shabd-logo

দ্বিতীয় পৰ্ব : এগার

18 October 2023

3 Viewed 3

মনোহর চক্রবর্তী বলিয়া একটি প্রাজ্ঞ ব্যক্তির সহিত আমার আলাপ হইয়াছিল। দাঠাকুরের হোটেলে একটা হরি-সংকীর্তনের দল ছিল; তিনি পুণ্যসঞ্চয়ের অভিপ্রায়ে মাঝে মাঝে তথায় আসিতেন। কিন্তু কোথায় থাকিতেন, কি করিতেন জানিতাম না। এই মাত্র শুনিয়াছিলাম—তাঁর নাকি অনেক টাকা, এবং সকল দিক দিয়াই অত্যন্ত হিসাবী। কেন জানি না, আমার প্রতি তিনি নিরতিশয় প্রসন্ন হইয়া একদিন নিভৃতে কহিলেন, দেখুন শ্রীকান্তবাবু, আপনার বয়স অল্প, জীবনে যদি উন্নতি লাভ করতে চান ত আপনাকে এমন গুটিকয়েক সৎপরামর্শ দিতে পারি, যার মূল্য লক্ষ টাকা। আমি নিজে যাঁর কাছে এই উপদেশ পেয়েছিলাম। তিনি সংসারে কিরূপ উন্নতি লাভ করেছিলেন শুনলে হয়ত অবাক হয়ে যাবেন: কিন্তু সত্য। পঞ্চাশটি টাকা মাত্র ত মাহিনা পেতেন; কিন্তু মরবার সময় বাড়িঘর, পুকুর-বাগান, জমি-জিরাত ছাড়া প্রায় দুটি হাজার টাকা নগদ রেখে গিয়েছিলেন। বলুন ত একি সোজা কথা! আপনার বাপ-মায়ের আশীর্বাদে আমি নিজেও ত

কিন্তু নিজের কথাটা এইখানেই চাপিয়া দিয়া বলিলেন, আপনি মাহিনাপত্ৰ ত মোটাই পান শুনি; কপাল আপনার খুব ভাল—বর্মায় এসেই ত এমন কারও হয় না; কিন্তু অপব্যয়টা কিরূপ করচেন বলুন দেখি! ভিতরে ভিতরে সন্ধান নিয়ে দুঃখে আমার বুক ফেটে যায়। দেখতেই ত পান আমি কোন লোকের কথায় থাকি না; কিন্তু আমার কথা মত, বেশি নয়, দুটো বৎসর চলুন দেখি; আমি বলছি আপনাকে, দেশে ফিরে গিয়ে চাই কি বিবাহ পর্যন্ত করতে পারবেন।

এই সৌভাগ্যের জন্য অন্তরে আমি এরূপ লালায়িত হইয়া উঠিয়াছি এ তথ্য তিনি কি করিয়া সংগ্রহ করিলেন, জানি না; তবে কিনা, তিনি ভিতরে ভিতরে সন্ধান লওয়া ব্যতীত কাহারও কোন কথায় থাকেন না তাহা নিজেই ব্যক্ত করিয়াছিলেন।

যাই হোক, তাঁহার উন্নতির বীজমন্ত্রস্বরূপ সৎপরামর্শের জন্য লুব্ধ হইয়া উঠিলাম। তিনি কহিলেন, দেখুন, দান-টান করার কথা ছেড়ে দিন— মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করতে হয় এক কোমর মাটি খুঁড়লেও একটা পয়সা মেলে না। সে কথা বলি না—নিজের মুখে রক্ত-উঠা কড়ি—আজকালকার দুনিয়ায় এমন পাগল আর কেই বা আছে! নিজের ছেলেপুলে, পরিবারের জন্য রেখেথুয়ে তবে ত?—সে কথা ছেড়েই দিন, তা নয়: কিন্তু দেখুন – যার সংসারে দেখবেন টানাটানি, কদাচ তেমন লোককে আমল দেবেন না।

বেশি নয়, দু-চার দিন আসা-যাওয়া করেই নিজে হতেই নিজের সংসারের কষ্টের কথা তুলে দুটাকা চেয়ে বসবে। দিলে ত গেলই, তা ছাড়া বাইরের ঝগড়া ঘরে টেনে আনা। দু-দুটাকার মায়া কিছু আর সত্যই কেউ ছাড়তে পারে না— তাগাদা করতেই হয়। তখন হাঁটাহাঁটি ঝগড়াঝাঁটি, কেন, আমার তাতে আবশৃষক কি বলুন দেখি?

আমি ঘাড় নাড়িয়া বলিলাম, সত্যই ত

তিনি উৎসাহিত হইয়া বলিলেন, আপনি ভদ্রসন্তান, তাই কথাটা চট্‌ করে বুঝলেন; কিন্তু এই ছোটলোক লোহা কাটা ব্যাটাদের বুঝাও দেখি! হারামজাদা ব্যাটারা সাতজন্মেও বুঝবে না। ব্যাটাদের নিজের এক পয়সা নাই, তবু পরের কাছে কজ করে আর একজনকে টাকা এনে দেবে এই ছোটলোক ব্যাটারা এমনি আহাম্মুক!

.একটু চুপ করিয়া কহিলেন, তবেই দেখুন, কদাচ কাকেও টাকা ধার দিতে নাই। বলে, বড় কষ্ট! কষ্ট তা আমার কি বাপু! আর যদি সত্যই কষ্ট ত দু ভরি সোনা এনে রেখে যাও না, দিচ্ছি দশ টাকা ধার! কি বলেন?

বলিলাম, ঠিক ত!

তিনি বললেন, ঠিক নয় আবার! একশ বার ঠিক! আর দেখুন ঝগড়া বিবাদের স্থানে কখনো যাবেন না। একজন খুন হয়ে গেলেও না। প্রয়োজন কি আমার। ছাড়াতে গেলেও হয়ত দু-এক ঘা নিজের গায়েই লাগবে; তা ছাড়া একপক্ষ সাক্ষী মেনে বসবে। তখন কর ছুটাছুটি আদালতে। বরঞ্চ থেমে গেলে ইচ্ছা হয় একবার ঘুরে এসে দুটো ভালমন্দ পরামর্শ দাও, পাঁচজনের কাছে নাম হবে। কি বলেন?

একটু চুপ করিয়া তিনি পুনশ্চ কহিলেন, আর এই লোকের ব্যামো স্যামোয় আমি ত মশাই, পাড়া মাড়াই না; তখনি ব'লে বসবে, দাদা মরি এ বিপদে দুটাকা দিয়ে সাহায্য কর। মশাই, মানুষের মরণ-বাঁচনের কথা বলা যায় না- তাকে টাকা দেওয়া আর জলে ফেলে দেওয়া এক বরঞ্চ জলে দেওয়াও ভাল, কিন্তু সে ক্ষেত্রে না। নাহয় ত বলবে, এসো রাত্রি জাগতে। আচ্ছা মশাই, আমি যাবো তার অসুখে রাত্রি জাগতে, কিন্তু এই বিদেশ-বিভুঁয়ে আমার কিছু-একটা— মা শীতলা না করুন, এই নাক কান মলচি মা! বলিয়া জিভ কাটিয়া তিনি নাকে একবার হাত ঠেকাইয়া নিজের হাতে নিজের দুই কান মলিয়া একটা নমস্কার করিয়া বলিলেন, আমরা সবাই তাঁর চরণেই ত পড়ে আছি – কিন্তু বলুন দেখি, সে বিপদে আমায় দেখে কে?

এবার আমি আর সায় দিতেও পারিলাম না। আমাকে যৌন দেখিয়া তিনি মনে মনে বোধ করি একটু দ্বিধায় পড়িয়া বলিলেন, দেখুন দেখি সাহেবদের তারা কখ খনো ওরূপ স্থানে যায় কি? কখনো না। নিজের একটা কার্ড পাঠিয়ে দিয়ে বাস্‌ ! হয়ে গেল। তাই তাদের উন্নতিটা একবার চেয়ে দেখুন দেখি! তার পরে ভাল হলে আবার যেমন মেলামেশা, সব তেমনি। মশাই কারুর ঝঞ্ঝাটের মধ্যে কখনো যেতে নাই ।

