সস্তায়, এমন কি হয়তো বিনি পয়সাতেই, কত ভালো ভালো ঠ্যাং কিনতে পাওয়া যায়, এলুমিনিয়মের কাঠামোর উপর রবার দিয়ে প্ল্যাস্টিক দিয়ে তৈরি। সত্যিকার পা থেকে দেখতে কোনো তফাৎ নেই। বরং ঢের ভালো, আলপিন ফুটলেও টের পাওয়া যায় না। 'তবে এই টেবিল-পায়ার ঠ্যাংটাই বা মন্দ কি? বন্ধুদের দান!'

এই বলে বড় মাস্টার আমার যন্ত্রপাতির বাক্স থেকে লম্বা একটা পেরেক নিয়ে কেঠো পায়ের গোড়ালির কাছে হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে নিলেন। নাকি বোলতায় গর্ত করেছিল। পরে মাস্টার কেঠো পায়ের গুলির কাছে ছোট একটা দেরাজ করে নেবেন তাতে পয়সাকড়ি রাখবেন, কাকপক্ষীও টের পাবে না। যা পকেটমারের দাপট আজকাল!

বড় মাস্টার চলে গেলে গুপি পকেট থেকে কাগজে মোড়া একটা মলাট- ছেঁড়া বই বের করল। বইটার নাম 'পুষ্পক থেকে প্লেন।' গুপির ছোটমামার বই। অনেক কষ্টে জোগাড় করা। আশ্চর্য সব বই আনে গুপি। মঙ্গলের মানুষ, বুধে বিপত্তি, চন্দ্রনাথের চন্দ্রযাত্রা, এই সব। একটা টাইমমেশিনের বই এনেছিল; ঐ মেশিনে চেপে অতীতে ভবিষ্যতে যে সময়ে ইচ্ছা যাওয়া আসা যায়। পড়ে গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। তাছাড়া

কলের মানুষের গল্প আনে, তাদের রোবো বলে। এই সবই আমাদের ভালো লাগে। আমরা বড় হয়ে প্রথমেই চাঁদে

যাব। গুপির ছোটমামা নাকি চাঁদে জমি কিনবেন। সেখানে ছোট একটা বাড়ি করবেন, তাতে মেশিনে রান্না হবে। তাহলে তো আমাদের সেখানে গিয়ে কোনো অসুবিধাই হবে না। খালি তার আগে আমার পা দুটোকে সারিয়ে নিতে হবে। এদিকে ছোটমামা বি-এস-সি পাস করেই মহাকাশযান বানাতে গিখবেন। এখন থেকেই তার জন্যে টিন, এলুমিনিয়ম, রবার, বল্টু, এই সব জমাচ্ছেন।

দুই

এর মধ্যে আবার গুপির জন্মদিন করা গেল। আর বড় মাস্টার মশাইকে নেমন্তন্ন করা হল। আমার ঘরে। ভজুদা সেদিন ছিল রবিবার, আমাদের বাড়ির সবাই বিকেলে চা খাবার পর অন্যান্য রবিবারের মতো দাদুর বাড়ি চলে গেল। খুব ভালো চা হয়েছিল। কোকা-কোলা, ছাঁচি পান, মাংসের সিঙ্গাড়া, আলু নারকেলের ঘুগনি, আইসক্রীম। গুপিদের বাড়িতে কারো জন্মদিন হয় না। গুপির দাদু বলেন জন্মদিন করলেই নাকি লোকেরা মারা যায়। অথচ ওরা কারো জন্মদিন করেন না, তবু ওদের পূর্বপুরুষেরা কেউ বেঁচে নেই। তার মানে জন্মদিন না করলেও লোকেরা মরে।

ভজুদার কাজকর্ম সেরে অনেক দেরি করে আসার কথা। প্রথমে গুপি এসেই 'চাঁদের যাত্রী' বলে দু-টাকা দামের একটা চমৎকার বই আমার হাতে দিল। আমি ঐ বইটা আর বালিশের তলা থেকে দুটো টাকা নিয়ে গুপিকে দিলাম। ওর জন্মদিনের উপহার। প্রথম পাতায় লিখে দিলাম, 'চাঁদের যাত্রীকে জন্মদিনে চাঁদের যাত্রী দিলাম, ইতি, চাঁদের যাত্রী।' বেশ হল না?

গুপির ঠাকুরদা এসব বইয়ের উপর হাড়ে চটা। তিনি এক সময় জাহাজে চাকরি করতেন। গুপি বলে পৃথিবীতে হেন সাগরতীর নেই যেখানে ওর ঠাকুরদা যান নি। এমন সব অদ্ভুত জিনিস তাঁর নিজের চোখে দেখা যে তিনি আর কল্পনায় বিশ্বাস করেন না। অবিশ্যি অত বড় চাঁদকে কিছু কল্পনার জিনিস বলা যায় না। আবহমান কাল থেকে লোকে তাকে দেখে আসছে, তার টানে সমুদ্রে জোয়ার উঠছে। রাশিয়ানরা আমেরিকানর। সেখানে রকেট নামিয়েছে পর্যন্ত এই সব ছবি দিয়েই 'চন্দ্রযাত্রী' বইটার পাতার পর পাতা ভরতি। যেখানে গাড়ি ঘোড়া নামানো যায়-আর রকেটকে গাড়ি ঘোড়া ছাড়া আজকাল আর কি বলা যায়? - সেখানকার ডাঙ্গায় যন্ত্র নামিয়ে ফটো তুলে পাঠানো যায়, সে এই পৃথিবীটার চেয়ে কোন দিক দিয়ে বেশি কাল্পনিক হল তা ভেবে পাওয়া যায় না। মোটেই পৃথিবীর সব জায়গার ফটো তোলা হয় নি।

সমস্ত বইটা গুপি এর মধ্যে একবার পড়ে ফেলেছে। অদ্ভুত জীবনযাত্রা ওধানকার। নাকি মহাকাশ-ট্রাকে করে মাটি নিয়ে গিয়ে তবে ধান-গম ফলাতে হবে। তাও সম্ভবতঃ মাটির নীচে ক্ষেত বানিয়ে। তেজ যে দিনের তাপমাত্রা ২০০ ডিগ্রী আর রাতের - সূর্যর এমনি ২০০ ডিগ্রী। সব ঝলসিয়ে জমিয়ে শেষ করে দেবে। যদি না মাটির তলায় ফসল ফলানো হয়। এক ফোঁটা জল নেই, দু-ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেন মিলিয়ে জল তৈরি করতে হবে। সে একেবারে বোতলে পোরা বিশুদ্ধ জন, খেলে কারো অসুখ করবে না। অক্সিজেন-ও ওখানে পাওয়া যাবে না, সম্ভবতঃ হাইড্রোজেন-ও না। সব পৃথিবী থেকে নিয়ে যেতে হবে। বাঁচতে হলে সবাইকে বোতলে ভরা অক্সিজেন শুঁকতে হবে। গুপির ছোটমামা তার মস্ত ব্যবসা করে, দেখতে দেখতে ফেঁপে উঠবেন । আগেই বলেছি যাঁরা প্রথম চাঁদে জমি কিনবেন গুপির ছোটমামা তাঁদের মধ্যে একজন। এই ব্যাপারে তিনি আমেরিকায় এরি মধ্যে একটা দরখাস্ত পর্যন্ত দিয়ে রেখেছেন। প্যান-অ্যাম্ নাকি টিকিট বিক্রি করবে।

অবিশ্যি ওঁদের বাড়িতে এ বিষয়ে কেউ এখনো কিছু জানে না। কারণ গত বছর সামান্য কয়েকটা নম্বরের জন্যে বি-এস্-সি পাস করতে না পারায়, বাড়িতে তাঁকে উদয়াস্ত যা-নয়-তাই শুনতে হয়। তাতে অবিশ্যি তাঁর চাঁদের ব্যবসা কিছু উঠে যাচ্ছে না, ছোটমামা গুপিকে বলেছেন, পরে এরাই কত খোসামোদ করবে।

গুপি বইটাতে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, 'আমরাও ঐ ব্যবসায় ঢুকে পড়ব। ছোটমামার চাঁদের বাড়িতে থাকব, মেশিনের সাহায্যে ওর কাজটাজ করে দেব। তুই তো খুব ভালো মাংস রেধেছিলি সেবার যখন ডায়মণ্ড হারবারে পিকনিক হয়েছিল। আর দ্যাখ নেপোকেও নিয়ে যাওয়া যাক। দেখিস্ কেমন দেখতে দেখতে এই বিরাট বাঘের মতো হয়ে যাবে। ওখানে বাতাসের প্রেসার নেই বলে সবাইকে প্রেসার স্যুট পরতে হবে। নেপোকে পরাব না। বাতাসের চাপ না থাকায় ব্যাটা এই এত উঁচু হয়ে উঠবে, বেশ আমাদের বাড়ি পাহারা দেবে। ওদিকে প্যান্টের মধ্যে পুরে লুকিয়ে। নিয়ে যেতে পারব, কেউ টের-ও পাবে না। নইলে বেড়ালদেরো চাঁদে যেতে মোটা টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে হবে।'

বড় মাস্টার সঙ্গে করে তাঁর নতুন ছোট মাস্টারকে নিয়ে এসেছিলেন।

রোগা, ফরসা, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পাৎলা চুল, নাকি সবে টাইফয়েড থেকে উঠেছেন। দু-জনে হাঁ করে গুপির কথা শুনছিলেন আর একটার পর একটা অনেকগুল্মে মাংসের সিঙ্গাড়া খাচ্ছিলেন। ভজুদা তখনো আসেন নি।

গুপি বলে চলল, 'ওখানে খুব রোবো ব্যবহার হবে। তারাই চাষ করবে, কারখানায় কাজ করবে। নইলে অত অক্সিজেন কে জোগাবে? তাছাড়া রোবোদের খিদেও হয় না, অসুখও হয় না, ভারি সুবিধা। নইলে চাঁদে গোরু মোষ নিয়ে গেলে, সেগুলো তো দেখতে দেখতে আট নয় ফুট উঁচু হয়ে উঠবে। তাদের খাবার জোগাতেই ট্যাঁক গড়ের মাঠ হবে। মাটির তলায় বাঁধা থাকবে, গোয়ালে অক্সিজেন ভরা থাকবে। রোবোরা তাদের দুইলে মণ মণ দুধ পাওয়া যাবে। কে জানে ছোটমামাও হয়তো একটা গোরু কিনে ফেলতে পারে। পায়েস আর রসগোল্লা করাটা ইতিমধ্যে শিখে নিস্, পানু।'

বড় মাস্টার একটু চা খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে এতক্ষণে কথা বললেন, 'অত অক্সিজেন কোথায় পাবে?'

গুপি খুব হাসতে লাগল, 'ছোটমামা বলেছে যে সব কারবন ডায়োক্সাইড আমরা নিশ্বাস ফেলব, সেগুলোকে আবার অক্সিজেন বানাবার ব্যবস্থা হচ্ছে শীগগির। এক রকম গাছের সাহায্যে।'

নতুন মাস্টার এবার বললেন, 'কিন্তু বন্ধ বালতিতে দুধ দুইতে হবে, নইলে ছকিয়ে সব বেরিয়ে আসবে। হাওয়ার চাপ নেই তো!'

বড় মাস্টার মাথা নাড়তে লাগলেন। উনিও গুপির ঠাকুরদার সঙ্গে এক মত। এই পৃথিবীটারি সব কিছু দেখার সময় হয় না, তা আবার চাঁদে যাওয়া। গুপি বিরক্ত হয়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আমি বললাম, 'চাঁদে যাওয়াটাই আসল কথা নয়, মাস্টার মশাই। চাঁদটা হবে একটা ছোট স্টেশন। সেখানে মহাকাশের আপিস থাকবে; ঐখানে অন্যান্য গ্রহে যাবার টিকিট কাটা যাবে। কারখানা থাকবে, মহাকাশযান মেরামত হবে। চাঁদে আমরা চিরকাল থাকব না।'

মাস্টার মশাই হঠাৎ গুপির দিকে তাকিয়ে বললেন, 'বর্মা গিয়েছ কখনো?' গুপি মাথা নাড়ল। মাস্টার বললেন, 'আমি বর্মায় থাকতাম। সালগুয়েন নদীর ধারে সেগুনকাঠের মস্ত ব্যবসা ছিল। আমার বাবা অনেক টাকা করেছিলেন। আমাদের নিজেদের এরোপ্লেন ছিল, নৌকো ছিল, মাঝ সমুদ্রে যাবার বড় বড় মোটর বোট ছিল। সমুদ্রের ঝড় দেখেছ কখনো?'

গুপি একটা চেয়ারে বসে পড়ে, সেটাকে টেনে মাস্টারের খুব কাছে নিয়ে গেল। ততক্ষণে আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, বাড়ির সবাই দাদুর বাড়ি চলে গেছে। রুমে অন্ধকার হয়ে আসছে, তবু আমার ঘরে আলো জ্বালা হয় নি, ভজুদাও আসেন নি, মাস্টার বললেন, 'একবার দারুণ ঝড়ে পড়েছিলাম। তখন আমার কুড়ি বছর বয়স। রেঙ্গুনের কলেজ থেকে সবে বি-এ পাস করে বেরিয়েছি। মাঝিদের সঙ্গে মাঝ সমুদ্রে মাছ ধরতে গেছিলাম। ওখানে ওরা প্রকান্ড সব মাছ ধরে, এক মণ, দেড় মল, পর্যন্ত। সমুদ্রের জলটা এত পরিষ্কার যে অনেক নিচে অবধি দেখা যায়। কোথাও কোথাও তলা অবধি দেখতে পাচ্ছিলাম। হয়তো সমুদ্রের নিচে সেখানে চড়া পড়েছিল। সূর্যের আলো সেখানে ফিকে সবুজ হয়ে পৌঁছচ্ছিল। দেখলাম বড় বড় সমুদ্রের আগাছা, জলের নিচে বালির উপর একটু একটু দুলছে। মাঝে মাঝে ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট রঙিন মাছের দল ভেসে যাচ্ছে। থেকে থেকে বড় বড় কালো ছায়ার মতো কি যেন এগিয়ে আসছে। তাই দেখে মাঝিরা কথা বন্ধ করে একেবারে চুপ; নোঙর ফেলা নৌকোটাও স্থির, শুধু ঢেউয়ের দোলায় একটু একটু দুলছে।' একবার মনে হল জলের নিচে মস্ত একটা চোখ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বুকটা ঢিপ ঢিপ করে উঠল। গাটাও কেমন সিরসির করতে লাগল। তখনো আমার দুটো ঠ্যাং ছিল। এখন আর কেয়ার করি না।

মাঝিদের দিকে তাকিয়ে দেখি, তারাও কেমন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, নোঙর তুলে, ডাঙায় ফেরার দিকে তাদের মন। নাকি ঝড় উঠছে। দেখতে দেখতে হাওয়া পড়ে গেল, পশ্চিম দিকে মেঘ জমা হতে লাগল। তার পরেই সূর্যটা একেবারে মুছে গেল। দোতলার সমান উঁচু কালো ঢেউ আমাদের উপর লাফিয়ে পড়তে লাগল। ছোট্ট একটা খেলনার মতো আমাদের নৌকোও একবার ঢেউয়ের মাথায় ওঠে, তার পরেই ঝপাস্ করে পড়ে। মাঝিরা ওস্তাদ, তারা ঠিক হয়ে রইল। পরে জানতে পেরেছিলাম যে ঢেউয়েরা ঝাপটা খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত তারা পরদিন ভোরে আধমরা অবস্থায় নিরাপদে ডাঙায় পৌঁছতে পেরেছিল। কিন্তু ঝড়ের গোড়ার দিকেই একটা মস্ত ঢেউ আমাকে ভাসিয়ে নিল ।

খানিকটা হাঁসফাঁস করলাম, তারপর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান হল দেখি মহাসাগরের মাঝখানে একটা অজ্ঞাত দ্বীপের বালির তীরে পড়ে আছি। সে কি দ্বীপ! সত্যি বলছি তোদের, পৃথিবীতে যদি কোথাও স্বর্গ থাকে, তবে সে সেইখানে। মানুষের বাস নেই; বনমানুষেরা উঁচু গাছে রাত কাটায়। শিম্পাঞ্জীকে বনমানুষ বলে তা জানিস্ তো? আর গাছে গাছে যত ফুল তত ফল। কত যে পাখি তার ঠিকানা নেই। উড়ে এসে কাঁধে বসে, হাত থেকে ফল খায়। ঘাসের উপর খরগোশরা লাফিয়ে বেড়ায়, আমাকে দেখে এতটুকুও ভয় পায় না। দলে দলে হরিণ চরে বেড়ায়। গাছের কোটরে এত বড় বড় মৌচাক।

সারাদিন গাছের পাতার মধ্যে সমুদ্রের হাওয়ার শব্দ, পাখির গান, ঝরণার জল পড়ার আওয়াজ। চোখের সামনে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি ওড়ে; তার পিছনে হলদে বালির তীরে সমুদ্রের সবুজ ঢেউ সারাক্ষণ আছড়ে পড়ে।'

মাস্টারমশাইয়ের কথা শুনতে শুনতে আমার চোখের সামনে থেকে অন্ধকারে ভরা নিজের ঘরটা কোথায় মুছে গেল, ফুটপাথের চায়ের দোকানের ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ আমার নাক অবধি পৌঁছল না, গা সির- সির করতে লাগল। গুপি ব্যস্ত হয়ে বলল, 'তারপর সেখান থেকে ফিরে এলেন কি করে? কেন এলেন? ই-স্, সেখানে নিশ্চয় গাছে চড়লেই পাখির ডিম! আর হরিণ মারা আর খাওয়া! আচ্ছা, মাস্টারমশাই খরগোশের মাংসও-'

মাস্টারমশাই হঠাৎ কর্কশ গলায় বললেন, 'চুপ!-ঢিল ছুড়ে একটা সবুজ পায়রাকে জখম করেছিলাম। মাটিতে পড়ে সেটা ছট ফট করছিল; চোখের কোণা দিয়ে একটু রক্ত গড়াচ্ছিল। অমনি শিম্পাঞ্জীর দল আমার ঘাড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, একটা নরকোল গাছের গুড়ি পড়েছিল, তাতে আমাকে চাপিয়ে, ঠেলে ঠেলে ঢেউ পার করে দিয়ে এল। ভাঁটার টানে কোথায় যে ভেসে গেলাম তার ঠিক নেই। ভাগ্যিস একটা জাপানী সদাগরী জাহাজের চোখে পড়ে গেলাম, নইলে সে যাত্রা হয়েছিল আর কি।' মাস্টারমশাই হঠাৎ কাঠের পা ঠুকে উঠে পড়লেন।

গুপি বলল, 'এক্ষুণি চলে যাবেন না, মাস্টারমশাই, কি করে বর্মা ছেড়ে চলে এলেন, বৌঠানের কি করে মুখ পুড়ল, সেসব কথা-।' মাস্টারমশাই বেজায় রেগে গেলেন। আমাকে বললেন, 'তোরা বড় বেশি কথা বলিস্। অন্য লোকের দুঃখ কষ্ট নিয়ে খুব মজা পাস, না?' আমি বললাম, 'না মাস্টারমশাই, না। আমাদেরো দুঃখ হয়, মজা

পাই না।'

মাস্টারমশাই বললেন, 'আচ্ছা আচ্ছা, থাক এখন। আরেক দিন বলব। উঠি। আমার নাইটস্কুলের ছেলেরা এক্ষণি আসবে। মিটিং আছে। তলাপত্র রইল, ওর সঙ্গে গল্প কর।'

মাস্টারমশাই চলে গেলেই ছোট মাস্টার মোড়া থেকে উঠে সেই চেয়ারে বসে বললেন, 'আমার কাছে মহাকাশ-যাত্রা সম্বন্ধে অনেক ভালো ভালো ইংরিজি বই আছে।'

গুপি হঠাৎ মুখের উপর আঙ্গুল রেখে বলল, 'চুপ করে শুনন! ঐযে ঠক-ঠক-ঠক শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না? স্পেস্-শিপ বানাচ্ছে।'

ছোট মাস্টার চমকে গিয়ে আরেকটু হলে চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন। আমি বললাম, 'আঃ গুপি! সবাইকে সব কথা বলা কেন?'

কিন্তু ছোট মাস্টারও কিছুতেই ছাড়বেন না, 'কি স্পেস্-শিল্প, কে বানাচ্ছে, বলতেই হবে। আমাকে না বলার কারণ নেই। আমি তো আর কাউকে বলতে যাচ্ছি না!'

তখন আমি বললাম, 'সরকারি ছাপাখানার ওপাশে চার বছর ধরে ঐ যে মস্ত বাড়িটা তৈরি হচ্ছে, গুপি বলে ওখানে মহাকাশ-যান তৈরি হচ্ছে।' ছোট মাস্টার তো অবাক। 'সে কি? শুনলাম ওটা ঠান্ডাঘর। ওখানে আলু পেঁয়াজ জমা থাকবে। ও-পাশেই গঙ্গা। লম্বা চোঙাপথ দিয়ে একেবারে জাহাজের খোলে মাল বোঝাই হয়ে বিদেশে যাবে। বড়

মাস্টার তো তাই বললেন।' গুপি কাঠ হেসে বলল, 'ঠাণ্ডাঘর করতে কখনো চার বছর লাগে ?'

|| তিন ||

ঠিক এই সময় কলেজের বিকেলের ক্লাস সেরে ভজুদা উপস্থিত হলেন। মুখে শুধু এক কথা। ওদের কলেজের প্রিন্সিপ্যালের নতুন গাড়ি দিন দুপুরে, কলেজের গেটের ভিতর থেকে, একরকম দারোয়ানের নাকের ডগার তলা দিয়ে চুরি গেছে। এই অবধি শুনে ছোট মাস্টার সুড়সুড় করে সরে পড়লেন। মা-বাবাও তখনি বাড়ি এলেন। সিঁড়িতে ছোট মাস্টারের সঙ্গে দেখা।

ঢুকেই বাবা আমাকে বললেন, 'কে ঐ স্লিপারি কাস্টমারটি? সোজা

তাকায় না কেন?' মা-ও বললেন, 'যাকে তাকে ঘরে ঢোকাস নি বাবা, কতবার বলেছি।'

আমি রেগে গেলাম, কিন্তু কিছু বলার আগেই গুপি আস্তে আস্তে বলল, 'না মাসিমা, উনি ভালো লোক, বড় মাস্টারমশাইয়ের নতুন অ্যাসিস্টেন্ট। ওঁর নাম তলাপত্র, এম-এ পাস।'

বাবা বসে পড়ে বললেন, 'কোত্থেকে ধরে আনে এসব লোক? যে ভাবে মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে হন হন করে নেমে গেল, আমি ভাবলাম নির্ঘাৎ কিছু সরিয়েছে। কেমন আছ ভজু?

আমি বললাম, 'ভজুদাদের প্রিন্সিপ্যালের নতুন গাড়ি হাওয়া।' বাবা চমকে উঠলেন! 'আরে, তোর মেজকাকুর গাড়িও যে পোস্টাপিসের সামনে থেকে ঠিক সাত মিনিটের মধ্যে ডিস্যাপিয়ার্ড!'

মা বললেন, 'কাল সন্ধ্যেবেলায় গেছে আর আজ দুপুরে চিড়িয়া মোড়ে • পাওয়া গেল। সুখের বিষয় পাঁচটা টায়ার, ব্যাটারি, যন্ত্রপাতির বাক্স আর হেডলাইট ছাড়া কিচ্ছু হারায়নি। থানার ওরা বলেছেন, পুরনো হলে নাকি এইভাবে পাওয়া যায় আর নতুন হলে বেমালুম উধাও। আসবে ঠাকুরপো একটু বাদেই, তার কাছেই শুনো সব কথা ।'

বাবা কাষ্ঠ হেসে বললেন, 'স্রেফ বিদেশে পাচার। বিদেশ তো এখন বেশি দূর নয়। পদ্মাও পার হতে হয় না।' তারপর ভজুদার কাছে শুনলাম যে এই গাড়ি চুরির ব্যাপারেরও একটা ভালো দিক আছে। গড়ে নাকি এই কলকাতা শহর থেকেই রোজ একটা করে গাড়ি চুরি থানায় রিপোর্ট হয়। বেশ কয়েক হাজার বেকার লোক এই দিয়ে করে খাচ্ছে। সেটাকে খুব খারাপ বলতে পারলাম না। তবু একটু সাবধানে থাকাই ভালো। ভাগ্যিস্ দাদুর দেওয়া আমার এই দু চাকার গাড়িটা তিনতলা থেকে নামে না। তবু আজ রাত থেকে ওটাকে আমার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের সঙ্গে সুতো দিয়ে বেঁধে রাখব। এতটুকু টান পড়লেই চোর বাছাধন হাতেনাতে ধরা পড়বেন। হতে পারে আমি চলতে পারি না, কিন্তু আমার হাতে খুব জোর। তাছাড়া রাতে আমার ঘরে রামকানাই শোয়। সে রোজ ভোরে উঠে আদা দিয়ে ছোলা ভিজে খেয়ে, আধ ঘণ্টা বুকডন করে আর মুত্তর ভাঁজে। খুব ঘামে।

গুপি বাড়ি যাবার জন্য উঠেছিল এমন সময় মেজকাকু একজন মোটা বেটে লোককে নিয়ে উপস্থিত। লোকটাকে আগেও কাকুর বাড়িতে দেখেছি। ওঁর নাম নিতাই সামন্ত। ডাক নাম কানু। মেজকাকু বলেছেন নাকি দু'দে ডিটেকটিভ, ও'র ভয়ে অনেক ঘাটে বাঘে গোরুতে এক সঙ্গে জল খায়। গাড়ি চুরির কথায় বললেন, 'ওরা জানে না, কিন্তু ওদেরো এবার দিন হয়ে এসেছে। যে সে নয়, এবার বাছাধনরা বিন তালুকদারের পাল্লায় পড়েছে। দিল্লীর পুলিসের বিখ্যাত গোপন গোয়েন্দা বিনু তালুকদার। এদিকে অক্সফোর্ড থেকে বি-এ পাস। নিজের চোখে না দেখলেও শুনেছি দেখে নাকি মনে হয় রোগা লিকলিকে নিরীহ মাস্টার মশাই, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। ওদিকে স্রেফ ম্যাজিশিয়ান!' গুপি বলল, 'ও মোটর চোরদের ধরে দেবে?'

