এক-একটা কথা দেখিয়াছি, সারাজীবনে ভুলিতে পারা যায় না। যখনই মনে পড়ে—তাহার শব্দগুলা পর্যন্ত যেন কানের মধ্যে বাজিয়া উঠে। পিয়ারীর শেষ কথাগুলাও তেমনি। আজও আমি তাহার রেশ শুনিতে পাই। সে যে স্বভাবতঃই কত বড় সংযমী, সে পরিচয় ছেলেবেলাতেই সে বহুবার দিয়াছে। তাহার উপর এতদিনের এই এত বড় সাংসারিক শিক্ষা! গতবারে বিদায়ের ক্ষণটিতে কোনমতে পলাইয়া সে আত্মরক্ষা করিয়াছিল; কিন্তু এবার কিছুতেই আর আপনাকে সামলাইতে পারিল না, চাকর বাকরদের সামনেই কাঁদিয়া ফেলিল। রুদ্ধকণ্ঠে বলিয়া ফেলিল, দেখ, আমি অবোধ নয়, আমার পাপের গুরুদণ্ড আমাকে ভুগতে হবে জানি; কিন্তু তবু বলচি আমাদের সমাজ বড় নিষ্ঠুর, বড় নির্দয়! একেও এর শাস্তি একদিন পেতে হবে! ভগবান এর সাজা দেবেনই দেবেন!
সমাজের উপর কেন যে সে এত বড় অভিশাপ দিল, তাহা সেই জানে, আর তাহার অন্তর্যামী জানেন। আমিও যে না জানি, তা নয়, কিন্তু নির্বাক হইয়া রহিলাম। বুড়া দরোয়ান গাড়ির কপাট খুলিয়া দিয়া আমার মুখপানে চাহিল। পা বাড়াইবার উদযোগ করিতেছি, পিয়ারী চোখের জলের ভিতর দিয়া আমার মুখপানে চাহিয়া একটু হাসিল, কহিল, কোথায় যাচ্ছ আর হয়ত দেখা হবে না একটা ভিক্ষা দেবে?
বলিলাম, দেব।
পিয়ারী কহিল, ভগবান না করুন, কিন্তু তোমার জীবনযাত্রার যে ধরন, তাতে — আচ্ছা যেখানেই থাকো, সে সময়ে একটা খবর দেবে? লজ্জা করবে না?
না, লজ্জা করব না-খবর দেব বলিয়া ধীরে ধীরে গাড়িতে গিয়া উঠিলাম। পিয়ারী পিছনে পিছনে আসিয়া আজ তাহার অঞ্চলপ্রান্তে আমার পায়ের ধূলা লইলা
ওগো, শুনচ? মুখ তুলিয়া দেখিলাম, সে তাহার ওষ্ঠাধরের কাঁপুনিটা প্ৰাণপণে দমন করিয়া কথা কহিবার চেষ্টা করিতেছে। উভয়ের দৃষ্টি এক হইবামাত্রই তাহার চোখের জল আবার ঝরঝর করিয়া ঝরিয়া পড়িল: অস্ফুট অবরুদ্ধ স্বরে চুপিচুপি বলিল, নাই গেলে অত দূরে থাক গে, যেও না!
নিঃশব্দে চোখ ফিরাইয়া লইলাম। গাড়োয়ান গাড়ি ছাড়িয়া দিল। চাবুক ও চারখানা চাকার সম্মিলিত সপাসপ ও ঘড়ঘড় শব্দে অপরাহ্নবেলা মুখরিত হইয়া উঠিল। কিন্তু সমস্ত চাপা দিয়া একটা ধরা গলার চাপা কান্নাই শুধু আমার কানে বাজিতে লাগিল।
More Books by শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
Other প্রেম-রোমান্স books
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শরৎচন্দ্র ছিলেন পিতামাতার নয় সন্তানের একজন। অমর ছিলেন একজন বাঙালি গল্পকার এবং বিখ্যাত ঔপন্যাসিক। তার বেশিরভাগ কাজই গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের সংগ্রাম এবং তারা যে সংকটের মুখোমুখি হয় তার বর্ণনা দেয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথাসাহিত্য যে রূপে ও বিন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে, জনপ্রিয়তার উপাদান তার সাহিত্য রুচিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হলেন একমাত্র ভারতীয় গল্পকার, যাঁর অধিকাংশ ক্লাসিক কাজ চলচ্চিত্রে তৈরি হয়েছিল এবং অনেক সিরিয়ালও তৈরি হয়েছিল। তাঁর রচনা দেবদাস, চরিত্রহীন এবং শ্রীকান্তের সাথে বারবার এমনটি ঘটেছে। শরৎচন্দ্রের প্রতিভা তার গল্পের পাশাপাশি উপন্যাসেও দৃশ্যমান। উপন্যাসের মতো তাঁর গল্পেও মধ্যবিত্ত সমাজের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। শরৎচন্দ্রের গল্পে প্রেম ও নারী-পুরুষের সম্পর্কের বলিষ্ঠ চিত্র পাওয়া যায়। শিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে তার কিছু গল্প খুবই মর্মস্পর্শী। এই গল্পগুলো শরতের হৃদয়ের সম্পূর্ণ অনুভূতির প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি তার শৈশবের স্মৃতিচারণ থেকে এবং তার বন্ধুদের এবং যাদের সাথে তিনি সংস্পর্শে এসেছেন তাদের জীবন থেকে গল্পগুলি সংগ্রহ করেছেন। মনে হয় এই গল্পগুলো যেন আমাদের জীবনেরই একটা অংশ। শরৎচন্দ্রের গল্পে নারীর সর্বনিম্ন ও সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ একসঙ্গে দেখা যায়। নারীর অবক্ষয়ের কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে শরৎচন্দ্র একই নারীর মহৎ ও উজ্জ্বল চরিত্র প্রকাশ করেছেন।শরৎচন্দ্র অনেক উপন্যাস লিখেছেন যার মধ্যে রয়েছে পন্ডিত মশায়, বৈকুণ্ঠের বিল, মেজ দিদি, দর্পচূর্ণ, শ্রীকান্ত, অরক্ষনীয়া, নিষ্কৃতি, মামলর ফল, অনুপমার প্রেম, গৃহদাহ, শেশপ্রশ্ন, দত্ত, দেবদাস, ব্রাহ্মণের মেয়ে, সতী, বিপ্রদাস, দেনা পবন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের ওপর তিনি লিখেছেন ‘পথের দাবী’ উপন্যাস। শরতের উপন্যাস বহু ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। শরৎচন্দ্রের কিছু উপন্যাস অবলম্বনে হিন্দি ছবিও বহুবার নির্মিত হয়েছে।D