অফিসের বেলা হইয়াছে বলিয়া উঠিয়া পড়িলাম। এই প্রাজ্ঞের সাধু-পরামর্শের বলে এতটা বয়সে যে খুব বেশি মানসিক উন্নতি হওয়া আমার সম্ভবপর, তাহা নহে। এমন কি মনের মধ্যে খুব বেশি আন্দোলনও উঠিল না। কারণ, এরূপ বিজ্ঞ ব্যক্তির একান্ত অভাব পল্লীগ্রামেও অনুভব করি নাই; এবং অপরাপর দুর্নাম তাঁহাদের যতই থাকুক, পরামর্শ দিতে কার্পণ্য করেন, এ অপবাদও শুনি নাই : এবং এ পরামর্শ যে সুপরামর্শ তা সামাজিক জীবনে তত না হোক, পারিবারিক জীবনে, জীবনযাত্রার কার্যে যে অবিসংবাদী সাধু উপায়, তাহা দেশের লোক মানিয়া লইয়াছে। বাঙ্গালী গৃহস্থ ঘরের কোন ছেলে যদি অক্ষরে অক্ষরে ইহা প্রতিপালন করিয়া চলে তাহাতে বাপ মা অসন্তুষ্ট হন বাঙ্গালী পিতামাতার বিরুদ্ধে এত বড় মিথ্যা বদনাম রটনা করিতে পুলিশের সি. আই. ডি.-র লোকেরও বোধ করি বিবেকে বাধে। সে যাই হোক, কিন্তু এই প্রাজ্ঞতার ভিতরে যে কত বড় অপরাধ ছিল, সপ্তাহ-দুই গত না হইতেই ভগবান ইঁহারই সাহায্যে আমার কাছে প্রমাণ করিয়া দিলেন।

সেই অবধি অভয়ার বাড়ির দিকে আর যাই নাই। তাহার সমস্ত অবস্থার সহিত তাহার কথাগুলি মিলাইয়া লইয়া আগাগোড়া জিনিসটা জ্ঞানের দ্বারা একরকম করিয়া দেখিতে পারিতাম সে কথা সত্য। তাহার চিন্তার স্বাধীনতা, তাহার আচরণের নির্ভীক সততা তাহাদের পরস্পরের অপরূপ ও অসাধারণ স্নেহ আমার বুদ্ধিকে সেইদিকে নিরন্তর আকর্ষণ করিত, ইহাও ঠিক; কিন্তু তবুও আমার আজন্মের সংস্কার কিছুতেই সেদিকে পা বাড়াইতে চাহিত না। কেবলই মনে হইত, আমার অন্নদাদিদি এ কাজ করিতেন না। কোথাও দাসীবৃত্তি করিয়া লাঞ্ছনা, অপমান, দুঃখের ভিতর দিয়াও বরঞ্চ তাঁর বাকি জীবনটা কাটাইয়া দিতেন: কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সুখের পরিবর্তেও— যাহার সহিত তাঁহার বিবাহ হয় নাই—তাঁহার সহিত ঘর করিতে রাজি হইতেন না।

আমি জানিতাম, তিনি ভগবানে একান্তভাবে আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন। তাঁহার সেই সাধনার ভিতর দিয়া তিনি পবিত্রতার যে ধারণা, কর্তব্যের যে জ্ঞানটুকু লাভ করিয়াছিলেন. – সে কি অভয়ার সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধির মীমাংসার কাছে একেবারে ছেলেখেলা?

অভয়ার একটা কথা হঠাৎ মনে পড়িল। তখন ভাল করিয়া সেটা তলাইয়া বুঝিবার অবকাশ পাই নাই। সেদিন সে কহিয়াছিল, শ্রীকান্তবাবু, দুঃখ-ভোগ করার মধ্যে একটা মারাত্মক মোহ আছে। মানুষ বহুযুগের জীবনযাত্রায় এটা দেখিয়াছে যে, কোন বড় ফলই বড় রকম দুঃখ-ভোগ ছাড়া পাওয়া যায় না। তার জন্মজন্মান্তরের অভিজ্ঞতা আজ এই ভ্রমটাকে একেবারে সত্য বলিয়া জানিয়াছে যে, জীবনের মানদণ্ডে একদিকে যত বেশি দুঃখের ভার চাপানো যায়, আর-একদিকে তত বড় সুখের বোঝা গাদা হইয়া উঠিতে থাকে। তাই ত মানুষ যখন সংসারে সহজ এবং স্বাভাবিক প্রবৃত্তিটুকু স্বেচ্ছায় বর্জন করিয়া, তপস্যা করিতেছে মনে করিয়া নিরাহারে ঘুরিয়া বেড়ায়, তখন যে তাহার জন্য কোথাও না কোথাও চতুর্গুণ আহার্য সঞ্চিত হইয়া উঠিতেছে –এ বিষয়ে না তাহার নিজের, না আর কাহারও মনে তিলার্ধ সংশয় উত্থিত হয়। এই জন্যই সন্ন্যাসী যখন নিদারুণ শীতে আকণ্ঠ জলমগ্ন হইয়া, এবং ভীষণ গ্রীষ্মের দিনে রৌদ্রের মধ্যে অগ্নিকুণ্ড করিয়া মাটিতে মাথা এবং আকাশে পা করিয়া বসিয়া থাকে, তখন তাহার দুঃখ ভোগের কঠোরতা দেখিয়া দর্শকের দল শুধু যে দুঃখই ভোগ করে না, তাহা নয়, একেবারে মুগ্ধ হইয়া যায়। তাহার ভবিষ্যৎ আরামের অসম্ভব বৃহৎ হিসাব খতাইয়া প্রলুব্ধ চিত্ত তাহাদের ঈর্ষাকুল হইয়া উঠে; এবং ওই পা-উঁচু ব্যক্তিটাই যে সংসারে ধন্য এবং নরদেহ ধারণ করিয়া সেই যে সত্যকার কাজ করিতেছে, এবং তাহারা কিছুই করিতেছে না, বৃদ্ধায় জীবন অতিবাহিত করিতেছে—এই বলিয়া নিজেদের সহস্র ধিক্কার দিতে দিতে মন খারাপ করিয়া বাড়ি যায়। শ্রীকান্তবাবু সুখের জন্য দুঃখ স্বীকার করিতে হয়, এ কথা সত্য; কিন্তু তাই বলিয়া ইহাকে উল্টাইয়া লইয়া যেমন করিয়া হোক কতকগুলা দুঃখ-ভোগ করিয়া গেলেই যে সুখ আসিয়া স্কন্ধে ভর করে, তাহা স্বতঃসিদ্ধ নয়। ইহকালেও সত্য নয়, পরকালেও সত্য নয়। আমি বলিতে গিয়াছিলাম, কিন্তু বিধবার ব্রহ্মচর্য

অভয়া আমাকে থামাইয়া দিয়া বলিয়াছিল, বিধবার আচরণ বলুন, তার সঙ্গে ব্রহ্মের বিন্দুবিসর্গ সম্বন্ধ নাই।

বিধবার চালচলনটাই যে ব্রহ্মলাভের উপায়, তাহা আমি মানি না। বস্তুতঃ ওটা ত কিছুই নয়। কুমারী সধবা বিধবা যে-কেহ তাহার নিজের নিজের পথে ব্রহ্মলাভ করিতে পারে। বিধবার চালচলনটাই সেজন্য একচেটে করিয়া রাখা হয় নাই।

আমি হাসিয়া বলিয়াছিলাম, বেশ, না হয় ত নাই। তাদের আচরণটাকে ব্রহ্মচর্য না হয় নাই বলিলেন। নামে কি আসে যায়?

অভয়া রাগ করিয়া বলিয়াছিল, নামই ত সব শ্রীকান্তবাবু। কথা ছাড়া আর দুনিয়ায় আছে কি? ভূল নামের ভিতর দিয়া মানুষের বুদ্ধির চিন্তার, জ্ঞানের ধারা যে কত বড় ভুলের মধ্যে চালনা করা যায়, সে কি আপনি জানেন না? ওই নামের ভুলেই ত সকল দেশে সকল যুগে বিধবার চালচলনটাকেই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে ভেবে এসেছে। ইহাই নিরর্থক ত্যাগের নিষ্ফল মহিমা শ্রীকান্তবাবু একেবারে বার্থ, একেবারে ভুল। মানুষকে ইহ-পরকালে পণ্ড করে দেবার এত বড় ছায়াবাজি আর নাই।

তখন আর তর্ক না করিয়া চুপ করিয়া গিয়াছিলাম। বস্তুত, তর্ক করিয়া পরাস্ত করা তাহাকে একপ্রকার অসম্ভব ছিল। প্রথম যখন জাহাজে পরিচয় হয়, তখন ডাক্তারবাবু শুধু তাহার বাহিরটাই দেখিয়া তামাশা করিয়া বলিয়াছিলেন, মেয়েটি ভারি forward; কিন্তু, তখন দুজনের কেহই ভাবি নাই এই forward কথাটার অর্থ কোথায় গিয়া দাঁড়াইতে পারে! এই মেয়েটি যে তাহার সমস্ত অন্তরটাকে পর্যন্ত কিরূপ অকুণ্ঠিত তেজে বাহিরে টানিয়া আনিয়া সমস্ত পৃথিবীর সম্মুখে মেলিয়া ধরিতে পারে, লোকের মতামত গ্রাহ্যও করে না—তখন তাহার ধারণাও আমাদের ছিল না। অভয়া ত শুধু তাহার মতটাকে মাত্র ভাল প্রমাণ করিবার জনাই কথা-কাটাকাটি করিত না–সে তাহার নিজের কাজটাকে সবলে জয়ী করিবার জন্যই যেন যুদ্ধ করিত। তাহার মত একরকম – কাজ আর-একরকম ছিল না বলিয়াই বোধ করি অনেক সময়ে তাহার মুখের উপর জবাব খুঁজিয়া পাইতাম না – কেমন একরকম থতমত খাইয়া যাইতাম; অথচ বাসায় ফিরিয়া আসিয়া মনে হইত, এই ত বেশ উত্তর ছিল! যাই হোক, তাহার সম্বন্ধে আজও যে আমার মনের দ্বিধা ঘুচে নাই, একথা ঠিক। যতই আপনাকে আপনি প্রশ্ন করিতাম—এ ছাড়া অভয়ার আর কি গতি ছিল – ততই মন যেন তাহারই বিরুদ্ধে বাঁকিয়া দাঁড়াইত।