'দেবে না তো কি! তাদের ঘাঁটিসুদ্ধ বের করে দেবে। এবার আর ছাড়ান-ছোড়ন নয়। তালুকদার বলে গাড়িগুলো একবার গেল তো গেল! যতক্ষণ না চোররা ইচ্ছা করে পথের ধারে ফেলে রাখছে, ততক্ষণ তাদের কোনো চিহ্ন খুজে পাওয়া যায় না। তার মানে এইখানে এই কল্পকাল শহরের মধ্যেই ওদের কোনো লুকানো আস্তানা আছে। সেখানে চোরাই গাড়ির রং পালটানো হয়, নম্বর বদলানো হয়, চেহারা এমনি করে দেওয়া হয় যে তাদের আসল মালিকের নাকের সামনে দিয়ে চলে গেলেও মালিকরা টের পায় না। শুধু তাই নয়, যারা এই চোরাই ব্যবসার পাণ্ডা তারাও ভোল বদলে এমনি ভালো মানুষ সেজে থাকে যে তাদেরো চেনা যায় না। এখানে ওখানে ভালো চাকরি-বাকরি করে, গাড়ি হাঁকায়। মাঝে মাঝে ওদের নিজেদের গাড়িও চুরি যাওয়া বিচিত্র নয়। একটা পান দিন তো।' এই বলে নিতাই সামন্ত খুব হাসতে লাগলেন। তারপর পান খেয়ে

আরো বলতে লাগলেন-

'এবার হয়েছে যেমন কুকুর তেমনি মুগুর। বিনূর দলের টিকটিকিরাও শহরের চারিদিকে চারিয়ে আছে। তাদের টিকিটি চিনবার জো নেই কারো! চোর ছ্যাঁচড় ধরবার জন্যে তারা চোর ছ্যাঁচড় সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে! একেবারে ওদের দলের ভেতরে সেঁদিয়ে তারা সমস্ত ব্যাপারটাকে নস্যাৎ করে দেবে!' মেজকাকু জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, 'এখানকার আশে-পাশে ই কোথাও ওদের ঘাঁটি হয়তো। ঐ তো গঙ্গার ঘাটে মাল বোঝাই নৌকোর ভিড়। ঐ কয়লা আর খড়ের তালের মধ্যে দিব্যি একটা করে আস্ত মোটর গজে পাচার করে দেওয়া যায়। আরে আমারি যে-' এই অবধি বলে আমার আর গুপির দিকে তাকিয়ে মেজকাকু চুপ করলেন!

নিতাই সামন্ত তাড়াতাড়ি বললেন-'এই রকম জায়গাতেই আইন- ভঙ্গকারীরা থাকে! উঃ, তাদের মধে। দিব্যি আছেন, দাদা, জানলায় একটা শিক পর্যন্ত নেই!'

বাবা একটু অপ্রস্তুত হলেন, 'ইয়ে তিনতলার উপর সে-রকম—'

শুনে নিতাই সামন্তর সে কি কান্ঠ হাসি! 'ঐ আনন্দেই থাকুন, স্যার! আপনার বাড়িটাকে চোরদের সোনার খনি বানিয়ে রাখুন! জানেন, ওরা টিকটিকির মতো দেয়াল বেয়ে ওঠানামা করে। ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। আচ্ছা ঐ সরকারি ছাপাখানার শেডে ওরা কারা গুপ্তানি করছে?'

আমি বললাম, 'বড় মাস্টারের নাইট স্কুলের ছাত্ররা রবিবার ওখানে মিটিং করে।'

নিতাই সামন্ত তো অবাক! 'তাই নাকি! বাঃ, বেড়ে আছে তো, দিনের বেলায় ছাপাখানায় ভালো মাইনের চাকরি, তেওয়ারির দোকানে চারবেলা পাতপাড়া, সন্ধ্যেবেলায় মিটিং আর রাতে-' এই বলে নিতাই সামন্ত উঠে পড়লেন।

মেজকাকুও উঠলেন, 'চলি রে পানু, নিতাইয়ের আবার নাইট-ডিউটি আছে।'

ও'রা দরজার কাছে যেতেই বাবা গুপিকে বললেন-'কিরে, তোর বাড়িঘর নেই নাকি? যা, ওদের সঙ্গেই যা।' তারপর দমাস্ দমাস্ করে আমার জানলা দুটো বন্ধ করে ছিটকিনি এঁটে দিলেন। হাসি পেল। যে কেউ ইচ্ছা করলেই পাশের বাড়ির ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে রাস্তা থেকে উঠে এসে, একটা তক্তা ফেলে আমাদের ঘোরানো সিঁড়িতে উঠতে পারে। রাতে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ থাকে বটে, কিন্তু কার্নিশ দিয়ে দু হাত হাঁটলেই আমাদের পিছনের বারান্দায় ওঠা যায়। তারপর দরজার খড়খড়ির ভিতর দিয়ে হাত গলিয়ে খাবার ঘরের দরজা খুলে ফেলা যায়। রামকানাই নিজে একবার দেরি করে ফেলে, বাইরে বন্ধ হয়ে গিয়ে, ঐ রকম করে এসেছিল।

পরদিন ভজুদার কাছে কথাটা তুললাম, 'ভজুদা, রাতে রোজ ঠক্ ঠক্ শব্দ শুনি।'

ভজুদা চোখ পাকিয়ে বললেন, 'ভূতে বিশ্বাস আছে নাকি?' 'না না, ভূত না, কিন্তু কিছু হয়তো তৈরি হচ্ছে ওখানে।' 'কোথায়?'

ঐ ছাপাখানার পিছনে, নতুন ঠাণ্ডা ঘরে।'

'ও তো এখনো শেষই হয় নি। সব বিষয়ে যুক্তি দিয়ে ভাবতে চেষ্টা করবে।'

'না ভজুদা, ভিতরটা হয়ে গেছে, শুধু সামনের দিকটাই চার বছর

ধরে তৈরি হচ্ছে। গুপি বলে-'

ভজদা বললেন, 'লেখো, একটা বাঁদর একটা তেল-তেলা বাঁশ বেয়ে এক মিনিটে-কি হল?'

'ভজদা, বড় মাস্টারমশাই নাকি ভূত দেখেছেন। এখানে সব্বাই ভূতের ভয় পায়। সন্ধ্যার পর কেউ ঘাটের গলির দিকে যাবে না। রেলের লাইনে পা দেবে না। রামকানাই বলেছে রাতে ও-লাইনে যে-সব গাড়ি আসে, তারা কোনো মালগুদোম থেকে আসে না।'

ভজদা বিরক্ত হয়ে উঠলেন, 'তা হলে কি বুঝতে হবে যে শুধু মানুষ মলেই ভূত হয় না, রেলগাড়িদেরো ভূত হয়? নাও, চটপট অঙ্কটা টুকে ফেল। তাছাড়া একটু হাঁটাচলা করতে অভ্যাস কর এবার। যত সব আজগুবি চিন্তা! ভূতত নেই। এক্সারসাইজ করলেই টের পাবে।'

অঙ্ক কষা হয়ে গেলে বললাম, 'আচ্ছা, ভূত না থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে যে কেউ লুকিয়ে স্পেস্-শিপ বানাবে না, তাইবা কি করে বলা যায়?'

ভজুদা অবাক্ হয়ে আমার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, 'এ বিষয়ে কয়েকটা বৈজ্ঞানিক বই এনে দেব। তাহলেই বুঝবে যে স্পেস্-শিপ চাট্টিখানিক কথা নয় যে গুদোম ঘরে লুকিয়ে বসে রাতে হাতুড়ি পিটে অমনি বানানো যাবে। আর বড় মাস্টার ভূত দেখেছেন না হাতি দেখেছেন! ওসবে কান দিতে হয় না।' ভজুদা চলে গেলে মনে হল কথাটা না তুললেই পারতাম। গুপি বারণ করেছিল।

সব শুনে, পরের রবিবার বড় মাস্টার বললেন, 'ভূত নেই বলেছে ভজ? চব্বিশ বছর বয়স না হতেই সব জেনে ফেলেছে নাকি? আমার আটষট্টি বছর বয়স। যতই দিন যায় ততই বুঝি কিছুই জানা হয় নি, আসল জিনিসই সব বাকি আছে। শোন তবে। জইন্তিয়া পাহাড়ের নাম শুনেছিস্? এখনকার জইন্তিয়া কি রকম জানি না, কেঠো পা নিয়ে কোথায়-ই বা যেতে পারি বল্? তবু মনে হয় মাঝে মাঝে দুটো পায়ের তলায় যেন জইন্তিয়া পাহাড়ের স্প্রিং-এর মতো ঘাস এখনো টের পাই। মাইলের পর মাইল শুধু ঘাস আর বড় বড় পাথর। পাথরের যে দিকটাতে রোদ পড়ে না, সেদিকে নরম শ্যাওলা হয়ে থাকে। তাতে শীতের আগে ছোট্ট ছোট্ট হলদে আর গোলাপি ফুল ফোটে, খুদে খুদে ফল ধরে। ঘাসজমির পাশেই হয়তো বাঁশবন। সে রকম বাঁশবন তোরা দেখিস্ নি। গাঢ় কালচে সবুজ, আমার পায়ের তিনগুণ মোটা গুড়ি থেকে সরু হতে হতে ষাট ফুট উচুতে উঠে, কচি কলাপাতা রঙের একগুছি পাতা আর কড়ে আঙ্গুলের মতো সরু একটা কুড়িতে গিয়ে শেষ হয়েছে। গুড়ির পায়ে পুরু একটা খাপের মতো জড়ানো। তাতে মিহি রোঁয়া, ছুলেই আঙ্গুলে লেগে যায় আর জ্বালা করতে থাকে। তার পাশে দিন রাত ঝর ঝর করে পাহাড়ের অনেক উঁচু থেকে জল পড়ে।

পাহাড়ের উপরে দেবদারুর বন। একবার আমার বন্ধু হরিদাস আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। সবুজ পায়রা শিকার করার ইচ্ছা তার। ওখানকার লোকরা অনেক বারণ করেছিল, ও পাহাড়ে নাকি কেউ চড়ে না। পাহাড়ের 'দেউ' ভারি রাগী, কেউ তাঁর জানোয়ার মারলে তাকে নাকি হাতেনাতে সাজা দেন। জিনিস বইবার জন্যে পর্যন্ত একটা লোক পাওয়া গেল না। শেষটা নিজেরাই ব্যাগে করে খাবার, জলের বোতল, টোটা আর কাঁধে বন্দুক নিয়ে চললাম। সারাদিন ঘুরে ঘুরে একটা চড়াইপাখি পর্যন্ত দেখতে পেলাম না। হরিদাসের কি রাগ। এ বনে জানোয়ার গিজগিজ করে, পাহাড়ের তলা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে সবুজ পায়রা উড়তে দেখা যায়, অথচ একটা কাঠবেড়ালি পর্যন্ত দেখা গেল না। বিরক্ত হয়ে আমাকে বলল, 'তুমি বড় খড়মড় করে হাঁট, তারি শব্দে জানোয়ার পালায়।' শেষে ক্লান্ত হয়ে বনের মধ্যে ছোট একটা ঝিলের ধারে বসে খাওয়া দাওয়া করলাম। তারপর হরিদাস শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। আমার কেমন বুক ঢিপঢিপ করছিল, চোখে আর ঘুম আসছিল, না।

এখানে বনের গাছগুলো যেন অন্য ধরনের, বড় বেশি ঘন, পাতাগুলো বড় বেশি বড়। হঠাৎ চমকে দেখলাম বড় বড় গাছের গুঁড়ির সঙ্গে মিলিয়ে আছে অনেক হাতির পা। তাদের মস্ত কান নাড়াও দেখতে পেলাম। তাকিয়ে তাকিয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিতে লাগল। জঙ্গলের ভেতরকার অন্ধকারে যেই চোখ সয়ে গেল, দেখি হাজার হাজার জানোয়ারের ভিড়, ছোট বড় মাঝারি, বাঘ, ভালুক, হরিণ, ভাম, খরগোশ। গাছের ডালে ডালে পাখি। অথচ এতটুকু শব্দ নেই। হাতি দেখেই বন্দুক তুলে নিয়েছিলাম। এবার সেটা হাত থেকে খসে ঝিলের জলে পড়ে গেল। চারদিকে কেমন একটা থমথমে ভাব। তারি মধ্যে হরিদাস উঠে বসে, পাগলের মতো এ-পাশে ও-পাশে তাকিয়ে দেখে, বন্দুক সেইখানেই ফেলে রেখে উল্টো দিকে টেনে দৌড়। ঐ যে একটু শব্দ, একটু নড়াচড়া, অমনি দেখি চারদিক ভোঁ তাঁ, কেউ কোত্থাও নেই। আমার শরীর কাঁপছিল, তবু এক-পা দু-পা করে বনের মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম। গাছের নিচে পা দিতেই একটু হাওয়ায় ডালপালা দুলে উঠল আর আমার গায়ে-মাথায় টুপটাপ করে সাদা সাদা বড় বড় ফুল ঝরে পড়তে লাগল। অমনি আমার সব ভয় দূর হল। দেখলাম বনের মধ্যে একেবারে অন্ধকার নয়, গাছের ফাঁক দিয়ে পড়ন্ত রোদ ঢুকছে। কি জানি মনে হল, দু-মুঠো ফুল কুড়িয়ে, বনের দেউকে মনে করে একটা গাছের গুঁড়িতে ছড়িয়ে দিলাম।

তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে পাহাড় থেকে নেমে এলাম। কত হরিণ, কত পাখি, কত সবুজ পায়রা দেখলাম, দিনের শেষে বাসায় ফিরছে। ডেরায় ফিরতেই দেখি হরিদাস তল্পিতল্পা বেঁধে যাবার জন্যে তৈরি। বললে -'জায়গাটা সত্যি ভালো না!'-সেইদিন-ই ফিরে এলাম।

মাস্টারমশাই থামলে গুপি বলল-'এ আবার কিরকম ভূতের গল্প?' বড় মাস্টার হেসে বললেন, 'ভূতের গল্পের আবার এ-রকম 'সে-রকম

হয় নাকি? যেমন দেখেছিলাম, বললাম। তলাপত্রকে কেমন লাগল?' আমি বললাম, 'ভালো। কিন্তু বাবা বললেন-সোজা তাকায় না কেন? মা বললেন-যাকে তাকে ঘরে ঢুকতে দিস্ না। আচ্ছা, মাস্টারমশাই, আমার পা-দুটোতে কি কোনো তফাৎ দেখতে পাচ্ছেন? আমি স্বপ্নে খুব দৌড়ই।'

মাস্টারমশাই বললেন, 'সে আর এমন কি। আমার নেই-পা-টাতে যখন চুলকোয়, তখন কি করে আরাম পাই বল্ দিকিনি?'

গুপি তখন কথা পালটে বলল, 'জানেন মাস্টারমশাই, মহাকাশযানগুলো যখন অনেক উপরে, অনেক দূরে চলে যায় তখন আর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে না। কোনো জিনিস নিচের দিকে যায় না, সব উপরে উঠতে থাকে। আমার চন্দ্র-যাত্রার নতুন বইটাতে আছে যাত্রীরা যদি নানান উপায়ে নিজেদের নিচে আটকিয়ে না রাখে, তাহলে সবাই বেলুনের মতো উড়ে গিয়ে আকাশযানের ছাদের কাছে ঝুলে থাকবে।'

বড় মাস্টার মহাকাশযাত্রার কথা শুনলে চটে যান। বিরক্ত হয়ে বললেন, 'নিশ্বাস ফেলবার বাতাস নিয়ে যেতে হয় না বোতলে ভরে? যাত্রীরা উড়ে বেড়াবার জায়গা কোথায় পাবে?'

গুপি বলল, 'আমার চন্দ্রযাত্রার বইয়ের লোকরা একরকম আগাছা নিয়ে সেছিল, তারা যাত্রীদের নিশ্বাস ফেলা কার্বন ডায়োক্সাইডগুলোকে আবার অক্সিজেন বানিয়ে দিত। ঐ আগাছার নাম ডাক-উইড। বোতলে করে কত বাতাস নেবে? আর শুধু চাঁদে গেলেই তো হল না, চাঁদটা খালি একটা টিকিট কাটার স্টেশনের মতো-।'

বড় মাস্টার উঠে পড়ে, ঠুক ঠুক করে কাঠের পা ঠুকতে ঠুকতে যেই এক পা পেছু হটেছেন অমনি 'ই'-য়া-য়া-ও' করে সে কি বিকট চীৎকার! তাকিয়ে দেখি কেঠো পা ঠিক পড়েছে নেপোর বেঁড়ে ল্যাজের ডগায়। পা-টা তুলতেই এক ঝিলিক বিদ্যুতের মতো নেপো জানলা উপকে ধনে পাতার গাছ মাড়িয়ে কার্নিশ পেরিয়ে, পাশের ফ্যাটের কালো মেমের জানলা গলে হাওয়া!

মাস্টারমশাই কাঁপতে কাঁপতে আবার চেয়ারে বসে পড়লেন। মুখটা একেবারে সাদা, চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে, ভাঙ্গা গলায় বললেন,- 'নেপোর গলা থেকে ঐ শব্দ বেরুল! আশ্চর্য! ওকে একটু ধরা যায় না?' আর ধরা! ততক্ষণে মেমের রান্নাঘর থেকে ঝন-ঝন ক্যাঁও মাও, তারপর সব চুপ।

চার

তার পরের রবিবারে গুপি এসেই বলল, 'একটা মুস্কিল হচ্ছে স্পেস্- স্টেশনটাকে নিয়ে। ছোটমামা বলছে নাকি মাধ্যাকর্ষণের এলাকা ছাড়বামাক্স ওটাকে তিন সেকেণ্ডে একবার করে পাক খেতে হবে। নইলে ধপাস্ করে পড়ে যাবে। তা হলে তো জিনিসপত্র ভেঙ্গেচুরে মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি খেয়ে একাকার হবে। মহাকাশযানগুলোই বা সারানো হবে কি করে?' আমি আঁৎকে উঠলাম।

'এ্যাঁ, তা হলে আমাদের বাতাসের বোতলের ব্যবসার কি হবে? ডাক- উইড দিয়ে যে অক্সিজেন তৈরি হবে তাকে রাখব কিসে?'

গুপি বিরক্ত হয়ে বলল, 'এই বিদ্যে নিয়ে হয়েছে তোর চন্দ্রযাত্রা! বাতাসের বোতল পাওলা প্ল্যাস্টিকের হবে, তাও জানিস না? কাচ তো বেজায় ভারি। কিন্তু মিনিটে কুড়িবার ঘোরালে বাতাস থেকে মাখন- টাখন না উঠলে বাঁচা যায়। ছোটমামা এই নিয়ে এত বেশি ভাবছে যে এবারও পরীক্ষায় কি হয় কে জানে।'

ছোট মাস্টার সেদিন আগেই এসেছিলেন। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ধনে পাতা চিবুচ্ছিলেন আর তেওয়ারির দোকানের বুড়িকে অবাক হয়ে দেখছিলেন। এবার তিনি হঠাৎ পকেট থেকে সবুজ মলাটের একটা বই বের করে বললেন, 'ছোটমামাকে ভাবতে বারণ কর। বরং পড়াশুনো করুক। এই বইতে লেখা আছে কি করে কল-কব্জার সাহায্যে বাইরের খোলট। পাক খাবে, অথচ ভিতরকার জিনিসপত্র শূন্যে ঝুলে থাকবে, একটুকু নড়বে না। এই দেখ ছবি, এই লোকগুলো সাতঘণ্টা পাক খেয়েছে, মাখন-টাখন কিচ্ছু ওঠে নি।'

তারপর গুপি আমার দিকে ফিরে বলল, 'ও কি, তোর চোখ লাল কেন?'

রামকানাই মাছের কচুরি এনেছিল। আমার গোল টেবিলে সেগুলোকে নামিয়ে রেখে, ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, 'লাল হবে না তো কি। দুদিন ধরে পাতি বেড়ালের শোকে কান্নাকাটি হয়েছে যে।'

তাই শুনে গুপি আর ছোট মাস্টার দুজনেই অবাক। সে কি! নেপোর সাংঘাতিক কিছু হয়েছে নাকি? রামকানাই বলল, 'হবে আবার কি! পেয়ারের বেড়াল হাওয়া। আজ তিন দিন সে বাড়ি আসে নি।'

ছোট মাস্টার বললেন, 'গেল কোথায়?'

শুনে রামকানাইয়ের কি হাসি। 'গেছে কার বাড়ির পাতকুভূনি খেতে।'

ভারি রাগ হল। চেঁচিয়ে বললাম, 'মোটেই না। নেপো কারো

পাতকুড়নি খায় না। বিদ্‌ঘুটে ওকে ভুলিয়ে নিয়ে গেছে।' ছোট মাস্টার বললেন, 'বিদঘুটে আবার কে?'

আমি কিছু বলার আগেই রামকানাই সর্দারি করে বলল, 'ঐ যে নটে-কান কেঁদো হুলো, তাছাড়া আবার কে! শুধু কি ডাস্ট-বিন ঘেঁটে ওর অমন গতর হয়েছে নাকি? গোলগাল বেড়াল দেখলেই তাকে ভুলিয়ে অন্ধকার গলিতে নিয়ে গিয়ে কপ। নেপো হতভাগাকে পই-পই করে মানা করেছি, ওর সঙ্গে মিশিস্ নে, তা কে কার কথা শোনে। এখন বোঝ ঠ্যালা! কোথায় ঠ্যাং ছড়িয়ে-' রামকানাই চুপ করল।

আমি বললাম, 'এই পাড়া থেকে গত ছয় মাসে একত্রিশটা বেড়াল নিখোঁজ। কালো মেমের হলদে ট্যাবি পর্যন্ত। বিছুটে কিছু অত বেড়াল খায় নি। আর খায়ই যদি তো আমার নতুন খাতা নিয়ে গেছে কেন?'

ছোট মাস্টার বললেন, 'নিতাই সামন্তকে বললে হয় না? যে অত চোরাই গাড়ি খুঁজে দেবে, সে একটা সামান্য বেড়াল খুঁজে দিতে পারবে না?'

এ কথা আমার আগে মনে হয় নি।

গুপি বলল, 'আমার ছোটমামাকেও বললে হয়, তার খুব বৃদ্ধি। সে বলেছে চাঁদে মাটি নিয়ে যেতে হবে। ওখানকার মাটিতে ফসল হবে না। তাছাড়া কেঁচোও নিয়ে যেতে হবে। তারা তলার মাটি উপরে তোলে। তাহলে বেশি ভারি ভারি ট্র্যাক্টর নিতে হবে না।'

বড় মাস্টার ঠিক সেই সময় এসে ঘরে ঢুকলেন। 'বড় দেরি হয়ে গেল, পানু। ঐ রাখেশ আর বকু ভূতের ভয়ে আজ কিছুতেই বাড়ি থেকে বেরুবে না! শেষ পর্যন্ত নিজে গিয়ে টেনে বের করে আনতে হল। নাকি মোড়ের ঐ কোম্পানির আমোলের গুদোম বাড়ির দেয়াল থেকে ভূত নামতে অনেকে দেখেছে। সাহেব মেম ভূত। সেজেগুজে, নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে চলে যায়, কারো দিকে তাকায় না।'

গুপি বলল, 'কিছু বলে না তো ওরা ভয় পায় কেন?'