যতই নিজেকে বলিতাম, তাহাকে অশ্রদ্ধা করিবার লেশমাত্র অধিকার আমার নাই, ততই যেন অব্যক্ত বিতৃষ্ণায় অন্তর ভরিয়া উঠিত। আমার মনে পড়ে, এমনি একটা কুণ্ঠিত অপ্রসন্ন মন লইয়াই আমার দিন কাটিতে ছিল বলিয়া, না পারিতাম তাহার কাছে যাইতে, না পারিতাম তাহাকে একেবারে দূরে ফেলিয়া দিতে।

এমনি সময় হঠাৎ একদিন শহরের মাঝখানে প্লেগ আসিয়া তাহার ঘোমটা খুলিয়া কালো মুখখানি বাহির করিয়া দেখা দিল। হায় রে! তাহাকে সমুদ্রপারে ঠেকাইয়া রাখিবার লক্ষ-কোটি যন্ত্র-তন্ত্র, কর্তৃপক্ষের নিষ্ঠুরতম সতর্কতা সমস্তই একমুহূর্তে একেবারে ধূলিসাৎ হইয়া গেল। মানুষের আতঙ্কের আর সীমা পরিসীমা রহিল না। অথচ শহরের চৌদ্দ আনা লোকই হয় চাকুরিজীবী, নাহয় বাণিজ্যজীবী। একেবারে দূরে পলাইবারও জো নাই—এ যেন রুদ্ধ ঘরের মাঝখানে অকস্মাৎ কে ছুঁচোবাজি ছুঁড়িয়া দিল। ভয়ে এ পাড়ার মানুষগুলো স্ত্রী পুত্রের হাত ধরিয়া পোঁটলা-পুঁটলি ঘাড়ে করিয়া ও-পাড়ায় ছুটিয়া পালায়, আর ও পাড়ার মানুষগুলো ঠিক সেই সব লইয়া এ পাড়ায় ছুটিয়া আসে। ইঁদুর বলিলে আর রক্ষা নাই। সেটা মরিয়াছে কি মরে নাই তাহা শুনিবার পূর্বেই লোকে ছুটিতে শুরু করিয়া দেয়। মানুষের প্রাণগুলা যেন সব গাছের ফলের মত প্লেগের আবহাওয়ায় এক রাত্রেই পাকিয়া উঠিয়া বোঁটায় ঝুলিতেছে, – কাহার যে কখন টুপ করিয়া খসিয়া নীচে পড়িবে, তাহার কোন নিশ্চয়তা নাই।

সে দিনটা ছিল শনিবার। কি একটা সামান্য কাজের জন্য সকালে বাহির হইয়াছি। শহরের মধ্যে একটা গলির ভিতর দিয়া বড় রাস্তায় পড়িতে দ্রুতপদে চলিয়াছি, দেখি অত্যন্ত জীর্ণ পুরাতন একটা বাটীর দোতলার বারান্দায় দাঁড়াইয়া ডাকাডাকি করিতেছেন প্রাজ্ঞ মনোহর চক্রবর্তী।

হাত নাড়িয়া বলিলাম, সময় নাই ।

তিনি একান্ত অনুনয়ের সহিত কহিলেন, দু-মিনিটের জন্য একবার উপরে আসুন শ্রীকান্তবাবু আমার বড় বিপদ। কাজেই সম্পূর্ণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও উপরে উঠিতে হইল। আমি তাই ত মাঝে মাঝে ভাবি, মানুষের প্রত্যেক চলাফেরাটি পর্যন্ত কি একেবারে ঠিক করা: নইলে, আমার কাজও গুরুতর ছিল না, এ গলিটার মধ্যেও আর কখনো প্রবেশ করি নাই। আজ সকালেই বা এখানে আসিয়া হাজির হইলাম কেন?

কাছে গিয়া বলিলাম, অনেক দিন ত আমাদের ওদিকে যাননি—আপনি কি এই বাড়িতে থাকেন।

তিনি বলিলেন, না মশাই, আমি দিন বারো-তেরো এসেছি। একে ত মাসখানেক থেকে ডিসেন্ট্রিতে ভুগচি, তার ওপর আমাদের পাড়ায় হ'ল প্লেগ। কি করি মশাই উঠতে পারিনে, তবু তাড়াতাড়ি পালিয়ে এলাম।

বলিলাম, বেশ করেচেন।

তিনি বলিলেন, বেশ করলে কি হবে মশাই—আমার combined hand ব্যাটা ভয়ানক বজ্জাত। বলে কিনা চলে যাবো। দিন দেখি ব্যাটাকে আচ্ছা কারে ধমকে।

একটু আশ্চর্য হইলাম। কিন্তু তাহার পূর্বে এই combined hard বস্তুটার একটু ব্যাখ্যা আবশাক। কারণ যাঁহাদের জানা নাই যে, পয়সার জন্য হিন্দুস্থানী জাতটা পারে না এমন কাজই সংসারে নাই, তাঁহারা শুনিয়া বিস্মিত হইবেন যে, এই ইংরাজি কথাটার মানে হইতেছে দুবে, চৌবে, তেওয়ারী প্রভৃতি হিন্দুস্থানী ব্রাহ্মণের দল। এখানে যাহারা চৌকার ধারে গেলেও লাফাইয়া উঠে, তাহারাই সেখানে রসুই করে, উচ্ছিষ্ট বাসন মাজে, তামাক সাজে এবং বাবুদের অফিসে যাইবার সময় জুতা ঝাড়িয়া দেয়, তা বাবুরা যে জাতই হোক। অবশ্য দুটাকা বেশি। মাহিনা দিয়া তবেই ত্রিবেদী চতুর্বেদী প্রভৃতি পূজা ব্যক্তিকে চাকর ও বামুনের function একত্রে combined করিতে হয়। মূর্খ উড়িয়া বা বাঙ্গালী বামুনদের আজিও একাজে রাজি করা যায় নাই, গিয়াছে শুধু ওই উহাদেরই। কারণ পূর্বেই বলিয়াছি পয়সা পাইলে কুসংস্কার বর্জন করিতে হিন্দুস্থানীর একমুহূর্ত বিলম্ব হয় না। (মুরগি রাঁধাইতে আরও চার আনা, আট আনা মাসে অতিরিক্ত দিতে হয়। কারণ, মূল্যের দ্বারাই সমস্ত পরিশুদ্ধ হয়, শাস্ত্রের এই বচনার্থের যথার্থ তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করিতে এবং এই শাস্ত্রবাক্যে অবিচলিত আস্থা রাখিতে আজ পর্যন্ত যদি কেহ পারিয়া থাকে, ত এই হিন্দুস্থানীরা—এ কথা আমাদের স্বীকার করিতেই হইবে।)

কিন্তু মনোহরবাবুর combined hard কে আমি কেন ধমক দিতে যাইব, আর সেই বা কি জন্য আমার ধমক শুনিবে, তাহা ভাবিয়া পাইলাম না। এই হ্যান্ডটি মনোহরবাবুর নূতন। এতকাল তিনি নিজের combined hand নিজেই ছিলেন— শুধু ডিসেন্ট্রির খাতিরে অল্পদিন নিযুক্ত করিয়াছিলেন। মনোহরবাবু বলিতে লাগিলেন, মশাই আপনি কি সহজ লোক! শহরসুদ্ধ লোক আপনার কথায় মরে বাঁচে, তা কি আর জানিনে ভাবচেন। বেশি নয়, একটি ছত্র যদি লাটসাহেবকে লিখে দেন ত ওর চৌদ্দ বছর জেল হয়ে যাবে, সে কি আমি শুনিনি? দিন ত ব্যাটাকে বেশ করে শাসিত করে।

কথা শুনিয়া আমি যেন দিশেহারা হইয়া গেলাম। যে লাটসাহেবের নামটা পর্যন্ত শুনি নাই তাঁহাকে বেশি নয়, মাত্র একটা ছত্র চিঠি লিখিলেই একটা লোকের চৌদ্দ বৎসর কারাবাসের সম্ভাবনা – আমার এত বড় অদ্‌ভূত শক্তির কথা এত বড় বিজ্ঞ ব্যক্তির মুখে শুনিয়া কি যে বলিব, আর কি যে করিব, ভাবিয়া পাইলাম না। তথাপি তাঁহার বারংবার অনুযোগ ও পীড়াপীড়িতে অগত্যা সেই হতভাগ্য combined hand কে শাসন করিতে রান্নাঘরে ঢুকিয়া দেখি, সে একটা অন্ধকূপের ন্যায় অন্ধকার।

সে আড়ালে দাঁড়াইয়া প্রভুর মুখে আমার ক্ষমতার বহর শুনিয়া এখন কাঁদ কাঁদ হইয়া হাতজোড় করিয়া জানাইল যে, এ বাড়িতে দেও আছে, এখানে সে কোনমতেই থাকিতে পারিবে না। কহিল, নানা প্রকারের ছায়া' রাত্রিদিন ঘরের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়ায়। বাবু যদি আর কোন বাড়িতে যান, ত সে অনায়াসে চাকরি করিতে পারে, কিন্তু এ বাড়িতে

যে অন্ধকার ঘর তা ‘ছায়া'র আর অপরাধ কি! কিন্তু ছায়ার জন্য নয়, একটা বিশ্রী পচা গন্ধ ঢুকিয়া পর্যন্তই আমার নাকে লাগিতেছিল। জিজ্ঞাসা করিলাম এ দুর্গন্ধ কিসের রো

Combined bxanxl কহিল, কোই চুহা-উহা সড়ল হোগা। চমকাইয়া উঠিলাম । —চুহা কি রে? এ ঘরে মরে নাকি?

সে হাতটা উল্টাইয়া তাচ্ছিল্যভরে জানাইল যে, প্রত্যহ সকালে অন্ততঃ পাঁচ- ছয়টা করিয়া মরা ইঁদুর সে বাহিরের গলিতে ফেলিয়া দেয়।

কেরোসিনের ডিবা জ্বালাইয়া অনুসন্ধান করা হইল, কিন্তু পঁচা ইঁদুরের সন্ধান পাওয়া গেল না। কিন্তু তবুও আমার গা টা ছম্ছম্ করিতে লাগিল। এবং কিছুতেই মন খুলিয়া লোকটাকে সদুপদেশ দিতে পারিলাম না যে, পীড়িত বাবুকে একা ফেলিয়া পালান তাহার উচিত নয়।

শোবার ঘরে ফিরিয়া আসিয়া দেখি, মনোহরবাবু খাটের উপর বসিয়া আমার অপেক্ষা করিতেছেন। আমাকে পাশে বসাইয়া তিনি এ বাড়ির গুণের কথা বলিতে লাগিলেন এমন অল্প ভাড়ায় শহরের মধ্যে এত ভাল বাড়ি আর নাই; এমন ভদ্র বাড়িওয়ালাও আর নাই, এবং এরূপ প্রতিবেশীও সহজে মিলে না। পাশের ঘরে যে চার-পাঁচজন মাদ্রাজী খ্রিস্টান মেস করিয়া বাস করে, তাহারা যেমন শিষ্টশান্ত তেমনি অমায়িক। একটু ভাল হইলেই এই বামুন ব্যাটাকে তাড়াইয়া দিবেন, তাহাও জানাইলেন। হঠাৎ বলিলেন, আচ্ছা মশাই, আপনি স্বপ্ন বিশ্বাস করেন।

বলিলাম, না।

তিনি বলিলেন, আমিও না; কিন্তু কি আশ্চর্য মশাই, কাল রাত্রে স্বপ্ন দেখলাম, আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছি। আর জেগে উঠেই দেখি ডান পায়ের কুঁচকি ফুলে উঠেচে। সত্যি মিথ্যে আমার গায়ে হাত দিয়ে দেখুন না মশাই, তাড়সে জ্বর পর্যন্ত হয়েছে।

শুনিয়াই আমার মুখ কালি হইয়া গেল। তার পরে কুঁচকিও দেখিলাম, গায়ে হাত দিয়া জ্বরও দেখিলাম।

মিনিটখানেক আচ্ছন্নের মত বসিয়া থাকিয়া, শেষে বলিলাম, ডাক্তার ডাকতে পাঠান নি কেন, শীঘ্র পাঠান।

তিনি কহিলেন, মশাই, যে দেশ এখানে ডাক্তারের ফি ত কম নয়। আনলেই ত চার-পাঁচ টাকা বেরিয়ে গেল। তা ছাড়া আবার ওষুধ! সেও ধরুন প্রায় দু'টাকার ধাক্কা। বলিলাম, তা হোক, ডাকতে পাঠান।

কে যাবে মশাই! তেওয়ারী বেটা ত চেনেই না। তা ছাড়া ও গেলে রাঁধবেই বা কে? আচ্ছা আমিই যাচ্ছি – বলিয়া ডাক্তার ডাকিতে নিজেই বাহির হইয়া গেলাম। ডাক্তার আসিয়া পরীক্ষা করিয়া আমাকে আড়ালে ডাকিয়া কহিলেন, ইনি আপনার কে?

বলিলাম, কেউ নয়। এবং কি করিয়া আজ সকালে আসিয়া পড়িয়াছি তাহাও খুলিয়া বলিলাম ।

ডাক্তার প্রশ্ন করিলেন এঁর কোন আত্মীয় এখানে আছে?

বলিলাম, জানি না। বোধ হয় কেউ নেই।

ডাক্তার ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিলেন, আমি একটা ওষুধ লিখে দিয়ে যাচ্ছি। মাথায় বরফ দেওয়াও দরকার; কিন্তু সবচেয়ে দরকার এঁকে প্লেগ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া। আপনি থাকবেন না এ ঘরে আর দেখুন, আমাকে ফিস্ দেবার দরকার নেই।

ডাক্তার চলিয়া গেলে, আমি বহু সঙ্কোচের পর হাসপাতালের প্রস্তাব করিতেই মনোহর কাঁদিতে লাগিলেন। সেখানে বিষ দিয়া মারিয়া ফেলে, সেখানে গেলে কেউ কখনো ফিরে না—এমনি কত কি!

ঔষধ আনিতে পাঠাইবার জন্য তেওয়ারীর সন্ধান করিয়া দেখি, combined hand তাহার লোটা-কম্বল লইয়া ইতিমধ্যে অলক্ষ্যে প্রস্থান করিয়াছে। সে বোধ করি ডাক্তারের সহিত আমার আলোচনা দ্বারের অন্তরাল হইতে শুনিতেছিল। হিন্দুস্থানী আর কিছু না বুঝুক, পিলেগ' কথাটা ভারী বুঝে।

তখন আমাকে যাইতে হইল ঔষধ আনিতে। বরফ, আইস ব্যাগ প্রভৃতি যাহা কিছু প্রয়োজন, সমস্তই কিনিয়া আনিয়া হাজির করিলাম। তাহার পরে রহিলাম, আমি আর তিনি তিনি আর আমি। একবার আমি দিই তাহার মাথায় আইস ব্যাগ তুলিয়া একবার সে দেয় আমার মাথায় আইস ব্যাগ তুলিয়া। এইভাবে ধস্তাধস্তি করিয়া বেলা দুটা বাজিয়া গেলে, তবে সে নিস্তেজ হইয়া শয্যা গ্রহণ করিল। মাঝে মাঝে তাহার চৈতন্য আচ্ছন্ন হইয়া যায়, আবার মাঝে মাঝে সে বেশ জ্ঞানের কথাও বলে। অপরাহ্নের কাছাকাছি সে ক্ষণেকের জন্য সচেতনভাবে আমার মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, শ্রীকান্তবাবু, আমি আর বাঁচব না।

আমি চুপ করিয়া রহিলাম। তখন সে বহু চেষ্টায় কোমর হইতে চাবি লইয়া আমার হাতে দিয়া কহিল, আমার তোরঙ্গের মধ্যে তিন শ গিনি আছে স্ত্রীকে পাঠিয়ে দেবেন। ঠিকানা আমার বাক্স খুঁজলেই পাবেন।

আমার একটা সাহস ছিল, পাশের মেস'টা। তাদের সাড়া শব্দ, চাপা কণ্ঠস্বর প্রায়ই শুনিতে পাইতেছিলাম। সন্ধ্যার পর একবার তাহাদের একটু বেশি রকম নড়াচড়ার গোলমাল আমার কানে আসিয়া পৌঁছিল, কিছুক্ষণ পরেই যেন মনে হইল, তাহারা দরজার তালা বন্ধ করিয়া কোথায় যাইতেছে। বাহিরে আসিয়া দেখিলাম, তাই বটে সত্যই দ্বারে তালা ঝুলিতেছে। বুঝিলাম, তাহারা বাহিরে বেড়াইতে বাহির হইয়া গেল, কিছুক্ষণ পরেই ফিরিয়া আসিবে। কিন্তু তবুও কেমন মনটা আরও খারাপ হইয়া গেল।