বড় মাস্টার বললেন, 'সে কথা কে বলে!' ছোট মাস্টার বললেন, 'পানুর অমন ভালো বেড়ালটাকে পাওয়া যাচ্ছে

না।'

তাই নাকি? রামকানাইকে দিয়ে পাড়া খোঁজাও। ঐ চীনে হোটেলের পেছনে ঠান্ডাঘরের কাঠের সিড়িতে রোজ রাতে বেড়ানদের সভা বসে, আমি নিজের চোখে দেখেছি। তাদের মধ্যে নেপো আছে কি না একবার দেখে আসুক।'

রামকানাই ঝুরিভাজা এনেছিল। সে বললে, 'সে কি আর বাকি রেখেছি, মাস্টারবাবু। সিড়িতে থিক্সিক্ করছে বেড়াল। কোন সময় হোটেন থেকে চিংড়িমাছের খোলা বাইরে পড়ে সেই আশাতেই বসে আছে। কিন্তু তার মধ্যে নেপো নেই। তিনি কাঁটা কি খোলা খান না। পানুদাদা মাছ বেছে দিলে তবে তিনি মুখে তোলেন।'

বড় মাস্টার চেয়ারে বসে বললেন, 'খায় না আবার! তেমন অবস্থায় পড়লে, না খায় এমন জিনিস থাকে না। একবার আমরা বড় বোট নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট ছোট দ্বীপে গুয়ানো খুঁজছিলাম। সমুদ্রের পাখিদের ময়লা জমে থাকে, তাকেই ওয়ানো বলে, বাজারে চড়া দামে বিক্রি হয়।

একটা ছোট্ট দ্বীপে উঠছি, সমুদ্রের তীরে অনেকটা বালি, দ্বীপটা কিন্তু পাথরে তৈরি, ওপরটা চ্যাপ্টা, পাথরের খাঁজে খাঁজে যেখানে মাটি একটু পুরু, সেখানেই বেঁটে বেঁটে গাছপালা, ঝরণাও আছে নিশ্চয়। ভাবলাম এখানে নোঙর করে দুদিন বিশ্রাম করা যাবে। দেখে মনে হল মাছের আর পাখির ডিমের অভাব হবে না। নৌকোর ক্যাপ্টেন আর আমি আর আমার পোষা বেড়াল ম্যাও আগে নামলাম। আমরা দেখে এলে অন্যেরা নামবে।

তবে অনেকেরি খুব রাগ, ম্যাও নামছে অথচ তাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে! যাই হোক, আমরা বালি পেরিয়ে হাঁচড় পাঁচড় করে দ্বীপের পাথুরে গা বেয়ে উঠতে লাগলাম। দেখতে দেখতে নৌকো আমাদের চোখের আড়াল হয়ে গেল।

আগে আগে ক্যাপ্টেন, তারপর আমি, আমার ক্যাপ্টেন বলল, "দ্বীপটা যেন একটু অদ্ভুত ঠেকছে। কেন ?" সত্যি, এমন চুপচাপ দ্বীপ কখনো দেখি নি। কাঁধে ম্যাও বসে। পাখির ডাক নেই সমুদ্রের শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যায় না। ওয়ানো ছেড়ে দিলাম, একটা জন্তুজানোয়ার বা পাখি, কিছু দেখতে পেলাম না। তার উপর ম্যাও ঘাড়ের লোম ফুলিয়ে কেবলি রেগে গর-গর করতে লাগল।

যাকে গাছগাছড়া ভেবেছিলাম তাও দেখলাম কাঁটাঝোপ ছাড়া কিছু নয়! অনেক খুঁজে ছোট্ট একটা ঝরণা পেলাম। আরেকটু রোদ উঠলে কি সাংঘাতিক গরম হবে ভেবে তাড়াতাড়ি পাথর বেয়ে নামতে লাগলাম । ঐ ন্যাড়া পাথর তেতে উঠলেই হয়েছে আর কি! খানিকটা পথ বাকি থাকতে অবাক্ হয়ে চেয়ে দেখি সমুদ্রের তীর চাঁছাপোঁছা, দূরে ডলের উপর একটা কালো দাগ ক্রমে ছোট হতে হতে শেষটা মিলিয়ে গেল। নাবিকদের নামতে দেওয়া হয় নি বলে তারা রেগেমেগে আমাদের ফেলে চলে গেছে।

হতাশ হয়ে যেখানে ছিলাম, বসে পড়লাম। অমনি ম্যাও এক লাফে আমার ঘাড় থেকে নেমে, রেগে তিনগুণ বড় হয়ে গর-র গর-র করতে লাগল। দেখি পাশেই একটা গুহার মুখ।

রোদ থেকে আশ্রয়ের আশায় ঢুকে পড়লাম তার ভিতর। খানিকদূর গিয়ে দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকারে এখানে ওখানে জোড়া জোড়া চোখ জ্বলছে। টর্চের আলো ফেলে দেখি পাথরের থাকে থাকে বেড়াল। কালো, হলদে, সাদা, ছাই, পাটকিলে। বোধ হয় ম্যাওকে দেখেই, তারা সব উঠে দাঁড়িয়ে, চার পা এক জায়গায় জড়ো করে, পিঠ কুলোর মতো বাঁকিয়ে, পাথরের উপর নখ ঘষতে লাগল। তার খড় খড় শব্দে আমাদের গায়ে কাঁটা দিল। ম্যাও একেবারে কাঠ!

কোনোমতে হোঁচট খেতে খেতে পড়িমরি করে গুহা থেকে বেরিয়ে বাঁচলাম। অবাক হয়ে দেখি আমাদের নৌকো আবার ফিরে আসছে। আমরা নিচে পৌঁছবার আগেই ম্যাও গিয়ে নৌকোয় উঠে পাটাতনের তলায় গুটিগুটি হয়ে বসে পড়ল। বেড়ালের খাদ্যের কথাই যদি বল, ঐ দ্বীপে তারা খেত কি? পাখি নেই, প্রাণী নেই, গাছপালা নেই। হয়তো পরস্পরকেই-'

ছোট মাস্টার বললেন, 'না, না, নিশ্চয় সমুদ্রের মাছ ধরে খেত। ঢেউয়ের সঙ্গে যে-সব ঝিনুক, শামুক, তারামাছ, সমুদ্রের ঘোড়া, জেলিফিস্ এসে বালির উপর পড়ে, তাও খেত ।'

বড় মাস্টার বললেন, 'পরে শুনেছিলাম, এক জাহাজের ক্যাপ্টেনের দুটো বেড়াল ছিল। তাদের উৎপাতে টেকা দায় হয়ে উঠেছিল বলে নাবিকরা লুকিয়ে ওদের ওখানে ফেলে দিয়ে গেছিল। ওরা নাকি টিনের মাছ ছাড়া কিছু খেত না! এদিকে নাবিকরা শুকনো মাংস পেত।

ঐ সব বেড়াল নিশ্চয় তাদেরি বংশধর।'

ঠিক এই সময় ঠান্ডাঘরের দিক থেকে খুব জোরে কতগুলো ঠক-ঠক শব্দ, তার পরেই এমনি ঝন ঝন্ যে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। বড় মাস্টার ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়লেন। কি জানি ওঁর বাড়িতেই কিছু হল না তো। পঙ্গু বৌ একলা আছে।

ছোট মাস্টার বললেন, 'বরফ ফাটলে ঐ রকম শব্দ হয়। রাখেশ আর তার বন্ধুরা বলছিল যে ঘর এত বেশি ঠান্ডা করে ফেলেছে যে কয়েকটা পেঙ্গুইন পাখি দেখা দিয়েছে।'

গুপি বলল, 'ওরা তো ভূতও দেখে।' সেদিন সবাই একটু তাড়াতাড়ি চলে গেল। রামকানাই ঘরে এসে বলল, 'তিনজনে এসে পঁচিশটা কচুরি সাঁটাল, অথচ বেড়ালের একটা গতি করতে পারল না। আমার কিন্তু বুড়ি মেমকেই সন্দেহ হয়।'

আমি বললাম, 'ওর বেড়াল-ও তো গেছে। তুমি সবাইকে সন্দেহ কর।'

'সবাইকে সন্দেহ না করেই বা করি কি। তুমি তো তেওয়ারির দুঃখে গলে যাও। আহা, বেচারা, রোদে বৃষ্টিতে চাটাইয়ের ছাউনির নিচে বসে চ! জলখাবার তৈরি করে আর বিক্রি করে। রাতে শোবার একটা ভালো জায়গা পায় না, হেনা তেনা কত কি বল। জান, ঐ চারতলা ঠান্ডা ঘরটির মালিক কে? ঐ তেওয়ারি ছাড়া আর কেউ নয়। তোমার বাবাকে তেওয়ারি কিনে ফেলতে পারে, তা জান?'

ভীষণ রেগে গিয়ে গড়গড় করে গাড়িটা চালিয়ে জানলার কাছে গেলাম। দেখলাম বুড়ি ভিকিরি তেওয়ারির সঙ্গে কি নিয়ে ঝগড়া করছে। রামকানাই-ও জানলার ধারে এসে বলল, 'ঐ আরেক জন। আমার হাতে দিয়ে ওর জন্যে কত পয়সাই না পাঠিয়েছ তুমি। তোমার মার কাছ থেকে চেয়ে খদ্দরের চাদর পর্যন্ত ওকে দিয়ে আসতে হয়েছে। আর তেওয়ারি তো প্রত্যেক দিন সন্ধ্যেবেলায় দোকান বন্ধ করার আগে, শালপাতার ঠোঙা ভরে ওকে ঝড়তিপড়তি খাবার দেয়। তাই নিয়েই আবার ঝগড়া করে বুড়ি। আর ঐ যে মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে অনেক রাতে একটা বুড়ো ভিক্ষে করে, চোখে দেখে না। মুখে কথা নেই, শুধু হাতটা পেতে দেয়। ওকে দেখে সকলের দয়া হয়, সবাই পয়সা দেয়। দুজনার তফাৎটা দেখেছ তো?'

আমি বললাম, 'তা দেখেছি। তাই বলে ঝগড়াটি বুড়িকে চাদর দেব না কেন? ওর-ও তো ঠাণ্ডা লাগে।' রামকানাই বলল-'তা লাগে বৈকি। তাছাড়া ঝগড়াটে বুড়ি আর ভালো মানুষ বুড়ো এক-ই লোক।

পাঁচ

শুনে আমি হাঁ। তাকিয়ে দেখি বুড়ি তেওয়ারির নিজের ভাগ থেকে আরো দুটো পুরী নিয়ে, ঝগড়া শেষ করে, খাবারগুলোকে কোঁচড়ে বেঁধে, তরতর করে ঠাণ্ডাঘরের বাঁশের ভারা বেয়ে উপরে উঠে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল! ভারায় চড়ার আগে একবার চারদিকে চেয়ে দেখল। মুখের উপর রাস্তার আলো এসে পড়ল। অবাক হয়ে দেখলাম রামকানাই ঠিক-ই বলেছে। অবিকল এক। মোড়ের মাথার বুড়োর আর ঝগড়াটি বুড়ির মুখ

বললাম, 'রামকানাইদা, ওরা তো যমজ-ও হতে পারে।' রামকানাই কাষ্ঠ হেসে বলল, 'তা হলে দুজনকে এক সঙ্গে দেখা যায় না কেন? না পানুদা, পৃথিবীতে কাকেও বিশ্বাস হয় না। বিশেষ করে তোমাদের নতুন বন্ধু ঐ ছোট মাস্টারটিকে তো নয়-ই। এদিকে তলাপত্র বলতে বুড়ো মাস্টার অজ্ঞান! ওর কপালে দুঃখ আছে বলে রাখলাম।'

এই বলে রামকানাই দরজা খুলে দিতে গেল। বাবা-মা নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরে এসেছেন। সঙ্গে আবার কাকু আর নিতাই সামন্ত-ও এসেছিলেন। নিতাই সামন্তকে আজকাল এই পাড়ায় রাতে ডিউটি দিতে হয়, তাই এক পেয়ালা গরম চা না হলে চলে না। এক পেয়ালা মানেই দুই পেয়ালা আর গোটা দুই পান।

আমি গাড়ি চালিয়ে বসবার ঘরে গিয়ে ওদের কথাবার্তা শুনতে লাগলাম। খালি বিন তালুকদারের অদ্ভুত বুদ্ধির গল্প। বিন্ তালুকদারের চেহারা নাকি দিল্লীর দু-একজন বড় কর্তা ছাড়া, কেউ দেখে নি। তার টিকটিকিদেরও কেউ চেনে না। এখানকার পুলিস বিভাগের কেউ তো নয়ই। নিতাই সামন্ত এক টিপ চুন দাঁতে লাগিয়ে বললেন, 'কে জানে মশাই, ঐ যে-লোকটাকে সন্দেহ করে আজ এই রাতের অন্ধকারে ভূতের গলিতে যাচ্ছি, সে-ই হয়তো বিনু তালুকদারের গুপ্ত গোয়েন্দা, ছদ্মবেশে বেড়াচ্ছে। আমার অবিশ্যি ভূতের ভয় নেই। কারণ প্রথমতঃ ভূত আছে বলেই বিশ্বাস করি না। দ্বিতীয়তঃ আমার হাতে গুরুদেবের দেওয়া অব্যর্থ মাদুলী বাঁধা আছে। ভূতে আমার কিছু করতে পারবে না।'

নিতাই সামন্ত চলে গেলে পর বাবা বললেন, 'ঐ গুপিটার পাল্লায় পড়ে তু-ইও যেন পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে শুধু চাঁদে যাবার জোগাড়-যন্ত্র করিস্ না। চাঁদে গেলেই হল আর কি!'

আমি বললাম, 'না, বাবা, শুধু চাঁদে যাওয়া নয়, চাঁদ থেকে আরো দূরে যাওয়া হবে। ওটা হল প্রথম স্টেশন, ওখানেই নাকি টিকিট কাটতে হবে, গুপির ছোটমামা বলেছেন।'

শুনে বাবা তো হেসেই কুটোপাটি। 'আর ছোটমামা! আরে তোদের গুপির ছোটমামা তো ফেরারি আসামী! এক বাক্স স্ক্রু-ট্র নিয়ে হাওয়া। লিখে রেখে গেছে যে সামান্য বি-এস্-স্ িপাস করে তার কিছু হবে না, সে চাঁদে যাওয়ার চেষ্টায় আছে।'

আমার কান্না পেল। 'তা হলে গুপিকে আমাকে না নিয়েই ছোটমামা চাঁদে চলে গেলেন নাকি? জমিটমি কিনে রেখেছেন বোধ হয়, কিন্তু-'

বাবা এত বেশি হাসতে লাগলেন যে থামতে হল। বাবা বললেন, 'না, না, অত ভাবনার কারণ নেই। চোঁয়াতেকুর ওঠাতে সে আবার ফিরে এসেছে।'

সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই ঝন-ঝন্ শব্দ। আমি বললাম, 'বরফ ফাটছে। ওখানে পেঙ্গুইন গজিয়েছে।'

বাবা এমনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে হাসি থেমে গেল। আমি যদি হাঁটতে পারতাম, একদিনও এ বাড়িতে থাকতাম না।

আরো সাত দিন কেটে গেল, নেপোর কোনো পাত্তা নেই। মেজকাকু বললেন, 'একটা পার্সিয়ান ক্যাট এনে দিই, কি বলিস? বাড়ি ছেড়ে এক পা নড়বে না, এই বড় সাইজের, ছাই রঙের গা, নীল চোখ। বেড়ালকে বেড়াল, কুকুরকে কুকুর। পাতি বেড়াল কেউ পোষে নাকি?'

খুব দুঃখ হল। বললাম, 'কেন পুষবে না? আমাদের এই বাড়িতে আটটা ফ্যাট, প্রত্যেকের একটা করে বেড়াল ছিল। এখন অবিশ্যি সবার নেই। তিন নম্বর, চার নম্বর আর সাত নম্বরের বেড়ালও অদৃশ্য হয়ে গেছিল, তবে তারা ফিরে এসেছে। বিদ্‌ঘুটে তাদের খায় নি, রামকানাই যাই বলুক না কেন।'

ছোট মাস্টার বললেন, 'এ তো ভারি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। আপনার বন্ধু নিতাই সামন্ত এই নিয়ে একটু তদন্ত করলে পারেন।'

মেজকাকু চটে গেলেন, 'রেখে দিন ওসব বাজে কথা। সে এখন নিজের কাজ ফেলে বেড়ালের পিছন ঘুরুক আর কি!'

বড় মাস্টারমশাই না থাকলে ছোট মাস্টারের বেজায় সাহস বেড়ে যায়। তিনি বললেন, 'আহা, এমন-ও তো হতে পারে যে গাড়ি চুরি আর বেড়াল চুরি দুটো আলাদা ব্যাপার নয়?'

মেজকাকু অবাক হয়ে ছোট মাস্টারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ঠিক সেই সময় বড় মাস্টার এসে ঢুকলেন। মেজকাকু তাঁকে তলাপত্রের মন্তব্যটা বলে খুব হাসতে লাগলেন।

বড় মাস্টারমশাই বেশ গম্ভীর মুখেই বললেন, 'তাহলে বুঝতে হবে কি যে এখনো নেপোকে পাওয়া যায় নি আর তলাপত্রের মতে চোরাই গাড়ি আর হারানো বিল্লি একসঙ্গে পাওয়া যাবে? তা কিন্তু কিছুই বলা যায় না। হয়তো চোরাই গাড়ির গোপন কারখানায় ইদুরের উপদ্রবে টেকা যাচ্ছিল না বলে ওরা বেড়াল আমদানি করছে। কি বল তলাপত্র?'

তলাপত্র লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। বড় মাস্টার বললেন, 'তা হলে শোন। বর্মায় একবার দেখা গেল যখনি-'

এইটুকু বলেছেন, এমনি সময় হন্তদন্ত হয়ে গুপি এসে উপস্থিত। তার চোখমুখ দেখে বুঝতে পারলাম একটা কিছু হয়েছে। সে ভীষণ উত্তেজিত- ভাবে বলল, 'ছোট মাস্টারমশাই, আপনি ঠিকই বলেছিলেন। এক্ষুণি দেখলাম দু তিন জন লোক জালে জড়িয়ে ছোট ছোট জ্যান্ত মাছ নিয়ে ঠান্ডাঘরের গলিতে ঢুকল। ওখানে যে পেঙ্গুইন গজিয়েছে সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই।'

বড় মাস্টার অবাক হয়ে বললেন, 'কি বলেছে তলাপত্র? ঠাণ্ডাঘরে পেঙ্গুইন গজিয়েছে? মাছ গজায় নি?'

তলাপত্র আস্তে আস্তে বললেন, 'না স্যার, জল ছাড়া মাছ বাঁচবে কি করে?'

বড় মাস্টার আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় বাবা মা ফিরে এলেন। 'আরে গুপি, তুই এখানে? এদিকে যে তোর ছোটমামাটি এবার সত্যি ফেরারি হয়ে গেছে সে খবর রাখিস?'

বাবা খুব হাসতে লাগলেন। কিন্তু আমাদের হাত পা জমে বরফ। ছোটমামা ফেরারি হলে আমাদের চাঁদে যাওয়ার কি হবে? বাবা একটা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, 'সে এক কান্ড, মশাই। বইয়ের সঙ্গে চাঁদু ছোকরার সম্বন্ধ নেই, খালি অলি-গলিতে ঘুরবে আর যত রাজ্যের রাবিশ কিনে আনবে। যত সব মলাট ছেঁড়া বাজে বই আর জং ধরা লোহার টুকরো। নিজের ঘরটাকে ছাদ অবধি বোঝাই করে ফেলছে। তারপর কাল একেবারে বাঘের সঙ্গে মুখোমুখি! বাছাধন বাজারের থলি বোঝাই পেরেক, শেকল ইত্যাদি নিয়ে বাড়িতে ঢুকছেন। তাও সোজা পথে না, জলের পাইপ বেয়ে। আর পেছন থেকে বেল্ট খামচে ধরেছেন প্রাণেশবাবু!'

বড় মাস্টার বললেন, 'তিনি কে?'

'কে আবার, ছোটমামার বাবা, অর্থাৎ গুপির দাদু! বুড়ো তো চটে কাঁই। হতভাগা কিছুতেই পড়বে না। পাছে পালায় তাই ঘরের শেকল তুলে দিয়েছিলেন, জানলা দিয়ে বেরিয়ে পাইপ বেয়ে পালাল!!-ছেলের হাত থেকে থলি পড়ে পেরেক ছড়িয়ে একাকার। তাই দেখে বুড়োর হাত-ও হয়তো একটু ঢিলে হয়েছিল, অমনি হ্যাঁচকা টানে বেল্ট ছিঁড়ে ছোকরা পগার পার! সারা রাত সারা দিন গেছে ছেলের দেখা নেই। ওবাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেছে। তুই বলতে চাস্, তুই কিছু জানিস না, গুপি?'

গুপি তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বলল, 'আমি কি করে জানব? আমরা থাকি হেদোর কাছে-আর দাদুরা বাদুড়বাগানে। যাই, অনেকগুলো হোমটাস্ক করতে হবে।' এই বলে দৌড়।

গুপি চলে গেলে বাবা বললেন, 'ঐ দুষ্টু মামা আর তার এমন ভালো ভাগ্নে! গুপির মতো হতে চেষ্টা করিস পানু।' তারপর মেজকাকুকে বললেন, 'আসল কথাই বলতে তুলে গেলাম! চাঁদুর ঘর সার্চ করা হয়েছে, যদি কোথায় গেল তার কোনো ক্ল পাওয়া যায়। লোহার স্তুপের নিচে থেকে দুটো ভাঙ্গা মোটর গাড়ির নম্বর প্লেট পাওয়া গেছে। দুটোই চোরাই মোটরের নম্বর প্লেট।'

মেজকাকু বললেন, 'সে কি! কি করে জানলে?'

'আরে, চাঁদুর মা এমন কান্নাকাটি লাগিয়ে দিয়েছেন যে শেষ পর্যন্ত বুড়ো থানায় গিয়ে ছেলে হারানো ডাইরি করে এলেন। সেখানে সবাই হেসেই কুটোপাটি, হারিয়েছে আবার কি, পেলিয়েছে বলুন! ঐখানেই তোর বন্ধু নিতাই সামন্তর সঙ্গে দেখা। সে-ই ঘর সার্চ করে নম্বর প্লেট বের করেছে আর ফর্দ মিলিয়ে দেখেছে দুটোই হারানো গাড়ির নম্বর প্লেট। কাজেই চাঁদুর পেছনে এবার হুলিয়া লেগেছে। শুধু যে ঘর পালানো ছেলে তাতো নয়, একেবারে ফেরারি আসামী। ধরা পড়লেই হাতে হাতকড়া।' শুনে সবাই থ। বাবা একটু হেসে, উঠে গেলেন। তখন আমি বললাম, 'তা হতে পারে না, আমরা চাঁদে যাব বলে ছোটমামা স্পেস্-শিপ বানাবেন, তাই পেরেক টেরেক জম। করছেন। ওসব জিনিস উনি নিজের টিপিনের পয়সা দিয়ে সের দরে কেনেন। কোথা থেকে ওগুলো কিনেছেন বের করতে পারলেই গাড়িচোরও বেরিয়ে পড়বে।'

মেজকাকু বললেন, 'তা হলে কোথা থেকে কিনেছে সেটা জানা দরকার। অর্থাৎ ওকে ধরা দরকার। যাই, দেখি নিতাই কি বলে।'

মেজকাকু চলে গেলে বড় মাস্টারমশাই বললেন, 'ও কি পানু, অত 'মন-মরা কেন? ঐ ছেলেকে ধরবে নিতাই সামন্তরা? তাহলেই হয়েছে! ওদের ও এক হাটে কিনে আরেক হাটে বেচে আসতে পারে। তোমাদের চাঁদে যাওয়ার কোনো অসুবিধাই হবে না। অবিশ্যি চাঁদে যাওয়াটা আমি কোনোদিনই সমর্থন করব না। তাছাড়া পায়ের এক্সারসাইজগুলো করছ তো? নইলে চাঁদে যাবেই বা কি করে?' কি বললে তলাপত্র, মুখ তুলে কথা বল না কেন? তোমাকে তো আর আমি খেয়ে ফেলব না!'

ছোট্ট মাস্টারমশাই ভয়ে ভয়ে বললেন, 'ঐ যে বর্মার গল্পটা- 'কোনটা? ঐ ফুতিদের মাছের গল্পটা? 'না, না, ঐ যে যখনি কি হয় তখনি আরেকটা কি হয়-'

বড় মাস্টার খুব হাসলেন, 'ও, সেইটে। বুঝলে পানু, বি-এ পাস করিয়ে, বাবা আমাকে কিছুদিন রেঙ্গুনে রেখেছিলেন। ওখানে আমাদের একটা আপিস ছিল। আপিসটা দেখতে ছোট, একটা এত সরু গলির মধ্যে যে তার ভিতর মোটর গাড়ি ঢুকত না। কিন্তু সেখানে লক্ষ লক্ষ টাকার আমদানি রপ্তানি কারবার হত। লোক গিজ গিজ করত গলিটিতে। একদিনে এত কোটি কোটি টাকার লেনদেন বর্মায় আর কোথাও হত না।

আমাদের থাকার জায়গা ছিল ওপর তলায়। পাশাপাশি দুটি বেশ বড় ঘর, রান্নাঘর, স্নানের ঘর। তা তোমাদের বৌঠান কিছুতেই একা বেরুবে না, সবটাতেই তার বেজায় সন্দেহ। যত পুরনো লোক হয় ততই ভালো। বুঝলাম লোক রাখতেই হবে, এবং দুঃখের বিষয়, লোকরা যেই একটু পুরনো হয়, রাঁধাবাড়ায় হাত পাকায়, অমনি বলা নেই কওয়া নেই কোথায় উধাও হয়। তারপর কিছুদিন ভারি অসুবিধা, লোক পাওয়া যায় না। তোমাদের বৌঠান রাঁধে খাসা, কিন্তু হাটবাজার আমাকে করতে হত। এদিকে কাজের এতটুকু ক্ষতি হলেই, বাবা হয়তো রেগেমেগে ত্যাজ্যপুত্র করে দেবেন।

এবাড়ি ওবাড়ি জিজ্ঞাসা করে টের পেলাম, শুধু আমাদের বাড়িতে নয়, সব বাড়ির ঐ এক অবস্থা। মাস তিনেক ঐ ভাবে চলে, তারপর আস্তে আস্তে আবার লোক পাওয়া যায়। ভাবলাম এদেশের ঐ রকমই ব্যাপার, এরা ছয় মাস কাজ করে তো তিন মাস দেশে বসে খায়।

দু বছর এইভাবে চলল, তারপর সালওয়েন নদীতে মানপু বলে একটা ছোট জায়গায় যেতে হল। একাই গেলাম, পরিবার নিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয়, বেজায় ডাকাতের উপদ্রব। পৃথিবীতে যেখানেই যাওয়া যাক না কেন, একটা না একটা ঝামেলা থাকে। ঐখানে আমাদের কাঠগুদোষ ছিল, বন্দুকধারী পাহারাওয়ালা রাখতে হত, নিজেদেরো যথাসম্ভব সতর্ক থাকতে হত। ডাকাতির ঢেউ আসত। মাস তিনেক খুব ডাকাতি, তারপর ছয়মাস সব চুপচাপ। তারপর আবার ডাকাতি। আমরাও তাই বুঝে কাজ গছিয়ে নিতাম, ঐ ছয়মাসের মধ্যে টাকাকড়ির লেনদেন সেরে ফেলতে চেষ্টা করতাম। রেঙ্গুনের চাকর পালানোর আর মানপুর ডাকাতির কোনো সম্বন্ধ আছে কেউ সন্দেহও করতাম না। বছর পাঁচেক বাদে রেঙ্গুনে একজনদের চাকর হঠাৎ মারা গেলে, তার জিনিসপত্রের মধ্যে এমন সব চোরাইমাল বেরুন যাতে আর কোনো সন্দেহই রইল না যে যারা ছয়মাস ভালোমানুষ সেজে রেঙ্গুনে লোকের বাড়িতে কাজ করত, তারাই মানপতে তিনমাস দুর্ধর্ষ ডাকাতি করত। কাজেই কিসের সঙ্গে কিসের সম্বন্ধ আছে কিছুই বলা যায় না। চল হে তলাপত্র, তোমাকে ভূতের গলিটা পার করে দিয়ে আসি।