এদিকে আমার ঘরের লোকটি উত্তরোত্তর যে-সকল কাণ্ড করিতে লাগিলেন, সে সম্বন্ধে এইমাত্র বলিতে পারি, তাহা রাত্রে একাকী বসিয়া উপভোগ করিবার মত বস্তু নয়। ওদিকে রাত্রি বারটা বাজিতে চলিল, কিন্তু পাশের ঘর খোলার সাড়াও পাই না, শব্দও পাই না। মাঝে মাঝে বাহিরে আসিয়া দেখি, তালা তেমনি ঝুলিতেছে। হঠাৎ চোখে পড়িয়া গেল যে, কাঠের দেয়ালের একটা ফুটা দিয়া ও- ঘরের তীব্র আলো এ-ঘরে আসিতেছে; কৌতূহলবশে সেই ছিদ্রপথে চোখ দিয়া তীব্র আলোকের যে হেতুটা দেখিলাম, তাহাতে সর্বাঙ্গের রক্ত হিম হইয়া গেল। সুমুখের খাটের উপর দুইজন যুবা পাশাপাশি বালিশে মাথা দিয়া নিদ্রা দিতেছে, আর শিয়রে খাটের বাজুর উপর একসার মোমবাতি জ্বলিয়া জ্বলিয়া প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। আমি পূর্বেই জানিতাম, রোমান ক্যাথোলিকরা মৃতের শিয়রে আলো জ্বালিয়া দেয়।

সুতরাং এ দুজনের ঘুম যে হাজার ডাকাডাকিতেও আর ভাঙ্গিবে না, এবং এমন হৃষ্টপুষ্ট সবলকায় লোক দুটির এত অসময়ে ঘুমাইয়া পড়িবার হেতুটা যে কি, সমস্তই একমুহূর্তে বুঝিতে পারিলাম ।

এ ঘরেও আমাদের মনোহরবাবু প্রায় আরও ঘণ্টা-দুই ছটফট করিয়া তবে ঘুমাইলেন। যাক, বাঁচা গেল৷

কিন্তু তামাশাটা এই যে, যিনি জানাশুনা লোকের পীড়ার সংবাদে পাড়া মাড়াইতে নাই বলিয়া আমাকে সেদিন বহু উপদেশ দিয়াছিলেন, তাঁহারই মৃতদেহটা এবং গিনি-পোরা বাক্সটা পাহারা দিবার জন্য ভগবান আমাকেই নিযুক্ত করিয়া দিলেন।

তা যেন দিলেন, কিন্তু বাকি রাত্রিটুকু আমার যেভাবে কাটিল, তাহা লিখিয়া জানাইবার সাধ্যও নাই, প্রবৃত্তিও হয় না। তবে মোটের উপর যে ভাল কাটে নাই, একথা বোধ করি, কোন পাঠকই অবিশ্বাস করিবেন না।

পরদিন death certificate লইতে, পুলিশ ডাকিতে, টেলিগ্রাফ করিতে, গিনির সুব্যবস্থা করিতে এবং মড়া বিদায় করিতে বেলা তিনটা বাজিয়া গেল। যাক, মনোহর ত ঠেলাগাড়ি চড়িয়া বোধ করি বা স্বর্গেই রওনা হইয়া পড়িলেন, আমিও বাসায় ফিরিলাম। আগের দিন একাদশী করিয়াছি — আজও অপরাহ্ন। বাসায় ফিরিয়া মনে হইল. আমার ডান কানের গোড়াটা যেন ফুলিয়াছে, এবং ব্যথা করিতেছে। কি জানি সমস্ত রাত্রি নিজেই টিপিয়া টিপিয়া বেদনার সৃষ্টি করিয়া তুলিলাম, কিংবা সত্য সত্যই গিনির হিসাব দিতে স্বর্গে যাইতে হইবে হঠাৎ বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। কিন্তু এটা বুঝিতে বিলম্ব হইল না যে, পরে যাই হোক, সম্প্রতি জ্ঞান থাকিতে থাকিতে নিজের বিলিব্যবস্থাটা নিজেই করিয়া ফেলিতে হইবে। যেহেতু মনোহরের ন্যায় আইস-ব্যাগ লইয়া টানাটানি করাটা সঙ্গত নয়, শোভনও নয়। স্থির করিতে দেরি হইল না। কারণ, চক্ষের পলকে দেখিতে পাইলাম, এতবড় বিশ্রী ব্যামোর ভার কোন পুণ্যাত্মা সাধুলোকের উপর নিক্ষেপ করিতে গেলে নিশ্চয়ই আমার গুরুতর পাপ হইবে। ভাল লোককে বিব্রত করা কর্তব্য নহে, অশাস্ত্রীয়। সুতরাং তাহাতে কাজ নাই। বরঞ্চ সেই যে রেঙ্গুনের আর এক প্রান্তে অভয়া বলিয়া একটা মহা পাপিষ্ঠা পতিতা নারী আছে এতদিন যাহাকে ঘৃণা করিয়া আসিয়াছি, তাহারই কাঁধের উপর এই মারাত্মক পীড়ার বিশ্রী বোঝাটা ঘৃণাভরে নামাইয়া দিয়া আসি গে, মরিতে হয় সে মরুক। হয়ত তাহাতে কিছু পুণ্যসঞ্চয়ও হইয়া যাইতে পারে। এই বলিয়া চাকরকে গাড়ি আনিতে হুকুম করিয়া দিলাম।

56
Articles
শ্রীকান্ত
0.0
"শ্রীকান্ত" প্রখ্যাত বাঙালি লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি ক্লাসিক উপন্যাস। গল্পটি শিরোনাম চরিত্র শ্রীকান্তের জীবনকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে, একজন বিচরণকারী এবং লক্ষ্যহীন যুবক যে আত্ম-আবিষ্কারের যাত্রা শুরু করে। উপন্যাসটি বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের ব্রিটিশ শাসিত ভারতের পটভূমিতে রচিত। শ্রীকান্তের জীবন বিভিন্ন মোড় এবং বাঁক নেয় যখন সে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যায় এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির মুখোমুখি হয়। তিনি অন্নদা, অভয়া এবং রাজলক্ষ্মী সহ একাধিক মহিলার প্রেমে পড়েন, কিন্তু স্বত্বের অনুভূতি খুঁজে পেতে সংগ্রাম করেন। শ্রীকান্ত নৈতিক এবং অস্তিত্বগত দ্বিধা নিয়ে, সামাজিক নিয়মকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তার যাত্রা মানব সম্পর্কের জটিলতা এবং ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব প্রতিফলিত করে। উপন্যাসটি প্রেম, পরিচয়, এবং সামাজিক সীমাবদ্ধতার বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করে। এটি তার সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়গুলির একটি সমালোচনামূলক অনুসন্ধানের প্রস্তাব দেয়। শ্রীকান্তের ভ্রমণ গভীর দার্শনিক আত্মদর্শনের দিকে পরিচালিত করে। গল্পটি শেষ হয় শ্রীকান্তের আধ্যাত্মিক জাগরণ এবং জ্ঞানার্জনের অনুভূতি অর্জনের মাধ্যমে। "শ্রীকান্ত" শরৎচন্দ্রের অন্যতম বিখ্যাত কাজ, যা মানুষের আবেগের চিত্রায়ন এবং পরিবর্তনশীল বিশ্বে নিজের সত্যিকারের সন্ধানের জন্য পরিচিত।
1

প্রথম পর্ব এক

15 October 2023
0
0
0

আমার এই ‘ভবঘুরে জীবনের অপরাহ্ন বেলায় দাঁড়াইয়া ইহারই একটা অধ্যায় বলিতে বসিয়া আজ কত কথাই না মনে পড়িতেছে! ছেলেবেলা হইতে এমনি করিয়াই ত বুড়া হইলাম। আত্মীয় অনাত্মীয় সকলের মুখে শুধু একটা একটানা 'ছ

2

প্রথম পর্ব - দুই

15 October 2023
0
0
0

কয়েক মুহূর্তেই ঘনান্ধকারে সম্মুখ এবং পশ্চাৎ লেপিয়া একাকার হইয়া গেল। রহিল শুধু দক্ষিণ ও বামে সীমান্তরাল প্রসারিত বিপুল উদ্দাম জলস্রোত এবং তাহারই উপর তীব্রগতিশীলা এই ক্ষুদ্র তরণীটি এবং কিশোরবয়স্ক দু

3

প্রথম পর্ব : তিন

15 October 2023
0
0
0

বড় ঘুম পেয়েছে ইন্দ, বাড়ি ফিরে চল না ভাই! ইন্দ্র একটুখানি হাসিয়া ঠিক যেন মেয়েমানুষের মত স্নেহার্দ্র কোমল স্বরে কথা কহিল। বলিল, ঘুম ত পাবার কথাই ভাই। কি করব শ্রীকান্ত, আজ একটু দেরি হবেই—অনেক কাজ র

4

প্রথম পর্ব : চার

16 October 2023
0
0
0

'পা আর চলে না—এমনি করিয়া গঙ্গার ধারে ধারে চলিয়া সকালবেলা রক্তচক্ষু ও একান্ত শুষ্ক ম্লানমুখে বাটী ফিরিয়া আসিলাম। একটা সমারোহ পড়িয়া গেল। এই যে! এই যে করিয়া সবাই সমস্বরে এমনি অভ্যর্থনা করিয়া উঠিল

5

প্রথম পর্ব - পাঁচ

16 October 2023
0
0
0

সমস্ত ব্যাপারটা শুনিতে শুনিতে ইন্দুর দিদি হঠাৎ বার-দুই এমনি শিহরিয়া উঠিলেন যে, ইন্দ্রর সেদিকে যদি কিছুমাত্র খেয়াল থাকিত, সে আশ্চর্য হইয়া যাইত। সে দেখিতে পাইল না, কিন্তু আমি পাইলাম। তিনি কিছুক্ষণ নী

6

প্রথম পর্ব : ছয়

16 October 2023
0
0
0

নিস্তব্ধ গভীর রাত্রে মা-গঙ্গার উপকূলে ইন্দ্র যখন আমাকে নিতান্ত অকারণে একাকী ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল, তখন কান্না আর সামলাইতে পারিলাম না। তাহাকে যে ভালবাসিয়াছিলাম, সে তাহার কোন মূল্যই দিল না। পরের বাড়

7

প্রথম পর্ব : সাত

18 October 2023
1
0
0

আজ একাকী গিয়া মুদীর কাছে দাঁড়াইলাম। পরিচয় পাইয়া মুদী একটি ছোট ন্যাকড়া বাহির করিয়া গেরো খুলিয়া দুটি সোনার মাকড়ি এবং পাঁচটি টাকা বাহির করিল। টাকা কয়টি আমার হাতে দিয়া কহিল, বহু, মাকড়ি-দুইটি আম

8

প্রথম পর্ব - আট

16 October 2023
0
0
0

লিখিতে বসিয়া আমি অনেক সময়ই আশ্চর্য হইয়া ভাবি, এই সব এলোমেলো ঘটনা আমার মনের মধ্যে এমন করিয়া পরিপাটিভাবে সাজাইয়া রাখিয়াছিল কে? যেমন করিয়া বলি, তেমন করিয়া ত তাহারা একটির পর একটি শৃঙ্খলিত হইয়া ঘট

9

প্রথম পর্ব - নয়

15 October 2023
0
0
0

মানুষের অন্তর জিনিসটিকে চিনিয়া লইয়া, তাহার বিচারের ভার অন্তর্যামীর উপর না দিয়া মানুষ যখন নিজেই গ্রহণ করিয়া বলে, আমি এমন, আমি তেমন, এ কাজ আমার দ্বারা কদাচ ঘটিত না, সে কাজ আমি মরিয়া গেলেও করিতাম না

10

প্রথম পর্ব : দশ

15 October 2023
0
0
0

সমস্ত ঘটনারই হেতু দেখাইবার জিদটা মানুষের যে বয়সে থাকে, সে বয়স আমার পার হইয়া গেছে। সুতরাং কেমন করিয়াই যে এই সূচিভেদা অন্ধকার নিশীথে একাকী পথ চিনিয়া দীঘির ভাঙ্গাঘাট হইতে এই শ্মশানের উপকণ্ঠে আসিয়া

11

প্রথম পর্ব : এগার

15 October 2023
1
0
0

পিয়ারীর কাছে যে সত্য করিয়াছিলাম, তাহা যে রক্ষাও করিয়াছিলাম, বাটী ফিরিয়া এই সংবাদ জানাইয়া তাহাকে চিঠি দিলাম। অবিলম্বে জবাব আসিল। আমি একটা বিষয় বারবার লক্ষ্য করিয়াছিলাম—কোন দিন পিয়ারী আমাকে তাহা

12

প্রথম পর্ব : বারো

15 October 2023
0
0
0

যাহাতে অচৈতন্য শয্যাগত হইয়া পড়িয়াছিলাম, তাহা বসন্ত নয়, অন্য জ্বর। ডাক্তারিশাস্ত্রে নিশ্চয়ই তাহার একটা-কিছু গালভরা শক্ত নাম ছিল, কিন্তু আমি তাহা অবগত নই। খবর পাইয়া পিয়ারী তাহার ছেলেকে লইয়া জন-দ

13

দ্বিতীয় পৰ্ব : এক

16 October 2023
1
0
0

এই ছন্নছাড়া জীবনের যে অ্যান্নত সেদিন রাজ মহীর কাছে শেষ বিদায়ের শুনে চোখের জলের ভিতর দিয়া শেষ করিয়া নিয়া আসিয়াছিলাম, মনে করি নাই, আবার তাহার ছিন্ন মুদ্রা যোজনা করিবার জন্য আমার ডাক পড়িবে। কিন্তু

14

দ্বিতীয় পৰ্ব : দুই

16 October 2023
0
0
0

এক-একটা কথা দেখিয়াছি, সারাজীবনে ভুলিতে পারা যায় না। যখনই মনে পড়ে—তাহার শব্দগুলা পর্যন্ত যেন কানের মধ্যে বাজিয়া উঠে। পিয়ারীর শেষ কথাগুলাও তেমনি। আজও আমি তাহার রেশ শুনিতে পাই। সে যে স্বভাবতঃই কত বড

15

দ্বিতীয় পৰ্ব : তিন

16 October 2023
0
0
0

দিন পাঁচ ছয় পরে একদিন ভোরবেলায় একটা লোহার তোরঙ্গ এবং একটা পাতলা বিছানামাত্র অবলম্বন করিয়া কলিকাতার কয়লাঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। গাড়ি হইতে নামিতে না নামিতে, এক খাঁকি-কুর্তি-পরা কুলি আসিয়া এই দু

16

দ্বিতীয় পৰ্ব : চার

16 October 2023
0
0
0

সেদিন এমন প্রবৃত্তি হইল না যে নীচে যাই। সুতরাং নন্দ টগরের যুদ্ধের অবসান কি ভাবে হইল, সন্ধিপত্রে কোন্ কোন্ শর্তাদি নির্দিষ্ট হইল, কিছুই জানি না। তবে, পরে দেখিয়াছি, শর্ত যাই হোক, বিপদের দিনে সেই স্ক্র্

17

দ্বিতীয় পৰ্ব : পাঁচ

17 October 2023
0
0
0

কেরেন্টি কারাবাসের আইন কুলিদের জন্য— ভদ্রলোকের জন্য নয়; এবং যে- কেহ জাহাজের ভাড়া দশ টাকার বেশি দেয় নাই, সেই কুলি। চা বাগানের আইনে কি বলে জানি না, তবে জাহাজী আইন এই বটে এবং কর্তৃপক্ষরাও প্রত্যক্ষ জ্

18

দ্বিতীয় পৰ্ব : ছয়

17 October 2023
0
0
0

অভয়া ও রোহিণীদাদাকে তাহাদের নূতন বাসায় নূতন ঘরকন্নার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিয়া যেদিন সকালে নিজের জন্য আশ্রয় খুঁজিতে রেঙ্গুনের রাজপথে বাহির হইয়া পড়িলাম, সেদিন ওই দুটি লোকের সম্বন্ধে আমার মনের মধ্যে

19

দ্বিতীয় পৰ্ব : সাত

17 October 2023
0
0
0

পথে যাহাদের সুখ দুঃখের অংশ গ্রহণ করিতে করিতে এই বিদেশে আসিয়া উপস্থিত হইলাম, ঘটনাচক্রে তাহারা রহিয়া গেল শহরের এক প্রান্তে, আর আমার আশ্রয় মিলিল অন্য প্রান্তে। সুতরাং পনর-ষোল দিনের মধ্যে ওদিকে আর যাইত

20

দ্বিতীয় পৰ্ব : আট

17 October 2023
0
0
0

রাজলক্ষীর অনুরোধ আমি বিস্মৃত হই নাই। পাটনায় একখানা চিঠি পাঠাইবার কথা আসিয়া পর্যন্তই আমার মনে ছিল, কিন্তু একে ত সংসারে যত শক্ত কাজ আছে, চিঠি লেখাকে আমি কারও চেয়ে কম মনে করি না। তার পরে লিখবই বা কি”