ওরা চলে যাবার আধঘণ্টা পরে রামকানাই আমার জন্যে হলিক্স নিয়ে এল। মুচকি হাসতে হাসতে বলল, 'যত সব বিদ্যে দিগগজ হয়েছেন।'

আমি বললাম, 'কি যে বল, রামকানাই, বড় মাস্টার কত দেশ ঘুরেছেন, কত রকম দেখেছেন।'

রামকানাই বলল, 'মুখে যত বৌয়ের উপর দয়া, আর ওদিকে একবার তাকিয়ে দেখ না। দুমুখো সাপ। আজ আমি কিন্তু রাতে তোমার ঘরে শোব না, যাল্লা দেখতে যাব। ভয় করে তো বুড়ো মাস্টারকে ডাকতে পার।' বড় মাস্টারমশাইকে ভক্তি করি বলে রামকানাইয়ের যত রাগ।

তবু ওদের জানলার দিকে তাকিয়ে একটু আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না। এত দূর থেকে কথা শোনা যায় না, শুধু ছায়ার মতো দেখা যায়। মনে হল বকবার আঙ্গুল তুলে মাস্টারমশাই বৌকে শাসাচ্ছেন। বড় কষ্ট হল ।

সে রাতে আর কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বার বার উঠে বসে জানলা দিয়ে দেখছিলাম, বড় মাস্টারমশাইয়ের ঘরে তখনো আলো জ্বলছে আর বড় মাস্টারমশাই ঘরময় অস্থির ভাবে পাইচারি করছেন। একবার তন্দ্রামতো এসেছিল, চমকে জেগে উঠলাম। কে ঠোঁট চেপে শিস্ দিচ্ছে 'শ্ শ্ টস্ শ্ট'। এ তো গুপির আর আমার গোপন সংকেত। এত রাতে গুপি কি করে এল? হাতে ভর দিয়ে এক লাফে গাড়িটাতে চড়ে জানলার কাছে গিয়ে দেখি যা ভেবেছি ঠিক তাই। গুপি ছাপাখানার ঘোরানো সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, কাঁধে একটা তক্তা। আমি ইশারা করে ডাকতেই তক্তাটা যথাস্থানে ফেলে স্বচ্ছন্দে ফাঁকটুকু পার হয়ে আমাদের ঘোরানো সিঁড়িতে এসে উঠল। বাবা! ঐ তিনতলার উপরে সরু তক্তার উপর দিয়ে ওকে হটিতে দেখে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। আমাদের সিঁড়িতে উঠে আবার ঝুঁকে তক্তণটাতে টান দিল। দেখি এ মাথাটা আমাদের রেলিংএর সঙ্গে বেঁধে ফেলেছে। ঐখানেই তক্তাটা ঝুলতে লাগল।

আমার শোবার ঘরের-পাশেই খাবার ঘর, তার বাইরে সরু বারান্দা। কার্নিশ বেয়ে দুই হাত হেঁটে সেই বারান্দায় উঠতে গুপির পাঁচ মিনিটও লাগল না। আমি খাবার ঘরের দরজার। নচু ছিটকিনিটা খুলে দিলাম। গুপি ঠোঁটের ওপর একটা আঙ্গুল রেখে আস্তে আস্তে আমার ঘরে এল। খাবার ঘরের পর বসবার ঘর, তার ওপাশে মা-দের ঘর।

তবু আমার দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম। গুপি বলল, 'বাড়িতে বলে এসেছি তোর এখানে খাব শোব।'

'খাবার কোথায় পাব? ভুলিতে পাঁউরুটি থাকতে পারে।'

'আরে দূর, ছোটমামার কাছে খেয়ে এলাম এক্ষুণি। পরটা কাবাব ক্ষীরের সন্দেশ।'

এমনি চমকে গেলাম যে জিব কামড়ে ফেললাম। গুপি বলল, 'এসব কথা কাউকে বলবি না। ছাপাখানার ঐ যে ঘোরানো সিঁড়ির মাথায় দরজা দেখছিস, ওটা ছোটমামার ঘর। ছোটমামা ছাপাখানার বদলি নাইট ওয়াচম্যানের চাকরি পেয়েছে।' এই বলে গুপি মুখ চেপে বেজায় হাসতে লাগল। 'সবাই জানে ও আগের পাহারাওয়ালার ছোট ভাই।'

একটু পরেই আমার আরাম কেদারায় কুশন মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ে গুপি বলল, 'দাড়ি পরে কি অদ্ভুত দেখাচ্ছে সে আর কি বলব। নকল দাড়ির নিচে সত্যি দাড়ি গজাচ্ছে। এই দুদিনেই চমৎকার খোঁচা খোঁচা বেরিয়েছে। কিন্তু ভুলে যাস্ না যে ওর প্রাণ তোর হাতে।' এই বলেই পাশ ফিরে গুপি দিব্যি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল।

আমারো গায়ের রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল! আমাকেও গুপির আর ছোটমামার উপযুক্ত হয়ে উঠতে হবে। আস্তে আস্তে পা দুটোকে গুটোতে চেষ্টা করতে লাগলাম। আশ্চর্য হয়ে টের পেলাম, অন্য দিন কিছু হয় না, আজ কিন্তু পায়ের গুলিটাকে বেশ শক্ত করতে পারছি।

শুয়ে শুয়ে ভাবলাম, কাল সকালে গুপিকে দেখে মা কি বলবেন। নিশ্চয় জানতে চাইবেন কোথা দিয়ে এসেছে! ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি সাতটা বেজেছে, রামকানাই আমার হলিক্স এনেছে, গুপির কোন চিহ্ন নেই। পরে জানলার কাছে গিয়ে দেখি তক্তাটাও নেই! তবে স্বপ্ন যে নয়, তার প্রমাণ গুপি তার ছেঁড়া চটি ফেলে, আমার আন্ত চটি কি আর জুতোই বাকি! পরে চলে গেছে। যাক্ গে, আমার চটিই বা আমি তো দু পায়ে ল্যাংড়া। এ কথা ভেবে বেজায় কান্না পাচ্ছিল। তাগ্যিস রামকানাই ঠিক সেই সময় গরম গরম তিন-কোণা পরটা আর কাল রাতের বাকি দুটো মাংসের চপ এনে হাজির করল, তাই মনটা আবার ভালো হয়ে গেল।

আজকাল ছোট মাস্টার-ও রোজ আসেন।

ডাক্তারবাবু বাবাকে বলেছেন যে আমাকে নানা রকম ভালো হাতের কাজ শেখালে মনটন ভালো থাকবে, তা হলে ঠ্যাং দুটোও তাড়াতাড়ি সারবে। নাকি রোগটা ঠ্যাংএর নয়, মনের। মনের জোর হলেই পায়ের জোর হবে। কিছু বললাম না, কারণ হাতের কাজ শিখতে আমার কোনো আপত্তি নেই।

আপত্তি তো নেই-ই, বরং আগ্রহ আছে বলা যায়। বড় মাস্টার বাবাকে বললেন, 'তলাপত্র যন্ত্রপাতি গাড়ি ইত্যাদির ছোট ছোট মডেল তৈরি করতে ওস্তাদ। আমাদের নাইটস্কুলের বড় ছেলেদের দিয়ে রেলগাড়ি আর ইঞ্জিনের যে খাসা মডেল করিয়েছে, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।'

বাবাকে দেখাবার জন্যে মডেলটা আনলেনও বড় মাস্টার। দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অবিকল একটা রেলগাড়ি। দরজা, জানলা, স্প্রিং, চাকা, আলো, পাখা, জলের ট্যাঙ্ক, লাইন, ব্রেক, অ্যালার্ম সিনেল, ইলেকট্রিক ইঞ্জিনের যাবতীয় কিছু, একেবারে হুবহু সত্যিকার গাড়িতে যেমন থাকে। রং টং দিয়ে তৈরি। আমার ঘরের মেঝেতে লাইন বসিয়ে, প্লাগ লাগিয়ে সেই গাড়ি চালানো হল। তার বাঁশিটি পর্যন্ত অবিকল। কি বলব, গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।

সেদিন রাতে মা-বাবার মুখে ছোট মাস্টারের প্রশংসা আর ধরে না। এত দিন চোর-চোর চেহারা, সোজা তাকায় না কেন, ইত্যাদি কি না বলেছেন সবাই। আজ একেবারে উল্টো কথা। তখনি ঠিক হয়ে গেল ছোট মাস্টার রোজ বিকেলে নাইটস্কুলে যাবার আগে, আমাকে ঘণ্টা দুই হাতের কাজ শেখাবেন। ভালোই হল। ঐ সময়টাই আমার ভালো কাটত না। আগে ঐ সময়টা খেলার মাঠে কাটত। রোজ চারটে থেকে ছটা যদি মডেল তৈরি করা যায়, বিশেষতঃ ছোট মাস্টারের সঙ্গে, তাহলে মন্দ কি। তাছাড়া আমার আরেকটা মৎলবও আছে।

প্রথম দিন ছোট মাস্টার এসে কিছ বলবার আগেই আমি বললাম, 'স্পেস্-শিপের মডেল করা যায় না?'

ছোট মাস্টার একটু হকচকিয়ে গেলেন। 'একেবারে স্পেস্-শিপ দিয়েই শুরু করবে নাকি? আগে ছোটখাটো দুটো একটা জিনিস করলে হয় না?'

আমি বললাম, 'বেশ তো, আগে ছোটখাটো জিনিস দিয়েই না হয় শুরু করা যাবে। ঐ যে সেদিন পাক-খাওয়ার মেশিনের কথা বলছিলেন, তাই দিয়েই আরম্ভ করা যাক। ঐ বইটাতে তার ছবিও আছে।'

অন্য কেউ হলে হয়তো বকাবকি করত। কিন্তু ছোট মাস্টার বললেন, 'আচ্ছা, তাই হবে। তা হলে বইটা থেকে ঐ যন্ত্রটার পার্টগুলোর ছবি আগে এঁকে নিতে হবে। কাগজ পেনসিল রবার সব-ই তো আছে। মাপ নেবার জন্য কম্পাস্ ইত্যাদিও লাগবে। ঐ মাপেই একো।'

তারপর একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'সত্যি সত্যি যাবার ইচ্ছা আছে দেখছি। কাগজে দেখলাম আমেরিকানরা সম্ভবতঃ এ বছর-ই চাঁদে মানুষ নামাবে।'

আমি আরেকটু হলে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই উঠছিলাম। পিছনটাকে চেয়ার থেকে খানিকটা বোধ হয় তুলেই ফেলেছিলাম। কিন্তু সে কথা মনে হতেই ধপ করে আবার চেয়ারের উপর পড়ে গেলাম। ছোট মাস্টার সব দেখলেন। বললেন, 'লাগে নি তো? চাঁদে যাবে বলে যে সবার আগে যেতে হবে তার কোনো মানে নেই। তা ছাড়া নিজেদের স্পেস্- শিপে করে যেতে হলে একটু দেরি তো হবেই। বৈজ্ঞানিকরা আগে গিয়ে দেখেই আসুক না সেখানকার অবস্থাটা কি রকম। কি বল? সেই বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। মাটির নিচে উপনিবেশ করতে সময় নেবে।'

আমি বললাম, 'বাবা বলছিলেন, এর মধ্যে রাশিয়ানদের একটা "জন্ড- পাঁচ" চাঁদের চারদিকে ঘুরে ফিরে এসেছে। আর আগে চাঁদে রকেট নেমেছে বটে, কিন্তু একবার নেমে, আবার উঠে ফিরে আসে নি। বোধ হয় মানুষ না গেলে, সেটা খুব শক্ত হবে। ইস পা-দুটোর উপর এমনি রাগ হয়!' এই বলে পা-দুটোকে শক্ত করবার চেষ্টা করলাম। কেমন যেন ঝিঁঝি ধরার মতো মনে হল।

ঠিক সেই সময় একটা ছোট বান্ডিল হাতে নিয়ে গুপি এসে উপস্থিত। স্কুলের জন্মদিন বলে সেদিন নাকি একটায় ছুটি হয়ে গেছে। পুটলিতে কি?

গুপি একটু লজ্জা পেল। খিদিরপুর ডকের কাছে নাকি সস্তায় খুব দরকারী সব পরনো জিনিস বিক্রি হচ্ছিল। তারি কিছু কিনে এনেছে। খুলে দেখলাম নাইলনের হাওয়া বালিশ, হাওয়া না থাকলে রুমালের মতো ছোট করে ভাঁজ করে ফেলা যায়। নাইলনের জলের বোতল আর খাবার রাখার থলি। হাঁ করে ছোট মাস্টার গুপির দিকে চেয়ে রইলেন। গুপি বলল, 'হ্যাঁ স্যার, আগে থাকতেই বন্দোবস্ত করা ভালো। বেশি দিন তো আর নেই। নিজেদের খাবার-দাবার নিজেরা নিলেই ভালো। শুনলাম পাঁচ দিনের ওয়াস্তা পাঁচদিন! মানে, খালি রকেট সাত দিনে ফিরতে পারে বটে, কিন্তু লোকজন জিনিসপত্র থাকলে নিশ্চয় কিছু বেশি সময়

লাগবে। হয়তো যেতে আসতে পাঁচ-পাঁচ মোট দশ দিন।'

আমি বললাম, 'চোঙা মতো ওটা কি?'

গুপি হেসে বলল, 'ঐটাই তো আসল জিনিস। চাঁদ দেখার টেলিস্কোপ। কোনো জাহাজের খ্যাপা ক্যাপ্টেন নাকি ওটাকে বন্ধক দিয়ে টাকা নিয়েছিল আর ছাড়াতে আসে নি।'

'টেলিস্কোপ? টেলিস্কোপ দিয়ে কি হবে?'

ছোট মাস্টার লাফিয়ে উঠলেন, 'আকাশ দেখার টেলিস্কোপ নাকি? সে তো অন্য রকম দেখতে হয়।' তারপর টেলিস্কোপটা বের করে বললেন, 'না, আকাশ দেখার নয়। কিন্তু খুব পাওয়ারফুল। সমুদ্রে দূরে দেখার জন্যে ব্যবহার হয়। আকাশে এরোপ্লেন ইত্যাদিও দেখা যায়। দেখবে নাকি, পানু?'

ছোট মাস্টার টেলিস্কোপের লেন্স পরিষ্কার করে দিয়ে, ফোকাস ঠিক করে, আমার হাতে দিলেন। আমি জানলা দিয়ে চারিদিক দেখতে লাগলাম। সব অন্যরকম লাগল। ঠান্ডা ঘরটাকে ভালো করে দেখলাম। ম'ন হল ছাদে কি সব পাইচারি করছে, ছোটোমতো, সাদা কালো। আলো কম বলে ভালো করে বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ একটা সন্দেহ হল, 'শুপি, নিশ্চয় পে-উঃ!'

গুপি আমার হাঁটুর উপরে জোরে চিমটি কাটল। আমি টেলিস্কোপ নামাতেই, ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে কিছু বলতে মানা করল। মুখে বলল, 'তাঁদ উঠেচে, দ্যাখ ভালো করে।'

চাঁদের দিকে টেলিস্কোপ ফেরালাম। অদ্ভুত লাগল। অবিশ্যি পাহাড়- পর্বত এটা দিয়ে দেখা গেল না। কিন্তু আরেকটা জিনিস দেখে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। স্পষ্ট দেখলাম, জিনিসপত্রে বোঝাই ডানাওয়ালা একটা নৌকোর মতো কি যেন, চাঁদের মুখের উপর দিয়ে আস্তে আস্তে ভেসে গেল। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে তার কুচকুচে কালো আকৃতি পূণিমার চাঁদের সোনালি গায়ের উপর পরিষ্কার ফুটে উঠল। তারপরেই চাঁদ পেরিয়ে এক টুকরো কালচে মেঘের পিছনে অবশ্য হয়ে গেল।

আমার মুখ দেখে ওরা দুজন চ্যাঁচাতে লাগল। 'কি হল? কি হল? শরীর খারাপ হল নাকি?'

আমি বললাম, 'না। চাঁদে যাবার প্রথম নৌকোটাকে বোধ হয় দেখলাম। লটবহর নিয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, গুপি, ছোটমামা কি-'

গুপি বলল, 'চোপ।'

ছোট মাস্টার তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন, 'আচ্ছা, আমি তা হলে আসি।

আমি থাকলে তোমাদের কথাবার্তার অসুবিধা হয়। তাছাড়া, নাইট ক্লাসের

আর বেশি দেরিও নেই।' বলেই, বোধ হয় একটু রেগে হনহন করে চলে গেলেন। খুব খারাপ লাগল। কিন্তু গুপি খুসি হয়ে বলল, 'যাক, বাঁচা গেল,

লোকটা ঠিক ছিনেজোঁক, কিছুতেই তোকে ছাড়তে চায় না।'

আমি বললাম, 'নারে গুপি। উনি রবিবার ছাড়া রোজ আমাকে দু-ঘণ্টা করে হাতের কাজ শেখাবেন। প্রথমে আমরা স্পেস-শিপের মডেল বানাব। তারপর সেটাকে বড় করে বানাতে কতক্ষণ!'

শুনে গুপিরো কি উৎসাহ! আমি বললাম, 'আচ্ছা, ছোটমামাকে তো আর একদিন-ও দেখতে পেলাম না, গুপি। চাকরি গেল নাকি?'

গুপি বলল, 'আরে, না, না, তাই যায় কখনো! ছোটমামা ভয়ঙ্কর চালাক, প্রেসের ভিতরে আজকাল ওর দিনের বেলায় ডিউটি। বড় সাহেবকে পটিয়েছে। ক্যান্টিন দেখে। তার জন্যে পয়সা নেয় না, কিন্তু দুবেলা খাবার পায়। বড় সাহেবরা যা খায়, ও-ও তাই খায়। চপ, কাটলেট,, মুরগির ভিন্দালু, পুডিং।'

দুজনেই খানিকক্ষণ চুপ করে সে-সব কথা ভাবতে লাগলাম। তারপর গুপি বলল, 'কিন্তু বড় মাস্টারের কি রাগ! ওকে চেনেন না, জানেন না, তবু কেবলি ছোট সাহেবের কান ভাঙাতে চেষ্টা করবেন। স্রেফ হিংসে। ছোটমামা খাবে ক্যান্টিনে আর বুড়ো খাবে তেওয়ারির দোকানে, এই আর কি। সমস্তক্ষণ ছোঁকছেকি করে ছোটমামার পিছনে ঘোরেন, প্রুফ দেখেন না হাতি! একটু যে তদন্ত করবে, ছোটমামার সে জো নেই'!'

আমি বললাম, 'কেন, রাতে তদন্ত করলেই হয়।'

শুনে গুপির কি হাসি, 'তাহলেই হয়েছে! ছোটমামার যা ভূতের

ভয়! ও রাতে গলি দিয়ে নামল আর কি!' আমি অবাক হয়ে গেলাম। 'তবে না নাইট ওয়াচম্যানের বদলির

কাজ নিয়েছিল বলেছিলি?

গুপি বলল, 'তাতে কি হয়েছে! সব নাইট ওয়াচম্যানরা ভূতের নামে জুজু! ছোটমামা সিঁড়ির মাথা থেকেই চৌকিদারি করত। আগের ওয়াচম্যান-ই তাই বলে দিয়েছিল। সে-ও তাই করত। এখানকার সব রাতের পাহারা-ওয়ালারাই তাই করে। আর ভূতে যারা বিশ্বাস করে না, তারা দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমোয়। মোট কথা ঠান্ডা ঘরে কি রকম স্পেস্- শিপ তৈরি হচ্ছে আর কারাই বা তৈরি করছে, এ বিষয়ে এতটুকু তদন্ত করার সময় পাচ্ছে না ছোটমামা। তাছাড়া ঐ সরকারি ছাপাখানাটা কি কম পুরনো ভেবেছিস্ নাকি। কোম্পানির আমলে ওটা এদিককার সবচেয়ে বড় গুদোমঘর ছিল। মোটে আশী বছর হল ছাপাখানা হয়েছে। ভূতফুত থাকলে ঐখানেই থাকা কিছু বিচিত্র নয়। ছোটমামা রাতে শুয়ে শুয়ে হাঁচড়পাঁচড় উয়া-উয়া শব্দ শোনে। কোনদিন না আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যায়।'

আমি ব্যস্ত হয়ে উঠলাম, 'মানা কর, গুপি, বাড়িতে পা দিয়েছে কি ক্যাক্ করে সামন্ত ওকে ধরবে। ওর ঘরে না চোরাই গাড়ির নম্বরপ্লেট পাওয়া গেছে!'

গুপি বলল, 'আরে দূর দূর! সে বিষয়ে ছোটমামাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বলল নাকি বড় রাস্তার ওদিকে পুরনো লোহার ডাঁই আছে, সেখান থেকে কুড়িয়ে এনেছে। গাড়ির নম্বরপ্লেট খুলবে ও! আমাকে দিয়ে নিজের পেনসিল কাটায়, ব্লেড দেখলে ওর গা শির-শির করে। নেংটি ইঁদুর ভয় পায়।'

তারপর হঠাৎ থেমে গুপি বলল, 'ছোট মাস্টারকে কি চোরাই কারবারি মনে হয়?'

ভয়ানক রাগ হল। বললাম, 'আমাদের বাড়িতে যারা আসে যায়, তাদের তোর সন্দেহ বাতিক থেকে বাদ দে। সামন্তর তো ধারণা যে তোর ছোটমামাই চোরাই কারবারের চাঁই!'

গুপি তার জিনিসপত্র গুটিয়ে তুলে চলে গেল। দরজার কাছ থেকে বলে গেল, 'আশা করি এর পরেও ছোটমামার স্পেস-শিপে জায়গা আশা কর না।'

আমিও চটেমটে বললাম, 'যারা স্পেস-শিপ বানায়, তারা পুরনো লোহার ছ্যাকড়া ঘুড়ি চড়ে না।'

গুপি চলে গেলে মনটা খুব-ই খারাপ হয়ে গেল। স্কুলের সব খবর ওর কাছেই পাই। বলতে গেলে ও-ই আমার একমাত্র বন্ধু। ছোট মাস্টারের হাতে লেখা চাঁদ বিষয়ক নোট বইটা খুলে বসলাম। তাতে এই সব লেখা:-

(১) চাঁদ পৃথিবী থেকে গড়পড়তা দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার মাইল দূরে।

(২) তার মধ্যে দুই লক্ষ ষোল হাজার মাইল পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির এলাকার মধ্যে। বাকি চব্বিশ হাজার মাইল চাঁদের মাধ্যাকর্ষণের এলাকায়।

(৩) চাঁদে নামতে হলে প্রথমে মনে রাখতে হবে সেখানে বাতাস নেই। শব্দতরঙ্গ ওঠে না, অর্থাৎ কানে কিছু শোনা যায় না। নিশ্বাস নেবার অক্সিজেন নেই, কাজেই অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে নিতে হবে। বায়ু নেই বলে সূখের আলোর বেজায় তাপ। আর রাতে বেজায় ঠান্ডা।

(৪) চাঁদের একেকটা দিন আর রাত আমাদের চোদ্দ দিনের সমান লম্বা। এক দিন আর এক রাতেই চাঁদের এক মাস কাবার হয়।

(৫) চাঁদ সর্বদা পৃথিবীর দিকে তার একটা পিঠ-ই ফিরিয়ে রাখে। পৃথিবী থেকে অন্য পিঠটা দেখা যায় না, তবে রকেট থেকে তার ছবি তুলে দেখা গেছে যে সে-দিকে পাহাড়-পর্বত কম। নামতে হলে ওদিকেই সুবিধা।

(৬) প্রথম বৈজ্ঞানিকরা চাঁদে গিয়ে, মাটির নিচে উপনিবেশ তৈরি, করবে। তা হলে রাতের বড় বেশি ঠান্ডা আর দিনের বড় বেশি গরম থেকে বাঁচা যাবে। উপনিবেশটা হবে শীত-তাপ নিয়ন্ত্রিত।

(৭) নিশ্বাস নেবার অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে আর নিশ্বাস ফেলার সঙ্গে যে কার্বন-ডায়ক্সাইড বেরুবে তাকে দূর করতে, ক্লরেলা বলে এক রকম শ্যাওলার চাষ করা হবে, মাটির নিচের সেই উপনিবেশে। ক্লরেলার অন্য নাম ডাক-উইড।

এইসব পড়ে আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু তাহলে আমাদের বাতাসের ব্যবসাটা তুলে দিতে হয়। তা হক। ক্লরেলার চাষ করব। তা হলে জমি কিনতে হবে মাটির নিচে ।

ভেবে দেখলাম চাঁদের মাটির তলার উপনিবেশে কি কি লাগতে পারে। জোনাকি পোকা সরবরাহ করা যায়। লক্ষ লক্ষ জোনাকি ছাড়লে মাটির তলার গুহা ঘর নিশ্চয় আলো হয়ে থাকবে। তবে হয়তো বিজলিবাতির ব্যবস্থা হবে। তাহলে জোনাকি লাগবে না। এক যদি না বিজলি বাঁচাবার জন্যে স্নানের ঘরেটরে ব্যবহার করা যায়। জোনাকি দিয়ে বোধ হয় রান্নার উনুন জ্বালানো যাবে না! একবার ধরেছিলাম মুঠো করে পাঁচ সাতটা। একটুও গরম মনে হয় নি।

পরদিন রবিবার। যখন বড় মাস্টার এলেন, চাঁদের সম্বন্ধে না বলে পারলাম না। মিটমিট করে হাসতে লাগলেন। বললেন, 'তার চেয়েও অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক কথা হল যে আমাদের এই ভারতের দক্ষিণ দিকের তীরভূমির কাছাকাছি সমুদ্রের তলা থেকে রাজার ঐশ্বর্য তোলা যায়।' আমি বললাম, 'মুক্তো?'

বড় মাস্টার হাসতে লাগলেন, 'মুক্তো হবে কেন? মুক্তো আর এমন কি, আজকাল মুক্তোর চাষ হয়, মুক্তোর দিন গেছে।' 'তবে?'

বড় মাস্টার বললেন, 'জাহাজডুবির কথা শুনেছিস্?' ইংরেজরা এদেশের নাম শোনার আগে পর্তুগীজরা ব্যবসা করতে আসত। আবার জলদস্যু বোম্বেটেরাও ছিল। সমুদ্রে লড়াই হত, ঝড় হত, ডুবন্ত পাহাড়ে জাহাজের তলা ফেঁসে যেত, জাহাজ-ডুবি হত। তার অনেক জাহাজ এখনো সমুদ্রের তলায় পড়ে আছে। সোনারূপোর গয়না, হীরে মণি মাণিক্য, এত বড় বড় মোহর সমুদ্রের নিচেকার বালির উপর ছড়িয়ে পড়ে আছে। কত লোকে নিজের চোখে দেখে এসেছে। আমিও।'

আমি অবাক হয়ে বড় মাস্টারের মুখের দিকে তাকালাম। চেয়ারের হাতলে দুহাত চাপড়ে, কেঠো পা মাটিতে ঠুকে তিনি বললেন, 'হ্যাঁ, আমিও। এবং এই কাঠের পা নিয়েই, আমাকে কি ঐ ফেরারি ছোটমামাটির চেয়ে কম ঠাউরেছিস নাকি?'

চমকে উঠেছিলাম। তবে কি পুপি ভুল বলল, ছোটমামাকে বড় মাস্টারমশাই চিনে ফেলেছেন? তাহলে সামন্তের কানে কথাটা তুলতেই বা কতক্ষণ! হয়ে গেল চাঁদে যাওয়া। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল ছোট মাস্টারের কথা। বড় মাস্টার বললেন, 'হাসছিস্ যে বড়? আমার কথাটা বিশ্বাস হল না বুঝি?'

'না, না, সেজন্যে নয়, ডুবো জাহাজের কথা খুব বিশ্বাস করেছি। কিন্তু কাল টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলাম, জিনিসপত্রে বোঝাই আকাশী নৌকো চাঁদে যাচ্ছে।'

'সে কি! চাঁদে জনমানুষ নেই, জিনিসপত্র যাচ্ছে আবার কি? কেনই বা যাচ্ছে?'

আমি বললাম, 'বাঃ, মাটির তলায় উপনিবেশ হবে যে। শীত-তাপ নিয়ন্ত্রিত উপনিবেশ তৈরি করতে হলে যন্ত্রপাতি, তার, তক্তা, সক্র ইত্যাদি লাগবে না?'

বড় মাস্টার চোখ থেকে চশমা জোড়া খুলে আমার দিকে একদৃষ্টে

চেয়ে রইলেন! তার পর বললেন, 'বুড়ো, ধরার কথা বলেছিলাম কি?'

সাত

আমি বললাম, 'বুড়ো-ধরা আবার কি? সে রকম আছে বলে তো

শুনি নি।'

বড় মাস্টার বললেন, 'তা যদি না থাকত তো এতদিনে এই পৃথিবী বুড়োতে ছেয়ে যেত। তোদের আর দাঁড়াবার জায়গা থাকত না।'

আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, 'আপনাকে ধরেছিল বুঝি?'

বড় মাস্টার রেগে গেলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, 'আমাকে আবার বুড়ো দেখলি কোথায়? বুড়োরা দিনের মধ্যে দশবার কেঠো পা

নিয়ে পাঁচ তলা অবধি ওঠানামা করতে পারে?' হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে বলে ফেললাম, 'গুপির ছোটমামা বলেন আপনি

ছাপাখানার লিষ্টে চড়ে চারতলায় ওঠেন, তারপর সেখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে পাঁচতলায় ওঠেন। সেটুকু সব বুড়োরাই পারে?'

মাস্টারমশায়ের মুখটা প্রথমে লাল হয়ে তারপর বেগনি হয়ে গেল। আমি তো ভয়েই মরি, এক্ষুণি না ফেটে যান।

অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে মাস্টারমশাই বললেন, 'গুপির ছোটমামা মানে সেই কুখ্যাত ফেরারি আসামী চাঁদু তো? সে আমাকে কোথায় দেখল ?'

আমি তো মহা মুস্কিলে পড়ে গেলাম। এর আগেই গুপি আমাকে বলেছিল যে ছোটমামার প্রাণ আমার হাতে। আমি আমতা আমতা করে বললাম, 'ও'র ভালো নাম নৃপেন্দ্রনারায়ণ।'

'তা হতে পারে, কিন্তু সে আমাকে দেখল কোথায়?' এই বলে বড় মাস্টার আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলেন।

আমি বললাম, 'না তা নয়, দেখেন নি হয়তো। কিন্তু উনি বলছিলেন যে সরকারি ছাপাখানার লিফ্ট তো চারতলায় শেষ। তারপর বোধ হয় তোদের মাস্টারমশাইকে হাঁটতে হয়।'

'কাকে বলছিলেন? তোকে?'

'না, না, আমাকে তো ভালো করে চেনেন না, তাই গুপিকেই বলেছিলেন। গল্পটা বলবেন না?'

বড় মাস্টার ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, 'ওঃ, আমার জন্যে ভেবে ভেবে চাঁদুর বুঝি ঘুম হয় না? গুপিকে বলিস্ ওকে বলে দিতে- ও কি! অমন চমকে উঠলি কেন?'

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'বুঝেছি। বলবে কি করে? সে এতক্ষণে জলঢাকায় কি সোফিয়ায় কি নাথুলায় কি কোথায় তাই বা কে জানে।'

আমি বললাম, 'তা ছাড়া গুপির সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে গেছে, সে এখন আমাদের বাড়িতে আসবে না।'

সঙ্গে সঙ্গে গুপি ঘরে ঢুকে বলল, 'না স্যার, ওর কোনো কথা বিশ্বাস

করবেন না, স্যার। ওর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বলে আসব নাই বা কেন,

আপনার গল্প শুনব নাই বা কেন, খাব নাই বা কেন?'

' এই বলে রামকানাইয়ের হাত থেকে ছোট ছোট মাংসের বড়া আর আলুমটর সিদ্ধর থালাটা নামিয়ে নিয়ে, তিনটে প্লেটে ভাগ করতে লাগল। মাস্টারমশাই একবার ওর দিকে, একবার আমার দিকে তাকাতে তাকাতে, চামচ দিয়ে খেতে লাগলেন। তখন গুপি পকেট থেকে দুটো মলাট-আলগা বই বের করে বলল, 'তা ছাড়া, ওর এসব পড়া দরকার। নইলে চাঁদে যাবার মতো যথেষ্ট জ্ঞান হবে কি করে?'

চোখ বুলিয়ে দেখলাম। একটার নাম, 'চাঁদে উপনিবেশ' অন্যটার নাম, 'চাঁদের আবহাওয়া'। ভেবেছিলাম ওর সঙ্গে কথা বলে কাজ নেই। বই দেখে বললাম, 'কোথায় পেলি রে?'

গুপি বলল, 'ছোট স্যারের কাছ থেকে নিয়েছিলাম।'

মাস্টারমশাই বিরক্ত হয়ে বললেন, 'তোমাদের মাথা খেতে আর বড় বেশি বাকি রাখে নি তলাপত্র। ওটা কিসের মডেল?'

আমি খুব খুসি হলাম। বললাম, 'ওটা স্পেস্-শিপের পার্ট। ওর ভিতরে মানুষরা বসে থাকবে, মহাকাশযান পাক খেলেও মানুষগুলো স্থির হয়ে বসে থাকবে।'

বড় মাস্টার একটুক্ষণ সেদিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, 'পুনালুর গেছিস্ কখনো?' আমরা তো অবাক।

পুনালুর আবার কোথায়? কোনো গ্রহের উপগ্রহট্রহ নয় তো?'

মাস্টারমশাই হেসে বললেন, 'ঐ যা বলি, চাঁদ চাঁদ করে তোরা ক্ষেপে গেলি, অথচ এই পৃথিবীটার কিছুই দেখলি না। পনালুর শুধু এই পৃথিবীতে নয়, আমাদের নিজেদের দেশে। মাদ্রাজ থেকে ত্রিবান্দ্রাম যেতে হলে প্রায় একটা গোটা দিন লেগে যায়। পথে খাওয়ার খুব ভাল ব্যবস্থা না থাকলেও, যেই না পশ্চিমঘাট ফুড়ে বেরিয়ে এসে আমাদের ট্রেন পুনালুরে থামল, প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট্ট একটা স্টেশন, তার পরেই সমুদ্রের গন্ধ পেলাম। তার পরেই কুইলন বলে একটা জায়গায় নেমে পড়লাম। সঙ্গে সামান্য জিনিসপত্র। কিছু কাপড়-চোপড়, একটা শতরঞ্চি আর হাঁসের সাজ!'

আমি বললাম, 'হাঁসের সাজ আবার কি, মাস্টারমশাই?'

বড় মাস্টার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। 'হাঁসের সাজ কি তাও জানিস্ না? এই বিদ্যে নিয়ে চাঁদে যেতে যাস্? হাঁসের সাজ না পরলে সমুদ্রের তলায় সরজামিন তদন্ত করব কি করে শুনি? কেঠো পায়ের উপর আড়াইমণি ডুবুরির পোশাক চাপালেই হয়েছে আর কি!'

গুপি গলা খাঁকরে বলল, 'অবশ্যি জলের নীচে আড়াই মণ আর কিছু আড়াই মণ থাকে না! বয়েন্সি অর্থাৎ প্লবতা জলের একটা গুণ!'

বড় মাস্টার বিরক্ত হয়ে বললেন-'থাক, আর বিদ্যে জাহির করতে হবে না। এ-ও নিশ্চয় তলাপত্রর কাছে শেখা? - বেশ, আড়াই মণ না হয় দেড় মণ-ই হয়ে যাবে, তবুও আমার শরীরের আড়াই মণ তার সঙ্গে জুড়তে হবে। কাঠের ঠ্যাং হয়তো ল্লিশ বছর সেই জাহাজের রান্নাঘরের টেবিল ঠেকিয়েছে। তারপর আমার কাছেই আছে ধর এই পঁয়ত্রিশ বছর। আর কত সইবে?'

গুপি বলল, 'আচ্ছা, এবার বলুন হাঁসের সাজের কথা।'

বড় মাস্টার বললেন, 'আর কিছু নয়, দু পায়ে প্ল্যাস্টিকের তৈরি বড় বড় হাঁসের পা লাগিয়ে, মুখে মুখোস, চোখে বড় বড় গগলস্ এটে, পিঠে অক্সিজেনের থলি বেঁধে, মুখোসের ভিতরে নাকে তার নল গুঁজে, হাতে হাপুণ নিয়ে তৈরি হয়ে নিতে কতক্ষণ লাগে! অতিরিক্ত বেশি পয়সা কড়ির বালাই নেই, সঙ্গে রিটার্ন টিকিট আর যৎসামান্য খাই-খরচা। তাছাড়া, ছোট্ট বিছানা আর কাপড়-চোপড়। বাদামগাছের মগডালে সেগুলো ঝুলিয়ে রেখে, কুইলনের সমুদ্রের ধারে গিয়ে জেলেদের একটা নৌকো ভাড়া করলাম। তীর থেকে সিকি মাইলটাক গিয়ে নৌকোতে বসে বসেই যেই না হাঁসের সাজ পরেছি, ভয়ের 'চোটে নৌকোর মাঝি মাঝ-দরিয়ায় নৌকো থেকে নেমে যায় আর কি! অনেক করে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নৌকো থেকে টুপ করে জলে নেমে পড়লাম। নেমেই টের পেলাম ব্যাটা ঊর্ধ্বশ্বাসে ডাঙার দিকে পাড়ি দিল। যাক গে, এসব সামান্য জিনিসে আমি ভয় খাই না। মিছিমিছি তো আর বর্মার শ্রেষ্ঠ সাঁতারুর সম্মান পাই নি। মানপত্র, সুবর্ণ পদক, টাকার থলি-যাক গে, নিজের বিষয়ে বেশি বলা আমি পছন্দ করি না।

আস্তে আস্তে ডুব দিলাম। একেবারে সমুদ্রের তলাকার বালির উপর নামলাম। বুঝতেই পারছিস্ সমদ্র সেখানে বেশি গভীর নয়, বিশেষ করে এই গরমের সময়ে। গভীর না হলেও অদ্ভুত। কানে কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু সবুজ আলোতে সব দেখতে পাচ্ছিলাম। অদ্ভুত আকারের মাছ, সমুদ্রের কচ্ছপ, আর কত রকম পলা আর আগাছা।

•তলাপত্র তোদের যে এত রকম জ্ঞান দেয়, আশা করি একথা বলতে ভোলে নি যে পৃথিবীর তিন ভাগ যখন জল আর মাত্র এক ভাগ মাটি, তখন মাটিতে যত না ফসল হয়, জলে হতে পারে তার তিন গুণ। দেখলাম সে-সব ফসলের কিছু কিছু একেবারে গিজগিজ করছে, গুঁড় নাড়ছে, দাঁত দেখাচ্ছে, চোখ পাকাচ্ছে। ডাঙায় তুলে রেধে খেলেই হল। হাজার বছরের খাদ্য মজুত আছে সমুদ্রের নিচে! চাঁদে জমি কেনার কথা বলিস্ তোরা, সমুদ্রের তলাকার জমি কিনতে পারলে আর কথা নেই।'

এক জায়গায় দেখলাম একেবারে জ্যান্ত ঝিনুকে ছেয়ে আছে! প্রত্যেকটির মধ্যে একটি করে বড় মুক্তো না থাকে তো কি বলেছি!' গুপি বলল, 'তুললেন না কেন দুচারটে?'

বড় মাস্টার ভুরু কুচকে বললেন, 'সামান্য মুক্তো তুলে সময় নষ্ট করব নাকি? আমার সামনে ছিল তার চেয়ে অনেক বড় উদ্দেশ্য। যার জন্যে এই অভিযান। তাছাড়া দুটো চারটে যে তুলি নি তাই বা কি করে জানিস্! দেখিস্ গিয়ে তোদের বৌঠানের কানে। চোখ টেরা হয়ে যাবে।'

বড় মাস্টার পানের ডিবে খুলে রামকানাইয়ের দিকে তাকালেন। রামকানাই রেডি ছিল। পকেট থেকে ভিজে ন্যাকড়ায় জড়ানো গোটা ছয় বড় পান বের করে ডিবে ভরে দিল। আজকাল দেখছি পারলে রামকানাই বড় মাস্টারের গল্প শুনতে ছাড়ে না। পরে অবিশ্যি নানা রকম মন্তব্য করে। ভারি ইয়ে হয়েছে ওর। যাই হোক, মুখে দুটো পান পুরে, দাঁতে চুণের টিপ মূছে, মাস্টারমশাই বলতে লাগলেন।

'একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উপরে না উঠলে অক্সিজেনের থলি খালি হবার ভয় থাকে। তাতে অবিশ্যি ডাঙায় ফেরার অসুবিধে হয় না। উপরে উঠে সাঁতরে ফিরলেই হল। কিন্তু তদন্ত করতে হলে, তাড়াতাড়ি কাজ করলে হয় কখনো?

আর একাজ সারতে হবে খুব গোপনে। হাঁসের সাজ পরে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়বে! কেউ টের পেলেই হয়ে গেল। পাকা খবর না নিয়ে যাই নি। খুব গূঢ় খবর। ঐখানে একটা পুরনো সমুদ্রের জাহাজ বমাল সমেত ডুবে পড়ে আছে। হয়ে গেছে। পর্তুগিজ জলদস্যুদের তিনশো বছরের বেশি

বর্মায় থাকতেই একজন নাবিক আমার বাবার কাছে একটা চিঠি আর এক সমুদ্রের তলার ছেঁড়া ম্যাপ এক টাকা দিয়ে বিক্রি করেছিল।-'

গুপি অবাক হয়ে গিয়ে বলল, 'মোটে এক টাকা দিয়ে?'

বড় মাস্টার বললেন, 'কেন, এক টাঁকা কি কম নাকি? আমার ঠাকুরদার বাবা এক টাকা দিয়ে একশো মণ ধান কিনতেন। এক টাকা রোজগার করতে পারিস? গল্প শুনবি, না কি?'

গুপি বলল, 'হ্যাঁ, হ্যাঁ, তারপর?'

'তারপর হঠাৎ পায়ে কি একটা ফুটল। তুলে দেখি একটি মোহর, খাড়া হয়ে বালিতে বিধে আছে। চেয়ে দেখি চারদিকে বালিতে ছড়ানো হাজার হাজার মোহর। সামনে একটা পুরনো লোহার সিন্দুক ভেঙে পড়ে আছে। জং ধরে সবুজ হয়ে গেছে। তার গায়ে কত খুদে খুদে সামুদ্রিক প্রাণী বাসা বেঁধেছে।

চোখ তুলে দেখি আরেকটু দূরে মস্ত মরা তিমি মাছের মতো একটা পুরনো জাহাজ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। খোলটা উপর দিকে, তাতে অসংখ্য ছোট বড় ছ্যাঁদা। তার ভিতর দিয়ে শত শত ছোট, বড়, লাল, কালো, হলদে মাছ আসছে, যাচ্ছে। চেয়ে চেয়ে আর কূল পাই না।

তবে বেশিক্ষণ চাইতে হল না। চারদিক থেকে নিঃশব্দে পনেরো কুড়িটা ছায়া নেমে এল। দেখলাম পনেরো কুড়িটা সাহেব। সকলের হাঁসের সাজ, সঙ্গে শুধু হাপুণ নয়, বন্দুকও। প্ল্যাস্টিকের থলিতে ভরা, যাতে। ভিজে না যায়।

তারপর আর কি, দেখতে দেখতে আমাকে ধরে ফেলে তারা ভাঙ্গা নৌকোর কানা তুলে তার ভিতর পুরে দিল। বলি নি এই ঘটনার বিষয়বস্তু হল বুড়ো-ধরা? এবং সত্যিই আমিই সেই হতভাগ্য বুড়ো। তারপর যত পারল সোনা দানা চেঁচেপুছে নিয়ে চলে গেল।

আমি প্রথমটা জাহাজের খোলের ভিতরকার গাঢ় অন্ধকার দেখে হকচকিয়ে গেলাম। তারপর আস্তে আস্তে যখন চোখ সয়ে গেল, তখন চেয়ে দেখলাম কত কঙ্কাল চারদিকে ছড়িয়ে আছে। তাছাড়া কত যে গয়নাগাঁটি ছড়ানো, সে আর কি বলব।'

গুপি বলল, 'আনলেন না স্যার, তা হলে এখন কত সুবিধে হত ।. স্পেস্-শিপের অনেক খরচ।'

বড় মাস্টার বললেন, 'তখন আমি বেরুবার পথ খুজতে ব্যস্ত, গয়না তোলার কথা মনেও হয় নি। তাছাড়া কঙ্কালগুলো জলের মধ্যে কেমন নড়ছিল চড়ছিল। শেষ পর্যন্ত হাপুণ দিয়ে একটা ছ্যাঁদাকে আরেকটু, বড় করে নিয়ে, বেরিয়ে পড়লাম। এদিকে অক্সিজেন প্রায় শেষ, কোনো মতে জলের উপরে উঠলাম। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে এসেছে। সারা দিন পেটে কিছু পড়ে নি। কোনো রকমে সাঁতরে ডাঙায় উঠলাম। তারপর বাদাম গাছের নিচে গিয়ে দেখি সর্বনাশ, বাঁদররা সব জিনিসপত্র তচনচ করে, চারিদিকে ছড়িয়েছে। অন্য জিনিস প্রায় সব-ই পেলাম। শুধু সেই চিঠিটা আর ম্যাপটা ছাড়া। মাঝে মাঝে কাগজে যখনি দেখি ডুবো জাহাজের সন্ধান পাওয়া গেছে ভারতের উপকূলের কাছে, ভাবি এই আমার সেই জাহাজ।'

গুপি বলল, 'তবে জাহাজটা তো আর সত্যি করে আপনার নয়।. অন্যরাই বা নেবে না কেন?'

বড় মাস্টার বললেন, 'আমার নয় মানে? দস্তুরমতো এক টাকা দিয়ে ওর কাগজপত্র কেনা হয় নি বলতে চাস্ ?'

তারপর বললেন, 'বোধ হয় আমার ঐ নৌকোর মাঝি সাহেবদের গুপ্তচর ছিল। আমাকে নামিয়েই শহরে গিয়ে খবর দিয়ে এসেছিল।

এই রকম করেই সাহেবদের অত টাকা হয়েছিল। সময় আমাদের গলিতে সে কি দুপদাপ ক্যাও ম্যাও! নইলে!' এমনি জানলা দিয়ে দেখি স্রাতের মতো বেড়ালের পাল ছুটে বেরিয়ে আসছে। বড় মাস্টার লাফিয়ে উঠে খটখট করতে করতে দৌড় দিলেন। দেখলাম তাঁর মুখটা অস্বাভাবিক রকমের সাদা। সঙ্গে সঙ্গে গুপিও ছুটল।

আট

আমি তো হাঁ করে বসেই রইলাম। রামকানাই এসে খাবারদাবারগুলো ভুলে নেবার তালে ছিল। বারণ করলাম। বললাম, 'থাক, ওদের খুষ্টিকর খাবার দরকার হতে পারে। অস্বাভাবিক রকম দৌড়চ্ছে।' রামকানাই ফোঁস শব্দ করে চলে গেল। আরো অনেকক্ষণ পরে গুপি এসে কোনো কথা না বলে খেতে আরম্ভ করে দিন। তারপর খানিকটা জল খেয়ে বলল, 'উঃফ্, ভাবা যায় না।'

3

আমি বললাম, 'নেপোকে দেখলে?' গুপি মাথা নাড়ল। 'কই, না তো। তবে ঐ শত শত বেড়ালের

মধ্যে চোখে না-ও পড়তে পারে।'

আমি চটে গেলাম। 'নেপোকে চোখে না-ও পড়তে পারে মানে? সাধারন বেড়ালের দেড়া সাইজ ওর, গোঁপগুলো পাঁচ ইঞ্চি লম্বা, বেঁড়ে ল্যাজ । চোখে পড়তে বাধ্য।'

গুপি বলল, 'তবে ছিল না।'

এমন সময় বড় মাস্টারও হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এলেন। ময়লা রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, 'সারা জীবন ধরে কোথায় না গেলাম, কি না দেখলাম। কিন্তু এর সঙ্গে কোনো কিছুর ভুলনা হয় না। দশ ফুট চওড়া বেড়ালের নদীর কথা কেউ কখনো শুনেছে? তার উপর বেড়ালের ঢেউ।'

আমি তো অবাক! 'বেড়ালের ঢেউ আবার কি?' গুপি বলল, 'তাও বুঝলি না? পেছনের বেড়াল যদি বেশি জোরে দৌড়য়, তাহলে সামনের বেড়ালের পিঠের উপর উঠে পড়বে। অমনি সেখানে ভেউ উঠবে।'

বড় মাস্টার চেয়ারে বসে কেবলি মাথা নাড়তে লাগলেন। আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, 'বলুন না গঙ্গার ধারে কি হল?'

গুপি আর চুপ করে থাকতে না পেরে বলল, 'বেড়ালের নদীর মাথায় তিনটে লোক দৌড়চ্ছিল। তাদের চুল খাড়া, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল। বেড়ালরা একবার ধরে ফেললেই তো হয়ে গেল।'

বড় মাস্টার বললেন, 'দু জনের মাথায় দটো মাছের চুপড়ি, একজনের

মুখে দাড়ি। প্রাণের ভয়ে চুপড়ি ফেলে প্রথম দু জন দে দৌড়। বেড়ালের

স্রোত এতটুকু থামল না।'

গুপি বলল, 'সামনের বেড়ালরা হয়তো থেমেছিল, কিন্তু তাদের মাথার উপর দিয়ে পেছনের বেড়ালরা সমান বেগে ছুটে চলাতে কিছু টের পাওয়া গেল না। ফেরার সময় দেখলাম চুপড়িগুলোর দুটো একটা বাঁশের কুচি পড়ে আছে। আর কিছু নেই।'

আমি উত্তেজনার চোটে চেয়ার থেকে ছয় সাত ইঞ্চি উঠেই পড়ে- ছিলাম। 'আর বেড়ালরা? নেপোকে তো খোঁজা দরকার।'

মাস্টারমশাই বললেন, 'তাকে আর পেয়েছ! নদীর ধারে পৌঁছে লোক তিনটে আর কোনো উপায় না দেখে, ঝপাঝপ দুটো খালি যাত্রীর নৌকোয় লাফিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে রাশি রাশি বেড়াল। তাই দেখে ঘাবড়ে গিয়ে যেখানে যত মাঝি ছিল যে যার নৌকো নিয়ে পাড়ি দিল। আর বেড়ালরাও ঝুপ-ঝাপ করে সে সব নৌকোয় চেপে বসল। পাঁচ মিনিটে গঙ্গার ধার ভোঁ ভাঁ। শুধু যারা হাওয়া খেতে গেছিল তারা হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল আর দূর থেকে কানে এল একটা ম্যাও-ম্যাও শব্দ। এরকম যে সত্যি হতে পারে কে ভেবেছিল। আমিও না। অথচ একদিন এই আমি ব্রেজিলের সত্যিকার কাঁকড়ামতী নদী থেকে, প্রাণ হাতে নিয়ে বেঁচে এসেছিলাম। সে এক-'

আমি চেঁচিয়ে বললাম-'না, না, শুনব না। এত বেড়ালের মধ্যে নিশ্চয়-ই নেপো ছিল। কেন তাকে ধরে আনলেন না?'