21

দ্বিতীয় পৰ্ব : নয়

18 October 2023
1
0
0

আবার অভয়ার স্বামীর পত্র পাইলাম। পূর্ববৎ সমস্ত চিঠিময় কৃতজ্ঞতা ছড়াইয়া দিয়া এবার সে যে কি সঙ্কটে পড়িয়াছে তাহাই সসম্ভ্রমে ও সবিস্তারে নিবেদন করিয়া আমার উপদেশ প্রার্থনা করিয়াছে। ব্যাপারটা সংক্ষেপ

22

দ্বিতীয় পৰ্ব : দশ

18 October 2023
1
0
0

হঠাৎ অভয়া দ্বার খুলিয়া সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইল, কহিল, জন্ম-জন্মান্তরের অন্ধ-সংস্কারের ধাক্কাটা প্রথমে সামলাতে পারিনি বলেই পালিয়েছিলাম শ্রীকান্তবাবু, নইলে ওটা আমার সত্যিকারের লজ্জা বলে ভাববেন না যেন।

23

দ্বিতীয় পৰ্ব : এগার

18 October 2023
0
0
0

মনোহর চক্রবর্তী বলিয়া একটি প্রাজ্ঞ ব্যক্তির সহিত আমার আলাপ হইয়াছিল। দাঠাকুরের হোটেলে একটা হরি-সংকীর্তনের দল ছিল; তিনি পুণ্যসঞ্চয়ের অভিপ্রায়ে মাঝে মাঝে তথায় আসিতেন। কিন্তু কোথায় থাকিতেন, কি করিতে

24

দ্বিতীয় পৰ্ব : বার

18 October 2023
0
0
0

সেদিন যখন মৃত্যুর পরওয়ানা হাতে লইয়া অভয়ার দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলাম, তখন মরণের চেয়ে মরার লজ্জাই আমাকে বেশি ভয় দেখাইয়াছিল। অভয়ার মুখ পাণ্‌ডুর হইয়া গেল, কিন্তু সেই পাংশু ওষ্ঠাধর ফুটিয়া শুধ

25

দ্বিতীয় পৰ্ব : তের

19 October 2023
0
0
0

কলিকাতার ঘাটে জাহাজ ভিড়িল। দেখিলাম, জেটির উপর বঙ্কু দাঁড়াইয়া আছে। সে সিঁড়ি দিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া কহিল, মা রাস্তার উপর গাড়িতে অপেক্ষা করচেন। আপনি নেমে যান, আমি

26

দ্বিতীয় পৰ্ব : চৌদ্দ

19 October 2023
0
0
0

শ্রীমান বঙ্কুকে কেন যে বাধ্য হইয়া আমাদের জন্য একটা স্বতন্ত্র গাড়ি রিজার্ভ করিতে হইয়াছিল, এই খবরটা যখন তাহার কাছে আমি লইতেছিলাম, তখন রাজলক্ষ্মী কান পাতিয়া শুনিতেছিল। এখন সে একটু অন্যত্র যাইতে রাজলক

27

দ্বিতীয় পৰ্ব : পনর

19 October 2023
0
0
0

রাজলক্ষ্মী আমার তত্ত্ব লইতে সেই সাজেই আমার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। আমি লাফাইয়া উঠিয়া তাহার প্রতি দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করিয়া থিয়েটারী গলায় কহিলাম, ওরে পাষণ্ড রোহিণি! তুই গোবিন্দলালকে চিনিস না? আহ

28

তৃতীয় পৰ্ব : এক

19 October 2023
0
0
0

একদিন যে ভ্রমণকাহিনীর মাঝখানে অকস্মাৎ যবনিকা টানিয়া দিয়া বিদায় লইয়াছিলাম, আবার একদিন তাহাকেই নিজের হাতে উদ্ঘাটিত করিবার আর আমার প্রবৃত্তি ছিল না। আমার সেই পল্লীগ্রামের যিনি ঠাকুরদাদা তিনি যখন আমার

29

তৃতীয় পৰ্ব : দুই

20 October 2023
0
0
0

বাঙ্গলার ম্যালেরিয়া আমাকে যে বেশ শক্ত করিয়াই ধরিয়াছিল তাহা পশ্চিমের শহরে প্রবেশ করিবার পূর্বেই বুঝা গেল। পাটনা স্টেশন হইতে রাজলক্ষ্মীর বাড়িতে আমি অনেকটা অচেতন অবস্থাতেই নীত হইলাম। ইহার পরের মাসটা

30

তৃতীয় পৰ্ব : তিন

20 October 2023
0
0
0

সাঁইথিয়া স্টেশনে আসিয়া যখন পৌঁছান গেল তখন বেলা পড়িয়া আসিতেছে। রাজলক্ষ্মীর গোমস্তা কাশীরাম স্বয়ং স্টেশনে আসিতে পারেন নাই – সেদিকের ব্যবস্থা করিতে নিযুক্ত আছেন, কিন্তু জন-দুই লোক পাঠাইয়া পত্ৰ দিয়

31

তৃতীয় পৰ্ব : চার

20 October 2023
0
0
0

সাধু জিজ্ঞাসা করিলেন, গঙ্গামাটি কি তোমাদের জমিদারি দিদি? রাজলক্ষ্মী একটু হাসিয়া কহিল, দেখচ কি ভাই, আমরা একটা মস্ত জমিদার। এবার উত্তর দিতে গিয়ে সাধুও একটুখানি হাসিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, মন্ত জমিদারি

32

তৃতীয় পৰ্ব : পাঁচ

20 October 2023
0
0
0

সাধুজীত স্বচ্ছন্দে চলিয়া গেলেন। তাঁহার বিরহব্যথাটা রতনের কিরূপ বাজিল অবশ্য জিজ্ঞাসা করা হয় নাই, সম্ভবতঃ মারাত্মক তেমন কিছু হইবে না : কিন্তু একজন ত দেখিলাম কাঁদিয়া গিয়া ঘরে ঢুকিলেন এবং তৃতীয় ব্যক্

33

তৃতীয় পৰ্ব : ছয়

21 October 2023
0
0
0

সকালে উঠিয়া শুনিলাম কুশারীমহাশয় মধ্যাহ্ন ভোজনের নিমন্ত্রণ করিয়া গিয়াছেন। ঠিক এই আশঙ্কাই করিতেছিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, আমি একা নাকি? রাজলক্ষ্মী হাসিয়া কহিল, না, আমিও আছি। যাবে? যাব বৈ কি। তাহার

34

তৃতীয় পৰ্ব : সাত

21 October 2023
0
0
0

আপনাকে আপনি বিশ্লেষণ করিলে দেখিতে পাই, যে কয়টি নারী চরিত্র আমার মনের উপর গভীর রেখাপাত করিয়াছে, তাহার একটি সেই কুশারীমহাশয়ের বিদ্রোহী ভ্রাতৃজায়া। এই সুদীর্ঘ জীবনে সুনন্দাকে আমি আজও ভুলি নাই। মানুষক

35

তৃতীয় পৰ্ব : আট

21 October 2023
0
0
0

পূর্বেই বলিয়াছি একদিন সুনন্দা আমাকে দাদা বলিয়া ডাকিয়াছিল, তাহাকে পরমাত্মীয়ের মত কাছে পাইয়াছিলাম। ইহার সমস্ত বিবরণ বিস্তৃত করিয়া না বলিলেও কথাটাকে প্রত্যয় না করিবার বিশেষ কোন হেতু নাই। কিন্তু আম

36

তৃতীয় পৰ্ব : নয়

21 October 2023
0
0
0

তাহাদের সম্বন্ধে সবাই ভাবিল, যাক, বাঁচা গেল! রাজলক্ষ্মীর তুচ্ছ কথায় মন দিবার সময় ছিল না; সে উহাদের দুই-চারিদিনেই বিস্মৃত হইল; মনে পড়িলেও কি যে মনে করিত সেই জানে। তবে, পাড়া হইতে যে একটা পাপ বিদায়

37

তৃতীয় পৰ্ব : দৃশ

22 October 2023
0
0
0

মানুষের পরকালের চিন্তার মধ্যে নাকি পরের চিন্তার ঠাঁই নাই, না হইলে আমার খাওয়া পরার চিন্তা রাজলক্ষ্মী পরিত্যাগ করিতে পারে এত বড় বিস্ময় সংসারে আর কি আছে? এই গঙ্গামাটিতে আমরা কতদিনই বা আসিয়াছি, এই ক'ট

38

তৃতীয় পৰ্ব : এগারো

22 October 2023
0
0
0

সকালে উঠিয়া শুনিলাম, অতি প্রত্যূষেই রাজলক্ষ্মী স্নান করিয়া রতনকে সঙ্গে লইয়া চলিয়া গেছে, এবং তিনদিনের মধ্যে যে বাড়ি আসিতে পারিবে না, এ খবরও পাইলাম। হইলও তাহাই। সেখানে বিরাট কাজ কিছু যে চলিতে লাগিল