খুব কান্না পাচ্ছিল। তার মধ্যে গুপি কর্কশ গলায় বলল, 'যদি থেকেও থাকে, তার বাড়ি ফেরার কোনো মতলব নেই।'

মাস্টারমশাইয়ের কি যেন মনে পড়াতে উঠে বললেন, 'যাই, আমার কাজ আছে। দ্যাখ, পানু, আমাদের বড় সাহেব তোর জন্যে সায়ামিজ ক্যাটের বাচ্চা দেবে বলেছে। তোর বেড়াল হারানোর দুঃখের কথা শুনে তার বড় কষ্ট হয়েছে! আচ্ছা চলি।'

বড় মাস্টার চলে গেলে গুপি আমার কাছে চেয়ার টেনে বসে বলল, 'ব্যাপারটা কিন্তু খুব ঘোরাল। যতদূর দেখলাম বেড়ালগুলো বেজায় মোটা। আর প্রত্যেকের গলায় ছোট্ট একটা করে সাদা টিকিট বাঁধা। সাধারণ বেড়াল নয় ওরা।'

আমি নাক টানতে লাগলাম। কান্না পেলে আমার সদি লাগে। গুপি

আবার বলল, 'বেড়াল তাড়া করা দাড়িওয়ালা লোকটা ছোটমামা।'

এমনি চমকে গেলাম, যে সত্যি সত্যি চেয়ার-গাড়ি থেকে পড়ে গেলাম । রামকানাই ছুটে এল। দু জনে মিলে আমাকে টেনে তুলল। পায়ের গোড়ালিতে খুব ব্যথা লাগল। কানে এল ঠান্ডাঘর থেকে ঠক-ঠক- ঠক।

গুপি বলল, 'শুনতে পাচ্ছিস্ না? স্পেস্-শিপ তৈরি হচ্ছে। তবু ব্যাপারটা বুঝতে পাচ্ছিস্ না? ঐ বেড়ালরা কে তা টের পাচ্ছিস্ না?' আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম।

গুপি বলল, 'ওরাই হল প্রথম ভারতীয় চন্দ্রযাত্রী। ট্রেনিং নিচ্ছে। আমি তখুনি সব বুঝতে পেরেছি, কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের সামনে কিছু বলি নি। ভারতীয় মানুষ যাবার আগে ওরাই চাঁদে যাবে। নেপো যদি আমাদের আগে চাঁদে যায়, তাতে তোর গর্ব হওয়া উচিত নয়। ভেবে দ্যাখ, আমরা পেঁৗছালে তার কি আনন্দটাই হবে।'

আমি বললাম, 'কিন্তু পালিয়ে গেছে যে। চাঁদে যাবে কি করে?' গুপি বলল, 'মোটেই পালায়নি। যাদের নেয় নি, তারাই পালিয়েছে। হয়তো গলার টিকিটে লেখাই ছিল, অমনোনীত, পড়তে তো আর পারি নি।

আমি বললাম, 'তা হলে কি করা উচিত?'

গুপি বলল, 'এখন মোটে সাতটা। আটটা অবধি বসি। ছোটমামা ঠিক সাঁতরে ফিরে আসবে। দারুণ সাঁতার কাটে জানিস্-ই তো। সেবার সেই-যে সোনার মেডেল পেল। বেড়ালরা কিছু জলে নেমে ওর পেছন পেছন সাঁতার দেবে না।'

সঙ্গে সঙ্গে চুপড় ভিজে ছোটমামার প্রবেশ। দাড়িগুলো ভিজে গালের সঙ্গে লেপটে রয়েছে।

আমাকে বললেন, 'পানু, প্যাণ্ট দে, গামছা দে।' আমার আলনাতেই সব ঝোলানো থাকে। পাশেই স্নানের ঘর। দশ মিনিটের মধ্যে গা মছে, কাপড় বদলে ছোটমামা চেয়ারে বসে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। নাকি গলায় দাড়ি জড়িয়ে গিয়ে সাঁতারের খুব কষ্ট হয়েছে। তা ছাড়া ইলিশ মাছে পায়ের আঙুলে ঠুকরে দিয়েছে। আইডিন দেওয়া দরকার। তাই দেওয়া হল।

রামকানাই একবার উকি মেরে বলল, 'ঐ আরেক খোদ্দের এলেন।' আমি বললাম, 'গরম চা জলখাবার কি আছে এনে দাও।' রামকানাই গরম চা 'থাকে কখনো ঘরে কিছু? আর ডিম দিয়ে পাঁউরুটি ভেজে এনে বলল, এয়ারা যা সব রাক্কস।' ছোটমামার খাওয়া শেষ হওয়া অবধি আমরা চুপ করে ছিলাম।

তারপর হাত ধুয়েই বড় বড় চোখ করে বললেন, 'বুড়ো চিনেছে নাকি আমাকে? তা হলেই তো বাবার কাছে লাগাবে, অমনি সামন্তর পেয়াদারা এসে ধরে নিয়ে যাবে। তা হলে রহস্য উদ্‌ঘাটন কে করবে?' এই সময় ছোট মাস্টার টুক করে ঘরে ঢুকে একটা মোড়ায় বসে

লজ্জিতভাবে বললে, 'চুল কাটাচ্ছিলাম পাড়ার সেলুনে। সেখানে বেড়ালের কথা শুনে ছুটে এলাম। ভাবলাম তাহলে হয়তো নেপোকে পাওয়া গেছে। কিন্তু তোমাদের মুখ দেখেই ভুল ভেঙ্গেছে, আর বলতে হবে না।' ঠক-ঠক-ঠক-ধড়াস্।

। ছোট মাস্টার চমকে উঠলেন। 'দিনরাত ঠাণ্ডা ঘরে কাজ হয়, তবু বাড়ি তৈরি শেষ হয় না কেন?'

ছোটমামা আঙুল দিয়ে দাড়ি শুকোতে শুকোতে বললেন,- 'অন্য কাজ হয়। বাড়ি তৈরির কাজ নয়। ঠান্ডাঘর যদি হবে তো তার বিজলির ব্যবস্থা কই? সুযোগ পেলেই ছোঁক-ছোঁক করে বেড়াই। এটুকু বঝেছি যে ওখানে ঠান্ডা করার কোনো ব্যবস্থাই হয় না।' আমরা বললাম, 'তবে কি স্পেস্-শিপের কথাই ঠিক? ঠান্ডাঘরটা

ছদ্মবেশ?

ছোট মাস্টার বললেন, 'তা স্পেস্-শিপ বানাবে, তার জন্যে অত গোপনীয়তার কি আছে? আমাদের দেশের লোকে মহাকাশযান তৈরি করছে, এতো ঢাক পিটিয়ে বলে বেড়াবার কথা। লুকিয়ে করবে কেন?' ছোটমামা বললেন, 'প্রকাশ্যে করলেই হয়েছে! অমনি প্ল্যান চুরি যাবে, পার্টস্ চুরি যাবে, সরকারি তলব আসবে, স্পেস্-শিপ বানাচ্ছ তার পারমিট কোথায়, ছবিসহ দরখাস্ত কর। আমি জানি না? ফালতু জিনিস দিয়ে ঘরে বসে রেডিও বানিয়েই আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে! করতে হলে লুকিয়েই করতে হবে। আপনি যেন আবার এসব কথা ফাঁস করে দেবেন না।'

ছোট মাস্টার জিব কেটে বললেন, 'না না, কি যে বলেন। কিন্তু হাজার হাজার বেড়াল এল কোত্থেকে! সেপস্-শিপ করতে কি বেড়াল লাগে? মানে লোম তোমে ইলেকট্রিসিটি-' নেপোর জন্য বড় ভাবনা হল।

গুপি বলল, 'তাও বুঝলেন না? একেবারে বাপ করে তো আর চাঁদে মানুষ পাঠানো যায় না। প্রথমে এদের সব পাঠানো হবে।'

'কিন্তু এতগুলো কেন? দুটো একটা পাঠালেই তো হয়। তাই তো

সব দেশ থেকেই পাঠায়।'

গুপি বলল, 'মানুষের ওজন সইবে কি না সেটাও তো দেখা দরকার। একটা আড়াইমণি মানুষের সমান ওজন নিতে হলে, কটি দেড়-সেরি বেড়াল লাগবে বলুন তো? একেবারে একশো দেড়শো মানুষ নিরাপদে যাওয়া আসা করতে পারবে কি না, তাও তো দেখা দরকার।'

ছোট মাস্টার তখন জানতে চাইলেন, 'কোথায় রাখা হয়েছিল এত বেড়াল?' আমরা ছোটমামার দিকে চাইলাম।

গুপি বলল, 'ছোট করে বল, ছোটমামা!' ছোটমামা বললেন, 'আজ অনেকদিন যাবৎ এই গুরু তদন্তের দায়িত্ব একলা -'

গুপি বলল, 'ছোটমামা, ফের!'

ছোটমামা বললেন, 'ঐ নকল ঠাণ্ডাঘরের ওদিকের দেয়ালে, ঠিক গঙ্গার উপরেই দেখলাম একটা বড় চোঙার মুখ। কাঠ দিয়ে এঁটে বন্ধ করা। সামান্য কাঠে আমি ভড়কাই না। দুটো মাছ-ওয়ালা রোজ গলি দিয়ে যায়, তাদের কিছু পয়সা দিয়ে রাজি করিয়ে, হাতুড়ি দিয়ে কাঠটি ভাঙ্গালাম। কাঠ ভেঙ্গে যেই না ওরা মাছের চুবড়ি মাথায় তুলেছে, অমনি চোঙার মধ্যে থেকে সে কি খচমচ খামচা খামচি।'

নয়

ছোটমামা বলতে লাগলেন, 'সে যে কিসের খ্যাচম্যাচ সেটা বুঝতে আর বেশি দেরি লাগল না। ঝরণার মতো ঝুপ ঝাপ ধূপ ধাপ করে কেবলি বেড়াল পড়তে লাগল। মাছ-ওয়ালারা একবার তাকিয়েই চুবড়ি তুলে দে দৌড়। আর যাবে কোথায়! সঙ্গে সঙ্গে বেড়ালের নদীও ছুটল। আমিও কি আর সেখানে থাকি! পাঁইপাই লাগালাম। মাছের গন্ধেই বেড়াল বেরিয়েছে। আমি ছোটবেলা থেকে কড লিভার অয়েল খেয়ে মানুষ, আমাতে আর মাছেতে কতটুকু তফাৎ তোরাই বল। ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে কোনোমতে একটা নৌকোতে যদি বা উঠলাম, সঙ্গে সঙ্গে এই কেঁদো কেঁদো গোটা পঁচিশ বেড়াল। জলে নেমে সাঁতরে কোনো রকমে প্রাণটা হাতে করে ফিরেছি। পানু, আরো পান দে। আর সেই খোঁচা গোঁপ ভদ্রলোক কোথায় উঠে গেলেন? কে উনি?'

তাকিয়ে দেখি, তাই তো ছোট মাস্টার কখন হাওয়া হয়ে গেছেন। গুপি বলল, 'ওঁ'র নাম তলাপত্র, এম্ এ পাশ, বড় মাস্টারের শাকরেদ।' ছোটমামা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললেন, 'কি সর্বনাশ! তবে তো নির্ঘাৎ ওর স্পাই! আর আমি কিনা ও'র সামনে সব কথা ফাঁস করে দিয়েছি। ই-ই-স্!'

গুপি বলল, 'না, না, ছোটমামা তোমার সবতাতেই ইয়ে। উনি তোমার বিষয়ে কিছু জানেন না। তাছাড়া জানলেও কেউ তোমাকে এখন চিনতে পারবে না।'

ছোটমামা খুসি হয়ে দাড়ি চুমরোতে চুমরোতে বললেন, 'চিনতে পারবে না, না? বাব্বা, ক্যায়সা ছদনবেশটা ধরেছি তাই বল্! ছোট মাস্টার ছেড়ে দে, সে তো আমাকে আগে কখনো দেখেই নি, আমার নিজের বাবাই চিনতে পারবে না দেখিস্। ভাবছি লোহালক্কড়গুলো কিছু কিছু নিয়ে এসে কাছে রাখি। পানু, তোর খাটের তলায় কিছু রাখলে তোর আপত্তি আছে?'

আমি তো মহা মুস্কিলে পড়লাম। সেই যে নিতাই সামন্ত চোরের কথা বলে গেছিল, সেই ইস্তক রোজ রাতে মা একটা বেঁটে লাঠি দিয়ে আমার খাঁটের তলা খুচিয়ে দেখেন। অথচ ছোটমামা যদি ভাবেন আমি ওকে সাহায্য করতে চাই না, তা হলে চাই কি হয়তো চাঁদের দল থেকে আমার নামটাই ছাঁটাই করে দেবেন। তাই বললাম, 'ইয়ে কি বলব, মানে, ইয়ে

গুপি বলল, 'না, না এখানে নিতাই সামন্তর বড় বেশি আনাগোনা। কে ওদের এক টিকটিকি এসেছে দিল্লী থেকে, সে শুঁকে শুঁকে ফেরারি আসামী বের করে দেয়।'

ছোটমামা চটে গেলেন, 'আমি ফেরারি হতে পারি, কিন্তু মোটেই আসামী নই। একটু তাড়াতাড়ি চাইছিলাম কারণ অ্যামেরিকানরা এর মধ্যে তিনটে লোক পাঠিয়ে চাঁদে বেড় দিয়ে এসেছে, এবার নাকি লোক নামাবে। এর পরে আর ওখানে জমিটমি পাওয়াই যাবে না!'

গুপি বলল, 'আমাদের হেডস্যার বলেছেন যে রাশিয়ানরা হয়তো এর আগেই ওখানে ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে-!' আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, 'হ্যাঁ, আমি তোর দূরবীন দিয়ে স্পষ্ট

দেখেছি, জিনিস বোঝাই নৌকো চাঁদে যাচ্ছে।'

গুপি বলল, 'না রে না, দূরবীনের কাঁচে কে একটা ছোট্ট খেলনা . আটকে দিয়েছে, তাতে খুদে একটা নৌকো জলের মতো জিনিসে ভাসে, মনে হয় বুঝি সত্যি! কিন্তু অ্যামেরিকানরা চাঁদে নেমে যদি দেখে রাশিয়ানরা আগেই সেখানে ঘর বাড়ি করে ফেলেছে, তাহলে বেশ মজা হয় ।'

এমনি সময় ছোট মাস্টার আবার ফিরে এসে মোড়ায় বসেই বললেন, 'চোঙা-টা লোহার ঢাকনি দিয়ে কে বন্ধ করে দিয়েছে। ঐ দিক দিয়ে ঢোকা যাবে না।'

ছোটমামা চমকে উঠে বললেন, 'কেন ঢোকা যাবে না? কিন্তু ঢুকবে

কে?'

ছোট মাস্টার ছোটমামার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'কেন, রোগাপানা সাহসী কেউ ঢুকবে।'

ছোটমামা বললেন, 'খুব বেশি রোগা হওয়া চাই নাকি?'

ছোট মাস্টার কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন, 'আমার চেয়ে রোগা কেউ। দাড়ি থাকলে ক্ষতি নেই। বরং চোঙার ভেতরে নরম লাইনিং-এর কাজ করবে।'

ছোটমামা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, 'বাবা দাড়ি রাখা পছন্দ করেন না, ওটা চেঁচে ফেলব ভাবছি।'

ছোট মাস্টার বললেন, 'বাবা তো শুনেছি

পড়াগুনো ফেলে লোহা-

লক্কড়ের সন্ধানে ঘোরাও পছন্দ করেন না। তবে সাহস না থাকলে কে-ই বা চোঙার মধ্যে ঢুকবে বলুন? কোথায় কি আছে কে জানে।' ছোটমামা উঠে পড়েছিলেন, আবার বসে পড়ে বললেন, 'কি আবার থাকবে? স্পেস্-শিপের গুপ্ত কারখানা আছে। বাইরের লোক ঢুকলে

মাথায় হয়তো স্প্যানার মারবে।

ছোট মাস্টার বললেন, 'কিন্তু বেড়ালরাও ছিল মনে রাখবেন। এ কাজে বেড়ালের চেয়ে মানুষ পেলে অনেক ভালো হয় না কি?'

ভালো করে ওদের কথার মানে বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু দেখলাম ছোটমামার চোখ দুটো হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠল। কি রকম চাপা গলায় বললেন, 'মানুষ! চাঁদে নামার প্রথম মানুষ! ই-স্!' একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা বাঁকিয়ে বললেন, 'কিন্তু লোহার ঢাকনি আঁটা বললেন যে?'

ছোট মাস্টার বললেন, 'আহা, বাইরে থেকে রিভেট করা। ওস্তাদ লোকের পক্ষে সে আর এমন কি। তাছাড়া আমার মনে হয়-'

ছোটমামা বললেন, 'কি মনে হয়?'

'আজ রাতে রিভেট খোলা থাকতেও পারে। যা ঘুরঘুট্টি অন্ধকার।' ছোটমামা বললেন, 'চলি। এ বেলা ডিউটি আছে ।'

কেমন যেন ওকে দেখতে অনেক লম্বা অনেক ষন্ডা অনেক লোমশ মনে হচ্ছিল। আমার শার্ট প্যান্ট পরেই চলে গেলেন। উৎসাহের চোটে আমার পায়ে বেজায় ঝিঁঝিঁ ধরে গেল। অথচ দশ দিন আগেও পায়ে কিছু টেরই পেতাম না। শেষটা হয়তো চাঁদে গিয়ে কোনো অসুবিধাই হবে না! এই সময় ছোটমামা ফিরে এসে বললেন, 'একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম। গুপি, শোবার সময় জানলা একটু খুলে রাখিস্। তেমন তেমন হলে, পায়রা গিয়ে খবর দেবে।' বলেই সুড়ৎ করে চলে গেলেন। আমরা অবাক হয়ে গুপির দিকে চাইলাম।

গুপি বলল, 'আমরা কয়েকটা পায়রা পুষে আমাদের বাড়ি আর দাদুদের বাড়ির মধ্যে খবর দেওয়া-নেওয়া করি। ছোট্ট ছোট্ট পাহাড়ি পায়রা, দিব্যি পকেটে পুরে রাখা যায়। একটা পায়রা ছোটমামাকে এনে দিয়েছি। সেটার কথাই বলছেন।'

ছোট মাস্টার এমন কথা কখনো শোনেন নি। বললেন, 'উনি থাকেন কোথায়?'

গুপি আমার দিকে চেয়ে একটু মাথা নাড়ল। ছোট মাস্টার লজ্জ। পেয়ে বললেন, 'জানি অবিশ্যি আপাততঃ ছাপাখানায় চাকরি নিয়ে সেখানেই বসবাস করেন! ভালো খানদান, কিন্তু সব সময় এত ঘোরাঘুরি করেন যে গায়ে মাংস লাগে না। শুনেছি একতলা থেকে পাঁচতলা অবধি দিনের মধ্যে পঁচিশবার ওঠানামা করেন। বড় স্যার ভারি চটা ওর উপর। তবে উনিই যে গুপির ফেরারি ছেটমামা এটা জানা ছিল না। সাহসী বটে।'

ছোট মাস্টার উঠে দাঁড়াতেই, গুপি ব্যস্ত হয়ে বলল, 'বড় মাস্টারকে ছোটমামার কথাটা বলবেন না কিন্তু স্যার, তাহলে সব ভেস্তে যাবে। শেষটা হয়তো আমাদেরও চাঁদে যাওয়া হবে না!'

ছোট মাস্টার বললেন, 'না, না, কোন কথাটা আমি তাঁকে বলেছি? তবে চাঁদুকে তাড়াতাড়ি চাঁদে যেতে বল। কারণ সত্যিই এ-বছরেই অ্যামেরিকানরা গিয়ে হয়তো সেখানে ব্যবসা ফাঁদবে। তারপর পারমিট পাওয়াই এক মহা সমস্যা হবে।'

ছোট মাস্টার সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল, গুপি বলল, 'নারে পানু, কাজটা খুব ভালো হল না। ছোটমামা চোঙায় ঢুকতে গিয়ে না আবার কোনো ফ্যাসাদে পড়ে। সাহসী হলে কি হবে। মাকড়সা, টিকটিকি, এমন কি ব্যাঙ দেখলেও ওর হাঁটু বেঁকে যায়। শেষটা চোঙায় ঢুকে না আটকে থাকে। তাছাড়া ছোট মাস্টার কি করে ছোটমামার ডাকনাম জানল? নিশ্চয় তোদের কাছে শুনেছে। তোরা বড্ড কথা বলিস্। এ সব ব্যাপারে ছোট মাস্টারের এত কিসের মাথাব্যথা তা বুঝলাম না।'

গুপি চলে গেলে, অনেকক্ষণ বসে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলাম। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম বড় মাস্টার হাত নেড়ে বৌকে কি বোঝাচ্ছেন আর বৌ ঘন ঘন মাথা নেড়ে আপত্তি জানাচ্ছে। কিছুদিন আগে বড় মাস্টারের বৌ-পোড়ার লোমহর্ষক কাহিনী শুনেছিলাম। বড় মাস্টার-ই বলেছিলেন। ঠিক যেন পরীদের গল্প। বর্মার ঘন জঙ্গলে বড় মাস্টারের বাবা সেগুন গাছের ইজারা নিয়েছিলেন। সেখানে যত সেগুন গাছ ছিল সব তাঁর কেটে আনার অধিকার ছিল। কিন্তু বনে গিয়ে সে গাছের শোভা দেখে আর কাটতে ইচ্ছা করত না। ভাবলেন তার চাইতে বড় বড় ডাল কেটেও তো কাজ চালানো যায়।

একবার সারাদিন বনে বনে ঘুরেছেন। সঙ্গের লোকেরা অনেক ছড়িয়ে পড়েছে। চারদিক ছায়াছায়া থমথম করছে। লোকের মুখে শোনা নানারকম ভয়ের গল্প মনে পড়ছে। তারপর ঐ বনে বিখ্যাত ডাকাতের সর্দার রামুর কথাও মাঝে মাঝে কানে আসত। মাস্টার- মশাইয়ের বাবা ভাবছিলেন অশরীরীদের চেয়ে বরং ডাকাতের সর্দারই ভালো। এমন সময় করুণ কান্নার শব্দ কানে এল।

মাস্টারমশাইয়ের বাবা চমকে উঠলেন। তীক্ষ্ণ বিষয়বুদ্ধি থাকলেও, মনটা তাঁর বড় নরম ছিল। কান্না শুনে আর থাকতে না পেরে খোঁজাখুঁজি লাগিয়ে দিলেন। হঠাৎ মনে হল তাঁরি একটা সেগুন গাছের তলা আলো করে কে যেন বসে হাপুস নয়নে কাঁদছে। কাছে গিয়ে দেখেন সাত আট বছরের একটি ছোট্ট সুন্দর মেয়ে, দুধে আলতা গায়ের রং, আঙুরের থোপার মতো কোঁকড়া চুল। কার মেয়ে কোথায় বাড়ি কিছু বলতে পারে না।

জিজ্ঞাসা করলেই মা-মা বলে কাঁদে।

বাবা তাকে অভয় দিয়ে, সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে এলেন। মাস্টার- মশাইয়ের মা ছিলেন না, কিন্তু বুড়ি পিসি ছিলেন। তিনিই অনেক যত্নে ঐ মেয়েটিকে মানুষ করে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। সবাই তখন মানা করেছিল, বলেছিল বন থেকে কুড়িয়ে আনা মেয়ে, কে জানে দৈত্যদানোর ঘরের কি না। কিন্তু পিসিমা কারো কথা শোনেন নি।

তারপর বৌয়ের একটু বয়স হলে রাতে বাড়িতে নানান উপদ্রব হতে লাগল। বাইরে থেকে কারা গোরু ছাগল চুরি করে। কারা যেন ছোরা ছুড়ে মারে। শেষটা বৌ একদিন আর থাকতে না পেরে সব ফাঁস করে দিলে। সে আসলে রামু ডাকাতের নাতনি। রামুই ওকে বনের মধ্যে ঐভাবে ফেলে রেখেছিল। যাতে বড় হয়ে মাস্টারমশাইয়ের বাবার বাড়ি থেকে ধনরত্ন নিয়মিত পাচার করতে পারে। এই রকম অনেক ছেলেমেয়েকে রামু এবাড়ি ওবাড়ি পাচার করে, ফলাও করে ডাকাতি ব্যবসা চালাত। এতে করে মাসে গড়ে হাজার দুই উপায় হত।

কিন্তু মুস্কিল হল যে পিসির উপর মাস্টারমশাইয়ের বৌয়ের বড় টান। কিছু পাচার করা দূরে থাকুক, এতটুকু শব্দ শুনলেই হাঁউমাউ করে উঠে। শেষে ওর জন্যেই দলের দু-চারজন ধরাও পড়ল। তখন রামুর দল ওদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে সে অঞ্চল থেকে সরে পড়ল। ঐ আগুনে জিনিসপত্রের অনেক ক্ষতি হয়েছিল বটে, কিন্তু প্রাণে কেউ মরেনি। দুঃখের বিষয় বৌয়ের মুখের একদিকটা ঝলসে গেছিল। সেই অবধি বৌ আর কারো সামনে বেরোয় না। কিন্তু পিসিদের বাঁচাতে গিয়েই বৌয়ের এই দশা, তাই হাজার খিটখিটে হলেও মাস্টারমশাই ওর যত্ন করেন। পিসি তো ওর কোলেই মাথা রেখে নব্বুই বছর বয়সে স্বর্গে গেছেন।

গল্প শুনে গুপির আর আমার খুব দুঃখ হয়েছিল। বৌয়ের জন্যে গুপি কিছু ফুল এনে দিয়েছিল। মাস্টারমশাই খুব খুসি হয়েছিলেন মনে হল ।

তবু রোজ রোজ এত কিসের তর্কাতর্কি ভেবে পেলাম না। আগে এমন ছিল না। জানলা দিয়ে শুধু বৌয়ের ঘোমটা পরা মাথাটুকু দেখা যেত। আজকাল মনে হয় বেশ ঘুঁষি পাকিয়ে মাস্টারমশাইকে ভয় দেখাচ্ছে।

তার পর দিন বিকেলে ছোট মাস্টার আমাকে হাতের কাজ শেখাতে এসে বললেন-'চাঁদে যাবার রকেটের এই মডেলটা বানিয়েছি দেখ।'

আমি তো অবাক। সব আছে দেখলাম। লঞ্চিং প্যাড পর্যন্ত।

নাকি সত্যি ওড়ানো যায়। তবে খোলা জায়গা দরকার। আমি বড় মাস্টারের ঘরের সামনে খোলা ছাদের দিকে তাকিয়ে বললাম- 'ঐখানে যেতে পারলে বেশ হত।'

ছোট মাস্টার একটু যেন থতমত খেয়ে গেলেন। হঠাৎ বললেন, 'ছোটমামার কাছ থেকে কি কোনো খবর আসে নি?'