39

তৃতীয় পৰ্ব : বার

22 October 2023
0
0
0

সকালে খবর পৌঁছিল আর দুই জন পীড়িত হইয়াছে। ঔষধ দিলাম, জমাদার সাঁইথিয়ায় সংবাদ পাঠাইয়া দিল। আশা করিলাম, এবার কর্তৃপক্ষের আসন টলিবো বেলা নয়টা আন্দাজ ছেলেটা মরিল। ভালই হইল। এই ত ইহাদের জীবন! সম্মুখে

40

তৃতীয় পৰ্ব : তের

22 October 2023
0
0
0

সন্ধ্যা শেষ হইল বলিয়া কিন্তু রাত্রির অন্ধকার গাঢ়তর হইয়া উঠিতে তখনও বিলম্ব ছিল। এই সময়টুকুর মধ্যে যেমন করিয়া হউক আশ্রয় খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। এ কাজ আমার পক্ষে নূতনও নহে, কঠিন বলিয়াও কোনদিন ভ

41

তৃতীয় পৰ্ব : চৌদ্দ

23 October 2023
0
0
0

গঙ্গামাটির বাটীতে আসিয়া যখন পৌঁছিলাম তখন বেলা প্রায় তৃতীয় প্রহর। দ্বারের উভয় পার্শ্বে কদলীবৃক্ষ ও মঙ্গলঘট বসান। উপরে আম্রপল্লবের মালা দোলানো। বাহিরে অনেকগুলি লোক বসিয়া জটলা করিয়া তামাক খাইতেছে।

42

তৃতীয় পৰ্ব : পনর

23 October 2023
0
0
0

সন্ন্যাসী বজ্রানন্দ তাহার ঔষধের বাক্স ও ক্যাম্বিসের ব্যাগ লইয়া যেদিন বাহির হইয়া গেল সেদিন শুধু যে সে এ বাড়ির সমস্ত আনন্দটুকুই ছাঁকিয়া লইয়া গেল তাই নয়, আমার মনে হইল যেন সে সেই শূন্য স্থানটুকু ছিদ

43

চতুর্থ পৰ্ব : এক

23 October 2023
0
0
0

এতকাল জীবনটা কাটিল উপগ্রহের মত। যাহাকে কেন্দ্র করিয়া ঘুরি, না 'পাইলাম তাহার কাছে আসিবার অধিকার, না পাইলাম দূরে যাইবার অনুমতি। অধীন নই, নিজেকে স্বাধীন বলারও জোর নাই। কাশীর ফেরত-ট্রেনের মধ্যে বসিয়া বা

44

চতুর্থ পৰ্ব : দুই

23 October 2023
0
0
0

স্টেশনে পদার্পণ মাত্র ট্রেন ছাড়িয়া গেল: পরেরটা আসিতে ঘণ্টা-দুই দেরি। সময় কাটাইবার পন্থা খুঁজিতেছি – বন্ধু জুটিয়া গেল। একটি মুসলমান যুবক আমার প্রতি মুহূর্তকয়েক চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, শ্রীকান্ত না?

45

চতুর্থ পৰ্ব : তিন

24 October 2023
0
0
0

সশব্দ উদগারে চমকিত করিয়া রতন দেখা দিল। কি রতন, পেট ভরলো? আজ্ঞে হ্যাঁ কিন্তু আপনি যাই বলুন বাবু, আমাদের কলকাতায় বাঙ্গালী বামুনঠাকুর ছাড়া রান্নার কেউ কিছু জানে না। ওদের ঐসব মেডুয়া মহারাজগুলোকে ত জ

46

চতুর্থ পৰ্ব : চার

24 October 2023
0
0
0

পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বড় সত্য এই যে, মানুষকে সদুপদেশ দিয়া কখনো ফললাভ হয় না। সৎপরামর্শ কিছুতেই কেহ শুনে না। কিন্তু সত্য বলিয়াই দৈবাৎ ইহার ব্যতিক্রমও আছে। সেই ঘটনাটা বলিব। ঠাকুর্দা দাঁত বাহির করিয়া

47

চতুর্থ পৰ্ব : পাঁচ

24 October 2023
0
0
0

গহরের খোঁজে আসিয়া নবীনের সাক্ষাৎ মিলিল। সে আমাকে দেখিয়া খুশি হইল, কিন্তু মেজাজটা ভারী রুক্ষ; বলিল, দেখুন গে ঐ বোষ্টমী বেটীদের আড্ডায়। কাল থেকে তো ঘরে আসাই হয়নি। সে কি কথা নবীন! বোষ্টমী এলো আবার ক

48

চতুর্থ পৰ্ব : ছয়

24 October 2023
0
0
0

যদিচ ধর্মাচরণে নিজের মতিগতি নাই, কিন্তু যাহাদের আছে তাহাদেরও বিঘ্ন ঘটাই না। মনের মধ্যে নিঃসংশয়ে জানি, ঐ গুরুতর বিষয়ের কোন অন্ধিসন্ধি আমি কোন কালে খুঁজিয়া পাইব না। তথাপি ধার্মিকদের আমি ভক্তি করি। বি

49

চতুর্থ পৰ্ব : সাত

25 October 2023
0
0
0

আজ আমাকে বৈষ্ণবী বার বার করিয়া শপথ করাইয়া লইল তাহার পূর্ব-বিবরণ শুনিয়া আমি ঘৃণা করিব কি না। বলিলাম, শুনতে আমি চাইনে, কিন্তু শুনলেও ঘৃণা করব না। বৈষ্ণবী প্রশ্ন করিল, কিন্তু করবে না কেন? সে শুনলে ম

50

চতুর্থ পৰ্ব : আট

25 October 2023
0
0
0

এখানে আর একদণ্ডও থাকা উচিত নয় এবিষয়ে সন্দেহ ছিল না, কিন্তু তখনি কে যেন আড়ালে দাঁড়াইয়া চোখ টিপিয়া ইশারায় নিষেধ করে, বলে, যাবে কেন? ছ-সাতদিন থাকবে বলেই ত এসেছিলে – থাক না। কষ্ট ত কিছু নেই। রাত্র

51

চতুর্থ পৰ্ব : নয়

25 October 2023
0
0
0

আজ অবেলায় কলিকাতার বাসার উদ্দেশে যাত্রা করিয়া বাহির হইয়াছি। তার পরে এর চেয়েও দুঃখময় বর্মায় নির্বাসন। ফিরিয়া আসিবার হয়ত আর সময়ও হইবে না, প্রয়োজনও ঘটিবে না। হয়ত এই যাওয়াই শেষের যাওয়া। গণিয়

52

চতুর্থ পৰ্ব : দশ

25 October 2023
0
0
0

ওগো, ওঠো! কাপড় ছেড়ে মুখহাত ধোও—রতন চা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে। আমার সাড়া না পাইয়া রাজলক্ষ্মী পুনরায় ডাকিল, বেলা হ'লো—কত ঘুমোবে? পাশ ফিরিয়া জড়িত কণ্ঠে বলিলাম, ঘুমোতে দিলে কই? এই ত সবে শুয়েছি

53

চতুর্থ পৰ্ব : এপার

26 October 2023
1
0
0

পরদিন আমার অনিচ্ছায় যাওয়া ঘটিয়া উঠিল না। কিন্তু পরের দিন আর ঠেকাইয়া রাখা গেল না, মুরারিপুর আখড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করিতেই হইল। রাজলক্ষ্মীর বাহন রতন, সে নহিলে কোথাও পা বাড়ানো চলে না, কিন্তু রান্না

54

চতুর্থ পৰ্ব : বার

26 October 2023
0
0
0

রাজলক্ষ্মীর প্রশ্নের উত্তরে আমার অর্থাগমের বৃত্তান্তটা প্রকাশ করিতে হইল। আমাদের বর্মা-অফিসের একজন বড়দরের সাহেব ঘোড়দৌড়ের খেলায় সর্বস্ব হারাইয়া আমার জমানো টাকা ধার লইয়াছিলেন। নিজেই শর্ত করিয়াছিলে

55

চতুর্থ পৰ্ব : তের

26 October 2023
0
0
0

এক সকালে স্বামীজী আনন্দ আসিয়া উপস্থিত। তাহাকে আসার নিমন্ত্রণ করা হইয়াছে রতন জানিত না, বিষণ্নমুখে আসিয়া আমাকে খবর দিল, বাবু, গঙ্গামাটির সেই সাধুটা এসে হাজির হয়েছে। বলিহারি তাকে খুঁজে খুঁজে বার করেছ

56

চতুর্থ পৰ্ব : চৌদ্দ

26 October 2023
0
0
0

সমস্ত পথ চোখ যাহাকে অন্ধকারেও খুঁজিতেছিল, তাহার দেখা পাইলাম রেলওয়ে স্টেশনে। লোকের ভিড় হইতে দূরে দাঁড়াইয়া আছে, আমাকে দেখিয়া কাছে আসিয়া বলিল, একখানি টিকিট কিনে দিতে হবে গোঁসাই সত্যিই কি তবে সকলকে

---