আমি বললাম, 'না তো।'

'মানে তিনি আছেন তো?'

আমি আঁৎকে উঠলাম। আছেন তো আবার কি? কত সময় তাঁকে দিনের পর দিন দেখা যায় না। ইচ্ছা করেই উনি গা ঢাকা দিয়ে থাকেন, যাতে পুলিসের নজরে না পড়েন।

ছোট মাস্টার হাত থেকে মডেলটা নামিয়ে রেখে বললেন, 'কিন্তু চোঙার মুখের ঢাকনিটা কাল রাত থেকেই খোলা।'

আমি চমকে উঠলাম। 'সে কি! তাহলে কি ছোটমামা-। নাঃ, উনি তো রাতে বেরুতে ভয় পান।'

ছোট মাস্টার হাসলেন, 'উচ্চাকাঙ্ক্ষার কাছে ভয়-ডর টেকে না, তাও জান না। ভদ্রলোক কোনোরকম বিপদেটিপদে পড়েন নি তো? এক রকম আমার কথাতেই চোঙায় সেঁদোলেন।- আচ্ছা আজ ঠক-ঠক শব্দটব্দ কিছু শুনেছ কি?'

তাই তো! আজ তো ঠাণ্ডাঘর একেবারে চুপ। তাকিয়ে দেখলাম বড় মাস্টারের নাইটস্কুলের শেডে একটা নোটিস্ লটকানো রয়েছে! ছোট মাস্টার বললেন, 'আজ স্কুল বন্ধ। বড় স্যারের বাড়িতে নাকি

কি গোলমাল হয়েছে। বৌটিকে কিন্তু বড় বদমেজাজী মনে হয়। যদিও

খাসা রাঁধে। ভাপি খেয়েছ কখনো?'

আমি বললাম, 'ওয়াক্ থুঃ'!

ছোট মাস্টার চটে গেলেন। ও আবার কি হল? যে জিনিস সম্বন্ধে কিচ্ছু জান না, তাকে ওয়াক থুঃ করার কোনো মানে হয় না। খুব ভালো জিনিস। এক থালা ভাতে এক চিমটি মাখলেই অমৃতের মতো লাগে। বড় স্যারের নিজের মুখে শোনা। ছাদের ঘরে ও'র বৌ ভাপি বানায়। ফুলের টবের মাটিতে পুঁতে রাখে। একদিন একটু চেয়ে নেব।'

তারপর ছোট মাস্টার যাবার জন্যে তৈরি হয়ে বললেন, 'মাঃ মনটা বড় খুৎখৎ করছে। গুপির দূরবীনটা দাও তো একটু দেখি।'

অনেকক্ষণ দেখলেন। সব ভোঁ-ভাঁ। ছাদে সেই ছোট ছোট সাদা কালো জানোয়াররাও চরছে না, তা সেই পেঙ্গুইন্-ই হোক, কি বেড়ালই হোক। শেষটা দূরবীন নামিয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ছোট মাস্টার চলে গেলেন।

যেই না সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়েছেন, দরজা তখনো ভালো করে বন্ধ হয় নি খাবার ঘরের মধ্যে দিয়ে গুপি এসে হুড়মুড় করে ঢুকে বলল, -'পান, সর্বনাশ হয়েছে।'

গুপি পকেট থেকে কিলবিলে গোলাপি রঙের কি একটা বিশ্রী জানোয়ার আমার কোলের উপর ফেলে দিয়ে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবলি হাঁপাতে লাগল। আমার তো চক্ষুস্থির। মনে হল নতুন ধরনের ব্যাঙ। আমি আবার ব্যাঙ দেখতে পারি না। তাই বলে যে ভয় পাই তা যেন কেউ মনে না করে। খুদে একটা গোলাপি ব্যাঙ: তাও যদি মস্ত পায়রাখেকো ব্যাঙ হত। ফেলেই দিচ্ছিলাম কোল থেকে, এমন সময় ছোট মাস্টার আবার ঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে উঠলেন- 'ওর পায়ে বাঁধা ওটা কি?'

বলে আমার কোল থেকে ব্যাঙটাকে তুলে নিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলেন। বাঁ পায়ে ছোট্ট একটা এলমিনিয়মের খাপের মতো। ব্যাঙটা থরথর করে কাঁপছিন্ন। মাঝে মাঝে কালো ঠোঁট দুটো খুলছিল আর বন্ধ করছিল। ভারি অদ্ভুত লাগল। ব্যাঙের আবার ঠোঁট হয় জানতাম না।

গুপি গোল গোল চোখ করে এক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে, বলল, 'ওটা ব্যাঙ নয়, ও আমাদের বার্তাবাহী পায়রা, বিদ্যুৎ।' বল কি! পায়রা কখনো ব্যাঙের মতো হয়? গুপি বলল, 'হয় হয়। সব জানোয়ারের লোম ছাড়ালেই ব্যান্ডের মতো। মানুষও। আমার ছোট বোনটা একেবারে ব্যাঙের মতো, শুধু একটু বড়, এই যা।'

ছোট মাস্টার ততক্ষণে পায়ের খাপটা খুলে ছোট একটা চিঠি বের করে ফেলেছেন। চিঠি খুলে চমকে উঠে সেটা গুপিকে দিলেন। গুপিও চিঠি পড়ে দারুণ বাস্ত হয়ে উঠে, আমাকে দিল। দেখি ফিকে পেনসিল দিয়ে লেখা—'গ্রুপে চলে আয়। লোমহর্ষক ব্যাপার।' নামটাম নেই।

ছোট মাস্টার বললেন, 'চাঁদুর লেখাই তো?' গুপি বলল, 'সে আর বলতে হবে না। অমন খারাপ লেখা আর কার হবে?'

ছোট মাস্টার বললেন, 'কিন্তু কোথায় চলে যেতে হবে? একেবারে শত্রুর খপ্পরে পড়ে যাবি না তো? ওরা যদি চিঠির কথা না-ই জানবে তো পায়রার পালক ছাড়াল কে?'

গুপি বলল, 'তাইতো, যে পালক ছাড়িয়েছে, সে খাপটাকেও দেখেছে। আর খাপ দেখেছে যখন তখন কি আর চিঠি খুলে পড়ে নি। পড়ে আবার গুজে রেখেছে। যাতে সবাইকে এক সঙ্গে ধরতে পারে। কে জানে ছোটমামা এতক্ষণ বেঁচেー!' গপি থেমে গিয়ে মুখ ঢাকল। হঠাৎ আমি হেসে উঠলাম। ওরা তো অবাক।

ছোট মাস্টার ভারি বিরক্ত হয়ে বললেন, 'একটা মানুষে! মরণ-বাচন সমস্যা আর তোমার কি না হাসি পাচ্ছে!'

খুব লজ্জা পেয়ে বললাম, 'না, না, সেজন্যে নয়, তাছাড়া ছোটমামা যে সহজে মরবে না সেটা ঠিক! আছে সেটা এবার প্রমাণ হল। আমি হাসছিলাম কারণ নেপো যে বেঁচে পাখি ধরতে পারলেই ও তাদের পালক ছাড়ায়। পায়রা যেখান থেকে এসেছে, সেখানে নেপোও আছে।'

গুপি বলল, 'তার মানে সেখানে ছোটমামাও আছে। চলুন, ছোট স্যার তাকে উদ্ধার করতে হবে। বিপদ আপদ দেখলে ছোটমামার দাঁত-কাপাটি লেগে যায়।'

ছোট মাস্টার কাষ্ঠ হেসে বললেন, 'তাহলে চাঁদে যাবার খুবই উপযুক্ত পাত্র দেখছি। তুমি বরং এগোও, আমি একটু কাজ সেরে আসছি।' গুপি বলল, 'কার কত সাহস বোঝাই যাচ্ছে।'

ঐ ওর দোষ, অল্পতেই রেগে যায়।

ছোট মাস্টার কিছু মনে করলেন না। তো দিন-রাতই এই ধরনের কথা শোনেন। বল নি। দুজনে গেলে বেশি কাজে দেবে। তাছাড়া বড় মাস্টারের কাছে নরম গলায় বললেন, 'মন্দ তা হলে তোমরা এখানে একটু অপেক্ষা কর, আমি কাজ দুটো সেরে আসি। ততক্ষণে এই বইটা থেকে চাঁদের বিষয়ে আরো কিছু তথ্য শেখো, কেমন?'

এই বলে ছোট একটা বই আমার হাতে দিয়ে ছোট মাস্টার এক রকম ছুটে বেরিয়ে গেলেন।

ভারি ভালো বইটা। নাম 'চাঁদের রহস্য'। খুলে দেখলাম লেখা রয়েছে সম্ভবতঃ সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে গ্যাস আর ধূলো এক সঙ্গে জমে চাঁদের সৃষ্টি হয়েছিল, এই রকম মত কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ পোষণ করে থাকেন। অর্থাৎ চাঁদ পৃথিবীর চেয়েও পুরনো। কেউ কেউ আবার বলেন পৃথিবীর টুকরো ছিঁড়ে উড়ে গিয়ে চাঁদ তৈরি হয়েছে।

চাঁদ নিজের অক্ষ-দণ্ডে ২৭৯ দিনে একবার পাক খায়। পৃথিবীর চারিদিকে ২৯ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট একবার ঘুরে আসে। চাঁদের ব্যাসের মাপ ৩৪৫৬ কিলোমিটার। মাঝে মাঝে চাঁদে রঙের পরিবর্তন দেখা যায়, তার কারণ সম্ভবতঃ নিবে যাওয়া আগ্নেয়গিরির গহ্বর থেকে গ্যাস বেরোয়।

এই অবধি পড়ে গুপি বইটাকে ছুড়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে, ঘরময় পাইচারি করতে লাগল। দেখলাম মুখটা লাল। বোধ হয় কান্না চাপছিল। ঠিক সেই সময় হস্ত-দন্ত হয়ে ছোট মাস্টার ফিরে এসে বললেন, 'গুপি, চল।'

তারপর একটা ছোট্ট কার্ডে একটি গোপন টেলিফোন নম্বর লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন, 'যদি দেখ রাত দশটার মধ্যেও আমরা কেউ ফিরে এলাম না, তাহলে এই নম্বরে ফোন করে শুধু বলবে-ফুস্-মন্তর, ব্যস্ আর কিছু নয়। কার্ডটি তখুনি ছিঁড়ে ফেলো আর কখনো কাউকে বল না।' বলিও নি কাউকে, তা ছাড়া এখন ভুলেও গেছি। অবিশ্যি ফোন করার দরকার-ও হয় নি। কার্ডটাকে ছিঁড়েও ফেলেছি।

ওরা চলে গেলে পর আমার নানান কথা মনে হতে লাগল । পা দুটোর উপর এমনি রাগ হতে লাগল যে আর কি বলব। তার উপর রামকানাই এসে ইনিয়ে বিনিয়ে ওর পিসেমশাইয়ের কতবার কি অসুস্থ হয়েছিল তাই বলতে লাগল। ওকে বললাম, 'জান, নেপো বেঁচে আছে।'

রামকানাই তো অবাক। 'ওকি কথা পানুদা, যারা অনেকদিন সঙ্গ ভোগ করছে, তাদের বিষয় অমন কথা বলতে হয় না। অবিশ্যি সঙ্গ কি না সে বিষয়েও ঠিক বলা যায় না।

আমি বললাম, 'না, রামকানাইদা, না। নেপো ছাড়া কে বিদ্য তের পালক ছাড়িয়েছে বল।' বুক পকেট থেকে বিদ্যৎকে বের করে দেখালাম। রামকানাই তো হাঁ।

হঠাৎ বড় মাস্টারের ঘরে আলো জ্বলছে না। জানলার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। এই ও ঘর অন্ধকার দেখি নি। বাড়িতে আমরা চার বছর আছি, কখনো যেই না সূর্য ডোবে ও ঘরেও বাতি জ্বলে। একবার অনেকক্ষণ পাড়ার আলো নিবে গেছিল! ও ঘরে মোমবাতির আলো দেখতে পেয়েছিলাম। নেবার সঙ্গে সঙ্গে বৌ বোধ করি অন্ধ- কারকে ভয় পায়। অথচ একদিন ঐ বৌ-ই বনে বাস করত।

জানলার কাছে গিয়ে দেখলাম ছাপাখানার আর ঠাণ্ডা-ঘরের কোনো আলোই জ্বলছে না। নিচে বড় মাস্টারের নাইটস্কুলের শেডের সামনের বড় আলোও নেবানো। কোথাও একটা লোক দেখা যাচ্ছে না। তবু আমার ঘরে বসেই টের পাচ্ছিলাম যে ঐ দুটো বাড়িতে সাংঘাতিক কিছু একটা পাকিয়ে উঠেছে।

রামকানাইকে বললাম, 'তুমি একবার যাও না, গুপি আর ছোট মাস্টারের সাহায্য দরকার হতে পারে।'

রামকানাই ফোঁস করে উঠল, 'ও বাবা, সে আমি পারব না। কেউটে সাপের বাসায় নাক গলানো আমার কম্ম নয়। তা ছাড়া আমি গেলে তোমার দেখাশুনো করবে কে! তোমাকে একা ফেলে যাই, আমার চাকরিটাও যাক্ আর কি। যাই, মাংসটা চাপিয়ে এসেছি।' এই বলে রামকানাই সত্যি সত্যি দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

দরজার কাছে পৌঁছে, ফিরে বলল, 'কোনো ভয় নেই, ঐ যে সামন্ত- বাবুও একদল প্যায়দা নিয়ে গলিতে ঢুকল। যাই, মাংস না ধরে যায়। চোর ধরার চেয়ে সে অনেক খারাপ হবে।'

আরো অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। রামকানাই একবার উকি মেরে দেখতে এন কি করছি। বললাম, 'সব গুনেও নেপোকে খু'জতে যাবে না?' রামকানাই বলল, 'না, আমার গুরুদেব শুনলে দুঃখিত হবেন!'

এই বলেই চলে গেল! একটু পরে আবার এসে বলল। 'অত নেপো-নেপো কর কেন? মহা পাজি বেড়াল। অমন ঢের ঢের বেড়াল পাওয়া যায়। চাও তো দুটো একটাকে এনেও দিতে পারি।' চাঁদের বইটা ছুড়ে মারলাম। সঙ্গে সঙ্গে সে কি চিৎকার!! শুনে আমার গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে উঠল। মনে হল কে চ্যাঁচাচ্ছে, 'পানু -পানু-পানু-ওরে পানু-বাঁচা-রে! মি-অ্যাঁ-ও মি-অ্যাঁও।' আর একি মিনিটও অপেক্ষা করলাম না, পাঁই পাঁই গাড়ি চালিয়ে একেবারে পেছনের বারান্দার ঘোরানো সিঁড়ির মুখের কাছে চলে গেলাম। মনে হল ওদিকে ওদের ঘোরানো সিঁড়ির মাথার দরজাটায় কারা যেন আছড়ে পড়ল। 'পানু-পানু-বাঁচা।' আর সে কি ম্যাঁও-ম্যাঁও শব্দ।

'ও রামকানাই দা। ও রামকানাই দা!' বলে চ্যাঁচাতে লাগলাম। উত্তর নেই। হঠাৎ দেখি রঙের মিস্ত্রিদের তক্তাটা আমাদের রেলিং-এর ধারে পড়ে আছে। এক মাথা সিঁড়ির রেলিং-এ বাঁধা। নিশ্চয় গুপির কাজ। হাত বাড়িয়ে সেটাকে তুলে নিলাম। বেশ ভারি। গাড়ি থেকে নেমে সিড়ির রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে ঠেলে ঠেলে যেই না ওদের সিড়ির সঙ্গে জুড়ে দিলাম, অমনি ওদিকের দরজা খুলে হুড়মুড় করে দাড়িওয়ালা একটা লোক, বেড়াল বগলে তক্তা পেরিয়ে চলে এল। সঙ্গে সঙ্গে গুপি এসেই তক্তা টেনে নিল। কিন্তু ততক্ষণে আরো গোটা দশেক বেড়াল আমাদের বারান্দায় এসে উঠেছে। উঠেই কার্নিশ বেয়ে হাওয়া।

আমি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম। এবার উঠে গাড়িতে চেপে খাবার ঘরে এলাম। গুপি বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমি কেবল বলতে লাগলাম-'ওরে নেপো! আবার ফিরে এসেছিস্।' আর নেপো আমার কোলে উঠে কেবলি আমাকে চাটতে লাগল । নেপোর গলায় দেখলাম একটা সাদা টিকিট ঝুলছে। তাতে লেখা-A।

ছোটমামা আর গুপি আমার বিছানায় বসে বসে খালি হাঁপাতে লাগল। তাদের মুখগুলো কাগজের মত সাদা, হাত পা কাঁপছে।

রামকানাইকে কিছু না বলতেই ওদের জন্যে গরম চা আর নেপোর জন্যে বাটি করে দুধ নিয়ে এল। টানতে টানতে নেপোকে আমার কাছ থেকে নিয়ে দুধের বাটির সামনে বসিয়ে দিল এবং বলা বাহুল্য নেপোও তৎক্ষণাৎ দুধের সদ্ব্যবহার করতে লেগ গেল।

এমন সময় দরজা ঠেলে মেজকাকু ঢুকেই, ওদের দেখে বললেন, 'এই যে তোমরা এখানে। ওটা কে? চাঁদ না? তুই আবার দাড়ি রেখেছিস্ কেন? চেঁচে ফেল, বিশ্রী দেখাচ্ছে, স্রেফ আইনভঙ্গকারী! তোরা এখানে কি কচ্ছিস্? এদিকে পাশের বাড়িতে বিনু তালুকদার যে কেল্লা ফতে করে দিয়েছে তাও জানিস না বুঝি? চাঁদ, এবার বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্ত মনে পড়াশুনো করগে যা। বুড়ো বাপকে আর জ্বালাস্ নি।'

গড়গড় করে কি যে বকছেন কাকু আমি ভালো করে বুঝতেই পারছিলাম না। কিন্তু গুপি আর ছোটমামা কোনো কথা না বলে পাশাপাশি আমার খাটের উপর শুয়ে পড়ল। কাকু বাস্ত হয়ে রামকানাইকে বললেন, 'হাঁ করে বসে আছিস যে? ও দুটোর দাঁতকপাটি লেগেছে দেখছিস্ না? মাথায় জলের ঝাপটা দে!'

কিন্তু রামকানাইএর-ও এমনি হাত পা কাঁপছিল যে সেও নড়তে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত আমিই তাক থেকে কুঁজো নামিয়ে জলের ঝাপটা দিতে লাগলাম। তাই দেখে কাকু আবার ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, 'এ্যা! তু-তু-ই হাটছিস্!'

তাইতো, দিব্যি হাঁটাহাঁটি করছি, এতক্ষণ তো টের পাই নি। বাবা-ও এসে ঘরে ঢুকে হাঁ করে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। কেন জানি হাঁট মাউ করে কেঁদে কেলরাম। বাবা-ও নাক টানতে টানতে আমার হাত ধরে আবার বসিয়ে দিলেন। পকেটে বোধ হয় চিপকে গিয়ে বিদ্যুৎ বক- বকম করে উঠল। মা এসে কিছু না বলে মহা কান্নাকাটি লাগালেন। এ তো বড় জ্বালা।

অনেক পরে বাবা বললেন, 'ডাক্তারবাবুকে ফোন করে দেওয়া হয়েছে, এখুনি আসবেন। বললেন এইরকম একটা উত্তেজনার-ই দরকার। কিন্তু এরা দুজন এখনো ভিজে বালিশে শুয়ে কেন? সদি লাগবে না?'

গুপি আর ছোটমামার দুজনারি সর্দির বড় ভয়। বাবার কথা শুনেই তড়াক করে উঠে বসে আমার তোয়ালে দিয়ে তারা মাথা মূহুতে লোগ গেল।

তারপর বাবা মেজকাকুকে বললেন, 'কি ব্যাপার খুলে বল্ দিকি

নি।'

কাকু বললেন, 'নিতাই সামন্ত এক্ষুণি এল বলে, এদের স্টেটমেন্ট নিতে। তার কাছেই সব শুনো। আমার বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে গেছে। নিতাই ফোন করে বলল তোমার বাড়ি থেকে পাখি যেন না পালায়। তাই এলাম ।'

একথা যেই না বলা, ছোটমামা আর গুপি দুজনেই লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। মেজকাকু বললেন, 'ও কি হচ্ছে? ওসব চলবে না। চুপ করে বসে থাক। আমি কথা দিয়েছি সে না আসা অবধি তোমাদের এখানে আটকে রাখব।'

গুপি বলল, 'কি, কি করে জানলেন আমরা এখানে?'

মেজকাকু তো অবাক। কি করে জানলাম? শুধু আমি না, পাড়াসুদ্ধ যত লোক অন্ধকার গলিতে খাপে দাঁড়িয়েছিল, সবাই দেখেছে তক্তা পার হয়ে দুজন আইনভঙ্গকারী এখানে আশ্রয় নিচ্ছে। খবরদার যদি নড়েছ !! আর সামন্ত আসার আগে ঠোঁট ফাঁক করবে না। তোমরাই পুলিসের সব চেয়ে বড় সাক্ষী। ভিতরের ব্যাপার স্ব-চক্ষে দেখে এসেছ। ছোট মাস্টার কোথায়? যাক গে, পুঁটিমাছ বোধ হয় বিনু তালুকদারের জালে পড়েছে।'

এই বলে মেজকাকু বেদম হাসতে লাগলেন। খুব রাগ হল । তারপর গম্ভীর মুখ করে ছোটমামার দিকে চেয়ে বললেন, 'তুমি সত্যি এর মধ্যে জড়িয়ে আছ দেখে বড় দুঃখিত হলাম। তোমার বাবা এত ভালো লোক, গেলেই কি ভালো তামাক খাওয়ান। তবে নিতাই সামন্ত যেই তোমার ঘরে চোরাই গাড়ির নম্বর প্লেট পেয়েছিল, তখনি সব আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি তুমি দুষ্টুলোকের-' ছোটমামা হঠাৎ রেগে গেলেন। 'ওসব আমি গোমেস ব্রাদার্স থেকে সের দরে কিনেছি, তার ভাউচার আছে মার হাতবাক্সে, গিয়ে দেখতে পারেন।'

শুনে মেজকাকু অবাক!

বাবা হেসে বললেন, 'ও হো, তোকে বলা হয় নি। চাঁদু যে স্পেস্- শিপ বানিয়ে গুপি আর পানুকে চাঁদে নিয়ে যাবে। সেখানে জমি কিনে ওরা স্পেস্-শিপ সারাবার কারখানা করবে। দ্যাখ চাঁদু, মাটির তলার জমি কিনিস্ কিন্তু, ওপরের জমি বাজে। হ্যাঁ কি বলছিলাম, তা চাঁদে যাবার খরচা কম নয়, ওরা পারবে কেন? তাই চাঁদু নিজেই স্পেস্-শিপ বানাবে। তাই নিয়ে এত ভাবতে হয় যে পড়া করার সময় পায় না। ফলে বি-এস-সিতে সুবিধা করতে পারে না।'

এই অবধি বলে বাবা আর মেজকাকু যে যার নিজের হাতঘড়ি দেখলেন। মেজকাকু জানলার কাছে গিয়ে বললেন, 'দশটা বাজতে দশ মিনিট, আমাদের সকলের জন্যে রাঁধতে দিয়েছ আশা করি, বড়দা?'

রামকানাই দরজার কাছ থেকে বলল, 'খিচুড়ি, মাংস, আলুভাজা, বেগুনভাজা।'

গুপি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। আমি বললাম, 'ছি, মেজকাকু, তোমার

শুধু খাওয়ার ভাবনা।' গুপি আর ছোটমামা একসঙ্গে বলল, 'খাওয়ার ভাবনা খারাপ নাকি? উঃ পেটে চড়া পড়ে গেছে!'

ডাক্তারবাবু এলেন। আমার পা পরীক্ষা করলেন। হাঁটালেন, চলালেন, ওঠ-বোস করালেন। তারপর ওষুধপত্র মালিশের ব্যবস্থা করে দিয়ে বললেন, 'পানু, এও তোমার এক রকম পরীক্ষা শেষ হল। তুমি খুব ভালো ভাবে পাস করেছ। এক মাস এক্সারসাইজ করবে, বাড়াবাড়ি করবে না। তারপর স্কুলে যেতে পারবে। কেমন, খুসি তো?'

আমার খুব সর্দি এসে গেল, কিছুই বলতে পারলাম না।

এমন সময় নিতাই সামন্ত এসে ঢুকলেন। সবাই চুপ। মেজকাকু একটু কেশে বললেন, 'এই যে কানু, তোমার সাক্ষী-সাবুদ, অনেক কষ্টে আটকে রাখা গেছে।'

বাবা বললেন, 'তা ছাড়া অবিশ্যি দৌড়-ঝাঁপ করার মতো ওদের ক্ষমতাও নেই।'

ছোটমামা ভাঙা গলায় বললেন, 'সুদিন খাই নি। খাঁচায় বন্ধ করে রেখেছিল।'

নিতাই সামন্ত বললেন, 'তাই নাকি? ভাগ্যিস গুপিরা গেছিল!' ছোটমামা চিচিঁ করে বললেন, 'মোটেই ওরা আমাকে উদ্ধার করে নি।

আমিই বরং-'

গুপি বলল, 'ফের।'

ছোটমামা থেমে গিয়ে ঢোক গিলতে লাগলেন।

বাবা আর মেজকাকু একসঙ্গে বললেন, 'এবার তাহলে রহস্য উদ্ঘাটন হোক ।'

নিতাই সামন্ত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বালেন, 'ধৈর্য ধরুন। বিনু তা বুকদার হয় তো রিং লিডারদের নিয়ে এখানে আসবেন, মোকাবিলা করতে। অর্থাৎ সবাইকে মুখোমুখি এনে ব্যাপার খোলসা করতে। তেওয়ারি রাখুর দলও আসবে, কিছু আসবাব সরালে ভালো হয়।'

,আমি বললাম, 'আমার ঘরে কেন? তার চেয়ে সবাই মিলে বসবার ঘরে গেলে হয় না?'

সামন্ত বললেন, 'আরো ভালো হয় একদল যদি এখনি খেয়ে নেয়। চাঁদু, গুপি, পানু, এরা খেয়ে নিক। দেখো, আবার পালাবার চেষ্টা করলে হুলিয়া লাগিয়ে ধরিয়ে এনে ফাটকে দেব কিন্তু। আর ভালোমানুষের মতো খেয়ে নিলে, তোমাদের স্টেটমেন্ট নিয়ে, আমার জিপে করে যার যার বাড়ি পাঠিয়ে দেব! তোমরা কিছু আসামী নাও, তোমরা হলে পুলিসের পক্ষের সাক্ষী।'

দরজার কাছ থেকে রামকানাই বলল, 'কোনো ভয় নেই। খাবার ফেলে ওনারা সগগেও যাবেন না। রান্না তৈরি।'

বাবা বললেন, 'চোপ ।'

ছোটমামা বললেন, 'খেয়ে এসে সব বলব। কিন্তু আমাকেও গুপিদের ওখানে পাঠাবেন। বাবার কাছে এমনি গেলে, বাবা দাড়ি ছিড়ে দেবেন।' খেয়ে দেয়ে সবে এসেছি অমনি আমাদের সদর দরজার ঘণ্টি তিনবার

বেজে উঠল। নিতাই সামন্ত লাফিয়ে উঠলেন, 'ঐ, ঐ বিনু তালুকদারের

লোকের সংকেত। আপনারা তিনটে বড় বড় শকের জন্য প্রস্তুত হোন।'

আমার পকেট থেকে বিদ্যুৎ আবার বকম-বকম করতে লাগল। আর নেপো তার পিঠটাকে কুলোর মতো করে, লোম ফুলিয়ে তিনগুণ বড় হয়ে, দাঁতের ফাঁক দিয়ে অদ্ভুত একটা ই-স্-ফ্-স্-স্ শব্দ করতে লাগল।



এগারো

শেষ পর্যন্ত সে রাত্রে আর কিছু শোনা হল না। ডাক্তারবাবু নিশ্চয় আমাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিলেন। হঠাৎ কেমন ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে গুপি আমাকে ঠেলে তুলল। রাতে সে বাড়ি যায় নি। আমার ঘরের কৌচে ঘুমিয়েছিল। অথচ আমি সে বিষয় কিছুই জানি না। ছোটমামার দেখা নেই!

চোখ খুলতেই গুপি আমার হাতে হারানো খাতা গুঁজে দিল। দুমড়ানো মুচড়োনো আঁচড়ানো কামড়ানো। এই আমার সেই আদি নেপোর বই। পরে গুপি নিয়ে গিয়ে মোড়ের মাথায় দোকান থেকে বাঁল্লিয়ে দিয়েছে। এতে আমি সমস্ত ব্যাপারটার যতখানি মনে আছে লিখে রেখেছি। যেমন মলাটে 'নেপোর বই' নাম লেখা ছিল, তেমনি আছে। ভেবেছিলাম কেমন বাড়েটাড়ে বাচ্চা বয়স থেকে সব লিখে রাখব। সে আর নানা কারণে হয়ে ওঠে নি। তাছাড়া সব কথা লেখাও যায় না। মহা পাজি।

খাতা পেয়ে অবাক হয়ে উঠে বসে গুপির দিকে তাকালাম। গুপি বলল, 'কাল বড় মাস্টারের ঘর থেকে ছোটমামা ওটাকে উদ্ধার করেছিল।' এমনি অবাক হলাম যে পায়ের জোর চলে গেল, খাট থেকে পড়ে গেলাম, নিজেই খচমচ করে উঠে বললাম, 'তা-তার মানে?'

খানিকটা তোতলামি এসে গেল। পা যখম হওয়ার পর থেকে একটু

তোত্মাই। আজকাল প্রায় সেরে গেছে।

গুপি বলল, 'সে অনেক কথা।'

বলে মুচকি হাসতে গিয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগল। আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম। তারপর বললাম, 'পোড়া বৌ মরেছে

বুঝি?'

পূপি মাথা নেড়ে বলল, 'খোড়া নয়। বৌ নয়।' 'তবে?'

'ওর দাদা।'

আমি বললাম, 'দাদা মরেছে তো তুই কাঁদছিস্ কেন? তাকে তো চিনিও না।'

গুপি বলল, 'মরে নি! সামন্ত তিনটে শকের কথা বলেছিল। ঐ হল এক নম্বর।'

'তবে কেন কাঁদছিস?'

'উনি বর্মায় যান নি কখনো, জাহাজডুবি হয় নি, বাঁদরদের দ্বীপ থেকে কেউ তাড়ায় নি, ডুবো-জাহাজে নেমে সোনা তোলেন নি, বনের দেউয়ের পাহাড়ে ওঠেন নি। ম্যাও নামে বেড়াল ছিন্ন না। সব বানানো কথা। ঐ হল দু নম্বরের শক্! ওর দাদা বলেছে।'

তাই শুনে আমারো কেমন পেট কামড়াতে লাগল। 'তবে কি বৌ রামু ডাকাতের মেয়ে নয়?'

গুপি বলল, 'না, না, কারো মেরে নয়, বৌই নয়, ও-ই দাদা।' কেমন গোলমাল লাগতে লাগল। 'কার দাদা?' 'বড় মাস্টারের দাদা! মোটর চুরির ব্যবসা ওর। ঠান্ডা ঘরের মালিক উনি!'

তারপর আরো খানিকটা কেঁদে বলল, 'স্পেস্-শিপ তৈরি হয় না ওখানে! চোরাই গাড়ির চেহারা বদলি করা হয়। ধরেছে। তাই কাল তার আসতে দেরি হল। বিনু তালুকদার সবাইকে এসে সব বলে গেল। তুই তখন হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লি! আজ আবার আসবে, তোর জবানি নেবে।' • আমি বললাম, 'আ-আ-আমি কি-কি-কি-কিসের বিষয় জবানি দে-ব?'

গুপি অবাক হরে বলল, 'বেড়ালের।'

'কি বেড়ালের জবানি।'

'নেপো বেড়ালের।'

আমি হাঁ করে তাকিয়েই রইলাম। নেপো ঘরে ঢুকে গুপিকে দেখে

রেগে গর-র-র-গ-র-র করতে লাগল। গুপি দুঃখিত হয়ে বলল, 'এক রকম বলতে গেলে আমিই ওকে বাঁচালাম আর আমার উপর রাগ দেখাচ্ছে দেখ!' 

'না না, তোর উপরে ঠিক নয়। তুই আমার আলোয়ানের উপর বসেছিস্ কি না, ঐখানে ও বসে।

গুপি সরে বসে বলল, 'মাস্টারের দাদা অবসর সময় হার্মোনিয়ম বানাত। অনেক জায়গায় নাকি তার খুব চাহিদা। অনেক পয়সা কামাত।'

আমি বললাম, 'কি রকম হার্মোনিয়ম?'

গুপি অবাক হয়ে গেল। 'কেন, বেড়ালের হার্মোনিয়ম নিশ্চয়। নাকি সন্দেশ পড়ে শিখেছিল। খালি ঐ বেড়ান ধরা যা একটা সমস্যা হয়েছিল। সব বেড়ালের সারেগামার সুর ঠিক থাকে না। সুর ঠিক না হলে লোকে কিনবে কেন। বেসুরো গান কে শুনতে চায়?'

কখন যেন বাবা এসে দাঁড়িয়েছিলেন টের পাই নি। বেজায় আশ্চর্য হয়ে বললেন, 'বেড়ালের হার্মোনিয়ম আবার কি?'

আমি বললাম, 'সেই যে সুবিমল রায় সন্দেশে লিখেছিলেন, কে যেন বানিয়েছিল। কাঠের খোপে খো.প বেড়াল বসাতে হয়, তলা দিয়ে ল্যাজ ঝোলে। একেক বেড়ালের একেক সুর হওয়া চাই, সা-রে-গা-মা-পা-ধা- নি-সা। ল্যাজ ধরে টানলেই বেড়াল ঐ সুরে ম্যাও ধরে। দিব্যি গানটান বাজানো যায় ।'

বাবা বললেন, 'পাগল নাকি?'

গুপি একটু চটে গেল। 'ন। কাকা, পাগল নয়। অনেক বেড়াল জোগাড় করতে হত, তাদের সুর ঠিক চিনে গলায় টিকিট ঝোলানো হত। টিকিট তো সবাই দেখেছে। নেপোর গলাতেও ছিল।'

বড় মাস্টার ওর ল্যাজে পা দিতেই ও একেবারে এক টানে সা-রে-গা- মা-পা-ধা-নি-সা আ-আ করে চেঁচিয়ে উঠে দে পিট্টান। বড় মাস্টার বাড়ি গিয়ে দাদার কাছে ঐ কথা বললেন! শুনে অবধি দাদা আর বড় মাস্টারকে ছাড়ান দেয় নি। 'ওটি আমার চাই, ডি লুক্স হার্মোনিয়ম বানাব।' বড় মাস্টার দাদাকে ঘরে আটকে রাখার জন্যে বেড়াল জোগাড় করে দিতেন। নইলে দাদা কোথায় কি করে বসবে তার ঠিক কি। নাকি সতেরো বার জেল খেটেছে, পৃথিবীর নানান দেশে, নানান নামে। ঐ ছাদে বেড়ালরা চরত। মাছ আসত ওদের-ই জন্যে। কিন্তু বেশি খেলে গলার সুর খোলে না। তাই খাওয়া কমানো হয়েছিল। ঠান্ডা ঘরের চোরাই গাড়ির কারখানায় ওরা থাকত। খাওয়া কমানোতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল।

অমনোনীতরা ছাড়াই থাকত। তেওয়ারি তাদের গলা সাধাত। মহা দৌড়ঝাঁপ করত ওরা। সেদিন ছোটমামা চোঙা খুলতেই ওরাই নদীর স্রোতের মতো বেরিয়ে এসেছিল। চোঙার বাইরে থেকে মাছের গন্ধ একটুখানি নাকে ঢুকতে না ঢুকতেই।'

আমি বললাম, 'আর ছোটমামা?'

গুপি একট হাসল। 'ছোটমামাই তো চোঙা দিয়ে কারখানায় ঢুকে, বেড়ালদের খাঁচা আবিষ্কার করে, নিজেই একেবারে থ। ছোটমামা একটা হীরো।'

এই বলে গুপি আরো খানিকটা কেঁদে নিল।

আমি বললাম, 'ওরকম করিস্ না। ভ্যালি তৈরি হয়ে যাবে।' তাহলে আর একটা দামোদর

গুপি বলল, 'চাঁদে যাবে না বলছে যে। নাকি বড্ড হাঙ্গামা।' বেজায় রাগ হল। চোঁচিয়ে বললাম, 'চাঁদে যাবে না তো করবেট। কি শুনি?'

গুপি বলল, 'পুলিসে চাকরি নেবে। ঐ হল তিন নম্বরের শক!'

'পু-পু-.ি সে চাকরি নেবে? সে আবার কি?'

'বিন্নু তালুকদার ওকে হাত করেছে বুঝলি না। ওকে দিয়ে কাজ হাসিল করেছে এখন আর কি ওকে ছাড়ে।'

বাইরের দরজার ঘণ্টি পড়ল। বাবা লাফিয়ে উঠে বললেন, 'ঐ যে মিঃ তানুকদারের দল এলেন বোধ হয়।'

সঙ্গে সঙ্গে মেজকাকু আর নিতাই সামন্ত ঘরে ঢুকে ধপাধপ করে একেকটা চেয়ারে বসে, কপালের ঘাম মুহুতে লাগলেন। মেজকাকু বললেন, 'উঃ, সাধে লোকে ওর নাম দিয়েছিল গোরিলা ঘোষাল! গায়ে কি জোরটা দেখলে? একবার গা ঝাড়া দেয় তো তোমাদের সব চাইতে জোরালো পাঁচ ছয়টা ছিটকে পড়ে! আবার তেজ কত! বুক চাপড়ে বলল, - কি করবি রে তোরা আমার? বৌ সেজে ঘোমটা দিয়ে সাত বছর কাটালাম, এখন আমার ভয় ডর বলে কিছু নেই। দে না পাঁচ বছরের জন্যে জেলে। পায়ের উপর পা দিয়ে তোদের পয়সায় দুবেলা খাব আর আমার হার্মোনিয়মের বইটা এই অবসরে লিখে ফেলব!--চাঁদ এল না; কালকের অত উত্তেজনার ফলে ওর পেটের অসুখ করেছে। গুপিদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। বাড়ি গেলে বুড়ো ওকে মাটিতে বিছিয়ে দেবে।'

নিতাই সামন্ত বললেন, 'কি জানি শেষ পর্যন্ত গাড়ি চুরির কেসটা টিকবে কি না। ওখানে তো ঐ দুটো ভাঙা গাড়ি ছাড়া কিছু পাওয়া গেল না। নাকি গাড়ি সারাবার কারখানা। ও দুটোকে সের দরে কিনেছে। লাইসেন্স নেই বলে লুকিয়ে কাজ করে। এদিকে বেড়ালের হার্মোনিয়ম তৈরি করা কিছু বে-আইনী নয়। ঐ লাইসেন্স নেই বলেই যা খানিকটা জরিমানা করা যেতে পারে।'

বাবা বললেন, 'সবটা খুলে না বললে ঠিক বুঝতে পারছি না।' সামন্ত বললেন, 'তাও বুঝলেন না? এর মধ্যে দুটো ব্যাপার জড়িত, এক গাড়ি ছুরি, দুই বেড়াল চুরি। চোরের সরদার কিন্তু একজন-ই। ঐ যে বললাম গোরিলা ঘোষাল, বড় মাস্টারের দাদা। ঠান্ডা ঘরটা একটা ভাঁওতা। ওটা আসলে মোটরের কারখানা। আমাদের বিশ্বাস চোরাই গাড়ির, কিন্তু তার কোন প্রমাণ পাচ্ছি না। তাছাড়া হার্মোনিয়মের কাঠের খোল তৈরি হয় ওখানে। তারি ঠক ঠক শোনা যায়। এয়ারা তাই শুনে ঐ স্পেস-শিপ বানাচ্ছে, বলে আহাদে আটখানা!

দেখলাম চমৎকার ব্যবস্থা। ঠান্ডাঘরের ছাদে ওঠার সিঁড়ি আছে ভিতরে। ছাদের কোণা দিয়ে নাইলনের দড়ির মই বেয়ে ঘুলঘুলির ভিতর দিয়ে বড় মাস্টারের ঘরে যাওয়া যায়। আবার সেখান থেকে বড় সিঁড়ি দিয়ে ছাপাখানার ভিতরে নামা যায়। নাইট ওয়াচম্যানের ঘরেও ঢোকা যায়। তাড়া খেয়ে গুপিরা তাই করেছিল। তারপর পানু তক্তা ফেলে দিতেই এবাড়িতে পালিয়ে আসতে পেরেছিল। নইলে গোরিলা ওদের মেরে পাট করে দিত। তার আগে কি হয়েছিল সে-কথা গুপিই ভালো বলতে পারবে। আমি তো তখনো পৌঁছই নি।'

গুপি দেখলাম খুব খুসি। হাসতে হাসতে বলল, 'ছোট স্যারের সঙ্গে গলি দিয়ে ঢুকে ও মাথায় গিয়ে দেখি ঠান্ডাঘরের গায়ের ছোট দরজাটা খোলা, হাওয়ায় দুলছে। ঐখানে গিয়ে ঢুকলাম। একটা প্যাসেজ দিয়ে যেতেই কারখানা। লোহালক্কড়, কাঠের ডাঁই, যন্ত্রপাতি! তেলে প্যাচ প্যাচে বিশ্রী জায়গা। একটা নিয়ন বাতি জ্বলছে। কেউ কোথাও নেই। তারপর একটা ফ্যাঁস ফ্যাঁস ফোঁস ফোঁস ম্যাও-ম্যাও মিউ মিউ শুনে দেখি বিরাট এক খাঁচার খোপে খোপে শত শত বেড়াল। এমন সময় কাতর কণ্ঠে কে বলল, "বাঁচাও!" এ ছোটমামা না হয়ে যায় না। দেখি মস্ত খাঁচার এক ধারে আলাদা খোপে গুড়ি মেরে ছোটমামা বসে। ভয়ে আধমরা। চোঙা ।দয়ে ওকে নামতে দেখেই কারখানায় যারা কাজ করছিল তারা নাকি ভূ-তত্ত্ব-ত বলে খিড়কি দোর খুলে দে দৌড়। ছোটমামা ঘরটা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখে ছাদ অবধি সিঁড়ি উঠে গেছে।

সিঁড়ি বেয়ে ঠাণ্ডাঘরের ছাদে গিয়ে দেখে, সামনে নাইলনের মই ঝুলছে। তাই বেয়ে একেবারে বড় মাস্টারের ঘরে, পোড়া বৌয়ের মুখো- মুখি। কিন্তু সে পোড়া বৌ নয়। এক হাত ঘোমটা, ঝোলা গোঁপ, মোটা বেঁটে গোরিলা ঘোষাল হার্মোনিয়ম পালিশ করছে। ওকে দেখে সে হুঙ্কার দিয়ে লাফিয়ে উঠল। তারপর এক মিনিটের মধ্যে বগলদাবা করে, স্বচ্ছন্দে দড়ির মই বেয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে একেবারে ঠান্ডা ঘরে। তারপর বেড়ালের খাঁচার অন্য অর্ধেকে পুরে বাইরে থেকে শিকল তুলে, কাঠ হেসে, কোনো কথা না বলে, আবার সিঁড়ি বেয়ে অদৃশ্য। সেই ইস্তক ছোটমামা ঐখানে বন্ধ, চ্যাঁচাবারো জো নেই। শব্দ করলেই বেড়ালেরা নাকি নখ বার করে। তারপর সামন্ত সাত আট জন পুলিস নিয়ে ঢুকলেন। এসেই আগে খাঁচার দরজা খুলে দিলেন।'

নিতাই সামন্ত খুব হাসতে লাগলেন। 'আর বলেন কেন, দাদা, খাঁচা খুললেও বেরোয় না। টেনে বের করতে হল। তখন আবার কিছুতেই নড়ে না, দ্বিতীয় খাঁচার বেঁড়ে ল্যাজের বেড়ালটা-ই নাকি নেপো। ওকে না নিয়ে নড়বে না। অগত্যা তাদের সবাইকে ছাড়া হল। তারা আবার আমাদের পা ঘেঁষে সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল। তারপর সে যা হৈ-হৈ! গোরিলা ঘোষাল লাঠি হাতে তেড়ে এল। গুপি আর চাঁদু তখুনি দুদ্দাড় দৌড়। পিছন পিছন গোরিলা ছুটল। পানুই শেষটা ওদের বাঁচাল এ আমি বলতে বাধ্য!'

একটু খুসি না হয়ে পারলাম না। নিতাই সামন্ত বললেন, 'অনেক কষ্টে গোরিলাকে ধরা হল। তারপর তাকে আমাদের ভ্যানে তুলে বড় মাস্টারের খোঁজে ছাপাখানায় গিয়ে দেখি তিনি চোখে ম্যাগনিফাইং চশমা এটে প্রুফ দেখছেন। এত সব কান্ড হল, তার কিছুই নাকি টের পান নি! বুঝলেন দাদা, ঐ নাইটস্কুলের ছাত্রদের মধ্যে বিন তালুকদারের চর ছিল। দোকানের বুড়ি সেজে ঘুঘু সমাদ্দার খবর সংগ্রহ করে দিত। বিনু তালুকদার একবার ধরলে কাউকে ছাড়ে না! এ সব প্ল্যান তার-ই।'

এই অবধি বলে নিতাই সামন্ত হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন। এর মধ্যে বিনু তালুকদার কোত্থেকে এল বুঝলাম না। বাবা আনার ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।

'মিঃ তালুকদার তো কই এখনো এলেন না?'

'আসবেন, আসবেন। ঐ বড় মাস্টারটিকে নিয়েই হয়েছে মুস্কিল। সব দেখেশুনে মনে হয় দাদার সঙ্গে হ্যান্ড-ইন্‌-গ্লভ যাকে বলে। অথচ বে-আইনী কিছু করেছেন বলে প্রমাণ খুঁজে পাচ্ছি না। এদিকে কি বলছেন জানেন, ওর দাদার নাকি একা জেলে কষ্ট হবে, ওকে সাকরেদ বলে ধরতে হবে। তা হলে নাকি বর্মার জঙ্গলে নাম দিয়ে অদ্ভুত স্মৃতি- কথা লেখার সময় পাবেন।'

মেজকাকুও হেসে কুটোপাটি! 'শোন একবার কথা! লোকটা চব্বিশ পরগণার বাইরে কখনো পা দিল না, উনি আবার "বর্মার জঙ্গলে" লিখবেন।'

ভীষণ রাগ হল! আমি কিছু বলার আগেই গুপি চেঁচিয়ে-মেচিয়ে বলতে লাগল, 'কিচ্ছু দরকার নেই বর্মা যাবার। দরকার করে না, লিখবার ক্ষমতা থাকলেই হল।' লিখতে হলে যাবার

ঠিক এই সময় সুড় সুড় করে ছোট মাস্টার ঘরে ঢুকলেন। তাঁকে দেখেই গুপি রেগে চতুণ্ডু'জ হয়ে উঠল। 'কাল আমাকে শত্রুরের গর্তে ঠেলে দিয়ে কোথায় কেটে পড়লেন, স্যার? আমি'-

কানু সামন্ত ছুটে এসে গুপির মুখ চেপে ধরে বলল, 'স-স্-স্ কাকে কি বলছ! উনিই বিন তালুকদার, ছোট মাস্টারের ভেক ধরে এমন কি আমার পর্যন্ত চোখে ধুলো দিয়েছিলেন।'

গুপি আমার দিকে তাকাল। আমি গুপির দিকে তাকালাম। তারপর গুপি ছুটে গিয়ে ছোট মাস্টারের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বলল, 'স্যার, আমিও পুলিশে চাকরি করব।'

বিনু তালুকদার ওর পিঠ চাপড়ে, আমার দিকে চেয়ে বললেন, 'স্পেস্- শিপের মডেলটা'-

আমি বললাম, 'বি-এস-সি পাস করে আমিও পুলিসে ঢুকব। চাঁদে গিয়ে কাজ নেই। যাওয়া হবেও না।'

'হবে না মানে? এই হল বলে। তারপর স্পেস্-শিপেও গুপ্ত গোয়েন্দা রাখা হবে। ওঃ, বলতেই ভুলে যাচ্ছিলাম, তোমাদের বড় স্যার রবিবারে এসে তোমাদের গল্প বলবেন। বর্মার সব ভালো ভালো অভিজ্ঞতা মনে পড়েছে, একদিন ফাটকে বসে বসে। এখন স্নান-খাওয়া করতে বাড়ি গেছেন।'

তখন গুপি আর আমি উঠে গিয়ে খাবার ঘরের দিকে চললাম। সঙ্গে সঙ্গে নেপো-ও চলল। বেঁড়ে ল্যাজ খাড়া করে।





4
Articles
লীলা মজুমদার রচনাবলী ७
0.0
লীলা মজুমদারের আরও ছোট ছোট কিছু অবিস্মরণীয় সৃষ্টি একত্রে আনা হয়েছে রচনাবলী ৩ বইটির মধ্যে। এটি এমন একটি উপন্যাস যেখানে গল্পগুলি এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যাতে বইটি সব বয়সের মানুষই পড়তে পারেন, এবং এর মজা উপলব্ধি করতে পারেন।
1

টং লিং

13 December 2023
0
0
0

এক যে জায়গাটাতে আমি এখন বসে আছি এটার নাম পেরিস্তান। জায়গার কথা আমি ছাড়া এ বাড়ির কেউ জানেও না, এখানে কেউ আসতেও পারে না। ছোটরা এখানে আসবার রাস্তাই খুঁজে পাবে না আর বড়দের পেট আটকে যাবে। কারণ, এক জায়গায়

2

সুকুমার রায়

14 December 2023
0
0
0

এক পঞ্চাশ বছরের পুরানো একটা খাতা, কালচে রঙ ধরা লাল খেরোয় বাঁধানো, ময়লা দড়ি দিয়ে জড়ানো। প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে লেখা, হিজিবিজি খাতা, উড়ো খাতা, ফাজতো খাতা, এমনি খাতা, বাজে খাতা, খসড়া খাতা, জাবেদা খাতা

3

নেপোর বই

16 December 2023
0
0
0

এক এটা কিন্তু সত্যিকার নেপোর বই নয়। আসন্ন বইটিকে নেপো নিয়ে চলে গিয়েছিল। পরে যখন পাওয়া গেল, দুমড়োনো, মুচড়ানো, আঁচড়ানো, কামড়ানো, খিমচোনো, কাদামাখা, কালো কালো থাবার দাগ লাগা, কোনো কাজেই লাগে না। কিচ্ছু

4

সেজমামার চন্দ্রযাত্রা

18 December 2023
1
0
0

আমার ছোটকাকা মাঝে মাঝে আমাদের বলেন, 'এই যে ভোরা আজকাল চাঁদে যাওয়া নিয়ে তো এতো নাচানাচি করিস, সে কথা শুনলে আমার হাসি পায়। কই, এতো খরচাপাতি, খবরের কাগজে লেখালেখি করেও তো শুনলাম না, কেউ চাঁদে গিয়ে আবার ফ

---